ময়ূখ চৌধুরী রচনাসমগ্র – ২য় খণ্ড
ময়ূখ চৌধুরী রচনাসমগ্র – ২য় খণ্ড
সম্পাদনা – তুষার মাজি, প্রদীপ গরাই
.
প্রতিবেশী প্রসাদ রায়
প্রসাদ রায় ওরফে ময়ুখ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে ছোটোদের কাছে একটি উজ্জ্বল নাম। কিন্তু এই প্রতিভাবান মানুষটি অত্যন্ত অবহেলিত এবং অর্থাভাবে ক্লিষ্ট জীবনযাপন করেছেন। হয়তো অল্পবিস্তর খামখেয়ালি জীবনদর্শন তার জন্য দায়ী।
এই অসমবয়স্ক বন্ধুটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এখনও সমবেদনায় আমার মন ভারাক্রান্ত হয় । কত ছোটো ছোটো ঘটনা আমার মনের মণিকোঠা থেকে উঠে আসে।
এখন মনে হয় এই নিঃসঙ্গ মানুষটিকে আরো একটু স্নেহ মমতা দিলে নিশ্চয় ভালো হতো, কিন্তু সমসাময়িক পরিচিতদের কাছ থেকে সে রকম কোনো চেষ্টা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বাংলার কিছু সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুর অক্লান্ত চেষ্টায় প্রসাদদার জীবনের কিছু কিছু অজানা তথ্য উদ্ঘাটিত হতে চলেছে। এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে অকুণ্ঠ প্রশংসার দাবি রাখে।
প্রসাদ রায়ের সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক বহু বছরের। শ্রী ময়ুখ চৌধুরীর আসল নাম শ্রী প্রসাদ রায়। সেই নামেই উনি কমিক্স জগতে সুপ্রসিদ্ধ। তাঁর রচনায় সাধারণত হিংস্র জন্তুদের কার্যকলাপ প্রাধান্য পেয়েছে। অধিকাংশ গল্পই মূলত Adventure নিয়ে। তাই খুদে পাঠকদের কাছে তা অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্য জগতে শ্রী ময়ূখ চৌধুরী চিত্রকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমি অবশ্য তাকে মানুষ প্রসাদ রায় হিসেবে চিনতাম।
একটা অপরিণত বালকের সঙ্গে এক জন পরিণত বয়স্ক মানুষের যে রকম সম্পর্ক হতে পারে আমাদের মধ্যেও সেই রকম সম্পর্কই ছিল। অনেক আবদার, দুষ্টুমি আমি অনায়াসে তাঁর সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারতাম। আমার বয়স তখন পাঁচ বছর হবে, আমার যত দূর মনে হয় তখন তার বয়স ৫০ বছরের আশেপাশে। বয়সের এতটা পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমার সঙ্গে ওঁর মেলামেশায় কোনো বাধা সৃষ্টি হয়নি।
আমার ছোটোবেলা থেকেই ওঁকে আমি প্রসাদদা বলেই ডাকতাম। তারও একটা কারণ ছিল। উনি আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ছিলেন, আমাদের ভবানীপুরের বাড়ির পেছনের ফ্ল্যাটে উনি ভাড়া থাকতেন । আমার জ্ঞান হবার সময় থেকেই আমি ভবানীপুরের বাড়িতে থাকতাম। উনি আমার মাকে অনেক ছোটোবেলা থেকে চিনতেন। সেই সূত্রে মা ওঁকে প্রসাদদা বলে সম্বোধন করতেন। আমার দিদি এবং আমিও ওঁকে প্রসাদদা বলেই ডাকতাম। বয়সের এবং সম্পর্কের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সেটা নিয়ে কোনো মতপার্থক্য হয়নি।
আমি যখন এতো বছর বাদে তাঁকে নিয়ে লিখতে বসেছি, ছোটো ছোটো ঘটনাগুলো আবার মনের ভেতর থেকে বার হয়ে আসছে। যে রকম ভাবে ঘটনাগুলো মনে পড়ছে সেই রকম ভাবেই লিখছি। তাতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারিনি।
প্রসাদদা যে কত বড়ো দরের শিল্পী তা আগে বুঝতে পারিনি। শুধু জানতাম উনি আঁকেন এবং ওঁর আঁকা অনেক কমিক্স বাংলা পত্রিকাগুলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
কিছু কিছু ঘটনা যেগুলো মনে পড়ছে তা বলি। আমার আঁকার প্রতি অনুরাগ ছোটোবেলা থেকেই ছিল । আমার আঁকার হাতেখড়ি প্রসাদদার কাছে। পেনসিল ধরা থেকে, Paint Brush কিরকম ভাবে ধরতে হবে সব কিছু প্রসাদদার কাছে শেখা। অনেক বকুনি খেয়েছি, ভুল করে পেনসিল ধরলে অথবা ভুল পেনসিল ব্যবহার করলে। প্রথমে আমাকে শুধু Circle বা শূন্য আঁকতে হত হাত যাতে steady হয়। একটু যখন বড়ো হলাম—কিছু দেখে ছবি আঁকতে প্রসাদদা অনুমতি দিতেন না, বিষয়টি ভালো করে দেখে নিতে হত, তার পর সেটা আঁকতে হত স্মরণশক্তি দিয়ে।
এখনো মনে আছে, এক দিন বিকেলে একা একা বসে রং আর তুলি নিয়ে খেলা করছি, প্রসাদদা হঠাৎ এসে ১০ মিনিটে খড়ি দিয়ে মেঝেতে একটা কুমির এঁকেছিলেন। ঠিক মনে হচ্ছিল এখুনি আক্রমণ করবে। এতটাই জীবন্ত ছিল সেই আঁকা। কোন কোন মূল রং অন্য রঙের সঙ্গে মিশিয়ে নতুন রং সৃষ্টি করা যায়, সেই পদ্ধতি ওঁর কাছেই শেখা। তুলি ঠিক করে ব্যবহার করা ও ব্যবহারের পর ঠিক করে ধুয়ে, মুছে, শুকিয়ে রাখতে হত, সেই শিক্ষাও ওঁর কাছে পেয়েছি। অহেতুক বকুনিও খেয়েছি অনেক।
প্রসাদদা মানুষ হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত খামখেয়ালি। পরনে থাকত হাফ হাতা বুশ শার্ট আর প্যান্ট। পায়ে থাকত এক জোড়া Bata-র চটি। শীতকালে সোয়েটার আর পায়ে ক্যানভাসের জুতো। কব্জিতে ঘড়ি পরতেন ডান হাতে। তিনি কখনো কাউকে নিজের ছবি তুলতে দিতেন না। জানি না কেন, কিন্তু এই নিয়ে কখনো তাঁকে প্রশ্ন করিনি।
জুতো অথবা চটি যখন কিনতে যেতেন, তখন আমাকেও ওঁর পছন্দমতো এক জোড়া উপহার দিতেন। উনি Jeans প্যান্ট একেবারে পছন্দ করতেন না এবং একেবারেই শৌখিন লোক ছিলেন না। ওঁর কাছে জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিল একেবারে অবাস্তব। সম্ভবত সেই জন্যই হয়তো Professional কাজে এত সাফল্য হওয়া সত্ত্বেও তাঁর শেষ জীবন কেটেছে খুবই অভাবের ভেতর। অর্থাভাব এবং অবহেলিত জীবন তাঁর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে। অযত্নে তাঁর অস্থি চর্মসার দেহ এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। প্রসাদদা কখনোই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন না। আমার শৈশব থেকে সব সময়ই তাঁকে রোগা আর লম্বা দেখেছি। কিন্তু শেষ জীবনে তিনি অপুষ্টিজনিত এবং অনিয়মিত খাদ্য গ্রহণজনিত ব্যাধিতে ভুগছিলেন। যাদের জন্য অথবা যাদের পত্রিকার জন্য তিনি কাজ করতেন ওঁর শেষ জীবনে তাদের কাউকেই ওঁর পাশে দেখা যায়নি, না তারা অর্থ দিয়ে ওঁকে সাহায্য করেছেন। প্রসাদদার জনপ্রিয়তা ছিল প্রচুর কিন্তু তার জন্য সঠিক মূল্য প্রকাশকরা তাঁকে দেয়নি।
একবার আমার মা এবং বাবা কোনো কাজে কলকাতার বাইরে গিয়েছিলেন, বাড়িতে ছিলাম দিদি আর আমি। তখন আমার বয়স ১৫/১৬ বছর। প্রসাদদাকে আমরা কয়েক দিন দেখিনি বাড়ি থেকে বেরুতে অথবা ঢুকতে, সেটা কিছু অস্বাভাবিক ছিল না। হঠাৎ জানতে পেলাম প্রসাদদা আমাকে ওঁর বাড়িতে খেতে বলেছেন। গিয়ে দেখি জীর্ণ শরীর নিয়ে প্রসাদদা খাটে শুয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম অনেক দিন থেকেই তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছে না। খাওয়া-দাওয়া কিছুই হয়নি। বাড়িতে মা ছিলেন না তাই আমার পক্ষেও কিছু করা সম্ভব হল না । আমাকে একটা পাঁচ হাজার টাকার চেক কেটে দিলেন SBI Bhawanipur Branch এবং টাকা নিয়ে এসে স্থানীয় ডাক্তারকে খবর দেওয়া হল। উনি এসে ‘আনন্দলোক’ Nursing Home-এ ওঁকে ভর্তি করতে পরামর্শ দিলেন। এই ৫০০০ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তোলার পর, ওঁর হিসাবে আর মাত্র আড়াই হাজার টাকা পড়ে ছিল। কিন্তু এখানে চিকিৎসার পরেও তার শরীরের বিশেষ কোনো ইংরেজি কমিক্স-এর মধ্যে ওঁর ভালো লাগত Tintin, Astirix, Mandrek ইত্যাদি। প্রসাদদার খুব প্রিয় ছিল ‘ফ্ল্যাস গর্ডন’ কমিক্স। ওনার সংগ্রহে অনেক ‘ফ্ল্যাস গর্ডন’ কমিক্স দেখেছিলাম । ওঁর সঙ্গে কিছু কিছু সিনেমাও আমি দেখেছি। Jungle Book (animation) আর Bruce Leeর ছবি।
শীতের ছুটি পড়লে আমাকে উনি চিড়িয়াখানা দেখাতে নিয়ে যেতেন। বড়ো বড়ো জন্তুদের খাঁচার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতেন। প্রথমে বুঝতে পারতাম না। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, জন্তুরা হাঁটাচলা করলে অথবা খাবার চিবুলে, মাংসপেশীর যে সঞ্চলন হয়, তাই তিনি বসে বসে পর্যবেক্ষণ করেন। সেইগুলোই তার চিত্রে প্রকাশ পেয়েছে। সেই কারণেই তার Bruce Leeর ছবি এতটা ভালো লাগতো। Bruce Leeর শরীরের প্রত্যেকটা মাংসপেশী ছিল দেখার মতো, তার martial arts প্রসাদদার কমিক্স-এর হিরোর ওপর প্রভাব ফেলেছিল। প্রসাদদা শ্রী সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতেও প্রায়ই যেতেন। সিনেমা, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হত তাঁদের মধ্যে। বাবার মুখে শুনেছি যে শ্রী সত্যজিৎ রায় প্রসাদদাকে ‘হীরক রাজার দেশে’-এর Premierএ আমন্ত্রণ করেন। ছবি দেখে বাড়ি ফিরে বাবাকে বলেছিলেন। সত্যজিৎ রায় ছন্দ মিলিয়ে কথা বলাটা ওই ছবিতে প্রথম প্রচলিত করেন।
আমার বেড়ে ওঠার জীবনে প্রসাদদার প্রভাবটা ছিল অনেকটাই। ছোটো থাকাকালীন তা আমি অনুভব করতে পারিনি। পরিবারের কেউ না হয়েও, তিনি ছিলেন আমার খুবই প্রিয় ৷ আজ প্রায় ১৮ বছর বাদে তার বিষয়ে লিখতে বসে, নিজের ছেলেবেলাকার অনেক কথাই আমার মনে পড়ছে। তাঁর হাত ধরেই আমার প্রথম রং আর তুলি নিয়ে খেলা। তাঁর জন্য আমি শেষ সময়টাতে কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু একটাই মনের শান্তি যে ৩০ শে অক্টোবর ১৯৯৬ তার মৃত্যুশয্যার যখন কেউ তাঁর পাশে ছিল না, আমি তখন তাঁর পাশে ছিলাম। যতটুকু পারি ততটুকু করার জন্য।
আজ আমাদের মধ্যে প্রসাদদা নেই, কিন্তু তার কাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে দেখে খুবই ভালো লাগছে। শান্তনু ঘোষের জন্যই আজ এই লেখার মাধ্যমে আমি আমার ছোটোবেলার পুরোনো দিনগুলোতে ফিরে যেতে পেরেছি এবং বুঝতে পারছি যে আমি কতটাই ভাগ্যবান যে এক জন প্রখ্যাত শিল্পীকে আমি কাছের মানুষ হিসেবে পেয়েছিলাম।
সন্দীপক চন্দ
১০/১সি ইন্দ্র রায় রোড
কলকাতা – ৭০০ ০২৬
Leave a Reply