ভারতের সংস্কৃতি – ক্ষিতিমোহন সেন
ভূমিকা
সব মানুষই এক ভগবানের সন্তান, অথচ দেশেই মানুষের মধ্যে নানাভাবে নানা রকমের ভেদ-বিভেদ রয়েছে। কিন্তু মানুষের সব-চেয়ে সাংঘাতিক রকমের সামাজিক ভেদ ভারতবর্ষে। আবার সব-চেয়ে সকল মানবের মধ্যে সাম্য ও অভেদের বাণী উচ্চারিত হয়েছেও এই ভারতেই। ভারতের মহাপুরুষেরা সকলেই মানবের মধ্যে নানা ভেদ-বিভেদের অবসান করবার মহামন্ত্রই ঘোষণা করে গিয়েছেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে ভারতে যা আছে এবং যা হওয়া উচিত—অর্থাৎ এখানকার ভূত ও ভব্যের মধ্যে একটা মস্ত অসংগতি বরাবরই চলে আসছে।
ভারতের নানা ভেদবিভেদের মধ্যে যোগস্থাপনার জন্য যুগে যুগে ভগবান একে একে তাঁর আপন যোগ্যতম সব সাধককে পাঠিয়েছেন। এই যোগ আজও সম্পূর্ণ হয়নি। যতদিন এই যোগস্থাপন-চেষ্টার প্রয়োজন থাকবে ততদিন তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ সাধকদের ক্রমাগতই এদেশে পাঠাবেন।
মহাবীর, বুদ্ধ, রাম, কৃষ্ণ, বসব, রামানন্দ, রবিদাস, কবীর, নানক, চৈতন্য, দাদু প্রভৃতি প্রাচীন যুগের সব যোগসাধক মহাপুরুষের দল এই কাজই করে গিয়েছেন, এই যুগেও মহাপুরুষের পর মহাপুরুষ এই কাজই করেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন। যুগগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেন, ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারাতে এইটেই হল মর্মকথা।
ভারতে ভগবান বৈচিত্র্যকেই চেয়েছেন বলে এখানে কোনো প্রবল সভ্যতা বা সংস্কৃতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল অন্য সভ্যতা বা সংস্কৃতিকে বিনাশ করেছি। সবাই পাশাপাশি বন্ধুভাবে বাস করেছে। বিভিন্নতা থাকলেই বা বিদ্বেষবুদ্ধি কেন জাগবে। এখানে ভগবান হয়তো চান সকল সাধনার মধ্যে মৈত্রী এবং সকল সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয়ের সাধনা। জগতে আর কোথাও ঠিক এমনতরোটি দেখা যায় না। সেখানে এক ধর্ম বা সংস্কৃতি অন্য সব দুর্বল ধর্ম ও সংস্কৃতিকে মেরে ফেলে সমস্যা সোজা করে দিয়েছে। সে সহজ পথ ভারতের নয়।
ভারতের শাস্ত্রে যা সারতম কথা তাই দিয়েই ভারতীয় সাধনার পরিচয় বা ধর্মের তাই হয়। প্রদীপের পরিচয় তার শিখায়, মানুষের পরিচয় তার প্রাণে। হীরার খনির মধ্যে হীরা অল্প, মাটিই বেশি। কবীর বলেছেন “হীরোকী ওবরী নহী”, খনিতে হীরা স্তূপাকৃতি হয়ে নেই। তবু হীরার নামেই তার পরিচয়।
ইহলোক নিয়ে সাধনা হল সংস্কৃতি, অনন্তলোক নিয়ে সাধনা হল ধর্ম। ভারতের সংস্কৃতি ও ধর্ম দুয়ের মধ্যেই অনেক যুগের অনেক মানব-মণ্ডলীর নানা দান মিলে মিশে আছে। সংস্কৃতি হতেও ধর্মেই প্রবর্তকদের পরিচয় সহজে পাওয়া যায়, তাতেও দেখা যায় ভারতের হিন্দুধর্ম কোনো বিশেষ যুগে কোনো বিশেষ মহাপুরুষের দ্বারা প্রবর্তিত হয়নি। সেইজন্য হিন্দুধর্মকে এক হিসাবে অপৌরুষেয় ধর্ম বলা যেতে পারে। ভারতে যত সংস্কৃতি বা ধর্ম এসেছে সবার সব দান একত্র মিলিত হয়েছে যে ধর্মে, তাকে কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রবর্তিত ধর্ম না বলে তার জন্মভূমির ভৌগলিক নামে তাকে ‘ভারতীয় ধর্ম’ বলাই সংগত। ভারতকে হিন্দ্ বলে। তাই এই দেশের সর্ব সংস্কৃতির সমন্বয়ে হিন্দের অর্থাৎ ভারতের, হিন্দু অর্থাৎ ভারতীয় ধর্ম বলাই ঠিক। ধর্মসাধনায় এই সমন্বয়কেই মহাত্মা কবীর ভারতের তপস্যা বলছেন। তাই তাঁর পন্থকে ‘ভারতপন্থ’ বলা হয়েছে। কবীরের শিষ্য যুগলানন্দ তাঁর সব গ্রন্থ সম্পাদনের সময় নিজেকে ‘ভারতপথিক’ যুগলানন্দ বলেই পরিচয় দিয়েছেন।
মহাত্মা কবীরের সেই ‘ভারতপন্থ’ আজও সম্পূর্ণ সাধিত হয়নি। রামমোহন রামকৃষ্ণ রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি মহাপুরুষেরা সবাই এই ভারতপন্থেরই সেবায় জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। এই গ্রন্থে ভারতের সাধনার ও সংস্কৃতির সেই গতিটি অল্পের মধ্যে সহজ কথায় দেখাবার চেষ্টা করে গিয়েছে। বর্তমান যুগেই নয়, মধ্যযুগেই নয়, ভারতের আদিকাল হতেই ভগবানের নির্দেশে এই সাধনা নিঃশব্দে নিরন্তর চলেছে।
Leave a Reply