মহাস্থবির জাতক – অখণ্ড সংস্করণ (চার পর্ব একত্রে) – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
প্রথম অখণ্ড সংস্করণ : বৈশাখ ১৩৯৩, এপ্রিল ১৯৮৬
পরিবর্ধিত দে’জ সংস্করণের ভূমিকা
প্রেমাঙ্কুর আতর্থী রচিত ‘মহাস্থবির জাতকে’র নূতন সংস্করণ প্রকাশিত হল দে’জ পাবলিশিং থেকে। এই সমগ্র সংস্করণ প্রথম প্রকাশ করেন ত্রিদিবেশ বসু। এই সংস্করণে যে ভূমিকা ও পরিশিষ্ট ছিল, দে’জ পাবলিশিং-এর নূতন সংস্করণে সেগুলির সঙ্গে সংযোজিত হল আরো চারটি রচনা–দুটি স্মৃতিচারণ ও ‘মহাস্থবির জাতকে’র একটি সমালোচনা এবং একটি সাক্ষাৎকার। স্মৃতিচারণ দুটি হেমেন্দ্রকুমার রায় ও শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের। সমালোচনাটি অভয়ঙ্করের (ভবানী মুখোপাধ্যায়) এবং সাক্ষাৎকরটি সুধীররঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের শৈলজানন্দের লেখাটি সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের রচনাটি দৈনিক ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল। সুধীররঞ্জনের সাক্ষাৎকারটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দেশ-এ’ বেরিয়েছিল। অভয়ঙ্করের রচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকায়।
উমা রায়
লেখক সম্বন্ধে দু’চার কথা – উমা দেবী
প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর সঙ্গে আমার পরিচয় অতি কিশোর বয়সে। সে-সময় তিনি ‘যাদুঘর’ পত্রিকা সম্পাদনা করছিলেন। ১৯৩০ সালে পত্রিকা উঠে যাবার পর তাঁর সঙ্গে পত্রযোগে সম্পর্কও বিচ্ছিন্ন হয়। তাঁর সেই সময়কার লেখা পত্রগুলিতে তাঁর ব্যক্তিত্ব, রুচি ও সহৃদয়তা এমন সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছিল যে, দীর্ঘ দশ বছর তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না থাকলেও তাঁর কথা মনে ছিল।
১৯৪০ সালে তাঁকে আমি প্রথম দেখি। আমার নিজের প্রয়োজনে আমি তাঁর খোঁজ নিয়েছিলুম। তিনি তখন বোম্বে থেকে ফিরেছেন, কিন্তু ১৯৩০ সালে লেখা পত্রে বাড়ির যে ঠিকানা ছিল–২০/২ এফ কর্নওয়ালিস স্ট্রিট–সে বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। স্থানীয় অনুসন্ধানের পর ২নং রঘুনাথ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে তাঁর সাক্ষাৎ পাই। তখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে–শীর্ণ, শুভ্র, দীর্ঘ, ঋজু দেহ–মাথার সব চুল একেবারে সাদা। বললেন–অনিদ্রা-রোদে ভুগছেন– তিনদিন চোখে একেবারে ঘুম নেই। শুনে পব দুঃখবোধ হয়েছিল।
এরপর নানা প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে তাঁকে দেখবার–অত্যন্ত নিকট থেকে তাঁকে জানবার সুযোগ ও সৌভাগ্য লাভ করেছি। ঈর্ষাহীন গুণগ্রাহিতা তাঁর চরিত্রের একটি বিশেষ গুণ ছিল। তাঁর মধ্যে কাব্য ছিল। জীবনে দুঃখ-কষ্ট-দারিদ্র্য বহু ভোগ করেছেন কিন্তু শিল্পীর মতো নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তা গ্রহণ করেছিলেন। যে গুণ থাকলে মনন, পঠন, অনুভবন ও অয়নে একটি সুষমা লক্ষিত হয়, সে-গুণ তাঁর ছিল। এবং সে-গুণ না থাকলে সাহিত্যকর্ম যে বাইরে থেকে গায়ে-তুলে-নেওয়া একটি বহুব্যবহৃত পোশাকমাত্র হয়ে ওঠে, পরবর্তী জীবনে তো আমি অনেক লেখক-লেখিকা সম্বন্ধেই অনুভব করেছি।
তাঁর ধর্মমত সম্বন্ধে কথা উঠলে তিনি বলতেন–আমি দীক্ষিত ব্রাহ্ম নই। তিনি শ্রীঅরবিন্দের ‘Life Divine’ ও তার অনুবাদ ‘দিব্যজীবন’ এবং অন্যান্য সমস্ত গ্রন্থই তিনি কিনেছিলেন ও যত্ন নিয়ে পড়েছিলেন। মনুষ্য-জীবনের রহস্য-সম্বন্ধে তিনি ছিলেন নিয়তিবাদী অর্থাৎ তিনি বিশ্বাস করতেন সমস্ত-কিছুই ঘটে আছে– সময় তাকে সামনে এনে দেয় মাত্র। পরলোক-সম্বন্ধে তাঁর ঔৎসুক্য ও তীব্র অনুসন্ধিৎসা সম্ভবত কোনো প্রত্যয়ে অধিষ্ঠিত হয়নি–যদিও ভূতগত বহু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই তাঁর ছিল–কারণ তিনি আমাকে শেষ দু-তিনবছর প্রায়ই বলতেন–’এখনও তো ওপারের কোনো আলো এসে পৌঁছল না!’ ১৯৬৪ সালের ১৩ অক্টোবর তারিখে সকাল পৌনে সাতটায় তিনি দেহত্যাগ করেন। সে-সময়ে আমি লখনউ ছিলুম। তাঁর শরীরের অবস্থা কিছুকাল ধরে খুবই খারাপ চলছিল-আমাকে কলকাতা ছাড়তে বারণ করেছিলেন, বলেছিলেন–”ফিরে এসে দেখতে পাবে না।” এই রকম উক্তি তিনি প্রায়ই করতেন বলে আমি যাত্রা স্থগিত করিনি। যাবার দিন দেখা করতে গেলে বললেন–”ফেরবার পথে কাশীতে নেমো। কালিপদবাবুকে (সুবিখ্যাত সাধক কালিপদ গুহরায়) আমার হয়ে বোলো–’ও-পারের কিছুই তো জানতে পারলুম না, ‘কী পাথেয় নিয়ে যাবো!” লখনউ যেদিন ত্যাগ করি সেদিন পথে খবরের কাগজে তাঁর মৃত্যুসংবাদ পড়লুম। কাশীতে আর নামিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সমারোহ পছন্দ করতেন কিন্তু সভা-সমিতি পছন্দ করতেন না। তিনি অত্যন্ত শৌখিন ছিলেন এবং সর্বদাই বহুমূল্য দ্রব্য ব্যবহার করতেন। অতিশুভ্র কাঁচির ধুতি ও পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসতেন,–শয্যাগত হবার আগে পর্যন্ত তাঁর পাঞ্জাবিতে কখনও ভাঁজ বা মালিন্য দেখিনি। বোম্বে থেকে ফিরে আসবার কিছুকাল পরে তাঁর দামি বিলিতি স্যুটগুলি তিনি স্নেহভাজনদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন। আহারের রুচিতে তিনি ছিলেন আমিষপ্রিয় এবং গুরু-মশলা-দেওয়া মাংস পছন্দ করতেন।
তিনি সর্বশ্রেণীর সাহিত্যের মধ্যে কবিতা পড়তে ভালোবাসতেন। কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ও Browning এবং গালিব তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন। কালিদাসকে তিনি ইন্দ্রিয় সমারোহের কবি বলে মনে করতেন। তিনি বলতেন যে, কবিতা তাঁকে এত অভিভূত করে যে, কোনোদিন কবিতা লিখতে ইচ্ছুক হলেন না। অবশ্য ইংরেজি ও বাংলা কিছু কবিতা তিনি লিখেছেন। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ইতিহাস তাঁর অতিপ্রিয় বিষয় ছিল। মুসলমান-যুগের ইতিহাস তিনি অনেক পড়েছিলেন এবং সে-সমস্তই তাঁর নখদর্পণে ছিল। শেষ বছর-পনেরো তিনি শ্রীঅরবিন্দের দর্শনের দিকে ঝুঁকেছিলেন–এবং এ-সম্বন্ধে অনেক পড়াশুনাও করেছিলেন। তাঁর আলাপচারিতা যে কত মনোমুগ্ধকর ছিল তা প্রত্যেকেই লিখেছেন–সে-সম্বন্ধ পুনরুক্তি করতে চাই না। পরিশিষ্টে ধৃত রচনায় তার প্রমাণ আছে। তাঁর বন্ধুমহলের পরিধি এত বিস্তৃত যে, সে-সম্বন্ধে কিছু বলা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাঁকে আমি কোনোদিন ফল খেতে দেখিনি–দিলে বলতেন–”মা ফলেষু কদাচন”–গীতায় বারণ আছে। ফুলের মধ্যে সাদা ফুল–বিশেষ করে রজনীগন্ধা অতি প্রিয় ছিল।
প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর রচনারীতিতে নিপুণ বাগ্-বৈদগ্ধ্য, রসকুশলতা, বুদ্ধিদীপ্ত রঙ্গরস ও চমকপ্রদ বাস্তবানুগতা অত্যন্ত অধিক পরিমাণে লক্ষিত হয়। কিন্তু তাঁর মধ্যে এমন একটি কবিপ্রাণ ছিল –যা খুব কম লোকের মধ্যেই দেখা যায়। কবিত্বশক্তি তাঁর রচনায় মৃত্তিকা-তল-প্রশ্রয়ী রসধারার মতন প্রবাহিত ছিল। এই কবিপ্রাণতাই তাঁর সংস্কারমুক্ত মনকে কখনও কদমলিপ্ত হতে দেয়নি এবং তাঁর আচরণে এমন একটি ভদ্র ও সৌজন্যময় আবেদন ছিল যা মুহূর্তের জন্যও ভুলতে দিত না তাঁর অনুপম ব্যক্তিসত্তাকে। অনেকসময় তাঁর কোনো কোনো ব্যবহার রূঢ় ও আক্ষেপ [য] মনে হলেও তার মধ্যে একটি সাময়িক নৈমিত্তিকতাকে বুঝে নিতে বিলম্ব হত না। জীবনে অর্থকষ্ট পেয়েছিলেন বলে শেষবয়সে হিসেবি হয়েছিলেন এবং পিপীলিকার মতন বিন্দু বিন্দু করে বেশ কিছু অর্থের মধু সঞ্চয় করেছিলেন। তাঁর ব্যবহৃত উপমাই এখানে ব্যবহার করলুম।
কিন্তু তাই বলে তিনি কৃপণ ছিলেন না। শৌখিন-জিনিস-ব্যবহারে তিনি এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, যখন শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন তখনও তিনি আপন রুচিমতো শৌখিন ব্যবহার্য জিনিস কিনিয়ে আনাতেন। নিউ থিয়েটার্স-এর চাকরি ছেড়ে দেবার পর তাঁর আর্থিক সংস্থান নির্ভর করত প্রধানত তাঁর লিখিত উপন্যাস, ছোটগল্প ও সাময়িক রচনার উপর। তাঁর প্রাপ্য অর্থ কোনো কোনো প্রকাশক সময়মতো দেননি অথবা একেবারেই দেননি; কিন্তু তাঁর স্বাভাবিক আভিজাত্য কখনও তাঁকে তাঁদের দ্বারস্থ হতে কিংবা তাঁদের বিরুদ্ধে আইনের সাহায্য নিতে দেয়নি। তাঁর রচিত ‘তত-এ-তাউস’ নাটকটি শ্রীরঙ্গমে মঞ্চাভিনীত হবার কালে অভিনীত রজনী-সংখ্যানুযায়ী তাঁর প্রাপ্য অর্থ তাঁকে চাইতে বা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
বোম্বে থেকে ফেরবার পর পর তিনি পুনরায় সাহিত্যকর্মে নিযুক্ত অর্থাৎ স্বধর্মে স্থিত হন! তাঁর নিজের জীবন নিয়ে এই ইচ্ছাকে ফলবতী করবার কার্যকরী প্রবল প্রেরণা অমল হোম মহাশয়ের কাছ থেকে পান। ২ নং রঘুনাথ চ্যাটার্জী স্ট্রিটে ‘মহাস্থবির জাতক’-এর প্রথম পর্ব রচনার সূত্রপাত হয়। সে-সময়ে সকালের দিকে কিছুক্ষণ তিনি জাতক-রচনায় নিযুক্ত থাকতেন এবং সন্ধ্যাবেলা ১৪নং কৈলাস বসু স্ট্রিটের বাড়িতে আরো খানিকটা লিখতেন। সজনীকান্ত দাস মহাশয় নিয়মিতভাবে আটটা-সাড়ে আটটায় প্রায়ই আসতেন এবং যতটা লেখা হত শুনতেন। অমল হোম মহাশয়ও শুনতে আসতেন। ‘মহাস্থবির জাতক’-এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব ১নং কৈলাস বসু স্ট্রিটের বাড়িতেই লিখিত হয়। তখন দ্বিতীয় যুদ্ধের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে প্রায়ই কার্ফু ও ব্ল্যাক-আউটের জন্য তাঁর বাড়ি-ফেরা সম্ভব হত না। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের প্রেস-কপি তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন কিন্তু তৃতীয় পর্বের প্রেস-কপি আমাকেই তৈরি করে দিতে হয়েছিল। সে-সময়ে তাঁর দক্ষিণ হস্তে কাঁধ থেকে একটা যন্ত্রণা নেমে আসত যার ফলে লেখার কাজ তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। চতুর্থ পর্বের কিছু অংশে তিনি স্বহস্তে রচনা করেছিলেন কিন্তু তারপর সবটারই শ্রুতিলিখন করতে হয়েছে। ১৯৫৩ সালের শেষের দিকে তিনি রক্তচাপাধিক্য-ব্যাধিতে আক্রান্ত হন, এবং ক্রমশ অসুস্থতা বাড়তে থাকে ও শেষপর্যন্ত শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এই সময়ে প্রতিদিনের কর্মান্তে সন্ধ্যাবেলায় তাঁর মুখ থেকে শুনে-শুনে ‘মহাস্থবির জাতক’-এর চতুর্থ পর্ব লিখতে হয়েছিল। তিনি দশ-বারো পঙ্ক্তির বেশি সাধারণত বলতেন না। যদি কোনোদিন বস্তুকথন দেড়-দুই পাতা কি কদাচিৎ তিন-চার পাতা হত তো তিনি মনে করতেন–যথেষ্ট হয়েছে–দু’-এক দিন না লিখলেও চলবে। এইভাবে দীর্ঘ দশবছর কাল ‘মহাস্থবির জাতক’-এর চতুর্থ পর্বের রচনা চলে। বিন্দু বিন্দু কথাবস্তু চয়ন করে এই জাতক চক্র-রচনায় তিনি কম ধৈর্যের পরিচয় দেননি।
‘মহাস্থবির জাতক’ স্বরূপত তাঁর আত্মলিপি, কিন্তু তার রূপটি উপন্যাসের। উপন্যাসের চলিত লক্ষণ তার মধ্যে কতটা পাওয়া যাবে সে-কথা ‘এহ বাহ্য’। যদি উপন্যাসের প্রাণসত্তা প্রতিষ্ঠিত থাকে জীবন-রূপায়ণের সমগ্রতায়, যদি তার সত্য নিহিত থাকে জীবন-দর্শনের গভীরতায়, যদি তার প্রত্যয় সুদৃঢ় হয় জীবন-বোধের বাস্তব ভিত্তিতে, যদি একটি মানবাত্মার পরিণমনক্রিয়া বিচিত্র কাহিনীর বহুল অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে ‘সূত্রে মণিগণা ইব’ চরিতার্থ হয়, তবে নিশ্চয়ই ‘মহাস্থবির জাতক’ একটি প্রথম শ্রেণীর উপন্যাস। লেখক এই গ্রন্থে ‘আমি’-অংশটিকে কোথাও উৎকট করে তোলেননি, আবার অসংখ্য নর-নারীর মিছিলে এই “আমি”-কে হারিয়েও ফেলেননি। জীবনের-বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে একটি আত্মিক পরিণমনের সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস এতে বিধৃত। মানবজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টিমূলে নিহিত অজ্ঞান এক রহস্যময় সত্তার আশ্চর্য অভিব্যক্তি, অনন্ত-সুখ-দুঃখময় মানবজীবনের ঘটনা-বহুলতার মধ্যে দিয়ে চিরন্তন মানবচরিত্রের সমুদ্রসত্তার উদ্ঘাটন কোনো একটি বিশেষ কাহিনীর ক্ষুদ্রতাকে আশ্রয় করে নিশ্চিন্তরূপেই সম্ভব হত না। সমস্ত সংস্কারের ‘এহ বাহ্য’–তার অন্তরালে চিরতৃষিত যে মানবাত্মা জীবনলীলায় নিজেকে বিস্মৃত হয়ে আছে তারই অসহায় রূপটিকে এমনভাবে এমন দরদের সঙ্গে ক’জন বা তুলে ধরেছেন? জীবনপথের পথিক মহাস্থবির যে-পথটিকে ধরে দিগন্তরেখায় বিলীন হয়েছেন সেখানে পথ-অতিক্রমণের মহত্তাই পথিক-চিত্তের মহত্তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘পূর্বস্মৃতির পর্যালোচনা’-মাত্র বলে এক বিরাট ঐশ্বর্যকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া মানুষ যে মানুষ-হিসাবেই কত বিচিত্র ও কত গম্ভীর এবং কত ভালোবাসার বস্তু, মানবাত্মার মহিমা যে ছোট বড়-নির্বিশেষে শুধুমাত্র অস্তিত্বের গৌরবেই স্থিত–”মহাস্থবির জাতক’-এ তার একটি অত্যুজ্জ্বল আলেখ্য প্রমাণস্বরূপ রইল।
‘মহাস্থবির জাতক’-এর বহু কাহিনির লৌকিক রূপটির সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘যদ্দৃষ্টং তল্লিখিতম্’-ন্যায়ে তিনি যে সেগুলিকে উপনিবদ্ধ করেননি –এ তাঁর মহতী শিল্পী-সত্তারই উদার প্রকাশ। সমস্ত বাহ্য পরিচয়ের অন্তরালে ধমনীর শোণিতপ্রবাহে প্রবাহিত মানব-মনের আদিম রসধারায় যে তিনি অবগাহন করেছিলেন–তার প্রমাণ ‘জাতক’-এর অঙ্গে অঙ্গে দীপ্যমান।
রচনা ও প্রকাশ–দুই দিক দিয়েই ‘মহাস্থবির জাতক’-ই লেখকের শেষ-সাহিত্যকৃতি। এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে তাঁর বাল্যবন্ধু প্রভাতকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধ এবং পরিমল গোস্বামীর লিখিত তিনটি প্রবন্ধের নির্বাচিত অংশ সংকলন করে দেওয়া হল। কারণ ব্যক্তি প্রেমাঙ্কুর-ই জাতকের মহাস্থবির। শ্রীদিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধও দিলুম। এই তিনটি প্রবন্ধে আলোচিত বস্তুর বহির্ভূত অংশই আমি ভূমিকাতে দিয়েছি। তাঁর রচিত গ্রন্থের তালিকাও পরিশিষ্টে দেওয়া হল।
পরিশেষে ত্রিদিবেশ বসু মহাশয়কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি–অতি যত্ন নিয়ে এর মুদ্রণব্যাপার নির্বাহ করবার জন্য। ইতি–মহালয়া, ১৩৭৬ (১৯৭০)।
১০, ডি. এল. রায় স্ট্রিট
কলিকাতা ৬
প্রকাশকের নিবেদন
পাঠকদের আগ্রহাতিশয্যে চার পর্বে সম্পূর্ণ ‘মহাস্থবির জাতক’-এর অখণ্ড সংস্করণ প্রকাশিত হল। প্রায় সাতশ পাতার এই বিশাল অখণ্ড সংস্করণ পাঠকদের কাছে সমাদৃত হবে, এই বিশ্বাস আছে। এই সংস্করণ প্রকাশে সহায়তার জন্য কবি-প্রাবন্ধিক অধ্যাপিকা ড. উমা রায়কে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। পরিশিষ্টে তৃতীয় বন্ধনীতে মুদ্রিত সব তথ্য প্রকাশক কর্তৃক পরিবেশিত। আশা করি এই নূতন পরিবর্ধিত সংস্করণটিও পাঠক মহলে সমাদৃত হবে।
বিনীত
সুধাংওশেখর দে
উৎসর্গ
বাবা,
কর্মক্লান্ত দিনশেষে আবার যেদিন তোমার সঙ্গে মিলন হবে, সেই মুহূর্তটি স্মরণ করে আমার শৈশব-কৈশোর-মায়া-উপবন থেকে চয়ন-করা এই স্মৃতির ডালা তোমার উদ্দেশে উৎসর্গ করলুম।
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
ভূমিকারও কোনো প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু লেখকের ঋণস্বীকারের কিছু দায়িত্ব আছে, জাতক সম্পূর্ণ হবার অপেক্ষায় থাকলে হয়তো তা অস্বীকৃতই থেকে যাবে। মহাস্থবিরের এই সাদায়-কালোয় চিত্রিত বিচিত্র জীবন যে আর কারও আনন্দের খোরাক যোগাবে, এই চিন্তার স্পর্ধা যাঁরা তাঁর মনে সঞ্চার করেছেন, আজ তাঁদের কথা স্বতঃই মনে হচ্ছে। তাঁদের উৎসাহ এবং উত্তেজনা না পেলে হয়তো জাতক অলিখিতই থেকে যেত। সুতরাং জাতকের ভালো-মন্দের নিন্দা-প্রশংসার ভাগও তাঁদের ওপর বর্তাবে। আমার বাল্যবন্ধু অমল হোম এই উৎসাহদাতাদের অগ্রণী। আসামীস্বরূপ তাঁকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলুম।
এই দুর্দিনে জাতক প্রকাশ করে সোদরোপম শ্রীমান সজনীকান্ত যে দুঃসাহস দেখিয়েছেন তার ফলাফল সম্পূর্ণ নিজস্ব। তাঁর শক্ত ঘাড়, আমি তাঁর জন্যে মোটেই চিন্তিত নই। প্রুফ আমি দেখতে জানি নে–ভুলভ্রান্তি যদি কিছু থাকে, তার দায়িত্ব সুবল ও গণেশ ভায়ার।
মানুষের জীবনের কাহিনীই সব-চাইতে বিচিত্র উপন্যাস– উপন্যাসের ঘটনা ও চরিত্রের জন্যে আশা করি কারও কাছে কোনো জবাবদিহিতে পড়তে হবে না। ইতি—
“মহাস্থবির”
১লা আশ্বিন, ১৩৫১
Leave a Reply