মহুয়া বনে (গল্পগ্রন্থ)
ভূমিকা
‘মহুয়া বনে’ কোয়েল তালুকদারের’ এক বিষণ্ণ মায়াবী গল্পের বই। এই গ্রন্থের প্রতিটি গল্পে কোয়েল তালুকদার অপরূপ আলো ছড়িয়েছেন। নিখিলেশ ঘোষ আমাদের পুণ্ড্রনগরের মানুষ হয়েও সন্ন্যাসী হয়ে থিতু হয়েছিল হিমালয়ের পাদদেশে গঙ্গোত্রী গোমুখে একটি নির্জন গুহায়। আর ‘কমলিকা’র কমলিকা এসেছিল উজ্জয়িনী থেকে মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরে। যোগিনী হয়েও সে ভালবেসেছিল এক নাগা সাধুকে। অনাগত এক শিশু ভ্রূণকে পেটে রেখে চির জনমের দুঃখ নিয়ে এক পূর্ণিমা তিথিতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন বঙ্গোপসাগরের জলে।
‘মহুয়া বনে’র অনিমেষ রায় নিঃসঙ্গ একাকী জীবনের অবসান ঘটিয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশনের একটি পরিত্যক্ত ভাঙ্গা ঘরের ধর্ণায় ফাঁসি দিয়ে। তার প্রিয়তমা পত্নী মহুয়া তখন পরমানন্দে ঘুরে বেড়িয়েছেন এক রাজস্থানী যুবকের হাত ধরে হাডসন নদীর তীরে। অনিমেষের পোড়া লাশের গন্ধ সে পায়নি। মহুয়া তখন শুনেছেন হাডসন নদীর উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পেলিক্যান পাখিদের গান।
এ রকম বহু বিষণ্ণ আলো ছড়ানোর গল্প আছে মহুয়া বনে গল্প গ্রন্থে। বিশেষ করে ‘রুপালী রাত্রি’ ‘মাধু গোয়ালিনী’ ‘বনবেশ্যা’ ‘আকাশ প্রদ্বীপ জ্বলছে’ ‘ ছোট মাস্টারজী’ ‘কেবলই দুঃখের শ্বাস’ ‘পদ্মাবতী’ ‘মনে রেখো আমায়’ ‘পদচিহ্ন পড়ে আছে’ ‘যশোর রোড’ প্রভৃতি গল্পগুলিতে।
কোয়েল তালুকদারের লেখায় রয়েছে মুগ্ধতা। শব্দ চয়নে যে কারুকার্য তিনি দেখিয়েছেন, তাতে বিস্মিত না হয়ে থাকা যায় না! এক অদ্ভুত স্বাদ। বহমান নদীজলের ছান্দিক প্রবাহের ন্যায় শব্দের খেলা বিহ্বল করে রাখে সারাক্ষণ! ‘মহুয়া বনে’ বইটির গল্পগুলো পড়ে এক রকম ঘোরের মধ্যে ছিলাম, কেবল তাঁর লেখনীশৈলির গুণে। প্রতিটি গল্পের কাহিনি বিন্যাসও অসাধারণ! কোনও রকম ব্যত্যয় ঘটেনি কোনও গল্পে।
কোয়েল তালুকদার জানেন, কীভাবে একটি সাধারণ কাহিনিকে অসাধারন করে তুলতে হয়। গল্পগুলো যত পড়েছি, তত মনে হয়েছে, গল্পের নায়ক নায়িকারা কত দিন-রাত্রি, কত একাকী মুহূর্ত ভরিয়ে দিয়েছেন আনন্দ-বেদনায়, সুখ-দুঃখে, উচ্ছলতায়-অশ্রুতে। বুঝতে চেয়েছি, কেন তাদেরকে এত আপন লাগে, এত কাছের মানুষ মনে হয়।
তিনি অতি সাধারণ ভাবে অবলম্বন করেছেন আটপৌরে ভাষাভঙ্গি। এত সহজে, এত আপনজনের মতো বলেছেন গভীরতর উপলব্ধির কথা। তাঁর বিষণ্ণ-সুন্দর মায়াবী গল্পগুলো যেন অতি সহজে হৃদয়ের কাছে পৌঁছে যাওয়ার জন্যই রচিত হয়েছে।
— আফজালুল বাসার
প্রাবন্ধিক ও সমাজচিন্তক।
১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ইং, ঢাকা।
উৎসর্গ
প্রিয়তম, হ্যাপি রহমান
অঞ্জলি লহো মোর।
১. মহুয়া বনে
যার ঘটনা নিয়ে এই লেখা তিনি হচ্ছেন অনিমেষ রায়। অনিমেষ আমার বন্ধু। আমেরিকায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখেই বসবাস করছিল সে। কিন্তু নয় এগারোর পর অবৈধভাবে বসবাসের কারণে হঠাৎ ঐদেশ থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়। কিন্তু স্ত্রী সন্তান রয়ে যায় সেদেশেই।
বাংলাদেশে আসার পরে সে একাকী হয়ে যায়। সে তার নিঃসঙ্গ সময়গুলোতে প্রায়ই আমার অফিসে এসে কাটাত। ওর সব কথা আমার জানা নেই। সব মানুষেরই হৃদয়ের কিছু গোপণ সুখ দুঃখ থাকে। তা শুধু জানে সে নিজেই । অনিমেষেরও তেমন সুখ দুঃখ ছিল। কিছু আমাকে বলত। আবার কিছু বলত না।
তখন ফেসবুক এত জনপ্রিয় ছিল না। ইয়াহু ম্যাসেঞ্জার জনপ্রিয় ছিল। ও তার স্ত্রীর সাথে প্রায়ই ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং করত। টেলিফোনেও কথা বলত। ও তার স্ত্রীকে দেশে চলে আসতে বলত। কিন্তু ওর স্ত্রী সে কথা শোনে নাই। ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে থেকে যায় ঐ দেশেই । এতে করে অনিমেষের ভিতরে হতাশা বিরাজ করত।
অনিমেষ থাকত মোহাম্মদপুরে ওর শ্বশুরালয়ে। ওখান থেকেই প্রায়ই উত্তরায় আমার অফিসে চলে আসত। আমার অফিসে ইন্টারনেট সুবিধা ছিল, এক্সট্রা একটি কম্পিউটার ছিল, এথানে বসে বসে ও তার নিঃসঙ্গ সময়গুলো পার করত। কখনো আমার সাথে গল্পগুজব করে, কখনো চ্যাটিং করে, কখনো একেরপর এক সিগারেট খেয়ে।
একদিন অনিমেষ এলো দুপুরের পরে। খুব বিধ্বস্ত চোখ মুখ ওর। সম্ভবত রাতে ঘুমায়নি। ওকে বললাম – কি হয়েছে তোমার?
অনিমেষ : মহুয়া সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে আর এদেশে আসবে না।
আমি : আসতে চাচ্ছে না কেন?
অনিমেষ : দুইটি মোহ তার।
আমি : কি?
অনিমেষ : এক. স্বপ্নের দেশে থাকবার মোহ। আরেক. ভারতীয় এক রাজস্থানী যুবক।
আমি : সত্যিই দুঃখের কথা।
অনিমেষ : কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে ইচ্ছা করে।
অনিমেষের বিষণ্ন মুখ দেখে মনে হতো, এই মুখে কতোকালের দুঃখ ছেয়ে আছে। চোখ দেখে মনে হতো, এই চোখ নির্ঘুম হয়ে থাকে সারারাত। ও ওয়াইন খেতে চাইত। আমি বলতাম — এইসব না। জীবন তো থেমে থাকবে না। জীবন চলবে জীবনের মতো করেই। দেখো, কি হয়? কোনো স্বপ্ন সুখ ফিরে আসতেও তো পারে জীবনে।
ফিরে কি এসেছিল সুখ আর জীবনে? অনিমেষের মুখেই শোনা যাক, সে কথা —
” চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলাম অনেক ক্ষণ। ঘুম আসে না। ভাবছিলাম মহুয়ার কথা। তখন শম্ভুগঞ্জ যেতে ফেরী পার হতে হতো। ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, ব্রহ্মপুত্র তীরে ফেরী পারাপারে। আমি চেয়েছিলাম জলের দিকে। মহুয়া তাকিয়েছিল আকাশের নীলে। তারপর দুইজনের চোখ দুুজনের দিকে। হঠাৎ ব্রহ্মপুত্রের সব জল যেন রোদ্রের আলোয় ঝিলমিল করে উঠল।
প্রথম কথা ছিল মহুয়ারই। বলেছিল — আপনার জল ভালো লাগে বুঝি?
আমি বলাছিলাম : জল এবং আকাশের নীল আমি একসাথে দেখি।
তারপর ব্রহ্মপুত্রের জল বেশী দূরে গড়তে দেওয়া হয়নি। ময়মনসিংহ রামকৃষ্ণ মঠের এক ব্রহ্মাচারী আমাদের বিয়ে পড়ান। আমাদের প্রথম বাসর হয়েছিল মঠের এক ভাঙা টিনের চালের ঘরে। জীবন আনন্দের হয়, আত্মাও জেগে ওঠে পরমানন্দে, যদি ভাঙা ঘরের বাইরে থাকে ভরা জ্যোৎস্নার রাত।
আজ কোনো আলোর ধারা বইল না কোনো দিক থেকেই। নুরজাহান রোডের বাড়িটির দোতলায় আমার থাকার রুমটিতে সব আলো নিভে দিয়ে অন্ধকার করে রেখেছিলাম সন্ধ্যা রাতেই। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছিল। একবার মনে হয়েছিল, জীবনের সমস্ত ভার আজ রাতেই হালকা করে ফেলব। আবার ভাবলাম, জীবন তো নদীর বাঁকের মতো। এক বাঁকে পলিমাটি ভাঙ্গে, আরেক বাঁকে বালিয়ারি। এই বাঁকে আছে হয়তো খরস্রোতা জল, আরেক বাঁকে যেয়ে দেখতে পাব সব স্রোত থেমে গেছে।
প্রথম যেদিন মহুয়াকে নিয়ে নিউইয়র্কে হাডসন নদীর পারে নিয়ে গিয়েছিলাম, হাডসনের জল দেখে মহুয়া সেদিন বলেছিল — ‘তুমি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও, আমার শহর ময়মনসিংহে। আমার এই শহর ভালো লাগে না। এই নদী ভালো লাগে না। এখানকার আকাশে কোনো নীল নেই। বিদ্যাময়ী স্কুলের সহপাঠীদের কথা আমার মনে হয়। স্টেশনে যেয়ে প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে গরম চা খেতে ইচ্ছা করে। ঘুরতে ইচ্ছা করে তোমাকে নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে।”
অনিমেষ রায়ের জীবন স্রোত থেমে গিয়েছিল জীবনের আরেক বাঁকে। একটানা একবছর অনিমেষ আমার কাছে আসে নাই। আমি ওর শ্বশুরবাড়িতে খোঁজ নিয়েছিলাম, তারা বলেছিল– অনিমেষ একদিন সন্ধ্যায় ওর ব্যাগটি নিয়ে যে বেড়িয়ে গেল। তারপর ও আর ফিরে আসে নাই । তারও এক বছর পর অনিমেষ আমার কাছে ফিরে এসেছিল। প্রথম দেখে আমি ওকে চিনতেই পারিনি। মুখে বড়ো বড়ো দাঁড়ি। সব সুদর্শন হারিয়ে গেছে ধূসর মেঘের আড়ালে। আমি ওকে বলি : এতদিন কোথায় ছিলে?
অনিমেষ : ময়মনসিংহে।
আমি : ওখানে কোথায়, কার কাছে ছিলে?
অনিমেষ : রামকৃষ্ণ মঠে।
আমি : ওখানে কেন?
অনিমেষ : আমি ঐ মঠের একজন ব্রহ্মাচারী।
আমি : তোমার এই দশা কেন? কেন তোমার এই সন্নাস জীবন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে জগতের যত দুঃখ তোমার চোখে মুখে লেগে আছে।
অনিমেষ : না আমি ভালোই আছি। আমার আছে আশ্রম। আমার আছে আনন্দলোক। যেখানে কোনো মহুয়া বনের সুঘ্রাণ নেই। ‘
অনিমেষ আমার সাথেই দেখা করার জন্য ঢাকা এসেছিল সেইবার। আমি ওকে সেধেছিলাম একটি দিন আমার এখানে থেকে যেতে। কিন্তু ও থাকেনি। ঐদিনই সে ফিরে চলে যায় রামকৃষ্ণ মঠের আশ্রমে। ও চলে যাবার পর মনে হয়েছিল, যে প্রেম আর যে স্বপ্ন দিয়ে অনিমেষের জীবন শুরু হয়েছিল, সে স্বপ্ন ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে হঠাৎ ঈষাণ কোণ্ থেকে আসা এক ঝড়ে।
কি এক অবহেলায় কয়েক বছর আমি আর কোনো খবর রাখিনি অনিমেষের। একবার খুব মন চাইল, ওকে একটু দেখতে। চলে যাই তাই ময়মনসিংহে রামকৃষ্ণ মঠের আশ্রমে। ওখানে যেয়ে জিজ্ঞাসা করি অনিমেষ রায়ের কথা। তারা আমাকে প্রাঙ্গনের একটি ভাঙ্গা টিনের ঘর দেখিয়ে বলল — ঐ যে ঘরটি দেখছেন, ওটাতেই অনিমেষের বাসর ঘর হয়েছিল। এক হেমন্তের পূর্ণিমা রাতে ঐ ঘরের ধর্নাতে ফাঁসি দিয়ে সে আত্মহত্যা করে।’ মৃত্যুর তারিখ মিলিয়ে দেখলাম আমার সাথে অনিমেষ দেখা করতে গিয়েছিল যেদিন, সেই দিনই ছিল সেই রাত। আর এই রাতই ছিল ওর বিয়ের রাত।
হাডসন নদীর তীরে কোনো এক রাজস্থানী যুবকের হাত ধরে ঘুরছে হয়ত মহুয়া। দেখছে সেখানে নিস্তব্ধ নদীর জল, দেখছে সেখানকার নীল আকাশ। শুনছে ডানা মেলা পেলিক্যানদের গান। কিন্তু কার জন্য উড়েছিল সেদিন অনিমেষ রায়ের দেহের ছাই ভস্ম ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে। সে খবর কেউ জানে না। মহুয়াও না।
২. কমলিকা
বহু বিস্মৃত বহু বছর আগের এই কাহিনী। কমলিকা নামে এক সন্ন্যাসিনী কবে মহেশখালী দ্বীপে এসে তপস্যায় বসেছিল, তা কেউ বলতে পারেনা। মৈনাক শিখরে আদিনাথ মন্দিরের কাছে দেবী দুর্গার মন্দিরের পাশেই সে থিতু হয়েছিল। জনশ্রুতি আছে এই তপস্বিনী এসেছিল উজ্জ্বয়িনী থেকে।
প্রতি বৎসর ফাল্গুনের শিব চতুর্দ্দশী তিথিতে মন্দির প্রাঙ্গণে পূজো-অর্চণা ও মেলা হয়। এসময় পূণ্য সঞ্চয় ও মনস্কামনা পূরণার্থে বিভিন্ন স্থান হতে আগত তীর্থ যাত্রীদের পদচারণায় মন্দির প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে ওঠে। মন্দিরে বিরল প্রজাতির একটি পারিজাত ফুলগাছ রয়েছে। ভক্তগণ প্রতিনিয়ত মনস্কামনা পূরণার্থে মানত করে গাছে সূতা বেঁধে রেখে যান এবং কামনা পূর্ণ হলে সূতা খুলে পূজা অর্পণ করেন।
এমনই ফাল্গুনের শুক্লা চতুর্দ্দশীতে এক নাগা সাধক এসেছিল মন্দিরে পূজা অর্চণা করতে। কী এক মনস্কামনা নিয়ে যখন সেই সাধক পারিজাত ফুল গাছে সুতা বাঁধতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই দেখা হয় কমলিকার সাথে। মুহূর্তেই যেন সাধকের হাত পা অবশ হয়ে গেল। তাঁর হাত থেকে সুতা মাটিতে পড়ে যায়। সে পুনরায় তা মাটি হতে তুলে পারিজাত গাছের দিকে এগুতে থাকে। দেখে সব পারিজাত ফুলগুলো ব্রহ্মকমল হয়ে গেছে।
সাধক সুতা বেঁধেছিল ডালে। তবে পূর্ব মনস্কামনা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল তার। সুতা বাঁধতে বাঁধতে সে মনে মনে বলেছিল — আমি কমলিকাকে চাই। মুখরিত মেলা প্রাঙ্গণে পূণ্যার্থীদের ভীড়ে কমলিকাও দেখেছিল এই ভিনদেশী সাধককে। চোখ মিলেছিল সাধকের চোখে। সে দুই চোখ বুজে ফেলে। পুনরায় চোখ মেলে দেখতে পায় —পারিজাত ফুলগুলো আজ বেশি রকম রক্তিম হয়ে আছে। সে অনুভব করে, তার শরীরের বহমান রক্ত কণিকাগুলো ঐ রকমই লাল হয়ে উঠেছে। সে দ্রুত পা ফেলে ফিরে আসে আশ্রমে।
কমলিকা দুই দিন আশ্রম থেকে বের হলো না। সে বিছানায় শুয়ে কেবল অশ্রুপাত করেছে আর ভেবেছে — যে প্রেম তাকে ঘর ছাড়া করেছে , যে প্রেমের গ্লানি ভুলে থাকার জন্য তাকে সন্ন্যাসিনী হতে হয়েছে। সেই রকম অভিশপ্ত কোনো মায়ার টানে নিজেকে আর জড়িয়ে ফেলতে চায় না।
এই দুই দিনে মেলা প্রাঙ্গণের কোলাহল অনেকটাই
স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। মনকে আর শরীরকে সে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আজ বড়ই ইচ্ছা হলো মন্দিরে সন্ধ্যা পূজা দেবার। কমলিকা আশ্রম থেকে বাহির হয়। সে পথ চলতে থাকে মন্দিরের দিকে। পাহাড়ে ওঠার সোপান গুলোতে সে পা ফেলতে পারছিল না। পা কেমন থেমে থেমে যাচ্ছিল। সে হাঁপিয়ে উঠছিল বারবার। হঠাৎ পিছন থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠ শুনতে পেল — ‘আমি কী আপনার হাতটি ধরব?’
এ যেন বহু বছরের পুরনো এক মহাজাগতিক কন্ঠস্বর। কোন্ দেবালয়ের দেবতা আজ এইখানে, এই সোপান উপরে। চোখ তুলে দেখতে পেল, সেই ভিনদেশি সাধক। যাকে সে দেখেছিল পারিজাত বৃক্ষ তলে। ততক্ষণে সাধক কমলিকার একটি হাত তার বাহুতে জড়িয়ে নিয়েছে।
অনেক রাত পর্যন্ত কমলিকা প্রণমিত ছিল দেব মূর্তির পদপাশে। নীরব অশ্রু বর্ষণে সে প্রার্থনা করেছিল পরমেশ্বরের কাছে — ‘আমাকে তুমি প্রেম দিও না। দিও না কোনো পাপ। কোনো অনাচার দিও না। জগতের যত আনন্দ কেড়ে নাও। যত মর্মরিত দুঃখ বেদনাও।’
কখন রাত্রি মধ্যপ্রহর হয়েছে জানতে পারে নাই। দেবালয় খালি হয়ে গিয়েছে। কমলিকা মন্দির থেকে বের হয়ে আসে। সে দেখতে পায়, সাধক ফটকে তার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় — আকাশ ভরা তারা আছে। নিশীথের নিঝুম মৌনতা আছে। কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়িঞ্চু চাঁদ তখনও অস্তমিত হয়নি। তখনও মান্দার ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে চারদিক। সাধকের আবারও সেই বিনীত কন্ঠস্বর — ‘তোমাকে আশ্রমে পৌঁছে দিয়ে আসি।’
আবারও সেই পুরানো মায়ার টান। আবারও যেন পথ ভুল করে ফেলল আশ্রমের যাওয়ার পথ। তখন সাগরের মোহন শব্দ ভেসে আসছিল। আস্তে আস্তে চাঁদ ডুবে যাচ্ছিল পশ্চিমের মেঘের নীচে। মায়াবী এক আঁধার নেমে আসে মৈণাক পাহাড়ে। তপস্বিনী আর তপস্যায় রইল না। সন্ন্যাসিনীরও রূপ হারাল তার। কমলিকা হয়ে উঠল সম্পূর্ণ মানবী। আবারও সে একই ভুল করে ফেলল তার প্রথম যৌবনের ভুলটির মতো। এক পার্থিব প্রেম প্রকাশিত হলো দুজনের দেহ থেকে দেহান্তরে। একি পাপাচার! নাকি পূণ্যময়তা!
ভোর হওয়ার আগেই সাধক কমলিকাকে আশ্রমে পৌঁছে দিয়ে পারিজাত গাছটির কাছে ফিরে আসে। গাছে বেঁধে রাখা মনস্কামনার সুতাটি খুলে ফেলে। তারপর মন্দিরে যেয়ে পূজা দেয় দেবতার। অর্চণার সময় সে দৈববানী শুনতে পায় — ‘তুই পাপ করে এসেছিস। তোর পূজা আমি নেব না। তূই দূর হয়ে যা এখান থেকে।’
সাধক ক্লেশে আর গ্লানিতে — প্রভাতের সূর্য কিরণ বিচ্ছূরণের আগেই মন্দির ত্যাগ করলেন। এরপর তাকে আর ঐ দ্বীপে দেখা যায়নি কখনও।
তারপর থেকে তপস্যায় আর মন নেই কমলিকার। পূজাও দিতে যায় না মন্দিরে। কায়ক্লেশ ছেয়ে আসতে থাকে জীবনে। সে বুঝতে পারে একটি ভ্রুণের প্রাণ স্পন্দন। সারা দ্বীপময় তার কলংক রটে গেল। সে আর মন্দিরে পূজা দিতে যেতে পারে না। এক সেবককে কমলিকা অনুরোধ করে — ‘ তুমি আমাকে কিছু পারিজাত ফুল ছিঁড়ে এনে দেবে?’ সেবক তাকে একগুচ্ছ ফুল এনে দেয়।
সেদিন ছিল পূর্ণিমার চাঁদভাসি রাত। সে চলে যায় সাগর কূলে। চাঁদের আলোয় জলের ভিতর দেখতে পায় নিজের মুখ। আর দেখে প্রণয়ের সৃষ্টিতে তৈরি হওয়া একটি শিশুর মুখ। সে পারিজাতের পাঁপড়িগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে জলে ভাসাতে থাকে। এবং নিজে ডুবে যায় জলে।
তারপর আদিনাথের কোথাও আর কমলিকাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। দ্বীপের মানুষ সকালবেলা দেখতে পায়– পারিজাতের ছেঁড়া পাঁপড়িগুলো সাগর জলে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে।
৩. রূপালী রাত্রি
বহু বছর আগে বর্ষা দিনের এক প্রসন্ন বিকেল। বৃহদ্বটু গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে স্বচ্ছ করোতয়া নদী। ঐ গ্রামেরই সন্ধ্যাকর নামে এক চারণ কবি নদীর কূলে একাকী বসে শুনছিল জলের কুলকুল ধ্বনি। নদী ছিল তখন ভরা যৌবনবতী। সারা নদীতে কোথাও একটি নৌকাও ছিল না। মনুষ্যহীন সেই নির্জন নদীর তীরে বসে সন্ধ্যাকর যখন জলের ধ্বনি শুনছিল, তখন পাশের জগদ্দল বিহার থেকে কমলাবতী নামে একজন মন্দির সেবিকা নীরবে হেঁটে হেঁটে তার কাছে এসে বসেছিল।
কমলাবতী মাথা রাখে সন্ধাকরের বাহুতে। সেও হেলান দিয়ে বসে শুনছিল জলের শব্দ। কোথা থেকে কয়েকটি বালি হাঁস ডানা ঝাপটে ওদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। কেউই কোনো কথা বলছিল না। এ যেন কথাহীন ভালবাসাবাসি।
তারপর নীরবতা ভেঙ্গে প্রথম কথা ছিল কমলাবতীর– ‘আমাকে তুমি হরণ কর। আমাকে তুমি নিয়ে যাও দূরে কোথাও। বহু দূরের কোনো পাহাড়ের আড়ালে। ঘর বাঁধি যেয়ে নির্জন গুহায়। তুমি জানো, আমাকে তোমার করে মেনে নেবে না সমাজপতি।’
দখিনা বাতাস তখন বয়েছিল মৃদুমন্দ। কমলাবতীর মাথার চুল উড়ে পড়ছিল সন্ধ্যাকরের মুখের উপর। তখনকার সেই নিঝুম হূ-হূ বাতাস কান্নার মতো করে নদীর শব্দের সাথে মিলে গিয়েছিল। কমলাবতী আবারও সন্ধ্যাকরের মুখপানে চেয়ে বলে — ‘তুমি কী আমাকে ভালোবাস না ?’
সন্ধ্যাকর বলেছিল : ভালোবাসি, ভালোবাসি।
সন্ধ্যাকর আর কমলাবতীর ভালোবাসার কথা জানল করোতয়ার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বালি হাঁস। বৃক্ষরাজিতে বসে থাকা সন্ধার পাখিরা, আর জানল বৃহদ্বটূ গ্রামের মানুষেরা। আরও জানল জগদ্দল বিহারের ভিক্ষু। মন্দিরের পুরোহিত। ধর্মপতি ও সমাজপতি।
কেউ বলল — ছি ছি জাত গেল। কেউ বলল — ধর্ম গেল। কেউ বলল — ক্ষত্রিয়ের সাথে শুদ্রের মেলামেশা। ছি ! সব উচ্ছন্নে গেল।
সেদিন ছিল শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথি। সন্ধ্যাকর চলে যায় জগদ্দল বিহারে। প্রার্থনার ছলে কথা বলে কমলাবতীর সাথে। কমলাকে বলে — ‘আজ রাত্রিতে নদীর তীরে চলিয়া আসিও।’
রূপালী রাত্রি। আকাশ ভরা তারা। সারা ভূবন জুড়ে জোৎস্নার ঢল নেমেছে। করোতয়ার স্রোত বেগ পেয়েছে যেন এই জোৎস্নায়। অতলান্ত প্রেমে ডুবে থাকা এক জোড়া যুবক যুবতী মিলেছে আজ এই শ্রাবণের রাত্রিতে, এই নদীর কূলে। পিছনের জঙ্গলে জোনাকি জ্বলছে। আকাশে চাঁদও জ্বলছে আকাশ প্রদীপের মতো। ঠিক এমন ক্ষণে সন্ধ্যাকর কমলাকে ডাকে — কমলাবতী।
কমলার পরনে ছিল মন্দির থেকে দেওয়া এক প্রস্থ সাদা ধুতি কাপড়। মাথায় কোনো ঘোমটা নেই। তার মুখখানি অবনত। চোখে জল এসেছে কিনা বোঝা গেল না। দূরে কোন্ অশ্বথ বৃক্ষ থেকে কোঁত কোঁত করে ডেকে উঠল পেঁচা। ঝপাং করে পাড় ভাঙার শব্দ হলো জলে। কমলাবতী ভয়ে যেন একটু কেঁপে উঠল। সে সন্ধ্যাকরকে জড়িয়ে ধরে। এবং পরম আবেগ জড়িত কণ্ঠে তার বুকে মুখ রেখে বলে — ‘ওগো, আমাকে তুমি দূরে কোথাও নিয়ে যাও।’
সন্ধ্যাকর বলেছিল — এই বিজন রাত্রিতে তুমি সামনে তাকিয়ে দেখ, কী সুন্দর জল! ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনি শোনো তার। যেন আমাদেরই ডাকছে ঐ জল। এই কূলে আর কেউ নেই। আছো তুমি । আছে তারা। আছে চাঁদ। তারও ঐ প্রান্তে আছে নীহারিকা।
কোথায় যেন মাটির পাড় ভেঙ্গে পড়ল। আর্তনাদের মতো ক্রন্দনের ধ্বনি শোনা গেল একবার। তারপর আর কাউকে দেখা গেল না সেখানে। তখন সেখানে ছিল কেবল জ্যোৎস্নাভূক রূপালী রাত্রির আঁধার।
৪. যশোর রোড
অনেক বছর আগে কোনো এক অবসন্ন জৈষ্ঠ্য্ দুপুরে হাঁটছিলাম যশোর রোড ধরে। জায়গাটার নাম ছিল গদখালি। বিভিন্ন ফুলের চাষ হয় সেখানে। রাস্তার উপর গাঁদাফুল, রজনীগন্ধা ও গোলাপের পশরা নিয়ে বসে থাকত ফুল চাষীরা। উপরের দিকে তাকালে আকাশ দেখা যেত না। বড় বড় রেইনট্রীর ঘন ডালপালা আর পত্র পল্লবে ঢেকে থাকত সেখানকার সুনীল আকাশ। তবুও হরিদ্রাব পাতার ফাঁক দিয়ে চলে আসত সূর্যের সোনালী আলো। আমি দেখেছি সে আলোর ছ্টায় মুহুর্তেই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল আমার পাশে হাঁটতে থাকা কান্তা গোমেজ নামে একটি মেয়ের মুখ।
আমি তার মুখের দিকে ফিরে তাকাই। সে মুখে কোনও মলিনতা ছিল না। ছিল না আবার হাস্যজ্জ্বল কোনো রেখাও। বিমুগ্ধ হয়েছিলাম সেই মুখখানিতে চেয়ে। সেদিন সেই অবসন্ন দুপুরে কোথাও বাতাসের শব্দ ছিল না। রিমঝিম রোদ্র ছায়া ছেয়েছিল সারা গদখালিতে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে নেমে পড়ি আলপথে। যেতে হবে কৃষ্ণপুর গ্রামে। ঐ গ্রামেই আমাদের অফিসিয়াল এ্যাসাইনমেন্ট।
হেঁটে যেতে যেতে পথের দুপাশে দেখেছিলাম গ্লাডিওলাস ফুলের প্রান্তর। রঙ বেরঙের ফুলের ফাঁকে ফাঁকে গ্রীষ্মের ফালি ফালি রোদ খেলা করছে ঝাড়ে । কখনও গ্লাডিওলাসের সৌরভের সাথে কেমন যেন মৌ মৌ সুর ধ্বনিত হচ্ছিল বাতাসে। কেমন যেন মর্মর মায়া হিল্লোলিত হচ্ছিল মেঠো পথের ধূলির উপরে। বাঁশি বেহালা আর পিয়ানো যেমন করে অ্যাকর্ডিয়নে একের পর এক মায়া জড়িয়ে যায়, তেমন করে নির্জন ফুলের প্রান্তরে ভালবাসার পাখিরা যেন হারিয়ে যাচ্ছিল।
এখানে কেউ কোথাও নেই। চারিদিকে এত ফুল, এত সৌরভ, উপর থেকে ঝুলে পড়া এমন নির্জন আকাশ, ফুলের বনে ফড়িং আর হলুদ প্র্জাপতিদের এত গান। মনটা কেমন যেন উদাস উদাস লাাগছিল। চারদিকে ছিল অসীম মৌনাতাও। হঠাৎ সেই মৌনতা ভঙ্গ করে সেই মেয়ের কন্ঠস্বর শোনা গেল — আর কতদূূর কৃষ্ণপুর গ্রাম ?
আমি বললাম — ক্লান্তি লাগছে ?
— না।।
— রোদ লাগছে ?
— না।
— খিদে লাগছে ?
— না।
— খারাপ লাগছে ?
— না।
মনে মনে বললাাম, কৃষ্ণপুর গ্রামটি আরো দূরে চলে যাক। রোদকে ঢেকে দিক মেঘ। মেঠো পথের দুপাাশের আচ্ছাদিত ফুলের প্রাান্তর দীর্ঘতর হোক। পথ যেন না ফুরায়।
আসলেই পথ শেষ হলো না। গ্লাডিওলাসের পর শুরু হলো হলুদ গাঁদা ফুলের প্রান্তর। কাকতালীয়ভাবে মিলে যায় গাঁদা ফুলের রংএর সাথে কান্তার পরনের সালোয়ার কামিজের রং। তারপর, অফুরন্ত সেই ফুলের পথ হাঁটতে হাঁটতে কান্তা যেন আর পথ চলতে পারল না। সে একটি গাঁদা ফুল হয়ে লক্ষ গাঁদা ফুলের মাঝে হারিয়ে গেল। সেইদিন সেই সন্ধ্যায় সবাই দেখল — একজনই মানব একাকী ফুলের ক্ষেতে ক্লান্তিতে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার শরীরময় গাঁদা ফুলের অসংখ্য পরাগরেণু লেগে আছে।
তারপর জীবনের অনেক পৃষ্ঠা এক এক করে উল্টে গেছে। জীবন পাাতার কোনো পাতাতেই ক্ষণকালের রোদ্রছায়ার সেই আলো ছড়ানো মেয়েটি আর দ্যূতি ছড়াতে আসেনি।
তারও অনেক বছর পরে একবার সোহাগ এন্টারপ্রাইজের একটি বাসে করে বেনাাপোল হয়ে কোলকাতা যাচ্ছিলাম। পথে যেতে যেতে সেই গদখাালি। যশোর রোড ধরে বাসটি যখন চলছিল — দেখলাম, রেইনট্র্রির ছায়াতল। রাস্তার দুপাশে অসংখ্য গ্লাডিওলাস ও হলুদ গাঁদা ফুলের আচ্ছাদিত প্রাান্তর। বাসের জানালা দিয়ে ফুলের ক্ষেতের মাঝে সেই মেঠো পথটি খুঁজছিলাাম। দেখতেও পেলাম সেই পথ। কী আশ্চর্য ! দূরাগত সেই মেঠো পথটি ধরে অজস্র গাঁদা ফুল সরিয়ে সরিয়ে কান্তা নামের সেই মেয়েটি আমার বাসটির দিকে ছুটে আসছে। ইশারায় ওকে ডাকতে না ডাকতেই বাসটি দ্রুত ওকে আড়াল করে দিয়ে বেনাপোলের দিকে চলে গেল।
৫. কোমল গান্ধার
ছাদের কার্নিশের উপর একটি নীলকণ্ঠী পাখি এসে বসেছিল। সেই পাখিটি দেখতে যেয়ে কণিকা দেখতে পায়, নীচে গলির মুখে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ দূর থেকে ওকে দেখে খুব ভাল লাগছিল কণিকার। সে একবার পাখিটিকে দেখছিল, একবার ছেলেটিকে। কিন্ত ছেলেটি কণিকার দিকে একবারও তাকাল না। সে আশা করছিল — ছেলেটি অন্তত একটিবার উপরের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে ওকে দেখুক।
কার্নিশে বসে থাকা পাখিটি হঠাৎ উড়ে চলে যায়। সে দেখতে পায়, সেখানে কয়েকটি পালক পড়ে আছে। কণিকা পালকগুলো কুড়িয়ে তার ওড়নাতে রাখে। ছেলেটি যে তাকে দেখল না, এজন্য অভিমান হলো তার। রুমে এসে একটি একটি করে পালক ছিঁড়ে ফেলল সে। তারপর জানালার ধারে যেয়ে ছেঁড়া পালকগুলো পথের উপর উড়িয়ে দেয়। পালকগুলো যেয়ে ছেলেটির গায়ে পড়ে। ছেলেটি তখন উপরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় — একটি মেয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পালকগুলো ফেলছে।
ছেলেটির নাম অমিত। সে এই পাড়ায় অতিথি হয়ে এসেছে বরিশালের আগৈলঝরা থেকে। একটি কর্কটীয় দুঃখ নিয়ে এসেছে ঢাকায়। সে তার মর্মর দুঃখের চাহনিতেই দেখল কণিকাকে। হঠাৎ তার দুঃখটির রঙ যেন সোনালি হয়ে গেল। সে সরাসরি তাকিয়েছিল কণিকার চোখের দিকে। কণিকা যেন ঝিলমিল চিত্রিত স্বপ্ন এক। কিংবা সে তাকে এর আগে দেখেছিল কোনো এক মহাজাগতিক সহস্রাব্দ-প্রাচীন ভোরবেলার স্বপ্নে?
এই পৃথিবীতে পথ চলতে চলতে কত মানুষের সাথেই তো এমন হঠাৎ দেখা হয়। সবাইকে কী আর এমন করে একে অপরে ভালোলাগে? এদের ভিতর থেকেই কখনও দুজন দজনকে ভালোলেগে যায়। কণিকা আর ঐ ছেলেটির মধ্যে এমনই এক ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল।
বেচারাম দিউরির গলির মুখে মনোহারি দোকানদার রতন মিয়াকে কণিকা চেনে সেই ছোটবেলা থেকেই। তার কাছ থেকেই সে খোঁজ নিয়ে জেনেছিল ছেলেটি চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এসেছে। কিন্তু তার যে কর্কট রোগ আছে তা রতন মিয়া জানত না। কণিকা একটি চিরকুট লিখে রতন মিয়ার হাতে দেয় — অমিতকে দেওয়ার জন্য। সেই চিরকুটে অমিতের সাথে তার দেখা করার কথা লেখা ছিল।
একদিন তারা দেখা করে বুড়িগঙ্গার পাড়ে। প্রথম কথা বলেছিল কণিকাই, প্রথমেই ছিল ভালোলাগার কথা। তারপর একে অপরের নিবেদন। প্রতিশ্রুতি হলো ভালোবাসার। অমিত যখন বলছিল — আমিও তোমাকে ভালোবাসি। ‘ তখন বুড়িগঙ্গার জল কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছিল। পানিতে ঢেউ তুলে লঞ্চগুলো কর্কশ শব্দ করে হুইসেল বাজিয়ে চলে যাচ্ছিল দুরের কোনো বন্দরে।
কণিকার সাথে কথা হওয়ার পর অমিত দুই দিন ছিল ঢাকায়। তারপর চলে যায় বাড়িতে। যাবার আগের দিন আবার ওরা দেখা করে এই বুড়িগঙ্গার পাড়েই। সেদিনও প্রথম কথা বলল কণিকাই — ‘আমাদের মিলনে অনুমোদন দেবে না কেউ, চল আমরা পালিয়ে কোথাও চলে যাই।’
অমিত বলেছিল — ‘আমাকে এক দুই মাস সময় দাও। আমি বাঙ্গালোর যাব। সেখান থেকে ফিরে এসে এই ঘাট থেকেই দুজন লঞ্চে উঠব একদিন । মেঘনা, কীর্তনখোলা পার হয়ে চলে যাব অনেকদূর, অন্য কোনো বন্দরে। সেখানে আমরা ঘর বাঁধব। তুমি হবে কোমল। আমি হব গান্ধার। আমাদের জীবনে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সুর বাজবে রবিশংকরের সেতারের সুর ঝংকারের মতো।’
আজ বুড়িগঙ্গার জল কেমন যেন স্থির হয়ে ছিল। কোথাও থেকে উতল হাওয়া বইল না। লঞ্চ, নৌকা আর যাত্রীদের কোনো কোলাহল নেই। অমিত তার বিষণ্ণ একটি হাত রাখে কণিকার হাতে। দুজন হাঁটতে থাকে নদীর কূলে ধরে। তখন সন্ধ্যা নেমে আসছিল। পশ্চিম আকাশের শেষ অস্তরাগের ছায়া এসে পড়েছিল কণিকার মুখের উপর। এক মায়াবী বিষণ্ণতায় কণিকা অমিতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল — আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
কোমল গান্ধার সুরটি এমনই যা ঘরের আলো নিভিয়ে একাকী শুনতে থাকলে চোখ সিক্ত হয়ে যায়। একাকীত্বের দিনে বিরহের অত্যাচারে পুড়তে থাকা মনে এর প্রভাব এতটাই যে, দুঃখের মেঘ আকাশে উড়ে বজ্রপাত ঘটায় কোমল গান্ধারে। সব সুর ঘুরে ঘুরে অসীম দিগন্তের মেঘ তলে থমকে যায়। কণিকার জীবনও এমনি এক অসীমে থেমে গেল।
বাঙ্গালোরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অর্কবতী নদীর তীরে এক শ্মশান ঘাট থেকে অমিতের দেহ ভস্মের ছাই উড়ে আসেনি ঢাকার বেচারাম দেউরির আকাশে। কিংবা বাতাসে ভেসে আসেনি তার পোড়া মাংসের গন্ধ। অমিত কণিকার জীবনে কোমল দুঃখ হয়েই থাকল। গান্ধার হয়ে আর আসেনি।
৬. বনবেশ্যা
এই কাহিনীটি শুনেছিলাম একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছ থেকে। অফিসের কাজে সেবার গিয়েছিলাম রামুতে। আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল রাবার বিভাগের একটি ডাকবাংলোতে। কী সুন্দর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই রামু। যে দিকে তাকাই শুধুই — রাবার বাগান, মেহগনি, জারুল আর সেগুন গাছের সারি।
প্রথম দিনের কথা। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দূরে কোথাও থেকে জন কোলাহলের শব্দ ভেসে আসছিল । বাংলোর কেয়ারটেকার ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করি — এটি কিসের শব্দ শোনা যায়? ও বলে, ‘একটু দূরেই বৌদ্ধ বনবিহার। ওখানে আজ বিশেষ প্রার্থনা হচ্ছে। ছোট একটি মেলাও বসেছে। জন মুখরতার এই শব্দ আসছে ওখান থেকেই। ” আমি বলি — আমাকে তুমি ওখানে নিয়ে চলো ।’
আমি ওর সাথে চলে যাই ঐ বৌদ্ধ বিহারে। ঢুকতেই দেখি — মন্দির প্রাঙ্গণে পাইন গাছের নিচে চল্লিশোর্ধ্ব একজন ভিক্ষু বসে আছে। পরনে কমলা রঙের ধূতি কাপড়। দেখতে অনেকটা সন্ন্যাসীদের মতো। সন্ন্যাসীর মতো কাউকে দেখলে, আমি কেমন যেন বিচলিত হয়ে যাই । কেন জানি মূহূর্তে দেখা এই লোকটিও আমার নজর কেড়ে নেয়।
বিহারের ভিতরে প্রবেশ করে দেখি মহামতি বুদ্ধের পিতলের মূর্তি। মূর্তির চারপাশে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ বসে প্রার্থনা করছে। আমিও ওদের সাথে বসে মঙ্গল প্রার্থনায় অংশ নেই। প্রার্থনা শেষে উপসানালয় থেকে বের হওয়ার সময় ঐ ভিক্ষুকে আবারও দেখতে পাই। আমার খুব কৌতুহল হয় ওর সাথে কথা বলবার।
ওর নাম ছিল হংসধ্বজ সেরিং। বান্দরবানের থানচি থেকে সে এসেছিল। সীমান্তবর্তী মদক পাহাড়ের গহীন অরণ্যে রেমাক্রীতে ওদের বাড়ি। উপত্যকার বুক চিরে বয়ে আসা শঙ্খ নদীর পাড়ে ওর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এক অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ ছিল হংসধ্বজ। কিয়াং এর পাশে এক টিনের ছাউনিতে হংসধ্বজ থাকত। তারুণ্য উদ্ভাসিত জীবন আমার তখন। পথ চলতে চলতে অদ্ভুত এই ধরণের মানুষদের সাথে পরিচয় হলে কেন জানি আমিও মিশে যাই তাদের জীবনের সাথে।
একদিন সন্ধ্যায় হংসের ওখানে যেয়ে দেখি, সে একাকী বসে আছে। ঘরের ভিতর অন্ধকার। আমাকে দেখে সে একটি কেরোসিনের শিখা ধরায়। কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে পকেট থেকে সে দুটো চুরুট বের করে বলে — ‘এটি বার্মিজ ভেষজ চুরুট। তুমি একটি খাও। খুব ভালো লাগবে। তোমার যদি কোনো দুঃখ থাকে, তুমি সব ভুলে যাবে।’ আমি বললাম — ‘ আমার তো কোনো দুঃখ নেই। ‘ হংস আবার বলে — ‘তুমি যদি সুখীও হও তারপরও তোমার ভাল লাগবে, তোমাকে আরও বেশি সুখী মনে হবে ।’
দুজন দুটো চুরুট ধরাই। দুজনই টানছিলাম সুখ আনন্দে। নিজেকে তখন সত্যিই সুখের অধিক সুখী মানুষ মনে হচ্ছিল। আলো অাঁধারে দেখছিলাম হংসধ্বজকে। ওকে দেখে মনে হলো — ও কোনো দুঃখ ভুলেনি। রুমটি কেমন যেন ধূয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। বৌদ্ধ মন্দিরে আজ কোনো কোলাহল নেই । বাইরে বনতলায় নীরবতা নামছে আকাশ ভেঙে। আমি হংসধ্বজকে বলি — তুমি কী তোমার দুঃখ ভুলে যেতে পেরেছো?
হংস : না।
আমি : কী এমন দুঃখ তোমার? আমাকে বলো না!
হংস : চলো বাইরে যাই। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।
বনতলে হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটি পুকুর ঘাটে যেয়ে বসি। সেই সন্ধ্যা রাতে অনেক কথাই শুনেছিলাম হংসধ্বজের কাছ থেকে। আমার কাছে মনে হয়েছিল, কিছু কথা বলেছিল সে স্বাভাবিক ভাবে। কিছু বলেছিল উন্মাতালের মতো। হংসধ্বজের মুখ থেকেই ওর কথাগুলো শোনা যাক।
আমাদের রোমাক্রীতে শঙ্খ নদীর তীরে পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার আছে। বংশানুক্রমে সেই বিহারের ভিক্ষু হতে হলো আমাকে। এর আগে ছিল আমার বাবা, তার আগে আমার দাদা। আমাকে এই বৌদ্ধ বিহারের দায়ভার নিতে হবে জেনে আমি প্রথম থেকেই বৈরাগ্য জীবন বেছে নিয়েছিলাম। বিবাহ কিংবা সংসার ধর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করি নাই।
এক প্রবারণা পূর্ণিমা দিনে বিহারে আসে এক বৃদ্ধা। তার সাথে ছিল বিশ বাইশ বছরের এক তরুণী। এর আগে এদের কোনো সময় কিয়াং এ প্রার্থনা করতে দেখিনি। পরিচয় পেয়েছিলাম, তারা সীমান্তের ওপারে ব্রহ্মদেশের বাসিন্দা। বৃদ্ধা সমর্পণ ভঙ্গিতে বিনীত করে বলে, বাবা, তুমি আমার এই মেয়েকে মঙ্গলের পথে ফিরে নিয়ে এসো।
তরুণীর নাম জিনা অংপ্রু। উপত্যকার এক ভাসমান বন বেশ্যা। মেয়েটি এত সুন্দরী ছিল যে, সে নাকি তার খদ্দরের বাইরেও প্রতিদিন ধর্ষিত হত। সীমান্তের ওপার থেকে ওর বৃদ্ধা মা নিরুপায় হয়ে তাই এই রেমাক্রীতে ওকে নিয়ে চলে আসে। এখানে এক পরিচিতের কাছে আশ্রয় নেয়। আমি বৃদ্ধাকে বলি, তুমি ওকে সাথে করে কয়েকদিন এই মন্দিরে নিয়ে আসবে।
মেয়েটি প্রায় তিনমাস প্রতিদিন মন্দিরে এসেছিল। আমি তাকে বুদ্ধের অমোঘ বাণীগুলো শোনাতাম প্রতিদিন। মেয়েটি যেন সুস্থ জীবনে ফিরে আসে, তার জন্য তাকে বোঝাতাম আমার যত চিন্তা চেতনা দিয়ে। ওকে বলতাম, আমার সংসার নেই। কিন্তু আমি ভালবাসি এই বৌদ্ধ বিহার। দীক্ষা নিয়েছি ধর্মের। বুদ্ধের অমিয় বাণী আমার আত্মাকে দিয়েছে শান্তি। তুমি সুন্দর জীবনে ফিরে আস। কাউকে বিয়ে কর। ঘরকে ভালবাস। সংসার পাতো। সন্তান নাও। ওকে বুঝিয়ে বলতাম — মানুষের কামনা-বাসনা সবই দুঃখের মূল। ঐসবের মাঝে যে সুখ আসে তা দুঃখ মিশ্রিত এবং অস্থায়ী। অবিমিশ্র সুখ বলে কিছু নেই। নিবার্ণ লাভে এই দুঃখের অবসান ঘটে। কামনা-বাসনার নিস্তারের মাঝে পূর্ণ শান্তি অর্জিত হয়।
মেয়েটি আশ্চর্যজনক ভাবে তার জীবনধারা বদলিয়ে ফেলে। মোহ কাটিয়ে নির্বাণ লাভ করে বুদ্ধের অহিংস বাণীতে। সে ধর্মের প্রতি আসক্ত হয়ে ওঠে। এবং রোমাক্রীর এই বৌদ্ধ বিহারের সেবিকা হয়ে যায়। নদীতীরে বনভূমির এই বিহারের জন্য মেয়েটি প্রতিদিন ঘটে করে জল আনত নদী থেকে। আমি নির্মোহ ভাবে অবলোকন করতাম তার চলাফেরা, তার প্রতিদিনের জীবন পট।
একদিন বসন্তের আবেশ হিল্লোলে অরণ্যের বাতাস স্পন্দিত হচ্ছিল। পলাশ ও কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম উচ্ছ্বাসে আকুল হয়েছিল অন্তরীক্ষ। কুসুমার্দ্র সুবাসে সুরভিত হয়ে উঠেছিল বনভূমি। কোকিলের কূজনে কুহরিত হচ্ছিল দশদিক। যেন ভ্রমর এসে বসেছে প্রসূনের বক্ষে। প্রকৃতির নিয়মে বিমুগ্ধ হরিণ-হরিণীর মতো কী এক আবেগে আমরা আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে যাই।
ঋতু বসন্তের কোন্ আচম্বিত বাসনায় জিনা অংপ্রু তার বক্ষের উত্তরীয় উন্মুক্ত করে দিল। স্তনপট্টের উপর দিয়ে কুচকুম্ভের স্পষ্ট আভাস দেখা দিল। আমি উদাত্ত জিনাকে দেখছিলাম মুগ্ধ চোখে। কিন্তু সহসা একটা দমকা বাতাস এসে সব এলমেল করে দিল। চকিতে সরে গিয়ে সে অরণ্যের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
তাকে সেদিন আর খুঁজে পাওয়া গেল না। পরেরদিন জিনা অংপ্রুর মৃতদেহ গ্রামের লোক খুঁজে পেল শঙ্খ নদীর তীরে বনঝোপের ভিতর থেকে। তার সমগ্র শরীর বিষ নাগিনের ছোবলে ক্ষত বিক্ষত ছিল।
——————————————————-
ডিসক্লেইমার : এই গল্পের দুটো প্যারা আমি সন্মাত্রানন্দ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছি।
৭. কেবলই দুঃখের শ্বাস
এই শহরে পথ চলতে চলতে জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া কতজনকে যে খুঁজে বেড়াই। পৃথিবীর কত অলিতে গলিতে হন্য হয়ে হাঁটি কাউকে আর একটিবার দেখবার জন্য। কত প্রিয় মুখ ম্লান হয়ে আছে কতকাল ধরে। আমি কেবল আকুল হই। কিন্তু কারোরই দেখা পাইনা। এ রকম কত যে মুখ অনেক দূরের স্বপ্ন হয়ে আছে।
আবার কিছু মুখের কথা মনে নেই। কিংবা মন চায়নি কখনও তাদের দেখতে। বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেছে তারা। এই রকমই না দেখতে চাওয়া বিস্মৃত কত মুখ যে আঁধারে পড়ে আছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেই রকমই হারিয়ে যাওয়া একটি মুখের দেখা পেয়েছিলাম একদিন, যার নাম আব্দুল মান্নান।
বারডেম হাসপাতাল থেকে পরিচিত এক রোগীকে দেখে পথের উপরে নেমে হাঁটছিলাম। কোনো মুমূর্ষু মানুষকে দেখার পর মন ভাল লাগার কথা নয়। যদি তিনি থাকেন জীবনের প্রান্ত সীমায় দাঁড়িয়ে। বিষণ্ণতায় মনটা তাই ছেয়ে আসছিল । তখন সন্ধ্যা ঘনয়মান। একটি সিগারেট কিনে ধরাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময় দেখি, আরও একজন মানুষ সিগারেট কিনছে। আমি তার দিকে তাকাই, সেও আমার দিকে তাকায়। দুজন দুজনকেই চিনতে পারি।
ওনার নাম আব্দুল মান্নান। একবারই দেখেছিলাম তাকে। সেও বহু বছর আগে। একবার দেখা এই মুখটিকে এত বছর পরও চিনতে পারলাম। ওনার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল নীলু। ওরা তখন কেনাকাটা করে বের হচ্ছিল নিউমার্কেট থেকে। ঠিক গেটেই হয়েছিল দেখা। নীলু বলেছিল — ‘ইনি আমার হাজব্যান্ড।’ আর আমাকে দেখিয়ে ওর স্বামীকে বলেছিল, ‘ওর নাম শুভ্র। আমার ইউনিভার্সিটি বন্ধু।’ আশ্চর্য লাগল — সামান্য মুহূর্তে দেখা এই আব্দুল মান্নানকে মনে রেখেছি এতদিন!
কিছুটা বিমর্ষ কন্ঠে প্রথম কথা বলেছিল আব্দুল মান্নান, কেমন আছেন আপনি?
— ভাল আছি। আপনি ভাল আছেন?
— ভাল মন্দ মিলিয়েই আছি। জানেন, অনেক দিন আগে আমি একবার কলাবাগানে একটি মেসে আপনাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম। আপনি ছিলেন না। আপনার মেসমেটরা বলেছিল, ‘উনি এখন এখানে থাকেন না।’ আপনি কোথায় থাকেন, তাও তারা বলতে পারেনি।
—- কেন গিয়েছিলেন ?
—- সে অনেক কথা। আমার হাতে সময় খুব কম। যদি সময় থাকত, তাহলে সব কথা বলা যেত। আমি অপেক্ষা করছি, এই রাস্তার উপরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি গাড়ি আসবে। আমি সেই গাড়িতে উঠে চলে যাব।
— কিছু কথা নাহয় বলেন, আমি শুনি।
আব্দুল মান্নান বলছিলেন — ‘এখান থেকে রমনা পার্ক বেশি দূরে নয়। এই পার্কে একদিন বিকালে নীলুকে নিয়ে আমি এসেছিলাম বেড়াতে। নীলু চিনে চিনে লেকের পাড়ে একটি কড়ই গাছের ছায়ায় বসে। মাঝে মাঝে কড়ই গাছ থেকে মরা পাতা ঝরে পড়ছিল। নীলু বলছিল, এই ঝরা পাতা আগেও একদিন এমনি করে ঝরে পড়েছিল। আজও পড়ছে।
নীলু বলেছিল, দেখ — ‘লেকের জল কত স্বচ্ছ। কী স্তব্ধ হয়ে আছে দুঃখিনীদের মতো। তুমি একটি ঢিল ছুড়ে দাও ঐ জলে।’ আমি ঢিল ছুড়েছিলাম সেই নিস্তব্ধ জলে। জলের সেই তরঙ্গ আর আলোড়ন দেখে নীলু বলেছিল —‘হলো না তোমারটা।’
মান্নান সাহেব আরো বলছিল —
‘আর একদিন নীলুই আমাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল বুড়িগঙ্গার ধারে। আমি বলেছিলাম, চলো সদরঘাটের প্লাটফর্মে যাই। ওখানে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেখব বুড়িগঙ্গার জল। নীলু সেখানে গেল না। সে আমাকে নিয়ে গেল ওয়াইজ ঘাটে। সে বেছে বেছে একটি শান বাঁধান ঘাটের উপর দাঁড়াল। মনে হলো, এই ঘাট এই নদী এই পথ ওর অনেক দিনের চেনা। আমাকে নীলু বলেছিল, ‘আজকের নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আনন্দের মনে হচ্ছে না। এর চেয়ে ক্রন্দনের শব্দ অনেক সুন্দর।’
এ কথা শোনার পর মনটা হঠাৎ কেমন করে উঠল। নীলুর এই স্মৃতি দুটোর সাথে আমি-ই যে জড়িয়ে ছিলাম।
মান্নান সাহেবকে একটু পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছিল। সে আবারও একটি সিগারেট কিনে ধরায়। আমাকেও একটি অফার করে। তিনি বলছিলেন — ‘ আপনি কী কখনও জীবন মূত্যু সন্ধিক্ষণের মানুষের চোখের পাতা দেখেছিলেন? ঐ সময়ে তাদের চোখগুলোতে জলের কণা চিকচিক করে। বলতে পারেন, কেন সেই জলগুলো অমন চিকচিক করে?’
মান্নান সাহেব বলছিলেন —
‘ঐ যে হাসপাতালটা দেখছেন, এর নাম ছিল পিজি হাসপাতাল। এই হাসপাতালটিতে একটি মেজর অপারেশন হয়েছিল নীলুর। আমি একজন ডাক্তার, তাই অপারেশন থিয়েটারে থাকবার অনুমতি পেয়েছিলাম। একজন রোগীকে যখন এ্যানেস্থেসিয়া দেয়া হয়, সে তখন অজ্ঞান অবস্থায় অনেক কথাই বলে। নীলুকে যখন এ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয়, অজ্ঞান অবস্থায় সে বারবার আপনার নাম বলেছিল। চোখের কোণ থেকে তখন চিকচিক করে জল ঝরে পড়ছিল। আর বিড়বিড় করে বলছিল — ‘আমি শুভ্রকে দেখব, আমি শুভ্রকে দেখব ।’
মান্নান সাহেবের কন্ঠ রোধ হয়ে আসছিল। এবং কথা বলতে যেয়ে থেমে থেমে যাচ্ছিল। আমি বললাম — তারপর নীলুর কী হলো? ও এখন কেমন আছে ? মান্নান সাহেব বলছিল — সেদিন ছিল শুক্রবার। আমার বাসা তখন জিগাতলায় । মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে বের হয়েছি। মনটা কেমন যেন উদাস লাগছিল। এত শূন্যতা এত হাহাকার এই জীবনে। ভাবলাম, আপনার সাথে একটু দেখা করব। হাঁটতে হাঁটতে সেই দিনই চলে গিয়েছিলাম কলাবাগানে আপনার মেসে। কিন্তু আপনাকে পাইনি।
হঠাৎ সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কার আমাদের সামনে এসে থামে। রাস্তার উপর গাড়িটা থামানো দেখে ট্রাফিক পুলিশ এসে চালককে ধমকাতে থাকে। মান্নান সাহেব তখন আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত গাড়িতে গিয়ে ওঠে।
আরও কিছুক্ষণ আমি একাকী দাঁড়িয়ে থেকেছিলাম পথের উপরে। বিপন্ন দুটো চোখ তাকিয়ে দেখছিল বহু বছর আগের বিস্মৃত কিছু মধুময় স্মৃতির দিকে। বুকের অতল থেকে একটি দুঃখের শ্বাস বেরিয়ে এল।
তারপর, সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে ফুটপাতের পথ ধরে সামনের দিকে হাঁটতে থাকি।
৮. মনে রেখো আমায়
মোঃ আব্দুল বারেক নামে আমার এক ফেসবুক বন্ধু কবে লিস্টে যোগ হয়েছিল মনে নেই। সে কখনই সক্রিয় ছিল না। আমার কোনো পোস্টে লাইক কমেন্টও সে দিত না। গত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে আমার ইনবক্সে একটি ম্যাসেজ আসে তার থেকে। সেখানে লেখা ছিল —
‘শ্রদ্ধেয় ভাইজান,
আমার ছালাম গ্রহণ করিবেন। আমি নিতান্তই আপনার একজন পাঠক। আপনার লেখা আমি নিয়মিত পড়ি। খুব ভাল লাগে। কিন্তু আমি কোনো লাইক কমেন্ট দেই না। যাহাহোক, পর সমাচার এই যে, আমি সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে এক নিভৃত পল্লীতে থাকি। আমি কবিতা লিখি। এইবার অনেক কস্ট করিয়া একটি কবিতার বই প্রকাশ করিয়াছি। আপনি যদি আমার কবিতার বইখানি পড়িতেন তাহা হইলে আমি খুব খুশি হইতাম। আপনি আপনার ঠিকানা পাঠাইলে আমার প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ মনে রেখো আমায়’ বইটি পাঠাইয়া দিতাম। ‘
আরজ গুজার —
মোঃ আব্দুল বারেক।
মৌতলা, কালিগঞ্জ, সাতক্ষীরা।’
আমার খুব ইচ্ছা হলো এই কবির বইটি পড়তে। আমি তাকে উত্তরে জানালাম, আপনি বইটি পাঠাতে পারেন একটি শর্তে। আমার কাছ থেকে সম্মানীর টাকা নিতে হবে। আপনার বিকাশ নাম্বারটি পাঠিয়ে দেন। আমি টাকাটা পাঠিয়ে দিব। তিনি আমাকে তাই করেন এবং আমি টাকা ও ঠিকানা পাঠিয়ে দেই। যথারীতি দুইদিন আগে ‘ মনে রেখো আমায় ‘ বইটি আমার হস্তগত হয়েছে।
বইটির মুদ্রণ মান খুবই নিম্নমানের। মফস্বলের কোনও এক অখ্যাত প্রেস থেকে বইটি ছাপা হয়েছে। প্রকাশক : মো: আবুল কালাম চৌং। প্রচ্ছদে হাতের সেলাইয়ের কাজ করা একটি রুমালের ফটোগ্রাফ। বিভিন্ন রঙের সুতা দিয়ে লতা পাতা ফুল আর পাখির ছবি আঁকা। অস্পষ্ট ভাবে লাল সুতার সেলাইয়ে লেখা আছে —‘ মনে রেখ আমায়। ‘ পাতা উল্টিয়ে দেখলাম, প্রচ্ছদ পরিকল্পনা : মোসাম্মদ দিলারা বেগমের নকশি রুমালের ফটোগ্রাফ অবলম্বনে, মো : আব্দুল বারেক।
বইটির উৎসর্গ পত্র এইভাবে লেখা আছে :
‘এই গ্রন্থটি আমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী, আমার নয়নতারা নয়নের মনি মোসাম্মৎ দিলারা খাতুন কে উৎসর্গ করিলাম। যাহাকে অন্তর্যামি বেহেস্তে লইয়া গিয়াছেন।’
উৎসর্গ পত্রটি দেখে মনটা একটু খারাপই হলো। ‘ মনে রেখো আমায় ‘ বইটির সব পাতা এলমেল করে উল্টাতে থাকি। বইটি আমার কাছে পুরোপুরি কবিতার বই মনে হলো না। গদ্য পদ্য মিলে একটি খন্ডিত আত্মকথা মূলক বই মনে হলো। কিছু কিছু লেখায় চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলাম, মো: আব্দুল বারেক তাঁর স্ত্রীকে অত্যধিক ভালবাসিত।
প্রথম দেখা :
বইয়ের প্রথম লেখাটির নাম ‘প্রথম দেখা’। কবি মো: আব্দুল বারেক লিখেছে — আমি তখন দশম শ্রেনীতে পড়ি। একদিন আশ্বিন মাসের বিকালে থানা পরিষদের কাঁচা রাস্তার উপর দিয়া হাঁটিয়া বাড়িতে আসিতেছিলাম। মেঠো রাস্তায় নামিয়া কিছুদূর আসিবার পরই শেখদের বাড়ি। আইল রাস্তার পাশেই একটি ছোট্ট পুকুরপাড় পরে । সেই পুকুরপাড়ে লিচু গাছ তলায় দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখি দিলারা বেগমকে। মাথায় তাহার ঘোমটা দেওয়া ছিল। আমি তাহাকে দেখিলাম, সেও আমাকে দেখিল। দুজনের চোখ দুজনকেই দেখিয়া ভালো বাসিয়া ফেলিল।’
তারপরেই পদ্যে লেখা —
‘হেরিনু যখন পদ্ম আঁখি তাহার
ধ্যান যেন ভাঙ্গিত না আমার, মুগ্ধ হইয়া দেখিতাম তাহাকে, যেমন দেখিত
বুদ্ধ তাহার আম্রপালীকে…..।’
এক জায়গায় দেখলাম, কবি উল্লেখ করেছে — ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর দাদাজান আমাকে বিবাহ করাইবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে। আমি দাদাজানকে বলিলাম, শেখ ৰাড়ির দিলারা বেগমকে যদি আমার সাথে বিবাহ করাইয়া আনেন, তবেই বিবাহ করিব। ‘
পরম আহলাদে নবপরিণীতা বধূকে নিয়ে কবির লেখা একটি কবিতা আছে এই রকম —
‘ চাঁদ পরী আমার টিয়া পাখির শাড়ি পড়িয়া হাঁটে উঠানে,
মন আমার উৎফুল্ল হইয়া ওঠে
চুপি চুপি নয়ন মেলিয়া দেখি তাহাকে
আমার সাথে দেখে বেহুঁশ হয় আমার দাদাজান
বধুর পায়ের আলতা যেন আমার হৃদয়ের
রক্তের মতো লাল … তারপর
থরথরিয়ে কাঁপুনি আসে, কখন নামিবে রাত্রি। ‘
‘মনে রেখো আমায়’ বইটি জুড়ে দিলারা কে নিয়ে ভালোবাসার অনেক কথা লিখেছেন কবি। লিখেছেন তাদের দাম্পত্য খুনসুটির কথা, রোমান্টিক মুহূর্তের অনেক মধুর মধুর কথা লেখা আছে কবিতায়। অজো পাড়াগাঁর সামান্য এক অখ্যাত কবি এমন সুন্দর সুন্দর লেখা লিখতে পারে, তা পড়ে সত্যিই আমি বিস্মিত হলাম।
কালিন্দী তীরে :
বইয়ের শেষের দিকে ‘কালিন্দী তীরে’ অংশটুকু কবি ৰর্ণনা করেছেন এইভাবে —
‘বাড়ীর পিছনে আমাদের কালিন্দী নদী। আমি প্রায়ই দিলারাকে নিয়া নদীর কূলে বেড়াইতে যাইতাম। ওপারেই ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলা। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। সন্ধ্যায় আকাশে চাঁদ উঠিল। জ্যোৎস্নায় বান ডাকিল প্রান্তর জুড়িয়া। একবার ইচ্ছা হইল ঘরে বসিয়া কবিতা লিখি। কিন্তু তাহা করিলাম না। মন বড়ই চঞ্চল হইয়া উঠিল। দিলারাকে দেখিলাম — একটি সাদা রঙের তাঁতের শাড়ি পড়িয়াছে। তাহাকে বলি, চলো — নদী দেখিয়া আসি। ‘
দিলারা আমাকে বলিল, ওগো, আমার বুকে একটু কান পাতিবে? শোনো, কেমন যেন নদীর কূলকূল ধ্বনি বাজিতেছে। নদী যেন আমাকে ডাকিতেছে। তুমি আমাকে কালিন্দী তীরে লইয়া যাও। ‘
আমরা সেদিন রাতে গিয়েছিলাম কালিন্দী তীরে। যাইয়া দেখিতে পাই, ঘাটে একটি ছোট্ট ডিঙি নৌকা নিয়া বসিয়া আছে সন্তোষ মাঝি। আমরা ওর নৌকায় যাইয়া বসিলাম। নৌকা মাঝ দরিয়ায় চলিয়া গেল। অজস্র জ্যোৎস্নার রোসনাই আসিয়া পড়িতেছিল জলে। চিকচিক করিতেছিল জলরাশি। আমি দিলারার মুখের দিকে তাকাইলাম। দেখি জগতের সকল সৌন্দর্য যেন ওর মুখখানিকে আলোকিত করিয়া ফেলিয়াছে। আমি আলো আঁধারিতে মুগ্ধ হইয়া দেখিতেছিলাম সেই রূপ। আমি ঝুঁকিয়া পড়িয়া একটি চুম্বন দিতে চাহিয়াছিলাম ওর কপালে। নৌকাটি কখন স্রোতের টানে ভাসিয়া চলিয়া যায় ভারতের জলসীমায়। হঠাৎ ওপারের দিক হইতে একটি গুলির শব্দ পাওয়া যায়। দেখি, দিলারা আমার বুকের উপরে লুটাইয়া পড়িল।’
শেষের কবিতাটি ছিল এইরকম :
‘আমার রাত্রি শেষ হইতে চাহে না, আমার দিন ফুড়াইতে চাহে না,
পূর্নিমা আসে প্রতিমাসে একবার
শতবার আমার বুক পোড়ে চাঁদের আগুনে
কালিন্দীর ভাঙ্গনের শব্দ শুনি
মনে হয় বিসর্জন দেই এই দেহকে তাহারই জলে
এখনও যে আগুন জ্বলে
এখনও যে পরান পোড়ে তাহারই তরে।’
৯. যতই কালো হোক
গুনে গুনে দেখলাম আজ থেকে তিরিশ বছর আগের কথা। সেদিনও ছিল এমনই বসন্ত চৈত্রের দিন। তপ্ত রোদ্দুর ঝরে পড়ছিল আকাশ থেকে। আমরা বসেছিলাম মেঘনা ঘাটে। নাসরিন সকালবেলা সায়েদাবাদ বাস স্টান্ডে একটি চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে বলেছিল — ‘ আজ তোমার সাথে হয় শেষ দেখা, না হয়, অনন্ত জীবনের শুরু। ‘
সায়েদাবাদ থেকে একটি লোকাল বাসে করে চলে আসি মেঘনা ঘাট। ব্রীজের কাছ থেকে নদীর কূল ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটু পূর্ব দিকে চলে যাই। যতই দূরে যাচ্ছিলাম, ততই যেন জনশূন্য মনে হচ্ছিল নদীর কূল। এক জায়গায় কেমন যেন পোড়া গন্ধ পাচ্চিলাম। পোড়া কাঠ আর কয়লাও দেখতে পেলাম নদীর পাড়ে। এগারো বারো বছরের একটি বালক লুঙ্গী পড়ে খালি গায়ে আসছিল আমাদের দিকে। ওকে বলি — এখানে কিসের পোড়া গন্ধ?
বালক : স্যার, এখানে কাল বিকেলে লাশ পোড়াইছে। এটি একটি শ্মশান ঘাট।
নাসরিন : মেয়ে মানুষের লাশ ছিল, না, ছেলে মানুষের লাশ?
বালক : আফা, মাইয়া মানুষের লাশ।
শ্মশান ঘাটটি পার হয়ে আমরা আরো কিছু দূরে চলে যাই। নদীর কূলেই দেখতে পাই একটি বড় নিম গাছ। আমরা দুজন সেই নিম গাছের তলে ঘাসের উপরে যেয়ে বসে পড়ি। জায়গাটা বেশ রোমান্টিকই মনে হ্চ্ছিল। দূরে ব্রীজের উপর দিয়ে অসংখ্য গাড়ি এদিকে ওদিকে ছুটে যাচ্ছে। নদীতে শ্যালো নৌকা ভটভট করে চলছে। মাঝে মাঝে দুএকটি লঞ্চও চলছে। পাশেই শ্মশান ঘাট। নিম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উপর থেকে আমাদের উপর চৈত্রের রোদ্দুর ঝরে পড়ছিল।
নাসরিন অনেকটা সুরঞ্জনার মতো করে বলে : ‘ এই খাঁখাঁ চৈত্র দুপুরে, এই শ্মশান ঘাটে কী কথা আমার সাথে? তোমার সাথে কেন যে আমার প্রেম হলো? তার চেয়ে নুরা পাগলা কিংবা শহীদ ডাকাত অনেক ভাল ছিল। ওরা ভাল প্রেমিক হতে পারত। ‘
আমি বলছিলাম — ‘আজ কয়েকদিন ধরে কেবল শ্মশান ঘাটের স্বপ্ন দেখছি। চন্দন কাঠে জড়ানো লাশ। দাউদাউ করে কাঠ আর লাশ পুড়ছে। স্বপ্নে এমনই একটি নদী দেখেছি। এখানে আসার পর সবকিছুই কেমন যেন মিলে যাচ্ছে। ঠিক যেন স্বপ্নে দেখা সেই জায়গা! সেই নদী, সেই নিম বৃক্ষ।’
কাছেই তাকিয়ে দেখি, মেঘনার উপর দিয়ে যাত্রা পার্টির একটি নৌকা যাচ্ছে। হারমোনিয়ামের কড়া সুরের তালে একটি মেয়ে ঘাঘরা পরে নাচ্ছে আর গান গাচ্ছে :
‘ “হাওয়া মে উড়তা যায়ে,
মেরা লাল দোপাট্টা…মল মল কা হো জি…হো জি।”
আমি নাসরিনকে বলি : ‘দেখ মেয়েটি কী সুন্দর করে গান গাচ্ছে। তুমি যদি ঐরকম একটি নটী হতে, কী যে সুন্দর লাগত তোমাকে! ‘
— ‘ আমাকে এই শ্মশান ঘাটে এনে শেষ পর্যন্ত যাত্রার নর্তকী বানালে। ‘
—- এই চৈত্র দুপুরে যদি কোকিল ডাকত এই নিম গাছের ডালে বসে, কী যে ভাল লাগত! কিন্তু কোনো কোকিল এখানে নেই।
—- ঐ দেখ, দাড় কাক বসে আছে নিমের ডালে। ‘
সত্যি তাই। দেখলাম, দুটো কাক কা – কা করে উড়ে চলে গেল। মনটা একটু খারাপই হলো। ওরা কাক না হয়ে যদি শালিক হতো। মনটা সত্যিই প্রফুল্ল লাগত। যেন ‘টু ফর জয়’।
এবার নাসরিন একটু গম্ভীর হলো। আমি বললাম — ‘তোমার কী খিদে পেয়েছে? ‘
—- হ্যাঁ।
—- কাছে কোনো হোটেল নেই। যেতে হবে মেঘনা ঘাট বাজারে। যাবে?
—- না।
—- খাবে না।
—- না।
নাসরিন আমার একটি হাত টেনে নিয়ে ধরে থাকে ওর হাতের ভিতর। খুব মায়াবী করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। কিছু সময় পর বলছিল — ‘তুমি এত উদাসীন কেন, বলো তো? তুমি কী সারাজীবন এমনই থাকবে? একটা ভাল চাকুরির খোঁজ নেবে না? টিউশনি করে বিয়ে করতে পারবে? সারাজীবন মেচেই থাকবে?’
—- কেন, তুমি আমাকে বিয়ে করে এমন শ্মশান ঘাটে নিম গাছ তলায় থাকতে পারবে না? ‘
—- তুমি পাগল। তুমি ইডিয়ট। ‘
—- আমি তো তোমাকে নিয়ে এমন খোলা আকাশের নীচে বসবাস করতে পারব হাজার বছর। প্রতি বসন্ত রাতে নক্ষত্র ঝরে পড়বে আমাদের উপর। শীতে পড়বে শিশির। আর বর্ষায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। কী যে ভালো লাগবে ! কী পারবে না আমার সাথে থাকতে এমন হাজার বছর? ‘
— তুমি সত্যিই একটা পাগল, সত্যিই তুমি ইডিয়ট।
হঠাৎ পশ্চিম দিক থেকে একটি ঘূর্ণিবায়ুর ধূলো বাতাস এসে লাগল আমাদের গায়ে। বাতাসে উড়ে আসছিল জীর্ণ মরা পাতা। শ্মশানের লাশ পোড়ার গন্ধও পেলাম। নাসরিন ওড়না দিয়ে ওর চোখ ঢাকে। একসময় ঘূর্ণিবায়ুটি উড়তে উড়তে মেঘনার জলের স্রোতের ঘুর্ণিতে মিশে যায়।
আমরা তখনও বসে আছি ঘাসের উপরে। নাসরিন ওড়না থেকে মুখ বের করে আমার কাঁধের উপরে মাথা ঠেকিয়ে বলছিল — কাল একজায়গা থেকে পাত্র আসবে আমাকে দেখতে। বড় দুলাভাই হচ্ছে ঘটক। যদি পাত্র পক্ষ আমাকে পছন্দ করে ফেলে। যদি বিয়ে পাকাপাকি হয়ে যায়। আমার খুব ভয় লাগছে। চলো কালই আমরা কোর্টে যেয়ে বিয়ে করে ফেলি। ‘
—- আরে না, তোমাকে কেউ পছন্দ করবে না। তুমি দেখতে অনেক কালো। কালো মেয়েদের এত তাড়াতাড়ি কেউ পছন্দ করবে না। আর, করলেও কালই তো তোমার বিয়ে হবে না। পরে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। দেখি, এর মাঝে একটি চাকুরী হয়ে যায় কিনা? ‘
আর কপালে যা হবার তাই হবে। ভানু চক্রবর্তীর সেই কবিতার মতো —-
‘ …পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়,
বন্ধন তারে করি না খাঁচায়,
ডানা-মেলে-দেওয়া মুক্তিপ্রিয়ের
কূজনে দুজনে তৃপ্ত।
আমরা চকিত অভাবনীয়ের
ক্বচিৎ কিরণে দীপ্ত।…’
কোথা থেকে সেই কাক দুটো আবার ফিরে এসে বসে নিম গাছের ডালে । কিছু ধূসর মেঘ হঠাৎ আকাশের তপ্ত সূর্যটাকে ঢেকে ফেলে। একধরনের প্রশান্তির ছায়া নেমে আসে মেঘনার তীরে। চেয়ে দেখি, এমন ছায়া রোদ্দুরে নাসরিনের মুখখানি আরও বেশি উজ্জল দেখাচ্ছে। নদী থেকে তখন শীতল হাওয়া বয়ে আসছিল। বাতাসে উড়ছিল ওর চুল। আমি নাসরিনের চোখের দিকে একবার তাকাই। দেখি সেই চোখে কোনো বিষন্নতা নেই। ওর বিনম্র মুখের দিকে তাকাই। চেয়ে দেখি — সেই মুখে কোনো অভিমান নেই। আমরা দুজন মেঘনার তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাস স্টান্ডের দিকে চলে আসতে থাকি।
কথা ছিল আমাদের দেখা হবে আবার। কিন্তু তারপরে নাসরিনের সাথে অামার আর দেখা হয় নাই। যে সমস্ত জায়গাগুলোতে আমরা সাধারণত দেখা করতাম, সে সমস্ত জায়গায় আমি ঘন্টার পর ঘন্টা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকেছি। কিন্তু নাসরিন আর আসে নাই। ওর ঠিকানায় কটি চিঠিও লিখেছিলাম। কিন্তু সেগুলোরও নো রিপ্লাই ছিল।
ওতো কালো মেয়ে ছিল। তারপরও সেদিনই হয়ত ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তারপর তিরিশ বছর চলে গেছে। ওকে ভুলিনি, ও যতই কালো হোক।
১০. রোড টু কোলকাতা
দুবাই থেকে বন্ধুবর সুচিন্ত্য র একটি ম্যাসেজ পেলাম। ও লিখেছে, ‘কোলকাতা আসলি, আমাকে একটু আগে থেকে বলবি না, আমিও থাকতাম। মধ্যমগ্রামে আমার বাসা খালি পড়ে আছে। সেখানেই থাকতে পারতিস। তা, কোথায় উঠেছিস?’
আমি বললাম, নিউ মার্কেটের কাছাকাছি একটি হোটেলে উঠেছি। মাত্র দুইদিনের জন্য এসেছি। ট্রেনে কোলকাতা আসার একটি সখ ছিল। সেই সখটা পূরণ করলাম।
সুচিন্ত্য আবার লিখল — ‘মাত্র দুইদিনে কোলকাতায় কী দেখবি? ‘
আমি বললাম — কিছুই দেখব না। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে আমরা দুজন একটি সেল্ফি তুলব। গঙ্গার ধারে যাওয়ারও ইচ্ছা আছে। সন্ধ্যায় কালীঘাটে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে নাকি গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। প্রদীপ জ্বলা সেই সন্ধ্যার মনোরম দৃশ্যটি দেখারও ইচ্ছা আছে। আর ঠিক দুপুরবেলায় একদিন গড়ের মাঠে যেয়ে সবুজ ঘাসের উপরে বসে দুজন গপ্পো করব ।
আরও লিখলাম — নিউ মার্কেটের সামনে ফুটপাত থেকে হ্যাপি গোলগাপ্পা, বেলপুরি, আর দোসা খাবে। অার আমার মহিষের দুধের এক গ্লাস মাঠা খাওয়ার ইচ্ছা আছে। আর মেট্রোতে টালিগঞ্জ যেয়ে দুজন আইসক্রিম খাব।
সুুচিন্ত্য লিখল — পার্ক স্ট্রীটে পার্ক হোটেলের পাশে মমো পাওয়া যায়। হ্যাপিকে নিয়ে ওখান থেকে মমো খেয়ে নিস। খুব ভাল লাগবে।
আরেক ফেসবুক বান্ধবী শ্রাবণী বিশ্বাস সাজেস্ট করল, কোলকাতায় যখন এসেছেন, কফি হাউসে যাবেন আর ইকো পার্কটাও দেখে নিবেন।
ঘটনাটি ছিল কাকতালীয় :
এবারই দেখলাম, টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের নাম বদলিয়ে রাখা হয়েছে মহানায়ক উত্তম কুমার। একদিন সন্ধ্যায় মেট্রোতে ফিরছিলাম এই উত্তম কুমার স্টেশন থেকে। ফেরাটা ছিল অফ্ আওয়ারে। অতো ভীড় ছিলনা। আমি আর হ্যাপি একটি খালি বেঞ্চে বসে পড়ি। আমাদের পাশের বেঞ্চে বসা ছিল একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা সাথে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের একজন তরুণ। মহিলার হাতে একটি ক্রাচ। হয়ত ওনার পায়ে সমস্যা আছে। ক্রাচে ভর করে হাঁটতে হয়। ওনারা উঠেছিল গীতাঞ্জলি থেকে।
আমি বারবার ঘুরে ফিরে দেখছিলাম এই মহিলাকে। মহিলাও দেখছিল আমাকে। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল এই মুখ। কপালে পড়েছে তার বলিরেখা। চোখের পাতায় নেই সেই ঔজ্জ্বল্য। কিন্তু তার চোখের দিকে চেয়ে দেখছি, এই চোখ আমি কোথায় যেন দেখেছি। হ্যাপি আমাকে বলছিল — তুমি ওনাকে যেভাবে দেখছ, মনে হচ্ছে উনি তোমার পরিচিত।’ আমি মনে মনে মিলাচ্ছিলাম, এই মুখটির সাথে অনেক বছর আগে দেখা একটি মুখের সাথে। মন বলছিল হয়ত সেই হবে।
সে ছিল কীর্তিকা পোখরেল। একটি নেপালি মেয়ে। কীর্তিকা এসেছিল নেপাল থেকে স্কলারশীপ নিয়ে ঢাকায় । বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ও আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল। কিন্তু ওতো অনেক আগে ওদের দেশে জন যুদ্ধে মারা গেছে। কীর্তিকাকে নিয়ে আমার একটি স্মৃতিচারণমুলক গল্পকথাও আছে। ওর তো এখানে এই কোলকাতায় থাকার কথা নয়। মন খুব আনচান করছিল ওনার সাথে একটু কথা বলবার। কিন্তু দ্বিধা করছিলাম। হ্যাপিকে বলছিলাম, ‘তুমি যেয়ে ওর সাথে একটু কথা বলো।’
কথা বলব বলব করে মেট্রো ট্রেনটি কখন রবীন্দ্র সূদন চলে এসেছিল বুঝতে পারিনি। ওনাদের মুভমেন্ট দেখে মনে হলো, সামনের কোনো স্টেশনে হয়ত নেমে যাবে। কেমন যেন অস্থির লাগছিল মনটা। কিছু বলব ভাবতে ভাবতেই ময়দান স্টেশনটি চলে আসে। এখানে তারা নামল না। কিন্তু পরের স্টেশন পার্ক স্ট্রীটে নামবার জন্য তারা প্রস্তুতি নেয়।
মহিলা নামবার জন্য আস্তে করে একহাতে ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আমি হ্যাপিকে বলি — চলো, ওনার সাথে একটু কথা বলি। আমি কাছে যেয়ে বলি — ‘এক্সকিউজ মী, আপনেরা কোথা থেকে এসেছেন?’
মহিলা : কাঠমান্ডু, নেপাল থেকে।
আমি : আপনার নাম কি?
মহিলা : কীর্তিকা পোখরেল।
আমার আত্মার স্পন্দন ধ্বনি মুহূর্তে থেমে গেল। আমি তার দুচোখের দিকে মায়া ভরে তাকিয়ে বলছিলাম — ‘তুমি কী বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে গিয়েছিলে কখনও? ‘
মেট্রো ট্রেনের এ্যানাউন্সমেন্ট বক্স থেকে বলছিল তখন, ‘ দিস ইজ স্টেশন পার্ক স্ট্রীট ‘।
কীর্তিকা আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আর সুযোগ পায়নি। ক্রাচে ভর করে সেই ছেলেটির হাত ধরে দ্রুত সে নেমে চলে যায়।
মেট্রো ট্রেনটি তারপর শোঁ-শোঁ করে এসপ্লানেডের দিকে ছুটতে থাকে। ভাবছিলাম — কী আফসোস তুমি রেখে গেলে কীর্তিকা! এত বছর পরে সুযোগ পেয়েও জানতে পারলাম না তোমার কথা। পরক্ষণেই ভাবছিলাম, এই পৃথিবীতে কাকতালীয় কতো কিছুই না ঘটে। সেই রকমই কিছু হবে এই ঘটনাটি। কিংবা কোনো ঘোর। কীর্তিকা পোখরেল আসলে বেঁচে নেই।
১১. ধীরে বহে ইছামতী
সেদিন ছিল চৈত্রের চাঁদের রাত্রি। লোকালয়ের সব কোলাহল থেমে গেছে সন্ধ্যা রাতেই। ইছামতী নদী থেকে ফিরে আসা বকগুলো পাঁকুড়ের ডালে বসে ঝিমুচ্ছে। রাত বাড়ছে আর ঝিঁ-ঝি পোকাদের ডাক ততবেশি গুঞ্জরিত হচ্ছে । বাড়ির কোণে সোনাল গাছের ফুলগুলো সুবাস ছড়িয়েছে। নুরজাহান বেগম তার স্বামীকে পান বানিয়ে এনে খেতে দেয়। তার স্বামী পানের খিলিটি মুখে পুরে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তার একটি অভ্যাস পান চিবুতে চিবুতে ঘুমিয়ে যাওয়া। আজও তিনি পান চিবুতে চিবুতে ঘুমিয়ে গেলেন।
নুরজাহান বেগমও শুয়ে আছে, কিন্তু তার চোখে ঘুম আসছে না। ঘরের জানালা দিয়ে একাদশী চাঁদের আলো এসে বিছানায় পড়েছে। সোনাল ফুলের গন্ধে ভরে গেছে ঘর। নুরজাহান পাশ ফিরে দেখে চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার স্বামীর মুখের উপরে। সে আলোয় তার মুখখানি অপূর্ব দেখাচ্ছিল। কী এক আকুলতায় নুরজাহানের মন ব্যাকুল হয়ে উঠল।
নুরজাহান বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে আসে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে দূরের নিরালা বৃক্ষতল। পাতা বাহারের পাতাগুলিতে জোসনা পড়ে ঝিলমিল করছে। আলো আঁধারিতে দেখা যাচ্ছিল মাধবীলতাগুলি ঝুঁকে পড়েছে দেবদারু গাছের দিকে। এমন জ্যোৎস্না ভরা রাত বিবশ করে তোলে নুরজাহানের দেহকে। সে বন্ধ করতে উদ্যত হয় ঘরের জানালা। ঠিক তখনই দুর থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসে রাত্রির আঁধার ভেদ করে। এত রাতে নদীর কূলে কে বাজায় বাঁশি?
বহু বছর আগে তাদের গাঁয়ের এক গায়েন এমন করে বাজাতো বাঁশি। তখন সে বালিকা ছিল। সে তখন বুঝতে পারত অপ্রস্ফুটিত কলিগুলি দিনে দিনে কী ভাবে পাঁপড়ি মেলে। সকালবেলা শিশির ঝরে পড়ে লাজুক সেই ফুলের উপরে। সে এও দেখেছে কী ভাবে মৌমাছি চারপাশে গুণগুণ করে। বালিকা ভালোবেসেছিল সেই গায়েনকে। আর ভালোবেসেছিল তার বাঁশীটিকে।
এক ভরা বর্ষায় সেবার রাজবাড়ি থেকে এসেছিল
যাত্রা অপেরা। গায়েন যোগ দেয় সেই যাত্রাদলে। একদিন চাঁদনী পরশ রাতে সেই যাত্রা দলের সাথে গায়েন গ্রাম ত্যাগ করে চলে যায়। সেই যে সে চলে যায় তারপর আর সে ফিরে আসে নাই।
আজকের এই জ্যোৎস্না ঝালর রাত, এমন বাঁশির বেবাগী সুর — মন যেন বাইরে টানে নুরজাহানকে। সে দেখতে পেল দূরের ঝাঁউ গাছের চিরিচিরি পাতার ফাঁক দিয়ে চৈত্র রাত্রির উন্মাতাল বাতাস এসে তার শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। আর কবেকার বসন্ত মর্মর স্মৃতিগুলো তারই অন্তরে ঐ বাঁশির সুরের সাথে ধ্বনিত হচ্ছে। সে একবার তার স্বামীর মুখের দিকে তাকালো, আর একবার খোলা জানালা দিয়ে ইছামতি নদীর কূলে। যেখানে শীতল জল ধীরে বহিতেছে। যেখান থেকে এই স্মৃতি মর্মর সুর ভেসে আসছে।
পরনে তার শাড়ি পরা ছিল। দুই হাতে ছিল দুটি রূপোর বালা। নাকে ছিল বিয়ের দিনের নাকফুল। চিরুনিতে কেশ বিন্যাসটুকু করল না। বুকের ভিতর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বের হতে চেয়েছিল, কিন্তু তা সে আটকে রাখল, যদি পাছে শব্দ হয়। দরজার কাঠের খিল আস্তে করে খুলে ফেলল। এবং খালি পায়ে ঘর হতে বের হয়ে পড়ল।
পুকুরের ধারে তখন নীল বেতস ফুল ফুটে উঠেছে। বাঁশ ঝাড়ের বাঁশ ঝুঁকে পড়েছে পথের উপর। যে যায় সে উদাস হয়ে যায়। সে আর ফিরে আসে না। বাঁশের পাতার ভিতর দিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাস আসছিল ইছামতি থেকে। তখনও নুরজাহানের অন্তরের ভিতরে বেজেছিল বহু দিনের সেই পুরনো বাঁশির সুর। পৃথিবীর ক্রন্দনগুলো আজ যেন এই জ্যোৎস্নাস্নাত জমিনের উপর আছড়ে পড়ছে।
রাতভর লোকালয়ের কেউ আর বাঁশির সুর শোনেনি। পাখিদের ডানায় ডানায় ঘষা লেগে যে বিদ্যুতের আলোর ছ্বটা তৈরি হয়েছিল, তাতে কী পুড়ে ভস্ম হয়েছিল কোনো আসক্ত শরীর? নাকি আরও বেশি ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছিল জোসনা। কেউ কি দেহজ আগুন নিভিয়েছিল ইছামতির জ্বলে সেই রাতে?
সকালবেলা নুরজাহান বেগমকে না পেয়ে তার স্বামী চলে যায় ইছামতির কূলে। সেখানে সে ধবল বকের কয়েকটি পালক পড়ে থাকতে দেখে । আর ধূর্বা ঘাসের উপরে পড়ে থাকতে দেখে কূঁচ পাথরের তৈরি নুরজাহানের নাকফুলটি আর কার যেন একটি পুরনো ভাঙা বাঁশি।
১২. মাধু গোয়ালিনী
অনেক বছর আগে আমি একবার পুণ্ড্রনগরীতে গিয়েছিলাম। পুণ্ড্রনগরী তখন পুরোটাই গড়। যেটি মহাস্থানগড় হিসাবে পরিচিত। এই গড়ে একটি প্রাচীন ভিটা আমি দেখতে পেয়েছিলাম, নাম গোবিন্দ ভিটা।
এই ভিটার পশ্চিম পার্শ্বে একটি ভগ্নস্তুপ মন্দির ছিল । যেটি “করতোয়া মহাত্ন্য’’ মন্দির নামে পরিচিত ছিল । এটিকে গোবিন্দ বা বিষ্ণু মন্দিরও বলা হতো। আমি হাঁটতে হাঁটতে আরও উত্তর দিকে চলে গিয়েছিলাম । করোতোয়ার কূল ঘেষে সেখানে একটি প্রাচীন অশ্বত্থ বৃক্ষ দেখতে পাই। মনে হয়েছিল এই বৃক্ষটি কয়েকশত বছরের পুরনো। এই গাছের তলায় একটি আশ্রম আছে। কয়েকজন সাধু জাতীয় লোক সেখানে বসবাস করত।
আমি সবসময়ই এই সাধু সন্ন্যাসীদের পছন্দ করতাম। আমার একসময় জীবনের লক্ষ্য ছিল সাধু সন্ন্যাসী হওয়া। কিন্তু তা হতে পারিনি। কেন হতে পারিনি, সেই দুঃখের কাহিনী আরেকদিন বলব। আজ এই সন্ন্যাসীকুলদের দেখে খুব ইচ্ছা হল, দুইতিন দিন এদের সাথে এই আশ্রমে থেকে যাই । আশ্রমের সবচেয়ে প্রবীণ সাধুটির নাম ছিল অনুকূল বৈশ্য। আমি তারই শিশ্যত্ব গ্রহণ করি।
আমার এই লেখার যা কিছু তথ্য বা কাহিনী কিংবা উপকাহিনী সবই এই গুরু অনুকূল বৈশ্যের কাছ থেকে শোনা। গোবিন্দ ভিটার উপর দিয়ে আমি হাঁটতাম আর ভাবতাম, — ইতিহাসের এক ধূসর ধূলি পথে আমি কোথায় যেন যাচ্ছি । আজ থেকে হাজার বছর আগের পুণ্ড্রনগরীর ইট বিছানো সেই পথ। যেখানে এখন লাল পোড়া মাটির ধুলো উড়ছে। বৃক্ষ রাজির ছায়াতল দিয়ে চলতে চলতে মনে হলো আমি অনেক বছর আগের এই মন্দিরের একজন গায়েন।
ফ্লাশব্যাক :
আমি মনি শংকর, কীর্তন করি গোবিন্দ ভিটার পার্শ্বে ঐ বিষ্ণু মন্দিরে। আমাদের বাড়ি ছিল বুমানপাড়া অঞ্চলে মাথুরা গ্রামে। গ্রামটির একপাশে দিয়ে বয়ে গেছে করতোয়া নদী। আমার বালক বয়স থেকেই গান গাইতাম বাবার গানের দলের হয়ে। এখন আমি যুবা এক পূর্ণ গায়েন। গানের দলের হয়ে বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় যেতাম। পৌষ সংক্রান্তির দিনে হুগলি নদীর তীরে গঙ্গাসাগর মেলা, মাঘে বাঁকুড়ার কেঞ্জেকুড়া গ্রামে দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে মুড়ি মেলা, শিবরাত্রিতে জলপাইগুড়িতে জল্পেশ্বর মেলা, শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মনসার পূজা উপলক্ষে ঝাঁপান উৎসব। এইসব মেলা পার্বনে সেখানে কীর্তন আর শ্যামা সংগীত গাইতাম।
আমি গান করি এখানে, এই পুণ্ড্রে। কীর্ত্তন আসর মাতিয়ে রাখি। দূর দূড়ান্তের গানের দল থেকে অনুরোধ আসত আমাকে তাদের দলে নেবার । কিন্তু আমি যেতাম না। কী এক মায়ার মোহে এখানেই পড়ে থাকি এই বিষ্ণু মন্দিরে। পৃথিবীর সব মোহ আমি ছাড়তে পারি, গান ছাড়তে পারি, ঠুমরির খুঞ্জরীর শব্দ আর না শুনতে পারি কিন্তু আমি ছাড়তে পারি নাই মাধু গোয়ালিনীকে।
বাঁকুড়ার কেঞ্জেকুড়া গ্রামের কার্তিক ঘোষের বউ ছিল মাধু। দেখতে অপরূপ সুন্দরী ছিল। দেবী প্রতিমার মতো দেহ বল্লরী তার। কার্তিক দুধ বিক্রি করত দ্বারকেশ্বর নদীর ঘাটে । মাধু গাভী দেখা শুনা করত। এক আশ্বিনে কেঞ্জেকুড়া গ্রামে ওলাওঠা রোগ ছড়িয়ে পড়লে কার্তিক ঘোষ সেই রোগে মারা যায়। মাধু হয় অকাল বিধবা। আমাদের গানের দল গিয়েছিল সেখানকার এক মুড়ি মেলায় গান করতে। মাধু আসত সেখানে গান শুনতে। মেলা শেষ হলে দ্বারকেশ্বর নদীর ঘাট থেকে খুব
প্রত্যুষে যেদিন নৌকা ছেড়েছিল , সেদিন দেখেছিলাম নৌকার ভিতরে মাধু গোয়ালিনীকে। আমাদের গানের দলে আরও দুই জন মেয়ে গায়েন ছিল শিবাণী ও দিপালী। ওদের সাথে সেদিন যোগ হয়েছিল এই মাধু গোয়ালিনী।
আমাদের নৌকাটি যখন দ্বারকেশ্বর পেরিয়ে কংসাবতী নদীতে এসে পৌঁছে তখন বিকাল হয়ে গিয়েছিল। ছইয়ের উপর আমি একাকী বসেছিলাম। কংসাবতীতে তখন মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। আমার মনটা খুব ভাল লাগছিল, আবার কেন জানি খারাপও লাগছিল। ভাল লাগছিল এইজন্য যে, মাধুকে আমার খুব ভাললাগত। ওকে প্রথম দেখেছিলাম মেলায় গানের আসরে। হেজাকের আলোর নীচে দেখেছিলাম ওর আনত মুখ। কী মাধুর্যময় সারল্য ছিল ওর মুখখানিতে। সেই অপূর্ব মুখের মেয়েটি এখন আমাদের দলে। এই নৌকায়। কংসাবতীর উচ্ছল জল ছলাৎছল করছিল ৰাতাসের ঢেউ লেগে। আমার মন কেমন যেন ফাগুন দোলায় দুলে উঠছিল। আবার খারাপও লাগছিল এইজন্য যে, আমি তো মাধুকে এই নৌকায় তুলি নাই। আমাকে তো ও কখনও ঐভাবে দেখে নাই, কথাও বলে নাই। আমাকে ওর ভাল লাগারও কথা না। তবে কেন সে এই নৌকায় উঠল? কে তুলল তাকে?
হঠাৎ চেয়ে দেখি শিবাণী। এবং ওর পিছনে মাধু গোয়ালিনী দাঁড়িয়ে। শিবাণী বলছিল — ‘ কী ভাবছ তুমি। ‘
আমি : কিছু না। দেখছি কংসাবতীর জল।
শিবাণী : ( মাধুকে দেখিয়ে) একে চেন?
আমি : না।
শিবাণী : ইনি মাধু গোয়ালিনী। জয় শংকর ওকে পছন্দ করে এই নৌকায় তুলেছে। নতুন গায়েন। ওকে নাকি নাচও শেখাবে।’
শিবানী মুচকি হেসে আরও বলছিল — ‘জয় শংকর খুব পছন্দ করেছে ওকে। মাধুও পছন্দ করে। তুমি শুধু আমাকে পছন্দ করো না। কী এখন থেকে করবে না?’
আমি : তোকে না কত বলেছি, তুই আমাকে বিরক্ত করবিনে। যা, ভাগ এখান থেকে।
শিবাণী রাগ হয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় মাধুকে হাত ধরে টান দিয়ে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু মাধু যায় নাই। দাঁড়িয়ে ছিল আরও কিছুক্ষণ। দেখছিল কংসাবতীর জল। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে নিভু নিভু প্রায়। মেঘের নীচে ম্লান হয়ে যাওয়া লাল আভা এসে পড়েছিল মাধুর মুখে। ওর সেই স্বপ্নীল মুখে অস্ফুট করে আমাকে বলেছিল — ‘ জয় শংকরের জন্য নয়। আমি তোমার জন্যই এই নৌকায় উঠেছি। ‘
জয় শংকর আমার বাবা। বিয়ে করেছিল পাহাড়পুর গ্রামের কিশোরী অশ্বিনী ডুমনীকে। আমার মা ছিল ডোম। অনিন্দ্য সুন্দরী হওয়াতে বাবা নাকি জোর করেই তাকে বিবাহ করেছিল। অল্প বয়সেই সে সন্তান সম্ভবা হয়। আমি জন্মিবার সময় আমার মা মারা যায়। তারপর বাবা আবার বিয়ে করে। আমার সেই মা নিঃসন্তান। মাথুরা গ্রামে নিভৃতে সে একাকী বসবাস করে।
আমি জানি বাইরে মেয়েদের সাথে বাবা স্ফূর্তি করে। এই যে শিবাণী, যে আমাকে ভালবাসতে চায়, তার সাথেও আছে বাবার অবৈধ সম্পর্ক। কাবেরী, দিপালীও যেন বাবার রক্ষিতা। মাঝে মাঝে মনে হতো, এই গানের দল ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই। কিন্তু যাই না। যাই না এই জন্য যে, বাবা আমাকে অধিক ভালবাসে। জগতের যত স্নেহ মমতা সে আমাকেই করে। আমি নাকি দেখতে হয়েছি মার মতো। বাবা সুন্দর গান করে। আমিও ঠিক বাবার মতো করে গান গাই।
সেই বার এই পুণ্ড্রে, এই করতোয়া নদীর তীরে, এই অশ্বত্থ গাছের তলে মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে মেলা বসেছিল। কত মানুষ, কত সাধু, কত সন্ন্যাসী, কত যোগিনী, কত বোষ্টুমী এসেছিল সেই মেলায়। গান আর নাচের উৎসব হয়েছিল মন্দিরের অদূরে অশ্বত্থ তলায়। সেদিন ছিল, শুক্লা দ্বাদশীর রাত। আমি মাধুকে সকালবেলাই বলে রেখেছিলাম, তুমি দেখা করবে পাহাড়পুর জঙ্গলে। আমি ওখানে নাগলিঙ্গম বৃক্ষতলে অপেক্ষা করব। আমরা নিরুদ্দেশ হয়ে যাব এই লোকালয় থেকে অন্যত্র।
শুক্লা দ্বাদশীর সেই রাতে মাধু যায়নি গড়ের সেই জঙ্গলে। আমি রাত দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম বৃক্ষতলে। ত্রয়োদশীতে মাধুকে আবার বলি — ‘ তুমি আজ অবশ্যই যাবে। আজও অপেক্ষা করব জঙ্গলের ঐ নাগলিঙ্গম বৃক্ষ তলে। ‘ মাধু আমাকে মাথা নেড়ে ইশারায় বলেছিল — ‘যাব’। আমি সেদিনও মাঝ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম মাধুর জন্য। কিন্তু মাধু সে রাতেও আসেনি।
সেদিন ছিল মাঘী পূর্ণিমা। সকালবেলা মন খারাপ করে বসে আছি। মাধুর সাথে আমি কথা বলছিলাম না। মাধু নিজেই কাছে এসে আমাকে বলে — ‘আজ রাতে অবশ্যই আমি পাহাড়পুর জঙ্গলে যাব। তুমি থাকিও। ‘
সন্ধ্যায় মন্দিরে শঙ্খধ্বনি বেজে উঠল। মহাস্থান গড়ের আকাশে চতুর্দশী পূর্ণিমার চাঁদ দেখা দিল। গানে গানে মন্দির প্রাঙ্গণ উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠল। মঞ্চে আমরা গান করছিলাম। গান গেয়েছিল শিবাণী, দিপালী, বাবা এবং আমি। মধ্য রাত পর্যন্ত গানের উৎসব চলে। আমার গানের সাথে মাধু ক্ষণে ক্ষণে নাচ্ছিলও। তারপর একসময় ঢাকের বারি থেমে যায়। হারমোনিয়ামের সুর বন্ধ হয়ে যায়, ঘুঙুর আর খুঞ্জরীর শব্দও থেমে যায়। একে একে খালি হয়ে যায় মেলা প্রাঙ্গণ। আমি আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা চুপিসারে চলে যাই পাহাড়পুর জঙ্গলের দিকে।
সেদিন পাহাড়পুড় জঙ্গলে আলোর ৰান ডেকেছিল। থৈথৈ জ্যোৎস্না ঢলে পড়েছিল বনে বনে, গাছে গাছে, বৃক্ষে বৃক্ষে, পল্লবে পল্লবে। আমি একাকী নির্জনে বসে থাকি নাগলিঙ্গম তলে। চাঁদ ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে নুয়ে পড়েছে। দেখলাম মাধু আসছে গানের পোশাক পরেই। পায়ের ঘুঙুরও সে খোলে নাই। তার পদধ্বনির সাথে নুপুরের মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
মাধু : বের হতে পারছিলাম না। জয়শংকর কে ব্যবস্থা করে তারপর আসতে হলো।
আমি : কী ব্যবস্থা করেছ?
মাধু : পরে বলব।
আমি : চলো, আমারা আগে মন্দিরে যাই। পুরোহিতকে বলে রেখেছি। আজ রাতেই আমি তোমাকে বিবাহ করব। কাকে করব, সে কথা পুরোহিতকে বলি নাই। চলো আর দেরি করব না।
মাধু : না, আমি তোমাকে বিবাহ করব না।
আমি : কেন করবে না।
মাধু: তুমি এখন ধর্মত আমার ছেলে হয়ে গেছ। আমাকে তোমার বাবা জয় শংকর প্রতিদিন ভোগ করে। আমি তার রক্ষিতা। আমাকে সে বিবাহ করে নাই। কিন্তু আমি তাকে দেখি আমার স্বামীর মতো। ধর্মত আমি এখন তার বউ।
আমি : কিন্তু, তুমি যে আমাকে ভালবাসতে।
মাধু: হ্যাঁ আমি তোমাকে এখনও ভালবাসি।
মাধুকে আমি অনেকটা জোর করেই বুকে টেনে নেই। মাঘী পূর্ণিমার সকল জ্যোৎস্না মাখিয়ে আমি তাকে পাগলের মতো আদর করতে থাকি। হয়ত সে রাতে স্বর্গ নেমে এসেছিল বনতলে। কতক্ষণ আমরা জড়িয়ে থেকেছিলাম, সে কথা কী কোনো মৃত মানুষ বলতে পারে?
শেষ এপিসোড :
মাধুকে না দেখতে পেয়ে জয় শংকর সেই রাতে পাহাড়পুর জঙ্গলের দিকে চলে গিয়েছিল। তারপর কী হলো?
তারপর একসময় মন্দিরে ভোরের শঙ্খধ্বনি বেজে ওঠে। জয় শংকরের সারা শরীরে রক্তের দাগ! বনের নীচ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, সূর্যের রশ্মি ভেদ করে জয় শংকর নিরুদ্দেশ হয়ে গেল! পিছনে নাগলিঙ্গম বৃক্ষ তলে পড়ে রইল দুইটি নিথর মৃত দেহ। সে দেহে পত্র পল্লবের ফাঁক দিয়ে সূর্যের রশ্মি এসে পড়ছিল।
১৩. লিলিয়ান অর্কিড
শিলিগুড়ি থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের উপত্যকার খাঁজে এক রমণীয় শৈল শহর হচ্ছে মংপু। এইখানেই মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত ‘জন্মদিন’ কবিতাটি লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মংপুতে কাটানোর দিনগুলি নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবী রচনা করেছিলেন ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’।
মৈত্রেয়ী দেবীর এই বইটি পড়েই আমার মংপু দেখবার সাধ হয়েছিল। আমার ভিতরে লক্ষ্যহীন একটি বাউণ্ডুলে স্বভাব ছিল। ঘুড়ে বেড়াতে ইচ্ছা করত দেশ থেকে দেশান্তরে। এমনি এক উদাসীন মনের টানে অনেক বছর আগে এক সেপ্টেম্বরে আমি মংপুতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। শিলিগুড়ি থেকে জীপে করে পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে মংপুতে যেয়ে পৌঁছেছিলাম দুপুরের পরেই ।
মংপুতে উঠেছিলাম শহর থেকে দূরে কালিঝোরা নদীর পাশে তিনচুলেতে নিরিবিলি এক ছোট্ট প্রাইভেট বাংলোতে। এখানে সূর্যালোকে ক্ষণে ক্ষণে সাজবদল করে। খুব কাছেই মহানন্দা অভয়ারণ্য। সনসেরিদাঁড়া ভিউপয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও অন্যান্য নয়নাভিরাম তুষারশৃঙ্গ দেখা যায়। আমি বাংলাতে একটু রেস্ট নিয়ে প্রথমেই রবীন্দ্র স্মারক ভবন দেখতে চলে যাই। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সদনটি। এখানে কবিগুরুর অনেক স্মৃতি চিহ্ন দেখে আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।
শাল, সেগুন, অর্জুনে ছাওয়া পাহাড় থেকে নেমেছে কালিঝোরা। সেই ঝোরার নামেই জায়গার নাম। পাশে বয়ে চলেছে তিস্তা। এই রকমই এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশে আকন্ঠ বুঁদ হয়ে ছিলাম সেদিনের সেই পাহাড়ি অরণ্য সন্ধ্যায়। মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম এই লাইনগুলো-
‘‘পাহাড়ের নীলে আর দিগন্তের নীলে
শূন্যে আর ধরাতলে মন্ত্র বাঁধে ছন্দে আর মিলে।
বনেরে করায় স্নান শরতের রৌদ্রের সোনালি।
হলদে ফুলের গুচ্ছে মধু খোঁজে বেগুনি মৌমাছি।
মাঝখানে আমি আছি,
চৌদিকে আকাশ তাই দিতেছে নিঃশব্দ করতালি।
আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ,”
এই অনিন্দ্য সুন্দর মংপু।
আমি যে বাংলোতে ছিলাম সেটি ছিল সিঙ্গেল কটেজের মত একটি বাড়ি। কালিঝরার পাহাড়ি ঢালে অবস্থিত হওয়ায়, এখান থেকে নদী, পাহাড়, উপত্যকা আর নীল আকাশ একসাথে দেখা যেত। কটেজের কেয়ারটেকার ছিল মধ্যবয়সি এক নেপালি, নাম ছিল অমল থাপা। ওর একটি গুণ ছিল, সে পুরোদস্তুর বাংলা ও হিন্দি বলতে পারত। প্রয়োজনীয় ইংরেজিও বলত সুন্দর করে। সে বাংলো থেকে সামান্য দূরে পাহাড়ের ঢালে স্ত্রী সন্তান নিয়ে আলাদা একটি বাড়িতে থাকত।
আমি এখানে দুইরাত থাকার জন্য বুকিং দেই। যে দুইদিন থাকব, আমার খাবারের ব্যবস্থা অমলই করে দেবে। দেখলাম, অমল ওর বাসা থেকে খাবার রেঁধে টিফিন বাটিতে করে তা এনে রেখেছে। আমি সন্ধ্যা রাতেই খেয়ে নেই। অমল আমাকে খাওয়ায়ে রেখে চলে যেতে চায়।
আমি ওকে বলি — ‘আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে।’ সে তখন একটি রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল — ‘ভয় নেই বাবু এখানে। জ্বীন,পরী, ভূত আসবে না।’ এই কথা বলে অমল চলে গেল।
সন্ধ্যায় কুণ্ডলী পাকিয়ে পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকতে দেখেছিলাম মেঘ। তারপর দেখেছিলাম এই অরণ্যে রাত নামতে। আমি বারান্দায় বসে একাকী রাতের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। অদ্ভুত এক অনুভূতি জেগেছিল তখন। এইরকম কাঠের বাড়ি, এই রকম পরিবেশ, এইরকম সৌন্দর্য শুধু সিনেমাতেই দেখেছিলাম। বাস্তবে তা অনুভব করতে পেরে অভিভূত হয়ে পড়ছিলাম। বাইরে তাপমাত্রা তখন পাঁচ। কেমন যেন জমাট ঠাণ্ডা লাগছিল। হঠাৎ ঘরের বাইরে কিসের যেন খচ খচ শব্দ শুনতে পাই। ভয় হল খুব। এই জনবসতি বিরল আদিম সৌন্দর্যের রাতে, এখানে আবার কে এল? আমি দ্রুত ঘরের মধ্যে চলে যাই। ভিতরে যেয়ে কান পেতে থাকি, কিন্তু সেই শব্দটি আর শুনতে পেলাম না।
ঘরের মধ্যে অসীম নিস্তব্ধতা। বাইরে নিঝুম রাত্রির পাহাড়। বনারণ্যে বুঁনো পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। কেমন যেন গা ছমছম করছিল। বুক হিম হয়ে আসছিল প্রচন্ডভাবে । এমন জনমানবহীন জনারণ্যে একাকী কোনো মনুষ্য বসবাস করে? একবার মনে হল কেন মরতে এলাম এখানে। আবার পরক্ষনেই মনে হল, ঘরহীন ৰোহেমিয়ানদের জীবনের জন্য এত মায়া করা ঠিক নয়।
রাত দ্রুত বেড়েই চলছে। রুমের ভিতরে বাতি নিভাতে ভয় পাচ্ছিলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে কাঁচের জানালা দিয়ে দেখ্ছিলাম, বাইরের মংপু। এমন অদ্ভুত আঁধার নামে আকাশের গায়ে! পাহাড়ের ফাঁকে যে আকাশটুকু দেখা যায়, তা ধূসর মেঘে ঢাকা। সেখানে চাঁদও নেই, তারাও নেই।
আমি জানালার কাছ থেকে সরে বিছানার উপর এসে বসি। দূরে বনে বাঁদারে পাখিদের কোনো ডাক নেই। ঝিঁঝিঁ পোকাদের গুঞ্জন নেই। ধবল তুষারপাতের শব্দ নেই। চারদিকে পাহাড় স্তব্ধ হয়ে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ বাইরে বারান্দায় কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। তাও আবার আস্তে আস্তে নুপুর পরে হাঁটবার শব্দ। আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। এত রাতে কার এই নুপুরের নিক্কণ!
আমি অনেকটা ঠাঁয় বসে থাকি। চুপচাপ কেটে যায় আরও কিছটাু সময়। মনে হলো, নুপুরের নিক্কণ থেমে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। এবং রমণী কণ্ঠে বলছিল — ‘তুমি দরজা খুলে দাও। ‘
আমি : তুমি কে?
রমণী : আমি জেসমিন রিনচেন। তুমি আমাকে চিনবে না। দরজা খোল। তারপর বলছি।
আমি সন্তর্পণে দরজার কাছে যেয়ে দরজা খুলে দেই। দেখি, ঝলমলে নাচের পোশাকে তিব্বতি ঘরানার একটি মেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ হবে। এমন নির্জন আঁধারে, এমন নিস্তব্ধ রাত্রি প্রহরে, এমন বনান্তরে, এমন একটি লাস্যময়ী মেয়ে আমার দরজার সামনে একাকী দাঁড়িয়ে। আমি পরম বিস্ময়ে এই রাত্রি সহচরীকে দেখছিলাম।
জেসমিন : আমাকে ঘরে বসতে দেবে না?
আমি : আসো, বসো।
জেসমিন রিনচেন এসে আমার বিছানায় বসে। আমি ওকে বলি, তুমি এতরাতে এখানে কী জন্য এসেছ? জেসমিন বলছিল —- ‘তুমি এই নির্জনে একাকী রয়েছ। আমি জানি, তুমি খুব ভয় পাচ্ছিলে। তাই তোমার কাছে চলে এলাম।’
আমি : তুমি কোথায় থাক, কী করো?
জেসমিন : আমার জন্ম এই মংপুতেই। বাবা নেপালি। আর আমার মা তিব্বতি। মা ছিল সিছুয়ানের খাংদিং এর একজন ক্যাবার ড্যানসার । সে আর এখন নৃত্য করে না। আমি করি।’
আমি : এত রাতে তুমি একাকী এখানে। আমি পরদেশী। দেখ, আমার বদনামি হবে। তুমি চলে যাও।
জেসমিন : কী বলো তুমি? তুমি আমার গান শুনবে না, নাচ দেখবে না, তাই কী হয়? আমার কাছে, তাওয়াংএর ভেষজ সুরা আছে। যেটি দালাইলামাও খুব পছন্দ করে। তুমি এটা পান করো। ভাল লাগবে তোমার। মনে হবে তুমি স্বর্গে আছো। ‘
আমি : আমার খুব ভয় লাগছে তুমি চলে যাও।
জেসমিন : কী বলো তুমি? এমন মধুময় যামিনীতে তুমি আমাকে এত কাছে পেয়েও দূরে সরিয়ে দিতে চাও? আমি যদি তোমাকে অনেক ভালোবাসতে চাই, তুমি আমাকে ভালবাসবে না?
আমি : না। আমার দেশের একজন মায়াবতীকে আমি খুব ভালোবাসি। তার সাথে আমার বিবাহ ঠিক হয়ে আছে। আমি তাকেই বিবাহ করব।
জেসমিন ওর ব্যাগ থেকে সোনালি মোড়কে মোড়ানো একটি প্যাকেট বের করে ছোট্ট একটি রূপালি গ্লাসে করে ঐ সুরা পান করতে দেয় আমাকে । আমি অনেকটা সম্মোহিত হয়েই তা পান করি। প্রথমে জেসমিন গেয়েছিল একটি তিব্বতি গান। অনেকটা মেলোডি সুরে গেয়েছিল গানটি। সেদিনের সেই পার্বত্য নির্জন রাত্রিতে সেই মায়াবী সুর মংপু র আাকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছিল। আমি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম সেই গান। তিব্বতি সেই গানটির অর্থ ছিল এইরকম —
‘যদি পথ আরো দীর্ঘ হয়,
তাহলে তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করবে?
যদি তুমি আমার মন দেখতে পারো,
তাহলে নিজেকেও খুঁজে পাবে।
আমি তোমার সঙ্গে ঘুমন্ত স্মৃতি নিয়ে
জেগে উঠতে চাই। আমার ভালোবাসা এখন
তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার ভালবাসা তোমার সঙ্গে আজীবন থাকবে।’
সকাল গড়িয়ে তখন বেলা হয়ে গেছে। অমল থাপা এসে বাইরে দরজায় নক করছিল । ডাকছিল আমাকে — ‘বাবুজি ওঠেন। ‘ আমি ধূরমুর করে জেগে উঠি এবং দরজা খুলে দেই। রুমের ভিতরে কোথাও রাতের সেই জেসমিন রিনচেনকে দেখতে পেলাম না। ঘরের দরজা যেমন করে বন্ধ করে শুয়েছিলাম তেমনি আছে। কিন্তু কী আশচর্য! বিছানার উপরে জেসমিনের পায়ের নুপুর, বুকের উপরে বাঁধা তার লাল দোপাট্টা, কয়েকটি চুলের কাঁটা, খোঁপায় লাগানো লিলিয়ান অর্কিড ফুল ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে।
——————————————————-
ডিসক্লেইমার : জেসমিন রিনচেনের সাথে আমার কথা হয়েছিল হিন্দি আর ইংরেজিতে। আমি ইচ্ছে করে এখানে বাংলা সংলাপ ব্যবহার করেছি।
১৪. গঙ্গোত্রী গোমুখ
দুই হাজার এগারো সালে একবার ভারতের উত্তরাখণ্ডে গঙ্গোত্রীতে এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি ওখানে একটা গুহায় থাকতেন। মা গঙ্গা মন্দিরে তিনি পূজা দিতেন। আমার সঙ্গে তার কথা হয় প্রথমে গঙ্গা ভাগিরথীর উৎপত্তি স্থলের এক পার্বত্য রাস্তার উপরে। তারপর তার গুহায় বসে । শুনেছিলাম তার কাছ থেকে অনেক কথা। সেও এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। মাথার চুলে তার জট ছিল, সারা মুখ মণ্ডল মোছ আর দাড়িতে ঢাকা ছিল। পরনে ছিল তেল চিটচিটে পুরানো ছেঁড়া পোশাক।
এই সন্ন্যাসীর সাথে কথা বলতে যেয়ে আমি অবাক হই তার কণ্ঠ শুনে, তার চোখের চাহনি দেখে। আমার কাছে মনে হয়েছিল, এই সন্ন্যাসীকে আমি কোথায় যেন দেখেছিলাম। এই কণ্ঠ আমার চেনা। এই চোখ আমার দেখা। তবে সন্ন্যাসী রূপে নয়, অন্য কোনো রূপে।
ফ্ল্যাস ব্যাক : ১৯৭১ সাল।
তখন মার্চের উত্তাল সময়। সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দলোন চলছে। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা শুরু করেছে। মানুষ উৎকন্ঠায় আছে, কী হবে, কী হবে না। এই রকমই এক অস্থির সময়ে নিখিলেশ ঘোষ নামে একজন লোক আমাদের গ্রামে ওর এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। তার আত্মীয়টি ছিল আমার একজন সিনিয়র বন্ধু। আমার সাথে ছিল তার হৃদিক সম্পর্ক। আমাদের গ্রামে উনি কয়েকদিন ছিলেন। আমি তাকে দাদা ডাকতাম। বাড়ি বগুড়ার মহাস্থান গড় এলাকায়। তিনি খুব বিনয়ী ও ভদ্র ছিলেন। খুব সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। বয়সে দশ বারো বৎসরের বড়ো হলেও বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছিলাম মাত্র কয়েকদিনেই। অল্প কদিনেই ওনার অনেক কাছাকাছি আমি যেতে পেরেছিলাম।
ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। নিখিলেশ’দাও চলে যায় তাদের গ্রামে । উনি চলে যাবার পর ওনার সাথে আর কোনোসময় দেখা হয়নাই। কিন্তু তার সাথে আমার ক্ষণসময়ের সম্পর্কটি আমার কিশোর মনে ভীষণরকম দাগ কেটে গিয়েছিল। জীবনে কখনই ভুলতে পারিনি তার সাথে আমার খণ্ড খণ্ড স্মৃতিগুলো।
শুনেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিখিলেশ দা’দের পুরো পরিবার শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল। নিখিলেশ দা তখন তেইশ চব্বিশ বৎসরের একজন টগবগে তরুণ। ম্যাট্রিক পাশ করার পর আর পড়াশুনা করে নাই। নিজেদের পারিবারিক মিষ্টি দধির ব্যবসায় দেখভাল করত । নিখিলেশ দা ভাল গান গাইতে পারত। স্থানীয়ভাবে তার একটি সুনাম ছিল।
বগুড়া শহর পাক সেনারা দখল করলে সেখানে তারা জ্বালাও পোড়াও শুরু করতে থাকে। স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পাকসেনারা বেছে বেছে হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালাতে পোড়াতে থাকলে একাত্তরের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝির দিকে নিখিলেশ’দা দের পুরো পরিবার ভারতের পশ্চিম বঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুরের বালুর ঘাট এরিয়াতে চলে যায়। ওখানে পতিরাম নামক এক গ্রামের স্কুল মাঠে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরে তারা আশ্রয় নেয়।
আজ প্রায় চল্লিশ বছর পর সেই নিখিলেশ দাকে আমি দেখলাম সন্ন্যাসী রূপে এই গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখে ভাগিরথী ও গঙ্গার উৎপত্তি স্থলের প্রায় ১৩২০০ ফুট উচুতে তীর্থস্থানে এক পর্বত গুহার পাশে। আমি বিস্ময়ে দেখছিলাম তাকে। তাকে বলি : ‘দাদা, আপনি কী নিখিলেশ ঘোষ? ‘ সন্ন্যাসী আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। মনে হল সে আমাকে চিনতে পারে নাই। বললাম — ‘ আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জ, ছোনগাছা হাটে। সত্যেন দা আমার সিনিয়র বন্ধু। ‘ আমার পরিচয় শুনে সন্ন্যাসীর দুচোখ ক্ষণিকের জন্য কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সেও হয়তো তাকিয়ে দেখছিল আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের এক কিশোর মুখকে। সন্ন্যাসী আমাকে চিনতে পারে। বলে — তুমি এত বড় হয়ে গেছ? চেনাই যায় না। সত্যেন কেমন আছে?
আমি : জ্বী বড়ই হয়ে গেছি। সত্যেন দা ভাল আছে। আপনার এ অবস্থা কেন? এমন সন্ন্যাস রূপ?
নিখিলেশ দা : সে অনেক কথা । তা তুমি এই গোমুখে কয়দিন আছ? কোথায় উঠেছ?
আমি : ভাগিরথী তীরে ‘সাগর গঙ্গা ‘ হোটেলে। আমি এখানে দুই দিন থাকব।
নিখিলেশ দা : তুমি আমার ডেরায় যাবে ?
আমি : চলেন, যাব।
উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীতে অবস্থিত শহর গঙ্গোত্রী। সেখানে রয়েছে মা গঙ্গার মন্দির। ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত সেই মন্দির হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে অন্যতম তীর্থস্থান। হিমালয় পর্বতশ্রেণির ৩,১০০ মিটার উচ্চতায় রয়েছে গঙ্গা মাতার মন্দির। প্রত্যেক বছর অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্য তিথিতে শুরু হয় চারধাম যাত্রা – গঙ্গোত্রী, যমুনেত্রী, বদ্রীনাথ ও কেদারনাথ। খুলে দেওয়া হয় মন্দিরের দ্বার।
যাহোক, আমি নিখিলেশ দার গুহায় চলে যাই। সে এক বিস্ময়কর দৃশ্য ! কেমন যেন ভূতরে পরিবেশ। কেমন যেন মাটির গন্ধ পাচ্ছিলাম। দেখছিলাম সংসার বৈরাগ্য এক নিঃসঙ্গ মানুষকে। চাল নেই। চুলা নেই। আমার এসব দেখে ভালও লাগছিল খুব। এ এক দুঃশ্চিন্তাহীন সুখের জীবন। একসময় কত ইচ্ছা হতো সন্ন্যাস জীবন যাপনে। আজ নিজ চোখে দেখছি, এই সন্ন্যাসব্রত জীবন।
আমি যে দুইদিন এখানে ছিলাম, সে দুইদিন নিখিলেশ দার গুহায় বসে সময় কাটিয়েছি। কখনো পার্বত্য রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছি। কখনও ভাগিরথীর তীরে বসে নিখিলেশ দার জীবনের কথা শুনেছি। আমার জানার খুব ইচ্ছা ছিল, কেনই তিনি বেছে নিলেন তার এই সন্ন্যাস জীবন?
আমার কৌতুহলী মন উদ্গ্রীব ছিল নিখিলেশ’দার কাছ থেকে তার সন্ত্রাস জীবন ধারণের কথা জানবার। তাকে বলেছিলাম, আপনারা যখন শরনার্থী হয়ে এসেছিলেন, সেই সময়ে আপনার তো বয়স ছিল মুক্তিযুদ্ধে যাবার। তা আপনি কেন যাননি মুক্তিযুদ্ধে? আমার এই কথা শুনে তিনি খুব বিমর্ষ হলেন। একটি বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিখিলেশ দা একটি গাঁজার চুরুট ধরালেন। জানালা দিয়ে দেখছিলেন দূরের পাহাড় । কী যেন ভাবছিলেন তিনি। তারপরের কথাগুলো নিখিলেশ দা ‘র মুখ থেকেই শোনা যাক :
বালুরঘাটের অন্তর্গত গঙ্গারাম বাজারে একটি মিষ্টির দোকানে আমি কাজ নেই। আমার কাজ ছিল আশেপাশের গ্রাম থেকে যারা দুধ বিক্রয় করতে আসত, তাদের কাছ থেকে সে দুধগুলো সংগ্রহ করে রাখা এবং কারখানায় কারিগরের সহকারী হিসাবে কাজ করা। এই মিষ্টি দোকানটির মালিক ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ একজন বিধবা মহিলা। নাম ছিল বেনুকা দেবী। আমি ওনাকে মাসী ডাকতাম। উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। অল্প কদিনেই আমি এই কারখানায় বেশ সুনাম করে ফেলি।
একদিন কারখানায় যেয়ে শুনলাম আজ বালুরঘাটে কলিকাতা থেকে স্বাধীন বাংলা শিল্পী সমিতি আসবে গান গাইতে। আমি মালিকানের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বালুরঘাটে চলে যাই । তখন বিকেল হয়েছে। বালুরঘাট স্টেশনের কাছে রাস্তায় খোলা ট্রাকের উপরে দশ বারো জনের একদল ছেলেমেয়ে উদ্দীপনামূলক মুক্তির গান গাইছে। আমি খুব উচ্ছসিত হই গান শুনে। গান শেষ হলে আমি এগিয়ে যাই খোলা ট্রাকটির দিকে। যিনি ঐ দলের নেতা ছিলেন, তাকে বলি : আমি গান গাইতে পারি। আমি আপনাদের গানের দলে যোগ দেব। উনি বলেছিলেন ‘তুমি কলিকাতায় এসো। অবশ্যই তোমাকে আমরা গানের দলে নিয়ে নেব। ‘ শুনেছিলাম ঐ দলের নেতা ছিলেন মাহমুদুর রহমান বেণু। অন্য সদস্যরা ছিলেন, শাহিন মাহমুদ, শারমিন মুরশিদ, নায়লা জামান, বিপুল ভট্টাচার্য, তারিক আলী, লুবনা মরিয়ম, স্বপন চৌধুরী সহ অনেকে।
কিন্তু আমার আর গানের দলে যোগ দেওয়া হয়নি। আমার মালিকান বলেছিল : তুমি চলে গেলে আমি উপোস নেব। আর একটিও অন্ন গ্রহণ করব না। তুমি আর কোনদিন তোমার এই মাসী মাকে দেখতে পাবে না। আরও একজন সেদিন খুব মন খারাপ করেছিল — সে হচ্ছে ফুলমনি সরেন। একজন সাঁওতাল রমণী। বয়স মধ্য তিরিশ। বিবাহিতা, কোনো সন্তান নেই । এই মেয়েটি এখানে মাঝে মাঝে দুধ বিক্রি করার জন্য আসত। খুব বেশি কথা হতো না ওর সাথে। ফুলমনির স্বামী রাঁচিতে থাকত। ওখানে রেলওয়ে স্টেশনের একজন কুলি। এক দুই মাস পর বাড়ি আসত। এসে যে কদিন থাকত সে নাকি রীতিমতো ফুলমনিকে ধর্ষণ করত। আর মারধর করত।
এই ফুলমনিকে বলেছিলাম —- ‘আমি কলিকাতা চলে যাব। গানের দলে যোগ দেব। মুক্তির গান গাইব। অথবা যুদ্ধে যাব। ‘
ফুলমনি : আপনি যাবেন না। আপনি চলে গেলে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাব।
আমি : কোথায় নিরুদ্দেশ হবে তুমি?
ফুলমনি : কত জায়গা আছে। কাশি, গয়া, বৃন্দাবন, না হলে গঙ্গোত্রী গোমুখ। সন্ন্যাসিনী হয়ে ঘুরব মঠে মঠে, মন্দিরে মন্দিরে।
আমি : আমাকে কী তুমি ভালবাসো?
ফুলমনি : জ্বী।
আমি থাকতাম বেনুকা মাসীর কারখানার পিছনে একটি ঘরে। এই ঘরের পিছনে অদূরেই ছিল পুনর্ভবা নদী। যেদিন কোনো কাজ থাকত না, যেদিন কোনো কারণে আমার মন খারাপ লাগত, সেদিন একাকী চলে যেতাম পুনর্ভবা নদীর তীরে। এই নদীর জল বয়ে গেছে আমাদের দেশেও। এপারে পুনর্ভবা, ওপারেও পুনর্ভবা। আজ ফুলমনির কথাগুলো শুনে চিত্ত আমার কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল। চলে যাই পুনর্ভবা নদীর তীরে। নির্জন ছাতিম গাছের তলে বসে দেখছিলাম নদীর জলের কুলকুল ধ্বনি। ভাবছিলাম — ফুলমনিকে কখনও ভালবাসলাম না। প্রাণ খুলে কথা বলিনি কোনদিন। তারপরেও এই সাঁওতাল রমণীটি আমার জন্য কেন নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে? কেন সে আমাকে ভালবাসলো?
মনটা আরও ভাল করার জন্য সন্ধ্যার পরে আমার ছোট্ট রেডিওটি কানের কাছে নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র শুনি। উনি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। চরমপত্রে তাঁর দৃপ্ত উচ্চারণ —– ‘ঘেটাঘ্যাট, ঘেটাঘ্যাট। কি হইলো? কি হইলো? অংপুরের ভুরুঙ্গামারীতে ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়ারা হালাক হইলো। কেইসটা কি?…..”
আমারও যে কী হয়েছিল একদিন কিংবা দুই তিন দিন ফুলমনি না এলে ভাল লাগত না। আমার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড় এই কালো সাঁওতাল মেয়েটির জন্য এমন লাগে কেন? আমি জানি আমার এই ভাললাগা আমার অন্তরের মধ্যেই ঢেকে থাকবে । প্রকাশিত হবে না কোনোদিন। পুনর্ভবা নদীতে সাঁওতাল পুরুষদের দেখেছি পানকৌড়ি শিকার করতে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো না ধনুকের তীর। আমি জানি, যদি বলি — ‘ফুলমনি, আমি তোমাকে ভালবাসি। ‘ শত শত তীর এসে বিদ্ধ হবে আমার শরীরে। রক্তাক্ত হবে পুনর্ভবার জল।’
আমার প্রায়দিনই খুব মন খারাপ লাগত। বেনুকা মাসী বলত ‘তোমার কী হয়েছে নিখিল? ‘ আমি মিথ্যা করে বলতাম, ‘কিছু হয়নি। ভাল আছি।’ আমার অনেক গ্লানি আছে, আমি যুদ্ধে যাইনি। আমার অনেক কষ্ট হয়, আমি গাইনি দেশের জন্য মুক্তির গান। ‘ আমিও গোপনে গোপনে ফুলমনিকে অনেক ভালবাসি। কিন্তু, কখনও ওকে বলিনি —– ভালবাসি।
সেদিন ছিল কার্তিকের অমাবশ্যার রাত। একটু আগে আগেই আটটার মধ্যেই দোকান বন্ধ করে খেয়ে শুয়ে পড়ি। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছিল। কেমন যেন গা ছমছম করছিল। ঘুম আসছিল না চোখে। রাত বেড়েই চলছিল। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পাই। সারা ঘরময় অন্ধকার। শিখা ধরাব কিন্তু দিয়াশলাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আস্তে আস্তে দরজার কাছে যেয়ে বলি —- কে? ওপাশ থেকে উত্তর আসে — আমি ফুলমনি।
তারপরের কিছু কথা নিখিলেশ দা ব্লাকআউট করলেন। আমাকে বললেন না। হয়তো তার চেয়ে বয়সে আমি অনেক ছোট, হয়তো দ্বিধায়, হয়তো লজ্জায়। আমি বুঝতে পারলাম কেন তিনি বললেন না সেইরাতের অনেক কথা। হয়ত অন্ধকার ছিল। হয়তো শিখা জ্বলে উঠেছিল। হয়তো কার্তিকের অমানিশার সমস্ত আঁধার ঢেকে দিয়েছিল নিখিলেশ’দাকে আর ফুলমনিকে। দূরে পুনর্ভবা নদীর জল নিস্তব্ধ ভাবে বয়ে যাচ্ছিল হয়তো গঙ্গা পদ্মা অববাহিকার দিকে।
সেদিন রাতে যে ফুলমনি ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল, এটি জেনে গিয়েছিল ফুলমনির পরিবার। সে যখন ঘরে ফিরে গিয়েছিল তা দেখে ফেলেছিল ওর নন্দিনী। আর ওর নন্দিনী বলে দিয়েছিল, ফুলমনির স্বামীকে। ফুলমনির গোয়ার স্বামী এই ব্যাপারটির জন্য তাকে অনেক মারপিট করেছিল। কিন্তু ফুলমনি স্বীকার করেনি , সে রাতে সে কোথায় গিয়েছিল। এরপর ফুলমনি আর ঘরের বাহির হয় নাই।
এরপর একবারই ফুলমনি আমার ঘরে এসেছিল। সেও একদিন সন্ধ্যা রাতে। খুব হন্যে হয়ে এসে বলেছিল — তোমাকে খুন করে ফেলার ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তুমি এই এলাকা ছেড়ে চলে যাও। আমি ফুলমনিকে বলি — তুমি আমার সাথে চলো, বল্লা মা কালী মন্দিরে। মা দেবীকে স্বাক্ষী রেখে তোমাকে বিয়ে করব। আমরা মন্দিরে চলে যাই। ফুলমনি ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে। এবং ওকে বিয়ে করি। ফুলমনি বলেছিল — আমি এখন ধর্মত তোমার বউ। আমি তোমার কাছেই থাকিব। আমি আর ফিরিয়া যাইব না।
আমি : তা কি করে সম্ভব? তুমি আজ চলে যাও। পরে কোনো একদিন চলে আসিও। ‘
ফুলমনি আর কোনো কথা বললো না। সোজা মন্দির থেকে বের হয়ে চলে গেল।
আমি প্রত্যুষেই পতিরাম শরণার্থী শিবিরে চলে যাই। কাকতালীয় কিনা জানিনা, সেদিন ছিল ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে খবর পাই, আমাদের বিজয় হয়েছে। গান বাজছে বেতারে —-
‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল
জোয়ার এসেছে জন-সমুদ্রে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল।।
বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল,
হয়েছে কাল, হয়েছে কাল, হয়েছে কাল।’
আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। আতিশয্যে ভুলে যাই ফুলমনিকে। স্বাধীন দেশ, বিজয়ের দেশ দেখার জন্য মন প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে। শিবিরে শিবিরে সেকি আনন্দ উৎসব সেদিন। সারি সারি নৌকায় পাল তুলে পুনর্ভবা নদী দিয়ে আমরা পরের দিনই হলুদ মানচিত্র খচিত লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে বাংলাদেশে চলে আসি।
আমি নিখিলেশ’দাকে বলি — ফুলমনি র কী হলো? আর আপনি কেন এখানে, এই গঙ্গোত্রী গোমুখে? কেনই এই সন্ন্যাস রূপ? নিখিলেশ দা ৰলেছিল —‘ আমি পতিরামে যেয়ে একবার ফুলমনির খোঁজ নিয়েছিলাম। শুনেছি সে নিরুদ্দেশ হয়ে কোথায় চলে গেছে। ‘ফুলমনি একদিন বলেছিল — ‘কত জায়গা আছে। কাশী, গয়া, বৃন্দাবন, না হলে গঙ্গোত্রী গোমুখ। সন্ন্যাসিনী হয়ে ঘুরব মঠে মঠে, মন্দিরে মন্দিরে। ‘
সেই কতকাল ধরে আমিও কাশী, গয়া, বৃন্দাবন, এই গঙ্গোত্রী গোমুখে সন্ন্যাসী হয়ে ঘুরছি। খুঁজছি হতভাগী ফুলমনি’কে। এখনও কোথাও ওর দেখা পাইনি।’
১৫. দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা
আজকের এই শীত আর কুয়াশা দেখে মনে পড়ল অনেক দিন আগের এক শীতের কথা। এমনই সেদিন শীত ছিল। এমনই শৈত্য প্রবাহ বয়ে এসেছিল হিমালয় পর্বতের গিরি শৃঙ্গ থেকে। উত্তরের জনপদ পঞ্চগড়ের আকাশে সেদিন ধবল মেঘ উড়ছিল তুলোর মতো। শরীর মন হিম শীতল হয়ে গিয়েছিল রাতের ট্রেন জার্নিতে। শীতে কাঁপতে কাঁপতেই আমি ও আমার এক সহকর্মী সেদিন সকালে ট্রেন থেকে নেমেছিলাম স্টেশনে। একটি রিক্সা নিয়ে শীতে জড়সড় হয়ে যেয়ে উঠেছিলাম ডাকবাংলোতে। সরকারি একটি প্রকল্প কাজের মূল্যায়নের জন্য ওখানে আমাদের যেতে হয়েছিল। আমরা সেখানে তিনদিন ছিলাম।
আমার সেই সহকর্মীটির নাম ছিল রুহুল আমিন। আমরা দুজন আবার বন্ধুও ছিলাম। একই সাথে ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম । আমি পড়তাম বাংলাতে। আমার বন্ধুটি পড়ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। আমি রুশপন্থী সমাজতন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলাম। ও ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিশ্বাসী রাজনীতিতে। আমাদের দুজনের রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই থাক, সরকারি চাকুরিতে যোগদানের পর আমরা আর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম না। আর আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব ছিল অমলিন। রাজনৈতিক বিশ্বাস কখনও বন্ধুত্বের সম্পর্ককে নষ্ট করতে পারেনি।
একই সময়ে আমাদের সাথে দর্শন বিভাগের একটি মেয়ে চাকুরীতে যোগদান করেছিল। ওর সাথে আমাদের দুজনের আগে থেকে কোনো পরিচয় ছিল না। মেয়েটির ডাক নাম ছিল তিথি। এই তিথির সাথে আমাদের দুই বন্ধুরই সখ্যতা গড়ে ওঠে। তবে কোনো প্রেমের সম্পর্ক কারও সাথে নয়। না আমার সাথে, না রুহুল আমিনের সাথে। তবে মেয়েটাকে আমার যে ভাল লাগত না,তা নয়। মনে হতো এই মেয়ের সাথে প্রেম করলে ভালই হবে। কেমন যেন শেষের কবিতার লাবণ্যর মত চেহারা ছিল ওর। ঐরকমই মায়াভরে কথা বলত আমাদের সাথে। ওর টানা টানা চোখ আমার চোখকে টানত। আর একটি গুণ ছিল তিথির, তাহল খালি গলায় সে ভাল রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারত।
একদিন বিকালে ছুটির পরে শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত আমাদের অফিস থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা তিনজন চলে এসেছিলাম সংসদ ভবন চত্বরে। ওখানে সবুজ ঘাসের উপর বসে আমরা সন্ধ্যা অবধি অনেক কথাই বলেছিলাম। সেদিন আমাদের একটি গান শুনিয়েছিল তিথি। অসাধারণ দরদ দিয়ে গেয়েছিল গানটি —–
‘শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়,
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো।
সারা পথের ক্লান্তি আমার সারা দিনের তৃষা
কেমন করে মেটাব যে খুঁজে না পাই দিশা—
এ আঁধার যে পূর্ণ তোমায় সেই কথা বলিয়ো।’
মাঝে মাঝেই কেমন যেন উদাস হতো মন। কেমন যেন স্বপ্নের ঘোরের মতো লাগত নিজেকে। একাকী পথ চলতে পা অবশ হয়ে আসত। রাতে শুয়ে থেকে অন্ধকারে চোখ বন্ধ করে ভাবতাম, তিথি যদি আমাকে ভালবাসত, যদি কোনো ক্লান্ত দুপুরে উদাস দুটি চোখ মেলে তাকিয়ে আমাকে বলত —– ‘তোমাকে আমি ভালবাসি। ‘ এসব ভাবতে ভাবতে ঘুম চলে আসত দুচোখে। স্বপ্নের ভিতরে চলে আসত তিথি আমার কাছে। কখনও সে প্রেমিকা হয়ে, কখনও বউ হয়ে। স্বপ্নের এই পাওয়ার আবেশ নিয়ে আমি প্রতিদিন অফিসে যেতাম। দেখতাম পরম বিস্ময় চোখে তিথিকে। দেখে আমার মন খারাপ হয়ে যেত — মনে হতো তিথি তো আমার বউ নয়। প্রেমিকাও নয়।
শীতের হিম শীতল আমেজ নিয়েই আমাদের পঞ্চগড়ের কাজগুলো শেষ করে ফেলি। আমাদের দুজনেরই খুব সাধ হলো, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার। তাই তেঁতুলিয়া চলে যাই। তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরে একটি ঐতিহাসিক ডাক বাংলো আছে। মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষা ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন সুউচ্চ গড়ের উপর সাধারণ ভূমি হতে প্রায় ১৫ হতে ২০ মিটার উচুতে বাংলোটি অবস্থিত। উক্ত স্থান হতে হেমন্ত ও শীতকালে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আমরা এই ডাক বাংলোতেই সেই রাতে অবস্থান করেছিলাম।
আমরা যখন তেঁতুলিয়া পৌঁছি তখন বিকাল হয়েছিল। বিকেলেই আমরা ভজনপুর ও তেঁতুলিয়া মধ্যবর্তী বুড়াবুড়ি নামক স্থানে একটি দূর্গের ভগ্নাংশ, ভদ্রেশ্বর মন্দির, শিবমন্দির ও গ্রিক ভাস্কর্ষ রীতিতে নির্মিত দুটি সমাধি স্তম্ভ দেখতে যাই। থানার সীমানা ঘেসে চলে যাওয়া মহানন্দা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে খুব ভোরবেলা কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত নাকি খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়।
রাতে ডাকবাংলোতে একই খাটে দুই বন্ধু পাশাপাশি শুয়ে আছি। শুয়ে শুয়েই বলছিলাম দুজন দুজনের কথা। দুজনের জীবনের অনেক সুখ দুঃখ প্রেম বিরহের কথা। অনেক কথাই বলতে বলতে রুহুল আমিন বলছিল —- ‘তোকে একটা কথা বলব। ‘
আমি : বল্, কী কথা?
রুহুল : আমরা যেদিন পঞ্চগড় আসি, তার আগের দিন তিথি আমাকে ডেকে নিয়ে নিবেদন করে বলেছে — ‘আমি তোমাকে ভালবাসি। ‘
রুমের ভিতরে তখন অন্ধকার বিরাজ করছিল। একে অপরের মুখ চোখ কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। হঠাৎ আমার মুখটি বিষাদে ছেয়ে গেল। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। কন্ঠ কেমন যেন রোধ হয়ে আসছিল। এসবের কিছুই রুহুলকে বুঝতে দিলাম না। আঁধারে লুকিয়েই রুহুলকে বললাম —- ‘ভাল তো! তুই খুব ভাগ্যবান। তিথির মত একটি সুন্দরী মেয়ে তোকে ভালবাসে। ‘
রুহুল : আমার ধারণা ছিল তিথি তোকে ভালবাসবে। তুইতো অনেক সুন্দর করে কথা বলিস। তুই অনেক ভাল ছেলে।
আমি : আরে, না। আমাকে ভালবাসবে কেন? আমার কী তোর মত এত ঐশ্বর্য আছে?
তারপর সেই রাতে ডাকবাংলোতে আমাদের মাঝে আর বেশি কথা হয় নাই। বেশি কথা বলতেও পারছিলাম না। একটু পর দেখি, রুহুল ঘুমিয়ে গেছে। আমার চোখে আর ঘুম আসছিল না। রাতের আঁধার ভেদ করে দৃষ্টি আর বেশি দূরে কোথাও যেতে চায়নি। মনে হচ্ছিল কেবল সেই চিরন্তন সত্য কথাটাই — ‘কেউ চেয়ে পায় না, কেউ না চেয়েই পায়। ‘
সব আঁধার সরে যেয়ে একসময় ভোর হয়। আমরা দুজন হেঁটে হেঁটে চলে যাই মহানন্দা নদীর তীরে। নদীর ওপারে ভারত। দূরে তাকিয়ে দেখি — হিমালয়ের সুদৃশ্য কাঞ্চনজঙ্ঘা। শৃঙ্গে তার ধবল মেঘ তুলোর মত উড়ছে। এত সুন্দর মোহনীয় দৃশ্য দেখে মনটি ভাল হওয়ার কথা, কিন্তু ভাল হলো না। কেমন যেন ঝিরিঝিরি শৈত্য প্রবাহের জল এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল আমার চোখ মুখ। ভেজা চোখের দৃষ্টিতেই দেখছিলাম অনেক দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা। ঘন কুয়াশায় সেদিন কেউ দেখতে পায়নি আমার ভেজা চোখ। রুহুল আমিনও না।
১৬. পদচিহ্ন পড়ে আছে
মেয়েটি প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে জিমনেসিয়াম মাঠে চলে আসত। মাঠে এসে পুরো মাঠটি দৌড়ে চার পাঁচবার প্রদক্ষিণ করত। তারপর মাঠের সবুজ ঘাসের উপর বসে যোগ ব্যায়ামের মতো করে রিলাক্স করে আবার হেঁটে হেঁটে সে বাড়ি চলে যেত।
আর একটি ছেলে। সেও প্রতিদিন আসত মাঠে। গাঢ় নীল রঙের জীন্স প্যান্ট পরত আর গায়ে থাকত টি সার্ট। একেক দিন একেক রঙের টি সার্ট পড়ে সে আসত। কিন্তু সে কখনো ব্যায়াম কিংবা দৌড়াদৌড়ি করত না। সে স্বাভাবিক হাঁটাহাঁটি করত।
দুইজনই স্লার্ট তরুণ তরুণী। প্রথম প্রথম দুজন দুজনকে ফলো করত, কথা হতো না কারোর সাথে। কিন্ত কথা বলতে মন চাইত দুুজনেরই। ছেলেটির ভাবনা ছিল এই রকম :
‘তুমি বেণী বেঁধে আসো না কখনো। আবার মাথার চুল ছেড়েও রাখো না। কাঁটা দিয়ে খোপা বেঁধে রাখো প্রতিদিন। কখনও তুমি চোখ মেলে দেখ ভোরের আকাশ। আবার আলো ঝরানো সূর্যও দেখ তুমি। তুমি কেন একবারও নয়ন ভরে আমার দিকে তাকাও না। একবার যদি দেখ বুঝতে পারতে, এই চোখে তোমার জন্য কত ভালো লাগা লেগে আছে।’
মেয়েটিও ভাবত ছেলেটির কথা। নিজের কাছেই নিজেকে বলত :
‘তুমিতো ছেলে মানুষ। হাঁটছো সবুজ ঘাসের উপরে। মনে হয় যেন কোনও স্বপ্ন নেই। তুমি রাজপুত্তুরের মতো অহংকার করো কেন? আমি যে স্বপ্ন মেলাতে চাই তোমার চোখে। হেঁটে হেঁটে যখন বাসায় চলে যাই। তখন পিছনে তোমাকে রেখে আসতে মন চায় না। তুমি একটিবার কাছে এসে তো বলতে পারো — ‘তোমার নাম কি? ‘ কিছুই বলো না তুমি। তোমার সাথে কথা বলার দায় কি শুধু আমার?’
কত সকাল চলে গেছে চুপিসারে অপলক দৃষ্টিতে। কত সকালের এলমেল হাওয়া দুজনের মনকে উতলা করেছে। আকুল হয়ে কাছে চলে এসেছে কথা বলবে বলে দুজন। কিন্তু কোনও কথাই বলা হয়নি।
ঠিক একদিন কাকতালীয় ভাবে ঘটল ঘটনাটি । মেয়েটি মাঠে দৌড়ানোর সময়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় ছেলেটির সামনে। জুতোর ভিতরে মোচড় লাগে পায়ে। মেয়েটি ব্যাথায় কাতরাচ্ছিল। ছেলেটি কাছে এগিয়ে যায়। মেয়েটির জুতার ফিতেগুলি খুলে দেয়। এবং পা তার হাঁটুর উপর রেখে ম্যাসেজ করে দেয়।
কিছু সময় পরে ছেলেটি মেয়েটিকে বলে — কেমন লাগছে এখন?
মেয়েটি : বেশ ভালো লাগছে! অনেক ধন্যবাদ।
ছেলেটি : ওয়েলকাম। কি নাম তোমার?
মেয়েটি : নাওমি। তোমার?
ছেলেটি : রাহুল।
বাসায় আসার পর নাওমির পা বেশ ফুলে যায়। এত যে ব্যথা পেয়েছিল মাঠে তা বুঝতে পারেনি। ডাক্তারের পরামর্শে এক মাসের জন্য পা প্লাস্টার ব্যান্ডেজ করে রাখতে হয়। বাড়ির বারান্দায় বেশির ভাগ সময় ইজি চেয়ারে বসে থাকতে হয় তাকে। মন তার উদাস হয়ে চলে যায় জিমনেসিয়াম খেলার মাঠে। ভাবে সে :
‘তুমি তো প্রতিদিন আসো ঐ মাঠে। সবুজ ঘাসের উপর হাঁটো যখন, তখন কি তুমি আমাকে খুঁজো সেই আগের মতোই। আমি উন্মেলিত চোখে চেয়ে থাকি এখনও তোমার দিকে। হলুদ রঙের টি সার্ট তোমাকে কী যে মানায়! আমার নরম হাতের পাঁচ আঙুলের স্পর্শ দিতে চায় তোমার বুকের পাঁজরে। আমার ভালো লাগে না কোনও কিছুই। মনে হয় সব ব্যান্ডেজ টেনে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেই।’
ছেলেটি এরপর প্রায় প্রতিদিনই মাঠে আসত। ছোট ছোট পা তুলে সবুজ ঘাসের উপর সে হাঁটত। হাঁটতে হাঁটতেই খুঁজত নাওমিকে। কিন্তু নাওমি আর অাসে না। হঠাৎ ভ্রান্তি তারও হয় :
‘ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসে উড়ছে তোমার মাথার চুল। তুমি দৌড়ে দৌড়ে চলে আসছ, রাজপথ থেকে মাঠে। তুমি দৌড়ে যেন আসছ আমার দিকেই। বুকে জড়িয়ে নাও আমাকে। পাঁজরের নীচে তোমার ঘামের গন্ধ পাই। আবেশে আমি দুইচোখ বন্ধ করি। আবার যখন চোখ মেলে ধরি, দেখি কোথাও তুমি নেই। সারা মাঠ খুঁজে ফিরি। শুধু শূন্য মাঠ পড়ে থাকে ঘাসের উপরে।’
পরপর দশ পনেরো দিন ছেলেটি মাঠে এসেছিল। কোনও দিনই সে নাওমির দেখা পায় নাই। তারপর সপ্তাহ খানেক সে আর আসে নাই। তারপর সে আর একদিনই এসেছিল মাঠে। সেদিনও একাকী হাঁটছিল সবুজ ঘাসের উপর। পরনে ছিল হলুদ রঙের টি সার্ট। একটু হাঁটার পরই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। বসে পড়ে ঘাসের উপরে। রোদ্রকরোজ্জ্বল সকাল ছিল সেদিন । সেদিনও সেই ভোরের আলোয় ছেলেটির বিষণ্ন চোখ খুঁজছিল নাওমিকে।
যে ছোট্ট মেয়েটি প্রতিদিন বকুল ফুলের মালা বিক্রি করত, সেই মেয়েটি আজও এসেছে মাঠে। রাহুল মেয়েটিকে ডেকে কাছে আনে। ওর কাছ থেকে একটি মালা নেয়। মালাটি নিয়ে ওর হাতে পাঁশশত টাকা দেয়। মেয়েটি বলে : আমার মালার দাম দশ টাকা। আপনি এত টাকা দিলেন কেন?
রাহুল : আমি তোমাকে মালার দাম দেই নাই। তুমি আমার ছোট বোনের মতো, তোমাকে এমনি এই টাকা দিলাম। তুমি একটি জামা বানিয়ে নিও।
নতুন জামা হবে এ কথা মনে করে মেয়েটি খুশিই হয়। রাহুল তারপর বলে —
‘ একটি মেয়ে যে প্রতিদিন এখানে দৌড়াতে আসে ওকে তুমি চিনো ?’
মেয়েটি : নাওমি আপুর কথা বলছেন? চিনি তো।
রাহুল পকেট থেকে খামের ভিতরে রাখা একটি চিঠি আর বকুল ফুলের মালাটি মেয়েটির হাতে দিয়ে বলে —
‘ দেখা হলে এগুলো তুমি তোমার নাওমি আপুকে দিয়ে দেবে। ‘
তারও একমাস পরে নাওমি একদিন আস্তে আস্তে হেঁটে মাঠে চলে আসে। সেদিন আর সে দৌড়াচ্ছিল না। হাঁটছিল সে ঘাসের উপর। খুঁজছিল এদিক ওদিক তাকিয়ে রাহুলকে। হেমন্তের সকালে কত শিশির পড়ে আছে এই ঘাসের উপরে । কিন্তু কোথাও রাহুলের পায়ের চিহ্ন নেই। মালা বিক্রি করা সেই মেয়েটি নাওমির কাছে এগিয়ে আসে। ওর জীর্ণ ব্যাগের ভিতর থেকে একটি শুকনো বকুল ফুলের মালা আর চিঠিটি নাওমির হাতে দিয়ে বলে — ‘এগুলো রাহুল ভাইয়া দিয়েছে আপনাকে দেবার জন্য। ‘
বাসায় এসে খামের ভিতরে থেকে চিঠিটি বের করে পড়তে থাকে নাওমি —
‘এই চিঠি তুমি পাবে কিনা জানিনা। যদি পাও তখন আমি সুদূর ভিয়েনায় থাকব। বাবার সাথে কিছু দিনের জন্য ঢাকা এসেছিলাম, আমার ফুপিকে দেখতে। আমি নাকি মায়ের মুখ দিখি নাই। এই ফুপিই আমাকে লালন পালন করেছে। কাল চলে যাচ্ছি ভিয়েনায়। ওখানে আমি বাবার সাথেই থাকি। বাবা একা মানুষ। মা মরে যাবার পরে বাবা আর বিয়ে করেনি।
তোমার কথা আমার খুব মনে পড়বে। জানো, তোমার পায়ে নুপুর পরাতে খুব ইচ্ছা করেছিল। যে পায়ে তুমি ব্যথা পেয়েছিলে। আর কন্ঠে পরাতে ইচ্ছা করে আমার মায়ের রেখে যাওয়া মণিহার। এই ইচ্ছা গুলো স্বপ্ন হয়েই রইল।
কোনও বিষণ্ন বিকেলে দানিয়ুব নদীর তীরে আমি হয়ত হাঁটব একাকী। ওখানে আছে এমনি সবুজ ঘাস। তোমার কথা মনে পড়বে। ওখানেও সন্ধ্যা নামে। ওখানেও চাঁদ ওঠে। ওখানেও তারা জ্বলে আকাশে। তোমাকে হয়ত খূঁজব সেই সব তারাদের নিবিড় অন্ধকারে।
যদি পারো একবার ফোন করো এই নাম্বারে।
+431972389.
——- রাহুল। ‘
নাওমির চোখ অশ্রু সজল হয়ে ওঠে। ডায়াল করে এই নাম্বারে +431972389. ওপাশ থেকে ধরে রাহুলের বাবা। বলে — কাকে চাচ্ছেন? ‘
নাওমি : রাহুলকে। আমি ওর বন্ধু।
রাহুলের বাবা : তুমি হয়ত এখনও জানো নাই — বাংলাদেশ থেকে আসার দুই দিন পরেই ওকে হাসপাতালে ভর্তি করি। ওর হার্টের দুটো বাল্বই অকেঁজো ছিল। পেসমেকার পরানো ছিল। হঠাৎ সেখানে অধিক রক্ত ক্ষরণ হতে থাকে। আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে ছিল সাত দিন। তারপরেও ওকে আর বাঁচানো যায়নি। চলে গেছে আমাকে ছেড়ে।
রাহুলের বাবা বলছিল — ‘তোমার নাম কি মা?’
নাওমি : নাওমি।
রাহুলের বাবা : ওহ! তুমি তাহলে নাওমি! ডাক্তার বলেছিল, আইসিইউ তে অজ্ঞান অবস্থায় তিনজনকে নাকি রাহুল ডেকেছিল। এক. ওর ফুপিকে, দুই. আমাকে আর তিন, নাওমিকে।
রাহুলের বাবা ওপাশ থেকে নাওমির কান্নার শব্দ ছাড়া অন্য কোনো কথা আর শুনতে পায় নাই।
১৭. কে এই অভাগী?
অনেক দিন আগের কথা। এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা রাতে জয়দেবপুরের রাজেন্দ্রপুর রেল স্টেশনে অপেক্ষা করছিলাম একটি লোকাল ট্রেনের জন্য। তখন বাসের যোগাযোগ এত ভাল ছিল না। ঢাকা আসার জন্য ট্রেনই ছিল একমাত্র ভরসা। চারদিকে শালবন বেষ্টিত এই স্টেশনটি সেই বৃষ্টির সন্ধ্যা রাতে ছিল প্রায় জনমানবহীন। ডাউন ট্রেন তাই লোকজনের অতো সমাগম ছিল না। অল্প কজন যাত্রী এলোমেলো ভাবে ঘোরাফেরা করছিল।
স্টেশন মাস্টারের কাছে খবর নিলাম। ট্রেন আসতে অনেক দেরি হবে। ট্রেন নাকি তখনও গফরগাঁও অতিক্রম করেনি। স্টেশনটিতে আলোর তেমন ঔজ্জ্বলতা ছিল না। সব মিলে তিন চারটি বাল্ব টিমটিম করে জ্বলছিল। গুরিগুরি বৃষ্টি ঝরছিল। রাত আটটা বেজে যায়, সাতটার ট্রেনের তখনও খবর নেই।
প্লাটফর্মের পূর্ব পাশে ছোট্ট চার দোকানের বেঞ্চে বসে চা আর সিগারেট খেয়ে সময় পার করছিলাম। হঠাৎ দেখি, পশ্চিম পার্শ্বে বিশ্রামাগারের ভিতর থেকে একটি বিশ একুশ বছরের মেয়ে বের হয়ে রেল লাইন ক্রস করে চায়ের দোকানের কাছে চলে আসছে। সে কখন বিশ্রামাগারে এসে বসেছিল খেয়াল করিনি। তার পরনে ছিল সালোয়ার কামিজ। মেয়েটিকে দেখে মনে হলো সে নিম্ন বিত্ত ঘরের মেয়ে হবে । তার চোখ মুখ খুবই বিমর্ষ লাগছিল।
আমার একটি লাজুক স্বভাব, কোন মেয়ের দিকে সরাসরি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। আরও একটি অভ্যাস কোন অপরিচিত মেয়ের সাথে আগ বাড়িয়ে কোন কথাও বলি না। দেখলাম — মেয়েটি চায়ের অর্ডার দিল। এবং চা খেতে খেতে মেয়েটি আমাকে বলছিল — কোথায় যাবেন আপনি?
আমি : তেজগাঁও, ঢাকা। বললাম, আপনি কোথায়.
যাবেন?
মেয়েটি : পিয়ারপুর। ময়মনসিংহ। অথবা অন্য
কোনো স্টেশনে।
আমি : কখন আসবে আপনার ট্রেন?
মেয়েটি : এখন কোন ট্রেন নেই। ভোর চারটায় ট্রেন ।
আমি : এতক্ষণ কী করবেন?
মেয়েটি : জানিনা, কি করব।
আমি : বাড়িতে ফিরে যান।
মেয়েটি : এখানে আমার বাড়ি নেই। এখানে কেউ নেই।
মেয়েটির অসহায়ত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে একটু চিন্তাই করছিলাম। ভাবছিলাম, এই বৃষ্টি ঝঞ্ঝা রাতে মেয়েটি একাকী এই স্টেশনে বসে থাকবে? একটু পর এই স্টেশন আরও জনশূন্য হয়ে যাবে। চায়ের দোকানটাও বন্ধ হয়ে যাবে। একটু চিন্তাই লাগছিল। মেঘাচ্ছন্ন আলো আঁধারে স্টেশনের পূর্ব পার্শ্ব ধরে আমি ও মেয়েটি হাঁটছিলাম। বলছিলাম — এখানে কোথায় এসেছিলেন?
মেয়েটি : আজই এখানে এসেছিলাম। যার কাছে এসেছিলাম সে এখানে নেই। এখানে সে থাকে না। সে কোনদিন এখানে ছিলও না। আমি ঘর ত্যাগ করে তার কাছে সারা জীবনের জন্য চলে এসেছিলাম। এসে বুঝতে পারলাম, আমি প্রতারিত হয়েছি।
আমি : যার কাছে এসেছিলেন উনি আপনার কী হয়?
মেয়েটি : কিছু হয়না। উনি আমার কেউ না।
আমি : এই যে বললেন, ওনার কাছে সারা জীবনের জন্য ঘর ছেড়ে চলে এসেছিলেন।
মেয়েটি : সে অনেক দুঃখের কথা।
স্টেশনের অদূরে দেখি, সবুজ সিগন্যাল বাতিটি জ্বলে উঠেছে। আমি মেয়েটিকে বললাম — ঢাকা যাবার ট্রেনটি বোধহয় চলে আসছে। আপনি এখানে খুব একা হয়ে যাবেন। ভোর চারটে হতে এখনও অনেক দেরি । একাকী এই স্টেশনে অপেক্ষা করতে ভয় পাবেন না তো?
মেয়েটি : আমাকে সাথে করে এক রাতের জন্য আপনার বাড়িতে নিয়ে যাবেন? কাল সকালেই চলে আসব।
আমি ভিতরে ভিতরে একটু বিব্রত হলাম। নতুন বিবাহ করেছি। এই রাতদুপুরে একটি অপরিচিত যৌবনবতী মেয়েকে নিয়ে বাসায় হাজির হবো, আমার নব পরিনীতা স্ত্রী কী ভাববে? এই কথা ভেবে মেয়েটিকে বললাম — তা সম্ভব হবে না। আপনাকে সাথে নিয়ে গেলে আমার নতুন সংসারে অমঙ্গল হবে।
মেয়েটি বলল, ও আচ্ছা। ঠিক আছে। আমি একাই এখানে এই স্টেশনে থাকতে পারব। আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
আমি মেয়েটিকে স্টেশনের এই পাশে রেখে ওপাশে টিকিট ঘরের দিকে এগিয়ে যাই। টিকিট কেটে এসে স্টেশনের এই পাশেই দাঁড়িয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। তখনও ট্রেনটি আসেনি।
তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছিল। আলো আঁধারে মনে হচ্ছিল রেল লাইনের ওপাশ থেকে মেয়েটি আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। কেন জানি মেয়েটির জন্য খুব মায়া হলো। মনে হলো এই মেয়ে যদি আমার প্রেয়সী হতো তাহলে ঠিকই তো আজ আমি ওকে আমার ঘরে নিয়ে যেতাম। ও আমার প্রেমিকা না হোক, পথের একটি অসহায় মেয়েকে আমার ঘরে এক রাতের জন্য স্থান দিলে কী এমন ক্ষতি হবে? আমার নব বধূকে না হয় ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলব।
দেখি ট্রেনটি স্টেশনের দিকে চলে আসছে। ওপাশে মেয়েটি তখনো আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি এপাশ থেকে মেয়েটিকে ইশারায় বললাম — ‘তুমি এই ট্রেনেই উঠবে। আমার সাথে ঢাকা যাবে।’
ট্রেনটি স্টেশনে এসে থামে। ট্রেনের আড়াল হয়ে যায় মেয়েটি। আমি ট্রেনে উঠে পড়ি। ওপাশে তাকিয়ে দেখি, মেয়েটি দাঁড়ানো নেই। ভাবলাম, ট্রেনের কোন কামড়ায় হয়ত সে উঠে পড়েছে। স্টেশনের বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। একটু পরে ট্রেনটি বৃষ্টি আর রাতের অন্ধকার ভেদ করে ঢাকার দিকে চলে আসতে থাকে।
তেজগাঁও স্টেশনে নেমে আবারও খুঁজলাম মেয়েটিকে। কোন কামড়া থেকেই সে আর নামল না। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। ঢাকার রাতের আকাশে কোন মেঘ নেই। নিয়ন আলোয় আলোকিত হয়ে আছে রাজপথ। স্টেশন থেকে একটি রিক্সা নিয়ে নাখাল পাড়ায় আমার বাসায় চলে আসি।
তারও একদিন পরে ইত্তেফাকের তৃতীয় পাতায় একটি নিউজ হেডিং দেখতে পাই — ” কে এই অভাগী? ” ভিতরে ছোট করে খবরে লেখা ছিল — ‘ গত পরশু রাত সাড়ে নয়টার দিকে রাজেন্দ্রপুর স্টেশনের কাছে ঢাকাগামী একটি লোকাল ট্রেনের নীচে কাটা পড়ে বিশ একুশ বছরের অজ্ঞাতনামা একটি মেয়ে মারা গিয়েছে। জিআরপি পুলিশ লাশটির ময়না তদন্তের জন্য জয়দেবপুর সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে। ময়না তদন্তে জানা যায় মেয়েটি দুই মাসের অন্তসত্তা ছিল। এ ব্যাপারে জয়দেবপুর সদর থানায় একটি মামলা রজ্জু করা হয়েছে। ‘
তারপর কত বছর চলে গেছে। ঐ মেয়ের কথা কখনও মনে পড়ে, কখনও পড়ে না। কিন্তু এখনও কোন ট্রেনের চাকার ঘস্ ঘস্ শব্দ শুনলে ঐ অভাগী মেয়েটির আর্তনাদ আমি শুনতে পাই। কানে বাজে একটি মিনতি — ‘আমাকে একটি রাতের জন্য সাথে করে নিয়ে যাবেন আপনার বাড়িতে? ‘
১৮. আকাশ প্রদীপ জ্বলছে
তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবেমাত্র স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পূর্ণ করেছি। কোথাও কোনো চাকুরী হয় নাই। হলেই থাকি। আমার এক পরিচিত বন্ধুর রেফারেন্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের গবেষণা কাজে সহায়তা করার জন্য সাময়িক ভাবে তাঁর ওখানে যোগ দেই। বান্দরবানের শঙ্খ নদীর তীরে বসবাসরত মানুষদের আর্থ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক জীবন ধারার উপর উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। আমাকে এ কাজের জন্য ওখানে এক মাসের মতো থাকতে হবে।
আমি চলে যাই বান্দরবানে। ছিমছাম ছোট এই পাহাড়ি শহরের একটি পুঞ্জিতে এক বৃদ্ধার বাড়িতে এক মাসের জন্য একটি রুম ভাড়া নেই। বৃদ্ধার দশ বারো বছরের একটি নাতি ছাড়া আর কেউ ছিল না। স্বামী আগেই গত হয়েছিল। ছেলে, ছেলে বউ দুজনেরই অকাল মৃত্যু হয়েছে। একমাত্র নাতিকে নিয়েই সে এই বাড়িতে থাকে। আমি এখানে নিজেই টুকটাক রান্না করে খেতাম। আবার মাঝে মাঝে রাস্তার উপরে কুসুমেন্দু মং এর পাতার ছাউনির হোটেলেও খেতাম।
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা উচ্ছল ছলছল এক তরুণ। হঠাৎ এমন নৈসর্গিক জায়গা পেয়ে উচ্ছসিত হয়ে যাই। পাহাড়, বনরাজি, মানুষ আর নদীর কাছে আমার সকল বিমুগ্ধতা বিলিয়ে দেই। প্রথম দিনই আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই শঙ্খ নদীর তীর ধরে পাইনছড়াতে। আঁকাবাঁকা সর্পিল বনপথ ধরে যখন একাকী চলছিলাম, দেখি লালচে একটি ভালুক হাঁটছে শঙ্খ নদীর তীর ধরে। আবার দেখি একটি গয়াল বন থেকে বের হয়ে নদীতে জল খেতে যাচ্ছে। পথের পাশে নাগলিঙ্গম গাছে কতোগুলো হনুমান এ ভাল ও ডালে লাফালাফি করছে। এসবই দেখে আমি মুগ্ধ হই। চলতে চলতে পথে আকাশের দিকে চেয়ে দেখি আকাশের নীল। অরণ্য, পাহাড়,পাখপাখালি, নদী, জীবজন্তু — এসব দেখার মুগ্ধতা নিয়েই আমি এই বনভূমিতে কাজ করতে থাকি।
আমার উদ্দেশ্যই ছিল এখানকার মানুষদের জীবন যাত্রাকে দেখা, তাদের জীবন আচার, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় উৎসব পর্যবেক্ষণ করা। এই এলাকা বা পুঞ্জীটি ছিলো মারমা উপজাতীয় প্রধান। আমি দেখছিলাম এইসব মানুষদেরই জীবন। তাদের প্রতিদিনের হাসি কান্না সুখ দুঃখ। এদের সাথে কথা বলে আমার প্রশ্ন সম্পর্কিত উত্তরগুলো টুকে নিতাম নির্দিষ্ট প্রশ্নমালায়।
একদিন পানছড়াতে যাবো বলে শঙ্খ নদীর পারের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে পথে পা আমার থেমে যায়। হঠাৎ কেন এই পথের মাঝে থেমে যাওয়া? জলের দিকে তাকিয়ে দেখি তীব্র স্রোত বয়ে চলেছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। সেই নিঝুম নিরালায় মন আমার উদাস হয়ে উঠল। বাসা থেকে চলে এসেছি তখন অনেকটা দূর। ভাবনায় কিছু স্বপ্নের মৃত্যু হতে দেখলাম। মন খারাপ হয়ে গেল। পথ চলতে আর মন চাইল না। মনে হচ্ছিল, যে মায়াবি চোখ আমি দেখে এসেছিলাম ঘর থেকে বের হওয়ার সময়। সেই মলিন চোখ কি কাঁদছে কারোর জন্য? মন চাইল, ফিরে যাই ঘরের দিকেই। দেখি যেয়ে ঐ মেয়েটিকে আবার।
সত্যি সত্যি ফিরে এলাম বাড়ির দিকে। কাঠের দোতলার বারান্দায় দাঁড়ানো যে মেয়েটিকে দেখে গিয়েছিলাম, সে তখন আর সেখানে দাঁড়ানো নেই। আমি চলে আসি আমার রুমে। ঢাকা থেকে আসার সময় কিছু বই নিয়ে এসেছিলাম। সেই বইগুলো থেকে পড়ছিলাম যাযাবরের দৃষ্টিপাত। পড়তে পড়তে যেখানে শেষ করেছিলাম, সেখান থেকে পড়া শুরু করি — ‘পরিহাসকে মনে করেছি প্রেম; খেলাকে ভেবেছি সত্য। কিন্তু আমি তো একা নই। জগতে আমার মতো মুর্খরাই তো জীবনকে করেছে বিচিত্র; সুখে দুঃখে অনন্ত মিশ্রিত। তাদের , ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবি রচনা করেছেন কাব্য, সাধক বেঁধেছেন গান, শিল্পী অঙ্কন করেছেন চিত্র, ভাস্কর পাষাণখণ্ডে উত্কীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষমা ।’
পড়তে পড়তে বুকের উপর বই রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। সারা দিনের কোনো ক্লান্তি ছিল না আজ। তবুও ঘুমালাম। জীবনের শুরুতে নাকি মানুষ বেশি করে স্বপ্ন দেখে। ঘুম ভাঙ্গার পর আজ কোনোই আফসোস নেই আমার। কোনো স্বপ্ন আসেনি আজ। আমিতো দেখতে পারতাম, পাশের বাসার ঐ মারমা মেয়েটিকে। ঐ যে তার দুঃখি দুঃখি চোখ, পরনে ছিল সাদা কালো চেকের থামি। বুকে বাঁধা ছিল রাংপাই। বয়স তার মধ্য তিরিশ। সে চেয়ে দেখে নীরব নির্ঝরে দুরের পাহাড়ের ঝর্ণাধারা। কখনো দেখে কি সে ধূসর মেঘ পাহাড়ের গায়ে। আমি প্রথম দেখায় বুঝতে পেরেছিলাম এই মেয়ের চোখের ভিতর শঙ্খ নদীর নিস্তব্ধ জল ভরে আছে।
বাইরে বের হবো বলে আজ বিকেলে পরিপাটি কাপড় চোপড় পরি। রুম থেকে বেরুনোর সময় বৃদ্ধা আমাকে বলছিল — তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছেনা তো?
আমি : না মাসি।
মাসি : কোনো কিছু অসুবিধা হলে বলবে আমাকে।
আমি : আচ্ছা। বলব।
এই বৃদ্ধাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, তার মুখে দেখেছিলাম আমার মায়ের প্রতিরূপ। যে কয়টি দিন ছিলাম এখানে সে জানতে পারেনি , তাকে দেখতে লাগে আমার মায়ের মতোন।
ঘর থেকে যখন বের হচ্ছিলাম, তখন এই শৈল শহরে সন্ধ্যা নামছিল। বনে বনে পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়েছে। অস্তমিত সূর্যের বিচ্ছুরিত লাল আভা পাহাড়ের উপর দিয়ে, বৃক্ষ রাজির ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম। স্বর্গীয় এই সন্ধ্যা আলোয় খুব ইচ্ছা হলো ঐ মেয়ের মুখখানি দেখবার। আস্তে আস্তে হেটে আসছিলাম তাই ঐ বাড়ির সামনে দিয়ে। পৃথিবীর সমস্ত সৌভাগ্য যেন ঈশ্বর আমাকেই দিল। সে দাড়িয়ে আছে আমারই পথের দিকে। কেন যেন কষ্ট পেলাম তাকে দেখে । আজকের এই সন্ধ্যার মেঘমালা তার মুখের গভীর দুঃখ ছায়াকে একটুও সরাতে পারেনি।
শহরের উঁচুনিচু পথ ধরে একাকী হাটছিলাম। মনটি কেমন যেন উড়ো উড়ো লাগছিল। দেখি এক জায়গায় একটি ইস্কন মন্দিরে কীর্তন হচ্ছে । অনেকগুলো নারী পুরুষ বসে শুনছে সে গান। আমি ওদের মাঝে যেয়ে বসে পড়ি। সন্নাসী জাতীয় কয়েক লোক গাইছিল তখন–
‘অঙ্গ পুলকিত, মরম সহিত, অঝরে নয়ন ঝরে।
বুঝি অনুমানি, কালা রূপ খানি,
তোমারে করিয়া ভোরে।।
দেখি নানা দশা, অঙ্গ যে বিবশা,
নাহত এত বড় ভারে।।
কিছুক্ষণ কীর্তন শুনে চলে যাই কুসুমেন্দুর হোটেলে। কুসুমেন্দুকে বলি : আজ তোমার মেনু কি? কুসুমেন্দু বলে, লইটকা শুটকি মাছ, আর বন মোড়গের তরকারি। আমি দুটোরই অর্ডার দেই।
একদিন মাসির নাতি বিজুকে ডেকে বলি — বিজু, পাশের বাড়ির ঐ যে মেয়েটা প্রতিদিন একাকী বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে, ওর নাম কি?
বিজু : আনা ফুফুর কথা বলছ? উনি আমার
সম্পর্কিত ফুপু হয়।
আমি : জ্বী বিজু। পুরো নাম বলো।
বিজু : আনাচিং মারমা।
আমি : কি করে সে?
বিজু : কিছু করে না।
আমি : তোমার ফুপির বিয়ে হয়নি?
বিজু : হয়েছিল। ফুপা মারা গেছে অনেক আগে।
পরে মাসির কাছে থেকে জেনেছিলাম, আনাচিং এর বিয়ের কয়েকদিনের মাথায় মাত্র তিন দিনের জ্বর ভোগের পর তার স্বামী মারা যায়। কোনো বাচ্চা নেই। সেও নাকি দশ বারো বছর হয়ে গেছে। তারপর তার আর বিয়েও হয়নি। মারমাদের গোত্রীয় নিয়ম অনুযায়ী বিধবাদের বিয়ে করার আর অনুমতি নাকি দেওয়া হয় না।
আনাচিং সম্পর্কে আরো কিছু জেনে আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি যে, সে তার বৈধব্য জীবনে বাড়ি থেকে কোথাও বের হয় না। কারো সাথে কোনো কথা বলে না। বিশেষ করে পুরষদের সাথে। সে দেখতে ঐ পুঞ্জীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিল। কোনো প্রকার সাজহীন মুখ তার বনভূমির নব কিরণের আলোর দ্যূতি ছড়ায় শঙ্খ নদীর পাড়ের আকাশে বাতাসে। সপ্তাহে প্রতি রবিবারে সে একবারই বের হয়, যায় তাজিংডং পাহাড়ের স্বর্ণ মন্দিরে। মহামতি বুদ্ধের স্বর্ণ মূর্তির পাশে বসে থাকে সে এবং ধ্যান করে।
সেদিনের বিকেল ছিল শান্ত ও সৌম্যের। সকাল থেকেই সোনালি রোদ্দুর ঝিলমিল করছিল বনভূমির বৃক্ষ রাজির পাতায় পাতায়। আমার মন বড়ই চঞ্চল হয়ে উঠল। আমি চলে যাই তাজিংডং পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত স্বর্ণ মন্দিরে। মন্দিরের বাইরে নিজ পাদুকা জোড়া রেখে মন্দিরে প্রবেশ করি। দেখি আনাচিং বুদ্ধ মূর্তির পাশে বসে একাগ্রচিত্তে ধ্যান করছে। আমি যেয়ে ওর পাশে বসি এবং ধ্যানে মগ্ন হই। আনা’র ধ্যান করা শেষ হলে তাকায় আমার দিকে। আমিও তাকাই আনাচিং এর দিকে। হঠাৎ মন্দিরের ভিতরে সমস্ত জপমালা যেন থেমে গেল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। কোনো হাসি নেই। বুদ্ধের চোখও যেন বিষণ্ন হয়ে দেখছে আমাদেরকে। আনাচিং এর চোখ দেখে মনে হলো হাজার বছর আগে কপিলাবস্তুুতে কোনো এক আম্রপালি গুমরে গুমরে কেঁদে স্থির করে রেখেছে এই চোখ। মন্দিরে মহামতি বুদ্ধের মূর্তির সামনে ওকে বলতে ইচ্ছা করল, এই চোখে তুমি এত জল ভরে রেখেছ কেন? কিছু জল রেখে দিতে পারো শঙ্খ নদীতে। আর কিছু দিতে পারো আমাকে।
আজ রাতে আর কুসুমেন্দু হোটেলে খেলাম না। অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে ঘরে এসে আলো জ্বালাই। মাসি এসে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি কি খেয়েছ?
আমি : না।
মাসি : খাবে না?
আমি : না।
একটু পর দেখি, মাসি জুম ফসলের কিছু খাবার থালিতে করে এনে রেখে দিল। বলল — খেয়ে নিও।
মাসির দেওয়া কিছু খাবার খেয়ে আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুমাবার চেষ্টা করলাম, ঘুম আসে না চোখে। পথে যেতে যেতে দেখেছিলাম আজ কতো বৃক্ষের ছায়া এসে পড়েছিল পথে। আনাচিং এর জীবনের এই পথে কোনো বৃক্ষের ছায়া কি আর পড়েনি? আমি তো হতে পারি তার শীতল বৃক্ষের ছায়া! আবার আলো জ্বালিয়ে দেই। আবার বসে থাকি। জানালা খুলে দেখি, দূরের পাহাড়ের গায়ে আঁধার। জীবন এত শূণ্য মনে হয় কেন?
মনে পড়ছিলো সেই শিলংয়ে লাবণ্য অমিতের কথা–
‘আকাশে সোনার রঙের উপরে চুনি গলানো, পান্না গলানো আলোর আভাসগুলো মিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাতলা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সুগভীর নির্মল নীল, মনে হয় তার ভিতর দিয়ে যেখানে দেহ নেই শুধু আনন্দ আছে সেই অমর্ত্য জগতের অব্যক্তধ্বনি আসছে। ‘
আস্তে আস্তে বান্দরবানের দিনগুলি আমার শেষ হয়ে আসে। এরপর একটি রবিবার পেয়েছিলাম স্বর্ণ মন্দিরে যাওয়ার। গিয়েছিলামও কিন্ত দেখা মেলেনি আনাচিং এর। সন্ধ্যার মেঘমালায় কখনো কখনো তার দেখা পেতাম ঐ বাড়ির কাঠের দোতলায়। মাঝে মাঝেই এলোচুলে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকত সে। পরনে থাকত সাদা থামি আর রাংপাই। কেন জানি মনে হতো, ঐ চোখ খুঁজতো ঝাঁকড়া চুলের কোনো এক তরুণকে। যে তরুণ কখনো বলেনি তাকে ‘আমি তোমাকে ভালবাসি।’ কিন্তু তার জন্য কেন অন্তর দাহ হয়। আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যায় কাঁচা সোনা। যে সোনা পোড়ানোর দাহে তপ্ত হয়েছিল এক বিধবা আনাচিং এর বৈধব্য মন।
সেদিন ছিল প্রবারণা পূর্ণিমা। আমারও শেষ দিন ছিল বান্দরবানে। প্রবারণা পূর্ণিমায় বৌদ্ধ নরনারীরা শুচি শুভ্র হয়। সুন্দর পোশাকে বৌদ্ধ বিহার সমবেত হয়। বুদ্ধকে পূজা দেয়। রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এদিন ঘরে ঘরে ভাল রান্না হয়। সন্ধ্যায় হয় ফানুস উড়ানো উৎসব। ফানুস উড়ানোর উদ্দেশ্য হলো আকাশে ভাসমান গৌতমের পবিত্র কেশধাতুকে প্রদীপ দিয়ে বন্দনা করা হয়। আশ্বিনের সেই পূর্ণিমার আকাশে মোহনীয় আকাশ প্রদীপ জ্বলে ওঠে।
মাসি অথবা বিজুর মাধ্যমে আমার চলে যাবার কথা শুনেছিল হয়তো আনাচিং। আজকের এই প্রদীপ জ্বালানো রাতে আনাচিং চেয়েছিল আমাকে। আলো আঁধারের সন্ধ্যায় যখন হাঁটছিলাম ঐ বাড়ির পাশ দিয়ে, হঠাৎ উপর থেকে উড়ে এলো একটি ছিন্ন কাগজ। তাতে লেখা ছিল –‘ তুমি তাজিংডং পাহাড়ে দেবতা পুকুর পারে চলে যেও। ‘
আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার সন্ধ্যা রাত। ফানুস উড়ানোর উৎসব হচ্ছে। আকাশে আকাশে আকাশ প্রদীপ জ্বলছে। উৎসবের এমন রাতে আমি দুরুদুরু পায়ে হাঁটতে থাকি জ্যোৎস্না তলার নীচ দিয়ে উপত্যকার পথ ধরে তাজিংডং পাহাড়ের দিকে। চারদিকে বুঁনো ফুলের গন্ধে উতলা হয়ে আছে বাতাস। জ্যোৎস্নার আলোর ছটা ঝরে পড়ছে পথে পথে। এই স্বর্গীয় মায়াময় পথে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাই দেবতা পুকুর পারে।
চারদিকে নীরব নির্জন। কোনো মনুষ্য নেই। মনুষ্য কর্তৃক কোনো আলো জ্বালানো নেই। আছে পূর্ণিমার চাঁদ। আর দূরে আকাশ প্রদীপ জ্বলছে। ঠিক পুকুর পারের ওপাশে একটি নারী মূর্তি দেখা গেল। কাছে এগিয়ে যেয়ে দেখি, আনাচিং। আজো পরনে সেই সাদা থামি। আর বুকে বাঁধা রাংপাই। আমি ওর মুখখানির দিকে একবার তাকাই। এই মুখ কতো সন্ধ্যার মেঘমালায় দেখেছি দূর থেকে। আজ এই পূর্ণিমার আলোয় দেখছি কাছে থেকে। কিযে ভালো লাগছিল আমার! আনাচিং খুব কাছে এসে আমার বুকে ওর কপাল ঠেকিয়ে বলছিল — তুমি কেন আমাকে ভালোবাসলে? এই জীবনে তুমি আমাকে তো পাবে না। ‘
আমার বুক থেকে আনাচিং ওর কপাল উঠিয়ে নেয়। দেবতা পুকুর পার ধরে সে হেঁটে হেঁটে চলে যায় পাহাড়ের ঢালের দিকে। আমাকে বলে, ‘ তুমি একটু এখানে দাঁড়াও।’ আমি ওর কথায় দাঁড়িয়ে থাকি। বুঁনো ফুলের গন্ধ আর বাতাসে ভেসে আসছিল না। হঠাৎ পূর্ণিমার চাঁদ মেঘে ঢেকে গেল। কেমন যেন আঁধার নেমে এলো চারদিক থেকে। তারপর অন্ধকারে আনাচিংকে আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। কাছে যেয়ে দেখি আনাচিং কোথাও নেই। নীচে তাকিয়ে দেখি, গিরি খাদ। খাদের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা শঙ্খ নদী। দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, আকাশ প্রদীপ জ্বলছে।
১৯. শুক্লা দ্বাদশীর দিনে
অনেক দিন আগের ফাগুনের এক শুক্লা দ্বাদশী রাতের কথা। তখন আমি পরিকল্পনা কমিশনের একজন তরুণ কর্মকতা। কমিশনের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন জনাব এম,এ আজিজ। ওনার বাড়ি ছিল ময়মনসিংহের গফরগাঁও এর নয়াবাড়ি গ্রামে।
ব্যক্তিগত জীবনে উনি ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব গিয়াস উদ্দীন খান পাঠানের জামাতা। ওনার বাড়িটি ছিল আধুনিক জমিদার বাড়ির মতো। অনেক কক্ষ বিশিষ্ট বড়ো দোতালা বাড়ি। বাড়ির সামনে ছিল শান বাঁধানো পুকুর। পুকুরের পাড় আর বাড়ির সামনে জুড়ে ছিল ফুলের বাগান। বিভিন্ন রকমের ফুলের সমারোহে পুরো বাড়িটাই একটা বলদা গার্ডেন বলে মনে হতো। তাছাড়া বাড়ির চারপাশে বিভিন্ন জাতের ফলের গাছও ছিল।
জনাব এম, এ আজিজ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া অনুরাগী ও ভীষণ রকম আমুদে মানুষ ছিলেন। উনি ছিলেন স্নেহ বৎসল একজন পিতার মতো। অনেক বড়ো কর্মকতা হয়েও আমাদের মতো জুনিয়র কর্মকর্তাদের উনি আপন করে নিতেন। অফিসিয়াল প্রটোকল অতো মানতেন না। প্রতি ফাল্গুনের শুক্লা দ্বাদশীর দিনে ওনার বিভাগের একদল ছেলে মেয়ে কর্মকর্তাকে দাওয়াত করে বাড়িতে নিয়ে যেতেন। দিনব্যাপী গান বাজনা ও আনন্দ হতো। পুকুরে মাছ ধরা আর খানাপিনা তো থাকতই।
এমনি এক ফাল্গুনের শুক্লা দ্বাদসীর দিনে আমরা ঢাকা থেকে দশ বারো জন ছেলেমেয়ে গিয়েছিলাম ওনার বাগান বাড়িতে বেড়াতে। আমাদের অফিসে একজন মেয়ে কর্মকর্তা ছিল, ওর ডাক নাম ছিল জয়িতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বৎসরের জুনিয়র ছিল। পড়ত আমাদের ডিপার্টমেন্টেই। মাঝে মাঝেই এই মেয়েটিকে কলাভবনের কোরিডরে কিংবা সেমিনার কক্ষে দেখতাম। কিন্তু কোনোদিন ওর সাথে কথা হয় নাই। অনেক মেয়েদের ভীড়ে এই মেয়েটিকে ভালোই লাগত। কিন্তু ঐ ভালোলাগা পর্যন্তই। কাকতালীয় ভাবে এই মেয়েই আমার সহকর্মী হয়ে এল।
অফিসে জয়িতার সাথে প্রতিদিনই দেখা হয়। এখানেও জয়িতা আমার জুনিয়র। পূর্বের বিশ্ববি্দ্যালয়ের রেশ ধরে সে আমাকে ভাই ডাকত। এবং আপনি সম্বোধন করত। জয়িতাকে আমি অফিসে প্রতিদিন দেখি। দেখি ওর টানা টানা চোখ, বাঁকানো ভ্রু। লম্বা স্ট্রেইট চুল, মাঝখানে সিঁথি করে পিছনে খোপা বাঁধত। সুন্দর বাচনভঙ্গীতে কথা বলত। হালকা পাতলা স্লীম বডি। ভালোই লাগত জয়িতাকে।
বাড়িতে এসে শুয়ে শুয়ে এমনি আলসে করে ভাবতাম। মনে হতো এই মেয়েটি যদি আমাকে প্রেম নিবেদন করত ! কিংবা যদি ওকে ডেকে বলতে পারতাম — ‘জয়িতা, তোমাকে আমার ভালো লাগে, তুমি কি আমাকে ভালোবাসবে ?’ কিন্তু দ্বিধা করতাম। ভাবতাম যদি জয়িতা প্রত্যাখান করে ? যদি মুখের উপর বলে দেয় – ‘না’। তাহলে তো আমাকে লজ্জা পেতে হবে। কিন্তু এইটাই মনে হতো আমার, জয়িতাই একদিন আমাকে বলবে- ‘আপনাকে আমার ভালোলাগে, আপনাকে আমি ভালোবাসি।’
আজিজ সাহেবের বাগানবাড়িতে আজ কেবলই আনন্দ। সবাই যে যার মতো আনন্দস্ফূর্তি করছে। কেন জানি আমার মনটা অত ভালো লাগছিল না। পুকুরপাড়ে শান বাঁধানো ঘাটে খুঁজছিলাম জয়িতাকে। একবার মনে হলো জয়িতা গাঁদা ফুলের ঝাড়ে কেচি দিয়ে মালিনীর মতো পাতাগুলো ড্রেসিং করছে। পিছন থেকে আমি ওর সাথে কথা বলি, ওকে বলি- ‘ফুল বাগানে তোমাকে মানিয়েছে ভালো।’ আজ জয়িতারও কি মন খারাপ ? আমার সাথে ঠিকমতো কথা বলছে না যে।
বিকালে আমরা বাড়ির বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কাজের মানুষেরা নাস্তা আর চা দিয়ে যাচ্ছিল। এখানেও দেখি জয়িতা নেই। মনে হলো জয়িতা একাকী মন খারাপ করে শুয়ে আছে। একবার মনে হলো ওর রুমে যেয়ে ওকে ডেকে নিয়ে আসি। কিন্তু সবাই আমাকে কি মনে করবে ? এই ভেবে জয়িতাকে আর ডাকা হলো না।
সন্ধ্যার পর আমাদের সেই কাঙ্খিত সময়টি এলো। আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ উঠল। পুকুর পারে শান বাঁধানো ঘাটের কাছে বকুলতলায় বেঁতের চেয়ারে আমরা বসে আছি। বাঁশ ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলো এসে ঝলমলিয়ে পুকুরের জলে পড়ছে। জোনাকীদের আলো ম্লান লাগলেও ভালো লাগছিল ঝিঁঝি পোকাদের গান। আমাদের অফিসের শর্মিলী দিদি গান গাইলেন —
‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ।
যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে
এই নিরালায় রব আপন কোণে। যাব না এই মাতাল সমীরণে।’
আমাকে সবাই বলল কবিতা আবৃতি করতে। আমি আবৃতি করলাম-
‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে. কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,. আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,.
এই সংগীত-মুখরিত গগনে. তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো।
এই বাহির ভুবনে দিশা হারায়ে. দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।’
গানে আর কবিতায় খুঁজছিলাম জয়িতাকে। আজ এই জ্যোৎস্না রাতে এত সুর এখানে, এত গান এখানে। এত আলো ঝরছে ঐ চাঁদ থেকে। এত তারা জ্বলছে দূরের ঐ আকাশে। আমার মন আকুল হলো জয়িতার কন্ঠে একটি গান শোনার জন্য। আজ এই রাতে, এই বকুলতলায় জয়িতা কোনো গান গাইল না। একাকী এক কোণে কোথায় পড়ে রয়েছ সে।
রাতে খেয়ে আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করি, বারোটার দিকে আমরা শুয়ে পড়ি। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম জয়িতার কথা। চোখে ঘুম আসছিল না । বাইরে পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছিল। ঝিঁঝি পোকার আওয়াজও কানে আসছে। রাত ক্রমেই নীরব নিঃশব্দ হয়ে উঠছিল। রুমের ভিতর দেয়াল ঘড়িতে রাত দুটো বাজার ঘন্টা বেজে ওঠে। তারও কিছুক্ষণ পরে বাইরে কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু দরজায় কোনও কড়া নাড়ার শব্দ হলোনা। আমি ভয় পেলাম না উঠে দরজা খুলে দেই। দেখি — বাইরে বারান্দায় জয়িতা দাঁড়িয়ে আছে । ওর পরনে সিল্কের সাদা সালোয়ার কামিজ। আমি এগিয়ে যেয়ে বলি- ‘এত রাতে তুমি একা, আমার রুমের সামনে। কেউ দেখলে কি মনে করবে ?’
জয়িতা : দেখলে দেখুক, মনে করলে করুক।
আমি : তুমি তোমার রুমে যাও। কাল ভোরে না হয় আমরা কথা বলব।
জয়িতা : না আমি যাব না। আমার ঘুম আসছে না। চলো আমরা ঘাটপাড়ে বকুল গাছের তলায় গিয়ে বসি।
আমি : চলো।
জয়িতা আমার হাত ধরল। আমরা দু’জন হাতধরেই বকুল তলায় যেয়ে বসি। শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ অনেকটাই পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। গফরগাঁও এর এই নয়াবাড়ি গ্রামের সারা প্রান্তর জুড়ে কেবলই জ্যোৎস্নার রোসনাই। জয়িতা আমার পাশে বসে আছে। চাঁদের আলো এসে পড়েছে ওর চোখে মুখে। ওকে দেখতে কী যে ভালো লাগছিল। জয়িতা আমার কাধে মাথা রেখে বলছিল- ‘ জানো, আমি এমনি একটি চাঁদের রাতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এই রকম শুক্লা দ্বাদশী চাঁদের রাতে তোমার বুকে মাথা রেখে বলতে চেয়েছিলাম — ভালোবাসি। ওগো, আজ তোমায় সেই কথাটিই বলছি- ‘তোমাকে ভালোবাসি।’
পুকুরপাড়ে গাঁদা ফুলের গন্ধে তীব্র করে ভরে উঠেছিল। রাতের বসন্ত বাতাস বয়ে চলছে মৃদুমন্দ। সাথে হাস্নাহেনার সুবাসে আকুল হয়ে উঠেছে পুকুরপারের বকুলতলা। আমি জয়িতাকে বুকে টেনে বলি — ‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি।’ তারপর আরো কিছু সময় বিমুগ্ধ হয়ে শুয়ে থেকেছিলাম বকুল গাছের নীচে দূর্বা ঘাসের উপর। দখিনা বাতাসে ঝির ঝির করে বৃষ্টির মতো বকুল ফুল ঝরে পড়েছিল আমাদের দুজনের শরীরের উপর।
ঘাট থেকে ঘরে ফেরার সময় কয়েকটি গাঁদা ফুল ছিঁড়ে তোড়া করে জয়িতা আমাকে দেয়। বলে — ‘এ আমার প্রেমাঞ্জলি। গ্রহণ করো।’ জয়িতা চলে যায় ওর রুমে। আমি চলে আসি আমার রুমে।
সকালে ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরি হয়ে যায়। ঘুম ভেঙ্গে দেখি বিছানার এক পাশে জয়িতার দেয়া রাতের সেই ফুলের তোড়াটি পড়ে আছে। দেখে মনটা বেশ খুশি হলো। ফুলগুলো হাতে নিয়ে সুবাসও নেই। চিত্তটা আনন্দে ভরে উঠল।
বিছানা থেকে উঠে বাইরে আসি। মনে মনে খুঁজতে থাকি জয়িতাকে। সবাই ঘুম থেকে উঠেছে। ওঠেনি কেবল জয়িতা। আরো কিছুক্ষণ পরে জয়িতাকে না দেখে শর্মিলী দিদিকে বলি– ‘জয়িতা এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি ?’
শর্মিলী দিদি বিস্ময়ে বলে–‘ তুমি এসব কি বলছ ? জয়িতা তো আমাদের সাথে এখানে আসেই নাই।’
২০. অচিন পাখি
আমি তখন আমাদের বাগবাটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন স্কুলে তিন পিরিয়ড করার পর বাকি ক্লাসগুলো করতে আর ইচ্ছা করছিল না। আমার খিদেও লেগেছিল খুব। ভাবলাম বাড়ি চলে যাই। তাই ক্লাসের পিছন দরজা দিয়ে বইগুলো অনেকটা লুকিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হই।
আমাদের স্কুল ছিল বাড়ি থেকে আড়াই মাইল দূরে। কাঁচা রাস্তা আর মেঠো পথে হেঁটে স্কুলে যেতে হতো। সেদিন ছিল চৈত্রের দুপুর। আমি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কাঁচা রাস্তা দিয়ে না এসে মাঠ আর ক্ষেতের পাশ দিয়ে মেঠো পথে বাড়ি ফিরছিলাম।
পথে নেমে দেখি, চৌচির করছে মাঠ। কোথাও সবুজ নেই। কোনও ক্ষেতে ফসল নেই। শুধু চাষের মাঠ। ক্ষেতগুলোতে পড়ে আছে মাটির শুখনো ছোট বড় ঢিল। রোদ্রে তপ্ত হয়ে যেন আগুন ছড়াচ্ছে। চারপাশে কোনো বাড়ি ঘর নেই। বিরাণ এই প্রান্তর পারি দিতে হবে আমাকে একা। সাথে কোনও সাথী নেই। দূরে তাকিয়ে দেখি মিছে পানির ঢেউ বইছে। আসলে সবই ছিল দুপুরের করুণ ধারা। সবই ছিল মরীচিকা।
হাঁটতে হাঁটতে ঘামতে ঘামতে ক্লান্তি নেমে এসেছিল শরীরে। ধুলির পথে পায়ে পায়ে উড়ছিল ধূলো। পথের শেষ যেন শেষ হতে চাইছিল না। পা দুটোও কেমন থেমে আসছিল। কোথাও কোনও ছায়াতলে একটু জিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছিল। নির্জন সেই চরাচরে পথের ধারে একটি উন্মুক্ত ঈদগাহ দেখতে পাই। সেখানে একটি আমগাছ আছে। আমি সেই আম গাছের ছায়াতলে যেয়ে দাঁড়াই। দেখি, সেখানে আমাদের গ্রামের ‘অন্ধ’ হাফেজ মিয়া বৃক্ষমূলে একাকী বসে আছে।
হাফেজ ভাল মতো চোখে দেখতে পেত না। আবছা আবছা দেখতে পেত। মাটির দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে একাই লাঠি হাতরিয়ে পথ চলত। সে ছিল কোরআনে হাফেজ। সেই জন্য সবাই তাকে হাফেজ নামে ডাকত। সে ভালো গানও গাইতে পারত। হাফেজ ছিল অত্যন্ত গরীব ও দীনহীন। পথে ঘাটে, স্টেশনে, লঞ্চ স্টীমারে, ক্বেরাত ও গান গেয়ে মানুষের কাছ থেকে দান ও সাহায্য গ্রহণ করে জীবন নির্বাহ করত।
আমি হাফেজের সাথে গল্প করি। কথা বলতে বলতে আমি তাকে বলি — ‘ হাফেজ ভাই, তুমি আমাকে একটা গান শোনাও না।’ হাফেজ ভাই বলল, ‘এখানে আর কেউ তো নেই। তুমি একাই শুনবে গান?’ বললাম, ‘আমি একাই শুনব। তুমি বিকেলে আমাদের বাড়ি এসে মার কাছ থেকে চাল নিয়ে যেও।’
সেদিন সেই খাঁখাঁ ক্লান্ত দুপুরে হাফেজ আমাকে এই গানটি গেয়ে শোনায়েছিল —
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি
দিতাম পাখির পায়।….’
আমি হাফেজের সাথে মাথা দোলায়ে আর দুহাত নেড়ে গানটি মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম। এই গানটি প্রথম তারই কাছ থেকে শোনা ছিল। এটি যে একটি লালন গীতি তাও তখন জানতাম না। গান শেষে হাফেজ ভাইকে আমি বলেছিলাম—
‘এই গানটির অর্থ বলে দাও না।’ হাফেজ ভাই বলেছিল, তুমি এই গানের অর্থ এখন বুঝবে না। বড়ো হও, তখন বুঝতে পারবে।’
তারপর অনেক বছর চলে গেছে। ততদিনে আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। স্কুল শেষ করে কলেজে পড়েছি। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছি। এখানে আমাদের লালন সাহিত্য পাঠ্য ছিল। ক্লাসে স্যার লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গীতিটি পড়িয়েছে। বুঝেয়েছেও আমাদের। কিন্তু খাঁচার ভিতরে সেই অচিন পাখিকে সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারিনি। চিনতেও পারিনি। আর কেমনই বা ছিল সেই পাখি দেখতে?
তারও অনেক পরে একবার বাড়িতে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, হাফেজ ভাইয়ের কাছ থেকে সেই অচিন পাখির গান আর একবার শুনে বুঝিয়ে নেব। কিন্তু জানতে পারলাম হাফেজ ভাই মারা গেছে। মনের ভিতরে কী এক আকুতি হলো — সেই অচিন পাখিকে আর বোঝা হলো না। পাখি অচিনই রয়ে গেল।
আমি এখনো তন্ময় হয়ে ভাবি — সেই কত বছর আগে এক অন্ধ গায়েন ধূঁ-ধূ খোলা প্রান্তরে বৃক্ষ তলে বসে গেয়েছিল গান। এক অর্বাচীন বালক সেই গান শুনে বিমুগ্ধ হয়েছিল। তার সেই গানের অপার্থিব সুর এখনও যে সেই বালকের অন্তরে বাজে —
‘মন তুই রইলি খাঁচার আসে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশের
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয়।’
২১. ছোট মাস্টারজি
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর আমি আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারি নাই। সংসারে অভাব অনটন ছিল। তাই দায় হলো আমারই পরিবারের জন্য কিছু করার। চাকুরির জন্য ঢেষ্টা করতে থাকি। এবং চাকুরি একটা হয়েও যায় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের। আমার বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় হলেও আমার পোস্টিং দেওয়া হয় দূর্গাপুরের এক পাহাড়ি জনপদে।
রোড টু রানীখং :
সকাল এগারটায় জারিয়া এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছাড়ে ময়মনসিংহ জংশন থেকে। ট্রেনটি যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হচ্ছিল, জানালা খুলে দেখছিলাম দূরের জলরাশি। ভাবছিলাম, গরীবের ঘরে জন্ম হলেও স্বপ্ন ছিল অনেক বড় হবার। কিন্তু তা আর হতে পারলাম না। লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে হতে হলো আমাকে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। মনে মনে আবার ভালও লাগছিল এই ভেবে যে, ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা আমাকে স্যার ডাকবে, মন্দ কী?
ট্রেনটি জারিয়াতে এসে পৌঁছে দুপুরে। স্টেশনে নেমে টমটমে করে দূর্গাপুর চলে আসি। প্রথমে থানা শিক্ষা অফিসে রিপোর্ট করে তারপর রিক্সায় করে চলে যাই সোমেশ্বরী নদীর তীরে। নৌকায় সোমেশ্বরী পার হয়ে পায়ে পায়ে হেঁটে পৌঁছে যাই রানীখং গ্রামে। এই গ্রামেরই স্কুলে আমি যোগদান করি।
স্কুলের হেড মাস্টারজি আমাকে স্কুল আঙিনার পিছনে একটি পুরোন ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। ওখানে একটি রুমে স্কুলের দফতরি বিশু দিব্রাও থাকে। বিশু থাকাতে আমার বেশ সুবিধাই হলো। রান্না বান্নার আর কোনো চিন্তা করতে হলো না। ওখানে কোনো চোকি ছিল না। প্রথম দিন আমি হোগলার পাতার মাদুরে কাঁথা বিছিয়ে ঘুমাই। পরের দিন স্থানীয় হাট থেকে একটি চোকি, একটি টেবিল ও একটি চেয়ার কিনে নিয়ে আসি।
প্রথম দিন আমার প্রথম ক্লাস ছিল শিশু শ্রেণীর। ক্লাশে পনের জনের মত ছাত্র ছাত্রী ছিল। বেশির ভাগই গারো উপজাতীয়। দুচারজন ছিল বাঙালি। সবার হাতে একটি করে শিশু শিক্ষা বই। আমার জীবনের প্রথম ক্লাস। কেমন যেন আবেগে ভরে উঠছিল মন। এই ছোট ছোট শিশুদের কাছে আমি কেমন যেন নার্ভাস ফিল করছিলাম। মনে হচ্ছিল এরাও এক একজন বিজ্ঞ পন্ডিত । কোথায় কোন্ ভুল ধরে বসে না জানি আমাকে।
প্রথম থেকেই ভাল লাগছিল এই রানীখং। প্রকৃতির এক অপরুপ লীলাভূমি যেন। এর পূর্ব পার্শ্ব দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা পাহাড়ী নদী সোমেশ্বরী। এই নদীর স্বচ্ছ জলধারার নিচ দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় সিলিকন বালিকণা। নজর কেড়ে নেয় বালিকণার নিচ থেকে আদিবাসী নারী-পুরুষদের পাহাড়ি কয়লা এবং কাঠ সংগ্রহের দৃশ্য। ওপরের নীল আকাশও খুব কাছাকাছি। এখানেই সুউচ্চ টিলায় রয়েছে ক্যাথলিক মিশন। এর উত্তর পাশে চোখ মেললে হাতছানি দেয় ভারত সীমান্তে অবস্থিত মেঘালয়ের সুউচ্চ পাহাড় সারি।
প্রায় দিনই বিকেল বেলা কোথাও না কোথাও ঘুরতে বের হতাম। কখনও একাকী কখনও বিশু দিব্রাকে সাথে নিয়ে নিতাম। সোমেশ্বরীর নির্জন তীরে কখনও একাকী বসে থাকতাম। আবার কোনো কোনো দিন বিশুকে নিয়ে যেতাম সিলিকন বালি উত্তোলনের দৃশ্য দেখবার জন্য। বিশু আমার মতোই বাইশ তেইশ বয়সের তরুণ। ওর বাড়ি এখান থেকে বেশি দূরে নয়। মাইল খানেক দূরে পাহাড় অার অরণ্যের ফাঁকে এক টিলার উপরে।
সোমেশ্বরীর তীরে বসে একদিন বিশুকে বলছিলাম —
‘ তুমি তো বাড়িতেই থাকতে পারো। এই স্কুলের পাশে এই ঘরে থাকো কেন? ‘
বিশু : ‘এই স্কুলের প্রতি আমার খুব মহব্বত হয় যে। আমার বাবাও এই স্কুলের দফতরী ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক আর্মিরা আমার বাবাকে মেরে ফেলে এই স্কুল প্রাঙ্গণে। সেও থাকত এই পুরনো ঘরটিতে। যেখানে আমি থাকি। বাবার কাজগুলোই আমি করি। স্কুল প্রাঙ্গণ পরিচ্ছন্ন রাখি। ক্লাস শুরুর ঘন্টা বাজাই। ঘন্টা বাজাই ছুটির। রাতে পাহারা দেই । গভীর রাতে উঠে একাকী স্কুলের বারান্দা দিয়ে হাঁটি।’
আমি : খুব ব্যাথিত হলাম বিশু। তুমি খুব ভাল ছেলে। তোমার বাবা মুক্তি যুদ্ধে একজন শহীদ। তিনি এদেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাকে আমি স্যালুট দেই।
একদিন ছুটির দিনে বিশুকে আমি বলি, তোমার মাকে আমার খুব প্রণাম করতে ইচ্ছা করছে। তোমাদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবে? বিশু বলে — ‘অবশ্যই যাবেন। তবে মা আজ বিকেলে গীর্জায় আসবে প্রার্থনা করতে। আপনি গীর্জায় যেয়ে দেখা করতে পারেন। আমিও আজ গীর্জায় যাব। ‘
আমি বললাম, ‘ আমিও যাব গীর্জায়।
রানীখং গির্জায় এমনিতেই আমার যাবার ইচ্ছা ছিল। আমি আজ বিশুর সাথে চলে যাই গীর্জায়। দক্ষিণ দিকে গির্জার দৃষ্টিনন্দন প্রবেশদ্বার। ঢুকে এর বাম পাশেই শত বছরের প্রাচীন এই ক্যাথলিক গীর্জা। আমি বিশুর সাথে গীর্জায় প্রবেশ করি। দেখি যীশু মূর্তিকে সামনে রেখে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষেরা প্রার্থনা করছে। আমরা দুজনে সেই প্রার্থনায় যোগ দেই।
প্রার্থনা শেষে গির্জা থেকে যখন বের হয়ে আসি, তখনই গির্জা প্রাঙ্গণে চল্লিশোর্ধ্ব একজন রমণীর সাথে বিশু আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। বিশু বলে — ‘ইনিই আমার মা।’ আমি চেয়ে দেখলাম — পরনে তার মলিন পোশাক। খালি পায়ে। মুখ তার রোগ ক্লীষ্ট। পরিপাটিহীন মাথার চুল। চোখে নেই কোনো হাসি। মনে হলো হাজার জনমের বিষণ্ণতা মুখে ছেয়ে আছে। তবুও তাকে দেখে একজন মহিয়সী মায়ের মতো মনে হলো। আমি তার পা ছুঁয়ে প্রনাম করি। আমাকে দেখে তিনি থমকে দাঁড়িয়েছিল গির্জার সোপানে। বিশু ওর মাকে বলেছিল — ‘ইনি আমাদের স্কুলের ছোট মাস্টারজি। ওনার নাম শ্রী সুনীল কুমার রায়। ‘
আমি দিনে দিনে বিশুর প্রতি আরও গভীর ভালবাসায় বাঁধা পড়ে যাই। ও আমার আপন কেউ নয়, কিন্তু ওর জন্যে আমার প্রাণ কাঁদে । এই নির্জন পাহাড়ি উপত্যকায় বিশুই আমার সকল সময়ের সঙ্গী হয়ে যায়। ও আমাদের স্কুলের একজন সামান্য দফতরী হলেও ওকে আমি আমার অন্তরে ঠাঁই করে নেই বন্ধুর মতো।
একদিন বিশু বলছিল ওর মা নাকি খুব অসুস্থ। দেখতে যাবে বাড়িতে। আমি ওকে বললাম, আমিও যাব তোমার মাকে দেখতে। টিলা আর অরণ্যের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ওদের বাড়িতে চলে যাই । পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট একটি কাঠের বাড়ি। চারিদিকে খোলা উঠোন। দূরে আরো ছোট বড় পাহাড় ও টিলা আছে । দূরে পাহাড়ের কোল থেকে ঝরনার জল ঝরে পড়ছে। ৰাড়িটির উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সোমেশ্বরী নদী। এমনি এক নৈসর্গিক পরিবেশে ধীতাং ধীতাং করে হেটে আসছিল সোমেশ্বরী নদীর কুল থেকে জল নিয়ে একটি পাহাড়ি মেয়ে। বাড়িতে যখন প্রবেশ করি, তখনই ঐ মেয়ের সাথে দেখা হয়। বিশু বলছিল, ও আমার ছোট বোন জরী দিব্রা।
জরী দিব্রাকে সেদিন শুধু দেখেই এসেছিলাম। ওর
সাথে আমার কোনো কথা হয়নি। কিন্তু পাহাড় আর অরণ্যের সেই নির্জনতায় ওকে একদম প্রকৃতি কন্যার মতো লাগছিল। পথে আসতে আসতে আমি বিশুকে জিজ্ঞাসা করি, তোমার বোনটি কী করে?
বিশু : কিছু করে না। এই স্কুলেই পঞ্চম ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে। তারপর আর পড়ানো হয় নাই।
আমি : বিয়ে দিয়েছ?
বিশু : না।
আমি : বিয়ে দিয়ে দাওনা কেন?
বিশু : বিয়ে দিতে পারিনা গুড্ডুর জন্য। ও বিয়ে দিতে দেয় না। আবার নিজেও বিয়ে করবে না। ও খুব মাস্তান ছেলে। ষন্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। জরীর বিয়ে আসলে বিয়ে ভেঙে দেয়। পাত্রকে ভয় ভীতি দেখায়।
আমি : গুড্ডু কোথায় থাকে?
বিশু : রানীখং গির্জার পাশের পুঞ্জিতে ।
আমি নিজেকে নিজে খুব ধিক্কার দিচ্ছিলাম। একজন শহীদের মেয়েকে দেখবার কী কেউ এখানে নেই? সবাই কী সন্ত্রাসী দেখে ভয় পায়? সবাই কী সন্ত্রাসের কাছে জিম্মি?
একদিন গির্জায় যেতে পথে গুড্ডুর সাথে আমার দেখা হয়! গুড্ডু আমাকে দেখে শাসিয়ে বলে — ‘এই মাস্টার, তুমি নাকি বিশুদের অভিভাবক হইয়াছ? হও। একেবারে সোমেশ্বরী দিয়া ভাসাইয়া দিব। ‘
আমি বললাম, তুই দিস। আমিও দেখব তোকে।
গ্রীষ্মের ছুটিতে একবার আমি বাড়িতে চলে আসি। বিশ দিনের ছুটি ছিল। বাবা অসুস্থ তাই পুরো ছুটির সময়টা আমি বাড়িতেই থাকি। মাঝে মাঝে জেলা সদরের অফিসে যেয়ে বদলি আদেশের তদবির করি। বদলি আদেশটি হয়েও যায়। বদলি করা হয় মুক্তাগাছা থানার একটি স্কুলে। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র আড়াই মাইল দূরে। ছুটি শেষে আমাকে এই স্কুলে এসে যোগদান করতে হবে।
আবারও রোড টু রানীখং :
সকাল এগারটায় জারিয়া এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছাড়ে ময়মনসিংহ জংশন থেকে। ট্রেনটি যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হচ্ছিল, জানালা খুলে আজকেও দেখছিলাম দূরের জলরাশি। ভাবছিলাম, নিজের কথা। আমিও কী তবে কাপুরুষ হলাম? কেউ কেউ বলবে, আমি ভয়ে বদলি নিয়ে চলে যাচ্ছি। গুড্ডু শুনে অট্টহাসি দেবে। এই সব ভাবতেই ভাবতেই ট্রেনটি একসময় জারিয়া পৌঁছে যায়।
আজও নৌকায় পার হচ্ছিলাম সোমেশ্বরী নদী। সোমেশ্বরীর জল আজ কেমন যেন স্তব্ধ ও স্থির মনে হচ্ছিল।
আমি হেড মাস্টারজিকে আমার বদলি আদেশের কপি দেই। উনি সেটি ফরোয়ার্ড করে থালা অফিসে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। বিশুকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। হেড মাস্টারজিকে বলি — বিশু কোথায়?
হেড মাস্টারজি : ও আজ দুতিন দিন ধরে অনুপস্থিত। শুনেছি, ওদের বাড়িতে নাকি কী ঝামেলা হয়েছে।
আমার অন্তর্আত্মায় খুব টান দিল। বিশু তো স্কুলে অনুপস্থিত থাকার ছেলে নয়। আমি পরের দিন আমার বদলির কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কাজ শেষে বিকালের দিকে বিশুদের বাড়িতে চলে যাই। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আমি ওদের ঘরের দরজার কাছে যেয়ে বিশুকে ডাকি। বিশু ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বাড়ির কাঠের বারান্দায় বসে আমি ওর সাথে কথা বলতে থাকি।
ওর সাথে যখন কথা বলছিলাম, তখন ঘরের ভিতরে থেকে একটি মেয়ের গুমরে গুমরে কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি ওকে বলি — কে কাঁদছে?
বিশু : জরী কাঁদছে।
আমি : কী হয়েছে ওর?
বিশু আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। ও আমাকে যা বলল, তাহলো জরি গুড্ডু কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছে। সেই থেকে ও কেবল কাঁদছে। মা অসুস্থ। জরিকে চোখের অাড়াল করতে পারছে না। চোখের আড়াল হলেই ও যদি আত্মহত্যা করে।
আমি সেই সন্ধ্যায় বিশু ও বিশুর মাকে বললাম, যদি আপনেরা রাজি হন তাহলে আমি জরীকে বিবাহ করব। এবং কাল প্রত্যুষেই ওকে নিয়ে এই এলাকা ছেড়ে চলে যাব।
বিশু : আপনি তো হিন্দু ধর্মীয় ….।
আমি : খ্রীষ্ট ধর্ম মোতাবিকই ওকে বিয়ে করব।
ওরা রাজি হয়। সন্ধ্যা রাতেই জরীকে নিয়ে আমি ও বিশু চলে যাই রানীখং গির্জায়। গির্জার ফাদার আমার সাথে জরিকে বিবাহ পড়িয়ে দেয়।
আমরা যখন জরীকে নিয়ে ওদের বাড়ি যাচ্ছিলাম, তখন দেখে ফেলে গুড্ডু। বিশু খুব ভয় পাচ্ছিল। ও বলছিল, ছোট মাস্টোরজি — সাবধানে থাকতে হবে। গুড্ডু খুব খারাপ ছেলে।
আমাকে সে রাতে বিশু আর বিশুর মা স্কুলে ফিরে আসতে দেয়নি। আমি ওদের বাড়িতেই থেকে যাই। পাশের একটি ঘরে সারারাত প্রায় লন্ঠণ জ্বেলে রেখেছিলাম। দু একটা করে কথা বলার চেষ্টা করছিলাম জরীর সাথে। লন্ঠণের আলোয় দেখছিলাম জরীর মুখখানি। সেদিনের সেই ধীতাং ধীতাং করে চলা মেয়েটি আজ কেবলই স্তব্ধ ও নির্বাক হয়ে আছে। আমার সাথে একটি কথাও বলছে না। ম্লান মুখে চেয়ে রইল লন্ঠনের অালোর দিকে। আমি ওর বিষাদ দুটো চোখের দিকে চেয়ে ভাবছিলাম — এমনই তুমি হতভাগী! বাসর সজ্জাটাও তোমার সাথে পাতা হলো না।
* * * * * * * * * * * *
লেখকের জবানবন্দি :
খুব ভোরবেলা জরির ঘুম ভাঙ্গে। চেয়ে দেখে ছোট মাষ্টারজি ঘরে নেই। তখনও মিটমিট করে লণ্ঠন জ্বলছিল। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে দরজাটির খিল ভাঙা। বাইরে থেকে কেউ ভেঙেছে এই রকম মনে হলো। জরী চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। বিশু পাশের ঘর থেকে উঠে আসে। বাড়ির উঠোনে দেখতে পায়, ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে।
* * * * * * * * * * * * *
তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি :
তারও বছর ছয়েক পরের কথা। একদিন প্রভাতবেলায় বিশু একটি বাচ্চা ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে আসে। ক্লাসে সেদিন ছিল ছোট মাস্টারজির মতো একজন নবীন শিক্ষক। সেই নবীন শিক্ষক বাচ্চেটিকে জিজ্ঞাসা করে — ‘বাবু তোমার নাম কি?’
বাচ্চাটি : সুদীপ্ত কুমার দিব্রা
শিক্ষক : তোমার মায়ের নাম কি?
সুদীপ্ত. : জরী দিব্রা
শিক্ষক : তোমার পিতার নাম কি?
সুদীপ্ত : স্বর্গীয় সুনীল কুমার রায়।
২২. বেনারসি শাড়ি
এ টি এম তাজুল ইসলাম সাহেব চাকুরী করেন একটি ইন্ডেন্টিং ফার্মে। সকাল নয়টায় অফিসে যান। কিন্তু বিকালে বাসায় ফিরবার কোনো টাইম টেবিল নেই তার। এক একদিন এক এক রকম সময়ে অফিস ছুটি হয়। অনেকটা মালিকের মর্জিমত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাত আটটা নয়টা বেজে যায়।
কিন্তু আজ বিকাল পাঁচ ঘটিকার সময় তাজুল সাহেব তার বসের কাছে যেয়ে বলে — স্যার, আজকে আমার একটু তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। অনুগ্রহপূর্বক ছুটি দেবেন।
—- এত তাড়াতাড়ি কেন যাবেন বাসায়?
—- আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। সকালে যখন অফিসে আসি তখন আমার স্ত্রী বলে দিয়েছে, আমি যেন আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরি।
—- ঠিক আছে যান।
—- স্যার কিছু মনে করবেন না। আমাকে কিছু অগ্রিম মাহিনা দেবেন?
বস অনেকটা বিরক্ত হয়ে বলে — আপনাকে আগে আগে ছুটি দিলাম। এখন আবার টাকা চাচ্ছেন? কি করবেন টাকা দিয়ে?
—– স্যার, স্ত্রীর জন্য একটি লাল রঙের বেনারসি শাড়ি কিনে নিয়ে যাব।
—– ক্যাশে তো আজ টাকা নেই। ঠিক আছে, একাউন্টটেন্টের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে যান।
তাজুল সাহেব অফিস থেকে ফিরবার পথে মিরপুর বেনারসি পল্লী থেকে একটি লাল রঙের বেনারসি শাড়ি কিনেন। তখন সন্ধ্যা গত হয়ে রাত হয়েছে। হঠাৎ আকাশে মেঘ গর্জন করে মুশুলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। রাস্তায় কোনো রিক্সা ছিল না। সে বৃষ্টিতে ভিজে হেঁটে হেঁটে কালশীতে তার বাসায় চলে আসে। বৃষ্টির পানিতে শাড়িটি যেন না ভিজে যায় তারজন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল সে। বুকে চেপে ধরেছিল শাড়ির বক্সটি। কিন্তু তারপরও শাড়িটি ভিজে চুপসে যায়।
বাসায় যখন পৌঁছে তখনও মুশুলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। সাথে দমকা বাতাস। ভেজা শাড়ির বক্সটি টেবিলের উপর রেখে তাজুল সাহেব খাটে শুয়ে থাকা তার স্ত্রীর কাছে যেয়ে বসে। বলে তোমার কী হয়েছে? শুইয়ে আছ কেন?
তাজুল সাহেবের স্ত্রী রুখসানা বেগম কিছু বলার আগেই তিনি তার স্ত্রীর কপালে হাত রাখেন। দেখে শরীরে প্রচন্ড জ্বর। মনে হচ্ছে যেন সারা শরীর আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি কী ঔষধ খেয়েছ? ‘ তার স্ত্রী মাথা নেড়ে বলে : ‘ দুপুর থেকে হঠাৎ করেই জ্বর চলে আসে। আমি নাপা ট্যাবলেট খেয়েছি। ‘
—- তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই?
—- হাসপাতালে নিতে হবে না। এমনিতেই ভাল হয়ে যাব।
—- তুমি কী কিছু খেয়েছ?
—- না। খেতে ইচ্ছা করছেনা। তুমি খেয়ে নাও। দুপুরের ভাত আছে।
তাজুল সাহেব মাথা নেড়ে বলে, ‘ আচ্ছা, খেয়ে নেব। ‘
তাজুল সাহেব স্ত্রীর শিয়রেই বসে থাকেন। আস্তে আস্তে রাত বাড়তে থাকে। টেবিলে রাখা বেনারসি শাড়ির বক্সের দিকে একবার সে তাকায়। দেখে, বক্সের ভিতর থেকে পানি চুয়ে চুয়ে টেবিল ভিজে যাচ্ছে। লাল রঙের পানি। শাড়িটি বের করে বাইরে মেলে দিতে তার আর ইচ্ছা হলো না।
সে তার স্ত্রীর পাশেই বসে আছে। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, বিয়ের পরে এক শ্রাবণ রাতের কথা। আজকের মতো এমনি বৃষ্টি ছিল সেদিন। এমনি ঝড়ো বাতাস বয়েছিল উত্তরের জানালা দিয়ে । রুখসানা সেই রাতে বলেছিল — ‘ এমন বৃষ্টির রাতে এসো আমরা সারারাত জেগে থাকি। এমন বৃষ্টির সময়ে ঘুমিয়ে রাত শেষ করতে হয় না। ‘
আমারও কী যে ভাল লাগছিল! আমি তো কবি ছিলাম না, তারপরেও মন চেয়েছিল একটি কবিতা লিখতে। লিখেওছিলাম একটি কবিতা, ‘ আজি ঝড়ের রাতে। ‘
তাজুল সাহেব তার স্ত্রীর কপালে আবারও হাত রাখে। জ্বরের প্রচণ্ডতায় তার হাত পুড়ে যাচ্ছিল। সে বালতিতে করে পানি এনে মাথায় জল ঢালতে থাকে। প্রায় ঘন্টা খানেকের মতো একটানা মাথায় জল ঢালে। জ্বর কিছুটা কমে গেলে সে তার কপালে জলপট্টি দিতে থাকে। একসময় দেখে তার স্ত্রী ঘুমিয়ে যায়। সে নিজে আর ঘুমায় না।
তাজুল সাহেব তার স্ত্রীর ঘুমন্ত মুখখানির দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবছিল, সেই সাত ৰছর আগের বাসর রাতের কথা। তাদের বিয়েতে সেদিন কোনো উৎসব হয়নাই। গায়ে কোনো হলুদ দেওয়া হয়নি কারোরই। তার পরনে ছিলনা শেরওয়ানি। মাথায় কোনো ঝালর টুপি পরে নাই। রুখসানাও পরেনি লাল রঙের বেনারসি শাড়ি। এক ক্রান্তিকাল পরিস্থিতিতে তাদের সেদিন বিয়ে হয়েছিল। ক্লান্তিতে সেদিনও রুখসানা ঘুমিয়ে পড়েছিল আগেই। সে আর তার ঘুম ভাঙায়নি। ‘
তাজুল সাহেব স্ত্রীর শিয়রেই বসেই সেবা করে সারারাত। তারপর একসময় ভোর হয়ে যায়। ঘরের ভিতরে সূর্যের আলোক রশ্মি এসে রুখসানার মুখে পড়ে। ভোরের সেই আলোর রোশনাইতে রুখসানার মুখখানি ভীষন মায়াময় দেখাচ্ছিল। হঠাৎ আলোর কিরণে সে একসময় চোখ মেলে তাকায়। দেখে তার স্বামী পরম বিস্ময়ে তারই দিকে তাকিয়ে আছে।
তাজুল সাহেবের একটি হাত আবার রুখসানার কপালে রাখে। দেখে জ্বর নেই। সারারাত জেগে থাকার নির্ঘুম ক্লান্ত শরীর প্রসন্ন লাগছিল তার। কাগজের বক্সটি খুলে ভেজা বেনারসি শাড়িটি বের করে রুখসানার গায়ের উপর জড়িয়ে ধরে। এবং বুকের উপর সে মুখ গুজে থাকে। রুখসানাও যেন প্রাণ পেয়ে বলছিল তখন —-
‘ আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো–
নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে। ‘
২৩. হাস্নাহেনা
সাধারণত গ্রামের বাড়িতে বাড়ির কোনো নাম থাকে না। কিন্তু সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর তীরে জয়নগর নামে একটি গ্রামে একটি বাড়ির নাম আছে ‘হাস্নাহেনা’। পুরানো টিনের সীটের উপরে অস্পষ্ট ভাবে আলকাতরা দিয়ে এখনও লেখা আছে এই নামটি। পুরো বাড়িটা হাস্নাহেনা ফুলের ঝাড়ে ঢাকা। ফাঁকে ফাঁকে দুই একটা ফলের গাছ থাকলেও সে গাছগুলো হাস্নাহেনা ফুলের ঝাড়ে জঙ্গল হয়ে গেছে। বাড়িতে দুটো জীর্ণ টিনের ঘর অাছে। এই পুরোনো জীর্ণ বাড়িতে বসবাস করে আশি বছরের বৃদ্ধ সেকেন্দার আলী। যার সংসারে কেউ নেই।
গত বছর হেমন্তে বাড়িতে গেলে এই ‘হাস্নাহেনা ‘ বাড়িটিতে গিয়েছিলাম। একাকী হাঁটতে হাঁটতে জয়নগর গ্রামে এই বাড়ীটিতে চলে যাই। তখন সন্ধ্যা। সূর্য কিছু আগে অস্তমিত হয়েছে। বাড়িটি দেখে আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। পুরো বাড়িটা যেন একটি হাস্নাহেনা ফুলের বাগান। হেমন্তে সব ফুল ফুটে গেছে। পুরো প্রাঙ্গন হাস্নাহেনার গন্ধে মৌ মৌ করছে। আমি প্রাণ ভরে এর নিঃশ্বাস নিতে থাকি।
আমি ষখন ওখানে যাই, তখন দেখি, বৃদ্ধ সেকান্দার আলী ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির ছোট পুকুর পাড়ের দিকে যাচ্ছে। আমি তাকে সালাম দিয়ে আমার পরিচয় দেই। সে আমাকে চিনতে পারে। সে আমাকে নিয়ে পুকুর পাড়ে একটি কবরের কাছে নিয়ে যায়। কী আশ্চর্য! এই কবরটিও হাস্নাহেনা ফুলে ফুলে ঢাকা। দেখি পুকুর পাড়ে কবরের কাছে একটি কাঠের হেলাঞ্চা চেয়ার রাখা আছে। যে চেয়ারে তিন চার জন একসাথে বসা যায়।
সেকেন্দার দাদাভাই ও আমি সেই চেয়ারটাতে বসি। আমি তাকে বলি : কেমন আছেন আপনি।?
—- ‘ভালই আছি। এইযে এখানে যে কবরটি দেখছ, সেটি আমার স্ত্রীর কবর। অনেক রাত পর্যন্ত এখানেই বসে থাকি একাকী। খুব ভাল সময় কাটে।’
সে যখন আমার সাথে কথা বলছিল, সে কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছিল বারবার। আমি বললাম, আমি বরঞ্চ চলে যাই। আপনি একাকীই থাকেন। আমার মনে হয় আপনি একাকী ভালো থাকেন। তিনি আমাকে সম্মতি দিয়ে বললেন : ‘.আচ্ছা, যাও। ‘
ষাট বছর আগে :
এই কাহিনীটি প্রায় অর্ধশত বছরেরও বেশি আগেকার। বাংলার মাটি বাংলার জল ধন্য করে আব্দুল মজিদ শেখের ঘরে একে একে পাঁচটি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। তিনি বহু আদর করে তাঁর পাঁচ কন্যার নাম রাখলেন ফুলের নামে — হাস্নাহেনা, শেফালী, চামেলী, জবা ও বকুল। বকুলের যখন জন্ম হয়, তখন হাস্নাহেনার বয়স চোদ্দ বছর। পিতা আব্দুল মজিদ শেখ কেন জানি তাঁর বড় কন্যা হাস্নাহেনাকে একটু বেশি আদর করতেন।
সবচেয়ে বড় কন্যা নাকি বাবার কাছে বেশি আহলাদি হয়। বাবার মায়ের আসনও নাকি বড় মেয়েই নিয়ে নেয়। হাস্নাহেনাও তার বাবার মায়ের অাসনটি নিয়ে ফেলেছিল সবার অলক্ষ্যে।
হাস্নেহেনা পঞ্চম ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পেরেছিল। তখন গ্রামে মেয়েদের এরচেয়ে বেশি লেখাপড়া করার সুযোগ ছিল না। সে ছিল অত্যন্ত লক্ষ্মী একটি মেয়ে। সকালবেলা প্রতিদিন হাঁসমুরগীর খোয়ারের দরজা খুলে দিত এবং ধান কুঁড়ো চাল সেই খেতে দিত। কবুতরের ঘরের দরজাও হাস্নাহেনা খুলত। কবুতরগুলো যখন বেরিয়ে ঘরের চালে যেয়ে বসত, তাদের উড়ে যাবার ডানা মেলার শব্দ সে শুনত কান পেতে।
হাস্নাহেনা দেখতেও ছিল ফুলের মতই লাস্যময়ী। গ্রামে তখন মেয়েদের অল্প বয়স থেকেই শাড়ি পড়তে হতো। হাস্নাহেনাকেও নয় দশ বছর বয়স থেকেই শাড়ি পড়তে হয়েছিল। বাবা আব্দুল মজিদ শেখ প্রথম লাল সবুজ রঙের চেক শাড়িটি কিনে এনে দিয়েছিল ছোনগাছা হাট থেকে। শাড়িটি পড়ে হাস্নাহেনা সেদিন উঠনে ছোট ছোট করে পা ফেলে হাঁটছিল। আর স্মিত হাস্যে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাচ্ছিল পরম খুশি মনে।
মাত্র চোদ্দ বছর বয়সেই এক অগ্রহায়ণে হাস্নাহেনার বিয়ে ঠিক হয়ে যায় পার্শ্ববর্তী গ্রামের মরহুম আব্দুল আলীর পুত্র সেকেন্দার আলীর সাথে। সেকেন্দার শিশু বয়সেই পিতৃহীন হয়। ওর আর কোনো ভাই বোন নেই। মাকে নিয়ে সংসার। থার্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করার পর আর পড়ে নাই। চাকুরীও করে না। জমি জিরাত ভালোই আছে। তাই দিয়ে চলে সংসার।
দিন ক্ষণ দেখে বিয়ের তারিখ ধার্য হয় : ১৪ ই অগ্রহায়ণ, ব়হস্পতিবার, ১৩৬৩ বাংলা সন। আব্দুল মজিদ শেখ দুই তিন গ্রাম মিলে হাজার লোককে দাওয়াত দেয়। গঞ্জে থেকে বিয়ের যাবতীয় সওদা করে। হাস্নাহেনার জন্য কানের একজোড়া ঝুমকা, হাতের শাঁখা, গলার মালা, কোমরে রূপার বিছা এবং পায়ের জন্য রুপার ছড়া বানালেন পাঁচকৌড়ি কর্মকারকে দিয়ে। কুড়াগাছা হাট থেকে লোকজনদেরকে খাওয়ানোর জন্য আনলেন একটি মহিষ, একটি গরু ও একটি বড় খাসি ।
গাঁয়ের উঠতি বয়সের ছেলেরা আব্দুল মজিদ শেখের কাছে এসে বায়না করল — ‘ চাচা, আমরা হাস্নাহেনার বিয়েতে শহর থেকে কলের গান নিয়ে আসব আর বাগবাটী সুবোধ গায়েনের কাছ থেকে ব্যান্ড পার্টি আনব। ‘ আব্দুল মজিদ শেখ সহাস্যে রাজি হয়ে বললেন — ‘ যাও তোমরা আজই বায়না করে আসো। টাকা যা লাগবে আমি দেব। তবে ভাল দেখে গান নিয়ে আসবে। আব্বাস উদ্দিন, কানন দেবী, মধুবালাদের যত ভাল ভাল গান। ‘
হঠাৎ বিয়ের দুইদিন আগে হাস্নাহেনার জ্বর আসে। মকবুল ডাক্তারের কাছ থেকে ঔষধ এনে খাওয়ানো হয়। যেহেতু বিয়ের আয়োজন সব সম্পূর্ণ। তাই আর তারিখ পিছানো হলো না। সবাই আশা করল, এই দুইদিনে জ্বর ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু, ভাল হলো না। যথারীতি বিয়ের দিন শহর থেকে কলের গান আসল। সুবোধ গায়েনের ব্যান্ড পার্টি আসল। মহিষ গরু ছাগল জবাই করা হলো। মহাসমারোহে রান্না বান্না হতে লাগল। বাবুর্চি আনা হলো কাজিপুরের জোজোরিয়ার চর থেকে। সবাই বলাবলি করতে লাগল — ‘ তরকারি দারুণ স্বাদের হইবে। ‘
দুপুরের আগেই দামান আসল পাল্কিতে চড়ে। পরনে সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় জিন্নাহ টুপি। বিয়ে পড়ানোর জন্য আবুল মুন্সীকে ডাকা হলো। দুই হাজার এক টাকা দেনমোহর ধার্য করে কাজী সাহেব বিয়ে পড়ালেন। হাস্নাহেনা অন্দর বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শোয়া ছিল। সাক্ষীরা যেয়ে তার কাছ থেকে সম্মতি আনলেন। আবুল মুন্সী কালেমা পাঠ করলেন। এবং নব দম্পতির জন্য সুখ শান্তি চেয়ে মোনাজাত করলেন।
এরপর মহা ধূমধামে ভোজন পর্ব সমাপ্ত হলো। মেহমানরা প্রায় সবাই চলে গেল যার যার মতো। কিন্তু কলের গান থেমে ছিল না। ব্যান্ড পার্টির বাজনাও বাজছিল। জামাইকে যখন অন্দর মহলে নেওয়া হবে, ঠিক তখনই ভিতর থেকে অার্ত চিৎকার শোনা যায়। হঠাৎ এই চিৎকারে কলের গান থেমে যায়। ব্যান্ড পার্টির বাজনা বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগেই সব প্রাণ স্পন্দন থেমে যায় হাস্নাহেনার। নিথর হয়ে যায় তার কিশোরী দেহ। তখনও ওর পরনে ছিল লাল শাড়ি, কানে ছিল ঝুমকা, গলায় ছিল মালা, আর হাতে ছিল শাঁখা। এসবই তার শরীর থেকে খুলে ফেলা হয়। বরোই পাতার গরম জলে তাকে গোসল করানো হয়। তারপর সাদা কাফনের কাপড় পরানো হয়। সেই কাপড়ে আতর গোলাপ আর চন্দনের সুবাস মেখে দেওয়া হয়।
প্রিয় মানুষদের ক্রন্দনধ্বনিতে খাটিয়ায় শুয়ে হাস্নাহেনা শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। শব যাত্রায় সেকেন্দার আলীর পরনে তখনও ছিল বিয়ের সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবি। সেদিনের সেই অশ্রু জলে ভেজা বিষণ্ণ সন্ধ্যায় সেকেন্দার আলীর বাড়ির পুকুর পাড়েই হাস্নাহেনাকে সমাধীস্থ করা হুয়।
ষাট বছর পরে :
সেকেন্দার আলী তাঁর দীর্ঘ জীবনে আর বিয়ে করেনি। সে একাকী কাটিয়েছে জীবনকাল। যে থাকে যখন থাকে — অন্তরে অন্তরেই থাকে। ভালোবাসা কখনই দূরের হয়ে যায় না। প্রকৃত প্রেম একা হয় না কখনও। বড়ই মায়া হলো বৃদ্ধ সেকেন্দার আলীর সাথে কথা বলে। হেমন্তে পূর্ণিমার চাঁদ উঠলে মনে পড়ে কী তার হাস্নাহেনার কথা? কোনো বৃষ্টি ভেজা লোনা হাওয়ায় হাস্নাহেনার সুবাস নিয়ে কী সে ঘুমিয়ে পড়ে? কেউ কোনোদিন তাকে কী বলেছে — এত কষ্টভোগের পরও তুমি তাকেই নিয়ে কেন আছো? তাকে তো কোনোদিনই পাওনি।
সেকেন্দার আলী আজও পূর্ণিমা চাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে পুকুরপাড়ে গভীর নিশীথ পর্যন্ত। সে কোনো অচিনপুরের দিকে চলে যেতে চায় না তো? যেখানে আছে হাস্নাহেনার ঝাড়। যে মৃত্তিকা তলে শুয়ে আছে তাঁর হাস্নাহেনা।
২৪. তাঁর পদচিহ্ন
আমি তখন একটি কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত । সেদিন অফিসে খুব কাজ ছিল। লেটার অফ ক্রেডিটের শর্ত অনুযায়ী পরেরদিনই শিপমেন্টের শেষ দিন, তাই সকাল থেকে অফিসে খুব ব্যস্ত সময় পার করছিলাম। এরই ফাঁকে রিসেপশনিস্ট এসে বলেছিল — ‘স্যার, একটা বৃদ্ধ লোক অাপনার সাথে দেখা করতে চায়। …..’ আমি তার নাম শুনবার আগেই বলেছিলাম : ওনাকে বসতে বলো, আমি ফ্রী হলে ডাকব তাকে।’
ভাগ্যটা মনে হয় এমনই আজ, ‘পড়বি পর মালীর ঘারেই’ এর মতো অবস্থা আমার। আজই আমাদের বিবাহেরও পাঁচতম বার্ষিকী। কাজগুলো তাই দ্রুততার সহিত শেষ করে ফেলি। ফাঁকে দিয়ে লাঞ্চটাও সেরে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম , একটি লোককে বাইরে বসিয়ে রেখেছি। বিকেলে বের হওয়ার সময় হঠাৎ মনে পড়ে তার কথা। আমি রিসেপশনিস্টকে বলি — ‘ ঐ লোকটি কোথায়?’
—- উনি বাইরে বারান্দায় বসে আছে। ভিতরে বসতে বলেছিলাম, বসেনি।
আমি বারান্দায় চলে আসি। দেখি, টুলের উপরে লুঙ্গী পরা একজন বৃদ্ধ লোক পিছন দিক হয়ে বসে আছে। লোকটা তখন ঝিমুচ্ছিল। সহসা চিনতে পারছিলাম না তাকে। ভাল করে যখন সে চোখ মেলে, তখন তাকে চিনতে পারি। ইনি গফরগাঁও এর কান্দিরপাড়ের আছির উদদীন চাচা।
আমি তাকে হাত ধরে নিয়ে ভিতরে বসাই। চোখে মুখে তার রোগ ক্লিষ্ঠতার ছাপ। সকাল থেকে সে যে কিছু খায়নি, এটা বোঝা গেল। নিজকে খুবই অপরাধী লাগছিল। আমি পিয়নকে দিয়ে হোটেল থেকে কিছু খাবার আনালাম। সে তৃপ্ত সহকারে সে খাবারগুলো খেয়ে নেয়।
আমি বললাম, সেই কত বছর পর আপনাকে দেখলাম। হঠাৎ এভাবে চলে এলেন? আপনি কীভাবে জানলেন, আমি এখানে আছি।
—- সে অনেক কথা। অনেক কষ্ট করিয়া তোমার খোঁজ আমি পাইয়াছি।
—- চাচি মা কেমন আছে?
—- দুই মাস আগে মারা গিয়াছে। আল্লাহ এমন রোগ তাহাকে দিয়াছিল। আমার যেটুকু জমি জিরাত ছিল, তা সবই তাহার চিকিৎসার জন্য শেষ করিয়া দিয়াছি। তারপরেও তাহাকে বাঁচাইতে পারি নাই।
—- আকলিমাকে কোথায় ৰিয়ে দিয়েছেন?
—- শম্ভুগঞ্জ চটকলের এক কেরানির সাথে।
—- তাসলিমা তো মনে হয় এখন অনেক ৰড় হয়েছে। ওকে কী বিয়ে দিয়েছেন?
—- ‘না। বাবা, আমি খুব বিপদে পড়িয়া এবং নিরাশ্রয় হইয়া তোমার কাছে আসিয়াছি।’
এই কথা বলে সে আমার দুটো হাত ধরে, এবং অনুনয় করে বলে — ‘আমাকে কিছু টাকা দিয়া সাহায্য করো। যদি আমি পারি, তোমাকে সে টাকা ফেরত দিয়া দিব। ‘
সে আরও বলছিল, ‘তুমি তো জানো আমার কোনো ছেলে নাই। আমার শরীরটা ভালো যাইতেছে না। যে কোনো সময় ইহলোক ত্যাগ করিতে পারি। তাসলিমার একটি বিবাহ দিতে পারিলে আমি বাঁচি। ওর বিবাহের জন্যই এই টাকা আমি তোমার কাছে ধার চাহিতেছি। ‘
আমি তাকে বলি, আপনি আমার হাত ধরে এভাবে অনুনয় করে বলছেন কেন? ঠিক অাছে, আমি যতটুকু পারি, তাসলিমার বিয়ের খরচের টাকা দিব। সে টাকা আপনাকে পরিশোধ করতে হবে না।’
দেখলাম, মুহূর্তেই আছির উদ্দিন চাচার মলিন মুখে হাসি ফুটে উঠল।
তখন সন্ধ্যা গত হয়ে গিয়েছে। এই সন্ধ্যারাতে বৃদ্ধ এই লোকটিকে আমি টাকা দিয়ে বিদায় করতে পারতাম। কিন্তু আমার বিবেকে বাঁধল। রোগক্লীষ্ঠ শরীরে কিভাবে তাকে এই রাতের বেলায় একাকী পাঠিয়ে দেই। আমি ওনাকে বললাম — আজ আমার বাসায় থাকবেন। কাল সকালের ট্রেনে আপনি চলে যাবেন।
আমার গাড়ির পিছনের সিটে বসিয়ে ওনাকে বাসায় নিয়ে আসি। আমার স্ত্রী শারমীন দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেল, আমি তাকে হাত ধরে নামিয়ে ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসালাম। নোংরা কাপড় আর ধূলি মাখা পায়ে একটি লোককে পরিপাটি একটি সোফায় বসাই, তা দেখে শারমীন বিস্মিত হচ্ছিল, পাশের রুমে বসে সে আমাকে বলছিল — ‘উনি কে? ওনাকে তো চিনলাম
না। ‘
—- ‘তুমি চিনবে না। আমার পরিচিত। গফরগাঁও থাকে।
—- তুমি তো কখনও ওনার কথা বলোনি।
—– পৃথিবীতে চলতে চলতে কত মানুষের সাথেই তো পরিচয় হয়। কার কথা কে কাকে অত বলে। অনেক মানুষই অজানা থেকে যায়, অনেকের কাছে। এই ধরো, তোমার সব পরিচিত মানুষকে কী আমি চিনি? কিংবা তাদের সবার কথা কী তুমি আমাকে বলেছ?
—- আচ্ছা, তা ঠিক। তুমি কী ভুলে গেছ, আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী? আমার জন্য কী গিফট এনেছ?
—- ‘কিছু কেনা হয়নি। তোমার জন্য গিফট কিনব বলে যে টাকা উঠায়েছিলাম, তা কাল সকালে ওনাকে দিতে হবে। উনি খুব বিপদে পড়ে আমার কাছে এসেছে।’
শারমিন খুব মন খারাপ করে বলল — ‘ আচ্ছা, দিও।’
শারমীন একটু বিরক্ত হয়ে বলছিল — ‘ওনাকে শুইতে দেবে কোথায়?
—– কেন? ড্রয়িং রুমে ডিভানের উপরই শুবে।
শারমীন একটু শ্লেষ সুরে বলছিল — ‘উনি কী আমাদের সাথে বসে খাবে? ‘
—- হ্যাঁ, উনি আমাদের সাথে ডাইনিং টেবিলে বসেই খাবে।
—– মনে হচ্ছে উনি তোমার শ্বশুর। কী আগে কোনো বিয়ে করেছিলে নাকি?
—– দেখো, তুমি ঝগড়া করো না।
শারমীনের সাথে আমার আরো কিছু কথা কাটাকাটি হয়েছিল। পরে আমার মনে হলো, আমার সম্পর্কে ওর ভুল ধারণাটি ভেঙে দেওয়া দরকার। আমি ওকে কাছে ডেকে বলি —
‘ দেখো, অনেকের জীবনে এমন কিছু ঘটনা থাকে, তা অনেক সময় গোপন রাখে। স্বামী তার স্ত্রীর কাছে কিংবা স্ত্রী তার স্বামীর কাছে সেসব কথা বলে না। লুকিয়ে বা গোপণ করে রাখে সারা জীবন। আছির উদ্দিন চাচার কথা তোমাকে আমি বলিনি এই জন্য যে, যদি তুমি আমাকে অবহেলা বা ছোট করে দেখ, এই জন্য।
আমি ওনাদের বাড়িতে পাঁচ বছর জায়গীর থেকে লেখাপড়া করেছি। জায়গীর থেকে লেখা পড়া করাকে অনেকে ছোট করে দেখে। হয়ত তুমি আমাকে বলতে — ‘আমি অনাথ।’ তাই তোমাকে সেকথা কোনোদিন বলিনি। আসির উদদীন চাচার কাছে, ওনার পরিবারটির কাছে আমি অনেক ঋণী। এই যে আমি অাজ এত বড় হয়েছি, তার পিছনে ওনাদের অনেক ত্যাগ আছে। অনেক দুঃখ কষ্ট আছে। অনেক অশ্রু জল মিশে আছে। ‘
শারমীন আমার দুহাত চেপে ধরে বলে —‘ লক্ষীসোনা, এই পাঁচ বছরে তুমি আমাকে এইটুকুই চিনলে? আমি কী এতই খারাপ মেয়ে? তোমাকে আমি বুঝব না? ওনার কাছে এত অকৃতজ্ঞ হইও না। আজ আমাদের বিয়ের পাঁচ বছর পূর্তি হচ্ছে। আজকের এই বিশেষ দিনে — চলো, আমরা আসির উদ্দিন চাচার পা ছুঁয়ে কদমবুচি করে আসি।’
আমরা দুজন ড্রয়িং রুমে যেয়ে দেখি, আছির উদদীন চাচা সেখানে নেই। সাদা কার্পেটের উপর তাঁর ধুলো পায়ের কতকগুলি পদচিহ্ন রেখে কখন যে সে চলে গেছে জানি নাই।
২৫. পথের কড়চা
প্রাক যৌবন পর্বের কথা। সেবার ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ যাচ্ছিলাম। মহাখালী থেকে বিকেলের বাসে উঠে প্রথমে চলে আসি ভূয়াপুর। সেখান থেকে লঞ্চে সিরাজগঞ্জ। ভূয়াপুরের চর গাবসারা থেকে লঞ্চ ছাড়ে সন্ধ্যার আগেই। যমুনার জল ঠেলে ভটভট করে লঞ্চটি চলতে থাকে সিরাজগঞ্জ ঘাটের দিকে। লঞ্চের দোতলায় খোলা কেবিনে বসেছিলাম। চারদিকে শুধু জল আর জল। মাঝে মাঝে যমুনায় জেগে ওঠা চর দেখছিলাম। শীতের মৌসুমে কাশবন মরে শুকিয়ে গেছে। একটি সাদা কাশফুলও কোথাও দেখা গেল না।
মনটা একটু খারাপই লাগছিল।
নদীতেই রাত নেমে এসেছিল। শীতের কুয়াশা ঝরে পড়ছিল অথৈ জলের উপরে। সারা আকাশ জুড়ে জ্বলে উঠেছিল তারা। ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ তুলে লঞ্চটি ছুটে চলছিল ঘাটের দিকে। খুব ভাল লাগছিল রাতের আকাশ আর নদীর জল দেখতে। অথৈ পাথারে জলের উপর দিয়ে লঞ্চ চলছে তো চলছেই। কোথাও গ্রাম নেই। আলো নেই। এই রকম জলের পথ চলতে চলতে একসময় দূরে দেখা যাচ্ছিল সিরাজগঞ্জ শহরের নিয়ন বাতি। মন উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল একটু পরেই ঘাটে পৌঁছব।
সিরাজগঞ্জ ঘাটে পৌঁছতে রাত আটটা বেজে যায়। খুব খিদে লেগেছিল তখন। আমি ঘাটেই একটি হোটেলে যমুনা নদীর আইর মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে নেই। আমাকে যেতে হবে সিরাজগঞ্জ শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে আমাদের গ্রামে। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটেই ভাল ছিলনা। মানুষ সাধারণত হেঁটে চলত। না হয় টমটম কিংবা গুরুর গাড়িতে। আমি একটি রিক্সা নিয়ে শহরের বাহিরগোলায় চলে যাই। ওখানে টমটম পাওয়া যায়। যেয়ে দেখি, স্টেশনের কাছেই একটি শেয়ারিং টমটম দাঁড়িয়ে আছে। তিনজন যাত্রী টমটমে বসে আছে। আর একজন যাত্রীর জন্য কোচয়ান অপেক্ষা করছে। সৌভাগ্যক্রমে আমি চতুর্থ যাত্রী হয়ে টমটমটিতে উঠে বসে পড়ি।
পৌষের শীতের রাত্রি। যাত্রীগুলো সবাই চাদর গায়ে দিয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। তাদের মধ্যে একজন মেয়েও আছে। টমটমটি একসময় কাটাখালী পার হয়ে রহমতগঞ্জ গোরস্থান অতিক্রম করছিল। গ্রামের পথঘাট সন্ধ্যার পরপরই খালি হয়ে গেছে। অন্ধকার রাত্রি। খুব ভয় ভয় লাগছিল। যে লোকগূলো টমটমে বসে আছে তাদের কাউকেই চিনতে পারছিলাম না। মেয়েটিকে তো আরো নয়। কেউ কারোর সাথে তেমন কথাও বলছিল না।
রাস্তার দুপাশের গ্রামগুলো ক্রমশ ঘুমিয়ে পড়ছে। দু একটি বাড়িতে টিমটিমে করে বাতি জ্বলছিল। ঘন কুয়াশায় ফসলের ক্ষেতগুলো ঢেকে গেছে। প্রান্তরের মধ্যে আরো বেশি নিকষ অন্ধকার। আস্তে আস্তে চোখ কেমন যেন ঘনিভূত হয়ে আসছিল। দূরদূরান্তের গ্রাম, বৃক্ষ, গাছ গাছালি কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।
পথে শালুয়াভিটা খেয়াঘাটের কাছে একজন যাত্রী নেমে যায়। আমার ধারণা ছিল ওরা তিনজনই একে অপরের পরিচিত। কিন্তু একজন নেমে যাওয়াতে আমার সেই ভুলটি ভেঙ্গে যায়।
টমটমটি যখন সাহানগাছা গ্রামে পৌঁছে, তখন আরো একজন যাত্রী নেমে যায়। যাত্রীটি নামার পূর্বে আমাকে বলেছিল —‘ আপনি কোথায় নামবেন? আমি বলি, ‘ সামনেই, ছোনগাছা হাট।’
লোকটি বলে —- ‘ মেয়েটি একা। সে সম্ভবত হরিপুর যাবে। আপনি একটু খেয়াল রাখবেন।’
টমটমটি অন্ধকারের ভিতরে সামনের দিকে চলতে থাকে। হঠাৎ এমন একা হয়ে যাওয়াতে একটূ
ভয়ই লাগছিল। পাশেই শ্মশান ঘাট। শিয়াল হুক্কা হুয়া করে ডাকছে। পাকুর গাছে ডাকছিল পেঁচা। আমি আমার চোখ ভয়ে শ্মশান ঘাটের দিক থেকে ফিরিয়ে অন্য দিকে রেখেছিলাম।
মেয়েটিকেও মনে হলো, ভয় পাচ্ছে। সে তখনও চাদর মুড়ে দিয়ে হুবুজুবু করে বসে আছে। ঘোমটা দিয়ে থাকার কারণে তার মুখখানি আমি ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলাম না।
আমি কখনই আগ বাড়িয়ে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলি না। এবারও বললাম না। মেয়েটিও আমার সাথে কোনো কথা বললো না।
সামনের গ্রামটিই ছোনগাছা হাট। যেখানে আমি নেমে পড়ব। টমটমটি সেখানে পৌঁছলে কোচয়ানকে থামাতে বলি। আমি তাকে ভাড়া পরিশোধ করে নেমে পড়ি। খানিকটা পথ হেঁটে চলে আসছিলাম, তখন পিছন থেকে মেয়েটির সকরুণ কন্ঠস্বর শুনতে পাই — ‘তুমি আমাকে একা ফেলে রেখে চলে গেলে !’
এ যে অনেকদিনের অনেক আগের চেনা কন্ঠস্বর! আমি পিছনে ঘুরে তাকাই। কিন্তু টমটমটি ততক্ষণে দ্রুত অনেক দূরে চলে গেছে। বিপুল অন্ধকারের ভিতর স্তব্ধ হয়ে কেবলই ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।
২৬. এই জনারণ্যে
জীবনের এক ক্রান্তিকালে সব ছেড়ে ছুড়ে একদিন চলে এসেছিলাম রাশিয়ার নিষিদ্ধ শহর সামারায়। এই শহরেই শুরু হয়েছিল আমার জীবনের এক অধ্যায়।
সেদিন ছিল বসন্তের এক বিকেল। ভলগা নদীর তীর ধরে একাকী হাঁটছিলাম। মনটা ভালো ছিল না। দূরে জিগোলস্কি পর্বতমালা ঢেকে ছিল মেঘে। উপত্যকায় জড়িয়েছিল কুয়াসার মায়াজাল৷ এখান থেকে দেখা যায় সামারার অপার্থিব যত সৌন্দর্য৷
রাশিয়ার এই প্রাকৃতিক শোভা মন্ডিত পার্বত্য শহরে ঘুরতে আসে অনেকেই। সেদিন এমনি ঘুরে বেড়াচ্ছিল কয়েকজন পর্যটক ভলগা নদীর তীরে । ছিপছিপে এক যুবতী বিস্ময় চোখে দেখছিল দূরের পর্বত শৃঙ্গ। হঠাৎই আমার চোখে চোখ রাখে সেই যুবতী৷ স্টাইলিশ আইরিশ মেয়েদের মতো এগিয়ে দিল তার ডান হাত৷ বলল —
গুড ডে ……, মী… মেলেনা অরলোয়েস্কি।
মেলেনার সাথে পরিচয়টা হয়েছিল এইভাবেই।
আর একদিন লিবার্টি স্কোয়ারের উদ্যানে সাক্ষাৎ হয়েছিল আমাদের। একটা ফাঁকা বেঞ্চের এক পাশে বসে কথা বলেছিলাম। বিকেলের দিকে এমনিতেই এ দিকটায় খুব ভিড় হয়না। কাছেই ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা অনেক সময় ভিড় জমায়। আড্ডা মারে। প্রেম করে। কিন্তু আজ ওসব ছিল না। আজ বন্ধের দিন ছিল।
তখন বিকেলের রোদ ফিরে যাচ্ছিল আকাশের কোলে। মেলেনার সাথে টুকরো টুকরো অনেক কথাই হয়েছিল। জীবনের অপূর্ণতার কথা, আশা নিরাশার কথা এবং মেলেনার কথাও।
মেলেনা আমার ছবি আঁকার মডেল হয়েছিল। ওকে নিয়ে যে ছবিগুলো আঁকতাম, তা বিক্রি করে আমরা ভাগাভাগি করে নিতাম। একবার ওকে নিয়ে একটি ছবি এঁকেছিলাম। পিছনের ক্যানভাস ছিল,ভলগা নদী আর দূরের পর্বত শৃঙ্গ। ছবিটির নাম দিয়েছিলাম —‘এই জনারণ্যে।’ ছবিতে অন্য কোনো মানুষ নেই। কিন্তু নাম দিয়েছিলাম জনারণ্য।
সুন্দর সুন্দর অনেক মুহূর্ত তৈরি করেছি আমরা দুজন। আমার মনে হতো, মানুষ অনেক কিছুই হারায়। আবার সেই শুন্যতায় ঈশ্বর অনেক কিছুই আবার পূর্ণ করে দেয়। যা হারিয়ে এসেছিলাম একদিন কোনো এক জীবনে, তাই আবার অকাতরে পেলাম এইখানে পূর্ণ করে। জীবন সবখানেই অনেক সুন্দর।
সেইবার উইন্টারে সামারাতে খুব তুষারপাত হয়েছিল । তাই ঐ শহর ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল আমাকে। ছিলাম বার্লিনের এক ভবঘুরে আস্তানায়। একটি শীতকালের সমান বিচ্ছেদ ছিল। তারপর আবার চলে গিয়েছিলাম ঐ শহরে।
ভলগা নদীর তীরে মেলেনাকে আর খুঁজে পাইনি। আমি দেখেছি জিগোলস্কি পর্বত মালা থেকে অজস্র জমে থাকা পাথরের তুষার খন্ড জল হয়ে ঝরে পড়ছে ভলগার জলে।
২৭. অতিথিনী
একবার একটি সরকারী কাজে সীতাকুণ্ড গিয়েছিলাম। পাঁচ ছয় দিন সেখানে থাকতে হয়েছিল। আমার থাকার ব্যবস্থা ঠিক করা হয়েছিল সীতাকুণ্ড স্টেশন লাগোয়া একটি ডাকবাংলোতে। ছিমছাম নিরিবিলি পরিবেশ। অদূরেই পাহাড়, ঝোপ ঝাড় আর বন। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষেই রেল লাইন সমান্তরাল ভাবে চলে গেছে দুই দিকে।
বাংলোর কেয়ারটেকার ছিল একজন মধ্যবয়স্ক লোক। ওর কথাবার্তা আচার আচরণ আমার কাছে ভালোই লেগেছিল। বাংলাটিতে দুইটি আলাদা কক্ষ ছিল। আমি থাকতাম একটি কক্ষে। অন্য কক্ষটি তখন খালি ছিল।কেয়ারটেকার থাকত পিছনের একটি ছোট্ট টিনের চালা ঘরে।
আমার খুব ভালো লাগত জায়গাটি। অফিসের কাজ সেরে আমি প্রায়ই ঘুরতাম। কোনো কোনো দিন চলে যেতাম সাগরের কাছাকাছি । আবার কোনো দিন যেতাম পাহাড়ে। ঘরে বসে শুনতাম ট্রেনের হুইসেল আর ধাবমান ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ। কোনো কোনো দিন সন্ধ্যায় স্টেশনে যেয়ে চা’র দোকানে বসে চা খেতাম। আবার কখনও প্লাটফর্মের উপর হাটতাম একাকী। দ্রুতগামী ট্রেন এই স্টেশনে থামতনা। থামত লোকাল ট্রেন। তাও সারা দিনে দু-তিনটি।
সেদিন সকাল থেকে আকাশ গুরুগম্ভীর ছিল। তার আগের দিন থেকে শুরু হয়েছিল চন্দ্রনাথ মন্দিরে তীর্থ মেলা। এ উপলক্ষে সীতাকুণ্ডে বহু মানুষের সমাগম ঘটেছিল। রেডিওর খবরে জানা গেল সাগরে নিম্নচাপ শুরু হয়েছে। সাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে। সব মানুষের ভিতরে একধরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে।
দুপুর থেকেই বৃষ্টি এবং ঝরো হাওয়া শুরু হয়ে যায়। সন্ধ্যার দিকে আরও বেশি। আমি একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম। তবে সীতাকুণ্ডে ঘূর্ণিঝড় যে আঘাত হানবে না, তা খবরে নিশ্চিত হতে পেরেছিলাম। সেদিনের সেই রাতটি ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। দমকা ঝরো হাওয়া বয়েছিল, সাথে মুশুলধারে বৃষ্টি । ইলেকট্রিসিটি আগেই বিচ্ছিন্ন ছিল। বাংলো এলাকা, স্টেশন, পুরো জনপদ ছিল অন্ধকার। আমি রাতে একাকী বিছানায় শুয়ে আছি। রাত তখন দশটা হবে। হঠাৎ বাইরে থেকে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। রুমে হেরিকেন জ্বালানোই ছিল। আমি যেয়ে দরজা খুলে বাইরে দেখি, কেয়ারটেকার। পাশে অদূরেই অবগুণ্ঠন দিয়ে একজন রমনী দাঁড়িয়ে আছে।
আমি বিব্রত হই। স্ত্রীলোকটিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে কেয়ারটেকার আমার রুমে প্রবেশ করে। এবং আমাকে বলে — স্যার এই মহিলাটি খুবই বিপদগ্রস্ত। সে তার পরিবারের সাথে তীর্থে এসেছিল। কিন্তু তীর্থ যাত্রীদের ভীড়ে আর হঠাৎ ঝড় বাদলের অন্ধকারে সে তার সতীর্থদের হারিয়ে ফেলে। সে এই ঝড়ের রাতে স্টেশনে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। ওনার বাড়ি ভৈরবে। ভেবেছিল, ট্রেন পাবে, এবং অদ্যই চলে যাবে। কিন্তু লোকাল ট্রেন কাল ভোর ছয়টায়। ওনাকে স্টেশনে একাকী খুব অনিরাপদ মনে হচ্ছিল। তাই এখানে নিয়ে এলাম। স্যার, উনি এই পাশের রুমটিতে শুধু রাতটুকু থাকবেন। এবং প্রত্যুষেই সে চলে যাবেন।
আমি প্রথমে একটু দ্বিধা করছিলাম কিন্তু পরক্ষনেই রাজি হলাম। বললাম, থাকুক।
কেয়ারটেকার যেয়ে রুমের দরজাটি খুলে দেয়। এবং সেখানে তার থাকার ব্যবস্থা করে আবার আমার কাছে চলে আসে এবং বলে — ‘স্যার মহিলা আপনার কথা জেনে খুব ভয়ও পাচ্ছে, আবার সাহসও পাচ্ছে।’
আমি বললাম, তাকে বলে দিও — ‘সে যেন কোনো রুপ ভয় না পায়।’ কেয়ারটেকার বলে, আমি তাই বলে দিয়েছি।’
রাতভর ঝড় হলো, বৃষ্টি হলো। আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। খুব ভোরবলায় ট্রেনের হুইসেলে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখলাম, ঝড় থেমে গেছে, বৃষ্টিও নেই। বারান্দায় কেয়ারটেকারের কথার আওয়াজ শুনতে পেলাম। মনে হলো মহিলাটি হয়ত এই ট্রেনটিতে চলে যাবে।
আমি উঠে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াই। দেখি — কেয়ারটেকারের সাথে মহিলা দ্রুত স্টেশনের দিকে চলে যাচ্ছে। ট্রেন ছাড়ার শেষ হুইসেল তখন বেজে উঠেছে। আমার দরজা খোলার শব্দ শুনে মেয়েটি পিছনে ফিরে তাকায়। আমি দেখি তাকে। সেও আমাকে দেখে। কী যে এক বিস্ময়ের দৃষ্টি দুজন দুজনের প্রতি ! এই মেয়ে যে আমারই জন্মজন্মান্তরের পরিচিত একজন।
২৮. হিমালয় কুইন এক্সপ্রেস
নব্বই দশকের মাঝামাঝির কথা। হরিয়ানার কালকা শহরেই আমার কাজটা ছিল। এল/সি’র শর্ত অনুযায়ী আমদানীকারকের পক্ষে কালকা স্টেশনের কাছেই মালবাহি ট্রেনে গমের শিপমেন্ট পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলাম। স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী গম শিপমেন্ট করছে কিনা এইটাই দেখা ছিল আমার কাজ। কলিকাতায় অবস্থানকালীন সময়ে ক্যামাক স্ট্রীটে রপ্তানীকারকের অফিসে মিঃ পি.কে আগোরওয়ালের চেম্বারে বসে কফি খাচ্ছিলাম। উনি আমাকে বলেছিলেন-‘ দাদা, কালকাতে যেহেতু যাচ্ছেনই, পারলে ট্রেনে সিমলা থেকে ঘুরে আসবেন। খুব ভালো লাগবে।’
কালকাতে পাঁচ দিন ছিলাম, ভালোই লেগেছিল হরিয়ানার এই ছোট শহরটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল স্বপ্নপুরীর মতো। আমি প্রায় সন্ধ্যায় শিখ উপসানালয় গুলোতে ঘুরতে যেতাম। দেখতাম আর মনে হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে অবস্থিত গুরুদ্বুয়ারা নানক সাইয়ের উপসানালয়টির কথা। কালকা স্টেশনের কাছেই হোটেল উইন্ডক্রসে আমি থাকতাম। হাতে দুইদিন সময় ছিল, ভাবলাম- সিমলাটা না হয় দেখেই আসা যাক। আমি সন্ধ্যায় হোটেল থেকে চেক আউট হই। টিকিট আগেই কাটা ছিল। রাত দশটা দশ মিনিটে হিমালয়া কুইন এক্সপ্রেস ট্রেনটি কালকা স্টেশন থেকে ছাড়ে। গন্তব্য সাদা তুষারের শহর সিমলা।
সিমলাগামী রাতের ট্রেনে যাত্রী একটু কমই থাকে । আট সিটের একটি কেবিন কম্পার্টমেনট রুমে আমরা যাত্রী মাত্র ছিলাম তিনজন। আমার ঠিক অপোজিট রো’তে একজোড়া শ্বেত চামড়ার দম্পত্তি বসে আছে। কিন্তু তাদের সাথে ঐভাবে কথা বলার সুযোগ নেই।কালকা-সিমলা রেলওয়ে একটি ন্যারোগ্যাজ রেলওয়ে। এটি উত্তর পশ্চিম ভারতের কলকা থেকে সিমলা ভ্রমণের সবচেয়ে পর্বতময় একটি রেলওয়ে। উত্তেজনাপূর্ণ পাহাড়-পর্বত এবং ছবির মতন আশেপাশের গ্রামের জন্য এই রেলওয়ে বিখ্যাত। কিন্তু রাতের জার্নিতে সেই সৌন্দর্য , সেই উত্তেজনাটা পাওয়া যায়না। আর যার কারণেই রাতের এই হিমালয়া কুইনে আজ যাত্রী কম।
ব্রিটিশ ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী সিমলার সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য কলকা-সিমলা রেলওয়ে স্থাপিত হয়। সিমলা হিমাচল প্রদেশের রাজধানী এবং কলকা হরিয়ানা প্রদেশের পাঞ্চকুলা’র একটি শহর। পুরো ট্রেন রাস্তায় দুইধারে দর্শনীয় প্রকৃতি এর চোখ ধাঁধানো প্রকৃতির মাঝে এই রেললাইন, ভ্রমণ পিপাসুদের আকর্ষন করে। ট্রেন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৫৬ মিঃ উচুতে অবস্থিত শহর কলকা অতিক্রম করার পরপর ট্রেন পাহাড়ে পাদদেশের প্রবেশ করে এবং এর পরপরই ট্রেনটি পাহাড়ে চড়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।আমি একাকী একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম। কারণ একটু পরপর ট্রেনটি পাহাড়ের সুরঙ্গে প্রবেশ করতে থাকে। বাইরে তখন নিকষ কালো অন্ধকার । মনে হয় যেন কোনো হরোর পাতালপুরী পাড়ি দিচ্ছি।
এই রুটটি কলকার সিভালিক মালভূমির বিভিন্ন স্থান যেমনঃ ধরমপুর, সোলান, কান্দাঘাট, তারাদেবী, সালগোরা, টটু, সামারহিল এবং সিমলা থেকে হিমালয়ের প্যানোরমিক ভিউ দেখা যায়, যা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ । কিন্তু রাতের আঁধারে আমি কোনো সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছিলাম না। ওপাশে শ্বেত কপোত কপোতীদের বেশ অন্তরঙ্গ অবস্হায় দেখা যাচ্ছিল। ওদের কোনো হুস নেই যে, আমি একজন এ পাশে বসে আছি। নাইট জার্নির সাথে নাইট রাইডিং ভালোই করছিল ওরা।
ট্রেনটা একসময় সোলান স্টেশনে এসে থামে। তখন রাত্রি সাড়ে বারোটা হবে। সোলান শহরটি ছোট সিমলা নামে পরিচিত। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি জুন মাসে সোলান শহরে শুলিনি দেবী’র পূজা হয় যার নাম অনুসারে শহরের নাম সোলান হয়েছে । রাতের সোলান স্টেশনটি খুব ভালো লাগছিল। বোঝাই যাচ্ছিল দিনের বেলা এই শহরটিকে ছবির মতো লাগত। আমি স্টেশনের আলো ঝলমল প্লাটফরমের দিকে তাকিয়েছিলাম। দেখলাম একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা আমার কেবিন কম্পার্টমেন্টে উঠলেন। এবং টিকিটের আসন মিলিয়ে ঠিক আমার সামনের সিটে মুখোমুখি বসে পড়লেন।
ট্রেন সোলান ছেড়ে আসে। কিছু দূর যাওয়ার পর ট্রেনটি আর একটি পার্বত্য সুরঙ্গে প্রবেশ করে। চারদিকে মনে হচ্ছে ভূত পেত্নীরা কাউমাউ করছে। এবার আর বেশী ভয় পাচ্ছিলাম না। কারণ আমার সামনে একজন বিগ বিউটিফুল ওমান বসে আছে। ট্রেনের লুকোচুরির আলো আঁধারিতে আমি ঐ মহিলাকে ফাঁকে ফাঁকে দেখছিলাম। ঠিক খারাপ কোনো দৃষ্টিতে নয়, শুধু কৌতূহল- মহিলা দেখতে কেমন ?
মহিলা ডীপ মেকআপ করেছে। মনে হলো মুখের দাগগুলো ঢেকে ফেলেছে ফাউন্ডেশন বেজ মেকআপে। চোখ অনেকটা স্মোকি স্টাইল করা। চোখে আর্টিফিসিয়াল ভ্রু এবং মাসকারা লাগানো। চোখের পাতায় বাদামি কালার হাইলাইট করা। ট্রেনের রাতের আলো আঁধারীতে ঠোঁটে গাঢ় ভাবে লাগানো পার্পেল কালারের লিপস্টিক চিকচিক করছিল। মহিলার পরনে ছিল ঘিয়ে রঙ্গের জর্জেট শাড়ি। স্লিভলেস ব্লাউজ, শাড়ি নাভীর অনেক নীচ পর্যন্ত নামানো। গলায় গোলাপী স্টোনের লকেটের নেকলেস। হাতে তার মুক্তাখচিত ব্রেসলেট। চুল পিছনে ব্যান্ড দিয়ে হালকা করে খোপা বাঁধা ছিল। শাড়ি ব্লাউজে তাকে দারুণ আবেদনময়ী লাগছিল। তার শরীরের খোলা অংশগুলোতেও বেজ মেকআপ করে লাবণ্যময় করে রেখেছিল। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিল কোথাও কোনো পার্টিতে সে এ্যাটেন করতে গিয়েছিল ।
উপত্যাকা আর পাহাড়ের পথে পথে ট্রেন চলছে। রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলছে হিমালয়া কুইন এক্সপ্রেস। ওপাশে শ্বেত মেয়েটা লোকটার ঘারের উপড় মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে। লোকটা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছে পাহাড়ের ফাঁকে দিয়ে রাতের আকাশ। আমার চোখে ঘুম নেই। মহিলাও জেগে আছে। আমি ওনার সাথে প্রথম কথা বলতে দ্বিধা করছিলাম, কিন্তু ইচ্ছা করছিল কথা বলতে। একটু সৌভাগ্যই বলতে হবে, উনিই প্রথম কথা বলল আমার সাথে। (ওনার সাথে কথা হয়েছিলো ইংরেজী আর হিন্দীতে। আমি এখানে বাংলা করে লিখলাম।)
মহিলা : আপনি কোথা থেকে এসেছেন ?
আমি : ঢাকা, বাংলাদেশ থেকে।
মহিলা: কোথায় যাচ্ছেন ?
আমি : এসেছিলাম কালকায় ব্যবসায়িক কাজে, যাচ্ছি সিমলায় ঘুরতে।
মহিলা : ও তাই।
আমি : এক্সকিউজ মী, আপনার নামটি একটু বলবেন ?
মহিলা : সায়নী সিং
আমি: আপনি কোথা থেকে এসেছেন ?
সায়নী : অমৃতসর, পাঞ্জাব। এখানে এসেছিলাম সোলান, যাচ্ছি সিমলা।
সায়নীর সাথে কথা বলে যেটা জানলাম, সে একজন শিখ ধর্মালম্বী। স্বামীর সাথে আন অফিসিয়ালী সেপারেশন চলছে। সে একটি বহুজাতিক কোম্পানীর আঞ্চলিক বিপনণ ব্যবস্থাপক। সে অফিসিয়াল কাজেই সোলান এসেছিল, এবং যাচ্ছে সিমলায়। ট্রেন চলছে, কখনো আঁকাবাঁকা পাহাড়ের গা ঘেসে, কখনো বিভিন্ন সেতু অতিক্রম করছে, কখনো বিভিন্ন সুরঙ্গ পাড়ি দিচ্ছে। ট্রেনটি তারাদেবী স্টেশনে চলে আসে। তখন সম্ভবতঃ রাত্রি তিনটা বাজে। দশ মিনিট দাড়িয়েছিল ট্রেনটি। তারপর ট্রেন আবার চলতেে থাকে। কথা বলতে বলতে আমি সায়নীর বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই। মনে হলো উনি খুব মিশুক। কথা আর গল্পে গল্পে সময়টা ভালোই কাটছিল। সায়নী আমাকে বলেছিল – ‘তুমি কি সিঙ্গেল ?’ আমি বলেছিলাম- ‘না। আমি নতুন বিবাহিত।’
সায়নীর চোখে ঘুম নেই। দেখলাম সে একটি হার্ড ড্রীংসের বোতল বের করেছে। গ্লাসে ঢেলে তা সে পান করতে থাকে। ড্রীংস সে আমাকেও ওফার করে। আমি খেতে চাইনা, আমি বলি- আই এ্যাম নট হ্যাবিচুয়েটেড ইট।’ কিন্তু সায়নী অনেকটা সম্মোহণের জাল তৈরী করে ফেলে। আমি ঠিক পুরোপুরী সজ্ঞানে নয়, সম্মোহিত হয়েই সুরা পান করি, সায়নী একটু বেশীই খাওয়েছিল মনে হয় আমাকে। কখন সালগোরা আর টুটু স্টেশন দুটি পার হয়ে গিয়েছিল আমি জানি নাই।
ট্রেনটি যখন সিমলা পৌঁছে, তখন সায়নী আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। ঘড়িতে চেয়ে দেখি সকাল সাতটা বাজে। আমি দিনের আলোয় চোখ মেলে দেখি সায়নীকে। আমি বিস্মিত হচ্ছিলাম সায়নীকে দেখে। এই সেই রাতের আবেদনময়ী সায়নী ? যে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল, যে আমার স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছিল। এই তার চেহেরা ! মুখের এবং শরীরের বলিরেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখের নীচে কালচে দাগ। এক বিধ্ধস্ত বিগত যৌবনা বয়স্কা রমণী সে। ফল্স ব্রান্ড অন্তর্বাস পরা। বয়স তার ষাট বাষট্রি হবে।
সায়নী, তার ব্যাগ ব্যাগেজ গুছিয়ে নেমে গেল। যাবার বেলায় হ্যান্ডশেক করে বলে গেল– ‘তুমি সত্যিই খুব ভালো ছেলে। তোমাকে আমার মনে থাকবে। আবার দেখা হবে কোনোদিন এমনই রোমাঞ্চকর রাতের কোনও ট্রেনে ।’
২৯. কে সেই জন
আমরা তিনজনই সিটি কলেজের ছাত্র ছিলাম। তিনজনই খুব ভালো বন্ধূ ছিলাম, আমি, গিয়াস এবং রিমি। কলাবাগানে একটি টিনসেড বাড়ির একটি রুম ভাড়া নিয়ে আমি আর গিয়াস থাকতাম। রিমি থাকত জিগাতলা মোড়ে ওর খালার বাসায়। ক্লাসে আরো ছেলেমেয়ে ছিল, তাদের সাথে বন্ধুত্ব হলো না, বন্ধু হলাম আমরা তিনজন, রিমি, গিয়াস আর আমি।
রিমি যেদিন ক্লাশে আসত না সেদিন খুব মন খারাপ লাগত। ক্লাশ করতেও মন চাইত না। এক দুই ক্লাশ করে চলে যেতাম বাসায়। শুয়ে থাকতাম বিছানায়। তারপর চোখে ঘুম আসত এবং ঘুমিয়ে যেতাম। যখন ঘূম ভাঙ্গত তখন দেখতাম সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গিয়াস ততোক্ষণে চলে আসত এবং বলত – ‘তুই কি রিমির জন্য মন খারাপ করে থাকিস ?’
আমি : হে।
গিয়াস : তুই কি রিমিকে ভালোবাসিস ?
আমি : না।
গিয়াস : দুপুরে কিছু খেয়েছিলি ?
আমি : না ।
গিয়াস : চল্ কালা চাঁদের হোটেলে যেয়ে কিছু খেয়ে আসি।
আমি : চল্।
সেদিন একাউন্টিং ক্লাশের স্যার আসেন নাই। আমরা তিনজনেই মিরপুর রোডের ‘চিরোকী’তে বসে আড্ডা দেই। আমাদের তিনজনের মধ্যে সেদিন অনেক কথাই হয়েছিল। অনেক গল্প করেছিলাম তিনজনে। না বলা অনেক কথাও হয়েছিল আমাদের মধ্যে। বলেছিলাম- কলেজে পড়া শেষ হলে কে কোথায় চলে যাব, কে কোথায় পড়ব ? কে কখন বিয়ে করব, আরো অনেক কথা। তিনজনে কথা বলতে বলতে কখন ক্লাশ আওয়ার ওভার হয়ে গিয়ছিল আমরা তা জানি নাই। সেদিন আর ক্লাস করা হয়নি।
বিকালে পড়ার টেবিলে বসে মার্কেটিংএর নোট খাতার ভিতর কি সব হিবিজিবি লিখছিলাম-
তুমি কি শুধুই বন্ধু হওয়ার জন্য এসেছিলে ! তুমি শুধু সহপাঠি নও আমার,
তুমি কাকে ভালোবাসো আমি জানিনা,
আমি পূর্ব মেঘে তাকিয়ে দেখেছি- সেখানে কেবল কালো মেঘ
আমি উত্তরের মেঘে তাকিয়ে দেখেছি- সেখানে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে,
আমি তোমাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখতে চাইনা,
তবুও আমার দু’চোখ মুদে ঘুম আসে-
ঘুমেও নয়, স্বপ্নেও নয় হঠাৎই মনে হয় আমি তোমাকে কাছে টেনে বলছি- ভালোবাসি।
ওপাশে তাকিয়ে দেখি গিয়াস ওর পড়ার টেবিলে বসে কি যেন লিখছে। আমি ওকে বলি- ‘কি লিখছিস ?’ গিয়াস বলে- ‘কবিতা লিখছি।’ আমি বলি- ‘তুই আবার কবি হলি কবে ?’ গিয়াস উত্তর দেয় – ‘এমনি হিবিজিবি কিছু লিখছিলাম।’ আমি বলি- ‘পড়ে শোনা।’ ও তখন আমাকে পড়ে শোনায়-
আমার থেকে হাজার ক্রোশ দূরে তুমি বসে আছো
শুনতে কি পাও ভালোবাসার মর্মরধ্বনি ?
লক্ষ যোজন দূরে থেকে বুঝতে কি পারো
আমার হৃৎ কম্পনের কথা ?
নির্জন নিরালায় তুমি আমার গান হয়ে ওঠো
শ্বেতকমলে তোমার পরশখানি জেগে ওঠে-
এখনো দূর হতে কোনো কোমল সিম্ফনি ভেসে আসে
এখনো তোমার জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকে।
আরেকদিন কলেজে যেয়ে হঠাৎ শুনতে পাই আজ কোনো ক্লাশ হবে না। কি যেন এক দাবীতে শহরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হচ্ছে। মন খুব একটা খারাপ হলো না। বলাকা সিনেমা হলে চলছিলো ‘সূর্যকন্যা’। আমরা তিনজন টিকিট কেটে সাড়ে বারোটার শো’তে হলে ঢুকে পড়ি। সারা সিনেমা চলাকালীন সময়ে রিমি আমার এক হাত ধরে থেকেছিল। ওর আরেক হাত ধরেছিল গিয়াসের হাত। সিনেমা শেষে আমরা তিনজন নিউ মার্কেটের ভিতরে লিবার্টি খাবার হোটেলে যেয়ে ভাত খেতে বসি। রিমি গুণগুণ করে আস্তে আস্তে আমাদের কানের কাছে সুর্যকন্যার এই গানটি গাচ্ছিল–
‘আমি যে আধারে বন্দিনী আমারে আলোতে ডেকে নাও
স্বপন ছায়াতে চঞ্চলা আমারে পৃথিবীর কাছে নাও.
শ্রাবণ ঘন এই আকাশ কালো তৃষিত হৃদয় মোর জ্বেলেছে আলো
এবার আমায় বাসিবে ভাল প্রিয় তুমি কথা দাও কথা দাও।’
মাঝে মাঝে নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করি, রিমি কাকে ভালোবাসে ? আমাকে না গিয়াসকে ? না অন্য কাউকে ? তার কোনো হিসাব মিলাতে পারিনা। শুধু এইটুকুই জানি, আমি রিমিকে ভালোবাসি, তা কেউ জানে না।
দেখতে দেখতে কখন আমাদের সব সিলেবাস শেষ হয়ে গেল, দেখতে দেখতে আমাদের শেষ ক্লাশটিও হয়ে গেল। এবং একসময় ফাইনাল পরীক্ষাও হয়ে যায়। এই ভাবেই আমাদের কলেজ পাঠ পর্ব শেষ হয়ে যায়।
সেদিন চলছিল আমাদের কলেজে একে অপরের বিদায় নেবার পর্বের দিন। দেখলাম রিমি একটা নীল রঙ্গের শাড়ি পড়ে কলেজে এসেছে। এর আগে ও কখনো শাড়ি পড়ে কলেজে আসে নাই। আজকেই প্রথম, আজকেই শেষ শাড়ি পড়া। খুব ভালো লাগছিল ওকে নীল শাড়িতে। সহপাঠীদের সাথে অনেক সুখের কথা হলো, অনেক প্রাণের কথা হলো। অনেক স্মৃতিচারণ হলো। তারপর আমরা তিনজন হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই ধানমন্ডি লেকের ধারে।
লেকের পাড়ে সবুজ ঘাসের উপর তিনজন বসে আছি। লেকের জল তখন নীরব স্থির হয়ে আছে। ঝিরিঝিরি কোনো বাতাস নেই। জলের উপর ছোটো ছোটো কোনো ঢেউ নেই। কড়োই,জারুল, কৃষ্ণচূড়া গাছে দু’একটি পাখি করুণ সুরে ডাকছিল। বিকেলের সূর্য গাছের আড়ালে চলে গেছে। আলোছায়ায় অনেকটা মন খারাপ করেই আমরা বসে আছি। কে কি বলব, যেন আমাদের কোনো ভাষা নেই। তারপরেও বললাম রিমিকে- কবে বাড়ি যাচ্ছো ?
রিমি : কালকেই। তোমরা কবে যাচ্ছো ?
আমি : আগামী মাসের এক তারিখে। রুম ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ করেছি।
গিয়াস : একই তারিখে আমিও যাচ্ছি।
রিমি : তোমরা ভুলে যেওনা আমাকে।
আমি: তুমিও ভুলে যেওনা। চিঠি লিখবে।
গিয়াস: আমিও ভুলব না। চিঠি লিখো।
রিমি চলে গেছে ওর দেশের বাড়ি বাগেরহাট। আমি আর গিয়াস এক তারিখেই রুম ছেড়ে দিয়ে যার যার মতো দেশের বাড়ি চলে যাই। গিয়াস চলে যায় পটুয়াখালীতে, আর আমি চলে আসি সিরাজগঞ্জে।
বাড়িতে যেয়ে মনটা উড়ো উড়ো লাগছিল। কারো সাথে ঠিক মতো মন খুলে কথা বলতে পারছিলাম না। এমনিতেই একাকী যেয়ে নদীর কূলে বসে থাকতাম। নয়তো মাঠের আলপথ দিয়ে, ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে হাঁটতাম। মনের মধ্যে কি এক ভ্রান্তি ঢুকেছিল যে, তা কাউকে প্রকাশ করতে পারছিলাম না। নির্জন প্রান্তরের অশ্বথ গাছের তলে বসে ভাবতাম আর অনুশোচনা করতাম, আমি তো রিমিকে ভালোবেসেছিলাম। এই কথা কেনোদিন তাকে আমি বলি নাই। যে কথা বলি নাই তা নিয়ে এখন কেন অনুশোচনা করছি ?
সেদিন ছিল হাটবার। আমাদের ছোনগাছা হাটে সেদিন মেলাও ছিল। মেলায় উৎসবের আমেজ। বাঁশের বাঁশি বাজছে। চারদিকে ঢাকের শব্দ, কাঁসার শব্দ। নাগরদোলার চড়কি ঘুরছে। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে কালি সন্ধ্যা হয়েছে। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে নাগরদোলার ঘূর্ণি দেখছিলাম। পোস্ট অফিসের পিয়ন আমাকে দেখে একটি চিঠি দেয়। প্রেরকের জায়গায় লেখা- রিমি, বাগেরহাট। আমি মেলার মধ্যে অন্ধকারে চিঠিটি আর খুললাম না।
রাতে বাড়িতে এসে হেরিকেনের আলোয় চিঠিটি খুলে পড়তে থাকি–
‘প্রিয় বন্ধু আমার,
তোমরা দু’জনই আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলে। তোমাদের দু’জনকেই আমি খুব ভালোবাসতাম। বাড়িতে এসে তোমাদের জন্য আমি অনেক কেঁদেছি। তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে? কই, কখনো বলোনি তো – ‘তোমাকে ভালোবাসি।’ আমাকে যে বলেছে ‘ভালোবাসি’, তার সাথেই আমার বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের তারিখ : ১৪ ই ফাল্গুন, ১৩৯০ বাং। তোমাকে নিমন্ত্রণ দিলাম। চলে এসো।
ইতি- রিমি।’
বুঝতে পারলাম গিয়াসের সাথে রিমির বিয়ে হচ্ছে । অভিমানে আমি আর বিয়েতে যাইনি। তারপর আর কোনো যোগাযোগও রাখিনি।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেই। এবং একটি সরকারি চাকুরীও পেয়ে যাই।
তারপর দশ বছর চলে গেছে। একবার একটি সরকারী কাজে গিয়েছিলাম- পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। কাজের ফাঁকে একদিন কুয়াকাটা বীচে বেড়াতে যাই। সাগরপাড় এত জমজমাট তখন ছিল না । একদম বিরাণ বালুকাবেলা ছিল। তখন সূর্যাস্তের সময়। সাগর তীরে একাকী হাঁটছিলাম, আর সূর্যাস্ত অবলোকন করছিলাম– হঠাৎ ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির এক লোক আমার কাছে এগিয়ে আসে। চিনতে অসুবিধা হলো না। এ যে সেই গিয়াস !
কাছেই লতাচাপালী গ্রামে গিয়াস থাকে। ও এখানকার এক প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। আমাকে জোর করে ওর বাড়িতে নিয়ে যায়।
বাড়িতে আমি তখন খুঁজতে থাকি রিমিকে। কিন্তু কোথাও রিমিকে দেখতে পেলাম না। তখন গিয়াসকে জিজ্ঞাসা করি- ‘রিমি কোথায়?’ গিয়াস আমার কথা শুনে বিস্মিত হয় এবং উল্টো আমাকে বলে – ‘তুই রিমিকে বিয়ে করিস নাই ? ‘ আমি বলি – ‘না।’
দুজনেই কিছু সময় স্তব্ধ! নির্বাক চেয়ে থাকি একে অপরের মুখের দিকে। গিয়াস ওর স্টীলের ট্রাংক খুলে রিমির একটা চিঠি বের করে আমাকে দেখায়–
সেই একই চিঠি, একই ভাষা, এবং একই তারিখ, যা রিমি আমাকেও লিখেছিল ।
৩০. পদ্মাবতী
আমি আর আমার স্ত্রী ২০০৯ সালে ডুয়ার্সের অরণ্য দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের শিলিগুড়ির বন্ধু শিশির রায় বলেছিল, এসেছ-ই যখন, এক ফাঁকে তোমরা কোচবিহারের রাজবাড়িটাও দেখে নিও, ভালো লাগবে। শিলিগুড়ির এনজে জংশন থেকে একদিন আমরা কাঞ্চনজঙ্গা এক্সপ্রেসে কোচবিহার চলে যাই। ছিমছাম সুন্দর শহরটির ইলোরা হোটেলে আমরা উঠি। ভখন বিকাল হয়ে গিয়েছে। সেদিন আর রাজবাড়ি দেখতে গেলাম না। সন্ধ্যায় রি্ক্সায় শহরটিতে একটু ঘুরে নেই । তারপর মদনমোহন মন্দির দেখতে যাই। সেখানে কৃষ্ণ মূর্তির পাশে বসে অনেকক্ষণ আমরা কীর্তন শুনেছিলাম।
রাতে ক্যাফেতেই খেয়ে নেই। খেয়ে হোটেল রুমে বসে আমরা গল্প করছিলাম। সে সময়ে হোটেল এ্যাটেন্ডেন্ট রুমে প্রবেশ করে। ও বলছিল আমাদের সুবিধা অসুবিধার কথা। ওর নাম কৃষ্ণ কুমার। মধ্য বয়সী অসমীয়া লোক। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে। বাড়ি আসামের ডিব্রুগড়ে। কথায় বুঝতে পারলাম লোকটা খুবই পরপোকারী এবং ভদ্র। আমরা ওর কাছ থেকেই জানার চেষ্টা করি রাজবাড়ির কথা। এই রাজবাড়ি সম্পর্কে বলতে গিয়েই কৃষ্ণ কুমার আমাদের একটি কাহিনি শোনায়েছিল। ও শুনেছিল নাকি ওর পিতামহের কাছ থেকে, আর পিতামহ শুনেছিল তারও পিতামহের কাছে। অনেকটা কিংবদন্তীই বলা যায়। শুনুন এবার সেই কাহিনি।
১৬২১ সালে রাজা দীননারায়ণ কোচবিহারের সিংহাসনে বসেন। রাজা ছিলেন কু-প্রবৃত্তির বশবর্তী। তাঁর চরিত্রে ছিল লাম্পট্যের আধিপত্য। যদিও তিনি সংগীতপ্রেমিক ও সংস্কৃতিমনস্ক ছিলেন, কিন্তু নিজের রাজত্বের বহু উচ্চবংশীয় নারীকে তিনি হরণ করে নিয়ে যেতেন, এবং তাঁদের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হতেন।
চিকনা পাহাড়ের পাদদেশের নিরিবিলি টিলা বেষ্টিত একটি লোকালয়। পাশেই খরস্রোতা কালজানি নদী। এই নৈসর্গিক উপত্যাকার একটি গ্রামে থাকতেন এক পণ্ডিত মশায়। আশে পাশের ছেলেরা এসে এই পণ্ডিতের কাছে লেখাপড়া করত। পণ্ডিত মশাইয়ের একটি ষোড়ষী মেয়ে ছিল নাম পদ্মাবতী। উদ্ভাসিত নব যৌবনা, টানা পিঙ্গল চোখ, মাথা ভর্তি কালো চুল, মৃগনাভি, চিকন কোমড়, প্রসারিত বক্ষরাজি, তোর্সা নদীর বাঁকের মতো তার উরু। একদিন রাজা দীন নারায়ণ তার সঙ্গী নিয়ে ঘোড়ায় চরে উপত্যাকার ঐ পথে যাচ্ছিল। পদ্মাবতী তখন কালজানি নদীতে স্নানরত ছিল। রাজা দীন নারায়ণ সেই দৃশ্য দেখে ফেলে। সে তখন সঙ্গীদের প্রাসাদে পাঠিয়ে দেয়। লম্পট দীন নারায়ণ পদ্মাবতীর সাথে প্রথম তার পৈশাচিক নিবৃত্তি চরিতার্থ করে এই কালজানি নদীর উপকূলে।
এরপর কালজানির নদীর কালো জল অনেক গড়িয়েছে। রাজা দীন নারায়ণ এই উপত্যাকায় এসেছে বার বার। একসময় পদ্মাবতী গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এ কথা লোক সমাজের কেউ জানত না। সন্তান জন্ম দেয়ার দুইতিন মাস আগে পদ্মাবতী নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। পাশের পরগনা দেওহাটায় ওর এক মাসি থাকত। সেখানেই পদ্মাবতী এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। নাম রাখে ইলা। এই ইলাকে নিঃসন্তান মাসীর কাছে রেখে পদ্মাবতী তার গ্রামে আবার ফিরে আসে। ইলা থেকে যায় মানুষের লোক চক্ষুর আড়ালে।
কিছু দিন পর রাজা দীন নারায়ন পদ্মাবতীকে বিয়ে করে। তাকে রাণীর মর্যাদা দিলেও রাজার লাম্পট্য থেমে থাকেনি। এভাবেই কেটে যায় পদ্মাবতীর ষোলোটি বছর। এদিকে ইলা পদ্মাবতীর মাসীর ঘরেই বড়ো হতে থাকে। ইতোমধ্যে সেই মাসীর মৃত্যু হয়। পদ্মাবতী ইলার পরিচয় গোপন রেখে রাজাকে বলে ইলাকে রাজ প্রাসাদে নিয়ে আসে। কিন্তু রাজা জানেনা ইলা তারই ঔরসজাত কন্যা।
ইলা অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে ছিল। রাজকুমারী হয়েও সে রাজকুমারী নয়। প্রাসাদে তার মর্যাদা অনেকটা বাঈজীদের মতো। ইলা সুন্দর গান গাইতে পারত, সুন্দর নাচতে পারত। ওর রূপ পদ্মাবতীর রূপকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। রাজা দীন নারায়ণের কুনজরে পড়ে ইলা। রানী পদ্মাবতী এ নিয়ে ভিতরে ভিতরে আশংকা বোধ করতে থাকে।
শরতের এক বিকেলে রাজা দীন নারায়ণ কালজানি নদীতে অনেকটা জোড় করেই ইলাকে নিয়ে বজরায় করে নৌ বিহারে যায়। পদ্মাবতী রাজার কুউদ্দেশ্য বুঝতে পারে। বজরাটি অপরূপ সাজে সাজানো হয়। গানের বাদ্যয্ন্ত্র ও নাচের নুপুর, ঘুঙ্গুরও নেয়া হয়েছিল। ইলার পরনে ছিল মুক্তাখচিত জয়পুরী চোলী। ইলা সেদিনের সেই বিকেলে রাজা দীন নারায়ণকে সব দুঃখের গানগুলি শোনায়েছিল। নেচেছেও রাজার সামনে একাকী।
তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বজরার অন্দরমহলে একসময় ইলার সব গান থেমে যায়। নুপুরের শব্দ আর শোনা যায় না। তখন সূর্য অস্তমিত হয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বক আর গাংচিলরা পাখা ঝাপটে দুর অরণ্যের দিকে উড়ে যাচ্ছে। জলের উপরে ছোটো ছোট পাখিদের কিচির মিচির গানগুলো কান্নার শব্দের মতো মনে হচ্ছেছিল। খরস্রোতা কালজানির জল যেন হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
তারপর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠে। বজরা এসে ঘাটে ভেঁড়ে। মাঝি মাল্লারা পাটাতন ফেলে দেয় কূলে। রাজা দীন নারায়ণ নেমে আসে। ইচ্ছাকৃতই হবে হয়ত — নামতে যেয়ে ইলা পা ফসকে অন্ধকারে নদীর গভীরে পড়ে যায়। শুধু টুপ করে একটা শব্দই শোনা গেল। মুহূর্তেই ইলা জলের তলে হারিয়ে গেল।
নদীর কূল থেকে পূর্ণিমার চাঁদের নীচ দিয়ে হেঁটে
হেঁটে রাজা দীন নারায়ণ একাকী প্রাসাদে ফিরে আসে। মুখে তার মগ্ন বিষাদ। নিঃশব্দে শোবার ঘরে ঢুকতেই সে দেখতে পায় রানী পদ্মাবতী ফাঁসিতে আত্মহত্যা করেছে। তার অবগুণ্ঠিত দেহখানি ঝুলছে প্রাসাদ প্রকোষ্ঠের কাঠের ধরণায়।
__________________________________
ডিসক্লেমেয়ার: এই কাহিনির কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা যাছাই করা হয় নাই। এটি কৃষ্ণ কুমারের বলা একটি কল্প কাহিনিও হতে পারে।
৩১. অঝোর ধারায় বৃষ্টি
আলেয়া নামের সেই মেয়েটি এই ঢাকা শহরেই থাকে জানা ছিল না। আর জানার জন্য ঐরকম আগ্রহ কখনো হয়নি । তবে ওকে যে মনে পড়ত না, তা নয়। কখনো যদি অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে, আর সে সময়টা যদি দুপুরের হয়, তখন আলেয়ার কথা মনে পড়ে।
আলেয়ার সাথে সম্পর্ক কিংবা জানাশোনা ছিল মাত্র পঁচিশ ত্রিশ দিনের। আমরা তখন ভাড়া থাকতাম পুরনো ঢাকায় দীননাথ সেন লেনের একটি বাসায়। ঠিক পাশের বাসাটা ছিল আলেয়ার বড়ো বোনের । তারাও ভাড়া থাকত। আর এখানেই বেড়াতে এসেছিল আলেয়া। ঠিক বেড়াতেও নয়, ছেলে দেখাতে নিয়ে এসেছিল ওকে। আর এখান থেকেই ওর বিয়ে হয়ে যায়।
তখন ঢাকাতে ‘আলো তুমি আলেয়া’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে। মরহুম ফতেহ লোহানী একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে এই ছবিতে অভিনয় করেছিল। সেদিন রূপমহল সিনেমা হলে ম্যাটিনী শো ‘আলো তুমি আলেয়া’ ছবিটি দেখে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছিলাম। দেখি দুই বাসার গলিমুখে আলেয়া দাঁড়িয়ে। এর আগেই ওর সাথে পরিচয় ও কথা হয়েছে। ও আমাকে দেখে একটু হাসি মুখ করে । বাসায় ঢোকার সময় আমি ওকে বলি– ‘আলো তুমি আলেয়া’।
এর পরেও ওর সাথে আমার দেখা হয়, কথা হয়।মেয়েটি দেখতে ভালোই। মফস্বলের সরলতা ছিল ওর চোখে মুখে। কিন্তু ওর সাথে প্রেম করব, এই ভাবনা কখনো ভাবিনি। আমি তখন কেবল ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। বিয়ে সাদির কথা মুখে আনলে সোজা বাড়ি থেকে আমাকে পিটাত।
আলেয়ার সাথে আরো কয়েকবার কথা হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, সে আমাকে ভালোবাসতে চায়। ওকেও যে ভালোবাসা যায়, সেই রকমই একটি মেয়ে আলেয়াও । সুচন্দার মতো টানাটানা চোখ, স্লিম বডি, লম্বা কালো চুল, শ্যামবর্ণ গায়ের রং। আমারও মনে হতো, ওর সাথে একটু প্রেম করি। দূরে কোথাও পালিয়ে নিয়ে যেয়ে ওকে বিয়ে করি। কিন্তু তা আমি নিজেকে করতে দিলাম না।
ইতোমধ্যে আলেয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। যেদিন বিয়ে হবে তার তিনদিন আগের ঘটনা। সেদিন ছিল অঝোর ধারায় বৃষ্টি। সময়টা ছিলো দুপুর। রুমের মধ্যে একাকী ছোট জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছিলাম। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে। বাড়ির সামনে গলিটি জলে ভেসে গেছে। বৃষ্টির সাথে শীলাও পড়ছিল। এবং সাথে মেঘ গুরুগম্ভীর বজ্রপাত। আমার রুমটা ছিল পুরনো জীর্ণ। দেয়ালে পলেস্তারা খসে গেছে। মেঘ বৃষ্টির কারণে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। রুমটা অন্ধকারোচ্ছন্ন হয়ে গেছে। বাইরে তখনো মুষুলধারে বৃষ্টি। হঠাৎ রুমের মধ্যে কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। আলো আঁধারিতে দেখতে পাই, আলেয়া।
আলেয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা লুকিয়ে কাঁদতে থাকে, এবং বলতে থাকে — তুমি এই বিয়ে ভেঙ্গে দাও। আমাকে তুমি এখান থেকে বের করে নিয়ে যাও।’ আমি কোনো কথা বলিনি। এটা আমার কাপুরুষতাও নয়। আমি তো আলেয়াকে কখনোই ভালোবাসিনি। ওকে আমি কখনোই বলিনি ভালোবাসি।
তখনো আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হচ্ছে। আলেয়া আমার বুকে জড়িয়ে। মানুষ মাঝে মাঝে প্রকৃতির অংশ হয়ে যায়। মানুষ একাকার হয়ে যায় বৃষ্টি, নদী, সাগর, জ্যোৎস্নার রাত কিংবা পাহাড়ি নির্জন অরণ্যের মতো প্রকৃতিগুলোর মাঝে। প্রকৃতি তার অসীম শক্তি দিয়ে মানুযকে কাছে টেনে নেয়, আর মানুষও তখন প্রকৃতির মাঝে একাকার হয়ে যায়। ধারণ করে স্বর্গীয় রূপের যা মর্তলোকের জীবন আচরণের সাথে কোনো মিল নেই। আলেয়ার চোখের জল ততোক্ষণে শুকিয়ে গেছে। বৃষ্টিও থেমে গেছে।
আলেয়ার ঐ ছেলের সাথেই বিয়ে হয়ে যায় এবং স্বামীর ঘরে চলে যায়। দু’তিন মাস পরে দীননাথ সেন লেনের বাসা ছেড়ে আমরা আজিমপুর কোয়ার্টারে চলে আসি। এরপর আলেয়ার সাথে কিংবা ওদের পরিবারের কারো সাথে আমাদের দেখা নেই।
ঠিক নয় বছর পর, একদিন নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানের সামনে আলেয়ার দেখা পাই। একটি আট বছরের ছেলের হাত ধরে আছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই একে অপরকে চিনে ফেলি। দু’জনের চোখে মুখে বিস্ময় এবং বিষণ্ণতা মুহূর্তেই ফুটে উঠে। সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হই ওর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে। আমার চাহনি থেমে যায় ছেলেটার মুখের উপর। আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। শরীরের সমস্ত রক্ত হঠাৎ তরঙ্গায়িত হয়ে হিম শীতল হয়ে গেল। ঐ রকম বয়সে আমাকে দেখতে ওর মতোই লাগত। আলেয়া বেশিক্ষণ দেরি করেনি। ছেলের হাত ধরে চলে যেতে উদ্যত হয়।
ছেলেটিকে খুব আদর করতে ইচ্ছা হলো। ওর মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করি- বাবু তোমার নাম কি ? ছেলেটি ওর যে নামটি বলেছিল – সেটি যে আমারই ডাক নাম।
৩২. মাধবী এসেই বলে যাই
রফিক আজাদের কবিতার পংতির মতো — ‘মাধবী এসেই বলে যাই’। আমি বলি কোথায় যাবে ? সে বলে, ‘কোথায় নিয়ে যাবে ?’ আজ আমরা বংশী নদীর পাড়ে যাব। ওখানে নদীর জল দেখব, নৌকা দেখব। গাছের ছায়ায় বসে থাকব। মাধবী বলে — ‘এই কাঠপোড়া রোদ্রের দুপুরে যাবে বংশী নদীর পাড়ে ! আমার খিদে লেগেছে। আগে খাওয়াও, তারপর যাব।’ আমরা নীলক্ষেতের ভাই ভাই হোটেলে কাচকি মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে নেই। তারপর চাঁন খাঁর পুল থেকে লোকাল বাসে উঠে সোজা চলে আসি সাভার বাজারে ।
বাস স্টান্ডের অদূরে দেখি গাধা টানা একটি ছোট টমটম দাঁড়িয়ে আছে। কোচোয়ানকে বলি, তোমার টমটম কি যাবে?
কোচোয়ান: কোথায় যাবেন স্যার ?
আমি: রাজা হরিশচন্দ্রের বাড়ী।
কোচোয়ান: আমি চিনিনা।
আমি: ( মাধবীকে দেখিয়ে ) ওকে চেনো ?
কোচোয়ান: না
আমি: উনি হচ্ছে রাজা হরিশচন্দ্রের বড়ো মেয়ে। নাম: রাজকুমারী অনুদা ।
মাধবী: তুুমি আমাদের বংশী নদীর তীরে নিয়ে চলো।
কোচোয়ান: চলেন।
টমটম চলছে। মনে হচ্ছে এ যেন সাম্ভার নগরী। বারশত বছর আগে লাল পোড়ামাটির পথ ধরে আমরা চলছি বংশী নদীর তীরে। টমটমের মুখোমুখি আমি আর মাধবী বসে আছি। মাধবীকে রাজকুমারী অনুদার মতোই লাগছিল। চুল হাওয়ায় উড়ছে। রোদ্র এসে পড়েছে ওর চোখে মুখে। ওড়না গলা থেকে দুই দিক থেকে বুুকের উপর দিয়ে সাপের মতো নীচে নেমে পড়েছে। ওকে খুব রোমান্টিক লাগছিল।
আমাদের টমটম এসে থামে বংশী নদীর তীরে।কোচোয়ানকে বললাম —- তুমি ঐ বটবৃক্ষ তলায় যেয়ে অপেক্ষা কর। আমরা ফিরব দুই ঘন্টা পর।
কোচোয়ান: স্যার, হরিশচন্দ্রের বাড়ী যাইবেন না।
আমি: যাব। বংশী নদীর হাওয়া খেয়ে আসি, তারপর যাব।
কোচোয়ান: হুজুর আপনার পরিচয়টা একটু দিবেন।
আমি : আমার নাম গোপীনাথ। আমি ময়নামতির মহারানীর পুত্র। রাজা হরিশচন্দ্রের হবু জামাতা।
কোচোয়ান: জ্বী,আচ্ছা।
তখন বিকেলের রোদ। বংশী নদীর কূল ধরে আমরা হেঁটে হেঁটে চলে যাই আরো সামনের দিকে। নদীর তীরে একটি জারুল গাছের নীচে দুজন ঘাসের উপর বসে পড়ি। হেমন্তের বংশী নদী। নদীর জল অর্ধেক হয়ে আছে। দু’একটা নৌকা এলমেল ভাবে চলছে। একটু পর পর বংশী নদীর শীতল হাওয়া আমাদের শরীরে এসে লাগছিল। চারদিকে জন মানবহীন। কেমন সুনসান নীরবতা ।
মাধবী: আমার ভয় লাগছে।
আমি: তাহলে চলে যাবে ?
মাধবী: না। যাব না।
আমি: কেন যাবে না ?
মাধবী: ভালো লাগছে।
নদীর কূল থেকে একটু দূরে একটি পরিত্যক্ত নাট মন্দির দেখতে পাই। আমরা আস্তে আস্তে ঐ নাট মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাই। দু’জন সন্তর্পণে মন্দিরের ভিতরে ঢুকে পড়ি। ভিতরে ঢুকে মন্দির দেখে বিস্মিত হই। কি অদ্ভূত কারুকার্যখচিত মন্দির। দেখি ভিতরে রাজা হরিশচন্দ্র ও রানী কর্ণবতী প্রার্থনায় রত। পাশে একজন পুরোহিত জপমালা জপছে। একটু পর রাজা রানীর প্রার্থনা শেষ হয়। পিছনে মুখ ফিরিয়েই তারা আমাদের দেখতেে পায়।
রানী: মা অনুদা তুমি এসেছ।
রাজা: বাবা গোপীনাথ তুমি এসেছ।
রাজা হরিশচন্দ্র পুরোহিতকে বললেন — এদের ধর্ম ও ভগবান মতে বিবাহের ব্যবস্থা করো। পুরোহিত তাই করলেন।
মন্দিরের সাথেই স্বর্ণকূটিেরের মতো একটি ছোট কক্ষে আমাদের প্রবেশ করানো হলো। রানী মা বললেন — তোমরা এখানে বিশ্রাম নাও। এই বলে রানী মা কক্ষের দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে চলে গেলেন। আমরা দুজন পালঙ্কের উপর যেয়ে বসলাম।
আমি : অনুদা, প্রিয়সী আমার — এই ক্ষণ কেমন লাগছে ?
অনুদা: জ্বী জাহাপনা, এই ক্ষণটির জন্য এতকাল অপেক্ষায় ছিলাম।
আমি: এসো আরো কাছে এসো।
অনুদা: জ্বী, আসছি।
আমি: এই ক্ষণ শুধু তোমার আমার !
তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। চারদিকে কেমন যেন অন্ধকার। সবকিছুই অপরিচীত লাগছে। চেয়ে দেখি — আমি আর মাধবী জীর্ণ এই নাট মন্দিরের মেঝেতে পাশাপাশি শুয়ে আছি। বাইরে থেকে কোচোয়ান ব্যাটা ডাকছে —- ‘হুজুর ! হূজুর ! গোপীনাথ স্যার ! আর কতক্ষণ দেরী হইবে ? যাইবেন না !’
৩৩. কাজল রেখা
আজ আমার এই চিলকোঠার ছোট্ট ঘরে কাজলের বউ হয়ে আসার কথা ছিল। সজ্জায় বিছিয়ে রাখার কথা ছিল ফুলের পাঁপড়ি। জ্বালাতে চেয়েছিল ঘরে আলো। এসব আজ কোনো কিছুই হলো না। আমি ঘরকে আঁধার করে একাকী বসে আছি। কোনো আলো জ্বালাতে ইচ্ছা করছে না। সিগারেটের ধূয়ায় রুমটা অন্ধকারে ভরে গেছে।
কাজল রেখা। আমি ডাকতাম ওকে কাজল বলে। ওর বাবা মা ডাকত রেখা। ঢাকা শহরের এই জনারণ্যে পথ চলতে চলতেই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। পথের মানুষ পথেই যেন প্রিয় মানুষের দেখা পেয়ে গেলাম। এক বৃষ্টি ঝুমঝুম সন্ধ্যায় দাঁড়িয়েছিলাম গুলিস্তান বাস স্টান্ডে রাস্তার উপরে। বৃষ্টিতে ভিজতেছিল আমার মাথার চুল। পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা ওর ছাতাটা এগিয়ে দিয়েছিল আমার মাথায় উপর। রাস্তার উপরে এই প্রথম কোনো মেয়ের কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়া, প্রথম কোনো মায়া দিয়েছিল একজন অপরিচিতা। সে এই কাজল।
মতিঝিল এরিয়ায় কাজল একটি চাকুরী করত। আমারও চাকুরীস্হল ছিল মতিঝিলেই। আমি অস্থায়ী ছোটো একটি চাকুরী করি, বেতন ভাতা নগন্য। কাজলের সাথে আমার প্রায়ই দেখা হতো, কথা হতো। কোনো কোনো দিন রাস্তার উপর হোটেলে বসে আমরা লাঞ্চ করতাম। কোনো কোনো দিন পাউরুটি কলা, কোনো কোনো দিন নোনতা বিস্কুট আর চা খেতাম।
এই ভাবেই চলতে চলতে দু’জন দু’জনার প্রতি মায়ায় বেঁধে যাই। দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে যাই। জগৎ সংসারে কোনো পাওয়াই মনে হয় মসৃন হয়না। কাজল যখন আমার কথা বলেছিল ওর মা বাবার কাছে, তখন তারা বলেছিল ‘না’। এ ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হবে না। আমার মতো চালচুলোহীন ছেলের কাছে কোনো বাবা মা তার আদরের মেয়েকে তুলে দিতে চায় ? কেমন যেন মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল এ জীবনে কাজলকে আমি আর পাব না। যাকে এত আপন করে কাছে টানতে চাইলাম , সে তাহলে দূরেই থাকবে।
গতকাল আমরা দুজনই লাঞ্চের পর আর অফিসে যাইনি। একটি রিক্সা নিয়ে বলদা গার্ডেনে চলে যাই। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল হয়েছে। আমরা দু’জন ঝাউবনের পাশে সবুজ ঘাসের উপর যেয়ে বসি। জারুল আর মহুয়াবনে পাখিরা তখন কিচির মিচির করছিল। কথা বলছি দু’জনে, ভালোবাসছি দু’জনে। যেন ‘ বাতাসের কথা সে তো কথা নয় রূপ কথা ঝরে তার বাঁশিতে আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই যেন দুটি আঁখি ভরে রাখে হাসিতে।’
কেন জানি ভানু চক্রবর্তীর কবিতার এই চরণটি আমার বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল- ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থি।’ গার্ডেনের সবুজ ঘাসে বসেই দু’জন সিদ্ধান্ত নেই. আগামীকালই আমরা কোর্ট ম্যারেজ করব।
সন্ধ্যার পাখিরা সব কলোরব করে উঠল। বাগানের সব ফুল যেন ফুটে উঠতে লাগল। সুবাস ছড়িয়ে পড়তে থাকল চারদিকে। মৃদুমন্দ বাতাস বইতে লাগল। কাজল কখন আমার হাত ধরেছিল, খেয়াল নেই। সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে ওর আনত মুখখানি একবার দেখলাম। জগতের সমস্ত সুখের আভা যেন ছড়িয়ে আছে ওর চোখে মুখে।
‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হারিয়ে. মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ। তব ভুবনে তব ভবনে. মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান।’
গার্ডেন থেকে আমরা বেরিয়ে আসি । কাজল রিক্সায় উঠে বক্সীবাজারে ওদের বাসার দিকে চলে যায়। যাবার বেলায় বলে যায়– কাল তোমার চিলেকোঠায় বউ হয়ে আসছি।
চিলেকোঠায় ফিরে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে ভাবছিলাম- এই ছোট্ট ঘরে কাল কাজল আসবে। আমার চুলো জ্বলবে। সন্ধ্যাবাতি জ্বালাবে ঘরে। ছোট সংসার হবে। ঘরবাড়ি গোছাবে লক্ষ্মী ঐ মেয়ে। যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, তারুণ্যের প্রথম প্রহরে, তা যেন কালকেই পূরণ হতে যাচ্ছে। আমার মন প্রাণ উল্লসিত হয়ে উঠল।
হঠাৎ দরজায় কড়ানাড়ার শব্দ শুনতে পাই। দরজা খুলে দেখি- একটি অপরিচিত লোক দাঁড়িয়ে। উনি বলছিল- আমি হাসপাতাল থেকে এসেছি। কাজল নামে একটি মেয়ে আমাকে পাঠিয়েছে। উনি রোড এক্সিডেন্টে আহত হয়ে জরুরী বিভাগে আছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। রক্ত দরকার।’
আমি দ্রুত হাসপাতালে চলে যাই। হাসপাতালের জরুরী বিভাগের কোরিডোরের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ডাক্তারকে বলি — কাজল এখন কেমন আছে ?
ডাক্তার : আপনি ওনার কি হন ?
আমি : আমি ওর কিছু হই না। বন্ধু বলতে পারেন।
ডাক্তার : ও আচ্ছা।
আমি : ওর সাথে আমি কি একটু কথা বলতে পারব ?
ডাক্তার : উনি এখন জীবনেও নেই, মরণেও নেই। আপনি ভিতরে যান। দেখেন, আপনার সাথে উনি কথা বলে কি না ?
আমি রুমে ঢুকি। কাজলের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি। কাজল আমার সাথে কথা বলেনি। সে তখন চেতনাহীন, অন্য এক অপার্থিব জগতে। আমি রুম হতে বের হয়ে আসি। বের হয়ে আসতেই দেখি- এক পৌঢ় ও একজন বয়স্কা মহিলা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কাজলের বাবা মা হবে হয়ত। তাঁরা কাঁদছে।
হাসপাতালের কোরিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় নেমে আসি। যে পথের উপর একদিন কাজলকে খুঁজে পেয়েছিলাম, সেই পথের জনারণ্যে আমি হারিয়ে গেলাম।
৩৪. চম্পা বকুল তলে
আমার স্কুল সহপাঠী নারায়ণ পূজা পার্বনে প্রায়ই ওদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যেত। নারায়ণের মা নারিকেলের নাড়ু আর গুরের বাতাসা খেতে দিত। সেবার ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর লক্ষীপূজায় গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। নারু আর বাতাসার সাথে মাসীমা ক্ষীরও খেতে দিয়েছিল। ক্ষীর খেয়ে বলেছিলাম, ‘ দারুণ মজা হইয়াছে।’ মাসীমা এই কথা শুনে বলেছিল, ‘তুমি আবার আসিও। তোমাকে আরও ভাল করে ক্ষীর রান্না করে খাওয়াব। ‘ কিন্তু আমার আর যাওয়া হয় নাই। সেইটাই ছিল শেষ যাওয়া। পরে শুনেছি, সেই মাসীমা ইহলোক ত্যাগ করেছেন।
এই নারায়ণের সাথে আমার দেখা হয় তিরিশ বছর পরে কূড়াগাছা মেলায়। ও আমাকে জোর জবরদস্তি করে নিয়ে যায় ওদের বাড়ি। স্কুল থেকে আগে যে পথ দিয়ে ওদের বাড়ি যেতাম, সে পথ ছিল ধূলির। সেই পথই দেখলাম ইট সুরকি বিছানো। একটি রিক্সায় করে চলে যাই ওদের ব্রহ্মগাছা গ্রামে। পথে দিয়ে চলছিলাম, আর দেখছিলাম পথের দুইপাশের চিত্রগুলি। সবকিছুই কেমন যেন অচেনা লাগছিল। সেইসময়ে পথের ধারে পাকুড় গাছতলায় দেখেছিলাম, খালি মাঠের উপরে একটি নাট্যশালা। আজ দেখলাম — সেই নাট্যশালাটি সেখানে নেই। ভেঙে সেখানে স্কুল করা হয়েছে।
নারায়ণদের বাড়িতে পৌঁছে মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে নতুন কোনো ঘর দুয়ার ওঠে নাই। যা দেখেছিলাম তাই আছে। সবকিছুই কেমন জীর্ণ পুরাতন হয়ে গেছে। মুখর করা বাড়িটি কোলাহলহীন মনে হচ্ছে। সাদা ধূতি শাড়ি পড়ে কোনো পৌঢ়া মহিলা আজ আর বের হলো না। কাছে এসে মায়ের মতো আদর করে বলল না — ‘ বাবা, তুমি কেমন আছ?’
একটু পরে নারায়ণ ওর স্ত্রীকে আমার সামনে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দেয়। সাথে ওর দুটো বাচ্চাকেও। আমি ওর স্ত্রীর মুখের দিকে ভাল করে একবার দৃষ্টি মেলে তাকালাম, যাকে ভেবে এই চেয়ে থাকা, সেই মেয়ে এই মেয়ে নয়। তারপরেও তাকেই দেখলাম, বললাম, বৌদি, ‘আমি নারায়ণের স্কুল সহপাঠী বন্ধু। তিরিশ বছর পর আমাদের দেখা। ‘
বাড়িতে তেমন কাউকে না দেখতে পেয়ে নারায়নকে বলি, অপর্ণা দিদির কোথায় বিয়ে হয়েছে? নারায়ণ বলে, দিদি এখন জলপাইগুড়িতে থাকে। ওখানেই তাঁর ঘর সংসার। ‘
—- সুধীন দাদা কোথায়?
—- সেও ওপারে চলে গেছে। শিলিগুড়িতেই বিয়ে করেছে।
—- তোর ছোট ভাই নৃপেন কোথায় থাকে?
—- ও কোলকাতায় চিৎপুরে থাকে। আমি এই পুরো বাড়িতে এখন একাই থাকি।
নারায়ণ আরও বলছিল, জানিস, কেমন যেন শ্মশানের মতো শূন্যতার মনে হয় — এই বাড়ি। এই লোকালয়। কতো আপন মানুষ যে স্বর্গীয় হয়ে গেল। কতো আত্মজন যে চলে গেল এই দেশ পারাপার ছাড়িয়ে ওপারে, অন্য পরভূমে। অন্তর হাহাকার করে ওঠে। তোকে যখন মেলায় দেখলাম, মনটা কি যে আনন্দে ভরে উঠল। কতো কথা মনে হচ্ছে তোকে দেখে। কতো স্মৃতি। ‘
আমি নারায়ণের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, কেমন যেন বিষাদে ছেয়ে উঠেছে ওর মুখখানি। আমি ওকে বলি — তোদের বাড়ির পিছনে তো ইছামতী নদী আছে, চল্, একটু বেড়িয়ে আসি তীর থেকে। তখন সন্ধ্যা নেমে আসছিল। আমি আর নারায়ণ হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই ইছামতীর তীরে । হায়! নদী আর নদী নেই। হয়ে গেছে মরা খাল। সামান্য কিছু জল স্থির হয়ে আছে তলাতে। সেই কাজল জল, সেই স্রোতধারা, সেই উথাল ঢেউ কিছুই আজ আর নেই।
ভেবেছিলাম মনটা আমাদের ভাল হবে নদী দেখে। তা আর হলো না। চৈত্রের এই সন্ধ্যা রাতে আকাশে উঠেছিল একাদশীর চাঁদ। বুঁনো জোনাকিরা জ্বলে উঠেছিল নদীর কাশবনে। ঝিঁঝির ডাক শুনতে শুনতে আকুল হয়ে নারায়ণকে বলছিলাম — ‘তোর সেই দীপা বর্মণের খবর কী, যাকে তুই ভালবেসেছিলি। বৌঠানের মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম — এই তো দীপা নয়।’
আমরা নদীর কূল থেকে সন্ধ্যার আঁধারে হেঁটে হেঁটে ফিরে আসছিলাম। যে পথ দিয়ে গিয়েছিলাম নদীর কূলে, সেই পথ দিয়ে নারায়ণ আমাকে আনলো না। অন্য একটি পথ দিয়ে সে আমাকে নিয়ে আসছিল। পথের দুপাশটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছিল। জ্যোৎস্নার আলো আঁধারিতে চিনতে পারছিলাম পরিচিত গাছগুলো। আজ থেকে তিরিশ বছর আগের সেই বকুলের গন্ধ, পথের পাশের ঝাড় থেকে আসছিল চম্পা ফুলের সেই সুবাস। আমার মনে পড়ছিল এই রকম সুবাস পেয়েছিলাম তিরিশ বছর আগে দীপা বর্মণদের বাড়ি যেতে।
নারায়ণ যে বাড়িটির সামনে আমাকে নিয়ে আসে, সে বাড়িও আমার চেনা। ইটের এই বাড়িটি তখনও পুরনো ছিল। আজ দেখলাম, এর পলেস্তারা সব খসে গেছে। ভাঙ্গা ইটের ফাঁকে পরগাছা জন্মে গেছে। নারায়ণ আমাকে বলে —-‘ চিনতে পারছিস বাড়িটি?’ আমি বললাম, চিনতে পারছি । এই বাড়ি দীপাদের। সেইবার লক্ষীপূজায় এখানে কীর্তণ গানের আসর বসেছিল। সেদিন আকাশে ছিল কোজাগরী চাঁদ। সারা পৃথিবী খাঁ-খাঁ জ্যোৎস্নায় ভরে উঠেছিল। পূজার প্রসাদ সেদিন দীপা তোকে না দিয়ে আমাকে দিয়েছিল। আজ তোকে বলছি — সেদিন সেই অসম্ভব সুন্দর জ্যোৎস্নায় দীপা গোপনে ধরেছিল আমার একটি হাত। দীপা বলেছিল — ‘ দাদা, তুমি আমাকে একটু চম্পা বকুলের ছায়াতলে নিয়ে যাবে? এই কোজাগরী চাঁদ, এই রাত তোমার জন্য মায়াময় মনে হচ্ছে।’ আমি জানি, দীপা ছিল তোর। তাই দীপার সেই হাত আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম সেদিন।’
নারায়ণ আমাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়। দেখি, চল্লিশোর্ধ্ব একজন রমণী বারান্দায় শীতল পাটি বিছিয়ে বসে আছে। তার পাশে লন্ঠন জ্বলছে। নারায়ণ লন্ঠনটি তুলে ধরে সেই রমণীর মুখের দিকে। এবং বলে, দেখত চিনতে পারিস কিনা এই মুখ। ‘ আমি চিনেছিলাম, সেই মুখ। এ যে দীপা বর্মণ। সে কোনো কথা বললো না, নির্বাক তাকিয়ে থাকল আমার মুখের দিকে। ফুরিয়ে যাওয়া কেরোসিনের লণ্ঠনটি নিভু নিভু করে জ্বলছিল তখন। একটা ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস আমার বুকের গভীরে থেকে ঝরে পড়ল। দীপা ওর অপলক দৃষ্টি নীচে নামিয়ে নিল। হয়ত চোখের কোণে অশ্রুকণা চিকচিক করছিল। সেই আধো আঁধার রাত্রিতে তা আমি দেখতে পাইনি।
গন্ধে আকুল করা চম্পা বকুল তলা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই রাতে বাড়ি ফেরার সময় নারায়ণ বলছিল — ‘ তিরিশ বছর ধরে জানতে পারিনি — দীপা কেন এমন বদ্ধ পাগল হয়েছে। আজ তোর কাছ থেকে জানতে পারলাম, দীপা কেন এমন পাগল হয়ে গেছে।’
৩৫. পৃথিবীর পথে পথে
সিরাজগঞ্জে শহীদ মনসুর আলী স্টেশন থেকে সিল্কসিটি ট্রেনে ঢাকা আসছিলাম। আমার পাশের সিটে মধ্য বয়সী এক বিদেশী বসা ছিল। প্রাথমিক পরিচয়ে যতটুকু জানতে পারি — ওর নাম পল এ্যান্ডারসন। সে একজন ধর্ম যাজক এবং পরিব্রাজক। অনেকটা ক্যারাভান লাইফ তার, যাযাবরীয় জীবন যাপন করে। গিয়েছিল দিনাজপুরে কান্তজীর মন্দির দেখতে। সেখান থেকে চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানসাট। সোনা মসজিদ দেখে এখন ঢাকার পথে। তারপরে যাবে রেঙ্গুন।
সিল্কসিটি ধীরে ধীরে যমুনা অতিক্রম করছিল। তখন বর্ষার সময়। জেগে থাকা চরগুলো জলে ডুবে গেছে।সারা যমুনার বুক জুুড়ে জল থৈথৈ করছে। সাগরের মতো লাগছিল যমুনাকে। ওপারের কোনও কূল কিনারা দেখা যায় না। ট্রেনের জানালা দিয়ে পল বিস্ময়ে দেখছিল যমুনা নদী !
পল : তোমাদের এই নদীটির নামই তো যমুনা ?
আমি: হ্যাঁ, এইটিই যমুনা নদী।
পল: খুবই সুন্দর একটি নদী। ঐ যে দূরে পানি আর পানি দেখছি। তারপরে কোনও শহর বা গ্রাম আছে ?
আমি: ঐ জলের ওপারে কোনও শহর নেই, নদীর কূল ঘেসে আছে শুধূ গ্রাম আর ফসলের ক্ষেত।
পলের সাথে এইভাবেই কথা বলতে থাকি। ট্রেনটি ইতোমধ্যে যমুনা পার হয়ে ঢাকার দিকে চলতে থাকে।মির্জাপুর পর্য্ন্ত যেতে যেতে পল সম্বন্ধে যতটুকু জানতে পারি — পলের জন্ম আমেরিকার টেক্সাসের হার্স্ট শহরে। ওর মা ছিল বার্মিজ। পলের বাবা চাকুরী সূত্রে রেঙ্গুনে থাকাকালীন সময়ে পলের মা’র সাথে প্রণয় হয় ও পরবর্তীতে বিয়ে হয়। পলের বাবা’র পরবর্তী পোস্টিং হয়েছিল বোম্বে। আর পলের কৈশরকাল কাটে এই ভারতবর্ষের বোম্বে নগরীতেই। এই নগরীতেই পলের মায়ের অকাল মৃত্যুও হয়।
ট্রেনটি মির্জাপুর স্টেশনে থেমে আছে। অন্য আর একটি ট্রেন এখানে ক্রসিং হবে। ট্রেনটি ছাড়তে দেরী হবে দেখে আমি আর পল স্টেশনে নেমে প্লাটফর্মের উপর দিয়ে হাঁটতে থাকি।
আমি : পল, তারপরের কথা বলো।
পল: আমার য়য়স যখন নয় বছর তখন বাবা হার্স্টে চলে আসে। এমনই দূর্ভাগ্য যে, বাবা একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান সে বছরেই।
আমরা যেয়ে একটি চা’র দোকানে বসি। এবং চা খেয়ে নেই । পলই আমাকে সিগারেট অফার করে। সিগারেট খেতে খেতে বলছিলাম — পল এবার তোমার ঘর সংসারের কথা কিছু বলো।
পল: আমার স্ত্রী একজন আইরিশ মেয়ে। সে এখন ডাবলিনে থাকে। বিচ্ছিন্ন জীবন। ওর কাছে আমার একটি সাত বছরের মেয়ে রয়েছে। নাম মিলিশা।
পল মানি ব্যাগ থেকে ওর মেয়ের একটি ছবি বের করে আমাকে দেখায়। ফুটফুটে পরীর মতো দেখতে ওর মেয়ে।
পল আরও একটি সিগারেট ধরিয়ে টানছে। ঢাকার দিক থেকে আসা ট্রেনটি স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। আমরা আবার ট্রেনে যেয়ে উঠে পড়ি।
ট্রেনটি যখন মৌচাক বনাঞ্চল অতিক্রম করছিল — দেখি বনারণ্যের গভীরে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে পল। আমি পলকে ডাকি — ‘পল ?’
পল: জ্বী, কোয়েল।
আমি: তুমি তো এখন অনেক নিঃসঙ্গ ! তোমার সময়গুলো কি ভাবে কাটাও ?
পল: এই তো ধর্ম কর্ম করছি। দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পৃথিবীর পথে পথে একাকী হাঁটছি। বিভিন্ন উপাসনালয়ে ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ মানুষের সাথে কথা বলি। আমার ধর্মের বাণী অন্য মানুষদের শোনাই। কাল চলে যাব রেঙ্গুনে। মাতামহ ও মাতামহীর গ্রেবইয়ার্ডে যাব। তাদের জন্য প্রার্থনা করব। ওখানকার বৌদ্ধ উপাসনালয়গুলো ঘুরব। এইতো এইভাবেই জীবন চলছে। এই ভাবেই সময় কাটাই।
আামাদের ট্রেনটি দ্রুত গতিতে ঢাকার দিকে ছুটে চলেছে। কখন টঙ্গী চলে এসেছে বুঝতেই পারি নাই। আমি পলকে বললাম— ‘সামনে বিমান বন্দর স্টেশনে আমি নেমে যাব।’ আমি পলকে শেষ যে প্রশ্নটা করেছিলাম, তাহলো- ”পল, তুমি তো পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছ, অনেক শহর জনপদ। কোন দেশে বা কোথায় তোমার মরতে ইচ্ছা করে ? ” আমার এ প্রশ্ন শুনে, পলের মুখটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। চোখ দুটো কেমন যেন ভারি হয়ে উঠল।
পল : তোমাদের ভারতবর্ষের বোম্বে নগরীতে আমি মরতে চাই। ওখানে আমার শৈশব ও ছেলেবেলা কেটেছে। ওখানকার আকাশ বাতাস এখনও আমাকে টানে। আরব সাগরের তীরে ছোটবেলায় আমার হাতধরে বাবা মা কত ঘুরে বেড়িয়েছে। আমার মায়ের সমাধিস্থল ঐ শহরেই। ঐ শহর আমাকে ডাকে। মেরিন ড্রাইভ রোডের আমাদের ছোট্ট বাড়িটার কথাও মনে পড়ে।
ট্রেনটি হুইসেল বাজিয়ে বিমান বন্দর স্টেশনে এসে থেমে যায়। আমি পলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেমে পড়ি।
বিদায় মুহূর্তে পলকে বলেছিলাম — তোমার সাথে আমার আর কি কখনও দেখা হবে? পল বলেছিল— হয়তো হবে, এই পৃথিবীর কোনও এক পথে। এই রকমই কোনও এক ট্রেনে।
Leave a Reply