ভাটির দেশ – অমিতাভ ঘোষ
ভাটির দেশ – অমিতাভ ঘোষ / অনুবাদ : অচিন্ত্যরূপ রায় / The Hungry Tide by Amitav Ghosh / প্রথম প্রকাশ: ২০০৪
লেখকের কথা
এই উপন্যাসের সব চরিত্রই কাল্পনিক। প্রধান দুই পটভূমি–লুসিবাড়ি এবং গর্জনতলারও বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই। কাহিনিতে উল্লিখিত অন্য কয়েকটা স্থাননাম, যেমন ক্যানিং, গোসাবা, সাতজেলিয়া, মরিচঝাঁপি এবং এমিলিবাড়ি, অবশ্য লেখকের কল্পনাপ্রসূত নয়। উপন্যাসে যেমনভাবে লেখা হয়েছে, সেইভাবেই একদিন গড়ে উঠেছে এইসব জায়গা।
আমার জ্যাঠামশাই শ্রী সতীশ চন্দ্র ঘোষ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের প্রতিষ্ঠা করা গোসাবার রুরাল রিকন্সট্রাকশন ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৯৬৭ সালে তার অকালমৃত্যুর আগে শেষ কয়েক বছর জ্যাঠামশাই হ্যামিলটন এস্টেটের ম্যানেজারের কাজও করেছেন। বহু বছর আগে দেখা ভাটির দেশের যে স্মৃতি আমার মনের মধ্যে রয়ে গিয়েছিল তার জন্য তার কাছে এবং তাঁর পুত্র সুব্রত ঘোষের কাছে আমি ঋণী।
পৃথিবীর প্রথম সারির সিটোলজিস্টদের মধ্যে অন্যতম, জেমস কুক ইউনিভার্সিটির শিক্ষিকা প্রফেসর হেলেন মার্শ, সম্পূর্ণ অচেনা এক লেখকের ই-মেলের জবাবে অকৃপণ ভাবে উজাড় করে দিয়েছেন তার জ্ঞানভাণ্ডার। তাঁর ছাত্রী, ওকালেয়া ব্রেভিরোষ্ট্রিস বিশেষজ্ঞ ইসাবেল বিসলির সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেওয়ায় অধ্যাপক মার্শের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার অবধি নেই। ইসাবেলের সঙ্গে মেকং নদীতে এক পর্যবেক্ষণ অভিযানে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাওয়ার ফলে ইরাবড়ি ডলফিন এবং সিটোলজিস্টদের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় হয়। ইসাবেলের মনোবল এবং নিষ্ঠার প্রতি আমার শ্রদ্ধাই একমাত্র তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতাকে ছাপিয়ে যেতে পারে।
ভাটির দেশের নানা অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করার সময় সঙ্গ পেয়েছি অনু জেলের। অনু সেই বিরল প্রজাতির জ্ঞানসাধকদের মধ্যে একজন, যাঁদের মধ্যে সমন্বয় ঘটেছে অসীম সাহস, অসাধারণ ভাষাজ্ঞান এবং বৌদ্ধিক শক্তির। সুন্দরবন অঞ্চলের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি বিষয়ে তার গবেষণালব্ধ ফল অদূর ভবিষ্যতেই প্রামাণিক বলে গণ্য হবে, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। চরিত্রের ঋজুতা এবং অন্যকে নিজের জ্ঞানের অংশভাক করে নেওয়ার ঔদার্যের যে পরিচয় আমি পেয়েছি তার জন্য অনুর প্রতি আমার ঋণ এবং কৃতজ্ঞতার সীমা নেই।
এক সময় পুরনো হ্যামিলটন এস্টেটের অংশ ছিল রাঙাবেলিয়া নামের একটি দ্বীপ। সেখানে তুষার কাঞ্জিলালের সঙ্গে আলাপ করার সৌভাগ্য হয় আমার। বাঙালি পাঠকের সঙ্গে নতুন করে তুষারবাবুর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এই অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পরিচালনায় টেগোর সোসাইটি অব রুরাল ডেভেলপমেন্ট (টি এস আর ডি) আজ ভাটির দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চেহারা পালটে দিয়েছে। রাঙাবেলিয়ার টি এস আর ডি হাসপাতালে অত্যন্ত যত্ন নিয়ে চিকিৎসা করা হয় রোগীদের। এখানকার কর্মীদের নিষ্ঠাও পৃথক উল্লেখের দাবি রাখে। এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে যার কথা আমার মনে পড়ছে তিনি হলেন ডাক্তার অমিতাভ চৌধুরী। ভাটির দেশে যাতায়াতের সূত্রে যখনই ডাক্তার চৌধুরীকে দেখেছি, আদর্শবাদের মূর্ত প্রতীক বলে তাকে মনে হয়েছে আমার। উল্লেখ করা প্রয়োজন, টি এস আর ডি-র কর্মক্ষেত্র এখন আর শুধু পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই সীমিত নেই। নারী অধিকার রক্ষা থেকে শুরু করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য বা কৃষি উন্নয়নের মতো নানা ক্ষেত্রে অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছে এই সংস্থা। সে কাজের ক্রমবর্ধমান বিস্তার এবং কার্যকারিতাই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতাদের প্রতি সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে মরিচঝাঁপির ঘটনা কলকাতার বাংলা এবং ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল। বর্তমানে একটিমাত্র ইংরেজি লেখায় সে ঘটনার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। সেটি হল রস মল্লিকের লেখা Refugee Resettlement in Forest Reserves : West Bengal Policy Reversal and the Marichjhapi Massacre (The Journal of Asian Studies, 1999, 58:1, pp. 103-125)। নীলাঞ্জনা চ্যাটার্জির অসাধারণ গবেষণাপত্র, Midnight’s Unwanted Children: East Bengali Refugees and the Politics of Rehabilitation (Brown University) কখনও প্রকাশিত হল না, সে আমাদের দুর্ভাগ্য। মরিচঝাঁপি বিষয়ে অনু জেলেও একটি প্রবন্ধ লিখেছেন : Dwelling on Marichjhampil
রাইনের মারিয়া রিলকের দুইনো এলিজির যে কয়টি বঙ্গানুবাদ এখানে ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলির বেশিরভাগই কবি বুদ্ধদেব বসুর অনুদিত। চমৎকার এই অনুবাদগুলি উনিশশো ষাটের দশকে প্রথম প্রকাশিত হয়। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা সংগ্রহের পঞ্চম খণ্ডে (সম্পাদনা মুকুল গুহ, ১৯৯৪, দে’জ প্রকাশনী, কলকাতা) কবিতাগুলি পাওয়া যায়।
আরও যাঁদের কাছ থেকে নানা ধরনের সাহায্য এবং আতিথেয়তা পেয়েছি তারা হলেন: লীলা এবং হরেন মণ্ডল, সান্টা ম্যাডালেনা ফাউন্ডেশন, মোহনলাল মণ্ডল, অনিল কুমার মণ্ডল, অমিতেশ মুখোপাধ্যায়, পরীক্ষিৎ বর, জেমস সিম্পসন, ক্লিন্ট সিলি, এডওয়ার্ড ইয়াজিজিয়ান, অভিজিৎ ব্যানার্জি এবং ডাক্তার গোপীনাথ বর্মন। বিশেষ ধন্যবাদের দাবি রাখেন আমার বোন, ড. চৈতালী বসু। এ ছাড়াও যাদের কাছে আমার ঋণের অন্ত নেই, তারা হলেন জ্যানেট সিলভার, সুসান ওয়াট, কার্ল ব্লেসিং, অ্যাগনেস ক্রুপ এবং কার্পফিঙ্গার এজেন্সির বার্নি কাৰ্পফিঙ্গার–যাঁদের সযত্ন প্রয়াস ছাড়া মূল ইংরেজি বইটি প্রকাশ করা সম্ভব হত না।
লিখতে গিয়ে সব সময় যাঁদের অমূল্য সহায়তা পেয়েছি তারা হলেন আমার স্ত্রী দেবী, কন্যা লীলা এবং পুত্র নয়ন। এঁদের কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য।
.
অনুবাদ প্রসঙ্গে
তারপর, যেতে যেতে যেতে যেতে এক নদীর সঙ্গে দেখা। এক নয়, অনেক। শত শত শাখাপ্রশাখা নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে দখিন বাংলার সীমানা জুড়ে। ছোট বড় একশোরও বেশি দ্বীপ জড়িয়ে, ডাইনে ঘুরে বয়ে বেঁকে এই মোহনা সেই মোহনার জল গায়ে মেখে অবশেষে সাগরে গিয়ে যাত্রা শেষ হয়েছে তাদের। পথের দু’ধারে কোথাও জেলেদের গাঁ, কোথাও গঞ্জ, আর বেশির ভাগটাই জুড়ে রয়েছে বাঘ-কুমিরে ভরা বাদাবন–সুন্দরবন। ভয়ানক সেই গহিন অরণ্য। দিনমানেও সেখানে ঢুকতে কেঁপে ওঠে অতি বড় সাহসীর বুক।
এই নদী-খাঁড়িতে জড়ানো আঠারো ভাটির দেশকে ঘিরে গড়ে উঠেছে যে কাহিনির কাঠামো, সে কাহিনি পড়তে পড়তে কখনও মনে হয়নি যে তা কোনও বিদেশি ভাষায় লেখা হয়েছে। পড়া শেষ হওয়ার পর, রেশ কিছুটা কাটলে মনে হয়েছে কেমন হত সত্যি সত্যিই যদি বাংলাতেই লেখা হত এই বই? এইভাবেই অনুবাদের চিন্তা এসেছিল মাথায়। তারপর নানা জায়গায় খোঁজ করে লেখকের ঠিকানা জোগাড় করা এবং অনুমতি চেয়ে চিঠি লেখা–সে আরেক পর্ব।
অনুমতি অবেশেষে মিলল, উপন্যাসের প্রথম কয়েক পাতার বাংলা করে লেখককে । পাঠানোর পর। কোনও ঝুঁকি না নিয়ে দু’রকম ভাবে অনুবাদ করা হয়েছিল সেই কয়েক পাতা– একটি আক্ষরিক অনুবাদ, আর অন্যটিতে এমনভাবে লেখার চেষ্টা করা হয়েছিল। যাতে পড়তে পড়তে কখনও মনে না হয় যে পাঠক আর গল্পের মাঝখানে অন্য কোনও ভাষার আবছায়া কোনও পরদা রয়ে গেছে।
অনুবাদের দ্বিতীয় ধরনটিই পছন্দ হয়েছিল অমিতাভ ঘোষের। পরের চিঠিতে লেখক STATTGA, “I just finished reading your sample pages. I wanted to write at once to let you know that I liked them very much–especially the second version where you took a somewhat more impressionistic approach (although ideally it might be best to aim for a mix of the literal and the impressionistic).
“It was a strange and exhilarating experience for me to read my own words translated into Bangla. When I was writing this book I often felt that I had trans lated these words from Bangla into English. Having read your pages I can tell that to see this book translated into Bangla will give me more joy than I can express.”
লেখকের ইচ্ছানুযায়ী literal এবং impressionistic এই দুই ধারার মাঝামাঝি পথেই চলার চেষ্টা করা হয়েছে এই অনুবাদে। সে চেষ্টা কতদূর সফল হয়েছে তার বিচারের দায় পাঠকের।
অনুবাদ শুরু করার পর থেকে সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের হাতে তুলে দিতে সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে তিন বছর। আর এই পুরো সময়টাতেই অনবচ্ছিন্ন ভাবে অনুবাদককে উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন লেখক–অধিকাংশ অনূদিত পরিচ্ছেদ পড়েছেন মন দিয়ে, কখনও পরিবর্তন করতে বলেছেন কিছু শব্দ, বাদ দিতে বলেছেন অপ্রয়োজনীয় কিছু পঙক্তি। অনুবাদ যাতে মূলের সুরকে ঠিকমতো ধরতে পারে তার জন্য একাধিকবার সুন্দরবনে ঘুরে আসতে পরামর্শ দিয়েছেন অনুবাদককে, সঙ্গে করে নিয়েও গেছেন একটি দ্বীপে, আলাপ করিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় জেলে পরিবারের সঙ্গে, উপন্যাসটি লেখার সময় যাদের খড়ে-ছাওয়া ছোট্ট বাড়িতে মাসাধিককাল কাটিয়েছিলেন লেখক।
এ সব কিছুই ঋদ্ধ করেছে অনুবাদককে নানা ভাবে, সহজ করে দিয়েছে অনুবাদের কাজ। সে বাবদে লেখকের কাছে অনুবাদকের যে ঋণ জমা হয়েছে তা শোধ হওয়ার নয়।
অনুবাদকর্ম চলাকালীন ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহায়তায় চার্লস ওয়ালেস ইন্ডিয়া ট্রাস্টের এক ফেলোশিপে বিলেতে গিয়ে মাস তিনেক কাজ করার সুযোগ ঘটেছিল অনুবাদকের। ইস্ট অ্যাংলিয়া ইউনিভার্সিটিতে ব্রিটিশ সেন্টার ফর লিটারারি ট্রানস্লেশন-এ ট্রানস্লেটর ইন রেসিডেন্স হয়ে কাটানোর সময় বারো সপ্তাহে একটানা অনুবাদ করা হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছু পাতা। তা না হলে পুরো সময়ের সাংবাদিক এই অনুবাদকের পক্ষে বইয়ের কাজ শেষ করে উঠতে দেরি হত আরও বেশ কয়েক মাস। এই সুযোগ পাওয়ার জন্য চার্লস ওয়ালেস ইন্ডিয়া ট্রাস্ট এবং ব্রিটিশ সেন্টার ফর লিটারারি ট্রান্সস্লেশন (বি সি এল টি)-এর কাছে অনুবাদক কৃতজ্ঞ। এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হবে একজনের নাম–বি সি এল . টি-র ডিরেক্টর আমান্ডা হপকিনসন। শ্রীমতী হপকিনসনের সস্নেহ সহযোগিতা না থাকলে প্রবাসে নির্ভার মনে লেখার কাজ এতটা এগোনো অনুবাদকের পক্ষে সম্ভব হত না।
আরও যে কিছু মানুষের উৎসাহ সব সময় অনুবাদকর্মে প্রেরণা জুগিয়েছে তাদের মধ্যে অনুবাদকের পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও রয়েছেন মার্কিন দেশ প্রবাসী বন্ধু প্রণবকুমার ভট্টাচার্য। প্রতিটি পরিচ্ছেদ অনুবাদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোৎসাহে তার প্রুফ দেখেছেন প্রণব, ধরিয়ে দিয়েছেন খুঁটিনাটি অনেক ত্রুটি। এই মানুষগুলির কাছ থেকে যে উৎসাহ এবং সাহায্য পাওয়া গেছে অনুবাদক তা নিজের পাওনা হিসেবেই গ্রহণ করেছেন, তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কথা কখনও মনে হয়নি।
আর যে তিনজনের কাছে ঋণ রয়ে গেছে, তারা হলেন কবি বুদ্ধদেব বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং মুকুল গুহ। রিলকের দুইনো এলিজির যে কটি পঙক্তি এই বইয়ে ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলি এই তিন কবির অনুবাদ (দে’জ কর্তৃক প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসু কবিতাসংগ্রহ, ৫ম খণ্ড এবং রাইনার মারিয়া রিলকের দুইনো এলিজি, ভাষান্তর শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও মুকুল গুহ)।
‘উপহার’ অধ্যায়ে জহুরানামার দীর্ঘ উদ্ধৃতি ভাটির দেশে প্রচলিত আব্দুর রহিম সাহেবের পুস্তিকা ‘বনবিবির কেরামতি’ অর্থাৎ ‘বনবিবি জহুরানামা’ থেকে নেওয়া হয়েছে। আব্দুর রহিম সাহেবের কাছে এ জন্য অনুবাদকের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই।
অচিন্ত্যরূপ রায়
কলকাতা
Leave a Reply