ভানু সমগ্র – ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়
আমার বাবা
১৯৪৭ সালে আমার জন্ম। তার পর থেকেই বাবাকে দেখছি, যবে থেকে চোখ ফুটল। কিন্তু দেখলাম আর কোথায়? সারাদিন বাবা ব্যস্ত। ঘুম থেকে ওঠার আগেই তিনি বেরিয়ে যান, ঘুমিয়ে পড়ার পরে ফেরেন।
সিনেমা, নাটক, ফুটবল, রেডিও, এমনকী যাত্রা—কোথায় বাবা নেই! কারও বিপদ হয়েছে, কেউ টাকাপয়সার অভাবে পড়েছেন, বাবা সবার আগে হাজির।
দেশভাগের আগেই, ১৯৪১ সালে বাবা দাদু-ঠাকুমাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। ফলে দেশভাগের পরে যখন দলে-দলে সব হারিয়ে ‘বাঙালরা’ এপারে আসতে লাগলেন, তখন বাবা ছিলেন তাঁদের বড় ভরসা। বাবা তখন সরকারি চাকরি পেয়ে গেছেন। বলতেন, ‘যুদ্ধের বাজার বলেই চাকরি পেয়েছিলাম।’ বাবা হাসিমুখে তাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেন। বলতেন, ‘ভালোই তো। আমাদের সংস্থান আছে বলেই সাহায্য করতে পারছি। এ সুযোগ ক’জন পায়!’
আমাদের বাড়িটা ছিল বেশ অদ্ভুত। মাত্র দেড় কামরার ভাড়া বাড়ি। মা নীলিমা মুখোপাধ্যায় ছিলেন নামী গায়িকা। তাঁকেও তেমন পেতাম না। গান রেকর্ডিং করে এলেন, এসেই খুচখুচ করে তরকারি কুটতে বসে গেলেন। আবার কোনো-কোনো সন্ধেবেলা দাদু-ঠাকুমাকে খাবার দিয়ে ফাংশনে গাইতে বেরিয়ে গেলেন।
এভাবেই বড় হয়েছি। মা’কে তবু মাঝেমধ্যে পেয়েছি, বাবাকে জীবনের প্রথম দশ বছরে সবসাকুল্যে দশ ঘণ্টা পেয়েছি কিনা সন্দেহ। আসলে কাজ শেষ হয়ে গেলেও বাবা বাড়ি ফিরতেন না। তাস আর আড্ডার নেশা ছিল সাংঘাতিক।
বাবার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা শুরু বোন বাসবীর বিয়ের পর থেকে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৩। এই সময়েই আমি জেনেছি বাবার জীবন। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মোহিতলাল মজুমদার বা এরকম মানুষদের গল্প সেসময়েই বাবার মুখে শুনি। বাবা জসীমউদ্দিনের কবিতা আবৃত্তি করতেন রেডিওয়, সিনেমার ডায়ালগ মুখস্থ বলে যেতে পারতেন, এসব আমার দেখা-জানা সব ১৯৭৫ সালের পরে।
তবে ছোটবেলা থেকে দেখেছি অনেক বড় বড় শিল্পীকেই। আমাদের দেড় কামরার ভাড়া বাড়ির বারান্দায় বসে রিহার্সাল দিয়েছেন তাবড় সব অভিনেতা, গান গেয়েছেন তালাত মামুদ থেকে উৎপলা-সতীনাথ।
বাবার লেখালেখি, রেকর্ডের কৌতুক-নকশা…কখন যে করতেন জানি না। জুবিলী পার্কের দেড় ঘরের বাসা থেকে যখন আমরা উঠে চারু অ্যাভিনিউয়ের একটু বড় জায়গায়, সেই বাড়ি বদলের সময় অনেক লেখা-ছবি উদ্ধার হয়।
সব ঝুরঝুরে হয়ে গেছিল। ছুঁচো-ইঁদুরে কেটে ফেলেছে অনেক। তবুও যেগুলো রক্ষা পেয়েছিল, সেগুলোকে আমি চেষ্টা করেছি জড়ো করার। নইলে বাবার সব সৃষ্টি হারিয়ে যেতে বসেছিল।
এ ব্যাপারে ছোটভাইয়ের মতো প্রদীপ্ত রায়ের নাম বলতেই হয়। সে মাঝে-মাঝেই আসত। বলত, ‘গৌতমদা, কদ্দূর? ভানুকাকার লেখালেখি…ছবি কিছু করলেন?’ তারপর চুপচাপ। ভুলে যেত। ফের হয়তো বছর দুয়েক পরে হাজির হত। একই কথা। তবে প্রদীপ্তর তাগাদা না থাকলে কাজটা হত না।
ধন্যবাদ পত্রভারতীর ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় এবং মানসবাবু ও অন্যান্য কর্মীদেরও। প্রায় বছরখানেক ধরে কাজটা খুব যত্নের সঙ্গে ওঁরা করেছেন। ওঁদের উৎসাহ না থাকলে ‘ভানু সমগ্র’ প্রকাশ করা সম্ভব হত না।
গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা
৩রা আগস্ট, ২০১৭
Leave a Reply