ভারতে ইসলাম ভারতীয় মুসলিম (অখন্ড / প্রথম খণ্ড ও দ্বিতীয় খণ্ড একত্রে) – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতে ইসলাম ভারতীয় মুসলিম (প্রথম খণ্ড : ৭১১ থেকে ১৮৫৭)
.
উৎসর্গ : কবি সুব্রত রায়কে
আমার সাহিত্যগুরু, যাঁর হাত ধরে মসিকে অসি করে নিয়েছি
.
সূচিমুখ
জবাবদিহি
ইসলাম এবং মুসলিম : গোড়ার কথা
এক হাতে তলোয়ার, অন্য হাতে কোরান
প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রভাবনা এবং ভৌগোলিক সীমানা
মধ্যযুগ : ভারতে মুসলিম শাসন
শাসকরূপে মুসলিমদের ভারতে প্রবেশ :
মোহম্মদ বিন কাসেম, সুলতান মামুদ, বখতিয়ার খলজি, মোহম্মদ ঘুরি, কুতুবউদ্দিন আইবক, ইলতুৎমিস, গিয়াসুদ্দিন বলবন, আলাউদ্দিন খিলজি, মোহম্মদ বিন তুঘলক, ফিরোজ শাহ তুঘলক, চেঙ্গিস খান, তৈমুরল, বাবর, হুমায়ুন, শেরশাহ সুরি, আকবর, জাহাঙ্গির, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, শিবাজী, দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর
সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা
.
জবাবদিহি
এক অদ্ভুত অসহিষ্ণু সময়ে আমরা বন্দি হয়ে পড়েছি। এ যেন এক চক্রব্যুহ। ঢুকে পড়েছি, বেরিয়ে যাওয়ার পথ চিনি না। এ এমন একটা সময়, যেসময় অর্ধসত্য, বানোয়াট-মিথ্যাচারকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণির উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। জাতীয়তাবাদ তথা হিন্দুত্ববাদের নামে প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করে সত্য বলে উপস্থাপন করতে উদগ্র উদগ্রীব হয়ে আছে। ইতিহাসবিমুখ আয়েসী মানুষ সেসব বিকৃত ইতিহাস দায়িত্বের সঙ্গে ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিদ্বেষী মানুষজন। যে ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা, তা আজ ভূলুণ্ঠিত। যে বিষবৃক্ষ ব্রিটিশ তথা খ্রিস্টান শাসকরা রোপণ করে গিয়েছিলেন, তাতে আমরা নিয়মিত জলসিঞ্চন করে মহিরূহে পরিণত করে ফেলেছি। ভারত এটি বহুমাত্রিক এবং বহুজাতিক উপমহাদেশ, তাকে একরঙা (গেরুয়া) করার চেষ্টা চলছে, যা অবৈজ্ঞানিক। হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয় ও ভাব আদানপ্রদানের লীলাক্ষেত্র এই ভারতভূমি। সেই সংস্কৃতির নাম হিন্দু সংস্কৃতি। হিন্দুস্তান তথা ভারতের সংস্কৃতি বলে কোনো একক সংস্কৃতি হয় না। ভারতের সংস্কৃতি বলতে একটি মিশ্র সংস্কৃতিকে বোঝায়। যেমন –অনার্য সংস্কৃতি, আর্য সংস্কৃতি, বৌদ্ধ সংস্কৃতি, জৈন সংস্কৃতি, শক সংস্কৃতি, স্থূন সংস্কৃতি, শিখ সংস্কৃতি, ইসলামি সংস্কৃতি, মোগল সংস্কৃতি, আফগান সংস্কৃতি, সুফি সংস্কৃতি, তুর্কি সংস্কৃতি, খ্রিস্টান তথা মিশনারি সংস্কৃতি, ফরাসি সংস্কৃতি, ডাচ সংস্কৃতি, পর্তুগিজ সংস্কৃতি ইত্যাদি মিলিয়েই ভারতীয় সংস্কৃতি। এখন সব সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার। এর মধ্যে একটিকেও পৃথক করলে ভারত আর ভারত থাকে না। সেটা করলে এ দেশের পক্ষে এ সমাজের পক্ষে মোটেই কাম্য নয়।
এক শ্রেণির বিদ্বেষী মনোভাবাপন্ন মানুষ কোরানের গুটিকয়েক খণ্ডিত আয়াত উদ্ধৃতি করে এটা প্রমাণ করতে চায় যে, ইসলাম কত খতরনাক। ভারতের ক্ষেত্রে দু-চারজন মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে সমগ্র মুসলিম জাতিকে কাঠগোড়ায় তুলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক বিনষ্ট করছে এবং করেই চলেছে। কোরানের আয়াত উদ্ধৃতি করে এবং মুসলিম শাসকদের কলঙ্কিত করে এমন কিছু তাঁরা বোঝাতে চায় যে, মুসলিম মানেই হিন্দুদের বুকে তলোয়ার ঠুসে দিয়ে মুসলিম বানায়, বিধর্মী বলে হিন্দুদের কচুকাটা করে এবং মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। বরং বারবার এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, সংখ্যাগুরুরা সর্বদাই সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করেছে এবং আজও করে। তা সে হিন্দু হোক বা মুসলমান, হিন্দু হোক বা বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ হোক বা শূদ্র। ইতিহাস সাক্ষী। প্রকৃত ইতিহাস কখনো-কখনো লুকিয়ে রাখা যায় বটে, কিন্তু ইতিহাস কখনোই মিথ্যা বলে না। খামোকা কোরান উদ্ধৃতি করে মুসলিমদের আসামীর কাঠগোড়ায় তোলা অর্থহীন, অপ্রাসঙ্গিক। আমি মনে করি কোরান শাসক দ্বারা লিখিত। যদিও ইসলামে বিশ্বাসীরা মনে করেন কোরান আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত। কোরান একটি রাজনৈতিক ধর্ম। তাই কোরানের একটা বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে যুদ্ধ বিষয়ক নির্দেশাবলি। যেখানে বলা হয়েছে শত্রুপক্ষকে কীভাবে জব্দ বা কবজা করতে হবে, কীভাবে বশে আনতে হবে এবং কীভাবে হত্যা করতে হবে। এমনভাবে হত্যা করতে হবে, যেন শত্রুর শেষ না থাকে। শত্রু যে-কোনো ধর্মগোষ্ঠীরই হতে পারে, ধর্মই যদি মানুষের একমাত্র পরিচয় হয়। কারণ ধর্মহীন বা নাস্তিকদের কোনো যুদ্ধের ইতিহাস নেই। অতএব প্রতিপক্ষের পরিচয় প্রতিপক্ষই। সব রাজাই পৃথ্বীরাজ চৌহান হবেন কেন? হওয়া উচিতও নয়। প্রতিপক্ষ বা শত্রুর কোনো ধর্মপরিচয় বিবেচ্য হতে পারে না। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু। প্রতিপক্ষ নিধনই যুদ্ধনীতি। একজন যোদ্ধা কি প্রতিপক্ষ বা শত্রুকে গাল ধরে চুমো খাবে?
দেশ চালাতে হলে, অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে এবং শত্রুপক্ষকে উচিত শিক্ষা দিতে একটা সুনির্দিষ্ট অনুশাসনের প্রয়োজন হয়, নির্দেশিকার প্রয়োজন হয়, যা প্রাচীন বা মধ্যযুগে ঈশ্বরের নামে প্রচারিত, এখন সংবিধানের নামে। এটা সারা পৃথিবীতেই প্রয়োজন হয়েছে। এর মধ্যে কোনো অন্যায় দেখি না। প্রাচীন যুগে এটা সময়ের দাবি ছিল। কোনো গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্ট অনুশাসন পছন্দ না-হলে নতুন অনুশাসন রচনা করে নতুন ধর্মীয় গোষ্ঠী তৈরি করেছে। এইভাবে আজ সারা বিশ্বে ধর্মপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৪২০০ টি। প্রাচীন ও মধ্যযুগে আইনগ্রন্থ বলতে এই ধর্মগ্রন্থকেই বোঝাত। অদৃশ্য কোনো সর্বশক্তিমানের অস্তিত্বের ভয় দেখিয়ে সেই অনুশাসন কায়েম করা হত। এতে কাজও হত। আজও মানুষ সেই সর্বশক্তিমানের ভয়ে সর্বদা ভীত থাকেন। তাঁরা ভাবেন রাষ্ট্রীয় আইন থেকে রক্ষা পেলেও সেই ‘সর্বশক্তিমান’-এর শেষ বিচারে কারোর রেহাই নেই। তিনি সব দেখতে পান, সব জানেন। কোরান এমন একটা সময়ে প্রণয়ন হয়েছে যখন আরবে চরম হানাহানি, খুনোখুনি, রক্তারক্তি এবং সামাজিক অস্থিরতা চলছে। কোরানের অনুশাসনের মাধ্যমে সমগ্র আরব সমাজকে এক ছাতার তলায় আনা সম্ভব হয়েছে। এটা যতটা সহজে বলা গেল, কাজটা তত সহজ ছিল না। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন একা হজরত মোহম্মদ। এমন একক মানুষের কৃতিত্ব সত্যিই ঈর্ষণীয়। তিনি চূড়ান্তরূপে সফল। তিনি এমন এক ধর্মীয় অনুশাসন প্রচার করলেন, যা অত্যন্ত সুসংগঠিত ও সুসংযত, যা আর কোনো ধর্মীয় অনুশাসনে পাওয়া যায় না। এই হজরত মোহম্মদের চরিত্র নিয়ে সারা পৃথিবী সরগরম। কী না, তিনি ছয় বছরের আয়েষাকে বিয়ে করেছেন। সেই যুগে এরকম বিয়ে কোটি কোটি হয়েছে। এই ভারতেও কয়েক বছর আগেও ছোটো ছোটো কন্যাদের বিয়ে হত। অনেকক্ষেত্রেই সেইসব শিশুকন্যাদের বিয়ে করত বয়স্ক পুরুষরা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের স্ত্রীর বয়স ছিল পাঁচ বছর। অনুসন্ধান করলে এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। আর-একটি অভিযোগ, তিনি একাধিক বিয়ে করেছিলেন। একাধিক মানে তিনি তেরোটা বিয়ে করেছিলেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের শেষভাগ পর্যন্ত কোনো পুরুষদেরই একাধিক বিয়ের ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। সামর্থ্য অনুযায়ী যে যতখুশি বিয়ে করতে পারত, সারা পৃথিবীতেই। হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট প্রচলন হওয়ার আগে পর্যন্ত ভারতের পুরুষরা একাধিক বিয়ে করত। তা ছাড়া রাজরাজড়ারাও একাধিক বিয়ে করত। তাঁরা যে সবাই কামনার জ্বালায় বিয়ে করত তা তো নয়, বেশিরভাগ বিয়েই করতে হত রাজনৈতিক কারণে। নারীভোগের ইচ্ছা হলে বিশ্বের সেরা সেরা সুন্দরীদের তুলে এনে ভোগ করার ক্ষমতা রাখতেন তাঁরা। বাল্মীকি বিরচিত রামায়ণের রাবণকে আমরা এভাবেই পেয়েছি। খামোক বিয়ে করতে যাবে কেন? গোটা পৃথিবীতে এমন কোনো রাজা বা শাসক ছিলেন নাকি, যাঁকে অসংখ্য বিয়ে করতে হয়নি?
তবে সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আরবসমাজে কোরানের মতো অনুশাসনের প্রয়োজন যতটা ছিল, পরে আর তেমন প্রয়োজনে আসে না। কারণ জীবনধারা বদলে গেছে নানা প্রযুক্তির কারণে। কিছু জীবনবিধান ছাড়া কোরান আর অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। তাল কেটে যায়। সময়ের দাবিতে কোরান অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। এখন ধর্মচর্চাতেই কোরানের সীমাবদ্ধতা। শুধু কোরান কেন, পৃথিবীর কোনো ধর্মগ্রন্থেরই আর প্রাসঙ্গিকতা নেই। পড়া আর পড়ে শোনানো ছাড়া। যেটুকু আছে, সেটুকু ধর্মব্যাবসা আর আধ্যাত্মিক উত্তরণের ক্ষেত্রেই। আর যুদ্ধনীতি আর প্রতিপক্ষ দমন? সেই যুদ্ধনীতি আর প্রতিপক্ষ দমন এখন আধুনিক রাষ্ট্রে সামরিক ক্ষেত্রে এর অন্যথা হয় না। কোরানের যুদ্ধনীতিতে এমন কিছু কি উল্লেখ আছে, যা আধুনিক সামরিকনীতিতে সেগুলি প্রয়োগ হয় না? কোরানে প্রতিপক্ষকে যেভাবে হত্যা করতে বলা হয়েছে, আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্রের সৈনিকরাও ঠিক সেইভাবেই প্রতিপক্ষকে হত্যা করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি নৃশংস। অস্ত্র বদলেছে মাত্র। তলোয়ার, বল্লমের বদলে বুলেট ও বেয়োনেট এবং রাসায়নিক ও জীবাণু বোমা।
এবার আসি ‘গনিমতের মাল’ প্রসঙ্গে। অমুসলমানেরা অনেক সময়েই এই গণিমতের মাল প্রসঙ্গটা তুলে আনেন মুসলমান সম্প্রদায়কে হেয় করার জন্যে। আসলে এই গনিমতের মাল বিষয়টা কী? ‘গনিমতের মাল’ মানে হল যুদ্ধে শত্রুপক্ষের স্থাবর অস্থাবর সব সম্পদ, যা বিজয়ী দলের সদস্যদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেওয়া হয়। সে সময় আরব উপত্যকায় অনেক যুদ্ধ হত। সেই যুদ্ধে পরাজিত দলের সব সম্পদ বিজয়ী দল নিজের করে নিত।
হজরত মোহাম্মদকে তখন তিনি ও তাঁর মুসলমান বাহিনী যুদ্ধে শত্রুপক্ষকে পরাজিত করলে যুদ্ধে পরাজিত দলের সব রেখে যাওয়া সম্পদের মালিকানা মুসলমান বাহিনীর দখলে আসত। তিনি সেই সম্পদের এক-চতুর্থাংশ নিজে রাখতেন পরিবারের জন্য, বাকি কিছু মুসলমান বাহিনীর সদস্যদের জন্য এবং বাকি সম্পদ তিনি দান করে দিতেন আরবের দরিদ্রদের জন্য। এমন নির্দেশ স্বয়ং কোরানেই আছে। কোরানে আছে মানে আল্লাহর নির্দেশ বলেই ধরে নেওয়া হয়। বলা আছে, ১/৪ অংশ আল্লাহ ও নবির, বাকি অংশ মুমিনদের ও গরিবদের।
সুরা আনফালে বলা হয়েছে– “গনিমতের মালের এক-পঞ্চমাংশ খোমস হিসেবে দিয়ে দেবে।” সুরা আনফাল মদিনায় অবতীর্ণ একটি সুরা। এতে রয়েছে ৭৫টি আয়াত ও ১০টি রুকু। অবতীর্ণ হওয়ার ধারাক্রম অনুযায়ী এ সুরা হল ৮৮ নম্বর সুরা। কিন্তু চূড়ান্ত সংকলন বা বিন্যাসে এই সুরা পবিত্র কোরানের অষ্টম সুরা হিসাবে স্থান পেয়েছে। ‘আনফাল’ নাফল শব্দের বহুবচন। এর আভিধানিক অর্থ অতিরিক্ত ও অনুগ্রহ। আর প্রচলিত অর্থে গনিমতের মালকে বলা হয় ‘আনফাল’। মিলের দিকটি হল আনফালও ‘মহান আল্লাহর এক অনুগ্রহ। আর ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে আনফাল বলা হয় কয়েকটি জিনিসকে। যেমন– প্রথমত, দারুল হারব বা কাফের শত্রুদের শাসিত অঞ্চলের যে সম্পদ বিনাযুদ্ধে অর্জিত হয়। দ্বিতীয়ত, সেই ভূখণ্ড যার অধিবাসীরা বিনাযুদ্ধে বহিষ্কৃত হয়েছে।
তৃতীয়ত, সেই ভূখণ্ড যা বিনাযুদ্ধে মুসলমানদের অধীনে এসেছে। চতুর্থত, মুসলমান ও কাফের নির্বিশেষে যে ভূখণ্ডের সব অধিবাসী মারা গেছে। পঞ্চমত, সেইসব অরণ্য, মরুদ্যান, মরুভূমি ও ঘর যার কোনো মালিক নেই। ষষ্ঠত, পাহাড়ের পাদদেশ। সপ্তমত, রাজা-বাদশাহদের রাজকীয় ও শাহী আসবাবপত্র, যা তাঁরা নানা ব্যক্তিকে উপহার হিসাবে দিয়েছে ও বর্তমানে তাঁর মালিক নেই এবং অষ্টমত, খনি ইত্যাদি।
.
সুরা আনফালের প্রথম আয়াত বলছে— “হে রসুল! তাঁরা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে, আনফাল বা গনিমত (তথা ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদ ছাড়া অন্য যে-কোনো সম্পদ) সম্পর্কে। বলে দিন, গনিমতের মাল হল আল্লাহ এবং রসুলের জন্য নির্দিষ্ট। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়গুলো সংশোধন করে নাও। আর আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের হুকুম মান্য করো, যদি ঈমানদার হয়ে থাক।” এই আয়াত বদর যুদ্ধে এসেছিল। এই যুদ্ধে পরাজয়ের মুখে কাফেররা পালিয়ে গেলে তাঁদের বহু জিনিসপত্র গনিমত হিসাবে মুসলমানদের হস্তগত হয় এবং বন্দি হয় অনেক কাফের। সাহাবিরা সে সময় তিন ধরনের দায়িত্ব পালন করছিলেন— সাহাবি সাদ বিন মায়াজসহ কেউ কেউ নবির তাঁবুর চারদিকে পাহারায় ছিলেন। হজরত আলি সহ কেউ কেউ কাফের নিধনে মশগুল ছিলেন। আর কেউ কেউ গনিমতের মাল জমা করতে ব্যস্ত ছিলেন। একদল মুজাহিদের মনে করে যে, তাঁরা যুদ্ধ করাতেই জয় এসেছে বলে গনিমতের পুরো মাল তাদেরই প্রাপ্য। আবার যাঁরা গনিমত সংগ্রহ করছিলেন, তাঁরাও একই ধারণা করছিলেন। তখন এ আয়াত হাজির হয়। এতে বলা হয়েছে যে, এইসব মাল বা গনিমত কেবলই আল্লাহ ও তাঁর রসুলের। তাই তাঁরা যাকে যতটা যোগ্য মনে করেন তাঁকে ঠিক ততটাই গনিমতের অংশ দেবেন। সুরা আনফালের প্রথম আয়াতটিকে গনিমতের মাল সংক্রান্ত বিশেষ বিধান বলে মনে হলেও আসলে এটি একটি সামগ্রিক হুকুম বা বিধান, ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদ ছাড়া সব ধরনের সম্পদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী এইসব সম্পদ মহান আল্লাহ, তাঁর রাসুল এবং রাসুলের স্থলাভিষিক্তের জন্য তথা অন্য কথায় ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য নির্দিষ্ট যাতে এইসব সম্পদকে মুসলিম জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা যায়। তাই আনফাল হচ্ছে ইসলামি রাষ্ট্রের বায়তুল মালের অন্যতম প্রধান উৎস। আর যুদ্ধে। অর্জিত গণিমতের ৫ ভাগের ৪ ভাগ মুজাহিদদের প্রাপ্য এবং এটা তাঁদের কষ্ট ও পরিশ্রমের আংশিক প্রতিদান। বাকি এক-পঞ্চমাংশ হচ্ছে খোমস, যার ব্যবহারের খাতগুলো এই সুরার ৪১ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুরা আনফালের অনেক আয়াত বদর যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধের প্রকৃতি সম্পর্কিত। মক্কার অন্যতম প্রধান সর্দার আবু সুফিয়ান ও তার সঙ্গী আমর ইবনুল আস সিরিয়া থেকে ব্যাবসার মালপত্র নিয়ে মক্কায় আসছিল। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে মহানবি এ সংবাদ জানিয়ে জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। নবি ৩১৩ জনের এক ক্ষুদ্র সেনাদল নিয়ে সেখানে রওনা হন। মক্কার মুশরিক ও কাফেররা সেখান থেকে হিজরতকারী মুসলমানদের সহায়-সম্পদ দখল করেছিল বলে আবু সুফিয়ানের এই কাফেলার উপর হামলা চালিয়ে মুসলমানরা সেইসব সম্পদের ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারত। কিন্তু আবু সুফিয়ানের গুপ্তচররা হামলার প্রস্তুতির খবর তাঁকে জানিয়ে দেয়। ফলে সে মক্কা থেকে কাফেরদের সাহায্য চায়। আবু জাহেল মক্কার কুরাইশদের নানাভাবে উত্তেজিত করে প্রায় ১০০০ সদস্যের একটি সেনাদল তৈরি করে যুদ্ধের জন্য রওনা হয়। পথে উভয়পক্ষের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়। মহানবি সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কারণ সাহাবিদের অনেকেই শত্রুর সেনাসংখ্যার আধিক্যে ভয় পেয়েছিলেন।(সূত্র : Pars Today)
অতএব গণিমতের মাল বলতে বোঝায় কোনো মুসলিম ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী অন্য কোনো ব্যক্তি বা জাতিগোষ্ঠির সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে এবং মুসলিমরা জয়লাভ করলে বিজিত দলের থেকে প্রাপ্ত অর্থ, দ্রব্য সামগ্রী ও দাস-দাসী প্রাপ্ত হয় সেগুলোকে। যুদ্ধের সময় পরাজিতদের সম্পদকেই গণিমতের মাল বোঝায়। ‘গণিমত’ শব্দটা ইসলামি পরিভাষায় ব্যবহার হলেও প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত সামন্ততান্ত্রিক যুগে পরাজিত পক্ষের ধন-সম্পদ, নারী হরণ করা সব দেশে সব ধর্মেই ছিল। ভারতের তাজমহলের চেয়ে দ্বিগুণ ব্যয়ে নির্মিত সোনা, হিরে ও মরকত মণিখচিত ময়ূর সিংহাসন নাদির শাহ এবং ময়ূর সিংহাসনের কোহিনুর হিরেটি ব্রিটিশরা ‘গণিমতের মাল’ হিসাবেই লুঠ করে নিয়ে গেছে।
মধ্যযুগ ছেড়ে যদি আধুনিক যুগে এসে দেখি বাংলাদেশে যখন পাকিস্তান বাহিনী নির্মম বর্বরতা চালায় তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বাংলাদেশেরই একটি বিশেষ শ্রেণির ধর্মযুদ্ধ হিসেবে নিয়েছিল। অর্থাৎ ইসলাম ও বিধর্মী কাফেরদের লড়াই। মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় হিন্দুদের দালাল ও রাজাকার এবং পাকিস্তান বাহিনীকে ইসলামের হেফাজতকারী হিসাবে মনে করা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানী রাজাকারেরা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পদ লুট করত ‘গনিমতের মাল’ হিসাবে। বাংলাদেশী নারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে ভোগ করত পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে নিয়ে। এটা যে ‘কবিরা গুনাহ’ সেটা রাজাকারেরা বোঝেনি। মনে করেছিল যুদ্ধ চলছে। শত্রুপক্ষের সম্পত্তি ও নারী ভোগ করা তাঁদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। বাংলাদেশে ‘রাজাকার’ তাঁদেরই বলা হয়, যাঁরা উর্দুভাষী পাকিস্তানের পক্ষে বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল যে বাঙালি বিভীষণরা। সুযোগসন্ধানী সেই সমস্ত বাঙালিরা বাঙালিদের হত্যার হত্যার পাশাপাশি বাঙালি মেয়েদের ধর্ষণ করেছিল। গনিমতের মালে ধর্ষণের কোনো বিধান নেই। ধর্ষণ ও গনিমতের মাল এক করে ফেলা হয়েছিল। গনিমতের মাল মানে নারী ভোগ নয়। যুদ্ধে পরাজিত দলের রেখে যাওয়া সম্পত্তির উপরে বিজয়ী দলের অধিকার। পরাজিত দলের মানুষদের বাড়িতে ঢুকে লুটপাট নয়। তাঁরা যখন কোনো কিছু রেখে স্থানত্যাগ করবে, তখন সেই সম্পদ বিজয়ী দলের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারাই হল গনিমতে মাল। নারী কি সম্পত্তি?
ইসলামে নারীর সম্মতি ছাড়া নিজ স্ত্রীর সঙ্গে যৌনকর্ম করাও নিষিদ্ধ। স্ত্রীর শরীর খারাপ। আপনি যদি অসুস্থ স্ত্রীর সঙ্গে সেক্স করেন তবে আপনি পাপকর্ম করছেন। এটা অপরাধ। ইসলামে দাসীর সঙ্গে যৌনকর্মকে বৈধতা দিয়েছে। তার মানে এই নয় যে, এই দাসী বাড়ির কাজের মেয়ে নয়। সেই দাসী হল উপপত্নী। সেক্ষেত্রে আপনার স্ত্রীর সব অধিকার দাসীকে দিতে হবে। এক অর্থে সেই ‘দাসী’ নিজের স্ত্রীই হয়ে যায়। গনিমতের মাল হিসাবে যদি দাসী ভোগ করা যায়, তবে সেই দাসীকে আপনাকে উপপত্নী করতেই হবে। নিজের স্ত্রীর মতোই মর্যাদা দিতে হবে। এককথায় নিজের স্ত্রী করতে হবে। এই দাসপ্রথা যেহেত বহু বছর বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তাই দাসীর সঙ্গে যৌনকর্ম করাও বর্তমানে প্রাসঙ্গিকতা।
অনেকে বলেন গনিমতের মাল হল প্রাচীন আরবের সংস্কৃতি। সেই গনিমতের মালের বিষয়টি ওই সময়ের যুদ্ধে প্রেক্ষাপটে চালু হয়েছিল, সেটা ইসলাম চালু করেনি। আগে থেকেই আরবে চালু ছিল। প্রাচীন যুগ তো এখন আর নেই। আজ থেকে ১৪০০ বছর পরে বর্তমান যুগ হবে প্রাচীন যুগ। ওই সময়ের প্রেক্ষাপট ও এখনকার প্রেক্ষাপটের মধ্যে থাকবে আকাশ পাতাল ব্যবধান। গনিমতের মালের ব্যাপারটাও সেই রকম। তবে শুধু আরবেই নয়, সমগ্র বিশ্বেই বিজয়ী পক্ষ বিজিতের সম্পদের দখল করে নিত। দখল করা হত বিজিতের রাজ্য। সম্পদ বলতে শুধু ধনসম্পদই বোঝত না, বোঝাত নারী, পুরুষ, শিশু সব। নারীদের দাসী করা হত, পুরুষদের দাসে পরিণত করা হত। এ ব্যবস্থা ভারতেও ছিল। এটা কোনো ধর্ম সম্প্রদায়ের বিষয় নয়, এটা বিজিতের প্রতি বিজয়ীর বিষয়। ভারতও একসময় যুদ্ধরত উপমহাদেশ ছিল। সে সময় যুদ্ধের সময় রাজাদের সেনাদের দলে ভিড়ে যেত সাধারণ মানুষও। তখন তো সারা বছর চাষাবাদ হত না। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বিজিতের সম্পদ লুঠ করার জন্য বিনা প্ররোচনায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত। যা পেত তাই-ই নিয়ে চলে আসত। অতএব গণিমতের মাল বিষয়টা শুধুমাত্র মুসলিম বিজয়ীদের একচেটিয়া ছিল না।
সে যুগে যা ধর্মনীতি, আজ সেটাই রাষ্ট্রনীতি। কোরান নয়, এখন মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতেও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আধুনিক ও সময়োপযোগী অনুশাসনকেই মান্য করতে হয়। এ কথা সব মুসলমানই জানে, বোঝে এবং মানে। দেরিতে হলেও সৌদি আরবের মতো দেশেও রাষ্ট্রব্যবস্থায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। কোরান বহির্ভূত অনেককিছুই এখন সৌদি আরবে চালু হয়েছে এবং হচ্ছে। গোঁড়ামি দূর হচ্ছে। সৌদি আরবের বাইরে অন্য মুসলিম দেশগুলি রাষ্ট্রীয় আইনই প্রয়োগ হয়, ইসলামি শাসন নয়। যদিও আফগানিস্তানের তালিবানরা ইসলামি শাসন বহু বছর যাবৎ কায়েম করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই শাসন মুসলিম দেশগুলি সহ সারা বিশ্বেই নিন্দিত। ব্যতিক্রম কখনোই আলোচনার বিষয় হতে পারে না। ভারতে একটানা প্রায় ৮০০ বছর হাজার হাজার মুসলিম শাসক শাসন করেছেন। ইতিহাস কজন শাসকের নাম মনে রেখেছেন? কজনের নাম মনে রেখেছি? কেন মনে রাখিনি? কারণ হয় তাঁদের উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো অবদান ছিল না, নয়তো উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। কিন্তু আমরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চেপে গেছি। আমরা কী করলাম, বেছে বেছে কয়েকজন মুসলিম শাসককে তুলে আনলাম। যাঁদের বিরুদ্ধে হিন্দুনিধন, জোর করে ভয় দেখিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা এবং হাজার হাজার মন্দির ধ্বংস করে ফেলার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা হল। কারা লিপিবদ্ধ করল? ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা। কেন ব্রিটিশরা মুসলমান শাসকদের ‘কুকীর্তি’ লিপিবদ্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল? কারণ ভারতের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমানদের আক্রোশ ও ঘৃণা ঢুকিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ভারতে শাসন কায়েম করা। তোরা ভারতীয়রা নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকটি করে মর, সেই অবকাশে আমরা ভারতকে লুটেপুটে খাই। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুলস’, অর্থাৎ ভাগ করো শাসন করো। তৎকালীন ভারতে যদি হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যালঘু থাকত, তাহলে হিন্দুদের বিরুদ্ধেও মুসলিম নিধন, মুসলিমদের জোর করে ভয় দেখিয়ে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করা এবং হাজার হাজার মসজিদ ধ্বংস করে ফেলার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা হত। এইভাবে দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য চিরকালের মতো বিনষ্ট করে নিরঙ্কুশভাবে ভারতে তাঁরা প্রায় ২০০ বছর শাসন করে গেছে। এছাড়া বহু সংখ্যক এলিট শ্রেণির হিন্দুকর্তাদেরও ব্রিটিশরা স্তাবক তথা পা-চাটা শ্রেণিদেরও তৈরি করে ফেলেছিল, যাঁরা সাদা চামড়ায় বিমুগ্ধ হয়ে ব্রিটিশদের প্রসাদ লাভ করে ব্যাপক খুশিতে ডগমগ হতে থাকল। ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুলসকে সফলভাবে প্রয়োগ করার কাজে তাঁদের অবদানও কিছু কম নয়। শুধু শাসনই নয়, লুটপাট করে ব্রিটিশরা সব ব্রিটেনে নিয়ে যেতে থাকল। অত্যাচারের সীমা অতিক্রম না-করলে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত না-হলে ব্রিটিশদের ভারত-ছাড়া করা যেত কি না এ বিষয়ে তর্ক চলতে পারে। ব্রিটিশদের তৈলমর্দন করতে গিয়ে কখন যে ভারত ভূখণ্ড টুকরো টুকরো হয়ে গেল! মাঝখান থেকে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিষবৃক্ষ রোপণ হয়ে গেল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো। নিস্তরঙ্গ ভারত ভূখণ্ডে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষপূর্ণতায় অস্থির হয়েই থাকল।
ইতিহাসকে আমরা নতুন করে গড়তে পারি না, কিন্তু ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন ভবিষ্যতের পথ নিরূপণের সহায়ক 360 SNTCSI “Nathing should more deeply shame the mordern student than the recency and inadequacy of his acquitance with India.”– উক্তিটি করেছেন will Durant। Will Durant-এর এই বক্তব্যের পর আমি ইতিহাসের ছাত্র বা ইতিহাসের অনুরাগী বলতে সংকোচ বোধ করছি। তবুও যেটুকু না বললেই নয়— আমার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিও নেই। আমি কেবলই ইতিহাসের জিজ্ঞাসু ছাত্র। প্রাচীন ইতিহাস থেকে আধুনিক ইতিহাস –কোনো কিছুতেই আমার অরুচি নেই। নিরন্তর পাঠের মধ্য দিয়ে নিজেকে ঋদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করেছি প্রাচীন, মধ্যযুগ এবং আধুনিক সময়ের ইতিহাসের ঘটনাসমূহকে। একটি শাসকের যেমন কালো দিক থাকে, তেমনি আলোর দিকও থাকে। আমাদের ভারতের ইতিহাসে বিশেষ করে মুসলিম শাসকদের কালো দিকগুলিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়। তার মধ্যে অধিকাংশই বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মুসলিম শাসকদের যেভাবে হিংস্র দেখানো হয়েছে, সত্যিই যদি তেমন হত তাহলে যেমন সুদীর্ঘ প্রায় ৮০০ বছর টানা ভারতশাসন করতে তাঁরা সক্ষম হত না। সত্যিই যদি তেমন হত তাহলে ভারত উপমহাদেশে একটিও অমুসলিম অবশিষ্ট থাকত না এবং অবশ্যই ক্ষোভে অভিমানে পৃথক দেশের দাবিও করতে হত না। আমাদের পাঠ্যবই থেকে ইতিহাস পাঠ করে আমরা বেড়ে উঠেছি, সেই ইতিহাস জন্ম দিয়েছে হাজার জিজ্ঞাসা, আমার মতো অনুসন্ধিৎসু ইতিহাস পাঠকের মনে। সেই জিজ্ঞাসার যথার্থ উত্তর খুঁজতেই মুসলিম শাসকদের এবং মুসলিম-ভাবনা নিয়ে নাড়াচাড়া করার দুঃসাহস লিপিবদ্ধ করেছি এই গ্রন্থে। প্রকৃত ইতিহাসটি উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি নির্মোহ দৃষ্ঠিভঙ্গি দিয়ে। হাজার বছরের ইতিহাসের যেমন মুসলিম শাসকদের চরিত্র বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি, তেমনি প্রাসঙ্গিকভাবে হিন্দু শাসক, বৌদ্ধ শাসক, খ্রিস্টান শাসকদের চরিত্রও তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে হয়েছে। সেই বিশ্লেষণে এসে পড়েছে দেশভাগ প্রসঙ্গও। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে একটি ব্রিটিশমুক্ত ভারত চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা ভারতভাগের মধ্যে দিয়ে হল কেন? এর জন্য কে বা কারা দায়ী –সেই প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি।
Facts বা ঘটনাই হল ইতিহাস –ইতিহাসের দেহ, মন এবং আত্মা। ইতিহাসে সেইসব ঘটনাসমূহের প্রাধান্য থাকা উচিত, যা দেশ ও জাতির জীবনে সুগভীর প্রভাব ছিল। ভারতের ইতিহাস বাস্তবে তেমনভাবে রচিত হয়নি, যা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যায়। মধ্য ও আধুনিক যুগের ইতিহাস রচনায় মুখ্য ঘটনাকে সযত্নে পরিহার করে যা নিতান্তই গৌণ, সেগুলিকেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে কল্পনার রং মিশিয়ে অভিনব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে গরম গরম পরিবেশন করা হয়েছে। আমরা পেয়েছি একটি বিকৃতি ইতিহাস। এই বিকৃতি ইতিহাস প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের হাত ধরেই। পরবর্তীতে অন্যান্য ঐতিহাসিকরা প্রভুতুল্য ব্রিটিশ রচিত ইতিহাস বেদবাক্য ভেবে নিয়ে বিকৃত ইতিহাসকে সম্প্রসারণ করে যাচ্ছেন। বস্তুত সংঘর্ষ হত্যালীলা যেমন মুসলিম শাসকদের সঙ্গে হিন্দু শাসকের সঙ্গে হয়েছে, ঠিক তেমনি মুসলিম শাসকদের সঙ্গে মুসলিম শাসকেরও হয়েছে। আবার হিন্দু শাসকের সঙ্গে হিন্দু শাসকদেরও যুদ্ধ হয়েছে। বৌদ্ধ শাসকদের সঙ্গে হিন্দু শাসকদের যুদ্ধও কিছু কম হয়নি। উপর্যুপরি হয়েছে। এমন নজির মোটেই বিরল নয়। হিন্দুশাসক যেমন মন্দির ভেঙেছে, ঠিক তেমনি মুসলিম শাসকরাও মসজিদ ভেঙেছে। এমন নজিরও বিরল নয়। এ তো রাজায় রাজায় বিষয়। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়েছে। ঠিকই (যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না সেই যুগে), কিন্তু নীচের তলায় হিন্দু-মুসলমানরা শতাব্দীর পর শতাব্দী বাস করেছে একসঙ্গে। বিবাদ-বিসংবাদ যে তাঁদের মধ্যে হয়নি, একথা কখনোই বলব না। তেমন বাদ বিবাদ তো সমধর্মী প্রতিবেশীদের মধ্যেও হয়। খুনোখুনি, রক্তারক্তি হয়েছে এবং আজও হয়।
ইতিহাসের সব উপাদান রক্ষিত আছে বিভিন্ন গ্রন্থাগার, সমসাময়িক পত্রপত্রিকা, মিউজিয়াম, ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ, দিল্লির ন্যাশনাল আর্কাইভস, বিভিন্ন নথি ও দলিলে। যেহেতু আমার এই গ্রন্থখানির মূল উপজীব্য ভারতের ইসলাম ও মুসলিম, সেই কারণে আমার প্রয়োজন হয়েছে মুসলিম সম্রাটদের আত্মজীবনী, সম্রাটদের ঘনিষ্টদের কর্তৃক রচিত জীবনী, দিনলিপি, বিভিন্ন সময়ে ভারতের আসা পরিব্রাজকদের রচনা এবং মুসলিম ঐতিহাসিকদের ইতিহাস। মুসলিম ঐতিহাসিকদের ইতিহাস আমি খুব গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করেছি। মুসলিম ঐতিহাসিকরা সবিস্তারে মধ্যযুগের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন, এ বিষয়ে নিশ্চয়ই কারোর দ্বিমত থাকার কথা নয়। ইতিহাসের বিপুল আকর গ্রন্থ থেকে তথ্য চয়ন করেই আমার এই গ্রন্থের প্রাণসঞ্চার করেছি। ভারত অতিক্রম করে বিশ্বভ্রমণও করতে হয়েছে। আলোচিত হয়েছে স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের হিন্দু-মুসলিমের অবস্থান বিষয়েও।
পশ্চিমের প্রচার মাধ্যম দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের খুনি, সন্ত্রাসী, অপহরণকারী হিসাবে চিত্রিত করে আসছে। ফলে সারা পৃথিবী জুড়ে ইসলাম-বিদ্বেষীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর এই বিদ্বেষ থেকে তুলে আনা তথ্য বিকৃতি করা ‘ইতিহাস’। অথচ বাস্তবে কেবল একদল মুসলিমই সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়িত। তাঁদের অধিকাংশরই শুরু হয় কোনো-না-কোনোভাবে প্রত্যক্ষ মার্কিন সহায়তায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। আবার প্রতিটি মুসলিম দেশেই যে চরমপন্থী মুসলিম সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিশাল উদারনৈতিক গোষ্ঠী সদা তৎপর সে ঘটনাগুলিও আলোচিত হয় না। পাশাপাশি এটাও আলোচিত হয় না যে, শুধু একটি দেশই (আমেরিকা) ১৯৪৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি দেশটির অস্ত্রে নিহত হয়েছে ২ থেকে ৩ কোটি বেশি নিরীহ বেসামরিক মানুষ। এটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের প্রায় দ্বিগুণ। ১০০ বছর আগের ভয়াবহ ওই যুদ্ধে নিহত হয় প্রায় দেড় কোটি মানুষ। সম্প্রতি ‘Global Research : Centre for Research on Globalization’ প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্টে গত ৭৩ বছরে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যাযজ্ঞের এ চিত্র উঠে এসেছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, যুদ্ধে প্রত্যেক নিহত ব্যক্তির বিপরীতে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে। এর মানে মার্কিন বাহিনীর হাতে আহত হয়েছে আরও অন্তত ২০ থেকে ৩০ কোটি মানুষ। সিরিয়ার কোনো সন্ত্রাসী হত্যাযজ্ঞ করলে সব মুসলিমকেই সন্ত্রাসবাদী বলা হয়। কিন্তু আমেরিকার সন্ত্রাসীরা হত্যাযজ্ঞ করলে সব খ্রিস্টানকে সন্ত্রাসবাদী বলার রীতি নেই। উলফার (ULFA) ৯৮% সদস্য যাঁরা হিন্দু, তাঁরা সন্ত্রাসবাদী নন। তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামী। বরো জঙ্গিগোষ্ঠীর ১০০% সদস্য হিন্দু, তাঁরা সন্ত্রাসবাদী নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামী। সারা দেশের এক তৃতীয়াংশ জেলা মাওবাদীদের দখলে এবং ওই মাওবাদী সংগঠনের ৯৫% সদস্য হিন্দু সন্ত্রাসসৃষ্টিকারী নন। তাঁরাও দেশপ্রেমিক। পশ্চিমবঙ্গে কামতাপুরী সন্ত্রাসবাদীর ১০০% সদস্যই হিন্দু, যাঁদের কাছে AK47 দুধ ভাত, তাঁরা সন্ত্রাসবাদী নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামী। গান্ধীজির হত্যাকারী নাথুরাম গডসে সন্ত্রাসী নন। আলোচনায় আসে না, জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা বলছে ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত কাশ্মীরে ইন্ডিয়ান আর্মির নির্যাতনে নিহত কাশ্মীরের নাগরিক ৯৪,৫০৪ জন, থানা হেফাজতে মৃত্যু ৭,০৬২ জন, ঘরবাড়ি ধ্বংস ১,০৬,২৬১ টি, বিধবা হয়েছে ২২,৮২৪ জন নারী, অনাথ হয়েছে ১,০৭,৫৮৬ জন শিশু, ইন্ডিয়ান আর্মি কর্তৃক গণধর্ষণের ঘটনা ১০,৪৩৩ জন। এই ক্ষুদ্র এলাকার বিদ্রোহ দমনে রাখতে ভারত মোতায়েন করেছে প্রায় দশ লক্ষ সেনাসদস্য। কাশ্মীরিরা যুগের পর যুগ জীবন দিয়ে যাচ্ছে, আর আমাদের অনেক মিডিয়া হেডলাইন করেছে তাঁরা সন্ত্রাসী, স্বাধীনতা সংগ্রামী হতেই পারে না। নেতারা বলছেন ওরা সন্ত্রাসী। আচ্ছা, কাশ্মীরিরা যদি মুসলিম না-হয়ে হিন্দু বা অন্য ধর্মের নাগরিক হত, তাহলেও কি তাঁদের সন্ত্রাসী বলতাম এমন অবলীলায়? দেশভাগের পটভূমি, বাংলাদেশ যুদ্ধ ইত্যাদি যুগসন্ধিক্ষণে পাকিস্তানি খান সেনাদের নৃশংস ধ্বংসলীলা যা বিশ্বের ইতিহাসে বেনজির বললে অত্যুক্তি হবে না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে সর্বহারার লাল ফৌজ কেবল বার্লিনে প্রবেশ করার পর কী ভয়াবহ ধর্ষণ লীলায় মেতে উঠেছিল, সেটাও আমরা ভুলে যাইনি। এন্টোনি বিভরের “Berlin : The Downfall 1945” শীর্ষক গ্রন্থটিতে এসব তথ্য দলিল হিসাবে নথিভুক্ত করা আছে। ৮ থেকে ৮০ কোনো নারী রেহাই সেদিন পাননি। প্রখ্যাত নাট্যকার জাখর আগ্ৰানেনকো প্রথম জীবনে পূর্ব প্রাশিয়াতে পদাতিক বাহিনীর অফিসার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর ডায়েরির এই পাশবিক বিবরণে তিনি কী লিখেছেন– “Red Army soldiers don’t believe in ‘individual liaisons’ with German women–nine, ten, twelve men at a time– they rape them on a collective basis.” একজন নারীকে একজন নয়, দশ এমনকি বারো জন মিলে ধর্ষণ করা হত। পঁচানব্বই হাজার থেকে এক লক্ষ তিরিশ হাজার নারীকে এই ভাবে ভোগ করেছিল সেই বিজয়ী লাল ফৌজ। এঁরা সন্ত্রাসী নয়?
ফিলিস্তিনি মুসলিমদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অথবা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মুখে আত্মরক্ষার জন্য ইরানের যুদ্ধকৌশলকে সন্ত্রাসী তৎপরতা বলে ব্যাখ্যা করা হয়। কোনো অমুসলিম দেশ এই আগ্রাসনের নিন্দা করে না। প্রাচ্যতত্ত্ব মুসলিমদের সম্পর্কে যে নমুনা নির্মাণ করেছে সেটাই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে গোটা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর। একদল সন্ত্রাসী মুসলমানের নমুনা দেখিয়ে বলা হচ্ছে ইসলাম সন্ত্রাসের ধর্ম, মুসলমানেই সন্ত্রাসী। আরবি নামধারী দেখলেই অমুসলিমরা ভীত সন্ত্রস্ত! প্রধানত তেল ও ইরানকেন্দ্রিক পশ্চিমী মনোভাব আরোপিত হয় গোটা মুসলিম বিশ্বের উপর। সেইসঙ্গে আগুনে ঘি ঢালার মতো ঘটনা ঘটাতে থাকে একদল জঙ্গি মুসলমান। এঁরা বিভিন্ন দেশে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়, মানুষ হত্যা করে, ধ্বংসের হুমকি দেয়। ফলে এই জঙ্গি মুসলমানদের ভাবমূর্তিই আরোপিত হয় মুসলমান ও ইসলাম ধারণাটির উপর। ইসলাম ‘শান্তির ধর্ম’ ‘শান্তির ধর্ম’ বলে চিৎকার করেও মোম আর গলানো যাচ্ছে না।
ইতিহাস হল এমন একটা বিষয়, যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সততায় সন্দেহের উদ্রেগ করে। সবচেয়ে বেশি ইতিহাসেই বিকৃতি ঘটানো হয়েছে নির্দয়ভাবে। শাসনের ইতিহাসে ঐতিহাসিকরা যেমন খলনায়ককে নায়ক বানিয়েছেন, তেমনি নায়ককে খলনায়ক বানিয়ে ছেড়েছেন। কোনো ইতিহাসই চূড়ান্তভাবে রচিত হয়নি। তাই পুনঃপুনঃ ইতিহাস রচনার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। নানাবিধ কারণেই জানা ইতিহাসকেই পুনরায় নতুন করে রচিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রসদ যুক্ত করে। বরং বলা ভালো যে, যে ঘটনাগুলোকে কার্পেটের নীচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, সেগুলিই টেনে আলোর নীচে উপস্থাপন করাই পুনর্লিখনের উদ্দেশ্য। খুব কম ক্ষেত্র ব্যতীত প্রায় প্রতিটি ঐতিহাসিকই নিজের বা নিজেদের আদর্শিক ও রাজনৈতিক বিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে নিজেদের অপরাধ ও ব্যর্থতাকে গোপন করতে বা কৃতকর্মকে মানবসমাজে বৈধতাঘটিত ঘটনার ইতিহাসকে বিকৃত করেন। এই বিকৃত ইতিহাসের কারণে সমাজ ও সভ্যতায় যে ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়ার কথা, সেটা আমাদের দেশ পাকিস্তান বাংলাদেশকে সরেজমিন করলেই যথার্থতা অনুধাবন করা যায়। এই বিকৃতির ইতিহাসের কারণেই আদর্শিক, মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সবকটিরই শিকার হচ্ছে ভারতের মুসলিম সমাজ। ইতিহাসের এমন অনেক খুঁটিনাটি ঘটনা, তথ্য ও উপাত্তকে অপ্রয়োজনীয় বা তুচ্ছ ভেবে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যান, যেসব তথ্য-উপাত্ত পাঠকমহলে আলোকিত উপস্থাপিত হয়, তাহলে নিশ্চয় মানবমনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
ইতিহাসে পক্ষপাতিত্ব থাকবে না, তা হয় না? কারোর ইতিহাস কেমনভাবে রচিত হবে তা নির্ভর করে কে রচনা করছেন তাঁর উপর, তাঁর চিন্তা-চেতনার উপর। যিনি ইতিহাস-বিশ্লেষক, তিনি বিশ্লেষণ করে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করবেন। ভারতে ইসলাম ভারতীয় মুসলমান’ গ্রন্থটি সেই জরুরি একটি সামাজিক প্রয়াস বলা যেতে পারে। এই গ্রন্থের আলোচিত বিষয়গুলি হয়তো শেষ কথা বলছে না, কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে আলোচনার প্রধান প্রধান সূত্রগুলি ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি। গবেষণা চলুক, আলোচনা অব্যাহত থাক, পুরোনো তর্কগুলি নতুন করে উপস্থাপিত হোক। ইতিহাস চর্চার এটাই তো প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।
কলেবর বৃদ্ধি হবে এই আশঙ্কায় প্রথম খণ্ডটি ৭১১ থেকে ১৮৫৭ সালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হল, অর্থাৎ শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ পর্যন্ত। এরপর ১৭৫৭ সালের সিরাজ-উদ্-দৌল্লা থেকে পরবর্তী স্বাধীনোত্তর ভারতের সময়কাল পর্যন্ত মুসলমান শাসক ও মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছা রইল দ্বিতীয় খণ্ডে। পরিশেষে জানাই, এই গ্রন্থ প্রণয়নে যাঁদের উৎসাহ ও সহযোগিতা ছিল, যাঁরা আমার নিত্য সহচর শিক্ষানুরাগী পরম শ্রদ্ধাভাজন মানুষদের রইল আমার অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা। বিশেষ করে যাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জ্ঞানদানে আমি ইসলাম সম্বন্ধ জ্ঞাত হয়েছি, সেই প্রাজ্ঞ বন্ধুবর জনাব মুহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুমকে দিলাম আমার সর্বক্ষণের সাহচর্য। যাঁর আগ্রহে এই গ্রন্থটি পাঠকদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, তিনি হলেন এই গ্রন্থের প্রকাশক। তাঁর জন্য রইল অকুণ্ঠ ভালোবাসা।
সর্বোচ্চ আন্তরিকতা সত্ত্বেও গ্রন্থটিতে ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে যেতে পারে অসতর্কতায়, সহৃদয় পাঠকদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার একান্ত অনুরোধ রইল। পরবর্তী সংস্করণে বিদগ্ধ পাঠকদের গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ অনুসারে গ্রন্থটি সংশোধন ও সংযোজন করার ইচ্ছা আমার রইল। এই গ্রন্থখানি যদি পাঠকদের সামান্যতম চিন্তার খোরাক জোগাতে সক্ষম হয়, তাহলে আমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করব। সামাজিক প্রজ্ঞা এইসব কিছু থেকেই প্রসারিত হোক। জ্ঞানচর্চার সেটাই তো মূল উদ্দেশ্য, অন্তত এমনটাই তো হওয়া উচিত।
অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
Leave a Reply