ভূতনাথের ডায়েরি – অনীশ দেব
প্রথম প্রকাশ: জুলাই ২০২১
সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়
স্নেহাস্পদেষু
.
এক মিনিট, আপনাকে বলছি
‘ভূতনাথের ডায়েরি’-র জেনেসিসটা আপনাকে প্রথমে জানিয়ে দিই। সালটা ছিল ১৯৯৯। ‘দেব সাহিত্য কুটীর’-এর সর্বময় কর্তা ছিলেন অরুণচন্দ্র মজুমদার—যিনি ‘শুকতারা’ পত্রিকার অন্যতম প্রকাশক ছিলেন। সেই ‘অরুণদা’ একদিন ফোন করে বললেন, ‘অনীশবাবু, একদিন আমার দপ্তরে একটু আসবেন? একটু দরকার ছিল—।’
সুভদ্র অরুণদা এরকমই ছিলেন। বহুবার আপত্তি করা সত্ত্বেও আমার শুভনামের লেজে ‘বাবু’ জুড়ে দেওয়ায় কখনও ক্ষান্ত হননি। আর তার সঙ্গে ‘আপনি’।
তো দেখা করতে গেলাম। অরুণদা বললেন, ‘সামনের মাস থেকে প্রতিমাসে ”নবকল্লোল” পত্রিকায় একটা করে ভূতের গল্প লিখতে হবে।’
ভয় পেয়ে গেলাম। আমি কি পারব?
প্রশ্নের উত্তরটা ঠিকঠাকভাবে ভেবে ওঠার আগেই তিনি বললেন, ‘কী ভাবছেন? আপনি ঠিক পারবেন।’
ব্যস, নির্বাহী সম্পাদককে তিনি পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দিলেন। এবং পরের মাস থেকে ‘নবকল্লোল’ পত্রিকায় শুরু হয়ে গেল ‘ভূতনাথ’-এর গল্পের সিরিজ। ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে এগারো মাসে দশটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল (একটি সংখ্যায় আমার লেখা দিতে দেরি হয়েছিল, তাই এগারোয় দশ)। পত্রিকায় প্রকাশের ক্রম অনুসারে গল্পগুলো বইয়ে সাজানো হয়েছে।
২০০১ সালে প্রথম প্রকাশের সময়ে প্রয়াত শিল্পী সমীর সরকার—আমার কাছে ‘সমীরদা’—বইয়ের সমস্ত ছবি এঁকে দেন। সম্পর্কের টানে ব্যক্তিগতভাবে ছবিগুলো তিনি আমাকে এঁকে দেন। এই ঘটনায় ‘ভূতনাথের ডায়েরি’-র প্রথম প্রকাশকের কোনওরকম ভূমিকা ছিল না।
সমীর সরকারের ছবিগুলো এতই মনোহর যে, সেগুলো ছাড়া ‘ভূতনাথের ডায়েরি’-কে আমার পক্ষে ভাবা সম্ভব নয়। সেইজন্যই এখন বইটির যে-সংস্করণ, প্রকাশিত হচ্ছে তাতেও অনীশ দেব ও সমীর সরকারের যুগলবন্দি।
বইটি নতুন করে প্রকাশের উদ্যোগে ‘বইতরণী’ সেই ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়। পত্রভারতীর বরুণ রায় বইটি সাজানোর কাজে যথেষ্ট অভিনবত্ব দেখিয়েছেন।
এবার ‘দেখা যায় না, শোনা যায়’।
‘দেখা যায় না, শোনা যায়’ উপন্যাসটির প্রথম পর্ব কিশোর ভারতীর শারদীয়া ১৪১৮-তে প্রকাশিত হয়েছিল। পুজো সংখ্যায় অর্ধেক উপন্যাস প্রকাশ করার বকুনি হিসেবে এক পাঠক রসিকতা করে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ‘এরকম দেখাও যায় না, শোনাও যায় না।’ অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে জানাই, উপন্যাসটির শেষ অংশ প্রকাশিত হয় কিশোর ভারতীর শারদীয়া ১৪১৯-এ।
বই প্রকাশের সময় লেখাটি যথাসাধ্য পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করেছি।
সুতরাং ‘নতুন’ ‘ভূতনাথের ডায়েরি সম্পূর্ণ’ এখন আপনার হাতে। সেইসঙ্গে আমার লেখালিখির গুণমানের বিচারও।
অনীশ দেব
১৭ এপ্রিল, ২০২১
.
ভূতনাথের ডায়েরি
আমার নাম প্রিয়নাথ জোয়ারদার। বিজ্ঞান যেখানে শেষ, সেইখান থেকে আমার কৌতূহল ও আগ্রহের শুরু। ছোটবেলা থেকেই ভূতে আমার ভীষণ ভয়। অশরীরী, অলৌকিক, ভূত, প্রেত, পিশাচ আমাকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিত। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের কাছে যখনই এ-জাতীয় কোনও কাহিনি শুনতাম তখনই খুব ভয় পেতাম। পরে বড় হয়ে, কাঠমাণ্ডুর এক সন্ন্যাসীর পরামর্শে, আমি ভূত-প্রেতের ভয় কাটানোর জন্য অভিনব এক পথ ধরি—ভূত-প্রেতের খোঁজ করে বেড়ানো।
সুতরাং সেই পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েস থেকেই আমার ভূতচর্চার কাজ শুরু হয়েছে। আজ, এই পরিণত বয়েসে এসেও সে-কাজ থামেনি। এই তিন যুগ সময়ে কখন যেন আমার নাম ‘প্রিয়নাথ’-এর বদলে ‘ভূতনাথ’ হয়ে গেছে। সমবয়েসি বা গুরুজনরা সামনেই ‘ভূতনাথ’ বলে ডাকেন। আর, ছোট যারা, তারা বলে আড়ালে। আমি তাতে কিছু মনে করি না। বরং বেশ মজা পাই।
প্রায় পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর ধরে ভূত-প্রেত, অশরীরী-অলৌকিক নিয়ে আমার কম অভিজ্ঞতা হল না। তা ছাড়া ভূত-প্রেতের বহু কাহিনিও আমি শুনেছি। সেই সব অভিজ্ঞতা ও কাহিনি আমি যত্ন করে লিখে রেখেছি বারোটা মোটা-মোটা বাঁধানো খাতায়—অনেকটা ডায়েরির মতন। মাঝে-মাঝে সেই খাতাগুলোর পাতা উলটে স্মৃতিচারণ করি।
সম্প্রতি আমার আলাপ হয় এক কলমচির সঙ্গে। আলাপ করে জানলাম, তিনি নাকি বানিয়ে-বানিয়ে ভূতের গল্প লেখেন। তখন আমি হেসে আমার খাতাগুলোর কথা তাঁকে বলি। শুনে তাঁর উৎসাহ দ্যাখে কে! আমার মিনমিনে ওজর-আপত্তি অগ্রাহ্য করে তিনি খাতাগুলো নিয়ে যান। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘ডায়েরির লেখাগুলো ঘষে-মেজে কল্পনার প্রলেপ দিয়ে সামান্য রদবদল করে একে-একে আমি লিখব। আপনার কোনও আপত্তি শুনব না।’
ভদ্রলোক আমার চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট। তাই একরকম স্নেহের বশেই তাঁকে আমি অনুমতি দিয়েছি। আমার ডায়েরির পৃষ্ঠায় কাহিনিগুলো বন্দি না থেকে সকলের সামনে প্রকাশ করলে ক্ষতি কী!
Leave a Reply