মতি নন্দী : ব্যক্তি ও সাহিত্য
একটা সিনেমা পত্রিকার পক্ষ থেকে একবার একটি উপন্যাস প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা হয়েছিল। অনেক রচনার মধ্যে যে তিনটি প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান পায়, সেই তিনটিরই লেখক পরবর্তীকালে বিখ্যাত হয়েছিলেন। প্রথম স্থান মতি নন্দীর, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে পূর্ণেন্দু পত্রী ও অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়।
উপন্যাসের লেখক হিসেবে মতি নন্দী পুরস্কৃত হলেও এর পরে বেশ কয়েক বছর তিনি ছোট গল্পের লেখক হিসেবেই বেশি সার্থক ছিলেন। এক একটা গল্প যেন এক একটি উজ্জ্বল রত্নের মতন। এখানে আমরা সেসব রচনার আলোচনার মধ্যে যাবো না। শুধু তার ছোটদের লেখাগুলি নিয়েই কিছু কথা বলবো।
সব লেখকই ছোটদের জন্য লিখতে পারেন না। অনেক মহান লেখকও ছোটদের জন্য কলম ধরেন নি। যেমন, বঙ্কিমচন্দ্র। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন যৎসামান্য। আবার রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন অজস্র। এবং সুকুমার রায়ের মতন এক অসাধারণ লেখক তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে অধিকাংশই লেখাই লিখেছেন শুধু ছোটদের জন্য, যেগুলি বাংলা সাহিত্যের চিরকালের সম্পদ। কেন কোনও কোনও লেখক ছোটদের জন্য লিখতে চান না, কেন কেউ কেউ শুধু ছোটদের জন্য লেখাতেই মন ঢেলে দেন, আবার কেন কোনও কোনও লেখক ছোটদের এবং বড়দের জন্য সমানভাবে লেখেন, তা ব্যাখ্যা করে বোঝানো খুব শক্ত। হয়তো কোনও কোনও লেখকের মানসিক গড়নই এমন থাকে, যা ছোটদের রচনার ঠিক উপযোগী নয়। যেমন, বঙ্কিমচন্দ্র খুব কড়া ধাতের মানুষ ছিলেন, বোধহয় ছোটদের নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতেন না। মতি নন্দীকেও আপাতদৃষ্টিতে সেই ধরনেরই মানুষ মনে হয়।
অনেকেরই ধারণা, মতি নন্দী খুব শক্ত ধরনের মানুষ এবং দুর্মুখ। লোকের মুখের ওপর শক্ত কথা শুনিয়ে দিতে তিনি দ্বিধা করতেন না। তিনি মিথ্যে কথা আর ন্যাকামি একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। সময়রক্ষার ব্যাপারে তিনি নিজে ছিলেন যেমন কঠোর, অপরের কাছ থেকেও তেমনই আশা করতেন। একদিনের ঘটনা মনে আছে। এক পত্রিকার সম্পাদক তাঁর কাছ থেকে একটি লেখা চেয়েছিলেন। সেই শনিবার সন্ধ্যে আটটার সময় এসে তাঁর সেই লেখাটি সংগ্রহ করে নেওয়ার কথা। মতি গল্পটি লিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় বসে অপেক্ষা করছেন। আটটা, সোয়া আটটা, সাড়ে আটটা বেজে গেল, সম্পাদকের দেখা নেই। আটটা বেজে চল্লিশের সময় মতি আর আমি দু’জনেই অফিস থেকে বেরুচ্ছি, এমন সময় সেই সম্পাদক হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উপস্থিত। ট্র্যাফিক জ্যাম বা এই ধরনের কোনও কারণে তাঁর দেরি হলো, তিনি সেটা বোঝাবার চেষ্টা করতে গেলেও মতি নন্দী তা শুনতেই চাইলেন না। ক্রোধে আগুন হয়ে তিনি বললেন, এতক্ষণ বসিয়ে রেখে আপনি আমাকে অপমান করেছেন, আপনাকে আমি লেখা তো দেবই না, আর কোনওদিন আমার সামনে আসবেন না। ভদ্রলোক তবু কাকুতি মিনতি করে বলতে চাইলেন যে তিনি সঙ্গে টাকাও নিয়ে এসেছেন। তাতে আরও জ্বলে উঠে মতি বললেন, আপনার টাকায় আমি থুতু ফেলি, আপনাকে আমি এ লেখা তো দেবই না, বরং এটা আপনার সামনেই আমি ছিঁড়ে ফেলবো। মতি নন্দী সত্যি সত্যি লেখাটা ছিঁড়ে ফেলতে উদ্যত হলেও আমি কোনওক্রমে বাধা দিয়ে সেটা রক্ষা করতে সক্ষম হই। কিন্তু মতি সেই সম্পাদককে আর কোনওদিনও কোনও লেখা দেন নি।
এই রকম ব্যবহারের জন্য অনেক সম্পাদকের সঙ্গেই মতি নন্দীর সম্পর্ক ভালো ছিল না। অনেক লেখক বা বন্ধুর সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হয়ে যেত। ‘দেশ’ পত্রিকার গল্প বিভাগ দেখতেন তখন প্রখ্যাত লেখক বিমল কর। তাঁর সঙ্গেও মতি নন্দীর মনোমালিন্য হয়েছিল। এবং সেজন্য প্রায় আঠারো বছর তিনি দেশ পত্রিকায় একটি লেখাও দেননি। বিমল কর মহাশয় অবসর নেওয়ার পর কিছুদিন গল্প বিভাগটি দেখার ভার পড়ে আমার ওপর। তখন আমার সনির্বন্ধ অনুরোধে মতি নন্দী অত বছর পর আবার দেশ পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন।
আমার সঙ্গে, সুদীর্ঘ জীবনে মতি নন্দীর একদিনের জন্যও মন কষাকষি হয়নি। কখনও একটুও সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। কেন? এটা খুব আশ্চর্যের না? কারণটা সম্ভবত এই যে, মতি নন্দীর কথা ও ব্যবহারে যে কঠিন আবরণ, তার আড়ালে যে একটা খুব নরম ও সংবেদনশীল মন আছে, সেটা আমি জেনে ফেলেছিলাম। উত্তর জীবনে, অনেকদিন দেখা হোক বা না হোক, তবু আমরা ছিলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এবং অনেকের ধারণা, অনেক গল্প—উপন্যাস যেমন কবিতা—টবিতা পড়েন না, মতি নন্দীর মতন কাঠখোট্টা মানুষও কবিতার ধার ধারেন না। কিন্তু সেটা ভুল। আমি জানতাম, নিজে কবিতা না লিখলেও মতি মন দিয়ে পড়তেন একালের অনেকের কবিতা, এমনকি কিছু কিছু কবিতা তাঁর মুখস্থও ছিল। সেই জন্য, আমি আমার কোনও গল্প উপন্যাসের বদলে কাব্য সংগ্রহের দ্বিতীয় খণ্ড উৎসর্গ করেছিলাম মতি আর তাঁর স্ত্রী নিতি নন্দীর নামে।
মতির মনের সেই নরম দিকটিই তাঁকে ছোটদের জন্য লিখিয়েছে। অনেক মানুষ তাদের শৈশব বা কৈশোরের দিনগুলির কথা হুবহু মনে রেখে দেয়, আবার অনেকে ভুলেও যায় বা ভুলতেই চায়। যারা মনে রাখে, তারাই ছোটদের জন্য সার্থক কিছু সৃষ্টি করতে পারে। মতির বড়দের লেখায় খুন, আত্মহত্যা কিংবা হিংসার কথা বড় বেশি দেখা যায়। কিন্তু তাঁর কিশোর সাহিত্যে এসবের কিছুমাত্র চিহ্ন নেই। রয়েছে দরিদ্র, অসহায় ছেলেমেয়েদের জীবনে উন্নতি করার জেদ, তাদের প্রতি রয়েছে লেখকের অসীম মমতা।
মতি নন্দী বাংলা তথা ভারতের খেলার জগতকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতেন। সেইসব কাহিনি নিয়ে লিখেছেন এবং সেইসব রচনাকে সত্যিকারের সাহিত্যমূল্য দিতে পেরেছেন। আমার মনে আছে, ‘স্ট্রাইকার’ উপন্যাসটি পড়ে আমি খুব কেঁদেছিলাম, ‘কোনি’ পড়েও চোখের জল ফেলেছি, তা আনন্দের অশ্রু। কারণ, মতি এই গল্পের ছেলেমেয়েদের শেষপর্যন্ত হারতে দেননি, তাদের জিতিয়ে দিয়েছেন। ছোটদের রচনায় মতি নন্দী অত্যন্ত সহৃদয় একজন মানুষ। কোথাও বিন্দুমাত্র তিক্ততা নেই, আছে আশার উদ্দীপনা। তাঁর অন্যান্য অনেক ছোটদের রচনা পড়েই আমার চক্ষু সজল হয়ে এসেছে।
বড়দের রচনার জন্যও মতি নন্দী একালের একজন অগ্রগণ্য লেখক। আর ছোটদের রচনাতেও সেই লেখকই সার্থক হতে পারেন, যাঁর লেখা ছোটদের সঙ্গে বড়োরাও সমান আগ্রহ নিয়ে পড়ে। যেমন, সুকুমার রায় তো আর শুধু শিশুপাঠ্য নয়, সর্বজনপাঠ্য। আনন্দমেলায় প্রতি বছর আমি মতি নন্দীর উপন্যাসই প্রথম পড়েছি। শেষ কয়েক বছরে তাঁর লেখা না পেয়ে আমি হতাশ হয়েছি। খেলার জগৎ নিয়ে এমন সার্থক রচনা মতি নন্দীর আগে বাংলা ভাষায় আর কেউ লিখতে পারেননি। এবং এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
Leave a Reply