মহাভারত ও সিন্ধুসভ্যতা – ড. অতুল সুর
প্ৰয়াত পিতৃদেব
ড. রাজেন্দ্রলাল সুরের
স্মৃতির উদ্দেশ্যে
প্ৰণাম
এই বই ও লেখক সম্বন্ধে
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মহাভারত মাত্র মহাকাব্য নয়, ইহা আমাদের জাতীয় ইতিহাস। ইহা কোনো ব্যক্তিবিশেষের ইতিহাস নহে, ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস।’ সেই ইতিহাস যে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বের, তা ডক্টর অতুল সুর এই বইয়ে দেখিয়েছেন। তিনি নৃতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, জ্যোতিষিক ও মহাভারতের অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রমাণ করেছেন যে মহাভারতের আদিম কাহিনিসমূহ সিন্ধুসভ্যতার সমসাময়িক বা তারও আগেকার যুগের। তার মানে আমরা ভারতের ইতিহাস লেখার সময় যে বলি, বৈদিক যুগের পর মহাকাব্যিক যুগের সভ্যতার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল তা ভুল। মহাকাব্যিক যুগের সভ্যতাকে বৈদিক যুগের আগে স্থান দিয়ে, ভারতের ইতিহাস এখন নতুন করে লিখতে হবে।
বইখানা সম্বন্ধে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নিশীথরঞ্জন রায় ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় লিখেছেন— ‘গ্রন্থকার তাঁর পাণ্ডিত্য বলে মহাভারতীয় এবং সিন্ধুসভ্যতার যুগের সামাজিক আচার-বিহার, চালচলন ইত্যাদির মধ্যে সাদৃশ্যের যে চিত্র এঁকেছেন তা শুধু মহাভারতের সাক্ষ্য-প্রমাণের উপর নির্ভরশীল নয়। তার সমর্থনে তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে কাজে লাগিয়েছেন। গ্রন্থকার আলোচনা করেছেন বহু তথ্য, অবতারণা করেছেন বহু প্রশ্নের, এবং তার যথাযথ উত্তরও দিয়েছেন। দু-একটি জায়গায় পুনরুক্তি সত্ত্বেও অভিজ্ঞ নৃতাত্ত্বিক তাঁর বক্তব্যকে দাঁড় করিয়েছেন আঁটসাঁট যুক্তির ভিত্তিতে। অবশ্য তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্তই নির্বিবাদে সকলে মেনে নেবেন এমন সম্ভাবনা আশা করি না। এ সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে যদি মতানৈক্য দেখা দেয়, তাতে বিস্ময়বোধের কোনো কারণ নেই। ড. সুরের বইটি সম্পর্কে ব্যক্তব্য এই যে, এতে একসঙ্গে বহু তথ্যের সমাবেশই শুধু পাওয়া যাবে না, নতুন চিন্তার খোরাকও পাওয়া যাবে প্রচুর মাত্রায়।’
ড. সুরের গবেষণা পদ্ধতি ও মৌলিকচিন্তা সম্বন্ধে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন— ‘ড. সুর মৌলিক চিন্তা করার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা নবীন গবেষকদের অনুসরণযোগ্য। তাঁর প্রবন্ধগুলো শুধু কৌতূহল উদ্দীপিত করে না, মনকে ভাবতে শেখায়।
ডক্টর ঝরা বসু ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখেছেন— ‘প্রবন্ধের জগতে ড. অতুল সুর প্রবাদপুরুষ। এহেন প্রবাদপুরুষের রচিত ‘মহাভারত ও সিন্ধুসভ্যতা’ ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এক বিপ্লব সৃষ্টি করবে। ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে এতদিন সাহেবদের ও তাদের অনুগামীদের লেখাই পড়েছেন, এবার একজন বর্ষীয়ান বিদগ্ধ বাঙালির লেখাও পড়ুন। বইখানি প্রতি লাইব্রেরিতে অবশ্য রক্ষিতব্য।’
সূচি
মহাভারত ও সিন্ধুসভ্যতা
মহাভারত ‘জাতীয় ইতিহাস’
মহাভারতের বিবরণ কতটা সত্য?
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ও বাঙালির পাণ্ডবগণ
যুধিষ্ঠিরের সশরীরে স্বর্গারোহণ কি সত্য?
সিন্ধুসভ্যতা ও বাঙালি
উপসংহার
স্বীকৃতি
এই বইয়ের লেখাগুলো ‘বর্তমান’ পত্রিকায় দুই পর্যায়ে প্রকাশিত হয়েছিল। কুড়ি কিস্তিতে সমাপ্ত হয়েছিল। অসংখ্য পাঠক-পাঠিকার অনুরোধে এগুলো পুনঃমুদ্রিত হলো।
ভূমিকা
রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে শান্তিনিকেতনে এক ‘জাতীয় সেমিনার’-এর আয়োজন করা হয়েছিল। আলোচনা-চক্রটি অনুষ্ঠিত হয় ‘বিশ্বভারতী’ ও ‘ইন্ডিয়ান কাউনসিল অফ হিস্টরিক্যাল রিসার্চ’-এর যৌথ উদ্যোগে। আলোচিত বিষয়বস্তু ছিল ‘রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস চিন্তা ও বনো সভ্যতা’। ওখানে আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম এক নিবন্ধ পাঠ করার জন্য। তাছাড়া তিনদিনব্যাপী ওই আলোচনা- চক্রের শেষদিন আমাকেই পৌরহিত্য করতে হয়েছিল। আমি যে নিবদ্ধ পাঠ করেছিলাম তার শিরোনাম ছিল, ‘রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস চিন্তার প্রেক্ষিতে বীরভূমের ঐতিহ্য’। এই নিবন্ধে প্রসঙ্গত আমাকে মহাভারত সম্বন্ধে অনেক কথা বলতে হয়েছিল। যা বলেছিলাম, সেগুলো অবশ্য আমার নতুন কথা নয়। গত পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে আমি মহাভারত সম্বন্ধে যে অনুশীলন করেছি তারই ফল এবং পূর্বে আমার বহু গ্রন্থ ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের গোড়ার দিক পর্যন্ত পণ্ডিতসমাজের বদ্ধমূলে ধারণা ছিল যে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথমার্ধের কোনো একসময় ভারতে বৈদিক আর্যগণের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত ভারতের অধিবাসীরা অসভ্য ও বর্বর জাতির লোক ছিল, এবং আর্যগণই তাদের সুসভ্য করে তুলে হিন্দু সভ্যতার গোড়া-জাতির লোক ছিল, এবং আর্যগণই তাদের সুসভ্যা করে তুলে হিন্দুসভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল। কিন্তু ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধুসভ্যতার আবিষ্কারের পর সে প্রত্যয় প্রত্যাহৃত হয়েছে। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সিন্ধুসভ্যতার মূল কেন্দ্রদ্বয়ে খননকার্য যখন কিছুদূর অগ্রসর হয়েছিল, তখন ভারতের প্রত্নতত্ত্ব সমীক্ষার অধিকর্তা স্যার জন মারশালের নির্দেশে আমি মহেঞ্জোদারোয় গিয়ে সরেজমিনে ওই সভ্যতার বৈশিষ্টসমূহ পর্যবেক্ষণ করি। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈতনিক গবেষক হিসেবে অনুশীলন করে আমি প্রমাণ করি যে পরবর্তীকালের হিন্দুসভ্যতার বারো আনা ভাগ সিন্ধুসভ্যতার উপাদান দিয়েই গঠিত হয়েছিল, এবং তার মাত্র চার আনা ভাগ বৈদিক আর্যসভ্যতার আবরণে মণ্ডিত হয়েছিল। এ সম্বন্ধে আমার অনুশীলনের প্রতিবেদন ১৯৩১-৩২ খ্রিষ্টাব্দের ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায় ছাপা হয়। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ড. দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকার ইন্ডিয়ান কালচারেল কনফারেন্সে প্রদত্ত তাঁর সভাপতির ভাষণে বলেন—’হিন্দুসভ্যতা যে আর্য ও অনার্য সভ্যতার মিশ্রণে উদ্ভুত এটা যে চারজন বিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ করেছেন তাঁরা হচ্ছেন স্যার জন মারশাল, রায় বাহাদুর রমাপ্রসাদ চন্দ্র, ড. স্টেলা ক্রামরিশ ও শ্রী অতুল কৃষ্ণ সুর।’
‘আর্য গরিমা’ থিওরির বশীভূত হয়ে আমাদের ঐতিহাসিকরা সিন্ধুসভ্যতার আবিষ্কারের পূর্বে ভারতের ইতিহাস আরম্ভ করতেন বৈদিকসভ্যতা হতে। পরে বৈদিকসভ্যতা দ্বিতীয় স্থান দিয়ে, সিন্ধুসভ্যতাকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়। আগে বৈদিকসভ্যতার পরের যুগের সভ্যতাকে মহাকাব্য-যুগের সভ্যতা বলা হতো। এখনও তাই বলা হয়। মহাকাব্যের অন্যতম হচ্ছে মহাভারত। আমি এই গ্রন্থে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি যে মহাভারতীয় যুগের সভ্যতা প্রাক-বৈদিক এবং এই সভ্যতা সিন্ধুসভ্যতার সমকালীন বা তার পূর্বের। এর সপক্ষে যুক্তিসমূহ এই গ্রন্থে দেওয়া হয়েছে। আমার এই মতবাদ যদি যথার্থ হয়, তাহলে বলতে হবে যে ভারতীয় সভ্যতা, তথা হিন্দুসভ্যতার সূচনা হয়েছিল মহাভারতীয় যুগে।
দ্বিতীয় সংস্করণ আরও তথ্যসমৃদ্ধ ও মুদ্রণ শুদ্ধ করা হয়েছে।
ড. অতুল সুর
Leave a Reply