মহানিষ্ক্রমণ – শিশিরকুমার বসু
প্রথম সংস্করণ: মার্চ ১৯৯৬
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
.
সুগত
শর্মিলা
সুমন্ত্র
ও
তাদের হাত দিয়ে একালের
ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে যারা
সুভাষচন্দ্রের স্বপ্নের ভারত
গড়বে
.
ভূমিকা
সুদূর পাঞ্জাবের লায়ালপুর জেল থেকে মুক্তি পেলাম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার মাস খানেক পরে, ১৯৪৫-এর সেপ্টেম্বরে। জেলের গেট থেকে বেরিয়েই চমকে গেলাম। মনে হল যেন এক সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে এসে পড়েছি। লোকের ভীড় ও ফুলের ছড়াছড়ি। টাঙ্গা চড়িয়ে যখন আমাকে সমারোহ করে শহরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন উত্তেজিত জনতার মুখে নতুন এক শ্লোগান শুনে বেশ বিব্রত হলাম—‘বোস খান্দান্ জিন্দাবাদ’! আগের বছর টাঙ্গা করে হাতকড়া লাগিয়ে যখন আমাকে স্টেশন থেকে জেলে নিয়ে এসেছিল তখন আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। কি অদ্ভুত পটপরিবর্তন!
পাঞ্জাব থেকে কলকাতার পথে ট্রেনে আসার সময় স্টেশনে স্টেশনে একই অভিজ্ঞতা হল। কলকাতা ফেরার পরও বেশ কিছুদিন ‘বোস খান্দান্’-এর ছেলেদের নিয়ে মাতামাতি চলল। যেন আমরা ছোট ছোট নেতা বা হিরো হয়ে গিয়েছি। ব্যাপারটা আমার বেশ অস্বস্তিকর লাগছিল।
সেই সময় আমার বাবা আমাকে আলাদা ডেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রথমত তিনি আমাকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে আমাদের নিয়ে যে হৈচৈ হচ্ছে তাতে যেন আমি প্রভাবিত বা বিভ্রান্ত না হই। তিনি বলেছিলেন যে আপাতদৃষ্টিতে আমরা যে গৌরবের অধিকারী হয়েছি সেটা বাস্তবিকপক্ষে ‘সুভাষের reflected glory’। আমার পক্ষে উচিত হবে ডাক্তারি পড়া শেষ করার দিকে মন দেওয়া এবং সাধারণভাবে জীবনসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়া। তিনি অবশ্য একথাও বলেছিলেন যে জনজীবনে নিজের স্থান করে নেওয়ার অধিকার সকলেরই আছে, কিন্তু সেটা অর্জন করতে হবে নিজের কাজ ও অবদানের মধ্য দিয়ে।
বাবার দ্বিতীয় পরামর্শ ছিল যে আমি যেন বিগত পাঁচ বছরের আমার অভিজ্ঞতার কাহিনী লিখে ফেলি। অবশ্যই ঐ লেখার প্রধান অঙ্গ হবে রাঙা-কাকাবাবুর গোপন গৃহত্যাগ ও আমার বৈচিত্র্যময় কারাজীবনের কাহিনী। তিনি পরিষ্কার করে বলেননি লেখাটি নিয়ে তখন আমরা কি করব, যদিও মাকে দিয়ে প্রায়ই এবিষয়ে আমাকে মনে করিয়ে দিতেন।
বাবার প্রথম পরামর্শমত আমি ডাক্তারি পড়ায় ফিরে গেলাম। অবশ্য দেশ-সেবার প্রস্তুতি হিসাবে বাবার সমর্থনেই নানাধরনের জনহিতকর কাজেও আমি অংশগ্রহণ করতে লাগলাম। চল্লিশ দশকের ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ পাঁচ বছরের কাহিনী লেখার ব্যাপারে বাবার কথা সেই সময় আমি রাখতে পারিনি। তবে যাতে ভুলে না যাই, গত তিন দশক ধরে সম্পূর্ণ কাহিনীটি আমি অসংখ্যবার মনে মনে নিজেকে শুনিয়েছি।
১৯৫০-এ যখন বাবার মৃত্যু হল তখনও আমার ছাত্রজীবন শেষ হয়নি। তারপর অনেক ভেবেছি, ঐতিহাসিক যে সব তথ্য নিতান্তই আমার নিজস্ব হয়ে রয়েছে সেগুলি সম্বন্ধে আমার কি করা উচিত। ‘দেশ’-এ ‘মহানিষ্ক্রমণ’ প্রকাশিত হবার পর অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, কেন আমি এতদিন ঐ কাহিনী প্রকাশ করিনি। বাবার সতর্কবাণীর কথা ত আগেই বলেছি। বিলম্বের আরও সুচিন্তিত কারণ আছে। আমি বহু পূর্বেই উপলব্ধি করেছিলাম যে রাঙা-কাকাবাবুর গৃহত্যাগে আমার সামান্য ভূমিকা কিছুকাল আমার মনপ্রাণ সম্পূর্ণ-ভাবে অধিকার করলেও তাঁর বিরাট জীবনের বহু, গুরত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে সেটি অন্যতম। সুতরাং আত্মপ্রচারের ইচ্ছা আমার না থাকলে কাহিনীটি প্রকাশের বিশেষ কোন তাড়া নেই। আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে রাঙা-কাকাবাবুর সম্পূর্ণ জীবনকথা লিপিবদ্ধ করার ও তাঁর জীবন নিয়ে চর্চা ও গবেষণার সুষ্ঠু, ব্যবস্থা হলে তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমি তাঁর মহানিষ্ক্রমণের কাহিনী নিবেদন করব। শেষ পর্যন্ত সেই পথের সন্ধান আমি পেলাম নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর মধ্যে এবং স্থির করলাম যে ব্যুরোর কাজে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করব।
পনের বছরের অক্লান্ত প্রচেষ্টার পর নেতাজী রিসার্চ ব্যুরো ১৯৭০ সালে নেতাজী ও ভারতের মুক্তিসংগ্রামের উপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করলেন। সেই সম্মেলনের জন্য আমি নেতাজীর ঐতিহাসিক গৃহত্যাগের বিবরণ লিখলাম। খবর পেয়ে বন্ধুবর শ্ৰীসাগরময় ঘোষ আমাকে ধরলেন যে, বাংলায় আরও বিশদভাবে কাহিনীটি ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য লিখতে হবে। সাগরবাবুর উৎসাহ না পেলে লেখাটি হত কিনা সন্দেহ। লেখাটি করতে হল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দিক থেকে এক বিশেষ দুঃসময়ের মধ্যে। সহধর্মিণী পাশে না থাকলে কাজটি করা একেবারেই অসম্ভব ছিল।
‘দেশ’-এ লেখাটি বেরোবার পর আমি আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যোগ করেছি এবং আমার বিশ্বাস যে কাহিনীটি এখন মোটামুটিভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে। পাঠক মনে রাখবেন যে এটা রহস্যের বা রোমাঞ্চের কাহিনী নয়। ভারতের ভবিষ্যত ইতিহাস রচয়িতাদের কাছে সুভাষচন্দ্রের মহানিষ্ক্রমণ এক চিরন্তন প্রেরণা, মুক্তিযজ্ঞে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদনের এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। প্রত্যক্ষ সহযোগী ও কাহিনীকার হিসাবে আমি এক্ষেত্রে উপলক্ষ্য মাত্র।
বসুন্ধরা শিশিরকুমার বসু
৯০ শরং বসু রোড
কলিকাতা ৭০০০২৬
২রা ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৫
Leave a Reply