মনের মতো মন – কাসেম বিন আবুবাকার
প্রথম প্রকাশ – মে ২০০৩
.
উৎসর্গ
তিন বছরের ছোট বোন ফৌজিয়া খানুম ও তার স্বামী
পশ্চিম বাংলার হাওড়া জেলার বাগনান কাঁচারীপাড়া
গ্রামের মরহুম জামসের আলি বেগ, যাদের শ্রদ্ধা ও
ভালবাসার ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না।
.
রাত সাড়ে দশটা। এ বছর শীত পৌষ মাসের পনের তারিখ থেকে পড়েছে। তার আগে শীতকাল বলে জানাই যায় নি। বিশ বাইশ তারিখ থেকে শৈত্যপ্রবাহের ফলে হাড় কাঁপানো শীত পড়েছে। আজ এক সপ্তাহ শৈত্যপ্রবাহ চলছে। উত্তর বাংলায় গরিব, বৃদ্ধ, শিশু ও রুগীদের মধ্যে প্রায় তিন চারশর মতো মারা গেছে।
আমজাদের তেমন গরম কাপড় নেই। অনেক দিনের পুরোনো মোটা গেঞ্জি, শার্ট, হাফ হাতা সোয়েটার ও কানে মাফলার জড়িয়ে অফিস থেকে বেরোল। শাঁ শাঁ শব্দে হিমেল বাতাস গায়ে লাগতে কেঁপে উঠল। এতক্ষণ অফিসের ভিতর গরমে বেশ আরামেই ছিল।
সে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা অফিসের প্রুফরিডার। অফিসের কাছেই মসজিদ ও তার পাশে খাবার হোটেল। মসজিদে এশার নামায পড়ে হোটেলে ভাত খেয়ে যখন বেরোল তখন সাড়ে এগারোটা। তাকে এখন হেঁটে যেতে হবে পল্টন। সেখান থেকে বাসে কাওরান বাজার। তারপর প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে গণি ভাইয়ের অফিস। সেখানে সে রাত্রে ঘুমায়। গণি ভাই বলে দিয়েছেন, এখানে যে তুমি থাক বাড়িওয়ালা বা অফিসের কেউ যেন না জানে। তাই রাত বারটা একটার সময় এসে খুব সাবধানে গেট টপকে চোরের মতো ঢুকে। আর সকাল নটার আগে বেরিয়ে যায়।
এম. এ. পাশ করে যে কোনো একটা চাকরির জন্য যখন হন্যে হয়ে ঘুরছিল তখন হঠাৎ একদিন একটা অফিসের সামনে গণি ভাইকে একজন লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। লোকটার সঙ্গে কথা শেষ করে চলে যেতে দেখে দ্রুত এগিয়ে এসে সালাম দিল।
গণি ভাই সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আরে আমজাদ যে, কি খবর?
গণি ভাই আমজাদের বাবার খালাত ভাইয়ের ছেলে। আমজাদ যখন। ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হয় তখন গণি ভাই মাষ্টার্সের শেষ বর্ষে। সে বছর ইলেকসানের সময় তাদের পরিচয় হয়। তারপর কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ হলেও এতবছর পর তাকে যে চিনতে পেরেছেন, তাতেই আমজাদ খুশী। বলল, যে। কোনো একটা চাকরি আমার খুব দরকার। কত অফিসে ঘুরলাম, কত ইন্টারভিউ দিলাম, কিন্তু কিছুই হল না।
গণি ভাই বললেন, আজকাল চাকরি পাওয়া খুব মুস্কিল। তারপর একটা ভিজিটিং কার্ড তার হাতে দিয়ে বললেন, এখন আমি খুব ব্যস্ত। কাল বারোটার সময় আমার অফিসে এস।
পরের দিন আমজাদ সময়মতো গণি ভাইয়ের অফিসে গেল।
গণি ভাই বললেন, আপাতত একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা অফিসে প্রুফ রীডারের কাজ কর। মাসে হাজার খানেক পাবে। পরে ভালো একটা কিছু ব্যবস্থা করা যাবে।
আমজাদ বলল, আমিতো প্রুফ দেখতে জানি না।
তাতে কি হয়েছে? অফিসে এ. টি দেব-এর বেঙ্গলী টু ইংলিশ ডিকশনারী আছে। কিভাবে প্রুফ দেখতে হয় ওটার পিছনে লেখা আছে। দুচার দিন ওটা দেখে প্রুফ দেখলে শিখে যাবে। তা ছাড়া আমি অফিসের বড় বাবুকে বলে দেব সে যেন তোমাকে সাহায্য করে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি থাক কোথায়?
মহসীন হলে এক বন্ধুর রুমের মেঝেয় থাকি, খাই হোটেলে।
তা হলে তো তোমার খুব অসবিধে হচ্ছে। এক কাজ করতে পার, আমার এই অফিসেই থাকতে পার রাতে। তারপর কিভাবে থাকবে বলে দিয়েছিলেন।
সেই থেকে আজ ছয় মাস পত্রিকা অফিসে প্রুফ রিডারের কাজ করছে আর রাতে গণি সাহেবের অফিসে ঘুমাচ্ছে।
হিমেল বাতাসে গা কাঁটা দিয়ে উঠছে। শরীর গরম করার জন্য জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। শুধু চোখ দুটো ফাঁকা রেখে মাফলার দিয়ে নাক, কান ও মুখ ডেকে দিয়েছে। তবু ঠাণ্ডা মানছে না। ঠাণ্ডা ও হিমেল বাতাসের কারণে রাস্তায় কোনো লোকজনের চলাচল নেই। মতিঝিলের মতো রাস্তায়ও গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। তবে অফিসের সামনের ফুটপাতগুলোতে দু’একজন করে দেহপসারিণীকে এত ঠাণ্ডাতেও সেজেগুজে খদ্দেরের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।
সেও ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিল। তাদের একজনকে পাশকেটে যাওয়ার সময় মেয়েটি বলে উঠল, এই যে ভাই, শুনুন।
আমজাদ না শোনার ভান করে হাঁটতে লাগল। মাত্র কয়েক গজ এসেছে এমন সময় আর একটা মেয়ে তার পথরোধ করে বলল, সায়লার থেকে আমার রেট কম। চলুন কোথায় নিয়ে যাবেন।
ওদের ব্যাপারে আগে আমজাদ কিছুই জানত না। এক গরমের রাতে বাসায় ফেরার সময় আদমজী জুট মিলের দারোয়ান সোলেমানের সঙ্গে পরিচয় হয়।
সে দিন কারেন্ট না থাকায় সোলেমান গেটের বাইরে টুলে বসে বিড়ি কুঁকছিল। বয়স প্রায় পঞ্চাশের মতো। তখন রাত একটা। এত রাতে আমজাদকে যেতে দেখে ডেকে আলাপ পরিচয় করে ।
আমজাদ এক সময় জিজ্ঞেস করেছিল, এত রাতে যোয়ান যোয়ান মেয়েরা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকে কেন।
সোলেমান বলেছিল, ওরা দেহ বিক্রি করে টাকা রোজগার করে। আপনি ভদ্রঘরের শিক্ষিত ছেলে। খবরদার, ওদের পাল্লায় পড়বেন না।
আমজাদ তওবা নাউজুবিল্লাহ পড়ে বলেছিল, কি যে বলেন চাচা, আল্লাহর কোনো মুমিন বান্দা এরকম খারাপ কাজ করতে পারে না।
তারপর থেকে মাঝে মধ্যে সোলেমানের সঙ্গে আমজাদের দেখা হলে কিছুক্ষণ আলাপ করে।
আজ মেয়েটি পথরোধ করে এই কথা বলতে আমজাদ বলল, সরে দাঁড়াও, আমি এই লাইনের লোক নই। কথা শেষ করে পাশকেটে চলে যেতে উদ্যত হল।
মেয়েটি খপ করে তার একটা হাত ধরে বলল, যাদের পকেটে কম টাকা থাকে তারা ঐ রকম বলে। ঠিক আছে, যা আছে তাই দেবেন।
এমন সময় একটা জীপ গাড়ি এসে থামতে মেয়েটি হাত ছেড়ে দিয়ে ছুটে গলিতে ঢুকে পড়ল।
গাড়ি থেকে একজন পুলিশ অফিসার নেমে এসে আমজাদকে বললেন, চল, গাড়িতে ওঠ।
কেন?
কেন? তোমাকে জামাই করব। শ্বশুরবাড়ি চল।
আশ্চর্য! আমি কোনো অন্যায় করি নি। তবু আমাকে গাড়িতে উঠতে বলছেন কেন?
অফিসার একজন সেপাইকে ইঙ্গিত করতে সে এসে আমজাদের হাত ধরে টানতে লাগল।
আমজাদ বলল, আপনি ভুল করছেন। যা ভাবছেন, সে রকম ছেলে আমি। নই।
অফিসার রেগে উঠে বললেন, ধরা পড়লে সবাই এ কথা বলে।
দেখুন, আমি পত্রিকা অফিসে কাজ করি। কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলাম। ঐ মেয়েটি আমার পথরোধ করে। পকেটে পয়সা নেই বলে প্রতিদিন এই পথটা হেঁটে যাই।
ওসব আমরা বুঝি। ভালোভাবে চল, নচেৎ এই শীতে পিটিয়ে গা গরম করব। তারপর আবার বললেন, ঠিক আছে তুমি সামনে ওঠো, আমার পাশে বসবে। গাড়ি স্টার্ট দেয়াই ছিল। ওরা গাড়িতে উঠতেই চলতে শুরু করল।
আমজাদ বলল, আমার কথা শুনুন, থানায় নিয়ে গিয়ে আমাকে পেটান ছাড়া আপনার কোনো লাভ হবে না। আমার পকেটে পাঁচ টাকা ছাড়া কিছুই নেই। আর ঢাকাতে আমার এমন কেউ নেই যে, খবর দিলে টাকা নিয়ে ছাড়াতে আসবে। আমি গ্রামের ছেলে। হলে থেকে এ বছর মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষার পর হল থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। চাকরির চেষ্টা করেও ভালো কিছু না পেয়ে বাধ্য হয়ে একটা পত্রিকা অফিসে সামান্য বেতনে চাকরি করছি।
আমজাদের কোয়ালিফিকেশন শুনে পুলিশ অফিসারের মন নরম হল। সেই সাথে টাকা নেই শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বললেন, মেয়েদের ইন্টারভিউ নেয়া হচ্ছিল বুঝি? আজকাল ভদ্রলোকের ছেলেমেয়েরা পত্রিকায় খারাপ মেয়ে। মানুষের গল্প পড়তে ভালবাসে। তা এতক্ষণ সে কথা বলেন নি কেন?
আমিতো বলতে চেয়েছিলাম, আপনি সময় দিলেন না।
যাবেন কোথায়?
কাওরান বাজার।
গত রাতেও বউনি হয় নি, আজও যদি না হয়। তা হলে … উহ্।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমজাদের হাসি পেল। হাসি চেপে রেখে ভণিতা। করে জিজ্ঞেস করল, বউনি মানে?
আরে মশায়, এই সামান্য কথাটাও বুঝতে পারলেন না? আমি সেপাইদের নিয়ে তেল পুড়িয়ে সারারাত হাওয়া খেতে বেড়াই নাকি? আমার বাড়ি মফস্বল টাউনে। সেখানকার কলেজে প্রফেসারি করতে পারতাম। তা না করে পুলিশে ঢুকেছি দু’টো পয়সা রোজগার করার জন্য। আজকাল শুধু বেতনের টাকায় কোনো শালার চলে নাকি? আমার তিন মেয়ে, দুই ছেলে। তাদের পড়াশোনার খরচ মাসে পাঁচ হাজার টাকা। তারপর মেয়েদের বিয়ের ব্যাপার আছে। সেই টাকা আসবে কোত্থেকে? অবশ্য আমার স্ত্রী খুব হিসেবী। বেতনের টাকা সবটাই ব্যাঙ্কে জমা রাখে। আর এই উপরি টাকা যা পাই তাই দিয়ে সংসার ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে।
আমজাদ হাঁ করে তার কথা শুনছিল। এবার না বলে পারল না, এরকম কথা আপনার মুখ থেকে শুনব ভাবতেই পারছি না।
কেন? আমি কি কোনো অন্যায় করছি? আজকাল কোন শালা ন্যায় পথে থেকে চাকরি করছে? আমরা তো তবু দু-চারশ কি দু পাঁচ হাজার, কিন্তু মন্ত্রী ও আমলারা তো লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকা ঘুষ খায়। তাদের অনেককে ধরা পড়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। মন্ত্রী আমলা থেকে সাধারণ মানুষও দু’হাতে ঘুষ খেয়ে ফুলেফেঁপে উঠছে। বাংলাদেশে কে ঘুষ খায় না বলতে পারেন? যে দেশের হাইকোর্টের বিচারপতি থেকে নিম্ন আদালতের চাপরাশী দারোয়ান পর্যন্ত ঘুষ খায়। সে দেশের পুলিশ অফিসাররা ঘুষ খাবে নাতো কি বাচ্চাদের মতো বুড়ো আঙ্গুল চুষবে? এইসব বলতে বলতে তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। সেই অবস্থাতেই ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন সামনের ট্যাক্সিটার গতিরোধ করে ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড় করাও।
ড্রাইভার দক্ষতার সঙ্গে অফিসারের আদেশ পালন করল।
অফিসার গাড়ি থেকে নেমে ঐ গাড়ির আরোহীকে চিৎকার করে নামতে বললেন।
আমজাদ দেখল, গাড়ির পিছনের সিটে একজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা। অফিসার চিৎকার করে নামতে বলায় ভদ্রলোকটা বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, কেন? কী হয়েছে?
কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করল না? গাড়িতে মেয়ে মানুষ তুলে প্রেমলীলা হচ্ছে? নামুন, নচেৎ ধোলাই দিয়ে বাপের নাম ভুলিয়ে দেব।
ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে বললেন, দেখুন, আমরা স্বামী-স্ত্রী। ও অসুস্থ। তাই আমার গায়ে হেলান দিয়ে শুয়েছিল। আপনি অনর্থক এসব কথা বলছেন।
স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক বললেই ছাড়া পেয়ে যাবেন ভেবেছেন? আমার চোখকে ফাঁকি দেয়া অত সহজ নয়। আপনি ওর ঘাড়ে মুখ ঘষছিলেন, মুখে কিস দিচ্ছেলেন। নিজের স্ত্রীকে কেউ গাড়িতে ওসব করে? তা ছাড়া আপনারা যে। স্বামী-স্ত্রী প্রমাণ দিতে পারবেন বলে অফিসার হাত বাড়ালেন। প্রমাণ নিয়ে কেউ। রাস্তায় বেরোয় না, বাসায় চলুন।
তাই নাকি? উঠুন জীপে। তারপর গাড়িতে বসা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই ভদ্রলোককে গাড়িতে তোলো।
ভদ্রলোক এবার খুব ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, আমরা কিন্তু কোনো অন্যায় করি। নি।
সেটা কোর্টে গিয়ে বলবেন। রাস্তায় অশালীন আচরণ করার জন্য আপনাদের আমি গ্রেফতার করছি।
অফিসারের কথা শুনে গাড়ির ভিতরের মহিলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
ভদ্রলোক গাড়ির ভিতর মুখ ঢুকিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে সোজা হয়ে অফিসারকে বললেন, আমার স্ত্রী সত্যিই অসুস্থ। দয়া করে আমাদের যেতে দিন।
ঠিক আছে, স্ত্রীর অসুস্থতার কথা যখন বলছেন তখন আর কি, তবে আপনারও কিছু করা দরকার।
ভদ্রলোক পকেট থেকে পার্স বের করতে অফিসার বললেন, দু’হাজার।
এত টাকা সঙ্গে নেই, বারশ আছে।
নেই যখন বারশই দিন।
টাকাটা নিয়ে তাদের চলে যেতে বলে জীপে উঠে দু’শ টাকা পিছনের পুলিশটাকে ও দু’শ টাকা ড্রাইভারকে দিয়ে আমজাদকে বললেন, সবাইকে দিয়ে খেতে হয় বুঝলেন? একাই সব খাব কাউকে দেব না এটা করলে বেইনসাফি। করা হয়। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এসব কথা পত্রিকায় লিখবেন না কি?
লিখব কি লিখব না সেটা আমার ব্যাপার।
লিখুন আর নাই লিখুন, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি ঘুষ খেয়েছি প্রমাণ করতে পারবেন না। আর ঐ ভদ্রলোকও কোর্টে কেস করে প্রমাণ করতে পারবেন না, আমি ওনার কাছে থেকে ঘুষ খেয়েছি। আপনি তো এখনো বিয়ে করেন নি। করলে জানতে পারতেন বিয়ের দশ-বার বছর পর কেউ স্ত্রীকে। বিছানায় চুমো খায় না। ঐ শালা ট্যাক্সিতে খাচ্ছিল।
আমজাদ বলল, আপনার নামটা জানতে পারি?
অফিসার হো হো করে হেসে উঠে বললেন, নামটা জানা থাকলে পত্রিকায় ঘটনা লিখতে সুবিধে হবে তাই না?
না, মানে নামটা জানলে বুঝতে পারতাম আপনি মুসলমান, না অন্য কিছু।
অফিসার হাসি থামিয়ে ভ্রুকুটি করে বললেন, যদি বলি আমি মুসলমান?
বিশ্বাস হচ্ছে না।
কেন?
কোনো মুসলমান ঘুষ খেতে পারে না। কারণ আল্লাহ্ ঘুষ খাওয়াকে হারাম করেছেন।
আরে, আপনি যে দেখছি হুজুর মানুষ। যে দেশে নব্বইভাগ মানুষ মুসলমান হয়েও আল্লাহর হুকুমের ধার ধারে না, সে দেশে আপনাদের মতো কয়েকজন হুজুর আল্লাহর হুকুম মেনে চলে দেশের কি উপকার করবেন? আল্লাহ্র হুকুমকে মানুষ গ্রাহ্য না করে নিজের খেয়াল খুশীমতো চলছে। কোনো মানুষেরই সাধ্য নেই তাদেরকে রুখবার। আপনি যদি সবার মতো কিছু না করতে পারেন, তা হলে জীবনে কোনো উন্নতি করতে পারবেন না। তারপর ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে আমজাদকে বললেন, কাওরান বাজারে এসে গেছে, নেমে পড়ন।
আমজাদ গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল। রাত প্রায় সাড়ে বারটা। রাস্তায় লোকজন না থাকলেও কুকুরের অভাব নেই। তাকে দেখে অনেকগুলো কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে লাগল। তাকে রোজ দেখেও কেন যে ঘেউ ঘেউ করে আমজাদ বুঝতে পারে না। নির্দিষ্ট বাড়িটার কাছে এসে গেট টপকে ভিতরে ঢুকল।
গণি ভাইয়ের অফিসটা খুব সুন্দর। অ্যাটাচড বাথরুম। কারো নজরে যেন না পড়ে সেজন্য স্টীল আলমারীর পিছনে আমজাদের বেডিংপত্র থাকে। গণি ভাই একটা এক্সট্রা চাবি তাকে দিয়ে বলেছেন, বড় লাইট জ্বালাবে না। ডিম লাইট জ্বেলে বিছানা করে ঘুমিয়ে পড়বে।
আমজাদ অফিসে ঢুকে প্রথমে ডিম লাইট জ্বালাল। তারপর প্রতিদিনকার মতো গণি ভাইয়ের গদীমোড়া মুভিং চেয়ারে কিছুক্ষণ আরাম করে বসে ভাবল, এত নরম চেয়ারে বসে কাজ করার ভাগ্য আল্লাহ কি তার কপালে লিখেছেন? হঠাৎ তার পুলিশ অফিসারের কথা মনে পড়তে ভাবল, অসৎ উপায়ে টাকা উপার্জন করা আল্লাহ্ হারাম করেছে জেনেও মুসলমানরা তা মানছে না। হারাম খেয়ে খেয়ে মানুষের মন শক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই মন থেকে দয়া-মায়া মমতা উঠে যাচ্ছে।
ক্লান্তিতে চোখে ঘুম জড়িয়ে আসতে উঠে বাথরুমে গেল। ফিরে এসে টেবিলে বিছানা পেতে গা এলিয়ে দিতে মায়ের কথা মনে পড়ল। মা বলত, তোর বাবা এ যুগে একদম অচল। অন্যায়ের সঙ্গে কখনো এতটুকু আপস করত না। আর সেই জন্যেই তাকে অকালে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হল। বাবাকে দেখে নি আমজাদ। সে মায়ের পেটে থাকতেই বাবা দুনিয়া থেকে বিদায় নেয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে। কিশোর বয়সে মায়ের কাছে শোনা কথাটা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। বাবা ছিলেন গ্রামের হাই স্কুলের আদর্শবান মাস্টার। পৈত্রিক সূত্রে বেশ জমি জায়গা পেয়েছিলেন। তাই অবস্থা খুব স্বচ্ছল ছিল। জাব্বার খান গ্রামের সেরা ধনী। তার এক ছেলে পাশের গ্রামের একজনকে খুন করে। বাবা তখন সেই পথ দিয়ে আসছিলেন। পাশের গ্রামের ছেলের বাবা জাব্বার খানের ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। বাবা যে ঘটনাটা দেখেছেন তা খুন হওয়া ছেলের বাবা কেমন করে যেন জেনে যান। তিনি মামলায় প্রধান সাক্ষি করেন বাবাকে। সেকথা জব্বার খান জানতে পেরে বাবাকে অনেক টাকা দিয়ে মিথ্যে সাক্ষি দেয়ার জন্য হাত করতে চেয়েছিলেন। বাবা টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, মুসলমান কোনোদিন মিথ্যে সাক্ষি দিতে পারে না। আল্লাহ্ কুরআন। পাকে বলিয়াছেন,
“হে ইমানদারগণ তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিধানসমূহ পূর্ণরূপে। প্রতিষ্ঠাকারী এবং ন্যায়ের সহিত সাক্ষ্য প্রদানকারী হও, এবং কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদিগকে ইহার প্রতি উদ্যত না করে যে, তোমরা ন্যায় বিচার না কর; ন্যায় বিচার কর। ইহা আল্লাহভীতির অধিকতর নিকটবর্তী, আর আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের সমস্ত কৃতকর্ম সম্বন্ধে পূর্ণ অবগত আছেন।” [সূরা মায়েদা, আয়াত-৮, পারা-৬]
মামলার দিন কোর্টে সাক্ষি দিতে যাওয়ার পথে বাবা খুন হয়। মা বলেছিল, জাব্বার খান নিজের ছেলেকে বাঁচাবার জন্য তোর বাবাকে লোকের দ্বারা খুন করায়।
কথাটা যখনই মনে পড়ে তখনই আমজাদের চেয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠে। ভাবে, বাবার খুনের প্রতিশোধ কি সে নিতে পারবে? প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সে ক্যারেট শিখেছে। আর্মস চালনাও শিখেছে। এখন শুধু আর্থিক উন্নতি করতে পারলেই তার মনের আশা পূরণ হবে।
এইসব চিন্তা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম যখন ভাঙল তখন সাড়ে আটটা। ধড়ফড় করে উঠে বিছানাপত্র গুছিয়ে যথাস্থানে রাখল। তারপর বাথরুমের কাজ সেরে নটায় রুমে তালা দিয়ে বেরিয়ে এল।
কয়েকদিন আগে গণি ভাই মগবাজারের একটা ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন, ত্রিশ তারিখে ওখানে গিয়ে বলবে, আমি তোমাকে পাঠিয়েছি। আমজাদকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে আবার বলেছিলেন, আরে ভাই, এক হাজার। টাকায় ঢাকা শহরে কি আর একটা মানুষের চলে? তাই আমার এক বন্ধু যখন তার মেয়েকে পড়াবার জন্য একটা টিউটরের কথা বলল তখন তোমার কথা বলে ফেললাম। মেয়েটা টেনে পড়ে। বেতন যাই দিক না কেন এক হাজারের কম দেবে না।
এক হাজার টাকা বেতনে এই ছ’টা মাস আমজাদের খুব কষ্টে কেটেছে। গণি ভাইয়ের কথা শুনে বলল, অসংখ্য ধন্যবাদ গণি ভাই। কি বলে যে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাব ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
থাক, কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে না। ঐ মেয়েকে যিনি পড়াতেন, তিনি চান্স পেয়ে ফরেনে চলে গেছেন। সামনে প্রিটেষ্ট। রেজাল্ট ভালো হলো বেতনও ভালো পাবে।
গতকাল অফিস যাওয়ার সময় মগবাজারে বাস থামতে গণি ভাইয়ের কথা মনে পড়েছিল। কিন্তু পুলিশের পাল্লায় পড়ে সে কথা মনে ছিল না। এখন মনে পড়তে হোটেলে নাস্তা খেয়ে মগবজারে যাওয়ার জন্য বাসে উঠল। ঠিকানামতো বাড়িটার কাছে যখন পৌঁছাল তখন পৌনে দশটা। ভাবল, আটটা-নটার মধ্যে আসা উচিত ছিল, এখন কি মেয়ে বা মেয়ের বাবা বাসায় আছেন? দ্বিধাচিত্তে গেটের কলিংবেলের বোতামে চাপ দিল।
আজকাল ঢাকা শহরে কলিংবেল বাজিয়ে ডাকাতি হচ্ছে। তাই প্রায় বাড়িওয়ালা গেটের দরজার মাঝখানে ফুটো করে মোটা কাঁচ বসিয়ে দেন। ভিতরের লোক সেই কাঁচে চোখ রেখে আগন্তুককে দেখে গেট খোলে। স্বাতি দরজার ফুটোতে চোখ রেখে আমজাদকে চিনতে পারলেন না। বললেন, কে আপনি? কাকে চান?
আমি আমজাদ। গণি সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাদের মেয়েকে পড়াবার ব্যাপারে।
মেয়ে স্কুলে, মেয়ের বাবাও অফিসে। কাল সকাল নটার আগে আসুন।
ঠিক আছে, তাই আসব বলে আমজাদ চলে এল।
পরের দিন আটটার সময় আমজাদ এসে কলিংবেল বাজাল।
ভদ্রমহিলা যেন ওর অপেক্ষায় ছিলেন। দরজার ফুটোয় চোখ রেখে চিনতে পেরে গেট খুলে দিলেন।
আমজাদ সালাম দিতে গিয়ে থেমে গেল।
সদ্য স্নানকরা এক আপরূপা মহিলা। সিথিতে সির্দুর জ্বলজ্বল করছে। সুদীর্ঘ চুলকে পাশ কাটিয়ে আঁচল মাথায় দেয়। সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী। বয়স পঁয়ত্রিশের কম না। কিন্তু আমজাদের মনে হল চব্বিশ পঁচিশ বছরের উদ্ভিন্ন যৌবনা এক কুমারী মেয়ে।
তাকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্বাতি মৃদু হেসে বললেন, আপনিই তো কাল এসেছিলেন?
আমজাদ যেন এতক্ষণ বাস্তবে ছিল না। স্বাতির কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, জি।
আসুন, ভিতরে এসে বসুন। মেয়ে ও মেয়ের বাবা নাস্তা খাচ্ছে, এখুনি এসে পড়বে। কথা শেষ করে চলে গেলেন।
গেটের রুমটাই ড্রইংরুম। আমজাদ একটা সোফায় বসে চিন্তা করল, মা যখন এতো সুন্দরী মেয়েও নিশ্চয় সুন্দরী। এরা হিন্দু গণি ভাই বলে নি। কেন বলে নি ভেবে পেল না। রুমের পরিবেশ দেখে আমজাদ খুশী হল। সব কিছু দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের যেমন টাকা আছে তেমনি রুচিজ্ঞানও আছে। উনি ব্যবসা করেন, না চাকরি করেন? ব্যবসা করলে আলাদা কথা, কিন্তু চাকরি করলে এত দামি কার্পেট ও সোফাসেট ও অন্যান্য সবকিছু করলেন কি করে? নিশ্চয় ঘুষ খান।
এমন সময় পর্দা ঠেলে একজন সুট পরা ভদ্রলোককে ঢুকতে দেখে আমজাদ দাঁড়িয়ে পড়ল।
ভদ্রলোক এগিয়ে এসে হ্যান্ডসেক করার সময় বললেন, আমি রজত।
আমি আমজাদ।
রজত আমজাদকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, গণি আপনার কথা বলেছে। বিথী মানে আমার মেয়ে অঙ্ক ছাড়া অন্যান্য সাবজেক্টে খুব ভালো। অঙ্কের টিচার রেখেও তেমন কোনো উন্নিতি হয় নি। আপনিও চেষ্টা করে দেখুন কতটা কি করতে পারেন।
এমন সময় স্ত্রী ও মেয়েকে নাস্তার ট্রে নিয়ে ঢুকতে দেখে আবার বললেন, আমার স্ত্রী স্বাতি আর মেয়ে বিথী।
বিথী আমজাদের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা হাত তুলল, মুখে কিছু বলল না।
স্বাতি টেট্রা টেবিলের উপর রেখে হাসিমুখে আমজাদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি গণি ভাইয়ের লোক জেনেও ফিরিয়ে দিয়েছি বলে রজত কাল আমার উপর রেগে গিয়েছিল। আমি অবশ্য ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি।
রজতের দিকে তাকিয়ে আমজাদ বলল, আপনার রেগে যাওয়াটা উচিত না অনুচিত হয়েছে বলব না, তবে উনি উচিত কাজই করেছেন। কারণ আজকাল ডাকাতরা অতি আপনজনের পরিচয় দিয়ে গেট খুলিয়ে ডাকাতি করছে। এরকম ঘটনা প্রতিদিন কাগজ খুললেই দেখা যায়।
রজত বলল, থাক ওসব কথা। আপনি বিথীকে কাল থেকে কখন পড়াতে আসবেন বলুন।
বিথীর নাম শুনে আমজাদ তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, এই বয়সেই মায়ের মতো সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী। শুধু তাই নয়, অচেনা কেউ দেখলে স্বাতির ছোট বোন মনে করবে। দৃষ্টি সরিয়ে বলল, আপনি বোধ হয় জানেন, দুপুরের পর থেকে আমি গণি ভাইয়ের পত্রিকা অফিসে কাজ করি। সকাল সাতটা সাড়ে সাতটায় আসব।
বেশ, তাই আসবেন। আর শুনুন, আগের টিচার সপ্তাহে তিন দিন পড়াতেন। তাকে এক হাজার দিতাম। যদি সময় হয় আপনি ছ’দিন পড়াবেন, দেড় হাজার দেব। আর যদি অঙ্কে ওর রেজাল্ট ভালো করাতে পারেন, তা হলে পরের মাস থেকে দু’হাজার পাবেন।
আমজাদ চিন্তা করল, গণি ভাই এক হাজারের কথা বলেছিলেন। দেড় হাজারের কথা শুনে খুব খুশী হল। বলল, আমি আমার সাধ্য মতো চেষ্টা করব।
থ্যাংক ইউ বলে রজত মেয়েকে বললেন, সকাল সাতটায় তুমি তৈরী থাকবে। তারপর আমজাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর সময় দিতে পারছি না, অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
আমজাদ দাঁড়িয়ে উঠে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এল।
পরের দিন ঠিক সাতটায় পড়াতে এলে কাজের বুয়া তাকে রিডিংরুমে পৌঁছে। দিল।
পাঁচ মিনিট আগে বিথী পড়তে বসেছে। আমজাদকে দেখে দাঁড়িয়ে ডান হাতটা শুধু মাথা পর্যন্ত তুলল, মুখে কিছু বলল, না।
আমজাদ তাকে বসতে বলে নিজেও বসল। তারপর বলল, আজ পড়াব না, কাল থেকে পড়াব। আজ শুধু আলাপ পরিচয় করব। ছাত্র শিক্ষক একে অপরের পরিচয় জানা উচিত। তা না হলে আমার কাছে পড়তে তোমার যেমন ভালো লাগবে না তেমনি আমিও তোমাকে ঠিক মতো টিচিং দিতে পারব না। কাল তোমার নাম বিথী শুনেছি। ওটা নিশ্চয় ডাক নাম, ভাল নাম বল।
রাবিয়া ব্যানার্জি।
আমজাদ অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস কলল, তোমরা মুসলমান?
আমার বাবা মুসলমান, মা হিন্দু।
আর তুমি?
আমি ওনাদের মেয়ে।
তা তো জানি। জানতে চাচ্ছি তুমি কোন ধর্ম অনুসরণ কর?
কোনোটাই অনুসরণ করি না। বাবাকে বলেছেন, বড় হয়ে আমি যেন মানব ধর্ম অনুসরণ করি।
উনি খুব ভালো কথা বলেছেন। আচ্ছা, তোমাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়?
আমি ঢাকাতেই জন্মেছি। মা বাবার বাড়ি কোলকাতা।
তোমরা কোলকাতা যাও না?
বাবা যান না, মা আমাকে নিয়ে প্রতি বছর পূজার সময় বেড়াতে যান। তারপর বিথী মৃদু হেসে বলল, আমার কথা তো-অনেক শুনলেন, এবার আপনার কথা বলুন।
আমজাদও মৃদু হেসে নাম বলে বলল, কয়েক মাস আগে স্থাপত্য শিল্পে মাষ্টার্স পরীক্ষা দিয়েছি। দেশের বাড়ি সাতক্ষীরা। আমার কোনো ভাই বোন নেই। মায়ের পেটে থাকতে বাবাকে হারিয়েছি। তারপর থেকে মা আমাকে নিয়ে একমাত্র মামার কাছে আছেন। বাবার কিছু টাকা পয়সা ছিল। মা সেই টাকায় আমাকে লেখাপড়া করিয়েছেন। এখন চাকির খুঁজছি। এই হল আমার কথা।
বিথী আজ ভি-গলার মাক্সি পরেছে। ফলে বুকের দু’টো মাংসপিণ্ডের অনেকটা দেখা যাচ্ছে। তাই আমজাদ তার মুখের দিকে মাঝে মধ্যে তাকিয়ে কথা বললেও বেশিরভাগ কথা দৃষ্টি টেবিলের উপর রেখে বলছে।
বিথী তা বুঝতে পেরে বলল, আপনি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন না কেন?
কারণ আছে।
কি কারণ বলুন!
কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা চিন্তা করতে লাগল আমজাদ।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, বলুন না, কেন আপনি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন না?
কাল থেকে একটা চাদর বা ওড়না গায়ে দিয়ে পড়তে আসবে।
স্বাস্থ্য ভালো হওয়ার কারণে এই বয়সেই বিথী পূর্ণ যুবতীর মতো। কিন্তু সেক্স সম্পর্কে যেমন এতটুকু জ্ঞান এখনো হয় নি তেমনি ছেলে মানুষিও যাই নি। তাই খুব অবাক হয়ে বলল, কেন? ওগুলোত বয়স্ক মহিলাদের গায়ে দিতে দেখেছি।
বয়স্ক মহিলাদের গায়ে ওড়না বা চাদর দেয়ার বিভিন্ন কারণ আছে। আমি তোমাকে বলছি অন্য কারণে।
কারণটা বলুন।
মায়েরা একদম ছোট ছেলেমেয়েদের জাঙ্গিয়া, গেঞ্জি বা ছোট জামা পরায়। একটু বড় হলে হাফ প্যান্ট পরায়। আরো একটু বড় হলে স্কুলে যাওয়ার সময় পায়জামা বা ফুলপ্যান্ট ও বড় জামা পরায়। এর কারণ হল, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পোশাকেরও পরিবর্তন হয়। তাই মেয়েরা যখন বড় হয় তখন তাদের পোশাকেরও পরিবর্তন হয়। তোমার ও হয়েছে। যেটুকু বাকি ছিল সেটাই বললাম।
মাস্টার কেমন পড়াচ্ছে জানার জন্য স্বাতি এতক্ষণ দরজার পর্দার আড়াল থেকে তাদের কথা শুনে খুশী হলেন। ভাবলেন, মাস্টার খুব চরিত্রবান ছেলে।
আমজাদের কথা শেষ হতে ভিতরে ঢুকে বললেন, আজ যখন পড়াবেন না তখন চা খেতে খেতে আলাপ করা যাক।
আমজাদ বলল, আমি চা খাই না, তবে আলাপ করা যায়।
চা না খান অন্য কিছু খাবেন। তারপর মেয়েকে বললেন, যাও, তোমার স্যারের জন্য কিছু নিয়ে এস।
আমজাদ মিনতি স্বরে বলল, দেখুন, কিছু মনে নেবেন না, আমি কিছুই খাব না।
কেন বলুনতো? আমি হিন্দুর মেয়ে, তাই বুঝি খেতে চাচ্ছেন না?
আপনার ধারণা ভুল। কয়েকদিন আগে হলে নিশ্চয় খেতাম।
কয়েকদিন আগের কথা বাদ দিন, এখন খাবেন না কেন বলুন।
কয়েকদিন আগে একটা দৈনিক পেপারে দেখলাম, দেশী-বিদেশী খাবার ও পানীয় অনেক উপাদানে শূকরের চর্বি আছে। মুসলমানদের জন্য শূকরের সব কিছু হারাম। একজন মুসলমান হয়ে তো শূকরের চর্বি মিশ্রিত কোনো খাবার খেতে পারি না?
যে সব জিনিসে শূকরের চর্বি মিশ্রত আছে, সেগুলোর নাম বলুন তো?
প্যাকেট বা টিনজাত গুড়া দুধ, ঘি, ডালডা, বিস্কুট, চানাচুর, সেমাই, লাচ্ছি বিভিন্ন সাবান, পানীয়জাত জিনিস ও প্রসাধনী দ্রব্যের মধ্যে শূকরের চর্বি রয়েছে।
পেপারে যখন লেখা হয়েছে তখন অন্যান্য মুসলমানরা, বিশেষ করে মোল্লা মৌলবীরা কি এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ করেছেন?
করেছেন কি না জানি না। তবে করলে নিশ্চয় জানতে পারতাম।
এ ব্যাপারে আপনিওতো লেখালেখি করতে পারেন?
তা অবশ্য পারি। ইচ্ছাও আছে। সময় সুযোগের অভাবে ফিচারটা লিখতে পারছি না। তবে বেশ কয়েক বছর আগে থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় এ ব্যাপারে লেখালেখি হয়েছে।
(১) যেমন–১৯৮৭ সালের ২৩শে নভেম্বরে দৈনিক দিনকাল ও দৈনিক নয়া বাংলা ২২শে জানুয়ারি, ১৯৮৮ইং সালে পত্রিকা দুটিতে লিখেছিল, “সাম্প্রতিক আরও চাঞ্চল্যকর উদ্ঘাটন করেছে সিঙ্গপুরস্থ মুসলিম মিশনারী সোসাইটির মুখপত্র দৈনিক ভয়েজ অব ইসলাম। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বিদেশী বিভিন্ন মহলের পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, ছোট ও বড়দের তৈরী শুকনো দুধে শূকরের চর্বি মেশানো হয়ে থাকে। এ বিষয়ে সত্যতা এম. ফি, খোঁজা বিরচিত বই থেকেও প্রমাণিত। প্রতি ৮৮৪ গ্রাম শুকনো দুধে ১০ গ্রাম শূকরের চর্বি থাকে।
সুইডেনের মুসলিম এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী মাহমুদ উদ্দিন ও একই মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কোথাও আপনি এমন দুধ পাবেন না, যাতে শূকরের চর্বি নেই,
(২) দৈনিক ইনকিলাব ২৫শে মে ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, বিশ্ব মুসলিম অবগতির লক্ষ্যে প্রফেসার আমজাদ সরকার বৈরুতের একটি প্রবন্ধ সংযুক্ত আরব আমিরাতে (U.A.E) সরকার কর্তৃক প্রচারিত হয়েছে, যার মধ্যে অত্যধিক পরিশ্রম ও গবেষণার পর ইউরোপ ও আমেরিকার কতিপয় সামগ্রীর ফিরিস্তি দেয়া হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে শূকরের দেহের কোনো না কোনো অংশ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সাবান, ক্রীম বিভিন্ন প্রকার খাদ্য। যেমন– চকলেট, বিস্কুট, পনির, রুটি এবং বিভিন্ন ধরনের পেয়সামগ্রী।”
(৩) দৈনিক ইত্তেফাঁকে ২৪শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সালে লিখেছিল, জুস, আচার, জেম, জেলী ক্রেতাগণ হুঁশিয়ার, সাবধান। বহির্বিশ্বে জেল্যাটিনবিহীন কোনো জুস, জেলী ও আচার তৈরী হয় না। জেল্যাটিন শূকরের চামড়া ও হাড় থেকে প্রস্তুত।… ইহা হালাল নয়।
(৪) দৈনিক ইনকিলাবে ১৩ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সালে লিখেছিল, বিদেশী টিনজাত গুঁড়ো দুধ, দুগ্ধজাত খাদ্যসামগ্রী, আইসক্রীম, মিষ্টান্ন, চকলেট, ওষুধাদি এমন সব হারাম উপাদান দিয়ে তৈরী, যা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণ করা যায় না। সম্প্রতি কনজুমার এসোসিয়েশন অব পেনাং গাইড বিদেশী পণ্যসামগ্রী বিশেষ করে খাদ্য এবং প্রসাধনীর উপর ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে দেখেছে যে, অধিকাংশ বিদেশী খাদ্য এবং প্রসাধনীতে হারাম দ্রব্যসামগ্রী, যেমন–শূকরের চর্বি মেশানো থাকে।
(৫) দৈনিক ইনকিলাবে ৮ই ডিসেম্বর ২০০১ ও ১২ই ফেব্রুয়ারি ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, শূকরের চর্বি দিয়ে লাচ্ছা সেমাই ভাজা হচ্ছে। রোযা শুরুর পর থেকে প্রতিদিন শতশত মণ লাচ্ছা সেমাই তৈরী হচ্ছে। এই লাচ্ছা তৈরীতে যে পশুচর্বি ব্যবহার হয়, যার ৯০ই ভাগই হল শূকরের চর্বি।
(৬) দৈনিক আজকের কাগজে ২রা ভাদ্র, ১৪০৩ বাংলা সালে, প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন বেকারীতে মিষ্টি, বিস্কুট, লাচ্ছা সেমাই, বাটার ওয়েল, ঘি উৎপাদনে অবাধে চর্বি ব্যবহার হচ্ছে। ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রচুর চর্বি এদেশে আমদানী করা হয়, তা গরুর না শূকরের তাও নিশ্চিত করে। কেউ বলতে পারছে না।
এবার আমাদের দেশের একটা ডাক্তারের কথা বলছি–বোন সোসালিস্ট সালাম তালুকদার, যিনি শ্যামলীতে একটা হাসপাতল খুলেছেন। ১৯৮৫ ইং সালে আমার এক আত্মীয় তার মেয়েকে ওনার কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম মেরুদন্ত্রে চিকিৎসা করানোর জন্য। সে সময় উনি বলেছিলেন, “এই মেয়েকে প্রতিদিন হাফ কেজি শূকরের চর্বি খাওয়াবেন।”
মেয়ের বাবা খুব অবাক হয়ে বলেছিলেন, আপনি মুসলমান হয়ে এই হারাম জিনিস খাওয়াতে বলছেন?
ডাক্তার হেসে উঠে বলেছিলেন, আপনি দেখছি দুনিয়ার কোনো খোঁজই রাখেন নি। আরে মশায়, বেকারীতে যা কিছু তৈরী হচ্ছে, সবটাতেই শূকরের চর্বি আছে। যেমন, রুটি, বিস্কুট, লাচ্ছা সেমাই। এমনকি ডালডা, বাটারওয়েল, ঘি ও পনিরের মধ্যে শূকরের চর্বি রয়েছে।’
সেদিন ঐ ডাক্তারের কথায় মেয়ের বাবা বিশ্বাস করেন নি আর মেয়েকে শূকরের চর্বিও খাওয়ান নি। ঐ আত্মীয় গ্রামে ফিরে যখন লোকজনদের কাছে ডাক্তারের কথা বলছিলেন তখন আমি ছোট থাকলেও কথাটা শুনে মনে সন্দেহ হয়েছিল; কিন্তু বিশ্বাস করি নি।
২০০২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বরে দৈনিক ইনকিলাবে উক্ত ফিচারগুলো পড়ার পর থেকে আমি ঐ সমস্ত খাদ্যসামগ্রী খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।
স্বাতি বললেন, আপনি গোঁড়া মুসলিম, তাই না?
গোঁড়া কি জিনিস জানি না। তবে মুসলমান হিসাবে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্র বিধি বিধান মেনে চলার চেষ্টা করি।
কিন্তু শুধু মুসলমানরা নয়, বর্তমানে সব ধর্মের লোকেরাই তো সৃষ্টি কর্তার বিধি-বিধান মেনে চলছে না।
হ্যাঁ, আপনি অবশ্য ঠিক কথা বলেছেন। তবে কি জানেন, যারা সৃষ্টিকর্তার হুকুম মেনে চলে তাদেরকে মুসলমান বলে। মুসলমানের অর্থই হল (আল্লাহর হুকুম) মান্যকারী। আজকাল মুসলমানরা আল্লাহ্র হুকুম মানছে না বলে সারা পৃথিবীতে তারা লাঞ্ছিত ও উৎপীড়িত হচ্ছে। আর যারা আল্লাহর হুকুম মেনে চলে অন্যদেরকে মেনে চালাবার চেষ্টা করছে তারা গোঁড়া, সম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী নামে আখ্যায়িত হচ্ছে।
এবার আসি ভাবি, সরি, বৌদি বলে আমজাদ দাঁড়িয়ে পড়ল।
স্বাতি মৃদু হেসে বলল, সরি বলছেন কেন? ভাবি বা বৌদি-কোনোটাতেই আমার আপত্তি নেই।
আমজাদও মৃদু হেসে বলল, আপনার কাছ থেকে এটাই আশা করেছিলাম। তারপর বিদায় নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।
সকালে নাস্তা না খয়ে পড়াতে এসেছিল। প্রচণ্ড ক্ষিধে অনুভব করে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে দুটো চাপাটি-ভাজি দিয়ে খেয়ে এককাপ লেমন টি খেল। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করল, রজতদা মুসলমান হয়ে হিন্দু মেয়েকে যখন বিয়ে করেছেন তখন নিশ্চয় লাভ ম্যারেজ। কিন্তু ইসলামেতো এভাবে বিয়ে সিদ্ধ নয়? মেয়ে যে কোনো ধর্মের হোক না কেন, বিয়ের আগে তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। ওনাদের তো হারামী গোজরান হচ্ছে। ওনাদের মেয়েকে পড়ান কি উচিত হবে?
ওয়ারলেস গেটে এসে ফারহানা ও মহিমকে দেখে বলল, কিরে, তোরা এখানে?
মহিম বলল, আর আমরা যদি বলি, তুই থাকিস কাওরান বাজারে। এখানে দেখব আশা করি নি?
তোর কাছে যাব বলে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। তা তোরা এখানে কেন বলবি তো?
সেকথা পরে শুনিস। চল, রেস্টুরেন্টে গিয়ে আগে গলা ভেজাই।
রেস্টুরেন্টে এসে ফারযানা বলল, রোজ আমি তোদেরকে খাওয়াই। আজ তোরা কেউ খাওয়াবি।
ফারনা থেমে যেতে আমজাদ বলল, এক্ষুনি চা নাস্তা খেয়েছি, আমি কিছু খাব না।
মহিম হেসে উঠে বলল, তুই শালা যা বেতন পাস তাতে তোর নিজেরই চলে না। তুই খাওয়াবি কোত্থেকে? ও যা বলার আমাকেই বলছে, তোকে বলে নি। তারপর বেয়ারাকে দু’প্লেট নাস্তা ও আমজাদের জন্য এককাপ লেমন টিয়ের অর্ডার দিয়ে বলল, তা হঠাৎ এখানে কেন?
আমজাদ ছাত্রী পড়াবার কথা বলল।
ফারযানা জিজ্ঞেস করল, বেতন কত দেবে বলেছে?
সপ্তাহে দুদিন পড়ালে দেড় হাজার।
তা হলে তো ভালোই।
ভালো হলেও কপালে বোধ হয় সইবে না।
মহিম কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কেন?
আমজাদ ছাত্রীর মা-বাবার ইতিহাস বলে বলল, যাদের বিয়েই সিদ্ধ হয় নি। তাদের মেয়েকে পড়াতে মন সায় দিচ্ছে না।
তুই শালা একটা বুদ্বু। আরে বাবা, মা হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক, তাতে তোর কি? তুই ছাত্রী পড়িয়ে বেতন নিবি। এতে মন সায় দেবে না কেন?
মহিম ও ফারযানা আমজাদের শুধু ক্লাসমেট নয়, অন্তরঙ্গ বন্ধুও। ক্লাস করার সময় প্রথমে মহিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় আমজাদের। ফারনাকে আমজাদ খুব এড়িয়ে চলত। যখন জানতে পারল, মহিম ও ফারনার মন দেয়া-নেয়া হয়েছে এবং পাশ করে মহিম কিছু একটা রোজগারের ব্যবস্থা করতে পারলেই তারা বিয়ে করবে তখন থেকে ফারনাকে আর এড়িয়ে চলে না।
এখন মহিমের কথা শুনে আমজাদ বলল, সে কথা বললে তোরা আমাকে মৌলবাদী বলবি।
তুই না বললেও আমরা তোকে মৌলবাদী বলেই জানি। শোন, আজকাল কেউ ধর্মের বিধি-বিধান মেনে চলে না। অল্প কয়েকজন যারা মেনে চলে। সমাজে বা দেশে তাদের কোনো ঠাই নেই। তারা জীবনে উন্নতি করতে পারে নি। তোর যদি আজ কঠিন অসুখ হয়, তুই ডাক্তার দেখাবার, ওষুধ-ইঞ্জেকশান কেনার টাকা পাবি কোথায়? কেউ তোর মুখ দেখে টাকা পয়সা দেবে? দেবে না। এই যে তুই টাকার অভাবে মেসে না থেকে গণি ভাইয়ের অফিসে চোরের মতো আছিস, সেটাতে মন বাধা দেয় নি। পড়িয়ে টাকা নিবি, চুরি চামারি তো করছিস না? খবরদার, আর কিছু একটা না হওয়া পর্যন্ত টিউশনিটা ছাড়বি না।
বাদ দে আমার কথা। তোদর কথা বল। তুই কি এখনো কিছু একটা জোগাড় করতে পারিস নি? কতদিন আর ফারনাকে ভোগাবি?
ফারযানার ভোগান্তি শেষ। খুব শিঘ্রী আমাদের বিয়ে হচ্ছে।
তার মানে তুই চাকরি পেয়েছিস?
হ্যাঁ পেয়েছি। সামনে সপ্তাহে জয়েনিং ডেট।
শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে আমজাদ বলল, এতবড় খবরটা আগে বলবি তো। তারপর ফারনাকে বলল, তোর মা বাবা তো মহিমকে পছন্দ করেন না। ওনারা মত দিয়েছেন?
ফারহানা বলল, না। আমরা কোর্ট ম্যারেজ করব। মহিমের চাকরি হয়েছে রাজশাহীতে। ওখানেই আমাদের বিয়ে হবে।
ফারনা বড়লোকের মেয়ে। সে জানে মা বাবা ও ভাইয়েরা কিছুতেই মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে মহিমের সঙ্গে তার বিয়ে দেবে না। মাষ্টার্স পরীক্ষার পর তারা পাত্র খুঁজছে। তারা পাত্র পেয়ে গেলে বিয়ে ঠেকানো খুব শক্ত হবে। এদিকে মহিমেরও কোনো চাকরি হচ্ছে না। মেয়েদের চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ভেবে ওদের সঙ্গে সেও রাজশাহী টেক্সটাইল মিলে অ্যাপ্লাই করেছিল। ফারযানার ইন্টারভিউ লেটার আসে নি। কারণ কোম্পানী মেয়েদের ঐ পদে পছন্দ করে নি। আমজাদ ও মহিম ভালো ইন্টারভিউ দিয়েছিল।
ফারনা জিজ্ঞেস করল, তুই কোনো চিঠি পাস নি?
আমজাদ মাথা নেড়ে বলল, না।
মহিম হেসে ফেলে বলল, চিঠি এলে তুই খবরটা পাবি কি করে? যখন এ্যাপ্লাই করেছিলি তখন তোর ঠিকানা ছিল ইউনির্ভাসিটির হোস্টেলে। চিঠি এলে তো ঐ ঠিকানায় আসবে।
ফারহানা বলল, কারেক্ট। চল, এখনই হোস্টেলে গিয়ে খোঁজ করি। হোস্টেলের পরিচালক হোসেন মধ্যবয়সী মানুষ হলেও নামায রোযা করতেন । ঠিকমতো বাড়িতেও যেতেন না। বেতনের টাকা নিয়ে জুয়া খেলতেন। আমজাদ জানতে পেরে তাকে কুরাআন-হাদিসের বাণী শুনিয়ে হোেদায়েত করেছে। এখন তিনি নিয়মিত বাড়ি যান, নামায-রোযা করতেন, দাড়িও রেখেছেন। জুয়া খেলাও ছেড়ে দিয়েছেন।
হোস্টেলে ঢুকতেই হোসেন এগিয়ে এসে হাসি মুখে সালাম বিনিময় করে আমজাদকে বললেন, কী বাবাজী, এত জলদি আমাদের ভুলে গেলেন। সেই যে গেলেন আর এলেন না। সব ভালো তো?
আমজাদ বলল, হ্যাঁ ভালো। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমার কোনো চিঠিপত্র এসেছে?
চিঠি? হ্যাঁ। দুটো চিঠি এসেছিল।
ফারযানা চেঁচিয়ে উঠে বলল, আমজাদ, নিশ্চয় তোরও জয়েনিং লেটার এসেছে।
হোসেনের দিকে তাকিয়ে আমজাদ বলল, চিঠি দুটো নিয়ে আসুন।
আপনি কোথায় আছেন জানি না। তাই সেগুলো আপনাদের বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছি।
আমজাদ হতাশ কণ্ঠে বলল, ওঃ।
মহিম বলল, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সামনের সপ্তাহে জয়েনিং ডেট। হাতে চার পাঁচ দিন সময় আছে। তোর বাড়ি তো সাতক্ষীরা টাউনে। আজ রাতের বাসে চলে যা, কাল রাতের বাসে ফিরে আসতে পারবি।
হোস্টেল থেকে ফেরার পথে আমজাদ বলল, পকেট একদাম খালি। তা ছাড়া গণি ভাইকে না জানিয়ে যাওয়াটাও ঠিক হবে না। কাল থেকে আবার ছাত্রী পড়াতে হবে।
ফারযানা বলল, গণি ভাইকে ফোন করে দে। চাকরি পেয়ে গেলে ছাত্রী পড়াবি কি করে? তুই তো রাজশাহী চলে যাবি। তোর যাতায়াত ভাড়া কত বল, আমি দিচ্ছি। বেতন পেয়ে শোধ করে দিবি।
যাতায়াত ছ’শ টাকা। এত টাকা তোর আছে
ফারযানা তিনটে কড়কড়ে একশ টাকার নোট তার হাতে দিয়ে বলল, আর নেই। ফেরার টাকা তোর মামার কাছ থেকে নিস।
আমজাদ টাকাটা পকেটে রেখে বলল, আল্লাহ্ তোর ভবিষ্যৎ জীবন সুখের করুক। কথা দিচ্ছি, প্রথম মাসের বেতন পেয়ে টাকাটা দিয়ে দেব। তারপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শাহবাগের মোড়ে এসে রাস্তা পার হওয়ার সময় তার নাম ধরে কেউ ডাকছে শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে হাঁটতে উদ্যত হলে। আবার শুনতে পেল, এই আমজাদ, চলে যাচ্ছিস কেন? আমি শাহিন।
আমজাদ বাড়ি যাওয়ার কথা চিন্তা করছিল বলে প্রথম ডাকটা অনেক দূর থেকে যেন কেউ ডাকছে শুনছে। এখন শাহিনের কথা শুনে মনে হল খুব কাছে পেছন থেকে ডাকছে। ঘাড় ঘোরাবার সময় দেখতে পেল, শাহিন ডান দিকের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
আজ প্রায় পাঁচ বছর পর স্কুল কলেজের বন্ধু শাহিনকে দেখে আমজাদের মন আনন্দে ছলকে উঠল। কাছে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, তুই ঢাকায় কবে এলি? গাড়ি কার?
শাহিন ট্রাফিক সিগন্যালে ছিল। পাশের দরজা খুলে দিয়ে বলল, আগে উঠে আয় তারপর বলব।
ততক্ষণে সিগন্যালে সবুজ বাতি জ্বলে উঠছে। আজমাদ গাড়িতে উঠে গেট লাগিয়ে দিতে শাহিন গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছিলি?
আমার কথা বাদ দে, তোর কথা বল।
আমার কথা আর কি বলব? তুই ভার্সিটিতে পড়ার জন্য ঢাকা চলে এলি। আমি বি এ পাশ করে চাকরি না পেয়ে ড্রাইভিং শিখে গাড়ি চালাচ্ছি। তা তুই চাকরি-বাকরি কিছু পেলি?
না পাইনি, বিকেলে একটা প্রেসে প্রুফ দেখি। তা তুই ঢাকায় এলি কবে বললি না যে?
এক ট্যাক্সি ক্যাব কোম্পানীতে ড্রাইভারের চাকরি নিয়েছি। প্যাসেঞ্জার ও দু’নাম্বার মাল নিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দেশের সব মফস্বল টাউনে মাল সাপ্লাই দিতে আসি। ঢাকায় এসে মাঝে মধ্যে থাকতে হয়। ঠিকানা জানা থাকলে অনেক আগেই তোর সঙ্গে দেখা করতাম। কাল দুনাম্বার মাল নিয়ে ঢাকায় এসেছি। আজ রাতে চলে যাব। তোর বাসার ঠিকানা দে, আবার এলে দেখা করব।
আমার বাসা নেই একজনের অফিসে থাকি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চাকরির চেষ্টা করি আর বিকেলে কি করি একটু আগে তো বললাম। তা হারে, তুই দু’নাম্বার মালের কথা কি যেন বললি? ওটা তো বেআইনী কাজ। তোর মতো ছেলে এর রকম কাজ করিস ভাবতেই পারছি না।
দেখ আমজাদ, আজকাল দু’নাম্বার কাজ না করলে ভালোভাবে খেয়ে পরে বাঁচা যায় না। তুই ধার্মিক, তাই এসব কথা বলছিস। কটা মানুষ সৎপথে রোজগার করছে বলতে পারিস? তুই তো দুনিয়ার খোঁজ খবর রাখিস না, কত দাড়ি টুপিওয়ালা নামাযীও হাজিদের দেখলাম, তাদের বেশিরভাগ দুনাম্বার ব্যবসা করে টাকার পাহাড় জমাচ্ছে। আর সাধারণ মানুষের কাছে তারা ধর্মের লেবাশ পরে কুরআন হাদিস আওড়াচ্ছে।
বাদ যে ওসব কথা, তুই আজ কটার সময় যাবি?
রাত বারোটায়।
এতরাতে কেন?
সে কথা তোর জানার দরকার নেই।
আমি আজ বাসে করে বাড়ি যাব ঠিক করেছিলাম। আমাকে তোর গাড়িতে নিতে পারবি না?
কেন পারব না?
তোর কোনো অসুবিধে হবে না তো?
কিসের অসুবিধে? বরং তুই সঙ্গে থাকলে খুব ভালো লাগবে।
হোটেল অ্যাম্বাসাডারের নিচে গাড়ি পার্ক করে শাহিন বলল, তোর তো এখন কোনো কাজ নেই। আমার রুমে চল, খেয়েদেয়ে লম্বা একটা ঘুম দেব। তা হারে, রাতে যে অফিসে থাকিস, তা কোথায়?
এখান থেকে কাছেই।
তা হলে তো ভালই হল। এক ফাঁকে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে আসতে পারবি।
যা পরে আছি, এর থেকে ভালো ড্রেস নেই। ওখানে যাওয়ার দরকার নেই।
রাত সাড়ে নটায় খাওয়ার পর রুমে এসে শাহিন বলল, তুই একটু ঘুমিয়ে নে, আমি কাজ সেরে এসে তোকে নিয়ে গাড়িতে উঠব।
আমজাদ জিজ্ঞেস করল, এখন আবার কি কাজ?
সেকথা পরে বলব বলে শাহিন রুম থেকে বেরিয়ে এল।
আমজাদও তার পিছনে পিছনে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, তুই ফিরবি কখন?
চিন্তা করিস না, বারটার আগেই ফিরব।
আমজাদ রুমে এসে গা এলিয়ে দিয়ে ভাবল, ওকি দু’নাম্বার মাল নিতে গেল? যদি রাস্তায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, তা হলে আমাকেও পুলিশ ছাড়বে না। বাসে যাওয়াই উচিত ছিল। কথাটা চিন্তা করে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কবে ছাড়া পাবে তার কোনো ঠিক নেই। হাত ঘড়িতে দেখল, পৌনে দশটা। এগারটা পর্যন্ত গাবতলীতে বাস পাওয়া যায়। বাসে করেই যাবে স্থির করে উঠে বসল। আবার ভাবল, ওকে না বলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে। বাথরুম থেকে অযু করে এসে এশার নামায পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইল, তিনি যেন নির্বিঘ্নে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেন, রাস্তায় যেন কোনো বিপদে না পড়ে।
শাহিন ফিরল সাড়ে এগারটায়।
আমজাদ দরজায় ছিটকিনি দিয়ে চিন্তা করছিল, বাড়িতে গিয়ে যদি চিঠিটা পাক না পাক, কাল রাতের বাসে ঢাকা ফিরে আসবে। দরজা নক হতে শুনে জিজ্ঞেস করল কে?
আমি শাহিন, দরজা খোল।
আমজাদ দরজা খুলে দিতে শাহিন ভিতরে ঢুকে বলল, পনের মিনিটের মধ্যে বেরোতে হবে। এর মধ্যে তৈরি হয়ে নে।
ঠিক বারোটার সময় ওরা গাড়িতে উঠল। আরিচা পৌঁছে ফেরিতে ওঠার সময় শাহিন দেখল, দু’জন লোক ঠেলা দিয়ে একটা ট্যাক্সিকে ফেরিতে তুলছে। ভাবল, গাড়িটা নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে। ফেরিতে গাড়ি পার্ক করে দেখল, খারাপ গাড়ি থেকে লতিফ নামল। লতিফও ট্যাক্সিক্যাবে চাকরি করত। সে সময় দু’জনের বন্ধুত্ব হয়। মাস ছয়েক হল লতিফ সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় আসমা ইন্ডাস্ট্রিজ মালিকের গাড়ির ড্রাইভারের চাকরি করছে, তা জানে। তার কাছে গিয়ে সালাম বিনিময় করে বলল, কিরে? গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে বুঝি?
লতিফ বলল, হ্যাঁ দোস্ত। চেকআপ করে গাড়ি বের করেছি। ঘাটে এসে। হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও কিছু দোষ ধরতে পারি নি।
শাহিন বলল, ফেরি লোড হয়ে ছাড়ার পর কি হয়েছে দেখব। তারপর আমজাদকে দেখিয়ে বলল, আমরা এক সঙ্গে স্কুল কলেজে পড়েছি। তোর মতো বন্ধু।
লতিফ আমজাদের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, আমি লতিফ।
আমি আমজাদ বলে তার সঙ্গে হাত মোসাফাহা করল।
শাহিন জিজ্ঞেস করল, গাড়িতে কারা?
সাহেব ও সাহেবের দুই মেয়ে।
ফেরি ছাড়ার পর আসিফ সাহেব দুই মেয়েকে নিয়ে দো-তলার ক্যান্টিনে চা খেতে গেলেন।
আমজাদ মেয়ে দুটোকে দেখে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। এত নিখুঁত সুন্দরী মেয়ে জীবনে দেখে নি। একজন তরুণী অন্যজন যুবতী। দু’জনেই। সালওয়ার কামিজ পরেছে। ওড়নাটা বুকের উপর দিলেও তা যথাস্থানে নেই। সূচাগ্র বক্ষ কামিজ ঠেলে রেখেছে। গোলাপী ঠোঁটে হাসির ঝিলিক লেগে রয়েছে। হাটার মধ্যে আভিজাত্যের ছাপ। পাশ থেকে যাওয়ার সময় পারফিউমের তীব্র গন্ধ আমজাদের নাকে লাগল। কোনো দিকে না তাকিয়ে বাবার পিছন দোতালায় কেবিনে উঠে গেল মেয়ে দুটি।
আরিচা থেকে দৌলতিয়া যেতে সময় লাগে ফেরিতে পৌনে এক ঘণ্টা। এই সময়ের মধ্যেও শাহিন ও লতিফ গাড়ি সারাতে পারল না।
আসিফ সাহেব মেয়েদের নিয়ে ফিরে এসে লতিফকে জিজ্ঞেস করলেন, গাড়ি ঠিক হয়েছে?
লতিফ বলল, জি না।
তা হলে এখন কি উপায়? তুমিতো জান, আমাদেরকে সকাল সকাল পৌঁছাতে হবে।
লতিফ কিছু না বলতে পেরে কাচুমাচু হয়ে চুপ করে রইল। শাহিন লতিফের অবস্থা বুঝতে পেরে আসিফ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল, ইঞ্জিনের ব্যাপার কখন কি হয় আগে থেকে জানা যায় না। আপত্তি না থাকলে আপনাদেরকে আমি লিফট দিতে পারি।
আসিফ সাহেব বিরক্ত কণ্ঠে বললেন। তুমি কে? আমাদেরকে কেন লিফট দিতে চাচ্ছে?
শাহিন বলার আগে লতিফ বলল, আমরা একই জায়গার ছেলে। ও আমার বন্ধু।
আসিফ সাহেব শাহিনকে জিজ্ঞেস করলেন, গাড়ি তোমার নিজের জি না।
সাতক্ষীরা ট্যাক্সি ক্যাবের। প্যাসেঞ্জার নিয়ে ঢাকা গিয়েছিলাম।
আসিফ সাহেব চিন্তিত মুখে শাহিনের আপাদমস্তক লক্ষ করতে লাগলেন।
লতিফ বলল, স্যার, ও আমার খুব বিশ্বস্ত বন্ধু। আপনি নিশ্চিন্তে ওর গাড়িতে যেতে পারেন। আমি গাড়ি সারিয়ে নিয়ে আসব।
এতক্ষণ আমজাদ তাদের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল আর মাঝে মাঝে আড়চোখে মেয়ে দুটোকে দেখছিল।
তাকে উদ্দেশ্য করে আসিফ সাহেব বললেন, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছ? আমজাদ কিছু না বলে শাহিনের দিকে তাকাল।
শাহিন বলল, আমার বন্ধু আমজাদ। এবছর স্থাপত্ত শিল্পে মাষ্টার্স পরীক্ষা দিয়েছে। আমার সঙ্গে বাড়ি যাচ্ছে। ওর বাড়িও সাতক্ষীরা।
আসিফ সাহেব চিন্তা করতে লাগলেন, একা হলে কোনো কথা ছিল না। দু’টো সেয়ানা মেয়ে নিয়ে অন্যের গাড়িতে যাওয়া কি ঠিক হবে? তা ছাড়া প্রায় একলাখ টাকার সোনার গহনা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন ভাগ্নীর বিয়েতে দেয়ার জন্য।
সাহেবের চিন্তার কথাটা লতিফ যেন বুঝতে পারল। বলল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। নিশ্চিন্তে শাহিনের গাড়িতে যান।
কোনো উপায় না দেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন, ঠিক আছে, আমরা ওর গাড়িতেই যাব। তুমি গাড়ি ঠিক করে তাড়াতাড়ি চলে আসবে।
ততক্ষণে ফেরী থেকে গাড়ি নামতে শুরু করেছে। শাহিন গাড়ির পিছনের গেট খুলে দিয়ে বলল, আপনারা উঠুন। ওনারা ওঠার পর গেট বন্ধ করে আমজাদকে সামনে উঠতে বলে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসল।
মাগুরা পৌঁছাবার মাইল তিনেক আগে সামনের গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে পড়তে শাহিনও গাড়ি থামাল। ওদের গাড়ির সামনে দুটো ট্যাক্সী, টাক্সী দু’টোর আগে একটা বাস। কয়েক মিনিটের মধ্যে ওদের গাড়ির পিছনে ট্যাক্সী, বাস ও লরীর দীর্ঘ লাইন পড়ে গেল।
আসিফ সাহেব বিরক্তি গলায় বললেন, কি ব্যাপার? এখানে কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে না কি?
কে একজন পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলল, গাছ ফেলে বেরিকেড দিয়ে তাকাতরা বাসে ডাকাতি করছে।
কথাটা শুনে আসিফ সাহেব ভয়ার্তস্বরে বললেন, সর্বনাশ, এখন কি হবে? আমাদের গাড়িতেও যদি ডাকাতি করে? তরপর শাহিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, গাড়ি ব্যাক করে ঘুরিয়ে ঘাটের দিকে চল।
শাহিন বলল, তা সম্ভব নয়। দেখছেন না, গাড়ি ঘোরাবার কোনো পথ নেই?
আমজাদ শাহিনকে বলল, তোর কাছে পিস্তল বা রিভলবার আছে?
পিস্তল নিয়ে তুই একা কি করবি?
যাই করি, আছে কিনা বল।
না, নেই।
আমজাদের কথা আসিফ সাহেব শুনতে না পেলেও শাহিনের কথা শুনতে পেয়ে বললেন, আমার রিভলবার আছে।
আমজাদ বলল, আমাকে দিন।
আসিফ সাহেব রিভলভার তার হাতে দিতে আমজাদ জিজ্ঞেস করল, লোডেড আছে তো?
আসিফ সাহেব বললেন, আছে। ছ’টা ফায়ার হবে।
ঠিক আছে বলে আমজাদ গাড়ি থেকে নামার সময় বলল, আপনারা গেটের কাঁচ বন্ধ করে দিন। আর আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন।
শাহিন বলল, এত সাহস দেখাস নি আমজাদ।
আমজাদ তার কথা শেষ হওয়ার আগেই অদৃশ্য হয়ে গেল। রাস্তার কিনারে এসে শুয়ে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নামল। নিচটা ধানি জমি। অন্ধকার রাত থাকায় সুবিধে হল। আমজাদ বুকে হেঁটে সামনের বাস বরাবর এসে একইভাবে রাস্তার উপরে উঠে এসে একটা বড় গাছের আড়ালে আত্মগোপন করে রইল।
ডাকাতরা দলে ছিল সাতজন। দুজন এল. এম. জি. হাতে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আর একজন বাসের গেটে দাঁড়িয়ে আছে, যাতে করে কোনো প্যাসেঞ্জার নামতে না পারে। বাকি চারজন প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে হাত ঘড়ি টাকা পয়সা, সোনার গহনা ও অন্যান্য দামী জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যখন একজন একজন করে নামতে শুরু করল তখন আমজাদ প্রথমে রাস্তায় দাঁড়ান। এল. এম. জি. হাতে দু’জনকে গুলি করল, আর অন্যদের দিকে তাক করে পরপর। চারটে ফায়ার করল। একটা গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও দলের পাঁচজন গুলি খেয়ে পড়ে যেতে দেখে বাকি দু’জন সবকিছু ফেলে দিয়ে মাঠের দিকে পালাতে গেল। আমজাদ রিভলভারটা গাছের তলায় রেখে পলাতক দু’জন ডাকাতের দিকে এগিয়ে আসার সময় চিৎকার করে দু’পাশের প্যাসেঞ্জারদের উদ্দেশ্য করে বলল, আপনারা সবাই ঘিরে ফেলুন। তারপর একজন ডাকাতকে ধরে উত্তম মধ্যম দিয়ে অজ্ঞান করে অন্যকে ধরার জন্য ছুটল। কিন্তু অন্ধকার রাত থাকায় কিছুদূর ছুটেও তাকে দেখতে পেল না। তারপর গাছতলা থেকে রিভলবারটা নিয়ে গাড়ির কাছে এসে আসিফ সাহেবকে ফেরৎ দিয়ে শাহিনকে বলল, আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, আমি ব্যারিকেডটা সরাবার ব্যবস্থা করে আসি। তারপর ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখল, শত শত প্যাসেঞ্জার ঐ পাঁচজন আহত ডাকতদের ধোলাই দিয়ে আধমরা করে ফেলেছে। তাদেরকে বেঁধে ফেলার কথা বলে আমজাদ অন্যান্য কিছু প্যাসেঞ্জারদেরকে বলল, মাগুরা থানায় ঘটনাটা জানানো দরকার। আমার গাড়ি আছে, আমি জানাতে যাব। সবাই মিলে রাস্তার ব্যারিকেডটা সরিয়ে ফেলি আসুন।
ব্যারিকেড সরিয়ে বাসের ড্রাইভার প্যাসেঞ্জারদেরকে আমজাদ বলল, আপনারা অপেক্ষা করুন, আমি থানায় খবর দিতে যাচ্ছি। পুলিশ আসার পর যা করার করবেন।
শাহিন গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আমজাদের সাহস ও বুদ্ধির কথা চিন্তা করছিল। স্কুল-কলেজের সেই হাঁদারাম মার্কা আমজাদ যে ডাকাতদের সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হবে ভাবতেই পারছে না।
আমজাদ ফিরে এসে বলল, গাড়িতে ওঠ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে কেটে পড়তে হবে।
শাহিন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, তুই যা করলি ভাবতেই পারছি না।
আমজাদ বলল, ভাববার দরকার নেই, স্পীড বাড়া। মাগুরা থানায় খবরটা দিয়ে আমরা বেরিয়ে যাব।
আসিফ সাহেব আমজাদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমার কার্যকলাপ দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি। তোমার মত সাহসী ছেলে দেশের জন্য গৌরব। তা তুমি ঢাকায় এখন কি কর?
চাকরি খুঁজছি।
আসিফ সাহেব একটা কার্ড তার হাতে দিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে দেখা করো।
কার্ডটি বুক পকেটে রেখে আমজাদ বলল, ধন্যবাদ।
যশোহরে পৌঁছাবার আগে বেশ ফর্সা হয়ে গেছে। হঠাৎ মিররের দিকে চোখ পড়তে আমজাদ দেখতে পেল, তরুণী মেয়েটি একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে হাসির আভা ফুটিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পর কৌতূহলবশত আবার মিররের দিকে তাকিয়ে দেখল, একইভাবে তরুণীটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। আমজাদ দৃষ্টি ফেরাতে যাবে এমন সময় মেয়েটি তাকে মৃদু হাসি উপহার দিল।
তরুণীর হাসি আমজাদের বুকে তীরের মতো বিঁধল। সেও মৃদু হেসে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল।
তরুণীর নাম আফরা আনান। সবাই আনান বলে ডাকে। তার বড় বোনের নাম আফরা রুমালী। ডাক নাম রুমালী।
রুমালী ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করে আনানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, কিরে এতক্ষণ ধরে মিররের দিকে তাকিয়ে রয়েছিস কেন?
আনান এতক্ষণ বাস্তবে ছিল না। মিররে আমজাদের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করছিল, দেখতে সুন্দর ও সহজ সরল ছেলেটা একা অতগুলো ঢাকাতদের ঘায়েল করল কি করে? নিশ্চয় সিভিল ড্রেসে পুলিশের লোক। আবার চিন্তা করল, তাই। যদি হয়, তা হলে বাবাকে চাকরি খোঁজার কথা বলল, কেন?
রুমালীর কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে আনানও তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ড্রাইভারের পাশের ছেলেটাকে দেখছিলাম আর চিন্তা করছিলাম, ঐ পুচকে ছোঁড়াটা কি করে এতবড় একটা ঘটনা ঘটাল।
তাই বল, আমি মনে করিছি ঐ পুচকে ছোঁড়াকে দেখে তুই মুগ্ধ হয়েছিস। যশোহর টাউনে এসে শাহিন আসিফ সাহেবকে বলল, ঠিকানাটা বলুন।
ওনাদের নামিয়ে দিয়ে সাতক্ষীরা যখন পৌঁছাল তখন বেলা আটটা। শাহিন আমজাদকে তাদের বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বলে গেল, তুই যদি আজই ফিরে না যাস, তা হলে সন্ধ্যেবেলা ক্যাবে দেখা করিস।
.
২.
বেল টিপতে ইসমাঈল দরজা খুলল।
ইসমাঈল আমজাদের মামাত ভাই। দু’তিন বছরের ছোট। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলেও পাশ করে নি। সেজন্য মামা তাকে জুতোপেটা করেছিলেন। তারপর পড়াশোনা ভালো লাগে নি বলে আর পড়ে নি। দরজা খুলে আমজাদকে দেখে চোখ বড় বড় করে অবাক কণ্ঠে বলল, তুমি? তারপর বড় গলায় বলল, ফুপু, দেখবে এস কে এসেছে।
আমজাদের মনে হল প্রথমে মা আসবে, তারপর মামা মামি। মামা এসেই রাগের সঙ্গে বলবেন, যে ছেলে ঢাকায় গিয়ে মায়ের খবর রাখে না, সেরকম ভাগ্নার সঙ্গে তিনি আর সম্পর্ক রাখতে চান না।
মায়ের আগে মামা এলেন। আরে আমজাদ যে, এস এস। কোনো খবর না দিয়ে এলে যে? অবশ্য নিজের বাড়িতে খবর দেয়ার দরকার কী। খালি হাত দেখছি, জিনিস পত্র কিছু নিয়ে আস নি?
মামা তাকে তুই তোকারি করে বলে। আজ তুমি করে বলছে শুনে আমজাদ বেশ অবাক হল। সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, হঠাৎ আসতে হল। আজ রাতের বাসে চলে যাব।
পাগল ছেলের কথা শোনো। বললেই হল আজ রাতেই চলে যাব? কি এমন। রাজ কাজ কর ঢাকায়?
আমি চাকরি করি মামা।
পরীক্ষার পর মামা চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, যা কিছু টাকা পয়সা তার বাবা রেখে মারা গিয়েছিল, তার পড়াশোনার পেছনে সব খরচ হয়ে গেছে। তার মা আর টাকা পয়সা পাঠাতে পারবে না। সে যেন রুজী-রোজগারের চেষ্টা করে।
তাই এখন ভাগ্নাকে বললেন, পরীক্ষার পর যখন এলে না তখন রাগের মাথায় কি না কি চিঠিতে লিখেছিলাম, আর তুমি কিনা সম্পর্ক ত্যাগ করে চাকরিতে লেগে গেলে? অবশ্য চাকরি করছ ভালো কথা। তাই বলে এতদিন পরে এসেই চলে যাবে তা হচ্ছে না। অন্তত দু’চার দিন থাক, তারপর না হয় যাবে। আচ্ছা, তুমি কি রকম ছেলে? আমাদের কথা না হয় বাদই দিলাম, বুবুর কথা চিন্তা করতো। তুমি তার একমাত্র সন্তান। তোমার মুখের দিকে চেয়ে, তোমার ভালো মন্দ চিন্তা করে আর বিয়ে করল না। তোমাকে ধার্মিক করে মানুষ করল। আর তুমি কি না তার মনে কষ্ট দিচ্ছ। এটাই কি ধার্মিক ছেলের পরিচয়?
নিজের কানকে আমজাদ বিশ্বাস করতে পারল না। আগের মামা আর এখনকার মামা কি এক? বয়স হলে মানুষ নাকি বদলে যায় শুনেছি। এত বেশি বদলায়?
পাশের রুমে মামির গলা শোনা গেল, কে এসেছে গো? মামা কিছু বলার আগে কাছে এসে বললেন, ওমা আমজাদ, তুইএ ঘরে কেন? ভিতরে আয়।
এ ঘরটা ড্রইংরুম। আগে এখানেই আমজাদ ও ইসমাঈল দুটো আলাদা চেয়ার টেবিলে পড়ত। আর একটা চৌকিতে ঘুমাত। আজ এখানে সোফাসেট ও অন্যান্য আসবাবপত্র দেখে আমজাদ খুব অবাক হয়ে ভাবল, এতসব হল কি করে?
এমন সময় মাকে ঢুকতে দেখে সালাম দিয়ে এগিয়ে এসে কদমবুসি করে বলল, কেমন আছ মা?
সালমা খাতুন সালামের উত্তর দিয়ে দোয়া করে মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, আল্লাহ্ যেমন রেখেছেন তেমনি আছি। মামা-মামিকে কদমবুসি করেছিস?
পেছন থেকে মামি বলে উঠলেন, বাড়ির সবার বড়কে আগে কদমবুসি করতে হয়।
সালমা খাতুন ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোকে তো আমি সেরকম শিক্ষা দিয়ে মানুষ করি নি।
মামা-মামিকে কদমবুসি করার পর সবাই ভিতরের রুমে এল।
বসার পর আমজাদ মাকে বলল, অনেকদিন তোমার চিঠি পাই নি।
সালমা খাতুন বললেন, চিঠি দিয়ে ঠিকানা জানিয়েছিস? তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুই যেন নিয়মিত আমাকে চিঠি দিস।
মামি বললেন, বুবু, এখন ওসব কথা থাক। আমজাদ মুখ হাত ধুয়ে চা নাস্তা খাক। তারপর যা বলার বলবেন। আমজাদ তুই ঐ রুমে যা। ওটা ইসমাঈলের রুম। রুমের সঙ্গে বাথরুম আছে। হাত মুখ ধুয়ে নে। আমি নাস্তা নিয়ে আসি।
ইসমাঈল আগেই বাইরে চলে গেছে। মামি চলে যাওয়ার পর মামাও চলে গেলেন।
সালমা খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, তোর জিনিসপত্র নিয়ে আসিস নি?
না। সঙ্গে কিছু নিয়ে আসি নি।
ও, তা হলে আজই ফিরে যাবি?
হ্যাঁ।
একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ঠিক আছে বলে সালমা খাতুন চলে গেলেন।
আমজাদ ইসমাঈলের রুমে ঢুকে চেয়ারে বসল। আসবাবপত্র দেখে আরো অবাক হল। নতুন খাটে জাজিম ও তোষকের উপর দামি চাদর, চব্বিশ ইঞ্চি রঙিন টিভি। তারপাশে সিডি ও রয়েছে। আর আলনায় দামি প্যান্ট শার্ট হ্যাঁঙ্গারে ঝুলছে।
এমন সময় ইসমাঈল রুমে এসে বলল, সঙ্গে যখন কিছুই আন নি তখন আমরটাই পর বলে আলনা থেকে একটা লুঙ্গি এগিয়ে দিল। আমজাদ প্যান্ট ছেড়ে লুংগি পরে বাথরুমে ঢুকল। বাথরুমও উন্নত। আয়না ফিট করা, কত রকমের দামি শ্যাম্পু ও সাবান। ভাবল, ইসমাইল তা হলে ভালোই রোজগার করছে। সাবান মেখে গোসল করে বেরিয়ে দেখল, মামি টেবিলের উপর নাস্তা রেখে গেছেন। খেতে বসে ইসমাঈলকে বলল, তুইও খা।
আমি একটু আগে খেয়েছি, তুমি খাও। তারপর পকেট থেকে গোন্ডলীফের প্যাকেট বের করে টেবিলের উপর রেখে বলল, এতদিন ঢাকায় রয়েছ, নিশ্চয় স্মোক কর?
না, এ রকম বাজে নেশা আমি করি নি।
ও, তুমিতো আবার হুজুর মানুষ।
তুই কি করছিস?
ব্যবসা।
ব্যবসা? টাকা পেলি কোথায়?
ইসমাঈল তার কথার উত্তর না দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে রিং তৈরী করে ধোয়া ছাড়তে লাগল।
ইসমাঈল আগে বাড়ির বাইরে লুকিয়ে সিগারেট খেত। এখন তাকে ঘরে সিগারেট খেতে দেখে অবিশ্বাস্য মনে হল। আমজাদ বলল, টাকা কোথায় পেলি বললি না যে?
ব্যবসা দু’রকমের হয়। কোনো প্রডাকশনে অথবা ডিস্ট্রিবিউশনে নামলে অনেক টাকার ক্যাপিটাল লাগে। আর টাকা ছাড়াও ব্যবসা করা যায়, যদি একটা গ্যাং তৈরি করা যায়।
গ্যাং তৈরি করে ব্যবসা, সে আবার কি ব্যবসা?
এইধর, এখানকার মাল অন্য জায়গায় আবার অন্য জায়গার মাল এখানে। যাকে বলে আমদানি রপ্তানী।
তোর কথা ঠিক বুঝলাম না।
বোঝার দরকার নেই। তা ছাড়া তোমার মাথায় ঢুকবেও না।
কী রকম আয় হয়?
এত কথা জানতে চাচ্ছ কেন? কোনো মাসে দশ, কোনো মাসে বিশ আবার বাজার খারাপ থাকলে কিছুই হয় না।
তোর মতো মামা মামিকেও যেন অন্য রকম দেখলাম। ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢুকছে না।
রূপোর ঝনঝনানী। মানে টাকা হলে সবাই পাল্টে যায়। আমি এখন বেরোব। কথা বলতে বলতে ড্রেস চেঞ্জ করেছে। তুমি রাতে থাকলে দেখা হবে বলে ইসমাঈল বেরিয়ে গেল।
একটু পরে সালমা খাতুন চা নিয়ে এসে ছেলের হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি চাকরি করছিস?
একটা প্রেসে সামান্য বেতনের চাকির করছি।
থাকিস কোথায়?
একজনের অফিসে রাতে থাকি?
ঘর ভাড়া করে আমাকে নিয়ে যাওয়া কি তোর পক্ষে সম্ভব হবে?
কেন? এখানে কি তোমার খুব অসুবিধে হচ্ছে?
তুই কি কিছুই বুঝতে পারিস নি? ইসমাঈল অসৎ পথে টাকা রোজগার করছে। তোর মামা মামি ছেলেকে বাধা দেয় নি। বরং ঐ অসৎ রোজগারের টাকা পেয়ে ভোগ বিলাসে মত্ত। এখানে এক দণ্ড থাকতে ইচ্ছা করছে না। তোর বাবা যা রেখে গিয়েছিল, সব তোর পেছনে খরচ করে এত লেখাপড়া করালাম। এখন তোর কাছ থেকে কি কিছুই আশা করতি পারি না?
নিশ্চয় পার মা। খুব চেষ্টা করছি। প্রেসে চাকরি করে যে টাকা পাই তাতে কোনো রকমে আমার চলে। তাই মেস ভাড়া নিতে না পেরে রাতে একজনের অফিসে থাকি। এ মাসে একটা ভালো বেতনের টিউসনি পেয়েছি। সামনের মাসে টিউসনির টাকা পেলে একরুম ভাড়া নিয়ে তোমাকে নিয়ে যেতে পারব ইনশাআল্লাহ্।
তা হঠাৎ এলি কেন?
চিঠি নিতে।
কী চিঠি?
কেন? আমার নামে কোনো চিঠি আসে নি?
তো। আমজাদ অবাক হয়ে বলল, সে কী? ঢাকা থেকে রিডাইরেক্ট করা কোনো চিঠি আসে নি?
না। এলে নিশ্চয় তোর মামা মামি আমাকে জানাত।
তা কী করে হয়? আগে আমি যে হোষ্টেলে থাকতাম, সেখানকার লোক বলল, চিঠিটা এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। জান মা, আমিও আমার এক বন্ধু একটা ভালো চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। বন্ধুটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমারও অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ওখান থেকেই এসেছে।
এমন সময় আমজাদের মামি সাজেদা বেগম এসে বললেন, মা-বেটায় কি এত কথা হচ্ছে?
সালমা খাতুন ছেলের চিঠির কথা বললেন।
সাজেদা বেগম বললেন, আমরা তো কোনো চিঠি পাই নি।
আমজাদ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আমি নিশ্চিত চিঠি এসেছে।
সাজেদা বেগম রুষ্টস্বরে বললেন, তোর কি মনে হচ্ছে, মিথ্যে কথা বলছি? তারপর স্বামীকে আসতে দেখে বললেন, তোমার ভাগ্নার কথা শোনো।
জহির উদ্দিন বললেন ভাগ্নের চাকরি হয়েছে বুঝি?
চাকরি না ছাই? ওর কি একটা চিঠি নাকি এখানে এসেছে। সেটা নিতে এসেছে। আমি তো জানি আসে নি, তুমি পেয়েছ?
জহির উদ্দিন মাথা নেড়ে বললেন, না, পাই নি?
আমজাদ মুখ নিচু করে চিন্তা করতে লাগল, চিঠিটা গেল কোথায়? মহিমের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছে শুনে তারও নিশ্চয় এসেছে মনে করে মনের মধ্যে যে আশা ও আনন্দ হয়েছিল, তা নিভে গেল।
জহির উদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, কি চিঠি আসার কথা ছিল?
চাকরির।
তাই নাকী? তা তুমি পোষ্ট অফিসে খোঁজ নিতে পার বলে জহির উদ্দিন সেখান থেকে চলে গেলেন।
সাজেদা বেগম বললেন, অনেক সময় পোষ্ট অফিসেই গোলমাল হয়। সেখানে খোঁজ করতে পার।
সালমা খাতুন ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তাই না হয় একবার পোষ্ট অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আয়।
আমজাদ যখন পোষ্ট অফিসে গেল তখন দুপুর বারোটা। কোনো পিয়নকে পাওয়া গেল না। সবাই চিঠি বিলি করতে বেরিয়ে গেছে, বিকেলে ফিরবে। এতক্ষণ অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না ভেবে ফিরে এল।
সালমা খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, কিরে কোনো খোঁজ পেলি?
না পিয়নরা কেউ নেই, বিকেলে আবার যাব।
বিকেলে যাওয়ার পথে পিওন সাগিরের সঙ্গে দেখা । সাগিরের বয়স চল্লিশের উপর এই এলাকায় প্রায় সবাইকে চেনে। সালাম বিনিময় করে আমজাদ জিজ্ঞেস করল, আমার নামে বড় খামে কেননা চিঠি আসে নি?
সাগির চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, কই, নাতো? এলে নিশ্চয় । তোমার মামার কাছে ডেলিভারী দিতাম।
কিন্তু বিশ্বাস করুন ঢাকা থেকে মামার ঠিকানায় পাঠান হয়েছিল।
কতদিন আসে বলুন তো?
কয়েকদিন আগে।
ঠিক আছে, আসুন আমার সঙ্গে। পোষ্ট অফিসে পৌঁছে আমজাদকে একটা টুল দেখিয়ে বলল, বসুন। তারপর অনেক খোঁজাখুজি করে ফিরে এসে বলল, না। পাওয়া গেল না। আমজাদের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। ফেরার সময় চিন্তা করল, আজ রাতেই ফিরে যাবে।
ছেলেকে মন খারাপ করে ফিরতে দেখে সালমা খাতুন বললেন, মনে হচ্ছে চিঠি পাস নি? মন খারাপ করছিস কেন? সবর করে আল্লাহর কাছে মনের বাসনা জানা। তিনি কুলমাখলুকাতের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। তাঁর ইশারাতেই সবকিছু চলছে। যা কিছু চাওয়ার তার কাছে কায়মনোবাক্যে চাইবি। তিনি অসীম দয়ালু। কোনো বান্দা কায়মনোবাক্যে কিছু চাইলে না দিয়ে থাকতে পারেন না। কখনো কোনো ব্যাপারেই তাঁর উপর অসন্তুষ্ট হবি না। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি আজই চলে যাবি?
হা মা। মনে করেছিলাম, চাকরিটা পেলে টিউসনিটা করব না। তা যখন হল না তখন টিউসনিটা করতেই হবে। আজ থেকে পড়াতে যাওয়ার কথা। কাল ঢাকায় পৌচ্ছে পড়াতে যাব। আজ যদি থেকে যাই, তা হলে দু’দিন কামাই হবে। পড়াতে যাওয়ার কথা বলে যদি প্রথমেই দু’দিন না যাই, তা হলে ছাত্র ও তার মা বাবা কি মনে করবে?
তা হলে তোকে আর থাকার কথা বলব না। তোর কাছে আমার একটাই দাবি, তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস এখান থেকে আমাকে নিয়ে যাবি।
তুমি দোয়া কর মা, আল্লাহ্ যেন তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। জান মা, আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে তিনশটাকা ধার নিয়ে এসেছি। ভেবেছি মামার কাছে শপাঁচেক টাকা চাইব।
না, চাইবি না। ইসমাঈল চোরা কারবার করে। ঐ টাকা তোকে নিতে দেব না। আমি তোর যাওয়ার গাড়ি ভাড়া দেব।
পরের দিন সকালে বাস থেকে নেমে আমজাদ সোজা মধুবাগে ছাত্রীকে পড়াতে এল।
বিথী জিজ্ঞেস করল, কাল এলেন না কেন?
বিশেষ কাজে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম।
আপনাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়?
সাতক্ষীরা।
ওমা, সেতো অনেক দূর। একদিনের মধ্যে গেলেন এলেন কী করে?
পরশু রাতের গাড়িতে গেছি, কাল রাতের গাড়িতে ফিরে এসেছি। এখন ওসব কথা রেখে বই খাতা বের কর।
বিথী বই খাতা বের করে বলল, আমরা তো মনে করেছি, আপনার কোনো অসুখ বিসুখ হয়েছে।
আমজাদ তার কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, গণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতিঃ এর মধ্যে কোনটা তোমার কাছে কঠিন লাগে?
গণিত।
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পড়াবার পর চলে যাওয়ার জন্য যখন আমজাদ উঠে দাঁড়াল তখন স্বাতি এসে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে। তারপর ডাইনিংরুমে নিয়ে এসে বাথরুমের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, যান, হাত মুখ ধুয়ে আসুন।
আমজাদ টেবিলের উপর প্লেটে পরোটা, ডিম ও সবজি ভাজা দেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
কি হল? আমার কথা শুনতে পান নি?
আমজাদের তখন মায়ের কথা মনে পড়ল, খাবার নিয়ে এসে বলবে, যা, হাত মুখ ধুয়ে এগুলো খেয়ে ফেল।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে স্বাতি বললেন, এসব আমি তেলে ভেজিছি। শুনুন, রজত বলেছে, আপনি প্রতিদিন এখানে নাস্তা খেয়ে যাবেন।
আমজাদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে স্বাতি বললেন, আপনার কোনো অজুহাত শুনব বা। গণি ভাই আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছেন। দ্বিধা বা লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। না খেলে বরং আমরা কষ্ট পাব।
অগত্যা আমজাদ হাতমুখ ধুয়ে এসে খেতে শুরু করল।
আপনি খান আমি চা নিয়ে আসি বলে স্বাতি চলে গেলেন।
আমজাদের প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছিল লজ্জা পেলেও চারটে পরোটা ও ডিম সজি সব খেয়ে ফেলল। বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে এসে তিন গ্লাস পানি খেল।
স্বাতি দুকাপ লেবু চা নিয়ে এসে একটা আমজাদের হাতে দিয়ে একটা চেয়ারে বসলেন। তারপর নিজের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, কাল আপনার জন্য নাস্তা তৈরী করেছিলাম, এলেন না কেন?
বিথীকে যে কথা আমজাদ বলেছিল, তার মাকেও তাই বলল।
গণি ভাই কাল রাতে এসেছিলেন। বললেন, আপনি অফিসে যান নি। বেশ চিন্তিত দেখলাম। ওনাকে জানিয়ে গেলেন না কেন?
হঠাৎ যেতে হয়েছিল, তাই জানিয়ে যেতে পারি নি। রজতদা বাসায় নেই?
ও কাল ঢাকার বাইরে গেছে।
এবার আসি বলে আমজাদ খালি চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বিদায় নিয়ে চলে এল।
রাস্তায় এসে খুব ক্লান্তি বোধ করল। ভাবল, টানা তিন চার ঘণ্টা ঘুমাতে পারলে খুব ভালো হত। কিন্তু ঘুমাবে কোথায়?
কাওরান বাজার থেকে অত সকালে পড়াতে আসা খুব অসুবিধে। তাই ছাত্রীর বাসার কাছাকাছি মেসে থাকার সিদ্ধান্ত নিল।
আসার সময় সালমা খাতুন ছেলের হাতে এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন। সে কথা মনে পড়াতে ভাবল, মধুবাগে আপাতত একটা মেসে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। দু’তিন মাস পরে না হয় একরুমের ফ্যামিলী বাসা ভাড়া নিয়ে মাকে নিয়ে আসা যাবে। এই ভেবে মধুবাগ গিয়ে মেসে সীট খুঁজতে লাগল। ভাগ্যক্রমে একটা মেসে সীট পেয়েও গেল। মাসে পাঁচশ টাকা ভাড়া আর বুয়া রান্না করে দিলে পঁচাত্তর টাকা। মায়ের দেয়া টাকা থেকে পাঁচশ টাকা মেস ভাড়া আর বাকি টাকা থেকে তিনশ টাকা ফারযানার ধারশোধ করবে ভেবে মেসের একমাসের অগ্রিম ভাড়া পাঁচশ দিয়ে সীট বুক করে বলল, কাল সকাল সাতটায় আসবে।
বিকেলে অফিসে এসে গণি ভাইকে ফোন করল।
গণি ভাই বললেন, কী খবর আমজাদ? কাল কোথায় ছিলে?
আমজাদ গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলল।
একটা ফোন করে যাওয়া উচিত ছিল।
যাওয়ার কোন ঠিক ছিল না, হঠাৎ গিয়েছিলাম। তখন আর ফোন করার সময় ছিল না।
তোমার বাড়ির খবর সব ভালো?
হ্যাঁ ভালো। গণি ভাই, অত দূর থেকে এসে সকালে টিউশনী করতে খুব অসুবিধে। তাই মধুবাগ মেসে সিট নিয়েছি।
ভালই করেছ। এবার রাখছি বলে গণি ভাই ফোন ছেড়ে দিলেন।
পরেরদিন টিউশনী পড়িয়ে আমজাদ মহিমের বাসায় খোঁজ নিয়ে জানল, আজ সকালের ট্রেনে রাজশাহী চলে গেছে। কমলাপুর থেকে রাজশাহীর ট্রেন ছাড়ে আটটা চল্লিশে। ঘড়ি দেখল দশটা। এখন আর স্টেশনে গিয়ে কাজ হবে না। ফারহানাও তার সাথে গেল কিনা জানার জন্য তাদের বাসায় যাওয়ার মনস্থ করেও গেল না। কারণ তাদের বাসা চেনে না।
.
৩.
আমজাদ প্রায় চার মাস বিথীকে পড়াচ্ছে। প্রিটেস্টে ও টেষ্টে বিথী ভালো রেজাল্ট করেছে। এখন ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। বিথীর বাবা রজত খুশী হয়ে আমজাদকে এখন দুহাজার টাকা বেতন দিচ্ছেন।
একমাস পরে বাসা ভাড়া নিয়ে মাকে নিয়ে আসবে বলে এলেও আমজাদ প্রথম মাসের টিউসনির বেতন পেয়ে চিন্তা করেছিল, দেড় দু’হাজার টাকার কমে ভদ্র মহল্লায় দুই রুমের বাসা ভাড়া পাওয়া যাবে না। মা যা ধার্মিক মেয়ে, সেপারেট বাথরুম ও কিচেন না হলে থাকতেই চাইবে না। দেড় দু’হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিলে বাকি টাকায় দু’জনের চলবে? তাই তখন মাকে নিয়ে আসে নি। অবশ্য চিঠি দিয়ে মাকে সে কথা জানিয়েছে। আরো জানিয়েছে, দু’তিন মাস পরে নিয়ে আসবে।
বিথীর পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের দিন মাকে নিয়ে আসার কথা বলার জন্য তাদের বাসায় গেল।
আজ সপ্তাহিক ছুটি। রজত বাড়িতে ছিলেন। সবাই একসঙ্গে নাস্তা খেয়ে চা খাওয়ার সময় রজত বললেন, বিথী খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েছে বলল। আপনার কি মনে হয়?
আমজাদ বলল, আশা করি, ওর রেজাল্ট ইনশাআল্লাহ্ খুব ভালো হবে।
আপনার সঙ্গে যতবার আলাপ করেছি, আপনি কথায় কথায় ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ্ সবকিছু করার মালিক বলেন কেন?’
আপনার কথার উত্তর দেয়ার আগে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
বেশতো, কি জানতে চান বলুন।
আল্লাহ্ যে এক ও তিনি যে ভূমণ্ডল ও আকাশমণ্ডলী এবং এতদউভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, তা কী বিশ্বাস করেন?
আমি ওসব নিয়ে কখনো চিন্তা করি নি।
আমজাদ স্বাতিকে জিজ্ঞেস করল, আপনি করেন?
করি।
কিন্তু আমি আপনাদের বেদ, উপনিষদ, গীতা ও অন্যান্য অনেক ধর্মের বই । পড়েছি। বেদে সবকিছু একজন সৃষ্টি করেছেন উল্লেখ থাকলেও বহু দেব-দেবীর উপাসনা আপনারা করেন। আমি এ ব্যাপারে আর কিছু বলতে চাই না। তারপর রজতের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা আমি যদি বলি এই বিল্ডিংটা আপনা থেকে তৈরী হয়েছে, তা কি কেউ বিশ্বাস করবে? করবে না। বরং আমাকে পাগল বলবে। তা হলে এই ভূমণ্ডল ও আকাশমণ্ডলীর নিশ্চয় সৃষ্টিকর্তা আছেন। যারা একাধিক সৃষ্টিকর্তা আছেন বিশ্বাস করে, তারাও ভুল করে। কারণ একাধিক সৃষ্টিকর্তা থাকলে এত নিখুঁত সৃষ্টি ও নিখুঁত নিয়মানুবর্তিতায় সৃষ্টিজগৎ চলত না।
রজত বললেন, আমি ধর্ম যেমন বিশ্বাস করি নি তেমনি ওসব ব্যাপারে পড়াশোনাও করি নি। তবে মানব ধর্ম অর্থাৎ মানবতায় বিশ্বাসী। যা সত্য ও ন্যায় সেটাই হল আসল ধর্ম। যারা ধর্মের মুখোশ পরে সত্য ও ন্যায়কে পদদলিত করে অমানুষের মতো কাজ করে, তাদেরকে দুনিয়ার সকল মানুষ ধার্মিক বললেও আমি তাদেরকে শয়তান মনে করি। তাদেরকে ঘৃণা করি।
আপনি যদি কুরআন হাদিস ও নবী (দঃ) ও তার পবিত্র সাহাবীদের জীবনী ও ইসলামের সঠিক ইতিহাস পড়াতেন, তা হলে বুঝতে পারতেন আপনার কথাগুলো ইসলামের কথা। ইসলাম এমন একটা ধর্ম, যেখানে মানব ধর্মকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। সেখানে এতটুকু অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় নি। যারা ধর্মের মুখোশ পরে মানবতাকে অবমাননা করে, তারা ইসলামিক পরিভাষায়। মুনাফেক। মুনাফেকদের অন্তরে থাকে এক জিনিস আর মুখে প্রকাশ করে অথবা কাজ করে তার বিপরীত। এদের ব্যাপারে আল্লাহ কুরআন পাকে বলিয়াছেন “আখেরাতে এরাই হবে জাহান্নামী। আর জাহান্নাম হল অতি নিকৃষ্ট স্থান। যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে তাদেরকে বলে মুসলমান। আর মুসলমান শব্দের অর্থ হল মান্য করা। অর্থাৎ যারা ইসলামের বিধি-নিষেধ মেনে চলে তাদেরকে মুসলমান বলে। শুধু তাই নয়, ইসলাম যে কত বড় মানবতার ধর্ম, সে ব্যাপারে ছোট্ট একটা উদাহরণ দিচ্ছি, আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) বলিয়াছেন, “তুমি কোনো ফল বাড়িতে নিয়ে এলে পাশের বাড়িতে সামান্য হলেও দেবে। যদি দেয়ার মতো সামর্থ না থাকে, তা হলে ফলের খোসা জানালা দিয়ে বাইরে না ফেলে নিজের উঠোনে পুঁতে দেবে। নচেৎ পাশের বাড়ির ছেলেমেয়ে খোসা দেখে তারা তাদের মা-বাবার কাছে ঐ ফলের বায়না ধরবে। হয়তো তাদের বাবার ফল কেনার সমর্থ নেই।” হাদিসে আছে, আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “যখন তোমরা তরকারী রান্না কর। তাহার সুরুয়া বা ঝোল বৃদ্ধি করিও এবং তোমরা প্রতিবেশীকে উহা হইতে কিঞ্চিৎ দিও।” [বর্ণনায় হযরত আবুজর (রাঃ)—মুসলিম]
আর নারীদের উদ্দেশ্য করে নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, হে মুসলমান মহিলাগণ, কোনো প্রতিবেশিনী তাহার প্রতিবেশীকে ছাগলের খুর রাঁধা হইলেও উপহার দিতে যেন কষ্ট বোধ না করে। [বর্ণনায় : হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী]
মুমীন মুসলমানের জীবন-যাপন কুরআন ও হাদিসের দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে তাহার নজর (দৃষ্টি) ক্ষুদ্র নয়। তাহার সহানুভূতি, ভালোবাসা ও প্রেম কোনো নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, (২) মুমীন মুসলমান আত্মসম্মান জ্ঞান-সম্পন্ন। মুশরেক (আশাবাদী) সৃষ্টির নিকট মাথা নত করে এবং মানুষকে ভয় করে চলে, (৩) অপরপক্ষে মুমীন মুসলমান গর্বিত ও অহঙ্কারী হতে পারে না, (৪) সে বুঝে আত্মার পবিত্রতা ও সৎ কাজ ছাড়া অন্য উপায় নাই, (৫) মুমীন মুসলমান কোনো অবস্থাতেই নিরাশ বা ভাগ্নোৎসাহ হয় না (৬) সে আল্লাহর পথে বা জেহাদে নির্ভীক ও পরম সাহসী, (৭) হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, লোভ ও মোহ মুমীন মুসলমানের হৃদয় থেকে বের হয়ে যায়, (৮) তার সর্বাধিক গুণ আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) এর বিধান ও নির্দেশের আজ্ঞাধীন হওয়া, ইহার নামই ইসলাম আর এরাই হল প্রকৃত মুমীন মুসলমান।
স্বাতি বললেন, এগুলোই যদি মুসলমানদের পরিচয় হয়, তা হলে সারা পৃথিবীতে তারা এত অবহেলিত কেন? কেন আজ তারা এত অনুন্নত? কেন তারা আজ এত নিপীড়িত?
আমজাদ ছোট্ট একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, তারা তাদের পরিচয় জানে না। জানার চেষ্টাও করে না। যদি জানত, তা হলে আজ তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হত। প্রমাণ পেতে হলে কুরআন, হাদিস নবী ও সাহাবীদের জীবনী ও ইসলামের ইতিহাস পড়তে হবে। নবী (দঃ) এর যুগ থেকে ছ’শ বছর পর্যন্ত ইসলামের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এই ছ’শ বছরের ইতিহাস পড়লে জানা যায়, ঐ সময়ে মানুষ কত সুখ-স্বাছন্দে ও নির্ভয়ে বসবাস করেছে। আজ সারা দুনিয়াতে ছাপ্পান্নটা মুসলিম দেশ। সেসব দেশের শাসনকর্তাদের মধ্যে একতা নেই। যে যার গদী রক্ষার জন্য ইসলামের বিধি বিধান ত্যাগ করে বিধর্মীদের সরণাপন্ন হচ্ছে। বিধর্মীদের কাছ থেকে সমরাস্ত্র নিয়ে একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। আর এই সুযোগে ইহুদী খ্রিষ্টানরা পরিকল্পিতভাবে তাদের উপর আধিপত্য খাটাচ্ছে। আল্লাহ কুরআন পাকে বর্ণনা করিয়াছেন–”স্থলভাগে ও জলভাগে মানুষের স্বহস্থকৃতসমূহের দরুন নানাপ্রকার বালা-মসীবত-বিপদ-আপদ ছড়াইয়া পড়িতেছে, যেন আল্লাহ তাহাদিগকে তাহদের (মন্দ) কাজের কিয়দংশের স্বাদ উপভোগ করান, যাহাতে তাহারা (উহা হইতে) ফিরিয়া আসে।” [সূরা-রূম, আয়াত্ত–৪১, পারা-২১]
আচ্ছা রজতদা, আপনি ছেলেবেলায় অথবা কিশোর বয়সে মাহফিলে যান নি? অথবা আপনার মা, বাবা, বা আত্মীয়স্বজনদেরকে ধর্মের বিধি বিধান মেনে চলতে দেখেন নি?
ওয়াজ মহফিলে গেছি এবং ওয়াজ শুনে মনে হয়েছে, মৌলবীরা মধ্যযুগের মুসলমানদের অলিক কল্পকাহিনী শোনাচ্ছেন। আর মা বাবা আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে অনেককে নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত পালন করতে দেখলেও তাদের হিংসা বিদ্বেষ ও চরিত্রহীনতার কথা জেনে তাদেরকে ভণ্ড মনে হয়েছে। তবে আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে মনে হচ্ছে, আপনি তাদের ব্যতিক্রম। যাই হোক, আপনার যদি আরো কিছু বলার থাকে, পরে আলাপ করা যাবে। এখন আমি একটু বেরোব।
আমি কিন্তু একটা কথা বলতে এসেছিলাম।
বলুন।
বিথীর তো পরীক্ষা শেষ। ওকে আর পড়াতে আসতে হবে কি?
স্বামী বলার আগে স্বাতি বললেন, নিশ্চয় আসবেন। রেজাল্ট বেরোন পর্যন্ত আপনি ওকে অঙ্ক ও ইংরেজিতে পাকা করে ফেলবেন। ও যেন ইংরেজিতে কথা বলতে পারে সে ব্যাপারেও চেষ্টা করবেন। আর কলেজে এ্যাডমিশন পরীক্ষায় যেন ভালোভাবে কৃতকার্য হতে পারে। আমরা আপনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছি। এই তিন-চার মাস দু’হাজার দিলে ও কলেজে এ্যাডমিশন নেয়ার পর আড়াই হাজার দেব।
আমজাদ বিথীর দিকে এক পলক তাকিয়ে বুঝতে পারল সে আনন্দিত মুখে এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পাঁচশ টাকা বেতন বাড়বে শুনে মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আমি কয়েকদিনের জন্য বাড়ি যেতে চাই।
এবার রজত বললেন, বেশতো যাবেন। কদিন থাকবেন?
এক সপ্তাহের মধ্যে ইনশাল্লাহ ফিরে আসব।
রজত হেসে উঠে বললেন, আপনার এই ইনশাল্লাহ কথাটার অর্থ কি বলুন তো?
মুসলমান হিসাবে আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কারো কিছু করার ক্ষমতা নেই। ইনশাআল্লাহর অর্থ হল, “আল্লাহর রাজি থাকলে তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত ভবিষ্যতে কোনো কাজ করার কথা বলার আগে ইনশাল্লাহ বলা। অর্থাৎ সব সময় আল্লাহকে স্মরণ রাখা। তা হলে শয়তান মানুষের মনে কুপ্রবৃত্তি জাগাতে পারবে না।
ঠিক আছে, এব্যাপারেও আপনার সঙ্গে পরে আলাপ করব, এই কথা বলে রজত ভিতরের রুমে চলে গেলেন।
আমজাদকে উদ্দেশ্য করে স্বাতি বলল, আপনি বিথীর সাথে কথা বলুন, আমি একটু পরে আসছি।
মা চলে যাওয়ার পর বিথী বলল, আপনি ভালো চাকরির চেষ্টা করছেন না কেন?
আমজাদ মৃদু হেসে বলল, তোমার বুঝি তাই ধারণা? আসলে আজকাল। ভালো চাকরি পাওয়া খুব দুষ্কর।
বাবা একজন ব্যবসায়ী। যদি বলেন, তাকে আপনার কথা বলব।
তা বলতে পার, তবে আমার মনে হয় কোনো কাজ হবে না।
আপনার এরকম মনে হল কেন? বাবার অফিসেতো অনেক লোক চাকরি করে।
ঠিক আছে, তোমাকে তো বলতে বললাম।
এমন সময় স্বাতি ফিরে এসে বসে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর স্যার কাকে কি কথা বলতে বললেন?
বিথী বলল, স্যার উচ্চ ডিগ্রী নিয়েও একটা ভলো চাকরি পাচ্ছেন না। তাই বাবাকে চাকরির কথা বলতে বললেন।
তোকে কিছু বলতে হবে না। যা বলার আমি বলব। তারপর আমজাদকে বললেন, রজতের কাছে শুনেছি, মা ছাড়া আপনার কেউ নেই। তিনি ভাইয়ের বাড়িতে থাকেন। ঢাকায় নিয়ে এসে রাখেন না কেন?
এতদিন ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ ছিল না। এবার মাকে নিয়ে আসার জন্যই যাচ্ছি।
বাসা ভাড়া নিয়েছেন।
না। আজ কালের মধ্যে বাসা ভাড়া ঠিক করে যাব।
একদিন আমাদের বাসায় আপনার মাকে নিয়ে আসবেন।
ইনশাআল্লাহ্ নিয়ে আসব বলে আমজাদ তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল।
দু’দিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে মধুবাগেই টিনসেড দু’রুমের বাসা ভাড়া নিল, তারপর গণি ভাইয়ের অফিসে গিয়ে মাকে নিয়ে আসার কথা বলে এক সপ্তাহের ছুটি নিল।
.
বাড়িতে পৌঁছে মাকে গেট খুলতে দেখে সালাম দিয়ে কদমবুসি করে বলল, তুমি ভালো আছ মা?
ছেলের জামা কাপড় ও চেহারায় জৌলুসী দেখে সালমা খাতুন আনন্দিত হয়ে বললেন, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। আয়, আমার ঘরে গিয়ে বসবি।
বাসার সবকিছু আগের মতো থাকলেও কিছু যেন একটা হয়েছে বলে মনে হল আমজাদের।
মায়ের ঘরে এসে বসার পর জিজ্ঞেস করল, মামা মামিকে দেখছি না কেন?
পরে শুনিস সব কিছু, এখন এতটুক শুনে রাখ ইসমাঈল জেলে আছে। তোর মামা তাকে ছাড়াবার তদারকি করতে গেছে। আর তোর মামি স্বামীর সঙ্গে রাগারাগি করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। তুই হাত মুখ ধুয়ে নে, আমি নাস্তা নিয়ে আসি বলে সালমা খাতুন বেরিয়ে গেলেন।
ইসমাঈলের যে এরকম কিছু হবে গতবারে এসে বুঝতে পেরেছিল। তাই কবে গেল কেন গেল জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না।
কিছুক্ষণ পর সালমা খাতুন নাস্তা নিয়ে ফিরে এলেন।
আমজাদ খেতে শুরু করে বলল, ইসমাঈল জেলে গেল কেন?
ও হীরোইনের ব্যবসা করত। মাস দুয়েক আগে এক রাতে পুলিশ ঘর তল্লাসী করতে এসে ওর খাটের নিচে এক কেজী হীরোইন পেয়ে ধরে নিয়ে গেছে। সেই থেকে জেলে আছে।
মামা ছাড়াবার ব্যবস্থা করেন নি?
করে নি আবার। পুলিশরা অনেক টাকা চেয়েছিল। অত টাকা তোর মামা পাবে কোথায়?
কেন? ইসমাঈল তো মাসে দশ বিশ হাজার টাকা রোজগার করত?
রোজগার করলে কি হবে? তোর মামা মামিকে সংসার খরচ দিত। বাকি টাকায় মদ খেত, জুয়া খেলত।
তা মামি রাগারগি করে বাপের বাড়ি চলে গেলেন কেন?
তোর মামি বাপের অনেক সম্পত্তি পায়। তোর মামা তাকে বলেছিল তা থেকে কিছু বেঁচে টাকা এনে দিতে ছেলেকে ছাড়াবার জন্য। তোর মামি রাজি হয় নি। তাই তোর মামা রাগারাগি করেছিল।
আমি বাসা ভাড়া করে তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
তা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তোর মামা নেই। তাকে একা ফেলে যাই কি করে?
ও নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। রাগ করে মামি এর আগেও অনেকবার বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। কিছুদিন পর আবার ফিরেও এসেছেন। এবারও তাই করবেন?
তুই কদিন থাকবি?
বড় জোর চার পাঁচ দিন।
ভালো চাকরি পেয়েছিস বুঝি?
না। আগের চাকরি করছি। সেই সাথে টিউশনী করছি।
দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েছিল আমজাদ। বিকেলে আসরের নামায পড়ে ট্যাক্সি ক্যাবে শাহিনের খোঁজ করল।
ম্যানেজার বলল, শাহিন এখানে আর চাকরি করে না। নিজেই ট্যাক্সি নামিয়েছে। জাফরের গ্যারেজে গেলে তার খোঁজ পাবেন।
জাফরের গ্যারেজ আমজাদ চেনে। এম. এস. সি. পরীক্ষার পর গাড়ি চালানো ও গাড়ি সারানো শেখার জন্য এই গ্যারেজে তিন মাস কাজ করেছে। তখন জাফরের বয়স ছিল পঞ্চাশ পঞ্চান্ন। আমজাদ তাকে নানা ডাকত। এখন তার বয়স ষাটের উপর। কিন্তু শরীরের গঠন ভালো হওয়ায় এত বয়স জানা যায় না। গতবারে এসে সময়ের অভাবে তার সঙ্গে দেখা করতে পারে নি।
আমজাদ গ্যারেজে এসে জাফরের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন নানা?
জাফর সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আল্লাহ্ খুব ভালো রেখেছেন। তা ভাই তোমার খবর বল। শুনলাম, তুমি ঢাকায় চাকরি করছ। তা মাকে এখানে ফেলে রেখেছ কেন? তোমার মামাত ভাইয়ের খবর নিশ্চয় জেনেছ?
জি, জেনেছি। মাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
শুনে খুশী হলাম। তোমাকে মানুষ করার জন্য তোমার মা অনেক কষ্ট করেছে। দোয়া করি, তাকে সুখী করার তওফিক আল্লাহ যেন তোমাকে দেন।”
আপনার দোয়া যেন আল্লাহ্ কবুল করেন। তারপর বলল, নানা, শাহিনকে এখন কেথায় পাব বলতে পারেন?
তাকে এখন পাবে না। গতকাল সে প্যাসেঞ্জার নিয়ে ঢাকা গেছে, আগামীকাল তাদেরকে নিয়ে ফিরবে। তবে কখন ফিরবে বলতে পারছি না? তা কবে মাকে নিয়ে যাবে?
চার পাঁচ দিন পর। এবার আসি নানা।
সে কী? কতদিন পর এলে। কিছু না খেয়ে চলে যাবে? তারপর একজন কর্মচারীকে ডেকে চা নাস্তা আনতে দিলেন।
মাগরিবের নামায পড়ে ঘরে ফিরে দেখল, মামা মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। আমজাদ সালাম দিয়ে কদমবুসি করে বলল, মামা, কেমন আছেন।
জহির উদ্দিন একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আর আমাদের থাকা না থাকা। আজ দু’মাস হয়ে গেল টাকার জন্য ছেলেটাকে জেল থেকে বের করতে পারলাম না। কবে পারব তাও জানি না। আর বের করেই বা কি হবে? জেল। থেকে বেরিয়ে আবার তো ঐ কাজই করবে? ওর জন্য কারো কাছে মুখ দেখতে পারি না।
ওকে আপনারা ছোটবেলা থেকে শাসন করেন নি। নিজেরা যেমন ধর্ম কর্ম করেন নি। ওকেও তেমনি সেসব শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেন নি। এখন হা-হুঁতাশ করলে কি হবে? ইসমাঈল আপনাদের একমাত্র ছেলে, যেমন করে তোক বের করার ব্যবস্থা করুন। তারপর না হয় আমি ওকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে কিছু একটা। ব্যবস্থা করব।
বুবু বলল, তুমি তাকে নিয়ে যেতে এসেছ, কয়েকদিন থাকবে তো?
চার পাঁচ দিন থাকব, এর মধ্যে গিয়ে মামিকে নিয়ে আসুন। এতদিনে তার রাগ পড়ে গেছে।
জহির উদ্দিন আবার একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, তা ছাড়া তো আর উপায় দেখছি না।
রাতে ঘুমাবার সময় সালমা খাতুন ছেলের রুমে এসে তাকে একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললেন, তুই চলে যাওয়ার পর ঘর ঝাড় দেয়ার সময় পেয়েছি। তোর চিঠি পেয়ে ভেবেছিলাম, অফিসের ঠিকানায় ডাকে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু খুঁজে পাই নি। আজ তোর বই-এর তাক গুছাতে গিয়ে একটা বইয়ের ভেতর পেয়েছি।
সেবারে ঢাকায় ফিরে আমজাদ আসিফ সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য এই কার্ডটা পকেটে পায় নি। ভেবেছিল, আসার পথে টাকা বের করার সময় হয়তো কোথাও পড়ে গেছে। এখানে পড়ে গেছে ভাবতেই পারে নি।
এবারে আসার আগে একটা অফিস ব্যাগ কিনেছে। কার্ডটা তার ভিতরের পকেটে রেখে বলল, জান মা, গতবারে আসার সময় এই কার্ডের মালিক আমি চাকরি খুঁজছি শুনে এটা দিয়ে বলেছিলেন দেখা করতে। ঢাকায় গিয়ে কার্ডটি খুঁজে পাই নি।
এবারে গিয়ে দেখা করবি। আল্লাহ্ রাজি থাকলে উনি তোকে চাকরি দিতে পারেন। এবার ঘুমিয়ে পড়। আমি যাই বলে সালমা খাতুন চলে গেলেন।
কার্ডটা দেখেই আসিফ সাহেবের মেয়ে দুটোর কথা মনে পড়ল। মা চলে যাওয়ার পর গাড়ির মিররে তার দিকে ছোট মেয়েটির একদৃষ্টি তাকিয়ে থাকার ও হাসি উপহার দেয়ার কথা মনে পড়তে ভাবল, ঢাকায় ফিরে প্রথমে আসিফ। সাহেবের সঙ্গে দেখা করবে।
পরের দিন সকালে নাস্তা খেয়ে বেরিয়েছে এমন সময় শাহিনকে আসতে দেখে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, কাল এসেই তোর খোঁজে ট্যাক্সি ক্যাবে গিয়েছিলাম। সেখানে শুনলাম তুই নিজেই ট্যাক্সি নামিয়েছিস।
হ্যাঁ, আল্লাহ্ আমার মনের আশা পূরণ করেছেন। হোটেলে চল, যা খেতে চাইবি তাই খাওয়াব।
হাঁটতে শুরু করে আমজাদ বলল, এখন তা হলে ভালোই কামাচ্ছিস?
হ্যাঁ, আল্লাহর রহমতে ভালোই কামাচ্ছি।
কী ব্যাপার বলতো? কথায় কথায় আল্লাহর নাম নিচ্ছিস?
খুব অবাক হচ্ছিস, তাই না?
অবাক হওয়ারই তো কথা। গতবারে একবারও তোকে আল্লাহর নাম নিতে শুনি নি।
গতবারে শুনিস নি তো কি হয়েছে? সবকিছুতে আল্লাহর নাম নেয়াই তো প্রত্যেক মুসলমানের উচিত।
আমজাদ বলল, এখন আর তা হলে দু’নাম্বার মাল গাড়িতে করে নিয়ে যাস নি?
না। আল্লাহর কাছে তওবা করে মাফ চেয়ে ঐ কাজ ছেড়ে দিয়েছি।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আমজাদ বলল, তুই যে ট্যাক্সী নামিয়েছিস, এত টাকা পেলি কোথায়?
বাবা জমি বিক্রি করে পঞ্চাশ হাজার দিয়েছিল। সেটা জমা দিয়ে মাসে মাসে কিস্তিতে দিচ্ছি। তিন বছরের মধ্যে শোধ হয়ে যাবে। আমার কথা রেখে এবার তোর কথা বল।
আমার কথা নতুন করে আর কি বলব? আজও ভালো কিছু পাই নি। সেই আগের চাকরিই করছি। তবে একটা ভালো টিউশনী করছি। মাসে হাজার দুই পাই।
গতবারে আসার সময় যে লোকটা কার্ড দিয়ে দেখা করতে বলেছিলেন, ওনার কাছে যাস নি?
কার্ডটা এখানে ফেলে গিয়েছিলাম। তাই যাওয়া হয় নি। আজ মা কার্ডটা দিল। ভেবেছি, ঢাকায় গিয়েই ওনার সঙ্গে দেখা করব।
তাই করিস। আমার মনে হয় তিনি তোকে ভালো চাকরি দেবেন। আছিস তো ক’দিন?
চার পাঁচদিন আছি।
তোর মামাত ভাই জেলে সেকথা নিশ্চয় শুনেছিস?
হ্যাঁ, শুনেছি। ছেলের জন্য মামা খুব ভেঙ্গে পড়েছেন। আমার টাকা থাকলে যেমন করে হোক ওকে জেল থেকে বের করতাম।
ভাগ্যিস আল্লাহ্ আমাকে আগেই হেদায়েত দিয়েছেন, নচেৎ আমারও হয়তো একদিন ওর মতো অবস্থা হত।
আমজাদ একটা কাগজে ঠিকানা লিখে তার হাতে দিয়ে বলল,ঢাকা গেলে এখানে আসবি।
বাসা ভাড়া নিয়েছিস?
হ্যাঁ, মাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
ঠিক আছে, ঢাকায় গেলে তোর বাসায় যাব। বিকেলে যশোহরের একটা ট্রিপ আছে, যাবি না কি?
তোর প্যাসেঞ্জার আপত্তি করবে না?
সেটা আমি বুঝবো। তুই যাবি নাকি বল?
যাব।
তিনটের সময় রেডি থাকিস, তুলে নেব।
প্যাসেঞ্জার বুড়ো দম্পতি। তারা পিছনের সিটে বসেছে। ওরা দু’জন সারা রাস্তা গল্প করে কাটাল।
প্যাসেঞ্জার নামিয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এসে শাহিন বলল, এখানে ঘণ্টাখানেক প্যাসেঞ্জারের জন্য অপেক্ষা করব। ভাগ্য ভালো থাকলে পেয়ে যেতে পারি।
আমজাদ বলল, ঠিক আছে, তুই এখানে থাক, আমি একটু মার্কেট থেকে। দু’একটা জিনিস কিনে আনি।
বেশতো যা, এক ঘণ্টার বেশি দেরি করবি না কিন্তু।
আমজাদ রাস্তা পার হয়ে মার্কটে ঢুকতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে সুরেলা মেয়েলী কণ্ঠ কানে এল–
এই যে শুনুন।
যদিও আমজাদের মনে হল, এখানে তার পরিচিত কোনো মেয়ে নেই যে, তাকে ডাকবে। তবু মেয়েটির মধুর কণ্ঠস্বর শুনে পিছনে না তাকিয়ে পারল না। তাকিয়েই অবাক।
মেয়েটি মৃদু হেসে বলল, চিনতে পারছেন?
নিজের অজান্তে আমজাদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আপনাকে একশ বছর পরে দেখলেও চিনতে পারব।
মেয়েটির সঙ্গে তারই বয়সী দুতিনটে মেয়ে রয়েছে দেখে আমজাদ সামলে নিয়ে বলল, সেই থেকে এখানে আছেন, না আবার এসেছেন?
এখানে আমার ফুপুর বাড়ি। বছরে দু’একবার বেড়াতে আসি। দু’দিন হল এসেছি। তা আপনি এখানে কেন? আপনার বাড়ি তো সাতক্ষীরা?
বন্ধুর সঙ্গে এসেছি।
বাবা আপনাকে কার্ড দিয়ে দেখা করতে বলেছিলেন, দেখা করেন নি কেন?
আপনি জানলেন কি করে?
বাবার কাছে জেনেছি। আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না যে?
কার্ডটা হারিয়ে ফেলেছিলাম।
হারিয়ে ফেলেছিলাম বললেন, এখন তা হলে পেয়েছেন?
হ্যাঁ, বাড়িতেই ফেলে গিয়েছিলাম। এবারে আসার পর মা দিয়েছেন।
ঢাকায় ফিরছেন কবে?
কয়েকদিনের মধ্যে।
আশা করি, বাবার সঙ্গে দেখা করবেন?
ইনশাআল্লাহ্ করব। কিছু মনে করবে না। আমি আমজাদ, আপনি?
আনান।
ধন্যবাদ, এবার আসি।
আনানও ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, চলুন না, একটু গলা ভেজান যাক।
মাফ করবেন, সময় নেই। বন্ধু অপেক্ষা করছে। তারপর আমজাদ বিদায় নিয়ে গাড়ির কাছে ফিরে এল।
শাহিন বলল, কিরে, মার্কেটে গেলি কিছু কিনবি বলে, হাতে কিছু দেখছি না যে?
মার্কেটে ঢোকার আগে এমন একজনের সঙ্গে দেখা হল, যাকে দেখে কেনাকাটার কথা ভুলে গেলাম।
তাই নাকি?
হ্যাঁরে তাই। কি জানিস, তার সঙ্গে এখানে দেখা হবে কল্পনাই করি নি। ভাগ্যিস তোর সঙ্গে এসেছিলাম।
কী ব্যাপার বলতো? তোকে খুব উফুল্ল দেখাচ্ছে? কার সঙ্গে দেখা হল?
আরে ঐ যে গতবারে আসার সময় একজন নামি-দামি সাহেব ও দু’মেয়েকে লিফট দিলি, সেই দু’মেয়ের মধ্যে ছোটটার সঙ্গে।
বলিস কি রে? ঐ মেয়ে তোর সঙ্গে কথা বলল?
শুধু কথা নয়, তার বাবার সঙ্গে কেন দেখা করি নি সে কথা জিজ্ঞেস করে বলল, এবারে ঢাকায় গিয়ে যেন দেখা করি।
আমার কি মনে হচ্ছে জানিস?
বল, কি মনে হচ্ছে।
তোর উপর মেয়েটার নজর পড়েছে।
মানে?
এই সামান্য কথার মানে বুঝলি না? আরে বোকা, তোকে মেয়েটা পছন্দ করে ফেলেছে।
ধ্যাৎ, কি যা তা বকছিস?
যা তা বকছি নয়, দেখিস, একদিন আমার কথা ফলবে।
এমন সময় দু’জন ভদ্রলোক এসে বললেন, সাতক্ষীরা যাবেন?
শাহিন বলল, যাব, গাড়িতে উঠুন।
.
আমজাদ বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর ফুপাতো বোন সুবর্ণ আনানকে জিজ্ঞেস করল, কেরে ছেলেটা?
তোরা শুনিস নি? ছেলেটা তো নিজেই বলল, তার নাম আমজাদ।
তাতো শুনেছি; কিন্তু তুই উপযক হয়ে যেভাবে তার সঙ্গে আলাপ করলি, যেন কত দিনের পরিচিত।
আনান হেসে উঠে বলল, শোন, ওর সঙ্গে আজই প্রথম আলাপ হল।
সুবর্ণার চাচাতো বোন অঞ্জলী বলল, আজ প্রথম আলাপ হতে পারে, আগে, নিশ্চয় পরিচয় হয়েছে। তা না হলে অপরিচিতের সঙ্গে কেউ প্রথম আলাপ ঐভাবে করতে পারে?
না, আগে পরিচয় হয় নি। তবে একে অপরকে দেখেছি মাত্র। তারপর গতবারে আসার সময় যা কিছু ঘটেছিল বলে বলল, সে সময় উচ্চশিক্ষিত হয়েও চাকরি পাচ্ছে না শুনে বাবা ওনাকে কার্ড দিয়ে দেখা করতে বলেছিল।
সুবৰ্ণ টিপ্পনী কাটল, আরে, তোরা ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও আমি পেরেছি। ও ছেলেটার প্রেমে পড়েছে।
আনান রেগে উঠে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, কচু বুঝেছিস।
সুবৰ্ণ ছাড়ল না, বলল, কচু খুব ভিটামিনযুক্ত খাদ্য। ছেলেটা বেকার হলেও অনেকগুণের অধিকারী।
আনান আরো রেগে উঠে বলল, তোরা পাঁচ কেজি কচু কিনে খেতে থাক, আমি চললাম বলে হাঁটতে শুরু করল।
সাবাই তার পিছনে হাঁটতে শুরু করে অঞ্জলী বলল, আমরা একটু রসিকতা করলাম, আর তুই কিনা আমাদেরকে কচু খাইয়ে ছাড়লি?
.
8.
আট দিন গ্রামের বাড়িতে থেকে আমজাদ মাকে নিয়ে ঢাকায় এসে ভাড়া বাসায় উঠল।
আসার সময় সালমা খাতুন ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সব-কিছু সেপারেট বাসা ভাড়া নিয়েছিস তো? আমি কিন্তু অন্য ফ্যামিলীর সঙ্গে থাকতে পারব না।
আমজাদ মৃদু হেসে বলেছিল, মা যেমন ছেলের সবকিছু জানে, ছেলেও মায়ের সবকিছু না জানলেও অনেক কিছু জানে। তাই সেই রকমই বাসা ভাড়া নিয়েছি।
এখন বাসায় ঢুকে মাকে জিজ্ঞেস করল, বাসা তোমার পছন্দ হয়েছে? ইচ্ছা থাকলেও এর থেকে ভালো বাসা নিতে পারি নি।
কেন? এই বাসা খারাপ কিসের? আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
আমি হোটেল থেকে রুটি ও ভাজি নিয়ে আসি। এই ফাঁকে বাজার থেকে কি কি আনতে হবে একটা লিস্ট করে রাখ। নাস্তা খাওয়ার পর নিয়ে আসব।
পরের দিন আমজাদ পড়াতে এলে বিথী জিজ্ঞেস করল, কবে ফিরলেন।
গতকাল।
ভালো আছেন?
হ্যাঁ, ভালো।
আপনার মাকে নিয়ে এসেছেন?
হ্যাঁ।
আজ পড়ব না, আপনার গ্রামের বাড়ির কথা শুনব।
তুমি কোনো দিন গ্রামে যাও নি?
না।
ঢাকার বাইরে কোথাও যাও নি?
না। কতবার বাবাকে কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার কথা বলেছি; নিয়ে যান নি।
কেন?
বাবা ব্যবসা নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকেন। এমন কি ছুটির দিনেও বাসায় থাকেন না।
তোমার মা তো ছুটির দিন তোমাকে নিয়ে ঢাকার বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন?
এমন সময় স্বাতি আয়ার হতে চা-নাস্তাসহ এসে আমজাদের কথা শুনে বললেন, পারব কি করে? রজত কি কখনো আমাকে ঢাকার বাইরে কোথাও নিয়ে গেছে? তারপর আয়াকে নাস্তার ট্রে রেখে চলে যেতে বললেন।
এটা রজতদা আপনার প্রতি খুব অবিচার করছেন।
আমি আবার স্বাতির প্রতি কি অবিচার করলাম বলতে বলতে রজত এসে বসলেন।
আমজাদ বলল, এই যে বৌদি ও বিথীকে কখনো কোথাও বেড়াতে নিয়ে যান নি, এটা কি অবিচার নয়?
নিশ্চয় অবিচার; কিন্তু কেন নিয়ে যাই নি সে কথা জানা থাকলে বলতে পারতেন না।
তেমন কিছু কারণ থাকলে বৌদি নিশ্চিয় জানতেন।
সেটা আপনার বৌদিকে জিজ্ঞেস করবেন। এখন বলুন, আমি যা পারি নি আপনি পারবেন কিনা।
সম্ভব হলে নিশ্চয় পারব। বলুন কি করতে হবে? ছুটির দিনে ওদেরকে বেড়াতে নিয়ে যাবেন।
আমজাদ চিন্তা করতে লাগল, মা-মেয়ে বাসাতেই যে পোশাকে থাকে তাদের দিকে ভালো করে তাকানই যায় না। বেড়াতে যাওয়ার সময় কি পোশাক পরবে আল্লাহকে মালুম। তখন হয়তো তাদের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেই পারবে না।
রজত বললেন, কিছু বলছ না যে?
বললে আপনারা মাইন্ড করবেন।
মাইন্ড করার কি আছে? আপনি বলুন।
বেড়াতে যাওয়ার সময় বৌদি ও বিথীকে চাদর বা ওড়না গায়ে দিতে হবে।
রজত হো হো করে হেসে উঠে বললেন, আপনি ধার্মিক সেকথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কী, তোমরা ওনার কথায় রাজি আছ?
বিথী বলে উঠল, আমি রাজি।
স্বাতি বললেন, পোশাক মানুষের ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার। সেখানে কারো হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।
আমজাদ বলল, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। তবে কি জানেন, যে কোনো ব্যাপারে সব মানুষের দৃষ্টিকোণ এক নয়। আর মুসলমানরা সবকিছু ইসলামের দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করে। তাই মুসলমান হিসাবে কথাটা বলেছি।
রজত বললেন, আপনি এত লেখাপড়া করেও মন বড় করতে পারলেন না। মন বড় করুণ, দেখবেন, সেখানে কোনো ব্যাপারেই দ্বিধা-সংকোচ বা হীন মনোভাব নেই।
আপনি খুব মূল্যবান কথা বলেছেন, যা ইসলামও বলেছে। ইসলামে হীন মনমানসিকতা অর্থাৎ ঈর্ষা বিদ্ধেশ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা ও অপরের ক্ষতি করার চিন্তা করাও নিষেধ। সেই ইসলাম মেয়েদেরকে বাইরে যাতায়াত করার সময় সৌন্দর্য ঢেকে রাখতে বলছে। একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন, সমাজে যেমন ভালো মানুষ আছে, তেমনি লুচ্চা, গুন্ডা, খুনী ও হীন মনোবৃত্তির মানুষও আছে। এদের হাত থেকে নারীর সম্ভ্রম রক্ষার জন্য ইসলাম এই আদেশ দিয়েছে। রাস্তায়, মার্কেটে বা সভা সমিতিতে অশালীন পোশাকে নারীদের দেখলে কয়জন উঁচুমনের পরিচয় দিতে পারে?
আমাদের নবী হয়ত মুহাম্মদ (দঃ) বলিয়াছেন, “যদি কেউ বলে অশালীন পোশাকে কোনো যুবতী মেয়েকে দেখে তার কামানা জাগ্রত হয় না, তা হলে হয় সে পুরুষত্বহীন, নয়তো মিথ্যাবাদী।” আমার কথায় কিছু মনে করলে ক্ষমাপ্রার্থী।
আমজাদ থেমে যেতে রজত ও স্বাতি একে অপরের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে বিথী আনন্দে উৎফুল্ল হয়েছিল। এখন তা ভেস্তে যাচ্ছে দেখে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, পূজার সময় কোলকাতায় গিয়ে কত মেয়েকে ওড়না বা চাদর গায়ে দিতে দেখেছি। তুমি রাজি হচ্ছ না কেন?
স্বামীর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আমজাদের দিকে তাকিয়ে স্বাতি বললেন, আপনার কথা মেনে নিলাম।
বিথী হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, পরশু শুক্রবার, ঐদিন সকালে নাস্তা খেয়ে বেড়াতে যাব।
আমজাদ বলল, ঠিক আছে, তাই হবে।
বিথী বাবাকে বলল, ঐ দিন তুমি গাড়ি রেখে যাবে।
.
শুক্রবার দিন আমজাদ সকাল সকাল বাজার করে নিয়ে এসে মাকে বলল, আজ আমাকে একটু বেরোতে হবে। ফিরতে হয়তো বেশ দেরি হতে পারে। তুমি সময় মতো খেয়ে নিও।
সালমা খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবি?
যাকে প্রাইভেট পড়াই, সে ও তার মা কোথায় যেন বেড়াতে যাবে। তাদের সঙ্গে আমাকে থাকতে হবে।
তুই তাদের সঙ্গে যাবি কেন? তাদের পুরুষ কেউ নেই।
আছে। তিনি যেতে পারবে না। তাই তিনিই আমাকে যেতে বলেছেন।
কোথায় যাবে কিছু বলে নি?
না। তাই তো বললাম ফিরতে দেরি হতে পারে।
আমজাদ ন’টার সময় বিথীদের বাসায় এল।
বিথী গাল ভার করে বলল, এত দেরি করে এলেন কেন? মা ও আমি সেই আটটা থেকে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছি।
এমন সময় স্বাতি এসে বলল, আমরা ভাবতেই পারি নি আপনি এত দেরি করে আসবেন। আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে রজত একটু আগে বেরিয়ে গেল। নাস্তা খেয়েছেন?
আগে একা ছিলাম, এখন মা আছেন। সকালে বাজার করে দিয়ে নাস্তা খেয়ে বেরোতে দেরি হয়ে গেল। চলুন, বেরোনো যাক।
গাড়িতে উঠে আমজাদ বলল, আজ না হয় নবাব বাড়ি, যাদুঘর, চিড়িয়াখানা ও সাভরের স্মৃতিসৌধ দেখা যাক। অন্য দিন ঢাকার বাইরে কোথায় যাওয়া যাবে।
মা বলার আগে বিথী বলল, ওসব ড্রাইভারের সঙ্গে গিয়ে আমরা দেখেছি। আজ বরং যমুনা সেতু দেখতে যাই চলুন।
যমুনা সেতুর এপারে ড্রাইভার গাড়ি পার্ক করল।
এই সেতু দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন আসে। তাই সব সময় ভীড় থাকে। সেতুর দুইপাশে বিভিন্ন ধরনের দোকান আছে। বড় বড় মার্কেট ও হোটেল হয়েছে। যারা বেড়াতে আসে তারা কেনাকাটা করে, খাওয়া। দাওয়া করে।
প্রায় আধঘণ্টা বেড়াবার পর তারা সেতুর ওপারে গেল। সেখানে কেনাকাটা করার সময় আজান হতে শুনে আমজাদ স্বাতিকে বলল, আপনারা কেনাকাটা শেষ করে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করবেন। আমি জুম্মার নামায পড়ে আসি। তারপর খাওয়া দাওয়া করে বাসায় ফিরব।
ফেরার সময় বিথী ড্রাইভারকে বলল, স্মৃতিসৌধে চলুন।
স্মৃতিসৌধেও প্রতিদিন অনেক লোক বেড়াতে আসে। ওরা কিছুক্ষণ বেড়িয়ে একটা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়ার জন্য বসল।
অহনাকে একটা অচেনা ছেলের সঙ্গে তাদের পাশ থেকে যেতে দেখে বিথী বলল, আরে অহনা তুই?
অহনা বিখীর ক্লাসমেট ও বান্ধবী। বলল, যা, ভাইয়ার সঙ্গে এসেছি।
বিথী মায়ের সঙ্গে অহনার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, আমি ওদের সঙ্গে একটু বেড়িয়ে আসি।
যা, বেশি দেরি করবি না। তারপর তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমজাদ বলল, বৌদি একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবেন না বলুন।
স্বাতি মেয়ের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আমজাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, যা জানতে চাচ্ছেন, তা আমি জানি।
আমজাদ অবাক হয়ে বলল, অসম্ভব।
শুধু অসম্ভব নয়, অনেক সময় অকল্পনীয় জিনিসও আমি জানতে পারি।
কই, বলুন তো আমি কি জানতে চাচ্ছি।
বিথীকে পড়াতে আসার দিন থেকে যে কথাটা আপনার মনে দানা বেঁধে আছে, সেটাই জানতে চাচ্ছেন।
সেটা কি বলবেন তো?
ভিন্ন ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করে আমি সুখী কিনা।
স্বাতির কথা শুনে আমজাদ এত অবাক হল যে, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না।
স্বাতি মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বললেন, কী ঠিক বলি নি।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। এবার উত্তরটা বলুন।
স্বাতি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, পৃথিবীতে কোনো মানুষই সুখী নয়। যাদেরকে আমরা সুখী বলে জানি অথবা ধারণা করি, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তারা কোনো না কোনো বিষয়ে অসুখী। তাই সুখ বা সুখী কথাটা আপেক্ষিক।
আপনি খুব খাঁটি কথা বলেছেন। তবে আমি আপনাকে সুখের পথ দেখাতে না পারলেও শান্তির পথ দেখাতে পারি।
স্বাতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এক সময় চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠতে দৃষ্টি নিচের দিকে করে নিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে চোখ মুখে বললেন, কোলকাতায় যখন কলেজে পড়তাম তখন এক মুসলিম বান্ধবী আমার জন্মদিনের উৎসবে গীরিশ চন্দ্রের কুরআনের বঙ্গানুবাদ দিয়েছিল। সেটা পড়ে মনে হয়েছিল, সত্যি এটা ঐশীগ্রন্থ। আমার বাবা ধনী হলেও কোনো ব্রাক্ষণ বা ক্ষত্রিয় বংশের লোকদের সঙ্গে মিশতে পারতেন না। কারণ তিনি ছিলেন নিম্নবর্ণের লোক। তাই উচ্চবর্ণের ছেলেমেয়েরা আমার সঙ্গেও মেলামেশা করত না। হিন্দুধর্মের এই বর্ণভেদ আমার মনে প্রচণ্ড আঘাত করে। তাই আমি ধর্মবিমুখ। গিরীশচন্দ্রের কুরআনের বঙ্গানুবাদ পড়ে বুঝতে পারি ইসলাম সাম্যবাদ। সেখানে কোনো বর্ণভেদ নেই। সবাই ভাই ভাই। সেই সময় রজতের প্রেমে পড়ি। তাকে ধর্মবিমুখ দেখে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি তোমার ধর্ম মান না? বলল, ধর্ম আবার কি? ওটা মানুষের তৈরি। এক শ্রেণীর মানুষ ধর্মের কথা বলে অন্য শ্রেণীর মানুষদের শোষণ করছে। আমি বললাম, তুমি যখন মুসলমান ঘরের ছেলে তখন নিশ্চয় কুরআন যে ঐশীগ্রন্থ তা স্বীকার কর? রজত রেগে উঠে বলল, দেখ, আমার সঙ্গে কখনো ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থ নিয়ে আলাপ করবে না। ধর্মগ্রন্থে যতসব আজগুবি ও কল্পকাহিনী আছে। আমরা মানুষ, মানব ধর্মই আমাদের কাছে বড়। আমি তখন ওর প্রেমে হাবুডুবি খাচ্ছি। ওর কথা আমার কাছে বেদবাক্য বলে মনে হল। তারপর আর ধর্ম নিয়ে কোনো দিন চিন্তা করি নি। আপনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর মনে হয়েছিল, একজন সত্যিকার মানুষ দেখলাম। কোলকাতা থেকে চলে আসার সময় গিরীশচন্দ্রের বঙ্গানুবাদটা সঙ্গে এনেছিলাম। সেটা আবার পড়লাম। পড়ার পর ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আরো বেশি জানার প্রেরণা পেলাম। মার্কেট থেকে আল্লামা ইউসুফ আলির কুরআনের ইংরেজি অনুবাদ কিনে পড়তে শুরু করেছি। এর মধ্যে গোলাম মোস্তফার “বিশ্ব নবী” পড়েছি। পড়ে মনে হল, ওঁনার মতো সবগুণের অধিকারী মানুষ দ্বিতীয় কেউ জন্মান নি পৃথিবীতে। এইসব পড়ে মনে হচ্ছে আমি যেন শান্তির পথ দেখতে পাচ্ছি।
স্বাতির কথা শুনে আনন্দে আমজাদের চোখে পানি আসার উপক্রম হল। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, ইনশাআল্লাহ্ আপনি খুব শিঘ্রী শান্তির পথের পথিক হয়ে যাবেন। একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছা করছে, যদিও কথাটা জানতে চাওয়া আমার উচিত হবে না।
ঠিক আছে, বলুন কি জানতে চাচ্ছেন।
হিন্দু বা ইসলাম কোনো ধর্মমতেই আপনাদের দাম্পত্যজীবন বৈধ নয় এবং বিথী আপনাদের অবৈধ সন্তান। এ ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে ইচ্ছা করছে।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি ধর্ম মানি না। ভার্সিটিতে রজতের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সময় জানতে পারলাম, সেও আমার মতো ধর্ম মানে না। তাই হয়তো আমরা প্রেমে পড়ে যাই। আর বিথীর কথা যে বলেছেন, তা নিয়ে কখনো চিন্তা করি নি। ধর্মের প্রতি ওর বিশ্বাস আছে না নেই, তাও কোনোদিন জিজ্ঞেস করি নি।
অনেকের কথা শুনেছি, যারা প্রেম করে বিয়ে করে, তাদের দাম্পত্যজীবনে কিছুদিনের মধ্যে অশান্তি নেমে আসে। কথাটা কতটা সত্য বলবেন?
স্বাতি হেসে উঠে বললেন, আপনিও প্রেমে পড়েছেন নাকি?
আপনার অনুমান ঠিক, তাইতো জিজ্ঞেস করছি।
দেখুন আমজাদ সাহেব, প্রেম করে বিয়ে হোক অথবা গার্জেনদের সিলেক্টেড বিয়ে হোক, স্বামী স্ত্রীর মন মানসিকতা যদি এক হয়, তা হলে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাদের দাম্পত্য জীবন শান্তিতে কাটবে। আর তা যদি না হয়, তা হলে তো অশান্তি হবেই। তবে দু’জনেই যদি একে অপরকে ভালবাসতে পারে, একে অপরের প্রাপ্য মর্যাদা দেয় এবং দুজনেই একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়, তা হলে তাদের মন-মানসিকতা এক না হলেও দাম্পত্যজীবন শান্তিতে কাটাতে পারবে। আরো কথা আছে, স্বামি স্ত্রীর মন-মানসিতা এক হলেও সাংসারিক জীবনে ছোট হোক বড় হোক কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হবেই। সেটা মোকাবেলা করার জন্য উভয়কেই ধের্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
ধন্যবাদ, আপনার কাছ থেকে অনেক মূল্যবান কথা জানতে পারলাম। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনাদের জীবনে নিশ্চয় এরকম কিছু ঘটেছে?
সবার জীবনে এরকম ঘটবেই, এটা ইউনিভার্সল ট্রুথ।
বললে বাধিত হতাম।
আপনি ভীষণ চালাক ছেলে, মৃদু হেসে বললেন স্বাতি। তারপর বললেন, আমরা জানতাম, হিন্দু বা মুসলিম কোনো সমাজই আমাদের প্রেমকে মেনে নেবে না এবং গ্রহণও করবে না। তাই পড়াশোনা শেষ করে এখানে পালিয়ে এসে আমরা কোর্টম্যারেজ করি। বিথী হওয়ার আগে পর্যন্ত মনে হত আমার চেয়ে ভাগ্যবতী মেয়ে পৃথিবীতে দ্বিতীয় নেই। বিথী হওয়ার পর থেকে রজত পাল্টাতে শুরু করল। প্রথমে বাইরে মদ খেতো, এখন ঘরে খায়। আগে সন্ধ্যের আগে বাসায় ফিরত, এখন রাত বারটা একটায় ফেরে। ব্যবসা ও টাকার পেছনে ছুটছে তো ছুটছেই। বাসায় যে স্ত্রী ও একটা মেয়ে আছে, তাদের প্রতি যে একটা কর্তব্য আছে, সেদিকে তার দৃষ্টি নেই। এখন মনে হয়, আমার চেয়ে টাকাকে বেশি ভালবাসে।
আপনি প্রতিবাদ করেন নি?
আমি ওকে এত ভালবাসি, যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। ও যদি আমার সামনে এক গ্লাস সরবতে বিষ মিশিয়ে খেতে দেয়, আমি হাসতে হাসতে সেই সরবত খেয়ে নিতে পারব। এতটুকু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংকোচ-রাগ বা অভিমান কিছুই হবে না।
আপনি একজন উচ্চশিক্ষিত মেয়ে। আপনার কাছ থেকে এরকম আশা করি নি।
স্বাতি হেসে উঠে বললে, ছেলেমেয়েরা প্রেম করে; কিন্তু খাঁটি প্রেম কাকে বলে তারা জানে না। আপনিও প্রেমে পড়েছেন বললেন? মনে হয়, খাঁটি প্রেম কাকে বলে জানেন না। জানলে একথা বলতেন না। শুনুন, রজত ও আমার মন মানসিকতা এক ছিল। বিথী হবার আগে পর্যন্ত আমাদের মধ্যে এতটুকু মতবিরোধ হয় নি। বিথী হওয়ার পর থেকে রজত হারিয়ে গেল। এখন যে রজতের সঙ্গে জীবন যাপন করছি, সে অন্য মানুষ। তবে এজন্য আমার কোনো হা-হুঁতাশ নেই। কারণ রজত আমার জীবন ও মরণ। আমার বিশ্বাস, আমি যদি শান্তির পথ পেয়ে যাই, তা হলে ওকেও সেই পথের পথিক করতে পারব ইনশাআল্লাহ্। তারপর হেসে বলে বললেন, এই দেখুন, আপনার মতো আমিও কথায় কথায় ইনশাল্লাহ বলে ফেললাম।
আমজাদ আবার মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলর, দোয়া করি, “আল্লাহ্ যেন আপনাকে অতি শীঘ্র শান্তির পথের পথিক করেন।”
স্বাতি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, আমি আগে ধর্মের কথা শুনলে রেগে গেলেও এখন আগ্রহসহকারে শুনি, ধর্ম সম্পর্কে জানতে ইচ্ছা হয়। তাই ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন বই-পত্র পড়তে শুরু করেছি। কিন্তু রজতের জন্য খুব কষ্ট অনুভব করি। কারণ ও ধর্মের কথা মোটেই সহ্য করতে পারে না।
আমার কি মনে হয় জানেন, উনি এমন অনেককে জানেন, যারা ধর্মের খোলস পরে অধর্মের কাজ করে।
এমন সময় বিথী ফিরে এলে স্বাতি বললেন, চলুন, এবার ফেরা যাক।
.
আমজাদ মাকে নিয়ে ঢাকায় আসার সপ্তাহ খানেক পর একদিন আসিফ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেল। অফিসে ঢুকে একজন পিয়নকে বলল, আমি আসিফ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
পিয়ন অবাক হয়ে তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ওনার পরিচিত?
কেন? অপরিচিত কোনো লোক বুঝি ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারে না?
প্যাচাল পাড়বেন না, যা জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দিন।
হ্যাঁ, পরিচিত।
তা হলে প্যাচাল পাড়ার কি দরকার ছিল? আসুন আমার সঙ্গে। তারপর পর্দা ফেলা একটা দরজার সামনে এসে বলল, ভিতরে যান সাহেবের পি. এ. আছেন। ওনাকে বলুন।
আমজাদ পর্দা সরিয়ে সালাম দিয়ে বলল, আসতে পারি?
কবির মুভিং চেয়ার ঘুরিয়ে আলমারী থেকে একটা ফাইল বের করছিল। কারো সালাম শুনে টেবিলের দিকে ঘুরে বললেন, আসুন।
আমজাদ ভিতরে ঢুকে সালাম দিল।
কবীর সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে বললেন, কি দরকারে এসেছেন বলুন।
আমজাদ বসল না। দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, আমি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
আপনার সঙ্গে কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?
না। প্রায় ছয় সাত মাস আগে সাতক্ষীরা যাওয়ার পথে ওনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আমি চাকরি খুঁজছি জেনে একটা কার্ড দিয়ে দেখা করতে বলেছিলেন। যে কোনো কারণে এতদিন আসতে পারি নি। তারপর বুক পকেট থেকে কার্ডটা বের করে দেখাল।
ঠিক আছে বলে কবীর ইন্টারকমে সাহেবকে কথাটা জানাল।
আসিফ সাহেব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, পাঠিয়ে দিন।
কবীর রিসিভার রেখে কলিং বেল বাজাতে একজন পিয়ন ভিতরে ঢুকল। এনাকে সাহেবের রুম দেখিয়ে দাও বললেন কবীর।
পিয়ন আমজাদকে নিয়ে সাহেবের রুমের কাছে এসে টুলে বসা দারোয়ানকে বলল, এনাকে সাহেব কল করেছেন।
দারোয়ান দরজা খুলে পর্দা সরিয়ে আমজাদকে বলল, যান, ভিতরে যান।
আমজাদ ঢুকেই সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে আসিফ সাহেব হর্ষোফুল্ল কণ্ঠে বললেন, এস, এস। তোমার কথা প্রায়ই মনে পড়ে।
অফিস কম্পাউন্ডে ঢুকে আমজাদের মনে হয়েছিল, সে যেন কোনো ফরেন অফিসে এসেছে। চাকরির চেষ্টায় তাকে অনেক অফিসে যেতে হয়েছে। সেসব অফিসের পরিবেশের চেয়ে এই অফিসের পরিবেশ অনেক উন্নত। তারপর পি. এর রুমের পরিবেশ আরো উন্নত দেখেছে। এখন সাহেবের রুমে ঢুকে মনে হল, ইনি নিশ্চয় বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ধনীদের একজন। খুব দামি কার্পেট বিছান থাকায় জুতো খুলে আসার সময় তার পা নরম কার্পেটে ঢুকে যাচ্ছিল।
তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আসিফ সাহেব বসতে বলে বললেন, কি খবর বল? এতদিন আস নি কেন? কোথাও ভালো চাকির পেয়ে গেছ মনে হয়?
আমজাদ বসে বলল, না, চাকরি পাই নি। কার্ডটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। পাওয়ার পর এলাম।
খুব খুশী হয়েছি। কি খাবে, ঠাণ্ডা না গরম?
নো থ্যাঙ্কস।
ড্রিঙ্কস?
আল্লাহ্ যে জিনিসকে হারাম করেছেন, তা কোনো মুসলমান খায় না।
কথাটা শুনে আসিফ সাহেবের চেহারা থেকে খুশী খুশীভাব নিভে গেল। কয়েক সেকেণ্ড আমজাদের আপাদমস্তক দেখে উত্তেজীত স্বরে বললেন, তবে কেন মুসলমান রাষ্ট্র হয়েও এদেশে মদের ব্যবসা মুসলমানরাই করছে। মিথ্যে, জোছুরী, ঠকবাজী, ব্যাভিচারী, হিংসা-বিদ্বেষ, দলাদলি খুনো-খুনী মুসলমানদের মধ্যে কেন এত বেশি? মোল্লা-মৌলবীরা মানুষদের কুরআন হাদিসের বাণী শোনাচ্ছে, আর নিজেরা সেসব মেনে চলছে না কেন? কেন মুসলমানরা ঘুষ খাচ্ছে, সুদের ব্যবসা করছে এগুলো বুঝি আল্লাহ জায়েজ করেছেন?
এসমস্ত কথা আলাপ করার জন্য সময়ের দারকার। আপনি চাইলে–
তাকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে আসিফ সাহেব বললেন, তোমার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। এগুলোও যে হারাম, তা জানি। যাকগে, এবার আসল কথায় ফিরে আসি। তুমি গাড়ি চালাতে জান?
তাকে ড্রাইভারের চাকরি দেবেন ভেবে আমজাদ খুব মনক্ষুণ্ণ হয়ে বলল, এইজন্য আসতে বলেছিলেন?
হো হো করে হেসে উঠে আসিফ সাহেব বললেন, না। যে পোষ্টে তোমাকে দেয়া হবে, তাতে বাড়ি-গাড়ি পাবে, ফোনও পাবে। অবশ্য গাড়ি চালাতে না জানলে ড্রাইভারও দেয়া হবে।
চাকরির পোষ্টের কথা শুনে আমজাদ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। ভাবল, স্বপ্ন দেখছে না তো? কিছু বলতে না পেরে একদৃষ্টে আসিফ সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
কী হল? ওভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কেন? তুমি কি মনে করেছ আমি তোমার সঙ্গে রসিকতা করছি? যদি তাই ভেবে থাক, তা হলে ভুল করছ।
আপনাকে ভুল বোঝার জন্য ক্ষমা চাইছি।
ঠিক আছে বলে আসিফ সাহেব ইন্টারকমে পি. এ.-কে কিছু নির্দেশ দিয়ে আমজাদকে বললেন, এস আমার সঙ্গে। তারপর তাকে নিয়ে নিচে নেমে এলেন।
ড্রাইভার গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে অন্য গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছিল। এত তাড়াতাড়ি সাহেবকে আসতে দেখে অবাক হয়ে পেছনের গেট খুলে দিল।
ব্রাউন কালারের মার্সিটিজ গাড়িটার প্রশংসা না করে পারল না আমজাদ।
আমজাদের মুখে প্রশংসার ছাপ ফুটে উঠতে দেখে আসিফ সাহেব বললেন, এটা আমার খুব পছন্দের গাড়ি হলেও অনেক পুরানো। তা ছাড়া এর হেডলাইটও আমার একদম পছন্দ নয়। বু গাড়িটার হেড লাইটের ডিজাইনটা খুব পছন্দ।
কয়টা গাড়ি আপনার?
আসিফ সাহেব তার কথার উত্তর না দিয়ে শুধু মুচকি হেসে গাড়িতে উঠে তাকেও উঠতে বললেন।
এয়ারপোর্ট রোড ধরে গাড়ি ছুটছে। আসিফ সাহেব চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আধখোলা জানালা দিয়ে প্রবল বাতাস এসে ওনার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে।
আমজাদও জানালা দিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে চিন্তা করছে, তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কেনই বা নিয়ে যাচ্ছেন? এয়ারপোর্ট পার হওয়ার পর চুপ করে থাকতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, আমরা কেথায় যাচ্ছি।
আমার স্ত্রীর বাড়িতে।
আমজাদ অবাক হয়ে বলল, আপনার, স্ত্রী বাড়িতে? শহরে আপনার বাড়ি নেই?
শহরে অনেকগুলো বাড়ি আছে। ধানমন্ডির বাড়িতে আমি থাকি। আমার স্ত্রী শহরে থাকতে পছন্দ করত না। তাই তার জন্য এই বাড়িটা তৈরী করেছি। এর ডিজাইন ও যাবতীয় যা কিছু সব আমার স্ত্রীর পছন্দ মতো হয়েছে।
সামনে স্পীড ব্রেকার দেখে ড্রাইভার গাড়ির গতি কমাল। সেটা পার হওয়ার পরেও গাড়ি ধীরে ধীরে চলতে লাগল। একটা লম্বা পাঁচিল চোখে পড়ল আমজাদের। পাঁচিলের মাথা ঢেউ খেলানো ও বাইরের সাইডে পাথর বাসানো। পাঁচিল থেকে বেশ দূরে টালির ছাদওয়ালা খুব সুন্দর দোতলা বাড়ি দেখতে পেল। পাঁচিলের মাঝ বরাবর একটা বড় লোহার গেটের কাছে এসে গাড়ি দাঁড়াতেই। দারোয়ান স্যালিউট দিয়ে গড়গড় শব্দে গেট খুলে দিল।
দীর্ঘ ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে গাছ-গাছালি ঘেরা বাড়ির গাড়ি বারান্দায় এসে ড্রাইভার গাড়ি থামাল।
দু’জন লোক এসে দু’পাশের গেট খুলে দিল।
গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল আমজাদ। বিশাল এলাকা জুড়ে ঘাসভূমি। আর সমান দূরত্বে নানারকম ফলের গাছ। প্রতিটি গাছের নিচে বসার জন্য পাকা বেঞ্চ। ঘাসভূমির বুক চিরে বেড়ানোর জন্য কংক্রীটের পথ। পথের দুপাশে লাইন ধরে ফুলের ও বাহারী পাতার গাছ। ওলিরা ফুলে ফুলে গুণ গুণ করে গান গেয়ে এক ফুল থেকে অন্য ফুলের মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে। পাখীরা কলতান করতে করতে এক গাছ থেকে অন্য গাছে গিয়ে বসছে। এখানে নেই কোনো মানুষের কোলাহল, নেই কোনো গাড়ির শব্দ। আমজাদের মনে হল, সে যেন এক অন্য জগতে এসে পড়েছে।
চল, ভিতরে গিয়ে বসি বললেন আসিফ সাহেব।
আমজাদ এতক্ষণ যেন অন্য জগতে বিচরণ করছিল। আসিফ সাহেবের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে যেতে যেতে বলল, এটাই তা হলে আপনার স্ত্রীর বাড়ি?
হ্যাঁ, এখানে কয়েকজন কাজের লোক, দারোয়ান ও বাবুর্চি ছাড়া কেউ থাকে না। আর কয়েকটা বিদেশী কুকুর আছে সিকিউরিটির জন্য। তাদের রাত্রে ছেড়ে দেয়া হয়।
এত সুন্দর একটা বাড়ি, এভাবে ফেলে রেখেছেন কেন?
এটা আমার স্ত্রীর স্মৃতি বহন করেছে। দোতলায় একটা হল রুম আছে। সেখানে আমার স্ত্রীর যাবতীয় জিনিস ছোট বড় কাঁচের ঘরে আলাদা আলাদা করে রাখা হয়েছে। ঐ ঘরে ঢুকলে মনে হবে মিউজিয়াম। চল, তোমাকে দেখাব।
আমজাদ লক্ষ্য কলল, সারা বাড়িটা পরিষ্কার ঝকঝকে। ঘরের মেঝে, দেয়াল ও সিঁড়িতে সাদা মার্বেল পাথর বসান।
দোতলায় উঠে আসিফ সাহেব তালা খুলে তাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন।
আমজাদ অবাক হয়ে দেখল, বিরাট রুম। যাদুঘরে যেমন কাঁচের ছোট ছোট ঘরে দুষ্প্রাপ্য জিনিস একের পর এক সাজিয়ে রাখে, আসিফ সাহেবও ঠিক সেইভাবে স্ত্রীর সবকিছু সাজিয়ে রেখেছেন।
পাশের রুমে ঢুকে আসিফ সাহেব বললেন, এই রুমে আমরা ঘুমাতাম।
আমজাদ ঢুকেই দেখতে পেল, একটা বিশাল ফ্রেমে বাঁধান পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক অসামান্য রূপসীর রঙিন ছবি। ভাবল, কোনো মানবী কি এত রূপসী হয়? হঠাৎ মনে হল, আনান অনেকটা এই মেয়ের মতো।
আসিফ সাহেব তার কাঁধে একটা হাত রেখে ভিজে গলায় বললেন, আমার স্ত্রী আফিয়া জয়নাব। আল্লাহ্ তাকে জান্নাতবাসিনী করুন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এই নামের অর্থ জান? পুণ্যবতী রূপসী। নামের সার্থকতা ছিল ওর জীবনে। এবার চল, অনেক বেলা হয়েছে, খেতে হবে।
ড্রইংরুমে এসে বসার পর আসিফ সাহেব ইন্টারকমে খাবারের অর্ডার দিলেন। তারপর কিভাবে তাদের বিয়ে হল, কিভাবে, দশটা বছর তাদের দাম্পত্যজীবন কাটালেন এবং কিভাবে স্ত্রী মারা গেছেন বললেন।
আমজাদের কাছে ওনাদের জীবন কাহিনী অলৌকিক মনে হল। অবাক হয়ে দেখল, আসিফ সাহেবের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।
পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে আসিফ সাহেব বললেন, যে বছর ব্যবসায় আমি বড় অঙ্কের লস খেলাম, সেই বছর আমাদের চার বছরের ছেলে সাকিল মাত্র কয়েকদিনের জ্বরে মারা গেল। ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে বড় বড় ডাক্তার দেখালাম, কিছুই হল না। আমার স্ত্রী ছোটবেলা থেকে ধর্মের বিধি নিষেধ কাঠোরভাবে পালন করত। বিয়ের পর আমাকে ধর্মের বিধি নিষেধ মেনে চলার কথা বলে অনেক বোঝাত। আমি তার কথায় কর্ণপাত না করে নিজের খেয়াল খুশীমতো চলতাম। তাই বলে সে আমাকে এতটুকু অবহেলা করত না। এমন কি কখনও অসন্তুষ্ট প্রকাশ করত না। বরং আমার প্রতি তার ভালবাসা দিনের প্র দিন আরো গম্ভীর হয়েছে। ছেলেটা মারা যাওয়ার পর দুটো মেয়ে হয়। হোট মেয়ের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন আমার স্ত্রী মারা যায়। যতদিন বেঁচে ছিল, ছেলের শোক ভুলতে পারে নি। ওকে বিয়ে করার পর তরতর করে আমি উন্নতির চরম শিখরে উঠি। ছেলেটা মারা যাওয়ায় আমিও খুব শোকাভূত হয়েছিলাম। তখন থেকে ধর্মের বিধি নিষেধ মেন চলতে শুরু করি। তারপর ঘড়ি দেখে বললেন, আমাদের জোহরের নামায পড়া হয় নি, এখনো সময় আছে। আমার স্ত্রী একটা রুমকে ইবাদতখানা করেছিল। বেশিরভাগ সময় সেখানে ইবাদ ও ধর্মীয় বই পুস্তক পড়ে সময় কাটাত। চল, সেখানে নামাযটা পড়ে নিই। ততক্ষণে খাবার রেডি হয়ে যাবে।
ইবাদতখানার পাশেই বাথরুম ও অযু করার ব্যবস্থা। বাথরুমের কাজ সেরে অযু করে ভিতরে ঢুকতেই আতর গোলাপের খুশবু আমজাদের নাকে এসে লাগল। পশ্চিম দিক ছাড়া অন্য তিন দিকে দেয়াল সংলগ্ন বড় বড় কাঁচের আলমারিতে ধর্মীয় বই রয়েছে দেখে আমজাদ আর একবার খুব অবাক হল। ভাবল, সে যেন পাবলিক লাইব্রেরীতে এসে ঢুকল।
আসিফ সাহেব বললেন, আমার স্ত্রীর হবি ছিল বই পড়া। সেজন্য প্রতি মাসে হাজার হাজার টাকার বই কিনত। এখানে শুধু ধর্মীয় বই। লাইব্রেরী রুমে অন্যান্য বইয়ের সমাহার দেখলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে।
নামায পড়ে আসিফ সাহেব বললেন, আমার স্ত্রীর করব জিয়ারত করে আসি চল।
বাড়ির পশ্চিম দিকে একটা পাকা কবর ও তার অনতি দূরে একটা পাকা কম। কবর জিয়ারত করার পর আসিফ সাহেব সেই রুমের কাছে এসে দরজা। নক করলেন।
দরজা খুলে একজন মৌলবী ধরনের লোক বেরিয়ে সালাম দিলেন।
আসিফ সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, কেমন আছেন?
আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। আপনি কেমন আছে।
আমিও ভালো। আপনার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?
জি, না।
আপনি বাইরে থেকে একটু বেড়িয়ে আসুন, আমরা আপনার রুমে বসে একটু আলাপ করব।
মৌলবী সাহেব চলে যাওয়ার পর আসিফ সাহেব আমজাদকে নিয়ে রুমে কলেন।
রুমটা বেশ বড়। একটা ছোট খাট ও একটা কাপড় রাখার আলনা। আলনায় মৌলবী সাহেবের জামা কাপড় গুছিয়ে রাখা। একটা টেবিল ও দুটো চেয়ার। টেবিলের উপর একজিল কুরআন ও কয়েকটা হাদিসের বই রয়েছে।
দুজন দুটো চেয়ারে বসার পর আসিফ সাহেব বললেন, এই মৌলবী সাহেব প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় কুরআন তেলাওয়াত করে ও দরুদ সালাম পড়ে আমার স্ত্রীর রুহের উপর বখশে দেন। সেজন্য খাওয়া পরা ও অন্যান্য খরচ বাদে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা ওনাকে বেতন দিই।
আপনি কি মনে করেন, এটা খুব ভালো কাজ?
হ্যাঁ, তাইতো মনে করি।
এটা ঠিক নয়। কাউকে টাকা দিয়ে মৃত ব্যক্তির জন্য ঐসব করালে কোনো ফল হয় না। মৃত স্ত্রীর জন্য যা করার আপনাকে করতে হবে। আপনি আপনার স্ত্রীর জন্য যতটা কায়মনোবাক্যে দোয়া খায়ের করবেন, টাকার বদলে অন্য কেউ কি করবেন? করবেন না। আর করলেও তা আল্লাহর দরবারে যাবে না। ফলে মৃত ব্যক্তির কোনো উপকারও হব না।
আসিফ সাহেব খুব অবাক হয়ে বললেন, এ তুমি কি বলছ তা হলে মৌলবীরা এই কাজ করছে কেন?
অল্পশিক্ষিত মৌলবীরা উচ্চশিক্ষিত মৌলবীদেরকে করতে দেখে করেন। আর উচ্চশিক্ষিত মৌলবীরা অর্থের লোভ সামলাতে পারেন না বলে করেন।
অবশ্য ওনাদের মধ্যে অনেকেই ব্যাপারটা জানেন না। আর সাধারণ মানুষেরা এ ব্যাপারে একরকম কিছুই জানে না। তারা মৃত ব্যক্তিদের রুহের মাগফেরাতের জন্য মৌলবী বা হাফেজদের দ্বারা মিলাদ, কুলখানি ও শবীনা খতম করিয়ে দোয়া খায়ের করান। সেজন্য ওনাদেরকে টাকা পয়সাও দেন। আসলে কি জানেন, এসব করার ইসলামে কোনো দলিল নেই। বরং দলিল আছে, মৃত ব্যক্তিদের জন্য যা কিছু করার তার আত্মীয় স্বজনরা প্রত্যেকে একা একা যা কিছু করার করবে। লেকাজনকে জানিয়ে করার কোনো দরকার নেই। এক কাজ করতে পারেন, আপনার স্ত্রীর রুহের মাগফেরাতের উদ্দেশ্যে ওনার কবরের পাশে একটা মসজিদ করুন। বাইরের লোকজনও যেন মসিজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে আসতে পরে, সে ব্যবস্থাও করবেন। আর এই মৌলবী সাহেবকে ইমাম নিযুক্ত করুন। সকালে ও দুপুরে ছোট ছেলেমেয়েদের ও এশার নামাযের পর বড়দের কুরআন পড়া শেখার ও বিভিন্ন মসলা-মাসায়েল শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করুন। তা হলে আল্লাহ্ খুশী হয়ে শুধু আপনার স্ত্রী নয়, মৃত্যুর পর আপনিও কবরে তার সওয়াব পাবেন। তারপর বলল, এসব ব্যাপারে আলাপ করতে হলে অনেক সময় লাগবে। আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলেন বলুন।
আসিফ সাহেব কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে বললেন, এটা ছুঁয়ে তোমাকে ওয়াদা করতে হবে, আমি যা বলব, তা তুমি মেনে নিলে কোনো কথা নেই। যদি না মেনে নিতে পার, তা হলে জীবনে কারো কাছে প্রকাশ করবে না।
আমজাদ খুব অবাক হলেও কুরআন শরীফের উপর হাত রেখে বলল, ওয়াদা করছি, এখন আপনি যা কিছু বলবেন, জীবনে কারো কাছে প্রকাশ করব না।
কথাটা শুনে আমার প্রতি কোনো খারাপ ধারণা অথবা অপমান করবে না বল?
করব না।
আসিফ সাহেব কুরআন শরীফ যথাস্থানে রেখে বললেন, তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। সত্যি বলতে কি, তুমি আমার ছেলের বয়সী। দুনিয়াতে দুটো মেয়ে ছাড়া আমার কেউ নেই। আল্লাহ আমাকে একটা ছেলে দিলেও আমার পাপের ফলে হয়তো তাকে তিনি দুনিয়া থেকে তুলে নিলেন। ছেলের শোকে স্ত্রীও মারা গেল। নিজেকে ভীষণ একা মনে হয়। সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকলেও রাতে ঠিক থাকতে পারি না। তাইতো সবকিছু ভুলে থাকার জন্য মদ খাই। তোমার মতো ছেলে দেখলেই মনটা হু-হুঁ করে উঠে। সে বেঁচে থাকলে আজ তোমার মতো হত। তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, অনেক দেরি করে ফেললাম, নিশ্চয় তোমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। আগে খেয়ে নিই চল, তারপর আলাপ করব।
খেতে বসে আমজাদ অবাক। এ যেন রাজা বাদশাহদের খাবারের আঞ্জাম। জীবনে এরকম খাবার খাওয়া তো দূরের কথা কখনো দেখেও নি ও শোনেও নি।
খাওয়ার পর আসিফ সাহেব আমজাদকে কোকো দিয়ে নিজের গ্লাসে মদ ঢেলে বললেন, এটা ছাড়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি; কিন্তু সফল হতে পারি নি।
আমাকে যখন ছেলে হিসাবে গ্রহণ করেছেন তখন যে জিনিস খেলে নিজের মায়ের সঙ্গে যেনা করার সমান গুনাহ হয়, সে জিনিস কিছুতেই খেতে দিতে পারি না। এই কথা বলে আমজাদ মদের গ্লাস ও বোতলটা নিয়ে জানালা ফাঁক গলিয়ে ফেলে দিয়ে এসে কাজের লোকটাকে বলল, যান, ফ্রিজের সব বোতলগুলো ফেলে দিন।
কাজের লোকটার নাম তালেব আলি। বয়স পঞ্চাশ পঞ্চান্ন। এই বাড়ি তৈরী হওয়ার পর থেকে আছে। আমজাদের কাণ্ড দেখে ভয় পেয়ে একবার তার দিকে ও একবার সাহেবের দিকে তাকাচ্ছিল। এখন তার কথা শুনে সাহেবের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
আমজাদ দৃঢ়কণ্ঠে বলল, কী হল? দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? তবুও যখন তালেব আলিকে একইভারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল তখন নিজে উঠে গিয়ে ফ্রীজ থেকে মদের সব বোতালগুলো নিয়ে জানালা গলিয়ে এক এক করে ফেলে দিল। নিচে পাকা থাকায় বোতলগুলো চুরমার হয়ে গেল।
ফিরে এসে সোফায় বসে আমজাদ বলল, আমার স্পর্ধার জন্য যা শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নেব। তবু বলব, আর কখনো এই জিনিস খাবেন না। যখনই মদ খাওয়ার ইচ্ছা জাগবে তখনই এর পাপের কথা চিন্তা করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবেন।
আসিফ সাহেব প্রথম দিকে খুব রেগে গেলেও পরে তার কাজে ও কথায় ধীরে ধীরে রাগ পড়ে গিয়ে চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
তাই দেখে আমজাদ বলল, যে কথা বলার জন্য আমাকে কুরআন ছুঁইয়ে শপথ করালেন, সে কথা বলবেন না?
আসিফ সাহেব চোখ মুছে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আমি তোমার সবকিছুর খবর নেয়ার পর মনে হয়েছিল, তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন। সেজন্য এতদিন তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। শোন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমার অনেকগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আর তেজগাঁয়ে রয়েছে একটা কনস্ট্রকসান ফার্ম। এটা লস দিচ্ছে। তুমি এই লস দেয়ার কারণ বের করে প্রফিটের ব্যবস্থা করবে। সেজন্য এই বাড়িতে থাকা, খাওয়া, গাড়ি, ফোন, মোবাইল আর দশ হাজার টাকা বেতন পাবে। প্রফিট দেখাতে পারলে বেতন ডবল করে দেব।
আমজাদের মনে হল, আল্লাহ যেন হঠাৎ করে তাকে গুপ্তধন পাইয়ে দিলেন। আনন্দে ও আবেগে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। সামলে নিয়ে মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, কারো প্রশংসা তার সামনে করতে নেই, তবুও না করে পারছি না; আপনি মহৎ। সত্যিই আপনি বাবার মতো আমাকে অনুগ্রহ করলেন। আমি চিরকাল আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।
এবার একটা অনুরোধ করব, বল রাখবে?
অনুরোধের কথা বলছেন কেন? আদেশ করুন। আপনিইতো বললেন, আমি আপনার ছেলের মতো। ছেলেকে কেউ অনুরোধ করে?
তোমার সঙ্গে আমার বড় মেয়ের বিয়ে দিতে চাই।
আমজাদ চমকে উঠে বলল, এ আপনি কি বলছেন?
যা বলেছি, তাতো শুনলে। এবার বল রাজি আছ কি না?
আমজাদের তখন ওনার ছোট মেয়ে আনানের কথা মনে পড়ল, সেদিন তার বড় বোনকে দেখলেও তার প্রতি এতটুকু আকর্ষণ অনুভব করে নি। বরং মনে হয়েছে, খুব উগ্র ও রাগী মেয়ে। কিন্তু ছোট আনানকে তার খুব পছন্দ হয়েছিল। তারপর যশোহরে তার সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পেরেছিল, তার মনের মতো মন আনানের। যদিও ভেবেছে, আনানকে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব, তবুও তার কথা ভুলতে পারে নি।
তাকে এতক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে আসিফ সাহেব বললেন, কি ভাবছ? কিছু বলছ না কেন?
আমার সম্পর্কে কতটুকু জেনেছেন জানি না, আমার ধারণা আপনার মেয়েকে বিয়ে করার এতটুকু যোগ্যতা আমার নেই।
যোগ্যতা বিচার করেই কথাটা বলেছি।
আমজাদ উঠে এসে ওনার দু’পা জড়িয়ে ধরে বলল, এটা ছাড়া আপনি যা করতে বলবেন তাই করব। দয়া করে শুধু এই কথাটা ফিরিয়ে নিন।
আসিফ সাহেব তার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে গম্ভীরস্বরে বললেন, যাও বস। তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি যদি কোনো মেয়েকে ভালবেসে থাক, তা হলে আমার কিছু বলার নেই। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন ছেলে হিসাবেই তোমাকে দেখব।
আমজাদ মেঝের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল।
যদি সত্যিই কোনো মেয়েকে পছন্দ করে থাক, তা হলে বল। আমি তার সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করব।
সে রকম আমার কেউ নেই। তবে … বলে থেমে গেল।
থেমে গেলে কেন? কথাটা শেষ কর।
কিছুদিন আগে একটা মেয়েকে দেখে ও তার সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করে পছন্দ হয়েছে। আমাকে মেয়েটির পছন্দ হয়েছে কিনা জানি না।
বেশ তো, তার পরিচয় বলো, আমি তার গার্জেনের সঙ্গে কথা বলব।
আপনি আলাপ করলে যে কোনো মেয়ের গার্জেন এক কথায় রাজি হয়ে যাবেন। আমি ওভাবে বিয়ে করতে চাই না। যে মেয়ের মন আমার মনের মতো হবে, সেই মেয়েকে বিয়ে করব।
সে রকম মেয়ে না পেলে কি করবে?
বিয়েই করব না।
তুমি আমার বড় মেয়ে রুমালীকে একবার দেখ, তার সঙ্গে আলাপও কর। আমার মনে হয়, তোমার আশা পূরণ হবে।
না, হবে না।
কি করে বুঝলে?
অনেক মেয়েকে আমার পছন্দ হয়েছে; কিন্তু যখনই আমার মনের মতো তাদের মন হবে কিনা বাজিয়ে দেখি তখনই ছাঁটাই করে দিতে হয়েছে। আমার মন বলছে, আপনার মেয়ের বেলায়ও তাই হবে।
অন্ততঃ একবার রুমালীর সঙ্গে আলাপ করে দেখ।
ঠিক আছে, দেখব।
ওর সম্পর্কে কয়েকটা কথা তোমার জানা দরকার। ওর বেশ কয়েকজন। বয়ফেন্ড আছে। তাদের মধ্যে আজম ও অমি নামে দু’টো ছেলের সঙ্গে একটু বেশি মেলামেশা করে। ওরা একসঙ্গে ভার্সিটিতে পড়ে। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ছেলে দুটো ভালো ও ওদের বাবারা ধনী। কিন্তু তোমার মতো ওরা আমার মনে স্থান করতে পারে নি। ওদের কাউকে রুমালী পছন্দ করে কিনা তাও জানি নি।
আমজাদ বলল, এবার আমার কথা শুনুন, এ বাড়ি আপনার স্ত্রীর স্মৃতি বহন করছে। এখানে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না। কয়েকদিন আগে মাকে গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি। তিনিও কিছুতেই এই বাড়িতে থাকতে রাজি হবেন না।
তুমি আমার মনে ছেলের স্থান দখল করেছ, তাই এই বাড়িতে থাকতে বলেছি। ঠিক আছে, তোমাদের থাকার ব্যবস্থা কয়েকদিনের মধ্যে করে দেব। তোমাকে এখন বাসায় নিয়ে যেতে চাই, আপত্তি আছে?
না, নেই। তবে দুপুরে বাসায় যাই নি, সে জন্যে মা হয়তো না খেয়ে আছেন।
সেকথা দুপুরেই বলা উচিত ছিল তোমার। যাই হোক, যা হওয়ার হয়েছে। কাল সকাল নটায় অফিসে আসবে।
জি, আসব। এবার আমি একটা কথা বলব, কিন্তু কথাটা ছোট মুখে বড় হয়ে যাবে। তাই আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পার।
স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আপনার বিয়ে করা উচিত ছিল। তা হলে এত একাকীত্ব অনুভব করে কষ্ট পেতেন না। এত অশান্তিও ভোগ করতেন না। যে মদকে আল্লাহ্ হারাম করেছেন, সবকিছু ভুলে থাকার জন্য সেই মদও খেতেম না। চরিত্র ঠিক রাখার জন্য ইসলাম একাধিক বিয়ে করা বৈধ করেছে। এখনও সময় আছে, আপনি বিয়ে করুন, নচেৎ বাকি জীবনে অনেক অশান্তি লোগ করবেন। অসুখ-বিসুখে অথবা বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রী যে সেবা যত্ন করবে, মেয়ে-জামাই বা চাকর-চাকরানীর সেরকম সেবা-যত্ন পাবেন না। আপনি যে স্ত্রীকে ভীষণ ভালবাসতেন এবং এখনও ভালবাসেন, তা বুঝতে পেরেছি। সেই কারণে যে আর বিয়ে করেন নি, তাও বুঝতে পেরেছি। তবু কেন বললাম জানেন? ছেলে হিসাবে। আমার কর্তব্য, বাবাকে ইহকালে ও পরকালের অশান্তি থেকে রক্ষা করার পথ দেখান। আপনি হয়তো ভাবছেন, জীবনের মধ্যাহ্ন পার করে অপরাহ্নে বিয়ে। করলে সমাজ কি বলবে? মেয়েরা বড় হয়েছে, তারাই বা কি মনে করবে? হয়তো তারা বাবাকে আগের মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করবে না। এমন কি আপনার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে পারে। এ ব্যাপারেও পথ আছে। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে যা দেয়ার দিয়ে দেবেন। আর সমাজের কথা চিন্তা করবেন না। কারণ সমাজ যেমন আপনাকে ইহকালে শান্তি দিতে পারবে না, তেমনি পরকালেও পারবে না। শান্তি দিতে পারে একমাত্র ইসলাম। ইসলাম শব্দের অভিধানিক অর্থ হল শান্তি ও আত্মসমর্পণ। পৃথিবীর মানুষ যদি ইসলামের কাছে আত্মসমর্পণ করত, তা হলে কেউ-ই এতটুকু অশান্তি ভোগ করত না।
আসিফ সাহেব স্ত্রীকে ভীষণ ভালবাসতেন। তাই স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আবার বিয়ে করার কথা কোনোদিন চিন্তা করেন নি। কিন্তু ভালবাসা যতই গভীর হোক মানুষের জৈবিক ক্ষুধা থাকবেই। তাই জৈবিক ক্ষুধার কারণে তিনি মাঝে মাঝে আবার বিয়ে করার চিন্তা মনে উদয় হলেও মেয়ে দুটোর ভালো মন্দ চিন্তা করে বিয়ে না করে মদ খেতে শুরু করেন।
এখন আমজাদের কথা শুনে ভাবলেন, সে খুব ভলো কথা বলেছে। অনেক আগেই তার বিয়ে করা উচিত ছিল। কিন্তু এখন কি বিয়ে করা সম্ভব?
আমজাদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বলল, আল্লাহ্ প্রত্যেক প্রাণীর মধ্যে পুরুষ ও স্ত্রী জাতি সৃষ্টি করেছেন। কেন করেছেন জানেন? বংশ বৃদ্ধি করার জন্য। আর সেই জন্য উভয়ের মধ্যে জৈবিক ক্ষুধা দান করেছেন। তাই পুরুষ বা নারী একা একা কেউ যেমন বংশবৃদ্ধি করতে পারে না তেমনি মানসিক শান্তি পায় না। যে নারী স্বামী মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চায় না অথবা এটা লজ্জাহীনতা মনে করে এবং যে পরুষের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ঐ একই কারণে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চায় না, তারা বিরাট ভুল করে। সেই ভুলের মাশুল দিতে হয় সারাজীবন। একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, “পুরুষ না হলে যেমন নারীদের চলে না তেমনি নারী না হলে পুরুষদেরও চলে না। তাই মহান রাব্বল আল আমিন তাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। কুরআন পাকে তিনি বলিয়াছেন, “মেয়েরা হচ্ছে পুরুষের পোশাক আর তোমরা পুরুষরা হচ্ছ মেয়েদের পোশাক।” [সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৭, পারা-২]
আমি বোধ হয় আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম।
আসিফ সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, অনেক সময় নষ্ট হয়েছে ঠিক, তবে বৃথা নষ্ট হয় নি। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আবার বিয়ে না করে বিরাট ভুল করেছি। যাই হোক, এ ব্যাপারে পরে চিন্তা-ভাবনা করব। এখন আসরের নামায পড়ে আমরা ফিরব।
আমজাদ সকাল সাতটায় টিউসনী পড়াতে যায়। সে কথা জেনে সালমা বেগম ফজরের নামায পড়ে নাস্তা তৈরী করেন। আজ নাস্তা খাওয়ার সময় আমজাদ মাকে বলেছিল, টিউসনী পড়িয়ে আসিফ সাহেবের অফিসে যাবে।
দুপুরে ছেলে ফিরল না দেখে তিনিও খেলেন না। আসর টপকে মাগরিবের সময়ও যখন ফিরল না তখন তার অমঙ্গল চিন্তা করে আতঙ্কিত হলেন। মাগরিবের নামায পড়ে ছেলের মঙ্গল কামনা করে আল্লাহ্র কাছে দোয়া চাইলেন।
আমজাদ ফেরার পথে কাওরান বাজারে নেমে গণি ভাইয়ের অফিসে গিয়ে তাকে চাকরি পাওয়ার ও প্রেসে চাকরি ছেড়ে দেয়ার কথা বলে যখন বাসায় ফিরল তখন রাত আটটা। বাসায় ঢুকে মায়ের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, আমাকে মাফ করে দাও মা, নিশ্চয় আমার কারণে দুপুরে খাও নি?
ফিরতে এত দেরি করলি কেন?
আমজাদ দেরি হওয়ার কারণ জানিয়ে বলল, তুমি সারাদিন না খেয়ে রয়েছ, খেয়ে নাও। আমি এশার নামায পড়ে খাব।
তুই দুপুরে খেয়েছিলি?
হ্যাঁ, সাহেবের সঙ্গে খেয়েছি। জান মা, সাহেবের স্ত্রী অনেক বছর আগে মারা গেছেন। তিনি শহর পছন্দ করতেন না বলে সাহেব এয়ারপোর্টের কাছে ওনার জন্য একটা বাড়ি করে দিয়েছিলেন। তিনি সেখানে থাকতেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর সাহেব টাউনের বাড়িতে থাকেন। সাহেব আমাকে ওনার স্ত্রীর বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন। আমি রাজি না হতে বললেন, কয়েকদিনের মধ্যে টাউনেই থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন। আমাকে ভাড়া দিতে হবে না। আরো বললেন, গাড়ি, ফোন ও মোবাইল দেবেন। রুমালীকে বিয়ে করার কথা সাহেব যে বলেছিলেন, সেকথা ইচ্ছা করে বলল না।
ছেলের কথা শুনে খুশীতে সালামা খাতুনের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করে বললেন, তুই বেরিয়ে যাওয়ার পর তোর চাকরি হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়ে দু’জুম্মা রোযা রাখার মানত করেছিলাম। তিনি তার এই নাদান বান্দির দোয়া কবুল করেছেন। সেজন্য দু’রাকায়াত শোকরানার নামায পড়ব।
তুমি যা কিছু করেছ, বাসা থেকে বেরিয়ে আমিও সে সব মানত করেছি। এশার নামায পড়ার সময় আমিও দু’রাকায়াত শোকরানার নামায পড়ব।
পরের দিন সকাল সাতটায় আমজাদ বিথীকে পড়াতে এল। বিথী জিজ্ঞেস করল, প্রতিদিন সাড়ে সাতটায় আসেন, আজ আধ ঘন্টা আগে এলেন যে?
তোমার মা বাবাকে ডেকে নিয়ে এস, তাদের সামনে বলব।
একটু পরে রজত ও স্বাতি এসে সোফায় বসল। বসার পর রজত বলল, কী ব্যাপার? আজ সময়ের আগে এসেই আমাদের তলব করেছেন?
যা বলব তা শুনে আপনারা দুঃখ পাবেন, না খুশী হবেন জানি না। তবে দুঃখ পেলে ক্ষমাপ্রার্থী।
স্বাতি বললেন, মনে হচ্ছে ভালো চাকরি পেয়ে জানাতে এসেছেন।
আপনার অনুমান ঠিক। আমি একটা কনস্ট্রাকসান ফার্মে চাকরি পেয়েছি। আজ জয়েনিং ডেট।
রজত বললেন, এটা তো শুভ সংবাদ, দুঃখ পাওয়ার কথা বলেলেন কেন?
স্বাতি স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, উনি তো আর বিথীকে পড়াতে পারবেন না। তাই আমরা দুঃখ পেতে পারি ভেবে বলছেন।
রজত বললেন, উনি চাকরি পেয়েছেন ভালো কথা, তাই বলে বিথীকে পড়াতে অসুবিধে কোথায়? সকালে অসুবিধে থাকলে সন্ধ্যের পর পড়াবেন। আজকাল প্রায়ই চাকরিজীবিরা বাড়তি আয় করার জন্য কিছু না কিছু করে। উনিও করবেন।
স্বাতি আমজাদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, রজত ঠিক বলেছে। আপনার সময়মতো পড়াতে আসবেন।
মা থেমে যেতে বিথী বলল, স্যার, পড়াতে আপনাকে আসতেই হবে। না এলে আমি লেখাপড়াই করব না।
আমজাদ বলল, কথাটা তুমি ঠিক বল নি। আমি যদি ঢাকার বাইরে চাকিরি পেতাম, তা হলে কি করতে? ঠিক আছে, সব দিন না আসতে পারলেও সপ্তাহে। তিন দিন আসব।
রজত বললেন, আপনার সঙ্গে কিছু আলাপ ছিল।
আজ জয়েনিং ডেট। তাই সময় দিতে পারছি না। পরে একদিন করবেন। এবার আসি বলে আমজাদ উঠে দাঁড়াল।
বিথী বলল, স্যার, কাল থেকে সন্ধ্যের পর আসবেন তো?
ইনশাআল্লাহ্ আসব বলে আমজাদ বিদায় নিয়ে চলে এল।
.
৫.
আসিফ সাহেবের কনস্ট্রাকসান ফার্ম তেজগাঁয়ে। আমজাদ ছয় মাস হল এখানে ডাইরেক্টর পদে জয়েন করেছে। জয়েন করার কয়েকদিনের মধ্যে বাড়ি, গাড়ি, ফোন ও মোবাইল পেয়েছে। ফার্মের লস হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে তিনজন স্টাফকে ছাটাই করে নতুন লোক নিয়োগ দিয়েছে এবং ম্যানেজারের উপর সবকিছুর দায়িত্ব দিলেও নিজেও লক্ষ্য রেখেছে। ফলে এই ছয় মাসের মধ্যে লস কভার করে প্রফিটের মুখ দেখিয়েছে। তাই আসিফ সাহেব তার বেতন ডবল করে দিয়েছেন। তিনি কয়েকবার তাকে বাসায় যাওয়ার কথা বলেছেন। আমজাদ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে যাই নি। কিন্তু রুমালী ও আনানকে নিয়ে অনেক চিন্তা করে। একদিকে সাহেবের ইচ্ছা, অপরদিকে তার ইচ্ছা … আনান যদি তাকে পছন্দ করে এবং তার মনের মতো আনানের মন হয়, তা হলে রুমালীকে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবে না। বড়কে পছন্দ হয় নি–ছোটকে হয়েছে, কথাটা সাহেবকে বলা কি ঠিক হবে? এসব চিন্তা করে করে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে এতদিন যাই নি। তবু রুমালীর সঙ্গে আলাপ করা উচিত ভেবে আজ সাহেবকে ফোন করে জানাল, পাঁচটার সময় বাসায় আসবে।
আসিফ সাহেব আনন্দিতস্বরে বললেন, ওয়েলকাম মাই সান। আমি বাসায়। থাকব।
আপনি রুমালীর সঙ্গে আমার ব্যাপারে কোনো আলাপ করেছেন?
না। ভাবছি, আজ তুমি আসার আগে করব।
না, তা করবেন না। আমি আলাপ করার পর করবেন।
বেশ, তাই করব!
আপনি সাড়ে পাঁচটা বা ছ’টার আগে বাসায় ফিরবেন না।
কেন বলতো?
আপনি বাসায় ফেরার আগে আমি রুমালীর সঙ্গে আলাপ করতে চাই।
আসিফ সাহেব হেসে উঠে বললেন, ওকে মাই সান। তারপর লাইন কেটে দিয়ে রুমালীকে মোবাইলে ফোন করলেন।
বাসায় ডিজিটাল ফোন আছে তিনটে। দুবোনের রুমে দু’টো আর আসিফ সাহেবের রুমে একটা। তিনজনের তিনটে মোবাইলও আছে।
রুমালী ফোন ধরতে আসিফ সাহেব বললেন, একটা ইয়াং গেস্ট পাঁচটার সময় বাসায় আসবে। তারা দু’বোন ভালোভাবে ট্রিটমেন্ট করবে।
উনি কে বাবা?
দেখলেই চিনতে পারবি।
ওনার পরিচয় বলছ না কেন?
জিদ করিস না মা, বললাম না, দেখলেই চিনতে পারবি?
তুমি কখন আসবে?
ছ’টার দিকে।
কেন? পাঁচটা সময়েই তো তোমার আসা উচিত।
আজ একটা জরুরী মিটিং আছে। শেষ হতে ছটা বেজে যেতে পারে। আমি তার আগে আসার চেষ্টা করব। তারপর রুমালী কিছু বলার আগে লাইন কেটে দিলেন।
রুমালী বাবার ফোন করার কথা আনানকে বলে জিজ্ঞেস করল, কে হতে পারে বলতে পারিস?
আনান বাবার কাছ থেকে অনেক আগে জেনেছে, আমজাদকে বাবা তেজগাঁ কনস্ট্রাকসান ফার্মের ডাইরেক্টার করেছে। জানার পর থেকে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য মন খুব অস্থির হয়ে উঠলেও লজ্জায় করে নি। এখন রুমালীর কথা। শুনে ভাবল, সে নয় তো আবার ভাবল, সে হলে বাবা আমাদেরকে তার ভালোভাবে ট্রিটমেন্ট করতে বলল কেন?
কি রে, কী ভাবছিস? কে হতে পারে বল না?
আমি কি করে বলব? কে হেতে পারে চিন্তা করছিলাম।
যেকোনো গেষ্টকে বাবা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। আজ ব্যতিক্রম হল। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না।
মাথায় ঢোকাবার দরকার নেই, এলেই তো জানা যাবে।
আমজাদ ঠিক পাঁচটার সময় সাহেবের বাসার গেটে এসে গাড়ি থামাতে যাবে এমন সময় গেট আপনা থেকে খুলে গেল। অবাক হলেও গাড়ি ভিতরে নিয়ে একেবারে গাড়ি বারান্দায় এসে থামাল।
নামার আগেই একজন লোক এসে গেট খুলে দিয়ে বলল, আমার সঙ্গে আসুন।
আমজাদ গাড়ি থেকে নেমে বেশ অবাক হয়ে বলল, আমার পরিচয় না জেনেই ভিতরে যেতে চাচ্ছেন?
আপনার পরিচয় না জানলেও সাহেবের নির্দেশ পালন করছি। লোকটা তাকে একটা বেশ বড় ড্রাইংরুমে বসেত বলে চলে গেল। ড্রইংরুমের পরিবেশ দেখে আমজাদের মনে হল, সাহেবের স্ত্রীর বাড়ির ড্রাইংরুম এটার চেয়ে অনেক উন্নত।
দু’বোন পাঁচটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে সেজেগুজে দোতালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেষ্টের অপেক্ষায় ছিল। আমজাদ গাড়িতে এসেছে বলে তারা চিনতে পারল না।
রুমালী ঘড়ি দেখে বলল, উনি এসে গেছেন, চল যাই।
আমজাদ দেয়ালে টাঙানো দুটো বাঘের লড়াইয়ের অয়েল পেন্টিং-এর দিকে তাকিয়েছিল। ওদের আগমন টের পেল না।
ওরা দরজার পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমজাদ পিছন ফিরে অয়েল পেন্টিং-এর দিকে তাকিয়ে ছিল। তাই চিনতে পারল না। রুমালী দরজায় আঙ্গুলের উল্টো পিঠ দিয়ে টকটক শব্দ করে এগিয়ে এল।
আমজাদ ঘুরে তাদেরকে দেখে সালাম দিল।
আনান চিনতে পেরে খুব আনন্দিত হয়ে সালামের উত্তর দিয়ে চুপ করে রইল। তখন তার মনে আনন্দের লহরী বইতে শুরু করেছে।
রুমালী চিনতে পেরে খুব রেগে গেলেও সংযত কণ্ঠে বলল, আপনি এখানে এসেছেন কেন? বাবার কাছে এসে থাকলে সন্ধ্যের পর অথবা কাল সকালে আসুন। এখন উনি বাসায় নেই।
রুমালীর কথা শেষ হতে আমজাদ সোফায় বসে তাদেরকে বসতে বলে বলল, আমি ওনার কাছে আসি নি, এসেছি আপনাদের কাছে।
রুমালী রাগ সহ্য করতে পারল না। বেশ উঁচু গলায় বলল, হোয়াট?
আনান তার কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চস্বরে বলল, তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? যা বলার ভালোমুখে বল।
রুমালী ঝাড়ি মেলে বলল, তুই চুপ কর। তারপর আমজাদের দিকে তাকিয়ে একটু স্বর নামিয়ে বলল, বসে আছেন কেন? এ সময়ে একজন গেস্ট আসার কথা আছে। আপনি চলে যান।
আমজাদ মৃদু হেসে বলল, যদি বলি আমিই সেই গেস্ট?
ইম্পসিবল, ইউ গেট আউট এ্যাট দ্য মোমেন্ট।
মুখে হাসি ধরে রেখে আমজাদ বলল, যদি না যাই?
দারোয়ান ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।
আনান রুমালীর একটা হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলল, এই আপা, কি যা-তা বলছিস? যশোহর যাওয়ার পথে উনি আমাদের কতবড় উপকার করেছিলেন মনে নেই।
কথাটা আনান আস্তে বললেও আমজাদ শুনতে পেয়েছে। বলল, সেদিন শুধু আপনাদের জন্য কাজটা করি নি, সব গাড়ির যাত্রীদের জন্য করেছিলাম। তারপর রুমালীকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি স্বনামধন্য কোটিপতি আসিফ সাহেবের কন্যা, ভার্সিটিতেও পড়ছেন, মানুষের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয় জানেন না। জেনে খুব দুঃখ হচ্ছে। যাক গে, আমি কিছু মনে করি নি। আপনাদের বাবা পাঁচটার সময় আসতে বলেছিলেন। আরো বলেছিলেন, আসতে একটু দেরি হলে আমার মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করে সময় কাটাবেন।
কথাটা শুনে রুমালী বাবার উপর খুব রেগে গেল। ভাবল, এরকম একটা যাচ্ছেতাই ছেলেকে আসতে ও তাকে ভালোভাবে ট্রিটমেন্ট করতে বলল কি করে
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আনান বলল, এই আপা, ওনার ট্রিটমেন্ট করবি না?
এরকম একটা ফালতু ছেলের ট্রিটমেন্ট করতে আমার বয়ে গেছে। তোর ইচ্ছা হলে কর, আমি চললাম বলে রুমালী সেখান থেকে চলে গেল।
আনান এগিয়ে এসে আমজাদের পাশের সোফায় বসে বলল, আপা একটু ঐ রকমই, কিছু মনে করবেন না। আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি। কেমন আছেন। বলুন।
আল্লাহ্ ভালো রেখেছেন বলে আসতে পেরেছি।
আপনি কেমন আছেন? ভালো।
অফিসের কাজ কর্ম কেমন লাগছে?
ভালো। অফিসের খবরও রাখেন দেখছি?
কেন রেখেছি বলতে পারেন?
পারি।
বলুনতো দেখি?
ফালতু ছেলেতো, হয়তো ফালতু কথা বলে ফেলব। তাই সাহস পাচ্ছি না।
আমিতো আপনাকে ফালতু ছেলে বলি নি, বলেছে আপা। আসলে কথাটা আপনি বলতে পারবেন না। তাই এইসব বলছেন।
কথাটা শুনে আপনার আপার মতো আপনিও রেগে যাবেন।
কথা দিচ্ছি রাগব না, এবার বলুন।
আপনি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। তাই আমার খবর রাখেন।
কথাটা শুনে আনান লজ্জারাঙা হয়ে মুখ নিচু করে চুপ করে রইল।
এমন সময় আয়া ট্রে টেবিলে বিভিন্ন আইটেমের নাস্তা ও পানীয় নিয়ে ঢুকে ছোট আপা বলে ডাকল।
আনান মুখ তুলে তাকিয়ে তাকে চলে যেতে বলল। আয়া চলে যাওয়ার পর ট্রে টেবিল ঠেলে আমজাদের সামনে নিয়ে এসে বলল, কি কি খেতে ভালো লাগে বলুন, আমি রেডি করে দিই।
এ সময়ে যা খেতে আপনার ভালো লাগে, আমারও তাই ভালো লাগে।
আনান হেসে ফেলে বলল, আমার ভালো লাগার কথা আপনি জানলেন কি করে? আমি কখন কি খাই আপনিতো কোনোদিন দেখেন নি?
দেখিনি বলেই তো আজ দেখতে চাই। আমার রুচির সঙ্গে আপনার রুচির মিল আছে কি না।
ঠিক আছে বলে আনান দু’পীস স্লাইস রুটিতে জেলী মাখিয়ে একটা প্লেটে রাখল। আর দুটো বড় সাগর কলা ছাড়িয়ে অন্য প্লেটে রেখে বলল, নিন, শুরু করুন।
আমি একা খাব না কী?
আমি নিচ্ছি, আপনি শুরু করুন তো।
রুটি কলা খাওয়ার পর তিনটে সিদ্ধ ডিম ছাড়িয়ে দুটো আমজাদকে দিল আর নিজে একটা নিল। তারপর ফ্লাক্স থেকে গরম দুধ দুটো গ্লাসে ঢালল।
দুধ খাওয়ার পর আনান বলল, পাশ করেছি কি না বলুন।
শুধু পাশ নয়, শতকরা একশ নাম্বার পেয়ে পাশ করেছেন?
যদি বলি আমার মন রাখার জন্য বললেন?
তা বলতে পারেন। তবে জেনে রাখুন, আমি মিথ্যা ও প্রবঞ্চনাকে ঘৃণা করি। কারণ, মুসলমান কখনও মিথ্যুক ও প্রবঞ্চক হতে পারে না।
শুনে খুশী হলাম। আপনার পকেটে মোবাইল দেখছি, আপনার নাম ও নাম্বারটা বলুন।
আমজাদ নাম ও নাম্বার বললে আনান নিজের মোবাইলে বুকে সেফ করে নিল।
আমজাদ মৃদু হেসে বলল, এবার আপনারটা বলুন। আনান নাম ও নাম্বার বলে জিজ্ঞেস করল, ফোন করলে বিরক্ত হবেন না
আপনার কি মনে হয়?
খুশী হবেন।
তা হলে জিজ্ঞেস করলেন কেন?
টেস্ট করলাম।
ফলাফল তিতা না মিষ্টি
আনান হেসে ফেলে বলল, মিষ্টি।
এবার আমি যদি একই প্রশ্ন করি?
করুন, ফলাফল একই হবে।
তা হলে ফাইন্যাল ফলাফল, আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি তাই না?
আনান লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ, তাই।
এমন সময় গাড়ির শব্দ পেয়ে আনান বলল, বাবা এসে গেছেন।
আসিফ সাহেব রুমে ঢুকে আনানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কিরে মা, তুই একা কেন? রুমালী কোথায়?
আপাও ছিল, কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে।
যা, তাকে ডেকে নিয়ে আয়।
আমজাদ বলল, তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে, ডাকবার আর দরকার নেই। অনেকক্ষণ এসেছি, এবার আসি।
আরো কিছুক্ষণ থাক না, আলাপ করা যাক।
মাফ করবেন, মায়ের শরীর ভালো না। অফিসে বেরোবার সময় বিকেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব বলে এসেছি।
তোমার মায়ের কি হয়েছে।
তেমন গুরুতর কিছু না, কয়েকদিন থেকে সারা শরীর ব্যথা করছে। সেকথা ডাক্তারকে বলে ওষুধ এনেছিলাম, কাজ হয় নি।
তা হলে আর দেরি করব না, যাও।
আমজাদ সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
আসিফ সাহেব আনানকে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটার সঙ্গে আলাপ করেছিস?
করেছি।
কেমন বুঝলি?
সাধারণ ঘরের অসাধারণ ছেলে।
আসিফ সাহেব উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, তুই ঠিক বলেছিস। কেন ওকে আসতে বলেছিলাম জানিস?
তুমি আসতে না আসতেই উনি চলে গেলেন। তাই কথাটা আমিই জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম।
ওকে আমি রুমালীর জন্য চয়েস করেছি। তাই তোদর সঙ্গে আলাপ করার জন্য আসতে বলেছিলাম। ওকে রুমালীর নিশ্চয় ভালো লেগেছে।
বাবার কথা শুনে আনানের মুখ শুকিয়ে গেল। কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল।
জানিস মা, এ যুগে ওর মতো ছেলে পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। আল্লাহ রাজি থাকলে খুব শিঘ্রী ওদের বিয়ে দেব। রুমালীর ভাগ্য খুব ভালো, তাই না? অবশ্য তোর জন্যেও ঐ রকম একটা ছেলে পছন্দ করে রেখেছি। তারপর চঞ্চল ও বাকপটু মেয়েকে চুপ করে থাকতে দেখে বললেন, কিরে মা, হঠাৎ তোর মন খারাপ হয়ে গেল কেন? আমজাদ সাধারণ ঘরের ছেলে বলে?
আনানের মনে তখন চিন্তার ঝড় বইছে। সামলে নিয়ে ঢোক গিলে কোনোরকমে বলল, এক্ষুনি বললাম না, উনি সাধারণ ঘরের অসাধারণ ছেলে? আমার মাথাটা খুব ধরেছে, তারপর যাই বলে নিজের রুমে চলে গেল।
হঠাৎ ছোট মেয়ের পরিবর্তন দেখে আসিফ সাহেবের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। ভাবলেন, তা হলে আমাজাদকে কি ওর পছন্দ? চিন্তিত মুখে দোতালায় রুমালীর রুমের দরজার কাছে এসে নাম ধরে ডাকলেন।
গাড়ির শব্দ পেয়ে রুমালী বুঝেছে বাবা এসেছে। তার উপর আগেই রেগেছিল, আসার পর আরো রেগেছে। বাবার গলা পেয়ে সংযত কণ্ঠে বলল, ভেতরে এস বাবা।
আসিফ সাহেব ডুকে বললেন, গেস্টের কাছে আনানকে দেখলাম, তুই চলে এলি কেন?
তুমি তো জান, আমি যার তার সঙ্গে আলাপ করি না। তবু তুমি একটা সাধারণ ছেলেকে গেস্ট হিসাবে পাঠাবে ভাবতেই পারি নি।
ও সাধারণ ঘরের ছেলে হলেও অসাধারণ। তাই ওকে তোর জন্য সিলেক্ট করে বাড়ি, গাড়িসহ তেজগাঁও কনট্রাকসান ফার্মের দায়িত্ব দিয়েছি। মনে হচ্ছে, ওকে দেখে চিনতে পেরেই আলাপ না করে চলে এসেছিস। আলাপ করলে বুঝতে পারতিস ছেলেটা কত জিনিয়াস।
যতই জিনিয়াস হোক, ওকে পছন্দ করা তো দূরের কথা, দেখতেই ইচ্ছা করে না। তারপর কুঁপিয়ে উঠে দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল, আমি কি তোমার কাছে এতই ভারি বোঝা হয়ে গেছি, এক্ষুনি বিয়ে দিতে চাচ্ছ?
ছেলেমেয়েরা মা বাবার কাছে কখনো ভারি বোঝা হয় না। শুধু তোর না, আনানের জন্যেও ছেলে সিলেক্ট করে রেখেছি। বিলেতে ব্যারিষ্টারী পড়তে গেছে। শিঘ্রী ফিরবে। ফেরার পর আনানের বিয়ে দেব। তাই ওদের আগে তোর বিয়ে দিতে চাই। কেন তোদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে যাচ্ছি জানিস, আমার ঐশ্বর্যের দিকে বন্ধুরা হায়েনার দৃষ্টি ফেলেছে। তাদের অনেকে তোদেরকে পুত্রবধূ করার প্রস্তাব দিতে শুরু করছে। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সেসব ছেলে শিক্ষিত হলেও চরিত্রবান নয়। তোদের কোনো ভাই নেই। ভবিষ্যতে তোরাই আমার ঐশ্বর্যের মালিক হবি। তোদের স্বামীরা যদি চরিত্রবান না হয়, তা হলে এত ঐশ্বর্য অসৎ। পথে উড়িয়ে দেবে। তোরা আপত্তি করলে তাদের সঙ্গে মনোমালিন্য হবে, এমন কি তোদের উপর অত্যাচার করবে। এইসব চিন্তা করে করে চরিত্রবান ছেলের খোঁজে ছিলাম। ভাগ্যচক্রে আমজাদকে পেয়ে তার সবকিছু খোঁজ-খবর নিয়ে জেনিছি, ওর মতো চরিত্রবান ছেলে আর হয় না। তাই তাকে তোর জন্য সিলেক্ট করে তেজগাঁ অফিসের ডাইরেক্টর পদে নিয়োগ করেছি। তুই আমাকে ভুল বুঝিসনি মা। উপযুক্ত পাত্রে তোমাদের বিয়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে চাই।
কিন্তু বাবা, আমি যে এখন বিয়ের কথা ভাবতেই পারছি না। তা ছাড়া আমজাদকে আমার একদম পছন্দ নয়। তাকে স্বামী হিসাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারব না।
তুই যদি তোর বন্ধুদের মধ্যে কাউকে পছন্দ করিস, তা হলে বল, তার সঙ্গেই বিয়ে দেব।
বন্ধু অনেক আছে, কিন্তু তাদের কাউকে বিয়ে করব, সেরকম কখনো ভাবি নি।
ঠিক আছে, আমজাদকে যখন তোর পছন্দ নয় তখন আর জোর করব না। বন্ধুদের মধ্যে যাকে তোর পছন্দ হবে তার সবকিছু পরীক্ষা করে আমাকে জানাবি। আমি তার মা বাবার সঙ্গে আলাপ করব।
রুমালী আনন্দিত হয়ে বাবার দুটো হাত ধরে চুমো খেয়ে বলল, তোমার মতো বাবা পেয়ে আমি ধন্য। একটা কথা বলব, রাগ করবে না বল?
তোদের দুজনের উপর কখনো রাগ করেছি।
রুমালী হেসে ফেলে বলল, তা অবশ্য কর নি। বলছিলাম কি, আমজাদকে তোমার যখন খুব পছন্দ তখন তার সঙ্গে আনানের বিয়ে দিতে পার।
কথাটা তুই ভালো বললেও তা একেবারেই সম্ভব নয়। কারণটাতো তোকে একটু আগে বললাম।
ছেলেটা কি তোমার আত্মীয়?
না, তবে এমন এক বন্ধুর ছেলে, যে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছে। আর তার টাকাতেই আমি ব্যবসা শুরু করে আজ এতবড় ব্যবসায়ী হয়েছি। তার কথা আর জিজ্ঞেস করিস নি মা। তারপর চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে বেরিয়ে ছোট মেয়ের রুমের দিকে গেলেন।
আনান বাবার পিছন পিছন উপরে এসে নিজের রুমে গিয়েছিল। যদিও ইচ্ছা হয়েছিল, বাবা আপাকে কি বলে না বলে শোনার জন্য; তবু ইচ্ছাটা দমন করে রেখেছিল। অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও যখন আপার রুম থেকে বাবাকে বেরোতে দেখল না তখন কৌতূহল বোধ করে পা পা করে এসে ভিতরে না ডুকে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনতে লাগল। রুমালী যখন আমজাদের সঙ্গে আনানের বিয়ে দেয়ার কথা বলার পর আসিফ সাহেব বললেন, কথাটা মন্দ বলিস নি তখন আর দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন নেই মনে করে ফিরে এল। তারপর খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে আমজাদকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনছিল।
আসিফ সাহেব ঢুকে বললেন, কিরে মা, মাথার যন্ত্রণা কমেছে?
আনান উঠে বসে বলল, একটু কমেছে।
আসিফ সাহেব একটা চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করলেন, রুমালী আমজাদের সঙ্গে আলাপ করেছিল?
আপা ওনাকে দেখেই খুব রেগে উঠে চলে যেতে বলে। উনি না যেতে সেখান থেকে চলে আসে। আমি বাধা দিলে আমার উপরও রাগ দেখিয়েছে।
কেন যে রুমালী আমজাদকে পছন্দ করল না বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, ও কাউকে ভালবাসে কিনা জানিস?
সেরকম কেউ থাকলে জানতে পারতাম। আমার মনে হয় উনি গরিব ঘরের ছেলে জেনে পছন্দ করতে পারে নি।
আমারও তাই মনে হচ্ছে বলে আসিফ সাহেব নিজের রুমে চলে গেলেন।
আপা ও বাবার আলাপ শোনার পর থেকে আনানের মন আনন্দে মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাই পড়তে বসেও এতটুকু মন বসাতে পারল না। কেবলই আমজাদকে ফোন করতে ইচ্ছা করছে। ভাবল, রাত দশটার পর করবে। এখন বাসায় নাও পাওয়া যেতে পারে।
আসিফ সাহেব রাত দশটার সময় দু’মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে খান। আজ খাওয়ার সময় লক্ষ্য করলেন, আনান সামান্য খেয়ে ভাত নাড়াচাড়া করছে, বললেন, কিরে মা, খাচ্ছিস না কেন?
আর খেতে ইচ্ছা করছে না বাবা। তোমরা খাও বলে বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে রুমে চলে এল। ফোনে আমাজাদের সঙ্গে কিভাবে আলাপ করবে প্রায় আধ ঘন্টা চিন্তা করল। তারপর ফোন করল।
আমজাদ মায়ের সঙ্গে খেয়ে উঠে সবেমাত্র রুমে এসেছে। রিং হতে শুনে ভাবল, সাহেব হয়তো তার সঙ্গে রুমালীর দুর্ব্যবহারের কথা জেনে ফোন করেছেন। রিসিভার তুলে সালাম দিয়ে বলল, আমজাদ বলছি।
আনান সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমি আনান। খুশী হয়েছেন? হান্ড্রেড পার্সেন্ট খুশী হয়েছি। কি করছিলেন?
সন্ধ্যের পর থেকে আপনার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম। সবেমাত্র খেয়ে এসে মনে হল, এক্ষুনি ফোন আসবে। এখন আপনার সঙ্গে কথা বলছি। এবার আপনার কথা বলুন।
প্রথমে আপনারটা বলুন। পরে আমারটা বলব।
আপনার বাবা আমাকে চাকরি দিয়ে রুমালীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। আমি রাজি না হয়ে বললাম, আমার মনের মতো যে মেয়ের মন, তাকে ছাড়া বিয়ে করব না। উনি বললেন, রুমালী খুব ভালো মেয়ে তার সঙ্গে আলাপ করে দেখ, তার মন তোমার মনের মতো হতে পারে। তাই আজ গিয়েছিলাম।
রেজাল্ট বলুন।
রেজাল্ট আগেই জানতাম। তবু আপনার বাবার কথা রাখার জন্য গিয়েছিলাম।
কি জানতেন বলবেন তোর।
আজ বিকেলে যা ঘটল তাতে বুঝতে পারেন নি?
পেরেছি।
তবুও জিজ্ঞেস করলেন কেন?
আনান তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, একজন পুরুষের মনের মতো মন, সারা পৃথিবীতে তেমন কোনো মেয়ে কি আছে?
আছে। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম।
তা হলে তখন আমাকে ভালবাসেন বললেন কেন?
আপনি ঐ খুব কম সংখ্যার দলের।
আমার মন যে আপনার মনের মতো, জানলেন কী করে?
আল্লাহ্ জানিয়েছেন।
প্রমাণ করতে পারবেন?
ইনশাআল্লাহ্ পারব।
কই, করুন তো দেখি।
কাল দুটোর সময় ফার্মগেটে তাইপিং রেস্টুরেন্টের গেটে থাকব, আপনি আসবেন। প্রমাণ মুখে নয় বাস্তবে দেখাব।
ঠিক আছে, আসব।
একটু ভুল বললেন।
ভুল বললাম মানে?
বলবেন ইনশাআল্লাহ্ আসব।
আনান কথাটা রিপীট করে বলল, এবার হয়েছে।
শুধু হয়েছে না, আপনার মন যে আমার মনের মতো তা আপনিই প্রমাণও করে দিলেন।
সত্যি বাবা আপনাকে ঠিকই চিনেছেন।
আপনি চেনেন নি?
চিনেছি বলেই তো আপনার মধ্যে বিলীন হতে ইচ্ছা করছে।
আমজাদ হেসে উঠে বলল, আমারও কিন্তু তাই ইচ্ছা করছে। এতেই প্রমাণ হয়ে গেল, আমাদের দুজনের দেহ ভিন্ন হলেও মন এক।
আমাকে পছন্দ হওয়ার কথা আপনি কি বাবাকে বলবেন?
আমার কিছু বলা লাগবে না, আপনার বাবাই আমাকে বলবেন।
বাবা তো আপাকে বিয়ে করার কথা আপনাকে বলেছিলেন, এখন আমার কথা বলতে হয়তো দ্বিধাবোধ করবেন। তাই আপনারই বলা উচিত।
আপনি অবশ্য ঠিক কথা বলেছেন। তবে আপাতত বলা উচিত হবে না। প্রয়োজনে পরে বলব। এবার রাখুন, মা এখনো ঘুমান নি। বাথরুমে যাওয়ার সময় এত রাতে কারো সঙ্গে কথা বলছি শুনলে অনেক রকম প্রশ্ন করবেন।
ঠিক আছে, আর একটা কথা বলে রাখছি, আপনার মাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে। কাল ফার্মগেট না গিয়ে আপনার বাসায় যেতে চাই। সাড়ে চারটের সময় আপনার অফিসের সামনে থাকব।
শুনে খুশী হলাম। এতক্ষণ এই কথা শোনার অপেক্ষায় ছিলাম।
ফার্মগেটের কথা না বলে বাসায় আসার কথা বললে আমিও আপনার মতো খুশী হতাম।
কোনো ব্যাপারেই জীবনে কারো কাছে হারি নি। আজ আপনি হারিয়ে দিলেন।
বুঝলাম না।
আপনি বাসায় আসার কথা বলেন কিনা জানার জন্য ফার্মগেটের কথা বলেছি। আপনি বলে হারিয়ে দিলেন আর তৃতীয়বারের মতো প্রমাণ করে দিলেন, দু’জনের মন একই।
আর একটা কথা বলতে চাই।
আমজাদ হেসে উঠে বলল, এটাই কিন্তু শেষ।
আনানও হেসে উঠে বলল, ঠিক আছে।
বলুন তা হলে।
কাল বাসায় গেলে মা যখন আমার পরিচয় জানতে চাইবেন তখন কি বলবেন?
সে কথা ভেবে রেখেছি।
বলুন না শুনি।
যখন বলব তখন শুনবেন।
এখন বললে কী হয়?
এখন বললে আপনি লজ্জা পাবেন। কাল হয়তো বাসায় আসার প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করবেন।
আপনার কথাই ঠিক, এখনই লজ্জা পাচ্ছি। কাল বাসায় যাব কি করে ভাবছি
মাকে আপনার পরিচয় কি বলব বুঝতে পেরেছেন তা হলে?
আপনার কথাতেই বলি, “আমাদের দেহ দু’টো হলেও মন এক।”
তা হলে তুমি করে না বলে আপনি করে বলছ কেন?
এক্ষুনি আমিও কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম, তার আগেই তুমি বলে ফেললে।
গুড, ভেরি গুড। তোমাকে জানাচ্ছি অসংখ্য ধন্যবাদ। আর সেই মহান রাব্বল আল আমিনের দরবারে জানাচ্ছি হাজার হাজার শুকরিয়া যিনি আমার মনের মতো মন দিয়ে তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। এবার আমি একটা কথা বলি।
আনান হেসে উঠে বলল, এখন মা শুনতে পাবেন না?
শুনতে পেলেও কথাটা বলা খুব দরকার।
তা হলে বল।
মা খুব ধার্মিক মহিলা। আসার সময় ধর্মীয় পোশাক পরে আসবে।
তুমি না বললেও তাই করতাম।
কি করে জানলে আমার মা ধার্মিক মহিলা।
তোমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আমার মন বলছে, তুমি ধার্মিক। মা ধার্মিক না হলে ছেলে ধার্মিক হয় না। তাই যখন তোমার বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম তখনই মন বলল, ধর্মীয় পোশাক পরে যেতে।
তোমার মন বুঝল কি করে আমি ধার্মিক
মাত্র দু’বার তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সে সময় তুমি আমার শরীরের কোনো অংশের দিকে না তাকিয়ে শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেছ। তাতেই আমার মন বুঝেছে তুমি ধার্মিক।
আমজাদ মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, এবার রাখ, ইনশাআল্লাহু কাল দেখা হবে।
ঠিক আছে বলে আনান সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
.
সালমা খাতুন প্রতিদিন রাতে খাওয়ার পর দুটো পান খান। তারপর দাঁত খেলাল করে বাথরুমের কাজ সেরে অযু করে এসে কিছুক্ষণ কুরআন তেলাওয়াত ও হাদিস পড়েন। বিয়ের আগে তিনি দাদির কাছে শুনেছিলেন, রাতে ঘুমাবার সময় এইসব করে ঘুমালে সারা রাত জেগে ইবাদত করার মতো সওয়াব পাওয়া যায়। সেই থেকে এই আমল করে আসছেন।
আজ খাওয়ার পর পান খাওয়ার সময় ফোন বাজতে শুনেছেন। প্রতিদিনের মতো কুরআন হাদিস পড়ে দরজা বন্ধ করতে এসে তখনও ছেলেকে ফোনে কথা বলতে শুনে তার রুমে যখন এলেন তখন তাকে রিসিভার ক্যাডেলে রাখতে দেখলেন।
মাকে দেখে আমজাদ বলল, বস, তোমার সঙ্গে কথা আছে। তুমি না এলে আমি এক্ষুনি তোমার কাছে যেতাম।
সালমা খাতুন বসে বললেন, এতক্ষণ ধরে ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
সাহেবের ছোট মেয়ের সঙ্গে। সাহেবের ছেলেমেয়ে কয়টা?
ছেলে নেই, শুধু দুটো মেয়ে।
তাদের বিয়ে হয়ে গেছে?
না।
সাহেবের ছোট মেয়ের সঙ্গে এতক্ষণ কি কথা হল?
সেসব অনেক কথা, তোমার শোনার দরকার নেই। জান মা, চাকরি পাওয়ার সময় তোমার কাছে একটা কথা গোপন করেছিলাম, এখন বলতে চাই।
কথাটা তখন গোপন করে এখন বলতে চাচ্ছিস কেন?
তখন না বলে যে ভুল করেছি, সেই ভুলের সংশোধন করতে চাই।
বল কি কথা গোপন করেছিলি?
সাহেব ঐ দিন ওনার বড় মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
বিয়ে করার জন্য সাহেব এখন বুঝি চাপ দিচ্ছেন?
না মা, তুমি যা ভাবছ তা নয়। তোমার ছেলের মন এত ছোট নয় যে, চাকরি পাওয়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব মেনে নেব।
তা হলে সাহেবকে তখন কি বলেছিলি?
রাজি না হয়ে বলেছিলাম, “যে মেয়ের মন আমার মনের মতো হবে তাকেই বিয়ে করব। নচেৎ সারাজীবন বিয়েই করব না।”
এই কথা শোনার পরও সাহেব তোকে চাকরি দিলেন?
তিনি আমাকে ছেলে হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তাই চাকরি দিয়েছেন। শুধু বলেছিলেন, “আমার বড় মেয়ের সঙ্গে অন্ততঃ একবার আলাপ কর, তা হলে হয়তো তোমার আশা পূরণ হতে পারে।” এতদিন অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত ছিলাম। আজ একটু অবসর পেয়ে সাহেবের বাসায় গিয়েছিলাম ওনার বড় মেয়ের সঙ্গে আলাপ করার জন্য।
আলাপ হয়েছে।
বলছি শোন, মেয়েটা ভীষণ সুন্দরী, কিন্তু খুব উগ্র ও রাগি। গরিবদের মোটেই দেখতে পারে না। আমি গরিব ঘরের ছেলে জেনে রেগে গিয়ে যা তা বলে অপমান করে আমার কাছ থেকে চলে গেল। অবশ্য তার ছোট বোনটা খুব ভালো। বড় বোন চলে যাওয়ার পর তার হয়ে ক্ষমা চেয়ে আমার সঙ্গে অনেক্ষণ আলাপ করল।
এখন সে ফোন করেছিল কেন?
কাল তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে বলার জন্য ফোন করেছিল।
তুই আমাকে খুব বোকা মেয়ে মনে করিস, তাই না?
তুমি হঠাৎ এরকম কথা বলছ কেন?
বলব নাতো কি? শুধু আমাকে দেখতে আসার কথা বলার জন্য কেউ ফোনে এক ঘন্টা কথা বলে? আসল কথাটা বলছিস না কেন? আমার তো মনে হচ্ছে, তোরা দুজন দুজনকে ভালবেসে ফেলেছিস। তাই আমাকে দেখতে আসতে চায়।
আমজাদ ধরা পড়ে খুব লজ্জা পেল। কোনো কথা বলতে না পেরে মুখ নিচু করে রইল।
কিরে, কিছু বলছিস না কেন? ছেলেমেয়েদের মনের কথা মায়েরা বুঝতে পারে। বড়টাকে যে তোর পছন্দ হয় নি, সাহেবকে জানিয়েছিস?
আমাকে জানাতে হবে না, সেই মেয়েই এতক্ষণে জানিয়ে দিয়েছে।
আর ছোট মেয়ের ব্যাপারটা?
সেটা ছোট মেয়েই জানাবে।
অত বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করে তুই কি সুখী হবি? না আমি হব?
তক্বদীরে যা আছে তার কম বেশি থেকে তো বঞ্চিত হব না। তবে এতটুকু বলতে পারি, ওকে যতটুকু জেনেছি ইনশাআল্লাহ্ তুমি আমি কেউ অসুখী হব না।
কাল কখন আসবে?
পাঁচটার সময়।
তোর সঙ্গে আসবে?
তাই তো বলল।
ঠিক আছে, ঘুমিয়ে পড় রাত হয়েছে বলে সালমা খাতুন চলে গেলেন।
.
পরের দিন আনান একটা ক্লাস গ্যাপ দিয়ে বাসায় এল। তারপর ড্রেস চেঞ্চ করে সিল্কের সাদা সালওয়ার কামিজ পরে সাদা জর্জটের ওড়ানা গায়ে মাথায় দিয়ে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলল, তেজগাঁ অফিসে চল। অফিসের সামনে গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে ফিরে যেতে বলে ঘড়ি দেখল, সারে চারটে।
আমজাদ চারটে পঁচিশে অফিস থেকে বেরিয়ে নিচে এসে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিল। আনানকে দেখে এগিয়ে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, আজ তোমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে জান?
হ্যাঁ জানি। নিশ্চয় মনে হচ্ছে, বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগীতায় অংশ নিলে ফাস্ট হব।
সুবাহান আল্লাহ্ বলে আমজাদ বলল, সত্যিই আমার তাই মনে হয়েছ। তারপর তাকে নিয়ে গাড়িতে উঠল।
আনানকে নিয়ে আমজাদ যখন বাসয় পৌঁছাল তখন সালমা খাতুন আসরের নামায পড়ে তসবীহ পড়তে পড়তে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
গাড়ি থেকে নেমে আমজাদ বলল, আমি মাকে মুখে সালাম দেব। তুমি মুখে সালাম দিয়ে পায় হাতে ছুঁয়ে কদমবুসিও করবে।
আনান বলল, ওসব তোমাকে বলতে হবে না। তুমি না বললেও করতাম।
বাসায় ঢুকে আমজাদ মাকে সালাম দিল।
আনান সালাম দিয়ে কদমবুসি করল।
সালমা খাতুন আনানকে দেখে খুব অবাক হলেন। ভাবলেন, কোনো মেয়ে কি এত সুন্দরী হয়? সালামের উত্তর দিয়ে তাকে জড়িয়ে প্রথমে কপালে ও পরে দু’গালে চুমো খেয়ে দোয়া করলেন, “আল্লাহ তোমাকে দুনিয়াতে ও আখেরাতে চিরসুখী করুক।”
আমজাদ মাকে বলল, তুমি বোধ হয় আসরের নামায পড়ে নিয়েছ। আমি পড়ে নিই ততক্ষণ ওর সঙ্গে আলাপ কর।
ছেলে চলে যাওয়ার পর সালমা খাতুন আনানকে জিজ্ঞেস করলেন তোমার নাম কি মা?
আফরা আনান। ডাক নাম আনান।
বাহ! খুব সুন্দর নাম তো? নামের মতই তুমি দেখতে। নামের অর্থ জান?
আনান লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বলল, জি, সাদা মেঘ।
তোমার বড় বোনের নাম কি?
আফরা রুমালী। ডাকনাম রুমালী।
এই নামও খুব সুন্দর। এটারও নিশ্চয় অর্থ জান?
জি, সাদা কবুতর।
তোমাদের দু’বোনের নাম যিনি রেখেছেন, তিনি খুব জ্ঞানী। তুমি নামায পড়
জি, না। আপনার ছেলের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে নামায পড়ার নিয়ম কানুন শিখছি।
আনান মুখ নিচু করে কথা বলছিল। সালমাখাতুন তার চিবুক ধরে তুলে বললেন, শহরের ধনী ঘরের শিক্ষিত মেয়েদের লজ্জা নেই বলে জানি। তোমাকে ব্যতিক্রম দেখে খুশী হয়েছি। আমাদের কাছে তোমাদের সবার কথা শুনেছি। এত লজ্জা পাচ্ছ কেন? দু’চারটে কথা বলছি মন দিয়ে শোন, বিত্ত বৈভব না। থাকলে মানুষ যেমন সুখ শান্তি পায় না, তেমনি বিত্ত বৈভব আবার মানুষের দুঃখের ও অশান্তির কারণও হয়। তাই বিত্ত বৈভবে থাকার সময় ও অভাবের সময় কি করা উচিত তা প্রতিটি মানুষের জানা একান্ত কর্তব্য। সেসব জানতে হলে প্রত্যেক নর-নারীকে স্কুল কলেজে পড়ার সাথে সাথে কুরআন হাদিস পড়তে হবে। কারণ সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বল আল আমিন ইহজগতে ও পরজগতের সুখ শান্তির পথ কুরআনপাকে ও হযরত মুহাম্মদ (দঃ) হাদিসে বাতলে দিয়েছেন। আজকাল মানুষ সেসব জানছে না ও মানছে না বলে সারা দুনিয়াতে এত অশান্তি। তুমি শিক্ষিত মেয়ে। আশা করি, আমার কথা বুঝতে পেরেছ এবং তা পালন করার চেষ্টা করবে। তারপর বললেন, নামায পড়ে আমজাদ এক্ষুনি এসে পড়বে। আমি তোমাদের নাস্তার ব্যবস্থা করি। পাশের রুমটা আমজাদের। তুমি ওখানে গিয়ে বস।
আমজাদ নামায পড়ে এসে দেখল, আনান চেয়ারে বসে টেবিলের উপর রাখা একটা হাদিসের বই নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছে। বলল, এতক্ষণ মায়ের বকবকানি শুনে নিশ্চয় বিরক্তি হয়েছ?
বিরক্ত হব কেন? উনি তো অনেক ভালো ভালো উপদেশ দিলেন। শুনে বরং খুশী হয়েছি।
তোমার কথা শুনে আমিও খুশী হলাম। জান, সেই ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত সময় সুযোগ পেলেই মা আমাকে উপদেশ দেন।
আমার কি মনে হচ্ছে জান? ওনার উপদেশের কারণেই তুমি ধার্মিক ও চরিত্রবান হয়েছ। উনি প্রকৃত আদর্শবতী মা। প্রতিটি ঘরে এরকম মা থাকা দরকার।
হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথা বলেছ। তাইতো মনিষিরা বেলেছেন, আদর্শবতী মা না হলে আদর্শবান ছেলেমেয়ে হয় না।
নাস্তা খাওয়ার পর আমজাদ আনানকে বলল, চল, তোমাকে পৌঁছে দিই। বিদায় নেয়ার আগে সালমা খাতুন আনানকে বললেন, আবার আসবে তো মা?
জি আসব বলে আনান ওনার সঙ্গে সালাম বিনিময় করে আমজাদের সঙ্গে বেরিয়ে এল।
.
৬.
আমজাদ একটা ব্রীজের নক্সার ফটো কপি খুব মনোযোগের সঙ্গে দেখছে।
তার সামনে বসে আছেন আসিফ সাহেব। যে নক্সাসহ আমজাদ ব্রীজ তৈরীর কন্ট্রাক্ট পাওয়ার জন্য টেণ্ডার সাবমিট করেছিল, এটা তারই ফটোস্ট্যাট কপি। টেণ্ডার পাওয়ার খবর পেয়ে তিনি এসেছেন ব্রীজের কাজ আমজাদ কিভাবে শুরু করবে তার সঙ্গে আলাপ করার জন্য।
ফোন বেজে উঠতে বিরক্ত হলেও রিসিভার তুলে সালাম দিয়ে বলল, আমজাদ বলছি।
অপর প্রান্তের লোকটা বলল, আপনি নিজেকে কি মনে করেন?
একজন আল্লাহর বান্দা।
তাতো সবাই মনে করে। আমি জানতে চাচ্ছি, আপনি যে ব্রীজ তৈরীর কন্ট্রাক্ট পেয়েছেন, তার কমিশন নেয়ার জন্য আমি লোক পাঠিয়েছিলাম, তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছেন কেন?
আপনি কে?
আমি কে, তা জানার দরকার নেই। কমিশনের টাকাটা কবে দেবেন বলুন।
আমরা কন্ট্রাক্ট পেয়েছি। ব্রীজ তৈরীর দায়িত্ব আমাদের। লাভ লোকসান যাই হোক না কেন সেটা আমরা বুঝব। আপনাকে কমিশন দেব কোন দুঃখে?
আমাদেরকে কমিশন না দিয়ে কাজ করতে পারবেন? এর আগে আপনার পোষ্টে যিনি ছিলেন, তিনি জানতেন এবং দিতেনও। আপনি নতুন এসেছেন। তাই জানেন না, আমাদের দাবি পূরণ না করলে শুধু ঐ পোষ্ট থেকে নয়, দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হবে।
ভয় দেখাচ্ছেন? ভয় পাওয়ার ছেলে আমি নই। বাপের বেটা হলে তোক না পাঠিয়ে কমিশন নেয়ার জন্য নিজে আসুন।
ঠিক আছে, দেখব আপনি কত বড় বাপের বেটা।
কত বড় বাপের বেটা দেখতে হলে কোনো অস্ত্র ছাড়াই আসতে হবে। আর যদি অস্ত্র ও সঙ্গিদের নিয়ে আসেন, তবু পুরোটা না হলেও কিছুটা অবশ্যই দেখতে পাবেন।
ফড়িং-এর পাখা কখন গজায় জানেন?
কেন জানব না, আগুনে ঝাঁপ দেয়ার জন্য।
আপনারও ফড়িং-এর মতো পাখা গজিয়েছে।
আমিও যদি ঐ কথা বলি?
যেদিন যাব, সেদিন প্রমাণ হয়ে যাবে কার পাখা গজিয়েছে।
সেটাই ভালো হবে বলে আমজাদ লাইন কেটে দিল।
আসিফ সাহেব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললেন, ওদের একটা গ্যাং আছে। তুমি একা ওদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। তোমার বড় কোনো ক্ষতি করে দিতে পারে। তাই বলছিলাম, গোলমাল না করে ওদের সঙ্গে মিটমাট করে ফেলাই ভালো।
আমজাদ কয়েক সেকেণ্ড ওনার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, সন্ত্রাসীদের কাছে যারা মাথা নত করে তারা কাপুরুষ। আর ঐসব কাপুরুষদের জন্য সন্ত্রাসীদের সাহস দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আপনাদের মতো ধনীরাই ওদের সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছেন। একবারও কি ভেবে দেখেছেন, যাদের সামর্থ নেই, তারা কিভাবে সন্ত্রাসীদের দাবি পূরণ করবে? তাই তাদের মধ্যে যারা ভয় পেয়ে সন্ত্রাসীদের দাবি পূরণ করে কাজ করছে, তারা কনস্ট্রাকসনে নিম্নমানের মেটিরিয়েল দিয়ে কাজ সম্পন্ন করছে। ফলে বিল্ডীং ও ব্রীজগুলো মজবুত হচ্ছে না। কয়েকমাস বা কয়েক বছরের মধ্যে ভেঙ্গে পড়ছে।
তোমার কথাগুলো খুব দামি হলেও মানুষের জীবনের থেকে নিশ্চয় দামি নয়। মানুষ জীবন রক্ষার জন্য সন্ত্রাসীদের দাবি পূরণ করছে।
আমজাদ মৃদু হেসে বলল, জীবন দেয়া-নেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ্। একথা মুসলমান মাত্রেই বিশ্বাস করতে হবে। আরো বিশ্বাস করতে হবে, আল্লাহ যখন যেখানে যেভাবে যার মৃত্যু লিখে রেখেছেন, নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে সেভাবেই তার মৃত্যু হবে। তাই কোনো মুসলমানের মৃত্যুকে ভয় পাওয়া মোটেই উচিত নয়। আমরা সেকথা অনেকে জানি না। জানলেও আল্লাহর উপর আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস নেই। তাই আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই।
আসিফ সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, বর্তমান যুগের মুসলমানরা টাকার পিছনে ছুটছে। এসব কথা জানার সময় নেই। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি ধারণা ওরা কমিশন নিতে আসবে?
আমারা ধারণা আসবে না। যদি আসত, তা হলে তার লোকেরা ফিরে যাওয়ার পরপরই আসত, ফোনে হুমকি ধুমকি দিত না। মনে রাখবেন, সন্ত্রাসীদের মনে সব সময় ভয় থাকে। তাই তারা সহজে এ্যাকসানে যেতে চায় না। ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করতে চায়।
তোমার কথা পুরোপুরি মানতে পারছি না। তা হলে যেখানে সেখানে এত খুন হত না।
এ ব্যাপারে অনেক কথা বলতে হয়। পরে সেসব বলব। এখন একটা কথা বলে পারছি না। দেশের পুলিশ প্রশাসন যদি সৎ ও নিষ্ঠাবান হত, তা হলে দেশে সন্ত্রাসী থাকত না। পুলিশের সহযোগীতার কারণে সারা দেশে সন্ত্রাসীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
হ্যাঁ, এতক্ষণে তুমি একটা খুব দামি কথা বলেছ। এবার এসব কথা থাক, আমরা ব্রীজ তৈরীর ব্যাপারে আলাপ করি এস।
আলাপ শেষ করে আসিফ সাহেব বললেন, তুমি একটু সাবধানে থেক।
আমজাদ বলল, আমার জন্য দুশ্চিন্তা করবেন না। আল্লাহ্ আমার ভাগ্যে যা রেখেছেন, তা কি আপনি ঠেকাতে পারবেন?
তা পারব না, তবে সাবধান থাকতে দোষ কোথায়। কেউ যেন তোমার এতটুকু ক্ষতি করতে না পারে, সে ব্যবস্থা আমি করব। তুমি শুধু একটু সাবধান থাকবে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এবার আসি।
আমজাদও দাঁড়িয়ে সালাম বিনিময় করে বলল, আসুন।
.
রাত এগারটা। আমজাদ ঘুমবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় ফোন বেজে উঠতে রিসিভার তুলে সালাম দিয়ে বলল, তোমার সামনে না পরীক্ষা? কোথায় পড়াশোনা করবে, তা না করে রোজ রোজ ফোন করলে রেজাল্ট ভালো হবে?
আনান প্রায় প্রতিদিন এই সময়ে ফোন করে। তাই আমজাদ আজ কথাগুলো বলল।
একজন বয়স্ক মহিলা সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, এসব কি বলছেন? কে আপনি?
আমজাদ জিজ্ঞেস করল, কত নাম্বারে ফোন করেছেন?
মহিলা নাম্বার বললেন।
হ্যাঁ, নাম্বার তো ঠিক আছে দেখছি। কাকে চাচ্ছেন?
আমজাদ সাহেবকে।
বলছি।
ও তা হলে ফোন ধরে প্রেমিকা মনে করে কথাগুলো বলেছেন? যাই হোক, প্রেম করেছেন ভালো কথা। প্রেমিকাকে সৎ উপদেশ দিয়েছেন তাও ভালো কথা। কিন্তু সন্ত্রাসীদের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ দেয়া কি উচিত হয়েছে?
সেটা আমার ব্যাপার। আপনি কে যে, কৈফিয়ৎ চাচ্ছেন?
যদি বলি আপনার একজন শুভাকাঙ্খি?
সেজন্যে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর কিছু বলবেন?
আই লাভ ইউ।
হোয়াট?
ইয়েস, আই লাভ ইউ ডিপলী।
মনে হচ্ছে আপনার মাথার স্কু ঢিলে। নচেৎ এত রাতে অচেনা কাউকে ফোন করে কোনো মহিলা একথা বলতে পারেন না।
আগে আমার মাথার স্কু খুব টাইট ছিল। আপনাকে দেখার পর থেকে ঢিলে হয়ে গেছে।
কি বলছেন আপনি? আমাকে চেনেন?
শুধু চিনি নয়, গুড় ও। জানেন তো গুড় থেকেই চিনি হয়। সেই গুড় খেয়েছি। তাইতো চব্বিশ ঘন্টা আপনি আমার তনু মনুতে বিরাজ করছেন।
কী যা তা পাগলের মতো বকছেন? আমি তো আপনাকে চিনি না।
পাগল আমি ছিলাম না, আপনিই আমাকে পাগল করেছেন। ভালো করে খেতে পারি না, রাতে ঘুমাতে পারি না। তাই তো থাকতে না পেরে এতরাতে ফোন করেছি।
আমজাদের মনে হল কোনো পাগল বয়স্ক মহিলা ফোন করেছে। বলল, আপনার পরিচয় বললে কৃতার্থ হতাম।
আগে বলুন, আমাকে ভালবাসেন। কিন্তু গলার স্বরে বুঝতে পারছি, আপনার বয়স চল্লিশ পঞ্চাশের কম না।
আপনার অনুমান ভুল। এই উনিশ পেরিয়ে বিশে পড়েছে। কয়েকদিন আগে ঠাণ্ডা লেগেছিল। তাই গলার স্বর বয়স্ক মহিলার মতো শোনাচ্ছে।
আমজাদ চুপ করে চিন্তা করতে লাগল, মহিলাটি কে হতে পারে?
কি হল? কিছু বলছেন না কেন? আমি কিন্তু আপনার চুপ করে থাকার কারণ জানি।
আমজাদ অবাক হয়ে বলল, কই, বলুন তো শুনি?
আপনি আনানকে ভালবাসেন, সেও আপনাকে ভালবাসে। কী ঠিক বলি নি?
হ্যাঁ, ঠিক বলছেন। কিন্তু জেনেও আমার পিছনে লেগেছেন কেন বুঝতে পারছি না।
মন যে মানে না। আমার সব কথা শুনলে আপনিও আমাকে ভালবাসতে। বাধ্য হবেন। বলছি শুনুন, আমি আনানের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী। শুধু তাই নয়, তার বাবার চেয়ে আমার বাবা অনেক বেশি ধনী। আমি মা বাবার একমাত্র সন্তান। আনানরা দু’বোন। তারা এক এক বোন বাবার সম্পত্তির অর্ধেক পাবে। আর আমি পাব বাবার সমস্ত সম্পত্তি। এরপরও আমাকে ভালবাসবেন না?
এবার আমার কথা শুনুন, আপনার বাবা যদি গোটা দুনিয়ার মালিক হন। এবং আপনি তার উত্তরাধিকারী হন, তবু আনানকে ছাড়া আমার হৃদয়ে আপনার এতটুকু জায়গা হবে না। আরো শুনন, আমি আনানকে ভালবাসি, তার বাবার সম্পত্তীকে নয়। যেখানে লোভ ও সার্থ থাকে, সেখানে খাঁটি ভালবাসা হয় না। আপনাকে অনুরোধ করছি, দেশে আপনার মতো মেয়ের জন্য ছেলের অভাব নেই। তাদের কাউকে সম্পৰ্ত্তীর লোভ দেখিয়ে ভালবাসার ফাঁদে ফেলুন। ভবিষ্যতে আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। এবার রাখছি বলে আমজাদ লাইন কেটে দিয়ে বিছানায় গেল।
সঙ্গে সঙ্গে আবার ফোন বেজে উঠল। ঐ মেয়েটাই ফোন করেছে ভেবে বিরক্ত হয়ে রিসিভ করল না।
আট দশবার রিং হয়ে লাইন কেটে গেল। একটু পরে আবার রিং হতে লাগল।
আমজাদ খাট থেকে নেমে রিভিভার তুলে খুব রাগের সঙ্গে বলল, কেন বারবার বিরক্ত করছেন? বললাম না, আমাকে আর ফোন করবেন না?
আনান আহতস্বরে বলল, আমি ফোন করলে তুমি বিরক্ত হও তা হলে? তাই বুঝি প্রথমে ফোন ধর নিঃ
এরকম কথা বলতে পারলে?
তুমি নিজেই তো বললে।
প্লীজ, রাগ করো না। একটু আগে একটা মেয়ে ফোন করেছিল। আমি বিরক্ত হয়ে লাইন কেটে দিই তারপর আবার রিং হতে মনে করেছিলাম, ঐ মেয়েটা করেছে। তাই প্রথমে ধরি নি এবং আবার রিং হতে ঐ কথা বলেছি।
আনান হেসে উঠে বলল, তুমি সব বিষয়ে জিনিয়াস হয়েও বোকার মতো কাজ করেছ। মেয়েটা তোমাকে ঘোল খাইয়েছে।
আমজাদ খুব অবাক হয়ে বলল, ঘোল খাইয়েছে মানে?
ঘোল খাইয়েছে মানে ঘোল খাইয়েছে। এত সহজ কথার মানে বুঝতে না পেরে আর একবার বোকার মতো কথা বললে।
মনে হচ্ছে, মেয়েটাকে তুমি চেনো?
হ্যাঁ, চিনি।
কে বলতো?
আনান।
বোকামীর জন্য নিজের উপর আমজাদের প্রচণ্ড রাগ হল। কিছু বলতে না পেরে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
কি হল, বোবা হয়ে গেলে নাকি? না বন্ধুর মতো কাজ করেছ বলে নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছে?
এজন্য খুব কঠিন শাস্তি পেতে হবে।
দিও। তা কখন দেবে? এক্ষুনি দিতে চাইলে চলে এস। যা শাস্তি দেবে মাথা পেতে নেব।
মাথা নয়, দেহ পেতে নিতে হবে।
অসভ্য, জঙ্গলী।
তাই তো শাস্তি দিতে চাই।
তা শাস্তি দিতে এক্ষুনি আসছ না কী?
সম্ভব হলে নিশ্চয় আসতাম। তাই এখন ভোলা রইল, বাসর রাতে দেব।
মানুষ যখন রেগে যায় তখন শাস্তি দেয় এবং তা কঠিনও হয়। রাগ পড়ে গেলে শাস্তির ওজন কমে যায়। আর বাসর রাতের কথা বলে আর একবার প্রমাণ করলে সত্যিই তুমি বুন্ধু।
দেখ, বারবার বন্ধু বলবে না বলছি, শাস্তির ওজন বেড়ে যাবে কিন্তু।
আনান হাসতে হাসতে বলল, তুমি কিন্তু বারবার বুন্ধুর পরিচয় দিচ্ছ।
আবার? কই প্রমাণ করো তো?
বাসর রাতে স্বামীরা যে শাস্তি স্ত্রীদের দেয়, সেই শাস্তি স্ত্রীরা নিজের থেকে পেতে চায়। তাই সেটাকে শাস্তি বলে না।
খুব ইঁচোড়েপাকা হয়েছ না?
আগে শুধু এচোড় ছিলাম, তোমাকে ভালবেসে পাকা হয়েছি।
উঃ! কি ধুরন্ধর মেয়েরে বাবা, কোনো কথায় যদি পারা যাচ্ছে।
তা হলে এখন আর শাস্তি দিতে মন চাচ্ছে না, তাই না?
আমজাদ প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বলল, সারারাত দুষ্টুমী করবে, ঘুমাবে না?
তোমার বুঝি খুব ঘুম পাচ্ছে?
তোমার পাচ্ছে না?
না। বাসর রাতে স্বামী-স্ত্রীরা যেমন সারারাত কথা বলে, আমারও তেমনি ইচ্ছা করছে।
বাসর রাতে তা হলে কী করবে?
কেন? তুমি তো বললে শাস্তি দেবে।
এবার তুমিও কিন্তু অসভ্য ও জঙ্গলীর মতো কথা বলছ?
স্বামী হলে স্ত্রীরও তাই হওয়া উচিত।
আমজাদ কথায় পেরে উঠতে না পেরে বলল, প্লীজ, এবার রাখ। নচেৎ ফজরের নামায়ের সময় ঘুম ভাঙবে না।
তা হলে বল, আমাকে ক্ষমা করেছ?
ক্ষমা চাওয়ার মতো তেমন কিছু ঘটনা ঘটে নি, তবু চাইছ কেন?
শুধু ঘটনা ঘটাইনি, বলেছিও।
যেমন?
গলার স্বর পাল্টে তোমাকে ঘোল খাইয়ে তোমাকে বুদ্ধ বানিয়েছি, অসভ্য ও জঙ্গলী বলেছি। তা ছাড়া এতরাত পর্যন্ত ঘুমাতে না দিয়ে জাগিয়ে রেখে কষ্ট দিয়েছি। এগুলো করে খুব অন্যায় করেছি।
এসব করার জন্য আমি যদি রেগে যেতাম, তা হলে অন্যায় হত এবং ক্ষমা চাওয়ার কথা আসত। রাগের বদলে খুব আনন্দ পেয়েছি। সেজন্যে তোমার পুরস্কার পাওয়া উচিত।
ওসব কথায় মনে শান্তি পাব না। ক্ষমা পেয়েছি বলতে হবে।
আমিও তোমাকে অনেক কিছু বলেছি। তা হলে তোমার কাছে আমারও তো ক্ষমা চাওয়া উচিত?
না, তুমি কিছুই কর নি। তোমাকে বলতেই হবে ক্ষমা পেয়েছি।
ঠিক আছে, পেয়েছ। এবার তা হলে রাখি?
প্লীজ, রেখ না। যে জন্যে ফোন করেছি, সেটাই বলা হয় নি।
কাল বললে হয় না?
না। বেশি সময় নেব না, প্লীজ।
ঠিক আছে, বল।
বাবার কাছে শুনলাম, সন্ত্রাসীদের তুমি টাকা দিতে রাজ হওনি বলে তারা তোমাকে নাকি শাসিয়েছে?
ও নিয়ে তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করো না। তারপর বাবাকে যা কিছু বলেছিল বলল।
কিন্তু আমার যে খুব ভয় করছে?
ঈমানদার বান্দা-বান্দি শুধু আল্লাহকে ভয় করবে, অন্য কাউকেই নয়।
তা আমিও জানি; কিন্তু মন মানছে না। তোমার বিপদের আশঙ্কায় খাওয়া, ঘুম ও পড়াশোনা কিছুই করতে পারছি না।
আল্লাহর উপর সব সময় ভরসা রাখবে। তাঁর কাছে সবার মঙ্গলের জন্য দোয়া করবে, তা হলে আশঙ্কা কেটে যাবে।
সত্যি বলছ, আশঙ্কা কেটে যাবে?
বললাম তা যদি কর, নিশ্চয় কেটে যাবে।
বেশ, তাই করব বলে আনান সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
একদিন সন্ধ্যের সময় রজতকে বাসায় ফিরতে দেখে স্বাতি বললেন, কী ব্যাপার? আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে? আবার কোথায় যাবে নিশ্চয়?
রজত বলেলেন, না, আজ আর কোথাও যাব না।
স্বাতি চা-নাস্তা খেতে দিয়ে বললেন, বিথীর মাষ্টার এ সম্পাহে একদিনও এলেন না। মনে হয় আর পড়াবেন না। তুমি অন্য মাষ্টার দেখ।
হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথা বলেছ। তুমিতো বিজনেস ম্যাগনেট আসিফ সাহেবকে চেনো। ওনার তেজগা কনস্ট্রাকসান ফার্মের ডাইরেক্টর বিথীর মাষ্টার। শুধু তাই নয়, জয়েন করার সাথে সাথে বাড়ি, গাড়ি, ফোন ও মোবাইল পেয়েছেন। আজ বিজনেস এ্যাসোসিয়েশনের মিটিং ছিল। আসিফ সাহেবের সঙ্গে উনিও এসেছিলেন। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে আলাপ করলেন। এক সময় কথা প্রসঙ্গে বললেন, বিথীকে আর পড়াতে পারবেন না।
খুব অবাক লাগছে। এতবড় পোষ্টে চাকরি পেয়েও বিথীকে এতদিন পড়াতে আসতেন?
হ্যাঁ, শুনে আমিও খুব অবাক হয়েছি।
সত্যি, ছেলেটা খুব ভালো।
শুধু ভালো নয়, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে কেউ এত ধার্মিক হয়, ওনাকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। আজ সাড়ে সাতটায় আসবেন বলেছেন।
বিথীও বাবার সঙ্গে চা নাস্তা খাচ্ছিল। বাবা থেমে যেতে বলল, জান বাবা, স্যার একদিন কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, স্বামী-স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ীর কর্তব্য সম্পর্কে এমন অনেক কথা বলেছেন, যা প্রত্যেকের জানা উচিত। স্যারের কথা শুনে মনে হয়েছে, প্রতিটি মানুষ যদি সেই সব কর্তব্য জেনে মেনে চলত, তা হলে সারা পৃথিবীর মানুষ সুখ শান্তিতে বাস করতে পারত। স্যার আরো বলেছেন, ঐ সব নাকি ইসলামের কথা। ইসলাম সম্পর্কে জানতে আমার খুব ইচ্ছা করে।
স্বাতি বললেন, বেশতো অবসর সময়ে ইসলামের উপর পড়াশোনা করবি।
.
আমজাদ যখন তাদের বাসায় এল তখনও তারা ড্রইংরুমে বসে তার কথাই আলাপ করছিলেন। কলিং বেল বেজে উঠতে রজত মেয়েকে বললেন, বোধ হয় তোর মাষ্টার এসেছেন। যা, কে এল দেখে গেট খুলবি।
বিথী দরজার ফুটো দিয়ে স্যারকে দেখে গেট খুলে দিয়ে বলল, ড্রইংরুমে চলুন। আপনি আসবেন, তাই বাবা আজ সন্ধ্যের আগেই ফিরেছেন। ওখানে মা বাবা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
আমজাদ ড্রইংরুমে ঢুকতে রজত বসতে বলে স্ত্রীকে বললেন, বিথীর মাষ্টারকে দেখে তোমার কি বিশ্বাস হয়, উনি মস্তবড় কনস্ট্রাকসান ফার্মের ডাইরেক্টর।
বিথী কিছু বলার আগে আমজাদ হাসতে হাসতে বলল, রজত দা, আপনি কিন্তু আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন।
স্বামীর আগে স্বাতি বললেন, এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে যা সত্য তাই তো উনি বললেন। তারপর বিথীকে স্যারের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে বললেন।
আপ্যায়নের পর স্বাতি আমজাদকে বললেন, আপনি শুধু চাকরি পাওয়ার কথা বলেছিলেন, কিন্তু এতবড় পোষ্টের কথা বলেন নি। বললে কি এমন ক্ষতি হত আপনার?
আমজাদ বলল, ক্ষতি হবে কেন? বরং শুনে আপনারা আরো বেশি খুশী হতেন।
তা হলে বলেন নি কেন?
ভেবেছিলাম, পারমানেন্ট হওয়ার পর জানাব।
আপনার মাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবেন বলেছিলেন। কই, নিয়ে তো এলেন না?
মাকে আপনাদের কথা বলে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, উনি রাজি হন নি।
কেন?
কথাটা বলা উচিত হবে কিনা আমজাদ চিন্তা করতে লাগল।
রজত যেন কারণটা অনুমান করতে পারলেন। বললেন, বলতে অসুবিধে থাকলে বলতে হবে না।
স্বাতি বললেন, অসুবিধে থাকলেও বলতে হবে।
আমজাদ বলল, মাকে যখন নিয়ে আসার কথা বলি তখন আপনাদের সম্পর্কে সব কিছু জানতে চাইলেন। আমি কখনো মিথ্যে বলি না। তাই আপনাদের সম্পর্কে যা জানি বললাম। শুনে মা আতঙ্কিত স্বরে বললেন, “ওদের বিয়ে হিন্দু বা ইসলাম কোনো ধর্মমতে বৈধ হয় নি। যারা অবৈধ জীবন-যাপন করছে তাদের বাসায় আমি যাব না। আপনারা জেনে মায়ের উপর কষ্ট পেতে পারেন ভেবে প্রথমে বলতে চাই নি।
রজত বললেন, কিন্তু আমরা তো কোর্ট ম্যারেজ করেছি, অবৈধ হবে কেন?
হিন্দু ধর্মমতে আপনাদের বিয়ে বৈধ হয়েছে কিনা জানি না, তবে এটা জানি, ইসলাম ধর্মমতে বৈধ হয় নি। কারণ ইসলামে কেবল মাত্র মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারীর মধ্যে বিয়ে বৈধ। অন্য ধর্মের ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে করা মুসলমানদের বৈধ নয়। নারী-পুরুষ যে কেউ অন্য ধর্মাবলম্বী হলে বিয়ের আগে তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর বিয়ে বৈধ হবে।
আমরা তো কোনো ধর্মই মানি না। মানবধর্মকে অনুসরণ করে আমরা বিয়ে করেছি। এটা অবৈধ হতে পারে না।
মনে হচ্ছে, আপনি কোনো ধর্মেরই বইপত্র পড়েন নি। তাই বিশেষ করে বর্তমানে ক্ষয়ে যাওয়া মুসলমান সমাজকে দেখে আপনার মনে ধর্মদ্রোহীতা জন্মেছে। আপনি জানেন না, ইসলাম মানব তথা মানবতার যে প্রধান্য দিয়েছে, পৃথিবীর অন্যান্য কোনো ধর্ম তা দেয় নি। যা সত্য ও ন্যায়, সেটাই ধর্ম। ধর্মজ্ঞান মানুষকে সৎ, নিষ্ঠাবান ও পরহিতৈষী করে। ধর্মজ্ঞানহীন মানুষ শয়তানের দোসর। শয়তানের কাজ হল, মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে পাপে লিপ্ত করা। মানুষ শয়তানের প্রলোভনে পড়ে মনুষত্ব হারিয়ে ফেলেছে। তাই সারা পৃথিবীর মানুষ আজ অর্থ আর ভোগবিলাসের আবর্তে পড়ে যা ইচ্ছা তাই করছে। এমন কি ধর্মকেও অস্বীকার করছে। আমার কথায় আপনারা হয়তো মনঃক্ষুণ্ণ হচ্ছেন; কিন্তু আমার জ্ঞান, আমর বিবেক সত্য প্রকাশ করতে বাধ্য করছে। মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করে তাঁর বিধি-নিষেধ যতদিন মেনে না চলবে ততদিন এই পৃথিবী নামক সংসারে হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, দলাদলি, মারামারি, খুনো-খুনী, চুরি ডাকাতি, মুক্তিপণ, ধর্ষণ ও সন্ত্রাস বন্ধ হবে না। প্রত্যেক দেশের সরকার এইসব। বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন প্রশাসন বিভাগ খুলেছে; কিন্তু বন্ধ করতে পেরেছে কি? পারে নি। বরং ক্রমশঃ বেড়েই চলছে। অথচ ইসলামের স্বর্ণযুগের ইতিহাসের দিকে তাকালে জানা যাবে, সে যুগে এত প্রশাসন বিভাগ না থাকা সত্ত্বেও এইসব অপরাধ ছিল না বললেই চলে। যতটুকু ছিল, ধরা পড়লে যেমন কঠোর শাস্তি দেয়া হত, তেমনি শাস্তি ভোগের পর যাতে সৎ জীবন যাপন করতে পারে সে ব্যবস্থা করা হত। আমার একান্ত অনুরোধ আপনারা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পড়ন। তা হলে বুঝতে পারবেন, ধর্ম কি ও কেন? আরো বুঝতে পারবেন, কোন ধর্ম অনুসরণ করা উচিত। যদি কোনো ব্যাপারে প্রয়োজন হয়, আমাকে জানাবেন, আমি আসব। আরো অনুরোধ করব, প্রথমে হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর জীবনী ও কুরআনের তফসীর পড়ার পর অন্যান্য ধর্মের প্রবর্তক ও তাঁদের ধর্মগ্রন্থ পড়বেন। আর একটা কথা বলে এই প্রসঙ্গ শেষ করব। কখনো নিজেকে অন্যের চেয়ে জ্ঞানী, গুণী ও বড় মনে করবেন না। কারণ এটা অহঙ্কার। আর এটা সর্বজনবিদিত অহঙ্কার পতনের মূল। জেনে রাখুন এই অহঙ্কারের কারণে আজাজিল ফেরেশতাদের মুয়াল্লেম (শিক্ষক) হয়েও শয়তানে পরিণত হয়েছে। তাই সে মানুষের মনুষত্ব ধ্বংস করার জন্য এই অহঙ্কার নামক অস্ত্র ব্যবহার করছে।
স্বাতি বললেন, আপনার কাছে আমার অনেক কিছু জানার আছে। এখন বলি?
আজ আর সময় দিতে পারছি না। নোট করে রাখুন, পরে যখন আসব তখন জেনে নেবেন।
বিথী বলল, মাঝে মাঝে আসবেন স্যার। না এলে দুঃখ পাব বলে উঠে এসে নিচু হয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করল।
আমজাদ তার মাথায় হাত রেখে বলল, আল্লাহ্ তোমাকে সত্য ধর্মপথে চলার তওফিক দিক। তারপর বলল, তোমার মা বাবাকেও সালাম কর।
বিথী সালাম করার পর আমজাদ বলল, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সেরা করে। সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর কাছে ছাড়া তার যে কোন সৃষ্টির কাছে মাথা নত করতে নিষেধ করেছেন। তাই যত বড় মহৎ ব্যক্তি হন না কেন, তাঁকে ভক্তি শ্রদ্ধা জানাবার জন্য মাথা নত করা চলবে না। এমন কি পিতা মাতার কাছেও না। এসব জানাবার জন্য ইসলামের নিয়ম হল, মুখে, সালাম দিবে অর্থাৎ একে অপরের শান্তি কামনা করবে। তারপর হাত মোসাফাহা করার সময় আল্লাহর কাছে দোষ-ত্রুটির জন্য ক্ষমা চাইবে। আর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা সমাজের প্রচলন। কেউ যদি তা করে, তবে তাকে বসে মাথা উঁচু করে করতে হবে। তারপর স্বাতির দিকে তাকিয়ে বলল, বৌদি, আমি কি বাঁচাল বা আহম্মকের মতো কিছু বললাম।
স্বাতি বললেন, না-না, তা কেন? আপনি খুব খাঁটি কথা বলেছেন। আমরা এসব নিয়ে কখনো চিন্তা করি নি। এখন মনে হচ্ছে, প্রতিটি মানুষের এসব বিষয়ে পড়াশোনা করা উচিত। আজ আপনি যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
আমজাদ রজতকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি কিছু বলবেন না?
আমি আর কি বলব? আপনার কথাগুলো ভালো হলেও অনেক প্রশ্ন মনে। জাগছে। তাই কোনো মন্তব্য করতে পারছি না। তবে আমার মনে হচ্ছে, আপনার কথার মধ্যে যাদু আছে। তা না হলে যে স্বাতি ধর্মের নাম শুনতে পারত না। সে কিনা আপনি বিথীকে পড়াতে আসার পর থেকে কুরআনের ব্যাখা পড়তে শুরু করেছে। অবশ্য ব্যাপারটা আমি মাত্র কয়েকদিন আগে জানতে পেরেছি।
সেজন্য আপনি কি বৌদির উপর অসন্তুষ্ট?
সন্তুষ্ট অসন্তুষ্ট কোনোটাই হয় নি। কারণ আমি কখনো কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করি না।
আবার অনুরোধ করছি, কুরআনের ব্যাখ্যা পড়ন। তা হলে বুঝতে পারবেন, আমার কথায় যাদু নেই, আছে আল্লাহ্ বাণী কুরআনে। আর যদি হযরত মুহাম্মদ (দঃ) ও সাহাবীদের জীবনী ও ইসলামের ইতিহাস পড়েন, তা হলে জানতে পারবেন কুরআনের বাণীতে যাদু আছে কিনা। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত যেসব বড় বড় জ্ঞানী, গুণী মনিষিরা কুরআনের ব্যাখ্যা পড়েছেন, তাঁরা প্রায় সকলে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন।
আমজাদের সব কথা বিথীর কাছেও অত্যন্ত ভালো লাগল। বলল, স্যার, আপনার একটা কার্ড দিন। মাঝে মাঝে ফোন করব। আর আমাদের ফোন নাম্বার তো আপনি জানেন। যেদিন আসবেন ফোন করে জানাবেন, বাবাকে বাসায় থাকতে বলব।
মেয়ে থেমে যেতে স্বাতি বললেন, হ্যাঁ, বিথী ভালো কথা বলেছে। আর শুনন, আপনার মা যখন আমাদের বাসায় আসবেন না তখন আমরা একদিন ওনাকে দেখতে যাব।
রজত বললেন, কিন্তু উনি যদি দেখা না দেন?
স্বাতি বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদেরকে নিরাশ করবেন না।
আপনার কি ধারণা বলে রজত আমজাদের দিকে তাকালেন।
বৌদির ধারণাই ঠিক।
তা হলে আমাদের বাসায় না আসার কারণ বুঝতে পারছি না।
আপনাদের বাসায় এলে কিছু না কিছু না খাইয়ে ছাড়তেন না। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি মা অন্য কারো বাড়িতে খান না। এমন কি কোনো পড়শী বা আত্মীয়দের কেউ কোনো খাবার দিয়ে গেলেও খান না। কোনো ফকির অথবা পড়ার গরিব প্রতিবেশীকে দিয়ে দেন। স্বামীর মৃত্যুর পর এত বছর ভাইয়ের বাড়িতে থেকে খাওয়া দাওয়া করলেও যখন ভাইয়ের ছেলে বড় হয়ে অসৎ পথে উপার্জন করা শুরু করল তখন থেকে ঢাকায় আসার আগে পর্যন্ত। তাদের কিছু খান নি।
তা হলে উনি কেথায় খেতেন? তখন তো আপনি উপার্জন করেন নি।
বাবা মারা যাওয়ার সময় মাকে বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকায় মা আমাকে লেখাপড়া করিয়ে যা ছিল, তা দিয়ে একবেলা এক সন্ধ্যে খেয়ে দিন কাটিয়েছেন। তা ছাড়া উনি বছরের বেশিরভাগ দিন রোযা রাখেন। অন্যের জিনিস কেন খান নি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, বললেন কে কিভাবে আয় করছে জানি না। যদি সুদ, ঘুষ খেয়ে অথবা অন্য কোনো অসৎ উপায়ে আয় করে, তা হলে তাদের দেয়া খাবার খেলে কোনো ইবাদৎ আল্লাহ কবুল করবেন না। ইবাদত কবুল হওয়ার প্রধান শর্ত হল, হালাল রুজী ও সত্য কথা বলা।
স্বাতি বললেন, আপনার মায়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে, উনি খুব পুণ্যবতী মহিলা। ওনাকে দেখাও পুণ্যের কাজ। খুব শিঘ্রী আমরা ওনাকে দেখতে যাব।
গেলে খুব খুশী হব। অনেকক্ষণ এসেছি, এবার আসি বলে আমজাদ তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এল।
.
৭.
এক বছরের মধ্যে আমজাদ আসিফ সাহেবের কনস্ট্রাকশান ফার্ম ও অন্যান্য ব্যবসার চরম উন্নতি করেছে। সেই সঙ্গে আনান ও তার ভালবাসা গভীর থেকে আরো গভীরতর হয়েছে।
এর মধ্যে একদিন আসিফ সাহেবের বন্ধুর ছেলে আমের ফোন করে জানাল, কয়েকদিনের মধ্যে ফিরছে।
রাতে খাওয়ার টেবিলে আসিফ সাহেব আমেরের পরিচয় ও ফেরার কথা দু’মেয়েকে জানিয়ে বললেন, তার সঙ্গে আনানের ছোটবেলা থেকে বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে। খুব ইচ্ছা ছিল, আমের আসার আগে রুমালীর বিয়ে দেয়ার। জানি না, আল্লাহ আমার সে আশা পূরণ করবেন কিনা। আমের আসার পর যদি বিয়ের কথা তুলে, দেরি করতে পারব না। কারণ বিলে যাওয়ার সময় তার সঙ্গে কথা ছিল, ফিরে আসার পরপর বিয়ে হবে।
বাবার কথা শুনে আনান চমকে উঠল। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। খাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
রুমালী ব্যাপারটা লক্ষ্য করে খুব আতঙ্কিত হল। মুখ নিচু করে খেতে শুরু করল।
আসিফ সাহেব আনানকে আমজাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে দেখেছেন। তাই কথাটা বলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন কোনো পরিবর্তন হয় কিনা জানার জন্য। তার অবস্থা দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে না বোঝার ভান করে বললেন, টিকিট এখনো ওকে হয় নি। হলে কবে আসবে ফোন করে জানাবে।
আনান দু’এক লোকমা খেয়েছিল। আর খেতে পারল না। উঠে টলতে টলতে চলে গেল।
রুমালী জানত আনান আমজাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে বেড়াতে যায়। তাদের গভীর সম্পর্কের কথা জানত না। এখন তার অবস্থা দেখে ও তাকে না খেয়ে ঐভাবে চলে যেতে দেখে বাবাকে বলল, আমেরের আসার কথা শুনে আনানের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছ? ও বোধ হয় তাকে বিয়ে করতে রাজি নয়।
আনানের পরিবর্তন দেখে আসিফ সাহেব রেগে আছেন। রাগের সঙ্গে বললেন, তোরা দু’বোন আমাকে পাগল না করে ছাড়বি না। তারপর তিনিও আর খেলেন না। উঠে চলে গেলেন।
রুমে এসে আনানের মনে চিন্তার ঝড় বইতে লাগল। অনেক রাত পর্যন্ত কি করবে না করবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে শেষে সিদ্ধান্ত নিল, ফোনে আমজাদের সঙ্গে আলাপ না করে কাল সামনাসামনি করবে।
.
পাঁচটার সময় আমজাদ অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে আনানকে দেখে সালাম বিনিময় করে বলল, না জানিয়ে হঠাৎ এলে যে?
তুমি খুশী হও নি?
এত খুশী হয়েছি যে, তোমাকে নিয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতে ইচ্ছা করছে। তারপর জিজ্ঞেস করল, গাড়ি এনেছ?
গাড়ি নিয়ে এলে তোমার সঙ্গে আকাশে উড়ব কি করে?
আমার তো জিনেদের মতো শক্তি নেই যে, তোমাকে নিয়ে আকাশে উড়ব। এই গাড়িতেই ওঠ, যে দিকে দুচোখ যায়, সেদিকেই যাব।
গাড়ি চলতে শুরু করার পর আনান বলল, তোমার সঙ্গে খুব জরুরী আলাপ করতে এসেছি। কোনো হোটেলে চল, কিছু খাওয়াও হবে আর জরুরী আলাপও হবে।
হোটেলে গিয়ে শুধু খাব। আলাপটা গাড়িতেই সেরে নাও।
সে আলাপ গাড়িতে করা যাবে না।
আমি কিন্তু জানি, কি জরুরী আলাপ করতে এসেছ।
দুষ্টুমী করবে না।
দুষ্টুমি নয়, সত্যি বলছি।
কই, বলতে শুনি।
তুমি যখন ছোট ছিলে তখন তোমার বাবার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়। সেই ছেলে কয়েকদিনের মধ্যে বিলেত থেকে ব্যারিষ্টারী পাশ করে ফিরছে। ফেরার কিছুদিনের মধ্যে তোমাদের বিয়ে হবে। কথা শেষ করে আমজাদ তার মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে গাড়ি চালাতে লাগল।
আনান খুব অবাক হলেও তার মুখে হাসি দেখে আহত স্বরে বলল, একথা জেনেও তুমি হাসছ? আর কাল বাবার মুখে শোনার পর থেকে দুশ্চিন্তায় সারারাত ঘুমাতে পারি নি।
সেদিন তুমি আমাকে বুদ্ধ বলেছিলে মনে আছে?
মনে থাকবে না কেন? সেদিন বুন্ধুর মতো কাজ করেছিলে, তাই বলেছিলাম।
এখন কিন্তু তুমিও বুন্ধুর পরিচয় দিচ্ছ।
হেঁয়ালী না করে সাফ সাফ বল, বুন্ধুর মতো কি পরিচয় দিলাম।
তার আগে বল, আল্লাহ্ রাজি থাকলে আমরা শুধু দু’জন দুজনার, কথাটা একশ পার্সেন্ট ঠিক কিনা?
অফকোর্স।
তা হলে আমেরের কথা জানা সত্ত্বেও কেন হাসছি বুঝতে পারা তোমার উচিত ছিল। তা না করে বুন্ধুর মতো কথা বললে।
ঠিক আছে, আমি না হয় বুন্ধু। এবার ব্যাপারটা খুলে বল।
তোমার বাবা গতকাল আমার অফিসে এসে যখন আমেরের পরিচয় দিয়ে তার ফেরার কথা ও তার সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা বললেন তখন ভেটো দিলাম, ব্যাস কাজ হয়ে গেল।
আনান ভেংচি কেটে বলল, ভেটো দিলাম ব্যাস কাজ হয়ে গেল। খুলে না বললে বুঝবো কি করে?
আমজাদ হেসে উঠে বলল, ভেটো দিয়ে বললাম, “চাকরি দেয়ার সময় রুমালীর সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তখন আমি রাজি না হয়ে বলেছিলাম, আমার মনের মতো যে মেয়ের মন তেমন মেয়ে পাওয়া গেলে তাকে বিয়ে করব। নচেৎ জীবনে বিয়েই করব না। প্রায় দেড় বছর আগে গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা যাওয়ার পথে আনানকে দেখে কেন যেন মনে হয়েছিল, ওর মন আমার মনের মতো। তারপর তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে বুঝতে পারলাম আমার অনুমান সত্য। তাই ওকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই। অবশ্য সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আনানের মনের খবর নিই। সেও আমার সিদ্ধান্তকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করেছে। এখন আমেরের সঙ্গে যদি আনানের বিয়ে দেন, তা হলে আমাকে চিরকুমার থাকতে হবে। তা ছাড়া আনান আমাকে ছাড়া কিছুতেই অন্য কোনো ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হবে না। যদি আপনি জোর করে কিছু করতে চান, তা হলে সে আমার কাছে পালিয়ে আসবে। আমি যদি আপনার সম্মান রাখার জন্য ফিরিয়ে দিই, তা হলে সে হয়তো সুইসাইড করবে। এখন কি করবেন চিন্তা করে দেখুন।
আমার কথা শুনে উনি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “একদিকে আমার ওয়াদা ও মান সম্মান, আর একদিকে তোমার ও আনানের জীবন মরণ সমস্যা। কি করব ভেবে কিছু ঠিক করতে পারছি না।”
আমি বললাম, “ছেলে হিসাবে বাবাকে সাহায্য করা উচিত। তাই বলছি, ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দিন, ইনশাআল্লাহ্ সুষ্ঠু মীমাংসা করতে পারব বলে আশা করি। অবশ্য আমার উপর যদি বিশ্বাস থাকে আপনার।”
উনি আবার অনেকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “তোমার উপর বিশ্বাস আছে বলেই তোমাকে ছেলে হিসাবে গ্রহণ করেছি। তাই তোমার কথা মেনে নিলাম।”
এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ, সবকিছু জেনেও কেন তোমার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছি?
সত্যিই, তোমার কোনো তুলনা হয় না।
থাক, অত পাম দিতে হবে না। তোমার দুশ্চিন্তা দূর করতে পেরেছি এটাই আমার সৌভাগ্য।
কথাটা ঠিক বল নি।
তুমি ঠিক করে দাও।
আল্লাহ্ আমাদের দুজনের দুশ্চিন্তা দূর করে ধন্য করলেন। সে জন্যে তার পাক দরবারে শত কোটি শুকরিয়া জানান উচিত।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আমজাদ বলল, তোমার ও কোনো তুলনা হয় না।
তুমিও কিন্তু পাম দিচ্ছ?
আগে তুমি দিয়েছ, তাই আমিও দিলাম।
বাইরের দিকে তাকিয়ে আনান বলল, গাড়ি শুধু চলতেই থাকবে, থামবে? ক্ষিধে পাই নি বুঝি? কোথায় এসেছি খেয়াল করেছ?
কোথায় আবার? সাভারে। তারপর একটা হোটেলের সামনে গাড়ি পার্ক। করল।
হোটেলে নাস্তা খেয়ে ফেরার পথে আনান বলল, কিভাবে মিমাংসা করবে ভেবেছ?
রুমালী ও আমের যাতে একে অপরকে পছন্দ করে সে ব্যবস্থা করব।
প্ল্যানটা খুব ভালো; কিন্তু কাজে পরিণত করা খুব দুরূহ।
যতই দুরূহই হোক, আল্লাহ্ রাজি থাকলে পারব। তারপর তাকে কি করতে হবে বলে জিজ্ঞেস করল, কী, পারবে না?
এতো সামান্য ব্যাপার, তোমাকে পাওয়ার জন্য এর থেকে হাজার গুণ কঠিন কিছু হলেও করতাম। প্রয়োজনে জীবনের বিনিময়েও।
আমজাদ রাস্তার সাইডে গাড়ি ফুল ব্রেক করে দাঁড় করাল।
.. হঠাৎ ফুল ব্রেক করায় গাড়ি বেশ জোরে ঝাঁকুনি খেতে আনান টাল সামলাতে না পেরে আমজাদকে জড়িয়ে ধরে ভয়ার্তরে বলর, কী ব্যাপার? এভাবে গাড়ি দাঁড় করালে কেন?
আমজাদ একটু রাগের সঙ্গে বলল, তোমার জীবনের বিনিময়ে সারা দুনিয়ার রাজতুও চাই না। প্রমিস কর, “আর কখনো এরকম কথা বলবে না।”
ঠিক আছে, প্রমিস করলাম।
আমজাদ তাকে সরে বসতে বলল।
আনানের এতক্ষণ খেয়ালই নেই, তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আমজাদের কথা শুনে লজ্জায় এতটুকু হয়ে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, সরি।
আমজাদ শুধু মৃদু হাসল। কোনো কথা না বলে গাড়ি ছেড়ে দিল। তারপর একেবারে তাদের বাসায় এসে গাড়ি থামাল।
.
রুমালী ভার্সিটি থেকে ফিরে খাওয়ার পর ঘুমিয়েছিল। বিকেলে উঠে চা খাওয়ার সময় কাজের বুয়াকে জিজ্ঞেস করল, আনান কোথায়? চা খেতে এল না যে?
ছোট আপা কলেজ থেকে এখানে ফেরেন নাই।
বাবা ফিরেছে?
না, উনিও ফেরেন নাই।
রুমালী মোবাইলে আনানকে ফোন করল।
আনান ইচ্ছা করে মোবাইল বন্ধ করে বাসায় রেখে গেছে। তাই রিপ্লাই না পেয়ে রুমালী চিন্তা করল, ওর কোনো বিপদ হল নাতো? তাড়াতাড়ি বাবাকে মোবাইলে ফোন করে আনানের কথা জানাল।
আসিফ সাহেব বললেন, তুই চিন্তা করিস না। কোনো বান্ধবীর বাসায় গেছে হয়তো। মনে হয় মোবাইল সঙ্গে নিতে ভুলে গেছে। তারপর লাইন কেটে দিলেন।
রুমালী আনানের রুমে গিয়ে দেখল, মোবাইলটা টেবিলের উপর রয়েছে। কিছুটা স্বস্তি পেয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।
সন্ধ্যের পর গাড়ির শব্দ পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে এল।
ততক্ষণ আমজাদ ও আনান গাড়ি থেকে নেমে ড্রইংরুমে এসেছে।
আনানের সঙ্গে আমজাদকে দেখে রুমালী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই ওনার সঙ্গে কোথায় গিয়েছিলি? মোবাইলে ফোন করে না পেয়ে বাবার কাছেও ফোন করেছিলাম। পরে অবশ্য জানতে পারলাম তুই মোবাইল বাসায় ভুলে ফেলে গেছিস। খুব চিন্তা হচ্ছিল, কোথাও থেকে একটা ফোন করে জানাতে পারতিস। যা, বাবাকে এক্ষুনি ফোন কর।
সরি আপা, ভুল হয়ে গেছে। তবে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলে চিন্তা করতে হত না।
আবার জ্যাঠামী হচ্ছে। যা, বাবাকে ফোন কর।
আনান আমাজাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বস, বাবাকে ফোন করেই আসছি।
আনান আমাজাদকে তুমি করে বলতে শুনে রুমালী আর একবার অবাক হল। সে চলে যাওয়ার পর আমজাদকে বলল, আপনার কাছে মোবাইল রয়েছে দেখছি। আপনিও তো ওকে বাসায় একটা ফোন করতে বলতে পারতেন।
সরি, আমারও ভুল হয়েছে। আমি মনে করেছিলাম ও বাসায় জানিয়ে গেছে। তারপর বলল, বসুন না, কিছুক্ষণ আলাপ করা যাক। ওদের কথা শুনে রুমালী বুঝতে পারল, ওরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ভাবল, আমেরের কথা জেনেও আনানের কি উচিত হয়েছে ওর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া? ওদের ব্যাপারটা বাবা জেনে গেলে কি পরিস্থতি হবে না-না, আমজাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে আনানকে নিষেধ করে দিতে হবে।
ওরা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। আমজাদ বলল, কী এত ভাবছেন? নিজেও দাঁড়িয়ে থাকবেন, আর আমাকেও দাঁড় করিয়ে রাখবেন?
রুমালী যেন এতক্ষণ বাস্তবে ছিল না। আমজাদের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, না-না, তা কেন? তারপর একটা সোফায় বসে তাকেও বসতে বলল।
আমজাদ বসে বলল, মনে হচ্ছে, আমার সঙ্গে আনান বেড়াতে গিয়েছিল বলে খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন। অবশ্য হওয়ারই কথা। কয়েকদিনের মধ্যে ওর জন্য নির্বাচিত পাত্র ব্যারিস্টারী পাশ করে বিলেত থেকে ফিরছেন জেনেও আমার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া উচিত হয় নি, তাই না?
রুমালী অবাক হলেও রেগে উঠে বলল, এসব কথা আপনাকে কে বলেছে, আনান।
আনান আজ বেড়াতে গিয়ে বলেছে ঠিক, তবে গতকাল আপনার বাবা বলেছেন।
তারপরও ওকে নিয়ে আপনি বেড়াতে গেলেন?
কি করব বলুন, আমরা একে অপরকে ভীষণ ভালবাসি। ও যেমন আমাকে ছাড়া বাঁচবে না, আমিও তেমনি ওকে ছাড়া বাঁচব না। তা ছাড়া আপনার বাবার এত ঐশ্বর্যের লোভ সামলাতে পারি নি।
রুমালী রেগে লাল হয়ে বলল, আপনার মতো ছোটলোক, ইতর ও লোভীকে বাবা যে কেন অত বড় পোষ্টে চাকরি দিয়েছেন বুঝতে পারছি না।
এতটুকু শুনেই রেগে গেলেন? আনানকে প্রেমের ফাঁদে ফেলার আরো অনেক কারণ আছে, সেগুলো শুনে তা হলে কী করবেন?
রুমালী চিৎকার করে উঠল, এই মুহূর্তে বেরিয়ে যান, নচেৎ দারোয়ান ডাকতে বাধ্য হব।
আমজাদ হাসতে হাসতে বলল, এক পাল্লায় আপনাকে আর এক পাল্লায় আপনার রাগ দিয়ে ওজন করলে রাগের পাল্লা অনেক নিচে নেমে যাবে।
রুমালী এতো রেগে গেল যে, কাঁপতে লাগল। কোনো কথা বলতে পারল না।
আমজাদ মোলায়েম স্বরে বলল, আপনি আনানের আপা হিসাবে আমারও আপা। প্লীজ আপা, বেশি উত্তেজিত হবেন না। আপনি আনানের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী। রাগলে আপনাকে আরো বেশি সুন্দরী দেখায়। তাই একটু রাগাবার জন্য এসব বলেছি। এত বেশি রেগে যাবেন জানলে রাগাতাম না। তারপর উঠে তার কাছে এসে হাঁটুগেড়ে বসে দু’কান ধরে মিনতিস্বরে বলল, প্লীজ আপা, এবারের মতো মাফ করে দিন। প্রমিস করছি, আর কোনোদিন রাগাব না।
আনান বাবাকে ফোন করে নামার সময় তাদের কথাবার্তা শুনে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। এখন আমজাদের কাণ্ড দেখে মুখে ওড়না চাপা দিয়ে হাসি থামাবার চেষ্টা করল।
ঠিক এই সময়ে আসিফ সাহেব রুমে ঢুকে আমজাদকে ঐ অবস্থায় দেখে হো হো করে হেসে উঠে আমজাদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কি এমন অন্যায় করেছ যে, রুমালী তোমাকে ঐভাবে কান ধরিয়ে শাস্তি দিচ্ছে?
বাবা আসার আগেই রুমালী নিজের ভুল বুঝতে পেরে খুব লজ্জা পেয়েছে। বাবাকে হাসতে দেখে ও তার কথা শুনে সেও হাসতে হাসতে বলল, সত্যি বাবা, তুমি ও আনান ওকে ঠিকই চিনেছ, আমি চিনতে পারি নি। কিন্তু ও এত জিনিয়াস, আজ নিজেই চিনিয়ে দিল। তারপর তার দুটো হাত ধরে সোফায় বসিয়ে বলল, আপা বলে যখন ডেকেছ তখন আপার আগে ও পরের ভুল ত্রুটিগুলো মনে না রেখে মাফ …
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে আমজাদ বলল, মাই ডিয়ার আপা, সেন্টেন্সটা পুরো বললে মনে ব্যথা পাব। আসলে তুমি ভুল-ক্রটি একটুও কর নি। যাতে তুমি রেগে গিয়ে ঐসব বলে আমাকে অপমান কর, সেজন্যে তোমার সঙ্গে অভিনয় করেছি। এতএব আমি দোষী আর তুমি নির্দোষ।
তার কথা শুনে সবাই হেসে উঠল।
আনান হাসতে হাসতে সিঁড়ি থেকে নেমে এসে বলল, জানিস আপা, ও না এক এক সময় আমার সঙ্গে এমন মিথ্যে অভিনয় করে, মনে হয় হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্য।
রুমালী মিষ্টি ধমকের স্বরে বলল, তুই আবার বড়দের মাঝে এলি কেন? তোর কি লজ্জা সরম বলতে কিছু নেই। যা ভাগ।
আহা, কি আমার বড় রে, আমজাদের অভিনয় ধরতে পারলি না। তারপর আমজাদকে বলল, আমার সঙ্গে দেখা না করে যাবে না। কথা শেষ করে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল।
আসিফ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তোমরা আলাপ কর, আমি আসছি। তারপর চলে গেলেন।
সাহেব চলে যাওয়ার পর আমজাদ বলল, আমি ও আনান খুব বড় বিপদে পড়েছি। একমাত্র আপনি ছাড়া অন্য কেউ এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে না।
এই গাধা, আপা ডেকে এতক্ষণ তুমি করে বলছিলে, এখন আবার আপনি কেন?
ভুল হয়ে গেছে, মাফ করে দাও।
ঠিক আছে। তারপর বলল, তোমাদের আবার কিসের বিপদ? অভিনয় করছ তো?
না আপা, অভিনয় করছি না, সত্যি বলছি।
তা হলে বল কি বিপদ, সাধ্যমতো উদ্ধার করার চেষ্টা করব।
শুধু চেষ্টা করব বললে হবে না, প্রমিস করতে হবে।
আচ্ছা পাগল তো? বিপদের কথা না বলেই প্রমিস করতে বলছ? বিপদ যদি কঠিন হয় অথবা উদ্ধার করা আমার সাধ্যের বাইরে হয়, তা হলে তো প্রমিস করে কোনো লাভ হবে না?
বিপদটা আমাদের জন্য খুব কঠিন হলেও উদ্ধার করা তোমার পক্ষে খুবই সহজ। তাই তো প্রমিস করতে বলছি।
ঠিক আছে, প্রমিস করলাম। এবার বিপদের কথাটা বল।
আমজাদ পকেট থেকে একটা ফটো বের করে রুমালীর হাতে দিয়ে বলল, ভালো করে দেখে এই ছেলেটার সম্পর্কে কমেন্ট কর। তারপর বিপদের কথা বলব।
রুমালী অনেকক্ষণ ধরে ফটোটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলল, দারুন হ্যান্ডসাম, নিখুঁত চেহারা, নাতিদীর্ঘ পেটাই শরীর, কোথাও এতটুকু মেদ নেই, খাড়া নাক, বড় বড় চোখ, চওড়া ললাট, ললাটের নিচে ভ্রমর কালো জোড়া ভ্র। তারপর কপাল কুঁচকে বলল, নাহ, কমেন্ট করার মতো আর কিছু দেখছি না।
ছেলেটা ভালো না মন্দ কিছু বললে না যে?
ফটো দেখে ভালো না মন্দ বলা মুস্কিল। অনেক ক্ষেত্রে ফটো দেখে ভালো মনে হলেও বাস্তবে কেউ বদরাগী, কেউ খুঁতখুতে, কেউ লোভী, আবার কেউ হিংসুটে ও চরিত্রহীন হয়।
তোমার কথা অবশ্য ঠিক, তবে যার মধ্যে ঐসব বদগুণ থাকে, তাদের চেহারার মধ্যে কিছু না কিছু লক্ষণ থাকে। সে রকম কিছু আছে কিনা আর একবার ফটোটা ভালো করে দেখ।
আর দেখা লাগবে না, ভালো করেই দেখেছি। সেরকম কিছু আমার নজরে পড়ে নি। ছেলেটা কে বল তো?
ওর নাম আমের। রুমালী আমেরকে কখনো দেখে নি। এমন কি কয়েকদিন আগে বাবার কাছে না শুনলে ঐ নামও কখনো শুনে নি। তাই ভাবল, এ হয়তো অন্য আমের। জিজ্ঞেস করল, তোমার আত্মীয়?
না।
পরিচিত কেউ
না।
তা হলে তার ফটো তোমার কাছে কেন? আর কেনই বা আমাকে দেখিয়ে কমেন্ট করালে।
বলব, সবই বলব। তার আগে বল, ছেলেটা পছন্দ করার মতো কি না?
হ্যাঁ, যে কোনো মেয়ে দেখলেই পছন্দ করবে।
তা হলে তোমারও পছন্দ। ফজলামী করবে না।
আপার সঙ্গে কেউ ফাজলামী করে? কথার পিঠে কথা আসে। তাই জিজ্ঞেস করেছি। বল না তোমার পছন্দ কিনা?
আবার ফাজলামী? কান মলে দেব কিন্তু?
আমজাদ মাথাটা তার দিকে ঝুঁকিয়ে বলল, আগে পছন্দ হয়েছে কিনা বলে তারপর না হয় কান মলে দিও।
রুমালী হাসতে হাসতে বলল, আপা হয়ে ছোট ভাইয়ের কাছে কেউ মুখে একথা বলে? তুমি এত জিনিয়াস হয়েও বুঝতে পারছ না কেন?
আমজাদ মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, অসংখ্য ধন্যবাদ। এবার বিপদের কথা বলছি শোন, এই আমের আমার ও আনানের মাঝখানে। দাঁড়িয়ে আমাদের বিচ্ছেদ ঘটাতে যাচ্ছে। তুমি ওকে সরিয়ে নিলেই আমাদের বিপদ কেটে যাবে।
রুমালী রেগে উঠে বলল, এই কথাটা বলার জন্য এত ভূমিকার দরকার ছিল না। শোন, তোমার ও আনানের মাঝখানে আমের দাঁড়াই নি, বরং আমের ও আনানের মাঝখানে তুমি দাঁড়িয়েছ।
তোমার কথা অবশ্য ঠিক। তবে কি জান আপা, কয়েকদিন আগে পর্যন্ত আমি বা আনান কেউ-ই আমেরের কাথা জানতাম না। আমরা তো অনেক আগেই একে অপরের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছি। তাই তুমি যদি আমেরকে কাছে টেনে না নাও, তা হলে আমাদের কি পরিণতি হবে ভেবে দেখ। আমি তকদীরের কথা ভেবে হয়তো সবর করে চিরকুমার থাকতে পারব; কিন্তু আনান কি পারবে? সে হয়তো কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। বড় বোন হয়ে ছোট বোনের জন্য কিছু করা কি তোমার উচিত নয়? সমাজে এমন অনেক ঘটনা দেখা যায়, বড় বোনের সঙ্গে যে ছেলের প্রেম হয়েছে, সেই ছেলেকে ছোট বোন ভালবেসেছে জেনে বড় বোন ছোট বোনকে সুখী করার জন্য নিজের প্রেম বিসর্জন দিয়ে তার প্রেমিকের সঙ্গে ছোট বোনের বিয়ে দিয়েছে। এটা ঠিক সেরকম কেস না হলেও ছোট বোনকে সুখী করার জন্য তুমি এতটুকু করবে না? আমের সব দিক দিয়ে তোমার উপযুক্ত। তা ছাড়া তুমি নিজেই স্বীকার করেছ তাকে তোমার পছন্দ। আর তুমি ওনার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী। তোমার কাছ থেকে একটু ঈশারা পেলে উনি বিনাবাক্যে হুমড়ি খেয়ে তোমার পায়ে এসে পড়বেন।
আমজাদের শেষের কথা শুনে ও বলার ভঙ্গি দেখে রুমালী হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল, সে যদি আনানকেই বিয়ে করতে চায়?
আনানকে তিনি কখনো দেখেন নি, পরিচয়ও হয় নি। আর আসার পর তোমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে পর্যন্ত আনান ওনার সঙ্গে ফেস করবে না। আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর, তুমি যদি ওনাকে কাছে টানার অগ্রভূমিকা নাও, তা হলে ভুলেও আনানের খোঁজ করবেন না।
তুমি শুধু জিনিয়াস নও, ভীষণ তাঁদোড় ও ফাজিলের গাছ। মানুষকে কনভেন্স করার ক্ষমতাও তোমার অসাধারণ। কিন্তু একথা ভুলে যাচ্ছ কেন, আমের জানে আনান তার বাগদত্তা। তিনি যদি ভালো ছেলে হন, তা হলে আমি যতই সুন্দরী হই না কেন আনানকে বাদ দিয়ে বিনাবাক্যে আমার পায়ে হুমড়ী খেয়ে পড়বেন না। আর যদি মন্দ ছেলে হন, তা হলে সম্পত্তির লোভে হয়তো পড়তে পাড়েন।
আমেরের ফটো দেখে ও সাহেবের মুখে ওনার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়েছে এরকম ছেলে লাখে একটা আছে কিনা সন্দেহ।
আর তিনি যদি আমাকে পছন্দ না করেন?
তোমাকে পছন্দ করবে না মানে? একশবার করবে, হাজারবার করবে। তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে লাখে নয়, কোটিতেও আছে কিনা সন্দেহ।
রুমালী হাসতে হাসতে বলল, থাক, অত আর পাম দিতে হবে না। সব পাম। আমাকে দিলে আনানকে কি দেবে?
ওকে পাম দেয়া লাগে না। পাম ছাড়াই দেড় বছর আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এখন কিনারে ওঠার জন্য বিয়ের প্রহর গুনছে।
সত্যিই তুমি ত্যাদোড় ও ফাজিলের গাছ। তা না হলে প্রেমিকার বড় বোনের সঙ্গে কেউ এভাবে ফাজলামী করতে পারে?
আগে আমি এরকম ছিলাম না, আনানের প্রেমে পড়ে হয়েছি। এবার তা হলে নিশ্চিত হতে পারি, আমেরকে তুমি আমাদের মাঝখান থেকে কাছে টেনে নিচ্ছ
রুমালী হেসে ফেলে বলল, এক্ষুনি সে কথা বলতে পারব না, ভেবে চিন্তে বলতে হবে।
আমজাদ কিছু বলতে যাচ্ছিল, আসিফ সাহেব ও আনানকে পাশাপাশি নামতে দেখে থেমে গেল। নেমে আসার পর দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আমার মিশন সাকসেসফুল। আমের যেদিন আসবে। সেদিন শুধু রুমালী আপা একা রিসিভ করার জন্য এয়ারপোর্টে যাবে।
আসিফ সাহেব আমজাদের দুটো হাত ধরে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, কগ্র্যাচুলেশন মাই সান। তুমি আমাকে অনেক বড় দুশ্চিন্তার হাত থেকে রক্ষা করেছ। বল, তুমি কি চাও! যা যাইবে তাই দেব।
কথাটা ফিরিয়ে নিন, যা পারবেন না, তা বলা উচিত নয়।
কি বলছ তুমি? আমাকে চিনতে তা হলে ভুল করেছ। একবার বলেই দেখ না, দিতে পারি কিনা।
তা হলে ওয়াদা করুন।
ওয়াদা করলাম, যা চাইবে তাই দেব।
আমি গরিবের ছেলে। মা আমাকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন। বিত্ত বৈভব কি জিনিস জানি না। তাই আপনার ঐশ্বর্যের লোভে প্রেমের ফাঁদে ফেলে আনানকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। এখন আপনি যখন যা চাইব তাই দেবেন বলেছেন তখন আর আনানকে বিয়ে করব না। আপনার সমস্ত সম্পত্তি আমার নামে দলিল করে দিন।
আসিফ সাহেব উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললেন, মাই চাইল্ড, মনে রেখ, যে লোক বাংলাদেশের শুধু শ্রেষ্ঠ ধনীদের একজন নয়, শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ীদেরও একজন, তার মনটাও সেইরকম শ্রেষ্ঠ। কালই সবকিছু তোমার নামে দলিল করে দেব।
আজ পর্যন্ত কারো কাছে আমি হার স্বীকার করি নি। আজ আপনার কাছে হেরে গেলাম। এই কথা বলে আমজাদ ওনার দু’পা জড়িয়ে ধরে বলল, মায়ের পেটে থাকতে বাবা মারা গেছেন। তাই বাবা কি জিনিস জানি না, বাবার স্নেহ আদর-ভালবাসা কি জিনিস জানি না। যে দিন আপনার মরহুমা স্ত্রীর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেদিনই আপনাকে চিনেছি। সেই থেকে বাবার স্নেহ-মায়া মমতা পাচ্ছি। স্বল্প জ্ঞানের কারণে আপনাকে পরীক্ষা করে অনেক বড় অন্যায়। করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিন বাবা।
আসিফ সাহেব তাকে বুকে জড়িয়ে ভিজে গলায় বললেন, আমার ছেলে বেঁচে থাকলে আমাকে কতটা ভক্তি শ্রদ্ধা করত জানি না; কিন্তু তোমার কাছ থেকে যা পেয়েছি তার তুলনা হয় না।
আমজাদের অভিনয় আনান ধরতে পারলেও রুমালী পারে নি। তাই খুব রেগে গিয়ে মনে মনে যা তা বলে গালাগালি করেছে। এখন তার কথা শুনে ভীষণ অনুতপ্ত হয়ে ভাবল, আনান খুব ভাগ্যবতী। তাই ওর মতো ছেলেকে পেয়েছে। বাবা থেমে যেতে মেকী রাগের সঙ্গে বলল, তুমি ওকে ক্ষমা করো না বাবা। কিছুক্ষণ আগে আমার সঙ্গে অভিনয় করে আমাকেও রাগিয়ে দিয়েছিল। এখন আবার অভিনয় করে তোমাকেও রাগাতে চেয়েছিল। ও একটা তাঁদোড় ছেলে। ক্ষমা করলে বারবার তাঁদড়ামী করে সবাইকে ভোগাবে।
রুমালী থেমে যেতে আনান বলল, হ্যাঁ বাবা, আপা ঠিক কথা বলেছে। আমার সঙ্গে ও মাঝে মাঝে তাঁদড়ামী করে। ওকে তুমি ক্ষমা করো না।
আনন্দে আসিফ সাহেবের চোখ থেকে পানি পড়ছিল। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে কান্নামুখে হাসি ফুটিয়ে প্রথমে রুমালীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুইও কি কম তাঁদোড়? এত করে বললাম আমাজদকে পছন্দ কর, কিছুতেই করলি না। তারপর আনানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুইও কম ত্যাদোড় না, আমেরের সঙ্গে তোর বিয়ে ঠিক করা আছে জানার পরও আমাজদকে বিয়ে করতে চাস। তারপর তাদের তিনজকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ছেলেমেয়েদের ভুল-ত্রুটি বাবা ক্ষমা করবে না তো কে করবে? তারা ক্ষমা করে, ছেলেমেয়েদের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করার জন্য। তাই তোদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম ভবিষ্যতে যেন তাঁদড়ামী আর না করিস।
Leave a Reply