মন জোছনার কান্না / মোশতাক আহমেদ / প্যারাসাইকোলজি থ্রিলার
প্রথম প্রকাশ : মাঘ ১৪২৮ জানুয়ারি ২০২২
.
উৎসর্গ
মোঃ মতিয়ার রহমান।
বয়সে আমার থেকে ছোট, তুমি করেই বলি। ফেসবুকে তার সাথে আমার পরিচয়। আমার বই পড়ে। তার কাছ থেকে শুনলাম, ‘নিহির ভালোবাসা’ বই পড়ে সে ঐ বইটি এক পাঠিকাকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিল। ঐ বইয়ের ভালোলাগা এবং আলোচনার সূত্র ধরে দুজনের পরিচয় এবং তারপর পরিণয়। বইয়ের ভালোবাসা রূপান্তরিত হয় সংসার জীবনের বাস্তব ভালোবাসায়। বই বন্ধন সৃষ্টি করে, বন্ধন বজায় রাখে, অনুভব করে বড় ভালো লাগল আমার। আমি এতটাই অভিভূত ছিলাম যে, তাকে আমি আমার অন্যতম প্রিয় সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস ‘দ্যা নিউ ওয়ার্ল্ড’ এর মোড়ক উনোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। আর হ্যাঁ, আমন্ত্রণ জানাবই বা না কেন, তার মতো বইপাগল মানুষ যে বড় বিরল! তার কাছে আমার আশিটির উপর বই আছে এবং সবকটিই সে পড়েছে। অনেক অনেক শুভ কামনা মোঃ মতিয়ার রহমান। সাথে এক মহাকাশ ভালোবাসা। যদি পারতাম, তাহলে আপনাকে আর আপনার প্রিয়জনকে একদিন ‘নিহির ভালোবাসা’ উপন্যাসের লিপিল গ্রহে নিয়ে যেতাম। জীবন হোক সুন্দর, আনন্দের, ভালোবাসার এবং বইয়ের।
.
লেখকের কথা
প্যারাসাইকোলজি উপন্যাসের একটা সমস্যা হচ্ছে অনেকে ঘটনাপ্রবাহ বিশ্বাস করতে চান না। তারা বলেন অবাস্তব, অবিশ্বাস্য কাহিনি, তবে দারুণ উপভোগ্য। আমি বলি ঘটনাটা অবিশ্বাস্য বলেই উপন্যাসটা প্যারাসাইকোলজি ঘরানার। যাইহোক, উপন্যাসটা পাঠকের কাছে উপভোগ্য হলেই আমি সন্তুষ্ট। আর হ্যাঁ, এই উপন্যাসে ইকবাল নামক একটি ছেলের Supernatural ক্ষমতার বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তবে ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। ইচ্ছে করেই দেইনি। কারণ ইকবালের মতো চরিত্র নিয়ে পরে আরেকটি প্যারাসাইকোলজি উপন্যাস লিখব। পাশাপাশি এটা সত্য যে, উপন্যাসে কিছু লাইন এবং গানের কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। উপন্যাসের স্বার্থে এই পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি। সত্যি কথা বলতে কি, পাঠকদের আমি প্যারাসাইকোলজির এমন এক কাল্পনিক জগতে নিয়ে যেতে চাই যেন সমাধান খুঁজতে তারাই ডাক্তার তরফদার হয়ে হারিয়ে যেতে থাকেন অদেখা প্যারাসাইকোলজির অজানা রহস্যে। আর হ্যাঁ, উপন্যাসটির প্রথমে নাম রেখেছিলাম ‘স্বপ্নছায়া’। পরে নাম পরিবর্তন করে রাখি ‘মন জোছনার কান্না’। কারণ কী জানি না। আসলে প্যারাসাইকোলজির জগতে অনেক কিছুর ব্যাখ্যা থাকে না। উপন্যাসের এই নাম পরিবর্তনেরও কোনো ব্যাখ্যা নেই হয়তো। শুভ কামনা এবং সবার জন্য এক মহাকাশ ভালোবাসা।
রচনাকাল : ঢাকা, ১৫.০৬.২০২১– ১৬.০৮.২০২১
.
ডাক্তার তরফদার পরিচিতি
প্রফেসর তরফদার একজন অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার। সবাই তাকে চিনে ডাক্তার তরফদার নামে। পেশাদারি জীবনের পুরোটাই তিনি মানসিক হাসপাতালে মানসিক রোগীর চিকিৎসা প্রদান করে কাটিয়েছেন। অবসরের পর পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত পুরাতন আমলের বিশাল দোতলা বাড়িতে থাকেন। বাড়িতে তার সঙ্গী বয়স্ক করিম চাচা। করিম চাচা অসাধারণ ইএসপি (Extra Sensory Perception) ক্ষমতার অধিকারী। ডাক্তার তরফদারের কাছে যেসব রোগী আসে তাদের মধ্যে কিছু কিছু রোগীর কেইস হিস্ট্রি বড় রহস্যময় হয়। রহস্যময় এসব কেইস হিস্ট্রি এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে রচিত হয়েছে ডাক্তার তরফদার প্যারাসাইকোলজি সিরিজ।
***
ছোট্ট একটা টিনের ঘর। ভিতরে একজন মানুষকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার দুই হাতে শিকল, শিকল তার কোমরেও। মানুষটার নাম হামিদ। আজ প্রায় বিশ বছর ধরে সে এই ঘরে আছে।
ডাক্তার তরফদার হামিদের ঘরে প্রবেশ করলেন। হামিদ মাদুরের উপর দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে আছে। হাত দুটোকে এমনভাবে পেট আর হাঁটুর মাঝে রাখা, দেখে মনে হবে বুঝি শীতে কষ্ট পাচ্ছে খুব। অথচ ঘরের বাইরে এবং ভিতরে বেশ গরম।
ডাক্তার তরফদার মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো হামিদ?
হামিদ কোনো কথা বলল না।
শরীর কেমন তোমার?
হামিদ চোখ বড় বড় করে ডাক্তার তরফদারের দিকে তাকাল যেন খুব বিরক্ত সে।
ডাক্তার তরফদার হামিদের জন্য ডালিম নিয়ে এসেছেন। একটা বাটিতে ডালিমটা রেখে এগিয়ে দিলেন হামিদের দিকে। হামিদ ছোঁ মেরে নিল ডালিমটা। তারপর দাঁত দিয়ে কামড়ে উপর থেকে খানিকটা অংশ আলাদা করে ফেলল। তাতে বেরিয়ে এলো ডালিমের লাল রঙের কোয়া। মুখে দিয়েই কাঁদতে শুরু করল। এমন কান্না, যে কেউ দেখলে খুব মায়া অনুভব করবে হামিদের জন্য। ডাক্তার তরফদার এই মায়ার টানেই বারবার আসেন হামিদের কাছে।
ডাক্তার তরফদার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই বাঁশির একটা করুণ সুর শুনতে পেলেন। হামিদই বাজাচ্ছে বাঁশি। সুরটা হলো সেই গানের,
প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়’।
***
জেসমিন অনুভব করছে রেইনবো রেইন হোটেলে তার কক্ষে কেউ একজন। প্রবেশ করেছে। কারণ একটা ছায়া দেখতে পাচ্ছে সে। কার ছায়া ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে যে প্রবেশ করেছে সে পুরুষ। পোশাকটা পায়জামা-পাঞ্জাবিই মনে হচ্ছে। কক্ষের মধ্যে হালকা লাল আলো। স্পষ্ট হচ্ছে না চেহারা, ছায়ার চেহারা আসলে স্পষ্ট হয় না। এত রাতে হোটেলে তার কক্ষে প্রবেশের কারো কোনো অধিকার নেই। নিজের বিপদ অনুধাবন করছে সে। এই কক্ষটিতে সে একা, তার বান্ধবী ইলা ছিল গতকাল। ইলার আম্মা হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় চলে গেছে আজ। তখন সে একা হয়ে পড়ে। ভয় ভয় করছিল প্রথমে। স্টাডি ট্যুরের সমন্বয়কারী শিক্ষক রাবেয়া খাতুন নিজেই থাকতে চেয়েছিলেন তার সাথে। শিক্ষকের সাথে থাকলে অস্বস্তিতে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় একা থাকারই সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছে।
রাত কয়টা বাজে অনুমান করার চেষ্টা করল জেসমিন, কিন্তু পারল না। তার মনে আছে সাড়ে এগারোটার সময় শুয়ে পড়েছিল। ঘুমানোর আগে এক গ্লাস পানি খেয়ে ফেসবুকে কয়েকটা ছবি আপলোড করে। তারপর ঘুম
আসায় পড়তে শুরু করে ‘আনন্দভ্রমণ” নামক বই। ছবি দিয়ে ভরা ছিল বইটি। ছবিগুলো দেখতে আর ছবির নিচের লেখাগুলো পড়তে ভালো লাগছিল তার। ঐ বই পড়তে পড়তেই সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে। তারপর হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম ভাঙার কারণটা সে ঠিক বের করতে পারছে না। সেক্ষেত্রে কি ঐ ছায়াই তার ঘুম ভাঙিয়েছে? প্রশ্নটা নিজেই নিজেকে করল। কিন্তু উত্তর পেল না।
জেসমিন ঠিক বুঝতে পারছে না কীভাবে ছায়াটা তার কক্ষে প্রবেশ করল। ঘুমানোর আগে দরজা নিজে বন্ধ করেছে সে। জানালায় মোটা লোহার শিক। কোনো মানুষের পক্ষে আসা সম্ভব না। তাছাড়া বাইরে পাহারা আছে। হোটেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো। সেক্ষেত্রে কীভাবে সম্ভব হলো একটা ছায়ার ভিতরে আসা?
ডান কাত হয়ে শুয়ে আছে জেসমিন। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ছায়াটা এগিয়ে আসছে তার দিকে। হুবহু মানুষের মতো অবয়ব। তবে চোখ-মুখ দেখা যাচ্ছে না। ভূত-প্রেত কি না ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে ভূত-প্রেত বলতে যে কিছু নেই সে জানে। সেক্ষেত্রে ছায়াটা কীভাবে এখানে এলো ব্যাপারটা তার মাথায় ঢুকছে না। তবে ছায়ার মতলব যে ভালো না অনুধাবন করছে সে। কারণ ছায়াটা এখন একেবারে খাটের কাছে চলে এসেছে।
জেসমিন উপলব্ধি করছে তার এখন চিৎকার করা উচিত। কিন্তু কেন যেন চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে না। বরং ইচ্ছে করছে দেখতে কী করে ছায়াটা। ভয়ও করছে। কাঁপতে শুরু করেছে শরীর। কী অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি! কেন যেন মনে হতে লাগল, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সে, নিয়ন্ত্রণটা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে ছায়ার কাছে।
ছায়াটা এসে বসল একেবারে তার পাশে, খাটের উপর। তারপর একটা হাত দিয়ে স্পর্শ করল তার ঠোঁট। মুহূর্তেই যেন ভয়টা চলে গেল জেসমিনের। ভালোলাগার ভিন্ন এক আবেশে ভরে উঠল মনটা। এই ভালোলাগার আর-একটা কারণ হলো ছায়াটাকে সে চিনতে পেরেছে, ছায়ার চোখ মুখ নাক দেখা যাচ্ছে এখন। তবে অনেকটা মূর্তির মতো যেন। তারপরও অবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে ডাক্তার হাডসনই হবেন।
ডাক্তার হাডসনকে সত্যি মূর্তি মূর্তি লাগছে। তবে তিনি নড়াচড়া করতে পারছেন। ঝুঁকে এসে তার কানের কাছে স্পষ্ট বাংলায় বললেন, কেমন আছো জেসমিন?
জেসমিন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। শুধু কাঁপতে থাকল ঠোঁট দুটো।
তুমি আমার কাছে এসেছ, তাই না?
জেসমিন নিশ্চুপ।
আগামীকাল তমি আমার আরো কাছে আসবে, আমি জানি। যদি সত্যি তুমি আমাকে চাও, আগামীকাল আমাকে স্পর্শ করবে। তাহলেই আমি চিরতরে তোমার হয়ে যাব।
ডাক্তার হাডসনের শ্বাস-প্রশ্বাসের উত্তাপ অনুভব করছে জেসমিন। ডাক্তার হাডসন তার মুখটা আরো খানিকটা নামিয়ে এনেছেন। তার ঠোঁটের একেবারে সামনে এখন ডাক্তার হাডসনের ঠোঁট, একটা হাত স্পর্শ করেছে শরীর। তবে চেহারা সেই মূর্তির মতোই।
বিড়বিড় করে ডাক্তার হাডসন বললেন, তুমি সুন্দর জেসমিন, অপূর্ব সুন্দর!
জেসমিনের উচিত এখন ডাক্তার হাডসনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া। কিন্তু এই উচিত কাজটি তার করতে ইচ্ছে করছে না। উলটো ভালো লাগছে ডাক্তার হাডসনের উপস্থিতি, তার স্পর্শ, তার তপ্ত নিঃশ্বাস।
জেসমিন অনুভব করল তার নিজের মুখের উপর কয়েকটা চুল আছে, সরিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো। কেমন যেন সুড়সুড়ি কাটছে মুখে। জেসমিনের এই ভাবনা যেন বুঝতে পারলেন ডাক্তার হাডসন। হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন চুলগুলো। তারপর প্রথমে খুব আলতোভাবে, পরে গভীরভাবে চুমু খেলেন জেসমিনের ঠোঁটে। জেসমিনের ঠোঁট দুটো এখন ডাক্তার হাডসনের ঠোঁটের মধ্যে। দারুণ এক শিহরন অনুভব করছে জেসমিন। আগে কোনোদিন কোনো পুরুষ তাকে চুমু দেয়নি। আজই প্রথম, এই প্রথম জীবনে প্রথম! পুরুষের স্পর্শ একজন নারীর জন্য যে কতটা শিহরনের আর ভালোলাগার, কল্পনাও করতে পারেনি আগে। মনে হচ্ছে, ভালোলাগার এই আবেশে পূর্ণতা আনতে ডাক্তার হাডসনকে সে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু পারছে না। শরীরে একটু শক্তিও নেই। ডাক্তার হাডসন যেন চেতনানাশক দিয়ে তাকে অবশ করে রেখেছেন, নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন তার শরীরের। এখন সে ভেসে বেড়াচ্ছে ডাক্তার হাডসনের ভালোবাসার আবেগে। তার শরীরের প্রত্যেকটা লোমকূপ উপভোগ করছে ভালোবাসার আনন্দ। এক জোড়া নর-নারীর পরস্পরের কাছে আসা, পরস্পরের ঐকান্তিক ভালোবাসার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া যে এতটা স্বর্গীয় বাস্তবে উপভোগ না করলে কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না।
একসময় দুজনই নিস্তেজ হয়ে এলো। একটু সময় নিয়ে ডাক্তার হাডসন বিড়বিড় করে বললেন, আ…আগামীকাল থাকবে লাল শাড়িতে, অপেক্ষায় থাকব তোমার স্পর্শের, প্রিয়তমা আমার।
কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার হাডসন। কক্ষটা এখন লাল আলোয় উদ্ভাসিত। সেই আলোর মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছেন তিনি। জেসমিন অস্থির হয়ে উঠল, সে যেতে দিতে চাচ্ছে না ডাক্তার হাডসনকে। তাই সিদ্ধান্ত নিল ডাক দেবে। কিন্তু পারল না। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। শরীর যেন এখনো অবশ হয়ে আছে। তবে ভালোলাগার একটা দারুণ অনুভূতি ছড়িয়ে রয়েছে সমস্ত মন আর শরীরে।
জেসমিন, জেসমিন…
কেউ একজন ডাকছে।
জেসমিন, জেসমিন!
এবার দরজায় টোকার শব্দ শুনতে পেল জেসমিন, গলার স্বরটা তার বান্ধবী শান্তার। উঠে বসতে আবার দরজায় টোকার শব্দ হলো। ঘড়ি দেখল জেসমিন, সকাল পাঁচটা।
দরজা খুলতে শান্তা বলল, সমুদ্রপাড়ে যাবি না? সূর্যোদয় দেখবি বলেছিলি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
তাড়াতাড়ি চল তাহলে। অন্যরা নিচে নেমে গেছে। আমি আসছি।
শান্তা চলে গেলে বারান্দায় এলো জেসমিন। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়। অপূর্ব লাগছে দেখতে। কিন্তু তার মন যেন হারিয়ে যাচ্ছে ডাক্তার হাডসনের এই কক্ষে প্রবেশের ঘটনার মধ্যে। যদিও সে বুঝতে পারছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ছিল শুধুই স্বপ্ন, তারপরও তার মনে বলছে কোথাও যেন সত্যতা আছে। তার জীবনে ডাক্তার হাডসনের উপস্থিতি একেবারে মিথ্যা হতে পারে না।
*
জেসমিন হাত-মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিল। যখন বাইরে বের হবে তখন নজর পড়ল খাটের উপর পড়ে থাকা ‘আনন্দভ্রমণ’ বইটির উপর। বইয়ের যে পাতা খোলা রয়েছে সেখানে ডাক্তার হাডসনের একটি ছবি দেখা যাচ্ছে। রাতের স্বপ্নের ডাক্তার হাডসন আর ‘আনন্দভ্রমণ’ বইয়ের ডাক্তার হাডসন একই ব্যক্তি। ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে কিছু তথ্য আছে বইটিতে। গতকাল পড়ে শেষ করতে পারেনি। সিদ্ধান্ত নিল আজ ফিরে আসার পর পড়বে।
সমুদ্রের পাড়টা সত্যি সুন্দর লাগছে জেসমিনের। আগে কখনো সে সমুদ্রে আসেনি। এই প্রথম। তাও তার বাবা আসতে দিতে চাননি। অনেকটা জোর করে এসেছে সে, কলেজের সহযোগী অধ্যাপক রাবেয়া খাতুনকে কথা বলতে হয়েছে তারা বাবার সাথে। স্টাডি টুরের এই সুযোগ আর পাবে না, তাই কিছুতেই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায়নি সে। সে পড়াশুনা করে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলা মডেল কলেজে। এখানে ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। ক্লাসে মোট ষাটজনের মতো ছাত্র ছাত্রী আছে। ক্লাস থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কক্সবাজার ভ্রমণের। মোট ত্রিশজন এসেছে তারা। এগারোজন মেয়ে আর ষোলোজন ছেলে, শিক্ষক এসেছেন তিনজন। তাদের ক্লাসের মোট বাইশজন এসেছে। গাড়িতে সিট বেশি থাকায় পরে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার থেকে নেয়া হয়েছে পাঁচজনকে। চট্টগ্রামে অবস্থান করেছে একদিন। ঘুরে দেখেছে পতেঙ্গা, ইপিজেড আর চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেটেরি। গতকাল তারা এসেছে কক্সবাজারে। আজ এবং আগামীকাল থেকে ফিরে যাবে পরশুদিন। এখন পর্যন্ত ভালো লাগছে জেসমিনের। বুঝতে পারছে স্টাডি টুরে না এলে বড় ভুল হয়ে যেত।
সকালের সমুদ্র দেখে দারুণ ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি হলো জেসমিনের মধ্যে। সমুদ্র যে এত সুন্দর এখানে না এলে বুঝতে পারত না। সকাল আটটা পর্যন্ত তারা সমুদ্র তীরে থাকল, বালু নিয়ে খেলল, ছবি তুলল, অনেক অনেক মজা করল। তারপর এলো নাস্তা খেতে। শান্তা বসেছে তার সামনে। বলল, কীরে জেসমিন, ঘুম হয়েছে কেমন রাতে?
ভালো।
একা একা ভয় পাসনি তো?
না। শুধু…
শুধু কী? একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম।
শান্তা চোখ কুঁচকে বলল, কীসের স্বপ্ন?
একটা ছায়া।
ছায়া!
থাক, পরে বলব। আজ আমাদের রুটিন কী? মানে কোথায় কোথায় ঘুরতে যাব?
নাস্তা শেষে যার যার কক্ষে চলে যাব। তারপর সাড়ে নয়টার সময় নিচে নেমে আসব। প্রথমে যাব কলাতলী বিচে। তারপর যাব ইনানী বিচ। এখান থেকে নাকি বেশ দূর ইনানী বিচ। মেরিন ড্রাইভ ধরে যেতে হবে। সেখান থেকে হাডসন হিলে।
হাডসন হিলটা কী?
‘আনন্দভ্রমণ’ বইটা পড়িসনি?
না, শেষ করতে পারিনি। তবে ছবিগুলো দেখেছি।
বইটিতে লেখা আছে। ইনানী বিচের পর বেশ দূরে আর-একটা জায়গা। হাডসন হিল মূলত একটা পাহাড়। ওখানে ডাক্তার হাডসন নামের এক ব্রিটিশ ডাক্তার এসেছিলেন। তার সাথে তার স্ত্রীও এসেছিল। নাম সম্ভবত এলিজা। এলিজার মৃত্যুর পর তিনি থেকে যান ঐ পাহাড়ে। তার নামের সাথে মিলিয়ে পাহাড়টার নাম রাখা হয়েছে হাডসন হিল। ওখানে তার নাকি একটা মূর্তি আছে, ঐ মূর্তিটা দেখতে যাব আমরা। আর যেহেতু জায়গাটা স্মৃতিবিজড়িত, ছবিও তুলব। তবে হাডসন হিল এখনো অতটা পরিচিতি লাভ করেনি। ধারণা করা হচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
কথাগুলো শুনছিল আর নিজের মধ্যে অন্যরকম এক শিহরন অনুভব করছিল জেসমিন। গতকাল রাতের স্বপ্নে দেখা ডাক্তার হাডসনের কথা বলছে শান্তা। ঘুমানোর আগে ‘আনন্দভ্রমণ’ বইটিতে ডাক্তার হাডসনের পাথুরে মূর্তির ছবিটা দেখেছিল সে। বয়স ত্রিশ-বত্রিশ মনে হয়েছিল। একসময় ছবি দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়ে আর স্বপ্নটা দেখে। স্বপ্নটা অপছন্দের হওয়ার কথা, কারণ ডাক্তার হাডসন তার ঠোঁটে চুমু দিয়েছে। এর আগে কখনো কেউ তাকে চুমু দেয়নি। এক্ষেত্রে ডাক্তার হাডসনের উপর তার রাগ হওয়ার কথা, কিন্তু রাগ উঠেনি। বরং ডাক্তার হাডসনের স্বল্পসময়ের উপস্থিতির আনন্দটা ছিল অসাধারণ।
কী ভাবছিস?
শান্তার প্রশ্নে বাস্তবে ফিরে এলো জেসমিন। বলল, না কিছু না।
অবশ্যই কিছু ভাবছিলি, কী বিষয় বল তো?
প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জেসমিন বলল, তোর কেমন লাগছে, তাই বল।
শান্তা মুখের মধ্যে খানিকটা রুটি ঢুকিয়ে বলল, দারুণ, দারুণ। না এলে কী যে মিস করতাম! আমি আগেও একবার এসেছি কক্সবাজারে। তবে এবারের আসাটা একেবারে অন্যরকম। কারণ সাথে ক্লাসের সবাই আছে।
তুই ঠিকই বলেছিস। এজন্য আনন্দটাও বেশি। বিকেলে কী প্রোগ্রাম?
হাডসন হিল থেকে ফিরে এসে যে যার মতো খেয়ে নেবে। তারপর ফ্রি টাইম, অর্থাৎ ঘোরাঘুরি। তবে রাত আটটার পর বিচে থাকতে নিষেধ করে দিয়েছেন ম্যাডাম। সাড়ে আটটার সময় সকলের হাজিরা নেবেন তিনি, এইখানে। তারপর রাতের খাবার খেতে হবে। আগামীকাল যাব মহেশখালী। ওখানে একটা বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট আর ফিশ প্রসেসিং ফ্যাক্টরি ভিজিট করব। ফিরতে ফিরতে বিকেল হবে।
মহেশখালী যেতে হলে তো স্পিডবোটে যেতে হবে, তাই না?
ট্রলারেও যাওয়া যাবে। ট্রলারে সময় কিছুটা বেশি লাগে। আমরা খুব সকালে রওনা দেব। ফিশারি ঘাটে প্রথমে মাছ দেখব। তারপর ট্রলারে উঠব। কক্সবাজার আর মহেশখালীর মাঝামাঝি স্থানে সমুদ্রে নাস্তা করব।
ওয়াও! ভাবতেই দারুণ লাগছে।
আমিও বিশ্বাস করছি বড় আনন্দের হবে টুরটা। চল, উঠি।
চা খাবি না?
শান্তা মাথা নেড়ে বলল, আমি চা খাই না।
কেন?
কালো মানুষ আমি, তোর মতো ধবধবে ফর্সা না। চা খেয়ে আর কালো হতে চাই না।
ভ্রু কুঁচকে জেসমিন বলল, চা খেলে মানুষ কালো হয় কে বলল তোকে? আজ খেয়ে নে, একদিন খেলে কিছু হবে না।
ঠিক আছে, তুই যখন বলছিস এক কাপ না হয় খেলামই।
কথা বলতে বলতে চায়ের কাপে চুমুক দিল শান্তা।
মিনিট দশেক পর রুমে ফিরে এলো জেসমিন। খাটের উপর ‘আনন্দভ্রমণ” বইটা পড়ে আছে। পাতলা একটা বই। তবে টুরিস্টদের জন্য ভালো, বিশেষ করে যারা কক্সবাজার আসে। কারণ বইটি মূলত কক্সবাজারের টুরিস্ট স্পটগুলো নিয়ে লেখা।
বইটা হাতে তুলে নিয়ে ডাক্তার হাডসনের ছবিটা আবারো দেখল সে। ছবিটা মূলত তার মূর্তির। বিশেষত্ব হলো বিদেশি হওয়া সত্ত্বেও পায়জামা পাঞ্জাবি পরা ডাক্তার হাডসন। আর চেহারার মধ্যে কেমন যেন মায়া মায়া ভাব আছে। যে কেউ দেখলে পছন্দ করবে মূর্তির ছবিটা। জেসমিন নিজেও অনুভব করল, তার কেন যেন ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে এবং বারবার তাকাচ্ছেও। ছবিটার নিচে লেখা,
‘ডাক্তার হাডসন ছিলেন একজন পেশাদার ব্রিটিশ ডাক্তার। ১৯৪১ সাল বা কাছাকাছি সময়ে কক্সবাজার এলাকায় আসেন। তার সাথে তার স্ত্রী এলিজাও ছিলেন। জাহাজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তারা কক্সবাজারের মনখালি এলাকায় একটা বড় পাহাড়ের পাদদেশে জাহাজ থেকে অবতরণ করেছিলেন। তার স্ত্রী সাগরে ডুবে মারা যান ওখানে। স্ত্রীর প্রতি তীব্র ভালোবাসার কারণে নীল চোখের ডাক্তার হাডসন আর ইংল্যান্ডে ফিরে যাননি। তিনি যে পাহাড়ের পাদদেশে থাকতেন তার নামে ঐ পাহাড়টির নাম রাখা হয়েছে হাডসন হিল। গ্রামের মানুষদের তিনি ফ্রি চিকিৎসা দিতেন। এজন্য তার সুনাম ছিল। কথিত আছে, অবসর সময়ে তিনি পাথর কেটে কেটে একটা মূর্তি তৈরি করেছিলেন। অবশ্য কেউ কেউ বলে মূর্তিটি অন্য কেউ তৈরি করেছিল। যাইহোক, পরে তিনি ইংল্যান্ড ফিরে গেছেন। অনেকে বিশ্বাস করে ইংল্যান্ডে মৃত্যুর পর তার আত্মা নাকি প্রায়ই এখানে আসে। সেই আত্মা স্থানীয় মানুষ দেখেছে। অবশ্য এই তথ্যের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।’
জেসমিন পৃষ্ঠা উল্টে দেখে আর কোনো উল্লেখযোগ্য তথ্য নেই ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে। পরের পৃষ্ঠায় টেকনাফ নিয়ে লেখা। ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে হঠাৎই তার কেন যেন জানতে ইচ্ছে করছে। ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে এতটা ভালোবাসতেন যে স্ত্রীর মৃত্যুর পর রয়ে গেছেন এই দেশে, সত্যি বিস্ময়কর। ডাক্তার হাডসনের যে ভালোবাসায় ভরা একটা মন ছিল, উপলব্ধি করছে জেসমিন! এমন ভালোবাসা কোন নারী না চায়! তার স্ত্রী এলিজা ছিল সত্যিই সৌভাগ্যবান।
—
*
কলাতলী বিচে বেশিক্ষণ থাকল না জেসমিন আর তার ক্লাসের সবাই। চলে এলো ইনানী বিচে। ঘণ্টাখানেক সময় লেগেছে আসতে। খুবই ভালো লাগল জায়গাটা। সাগরের মধ্যে অনেক কোরাল পাথর। কক্সবাজার বিচে এত সুন্দর পাথর নেই। পাথরগুলোর উপর দাঁড়িয়ে পা ভিজাতে যে কারোরই ভালো লাগবে। তাছাড়া বিচটা বেশ প্রশস্ত। পর্যটকের ভিড়ও কম। অনেকে আবার পানিতে নেমে পড়েছে। সবাইকে ডাক দিলে উঠতে শুরু করল গাড়িতে।
গাড়িতে উঠার সময় রাবেয়া ম্যাডাম বললেন, তুমি শাড়ি পরে এসেছ কেন জেসমিন?
জেসমিন বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, আমি আসলে ম্যাডাম বুঝতে পারিনি।
এটা কোনো কথা হলো! এখানে এমন পোশাক পরা উচিত যেন তুমি সহজে চলাফেরা করতে পার, তার উপর আবার লাল রং।
লাল রঙে ছবি তুললে ভালো আসবে।
ছবি ভালো আসবে কি না জানি না, কিন্তু তুমি তো নামতে পারলে না পানিতে। সবাই কম-বেশি নেমেছে।
গোড়ালি পানিতে নেমেছিলাম। ভালো লেগেছে।
সমুদ্রে এসে যদি পানিতেই না নামো তাহলে আর লাভ কী?
এর পরেরবার নামব ম্যাডাম।
সুযোগ সবসময় আসে না। সুযোগের সদ্ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ, বুঝেছ? এখন থেকে সবসময় সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। আগে থেকে সবকিছুর পরিকল্পনা করে রাখবে।
জি ম্যাডাম অবশ্য আমার ভালোই লেগেছে।
তুমি সন্তুষ্ট হলেই হলো। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে তুমি ভুল করেছ। যাইহোক, সিটে গিয়ে বসো। গাড়ি ছেড়ে দেবে এখনই।
গাড়িতে বসতে ফোন এলো জেসমিনের। আগে জেসমিনের ফোন ছিল না। কলেজে উঠার পর কিনেছে একটা। প্রথমে তার বাবা কিনে দিতে চাননি। অনেকটা জোর করেই কিনেছে সে। মোবাইল ছাড়া জীবন যেন এখন অচল, তাছাড়া নিজেকে আধুনিক মনে হয় না।
জেসমিন ফোন ধরে দেখল তার মা নিলুফার ইয়াসমিন ফোন করেছেন। ফোন ধরতে নিলুফার বললেন, জেসমিন কী খবর তোর?
ভালো আছি মা।
সকালে ফোন করলি না যে!
গাড়িতে বসেই করতাম। আর এখনই তুমি ফোন করেছ।
বড় চিন্তায় আছি তোকে নিয়ে। তোর বাবা তো সকালে আমাকে কিছুক্ষণ বকাবকি করল, কেন তাকে শিক্ষাসফরে যেতে দিলাম!
তুমি চিন্তা কোরো না মা। আমরা সবাই ভালো আছি।
নাস্তা করেছিস?
হ্যাঁ, করেছি।
রাতে রুমে একা ঘুমাবি না। সাথে কাউকে রাখবি। হোটেল-ফোটেলে বিশ্বাস নাই। আর নতুন কারো সাথে মিশবি না।
আচ্ছা মা। আর আমি একা ঘুমাচ্ছি না। সাথে কেউ না কেউ থাকে। তুমি অতটা ভাববে না।
কেন যে ভাবি বুঝবি না, মা হলে বুঝতি। আবারো বলছি, সাবধানে থাকিস।
আচ্ছা মা।
ঠিক আছে।
লাইন কেটে দিলেন নিলুফার। জেসমিন এবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ডান পাশে সমুদ্র আর বাম পাশে পাহাড়। দেখার মতো দৃশ্য। যতই সামনের দিকে এগোচ্ছে ততই প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন বাড়ছে। বাড়ছে সবুজের ঘনত্বও। মানুষের চলাচল তুলনামূলকভাবে কম। সমুদ্রতীরে মাঝে মাঝে মাছ ধরা নৌকা দাঁড়িয়ে আছে, পাশেই বশের উপর শুকাতে দেয়া হয়েছে জাল। এমনই একটা জায়গায় ছবি তোলার জন্য থামল সবাই।
শাড়ি পরে কয়েকটি ছবি তোলার ইচ্ছে ছিল জেসমিনের। কিন্তু সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। শান্তাসহ সবাই উঠে পড়েছে নৌকার উপর। সে উঠতে পারেনি, কারণ শাড়ি পরা। শাড়ি পরে এসে কী যে ভুল করেছে অনুধাবন করছে সে। তাই নিজে নিজেই সেলফি তুলতে লাগল। হঠাৎই কাউকে বলতে শুনল, আমি তোমার ছবি তুলে দেব আপু?
তাকিয়ে দেখে জেহান। তাদেরই ক্লাসের ছেলে। থাকেও তাদের বাড়ির পাশে। জেহানরা অবশ্য অনেক ধনী, তার বাবার অনেক বড় ব্যবসা রয়েছে। খুব ভদ্র, নম্র আর বিনয়ী ছেলে জেহান। দেখতেও সুন্দর, ফর্সা। তাদের বাড়িতে মাঝে মাঝেই আসে। ফার্স্ট ইয়ার থেকে যে কয়েকজনকে শিক্ষাসফরে আনা হয়েছে তাদের মধ্যে জেহান একজন। সেও অনেকটা জোর করে এসেছে। তাকে প্রথমে আসতে দিতে চায়নি তার বাবা-মা। কিন্তু নাছোড়বান্দা হওয়ায় বাড়ি থেকে অনুমতি পেয়েছে।
জেসমিন মোবাইল ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল, তাহলে তো ভালোই হয়, দাও ছবি তুলে দাও।
আমার ক্যামেরায় তুলে দেই, রেজুলেশন ভালো, ছবি সুন্দর আসবে।
ঠিক আছে, ছবিগুলো আমাকে পাঠিয়ে দেবে কিন্তু।
আচ্ছা আপু।
জেহান অনেকগুলো ছবি তুলল। ছবিগুলো আসলেই সুন্দর হয়েছে, খুশি হলো জেসমিন। বলল, ধন্যবাদ তোমাকে জেহান।
আপু, তোমার সাথে আমি একটা ছবি তুলব।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, আজ তোমাকে সত্যি খুব সুন্দর লাগছে, বিশেষ করে লাল শাড়িতে।
তোমার কথা শুনে ভালো লাগল। সবাই আমাকে উলটো বকাবকি করছে, কেন আমি লাল শাড়ি পরে এসেছি। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও খারাপ লাগছিল কেমন লাগছে আমাকে জানতে। একমাত্র তুমিই বললে। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
এরমধ্যে শান্তা এসে উপস্থিত। জেসমিন অনুরোধ করলে শান্তা জেহান আর জেসমিনের কয়েকটা ছবি তুলে দিল। তারপর আবার সবাই উঠে পড়ল বাসে। চিত্তার করছেন রাবেয়া ম্যাডাম, খানিকটা রেগেও গেছেন। কারণ ত্রিশ মিনিট দেরি হয়ে গেছে এর মধ্যে।
গাড়িতে উঠার পর রাবেয়া ম্যাডাম সবার উদ্দেশে বক্তব্য দিলেন। বক্তব্যের সারমর্ম নিম্নরূপ,
তোমরা সবাই জানো প্রতি বছর আমরা আমাদের কলেজ থেকে শিক্ষা সফরে আসি। শিক্ষা সফর মূলত বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য। পাশাপাশি দর্শনীয় স্থান আমরা ভ্রমণ করি এবং আনন্দ উপভোগ করি। এই আনন্দ উপভোগ মানে ইচ্ছামতো চলা নয়। তোমাদের অবশ্যই নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে এবং নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। আমি সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে বলছি, তোমরা কেউ কেউ আমাদের আচরণবিধি বা নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করছ। এরকম করলে ভবিষ্যতে শিক্ষাসফর বাতিল হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে তোমরা পরবর্তী নবীন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটা পথ বন্ধ করে দিয়ে যাচ্ছ বলে সবাই বিশ্বাস করবে। তোমরা জানো, আমরা কাউকে জোর করে এই শিক্ষা সফরে আনিনি। তোমরা স্বেচ্ছায় এসেছ। আমরা বিশ্বাস করি, তোমরা দায়িত্বশীল হবে এবং এমন কোনো আচরণ করবে না যার জন্য আমাদের বিব্রত হতে হয়। তোমাদের প্রতি কড়া নির্দেশ, এখন থেকে তোমরা সময় মেনে চলবে এবং যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে শতভাগ পালন করবে। অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তোমাদের কারো জন্য যেন অন্যরা বিপদগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে লক্ষ রাখবে। আর যে হাডসন হিলে আমরা যাচ্ছি সেখানে সবাই দলবদ্ধভাবে থাকবে। জায়গাটা নির্জন। কেউ ভুলেও দলছুট হবে না। যাইহোক, আমি আর কিছু বলতে চাচ্ছি না। শুধু এটুকু বলছি, তোমরা বড় হয়েছ। কেউ এমন কিছু করবে না যাতে এই শিক্ষা সফর অন্যদের জন্য কষ্টের, চিন্তার কারণ হয়ে পড়ে। আর সবাই নিজ নিজ অভিভাবকের সাথে যোগাযোগ রাখবে। ইতিমধ্যে আমি দুজন অভিভাবকের ফোন পেয়েছি। তারা চিন্তায় আছেন কারণ তোমাদের ফোনে পায়নি। এমন যেন না হয়। তোমাদের পিতা মাতা অভিভাবক যেন সবসময় তোমাদের পায়। আমাদের শিক্ষা সফর আরো সুন্দর আর আনন্দময় হোক এই আশা ব্যক্ত করছি।
কথা শেষ হলে রাবেয়া ম্যাডাম সামনের সিটে বসে পড়লেন। জেসমিনের পাশে বসেছিল শান্তা। সে নড়েচড়ে বসে বলল, ম্যাডাম বোধহয় একটু বেশিই রেগে গেছেন।
না রেগে উপায় আছে! নৌকা থেকে কেউ নামতেই চাচ্ছিল না।
আসলে অনেকের কাছে জায়গাটা নতুন, আর নৌকাটা কত বড় দেখেছিলি! এজন্য কেউ নামতে চায়নি।
জেসমিন বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে যা কিছু আছে সবই আমাদের জন্য নতুন। তাই বলে এত সময় ধরে নৌকা দেখতে হবে, নৌকায় থাকতে হবে?
তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। হাডসন হিলে আবার কী হয়, কতক্ষণ লাগে কে জানে?
এখন আর কিছু হবে না। ম্যাডাম যেহেতু কড়াভাবে বলে দিয়েছেন, কেউ আর অহেতুক দেরি করবে না। তাছাড়া…।
তাছাড়া কী?
তখন ক্ষুধাও লেগে যাবে সবার। দেখবি তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে চাইবে।
মনে হয় না।
কেন?
শান্তা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, এত সুন্দর জায়গা সব। আজ প্রকৃতির সৌন্দর্যের কাছে ক্ষুধা পরাজিত হবে। দেখবি আবার সাগরে লাফালাফি শুরু করেছে সবাই।
তাহলে তো বকা খেতেই হবে।
একদিন না হয় বকা খেলামই। প্রত্যেকদিন তো আর কক্সবাজারে আসা হবে না, আসা হবে না হাডসন হিলেও।
জেসমিন আর কিছু বলল না, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই থাকল। সমুদ্র দেখা যাচ্ছে, অপূর্ব সুন্দর সমুদ্র। এই সমুদ্র কার না দেখতে ভালো লাগে। জেসমিন ভাবল, ইস! এই সমুদ্রের পাশে যদি আজীবনের জন্য থেকে যাওয়া যেত কতই না আনন্দ হতো!
*
গাড়ি থেকে নেমে হাতের ডানে তিন শ গজের মতো হাঁটতে হয়। তারপর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরু একটা রাস্তা বের হয়ে গেছে দুই পাহাড়ের মাঝ বরাবর। ঐ রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে বাম পাশে অপূর্ব সুন্দর হাডসন হিল।
হাডসন হিল দেখে তো অবাক সবাই। এত সুন্দর! পাহাড়টা বেশ উঁচু সামনে ছোট উচ্চতার কিছু ঝোঁপ আছে। তারপর বিচ এবং সাগর। বিচ যেখানে শেষ সেখানে একটা বিশাল পাথর। এক তলা বাড়ির সমান উঁচু। ঐ পাথরের উপরে উঠলে কার না ভালো লাগবে? জোয়ারের সময়ও ডুবে না পাথরটা। পাহাড়ের দক্ষিণে আরো একটা ছোট পাহাড়। পুরোটাই নারকেল গাছে ঢাকা। জানতে পারল নাম ‘কোকোনাট হিল’। তবে এখন সবাই এগোচ্ছে পাথরটার দিকে।
জেসমিনদের সাথে অল্পবয়সি একজন গাইড এসেছে। সে জানাল, ঐ পাথরটার উপর ডাক্তার হাডসন পূর্ণিমা রাতে বসে থাকতেন। উপভোগ করতেন সমুদ্র আর জোছনার সৌন্দর্য। পাথরটার নাম তিনি রেখেছিলেন ‘এলিজা স্টোন’। কারণ তার স্ত্রীও খুব পছন্দ করতেন পাথরটা। তবে
অনেকে পাথরটাকে বলে ‘নীল পাথর’।
পাথরের উপর খোদাই করে এলিজা নামটা লেখা আছে। উপরে উঠার জন্য পাশে আছে আরো ছোট ছোট তিনটা পাথর। ঐ পাথরগুলোতে পা রেখে উপরে উঠে গেল অনেকেই। ছবি তুলতে শুরু করল। রাবেয়া ম্যাডাম বরাবরের মতোই চিৎকার করতে লাগলেন, সাবধান, কেউ পাথরের ফাঁকে পা ফেলবে না, খবরদার দলছুট হবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সবাই ব্যস্ত ক্যামেরায় ছবি তুলতে। আর মুখে সবার একটাই কথা, কী সুন্দর! কী সুন্দর!
গাইড এবার সবাইকে ডাকল হাডসন গুহায় যাওয়ার জন্য। পাহাড়ের ঠিক নিচে, বিচ থেকে ফুট তিনেক উপরে গুহাটা। বেশ চওড়া। লম্বায় এক শ ফুট আর ভিতরের দিকে চওড়া ষাট ফুটের মতো। পাহাড়ের নিচে এত বড় একটা গুহা কীভাবে তৈরি হলো এটা এক বড় রহস্য। একে একে সবাই গুহার ভিতরে প্রবেশ করতে শুরু করল। জেসমিন দেখল, গুহাটাকে বাইরে থেকে যত বড় মনে হয়, ভিতরে আসলে আরো বড়। একেবারে মাথায় একটা মূর্তি।
মর্তিটার উচ্চতা দশ ফুটের মতো হবে। দেখে বড় অবাক হলো জেসমিন, এই মূর্তিটাকেই গতকাল সে স্বপ্নে দেখেছিল। তার কক্ষে এসেছিল মূর্তিরূপী ডাক্তার হাডসন। বলেছিল লাল শাড়ি পরে আসতে আর স্পর্শ করতে তাকে। তার খুব ইচ্ছে করছে মূর্তিটাকে ধরার। কিন্তু এই মুহূর্তে সম্ভব না, কারণ গাইড সবার উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছে।
গাইড বলছে, এই মূর্তিটা ডাক্তার হাডসনই তৈরি করেছিলেন। জানা যায় যে, তিনি তার স্ত্রী এলিজার একটি মূর্তিও তৈরি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত করেননি। কেন করেননি তা এখনো রহস্যাবৃত। লোকমুখে শোনা যায় তার বাস্তব চেহারা আর এই মূর্তির চেহারা হুবহু একইরকম। এতে বোঝা যায় মূর্তি তৈরিতে তার খুব ভালো হাত ছিল। তিনি এই গুহাটাতেই বসবাস করতেন। গুহাটাকে হাডসন হাউসও বলা হয়। এখানে বসেই মানুষের চিকিৎসা করতেন তিনি।
একজন ছাত্রী প্রশ্ন করল, এখানে তো মানুষজন নেই। কার চিকিৎসা করতেন?
আপনি ঠিকই বলেছেন। এখনো এই জায়গাটতে তেমন বসতি গড়ে উঠেনি, আর এখন থেকে সত্তর-আশি বছর আগে মানুষ থাকার তো প্রশ্নই উঠে না। কথিত আছে তিনি সপ্তাহে তিন দিন ঘোড়ায় করে উখিয়া বাজারে চলে যেতেন। উখিয়া বাজার শত বছরের পুরাতন বাজার। ওখানে মানুষজন আসত। ওখানেই রোগী দেখতেন তিনি। ওষুধ আনতেন টেকনাফ কিংবা চট্টগ্রাম থেকে। এজন্য তার লোক ছিল। মাঝে মাঝে উখিয়াতেই রাত যাপন করতেন। তারপর চলে আসতেন এই গুহায়। ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়তে থাকলে মানুষজন এখানেও আসতে শুরু করে।
এবার এক জুনিয়র ছাত্র প্রশ্ন করল, তিনি এখানে কীভাবে এসেছিলেন?
কথিত আছে জাহাজটা সামনের ঐ সাগরে ঝড়ের কবলে পড়েছিল। ডাক্তার হাডসনসহ অনেকে নৌকায় করে তীরে আসেন। অন্যরা চলে গেলেও ডাক্তার হাডসন আর তার স্ত্রী থেকে যান এখানে। পরে তার স্ত্রী সাগরে ডুবে মারা গেলে তিনিও আর ফিরে যাননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এলিজা মারা যায়নি। বরং বিশ্বাস করতেন কোনো না কোনোদিন ফিরে আসবে তার প্রিয়তমা স্ত্রী।
তারপর কী হলো?
প্রায় বারো-তেরো বছর পর হঠাৎই তিনি সবার অলক্ষ্যে ইংল্যান্ড চলে যান। তবে স্ত্রীর প্রতি তীব্র ভালোবাসার কারণে তিনি ফিরে আসেন, মানুষ হিসেবে নয়, আত্মা হিসেবে। অনেকে সেই আত্মা দেখেছে। যাইহোক, সময় যত পার হতে থাকে মানুষের মন থেকেও মুছে যেতে থাকে ডাক্তার হাডসনের স্মৃতি। তবে গত কয়েক বছর ধরে আবার আলোচনায় এসেছেন তিনি। মূল কারণ পর্যটকদের আগমন এবং ফেসবুকে হাডসন হিলের সংবাদের বিস্তৃতি।
গত এক বছরে কেউ কি ডাক্তার হাডসনের আত্মা দেখেছে এই পাহাড়ে?
দুই মাস আগে একজন মাঝবয়সি নারী দেখেছে বলে দাবি করেছে। সে যখন গুহায় প্রবেশ করে তার স্বামী ছিল বাইরে। দেখেছিল কাফনের কাপড় পরা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে গুহার ভিতর। তার চোখের দিকে নাকি তাকিয়েও ছিল। নীল চোখ জ্বলজ্বল করছিল। ভয়ে অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল তার। পরে অবশ্য তারা তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যায়। যাইহোক, তোমাদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে এটা সত্য হাডসন হিল এক রহস্যময় জায়গা, আমি নিজেও বিশ্বাস করি ডাক্তার হাডসনের আত্মা এই হাডসন হিলে আছে। তবে এখন পর্যন্ত ডাক্তার হাডসন কিংবা তার আত্মা কারো কোনো ক্ষতি করেছে বলে জানা যায়নি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এই এলাকায় ডাক্তার হাডসন সবার কাছে একজন ভালোবাসার মানুষ হিসেবে পরিচিত। যাইহোক, এখন তোমরা ছবি তুলে নাও। তারপর আমরা বের হব।
শুরু হয়ে গেল ছবি তোলার হিড়িক। সবাই ডাক্তার হাডসনের মূর্তির সাথে ছবি তুলতে চায়। জেসমিন অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকল। সে দেখতে লাগল মূর্তিটাকে, আর অপেক্ষা করতে থাকল ভিড় কমার জন্য। মূর্তিটা আসলেই সুন্দর। হঠাৎ তার মনে হলো মূর্তিটা যেন নড়ে উঠল। চমকে উঠল সে। ভালোমতো তাকাল মূর্তিটির দিকে। না, মূর্তিটি আগের জায়গায়ই আছে, নড়ে উঠা সম্ভব না। কারণ বড় একটা পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে মূর্তিটাকে। নড়তে হলে পুরো পাহাড়কে নড়তে হবে।
ভিড় কমে গেলে জেসমিন ধীরপায়ে এগিয়ে গেল মূর্তিটার দিকে। তার দাঁড়িয়ে থাকার আর-একটা কারণ ছিল। তলপেটে হালকা চিনচিন ব্যথা করছে। এরকম ব্যথা আগে কখনো করেনি। কারণটা ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে ব্যথাটা সহ্য করা যাচ্ছে, তেমন সমস্যা হচ্ছে না।
জেসমিন তাকাল উপরের দিকে। স্থির দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিটা। হঠাৎই তার মনে হতে লাগল মূর্তিটা যেন তাকে কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারছে না। মূর্তিটার যেন অনেক অনেক কথা, এমন কাউকে খুঁজছে যাকে সে সবকিছু খুলে বলতে পারে। হয়তো সে নিজে সেই মানুষই, এমনই অনুধাবন করল জেসমিন।
মনের মধ্যে আবোল-তাবোল কল্পনা জন্ম নিচ্ছে উপলব্ধি করে মাথা ঝাঁকি দিল জেসমিন। এসে দাঁড়াল মূর্তির একেবারে পাশে। মূর্তিটা উঁচু হওয়ায় মূর্তির হাত তার গলা পর্যন্ত নেমে এসেছে প্রায়। আলতোভাবে হাত স্পর্শ করল সে। আর সাথে সাথে যেন নিজের মধ্যে ভিন্ন এক শিহরন অনুভব করল। তার মনে হলো, ভালো লাগার চমৎকার এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত শরীরে। সে ছাড়াল না হাতটা, ধরেই রাখল। সবচেয়ে ভালো লাগছে উপলব্ধি করে যে তার তলপেটের ব্যথাটাও উধাও হয়ে গেছে। ডাক্তার হাডসনের স্পর্শ ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে যেন।
এই এতক্ষণ হাত ধরে আছিস কেন?
শান্তার প্রশ্ন শুনে বাস্তবে ফিরে এলো জেসমিন।
শান্তা আবার বলল, আমি ছবি তুলব। তুই একটু সরে দাঁড়া জেসমিন।
জেসমিন সরে দাঁড়ালে শান্তাসহ বাকি কয়েকজন নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলল।
সবাই যখন গুহা থেকে বের হয়ে গেল গুহার মুখে তখনো দাঁড়িয়ে থাকল জেসমিন। অজানা একটা টান অনুভব করছে ডাক্তার হাডসনের মূর্তিটার জন্য। মূর্তিটা যেন তাকে বলছে, তুমি থেকে যাও জেসমিন, থেকে যাও, আমার কাছে তুমি থেকে যাও, আমি অপেক্ষায় আছি, অনেক অনেক দিন ধরে তোমার অপেক্ষায় আছি, শুধুই তোমার অপেক্ষায়।
জেসমিন, জেসমিন।
রাবেয়া ম্যাডামের চিৎকার শুনে বাস্তবে ফিরে এলো জেসমিন।
রাবেয়া ম্যাডাম বলে চলছেন, তুমিও শেষ পর্যন্ত দেরি করছ। এজন্যই আমি শিক্ষা সফরে আসতে চাই না। কেউ কথা শোনে না। যাও গাড়িতে ওঠো। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর দেরি করেছ তো…
জেসমিন আর দাঁড়াল না। দ্রুত উঠে এলো বাসে।
বাস চলতে শুরু করেছে। জেসমিন তাকিয়ে আছে সবচেয়ে উঁচু পাহাড় হাডসিন হিলের দিকে। তার অবচেতন মন বারবার বলছে, সে যেন কাউকে ফেলে যাচ্ছে, ফেলে যাচ্ছে তার প্রিয়, অতি প্রিয় কাউকে।
*
বিকেলে জেসমিন সমুদ্রের পাড়ে ঘুরতে বের হয়েছে। এখানে ঝিনুক মার্কেটে ঝিনুকের তৈরি অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস পাওয়া যায়। বছরখানেক হলো মার্কেটটা পাঁচমিশালী ধরনের হয়ে গেছে। ছোটদের খেলনা, বিছানার চাদর, জুতা, স্যান্ডেলসহ এমন কিছু নেই যা পাওয়া যায় না, দামও বেশি। মানুষ তারপরও কেন যেন বেশ আগ্রহ নিয়ে কিনতে থাকে সবকিছু। প্রত্যেকটা দোকানেই ভিড়। কোনো কোনো দোকানে তো বিক্রেতারা ক্রেতার সাথে কথা বলার সময়ও পাচ্ছে না। জমজমাট এই কক্সবাজার দেখতে সত্যি ভালো লাগছে জেসমিনের।
জেসমিন আর শান্তা ঢুকেছে একটা মুক্তোর দোকানে। দুই ধরনের মুক্তোর মালা পাওয়া যায় কক্সবাজারে। প্রথম ধরনটা হলো কৃত্রিম এবং হালকা আর দ্বিতীয় ধরনটা আসল। আসল মুক্তোর মালা বেশ ভারী হয়। এরকমই একটা মুক্তোর মালা পছন্দ করল জেসমিন। কিন্তু দাম তিন হাজার টাকা। এত টাকা দেয়ার সামর্থ্য নেই জেসমিনের। দামাদামি করার পর দুই হাজার পাঁচ শ টাকায় রাজি হলো দোকানদার। কিন্তু তারপরও কিনতে পারল না জেসমিন। সে সতেরো শ টাকা পর্যন্ত বলেছে।
যখন দোকান থেকে বের হয়ে আসবে তখন দেখে জেহান দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে জেসমিন বলল, কী ব্যাপার জেহান, তুমি এখানে?
তোমাকে দেখে এলাম আপু।
কেন?
হাড়সন হিলে তোমার অনেকগুলো ছবি তুলেছি। আমার মোবাইল ফোনে আছে। তুমি অনুমতি দিলে আমি তোমার হোয়াটস্অ্যাপে কিংবা মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেই।
জেসমিন খানিকটা ধমকে উঠে বলল, তুমি অনুমতি ছাড়া আমার ছবি তুলেছ কেন?
জেহান একেবারে হতচকিত হয়ে গেল। সে ভাবতে পারেনি জেসমিন এভাবে রেগে উঠবে। বলল, আ…আমি তো দুপুরে তোমার ছবি তুলে দিয়েছিলাম। তুমিই অনুমতি দিয়েছিলে। মনে আছে, মেরিন ড্রাইভে নৌকা থেকে একটু দূরে। আমার সাথেও ছবি তুলেছিলে।
তার মানে এই নয় যে হাডসন হিলে তুমি ছবি তুলতে পারবে আমার!
শান্তা এবার জেসমিনকে উদ্দেশ করে বলল, ওকে তুই শুধু শুধু বকছিস কেন? শিক্ষাসফরে ছবি তোলার কাউকে পাওয়া যায় না। জেহান আমাদের জুনিয়র, ছবি তুলে দিয়েছে তাতে দোষের কী? জেহান তুমি ছবিগুলো পাঠিয়ে দিও জেসমিনের মোবাইলে। আর আমি তোমাকে আমার ছবি তোলার অনুমতি দিয়ে দিলাম, যখন ইচ্ছা তখন তুলতে পারো। তবে ছবিগুলো শুধু আমাকেই পাঠাবে, ঠিক আছে।
শান্তা পরিবেশটাকে হালকা করে দিল। তবে জেহান আর কিছু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল শান্তা আর জেসমিন দোকান থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত।
জেসমিন বাইরে আসতে রিং বেজে উঠল ফোনে ফোন করেছে রাশেদ। রাশেদ তাদের কলেজের ছাত্র। ম্যানেজমেন্টে অনার্স করছে। এখন তৃতীয় বর্ষে পড়ে। জেসমিনের প্রতি তার বেশ ঝোঁক। জেসমিনও পছন্দ করে তাকে। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠছে অনেকে মনে করলেও সম্পর্কটা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এখনো। একজন অন্যজনকে দেখলে মুচকি হাসে, টুকটাক কথা বলে এ পর্যন্তই। রাশেদ ছেলে হিসেবে ভদ্র, নম্র, দেখতেও সুন্দর। কলেজের প্রায় সব মেয়েই পছন্দ করে রাশেদকে। এই হিসেবে জেসমিন সৌভাগ্যবান। কারণ সে কিছুটা হলেও সম্পর্ক করতে পেরেছে রাশেদের সাথে। রাশেদদের পারিবারিক অবস্থাও স্বচ্ছল। বাবা বড় কাপড় ব্যবসায়ী, চারতলা বাড়ি আছে নিজেদের। রাশেদের একটা মোটরসাইকেল আছে। রাশেদ তাকে উঠতে বলেছে কয়েকবার, কিন্তু ভয়ে মোটরসাইকেলে উঠেনি সে। অবশ্য এটাও ঠিক, সম্পর্কটা এখনো মোটরসাইকেলে উঠে ঘুরতে যাওয়ার মতো হয়নি।
ফোন ধরতে রাশেদ বলল, কেমন আছো জেসমিন?
ভালো আছি ভাইয়া।
কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?
না না।
কোথায় কোথায় ঘুরলে?
অনেক জায়গায়।
ভালো লাগলো কোন জায়গাটা?
হাডসন হিল।
ঐ জায়গা আবার কোনটা?
এলে বুঝতে পারবেন। ফোনে বোঝানো যাবে না।
ঠিক আছে, তুমি ফিরে এলে তখন শুনব। আসলে আমি নিজেও কখনো কক্সবাজার যাইনি। তুমি যখন যাচ্ছিলে, ইচ্ছে হচ্ছিল একাই চলে যাই। পরে ভাবলাম ঠিক হবে না। যাইহোক, কবে আসবে?
পরশুদিন রওনা দেব। ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। কক্সবাজার থেকে ঢাকা অনেক দূর।
আমি মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করব। তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব বলে ঠিক করেছি।
মোটরসাইকেলে আমি উঠতে পারব না। ভয় করে।
আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে রিকশায় পৌঁছে দেব।
আজ তাহলে রাখি।
এত তাড়াতাড়ি!
জি।
আচ্ছা।
এভাবে ছোট ছোট বাক্যে কথা হয় দুজনের। তবে নিয়মিত না। জেসমিন অবশ্য নিজে ফোন করেনি একদিনও। যতদিন ফোন করেছে রাশেদই। জেসমিনের মধ্যে কিছুটা হলেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে দ্বিধাদ্বন্দ্বটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। আগে কথায় কথায় “ভাইয়া বলত রাশেদকে। ইদানীং একবার কি দুবার বলে।
রাতে খাওয়ার পর তলপেটের ব্যথাটা আবার শুরু হলো। এরকম হচ্ছে কেন সে ঠিক বুঝতে পারছে না। আজই ব্যথাটা তার উঠেছে এবং তা হাডসিন হিলে যাওয়ার পর। আবার ডাক্তার হাডসনের মূর্তির স্পর্শে মিলিয়ে গেছে। কী অদ্ভুত! এই ব্যথার সাথে হাডসন হিলের কোনো যোগসাজস আছে কি না ঠিক বুঝতে পারছে না সে।
ব্যথার মাত্রা আরো বাড়লে শান্তার কক্ষে প্রবেশ করল সে। প্যারাসিটামল চাইলে প্যারাসিটামল দিয়ে শান্তা বলল, ব্যথা কি খুব বেশি?
সহনীয় মাত্রায় আছে, তবে কষ্ট হচ্ছে।
আমি কি রাতে তোর পাশে ঘুমাব?
না, দরকার হবে না। অত চিন্তা করিস না। সকালে একবার উঠেছিল, তারপর এমনিতেই চলে গেছে। আশা করছি এবারও কমে যাবে।
কথাগুলো বলে নিজের কক্ষে চলে এলো জেসমিন। ঘড়ি দেখল, রাত সাড়ে নয়টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি তার শুতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু ব্যথাটার জন্য দাঁড়িয়েও থাকতে পারছে না। শেষে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল সে। আর তখনই অনুভব করল, কেউ একজন আছে এই ঘরের মধ্যে। অজানা একটা শঙ্কা হঠাৎই তাকে অস্থির করে তুলল। কিন্তু সে নিশ্চিত কেউ নেই, অথচ মন বলছে কেউ আছে। কী এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব।
বাথরুম, খাটের নিচে, দরজার পিছনে, বারান্দা সবজায়গায় দেখল জেসমিন। না, কেউ নেই। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শরীরের উপর চাদর টেনে দিল সে। আর তখনই মেসেঞ্জারে একসাথে অসংখ্য ছবি এলো, পাঠিয়েছে জেহান। হাডসন হিলে তোলা ছবিগুলো, খুব সুন্দর হয়েছে। জেহানের মোবাইল ফোনের ক্যামেরার রেজুলেশন অনেক ভালো, এজন্য ছবিগুলো সুন্দর হয়। কিছুটা খারাপ লাগছে ভেবে যে জেহানকে আজ ছবি তোলার জন্য বকা দিয়েছে। ব্যাপারটা যে উচিত হয়নি অনুধাবন করছে। সে। ঠিক করল, অযাচিত ব্যবহারের জন্য আগামীকাল ক্ষমা চেয়ে নেবে জেহানের কাছে।
এমন একটা ভাবনা স্বস্তি দিলেও তলপেটের ব্যথা তার জন্য কষ্টের কারণ হয়ে পড়ল। ব্যথাটা বাড়ছে ধীরে ধীরে। ওষুধে কাজ হচ্ছে না। উঠে একবার পানি খেল সে। তারপর আবার এসে শুলো। ব্যথাটা বাড়ছে তো বাড়ছেই। সে অনুভব করল ঘামতে শুরু করেছে, এটা ভালো লক্ষণ না। জোরে কয়েকবার শ্বাসও নিল। এতে কিছুটা যেন কমল ব্যথাটা। এরপর হাতে তুলে নিল মোবাইল ফোন। দেখতে লাগল হাডসন হিলে ডাক্তার হাডসনের মূর্তির সাথে তোলা ছবিগুলো।
ব্যথাটা বাড়ছেই। জেসমিন শুয়েছিল ডান কাত হয়ে। এবার চিৎ হয়ে শুলো। পা টান করলে মনে হলো একটু বুঝি কমল। মোবাইলটা তার তখনো হাতে। একটা ছবি চোখের সামনে ভাসছে। সে দাঁড়িয়ে আছে ডাক্তার হাডসনের মূর্তির পাশে আর ডাক্তার হাডসনের হাতটা তার কাঁধে। হঠাৎ যেন তার মনে হলো ডাক্তার হাডসন নড়ে উঠলেন। হ্যাঁ, নড়েই উঠলেন। জেসমিন যখন হেঁটে আসছে, তিনিও হেঁটে হাসছেন সামনের দিকে। একেবারে গুহার বাইরে বের হয়ে এলেন তিনি। সময়টা রাত। তবে জোছনা থাকায় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জোছনা যেন আজ বৃষ্টির মতো করছে নিচের দিকে, অবশ্য হালকা বৃষ্টিও পড়ছে। আর ডাক্তার হাডসন ছায়ার মতো এগিয়ে আসছেন তার পাশে। এ যেন ছায়া আর জোছনার বৃষ্টির এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। জেসমিন বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করেছে দেখে লাল একটা ছাতা মাথার উপর ধরলেন ডাক্তার হাডসন। সেই ছাতার নিচে এখন দুজন। ডাক্তার হাডসন আর মূর্তি নেই, নীল চোখের অপূর্ব সুন্দর এক পুরুষ, পরনে সাদা পায়জামা আর নীল পাঞ্জাবি। তার পাশে সে পরে আছে লাল শাড়ি।
জেসমিন অবাক হয়ে দেখল যে সে নিজেই নিজেকে দেখছে। কীভাবে সম্ভব হচ্ছে বুঝতে পারছে না। তার এই ভাবনার মাঝেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল বৃষ্টির মধ্যে। এখন শুধু দেখা যাচ্ছে ডাক্তার হাডসনকে। লম্বাটে মুখ, ফর্সা গায়ের রং, নিষ্পাপ একটা ভাব আছে চেহারায়। এগিয়ে আসছেন তারই কাছে। যত কাছে আসছেন ততই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাকে। আসছেন, ডাক্তার হাডসন আসছেন এবং একসময় মোবাইলের স্ক্রিন পার হয়ে সত্যি তার কক্ষে চলে এলেন। তারপর খাটের পাশে এসে মিষ্টি হেসে বললেন, কেমন আছো জেসমিন?
জেসমিন বিশ্বাস করতে পারছে না ডাক্তার হাডসন তার কক্ষে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ডাক্তার হাডসন সুন্দর, দেখতে আসলেই সুন্দর।
আমি খুব খুশি হয়েছি এ কারণে যে তুমি লাল শাড়ি পরে আমার কাছে এসেছিলে
এবার জেসমিন মিনমিন করে বলল, আ…আপনি বলেছিলেন এজন্য লাল শাড়ি পরেছিলাম।
শুধু আমি বলেছিলাম বলে যে তুমি শাড়ি পরেছিলে, তা কিন্তু নয়।
জেসমিন কিছু বলল না।
ডাক্তার হাডসন মৃদু হেসে বললেন, তুমি আমাকে পছন্দ করো, কল্পনা করো, আমাকে কাছে পেতে চাও, এজন্যই তুমি আমার পছন্দের শাড়ি পরে গিয়েছিলে। সত্য বললাম কি?
আ…আ…আমি জানি না।
তুমি জানো। কিন্তু বলতে পারছ না। আমার প্রতি তোমার ভালোলাগাকে আমি উপলব্ধি করি। এজন্যই তোমার এখানে এসেছি। আমি জানি, তুমি তলপেটের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছ।
আপনি জানলেন কীভাবে?
তুমি যখন আজ দুপুরে আমাকে স্পর্শ করেছিলে তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। আমার স্পর্শ তোমার ব্যথা কমিয়ে দিয়েছিল, তাই না?
হ্যাঁ।
তোমার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তীব্র একটা ব্যথা তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমি কি তোমার ব্যথাটা কমিয়ে দেব?
কীভাবে?
তোমার ব্যথার স্থানটা আমাকে স্পর্শ করতে হবে।
আ…আ…আমি…
তুমি অনুমতি দিলেই আমি স্পর্শ করব এবং দেখব।
আ…আমি চাই ব্যথাটা কমে আসুক। সহ্য করতে পারছি না আর। আপনি আমাকে স্পর্শ করতে পারেন।
ডাক্তার হাডসন মৃদু একটা হাসি দিলেন। তারপর বসলেন খাটের উপর। ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেললেন চাদরটা। বললেন, ঠিক কোন জায়গায় তোমার ব্যথাটা?
জেসমিন খানিকটা অস্বস্তিবোধ করছে। একজন অপরিচিত পুরুষ তার কক্ষে, তাকে স্পর্শ করছে, বিষয়টা ঠিক যেন মেনে নিতে পারছে না সে। অস্বস্তিটা আরো বাড়ল যখন মনে পড়ল গত রাতে এই মানুষটাই তাকে চুমু খেয়েছিল, তার সাথে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। আজ আবার এসেছে। মানুষটাকে তার ভালো লাগছে না খারাপ লাগছে, ঠিক অনুধাবন করতে পারছে না এখন, তবে এটুকু বুঝতে পারছে তার ব্যথাটা কমানো দরকার। তাই সে হাত দিয়ে তলপেটে নাভির পাশে জায়গাটা দেখিয়ে দিল ডাক্তার হাডসনকে।
সালোয়ার-কামিজ পরা ছিল জেসমিন। কামিজ খানিকটা সরিয়ে ব্যথার স্থানে হাত রাখলেন ডাক্তার হাডসন। তারপর ধীরে ধীরে চাপ দিতে থাকলেন। চাপের সাথে সাথে ব্যথার তীব্রতাও বাড়তে থাকল। জেসমিন মুখে উহ্ উহ্ করতে লাগল।
ডাক্তার হাডসন বললেন, তোমাকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে জেসমিন।
আ…আমি আর পারছি না।
কিছুটা ব্যথা লাগবে, তবে তার পরে সেরে যাবে।
আ…আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। এখন ব্যথা আরো বাড়ছে।
আ…আমি বোধহয় বুঝতে পারছি তোমার ব্যথার কারণটা।
কী কারণ?
ডাক্তার হাডসন কোনো কথা বললেন না। হঠাই ঝুঁকে এলেন জেসমিনের মুখের উপর। তারপর আলতোভাবে চুমু খেলেন জেসমিনের ঠোঁটে, আর ডান হাত দিয়ে জোরে চাপ দিলেন জেসমিনের তলপেটে। তীব্র ব্যথায় জেসমিন চিৎকার করে উঠতে গিয়েও পারল না। কারণ তার ঠোঁট দুটো তখন ডাক্তার হাডসনের ঠোঁটের মাঝে। রেগে উঠল সে, ডাক্তার হাডসনের কাছ থেকে অযাচিত এরকম আচরণ সে আশা করেনি। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে বুঝতে পারল ব্যথাটা চলে গেছে তার, শরীরটা এখন একেবারে ব্যথাহীন। তবে সে ঘেমে ভিজে গেছে আর অবশ হয়ে আসছে তার শরীর। সে অনুধাবন করল ডাক্তার হাডসনের এক অলৌকিক ক্ষমতা আছে শরীরকে অবশ করে দেয়ার এবং শরীরে ভালোলাগার তীব্র অনুভূতি সৃষ্টি করার। এখন তার মনে হচ্ছে ডাক্তার হাডসন তার কাছে আসুক, আরো কাছে আসুক।
ডাক্তার হাডসন মাথা উঁচু করলেন। তারপর বাম হাতটা জেসমিনের মুখে রেখে বলল, চিৎকার কোরো না। তোমার ব্যথাটা বোধহয় কমে গেছে।
আ…প…আপনি… আপনি…
আমি অন্যায় করিনি। তুমি আমাকে চাও, মনের গভীর থেকে চাও, আমি অনুধাবন করি। করি বলেই তোমার কাছে এসেছি। আর আমি এটাও জানি যে তুমি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছ। ভালোবাসার ক্ষেত্রে প্রত্যেক নারীরই প্রথমে সংকোচ থাকে, সংকোচ কাটিয়ে অতঃপর ভালোবাসাকে নারী উপভোগ করে।
না, না, আমি হয়তো আপনাকে ভালোবাসি না।
তুমি অবশ্যই আমাকে ভালোবাসো। তোমার চোখ দেখে আমি বুঝতে পারছি জেসমিন। ভালোবাসাকে লুকিয়ে রাখতে নেই, তাহলে ঠকতে হয় জীবনে। ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে প্রিয়জনকে দেয়ার জন্য, প্রিয়জনের ভালোবাসা ভাগাভাগি আর উপভোগের জন্য। ভালোবাসা কষ্টের নয়, আনন্দের। তুমি আমাকে ভালোবাসো, মনের গভীর থেকে ভালোবাসো। আমি জানি, আমি উপলব্ধি করি। এজন্য আমি আবার আসব, বারবার আসব। আগামীকাল রাতেও আসব তোমার এখানে। আগামীকাল তুমি জানালাটা খোলা রাখবে আর লাল রঙের শাড়ি পরবে। জানালা বন্ধ থাকলে বুঝব তোমার হৃদয় আমার জন্য বন্ধ। আর আসব না তোমার কাছে। আর খোলা রাখলে বুঝব তোমার হৃদয় আমার জন্য উন্মুক্ত, তুমি আমাকে চাও, অনেক অনেক কাছে চাও, একেবারে হৃদয়ের গভীরে। আমি আগামীকাল তোমার হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে যেতে চাই।
কথাগুলো বলে ঠোঁটের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলেন ডাক্তার হাডসন। তারপর আবার একটা চুমু খেলেন। এবার আলতোভাবে। জেসমিন অনুভব করল তার শরীর কাঁপছে এবং সে খুব ক্লান্ত। সে যে কিছু বলবে কিংবা বাধা দেবে সেই শক্তি তার এখন আর নেই।
এদিকে ডাক্তার হাডসন উঠে দাঁড়িয়েছেন। ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেন পিছনের দিকে। হঠাৎই রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে মিলিয়ে গেলেন জোছনার বৃষ্টিতে।
জেসমিন চোখ বুঝল। অনুভব করল তার শরীরের কোথাও কোনো ব্যথা নেই। বরং ভালোলাগার একটা আবেশ যেন ছড়িয়ে আছে সমস্ত শরীরে। আর ঘুম আসছে, ঘুম আসছে দুচোখ জুড়ে!
*
জেহান সকালে সাগরের পাড়ে এসেছে। কলেজের অনেকে আছে বিচে। তবে সে তাদের থেকে খানিকটা দূরে। ইচ্ছে করেই একা থাকছে। কারণ তার পকেটে আছে মুক্তোর মালা। এই মালাটা সে দিতে চায় জেসমিনকে, কিন্তু কীভাবে দেবে ঠিক বুঝতে পারছে না। জেসমিন ভালোভাবে নেবে কি নেবে না জানে না সে। তার আসলে জেসমিনকে বড় ভালো লাগে! তাকে নিয়ে স্বপ্নও দেখে সে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পক্ষে মূল সমস্যা হচ্ছে বয়স। জেসমিন তার থেকে এক বছরের বড়। জেসমিনকে ভালোলাগা যে মূলত ভালোবাসা, তা ইদানীং উপলব্ধি করছে সে। কিন্তু এই সমাজে বয়সে ছোট ছেলেরা বয়সে বড় মেয়েদের ভালোবাসতে পারবে না, এরকম একটা অলিখিত নিয়ম যেন আছে। বিষয়টাকে সে নিজেও মেনে নিতে চায়, কিন্তু পারে না, জেসমিনকে দেখলে তার মাথা ঠিক থাকে না। তার খুব ইচ্ছে হয়, জেসমিনকে ‘আপু’ করে সম্বোধন না করে শুধু ‘জেসমিন’ বলে ডাকতে। কিন্তু বাস্তবে যে তা সম্ভব নয়। কেউ মেনে নেবে না, না জেসমিন নিজে, না তার পরিবার।
গত রাতে ছবি পাঠানোর পর জেসমিন মেসেঞ্জারে তাকে ধন্যবাদ দিয়েছে। মোবাইল ফোনে ধন্যবাদটা বের করে বেশ কয়েকবার দেখল সে। জেসমিনের লেখা ‘ধন্যবাদ’ তার জীবনে এক অনন্য প্রাপ্তি। স্ক্রিনশটটা রেখে দিল, যেন যে কোনো সময় ইচ্ছে হলে দেখতে পারে। জেসমিনের সাথে ভোলা তার ছবিগুলোও দেখল! কী সুন্দর জেসমিন! অথচ এত কাছে থেকেও যে কত দূরে! তাদের আর জেসমিনদের বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায়, যখন ছোট ছিল অনেককিছু জেসমিনের কাছ থেকে পেত সে। চকলেট, আইসক্রিম, খেলার জিনিসপত্র, আরো কত কী! বয়স তাদের যত বাড়ছে ততই যেন জেসমিন দূরে সরে যাচ্ছে, কেমন যেন পর হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। ইদানীং কলেজের বড় ভাই রাশেদের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে জেসমিনের। ব্যাপারটাকে ঠিক মেনে নিতে পারছে না সে। রাশেদ পড়াশুনায় যেমন ভালো, তেমনি দেখতেও হ্যান্ডসাম। জেসমিন তার প্রেমে পড়ে গেলে সে যে জেসমিনকে আর পাবে না তা নিশ্চিত। রাশেদের প্রেমে পড়ার আগেই জেসমিন যেন তার প্রেমে পড়ে সেই ব্যবস্থাই করতে হবে এখন। কিন্তু কীভাবে সম্ভব, জানে না সে। প্রাথমিকভাবে মুক্তোর মালাটা কিনেছে। এই মালা দিয়েই নিজের ভালোলাগার কথা জেসমিনকে বলবে বলে ঠিক করল। অবশ্য আগেও সে কয়েকবার নানানাবে জেসমিনকে ভালোলাগার কথা বলবে বলে ঠিক করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলতে পারেনি। কেন যেন তার ভয় ভয় লাগে। মনে হয় জেসমিন তাকে প্রত্যাখ্যান করবে, তারপর আর কোনোদিন সে জেসমিনের সামনে দাঁড়াতে পারবে না।
জেসমিনকে হঠাৎই সে দেখতে পেল বিচের দিকে হেঁটে আসছে এবং একা। এরকম একা জেসমিনকে সাধারণত পাওয়া যায় না। জেহান আর অপেক্ষা করল না। দ্রুত হেঁটে জেসমিনের কাছে এলো। জেসমিন অবাক হয়ে বলল, তুমি কি সকালেই এসেছ বিচে?
হ্যাঁ। আ…আর তোমাকে ধন্যবাদ।
কেন?
তুমি গতকাল আমাকে ‘ধন্যবাদ’ লিখে মেসেঞ্জারে উত্তর দিয়েছিলে।
ও আচ্ছা। তুমি আসলেই ছবিগুলো সুন্দর তুলেছ। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। স্বীকার করতেই হয় ক্যামেরায় তোমার হাত ভালো।
শুনে বড় খুশি হলাম।
দুজন পাশাপাশি হাঁটছে। তাদের গন্তব্য সাগরের দিকে। জেহান সিদ্ধান্ত নিল এখনই বলবে মুক্তোর মালাটার কথা। যদি মালা পছন্দ হয় তাহলে সে বলবে ভালোলাগা আর ভালোবাসার কথা, যা থাকে কপালে।
জেহান যখন এরকম ভাবছে তখন হঠাৎই জেসমিন বলল, জেহান তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি সত্য উত্তর দেবে।
অবশ্যই দেবে।
কারো সাথে এ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করবে না।
না করব না।
তুমি কলেজের রাশেদ ভাইকে নিশ্চয় চেন। সে আসলে মানুষটা কেমন?
এরকম কিছু শুনবে বলে মোটেও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না জেহান। আমতা আমতা করে বলল, রা…রাশেদ ভাই!
হ্যাঁ, রাশেদ ভাই, ঐ যে লম্বা করে সুন্দর মতন দেখতে।
ভা…ভালো, ত…তবে…
জেসমিন ভ্রু কুচকে বলল, তবে কী?
একটু অহংকারী।
অহংকারী তো একটু হবেই, পুরুষ মানুষকে কি অহংকারী ছাড়া মানায়! মিনমিন করা পুরুষ মানুষকে কেউ পছন্দ করে না, তাই না?
জেহান কী বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। রাশেদ মোটেও অহংকারী না, সে বানিয়ে বলেছে এ কারণে যেন জেসমিন আর রাশেদকে পছন্দ না করে। এখন দেখছে, রাশেদের পক্ষেই সাফাই গাইছে জেসমিন। সারাজীবন শুনে এসেছে অহংকার পতনের মূল, আর এখন শুনছে অহংকার পুরুষের গুণ। জেসমিন কি সত্যি তাহলে প্রেমে পড়ে গেছে রাশেদের? ভাবতেই মাথাটা গুলিয়ে উঠল জেহানের। এমন একটা পরিস্থিতিতে কীভাবে মুক্তোর মালাটা জেসমিনকে দেবে ঠিক বুঝতে পারছে না।
জেসমিন, জেসমিন!
শান্তা ডাক দিল জেসমিনকে। জেসমিন আর দাঁড়াল না, চলে এলো শান্তার কাছে। শান্তা পানিতে নেমেছে। বলল, তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? পানিতে আয়।
পানির মধ্যে পা ডুবাল জেসমিন।
তোর ব্যথাটা কমেছে?
হ্যাঁ, কমেছে।
প্যারাসিটামলে ভালো কাজ হয়েছে তাহলে।
প্যারাসিটামলে নয়, ব্যথা কমেছে ডাক্তার হাডসনের স্পর্শে।
কথাটা বলতে গিয়েও বলল না জেসমিন। উপরে নিচে মাথা ঝাঁকাল শুধু। তবে ডাক্তার হাডসনের কথা মনে হতে নিজের মধ্যে ভিন্ন এক অনুভূতি কাজ করতে শুরু করল। ভালোলাগার পাশাপাশি কিছুটা অস্বস্তিও যেন আছে ঐ অনুভূতির মাঝে।
কী ভাবছিস?
না, কিছু না।
মনে হচ্ছে কিছু একটা ভাবছিস।
প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জেসমিন বলল, মহেশখালী যাওয়ার সময় আজ সাথে ছাতা নিতে হবে, তাই না? অনেক রোদ নাকি?
হ্যাঁ, ঐরকমই বলেছেন ম্যাডাম। চল যাই, আগে নাস্তা করে নেই। : নাস্তার পর হাতে তাহলে খানিকটা সময় পাওয়া যাবে।
চল তাহলে। যাওয়ার আগে এইখানে আর আসা হবে না।
কেন হবে না? আগামীকাল রওনা দেয়ার আগে আবার আসব। আর…
আর কী?
বিয়ে করে হানিমুনে আসবি না?
কী যে বলিস!
আমি অবশ্যই আসব। কক্সবাজারের মতো সুন্দর জায়গা আর নেই। আমার এত ভালো লেগেছে তোকে বুঝাতে পারব না। আমি হানিমুন এই কক্সবাজারেই করব। আর তুই রাশেদ ভাইকে…
ফাজলামি করিস না। চল যাই।
জেসমিন আর শান্তা যখন ফিরে যাচ্ছে, জেহান তখন চার হাত-পা টান করে শুয়ে আছে বালুর উপর। হঠাৎ তার কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে, বড় কষ্ট! তার মনে হচ্ছে এ জীবনে সে জেসমিনকে কখনো পাবে না, কখনোই না। আজ অনেক প্রস্তুতি নেয়ার পরও জেসমিনকে মনের কথা বলতে পারেনি। শুধু ‘আপু’ শব্দটা আজ সে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেনি। এই যা সাফল্য। কিন্তু তার এই সাফল্য ম্লান হয়ে গেছে জেসমিনকে মনের কথা বলতে না পারার ব্যর্থতায়। তাই তো কিছুতেই সে নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারছে না। চোখ দিয়ে পানি আসছে তো আসছেই, আর বিড়বিড় করে গাইছে,
প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়।
*
রাত এগারোটা পর্যন্ত আড্ডা দিল সবাই। এই সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। কারণ আগামীকাল চলে যাবে তারা। যারা এসেছে তাদের প্রায় সবাই প্রথমবার এসেছে কক্সবাজারে, এজন্য আনন্দ-উচ্ছ্বাসটা তুলনামূলকভাবে বেশি। সন্ধ্যার পর থেকে অবশ্য জেসমিন খানিকটা চুপ হয়ে গেছে। কারণ আজ রাতে ডাক্তার হাডসন আবার আসবেন তার কক্ষে। পরতে বলেছেন। লাল শাড়ি, আর খোলা রাখতে বলেছেন জানালা।
নিজের কক্ষে আসার পর জেসমিন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। সে ঠিক বুঝতে পারছে না রাতে ডাক্তার হাডসনের তার কাছে আসার বিষয়টা সত্য না মিথ্যা। বাস্তবে সত্তর আশি বছর আগে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়া একজন মানুষের তার কাছে আসা অসম্ভব। অথচ ডাক্তার হাডসন আসছেন এবং তার ব্যথা কমিয়ে দিচ্ছেন। বিষয়টা অলৌকিক বলেই তার ধারণা এবং সে জানে পৃথিবীতে অলৌকিক অনেক কিছু ঘটে। এজন্য ডাক্তার হাডসনের আগমনের বিষয়টিকে অবিশ্বাস করার কিছু নেই। তার থেকে বড় কথা, সে অনুভব করছে ডাক্তার হাডসনের উপস্থিতি তার ভালো লাগে। এই অনুভব বা উপলব্ধির ব্যাখ্যা কী তা সে জানে না।
দুটো শাড়ি এনেছিল জেসমিন। একটা লাল আর একটা নীল। নীলটা পরতে ইচ্ছা হচ্ছে তার। ডাক্তার হাডসনের পছন্দকেই গুরুত্ব দেয়া উচিত এমন ভাবনা থেকে নীল শাড়িটাকে উপেক্ষা করল। তবে ব্লাউজটা পরল নীল। যদিও লাল শাড়ির সাথে নীল ব্লাউজ ম্যাচিং করে না, তারপরও সে পরবে বলে সিদ্ধান্ত নিল।
শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়াতে নিজেই অবাক হয়ে গেল জেসমিন। তাকে সত্যি সুন্দর লাগছে। এমনিতেই সে সুন্দর, সম্ভবত তার কলেজে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে সে নিজে। আশেপাশের ছেলেদের চাহনি আর কথোপকথনে বুঝতে পারে। তার বান্ধবীরাও বলে একই কথা। তবে আজ যেন তাকে বেশি সুন্দর লাগছে। কপালে টিপ পরবে কি পরবে না ভাবল কিছুক্ষণ। পরে বাদ দিল টিপ পরার সিদ্ধান্তটা। এসে দাঁড়াল বাইরের বারান্দায়। সমুদ্রের ঠান্ডা বাতাস এসে লাগছে শরীরে। দারুণ লাগছে, মনে হচ্ছে যেন এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
আকাশটাও যেন আজ বড় সুন্দর। ভরা পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যাচ্ছে। মেঘগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি উজ্জ্বল। সেই মেঘের ফাঁক দিয়ে জোছনা যেন বৃষ্টি হয়ে এসে পড়ছে ধরণির বুকে। সোনালি জোছনা, দারুণ লাগছে দেখতে।
জেসমিন ঘড়ি দেখল। রাত বারোটা বাজে। তার মানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। কিন্তু ডাক্তার হাডসনের কোনো দেখা নেই। কেমন যেন অস্থিরতা অনুভব করছে নিজের মধ্যে। তাহলে ডাক্তার হাডসন কি তার উপর রাগ করলেন? কেন করবেন? সে এমন কিছু করেনি যার জন্য ডাক্তার হাডসন তার উপর রাগ করতে পারেন। তার পছন্দমতো লাল শাড়িই তো পরেছে আজ। আর হ্যাঁ, ডাক্তার হাডসন যদি না আসে তাহলে কী-ইবা আসে যায়। ডাক্তার হাডসনের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই যদি হয়, তাহলে কেন সে তার অপেক্ষায় আছে? কেন আর তার জন্য লাল শাড়ি পরেছে? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেল না জেসমিন। তার মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল। তাই আর বাইরে থাকল না, বারান্দা থেকে এসে ঢুকল কক্ষের মধ্যে।
জেসমিন শুয়ে শুয়ে মোবাইল ফোনে ডাক্তার হাডসনের মূর্তির সাথে তোলা ছবিগুলো দেখল কিছুক্ষণ। ছবিগুলো দেখার পর ডাক্তার হাডসনের আগমনের জন্য সে যেন আরো বেশি উতলা হয়ে উঠল। তাকাল দক্ষিণের জানালার দিকে। জানালার ওপাশে বারান্দা। না নেই, ডাক্তার হাডসন নেই। অথচ তার আসার কথা, আজ এই রাতে!
একটা সময় বেশ হতাশ হয়ে পড়ল জেসমিন। অনুমান করল ডাক্তার হাডসন আর আসবেন না। এমন একটা ভাবনা দারুণভাবে মর্মাহত করল তাকে। তার মনে হতে লাগল আজ রাত তার জীবনে সবচেয়ে কষ্টের রাত। এত কষ্টের যে সে সহ্য করতে পারছে না। কষ্টের তীব্রতা গতকালকের তলপেটের ব্যথার থেকেও বেশি। পার্থক্য শুধু, গতকাল ছিল শারীরিক কষ্ট আর আজ মানসিক।
হঠাৎ জেসমিনের মনে হলো নীল ব্লাউজ তার পরা ঠিক হয়নি। হয়তো এজন্যই রাগ করে আছেন ডাক্তার হাডসন। এমন মনে হতে ব্লাউজটা খুলে ফেলল শরীর থেকে। এখন শুধু ব্রেসিয়ার পরা। তার উপর লাল শাড়ি।
খাট থেকে উঠে জেসমিন এলো আয়নার সামনে। তার নিজেকে এখন অনেকটাই বিধ্বস্ত লাগছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, কাঁধের উপর থেকে পড়ে গেছে শাড়ি। শাড়িটা আর আগের জায়গায় তুলতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে, এতটুকুও শক্তি নেই শরীরে। যে কোনো সময় নিচে পড়ে যেতে পারে সে। ঘুরতে শুরু করেছে মাথাটা, চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু।
আয়নায় হঠাই যেন দেখতে পেল ডাক্তার হাডসনকে। ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই ফর্সা চেহারা, নীল পাঞ্জাবি। নিজের আবেগকে আর আটকে রাখতে পারল না জেসমিন। উলটো ঘুরেই জড়িয়ে ধরল ডাক্তার হাডসনকে। তারপর আবেগভরা কণ্ঠে বলল, এত দেরি করলেন কেন আপনি?
ডাক্তার হাডসন বললেন, আমি বুঝতে চেষ্টা করছিলাম তুমি সত্যি আমাকে অনুভব করো কি না।
অবশ্যই করি, অবশ্যই করি। আপনি কেন বুঝতে পারছেন না।
না, করো না।
মাথা উঁচু করে জেসমিন বলল, কী বলছেন আপনি!
সত্য বলছি। যদি আমাকে অনুভব করতে, তাহলে অবশ্যই আমাকে ‘তুমি করে বলতে।
জেসমিন চোখ বড় বড় করে বলল, আ…আমি আপনাকে ‘তু…তুমি’ করে বলব!
হ্যাঁ বলবে, আমি চাই তুমি এখন থেকে আমাকে তুমি করে বলবে।
জেসমিন নিজের ঠোঁট কামড়ে একটু সময় নিল। তারপর দুই হাতে ডাক্তার হাডসনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আর তুমি কোনোদিনও দেরি করবে না।
ডাক্তার হাডসন উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে বললেন, আমি দেরি করতে চাই না, কখনো না। তোমার কাছেই থাকতে চাই।
আমিও যে তোমাকে আমার কাছে রেখে দিতে চাই।
কথাগুলো বলতে বলতে জেসমিন নিজেই আলতোভাবে একটা চুমু খেল ডাক্তার হাডসনের মুখে। তারপর শরীরটাকে এলিয়ে দিল ডাক্তার হাডসনের বুকের মধ্যে। ডাক্তার হাডসন তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এলেন খাটের উপর। তারপর শুইয়ে দিয়ে বললেন, জেসমিন, তুমি সুন্দর! অপূর্ব সুন্দর।
জেসমিন চোখ বন্ধ করে বলল, শুধু তোমার জন্য।
সত্যি!
হ্যাঁ, শুধু তোমার জন্য। এই তোমার জন্যই আমি আজ লাল শাড়ি পরেছি, দক্ষিণের জানালা খোলা রেখেছি। আমি চাই না, তুমি আর আমাকে ছেড়ে চলে যাও, এক মুহূর্তের জন্য না। আমি থাকতে চাই, থাকতে চাই তোমার ঐ বুকের মাঝে, হারিয়ে যেতে চাই তোমার ঐ গহিন ভালোবাসায়। আ…আ…আমি বোধহয়…
হ্যাঁ বলো জেসমিন। তুমি বোধ…হ…য়…
আ…আমি বোধহয় তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। অনেক অনেক ভালোবাসা…
তোমার ভালোবাসার স্পর্শ আমি অনুভব করছি।
জেসমিন দুই হাতে আবার জড়িয়ে ধরল ডাক্তার হাডসনকে। ডাক্তার হাডসনও নিজের মধ্যে টেনে নিলেন জেসমিনকে। জেসমিন অনুভব করল, তার ভালো লাগছে, অসম্ভব ভালো লাগছে। তার শরীরের তাপমাত্রা বাড়ছে, অনুভূতিও যেন স্বর্গীয়। ডাক্তার হাডসন যতই তার শরীর থেকে শাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন ততই ভালো লাগার অনুভূতিটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এক সময় সে অনুভব করল, তার আর ডাক্তার হাডসনের মাঝে কোনো দূরত্ব নেই, নেই কোনো বাধাও। তারা দুজনে মিলে যেন একজন, শুধুই একজন। পরস্পরকে কাছে পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে নেই কোনো সংশয়, শঙ্কা কিংবা জড়তা। পরিপূর্ণ ভালোবাসার আনন্দে আজ দুজনেই তারা তৃপ্ত
*
শিক্ষা সফর শেষ। গাড়ি এসে থেমেছে কলেজে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাগরিবের আজান দেবে। জেসমিন গাড়ি থেকে নামলে এগিয়ে এলো জেহান। বলল, তোমার জন্য একটা রিকশা ঠিক করে ফেলেছি।
জেসমিন অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?
হু, উঠে পড়ো।
আমি কি তোমাকে রিকশা ঠিক করতে বলেছি?
জেহান বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, না।
তাহলে রিকশা ঠিক করলে কেন?
ইচ্ছে করলে গাড়িতে যেতে পার। আমার জন্য গাড়ি এসেছে।
তোমার গাড়িতে যাব কেন? না, আমি একাই যাব।
একটু থেমে জেসমিন আবার বলল, আচ্ছা জেহান, আমি লক্ষ করেছি। দুই-তিনদিন হলো তুমি আমাকে আপু ডাকছে না। ভাববাচ্যে কথা বলছ। কেন?
ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল জেহান। তাড়াতাড়ি বলল, না আপু, আসলে আমি তো তোমাকে আপুই ডাকি, আপু, আপু।
ঠিক আছে, দেখা হবে পরে, আসি তাহলে।
জেসমিন সামনে দাঁড়ানো আর-একটা রিকশায় গিয়ে উঠল। জেহান দেখল রিকশার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ। জেসমিন রিকশায় উঠার পর রাশেদও উঠে বসল। তারপর হুড টেনে দিল। এখন খুব কাছাকাছি বসতে পারবে দুজন, আবার বাইরে থেকে কেউ দেখতেও পাবে না। সবকিছু দর থেকে দেখল জেহান। এভাবে জেসমিনের সাথে বসার বহুদিনের স্বপ্ন ছিল তার, অথচ আজ রাশেদ সেই স্বপ্নকে ধূলিস্যাৎ করে দিল। কী ভয়ানক কষ্ট।
এদিকে রিকশা চলতে শুরু করেছে। জেসমিন বলল, আপনি উঠেই গেলেন রিকশায়!
হ্যাঁ, উঠে পড়েছি। এখন থেকে আর রাখঢাক করার কিছু নেই।
কিন্তু সবাই দেখলে কী ভাববে?
ভাবাভাবির কী আছে। আমরা একজন অন্যজনকে পছন্দ করি, এই কথা সবাই জানলে তো দোষের কিছু নেই, তাই না?
না, না, এখন জানানো যাবে না। বাবা-মা সবাই খুব ঝামেলা করবে।
ঠিক আছে। তুমি যদি না চাও…
না, তা বলছি না, তবে বোধহয় আমাদের আর একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
আমি রাজি আছি, তোমার জন্য হাজার বছর ধৈর্য ধরতেও রাজি। আর আজকের জন্য ধন্যবাদ, কিছুক্ষণের জন্য হলেও তোমার পাশে বসতে পেরেছি। খুব শখ মোটরসাইকেলে তোমাকে নিয়ে দূরে কোথাও যাব। কবে যাবে তা আমাকে জানাবে। আসি আজ, রাতে ফোনে কথা হবে।
কথাগুলো বলে নেমে গেল রাশেদ। জেসমিন লম্বা শ্বাস নিল। রাশেদ পাশে বসায় আতঙ্কিত ছিল ঠিকই, তবে ভালোও লাগছিল। এখন নেমে যাওয়ায় স্বস্তি পাচ্ছে। আসলেই সে বাড়ির সবাইকে ভয় পায়। কেউ তাকে শিক্ষা সফরে আসতে দিতে চায়নি। জোর করে এসেছে। এতক্ষণ পর্যন্ত সবকিছু ভালোই কেটেছে। শেষ সময়ে এসে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। তাই রাশেদ রিকশা থেকে নেমে যাওয়ায় আতঙ্ক কেটে গেছে।
জেসমিনরা থাকে তার দাদার বাড়িতে। দাদা এখন বেঁচে নেই। পৈতৃক সূত্রে যতটুকু জায়গা তারা পেয়েছে সেখানে ছোট্ট একটা অর্ধপাকা বাড়ি আছে। ঐ ঘরেই থাকে জেসমিন, তার বাবা, মা আর ছোট ভাই। বাবা মোহাম্মদ নাজমুল হোসেন প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সবাই হেডস্যার বলে ডাকে। মা নিলুফার ইয়াসমিন গৃহিণী, আর ছোট জমজ দুই ভাই জয় আর জনি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। তার মা নিলুফার ইয়াসমিন গৃহিণী হলেও শিক্ষিত এবং সবকিছু নিজের নখদর্পণে রাখেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা, আদব-কায়দা, ভদ্রতার ব্যাপারে অতি সতর্ক তিনি। নিজে সম্পূর্ণ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন এবং সবাইকে বলতেও উদ্বুদ্ধ করেন। একসময় সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতেন, এখন আর সেই অভ্যাস নেই। সংসার আর আর্থিক সংকটের কারণে চর্চাগুলো কমে গেছে। তবে অভাবে থাকলেও সুখে আছে। তারা। তেমন কোনো ঝুটঝামেলা নেই পরিবারে।
কক্সবাজার থেকে বাড়ির সবার জন্যই ছোট বড় উপহার নিয়ে এসেছে। জেসমিন। উপহার পেয়ে দারুণ খুশি সবাই। জয় আর জনির জন্য এনেছে বড় সামুদ্রিক শামুকের খোল। খোলটা হাতে নিয়ে জয় বলল, এত বড় শামুকের খোল!
জেসমিন বলল, কানে লাগিয়ে দেখ, কোনো শব্দ হয় কি না।
শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে।
এই শব্দ সমুদ্রের গর্জনের শব্দ।
এবার জনি চোখ বড় বড় করে বলল, তাই নাকি!
সবাই তাই বলে। যখন সমুদ্র দেখতে ইচ্ছে হবে শামুকটা কানে লাগিয়ে নিবি। দেখবি কী যে ভালো লাগবে। মনে হবে তুই সমুদ্রের পাড়ে আছিস। আর এই যে নে, বার্মিজ আচার। দশটা আছে। তোদের বন্ধু বান্ধবরে দিবি।
ঠিক আছে আপা।
বড় স্বাদের আচারগুলো।
দেখেই মনে হচ্ছে।
খালি দেখলে হবে নাকি, একটা খেয়ে দ্যাখ।
জয় আর জনি আচার মুখে দিয়ে বলল, উমম! তারপর দুজনেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। দুজনের চেহারা হুবহু এক। জনির শুধু কপালে একটা দাগ আছে। ছোটবেলায় সিঁড়ি থেকে পড়ে কপাল ফাটিয়ে ফেলেছিল। ঐ দাগটা স্থায়ী হয়ে গেছে। দাগের সুবিধা হলো, জনিকে চেনা যায় সহজে। তা না হলে দুজনের মধ্যে কে জয় আর কে জনি, চিনতে পারা বড় কঠিন। দুজনের একটা অভ্যাস, সবসময় একসাথে থাকবে, একই সাথে খেলবে, একই সাথে ঘুরতে যাবে। জমজ ভাই-বোনদের মধ্যে মিল থাকে ঠিকই। কিন্তু জয় আর জনির মিল যেন খানিকটা বেশিই।
জেসমিনদের বাড়িতে বড় বড় তিনটা ঘর। একটাতে তার বাবা-মা থাকেন, একটাতে থাকে সে। আর একটাতে জয় আর জনি। বাড়ির সামনে লম্বা একটা বারান্দা, বারান্দার এক কোনায় রান্নাঘর। রান্নাঘরের পাশে ছোট্ট একটা ডাইনিং কাম ড্রইং রুমও আছে। সম্পূর্ণ বাড়িটা পাঁচফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির সামনে একটু ফাঁকা জায়গা আছে। ঐ জায়গায় ফুল আর সবজি চাষ করে জেসমিন। তাদের বাড়ির সাথেই লাগোয়া জেহানদের বিশাল দোতলা বাড়ি। জেহানের বাবা অনেক বড় কাপড়-ব্যবসায়ী। ঐ বাড়ির সবার সাথে তাদের সদ্ভাব আছে। তবে বড়লোক হলে যা হয়, পাত্তা দিতে চায় না আশেপাশের গরিবদের! জেহানের বাবা-মা খানিকটা অহংকারীও বটে! ইদানীং যেন অহংকারটা বেড়েছে। তবে জেহান ভালো এবং পরোপকারী, উপলব্ধি করে জেসমিন। আজ তার জন্য রিকশা ঠিক করে রেখেছিল। অথচ সে রিকশাটা নেয়নি, কাজটা যে ঠিক হয়নি বুঝতে পারছে সে। তবে এটাও সত্য, তাকে জিজ্ঞেস না করে জেহানের রিকশা ঠিক করা উচিত হয়নি। যাইহোক, জেসমিন সিদ্ধান্ত নিল পরে কথা বলে জেহানের মনোকষ্ট সে দূর করে দেবে। শত হলেও, জেহান তার প্রতিবেশী এবং বয়সে ছোট। ছোটদের প্রতি বড়দের একরকম দায়িতৃবোধ থাকা উচিত। এই দায়িত্ববোধ থেকেই সে অনুধাবন করছে, জেহানকে অহেতুক আর কষ্ট দেবে না।
জেসমিন রাতে ঘুমাতে গেল সাড়ে দশটার সময়। কক্সবাজার থেকে ঢাকা আসার ভ্রমণে খুব ক্লান্ত ছিল সে। শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়েও পড়ল। তবে হঠাৎ অনুভব করল সে একা নেই খাটে। আরো একজন আছে। যিনি আছেন তিনি আর কেউ নন, ডাক্তার হাডসন। নিজ বাড়িতে, নিজের কক্ষে ডাক্তার হাডসনের উপস্থিতিতে তার আতঙ্কিত হওয়ার কথা। কিন্তু সে আতঙ্কিত হলো না। বরং খুশিই হলো। মনে মনে যেন কামনা করছিল ডাক্তার হাডসনকে। তাই নিজেই মুখ গুঁজে দিল ডাক্তার হাডসনের বুকের মধ্যে। আর অনুধাবন করল, ধীরে ধীরে ডাক্তার হাডসনও তাকে টেনে নিচ্ছে হৃদয়ের একেবারে গভীরে।
*
তিন মাস পর।
কলেজ থেকে ফেরার পর হঠাই মাথা ঘুরতে শুরু করল জেসমিনের। একইসাথে তলপেটে তীব্র ব্যথা অনুভব করতে লাগল। সাথে সাথে শুয়ে পড়ল বিছানায়। চিৎকার করে ডেকে উঠে মা, ও মা।
দৌড়ে এলেন নিলুফার। বললেন, কী হয়েছে?
পেটে খুব ব্যথা করছে মা।
কোথায়?
এখানে, এই যে তলপেটে।
হাত দিয়ে নাভির চারপাশটা দেখিয়ে দিল জেসমিন।
নিলুফার কিছু বুঝতে পারলেন না। হঠাৎ মেয়ের এরকম পেটে ব্যথার কারণ কী হতে পারে? দেরি করলে সমস্যা হতে পারে ভেবে তাড়াতাড়ি খবর দিলেন জেসমিনের বাবা নাজমুল হোসেনকে।
প্যারাসিটামলে ব্যথা না কমায় নিয়ে আসা হলো কেরানীগঞ্জের হিউম্যানিটি ক্লিনিকে। সদ্য যোগদান করা মধ্যবয়সি গাইনির ডাক্তারকে পাওয়া গেল। নাম ফারজানা আক্তার। বেশ সময় নিয়ে তিনি পরীক্ষা করলেন জেসমিনকে। তারপর বাইরে এসে টেনে টেনে বললেন, আপনারা কি কিছু বুঝতে পারছেন?
জেসমিনের বাবা নাজমুল হোসেন অবাক হয়ে বললেন, কীভাবে বুঝব? আমরা তো ডাক্তার না।
ডাক্তার না হলেও বোঝা যায়।
ঠিক বুঝলাম না।
বিয়ে হয়েছে কবে মেয়ের?
কী সব বলছেন আপা!
ফারজানা আক্তার খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, আমি জানতে চাচ্ছি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন কবে? আর তার স্বামীও বা কে?
নাজমুল হোসেন কিছু বলছেন না দেখে ফারজানা এবার হেসে দিয়ে বললেন, মিষ্টি খাওয়ান। আপনি নানা হতে চলেছেন।
আ…আ…
হ্যাঁ, আপনার মেয়ে প্রেগন্যান্ট।
কী সব বলছেন আপা! জেসমিন প্রেগন্যান্ট হবে কীভাবে? ওর তো বিয়েই হয়নি।
ডাক্তার ফারজানা ভ্রু কুঁচকে বললেন, তাহলে বোধহয় অন্য সমস্যা আছে। যাইহোক, আমি কিছু টেস্ট দিচ্ছি। করে ফেলুন।
কথাগুলো বলে ডাক্তার ফারজানা ডাক দিলেন পারুলকে। একটা কাগজে কয়েকটা টেস্ট লিখে দিয়ে বললেন, সাসপেকটেড প্রেগন্যান্সি কেস। টেস্টগুলো করে দ্রুত ফলাফল দিতে বলো।
তারপর আবার নাজমুল হোসেনের দিকে ফিরে বললেন, আমি দেখি টেস্টে কী পাওয়া যায়। রাত নয়টার পর জানতে পারবেন। এখনো পাঁচ ঘণ্টা বাকি। ইচ্ছে করলে অপেক্ষা করতে পারেন আবার বাসায়ও চলে যেতে পারেন। আমি ব্যথানাশক একটা ইনজেকশন দিয়ে দিচ্ছি। আশা করছি পনের বিশ মিনিটের মধ্যে ব্যথা কমে যাবে। আর সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন।
আধঘণ্টার মধ্যে জেসমিনের ব্যথা কমে গেল। তবে ব্যথা শুরু হয়ে গেল তার বাবা আর মায়ের বুকের মধ্যে। কী অবিশ্বাস্য কথা শুনে এলো তারা। ভাগ্য ভালো যে ডাক্তার কথাগুলো জেসমিনের সামনে বলেননি। সেক্ষেত্রে সর্বনাশ হয়ে যেত! নাজমুল হোসেন তার স্ত্রীকে বললেন, তুমি এখন কিছু বোলো না জেসমিনকে, আগে রিপোর্টগুলো আসুক।
আমি তো ভয়েই মরে যাচ্ছি। বুকটা কেমন কাঁপছে।
আমার ধারণা ডাক্তার কোথাও ভুল করছে।
অভিজ্ঞ ডাক্তার। ভুল করবে কেন?
হতে পারে। মানুষেরই তো ভুল হয়। যাইহোক, জেসমিন যেন কিছু জানে। আর বাইরের কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও কিছু অনুমান করতে না পারে।
তা পারবে কীভাবে?
জয় আর জনিও যেন জানে না কিছু। ওরা ছোট মানুষ, বুঝবে না। শেষে আবার উলটাপালটা কী বলে বসে!
না, না, জানবে না।
নাজমুল হোসেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, কেমন যেন দুর্বল দুর্বল লাগছে শরীরটা। এক কাপ চা দাও আমাকে।
দিচ্ছি।
চিনি দিও খানিকটা।
তুমি তো চায়ে চিনি খাও না।
আজ খেতে ইচ্ছে করছে।
সাথে আর কিছু দিব?
থাকলে দাও।
নিলুফার চায়ের সাথে বিস্কুটও দিলেন নাজমুল হোসেনকে। তবে বিস্কুট খেতে পারলেন না, খুবই খারাপ লাগছে তার। চায়ে দুই চুমুক দিয়ে বাইরে বের হয়ে এলেন। দমটা কেমন যেন বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে বিশুদ্ধ বাতাসের বড় অভাব। সারাটা জীবন তিনি সৎ পথে চলেছেন, লোভহীন একটা জীবন অতিবাহিত করেছেন। মূল লক্ষ্য ছিল শান্তি। সবকিছু মিলিয়ে ভালোই ছিলেন। অথচ আজ তিনি কী শুনছেন! তার অবিবাহিত মেয়ে জেসমিন গর্ভবতী। বিষয়টা কিছুতেই মানতে পারছেন না তিনি। মনে-প্রাণে প্রার্থনা করছেন যেন প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টে এমন কোনো ফলাফল না আসে।
রাতে মসজিদে এশার নামাজ পড়লেন নাজমুল হোসেন। তারপর এলেন হিউম্যানিটি ক্লিনিকে। ডেলিভারি বুথ থেকে রিপোর্টগুলো নিয়ে আর ডাক্তারের কাছে গেলেন না। নিজেই দেখলেন রিপোর্টগুলো। স্পষ্ট লেখা
আছে, প্রেগন্যান্সি পজেটিভ, অর্থাৎ জেসমিন গর্ভবতী! নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। ডাক্তার এখন নেই। নিজের ভুল হতে পারে ভেবে কর্তব্যরত একজন নার্সকে দেখালেন রিপোর্টগুলো। নার্স দেখে মিষ্টি হেসে বলল, কার রিপোর্ট এগুলো?
আমার মেয়ের।
মিষ্টি খাওয়ান তাড়াতাড়ি। আপনি নানা হতে চলেছেন।
আ…আপনি কি সত্যি বলছেন!
জি সত্য বলছি।
নার্স রিপোর্টগুলো দিয়ে চলে গেল। নাজমুল হোসেন অনুভব করলেন তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। পাশেই একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। ঘামছেন এখন, চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। বুঝতে পারলেন জীবনে ভয়াবহ এক বিপদে পড়তে যাচ্ছেন তিনি, বিপদ নয়! মহাবিপদ!
*
ডাক্তার তরফদার বসে আছেন তার চেম্বারে। তার সামনে একটি বাচ্চা বসা। বয়স নয় বছর, নাম ইকবাল। চোখ দুটো স্বচ্ছ নীল। দেখলে কেমন যেন মায়ার সৃষ্টি হয়। সাথে এসেছে তার মা রিতা। খুব অসহায় দেখাচ্ছে তাকে। ডাক্তার তরফদার বললেন, ইকবালের সমস্যা কী?
রিতা চোখ বড় বড় করে বলল, স্যার মেলা বড় সমস্যা।
কী সমস্যা?
স্যার ও একবার যা দ্যাখে তা ভুলে না। সব মনে রাখবার পারে।
এটা তো ভালো লক্ষণ।
স্যার যা পড়ে সব মুখস্থ হইয়া যায়।
দারুণ ক্ষমতা!
কঠিন কঠিন শব্দ যা আমরা দ্বিতীয়বার মনে রাখবার পারি না ইকবাল সব মনে রাখবার পারে।
সত্যি?
জি স্যার।
তাহলে বলতেই হয় ইকবাল খুব ক্ষমতাবান। তো তুমি কী করো? আর ইকবালের বাবা কোথায়? সে কী করে?
স্যার ইকবালের বাবা একটা গার্মেন্টসে লাইনম্যান পদে চাকরি করে। আমি বাসায়ই থাকি। ঘর সামলাই। মাঝে সেলাইয়ের কাজ করবার চেষ্টা করছিলাম। ইকবালের এই অসুখের পর থাইকা আমি আর পারতেছি না, ওরে সামলাতেই আমার সময় চইলা যায়।
ইকবাল তো অসুস্থ নয়, তার কিছু ক্ষমতা আছে বলছ, এটা দোষের কিছু না। যাইহোক, আমি ইকবালের সাথে কথা বলি।
ডাক্তার তরফদার এবার ইকবালের দিকে ফিরে ডাক দিলেন, এসো বাবা, আমার কাছে এসো।
ইকবাল কোনো কথা বলল না। শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ডাক্তার তরফদারের দিকে।
ডাক্তার তরফদার মিষ্টি হেসে বললেন, কী নাম তোমার?
ইকবাল নিরুত্তর।
রিতা বলল, স্যার মাঝে মাঝে ও কথা বলে না। চুপ হইয়া যায়। কী যেন ভাবে। ওর ঐ দৃষ্টি দ্যাখলে আমার ভয় করে।
ডাক্তার তরফদার এবার নিজেই উঠে ইকবালের পাশের চেয়ারে বসলেন। তারপর বললেন, আমি তোমাকে কিছু কঠিন শব্দ বলব। তুমি মনে করতে পারো কি না আমি দেখব। যদি পারো বুঝব তুমি সত্যি অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী। হ্যাঁ, এখন তাকাও আমার দিকে।
ইকবাল ডাক্তার তরফদারের দিকে তাকাল। ডাক্তার তরফদার বললেন, তুমি বলবে ‘সাইক্লো পেন্টানো পার হাইড্রো ফিনানথ্রিন’।
নিশ্চুপ ইকবাল।
ডাক্তার তরফদার মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, আমি কী বলেছি, তুমি বলো।
ইকবাল একবার রিতার দিকে তাকিয়ে আবার তাকাল ডাক্তার তরফদারের দিকে। তারপর স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, সাইক্রো পেন্টানো পার হাইড্রো ফিনানখ্রিন।
ডাক্তার তরফদার স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি স্টেরয়েডের মূল রাসায়নিক স্ট্রাকচারের ‘মৌলিক রিং’-এর নাম বলেছিলেন। রসায়নের একজন ছাত্রের প্রথম প্রথম এই ‘মৌলিক রিং’-এর সঠিক উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত ভেঙে যায়। আর নয় বছরের ইকবাল কিনা একেবারে সঠিক উচ্চারণটা বলল। তিনি বিস্মিত না হয়ে পারলেন না এবং বুঝলেন ইকবাল অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী।
এদিকে রিতা খুব উচ্ছ্বসিত। কারণ ইকবাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে ডাক্তার তরফদারের দিকে। ডাক্তার তরফদারের সামনে একটা কবিতার বই ছিল। বইটা হাতে নিয়ে তিনি ইকবালকে বললেন, আমি একটা কবিতা পড়ব। আমার পড়া শেষ হলে তুমি আমাকে মুখস্থ শোনাবে। ঠিক আছে?
ইকবাল আগের মতোই চুপ থাকল।
ডাক্তার তরফদার পল্লিকবি জসিম উদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার প্রথম আট লাইন পড়ে শোনালেন ইকবালকে। তারপর বললেন, যতটুকু পড়েছি তুমি আমাকে শোনাও তো।
আটটা লাইন হুবহু মুখস্থ বলল ইকবাল।
ডাক্তার তরফদার কবিতার বই বন্ধ করে রিতার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, কবে থেকে ইকবালের এই ক্ষমতা প্রকাশ পাচ্ছে?
স্যার ছয় মাস হলো। আমরা প্রথমে পাত্তা দেই নাই। এখন দেখতেছি, দিনে দিনে ও ওর ক্ষমতা দেখাইতেছে, আর কথা বলা কমায় দিতেছে।
কথার মাঝেই উঠে গেল ইকবাল। তারপর কাউকে কিছু না বলে ঢুকে গেল ভিতরের রুমে। ডাক্তার তরফদার তো অবাক। তবে তিনি ইকবালের পিছনে গেলেন না। বরং রিতাকে বললেন, তুমি যাও।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো ইকবাল। তার হাতে পরির পায়েস। তিনটা বাটি এনেছে সে। একটা দিল তার মাকে, একটা ডাক্তার তরফদারকে। আর একটা সে খেতে শুরু করল।
ডাক্তার তরফদার বড়ই অবাক হলেন। বিড়বিড় করে বললেন, এই বাসার অন্যতম স্বাদের খাবারটা ইকবাল নিয়ে এসেছে। কীভাবে বুঝল?
স্যার জানি না। ইদানীং ইকবাল অনেককিছুই বুঝবার পারে। এজন্য আমি ভয়ে ভয়ে থাকি।
ভয়ে থাকার কোনো কারণ নেই। ও ছোট মানুষ। ওকে অনেক অনেক ভালোবাসবে। সময় দেবে। আমি এই সপ্তাহের মধ্যে তোমাদের বাসায় একদিন আসব। এই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছি না। শুধু একটাই পরামর্শ, সবসময় ইকবালের সাথে থাকবে, ইকবালকে আপন করে রাখবে।
কোনো ওষুধ দেবেন না স্যার?
কী জন্য?
ইকবালের ব্রেইনের ক্ষমতা যেন কইমা যায়, যেন আমাগো মতো হয়।
ইকবাল সুস্থ আছে। তার কোনো ওষুধের প্রয়োজন নেই। আমি তাকে আরো পর্যবেক্ষণ করব। আর হ্যাঁ মনে রাখবে, ওষুধে নয়, মনের অসুখ মন দিয়ে সারাতে হয়। তবে এটা সত্য, ইকবাল অসুস্থ নয়।
জি স্যার, তারপরও আমি..
কথা শেষ করতে পারল না রিতা। ইকবাল উঠে আবার ভিতরে গেল। সেও গেল তার পিছন পিছন। বের হয়ে এলো কিছুক্ষণ পর। ইকবাল এবার একটা ব্যাগের মধ্যে অনেকগুলো পরির পায়েস নিয়েছে। পরি এখন দুইভাবে পায়েস তৈরি করে। পেয়ালায়, আবার ছোট ছোট মাটির বাটি কিংবা প্লাস্টিকের কাপে। প্রায় বিশটা পায়েস ভরা কাপ নিয়েছে ইকবাল। লজ্জিত ভঙ্গিতে রিতা বলল, স্যার, ফ্রিজের পাশেই একটা পলিথিনের ব্যাগ আছিল। একা একাই সে ব্যাগে ভইরা সবগুলা পায়েস নিয়া আইছে।
ডাক্তার তরফদার বললেন, ইকবালের পছন্দ হয়েছে, তাই নিয়েছে। দোষের তো কিছু নেই। ওকে নিতে দাও।
কী লজ্জার কথা!
লজ্জার কিছু নেই। আমি ওকে আরো পায়েস দেব।
ডাক্তার তরফদার চেয়ার থেকে উঠে এসে এবার ইকবালের দিকে ঝুঁকলেন। বললেন, তোমার যখন পায়েস খেতে ইচ্ছে হবে চলে আসবে। ঠিক আছে?
ইকবাল মিষ্টি হাসল। তারপর পা বাড়াল বাইরের দিকে। ভাবখানা এমন যেন সব সিদ্ধান্ত সে নিজেই নিচ্ছে। তার মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে না। কিছুটা পথ এগিয়ে আবার ফিরে এলো সে। বলল, ডাক্তার তুমি বড় ভালো মানুষ।
রিতা ধমক দিয়ে উঠে বলল, ডাক্তার বললি ক্যান? স্যার বল। আর ‘তুমি’ কইরা বলতেছিস ক্যান? ‘আপনি’ কইরা বল।
তারপর রিতা ডাক্তার তরফদারের দিকে ফিরে বলল, স্যার, দ্যাখছেন, কত বড় বেয়াদব! আপনেরে ‘তুমি’ কইরা বলে!
এদিকে মায়ের ধমক খেয়ে ইকবাল বেশ ভয় পেয়েছে, নীল চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে। সে একবার রিতার দিকে তাকিয়ে আবার তাকাল ডাক্তার তরফদারের দিকে। শুদ্ধ ভাষায় বলল, ডাক্তার, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
ইকবালের কথা শুনে রিতা মনে হলো অজ্ঞান হয়ে যাবে, আবার ‘তুমি’ করে বলছে ইকবাল! সে ঠাস করে একটা চড় মেরে বসল ইকবালের গালে। ইকবাল একেবারে চুপ হয়ে গেল।
ডাক্তার তরফদার রিতাকে ধমক দিয়ে বললেন, এসব কী করছো! ও ছোট মানুষ। এরকম আচরণ করতে আমি যেন আর না দেখি তোমাকে।
রিতা এবার হঠাৎই ডুকরে কেঁদে উঠল। তারপর বলল, স্যার আমি ইকবালরে আগে কখনো মারি নাই। আইজই প্রথম মারলাম। আসলে নিজেরে নিয়ন্ত্রণ করবার পারি নাই, আমারে ক্ষমা কইরা দিবেন স্যার।
ডাক্তার তরফদার ইকবালকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, তুমি অনেক বুদ্ধিমান ইকবাল। আমি তোমাদের বাড়িতে এসে তোমার সাথে সময় কাটাব, গল্প করব। ঠিক আছে?
ইকবাল কিছু বলল না। তার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এসেছে।
দেখে খুব খারাপ লাগল ডাক্তার তরফদারের, এদিকে রিতা তো কাঁদছেই। ডাক্তার তরফদার কী করবেন যখন ভাবছেন তখন দেখলেন ইকবাল বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। সামনে একটা চেয়ারে সুন্দর চেহারার তেরো-চৌদ্দ বছরের একজন কিশোর বসে ছিল। সে এতক্ষণ সবকিছু দেখছিল। তার হাতে একটা পায়েসের কাপ দিয়ে বের হয়ে গেল ইকবাল। রিতা তখন হাঁটতে শুরু করেছে ইকবালের পাশে। তার হাতে পায়েসের ব্যাগ।
ডাক্তার তরফদারের কাছে যে রোগী আসে তাদের অধিকাংশই আঠারো বছরের উপরে। আর অল্পবয়সিদের সাথে তাদের অভিভাবক থাকে। বসে থাকা ছেলেটির সাথে কোনো অভিভাবক নেই দেখে খানিকটা অবাকই হলেন তিনি। সামনে এসে বললেন, কী নাম তোমার?
লাজুক ভঙ্গিতে ছেলেটি বলল, জেহান স্যার।
জেহান, আগে এই নাম শুনিনি। তোমার নামের কি কোনো অর্থ আছে?
জি স্যার আছে। জেহান শব্দের অর্থ উজ্জ্বলতা।
ও আচ্ছা। এসো, ভিতরে এসো।
জি স্যার।
আর কেউ নেই সাথে?
না স্যার।
কী করো তুমি?
পড়াশুনা করি। ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে।
তাই নাকি। বয়স কত তোমার?
সতের বছর হতে আর একমাস বাকি
কিন্তু তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে তোমার বয়স তেরো-চৌদ্দ বছর। যাইহোক, তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষদের একজন, কারণ প্রকৃত বয়সের ছাপ তোমার চেহারায় পড়ছে না। অথচ মানুষ বয়স ধরে রাখার জন্য, নিজের চেহারা সুন্দর করার জন্য কত চেষ্টাই না করছে। পার্লারে যাচ্ছে, দামি কসমেটিকস ব্যবহার করছে, ভেষজ সামগ্ৰী শরীরে মাখছে, লেসার মেশিনের নিচে শরীর পেতে দিচ্ছে, ঠোঁট-নাক কেটে কসমেটিক সার্জারি করছে। অথচ মানুষ বুঝতে চায় না, মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য চেহারায় নয়, মনে। চেহারার কসমেটিক সার্জারির পরিবর্তে মনের শুদ্ধি সার্জারির গুরুত্ব অনেক বেশি। যাইহোক, এসো ভিতরে এসো, তোমার কথা শুনি।
ডাক্তার তরফদার ভিতরে প্রবেশ করে পিছনে ফিরলেন। কিন্তু দেখতে পেলেন না জেহানকে। তিনি আবার বাইরে বের হয়ে এলেন। না নেই, জেহান নেই। অবাকই হলেন তিনি, এক কিশোর হঠাৎ এসে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল! তবে একটা বিষয়ে তিনি নিশ্চিত, জেহান সুস্থ নয়, অসুস্থ। তার অসুস্থতার মাত্রা কী ধরনের কথা না বললে জানা যাবে না। অবশ্য একটা বিষয়ে তিনি আশাবাদী, জেহান আবার আসবে এবং অল্পদিনের মধ্যেই।
*
রাত সাড়ে নয়টা। জেসমিন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ঘরে প্রবেশ করলেন নিলুফার। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ডাকলেন, জেসমিন, জেসমিন!
জেসমিন মায়ের দিক মুখ ফিরিয়ে উলটো করে শুলো। নিলুফার বললেন, টেবিলে খাবার দিছি, খেতে আয়।
আমার ক্ষুধা নেই মা।
সেই দুপুরে কয়টা ভাত খেয়েছিস। আর কিছু খাসনি। না খেলে তো মারা যাবি।
না মা, আমার কিছু হবে না, তুমি নিশ্চিত থাকতে পার।
কীভাবে নিশ্চিত থাকব? যে বিপদ আমাদের পরিবারের উপর!
মা তুমি চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কীভাবে ঠিক হবে? বিয়ে করিসনি, পেটে বাচ্চা নিয়ে বসে আছিস! এই কথা মানুষজন জানলে মুখ দেখাব কীভাবে? তোর বাবা তো এখনই ঘর থেকে বের হতে চাচ্ছে না। কে তোর এই সর্বনাশ করল! রাশেদ।
তু…তুমি রাশেদ ভাইয়ের কথা জানলে কীভাবে?
আমি আগেই জেনেছি। কানাঘুষা তাড়াতাড়ি ছড়ায়। যা হবার হয়েছে। তুই যদি চাস, তাহলে আমি রাশেদের সাথে কথা বলতে পারি।
কী কথা?
বিয়ে করে ফেলবি দুজন।
জেসমিন চোখ বড় বড় করে বলল, এই বয়সে আমি বিয়ে করব।
আমি তোর কথা কিছু বুঝতে পারছি না। এই বয়সে বাচ্চা নিয়ে ফেলেছিস, বিয়ে করতে দোষ কোথায়? এখন না করলে পরে রাশেদের পরিবারও রাজি হবে না।
রাশেদ ভাইয়ের কথা বারবার আনছ কেন?
সে-ই তো তোর এই সর্বনাশ করেছে। তার কথা আনব না কেন?
না রাশেদ ভাইয়ের কোনো দোষ নেই।
তাহলে তোর সন্তানের বাবা কে?
জেসমিন চুপ হয়ে গেল।
নিলুফার খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, তুই বলছিস না কেন? আর কত জিজ্ঞেস করব। জিজ্ঞেস করতে করতে আমার মুখ ব্যথা হয়ে গেল।
জেসমিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, মা, তুমি আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
তুই তো সারাদিন একাই থাকিস। খাবার কি এই ঘরে দিয়ে যাব?
না।
আমি আসলে তোকে বুঝতে পারছি না। তোর উচিত আমাদের মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করার চেষ্টা করা। যেভাবে তুই গো ধরে বসে আছিস, তাতে আমাদেরই মরে যেতে ইচ্ছে করছে। যা খুশি কর, আর ভালো লাগে না। এই সংসার আমার জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
রাগ করে চলে গেলেন নিলুফার। জেসমিন উঠে বাথরুমে ঢুকল। হাত-মুখ ধুয়ে নিল ভালোমতো। একটা বিষয় অবশ্য সত্য। মাঝে ক্ষুধা থাকলেও এখন তার ক্ষুধা কমে গেছে। খেতে ইচ্ছে করে না। না খাওয়ায় একটা সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, বমি হচ্ছে না। গত মাসে প্রায় প্রত্যেকদিনই বমি করত সে, খুব কষ্ট হতো। এখন আর অতটা হচ্ছে না। কষ্টটা একেবারে থাকে না যখন ডাক্তার হাডসন আসেন। রাতে দিনে যে কোনো সময় চলে আসেন তিনি। আজ জেসমিনের খুব ইচ্ছে করছে ডাক্তার হাডসনের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে। তাই মনে-প্রাণে প্রার্থনা করছে তিনি যেন রাতে আসেন। জেসমিন অবশ্য জানে। ডাক্তার হাডসন আসবেনই, কারণ এতদিন পর্যন্ত যখনই সে তাকে কামনা। করেছে তখনই তিনি এসেছেন। পৃথিবীতে এই একটা মানুষ কখনোই তাকে নিরাশ করেনি। প্রথম প্রথম ডাক্তার হাডসনের অস্তিত্বকে তার মিথ্যা বলে মনে হতো। কিন্তু যেদিন থেকে অনুভব করল সত্যি তার পেটে ডাক্তার হাডসনের সন্তান আছে সেদিন থেকে শতভাগ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে ডাক্তার হাডসনের অস্তিত্বও সম্পূর্ণ সত্য। যদি সত্য না হতো, তার পেটে সন্তান আসবে কীভাবে? আর একটা বিশ্বাস তার জন্মেছে, তা হলো ডাক্তার হাডসন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, তা না হলে এভাবে চাইলে তিনি তার কাছে আসতে পারতেন না। আর তিনি যখন আসেন, জেসমিন অনুভব করে তার আর কোনো দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা থাকে না, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হয় সে।
জেসমিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। হঠাই হালকা বাতাসের ধাক্কায় কয়েকটা চুল এসে পড়ল তার মুখে। চোখ খুলে দেখে চারদিকে হালকা লালচে আলো। আর সেই আলোতে তারই পাশে বসে আছেন ডাক্তার হাডসন। সেই নীল পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরা। চোখ দুটোও নীল, গভীর সমুদ্রের টলটলে হালকা নীল পানির মতো, কী সুন্দর! খালি তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। জেসমিনের ইচ্ছা তার সন্তানের চোখও নীল হবে, সমুদ্রের পানির মতো স্বচ্ছ নীল!
ডাক্তার হাডসন বিড়বিড় করে বললেন, আজ তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাব জেসমিন।
কোথায়?
হাডসন হিলে।
হাডসন হিল তো অনেক দূর! সেই কক্সবাজার।
হ্যাঁ, তোমাকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। আজ রাতটা তুমি আমার ওখানে থাকবে। তারপর শেষ রাতে আবার তোমাকে দিয়ে যাব।
আপনি কি আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন?
অবশ্যই পারব। তবে একটা শর্ত আছে আমার।
কী শর্ত?
আমাকে তুমি করে বলতে হবে।
জেসমিন লাজুক ভঙ্গিতে বলল, আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। কীভাবে ‘তুমি করে বলব আপনাকে?
বিষয়টা বয়সের নয়, শুধুই সম্পর্কের। তুমি আমাকে একবার ‘তুমি’ বলা শুরু করে আবার আপনি বলতে শুরু করেছ।
আপনি অনেক গুণী মানুষ। এরকম গুণী মানুষকে তুমি করে বলা ঠিক না। আমি পারব না, আপনাকে আপনি করেই বলব।
ডাক্তার হাডসন খানিকটা নিচে ঝুঁকে এলেন। তারপর টেনে টেনে বললেন, না, ‘তুমি’ করে বলবে, শুধুই ‘তুমি’।
না, না…
হ্যাঁ, ‘তুমি’, শুধুই ‘তুমি’। আগে একবার পেরেছিলে, আজও পারতে হবে এবং আজীবনের জন্য।
জেসমিন চোখ বুজল। তারপর চোখ খুলে টেনে টেনে বলল, তু…তু…মি, তু…তুমি…
এই তো হয়েছে। এখন তৈরি হয়ে নাও, লাল শাড়ি পরবে।
লাল শাড়ি!
হ্যাঁ, লাল শাড়ি।
ঠিক আছে।
জেসমিন লাল শাড়িটা পরল। তারপর হাত ধরল ডাক্তার হাডসনের। মুহর্তেই ভালোলাগার এক অজানা শিহরন খেলে গেল তার সমস্ত শরীরে। সে অনুভব করল যেন উড়ছে, হাওয়ায় উড়ছে।
জেসমিন আর ডাক্তার হাডসন এখন হাডসন হিলে। খালি পায়ে প্রথমে তারা বালুতে নেমে এলো। জেসমিনের মনে হতে লাগল পৃথিবীতে আজকের চাইতে সুখের দিন বুঝি আর নেই। চারপাশটা কী সুন্দর! একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে সমুদ্র, চাঁদের আলোতে অপূর্ব লাগছে দেখতে। সমুদ্রের তীরে পড়ে থাকা পাথরটাকে আজ যেন একটু বেশি সুন্দরই মনে হচ্ছে। কেমন চকচক করছে। ঐ পাথরের উপরেই এসে বসল দুজন। সাগরের হালকা ঠান্ডা বাতাস এসে লাগছে মুখে। একেবারে জুড়িয়ে যাচ্ছে মনটা।
ডাক্তার হাডসন জেসমিনের হাত নিজের মধ্যে নিয়ে বললেন, তুমি সুন্দর জেসমিন, অপূর্ব সুন্দর!
জেসমিন কিছু বলল না, শুধু দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
তোমার কি ভালো লাগছে জায়গাটা?
উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল জেসমিন।
তুমি কিন্তু কথা বলছ না!
এবার জেসমিন মৃদুস্বরে বলর, কী কথা বলব?
ভালোবাসার কথা।
আমি বলতে পারি না। শুধু অনুভব করতে পারি।
অবশ্য এটা সত্য, ভালবাসা যতটা না বলতে পারার, তার থেকে অনেক বেশি হলে অনুভবের। মুখে বললেই ভালোবাসা হয় না, অনুভব করতে হয়। তুমি কি আমাকে অনুভব করো?
আবারো উপরে নিচে মাথা দোলাল জেসমিন।
হঠাৎই ঝাঁপটা একটা বাতাস এসে জেসমিনের চুলগুলোকে মুখের উপর নিয়ে এলো। ডাক্তার হাডসন হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন চুলগুলো। চুল সরাতে না সরাতেই আর একটা বাতাসের ঝাঁপটা জেসমিনের শাড়ির আঁচলটা কাঁধের উপর থেকে সরিয়ে দিল। এবার অবশ্য ডাক্তার হাডসন ঠিক করে দিলেন না আঁচলটা। জেসমিন নিজের হাত দিয়ে শাড়ি ঠিক করতে গেলে ডাক্তার হাডসন জেসমিনের হাত ধরে বললেন, না, তুমি আমার, তোমার সবকিছুই আমার।
জেসমিন কিছু বলল না, নিজের মাথাটা এলিয়ে দিল ডাক্তার হাডসনের কাঁধে। ডাক্তার হাডসন ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল জেসমিনকে। তারপর কাছে টেনে নিতে লাগল, অনেক অনেক কাছে!
*
রাত দুটা। জেহান বসে আছে তার ঘরে। ঘুম আসছে না। ইদানীং তার ঘুম আসে না। বড় অস্থিরতায় থাকে। মূল কারণ জেসমিন। সময় যত যাচ্ছে ততই জেসমিন তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। বিষয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে। তাই জেসমিনকে হারানোর অজানা একটা ভয় কাজ করছে তার মধ্যে। নিজের ব্যর্থতার জন্য নিজেকেই দায়ী করে সে। কারণ এখন পর্যন্ত নিজের ভালোবাসা ভালোলাগার কথা বলতে পারেনি জেসমিনকে। বেশ কয়েকবার প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। শেষ মুহূর্তে কেন যেন ভয় ভয় করে, মুখ থেকে কথা বের হয় না। শেষে অন্যকিছু বলে আসতে হয়, আর বুকভরা কষ্ট নিয়ে পার করতে হয় দিনটা।
জেহান সবুজ রঙের ডায়ারিটা বের করল। এই ডায়ারিটা গোপনে সংরক্ষণ করে সে। ডায়ারির পাতায় পাতায় জেসমিনকে লেখা তার চিঠি। সে লেখে ঠিকই কিন্তু একটাও পাঠাতে পারে না। সেই আগের কারণ, কেমন ভয় ভয় করে, চিঠি পাওয়ার পর আবার কী ভাববে জেসমিন! আজও জেহান একটা চিঠি লেখা শুরু করল।
প্রিয় জেসমিন,
ভালোবাসা নিও। এখন রাত দুইটা। অথচ তোমার চিন্তায় ঘুম আসছে না। তুমি ইদানীং কেমন যেন চুপ হয়ে গেছ। বাড়ি থেকেও বাইরে বের হও না। কলেজে তো যাওই না। জানি না কী হয়েছে তোমার। আজ পুরো বিকেলটা বসেছিলাম ছাদে। আশা ছিল তুমি একবার তোমাদের বাগানে বের হবে। কিন্তু বের হওনি। অথচ আগে প্রত্যেক বিকেলে তুমি বাগানে কাজ করতে। গাছগুলোকে তুমি যখন পানি দিতে আর পশ্চিমের হেলে পড়া সূর্যের আলো তোমার মুখে এসে পড়ত, আমি তোমার সৌন্দর্যে সত্যি পাগল হয়ে যেতাম। কী সুন্দর তুমি! আমি শুধু তোমাকে দেখি আর দেখি! মনে হয় সারাটাদিন তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি। তুমি এত সুন্দর কেন! তুমি কি জানো তোমার হাসি আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ করে দেয়, আমার সমস্ত চঞ্চলতাকে স্থবির করে দেয়, আমি হয়ে পড়ে এক মূর্তি, ভালোবাসার মূর্তি। আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি জেসমিন, দারুণ ভালোবাসি। অথচ সেই ভালোবাসার কথা তোমাকে বলতে পারছি না, বুঝাতে পারছি না। আমি অধম, সত্যি অধম। তবে আমি প্রতিজ্ঞা করছি তোমাকে বলব, আমার ভালোবাসার কথা তোমাকে বলব আর জয় করব তোমার মন। তারপর আমাদের জীবন হবে আনন্দের, বড় সুখের। তবে তুমি সত্যি পালটে যাচ্ছ, চুপচাপ থাকছ সবসময়। তোমাদের বাসায় গেলে খুব একটা কথাও বলো না, যদিও আগে বলতে। আমি অনুভব করি, তোমার কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। কেউ কিছু বলে না। হেডমাস্টার স্যার আর তোমার আম্মা দুজনকেও কেমন যেন চিন্তিত দেখায় সবসময়, কথা বলতে গেলে মনে হয় এড়িয়ে যাচ্ছেন। বুঝতে পারছি না কেন। তোমার এই মন খারাপ থাকা, বিষণ্ণ থাকা আমাকে এতটাই উদ্বিগ্ন করেছে যে আমি গিয়েছিলাম বিখ্যাত মনোচিকিৎসক ডাক্তার তরফদারের কাছে। মূল উদ্দেশ্য ছিল, তোমার বিষণ্ণতা কীভাবে দূর করা যায় তা জানা। আমি তার সাথে কথা বললেও তোমার বিষয়টা নিয়ে শেষ মুহূর্তে আর কথা বলতে পারিনি। কারণ আতঙ্কিত ছিলাম, যদি তিনি জিজ্ঞেস করেন তুমি আমার কী হও, তাহলে কী উত্তর দেব? আসলে আমি তোমার জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। এই না-পারা আমার জীবনের আর-এক ব্যর্থতা। জানি না তোমার জন্য আমাকে কত হাজারবার ব্যর্থ হতে হবে। আমি তোমাকে চাই, মন থেকে চাই। সামনাসামনি না পারলেও মনে মনে ভোমার কাছে আবেদন করছি, নিবেদন করছি, তুমি আমার হও। জানি না, কত সহস্ত্র নিবেদনে হবে তুমি আমার। তবে এটা সত্য, তোমার জন্য ব্যর্থ হতে, হারতে আমার লজ্জা লাগে না, কষ্ট লাগে না। বরং এই ভেবে তৃপ্তি পাই যে আমি হারলেও হারছি আমার প্রিয়তমার জন্য।
শুভরাত্রি!
প্রিয়তমা আমার।
চিঠি লেখা শেষ করার পর মনের মধ্যে কিছুটা হলেও প্রশান্তি অনুভব করছে জেহান। সবসময়ই সে লক্ষ করেছে যখন জেসমিনকে সে গভীরভাবে অনুভব করে, একটা চিঠি লিখলে শান্ত হয়ে উঠে মনটা। এখন কিছুটা হলেও ভালো লাগছে। তাই সে বিছানায় এলো। অনুভব করছে ঘুম দরকার তার, আজ সারাটা দিন অস্থিরতায় থাকায় ক্লান্তিও গ্রাস করেছে তাকে। তাই শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের দিন সকাল সাড়ে দশটার দিকে জেসমিনদের বাড়িতে এলো জেহান। এই বাড়িতে আসার ক্ষেত্রে তার কোনো বিধিনিষেধ নেই। তবে বয়স যত বাড়ছে যাতায়াত ততই কমে আসছে। জেসমিন নিজেও আগে তাদের বাড়িতে আসত। ইদানীং আসে না বললেই চলে। গত ছয় মাসে তো একবারও আসেনি।
বাড়ির বারান্দায় দেখা হলো জয়ের সাথে। জয় মাথা উঁচু করে বলল, ভাইয়া, আমার চকলেট কোথায়?
জেহান পকেট থেকে চকলেট বের করে জয়কে দিলে। জয় খুশি হয়ে বলল, আমি জনিকে দিয়ে আসি।
ঠিক আছে, তোমার আপু কোথায়?
ঘরে আছে। তুমি যাও। আমি একটু আগে কথা বলে আসছি।
আর তোমার আম্মু?
রান্নাঘরে, ইলিশ মাছ রাঁধতেছে।
কথাগুলো বলতে বলতে জয় চলে গেল তাদের ঘরে। জনি ওখানে আছে।
জেহান এখন জেসমিনের ঘরের দরজার সামনে। মনে মনে ঠিক করল আজ সে ‘আপু’ সম্বোধন করবে না। আর পারলে নিজের ভালোবাসার কথাটাও বলবে, বলবে ডাক্তার তরফদারের কথা। এরকম একটা ভাবনা থেকে দরজায় টোকা দিল। তারপর ঢুকে গেল ভিতরে।
জেসমিন চেয়ারে বসে ছিল। তার দিকে তাকিয়ে বলল, জেহান তুমি!
তোমার সাথে কথা বলতে এলাম। কলেজে যাচ্ছ না, বাইরে বের হচ্ছ না, কেন?
ম্লান হাসল জেসমিন। বলল, শরীরটা একটু খারাপ।
কী হয়েছে?
দুর্বল দুর্বল লাগে।
ডাক্তার দেখাওনি?
হ্যাঁ দেখিয়েছি, ওষুধও খাচ্ছি। ডাক্তার বলেছে সময় লাগবে।
তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি খুব অসুস্থ। অনেকটা শুকিয়ে গেছ। চোখের নিচে হালকা কালি পড়েছে। কী ব্যাপার বলল তো!
জেহান, তুমি অত চিন্তা করো না। কলেজ কেমন চলছে?
ক্লাস তো হচ্ছে। কিন্তু সবাই জিজ্ঞেস করে, তুমি কেমন আছো? কিছু তো বলতে পারি না। আসলে তোমার অসুখটা কী তাও জানি না। টেবিলের উপর দেখছি আবার অনেক ওষুধ।
অধিকাংশই ভিটামিন আর আয়রন ট্যাবলেট। আর ঐগুলো যেগুলো দেখছ, ব্যথার ওষুধ, সাথে গ্যাস্ট্রিকের।
কীসের ব্যথা?
তলপেটে ব্যথা। কলেজে একবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, মনে আছে?
হ্যাঁ, ঐ ব্যথা না কমে গেল!
এখনো কমেনি। হঠাৎ হঠাৎ ওঠে। এত বেশি যে সহ্য করা যায় না, মনে হয়…
কী মনে হয়?
থাক ওসব কথা। তুমি কি আমার একটা উপকার করতে পারবে?
কী উপকার?
বিষয়টা অত্যন্ত গোপনীয়।
জেহান নড়েচড়ে বসে বলল, অবশ্যই করতে পারব। আর সবকিছু গোপনও রাখব। তুমি আমার উপর শতভাগ আস্থা রাখতে পারো।
জেহান এমনভাবে কথাগুলো বলল যেন এরকম একটা মুহূর্তের জন্যই সে অপেক্ষা করছিল। একই সাথে সে অনুভব করছে, এখনই মোক্ষম সময়। নিজের ভালোলাগা আর ভালোবাসার কথা এই সুযোগে তার বলা উচিত। সে যখন এরকম প্রস্তুতি নিচ্ছে বইয়ের ভাজ থেকে একটা খাম বের করে তাকে দিল জেসমিন। বলল, তুমি এই চিঠিটা রাশেদ ভাইকে দেবে।
জেহান তোতলাতে তোতলাতে বলল, রা…রা…রাশেদ ভাই!
হ্যাঁ, খুব অস্থিরতায় ভুগছেন উনি। আর বলবে যেন আমাকে নিয়ে বেশি চিন্তা না করে।
জেহান একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। ডিজিটাল এই যুগে প্রেমের গভীরতা কত বেশি হলে চিঠির আদানপ্রদান সম্ভব! তার ইচ্ছে হলো বলতে যে সে চিঠি দিয়ে আসতে পারবে না, কারণ সে জেসমিনকে ভালোবাসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে বলল। জেসমিন কষ্ট পাক এমন কিছু সে করতে চায় না, জেসমিনের সুখ আর শান্তিই তার মূল লক্ষ্য।
বাইরে আসতে দেখা হলো জেসমিনের মা নিলুফারের সাথে। তিনি বললেন, কখন এসেছ জেহান?
এই তো কিছুক্ষণ হলো খালাম্মা।
তোমার আম্মা কেমন আছেন?
ভালো।
যাব যাব করে যাওয়া হয় না তোমাদের বাড়িতে। দেখি একদিন যাব।
আসবেন খালম্মা।
একটু থেমে জেহান আবার বলল, একটা কথা বলি…খা…লাম্মা, জেসমিনের শরীর বোধহয় খুব খারাপ। একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভালো একজন ডাক্তার দেখানো উচিত।
নিলুফার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ডাক্তার দেখিয়েছি, লাভ হয়নি। একজন মনোরোগবিশেষজ্ঞকে দেখাতে বলেছে ডাক্তার। তোমার হেডস্যার চেষ্টা করছে। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখাব। আসো, মুড়ি খাও, ঝালমুড়ি মাখিয়েছি।
না খালাম্মা, আজ খাব না। অন্য একদিন খাব। আসি।
সালাম দিয়ে বের হয়ে এলো জেহান। তার চোখে পানি। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তার নিজের পছন্দের মানুষের চিঠি কিনা তাকে পৌঁছে দিতে হবে তার চিরশত্রুর কাছে। কী অবিশ্বাস্য! তারপরও সে কাজটা করবে, করবে এই ভেবে যে সে কথা দিয়ে এসেছে জেসমিনকে।
*
নিলুফার রান্নাঘর গুছিয়ে শোবার ঘরে প্রবেশ করলেন রাত দশটার দিকে। প্রথমে বিছানা গুছালেন তিনি। শরীরটা বড় ক্লান্ত লাগছে তার। অবশ্য আজ, প্রায়ই ক্লান্ত লাগে। জেসমিন গর্ভবতী, এই সংবাদটা শোনার পর থেকেই মানসিক অবসাদ প্রতিদিনই বাড়ছে। এজন্য জোর পান না শরীরে। মন ভালো না থাকলে যে শরীর ভালো থাকে না এই সত্যটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন তিনি।
নাজমুল হোসেন ঘরে ঢুকলেন অনেকটা নিঃশব্দে। ওষুধের দোকানে গিয়েছিলেন তিনি। নিলুফার বললেন, ওষুধ পেয়েছ?
উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে নাজমুল হোসেন বললেন, হ্যাঁ পেয়েছি। এই যে ট্যাবলেট। আজ রাতে খাইয়ে দেবে। তাহলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গর্ভপাত হবে।
নিলুফার কাঁপা হাতে লাল রঙের ওষুধ দুটো নিলেন।
নাজমুল হোসেন আবার বললেন, জেসমিন রাজি হবে তো?
রাজি হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় আছে! কার সন্তান পেটে ধরেছে এখন পর্যন্ত বলল না। ঐ সন্তান জন্ম দিলে সমাজে মুখ থাকবে নাকি আমাদের? আজ সারাদিন তো ব্যথায় ভুগল। ক্লিনিকেও নিতে হয়েছে। কলেজে পরীক্ষা পর্যন্ত দিতে পারল না। সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন এই ওষুধ না খেয়ে উপায় কী?
আমার নিজের যতটা না কষ্ট হচ্ছে, ওর কথা ভেবে বেশি কষ্ট হচ্ছে। এই বয়সে কত বড় একটা ভুল করে ফেলল!
শুধু ওর দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের সমাজেরও দোষ। ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতে মোবাইল ফোন, কম্পিউটারে ইউটিউব, টেলিভিশনে শুধু উলটাপালটা হিন্দি সিরিয়াল, এইগুলা দেখেই তো নষ্ট হচ্ছে সবাই।
তুমি ঠিকই বলেছ। তবে সমাজের কথা চিন্তা করে এখন আর লাভ নেই। আগে ঘর সামলাই। আমার কাছে সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে।
শুধু এলোমেলো না, রহস্যও আছে এর মধ্যে।
কী রহস্য?
গত তিন মাসে আমি অনেকদিন সকালে জেসমিনকে লাল শাড়ি পরে শুয়ে থাকতে দেখেছি। ও রাতে ঘুমায় সালোয়ার কামিজ পরে, অথচ সকালে দেখি শাড়ি। কী অদ্ভুত! রাতে শাড়ি পরে ঘুমাবে কেন?
কই! আগে বলোনি তো!
ঠিক ঐভাবে সন্দেহ হয়নি। হয়তো ভেবেছিলাম শখ করে পরেছে। বিষয়টা কেমন যেন সন্দেহজনক।
রাতে কি তাহলে বাইরে যায়?
তা তো সম্ভব না। সামনের গ্রিলে তালা দেয়া থাকে। ওর ঘরের জানালায়ও গ্রিল লাগানো। বাইরে যাবে কীভাবে? আবার চাবিও তো থাকে আমাদের ঘরে।
তালার দুইটা চাবি, আর-একটা কোথায়?
ওটাও আমার কাছে।
তাহলে?
ঠিক বুঝতে পারছি না। ওর কাণ্ডকারখানা যেন কেমন! বাচ্চা পেটে, খুব যে টেনশনে আছে মনে হয় না। মাঝে মাঝে গুনগুন করে গানও গায়।
নাজমুল হোসেন মাথা নেড়ে বললেন, না না, এভাবে বলো না। জেসমিন শুকিয়ে যাচ্ছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে। লক্ষ করেছ?
হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের সবকিছু খুলে বলবে না! ওর আচরণে মনে হয় আমরা ওর শত্রু। আমরা যে ওর মঙ্গল চাই তা ও বুঝতে পারছে না।
এমন একটা বিষয়, কথা বলাও অস্বস্তিকর। যাইহোক, তুমি ওকে ওষুধ দুটো খাইয়ে দাও। ওষুধ খাওয়ানোর পর তলপেটে ব্যথা উঠতে পারে। লক্ষ রাখতে হবে ওর উপর।
আমি তো চাই জেসমিনের ঘরে ঘুমাতে। জেসমিন রাজি হয় না। দেখি, আজকেও বলে দেখি।
কথাগুলো বলে ওষুধ হাতে নিলুফার এলেন জেসমিনের ঘরে। জেসমিন শুয়ে ছিল। জানালা দিয়ে দেখছিল বাইরের চাঁদ। নিলুফার আসলে নিজে থেকেই বলল, কী সুন্দর চাঁদ, দেখেছ মা?
হা, পূর্ণিমা বোধহয়।
আজ না, আগামীকাল।
বুঝলি কীভাবে?
চাঁদটা একটু ছোট ছোট মনে হচ্ছে।
রাতে বাইরে তাকিয়ে আছিস, ভয় করছে না?
কীসের ভয়?
কতকিছুর ভয়ই তো থাকে। তুই যেন ইদানীং বুঝেও অনেককিছু বুঝতে চায় না। শোন, ঝামেলা যা হবার হয়েছে। এখন সবকিছুর সমাধান করতে হবে। তোর বাবা ওষুধ নিয়ে এসেছে। এই ওষুধ দুটো খেয়ে নে।
জেসমিন অবাক হয়ে বলল, কীসের ওষুধ!
নিলুফার কোনো ভণিতা ছাড়াই বললেন, গর্ভপাতের ওষুধ। এই ওষুধ খেলে পেট খালি হয়ে যাবে। তখন তুই নিশ্চিন্ত হতে পারবি। আমরাও বেঁচে যাব।
কী বলছ এসব!
কী বলছি মানে!
আ…আমি একটা মানুষকে মেরে ফেলব!
মানুষকে মারছিস কোথায়? জন্মই তো হয়নি ওর।
হয়নি, তবে জীবন তত সৃষ্টি হয়েছে, হৃদস্পন্দন তো আছে। আমি কীভাবে একটা মানুষকে হত্যা করব!
নিলুফার খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, গর্ভপাত মানুষ হত্যার জন্য না, তোর জন্য চিকিৎসা। তুই যা করছিস! নিজেও মরবি, আমাদেরও মারবি। এই যে নে পানি, ওষুধ দুটো খেয়ে নে। আর দুই-একদিনের মধ্যে তোকে একজন মানসিক ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তোর বাবা ডাক্তার ঠিক করছে।
ঠিক আছে ডাক্তারের কাছে যাব। তবে ওষুধ এখন খাব না।
তো কখন খাবি?
পরে খাব। টেবিলের উপর রেখে যাও।
এখন খেলে কী হয়?
জেসমিন বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মা।
আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না?
না। যাও তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
কথা শেষ করে আবার চাঁদের দিকে মুখ ফেরাল জেসমিন। নিলুফার আর কিছু বললেন না! টেবিলের উপর ওষুধ আর পানি রেখে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। বড় অস্বস্তি লাগছে তার।
জেসমিন বিছানা থেকে উঠল আধ ঘণ্টা পর। তারপর টেবিল থেকে ওষুধ দুটো নিয়ে বাথরুমে গেল। বেসিনে ফেলে ছেড়ে দিল কল। দুটো ওষুধই গলে হারিয়ে গেল পানির মধ্যে।
জেসমিন মৃদু একটা হাসি দিল। এতক্ষণ নিজের মধ্যে একরকম আতঙ্ক কাজ করলেও কেন যেন এখন বড় ভালো লাগছে। আজ তার ইচ্ছে হচ্ছে লাল শাড়ি পরে ডাক্তার হাডসনের সাথে সময় কাটানোর। বলবে, তাকে কক্সবাজার নিয়ে যাওয়ার জন্য। জায়গাটা তার বড় পছন্দের। যখনই যায়, তখনই ভালো লাগে। এই পর্যন্ত কতবার যে গেছে তার কোনো হিসাব নেই। নির্জন পাহাড়ে সে আর শুধু তার প্রিয় ডাক্তার হাডসন! মাঝে মাঝে ভাবে সারাটাজীবন যদি ঐ হাডসন হিলে কাটিয়ে দিতে পারত।
ভাবনায় সুন্দর একটা ভালোলাগা নিয়ে চোখ বন্ধ করল জেসমিন। কতক্ষণ সে চোখ বন্ধ করে ছিল বলতে পারবে না। ঠুক ঠুক শব্দ শুনে চোখ মেলে তাকাল। তার ঘরের জানালার ওপাশে শব্দ হচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিল বুঝি ডাক্তার হাডসন এসেছে। পরে যখন ‘জেসমিন, জেসমিন’ ডাক শুনল ভুল ভাঙল তার। ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ।
জেসমিন অবাক হয়ে বলল, ভাইয়া আপনি!
হ্যাঁ। অনেকদিন তোমাকে দেখি না। তাই আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না।
এত রাতে এসেছেন! এখন কয়টা বাজে!
সাড়ে বারোটা।
আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?
আসলেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে তোমার! শুকিয়ে গেছ অনেকটা, চোখের নিচে কালি পড়েছে।
মৃদু হাসল জেসমিন। তারপর টেনে টেনে বলল, এজন্যই আপনাকে চিঠিতে লিখেছি যে আমাকে ভুলে যান। আমার ভালোবাসা আপনার জন্য নয়। চিঠিটা কি দেয়নি জেহান?
হ্যাঁ দিয়েছে। ঐ চিঠি পেয়েই মন খারাপ হয়ে গেছে। তুমি আমার ফোন পর্যন্ত ধরছ না ইদানীং।
ঐ যে বললাম, আপনার জন্য আমার আর ভালোবাসা নেই ভাইয়া, আমার ভালোবাসা নীল চোখের ছায়ার জন্য।
নীল চোখের ছায়া!
হ্যাঁ। নীল চোখ।
কী সব বলছো জেসমিন!
সত্য বলছি। এজন্য অনুরোধ করব আর আমাকে ফোন করবেন না, চিঠি লিখবেন না। আমার কাছে কোনোদিন আসবেনও না। আমি সত্যি অন্য কারো হয়ে গেছি। আর এটাও সত্য, কখনো আপনার ছিলাম না, এখনো নেই। মাঝে হয়তো আপনার সাথে কথা বলেছি, রিকশায় উঠেছি, মোটরসাইকেলে ঘুরতে গিয়েছি…
শুধু ঘুরতেই যাওনি, আমরা দুজনে দুজনার…
জেসমিন ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, প্লিজ ভাইয়া, যা কিছু ঘটেছে নিজের মধ্যেই রাখুন। আমি চাই না কোনো কারণে আপনি বিব্রত হন, আপনার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক।
তোমার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না জেসমিন।
প্লিজ আপনি যান। বাবা-মা এখনো জেগে আছে। যে কোনো সময় চলে আসতে পারে। আর-একটা কথা, কোনোদিনও এখানে আসবেন না। ভুলে যাবেন আমাকে, চিরদিনের জন্য। একটা কথা সত্য, আমি আপনাকে ঠকাতে পারব না।
আ…আমি…
জেসমিন আবার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে নিষেধ করল রাশেদকে। ফিসফিস করে বলল, আপনি চলে যান, সম্ভবত মা এদিকে আসছে, পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
রাশেদ আর কথা বলল না। চলে যাওয়ার জন্য লাফ দিয়ে পিছনের দেয়ালের ওপর উঠল। জেসমিন অবশ্য ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকল। নিলুফার ঢুকলেন ভিতরে। কপালে হাত রাখলেন জেসমিনের। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, আমার এত সুন্দর মেয়েটার কী যে হয়ে গেল!
*
জেহানের মনটা খারাপ। কারণ জেসমিন আজও পরীক্ষা দিতে পারেনি। তার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা। হিউম্যানিটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সারাদিন ওখানে ছিল। সন্ধ্যার পর নিয়ে আসা হয়েছে বাসায়। সে গিয়েছিল দেখতে। কিন্তু কথা বলতে পারেনি। কারণ ঘুমিয়ে ছিল জেসমিন। অথচ জেসমিনের সাথে তার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে। কয়েকদিন আগে যেদিন শেষ কথা হয়েছিল, রাশেদকে দেয়ার জন্য চিঠি ধরিয়ে দিয়েছিল জেসমিন।
জেহান তার সবুজ ডায়ারিটাতে আবার লিখতে শুরু করল,
প্রিয় জেসমিন, মন ভালো নেই। কারণ, তোমাকে আজ দেখতে পেলাম না। তুমি অসুস্থ হলে আমি নিজেও অসুস্থ হয়ে যাই। কিছু ভালো লাগে না। শুধু মনে হয় তুমি কখন সুস্থ হবে আর তোমাকে দেখতে পাব। আজ তুমি পরীক্ষা দিতে পারলে না, তার মানে সামনের এইচএসসি পরীক্ষা তুমি দিতে পারবে না। বড় দুঃসংবাদ তোমার জন্য। তবে মন খারাপ কোরো না। আমি তো আছি। সামনে হয়তো আমাদের সাথেই তোমার ক্লাস করতে হবে। আমি নিশ্চিত করে বলছি, তোমাকে যত সাহায্য করতে হয় করব, তোমাকে ক্লাসনোট দেয়া, পড়া বুঝিয়ে দেয়া, অ্যাসাইনমেন্ট করে দেয়া সব আমার দায়িত্ব। ক্লাসের ফাঁকে তোমার সাথে সিঙ্গারা পুরি খাওয়ার আমার বড় শখ। দুজনে সিরাজ মামার দোকানে বসব আর সিঙ্গারা খাব। আমি কিন্তু তখন তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকব। তুমি নিষেধ করতে পারবে না। সত্যি কথা কী, তোমার অবস্থান আমার মনে নয়, মনের অনেক অনেক গহিনে, যেখানে অন্য কেউ কোনোদিন পৌঁছাতে পারবে না। ঐ জায়গাটা শুধু তোমার, শুধুই তোমার। যখনই প্রয়োজন হবে, আমি তোমাকে বুকের ঐ গহিন থেকে বের করে আনব, তারপর দেখব, দেখব, আর দেখতেই থাকব। কেন জানো? তুমি সুন্দর, অপূর্ব সুন্দর। তোমার মতো সুন্দর আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। ভালো থেকো, সুন্দর থেকো, আর দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠো প্রিয়তমা আমার।
চিঠি লেখা শেষ করার পরও ঘুম আসছে না জেহানের। কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে ছাদে উঠে এলো সে। হাঁটাহাঁটি করতে থাকল এ মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত। জেসমিনদের বাড়ির প্রান্তে যখন আসে তখন প্রত্যেকবারই চোখ রাখে বাড়ির উপর, যদি একবার জেসমিনকে দেখা যেত। সে জানে জেসমিনকে দেখা যাবে না, তারপরও মন যে বারবার চায়!
হঠাৎই জেহানের চোখ পড়ল একজন পুরুষ বের হয়ে যাচ্ছে জেসমিনদের বাড়ির পিছনের দেয়াল ডিঙিয়ে। প্রথমে মুখটা দেখা না গেলেও পরে যখন পিছন ফিরল তখন দেখা গেল। আর কেউ নয় রাশেদ। এত রাতে রাশেদ এখানে ভাতেই ভাঙা মনটা আরো ভেঙে গেল জেহানের। তার মানে রাতে রাশেদকে বাড়িতে আসতে দিচ্ছে জেসমিন। কী অবিশ্বাস্য! যে জেসমিন আজ অসুস্থ, ক্লিনিকে ছিল সারাদিন, পরীক্ষা দিতে পারেনি, এমনকি সে নিজে গিয়েও দেখা করতে পারেনি, সেই জেসমিন কিনা আজ রাতেই কথা বলছে রাশেদের সাথে। নিশ্চয় ফোনে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ভাবতেই শরীর কাঁপতে শুরু করল জেহানের। ভয়ংকর এই কষ্টটা সে আর সহ্য করতে পারছে না। ছাদেই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে বের হয়ে আসতে লাগল পানি। সিদ্ধান্ত নিল আজ সে কাঁদবে, যতক্ষণ ইচ্ছা হবে কাঁদবে। কেঁদে কেঁদে নিজের বুকের কষ্ট লাঘব করবে।
জেহান কতক্ষণ ছাদে বসে ছিল বলতে পারবে না। একসময় নিচে এলো, তারপর আবার টেনে নিল ডায়ারিটা। লিখতে শুরু করল,
প্রিয় জেসমিন, তুমি ভাবছ অন্যের প্রতি তোমার ভালোবাসা থাকলে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কমে যাবে। না মোটেও না। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা বড় নিখাদ, বড় খাঁটি। দিন যত যাবে এই ভালোবাসা ততই বাড়তে থাকবে। জানি না বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে। দুঃখ, এই ভালোবাসা তোমাকে দেখাতে পারছি না। তুমি আমাকে ভালোবাসো বা নাই বাসো, অন্তত আমার ভালোবাসাটা যদি তোমাকে দেখাতে পারতাম, তাহলে অন্তত মনে শান্তি পেতাম। তুমিও বুঝতে পারতে একজন মানুষ অন্য একজন মানুষকে কতটা ভালোবাসতে পারে, ভালোবাসার তীব্রতা আর গভীরতা কত দূর পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, আমি নিজেকে তোমার কাছে প্রকাশ করতে পারি না, বারবার ব্যর্থ হই। তুমি কি একবারের জন্য হলেও আমাকে বুঝতে পারো না? বুঝতে পারো না যে, তোমারই বাড়ির পাশের কেউ একজন তোমাকে দারুণ ভালোবাসে, তার হৃদয়ে শুধু তুমি, তুমি আর তুমি। একবার, শুধু একবার যদি তুমি বুঝতে পারতে আমি যে কী খুশি হতাম! যাইহোক, তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসতেই পারো, সেই অধিকার তোমার আছে। আমি তোমাকে নিষেধ করব না। তবে মনে রেখো, যাকে তুমি ভালোবেসেছ সে যদি তোমাকে ছেড়ে চলেও যায় আমি তোমাকে ঠিকই ভালোবাসব। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কোনোদিনও কমবে না, কোনোদিনও না, শুধু বাড়তেই থাকবে, বাড়তেই থাকবে। এত বাড়বে যে হিমালয় পেরিয়ে আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে, আকাশ পেরিয়ে মহাকাশ, তারপর দূরে আরো দূরে… তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার ব্যাপ্তি সীমাহীন, প্রিয়তমা আমার।
চিঠি লেখা শেষ করার পর জেহান ডাইনিং রুমে এলো। পানি খেল এক গ্লাস। দেখল তার মা মরিয়মও ঘুম থেকে উঠেছেন। জেহানকে দেখে বললেন, কী রে, ঘুমাসনি?
না মা।
কেন?
ঘুম আসছে না।
কী বলছিস! কী হয়েছে?
জানি না মা, তুমি কি আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দেবে?
আহারে আমার ছেলেরে! তোকে ঘুম পাড়িয়ে না দিলে কাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব। চল, চল।
শুয়ে পড়লে মরিয়ম জেহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। জেহান একসময় বলল, মা, আমি যদি তোমার কাছে কোনো সাহায্য চাই করবে?
অবশ্যই করব। কী হয়েছে তোর, বল তো।
কিছু হয়নি।
কিছু একটা তো হয়েছে। তা না হলে সাহায্যের কথা বলবি কেন?
বললে রাখবে কি না বলো?
আমি তোর মা। রাখার মতো হলে অবশ্যই রাখার চেষ্টা করব। কী হয়েছে বল!
জেহান সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তার মাকে জেসমিনের কথা বলবে। যা থাকে কপালে হবে। কিন্তু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। বলল, মা আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে আছে, নাম হাবিব। হাবিবের দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক টাকা লাগবে চিকিৎসা করতে। তুমি কি ওকে আপাতত হাজার দশেক টাকা দিতে পারবে?
মরিয়ম মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, এই সামান্য বিষয় নিয়ে এত চিন্তা করছিস! আমি তোর নানাকে বলে দিচ্ছি। তুই তো জানিস তোর নানা ডাক্তার আর তার ক্লিনিকও আছে। ওখানে হাবিবের ফ্রি চিকিৎসা করা হবে। আর দশ হাজার টাকা কালই তোকে দিয়ে দেব। তুই হাবিবকে দিয়ে আসিস। আরো যদি কিছু করা লাগে, বলবি। এটা তো ভালো উদ্যোগ, আমি চাই তুই এইসব ভালো উদ্যোগের সাথে থাকবি।
জেহান তার মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। মরিয়ম ভাবলেন তার সন্তান বড় খুশি হয়েছে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তিনি টের পেলেন না যে কী অসম্ভব এক কষ্ট ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে জেহানের হৃদয়টা!
*
পড়ন্ত বিকেল।
ডাক্তার ফারজানা আক্তারের কাছে এসেছেন নাজমুল হোসেন। সকালে এসেছিলেন তার স্ত্রী আর জেসমিনকে নিয়ে। আলট্রাসনোগ্রাম করতে দিয়েছেন তিনি। সকালেই করিয়েছেন, তবে রিপোর্ট হাতে পেয়েছেন কিছুক্ষণ আগে। ডাক্তার ফারজানাকে রিপোর্ট দেখিয়ে তারপর তিনি বাসায় যাবেন।
ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর যখন নিশ্চিত হলেন ডাক্তার আসবেন তখন বেশ অস্থির হয়ে পড়লেন নাজমুল হোসেন। কী করবেন ভাবতে শুরু করলেন। পারুল নামের যে নার্স সবসময় সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করে তাকে রিপোর্টগুলো দেখালেন নাজমুল হোসেন। পারুল আগে থেকেই চিনত নাজমুল হোসেনকে, তিনি যে স্কুলের হেডমাস্টার তাও জানত। বলল, স্যার, পেটের সন্তান তো বড় হয়ে গেছে!
নাজমুল হোসেন তোতলাতে তোতলাতে বলল, আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না…
রিপোর্ট যে ডাক্তার লিখেছেন উনার মতামত তো প্রেগন্যান্সিরই। আর এই যে পেটের ভিতরের ছবি দেখুন, বাচ্চাটা বেশ বড় হয়েছে। মাথা, শরীর বোঝা যাচ্ছে।
এখন আমি কী করব?
অ্যাবরশনের জন্য যে ওষুধ দিয়েছিলাম সেগুলো খাওয়াননি।
না, খাওয়াইনি।
সর্বনাশ, সময় তো পার হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা বড় হয়ে গেলে অ্যাবরশন মানে গর্ভপাত আর সম্ভব হবে না।
আমি একটু ডাক্তারের সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
ফারজানা ম্যাডাম বোধহয় আর আসবেন না।
আসবেন না মানে!
ম্যানেজমেন্টের সাথে সকালে তার ঝগড়া হয়েছে। যাওয়ার সময় বলে গেছেন আর আসবেন না। ফোনে কথা বলতে পারেন। কিন্তু লাভ হবে না। রিপোর্ট না দেখে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না।
অন্য কোনো ডাক্তার কি দেখানো যাবে?
আর কোনো গাইনির ডাক্তার নেই। আসলে কি জানেন স্যার, কেরানীগঞ্জে কোনো ডাক্তার থাকতে চায় না। সবাই থাকতে চায় ঢাকায়।
আমি তাহলে কী করব?
আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি আপনার মেয়ের পেটের সন্তানকে এই পৃথিবীর আলো দেখতে দেবেন, কি দেবেন না। পরিবারের সবার সাথে কথা বলুন। যদি জন্ম দিতে চান তাহলে নিয়মিত চেকআপ করাবেন। আর যদি না দিতে চান, দুই-একদিনের মধ্যেই গর্ভপাতের ওষুধ খাইয়ে দেবেন। আমি আবার ওষুধ লিখে দিচ্ছি, সিদ্ধান্ত আপনার। যত দেরি হবে, বিপদ তত বাড়বে। তখন হাসপাতালে ভর্তি করানো ছাড়া উপায় থাকবে না।
কথাগুলো বলে পারুল একটা কাগজে ওষুধের নাম লিখে দিল।
নাজমুল হোসেন বাসায় ফিরলেন রাত নয়টার দিকে। হাতে ওষুধ। মন খারাপ করে অনেকক্ষণ বসে ছিলেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। তারপর বাসায় ফিরেছেন। সবকিছু শোনার পর নিলুফার বললেন, আমাদের কিছু করার নেই এখন। ওষুধ খাওয়াতেই হবে জেসমিনকে। বড় বেয়াড়া হয়ে গেছে। ও। আমার কানে আজ একটা কথা এসেছে।
কী কথা?
রাশেদ নামের যে ছেলেটার সাথে ওর সম্পর্ক হয়েছিল তার সাথে মোটরসাইকেলে দূরে নাকি ঘুরতেও গিয়েছিল কয়েকবার।
নাজমুল হোসেন চোখ বড় বড় করে বললেন, কে বলল তোমাকে এই কথা?
আমাদের বাসায় যে রহিমা বুয়া কাজ করে, সে বলেছে।
তার মানে জেসমিনের পেটে যে বাচ্চা আছে তা রহিমা বুয়াও জানে!
অনেকেই জেনে গেছে।
কী সর্বনাশ!
এই কথা দিনের পর দিন লুকিয়ে রাখবে কীভাবে? তবে আমি এখনো স্বীকার করিনি কারো কাছে। স্বীকার করা যাবে না। তার আগেই ওষুধ খাইয়ে কলেজে পাঠাতে হবে জেসমিনকে। তা না হলে সন্দেহ বাড়তেই থাকবে।
তুমি কি নিশ্চিত হয়ে বলছ যে রাশেদের সাথে অনেক দূরে ঘুরতে যেত জেসমিন?
হ্যাঁ। সন্ধ্যায় আমি জেসমিনের বান্ধবী শান্তাকে ডেকেছিলাম। ওর কাছ থেকেও শুনেছি।
শান্তা কি জানে বাচ্চার কথাটা?
সরাসরি আমার সাথে কথা হয়নি। তবে আমার ধারণা ও অনুমান করতে পেরেছে।
নাজমুল হোসেন দাঁড়িয়ে ছিলেন। চেয়ারে বসে বললেন, আমার যে কী হবে? স্কুলের ছেলেমেয়েরা জানলে আর হেড মাস্টারগিরি থাকবে না। বড় বিপদে পড়ে যাব।
তুমি অত ভেবো না। আজ আমি ওকে ওষুধ খাওয়াবোই খাওয়াবো।
নাজমুল হোসেন আর কোনো কথা বললেন না। শুয়ে পড়লেন বিছানায়। বড় ক্লান্ত লাগছে তার নিজেকে। নিলুফার জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, খাবে না?
ক্ষুধা নেই।
মন খারাপ কোরো না। আমি একটা ব্যবস্থা করছি। আশা করছি আমাদের আপদ-বিপদ সব দূর হয়ে যাবে। কেন এ কথা বলছি জানো? জ্ঞাতসারে আমরা কখনো কোনো অন্যায় করিনি। আশা করছি বড় ধরনের কোনো বিপদে আমরা পড়ব না।
মুদু হাসলেন নাজমুল হোসেন। বললেন, আমরা তো মহাবিপদের মধ্যে আছি।
এই বিপদ থেকে আল্লাহই আমাদের উদ্ধার করবেন। আমি খাবার গরম করছি, তুমি খাবে। তারপর আমি যাব জেসমিনের কাছে। জেসমিনও রাতে খায়নি। ওকেও খাওয়াতে হবে।
জেসমিন অবশ্য রাতে খেল না। ওষুধ খাওয়ার কথা বলাতে প্রচণ্ড রেগে উঠল। নিলুফারও ছাড়লেন না আজ। বললেন, তুই যদি ওষুধ না খাস, তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি। তোর জন্য আজ আমাদের মানসম্মান সব শেষ!
এবার জেসমিন কিছু বলল না, চুপ করে বসে থাকল।
এই যে পানি, ওষুধ খা।
আগের মতোই মুখ গম্ভীর করে বসে থাকল জেসমিন।
নিলুফার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। ঠাস করে একটা চড় কষালেন জেসমিনের গালে। তারপর পানি আর ওষুধ এগিয়ে দিলেন। জেসমিন এবারও ওষুধ নিল না। শুধু তার দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
হঠাৎই খুব খারাপ লাগতে শুরু করল নিলুফারের। তিনি জীবনেও জেসমিনের গায়ে হাত তোলেননি। আজ প্রথম তুললেন। ভয়ানক এক কষ্টে মুষড়ে উঠল বুকটা। আর অপেক্ষা করলেন না, ফিরে এলেন নিজের কক্ষে। নাজমুল হোসেন তার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করে বুঝলেন ওষুধ খায়নি জেসমিন। মনটা তারও খারাপ হয়ে গেল। তাদের সংসারটা যে ধ্বংস হতে চলেছে তা এখন সম্পূর্ণই উপলব্ধি করছেন তিনি।
নাজমুল হোসেন কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলতে পারবেন না। তার ঘুম ভাঙল পাশের বাড়ির জেহানের চিৎকারে। সে চিৎকার করে বলছে, সবাই বের হয়ে আসেন, বের হয়ে আসেন, জেসমিন আত্মহত্যা করতেছে, আত্মহত্যা করতেছে।
জেহানের চিৎকার আর চেঁচামেচিতে বের হয়ে এলো সবাই। দেখল বাড়ির সামনে যে আমগাছটা আছে সেই আমগাছের সাথে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দেয়ার চেষ্টা করছে জেসমিন। নিচে একটা চেয়ার। চেয়ারটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে জেসমিন। এখন ঝুলতে শুরু করেছে শরীরটা।
নাজমুল হোসেন জেসমিনের কাছে পৌঁছানোর আগে জেহান পৌঁছাল। দুই পা ধরে উপরের দিকে উঁচু করে ধরল জেসমিনের শরীর যেন গলায় চাপ না পড়ে। নাজমুল সাহেব কাছে আসতে বলল, স্যার, আমি ছাদে হাঁটতেছিলাম, হঠাৎ দেখি আত্মহত্যা করছে জেসমিন।
জেসমিনকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতরে ঢুকে গেলেন নাজমুল হোসেন। এর মধ্যে আশেপাশের অনেকেই জেগে গেছে। তাদের সবার মনে একটাই প্রশ্ন, কেন জেসমিন আত্মহত্যা করতে গেল?
*
কয়েকদিন পর জেহান কলেজ থেকে বাসায় ফিরছে। পথে দেখল রাশেদ তার এক বন্ধুর সাথে কথা বলছে। জেহান বিশ্বাস করে জেসমিনের বর্তমান অবস্থার জন্য রাশেদই দায়ী। কারণ সে রাতে রাশেদকে জেসমিনদের বাড়ি থেকে গোপনে বের হয়ে আসতে দেখেছে। কিন্তু জেসমিন কেন সবকিছু সবাইকে বলে দিচ্ছে না ঠিক বুঝতে পারছে না।
জেহান, জেহান!
ডাক দিল রাশেদ।
রাশেদের কাছে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তারপরও পা বাড়াল জেহান।
কেমন আছো তুমি?
ভালো ভাইয়া।
তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
হ্যাঁ, বলেন।
রাশেদ জেহানকে নিয়ে খানিকটা সরে এলো যেন তাদের কথা কেউ শুনতে না পায়। তারপর চারদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, কী অবস্থা জেসমিনের?
আপনি খোঁজ নিচ্ছেন না কেন? ওকে তো আপনিই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এভাবেই বলতে ইচ্ছে হলো রাশেদের। তবে সে বলল না। রাশেদকে কিছুটা হলেও ভয় পায়। কারণ রাজনীতি করতে শুরু করেছে। সে। ইদানীং কিছু গুন্ডা টাইপের তোক নিয়ে ঘুরে। শেষে বলল, ভালো না, আজ একজন মানসিক ডাক্তারকে দেখাবে।
জেসমিন কি পাগল হয়ে গেছে?
না, হয়নি।
আমার মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। তা না হলে মানসিক ডাক্তার দেখাবে কেন? কয়েকদিন আগে নাকি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। তুমি তাকে বাঁচিয়েছ।
হ্যাঁ।
অত রাতে তুমি জানলে কীভাবে যে সে আত্মহত্যা করবে?
আমি ছাদে হাঁটছিলাম।
প্রতি রাতেই কি তুমি ছাদে হাঁটো?
না।
তাহলে যেদিন জেসমিন আত্মহত্যা করবে সেদিনই হাঁটছিলে। কীভাবে এতটা মিলল? তুমি কি আগে থেকে জানতে যে আত্মহত্যা করবে জেসমিন।
কী যা তা বলছেন ভাইয়া! আমি জানব কীভাবে?
রাশেদ টেনে টেনে বলল, তুমি ছোট মানুষ। সবকিছু জানার চেষ্টা করবে না। আর মনে রাখবে, অল্পবয়সে সবকিছু জানা ভালো না। তোমার কাজ পড়াশুনা করা, পড়াশুনা করবে। ঠিক আছে?
জি ভাইয়া।
আমি আগে কখনো জেসমিনদের বাড়িতে যাইনি। ভাবছি একবার যাব। কখন গেলে ভালো হয়?
জেহান বুঝতে পারল ডাহা মিথ্যা কথা বলছে রাশেদ। সে নিজে রাশেদকে দেখেছে জেসমিনদের বাড়ি থেকে বের হতে। তাও গভীর রাতে। আর আজ কিনা বলছে সে আগে কখনো জেসমিনদের বাড়িতে যায়নি।
রাশেদ আবার বলল, তুমি কি একটু কথা বলতে পারবে জেসমিনের সাথে? আমি সত্যি তার সাথে দেখা করতে চাই।
তাকে ফোন করেন।
ফোন ধরছে না।
আমার সাথেও তো কথা হয় না।
তারপরও তোমার বাসা তো পাশেই।
আচ্ছা আমি চেষ্টা করব।
তুমি তাহলে আমাকে জানাবে। আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকব। আসলেই তুমি খুব ভালো জেহান। এজন্যই তোমাকে এতটা পছন্দ করি। চলো ঐ দোকানে যাই, চা খাই।
না ভাইয়া, আমি চা খাব না। আসি।
আমাকে ফোন দেবে কিন্তু।
আচ্ছা ভাইয়া।
জেহান মাঝে মাঝে গাড়িতে করে কলেজে আসে। আজও গাড়ি এনেছে। গাড়িতে উঠে হাঁপাতে লাগল সে। হাঁপানোর কারণটা অবশ্য বুঝতে পারছে। রাশেদকে সে ভয় পেতে শুরু করেছে। দুটো কারণ হতে পারে। প্রথম কারণ রাশেদ রাজনীতির সাথে জড়িত হওয়ার পর থেকে খানিকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, আর দ্বিতীয় কারণ হয়তো রাশেদ অন্যায় করতে শুরু করেছে। প্রথম অন্যায় করেছে জেসমিনের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে। এ কারণেই জেসমিন আজ প্রেগন্যান্ট। খবরটা সে ভাসাভাসা শুনেছে, নিশ্চিত নয়। ঠিক করেছে, জেসমিনের সাথে দেখা করতে পারলে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে। তবে এটা সত্য জেসমিনের পেটটাকে হালকা উঁচু মনে হয়েছে তার। আর এর জন্য রাশেদই যে দায়ী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাশেদ এখন ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। তবে একটা প্রশ্ন উঠছে, রাশেদ আবার কেন কথা বলতে চাচ্ছে জেসমিনের সাথে? হিসাবগুলো মিলছে না। আর হিসাব না মিললে সে অস্থির হয়ে ওঠে। এজন্য তার মধ্যে অস্থিরতা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
জেহান বাসায় ফিরে খাওয়াদাওয়ার পর দুপুরে ঘুম দিল। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মোবাইল ফোনের রিং-এর শব্দে ঘুম ভাঙল তার। ফোন করেছে জেসমিন। জেসমিনের ফোন দেখে হাত-পা কাঁপতে শুরু করল তার। ফোন ধরতে, ওপাশ থেকে জেসমিন বলল, কেমন আছো?
ভা…ভালো। তুমি!
তোমাকে ধন্যবাদ জেহান। তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ।
ইয়ে… মানে…
তুমি না থাকলে হয়তো আমার লাশটা এতদিন পচে-গলে যেত।
কিছু বলতে গিয়েও পারল না জেহান, চুপ থাকল।
জেসমিন বলল, তবে কি জানো?
কী?
আমাকে তুমি বাঁচাতে পারবে না।
কী বলছ আপু?
সত্য বলছি।
আ…আমি তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারছি না। তুমি তো বেঁচেই আছ। এখানে বাঁচা…
হ্যাঁ, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আত্মহত্যা করব। তুমি আর কতক্ষণ ঠেকাবে আমাকে?
তু…তুমি আত্মহত্যা করবে কেন?
আমার বাবা-মা আমার জন্য বড় কষ্টে আছে। জয় আর জনি এখনো বুঝতে পারছে না, তবে এটা সত্য, ওরাও একসময় কষ্ট পাবে আমার জন্য। আসলে কি জানো, আমার কিছু করার নেই, আমি… বড় অসহায়… আমি পারছি না… আর পারছি না…।
কথার মাঝেই কেঁদে উঠল জেসমিন। তারপর লাইন কেটে দিল।
জেসমিনের ফোন পাওয়ার পর খুব অস্থির হয়ে পড়ল জেহান। সে তাড়াতাড়ি ছাদে উঠল। না কোথাও দেখা যাচ্ছে না জেসমিনকে। একবার ভাবল জেসমিনদের বাড়ি যাবে। পড়ে বাদ দিল সেই চিন্তাটা, তার কেন যেন মনে হচ্ছে ইদানীং জেসমিনদের বাড়ির কেউ চায় না তাদের বাড়িতে অন্য কেউ আসুক।
জেহান আরো কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর পা বাড়াল বাইরে।
*
ডাক্তার তরফদার মানিকগঞ্জ এসেছেন। উদ্দেশ্য একজন রোগী দেখা। রোগীর বাড়িতে আছেন তিনি, নাম হামিদ। একটা ঘরের মধ্যে তার দুই হাত শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। কোমরেও একটা শিকল। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তিন ভাই, এক বোন তারা। ভাইদের মধ্যে হামিদ ছোট। অন্য দুই ভাই তার কোনো খবর রাখে না। বোনই মূলত দেখাশুনা করে হামিদকে। হামিদের প্রিয় একটা কাজ হলো বাঁশি বাজানো। তার একটা বাঁশের বাঁশি আছে। পাশেই থাকে। মাঝে মাঝে বাজায়। বড় করুণ সুর ঐ বাঁশির। কলেজে একটা অনুষ্ঠানে তার ঐ বাঁশির সুর শুনেই তার প্রেমে পড়েছিল ‘শিরিন’।
ডাক্তার তরফদার হামিদকে দেখা শুরু করেছেন বছরখানেক হলো। তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ। তিনি সবসময় আসতেও পারেন না। আবার হামিদের বোন হুশনারও এমন আর্থিক সংগতি নেই যে তাকে ঢাকা নিয়ে নিয়মিত চিকিৎসা করাবে। তাই ডাক্তার তরফদার মাঝে মাঝে আসেন। আজ শেষ রাতে হঠাৎই তার হামিদের কথা মনে পড়ে। তখনই রওনা দেন মানিকগঞ্জের উদ্দেশে।
হামিদের বোন হুশনার বিয়ে হয়েছে পাশের বাড়িতে। এজন্য হুশনা যত্ন নিতে পারে হামিদের। অন্য দুই ভাই একই বাড়িতে থাকলেও তাদের অতটা সহমর্মিতা নেই যতটা আছে হুশনার। আগে হামিদের মা হামিদের যত্ন নিত, কিন্তু বছর তিনেক হলো সে মারা গেছে। তারপর থেকে হুশনাই দেখাশুনা করছে হামিদের।
হামিদের যে আচরণ তাতে তাকে প্রচলিত সমাজে ‘পাগল’ বলবে সবাই। ডাক্তার তরফদারের কাছে সে ক্রনিক এন্ড কমপ্লেক্স সিজোফ্রেনিয়ার (Chronic and Complex Schizophrenic) রোগী। তাকে সুস্থ করা সত্যি দুরূহ কাজ। তারপরও ডাক্তার তরফদার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বর্তমানে অবস্থা কিছুটা ভালো, মানুষ চিনতে পারে। তবে যে কোনো সময় আবার অবনতি হতে পারে। যখন মানসিক অবস্থা খুব খারাপ থাকে তখন সবাইকে সে ‘শিরিন মনে করে। শিরিন ছিল উপজেলা শহরের এক মেয়ে যাকে হামিদ ভালোবাসত। একই কলেজে পড়ত তারা। শিরিনের বাবা সরকারি কাজের জন্য এখানে বদলি হয়ে এসেছিলেন। শিরিন ভর্তি হয়েছিল হামিদদের কলেজে। প্রেমের সম্পর্ক অনেকটাই এগিয়েছিল তাদের। কিন্তু শিরিনের বাবা-মা রাজি না হওয়ায় একুশ বছর আগে বিয়ে হয়ে যায় শিরিনের। তারপর থেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে হামিদ। কয়েকবার শিরিনের শ্বশুড়বাড়ি সিলেট গিয়েও বিরক্ত করেছিল। একবার শিরিনের শ্বশুরবাড়ির লোকজন প্রচণ্ড মারপিট করে হামিদকে। দুইমাস হাসপাতালে থাকার পর মানসিক অবস্থা আরো খারাপ হয় তার। যে কোনো মেয়েকে দেখলেই সে ‘শিরিন’ মনে করা শুরু করে। তার হাত ধরে প্রেমের কথা বলতে থাকে। থানায় অভিযোগ পড়তে থাকে। মামলাও হয় কয়েকটা। তবে ‘পাগল’ বলে খালাস পেয়ে যায়। শেষে সিদ্ধান্ত হয় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার। সেই কারণে আজ অবধি প্রায় বিশ বছর ধরে শিকল বন্দি হামিদ। মাঝে মাঝে হুশনা তাকে ঘরের বাইরে নেয়। তাও অল্প সময়ের জন্য।
হামিদ সবসময় একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে থাকে। টুর নিজ পর্যন্ত বিস্তৃত প্যান্টটা। একটা মাদুর আছে বসে থাকা আর শোয়ার জন্য। প্রস্রাব-পায়খানার বোধশক্তি তার আগে ছিল না। তবে ডাক্তার তরফদার চিকিৎসা করে বুঝাতে পেরেছেন যে তাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। ঘরের মধ্যেই একটা মালশা আছে, ওখানেই সে প্রাকৃতিক ডাকের কাজগুলো সারে। আর এগুলো পরিষ্কার করে হুশনা। একজন বোন যে ভাইয়ের কতটা আপন হতে পারে, হুশনাকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
হামিদকে দেখতে এলে ডাক্তার তরফদার সাথে করে ডালিম নিয়ে আসেন। কারণ ডালিম হামিদের খুব প্রিয়। হামিদ ডালিমের ভক্ত হয় শিরিনের সাথে সম্পর্কের সময়। শিরিনের পছন্দ ছিল ডালিম। শিরিন নাকি প্রায়ই তাকে ডালিম উপহার দিত। শিরিনের দেয়া ডালিম বড় যত্ন করে খেত সে।
ডাক্তার তরফদার আজও ডালিম নিয়ে এসেছেন। ডালিম কেটে দিলে খাবে না হামিদ। আস্ত দিতে হবে। নিজে ভাঙবে, তারপর একটা একটা করে রোয়া খাবে। লাল একটা রোয়া মুখে দিয়ে হামিদ বলল, স্যার বড় মিষ্টি।
ডাক্তার তরফদার মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, তোমার মজা লাগছে।
হামিদ মাথা দুলিয়ে বলল, জি স্যার, মেলা মজা। আমি যখন স্যার সুস্থ হবো, তখন কী করব জানেন স্যার?
কী করবে?
বাংলাদেশের রাস্তাঘাট সবজায়গায় ডালিম গাছ লাগাব, শত শত ডালিম গাছ, হাজার হাজার ডালিম গাছ, লাখ লাখ ডালিম গাছ। বাংলাদেশ হবে ডালিমের বাংলাদেশ, লাল লাল ডালিম। ডালিমগুলা পাইকা গাছে ঝুইলা থাকবে। আমি শিরিনরে মেলা ডালিম দিব, মেলা। আর কারে দিব জানেন স্যার?
না জানি না।
আপনেরে দিব। তয় বেশি না, একটা।
ডাক্তার তরফদার কিছু বললেন না। কেন যেন তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন। হামিদের বলার ধরনটা একেবারে শিশুর মতো।
হামিদ আবার বলল, স্যার আর একজনরে দিব।
কে সে?
আমার মায়েরে দিব, মা।
তাই নাকি?
জি স্যার। মা প্রত্যেকদিন আমারে দেখবার আসে। ডালিম নিয়া আসে। তয় আমার জন্য ডালিম কিনতে মায়ের বড় কষ্ট হয়। ক্যান, জানেন স্যার? মায়ের অভাব। গরীব মানুষ তো, অত টাকাপয়সা নাই। মায়ে মেলা ভালো। আসলে কি জানেন স্যার? সব মা-ই ভালো। মায়ের মুত্যু হইলেও সন্তানের পাশে থাকে, যতদিন সন্তান বাঁইচা থাকে তারে আঁচলের নিচে আগলায় রাখে। সব সন্তানেরা বুঝবার পারে না, আমি পারি।
ডাক্তার তরফদারের কী যে হলো তিনি বলতে পারবেন না। তার চোখে পানি চলে এলো। মাঝে মাঝে তিনি প্রকৃতির উপর খুব রাগ হন। প্রকৃতি পৃথিবীর সুন্দর মনের মানুষগুলোকে এত কষ্ট দেয় যে সহ্য করা যায় না। হামিদের তেমন কোনো দোষ নেই, দোষ ছিল শুধু একটাই সে শিরিনকে ভালোবেসেছিল। তাই আজ বিশটি বছর শিকলবন্দি সে। তার থেকেও কষ্টের তার স্বপ্ন কোনোদিন হয়তো পূরণ হবে না। কারণ তার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। কিছুক্ষণ আগে রক্তে গ্লুকোজ মেপেছেন তিনি। গ্লুকোজের মাত্রা চব্বিশ। ক্রনিক ডায়াবেটিসের রোগী সে। হার্টের অবস্থাও ভালো না। হৃদস্পন্দন অনিয়মিত। সবই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কোনো ওষুধ হামিদ খাবে না। এজন্য দিন যত যাচ্ছে অবস্থা ততই খারাপ হচ্ছে।
হঠাই হামিদ ডেকে উঠল, স্যার!
বলল হামিদ।
স্যার আমার একটা কথা শুনবেন?
কী কথা?
আগে বলেন শুনবেন।
আচ্ছা শুনব।
আমারে একটু শিরিনের কাছে নিয়া যাবেন। মেলা দিন হইল তারে দেখি না, আমারে না দেইখাও হে বড় কষ্টে আছে।
ঠিক আছে নিয়ে যাব।
কবে নিবেন স্যার?
আমি শিরিনের সাথে কথা বলে নেই।
জি স্যার, বলেন। ঐ দিন আমারে একটা সুন্দর কাপড় কিনা দিবেন। আসলে কি জানেন স্যার, আমি তারে কত ভালোবাসছি আপনেরে বুঝাবার পারব না।
তুমি শিরিনকে অনেক ভালোবাস, তাই না?
তারে আমি মেলা ভালোবাসি, মেলা। আমার বুকের মইধ্যে খালি তার জন্যই সব ভালোবাসা, সব স্যার।
কথাগুলো বলতে বলতে হঠাই ডুকরে কেঁদে উঠল হামিদ। তারপর চোখ মুছতে মুছতে বলল, স্যার আমার মনে বড় কষ্ট, আমার একটা সুন্দর কাপড়ও নাই স্যার। শিরিন যদি দ্যাখে আমার কোনো ভালো কাপড় নাই, কী যে কষ্ট পাবে! আমি তারে কষ্ট দিবার চাই না স্যার, কষ্ট দিবার চাই না। আমার খুব শখ তারে আমি একটু বাঁশি বাজায় শুনাব। আমার বাঁশি বড় পছন্দ করত সে। কতদিন আমার বাঁশি শুনে না। কী যে কষ্টে আছে স্যার, আপনেরে বুঝাবার পারব না।
ডাক্তার তরফদার কী বলবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। হামিদকে তিনি প্রচণ্ড ভালোবাসেন। হামিদের প্রত্যেকটা কথা তার বুকের মধ্যে বিধে। তার এরকম কিছু রোগী আছে যাদের জন্য তিনি অনেককিছু করতে চান। অথচ কিছু করতে পারেন না। মেডিক্যাল সায়েন্স, সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স, প্যারাসাইকোলজিক্যাল সায়েন্স, ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স, সার্জিক্যাল সায়েন্স, স্পিরিচুয়াল সায়েন্স, মেডিটেশনাল সায়েন্স, ফিজিওথেরাপি সবকিছুর ঊর্ধ্বে এই রোগীরা। একজন ডাক্তার হিসেবে একজন রোগীর জন্য কিছু করতে না পারা যে কতটা কষ্টের তা ঐ ডাক্তার ছাড়া আর কেউ বোঝে না। কিন্তু ডাক্তার তরফদার মাঝে মাঝে অনুধাবন করেন, বিজ্ঞান যতই উন্নত হোক না কেন, প্রকৃতি তার ক্ষমতা দিয়ে মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দেয় যে প্রকৃতির কাছে মানুষের বিজ্ঞান বড় তুচ্ছ।
হামিদের আর একটা সমস্যা হচ্ছে হামিদ পানি খেতে চায় না। ডাক্তার তরফদার নিজেও অনেকক্ষণ চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। একপর্যায়ে হামিদ খানিকটা রেগে ডাক্তার তরফদারের দিকে বোতলও ছুঁড়ে মারল। ডাক্তার তরফদার তারপরও চেষ্টা করে গেলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিফলই হতে হলো তাকে। একজন মানুষের দৈনিক যেখানে দুই লিটার পানির প্রয়োজন হামিদ সেখানে এক গ্লাস পানিও খেতে চায় না। এটা খুব খারাপ লক্ষণ।
ডাক্তার তরফদার যখন বিদায় নিলেন হামিদ তখন তার বাঁশিতে সুর তুলল,
প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়।
এক বুক কষ্ট নিয়ে ডাক্তার তরফদার বাসায় ফিরে এলেন। গেট দিয়ে প্রবেশের সময় দেখলেন সুন্দর চেহারার একটা ছেলে বসে আছে বারান্দায়। তিনি কিছু বলার আগেই ছেলেটি বলল, স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমার নাম জেহান, আগে একবার এসেছিলাম।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কয়েকদিন আগে তুমি কিছু বলতে এসেছিলে আমাকে। না বলেই চলে গিয়েছিলে।
জি স্যার।
আসো ভিতরে আসো।
আচ্ছা স্যার।
ডাক্তার তরফদার ঘড়ি দেখলেন। বিকেল চারটা। মানিকগঞ্জ থেকে তার আরো আগে ফেরার কথা ছিল। পারেননি এ কারণে যে গাবতলীতে খুব জ্যাম ছিল। ঘণ্টাতিনেক ওখানেই নষ্ট হয়েছে।
ডাক্তার তরফদার জেহানকে বসিয়ে রেখে হাত-মুখ ধুতে গেলেন। এসে দেখেন জেহান নেই। তবে একটা চিঠি রেখে গেছে সে। চেয়ারে হেলান দিয়ে খুললেন সাদা খামের চিঠিটা। ভিতরে টানা টানা অক্ষরে লেখা,
স্যার,
আমার সালাম নিবেন। ক্ষমা করবেন এই কারণে যে আপনার সাথে সামনাসামনি সব কথা বলার সাহস আমার নেই। কারণ আপনি অনেক বড় মানুষ। অনেক সুনাম আপনার। সেই তুলনায় আমি একেবারেই নগণ্য, ক্ষুদ্র। আমার থেকে ক্ষুদ্র মানুষ বোধহয় এই পৃথিবীতে আর নেই। যাইহোক, স্যার আবারো সালাম নিবেন। আমি চিঠি লিখছি আমার নিজের জন্য নয়। একজনের জীবন বাঁচানোর জন্য। তাকে বাঁচানোর জন্য আপনার সাহায্য বড় প্রয়োজন। যদি অসহায় এক মেয়ের জীবন বাঁচাতে চান, তাহলে স্যার চিঠির উলটো পাশে লেখা নম্বরে আমাকে ফোন করবেন। আমি জানি আপনি ফোন করবেনই করবেন। কারণ আপনি চান না কেউ আত্মহত্যা করে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে যাক। আপনি বড় উদার আর ভালো মনের মানুষ। এখন থেকে প্রত্যেকটি মুহূর্ত আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকব। বিষয়টি অতীব জরুরি।
ইতি
জেহান
ডাক্তার তরফদার চিঠিটা পরপর তিনবার পড়লেন। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য দুই মিনিট সময় নিলেন। চিঠিটা ছোট হলেও যে খুব গুরুত্বপূর্ণ বুঝতে পারছেন তিনি। তা না হলে জেহান কখনোই তার কাছে আসত না, আগেও সে তার কাছে এসেছিল। তিনি ঠিক করলেন আত্মহত্যার ঘটনাটা প্রতিহত করবেন। তাই ফোন করলেন জেহানের চিঠির উলটো পাশে দেয়া ফোন নম্বরে। পরপর তিনবার ফোন করে যখন ফোন নম্বরটা বন্ধ পেলেন তখন সিদ্ধান্ত নিলেন দ্বিতীয় কোনো উপায়ে জেহানকে তার খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
শুধু ফোন নম্বর থেকে ঠিকানা বের করতে হলে সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন কোম্পানি কিংবা পুলিশের সহায়তা লাগবে। যদিও জেহান লিখেছে যে ফোনটি তার, তারপরও সন্দেহ থেকে যায় যে ফোনটি অন্য কারো কি না। প্রতারণা বা হয়রানির বিষয়টাও মাথায় রেখেছেন ডাক্তার তরফদার। সেক্ষেত্রে যার ফোন নম্বর তার ঠিকানা খোঁজা সমীচীন হবে না।
সবকিছু বিবেচনা করে ডাক্তার তরফদার থানায় আসাটাকেই যৌক্তিক মনে করলেন। থানার ওসি সাহেব আগে থেকেই তাকে চেনেন। সবকিছু শুনে একটা আবেদন চাইলেন ওসি সাহেব। ডাক্তার তরফদারের আবেদনের ভিত্তিতে একটা জিডি হলো। ওসি সাহেব বললেন, স্যার চিন্তা করবেন না, আমি মোবাইল ফোনের মালিকের ঠিকানা আপনাকে দেব। প্রয়োজনে পুলিশও আপনাকে সাহায্য করবে। তবে আমাদের কয়েক ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন।
ডাক্তার তরফদার রিকশায় বাসায় ফিরছিলেন। রিকশা থেকে নামার পর তার কেন যেন বড় ক্লান্ত মনে হলো যুবকবয়সি রিকশাওয়ালাকে। ইচ্ছা করেই এক শ টাকা বেশি দিলেন। তারপর বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে বড় ক্লান্ত তুমি, খুব কি খারাপ লাগছে?
মনটা ভালো নাই স্যার।
কেন?
সারাদিন খালি কাম আর কাম। সকাল থাইকা সন্ধ্যা পর্যন্ত। বাড়ির সবাইর শুধু চাওয়া আর চাওয়া। এই চাওয়া-পাওয়ার যেন শ্যাষ নাই স্যার। ভাবখানা এমন যেন আমি তাগো জন্য কিছু করি নাই। অথচ স্যার যা আয় হয় সবই ব্যয় করি সংসারের জন্য।
মৃদু হাসলেন ডাক্তার তরফদফার। তারপর বললেন, মানুষ তোমার কাছ থেকে কী পেয়েছে সেই হিসাব তোমাকে সাধারণত সে দেবে না, তোমার কাছ থেকে কী কী পায়নি সেই হিসাব তোমাকে বারবার শোনাবে।
একটু থেমে ডাক্তার তরফদার আবার বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে পানিশূন্যতা রয়েছে তোমার শরীরে। দিনে আট থেকে দশ গ্লাস পানি খাওয়ার নিয়ম। তুমি রিকশা চালাও, পানি আরো বেশি খেতে হবে তোমাকে। পানি শরীরকে যেমন ঠান্ডা রাখে মনে এনে দেয় প্রশান্তি। ভালো থেকো।
গেটের ভিতর ঢুকলেন ডাক্তার তরফদার। সারাদিন বড় ব্যস্ততায় কেটেছে তার। ক্লান্তও লাগছে। বাড়ি ফিরে দেখেন দুজন রোগী বসে আছে। তাদের সাথে কথা শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে নিলেন। তারপর আবার ফোন করলেন জেহানকে। না, ফোন বন্ধ। তিনি নিশ্চিত হলেন বড় ধরনের কোনো রহস্য আছে জেহানের কার্যক্রমে। এই রহস্যটা তাকে ভেদ করতেই হবে।
*
হাডসন হিলে ডাক্তার হাডসনের হাত ধরে হাঁটছে জেসমিন। হাডসন হিলকে আজ বেশি সবুজ মনে হচ্ছে। চারদিকে ছোট বড় প্রত্যেকটি গাছে নতুন পাতা। এ যেন সবুজের মেলা! জেসমিন বলল, আজ এত সবুজ কেন চারপাশটা?
ডাক্তার হাডসন বললেন, কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে ছোট ছোট গাছগুলো সতেজ হয়ে উঠেছে। এজন্য সবুজ লাগছে সব।
আগে হাডসন হিল কখনো এতটা সবুজ ছিল না।
তা ছিল না। এতটা সুন্দরও ছিল না।
না না, হাডসন হিল সবসময় সুন্দর।
হয়তো, তুমি যেদিন প্রথম এসেছ সেদিন থেকেই বেশি সুন্দর।
জেসমিন ডাক্তার হাডসনের চোখে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। ডাক্তার হাডসন বললেন, সত্যি জেসমিন তুমি সুন্দর, অপূর্ব সুন্দর! তুমি
আমার জীবনটাকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছ।
তাই বুঝি!
হ্যাঁ।
তুমি আমাকে এখানে নিয়ে আসছ না কেন?
তুমি কি থাকতে পারবে এই পাহাড়ে, গুহার মধ্যে? মাঝে মাঝে ভয় পাই। বড় কষ্ট হবে তোমার।
তুমি থাকতে পারলে আমি পারব না কেন?
হয়তো পারবে। তবে এখানে বেঁচে থাকাটা একেবারে সহজ না। আমি তো আছি বহুদিন ধরে। তো প্রায় সত্তর আশি বছর। ভ্যস্ত হয়ে গেছি। তবে তোমাকে নিয়ে আসব, দ্রুতই নিয়ে আসব। আর…
আর কী?
ডাক্তার হাডসন টেনে টেনে বললেন, তোমার সন্তানের পরিচর্যা দরকার। এখানে এই জায়গায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নেই। এজন্য ভাবি চিকিৎসার অভাব হয় কি না।
তুমি ডাক্তার। তুমি থাকতে চিকিৎসার ঘাটতি হবে কেন?
শুধু ডাক্তার থাকলে হবে না। ওষুধপত্র, সরঞ্জামাদি থাকতে হবে। তবে তোমাকে নিয়ে আসার কথা ভাবছি। তোমাকে অবশ্য ধৈর্য ধরতে হবে। অধৈর্য হয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে, এটা ঠিক না।
আসলে মায়ের কথায় বড় কষ্ট পেয়েছিলাম। সহ্য করতে পারছিলাম না আর, ঐদিন আশা করছিলাম তুমিও পাশে থাকবে। কিন্তু তুমি এলে না। তাই একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।
হতাশা মানুষকে শেষ করে দেয়। হতাশ হবে না। সামনে আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ।
জেসমিন খানিকটা অস্থির হয়ে বলল, আমি আর বাড়ি থাকতে চাচ্ছি না। বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে। করে না।
কেন?
জানি না, আমি সত্যি এখানে চলে আসতে চাই। তোমার কাছে।
ডাক্তার হাডসন মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, সময় হলেই নিয়ে আসব, চলো আজ তোমাকে পাহাড়ের উপর নিয়ে যাব।
পাহাড়ের উপর।
যে পাহাড়টার নিচে আমাদের গুহা ঐ পাহাড়টার চুড়ায় উঠার একটা পথ আছে। এদিকে মানুষজন না আসায় বহুদিন ধরে বন্ধ আছে পথটা। চলো যাই। তবে ধীরে ধীরে উঠতে হবে, তা না হলে হাঁপিয়ে উঠবে।
পেটে সন্তান নিয়ে কি পাহাড়ে উঠা ঠিক হবে?
আমি আছি, সমস্যা হবে না। খারাপ লাগলে বলবে।
আমার কিন্তু ভয় করছে।
ভয় পাবে না, মনে সাহস রাখো। আর আমি তো আছি।
আসলেই, তুমি থাকলে মনে বড় জোর পাই।
কথা বলতে বলতে পাহাড়ে উঠার পথের কাছে চলে এলো দুজন। পথটা প্রথম দিকে ভালো থাকলেও পরের দিকে অমসৃণ বেশি। ছোট-বড় পাথর অনেক। ডাক্তার হাডসন জেসমিনের হাত ধরে রেখেছেন। অসুবিধা হচ্ছে না এগিয়ে যেতে। তবে মাঝপথে বড় একটা চওড়া পাথর থাকায় দাঁড়াতে হলো। পাথরটা প্রায় বুক সমান উঁচু। উপরে উঠতে হলে এই পাথরে উঠতে হবে প্রথমে। ডাক্তার হাডসন বললেন, এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠার ক্ষেত্রে এটাই বড় প্রতিবন্ধকতা। স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষ উঠতে পারবে না। দ্বিতীয় কাউকে টেনে তুলতে হবে। এজন্য এই পাহাড়ের চূড়ায় সবাই উঠতে পারে না। তবে আমি একা উঠতে পারি। কারণ দীর্ঘদিনের চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
ডাক্তার হাডসন পাথরের উপর এতটাই সাবলীলভাবে উঠে গেলেন যে দেখে অবাকই হলো জেসমিন। তারপর তাকে টেনে তুললেন উপরে। দুজন আবার হাঁটতে শুরু করল। দুপাশে এখন বড় বড় সেগুন গাছ। এক-একটা গাছ এত মোটা যে দেখে সত্যি অবাক হচ্ছে জেসমিন। বলল, এই গাছগুলোর বয়স কত হবে?
এক শ বছরের নিচে হবে না।
এক শ বছর!
হু, এক শ বছর তো হবেই। আমি যখন এখানে প্রথম আসি তখনো এই গাছগুলো এমনই বড় ছিল। মাঝের এই বছরগুলোতে শুধু মোটা হয়েছে।
আমি সত্যি অবাক হচ্ছি।
সামনে আরো বড় আর মোটা গাছ আছে। এই গাছগুলো এই পাহাড়ের বিশেষ সৌন্দর্য। একেবারে সবুজ করে রেখেছে চারপাশটা। চলো এগোই।
একসময় হাডসন হিলের চূড়ায় এসে পৌঁছাল দুজন। সামনের দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল জেসমিনের। নিজের অজান্তেই উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, এত সুন্দর! সাগরটাও অপূর্ব! আর কতদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।
হ্যাঁ, সাগর উপর থেকে দেখলে ভালো লাগে।
আমার সত্যি দারুণ লাগছে।
জায়গাটা আমারও পছন্দের। নাম কী রেখেছি জানো? হিল টপ।
সুন্দর নাম।
ঐ পাথরটা দেখতে পাচ্ছ, চলল ওটার উপর গিয়ে বসি।
হ্যাঁ, চলো। পাথরটার নাম কী জানো?
কী নাম?
লাভ স্টোন।
লাভ স্টোন!
হু, এখানে বসলে শুধু একজন অন্যজনকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হবে। তুমি যখন বসবে তখন দেখবে আমার কাঁধে মাথা রেখে বসার ইচ্ছে হচ্ছে তোমার।
জেসমিন আর ডাক্তার হাডসন ‘লাভ স্টোনের উপর বসল। হাডসন বললেন, একটা কাজ করতে পারি আমরা। এই লাভ স্টোনের উপর আমাদের নাম লিখে রাখতে পারি।
কীভাবে নাম লিখব?
পাথর দিয়ে। আমি তোমার নাম লিখব আর তুমি আমার নাম লিখবে। পারবে?
জেসমিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, অবশ্যই পারব।
ডাক্তার হাডসন ছোট ছোট দুটো চোখা পাথর নিয়ে এলেন। একটা দিলেন জেসমিনকে আর একটা নিলেন নিজে। তারপর দুজনেই পাথরের উপর ঘষে ঘষে নাম লিখতে শুরু করল। জেসমিন লিখছে ডাক্তার হাডসনের নাম, আর ডাক্তার হাডসন লিখছেন জেসমিনের নাম।
পাথরের উপর পাথর দিয়ে লিখতে গিয়ে মাঝে মাঝে বড় পাথরটাতে ছোট পাথর দিয়ে আঘাত করতে হচ্ছে। এতে শব্দ হচ্ছে। সময় যত যাচ্ছে শব্দ যেন তত বাড়ছে। শব্দটা কানে বাজছে, একসময় জেসমিন শব্দটা সহ্য করতে পারল না। দুই হাতে কান চেপে চোখ বন্ধ করল। কিন্তু শব্দ হচ্ছেই, একই সাথে তাকে কেউ ডাকছেও। কে ডাকছে ঠিক বুঝতে পারল না। যখন চোখ খুলল, বুঝল সে শুয়ে আছে তার ঘরে। আর দরজায় কড়া নেড়ে তাকে ডাকছে তার মা।
তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নামল জেসমিন। কখন সকাল হয়ে গেছে টের পায়নি। সিদ্ধান্ত নিল আগে লাল শাড়িটা পালটে ফেলবে। লাল শাড়ির জন্য আজ আর সে বকা খেতে চাচ্ছে না!
*
ডাক্তার তরফদার রাত এগারোটার সময় ঠিকানা পেয়েছিলেন। থানা থেকে একজন সাব-ইন্সপেক্টর এসে দিয়ে গেছে। মোবাইলের সিম রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে আবুল হাসেম নামের একজনের নামে, ঠিকানা কেরানীগঞ্জ। নাম দেখে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলেন ডাক্তার তরফদার, সিমটা তাহলে জেহানের নয়। অবশ্য জেহানের বয়স কম, এজন্য তার অভিভাবক কারো সিমটা কিনে দেয়ার সম্ভাবনা বেশি। হয়তো জেহান ব্যবহার করছে। সেক্ষেত্রে তাকে আরো নিশ্চিত হয়ে অগ্রসর হতে হবে। তাই তিনি আর গত রাতে কেরানীগঞ্জ যাওয়ার চিন্তা করেননি। তাছাড়া, রাত হয়ে যাওয়া এবং অতিরিক্ত ক্লান্তির কারণেও যাওয়া সম্ভব ছিল না।
ডাক্তার তরফদার থানার জিডিতে লিখেছিলেন যে, একজন মেয়ে আত্মহত্যা করবে বলে একজন ছেলে তাকে খবর দিয়েছে। এই সংবাদের ভিত্তিতে মেয়েটির জীবন রক্ষা যোক বলে আবেদন করেন জিডিতে। এই জিডি মূলে মোবাইলের রেজিস্ট্রেশন নম্বর জোগাড় করা হয়েছে এবং সংবাদদাতা হিসেবে তাকে দেয়া হয়েছে থানা থেকে। বিষয়টার সম্পূর্ণই আইনগত ভিত্তি রয়েছে। ডাক্তার তরফদার এই বিষয়ে সবসময় সতর্ক থাকেন, আইনের বাইরে কিংবা অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় এরকম কিছু তিনি কখনোই করেন না। গতরাতে সাব-ইন্সপেক্টর এলে তদন্ত শুরু করবে কি না জানতে চায়। ডাক্তার তরফদার সম্মতি দিয়ে বলেছেন, তিনি তদন্ত চান, তবে জেহানের পরিচয় যেন ফাঁস না হয়। কারণ তার কাছে মনে হয়েছে, জেহান নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায় অথবা জেহানের কোনো মানসিক সমস্যা আছে। এই মানসিক সমস্যার কারণেই তার আগ্রহটা বেশি।
রাতে গাঢ় ঘুম হয়েছে ডাক্তার তরফদারের। সকালে এক কাপ গরম চা খাওয়ার পর একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেল শরীর। তিনি আর দেরি করলেন না, চলে এলেন কেরানীগঞ্জে। যে ঠিকানা তাকে দেয়া হয়েছে সেটা একটা দোতলা বাড়ির ঠিকানা। বাড়িটাকে খুব বেশি আধুনিক মনে হলো না। তবে প্রাথমিকভাবে বাড়ির মালিক বিত্তবান বলে ধারণা করলেন তিনি।
ডাক্তার তরফদার সকালেও কয়েকবার কল করেছেন। কিন্তু বন্ধ পেয়েছেন জেহানের নম্বর। তার ধারণা এই বাড়ির আশেপাশেই থাকে জেহান। হঠাৎ তার মনে হলো তিনি অতিআগ্রহ দেখাচ্ছেন কি না। পরে নিজেকে আশ্বস্ত করলেন এই ভেবে যে, না তিনি সঠিক পথেই আছেন। কারণ কিশোরবয়সি জেহান পরপর দুবার তার কাছে সমস্যা নিয়ে এসেছে কিন্তু বলতে পারেনি। তাকে সাহায্য করা তার নৈতিক দায়িত্ব। পাশাপাশি একজন মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে এই সংবাদও পেয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে ঐ আতাহত্যা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করাও তার কর্তব্য। এজন্য তিনি খুঁজছেন জেহানকে।
বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে একটা মুদি দোকান আছে। পাশে একটা হোটেল। ডাক্তার তরফদার হোটেলের ভিতরে বসে চায়ের অর্ডার দিলেন। যে ছেলেটা চায়ের অর্ডার নিল সে কিশোরবয়সি। তাকে জেহানের কথা জিজ্ঞেস করতে সাথে সাথে বাড়িটা দেখিয়ে বলল, ঐ বাড়িতে থাকে স্যার।
তোমার পরিচিত?
হ স্যার। বাড়ির সবাই প্রায়ই সিঙ্গারা-পুরি নেয় এই হোটেল থাইকা।
তুমি কি জেহানকে ডেকে আনতে পারবে?
আমি ডাকলে আসবে কি না জানি না। তারা মেলা বড়লোক। তয় আমার সাথে পরিচয় আছে, কথাবার্তা অতডা হয় না।
তুমি জেহানকে গিয়ে বলবে যে ডাক্তার তরফদার এসেছে।
ঠিক আছে স্যার।
কী যেন নাম তোমার?
বুল।
ঠিক আছে বাবুল। আর যদি না আসে যেন এখনই আমার সাথে ফোনে কথা বলে। এই যে আমার নম্বর। বিষয়টা বড় জরুরি। বলবে আমি মাত্র পনেরো মিনিট থাকব এখানে, তারপর চলে যাব।
আচ্ছা স্যার।
ডাক্তার তরফদার চায়ের সাথে একটা সিঙ্গারা নিলেন। সিঙ্গারা সত্যি বড় স্বাদের হয়েছে। উপরের অংশে সাদা সাদা, মাঝে আবার পোড়া পোড়া। মুখে দিলে মচমচ করে। আলুর সাথে বাদাম দেয়া হয়েছে, পিয়াজের পরিমাণও বেশি। প্রকৃত সিঙ্গারার যে বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত তার সবগুলোই আছে এই দোকানের সিঙ্গারায়। এরকম সিঙ্গারা এখনকার মানুষ বানাতে পারে না। সবই কেমন যেন কৃত্রিম হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি তিনি অনুভব করেন, দিন যত যাচ্ছে ততই কৃত্রিমতায় ভরে উঠছে পৃথিবী। একদিন ভালোবাসাও কৃত্রিম হয়ে যাবে। কৃত্রিম ঐ ভালোবাসা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে মানুষকে। মানুষ তখন জানবে না, কোনো একদিন এই পৃথিবী ভরপুর ছিল অকৃত্রিম, উপভোগ্য আর অফুরন্ত ভালোবাসায়।
বাবুল ফিরে এলো দুই মিনিট পর। বলল, স্যার আমি কইছি। কিন্তু জেহান ভাইজান কিছু বলে নাই।
ও আচ্ছা। তুমি আমাকে আর-একটা সিঙ্গারা দাও।
জি স্যার।
তবে এখন না, জেহান এলে দেবে।
জেহান ভাইজান আসবে কি না ঠিক জানি না।
আমি জানি আজ সে আসবে।
আইচ্ছা স্যার।
ঠিক চার মিনিট পর জেহান এলো। তার চোখে-মুখে ভয়। ডাক্তার তরফদার নিজেই কাছে ডাকলেন তাকে। বসতে বললেও বসল না প্রথমে। সিঙ্গারা খেতে বললে তখন বসল।
ডাক্তার তরফদার অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি জানেন এইসব ক্ষেত্রে কোন কথা দিয়ে শুরু করলে জেহানের কাছ থেকে কথা বের করা যাবে। তিনি সরাসরি বললেন, মেয়েটি কে যে আত্মহত্যা করবে?
স্যা…স্যা…র…
তাড়াতাড়ি বলে ফেলল। দেরি কোরো না। তুমি যদি তাকে পছন্দও করে থাকো আমাকে বলতে পারো। আমি তোমাকে সাহায্য করব।
আ…আমি স্যার…
আমি মেয়েটির নাম জানতে চাচ্ছি এবং ঠিকানা।
কাউকে বলবেন না স্যার।
না, বলব না। তুমি আমার সাহায্য চেয়েছ, তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি। এখন বলো মেয়েটির নাম কী, আর ঠিকানা কোথায়?
স্যার নাম জে..জেসমিন। আর ঠিকানা পাশের ঐ বাড়ি।
হাত দিয়ে জেসমিনদের বাড়ি দেখিয়ে দিল জেহান। ডাক্তার তরফদার কিছুটা আতঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে জেহান আবার চলে না যায়। এখন তিনি নিশ্চিত জেহান যাবে না। কারণ জেহানের জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল জেসমিনের নাম উচ্চারণ করা এবং বাড়ির ঠিকানা বলা। সে কঠিন কাজটা সম্পাদন করেছে। এখন ফলাফল চাইবে। এমনই হয়ে থাকে।
ডাক্তার তরফদারের অনুমানই সত্যি হলো। সিঙ্গারায় কামড় দিয়ে জেহান বলল, স্যার, জেসমিনকে বাঁচাবেন কীভাবে?
আমি ওদের বাড়ি গিয়ে কথা বলব।
জেহান চোখ বড় বড় করে বলল, আমার কথা আবার বলে দেবেন নাকি স্যার?
তোমার কথা কেউ জানবে না।
ধন্যবাদ স্যার, বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
আমি যদি জেসমিনদের বাড়ি যাই, জেসমিনের বাবা-মা কি আমার সাথে কথা বলবেন?
জানি না স্যার। তারা তো বাড়িতে এখন কাউকে ঢুকতে দেয় না।
কেন?
স্যার সত্য কা বলব?
সত্যই তো বলবে।
জেসমিন কীভাবে যেন প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে স্যার।
ডাক্তার তরফদার একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন, কে এই কাজটা করেছে?
রাশেদ। আমাদের কলেজের ছাত্র। জেসমিনের সাথে প্রেম ছিল। আগে ঘুরতেও যেত একসাথে। এমনকি রাতে জেসমিনদের বাড়িতেও এসেছে। আমি নিজে দেখেছি। মাঝরাতে পিছনের দেয়াল টপকে বের হয়ে গেছে। কিন্তু এখন আর জেসমিনের খোঁজখবর রাখে না। ফার্স্ট ইয়ারের এক নতুন মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর রাজনীতি করছে।
তোমার সাথে কথা হয় জেসমিনের?
আগে হতো। এখন আর হয় না। কয়েকদিন আগে জেসমিন যখন রাতে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল আমি তাকে রক্ষা করেছিলাম। তারপর একবার ফোন করেছিল, ধন্যবাদ দিতে। আর বলেছিল আবার আত্মহত্যা করবে। তখনই আমি আপনার কাছে যাই।
আমাকে চিনলে কীভাবে?
স্যার আমার এক বন্ধুর মা পাগল ছিল। আপনি সুস্থ করে দিয়েছেন। সে আপনার গল্প বলেছে আমাকে। যেদিন জেসমিন ফোন করে আবার আত্মহত্যার কথা বলল, আমার আর ভালো লাগছিল না। তাই আপনার কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভয়ে বলতে পারিনি।
এখন তো সবকিছু বলতে পারছ।
পারছি স্যার। কিন্তু অনেক সময় অনেক কিছু বলতে পারি না।
জেসমিনকে কি বলেছ তোমার ভালোবাসার কথা?
ডাক্তার তরফদার সরাসরি প্রশ্নটা করলেন জেহানকে।
জেহান মাথা নিচু করে বলল, স্যার, অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি।
কেন?
আমার থেকে সে বয়সে বড়।
তাহলে তাকে ভালোবাসো কেন?
মাথাটা আরো নিচু হয়ে গেল জেহানের। বিড়বিড় করে বলল, স্যার আমি জানি না, জেসমিনকে দেখলেই আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। জেসমিন এত সুন্দর! স্যার আমি কোনো কথা বলতে পারি না।
তুমি কি জেসমিনকে এখনো ভালোবাসো? মানে জেসমিন অন্য কারো সন্তান ধারণ করছে জেনেও।
এবার জেহান মাথা উঁচু করল। তার চোখে পানি। বিড়বিড় করে বলল, স্যার, আমি জেসমিনকে সবসময়ই ভালোবাসি।
এই কথাটা কি অন্য কেউ জানে?
না স্যার।
জেসমিন কি বুঝতে পারে যে তুমি তাকে ভালোবাসো?
না স্যার।
তাকে তুমি তোমার ভালোবাসার কথা, তোমার ভালোলাগার কথা বলোনি কেন?
ভয়ে বলিনি স্যার। তবে বুঝতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি।
জেসমিন এবং তার পরিবার সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য জেনে ডাক্তার তরফদার বললেন, ঠিক আছে তুমি বাসায় যাও। আমি চেষ্টা করব জেসমিনকে বাঁচিয়ে রাখতে, তার আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে। আর হ্যাঁ মনে রেখো, ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হওয়া যতটা না কষ্টের, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করতে না পারা অনেক অনেক বেশি কষ্টের। এই কষ্টটা এক-দুই দিনের নয়, আজীবনের। তাই বুকের মধ্যে ভালোবাসা চেপে না রেখে প্রকাশ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এতে মন যেমন হালকা হয়, ভালোবাসায় জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
*
ডাক্তার তরফদার এলেন নাজমুল হোসেনের স্কুলে। স্কুলেই ছিলেন তিনি। ডাক্তার তরফদার নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, যে কোনোভাবেই হোক, আমি জানতে পেরেছি আপনার মেয়ে জেসমিন বড় ধরনের সমস্যায় আছে।
নাজমুল হোসেন বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, আসলে আপনি কী বলতে চাইছেন?
আমি জেসমিন এবং আপনাদের সাহায্য করতে চাই।
কেন?
মানুষ হিসেবে অন্য একজন মানুষের জীবন বাঁচানো নৈতিক দায়িত্ব। ঐ দায়িত্ববোধ থেকেই বলছি কথাগুলো। আপনার মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। কোনো কারণে কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে ঐ কারণ দূর না করতে পারলে আবার সে আত্মহত্যার চেষ্টা করবে। একজন মানুষ নিজেই যদি নিজেকে হত্যা করতে চায় কতক্ষণ আপনি তাকে আটকে রাখবেন, বরং তার সমস্যাটা চিহ্নিত করে তা দূর করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আপনি ঠিকই বলেছেন, কিন্তু আমার মনে হয় না জেসমিনের সমস্যা আপনি দূর করতে পারবেন।
চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।
তা নেই। কিন্তু আপনি অনেক বড় মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ হবেন নিশ্চয়। আসলে এই চিকিৎসার অনেক খরচ। আমি…
আমি তো আপনার কাছে কোনো খরচ চাইনি।
তারপরও…
অর্থ অনেক কিছু মানি, তবে আপাতত আমার প্রয়োজন নেই। বরং প্রয়োজন একজন মানুষের জীবন রক্ষা করা। আমি জেসমিনের সাথে কথা বলতে চাই।
জেসমিন তো কারো সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না ইদানীং। এমনকি ওর ছোট ভাইদের সাথেও কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে।
ডাক্তার তরফদার চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, এটা ভালো লক্ষণ না। অর্থাৎ জেসমিন একা হয়ে যাচ্ছে। একাকিত্ব মানুষের বড় শত্রু। মানুষ সামাজিক জীব, মানুষকে একা থাকার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। মানুষ যত একা থাকবে বিষণ্ণতা ততই জেঁকে ধরবে। বাড়বে আত্মহত্যারও ইচ্ছা।
নাজমুল হোসেন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আমার স্ত্রীও চায় না কেউ এখন জেসমিনের সাথে দেখা করুক।
এই কথার অর্থ হলো আপনারা কিছু গোপন করতে চাচ্ছেন।
এখন আর কিছু গোপন নেই, সবই ফাঁস হয়ে গেছে।
তাহলে আমাকে বিস্তারিত বলতে তো আপত্তি থাকা উচিত নয় আপনার। আর আমাকে চিকিৎসার সুযোগও দিতে পারেন। চিকিৎসা না হলে শুধু জেসমিন নয়, আপনার স্ত্রীও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। আর ইতিমধ্যে আপনিও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, আপনার চোখ ঐরকমই বলছে।
আমার মতো অবস্থা হলে আপনিও মানসিকভাবে ভেঙে পড়তেন।
স্বীকার করছি। এজন্যই সহায়তা করতে চাই আপনাদের।
চলুন তাহলে।
স্কুল থেকে বাড়ি দূরে নয়। দশ মিনিটের হাঁটা পথ। এই দশ মিনিটে ডাক্তার তরফদার যতটুকু পারলেন জেসমিন সম্পর্কে তথ্য নিলেন নাজমুল হোসেনের কাছ থেকে। শুধু এটুকু অনুধাবন করলেন যে, হেডমাস্টার নাজমুল হোসেন মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত, তবে কাউকে তিনি কিছু বুঝতে দেন না।
বাড়ির একেবারে কাছাকাছি আসতে ডাক্তার তরফদার বললেন, কার সাথে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল জেসমিনের?
আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না। কিছুই বলে না জেসমিন।
তারপরও কাউকে না কাউকে তো আপনারা সন্দেহ করছেন?
রাশেদের কথা আপনাকে বলেছি। ওর সাথেই সম্পর্ক ছিল জেসমিনের।
রাশেদ কি জানে যে জেসমিনের পেটে সন্তান আছে?
আমাদের করো সাথে কথা হয়নি। জেসমিনের মা একবার ভেবেছিল রাশেদের পরিবারের সাথে কথা বলবে। কিন্তু নিশ্চিত প্রমাণ নেই আমাদের কাছে। জেসমিন মোটেও সহযোগিতা করছে না। একটু খুলে বললেই হতো। এখন তো আর আমাদের উপায় নেই। বাচ্চার জন্ম দিতেই হবে। সমাজে কী লজ্জায়ই না পড়ব আমরা!
মানুষের জীবনে নানারকম আপদ-বিপদ আসে। আবার এইসব আপদ বিপদ মানুষই মোকাবেলা করে। আপনি এত চিন্তা করবেন না। দেখি কী করা যায়!
বাড়ির বারান্দায় একটা চেয়ারে বসতে দেয়া হলো ডাক্তার তরফদারকে। নাজমুল হোসেন ডাকতে গেলেন জেসমিনকে। জেসমিন অবশ্য বের হতে রাজি হলো না। উলটো রাগ হয়ে বলল, আমাকে বিরক্ত কোরো না বাবা।
তুই একটু বুঝতে চেষ্টা কর।
না, আমি যাব না, আমার মতো থাকব। আর আমাকে নিয়ে তোমরা এত চিন্তা কোরো না। বাড়িতে ডাক্তার আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমার শরীরের কোথাও কোনো ব্যথা নেই এখন, আমি সুস্থ আছি।
যিনি এসেছেন উনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
আমার মন ভালো আছে।
কিন্তু আমাদের কারো মন তো ভালো নেই। তোকে বুঝতে হবে ব্যাপারটা। তোর জীবনটা সুন্দর করার জন্য কত কী-ই না আমরা করছি, আর তুই আমাদের সহযোগিতা করছিস না।
জেসমিন তার বাবার চোখে তাকাল। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে সরাসরি এলো ডাক্তার তরফদারের সামনে। একটা চেয়ারে বসে বলল, নিন আমাকে পরীক্ষা করুন। আমার কোনো অসুখ নেই, অথচ সবাই মিলে আমাকে এখন অসুস্থ বানাচ্ছে।
ডাক্তার তরফদার হেসে দিয়ে বললেন, আমি তো তাই বলছি, তুমি অসুস্থ নও, সবাই তোমাকে অসুস্থ বলছে।
তাহলে আপনি এসেছেন কেন?
এসেছি সবাইকে বুঝাতে যে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ।
এখন বলে দিন।
ঠিক আছে আমি বলে দিচ্ছি। তুমি কি একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?
কী প্রশ্ন?
নাজমুল হোসেন আর নিলুফার পাশেই ছিলেন। ইশারা করতে তারা দরজার ওপাশে চলে গেলন। ডাক্তার তরফদার বললেন, এই বাসায় তোমাকে কে সবচেয়ে বেশি অসুস্থ মনে করে?
সবাই।
তুমি এখন থেকে একটা কাজ করবে।
কী কাজ?
ঘরের মধ্যে না থেকে বাসার কাজগুলো করবে, কঠিন কাজ না। সহজ কাজগুলো। দেখবে সবাই তোমার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করছে।
জেসমিন কিছু বলল না। ঝিম মেরে বসে থাকল।
ডাক্তার তরফদার এবার বললেন, তুমি কি আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াবে?
জেসমিন চেয়ার ছেড়ে উঠে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। পুরো পানিটুকু খেলেন ডাক্তার তরফদার। তারপর বললেন, তোমার যখন খারাপ লাগবে তখন তুমি আমার চেম্বারে আসতে পারো। এই যে ভিজিটিং কার্ড। এখানে সবকিছু লেখা আছে। জানি আমার সাহায্য হয়তো তোমার লাগবে না। তারপরও যদি মনে করো আসতে পারো। ধন্যবাদ তোমাকে, তুমি এখন তোমার ঘরে যেতে পারো।
জেসমিন তার ঘরে চলে গেল। ডাক্তার তরফদারকে নাস্তা করার কথা বললেও অপেক্ষা করলেন না তিনি। বাইরে বের হয়ে এলেন। নাজমুল হোসেনের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় বললেন, জেসমিন সুস্থ নয়, মারাত্মক অসুস্থ। অসুস্থতার কারণটা খুঁজে বের করতে হবে। হতে পারে অল্প বয়সে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে এজন্য। মারাত্মক অপরাধবোধ কাজ করছে ওর মধ্যে। এজন্য সে মানসিক চাপেও আছে। আজ থেকে কোনোরকম খারাপ ব্যবহার করবেন না ওর সাথে। আচরণ এমন করবেন যেন সবকিছু স্বাভাবিক আছে। বরং আপনারা খুশিই হয়েছেন তার পেটে সন্তান আসার জন্য, ব্যাপারটা যেন এমন থাকে। আর হ্যাঁ, জেসমিনের দুজন বান্ধবীর নাম আমাকে দেবেন যারা ওর খুব ঘনিষ্ঠ। আমি কথা বলতে চাই ওদের সাথে। আসি।
নাজমুল হোসেন কিছু বলতে পারলেন না। তার চোখ দিয়ে পানি আসে আসে অবস্থা।
ডাক্তার তরফদার চলে আসার সময় ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারলেন না, পুরোটা সময় ছাদের উপর থেকে তার উপর নজর রাখছিল জেহান।
*
ডাক্তার তরফদার বাসায় এসে লম্বা একটা ঘুম দিলেন। শরীরটা তার ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। কেমন যেন দুর্বল দুর্বল লাগে। কারণটাও বুঝতে পারছেন না। শরীরে তার তেমন কোনো রোগ নেই। নেই ডায়াবেটিসও। তবে লক্ষণটা মনে হচ্ছে ডায়াবেটিসের। রক্তে গ্লুকোজ মাপার একটা ডিজিটাল মেশিন আগে থেকেই বাসায় ছিল। ঐ মেশিনে রক্তের গ্লুকোজ মাপলেন তিনি। মাত্র চার দশমিক এক। বুঝলেন শরীরে শর্করার অভাবে এমন হচ্ছে। তার অন্যতম একটা প্রিয় খাবার হলো পোলাওয়ের চালের পাতলা জাউ আর শুকনো মরিচ পিয়াজ দিয়ে বানানো ঝলবেশি আলুভর্তী। ঠিক করলেন আজ তিনি তার প্রিয় খাবারটা খাবেন। কিন্তু করিম চাচার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বাইরে বের হয়ে এসে দেখলেন বাগানেও নেই। করিম চাচাকে নিয়ে এই একটা সমস্যা। হুটহাট বাইরে চলে যায়। বাড়ির কুকুর ভুলু তাকে দেখে শুধু লেজ নাড়ছে। ভুলুও মাঝে মাঝে করিম চাচার সাথে বাইরে চলে যায়। তবে আজ যায়নি। বাড়িতেই আছে।
ডাক্তার তরফদার ঠিক করলেন তিনি আজ পোলাওয়ের চালের সাদা জাউ খাবেনই। প্রয়োজনে নিজে রান্না করবেন। অবশ্য রান্নাঘরে এসে বড় অবাক হলেন। করিম চাচা তার জন্য পোলাওয়ের চালের সাদা জাউ বেঁধে রেখেছে। আলু ভর্তাও করেছে, সাথে শুকনো মরিচ ভর্তা। করিম চাচার এই ক্ষমতাটা অসাধারণ। সে বুঝতে পারে মানুষ ভবিষ্যতে কী চায় কিংবা মানুষের জীবনে কী ঘটতে যাচ্ছে। একেবারে নির্ভুলভাবে ভবিষ্যৎ বলতে পারে করিম চাচা। পৃথিবীতে তার মতো এতটা নিখুঁতভাবে ভবিষ্যৎ বলতে পারে এমন কোনো মানুষ নেই বলেই বিশ্বাস করেন ডাক্তার তরফদার। অবশ্য তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সে নিজেই করে, অন্য কেউ জানতে চাইলে কখনোই বলে না। তার একটাই কথা, ভবিষ্যৎ জানতে চেও না, নিজের ভবিষ্যৎ নিজে গড়ে নাও।
পোলাওয়ের চালের সাদা জাউ তৈরি করার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। দুই লিটার পানিতে এক মুঠো সুগন্ধী পোলাওয়ের চাউল নিতে হবে। তারপর সিদ্ধ করতে হবে ধীরে ধীরে। একসময় সম্পূর্ণ চাল পানিতে গলে যাবে, হবে অনেকটা স্যুপের মতো। ইচ্ছে করলে একটা সিদ্ধ ডিম গুলিয়ে নেয়া যেতে পারে। তারপর নিতে হবে একটা বাটিতে, সাথে শুকনো মরিচের ঝাল ঝাল আলুভর্তা থাকবে। বাটিতে যখন জাউ ঢালা হবে তখন যেন ধোয়া উড়ে জাউ থেকে, নাকে এসে লাগা বাসনা ক্ষুধাকে আরো চাঙা করে তুলবে। অতঃপর একটা চামচ দিয়ে ধীরে ধীরে খেতে হবে। স্বাদ হবে একেবারে অমৃতের মতো।
ডাক্তার তরফদার বাটিতে জাউ নিয়ে নিজের চেম্বারে এসে বসলেন। বেশ সময় নিয়ে তিনি জাউ খেতে শুরু করলেন। স্বাদ সত্যি অসাধারণ। তার থেকে বড় কথা দুর্বলতা কেটে গেছে। নিজেকে সম্পূর্ণ সতেজ মনে হচ্ছে তার। তাই একটা কাগজ টেনে জেসমিন বিষয়ে লিখতে শুরু করলেন
জেসমিন সম্পর্কে যতটুকু তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে তা পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে জেসমিন গর্ভবতী। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো কে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে তা সে বলতে চাচ্ছে না। একজন মেয়ে সাধারণত এ ধরনের তথ্য লুকিয়ে রাখে না। রাখতে পারে তখনই যখন তাকে ভয় দেখানো হয় কিংবা সে নিজেই বিশ্বাস করে না যে সে গর্ভবতী। যেহেতু আলট্রাসনোগ্রামে বাচ্চার অবয়ব স্পষ্ট দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন তার বাবা সেক্ষেত্রে সে যে গর্ভবতী, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাহলে কে তাকে ভয় দেখাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন। কারণ তার আশেপাশে এমন কেউ নেই যে তাকে ভয় দেখাতে পারে। রাশেদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল ঠিকই, কিন্তু রাশেদ যে তাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু রাশেদের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে জেসমিনের, কারণটা কী? হতে পারে ঐ গর্ভের সন্তান। রাশেদ হয়তো চাচ্ছে সন্তানকে মেরে ফেলতে, জেসমিন চাচ্ছে না। পৃথিবীতে কোনো নারীই চায় না তার গর্ভে সৃষ্ট হওয়া কোনো মানব ভ্রুণের মৃত্যু হোক। এজন্য হয়তো রাশেদ আর জেসমিনের মধ্যে মনোমালিন্য চলছে। জেসমিন হয়তো চেষ্টা করছে রাশেদকে বোঝনোর জন্য যে সন্তানকে সে জন্ম দিতে চায়। রাশেদ রাজি না হওয়ায় হতাশাগ্রস্ত সে। এই হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল। এই মুহূর্তে তার জীবন রক্ষার অন্যতম উপায় রাশেদ আর তার মধ্যে মিল করিয়ে দেয়া। এক্ষেত্রে কথা বলতে হবে রাশেদের সাথে। রাশেদ সবকিছু স্বীকার করবে কি না সন্দেহ আছে। কারণ রাশেদ ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে চাচ্ছে এখন। সম্পর্কের বিষয়ে আরো নিশ্চিত হতে জেসমিনের ঘনিষ্ঠ কোনো বান্ধবীর সাথেও কথা বলা প্রয়োজন। তবে সবার আগে দরকার জেসমিনের উপর নজর রাখা। আত্মহত্যার চেষ্টা প্রতিহত করার জন্য নজরদারি বড় জরুরি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে জেহান। জেহান সত্যি ভালোবাসে জেসমিনকে। কিন্তু জেসমিন জেহানকে ভালোবাসে না, ভালোবাসার সম্ভাবনাও কম। কারণ জেহান বয়সে ছোট। বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে একজন মেয়ে সাধারণত তার থেকে কম বয়সি একটি ছেলেকে ভালোবাসার মানুষ কিংবা স্বামী হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত নয়। জেহানকে আজ জানানো হয়েছে যে ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হওয়া যতটা না কষ্টের, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করতে না পারা অনেক অনেক বেশি কষ্টের। এই কষ্টটা এক-দুই দিনের নয়, আজীবনের। তাই বুকের মধ্যে ভালোবাসা চেপে না রেখে প্রকাশ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এতে মন যেমন হালকা হয়, ভালোবাসার জয় হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে মনে হবে এমন কিছু কথা জেহানকে বলা ঠিক হয়নি, কিন্তু যৌক্তিকতা আছে। জেহানের বয়স এখনো আঠারো হয়নি। সে বয়ঃসন্ধিকালে আছে, টিনএজার। জেসমিনের প্রতি মারাত্মক দুর্বল। এই দুর্বলতা পরবর্তীকালে তার নিজের মানসিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। সে যদি এখনই প্রত্যাখ্যাত হয় তাহলে তার নিজের মধ্যে আফসোস থাকবে না, অন্তত এই ভেবে মানসিক শান্তি পাবে যে সে চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি জেসমিনের প্রতি তার মোহ কেটে যাবে। এই মোহ কেটে যাওয়াটা বড় জরুরি। মোহ কাটার অন্যতম উপায় ভালোলাগার কথাটা জেহানকে দিয়ে বলানো। এজন্য ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কথাগুলো বলা হয়েছে জেহানকে। তবে জেহান জেসমিনকে ভালোবাসার কথা বলতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ জেহান তুলনামূলকভাবে ভীতু ধরনের ছেলে। এই ভয়ই তার অস্থিরতা আর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেভাবেই হোক এই ভয় আর অস্থিরতা তাড়াতে হবে। তা না হলে জেহান নিজেও অস্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করবে। যাইহোক, এখন মূল বিষয় হচ্ছে জেসমিনের গর্ভের সন্তানের পিতা কে তা খুঁজে বের করা। এজন্য জরুরি হলো রাশেদ এবং জেসমিনের ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সাথে কথা বলা।
ডাক্তার তরফদার কলম রেখে আবার মনোযোগী হলেন জাউয়ের প্রতি। লেখায় অতিরিক্ত মনোযোগ থাকার কারণে শেষের দিকে জাউ খেতে ভুলে গিয়েছিলেন। ঠান্ডা হয়ে গেছে জাউ। চুলা থেকে আবার গরম জাউ নিয়ে এলেন। এসে বসলেন বারান্দায়। ভুলু তার পায়ের কাছে এসে কুঁইকুঁই করতে লাগল। তিনি বুঝলেন ক্ষুধা লেগেছে ভুলুরও। কুকুর জাউ খায় কিনা, ভাত খায় কিনা, ঠিক মনে করতে পারলেন না। তিনি উপলব্ধি করলেন, অনেক কিছুই তার ইদানীং মনে থাকে না, এটা ভালো লক্ষণ না।
ডাক্তার তরফদার পোলাওয়ের চালের জাউ এনে দিলেন ভুলুকে। জাউ থেকে ধোঁয়া উড়ছে, ভিতরে ঝাল আলুভর্তাও আছে, সুগন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে। ভুলু বারবার শুঁকে ঘ্রাণ নিচ্ছে।
তিনি ভুলুকে বললেন, ভুলো খেয়ে দ্যাখো, রাজকীয় জাউ, অনেক আগে রাজা-বাদশাহরা খেত।
রাজা-বাদশা শব্দ শুনে লেজ নাড়াতে লাগল ভুলু। তারপর চার পায়ে খুব আরাম করে বসল। জাউ এখন তার মুখের সামনে।
ডাক্তার তরফদার এবার বললেন, খেয়ে নাও।
ভুলু নিচে তাকাল, জিহ্বাটা দিয়ে হালকা স্পর্শ করল জাউ। তারপর খেতেই থাকল, জাউ শেষ করতে খুব একটা সময় লাগল না তার। খাওয়া শেষে ঘেউঘেউ করে উঠল। বোঝা গেল আরো চায়।
ডাক্তার তরফদার উঠে গিয়ে পুরো জাউটুকু নিয়ে এলেন। তারপর ঢেলে দিলেন ভুলুর বাটিতে।
ভুলু মহাখুশি। লাফ দিয়ে উঠে দুবার চক্কর দিল ডাক্তার তরফদারের পাশে। তারপর রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে পোলাওয়ের চালের রাজকীয় জাউ খেতে শুরু করল।
ডাক্তার তরফদার হাতের বাটি থেকে নিজেও এক চামচ জাউ মুখে দিলেন। আজ জাউটা বেশি স্বাদের হয়েছে। কারণ করিম চাচা খাঁটি ঘি দিয়ে বানিয়েছেন আলুভর্তা! আর খাঁটি ঘিয়ের যে কোনো খাবারই বড় স্বাদের হয়!
*
ডাক্তার তরফদার শান্তার সাথে কথা বলতে কলেজে এসেছেন। শান্তার ফোন নম্বর তিনি জোগাড় করেছেন জেহানের কাছ থেকে। নিজেই ফোন করে সময় নিয়েছেন। এখন কথা বলছেন লাইব্রেরিতে বসে। প্রাথমিক কথাবার্তা শেষে প্রশ্ন করলেন ডাক্তার তরফদার, জেসমিনের সাথে তোমার পরিচয় কতদিনের?
শান্তা ঠোঁট কামড়ে বলল, স্যার কলেজে উঠে পরিচয়।
আমি যতদূর জেনেছি তোমার সাথেই জেসমিন সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল।
জি স্যার। কলেজে আসার পর আমরা দুজন একসাথেই থাকতাম, পাশাপাশি বসতাম, ঘুরতাম, চা-নাস্তা খেতাম।
জেসমিনের সমস্যাটা তুমি নিশ্চয় শুনেছ?
জি স্যার শুনেছি। কথা বলতেও গিয়েছিলাম। কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। বারবার জিজ্ঞেস করেছিলাম ওর বাচ্চার বাবা কে? সুনির্দিষ্টভাবে কোনো উত্তর দেয়নি। খালাম্মা মানে জেসমিনের মা-ই আমাকে অনুরোধ করে বলেছিলেন যেন আমি বাচ্চাটার বাবা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল ও খুব বিরক্ত।
কেন?
জানি না স্যার। হয়তো কিছু লুকাতে চাচ্ছে। অবশ্য লুকাবেও বা কেন? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
রাশেদের সাথে সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল জেসমিনের?
আমি ওকে নিষেধ করতাম। কিন্তু ও শুনত না। মাঝে মাঝে রাশেদ ভাইয়ার মোটরসাইকেলে করে অজানা কোথাও চলে যেত। জিজ্ঞেস করলে বলত না। শেষের দিকে ওদের ভালোবাসা এতটাই গম্ভীর হয়েছিল যে ক্লাস বাদ দিয়ে মোেটরসাইকেলে ঘুরত জেসমিন।
রাশেদ ছেলেটা কেমন?
প্রথমে ভালোই ছিল। মাস দুয়েক ধরে একেবারে পালটে গেছে। রাজনীতিতে ঢুকেছে। এখন একটা গ্রুপের নেতা সে। সবসময় ছয়-সাতজন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে থাকে। শুনেছি স্থানীয় বাজারে চাদাবাজিও করে। কয়েকদিন আগে বাজারের দোকান মালিক সমিতির সাথে মারামারিও হয়েছে। থানায় জিডি হয়েছে। আর…আর…
আর কী?
জেসমিনকে বোধহয় ভুলে গেছে। খোঁজখবর নেয় বলে মনে হয় না। আর একটা মেয়ের সাথে ঘুরতে দেখি ইদানীং। মেয়েটা অবশ্য সুবিধার না। ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে হলেও আগেও একজনের সাথে প্রেম করেছে।
ডাক্তার তরফদার বুকের মধ্যে আটকে রাখা দমটা ছেড়ে দিয়ে বললেন, তোমার কি মনে হয় রাশেদই জেসমিনের বাচ্চার বাবা?
অন্য কেউ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ জেসমিনকে একমাত্র রাশেদ ভাইয়ের সাথেই ঘুরতে দেখেছি। কিন্তু একটা যুক্তি মিলছে না।
কী যুক্তি?
জেসমিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওর বাচ্চা রাশেদের কি না। জেসমিন স্পষ্টভাবে বলেছে ‘না’। তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম বাচ্চাটা কার তাহলে? মৃদু হেসে বলেছিল, আমি কারো জন্য বিপদের কারণ হতে চাই না, সব দায়িত্ব আমার। শুনে রাখ, বাচ্চাটার বাবা এমন কেউ যে তুই কল্পনাও করতে পারবি না। সময় হলে বাচ্চার বাবা ঠিকই বাচ্চার দায়িত্ব নেবে। আপাতত ধরে রাখ বাচ্চাটার বাবা এক মূর্তি যে কিনা আমাকে খুব ভালোবাসে। ছায়া হয়ে আমার কাছে আসেও।
মূর্তি কীভাবে বাচ্চার বাবা হবে? আবার ছায়া হয়ে আসবে? তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
কীভাবে বুঝবেন স্যার? জেসমিনের কথা তো আমিও বুঝিনি। আর এখন তো আরো বোঝা যায় না। সবসময় মনমরা হয়ে বসে থাকে।
জেসমিনের এই পরিবর্তনটা তোমার কবে থেকে চোখে পড়েছে?
কোন পরিবর্তন?
জেসমিনের নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া, বিষণ্ণতায় ভোগা, কারো সাথে কথা না বলা।
শান্তা খানিকটা সময় নিয়ে বলল, স্যার মনে করতে পারছি না। সম্ভবত যখন থেকে বুঝতে পারে যে তার পেটে বাচ্চা আছে তখন থেকেই সে বেশি চুপ হয়ে যায়। তবে কক্সবাজার থেকে আসার পর পরিবর্তনটা চোখে পড়ে আমার। মাঝে মাঝে কী যেন ভাবত, অন্যমনস্ক হয়ে যেত।
ধন্যবাদ তোমাকে, আমার আর তেমন কিছু জানার নেই। নতুন কোনো তথ্য থাকলে আমাকে জানাবে। এই যে ভিজিটিং কার্ডে আমার ফোন নম্বর আছে। আর হ্যাঁ, তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে যে আমি জেসমিনকে সাহায্য করতে চাই। যখন এই বিশ্বাসটা তোমার মধ্যে জন্মাবে তখন দেখবে অনেক নতুন তথ্য তোমার মাথায় আসছে।
স্যার আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।
আমি জানি। তারপরও তোমাকে বললাম যেন তুমি, আমি, আমরা সবাই মিলে জেসমিনকে সুস্থ করে তুলতে পারি।
জি স্যার।
ডাক্তার তরফদার রাশেদের সাথেও কথা বলবেন বলে ঠিক করেছেন। কলেজে একটা হোস্টেল আছে, রাশেদের সাথে দেখা করতে হোস্টেলে যেতে হবে। হাতে এখনো বিশ মিনিট সময় আছে। রাশেদ তার সাথে কেমন ব্যবহার করবে সেটা নিয়ে তিনি খানিকটা শঙ্কিত। কারণ জেসমিনের প্রতি তার আর টান নেই বলে তার ধারণা।
বিশ মিনিটের মধ্যে ডাক্তার তরফদার দুজন ছাত্রের সাথে কথা বললেন। মূল বিষয়-কলেজের রাজনীতি। রাজনীতির কথা বলতে রাশেদের কথাও এলো, তার চাঁদাবাজির কথা বলতেও ভুলল না দুই ছাত্রের কেউ। একই সাথে জানাল সে কলেজের জন্য একটা ত্রাস হয়ে উঠছে। নতুন যে হোস্টেল নির্মিত হবে, ঠিকাদারির কাজ নাকি তার পছন্দের মানুষকেই দিতে হবে। কলেজের একজন ছাত্র কীভাবে ঠিকাদার ঠিক করবে তা ঠিক বুঝতে পারলেন না ডাক্তার তরফদার। দিনে দিনে শিক্ষাব্যবস্থা যে একটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে এই ঘটনা যেন তারই উদাহরণ।
কলেজে মাঠের পাশে বড় একটা আমগাছ আছে। সেই গাছের নিচে কথা বলতে শুরু করলেন ডাক্তার তরফদার আর রাশেদ। নিজের পরিচয় দিয়ে ডাক্তার তরফদার বললেন, আমি তোমার কাছে এসেছি শুধু একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য, তোমার উপর কোনো চাপ সৃষ্টি কিংবা তোমার চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করার জন্য নয়। যদিও বিষয়টি তোমার ব্যক্তিগত, তোমার কাছে জানতে চাইব তুমি কেন জেসমিনকে ছেড়ে চলে এসেছ?
রাশেদ সরু চোখে তাকাল ডাক্তার তরফদারের দিকে। তারপর টেনে টেনে বলল, জেসমিনই তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
তাই বুঝি!
জি স্যার। আমাকে সে চিঠিও লিখেছে, এসএমএস দিয়েছে। সবই আছে আমার কাছে। হঠাৎ আমার ফোন ধরা বন্ধ করে দেয় সে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও একদিন রাতে দেয়াল টপকে আমি ওর কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এরপর বোধহয় দুবার ফোনে কথা হয়েছে আমাদের। আমিই ফোন করেছিলাম। এখন আর আমার ফোন ধরে না।
ডাক্তার তরফদার বড় অবাক হলেন। রাশেদের কণ্ঠ আর চোখের ভাষা শুনে বুঝতে পারছেন রাশেদ সত্য কথা বলছে।
রাশেদ আবার বলল, স্যার, তবে এখন আর আমার কোনো আগ্রহ নেই জেসমিনের প্রতি।
কেন?
সত্যমিথ্যা জানি না। তবে শুনেছি ও প্রেগন্যান্ট। তার মানে কী? নিশ্চয় কারো সাথে ওর সম্পর্ক আছে!
অনেকে বলছে, এই সন্তান তোমার।
কথাটা শোনার পর রাশেদের রেগে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে রাগল না। বলল, স্যার সবাই বলবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ জেসমিন আমার সাথে ঘুরেছে, আমার মোটরসাইকেলে উঠেছে, আমরা দূরেও গেছি ঘুরতে। তবে এটা সত্য আমাদের কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। অবশ্য…
অবশ্য কী?
শেষ যখন জেসমিনের সাথে আমার দেখা হয়, মানে যে রাতে আমি ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, জেসমিন আমাকে বলেছিল যে নীল চোখের ছায়াকে ভালোবাসে, আমাকে না।
নীল চোখের ছায়া কী?
জানি না স্যার। তবে ‘ছায়া’ শব্দটা বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করেছে ও। ঐ দিনের পর আমি জেসমিনের সাথে একবার ফোনেও কথা বলেছিলাম, জিজ্ঞেস করেছিলাম তার প্রেগন্যান্সির বিষয়টি। বেশ সাবলীলভাবে সে বলেছিল যে তার পেটের বাচ্চা নীল চোখের ছায়ার বাচ্চা। ঐ দিনও জিজ্ঞেস করেছিলাম, নীল চোখের ছায়া আবার কী? বলেছিল, তার মনের মধ্যে একটা জোছনা আছে, সেই জোছনায় একটা ছায়া আসে। ছায়াটার চোখ নীল। ঐ নীল চোখের ছায়াটাই তার সন্তানের বাবা। পেটের ঐ সন্তানকে সে খুব ভালোবাসে এবং সে চায় সন্তানের জন্ম হোক। যেহেতু আমি ঐ সন্তানের বাবা না, তাই আমাকে সে তার কাছে যেতে বারণ করেছে। আরো বলেছে সে দ্রুতই চলে যাবে নীল চোখের ছায়ার কাছে। ঐ ছায়া নাকি থাকে সমুদ্রের তীরে, পাহাড়ের ঢালে। জেসমিনের কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল ও পাগল হয়ে গেছে। কথা বলার সময় কেমন যেন উদাস হয়ে যাচ্ছিল। তবে ওকে আমার মোটেও চিন্তিত মনে হয়নি। বরং মনে হচ্ছিল ঐ নীল চোখের ছায়ার কাছে যাওয়ার আনন্দে সে বিভোর। যেহেতু আমার প্রতি ওর আর কোনো আগ্রহ নেই, এজন্য আমিও আর ওর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি না। ধীরে ধীরে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছি।
তুমি কি জেসমিনের কথা বিশ্বাস করেছ?
জেসমিন নিজের মুখে আমাকে বলেছে।
ডাক্তার তরফদার লম্বা শ্বাস টেনে বললেন, রাশেদ ধন্যবাদ তোমাকে। আমি চলে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে তোমাকে বলে যাই, সাবধানে থেকো, আর এই বয়সে রাজনীতিতে এতটা সম্পৃক্ত হবে না। বয়সটা পড়াশুনার। রাজনীতি করার জন্য সামনে অনেক সময় পাবে। তখন রাজনীতি করতে পারবে। ভালো থেকো, সুন্দর থেকো।
ফিরে আসার সময় ডাক্তার তরফদার বড় চিন্তায় পড়লেন। কারণ তিনি নিশ্চিত রাশেদ তাকে মিথ্যা বলেনি। মানুষের কথা বলার ধরন আর দৃষ্টি দেখলে অনেকটাই বুঝতে পারেন তিনি। তাছাড়া কথাবার্তায় খুব সাবলীল ছিল রাশেদ। এরকম সাবলীলতা দিয়ে মিথ্যাকে ঢেকে রাখার ক্ষমতা মানুষের নেই বললেই চলে। তারপরও এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার সময় হয়নি, রহস্যের আরো গভীরে প্রবেশ করতে হবে-উপলব্ধি করলেন তিনি। আর কয়েকটা শব্দ তার মাথায় ঘোরাফেরা করতে লাগল। এই শব্দগুলো হলো নীল চোখ, ছায়া, পাহাড়, সমুদ্র, মূর্তি।
*
শেষ রাত। হাডসন হিলে সাগরের তীর ধরে হাঁটছে জেসমিন আর ডাক্তার হাডসন। বরাবরের মতো জেসমিনের পরা লাল শাড়ি আর ডাক্তার হাডসন পরেছে নীল পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। বাতাসের গতি আজ তুলনামূলকভাবে বেশি। এজন্য ভালোলাগাটাও যেন বেশি উপভোগ্য। দেখা হওয়ার পর দুজন প্রথমে বেশ কথা বলেছে। কিছুক্ষণ হলো চুপচাপ হাঁটছে।
বড় একটা ঢেউ পায়ে আছড়ে পড়তেই ডাক্তার হাডসন বললেন, কেমন লাগছে তোমার?
জেসমিন মিষ্টি হেসে বলল, অসাধারণ!
আমারও খুব ভালো লাগছে।
সত্যি?
হ্যাঁ, তোমার পাশে থাকতে, তোমার হাত ধরে হাঁটতে বড় ভালো লাগে।
হাত তো আজ ধরোনি তুমি!
ডাক্তার হাডসন মিষ্টি করে হাসলেন। তারপর ডান হাত দিয়ে জেসমিনের বাম হাত ধরে বললেন, এই তো ধরলাম।
এই হাত আর ছাড়বে না।
ছাড়তে চাইও না।
জেসমিন এবার বলল, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আর এই হাডসন হিল থেকে যাব না।
ডাক্তার হাডসন ভ্রু কুঁচকে বললেন, কেন?
এই হাডসন হিল আমার দারুণ পছন্দের। আমার চিন্তা-চেতনা আর স্বপ্নে যে স্বর্গ, সেই স্বর্গ হলো হাডসিন হিল। যতদিন বেঁচে থাকব, এখানেই থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমার পাশে, তোমারই পরশে।
কী সুন্দর করে কথা বলছ তুমি আজ!
জেসমিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, এখানে এলে আমার কেন যেন দারুণ ভালো লাগে। ভালোলাগাটা আরো বাড়ে যখন তুমি পাশে থাকে। এজন্য বলতে পারো, এই হাডসন হিলের প্রেমে পড়ে গেছি।
ডাক্তার হাডসন চোখ বড় বড় করে বললেন, হাডসন হিলের প্রেমে পড়লে আমার কী হবে?
হাডসন হিল তো তোমারই। হাডসন হিলের প্রেমে পড়া মানে তোমার প্রেমে পড়া। তুমি অনুমতি দিলে আমি চলে আসব।
হঠাৎ এখানে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছ কেন?
বাড়িতে না আমার আর ভালো লাগে না। সবাই জেনে গেছে যে আমার পেটে একটা বাচ্চা আছে। বাচ্চাটা যে তোমার তা আমি কাউকে বলতে পারছি না।
বলছ না কেন?
কারণ তুমি আমার সাথে আমাদের বাড়িতে থাকো না। তুমি থাকো এই হাডসন হিলে। কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখানে চলে আসব। তখন যে কেউ এলে দেখতে পাবে তোমাকে। ইদানীং বড় খারাপ লাগছে বাবা-মায়ের জন্য। বড় কষ্ট পাচ্ছে তারা। অহেতুক সন্দেহ করছে রাশেদ ভাইকে।
রাশেদ ভাই কে?
আমাদের কলেজের বড় ভাই। সে আমাকে খুব পছন্দ করত। আমরা দূরে ঘুরতেও গিয়েছিলাম। তোমাকে সবকিছু খুলে বলছি এ কারণে যে
আমি তোমার কাছে কিছু লুকাতে চাই না। রাশেদ ভাইয়ের প্রতি আমার ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছিল সত্যি, তবে তা জোরালো ছিল না। তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমি অনুধাবন করি, আমার ভালোবাসাটা মূলত তোমারই জন্য।
ডাক্তার হাডসন কিছু বললেন না। চুপ থাকলেন।
জেসমিন আবার বলল, তুমি কি আবার আমার উপর রাগ করলে? তোমাকে আমি সরল মনে সবকিছু খুলে বলেছি।
মৃদু হাসলেন ডাক্তার হাডসন। বললেন, না জেসমিন, রাগ করিনি। বরং তোমার স্পষ্টবাদিতা এবং সরলতায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমারওতো স্ত্রী ছিল, তাকে বড় ভালোবাসতাম। তুমি সবই জানো। এই সমুদ্রে হারিয়ে গেছে সে। ভেবেছিলাম জীবনে আর কাউকে ভালোবাসতে পারব না। কিন্তু তোমাকে দেখার পর বুঝতে পারি, তোমার জন্য আমার এক মহাসমুদ্র ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছে। ঐ ভালোবাসা তোমাকে দিতে না পারলে আমি শান্তি পাব না। আসলে কি জানো, আমাদের অতীত নিয়ে না ভেবে বর্তমান নিয়েই ভাবা উচিত। সহজ সরল কথাটা হলো, তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর এটাই সত্য। কী বলো তুমি?
এবার জেসমিন দুই হাত দিয়ে ডাক্তার হাডসনের বাহু ধরল। তারপর নিজের ভরটা ডাক্তার হাডসনের শরীরে ছেড়ে দিয়ে বলল, তুমিই আমার সব, সবকিছু। আমি চলে আসব, আসব আমার এই সাগর তীরের স্বর্গে, যে স্বর্গে শুধু আছো তুমি, আর থাকব আমি।
ডাক্তার হাডসন বিড়বিড় করে বললেন, আমি তো তোমার অপেক্ষায়ই আছি।
জেসমিন আর কিছু বলল না। পানির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগল। সমুদ্রের ঢেউগুলো যখন পায়ে এসে পড়ছে দারুণ ভালো লাগছে জেসমিনের। আর বাতাসের ছোঁয়া তো আছেই। সবচেয়ে বড় কথা সে পাছে তার প্রিয় মানুষ ডাক্তার হাডসনের ছোঁয়া যার একটু স্পর্শের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে সারাটা দিন।
হাঁটতে হাঁটতে তারা এলো নীল পাথরের কাছে। ডাক্তার হাডসন বললেন, উপরে উঠবে?
উপরে নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল জেসমিন।
নীল পাথরে উঠতে হাঁপিয়ে গেল জেসমিন। সে পাথরের উপর শুয়ে জোরে কয়েকবার দম নিল। তারপর বলল, আসলে এখন অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি।
ডাক্তার হাডসন বললেন, খুব স্বাভাবিক। তোমার শরীরে তুমি তো শুধু একা নও, আরো একজন আছে, নতুন অতিথি।
তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু…
কিন্তু কী?
একটা বিষয় লক্ষ করেছি। ও না বড় হচ্ছে না।
বড় হচ্ছে না মানে?
মাসখানেক ধরে যেন আগের মতোই আছে। এতদিনে পেটটা তো আরো উঁচু হওয়া উচিত ছিল, তাই না?
কীভাবে বুঝলে?
ইন্টারনেটে দেখেছি।
ব্যতিক্রম হয়। তুমি এত চিন্তা কোরো না। বরং তোমার বেশি বেশি খাওয়াদাওয়া করা উচিত। পুষ্টির অভাব হলে গর্ভের সন্তান বড় হয় না।
তুমি একেবারেই খাওয়াদাওয়া করো না। কেন?
ভালো লাগে না।
এটা ঠিক না। ভালো লাগতেই হবে।
তোমার এখানে আসার পর খাব।
আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে তাড়াতাড়ি চলে এসো। তুমি এলে আমারও ভালো লাগবে। বড় বেশি অনুভব করি তোমাকে। একা একা আমারও ভালো লাগে না।
আমি চলে এলে তোমার একাকিত্ব আর থাকবে না।
কথার মাঝে বাতাসের ঝাঁপটায় চুল এসে পড়ল জেসমিনের মুখে। সেই চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ডাক্তার হাডসন হালকা একটা চুমু খেলেন জেসমিনের ঠোঁটে। জেসমিন নিজেই এবার এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল ডাক্তার হাডসনকে। তারপর বিড়বিড় করে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি, দারুণ ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না, কখনোই না, তুমিই আমার জীবন, তুমিই আমার প্রাণ।
*
নিলুফার বসে আছেন জেসমিনের সামনে। জেসমিন জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। নিলুফার বললেন, সিদ্ধ ডিমটা খেয়ে নে। শরীর ভালো থাকবে।
জেসমিন না তাকিয়েই বলল, আমার শরীর ভালো আছে মা।
তুই বললে তো হবে না। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোর শরীর দিনে দিনে ভেঙে পড়ছে।
তুমি আমাকে নিয়ে এতটা ভেবো না।
তোকে নিয়ে না ভাবলে কাকে নিয়ে ভাববো?
জয় জনিকে নিয়ে ভাবো। ওরা ছোট।
নিলুফারের খুব রাগ উঠছে। কিন্তু তিনি ঠিক করে রেখেছেন আজ রাগবেন না। তাই নিজের রাগটা সামলে বললেন, বলতো, তুই রাতে লাল শাড়ি পরিস কেন?
জেসমিন খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, আমার ভালো লাগে মা।
শাড়ি পরে ঘুমাতে ভালো লাগবে কেন?
তুমি বুঝবে না।
কেন বুঝব না?
মা, আমি তো বড় হয়েছি, তাই না? আমার নিজের কিছু সিদ্ধান্ত আছে না! এখনো কি সবকিছুতে তোমরা মতামত দেবে? আমার পছন্দ অপছন্দ বলে কি কিছু থাকবে না?
তুই এরকম রেগে যাচ্ছিস কেন?
কথা বলতে আমার ভালো লাগছে না। এখন তুমি যাও মা। খাবার থাক, ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নেব। আর আমার খাবার নিয়ে তুমি আর কখনো চিন্তা করবে না। আমি নিজেই নিজের যত্ন নিতে পারি।
নিলুফারের ইচ্ছে হলো জেসমিনের গালে কষে একটা থাপ্পড় মারে। কিন্তু কাজটা করলেন না তিনি। আগের মতোই অনেক কষ্টে নিজের রাগ সামলালেন। তার ইচ্ছা ছিল জেসমিনের গর্ভের সন্তানটা নিয়ে কথা বলবেন আজ। কিন্তু জেসমিনের ব্যবহার দেখে বুঝতে পারলেন এখন আর ঐ বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। তাই তিনি বের হয়ে নিজের কক্ষে এলেন। এসে দেখেন চেয়ারে বসে কী যেন লিখছেন নাজমুল হোসেন। জানতে চেয়ে বললেন, কী লিখছ?
বদলির আবেদন।
মানে!
এখানে আর থাকা যাবে না।
কেন?
বুঝতেই পারছ। জেসমিন যে সন্তানসম্ভবা তা সবাই জেনে গেছে। আশেপাশের মানুষগুলো এখন কীভাবে যেন আমার দিকে তাকায়। ছাত্রছাত্রীদের দিকেও তাকাতে পারি না আমি। এই রকম পরিস্থিতিতে এখানে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়বে। আশেপাশের উপজেলায় চলে যেতে হবে।
তাহলে তো এই বাড়ি ছাড়তে হবে।
ভাড়া দিয়ে দেব।
কী বলছ?
আমি তো আর কোনো বিকল্প দেখছি না। মান-সম্মান নিয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। জেসমিনের জন্যও খারাপ লাগছে। ওর মানসিক অবস্থা নিশ্চয় আমাদের থেকে খারাপ।
জেসমিন তো নিজের সর্বনাশ নিজেই করেছে।
তা করেছে। কিন্তু এখন তো আর তাকে আমরা উপেক্ষা করতে পারব না। বাচ্চাটাকে জন্ম দিতেই হবে। তখন তাকে লালনপালন করা, বড় করা সবই করতে হবে।
নিলুফার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমরা কি দূরে কোনো জায়গায় বাচ্চাটার জন্ম দিতে পারি? তারপর হয়তো কোথাও রেখে আসলাম।
কোথাও রেখে আসব মানে?
এই যেমন ধরো, এতিমখানা।
তোমার কি মাথা খারাপ! জেসমিন মানবে নাকি? সে তো এখন পর্যন্ত বলল না বাচ্চার বাবা কে?
আমি নিশ্চিত রাশেদ।
প্রমাণ ছাড়া নিশ্চিত হওয়া কি ঠিক হবে?
তা হবে না। তবে একটা উপায়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারব। রাশেদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করে দিতে পারি। তখন ডিএনএ টেস্ট করতে হবে রাশেদকে। আমার বিশ্বাস বাচ্চা আর রাশেদের ডিএনএ মিলে যাবে।
সত্যি কথা বলতে কি কোনো মামলা-মোকদ্দমায় আমি যেতে যাচ্ছি না। এতে গন্ধ আরো বেশি ছড়াবে! পুলিশ জানতে চাইবে, উকিল জেরা করবে, শত্রুতা বাড়বে এলাকায়।
নিলুফার আবারো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর জানতে চাইলেন, ডাক্তার তরফদার কিছু বলেছেন? উনি কি কিছু করতে পারবেন?
মনে হচ্ছে না। আজ সকালে আমাকে ফোন করেছিলেন। জেসমিনের রিপোর্টগুলো নিয়ে যেতে বলেছেন। ভাবছি যাব কি না।
আমার মনে হয় যাওয়াটাই ভালো হবে। ভদ্রলোক যেহেতু নিজে ফোন করেছেন, আমার বিশ্বাস কোনো না কোনো তথ্য তিনি দিতে পারবেন।
তা পারবেন। কিন্তু কী লাভ তাতে? জেসমিন আর ওর বাচ্চাটার কী হবে?
আসলে পোড়া কপাল আমাদের! এই বয়সে এসে এমনভাবে বেইজ্জতি হতে হবে কোনোদিনও ভাবতে পারিনি।
মন খারাপ কোরো না। লক্ষ রেখো জেসমিনের উপর। আবার যেন আত্মহত্যা করতে না যায়।
ঘরে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে যদি আত্মহত্যা করে ঠেকাব কীভাবে?
নাজমুল হোসেন এবার চেয়ারে হেলান দিলেন। তারপর টেনে টেনে বললেন, তুমি এখন থেকে রাতে জেসমিনের পাশে ঘুমাতে পারো। তাহলে ও আর আত্মহত্যা করার সুযোগ পাবে না।
জেসমিন কি আমাকে তার পাশে ঘুমাতে দেবে? আমি তো তিন মাস আগে থেকেই বলতেছি, ও রাজি না। একা ঘুমাবে, এমনকি জয়, জনিকেও ঘুমাতে দেয় না পাশে।
বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। ভালো লাগছে না। এক কাপ চা খাওয়াবে?
দিচ্ছি। কিন্তু এই অসময়ে চা খাবে! ঘুম আসবে না তো।
দাও, অসুবিধা নেই।
সাথে আর কিছু দেব?
না।
পারলে জেসমিনের কাছে তুমি একটু যেও। তোমার কথা কম-বেশি হলেও শুনে। আমাকে কেন যেন ও পছন্দ করে না। যদি খাবারটা খাওয়াতে পারো বড় ভালো হয়।
ঠিক আছে যাচ্ছি।
নাজমুল হোসেন চেয়ার থেকে উঠে জেসমিনের কক্ষের সামনে এলেন। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। রাত সাড়ে নয়টা বাজে। এখন ঘুমানোর কথা নয় জেসমিনের। অথচ সে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। জেসমিন যে জেগে আছে নিশ্চিত তিনি। একবার ভাবলেন ডাকবেন, পরে বাদ দিলেন। অনুভব করলেন, কেমন যেন ভয় ভয় করে জেসমিনের সাথে কথা বলতে। কারণটা কী তা ঠিক জানেন না। তবে অনুধাবন করলেন, ‘হতাশাগ্রস্ত যে মানুষ আত্মহত্যা করতে চায় তাকে সবাই ভয় পায়। কারণ তার নিজের জীবনের প্রতি মায়া থাকে না। যখন মানুষের নিজের জীবনের প্রতি মায়া থাকে না তখন সে হয় সবচেয়ে দুর্বল কিংবা সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষ।
*
ডাক্তার তরফদার তার চেম্বারে বসে আছেন। মনটা বেশ খারাপ। কারণ হামিদের বোন হুশনা তাকে চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে লিখেছে,
শ্রদ্ধেয় স্যার,
আশা করি ভালো আছেন। আমি ভালো নাই। ভালো নাই হামিদ ভাইজানও। তার পাগলামি আগের চাইতে বাড়ছে। এখন অনেক বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করে। গ্রামের সবাই পরামর্শ দিতেছে তারে মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর জন্য। কিন্তু অত টাকা আমাগো নাই। আমার মনে হইতেছে, হামিদ ভাইজান বেশিদিন বাঁচবে না। ইদানীং বেশি ‘শিরিন শিরিন করতেছে। যদি শিরিনরে একবার আনা যাইত, মনে হয় অল্প হইলেও মনে শান্তি পাইত সে। অবশ্য জানি, বাস্তবে শিরিনরে নিয়া আসা কোনোভাবেই সম্ভব না। কারণ এখন সে অন্যের স্ত্রী এবং তার সংসার আছে। কেন যেন গতকাল হঠাৎ ভাইজান আপনের কথা বলতেছিল। আপনে নাকি শিরিনরে নিয়া আসবার পারবেন। জানি না, সত্য কি না। স্যার, চিঠি লিখা বিরক্ত করলাম। মনে কষ্ট নিয়েন না, সময়ে অসময়ে বিরক্ত করি। আসলে স্যার, আমি আমার ভাইজানরে বড় ভালোবাসি। পারলে একবার আইসেন। আপনের প্রিয় রুগীরে দেইখা যাইয়েন। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
ইতি
হুশনা।
ডাক্তার তরফদার চিঠিটা পরপর দুবার পড়লেন। খামের উপর সিল দেখে বুঝলেন দুই দিন আগে চিঠিটা লিখেছে হুশনা। হুশনার এই একটা অভ্যাস, চিঠি লেখা। এই যুগে এইরকম মানুষ খুব কম আছে। হুশনার ভাষ্যমতে চিঠি লিখলে গুরুত্ব নাকি বেশি দেয়া হয়। হয়তো সত্য। ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করছেন, সত্যি তার একবার যাওয়া উচিত হামিদকে দেখতে। কারণ হামিদ যে আসলেই বেশিদিন বাঁচবে না তা তিনি নিজেও অনুধাবন করছেন। তবে একবার যদি শিরিনের সাথে তার দেখা করিয়ে দেয়া যেত ব্যাপারটা মন্দ হতো না। এতদিন পর শিরিনকে দেখে হামিদের প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা অবশ্য ভাবার বিষয়। শিরিন থাকে সিলেটে। ধনাঢ্য এক ব্যক্তির স্ত্রী সে। বছরখানেক আগে ঠিকানা জোগাড় করেছিলেন তিনি। একবার ভেবেছিলেন যোগাযোগ করবেন। পরে আর করেননি। শিরিনের ফোন নম্বর জোগাড় করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পারেননি। সিলেটে গিয়ে তিনি অবশ্য তার সাথে কথা বলতে পারবেন। কিন্তু তার ভয় আবার তার পারিবারিক জীবনে কোনো অশান্তি নেমে না আসে।
ডাক্তার তরফদার সিদ্ধান্ত নিলেন শিরিনকে একটা চিঠি লিখবেন। তবে সাংকেতিক ভাষায়। শিরিন যদি আজও হামিদকে ভালোবেসে থাকে, অবশ্যই সাড়া দেবে। কারণ, জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা হৃদয়ের দেয়ালে এমনভাবে অঙ্কিত থাকে যে চাইলেও মোছা যায় না।
‘বাঁশি, ডালিম’
ডাক্তার তরফদার মাত্র এই দুটি শব্দ লিখলেন মূল চিঠিতে। প্রেরক আর প্রাপকের ঠিকানা লিখলেন খামের উপরে। তারপর করিম চাচাকে দিলেন চিঠিটা পোস্ট করার জন্য। করিম চাচার ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা রয়েছে। জিজ্ঞেস করলেই জানা যেত যে শিরিন চিঠি পাওয়ার পর আসবে কি আসবে না। ডাক্তার তরফদার, কখনোই জিজ্ঞেস করেন না। তিনি পছন্দ করেন, জীবন তার গতিতেই চলুক, অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত কোনো ক্ষমতার পূর্বাভাসে নয়।
চেম্বারে আবার বসতে না বসতে নাজমুল হোসেন এলেন। কুশল বিনিময়ের পর নাজমুল সাহেব নিজে থেকেই বললেন, স্যার বড় বিপদে আছি।
ডাক্তার তরফদার মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, বুঝতে পারছি, এজন্যই আসতে বলেছি আপনাকে। রিপোর্টগুলো এনেছেন?
হ্যাঁ এনেছি।
ডাক্তার তরফদার রিপোর্টগুলো দেখলেন। তারপর দেখলেন আলট্রাসনোগ্রামের ফিল্মগুলো। পেটে যে বাচ্চা আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হাড়ের উপস্থিতি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বললেন, নতুন একটা আলট্রাসনোগ্রাম কি করতে পারবেন? তাহলে বুঝতে পারতাম বাচ্চাটা কত বড় হয়েছে।
আমি তো করতে চাচ্ছি। কিন্তু রাজি হচ্ছে না জেসমিন। তার ধারণা জন্মেছে যে, আলট্রাসনোগ্রাম করলে বাচ্চার ক্ষতি হয়।
এখন কেমন আছে জেসমিন?
ভালো না, শুকিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।
কথা বলছে আপনাদের সাথে?
আপনি যেদিন গিয়েছিলেন তারপর দুটো দিন ভালো ছিল। এখন আবার আগের মতো হয়ে গেছে। আর…
আর কী?
প্রায় প্রত্যেকদিন রাতেই লাল শাড়ি পরে ঘুমিয়ে থাকে। ঘুম ভাঙে অনেক দেরিতে।
পর্যাপ্ত ঘুম হওয়া ভালো। কিন্তু লাল শাড়ি পরবে কেন?
জানি না স্যার। সকালে উঠে অবশ্য ও পরিবর্তন করে ফেলে। কিন্তু ওর মা সকালে পিছনের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেছে লাল শাড়ি পরা থাকে জেসমিন।
প্রত্যেক রাতেই?
বলতে পারেন।
ডাক্তার তরফদারের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো। বললেন, লাল শাড়ি কি জেসমিনের খুব প্রিয়?
এরকম কিছু ছিল না। আগে তো ও শাড়িই পরত না। শাড়িটা ওর মায়ের। নিয়ে গিয়েছিল কক্সবাজার। তারপর আর ফেরত দেয়নি ওর মাকে। বড় অবাক হয়েছি।
বাঙালি নারীর শাড়ি পরা শুরু হয় মায়ের শাড়ি দিয়ে। মায়ের শাড়িই হয় তার প্রথম পছন্দের শাড়ি। তবে জেসমিনের লাল শাড়ি পরার যৌক্তিকতা ঠিক ঐরকম মনে হচ্ছে না। বিষয়টা রহস্যজনক।
নাজমুল হোসেন উপরে নিচে মাথা নেড়ে বললেন, আমি আসলে কিছু বুঝতে পারছি না।
নতুনভাবে কাউকে কি সন্দেহ করছেন আপনারা?
নাজমুল হোসেন চুপ থাকলেন, কিছু বললেন না। কথা বলছেন না কেন?
আসলে, আসলে আমার মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ভৌতিক। কোনো পিশাচের কাজ হবে এটা। সন্ধ্যার পর সম্ভবত ওর ঘাড়ে চড়ে বসেছে।
কী বলছেন এসব!
একজন ফকিরকে ডেকেছিলাম। কুতুব ফকির। সে বিষয়টা নিশ্চিত করেছে আর বলেছে ঐ পিশাচকে দূর করতে হবে, ছায়া হয়ে নাকি আসে। কাজটা সে-ই করবে।
কীভাবে দূর করবে?
ধোঁয়া দিয়ে দূর করবে। কী সব শিকড়ের ধোঁয়া! হাজার দশেক টাকা লাগবে। আমরা টাকা দিয়ে দিয়েছি। বড় বড় চোখ করে ডাক্তার তরফদার বললেন, কী বলছেন এসব! আপনি শিক্ষিত মানুষ! আপনি ভূত-প্রেত, পিশাচে বিশ্বাস করবেন কেন?
আসলে স্যার বিপদে পড়ে গেছি। মাথা ঠিক নেই।
ঐ কুতুব ফকিরের ফাঁদে পা দেবেন না। আমাকে আর কয়েকটা দিন সময় দিন। দেখি কিছু করতে পারি কি না।
আচ্ছা স্যার।
নাজমুল হোসেন চলে গেলে ডাক্তার তরফদার বাগানে এলেন। দেখলেন আকাশে অনেক মেঘ জমেছে, কালো মেঘ। সাথে বাতাসও আছে। তিনি বুঝতে পারলেন আজ বৃষ্টি হবে, অনেক বৃষ্টি। কেন যেন তার অবচেতন মন বলছে, এই বৃষ্টি মানুষের জন্য মঙ্গলময় হবে না, হবে ক্ষতির, মারাত্মক ক্ষতির। এটা একটা বাস্তব সত্য যে, বৃষ্টি সবসময় সবার জন্য সুন্দর আর মঙ্গলময় হয় না। দৃষ্টিনন্দন বৃষ্টিরও একটা কষ্টের রূপ থাকে।
ডাক্তার তরফদারের ভাবনার মধ্যেই প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। এমন বৃষ্টিতে চা মন্দ না। তাই তিনি রান্নাঘরে এলেন। দুধ চা বানালেন এক কাপ। তারপর নিয়ে এসে বসলেন চেম্বারে। জেসমিনের ফাইলটা টেনে লিখতে শুরু করলেন,
জেসমিন মেয়েটি মানসিকভাবে অসুস্থ, বিষয়টা নিশ্চিত। তার অসুস্থতার প্রধান কারণ তার গর্ভবতী হওয়া। কিন্তু কীভাবে সে গর্ভবতী হলো এ বিষয়টি রহস্যময়। তার পেটের সন্তানের বাবা রাশেদের হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকলেও তৃতীয় কেউও হতে পারে। এই মুহূর্তে রাশেদ অবশ্য সন্দেহের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। তবে তৃতীয় ব্যক্তিটি কে তা বড় রহস্যময়। এই রহস্য ভেদ করতে গিয়ে কিছু বিষয় নজরে এসেছে। প্রথম বিষয়টা হলো, ‘নীল চোখের ছায়া। এক্ষেত্রে নীল চোখের কেউ একজন তার পরিচিত বলে ধরে নিতে হবে, কিন্তু কে সে? দ্বিতীয় বিষয়টা হলো ‘লাল শাড়ি। রাতে জেসমিন মাঝে মাঝেই লাল শাড়ি পরে! কেন? বড় জটিল প্রশ্ন। একজন নারী শাড়ি পরে আমাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এবং তার নিজের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলার জন্য। নিঃসন্দেহে এটাই সত্য যে, বাঙালি নারী সবচেয়ে সুন্দর শাড়ীতে। কিন্তু রাতে কেন শাড়ি পরবে জেসমিন? কোনো পুরুষের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করার জন্য, নাকি নিজের ইচ্ছাকে পূরণ করার জন্য দ্বিতীয় বিষয়টা সত্য হতে পারে, নিজের সন্তুষ্টির জন্য কেউ কেউ পছন্দের পোশাক পরে। নিজেকে সুন্দর দেখার এই প্রবণতার নাম নারসিসিজম (Narcissism)। কিন্তু জেসমিন নারসিসিজম-এ আক্রান্ত বলে মনে হয় না। কারণ দিনের বেলায় সে তার সৌন্দর্য নিয়ে যে খুব বেশি সচেতন থাকে, সেরকম কিছু জানা যায়নি। তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়, যা কিছু ঘটছে সবই কক্সবাজার থেকে আসার পর। কক্সবাজারে রেইনবো রেইন হোটেলে একা সে একটা কক্ষে ছিল। ঐ কক্ষে কেউ তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে কি না তা বিবেচনার বিষয় রয়েছে। ঐ কক্ষটাতে না গেলে জানা যাবে না। রেইনবো রেইন হোটেলের কক্ষ নম্বর ছিল ২২১। হোটেলে নানা ধরনের ঘটনা ঘটে, সেরকম কোনো ঘটনার স্বীকার হতে পারে জেসমিন। বিষয়টা হয়তো এরকম যে, হোটেল বয় কিংবা অন্য কেউ কিংবা একাধিক ব্যক্তি রাতে তার কক্ষে প্রবেশ করে তাকে বাধ্য করেছে শারীরিক সম্পর্ক করতে। অর্থাৎ জেসমিন ধর্ষিত হয়েছে। লজ্জায় অপমানে সে হয়তো বলতে পারেনি কাউকে। হতে পারে তার কলেজের কোনো শিক্ষক কাজটা করেছে। শিক্ষকের বিরুদ্ধে যাওয়া ছাত্রীদের জন্য বড় কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের শিক্ষাসফরে একজন মহিলা আর দুজন পুরুষ শিক্ষক ছিল। যে দুজন পুরুষ শিক্ষক ছিল তাদের বয়স কত জানতে হবে তাকে। অবশ্য বয়স কোনো বিষয় নয়। নারীর প্রতি আকৃষ্ট হতে পুরুষের বয়সের প্রয়োজন হয় না, যে কোনো বয়সের পুরুষ একজন অল্পবয়সি নারীর প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে। এই আকর্ষণের মূল কারণ ‘টেসটেসটেরন হরমোন যা একজন মানুষের পুরুষ হিসেবে বেড়ে উঠার অন্যতম নিয়ামক যাইহোক, কক্সবাজারে যে কিছু একটা ঘটেছে এটা মাথায় রাখতে হবে। কিন্তু এই যুক্তিটা মিলছে না এ কারণে যে জেসমিনের শরীরে কোনো ধস্তাধস্তির দাগ ছিল না, তাছাড়া সে চিৎকার করতে পারত। অবশ্য যদি পানীয় কিংবা অন্যকিছুর সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাকে অচেতন করা হয়ে থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। একটা প্রশ্ন অবশ্য থেকে যাচ্ছে, লাল শাড়ি কেন পরে জেসমিন? উত্তরটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটা মূর্তির কথা এসেছে। কক্সবাজারে অনেক মূর্তি আছে, বিশেষ করে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রতিমা, মূর্তি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঐ রকম কোনো ধর্মীয় উপাসনালয় দেখতে যায়নি জেসমিন। তাহলে কোন মূর্তি দেখতে গিয়েছিল? প্রশ্নটা করতে হবে শান্তাকে কিংবা তার অন্য বন্ধু-বান্ধবীদের। যে কেউ একজনের কাছ থেকে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে। অনুসন্ধানে আরো এসেছে পাহাড়-সমুদ্রের কথা। ঐ এলাকাটাও কক্সবাজার হবে। যাইহোক, সবকিছু মিলিয়ে এখন মনে হচ্ছে কক্সবাজারে রেইনবো রেইন হোটেলে যেতে হবে এবং খুঁজে পেতে হবে মূর্তির রহস্য।
ফাইলে উপরের অংশটুকু লিখে ডাক্তার তরফদার বারান্দায় এলেন। ঝড় শুরু হয়েছে, সাথে প্রচণ্ড বৃষ্টি। কয়েকজন রিকশাওয়ালাকে রিকশা। দেখা গেল, তবে বাতাসের সাথে যেন পেরে উঠছে না তারা। দূরে কোথাও শব্দ হলো ভয়ংকর বজ্রপাতের। একজন মহিলাকে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাতাসের বিপরীতে দৌড়াতে দেখা গেল যেন মহাবিপদে আছে সে।
ডাক্তার তরফদার আবারও উপলব্ধি করলেন, বৃষ্টি সবসময় সবার জন্য সুন্দর আর মঙ্গলময় হয় না। দৃষ্টিনন্দন বৃষ্টিরও একটা কষ্টের রূপ থাকে।
*
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।
নিলুফার বসে আছেন বারান্দায়। তার সামনে কুতুব ফকির। গলা থেকে পা পর্যন্ত কালো একটা পোশাক পরা। চুল-দাড়ি অনেক লম্বা। বয়স সম্পর্কে অনুমান করা কঠিন। পঞ্চাশও হতে পারে, ষাটের বেশিও হতে পারে। তাকে দেখে কেমন যেন ভয় ভয় করছে নিলুফারের। ইচ্ছে হচ্ছে বলেন, যেন বাড়ি থেকে চলে যায়। কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। কারণ তাকে নিয়ে এসেছে তারই জোবেদা খালা। জোবেদা খালার যখন সন্তান হচ্ছিল না তখন নাকি এই কুতুব ফকির তাকে পড়া পানি খাইয়ে আর ঝাড়ফুক দিয়ে দোয়া করে বলেছিল, “যা তোর সন্তান হবে। ঐ দোয়া পাওয়ার এক মাসের মাথায় গর্ভবতী হন জোবেদা খালা। সেই থেকে তার ভক্ত জোবেদা খালা। জোবেদা খালা তার আত্মীয়, শারীরিকভাবে লম্বা-চওড়া। কথাবার্তায় সবসময় কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। এজন্য ঠিক নিষেধ করতে পারছেন না তাকে। বাড়িতে ফকির নিয়ে আসার এই ব্যাপারটা তার স্বামী নাজমুল হোসেনও পছন্দ করেননি। প্রথমে দোটানায় থাকলেও বিকেলে জানিয়ে দিয়েছেন যেন কুতুব ফকির এই বাড়িতে না আসে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য না করতে পারেননি নিলুফার। মনের মধ্যে কিঞ্চিৎ আশার আলো ছিল যে সুস্থ হবে জেসমিন। কিন্তু এখন বড় ভয় করছে তার।
কুতুব ফকিরের সাথে একজন কিশোর এসেছে। সে তার সাগরেদ। নাম হাসু। বয়স ষোলো-সতেরো হবে। কুতুব ফকির চেয়ারে চোখ বুজে নির্দেশ দিচ্ছে আর সে সব কাজ করছে। কুতুব ফকির বলছে, হাসু।
ফকিরবাবা বলেন।
পিশাইচটা কি আছে?
আমি বলবার পারতেছি না।
তুই পারবি ক্যামনে? তুই ছোড মানুষ। আমি পারব। আছে, পিশাইচটা আছে। কালা কুইচকুইচা। এইরকম পিশাইচ খুব কমই দেখা যায়। জীবনে এই নিয়া আমি তিনবার দেখলাম। যাইহোক, গত দুইবার আমি ঐগুলারে তাড়াইছি, এইবারও তাড়াব। মরিচ কোথায় মরিচ?
মালশায় আছে বাবা।
কয়ডা মালশা?
পাঁচটা আছে।
ভালো। এই মরিচে বড় ঝাল, দামেও ঝাল। বেশি টাকা দিয়া কিনা লাগছে। মরিচগুলা সামনে রাইখা এক রাইত ধইরা মন্ত্র পড়া হইছে। মরিচের ধোঁয়ায় দৌড়াইয়া পালাবে পিশাইচ। যা, তুই বাড়ির চাইরপাশে চাইরডা মালশা রাইখা আয়। আর একটা মালশায় মরিচ পুড়াব জেসমিনের সামনে, শিকড়গুলা নিচে দিস। দেখি ওর শরীরে কতক্ষণ বইসা থাকবার পারে ঐ পিশাইচ।
জোবেদা খালা এবার নরম গলায় বললেন, আর কিছু লাগবে, বাবা?
আপাতত দরকার নাই। তয় কিছু খরচপাতি হইছে। নগদে কিছু শিকড় কিনা লাগছে, দাম বেশি। হাজার পাঁচেক টাকা লাগবে।
হাজার পাঁচেক!
হ খরচটা একটু বেশিই। তয় কোনো উপায় নাই।
জোবেদা খালা নিলুফারের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস বললেন, পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে আসো।
এত টাকা তো ঘরে নাই।
কত আছে?
তিন হাজারের মতো হবে।
ঐ টাকাই আনো। আমি আর দুই হাজার টাকা দিয়া দিতেছি। ফকির বাবারে অসন্তুষ্ট রাখা যাবে না। তাইলে পিশাইচ তাড়ানো কঠিন হইয়া পড়বে।
আচ্ছা ঠিক আছে।
বাড়িতে তিন হাজার এক শ টাকা ছিল। নিলুফার তিন হাজার টাকা এনে হাতে দিল জোবেদার হাতে। খালা তার নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করল আরো দুই হাজার টাকা। তারপর পাঁচ হাজার টাকা ফকির বাবাকে দিয়ে বলল, বাবা, পিশাইচটা যেন এই বাড়িতে আর না থাকে।
ফকির বাবা ধমকে উঠে বললেন, না, থাকবে না। এই বাড়িতে আর থাকবে না পিশাইচ। ওরে শুধু এই বাড়ি না, গ্রামছাড়া করব, দ্যাশছাড়া করব। যা কালাপিশাইচ যা, ভাগ এইখান থাইকা, ভাগ?
কথাগুলো বলতে বলতে বাড়ির চারপাশে হাঁটা শুরু করল কুতুব ফকির। এককোনায় যাচ্ছে আর মালশার শিকড় মরিচে আগুন ধরাচ্ছে সে। যখন চারপাশের মালশায় আগুন জ্বালানো শেষ হলো তখন মরিচের ঝাঝে চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম সবার। নিলুফার বললেন, খালা, বাড়ির মধ্যে থাকা তো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।
কষ্ট হইলেও থাকা লাগবে।
ফকির বাবা এরপর ঢুকলেন জেসমিনের ঘরে। জেসমিন আগে থেকেই জানত যে তাকে ফকির দিয়ে ঝাড়ফুক দেয়া হবে। সে রাজি ছিল না। নিষেধও করেছিল তার বাবা মাকে। ভেবেছিল সত্যি ফকির আসবে না। কিন্তু এখন ফকির দেখে রাগে কাঁপতে শুরু করল সে। তার উপর মরিত্রে ঝাঁজে চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। নিজে থেকেই বলল, আমার ঘরে ঢুকবেন না কেউ।
কুতুব ফকিরের হাতে একটা মালশা। মালশায় এখনো আগুন ধরানো হয়নি। ধরালে ঘরের মধ্যে মরিচের ঝাজ আরো বাড়বে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জোবেদা খালা মুখের উপর কাপড় চেপে ধরে রেখেছেন। একইভাবে ঝাঁজ থেকে নিজেকে রক্ষা করছেন নিলুফার।
কুতুব ফকির বলল, পিশাইচটা আমারে ভয় দেখাইতেছে, ঘরে ঢুকবার নিষেধ করতেছে।
খবরদার ঘরে ঢুকবেন না।
চিৎকার করে উঠল জেসমিন।
কুতুব ফকির এবার জোরে ধমক লাগাল, চুপ হারামজাদা! কোনোরকম চেঁচামেচি করবি না। ভালোয় ভালোয় এই বাড়ি থাইকা বাইরায় যা, নইলে মরিচের ঝাল দিয়া তোরে পুড়ায় দিব।
না এই ঘরে মরিচ জ্বালাবেন না।
ক্যান জ্বালাব না। তোর শরীর জ্বলবে, মন জ্বলবে, না? আমি তো চাই তুই জ্বইলা পুইড়া শ্যাষ হইয়া যাবি। এখন পর্যন্ত জেসমিনের মতো কতজনের সর্বনাশ করছস? আর সুযোগ পাবি না। পুরা বাড়ি ধোয়ায় ছাইয়া গেছে। পালাবারও পারবি না। তোর আইজ মরণ হবে, মরণ।
কথাগুলো বলতে বলতে মালশাতে আগুন ধরাল কুতুব ফকি মরিচের তীব্র ঝাঁজ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল ঘরের মধ্যে। ঝাঁজ সহ্য করতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দৌড় দিল জেসমিন। কিন্তু তার হাত ধরে বসল কুতুব ফকির। তারপর টেনে টেনে বলল, না তোরে পালাবার দিব না। তোরে আইজ আমি মাইরা ফেলাব, নিজের হাতে মারব। গামছা কই, দুইডা গামছা দ্যান, বাইন্দা ফেলাই ওরে।
জোবেদা খালা এবং নিলুফার দুজনের অবস্থাই খারাপ। চোখ, নাক দিয়ে পানি ঝরছে। এর মধ্যেই জোবেদা খালা বললেন, দুইটা গামছা দরকার, কোথায় পাব?
নিলুফার বললেন, না না। আমার মেয়েটা মরে যাবে। ওকে ছেড়ে দিন, ওকে ছেড়ে দিন। আর, ফকির বাবা, আপনি চলে যান। লাগবে না, লাগবে না পিশাচ তাড়ান।
কুতুব ফকির বলল, না না, আমার যাওয়া ঠিক হবে না। এই মুহূর্তে পিশাইচডারে ছাড়াও যাবে না, তাইলে সর্বনাশ হইয়া যাবে। পিশাইচের সাহস বাইড়া যাবে। তখন আরো ক্ষতি করবে মানুষের। গামছা দ্যান, গামছা। শক্ত কইরা বাইন্দা রাখি। পুড়া মরিচের ঝাঁজ নাক-মুখ দিয়া শরীরে ঢকান লাগব। পিশাইচটা সমস্ত শরীরে বইসা আছে। তয় বড় কষ্ট হইতেছে পিশাইচের।
নিলুফার এবার এগিয়ে এসে নিজেই ছাড়িয়ে নিলেন জেসমিনকে। জেসমিন আর দাঁড়াল না। দৌড়ে ঢুকে গেল তার ঘোট দুই ভাইয়ের কক্ষে।
এদিকে খুবই রেগে গেল কুতুব ফকির। চোখ বড় বড় করে বলতে থাকল, এই বাড়িতে গজব পড়ক, গুজব। এত কাছে আইসাও মারবার পারলাম না পিশাইচটারে। আরো কতজনের যে সর্বনাশ করবে? না না, মানুষ কিছু বুঝে না, কিছুই বুঝবার চায় না, মানুষ বড় খারাপ, বড় খারাপ!
কথাগুলো বলে বাড়ির বাইরে বের হয়ে গেল কুতুব ফকির। তার পিছন পিছন গেলেন জোবেদা খালা। তিনিও খুব বিরক্ত এবং লজ্জিত নিলুফারের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য!
*
ডাক্তার তরফদারের আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল কক্সবাজার ঘুরতে আসবেন। কিন্তু সুযোগ হচ্ছিল না। এবার সুযোগটা নিয়েছেন তিনি। একটা মাইক্রোবাসে ঢাকা থেকে কক্সবাজার এসেছেন। ড্রাইভার সালাম নামের এক যুবক। কখনো গাড়ি নিয়ে দূরে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে সালামকে বলেন তিনি। যুবক বয়সি সালাম সবসময় হাসিখুশি থাকে। এজন্য সালামকে বেশ ভালো লাগে তার। ড্রাইভার হিসেবেও খুব ভালো। নিয়ম মেনে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে গাড়ি চালায়। তাছাড়া তাকে খুব শ্রদ্ধাও করে। তিনি ডাকলে অন্য যত বড় কাজ থাকুক না কেন চলে আসবে সে।
রেইনবো রেইন হোটেলের ২২১ নম্বর রুমটা বুক দিয়ে এসেছিলেন ডাক্তার তরফদার। এজন্য ঐ রুমে উঠতে পেরেছেন। হোটেলটা মাঝারি আকৃতির। পাঁচতলা। এক তলায় ডাইনিং হল, রিসেপশন, ওয়েটিং রুম। দোতলা থেকে পাঁচ তলা পর্যন্ত থাকার রুম। প্রত্যেক তলায় বিশটি করে রুম। শুধু দোতলায় একটা রুম বেশি। এই রুমটাই হলো ২২১ নম্বর। রুম হিসেবে অতিরিক্ত হওয়ায় কেমন যেন খটকা লাগল ডাক্তার তরফদারের। কেন দোতলায় একটা রুম বেশি করা হয়েছে। বিষয়টা রহস্যজনক।
এখানে আসার আগে ডাক্তার তরফদার জেসমিনদের কলেজের প্রভাষক রাবেয়া খাতুনের সাথে কথা বলে এসেছেন। রাবেয়া খাতুন শিক্ষা সফরে কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন সবই বলেছেন ডাক্তার তরফদারকে। রাতে যে তার থাকার কথা ছিল জেসমিনের সাথে সে কথাও বলেছেন এবং তিনি যে থাকেননি তাও গোপন করেননি। তবে এটাও উল্লেখ করেছেন যে, ২২১ নম্বর কক্ষে এমন কোনো অঘটন ঘটেনি যা উল্লেখ করার মতো।
রাবেয়া খাতুনের কাছ থেকে হাডসন হিলের মূর্তির কথা জেনেছেন ডাক্তার তরফদার। ঐদিন যে জেসমিন লাল শাড়ি পরেছিল, বকা খেয়েছিল তাও জেনেছেন। পরে জেসমিনের সাথে দেখা করার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু জেসমিন তার সাথে কথা বলেনি। শেষে কথা হয় জেহানের সাথে। জেহান অনেক বেশি হতাশ এখন। সে জানিয়েছে জেসমিনের শরীর দিনে দিনে ভেঙে পড়ছে এবং কারো সাথে কথা বলে না ইদানীং। এজন্য সে নিজে খুব অস্থিরতায় ভুগছে। আর বরাবরের মতো জেসমিনের কাছে তার ভালোলাগার আর ভালোবাসার কথা এখনো বলতে পারেনি। ডাক্তার তরফদার আসার আগে তার মাথায় হাত রেখে বলেছেন, মনে রাখবে, ‘আবেগে নয়, ভালোবাসা হয় প্রকাশে।
হোটেলে ডাক্তার তরফদার সবচেয়ে পুরাতন একজন বয় খুঁজে বের করলেন। নাম উদিম। উপজাতীয় হলেও সে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে। ম্যানেজারকে বলে দিলেন, উদিমই যেন তার রুমে কাজ করে। ম্যানেজার রাজি হলেন।
উদিম পানি নিয়ে এলে ডাক্তার তরফদার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বয়স কত উদিম?
চব্বিশ বছর।
কত বছর ধরে এই হোটেলে আছ?
স্যার দশ বছর। হোটেলের শুরু থেকেই।
তার মানে তোমার যখন বয়স চৌদ্দ তখন থেকেই তুমি কাজ শুরু করেছ এখানে। তাই না?
জি স্যার।
এত কম বয়সে কাজে নিল কেন তোমাকে?
বেতন কম দেয়া লাগত এজন্য স্যার। বড় মানুষ রাখলে টাকা বেশি দেয়া লাগে। আর ছোট মানুষ রাখলে পেটে-ভাতে রাখা যায়। আমাকে অবশ্য দুই হাজার টাকা বেতন দিত তখন, অন্যরা পেত ছয়-সাত হাজার টাকা।
এখন তোমার বেতন কত?
দশ হাজার টাকা।
তাহলে তো ভালোই। আচ্ছা একটা বিষয় বলো তো আমাকে, দোতলায় এই একটা রুম বেশি কেন? মানে এই ২২১ নম্বর রুমটা।
স্যার এই রুম করা হয়েছিল মালিকের ছেলের জন্য। সাধারণত ভাড়া দেয়া হয় না। তবে কাস্টমার বেশি হলে ভাড়া দেয়া হয়। বিশেষ করে শীতকালে ফাঁকা পাওয়া যায় না।
মালিকের ছেলে এই রুম দিয়ে কী করে?
মাঝে মাঝে আসে, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এখানে ফুর্তি করে।
আজ তো দেখছি একটা খাট। কখনো কি দুটো খাট ছিল?
প্রয়োজন হলে দিয়ে দেই স্যার। হোটেলে ছোট ছোট লোহার খাট আছে। উপরে ফোম। যখন যেখানে প্রয়োজন দিয়ে দেই। আপনের এই বেড তো ডবল বেড। আর একটা সিঙ্গেল খাট কি দিব? কেউ কি আসবে?
না আসবে না। যাইহোক, তোমার ঐ মালিকের ছেলে কোথায় এখন?
উদিম চুপ হয়ে গেল।
কী ব্যাপার, কথা বলছ না কেন?
স্যার জেলে আছে।
জেলে আছে মানে?
স্যার আসলে কী বলব, বড় লজ্জার কথা। এই কক্ষের মধ্যে সে এক মেয়েকে নিয়ে আসছিল। তারপর তার সাথে জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করে। ঐ মেয়ে পরে মামলা করে দিয়েছে বাশার স্যারের নামে। আসলে স্যার, বাশার হলো মালিকের ছেলের নাম।
ডাক্তার তরফদার একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন, ঐ রাতে তুমি ছিলে এখানে?
না, স্যার। বাশার স্যারের ডিউটি করার জন্য আলাদা এক বয় আছে। নাম লিটন। আমার মতোই বয়স।
আমি কি লিটনের সাথে কথা বলতে পারব?
এখন ডিউটি নেই স্যার। ডিউটিতে আসলে আমি আপনার কাছে নিয়ে আসব।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
এখন কি খাবার দিব স্যার?
না, ক্ষুধা নেই। রাতে ডাইনিংয়ে গিয়ে খাব। ইচ্ছে একটু সাগরপাড়ে যাব। সারাদিনের জার্নিতে একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
ঠিক আছে স্যার। যখন প্রয়োজন হবে তখন ডাকবেন। আমি এই হোটেলেই থাকি। আপনি ডাক দিলে চলে আসব। আর এই কক্সবাজার এলাকা আমার চেনা। কোথাও যেতে চাইলে আমাকে বলবেন।
তা বলব। তুমি কি হাডসন হিল সম্পর্কে কিছু জানো?
আমি জানি স্যার, তবে বেশি জানি না। আনন্দভ্রমণ” বইতে লেখা আছে হাডসন হিল সম্পর্কে। আমি কি একটা বই আপনাকে দেব? পড়ে দেখতে পারেন।
ঠিক আছে দাও।
তবে কি স্যার…
হ্যাঁ, বলল।
‘আনন্দভ্রমণ’ বইতে যা লেখা আছে তা সব বিশ্বাস করবেন না। ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। আর ওখানে কিছু টুরিস্ট গাইড আছে। টুরিস্টদের কাছ থেকে টিপস পাওয়ার জন্য নিজেদের মতো গল্প তৈরি করে। আপনি ওখানে গেলে বুঝতে পারবেন।
অবশ্য এটা সত্য, ডাক্তার হাডসন বড় ভালো মানুষ ছিলেন।
তুমি জানলে কীভাবে?
শুনা কথা।
ও আচ্ছা।
ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করলেন, ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে জানতে হলে এমন কাউকে খুঁজে পেতে হবে যে ডাক্তার হাডসনের খুব কাছের ছিল। এরকম মানুষ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ এখন ২০২২ সাল। আর ডাক্তার হাডসনের ঘটনা ১৯৫০ সাল কিংবা তার কাছাকাছি সময়ের। অর্থাৎ সত্তর-পঁচাত্তর বছর আগের। এক্ষেত্রে তাকে কমপক্ষে নব্বই কিংবা এক শ বছর বয়সি কাউকে খুঁজে পেতে হবে। বিষয়টা একেবারে সহজ না।
*
মাঝ রাত জেগে আছে জেহান। ঘুম আসছে না। ইদানীং তার ঘুম খুব কম হয়। শরীরটাও কেমন যেন দুর্বল দুর্বল লাগে। হয়তো ঘুম কম হওয়ার জন্য এমন হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে আজ সে লম্বা একটা ঘুম দেবে। কিন্তু ঘুম যেন আজ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। জেহান এবার বিছানা থেকে উঠে ডায়ারিটা নিল। তারপর লিখতে শুরু করল,
প্রিয় জেসমিন,
তোমাকে খুব মনে পড়ছে। ইচ্ছে হচ্ছে তোমার হাত ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকি। কিন্তু সেরকম সুযোগ নেই। তুমি ইদানীং কারো সাথে কথা বলো না। একেবারে একা হয়ে গেছ। তোমার রুম থেকেও বের হও না। ঘন্টার পর ঘণ্টা ছাদে দাঁড়িয়ে থেকেও দেখা পাই না তোমার! মনে বড় কষ্ট আমার। এত ভালোবাসি তোমাকে, অথচ তোমার ভালোবাসা পাই না। জানি না পাব কি না। তোমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে সবকিছুর জন্য দায়ী রাশেদ ভাই, আমি জানি, কিন্তু বুঝতে পারছি না কেন তুমি তার নাম বলছ না। আমি চাই তার শাস্তি হোক। যে অপরাধ সে করেছে, তার কোনো ক্ষমা নেই। তুমি তোমার জীবন নিয়ে অতটা চিন্তা কোরো না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি তোমাকে সবসময় ভালোবাসাব। যদি তোমার সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তোমাকে পাওয়ার জন্য ঐ সন্তানসহ তোমাকে আমি গ্রহণ করব। সত্যি কথা বলতে কি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। আর হ্যাঁ, রাশেদ ভাই যে সর্বনাশ তোমার করেছে তার জন্য তাকে পস্তাতে হবে। আমি কথা দিচ্ছি দুই-একদিনের মধ্যে আমি প্রতিশোধ নেব। এত বড় একটা অপকর্ম করে সে পার পেতে পারে না, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। প্রিয়তমা আমার, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না। ইদানীং খুব ইচ্ছে হয় তোমার হাত ধরে একটা দিন হাঁটি। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য বড় বেশি কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার বাড়ির সামনে গিয়ে চিৎকার করে বলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু পারি না। ডাক্তার তরফদার স্যার বলেছেন, আবেগে নয়, ভালোবাসা হয় প্রকাশে। তোমার জন্য আমার আবেগ, ভালোলাগা, ভালোবাসার অভাব নেই, অথচ আমি প্রকাশ করতে পারি না। এজন্যই আমার ভালোবাসা তোমাকে বোঝাতে পারছি না। এবার আমি যেভাবেই হোক প্রকাশ করার চেষ্টা করব। তরফদার স্যার আর-একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। আর তা হলো, প্রিয়জনের কাছে প্রথম ভালোবাসার কথা বলে প্রকাশ করার থেকে লিখে প্রকাশ করা অনেক সহজ। আমি মুখে বলতে না পারলেও তোমাকে এ পর্যন্ত লেখা আমার সকল চিঠিগুলো দেব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তখন তুমি বুঝতে পারবে আমার এই বুকে তোমার জন্য কত ভালোবাসা জমে আছে। অবশেষে, এই কামনা করি তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠো। আর হ্যাঁ, ভাবছি, আগামীকাল ডাক্তার তরফদার স্যারের বাসায় যাব। ওখানে করিম চাচা আছে। সে ভবিষ্যৎ বলতে পারে। আমি তার কাছে গিয়ে জানতে চাইব তোমাকে আমি আমার জীবনে পাব কি না। আশা করছি আশার আলো থাকবে করিম চাচার কথায়। ভালো থেকো, সুন্দর থেকো প্রিয়তমা আমার।
তোমারই ভালোবাসার
জেহান
চিঠি লেখা শেষ হলে আবার বিছানায় এলো জেহান। এবার শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর ঘুম, ঠিক যেমনটা সে আশা করেছিল।
সকালে কলেজে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো জেহান। বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে এপার আসতে ফুটপাতে এক গণককে বসে থাকতে দেখল। সে টিয়াপাখির মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করে। জেসমিনের কথা বলাতে গণক বলল, কোনো চিন্তা করবেন না, টিয়াপাখি শতভাগ সঠিক উত্তর দেবে।
কত টাকা লাগবে?
মাত্র দশ টাকা।
এই যে দশ টাকা নিন।
টাকা হাতে নিয়ে গণক টিয়াপাখিকে বলল, বাবা, তুমি আমাগো জানাও তো জেহান ভাইজান জেসমিনরে পাবে কি না?
টিয়া লাফ দিয়ে ডানে বামে গেল দুবার। তারপর নিচে রাখা অসংখ্য খাম থেকে একটা তুলে দিল গণকের হাতে। গনক মিষ্টি হেসে খামটা খুলল। তারপর বলল, এই যে দ্যাখেন ‘হ্যাঁ লেখা। তার মানে কী? আপনে আপনার জীবনে ভালোবাসার জেসমিনরে পাবেন।
জেহান খুব খুশি হলো। পঞ্চাশ টাকা অতিরিক্ত বকশিশ দিল গণককে। তারপর রিকশা নিয়ে রওনা দিল ডাক্তার তরফদারের বাসার উদ্দেশে।
করিম চাচাকে পাওয়া গেল বাড়িতেই। তার কাছ থেকে জানতে পারল ডাক্তার তরফদার কক্সবাজার গেছেন। জেহানের ইচ্ছা ছিল ডাক্তার তরফদারের সাথে কিছু কথা বলার। কিন্তু আজ আর সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে কিছুটা হলেও মন খারাপ হলো তার। শেষে করিম চাচার কাছে আসার কারণটাও খুলে বলল সে।
করিম চাচা বাড়ির ভিতরের বইগুলো ঝেড়ে রাখছিল। অনেকদিন এক জায়গায় থাকলে বইগুলোর উপর ধুলো জমে যায়। সবকথা শোনার পর করিম চাচা বলল, পৃথিবীতে প্রেম ভালোবাসা সবকিছু না, আরো মেলা কিছু আছে।
তারপরও আমি জানতে চাই জেসমিন আমাকে ভালোবাসবে কি না।
পৃথিবীর সব মানুষই সবাইরে ভালোবাসে।
আমি ঐ ভালোবাসার কথা বলছি না। প্রেম-ভালোবাসার কথা বলছি চাচা। আমি জানি, আপনি ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। প্লিজ আমাকে বলুন।
ভবিষ্যৎ জানলে জীবনের প্রতি আগ্রহ কইমা যায়।
তারপরও আমি জানতে চাই।
এইডা ঠিক না।
আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বড় বেশি কষ্ট হচ্ছে আমার।
করিম চাচা জেহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আমি চা বানায় আনতেছি, চা খাইলে ভালো লাগবে।
না, আমি চা খাব না।
পৃথিবীতে অনেক কিছু খাবার ইচ্ছা না করলেও খাইতে হয়, অনেক কিছু করবার না চাইলেও করতে হয়। উলটাভাবে, অনেক কিছু করবার ইচ্ছা থাকলেও না কইরা বইসা থাকতে হয়, অনেক কিছু চাইলেও না পাইয়া দুঃখ কষ্ট বেদনা সহ্য করতে হয়। পৃথিবী যেমন পাওয়ার, তেমন না-পাওয়ারও। পৃথিবী যেমন সুখের, তেমনি দুঃখেরও।
আপনার কথাগুলো বড় জটিল করিম চাচা। আমি বুঝতে পারছি না, স্পষ্ট করে বলুন। আমি সুখী হতে চাই, সত্যি জেসমিনকে নিয়ে সুখী হতে চাই।
আমি চা নিয়া আসতেছি।
কথাগুলো বলে করিম চাচা রান্নাঘরে গেল। চা নিয়ে ফিরে এসে দেখল যে জেহান নেই। করিম চাচা চায়ের কাপটা পাশের টেবিলে রেখে আবার বইয়ের উপর মনোনিবেশ করল।
জেহান এবার এলো কলেজে। খুব উত্তেজিত হয়ে আছে সে। উত্তেজনার মূল কারণ রাশেদ। কলেজের মাঠের কোনায় একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে। এই মেয়েটার সাথেই নতুন প্রেম শুরু করেছে সে। জেহান সিদ্ধান্ত নিল যেভাবেই হোক শায়েস্তা করবে জেহানকে। এজন্য তার একটা ছুরি দরকার। ছুরিটা সে কলেজের পাশের বাজার থেকে কিনল। বেশ ধারালো ছুরি, কাউকে হত্যা করার জন্য যথেষ্ট।
*
রেইনবো রেইন হোটেলের ২২১ নম্বর কক্ষে এমন কিছু ঘটেছে যার জন্য জেসমিন এখন গর্ভবতী, এই বিষয়টাকে ডাক্তার তরফদার একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না। বিষয়টা যদি ধর্ষণ পর্যায়ের হয়ে থাকে, স্বাভাবিকভাবে লাজলজ্জার ভয়ে জেসমিন কাউকে কিছু বলতে চাইবে না। হয়তো সেরকম কিছু ঘটেছে। কিন্তু বিষয়টা প্রমাণ করা বড় কঠিন। কারণ একটা ব্যাপার তিনি বুঝতে পারছেন না, বাইরে থেকে ভিতরে কেউ প্রবেশ করবে কীভাবে? মূল দরজায় এবং বারান্দার সাথের দরজায় ছিটকিনি রয়েছে। এক্ষেত্রে বাইরে থেকে কারো পক্ষে ভিতরে প্রবেশ করা অসম্ভব। হতে পারে কেউ আগে থেকে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু যুক্তিটা বড় অবাস্তব। একজন অপরাধী এত বড় ঝুঁকি কীভাবে নেবে? অবশ্য যদি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র হয়, যাকে বলে অর্গানাইজড ক্রাইম, তাহলে হয়তো সম্ভব হতে পারে। বিষয়টাকে ডাক্তার তরফদার বেশ গুরুত্বের সাথে বিশ্লেষণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
‘আনন্দভ্রমণ’ বই পড়ে হাডসন হিল সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পেলেন না ডাক্তার তরফদার। একদিন আরো খোঁজখবর নিলেন। কিছুদিন হলো জায়গাটা পরিচিত পেয়েছে পর্যটন স্পট হওয়ার কারণে। হোটেল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে উদিমকে পাঠিয়েছিলেন হাডসন হিলে বয়স্ক কোনো মানুষ পাওয়া যায় কি না খুঁজে বের করার জন্য। উদিম একজনকে খুঁজে পেয়েছে। নাম ইরফান আলী। জনশ্রুতি আছে তার বয়স এক শ বছর। একসময় ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন। এখন বাড়িতেই থাকেন।
ডাক্তার তরফদার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রথমে তিনি হাডসন হিলে যাবেন। জায়গাটা দেখার জন্য তার নিজের মধ্যেই এক ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এরকম পরিকল্পনা থেকে সকাল আটটার সময় রওনা দিলেন হাডসন হিলের উদ্দেশে। সাথে ড্রাইভার সালাম আর হোটেল-বয় উদিম। উদিম থাকায় পথ চিনতে সমস্যা হলো না। হাডসন হিলে এসে ডাক্তার তরফদার বিস্ময়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলেন। এত সুন্দর জায়গা! সাগরের তীর ঘেঁষে উঁচু উঁচু পাহাড়। সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টা হাডসন হিল। সামনে ছোট-বড় গাছ। তারপর সমুদ্রের তীর আর সাগর। পাহাড়ের উপরের অংশটা দারুণ সবুজ। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কিছু কিছু গাছ এত বড় যে কল্পনা করা যায় না।
হাডসন হিলে আট-দশজন দেশি পর্যটক হাঁটাহাঁটি করছে। তিনি প্রথমে এলেন এলিজা স্টোন বা নীল পাথরে। উপরে উঠে চারদিকে তাকাতে এক কথায় নয়ন জুড়িয়ে গেল তার। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন রাতটা এখানেই কাটাবেন। দেশে-বিদেশে বহু জায়গায় ঘুরেছেন, কিন্তু এরকম জায়গায় কখনো এসেছেন বলে মনে করতে পারলেন না। শরীরে বাতাসের পরশ এতটাই আরামদায়ক যেন মনে হয় সকল অস্বস্তি আর অসুস্থতাকে দূরে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
পাথরের উপরে অনেকে অনেককিছু লিখেছে। ডাক্তার তরফদার ছবি তুললেন, ভিডিও করলেন যেন পরবর্তীকালে যুক্তি-তর্ক বিশ্লেষণে কাজে লাগাতে পারেন। অতঃপর এলেন হাডসন গুহায়। ভিতরটা দেখে একেবারে বিস্মিত হয়ে গেলেন। গুহার পিছনের দিকে একটা বিশাল মূর্তি। সেই মূর্তির সামনে সাদা পাথরের চত্বর। এখানে সাদা পাথর থাকার কথা নয়। কীভাবে এলো তা এক বিস্ময়! মূর্তিটার পরনের পোশাক অনেকটা পায়জামা পাঞ্জাবির মতো। চারপাশের দেয়ালে অনেক নাম লেখা। পুরো গুহাটার অনেক ছবি তুললেন তিনি, ভিডিও করলেন চারপাশটা। কেমন যেন ঠান্ডা ভিতরের অংশে, পরিবেশটা বেশ আরামদায়ক। একপাশে পাথুরে চৌবাচ্চায় পানি জমে থাকতে দেখলেন, পরিষ্কার পানি।
মূর্তিটার একেবারে কাছে এলেন ডাক্তার তরফদার। পাথরের তৈরি মূর্তি। পাহাড়ের সাথে যে পাথর থাকে সেই পাথর কেটে বানানো হয়েছে। কাছে এলে বোঝা যায় মূর্তিটা কত বড়। এত বড় একটা মূর্তি ডাক্তার হাডসন নিজে বানিয়েছেন বিশ্বাস করা কঠিন। বহু সময় লাগবে। পেশাদার ভাস্কর ছাড়া পাথর দিয়ে মূর্তি বানানো সহজ নয়। অথচ এই কাজটিই করেছেন ডাক্তার হাডসন। অবশ্য একটা সন্দেহ কাজ করছে ডাক্তার তরফদারের মনে। ডাক্তার হাডসন কেন নিজের মূর্তি নিজে বানাবেন। তার বানানো উচিত ছিল তার স্ত্রী এলিজার মূর্তি! অবশ্য পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের কাজকর্ম অন্যদের সাথে মিলে না। সেই বিবেচনায় ডাক্তার হাডসনের নিজের মূর্তি বানানো সমর্থনযোগ্য হতে পারে।
স্থানীয় একজন টুরিস্ট গাইড পেলেন ডাক্তার তরফদার। নাম আকিব। তার কাছ থেকে জানতে পারলেন ব্রিটেনে ডাক্তার হাডসনের মৃত্যু হলেও তার আত্মা নাকি এখানে চলে এসেছে।
ডাক্তার তরফদার উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলেন, কীভাবে বুঝলেন যে তার আত্মা এখানে থাকে?
রাতে অনেকেই দেখেছে স্যার।
কী দেখেছে?
একটা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা মানুষ ঘুরে বেড়ায়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কী রঙের পাঞ্জাবি?
নীল রঙের।
ও আচ্ছা। আপনি কখনো দেখেছেন?
না স্যার, দেখিনি। তবে একবার চেষ্টা করেছিলাম। শুনেছিলাম সন্ধ্যার পর গুহা থেকে বের হয় তার আত্মা। আমি আর আমার তিন বন্ধু রাত নয়টা পর্যন্ত ছিলাম। তারপর আর থাকতে পারিনি। ভয়ে শরীর কেমন যেন ছমছম করছিল।
এমন কেউ আছে যে রাতে ডাক্তার হাডসন বা তার আত্মাকে দেখেছে?
আমাদের গ্রামে আছে। নাম মোবারক।
আমি কি মোবারকের সাথে কথা বলতে পারি?
পারেন স্যার। আমি ব্যবস্থা করব। তাকে কি ডাক দেব?
দিতে পারেন।
আর একটা কথা স্যার। কী কথা?
ডাক্তার হাডসন কিন্তু সুন্দরী মেয়েদের দেখলে তার উপর ভর করে বসে।
কী বলছেন এসব!
জি স্যার। আসলে তার স্ত্রী ‘এলিজা এখানে মারা গিয়েছিল তো, তাই তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। তখন থেকেই মেয়েদের প্রতি ছিল তার বিশেষ আকর্ষণ। সুন্দরী কোনো মেয়ে দেখলে তার আত্মা ঐ মেয়ের প্রতি এখনো আগ্রহ অনুভব করে। মেয়েরাও ডাক্তার হাডসনকে খুব পছন্দ করে। কারণ বিদেশি ফর্সা মানুষ। গ্রামে অনেক মেয়েই নাকি ডাক্তার হাডসনকে রাতে তাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতে দেখেছে!
এমন কোনো মেয়ে পরিচিত আছে?
আমার নেই। তবে খুঁজলে বের করতে পারব।
পারলে ভালো হতো। আর আপনি কীভাবে জানলেন যে ডাক্তার হাডসন সুন্দরী মেয়েদের পছন্দ করে?
এই কাহিনি সবাই জানে, আমার মতো যত ট্যুরিস্ট গাইড আছে সবাইকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আর দেখবেন, যত মেয়ে এখানে আসছে সবাই ছবি তুলছে ডাক্তার হাডসনের মূর্তির সাথে।
এটা তো স্বাভাবিক যে তারা ছবি তুলবে। কারণ ডাক্তার হাডসনের মূর্তি তো আর কোথাও নেই। জীবনে হয়তো তারা এই সুযোগ একবারই পাবে। স্মৃতিটা ধরে রাখতে কে না চায়!
না স্যার, এত সহজভাবে নিবেন না বিষয়টা। বছর ত্রিশেক আগে এখানে এক সুন্দরী মেয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। বয়স আঠার-উনিশ হবে। লাশটা পাওয়া গিয়েছিল সাগরের তীরে। শুধু ছায়া আর ব্লাউজ পরা ছিল। লাল শাড়িটা খানিকটা দূরে পড়ে ছিল। ঐ মেয়েটা কোথা থেকে এসেছিল জানা যায়নি। আশেপাশে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও হদিস মেলেনি তার বাবা-মায়ের।
আপনার বয়স কত?
স্যার বাইশ বছর।
তো ত্রিশ বছর আগের ঘটনা কীভাবে জানলেন?
সবাই জানে স্যার। যাকে জিজ্ঞেস করবেন সে-ই বলবে।
লাশটা কী করা হয়েছিল?
মাটি দেয়া হয়েছিল। পরে কবরের ভিতর থেকে লাশটা আবার বের করেছিল কেউ। ধারণা করা হয় ডাক্তার হাডসনের আত্মাই করেছিল কাজটা।
কী বলছেন!
দ্বিতীয়বার মাটি দেয়ার পর অবশ্য ডাক্তার হাডসন কিংবা তার আত্মা আর আসেনি কবরের কাছে। তবে অনেকে বলে, ঐ মেয়েটার সাথে নাকি এখনো ডাক্তার হাডসন ঘুরে বেড়ায়। ডাক্তার হাডসনের সাথে মেয়েটার আত্মাও আছে এই হাডসন হিলে।
ডাক্তার হাডসন যদি মেয়েটিকে হত্যা করে থাকে তাহলে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে কেন?
আমি বলতে পারব না স্যার। মোবারক বলতে পারবে।
আচ্ছা ঠিক আছে, মোবারককে ডাকার ব্যবস্থা করুন, দেখি সে কী বলে।
মোবারক এলো আধঘণ্টা পর। এই আধঘণ্টা ডাক্তার তরফদার চারপাশটা ঘুরলেন। সত্যি ভালো লাগার মতো জায়গা। সাগরের ঢেউয়ের শব্দের পাশাপাশি গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে বাতাস যাওয়ায় একরকম শো শো শব্দ কানে আসে। এই দুটো শব্দ শুনতে বড় ভালো লাগে। একটা দিনের জন্য যদি কেউ এখানে বেড়াতে আসে নিঃসন্দেহে উপভোগ্য হবে দিনটা।
মোবারকের কাছ থেকে যে কাহিনি শুনলেন তা হলো, ‘মোবারক দুই বছর আগে ডাক্তার হাডসনকে এই হাডসন হিলের বিচে হাঁটতে দেখেছিল। সময় ছিল মাঝরাত। সে আর তার গ্রামের আরো দুজন মিলে সাগরে মাছ ধরে ফিরছিল। তাদের কাছে মাছও ছিল। ডাক্তার হাডসন তাদের কাছে আসেন এবং মাছ চান। ভয়ে ঐ মাছ ফেলে দৌড় দেয় মোবারক আর তার দুই সঙ্গী। সকালে তারা আবার আসে মাছের সন্ধানে। মাছ পায়নি তারা, শুধু পেয়েছিল মাছের কাটা।
ডাক্তার তরফদারের বেশকিছু প্রশ্ন করার ছিল মোবারককে। কিন্তু তিনি রলেন না। কারণ অশরীরীয় আত্মায় তিনি বিশ্বাস করেন না। ষাট-সত্তর বছর আগে মৃত কোনো ব্যক্তির আত্মা এই সাগরতীরে ঘুরে বেড়ায়, ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। তাই তিনি মনোযোগ দিলেন ইরফান আলীর সাথে সাক্ষাৎ করার বিষয়ে। ডাক্তার তরফদারের বিশ্বাস ইরফান আলী তাকে সঠিক তথ্য দিতে পারবেন।
*
জেহান কলেজে এসেছে। সে সুযোগ খুঁজছে কীভাবে রাশেদকে একা পাওয়া যায়। তাহলেই পেটের মধ্যে ছুরিটা ঢুকিয়ে দেবে। কিন্তু সুযোগ সে পাচ্ছে না। রাশেদ সবসময় তিন-চারজন সঙ্গী নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
ক্লাস থেকে বের হওয়ার সময় দেখা হলো শান্তার সাথে। ডাক দিল তাকে। কাছে যেতে বলল, জেসমিনের কী অবস্থা?
আমি জানি না আপু।
তোমার তো বাড়ির পাশে। কথা বলো না কেন?
আমি গতকাল গিয়েছিলাম। কিন্তু খালাম্মা বলল, কারো সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না জেসমিন। একা একা থাকতে চায় সবসময়।
এটা একটা কথা হলো। আমি যাব ভাবছি।
একটু থেমে শান্তা আবার বলল, তুমি কি সংবাদটা শুনেছ?
কী সংবাদ?
রাশেদ ভাই নতুন যে মেয়েটার সাথে প্রেম শুরু করেছে, নাম মুনিরা, ওর সাথে ঝগড়াঝাটি হয়েছে।
না শুনিনি। কেন?
ভয়ংকর সংবাদ।
কী ভয়ংকর!
চারদিকে এই কথা কানে ভাসছে যে মুনিরা প্রেগন্যান্ট। মুনির পেটে রাশেদ ভাইয়ের সন্তান। মুনিরা রাশেদ ভাইকে চাপ দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য কিন্তু রাজি হচ্ছে না রাশেদ ভাই।
কী বলছেন আপনি আপু!
হ্যাঁ। আমার ধারণা কি জানো?
কী?
জেসমিনের পেটের সন্তানও রাশেদ ভাইয়ের। রাশেদ ভাই অস্বীকার করছে।
কীভাবে সম্ভব! একজন মানুষ এতজন মানুষের সাথে সম্পর্ক করবে কীভাবে? এটা তো অন্যায়।
তোমাকে বললাম এ কারণে যে তুমি জেসমিনদের বাড়ির পাশে থাকো। আমি ভাবছি বিষয়টা আমি জেসমিন আর খালাম্মাকে জানাব। তুমি পাশে থাকবে। জেসমিনের বাচ্চার একটা সুরাহা করা দরকার। তা না হলে পিতৃপরিচয়হীনভাবে বাচ্চাটা বড় হবে। এটা হতে পারে না। তুমি এই ফাঁকে সত্যতা যাচাই করে নাও।
আপনি বলেছেন এটাই সত্য।
আমি বলেছি বলে নয়, মুনিরার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আমাকে বলেছে।
কী হচ্ছে কলেজে এসব? প্রিন্সিপ্যাল স্যার কিছু করছেন না কেন?
কেউ তো দরখাস্ত দিচ্ছে না। জেসমিন দেয়নি, দেয়নি মুনিরাও। একটা দরখাস্ত দিলে তদন্ত হতো, তখন কোনো না কোনো পদক্ষেপ নিতে পারতেন প্রিন্সিপ্যাল স্যার।
জেহান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আর পদক্ষেপ আপা! যা করার আমাদেরই করতে হবে।
আমরা করব কীভাবে?
দেখি কী করা যায়। আপনি কখন যাবেন জেসমিনদের বাড়িতে?
তোমাকে ফোন করে জানাব।
আচ্ছা ঠিক আছে।
জেহান কলেজে এলোমেলো কিছুক্ষণ ঘুরল। খোঁজখবর নিতে চেষ্টা করল মুনিরার প্রেগন্যান্ট হওয়ার বিষয়ে। কিন্তু নিশ্চিত কোনো তথ্য পেল না। শেষে যখন চলে আসবে তখন দেখল কলেজের পুকুড়পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ। নিজে থেকেই ডাক দিল তাকে।
জেহান যাবে কি যাবে না ভাবছে। কারণ রাশেদের সাথে একটি ছেলে আছে। অবশ্য সে কলেজের না, বাইরের কোনো জায়গার হবে। জেহানের বুকটাও ধড়ফড় করতে শুরু করেছে। ছুরিটা পরিকল্পনামতো ব্যবহার করতে পারবে কি না সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্যে। আর তাছাড়া সে কোনো সাক্ষী রাখতে চায় না। অথচ পাশের ছেলেটা যাবে বলে মনে হলো না।
জেহান কাছে পৌঁছাতে রাশেদ বলল, কেমন আছিস তুই জেহান?
কথা শুনে খানিকটা ভড়কে গেল জেহান। কারণ রাশেদ তাকে ‘তুই’ করে বলছে। আগে ‘তুমি’ করে বলত। সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ভালো ভাইয়া।
আমাকে তুই ভালোমতোই চিনস?
হ্যাঁ, চিনি।
আমি যতদূর জানি তোর বাপ অনেক বড়লোক। আমার কিছু টাকা দরকার। হাজার বিশেক। আমাকে ধার দেয়া লাগবে।
এত টাকা আমি পাব কোথায়?
তুই পাবি ক্যামনে? তোর বাপে দিবে। আনবার পারবি না?
না।
পারলে তোর কাছে এখন যা আছে দিয়া দে।
আমার কাছে?
হুঁ।
কথা বলেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার সাগরেদের দিকে চোখের ইশারা করল রাশেদ। তারপর বলল, ওর কাছে কত টাকা আছে দ্যাখতো জুবায়ের!
জুবায়ের এগিয়ে এসে রাশেদের পিছনের পকেট থেকে মানিব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে নিল। সাথে সাথে মাথা গরম হয়ে উঠল জেহানের। সে সাইড পকেট থেকে ছুরি বের করে আঘাত করে বসল জুবায়েরকে। তাতে জুবায়েরের ডান হাতে খানিকটা কেটে গেল। জেহানের এই ঔদ্ধত্য দেখে প্রচণ্ড খেপে উঠল রাশেদ। ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিল জেহানকে। ততক্ষণে জুবায়ের মানিব্যাগ দেখে ফেলেছে। বলল, বস টাকা বেশি নাই। তয় এক মাইয়ার ছবি আছে।
ছবিটা দেখে রাশেদ বলল, তোর পকেটে জেসমিনের ছবি ক্যান?
জেহান যে কিছু বলবে সেই উপায় নেই, ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে হতবিহ্বল হয়ে গেছে সে।
রাশেদ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তুই তাহলে জেসমিনের সাথে আকামডা করছস! জেসমিনরে গর্ভবতী করছস! তলে তলে এত দূর! তোরে আমি ছাড়ব না। কলেজে আমি কাইলই সবকিছু ছড়ায়া দিব। তুই আকাম কইরা আমার নামে আজেবাজে কথা ছড়াইতেছস। আমার বদনাম করতেছস। আর ছুরি নিয়া চলা শুরু করছস? আমার উপর খবরদারি দেখাচ্ছি মজা।
কথা বলতে বলতে রাশেদ নিজে জেহানের বাম হাতের আঙ্গুল ধরে মোচড় দিল। তাতে মট শব্দে কনে আঙুলটা ভেঙে গেল জেহানের। আর দেরি করল না জেহান। কামড় বসিয়ে দিল রাশেদের হাতে। তাতে রাশেদ খানিকটা সরে গেলে সুযোগটা কাজে লাগাল সে। উঠেই দৌড় দিল। ততক্ষণে আরো কয়েকজন ছাত্র আসতে শুরু করেছে পুকুরের দিকে। অবস্থা বেগতিক দেখে দ্রুত সরে পড়ল রাশেদ।
তীব্র ব্যথায় জেহানের চোখে তখন পানি আসার অবস্থা। সে উঠে দাঁড়াতে কাছে আসা কয়েকজন ছাত্র জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? কী হয়েছে?
জেহান চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আমার মানিব্যাগটা নিয়ে গেছে।
এবার অন্য এক ছাত্র বলল, কয়েকদিন আগে তো রাশেদ ভাই আমার মানিব্যাগ থেকে এক হাজার দুই শ টাকা জোর করে নিয়ে গেছে। বলেছে ধার, কিন্তু দেবে বলে মনে হয় না।
জেহান অবশ্য আর কিছু বলল না। সে হাঁটতে শুরু করল সামনের দিকে। তার হাতে খুব ব্যথা করছে। বুকেও ব্যথা আছে, এই ব্যথার তীব্রতাটা যেন বেশি। কারণ সে প্রতিশোধ নিতে পারেনি, ছুরিটা ঢুকিয়ে দিতে পারেনি রাশেদের পেটে কিংবা বুকে।
*
ডাক্তার তরফদার ইরফান আলীকে দেখে খানিকটা অবাকই হয়েছেন। যতটা বয়স্ক তাকে ভেবেছিলেন চেহারা দেখে ততটা বয়স্ক মনে হচ্ছে না। যখন বয়স জানতে চাইলেন ইরফান আলী মৃদ হেসে বললেন, বিরানব্বই বছর।
বিরানব্বই বছর বয়সে যে সকল মানুষ নিজের পায়ে হাঁটাচলা করতে পারে তারা সত্যি সৌভাগ্যবান। ইরফান আলী সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। তবে তার একটা লাঠিতে ভর দিতে হয়, এই যা। ইরফান আলীর বাড়িটাও চমৎকার। একটা টিলার উপর ছোট্ট দোতলা বাড়ি। বারান্দায় বসে সাগর দেখা যায়। এত সুন্দর দৃশ্য যে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।
ডাক্তার তরফদার পরিচয়পর্বের কথা শেষ করে বললেন, আমি আসলে এসেছি ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে জানতে। আপনি বলেছেন আপনার বয়স বিরানব্বই বছর। বর্তমানে ২০২২ সাল। তার মানে ১৯৩০ সালে আপনার জন্ম। আর ডাক্তার হাডসন এসেছিলেন ১৯৪০-এর দশকে, তাই না?
ডাক্তার হাডসনের কথা শুনে প্রথমে একটু যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন ইরফান আলী। তারপর হঠাৎই মৃদু হেসে বললেন, আমার কাছে অনেক মানুষ এসেছে, অনেকে জানতে চেয়েছে ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে। তাও বহুদিন আগে। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পর আপনি হচ্ছেন নতুন কেউ যিনি এসেছেন ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে। আমি অবশ্যই আপনাকে সঠিক তথ্য দেব। সময় পালটে গেছে, আগের অবস্থা আর নেই।
সময় পালটে গেছে মানে?
ইরফান আলী চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। এবার সোজা হয়ে বসে বললেন, ডাক্তার হাডসন এই এলাকায় এসেছিলেন ১৯৪৪ সালের কাছাকাছি সময়ে। সম্ভবত প্রথমে চাকরি করতেন অস্থায়ী সামরিক হাসপাতালে। কারণ আমার মনে আছে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমি একটা জাহাজে অনেক বিদেশি সৈনিককে চলে যেতে দেখেছিলাম। কোন দেশের সৈনিক বলতে পারব না। অতটা মনে নেই।
ডাক্তার হাডসন কীভাবে এসেছিলেন?
উনি সম্ভবত সামরিক ব্যবস্থাপনায় এসেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে একটা খ্রিষ্টান মিশনারিজে কাজ নেন। তারপর যান ছুটিতে। পরে স্ত্রী এলিজাকে নিয়ে জাহাজে ফিরছিলেন। ডাক্তার হাডসন ছিলেন ব্রিটিশ। পূনরায় খ্রিষ্টান মিশনারিতে কাজ করবেন বলেই ফিরে আসছিলেন তিনি। জাহাজটা যখন চট্টগ্রামের কাছাকাছি তখন জাহাজে বড় ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। ঐ সময় বেশ ঝড় হয়েছিল দুইদিন। বাতাসের গতি ছিল অনেক বেশি। ঝড় আর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে জাহাজটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। চলে আসে এইদিকে। অবশেষে অগভীর পানিতে নোঙর ফেলে। জাহাজের অধিকাংশ যাত্রী তখন তীরে নেমে আসে। তাদের মধ্যে ছিলেন ডাক্তার হাডসন এবং এলিজা। প্রায় এক সপ্তাহ লেগেছিল জাহাজটি ঠিক করতে। ঐ এক সপ্তাহ ডাক্তার হাডসন এবং এলিজা সমুদ্রের তীরে হেভেন হিলে ছিলেন।
‘হেভেন হিল’ মানে?
হাডসন হিলের আগের নাম ছিল হেভেন হিল। আমারও জন্মের বেশ আগে এক ব্রিটিশ গবেষক দল সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করতে এসেছিল এই এলাকায়। জায়গাটার সৌন্দর্য দেখে তারা নাম রেখেছিল ‘হেভেন হিল, অর্থাৎ স্বর্গের পাহাড়। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ সময়ে উপমহাদেশের সবাই যখন স্বাধীনতার জন্য মরিয়া এবং বাঙালিরা ইংরেজি পরিহার করা শুরু করে তখন এই হেভেন হিল হয়ে যায় ‘স্বর্গের পাহাড়’। স্বর্গের পাহাড় নামটা কালের বিবর্তনে হয় ‘স্বর্গস্বপ্ন’। জনশ্রুতি আছে, কোনো এক বিখ্যাত বাঙালি কবি এসে নাকি ‘স্বর্গস্বপ্ন’ নামটা রেখেছিলেন। ছোটবেলা জায়গাটার নাম স্বর্গস্বপ্ন বলেই শুনেছি। গুহায় প্রবেশের আগে ডান পাশে দেখবেন পাথরের উপর হেভেন হিল নামটা লেখা আছে। তার উপর আবার লেখা স্বর্গস্বপ্ন।
তাহলে এখন ‘হাডসন হিল’ বলে কেন সবাই?
আসলে ডাক্তার হাডসন এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে ‘স্বর্গের পাহাড় কিংবা ‘স্বর্গস্বপ্ন’ নামটা তার জনপ্রিয়তার কাছে হারিয়ে যায়। আর নতুন নাম হয় ‘হাডসন হিল। ঐ নামটা এখনো প্রচলিত আছে। যাইহোক, বলছিলাম ডাক্তার হাডসনের কথা। যেদিন জাহাজ চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেবে তার একদিন আগে অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা ঘটে। সাগরে গোসল করতে গিয়ে ঢেউয়ের টানে ডুবে যায় তার স্ত্রী এলিজা। তাকে খুঁজতে গ্রামের সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমার এখনো মনে আছে, নৌকা নিয়ে আমরা কয়েকজন যুবক তখন অগভীর সাগরেও খোঁজাখুঁজি করেছিলাম। খুঁজছিলাম লাল কিছু, কারণ এলিজার পরা ছিল লাল পোশাক। লাশটা পাওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এলিজার লাশ আর পাওয়া যায়নি। স্ত্রী হারানোর শোকে একেবারে পাথর হয়ে যান ডাক্তার হাডসন। তিনি কেন যেন বিশ্বাস করতেন তার স্ত্রী মারা যায়নি, বেঁচে আছে এবং আবার ফিরে আসবে। যতদিন স্ত্রী ফিরে না আসবে ততদিন তিনি আর হাডসন হিল ছেড়ে যাবেন না, এরকমই সিদ্ধান্ত নেন।
কথা শেষ করে থামলেন ইরফান আলী। এরমধ্যে নাস্তা চলে এসেছে। এই সাগরতীরে মাল্টার জুস তৈরি করেছেন ইরফান আলীর বাসার লোকজন। সাথে আরো ছয় রকমের খাবার। অবাকই হলেন ডাক্তার তরফদার। জুস মুখে দিয়ে বললেন, ডাক্তার হাডসন সময় কাটাতেন কীভাবে? আর ডাক্তার হিসেবে তার যশ-খ্যাতির কারণ কী ছিল?
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ইরফান আলী। তারপর বলতে থাকলেন, ডাক্তার হাডসনকে আমরা বলতাম জাদুর ডাক্তার। মৃতপ্রায় রোগী তার কাছে গেলে তিনি তাকে সুস্থ করে দিতেন। কীভাবে সম্ভব হতো তা সত্যি ছিল এক বিস্ময়! চিকিৎসক হিসেবে তার হাত ছিল আসলেই অসাধারণ। তার সুনাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারদিকে। এক পর্যায়ে এমন অবস্থা হয় যে, সবসময় হাডসন হিলে কমবেশি মানুষ থাকত। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মাত্র তিন বছরে তিনি বাংলা বলতে শিখে গিয়েছিলেন। ভাষাগত দূরত্ব কমে যাওয়ার কারণে মানুষের একেবারে মনের মধ্যে ঢুকে যেতে থাকেন তিনি। ডাক্তার হাডসনের সাথে প্রথম থেকেই আমার কথোপকথন হতো। কারণও ছিল বটে। আমি তখন অল্প অল্প ইংরেজি বলতে পারতাম। যে কয়েকজন প্রথম প্রথম তার সাথে কথা বলত তাদের মধ্যে একজন ছিলাম আমি। বয়সে যুবক হওয়ায় আমার উৎসাহ ছিল বেশি। তবে আমি বেশি যেতে পারতাম না, কারণ আমাকে পড়াশুনার জন্য চট্টগ্রাম থাকতে হতো। হঠাৎ একবার আমার প্রচণ্ড জ্বর হলো। তারপর সমস্ত শরীরে এক ধরনের ফোস্কা উঠতে শুরু করল, ফোস্কাগুলো রূপান্তরিত হতে লাগল বড় বড় ঘায়ে। শরীর যেন আমার পচে যাচ্ছিল, আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সারা শরীর থেকে তখন পুঁজ বের হতো। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল আমি বাঁচব না। মাত্র সাত দিনের মাথায় এমন অবস্থা হয় যে আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। শুধু এটুকু বলব, অনেক কষ্টে চট্টগ্রাম থেকে এসে পৌঁছাই ডাক্তার হাডসনের কাছে। বিশ্বাস করুন, উনার ওষুধের ছোঁয়ায় চিকিৎসা শুরুর দ্বিতীয় দিনেই আমি ফল পেতে শুরু করি। কিন্তু কী অসুখ আমার হয়েছিল, আর কী ওষুধ দিয়েছিলেন তিনি, তা কখনো জানতে পারিনি। তবে ইনজেকশনের কথা মনে আছে। ইনজেকশন আনতে মাঝে মাঝেই চট্টগ্রাম মিশনারি হাসপাতালে যেতেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্থায়ী সামরিক হাসপাতালের পাশাপাশি স্থানীয় সৈন্যদের জন্য ঐ মিশনারিজটা তৈরি করা হয়েছিল। ওখান থেকে আনা ইনজেকশন ছিল দারুণ কার্যকর। এমনও শোনা গেছে যে মিশনারিজের মাধ্যমে তিনি ব্রিটেন থেকে ওষুধ আনিয়েছিলেন। বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল যে, তিনি কারো কাছ থেকে কোনো ফি বা টাকাপয়সা নিতেন না। গ্রামের মানুষজনই তাকে খাবার পাঠিয়ে দিত। তার রোগীরা বিভিন্নরকম খাবার নিয়ে আসত তার জন্য। এখন যে পাহাড়টায় নারকেল বাগানটা আছে ওটা তার নিজের হাতে করা। তার কোনো রোগী তাকে কোনো নারকেল দিলে তিনি সেটা ঐ পাহাড়ে লাগাতেন। ঐ নারকেল গাছের কারণে পাহাড়টার নাম হয়ে যায় কোকোনাট হিল। আর একটা বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল, তিনি মাত্র একবেলা খাবার খেতেন। আর তা হলো দুপুরের ঠিক আগে। স্ত্রী এলিজা মারা যাওয়ার পর থেকে এই অভ্যাসটা গড়ে তুলেন তিনি। ধারণা করা হয়, হয়তো কখনো খাবারের অভাব হবে এরকম চিন্তা করে একবেলা খাবারে অভ্যস্ত হন তিনি। অবশ্য তার জন্য খাবার সংগ্রহ কঠিন ছিল না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে গাছের ডাল কেটে মাখা চোখা করে সমুদ্র থেকে মাছ ধরতে পারতেন তিনি। খুব ভালো সাঁতারুও ছিলেন। এত ভালো সাঁতারু হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রী পানিতে ডুবে মারা গেল, এই দুঃখটা কিছুতেই সইতে পারতেন না। তার গলায় তার স্ত্রীর দেয়া স্বর্ণের একটা লকেট ছিল। ঐ লকেটটা খোলা বন্ধ করা যেত। ভিতরে একপাশে ছিল তার ছবি, অন্যপাশে তার স্ত্রীর ছবি। লকেট খুলে দিনে অনেকবার তিনি তার স্ত্রী এলিজার ছবিটা দেখতেন। এলিজার নামের দুটো অংশ ছিল। প্রথম অংশ এলিজা, দ্বিতীয় অংশ ঠিক মনে করতে পারছি না। হয়তো মনে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে। ডাক্তার হাডসনের পানির সমস্যাও ছিল না। হাডসন হিলের গুহা যেটাকে আমরা হাডসন হাউস বলি, ভিতরে ছোট্ট একটা পাথুরে চৌবাচ্চা আছে। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের উপর থেকে পানি গড়িয়ে ঐ চৌবাচ্চায় জমা হয়, অনেকটা ঝরনার মতো। এজন্য ঐ জায়গাটাকে বলা হয় ওয়াটার গার্ডেন বা পানির বাগান। চৌবাচ্চা একবার ভরলে দুইমাস পর্যন্ত পানি খাওয়া সম্ভব হতো। এজন্য বিশুদ্ধ পানির অভাব ছিল না তার।
যাইহোক, ব্যাংকে চাকরি হয়ে গেলে আমি স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম থাকতে শুরু করি। ডাক্তার হাডসনের সাথে যোগাযোগ কমে যায় আমার। তবে গল্প ঠিকই কানে আসতে থাকে। তার সুনাম আর খ্যাতি টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কক্সবাজার পেরিয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। চট্টগ্রামের অনেক রোগী আসত তার কাছে। আসত বার্মা থেকেও। আমিও অনেক রোগী পাঠিয়েছি। বেশ কয়েকজন রোগী ভক্তও হয়ে যায় তার। তারা ঐ গুহার আশেপাশে অস্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করে। এই ভক্তদের মধ্যে একজন ছিলেন পাথর ব্যবসায়ী। নাম মনে নেই। তিনি ডাক্তার হাডসনকে সাদা আর লাল পাথর এনে দেন ভারতের রাজস্থান থেকে। গুহার মধ্যে টাইলসের মতো যে সাদা পাথর আছে সেগুলো ঐ ব্যবসায়ীই এনেছিলেন। ঐ জায়গাটাকে বলা হতো হোয়াইট গার্ডেন বা শ্বেত পাথরের বাগান। লাল আর রঙিন পাথরগুলো বসানো হয় পাহাড়ের উপর। পাথরের ঐ জায়গাটাকে বলা হতো স্টোন গার্ডেন। আপনি বোধহয় ওখানে যাননি?
ডাক্তার তরফদার নড়েচড়ে বসে বললেন, না যাইনি।
পাহাড়ের চূড়ার পুরোটার নাম ‘হিলটপ’। ডাক্তার হাডসন প্রায়ই ঐ হিলটপে বসে চারপাশে তাকিয়ে থাকতেন, যেন তিনি তার স্ত্রীকে খুঁজে ফিরছেন। আমিও বেশ কয়েকবার উঠেছি উপরে। জায়গাটা আসলেই সুন্দর। আর একটা বিষয়, গুহার ভিতরে ডাক্তার হাডসনের যে মূর্তিটা আছে সেটা তিনি নিজে তৈরি করেননি। তৈরি করেছে ইমরান নামের এক যুবক। চিকিৎসা নিতে এসে সে এখানে থেকে যায়। একটানা তিন বছর কাজ করে সে, তারপর চলে যায় ঢাকায়। নামটা মনে আছে, কারণ আমার ঘোট ভাইয়ের নামও ছিল ইমরান, অবশ্য আমার ছোট ভাই বেঁচে নেই। যাইহোক, ঢাকা থেকে ইমরান আর ফিরে আসেনি যদিও সে কথা দিয়েছিল যে ডাক্তার হাডসনের পাশে তার স্ত্রীর একটা পাথুরে মূর্তিও তৈরি করবে। বড় বড় করে নামও লিখে ফেলেছিল পাথরের উপর। ওখানে এলিজার পুরো নামটা পাবেন আপনি। যাইহোক, ইমরান ফিরে না আসায় আর এলিজার মূর্তিটা তৈরি হয়নি। পরে শুনেছিলাম যে, ভাস্কর ইমরান ফ্রান্সে চলে গিয়েছিল পড়াশুনার জন্য, তারপর আর ফিরে আসেনি। সত্য-মিথ্যা নিশ্চিত করে বলতে পারব না।
কথাগুলো বলে ইরফান আলী কিছুটা সময়ের জন্য থামলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, আমাদের গ্রামে মাহাতাব হাকিম নামের এক ব্যক্তি ছিল। মূলত সে ছিল এই এলাকার অন্যতম ধনী এবং প্রভাবশালী। তার টাকার উৎস ছিল পাহাড়ের সেগুন কাঠ বিক্রি আর তৎকালীন বার্মার সাথে চোরাই মালের ব্যবসা। বার্মা থেকে কেউ কোনো মালামাল আনলে আর তাকে মাসাহোরা না দিলে কক্সবাজার টেকনাফ সড়কে সে নিজের লোক দিয়ে ঐ মালামাল জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিত। সোজা বাংলায় যাকে বলে ডাকাতি। যাইহোক, এই মাহাতাবের স্ত্রী কুলসুম একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। কী এক রোগে তার পায়ে হাঁটুর নিচ থেকে পচন দেখা দেয়। মাহাতাব ছিল মাঝবয়সি আর কুলসুম ছিল অল্পবয়সি। তবে এটা সত্য মাহাতাব বড় ভালোবাসত কুলসুমকে। তাই তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসে ডাক্তার হাডসনের কাছে। ডাক্তার হাডসন প্রায় দুইমাস তার চিকিৎসা করেন। চিকিৎসার জন্য ডাক্তার হাডসনকে বেশ কয়েকবার মাহাতাবের বাড়িতেও যেতে হয়েছিল। কুলসুম সুস্থ হওয়ার পর মাহাতাব যেন আবার নতুন জীবন ফিরে পায়। নিজেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ডাক্তার হাডসনের প্রতি। কিন্তু জটিলতার উদ্ভব হয় যখন কুলসুমের সন্তান হয়। পুত্রসন্তান হওয়ায় খুশিই হয় মাহাতাব, কিন্তু যখন দেখে সন্তানের চোখ নীল তখন মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা হয় তার। তার ধারণা হয়, ঐ পুত্রসন্তান তার না, ডাক্তার হাডসনের। তা না হলে চোখ নীল হবে কেন? ঐ নীল চোখ নিয়ে গ্রামে বেশ কানাঘুষা চলতে থাকে। বিষয়টা সহ্য করতে পারছিল না মাহাতাব। আবার কিছু করতেও পারছিল না, কারণ গ্রামবাসীর কাছে ডাক্তার হাডসন ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে গোপনে সে ডাক্তার হাডসনের বিরুদ্ধে একটা জনমত তৈরি করতে থাকে। স্থানীয় হাতুড়ে চিকিৎসক, ধর্মীয় নেতা এবং ভণ্ড কয়েকটা ফকির মিলে গুজব ছড়ায় যে ডাক্তার হাডসনের কাছে কোনো নিঃসন্তান নারী রোগী গেলে ডাক্তার হাডসন তাকে অজ্ঞান কিংবা সম্মোহিত করে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেন। গুজবটা চাপাই ছিল, কিন্তু ১৯৫৭ সালের দিকে গুজবটা বেশ জোরালো হয়। কারণ টেকনাফে আরেক মহিলার সন্তানের চোখ হয় নীল। ঐ মহিলা সন্তান জন্ম দেয়ার নয়-দশ মাস আগে চিকিৎসা নিয়েছিল ডাক্তার হাডসনের কাছে। এই সুযোগটা আর হাতছাড়া করেনি মাহাতাব। সে গুজব রটিয়ে দেয় যে, কোনো নারী রোগী ডাক্তার হাডসনের কাছে চিকিৎসার জন্য গেলে হাডসন রাতে অদৃশ্য ক্ষমতাবলে ঐ নারীর কক্ষে আসে এবং তার সাথে সম্পর্ক করে তাকে গর্ভবতী করে নিজের সন্তান জন্ম দেয়। গ্রাম পর্যায়ের ধর্মীয় নেতারা এই কথাগুলো দ্রুত প্রচার করতে থাকে চারদিকে। মাহাতাব, গ্রামের মাতুব্বর, গোত্রপ্রধানসহ সকলে তখন আসে ডাক্তার হাডসনের কাছে এবং তাকে চলে যেতে বলে এখান থেকে। ডাক্তার হাডসন প্রথমে যেতে না চাইলেও পরে সবার অলক্ষ্যে একদিন সকালে চলে যান হাডসন হিল ছেড়ে। তাই সবাই জানে যে ডাক্তার হাডসন তার নিজ দেশ ইংল্যান্ডে চলে গেছেন। তার চলে যাওয়ার এক মাসের মাথায় আত্মহত্যা করে কুলসুম আর তার নীল চোখের সন্তান। সকালে আমগাছের ডালের সাথে তাদের ঝুলন্ত মরদেহ পাওয়া যায়।
ডাক্তার তরফদার জুস শেষ করেছেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনছিলেন তিনি। বললেন, ডাক্তার হাডসন কত সালে ইংল্যান্ড ফিরে গেছেন?
ইরফান আলী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আসলে কি, ডাক্তার হাডসন দেখতে ছিলেন খুবই সুন্দর। সাগরের পাড়ে তিনি যখন খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম তার নীল চোখের দিকে। সত্যি দারুণ হ্যান্ডসাম ছিলেন তিনি। তার পছন্দের পোশাক ছিল নীল পাঞ্জাবি। তখন তো আর এখনকার মতো সুন্দর পাঞ্জাবি ছিল না, তারপরও তিনি ঐ নীল রঙের পাঞ্জাবিই পরতেন। টেকনাফ থেকে একবার বেশকটি পাঞ্জাবি তৈরি করেছিলেন। দুই-একজন আবার উপহারও দিত। তাকে আমি যতদিন দেখেছি অধিকাংশ সময় ঐ নীল পাঞ্জাবি পরাই দেখেছি। যাইহোক, আমারও ধারণা ছিল তিনি ব্রিটেনে চলে গেছেন। চট্টগ্রামে আমার ব্যাংকে তার একটা অ্যাকাউন্ট ছিল। যদিও অর্থকড়ির প্রতি তার কোনো মোহ ছিল না, ঐ অ্যাকাউন্টটি তিনি করেছিলেন ব্রিটেন থেকে অর্থ আনার জন্য। কয়েকবার এনেছিলেনও, যদিও খুব সময় সাপেক্ষ এবং জটিল ছিল প্রক্রিয়াটা। ঐ অ্যাকাউন্টে তখন কিছু অর্থও ছিল তার। তিনি চলে যাওয়ার সময় নিয়ে যাননি। ভেবেছিলাম হয়তো ফিরে আসবেন এবং এজন্য নেননি। তার চলে যাওয়ার পর মাহাতাব আর গ্রামের মানুষজন হাডসন হিলের চারদিকে এমনভাবে বেড়া দিয়ে দেয় যেন কেউ আর ঐদিকে না যায়। কারণ কয়েকজন নাকি তখন ডাক্তার হাডসনের আত্মাকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছিল ঐ পাহাড়ে। যারা ঘুরে বেড়াতে দেখেছিল তারা ভাবত যে ডাক্তার হাডসন সমুদ্রে ডুবে মারা গেছেন। তবে তার আত্মা ঠিকই রয়ে গেছে। আসলে তারা ছিল ডাক্তার হাডসনের অন্ধভক্ত। যাইহোক, আমার ব্যাংকে মাহাতাব হাকিমেরও একটা অ্যাকাউন্ট ছিল। কুলসুমের মৃত্যুর পর মাহাতাব কেন যেন তার কর্মকাণ্ড গুটিয়ে নেয়, দুর্বল হতে থাকে তার ব্যবসা-বাণিজ্য। ডাকাতি করাও বন্ধ করে দেয়। একসময় একেবারে ঘরকুনো হয়ে পড়ে। ১৯৮০ সালের দিকে মাহাতাবের এক সাগরেদ এসে জানায় যে মাহাতাব খুব অসুস্থ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি এবং আমার সাথে কথা বলতে চায়। আমি তখন ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার। ব্যাংকের কাজ করে আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই মাহাতাবের সাথে দেখা করার জন্য। আমি তাকে দেখে বড় অবাক হই। শরীর খুব দুর্বল, হাত-পা একেবারে শুকিয়ে গেছে। ডাক্তাররা চেষ্টা করেও সুস্থ করতে পারছিল না তাকে। আমাকে দেখে তার চোখে পানি চলে আসে। সে আমার কাছে জানতে চায় কত টাকা আছে তার অ্যাকাউন্টে। জানাই, প্রায় দুই কোটি টাকা। এরপর মাহাতাব আমাকে যা বলে তা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। তার কথার সারমর্ম ছিল এরকম যে, ডাক্তার হাডসন মারা যাননি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। নীল চোখের বাচ্চাটাকে একেবারেই সহ্য করতে পারত না মাহাতাব। বারবার মনে হতো বাচ্চাটা ডাক্তার হাডসনের। কিন্তু সে কিছু করতে পারছিল না। তাই সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিশোধস্বরূপ ডাক্তার হাডসনকে হত্যা করবে। ঐ পরিকল্পনা থেকেই তার যে ডাকাত দল ছিল তাদেরকে সাথে নিয়ে একদিন শেষ রাতে ডাক্তার হাডসনের আস্তানায় হাজির হয়। তারপর গলা কেটে হত্যা করে ডাক্তার হাডসনকে। লাশ সমুদ্রে ফেলে দিলে ভেসে আসতে পারে এই আশঙ্কা থাকায় হিলটপের একেবারে দক্ষিণে মাটি দেয় তাকে। অতঃপর কাটা দিয়ে আটকে দেয় হিলটপে উঠার রাস্তা। পরে যারা তখন গুজব ছড়াচ্ছিল যে ডাক্তার হাডসনের আত্মাকে দেখা যাচ্ছে, তাদের গুজবকে নিজেরাও ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। এতে ঐ সময় সবার মধ্যে দাবি উঠে হাডসন হিলে গমনাগমন নিষিদ্ধ করার জন্য। বাস্তবে তাই ঘটে, চারপাশে বাঁশ আর খেজুরের কাঁটাওয়ালা ডাল ব্যবহার করে বেড়া দেয়া হয়। ফলে কেউ আর যেতে পারত না ওখানে। এদিকে মাহাতাব নির্যাতন অত্যাচার বাড়িয়ে দেয় কুলসুম আর তার ছেলের উপর। বিশেষ করে সন্তানের প্রতি তার নির্যাতন ছিল অসহনীয়। কুলসুম তাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করে নীল চোখের ছেলেটি তারই। কিন্তু বুঝতে চাইত না মাহাতাব, বরং ধীরে ধীরে ক্ষোভ বাড়তে থাকে কুলসুমের উপরও। পরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে কুলসুম আর তার নীল চোখের ছোট্ট সন্তানকে। রাতে লাশ ঝুলিয়ে রাখে গাছের সাথে। সকালে গ্রামের সকলের উপস্থিতিতে মাটি দেয়। থানা খবর পায় দুই দিন পর। কারো কোনো অভিযোগ না থাকায় থানা পুলিশও দুজন মানুষের মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তবে স্ত্রী আর সন্তানকে হত্যার পর নিজের ভুল বুঝতে পারে মাহাতাব এবং কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে যায়। তার জীবনে ঘটে মারাত্মক ছন্দপতন। সবকিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং ঘরেই সময় কাটাতে থাকে বেশি। বয়স বাড়লে নিজের বাড়িতে একটা ছোট্ট দাঁতব্য হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত নেয় সে, যেখানে শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হবে সাধারণ মানুষকে। ঐ হাসপাতালের নাম রাখা হয়। হাডসন হাসপাতাল। হাসপাতালটি চালু হওয়ার আট মাসের মাথায় মারা যায় মাহাতাব। বর্তমানে ঐ হাসপাতালে সাধারণ মানুষকে ফ্রি চিকিৎসা দেয়া হয়। হাসপাতাল তৈরিতে অল্প কিছু টাকা খরচ হয়েছিল, কারণ মাহাতাবের বাড়িতেই হয়েছিল হাসপাতালটি। বাকি টাকা ব্যাংকে ছিল। ঐ টাকা প্রত্যেক ছয় বছরে দ্বিগুণ হয়েছে, সুদে-আসলে গত চল্লিশ বছর ধরে দ্বিগুণ হতে হতে এখন হয়েছে এক শ বিয়াল্লিশ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে বড় একটা হাসপাতাল করা যাবে। কেন যেন মৃত্যুর আগে হাসপাতালটা পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে আমাকে দিয়ে গিয়েছিল মাহাতাব। ব্যাংকের টাকার নমিনিও করে যায় আমাকে। বয়স হওয়ায় আমি এখন আর পারছি না। একটা কমিটি করে দায়িত্ব তাদের কাছে হস্তান্তর করে দেব আগামী সপ্তাহে।
কথাগুলো বলে ইরফান আলী আবার থামলেন।
ডাক্তার তরফদার জীবনে বহু ঘটনা শুনেছেন। কিন্তু এতটা রোমাঞ্চকর আর হৃদয়বিদারক ঘটনা শোনেননি কখনো। তিনি কী বলবেন ঠিক ভেবে পাচ্ছেন না।
ইরফান আলী আবার বলতে থাকলেন, মৃত্যুর তিন দিন আগে মাহাতাবের অনুরোধে তার সাগরেদরা তাকে কুলসুমের কবরের পাশে নিয়ে যায়। ঐ কবর ছেড়ে মাহাতাব আর ফিরে যায়নি। তিনদিন শুধু সে কুলসুম আর নীল চোখের সন্তানের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। মৃত্যুর পর তার নির্দেশনামতো তার সাগরেদরা কুলসুমের কবরেই মাটি দেয় তাকে। এই হচ্ছে মাহাতাব আর ডাক্তার হাডসনের কাহিনি। সত্যি কথা বলতে কী, ডাক্তার হাডসনের করুণ মৃত্যুর কথা আমিও কাউকে কোনোদিন বলিনি। বলে কী লাভ? কারণ আমিও সত্যটা জেনেছিলাম তার মৃত্যুর তেইশ বছর পর। সম্ভবত তাকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৫৭ সালের দিকে আর মাহাতাব আমাকে বলেছে ১৯৮০ সালে। তাই নিজের মধ্যেই রেখেছিলাম সবকিছু। যেহেতু বয়স হয়ে গেছে, আর বেশিদিন বাঁচব না, তাই জানিয়ে গেলাম আপনাকে। আপনি ইচ্ছা করলে যে কাউকে বলতে পারেন।
কথাগুলো বলে ইরফান আলী এক গ্লাস পানি খেলেন। ডাক্তার তরফদার বললেন, আপনি কি কখনো হিলটপে ডাক্তার হাডসনের লাশ খুঁজে দেখেছিলেন?
না দেখিনি। কারণ অহেতুক ঝামেলায় জড়াতে চাইনি। ডাক্তার হাডসন নিখোঁজ হওয়ার পর পাকিস্তান আমলে ব্রিটিশ এমব্যাসি থেকে দুইবার এই গ্রামে প্রতিনিধি দল এসেছিল তার খোঁজে। অবশ্য তখন কেউ খোঁজ দিতে পারেনি ডাক্তার হাডসনের। পারবে কীভাবে? কেউ তো জানত না তার মৃত্যুর রহস্যটা, সবাই জানত তিনি ব্রিটেন কিংবা অন্য কোথাও চলে গেছেন। আর আগেই বলেছি আমি নিজে জেনেছি ১৯৮০ সালে। ১৯৮০ সালের আগে আমার ভাবনাও অন্যদের মতো ছিল।
আমি যদি হিলটপে খুঁজে বের করতে চাই ডাক্তার হাডসনের মৃতদেহটাকে?
এতদিনে কি আর লাশের কিছু অবশিষ্ট থাকবে?
আশা করছি কিছু না কিছু পাওয়া যাবে।
চেষ্টা করতে পারেন।
ডাক্তার তরফদার আরো কিছুক্ষণ কথা বলে বের হয়ে এলেন ইরফান আলীর বাড়ি থেকে। তিনি অনুধাবন করছেন, তার হাত-পা কাঁপছে। দারুণ এক শিহরনে এই মুহূর্তে শিহরিত তিনি। ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, ডাক্তার হাডসনের দেহাবশেষ তিনি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবেন, নাকি করবেন না।
*
শান্তা এসেছে জেসমিনদের বাসায়। বসে আছে জেসমিনের কক্ষে। জেসমিন একেবারে শুকিয়ে গেছে। আগের সেই সুন্দর চেহারা আর নেই। চোয়ালটা পর্যন্ত চেপে গেছে। তবে পেটটা ফোলা। পেটে যে বাচ্চা আছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
শান্তা বলল, জেসমিন তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না!
জেসমিন মৃদু হেসে বলল, বাচ্চাটা হয়ে গেলে শরীর আবার ঠিক হয়ে যাবে।
মনে হচ্ছে না। বেশি খারাপ হয়েছে তোর শরীর। আর তুই নাকি কোনোকিছু খাওয়াদাওয়াও করছিস না। কেন?
খেতে ভালো লাগে না। মুখের রুচি চলে গেছে।
রুচি চলে গেলেও খেতে হবে।
দেখি, চেষ্টা করব। কলেজের কী খবর?
ঠিকঠাকই আছে সবকিছু। শুধু…
শুধু কী?
রাশেদ ভাইয়ের নতুন প্রেমিকা মুনিরার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে মুনিরাও নাকি প্রেগন্যান্ট।
সত্যি নাকি?
আমি মুনিরার সাথে কথা বলেছি। সে অবশ্য তোর মতোই, স্বীকার করেনি।
হয়তো মুনিরা সত্য বলছে।
শান্তা খানিকটা রেগে উঠে বলল, এটা কোনো কোনো কথা হলো। রাশেদ ভাই একজনের পর একজনের সাথে প্রেম করবে, শারীরিক সম্পর্ক করবে, তারপর তাকে ছেড়ে চলে যাবে, তা কীভাবে সম্ভব?
জেসমিন এবার শান্তার চোখে তাকাল। তারপর বলল, তুই বোধহয় আমার কথাও ইঙ্গিত করছিস! সত্যি কথা বলতে কি আমার পেটের সন্তান রাশেদ ভাইয়ের না।
তাহলে কার?
নীল চোখের এক ছায়ার। এর বেশি বলতে ইচ্ছে করছে না।
বললে সমস্যা কোথায়? তোর জন্য আজ সবাই চিন্তায় আছে। হেডস্যার আর খালাম্মা কতটা টেনশনে আছে বুঝতে পারছিস? শুধু শুধু সবাইকে কষ্ট দিবি কেন? নামটা বলে ফেল, প্রয়োজনে তাকে বিয়ে করবি।
বিয়ে করতে একটু সময় লাগবে।
কেন?
কারণ মানুষটা বিদেশি।
বিদেশি! ভ্রূ কুঁচকে বলল শান্তা।
হ্যাঁ, শুধু এটুকু জেনে রাখ মানুষটা বিদেশি এবং খুব ভালো। ছায়া হয়ে আসে আমার কাছে।
তোর সাথে বিদেশি কারো পরিচয় হলো কবে? আমি তো কখনো দেখিনি। আর আমাদের এলাকায়ও তো কোনো বিদেশি নেই। ব্যাপারটা কী বল তো! আর ছায়া হয়ে আসবে কীভাবে? এ কথা তুই আগেও বলেছিস। মাথা ঠিক আছে তো তোর?
আর একটু ধৈর্য ধর। আমি তোদর সত্যি সারপ্রাইজ দেব!
অনেক সারপ্রাইজ দিয়েছিস! আর দরকার নেই। তুই বুঝতে পারছিস তোর চারপাশের অবস্থা কতটা সংকটময়! আমার মনে হয়, তুই একটা ঘোরের মধ্যে আছিস অথবা তোকে ভয় দেখিয়ে রেখেছে কেউ। এজন্য কিছু বলতে পারাছস না। ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা সবাই তোর সাথে আছি। তুই খালি নামটা বল।
জেসমিন ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, তুই শুধু শুধু চিন্তা করছিস!
শুধু শুধু চিন্তা করছি না। তুই কি জানিস তোর ছবি দেখে আমেরিকায় থাকা হেডস্যারের এক বন্ধু তার ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
শুনেছি। কিন্তু সে কি জানে আমার পেটে সন্তান আছে?
তা জানে না। আগের ছবি দেখেছে।
যখন জানবে তখন আর বিয়ে করতে চাইবে না।
আমি তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিষয়টা বুঝাতে চেষ্টা করছি। বিয়ে হয়ে গেলে আমেরিকা চলে যেতে পারবি। আর তা না করে এখানে কার সাথে তুই সম্পর্ক করে বেড়াচ্ছিস! কেউ জানেও না, বুঝতেও পারছে না।
আমার জীবন আমার। সবার বুঝার দরকার নেই।
তোর এখনো আঠার বছর হয়নি। মুরব্বির মতো কথা বলিস না।
আঠার বছর হতে হতে বাকি নেই বেশিদিন। বাদ দে এসব কথা, পরীক্ষার ফরম ফিলআপ করেছিস?
না। সামনের মাসে।
আমিও করব।
তুই করে কী করবি? এই শরীর নিয়ে পরীক্ষা দিবি কীভাবে?
সেটা আমার ব্যাপার। ফরম পাঠিয়ে দিস আমার কাছে। পূরণ করে দেব। পরীক্ষার বিষয়টা মাথায় থাকলে দ্রুত সময় কাটবে। তবে এটা সত্য, শরীরটা ভালো না। মাঝে মাঝে তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। তখন পেইনকিলার খেতে হয়। অতিরিক্ত পেইনকিলার নাকি বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর। তাই খেতেও পারি না বেশি। সহ্য করতে হয় ব্যথাটা!
ঠিক আছে, তুই যা ভালো মনে করিস। আজ তাহলে আসি। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবি। মনে রাখবি, আমি তোর পাশে ছিলাম, আছি এবং থাকব।
শান্তা উঠে গেলে জেসমিন ওষুধ হাতে নিল। তার পেটের ব্যথাটা আবার বাড়ছে। কেন যেন এখন তার হঠাৎ ভয় ভয় করছে, তার ধারণা ব্যথাটা বড় কষ্ট দেবে আজ। এত কষ্ট যা আগে সে কখনো ভোগ করেনি!
*
ডাক্তার তরফদার হাডসন হিল থেকে সরাসরি এসেছেন কক্সবাজার সদর থানায়। তিনি ডাক্তার হাডসনের শেষ পরিণতির দিকে মনোনিবেশ করতে চাচ্ছেন না। কিন্তু মন তাকে বারবার টেনে নিচ্ছে ডাক্তার হাডসনের দিকেই। তার কেন যেন মনে হচ্ছিল আজই তিনি উখিয়া থানার সাহায্য নিয়ে হাডসন হিলের উপরে উঠবেন, তারপর মাটি খুঁড়ে দেখবেন সত্যি ডাক্তার হাডসনের দেহাবশেষ ওখানে আছে কি না। উখিয়া থানায় যাওয়ার কারণ, হাডসন হিল এলাকাটা পড়েছে উখিয়া থানার মধ্যে। পরে অনেক কষ্টে ইচ্ছেটাকে নিয়ন্ত্রণ করে ফিরে এসেছেন কক্সবাজারে। এখন আছেন সদর থানায়।
ওসি সাহেবের নাম আনিসুর রহমান। শরীরটা তার বেশি শুকনা। তবে কাজেকর্মে তৎপর, প্রাথমিক কথাবার্তায় স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন ডাক্তার তরফদার। রেইনবো রেইন হোটেলের ২২১ নম্বর কক্ষের কথা বলতেই তিনি বললেন, আপনি কি ঐ রুমে থাকছেন স্যার?
হ্যাঁ।
আপনি কি নিজেই নিয়েছেন রুমটা, নাকি ওরা দিয়েছে?
আমি নিজেই নিয়েছি।
ঐ রুমটা তো হোটেল মালিকের ছেলের ব্যবহারের জন্য। কী যেন নাম, হ্যাঁ মনে পড়েছে বাশার। বড় বদ ছেলে। নারী-মদ নিয়ে ফুর্তি করত ঐ রুমে। পরে আর কী, ধরা খেল, মামলা হলো, এখন জেলে।
কতদিন থাকবে জেলে?
বেশি দিন থাকবে বলে মনে হয় না। বাদীর সাথে আপস করে ফেলেছে শুনেছি। তবে আমরা চার্জশিট দিয়ে দিয়েছি।
বাদী আপস করল কেন?
হিসাবটা খুব সোজা স্যার। বাদী সুবিধার মেয়ে ছিল না। বুঝতেই পারছেন কী বলতে চাচ্ছি। সোজা কথায় কলগার্ল বা পতিতা। বাশার মাঝে মাঝেই ঐ রুমে কলগার্লদের নিয়ে যেত, আমোদ-ফুর্তি করত। ঐ মেয়ের সাথে পেমেন্ট নিয়ে গন্ডগোল হয়েছিল। ব্যস, মেয়ে দিয়েছে ধর্ষণের মামলা করে। তাতে নিজের অপকর্মে নিজেই ফেঁসে গেছে বাশার। শেষে আর কী করবে, মেয়ের সাথে টাকার বিনিময়ে সমঝোতায় এসেছে। সম্ভবত তাড়াতাড়ি জামিন পেয়ে যাবে। আর মেয়ে টাকা পেয়ে যদি কোর্টে সাক্ষী না দেয় কিংবা তার বুঝার ভুল হয়েছে বলে বক্তব্য দেয়, কোর্টের পক্ষে তখন শাস্তি দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তবে বাশারের শাস্তি পাওয়া উচিত। কারণ তার মনের মধ্যে শুধু কুচিন্তা। ২২১ নম্বর রুমের দরজার দুই পাল্লার উপরের দিকে দুটো ঘোলা বা অস্বচ্ছ কাঁচ আছে দেখবেন। ডান পাশের কাঁচটা এমনভাবে লাগানো ছিল যে ধাক্কা দিলে নিঃশব্দে খুলে যায়। তখন যে কেউ ওখান দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ছিটকিনি খুলে ফেলতে পারবে। কী ভয়ংকর পরিকল্পনা, ভাবতে পারছেন? ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি নিজে ঐ কাঁচ স্থায়ীভাবে লাগানোর ব্যবস্থা করেছি। আসলে হোটেল ব্যবসার সাথে অনৈতিক ব্যবসা এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে একটা আর-একটা ছাড়া যেন চলে না।
এমনকি হতে পারে যে দরজার ঐ কাঁচ সরিয়ে ছিটকিনি খুলে আগেও সে কোনো অপকর্ম করেছে।
হতেই পারে। হয়তো আমাদের কাছে রিপোর্ট হয়নি। বাশার না করলেও হোটেলেও অন্য কেউ করতে পারে অপকর্ম।
আপনারা হোটেল বা করে দিচ্ছেন না কেন?
হোটেল বন্ধ তো সমাধান না স্যার। এক হোটেল বন্ধ হলে অন্য হোটেলে শুরু হবে এই অপকর্ম। তা না হলে ফ্ল্যাট বাড়ি ভাড়া করবে। আসলে এগুলোর একটা স্থায়ী সমাধান দরকার। একজনের টাকা আছে, সে খরচ করবে, অন্যজনের টাকা প্রয়োজন, সে সবকিছুর বিনিময়ে টাকা নেবে। সামাজিক চাহিদা এবং সরবরাহের এই হিসাবনিকাশ বন্ধ করা বড় কঠিন। বাশারকে গ্রেফতার করার পর আমরা রেইনবো রেইন হোটেল সিলগালা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কোর্টের অর্ডার নিয়ে সাত দিন পর আবার খুলেছে মালিক। তবে এখন মালিকপক্ষ অনেক সতর্ক। হোটেলে যেন আর কোনো অপকর্ম না ঘটে সে বিষয়ে সবসময় সজাগ থাকে তারা। আমরা সর্বত্র সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টাও করে যাচ্ছি।
ডাক্তার তরফদার ওসি সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে হোটেলে ফিরে এলেন। তারপর লম্বা একটা ঘুম দিলেন। হোটেলে সালাম ড্রাইভারের জন্যও একটা রুম রেখেছেন তিনি। সালামের সাথে বসে রাতের খাবার খেলেন। তারপর এলেন ২২১ নম্বর কক্ষে। পরীক্ষা করে দেখলেন সত্যি দরজার উপরের অংশ ঘোলা কাঁচের। ধাক্কা দিয়ে বুঝতে পারলেন সরানো সম্ভব না কাঁচটা, তবে আগে সম্ভব হতো। সেক্ষেত্রে হাত দিয়ে দরজা খোলা কঠিন হতো না কারো জন্য। রাতে যদি কোনো নারীকে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়, তাহলে এই ঘরে প্রবেশ করে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করা অসম্ভব কিছু নয়। জেসমিনের সাথে ঐরকম কিছু ঘটতে পারে। কারণ পরের দিন তার তলপেটে ব্যথা হয়েছিল। নাজমুল হোসেন জানিয়েছেন, কক্সবাজার ভ্রমণের সময়ই তলপেটে ব্যথা শুরু হয় জেসমিনের। সবকিছু কীভাবে যেন মিলে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষটা কে? হোটেল বয়, নাকি বাশার। বাশার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ এই কক্ষের সবকিছু তার নিজের হাতে করা। কক্ষটা আবার সে দোতলায় রেখেছে যেন প্রয়োজনে পিছনের বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে পালানো যায়। ভয়ংকর এই বিষয়টা প্রমাণের এখন একমাত্র উপায় সিসি ক্যামেরা। হোটেলের প্রবেশ পথ এবং করিডোরে সিসি ক্যামেরা আছে। এতদিন আগের ভিডিও ফুটেজ থাকার কথা নয়। তারপরও যদি থাকে, এই আশায় ডাক্তার তরফদার উদিমকে ডাকলেন। উদিম বলল, হোটেলের সব জায়গায় সিসি ক্যামেরা আছে স্যার। তবে…
তবে কী?
লাগানো হয়েছে মাত্র দুই মাস আগে। কিন্তু আপনি যে তারিখের কথা বলছেন সেটা তো ছয়-সাত মাস আগের।
হ্যাঁ।
ঐ সময় তো সিসি ক্যামেরা ছিল না স্যার!
ও আচ্ছা।
একটু থেমে ডাক্তার তরফদার আবার বললেন, এই কক্ষের বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যায়। সত্যি সুন্দর। কিন্তু আমার মন যেন ভরছে না। আমি সমুদ্রের পাড়ে বসতে চাই। এত রাতে কি যাওয়া যাবে?
স্যার আপনি চাইলে আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারব। তবে…
আবার তবে কেন?
নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে। অবশ্য ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ শুরু করার পর থেকে ছিনতাই কমে গেছে। রাতে ওদের টহল পার্টি থাকে। যদিও পুলিশ কাউকে রাত দশটার পর বিচে থাকতে দেয় না, আমি অনুরোধ করলে থাকতে দেবে। ট্যুরিস্ট পুলিশের ইন্সপেক্টর স্যার আমার পরিচিত।
তুমি তাই করো।
ঠিক আছে স্যার। আর কিছু লাগবে? কোনো খাবার বা ড্রিংকস!
তুমি ইচ্ছে করলে আমাকে গরম কফি দিতে পার। বহুদিন কফি খাই না। কফি বানানোর মেশিন আছে তোমাদের?
জি স্যার আছে। আপনি কি নিয়মিত কফি খান?
আগেই বলেছি বহুদিন ভালো কফি খাওয়া হয় না। আজ খাব। খেতে ইচ্ছে করছে। আসলে কি জানো, হঠাৎ হঠাৎ মন এমন কিছু পেতে চায় যেগুলো পাওয়া অনেক কষ্টের। মনের চাওয়াটা যদি বৈধ হয়, কষ্ট হলেও অর্থ খরচ করে মাঝে মাঝে এই চাওয়াটাকে পাওয়ায় রূপান্তরিত করতে হয়। এতে যে মানসিক তৃপ্তি পাওয়া যায় তা একেবারেই স্বর্গীয়।
বুঝতে পেরেছি স্যার।
উদিম চলে গেলে ডাক্তার তরফদার বারান্দায় এলেন। তারপর তাকালেন সমুদ্রের দিকে। তিনি অনুধাবন করছেন, এই বারান্দাটা অসম্ভব সুন্দর, অথচ সংলগ্ন কক্ষটাতেই ঘটেছে সবচেয়ে অসুন্দর ঘটনা। কক্ষটার দিকে ফিরে এবার তিনি বিড়বিড় করে বললেন, পৃথিবীতে সকল সুন্দরের মাঝে একটা অসুন্দর থাকে, একটা খুঁত থাকে, একটা কষ্ট থাকে। পরিপূর্ণ, নিখুঁত আর চিরস্থায়ী সুন্দর বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই।
*
দুপুর তিনটা।
জেহান চোখ বুজে পড়ে আছে বিছানায়। ভালো লাগছে না তার। আজ ছিল জেসমিনের জন্মদিন, অথচ জেসমিনের সাথে তার দেখা হয়নি। কী অবিশ্বাস্য! প্রত্যেক বছর সে জেসমিনের জন্মদিনে জেসমিনকে চকলেট দেয়। আজ পারল না। এজন্য খুব খারাপ লাগছে, একই সঙ্গে অস্থিরতা তাকে যেন পাগল করে ফেলছে সকাল থেকে। এই সবকিছুর জন্য দায়ী রাশেদ। রাশেদ ভয়াবহ গুজব ছড়াচ্ছে। সব জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে জেসমিনের সন্তানের বাবা হলো জেহান। যদিও কেউ বিশ্বাস করছে না, কিন্তু আলোচনা তো হচ্ছে সর্বত্র। আর প্রমাণস্বরূপ তার মানিব্যাগে থাকা জেসমিনের ছবির কথা তো বলছেই।
দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকাল জেহান। জেসমিন দাঁড়িয়ে আছে। হুড়মুড় করে বিছানা থেকে উঠল সে। চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, আ…আ…আপু তুমি!
চারপাশে চোখ বুলাল জেসমিন। তারপর বলল, তোমাকে দেখতে এলাম।
আ…আমি তো কল্পনাও করতে পারছি না!
হ্যাঁ, অনেক দিন আগে এসেছিলাম তোমাদের বাড়িতে। তারপর আর আসা হয়নি।
বসো, বসো।
না, বসব না।
কেন?
আসলে বাড়িতে ভালো লাগছিল না। তাই বের হয়েছি। খালাম্মার সাথে কথা বলছিলাম এতক্ষণ। এখন চলে যাচ্ছি।
আমি চা দিতে বলব?
না, খালাম্মাও জিজ্ঞেস করেছিলেন, চা খাব না। ভাবলাম তোমার সাথে দেখা হয় না বেশ অনেকদিন। আজ না হয় দেখা করে যাই। তুমি আসো না কেন আমাদের বাড়িতে?
ইয়ে… মানে…তু…তুমি অসুস্থ।
তাতে কী? তুমি জানো আমি তোমাকে পছন্দ করি। সময় পেলে চলে আসবে। দুজনে গল্প করব।
জি আপু, অবশ্যই আসব।
আর… হ্যাঁ আপু।
আমি জানি, আমাকে নিয়ে তুমি অনেক ভাবো, অনেক চিন্তা করো। এত ভাবাভাবির দরকার নেই। আমি ভালো আছি। আমার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তুমি ভালোমতো পড়াশুনা করো। আসি জেহান।
জেহানকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে গেল জেসমিন।
জেহানের খুব ইচ্ছে ছিল জেসমিনের সাথে আরো কিছুক্ষণ গল্প করার। কিন্তু পারল না। আসলে জেসমিন যে তার ঘরে আসবে কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। আজ জেসমিনকে বেশি সুন্দর লাগছিল, কারণটা কী সে জানে না। এজন্যই হয়তো তার কথা বলার আগ্রহটাও বেশি ছিল।
আবার খাটে এসে শুয়ে পড়ল জেহান। হালকা মাথা ব্যথা করছে। চোখ বন্ধ করল সে। ভাবল, কিছুক্ষণ এভাবে নিরিবিলি শুয়ে থাকবে, তাতে যদি মাথা ব্যথা কমে। হঠাৎই চুলে আলতো স্পর্শ অনুভব করল। চোখ খুলে দেখে তার মা বসে আছেন পাশে। জেহান চোখ খুলতে মরিয়ম বললেন, কী হয়েছে তোর?
জেহান খানিকটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, না মা, কিছু না।
তাহলে এই অসময়ে শুয়ে আছিস যে!
জেহান ঘড়ি দেখল। সন্ধ্যা সাতটা বাজে। দুপুরে শোয়ার পর এত লম্বা ঘুম তার হয় না। আর জেসমিনের তার ঘরে আসার ব্যাপারটা যে ছিল স্বপ্ন এতক্ষণে যেন অনুধাবন করল সে।
কথা বলছিস না কেন?
জেহান উঠে বসে মাথা ঝাঁকি দিল। তারপর বলল, এই তো কথা বলছি মা।
তোর আঙুলের কী অবস্থা?
ব্যথা নেই এখন।
আর কখনো রাশেদের সামনে যাবি না। ছেলেটা বড় বজ্জাত।
ঠিক আছে মা, যাব না।
উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নে। এই অসময়ে ঘুমানো ঠিক না। তোর নাস্তা কি পাঠিয়ে দেব এখানে?
হ্যাঁ মা, দাও।
মরিয়ম উঠে চলে গেলেন। জেহান হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখে নাস্তা রেখে গেছে তার মা। কিন্তু তার নাস্তা খেতে ইচ্ছে করছে না। মনটা বড় অস্থির অস্থির লাগছে। তার ঘরের জানালা দিয়ে জেসমিনদের বাড়ি দেখা যায়। সে জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল জেসমিনদের বাড়ির দিকে। কিন্তু না, দেখা গেল না জেসমিনকে। এখন একেবারেই ঘর থেকে বের হয় না জেসমিন। বড় একা হয়ে গেছে সে, কেউ নেই তার পাশে। ভাবতেই বুকটা হুহু করে উঠল জেহানের। তার খুব ইচ্ছে করছে জেসমিনের জন্য কিছু একটা করার। কিন্তু কী করবে? আর কীভাবেই বা করবে? রাশেদ তার সর্বনাশ করছে। তাকে আর জেসমিনকে নিয়ে কুৎসা রটাচ্ছে। নিশ্চয় এই কথা খালাম্মা মানে জেসমিনের মায়ের কানে গেছে। সেক্ষেত্রে তিনি কী ভেবেছেন, তা আর কল্পনা করতে চাচ্ছে না জেহান।
জেহান মুক্তোর মালাটা বের করল। এখনো দিতে পারেনি। জেসমিনকে। ঠিক করল আজ সে মালাটা জেসমিনকে দিবেই দিবে, যা থাকে কপালে। এরকম একটা ভাবনা থেকে জেসমিনদের বাড়িতে এলো না সে। কিন্তু পাওয়া গেল না জেসমিনকে। ডাক্তারের কাছে গেছে, জানাল জয় আর জনি।
জেহান আবার ফিরে এলো তার ঘরে। তারপর চেয়ারে বসে টেনে নিল ডায়ারিটা। লিখতে শুরু করল,
প্রিয় জেসমিন,
আজ তোমার জন্মদিন। অথচ আমি তোমাকে শুভেচ্ছা জানাতে পারলাম না। মুক্তোর মালাটাও দেয়া হলো না তোমাকে। জানি না, এই জীবনে আর দিতে পারব কি না। আসলে পৃথিবীটা বড় অদ্ভুত, উপহার দিতে চাইলেও পছন্দের মানুষকে অনেক সময় উপহার দেয়া যায় না। তোমাকে আসলেই কিছু দিতে পারলাম না। না দিতে পারলাম উপহার, না দিতে পারলাম মন। একটা সত্য কি জানো, প্রিয়জনকে উপহার দিতে না পারার ব্যর্থতাটা ভয়ংকর কষ্টের। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় শেষ পর্যন্ত আমি ব্যর্থ হব না। একদিন না একদিন তুমি আমার ভালোবাসা বুঝবে এবং ফিরে আসবে আমার কাছে। আমি শুধু তোমাকে চাই, শুধুই তোমাকে। এজন্যই আমি অপেক্ষা করব বছরের পর বছর। তোমার জন্য অপেক্ষা করতে আমার কষ্ট হলেও ধৈর্যহারা হবো না। প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা একই সাথে কষ্টের এবং আনন্দের। আনন্দের এ কারণে যে এই অপেক্ষার মধ্যে থাকে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির স্বপ্ন। ডাক্তার তরফদার স্যারের একটা কথা কি জানো, তিনি বলেছিলেন, ধারাবাহিক সুখ প্রকৃত সুখ উপলব্ধির তৃপ্তি দেয় না, মাঝে মাঝে দুঃখ থাকতে হয়, দুঃখের পর সুখটা হয় বড় তৃপ্তির আর পরিপূর্ণ উপভোগের। এজন্য পৃথিবীটা সুখ আর দুঃখে ভরা। সুখ-দুঃখের মালাটা একবার সুখ একবার দুঃখ, এভাবেই গাথা। তবে আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। আমার মালাটা শুধু দুঃখেরই। অবশ্য যখন সুখের সময়টা আসবে তখন তোমাকে নিয়ে আমি সুখী হব, লম্বা সময়ের জন্য। আমাদের সুখটা হবে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সুখ। আর যদি কোনো কারণে তোমাকে না পাই, মনে রেখো, তোমাকে হারানোর সাথে সাথে আমিও হারিয়ে যাব। এটাই সত্য যে, তুমি যেদিন হারাবে আমার কাছ থেকে, আমি সেদিন হারাব এই পৃথিবী থেকে সুখে থেকো, শান্তিতে থেকো, হে প্রিয়তমা। শুভ জন্মদিন।
তোমারই
জেহান
সাধারণত চিঠি শেষ করার পর জেহান নিজের মধ্যে প্রশান্তি অনুভব করে। কিন্তু আজ করছে না। তার অস্থিরতা বাড়ছে তো বাড়ছেই। একটা পর্যায়ে সে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। ঘরের দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
*
ডাক্তার তরফদার ঘুম থেকে উঠলেন সকাল সাড়ে নয়টায়। সাধারণত এতক্ষণ পর্যন্ত তিনি ঘুমান না। আজ ঘুমিয়েছেন, কারণ সারারাত তিনি ইন্টারনেটে প্রেগন্যান্সির উপর পড়াশুনা করেছেন। যদিও তিনি ডাক্তার, গাইনির আধুনিক বিষয়গুলো সম্পর্কে তিনি অতটা অবহিত নন। তবে এটা সত্য, এক রাতের পড়াশুনায় বহুকিছু জানতে এবং শিখতে পেরেছেন তিনি। শিক্ষার কোনো শেষ নেই, শিক্ষার কোনো বয়স নেই এই সত্যটা যেন আবারও উপলব্ধি করলেন।
সকালে নাস্তা শেষ করে ফোন করলেন জেসমিনের বাবা নাজমুল হোসেনকে। ফোন ধরতেই জানতে চাইলেন জেসমিনের অবস্থা। নাজমুল হোসেন বললেন, ভালো না স্যার, সারাদিন ঘরের মধ্যে বসে থাকে আর কী যেন ভাবে।
ডাক্তার কী বলল?
হিউম্যানিটি ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার পাইনি। নার্স দেখেছে। বলল, গর্ভের বাচ্চা যথেষ্ট বড় হয়েছে। নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করতে হবে। আর সিজার করে বের করতে হবে বাচ্চাকে। কিন্তু…
কিন্তু কী?
আমি সিজার করাতে চাচ্ছি না। সিজার করলে পেটে একটা দাগ থেকে যাবে, সারাজীবন ঐ দাগটা কষ্ট দেবে আমার মেয়েকে।
সন্তান যদি জন্ম নেয় সন্তান তো সামনেই থাকবে, দাগ কী কষ্ট দেবে?
আসলে স্যার আমার কথা বলার মতো অবস্থা নেই। এমন যদি হতো সন্তানটা জন্ম না হতো তাহলে সবচেয়ে খুশি হতাম বোধহয়। আর ঐ সন্তানের বাবা কে, তাও তত বের করতে পারলাম না। কী ভয়ংকর! এর মধ্যে আমার এক বন্ধু আমেরিকা থাকে, প্রস্তাব পাঠিয়েছে তার ছেলের জন্য আমার মেয়েকে বউ হিসেবে নিতে চায়। কীভাবে যেন জেসমিনের আগের একটা ছবি জোগাড় করেছে। খুব পছন্দ করেছে জেসমিনকে, এজন্য ফোন করেছে। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! তাকে কি বলা যাবে যে আমার মেয়ে গর্ভবতী, তার পেটে সন্তান আছে!
একটু ধৈর্য ধরুন। আশা করি সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে। আমার কী মনে হয় জানেন?
কী মনে হয়?
এমন একটা সমাধান আপনারা পাবেন যা আপনাদের সকল দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেবে। আগামীকাল জেসমিনকে ঢাকা নিয়ে যাবেন। আমি একজন ডাক্তারের ঠিকানা দিচ্ছি, নাম নুসরাত জাহান। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা গাইনির ডাক্তার এবং আধুনিক ধ্যান-ধারণাসম্পন্ন। সে কিছু পরীক্ষা করবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেব আমরা।
ঠিক আছে স্যার।
জেসমিন কি এখন কারো সাথেই কথা বলে না?
ছোট দুই ভাইয়ের সাথে কথা বলে মাঝে মাধ্যে। আর ওর মাকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। সত্যি কথা বলতে কি আমার নিজের ভয় করে জেসমিনের সামনে যেতে। মানসিকভাবে একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছি।
আপনার দুই ছেলের নাম যেন কী?
জয় আর জনি।
চমৎকার। ওরা তো জমজ। তাই না?
হ্যাঁ।
ওদেরকে বলবেন যেন জেমসিনের সাথেই বেশি সময় কাটায়।
আচ্ছা।
আমি এখন তাহলে রাখছি। আপনি যেভাবেই পারেন ডাক্তার নুসরাত জাহানের কাছে নিয়ে যাবেন জেসমিনকে। গিয়ে আমার কথা বলবেন। সিরিয়াল লাগবে না। আমি আপনার মোবাইলে ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি। ভালো থাকবেন। আর আমি সবকিছু বলে দিয়েছি নুসরাত জাহানকে।
ডাক্তার তরফদার অতঃপর এলেন উখিয়া থানায়। ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে সবকিছু খুলে বললেন ওসি সাহেবকে। ওসি সাহেব বললেন, ডাক্তার হাডসনের বিষয়টা তো অনেক পুরোনো ব্যাপার।
থানায় কি কোনো ডকুমেন্ট আছে?
না। সবকিছু তো পাকিস্তান আমলের। ঐ সময়ের কোনো ডকুমেন্ট সংরক্ষিত নেই।
আমি চাচ্ছি ডাক্তার হাডসনের মৃতদেহটা কবর থেকে উত্তোলনের জন্য।
বিষয়টা রহস্যময়। আমার নিজেরও আগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে ঘটনার সত্যতা কতটুকু, এ বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।
আমার সন্দেহ নেই। ইরফান আলী আজ বয়োবৃদ্ধ, এই বয়সে এসে তার মিথ্যা তথ্য উপস্থাপনের কোনো যুক্তি দেখছি না। আমি কাজটা একাই করতে পারতাম, হয়তো মাটি খুঁড়তে দুইজন দিনমজুর লাগত। কিন্তু যেহেতু বিষয়টি হত্যা, বিদেশি ব্যক্তি এবং পাহাড়ি এলাকায় সংগঠিত, এজন্য আপনার সহায়তা চাচ্ছি। জিজ্ঞেস করতে পারেন আমার উদ্দেশ্য কী? সোজা কথায় বলব একটি সত্যকে উদ্ঘাটন করতে চাচ্ছি এবং সাধারণ মানুষকে সত্যটা জানাতে চাচ্ছি।
ওসি সাহেব এতক্ষণ সামনে ঝুঁকে ছিলেন। এবার সোজা হয়ে বসে বললেন, ঠিক আছে স্যার, পুলিশ আপনার সাথে থাকবে। আপনি কখন কাজ শুরু করতে চান?
আজকে, এখনই।
আমি বলে দিচ্ছি আমার একটি টিমকে। আপনার সাথে থাকবে, আর আমিও আসব কিছুক্ষণ পরে। স্থানীয় একজন ভিডিও এবং ক্যামেরাম্যানকে বলে দিচ্ছি। তারা সবকিছু ভিডিও করবে। যেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর, এজন্য চাচ্ছি সবকিছুর ভিডিও হোক।
আমিও চাই। ধন্যবাদ আপনাকে।
ডাক্তার তরফদার দশ মিনিটের মাথায় পাঁচজন পুলিশের একটা দল নিয়ে রওনা দিলেন হাডসন হিলের উদ্দেশে। দেড় ঘণ্টা পর পৌঁছালেন হাডসন হিলে। আগেই খবর দিয়ে রেখেছিলেন ইরফান আলীকে। এক নাতিকে নিয়ে তিনি এসেছেন। বসে আছেন একটা গাছের নিচে। ডাক্তার তরফদার দুজন দিনমজুরকে নিয়ে উঠতে শুরু করলেন পাহাড়ের উপর। পথটা সত্যি ঝুঁকিপূর্ণ। তার শরীর যেন পেরে উঠছে না। তারপরও তিনি উঠার চেষ্টা করছেন। তাকে সাহায্য করছে পুলিশের দলটি। মানুষের চলাচল এই পথে যে কম বোঝা যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে কিছু কিছু টুরিস্ট উপরে উঠে মাত্র। একটা জায়গায় পথটা বেশ খাড়া হয়ে উপরে উঠে গেছে। আসলে এটা খাড়া একটা পাথর। একজন কনস্টেবল তাকে টান দিয়ে উপরে উঠিয়ে নিল। অন্যরাও উঠল একইভাবে। ভিডিওম্যান কামরুল বেশ সাহসী। সে একেবারে ঢালে ঝুঁকে, শুয়ে, বসে ভিডিও করছে। ভাবখানা এমন যেন সে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের জন্য একটা ডকুমেন্টারি বানাচ্ছে।
অবশেষে হাডসন হিলের উপরে উঠতে পারল সবাই। ছোট-বড় নানা আকারের পাথর রয়েছে উপরে। পশ্চিম পাশে দেখা গেল লাল, সাদা, ধূসর, খয়েরি, হলুদ রঙের অনেক পাথর। কেন এই জায়গাটাকে স্টোন গার্ডেন বলা হয় অনুধাবন করলেন ডাক্তার তরফদার। স্টোন গার্ডেনের ঠিক মাঝে লাল পাথরের একটা চত্বর। চারপাশে তিনটা খুঁটিও আছে। একটা ভেঙে গেছে। সম্ভবত এই খুঁটির উপরে ছাউনি তৈরি করা ছিল, অনুমান করলেন ডাক্তার তরফদার। তখন দেখতে দূর থেকে একটা কুঁড়েঘরের মতো মনে হবে। কুঁড়েঘরের ইংরেজি হাট (Hut)। এজন্য এই জায়গাটাকে বলা হতো রেড হাট, অর্থাৎ ভালোবাসার কুটির। লাল বড় পাথরটাকে বলা হতো লাভ স্টোন। আজ নিচ থেকে উপরে উঠার আগে ইরফান আলী রেড স্টোন আর রেড হাটের কথা বলেছেন তাকে।
পাহাড়ের উপরের অংশটা খুব বড় নয়, তিন হাজার স্কয়ার ফুটের মতো হবে। প্রায় সম্পূর্ণ চূড়াটাই পাথরে ঢাকা। শতবর্ষী সেগুন গাছ আছে তিনটা। ডাক্তার তরফদার একেবারে দক্ষিণে চলে এলেন। একটা জায়গায় তার মনে হলো কোনো পাথর নেই। ইরফান আলীর কথা মিলে যাচ্ছে। দিনমজুরদের ইশারা করতেই মাটি খুঁড়তে শুরু করল তারা। হাত তিনেক খোঁড়ার পরই পাওয়া গেল মাঝারি আকৃতির কয়েকটি পাথর। পাথরগুলো সরানোর পর দেখা গেল মানব হাড়ের অবশেষ। মুহূর্তেই খাড়া হয়ে গেল ডাক্তার তরফদারের শরীরের সবকটি লোম। ওসি সাহেব কিছুক্ষণ আগে এসেছেন, তারও একই অবস্থা। অকল্পনীয় একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে!
প্রায় পয়ষট্টি বছর আগে ডাক্তার হাডসনের দেহ মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। এখন অবশিষ্ট আছে কঙ্কালের কিয়দংশ। খুলিটা কোনোরকম বোঝা যায়। একটা লকেট পাওয়া গেল। সোনার তৈরি। ডাক্তার তরফদার হাতে নিয়ে বললেন, এই লকেটটার কথাই সম্ভবত বলেছিলেন ইরফান আলী।
লকেটের দুটো অংশ। জোরে টান দিতে খুলে গেল। নিচের দিকে লেখা ‘হাডমিন’। লেখার উপরে দুপাশে দুটো ছবি, হলুদ হয়ে গেছে অনেকটা, তবে চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ডাক্তার তরফদার আর দেরি করলেন না, দ্রুত নিচে নেমে এলেন। তার সাথে ওসি সাহেবও এলেন। ইরফান আলীকে দেখানোর সাথে সাথে তার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এলো। আবেগঘন কণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ, এ…এই… তো আমাদের সবার প্রিয় ডাক্তার হাডসন আর তার স্ত্রী এলিজা।
*
জেসমিন আর ডাক্তার হাডসন কোকোনাট হিলে পাশাপাশি দুটো পাথরে বসে আছে। হালকা বাতাসে চুল উড়ছে জেসমিনের। মন কিছুটা হলেও বিষণ্ণ তার। ডাক্তার হাডসন বললেন, কী হয়েছে তোমার জেসমিন?
আমি চূড়ান্তভাবে মনস্থির করেছি যে তোমার এখানে চলে আসব।
আমিও চাই তুমি চলে আসো। আগেও বলেছি এ কথা।
চিকিৎসার নামে আজ আমাকে ঢাকা নিয়ে গিয়েছিল বাবা। ডাক্তারের নাম নুসরাত জাহান। বেশ কিছু টেস্টও করাল। আমি যেতে চাইনি। অনেকটা জোর করে নিয়ে গেছে। আমার ধারণা আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবে ডাক্তার নুসরাত।
এমন মনে হওয়ার কারণ কী?
আমি জানি না। অবচেতন মন বলছে। আসলে কেউই চাচ্ছে না বাচ্চাটার জন্ম হোক, শুধু তুমি ছাড়া।
আমাদের সন্তান অবশ্যই পৃথিবীর আলো দেখবে।
তোমার হাতে আমাদের সন্তান প্রথম পৃথিবীর আলো দেখুক, আমি এরকমই চাই। এজন্যই আমি চলে আসব তোমার কাছে।
ডাক্তার হাডসন জেসমিনের মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে বললেন, আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। তবে এখানে এলে তোমার কিন্তু কিছুটা কষ্ট হবে।
তোমাকে তো পাব!
মৃদু হাসলেন ডাক্তার হাডসন। বললেন, আমি এ কথাটাই শুনতে চাচ্ছিলাম তোমার কাছ থেকে। কখন রওনা দেবে?
শেষ রাতে। প্রথমে বাড়ি থেকে যাব সায়েদাবাদ। সেখান থেকে বাসে করে আসব কক্সবাজার।
আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
সমস্যা হবে না। মনে জোর আছে আমার। কক্সবাজার এসে একটা গাড়ি নিয়ে সরাসরি এখানে চলে আসব।
ঠিক আছে। কাপড়চোপড় গুছিয়েছ?
হ্যাঁ। বেশি কিছু আনব না।
অল্প হলেই হবে।
জেসমিন এবার ডাক্তার হাডসনের চোখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, আমাদের সন্তানের একটা নাম ঠিক করবে বলেছিলাম।
তুমি আসো, দুজনে একসাথে করব।
তুমিই করো।
না, দুজনে মিলে করব। ছেলে না মেয়ে হবে এখনো জানি না। তোমার কী ইচ্ছে, ছেলে চাও, নাকি মেয়ে?
ছেলে-মেয়ে একজন হলেই হলো। তবে কোনোভাবেই আমি আমার প্রথম সন্তানকে হারাতে চাই না। এজন্যই তোমার কাছে চলে আসা। আমার আশেপাশে সত্যি সবাই চাচ্ছে যেন আমার সন্তান জন্মগ্রহণ না করে। আমি বাবা-মায়ের কথাও শুনতে পেয়েছি। মা বলছিল, আমাকে নিয়ে দুরে কোথাও চলে যাবে। তারপর সন্তান জন্ম হলে কাউকে দিয়ে আবার ফিরে আসবে এখানে।
তাতে লাভ কী?
লাভ-লোকসান আমি জানি না। আমি শুধু চাই তোমার আমার সন্তানকে জন্ম দিতে।
এই আশা অবশ্যই পূরণ হবে। চলো এগোই।
দুজনে হাঁটতে শুরু করল। রাতটা আজ পূর্ণিমার রাত। চারপাশে ভরা জোছনার আলো। সাগরের তীরে আছড়ে পড়া ঢেউগুলো চিকচিক করছে। সেই ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে জেসমিন বলল, আমার একটা ইচ্ছা আছে।
কী ইচ্ছা?
এখানে আসার পর আমি তোমার সাথে সাগরে গোসল করতে চাই।
কিন্তু আমি সাগরকে বড় ভয় পাই।
কেন?
সাগর বড় ভয়ংকর! মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষকে টেনে নিয়ে যায়।
আমি তোমার হাত ধরে থাকব। তোমার কাছ থেকে কেউ আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না।
কথাগুলো বলে হাডসনের বাহুতে মাথা রেখে ধীর-পায়ে হাঁটতে লাগল জেসমিন। মৃদু হাসলেন ডাক্তার হাডসন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, তুমি যেহেতু চাইছ অবশ্যই তোমাকে নিয়ে ঐ সাগরে গোসল করব আমি।
রাতটা হতে হবে পূর্ণিমার রাত।
তাই হবে।
জেসমিন এবার চোখ তুলে উপরের দিকে তাকাল। তবে ডাক্তার হাডসনকে সে আর দেখতে পেল না। প্রথমে খানিকটা চমকে উঠলেও পরে বুঝল সে ঘুম থেকে উঠেছে। আছে তাদেরই বাড়িতে। ঘড়ি দেখল। রাত সাড়ে চারটা বাজে। এরকমই একটা সময় তার উঠার ইচ্ছা ছিল। হাত-মুখ ধুয়ে বোরকা পরে নিল। বোরকার নিচে লাল শাড়ি। একটা ব্যাগ ঘুমানোর আগেই গুছিয়ে রেখেছিল। বাসা থেকে যখন সে বের হলো তখনো ফজরের আজান দেয়নি। কেন যেন নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এলো তার। বাবা-মা, ছোট ভাইদের ফেলে রেখে যেতে বড় কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই তার। নিজের সন্তানকে যে তার বাঁচাতেই হবে।
কেরানীগঞ্জ ব্যবসা কেন্দ্র। সারারাত এখানে গাড়ি চলাচল করে। একটা সিএনজি নিয়ে নিল জেসমিন। সমস্ত জীবনের সঞ্চয় এগারো হাজার টাকা তার সাথে আছে। এই টাকা দিয়ে সে কক্সবাজার চলে যেতে পারবে বলে তার বিশ্বাস। হাতে কিছু টাকাও থাকবে ওখানে পৌঁছানোর পর। একবার পৌঁছে গেলে আর সমস্যা হবে না। ডাক্তার হাডসন তার দায়িত্ব নেবেন। তখন দুজনে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবে। এরকম একটা ভাবনা তার মনে শক্তি জোগাচ্ছে।
সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে এসে নয় শ টাকা দিয়ে ঢাকা-কক্সবাজার সরাসরি বাসের একটা টিকিট কাটল। জানালার পাশে বসতে এক চিলতে রোদ এসে পড়ল তার কোলে। দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে, পৃথিবীটাকে যেন আজ তার কাছে মনে হচ্ছে বড় বেশি সুন্দর।
গাড়ি নারায়ণগঞ্জ পার হতে দুপাশে শুরু হলো ফসলের ক্ষেত। সিটে হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে প্রথমে সে দেখতে লাগল ক্ষেতগুলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আর ক্ষেত দেখা গেল না, শুধু সাগর। ঢেউগুলো এসে আছড়ে পড়ছে তীরে। কী সুন্দর! আর সেই ঢেউয়ের মাঝে হাত ধরাধরি করে ছুটছে সে আর ডাক্তার হাডসন। দুজনেই খুবই উচ্ছ্বসিত আর দারুণ আনন্দিত। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সকল সুখ বুঝি তাদের, শুধুই তাদের!
*
ডাক্তার তরফদার চট্টগ্রামে এসেছিলেন। কথা বলেছেন একজন বয়স্ক পাদ্রীর সাথে। ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন তিনি। যখন ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন তখনই ফোন পেলেন ডাক্তার নুসরাত জাহানের। ফোন ধরতে নুসরাত জাহান বললেন, আপনার অনুমানই সত্য স্যার।
ধন্যবাদ নুসরাত তোমাকে। এখন কী করতে হবে?
সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে দেখলাম দেরি করা ঠিক হবে না। অপারেশন করে বাচ্চাটাকে জেসমিনের পেট থেকে বের করে আনতে হবে। আপনি চাইলে আমি অপারেশন করে দিতে পারি।
তুমিই করো। ভালো হবে। জেসমিনের বাবা-মা কি জানে?
না, জানে না।
তুমি তাদেরকে জানিয়ে দাও। আমি কথা বলব এখনই।
ঠিক আছে স্যার।
ডাক্তার তরফদার ফোন কেটে দিয়ে যখন নাজমুল হোসেনকে ফোন করতে যাবেন তখন নাজমুল হোসেনেরই ফোন পেলেন। উৎকণ্ঠিত গলায় তিনি বললেন, স্যার একটা দুঃসংবাদ আছে।
কী দুঃসংবাদ?
জেসমিনকে সকাল থেকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না!
কী বলছেন আপনি!
জি স্যার। টেবিলে শুধু একটা চিরকুট লিখে রেখে গেছে, সেখানে লেখা, আমাকে ক্ষমা করো, আমি চলে যাচ্ছি আমার নীল চোখের ছায়ার কাছে।
ডাক্তার তরফদার চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বললেন, আপনি আত্মীয়স্বজন, ওর বান্ধবী আর পরিচিতজনের বাসায় খোঁজার চেষ্টার করুন। পুলিশকেও জানাতে পারেন। আর আমি কোনো তথ্য পেলে আপনাকে জানাব।
আমার ভালো লাগছে না। মাথা ঠিক নেই। জেসমিনের মা সকালে দাঁত লেগে পড়ে গেছে। এখন ঠিকমতো কথা বলছে না।
আশা করছি সব ঠিক হয়ে যাবে। বিপদ আসে চলে যাওয়ার জন্য। আতঙ্কিত না হয়ে সাহসিকতা এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে মোকাবেলা করাই দ্রুত বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অন্যতম উপায়। আশা করছি অতি শীঘ্র আপনাদের সকল বিপদ কেটে যাবে।
কথা শেষ করে ডাক্তার তরফদার ভাবতে শুরু করলেন। নীল চোখের ছায়া মানে কী বোঝাতে চাচ্ছে জেসমিন? নিশ্চয় স্বপ্নে যে ছায়া আসে তার কথা। এরকম ভাবতে ভাবতে তিনি সালামকে বললেন গাড়ি ঘোরানোর জন্য। তারপর ফোন হাতে তুলে নিলেন। তাকে এখন কয়েকটা ফোন করতে হবে।
গাড়ি যখন উলটো দিকে ছুটতে শুরু করেছে তখন রিং বেজে উঠল ফোনে। স্ক্রিনে নাম উঠছে হামিদের বোন হুশনার। হুশনা সাধারণত ফোন করে না। ফোন ধরতে হুশনা বলল, স্যার, হামিদ ভাইজান বড় পাগলামি করতেছে।
কী হয়েছে বলো।
চিৎকার কইরা হাত-পায়ের ছিকল খুইলা ফেলবার চাইতেছে।
কতক্ষণ হলো এমন করছে?
সারাদিন।
ডালিম দিয়েছিলে?
জি স্যার। কিন্তু খায় নাই।
মুখে কোনো কথা কি বলছে?
‘শিরিন শিরিন’ করতেছে স্যার। শিকল ধইরা টানাটানি করায় হাতের কব্জিতে রক্ত বাইর হইয়া আইছে। আমার আসলেই ভয় করতেছে।
ভয় পেও না। আমার বিশ্বাস কিছুক্ষণ পর সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি ঢাকার বাইরে আছি। তা না হলে দেখতে আসতাম হামিদকে। যত তাড়াতাড়ি পারি আমি আসব।
স্যার আমার মনটা খারাপ।
চিন্তা করো না। আল্লাহর কাছে দোয়া করো।
ঠিক আছ স্যার।
ডাক্তার তরফদার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বিকেল হয়ে গেছে। জেসমিন কোথায় আছে তিনি জানেন না। জেসমিনের ফোন নম্বরটাও তার কাছে নেই। থাকলে ফোন করতেন। একবার ভাবলেন ফোন নম্বরটা চেয়ে নেবেন নাজমুল হোসেনের কাছ থেকে। পরে সিদ্ধান্ত পালটালেন। কারণ ধারণা করছেন, জেসমিন ফোন বন্ধ করে রেখেছে।
এবার তিনি চোখ বুজলেন। গাড়ি ছুটে চলেছে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ তার কানে গানের সুর ভেসে এলো,
প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়’।
*
জেসমিন কক্সবাজার এসে পৌঁছাল সন্ধ্যা সাতটায়। এখন তাকে যেতে হবে হাডসন হিলে। মেরিনড্রাইভে বড় বাস না চলায় একটা বেবিট্যাক্সি ভাড়া করবে বলে ঠিক করল সে। কিন্তু অধিকাংশ বেবিট্যাক্সিই যেতে চাচ্ছে না। কক্সবাজারের মধ্যেই চলাফেরা করে বেবিট্যাক্সিগুলো। কয়েকজনকে বলার পর অবশেষে মাঝবয়সি একজন বেবিট্যাক্সিওয়ালাকে পেল। ড্রাইভারের গোঁফটা বেশি চওড়া, দেখলে কেমন যেন ভয় ভয় করে। কিন্তু কোনো উপায় নেই, একটা বেবিট্যাক্সি তাকে নিতেই হবে।
বেবিট্যাক্সিতে উঠার সময় খসখসে গলায় ড্রাইভার বলল, এই রাইতের বেলায় আপনে হাডসন হিলে যাইবেন ক্যান?
কাজ আছে।
জায়গা নির্জন। রাইতে একা যাওয়ার জন্য ভালা না। তাছাড়া আপনে মাইয়া মানুষ, বিপদে পড়বার পারেন।
না পড়ব না। ওখানে আমার পরিচিত ব্যক্তি রয়েছে।
নাম কী তার?
ডাক্তার হাডসন।
কী বলতেছেন এইসব! উনি তো বহুত আগে মইরা গেছে।
না মারা যাননি। উনি বেঁচে আছেন।
আপনের মাথা কি ঠিক আছে? কবে জানি শুনলাম যে তার হাড়গোড়ও পাওয়া গেছে পাহাড়ের উপর।
মৃদু হাসল জেসমিন। তারপর বলল, আপনে ভুল শুনেছেন। উনি বেঁচে আছেন। গত রাতেও তার সাথে আমার কথা হয়েছে।
জানি না কী কইতেছেন আপনে! যাইহোক, আমার দরকার পৌঁছায় দেওয়া, আমি আপনেরে পৌঁছায় দিতেছি। তয় আবারো কইতেছি যে, জায়গাডা নির্জন, এত রাইতে যাওয়া ঠিক হবে না।
কথা বলতে বলতে বেবিট্যাক্সির গতি বাড়িয়ে দিল ড্রাইভার। জেসমিনের এখন বেশ ভালো লাগছে। এতক্ষণ গভীর উৎকণ্ঠা ছিল তার মধ্যে। হঠাৎই যেন সেই উৎকণ্ঠা হারিয়ে গিয়ে ফুরফুরে একটা অনুভূতি জায়গা করে নিয়েছে মনে। শারীরিক দুর্বলতাও ছিল মারাত্মক। ঢাকা থেকে আসার পথে গাড়ি দুইবার রেস্টুরেন্টে থামলেও সে খেতে পারেনি। প্রথমবার বমি বমি ভাব ছিল। দ্বিতীয়বার তলপেটে ব্যথা হচ্ছিল। এখনো হচ্ছে ব্যথাটা, তবে সহনীয়। জেসমিন অনুধাবন করছে, আর মাত্র কিছুটা পথ, তারপরই সে পৌঁছে যাবে তার প্রিয়, অতি প্রিয় মানুষটির কাছে।
একপাশে সমুদ্র আর অন্যপাশে পাহাড়। মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেছে। মেরিন ড্রাইভ। খুব সুন্দর লাগছে চারপাশটা। আকাশের চাঁদটাও একেবারে যেন পরিপূর্ণ আজ। পূর্ণিমা কি না সে ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে জোছনা ছড়িয়ে আছে চারদিকে। আজ রাতটা যেন শুধুই জোছনা আর ভালোবাসার রাত।
রাস্তা একেবারে জনমানবশূন্য। উলটো দিক থেকে মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি আসছে। মাইক্রোবাসই বেশি, অধিকাংশই ফিরছে টেকনাফ থেকে, বুঝতে পারছে জেসমিন। আর সে যাচ্ছে তার প্রিয় মানুষের কাছে, যার কাছে থাকবে জীবনের বাকি সময়টা, বেঁচে থাকবে যার ভালোবাসার ছায়াতলে। এরকম একটা মুহূর্তের জন্যই ছিল তার প্রতীক্ষা, দীর্ঘ প্রতীক্ষা। সেই স্বর্গীয় শুভক্ষণের দোরগোড়ায় এখন সে। ভাবতেই নিজের মধ্যে অন্যরকম শিহরন অনুভব করছে।
হাডসন হিলের পাশে থামলে ভাড়া মিটিয়ে দিল জেসমিন। হাতে ব্যাগ তুলে নিতে ড্রাইভার বলল, আমি কি আপনেরে সাহায্য করব ম্যাডাম?
না, দরকার নেই।
ও আইচ্ছা।
কথাটা বলল ঠিকই, কিন্তু ট্যাক্সি টান দিল না ড্রাইভার। জেসমিন অবাক হয়ে বলল, চলে যাচ্ছেন না কেন?
ড্রাইভার বড় বড় চোখে বলল, ইয়ে মানে ভাবতেছি এই নির্জন স্থানে আপনে আবার কোনো বিপদে না পড়েন। শ্যাষে ঐ বিপদ আবার আমার ঘাড়ে আইসা না পড়ে।
না পড়বে না। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। মিষ্টি হেসে বলল জেসমিন।
ড্রাইভার আর অপেক্ষা করল না। বেবিট্যাক্সি টান দিল।
জেসমিনের নিজেকে হঠাৎই বড় নিঃসঙ্গ মনে হতে লাগল। ডানে বামে একটা গাড়িও এখন দেখা যাচ্ছে না, নেই কোনো মানুষও। সবুজ প্রকৃতিতে যেন শুধুই শূন্যতা। তবে এটা সত্য, আছে জোছনার পূর্ণতা।
জেসমিন উলটো ঘুরল। হাডসন হিলকে সে চিনতে পেরেছে। এখন সরু একটা পথ বরাবর দিয়ে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে পৌঁছে যাবে সমুদ্রের তীরে। বামে থাকবে প্রিয় হাডসন হিল।
ব্যাগ টানতে গিয়ে জেসমিন অনুভব করল, বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। অতিরিক্ত কষ্টে হালকা ঘামতে শুরু করেছে। আগে যেদিন এসেছিল পথটাকে তার এতটা দীর্ঘ মনে হয়নি আজ যতটা মনে হচ্ছে। পা দুটো যেন ভেঙে আসছে। চোখের সামনে হঠাৎ হঠাৎ ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু। তবে আশার কথা, পথ আর বেশি নেই।
সমুদ্রের পানি চোখে পড়তে শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল জেসমিনের, শক্তিও ফিরে পেল। দ্রুত হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগল হাডসন হিলের সামনে। তাকাল ডানে বামে। কোথাও দেখা যাচ্ছে না ডাক্তার হাডসনকে। খানিকটা অবাকই হলো। তার আশা ছিল ডাক্তার হাডসন রাস্তা থেকে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। এখানেও নেই ডাক্তার হাড়সন। উজ্জ্বল জোছনা থাকায় অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। শুধু দেখা যাচ্ছে না কাক্ষিত ডাক্তার হাডসনকে।
হাতের ব্যাগটা নিচে বালুর উপর রাখল জেসমিন। ঘেমে ভিজে গেছে শরীর, সৃষ্টি হয়েছে পানিশূন্যতার। ব্যাগে একটা বোতলে পানি ছিল। মুখে দিতে কিছুটা ভালো লাগল। কিন্তু মনের শূন্যতাটা যেন বাড়তেই থাকল। ধীর-পায়ে এবার সে এগিয়ে যেতে থাকল হাডসন হাউসের দিকে। বারবার। ডানে-বামে তাকাচ্ছে যদি হঠাৎ ডাক্তার হাডসনকে দেখা যায়। কিন্তু তার মনের আশা পূরণ হলো না। হাডসন হাউসের মধ্যে আলোর তীব্রতা একেবারে কম। তারপরও দেখা যাচ্ছে এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত। না নেই, কোথাও ডাক্তার হাডসন নেই। এবার বেশ ভীত হয়ে উঠল সে। ডাক্তার হাডসন থাকবেন না কেন? জেসমিনের ইচ্ছা হলো ‘হাডসন হাডসন বলে ডেকে উঠে। কিন্তু পরক্ষণে বাদ দিল চিন্তাটা। সে এতদিন ডাক্তার হাডসনকে কী বলে সম্বোধন করেছে ঠিক মনে করতে পারল না। মাথাটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, বাড়ছে পেটের ব্যথাটাও। এটা ভালো লক্ষণ না। ব্যাগে ওষুধ আছে, কিন্তু তার খেতে ইচ্ছে করছে না। সে অনুধাবন করল, ডাক্তার হাডসনের সাক্ষাৎ না পাওয়া পর্যন্ত স্থির হবে না মন।
জেসমিন বাইরে বের হয়ে এলো। তারপর উপরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, আমি এসেছি, তুমি কোথায়, তুমি কোথায়?
চারদিকে কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই।
আমি এসেছি, তোমার কাছে, প্লিজ বের হয়ে এসো।
আগের মতোই নিশ্চুপ চারপাশটা। শুধু তীরে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
জেসমিন অনুমান করল, হয়তো ডাক্তার হাডসন শহরে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবেন। কিন্তু মন যে মানছে না। তার আজ শহরে যাওয়ার কথা না। কারণ তিনি জানেন যে সে আসবে। তাহলে কোথায় ডাক্তার হাডসন?
জেসমিন এবার কোকোনাট হিলের উদ্দেশে রওনা দিল। অর্ধেক পথ আসতে পায়ের একটা স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেল তার। বাধ্য হয়ে দুটো স্যান্ডেলই খুলে ফেলতে হলো পা থেকে। বালির গভীরতা বেশি হওয়ায় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে বেশ। একসময় অবশ্য সে এসে পৌঁছাল কোকোনাট হিলের সামনে। না, এখানেও নেই ডাক্তার হাডসন। তারপরও নিশ্চিত হতে আগের মতোই জোরে বলতে থাকল, আমি এসেছি, আমি জেসমিন এসেছি তোমার কাছে, তুমি কোথায়?
কোনো উত্তর নেই।
জেসমিন এবার নাম ধরেই ডাক দিল। ডাক্তার হাডসন, তুমি কোথায়? তুমি কোথায়?
শুধু ঢেউয়ের শব্দ কানে আসছে তার।
ডাক্তার হাডসন, ডাক্তার হাডসন!
না, কোনো সাড়াশব্দ নেই।
হতাশ হয়ে বালুর উপরই বসে পড়ল জেসমিন। তার এখন বেশ ভয় ভয় করছে। শরীরটাও কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। আগে তার শরীর কখনো এতটা কেঁপে উঠেনি। এই প্রথম।
কতক্ষণ সে বালুর মধ্যে বসে ছিল বলতে পারবে না। একসময় আবার উঠে দাঁড়াল। কিন্তু শরীরের শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে আসছে। তীব্র একটা অভিমান আর কষ্ট দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে তার বুকটাকে। ডাক্তার হাডসন তার সাথে প্রতারণা করেছে, ভয়ংকর প্রতারণা! তার পেটে ডাক্তার হাডসনের সন্তান, অথচ ডাক্তার হাডসন নেই, কোথাও নেই। কীভাবে সম্ভব!
আবার সে আসতে শুরু করল হাডসন হাউসের দিকে। অর্ধেক পথ আসার পর আর পারল না। পড়ে গেল নিচে। শরীরে অতিরিক্ত গরম লাগায় খুলে ফেলল বোরকাটা। তারপর উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। শেষে চার হাত-পায়ে ভর করে এগোতে থাকল হাডসন হাউসের দিকে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তারপরও এগোচ্ছে। একসময় ঠিকই ভিতরে প্রবেশ করতে পারল। সাদা পাথরের উপর শুয়ে পড়ল কাত হয়ে। ক্লান্তিতে ধড়ফড় করছে বুক। পিপাসা পেয়েছে প্রচণ্ড। পাশেই ওয়াটার গার্ডেনে পানি জমে আছে, কিন্তু তার যাওয়ার শক্তি নেই। চোখ দুটো শুধু হাডসনের মূর্তির দিকে। দুঃখ, কষ্ট আর যন্ত্রণায় ফেটে পড়তে ইচ্ছে করছে জেসমিনের। কিন্তু পারছে না। কারণ কথা বলার শক্তিও যেন নেই শরীরে। একইসাথে যোগ হয়েছে তৃষ্ণা, ভয়ংকর তৃষ্ণা। শেষে সিদ্ধান্ত নিল ওয়াটার গার্ডেনের কাছে যাবে। কিন্তু চেষ্টা করেও শরীর নাড়াতে পারছে না। তীব্র ব্যথা, বিশেষ করে তলপেটে। এরকম ব্যথা তার আগে কখনো ওঠেনি, এই প্রথম।
জেসমিন অনুধাবন করল তার মৃত্যু আসন্ন। কারণ এখানে এই হাডসন হিলে কেউ আসবে না তাকে সাহায্য করতে। আর এ সবকিছুর জন্য দায়ী ডাক্তার হাডসন। সে যে প্রতারণার শিকার বুঝতে পারছে এখন। কিন্তু কিছুই করার নেই ডাক্তার হাডসনকে ঘৃণা করা ছাড়া।
চোখের সামনে সবকিছু আবছা হয়ে আসতে শুরু করেছে আগে থেকেই। সময় যত যাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি ততই ঝাপসা হয়ে আসছে। তাকিয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে এখন। কিন্তু সে তাকিয়ে থাকতে চায়, বাঁচতে চায় এ পৃথিবীতে। অথচ তাকে বাঁচানোর মতো কেউ নেই।
ঝাপসা দৃষ্টিতে হঠাই কাউকে যেন আসতে দেখল জেসমিন। বুঝতে পারল সবই দৃষ্টিভ্রম। মৃত্যুর আগে নাকি মানুষ অনেকের আত্মা দেখতে পায়। সেও ঐরকম কারো আত্মা দেখছে বলে অনুমান করল। তবে যখন তার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে তার মুখে পানি দিল, তখন বুঝতে পারল তার অনুমান মিথ্যা ছিল। সত্যি তার পাশে একজন মানুষ এসে বসেছে, উনি আর কেউ নন, ডাক্তার তরফদার।
অ্যাম্বুলেন্স আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। ছিলেন ডাক্তারও। জেসমিনকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে উখিয়া থানার ওসিকে ধন্যবাদ দিলেন ডাক্তার তরফদার। ওসি সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন কেন স্যার? ফোন পেয়ে আমি শুধু আপনার কথামতো কাজ করেছি। আপনার পরামর্শ অনুসারে আমার দশজন পুলিশ সদস্যকে আশেপাশের পাহাড়ে আর গাছের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলাম। তারা নজর রাখছিল জেসমিনের উপর।
ডাক্তার তরফদার উপরে-নিচে মাথা দুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ, এই নজর রাখাটাই প্রয়োজন ছিল। কারণ আগেই যদি জেসমিনকে আমরা আটকে দিতাম তাহলে সে ভাবত সত্যি ডাক্তার হাডসনের কাছ থেকে জোর করে তাকে আমরা আলাদা করে রাখছি। আসলেই যে ডাক্তার হাডসন জীবিত নেই, এখন সে বুঝতে পেরেছে। তাকে এই বিষয়টা বুঝতে দেয়ার উপায় বের করাই ছিল আমার চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য।
আপনার কথাগুলো বড় রহস্যময় স্যার। তবে আমি সত্যি রোমাঞ্চিত হই।
আসলে মানুষের মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াই তো! সত্যি কথা বলতে কি জানেন, পৃথিবীর সবচেয়ে রোমাঞ্চকর আর রহস্যময় জায়গা হলো মানুষের মন। যাইহোক, ডাক্তার হাড়সনের কঙ্কালের কী অবস্থা?
ব্রিটিশ এম্বেসিকে জানানো হয়েছে। তাদের একটা প্রতিনিধি দল আসবে। তারা সিদ্ধান্ত নেবে কী করা হবে তার দেহাবশেষ।
বড় কষ্ট হয় ডাক্তার হাডসনের জন্য!
আমারও।
আসলে কি জানেন, পৃথিবীতে ভাগ্য বলে একটা কথা আছে। এই ভাগ্যের উপর কারো হাত নেই। ভাগ্য মূলত সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা। মহাবিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী ইচ্ছা হলো সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা। মানুষ অনেককিছু পরিবর্তন করতে পারলেও পারে না সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাকে পরিবর্তন করতে। আসি, ভালো থাকবেন।
ডাক্তার তরফদার হাঁটতে শুরু করলেন। ওসি সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ডাক্তার তরফদারের দিকে। তিনি জীবনে বহু অদ্ভুত মানুষ দেখেছেন, কিন্তু ডাক্তার তরফদারের মতো অদ্ভুত মানুষ কখনো দেখেননি। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, ডাক্তার তরফদার নামক মানুষটির পুরোটাই রহস্যে ঘেরা এবং পৃথিবীতে তিনি অদ্বিতীয়।
*
ডাক্তার তরফদার তার চেম্বারে বসে আছেন। তার সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে শিরিন। ডাক্তার তরফদার বললেন, আমি জানতাম চিঠি পেলে তুমি আসবে।
স্যার আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
কেন?
জানি না স্যার।
তোমার পরিবার কি জানে তুমি এখানে এসেছ?
না স্যার, সিলেটে আপনার চিঠি পাওয়ার পর আমি সুযোগ খুঁজছিলাম। কিন্তু পাচ্ছিলাম না। পরে একটা বিয়ের দাওয়াত পেলাম ঢাকায়। পরিবারের সবাই এসেছি। রাতে অনুষ্ঠান। কিছু জিনিস কিনব বলে বাসা থেকে বেরিয়েছি। সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইরে থাকতে পারব। চার-পাঁচ ঘণ্টার মতো সময় আছে। আমি শুধু একবার, একবার ওকে দেখতে চাই স্যার।
বড় কষ্ট হবে তোমার।
তারপরও একবার আমি ওকে দেখতে চাই। অন্তত নিজেকে সান্তনা দিতে পারব।
তুমি কি এখনই যেতে চাও?
জি স্যার। কিন্তু কীভাবে যাব? আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে।
আমিও যাব। কিন্তু তোমার হাতে ওটা কী?
একটা ব্যাগ।
কী জন্য? স্যার পরে বলব।
ডাক্তার তরফদার ড্রাইভার সালামকে আসতে বললেন। তারপর রওনা দিলেন মানিকগঞ্জের উদ্দেশে। পথে জানতে পারলেন শিরিনের দুই সন্তান আছে। তার স্বামী-শ্বশুরকুল অনেক বড়লোক। সিলেটের ধনাঢ্য পরিবারগুলোর মধ্যে তাদের পরিবার একটি। তার নিজের টাকাপয়সার কোনো অভাব নেই, স্বামী যথেষ্ট উদার মানুষ।
হামিদদের বাড়িতে এসে গাড়ি থেকে নামল শিরিন। তারপর ডাক্তার তরফদারের পিছন পিছন আসতে লাগল। ডাক্তার তরফদার হামিদের ছোট বোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন শিরিনের। শিরিন অবশ্য কোনো কথা বলল না। ব্যাগটা হাতে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকল ডাক্তার তরফদারের পিছন পিছন। হামিদের ঘরে প্রবেশ করে একেবারে স্থির হয়ে গেল সে। হামিদ মাটিতে শুয়ে ছিল। ডাক্তার তরফদার ডাক দিলেন, হামিদ।
হামিদ ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল।
হামিদ!
চোখ দুটো কুঁচকে গেল হামিদের এবার।
কাকে নিয়ে এসেছি দেখতে পাচ্ছি?
শিকল দিয়ে বাঁধা হামিদের সমস্ত শরীর হঠাৎই কাঁপতে শুরু করল। ঠোঁট দুটো যেন বেশি জোরে কাঁপছে। বোঝা যাচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছে সে। কিন্তু বলতে পারছে না। একদৃষ্টিতে শুধু দেখছে শিরিনকে। শিরিনের চোখে তখন পানি, পানি হামিদের চোখেও।
হামিদ উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করেও পারল না। শরীর বড় দুর্বল তার। চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করল। কিন্তু খুব বেশিদূর আসতে পারল না। শিকলে টান পড়ল।
শিরিন এবার কাঁপা হাতে ব্যাগের মধ্যে থেকে বড় একটা ডালিম বের করল। আগে থেকেই কাটা ছিল ডালিমটা। ভিতরে থেকে কয়েকটা কোয়া বের করে অশ্রুসিক্ত চোখে এগিয়ে যেতে শুরু করল হামিদের দিকে। হুশনা এসে টেনে ধরতে চেষ্টা করল শিরিনকে। শিরিন ঝাঁকি দিয়ে সরিয়ে নিল নিজের হাতটা। তারপর হামিদের একেবারে সামনে গিয়ে বসল। হামিদ তখন বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে শিরিনের দিকে, তার চোখে অশ্রু বন্যা।
একটা একটা করে কোয়া বের করছে শিরিন আর মুখে তুলে দিচ্ছে। হামিদের। হামিদ সেই কোয়াগুলো চিবোচ্ছে। একবারের জন্যও চোখ ফিরাচ্ছে না। শিরিন কোয়া দিচ্ছে আর হামিদ খাচ্ছে। চোখে আগের মতোই অশ্রু। অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করলেন, তি সুন্দর আর স্বর্গীয় দৃশ্যটা যেন দেখছেন এখন!
ডালিমটা শেষ করতে প্রায় দশ মিনিটের মতো সময় লাগল। তারপর নিজের আঁচল দিয়ে হামিদের চোখের পানি মুছে দিল শিরিন। এতক্ষণে একটা কথাও বলেনি দুজন। একসময় উঠে দাঁড়াল সে। হামিদ তাকিয়ে আছে তো আছেই, একেবারে শিশুর মতো তার দৃষ্টি। দুচোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে নিচে। শিরিনও নিজের আবেগকে আটকে রাখতে পারছে না। বারবার ভিজে উঠছে চোখ। শেষ মুহূর্তে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলে ডান দিকে মাথা কাত করল হামিদ যেন সে তাকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিল। তারপর আর দাঁড়াল না শিরিন। ব্যাগটা হাতে নিয়ে একেবারে উঠোনের মাঝখানে চলে এলো। হুশনা তখন তার সামনে। ভেজাকণ্ঠে বলল, হুশনা, বুইন আমার, মাফ করে দিও আমারে। এই ব্যাগে এক কোটি টাকা আছে। পারলে চিকিৎসা করিয়ে তোমার ভাইয়ের।
তারপর নিজের দুই হাতে থাকা চারটি স্বর্ণের চুরি খুলে হাতে পরিয়ে দিল হুশনার। বলল, বড় বোন হিসেবে আমি তোমাকে দিলাম, চারটি চুরিতে আটভরি স্বর্ণ আছে। হ…হয়তো আর দেখা হবে কি না জানি না, ত…তবে মনে থাকবে তোমাকে। তোমার জন্য আজও আমার ভালোবাসা বেঁচে আছে এই পৃথিবীতে, বড় কৃতজ্ঞ আমি তোমার কাছে। আ… আ…আসি রে হুশনা!
কথাগুলো বলে মুখে আঁচল চেপে গাড়িতে উঠল শিরিন।
হুশনা ডাক্তার তরফদারের কাছে এসে বলল, স্যার, আমি কী করব ভাইজানরে নিয়া?
ডাক্তার তরফদার আবার ঢুকলেন হামিদের ঘরে। হামিদ শুয়ে পড়েছে মাটিতে। তার হাতে বাঁশি। ডাক্তার তরফদার বেশ কয়েকবার তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হামিদ কোনো কথা বলল না। একসময় সে চোখ বুজল। তার মুখের কোনে এক চিলতে তৃপ্তির হাসি। ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করলেন, হামিদকে এখন বিরক্ত করা ঠিক হবে না। বাইরে এসে হুশনাকে বললেন, আমি সাত দিনের মধ্যে আবার কোথাও হামিদকে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেব।
ডাক্তার তরফদার গাড়িতে উঠতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শিরিন। ভাঙা গলায় বলল, স্যার, আমার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা পূর্ণতা পেল না কেন?
ডাক্তার তরফদার একটু সময় নিলেন। তারপর টেনে টেনে বললেন, ‘মানুষের জীবনে অন্যতম বড় আনন্দ আর ভালোলাগা হলো প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এই প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসার অধিকাংশই পূর্ণতা পায় না, কেন যেন ঝরে যায় অকালে।
ডাক্তার তরফদারের কথা শেষ না হতেই চলতে শুরু করল গাড়ি। দূর থেকে তখন ভেসে আসছে বাঁশির সুর, হামিদের বাঁশি,
প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়’।
ডাক্তার তরফদার অনুভব করলেন আজ অনেক অনেকদিন পর হামিদ সুন্দর বাঁশি বাজাচ্ছে। আজকের বাঁশির সুর যেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুর, আগে কখনো এত সুন্দর সুর সে বাঁশিতে তুলতে পারেনি। আর তার পাশে, বসে থাকা শিরিন মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে, হুহু করে কাঁদছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, শিরিনকে তিনি থামানোর চেষ্টা করবেন না, কারণ সে মন থেকে কাঁদছে। মন থেকে আসা কান্না প্রিয়জনের ভালোবাসা কিংবা প্রিয় কিছু হারানোর কান্না, এই কান্নার উপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, চাইলেও কেউ থামিয়ে রাখতে পারে না এই কান্নাকে।
*
ডাক্তার তরফদার জেসমিনের ফাইলে লম্বা একটা লেখা লিখেছেন। ক্লান্তি দূর করতে এক কাপ দুধ চা শেষ করলেন তিনি। তারপর শেষবারের মতো পড়তে শুরু করলেন লেখাটা,
ডাক্তার হাডসন কীভাবে জটিল অসুখগুলো সারিয়ে তুলতেন, এ বিষয়ে একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা রয়েছে। মূল ব্যাপারটা ছিল পেনিসিলিন নামক অ্যান্টিবায়োটিকস্ প্রয়োগ। বিষয়টা বুঝতে হলে ব্যাকটেরিয়া ও সৃষ্ট রোগ সম্পর্কে খানিকটা জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অ্যান্টনি ভ্যান লিউয়েন হুক ১৬৬৫ সালে ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেন এবং তাকে ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কারের স্বীকৃতি দেয়া হয় ১৬৭৭ সালে। তিনি ছিলেন একজন ডাচ বিজ্ঞানী। ফাদার অব মাইক্রোবায়োলজি হিসেবেও তিনি বহুল পরিচিত। তার ঐ আবিষ্কারের সাথে সাথে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা কী কী রোগের সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে চলতে থাকে গবেষণা। উল্লেখযোগ্য রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে কলেরা, ডিপথেরিয়া, মেনিনজাইটিস, টিটেনাস, গনোরিয়া, সিফিলিস, ফুড পয়জনিং, নিউমোনিয়া, গ্যাসট্রিটাইটিস, সেলুলাইটিস আর নানা ধরনের ঘা-পাঁচড়া। এছাড়াও আরো অনেক সংক্রামক রোগ, ইনফেকশন সৃষ্টি হয় ব্যাকটেরিয়া দ্বারা।
ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধ তৈরির গবেষণাও চলতে থাকে বছরের পর বছর ধরে। অবশেষে সফল হন স্কটিশ ডাক্তার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। তিনি পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন ১৯২৮ সালে। লন্ডনের সেন্ট মেরিস হাসপাতালে গবেষণা করার সময় ১৯২৮ সালের ৩ অক্টোবর তিনি লক্ষ করেন যে ছত্রাক এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদন করে যা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে বন্ধ করে দেয়। এই রাসায়নিক পদার্থটির নাম দেন পেনিসিলিন এবং এ বিষয়ে ১৯২৯ সালে একটি প্রতিবেদন লেখেন। প্রতিবেদনে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে এই পেনিসিলিন চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। কিন্তু আলেকজান্ডার ফ্লেমিং কাউকে বোঝাতে সক্ষম হননি যে আসলেই তার আবিষ্কারটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর মূল কারণ ছিল, ছত্রাক থেকে বেশি পরিমাণ পেনিসিলিন উৎপাদন সম্ভব না হওয়ায় বড় পরিসরে পেনিসিলিনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা যাচ্ছিল না। তবে তার প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। তিনি সবাইকে বিষয়টি জানাতে থাকেন এবং বলতে থাকেন ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে পেনিসিলিন অত্যন্ত কার্যকর। ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ডের শেফিল্ডের সিসিল জর্জ পেইনি নামের একজন ডাক্তার এক রোগীর শরীরের গনোকক্কোল নামক ব্যাকটেরিয়াকে দমন করতে সক্ষম হন পেনিসিলিন ব্যবহার করে। বিষয়টি জানাজানি হলে অনেকেই নড়েচড়ে বসেন।
ছত্রাক থেকে পেনিসিলিন উৎপাদন তখন সহজতর ছিল না। ১৯৪০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড ফ্লোরে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরিতে বেশ খানিকটা পেনিসিলিন উৎপাদনে সক্ষম হন। এই পেনিসিলিন ব্যবহার করে আলবার্ট আলেকজান্ডার নামক একজন পুলিশ অফিসারের মুখের ইনফেকশন তিনি প্রায় সারিয়ে তুলেছিলেন, কিন্তু পর্যাপ্ত পেনিসিলিনের অভাবে ঐ পুলিশ অফিসার পরে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু অন্য যাদের ছোটখাট ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন ছিল তারা সুস্থ হয়ে উঠে। এতে বাড়তে থাকে পেনিসিলিনের চাহিদা। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি চাহিদার তুলনায় খুব কম পরিমাণ পেনিসিলিন তখন উৎপাদন করতে পারত।
১৯৪৩ সালে সকল সাফল্য নিয়ে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং দ্যা ল্যানসেট জানালে তার গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করেন। ১৯৪৩ সালের ৫ এপ্রিল গুরুত্ব উপলব্ধি করে ব্রিটিশ ওয়ার কেবিনেট (British War Cabine) পেনিসিলিনের উৎপাদন এবং প্রয়োগ বিষয়ে একটি পেনিসিলিন কমিটি গঠন করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বাণিজ্যিকভাবে পেনিসিলিন উৎপাদনে ব্যর্থ হয়। এর মধ্যে আমেরিকা পেনিসিলিন সম্পর্কে জানতে পারে এবং তারা বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করে। ১৯৪৩ সালে আমেরিকার War Production Board সর্বমোট ২.৩ মিলিয়ন ডোজ পেনিসিলিন তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই পেনিসিলিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা শুরু হয় যা মৃত্যু কমিয়ে আনে প্রায় ১৫%। তখন পেনিসিলিন গ্রহণের মাত্র তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে শরীর থেকে প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে যেত। ফলে রোগীর শরীরে বেশিক্ষণ পেনিসিলিন কার্যকর থাকত না এবং ঘন ঘন ডোজের প্রয়োজন হতো। এজন্য পেনিসিলিন ব্যবহারের খরচ ছিল অত্যন্ত বেশি। সাধারণ মানুষের জন্য অকল্পনীয় ছিল মূল্য। শুধু যুদ্ধের সৈনিক কিংবা ধনী ব্যক্তিরা ব্যবহার করতে পারত। ক্ষেত্র বিশেষে এমনও ঘটনা ছিল যে, রোগীর মূত্র সংগ্রহ করে রাখা হতো যেন ঐ মূত্র থেকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পেনিসিলিন আলাদা করে আবার ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এটা সন্তোষজনক কোনো সমাধান ছিল না। পুনরায় শুরু হলো গবেষণা এবং এমন একটা কিছু খোঁজা যা পেনিসিলিনকে শরীর থেকে বের হতে দেবে না। অনেক গবেষণার পর পেনিসিলিনের সাথে প্রবেনাসিড নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত হলো এবং দেখা গেল সত্যি শরীরে দীর্ঘক্ষণ পেনিসিলিন থাকছে এবং ভালো সাফল্য আসছে। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পেনিসিলিনের বহুল প্রয়োগ শুরু হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কারের জন্য আলেকজান্ডার ফ্লেমিং নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
১৯৪৫ সালে আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া পেনিসিলিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করলেও অতিরিক্ত চাহিদা এবং মূল্যের কারণে আফ্রিকা এশিয়ার মতো মহাদেশে পেনিসিলিন পাওয়া ছিল দুঃসাধ্য। ডাক্তার হাডসন প্রথমে কাজ করতেন ব্রিটেনের সামরিক হাসপাতালে। সেখানে তিনি যুদ্ধাহত সৈনিকদের উপর পেনিসিলিন প্রয়োগের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশে আসেন ১৯৪৪ কিংবা ১৯৪৫ সালের দিকে, চট্টগ্রামে বয়োবৃদ্ধ পাদ্রীর কাছ থেকে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। ডাক্তার হাডসন প্রথমে অস্থায়ী সামরিক হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন, পরে কাজ নেন খ্রিষ্টান মিশনারি হাসপাতালে। কিছু মিশনারিজ-এর মাধ্যমে পেনিসিলিন তখন এই উপমহাদেশে আসত এবং মিশনারিজের ডাক্তাররাই শুধু প্রয়োগ করতে পারতেন। ডাক্তার হাডসনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈনিকদের পেনিসিলিন দিয়ে চিকিৎসা করার অভিজ্ঞতা থাকায় তিনি স্থানীয় রোগী যাদের ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হয়েছিল তাদেরকেও পেনিসিলিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। এই পেনিসিলিনই ছিল তার ম্যাজিক ওষুধ কারণ তখনো পেনিসিলিন উপমহাদেশে সহজলভ্য হয়নি। পেনিসিলিন নামটা কাউকে তিনি জানাতেন না। কারণ সম্ভবত মিশনারিজ ছাড়া অন্য কোথাও সেটি ব্যবহারের অনুমতি ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে বিদেশি সৈনিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। ঐ সময় বাংলাদেশে মিত্রশক্তি ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়ান ও আফ্রিকান অনেক সৈন্য অবস্থান নিয়েছিল। বার্মার সাথে যুদ্ধে তাদের অনেকে আহত হয়, কেউ কেউ মৃত্যুবরণও করে। প্রমাণস্বরূপ চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লায় রয়েছে ওয়ার সিমেটেরি যেখানে মিত্রশক্তির সামরিক সদস্যদের কবর রয়েছে। ঐ সামরিক সদস্যদের চিকিৎসায় জন্য পাঠানো হতো দুর্লভ পেনিসিলিন। সাধারণ মানুষের চিকিৎসার কথা ভেবে সম্ভবত রয়ে যাওয়া অতিরিক্ত পেনিসিলিন ব্যবহার করতেন মানবিক ডাক্তার হাডসন। তার ঐ চিকিৎসার জাদুতেই বেঁচে গিয়েছিলেন ইরফান আলীসহ আরো অনেকে। তবে অ্যান্টিবায়োটিকসের অতিরিক্ত ব্যবহার শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কারণ ব্যাকটেরিয়া রেজিস্ট্যান্স লাভ করে, অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিকসূকে অকার্যকর করে দেয়ার ক্ষমতা সৃষ্টি হয় ব্যাকটেরিয়ার শরীরে। পেনিসিলিন এখন অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অকার্যকর। মানুষও পিছিয়ে নেই। পেনিসিলিনের উপর গবেষণা করে নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিকস্ তৈরি করে ফেলেছে। এগুলোর ডোজও কম। তবে এক-একটির কার্যকারিতা ও ব্যবহার একেক রকম। এজন্য ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনোই অ্যান্টিবায়োটিকস গ্রহণ করা উচিত নয় এবং অতিরিক্ত ডোজ থেকে সম্পূর্ণই নিজেকে বিরত রাখা সমীচীন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ডাক্তার হাডসন তার স্ত্রীকে ইংল্যান্ড থেকে জাহাজে করে বাংলাদেশে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন। সম্ভবত সাথে করে অনেক পেনিসিলিনও এনেছিলেন। কিন্তু ঝড়ে আক্রান্ত হয়ে জাহাজ বিকল হয়ে গেলে জাহাজ চলে আসে হাডসন হিলের কাছাকাছি। তিনি, তার স্ত্রী এলিজা এবং অনেকে সিদ্ধান্ত নেন নেমে যাওয়ার। জায়গাটা ভালো লাগায় থাকতে চান কয়েকটা দিন। কিন্তু এলিজার মৃত্যু তাকে আর ফিরে যেতে দেয়নি মিশনারিজে। ভালোবাসার টানে প্রিয় স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন বছরের পর বছর। অবশেষে করুণ মৃত্যুবরণ করতে হয় তাকে। পাহাড়ের উপর মাটি দেয়ার প্রায় ষাট বছর পরও তার কঙ্কাল পাওয়ার বিষয়টি সত্যি বিস্ময়কর। সাধারণত কঙ্কাল মাটির সাথে মিশতে সময় লাগে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর। অবশ্য ব্যাপারটা নির্ভর করে পানির উপস্থিতি, আর্দ্রতা, মাটির ধরনের উপর। ডাক্তার হাডসনের লাশের নিচে এবং উপরে পাথর থাকায় এবং চারপাশের পাহাড়ের গঠনে পাথরের পরিমাণ বেশি থাকায় কঙ্কাল পরিপূর্ণভাবে মাটির সাথে মিশতে পারেনি। এজন্যই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ডাক্তার হাডসনের কঙ্কাল।
এলিজার মৃত্যু হয়েছিল সম্ভবত সাগরের রিপকারেন্ট (Rip Current) এবং আন্ডারটো (Undertow)-এর কবলে পড়ে। প্রতিদিন গড়ে সাগরের প্রায় ৬০০০ ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ে। তারপর ঢেউগুলো আবার ফিরে যায় সাগরে। কোনো কারণে ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ার আগে যদি ভেঙে যায় এবং ফিরে যাওয়ার সময় অভিকর্ষজ ত্বরণ বা বাতাসের কারণে অতিরিক্ত গতি লাভ করে তখন সৃষ্টি হয় রিপ কারেন্টের। দুইপাশের পানি একত্রে ফিরে যাওয়ার ধাক্কায় এই স্রোতের গতি অনেক বেশি হয় যা মানুষকে দ্রুত ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। খুব ভালো সাতারুকেও অনেকদূর ভাসিয়ে নিতে পারে রিপ কারেন্ট। একটি রিপ কারেন্ট গড়ে ১৬ মিটার পর্যন্ত চওড়া হয়। তবে কতদূর ভাসিয়ে নেবে তা সঠিকভাবে বলা কঠিন। বিষয়টি নির্ভর করে সাঁতরানোর দক্ষতা এবং স্রোতের টানের উপর। আশার কথা রিপ কারেন্ট মানুষকে সমুদ্রের তলদেশে টেনে নেয় না, শুধু ভাসিয়ে ভাসিয়ে টানতে থাকে। এজন্য আতঙ্কিত না হয়ে ভেসে থেকে রিপ কারেন্ট থেকে বাঁচা সম্ভব। কেউ রিপ কারেন্টে আক্রান্ত হলে তাকে মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখতে হবে, জোরে জোরে সাহায্য চাইতে হবে, বিচের সাথে আড়াআড়ি সাঁতরাতে হবে। বিচের সাথে আড়াআড়ি সাঁতরে যদি রিপ কারেন্টের বাইরে চলে আসা যায় তাহলে পাশের ঢেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে তীরের দিকে নিয়ে আসবে। রিপ কারেন্টের মধ্যে থেকে কখনো তীরের দিকে সাঁতরানোর চেষ্টা করতে নেই, এতে শুধু শক্তির অপচয় হয়। রিপ কারেন্টের গতি সাগরের দিকে এত বেশি থাকে যে আগত বড় বড় ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে মানুষকে সাগরের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। যেহেতু রিপ কারেন্ট গড়ে সর্বোচ্চ ১৬ মিটার বা ৫০ হাতের কাছাকাছি চওড়া হয়, এতটুকু আড়াআড়ি সাঁতরাতে পারলে রিপ কারেন্ট থেকে বাঁচা সম্ভব। রিপ কারেন্টে কেউ আক্রান্ত হলে প্রশিক্ষিত ব্যক্তি ব্যতীত সেই রিপ কারেন্টের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাউকে উদ্ধারের চেষ্টা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু না। কারণ যিনি উদ্ধার করতে যাবেন, তিনিও মৃত্যুবরণ করতে পারেন। উদ্ধারকারীদের রিপ কারেন্টে মৃত্যুর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ রয়েছে। কোনো কারণে রিপ কারেন্টের সাথে যদি আন্ডারটো (Undertow) যুক্ত হয় তাহলে মানুষের বেঁচে থাকা আরো কঠিন হয়ে পড়ে। আন্ডারটো হলো মানুষকে পানির নিচে টেনে নিয়ে যাওয়ার শক্তিসম্পন্ন ঢেউ। তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের উচ্চতা যখন খুব বেশি হয়, তখন ঐ ঢেউ অভিকর্ষজ বলের টানে খুব দ্রুত নিচের দিকে যেতে থাকে। পানির নিচের দিকে যাওয়ার এই প্রবণতাকে বলে আন্ডারটো। কোনো মানুষ এই আন্ডারটোতে পড়লে সে শ্বাস নিতে পারে না। যদি সাগরতীরে পানির গভীরতা বেশি হয় এবং উঁচু-নিচু পাথর থাকে সেক্ষেত্রে আহত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এজন্য পাথুরে সাগর তীরে নামা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যদি কোনো কারণে রিপ কারেন্ট আর আন্ডারটো একইসাথে হয় এবং ঐ স্রোতের মধ্যে দুর্ভাগ্যবশত মানুষ পড়ে, তাহলে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে পড়ে। একটা আন্ডারটোর উপর যদি বড় আর-একটা ঢেউ এসে পড়ে তাহলে মানুষ ভেসে উঠার আগেই পানির চাপে আবার নিচে চলে যায়। মৃত্যু তখন অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই রিপ কারেন্ট এবং আন্ডারটোর গতি ভাটার সময় বৃদ্ধি পায় বেশি। কারণ তখন পানির টান এমনিতেই তীরের বিপরীতমুখী হয়। এ কারণে ভাটার সময় রিপ কারেন্ট কিংবা আন্ডারটো আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠে। বিষয়টি উপলব্ধি করে ভাটার সময় সাগরে নামা নিরুৎসাহিত করা হয়। লাল পতাকা টাঙানো হয় সর্বত্র। সাগরে গোসল করার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে জোয়ারের সময়টা বেশি নিরাপদ। ২০২০ ও ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে প্রতি বছর শুধু আমেরিকাতেই রিপ কারেন্টের কারণে ১০০-এর উপর মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
এলিজা যখন সাগরে ডুবে যায় তখন ছিল সন্ধ্যা এবং বাতাসও ছিল বেশি। খুব ভালো সাঁতারু ছিল না সে। হয়তো রিপ কারেন্ট আর আন্ডারটো একসাথে হওয়ায় পানির নিচ থেকে আর উঠতে পারেনি এলিজা। দ্রুত অন্ধকার নেমে আসায় তাকে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। দূরে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলেও জানা যেত, কারণ সে ছিল ব্রিটিশ নাগরিক। বিদেশি নাগরিকের মৃতদেহ প্রাপ্তি বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করত। কিন্তু সেরকম কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ধারণা করা যেতে পারে সাগরেই মিশে গেছে এলিজার মৃহদেহ।
ডাক্তার তরফদার চেম্বার থেকে বের হয়ে এলেন। বারান্দায় দেখলেন নীল চোখের ছোট্ট ইকবাল আর তার মা রিতা বসে আছে। ইকবাল পরির পায়েস খাচ্ছে। বড় পছন্দ তার।
রিতা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, আসলে না আইসা পারলাম না। ইকবাল পায়েস খাবেই। পরির পায়েস। না দিলে কান্নাকাটি কইরা পাগল বানায় ফেলায়। তাই নিয়া আইছি। কিছু মনে করবেন না স্যার। নিজে যাইয়া ফ্রিজ থাইকা নিয়া আইছে।
ডাক্তার তরফদার ইকবালের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, তোমার যখন ইচ্ছে হয় তখন চলে আসবে আর পায়েস খাবে। ইচ্ছে করলে নিয়েও যাবে।
ইকবাল মিষ্টি একটা হাসি দিল। নীল চোখের মানুষ যখন হাসে তখন বড় সুন্দর লাগে তাকে দেখতে। ফর্সা ইকবালকে সত্যি দারুণ লাগছে। আজ।
রিতা এবার বলল, স্যার ওর সমস্যা তো ঠিক হইল না।
কী সমস্যা?
যা দ্যাখে আর শুনে সব মনে রাখবার পারে।
এটা তো ভালো গুণ।
আমার খুব ভয় করে!
ভয়ের কিছু নেই। বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। অত চিন্তা কোরো না।
সবসময় স্যার আমার চিন্তা হয় ওরে নিয়া! একটানা একটু শান্তি, একটু সুখ চাই স্যার আমি।
সুখেই আছো ত অনেক মানুষ আছে যারা তোমার থেকে অসুখী। সুখের পাশাপাশি দুঃখ থাকবে এটা স্বভাবিক। আর এটাও তোমাকে মনে রাখতে হবে যে, একটানা সুখ মানুষের ভালো লাগে না। মানুষ যখন বেশি সুখী হয় তখন বাস্তবে না হলেও কল্পনায় অসুখী হওয়ার চেষ্টা করে। কারণ সে জানে, অসুখী হওয়ার পর আবার সে সুখী হবে। তখন সুখের অনুভবটা হয় সর্বোচ্চ। মানুষের জীবনে সুখী অসুখী হওয়ার এই চক্রটা হলো সুখচক্র। আমরা সবাই কম-বেশি সুখচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছি।
কথার মাঝেই ইকবাল ঘরের ভিতর ঢুকে গেল। রিতা বলল, দ্যাখছেন স্যার, কত বড় বেয়াদব! আপনের অনুমতি পর্যন্ত নিল না। মাঝখানে যে কয়েকবার আইছিল করিম চাচার অনুমতি নিছিল। আপনেরে দ্যাখলে ওর সাহস বাইড়া যায়। ভাবখানা এমন যেন তার নিজের বাড়ি।
পেয়ালার পাশাপাশি প্লাস্টিকের ছোট ছোট কাপেও রাখা হয় পরির পায়েস। দুই হাতে চারটা কাপ নিয়ে এসেছে ইকবাল। রানু রাগে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল ইকবালের গালে। বলল, এতগুলা কাপ আনা লাগে নাকি! স্যার কী মনে করবে।
ইকবালের চোখে সাথে সাথে পানি চলে এলো।
ডাক্তার তরফদার একটু বিরক্তই হলেন। বললেন এভাবে মারছ কেন ওকে? আগেও তোমাকে নিষেধ করেছি। খবরদার আর এরকম করবে না। আর বলে দিচ্ছি এই বাড়ির সব পায়েস ওর, সবকিছু ওর। কথাগুলো বলে ডাক্তার তরফদার ইকবালকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। তারপর ফ্রিজে যতগুলো পায়েসের কাপ ছিল একটা কার্টুনে ভরে দিয়ে দিলেন। ইকবালের চোখের অশ্রু তখনো থামেনি। ডুকরে ডুকরে কাঁদছে সে। ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করলেন, নীল চোখের মানুষ হাসলে যেমন সুন্দর লাগে, কাঁদলেও তেমন সুন্দর লাগে। নীল চোখের মানুষ সত্যি সৌভাগ্যবান, একমাত্র ডাক্তার হাডসন ছাড়া। বড় করুণ মৃত্যু হয়েছিল তার। তার মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল টেকনাফ এলাকায় দুটো শিশুর নীল চোখ নিয়ে জন্ম নেয়ার ঘটনা। অথচ কেউ বুঝতে চায়নি ঐ নীল চোখের শিশু ডাক্তার হাডসনের সাথে কারো শারীরিক সম্পর্কের ফলে জন্ম হয়নি। মানুষের চোখের রঙের জন দায়ী ক্রোমোজমের ১৬তম জিন। একজন মানুষের চোখের রং কীরকম হবে তা নির্ভর করে চোখের আইরিশে কতটুকু মেলানিন আছে তার উপর। চোখে স্বাভাবিক পরিমাণ মেলানিন থাকলে চোখটিকে ব্রাউন বা বাদামি দেখায়। মেলানিনের পরিমাণ কিছুটা কম হলে চোখ সবুজ দেখায়, আর যদি একেবারে কম হয় তাহলে নীল দেখায়। মেলানিন যত বেশি হবে চোখের আইরিশ ততই আলো শোষণ করবে। নীল চোখের মানুষের চোখে মেলানিন কম থাকায় বেশি আলো শোষণ করতে পারে না, আলো চোখ থেকে বাইরের দিকে প্রতিফলিত হয় বেশি। এজন্য নীল চোখকে উজ্জ্বল দেখায় এবং চোখ দেখতেও সুন্দর লাগে। পৃথিবীতে দেশভেদে প্রায় ৭৫ ভাগ মানুষের চোখ বাদামি। মাঝে মাঝে আমরা এই বাদামি চোখকে কালো বলে ভুল করি। আয়নার সামনে গিয়ে আমরা যদি আমাদের দেশের আট-দশজনের চোখ উজ্জ্বল আলোতে পরীক্ষা করি তাহলে বিষয়টা বুঝতে পারব। বাদামি চোখের পর সবচেয়ে বেশি হয় নীল চোখ, প্রায় ১৫ ভাগ। বাকি ১০ ভাগ মানুষের চোখ হয় সবুজ, ধূসর কিংবা অন্য রঙের। কক্সবাজারে যে দুটো শিশুর চোখ নীল ছিল তাদের চোখে কোনো কারণে মেলানিনের পরিমাণ কম হয়েছিল, হতে পারে বিবর্তনগত পরিবর্তনের কারণে। আমাদের দেশে বাদামি (আমরা কালো বলি) চোখের বাবা-মায়ের এমন অনেক সন্তান রয়েছে যাদের চোখের রং নীল, সবুজ কিংবা ঘোলাটে (Cat’s Eys)। ডাকাত মাহাতাব অজ্ঞতার কারণে নীল চোখের সন্তান হওয়ায় সন্দেহ করেছিল তার স্ত্রীকে এবং দায়ী করেছিল ডাক্তার হাডসনকে। এই নীল চোখের অন্যতম উদাহরণ ইকবাল যে কি না তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এজন্য আমাদের সমাজে নীল, ধূসর কিংবা সবুজ চোখ দেখলে কাউকে অহেতুক দোষারোপ করা উচিত নয়। বুঝতে হবে এটা স্বাভাবিক বিবর্তনের ফল অথবা প্রকৃতির চাওয়া।
ডাক্তার তরফদার সামনে ঝুঁকে এসে ইকবালের কপালে একটা চুমু খেলেন। চোখে অশ্রু থাকলেও ইকবাল এবার হেসে দিল। নীল চোখের মানুষ একই সাথে হাসছে আবার কাঁদছে। ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিরল এবং সুন্দর দৃশ্যটি তিনি এখন দেখছেন।
*
হুশনা বসে আছে ডাক্তার তরফদারের সামনে। এই প্রথম হুশনা তার চেম্বারে এসেছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে মন খুব খারাপ। ডাক্তার তরফদার বললেন, আমার মনে হচ্ছে তুমি ভয়ংকর কিছু বলতে এসেছ?
স্যার!
বলো।
স্যার হামিদ ভাইজান গত পরশুদিন মারা গেছে।
ডাক্তার তরফদার কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। দীর্ঘদিন ডাক্তারি পেশায় থাকায় রোগীর মৃত্যুর খবরে তার চোখে পানি খুব একটা আসে না, বুকের মধ্যেই কষ্টটা চেপে রাখতে পারেন। তবে আজ পারলেন না। চোখ দিয়ে তার টপটপ করে পানি বেরিয়ে এলো।
হুশনা মুখে আঁচল চেপে বলতে থাকল, স্যার, রাত তিনডার দিকে আজানের শব্দে ঘুম ভাইঙ্গা যায় আমার। ঘুম থাইকা উইঠা দেখি ভাইজান আজান দিতেছে। আমার ভাইজানরে আমি কোনোদিন আজান দিবার দেখি নাই। আজান দেওয়া শ্যাষ হইলে আমার কাছে এক গ্লাস পানি চাইল। আমি পানি দিলাম। ভাইজান নামাজ পড়ল। তারপর বলল, আমার সময় হইয়া আইছেরে হুশনা, সময় হইয়া আইছে। তুই আমারে নিয়া ভাবিস না। আমি ভালোই থাকব। ক্যান জানস? মায়ে আমারে নিবার আইছে। সাদা কাপড় পইরা বাইরা দাঁড়ায় আছে। তুই ভালো থাকিস বুইন, বড় যত্ন করছস আমার। কিন্তু আমি কিছু করবার পারলাম না। আ…আর, আমার। মরণের খবর কাউরে জানাবি না। তরফদার স্যাররেও না, বড় কষ্ট পাবে হে। ক্যান জানস? আমারে বড় ভালোবাসে স্যার। স্যাররে আমি কিছু দিবার পারি নাই। তয় আমারে মাটি দিবার পর যাইয়া এই বাঁশিড়া দিবি। স্যাররে বলবি, স্যার যেন আমারে মনে রাখে। আর আমারে এই ঘরেই মাটি দিবি। আর বলবি, আমি আত্মা হইয়া মাঝে মাঝে স্যারের বাড়িতে যাব, স্যাররে দেখব, বড় ভালো মানুষ হে, বড় ভালো মানুষ!
কথাগুলো বলে হুশনা মুখে আঁচল চাপল আর ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকল। ডাক্তার তরফদার একেবারে নির্বাক হয়ে গেছেন। কিছুতেই তিনি তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।
কিছুক্ষণ পর হুশনা চোখ মুছে হাতের বাঁশিটা বের করে বলল, স্যার, এই যে আপনের বাঁশি।
ডাক্তার তরফদার কাঁপা হাতে বাঁশিটা নিলেন।
হুশনা বলল, স্যার আমি শিরিন আপার কথা মনে করায় দিছিলাম। তারেও জানাবার নিষেধ করছে।
ডাক্তার তরফদার এখনো চুপ। কথা বলার মতো শক্তি যেন ফিরে পাচ্ছেন না তিনি। দাঁতে দাঁত চেপে চোখের পানি আটকাতে চেষ্টা করছেন।
স্যার, এক কোটি টাকার আমার আর দরকার নাই। সোনার চুরিগুলাও। আমি আমার ভাইরে নিঃস্বার্থভাবে সেবা করছি। আমি টাকা আর চুরিগুলা ফিরায় দিবার চাই শিরিন আপারে।
ডাক্তার তরফদার ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে বললেন, ঠিক হবে না। তুমি বরং একটা আশ্রয়কেন্দ্র করো। হামিদের মতো যারা আছে তারা যেন এই আশ্রয়কেন্দ্রে এসে থাকতে পারে, যেন তাদের চিকিৎসা হয় আর তোমার মতো সেবক পায়। এতে তোমার ভাইয়ের আত্মা বড় শান্তি পাবে।
আমি একা পারব না স্যার।
তোমার সাথে না হয় আমি থাকব। আমাদের দেশে বহু ধনী মানুষ আছে যারা তোমার ভাইয়ের মতো মানুষদের সাহায্য করতে চায়। আমি তাদের কয়েকজনকে তোমার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেব। আর ঐ আশ্রয় কেন্দ্রের নাম তোমার ভাইয়ের নামেই রেখো। হতে পারে হামিদ আরোগ্য সেন্টার, হামিদ মানবিক কেন্দ্র, হামিদ আশ্রয় কেন্দ্র অথবা হামিদ ক্লিনিক।
স্যার ঠিক আছে, আপনে যখন বলছেন আমি অবশ্যই করব। আমার এলাকার চেয়ারম্যান বড় ভালো মানুষ। সেও এইরকম একটা কথা বলতেছিল।
তাহলে তো ভালোই হয়।
আরো কিছুক্ষণ কথা বলে উঠে গেল হুশনা। তাকে বিদায় দিতে বাইরে এলেন ডাক্তার তরফদার। এসে দেখেন মুখ কালো করে জেহান বসে আছে। বললেন, কী হয়েছে জেহান?
স্যার আমার আর ভালো লাগছে না।
কেন?
জেসমিনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
কী বলছ!
জি স্যার। হেডস্যারের এক বন্ধুর ছেলের সাথে। আমেরিকায় থাকে।
তারা কি সবকিছু জানে?
জি স্যার, জানে।
জেসমিনের শরীরের কী অবস্থা এখন?
ভালো স্যার। জেসমিনকেও খুব খুশি দেখলাম। মনে হচ্ছে সেও চাচ্ছে বিয়েটা হয়ে যাক। আসলে আমেরিকায় চলে যেতে পারবে।
ওর তো আঠারো বছর হয়নি।
হয়ে গেছে স্যার।
পড়াশুনা শেষ করবে না?
জেহান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, মনে হচ্ছে না। স্যার বড় কষ্ট হচ্ছে আমার। আমার জন্য আপনি কিছু করুন।
তোমার বাবা-মা কি জানে জেসমিনের বিয়ের কথা?
জানে স্যার। কিন্তু তারা জেসমিনকে দেখতে পারে না। তাদের কথা বিয়ের আগে যে মেয়ের পেটে বাচ্চা হয় সে কখনো ভালো হতে পারে না। শুধু তাই না, দুজনেই বিশ্বাস করে জেসমিনের সন্তানটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। এজন্য জেসমিনের নাম শুনলেই রেগে উঠছে। রাশেদ ভাই আমাকে জড়িয়ে আবার গুজব ছড়ানোতে বিব্রতকর অবস্থায় আছি আমি। রাশেদ ভাই পরে যাকে ভালোবেসেছিল সে অবশ্য প্রেগন্যান্ট না। কেউ মিথ্যা গুজব ছড়িয়েছে। এতে আমার উপর অনেকের সন্দেহ বাড়ছে। কিন্তু স্যার বিশ্বাস করেন জেসমিনের সাথে আমার অন্য কোনো সম্পর্ক নেই।
আমি বিশ্বাস করি। আর এখন তো বিষয়টা প্রমাণিত। কারণ জেসমিনের বাচ্চার রহস্য উদঘাটিত হয়েছে।
কেউ বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না।
ধীরে ধীরে করবে। রাশেদের কী অবস্থা?
চাঁদাবাজির অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। এখন জেলে আছে। মনে হচ্ছে না তাড়াতাড়ি ছাড়া পাবে। সাধারণ ছাত্রদের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা নেয়ার অভিযোগে কলেজ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে।
একটু থেমে জেহান আবার বলল, স্যার আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাব। কিছুই ভালো লাগে না। আমি কী করব?
ডাক্তার তরফদার জেহানের কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুমি খুব স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে। মনে রাখবে, জেসমিন জীবনের সবকিছু নয়। তুমি হয়তো জেসমিনকে পছন্দ করো, তাকে ভালোবাসো। কিন্তু জেসমিন তোমাকে ভালোবাসে বলে কোনো প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। ভালোবাসার বন্ধন একটি মন দিয়ে হয় না, দুটি মনের সম্মতি লাগে। তাছাড়া জেসমিনের বাবা-মা, তোমার বাবা-মা কেউ রাজি হবেন না। সমাজও মেনে নিতে চাইবে না, কারণ জেসমিন বয়সে তোমার বড়। প্রেমের বিয়ে আমাদের সমাজ এমনিতেই মানতে চায় না, আর তোমাদের হচ্ছে অসম প্রেম। প্রতিবন্ধকতাও বেশি। এত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে জেসমিনকে পাওয়া তোমার জন্য সত্যি অসম্ভব। তোমাকে বাস্তবতা মানতে হবে। মনে রাখবে, ‘অসম সম্পর্ক সাময়িকভাবে সুখ দিতে পারলেও, সুখকে স্থায়ী করতে পারে না।’
জেহান শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল ডাক্তার তরফদারের দিকে। ডাক্তার তরফদার বললেন, এসো আমার সাথে ভিতরে এসো। তোমার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করব।
চেম্বারের ভিতরে এসে ডাক্তার তরফদার দেখলেন জেহান নেই। তিনি আবার বাইরে এলেন, কিন্তু দেখতে পেলেন না জেহানকে। বড় আবেগী হয়ে পড়েছে সে। এরকম আবেগ যে কোনো সময় বড় ধরনের বিপদের কারণ হতে পারে। ডাক্তার তরফদার জেসমিনের ফাইলটা টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করলেন।
মানুষের জীবনে প্রেম যেমন আনন্দের, তেমনই কষ্টের। তবে এই প্রেম ভালোবাসা মাত্রাতিরিক্ত হলে তখন শুধুই কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একজন নারী বা পুরুষের অন্য একজন পুরুষ বা নারীর প্রতি মাত্রাতিরিক্ত অস্বাভাবিক প্রেমকে বলে অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডার (Obsessive Love Disorder}. অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত মানুষ তার পছন্দের মানুষকে ভালোবাসতে চায়, কাছে পেতে চায়, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, কল্পনা করে, তাকে খুশি করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে, তাকে পাওয়ার জন্যও সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে। এটি একটি মানসিক সমস্যা। এমনকি প্রিয়জনকে পাওয়ার জন্য নিজের সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিত্বকেও ভুলে যায় ব্যক্তিটি। আর ইচ্ছামতো সবকিছু না চললে হিংস্র হয়ে উঠতে পারে যে কোনো সময়, নতুবা নীরবে শুধু কষ্ট পেতেই থাকে। নীরব এই কষ্ট এক সময় বিষণ্ণতার (Depression) সৃষ্টি করে যা তার স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করে এবং আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। জেসমিনকে নিয়ে জেহান ভুগছে অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারে। জেসমিনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার দিন সে যখন নিশ্চিত হবে তার পক্ষে আর জেসমিনকে পাওয়া সম্ভব নয় তখন ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করতে পারে। জেহানের মতো জেসমিনও ভুগেছে অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারে। কল্পনায় সে ভেবে নিয়েছিল ডাক্তার হাডসনকে তার প্রিয় মানুষ হিসেবে। বয়ঃসন্ধিকাল বিশেষ করে বারো থেকে আঠারো বছর একজন ছেলে কিংবা মেয়ের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে ছেলেদের শরীরে সৃষ্টি হয় টেসটেসটেরন হরমোন, যে হরমোন একজন ছেলেকে পুরুষ হিসেবে গড়ে তোলে। মেয়েদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ওয়েস্ট্রেজন এবং প্রজেস্টিরিন নামক দুটো হরমোন। এই দুই হরমোন একজন মেয়েকে পরিপূর্ণ নারী হিসেবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। বয়ঃসন্ধিকালে সৃষ্ট এই দুই হরমোন শারীরিক যেমন পরিবর্তন ঘটায় তেমনি ঘটায় মানসিক পরিবর্তনও। এজন্য বয়ঃসন্ধিকালে একজন ছেলে কিংবা মেয়ের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তীব্র আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। লিঙ্গভেদে শরীরে পর্যাপ্ত টেসটেসটেরন কিংবা ওয়েস্ট্রেজনের উপস্থিতি তাদেরকে প্রেম করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং না পাওয়া পর্যন্ত স্থির থাকতে দেয় না। যারা নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারাই হয়তো সফল হয়। আর যারা পারে না তাদের কেউ কেউ অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হতে পারে। এই মানসিক অসুখটা যে শুধু বয়ঃসন্ধিকালে সৃষ্টি হবে তা কিন্তু নয়। যে কোনো বয়সে যে কারো হতে পারে। হামিদের মধ্যে অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে মৃত্যুই হয়েছিল তার শেষ পরিণতি। জেসমিনের ক্ষেত্রে ঘটনাটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারের সাথে তার ছিল তীব্র হ্যালুসিনেশন (Hallucination)। কক্সবাজার যাওয়ার আগে তার রাশেদের প্রেমে পড়ার মতো অবস্থা ছিল। কিন্তু বাদ সাধে শিক্ষাসফর। কল্পনায় সে যেমন একজন পুরুষকে খুঁজছিল ঠিক সেরকমই সুদর্শন, ভদ্র, মার্জিত একজনকে পেয়ে যায় হাডসন হিলে। নাম তার ডাক্তার হাডসন। ডাক্তার হাডসনের নীল চোখ, তীব্র ভালোবাসা, তার মানবিকতার গল্প দারুণভাবে আকৃষ্ট করে জেসমিনকে। এই আকর্ষণের টানে তার মন থেকে মুছে যায় রাশেদের অবস্থান। সেখানে শক্ত অবস্থান করে নেয় ডাক্তার হাডসন। এই অবস্থানের অন্যতম কারণ ছিল তার স্ত্রীর নাম। সবাই জানে ডাক্তার হাডসনের স্ত্রীর নাম এলিজা। কিন্তু কম মানুষই জানে তার পুরো নাম ছিল এলিজা জেসমিন। এই নামটা লেখা আছে হাডসনের মূর্তির ঠিক পাশে যেখানে এলিজার মূর্তি তৈরির কথা ছিল। সম্ভবত ব্যাপারটা নজরে পড়েছিল জেসমিনের। ডাক্তার হাডসন ভালোবাসায় ভরা বুক নিয়ে বসে আছে স্ত্রী এলিজা জেসমিনের জন্য, আর জেসমিন গিয়ে হাজির হয়েছে হাডসন হিলে। এই দুয়ের সমন্বয় জেসমিনের অবচেতন মনে এক অবিশ্বাস্য অনুরণন সৃষ্টি করে এবং সে বিশ্বাস করতে থাকে ডাক্তার হাডসন জীবিত আছে এবং তাকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে। তারপর থেকে শুরু হয় কল্পনায় ডাক্তার হাডসনকে পাওয়ার ইচ্ছা। কোনোভাবে হয়তো শুনেছে তিনি লাল রং পছন্দ করতেন। জেসমিনও শুরু করে লাল রঙের শাড়ি পরা। সতের বছরের জেসমিনের শরীরে তখন ওয়েস্ট্রেজন হরমোনের দারুণ আধিক্য। যার ফলে ঐ হরমোন তাকে বারবার বাধ্য করত পুরুষের কথা ভাবতে। এই ভাবনা প্রসারিত হতো অবচেতন মনে। অবচেতন মন তার সামনে নিয়ে আসত ডাক্তার হাডসনের চেহারাকে। এজন্য কল্পনায় ডাক্তার হাডসনের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করা এবং কাছে পাওয়ার তীব্র বাসনা তৈরি হতো তার মধ্যে। ঐ কল্পনায় সে ডাক্তার হাডসনকে আমন্ত্রণ জানাত নিজের কাছে এবং তার সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতো। বয়ঃসন্ধিকালে এরকম চিন্তা, চেতনা বা স্বপ্নে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন একটা প্রাকৃতিক ফিজিওলজিক্যাল প্রক্রিয়া। এজন্য পেটের অভ্যন্তরের সন্তানকে জেসমিন মনে করত ডাক্তার হাডসনের সন্তান এবং ডাক্তার হাডসনকে মনে করত নিজের স্বামী। পরবর্তী সামাজিক চাপে সে যখন একা হয়ে যায় তখন সারাদিন ডাক্তার হাডসনকে নিয়েই ভাবত। তার একাকিত্বের জগতে ভালোলাগার একমাত্র সঙ্গী ছিলেন ডাক্তার হাডসন। এতে ডাক্তার হাডসনের প্রতি সে আরো আসক্ত হয়ে পড়ে। কল্পনার গভীরতা তার এত বেশি ছিল যে সে সচেতন জীবন এবং অবচেতন মনের কল্পনার জীবন, এই দুই জীবনের পার্থক্য বুঝতে পারত না। তাই ধীরে ধীরে অবিশ্বাস করতে থাকে নিজের বাবা-মাকে এবং হয়ে উঠে সিজোফ্রেনিক (Schizophrenic)। একসময় এই অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতা ঘর ছাড়তে বাধ্য করে তাকে। চলে যায় কক্সবাজারে হাডসন হিলে। ঐখানে গিয়ে যখন বুঝতে পারে আসলেই ডাক্তার হাডসন বেঁচে নেই তখন আবার সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। জেসমিনের এরকম প্রেমে পড়া এবং কক্সবাজারে চলে যাওয়াটা অবিশাস্য মনে হলেও বাস্তবে মানসিক রোগীর ক্ষেত্রে সম্ভব। সত্যি কথা বলতে কি, ডাক্তার হাডসনের প্রতি তার তীব্র ভালোবাসাও ছিল এক ধরেন অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডার। এদিকে জেসমিন জানে না তাকে ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে বসিয়ে অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারে ভুগছে তার থেকে বয়সে ছোট জেহান। জেহান যদি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে তাহলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে জেসমিনের। আর যদি প্রতিশোধপরায়ণ না হয়ে ঠান্ডা থাকে তাহলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে জেহানের নিজের। অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত জেহান এখন এক মহাসংকটের নাম। কারণ সে তার ভালোবাসার কথা বলতে পারছে না তার প্রেমিকাকে, মূল কারণ নিজের উপর আস্থার অভাব। মানসিক এই ভয় বা সংকটের নাম ফিলোফোবিয়া (Philophobia)। ফিলোফোবিয়া পূর্বে প্রেম প্রত্যাখ্যানের ইতিহাস থেকে হতে পারে অথবা হতে পারে জেনেটিক কারণে! জেহানের ফিলোফোবিয়ার কারণ সম্ভবত জেনেটিক, এজন্য তাকে সুস্থ করে তোলা সত্যি বড় কঠিন।
লেখা শেষ করে ডাক্তার তরফদার চেয়ারে হেলান দিলেন। তার সামনে একটা বাঁশি। বাঁশিটা হামিদের বাঁশি। এই বাঁশি আর কখনো বাজবে না, ভাবতেই তার বুকটা হুহু করে উঠল। হামিদের মৃত্যু শুধু একটা সাধারণ মৃত্যু নয়, এক নির্মল পবিত্র ভালোবাসার মৃত্যু। এভাবে কত ভালোবাসার যে জন্ম হয় আর কত ভালোবাসার যে মৃত্যু হয় তার কোনো হিসাব নেই। পৃথিবীতে টাকাপয়সা, অর্থকড়ি, হীরা-জহরতের হিসাব থাকলেও মহামূল্যবান ভালোবাসার কোনো হিসাব থাকে না। বড় অদ্ভুত এই পৃথিবী!
ডাক্তার তরফদার সামনে ঝুঁকে বাঁশিটা তুলে নিয়ে বইয়ের পাশে খাড়া করে রাখলেন। তারপর আবার হেলান দিলেন চেয়ারে। চোখ তার ঝাপসা হয়ে আসছে। আজ তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে, খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এই কান্নাটা যতটা না হামিদের জন্য তার থেকে বেশি নির্মল এক ভালোবাসার নিষ্ঠুর মৃত্যুর জন্য। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আজ কাঁদবেন। যতক্ষণ ইচ্ছা হয় কাঁদবেন। এই কান্নার কারণেই একসময় তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল।
ডাক্তার তরফদার উপলব্ধি করলেন দরজা দিয়ে কেউ একজন ভিতরে প্রবেশ করছে। বুঝলেন হামিদ। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে আছে। দুই হাতে শিকল। কোমরেও শিকল। এসে বসল টেবিলের উলটো পাশের চেয়ারে। তার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আমি চইলা আইছি, বড় ভালো লাগে আপনেরে, অনুমতি দিলে একটু বাঁশি বাজাই।
ডাক্তার তরফদার বললেন, কেন?
পৃথিবীতে আইজও তিনডা নির্মল ভালোবাসার নিষ্ঠুর মৃত্যু ঘটছে। কেন এত ভালোবাসা মইরা যাইতেছে জানি না স্যার! এই দুঃখে বাঁশি বাজাব, কষ্টের বাঁশি, করুণ বাঁশি।
ডাক্তার তরফদার টেনে টেনে বললেন, পৃথিবী ধীরে ধীরে কৃত্রিমতায় ভরে যাচ্ছে। কৃত্রিমতা আজ ভালোবাসায়ও। মানুষ আজ দুই-তিনজনের সাথে প্রেম করে, রাখে একাধিক গার্লফ্রেন্ড কিংবা বয়ফ্রেন্ড, উদ্যাপন করে ডিভোর্স, ব্রেকআপে কাটে কেক। কী নিষ্ঠুর! কী নির্মম! ভালোবাসা যেন সৃষ্টি হচ্ছে ঝরে যাওয়ার জন্য। আর এই ঝরে যাওয়া ভালোবাসাগুলোই দুঃখ হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে চারদিকে। আসল ভালোবাসার চাইতে ঝরে যাওয়া ভালোবাসার সংখ্যাই এখন যেন বেশি। ফেসবুক, টুইটারে আজ আমাদের কত বন্ধু, কত সম্পর্ক, কত শুভাকাঙ্ক্ষী অথচ কয়টা সম্পর্ক আমাদের আত্মার, কয়টা প্রকৃত ভালোবাসার। ভালো না লাগলে মুহূর্তের মধ্যে কাউকে আমরা ব্লক করছি, কাউকে আনফ্রেন্ড করছি, কাউকে ডিলিট করছি। আহারে সম্পর্ক, আহারে বন্ধুত্ব, আহারে ভালোবাসা! কত সহজেই না হত্যা করছি, দূরে সরিয়ে দিচ্ছি, ঝরিয়ে দিচ্ছি! ভালোবাসা আজ মন জোছনার গহিনে মুক্ত নয়, বন্দি যেন চকচকে মুঠোফোনের অ্যাপসে। চিঠি লেখা আজ আটকে গেছে এসএমএস-এ, প্রিয়জনের মুখ দর্শন বন্দি ভিডিওকলে, জন্মদিনের শুভেচ্ছা কৃত্রিম অটো মেসেজে। মহামূল্যবান ভালোবাসা আজ আমাদের কাছে সত্যি যেন হয়ে উঠেছে সস্তা ইলেকট্রন প্রবাহের সাময়িক ঝলকানি। আমরা এ যুগের মানুষেরা অনুধাবন করতে পারছি না যে, ফেসবুক, টুইটার কিংবা সামাজিক মাধ্যমে ভালোবাসাকে হত্যা করতে করতে আমরা বাস্তব জীবনেও আমাদের প্রকৃত ভালোবাসাকে সহজেই দূরে সরিয়ে দিতে কিংবা হত্যা করতে শিখে যাচ্ছি। আর এজন্যই প্রকৃত ভালোবাসায় ভরপুর সুন্দর পৃথিবী ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে ভালোবাসাহীন নির্মম নিষ্ঠুর পৃথিবীতে।
ডাক্তার তরফদারের কথার মাঝেই বাজতে শুরু করেছে বাঁশি। বাঁশিতে আজ বাজছে সেই করুণ সুর, প্রিয় ভালোবাসাকে হারানোর সুর
প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়’।
ঝাপসা চোখ আরো ঝাপসা হয়ে আসছে ডাক্তার তরফদারের। তার চোখের সামনে এখন মিষ্টি মোলায়েম একটা আলো। এই আলো মনের জোছনার আলো, সংক্ষেপে বলে ‘মন জোছনা’। বড় পূত-পবিত্র এই মন জোছনা। প্রত্যেক মানুষের মনে এই মন জোছনা থাকে। বয়ঃসন্ধিকালে মন জোছনায় সৃষ্টি হয় বিপরীত লিঙ্গের কারো প্রতিচ্ছবি। মন আর মস্তিষ্ক একত্রে সকল পছন্দ, ভালোলাগা আর স্বপ্নকে সমন্বয় করে সৃষ্টি করে এই প্রতিচ্ছবি। তারপর খুঁজে বেড়ায় প্রতিচ্ছবির মানুষটিকে। যদি পায় আর জীবনসঙ্গী করতে পারে তাহলেই জীবনটা হয় আনন্দের। এই আনন্দ সুখের আনন্দ, মন জোছনার আনন্দ। আর যদি সঙ্গীকে পেয়েও হারায়, তাহলে মন জোছনার এই জগৎটা হয় কষ্ট আর কান্নার। ডাক্তার তরফদার এখন যে মনটাকে দেখতে পাচ্ছেন সেই মনটা কষ্টের মন, সঙ্গী করতে পারেনি প্রথম ভালোবাসার মানুষটিকে। তাইতো এই মনের জোছনা আজ অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ছে বিবর্ণ পৃথিবীতে, এ যে বড় কষ্টের ‘মন জোছনার কান্না!
*
আজ জেসমিনের বিয়ে। ডাক্তার তরফদার আমন্ত্রণ পেয়েছেন। তার অবশ্য আসার ইচ্ছা ছিল না। তারপরও তিনি এসেছেন। কারণ জেহানের জন্য তাকে আসতে হয়েছে। জেহানকে তিনি চোখে চোখে রাখছেন। বেশ উফুল্ল জেহান। আগে তাকে কখনো এতটা উৎফুল্ল দেখেননি ডাক্তার তরফদার। এটাই তার আচরণের সন্দেহজনক দিক, যা অনুমান করেছিলেন তাই ঘটছে জেহানের ক্ষেত্রে। জেহানের আচরণের বৈপরীত্য বলছে আসলেই সে একজন একিউট অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারের রোগী, কারণ জেসমিনের বিয়েতে তার কখনোই হাসিখুশি থাকার কথা নয়।
ডাক্তার তরফদার এক ফাঁকে জেহানের বাবা আবুল হাসেমের সাথে পরিচিত হলেন। পরিচয়ের মাঝেই আবুল হাসেম সাহেব বললেন, দেখলেন কী ভাগ্য মেয়েটার! এই বয়সে অন্যের সন্তান পেটে ধরেছিল। আর এখন কিনা বিয়ে করে চলে যাচ্ছে আমেরিকায়!
আপনি বোধহয় সবকিছু শোনেননি!
সবই শুনেছি। নুসরাত জাহান নামক এক ডাক্তারকে দিয়ে এমন নাটক তৈরি করেছে যা অবিশ্বাস্য। ঐ নাটক সবাই বিশ্বাস করলেও আমি করিনি। যাইহোক, আমি জেসমিনের মঙ্গল কামনা করি। সে সুস্থ থাকলে আমাদের তো কোনো সমস্যা নেই।
আবুল হাসেমকে জেহানের ভালোবাসার কথা বলা উচিত কি উচিত না এ ব্যাপারে যথেষ্ট ভেবেছেন ডাক্তার তরফদার। শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলবেন না। কারণ তিনি জানতেন আবুল হাসেম একজন ব্যবসায়ী, আধুনিক ধ্যান ধারণা তার মধ্যে কম। জেহান যে জেসমিনকে সত্যি পছন্দ করে এ ধরনের কথা তাকে বললে তিনি কখনো বিশ্বাস করতেন না। তার এই অবিশ্বাস জেহানের উপর আরো মানসিক চাপ তৈরি করত এবং সংসারে ভয়ানক বিপর্যয় টেনে আনত। জেহানের মনে তার বাবা-মায়ের প্রতিও ঘৃণার জন্ম হতো। তবে তিনি অনুভব করছেন এখন বলার সময় এসেছে।
ডাক্তার তরফদার এবার সরাসরি তাকালেন আবুল হাসেমের চোখে। বললেন, আপনি জানেন আমি জেসমিনের অসুস্থতার বিষয়টা নিয়ে কাজ করেছি কিছুদিন।
জি শুনেছি।
আমি আর একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই আপনার সাথে।
কী বিষয়?
আপনার ছেলে জেহান এখন বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত। এই ফাঁকে জেহানের ঘরটা আমি সার্চ করতে চাই।
কী বলছেন! কেন?
আপনাদের মঙ্গলের জন্য।
আবুল হাসেম রেগে উঠে বললেন, আপনি কি পুলিশ নাকি যে আমার ছেলের ঘর সার্চ করবেন। সে কি কোনো অপরাধের সাথে জড়িত?
আমি আপনাকে বিনয়ের সাথে বলছি সার্চ করা অতীব জরুরি। কারণ আমার ধারণা আজ রাতে জেহান আত্মহত্যার চেষ্টা করবে। তাকে বাঁচানো আমার দায়িত্ব।
আমার ছেলে আত্মহত্যা করবে কেন! কী সুন্দর হাসিখুশি সে, দেখেছেন? গত কয়েক মাসে তাকে এরকম হাসিখুশি কখনো দেখিনি।
এটাই সমস্যা। আপনার সন্তান অসুস্থ। কেউ না জানলেও আমি জানি। আমার কথা বিশ্বাস করুন। তা না হলে বড় বিপদ হতে পারে আপনাদের। কারণটাও বলে দেই, জেহান পছন্দ করত জেসমিনকে। জেসমিনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার বিষয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে। আমাকে বলেছে জেহান। যেহেতু এই বিয়ে সে ঠেকাতে পারছে না তাই হাসিখুশির ভান করছে, তার মনে ভয়ানক এক কষ্ট রয়েছে যা তাকে বিষণ্ণতার চরমে পৌঁছে দিয়েছে। বিষণ্ণতা যেন প্রকাশ না পায় এজন্য কৃত্রিম হাসিতে ভরিয়ে রেখেছে মুখটা। আজ রাতে এই বাড়ি থেকে জেসমিন চলে যাওয়ার পরই ভয়ানক কিছু একটা ঘটবে। কী ঘটবে আমি জানি না। তবে ভয়ানক ঐ ঘটনাগুলো প্রতিরোধ করতে হবে আমাদের।
আবুল হাসেম চরম বিরক্তি প্রকাশ করে দূরে সরে গেলেন। এর মধ্যে খাওয়াদাওয়ার দ্বিতীয় পর্ব শেষ হয়েছে। ডাক্তার নুসরাতও এসেছেন আজ। চলে যাওয়ার সময় জেসমিনের বাবা নাজমুল হোসেন বললেন, ম্যাডাম, আপনার জন্যই আমার মেয়ে আজ নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে।
নুসরাত জাহান ডাক্তার তরফদারকে দেখিয়ে বললেন, আমার জন্য না, তরফদার স্যারের জন্যই বেঁচে গেছে জেসমিন। স্যারই প্রথমে ধারণা দেন বিষয়টি সম্পর্কে। কক্সবাজার থাকা অবস্থায়ই তিনি আমাকে তার সন্দেহের কথা জানান। তা না হলে আমিও ভুল করতাম হয়তো। যাইহোক, ভালো থাকবেন, জেসমিন সুস্থ থাকুক, সুন্দর থাকুক এই কামনা করছি।
নুসরাত জাহান চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন আবুল হাসেম। তাকে কেন যেন এখন খানিকটা ভীত দেখাচ্ছে। কাঁপা কণ্ঠে বললেন, স্যার চলুন, আমাদের বাড়ি চলুন।
ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করলেন আবুল হাসেম তাকে স্যার সম্বোধন করে কথা বলছে এখন। তার মানে আসলেই তিনি ভয় পেয়েছেন। জেহানের ঘর সার্চ করে ড্রয়ারের মধ্যে একশটা ঘুমের ওষুধ পাওয়া গেল। পাওয়া গেল জেসমিনকে নিয়ে লেখা ডায়ারিটাও। ডায়ারির মধ্যে শেষ চিঠির শেষ লাইনে লেখা, ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অর্থহীন, তাই আজ রাতে আমিও চলে যাব পৃথিবী ছেড়ে, ভালো থেকো প্রিয়তমা আমার, প্রিয় জেসমিন।
আবুল হাসেম বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, এ আমি কী দেখছি!
আপনি তো সব নিজের চোখে দেখছেন। চিঠিটা আজ সকালে সে লিখেছে। তারিখ আছে নিচে।
বিশ্বাস করতে পারছি না আমি!
বিশ্বাস করা না-করা আপনার বিষয়।
আসলেই কি সব সত্য!
ডাক্তার তরফদার মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, ঘুমের ওষুধ খেয়েই আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেহান। তবে আত্মহত্যা তাকে করতে দেয়া যাবে না। আমি আজ জেহানকে সাথে করে নিয়ে যেতে চাই। কারণ আপনারা চেষ্টা করলেও তাকে শান্ত রাখতে পারবেন না। শেষে দরজা আটকে না আবার গলায় দড়ি দেয়। আজ রাতে তাকে শান্ত রাখতে হলে তার প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে গল্প করতে হবে। আপনাদের সাথে সে এ বিষয়ে কথা বলতে পারবে না, কারণ সে জানে না তার ভালোবাসার বিষয়টা আপনি এখন জানেন। তাছাড়া আপনার সাথে স্বাভাবিকও হতে পারবে না। আমার সাথে পারবে, পারবে করিম চাচার সাথে। আমরা তার কথা যতই শুনব, ততই তার কষ্ট লাঘব হবে এবং হালকা হবে মন। আজ রাতে তার মন হালকা করাই হবে মূল উদ্দেশ্য।
আবুল হাসেম হঠাৎই ডাক্তার তরফদারের হাত ধরে বললেন, স্যার, জেহান আমাদের একমাত্র সন্তান। তাকে বাঁচান স্যার, তাকে বাঁচান!
ডাক্তার তরফদার কিছু বললেন না, ধীর-পায়ে বাইরে বের হয়ে এলেন। তার এখন প্রধান কাজ জেহানকে সাথে নিয়ে যাওয়া। তার বিশ্বাস জেহান তার সাথে যাবে।
*
রাত তিনটা।
ডাক্তার তরফদার তার চেম্বারে চেয়ারে হেলান দিয়ে আছেন। তার সামনে জেসমিনের ফাইল। সকল বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি ফাইলে লিখেছেন। জেসমিনের গর্ভে সন্তান হওয়ার বিষয়টিও লিখে শেষ করেছেন কিছুক্ষণ আগে। চেয়ার ছেড়ে উঠার আগে আবার একবার পড়বেন বলে মনস্থির করলেন এবং পড়তে শুরু করলেন।
জেসমিনের গর্ভে সন্তান হওয়ার বিষয়টি একটি বিরল ঘটনা। মানুষ সাধারণত একটি সন্তান জন্ম দেয়। তবে মাঝে মাঝে জন্ম হয় জমজ শিশুর। জমজ শিশু সৃষ্টির ক্ষেত্রে মায়ের পেটে দুটো জ্বণ থাকে। এই দুই প্রাণ একে অপরের ভাই কিংবা বোন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, একটি ঐণ ঠিকই বেড়ে উঠছে, কিন্তু অন্যটির বৃদ্ধি হচ্ছে না। যে জ্বণটি বড় হয় না, সেটি বৃদ্ধি পাওয়া জ্বণের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং সেখানেই অপেক্ষা করতে থাকে। বছরের পর বছর। বড় জ্বশটির জন্ম হলে বাবা-মা ধরে নেয় যে তাদের একটি সন্তান হয়েছে। তারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে না তার সন্তানের শরীরে রয়েছে আর-একটি সুপ্ত সন্তান। এমনকি জন্ম নেয়া সন্তান বড় হওয়া শুরু করলে নিজেও বুঝতে পারে না যে তার শরীরে রয়েছে তারই এক ভাই কিংবা বোন। সুপ্ত ঐ ভাই কিংবা বোনটি জীবনের কোনো এক পর্যায়ে হঠাৎ বড় হতে শুরু করে, প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি সে সংগ্রহ করে জন্ম নেয়া ভাই কিংবা বোনের শরীর থেকে। শরীরের ভিতরে থাকা ঐ সুপ্ত ভ্রুণটি যত বড় হতে থাকে ততই আকার নিতে থাকে মানুষের। থাকে মাথা, হাত, পা, গজায় চুল, গঠিত হয় হাড়। শিশু বড় হওয়ার এই অস্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলে ফেটাস ইন ফেটু (Fetus in Fetu)। প্রতি পাঁচ লক্ষ শিশু জন্মগ্রহণের ক্ষেত্রে মাত্র একটি এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। সাধারণত প্রথম শিশুটির জনের তিন-চার বছর পর থেকে বিশ বছরের মধ্যে বড় হতে শুরু করে দ্বিতীয় জ্বণ। শতকরা আশি ভাগ ক্ষেত্রে এই সুপ্ত ভ্রণটি তলপেটে বা শরীরের ফাপা জায়গায় বড় হয়। শরীরের অন্য জায়গায় বড় হতে থাকলে টিউমার বলে ভুল হয়। যদি ইউটেরাস এর পাশে বড় হতে থাকে তাহলে মনে হবে সন্তান বড় হচ্ছে। জেসমিনের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। তার সুপ্ত বোনটি বড় হয়েছে তার ইউটেরাসের উপরে। গর্ভে সন্তান বড় হওয়ার স্থান মায়ের ইউটেরাস। এজন্য আলট্রাসনোগ্রাম দেখে জেসমিনের বোনটিকে মাতৃগর্ভে বড় হওয়া মানব সন্তান বলেই মনে হয়েছে। আর জেসমিনের পেটের শিশুটি যে তারই বোন ছিল তা প্রমাণিত হয়েছে ডিএনএ টেস্টে। শিশুটির ডিএনএ’র সাথে মিলে গেছে নাজমুল হোসেন এবং তার স্ত্রীর ডিএনএ। তাদের ক্ষেত্রে ফেটাস ইন ফেটু তত্ত্বটি আরো সমর্থনযোগ্য কারণ নিলুফার ইয়াসমিনের পরের দুই সন্তান যমজ, যাদের নাম জয় এবং জনি। এতে বোঝা যায় তার শরীর যমজ সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম। দুঃখের বিষয় হলো এ ধরনের জ্বণ বা শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হয় না এবং শরীরের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করে। জেসমিনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কক্সবাজারে যখন সে ডাক্তার হাডসনের অনুসন্ধান করছিল তখন তার শরীরের অভ্যন্তরে থাকা শিশুটি মারা যায়। ঢাকা এনে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন করা সম্ভব হয়েছে বলে বেঁচে গেছে জেসমিন নিজেও।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন একজন ডাক্তার ধরতে পারল না বিষয়টি? আসলে হিউম্যানিটি ক্লিনিকে আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টগুলো একজন টেকনিশিয়ান দেখে স্বাক্ষর করত। ডাক্তার না পাওয়ায় এই অপকর্মটিকে প্রশ্রয় দিত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমনকি রোগীর শারীরিক অবস্থা দেখে প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টও লিখত, টেস্ট পর্যন্ত করত না। জেসমিনের যে প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট এবং আলট্রাসনোগ্রাম করা হয়েছিল সেগুলোর রেকর্ড পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে আসলে যথাযথভাবে পরীক্ষাগুলো করা হয়নি। ক্লিনিকটি মানুষকে চিকিৎসার মাধ্যমে সেবা প্রদানের পরিবর্তে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের দিকেই জোর দিয়েছিল বেশি। এমনকি নার্সকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে চিকিৎসা প্রদান করার প্রমাণও মিলেছে। এজন্য পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে ক্লিনিকটি। মামলা করেছে ক্লিনিকের বিরুদ্ধে। এরকম শত শত ক্লিনিক আর প্যাথলজিক্যাল ল্যাব গড়ে উঠেছে দেশের আনাচে-কানাচে, যেগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ করা বড় জরুরি।
কোনো নারী গর্ভবতী হলে তাকে দোষারোপ করা উচিত নয়। জেসমিনের মতো অবস্থা যদি গ্রাম-গঞ্জে কোনো নারীর হয় তাহলে তার কী অবস্থা হবে নিশ্চয় অনুমেয়। শারীরিক সমস্যা যেন সামাজিক সমস্যায় পরিণত না হয়। মনে রাখতে হবে সকল সমস্যাই সমাজের সমস্যা, তাই সমাজের মানুষের উচিত মনগড়া গুজব না ছড়িয়ে সমস্যার দ্রুত সমাধান করা।
জেসমিন সত্যি সৌভাগ্যবান। জটিল পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়েছে সে। সিজোফ্রেনিয়া, অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডার, হ্যালুসিনেশন, ডিপ্রেশন এগুলো একেবারে তাকে কাবু করে ফেলেছিল। এজন্য সে চলে গিয়েছিল কল্পনার জগতে ডাক্তার হাডসনের কাছে। ঠিক ঐ সময় ফেটাস ইন ফেটুর (Fetus in Fetu)* কারণে তার পেটের শিশুটি বড় হতে শুরু করলে ব্যথা শুরু হয়। ডাক্তার হাডসনের সাথে শারীরিক সম্পর্কের স্বাপ্নিক কল্পনার প্রভাবে নিজেকে গর্ভবতী ভাবতে শুরু করে এবং মানসিকভাবে মেনেও নেয়। এজন্য অবচেতন মনের কল্পনায় ডাক্তার হাডসন এবং শিশুটি হয়ে উঠে তার ভালোলাগার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ডাক্তার হাডসনের অস্তিত্বকে মিথ্যা অনুভব করার চেষ্টা করলেও উপেক্ষা করতে পারেনি শিশুটির অস্তিত্বের কারণে। একই সময়ে ডাক্তার হাডসনের নাম শোনা এবং শিশুটির বড় হয়ে উঠার বিষয়টি হয়তো কাকতালীয় বিষয়। পৃথিবীতে এমন অনেক কাকতালীয় ঘটনা ঘটে যেগুলো আমরা বিশ্বাস করতে চাই না, আবার বিশ্বাস না করেও থাকতে পারি না। যাইহোক, জেসমিন সুস্থ হয়েছে এটাই বড় কথা। তার জীবন হোক আরো সুখের, আরো আনন্দের।
[* Fetus in Fetu সম্পর্কে অধিকতর জানতে চাইলে Fetus in Fetu লিখে Google কিংবা You Tube-এ সার্চ দিলে বিস্তারিত জানা যাবে।]
ডাক্তার তরফদার চেম্বার থেকে বের হয়ে এলেন। বাইরের বাগানে। বেঞ্চের উপর শুয়ে আছে জেহান। তার পাশে করিম চাচা। কথা বলে যাচ্ছে দুজন। জেসমিনের বিয়ে শেষে রাত সাড়ে বারোটার দিকে জেহানকে নিয়ে এসেছেন তিনি। কিছুক্ষণ কথাও বলেছেন। কিন্তু জেহানের কথা বলার আগ্রহ করিম চাচার সাথে বেশি। তাই তিনি সরে এসেছেন।
কাছে আসতে জেহান উঠে বসে বলল, স্যার, করিম চাচাকে কত অনুরোধ করলাম, কিছু বলল না।
ডাক্তার তরফদার করিম চাচার দিকে তাকালেন।
জেহান আবার বলল, চাচা, একটা কথা বলি। কোনো কারণে যদি জেসমিনের স্বামী মারা যায়, তাহলে কিন্তু আমি জেসমিনকে বিয়ে করব।
করিম চাচা নিশ্চুপ।
জেহান এবার বলল, চাচা, শুধু একবার, একবার বলুন, একটা দিনের জন্য হলেও কি জেসমিন আমাকে ভালোবাসবে?
করিম চাচা মৃদু হেসে বলল, অন্যের স্ত্রী আপনেরে ভালোবাসবে ক্যামনে?
ডাক্তার তরফদার ইচ্ছে করেই কথা বললেন না, এসে বসলেন বারান্দায়। করিম চাচা আর জেহান কথা বলছে বলুক। কেন যেন করিম চাচার সাথে কথা বলতে জেহানের আগ্রহটা বেশি, লক্ষ করেছেন তিনি। অবশ্য দূরে বসলেও তাদের কথোপকথন ঠিকই তার কানে আসছে।
জেহান এবার জিজ্ঞেস করল, চাচা কিছু একটা বলুন, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
বিড়বিড় করে করিম চাচা এবার বলল, আপনের উচিত কিছুক্ষণ ঘুমান।
আমার ঘুম আসছে না। আমি জেসমিনকে দেখতে চাই। কীভাবে দেখব? কিছু একটা বলুন চাচা। আপনিতো ভবিষ্যৎ বলতে পারেন।
করিম চাচা এবার জোরে শ্বাস নিল। তারপর বলল, আপনে আজ মুক্তোর মালাডা দিয়েছেন জেসমিন ম্যাডামরে, তাই না?
জেহান চোখ বড় বড় করে বলল, আপনি জানলেন কীভাবে? ঐ সময় তো অন্য কেউ উপস্থিত ছিল না। পৃথিবীর কারো এই বিষয়টা জানার কথা না যে বিয়ে উপলক্ষ্যে তাকে আমি একটা মুক্তোর মালা উপহার দিয়েছি।
ঐ মালাডা জেসমিন ম্যাডাম খুব পছন্দ করছেন। তিনি দেশে ফিরে আসবেন কোনো এক মাসের প্রথম শুক্রবার। সময় হবে বিকেল, আছর আর মাগরিবের মাঝামাঝি। ঐ দিন তার গলায় আপনের মুক্তোর মালাডা থাকবে।
জেহান লাফ দিয়ে উঠে বলল, সত্যি চাচা!
জি, এখন চলেন ঘুমাইতে যাই, অনেক রাইত হইছে।
জেহান আর কোনো কথা বলল না। উঠে হাঁটতে শুরু করল। সত্যি সে ঘুমাবে, দীর্ঘক্ষণ ঘুমাবে। অনেক, অনেকদিন পর আজ কেন যেন তার ভালো লাগছে। কারণ মুক্তোর মালাটা পছন্দ করেছে জেসমিন। নেয়ার সময় সে অবশ্য কিছু বলেনি। কিন্তু করিম চাচা বলেছে। করিম চাচা কখনো মিথ্যা বলে না এবং করিম চাচার ভবিষ্যদ্বাণীও মিথ্যা হয় না। আবার সে দেখতে পাবে জেসমিনকে, তারই দেয়া মুক্তোর মালা গলায় দেয়া অবস্থায়, পৃথিবীতে এর চাইতে বড় প্রাপ্তি আর কী আছে!
*
শুক্রবার সন্ধ্যা।
ডাক্তার তরফদার চট্টগ্রাম যাচ্ছেন। উদ্দেশ্য হাডসন হিলে একটা রাত কাটাবেন। তার যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। ইরফান আলীর আমন্ত্রণে যাচ্ছেন তিনি। একটা রাত হাডসন হিলে কাটাবেন, পূর্ণিমার রাত। সাথে নাকি ওসি সাহেবও থাকবেন।
ওসি সাহেব জানিয়েছেন, ব্রিটিশ এম্বেসির সম্মতি মোতাবেক ডাক্তার হাডসনের কঙ্কাল হাডসন হিল আর কোকোনাট হিলের মাঝে মাটি দেয়া হয়েছে। কবরটির নাম রাখা হয়েছে ‘হাডসন গ্রেভ’। ডাক্তার হাডসনের কোনো সন্তান না থাকায় হাডমিন লকেটটিকে বাংলাদেশ সরকারকে দিয়ে দিয়েছে এম্বেসি কর্তৃপক্ষ। লকেটটিকে হাডসন হাউস অর্থাৎ গুহার মধ্যে একটা চারকোনা বুলেটপ্রুফ কাঁচের অবয়বের মধ্যে রাখা হয়েছে। পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে ইদানীং। হাডসন হিল, কোকোনাট হিল, রেড হাট, স্টোন গার্ডেন, এলিজা স্টোন, হেভেন হিল, হাডসন গ্রেভ, ওয়াটার গার্ডেন, হাডসন হাউস, গ্রিন হিল, হাডসন ভাস্কর্য, হাডমিন লকেট, লাভ স্টোন দেখার জন্য এখন শত শত পর্যটক আসে। পর্যটকদের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ থাকে এলিজা স্টোনকে নিয়ে। তারা আর যাই করুক বা না করুক এলিজা স্টোনে উঠে একটা ছবি তুলবেই তুলবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এলিজা স্টোন কখনো পানিতে ডুবে না। এমনকি পরিপূর্ণ জোয়ারের সময়ও না। এ যেন অমর ভালোবাসার চিরায়ত নিদর্শন।
পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে হাডসন হিলে বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশ একটা দপ্তরও খুলেছে। বিদেশিদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। তিন শ মিটার দূরে একটা ফাইভ স্টার হোটেল তৈরি হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে হাডসন হিল বাংলাদেশের অন্যতম একটা টুরিস্ট স্পটে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে।
এয়ারপোর্টে প্রবেশের রাস্তায় হঠাৎ ডাক্তার তরফদারের মনে হলো পরিচিত কাউকে তিনি দেখলেন। গাড়ি থামিয়ে ভালোমতো তাকাতেই দেখলেন জেহান। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল জেহান। দূর থেকে ডাক দিতে কাছে এসে মিষ্টি করে হাসল। অবাক হয়ে বললেন, এখানে কী করছ তুমি!
স্যার আপনি জানেন কী করছিলাম।
মানে?
অপেক্ষা করছি জেসমিনের জন্য। মাসের প্রথম শুক্রবার আছর থেকে মাগরিব পর্যন্ত আমি এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করি। কোনো একদিন জেসমিন আসবে। আমার দেয়া মুক্তোর মালাটা গলায় পরে থাকবে স্যার।
ডাক্তার তরফদার কী বলবেন কিছু বুঝতে পারলেন না। তিনি জেহানকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললেন, জেহান, যদি পারতাম তাহলে তোমার মনের সব কষ্ট আমি নিয়ে নিতাম। তোমার মন জোছনার কান্না আমার হৃদয়টাকে ভেঙে দিচ্ছে। যাও, বাড়ি যাও।
জেহান হাত দিয়ে চোখ মুছে বল, স্যার আজও জেসমিন আসেনি। তবে একদিন আসবে, কারণ করিম চাচা বলেছে। করিম চাচা কখনো মিথ্যা বলে না, করিম চাচার ভবিষ্যদ্বাণী কখনো মিথ্যা হয় না।
কথাগুলো বলতে বলতে জেহান চলে গেল, শেষ মুহূর্তে ডাক্তার তরফদার তার চোখের পানি দেখতে পেয়েছিলেন। এই কান্না মন জোছনার কান্না।
ডাক্তার তরফদার উপলব্ধি করছেন, জেহান এখন অনেকটাই সুস্থ। তার সবকিছুই স্বাভাবিক। শুধু মাসের প্রথম শুক্রবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা। পর্যন্ত এয়ারপোর্টে আগমনী লাউঞ্জের সামনে থাকে সে। কারণ জেসমিন একদিন আসবে, সত্যিই আসবে জেহানের দেয়া মুক্তোর মালা পরে। করিম চাচা বলেছে। করিম চাচা মিথ্যা বলে না, করিম চাচার ভবিষ্যদ্বাণীও মিথ্যা হয় না। আর যেদিন সত্যি জেসমিন আসবে মনের আশা পূরণ হবে জেহানের। জেহান সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে। তবে এটা সত্য, জেহান বোধহয় আর কোনোদিন কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। কারণ তার মনের সব ভালোবাসা শুধু একজনেরই জন্য, আর সে হলো জেসমিন। জেসমিন বড় অভাগা, তার জন্য রক্ষিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভালোবাসার ভান্ডারের সন্ধান সে পায়নি। পৃথিবীতে খুব কম নারী কিংবা পুরুষ আছে যারা তাদের জন্য রক্ষিত সবচেয়ে বৃহৎ ভালোবাসার ভান্ডারকে খুঁজে পায়। অবশ্য এদিক দিয়ে সৌভাগ্যবতী ছিল এলিজা জেসমিন। বুকভরা ভালোবাসা পেয়েছিল ডাক্তার হাডসনের কাছ থেকে। তার মৃত্যুর পরও সেই ভালোবাসা আর আশা নিয়ে বেঁচে ছিলেন ডাক্তার হাডসন। কিন্তু ভালোবাসায় আর পূর্ণতা আসেনি। বড় অদ্ভুত এই পৃথিবী, পৃথিবীর বড় বড় ভালোবাসাগুলো কেন যেন পূর্ণতা পায় না। পূর্ণতা পায়নি রোমিও জুলিয়েট, শিরি ফরহাদ, লাইলী মজনুর ভালোবাসা, বিচ্ছেদই ছিল যেন চূড়ান্ত পরিণতি। তেমনি কোনোদিন পূর্ণতা পাবে না জেহান-জেসমিনের ভালোবাসাও।
ডাক্তার তরফদার আরো উপলব্ধি করলেন, পৃথিবীতে ভালোবাসার কমতি নেই, আবার ব্যক্তিজীবনে ভালোবাসার পূর্ণতাও যেন নেই। অপূর্ণ ভালোবাসা নিয়ে অধিকাংশ মানুষ বেঁচে থাকে পরিপূর্ণ ভালোবাসার আশায়। অথচ মানুষ জানে না, পরিপূর্ণ ভালোবাসা বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই। কারণ ভালোবাসার ব্যাপ্তি সীমাহীন। একজনকে যত ভালোবাসা যায়, ভালোবাসা ততই সৃষ্টি হয়। আর এই ভালোবাসার সৃষ্টিটাই হলো আনন্দ আর ভালোলাগা। ভালোবাসার বিভাজন ভালোবাসায় পূর্ণতা আনে না, আনে শুধু শূন্যতা। তাই বিভাজন নয়, ভালোবাসা যেন চিরায়ত হয় প্রথম প্রেমের মানুষটির জন্য, তাহলেই ভালোবাসা হবে সর্বোচ্চ আনন্দের আর উপভোগের।
ডাক্তার তরফদার দ্রুত পা বাড়ালেন। তাকে যে হাডসন হিলে পৌঁছাতে প্লেন ধরতে হবে। যখন এয়ারপোর্টে প্রবেশের দরজার একেবারে কাছে তিনি, তখনই গানের সুর ভেসে এলো তার কানে,
প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়’।
Leave a Reply