মহাভারতের অষ্টাদশী – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
প্রথম সংস্করণ এপ্রিল ২০১৩, পঞ্চম মুদ্রণ আগস্ট ২০১৬
.
উৎসর্গ
তিনি এখন ত্বরিতগতি ছন্দ থেকে মন্দাক্রান্তায় পরিণত
সেই উত্তর-মেঘের সুষমাকে।
.
আরম্ভে
মহাভারতের অষ্টাদশী। অষ্টাদশী কথাটা একটা সংজ্ঞা। আমি বিয়াল্লিশ বছরের ঈষৎ-মেদিনী দেখেছি কত, তাদের মনের ভিতর এখনও কেমন অষ্টাদশী খেলা করে। কত ষাট বাষট্টির মহিলা দেখেছি–সতত রোমন্থনী-সংস্কৃতের কবিতমা শিলা ভট্টারিকা কি এঁদেরই কথা স্মরণ করেছিলেন সহস্রবার উচ্চারিত এই শ্লোকে–সেই আমার যৌবন সন্ধিতে আমার কুমারীত্ব-হরণ-করা এই বর, সে তো সেই আছে, সেই চৈত্রের রাতগুলি তাও একই রকম আছে, এখনও উন্মীলিত মালতীর বুক স্পর্শ করে ঘুরে আসে প্রৌঢ়পুষ্প কদমফুলের হাওয়া, এমনকী আমিও তো সেই আমিই আছি, বদলাইনি একটুও, কিন্তু তবুও…তবুও বারবার মনে পড়ে সেই রেবা নদীর তীর, সেই বেতসীলতার কুঞ্জগৃহগুলি, যেখানে বারবার চুরি করে গিয়ে মিলিত হয়েছি তাঁর সঙ্গে–সা চৈবাশ্মি তথাপি চৌর্য-সুরতব্যাপার-লীলাবিধৌ/রেবা রোধসি বেতসীতরুতলে চেতঃ সমুৎকণ্ঠতে।
এই হল বিয়াল্লিশ-বাষট্টির দেহপুটে অষ্টাদশীর মন। আর পুরুষ মানুষের কথা নাই বা বললাম। প্রাচীন এক রমণীই দুঃখ করে বলেছিলেন–এটা ঠিকও নয় এবং এটা মানায়ও যে, পুরুষগুলোর শরীরে জরা ধরে যাবে, তবু তাদের লাম্পট্যের বিকার যায় না–যদিহ জরাস্কপি মান্মথাঃ বিকারাঃ। কথাটা সম্পূর্ণ মেনে নিয়েছিলেন বিদগ্ধ ভোজরাজ। তিনি এই কথার উত্তরে বলেছিলেন–তা হলে কি মেয়েরা ঠিক এইরকম নাকি যে, যৌবনবতীর মৃদু-কঠিন স্তন দুটি বয়সের ভারে একটু নমিত হতেই তাদের জীবনটাও শেষ হয়ে যায়, নাকি শেষ হয়ে যায় রতি-বিলাস-কলা–স্তনপতনাবধি যৌবনং বা রতং বা? ভোজরাজের প্রত্যুত্তরটা হয়তো একটু তীক্ষ্ম হয়ে গেছে বিদগ্ধা রমণীর মুখের ওপর জবাব দিতে গিয়ে এবং আমরা এটা বেশ জানি যে, শাস্ত্র এবং কাব্যে অশেষ রমণীকুলকে যতই কলঙ্কিনী করা হোক, যতই না তাদের অখিল পুরুষের ধৈর্য-ধ্বংসী যন্ত্রে পরিণত করা হোক, আমরা বেশ জানি–তার জন্য দায়ী পুরুষেরাই এবং দায়ী তাদের বিধিসৃষ্ট শরীরগ্রন্থিগুলি, আর হৃদয়গ্রন্থিও বটে।
পরস্পরের ওপর দোষারোপ বাদ দিয়েও বলা যায়–দুই পক্ষেই অন্তঃশায়ী মনের বয়স খুব বাড়ে না। বাড়লে জীর্ণ-পক্ক শরীরের সঙ্গে মানায় না বলে মনকে খানিক বুড়িয়ে নিতে হয় বটে, কিন্তু গভীর সঙ্গোপনে অষ্টাদশী মন তখনও কাজ করে, কাজ করে পৌরুষেয় আঠেরোর কৌতূহল–সেই ইনারশিয়া, যা চলতে থাকে এবং যার উৎসমূল সেই আঠেরো–অথবা the cobweb of premarital acquaintanceship–জর্জ ইলিয়টের শব্দ। আমরা কিন্তু অষ্টাদশীর মন নিয়ে বিচার করতে বসিনি এখানে, শুধু বলতে চেয়েছি, মহাভারতে বহুল নারী-চরিত্রের মধ্যে রাজকুলের রজোগুণ-সমন্বিত রমণীরা যেমন আছেন, তেমনই আছেন ঋষিপত্নীরা, আছেন দার্শনিক মহিলা, এবং আছেন গণিকা-বেশ্যারাও। সবচেয়ে বড় কথা, ভারতবর্ষের চিরন্তন ঐতিহ্যে হাজারো যারা ভাগ্যবতী পরম সতী আছেন, তাঁরাও তো বিরাজ করছেন মহাভারতে। সাবিত্রী আছেন, দময়ন্তী আছেন– সতীত্বের জন্যই তারা অসাধ্য সাধন করেছেন। এই দুজনের মধ্যে সাবিত্রী তো মৃত্যুর দেবতা যমরাজকে পর্যন্ত অভিভূত করে ফেলেছেন আপন নিষ্ঠায়। মহাভারত-পুরাণ, আমাদের ধর্মশাস্ত্র, শ্ৰেীতশাস্ত্র সর্বত্র যে-কথাটা পাওয়া যাবে, সেটা হল পুরুষের জন্য শত রকমের ধৰ্ম-নিয়ম, সংস্কার, তপস্যার বিধান আছে আত্মশুদ্ধির জন্য, ঐহিক-পারত্রিক উন্নতির জন্য। কিন্তু স্ত্রীলোকের কাছে সংস্কার একটাই, সেটা বিবাহ এবং তাঁর সমস্ত তপস্যাটাই স্বামীর সন্তুষ্টি লাভের মধ্যে নিহিত। এই মানসিকতার চরম পর্যায়ে কিন্তু সেই বিখ্যাত পৌরাণিক কাহিনী তৈরি হয়েছে–যেখানে এক কুষ্ঠরোগী চলচ্ছক্তিহীন স্বামীকে বেশ্যাবাড়ি পৌঁছে দেবার মধ্যে সতীত্বের সিদ্ধি চিহ্নিত হয়েছে প্রাচীন পুরাণেই। সাবিত্রী এখানে সতীত্বের প্রভাবে মৃত্যুলোক থেকে ফিরিয়ে আনছেন স্বামীকে এবং একভাবে তিনি যেন এখানে কঠোপনিষদের নচিকেতার কাছাকাছি পৌঁছে যান।
আর দময়ন্তীকে দেখলাম সে এক অদ্ভুত দুরন্ত প্রেম, যা এক বিরাট ‘স্ট্রাগল’-এর মধ্য দিয়ে আসছে–নল-রাজা দৈব-দুর্বিপাকে জুয়া খেলে সব হারাচ্ছেন, কলি প্রবেশ করছে তাঁর শরীরে, শেষ পর্যন্ত সর্বরিক্ত এক হীন মানুষে পরিণত হচ্ছেন তিনি। দময়ন্তী যেখানে নির্মল প্রেমের প্রতীক, প্রেমের জন্য লৌকিক জগতের যন্ত্রণা এবং অলৌকিক জগতের পরীক্ষা–সব সামলাচ্ছেন। অবশেষে মিলন এসেছে পতিনিষ্ঠার অনিবার্য পরিণতিতে। এটাও কিন্তু সতী ধর্মেরই একপ্রকার রোমান্টিক ট্রান্সফরমেশন’। অথচ আমরা এই সংকলনের মধ্যে সাবিত্রী-সত্যবানের মৃত্যুঞ্জয়ী সতীভাবনা অথবা নল-দময়ন্তীর পরিণাম রমণীয় প্রেম নিয়ে পুনর্বিচার করিনি। মহাভারত গ্রন্থখানা যেহেতু এক বিরাট বিচিত্র সভ্যতা এবং এক চলমান জীবনের প্রাচীন প্রতিরূপ, আমরা তাই নিখিল-রমণীকুলের বিচিত্র মানসলোকে প্রবেশ করবার চেষ্টা করেছি। কেননা চলমান রমণী-জীবন শুধু সতীত্ব নির্ভর এককেন্দ্রিক অনুভূতি নয়। সেখানে ব্যাকরণ মতে পঞ্চস্বামীর প্রতি সম ব্যবহারের দায় এবং দাবি থাকলেও দ্রৌপদী বেশি ভালবাসেন অর্জুনকে। কিংবা কন্যাবস্থায় পুরুষ-সমাগমের মতো অষ্টাদশী ভ্রান্তি ঘটলেও পরবর্তী বিবাহিত জীবনের মুখোমুখি হওয়াটা কেমনতর দুঃসাহসিক অভিযান হয়ে দাঁড়ায়–সেটাও মহাভারতীয় সত্য উদঘাটনের একটা বড় প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে কুন্তী কিংবা সত্যবতীর জীবনে।
মহাভারতের রমণী-মানস নিয়ে যদি গভীরভাবে চিন্তা করা যায়, তা হলে দেখা যাবে সেখানে একটা বড় দুশ্চিন্তা আছে মেয়েদের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে। এটা অবশ্যই সেই চরিত্র যার অবশেষ পরিণতি হল সেই সব নিন্দামুখর প্রবাদ– নারী নরকের দ্বার, কিংবা বিশ্বাসো নৈব কর্তব্যঃ স্ত্রী রাজকুলেষু চ। মেয়েদের সম্বন্ধে এইসব প্রচার যে, মেয়েরাই দুর্দম কামনায় পুরুষকে প্রলুব্ধ করে, তারাই সবচেয়ে বেশি কামুক এবং সুযোগ পেলে কোনও পুরুষকেই তারা ছাড়ে না–পুমান্ ইত্যেব ভুঞ্জতে–এই সব প্রচার কিন্তু ভারতীয় নীতি-উপদেশের জায়গা নয় শুধু, কিংবা নয় শাস্ত্রীয় সতর্কবাণী, এমনকী এটা একটা সামাজিক সিদ্ধান্তও শুধু নয়, এটা একটা সামগ্রিক বিশ্বাস যে, মেয়েরাই যত সর্বনাশ তৈরি করে। তার মধ্যে মহাভারতে যখন এক ঋষি এক স্বর্গবেশ্যা অঙ্গরাকে জিজ্ঞাসা করেন–তোমার কাছে আমি মেয়েদের স্বভাবের কথা শুনতে চাই, তখন উত্তরটা ভীষণ ‘ইনট্ৰিগিং’ হয়ে যায়। অপ্সরা বলে–আমি একটা মেয়ে হয়ে মেয়েদের নিন্দে করতে পারব না–প্রত্যুবাচ ন শক্ষ্যামি স্ত্রী সতী নিন্দিতুং স্ত্রিয়ঃ। তার পর অপ্সরা রমণী আস্তে আস্তে বলতে থাকে মেয়েদের স্বভাব চরিত্রের কথা। তাতে মেয়েদের মনের গভীরতা এমনভাবেই ফুট হয়ে ওঠে যেন মেয়েরা সবাই পুরুষ দেখলেই হামলে পড়ছে–বেঁটে-খাটো, মোটা-কালো, মূক-বধির কোনও পুরুষেই যেন আপত্তি নেই–স্ত্রীণামগম্যো লোকেহস্মিন্ নাস্তি কশ্চিন্মহামুনে।
আমরা স্বচ্ছ দৃষ্টিতে বুঝতে পারি যে, এই কথাগুলির মধ্যে একটা একপেশে বাড়াবাড়ি আছে এবং কথাগুলি মেয়েদের মুখেও সাজিয়ে-গুছিয়ে চাপানো হয়েছে। ফলত একটি মেয়েই এখানে ত্রস্ত-ভীত নীতিবাগীশ বৃদ্ধের মতো বলে ওঠে–যৌনতার সমস্ত দোষের মূলে আছে মেয়েরা এবং তা সবাই জানে–স্ত্রিয়ো হি মূলং দোষাণাং তথা ত্বমপি বেথ চ৷ আমরা অবশ্য মনে রাখব যে, এই কথাগুলি যে বলছে সে একজন অপ্সরা, যার মধ্যে পৌরুষের গণ্যতা থাকে না, গম্যতাও নয় এবং বিপ্রতীপ ভাবনায় এটাও বুঝতে দেরি হয় না যে, পুরুষমাত্রেই যেভাবে সার্বিক কামনায় মথিত হয়, সেই মানসিক তথা যৌন মন্থনই প্রতিফলিত-ভাবে নারীর মধ্যে দেখে পুরুষ। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, নারী-শরীরের গঠন, তার স্তন-জঘন-নিতম্বের ব্যঞ্জন স্বভাবতই অথবা ‘ইনস্টিংটিভলি’ পুরুষকে আকর্ষণ করে এবং সে আকর্ষণ দুর্দমনীয় বলেই কামুকতায় আচ্ছন্ন পুরুষ সমস্ত দোষটাই চাপিয়ে দেয় মেয়েদের ওপর যেন তারা আকর্ষণ করছে বলেই পুরুষ আকৃষ্ট হচ্ছে, তা নইলে তারা শমদমের সাধনে এতটাই সিদ্ধ যে অশেষ রমণীকুল যদি চলাফেরা করে আকর্ষণ না করত তা হলে পুরুষেরা সব সময় উদাসীন চক্ষুতে ঊর্ধরেতা হয়ে বসে থাকত।
মহাভারত মেয়েদের খুব বাস্তব দৃষ্টিতে দেখে এবং সমাজের বাস্তবটাও সে সঠিকভাবে জানে। ফলে সীতার মতো অমানুষী সতী-চরিত্র সাবিত্রী কিংবা দময়ন্তীর মাধ্যমে আরও নাটকীয়ভাবে সেখানে আসে। কিন্তু সতীত্বের মতো এমন সৎ উপদেশ বস্তু থাকতেও মহাভারত জানে যে সংসারের বাস্তব এমনই অথবা কন্যা-জীবনের কৌতূহল এবং আকর্ষণও এমন হতে পারে যে, বয়ঃসন্ধিতে বিধিসম্মত বিবাহের পূর্বেই তার গর্ভাধান ঘটে গেল। মহাভারতে সত্যবতীর জীবনে এই ঘটনা ঘটেছে, একই ঘটনা ঘটেছে কুন্তীর জীবনেও। সত্যবতী তাঁর জীবনের এই রহস্য প্রকট করে দিয়েছেন, কিন্তু সত্য লুক্কায়িত ছিল কুন্তীর জীবনে। যে সমাজ কানীন পুত্রকে মেনে নিত, সেইখানে দাঁড়িয়েও কুন্তী যে তার এই সঞ্চিত রহস্য উন্মোচন করলেন না, এটাও তো একটা জটিল জীবন-যাপনা, যা অনেকানেক বাস্তবের কাছাকাছি আসে। মহাভারত এই বাস্তবকে মর্যাদা দেয়, এই বাস্তবকে সে মহাকাব্যিক পরিণতি দেয়–কুন্তীকে দেখতে হয় তার কানীন পুত্র তারই বিধিসম্মত পুত্রের প্রতিযোদ্ধা।
নারী-জীবনে সতীত্বের নিষ্ঠা বৈধতাকে তুঙ্গভূমিতে প্রতিষ্ঠা করে বটে, কিন্তু ঔপপত্যের আকর্ষণও পৃথিবীতে কম নয়, যেমন কম নয় পুরুষের দিক থেকে পরকীয়া প্রেমের আকর্ষণ। কিন্তু স্ত্রীলোকের দিক থেকে ঔপপত্য কিংবা পুরুষের দিক থেকে পরকীয়ার কোনও সুস্থির পরিণতি নেই, তা নেহাৎই এক চরম আস্বাদন মাত্র। ব্যবহারিক জীবনে পরকীয়া কিংবা ঔপপত্যের ব্যাপারে কোনও শাস্ত্রীয় অনুমোদন থাকতে পারে না। ফলে মহাভারত সেখানে প্রায় নিশ্চুপ আর ধর্মশাস্ত্রের ভাবনাতেও প্রথাসিদ্ধ বৈবাহিক প্রেমের বাইরে নারী পুরুষকে উৎসাহিত করাটা কোনও মহাকাব্যিক উদ্দেশ্য হতে পারে না। কিন্তু মহাভারতের সমসাময়িক সমাজ এবং তার পূর্বকল্পে জীবনচিত্রটাই এমন ছিল, যেখানে কন্যা অবস্থায় যাচিত এবং অযাচিত পুরুষ-সঙ্গমে স্ত্রীলোককে নিগ্রহের জায়গায় নিয়ে যায়নি। এমনকী বৈবাহিক জীবনেও ধর্ষণ এবং অতিক্রমের ঘটনায় স্ত্রীকে পরিত্যাগ করা বা ভয়ংকর শাস্তি দেওয়া শাস্ত্রীয় অনুমোদনেই নিষিদ্ধ হয়েছে মহাভারতে। মহাভারতে সত্যবতী, কুন্তী এবং দ্রৌপদীর জীবনে বারবার যে প্রশ্ন উঠেছে–প্রথম সঙ্গমের পরেও তাদের কন্যাভাব সুস্থির থাকছে কিনা–এই কুটিল প্রশ্নে দেবতার বরদান বস্তুটাকে একটা অতিপ্রাকৃতিক স্যাংশন হিসেবে না মানলেও চলে। মাসান্তিক অথবা সন্তান জন্মের পর রজঃচক্রের আবর্তনেই স্ত্রী-শুদ্ধির ঘটনাটা এত উদার এবং মহান ভাবে বুঝেছে মহাভারত যে সেটাকে দেবতার বরদানের মতোই গ্রহণ করা যায়। এমনকী তা পরবর্তীতে কঠিন-হৃদয় ধর্মশাস্ত্রকার অথবা স্মার্তেরও বিধান-নিদান বটে।
নারী-স্বাধীনতার উচ্চারণের মধ্যে আজকাল এক ধরনের অসহিষ্ণুতা দেখি। অনেক মহিলাকেই দেখি তাঁরা আকণ্ঠ ক্রুব্ধ হয়ে আছেন পুরুষের ওপর। মহাভারতের চরিত্র-ভাবনায় বোঝা যাবে যে জীবন বড় বিচিত্র রসময়তায় বয়ে চলে, সেখানে পুরুষের পৌরুষেয় যন্ত্রণা অত্যাচার এবং সর্বগ্রাসী অধিকারবোধ কখনও এককোটিক চরম সত্য হতে পারে না। পুরুষের প্রতি সার্বিক সন্দেহ এবং শঙ্কা এক ধরনের রমণীয় অসহনীয়তা তৈরি করছে এবং তা আজকাল আমাদের সমসাময়িক যুবক-যুবতীর মধ্যে এমন এক মানসিকতার ইন্ধন দিয়েছে যে, তারা অনেক সময় সঠিক বয়সে বিয়েই করতে চাইছে না। বিশেষত মেয়েরা। মহাভারত এখানে যেন এক বিকল্প হিসেবে কাজ করে। এখানে প্রেম, ভালবাসা, যৌনতা, এবং নারী-পুরুষের এককোটিক উদগ্রতাও এমন এক মহাকাব্যিক সহনীয়তার মধ্য দিয়ে পরিশ্রুত হয়, যাতে অনেক কিছুই শিক্ষণীয় হয়ে ওঠে, এমনকী পালনীয়ও বটে।
এই গ্রন্থে মহাভারতের সেই সব রমণীর চরিত্র এবং মানস নিয়ে আমরা ভেবেছি, যাঁদের বিশেষত্ব আছে–এবং সেটা মহাকাব্যিক বিশেষ। কুন্তী এবং দ্রৌপদীকে নিয়ে আমায় নতুন করে তপস্যায় বসতে হয়েছিল, কেননা এঁদের কথা আমি আগে লিখেছি। কিন্তু এতদিনে আমার বয়স বেড়েছে এবং তার সঙ্গে ছাত্র হিসেবে বিদ্যালাভের পরিসরও কিছু বেড়েছে। বিশেষত পণ্ডিত-সজ্জনদের সতত চলমান সারস্বত চর্চার নিরিখে মহাভারতের স্ত্রী-চরিত্র নিয়ে যেহেতু নতুন করে ভাবার প্রয়োজন ছিল, তাই কুন্তী-দ্রৌপদীর মতো শাশুড়ি-বউকে নিয়ে আরও ভাবতে হয়েছে আমাকে। অন্যান্য স্ত্রী-চরিত্রগুলিও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আগে বেরিয়েছে, কিন্তু গ্রন্থনার প্রয়োজনে সেগুলিরও পরিবর্ধন-পরিমার্জন ঘটেছে।
পরিশেষে জানাই, অনেক বিপরীত পরিস্থিতি এবং বাধার মধ্য দিয়ে যে কোনও লেখককে কাজ করতে হয় এবং একজন লেখক, যাকে মাঝে-মাঝেই পাঠকের কাছে শব্দমূর্তিতে পৌঁছোতে হয় তার পক্ষে সবচেয়ে বড় বাধা হল অন্য এবং অন্যতর বিষয় নির্মাণ। সেখানে কোনও বিষয়কেই অপ্রাধান্যে কম সমাদরে দেখলে চলে না। এর ফলে পূর্ব প্রতিজ্ঞা বিষয়-বিশ্লেষণ বিলম্বিত হতে থাকে। এই গ্রন্থের ক্ষেত্রেও আমার এই বিড়ম্বনা ঘটেছে। তবে এই প্রকাশনা সম্পূর্ণ করার জন্য আমার পুত্র অনির্বাণের নিরন্তর চেতাবনি ছিল, সেটা সময়ে আমার চৈতন্য সম্পাদন করেছে। অনেক কাটাকুটি, অনেক ইতস্তত গোলাকার পরিচ্ছেদ সঠিকভাবে সংস্থাপন করে আমার কৃতজ্ঞতা ভাজন হয়েছেন আমার সহকারী শিষ্যা তাপসী মুখার্জী। সংসারের আর অন্য মানুষগুলি ছাড়াও প্রকাশনা-ক্ষেত্রে আমার বড় সহায় আনন্দ-প্রকাশনার সদস্যবৃন্দ। সর্বশেষে আমার প্রাণারাম সেই কিশোর আর বিনোদিনী রাইকিশোরী, যাঁরা চিরকাল লীলায়িত শব্দ-সরস্বতীতে; সেই লীলায়ন ছাড়া কেম্নে এই মহাকাব্যিক অষ্টাদশীর হৃদয় বোঝাতে পারতাম–লীলা কাঁচন বৰ্ততাং মনসি মে রাধামনোমোহিনী।
—নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
Leave a Reply