ভারতের কৃষি : একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ – অপরাজিতা মুখোপাধ্যায়
প্রথম সংস্করণ: এপ্রিল ২০২১
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
.
ভূমিকা
আমাদের দেশে মাতৃভাষায় অর্থনীতি বিষয়ে বই লেখার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল বিষয়ভিত্তিক নানা ইংরাজি শব্দের যথাযথ প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া। লেখায় ব্যবহৃত যে-কোনও প্রতিশব্দ পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এমন আস্থায় থিতু হওয়ার জন্য ভাষার ওপর নিজের দখলদারি নিয়ে যে-আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন, ততটা আমার সত্যিই নেই। তাই প্রথমেই এই দুঃসাহসের জন্য পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
ভারতের কৃষি-অর্থনীতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে ইতিপূর্বে অনেক অর্থনীতিবিদই অতি উচ্চস্তরের গবেষণাভিত্তিক কাজ করেছেন, অনেকে এই বিষয়ে বইও লিখেছেন। যেমন, এঁদের মধ্যে বাংলায় বই রচনা করেছেন আমার গবেষণা-শিক্ষক, শ্রদ্ধেয় প্রয়াত অধ্যাপক অশোক রুদ্র। তাঁর বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ৩৫ বছর আগে। ১৯৮৫ সাল অবধি ভারতীয় কৃষি-অর্থনীতির প্রকৃতি বিষয়ে তিনি আলোচনা করেছিলেন। সামগ্রিকভাবে সেই আলোচনার মূল কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যটি মার্কসীয় পদ্ধতির অনুসারী ছিল, যেমনটি আছে এই গ্রন্থেও। কিন্তু উল্লেখ্য হল, দু’টি আলোচনার অন্তর্বর্তী বিষয়বস্তুগুলি পুরোপুরি এক নয়, সাদৃশ্য যেখানে আছে, সেখানেও তুলনামূলক গুরুত্ব, বিস্তার ও বিশ্লেষণ পদ্ধতির দিক থেকে সেগুলি আমূল ভিন্ন।
পুঁজিবাদ বিকাশের ধ্রুপদী প্রক্রিয়াটি কী তা বোঝার জন্য আমরা যেমন ইউরোপের ভূমিব্যবস্থায় বিবর্তনের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মূল বৈশিষ্ট্যকে বোঝার চেষ্টা করেছি, তেমনই বুঝতে চেয়েছি জাপানের বিশেষ অবস্থায় ক্ষুদ্র জোত মারফত পুঁজিবাদের বিকাশ প্রক্রিয়াকে। অন্যদিকে বিপ্লব-পরবর্তী চিন ও রাশিয়ায় ভূমিসংস্কারের সাহায্যে জমি পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে ছোট জোত গঠন দিয়ে শুরু করে ক্রমশ পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধীর পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে সমবায় ও যৌথ চাষের ভিত্তিতে বড় জোতভিত্তিক কৃষি-অর্থনীতি গড়ে তোলার সমাজতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটিও বোঝার চেষ্টা করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য কৃষি-অর্থনীতির বিকাশে সামন্ততান্ত্রিক ভূমিসম্পর্কের অবসানের বিভিন্ন বিকল্প পদ্ধতি অনুধাবন করে আমাদের দেশের ভূমিসংস্কারের প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতাগুলি বোঝা। অশোক রুদ্র ব্রিটিশ যুগের অবস্থার সঙ্গে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তুলনা করে দেখিয়েছিলেন উৎপাদন-সম্পর্ক কোথায় কতটা পরিবর্তিত হয়েছে। আমরা সমস্যার প্রকৃতিকে অনুসন্ধানের জন্য আরও পিছিয়ে মুঘল যুগের কৃষি-অর্থনীতির মধ্যে এর স্বরূপ ও মূলের সন্ধান করেছি ও এই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি যে, ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে মুঘল আমলের সামন্ততন্ত্রের মৌল বৈশিষ্ট্যের কোথায় কতটা পরিবর্তন হয়েছিল, এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগের ভূমিসংস্কার কি সত্যিই উৎপাদন-সম্পর্কের পিছিয়ে-পড়া মৌল বৈশিষ্ট্যগুলিকে সমূলে উৎপাটিত করে নতুন প্রগতিশীল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে ’৮০-র দশকের মাঝামাঝি অবধি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে আপাত শান্তির পরিবেশ বজায় ছিল সেই অবস্থায় আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের সঙ্গে এ দেশের পারস্পরিক সম্পর্কে প্রাধান্য পেয়েছিল পরামর্শ, আর্থিক সাহায্য ও পুঁজি বিনিয়োগের কর্মসূচি। স্বাধীনতার পর আমেরিকার পরামর্শ ও নানাপ্রকার আর্থিক সমর্থনে সরকারি উদ্যোগে গ্রামীণ উন্নয়নের বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়। অশোক রুদ্রের রচনায় কৃষি উন্নয়নের তৎকালীন ধরনটির খুব বিস্তৃত বিশ্লেষণ আছে। বর্তমান আলোচনায় আমরা এই কালপর্বকে অবশ্যই বাদ দিইনি, কিন্তু তাঁর কাজের পর এই বিষয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজনাতিরিক্ত বলে মনে হওয়ায় এ প্রসঙ্গে অতি সংক্ষিপ্ত উল্লেখমাত্র করা হয়েছে। ভূমিসংস্কারের আলোচনায় আমরা বিস্তৃতভাবে ক্ষুদ্র জোতের মাধ্যমে পুঁজিবাদ বিকাশের সম্ভাবনা বিষয়ে আলোচনা করেছি। অন্যদিকে সবুজ বিপ্লবের আলোচনায় এই নতুন প্রযুক্তি কোন রাজ্যে কতটা গৃহীত হয়েছে এবং বিভিন্ন খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লবের অবদান কতটা তা আমরা নতুন ভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি। একদিকে যেমন ভারতের সব রাজ্যকে বিবেচনায় এনে রাজ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে, অন্যদিকে সারা ভারতের জন্য গম ছাড়াও নানা শস্যের পরিসংখ্যান-গত বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি।
১৯৮৫ সালের পরবর্তী সময়ে ভারতের কৃষি-অর্থনীতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। এই পরিবর্তনগুলি ভারতের কৃষি-অর্থনীতির অন্তর্নিহিত দুর্বলতার নানা দিককে নতুন ভাবে উদ্ঘাটিত করেছে। ভারতীয় কৃষি-অর্থনীতির সমস্যাকে আমরা দেখেছি উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে টিকে থাকা বিভিন্ন পিছিয়ে-পড়া বৈশিষ্ট্যের কার্যকারিতার ফল হিসেবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে এই পিছিয়ে-পড়া উৎপাদন-সম্পর্কের বৈশিষ্ট্যগুলি আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের সঙ্গে ভারতীয় অর্থনীতির সম্পর্কের প্রকৃতির দ্বারা এবং সেই প্রকৃতি পরিবর্তনের নানা পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যগুলির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সমস্যাগুলি নিত্য নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। এর প্রভাব কীভাবে আমাদের কৃষি-অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে, কৃষি-অর্থনীতির ঐতিহাসিকভাবে টিকে থাকা অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলি এইসব পরিবর্তনের ফলে আজ কোন নতুন রূপ নিচ্ছে তার অনুসন্ধান করা হয়েছে এই আলোচনায়।
সপ্তম অধ্যায়ের পর থেকে কৃষি-উৎপাদনের বাজার-ব্যবস্থায় এই পিছিয়ে-পড়া বৈশিষ্ট্যগুলিই কীভাবে আবার নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে তার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এরপর পর পর অধ্যায়গুলিতে বাজার-ব্যবস্থার এই বৈশিষ্ট্যগুলি কীভাবে কৃষি উৎপাদন-ব্যবস্থার পরিবর্তনে বাধা দিয়ে কৃষির উন্নয়ন বিঘ্নিত করেছে এবং একই সঙ্গে কৃষকের জীবনযাত্রায় সংকট ডেকে এনেছে, তাকে আত্মহত্যার পথে নিয়ে গেছে, তার বিশ্লেষণ করা হয়েছে, ও শেষে ভারতের কৃষি-অর্থনীতিতে নতুনভাবে দেখা দেওয়া কিছু কিছু সাধারণ সমস্যা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি।
বইটি যখন প্রস্তুতিপর্বের প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন কৃষি-উৎপাদনের বাজার সংক্রান্ত তিনটি বিল পার্লামেন্টের স্বীকৃতি পেয়ে আইন হিসেবে গৃহীত হয়েছে (১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০)। নতুন আইনগুলি নিয়ে একটি অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনা পরিশিষ্ট আকারে সংযুক্ত করা হল বইয়ের শেষে। কৃষি-বাজার সংক্রান্ত আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন গবেষক-পর্যবেক্ষকের পর্যবেক্ষণ থেকে চলতি বাজার-ব্যবস্থা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নতুন আইনগুলি সেইসব অভিপ্রেত প্রয়োজন আদৌ মেটাতে পারছে কি না তা দেখা অত্যন্ত জরুরি বলে আমাদের মনে হয়েছে।
এই গ্রন্থে ভারতের কৃষি-অর্থনীতির ওপর আমার বিভিন্ন সময়ের গবেষণা এবং তৃণমূল স্তরের সমীক্ষাগুলি থেকে পাওয়া বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ কাজে লাগানো হয়েছে। তৃণমূল স্তরের সমীক্ষাগুলিতে তথ্য সংগ্রহের জন্য আমাকে সাহায্য করেছেন আমার প্রাক্তন ছাত্র কালীশংকর চট্টোপাধ্যায় ও প্রয়াত ফজলুল রহমান। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে গবেষণা-সহায়ক হিসেবে সুব্রত, শৌনক, শুভদীপ, মিঠুন, রুনা, প্রীতিকণা, দীপান্বিতা, অনুকা প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এই বিষয়ে সাহায্য করার জন্য অসংখ্য গ্রামবাসীর কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। আমার নিজস্ব গবেষণা ছাড়াও আমার তত্ত্বাবধানে দেবজিৎ রায়ের গবেষণা থেকে পাওয়া কিছু পর্যবেক্ষণ আমি ব্যবহার করেছি। ভারতের কৃষির উৎপাদন-সম্পর্কের বিবর্তনের ইতিহাসের জন্য আমি বিভিন্ন ঐতিহাসিকের পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করেছি।
ভারতীয় অর্থনীতির সমস্যা সম্পর্কে ধারণা গঠনে আমার শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক অশোক রুদ্রের অবদানের জন্য আমি তাঁর কাছে বিশেষভাবে ঋণী। তাঁর সঙ্গে নানা আলোচনা ও বিতর্ক আমাকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। এছাড়া এই বিষয়ে যাঁদের সঙ্গে নানা সময়ে আলোচনা করে আমি বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছি তাঁরা হলেন অধ্যাপক রতন খাসনবিশ, আলোক মুখোপাধ্যায় এবং বীরেন ঘোষ। অধ্যাপক সৌম্য চক্রবর্তীর সঙ্গে এ বিষয়ে নানা আলোচনা আমাকে বিশেষভাবে উপকৃত করেছে। বিশেষত গবেষণা ও লেখার কাজ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমি বীরেন ও সৌম্যের কাছে নানা দিক থেকে বিভিন্ন প্রকার সাহায্য পেয়েছি। রমেন মণ্ডল আমার পরিসংখ্যান বিষয়ক কাজে সহায়তা করে আমাকে বিশেষভাবে উপকৃত করেছেন। আমার কাজটি সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে তাঁর সাহায্য ছিল অত্যাবশ্যক ও অপরিহার্য। এঁদের সকলকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। বিশেষ কৃতজ্ঞতা আনন্দ পাবলিশার্সের কমিশনিং এডিটর মলয় ভট্টাচার্যের প্রতি, তাঁর উৎসাহ ও সহযোগিতার জন্য।
এই বইটি আমার শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক অশোক রুদ্রর স্মৃতিতে শ্রদ্ধাসহ উৎসর্গ করলাম।
অপরাজিতা মুখোপাধ্যায়
অক্টোবর ২০২০, শান্তিনিকেতন
Leave a Reply