ভূত সমগ্র – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০১০
উৎসর্গ
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ / এই দেশের ছেলেমেয়েদের যিনি বই পড়তে শিখিয়েছেন, বইকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, যেই কাজটি একটি রাষ্ট্রের করার কথা সেই কাজটি যিনি নিজে করে ফেলেছেন!
ভূমিকা
আমার ভৌতিক লেখাগুলো নিয়ে ভূতসমগ্র বের হলো। এখন পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞানী ভূতকে ধরে বোতলে ভরতে পারেন নি, ডিসচার্জ করে তার স্পেকট্রাম দেখে সেটা কোন কোন মৌল দিয়ে তৈরি বের করতে পারেন নি-কাজেই ধরে নেওয়া যায় পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু নেই। কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে। পৃথিবীতে ভূতের গল্প আছে, শুধু যে আছে তা নয় পৃথিবীতে যতদিন মানুষ থাকবে ততদিন ভূতের গল্পও থাকবে! সেই ছেলেবেলায় কুপিবাতির আলোতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে নানির কাছে ভূতের গল্প শুনেছি। বাইরে ঝমঝমে বৃষ্টি, ঝড়োবাতাসে ভেজা গাছের পাতা শরশর শব্দ করছে তার মাঝে নানি অবলীলায় ভয়ংকর ভয়ংকর সব ভূতপ্রেতের কথা বলে যাচ্ছেন। শুনে ভয়ের চোটে আমাদের হাত-পা শরীরের ভেতর সেধিয়ে যেতে যাচ্ছে কিন্তু তাই বলে একটিবারও সেই গল্প শোনা বন্ধ করি নি-পৃথিবীতে এর চাইতে মজার জিনিস আর কী আছে?
সে কারণেই কী না আমি জানি না, কয়দিন পরে পরেই আমার একটা ভূতের গল্প লেখার জন্যে হাত নিশপিশ করে-এই ভূত সমগ্ৰটাই তার প্রমাণ।
ভূত নিয়ে আমার প্রথম লেখা বইটির নাম প্রেত। আমি তখন আমেরিকায় একা একা আছি, একদিন একটা ভূতের সিনেমা দেখে এসেছি, বাসায় এসে গা ছম ছম করছে। সেই গা ছম ছম করা থেকেই প্রেতের জন্ম। বইয়ের পাণ্ডুলিপিটা আমেরিকা থেকে ঢাকায় একটা ম্যাগাজিনে পাঠিয়েছিলাম। ম্যাগাজিনে ছাপা না হয়ে সেটা কীভাবে কীভাবে জানি একটা পেপারব্যাক বই হিসেবে বের হয়ে গেল, প্রচ্ছদ করেছেন শাহাদাত চৌধুরী। আহির আলম নামে একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান তরুণু এই বইয়ের কাহিনীটা নিয়ে একুশে টেলিভিশনের জন্যে একটা অসাধারণ সিরিয়াল তৈরি করেছিল। আহির আলম আমাকে অনুরোধ করেছিল আমি যেন প্রেতের দ্বিতীয় পর্ব লিখে দিই, সেটা দিয়ে সে আরো একটা। সিরিয়াল তৈরি করবে। আমি কখনো কোনো বইয়ের দ্বিতীয় পর্ব লিখি না কিন্তু আহির আলমের জন্যে আমি সেটা লিখতে রাজি হয়েছিলাম। আহির আলম হঠাৎ করে একটা দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ায় আমি আর “প্রেত”-এর দ্বিতীয় পর্বটুকু লিখি নি। তবে পাঠক যদি খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে তাহলে বুঝতে পারবে সেই কাহিনীটাই একটু অন্যভাবে লেখা হয়েছে ভূত সমগ্রের শেষ উপন্যাস দানব বইটিতে। ভূত সমগ্রে এই দুটিই হচ্ছে উপন্যাস, অন্য সব ভূতের গল্প, কোনোটা ছোট কোনোটা বড়।
আমার দ্বিতীয় ভৌতিক বই পিশাচিনী। অনেক গল্পের সংকলন, কয়েকটা আমার খুব প্রিয়। এই বইটি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম খুব সখ করে পড়েছিলেন, পড়ে বলেছিলেন তার সবচেয়ে ভালো লেগেছে পরিশিষ্টটি। বইটি যখনই হাতে নেই তখনই আমার শহীদ জননীর কথা মনে পড়ে। এই বইটি নিয়ে আমি সব সময়েই একটু ভয়ে ভয়ে থাকি কারণ বাংলা ডিকশনারিতে কিন্তু পিশাচিনী বলে কোনো শব্দ নেই। বাংলা ভাষার অধ্যাপকেরা হয়তো আমাকে ক্ষমা করবেন না, কিন্তু আমার ধারণা পাঠকেরা আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। বানিয়ে বানিয়ে একটা কাহিনী দাঁড়া করালে যদি দোষ না হয় তাহলে একটা শব্দ বানালে এমন আর কী দোষ হবে?
নিশিকন্যা বইয়ে নিশিকন্যা গল্পটি আমার প্রিয় একটা গল্প। সত্যি কথা বলতে কী এটি ভৌতিক গল্প নয় তবুও কেন ভৌতিক গল্পের সংকলনে রেখেছি সেটা হয়তো পাঠকেরা পড়লেই বুঝতে পারবেন।
ছায়ানীলী সাম্প্রতিককালে লেখা, কেউ এই বইটি পড়লে আমার একটা সীমাবদ্ধতার কথা জেনে যাবে, খাটাখাটনি করে আমি হয়তো একটা কাহিনী দাঁড়া করে ফেলতে পারি, কিন্তু প্রায় সময়েই তার একটা ভালো শিরোনাম খুঁজে পাই না। এই বইয়ের শেষ গল্পটির নাম দানব, অথচ এই একই নাম দিয়ে আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি উপন্যাসও লিখে বসে আছি। কে জানে হয়তো ভবিষ্যতে এই একই নাম ব্যবহার করে আরো কিছু একটা লিখে বসে থাকব।
‘ও’ বইটিতেও কয়েকটা ভূতের গল্প রয়েছে। ভূতের গল্প পড়ে একটু ভয় ভয় লাগতে হয়। সেটা ঘটে থাকে যদি ধারণা দেওয়া। যায় যে গল্পটি সত্যি! সেটা করার জন্যে আমি মাঝে মাঝেই উত্তম পুরুষে লিখি এবং চরিত্রটির জন্যে নিজের নাম ব্যবহার করি-যেন আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা বলছি। পুরো বানানো গল্প তারপরও কেউ কেউ অবাক হয়ে জানতে চান সত্যিই এরকম কিছু ঘটেছিল কী না! তবে ‘ও’ বইটির বিশেষত্ব অন্য জায়গায় এটা আমার ক্ষুদ্রতম নামের বই-এর থেকে ছোট কোনো বইয়ের নাম দেওয়া সম্ভব কী না আমি জানি না।
মূর্তি এবং শকসো দুটি প্রথমে আমার দুটি কিশোর গল্প সংকলনে জায়গা পেয়েছিল। ভূত সমগ্র বের করার সময় সেখান থেকে কেটে এখানে আনা হয়েছে ভূত-সংক্রান্ত সব লেখা দুই মলাটের মাঝখানে আনার জন্যে।
ভূতের এই গল্প এবং উপন্যাসগুলো লিখে আমি ভিন্ন এক ধরনের আনন্দ পেয়েছি। মানুষ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে পারে তবুও স্বীকার করতে লজ্জা নেই, মাঝে মাঝে এরকম হয়েছে। যে বানিয়ে বানিয়ে ভূতের একটা গল্প লিখে নিজেই তার ভয়ে জড়সড় হয়ে গেছি! আমার মতো ভীতু কোনো পাঠক যদি ঠিক আমার মতোই এই গল্পগুলো কোনো একটি পড়ে একটুখানি ভয় পেয়ে যায়, তারপরেও আগ্রহ নিয়ে পরের গল্পটি পড়তে শুরু করে তাহলে মনে করব যে আমার পরিশ্রমটা হয়তো সার্থক হয়েছে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২.৯.০৯
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট।
লেখক পরিচিতি
জন্ম : ২৩ ডিসেম্বর ১৯৫২, সিলেট। বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, পিএইচডি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন থেকে। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এবং বেল কমিউনিকেশান্স রিসার্চে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করে সুদীর্ঘ আঠার বছর পর দেশে ফিরে এসে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়াং বিভাগে।
স্ত্রী ড. ইয়াসমীন হক, পুত্র নাবিল এবং কন্যা ইয়েশিম।
পাঠকনন্দিত এই লেখক ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন।
রুহান
নকশা কাটা কবজ বইটির জন্য অপেক্ষায় আছি।