ভ্রমণ সমগ্র ১ – নবনীতা দেব সেন
ভ্রমণ সমগ্র ১ – নবনীতা দেব সেন
BHRAMAN SAMAGRA (Vol-I) by NABANEETA DEV SEN
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০০৯, মাঘ ১৪১৫
প্রচ্ছদ : রঞ্জন দত্ত
প্রকাশক : সুধাংশুশেখর দে, দে’জ পাবলিশিং ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০৭৩
স্নেহের অপুকে
.
ভ্রমণের নেশা এক তীব্র নেশা, প্রায় কৃষ্ণপ্রেমের মতো, সে মাদকের সুখ যে একবার আস্বাদন করেছে, সে বারবার সেই স্বাদ ফিরে পেতে চায়। আমিও ব্যতিক্রম নই। আমার বাবা নরেন্দ্র দেব ছিলেন ভ্রমণ পাগল মানুষ। তাঁর ভ্রমণ কাহিনি এক সময়ে মানুষের মর্ম স্পর্শ করেছিল। অল্পবয়সে একা ও লেখক-শিল্পী বন্ধুদের সঙ্গে সারা ভারত, শ্রীলংকা, ঘুরে বেড়িয়েছেন। সংসারী হয়েও বাবার পথের অমোঘ টানে ছেদ পড়ল না, এবারে সাড়া দিলেন সংসার সমেত। বাবা মানব সভ্যতাকে স্পর্শ করতে চাইতেন প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে। আশৈশব আমি মা বাবার সঙ্গে সারা ভারত, এবং ইউরোপের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার রক্তের মধ্যে বাবার এই মারাত্মক নেশাটি স্বতঃই সঞ্চারিত হয়েছে। কোনো দেশে গিয়ে আমার নিজেকে বাইরের লোক বলে মনে হয় না, মনে হয় না এখানে আমি একা, নিঃসঙ্গ। সর্বত্রই ঈশ্বর আমার জন্যে ভালোবাসার পাইক পেয়াদা মজুত করে রেখে দেন, কোথাও তারা আমাকে পাকড়াও করতে ব্যর্থ হয়নি। এত অচেনা মানুষ এত অজানা জায়গায় ছোটো বড়ো সংকটের মুহূর্তে পাখির মায়ের মতো ডানার আড়াল দিয়ে আমাকে আগলেছেন, যে আমি সর্বত্রই স্বস্তি বোধ করি। মনে হয়, মানুষের কাছাকাছি যতক্ষণ আছি, সব ঠিক ঠাক আছে। যে কোনো সমস্যাই আসুক, একটা সুরাহা হয়ে যাবে। মানুষ আসলে সব বোঝে। তাই আমার নতুন দেশে, নতুন পরিস্থিতিতে, অচেনা মানুষদের মাঝখানে, অনভ্যস্ত আবহাওয়ায় চলে যেতে একটুও ভয় করে না। মানুষের স্বভাবের মূল উষ্ণতায় আমার গভীর বিশ্বাস। জগতের সব শিল্পীর মতোই আমিও হয়তো বুকের মধ্যে এক ভবঘুরে প্রাণী, কিন্তু কপালগুণে জীবনেই বা ভবঘুরঘুরেপনায় কম গেলুম কোথায়? এই পৃষ্ঠাগুলি সেই সব ঘুরঘুরে গল্পে ভরা।
বেশ কিছুকাল ধরেই আমার ‘ভ্রমণ সমগ্র’ প্রকাশে আগ্রহ হয়েছে শ্রীমান অপুর, তিনি নিজেই প্রায় সব লেখাপত্তর সংগ্রহ করেছেন, আমার কাজ অল্পই, একটি মুখবন্ধ লেখা। আপাতত দুটি খণ্ড প্রস্তুত হচ্ছে। প্রথমে অপু ভেবেছিলেন একটিতে দেশ আর একটিতে বিদেশ, এমন দুটি পর্বে ভাগ করবেন হাতে আসা লেখাগুলো। কিন্তু আমার এই দেশ-আর বিদেশের মধ্যে দাঁড়ি টানা মনের মতো হল না। তাই ভাগ হচ্ছে মেলামেশার মধ্যে, যাতে দুটি খণ্ডেই দেশ আর বিদেশের ছোঁয়া লাগে। প্রথম খণ্টে যাচ্ছে, ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’, ‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে’, আর ‘ভ্রমণের নবনীতা’, এই তিনটি বই, আর অগ্রন্থিত চারটি ভ্রমণ রচনা। দ্বিতীয় খণ্ডে যাবে ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে’, ‘তিন ভুবনের পারে’, ‘উত্তমাশা অন্তরীপ’-—এই তিনটি বই, আর চারটি অগ্রন্থিত ভ্রমণ কথা। উত্তর মেরুর তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ, কুম্ভমেলা থেকে তিব্বত সীমান্ত, আমার ভ্রমণ কাহিনীর অলি গলি তো পাগলামিতে ভরা। এরোপ্লেনে হিজ হাইক করে তুন্দ্রা, ট্রাকে হিচহাইক করে তিব্বত। এই বই পড়ে কেউ কোমর বেঁধে কোথাও বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা নিতে পারবেন না, কিন্তু চোখ বুজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবেন। আমার যাওয়া আসার ব্যাপারস্যাপারগুলিও তো ঠিকঠাক নয়, সবই একটু কেমন যেন! আর সময়ও বদলে যাচ্ছে, বন্ধ পথ খুলে যাচ্ছে। যা ছিলো কঠিন তা সরল হচ্ছে জীবনে, আর সারল্য হয়ে উঠচে কঠিন। অগম্য, দুর্গম স্থানগুলি এখন টুরিজমের প্যাকেজের মধ্যে পড়ে। আলাস্কা, গালাপাগোস দ্বীপ, গ্রীনল্যান্ড, মাসাইমারি জঙ্গল, চীনের সিল্ক রুট, কি অস্ট্রেলিয়ার প্রবালদ্বীপ, অর্থানুকূল্য থাকলে সব কিছুই আজ হাতের মধ্যে। আমার ভ্রমণ কিন্তু একটিও তেমন সভ্য ভব্য উপায়ে নয়। সবই প্রায় কপালজোরে আর ইচ্ছের জোরে। মানুষের ভালোবাসার ওপরে ভর করে।
আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, কুঁড়ে মানুষদের পক্ষে, নিজের ঘরের আরামকেদারাতে আধশোয়া হয়ে চায়ের কাপটি হাতে, নিরাপদে বিশ্ব জুড়ে মানসভ্রমণের সুখ আস্বাদন করতে চাইলে, এই সব খামখেয়ালের গল্প কাজে দেবে।
আমার ভ্রমণের কাহিনি এক দিক থেকে কিন্তু পঙ্গুর গিরিলংঘনের কাহিনি। আশাতীত ইচ্ছাপূরণের কাহিনি। চিরকেলে রুগ্ন মেয়ে আমি, সূচীপত্র দেখে আমার নিজেরই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না, এসব আমিই গিয়েছি? এতখানি আহ্লাদ পেয়ে গেছি মা ধরিত্রীর কাছে? কপাল করে এসেছি বটে! তাও তো বহু ভ্রমণ গল্প এই দু খণ্ডে নেই, এক এক ঝলক মনে পড়ে, এমন কত লেখা অযত্নে সূত্রহীন হয়ে জন্মের মতো হারিয়ে গিয়েছে।
আমার বইতে মুখ গুঁজে আমার সঙ্গে মনে মনে বেড়াতে যেতে যাঁদের ভালো লাগে, কাছে দূরে এমন যে সব সমমনস্ক, সহৃদয় পাঠকরা আছেন, তাঁদের সকলের জন্যে সাদরে তৈরি হল এই ‘ভ্রমণ সমগ্র’।
নবনীতা দেব সেন
পৌষ সংক্রান্তি ১৪১৫
ভালো-বাসা
২০০৯
সূচি
অগ্রন্থিত
- না যাওয়ার কাহিনি
- বকুল বিছানো পথে
- কাসা গ্রান্দে
- গুল্লা কাহিনি
Leave a Reply