মর্মরিল সখী আশ্চর্য মর্মরে (কাব্যগ্রন্থ) – কোয়েল তালুকদার
প্রকাশকাল – জানুয়ারি, ২০২৪ ইং
উৎসর্গ –
আমার যৌবনসখী ময়ূরীপেখমকোমল মায়াবতীকে।
১. পদ্মকুসুম
কিছুদিন ধরে কোনো গল্প লেখা হয় না। একদিন
রাত্রির নিরিবিলিতে তাই লিখতে বসি গল্প। মনে মনে কাহিনি সাজাচ্ছিলাম কিন্তু কিছুতেই মিলছিল না পরম্পরা। ভাবলাম গল্প থাক — তারচেয়ে কবিতা লিখি। আমার প্রথম যৌবনের থরথর কম্পনের মতো লিখে ফেললাম একটি কবিতা —
তুমি শুধু একবার খুলে দাও হৃদয়ের কপাট
এই উচ্ছ্বল যুবকের সামনে বন্ধ করো না দরজা
একবার খুলে ফেলো লজ্জার অবগুন্ঠণ।
তোমাকে শেখাবো কীভাবে ভালোবাসতে হয়
সব তছনছ করে, সব ভেঙ্গেচুরে কীভাবে গড়তে হয় শরীর শিল্প, হৃদয় ভাঙ্গতে হয় হৃদয়ের গহীনে
যেয়ে।
আমি হাঁটু মুড়ে দু’হাতে স্পর্শ করতে চাই স্বর্ণরেণু
ভুলে যাওয়া ঢের ভাল স্মৃতি কাতর যন্ত্রণা
তুমি এই উন্মূল যুবকের বুকে মাথা রাখো
তোমার সব মণিকাঞ্চন বিলিয়ে দাও অকাতরে।
আমরা মিলব নদীর মতো, অন্তঃশীল স্রোত ধারার মতো — ভেসে ভেসে তুলে আনব অলক্তমাখা পদ্ম-কুসুম।
২. প্রথম জল, প্রথম অগ্নিমালা
কথা ছিলো মেঘ বৃষ্টির নীচে শুয়ে রবো; এই ভরা শ্রাবণ নদী সন্ধ্যায়।
কতোটা আঁধার পেলে এ রাত একা হয়ে যায়।
নিজস্ব শাড়ির আড়ালে বিপন্ন বেহাগ, কেঁপে ওঠে চাঁদের শরীর।
দূর কোন অতীতের পাখি উষ্ণতা নিয়ে উড়ে যাবে আরো দূর ইপ্সিত অন্ধকারে।
নরম নৈঃশব্দ্যের মতো আমিও হেঁটে যাবো প্রগাঢ় তৃষ্ণার দিকে।
কে আমার প্রথম জল, প্রথম অগ্নিমালা।
কার কাছে হারাবো, ভেসে যাবো জলের তরলে অমৃতের জোৎস্নায়।
৩. সমুদ্র বিষয়ক কবিতা
সীগাল পাখির মত তুমি অবগাহন কর
সমুদ্র জলে,
পথহারা নাবিকের মত ভাসতে ভাসতে
কূলে এনে তোমাকে করি নোঙর।
তোমার মুখ তোমার বাহু তোমার উরু তোমার পা অতলে ডুবুক,
আমি উন্মত্ত ডুবুরির মত খুঁজে নেব সমুদ্রের
অতল তল থেকে।
কত হাঙ্গর এল, কত কুমিড়, কত জলদ হস্তি –
তোমাকে নিয়েই যত কাড়াকাড়ি,
ওদের যত কামজ লালসা তোমার তনুজে,
আমাকেই লড়তে হয় দূরন্ত নাবিকের মত
নির্ভীক একা।
ভাসতে ভাসতে ডুবতে ডুবতে তুমি বলো–
মন্থন কর।
ঝিনুকমুক্তার খোঁজে ভাসি রুপালি জলে আমিও,
কত যে সাঁতরাতে হয়, ক্লান্তিহীন।
৪. রাতের পদাবলী
কবিতা লিখব বলে রাত জেগে আছি
তারপর নিশাচর পাখিরা এল
তারারা ছুটে এল
উতল বাতাস এল
নৈঃশব্দ্যের গান শোনা গেল
জ্যোৎস্নায় চরাচর ভাসল
তোমার পদধ্বনি বাজলো।
সকাল বেলা খাতা খুলে দেখি —
সেখানে কোনো পদ নেই
কোনো পদাবলী নেই
কবিতার কোনো পংক্তি নেই
সারা পাতা জুড়ে কেবল তোমারই নাম লেখা।
৫. বিস্মৃত পদাবলি
বহুবিস্মৃত পদচিহ্নের পথ পেরিয়ে এসে, এই পথে আজ আমার দীপ্ত চলন,
কত আপ্লুত মধুময় ক্ষণ হারিয়ে এসে
আজ আমি এই সন্ধ্যারাত্রির আঁধারে লুপ্ত এক জোনাকি…
কত বিমুগ্ধ অস্তরাগ এখন অস্তমিত।
৬. এলোমেলো ভাবনা
কবিতা নয়, গল্প নয়, একটি ব্যঞ্জনাময় বাক্যও নয়। সেই কতকাল থেকে একটি মাত্র শব্দকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি, কিন্তু তার দেখা আমি আজও পাইনি।
আগে ঘরের চালে এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়লে ঘুম ভেঙ্গে যেতো। এখন অঝোর ধারায় ঝুমঝূমিয়ে বৃষ্টি হলেও ঘুম ভাঙ্গে না।
ছোটবেলায় সূর্য নিঃশেষিত সন্ধ্যায় ধনিদহ বিলে পাখিদের পালক খুঁজতে যেতাম। এখন সন্ধ্যার বুকে নিজেই ছটফটে পাখি হয়ে থাকি।
এখানে জানালার পাশে বড়ো বড়ো অট্টালিকা উঠছে। নীল আকাশ দেখা যায়না। দক্ষিণের বাতাস নেই। ক্লান্ত দুপুরে ঘুঘুর ডাক শুনতে পাইনা।
একটি সুন্দর ঝলমলে রোদ্দুরের দিন খুঁজছি। নীল রঙের পাঞ্জাবি পরে, হাওয়াই চপ্পল পায়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে যাব।
আমার খুব ঘুম পায়। ঘুমিয়ে থাকার এক অনন্ত খিদে। কোথায় সেই সবুজ ঘাসের বিছানা? যেথায় রাতভর জ্যোৎস্না ঝড়বে আর ভোরের শিশির বিন্দু।
৭. চোখ
তুমি দাঁড়িয়ে আছো আমার চোখের পাতার কাছে
চেয়ে দেখি তোমার চুলে আমার চোখ ঢেকে গ্যাছে
চোখের উপর রেখেছ তোমার চোখ
জল ঝরে নাই ছিলনা কোনো শোক
তোমার চোখেই আমার ভালোবাসা জেগে আছে।
৮. তুমি শুনে যেও
চরাচরের ধাঁধানো রোদ্র থেকে
পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘরাশি থেকে
অমাবস্যার নিগুঢ় অন্ধকার থেকে
শরতের নীল আকাশ থেকে —
পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য কুড়িয়ে এনে আমরা যে জীবন শুরু করেছিলাম
এই ভূবনের বুক চিরে যে ভালোবাসা দুজনের যৌথ হাতের আঁজলায় ভরে তুলে নিয়েছিলাম
অশ্রুতে দীর্ঘশ্বাসে স্বর্ণচ্ছটা যে ভবিষ্যৎ আমরা নির্মাণ করেছিলাম–
সেই সব সুন্দর, সেই সব আলোকিত রোসনাই
তুচ্ছ করে দিয়ে তুমি একাই চলে যাবে তা হয় না।
৯. আমরা ভেসে যাই
সেই কবে একদিন মেঘ গুরুগম্ভীর আকাশ দেখে
তুমি ইশারায় বলেছিলে,
‘চলে যাও যমুনা কূলে – শ্রাবণ কদম্বের সুগন্ধি মেখে ভিজব দুজনে! আমি আসব।’
আহা! এমন নিমন্ত্রণ কেউ ফেরায় কখনও
এমন ভর বৃষ্টির জলে শীতল স্নান,
দোঁহে এমন হিম স্পর্শ, সন্ত্রস্ত মৎস কন্যার মতো নিবিড় আলিঙ্গন,
এমন জড়িয়ে রাখার আকুলতা, কেউ গ্রহণ না করে থাকতে পারে !
আমি এর আগেও স্নান করেছি দিঘির জলে
বৃষ্টির জল পড়ত জলে,
মুক্তার মতো রুপালি জলের ফোঁটা পড়ত, কস্তোরির আড়ালে চলত জলকেলি
কীভাবে ক্লান্ত দুপুর গড়িয়ে যেত নিমিষে !
টলটলে জলে মৃদঙ্গ ঢেউ তুলে সাঁতরাতে সাঁতরাতে কূলে ফিরে আসতাম।
তোমার এমন আমন্ত্রণের অপেক্ষা করেছি আমার যৌবনকাল থেকে ,
কত হাহুতাশ করেছি, হৃদয় ভেঙে কত ক্ষরণ হয়েছে বেদনা, তুমি মায়াচোখ মেলে তা দেখোনি কখনও,
সেই তুমি প্রেমজ আহবান করলে আামাকে,
আমি তা ফেরাই কী করে!
বৃষ্টি নামুক সেখানে, জলে ভরুক যমুনা, উপচে উঠুক একূল ওকূল —
কদম্ব ফুটুক, সুগন্ধ ছড়াক চারিদিকে —
মেঘমেদুর বরষায় ভিজব শ্রাবণ অঝোর ধারায় —
আত্মহননের মতো কী ভয়ংকর মুহূর্ত হবে, ঢেউয়ের দোলায় তোমার দিগন্ত জোড়া ধবল পিঠ ,
বাঁক খাওয়া কোমড় ও উরু ডুবে বুঁদবুঁদ হবে,
কী অদ্ভূত জলস্রোত, কী সুন্দর জলস্রাব!
জাদুর চুম্বকের মতো আমরা দুজন একজন হয়ে যাব!
আমরা শুচি হবো দোঁহের শরীর ছুঁয়ে, আরও কত শ্বেত জল একাকার হবে স্রোত বক্ষে! কত কাঙ্গাল ছিলাম আমি এই ক্ষণটির জন্য।
আশ্চর্য শিহরণে গা কাঁপে, আমরা উথাল-পাতালে ডুবে যাই… জলতরঙ্গে ভেসে ভেসে যাই, অতলে তলিয়ে যাই নিরুদ্দিষ্ট হাঙ্গরের মতো।
১০. এই প্রেম সেই প্রেম ছিল না
আজ এই সন্ধ্যার বাতাস থেকে জেনে নিয়েছি
যে হাওয়া বইছে আজ এখানে
যে গানের সুর ভেসে আসছে পূরবী ঝংকারে
সেই সুর ঝংকার আমার জন্য বাজেনি —
তোমার ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত কাপড় বলে দিচ্ছে
গর্ভধারণের আড়ালে যে তুমি
সে তুমি কখনোই আমার ছিলে না।
এই প্রেম, সেই প্রেম ছিল না কস্মিনকালেও
এ ছিল প্রেমহীনতার উৎসব উৎসব খেলা
প্রেমের আড়ালে ছিল শূন্য করে দেবার দহন
জ্যোৎস্নার আড়ালে যে উদ্বাস্তু প্রান্তর ছিল
সেখানে হতো কেবল বেদনাহতদের কান্নার উৎসব।
এই রকম শোকাচ্ছন্ন উৎসবের রাতে —
এই রকম অন্ধকার পথের প্রান্তের উপর
অনিশ্চিত গোপণ রক্ত ক্ষরণের ভিতর
পূর্ব পুরুষদের বিদ্ধ করতে চাই না কোনো পাপ স্খলণে।
আজ এই সন্ধ্যার বাতাস সেই বার্তাই দিয়ে গেল।
১১. দূরের সুবর্ণরেখা
কপালে পরেছিলে টিপ যেন লেগে রয়েছিল চাঁদ
পুর্ণিমার আকাশ থেকে
মুখ তোমার আলোয় হেসেছিল
মায়াবী ছোঁয়ায় চুল ছড়িয়ে পড়েছিল পিঠের উপরে
যেন আদিগন্ত ছায়া পড়েছিল সেখানে
স্থির হয়েছিল তোমার গ্রীবার ভঙ্গি
ভ্রু বেঁকেছিল তৃতীয়া চাঁদের মতো ধনুকের।
চোখ ছিল চোরাবালির বালি, পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার
এসে ডুব দিয়েছিল সেখানে —
তারপরও ভালোবাসার চিহ্নগুলি খুঁজেছিলাম
দূরের সুবর্ণরেখায়।
১২. ভয়ংকর সুন্দর
যখন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তখন আমি নিজেকে মলিন করে ফেলি —
কী হবে নিজের সৌকর্যময় সৌন্দর্যের,
কেমন যেন সুখ নেই
বেদনা নেই
বিষণ্ণতা নেই
আনন্দ নেই,
জীবন নেই, জীবনের কোলাহল নেই
প্রাণ নেই —
ঐ অদূরে বয়ে যাওয়া নদীর মতো শীর্ণ, স্রোত নেই,
স্থীর জলতল, কোনো প্রবাহ নেই,
কূলে বৃক্ষ নেই, সবুজ পাতা নেই, চৌচির করছে জীর্ণ পাতা, মর্মর হয়ে ঝরে পড়ছে করুণ সুরের মতো —
ছিন্ন ভূষণ আরক্তহীন অবয়ব,
রুক্ষ কেশ, মৃন্ময় চোখ,
ভাবনা লেশহীন ভাবে পথ চলতে চলতে মনে হয়
আমি সব সুন্দরকে বিসর্জন দিয়ে হাঁটছি একাকী, নিসঙ্গ নিভৃতচারী ভবঘুরের মতো
অরূপে আমার পথ চলা কোনো অসীমে —
মনে হয়,
সুন্দর নেই ছিটেফোঁটাও, তবুও
সৌন্দর্যহীন এই আমার সৌন্দর্য দেখছে কেউ দূর থেকে পলকহীন উদ্বীগ্ন চোখে।
১৩. যখন তুমি থাকবে না
এই প্রেম তোমার, এই নির্জনতাও তোমার
সমস্ত স্মৃতিতে বিস্মৃতির ধূলো জমবে একদিন
যখন তুমি থাকবে না।
শোক বিহবল শয়ন কক্ষের অসীম নীরবতায়
মন ছুটে চলবে দিগন্তে, যেখানে ওড়ে একাকী চিল
তার ডানা মেলার কোনো শব্দ নেই
মেঘ আকাশ জলরাশি নক্ষত্রমণ্ডলী
প্রত্যেকেই আর্তনাদ করবে তোমার অনুপস্থিতিতে।
পার্কের পাশে পাইন গাছ ছিল
ছাতিম গাছের তলায় নির্জনতাও ছিল
লেকের জল স্থির হয়ে ছিল
দুইজনের নিঃশ্বাস মাতাল করতে পারতো হাওয়া।
অবসর আর কর্মহীন প্রহরে তোমার ছায়া পড়বে না
পাখি কলরব করবে মোয়াজ্জিনের আযান হবে
মন্দিরে শঙ্খধবনি বাজবে, গীর্জায় নিনাদ হবে
এই আকাশ এই নক্ষত্র সবই থাকবে যেখানে আছে
শুধু তুমি থাকবে না।
তখন মাতাল হবেনা কোনো বাতাস
তখন মেঘে মেঘে ছেয়ে থাকবে না কোনো আকাশ।
১৪. সে ছিল প্রথম নদী
সে ছিল প্রথম জীবনে লেখা একটি কবিতা।
কি ছিল সেখানে উপমা উৎপ্রেক্ষা অনুপ্রাস?
কোন ছন্দে লেখা হয়েছিল কবিতার শরীরখানি ?
কবিতাটি ছিল একটি নদী-
উদ্দাম তরঙ্গমালা, পাহাড়, টিলার বুক চিরে জলপ্রপাত
প্রথম স্রোতধারা, প্রথম বিমুগ্ধ নিম্নচাপ
ফেনায়িত শুভ্র আভা, প্রথম কোনো সঙ্গম স্থলের দিকে অভিযাত্রা
নদীর বা্ঁকে বা্ঁকে বু্ঁনো হাসের জল মগ্নতা
সে ছিল প্রথম দু’পাড়ে ভাঙ্গন, নোঙ্গর ফেলা ছিল অতল তলে।
নদীর শরীর ছিল ব্যঞ্জনবর্ণ, অনুপ্রাস ছিল স্বরধ্বনির
সে ছিল প্রথম নদী, সে ছিল প্রথম সা্ঁতার কাটা
প্রথম কোনো শিহরণ, প্রথম জলে ভাসতে থাকা।
১৫. নিমগ্ন রাত
কাল ছিল ঘুমহীন রাত। দুঃস্বপ্ন ধেয়ে এসেছিল খোলা জানালা দিয়ে। সূর্যের এত আলো, সেও নিঃশেষিত হয়েছিল আঁধারের কাছে। অন্ধকারে চেয়ে জীবনকে দেখেছি। সেখানে পৃথিবীর কোনো মায়া ছিল না।
এসো মায়াবতী,
আমাকে এমন বিষণ্ণ করে রেখ না। ভিতরের কান্নার শব্দ নিস্তব্ধ করে দাও। মুখের দিকে চেয়ে দুঃখ ভুলিয়ে দাও।
একটি ফুল ঝরে গেছে তাই বলে কী ফুটবে না আর ফুল সুবাস ঝরাতে?
একটি বাঁশি ভেঙ্গে গেছে, তাই বলে কী পৃথিবীর সব গান থেমে থাকবে ?
জেগে আছি। ভালোবাসাময় সূর্য একসময় আলো ছড়াবেই।
১৬. চাই অমৃতভোগ
শরৎ সন্ধ্যায় আজ রং ছিল
তোমার মনে আজ ঢং ছিল
পরনে লাল শাড়ি ছিল
তোমার সাথে আরি ছিল
শরীরটাতে নদীর বা্ঁক ছিল
পরান তোমাকে ডাকছিল।
রাতের মধ্যে স্বপ্ন আছে
বুকের তলায় রত্ন আছে
রূপবতীর রূপ আছে
স্বপ্নলোকে আলো আছে।
শরৎ রাতে বাজছে গান
লীলাবতীর হাসছে প্রাণ
রাতের রংএ রাঙ্গিল এক রাধা
কৃষ্ণের প্রেমে থাকল না বাধা।
স্পর্শে কা্ঁপল তার দেহলোক
চাই অসীমে যত অমৃতভোগ
এসো তবে তব তাই হোক।
১৭. কত দিনের কত কথা
মেঘ ঝরঝর বৃষ্টি , বৃষ্টি ভেজা রোদ্দুর, রংধনু
আছে কী নেই, এইসব কোনো মনখারাপ করেনা, মনখারাপ করে দাও তুমি।
তুমি আসো বা না আসো, তোমাকে পাই বা না পাই
ভালোবাসো আর না বাসো, এই সবের আক্ষেপ না আক্ষেপের যত কারণ হচ্ছ তুমি।
শিউলি ফুলের রেণুর গন্ধের জন্য না
স্নানের পর ভেজা চুলের সুবাসের জন্য না
রুপালি কোনও জলের জন্য না
শরীরের কোনও গোপন ঝিনুক মুক্তার জন্য না,
আমার সকল মনখারাপের কারণ হচ্ছ তুমি।
রাতবিরেতে জ্যোৎস্না তলায় একাকী হাঁটি
নির্জন সেই পথ, ঘুম আসেনা
ঘুমের বাইরে, স্বপ্নের বাইরে কাউকে খুঁজি না।
অন্য কাউকে চাইও না,পাইও না, জীবনের মর্মমূলে তুমি, তোমার জন্যই আমার যত মনখারাপ।
১৮. মনে কি পড়ে
মনে কি পড়ে কোভা? ব্যস্ত শহরে সেদিন বৃষ্টি নেমেছিল
তুমি ভেজা হাইওয়ে ধরে
চলে গিয়েছিলে লং ড্রাইভে অনেক দূরে
কি নিঝুম বৃষ্টি ছিল ! রিমঝিম উড়ছিল পথের ক্লান্তি
মনে কি পড়ে কোভা? আমি ছিলাম তোমার পাশে।
চোখ মেলেছিল ডানা উড়ন্ত গাংচিলে
দূরে ঝাঁও বনে ঝরছিল বৃষ্টি অনবরত
আরও বেশি স্তব্ধতার ভিতর তুমি ছিলে ভাবলেশহীন,
মনে কি পড়ে কোভা?
কি মোহময় সেই বৃষ্টিপাত! কি অবিরাম জলের ধারা
বাহূর আশ্রয়ে জানিয়েছিলে প্রথম ভালোবাসার নিমন্ত্রণ
বলেছিলে –‘ তোমাকে ভালোবাসি। ‘
তুমি বিস্মৃত হয়োনা কোভা —
সেই বিনম্র মুখের হাসি সেই মায়াবী দৃষ্টিপাত
নগরীর সমস্ত সভ্যতা ভেঙে চুরমার হয়েছিল
বৃষ্টির শব্দে পথ চলতে চলতে সেই বিকেল!
বিস্মৃত হয়োনা কোভা
শান্তা মনিকার তীরে আমাদের সেই শেষ আলিঙ্গন!
প্যাসিফিকের জল স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল তারও আগে
যা আজ আর মনে পড়েনা।
১৯. হঠাৎ তুমি ছাড়া
আমি জানি তুমি ছাড়া পুড়ে খাক হয়ে যায়
সবুজের প্রান্তর, ফসলের মাঠ
চৌচির হয়ে যায় উর্বর মাটি
বিরাণ হয়ে যায় লতা গুল্ম বৃক্ষ, সারি সারি তরু।
তুমি না থাকলে গান নেই
গৌরীপ্রসন্নের কলম থেমে যায়
বেটোফোনের ভায়োলিন করুণ সুরে ভেসে যায়
কানে বাজে রাতভর বিসমিল্লা খাঁর সানাই
তুমি না থাকলে দূরাগত কোনো নিক্কণ বাজেনা।
সুখ নেই, প্রশান্তির বুক নেই, ভালোবাসা নেই
তুমি না থাকলে শুকিয়ে যায়
দীঘির শান্ত জল,
সব কিছুই বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, মেঘে মেঘে ভেসে যায়।
আমার সকল মায়া সুধা, হৃদয় গহীনের সকল আকুলতা, সকল ভাবনা,
তিস্তা পারের দু ‘কূলের সকল দীর্ঘশ্বাস —
হঠাৎ তুমি ছাড়া সব কিছুতেই হাহাকার করে ওঠে।
২০. আমিই ওর নিঃসঙ্গতা
আমিই ওর নিঃসঙ্গতা। আমিই ওর একাকীত্ব
এই অনুভব অনুপ্রবেশ করেছে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে। অথবা আমি সেই গন্ধবিধুর বাতাস ভেজা অস্তিত্ব, যা ভেসে বেড়ায় ওর যাপনদুঃখে।
সোনালি হলুদ চন্দ্রমল্লিকাদের সূর্যের দিকে চোখ,
শরীর জুড়ে হাসির হিল্লোল। কিন্তু আমি জানতেই পারি না। এই অনন্ত অন্ধকারের কথা।
আর ওর দিকে তাকিয়ে যেন শুনতে পাই রাতচরা পাখির কান্না। মুহূর্ত বিলীন হয় অনুকম্পার দিগন্তরেখায়। আমি অনুভব করি মন্দলয়ে… কামনার সুর, আবেগমদির….
আমি ওকে দখল করি চাঁদের আলোয় ভেসে। বাঁধা দেয়না। আমি দেখি.. ওই হাসিটি এখন ওর ঠোঁটে … কিন্তু যে কান্না আমি কোনওদিন স্পর্শ করতে পারব না …
কেমন অক্লেশে গড়িয়ে যায় ওর জ্বরতপ্ত গাল দু’টি বেয়ে … চাঁদের আলো মেখে … স্বর্নীল মুক্তা বিন্দু যত..।
২১. করুণা ধারায় এসো
কেমন যেন চৌচির হয়ে যাচ্ছে বৃক্ষ, পত্র পল্লব।
বৃষ্টির মেঘ কোথাও নেই। বাতাসে জ্বলে উঠছে আগুন। তপ্ত রোদ্রে শুকিয়ে যাচ্ছে জল।
এই উতল রুক্ষ পৃথিবীতে কেমনে তোমাকে ভালবাসা অর্পণ করব? তর্পণ করব কিভাবে অন্তরের মায়া? এই নাও আঁজলা ভরা জল।
আমার জীবন একদিন যখন শুকায়ে যাবে। তখন করুণাধারায় আসিও। আসবে তো নিশ্চয়?
২২. বিসর্জন দাও
দূর থেকে তাকে আজ দেখলাম বুড়িগঙ্গার পাড়ে
হেঁটে হেঁটে সে এসেছিল আরমানীটোলা থেকে।
নবাব বাড়ির গেটে এসে
থমকে দাঁড়িয়েছিল সে একবার।
আমি তার নাম জানিনা,
সে কি কৃষ্ণা? নাকি দীপালী? নাকি বিজলী?
কপালে তার সিঁদুর ছিল না,
সেকি মীর্জা বাড়ির মেয়ে তবে ?
নাকি সাঁওতাল, হরিজন দাসী কেউ?
মেয়ে তুমি যেই হও, চিত্ত আজ বিমুগ্ধ তোমাকে দেখে।
পায়ে ঝুমঝুম মল বেজেছিল
হাতে ছিল শাঁখারী বাজারের শাঁখা
কানে ঝুলেছিল ঝুমকা , মাথার চুলে চন্দনের গন্ধ
লালবাগের কেল্লার লাল রং মেখে বিস্ময়ে দাঁড়িয়েছিল।
তুমি কি বিসর্জন দেবে এই গঙ্গার জলে?
পার্বতী আজ ফিরে যাবে কৈলাসে মানস সরোবরে
যাবে সে শ্বশুরবাড়ি, শিব সংসারে —
মেয়ে, তোমার তো কোনও শ্বশুরবাড়ি নেই।
যদি সন্ন্যাস হতে হয় হবো , যদি বেদুইন হতে হয় হবো
যদি সাঁওতাল হতে হয় হবো
হরিজন হরিদাশ হতে হলে তাই হবো —
তবুও বিসর্জন দাও এসে তোমাকে আমারই হৃদ যমুনায়।
২৩. তুমি এসো
এত কাছে আসতে নেই অগ্নিমুখ প্রজ্বলিত করে
দীর্ঘ চুম্বনের পথ পাড়ি দিয়ে
হঠাৎ জ্বলে ওঠা প্রথম আলোর মূর্ছনার মতো।
এত ভালো বাসতে নেই
সব প্রেমচিহ্নর পথ মাড়িয়ে আবাস গড়ো এসে
যেখানে নদী আছে
জ্যোতির্ময় অরণ্যানী আছে
বসন্তদীঘি আছে
যেখানে হাত ডোবালেই পেয়ে যাও অমৃতের শুদ্ধতা।
তুমি আলো হয়ে আলো ছড়াও নির্জনতার ভিতর
মহাকাশ ছুঁয়ে থাকে যেমন পৃথিবীর বুকে —
তোমার দীপ্তিময় মুখে বিষণ্ণতার বিলাপ নেই
তুমি ঘুমঘোরে জড়িয়ে ধরো
অঙ্গার করো
ছাই করো
ভস্মীভূত করো
আপন কক্ষপথে জ্বলে ওঠে যত নক্ষত্র-বীথি।
এত কাছে জড়াতে নেই
যেখানে নক্ষত্রে নক্ষত্রে সংঘর্ষ হয়
আলিঙ্গন তৈরি হয়
নৈঋত থেকে ঝড় আসে, হৃদয় তোলপাড় হয়
রক্তক্ষরণ হয়,
বসতি ধ্বংস হয় —
আমি এই প্রেম চাই না।
এসো প্রিয়তমা, এসো –
অন্ধকারের নৈঃশব্দ ভেঙ্গে সকল শূন্যতা পূর্ণ করো
পূর্ণিমার চাঁদের মতো আলো ঝলমলিয়ে এসে
আলোকবর্তিকা হও।
২৪. তোমার আকাশে নীল নেই
প্রিয়তমা, আমি এক দুঃসহবাসে বেঁচে আছি
হৃদয়ের একূলে ভালোবাসা নেই,
হৃদয়ের ওকূলেও ভালোবাসা নেই
যখন নিঃশেষিত সব আবেগের টান, চুম্বনের আশ্লেশও শুকায়েে যায়।
মায়াহীন চোখের চাহনী, ধরিত্রীর বিষাদ হেম – এই ভয়,
আমার সন্ততির জন্য আমার যত ভয় , যত যন্ত্রণাক্লিষ্ট হওয়া
প্রিয়তমা, তোমার আকাশে নীল নেই
তোমার বাতাসে নির্মলতা নেই
তোমার হৃদয় নেই আর পদ্ম কোমল – নেই তাতে আর কস্তরী আভার গন্ধ
তোমার হৃদয়ে আর নীল নেই
আকাশের যাবতীয় সুনীল ধূসর হয়ে গেছে
নৈঋত থেকে আসা কালো মেঘে সব নীলিমা আজ ঢেকে গেছে।
২৫. যদি নাও প্রেম
চারপাশের শূন্যতারা মিথ্যে হোক, ভালোবাসার
সুগভীর ছায়া পড়ুক এই জীবনে
তোমার ভিতরে ছড়িয়ে দেব আমার প্রাণ, আমার প্রেম
ঈশ্বরের নির্মিত এই বুকে যতোই বাজুক গভীর যত ক্রন্দনের আওয়াজ।
আত্মার মধুর আলোকে দ্যুতি ছড়িয়ে দেব তোমার অন্তরাত্মায়
প্রিয় তুমি, সবই হতে পারে তোমাকে নিয়ে এই পৃথিবীর ধূলোয়
আমার রক্ত কণিকায় জাগাও তোমার সকল প্রবাহমান প্রেম সকল মায়া
তুমি এসে চূর্ণ করো আমার অন্তর্গত সকল গ্লানি।
তোমাকেই ভালবাসা অর্পণ করি
তর্পন করি মায়া মমতা
আমার দু ‘হাতের আজলায় উপচিয়ে পড়ে প্রেম
যদি ভরে নাও সেই প্রেম, যদি থাকো কাছাকাছি
তুমি কখনোই পরাজিত হবেনা।
২৬. কে সে জন?
মর্ত্যে অমর্ত্যের কোন্ অন্তঃপুর বাসিনী সে?
কী সব স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ক্ষরণে অন্তঃসলিল প্রবাহমান হয়। রাতের বিছানা সব এলমেল থাকে। শুকিয়ে যাওয়া রজনীগন্ধার মতো চোখ মুদে আসে। এত সংবেদনা, তবুও এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে না। কবে কে বলেছিল — অশ্রুহীন রেখ চোখ।
মায়াবতী বা কোথায়?
কত গল্পের কত রমণীকূল, বালিকা, নর্তকী, রাজকুমারী, ঘুটেকুড়ানী, যোগিনী, সন্ন্যাসিনী, প্রেতেনী, কঙ্কাবতী, বনলতা …..
তারা কেউ নেই।
মিত্রা, কমলিকা, সাহানা, মেহেরজান, ঊষা, হৈমন্তী, দীপান্বিতা, মালিনী, মাধবী, যামিনী, টিনটিন, মহুয়া, পিয়ালি…..
সবাই ছিল লাবণ্যময়। ঘোরে অঘোরে কত নাম লিখি। কত নাম যপি। শব্দ সাজাই। কবিতার চরণ লিখি। কত সব নামের উপরে সমুজ্জল মুক্তো জ্বলে, একটি দুটি নাম উপনাম হয়ে যায় ….
অমরাবতী আর মায়াবতী।
২৭. তার হৃদয়খানি
তার কটিতে এতটা আবেদন ছিল না, যেখানে জ্যোৎস্না এসে বাঁক খেতে পারে।
তার মুখে এমন কোনো মায়া ছিল না, যেখানে
মধুরিমার আবেশ না দিতে হয়
তার চিবুকে একটি তিলও নেই, যেথায় কাজলের আঁচড় না লাগাতে হয়।
চুলকে কখনোই অবন্তীর আঁধার মনে হয়নি
না ছিল তার পায়ে ঘুঙুরের আওয়াজ
না ছিল ওষ্ঠের আশ্লেশ —
না ছিল ভ্রু-তে কোনো আমন্ত্রণের ঝিলিক, যা দেখে কোনো স্বর্গলোকের পথে হাঁটা যায় !
না ছিল তার স্পর্শে এমন চুম্বকীয় টান, যা কোনো নদী নিমিষেই সাগরে বিলীন হতে পারে —
তবুও ভালবেসেছি তাকে, শুধু তাকেই। দুর্বার গতিতে…
জানি, তার হৃদয়খানি পৃথিবীর মতো অসীম !
২৮. নিশীথের পদাবলী
কী এক বিস্ময়কর ঝাঁকুনিতে দুলে উঠেছিল রাতের প্রথম প্রহর
নক্ষত্রেরা ছিন্নভিন্ন হলে দূর থেকে শুধু বিষাদ ভেসে আসে।
প্রগাঢ় চুম্বনে তুমি বিষণ্নতা মুছে নাও
রাত্রির আঁধার গভীর হলেই ক্রমশ চঞ্চল হয়ে ওঠো
নিশীথের সুররাগ কী আমরা জানি না, জানিনা মূর্ছনাও —
শুধু নিশাচর পাখিরা ম্লান মেঘ ভেদ করে
ঘুমন্ত চরাচরের দিকে উড়ে উড়ে চলে গিয়েছিল।
২৯. একটি সুইসাইডাল স্টাটাস
স্পর্শ দিয়ে তোমার সাথে আমার সম্পর্কের শুরু
সিনে কমপ্লেক্সের সবগুলো আলো তখন নীভে গিয়েছিল
একটি কোমল কঠিন হাত আমার স্নিগ্ধ নরম হাত স্পর্শ করেছিল।
প্রথম কম্পন সেখান থেকেই , প্রথম ভালোলাগাও সেখান থেকে শুরু —
‘চিত্রা নদীর পারে’র শেষ দৃশ্য সেদিন আর দেখা হলো না।
তারপর, রিক্সার হুড ফেলে সাহসী যাত্রীর মতো চষে বেড়িয়েছি ঢাকার অনেক রাজপথ অলিগলি
কত রোদ্দূর, কত বৃ্ষ্টির মেঘ, কত ছায়াতল দিয়ে আমরা হেঁটে গিয়েছি।
আমাদের স্পর্শগুলো সভ্যের সিমানা ছাড়িয়ে যেতে থাকে
দিয়াবাড়ির কাশবন, বেড়ীবা্ঁধের পাশে নির্জন একাকী রেস্তোরায় হয়েছে যত স্পর্শের মহোৎসব।
যে তুমি একদিন ভালোবাসার জন্য মাহিনের ঘোড়ায় চড়ে আমাকে নিয়ে সোয়ার হতে চেয়েছিলে
সেই তুমি আমাকে গনিকার মতো করে রেখে দিলে।
আমাকে ভালোবাসবার তোমার সময় হয় না
নীল আলোর নীচে নগ্নিকা করে সৌন্দর্য ভোগ করতে তোমার সময় হয়
বিয়ের কথা শোনার জন্য তোমার সময় হয় না
আমার উত্তপ্ত শরীর খুবলে খামছে খেতে তোমার সময় হয়।
বার্থ কন্ট্রোল পিল কিনিনি ,আজ ফার্মেসীগুলো ঘূরে ঘুড়ে স্লিপিং পিল কিনেছি
আজ রাত্রে একজন বেশ্যা ঘুমিয়ে যাবে চিরঘুমে–
I love you more than life itself, but you didn’t see it.
You didn’t realize what you had. Maybe once I’m gone.
( একটি জাতীয় দৈনিকে একটি মেয়ের আত্মহত্যার খবর পড়ে এই কবিতা।)
৩০. চেতনার ওপারে
একদিন পবিত্র কোনো সকালে চলে যাব এই জনপদ শূন্য করে,
চিরকালের পথগুলি তখন হয়ে থাকবে নীরব,
যে পথে ধ্বনিত হবে না আর আমার পায়ের শব্দ।
কোনও নদী বা সাগর তীরের
বা পাহাড়ের পাশের কোনও শান্ত লোকালয় থেকে
প্রিয়জনরা আসবে সেই পবিত্র সকালে
কেউ আর রবে না বলার
কেন আমি শুন্য করে চলে যাচ্ছি, সব ক্রন্দনধ্বনি স্তব্ধ করে, যে কখনও ফিরবে না আর।
বৃক্ষ শাখা থাকবে, বনের মাধবীলতা জড়িয়ে থাকবে,
নিস্তব্ধতার প্রতিমূর্তি তখন আমি! বয়ে নিয়ে যাব তোমাদের ভালোবাসা চেতনার ওপারে, অনন্তের যত কথা হিম-শীতল করে।
এই বংশ পরম্পরা নিঃশেষ হয়ে যাবে একদিন —
আমি রয়ে যাব তখন মানুষের বেদনার মাঝে,
স্পন্দিত হবে আমার আত্মা অন্য কোনো অনাগত শিশুর বুকের ভিতর।
৩১. কেউ আসুক না আসুক
এ কেমন নিশি রাত্রি! এ কেমন থমকে যাওয়া শ্বাসের মতো নিস্তব্ধ প্রহরবাস
ঘুম নির্ঘুম ঠাহর করতে পারিনা, এ কেমন ক্ষণ পোহাতে হয়!
ভুল নর্দমায় কত আনন্দবীর্য ভাসিয়ে দিয়েছি, কত ব্যবচ্ছেদ করেছি উল্টেপাল্টে,
কত কাঁটাছেঁড়া করেছি ত্রস্ত হরিণীর দেহ, করোটি, তার মাংস, মজ্জা — কত মাতোয়ারা হয়েছি উন্মুক্ত নাভিমূলে মুখ গুজে, কত অমল অম্বুজ ভেসে গেছে রুপালী ধারায়, কত পাপড়ি হয়েছে ছিন্নভিন্ন…
তুমি কে? তুমি কী! তখন বুঝতাম না
তোমার নালন্দা কুচের ভার, আর জঙ্ঘা পাড়ের রেশম কোমল চুলের ধানী গন্ধ নিতাম,
নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে দেখতাম ধবল পর্বত শৃঙ্গ, মধুবনি নদী, জগৎ বলতে তোমাকেই জানতাম, তুমিই ছিলে যৌবনজম কক্ষপথ…
তুমি চিনতে পারতে কে তোমার নিষ্ঠুরতম পুরুষ,
কে শুধু ধ্বংস করে, সৃষ্টির আদিঅন্তে যে কোনও বীজ বপন করেনি প্রাজ্ঞভূমিতে, যার কোনও বংশবৃদ্ধি নেই..
তুমি দেখেছ শ্মশানে ছাই উড়ছে…
তুমি দেখতে পাওনি কবর ফুঁড়ে কোথাও কোনও ফুল ফোটেনি ।
বাইরে এখন আশ্বিনের বিগলিত ধূম জোছনার নহর বইছে – পৃথিবীর কোথাও কোনও উপত্যকায় কী থোকা থোকা গাঁদা ফুল ফুটেনি আজ?
আমার কোনও নিঃসঙ্গতা নেই, নেই কোনও অনুশোচনাও…নেই চন্দ্রচেতনা, দীপ্তি ছড়ান কোনও ভৃগুর খোঁজে উন্মাতালও নই,
এই রাত্রি নিশীথে কেউ আসুক না আসুক, কেউ থাক্ বা না থাক্ —
এই রাত্রি এই জীবনকাল একসময় নিঃশেষিত হবেই।
৩২. দূরবর্তিনী
এক একদিন নেমে আসে সন্নাস আধাঁর
বেটোফোনের সুর বাজে রক্তের তরঙ্গে
গুমরে কেঁদে ওঠে শোকাশ্রিত চোখ
দীর্ঘশ্বাসের রাত্রি যেন শেষ হতে চায় না।
আলুথালু যুবকের মতো হাঁটি রাজপথে
রোদ্রে পুড়ে যায় শরীর, পায়ের তালু —
স্বপ্নগুলো থেতলে যায় কালো আলকাতরায় মিশে
তারপরও উদ্গ্রীব হই রক্তজবার প্রস্ফুটিতের জন্য।
আমি আশা নিরাশায় জেগে উঠি
দূরবর্তিনী এক রমণীর চোখ ইশারার আহ্বানে
তখন তোমাকেই খুঁজি স্বপ্নভূক এই রাত্রির আকাশে বাতাসে।
৩৩. অস্তিত্ব
গতরাতে রাতের মাঝখানে ঘুম ভেঙ্গে যায়
আজও দেখলাম তোমার একটি নিষ্কলুষ হাত আমার বুক ছুঁয়ে আছে
এটাই তোমার বার্তা, এইটাই তোমার অস্তিত্বের জানান– তোমার থেকে যেন দূরে চলে না যাই।
কোনোদিন কোনো বিদায়ের ক্ষণে
ক্ষণতরে যদি তোমার ও দুটি হাত না ছুঁইতে পারে আর,
তখন তুমি দারজা লাগিয়ে দিয়ে চলে যেয়ো, আমার অশ্রুবিন্দুর মাঝে তোমার মুখচ্ছবির কোনও ছায়া যেন ফেলে না যাও।
৩৪. বিবর্ণ এলিজি
তুমি যখন হেঁটে হেঁটে চলে আসলে
জ্যোৎস্না ঝরে পড়েছিল তার চারপাশ
চোখে তোমার স্বপ্ন ছিল
দখিনা বাতাস দোল দিয়েছিল
ভেসে গিয়েছিল তোমার সকল সৌন্দর্য।
হঠাৎ আবার কালরাতে উতাল হলো বাতাস
তারায় ভরলো আকাশ
চোখ ভরা তোমার কাজল আঁকা ছিল
ভ্রু যুগলে কার নিমন্ত্রণ ছিল
পায়ে তোমার নুপুরের রিনিঝিনি শব্দ ছিল
সেজেছিলে কি তুমি অকারণে?
কলঙ্কহীন ভাবেই কাটালে তোমার সকল বেলা তোমার সারারাত
হৃদয় উন্মুক্ত হয়নি,শরীর চায়নি শরীর
আমার সঙ্গে কেউ হাঁটেনি কোনও কক্ষপথে।
বিবর্ণ এলিজিগুলি তাই ফিরে আসে অবশেষে
না ফেরার সকল প্রতিশ্রুতি ভুলে,
তারপরও ভালোবাসা বেঁচে থাকে, এই পৃথিবীর পথে প্রান্তরে।
৩৫. তুমি মণিভূষণ বেষ্টিত
তুমি নিজেই সন্ধ্যাতারা হয়ে জ্বলছো
তোমার আকাশে,
আমার আঁধারে তাই তোমাকে খুঁজে না পাবার ভয় নেই।
তুমি শান্ত স্নিগ্ধ দীঘির জল —
সাতার কাটি সেই জলে প্রতিদিন প্রাণ ভরে।
তুমি ‘ মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগনমাঝে
বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে ‘
তুমি ‘ধরণী’পরে ঝরে নির্ঝর, মোহন মধু শোভা ফুলপল্লব-গীতবন্ধ-সুন্দর-বরনে।’
৩৬. আবার কি হবে দেখা
এই শহর বিষাদে আক্রান্ত হয়
গোধূলি লগ্ন কেঁদে ওঠে শরতের পড়ন্ত শুভ্রমেঘে
যেখানে জল নেই
যেখানে প্রেম নেই, যেখানে ছায়া পড়েনা তোমার।
হঠাৎ দুঃস্বপ্নের রাত্রির প্রহরে
আমার প্রেমিকারা আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়,
আমি শুনছিলাম তখন শোকের গান
পড়ছিলাম মধ্যযুগের গীতি কবিতা
চোখ বন্ধ করে দেখছিলাম দুরে চাঁদের পাহাড়।
তুমি দেখা করতে এসেছিলে দূর কক্ষপথে হেঁটে হেঁটে
এই গোলার্ধে, এই শ্যামলিমায়,
কিন্তু হলো না দেখা মুখে মুখ রেখে —
আবার কি কখনও হবে দেখা বংশী নদীর তীরে
যেথায় পথের ধূলি উড়ে বাতাসে
যেথায় ধূসর সন্ধ্যা নামে,
যেথায় শোনা হবে কী আবার কোনও সন্ধ্যার গান।
৩৭. ধ্রুপদী প্রেমের কবিতা
প্রেম আসে প্রেমিকা আসে
বিরহ আসে ,
প্রেম যায় প্রেমিকা চলে যায়
বিরহ আর যায় না।
কী যে উন্মুখ ছিলাম তোমাকে উন্মোচন করতে
কী যে প্রস্ফুটনের জন্য অপেক্ষার ক্ষণ ছিল আকুলতায় ভরা,
মাধবী, তুমি আমাকে সেই অমরত্ব দিলে না
তুমি আর আমার হলে না।
ভুলতে পারিনি দেহশ্রম ,
ভুলতে পারিনি নিশিকনকচাঁপার মাতাল গন্ধ
ভুলতে পারিনি অস্তসন্ধ্যার প্রগাঢ় চুম্বন,
ভুলতে পারিনি হাজার নক্ষত্রবীথির চন্দ্ররাত্রির আকাশভূক দ্যুতি ।
কে যে কখন হয় শোকগাঁথা, কে যে হয় মৌনতার করণ সুর, কে যে হয়ে যায় দূরের দূরবর্তিনী –
মাধবী, আফসোস তোমারই তুমি হতে পারলে না আমার পুণ্যমহিমার একটি
ধ্রুপদী প্রেমের কবিতা।
৩৮. স্বপ্ন প্রহরে দেখা সেই মেয়েটি
আমি যখন দূর অরণ্যে শূন্যতার চোখে খু্ঁজছিলাম কোনো এক মানসীকে,
তখন তুমি অপেক্ষায় ছিলে তোমারই বাড়ির আঙ্গিনায়।
তখনো তুমি আমাকে দেখনি, দেখনি এক স্বপ্নবাজ তরুণের ঝাঁকড়া চুল,
যে কবিতা লিখে নিশীথের চন্দ্রপ্রহরে। যে কবিতায় তুমি কখনই ছিলে না।
কোনো এক স্বপ্ন পহরে তাকে আমি প্রথম দেখলাম,
দেখলাম বাড়ির দেউটিতে বসে থাকা সেই মেয়েটির কাজল কালো চুল
দেখলাম তার আনত চোখ, দেবী প্রতিমার মতো আ্ঁকা তার দেহখানি
যেখানে শরতের কা্ঁচা রোদ্রের মতো শুভ্র রং ছু্ঁয়ে আছে
দেখলাম সেই স্বপ্ন দেখা মেয়ে যাকে আমি খু্ঁজেছিলাম স্বপ্ন প্রহরে,
আমার সকল দিন রাত্রিতে, আমার সকল কবিতায়।
৩৯. মার্জিনের লেখা
তুমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে এই বাড়ির
বাকি আত্মকথা কীভাবে লেখা হবে ?
তোমার প্রস্থান বন্ধ করো, এই তোমার শাড়ির আঁচল টেনে ধরলাম, যাও দেখি কী করে?
তুমি অপরিহার্য অঙ্গ এই বাড়ির, এর আঙ্গিনার সীমারেখা অতিক্রম করে তুমি
উড়ে চলে যাবে পরিযায়ী পাখির মতো
দূর ছায়াপথে, তা কী করে হয়?
এই তোমার দুই বাহু বক্ষে টেনে নিলাম, উড়ে যাও তো দেখি কী করে?
তুমি যেদিন প্রথম পা রেখেছিলে উঠোনে
সেই পদচিহ্ন এখনও আছে, উঠোনের উপরের আকাশ এখনও খালি –
আমরা দেখতাম নীল আকাশ, মাদুর পেতে বসে উপভোগ করতাম তারাভরা রাত্রি,
দেখতাম কত চন্দ্র কিরণের আবীর মাখা মায়াবী অন্ধকার!
বাঁশঝাড়টা এখনও আছে,
এখনও সন্ধ্যা রাত্রিতে জোনাক জ্বলে, মিটিমিটি করে আলো জ্বলে তোমার নামে,
রবি ঠাকুরের গান থামিয়ে দিয়ে আমরা শুনেছি ঝিঁঝি পোকাদের গান –
উঠোনে বসে আর দেখা হবেনা নীলআকাশ, শোনা হবেনা ঝিঁঝি পোকাদের গান –
তাই কী হয়? এই তোমার যাবার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়ালাম, আমার দেহ মাড়িয়ে তুমি যাও তো দেখি কী করে?
কত কথা মনে পড়ে –
বালিকা তখনও শাড়ি পরা শেখেনি, পিঠের উপরে এলমেল পড়ে থাকত আঁচল –
খোলা অলিন্দে দাঁড়িয়ে এই বাড়িতে প্রথম যেদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, তা দেখে ফেলেছিল আকন্দ গাছে বসে থাকা দুটি দাঁড়কাক,
লজ্জাবতীর লজ্জার মতো তুমি লুকিয়ে যেতে চেয়েছিলে বেতসের ঝাড়ে…
আরও কত কথা মনে পড়ে –
আমি তখন উঠতি অখ্যাত এক কবি, ঋষির মতো মাথাভর্তি চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আঁতেলদের মতো কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে পথ চলতাম, এসব প্রশ্রয় দিতে তুমিও।
যে আমি দিনরাত জীবনানন্দ দাশ, ওমর খৈয়াম আর গালিবের কবিতা পড়তাম ,
সেই আমি কবিতার বদলে তোমাকে পেলাম,
কবির পরিবর্তে হয়ে গেলাম প্রেমিক স্বামী,
আর তুমি হয়ে গেলে আমার কবিতা, যত পাঠ তোমাকেই করতাম।
তুমি কখন অলক্ষ্যে এই বাড়ির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিলে তা তুমিও জানোনা,
এই অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিন্ন করে তুমি চলে যাবে, তা হয়না- প্রফেসর ডাক্তার রোকনুজ্জামান যতই রিপোর্ট দেখাক – ‘তোমার রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে গেছে।’
কিন্তু তা যেন মিথ্যা হয়,
আমি জানি – তোমার শরীরে আবার রক্তের প্রবাহ বইবে।
কুসমপুরের পথে পথে আমরা আবার দুজন হাঁটব, আলপথ ধরে ধানের গন্ধ শুকে
হেঁটে হেঁটে চলে যাব যমুনা কূলে, নদীও দেখবে তোমাকে, নদী তার জলের শব্দ শোনাবে তোমার কানে কানে, স্রোত বক্ষে দেখবে তুমি তোমার আরক্ত সুন্দর মুখ, দেখবে বালিহাঁস উড়ছে মেঘের নীচ দিয়ে – দেখবে বালুচরে ফুটে আছে অজস্র কাশফুল।
মনে আছে তোমার!
একদিন এক অবসন্ন বিকেলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমরা ভেবে রেখেছিলাম –
কোনও একদিন শ্রাবণ দুপুরে ক্রিস্টাল ধবধবে শিলাবৃষ্টি হবে, বরফের স্তুপ জমবে উঠোনে,
তুমি সেই স্বচ্ছ শিলা কুড়িয়ে এনে জল করে পান করবে,
দু’জনে আরও ভেবে রেখেছিলাম –
একদিন এক শরতরাতে আকাশে মস্ত বড়
একটি চাঁদ উঠবে,
ধবল জোছনায় ভাসবে এই বাড়ির উঠোন, দার্জিলিং থেকে আনা সাদা জর্জেট শাড়িটি পরে হাঁটবে তুমি উঠোনে..
যে শাড়িটি তুমি সযত্নে তুলে রেখেছ তোরঙ্গে —
সেই ঝুম শিলাবৃষ্টি এখনও হয়নি,
সেই মস্ত বড় চাঁদ আজও আকাশে ওঠেনি,
সেই শিলাবৃষ্টি, সেই চাঁদ তুমি না দেখেই চলে যাবে, তাই কী হয়?
কত স্বপ্ন দেখেছি দুজন, কত স্বপ্ন দেখা এখনও রয়েছে বাকি, সেইসব স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে তুমি আগে চলে যাবে – তাই কী হয় কখনও ?
_______________________________
মুখবন্ধ –
উপরের লেখাটি দেখে মনে হচ্ছে এটি একটি কবিতা। আসলে এটি কবিতা ছিল না। ২০১৯-২০ সালে আমার স্ত্রী যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর দুয়ারের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল, তখন টুকরো টুকরো করে আমার কিছু অনুভূতির কথা খাতার মার্জিনে টুকে রেখেছিলাম। মার্জিনে লেখা সেই সব লেখাগুলি একত্রিত করে এখানে একটি কবিতার রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র।
৪০. হতে পারতে তুমিও
যে প্রেম হৃদয়ে মাখা ছিল, যে প্রেম আঁধারে ছিল না ঢাকা।
বুঝি সে অভিসারে যাবে ছায়া ঘেরা কোনো বনে। খুব মনে পড়ে তারে।
যদি দেখা হয় আবার চন্দ্রতারা খচিত আকাশ তলে।
গোপনে গোপনে কেয়া ফুল ফুটবে বর্ষার জলে ভিজে,
আমার কেবল নিদ্রাহীন রাত্রি ঘুরে ফিরে আসে। আমি যে সব হারিয়ে খুঁজে পাই তারে
সরিয়ে দিয়ে সব মেঘ আর কুহেলী রাত্রি।
মাধবীলতা, মনে পড়ে তোমাকে আবার।
আল্পস পর্বতমালার পাশে দাঁড়িয়ে দানিউব নদীর জল তুমি যখন দেখ,
তখন কী তোমার মনে পড়ে অন্য আর একটি নদীর কথা?
তুমি তো ইচ্ছা করলে কুসুমপুরের কেউ হতে পারতে।
সেখানেও ছিল নদী। সেখানেও শীতল হাওয়া বয়ে আসত হিমালয় থেকে।
৪১. স্বৈরিণী
স্বৈরিণী, আমি তোর চোখের মধ্যে বসবাস করি,
এ কথা আমার সকল ছন্নছাড়া কবিতার শরীরে লেখা আছে।
আমি জেনে গিয়েছিলাম তা নিশ্চল সন্ধ্যা রাত্রিতে সপ্তপর্ণী পাতা ছিঁড়তে গিয়ে !
তুই পাশেই পড়ে থেকেছিলি কালিদাসের নায়িকা শকুন্তলার মতো।
তখন কুমারসম্ভব উপাখ্যানের পাতা ছিন্নভিন্ন হয়েছিল,
তখন শীতঘুম ভেঙ্গে পড়ছিল দুচোখে,
কী যে আশ্চর্য ছিল সেই রাতের সব
প্রেমকাহিনী।
স্বৈরিণী, তোর চোখে কি কোনও হাওয়ার রাতের দোল খেলেনা?
উন্মত্ত হাওয়ার মেঘ কী আদর করে কাছে টানেনা তোকে?
স্বৈরিণী, তুই আর একবার আয়,
গল্প হবে বৃষ্টি হবে শিউলী ফুল ফুটবে
প্রেমের খুনসুটি হবে রিমঝিম শিশির মাখা আদরে।
৪২. হাজার তারার ভিতর
অনেক আগে অরুন্ধতি হয়ে সে এসেছিল
একবার
এখন ছায়ার মতো অন্ধকার!
অনেক আগে যে নদীর ঘাটে ভিড়াতাম নৌকা
এখন সেখানে কেবল ধূঁধূঁ বালুচর —
অনেক আগে কাঁঠালি চাঁপা ফুটে থাকতো
যেখানে
এখন সেখানে বুনো নাগকেশরের গন্ধ।
এখন হেমন্ত এসেছে –
এখন চলে যাবার সময় সেখানে
এখন সেখানে আছে পাকা ধানের মাঠ,
বিস্তৃত সরিষার ক্ষেত –
হলুদ গালিচার উপরে শুয়ে থাকবো
রাতভর চেয়ে থাকবো নক্ষত্রের দিকে,
আর খুঁজবো তোমাকে হাজার
তারার ভিতর।
৪৩. দেখা হবে
পথে চলতে চলতে বনবীথির গন্ধে-
মায়ালোকের মলিন ধুলিতে
কত খুঁজলাম তারে চন্দ্রসূর্যের উজ্জ্বল
আলোর দীপ্ত প্রভায়।
কত সময় নষ্ট হলো,
ক্লান্তিতে দেহ ন্যুব্জ হয়ে গেল
তবুও দেখতে পেলাম না তারে।
সুনিশ্চিত দেখা মিলবে এই জীবনে কিংবা
অন্য আরেক জীবনের
কোন মৌন সন্ধ্যায় অস্তদিনের ধূসর
আলোয়।
৪৪. জানি নাই
কখন কে এসে আমার পথে এঁকেছিল
তার প্রথম পদচিহ্ন?
কখন আমাকে বলেছিল প্রথম সম্ভাষণ প্রেমের!
তখন প্রণয় বুঝিনি
তখন কুঞ্জবনে পাখিদের গানের অর্থ বুঝিনি
তখন ঝলমল করে উচ্ছসিত হয়নি কাঁচা প্রাণ।
তখন শুনতে পাইনি কোনো জাতিস্মরের বাঁশি
তখন বিন্দু বিন্দু করে ঝরে পড়েনি
কোনো অশ্রু জলের মায়া —
তারপর কখন সেই পায়ের চিহ্ন ধরে তুমি এলে
তারপর বিস্মরণের খেয়ায় পার হবার জন্য
বসেছিলাম দু ‘জন জীবন নদীর তীরে —
এসব তখন কিছুই জানি নাই।
৪৫. পূর্ণতায় তুমি
আঙিনায় নতুন অতিথি রক্তকুচের ছোট্ট চারাটি দুপুরের রোদে পুড়ে যায়, পানি ঢেলে তা সতেজ রাখতে পেরেছি কখনও?
যে নদী বাঁক খেয়ে চলে গেছে নিরুদ্দেশের পথে
তাকে কী আমি অনুসরণ করতে পেরেছি কখনও?
কতো ধূলির পথ বৃষ্টিতে ভিজে কাদা হলো —
পথের সেই ধুলোয় আর কাঁদায় হেঁটে চলে যেতে পেরেছি কী কখনও?
ভালোবাসাহীন ভাবে এ জীবন মৃত্যুর দিকে ধেয়ে যাক দিগ্বিদিক, তা কী কেউ চায় কখনও?
এই ঘর ভালোবাসায় ভরে দিতে হবে তোমাকেই, অপূর্ণ করে রেখো না তুমি কখনও।
৪৬. যদি সে আসে
ছায়া রোদ্দুর বিকালে কোথায় যেন গান বাজে
কে যে গায় গান, তাকে আমি চিনিনা
আমার কেবলই ঘুম পায়,
মনে হয় রাত্রি নেমে এল তারই করুণ সঙ্গীতের সুরে সুরে।
মাঝে মাঝে তার ছায়াখানি দেখি —
রোদ্দুরের উত্তাপ হিমেল বাতাসে হিম হয়ে ভাসে
তখন সত্যি যে রাত হয়,
আমার ঘুম পায়, তবু জেগে থাকি যদি সে আসে।
৪৭. ভালোবাসা জেগে আছে
সেই কবে রক্ত কণিকায় লুপ্ত হয়েছিল ভালোবাসা
সেই কবে এক্কা দোক্কা খেলতে গিয়ে পায়ে বেজে উঠেছিল ঝুমুর সুরে তোমার ঘুঙুর —
আমার প্রথম গান ধ্বনিত হয়েছিল সেইদিন থেকে।
কেমন যেন মেঘমেঘ ছিল কালরাত
কেমন যেন বৃষ্টিবৃষ্টি ছিল সময় —
কেমন যেন কম্পিত হচ্ছিল শিরা উপশিরা
যেন বিদ্যাপতির রাধিকা নেমে এসেছিল পথে
নিবিড় করে চুপসিয়ে ভিজছিল তোমার আঁচলখানি।
কয়দিন আগে দীপাবলীর সব দীপ নিভে গেছে
দীপ নেই আলো নেই এই রাতে
বৃষ্টি তো আছে, দেখ তুমি — অন্তরে তোমার ভালোবাসা জেগে আছে।
৪৮. ময়ূরাক্ষী বৃষ্টি
তোমার চোখ ময়ূরাক্ষী বৃষ্টির জলে ভিজে
কী দুঃখ তুমি জাগিয়ে দিলে,
আজন্ম ঋণী হলাম তোমার ঐ সিক্ত চোখের কাছে,
আমার চোখও জলে ভিজল,
চৌচির এই জলাভুমিতে অকাল বন্যা হলো,
তারপরও তোমাকে পাওয়া হলো না।
তোমাকে হারিয়ে খুঁজি অরণ্যানীতে,
ধুলি পথের উপরে, অস্তরাগের রং লুপ্ত হয়ে যাওয়া দিগন্তের প্রান্তরে,
শীর্ণাকান্ত তটিনী তীরে, পর্বত গুহার আঁধারে,
ধাবমান উত্তর মেঘে।
লিখি শ্লোক, লিখি গল্পকথা, লিখি গ্লানিবদ্ধ শব্দ
দিয়ে যত মর্মরিত কবিতা ।
৪৯. উতল পংক্তিমালা
আজ এমনই এক চাঁদ উঠুক আকাশে
এমনই তার জোছনা,
শুধু গানেরই সেই রাত হবে।
আজ এমনই মেঘ গুরুগম্ভীর দিন হোক,
শুধু ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরবে, কাক ভেজা ভিজব দুজনে।
আজ নাহয় রুপালি রঙের রোদ্দুর হোক,
সারা গায়ে উত্তাপ ছড়াক তার
রূপশুভ্র আভা।
ঐ পরগনা থেকে সেই সাওতাল মেয়েটি
নাকি আজ আসবে, যাকে দেখেছিলাম জগতি স্টেশনে-
ও নাকি ঠুমরী শোনাবে,
ওকে আজ ছুঁয়ে দিক এই জোছনা, এই বৃষ্টি, এই রোদ্দুর।
এত ক্ষুধার্ত ঐ বুভুক্ষু চাঁদ,
এত ঝুমুর ঝুমুর মাদল বাজে ঐ বৃষ্টি ধারায়, এত উত্তপ্ত এই রোদ্দুর…
৫০. চলে যাচ্ছি
যে পথে আমার যাওয়া হয়নি
আমি চলে যাচ্ছি সেই পথ ধরে অনেক দূর
কেমন যেন অবশ লাগছে আমার পা
কেমন যেন দুঃখ ছেয়ে আছে
পথের ধুলোর উপর।
যেথায় যাচ্ছি সেখানে তুমি নেই
সেথায় তাই দুঃখও নেই —
ক্লান্তির ছায়া পড়ে আছে পথে পথে
পায়ে পায়ে আমার কোনো ক্লান্তি নেই।
৫১. তুমি না থাকলে
তোমাকে বাদ দিলে কিছুই থাকে না এই পৃথিবীতে
বিরাণ হয়ে যায় ফসলের ক্ষেত
জলহীন হয় দিঘি নদী সাগর
ভস্ম হয়ে যায় দূরের সবুজ বনান্তর
তোমাকে বাদ দিলে পৃথিবী হয়ে যায় অর্থহীন।
তুমি না থাকলে নদীতে রূপালী মাছের খেলা নেই
অরণ্যে থাকে না চির হরিৎ রং
তখন আর চাঁদ ওঠে না
পাখি ডাকে না
তারা জ্বলে না —
তোমাকে বাদ দিলে পৃথিবী হয়ে যায় খাঁখাঁ শূন্যতার
কবরের অন্ধকারের মতো আঁধার নামে চারদিকে
শ্মশাণের মতো দূঃখী হয়ে ওঠে এই অন্তর চরাচর।
৫২. তুমি অমরাবতী
আমি বাল্মিকী নই আমি বিশ্বমিত্রও নই তারপরেও তুমি হয়েছ আমার মেনকা,
এ কোন্ অপ্সরী তুমি — তুমি আমার তপস্যা ভেঙ্গে দিলে !
তোমাকে কি দেখেছিলাম পুষ্করতীর্থে স্নানরত?
তুমি কি দশক ধরে আমার চৈতণ্যে সহবাসে ছিলে ! আমি তো সম্ভোগ চাইনি — চেয়েছি নিকষিত হেম, চেয়েছি অমরত্ব !
তোমাকে বিরহিনী করে দক্ষিণ থেকে চলে যাই উত্তরে, হিমাচলে কৌশিকী নদীর তীরে —
এ কোন্ বিষণ্ণতা আমার ! কার জন্য তপস্যাা আমার, আমিতো মহর্ষি হতে চাই না.
কোন্ দেবরাজ আবার তোমাকে পাঠাল রম্ভা রূপে — তুমি এসে এবারও আমার ধ্যান ভেঙ্গে দিলে !
তুমি ইন্দ্রিয়েও আসলে না, রতিক্রিয়াতে আসলে না– কার শাপে পাষাণি হলে ! হয়ে গেলে তুমি অমরাবতী।
৫৩. গোলাপ ফোটান দিন
আজ তোমার গোলাপ ফোটানোর দিন
জুঁই চামেলীর তোড়া নিয়ে আজ তোমার অপেক্ষা করার দিন —
আমি জানি তুমি এখন আছো বিবর্তনে
জানি আজ তুমি অসময়ে রক্ত জবা ফুটিয়ে রেখেছ।
ভ্রু কুঁচকে যখন তুমি পাশে এসে দাঁড়াও
আমি তখন ভালোবাসার কোনো ব্যাকরণ মানি না, সনদ মানি না ধর্মের কিংবা জাতিসংঘের,
তাই তো আমি রাতভর সুবাস ছড়িয়ে বসে থাকি জংলী এই ক্যামেলিয়ার বাগানে।
তখন অপার্থিব এক ভালোবাসায় ভরে ওঠে দেহ মন জানালা —
পথে পথে শুনি তার কাছে আসার পদশব্দ
সারা রাত্রিতে কামিনী কুন্তলের ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য মাতোয়ারা হয়ে অপেক্ষায় থাকি।
চাই না ঘৃণা , চাই অমরতা —
হেমলক পান করতে হলে তাই করব
তা হোক গন্দম , তবুও চাই –
অমৃতবীণায় তুলুক সুরলহরী
গোলাপ ফোটান দিনে গীত হোক আমাদের আনন্দ সঙ্গীত।
৫৪. পথ সঙ্গীত
আমরা আজ এখানে এই পথের উপর এসেছি
আমরা তোমাদের ভালোবাসা দিতে এসেছি
আকাশের গায়ে থেকে মুঠো ভরে নীল এনেছি
তোমাদের আজ নীলাদ্রী করে রাঙাতে এসেছি।
আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি।
দুরের ঐ পাহাড় থেকে লতাগুল্ম বনফুল এনেছি
মহুয়া বন থেকে ঝাঁপি ভরে ফুল তুলে এনেছি
তোমাদের আজ মালা পরিয়ে দিতে এসেছি
ফুলের সুবাসে আকুল করে দিতে এখানে এসেছি।
আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি।
সাগর বালুকাবেলা থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে এনেছি
তোমাদের ঘরে মণিমুক্তা ভরিয়ে দিতে এসেছি
রূপালি ঢেউয়ের সমুদ্র পাড়ে নিয়ে যেতে এসেছি
সূর্যস্নানে পুণ্য হবে এই আনন্দ বার্তা দিতে এসেছি।
আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি।
পথের উপরে তোমাদের গান শোনাতে এসেছি
তোমাদের জন্য আজ এই আনন্দ গান বেঁধেছি
পথের দিশা দিতে তোমাদের কাছে এসেছি
পথের মাঝে যেন হারিয়ে না যাও সেকথা ভেবেছি।
আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি।
আমরা অনেক দুঃখ যাতনার কথা ভুলেছি
ভালোবাসা হৃদয় কোণে কানায় কানায় ভরেছি
আমরা তোমাদের সেই ভালোবাসা দিতে এসেছি
ভালোবেসে শুন্য করে দিতে এখানে এসেছি।
আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি।
৫৫. এপিটাফ
কঠিন প্রস্তরের উপর খোদাই করে লিখে রেখে যাব আমাদের নাম ও কিছু নির্মল শব্দাবলি। প্রাণহীন এবং অনুজ্জ্বল সেই শব্দগুলি চেয়ে থাকবে জ্বলজ্বল করে পৃথিবীর স্বরূপের দিকে। দূর্বা ঘাস আর শিলালিপির উপর হেমন্তের শিশির ঝরে পড়বে নির্জন রাত্রি প্রহরে।
খোদাই করা এই অভিজ্ঞান চিহ্ন থাকবে অনন্তকাল।
এখানেই পড়ে রইবে আমাদের স্বপ্নের কথা, আমাদের আরক্ত মুখচ্ছবি।
৫৬. তুমি
চোখ খুলে দূরের যে মেঘ দেখি সেখানে তুমি
সে মেঘের ছায়াপথে আমার যে চোখের তারা
সে তারায়ও মিটিমিটি জ্বলছ তুমি।
ঝিরিঝিরি যে বৃষ্টির ধারা বইছে ভূবন জুড়ে
সে জলপতনের শব্দেও তুমি
জলে জলে ভরে যায় যে নদী সেই স্রোতধারাও তুমি।
সকালে পাখিদের যে গান বাজে সেই গানে তুমি
অলিন্দে বসে ডাকে যে কাকাতুয়া তার সুরেও তুমি
সেই কাকাতুয়ার বিষণ্ণ চোখের মায়াতেও তুমি।
বুকের গভীরে তুমি মিশে গেলেই নির্জনতা বাড়ে, আকুল হয়ে ওঠে যে বিন্দু বিন্দু রক্ত কণিকা–
স্তব্ধ হয়ে যায় যে শ্বাস প্রশ্বাস সেই দীর্ঘশ্বাসেও তুমি।
এলমেল যে স্বপ্ন আসে রাত্রির গভীরে থেকে
হৃৎপিণ্ডের দু’পাশে যে স্পন্দন শুনি —
যে ঝড় আসে বুকের অতল থেকে সে ঝড়েও তুমি।
জীবন আর কালের কপোলের যে অন্ধকার,
সে অন্ধকারের ওপাশে দেখি যে আলোর ছটা–
সেই নিঃশেষিত আলোক বিন্দুতেও তুমি।
৫৭. তুমি এসেছিলে
হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় তাকে —
চেয়ে দেখি সে যে নান্দীমুখ আবার ভৈরবীর
ঠুমরির সুরও যেন ভেসে আসে
মেঘদূতম্ শ্লোকও শোনা যায়
যেন যমুনা তীরে অকালে বান এসেছে।
‘বর্ষন মন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি তোমারি এ দ্বারে,
পথিকেরে লহ ডাকি তব মন্দিরের এক ধারে।’
এই গান গেয়েছিল কে প্রথম —
এখন সে কোথায়?
এখনও আছ তুমি, এখনও সে আহ্বানও দাও তুমি।
সেই কোন্ জনমে শিউলী ফুটেছিল বাগানে
আগে মাতাল হতাম এর গন্ধে , এখনও হই–
এখনও হাত বাড়ালেই তোমাকে ছুঁই
যেন সায়গল এসে থামে ‘পিয়া নাহি আয়ে’।
নাহ্! তুমি এসেছিলে আমারই গানে।
৫৮. এসো দু’জনে
হাতখানি বাড়িয়ে দাও
চুড়ির রিনঝিন শব্দ বাজে যে মেহেদি পরা হাতে
এসো সে হাতে অঙ্গুরী পরিয়ে দেই।
মাথাটি বাড়িয়ে দাও
কুচবরণ কেশে বেঁধেছ যে রাজকুমারীর খোঁপা
এসো সে খোঁপায় গোলাপ পরিয়ে দেই।
মুখখানি বাড়িয়ে দাও
কপালে পরেছ যে টিপ চোখে মেখেছ যে কাজল
এসো সে মুখে লোধ্ররেণু লাগিয়ে দেই।
কোমর বাড়িয়ে দাও
পরেছ যে মোঘল নর্তকী আনারকলির বিছা
এসো নাভীপদ্মে চারুকলার কারুকাজ এঁকে দেই।
পা দুটি বাড়িয়ে দাও
নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গের পদধ্বনি বাজে যে পায়ে
এসো আলতা রাঙ্গা ঐ পায়ে নুপুর পরিয়ে দেই।
বুকখানি বাড়িয়ে দাও
আতরের গন্ধ আর চন্দনের সুবাসে ভরে আছে যে বুক
এসো সেই বুকখানি আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেই।
ভালোবাসা ভরিয়ে দাও
পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় আকুল হয়ে আছে আজ চারিদিকে
এসো দু’জনে এই রাতে প্রেমের ফল্গুধারা বইয়ে দেই।
৫৯. মধুকর
ভোরের আলোয় পথ চিনে বেরিয়ে পড়েছি পথে
কোথা’ থেকে ভেসে আসছে এমন অচেনা সুবাস
এমন অস্পর্শ ফুল ফুটে আছে কোন্ কুসুম কাননে।
আমি তার আরক্ত পরাগ রেণূতে ছুঁয়েছি ঠোঁট
যেন প্রজাপতি প্রথম পালক রেখে গেল পত্রপল্লবে।
এমন লাজুক প্রস্ফুটিত পাঁপড়িতে বসেনি এর আগে
কোনও উড়ন্ত মৌমাছি থামিয়ে দিয়ে ডানা,
শুষে নিতে পারেনি এর মধুরিমা।
৬০. হারিয়ে গেছে
এখানে অট্টালিকার আড়ালে চাঁদ লুকিয়ে থাকে
ছাই ভস্ম হয়ে উড়ে যায় যতো মেঘ
সহাস্য মুখখানি তার ভেসে যায় অন্তরালে।
এইসব মেঘের নীচে ছেলেবেলা হারিয়ে গেছে
কবেকার সন্ধ্যার পাখি সব ডানা মেলে চলে গেছে
সেই কবে লুকোচুরিতে কেটে গিয়েছিলো বেলা।
ক্লাশে রাফ খাতায় টুকেছিলাম কিছু শব্দাবলী
পংক্তিও কিছু লিখেছিলাম ছন্দহীন
খাতার পাতায় ঝাউ পাতাও রেখে দিতাম
এসবই জীর্ণ হলো, ছিঁড়ে গেলো —
কোনো পংক্তিমালাই সম্পূর্ণ কবিতা হলোনা আর।
যাকে ভালোবেসেছিলাম অবগুন্ঠন খোলার সময় হলোনা তার —
কোনো ঘাসফুল ফুটে পদ্ম হলোনা
কোনো ছবি জলছবি হয়নি জীবনের।
কোথায় আমার হারিয়ে গেছে ছেলেবেলা —
কোথায় যেয়ে লুকাবো আমার মলিন মুখখানি।
৬১. সেই তুমি
কোনদিন কোনো জনম দেখিনি
তারে ক্ষণতরে,
সেই তুমি এসে মর্মরিত হলে
আশ্চর্য মর্মরে।
Leave a Reply