মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ – আহমদ শরীফ
ভূমিকা –মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ
বাঙলাদেশে সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগৎ-এর প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে সম্ভবত ড. আহমদ শরীফ-ই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সকলের কাছে প্রিয় হওয়ার দূর্বলতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছিলেন। পণ্ডিত ও বয়স্ক বিদ্রোহী ড. আহমদ শরীফ চট্টগ্রামের পটিয়ার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২১ সনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সনে ঢাকায় প্ৰয়াত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সনে বাঙলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও ১৯৬৭ সনে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। কলেজে অধ্যাপনার (১৯৪৫-৪৯) মধ্য দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু। পরে এক বছরের কিছু বেশি সময় তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে অনুষ্ঠান সহকারী হিসেবে থাকার পর ১৯৫০-এর শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগে যোগ দিয়ে একটানা ৩৪ বছর অধ্যাপনা করে ১৯৮৩ সনে অধ্যাপক হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে তিনি বাঙলা বিভাগের চেয়ারম্যানসহ সিন্ডিকেট সদস্য, সিনেট সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি, শিক্ষকদের ক্লাবের সভাপতি ও কলা অনুষদের চারবার নির্বাচিত ডিন ছিলেন। সেই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অন্যতম রূপকার ছিলেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের প্রথম “কাজী নজরুল ইসলাম অধ্যাপক” পদে ১৯৮৪-১৯৮৬ পর্যন্ত নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
দেশ-কাল সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রথাগত সংস্কার পরিবর্তনের লক্ষ্যে সবসময় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তিসহ সমাজতন্ত্রের প্রতি ছিল তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ। ভাববাদ, মানবতাবাদ ও মার্কসবাদের যৌগিক সমম্বয় প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর চিন্তা চেতনা, ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণে, বক্তব্যে ও লেখনীতে। তাঁর রচিত একশতের অধিক গ্রন্থের প্রবন্ধে তিনি অত্যন্ত জোরালো যুক্তি দিয়ে পরিত্যাগ করেছিলেন প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, বিশ্বাস ও সংস্কার এবং আন্তরিকভাবে আশা পোষণ করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য। পঞ্চাশ দশক থেকে নব্বই দশকের শেষ অবধি সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাসসহ প্ৰায় সব বিষয়ে তিনি অজস্র লিখেছেন। দ্রোহী সমাজ পরিবর্তনকামীদের কাছে তার পুস্তকরাশির জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়, তাঁর রচিত পুস্তকরাশির মধ্যে বিচিত চিন্তা, স্বদেশ অম্বেষা, বাঙলার সুফি-সাহিত্য, বাঙালির চিন্তা-চেতনার বিবর্তন ধারা, বাঙলার বিপ্লবী পটভূমি, এ শতকে আমাদের জীবনধারার রূপরেখা নির্বাচিত প্ৰবন্ধ. প্ৰত্যয় ও প্রত্যাশা এবং বিশেষ করে। দুখণ্ডে রচিত ‘বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য” তাঁর অসামান্য কীর্তি। তবে একথা নির্দিধায় বলা যায় যে, পিতৃব্য, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ-এর অনুপ্রেরণায় মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কে পাহাড়সম গবেষণা কর্ম তাঁকে কিংবদন্তী পণ্ডিতে পরিণত করেছে। উভয় বঙ্গে এ বিষয়ে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং অদ্যাবদি স্থানটি শূন্য রয়ে গেছে। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করে তিনি মধ্যযুগের সামাজিক ইতিহাস রচনা করেছিলেন। বিশ্লেষাণাত্মক তথ্য-তত্ত্ব ও যুক্তি সমৃদ্ধ দীর্ঘ ভূমিকার মাধ্যমে তিনি মধ্যযুগের সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাস বাঙলা ভাষা-ভাষী মানুষকে দিয়ে গেছেন, যা বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমর গাথা হয়ে থাকবে। তিনি জীবৎকালে বেশ কিছু পুরস্কার লাভ করেছিলেন, তার মধ্যে রাষ্ট্ৰীয় পুরস্কার একুশে পদকসহ পশ্চিম বঙ্গের রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “সম্মান সূচক ডিলিট” ডিগ্রি পেয়েছিলেন।
মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার প্রাগ্রসর ড. আহমদ শরীফ পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ (১৯৫২), লেখক সংগ্রাম শিবির (১৯৭১), বাঙলাদেশ লেখক শিবির (১৯৭২), স্বদেশ চিন্তা সংঘ (১৯৮৩), সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী নাগরিক কমিটি (১৯৮১), মুক্তিযুদ্ধচেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি (১৯৯২), সমাজতান্ত্ৰিক বুদ্ধিজীবী সংঘ (১৯৯৯) সহ অন্যান্য প্রগতিশীল সংগঠনের সাথে জড়িত থাকাসহ উভয়বঙ্গে বহুবার সংবর্ধিত হয়েছিলেন।
তাঁর বিশাল পুস্তকরাশির মধ্যে যেমন মানুষের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মুক্তির কথা রয়েছে তেমনি তৎকালীন পাকিস্তানের বেড়াজাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান-এর নেতৃত্বে ১৯৬২ সনে গঠিত “নিউক্লিয়াস”-এর সাথেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ১৯৬৫ সনে রচিত “ইতিহাসের ধারায় বাঙালী” প্রবন্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে “বাঙলাদেশ” এবং “আমার সোনার বাঙলা, আমি তোমায় ভালবাসি” গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন। এছাড়া বাঙলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব সময় থেকে তাঁর মৃত্যু অবধি তিনি দেশের সব ক্ৰান্তিলগ্নে কখনো এককভাবে, কখনো সম্মিলিতভাবে তা প্রশমনের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন।
উপমহাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অসামান্য পণ্ডিত, বিদ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক, যুক্তিবাদী, দার্শনিক, বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, মুক্তবুদ্ধির ও নির্মোহ চিন্তার ধারক ড. আহমদ শরীফকে ধর্মান্ধিরা শাস্ত্র ও প্রথা বিরোধিতার কারণে “মুরতাদ” আখ্যায়িত করেছিলেন। কথা ও কর্মে অবিচল, আটল, দৃঢ় মলোভাবের নাস্তিক সবরকমের প্রথাসংস্কার শৃঙ্খল ছিন্ন করে ১৯৯৫ সনে লিপিবদ্ধ করা “অসিয়তনামা”-র মাধ্যমে মরণোত্তর চক্ষু ও দেহদান করে গেছেন। অসিয়তনামায় উল্লেখ ছিল “চক্ষু শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্ৰাণ প্রতীক। কাজেই গোটা অঙ্গ কবরের কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাই তো বাঞ্চনীয়।”
পরিশেষে বলতে হয় যে, বর্তমান গ্রন্থটি ১৯৭৭ সনে প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথম সংস্করণ বহু বছর পূর্বেই নিঃশেষ হয়ে যায়। আগ্রহী পাঠকদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ও সর্বপরি বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে বর্তমান সংস্করণটি প্রকাশ করা হল। পূর্বের ন্যায় বর্তমান সংস্করণটিও নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস ও সাহিত্যের উৎসুক পাঠকদের মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির স্বরূপ সন্ধানের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশা করছি।
বর্তমান সংস্করণটি প্রকাশ করার ব্যাপারে। জনাব মাহমুদ করিম-এর উৎসাহ, এডভোকেট যাহেদ করিম স্বপন-এর উৎসাহ ও সহযোগিতা এবং সময় প্ৰকাশন-এর জনাব ফরিদ আহমেদএর একান্ত আগ্রহের জন্য গ্রন্থটি পাঠকদের কাছে পৌছাতে পেরেছে। তাদের সবাইর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
নেহাল করিম
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
১৮ অক্টোবর, ২০০০
Leave a Reply