মাই জার্নি : স্বপ্নকে বাস্তবতা প্রদান – এ পি জে আবদুল কালাম
অনুবাদ – রাব্বি উস সানী
বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশ – ডিসেম্বর ২০১৫
ভূমিকা
আমার বয়স এখন আশির উর্ধ্বে। আমার এই দীর্ঘযাত্রা, আমার শৈশব থেকে এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া অসংখ্য অভিজ্ঞতা সম্বলিত। এই দীর্ঘসময় জুড়ে অসংখ্য অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে আমি জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা পেয়েছি। তা হলো—সবাইকে জীবনের প্রতিটি ধাপেই স্বপ্ন দেখতে হবে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবতা প্রদানের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। যদি কেউ এমনটা করতে পারে, তবে সাফল্য তার জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমার পরিচিত অসংখ্য মানুষকে আমি বলেছি, ‘আমরা ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্ন দেখি, তা প্রকৃতপক্ষে কোনো স্বপ্নই নয়। স্বপ্ন হলো ঐ বস্তু যা আমাদেরকে ঘুমাতে দেয় না।
একদিন যখন আমি আমার বাগানে হাঁটছিলাম, তখন হঠাৎ করেই এই বইটি লেখার কথা আমার মাথায় আসল। বরাবরের মতোই আমি আমার বাগানের বুড়ো অর্জুনগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে পড়লাম। গাছটার বয়স একশ’র বেশি হবে। আমি গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে এর ডালপালার দিকে তাকালাম। আমি খুঁজছিলাম এই গাছে কোনো পাখি বাসা বেঁধেছে কি না বা নতুন কোনো জীবনের উপস্থিতি আছে কি না। আর এরকম একটি মুহূর্তে যখন আমি গাছের দিকে তাকিয়ে আছি, তখন আমার বাবার কথা মনে পড়ে গেল। আমার বাবাও খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন।
তিনি তার বাগানের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার নারকেলের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতেন। বাবার কথা ভাবতে ভাবতেই আমার মুখের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। আমার শৈশবের স্মৃতি এবং এর সাথে জড়িত মানুষগুলোর কথাও মনে পড়ে গেল। যাদের হাত ধরে আমি এতটা পথ পাড়ি দিয়েছি। এরপর আমি আমার এই দীর্ঘযাত্রার কথা স্মরণ করলাম। যে সকল পথে আমি হেঁটেছি, যে সকল ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখেছি, আমি নিজে যে সকল ঘটনার অংশ ছিলাম, সে সকল কিছু আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল I আমি তখন চিন্তা করে দেখলাম এই সকল স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতাকে আমার নিজের মাঝে রেখে দেওয়া উচিত নাকি, সকলকে জানানো উচিত। যারা আমাকে জানতে চায়। বটবৃক্ষের শাখা-প্রশাখার ন্যায় গড়ে ওঠা আমার পাঠকদেরকে।
এর আগেও আমি বেশ কিছু বই লিখেছি। সে সকল বইয়ের কোনো কোনোটাতে আমার শৈশবের সামান্য বর্ণনাও দিয়েছি। যখন আমি আমার জীবনের ঘটনা নিয়ে প্রথম বই লিখি, আমি নিশ্চিত ছিলাম না, কেউ আমাকে নিয়ে আগ্রহী হবে কি না। তবে ‘মাই জার্নি’ আমার অন্য সকল বইয়ের মতো না। এই বইতে আমার জীবনের ক্ষুদ্র এবং অজানা ঘটনাগুলো রয়েছে। আমি আমার বাবা এবং মাকে নিয়েও লিখেছি। কারণ এই বিরাশি বছর বয়সে এসেও আমি আমার মাঝে তাদের ভালোবাসা এবং আশির্বাদ খুঁজে পাই। তারা আমার মাঝে যে সকল গুণাবলি তৈরি করে দিয়ে গেছেন এবং তাদেরকে দেখে যে সকল সুনাবলি আমি আয়ত্ত করতে পেরেছি তা আমাকে পথ চলতে সাহায্য করেছে। তারা সেই সকল গুণাবলির মাধ্যমেই আমার মাঝে রয়ে গেছেন।
আমার বাবা, আমাকে মানুষকে বুঝতে চেষ্টা করা এবং সামাজিকভাবে সকল সমস্যা মোকাবেলার শিক্ষা দিয়েছেন। বহু বছর পর যখন আমি নিজেই জীবনযুদ্ধে সামিল তখন আমার বাবার প্রতিটি কথা আমার মনে পড়ে গেল। আমার মা যে ভালোবাসা এবং যত্ন নিয়ে তার সন্তানদের লালন-পালন করেছিলেন, তার মাঝে আমি ভালোবাসা এবং মহত্ব খুঁজে পেয়েছি। আমি আমার
জন্য আমার বোন জোহরার অসামন্য অবদানের কথাও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছি। আমার বন্ধু জালালউদ্দিনের অনুপ্রেরণার কারণেই আমি নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে বেড়িয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলাম।
ভারতের এয়ার ফোর্সের পাইলট হওয়ার স্বপ্নভঙ্গ, নানা প্রতিকূলতা এবং ব্যর্থতা-সবই আমার জন্য দরকারি ছিল। হ্যাঁ, এগুলো নিয়ে আমি এক পর্যায়ে ঠিকই হতাশ ছিলাম, তবে এমন কোনো হতাশা নেই যা হৃদয়ের কোটর সংকল্প দ্বারা দূর করা যায় না।
কিছুদিন আগে আমি আমার এক বন্ধুর সাথে আলাপ করছিলাম। আমার বন্ধুর নাম, প্রফেসর অরুণ তিওয়ারি। সে আচমকা আমাকে প্রশ্ন করে বসল, কালাম সাহেব, আপনি মাত্র একটি বাক্যে আপনার জীবনের সারাংশ বলতে পারবেন?
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। তবে আমি বললাম, ‘অরুণ, এই শব্দাংশ এবং শব্দগুলো আমার জীবনের সারাংশ বহন করে, শৈশবে সীমাহীন ভালোবাসা…টিকে থাকার লড়াই…আবারও লড়াই…তিক্ত অশ্রু…খুশির অশ্রু… অতঃপর ভরা পূর্ণিমার চাঁদের মতো সুন্দর এক জীবন’।
আমি আশা করছি, আমার গল্পগুলো পাঠকদেরকে নিজেদের স্বপ্ন উপলব্ধি করতে সহায়তা করবে, এবং তারা নিজেদের স্বপ্নকে বাস্তবতা প্রদান করতে পারবে।
এ.পি. জে আবদুল কালাম
গত দুই দশকে দেখা আমার পরিচিত
ষোল মিলিয়ন উদ্যমি যুবকদের জন্য…
ধন্যবাদ পাতা
প্রথমেই বইয়ের কথা দিয়ে শুরু করি। বইটির প্রকাশক সবুজপাতা। একদিন হঠাৎ করেই সবুজপাতার রাশেদ ভাইয়ের ফোন এলো। তিনি ফোন দিয়ে বললেন, ‘সানী তোমার পছন্দের একটা কাজ আছে।’ আমি আগ্রহ নিয়েই জানতে চাইলাম, কি কাজ। তিনি তারপর আমাকে বললেন. এই বইটি অনুবাদ করার কথা।
প্রয়াত এ. পি. জে আবদুল কালাম একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক এবং বিজ্ঞান জগতের একজন কিংবদন্তি। তাঁর প্রশংসা আর অবদান বলে শেষ করা যাবে না। তাঁর ‘মাই জার্নি’ বইটিতে তাঁর শৈশব, তাঁর পরিবার এবং তাঁর জীবনে প্রভাববিস্তারকারী কিছু মহৎ মানুষের বিবরণ দিয়েছেন। বইটি আমি ঠিক কতবার পড়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। এ. পি. জে আবদুল কালামের মতো একজন প্রবাদ পুরুষের লেখা বই অনুবাদের সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি।
এবার আসি একান্তই আমার নিজস্ব কিছু কথায়। এই দুনিয়ায় আমার সবচেয়ে আপনজন হলো মা। বরাবরের মতোই আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যান এই মহীয়সী নারী, যাঁকে আমি ‘মা’ বলে সম্বোধন করি। তাই এই বইটির উৎসর্গ আর কাকেই বা দেবার আছে!
এই বইটির সফল অনুবাদের পেছনে অসামান্য অবদান রয়েছে, এমন কয়েকজনের কথা না বললে শান্তি পাব না। প্রথমেই আমাকে উল্লেখ করতে হবে আরিফ ভাইয়ের নাম। তিনি না থাকলে হয়তো বইটি করা অসম্পূর্ণ থেকে যেত। এরপর আমি যে ব্যাক্তির কথা উল্লেখ করব, সেই ব্যক্তি সম্পর্কে আমার বন্ধু। আমার এই বন্ধুটিও একজন সফল অনুবাদক। তার নাম মহিউল ইসলাম মিঠু। আমাকে এই লেখা-লেখির জগতে নিয়ে আসার পেছনে তার অবদান আমি কোনোদিন অস্বীকার করতে পারব না। এরপর আমি উল্লেখ করব আমার আরেক বন্ধু নিয়াজ রশীদের নাম। নিয়াজ, একাধারে আমার একজন পাঠক এবং সমালোচক এবং আমার অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস। আমার ব্যক্তিগত জীবনে বন্ধুর সংখ্যা খুবই সামান্য। আর সেই সামান্য কজন বন্ধুর মধ্যে নিয়াজ অন্যতম। আরেকজনের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তার নাম রিফা রাফিয়া মনির। জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন উপদেশ এবং পথ বাতলে দিয়ে আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে আসছে। যাকে দিয়ে কথা শেষ করব, তিনি হলেন অলিভার তীর্থ সংকার। ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ উপাধিটা যদি কাউকে দিতেই হয় আমাকে, তবে
এই বন্ধুটি ছাড়া আর কারো কথা আমার মাথায় আসবে না। ধন্যবাদে যাদের নাম উল্লেখ করা উচিত ছিল, তবে আমার দুর্বল স্মৃতিশক্তির কারণে তাদের নাম ফসকে গেছে, তাদের কাছে আমি হাত জোর করে ক্ষমা চাইছি।
এবার পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাই। এ. পি. জে আবদুল কালামের এই বইটি আপনাদের কাছে পৌছে দিতে পেরে আমি সত্যিই আনন্দিত। আশা করি আপনারাও উপভোগ করবেন,এই প্রবাদ পুরুষের ঘটনাবহুল জীবনের কিছু কথা। নাহ! আর আপনাদের সময় নষ্ট করতে চাই না। জলদি বইটিতে ডুবে যান। সকলের শুভ কামনা করে শেষ করলাম। রাব্বি উস সানী
ঢাকা, নভেম্বর ২০১৫
Tarak Ruhul
Excellent