মতি নন্দী উপন্যাস সমগ্র ৩য় খণ্ড
মতি নন্দী উপন্যাস সমগ্র ৩য় খণ্ড
.
ভালো লেখা, না তার ভান?
ষোল বছর আগে (১৯৭৮ সালে) ষাটের দশকে উঠে আসা বাইশজন লেখকের প্রতিনিধিত্বমূলক গল্প সংকলন গ্রন্থের আলোচনা করেছিলাম একটি লিটল ম্যাগাজিনে। ওই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত একজন লেখেন, তিনি ‘বিশ্বাস করেন পূর্বসূরি লেখকদের সঙ্গে ষাটের দশকের লেখকদের কোনোরকম বিষয় ও বোধগত মিল নেই।’
তখন আমি লিখেছিলাম কুড়ি বছর আগে (অর্থাৎ ১৯৫৭ নাগাদ, যে সময় থেকে আমি লেখা শুরু করি) বাংলা গল্পে যে বিষয় ও বোধসমূহ প্রকাশিত হয়েছে এই সংকলনের গল্পগুলিতে প্রায় সেই জিনিসই পাচ্ছি। লিখেছিলাম : ‘জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বা বিমল করকে সরিয়ে রেখেই বলা যায়, দীপেন, সন্দীপন, দেবেশ, দিব্যেন্দু, সুনীল বা শ্যামল এমনকি তখনকার শীর্ষেন্দুও যে বিষয় ও বোধ নিয়ে গল্প লিখেছিল, তার থেকে ষাটের দশকের লেখকরা নতুন কোনো জমিতে পা দেননি, শুধুমাত্র চেহারার আদলে কিছু রকমফের হওয়া ছাড়া। নতুন সংজ্ঞা, ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধির নতুন প্রণালী বা রূপকের নতুন বিস্তার যে বাস্তবতার জমি থেকে উৎপন্ন হয় তা ‘পূর্বসূরিদের’ আমল থেকে এমন কিছু বদলায়নি যাতে ‘কোনোরকম’ শব্দটি গ্রাহ্য হতে পারে। ইতিহাসের যে চাপ গত দশ বছর (১৯৬৭—৭৭) এই রাজ্যটি সহ্য করেছে তার থেকেও শ্বাসরোধকারী উত্তপ্ত, দিশাহারা করে দেওয়ার মতো চাপ চল্লিশের দশকে সহ্য করেছে এই বাংলা। উপরিভাগে কিছু রূপান্তর ঘটলেও ষাটের দশকে যা প্রবাহিত হয়ে এসেছিল তা চল্লিশেরই জোয়ার থেকে। আমাদের সামাজিক বনিয়াদে মৌল কোনো রূপান্তর ঘটেনি। যেসব বহিঃশক্তির সমাবেশের প্রভাবে আমাদের জগৎকে ঘিরে বাস্তবতা ও ভাবাবেগ তৈরি হয় তাতে এমন কোনো বিস্ফোরণ ঘটেনি যাতে পূর্বসূরি ও ষাটের দশক, এই দুই আমলের মানসিকতার মধ্যে ফাটল ধরিয়েছে মনে করতে হবে। এখন ভারতে শতকরা ৮০ জন দিনযাপন করেন ভূমির ওপর নির্ভর করে। পূর্বসূরি লেখকদের মতো ষাটের দশকের এঁরাও কৃষিপ্রধান সামাজিক আবহাওয়াতেই লালিত। ঔপনিবেশিক মানসিকতার জের এখনও টেনে চলেছে এই সমাজ। এই সমাজের শৃঙ্খলারক্ষার প্রধান খুঁটি হলো ধর্ম ও বুর্জোয়া নীতিবোধ। ভবিতব্যে নির্ভরশীলতা, অনুসন্ধিৎসায় অনিচ্ছা, প্রথানুসরণের ইচ্ছা, অ্যাডভেঞ্চারে স্বতঃস্ফূর্ত তাগিদের অভাব এবং নির্লিপ্ত অর্থাৎ স্থাণু ও জড়চেতনার অনুকূল প্রতিটি উপাদান আমাদের ব্যক্তি ও সমাজজীবনে অটুট হয়ে রয়েছে। কংগ্রেসের বা নেহরুদের বিকল্প কিছুর চিন্তা সত্তর দশকের অর্ধেক অতিক্রান্ত হওয়ার পর তবেই আমাদের মাথায় এসেছে। শরৎচন্দ্র, যাত্রাপালা বা ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ প্রভৃতি কৃষিনির্ভর আবহাওয়ায় যে সব ব্যাপারের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ এখনও তা আমাদের উৎসবের কারণ।’
লেখাটির ষোল বছর পর উপরোক্ত পর্যবেক্ষণ থেকে এখনও আমি এক পা—ও পিছিয়ে আসতে রাজি নই। পশ্চিমবাংলার সমাজ—বাস্তব পঁয়ত্রিশ বছর আগে যেখানে ছিল এখন অবশ্য আর সেখানে নেই। এখন তার সঙ্গে বর্ধিত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলির পৃষ্ঠপোষকতা— স্থূল অনুভূতি, আগ্রাসী পেশিশক্তি, কাপট্য, ভান, নির্বুদ্ধিতা আর অন্ধ আক্রোশ। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে— ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ও বিস্তার, জ্যোতিষীদের আংটি ও মাদুলির ফলাও কারবার, লটারির পুরস্কার মূল্য কোটি টাকায় পৌঁছে যাওয়া, সংবাদপত্রে প্রতিদিনের রাশিফল নামক ধাপ্পা আর বিনা পরিশ্রমে হাতিয়ে নেওয়ার জন্য সুযোগের ও উৎকোচের অন্বেষণ। এই সবই ইঙ্গিত দেয়, পশ্চিমবাংলা নিজেকে সঁপে দিয়েছে ভবিতব্যের হাতে, সে হারিয়েছে আত্মবিশ্বাস, কাজের ও চিন্তার ক্ষমতা। তার বদলে অর্জন করেছে ভীরুতা, আত্মপ্রবঞ্চনা, হতাশা আর আতঙ্কে দিনযাপনের গ্লানি। টেনেটুনে কোনোক্রমে নিজেকে টিকিয়ে রেখে জীবনযাপনের জন্য একটু জায়গা করে নেওয়ার অভ্যাসে এই রাজ্যের সাধারণ মানুষ রপ্ত হয়ে গেছে। দশ বছর আগেও বাসে যে আসনে পাঁচজনে বসতো এখন তাতে বসছে ছজন, লোকাল ট্রেনে তিনজনের আসনে বসছে চারজন। পশ্চিমবঙ্গ আত্মমর্যাদাবোধ তো হারিয়েছেই, ন্যায্য সুস্থতার জন্য দাবি জানাতেও ভয় পায়।
এমন অবস্থায় বাস্তব সচেতন গল্প, উপন্যাস, কবিতার লিখিয়েরা কী করতে পারেন? তা হলে একটা কথা সোজাসুজি প্রথমেই বলে নিই, গল্প বা কোনো কিছু লিখে দেশের বা দশের উন্নয়ন ঘটানো যায় না। পৃথিবীতে এমন ব্যাপার কোথাও ঘটেছে বলে জানি না। বহু বছর ধরে বহু লেখক বহু ভাবে গরিব সর্বহারাদের দুঃখ, বেদনা, প্রতিরোধ ও সংগ্রামের কাহিনি লিখেছেন, তাতে সর্বহারাদের বৈষয়িক ও আত্মিক দুর্দশা এক কাচ্চচাও লাঘব হয়নি। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলার তথাকথিত ‘প্রগতি’ সাহিত্য। গরিবদের কাহিনি যাঁদের নিয়ে লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে তাঁরা কেউ সে সব কাহিনি পড়েননি এবং পড়ছেন না। তার কারণটা বুঝে নেওয়া খুব জটিল নয়। যাঁদের জন্য এই সব লেখা হয়েছে বা হচ্ছে তাঁরা একদমই পড়তে—লিখতে জানেন না। পড়েন শুধু টেবিল—চেয়ারে বসে কাজ করা কিছু লোক। এঁরা প্রধানতই শহুরে এবং মধ্যবিত্ত। ‘শিক্ষিত’ নামক জনসমষ্টির বিরাট একটা অংশ সাহিত্য পাঠের ধারই ধারেন না।
লেখক এই সব তথ্য জানেন এবং এটাও জানেন এঁরা তাঁর লেখাকে ভালো হয়েছে বললে তিনি প্রতিষ্ঠা অর্জনে সুবিধা পাবেন। তাই গরিব সর্বহারাদের নিয়ে গল্প লেখার সময় তাঁর মনে ভেসে থাকে এক মধ্যবিত্ত পাঠকের চেহারা যিনি সাহিত্য রসাস্বাদনে পটু, বোদ্ধা, হয়তো বা আলোচনা—প্রবন্ধও লিখে থাকেন। লেখক এই শিক্ষিত পাঠকের বোধ ও বুদ্ধির কাছে নিবেদন করেন তাঁর লেখাটিকে। তাঁর গল্পের মানুষরা যদিও দিনমজুর, ছোটচাষি, ভিক্ষুক, বেশ্যা, উপজাতি, বাচ্চচা শ্রমজীবী ইত্যাদি। লেখক কিন্তু কোনোদিনই এঁদের মতো জীবনযাপন করেননি, এঁদের সমস্যার ও ভাবনার ধারে কাছেও তিনি যেতে পারেন না এবং তিনি এঁদের ব্যক্তিমানুষ হিসেবে ততটা দেখেন না যতটা দেখেন সামাজিক শ্রেণি হিসাবে। একটি প্রগতিশীল পত্রিকায় গত দশ বছরের গল্পকারদের নিয়ে একটি সমীক্ষা—প্রবন্ধে দেখলাম বলা হয়েছে, ‘এখানেই পূর্ববর্তী সময়ের গল্প থেকে এই সময়ের এ জাতীয় গল্পের মূল পার্থক্য।’ প্রবন্ধকারের মতে, গল্পকারদের দৃষ্টি সর্বহারাদের ওপর গিয়ে পড়েছে হয়তো বা নকশালবাড়ি আন্দোলনের ঝাঁকুনির ফলে।
আমাদের বাস্তবতাকে বিভিন্ন আমলের লেখকরা নানা ভঙ্গির চাহনি মেলে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছেন। এই চাহনি বা রচনার কাজ করতেই লেখক নিজেকে সংস্কার করেন। সমাজবাস্তবতার বাইরের গড়ন আর তার ভিতরের টানাপোড়েন অর্থাৎ কোনটি প্রকৃত আর কোনটি প্রতিবিম্ব এটা চিনে নিয়ে আলাদা করা বেশ জটিল ব্যাপার। এই টানাপোড়েন, ঘাতপ্রতিঘাত থেকে তৈরি হয় লেখকের অনুভূতি। কিন্তু বাস্তবের মৌল শক্তিগুলির কি কোনো বদল এখন পর্যন্ত ঘটেছে? নকশাল আন্দোলন দেশের ও দেশের মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতার অভাব থেকে তৈরি ভঙ্গিসর্বস্ব এমন এক বিপ্লবীয়ানা, যা তৈরি করতে পারেনি নতুন কোনো বিপ্লবী পথ, গড়ে তুলতে পারেনি আদর্শের জন্য রাজনীতি করার উন্নত কোনো নৈতিকতা। এই আন্দোলন যেভাবে দপ করে উঠেই নিভে গেল, যেভাবে টুকরো গোষ্ঠীতে পরিণত হলো, সর্বোপরি এর নেতাদের মধ্যেই যেভাবে হতাশা ও অবসাদের ছাপ ফুটে উঠতে লাগল, তাই থেকেই বোঝা যায় শুধু এর বহির্বাস্তবতাকে অবলম্বন করে গল্প লিখলে তার পরিণতি ওই আন্দোলনের মতই ব্যর্থ হবে। এই আন্দোলনের ঝাঁকুনি থেকে উৎপন্ন গল্পগুলির কিছু কিছু পাঠকদের তারিফ অর্জন করেছে কিন্তু সেটা মূলতই সমাজের ও রাষ্ট্রের দৃশ্যমান বিশৃঙ্খলাটুকু লেখায় প্রতিফলিত হওয়ার জন্য। ৫৬ বছর আগে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রঙ্গপুর সাহিত্য সম্মেলনে তাঁর ভাষণে বলেছেন : ‘সাহিত্যিক বাস্তব জগতের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তার চিত্র আঁকবেন কিন্তু তাঁর অন্তর্দৃষ্টি যথেষ্ট পরিষ্কার হলে তিনি দেখবেন যে বাইরের জগতে যা ঘটে তার চেয়ে লেখকের মনের জগতে আর এক মহত্তর ব্যঞ্জনাময় বাস্তব আছে।’
মনের জগতের বাস্তবটিকে আবিষ্কারে আমাদের প্রগতিশীল লেখকরা খুব বেশি সফল হতে পারেননি। না পারার একটি বড় কারণ, মানুষকে সামাজিক শ্রেণির প্রতিভূরূপে দেখার তত্ত্ব মেনে লিখতে গিয়ে একটা ছাঁচের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। স্বাধীনতা লাভের আগে সারা দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পরাধীনতা ঘোচাবার জন্য একটা একমুখী কর্মিষ্ঠ সদর্থক সমাজচেতনা গড়ে উঠেছিল। ‘মহত্তর ব্যঞ্জনায়’ ভূষিত মানবিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা তখন তৈরি হয়ে ওঠে, ফলে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা সমাজে দানা বাঁধে। এরই সঙ্গে যোগসূত্র রচিত হয়েছিল বহিঃস্তরের আন্দোলনের আর বাঙালি সাহিত্যিকদের কাছে সেইজন্য অন্তর্দৃষ্টিকে সাহায্য করতে সেটাই নোঙরের কাজ করে। ব্যক্তিমানুষকে সদর্থক সামাজিক পটভূমিতে রাখার সুযোগ তখন ছিল। সেই আমলের বহু লেখকের গল্প উপন্যাস আজও পাঠকদের আনন্দ দেয়।
মানুষের অভিজ্ঞতা বিষয়ে যে কোনো ধরনের সত্যে পৌঁছতে হলে শেষ পর্যন্ত শৃঙ্খলার দিকে আসতেই হবে। কিন্তু শৃঙ্খলা সম্পর্কে বিশেষ কোনো ধারণা আঁকড়ে বসে থাকা যায় না। এটা স্থাণু নয়, এটা বদলায়। যেমন বদলায় বিশৃঙ্খলার ধরন। বিশৃঙ্খলার ততটাই বরদাস্ত করি যতটা আমাদের বর্তমান মূল্যবোধগুলির সঙ্গে মানিয়ে যাচ্ছে। মানুষের প্রকৃতি এমনই, নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি বিশৃঙ্খলা সইতে পারে না। পরিমাণটা সহনীয় করতে তখন কল্পনার সাহায্য নেওয়া হয়। কল্পনা তখন শৃঙ্খলা সম্পর্কে মায়াবী পরিমণ্ডল তৈরি করে দেয়। এই পরিমণ্ডলই অন্যতর কোনো উপলব্ধির জন্য পাঠককে উত্তেজিত করায়। কিন্তু যে কল্পনার সাহায্য লেখকরা নেবেন তা কীসের উদ্দেশে ধাওয়া করবে, সেই লক্ষ্যটা স্থির করার জন্য চাই মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা। গত দশ পনেরো বছরের মধ্যে যাঁরা গল্প লিখতে এসেছেন তাঁরা বিশৃঙ্খলার বহিঃস্তরের কিছুটা অল্প পরিসরের মধ্যে দেখতে পেয়েছেন। এটা কিন্তু সমগ্র বাস্তব নয়। পাঠককে অন্য কোনো উপলব্ধিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শুধু ‘অন্তর্দৃষ্টি’ই যথেষ্ট নয়, তাদের কল্পনার বহনযোগ্যতার ক্ষমতাও থাকা চাই। এই দুটি ব্যাপারেই এখন বিরাট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণ কোনো তত্ত্ব দ্বারা সম্ভব নয়। সম্প্রতি এক বিদগ্ধ গ্রন্থসমালোচক আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে বাংলা কথাসাহিত্যে যথার্থ শিল্পীর সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। এটা যদি বাংলা সাহিত্যের পক্ষে এবং বাংলা সাহিত্যের প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের পক্ষে আক্ষেপের কথা হয়, তবে এর চেয়েও আক্ষেপের কথা, এই ঘটনাটি সম্বন্ধে আমরা যথেষ্ট মনোযোগী হতে পারছি না, অথবা এর প্রতি আমরা এক দায়িত্বজ্ঞানহীন ঔদাসীন্য দেখাচ্ছি।’ তিনি বলছেন, ‘মনে রাখবার মতো ছোট গল্পের সংখ্যা যে ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে, এটাও আমাদের আর যথেষ্ট দুঃখ দিতে পারে না।’
সামাজিক চেতনায় গত কুড়ি বছরে যদি কিছু বদল হয়ে থাকে তা হলে সেটা ওই ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন ঔদাসীন্য’টার বেড়ে যাওয়া। সোমনাথ হোর বলছেন : ‘পঞ্চাশের মন্বন্তরের যে ক্ষত, যুদ্ধের যে অমানবিকতা, ছেচল্লিশের দাঙ্গার বীভৎসতা—এগুলি আমার আঁকার পদ্ধতিতে খোদিত হয়ে যাচ্ছিল, আমার অজানিতে।… দুর্ভিক্ষের ছবির যে খড়ি হাতের আঙুল পেরিয়ে হৃদয়ে যে দাগ কেটেছিল, তার দাগ আর মিলাল না।’ জীবনকে ভালোবাসলে, অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা থাকলে হৃদয়ে দাগ কেটে যাওয়া দাগ সৎ ও খাঁটি শিল্পী কখনও মিলিয়ে যেতে দিতে পারেন না। উনি চল্লিশের দশকের পোড় খাওয়া মানুষ। দাগটা রেখে দেওয়ার দায় উনি বহন করে চলেছেন।
তারপরও অনেক দশক এসেছে ও চলে গেছে কিন্তু হৃদয়ে দাগ কেটে দেওয়ার মতো কোনো মন্বন্তর, কোনো যুদ্ধ বা কোনো বীভৎস দাঙ্গা, এমনকি ছিন্নমূল মানুষের বন্যা পশ্চিমবঙ্গ আর দেখেনি। গত চার দশক ধরে ক্রমান্বয়ে অপহৃত হয়ে চলেছে মানবিক মূল্যবোধগুলি, সমাজ চেতনায় ছড়িয়ে গেছে টেনশন, গা—ছাড়া হয়ে পড়েছে ব্যক্তির সঙ্গে তার জগতের সম্পর্ক। মানুষ পড়েছে অবিশ্বাসের শূন্যতার মধ্যে। আধুনিক সময়ের এই আঁচড়গুলো পড়ছে যে সমাজদেহের অঙ্গে সেটা কিন্তু রয়ে গেল চারদশক আগের। এই বাইরের আর ভিতরের মধ্যেকার আমলকে তারা সনাক্ত করতে চাইল। এই দুইয়ের সঙ্ঘাত থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎকে ভাষার মাধ্যমে গল্পে সঞ্চার করার জন্য মাঝে মাঝেই ঝাঁক বেঁধে আন্দোলনে নেমেছেন তরুণরা। সাহিত্যে বাসি হয়ে যাওয়া প্রথাগুলিকে ভেঙে নতুন চেতনার বাস্তবতায় তাঁরা বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন চমকপ্রদভাবে আধুনিক হওয়ার জন্য, বাস্তবকে মুচড়ে মনোমতো করে বানিয়ে, যুক্তির মাত্রা কমিয়ে চমকদার বাক্য সাজিয়ে যাওয়া ছাড়া কিন্তু তাদের কাছ থেকে আর কিছুই পাওয়া গেল না। আধুনিকপন্থীদের হামলার প্রধান লক্ষ্য হয় বুর্জোয়া সমাজ ও মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ। সবেগে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলে প্রথমে একটু পিছিয়ে আসতে হয়। তাই করতে গিয়ে সমাজ—বাস্তবতা থেকে আন্দোলনকারীদের কখন যেন বিযুক্তি ঘটে যায়। আধুনিক রূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর তাঁরা বুর্জোয়া বিরোধিতার একই কথার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে থাকেন, তবে একটু অন্য গলায়। সাহিত্য থমকে থাকে একই জায়গায়। তখন আমরা বলি, মনে রাখবার মতো গল্প আর পাচ্ছি না। যশস্বী হওয়ার আগে বাঙালি লেখকরা যে পরিমাণ যত্ন ও পরিশ্রম লেখার জন্য দেন, দুঃখের কথা, পরে আর তা দেন না। আরও দুঃখের কথা, বহু নামী লেখকের দুর্বল রচনা সম্পাদকেরা ছাপিয়ে চলেছেন, যে রকম রচনা কোনো অনামী লেখক লিখলে অবশ্যই অমনোনীত হত। এবং আরও দুঃখের কথা, পাঠকরা দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে সত্যিই উদাসীন।
মতি নন্দী
২৩.১.৯৪
Leave a Reply