মান্টোর সেরা পঁচিশ – সাদত হাসান মান্টো
মান্টোর সেরা পঁচিশ – সাদত হাসান মান্টো
ভাষান্তর : সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর ২০২০
.
আমার দিদা, কল্যাণী আচার্য,
যিনি এই বই দেখতে পাওয়ার এক বছর আগেই
আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন;
এবং
সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেব, যাঁকে চোখে
কখনো দেখতে না পাওয়ার আফশোস
আমার এজীবনে যাবে না…
.
কৈফিয়ত
সাহিত্যানুরাগী মাত্রেই জানেন, উর্দু সাহিত্য ভাণ্ডারের এক অপরিহার্য অঙ্গ তার গদ্য সাহিত্য। এই সাহিত্যের অনেক কাণ্ডারীর মধ্যে একজন ছিলেন সাদত হাসান মান্টো। ১৯১২ থেকে ১৯৫৫ এই ৪৩ বছরের জীবনে তিনি যা কীর্তি রেখে গেছেন, তা অসামান্য। তাঁর বইয়ের সংখ্যা, জন্মস্থান, মৃত্যুস্থান, পারিবারিক জীবন নিয়ে কিছু বলব না। এই ইন্টারনেটের যুগে সবাই জানে বা পড়ে ফেলতে পারে। আসল কথা হল, পাঠকের কী দায় তাঁর লেখা পড়ার? আজ থেকে ষাট বছর বা তারও আগের লেখা এই ২০২০-তে পড়ে পাঠক কী পাবে? এককথায় উত্তর—তাঁর কলমে সমাজচিত্র আজও একইরকম প্রাসঙ্গিক।
মান্টোর লেখার বৈশিষ্ট্য হল, উনি কোনো সত্যকে রেখে-ঢেকে পরিবেশন করতেন না। মানুষের রোজনামচা হোক বা তার দৈনন্দিন আত্মিক ও বাহ্যিক সংগ্রাম, সমাজের কপটতা, অশ্লীলতা বা সম্পর্কের খুঁটিনাটি সব কিছুরই অপরিবর্তিত, নির্ভেজাল, নগ্ন রূপ তাঁর লেখায় ফুটে উঠত। সমাজের প্রান্তিক ও ব্রাত্যজনেরাও ছিলেন তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মান্টো কখনো ঠুনকো ভদ্রতার আশ্রয় নেননি। মান্টোর কথায়, ‘সমাজ যদি উলঙ্গ হয়, তাকে জামাকাপড় পরানোর দায়িত্ব আমার নয়…যদি আমার লেখা অসহ্য মনে হয়, তার অর্থ হল, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিই অসহ্য হয়ে উঠেছে।’…এই স্পষ্ট ভাষণ থেকে তিনি একমুহূর্তের জন্যও বিচ্যুত হননি। সরকার, আদালতের বিরাগভাজন হওয়া, অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হওয়া কোনো কিছুই তাঁকে তাঁর দায়িত্ববোধ থেকে সরাতে পারেনি।
মান্টোর লেখা পড়লে আরেকটা জিনিস খুব পরিষ্কার চোখে পড়ে। সেটা হল কোনো ভাবাবেগের বাড়াবাড়ি ছাড়া স্পষ্ট এবং নৈর্ব্যক্তিক গল্প বলার ধরন। গল্পের শেষ পর্যন্ত গিয়ে মান্টো পাঠককে ঠিক সেই জায়গায় আঘাত করেন, যেখানে তিনি আহত হয়েছেন।
যে যে বিষয়ে মান্টো লিখেছেন, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল দেশভাগ! রাজনীতির শঠতা, মানুষের ক্ষয়ক্ষতি-যন্ত্রণা তাঁকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর সাহিত্যে।
মান্টোর সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পগুলোর বেশিরভাগই দেশভাগকে কেন্দ্র করে। সত্যি কথা বলতে, মান্টোর লেখা সমস্ত গল্পের মধ্যে ‘সেরা’ বাছাই করতে পারার যোগ্যতা আমার নেই। তবু নিজের জ্ঞানবুদ্ধিমতো পঁচিশটা গল্প বেছে আমি অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি। চেয়েছি, পাঠক যাতে মান্টোর মূল বক্তব্য কিছুটা অনুভব করতে পারেন। সব গল্পের সুর এক নয়। কিছু অপেক্ষাকৃত হালকা মেজাজে লেখা, কিছু কঠোর ভাষায়, আর কিছু রূঢ় ব্যঙ্গে আঁকা কর্কশ বাস্তবের ছবি।
মান্টোর লেখা যখন আমি প্রথম পড়ি, সেই মুগ্ধতা থেকে অনেকদিন অবধি বেরোতে পারিনি। বারবারই মনে হয়েছে, এ সৃষ্টি সবার পড়া দরকার। উর্দু ভাষা আর তার বিশাল সাহিত্য সম্ভারের সঙ্গে অনেক বঙ্গসন্তানই সেভাবে পরিচিত নন। আমি নিজে এর আগে মান্টোর কিছু গল্পের ইংরাজি অনুবাদ পড়েছি। আমার মনে হয়েছে, ঠিক ভাবটা ফুটে ওঠেনি। তাই মান্টোকে পৌঁছে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছায় খানিকটা নিজের তাগিদেই সরাসরি উর্দু থেকে আমি এই অনুবাদের কাজ শুরু করি। ঘটনাচক্রে তার দুয়েকটা কাকু ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়কে পড়তে অনুরোধ করি। তখনই এই বইয়ের সূত্রপাত।
এবার কৃতজ্ঞতা স্বীকারের পালা। এই তালিকাটা ছোট নয়। প্রথমেই আমার বাবা, মা যাঁরা আমি পড়ার বই ছেড়ে ‘গল্পের বই’ পড়লে কোনোদিন ভুরু কোঁচকাননি। তাঁদের প্রভাবেই আমার ভাষা শেখা, নতুন বই পড়ার আগ্রহ! এরপর আমার পার্টনার, অভিজ্ঞান। আমার প্রতিটা অনুবাদ প্রূফরিড করা আর আরও প্রাঞ্জল করায় যার ভূমিকা সবার প্রথমে। আমার বোন ও বন্ধু এষা এবং আমার আরেক বিশেষ বন্ধু অভীক তাদের চরম ব্যস্ততার মধ্যেও প্রত্যেকটা লেখা পড়ে মতামত দিয়েছে আর ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে গেছে। এখানে বলে রাখি, আমার তিন ইংরাজি শিক্ষক, শ্রীসত্যপ্রকাশ রায়, শ্রীমতী প্রণতি রায় এবং স্বর্গত শ্রীবিশ্বেন্দ্রনারায়ণ সান্যাল যদি আমায় স্কুলজীবন থেকে আজ অবধি অনুবাদে উৎসাহিত না করতেন, বোধহয় এ সাহস আমি পেতাম না। এরপর একজন প্রণম্য সাহিত্যিকের কথা। সৈয়দ মুজতবা আলী। যদি আমাকে আইডল হিসেবে কোনো একজন সাহিত্যিকের নাম করতে হয়, তিনি আলীসাহেব। আর যিনি না থাকলে এই বই হতোই না, তিনি হলেন ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
পাঠকদের কাছে আমার শেষ কৈফিয়ত দিয়ে আমি আমার বক্তব্যে ইতি টানব। আমার অনুবাদের মাধ্যমে যদি কিছু পাঠককেও উর্দু সাহিত্য এবং মান্টোর বিষয়ে উৎসাহিত করতে পারি, আমার কাজ সার্থক মনে করব।
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
Leave a Reply