মানবতন্ত্র – আবুল ফজল
প্রথম প্রকাশ – বইমেলা ২০১৬
প্রচ্ছদ – মোবারক হোসেন লিটন
.
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
আমার পাঁচটি লেখা নিয়ে এ সংকলনটি প্রকাশিত হলো। প্রথম চারটি লেখা ইতিপূর্বে আমার অন্য বইতেও ছাপা হয়েছে। শেষের লেখাটি এর আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি, এমন কি কোনো সাময়িক কাগজেও না। যদি লেখাটির রচনাকাল বেশ কয়েক বছর আগে।
বাংলাদেশ যখন পূর্ব পাকিস্তান ছিল লেখাটি তখন একাধিক কাগজে পাঠিয়ে দেখেছি, কেউ ছাপতে রাজি হয়নি। হঠাৎ দেশে এমন এক ওলটপালট ঘটে গেল যে যার ফলে রাষ্ট্রীয় আদর্শ আর ধ্যান-ধারণায় অবিশ্বাস্যরূপে একটা পটপরিবর্তন দেখা দিয়েছে যার সঙ্গে আমাদের নিজেদের ধ্যান-ধারণার রয়েছে মিল। আমরা যারা লিখে থাকি তারাও যেন এবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম। হয়তো মনের কথা মনের মতো করে বলা যাবে এখন থেকে।
তবে এও সাময়িক কিনা তা বুঝতে সময় লাগবে।
লেখকের একটা দায়িত্ব পাঠকের মনে কিছু জিজ্ঞাসা জাগিয়ে তোলা। আমার বারে বারে প্রত্যাখ্যাত লেখাটিরও এ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। সবকিছু থেকে মানুষ মোহ-মুক্ত হোক। বুদ্ধি দিয়ে সবকিছু বিচার করে দেখুক, সর্ব ব্যাপারে মানুষ যুক্তিশীল তথা র্যাশেনাল হোক, লেখক সর্বান্তকরণে এ লেখাগুলির মারফৎ সে কথাটাই বলতে চেষ্টা করেছে। এ বইটি প্রকাশের জন্য আমি শ্রীসত্যেন সেনের কাছে ঋণী।
আবুল ফজল
.
ভূমিকা
সার্থক শিক্ষক, লেখক, শিক্ষা-প্রশাসক আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩)। এসবের উপরে তিনি নিখাদ মানবতাবাদী এক সংগ্রামী মানুষ। আজীবন সংগ্রামী আবুল ফজল কখনও কোনো পরিস্থিতিতে সত্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। আপোষ করেননি অসত্যের কাছে। তাইতো তিনি বাংলার বিবেক শিরোপায় ভূষিত। আবুল ফজল শিখিয়েছেন যেকোনো লোভনীয় পদের অবস্থান কিংবা পদের বিনিময়ে সত্যের পথে নিজের বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে ঋজু হয়ে দাঁড়াতে। আবুল ফজল শিখিয়েছেন ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। প্রচার করেছেন ‘মানবতন্ত্রে’র অমোঘ বাণী।
বাঙালি নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরে জন্মগ্রহণ করে সাহস, সচেতনতা, সদিচ্ছা আর একাগ্র সাধনায় তিনি আবুল ফজল হয়ে উঠেছেন। প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন উঁচু থেকে সুউচ্চ পদে। পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ছাত্র জীবন থেকেই যুক্ত হন নানা সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে। শুরুতে কাজ করেন আবুল হোসেন প্রতিষ্ঠিত ‘মুক্তবুদ্ধি চর্চা’ আন্দোলনের সঙ্গে। সম্পাদনা করেন ‘শিখা’ পত্রিকা (১৯৩১)। এর আগেই তিনি যোগদেন ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের জুনিয়র শিক্ষকের অস্থায়ী পদে। পিতার ইচ্ছায় পরের বছর বি. টি পাশ করে প্রথমে যোগ দেন কাজেম আলী স্কুলে (১৯৩২) পরের বছরই খুলনা জিলা স্কুলে। খুলনা থেকে চট্টগ্রাম। চাকরি, ঘর-সংসার কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি জ্ঞান পিপাসু আবুল ফজলকে। ১৯৪০ খ্রিস্টাকে এম. এ পাস করেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরের বছরই স্কুলের চাকরি ছেড়ে যোগ দেন কৃষ্ণনগর কলেজে অধ্যাপক হিসেবে। একবছর বাদে ১৯৪৩-এ যোগ দেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে। এই কলেজ থেকেই চাকরি জীবনের সমাপ্তি টানেন ১৯৫৯-এ। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ঘরে বসে থাকেননি আবুল ফজল। জড়িত থেকেছেন না না সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩-এ যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে। উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনে তাঁর ন্যায়নিষ্ঠ সাহসিকতা আর কর্তব্যপরায়ণা তাকে অনন্য করে তুলেছে।
উপাচার্য থাকা অবস্থায় দেশে ঘটে যায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড। সপরিবারে নিহত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। দেশে জারি হয় সামরিক আইন। বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা পরিষদে শিক্ষা উপদেষ্টা পদে যোগ দেন ১৯৭৫-এর শেষের দিকে। কোনো পদই আবুল ফজলের বিবেককে আঁধার করতে পারেনি। উপদেষ্টা থাকা অবস্থায়ই লিখলেন ছোটোগল্প ‘মৃত্যের আত্মহত্যা’। জাতির জনকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বিবেকের তাড়নায় রচিত আবুল ফজলের ছোটোগল্প ‘মৃতের আত্মহত্যা’ প্রকাশিত হয় ‘মাসিক সমকাল’ সাময়িকীতে। তোলপাড় শুরু হয় সামরিক শাসক মহলে। ডেকে নেয়া হয় সমকাল সম্পাদক ইসমাইল মোহাম্মদকে। নানা হ্যানস্তা। ঘটনায় অস্থির অশান্ত হয়ে ওঠেন আবুল ফজল। তারপর উপদেষ্টার পদ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন সচেতন নির্ভীক আবুল ফজল। ১৯৭৮-এর এপ্রিলে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে মাসিক সমকাল আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশের বিবেক’ উপাধিতে ভূষিত করে আবুল ফজলকে। ১৯৮০-র ৪মে তারিখে জীবনাবসাস ঘটে ‘বাংলাদেশের বিবেক’ আবুল ফজলের। সন তারিখের হিসেবে তিনি বেঁচেছিলেন ঊনআশি বছর দশ মাস তিন দিন।
দুই.
এই দীর্ঘ জীবনে আবুল ফজলের সৃষ্টি বিশাল সাহিত্যসম্ভার নানা বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। বয়সের হিসেবে আশি বছরের জীবনের ষাট বছর তাঁর লেখক-জীবন। আবুল ফজল লিখেছেন উপন্যাস, ছোটোগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা ইত্যাদি। “শিল্পের জন্য শিল্প নয়, মানুষ আর সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেই লিখেছেন আবুল ফজল। তাই তিনি হয়ে উঠেছেন সমাজ সচেতন নির্ভীক গণসাহিত্য শিল্পী। আবুল ফজল রচিত উপন্যাসের সংখ্যা সাত। প্রথম উপন্যাস ‘চৌচির’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে। তখন তিনি চব্বিশ বছরের যুবক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র। এর আগেই তিনি যুক্ত হন অধ্যাপক আবুল হোসেন প্রতিষ্ঠিত আল-মামুন ক্লাবের সঙ্গে। এখানেই গড়ে ওঠে পর্দা বিরোধীসংঘ বা ‘এন্টি পর্দা লিগ’। সঙ্গের এক সভায় আবুল ফজল পাঠ করেন ‘পর্দা প্রথার সাহিত্যিক অসুবিধা’ শীর্ষক প্রবন্ধ। পরিচিত হন আবুল হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, কবি আবদুল কাদির প্রমুখের সঙ্গে। সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের কাজে। এসময় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় এলে (৭ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬) তাঁর ভাষণ শুনে অনুপ্রাণিত হন আবুল ফজল। বি. এ. পাস করে কলকাতা যান আইন পড়ার উদ্দেশ্যে। সেখানে পরিচিত হন কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে। লেখার অনুপ্রেরণা লাভ করেন এঁদের কাছ থেকে। এরপর লিখে চলেছেন অবিরাম।
লিখেছেন ‘নারী ও পুরুষ’ (১৯৩২, পরে ‘জীবন পথের যাত্রী’ নামে প্রকাশিত) ‘প্রদীপ ও অপ্রতঙ্গ’ (১৯৪০), ‘সাহসি’ (১৯৪৬) জীবন পথের যাত্রী’ (১৯৪৮) ‘রাঙাপ্রভাত’ (১৯৫৭), ‘পরাবর্তন’ (১৯৬৮) প্রভৃতি উপন্যাস। আবুল ফজলের রচিত ছোটো গল্প সংকলন চারটি। ‘মাটির পৃথিবী’ প্রকাশিত হয় ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে, ‘আয়না’ ১৯৫১-তে ‘মৃত্যের আত্মহত্যা’ ১৯৭৮-এ। ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ শিরোনামে গল্প সংকলন প্রকাশিত ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে।
আবুল ফজল রচিত নাটকের সংখ্যা ছয়। প্রকাশকাল যথাক্রমে ‘একটি সকাল’ (১৯৩৬); ‘আলোক লতা’ (১৯৩৬), কায়েদে আজম’ (১৯৪৬), ‘প্রগতি’ (১৯৪৮ ‘সাহসিকা’ উপন্যাসের নাটরূপ), ‘স্বয়ম্বরা’ (১৯৬৬) এবং ‘ছদ্মবেশী’ (১৯৭০, মূল গোগল) আবুল ফজলের প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ নয়টি। এগুলো হলো: ‘বিচিত্র কথা’ (১৯৪০) ‘বিদ্রোহী কবি নজরুল’ (১৯৫৭), ‘সাহিত্য এ সংস্কৃতি সাধনা’ (১৯৬১) ‘সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন’ (১৯৬৫), ‘সমাজ সাহিত্য ও রাষ্ট্র’ (১৯৬৮), ‘সমকালীন চিন্তা’ (১৯৬৮), ‘মানবতন্ত্ৰ (১৯৭৩), ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’ (১৯৭৮) এবং ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন’ (১৯৭৯)
আবুল ফজলের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ তিনটি। আত্মজীবনী ‘রেখাচিত্র’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে। ‘রেখাচিত্র’ বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য আত্মজীবনী। এছাড়া তিনি লিখেছেন ‘লেখকের রোজনামচা’ (১৯৬৯), এবং ‘দুর্দিনের দিনলিপি’ (১৯৭২) শীর্ষক ডাইরিকল্প গ্রন্থ। তাঁর রচিত জীবনী গ্রন্থ দুইটি ‘সাংবাদিক মুজিবুর রহমান’ (১৯৬৭) এবং ‘হজরত আলী (১৯৬৮)।
আবুল ফজলের ভ্রমণকাহিনি ‘সফরনামা’ ও ‘বৃটেন সফর’ প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৭৫ ও ১৯৭৭-এ।
তিনি ধর্ম নিয়ে লিখেছেন ‘কোরানের বাণী’ (১৯৪৯), ‘হাদিসের বাণী’ (১৯৬১) গ্রন্থ।
এছাড়া তার প্রকাশিত গ্রন্থ ‘জার্নিস এন্ড’ (১৯৫৫) ‘সপ্তপর্না’ (১৯৬৪) ‘তবুও সূর্য ওঠে’ (১৯৭৪), ‘শুভবুদ্ধি ও সাহিত্য’ (১৯৭৪) ‘দি স্টোরি অব ফিলসফার’ (১৯৮১)। এর কোনোটি অনুবাদ আবার কোনোটি কোনো বিদেশী গ্রন্থের অবলম্বনে রচিত।
আবুল ফজলের সাহিত্য সৃষ্টি স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল। গোড়ামি আর ভূপমণ্ডুকতার ঊর্ধ্বে তাঁর সাহিত্য ভাবনা। সত্য ভাষণে তিনি এক উজ্জ্বল দিশারী। সহজ কথা সহজে বলার এক দুর্দান্ত সাহসিকতার প্রমাণ তাঁর ‘রেখাচিত্র’। ‘রেখাচিত্র’ কেবল ব্যক্তি আবুল ফজলের ব্যক্তি জীবনের চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, হয়ে উঠেছে সার্বজনীন। সমসাময়িক সময়ের সমাজ মানসের রেখাচিত্র। অসাধারণ বর্ণনা কৌশলে হয়ে উঠেছে যথার্থ রেখাচিত্র I
সত্য ভাষণ এবং সোচ্চার উচ্চারণের কারণে সাহিত্যিক আবুল ফজলকে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে একাধিকবার। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে মাসিক ‘সমকাল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রবন্ধ ‘মানবতন্ত্র’। টনক পড়ে পাকিস্ত ানী শাসকের। বাজেয়াপ্ত করা হয় সমকালের সেই সংখ্যাটি। এর তেরো বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার রোষানলে পরে আবুল ফজলের রচনা। তখন তিনি রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পদে আসীন। সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ছোটোগল্প ‘মৃতের আত্মহত্যা’। এই গল্পকে গ্রহণ করতে পারেনি সামরিক শাসকগোষ্ঠী। এবার সমকালের সম্পাদক ইসমাইল মোহাম্মদকে তলব করা হয় সেনা ছাউনিতে। জর্জরিত করা হয় নানা প্রশ্নবাণে। পরে আবুল ফজলের প্রকৃত পরিচয় জেনে আপাত শান্ত হলেও আবুল ফজল আর বেশিদিন উপদেষ্টা থাকলেন না। চলে এলেন পদ ছেড়ে।
পরের বছর লিখলেন ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’ শীর্ষক প্রবন্ধ। নতুন উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত করলেন নতুন প্রজন্মকে। এবছরই প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘মৃত্যের আত্মহত্যা’। গ্রন্থে সংযুক্ত হয় আরো চারটি গল্প। এই বছরেই (১৯৭৮) পহেলা বৈশাখ মাসিক সাহত্যি পত্রিকা ‘সমকাল’-এর পক্ষ থেকে তাঁকে ভূষিত করা হয় ‘বাংলাদেশের বিবেক’ উপাধিতে।
‘মানবতন্ত্র’ শিরোনামেই পরবর্তীকালে ১৯৭২-এ প্রকাশিত তাঁর একটি প্রবন্ধ সংকলন। শিল্পী-সংগ্রামী সত্যের সেনের উদ্যোগে এই প্রকাশনা গ্রন্থের শুরুতে সত্যেন সেনের একটি ভূমিকাসহ প্রথম সংস্করণে সংকলিত হয় পাঁচটি লেখা, পরে এতে আরো একটি লেখা যুক্ত হয়। বাংলাবাজারের একটি প্রকাশনা থেকে এটি প্রথম প্রকাশিত। একই বছর ‘মুক্তধারা’ প্রকাশনা সংস্থা থেকে ‘মানবতন্ত্র’ প্রকাশিত হয়। ‘মুক্তধারা’ সংস্করণে আরও একটি প্রবন্ধ যুক্ত হয়। কিন্তু আবুল ফজল স্বাক্ষরিত ভূমিকাটি অপরিবর্তিত থাকে। ভূমিকায়
লেখক লিখেছেন ‘আমার পাঁচটি লেখা নিয়ে এ সংকলকটি প্রকাশিত হলো’। তিনি আরো লিখেছেন: ‘এ বইটি প্রকাশের জন্য আমি শ্রী সত্যেন সেনের কাছে ঋণী’ পরে এতে সংকলিত হয় আরো একটি লেখা। এই ছয়টি লেখা নিয়েই ‘মুক্তধারা’ সংস্করণের প্রকাশ। আমাদের অবলম্বনও এই সংস্করণ। আবুল ফজলের কথায় জানা যায় আরো একটি লেখা ‘মানবতন্ত্রে’র জন্য লেখা হয়েছিল। তবে তা মুক্তধারা সংস্করণের প্রকাশের পরে। বর্তমান সংস্করণে সেই লেখাটি সংযুক্তি হিসেবে মুদ্রিত হলো।
মানবতন্ত্র ভিন্নধারার গ্রন্থ। বাংলাসাহিত্যে ‘মানবতন্ত্র’-র তুলনা কেবল ‘মানবতন্ত্র’ই। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’-কে প্রতিষ্ঠা করাই এই সংকলনের মূল বক্তব্য। আবুল ফজল অত্যন্ত দৃঢ় ও ঋজু হয়ে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ সবার উপরে তিনি স্থান দিয়েছেন মানবতাকে। আর এই মানবতাবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে আবুল ফজল তুলে ধরেছেন নানা যুক্তিতর্ক, উদাহরণ উপমা। ফলে ‘মানবতন্ত্র’ হয়ে উঠেছে সরস রচনা। এক্ষেত্রে কোনো সংকীর্ণতা ভয়-ভীতি স্পর্শ করতে পারেনি মানবতাবাদী আবুল ফজলকে।
গ্রন্থের প্রথম লেখার শিরোনাম ‘মানবতন্ত্র’। এই নামেই বইয়ের নামকরণ। প্রবন্ধের শুরুতেই লেখক সত্য প্রকাশের দৃঢ়তা ব্যক্ত করে লিখেছেন: ‘সাহিত্যিকদের কাছে সত্যই বড় কথা। সত্যের সঙ্গে যদি জাতীয় আদর্শ, ধর্ম বা শাস্ত্রের বিরোধ ঘটে নিঃসন্দেহে বিনা দ্বিধায় সাহিত্যিক সত্যের পক্ষাবলম্বন করবে’।
এর মধ্য দিয়ে আবুর ফজল সত্যকে স্থান দিয়েছেন সবার উপরে। আর এই সত্য-র প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিছেন জাতীয় আদর্শ, ধর্ম এবং শাস্ত্রকে। এই জাতীয় আদর্শ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় আদর্শকে। সেই সঙ্গে এসেছে ধর্ম এবং শাস্ত্রের কথা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যা, পরের সম্পত্তি দখল এসবের প্রতিপক্ষ হিসেবেই দাঁড়িয়েছেন মুক্তবুদ্ধির ধারক আবুল ফজল। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে আবুল ফজল নানা উদাহরণ উপমা দিয়ে যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন মানব-সত্যকে। সকল ধর্মকর্মের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন মানুষের চরিত্র, আদর্শ আর নীতিকে যা সমাজকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যেতে পারে। তার সহজ-সরল উক্তি: ‘চরিত্র ও নীতিবোধের পরিবর্তে তসবির জনপ্রিয়তা, মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা বৃদ্ধি বা হরি সংকীর্তনে কণ্ঠস্বরের প্রতিযোগিতা মোটেও সামাজিক অগ্রগতির দিগদর্শন নয়। বরং এ যুগে এটাও এক রকম Playing to the gallery—ওতে খেলায় জেতা যায় না।’ কঠিন ও দৃঢ়তার সঙ্গে সহজ ভাষায় আবুল ফজল তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। বিষয়টিও আরো ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন ‘যা পরকালের সঙ্গে জড়িত, অর্থাৎ ধর্ম, তার উপর জোর না দিয়ে যা এ জীবনের সঙ্গে জড়িত, অর্থাৎ মানবতার ওপর জোর দেওয়াই উচিত। মানুষের কল্যাণ এ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে জড়িত।’ ধর্মবিশ্বাস, সেই বিশ্বাসের ভিত্তিতে পরকালে অনন্তকাল সুখবাসের কল্পনাকে সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন আবুল ফজল। মানুষের চৈতন্য বিকাশে তিনি মানবতন্ত্র বা মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন দৃঢ়তার সঙ্গে।
এরপরের প্রবন্ধ ‘ধর্ম ও রাষ্ট্র’। পাকিস্তানে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণার দাবিতে যখন সোচ্চার একশ্রেণীর ধর্মান্ধ মানুষ সেই সময়েই আবুল ফজলের এই লেখা। নানা যুক্তিতর্ক, উদাহরণ দিয়ে তিনি ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে দূরে রাখার কিংবা রাষ্ট্রকে কোনো বিশেষ ধর্মের ঘেরাটোপে বন্দী না করার পক্ষে জোড়ালো বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তার সহজ যুক্তি রাষ্ট্র ইহলৌকিক আর ধর্ম পারলৌকিক। পারলৌকিক বা ধর্মীয় বিষয় বা নিয়মনীতি বা আইন কানুন ইহজাগতিক কাজে ব্যবহৃত হলে উভয়ের ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি লিখেছেন ‘ধর্মকে রাষ্ট্রের সাথে আর রাষ্ট্রকে ধর্মের সাথে জুড়ে দিতে গেলেই এক অদ্ভুত গোঁজামিল স্ববিরোধিতার সম্মুখীন হতেই হবে। কারণ, ধর্ম অলঙ্ঘনীয়-তার নির্দেশ ও বিধান অপরিবর্তনীয়। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র স্থানু নয়—প্রগতিশীল বলেই তা পরির্তনশীল। আর বিচ্ছিন্ন নয় বলে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে নানা স্বার্থে ও বিচিত্র আইন-কানুনে তা শৃঙ্খলিত’। প্রবন্ধের প্রায় শেষ পর্যায় আবুল ফজলের সোচ্চার উচ্চারণ: ‘আসল কথা এ যুগে কোনো রাষ্ট্রই ধর্মভিত্তিক হতে পারে না, পারবে না। করতে গেলেই ধর্মকে ফাঁকি ও গোঁজামিলের আড়ালে মুখ ঢাকতে হবে’। এর পক্ষে তিনি উপস্থাপন করেছেন নানা যুক্তি।
গ্রন্থের পরের প্রবন্ধ ‘সভ্যতার সংকট’। সভ্যতার সংকট আলোচনা করতে আবুল ফজল আমাদের সংস্কৃতির সংকটের দিকেই আঙ্গুল তুলেছেন। আলোচনা করেছেন জীবন দর্শনের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে। ছোটো এই লেখায় আমাদের শিক্ষা, শিক্ষার ফলাফল এবং মানুষের যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার প্রতিবন্ধকতার বিষয় উঠে এসেছে। বর্তমান সভ্যতা প্রসঙ্গে তার মন্তব্য : ‘বিগত সভ্যতা—যা মহৎ শিল্প সাহিত্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল, এমনকি রেনেসাঁ ও এনসাইক্লোপিডিস্টদের যুগের দিকে তাকালেও আমরা বুঝতে পারবো, মত-বিশ্বাস-আদর্শ-নিষ্ঠা, যা চিন্তা চর্চারই ফল-সভ্যতার স্থিতি, বিকাশ ও সমৃদ্ধির জন্য কতখানি আবশ্যক। আধুনিক সভ্যতার পায়ের তলায় এই অত্যাবশ্যক শর্তগুলি অনুপস্থিত। ফলে আজ সভ্যতার ত্রিশঙ্কু দশা। এই ত্রিশঙ্কু দশা থেকে মুক্তির পথ বাতলেছেন এভাবে: ‘আজ এই মহাসংকটের দিনে বাঁচতে হলে মানব-সভ্যতাকে একটা নীতি ও সত্যের উপর দাঁড় করাতে হবে। আর তা করতে হলে মানুষকে ভাবতে হবে, করতে হবে চিন্তা ও যুক্তির চর্চা, হতে হবে বিবেকী’। চিন্তা ও যুক্তি চর্চার এই আহ্বানের মধ্য দিয়েই লেখার সমাপ্তি।
এরপর আবুল ফজল চোখ ফিরিয়েছেন সরাসরি সংস্কৃতির দিকে। বলা যায় পূর্ববর্তী ‘সভ্যতার সংকট’-এর ধারাবাহিকতায়ই এই প্রবন্ধের সৃষ্টি। সংস্কৃতি সভ্যতার সূতিকাগার। সভ্যতায় ক্ষেত্রে যে পশ্চাদপদতা তাকে দূর করতে পারে সুষ্ঠু সংস্কৃতি চর্চা। বিষয়টি আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি সমাজ- সভ্যতা, রাষ্ট্র-ধর্ম ইত্যাদি বিষয় উপস্থাপন করেছেন। মানবমুক্তির পথ খুঁজেছেন সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে। লেখার শেষ কথা : ‘মোটকথা, মনুষ্যত্ব তথা মানব-ধর্মের সাধনাই সংস্কৃতি এবং একমাত্র এ সাধনাই জীবনকে করতে পারে সুন্দর ও সুস্থ’। মানব জীবনে এমন সৌন্দর্য এবং সুস্থতাই মুক্তমনা আবুল ফজলের কাম্য।
এর পরেই এসেছে ‘আগামী দিনের সভ্যতা: একটি কল্পনা’; শীর্ষক লেখা। লেবাননের বিখ্যাত কবি দার্শনি খলিল জিব্রানের একটি গল্প দিয়ে এই লেখার শুরু। গল্পের মূল কথা ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং তার প্রতিপক্ষ শয়তানের অবস্থান। লেখকের মতে এরা পরস্পর নির্ভরশীল। অর্থাৎ এদের অনুপস্থিতি অকল্পনীয়। পাঁচটি পর্বে লেখা এই প্রবন্ধের মূল কথা মানবতাবাদ বা মানবতন্ত্র। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ কিংবা ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান’- এর বাণীই উচ্চারণ করেছেন আবুল ফজল। একে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন নানা যুক্তি আর উদাহরণ সহযোগে। সবার উপরে যে মানুষ তারই কল্যণকামী আবুল ফজলের পরের লেখার শিরোনাম ‘মানবকল্যাণ’। মানবতাবাদের উপসংহার যেন এই লেখা। দান বা ভিক্ষা প্রদান বা গ্রহণে মানুষের কোনো কল্যাণ হতে পারে না। তাঁর কথায় ‘মানুষের মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়ে শ্রেফ তার জৈব অস্তিত্বের প্রতি সহানুভূতিশীল এ ধরনের মানবকল্যাণ বিন্দুমাত্র ফলপ্রসূ হতে পারে না’। অথচ এমন মানবকল্যাণকেই আমরা মোক্ষম বিবেচনা করি। আসলে তা মানবতার অপমান। মানুষকে বাঁচতে হবে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে, মানুষ হিসেবে। তার জন্য আত্মার বিকাশসাধন অপরিহার্য। নিজের বুদ্ধির চর্চাই মানুষকে প্রকৃত মানুষ করে তুলতে পারে। বার্ট্রান্ড রাসেলের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে আবুল ফজল তার এই লেখা শেষ করে বলেছেন : ‘আমাদের বিশ্বাস মুক্তবুদ্ধির সহায়তায় সুপরিকল্পিত পথেই কল্যাণময় পৃথিবী রচনা সম্ভব। একমাত্র মুক্ত বিচারবুদ্ধির সাহায্যেই বিজ্ঞানের অভাবনীয় আবিষ্কারকে ধ্বংসের পরিবর্তে সৃজনশীল মানবিক কর্মে করা যায় নিয়োগ। তা করা হলেই মানবকল্যাণ হয়ে উঠবে মানব-মর্যাদার সহায়ক’।
আবুল ফজল মানবতাবাদী উদার মানসিকতার সানুষ। তিনি তাঁর বিশ্বাসের প্রতি দৃঢ়। তাঁর উচ্চারণ ঋজু এবং বিশ্লেষণী। নিজের জীবনে ‘মাথা নত না করার’ যে স্থির অবস্থান তারই বাণী শোনা যায় পরবর্তী গ্রন্থ ‘একুশ মানে মাথা নত না করার’ বাণীতে। মানবতা, মানবকল্যাণ অন্যায় অবিচারের কাছে মাথা নত না করার প্রত্যয়ে স্থির থাকতে চাই বুদ্ধির চর্চা বা বুদ্ধির মুক্তি। এমন মুক্তবুদ্ধি চর্চার উদ্দেশ্যে একসময় ঢাকায় গড়ে উঠেছিল সংগঠন। অনেক মনীষীর সঙ্গে আবুল ফজল যুক্ত ছিলেন সেই আন্দোলনে। এই আন্দোলনের আদর্শ, উদ্দেশ্য, কার্যক্রম, সার্থকতা, ব্যর্থতা ইত্যাদির পরিচয় পাওয়া তার ‘বুদ্ধির মুক্তি’ লেখায়। পাঠকের পরিতৃপ্তির উদ্দেশ্যে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ সংযোজিত হলো বর্তমান সংস্করণে। মানবতন্ত্র পাঠে পাঠক যেমন আত্মবোধে উদ্দীপ্ত হবেন তেমনি পথ খুঁজে পাবেন ‘মানুষ’ নামের যথার্থতা অনুধাবনে।
বদিউর রহমান
ফেব্রুয়ারি ২০১৬
.
সূচি
মানবতন্ত্র
ধর্ম ও রাষ্ট্র
সভ্যতার সংকট
সংস্কৃতি
আগামী দিনের সভ্যতা : একটি কল্পনা
মানবকল্যাণ
সংযোজন : বুদ্ধির মুক্তি
Leave a Reply