মতি নন্দী উপন্যাস সমগ্র ২য় খণ্ড
মতি নন্দী উপন্যাস সমগ্র ২য় খণ্ড
.
আমার লেখক হয়ে ওঠার কথা
শিবু, শিবু, বলে ডাক দিয়ে বাস থেকে লাফিয়ে নামলাম। সেটা ১৯৫৩ সাল হবে। শিবু মানে শিবশম্ভু পাল। আমার বন্ধু। সবসময় ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আর কবিতা লেখে। সেদিন শিবুর সঙ্গে আর একজন যুবক ছিলেন। মোহিত চট্টোপাধ্যায়। সেদিন শিবু আমাকে মোহিতের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। মোহিত তখন নাটক নয়, কবিতা লেখে। সে সময়ে লেখালেখি নিয়ে ওদের সঙ্গে কথা হয়।
কথামতো একটা গল্প নিয়ে এক রোববার শিবুর বাড়িতে গেলাম। তখন মার্কসবাদ আমার মধ্যে ভুরভুর করছে। সেদিন শিবুর বাড়িতে প্রধান আলোচক ছিলেন মোহিত। গল্প পড়তে গিয়ে দেখলাম আমার বুক ধুপধুপ করছে। কিন্তু পরে মোহিতের বক্তব্য শুনে খানিকটা উৎসাহও পেলাম। পরের রোববার আবার গল্প লিখে নিয়ে গেলাম। এইভাবে প্রত্যেক রোববার গল্প লিখে নিয়ে যেতে থাকলাম। ওই আড্ডাতে তখন বীরেন্দ্র দত্ত, বিশ্ববন্ধু ভট্টাচার্যরা আসতেন। টালার কাছে শৈলজানন্দের পাশের বাড়িতে থাকতেন বিশ্বজীবন মজুমদার। রবিবার বিকেলে কখনো কখনো ওঁদের বাড়িতেও আমাদের আড্ডা বসত।
যে সময়টার কথা বলছি, ৫৩-৫৪, এ সময়ে আমি ময়দানে খেলে বেড়াতাম। বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে ফ্রেন্ডলি ক্রিকেট ম্যাচ খেলতাম। বাড়িতে গল্প লেখা আর ময়দান চষে বেড়ানো- তখন এই আমার কাজ। বাবা মারা গেছেন আমার মাত্র এক বছর বয়সে। ছাড়া গোরুর মতো ঘুরে বেড়াতাম।
ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে বুঝলাম বয়স বাড়ছে। তখন পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। আমার যা বিদ্যে তাতে কোনো চাকরি হবার নয়। আই এসসি পাশ করার পর অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমা করেছিলাম। পরে ভেবে দেখলাম ওসব আমার পোষাবে না। ফলে আবার পড়ার ঝোঁক চাপল। অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সুপারিশে মণীন্দ্র কলেজে খেলার কোটায় ভরতি হয়ে গেলাম। বাংলায় অনার্স নিয়ে। সেটা ১৯৫৬ সাল। খেলার কোটায় ভরতি হয়েছিলাম বটে, কিন্তু কলেজে খেলা তো ঘোড়ার ডিম। তেমন খেলতে হত না। দু-একটা ক্রিকেট খেলেছি। চাকরির ব্যাপারটা না থাকলে আমি আর এসব পড়াশোনার মধ্যে যেতাম না।
আমার ছোটোবেলায়, বাইরের ঘরে বাবার ছবির নীচে একটি বাঁধানো সার্টিফিকেট ছিল। তিনি প্রথম মহাযুদ্ধের আই এম এস। আমার এক বছর বয়সে মারা যান। আমার জন্ম ১০ জুলাই ১৯৩১। সেই সার্টিফিকেটের এক কোণে সই ছিল ‘George V’। মা সগর্বে বলতেন, ওটা পঞ্চম জর্জের নিজ হাতের সই। আমার মনে হয়েছিল রাবার স্ট্যাম্প। একদিন কাঁচ খুলে ব্যাপারটা পরীক্ষা করে বুঝলাম ওটা রাবার স্ট্যাম্পই। মা-র জন্য যে করুণাবোধ করেছিলাম, সেটা ক্রমশই সারল্যগ্রস্ত মোহের প্রতি মমতায় পরিবর্তিত হয়।
আর একটা জিনিস বাইরের ঘরে টাঙানো ছিল- মামলার রায়। কাকাদের সঙ্গে ফৌজদারি মামলা হয়। তখন আমি বছর ছয়েকের। বৃদ্ধ কাকা, নাবালক ভাইপোর কাছে আদালতে ক্ষমা চান। ‘বসুমতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত সেই খবরটি কেটে বাঁধিয়ে রাখে আমার এক দাদা। উদ্দেশ্য : কাকার ছেলেরা ওটা দেখে যেন নির্যাতন ভোগ করে। ব্যাপারটাকে ঘৃণা করেছি। পাঠশালায় আমাদের সঙ্গে পড়ত, নাম সম্ভবত নির্মল, স্বাস্থ্যবান গৌরকান্তি সুদর্শন। চাকরের সঙ্গে আসত সোনাগাছি থেকে। দুপুরে চাকর তার জন্য আনত দুটি বৃহদাকার সন্দেশ ও দুধ। অনেকে তার খাওয়া দেখত, তার মধ্যে আমিও ছিলাম এবং ঈর্ষা বোধ করতাম। সোনাগাছিরই এক বারাঙ্গনার ‘আঁটকৌড়ে’ তোলার জন্য পাঠশালা থেকে কয়েকজন ছেলে নিয়ে যাওয়া হয়, আমিও ছিলাম। খই, কড়ি, সুপারি ইত্যাদির সঙ্গে ছিল একটি দু-আনি। আমার প্রথম আয়। দু-আনিটা আমাকে অভিভূত করে রেখেছিল বহুদিন। ওটা আমার মেরুদণ্ডে কাঠিন্য এনে দিত, মাটিতে বেশ শক্তভাবে পা ফেলতাম। পরে ওটা হারিয়ে যায় বা চুরি যায়।
ক্লাস সেভেন থেকেই গড়ের মাঠে যাতায়াত। শৈলেন মান্নার ফ্রি-কিক দেখার লোভ সম্বরণের সাধ্য ছিল না। ডেনিস কম্পটন আর হার্ডস্টাফের ব্যাটিং দেখি সাহেবদের একদিনের একটি ম্যাচে (কোচবিহারের যুবরাজও ছিলেন), ইডেনে গাছতলায় কাত হয়ে শুয়ে। কম্পটনের ফুটবল খেলা তখনকার মোহনবাগান মাঠে গোলের পিছনে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম। ‘ভিক্ট্রিসেলিব্রেশন’ ম্যাচ আই এফ এ-র সঙ্গে, খেলায় টিকিট ছিল না। গলিতে গ্যাসবাতি থেকে ব্ল্যাক আউটের ঠুলি তখনও খোলা হয়নি। বিকেলে সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুয়ে দাঁড়াতাম মিলিটারি দেখার জন্য। একদিন চমকে উঠেছিলাম, হাত দশেক দূরে জওহরলাল নেহরুকে দেখে। একটা ছাদখোলা মোটরের পাদানি থেকে নেমে তাড়াতাড়ি ভিতরে গিয়ে বসলেন। পিছনে ছুটে আসছে কিছু লোক জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে দিতে। জয়পুরিয়া কলেজের উদ্বোধন করতে নেহরু এসেছিলেন। কাছে থেকে সেই প্রথম একজন কান্তিময় পুরুষকে দেখা। বালক রোমাঞ্চ পেয়েছিল। কিন্তু ভালো লাগেনি গান্ধীজিকে। তিনি তখন বেলেঘাটায়। আমরা কংগ্রেস সেবাদলের স্বেচ্ছাসেবক। খাকি হাফপ্যান্ট-শার্ট ও সাদা খদ্দরের টুপি মাথায় ভোরে আমরা লরিতে যেতাম পাহারাদারির, ভিড় নিয়ন্ত্রণের এবং ফরমাস খাটার জন্য। গান্ধীজির গায়ে একবার আঙুল ছোঁয়াবার ইচ্ছা হয়েছিল। সকালে বেড়িয়ে ফিরছেন, ভেবেছিলাম তখনই ছোঁয়াব। পাশে দাঁড়িয়েও সম্ভব হয়নি, হঠাৎ লজ্জায় পেয়ে বসে। ওঁর গায়ের গন্ধ পাচ্ছিলাম, খুব সাধারণ, মনে না-রাখার মতো গন্ধ। মনে নেইও। এখন, প্রায় পঞ্চাশ বছর পর ইচ্ছা করে আবার গন্ধটা পেতে। বেলেঘাটার সময়ই ১৫ আগস্ট। সেই রাতে কলুটোলা দিয়ে লরিতে যেতে যেতে মুখে ফেনা তুলে চিৎকার করেছি ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই; ভুলো মৎ, ভুলো মৎ।’ কচি১ তখন ‘কাঁকর’ হয়ে চেতনায় ঢুকে গেছে। ওটাই ছিল স্কুলে আমার শেষ বছর। পরের বছর ধ্যানচাঁদকে প্রথম ও শেষবারের মতো ক্যালকাটা মাঠে খেলতে দেখি। কৈশোরই আমার মানসিকতার একটা ছাঁচ তৈরি করে দেয়।
খেলা আর মাঠ আমার কাছে জ্ঞান হওয়া থেকেই একটা ব্যাপার। এটাই অবশেষে আমার জীবিকা হয়েছে। খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায়- মানুষের দেহের গুরুত্ব, দেহ সঞ্চরণের সৌন্দর্য, পরিশ্রম দ্বারা অধীত গুণাবলির প্রকাশ যা কখনো কখনো শিল্প আস্বাদনের স্তরে উত্তীর্ণ হয়, এবং সমাজের নীচুতলার মধ্যবিত্ত মানুষের অস্তিত্বে চেহারাটি কেমন, তা আমাকে দেখিয়ে ও বুঝিয়ে দেয়। সুযোগটি আরও বেশি পেয়েছি আমার চাকুরির জন্য। যে দেশে এখনও কুড়ি কোটিরও বেশি মানুষ অর্ধাহারে ধুঁকছে, শতকরা ৭০ জন লিখতে-পড়তে জানে না, সে দেশের শিল্পীর পক্ষে দেশের এই অবস্থাটা কিছুতেই এড়ানো সম্ভব নয়, অবশ্য যদি যোগাযোগ থাকে। ‘স্ট্রাইকার’ বা ‘কোনি’ এই যোগাযোগেরই একটা দিক। এই দিকে রয়েছে হতাশা, আত্ম-অবমাননা, নেতিমূলক ভবিষ্যৎ। এখানে আঁকড়ে ধরার জন্য একমাত্র অবশিষ্ট রয়েছে স্বপ্ন। তার মারফত কাঙ্ক্ষিত জগতে বিচরণ।
কোনো একটা ব্যাপারে নাড়া খেয়েই বা আগে থেকে সযত্নে প্লট তৈরি করে লিখতে বসা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। যুক্তিবিরোধী, অনুভূতিশীল, মনের নির্জ্ঞান অংশ লেখকের কাজের জন্য নিজেদের ভূমিকা অবশ্যই পালন করবে। কিন্তু লেখকের সজ্ঞান মনও আছে এবং তা নিস্ক্রিয় নয়। যখন সমগ্র ব্যক্তিত্ব নিয়ে একাগ্রভাবে লেখক কাজ করে, তখন তার মনের সজ্ঞান অংশটিই দ্বন্দ্ব সংঘাতের মীমাংসা করে, স্মৃতিগুলিকে সংঘটিত করে এবং একই সময়ে তার দুই দিকে চলার চেষ্টাকে রুখে দেয়।
লেখার এইসব চরিত্ররা যতক্ষণ না জমাট পারম্পর্যময় একটা অবয়ব পাচ্ছে বা কাহিনির উদ্দেশ্য এবং রচনার বুনোট সম্পর্কে কিছুটা ধারণা তৈরি হচ্ছে, ততক্ষণ লেখা শুরু করি না।
কী ঘটবে সেই সম্পর্কে অল্প কিছু ধারণা প্রথমে থাকে। এজন্য ছক বেঁধে নিই না, নোটের সাহায্যও নয়। যখন চরিত্ররা জীবন্ত হয়, কথা বলে, তখন এমন সব ব্যাপারের প্রত্যাশায় থাকি যা চমকে দেবে, বিব্রত করবে। ওরা বহু সময় নিজেরাই ঘটনা তৈরি করে কাহিনির পথ বদল করে দেয়। কিন্তু আলগা রাশ সবসময়ই ধরে রাখি, ফলে গন্তব্যচ্যুত হতে দিই না। ওদের কার্যকলাপে যে সংশোধন মনে মনে করতে হয় তাতে অদ্ভুত মজা আছে। তা না করলে জীবনের আসল চেহারাটা মিথ্যা ভোল ধরে দাঁড়ায়।
ভালো লেখা দুর্ঘটনাক্রমে হয় না। ওটা বারংবার লেখারই ফল। একই গল্প বার বার লেখার বাতিক আমার আছে এবং ছাপাতে দেবার আগে আবার ফিরে লিখি। এ সম্পর্কে একশো বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনাটি যথাসম্ভব অনুসরণের চেষ্টা করি। বঙ্কিমের বারোটি নিবেদনের পঞ্চমটি হল : ‘যাহা লিখবেন তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছুকাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছুকাল পরে উহা সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য, নাটক, উপন্যাস দুই এক বৎসর ফেলিয়া রাখিয়া তারপর সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। যাহারা সাময়িক সাহিত্যের কার্যে ব্রতী, তাহাদের পক্ষে এই নিয়মরক্ষাটি ঘটিয়া উঠে না। এ জন্য সাময়িক সাহিত্য, লেখকের পক্ষে ক্ষতিকর।’
বাংলা ভাষায় যেসব রচনা গল্প-উপন্যাস নামে গত দুই দশক ধরে ‘বিশেষ সংখ্যা’গুলি উদগিরণ করেছে সেগুলির অধিকাংশেরই পাঠযোগ্যতা থেকে চ্যুত হওয়ার কারণ বঙ্কিমই বলে দিয়ে গেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হবে প্রকাশকবৃন্দের তাৎক্ষণিক লাভের কড়ি সংগ্রহের ইচ্ছা। বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগে পুজোসংখ্যাগুলিতে একটিমাত্র উপন্যাসই প্রকাশিত হত। লেখকরা যত্ন নিয়ে লিখতেন। পাঠকরা যত্ন নিয়ে পড়তেন।
নিজের সম্পর্কে এইটুকু বলতে পারি, অযত্নের লেখা কখনো ছাপাতে দিইনি। শুরুতে বছর চারেক শুধু অনুশীলনই করেছি গল্প লেখার। পাইকপাড়ায় শিবশম্ভু পালের বাড়িতে প্রতি রবিবার আমি আর মোহিত চট্টোপাধ্যায় হাজির হতাম। ওরা পড়ত কবিতা, আমি গল্প। চার বছর প্রতি সপ্তাহে একটি করে গল্প লিখে গেছি। পরে ওগুলো ফেলে দিতাম। একদিন ওরা বললে, এটা ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঠানো যাক। আমরা নোংরা পাণ্ডুলিপি এবং হাতের লেখা দেখামাত্রই সম্পাদক যে গল্পটি অবিলম্বে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেবে এ বিষয়ে ওরা নিঃসন্দিগ্ধ, তাই শিবশম্ভু কপি করে দেয় ওর মুক্তার মতো হস্তাক্ষরে। বোধহয় বীরেন্দ্র দত্ত গল্পটি ‘দেশ’ অফিসে দিয়ে আসে। মাস ছয়েক পর ১৯৫৭২-র মার্চের সকালে পাইকপাড়া থেকে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে শিবু আমাকে ঘুম থেকে তুলে আনন্দবাজার দেখাল। আগামী সংখ্যায় শ্রী মতি নন্দীর লেখা ‘ছাদ’ গল্পটি বেরোবে। কুড়ি টাকা পেয়েছিলাম।
‘ছাদ’-এরপর পরিচয় পত্রিকায় পাঠাই ‘চোরা ঢেউ’ গল্পটি। মাসখানেক বাদে এক দুপুরে যাই, মনোনীত হবে কিনা জানতে। কোনো পত্রিকা দপ্তরে এই আমার প্রথম যাওয়া। মিষ্টি হেসে মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর হাতের প্রুফটা এগিয়ে ধরলেন। সেটি ‘চোরা ঢেউ’-এর। কয়েক মাস পর তাঁর চিঠি পেলাম, পুজো সংখ্যার জন্য গল্প চেয়ে। গল্প চাওয়া প্রথম চিঠি আমার জীবনে। চিঠিটি আমার কাছে স্যুভেনির হয়ে আছে। লিখেছিলাম ‘বেহুলার ভেলা’। নামটা বিষ্ণু দের কবিতা থেকে নিয়েছিলাম। কবিতাটার নাম ছিল ‘পঁচিশে বৈশাখ’৩। লেখক হিসাবে সেই আমার যাত্রা শুরু।
এই ৫৬/৫৭ সালে আমার জীবনের আরও একটি বড়ো ঘটনা ঘটে গেছে। বাংলা সাহিত্যের মোড় বদলটাও এই সময় থেকে শুরু। এর আগের লেখক বিমল কর, সমরেশ বসু, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, রমাপদ চৌধুরি প্রমুখের একটি আলাদা ধরন ছিল। কিন্তু তাঁদের সময়ে কী বিষয়ে, কী আঙ্গিকে আন্তর্জাতিকতা আসেনি। আমাদের সময় থেকে লেখকেরা আন্তর্জাতিকতার দ্বারা প্রভাবিত হতেন। ডস্টয়েভস্কি, কাফকা, টমাসমান এলেন। সেই সময়ে সার্ত্র এবং কামুও এসে গেছেন। এঁদের লেখালেখি তখন পড়তে শুরু করেছি। হাওয়ার্ড ফাস্ট, স্টেইনবেক, কডওয়েল আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে স্টেইনবেক। এঁদের লেখালেখি পড়তে পড়তে লেখা সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে সমাজ সম্পর্কে আমার ধারণা বদলাচ্ছে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন ধারণা। গল্পে নতুন ধারা এল। গল্প বলায় বিদেশি প্রভাবে আঙ্গিক সচেতনতা এল।
এইরকম একটা সময়ে ১৯৫৬-য় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যান। তাঁর শোকসভায় যেতে গিয়ে আমি প্রথম কফি হাউসে যাই। অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য সজনীকান্ত দাস চাঁদা সংগ্রহ করেছিলেন। শোকসভাটি হয়েছিল ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে।
সেই অনুষ্ঠানে ‘উল্টোরথ’ পত্রিকার তরফ থেকে ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি উপন্যাস’ প্রতিযোগিতার কথা ঘোষণা করা হয়। তখন উপন্যাসের প্রকাশক হিসাবে উল্টোরথের কোনো তুলনা নেই। ওখানে সব বড়ো বড়ো লেখকই তখন লেখেন। একেবারে ডাকসাইটে পত্রিকা। তো, এই অনুষ্ঠান থেকে ঘোষণাটি কানে নিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম। তারপর প্রায় একশো পৃষ্ঠার একটা উপন্যাস লিখে নিয়ে জমা দিতে গেলাম। গিয়ে দেখলাম সবাই অনেক যত্ন করে ভালো দামি কাগজে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে জমা দিয়েছে লেখা। আমার অযত্নের পাণ্ডুলিপি, ময়লা কাগজ। উদ্যোক্তারা বললেন, এইভাবে কেউ পাণ্ডুলিপি জমা দেয়? কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁরা উপন্যাসটি জমা নিলেন এবং আমাকে রসিদ দিলেন। এই উপন্যাস প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক ও নগদ পাঁচশো টাকা পুরস্কার পাই। মনে আছে দ্বিতীয় হয়েছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। আর তৃতীয় স্থান লাভ করেছিলেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। রংমহলে একটা অনুষ্ঠান করে আমাদের পুরস্কৃত করা হয়। উপস্থিত ছিলেন অশোক কুমার সরকার এবং জ্যোতি বসু। ওই রংমহলেই পূর্ণেন্দু এবং অতীনের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ।
পরে শুনেছি এই উপন্যাস প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন বিমল মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও লীলা মজুমদার। সবার উপরে ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রথম পুরস্কারের জন্য আমার উপন্যাসটাকেই বেছে নিয়েছিলেন। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘ধুলো বালির মাটি’। বিখ্যাত লেখক ননী ভৌমিকের ‘ধুলোমাটি’ উপন্যাসের দ্বারা আমি প্রভাবিত হয়েছিলাম। নামকরণের ক্ষেত্রে।
তখন আমি পরিচয় পত্রিকায় গল্প দেখার দায়িত্ব পেয়েছি। মস্কো থেকে ফিরে এসে ননী ভৌমিক একদিন আমার উপন্যাসটা পড়তে চান। পরে একটা জায়গা দেখিয়ে বলেন, এই জায়গাটা বেশ কাঁচা হয়ে গেছে। আমি বাড়ি ফিরে এসে ওই জায়গাটা ছিঁড়ে ফেলে সংশোধন করি। ননীবাবুর কাছে আমি ঋণী। ননী ভৌমিক, সমরেশ বসু একই সময় সাহিত্যের জগতে এসেছিলেন। ওঁরা শিক্ষিত গদ্য লিখতেন।
আমার প্রথম লেখা অবশ্যই একটা গল্প। ছাপার হরফে বেরোয়নি। আমাদের পাড়ায় একটি লাইব্রেরি ছিল। পূর্বাচল। ৫০ সাল নাগাদ ওই লাইব্রেরির দেওয়াল পত্রিকায় গল্প লিখে আমার লেখক জীবনের শুরু হয়। এই দেওয়াল পত্রিকায় পরে আরও অনেক লিখেছি। তখন আমাদের মধ্যে সোভিয়েত লিটারেচার পড়ার খুব চল ছিল। ক্রস রোড নামে কমিউনিস্টদের একটি পত্রিকা ছিল। সেই ইংরেজি পত্রিকা থেকে, সোভিয়েত লিটারেচার থেকে গল্প অনুবাদ করে দেওয়াল পত্রিকায় দিতাম। হাওয়ার্ড ফার্স্ট, স্টেইনবেক প্রমুখ লেখকেরা এই সময় থেকে আমার ওপরে প্রভাব ফেলতে থাকেন। হেমিংওয়ের ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি, কামুর দ্য ফল, পরে আউডসাইডার, সার্ত্র-এর ইনটিমেসি- এসব রচনা, এইসব বিদেশি সাহিত্য আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু আজও আমরা রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে পারিনি। নকশালরা ভাঙবার কথা বলত। ভাঙত; আমার খুব ভালো লাগত।
বাংলা সাহিত্যে সুবোধ ঘোষ একজন অসাধারণ গল্পকার। দীপেন্দ্রনাথ, সমরেশ বসু, দেবেশ রায় প্রমুখের জাতই আলাদা। অমিয়ভূষণ সৎ লেখক। আর সতীনাথ ভাদুড়ী অতি উচ্চচস্তরের লেখক। আমরা গলি রাস্তা কিংবা রাজ্য নিয়ে আছি। কিন্তু আস্ত ভারতবর্ষ উঠে আসে সতীনাথের লেখায়। ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ পড়তে পড়তে মনে হয় সতীনাথ পূর্ণিয়া শহরের লোক হয়ে, প্যারিস ঘুরে আসা মানুষ হয়ে এঁদের জীবন জানলেন কী করে। বিভূতিভূষণও অত জানতেন না। বাংলা সাহিত্যের আর একজন বড়ো লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র গল্পকার হিসাবে আজও বাংলা সাহিত্যের চুড়োয় বসে আছেন। আমার মনে হয় এই সব চুড়োয় বসে থাকা লেখকদের পুনর্মল্যায়নের সময় এসে গেছে। তুলনামূলকভাবে কলকাতার বাইরে থাকা লেখকেরা অনেক ভালো লিখেছেন বলে আমার মনে হয়। কলকাতায় থাকলে এঁরা হয়তো নষ্ট হয়ে যেতেন।
আজকের বাংলা সাহিত্যে কোনো বৈচিত্র্যে নেই। বিষয়ের এই বৈচিত্র্যহীনতার ফলে সব একঘেয়ে লাগে। তবু এঁদের মধ্যে অনেকেই ভালো গদ্য লেখেন। অনিতা অগ্নিহোত্রী, অমর মিত্র ভালো লিখছেন। এ ছাড়া স্বপ্নময়, ঝড়েশ্বর, সাধন, কিন্নর আমাদের পরবর্তী এইসব নতুন লেখকেরা তাঁদের লেখায় অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো মহান ভাব সঞ্চারিত করে দিয়েছেন, কিন্তু এঁরা প্রত্যেকেই একটা ভাব, একটা নির্দিষ্ট আবেগকেই সম্বল করে যেন আঁকড়ে পড়ে আছেন। কোনো জন্মান্তর নেই। এটাই কি আধুনিক জীবন! যৌনজীবন এখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে ট্যাবু হয়ে আছে। তার জন্য হয়তো বাংলা ভাষার দুর্বলতাই দায়ী।
যৌন জীবন, আমাদের শরীরের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম লেখায় প্রকাশ করার মতো ভাষা শব্দ বাংলায় এখনও নেই। বিদেশি ভাষায় আছে, সাহিত্যে আছে। যদি কেউ ভেবে তৈরি করতে পারেন, সেদিনই সাহিত্যে ঠিক ঠিক সম্পূর্ণ জীবন উঠে আসবে। বিদ্যাপতি থেকে ভারতচন্দ্র, এমনকী হুতোমের লেখায় যৌন কথাবার্তা যত স্বচ্ছন্দে উঠে আসে, পরবর্তী কালের বাংলা সাহিত্যে তাও পাওয়া যায় না। ভিক্টোরিয়া রুচিবোধের দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হবার ফলে বাংলা সাহিত্যে তাও পাওয়া যায় না। ভিক্টোরিয়া রুচিবোধের দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হবার ফলে বাংলা সাহিত্য কুঁকড়ে গেল। সম্পূর্ণ জীবন বাংলা সাহিত্যে উঠে এল না।
অনুলিখন : কল্যাণ মণ্ডল
কোরক : শারদ সংখ্যা (শ্রী শতদ্রু মজুমদারের সৌজন্যে প্রাপ্ত)
প্রাসঙ্গিক টীকা
১. কচি হল লেখকের ছোটোবেলার এক মুসলিম বন্ধু। দাঙ্গার সময় ছাদ থেকে লেখক তাকে দেখে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। লেখকের ধারণা কচি তাঁর কাছে সাহায্য চেয়েছিল। এই ব্যাপারটাই ‘কাঁকরের’ মতো হয়ে দাঁড়ায় লেখকের মনে।
২. সময়টা ১৯৫৭ নয়। ১৯৫৬ সালের শেষাশেষি হবে। কারণ, ‘ছাদ’ গল্পটি ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৫ ডিসেম্বর ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয়।
৩. উল্লিখিত কবিতাটির নাম ‘এবারের গরম’। ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নয়। কবিতাটি কবি বিষ্ণু দে-র ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। কবিতাটির প্রাসঙ্গিক লাইনদুটি :
‘হে সমুদ্র হিমালয়! অসহ্য এ শুকনো অবহেলা,
অশ্রু দাও, বৃষ্টি দাও, বেয়ে যাব বেহুলার ভেলা’।
অভীক চট্টোপাধ্যায়
Leave a Reply