ময়ূখ চৌধুরী রচনাসমগ্র – ৩য় খণ্ড
ময়ূখ চৌধুরী রচনাসমগ্র – ৩য় খণ্ড
সম্পাদনা – স্বাগত দত্ত বর্মন
[কমিক্স অংশটি দেয়া হয়নি]
.
রহস্যের নাম ময়ূখ
১৯৯৬ সাল – বাংলা কমিকসের জগৎ থেকে সকলের অগোচরে বিদায় নিলেন শিল্পী-লেখক ময়ূখ চৌধুরী। এক নিঃসঙ্গ স্বজনহীন মৃত্যু।
সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর বা আরও বেশি… কালের বিবর্তনে প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক স্রষ্টার সগৌরব প্রত্যাবর্তন ২০১২ সালে ময়ুখ চৌধুরীর চিত্রকাহিনি বা কমিক্স সম্ভার নিয়ে ‘লালমাটি’ প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হল কমিক্স সমগ্র – ১ম খণ্ড, তারপর কিছু সময়ের ব্যবধানে কমিক্স সমগ্রের আরও দুটি খণ্ড। পরিণামস্বরূপ যাঁরা ছিলেন তখনকার কিশোর এবং আজকের প্রবীণ সেইসব পাঠকেরা সুযোগ পেলেন অতীতের স্মৃতিকে ঝালিয়ে নেবার আর একালের কমিক্স ভক্ত তরুণ পাঠককুল যাদের চোখের সামনে ভিড় করে আছে বিদেশি তথা ভারতীয় কমিক্সের বাংলা অনুবাদের মোড়কে মোড়া চেহারাগুলো অর্থাৎ ফ্যান্টম, ম্যানড্রেক, বাহাদুর, রাকা প্রভৃতি— তাদের কাছে ময়ুখের ‘রুদ্রদমন’ এক নতুন আবিষ্কার।
আমি এই কমিক্স ভক্ত ও সন্ধানী তরুণ পাঠকদেরই একজন। নাম ‘রাকা’। কমিক্স-এর সন্ধান করতে করতে একদিন বেরিয়ে পড়লাম ময়ূখ সন্ধানে। পুরোনো শুকতারা, সন্দেশ, কিশোর ভারতী পত্রিকার পাতায় দেখতে পেলাম ময়ূখ চৌধুরীর বিভিন্ন কমিক্স … দুর্ধর্ষ সব অলংকরণ, আশ্চর্য গতিময় সেইসব ছবি। তার সঙ্গে ময়ূখের লেখকসত্তার আবরণ উন্মোচন।
পরিচয় হল এক সংগ্রাহক বন্ধু ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। চলল নিজেদের সংগ্রহের নানা কমিক্স নিয়ে আলোচনা আর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া ছবিতে গল্পের সম্পাদক আগ্ৰহী মানুষদের কাছে তুলে ধরা।
এযাবৎ ময়ূখের কমিক্স ও নানান লেখা যা লালমাটি-র পাঁচটি বইতে সংকলিত তার বাইরে আরও কিছু কমিক্স, উপন্যাস, গল্প বা অন্যান্য লেখার সন্ধান মিলল। আর সেইসব অজানা ময়ূখ-সৃষ্টিকে একত্র করে গঠিত হল ময়ূখ চৌধুরীর এই নতুন সংকলন।
লেখক ও চিত্রকাহিনিকার ছাড়াও ময়ূখের অন্যতম পরিচয় গ্রন্থচিত্রণ শিল্পীরূপে, যাতে তাঁর দক্ষতা সংশয়াতীতভাবে প্রমাণিত। ময়ূখের সেইসব সাবলীল কিছু অলংকরণের সমাবেশও মুদ্রিত হয়েছে এ বইয়ের একটি অংশে।
এবার আসি ‘অজানা ময়ূখ’-এর কথায়। এই প্রকাশনার ময়ূখ চৌধুরী কমিক্স সমগ্রের ২য় খণ্ডে সম্পাদক অনেকটাই আলোকপাত করেছেন ময়ূখের জীবনের উপর। ‘ময়ুখ চৌধুরী’ নামটা আসল নয়, উনি আরও পাঁচটা নাম ব্যবহার করতেন, স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল, রাত জেগে কাজ করতেন, এঁকে দেখতে কেমন ছিল, কোথায় পড়াশোনা করেছেন, কর্মজীবন— লেখাটা ময়ুখের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী বললে অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু কিছু প্রশ্ন আমার মনে বার বার উঠে আসতে লাগল— মা বাবার নাম নেই কেন? জন্মসাল ‘আনুমানিক’? ১৯৯৬ সালে মারা যান— তারিখটা যদি জানা যেত। একটা ছবিও পর্যন্ত জোগাড় করা গেল না। লেখাটা যতবার পড়লাম, ততবারই কৌতূহল বাড়তে লাগল। ভদ্রলোকের আসল নাম তাহলে কী? শক্তিপ্রসাদ না শনিপ্রসাদ? বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, ‘বাড়ির ঠিকানায় গিয়ে খোঁজ কর। রুদ্ধশ্বাস কমিকসের পিছনে মৃত্যুটা লেখা আছে— ৩০ নভেম্বর ১৯৯৬।’
পরের দিন গেলাম সে-বাড়িতে। দু-তলায় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা… বললাম গবেষণা করছি… ‘শক্তিপ্রসাদ’ বলতে চিনতে পারলেন না… যখন বললাম ‘ময়ূখ চৌধুরী’ তখন বুঝতে পারলেন। বললেন নির্বেদ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। নির্বেদ রায় বলেছিলেন ওই বাড়ির মালিক আর লেখকের ছোটোবেলার বন্ধু মঞ্জিল সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
ময়ূখ যে বাড়িতে থাকতেন সেখানে যাতায়াতের সূত্রে আলাপ হয়েছিল বাড়ির বর্তমান মালিক দেবাশিস সেনগুপ্তের সঙ্গে। উনি যতটা সম্ভব আমার নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। উনি জানান ময়ুখের বাবার নাম— প্রফুল্ল রায়চৌধুরী। পরের দিকে জানতে পেরেছিলাম এক নিকট সম্পর্কের বোনের নাম পদ্মিনী। শিল্পী মারা যাওয়ার পর তিনি শিল্পীর যাবতীয় আসবাবপত্র নিয়ে চলে যান। অবশেষে মিত্র স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জানতে পারি ময়ুখের আসল নাম শক্তিপ্রসাদ রায়চৌধুরী; শনিপ্রসাদ নয়। বাবার নাম P C. Raychaudhuri.
একদিন নভেম্বর ১৯৯৬-এর সন্দেশ খুলে দেখি, ফেলুদার ‘টিনটোরেটোর যীশু’র ছবির নীচে আলাদা একটা বক্সে লেখা— ‘প্রসাদ দা’। ভেতরে প্রসাদ দা ওরফে প্রসাদ রায় বা ময়ূখের সম্বন্ধে লেখা। সম্পাদক লিখছেন ‘… চলে গেলেন প্রসাদদা… গত ৩০ অক্টোবর’। এ কী! একই লোকের ‘দুটো মৃত্যুদিন।’ কৌতূহল মেটাতে ও সঠিক তথ্য জানতে জাতীয় গ্রন্থাগারে গিয়ে দেখতে পাই, ডিসেম্বর ১৯৯৬-এর কিশোর ভারতীতে সম্পাদক লিখছেন ‘নভেম্বরের গোড়ায়…. গল্প হচ্ছিল….. প্রসাদবাবু মারা গেছেন। গত মাসে ৩০ তারিখে।’ অর্থাৎ ৩০ অক্টোবর। প্রকৃত সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল আজকাল ১ নভেম্বর ১৯৯৬। সংবাদ পত্রের তথ্যানুসারে ময়ূখ চৌধুরী ৩০ অক্টোবর ১৯৯৬ (১৩ কার্তিক ১৪০৩), বুধবার দুপুর বেলা শ্বাসকষ্টের জন্য শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে দেহত্যাগ করেন। এ ছাড়াও শিল্পীর মৃত্যুকালীন একমাত্র সঙ্গী সন্দীপন চন্দ (মন্টিদা) তাঁর লেখা ‘প্রতিবেশী প্রসাদ রায়’-তে একথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ময়ূখের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ভুল ধারণা মৃত্যুর দু-দিন পরে ঘরের দরজা ভেঙে তার মৃতদেহ আবিষ্কার করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তাঁর ঘরের দরজা ভেঙে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। (গ্রন্থপ্রসঙ্গ দ্রষ্টব্য)
পুরোনো নবকল্লোলে যে কমিক্স বেরোত, তা আমি জানতাম। একদিন জাতীয় গ্রন্থাগার থেকে নবকল্লোল ঘাঁটতে গিয়ে দেখি ময়ূখের কমিক্স, ‘অপরাধী কে?’ সালটা ১৩৮৫। তারপর আবার ১৩৮৬ অবধি এই কমিক্স সিরিজ চলেছে। এই সিরিজের মধ্যে দুটি প্রকাশিত, বাকি ৯টি কমিক্স এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হল।
একদিন ১৩৮৫ সালের নবকল্লোল দেখছি, সূচিপত্রে লেখা: ‘আমার চোখে সত্যজিৎ রায়… ময়ূখ চৌধুরী… পৃষ্ঠা… – নির্দিষ্ট পাতায় দেখি ময়ূখের অপ্রকাশিত প্রবন্ধ, লেখক নিজেই লিখছেন- ‘প্রবন্ধের মতো গুরুতর বস্তুর কাছাকাছি কখনো যাইনি।’ একই বছরের কিছুদিন পরে, একটি কবিতা ‘চিরঞ্জীব’ যেখানে ময়ূখ চৌধুরী লিখছেন তাঁর মতন সংগ্রামী মানুষদের নিয়ে। যারা জীবনে অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছেন, কিন্তু কখনো হার মানতে শেখেননি। তাঁর ভাষায়,
‘লণ্ঠনের কাচের আধারে
এরা তো হয় না বন্দী।’
অর্থাৎ তাঁর মতন অদম্য মানুষের ভেতরের আগুনকে লণ্ঠনের মতন ক্ষুদ্র আধারে ধরে রাখা যায় না। এই আগুন চারিদিকে ‘দাবানল’-এর মতন ছড়িয়ে পড়ে। তিনি লিখছেন, (অসম্পূর্ণ)
Leave a Reply