মার্কস ২০০ : একুশের ভাবনা – সম্পাদনা শোভনলাল দত্তগুপ্ত
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০২০
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ: শুভম দে সরকার
.
উপক্রমণিকা
১
মার্কস দ্বিশতবর্ষে পা দিলেন এমন একটা সময়ে যখন বিশ্বের এক বড় অংশ জুড়ে বিরাজ করছে বামপন্থার পক্ষে অতীব প্রতিকূল এক পরিস্থিতি। আবার এ কথাও ঠিক যে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রতিস্পর্ধা এসবও দানা বাঁধছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এবং তার সুবাদে ঘুরে-ফিরে উঠে আসছে একটি নাম— কার্ল মার্কস। সামগ্রিকভাবে বামমনস্ক মানুষের কাছে দক্ষিণপন্থার ক্রমবর্ধমান বিপদ ঠেকাতে মার্কস-ই এখন বড় ভরসা। ২০১৭ সালে ক্যাপিটাল-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশনার ১৫০ বছর পূর্তি এবং তার অব্যবহিত পরেই ২০১৮ সালে মার্কসের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী— এই দু’টি ঘটনা একবিংশ শতাব্দীর বৌদ্ধিক চিন্তার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সোভিয়েত–উত্তর পৃথিবীতে মার্কসের মুখোমুখি হওয়াটা কিন্তু বেশ শক্ত কাজ। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সূচনাপর্ব থেকে শুরু করে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির গোটা সময়টি জুড়ে ঐতিহাসিক কারণেই পৃথিবীর এক বিরাট অংশের মানুষের মনন ও চিন্তাকে প্রভাবিত করেছিলেন মার্কস। ১৯৬৮ সালে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়েছিল মার্কসের জন্মের ১৫০তম বর্ষ। ১৯৮৩ সালটি ছিল মার্কসের মৃত্যুর শতবর্ষ। উভয় ক্ষেত্রেই সেই সময়ে গোটা পৃথিবী জুড়ে এই দু’টি ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্কসচর্চা একটি নতুন মাত্রা পরিগ্রহ করেছিল। সেই সময়ের প্রতিবেদনগুলির দিকে দৃষ্টি দিলে দু’টি ভিন্নধর্মী ভাবনা চোখে পড়ে। মার্কসকে নিয়ে প্রচুর আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিভিন্ন দেশের শাসক কমিউনিস্ট পার্টির সৌজন্যে। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জার্মান গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র। দু’টি ক্ষেত্রেই মার্কস বন্দিত হয়েছিলেন, পূজিত হয়েছিলেন মুক্তিকামী মানুষের জীবনসংগ্রামের পথপ্রদর্শক রূপে এবং প্রত্যয়সিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল যে ধনতন্ত্রের পতন আসন্ন প্রায় এবং সমাজতন্ত্রই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। অপর দিকে সংঘটিত হয়েছিল বৌদ্ধিক স্তরে মার্কসকে কেন্দ্র করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভা, প্রকাশিত হয়েছিল নানা ধরনের গ্রন্থ ও প্রবন্ধ। সেখানে স্থান পেয়েছিল অনেক ধরনের বিতর্ক, উঠে এসেছিল অনেক প্রশ্ন, পরিবেশিত হয়েছিল অনেক নতুন ভাবনা। সেই অর্থে ষাট থেকে আশি— এই তিনটি দশকে মার্কসের বৌদ্ধিক শাসন ছিল প্রায় একচ্ছত্র।
২০১৮-তে সেই ছবিটা কিন্তু একেবারেই বদলে গেছে। সোভিয়েত-উত্তর পৃথিবীতে বামপন্থার আদর্শ ও রাজনীতি অনেকটাই কোণঠাসা। মার্কস নিয়ে আগ্রহ বিশ্বায়িত দুনিয়ার এক বড় অংশের মানুষের মধ্যে ক্রমহ্রাসমান। এক দিকে মতাদর্শগত শূন্যতা, অপর দিকে সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের বিপদ, এক দিকে ভোগবাদের হাতছানি, অপর দিকে এককালের প্রবল পরাক্রমশালী কমিউনিস্ট পার্টিগুলির অবলুপ্তি তরুণ প্রজন্মকে স্বাভাবিক কারণেই মার্কসের প্রতি অনাগ্রহী করে তুলতে এক বড় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এটাই আবার শেষকথা নয়। বিশ্বায়ন, দক্ষিণপন্থার বাড়বাড়ন্ত, নয়া-উদারনীতিবাদের দাক্ষিণ্যে ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের তাড়নায় মানুষ খুঁজছে এক বিকল্প পথের সন্ধান এবং সেখানেই মার্কস আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন নতুন প্রেক্ষিতে, নতুন ভাবনায়। নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মার্কসকে নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করা হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে এবং তার ফলে বিশ্বায়িত পৃথিবীরই এক বড় অংশের কাছে মার্কস পৌঁছে যাচ্ছেন প্রতিকূলতার বাধা অতিক্রম করে। তাই মার্কসের প্রতি আগ্রহ ও অনীহা দু’টি প্রক্রিয়াই সমানভাবে জারি রয়েছে।
২
এই প্রেক্ষিতটিকে খেয়াল রাখলে ১৯১৮–২০১৮, অর্থাৎ, মার্কসের জন্মের শতবর্ষ (১৯১৮) ও দ্বিশতবর্ষের (২০১৮) অন্তর্বতী কালপর্বে মার্কসচর্চার অভিমুখগুলি সম্পর্কে আমরা কিছুটা পরিচিত হতে পারি। আমরা অবহিত হতে পারি মার্কসভাবনা কোন পথে, কী ধরনের বাঁক নিয়েছিল, সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, ব্যাপ্তি, সংকট ও প্রায় অবলুপ্তির বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব প্রশ্ন উঠে এসেছে সেগুলির মোকাবিলা কীভাবে করা হয়েছিল, ইত্যাদি অনেক বিষয় সম্পর্কে। এই প্রসঙ্গে দু’টি কথা বলা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এক: বিশ, তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত মার্কসের বহু রচনাই ছিল অধরা, অনাবিষ্কৃত এবং সেই অর্থে মার্কসচর্চায় এক বড় ধরনের ঘাটতি ছিল। মার্কস-এঙ্গেলস রচনাবলির মূল জার্মান সংস্করণ প্রকাশিত হতে শুরু করে জার্মান গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র থেকে ষাটের দশকে Werke (রচনাবলি) শিরোনামে এবং মূলত সেটিকে অনুসরণ করে মার্কস-এঙ্গেলস রচনাবলির ইংরেজি সংস্করণ আমাদের হাতে আসতে শুরু করে সত্তরের দশকে,— যার সুবাদে মার্কসচর্চার ক্ষেত্রে যুক্ত হয় সম্পূর্ণ নতুন একটি মাত্রা। বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্বে গ্রহণ করা হল মার্কস-এঙ্গেলস সমগ্র রচনাবলি প্রকাশের এক মহাপ্রকল্প, যার কাজ বর্তমানে চলছে। এই মহাপ্রকল্পটি আজ MEGA (Marx-Engels Gesamtausgabe), অর্থাৎ, মার্কস-এঙ্গেলস সমগ্র রচনাবলি হিসেবে খ্যাত, যার শুরুটা কিন্তু হয়েছিল বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতে আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে। এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মার্কস-এঙ্গেলস রচিত যাবতীয় সব কিছুই, সম্পূর্ণ রূপ থেকে অসম্পূর্ণ খসড়া, তাঁদের ব্যবহৃত বইপত্রের পাতায় লেখা নানা ধরনের নোট থেকে শুরু করে কয়েক হাজার চিঠিপত্র,— যার অনেকটাই Werke-তে পাওয়া যায় না। বলা বাহুল্য, MEGA-র সৌজন্যে একবিংশ শতাব্দীর মার্কসচর্চায় সংযোজিত হতে চলেছে সম্পূর্ণ এক নতুন ও ভিন্ন মাত্রা।
দ্বিতীয় বিষয়টি প্রায় অনালোচিতই থেকে গেছে, বলা যায়। মার্কসচর্চার ভাবনাকে আমরা সাধারণত এক ধরনের ‘বিশুদ্ধ’ বৌদ্ধিক প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য করতে গিয়ে কিছুটা হয়তো একপেশেভাবেই একটা কথা ভুলে যাই। দু’টি বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন পর্বে, যে সময়টিকে মার্কসচর্চার প্রায় আদিপর্ব বলা যেতে পারে, যাঁরা মার্কসীয় তত্ত্বভাবনাকে নানা দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন, জন্ম দিয়েছিলেন অনেক বিতর্কের, রসদ জুগিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর মার্কসভাবনার, তাঁরা প্রায় সকলেই ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তাঁদের মুনশিয়ানা ছিল এটাই যে, তাঁদের তাত্ত্বিক তথা বৌদ্ধিক অবস্থান কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি দ্বারা, কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত হলেও নির্ধারিত হয়নি। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, আনতোনিও গ্রামশি, গেওর্গ লুকাচ, কার্ল কর্শ সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি ও আন্দোলনের সঙ্গে। কিন্তু এঁদের তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বহুলাংশেই কমিউনিস্ট পার্টির প্রথাগত ভাবনা অনুযায়ী ছিল না, যদিও কর্শ ব্যতিরেকে অন্যেরা সরাসরি তাঁদের পার্টির রাজনৈতিক লাইনের সমালোচনা করা থেকে বিরত ছিলেন। এ-রকমই অপর এক দৃষ্টান্ত নিকোলাই বুখারিন। একসময়ে তিনি ছিলেন বলশেভিক পার্টির অন্যতম সেরা তাত্ত্বিক এবং ১৯২১ সালে গৃহীত নয়া অর্থনীতি (NEP)-র অন্যতম উদগাতা। কিন্তু লেনিনোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিন-পর্বে অনুসৃত নীতির সঙ্গে অচিরেই তাঁর গুরুতর মতপার্থক্য দেখা দেয় এবং তার পরিণতিতে শেষপর্যন্ত ১৯৩৮ সালে মস্কো মামলায় অন্য আরও অনেকের মতো তাঁকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। গ্রামশি, লুকাচ, কর্শ-এর মতো বুখারিনও সওয়াল করেছিলেন যে-ধাঁচের মার্কসবাদের পক্ষে, সেটি ছিল এক অর্থে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথাগত ভাবনার বিপরীতমুখী।
বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতে মার্কসবাদের চর্চায় গোড়া থেকেই একটি বিতর্ক দানা বেঁধেছিল। একপক্ষে ছিলেন আব্রাম দেবোরিন (Abram Deborin) ও তার অনুগামীরা, যাঁরা অনেকটাই ছিলেন এক ধরনের হেগেলীয় মার্কসবাদের পক্ষে। অপরপক্ষে ছিলেন বগদানভ (Bogdanov) আক্সেলরদ (Axelrod) প্রমুখ তাত্ত্বিকরা, যাঁরা ছিলেন বিজ্ঞানমনস্কতার নামে মার্কসবাদের এক ধরনের নির্ধারণবাদী ভাষ্যের পক্ষে। লেনিন-উত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে এই বিতর্কে ছেদ টেনে দেওয়া হয় ও শেষপর্যন্ত সেখানে বৈধতা পায় মার্কসবাদের একটি একরৈখিক, প্রায় দৃষ্টবাদী (positivist), যান্ত্রিকতাধর্মী ভাষ্য, যার মূলকথাটি ছিল নির্ধারণবাদ ও অনিবার্যতা। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, গ্রামশি, লুকাচ, কর্শ এবং NEP-উত্তর বুখারিন প্রত্যেকেই মার্কসবাদের যে-ধাঁচার কথা বললেন, সেখানে প্রাধান্য পেল বিষয়ী (subject), গুরুত্ব পেল চেতনা, নিছক বস্তুতান্ত্রিকতার পরিবর্তে সংস্কৃতির প্রশ্নটি।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠী, যার সঙ্গে গ্রামশি, লুকাচ প্রমুখেরা মার্কসবাদের যে অপ্রচলিত ভাষ্যটি প্রতিষ্ঠা করলেন, তার সঙ্গে এক দিকে সাদৃশ্য ও অপর দিকে বৈসাদৃশ্য নজরে পড়ার মতো। সাদৃশ্যটা ছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠীরও সংস্কৃতি, বিষয়ীবাদিতা, চেতনা ইত্যাদি উপাদানের ওপর গুরুত্ব দেবার ক্ষেত্রে এবং তথাকথিত বিজ্ঞানধর্মী মার্কসবাদকে উপেক্ষা করার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু উভয়ের মধ্যে বৈসাদৃশ্যটাও খেয়াল রাখা প্রয়োজন। ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠীর তাত্ত্বিকরা (হর্কহাইমার, আডোরনো প্রমুখ) প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না এবং সরাসরি বামপন্থী হিসেবে তাঁদেরকে আখ্যায়িত করাটাও ভুল হবে। তাঁদের অনেকেই মার্কসের ভাবনাকে বিচার করেছিলেন বিশুদ্ধ বৌদ্ধিক দৃষ্টিকোণ থেকে, চিরায়ত জার্মান দর্শনের ঐতিহ্যের মধ্যেই তার চিন্তার সূত্রগুলিকে খোঁজ করার তাগিদে। ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠীর চিন্তকদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের ক্রমবর্ধমান বিপদকে বোঝা ও বিশ্লেষণ করা এবং তার সুবাদে হর্কহাইমার ও তাঁর সতীর্থরা তৎকালীন জার্মান সমাজ ও রাষ্ট্রকে তথ্যানুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ব্যাখ্যা করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তাঁদের অনেকে তাই বিজ্ঞানমনস্কতাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, যদিও তাঁরা খারিজ করেছিলেন দৃষ্টবাদ ও যান্ত্রিক নির্ধারণবাদকে। এইসব কারণে ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠীর গবেষকদের কাছে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকে কীভাবে সাধারণ মানুষ মান্যতা দেয় সেই বিষয়টির অনুসন্ধান করা এবং এই প্রেক্ষাপটেই তাঁরা নিশানা করেছিলেন জার্মান ফ্যাসিবাদকে ও সোভিয়েত ইউনিয়নের স্তালিনতন্ত্রকে। এর ফলে সোভিয়েত মার্কসবাদের ধ্বজাধারীরাও ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠীকে প্রতিক্রিয়াশীল ও সংশোধনবাদী আখ্যা দিয়েছিলেন এবং ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠীর তত্ত্বভাবনা সোভিয়েত মার্কসবাদের কাছে ছিল সম্পূর্ণ ব্রাত্য।
দু’টি বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে মার্কসচর্চার এই যে চরিত্র, বলা যেতে পারে সেটিই কিন্তু পরবর্তী দশকগুলিতে মার্কস নিয়ে ভাবনাচিন্তা কোন পথে এগোবে তার অভিমুখটিকে চিহ্নিত করে দিয়েছিল। ১৯৪৫-১৯৯১, যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর এই যে সময়, তার রাজনৈতিক চরিত্রটি মার্কসভাবনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে ওঠে। এক দিকে পূর্ব ইউরোপ সহ চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে সমাজতন্ত্রের বিস্তার, অপর দিকে ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে স্তালিনতন্ত্রের প্রকাশ্য সমালোচনা, এক দিকে ঠান্ডা যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়নের উজ্জ্বল ভূমিকা, অপর দিকে সোভিয়েত শিবিরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তর অভিযোগ, ১৯৫৬ ও ১৯৬৮ সালে হাঙ্গেরি ও চেকোশ্লোভাকিয়াতে সোভিয়েত বাহিনীর সমরাভিযান, তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির বুদ্ধিজীবী মহলে অসন্তোষ ও ভাঙন, ৭০-এর দশকের গোড়ায় ইউরোকমিউনিজ়মের উত্থান এবং সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে তার তীব্র সমালোচনা, ষাটের দশকের গোড়ায় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যয়সিদ্ধ ঘোষণা যে পুঁজিবাদের পতন আসন্ন প্রায় এবং সমাজতন্ত্রের বিজয়কেতন গোটা বিশ্বজুড়ে উড্ডীন হতে আর বিলম্ব নেই ও একইসঙ্গে সমাজতান্ত্রিক শিবিরে অর্থনৈতিক প্রগতি হ্রাস পাওয়া থেকে শুরু করে আমলাতান্ত্রিকতা ও দুর্নীতির অভিযোগ মার্কসবাদে আস্থাশীল মানুষদের মনে অনেক প্রশ্ন তুলে দিতে শুরু করে। ১৯৮৫ সালে গর্বাচেভ-এর ক্ষমতায় আসা এবং তার ফলশ্রুতিতে ‘পেরেস্ত্রোইকা’ ও ‘গ্লাসনস্ত’-এর প্রবর্তন ও পরিশেষে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তি মার্কসবাদী প্রত্যয়ের জায়গাগুলোকে আরও টলিয়ে দিল। এক গভীর সংশয়ের আবর্তে প্রশ্ন উঠে গেল যে মার্কসের আদৌ আর কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে কি না। অনেকে এই প্রশ্ন তুলে দিলেন যে মার্কসের ভাবনায় কোনও গোলমাল ছিল না। গোলমালটা পাকালেন রুশ বিপ্লবের পরবর্তী অধ্যায়ে সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়নের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁরা, অর্থাৎ, তত্ত্ব সঠিক থাকলেও প্রয়োগে ভুল হয়েছিল।
প্রশ্ন ও প্রতিপ্রশ্নের এই রাজনৈতিক আবহ, যার শুরুটা হয়েছিল ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসের সময়ের পরে পরেই, বৌদ্ধিক স্তরে মার্কসচর্চাকে বিপুলভাবে আলোড়িত করেছিল। আগেই বলেছি, এর সূত্রপাতটা কিন্তু হয়েছিল বিশ-তিরিশের দশকে সোভিয়েত মার্কসবাদের অভ্যন্তরীণ বিতর্ক এবং গ্রামশি-লুকাচ-কর্শ-ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠী প্রদর্শিত এক বিকল্প মার্কসবাদের দিশাকে অবলম্বন করে। দু’টি পরস্পরবিরোধী প্রশ্ন গোড়াতেই উঠে এসেছিল। এক: বিজ্ঞানমনস্কতার নামে, শ্রেণিসংগ্রামের নামে মার্কস কি কোনও সাধারণীকরণকে, আবশ্যিকতা ও অনিবার্যতার ভাবনাকে মান্যতা দিয়েছিলেন? না কি তাঁর ভাবনায় প্রাধান্য পেয়েছিল মানুষের চেতনা, বিষয়ীগামিতা? অনন্বয় (alienation) না শ্রেণিসংগ্রাম— মার্কস কোনটিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন? অর্থাৎ, ঘুরে-ফিরে দুই মার্কসের তত্ত্বই বড় হয়ে দেখা দিল। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল Economic and Philosophical Manuscripts of 1844, যা ‘পারি পাণ্ডুলিপি’ নামে খ্যাত। তার অনেক পরে সত্তরের দশকে ক্যাপিটাল-এর খসড়া নোট হিসেবে ১৮৫৭–৫৮ পর্বে রচিত গ্রুনড্রিশে ( Grundrisse) প্রকাশিত হল ইংরেজি অনুবাদে। যাঁরা মানবতাবাদী মার্কসের পক্ষে সওয়াল করছিলেন, তাঁদের কাছে এক বড় ধরনের বৌদ্ধিক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল মার্কসের এই পাণ্ডুলিপিগুলি। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবতাবাদ— এগুলিকে ভিত্তি করেই সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, কারণ মানবমুক্তির যে স্বপ্ন, যে দিশা মার্কস দেখিয়েছিলেন, তার মূলে ছিল এই ভাবনাগুলিই— এমনটাই বললেন তাঁরা, যাঁরা ছিলেন কর্তৃত্ববাদী সমাজতন্ত্রের কঠোর সমালোচক। অপর পক্ষে, যাঁরা মার্কসের শিক্ষাকে বিজ্ঞানমনস্কতার আলোকে বিচার করে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলেন যে মার্কস ছিলেন কার্যত একজন বিজ্ঞানী, যিনি মানবসভ্যতার ইতিহাসকে, সমাজ পরিবর্তনের প্রশ্নটিকে কতকগুলি সর্বজনীন সূত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এঁদের চিন্তায় তাই মান্যতা পেল এক ধরনের একমুখী ভাবনা, অনিবার্যতার ধারণার প্রতি ঝোঁক, সমাজতন্ত্রের নিশ্চয়তা সম্পর্কে দ্বিধাহীন প্রত্যয়। স্বাভাবিকভাবেই এঁদের দৃষ্টিতে ১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে স্তালিনবাদের সমালোচনা, সত্তরের দশকে ইউরোকমিউনিজ়মের উদ্ভব এবং ৮০-র দশকে গর্বাচেভের সংস্কার কর্মসূচি ছিল মার্কসবাদের বিচ্যুতি ছাড়া আর কিছু নয়।
আশির দশকের গোড়াতে মার্কসচর্চার পরিস্থিতি জটিলতর হয়ে দাঁড়াল একটি বিশেষ কারণে। প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্রমেই যখন প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়াতে শুরু করল, সমাজতন্ত্রের ঘনায়মান সংকট যখন বামপন্থী মহলের একটা বড় অংশকে সংশয়াচ্ছন্ন করে তুলল, যখন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অনিবার্যতার ভাবনা বড় রকমের প্রশ্নচিহ্নের মুখে এসে দাঁড়াল, বৌদ্ধিক স্তরে তখনই একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল উত্তর-আধুনিকতাবাদের উত্থান। ষাটের দশকের ফ্রান্সে কাঠামোতত্ত্ব (Structuralism)-কে আশ্রয় করে আশির দশকে লিওতার (Lyotard), ফুকো (Foucault), বার্থ (Barthes), দেরিদা (Derrida) প্রমুখ তাত্ত্বিকদের লেখাপত্রগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে আমাদের হাতে এসে পৌঁছতে শুরু করে এবং তার সুবাদে উত্তর-আধুনিকতা, উত্তর-কাঠামোতত্ত্ব বামপন্থার বৌদ্ধিকচর্চার পরিসরে বড় রকমের প্রভাব ফেলে। মার্কসচর্চার ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, অন্তত দু’টি কারণে। এক: মার্কসের তত্ত্ব ও ভাবনা ইউরোপীয় আধুনিকতা তথা আলোকায়নের (Enlightenment) অংশভাক হিসেবে অ-পশ্চিমি, অনুন্নত বিশ্বের বাস্তবতাকে বোঝার ক্ষেত্রে শুধু যে অক্ষম তা-ই নয়, পশ্চিমি আধুনিকতা যে একদেশদর্শিতা, পক্ষপাতিত্ব ও একরৈখিকতার জন্ম দেয়, সেই দোষেও দুষ্ট। এই সুত্রকে অবলম্বন করেই এডওয়ার্ড সইদ (Edward Said) ১৯৭৮ সালে প্রকাশ করলেন Orientalism বইটি এবং তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল উত্তর-উপনিবেশবাদের (Postcolonialism) তত্ত্ব। দুই: বামপন্থী মহলে উত্তর-আধুনিকতা ও উত্তর-উপনিবেশবাদের এই দাবিগুলি নিয়ে এক ধরনের তাত্ত্বিক বিভাজন তৈরি হয়ে গেল। এককালের অনেক মার্কসবাদী উত্তর-আধুনিকতাবাদের যুক্তিকে মেনে নিয়ে মার্কসের বেশ কিছু বক্তব্য, তত্ত্ব ও ধারণা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেন। আবার প্রতিস্পর্ধী অনেক মার্কসবাদী তাত্ত্বিক উত্তর-আধুনিকতা ও উত্তর-উপনিবেশবাদকে এক ধরনের নেতিবাচক, নৈরাজ্যবাদী আখ্যা দিতে কসুর করলেন না, কারণ উত্তর-আধুনিকতার অন্যতম কথাটাই হল যে, শাশ্বত সত্য বলে কিছু নেই, ইতিহাসের অর্থ খোঁজা অর্থহীন, কোনও বিকল্প, সুনির্দিষ্ট সমাজ প্রতিষ্ঠার ভাবনাকে মান্যতা দেওয়ার অর্থ একটি একপেশে দৃষ্টিভঙ্গিকে অনুমোদন করা, যা মানুষের স্বাধীন চিন্তা ও স্বতন্ত্র ভাবনার পরিপন্থী। একেবারে সাম্প্রতিক কালের মার্কসচর্চায় কিন্তু এই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে যে, মার্কস কি সত্যিই কোনও একরৈখিকতাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, যদিও উত্তর-আধুনিকতা যে চূড়ান্ত আপেক্ষিকতার কথা বলে, তার সঙ্গে মার্কসের ভাবনার ফারাক বিস্তর।
৩
পশ্চিমে মার্কসচর্চার এই বিভিন্ন ধারা ও বিতর্ক বাংলায় মার্কসভাবনাকেও সমৃদ্ধ করেছে, প্রভাবিত করেছে। বঙ্গসংস্কৃতিতে বামপন্থী ভাবনাচিন্তার অভিঘাত অতি বড় বামবিরোধীও অস্বীকার করতে পারবেন না। যদি কেউ প্রশ্ন করেন যে মার্কস নিয়ে বাঙালির এমন মাতামাতির রহস্যটা ঠিক কী, তাহলে তার উত্তর একটাই। স্বাধীনতার আগে ও পরে মধ্যবিত্ত বাঙালি তার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের সঙ্গে, তার দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের তিক্ততা ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে মার্কসের ভাবাদর্শের সঙ্গে এক ধরনের বৌদ্ধিক নৈকট্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। দীর্ঘ কয়েক দশকের বামপন্থীদের পরিচালিত বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন, ১৯৬৭ সালে প্রথম অ-কংগ্রেসি যুক্তফ্রন্টের এবং ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্টের প্রতিষ্ঠা এই আবহকে আরও পুষ্ট করেছিল। এ কথাটাও স্বীকার করে নেওয়া দরকার যে শ্রমিক-কৃষকের তুলনায় মার্কসকে নিয়ে ভাবনাচিন্তার ধারণাটা কিন্তু গড়ে উঠেছে মধ্যবিত্ত বাঙালির বৌদ্ধিক প্রশ্রয়কে অবলম্বন করে। তার সুবাদে মার্কসকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন সভা, আলোচনাচক্র, প্রকাশিত হয়েছে মার্কস-বিষয়ক অসংখ্য বই ও প্রবন্ধ। এখানে পশ্চিমে মার্কসচর্চার সঙ্গে বাঙালির মার্কসচর্চার একটি সাদৃশ্য লক্ষ করার মতো। সংগঠিত শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন বহুলাংশেই বামপন্থীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ফলে মার্কসের নাম সেখানে বারে বারেই উচ্চারিত হয়েছে, বজ্রমুষ্টিতে শপথ নেওয়া হয়েছে কমিউনিস্ট ইস্তাহার-এর রণধ্বনিকে অবলম্বন করে, অর্থাৎ, মার্কস সেখানে অতীব দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছেন। তার পরিণতিতে শ্রমজীবী মানুষের মননে মার্কস অনেকটাই স্থান করে নিয়েছেন সোভিয়েত ধাঁচে গঠিত কমিউনিস্ট পার্টির মার্কসভাবনার প্রথাসিদ্ধ আদলে। তার পরিণতিতে পার্টির সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলায় শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনে শামিল হয়েছেন লাখো মানুষ। তাঁদেরকে তাড়িত করেছে এক প্রবল বৈপ্লবিক আবেগ, এক প্রত্যয়দীপ্ত একরৈখিক, একমাত্রিক ভাবনা, যে, সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা আসন্ন প্রায়— সশস্ত্র সংগ্রাম, জাতীয় গণতান্ত্রিক কিংবা জনগণতান্ত্রিক যেমনটাই হোক না কেন বিপ্লবের পথ। আরও সহজ করে বললে, মার্কসভাবনার এই যে আদল, এখানে প্রাধান্য পেয়েছিল প্রয়োগের বিষয়টি, ব্যাবহারিক অর্থে মার্কস কেন প্রাসঙ্গিক সেই প্রশ্নটি। এর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল ক্ষমতায় আসা ও ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার ভাবনা। ক্ষমতাচ্যুতির সম্ভাবনা এবং ক্ষমতা হারালে কী করণীয় সেই প্রশ্ন বাম মহলে প্রায় উহ্যই থেকে গিয়েছিল। তাই প্রথমে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বাম জমানার অবসান সংগঠিত শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনকে প্রবলভাবে বিদ্ধ করেছিল। একরৈখিকতার ভাবনা ও প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলশ্রুতি এমনটাই হতে বাধ্য— যেমনটা ঘটেছে সোভিয়েত-উত্তর আর্ন্তজাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে।
তুলনায় বাঙালির মার্কসচর্চার বৌদ্ধিক পরিসর আজও অনেক খোলামেলা, অনেকটা ইউরোপের মতোই। এখানে বিতর্ক আছে, মতের বিভিন্নতা আছে, বহুমাত্রিক স্বরের উপস্থিতি আছে এবং এমনটা সম্ভব হয়েছে মূলত দু’টি কারণে। এক: বাম বাঙালির বৌদ্ধিক চিন্তার পরিসর পার্টির নিয়ন্ত্রণ থেকে আজও অনেকটাই মুক্ত। দুই: বাঙালির মার্কসচর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এমন অনেক বুদ্ধিজীবী যাঁরা প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত থেকেও তাঁদের বৌদ্ধিক ভাবনাকে পার্টিসত্তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে দেননি। এখানে আরও উল্লেখ্য, বাঙালির মার্কসচর্চা থেকে এটা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, যাঁরা এই বিষয়টিতে লিপ্ত থেকেছেন, তাঁরা পশ্চিমে মার্কসচর্চার খবরাখবর সম্পর্কে যথেষ্টই ওয়াকিবহাল। তরুণ বনাম পরিণত মার্কস বিতর্ক, গ্রামশি, আলথুসের, উত্তর-আধুনিকতা বনাম মার্কসবাদ বিতর্ক বাঙালির মার্কসচর্চাকে বারে বারেই স্পর্শ করেছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্ন গ্রন্থে ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নানা প্রবন্ধে।
বাঙালির মার্কসচর্চার এই বৌদ্ধিক আদলটিকে যদি খেয়াল রাখি, তাহলে ১৯৬৮ ও ২০১৮ এই দু’টি বছরের প্রতি একটু বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন, কারণ ১৯৬৮ সালটি ছিল মার্কসের জন্মের ১৫০তম ও ২০১৮ সালটি ২০০তম বর্ষ। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল পরিচয় ও এক্ষণ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা এবং ২০১৮ সালে স্বরান্তর প্রকাশ করেছে মার্কসকে কেন্দ্র করে একটি স্বতন্ত্র সংখ্যা। বর্তমান প্রবন্ধ সংকলনটি এসবেরই উত্তরসূরি, তবে এর আদলটা অনেকটাই ভিন্ন। পরিচয় (বর্ষ ৩৭, সংখ্যা ১০–১২, মে-জুলাই, ১৯৬৮) মার্কস সংখ্যাটি ছিল বিদায়ী সম্পাদক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত শেষ সংখ্যা; সেখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো একটি প্রবন্ধের নাম করতে হয়, যেটি লিখেছিলেন চিন্মোহন সেহানবীশ ‘বাংলা ভাষায় কার্ল মার্কস’ এই শিরোনামে। অন্যান্য প্রবন্ধকারদের মধ্যে ছিলেন সুশোভন সরকার, অমল দাশগুপ্ত, শংকর চক্রবর্তী প্রমুখ ব্যক্তি। তবে এ কথা বলতেই হয় পরিচয়-এর এই সংখ্যাটি মননশীল বাঙালির মনে তেমন রেখাপাত করতে পারেনি, কারণ এই সংখ্যাটি প্রকাশের ক্ষেত্রে তেমন কোনও ভাবনা বা পরিকল্পনা ছিল বলে মনে হয় না। সেই অর্থে বাঙালির বৌদ্ধিক চিন্তার জগতে অবশ্যই এক বড় রকমের প্রভাব ফেলেছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নির্মাল্য আচার্য সম্পাদিত এক্ষণ কার্ল মার্কস বিশেষ সংখ্যা (ষষ্ঠ বর্ষ, দ্বিতীয়-তৃতীয় সংখ্যা, ১৯৬৮) যেখানে স্থান পেয়েছিল প্রায় গোটা তিরিশ অত্যন্ত মূল্যবান প্রবন্ধ। ধর্ম, ইতিহাসতত্ত্ব, মানবতাবাদ ও মার্কসবাদ, মার্কসবাদ ও জ্ঞানতত্ত্ব, বিপ্লব ও মার্কসবাদ, অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে মার্কসের ভাবনা, ভারতবর্ষ প্রসঙ্গে মার্কস— এরকম অতীব গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছিলেন হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুনীল সেন, সতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দীপ্তেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অমলেন্দু গুহ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং আরও অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তি। বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন মরিস ডব, জোসেফ নীডহ্যাম, রজনী পাম দত্ত এবং আরও কয়েকজন বিদেশি পণ্ডিত এক্ষণ পত্রিকার জন্যই এবং তার জন্য সম্পাদকদ্বয়কে তারিফ করতেই হয়। এই সংখ্যাটির সামগ্রিক পরিকল্পনা ও মান ছিল অতি উচ্চ মানের, বামমনস্ক বাঙালির মননকে যা গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। ২০১৮ সালে মার্কসের জন্মের দ্বিশতবর্ষে দ্বিজেন্দ্র ভৌমিকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে স্বরান্তর-এর বিশেষ সংখ্যা (বর্ষ ৪, সংখ্যা ৮, জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৮)। লিখেছেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, আশীষ লাহিড়ী, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, রতন খাসনবিশ ও আরও অনেকে। মূল ফরাসি থেকে অনুবাদ করে আল্যাঁ ব্যাজু-র একটি প্রবন্ধের সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করে দিয়েছেন জয় বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৬৮ সালের বৌদ্ধিক জগতে যেসব চিন্তাভাবনা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হত, ২০১৮-তে তার অনেকটাই বদলে গেছে। ফলে এই সংকলনটিতে স্থান পেয়েছে পুরনোর সঙ্গে অনেক নতুন ভাবনাও, যেমন, মার্কসের পারি পাণ্ডুলিপি, ক্যাপিটাল-কে কেন্দ্র করে বেশ কিছু নতুন ধাঁচের প্রবন্ধ, মার্কস ও উত্তর-উপনিবেশবাদ, পাভলভ ও মার্কস, মার্কস, এঙ্গেলস ও ডারউইন ইত্যাদি। স্বরান্তর-এর এই সংখ্যাটি এক্ষণ-এর মার্কস সংখ্যার যোগ্য উত্তরসূরি, এ কথা বলাটা বোধহয় খুব অন্যায় হবে না। এসবের পাশাপাশি অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় শিপ্রা সরকার ও অনমিত্র দাশ (সংকলিত) বাঙালির সাম্যবাদ চর্চা, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। বঙ্গে মার্কসভাবনার বিকাশের গতিমুখটি বুঝতে এই অতি মূল্যবান সংকলনটি অপরিহার্য।
এবারে আসা যাক বর্তমান গ্রন্থটি প্রসঙ্গে। গোড়াতেই বলে রাখা দরকার যে, এই সংকলনটির উদ্দেশ্য একুশ শতকের প্রেক্ষিতে মার্কসকে নতুন করে দেখা, তাঁর চিন্তার পুনর্মূল্যায়নে, পুনর্বিচারে প্রয়াসী হওয়া, তাঁর স্তুতি বা বন্দনা করা নয়, যেমনটা এই ধরনের চিন্তকদের জন্ম-মৃত্যুকে স্মরণ করার ক্ষেত্রে সাধারণত হয়ে থাকে। মার্কস পৃথিবীকে বদলে দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন, বাতলে দিয়েছিলেন এক মৌলিক দর্শনভাবনা, যা দিশা দেখাবে এই বদলের, এই পরিবর্তনের। ১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লব ছিল সেক্ষেত্রে একটি মাইলফলক, এক নতুন পৃথিবী গড়ার সূচনাপর্ব। ২০১৮ সালে আমরা আজ যে পৃথিবীর মুখোমুখি, সেও এক পরিবর্তিত, বদলে যাওয়া মহাপৃথিবী, কিন্তু তার অবস্থান মার্কসের ভাবনার একেবারেই বিপরীত বিন্দুতে। ভুলটা কি মার্কস করেছিলেন? না কি আমাদেরই মার্কসকে বোঝার ক্ষেত্রে, তাঁর নাম করে মার্কসবাদের চর্চা ও অনুশীলনে কোথাও ভুল হয়ে গেছে? তাঁর তত্ত্বভাবনার আদলটা কেমন ছিল? তাঁর ভাবাদর্শের তাত্ত্বিক খুঁটিনাটি না বুঝলেও শ্রমজীবী মানুষ, সংগ্রামী জনতা আজও তাঁকে মানবমুক্তির অন্যতম দিশারি হিসেবে কেন গণ্য করেন? বাম বুদ্ধিজীবীদের একাংশ আজ মার্কসের তাত্ত্বিক অবস্থান নিয়ে সংশয়াচ্ছন্ন, তাঁর ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সন্দিহান। এরকম হরেক প্রশ্নের অনুসন্ধান করেছেন এই সংকলনের লেখকমণ্ডলী তাঁদের নিজের নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে। যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই পেশ করেছেন মৌলিক প্রবন্ধ। এই সংকলনে স্থান পায়নি কোনও পুনর্মুদ্রণ বা অনুবাদকর্ম, যা অতীতের উল্লিখিত কোনও কোনও মার্কস সংখ্যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। এই সংকলনটির আরও একটি উদ্দেশ্য একুশ শতকের বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মার্কসচর্চার ধাঁচাটির অনুসন্ধান করা। প্রবন্ধগুলির বিষয়বৈচিত্র এবং লেখক নির্বাচন এই ভাবনারই সূচক। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত মার্কস সংখ্যাগুলির সঙ্গে তুলনা করলে আরও একটি বৈশিষ্ট্য বর্তমান সংকলনটির ক্ষেত্রে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের চোখে পড়বে। পূর্বোক্ত সংকলনগুলিতে মার্কসকে একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ তাত্ত্বিক হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল,— বিভিন্ন প্রশ্ন বা বিষয়ে তাঁর অবদানের গুরুত্ব বা তাৎপর্যকে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। বর্তমান সংকলনটিতে এমন কয়েকটি প্রবন্ধ আছে যেখানে মার্কসের চিন্তায় অসম্পূর্ণতা, অসংগতির দিকগুলিকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে, মার্কসকে অসম্মান বা উপেক্ষা করার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই ধাঁচের প্রবন্ধগুলি রচিত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেয়েছে মার্কসের দৃষ্টিকোণ, তাঁর মনন, তাঁর পাঠপদ্ধতি, তাঁর চিন্তাশৈলী। উঠে এসেছে সাম্প্রতিক গবেষণার আলোকে মার্কসকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু বিতর্কিত বিষয়, যেমন, ঔপনিবেশিক প্রশ্ন, ধর্ম, রাষ্ট্র, ক্যাপিটাল–পাঠ নিয়ে কিছু ভাবনা, উত্তর-কাঠামোবাদ ও মার্কস বিতর্ক ইত্যাদি।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় ‘ কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো কি আজও প্রাসঙ্গিক?’ প্রবন্ধটিতে প্রশ্ন তুলেছেন, ১৮৪৮ সালে রচিত এই ঐতিহাসিক দলিলটি প্রবলভাবে ইউরোপকেন্দ্রিক হলেও গোটা পৃথিবীতে, বিশেষত আফ্রো-এশীয় দেশগুলিতে মান্যতা পেল কেন। তিনি দেখিয়েছেন, এই দলিলটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব শ্রেণিদ্বন্দ্বে দীর্ণ আজকের পৃথিবীতে যথেষ্টই প্রাসঙ্গিক, যদিও মার্কস যেভাবে পুঁজিবাদের বিকাশকে, বিশেষত অ-পশ্চিমি দেশগুলিতে, বিচার করেছিলেন, তার সঙ্গে বর্তমান সময়ের অভিজ্ঞতার অনেক গরমিল আছে। ম্যানিফেস্টো-কে তাই কোনও ধর্মগ্রন্থ হিসেবে না দেখে বিচার করা উচিত তার অন্তর্নিহিত শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে। শৌভিক মুখোপাধ্যায় ‘মার্কসের ইতিহাসচর্চায় বিপ্লবের ধারণা : একটি সম্ভাব্য রূপরেখা’ প্রবন্ধটিতে মার্কসের ক্রমাগত পরিবর্তনশীল ইতিহাসভাবনার ওপরে আলোকপাত করে দেখিয়েছেন তাঁর চিন্তায় বিপ্লবের ভাবনা উৎসারিত হয়েছিল তাঁর ইতিহাসভাবনা থেকে এবং আদতে বিপ্লবের এই ভাবনা ছিল চলমান বিপ্লবের ভাবনারই নামান্তর। তিনি আরও দেখিয়েছেন, মার্কসের বিপ্লবভাবনায় বারে বারেই উঠে এসেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন : বিপ্লবের সাফল্যের জন্য কী ধরনের শর্তপূরণ প্রয়োজন এবং তার নিরিখেই তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন জার্মানিতে কেন ফরাসি বিপ্লবের প্রতিধ্বনি শোনা গেল না। ‘উপনিবেশবাদ প্রসঙ্গে মার্কস’ প্রবন্ধে রণবীর সমাদ্দার দেখিয়েছেন মার্কসের তথাকথিত ইউরোপকেন্দ্রিকতার উত্তর-উপনিবেশবাদী সমালোচনা সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, উপনিবেশবাদ প্রসঙ্গে মার্কসের সুনির্দিষ্ট ভাবনাচিন্তা ছিল, যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল উপনিবেশবাদকে পুঁজিবাদের বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী বিস্তারের পরিণতি হিসেবে গণ্য করা।
অঞ্জন চক্রবর্তী ও অনুপ ধর-এর ‘বাংলায় মার্কস’ প্রবন্ধের ভিত্তি মার্কসের Ethnological Notebooks-এ John Budd Phear-এর The Aryan Village-এর ওপরে সংকলিত তাঁর নোটগুলি। লেখকরা বাংলার গ্রাম বিষয়ে মার্কসের ভাবনাচিন্তা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, তিনি এক দিকে যেমন সচেষ্ট ছিলেন ইউরোপীয় আধুনিকতা ও ভারতবর্ষের অনগ্রসরতার বৈসাদৃশ্য খুঁজতে, অপর দিকে তিনি অনুধাবন করতে চেয়েছিলেন গ্রামবাংলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে। সুদীপ্ত কবিরাজ ‘মার্কসের রাষ্ট্রভাবনা’ প্রবন্ধটিতে দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে গিয়ে বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের ইতিবাচক উপস্থিতির চেহারাটা কেমন দাঁড়াবে তার কোনও স্পষ্ট দিশা মার্কসের চিন্তায় পাওয়া যায় না। সেইসঙ্গে স্বাধীনতার তুলনায় সাম্যের ভাবনাকে অধিকতর গুরুত্ব দেবার কারণে পরবর্তীকালে মার্কসীয় রাষ্ট্রভাবনার ক্ষেত্রে অগণতান্ত্রিকতার ধারণা বৈধতা পেয়েছে এবং এই জায়গায় উদারনীতিবাদের জমি অনেকটাই বেশি শক্তপোক্ত।
‘মার্কস ও একজন উত্তর-কাঠামোবাদী : একটি কাল্পনিক সংলাপ’ প্রবন্ধে প্রদীপ বসু উত্তর-কাঠামোবাদ বনাম মার্কসবাদ বিতর্কটির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন এই বিতর্কে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতায় আসা যথেষ্ট কঠিন। উত্তর-কাঠামোবাদ মার্কসের ভাবনাকে ইউরোপের জ্ঞানদীপ্তি (Enlightenment)-র অনুসারী এই অভিযোগ করলেও মার্কস আধুনিকতার যে বিকল্প ভাষ্য হাজির করেন উত্তর-কাঠামোবাদীরা সেটি মেনে নিতে প্রস্তুত নন। অপর দিকে মার্কস পালটা অভিযোগ করেন যে, উত্তর-কাঠামোবাদ/উত্তর-আধুনিকতা শেষপর্যন্ত পর্যবসিত হয় এক নৈরাজ্যের দর্শনে— যে যুক্তি উত্তর-কাঠামোবাদ গ্রহণ করতে অপারগ।
অনুরাধা রায় ‘মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব ও একটি তৃতীয় বিকল্পের সম্ভাবনা : বাংলার অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রে মার্কসীয় ভাবনার বিভিন্ন ধারাগুলির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে তিরিশ-চল্লিশের দশকে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তার প্রভাব আলোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, এই ব্যাপারে বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সহমত ছিল না। এক পক্ষ সাহিত্য ও শিল্পকর্মকে নিছকই শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার পক্ষপাতী ছিলেন। অপর দিকে ছিল আরও একটি গোষ্ঠী, যাঁরা শ্রেণিদ্বন্দ্বের তুলনায় অনন্বয়ের ভাবনাকে অধিকতর গুরুত্ব দেবার পক্ষপাতী ছিলেন।
দেবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ধর্ম প্রসঙ্গে মার্কস : একটি সমকালীন মূল্যায়ন’ প্রবন্ধে ধর্ম নিয়ে মার্কসের ভাবনার অতিসরলীকৃত ভাষ্যকে খণ্ডন করে তিনি ধর্মকে কীভাবে বিচার করেছিলেন সেই প্রশ্নটির আলোচনা করেছেন এবং দেখিয়েছেন ধর্মকে ‘জনগণের আফিং’ বলে নস্যাৎ করার প্রবণতার বিপদ আজকের দিনে কোথায়।
অচিন চক্রবর্তী ‘শ্রেণিপ্রক্রিয়াকে কেন্দ্রে রেখে একটি নতুন রাজনৈতিক ভাষ্যের সন্ধানে’ প্রবন্ধটিতে দেখিয়েছেন বাজার বনাম পরিকল্পনা জাতীয় যে-বিতর্ক সাধারণত চোখে পড়ে, সেটিতে মন অর্থপূর্ণ নয়, কারণ মূলকথাটি হল শ্রেণি। বাজারকে, উদ্বৃত্ত মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে কোন শ্রেণি, সেটাই আসল কথা। তাই সমাজতন্ত্রেও বাজারের উপস্থিতি থাকতে পারে, যদি উৎপাদিত উদ্বৃত্ত মূল্য শ্রমিকশ্রেণির নিয়ন্ত্রণাধীন হয়।
সৌরীন ভট্টাচার্য ‘মার্কস : নৈতিক মাত্রায় মূল্যতত্ত্ব’ প্রবন্ধে ক্যাপিটাল, প্রথম খণ্ডের আলোকে মার্কসের মূল্যতত্ত্বের নৈতিক তাৎপর্য ও গুরুত্ব বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদিত দ্রব্য যখন পণ্যে রূপান্তরিত হবার সুবাদে তার বিনিময় মূল্য তার ব্যাবহারিক মূল্যকে অতিক্রম করে যায়, তখনই সেটি এক নৈতিক মাত্রা পরিগ্রহ করে, প্রভাবিত করে গোটা সমাজব্যবস্থাকে, যার তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। শোভনলাল দত্তগুপ্ত ‘মার্কসচর্চা : একুশ শতকের ভাবনা’ প্রবন্ধে MEGA প্রকল্পের আলোকে সোভিয়েত-উত্তর পৃথিবীতে মার্কসভাবনা কী ধরনের নতুন প্রশ্ন, নতুন বিষয়ে আলোকপাত করছে, তার বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর ব্যাখ্যায়, MEGA-র প্রেক্ষিতে মার্কসকে আজ সম্পূর্ণ নতুন করে আবিষ্কার করার, নতুনভাবে পাঠ করার এক সুযোগ উপস্থিত হয়েছে, যার ফলে আগামীদিনে মার্কসচর্চার আদল অনেকটাই বদলে যেতে পারে।
* * * *
মার্কসের জন্মের দ্বিশতবর্ষে আনন্দ পাবলিশার্স-এর পক্ষ থেকে যখন আমার কাছে এই প্রবন্ধ সংকলন ও সম্পাদনার প্রস্তাব আসে, আমি সানন্দে রাজি হলেও এই প্রকল্পটিকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। তার অন্যতম একটি কারণ ছিল যথোপযুক্ত বিষয় ও লেখক নির্বাচন করার প্রশ্নটি, কারণ এই ধরনের সংকলনে প্রবন্ধগুলির উচ্চমান সুনিশ্চিত করাটা সম্পাদকের একটি বড় দায় হয়ে দাঁড়ায়। অপর কারণটি এই সংকলনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল, আমাকে খেয়াল রাখতে হয়েছিল ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত এক্ষণ-এর মার্কস সংখ্যাটির কথা, চিন্তামনস্ক বাঙালির মনে যার অভিঘাত ছিল সুদূরপ্রসারী। পঞ্চাশ বছর পরে আনন্দ পাবলিশার্স-এর এই উদ্যোগকে বর্তমানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাঙালি পাঠককুল কীভাবে গ্রহণ করবে, সেই প্রশ্নটি আমাকে বারে বারেই ভাবিয়েছে। আমার সৌভাগ্য, এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটির বাস্তবায়নে আমি নবীন ও প্রবীণ সব লেখকের কাছ থেকেই অত্যন্ত ইতিবাচক সাড়া ও উষ্ণ সহযোগিতা পেয়েছি। তাঁদের কাছে আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ, বিশেষত এই কারণে যে, এঁদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যাঁরা তাঁদের প্রবল ব্যস্ততা, এমনকী অসুস্থতা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে লেখা পাঠিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন।
এই প্রবন্ধসংগ্রহের সম্পাদনার প্রতিটি পর্যায়ে আনন্দ পাবলিশার্স-এর পক্ষ থেকে মলয় ভট্টাচার্য আমাকে যেভাবে সাহায্য করেছেন, তার জন্য তাঁকে এবং তাঁর সহকর্মীদের আমি অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাই।
পরিশেষে বলি, একুশ শতকের বাঙালির মননে মার্কসের স্থান কোথায়, মার্কস কী অর্থে এবং কতটা প্রাসঙ্গিক, নতুন তথ্য ও গবেষণার আলোকে তাঁকে আজ আমরা কীভাবেই-বা পাঠ করব,— এমন অনেক প্রশ্নের অনুসন্ধান করেছেন প্রবন্ধগুলির রচয়িতারা তাঁদের নিজেদের মতো করে। মার্কসের জন্মের দ্বিশতবর্ষে আনন্দ পাবলিশার্স-এর এই প্রকল্পের গুণমান যাচাই করার কাজটা বুদ্ধিমনস্ক বাঙালি পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম। সতর্কতা অবলম্বন করলেও ত্রুটিবিচ্যুতি, ভুলভ্রান্তি যদি থেকে যায়, সেই দায় অবশ্যই এককভাবে সম্পাদকের, লেখকের নয়।
শোভনলাল দত্তগুপ্ত
কলকাতা
সেপ্টেম্বর ২০১৯
Leave a Reply