মরুস্বর্গ – উপন্যাস – আবুল বাশার
মরুস্বর্গ – উপন্যাস – আবুল বাশার
উৎসর্গ : কলা-সমালোচক সন্দীপ সরকার শ্রদ্ধাভাজনেষু
প্রথম প্রকাশ– জানুয়ারি ১৯৯১
পটভূমিকা প্রসঙ্গে
পুরাণ-মিশ্রিত এই কাহিনীর পটভূমি খ্রিস্টের জন্মের সহস্রাধিক বৎসর আগের প্রাচীন পৃথিবী–পৃথিবীর এক নির্দিষ্ট ভূখণ্ড। এই ভূখণ্ডের আকৃতি বাঁকা চাঁদের মত। উত্তরে তার কৃষ্ণসাগর, দক্ষিণে আরব মরুভূমি। পূর্বে পারস্য, পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর–পারস্য উপসাগর থেকে অর্ধবৃত্তাকার এই ভূমি মিশরের লোহিত সাগরের কিনারা ছাড়িয়ে গেছে।
আরব মরুভূমির বুকে তিনটি প্রধান ধর্মের জন্ম–যিশুর ধর্ম, মুসার ধর্ম এবং হজরত মুহম্মদের ধর্ম। বর্ণিত মরুভূমি থেকে ধর্মগোষ্ঠীগুলি অর্ধবৃত্তাকার জমির কোলে আশ্রয় পেয়েছিল এবং সেখান থেকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে। অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভূভাগে ছিল কৃষি জীবন নির্ভর বহু দেবদেবীর নানান বিচিত্র ধর্ম। প্রাচীন বাইবেলে পশুপালক মরুযাযাবর গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে কৃষিজীবী মানুষদের ধর্ম ও জীবনগত এক নিরন্তর দ্বন্দ্বের স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। বর্তমান কাহিনীতে এই দ্বন্দ্বকে মূর্তিমান ঈশ্বর এবং মূর্তিহীন ঈশ্বরের দ্বন্দ্ব রূপে কল্পনা করা হয়েছে। কল্পনাকে মরুভূমির প্রধান তিনটি ধর্মই সমর্থন করে।
পুরনো বাইবেলেই রয়েছে ভাষাগত বিভেদের কথা। কাহিনীতে বিশেষ উপাদান রূপে ভাষার সমস্যাটিকে লোটা নামের একটি কাল্পনিক চরিত্রের সাহায্যে উপস্থিত করা হয়েছে। ধর্ম এবং ভাষার সমস্যা উপন্যাসের সৃষ্টি নয়, ধর্মশাস্ত্রীরাই এই দ্বন্দ্বের রূপকার। জীবন আশ্রয় না পেলে ধর্ম বাঁচে না–মরুভূমিতে এই সত্য আবিষ্কৃত হয়। নিরন্তর এক অর্থহীন যুদ্ধের হাত থেকে জীবন পরিত্রাণ খুঁজেছে মাটির কাছে। লোটা আশ্রয় চেয়েছিল, উপন্যাসের এটিই প্রধান আকাঙ্ক্ষা। ধর্ম এবং ভাষা সভ্যতার বাহন হলেও, এই দুইটি জৈবনিক উপাদান শুধু আজকার ভারতবর্ষেই নয় প্রাচীন দুনিয়াতেও মানুষকে বিচ্ছিন্ন, দগ্ধ এবং যুদ্ধলিপ্ত করেছে। লোটা তারই নিদর্শন। এ কাহিনী। তাই মরুভূমির পটকে নির্বাচন করে শস্যশ্যামল ভূমিক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হয়েছে।
লোটার উটপূজা কোন কল্পনা নয়। হজরত মুহম্মদ নারীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, তোমরা খোদাকে সিজদা (প্রণাম) করবে। যদি খোদা ব্যতীত কারুকে সিজদা করতে চাও, স্বামীদের কর-কুত্রাপি উটকে সিজদা কর না–বোঝা যায় উটপৃজা ঐতিহাসিক সত্য। বিভিন্ন পুঁথিতে এবং লোককথায় উটপূজা আর উটের দেবতা বা নবীর কথা বর্ণিত। এভাবে বিচিত্র উৎস থেকে, এই কাহিনীর গড়ন গড়বার জন্য অজস্র (যেমন উটের পিঠে যৌনাচার ইত্যাদি) উপকথা, কিংবদন্তী বা লোককল্পনার বিবিধ উপাদান জড়ো করা হয়েছে, যা কল্পনামাত্র নয়, তা ইতিহাসও বটে–উটের পিঠে যৌনবিহারের কথা মুসলমানদের হাদিসে অবধি উল্লিখিত রয়েছে। অতএব লোটাই শুধু নয়–সাদইদ, নোয়া প্রমুখ চরিত্রগুলি কিংবদন্তী আশ্রিত হলেও সমস্তটাই সেই প্রাচীন নগর-সভ্যতার বিলুপ্ত ইতিহাসের সাক্ষ্য। সাদইদ স্বর্গ গড়তে চেয়েছিল সেদিনের নির্মিত নগরগুলির নির্মাণ আর ভাস্কর্যের বাস্তব সৌন্দর্য দেখে–নগরগুলিই তার স্বর্গ কল্পনার ভিত্তি। বাইবেল এবং কোরানে সাদইদকে নিন্দা করা হয়েছে, এবং সাদইদের জন্য অশ্রুপাতও শাস্ত্রসম্মত। এছাড়া কৃষির দেবদেবীদের কথা, সূর্যদেবতার বিবরণ একই প্রকারে প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতি, যা গুহাচিত্র, প্রাচীরচিত্র ইত্যাদি থেকে উৎকীর্ণ হয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থে—এ-কাহিনী সেইসব গ্রন্থের প্রণেতা এবং পুরাতত্ত্ববিদদের কাছে ঋণী। ঋণী সেইসব গ্রন্থের অঙ্কিত চিত্রগুলির শিল্পীদের কাছে, সংগ্রাহক বিজ্ঞানীদের নিকট। তাছাড়া সাধারণ প্রচলিত বিভিন্ন গ্রন্থও এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে–সব গ্রন্থের নামোল্লেখ সম্ভব নয়। প্রধান যে গ্রন্থটিকে অবলম্বন করা হয়েছে, তার প্রণেতা লরেন্স টুম্স্।
শ্রদ্ধেয়কলা-সমালোচকসন্দীপ সরকার অজস্র চিত্র এবং ভাষ্যের সাহায্যে এই কাহিনী নির্মাণে আমাকে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছেন। তাঁর সহযোগিতা ছাড়া এই উপন্যাস অসম্ভব ছিল।
–লেখক
.
চরিত্র ও স্থান পরিচিতি
ইহুদ–মুসাপন্থী এক অখ্যাত নবী।
সাদইদ–সেনাধিপতি।
লোটা–সাদইদের প্রধান সেনা।
হেরা–নিনিভে নগরীর নির্মাতা ভাস্কর।
আক্কাদ–দামাস্কাস ও মেসোপটেমিয়ার বণিক।
নমরু-মিশরের ভূপতি; মিশর-নগরী আমারনার পুরোহিত।
আবীরুদ–নমরুর পুত্র; রিবিকার প্রেমিক।
হিতেন–হিটাইট বা হিত্তীয় জাতির রাজা।
আব্রাহাম–প্রাচীন নবী।
নোহ–নৌ-নির্মাতা নবী । অপর উচ্চারণ নোয়া।
লোট–আব্রাহামের বন্ধু।
মিশাল–নৌকারিগর।
দিনার–রহস্যময় মরু-কিশোর ।
ফেরাউন–মিশরের রাজা।
মোসি–মুসা বা মজেস।
আমন–সূর্যদেবতা।
যবহ–ঈশ্বর। অন্য উচ্চারণ ইয়াহো।
ইস্তার–কৃষির দেবী।
মসীহ–ত্রাতা।
সারগন–রাজচক্রবর্তী, যিনি সাধারণ অবস্থা থেকে রাজা হয়েছিলেন।
জিব্রিল–দেবদূত।
আজরাইল–যম। জিগুরাত-স্বর্গ ।
নিনিভে–আসিরিয়ার নগরী।
কনান–প্যালেস্টাইন।
রিবিকা–নায়িকা।
রুহা–হাতকাটা দেবদাসী।
নিশিমা–দেবদাসী।
নিনিভা–হেরার দ্বিতীয় পত্নী।
Leave a Reply