ভাঙ্গাগড়া – ইসলামিক প্রেমের উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার
০১.
গ্রীষ্মের অপরাহ্ন। বেলা তখন তিনটে। রোদের তেজ কমেনি। লোজন ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। যুবাইদা খানম চার ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন। শবনমের চোখে ঘুম নেই, তবু ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে মাথা তুলে মা, মেজভাই ও হোট দুভাই বোনের দিকে তাকিয়ে দেখল, তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ধীরে ধীরে চৌকি থেকে নেমে আস্তে করে দরজা খুলে বাইরে এসে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চেীধুরীদের বাগানের দিকে ছুট দিল। বাগানটা বেশি দূরে নয়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাগানের ভিতরে ঢুকে আতাহারকে দেখতে না পেয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগল।
আতাহার আগেই এসেছে। শবনমের দেরি দেখে রেগে ছিল। তারপর তাকে আসতে দেখে সাজা দেওয়ার জন্য একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে তার দিকে লক্ষ্য রাখল।
শবনম তাকে খুঁজে না পেয়ে ভাবল, তাহলে আতাহার কি এখনও আসেনি? তারপর একটা গাছের গোড়ায় বসে পথের দিকে চেয়ে রইল।
আতাহার পিছন দিক থেকে পা টিপে টিপে এসে দুহাতে তার দুচোখ চেপে ধরল।
শবনম চমকে উঠে তার হাত ধরে বুঝতে পারল আতাহার। মুখ ভার করে বলল, যাও তোমার সঙ্গে কথা বলব না। আমার ভয় করেনা বুঝি? আসা অবধি তোমাকে না দেখে এমনিতেই ভয় লাগছিল।
আতাহার চোখ ছেড়ে দিয়ে তার পাশে বসে বলল, কিসের ভয় শুনি?
কিসের আবার? এই ভর দুপুরে কেউ কোথাও নেই। তুমি না হয়ে যদি অন্য কেউ হত?
এই সময় কেউ এদিকে ভুলেও আসবে না। আশ পাশের সবাই জানে চৌধুরীদের বাগানে ভূতের আড্ডা।
ভূতেরা যদি আমাকে ধরতে আসত?
আতাহার হেসে উঠে বলল,আরে দূর, ভূত বলে আবার কিছু আছে না কি?
এক্ষুণি তুমি তো বললে।
লোকেরা বলে, তাই বললাম। আমি ভুত-টুত বিশ্বাস করি না। কতদিন থেকে আমরা এখানে খেলাধুলা করছি, কই কোনোদিন ভূত দেখেছি? ভুত বলে কিছু থাকলে, তারা আমাদেরকে কিছু বলেনি কেন?
তোমার কথা অবশ্য ঠিক। কিন্তু গ্রামের সবাই তবে বলে কেন? তা ছাড়া আম্মার মুখে শুনেছি। ভূতের অত্যাচারে চৌধুরীরা এখানে বাস করতে পারেনি। সবকিছু বেচে দিয়ে ঢাকা চলে গেছে।
আমিও আম্মার মুখে ঐ কথা শুনেছি। তবে আব্বার কাছে শুনেছি, চৌধুরীরা হিন্দু ছিল। তারা ভুত বিশ্বাস করে। আসলে ভূত বলে কিছু নেই। হিন্দুরা জ্বীনকেই ভূত বলে।
জ্বীনেরাও তো মানুষের ক্ষতি করে। শেখ পাড়ার কসিবুড়িকে মাঝে মাঝে জ্বীনে ধরে। তুমিও তো সে কথা জান?
হ্যাঁ জানি! জ্বীন হল আগুনের তৈরি। তাই তারা খুব উগ্র। আর মানুষের মতো তাদের মধ্যেও অনেক জাত আছে। যারা ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছে, তারা ভালো। আর অন্যরা মানুষের ক্ষতি করে। তবে সহজে করে না।
শবনম ভয় পেয়ে বলল, এখানে যদি জ্বীন থাকে?
তা থাকতে পারে? তাতে আমাদের কি?
তারা যদি আমাদেরকে মেরে ফেলে।
আতাহার হেসে উঠে বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আল্লাহ যার যতদিন হায়াৎ রেখেছে, তার এক সেকেন্ড আগেও কেউ কাউকে মেরে ফেলতে পারবে না। তবে ভয় দেখাতে পারে। আমার মনে হয়, এখানে আগে জ্বীনেরা থাকলেও এখন নেই। তা না হলে এতদিনে তাদের কিছু না কিছু আলামত আমরা পেতাম।
শবনম ভীতকণ্ঠে বলল, তোমার কথা হয়তো ঠিক। তবু আমার যেন কেমন ভয় ভয় করছে। এখানে থাকতে আর মন চাইছে না।
আতাহার বলল, তুমি বড় ভীতু। ঠিক আছে, এক কাজ করবে, এখানে আসবার আগে অজু করে বিসমিল্লাহর সঙ্গে একবার সূরা এখলাস, সূরা ফালাক সূরা নাস পড়ে দুহাতে তালুতে ফুঁক দিয়ে হাত দুটো সারা শরীরে বুলোবে। এভাবে তিনবার করলে গা বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর আর জ্বীনেরা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
শবনম বলল,সত্যি বলছ?
হ্যাঁ সত্যি বলছি। এ কথা অনেক আগে আম্মা আমাকে বলেছে। আমি আগে রাত্রে ঘুমিয়ে স্বপ্নে ভয় পেয়ে খুব কাঁদতাম। আম্মা তা জানতে পেরে আমাকে বলল, ঘুমোবার আগে অজু করে ঐ তিন সূরা পড়ে গা বন্ধ করে ঘুমোতে। যে দিন থেকে আমি আম্মার কথামত গা বন্ধ করে ঘুমাই, সেদিন থেকে আর ভয়ের স্বপ্ন দেখিনি।
ঠিক আছে, আমিও তাই করব। কিন্তু আম্মার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আর এখানে আসা যাবে না।
কেন?
এখানে এসে তোমার সাথে খেলাধুলা করতে আম্মা নিষেধ করেছে।
কেন?
তা আমি জানি না।
চল এক্ষুনি তোমার আম্মার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করব, কেন তোমাকে আসতে নিষেধ করেছে। এই কথা বলে শবনমের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল।
দুজনেরই বাড়ি দৌলতখান গ্রামে। তবে এপাড়া ওপাড়া। আতাহার যখন চতুর্থ শ্রেনীতে পড়ে তখন শবনম দ্বিতীয় শ্রেনীতে। একদিন টিফিনের সময় খেলার মাঠে আতাহার শবনমকে কাঁদতে দেখে তার কাছে এসে বলল, এই মেয়ে তুমি কাঁদছ কেন?
শবনম হেঁচকি তুলতে তুলতে একটা ছেলের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ঐ ছেলেটা আমাকে শুধু শুধু মেরেছে।
আতাহার বলল, শুধু শুধু কেউ কাউকে মারে বুঝি? তুমি নিশ্চয় তার সঙ্গে কিছু করেছ?
শবনম বলল, আমাকে খেলতে ডেকেছিল, আমি যাইনি বলে মেরেছে।
আতাহারের বয়স আট নয় বছর হলে কি হবে, বেশ লম্বা। স্বাস্থ্য খুব ভাল। শবনমকে বলল, তুমি এস আমার সাথে তারপর সেই ছেলেটার কাছে এসে বলল, একে মেরেছ কেন?
ঐ ছেলেটার নাম মফিজুর। বড় লোকের ছেলে। বলল, মেরেছি বেশ করেছি, তাতে তোর কি?
আতাহার তাকে একটা ঘুসি মেরে বলল, তুই কি মনে করেছিস ওর কেউ নেই?
মফিজুর মার খেয়ে পাল্টা মারামারি শুরু করল। দুজনে মারামারি করতে করতে মাটিতে পড়ে গেল।
এমন সময় হেড মাস্টার দেখতে পেয়ে বেত নিয়ে এসে দুজনকেই দুচার ঘা লাগিয়ে বললেন, তোমরা স্কুলে কি মারামারি করতে এসেছ? তারপর তাদেরকে যার যার ক্লাসে যেতে বললেন।
তারপর থেকে শবনম আতাহারের সঙ্গে স্কুলে ও বাড়িতে খেলাধুলা করে। আতাহার প্রায় প্রতিদিন শবনমদের বাসায় যায়। শবনমকেও মাঝে মাঝে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এক সঙ্গে খেলাধুলা ও স্কুলে লেখাপড়া করে মানুষ হচ্ছে। কখনো নদীর পাড়ে ছুটোছুটি করে। তবে বেশিরভাগ দিন তারা চৌধুরীদের বাগানে খেলাধুলা করে। এখন আতাহার এইটে আর শবনম সিক্সে পড়ে।
শবনমের সঙ্গে তাদের বাড়িতে গিয়ে আতাহার তার মাকে বলল, চাচীআম্মা, আপনি নাকি শবনমকে আমার সঙ্গে খেলতে বারণ করেছেন?
যুবাইদা খানম আতাহারকে চেনেন। তার ফুফু ওনার চাচাতো ভাবি। তা ছাড়া যেদিন স্কুলের একটা ছেলে শবনমকে মেরেছিল এবং সে জন্য আতাহার সেই ছেলেটার সাথে মারামারি করেছিল, তা জানার পর থেকে তাকে বড় স্নেহ করেন। বললেন, না বাবা মানা করিনি। তবে চৌধুরীদের বাগানে যেতে নিষেধ করেছি। ওখানে জ্বীন আছে।
আতাহার বলল, আমরা তো অনেক দিন থেকে ওখানে খেলাধুলা করি, কই একদিনও তো জ্বীন দেখলাম না।
যুবাইদা খানম হেসে উঠে বললেন, পাগল ছেলের কথা শোন, জ্বীনদেরকে কি মানুষ দেখতে পায়? ওরা আগুনের তৈরি। ওদেরকে মানুষ সহসা দেখতে পায় না। তোমরা যখন খেলাধুলা কর, তখন হয়তো জ্বীনেরা সেখানে থাকে না। যেদিন তাদের সামনে পড়ে যাবে, সেদিন তোমাদের ক্ষতি করবে। তোমরা ছেলে মানুষ। তোমাদেরকে একা পেলে মেরে ফেলতে পারে। খবরদার আর কোনোদিন ওখানে খেলতে যাবে না।
আতাহার বলল, ঠিক আছে, আপনি যখন নিষেধ করছেন তখন শবনমকে নিয়ে আর যাব না; কিন্তু আমি একা যাবই। আমি জ্বীন-টীন কাউকে ভয় করি না।
যুবাইদা খানম আতঙ্কিতস্বরে বললেন, না বাবা না, তুমিও যেও না। ওদের সামনে পড়ে গেলে তোমার ক্ষতি করবে।
এমন সময় শবনমের বাবা সাখাওয়াত হোসেন, সেখানে এসে স্ত্রীর শেষ কথা শুনতে পেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে কার সামনে পড়ে গেলে ক্ষতি করবে?
যুবাইদা খানম বললেন, শবনম আর আতাহার চৌধূরীদের বাগানে খেলতে যায়। তাই ওদেরকে জ্বীনের ভয় দেখিয়ে যেতে নিষেধ করলাম।
সাখাওয়াত হোসেন চট্টগ্রামে কাস্টমস অফিসে চাকরি করেন। দুই তিন মাস অন্তর বাড়িতে আসেন। এক সপ্তাহ থেকে চলে যান। তাই গ্রামের সবাইকে চেনেন না। স্ত্রীর কথা শুনে বললেন, হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথাই বলেছ। চৌধুরীদের বাগানে জ্বীন থাকে। তারপর আতাহারের দিকে চেয়ে বললেন, এই খোকা, তুমি কার ছেলে?
মোজাম্মেল খন্দকারের।
ও তুমি তা হলে খন্দকার বংশের ছেলে? তোমার আব্বা কি জাহাজে চাকরি করেন?
জ্বি?
উনি চট্টগ্রামে থাকেন না?
জ্বি বলে আতাহার বলল, আমি এখন যাই তা হলে?
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, হ্যাঁ, আবার এস। আর শোন তোমরা কিন্তু আর চৌধুরীদের বাগানে খেলতে যাবে না।
জ্বি আচ্ছা বলে আতাহার চলে গেল।
আতাহার চলে যাওয়ার পর সাখাওয়াত হোসেন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, বেশ কিছু দিন আগের ঘটনা, বাড়ি আসব বলে আমি একদিন রিয়াজুদ্দিন বাজারে কিছু কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম। একটা দোকানে সওদাপাতি কিনে পকেটে হাত দিয়ে দেখি টাকা নেই। এ পকেট সে পকেট হাতড়েও পেলাম না। ভাবলাম, বাসে আসার সময় পকেটমার হয়ে গেছে। টাকাটার জন্য যা না দুঃখ হল, দোকানদারের কাছে অপমান হতে হবে ভেবে তার চেয়ে বেশি লজ্জা হতে লাগল। আমার অবস্থা দেখে দোকানদার বললেন, কি ভাই মনে হচ্ছে, টাকা খোয়া গেছে? আমি বললাম, দুটো পাঁচশ টাকার নোট পকেটে নিয়ে বেরিয়েছিলাম, মনে হয় বাসে পকেট মেরে দিয়েছে। আপনি মালগুলো বেঁধে এক সাইডে রেখে দিন, আমি বাসা থেকে টাকা নিয়ে আসি।
আমি যখন সওদার অর্ডার লিখাচ্ছিলাম তখন একজন লোক সদাই করে ব্যাগে ভরছিলেন। তিনি তখনও সেখানে ছিলেন। পকেটমার হয়ে গেছে শুনে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, কিছু মনে করবেন না, আপনার বাড়ি দৌলতখান না?
আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম, ত্যা কেন বলুন তো?
লোকটি বললেন, আমার বাড়িও দৌলতখান। আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমার নাম মোজাম্মেল খন্দকার। আপনার নামটা ঠিক মনে পড়ছে না।
আমি নাম বলে বললাম, এখানে কাস্টমস অফিসে চাকরি করি। দেশের বাড়িতে কম থাকি। সবাইকে তেমন চিনি না।
লোকটি বললেন, আমি এখানে জাহাজে চাকরি করি, দেশে কম থাকি। তবু কিন্তু আপনাকে দেখেই চিনেছি। তারপর দোকানদারকে বললেন, ওঁর কত টাকার সওদা।
দোকানদার স্লিপ দেখে বললেন, সাড়ে আটশো।
খন্দকার টাকাটা দোকানদারকে দিয়ে আমাকে বললেন, সওদাগুলো নিয়ে নিন ভাই। টাকাটা আমাকে এক সময় দিয়ে দেবেন। তারপর ঠিকানা দিয়ে বললেন, সময় করে একদিন আসবেন।
আমি পরের দিন তার বাসায় গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসি।
যুবাইদা খানম বললেন, ওঁকে আমি চিনি। ওঁর বোনকে আমার চাচতো ভাই বিয়ে করেছে।
.
০২.
সাখাওয়াত হোসেনের তিন মেয়ে তিন ছেলে। তাদের মধ্যে সবার বড় খালেদা মেজ সামসুদ্দিন। তারপর নাসির উদ্দিন, শবনম, কলিম উদ্দিন ও সাবার ছোট আসমা। উনি খুব ধর্মভীরু লোক। কাস্টমস অফিসে চাকরি করলেও ঘুষ খান না। সেই জন্যে অফিস স্টাফরা ওঁকে সুফি সাহেব বলে বিদ্রূপ করে। আল্লাহপাকের মেহেরবানীতে সত্যিই উনি সুফি। কিশোর বয়স থেকে লুঙ্গি অথবা পাজামা ও ঝুল পিরান এবং সব সময় মাথায় টুপি পরে থাকতেন। কখনো দাড়ী কামাননি। কোন দামী পোষাক পরেননি। ছাত্র জীবনেও ঐ পোষাকে স্কুল-কলেজে পড়েছেন। সে সময় সহপাঠিরা তাঁকে কাটমোল্লা আবার অনেকে সুফি সাহেব বলেও কটাক্ষ করত। পরবর্তিতে চাকরি জীবনেও ঐ একই পোষাকে অফিস করেছেন এবং এখনও করছেন।
ওঁর স্ত্রী যুবাইদা খানম দৌলতখান গ্রামের ধনী শিক্ষিত ফ্যামিলির একমাত্র মেয়ে। এইচ, এস,সি পাস করার পর বিয়ে হয়। ধনী ও শিক্ষিত ফ্যামিলির মেয়ে হলেও ধর্মীয় অনুশীলনে মানুষ হয়েছেন। তাই ধার্মিক স্বামী পেয়ে তিনি ধন্য। এই এলাকার প্রায় সবাই ধর্মের আইন-কানুন মেনে চলেন। মেয়েরা পর্দা মেনে চলে। স্কুল কলেজে পড়লেও বোরখা বা চাদর ব্যবহার করে। এসবের পিছনে ভারতের অধিবাসী পীরে কামেল হযরত মৌলানা কেরামত আলী জৌনপুরী(রাঃ)–এর বিরাট অবদান রয়েছে। শুধু এই এলাকায় নয়, সারা বাংলাদেশের (সাবেক পূর্ব বঙ্গের) মুসলমানরা বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অশিক্ষিত মুসলমানরা যখন অজ্ঞতার কারণে বেদাঁতের মধ্যে ডুবে ছিল। তখন তিনি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এসব অঞ্চলে সফর করে ইসলামের দ্বীপশিখা জ্বালাবার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। মুসলমানদেরকে বেদাঁতের অন্ধকার থেকে ইসলামের আলোতে ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতের পশ্চিম বঙ্গের আরো একজন পীরে কামেলের অবদান রয়েছে। তিনি হলেন, ফুরফুরা শরীফের পীরে আলা হযরত মৌলানা আবুবকর সিদ্দিকী (রাঃ)। আজও উনাদের বংশধরগণ বাংলাদেশ সফর করে মুসলমানদের মধ্যে দ্বীনি এলেম প্রচার করার জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
বর্তমান জৌনপুরের গদীনশীন পীর এখনো প্রতিবছর রমযান মাসে দৌলতখানে এসে মাসাধিক কাল থেকে ওয়াজ নসীহত করেন। দৌলতখান বাজারের দক্ষিণে বিরাট ঈদগাঁ। উনিই প্রতি বছর ঈদের নামাযের ইমামতি করেন। আশপাশের এবং বহু দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে ওঁর পিছনে ঈদের নামায আদায় করে।
সাখাওয়াত হোসেনের আসল বাড়ি ছিল হাজিপুর গ্রামে। এককালে দৌলতখান গ্রামের প্রায় বার মাইল পূর্বে মেঘনা নদী উত্তর দক্ষিণে প্রবাহিত ছিল। নদী ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বর্তমানে সেই দূরত্ব এক মাইলের মত ঠেকেছে। গত দুবছর ভাঙ্গন বন্ধ রয়েছে। নচেৎ এতদিনে দৌলতখান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেত। গত কয়েক বছরে হাজিপুরসহ এই ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম, সাহেবের হাটের দুই-তৃতীয়াংশ, সঈদপুর গ্রাম ও এই ইউনিয়নের বেশ কিছু অংশ, চৌকির হাট ও পুরো মেঘরা গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মেঘনা নদী পশ্চিম দিকের বহু গ্রাম যেমন গ্রাস করেছে তেমনি পূর্ব দিকে বড় বড় চরের সৃষ্টি করেছে। সেগুলোর নাম চর জহিরুদ্দিন, নলডোগী ও বৈকুণ্ঠপুর ইত্যাদি। এই চরের পূর্ব দিক দিয়েও মেঘনা প্রবাহিত। ওপারে নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলা। এই সব চরে দৌলতখান, হাজীপুর, সাহেবের হাটের মানুষেরা চাষাবাদ করে। ধান ও রবি ফসল প্রচুর জন্মায়। গরু, মহিষ হাঁস-মুরগি পালন করে। এখানকার উৎপন্ন সবকিছু দেশের বিভিন্ন জায়গায় লঞ্চ,স্টীমার ও গয়না নৌকায় করে পাঠান হয়। নদীর ভাঙ্গন রোধ করার জন্য সরকার দুবার উঁচু করে সুদীর্ঘ ভেড়ীবাঁধ দিয়েছিল। কিন্তু তা নদীগর্ভে চলে যায়। বর্তমানে যে ভেড়ীবাঁধ দেওয়া হয়েছে, তার দুপাশে চর ভাঙ্গা, অনেক গ্রামবাসী ঘোট ঘোট ঘর উঠিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। যারা এককালে। বড় বড় গৃহস্থ ছিল। যাদের বিশ, পঞ্চাশ ও একশো বিঘা ক্ষেতি জমি ছিল, তারা আজ নিঃস্ব হয়ে অভাব অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন অতিবাহিত করছে। তাদের বেশির ভাগ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে। কিছু সংখ্যক অবস্থাপন্ন লোক নদীর ভাঙ্গন দেখে দূর দূর গ্রামে জমি– জায়গা কিনে রেখেছিল। বাড়ি- ঘর ভেঙ্গে যাওয়ার পর তারা সেখানে এসে বসবাস করছে। আবার অনেকে সবকিছু হারিয়ে দূর গ্রামের আত্নীয়– স্বজনদের সহায়তায় জমি– জায়গা কিনে বাড়িঘর করে বসবাস করছে।
সাখাওয়াত হোসেনের বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে যাওয়ার পর দৌলতখান শ্বশুর বাড়িতে এসে বসবাস করছেন। বর্তমানে শ্বশুর-শ্বাশুড়ী কেউ বেঁচে নেই।
মোজাম্মেল খন্দকারের বাড়ি ছিল আলিপুর গ্রামে। তার একমাত্র বোনের বিয়ে হয়েছিল দৌলতখান গ্রামে। আলিপুর যখন নদীতে বিলীন হয়ে গেল তখন তিনি স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে বোনের বাড়িতে উঠেন। পরে ওঁর দুলাভাইয়ের বাড়ির অনতি দূরে তাদেরই জায়গায় ঘর উঠিয়ে বাস করছেন। এখানে আসার এক বছর পর ওঁর স্ত্রী চার বছরের এক ছেলে রেখে মারা যান। ঐ ছেলের নাম রহিম। মোজাম্মেল খন্দকারের এক চাচাতো বোনের বিয়ে হয়েছিল বাঠামারা গ্রামে। তার কোন ছেলে মেয়ে হয়নি। উনি রহিমকে মানুষ করার জন্য নিয়ে যান। আল্লাহপাকের কি শান, রহিমকে নিয়ে যাওয়ার দুবছর পর তাদের ঘরে সন্তান জন্মাল। এখন তাদের দুছেলে দুমেয়ে। রহিম তাদের। কাছে থেকে ম্যাট্রিক পাস করে।
মোজাম্মেল খন্দকার চেষ্টা চরিত্র করে বরিশালের পাতারহাটে নির্বাহী অফিসে রহিমকে চাকুরিতে ঢুকিয়ে দেন। রহিম একজনের বাড়িতে লজিং থাকত। তাদের দুটো ছেলেমেয়েকে সকালে ও রাত্রে পড়াতো। মেয়েটা তখন ক্লাস এইটে পড়ত। তার নাম সালেহা। ক্রমে সালেহা ও রহিমের ভালবাসা হয়। সালেহার মা-বাবা জানতে পেরে। তাদের বিয়ে দিয়ে দেন।
পরে মোজাম্মেল খন্দকার জানতে পেরে ছেলের উপর রাগ করে তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার এক বছর পর উনি আবার রফিকা বেগমকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহন করেন। এই স্ত্রীর গর্ভে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে আতাহার। তারপর দুই মেয়ে কুলসুম ও খাদিজা। সর্ব কনিষ্ঠ আনোয়ার। সৎ ছেলে বিয়ে করেছে শুনে রফিকা বেগম স্বামীকে বুঝিয়ে ছেলে- বৌকে বাড়িতে আনেন। মোজাম্মেল খন্দকার ছেলে- বৌকে গ্রহন করলেও বাড়িতে এনে ভিন্ন করে দেন। রহিম। মনে কষ্ট পেয়ে এক বাড়িতে না থেকে পাশে জায়গা কিনে বাড়ি করে সেখানে থাকে।
সালেহা বনেদী ঘরের মেয়ে। শ্বশুর তাদেরকে আলাদা করে দিলেও শ্বশুর শ্বাশুড়ীকে যেমন ভক্তি শ্রদ্ধা করে, তেমনি সৎ ননদ ও দেবরদের আদর যত্ন করে।
ঐ দিন আতাহার শবনমদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে মাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আম্মু, চৌধুরীদের বাগানে কি সত্যি সত্যি জ্বীন আছে?
রফিকা বেগম ছেলের কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন, হ্যাঁ আছে। কিন্তু তুই এখনও ছেলেমানুষ, জ্বীনদের কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
আতাহার বলল, আমি ও শবনম চৌধুরীদের বাগানে রোজ খেলতে যাই। সে কথা ওর আম্মা জানতে পেরে জ্বীনের কথা বলে ওখানে খেলতে যেতে নিষেধ করে বললেন, জ্বীনেরা মানুষের ক্ষতি করে। তোমরা কোনোদিন ওখানে খেলতে যেওনা।
রফিকা বেগম শবনমকে তাদের বাড়িতে অনেকবার আতাহারের সঙ্গে এসে। খেলাধুলা করতে দেখেছেন। সুন্দর ফুটফুটে শবনমকে তিনি খুব স্নেহ করেন। আদর করে কিছু না কিছু খেতে দেন। আজ ছেলের কথা শুনে বললেন, শবনমের আম্মা ঠিক কথা বলেছেন। আমিও তো তোকে ওখানে যেতে নিষেধ করেছি। তবুও যাস কেন? আর কোনোদিন যাবি না। জ্বীনদের ছোট ছেলেমেয়েদের উপর খুব লোভ। ফাঁক পেলে তুলে নিয়ে কোথায় চলে যায় কেউ বলতে পারে না।
তারপর থেকে আতাহার শবনমকে নিয়ে তাদের বাড়ির পিছনে বাগানে খেলা করে। শবনমের নানা জমি ভরাট করে এখানে সুপারি, নারিকেল, আম ও কাঁঠাল গাছ লাগিয়েছেন। এখন এইসব গাছে প্রচুর ফল হয়। বাগানটাও খুব বড়। এখানে খেলাধুলা করলেও আতাহারের মন চৌধুরীদের বাগানে যাবার জন্য ছটফট করে। এক ছুটির দিনে নাস্তা খেয়ে একা সেখানে গেল। যেখানে তারা খেলা করত, সেখানে বেশ কিছুক্ষণ বসে বসে ভাবতে লাগল, আজ যদি জ্বীন আসত, তা হলে দেখতাম জ্বীন দেখতে কেমন। হঠাৎ একটা বয়স্ক দাড়ীওয়ালা পাজামা পাঞ্জাবী পরা ও মাথায় টুপি দেওয়া লোককে। বাগানের ভিতর থেকে আসতে দেখে অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল।
লোকটা কলাকোপা সিনিয়র মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। নাম মহিউদ্দিন চৌধুরী। অত্যন্ত ধার্মিক। উনি জৌনপুর পীর সাহেবের খলিফা। সে জন্য অনেকে ওঁর হাতে বায়াত হয়েছেন। সবার কাছে উনি চৌধুরী হুজুর নামে খ্যাত। ওঁর কোন ছেলেমেয়ে নেই। ওঁরা দুভাই। ছোট ভাইয়ের একটা ছেলেকে পালক নিয়েছেন। সে দাখিল নবমে পড়ে। উনিই বাগানটা কিনেছেন। আজ দৌলতখান বাজারে একটা দরকারে এসেছেন। তাই আসার পথে বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। একটা ছেলেকে এই নির্জন বাগানে বসে থাকতে দেখে তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলে, কে তুমি?
আতাহার সালাম দিয়ে বলল, আমি এই গ্রামের মোজাম্মেল খন্দকারের ছেলে।
চৌধুরী হুজুর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, এখানে বসে আছ কেন? জান না এখানে জ্বীন থাকে?
জী জানি। জ্বীন দেখব বলেই তো বসে আছি।
চৌধুরী হুজুর অবাক হয়ে বললেন, জ্বীন কি, তা কি জান?
জী জানি। জ্বীন আগুনের তৈরী। তাদের মধ্যে ভালো মন্দ দুই-ই আছে। যারা মন্দ তারা মানুষের ক্ষতি করে। তবে আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
কেন?
আমি অজু করে তিন স্কুল পড়ে গা বন্ধ করে এসেছি।
চৌধুরী হুজুর তার পাশে একটা গাছের শিকড়ে বসে মৃদু হেসে বললেন, কার কাছে এসব শিখেছ?
আম্মার কাছে।
তোমার আম্মা জানেন, তুমি এখানে এসেছ?
না। আম্মা এখানে আসতে নিষেধ করেছেন। আমি লুকিয়ে এসেছি।
এটা তুমি ঠিক করোনি। তুমি তো দেখছি খুব ভালো ও বুদ্ধিমান ছেলে। ভালো ছেলেরা আম্মার কথার অবাধ্য হয় না। তুমি হলে কেন?
আমি আম্মা ও আব্বার কথার অবাধ্য হই না। জ্বীন দেখার আমার খুব সখ। তাই আম্মার শুধু এই নিষেধটাই শুনিনি।
চৌধুরী হুজুর বুঝতে পারলেন, ছেলেটা ভবিষ্যৎ জীবনে উন্নতি করবে। তার মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বললেন, কতদিন থেকে এখানে আসছ?
আগে আমি ও শবনম এখানে প্রতিদিন খেলাধুলা করতে আসতাম। শবনমের আম্মা জানতে পেরে আমাদেরকে জ্বীনের কথা বলে এখানে আসতে নিষেধ করেন। তারপর থেকে আমরা আর আসিনি। আজ জ্বীন দেখব বলে আমি একা এসেছি।
হুজুর বললেন, শবনম কে?
আমাদের পাড়ার সাখাওয়াত চাচার মেয়ে। ক্লাস সিক্সে পড়ে।
তুমি কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস এইটে।
তোমার রোল নাম্বার কত?
এক।
শবনমের রোল নাম্বার জান?
জি জানি, তারও রোল নাম্বার এক।
খুব ভাল। তা বাবা তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি একা একা বা শবনমকে নিয়ে এখানে এস না। জ্বীনেরা ছোট ছেলে-মেয়েদের একা পেলে তাদের ক্ষতি করে। আমি এখানে বাড়ি করার ইচ্ছা করেছি। বাড়ি করার পর আসবে।
এখানে জ্বীন আছে জেনেও বাড়ি করবেন? তারা আপনাদের ক্ষতি করবে না?
জ্বীনেরা নির্জন জায়গায় থাকে। লোকজন দেখলে এখান থেকে চলে যাবে। তা ছাড়া বড়দের তারা ক্ষতি করতে পারে না।
তা হলে কসিবুড়িকে জ্বীনে ধরে কেন?
কসিবুড়ি আবার কে?
তার বাড়ি আমাদের গ্রামেই।
তাই নাকি? কসিবুড়িকে জ্বীনে ধরে, না তার কোনো অসুখ, তাকে না দেখে। বলতে পারব না।
আমাদের গ্রামের সবাই বলে, কসিবুড়ির সঙ্গে জ্বীন থাকে। প্রতি বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে তার উপর ভর করে। সেই সময় তার বাড়িতে অনেক লোকের ভীড় হয়। তারা যে যার অসুখের কথা বললে, সেই জ্বীন আবার ঔষধ দেয়।
তুমি এসব কথা জানলে কেমন করে?
আম্মার মুখে শুনেছি।
ঠিক আছে, যে দিন কসিবুড়িকে জ্বীনে ধরে সে দিন আমি গিয়ে দেখব তোমার কথা কতটা সত্য। কারণ শোনা কথা বিশ্বাস করতে নেই। আর তুমি এখন ছেলেমানুষ, এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে না। এখন চল বাজারে যাই বলে চৌধুরী হুজুর দাঁড়িয়ে পড়লেন।
আতাহারও দাঁড়িয়ে বলল, আমি আপনার সঙ্গে বাজারে যাব কেন?
আহা চলই না বলে চৌধুরী হুজুর তার একটা হাত ধরে হাঁটতে লাগলেন। তারপর দৌলতখান বাজারে একটা মিষ্টির দোকানে এসে মিষ্টির অর্ডার দিয়ে আতাহারকে বললেন, তুমি খুব ভালো ছেলে, তোমাকে আমি মিষ্টি খাওয়াব।
আতাহার কিছুতেই রাজি হল না। বলল আপনি আমাকে মিষ্টি খাওয়াবেন কেন? আপনাকে তো আমি চিনি না।
মিষ্টি দোকানের মালিক হিন্দু। নাম মাখন বাবু। তিনি চৌধুরী হুজুর ও আতাহারকে চেনেন। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললেন, তুমি ছেলেমানুষ, তাই চৌধুরী হুজুরকে চেন না। তোমার বাবা চেনেন। উনি খুব মানি লোক। তুমি মিষ্টি খাও বাবা।
আতাহার তবুও খেল না। বলল, কারো কাছ থেকে কোনোকিছু খেতে আম্মা-আব্বা নিষেধ করেছেন।
চৌধুরী হুজুর তার কথা শুনে খুব খুশি হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার আব্বা বাড়িতে আছেন?
জি আছেন।
চৌধুরী হুজুর দোকানদারকে এক কেজি মিষ্টি প্যাকেট করে দিতে বললেন। তারপর প্যাকেটটা নিয়ে আতাহারের সঙ্গে তাদের বাড়ির কাছে এসে বললেন, তোমার আব্বাকে গিয়ে বল, কলাকোপা সিনিয়র মাদ্রাসার একজন শিক্ষক এসেছেন।
মোজাম্মেল খন্দকার তখন বাড়িতেই ছিলেন। আতাহার বাড়ির ভিতরে গিয়ে আব্বাকে কথাটা জানাল।
মোজাম্মেল খন্দকার ছেলেকে সঙ্গে করে বাইরে এসে ওঁনাকে দেখে সালাম দিয়ে ভক্তিগদগদ কণ্ঠে বললেন, হুজুর আপনি? আমার কি সৌভাগ্য? তারপর হাত মোসাফা করে বসবার রুমে এনে বসতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন হুজুর?
চৌধুরী হুজুর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আল-হামদুলিল্লাহ,আল্লাহপাকের রহমতে ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন?
আল্লাহপাকের রহমতে ও আপনার নেক দোয়ায় ভালো আছি। আতাহার বুঝতে পারল, আব্বা ওঁকে চেনেন। সে ওঁর দিকে চেয়ে ছিল। চৌধুরী হুজুর তার হাতে মিষ্টির প্যাকেটটা দিয়ে বললেন, এবার তো আর না করতে পারবে না? যাও ভিতরে গিয়ে খাও।
মোজাম্মেল খন্দকার বললেন, আপনি আতাহারকে চিনলেন কি করে?..
আতাহার ভাবল, উনি যদি বাগানে যাওয়ার কথা এবং মিষ্টি না খাওয়ার কথা বলে দেন, তা হলে আব্বা বকাবকি করবেন। তাই চৌধুরী হুজুর কিছু বলার আগেই ভিতরে চলে গেল।
চৌধুরী হুজুর সব কথা বলে বললেন, আপনি খুব সৌভাগ্যবান। আপনার এই ছেলে খুব ভালো। দোয়া করি, আল্লাহ হায়াতে তৈয়্যেবা দান করুন, নেক বখত করুন। আল্লাহ চাহেতো এই ছেলে একদিন আপনার বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। ওর পড়াশোনার দিকে খুব লক্ষ্য রাখবেন।
মোজাম্মেল খন্দকার বললেন, আপনার দোয়া আল্লাহ কবুল করুক। তারপর সাধ্যমত মেহমানদারী করলেন।
যাওয়ার সময় আব্বার কথামত আতাহার চৌধুরী হুজুরকে কদমবুসি করল। চৌধুরী হুজুর দোয়া করে বললেন, ইনশাআল্লাহ তোমার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে। তখন। চিনতে পারবে তো?
আতাহার লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, জি পারব।
চৌধুরি হুজুর সালাম বিনিময় করে চলে যাওয়ার পর মোজাম্মেল খন্দকার ছেলেকে বললেন, উনি খুব বুজুর্গ লোক। আবার দেখা হলে নিয়ে আসবি। আর উনি যা বলবেন, তাই মেনে চলবি।
জ্বি আচ্ছা বলে আতাহার খেলতে চলে গেল।
.
০৩.
সাখাওয়াত হোসেনের বড় মেয়ে খালেদা যে বছর দৌলতখান সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি পাস করে, সেই বছরই চরখলিফা থেকে তার বিয়ের সম্বন্ধ আসে।
দৌলতখানের পশ্চিম দিকে চরখলিফা গ্রামের আব্দুল মজিদ বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। সে বি.এ পাস করে দৌলতখান সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। খালেদাকে তার খুব পছন্দ। খালেদা এস. এস. সি পাস করার পর আব্দুল মজিদ মা-বাবাকে নিজের পছন্দের কথা বলে। ওঁরা ছেলের কথামত খালেদাকে এবং তাদের বাড়িঘর সবকিছু দেখে পছন্দ করেন। তারপর কিছু দিনের মধ্যে তাকে বৌ করে ঘরে নিয়ে আসেন।
এখন তাদের দুটি ছেলেমেয়ে। ছেলের বয়স চার, আর মেয়ের বয়স এক বছর। এতদিনে সাখাওয়াত হোসেনের বড় ছেলে সামসুদ্দিন বি.এ পাস করে এক বছর হল। চট্টগ্রামে ফায়ার সার্ভিসে চাকুরি করছে। নাসির উদ্দিন নাইনে, মেজ মেয়ে শবনম এইটে, ছোট ছেলে কলিম উদ্দিন সিক্সে আর ছোট মেয়ে আসমা ফোরে পড়ে।
আতাহার এখন টেনে পড়ছে। শবনমের সঙ্গে আতাহারের সম্পর্ক আরো গাঢ় হয়েছে। কিন্তু ইদানিং শবনমকে তার মা আতাহারের সঙ্গে মেলামেশা করতে দিচ্ছে না। মেয়ের স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলে রাগারাগি করে বলেন, তুই এখন বড় হয়েছিস। আগের মতো আতাহারের সঙ্গে মেলামেশা করলে লোকে মন্দ বলবে। শবনম মায়ের কথা কানে নেয় না। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে আতাহারের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে তারপর বাড়ি ফিরে। ফলে প্রতিদিনই তাকে মায়ের বকুনী হজম করতে হয়।
এর মধ্যে আতাহারের বাবা মোজাম্মেল খন্দকার অসুস্থ হয়ে বাড়িতে এলেন। চট্টগ্রামে কোম্পানীর ডাক্তারকে দেখিয়েছেন। কিন্তু কোনো কাজ না হওয়াতে বাড়িতে আসেন। এখানকার ডাক্তার বললেন, এ রোগের চিকিৎসা বাড়িতে হবে না। ভোলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নেওয়ার তিন দিন পর মোজাম্মেল খন্দকার মারা গেলেন।
ওঁর মারা যাওয়ার খবর পেয়ে আতাহারদের বাড়ির সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।মোজাম্মেল খন্দকারের মৃত্যুর পর তাদের সংসারে দুর্যোগ নেমে এল। উনি চরফ্যাসনে বেশ কিছু জমি কিনেছিলেন। সেই সময় সার্ভিস থেকে অনেক টাকা তুলেছিলেন। মারা যাওয়ার পর মাত্র বিশ হাজার টাকার পাওনা ছিল। ঐ বিশ হাজার টাকা তুলতে অফিসারদের পেছনে আতাহারকে দশ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। বাকি দশ হাজার টাকা তোলার পিছনে তাকে বেশ কয়েক বার ঢাকা-চট্টগ্রাম ছুটাছুটি করতে হল। তাতে তার লেখাপড়ার অনেক ক্ষতি হল। তারপর ঐ টাকা দিয়ে আব্বার কুলখানি করার পর যা হাতে ছিল, তা থেকে আবার সভাই রহিমকেও দিতে হল।
আতাহার লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কিছু করার চিন্তা ভাবনা করল।
রফিকা বেগম একদিন ছেলেকে ডেকে কষ্ট করে আর একটা বছর পড়াশোনা করে ম্যাট্রিক পরীক্ষাটা দিতে বললেন।
আতাহার বলল, সংসার কিভাবে চলবে সেই চিন্তায় আমার আর লেখাপড়া করতে মন চায় না। চরফ্যাসনের জমি থেকে যা ধান আসে তাতে ছয় সাত মাসের খোরাকী হয়। তারপর কি খাব। ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়া, বাজার খরচ, কাপড়-চোপড় কিভাবে কেনা হবে ভেবে পাচ্ছি না। তাই ঠিক করেছি, ঢাকা গিয়ে একটি চাকরির চেষ্টা করব।
রফিকা বেগম বললেন, তুই ছেলেমানুষ। তার উপর তোর কোন ডিগ্রী নেই, তোকে কে চাকরি দেবে? তার চেয়ে একটু কষ্ট করে ম্যাট্রিকটা পাস করে নে। তারপর যা করার করবি।
আতাহার বলল, বললাম না, লেখাপড়া করতে আমার আর ভালো লাগে না। তারপর বলল, ঢাকায় বড় মামা আছে, খালা-খালু আছে। তাদেরকে ধরলে ইনশাআল্লাহ একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই।
রফিকা বেগম বললেন, তুই যখন আমার কথা শুনবি না তখন তাই কর।
আতাহার অনেক দিন থেকে স্কুলে না গেলেও ছুটির সময় রাস্তায় শবনমের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন দেখা করে। প্রথম যে দিন আতাহার তাকে লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার কথা বলল, সেদিন শবনম তাকে অনেক কথা বুঝিয়ে লেখাপড়া ছাড়তে নিষেধ করল। তারপর আতাহার যখন তার আর্থিক অনটনের কথা বলল তখন শবনম চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, আমার একটা কথা রাখবে আতাহার ভাই?
অন্যায় না হলে নিশ্চয় রাখব।
আমি তোমার কাছে অন্যায় আব্দার করব, ভাবতে পারলে?
আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে মাথা ঠিক নেই। তাই হয়তো হঠাৎ ভুল করে কথাটা বলে ফেলেছি। মনে কষ্ট নিও না। বল কি তোমার আব্দার?
আমার জমানো কিছু টাকা আছে। দুটো আংটি একজোড়া কানের রিং একজোড়া। পার্শি বালি আছে। সে সব তোমাকে দেব। তুমি ঐসব বিক্রি করে এস, এস, সি পরীক্ষাটা অন্তত দাও।
শবনমের কথা শুনে আতাহারের চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, সংসার চলার মত অবস্থা থাকলে তোমার কথা নিশ্চয় রাখতাম। তারপর সেখান থেকে হনহন করে চলে গেল। এরপর থেকে শবনম লেখাপড়ার ব্যাপারে আর কিছু বলেনি।
ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আতাহার চরফ্যাসন গিয়েছিল জমি লাগিয়ে টাকা আনার জন্য। মোজাম্মেল খন্দকার প্রতি বছর চাষের সময় অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সেখানকার জমিতে ধান চাষ করতেন। আতাহারের পক্ষে তা সম্ভব নয়। প্রায় এক সপ্তাহ থেকে জমি বিলির ব্যবস্থা করে টাকা নিয়ে এসে মায়ের হাতে দিয়ে বলল, এই টাকায় যতটা সম্ভব ধান কিনে ফেলতে হবে।
রফিকা বেগম বললেন, তুই ঠিক কথা বলেছিস। তা না হলে খাব কি?
পরের দিন আতাহার বিকেলে শবনমের সঙ্গে দেখা করে বলল, দুএক দিনের মধ্যে আমি ঢাকায় চলে যাচ্ছি। সেখানে চাকরির চেষ্টা করব।
শবনম ছলছল চোখে চলল, তুমি এই কদিন আসনি কেন?
চরফ্যাসন গিয়েছিলাম জমির বন্দোবস্ত করতে।
আমাকে বলে গেলে না কেন?
রাতে মা বলল, তুই ঢাকায় চলে যাবি বলছিস, কাল সকালে চরফ্যাসন গিয়ে জমি লাগিয়ে টাকা নিয়ে আয়। পরের দিন সকালেই রওয়ানা দিই। তাই তোমাকে কথাটা জানাবার সুযোগ পাইনি।
শবনম চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, এই কদিন তোমাকে না দেখে আমি অস্থির ছিলাম। ঢাকায় গেলে থাকব কি করে?
আতাহার ভিজে গলায় বলল, তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমারও খুব কষ্ট হবে। তবু না গিয়ে উপায় নেই। তোমাকে তো আমাদের সংসারের সব কথা বলেছি। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে দেখে আবার বলল, কাঁদছ কেন? আমি তোমাকে স্কুলের ঠিকানায় প্রতি মাসে চিঠি দেব। তুমিও দেবে। আর দোয়া করো, আল্লাহ যেন আমার ও তোমার মনস্কামনা পূরণ করে। তারপর চোখ মুছে দিয়ে বলল, এবার হাসি মুখে আমাকে বিদায় দাও। যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে আর হয়তো দেখা হবে না।
শবনম বলল, শুনেছি ঢাকার মেয়েরা খুব বেপর্দা হয়ে চলাফেরা করে। তাদেরকে দেখে আমার কথা ভুলে যাবে না তো?
আতাহার মিষ্টি ধমকের স্বরে বলল, ছিঃ শবনম, একথা বলতে পারলে? আমরা দুজনে সেই ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। তখন থেকেই আমরা একে অপরকে ভালবেসেছি। ইনশাআল্লাহ যতদিন বাঁচব ততদিন সেই ভালবাসায় কোন চিড় ধরবে না। আল্লাহ ছাড়া আমার কাছ থেকে তোমাকে কেউ বিছিন্ন করতে পারবে না। তুমি শুধু দোয়া কর, আমি যেন স্বাবলম্বী হয়ে তোমার উপযুক্ত হতে পারি।
শবনম বলল, দোয়া তো নিশ্চয় করব। ওয়াদা কর, আমাকে তুমি ভুলে যাবে না।
আতাহার মৃদু হেসে বলল, করলাম। তুমিও কর।
শবনম তার পায়ে হাত দিয়ে ছালাম করে বলল, করলাম।
আতাহার ভিজে গলায় বলল, হে আল্লাহ, তুমি আমাদেরকে ওয়াদা পূরণ করার এবং সবর করার তওফিক দাও। তারপর বলল, তোমাকে যেতে বলতে মন চাইছে না। তবু বলছি এবার বাড়ি যাও। তোমার মেজ ভাই নাসির উদ্দন আসছে। তারপর সালাম বিনিময় করে আল্লাহ হাফেজ বলে যার যার পথে চলে গেল।
নাসির উদ্দিন ও আতাহার ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে পড়েছে। দুজনের মধ্যে বেশ সখ্যতা। কিন্তু নাসির উদ্দিন শবনম ও আতাহারের সম্পর্কের কথা জানে না। আতাহার ভেবে রেখেছে আগে স্বাবলম্বী হয়ে, তারপর জানাবে। এখন শবনমের সঙ্গে রাস্তায় কথা বলতে দেখে কিছু মনে করতে পারে ভেবে আতাহার অন্য পথ ধরল।
পরের দিন এগারটায় আতাহার ঢাকা রওয়ানা দিল। এর আগে কয়েকবার সে ঢাকা এসেছে। আতাহারের তিন মামা। বড় মামা হামিদ ঢাকায় সরকারী অফিসে চাকরি করেন। তিনি ঢাকায় ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন। আর তার মেজ খালাও ঢাকায় থাকেন। খালু একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন। আতাহার মামার বাসায় এসে উঠল। তারপর মামাকে চাকরির কথা বলল।
হামিদ বললেন, তুই এখনো ছেলেমানুষ, কে তোকে চাকরি দেবে। অন্তত ম্যাট্রিকটা পাস করলে কিছু একটা করা যেত। কত বি, এ, এম, এ,পাস ছেলে চাকরি পাচ্ছে না। যাক, কিছুদিন থাক, চেষ্টা করে দেখি যদি কোথাও লাগাতে পারি।
মামাদের বাসা থেকে খালাদের বাসা বেশি দূরে নয়। আতাহার খালুকেও চাকরির কথা বলল।
তার খালুর নাম হাবিব। তিনিও ঐ একই কথা বললেন। প্রায় ছয়মাস মামা ও খালুর বাসায় থেকে চাকরির চেষ্টা করতে লাগল। অবশেষে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে আটশো টাকা বেতনের চাকরি পেল। চাকরিটা খালুই ঠিক করে দেন। এর মধ্যে সে একবারও বাড়ি যায়নি। তবে মাকে ও শবনমকে চিঠি দিয়েছে। শবনমও প্রতি চিঠির উত্তর দিয়েছে।
আতাহার মামাদের বাসায় থেকে চাকরি করছে। তাই তার খরচ নেই। বেতনের টাকা থেকে সামান্য কিছু মামীর কাছে জমা রেখে বাকীটা মনি অর্ডার করে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। চাকরি পাওয়ার ছমাস পর সাত দিনের ছুটিতে প্রায় একবছর পর বাড়িতে রওয়ানা দিল।
ঢাকা সদরঘাট থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় ভোলার লঞ্চ ছাড়ে। পরের দিন সকাল আটটায় পৌঁছে। লঞ্চ থেকে নেমে প্রায় দশ বার মাইল বাসে করে দৌলতখান আসতে হয়। আতাহার যখন বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাল তখন বেলা দশটা। মাকে সালাম দিয়ে কদমবুসি করে বলল, কেমন আছ আম্মা?
রফিকা বেগম আজ একবছর পর ছেলেকে দেখে চোখের পানি রাখতে পারলেন না। জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করে বললেন, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি বাবা। তুই কেমন ছিলি? মাকে ছেড়ে এতদিন থাকতে তোর কষ্ট হয়নি?
আতাহার বলল, হয়নি আবার; কিন্তু আম্মা নতুন চাকরি, বেতনও কম। ঘন ঘন আসার টাকা কোথায়?
রফিকা বেগম বললেন, হ্যাঁরে তুই যে তোর মামাদের বাসায় থাকিস, তোর মামী বিরক্ত হয় না তো?
না আম্মা, মামীর মত মেয়ে আজকাল দেখা যায় না। আমাকে নিজের ছেলের মত দেখে। মামা-মামী তোমাকে সালাম জানিয়েছে।
রফিকা বেগম ওয়ালাইকুম আসোলাম বলে বললেন, তুই তাদেরকে খুব মেনে চলবি। তাদের ছেলেমেয়েদের আদর করবি।
আতাহার হেসে উঠে বলল, সে কথা তোমাকে বলে দিতে হবে না। মামার দুটো ছেলে। আমি যতক্ষণ বাসায় থাকি, তারা সব সময় আমার কাছেই থাকে।
তা হারে, আমি যে গত চিঠিতে তোর মামা-মামীকে আসতে বলেছিলাম, তার কি হল কিছু শুনেছিস?
মামীর আসার খুব ইচ্ছা। মামা বললেন, এখন অফিস থেকে ছুটি দেবে না। পরে আসবেন।
তোর খালা-খালু কেমন আছে? তাদের কাছে যাতায়াত করিস তো?
কি যে বল আম্মা, যাব না কেন? মামাদের বাসা থেকে খালাদের বাসা পাঁচ মিনিটের রাস্তা। প্রায় প্রত্যেক দিনই যাই। মাঝে মাঝে সেখানে খাওয়া-দাওয়া করি।
এবার জামা কাপড় খুলে গোসল করে নে। আমি মুড়ি আর নারকেল এনে দিচ্ছি, খেয়ে ঘুমা। লঞ্চে কি আর ঘুম হয়েছে? রান্না করে তোকে জাগিয়ে খেতে দেব।
নদীতে বাস্তভিটে ভেঙ্গে যাওয়ার পর মোজাম্মেল খন্দকার যখন বোনের বাড়িতে এসে উঠেন, তার অনেক আগেই দুলাভাই মারা যান। বোনের একছেলে দুই মেয়ে। ছেলে ঢাকায় চাকরি করে এবং সেখানে বাড়ি করে ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। বড় মেয়েও ঢাকায় থাকে। তার স্বামী ব্যবসা করে। ছোট মেয়ের বিয়ে তজুমদ্দিন গ্রামে দিয়েছেন। জামাই দৌলতখান বি. ডি. ও অফিসে কেরানীর চাকরি করে। তজুমদ্দিন দৌলতখান থেকে প্রায় দশ-এগার মাইল দক্ষিণে। তাই মেসে থেকে চাকরি করতো। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে থাকে। ঐ মেয়ের নাম রমিসা। আর জামাইয়ের নাম মনসুর। রমিসা যেমন মুখরা ও হিংসুটে, মনসুর তেমনি রাগি ও বদমেজাজী। সামান্য ব্যাপার নিয়ে প্রায়। প্রতিদিনই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ হয়। আর সেই কলহ পাড়া-পড়শী সবাই শুনে। প্রথম প্রথম তারা বিরক্ত হলেও পরে গা-সওয়া হয়ে গেছে। রমিসার মা শাইমা বেগম মেয়ে জামাইয়ের কলহ সহ্য করতে না পেরে বাস্তুর একদিকে কিছু অংশ মেয়ের নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে বললেন, তোমরা ওখানে ঘর করে নিজেদের সংসার নিয়ে থাক।
মনসুর ধার-দেনা করে এবং স্ত্রীর দ্বারা শ্বাশুড়ীর কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে একটা চৌচালা টিনের ঘর করে সেখানে বাস করছে।
যতদিন মামা শ্বশুর, মানে মোজাম্মেল খন্দকার বেঁচেছিলেন, ততদিন তদের সঙ্গে বেশ সদ্ভাব ছিল। মোজাম্মেল খন্দকার মারা যাওয়ার পর তারা তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে ভিটে থেকে সরাবার ষড়যন্ত্র করল। সেই জন্য কারণে অকারণে তাদের সঙ্গে ঝগড়া। করতে শুরু করল। রমিসা এমন কথাও মামীকে বলতে লাগল, আমার মায়ের জায়গা ছেড়ে তোমরা চলে যাও।
এইসব ব্যাপার দেখে শুনে শাইমা বেগম মেয়েকে রাগারাগি করে বললেন, আমার জায়গায় আমি ভাইকে থাকতে দিয়েছি। তাতে তোদের কি? তোরা ওদেরকে তাড়াতে চাস কেন? ভাইকে আল্লাহ দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছে। চার-চারটে এতিম ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাবি যাবে কোথায়? আমি ভাইপোদের নামে ঐ জায়গা রেজিস্ট্রি করে দেব। দেখি তুই আর জামাই কেমন করে ওদেরকে তাড়াতে পারিস। ছোট ছোট মামাতো ভাইবোনদের জন্য তোর মায়া হয় না। লোকজন শুনলেই বা বলবে কি?
রমিসাও মায়ের উপর রেগে গিয়ে বলল, নিজের মেয়ের ছেলেমেয়ের চেয়ে ভাইয়ের ছেলেমেয়ের উপর তোমার দরদ যখন বেশি তখন তারাই তোমাকে দেখুক। আমরা আর তোমাকে দেখব না।
রমিসাকে পেটে ধরলে কি হবে, ছোটবেলা থেকে মুখরা ও ঝগড়াটে বলে শাইমা বেগম তাকে শাসন করেও ঠিক করতে পারেননি। তাই বরাবর তার প্রতি অসন্তুষ্ট। এখন মেয়ের কথা শুনে বললেন, তোরা আমাকে কি এমন দেখিস? জামাইটা শুধু মাঝে মধ্যে বাজার করে দেয়। আর যা কিছু করে আমার ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা। অসুখে বিসুখে তোরা আমাকে দেখিস? ভাবি না দেখলে কবেই আমার কবরে ঘাস ফুটে যেত।
এরকম ঝগড়া প্রায়ই মা-মেয়ের মধ্যে হয়। এর মধ্যে আতাহার ঢাকা থেকে বাড়িতে এল। আতাহার যখন বাড়িতে থাকত তখন প্রায় বাজার থেকে ফুফুর জন্য ফল পাকাড়ি কিনে আনত। ফুফুর খোঁজ-খবর নিত। এবারে ঢাকা থেকে আসার সময় অনেক কিছু এনেছে। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করার সময় শাইমা বেগম বললেন, রমিসা ও তার স্বামী তোদেরকে এখান থেকে তুলে দিতে চায় সে কথা তোর মা হয়তো তোকে বলেছে। আমার কথা হল, আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন ওরা কিছু করতে পারবে না। কিন্তু মরে যাওয়ার পর তোরা এখানে টিকতে পারবি না। তাই ভেবেছি, তোদের দুভাইয়ের নামে বাস্তুটা রেজিস্ট্রী দেব। তুই সেই ব্যবস্থা কর।
আতাহার বলল, ফুফু, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। আম্মা বলছিল, সরকারী টিউব ওয়েল ওদের ঘরের কাছে বলে কুলসুম ও খাদিজাকে পানি নিতে দেয় না। বলে এদিকে এলে হাত-পা ভেঙ্গে দেব।
শাইমা বেগম বললেন, আমি সবকিছু জানি, আমাকে কিছু বলা লাগবে না। নিজের চোখে দেখে ও কানে শুনে তোকে রেজিস্ট্রী করার কথা বললাম। জেনে রাখ, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। নিজের পেটের মেয়ে হলে কি হবে, পেটে হিংসা গিজগিজ করছে। জামাইটাও একই রকম। শিক্ষিত ছেলে দেখে মেয়ে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, শিক্ষিত ছেলে নিশ্চয় মেয়েমানুষের স্বভাব চরিত্র পাল্টাতে পারবে। ওমা, ভবলাম কি? আর হল কি? দুজনেই কাঁটায় কাঁটায়। আর একটা কথা তোকে বলি, কথাটা তোর ফুফার কাছে শুনেছিলাম। মৌলানা কেরামত আলী জৌনপুরীর(রঃ) লেখা মেফতাহুল জান্নাত কেতাবে আছে, আগুন যেমন কাঠকে পুড়িয়ে ফেলে, হিংসা তেমনি মানুষের সব নেকীকে নষ্ট করে দেয়। তারপর শাইমা বেগম কিছুক্ষন স্বামীর স্মৃতিচারন করে ভিজে গলায় বললেন, খবরদার কোনোদিন অন্যের প্রতি হিংসা করবি না। এবারে কয়েকদিন থেকে জায়গাটা রেজিস্ট্রী করে নে। আমার বয়স হয়েছে, কবে বলতে কবে আল্লাহ আমাকে তুলে নেয় তার ঠিক কি?
আতাহার বলল, ঠিক আছে ফুফু, আমি সেই ব্যবস্থা করছি।
আসাঅব্দি শবনমকে দেখার জন্য আতাহারের মন ছটফট করছে। আজ শুক্রবার স্কুল বন্ধ। পথে দেখা হবে না। একবার চিন্তা করল, কাল স্কুল ছুটির পর পথে দেখা করবে। কিন্তু মনকে বোধ মানাতে পারল না। মসজিদে আসরের নামায পড়তে গেল। নাসির উদ্দিনও নামায পড়তে এসেছিল। নামাযের পর মসজিদ থেকে বেরিয়ে নাসির উদ্দিন প্রথমে আতাহারকে দেখতে পেয়ে সালাম দিয়ে বলল, কি রে কখন এলি?
আতাহার সালামের জওয়াব দিয়ে বলল, এই তো আজ সকালে। কেমন আছিস বল।
আল্লাহর রহমতে ভালো। তুই?
আমিও তাই। তারপর তার সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করল, এর সঙ্গে ওদের বাড়িতে গেলে শবনমের সঙ্গে দেখা হবে।
নাসির উদ্দিন বলল, কিরে চুপ করে আছিস কেন?
আতাহার শবনমের কথা চিন্তা করতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলা সামলে নিয়ে বলল, এ বছর তোদের সবার রেজাল্ট কেমন হল?
ভালো, সবাই পাস করেছি।
আতাহার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার তকদিরে আর লেখাপড়া হল না। তোরা ভালো রেজাল্ট করেছিস শুনে মনে একটু শান্তি পেলাম। তারপর বলল, চল চাচী-আম্মার সঙ্গে দেখা করে আসি।
শবনম উঠোন ঝাড় দিচ্ছিল। মেজ ভাইয়ের সাথে আতাহারকে দেখে তার মন আনন্দে ছলকে উঠল। ঝাড়টা একপাশে রেখে সালাম দিয়ে বলল, আতাহার ভাই কবে এলে?
আতাহার সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আজ দশটা-এগারোটার দিকে।
নাসির উদ্দিন শবনমকে বলল, যা, আম্মাকে গিয়ে বল, আতাহার এসেছে। আর আমাদের জন্য কিছু নাস্তা নিয়ে আয়। তারপর আতাহারকে বলল, আয় আমরা পড়ার ঘরে বসি।
শবনম মায়ের কাছে গিয়ে আতাহার আসার কথা বলে বলল, মেজভাইয়া নাস্তা দিতে বলল।
যুবাইদা খানম বললেন, ছেলেটা অনেক দিন আসেনি। টিনে মুড়ি আছে তেল মাখিয়ে দিয়ে আয়, আমি চা করি।
শবনম একটা প্লেটে মুড়িতে তেল মাখিয়ে একজগ পানি ও একটা গ্লাস নিয়ে এসে বলল, এগুলো ততক্ষণ খাও, আম্মা চা বানাচ্ছে একটু পরে আসবে। তারপর সে চলে গেল।
দুবন্ধুতে মুড়ি খেতে খেতে গল্প করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে শবনম দুকাপ চা নিয়ে এসে তাদেরকে দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল।
শবনম আসার একটু পরে যুবাইদা খানম এলেন।
ততক্ষণ ওদের চা খাওয়া হয়ে গেছে। আতাহার সালাম দিয়ে বলল, চাচী আম্মা কেমন আছেন?
যুবাইদা খানম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। বাবা। তোমার কথা নাসির উদ্দিনের কাছে শুনেছি। ঢাকায় চাকরি করছ, তাও শুনেছি। এর আগে দেশে আসনি?
না-চাচী-আম্মা, একবছর পর আসলাম।
তোমরা গল্প কর আমি যাই বলে তিনি চলে গেলেন।
শবনম ও আসমা বাড়ির ভিতরের দিকের রুমে পড়ে। আর নাসিরউদ্দিন ও কলিম উদ্দিন বারান্দার রুমে পড়ে। দুটো রুমের মাঝখানে জানালা আছে। মা আসার পর শবনম পড়ার রুমে গিয়ে জানালার পর্দা ফাঁক করে আতাহারের দিকে চেয়েছিল। আসমা ও কলিম উদ্দিন সকালে ভবানীপুর নানার বাড়ি গেছে। নাসির উদ্দিন খাটে বসেছে। তার পিছন দিকে জানালা। আতাহার চেয়ারে বসেছে। তার মুখ জানালার দিকে।
শবনম চলে যেতে আতাহারের মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ জানালায় তাকে দেখে তার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল।
শবনম এই রুমে এসে খাতায় কিছু লিখে রেখেছিল। আতাহার তার দিকে তাকাতে সেটা দেখাল।
আতাহার পড়ল-কাল বেলা তিনটের সময় চৌধুরীদের বাগানে আসবে। লেখাটা পড়ে আতাহারের অশান্ত মন শান্ত হল। সে এই কথাটাই বলার জন্য অপেক্ষা করছিল। চোখের ঈশারায় সম্মতি জানিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। তারপর নাসির উদ্দিনকে বলল, এবার আসি?
নাসির উদ্দিন বলল, কয়েকদিন আছিস তো?
এক সপ্তাহ আছি। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
.
০৪.
পরের দিন যোহরের নামায পড়ে আতাহার খাওয়া-দাওয়া করল। তারপর কিছুক্ষণ। রেস্ট নিয়ে আড়াইটার সময় ঘর থেক বের হল।
রফিকা বেগম দেখতে পেয়ে বললেন, এত রোদে কোথায় যাবি?
আতাহার বলল, কাল রাতে তোমাকে ফুফুর জমি রেজিস্ট্রী দেওয়ার কথা বললাম না? সে ব্যাপারে উকিলের সঙ্গে দেখা করতে যাব। তার আগে আর একজনের সঙ্গে দেখা করব। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেল।
শবনমকে দেখার জন্য তার মন ছটফট করছিল। তাই সময়ের আগেই বেরিয়ে পড়েছে। ওর সঙ্গে দেখা করে তারপর উকিলের কাছে যাবে।
টিফিনের পর ফোর্থ ক্লাস সোয়া দুটোই শেষ হতে শবনম শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে ছুটি নিয়ে যখন চৌধুরীদের বাগানে এল তখন পুরো আড়াইটা।
দৌলতখান বাজার থেকে যে রাস্তাটা গুপ্তগঞ্জ বাজারের দিকে গেছে সেই রাস্তার পাশে চৌধুরীদের বাগান। চৌধুরী হুজুর এর মধ্যে বাগানের উত্তর দিকের গাছপালা কেটে দুটা টিনসেড বাড়ি করেছেন। ওনার ইচ্ছা শেষ বয়সে এখানেই আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করে কাটাবেন। বাগান ও বাড়ি দেখাশুনা করার জন্য আলমাস নামের একজন তোক রেখেছেন। সে স্ত্রী ও দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে এখানে থাকে। চৌধুরী হুজুরই তাদের সংসারের খরচ চালান। মাত্র মাস দুয়েক আগে বাড়ি তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। বাড়ি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর একদিন এসে দেখে শুনে আলমাসকে রাখার ব্যবস্থা করেন। তারপর ফিরে যাওয়ার সময় তাকে বললেন, আতাহার ও শবনম নামে দুটো ছেলেমেয়ে যদি এখানে আসে তা হলে তাদের আদর যত্ম করবে।
আজ তিন চার বছর হতে চলল, শবনম চৌধুরীদের বাগানে আসেনি। কিছুদিন আগে মেজ ভাইয়ের মুখে যখন শুনল, যারা বাগানটা কিনেছে তারা নাকি সেখানে বাড়ি করেছে। এখন ভাবল, আতাহার ভাই যে বলেছিল, ওখানে জ্বীন নেই, তার কথা ঠিক। জ্বীন থাকলে সেখানে বাড়ি ঘর করে লোকজন আছে কি করে? আজ স্কুল থেকে চৌধুরীদের বাগানে আসার সময় সেই সব কথা শবনমের মনে পড়ল। ভাবল, যারা। ওখানে বাস করছে, আজ আতাহার ভাইকে নিয়ে তাদের সাথে আলাপ করবে।
শবনম কাছে এসে দেখল, বাগানের একপাশের গাছপালা কেটে ছয় সাত হাত চওড়া রাস্তা করা হয়েছে। রাস্তার শেষ মাথায় দুটো টিনসেড ঘর। শবনম ঐ রাস্তা দিয়ে না গিয়ে যেখানে তারা আগে খেলাধূলা করত, সেদিকে যেতে যেতে আতাহারকে আসতে দেখে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পড়ল।
আতাহারও তাকে দেখতে পেয়েছে। কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, চল, আমাদের পুরোনো জায়গায় গিয়ে বসি।
শবনম সালামের জওয়াব দিয়ে বলল, তাই চল। তারপর যেতে যেতে অভিমান। ভরা কণ্ঠে বলল, তোমার জান পাথরের মত শক্ত। নচেৎ এক বছর কি করে ছিলে?
আতাহার বলল, আর তোমার বুঝি খুব নরম, যা নাকি বিরহের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে?
শবনম দাঁড়িয়ে পড়ে তার মুখের দিকে চেয়ে ভিজে গলায় বলল, সে কথা আল্লাহকে মালুম। তোমার চিঠি পেতে দেরি হলে কত রাত যে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছি, তা যদি জানতে তা হলে ….. বলে থেমে গেল। কান্নায় তখন তার গলা ধরে এল, আর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
আতাহার বলল, তা আমি জানি শবনম। কথাটা একটু রসিকতা করেই বলেছি। বলাটা যে ঠিক হয়নি, তা বুঝতে পারলাম। তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে দিয়ে বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে; আর কখনো বলব না। চল আমাদের পুরোনো জায়গাতে বসে দুজনে দুজনকে প্রাণভরে দেখব। কিন্তু কাঁদতে পারবে না। বলে দিচ্ছি। এতদিন পর এসে তোমার হাসি মুখ দেখতে চাই।
শবনম যেতে যেতে বলল, তুমি আবার চলে যাবে মনে হলে যে শুধু কান্না পাচ্ছে?
আতাহার বলল, আমি ওসব শুনতে চাই না। তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমারও মনে যে কি যন্ত্রনা হয়, তা আল্লাহপাক জানেন। কিন্তু তকদিরের লিখন কি খন্ডাতে পারব? পারব না। তাই সবর করে থাকি। তুমিও থাকবে।
কথা বলতে বলতে তারা তাদের সেই পুরোনো জায়গায় এসে দেখল, সেখানে নানা রকম ঘাস জন্মেছে। আতাহার ঘাস পরিষ্কার করে দুজনের বসার জায়গা করে বসে বলল, তোমার কথাই ঠিক, তোমাকে এতদিন পরে দেখে যতটা আনন্দ পাচ্ছি, কয়েকদিন পরে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছি।
শবনম কোনো কথা না বলে তার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
তাই দেখে আতাহারের চোখেও পানি এসে গেল। সামলে নিয়ে চোখ মুছে বলল, আবার কাঁদছ? একটু আগে না নিষেধ করলাম।
শবনম একটা বড় চাদর গায়ে দিয়ে স্কুলে যায়। চাদরের আঁচলে চোখ মুছে বলল, তোমার চোখেও তো পানি দেখলাম। তুমি ছেলে হয়ে যদি সামলাতে না পার, তবে আমি মেয়ে হয়ে কি করে পারব?
ঠিক আছে, এখন থেকে কেউ আর কাঁদব না। এবার তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট বল।
তোমার চিন্তায় ভালো করে পড়াশুনা করতে পারিনি; তবুও সেকেন্ড হয়েছি।
আলহামদুলিল্লাহ বলে আতাহার বলল, আমি দোয়া করছি সামনের বছর ইনশাআল্লাহ আরো ভাল রেজাল্ট হবে। কি হবে না?
শবনম বলল, তুমি দোয়া করলে ইনশাআল্লাহ হবে। এবার তোমার চাকরির কথা বল।
চাকরিটা ভালো; কিন্তু বেতন মাত্র আটশো টাকা। তবে সামনের মাসে দুশো টাকা বাড়বে। মামা খালাদের বাসায় থাকি বলে পুরো টাকাটা বাঁচে। নচেৎ কিছুই বাঁচাতে পারতাম না। তুমি দোয়া করো, আমার সাহেব খুব ভালো মানুষ। তাকে একটা ভালো চাকরির কথা বলেছি। উনি আশ্বাস দিয়েছেন।
শবনম বলল, আল্লাহ যেন তোমার মকসুদ পূরণ করেন।
আলমাস ঘরের দাওয়ায় বিছানা পেতে ঘুমাচ্ছিল। ঘুম থেকে উঠে বদনা নিয়ে ছোট প্রাকৃতিক কাজ সারবে বলে বাগানের ভিতরে গেল। তখন তার কানে এল কাছা-কাছি কারা যেন কথা বলছে। ভাবল, তা হলে কেউ কি সুপারি বা নারিকেল চুরি করতে এসেছে? প্রাকৃতিক কাজ সেরে আস্তে আস্তে যে দিক থেকে কথা বলার শব্দ আসছিল, সেদিকে এগোল। কিছুটা এসে দুজন তরুণ-তরুণীকে মুখোমুখি বসে কথা বলতে দেখে খুব অবাক হল। ভাবল, কে এরা? এই সময় এমন নির্জন জায়গায় বসে কথা বলছে? হঠাৎ চৌধুরী সাহেবের কথা মনে পড়তে কাছে এসে গলা খ্যাকারী দিয়ে বলল, কে তোমরা? এখানে কি করছ? তোমাদের কি ভয় ডর নেই?
আলমাসের কথা শুনে শবনম ভয় পেলেও আতাহার পেল না। সালাম দিয়ে বলল, আমরা এই গ্রামেরই ছেলেমেয়ে। আপনি কে?
আলমাস সালামের উত্তর দিয়ে বলল, এই বাগানের মালিক চৌধুরী হুজুর আমাকে এখানে রেখেছেন সবকিছু দেখাশুনা করার জন্য।
তার কথা শুনে শবনমের ভয় কেটে গেল। আতাহারের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে এই বাগানের মালিকের বাড়ি তৈরীর কথা বলল।
শবনমের কথা শুনে আতাহার আলমাসকে জিজ্ঞেস করল, চৌধুরী হুজুর কি এখানে আছেন?
আলমাস ভাবল, এদের কথাই হয়তো চৌধুরী হুজুর বলে গেছেন। বলল, না উনি নেই। তারপর তাদের নাম জিজ্ঞেস করল?
আতাহার নিজের ও শবনমের নাম বলল।
আলমাসের মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, তোমরা আমার সঙ্গে এস।
আতাহার বলল, কেন?
সে কথা পরে বলব, আগে এসতো আমার সঙ্গে।
আতাহার শবনমকে বলল, চলল চৌধুরী হুজুরের বাড়ি দেখে আসি।
শবনম এটাই চাচ্ছিল। তাই কোন প্রতিবাদ না করে তাদের সাথে যেতে লাগল।
আলমাস তাদেরকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, চৌধুরী হুজুর মাস দুয়েক আগে বাড়ি তৈরী হয়ে যাওয়ার পর একদিন এসেছিলেন। যাওয়ার সময় আমাকে তোমাদের নাম বলে বললেন, তোমরা এলে তোমাদেরকে যেন খাতির যত্ন করি।
আতাহার জিজ্ঞেস করল, উনি আবার কবে আসবেন?
তা বলতে পারব না। হুজুরের যখন মর্জি হবে তখন আসবেন। ততক্ষণে তারা। বাড়ির কাছে এসে গেছে। আলমাস স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে একটু জোরেই বলল, কইগো ইউসুফের মা, একটা পাটি এনে দাওয়ায় বিছিয়ে দাও; মেহমান এসেছে।
আলমাসের স্ত্রী জয়তুন ঘরের ভিতর ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘুমিয়েছিল। একটু আগে জেগেছে। স্বামীর কথা শুনে মনে করল, তাদের কোনো আত্মীয় হয়তো এসেছে। তাড়াতাড়ি করে উঠে ভালো করে গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে একটা খেজুর চাটাই নিয়ে বেরিয়ে এসে আতাহার ও শবনমকে দেখে অবাক হল। তারপর চাটাই বিছিয়ে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলল, এরা কারা?
সে কথা পরে বলব, আগে জগে করে পানি এনে দাও এরা হাত মুখ ধুয়ে নিক। খুব গরম পড়েছে, এদেরকে পাখা দিয়ে বাতাস কর। আমি ডাব পেড়ে নিয়ে আসি। তারপর ওদের দুজনের দিকে চেয়ে বলল, তোমরা মুখহাত ধুয়ে বস, আমি ডাব পেড়ে এক্ষুণী আসছি। কথা শেষ করে চলে গেল।
শবনম খুব অবাক হয়ে আতাহারের দিকে চেয়ে বলল, কি ব্যাপার বলতো?
আতাহার মৃদু হেসে বলল, পরে সব বলব, এখন বসি এস।
একটু পরে জয়তুন জগে করে পানি এনে বলল, তোমরা মুখ হাত ধুয়ে নাও।
ওরা হাতমুখ ধুয়ে বসার পর জয়তুন হাত পাখা দিয়ে তাদেরকে বাতাস করতে লাগল।
আতাহার তার হাত থেকে পাখাটা নিয়ে বলল, আপনাকে বাতাস করতে হবে না। তারপর জিজ্ঞেস করল, চাচী, আপনাদের গ্রামের নাম কি।
জয়তুন বলল, হুজুরের গ্রামেই আমাদের বাড়ি। ইউসুফের আব্বা ও আমি হুজুরের বাড়িতে কাজ কাম করতাম। এখানে বাড়ি করার পর হুজুর আমাদেরকে এখানে এনে রেখেছেন। তোমরা কোন গ্রামের ছেলেমেয়ে?
এবার শবনম বলল, আমাদের বাড়ি এই গ্রামেই।
তোমরা দুজন কি ভাইবোন?
শবনম কি বলবে ঠিক করতে না পেরে চুপ করে রইল।
আতাহার বলল, হা; তবে চাচাতো।
এমন সময় আলমাস বড় বড় দুটো ডাব এনে স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল, কাটারীটা দাও। জয়তুন কাটারি এনে দিলে আলমাস ডাব কেটে জগে ঢেলে ওদেরকে গ্লাসে করে খেতে বলল। তারপর স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল, একটা বাসনে করে মুড়ি নিয়ে এস, আমি ডাব ফেড়ে শাস বের করছি।
নাস্তা পানি করতে করতে আসরের নামাযের আযান হয়ে গেল।
আতাহার বলল, এবার আমরা আসি চাচা?
আলমাস বলল, আবার এস।
আতাহার বলল, আসব; তবে কবে আসব তা আল্লাহপাক জানেন।
কেন? তোমরা তো এই গ্রামেরই ছেলেমেয়ে, যখনই মন চাইবে চলে আসবে।
মন চাইলেই কি সব কিছু করা যায় চাচা? আমি ঢাকায় থাকি। এক বছর পর এসেছি। এক সপ্তাহ পর চলে যাব। আল্লাহপাক আবার কবে নিয়ে আসবেন, তা তিনিই জানেন।
আলমাস তার কথার মধ্যে বেদনার সুর শুনতে পেল। বলল, ঢাকা থেকে যখন ফিরবে তখন তো আসবেই। এখন যে কদিন আছ, রোজ আসতে পারবে না?
তাও আল্লাহপাকের মর্জি। তারপর আতাহার শবনমের দিকে চেয়ে বলল, কি পারবে?
শবনম বলল, তুমিই তো এক্ষুণী আল্লাহপাকের মর্জির কথা বললে, তবে তুমি বললে ইনশাআল্লাহ পারব।
আতাহার এবার আলমাসের দিকে চেয়ে বলল, ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করব, কিন্তু রোজ রোজ মেহমানী করতে পারবেন না। আমাদেরকে যেখানে বসে বসে গল্প করতে দেখেছেন, সেখানে আমরা ছোট বেলায় প্রতিদিন খেলাধুলা করেছি। লুকোচুরি খেলেছি। যে কদিন থাকব সে কদিন আল্লাহ রাজি থাকলে হয় তো ঐখানেই আসব। আর চলে যাওয়ার সময় আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাব।
আলমাস বলল, তাই এস বাবা।
আতাহার ও শবনম তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এল। আসার সময় শবনম বলল, আলমাসের এরূপ করার কারণটা এবার বল।
আতাহার তাকে চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে কিভাবে পরিচয় হয়েছিল এবং তার পরের ঘটনা বলে বলল, উনি খুব বুজুর্গ লোক।
শবনম জিজ্ঞেস করল বুজুর্গ লোক কাকে বলে?
যারা খুব জ্ঞানী, পরহেজগার, মোত্তাকী এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আইন মোতাবেক সব কিছু মেনে চলেন এবং মানুষকেও সেই পথে চালাবার চেষ্টা করেন, তাদেরকে পীর বা বুজুর্গ লোক বলে।
তাই বলো, আমি তো আলমাস চাচার ব্যবহার দেখে এতক্ষণ খুব অবাক হয়েছি। কিন্তু চৌধুরী হুজুর তাকে আমাদের খাতির যত্ন করতে বলেছেন কেন, ঠিক বুঝতে পারছি না।
আমিও ঠিক পারিনি, তবে শুনেছি পীরদের অনেক কাজ-কাম সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। ওসব কথা এখন থাক, কাল কখন আসবে বল।
প্রতিদিন তো মিথ্যে বলে স্কুল থেকে ছুটি নিতে পারব না। আজ শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে চার পিরিয়ডের পর ছুটি নিয়ে এসেছি। কাল থেকে ছুটির পর আসব।
সেটাই ভাল। ততক্ষণে তারা শবনমদের বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছে। আতাহার দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, এবার তুমি যাও। ইনশাআল্লাহ কাল আবার দেখা হবে।
এরপরের দিনগুলো আতাহারের ব্যস্ততার মধ্যে স্বপ্নের মতো কেটে গেল। বাস্তুজমিটা ফুফুর কাছ থেকে রেজিস্ট্রি করে নিতে উকিলের কাছে ও কোর্টে ছুটাছুটি করতে হয়েছে। ছুটিও শেষ কাল দশটার দিকে ঢাকা রওয়ানা দিবে। আজ শেষবারের মতো শবনমের সঙ্গে দেখা করবে বলে সময়ের আগে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে অপেক্ষা করতে লাগল।
শেষ পিরিয়ডের শিক্ষক না থাকায় শবনমদের এক পিরিয়ড আগে ছুটি হয়ে গেল। সে পাড়ার মেয়েদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অন্য রাস্তা হয়ে চৌধুরীদের বাগানে এল। অবশ্য এরকম চালাকি সে বরাবরই করেছে। আসার সময় চিন্তা করেছিল, এত তাড়াতাড়ি কি আতাহার ভাই আসবে? কিন্তু এসে যখন তাকে দেখল তখন মনটা খুশিতে ভরে গেল। কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, আজ এক পিরিয়ড আগে ছুটি হয়েছে। ভাবলাম, তোমার জন্য পৌনে এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। আর তুমি কিনা আমার আগে এসে গেছ।
আতাহার সালামের জওয়াব দিয়ে বলল, আমার মন বলল, তুমি হয়তো আজ তাড়াতাড়ি আসবে। তাই সময়ের আগে চলে এলাম। এস, বস।
শবনম তার সামনে বসে বই-খাতা কোলের উপর রেখে বলল, আর কদিন থাকবে?
আতাহার কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, পরশু অফিস করতে হবে। তাই ইনশাআল্লাহ কাল সকাল দশটার দিকে রওয়ানা দেব ভেবেছি।
আতাহারের কথা শুনে শবনমের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। কোনো কথা বলতে পারল না।
তার অবস্থা দেখে আতাহারের চোখেও পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, কোন দিক দিয়ে যে সাতদিন চলে গেল, বুঝতে পারলাম না। মনে হচ্ছে যেন, এই কদিনের ঘটনাগুলো স্বপ্ন।
শবনম প্রথমে চাদর দিয়ে নিজের চোখ মুছল, তারপর আতাহারের চোখ মুছে দেওয়ার সময় বলল, শুনেছি, আনন্দের দিনগুলো নাকি স্বপ্নের মত চলে যায়।
আতাহার তার দুটো হাত ধরে নিজের গালে চেপে ধরে ভিজে গলায় বলল, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে দোয়া করো, আল্লাহ যেন আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন না করেন, আমাদের দুজনকে যেন স্বামী-স্ত্রী রূপে কবুল করেন। কেন কি জানি মনে হচ্ছে, আবার হয়তো তোমার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হবে না।
শবনম চোখের পানি রোধ করতে পারল না। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, এই দোয়া আমি সব সময় করি। আব্বা-আম্মার মুখে শুনেছি, ঈমানদার বান্দা-বান্দীর দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। আমার পূর্ণ একিন আছে, আল্লাহ আমাদেরকে নিরাশ করবেন না। তারপর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আতাহারের দুটো হাত নিজের গালে চেপে ধরে বলল, আমি তোমাকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করলাম। তিনি তোমাকে হেফাজত করবেন এবং কামিয়াব করবেন।
আতাহার বলল, আমিও তোমাকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করলাম। তিনি তোমাকেও কামিয়াব করবেন।
শবনম আমিন বলে বলল, চল এবার ফেরা যাক।
আতাহার ও শবনম এই কদিন চৌধুরীদের বাগানে প্রতিদিন এলেও সময়ের অভাবে মাত্র আর একদিন আলমাস ও তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছে।
আলমাস প্রথম দিন তাদেরকে খাতির যত্ম করলেও দুজনের সম্পর্কের কথা বুঝতে পারেনি। তারা চলে যাবার পর স্ত্রীর কাছে শুনেছে, ওরা একে অপরকে ভালবাসে। কিন্তু। আজ আড়াল থেকে তাদের সবকিছু দেখে শুনে জানতে পারল ওরা একে অপরকে কি দারুন ভালবাসে। হঠাৎ চৌধুরী হুজুরের কথা মনে পড়তে ভাবল, উনি বুঝি ব্যাপারটা জানেন এবং ওদেরকে খুব স্নেহ করেন। তাই খাতির যত্ন করতে বলেছেন। ওদেরকে চলে যেতে দেখে এগিয়ে এসে বলল, আমাদের সঙ্গে দেখা না করে চলে যাচ্ছ যে?
আতাহার সালাম দিয়ে বলল, আজ আমাদের মন ভালো নেই চাচা। তাই ভুলে গেছি। চলুন চাচির সঙ্গে দেখা করে আসি।
দেরি হয়ে যাবার আপত্তি সত্ত্বেও আলমাস ও জয়তুন শুনল না। তারা নাস্তা বানিয়ে খাইয়ে তবে বিদায় দিল। বিদায় দেওয়ার সময় আলমাস আতাহারকে বলল, ঢাকা থেকে এলে কিন্তু মা শবনমকে নিয়ে আসবে।
তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় এসে আতাহার শবনমকে বলল, তুমি যাও, আমি বাজার হয়ে ঘুরে যাব।
শবনম সালাম জানিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলে কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর চোখের পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে হাঁটতে শুরু করল।
আতাহার সালামের জওয়াব দিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলে তার চলে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। একসময় তার চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়ল। শবনম চোখের আড়াল হয়ে যেতে চোখ মুছে বাজারের পথ ধরল।
পরের দিন আতাহার দশটার সময় খাওয়া দাওয়া করে ভারাক্রান্ত মনে ঢাকায় রওয়ানা দিল।
.
০৫.
এ বছর শবনম ও তার মেজ ভাই নাসির উদ্দিন এস, এস, সি পরীক্ষা দিবে। গত বছর নাসির উদ্দিন পরীক্ষা দিয়েছিল কিন্তু পাশ করতে পারেনি। তাই এ বছর আবার দিবে। এই দুবছরের মধ্যে শবনমের ও আতাহারের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতম হয়েছে। শবনম যেমন স্বাস্থ্যবতী ও সুন্দরী হয়েছে তেমনি রূপের জৌলুসও বেড়েছে। ক্লাস টেনে উঠার পর থেকে বোরখা পরে স্কুলে যাচ্ছে।
আতাহারও স্বাস্থ্যবান যুবক হয়ে উঠেছে। ছোটবেলা থেকে তার লম্বা চওড়া স্বাস্থ্য। যৌবন প্রাপ্ত হয়ে আরো লম্বা চওড়া হয়েছে। এমনি তার গায়ের রং খুব ফর্সা এখন সেই রং আরো উজ্জ্বল হয়েছে।
আতাহার মাঝে মাঝে বাড়িতে এসে যে কদিন থাকে, সেই কদিন মেয়ের স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হয় দেখে যুবাইদা খানমের মনে সন্দেহ হয়েছে। আরো একটা কারণে তাঁর সন্দেহ জেগেছে, আতাহার বাড়িতে এসেই একবার হলেও তাদের ঘরে আসে। আর তখন থেকেই মেয়ের মুখে আনন্দের আভা দেখতে পান। কয়েকদিন পর সেই আনন্দের আভা থাকে না। মাঝে মাঝে তাকে মন খারাপ করে বই খুলে বসে থাকতে দেখেন। ছেলেমেয়েরা সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও মাকে পারে না। সব। মায়েরাই ছেলেমেয়েদের মনের খবর বুঝতে পারেন। যুবাইদা খানম মেয়ে সেয়ানা হওয়ার পর তার পরিবর্তন লক্ষ্য করে সন্দেহ করেন; শবনম নিশ্চয় আতাহারকে ভালবাসে। তিনি ভাবেন, ছেলে হিসাবে আতাহার খুব ভালো, তাদের বংশও খুব ভালো। কিন্তু সে শবনমের অনুপযুক্ত। আতাহার ক্লাস টেনে ওঠে আর্থিক দূরবস্থার কারণে লেখা পড়া ছেড়ে দিয়ে চাকরি করে সংসার চালাচ্ছে। একটা বোন বিয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। আরেকটা বোন চার পাঁচ বছর পর উপযুক্ত হবে। সামান্য চাকরির টাকায় তাদের সংসারের অভাব মেটে না। কিভাবে বোনদের বিয়ে দেবে? এই সব চিন্তা করে ও মেয়ের হাবভাব লক্ষ্য করে তিনি শঙ্কিত হলেন। এবারে আতাহার ঢাকা থেকে এসে যখন তাদের ঘরে এল তখন মেয়ের মুখে সেই একই রকম আনন্দের আভা দেখলেন এবং তার পরের দিন স্কুল থেকেও ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে দৃঢ় বিশ্বাস হল; স্কুল ছুটির পর শবনম ফেরার পথে নিশ্চয় আতাহারের সঙ্গে কোনো জায়গায় যায়। তাই দেরি হয়। শবনমের ছোটবোন আসমা এ বছর সিক্সে পড়ছে। তাকে আজ একা স্কুল থেকে ফিরতে দেখে যুবাইদা খানম জিজ্ঞেস করলেন, তারা দুবোন তো প্রতিদিন একসাথে স্কুলে যাতায়াত করিস। আজ তুই একা এলি যে? তোকে না বলেছি, তোর আগে ছুটি হলেও শবনমের জন্য অপেক্ষা করবি?
আসমা বলল, আমার ছুটি হয়ে যাওয়ার পর আমি অপক্ষো করছিলাম। মেজ আপা এসে বলল, তুই বাড়ি চলে যা, আমার ফিরতে দেরি হবে। তাই চলে এলাম।
যুবাইদা খানম বললেন, কাল যদি তোকে চলে আসতে বলে, তা হলে বলবি, আম্মা থাকতে বলেছে।
পরের দিন স্কুল ছুটির পর আসমা ক্লাসে বসে অপেক্ষা করছিল। এমন সময় শবনম এসে বলল, তোকে থাকতে হবে না। তুই চলে যা। আমার আজও ফিরতে দেরি হবে।
আসমা বলল, তোমাকে রেখে কাল চলে গেছি বলে আম্মা বকাবকি করে বলল, তোমার দেরি হলেও অপেক্ষা করতে।
শবনম ভাবল, আম্মা কি কিছু টের পেয়েছে? কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে, আয়।
কিছু দূর আসার পর অন্য রাস্তায় যেতে দেখে আসমা বলল, এদিকে যাচ্ছ কেন? শবনম সে কথার জওয়াব না দিয়ে বলল, তুই চৌধুরীদের বাগানে কখনো গেছিস?
না। ওখানে নাকি জ্বীনেরা থাকে। আম্মা সে কথা বলে ওখানে যেতে নিষেধ করেছে।
আম্মা ঠিক কথাই বলেছে, তবে এখন আর সেখানে জ্বীনেরা থাকে না। চৌধুরী হুজুর সেখানে বাড়ি করেছেন। এখন সেখানে লোকজন বাস করে।
সত্যি বলছ মেজ আপা?
হারে সত্যি। চল আজ তোকে তাদের কাছে নিয়ে যাব। তা হলেই বুঝবি আমি সত্যি বলছি না মিথ্যে বলছি।
শবনম তাকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আলমাসদের বাড়িতে এল।
আলমাস তখন বাড়ির সামনে যেখানে লালশাক চাষ করেছিল, সেখানে দাউলি দিয়ে নিড়ানী দিচ্ছিল। ওদেরকে দেখতে পেয়ে দাউলি হাতে করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কি মা, আজ আতাহার বাবাজী কোথায়? তারপর আসমার দিকে তাকিয়ে বলল, এ আবার কাকে সাথে করে এনেছ?
শবনম সালাম দিয়ে বলল, এ আমার ছোট বোন আসমা। ওতো ভয়ে আসতেই চায় না। বলে, এখানে জ্বীনেরা থাকে।
আলমাস সালামের উত্তর দিয়ে হেসে উঠে আসমার দিকে চেয়ে বলল, জান মা আগে হয়তো এখানে জ্বীন থাকত, এখন আর নেই।
জয়তুন এতক্ষণ ঘরের ভিতর ছিল। স্বামীর সঙ্গে কারা যেন কথা বলছে শুনে বেরিয়ে এল।
তাকে দেখে শবনম বলল, চাচি আমার বোন আসমা আপনাদেরকে দেখতে এসেছে। আপনারা এর সঙ্গে কথা বলুন, আমি একটু আসছি। তারপর ফিরে চলল।
আসমার জ্বীনের ভয় এখনও কাটেনি। ভয়ার্তকণ্ঠে বলল,এই আপা, তুমি আমাকে রেখে কোথায় যাচ্ছ?
শবনম এগিয়ে এসে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে হাসতে হাসতে বলল, কিরে ভয় পাচ্ছিস কেন? এনারা তো জ্বীন নয়, আমাদের মত মানুষ।
এমন সময় পাঁচ বছরের ও দুবছরের দুটো ছেলে-মেয়ে এসে জয়তুনকে জড়িয়ে ধরে বলল, আম্মা খিদে পেয়েছে, মুড়ি খাব।
জয়তুন বলল, দাঁড়া দিচ্ছি। তারপর আসমা ও শবনমের দিকে চেয়ে বলল, এস মা, তোমাদেরকেও কিছু খেতে দেই।
শবনম বলল, আমি খাব না, আসমাকে দিন। তারপর আসমাকে বলল, তুই নাস্তা খা। বাগানের ওপাশে আমার এক বান্ধবীর বাড়ি। তার সঙ্গে দেখা করে এক্ষুণি ফিরব। তারপর সে চলে গেল।
আসমার তবুও ভয় কাটল না। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
জয়তুন তাহার হাত ধরে এনে দাওয়ায় পাটি বিছিয়ে বসতে দিল। তারপর মুড়ি ও নারকেলের নাড় খেতে দিয়ে বলল, খাও মা। তোমার আপা তো আতাহারের সঙ্গে প্রায়ই এখানে আসে।
আসমা বুঝতে পারল, মেজ আপার কেন বাড়ি ফিরতে দেরি হয়।
আতাহার আগে থেকে বাগানের রাস্তার ধারে একটা গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। শবনমের সঙ্গে আসমাকে আসতে দেখে আড়াল হয়ে গিয়েছিল। তারপর তাদেরকে আলমাসদের ঘরের দিকে যেতে দেখে তাদের পিছু নিয়ে আড়াল থেকে সবকিছু লক্ষ্য করছিল। শবনম কাছাকাছি এলে তার সামনে এসে সালাম দিয়ে বলল,কি ব্যাপার। আজ আসমাকে এনেছ কেন?
শবনম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমার ফিরতে দেরি দেখে আম্মা এতদিন বকাবকি করেছে। এবার মনে হয় সন্দেহ করতে শুরু করেছে। তারপর আসমাকে আনার কারণ বলে বলল, আজ দেরি করতে পারব না। কাল থেকে এখানে আসতেও বোধ হয় আর পারব না। তুমি কাল টিফিনের সময় স্কুলের বাইরে থেক, খুব জরুরী কথা আছে বলব। এখন আসমাকে নিয়ে বাড়ি যাই।
আতাহার বলল, ঠিক আছে যাও। ইনশাআল্লাহ কাল দেখা হবে। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেল।
শবনম আসমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল।
ঐদিন দেরিতে ফিরতে দেখেও যুবাইদা খানম তখন কাউকে কিছু বললেন না। এশার নামায পড়ে যুবাইদা খানম পাশের রুম থেকে আসমা বলে ডাক দিলেন।
আসমা ও শবনম তখন পড়ছিল। মায়ের ডাক শুনে জ্বি আম্মা আসছি বলে আসমা মায়ের কাছে এল।
যুবাইদা খানম তাকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে আজও তোদের স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হল যে?
আসমা খুব সহজ সরল মেয়ে। বলল, জান আম্মা, চৌধুরীদের বাগানে এখন আর জ্বীন থাকে না। সেখানে ঘর উঠিয়ে লোকজন বাস করছে। আপা আজ আমাকে তাদের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তারা নারকেলের নাড়ু ও মুড়ি খেতে দিল। তাদের মুখে শুনলাম, আতাহার ভাই ও মেজ আপা প্রায় ওখানে যায়।
যুবাইদা খানম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, চৌধুরীদের বাগানের কথা আমি জানি। আর কখনো ওখানে যাবি না। আজও আতাহার গিয়েছিল?
আমি দেখিনি। আমি যখন নাস্তা খাচ্ছিলাম তখন আপা কোথায় যেন গেল। বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে আমাকে নিয়ে ঘরে এল। যুবাইদা খানম যা জানার জেনে গেলেন। বললেন, যা এবার পড়তে যা।
আসমাকে ডাকতে শবনম ভাবল, আম্মা নিশ্চয় ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবে। তাই উৎকণ্ঠিত হয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করছিল। আসমা ফিরে এলে জিজ্ঞেস করল, কিরে তোকে আম্মা ডাকল কেন?
আসমা বলল, আম্মা আমাদের স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হল কেন জিজ্ঞেস করল।
তুই কি বললি?
বললাম,তুমি চৌধুরীদের বাগানে যারা থাকে তাদের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলে।
আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি?
আতাহার ভাই সেখানে ছিল কি না জিজ্ঞেস করেছিল। আমি বললাম তাকে দেখিনি।
যুবাইদা খানম মেয়েকে শাসন করার জন্য আসমার পিছনে পিছনে এসে শবনম তাকে কিছু বলছে শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। আসমার কথা শেষ হতে ভিতরে এসে রাগের সঙ্গে শবনমকে বললেন, তোকে আতাহারের সঙ্গে মিশতে কতবার নিষেধ করেছি, তবুও তুই তার সঙ্গে মিশিস কেন? তোর কী বদনামের ভয় ডর নেই? তোর আব্বা বাড়ি আসুক, তারপর কি করি দেখিস। আর কোনোদিন ওর সাথে মিশবি না। যদি শুনি আবার তার সঙ্গে চেীধুরীদের বাগানে গেছিস, সেদিন তোর একদিন কি আমার একদিন। তারপর নাসির উদ্দিনের রুমে গিয়ে তাকে বললেন, আতাহারের সঙ্গে তোর তো খুব বন্ধুত্ব। সে দেশে এলে তাকে ঘরে নিয়ে আসিস। তার সঙ্গে যে তোর বোন। চৌধুরীদের বাগানে যায়, সে খবর রাখিস?
আতাহারের পরের বোন কুলসুম সেভেনে পড়ে। তাকে নাসির উদ্দিনের খুব পছন্দ। ভেবে রেখেছে, ভবিষ্যতে তাকে বিয়ে করবে। সেই জন্যে আতাহার ঢাকা থেকে এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করার অসিলায় মাঝে মাঝে তাদের বাড়ি যায়। তার সঙ্গে স্কুলের যাতায়াতের পথে দেখা করে।
কুলসুম এখন কিশোরী হলে কি হবে, খুব চালাক চতুর মেয়ে। নাসির উদ্দিন যে ভাইয়ার বন্ধু তা জানে। ভাইয়ার সঙ্গে অনেকবার তাদের বাড়ি এসেছে। মাও যে তাকে বেশ স্নেহ করে তাও জানে। তাই তার কিশোরী মনে নাসির উদ্দিনকে ভালো লাগে। সে ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে তার সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পেলেও খুশি হয়। কুলসুম অংকে ও ইংরেজিতে কাঁচা। তাই মাকে ও ভাইয়াকে একদিন বলেছিল, প্রাইভেট মাস্টার রাখার কথা।
আতাহার কিছু বলার আগে রফিকা বেগম বলেছিলেন, নিজে কষ্ট করে পড় মা। দেখছিস না, তোর ভাইয়া নিজে পড়াশোনা বন্ধ করে কত কষ্ট করে তোদেরকে লেখাপড়া করাচ্ছে।
আতাহার তখন কিছু না বললেও সেইদিন নাসির উদ্দিনকে সময় করে কুলসুমের অংক, ইংরেজিটা একটু বুঝিয়ে দিতে বলেছিল।
নাসির উদ্দিন সানন্দে রাজি হয়ে যায় এবং তারপর থেকে প্রতিদিন বিকেলে কুলসুমের বাড়ি গিয়ে তাকে অংক, ইংরেজি বুঝিয়ে দেয়। তার ছোট বোন খাদিজাকেও পড়ায়।
একথা তাদের বাড়ির কেউ জানে না। এখন মায়ের কথা শুনে ভাবল তা হলে কি আতাহার ও শবনমের মধ্যে ভালবাসা হয়েছে। নিজের কথা ভেবে আতাহারের উপর রাগতে গিয়েও পারল না। কি বলবে না বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে চুপ করে রইল। যুবাইদা খানম তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আরো রেগে গেলেন। রাগের সঙ্গেই বললেন, কিরে কিছু বলছিস না কেন?
নাসির উদ্দিন বলল, আমাকে বকছ কেন? শবনমকে নিষেধ করে দাও। ওতো সেই ছোটবেলা থেকেই আতাহারের সঙ্গে মিশে। আগে থেকে নিষেধ করলে এরকম হত না।
নিষেধ আমি আগে থেকেই করছি। তুই আতাহারকে ঘরে নিয়ে এসে ওর সাহস বাড়িয়ে দিয়েছিস। আর কোনোদিন আনবি না। ওর সঙ্গে তুইও মেলামেশা করবি না। এবারে খালেদা এসে বলে গেল, তার বড় ননদ দেবরের জন্য শবনমকে পছন্দ করেছে। কত বড়লোক তারা। ছেলে এম, এ পাশ। ভোলাতে ব্যাংকে চাকরি করে। এসব ব্যাপার জেনে গেলে তারা কি আর সম্বন্ধ করবে?
এসব কথা আমাকে বলছ কেন? তোমার মেয়েকে বল।
মেয়েকে বললে যদি শুনতো, তা হলে আতাহারের সঙ্গে মিশত না। তোদের আব্বাকে কালকেই চিঠি দেব। যার মেয়ে সেই এসে যা করার করবে। তারপর গজর গজর করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলেন।
এবারে খালেদা এসে যখন শবনমকে তার ননদের ইচ্ছার কথা বলছিল তখন থেকে শবনম খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। গতকাল চৌধুরীদের বাগানে আতাহারকে বলতে চেয়েছিল, কিন্তু আতাহারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে কথা ভুলে গেছে। আজ বলবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু আসমার জন্য টেনসনে ছিল বলে বলতে পারেনি। এখন মেজভাইকে আম্মা যেসব কথা বলল, সব শুনে শবনমের দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেল। ভেবে রাখল, কাল আতাহার ভাইকে কথাগুলো বলতেই হবে।
পরের দিন আতাহার দুপুর একটার সময় শবনমদের স্কুলের গেটের বাইরে এসে অপেক্ষা করতে লাগল।
টিফিনের ঘন্টা পড়ার দুতিন মিনিট পর শবনম গেটের বাইরে এসে আতাহারকে দেখে সালাম দিল।
আতাহার সালামের উত্তর দিয়ে তার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখে বলল, কি ব্যাপার, চাচি-আম্মা বকেছে নাকি? তোমার মনটা ভার ভার মনে হচ্ছে?
শবনম বলল, আম্মা তোমার আমার সম্পর্কের কথা এবং তুমি বাড়ি এলেই তোমার সঙ্গে যে চৌধুরীদের বাগানে দেখা করি, সে সব জানতে পেরেছে। গতরাতে আমাকে খুব বকাবকি করেছে। আর একটা কথা, আপার ননদ তার দেবরের জন্য আমাকে পছন্দ করেছে। আম্মা, আব্বাকে বাড়ি আসার জন্য চিঠি দিয়েছে। তুমি ঢাকা চলে যাওয়ার পর যদি আব্বা বাড়ি এসে বিয়ের কথাবর্তা ঠিক করে ফেলে, তা হলে কি হবে?
আতাহার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, এতে দুঃশ্চিন্তার কি আছে? আল্লাহ আমাদের জোড়া যদি তৈরি করে থাকেন, তা হলে যতই বিয়ের কথাবার্তা হোক বা অন্য কিছু হোক না কেন সব ভেস্তে যাবে। তুমি সবর করে আল্লাহপাকের কাছে দোয়া চাও। আমিও চাইব। তারপর তকৃদিরে যা আছে তা তো হবেই। আমি চারদিনের ছুটিতে এসেছি। কাল চলে যাব। তোমার আব্বা আসার পর কি হল না হল, চিঠি দিয়ে জানাবে। তারপর কি করব না করব আমিও তোমাকে চিঠি দিয়ে জানাব। নচেৎ এসে যা করার ভেবে চিন্তে করব। তোমার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি বিয়েতে মত দিও না।
শবনম ছলছল চোখে বলল, আমার খুব ভয় ভয় লাগছে। আমার চিঠি যদি তুমি সময় মত না পাও?
আতাহার বলল, এতদিন যখন সময় মত পেয়েছি, তখন ইনশাআল্লাহ এবারও পাব। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আল্লাহর উপর সব সময় ভরসা রাখবে। আর নিজের মনের। বাসনা তাকে জানাবে। টিফিন ওভারের ওয়ার্নিং ঘন্টা শুনে বলল, এখন আসি। তারপর সালাম বিনিময় করে আল্লাহ হাফেজ বলে ফিরে চলল।
শবনম আতাহারের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়েছিল। ও অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরও একইভাবে তাকিয়ে রইল। এক সময় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। তারপর ঘন্টা পড়ার শব্দ শুনে চোখ মুছে ক্লাসে গেল।
স্ত্রীর চিঠি পেয়েও সাখাওয়াত হোসেন অফিসের কাজের চাপে আসতে পারলেন না। চিঠির উত্তরে সে কথা জানিয়ে লিখলেন, শবনমকে এ ব্যাপারে এখন বেশি রাগারাগি করার দরকার নেই। ওর সামনে পরীক্ষা। পরীক্ষার পর সামসুদ্দিনের ও ওর একসঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করব। আল্লাহপাক রাজি থাকলে সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে আসব।
স্বামীর চিঠি পেয়ে যুবাইদা খানম খালেদাকে চিঠি দিয়ে জানালেন, তোর আব্বা সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে আসবে। আমি তাকে তোদের ওখানে পাঠাব। যতটা পারিস কথা এগিয়ে রাখবি। শবনমের পরীক্ষার পরপর বিয়ের দিন করার ব্যবস্থা করবি।
.
০৬.
এতদিন রমিসা ও মুনসুর জানে না যে, শাইমা বেগম তার ভাইপোদের নামে তাদের বাস্তুটা রেজিষ্ট্রি করে দিয়েছেন। একদিন কুলসুমের সাথে মুরগী নিয়ে ঝগড়ার এক পর্যায়ে রমিসা বলল, তোদের গুষ্ঠীকে ভিটে ছাড়া না করেছি তো আমি বাপের বেটি না। আমার মায়ের জায়গায় কি করে থাকিস দেখব।
কুলসুম এখন বড় হয়েছে। জ্ঞানও বেশ হয়েছে। বলল, আমরাও দেখব কেমন করে ভিটে ছাড়া কর। ফুফু আমাদেরকে এই জায়গা রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে।
রমিসা শুনে মায়ের উপর ভীষণ রেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে গিয়ে বলল, তুমি নাকি আতাহারদের বাস্তুটা তাদের নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছ?
শাইমা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন, যা দিয়েছি, তাতে তোর কি?
রমিসা আরো রেগে গিয়ে বলল, আপা ও ভাইয়া জানে?
শাইমা বেগম বললেন, আমার অংশ থেকে দিয়েছি, তাদেরকে জানাতে হবে কেন?
রমিসা রাগের সঙ্গেই বলল, কাজটা তুমি ঠিক করনি মা। আমি ও তোমাদের জামাই এখানে রয়েছি, আমাদেরকে অন্তত জানান উচিত ছিল। যারা আমাদেরকে একদম দেখতে পারে না, তাদেরকে দেওয়া ঠিক হয়নি।
শাইমা বেগম তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তোর অংশ তোকে দিয়েছি। আর তোর বড় বোনের অংশ রেখে এতিম ভাইপোদেরকে দিয়েছি। এতে আবার উচিত অনুচিত হল কোথায়?
রমিসা বলল, তোমার জামাই বলছিল, আমাদের ঐটুকু জায়গায় গোজরান করা খুব কষ্টকর। তাই ঐ জায়গাটা আমার নামে রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার কথা তোমাকে বলব, ভেবেছিলাম।
শাইমা বেগম এবার রেগে গিয়ে বললেন, যতটুকু দিয়েছি, তাতেই কষ্ট করে। পারলে থাকবি, নচেৎ অন্য কোথাও বেশি জায়গা-জমি কিনে জামাইকে বাস্তু বানাতে বলবি।
রমিসা কেঁদে ফেলে বলল, তুমি নিজেই তো দেখে শুনে জামাই করেছ। এখন আবার এই কথা বলছ কেন? তোমার জামাইয়ের যদি সে রকম ক্ষমতা থাকত, তা হলে তোমার জায়গার আশা করতাম না। মেয়ে জামাইয়ের ভালোমন্দ দেখে না, এমন মা যে দুনিয়াতে আছে তা জানতাম না।
শাইমা বেগম বললেন, তোর কি জ্ঞানগম্য বলতে কিছুই নেই? তোকে তো তোর প্রাপ্য দিয়েছি। তবু তোর আশা মিটেনি। এতিম মামাতো ভাইবোনদের পথে বসিয়ে ঐ জমিটাও পেতে চাস। তোদের মতো অমানুষ আছে বলে আমিও জানতাম না। যা আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা। তোকে পেটে ধরেছি ভাবতে নিজের কাছে ঘেন্না লাগছে।
রমিসা কাঁদতে কাঁদতে বলল, মামী তোমাকে তাবিজ করেছে। তা না হলে নিজের মেয়ে জামাই নাতি নাতনিদের চেয়ে ভাবি ও ভাইপো-ভাইজীরা তোমার আপন হল।
শাইমা বেগম আরো রেগে গিয়ে বললেন, তোর মধ্যে যদি এতটুকু মনুষ্যত্ব বোধ থাকত, হা হলে এসব কথা বলতিস না। তোর আর কোন কথা শুনতে চাই না। চলে যা এখান থেকে।
রমিসা যেতে যেতে বলল, বেঁচে থাকতে আর কোনোদিন তোমার কাছে আসব না।
শাইমা বেগম বললেন, তোর মতো মেয়ের মুখ আমিও দেখতে চাই না।
সাখাওয়াত হোসেন স্ত্রীর চিঠির উত্তর দেওয়ার পর বড় ছেলে সামসুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে বললেন, সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি বাড়ি যাব। তুমি অনেক দিন যাওনি। আমার ইচ্ছা-আমার সঙ্গে তুমিও যাবে। সেই মতো ছুটি নিও।
সামসুদ্দিন বলল, ঠিক আছে আব্বা তাই হবে।
পরের মাসে সাখাওয়াত হোসেন ও সামসুদ্দিন বাড়িতে এল।
যুবাইদা খানম এক সময় সামসুদ্দিনের সামনে স্বামীকে শবনম ও আতাহারের সম্পর্কের কথা বলে খালেদার ননদের কথাও বললেন।
সামসুদ্দিন শুনে খুব রেগে গেলেও আব্বার আগে কিছু বলা বেয়াদবি হবে ভেবে চুপ করে রইল।
সাখাওয়াত হোসেন আতাহারকে ছোট বেলা থেকেই খুব ভালবাসতেন। শবনমের সঙ্গে যখন খেলাধুলা করতে দেখতেন, সেই সময় তাদের দুজনের মিল দেখে মনে মনে ভেবে ছিলেন, আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে আতাহারের সাথে শবনমের বিয়ে দেবেন। পরে যখন আতাহারের আব্বা মারা গেলেন এবং আতাহার লেখাপড়া বন্ধ করে ঢাকায় চাকরি করছে শুনলেন তখন সেই ইচ্ছাটা বাতিল করে দেন। এখন স্ত্রীর মুখে তাদের সম্পর্কের কথা শুনে গম্ভীর মুখে বললেন, আতাহারের আব্বা খুব ভালো লোক ছিলেন। ওদের বংশটাও খুব ভালো। আতাহার খুব ভাল ছাত্র ছিল; কিন্তু তার আব্বা হঠাৎ মারা যাওয়ায় পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর তিনিও বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
সামসুদ্দিন আব্বাকে চুপ করে থাকতে দেখে সংযত কণ্ঠে বলল, তাই বলে আমরা তো শবনমকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে পারি না। এ বছর শবনম এস.এস.সি পরীক্ষা। দেবে। আতাহার তো টেনে উঠে আর পড়েনি। তাদের আর্থিক অবস্থাও খারাপ। তা ছাড়া যেখানে আপার ননদ তার দেবরের জন্য শবনমকে পছন্দ করেছে, সেখানে। আতাহারের কথা চিন্তা করাই যায় না। আমি আপাদের বাড়ি গিয়েছি। তখন একবার তার ননদের স্বামী আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের অবস্থা খুব ভালো। ছেলে শিক্ষিত ও চাকরি করে। এত ভালো সম্বন্ধ আমরা হাতছাড়া করতে পারি না।
সাখাওয়াত হোসেন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যা তোমার কথাই ঠিক। খালেদা যখন এটা চাচ্ছে তখন আমাদের এই পাত্র হাত ছাড়া করা উচিৎ হবে না। তবে সবকিছুর আগে ছেলেকে ও তাদের সবকিছু দেখতে হবে। ছেলে শিক্ষিত ও চাকুরে হলেই যে ভালো হবে, তা ঠিক নয়। তার স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে খোঁজ নিতে হবে। ছেলে ও তাদের বাড়ির সবাই ধর্ম-কর্ম করে কিনা, ছেলের বাবা, দাদা নানা সুদ খায় কি না সবকিছু জানতে হবে। তা ছাড়া ছেলের আগে কোনো বিয়ে হয়েছে কিনা? হয়ে থাকলে সে স্ত্রীর খোঁজও নিতে হবে। আজকাল মেয়ের বাবারা এইসব না দেখে না শুনে রোজগারী ছেলে ও ভালো অবস্থা দেখে জামাই করছে। তার ফলে বিয়ের পর মেয়েকে অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে।
যুবাইদা খানম বললেন, খালেদার বিয়ে দেবার সময় তো তার শ্বশুরদের সবকিছু জেনেছ। এই ছেলে তো তাদেরই আত্মীয়। সে রকম কিছু হলে খালেদা রাজি হত না।
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, তোমার কথা অবশ্য ঠিক। তবু আমি গিয়ে খোঁজ খবর নেব।
যুবাইদা খানম বললেন, বেশ তো, দু-একদিনের মধ্যে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে এস।
সাখাওয়াত হোসেন দুদিন পর চরখলিফায় মেয়ের বাড়ি গেলেন। খালেদার ননদের বিয়ে হয়েছে একই গ্রামে। ছুটিতে জামাই বাড়িতে ছিল। জামাই মজিদের কাছে সবকিছু শুনে একদিন তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখে শুনে সাখাওয়াত হোসেনের পছন্দ হল। তিনি পাত্র পক্ষকে দাওয়াত দিয়ে বললেন, আপনারা আমাদের বাড়িতে এসে সবকিছু দেখাশোনা করুন। তারপর বিয়ের কথাবার্তা পাকা করা হবে এবং শবনমের এস.এস.সি পরীক্ষার পর দিন ঠিক করা হবে।
বাড়ি ফিরে সাখাওয়াত হোসেন স্ত্রীকে সব কিছু বলে বললেন, এর মধ্যে সামসুদ্দিনের জন্য মেয়ে দেখতে হবে। ঠিক করেছি, সামসুদ্দিনের ও শবনমের বিয়ে একসঙ্গে দেব।
যুবাইদা খানম বললেন, আমারও তাই ইচ্ছা।
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, ফজল ঘটকের সাথে আজ বাজারে দেখা হয়েছিল। তাকে সামসুদ্দিনের জন্য একটা মেয়ে দেখতে বলতেই বলল, চৌকির ঘাটে একটা মেয়ে। আছে। মেয়েটা বি.এ. পড়ছে। নামায কালাম পড়ে। দেখতে শুনতে ভালো। বনেদী বংশের মেয়ে। তবে তার বাবার অবস্থা তেমন ভালো না। ভদ্রলোকের চেীকির ঘাটেই একটা ভাতের হোটেল আছে। হোটেলের আয়ে সংসার চলে। জমি-জায়গা নেই বললেই চলে। মেয়েটাই বড়। আরো দুতিনটে ছোট ছোট ভাইবোন আছে। মেয়েটা হস্তশিল্পের কাজ খুব ভালো জানে। সেই কাজ করে নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালায়।
যুবাইদা খানম বললেন, সামসুদ্দিন ঐ রকম ঘরে বিয়ে করতে রাজি হবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া তাদের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা করা কি ঠিক হবে? মান-সম্মান বলে একটা কথা আছে। তুমি অন্য কোথাও সম্ভ্রান্ত ঘরের কোনো মেয়ের খোঁজ করতে ফজল ঘটককে বল।
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, তা না হয় বলব; কিন্তু আজকাল সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা নামায কালামের ধার ধারে না। তাদের লজ্জা শরমও কম।
যুবাইদা খানম বললেন, সবাই কি এক রকম হয়। এর মধ্যে দেখেশুনে করতে হবে। চৌকির ঘাটের যে মেয়ের কথা বলছ, তার বাবা তো মেয়ে জামাইকে কিছুই দিতে পারবে না। সামসুদ্দিনের মত শিক্ষিত ও চাকরিওয়ালা ছেলের সেই রকম উপযুক্ত ঘরে বিয়ে না হলে আত্মীয়-স্বজনরাই বা কি বলবে। না না, ঐ মেয়ে যতই ভালো হোক আমরা তাকে বৌ করে আনতে পারব না।
সাখাওয়াত হোসেন অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, তুমি যে লেনদেনের কথা বললে, তা আমি মেনে নিতে পারলাম না। ছেলের বিয়ে দিয়ে মেয়ের বাবার কাছ থেকে দাবি করে কিছু নেওয়া শরীয়তে নিষেধ। সামসুদ্দিনকে তো আমি চিনি, শুনলে সেও রেগে যাবে। কি জান, আমাদের মতো সামর্থবানরা গরীব ঘরের মেয়েদেরকে গ্রহণ করছি না বলেই অনেক ভালো ভালো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না। যদিও কারো কারো হচ্ছে। সে সব মেয়েরা এমন ছেলের হাতে পড়ছে, যাকে বলে বানরের গলায় মুক্তার মালা। বানরেরা তো মুক্তার কদর বুঝে না। তারা সেটাকে সিঁড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। আমাদের নবী করিম (দঃ) বিয়ের ব্যাপারে পুরুষদেরকে বলেছেন, ধন দৌলতের চেয়ে ধার্মিক মেয়ে বিয়ে করবে। তিনি আরো বলেছেন, ধনদৌলতের চেয়ে ধার্মিক স্ত্রী অতি উত্তম।-এসব হাদিসের কথা। আজকাল মানুষ ধনদৌলতের লোভে আল্লাহ ও তাঁর রসূল (দঃ) এর কথা ভুলে গেছে। তাই মুসলমানদের এত দূর্গতি। যাই হোক, তবু আমি ফজল ঘটককে বড় ঘরের ভালো মেয়ের খোঁজ নিতে বলব। তারপর তকদিরে যা আছে, তা তো হবেই।
সাখাওয়াত হোসেনের ছুটি শেষ, তিনি এক সপ্তাহ থেকে চলে গেলেন।
সামসুদ্দিন অনেক দিন পর পনের দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে। সে আরো এক সপ্তাহ থাকবে। সামসুদ্দিন তার বিয়ের ব্যাপারে মা-বাবার কথোপকথন শুনেছে। সে ফজল ঘটককে চিনে। খালেদার ঘটকালি সেই করেছিল। তার বাড়ি গুপ্তগঞ্জে। সেও সামসুদ্দিনকে চিনে। একদিন সামসুদ্দিন ফজল ঘটকের সাথে দেখা করে চৌকির ঘাটের মেয়েটাকে দেখাবার ব্যবস্থা করতে বলল।
ফজল ঘটক সেই দিনই তাকে সঙ্গে নিয়ে ছুটির সময় কলেজের কাছা-কাছি রাস্তায় অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে দুজন মেয়েকে আসতে দেখে বলল, ডানদিকের মেয়েটি।
মেয়েটিকে দেখে সামসুদ্দিনের পছন্দ হল। মেয়ে দুটি তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার পর বলল, বাড়িতে গিয়ে আম্মাকে বলবেন, আমি এই মেয়েকে বিয়ে করব।
ফজল ঘটকের বয়স পঞ্চাশের মত। বলল, বাবাজী তোমার পছন্দের তারিফ না করে পারলাম না। সারা জীবন ঘটকালি করলাম, কিন্তু এরকম পয়মন্ত মেয়ে আর একটাও দেখিনি। যাদেরকে আল্লাহ দেখার মত চোখ দিয়েছে, তারাই এই মেয়েকে দেখলে পছন্দ করবে। আমি হলফ করে বলতে পারি, এই মেয়েকে বিয়ে করলে ইনশাআল্লাহ তুমি সুখ শান্তিতে জীবন কাটাতে পারবে।
সামসুদ্দিন বলল, আল্লাহপাক আমাকে যতটুকু জ্ঞান দিয়েছেন, তাতেই মেয়েটিকে দেখে আপনার সঙ্গে আমি একমত। মেয়েটির নাম জানেন চাচা?
নিশাত তামান্না। নামও যেমন, গুণও তেমন।
নামের অর্থটা বলবেন?
আকাঙ্খিত আনন্দ। তারপর হেসে উঠে বলল প্রত্যেক মানুষই আনন্দ আকাঙ্খা করে।
সামসুদ্দিন বলল, হ্যাঁ চাচা আপনার কথাই ঠিক। এবার আসি, তারপর সালাম বিনিময় করে চলে এল।
ছুটি শেষ হওয়ার পর সামসুদ্দিন কর্মস্থলে চলে গেল।
আব্বা আপাদের বাড়িতে কেন গিয়েছিল, শবনম তা বুঝতে পারলেও কি হল, না হল, জানতে পারল না।
মাসখানেক পর খালেদা বাপের বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এল। একদিন শবনমকে বলল, ভালো করে পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করার চেষ্টা করবি। আমার বড় ননদ বলছিল, তার দেবর বলেছে, বিয়ের পর তোকে ভোলাতে নিজের কাছে রেখে কলেজে পড়াবে।
আপার কথা শুনে শবনম বুঝতে পারল, বিয়ের কথা তা হলে ঠিক হয়ে গেছে। ভাবল, এখনই আপাকে নিজের মতামত জানান দরকার। কিন্তু কিভাবে বলবে চিন্তা করতে লাগল।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে খালেদা বলল, কিরে চুপ করে কি ভাবছিস? তারপর বলল, তোর ভাগ্য খুব ভালো। ছেলেটা যেমন সৎ তেমনি আচার ব্যবহারও খুব সুন্দর।
শবনম বলল, ভাগ্যের কথা আল্লাহ জানে। আপা তোমাকে একটা কথা বলছি, আমি কিন্তু এই বিয়েতে রাজি না।
খালেদা মায়ের কাছে শবনমের ও আতাহারের সম্পর্কের কথা শুনেছে। এখন তার অমতের কথা শুনে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান করে জিজ্ঞেস করল, কেন?
আমি আতাহার ভাইকে ভালবাসি।
তাতে কি হয়েছে? কারো সঙ্গে ভালবাসা হলেই যে, তার সঙ্গে বিয়ে হবে, এটা ঠিক নয়। তা ছাড়া আতাহার তোর চেয়ে কম শিক্ষিত। তাদের অবস্থাও খুব খারাপ। আমার ননদের দেবরের কাছে আতাহার কিছুই না। ওসব বদখেয়াল ছেড়ে দে।
কিন্তু আপা, আমরা একে অপরকে ছোটবেলা থেকেই ভালবাসি। তাকে ছাড়া আমি যেমন বাঁচব না, তেমনি আমাকে ছাড়া সেও বাঁচবে না। সেজন্য আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি, কেউ কাউকে ছাড়া বিয়ে করব না।
এ তুই কি বলছিস শবনম? প্রতিজ্ঞা করার আগে আমাদের ও আতাহারদের অবস্থার কথা চিন্তা করলি না। আব্ব ও সামসুদ্দিন শুনলে তোকে আস্ত রাখবে? এবার আব্বা চর খলিফায় গিয়ে আমার ননদের শ্বশুরের সঙ্গে এক রকম কথাবার্তা ঠিক করে এসেছে। তোর পরীক্ষার পর বিয়ে হবে।
শবনম চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, না আপা না, এ কখনই সম্ভব নয়। তোমরা যদি জোর করে আমার বিয়ে দাও, তবে আমার লাশের বিয়ে হবে।
খালেদা খুব রেগে গিয়ে তার গালে একটা চড় মেরে বলল, তোর এতবড় সাহস। যতবড় মুখ নয় ততবড় কথা। একটা গরিব এতিম ছেলের জন্য আত্মহত্যা করার ভয় দেখাচ্ছিস? তারপর মাকে ডেকে বলল, আম্মা, শবনম কি বলছে শুনবে।
শবনম ভাবতেই পারেনি আপা তাকে মারবে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, তুমি আমাকে মারলে আপা?
খালেদা রাগের সঙ্গেই বলল, আমি না হয় একটা চড় মেরেছি। আম্মা জানতে পারলে তোকে মেরে খুন না করে ফেলে।
যুবাইদা খানম রান্নাশালে আনাজ কূটছিলেন। খালেদার কথা শুনে তাদের কাছে। এসে শবনমকে কাঁদতে দেখে ঘটনাটা আঁচ করতে পেরেও বড় মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে ওকে বকছিস কেন? আর ও কাঁদছেই বা কেন?
খালেদা বলল, ওকে আমি আমার বড় ননদের দেবরের সঙ্গে বিয়ের কথা বলতে বলে কিনা, ও আতাহারকে ভালবাসে। তাকে ছাড়া অন্য কোথাও বিয়ে বসবে না। তাই মেরেছি।
যুবাইদা খানম রাগ সামলাতে পারলেন না। বললেন, ঠিক করেছিস। তারপর শবনমের চুল ধরে পিঠে কয়েকটা কিল মেরে বললেন, ঐ কথা যদি আবার মুখে আনিস, তা হলে তোকে খুন করে ফেলব।
শবনম মায়ের দুপা জড়িয়ে ধরে বলল, তাই কর মা তাই কর। আমি আতাহার ভাইকে ছাড়া অন্য কোথাও বিয়ে বসব না।
এই কথা শুনে যুবাইদা খানম আরো মারতে লাগলেন।
খালেদা চিন্তা করল, সামনে ওর পরীক্ষা, এখন বেশি মারধর করলে ভালভাবে পড়াশোনা করতে পারবে না। তাই মাকে ধরে ফেলে বলল, এখন আর মারার দরকার নেই। ছেলেমানুষী বুদ্ধিতে কি বলতে কি বলে ফেলেছে। আমি ওকে বোঝাব। তারপর। মাকে পাশের রুমে নিয়ে গিয়ে বলল, এখন ওর উপর অত্যাচার করা ঠিক হবে না। কারণ সামনে পরীক্ষা। পরীক্ষার পরপর ওর বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে হবে। যে কদিন আছি ওকে আমি বোঝাব।
যুবাইদা খানমের রাগ তখন কিছুটা কমেছে। ভাবলেন, খালেদা ঠিক কথাই বলেছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, হ্যাঁ তুই ওকে বুঝিয়ে বলবি, ও যেন আতাহারের কথা ভুলে যায়। তারপর রান্নাঘরে চলে গেলেন।
খালেদা শবনমের কাছে এসে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিতে দিতে বলল, ঠিক আছে, তোকে আমরা আর কিছু বলব না। এখন ঐসব চিন্তা দূর করে মন দিয়ে পড়াশোনা কর। বিয়ে শাদী তকদিরের ব্যাপার। কাকে কার সঙ্গে জোড়া করে পয়দা করেছে, সে কথা আল্লাহ জানে।
আতাহারের কথা জেনে আম্মা যে মারধর করবে, তা শবনম জানত। কিন্তু আপা তাকে মারবে, সে চিন্তাই করতে পারেনি। এখন আবার তার নরম সুর শুনে তার উপর। প্রচন্ড অভিমান হল। কোনো কথা না বলে ফোঁপাতে ফোঁপাতে পড়ার রুমে চলে গেল।
এরপর যে কদিন খালেদা ছিল, সেই কদিন শবনম তার সঙ্গে কথা বলেনি। তার ছেলে-মেয়েকে আদরও করেনি। কয়েকদিন পর দুলাভাই আপাকে নিয়ে যেতে এল। তারসঙ্গে কথা বললেও আগের মতো ধারে কাছে গেল না।
মজিদ একদিন স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল; কি ব্যাপার বলতো, শবনমের কি হয়েছে? সব সময় মন খারাপ করে থাকে। আমার কাছেও বড় একটা আসে না।
খালেদা মিথ্যা করে বলল, মেয়েদের অনেক রকম অসুখ হয়। সেই রকম কিছু একটা হয়েছে, তাই আর কি।
মজিদ হেসে উঠে বলল, ও তাই বল। আমি মনে করেছিলাম কি না কি হয়েছে।
যেদিন খালেদা ছেলেমেয়ে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে চলে গেল, সেদিনও শবনম ভাগনা ভাগনিকে আদর করল না। আপার সঙ্গেও কথা বলল না। শুধু দুলাভাইকে আবার আসতে বলল।
কয়েকদিন পর শবনম সবকিছু জানিয়ে আতাহারকে চিঠি দিল।
আতাহার চিঠির উত্তরে সমবেদনা জানিয়ে লিখল, পরীক্ষা পর্যন্ত এসব নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করো না। তোমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই ইনশাআল্লাহ আমি আসব এবং যা করার করব। এর মধ্যে আসতে পারব না। তুমি আল্লার উপর ভরসা করে ধৈৰ্য্য সহকারে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দাও। তোমাকে তো বলেছি তকৃদিরে যা আছে, তা কেউই রদ করতে পারবে না। আর তোমার আমার সম্পর্কের ব্যাপার নিয়ে কারো সঙ্গে কোনো উচ্চবাচ্য করো না।
শবনম চিঠি পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হলেও সম্পুণ হতে পারল না। তবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগল। টেস্ট পরীক্ষায় এলাও হওয়ার পর একদিন মেজভাই নাসির উদ্দিনকে বলল, তুই আমার একটা উপকার করবি?
নাসির উদ্দিন ও শবনম কোলে-পিঠে। তাই দুজনে যেমন তুই তোকারি করে, তেমনি সব সময় খিটির-মিটির লেগেই থাকে। কিন্তু উক্ত ঘটনার পর কেউ কারো সঙ্গে লাগেনি। নাসির উদ্দিনের মনে ভয় ঢুকে গেছে। সে যে আতাহারের বোন কুলসুমকে ভালবেসে ফেলেছে। সে কথা এখনো কেউ জানে না। তবে কুলসুমকে যে সে রোজ বিকেলে পড়াতে যায়, শবনম সে কথা আতাহারের কাছে শুনেছে। তাই এই ঘটনার পর যেদিন শবনম তাকে বলেছিল, তুই যে কুলসুমকে পড়াতে যাস, আম্মা শুনলে তোর সঙ্গেও খুব রাগারাগি করবে। সেদিন নাসির উদ্দিন কোনো কথা না বলে চুপ করেছিল। আতাহারের জন্য আপা ও আম্মা শবনমকে মেরেছিল জেনে তার যেমন মায়া হয়েছিল, তেমনি নিজের কথা ভেবে আরো বেশি ভয় পেয়েছিল। আজ শবনমের উপকার করে দেবার কথা শুনে বলল, বল কি করতে হবে।
আপার ননদের দেবরের ভোলার ঠিকানাটা জোগাড় করে আমাকে দিতে পারিস?
নাসির উদ্দিন শবনমের চেয়ে দুবছরের বড়। স্মরণ শক্তি কম বলে এস.এস.সি পরীক্ষায় দুবার ফেল করে এবছর শবনমের সঙ্গে আবার দিবে। যার সঙ্গে তার বিয়ের কথা হয়েছে। তার ঠিকানা কেন চাইছে বুঝতে না পেরে বলল, তার ঠিকানা নিয়ে তুই কি করবি?
কি করব এখন বলব না, পরে বলব।
নাসির উদ্দিন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, আমি তার ঠিকানা জানি।
সত্যি বলছিস?
হারে সত্যি, আপাদের বাড়িতে বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সে একবার আমাকে ঠিকানা দিয়ে বলেছিল বেড়াতে যাওয়ার জন্য।
শবনম কাগজ কলম নিয়ে এসে বলল, তা হলে লিখে দে।
নাসির উদ্দিন ঠিকানা লিখে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিরে তাকে চিঠি দিবি নাকি?
শবনম মৃদু হেসে বলল, বললাম না, এখন কিছু বলব না, পরে বলব? তারপর জিজ্ঞেস করল, তুই কি এখনো কুলসুমকে পড়াতে যাস?
নাসির উদ্দিন মাথা নেড়ে বলল, তুই যেন আম্মাকে বলে দিস না।
শবনমের সঙ্গে কুলসুমের স্কুলে প্রায় দেখা হয়। তার সঙ্গে কথা বলে শবনম বুঝতে পেরেছে, মেজ ভাইয়ের সঙ্গে কুলসুমের সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করেছে। কয়েকদিন আগে তাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে মেজভাই এখনো তাকে পড়াতে যায়। তবু কি বলে জানার জন্য এখন জিজ্ঞেস করেছিল। মেজ ভাইয়ের কথা শুনে হেসে উঠে বলল, তোদের ব্যাপারটা জেনে গেছি। আম্মাকে অনেক আগেই জানাতে পারতাম, কিন্তু জানাইনি। তবে বিশ্বাস রাখিস, এতদিন যখন জানাইনি তখন ভবিষ্যতেও জানাব না।
ছোট বোনের কাছে ধরা পড়ে নাসির উদ্দিন লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
সেইদিন রাত বারোটা পর্যন্ত শবনম পড়াশোনা করল। তারপর বই বন্ধ করে মেজ ভাইয়ের পড়ার শব্দ না পেয়ে বুঝতে পারল, সে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাগানের দিকে কি একটা পাখি ডানা ঝাঁপটে উড়ে গেল। দূরে শিয়ালের ডাক শুনতে পেয়ে পাড়ার কুকুরগুলো একসঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। এমন সময় কয়েকটা পেঁচা এক সঙ্গে ডেকে উঠতে শবনম ভয়ে চমকে উঠল। জানালাটা বন্ধ করে ছোট বোন আসমার দিকে চেয়ে দেখল, সে বেঘোরে গুমোচ্ছে। আস্তে আস্তে মাঝখানের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, আম্মাও ঘুমাচ্ছে। ঠিকানা পাওয়ার পর ভেবে রেখেছে, সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সে। মুবিনকে চিঠি লিখবে। পড়ার টেবিলের কাছে এসে চিঠি লিখতে বসল। কি বলে সম্বোধন করবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে শেষে চিন্তা করল, আপার ননদের দেবর যখন, তখন তো বিয়াই বলেই সম্বোধন করা যায়।
বিয়াই,
পত্রে আমার সালাম নেবেন। আশা করি আল্লাহপাকের রহমতে ভাল আছেন। আর তাই কমনাও করি। এবার আমার পরিচয় দিয়ে আসল বক্তব্যে আসছি, আমি হলাম আপনার ভাবির ভাবির বোন। অর্থাৎ আমার বড় আপা হল, আপনার ভাবির ভাবি। আরো ভোলাসা করে বলছি। আপনার ভাবির বড় ভাই আমার আপাকে বিয়ে করেছে। এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন আমি কে? হ্যাঁ আমার সঙ্গেই আপনার বিয়ের কথা হয়েছে। ছোটবেলায় আপনাদের বাড়িতে অনেকবার গিয়েছি। তখনকার কথা মনে নেই। তবে বড় বেলায় আপনার সঙ্গে মাত্র একবার অল্পক্ষণের জন্য আলাপ হয়েছিল। সেই সময়ে যতটুকু আপনাকে জেনেছি এবং আপার মুখে আপনার প্রশংসা শুনে যা বুঝেছি তাতে মনে হয়েছে, আপনি পাত্র হিসেবে রত্ন। আপনার যিনি স্ত্রী হবেন, তিনি যে অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আপনার সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ করার পেছনে আপার অবদান প্রচুর। আব্বা গিয়ে আপনাকে ও আপনাদের সবকিছু দেখেশুনে পছন্দ করে বিয়ের কথাবার্তা একরকম পাকা করে এসেছেন। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য। কারণ আমি আপনার অনুপযুক্ত। আমার তকদিরে আপনার মতো রত্নকে আল্লাহপাক রাখেননি। তা না হলে তিনি কেন ছোটবেলা থেকে আমাদের গ্রামেরই একটা ছেলের সঙ্গে ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়ে দিলেন? তার ভেদ তিনিই জানেন। জ্ঞান হওয়ার পর আমরা একে অপরের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সামাজিক দৃষ্টিতে ছেলেটি আমার ও আমাদের পরিবারের অনুপযুক্ত। তাই আমাদের দুজনের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে অভিভাবকেরা আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। অবশ্য আপনার মতো পাত্র পেলে যে কোনো মেয়ের অভিভাবক লুফে নেবে। আমি এই সম্বন্ধ জানতে পেরে প্রতিবাদ করি। ফলে আমার উপর নেমে আসে অভিভাবকদের অত্যাচার। পরীক্ষার জন্য এখন অত্যাচার বন্ধ আছে। মনে হয়, পরীক্ষার পর অত্যাচারের মাত্রা-সীমা ছেড়ে যাবে এবং আমার অমতে আপনার সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেবে। তবে আমিও তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছি, তোমরা যদি জোর জবরদস্তি কর, তা হলে আমার সঙ্গে নয়, আমার লাশের সঙ্গে বিয়ে হবে। এই পত্র পড়ে আমাকে চরিত্রহীনা মেয়ে ভাবতে পারেন, তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি কি, তা আল্লাহপাক জানেন। আর একটা কথা লিখে আমার বক্তব্য শেষ করব। সবকিছু জানার পরও যদি আমাকে বিয়ে করতে চান অথবা না চান, তা হলে আপনার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, এই চিঠির কথা সারা-জীবন গোপন রাখবেন। আশা করি আমার এই অনুরোধটুকু ইনশাআল্লাহ রাখবেন। আর আমার চিঠি পড়ে যদি আপনি মনে কষ্ট পান, তা হলে আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ করে দেবেন। আল্লাহপাকের দরবারে আপনার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবন সুখের হোক, শান্তির হোক, এই কামনা করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি আপনার শুভাকাখিনি
শবনম।
চিঠি লেখা শেষ করে দুবার পড়ল। তারপর ভাজ করে বইয়ের মধ্যে রেখে ভাবল, কাল কোচিং করতে যাওয়ার সময় পোস্ট করবে।
.
০৭.
শবনম যাকে চিঠি দিল, তার নাম আব্দুল মুবিন। ডাক নাম মুবিন। মুবিন ঢাকা থেকে এম, এ পাশ করে ভোলায় সোনালী ব্যাংকে চাকরি করে। সেখানে তার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকে। ধার্মীক ও সৎ ছেলে হিসাবে ছোটবেলা থেকে তার একটা সুনাম আছে। যতদিন গ্রামের বাড়িতে ছিল, ততদিন গ্রামের বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। ভোলাতে এক বছর মাত্র আছে। এরই মধ্যে সেখানে বিভিন্ন সমাজ কল্যাণ ও ধর্মীয় সংগঠনের সদস্য হয়ে কাজ করছে। তার কর্ম ও উন্নত চরিত্র দেখে সেখানকার অনেক উচ্চপদস্থ সরকারী লোকজন তাকে জামাই করতে আগ্রহী। কিন্তু মুবিন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদেরকে জানিয়ে দেয়, এসব ব্যাপারে আমার অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ইদানিং সমাজ কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারী ওয়াহাবের সঙ্গে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। ওয়াহাব ভোলারই ছেলে। ডাক্তারী পাশ করে ভোলা সদর হাসপাতালে ডাক্তারী করছে। এখনো বিয়ে করেনি। ধর্ম সম্বন্ধে যেমন কিছু জানত না, তেমনি ধর্মকে খুব এড়িয়ে চলত। বলত, চরিত্রবান হয়ে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সেবা করা অথবা উপকার করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আরো বলত, যারা ধর্মের কিছু আনুষ্ঠানিকতা মেনে চলে, অথচ মানুষের উপকার করে না, যারা মানুষকে ঠকায়, মানুষের ক্ষতি করে, তারা আবার কিসের ধার্মীক? ঐ রকম ধার্মীক লোকদের আমি ঘৃণা করি। তাদের চেয়ে অধার্মীক লোক অনেক ভালো।
মুবিনের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর প্রথম দিকে এসব নিয়ে তার সঙ্গে ওয়াহাবের খুব তর্ক-বির্তক হত। মুবিন তার কথা স্বীকার করে নিয়ে যখন ইসলামের, কোরআনের ও হাদিসের ব্যাখ্যা তাকে বোঝাতে লাগল তখন ধীরে ধীরে তার জ্ঞানের চোখ-খুলে যায় এবং ইসলামের দৈনন্দিন আচার অনুষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে মেনে চলতে শুরু করে। ওয়াহাব কমিউনিজমের সবকিছু ফলো করত। মুবিন তাকে বোঝালো কমিউনিজমের কাঠামো ইসলাম থেকে নেয়া এবং তারা ইসলামের দুষমন বলে ইসলামকে স্বীকার করে না। উদাহরণ স্বরূপ বলল, ধর কমিউনিজম ছোট-বড়-ধনী গরিব স্বীকার করে না। তারা বলে মানুষ সব সমান। কেউ গাছ তলায়, ফুটপাতে ও কুঁড়ে ঘরে থেকে একবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাবে, আবার কেউ বড় বড় অট্টালিকায় ভোগবিলাসে জীবন যাপন করবে, তা হতে পারে না। আর ইসলাম কি বলে জানেন, পৃথিবীর মানব গোষ্ঠীকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য এবং সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য আল্লাহপাক ছোট বড়, ধনি-গরিব তৈরি করেছেন। সেই সঙ্গে ধনি-গরিব, ছোট-বড় সকলের জীবন ব্যবস্থার আইন কোরআন ও হাদিসে বাতলে দিয়েছেন। সেই সব আইন যদি মানবগোষ্ঠী মেনে চলত, তা হলে ছোটরা বড়দের বিরুদ্ধে এবং গরিবরা ধনীদের উপর এত অত্যাচার করত না। অথবা শোষণের স্টীম রুলার চালাত না। ক্বোরআন এবং হাদিসের ব্যাখ্যা পড়লে মুসলমানদের জন্য দুঃখে আপনার চোখ থেকে শুধু পানি নয়, রক্ত বেরিয়ে আসবে। কোরআন-হাদিসের একটা বাণী আপনাকে বলছি, এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই এবং পৃথিবীর সমস্ত মুসলমান শুধু যে ভাই ভাই তা নয়, তাদের সমষ্টি মিলে একটা শরীর। শরীরের যে। কোনো অংশে ব্যথা লাগলে যেমন সমস্ত শরীরে তা অনুভুত হয়, তেমনি যে কোন মুসলমান দুঃখ কষ্টে বা বিপদে পড়লে সারা পৃথিবীর মুসলমানদের সেই দুঃখ কষ্ট বা বিপদ অনুভুত হবে এবং তার প্রতিকার করার জন্য সাহায্যার্থে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এক মুসলমানের ধন-সম্পত্তি অন্য মুসলমানদের কাছে আমানত স্বরূপ। আমানত যেমন খেয়ানত করা হারাম তেমনি এক মুসলমানের ধন-সম্পত্তি অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা বা গ্রহণ করা হারাম। এমন কি কোন বিধর্মীও যদি বিপদে পড়ে, তাকে সাহায্য করা। মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব এবং তাদের ধন-সম্পত্তিও অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা হারাম। বিধর্মীরাও আল্লাহপাকের সৃষ্টি। কিন্তু মুসলমানরা কি কোরআন হাদিসের ঐসব আইন মানছে? মানছে না। তাই তো সারা দুনিয়ার মুসলমানরা আজ বিজাতীয়দের কাছে ঘৃণিত; লাঞ্ছিত ও উৎপীড়িত। এই পর্যন্ত বলে মুবিন বলল, আপনি কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ুন, আর সেই সঙ্গে নবী রসুল ও বিভিন্ন ইসলামী মণীষীদের জীবনী ও ইসলামের ইতিহাস পড়ুন। দেখবেন, ইসলামের কাছে পৃথিবীর কোনো ইজমই পাত্তা পাবে না।
মুবিনের সঙ্গে মেলামেশার ফলে এবং কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ে ওয়াহাবের মনের কালিমা দূর হয়েছে। এখন সে ধর্মের অনেক নিয়ম মেনে চলে।
একবার ওয়াহাব অসুখে বেশ কিছুদিন বিছানায় পড়েছিল। খবর পেয়ে মুবিন কয়েকবার তাকে দেখতে গিয়েছিল। ওয়াহাবদের বাড়ির সবাই খুব মডার্ন। মেয়েরা ধর্ম কর্ম তো করেই না এমন কি পর্দা কি জিনিস তাও জানে না। মুবিন যেদিন ওয়াহাবকে প্রথম দেখতে যায় সেদিন তাদের বাড়ির মেয়েরা তাকে ওয়াহাবের বন্ধু জেনে অবাধে মেলামেশা করেছে। কিন্তু দ্বিতীয় দিন যখন যায় তখন হঠাৎ মুবিন লক্ষ্য করল, গায়ে মাথায় চাদর জড়ান, এমন কি চোখ দুটো ছাড়া মুখও ঢাকা একটা মেয়ে অন্যান্য মেয়েদের সাথে ওয়াহাবের খাটের কাছে রয়েছে। মুবিনের মনে হল, মেয়েটা তার দিকে চেয়ে রয়েছে। মুবিন তার দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ে গেল। সাথে সাথে মেয়েটা চোখ নামিয়ে নিল। মুবিন মাত্র কয়েক সেকেণ্ড মেয়েটার চোখে চোখ রেখেছে। তাতেই তার মনে অজানা এক অনুভূতি অনুভব হল। তারপর যে কয়দিন ওয়াহাবকে দেখতে গেছে, সেই কয়দিনই মেয়েটাকে দেখার আগ্রহ জেগেছে। কিন্তু বাড়ির এখানে ওখানে দেখলেও সে যতক্ষণ থেকেছে ততক্ষণ ওয়াহাবের কাছে আসেনি। ওয়াহাব মোটামুটি সুস্থ্য হওয়ার পর শেষ দিন যখন মুবিন তাকে দেখতে গেল তখন সেই মেয়েটি ওয়াহাবকে নাস্তা খাওয়াচ্ছিল। সেখানে আর কেউ ছিল না। মুবিনকে দেখে একপাশে। সরে দাঁড়াল।
ওয়াহাব খাচ্ছিল, তাই সালাম না দিয়ে মুবিন জিজ্ঞেস করল, আজ কেমন আছেন?
ওয়াহাব বলল, আল্লাহ চাহেত ভালো। আসুন বসুন। তারপর খাওয়া বন্ধ করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, নাসিমা, মুবিন ভাইয়ের জন্য কিছু নিয়ে আয়।
মুবিন বলল, আপনি খান, আমি অফিস থেকে বেরিয়ে হোটেলে নাস্তা খেয়ে এসেছি। তারপর নাসিমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমার জন্য কিছু আনবেন না।
নাসিমা কিন্তু শুনল না। এক কাপ চা এনে মুবিনের হাতে দেওয়ার সময় বলল, হোটেলে নাস্তা খেলেও চা খাননি। তাই নাস্তা না দিয়ে শুধু চা দিলাম। আশা করি, হোটেলের চা খেতে না পারলেও এটা পারবেন।
নাসিমার কথা শুনে মুবিনের মনে হল, তার সঙ্গে যেন অনেক দিনের আলাপ পরিচয়। আরো মনে হল, মেয়েটি শিক্ষিত। বেশ অবাক হয়ে বলল, চায়ের ব্যাপারটা আপনি জানলেন কি করে?
নাসিমা কিছু বলার আগে ওয়াহাব বলল, আপনার সঙ্গে যেদিন প্রথম পরিচয় হল, সেদিন হোটেলে নাস্তা খাওয়ার পর চায়ের অর্ডার দিতে আপনি বলেছিলেন, হোটেলের নাস্তা খেতে পারলেও চা খেতে ভালো লাগে না বলে খান না। একদিন বাড়িতে আপনার কথা আলোচনা করার সময় কথাটা বলেছিলাম।
মুবিন আর কিছু না বলে চা খেয়ে কাপ পিরীচ টেবিলের উপর রেখে দিল।
ততক্ষণে ওয়াহাবেরও খাওয়া শেষ হয়েছে। নাসিমা ট্রেতে সব কিছু তুলে নিয়ে চলে গেল।
মুবিন ওয়াহাবকে বলল, আপনাদের বাড়ির সব মেয়েদের থেকে ওঁকে একটু অন্য রকম মনে হল।
ওয়াহাব মৃদু হেসে বলল, আমারই ভুল হয়েছে। সবার সঙ্গে পরিচয় করালেও নাসিমার সঙ্গে করান হয়নি। ও আমাদের একমাত্র বোন। বি, এ, পড়ছে। সবার ছোট। ও আমার মতো কমিউনিজমের ভক্ত ছিল। আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে আমার মনের কালিমা যেমন আল্লাহপাক দূর করে ইসলামের আলোয় আলোকিত করেছেন। তেমনি নাসিমাও আমার কাছ থেকে আপনার কথা শুনে ও ইসলামী বই পুস্তক পড়ে আমার থেকে বেশি ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়েছে এবং আমার থেকেও বেশি ধার্মিক হয়ে গেছে। তারপর নাসিমাকে ডাকার জন্য একটু উচ্চস্বরে বলল, নাসিমা, এখানে একবার আয়তো।
নাসিমা ট্রে রেখে ফিরে এসে ভাইয়াকে বলল, কেন ডাকলে বল,
ওয়াহাব বলল, তুই তো আমার বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করার জন্য কতবার তাকে আনতে বলেছিলি। আমার এমনই ভোলা মন, মুবিন সাহেব কতবার আমাকে দেখতে এলেন, সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম অথচ তোর সঙ্গেই পরিচয় করাইনি। অবশ্য সে সময় তুই ছিলি না। যাকগে, এখন পরিচয় করিয়ে দিই।
নাসিমা বলল, তার আর দরকার নেই। ওঁকে দেখেই আমি চিনেছি। তারপর মুবিনের দিকে চেয়ে বলল, আপনার কথা ভাইয়ার মুখে অনেক শুনেছি। তাই আপনাকে দেখে চিনে ফেলেছি। আমার কথা ভাইয়ার কাছে নিশ্চয় শুনেছেন?
আগে শুনিনি, একটু আগে শুনলাম।
নাসিমা ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, আর কিছু বলবে?
কি আর বলব, যা বলতে চেয়েছিলাম, তার আর দরকার নেই।
তা হলে এবার য়ুই?
হ্যাঁ যা।
নাসিমা মুবিনের দিকে চেয়ে বলল, আবার আসবেন। নাকি বন্ধু সুস্থ হয়ে গেছে। বলে আর আসবেন না?
মুবিন আজ আসার পর ওয়াহাবকে সুস্থ দেখে ভেবেছে, আর আসার দরকার নেই। তার মনের কথা নাসিমা জানতে পারল কেমন করে ভেবে খুব অবাক হল। কয়েক সেকেণ্ড তার চোখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, আল্লাহপাকের ঈশারা থাকলে আসব।
সেদিনের পর থেকে মুবিনের ওয়াহাবদের বাসায় যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও যায়নি। ওয়াহাব তাকে কতবার নিয়ে যেতে চেয়েছে। এমন কি নাসিমা ডেকেছে বলার পরও যায়নি। কারণ প্রথম দিন নাসিমার চোখের দিকে চেয়ে যে অনুভুতি অনুভব করেছিল, শেষ দিন তার সঙ্গে পরিচয় হবার পর সেই অনুভুতি আরো বেড়েছে। অন্য কোন ছেলে হলে হয়তো নাসিমাকে দেখার জন্য নিজের ইচ্ছায় যেত। কিন্তু মুবিন খুব সংযমী ছেলে। ইচ্ছাকে দমন করার ক্ষমতা তার প্রচুর। এর কয়েকদিন পর বাড়িতে গিয়ে যখন শুনল, ভাবির ভাইয়ের শালীর সঙ্গে তার বিয়ের কথাবার্তা হয়েছে তখন থেকে নাসিমার কথা মনে পড়লেও গুরুত্ব দেয়নি।
আজ মুবিন অফিসে শবনমের চিঠি পেল। অবশ্য চিঠিটা যে শবনমের তা জানতে পারল না। কারণ খামের উপর প্রেরকের ঠিকানা নেই। তাই তেমন গুরুত্ব না দিয়ে রেখে দিল।
ছুটির পর বাসায় এসে চা-নাস্তা খেয়ে চিঠিটা পড়ল। পড়ে মুবিন গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। তার কি করা উচিত ভাবতে লাগল। শবনম ছোট বেলায় যখন তার আপার বাড়িতে এসেছে তখন অনেকবার তাকে দেখেছে। সে সময় তার সঙ্গে কথাবার্তা না বললেও গতবছর তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারপর কিছুদিন আগে বাড়িতে গিয়ে যখন শুনল, শবনমকে বড় ভাবীর ও আব্বার খুব পছন্দ এবং তাকে ছোট পুত্রবধূ করার। ব্যবস্থা করেছেন তখন মনে মনে খুশিই হয়েছিল। তাই ওয়াহাব তাকে তাদের বাসায় নিয়ে যেতে চাইলে, নাসিমার সঙ্গে দেখা হতে পারে ভেবে ছয় মাস হতে চলল, যায়নি। আজ শবনমের চিঠি পড়ে কি করবে চিন্তা করতে করতে হঠাৎ নাসিমার কথা মনে পড়ল। ভাবল, তা হলে কি এর মধ্যে আল্লাহপাকের কোনো ঈশারা আছে? কথাটা ভেবে মনে কিছুটা শান্তি অনুভব করল।
মুবিনরা তিন ভাই তিন বোন। মুবিন সবার ছোট। অন্যান্য সব ভাইবোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। মুবিন শবনমের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিল, এই চিঠির কথা সারাজীবন গোপন রাখবে। শুধু শুধু ওদের দুজনের জীবন নষ্ট করা ঠিক হবে না। বড় ভাবীকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিল, কোনো বিশেষ কারণে আমি এখন বিয়ে কবর না। তুমি আব্বাকে কথাটা জানিয়ে দৌলতখানে বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙ্গে দাও।
মুবিনের চিঠি পেয়ে তার বড় ভাবি সুরাইয়া খুব চিন্তায় পড়ে গেল। সে-ই শবনমকে পছন্দ করে স্বামী ও শ্বশুরদের বলে এতোটা এগিয়েছে। এখন শুধু বিয়ের দিন ঠিক করা বাকি। চিন্তা করল, এবার মুবিন বাড়িতে আসার পর যখন শবনমের সঙ্গে বিয়ের কথা বললাম তখন তো তাকে বেশ খুশি খুশি মনে হল। এখন আবার কি এমন হল যে, বিয়ে ভেঙ্গে দিতে বলছে? তা হলে কি এর মধ্যে মুবিন ভোলাতে কোনো মেয়ে পছন্দ করেছে? কি করবে না করবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে ঐ দিন রাতে ঘুমোবার সময় কথাটা স্বামীকে জানাল।
মুবিনের বড় ভাই লতিফ। স্ত্রীর কথা শুনে কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
সুরাইয়া অধৈর্য গলায় বলল, কিছু বলছ না যে?
লতিফ বলল, কি আর বলব, মুবিন যদি এখন বিয়ে করতে না চায়, তা হলে আমরা তো জোর করে বিয়ে দিতে পারি না?
তা না হয় ঠিক, কিন্তু এত কিছুর পর বিয়ে ভেঙ্গে দিলে ভাবি ও তার বাবা-মা কী ভাববেন? তা ছাড়া আব্বাকে কথাটা কে জানাবে?
কেন? তুমি জানাবে। তুমি যখন সবকিছুর উদ্যোক্তা তখন তোমারই জানান উচিত।
আমি পারব না। ছি, ছি, মুবিন ভাইটা যে কী, আমি ভাবতেই পারছি না। তাই যদি মনে ছিল, কথাবার্তা হওয়ার পর-পরই জানাতে পারত।
কেন জানাল না, তা তোমার আদরের দেবর জানে। তুমিই তো তাকে সব থেকে বেশি লাই দাও। এখন তার ঠেলা তোমাকেই সামলাতে হবে।
আমি মরে গেলেও কাউকে কিছু জানাতে পারব না।
একান্ত তুমি না পারলে, আমাকেই জানাতে হবে। হাজার হোক মুবিন আমাদের সবার ছোট। ছোটদের ন্যায় অন্যায় বড়দেরকে সামলাতে হয়। এখন রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়। কাল যা করার আমি করব।
পরের দিন লতিফ মুবিনের অমতের কথা মা-বাবাকে জানিয়ে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে তাদেরকেও জানিয়ে এল।
কথাটা শুনে খালেদার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। স্বামীকে বলল, মুবিনের বিয়েতে অমতের কারণ কিছু বুঝতে পারছ?
মজিদ বলল, না, তবে মনে হয় সে কোনো মেয়েকে ভালবাসে?
খালেদা বলল, তা হলে শবনমের সঙ্গে বিয়ের কথা শোনার পরপর অমত করল না। কেন?
মজিদ বলল, তখন হয়তো সেই মেয়ের সঙ্গে তেমন ভালবাসা জমেনি।
তোমার যেমন কথা। আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না।
না হলে আমি কি আর করবো?
তুমি একবার ভোলায় গিয়ে মুবিন বিয়াইয়ের সঙ্গে দেখা কর।
তা সম্ভভ নয়। এটা কি দাওয়াত খাওয়ার ব্যাপার? রাগ করে না এলে তোষামোদ করে আনব। বিয়ে-শাদীর ব্যাপার জোর করে কিছু করা যায় না। পাত্র রাজি থাকলে তার মা-বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করান যায়। কিন্তু পাত্র যেখানে নিজেই অরাজি সেখানে কিছু করতে যাওয়াটা বোকামী।
কিন্তু আম্মা-আব্বাকে খবরটা তো জানাতে হবে?
তুমিই যখন এটার সবকিছু করেছ তখন তুমিই গিয়ে জানিয়ে এস।
আমি কোন মুখ নিয়ে তাদের কাছে যাব?
যেতে না পারলে চিঠি দিয়ে জানাও।
আচ্ছা তুমি কি বলত? তোমার শালীর বিয়ে ভেঙ্গে গেল, আর তুমি কোনো গুরুত্ব। দিচ্ছ না। শালীর প্রতি তোমার কি কোনো দায়িত্ব নেই?
মজিদ হেসে উঠে বলল, পাত্র-পাত্রীর অমতে জোর করে বিয়ে দিলে বুঝি দায়িত্ব পালন করা হত। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলল, তুমি আমার কাছে সব কিছু গোপন। করলেও আমি জানতে পেরেছি, শবনমের অমতে তুমি তোমার মা-বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে জোর করে বিয়ে দিতে চাচ্ছ। এমন কি আমার কাছেও সব কিছু গোপন করেছ। তুমি শিক্ষিত ও ধার্মিক পরিবারের মেয়ে। তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি। স্বামীর কথা শুনে খালেদা নিজের ভুল বুঝতে পারল। আরো বুঝতে পারল যে, তার উপর স্বামী মনে মনে রাগ করেছে এবং মনেও কষ্ট পেয়েছে। তাড়াতাড়ি স্বামীর পা জড়িয়ে ধরে বলল, তোমাকে না জানিয়ে অন্যায় করেছি। আমাকে মাফ করে দাও।
মজিদ তাকে বুকে জড়িয়ে আদর দিয়ে বলল, যে কোনো বিষয়ে স্ত্রীর উচিত, স্বামীকে জানান। যে সব স্ত্রীরা তা করে না, তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক আর থাকে না, অনেক হালকা হয়ে যায়। তুমি যে নিজের অন্যায় বুঝতে পেরেছ, তাতে আমি খুশি হয়েছি।
খালেদার চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, বল মাফ করে দিয়েছ?
মজিদ তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, স্কুলে দেখার পর থেকে অনেক বছর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে তোমাকে পেয়েছি। তোমার সব অন্যায় আমার কাছে। ক্ষমার যোগ্য। তা ছাড়া যে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সংশোধনের চেষ্টা করে, তাকে আল্লাহ মাফ করে দেন এবং তাকে ভালবাসেন। আর তুমি তো আমার প্রাণাধিকা স্ত্রী। তোমাকে মাফ না করে কি পারি? এবার তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি শবনমের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিও না। আল্লাহপাক যার সঙ্গে যার জোড় রেখেছেন, তার সঙ্গে তার বিয়ে হবেই। ধনী ঘরের শিক্ষিত রোজগারী ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলেই যে, মেয়ে সুখী হবে, এমন কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না। সমাজে কত ধনী লোক গরিব হচ্ছে। আবার কত গরিব লোক ধনী হচ্ছে; এরকম তো কতই দেখা যায়। এই তোমার আব্বার কথাই ধর না; ওঁর আব্বার আগে কত জায়গা-জমি ছিল। নদীতে সব ভেঙ্গে যাওয়ার পর একরকম নিস্ব হয়ে শ্বশুর বাড়ীতে এসে উঠেন। শ্বশুরের সম্পত্তি না পেলে ওঁর অবস্থা কি হত, চিন্তা করে দেখ। আল্লাহপাকের ঈশারায় অবস্থা আজ কত ভালো। শবনম যে ছেলেটাকে ভালবাসে তার বাপেরও ঐ একই অবস্থা। তারপর তার আব্বা মারা যাওয়ার পর তাদের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। আল্লাহপাকের ঈশারা থাকলে ভবিষ্যতে ঐ ছেলের অবস্থা ফিরে যেতে পারে। তবে হ্যাঁ প্রত্যেক মা-বাবা মেয়েকে স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষিত ও রোজগারী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চান। তাই বলে সাবালিকা মেয়ের অমতে জোর করে কিছু করা উচিত নয়।
খালেদা বলল, তোমাকে কিছু বলতে হবে না। শবনমের পরীক্ষার পর বিয়ের দিন ঠিক হওয়ার কথা। তার আগে একদিন গিয়ে মুবিনের অমতের কথা বলে আসব।
.
০৮.
সাখাওয়াত হোসেন চট্টগ্রাম যাওয়ার তিন মাস পর অসুস্থ হয়ে বাড়ি এলেন। শ্বশুরের অসুখের কথা শুনে মজিদ স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখতে এলেন। একদিন। মজিদ শ্বাশুড়ীকে মুবিনের অমতের কথা বলল।
যুবাইদা খানম আতঙ্কিত হয়ে বললেন, তা হলে এখন কি হবে বাবা? তোমার শ্বশুর শুনলে তো হার্টফেল করবে।
মজিদ বলল, ওঁকে এখন একথা জনাবেন না। আর বিয়ে শাদীর ব্যাপার আল্লাহ পাকের হাতে। তিনি শবনমের জোড়া যেখানে রেখেছেন সেখানেই হবে। ওসব নিয়ে আপনি দুঃশ্চিন্তা করবেন না। আব্বা সুস্থ হয়ে উঠলে আপনি তাকে জানাবেন। উনি জ্ঞানী লোক। সামলে নেবেন।
সেখানে খালেদাও ছিল। স্বামী থেমে যেতে বলল, হ্যাঁ আম্মা, তোমার জামাই ঠিক কথা বলেছে। আল্লাহর যা ইচ্ছা তাই হবে। মানুষ জোর করে কিছু করতে পারে না।
যুবাইদা খানম বললেন, তোমরা শবনমের জন্য অন্য ছেলের খোঁজ কর। এদিকে সামসুদ্দিনের জন্য খালেদার আব্বা ফজল ঘটককে মেয়ে দেখতে বলেছিল। সে সময় ফজল ঘটক চৌকিরঘাটের একটা মেয়ের কথা বলেছিল। মেয়েটা নাকি দেখতে শুনতে ভালো। কলেজে পড়ে। অনেক রকম হাতের কাজও জানে। কিন্তু মেয়ের বাপের অবস্থা ভালো নয়। শুনে আমরা না করে দিয়েছিলাম। কিছুদিন আগে ফজল ঘটক এসে বলল, সামসুদ্দিন নাকি তাকে বলেছে, সে ঐ মেয়েকে বিয়ে করবে।
খালেদা বলল, সামসুদ্দিন যখন জেনে শুনে গরীবের মেয়েকে বিয়ে করতে চায় তখন আর অসুবিধা কিসের?
যুবাইদা খানম বললেন, আমি তোর আব্বাকে সে কথা বলেছি। শুনে সেও তাই বলল।
খালেদা বলল, চৌকিরঘাট তো কাছেই। আব্বা একটু সুস্থ হলে তোমাদের জামাইকে নিয়ে একদিন মেয়ে দেখতে যাব।
যুবাইদা খানম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ভেবেছিলাম, শবনম ও সামসুদ্দিনের বিয়ে একসঙ্গে দেব, কিন্তু তা আর হবে কি না আল্লাহ মালুম।
মজিদ এতক্ষন চুপ করে ছিল। শাশুড়ী থেমে যেতেই বলল, সামসুদ্দিন ভাইয়ের এবার বিয়ে দেওয়া উচিত। বয়স অনেক হয়েছে। আল্লাহর যখন মর্জি হবে তখন শবনমের হবে। তা ছাড়া শবনমের বয়সই বা কত? এর মধ্যে যদি সে রকম ভালো ছেলে পাওয়া যায়, তা হলে এক সঙ্গেই হবে। নচেৎ ও পাশ করার পর কলেজে পড়ক। আমরা ছেলের সন্ধান করতে থাকি।
যুবাইদা খানম বললেন, তোমরা যা ভালো বুঝ তাই কর বাবা।
খালেদা প্রায় মাস খানেক হতে চলল বাপের বাড়িতে রয়েছে। মজিদও শ্বশুর বাড়িতে থেকে স্কুল করছে। মাঝে মাঝে অবশ্য বাড়িতে যায়।
সাখাওয়াত হোসেন সুস্থ হওয়ার পর আব্বার অনুমতি নিয়ে খালেদা স্বামী ও মাকে নিয়ে চৌকির ঘাটে মেয়ে দেখতে গেল। মেয়ে পছন্দ হলেও মেয়ের বাপের আর্থিক অবস্থা দেখে খুশি হতে পারল না। ফিরে এসে আব্বাকে সে কথা জানাল।
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, আমি মেয়ের বাপের অবস্থা জানি। তোর আম্মা গরিবের মেয়েকে বৌ করতে চায় না। কিন্তু সামসুদ্দিন যখন ঐ মেয়েকে বিয়ে করবে বলেছে তখন আর আপত্তি করার কি আছে। ভাবছি এবারে দিন করে ফেলব। তিনি স্ত্রীর কাছে শবনমের বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার কথা আগে শুনেছেন। এখন ছেলের বিয়ের কথা বলার পর বললেন, শবনমের বিয়েটাও একই সঙ্গে দেব ভেবেছিলাম। তা আর হল না।
মজিদ বলল, আব্বা, আল্লাহপাকের যা মর্জি তাতে আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। শবনম এখন পড়াশোনা করতে থাকুক। আমরা ওর জন্যে পাত্রের খোঁজ করব। তেমন। ভালো ছেলে পাওয়া গেলে বিয়ের ব্যবস্থা করা যাবে।
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, তাই হবে বাবা, আল্লাহর মর্জি ছাড়া তো মানুষ কিছু করতে পারে না।
শবনমের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সে পড়া নিয়ে ব্যস্ত। আপার উপর অভিমান এখনো যায়নি। ভাগনা-ভাগনিদের আদর করলেও আপা বা দুলাভাইয়ের সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না।
একদিন খালেদা তাকে বলল, তুই যে সেই থেকে আমার উপর রাগ করে আছিস, তা আমি জানি। আমি তোর বড় বোন। একটু শাসন করার অধিকারও কি আমার নেই? আর তোর দুলাভাই দুঃখ করছিল, তুই নাকি তার সঙ্গে ভালো করে কথা বলিস না। তার উপর রাগ করে আছিন কেন? সে কি তোকে কিছু বলেছে?
শবনম কোন কথা না বলে চুপ করে রইল।
কিরে কিছু বলছিস না যে?
শবনম ভিজে গলায় বলল, তোমাদের উপর রাগ করলেই বা কি, আর না করলেই বা কি। তোমরা অভিভাক। ছোটরা অন্যায় করলে শাসন তো করবেই। তারপর কুঁপিয়ে উঠল।
খালেদা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার উপর রাগ করে থাকিস না বোন। সে দিন রাগের মাথায় যা করেছি, তা ভুলে যা। আর শোন, আমার বড় ননদের দেবরের সঙ্গে যে তোর বিয়ের কথা হয়েছিল, তা ভেঙ্গে গেছে। ছেলে এখন বিয়ে করবে না বলে জানিয়েছে। তোর দুলাভাই আম্মা আব্বাকে সে কথা জানিয়ে বলল, শবনম পাশ করার পর কলেজে পড়ক, পরে আমরা ভালো ছেলে দেখে ওর বিয়ে দেব।
কথাটা শুনে শবনমের মন মুবিনের উপর কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। ভাবল, ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো। তারপর মনে মনে আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করল।
এর কয়েক দিন পর মজিদ স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি চলে গেল। সাখাওয়াত হোসেন মেয়ে জামাই থাকতেই চৌকিরঘাটের মেয়ের সাথে সামসুদ্দিনের বিয়ের দিন ঠিক করে চট্টগ্রামে চলে গেছে। শবনম শেষ পরীক্ষা দিয়ে এসে চিন্তা করল, আতাহার ভাই চিঠিতে জানিয়েছিল; পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে এসে যা করার করবে; কিন্তু এল না কেন? এলে তো নিশ্চয় দেখা করত?
আরো কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পরও যখন আতাহার এল না তখন একদিন নাসির উদ্দিনকে সে এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করল।
নাসির উদ্দিন বলল, আতাহার অনেক দিন থেকে কঠিন অসুখে ভুগছে। সে ঢাকায় হাসপাতালে আছে। তার মা কয়েকদিন হল তার কাছে গেছে। এখন কেমন আছে জানি না।
শুনে শবনম চমকে উঠল। তার মন কেঁদে উঠল। চোখে পানি এসে যেতে মেজ ভাই দেখলে কি মনে করবে ভেবে সেখান থেকে নিজের রুমে এসে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করল, আল্লাহ পাক, তুমি ওকে ভালো করে দাও। আমি চার জুম্মা রোযা রাখব, একশো রাকাত নফল নামায পড়ব। তুমি রহমানুর রহিম, তোমার রহমতের কোনো শেষ নেই। ওর উপর রহমত কর। তোমার হাবীবে পাকের উপর শতকোটি দরুদ ও সালাম পেশ করছি। তাঁরই অচিলায় তোমার এই নাদান বান্দীর দোয়া কবুল করো। আমিন। এরপর থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর আতাহারের রোগ মুক্তির জন্য দোয়া করতে লাগল। আর সেই সঙ্গে মানতের রোযা ও নফল নামায আদায় করতে লাগল।
দীর্ঘ দুইমাস অসুখে ভোগার পর সুস্থ হয়ে আতাহার গ্রামের বাড়িতে এল। সে অসুখের কথা শবনমকে জানায়নি। কারণ তার অসুখের কথা শুনে যদি শবনমের পরীক্ষার ক্ষতি হয়। আর পরীক্ষার পর সে স্কুলে যাবে না। চিঠি দিলে কাজ হবে না। ভেবে সুস্থ হওয়ার পরও দেয়নি। অসুখে পড়ে হাসপাতালে দুশ্চিন্তায় দিন কাটিয়েছে। আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে শবনমকে হেফাজতে রাখার দোয়া করেছে। তারপর আম্মার কাছে যখন শুনল, তার বিয়ে এখনো হয়নি তখন কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে। বাড়িতে এসে কুলসুমের কাছে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে শুনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে গিয়ে চোখে পানি ধরে রাখতে পারল না। সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই কার কাছে শুনেছিস?
কুলসুম বলল, নাসির উদ্দিন ভাইয়ের কাছে।
আতাহার দুরাকাত শোকরানার নামায পড়ে আল্লাহপাকের কাছে মনের বাসনা জানাল। তারপর শবনমের সঙ্গে কি করে দেখা করবে সেই চিন্তা করতে লাগল।
বিকেলে নাসির উদ্দিন কুলসুমকে পড়াতে এসে আতাহারকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, আল্লাহপাকের কাছে শুকরিয়া জানাই, তিনি তোকে সুস্থ করে দেশে আনলেন।
আতাহার সালামের উত্তর দিয়ে বলল, হ্যাঁ আল্লাহপাকের দয়ায় এ যাত্রা বেঁচে গেলাম, নচেৎ যে অসুখ হয়েছিল কবেই মরে যেতাম। তুই ভালো আছিস? তোদের বাড়ির সবাই ভালো?
আল্লাহর রহমতে আমরা সবাই ভালো আছি।
আতাহার বলল, আজ আর পড়িয়ে কাজ নেই, চল তোদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।
নাসির উদ্দিন অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোকে একটা কথা বলব, আমার উপর রাগ করবি না বল?
রাগ করব কেন? বল কি বলবি।
তোকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে আম্মা নিষেধ করেছে। কারণটা বলছি শোন, আমি তোর আর শবনমের ব্যাপারটা অনেক আগে থেকে জানি। এটাকে আমি খারাপ কিছু ভাবতাম না। কিন্তু তোর আব্বা মারা যাওয়ার পর তুই যখন লেখাপড়া বন্ধ করে দিলি তখন থেকে তাদের পরিণতির কথা ভেবে খারাপ লাগত। গতবারে এসে তুই চলে যাবার পর আপা তার বড় ননদের দেবরের সঙ্গে শবনমের বিয়ে দেবার কথা বলতে শবনম প্রতিবাদ করে বলেছিল, সে তোকে ভালবাসে এবং তোকে ছাড়া অন্য কোথাও বিয়ে বসবে না। শুনে আপা ও আম্মা শবনমকে মেরেছিল। তারপর আব্বা চরখলিফায় গিয়ে আপার ননদের দেবরের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা পাকা করে আসে। ঠিক হয়েছিল, শবনমের পরীক্ষার পর বিয়ে হবে। কিন্তু কেন কি জানি কিছুদিন আগে আপা আর দুলাভাই এসে জানাল, সেই ছেলে এখন বিয়ে করবে না বলে জানিয়েছে। সে সময় আব্বা অসুখে বাড়িতে ছিল। তাকে আপা ও দুলাভাই সেই কথা জানিয়ে বলল, শবনম পাশ করলে কলেজে পড়বে। সামসুদ্দিনের বিয়ের ব্যবস্থা করুন। এর মধ্যে তারা অন্য পাত্রের সন্ধান করবে। আব্বা শুনে বলল, আমার ইচ্ছা ছিল, শবনম আর সামসুদ্দিনের বিয়ে একসঙ্গে দেব। আল্লাহ যখন তাতে রাজি নয় তখন তোমরা যা বলছ তাই হবে। এবার তুই-ই বল, তোকে কি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে?
আতাহার বলল, না উচিত হবে না। তারপর বলল, শবনম আমাকে বিয়ের কথা চিঠিতে লিখে জানিয়েছিল, তবে মারধর করার কথা বা এত কিছু ডিটেলস্ জানায়নি। সবকিছু জানিয়ে ভালই করলি। তুই শবনমের সঙ্গে অন্ততঃ একবার দেখা করার ব্যবস্থা করতে পারবি না?
নাসির উদ্দিন বলল, দেখ শবনম আমার বোন, আর তুই আমার বন্ধু। তোদের কারো মনে ব্যথা দেওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু আমি তোদেরকে কোনো রকম সাহায্য করতে অক্ষম। তবে আজ হয়তো দেখা করার ব্যবস্থা করতে পারব। ভবিষ্যতের কথা আল্লাহ জানে। বলছি শোন, বড় খালা বেশ কিছু দিন থেকে অসুখে ভুগছে। আজ সকালে শবনম তাকে দেখতে গেছে। আমিও তার সঙ্গে গিয়েছিলাম। এখন আম্মা তাকে নিয়ে আসতে বলেছে। আমি বলেছি মাগরিবের নামাযের পর আনতে যাব। মাগরিবের নামায পড়ে তুই আমার সঙ্গে গিয়ে পথে অপেক্ষা করবি। আমি শবনমকে নিয়ে ফেরার সময় তোর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দিতে পারি।
আতাহার উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, তাই করিস, তোকে যে কি বলে কৃতজ্ঞতা জানাব, ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
নাসির উদ্দিনের ঐ খালার বাড়ি গুপ্তগঞ্জে। সেদিন আর পড়ান হল না। দুবন্ধুতে গল্প করে, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে গুপ্তগঞ্জ বাজারের মসজিদে মাগরিবের নামায পড়ল। তারপর নাসির উদ্দিন তাকে সঙ্গে করে কিছুদূর এসে বলল, তুই এখানে অপেক্ষা কর, আমি শবনমকে নিয়ে আসি।
আতাহার বলল, ঠিক আছে যা।
প্রায় আধা ঘন্টা পর নাসির উদ্দিন শবনমকে নিয়ে আসার সময় তাকে বলল, আতাহার তোর জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করছে। আমি তার কাছে তোকে রেখে কাছাকাছি। থাকব।
শবনম অবিশ্বাস্য সুরে বলল, সত্যি বলছিস মেজভাই? দুষ্টুমী করছিস না তো?
হারে সত্যি। অন্য সময় তোর সঙ্গে দুষ্টুমী করলেও এখন করছি না।
গুপ্তগঞ্জে এখনও বিদ্যুৎ যায়নি। কিন্তু সেদিন ছিল চতুর্দশী। চাঁদের আলোয় চারদিক উজালা। কিছুদূর আসার পর নাসির উদ্দিন বলল, ঐ যে সামনে আতাহার দাঁড়িয়ে আছে। তুই যা আমি এখানে আছি।
শবনম একবার আতাহারের দিকে চেয়ে নিয়ে ভয়ে ভয়ে মেজভাইয়ের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
নাসির উদ্দিন বলল, কিরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? যা দেরি করিস না।
আতাহার তাদেরকে দেখতে পেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল।
তাই দেখে নাসির উদ্দিন বলল, আতাহার এদিকে আসছে, আমি অল্প দূরে আছি বলে কিছুটা পিছিয়ে এসে রাস্তার ধারে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল।
আতাহার শবনমের কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ?
প্রায় আট দশ মাস পর আতাহারের ভাঙ্গা শরীর দেখে শবনম নিজেকে সামলাতে পারল না। কোনো রকমে সালামের উত্তর দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, আল্লাহপাক আমার মনের আশা পূরণ করেছেন, সেজন্য তাঁর পাক দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া জানাচ্ছি।
তার কান্না দেখে আতাহারের চোখেও পানি এসে গেল। চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, অসুখে পড়ে কথামত আসতে না পেরে যা দুশ্চিন্তায় দিন কাটিয়েছি তা আল্লাহ মালুম। হাসপাতালে আম্মার মুখে তোমার বিয়ে হয়নি শুনে আল্লাহপাকের দরবারে লাখোকোটি শুকরিয়া জানিয়ে তোমাকে হেফাজতে রাখার জন্য ফরিয়াদ করেছি। তারপর বাড়িতে এসে কুলসুমের কাছে ও তোমার মেজ ভাইয়ের কাছে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে শুনে শোকরানার নামায পড়েছি।
শবনম সামলে নিয়ে বিয়ে ভেঙ্গে যাবার নেপথ্যের কাহিনী না বলে বলল, কি করবে না করবে কিছু ভেবেছ? আবার যদি অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করে?
আতাহার বলল, ভেবে কিছু করার মতো এখন আমার শারিরীক ও মানসিক অবস্থা। নেই। আর আমার আর্থিক অবস্থার কথাও তুমি জান। তকদিরের উপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আল্লাহপাক যখন একটা ফাড়া কাটিয়েছেন তখন পরেরগুলোও কাটাবেন। তার উপর আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা রাখা ছাড়া অন্য কোনো পথ মাথায় আসছে না।
শবনম বলল, আমি একটা কথা বলব শুনবে?
বল।
এবারে ঢাকা যাবার সময় আমাকেও নিয়ে চল। সেখানে তো তোমার মামা-খালা আছেন। তারা সবকিছু জানার পর নিশ্চয়ই আমাদের বিয়ে দিয়ে দেবেন।
না শবনম তা হয় না। তুমি যা বললে তা হয়তো তারা করবেন। তবু এটা আমি পারব না। তোমাকে ভালবেসেছি বললে ভুল হবে, এক কথায় তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না, কিন্তু তাই বলে তোমার আম্মা-আব্বার ও তোমাদের বংশের মুখে চুন কালি লেপন করতে পারব না। তবে একথা বিশ্বাস রেখ, অন্য কোথাও বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই ইনশাআল্লাহ আমি কিছু একটা করবই।
সে বিশ্বাস আমার আছে আতাহার ভাই। তবু মাঝে মাঝে খুব ভয় হয়।
ভয়ের কি আছে? প্রত্যেক নামাযের পর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে। নাসির উদ্দিন বলছিল, রেজাল্ট বেরোবার পর তুমি কলেজে ভর্তি হবে। তখন তোমাকে কলেজের ঠিকানায় চিঠি দেব। বাড়িতে এলে যাতায়াতের পথে দেখা করব।
এমন সময় নাসির উদ্দিন তাদের কাছে এসে বলল, তোদের কথা শেষ হয়েছে? এবার চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আতাহার শবনমকে বলল, এবার যাও।
তারপর নাসির উদ্দিনকে বলল, তোর এই উপকারের কথা সারাজীবন মনে থাকবে।
নাসির উদ্দিন শবনমকে নিয়ে চলে গেল।
আতাহার কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে থেকে বাড়ির পথ ধরল।
আতাহারের ফুফাতো বোন রমিসা ও তার স্বামী মুনসুর শবনমদের সবাইকে চেনে। আতাহারের সঙ্গে শবনমের সম্পর্কের কথা মুনসুর একটু আধটু স্ত্রীর মুখে শুনেছে। কিন্তু প্রমাণ না পেয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। আজ সে সন্ধ্যের পর গুপ্তগঞ্জ বাজারে কিছু সদাইপাতি করতে গিয়েছিল। ফেরার পথে নাসির উদ্দিনকে রাস্তার ধারে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিনতে পেরে জিজ্ঞেস করল, তুমি সাখাওয়াত হোসেন চাচার ছেলে নাসির উদ্দিন না? এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
নাসির উদ্দিন বলল, একটা লোকের জন্য অপেক্ষা করছি।
মুনসুর আর কিছু না বলে চলে গেল।
নাসির উদ্দিন জানে মুনসুর কি ধরনের লোক। ভাবল, যেতে যেতে ওদেরকে দেখলে আম্মাকে বলে দিতে পারে। এই কথা ভেবে বেশ আতঙ্কিত হয়ে একটু এগিয়ে এসে তার দিকে লক্ষ্য রাখল, ওদের দেখে কিছু জিজ্ঞেস করে কিনা। তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল। ভাবল, ওদেরকে হয়তো দেখেনি। শবনমকে নিয়ে ঘরে ফেরার সময় জিজ্ঞেস করল, আতাহারের ফুফাতো দুলাভাই মুনসুর আমাকে দেখেছে। মনে হয় তোদেরকেও দেখেছে। আম্মাকে বলে একটা গোলমাল বাধাতে পারে।
শবনম বলল, লোকটা যা পাজী, বাধালেও বাধাতে পারে।
মুনসুর, আতাহার ও শবনমকে কথা বলতে দেখেছে ঠিক; কিন্তু তাদেরকে কিছু জিজ্ঞেস না করে চলে আসে। কারণ তখন তার মাথায় একটু কূটবুদ্ধি এসেছে। ভাবল, এতদিন ওদের ভালবাসার কথা শুনলেও প্রমাণ পাইনি। আজ যখন পেলাম তখন আতাহারকে জব্দ করে ছাড়বে।
পরের দিন এক সময় শবনমদের বাড়িতে গিয়ে তার মাকে বলল, চাচি একটা কথা বলতে এলাম। গতকাল রাত আটটার সময় শবনম ও আতাহারকে গুপ্তগঞ্জ বাজারের কাছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখলাম। শবনম সেয়ানা হয়েছে, তার কি এটা করা উচিত হয়েছে? আপনি ওর দিকে খুব লক্ষ্য রাখবেন। আপনাদের বংশের কত সুনাম। লোক জানাজানি হয়ে গেলে সমাজে মুখ দেখাবেন কি করে? তা ছাড়া ওর বিয়ে দিতে পারবেন? আতাহারের বাপ মারা যাওয়ার পর লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চোরা কারবার করে। আর বলে কিনা চাকরি করে। সব মিথ্যে কথা। আমার বড় শালী ঢাকায় থাকে। কিছুদিন আগে তাদের ওখানে গিয়েছিলাম। আতাহার কি করে না করে তারা সব জানে। তাদের কাছেই আমি আতাহারের কীর্তিকলাপ শুনেছি।
যুবাইদা খানম অবাক হলেন। বললেন, আতাহার কেমন ছেলে তা আমার জানার দরকার নেই; কিন্তু শবনমের সঙ্গে তার দেখা হবে কি করে? গতকাল সকালে সে গুপ্তগঞ্জে তার খালার বাড়ি গিয়েছিল। সন্ধ্যের পর নাসির উদ্দিন তাকে নিয়ে এসেছে।
মুনসুর বলল, নাসির উদ্দিন তখন ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। তার সঙ্গে আমি কথাও বলেছি, তারপর বলল, আচ্ছা চাচি নাসির উদ্দিন কি আতাহারের বোন কুলসুম ও খাদিজাকে প্রাইভেট পড়ায়?
কই না তো? সে ওদেরকে প্রাইভেট পড়াতে যাবে কেন? কে তোমাকে বলেছে?
কেউ বলেনি, পাশা-পাশি ঘর এমনিই জানা যায়। ওদেরকে পড়ায় জানতে পেরে আমি একদিন নাসির উদ্দিনকে বললাম, আমার দুটো ছেলেমেয়েকে পড়াবে? একশো টাকা বেতন দেব। নাসির উদ্দিন বলল, আমি কাউকে প্রাইভেট পড়াই না। আমি তখন ওদেরকে পড়াবার কথা জিজ্ঞেস করলাম। বলল, ওদেরকে তো বেতন নিয়ে পড়াইনি। বন্ধুর বোন হিসাবে পড়াগুলো একটু দেখিয়ে দিই। আপনি জানেন কিনা জানি না। আতাহারের একটা বোন বিয়ের লায়েক হয়ে উঠেছে। ওর মায়ের যা স্বভাব, আমার মনে হয়, নাসির উদ্দিনকে মেয়ে গচাবার তালে আছে।
যুবাইদা খানম বুঝতে পারলেন, নাসির উদ্দিনের সাহায্যেই গতরাতে ওদের সাক্ষাৎ হয়েছে। কথাটা বুঝতে পেরে শবনম ও নাসির উদ্দিনের উপর খুব রেগে গেলেন। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করলেন না। গম্ভীর স্বরে বললেন, কথাটা বলে তুমি ভালো করেছ। ঠিক আছে তুমি এখন যাও, যা করার আমি করব।
যুবাইদা খানম যে খুব রেগে গেছেন, তা বুঝতে পেরে মুনসুরের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, যাই চাচি, আমাকে আবার বাজারে যেতে হবে। ফিরে আসার সময় চিন্তা করল, এবার খেলাটা ভালভাবেই লাগবে।
মুনসুর যখন ঐসব কথা বলছিল, তখন শবনম ঘরে ছিল এবং সব কিছু শুনেছে; কিন্তু নাসির উদ্দিন ছিল না। সে আসার পর শবনম তাকে মুনসুর মাকে যা যা বলেছে। সব বলল।
নাসির উদ্দিন বলল, কালকেই তোকে বললাম না, লোকটা ভীষণ খারাপ।
শবনম বলল, আম্মা সেই থেকে খুব রেগে আছে। মনে হয় আমাদেরকে খুব বকাবকি করবে।
নাসির উদ্দিন বলল, কি আর করা যাবে। দোষ যখন করেছি তখন বকাবকি হজম করতে হবে।
রাতের খাওয়া দাওয়ার পর শবনম ও নাসির উদ্দিনকে ডেকে বললেন, তোরা দুভাই বোন কি বংশের মুখে চুন কালি দিবি? তারপর শবনমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোর লজ্জা শরম বলতে কি কিছু নেই? এখনো তুই আতাহারের সঙ্গে দেখা করিস? আজ মুনসুর এসে যে কথা বলে গেল, সে কথা পাঁচজন শুনলে কি হবে ভেবে দেখেছিস? আতাহার কি তোর উপযুক্ত? জামাই বলে গেল, সে বড় ঘরের শিক্ষিত ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে দেবার জন্য চেষ্টা করছে। তাই তোকে কলেজে পড়াবার কথা বলল। আর তুই কিনা আতাহারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিস? আতাহারের বাপের কি আছে? তোকে খাওয়াবে কি? তা ছাড়া মুনসুর ঢাকায় গিয়ে শুনে এসেছে, সে চোরা কারবার করে। ছিঃ ছিঃ এমন জঘন্য ছেলের সাথে তুই সম্পর্ক রেখেছিস। তারপর নাসির উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন তোর কি জ্ঞান-গম্য বলতে কিছু নেই। বড় ভাই হয়ে ছোট বোনের অন্যায় কাজকে প্রশ্রয় দিস? তোকে তো কতবার বলেছি, আতাহারের সঙ্গে মিশবি না। তবু তার সঙ্গে মিশিস কেন? আর তুই নাকি আতাহারের দুই বোনকে রোজ পড়াতে যাস। আতাহারের এক বোন বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। সেই জন্যে যাস বুঝি? দাঁড়া তোর আব্বা আসুক, তারপর তোদের দুজনের কি করি দেখবি।
নাসির উদ্দিন সাহস করে বলল, আম্মা মুনসুর কি জঘন্য ধরনের লোক তা জেনেও তার কথা বিশ্বাস করলে? তার কাজই হলো মানুষের দোষ খোঁজে বেড়ান। আর একটা দোষ পেলে তার সঙ্গে হাজারটা মিথ্যে মিশিয়ে প্রচার করা।
যুবাইদা খানম বললেন, তা আমি জানি। তোকে আর ফুট কাটতে হবে না। একটা দোষই বা তোরা করবি কেন? সত্য হোক, আর মিথ্যে হোক পাঁচকান হলে তোদের। আব্বার মান-সম্মান বাড়বে না কমবে? আজ বাদে কাল তোদের বড় ভাইয়ের বিয়ে। এখন যদি মুনসুর তোদের নামে এসব কথা পাঁচজনের কাছে বলে বেড়ায়, তা হলে কি হবে ভেবেছিস? এবার তোরা যা আমার সামনে থেকে। তারপর ভেবে রাখলেন, কাল আতাহারের মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন।
পরের দিন যুবাইদা খানম ছোট ছেলে কলিম উদ্দিনকে সাথে নিয়ে যখন আতাহারদের ঘরে গেলেন, তখন আতাহার বাইরে ছিল।
রফিকা বেগম শবনম ও আতাহারকে নিয়ে এতকিছু ঘটনা ঘটেছে তা জানতে না। তাই যুবাইদা খানমকে দেখে খুশি হয়ে বসতে বলে বললেন, আমার কি সৌভাগ্য। আজ হঠাৎ কি মনে করে এলেন আপা?
যুবাইদা খানম রাগের সঙ্গে বললেন, আমি বসতে আসিনি, একটা কথা বলতে এলাম। শুনুন আতাহারকে সাবধান করে দেবেন, সে যেন শবনমের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখে। আমার মেয়ের দুর্নাম রটলে কি হবে ভেবে দেখেছেন? আপনি জানেন কি না। জানি না, সে শবনমকে বিয়ে করতে চায়। আপনিই বলুন, এটা কি সম্ভব?
রফিকা বেগম ছোটবেলায় তাদের দুজনের মিল দেখে ভাবতেন, আল্লাহ যদি রাজি থাকে, তা হলে শবনমকে বৌ করবেন। স্বামী মারা যাবার পর সে কথা ভুলে গেছেন। তারপর আতাহার যে এখনো তার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে, তা জানতেন না। বললেন, আপা আপনি আমার উপর রাগ করবেন না। আমি এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না। ঠিক আছে আতাহারকে আমি শাসন করে শবনমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করে দেব। আপনি বসুন আপা, একটু কিছু মুখে দিয়ে যান।
যুবাইদা খানম বললেন, বসতে পারব না। হাতের কাজ ফেলে এসেছি। আর একটা কথা বলে যাই, ঘরে সেয়ানা মেয়েকে সেয়ানা ছেলের কাছে পড়াতে নেই। আশা করি আমার কথাগুলো মনে রাখবেন, নচেৎ এর পরিণাম ভালো হবে না। তারপর কলিম উদ্দিনকে নিয়ে ফিরে এলেন।
রফিকা বেগম ছেলের উপর রেগে রইলেন। একটু পরে আতাহর ঘরে এলে রাগের সঙ্গে বললেন, কিছুক্ষণ আগে শবনমের মা এসে বলে গেলেন, তুই নাকি শবনমের সঙ্গে এখনো মেলামেশা করিস? তাকে বিয়েও করতে চাস?
আতাহার কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বলল, উনি সত্যি কথাই বলেছেন।
রফিকা বেগম রাগতে গিয়েও পারলেন না। চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বললেন, না বাবা না, এটা কখনো সম্ভব নয়। শবনমের বাবার অবস্থা ভালো। তা ছাড়া সে তোর চেয়ে বেশি শিক্ষিত। শবনম চাইলেও তার মা-বাবা কিছুতেই তোর সঙ্গে বিয়ে দেবেন না। তুই গরিবের ছেলে। এই অভাবের সংসারে এসে সে খুব অশান্তি ভোগ করবে। তোর এখন বিয়ের বয়সও হয়নি। আমাকে যদি আম্মা বলে ডেকে থাকিস, তা হলে শবনমের কথা ভুলে যা। তার সাথে আর কখনো যোগাযোগ করবি না। আর শবনমের ভাই নাসির উদ্দিনকে কুলসুমদের পড়াতে আসতে নিষেধ করে দিস।
আতাহার কোনোদিন মায়ের কোনো কথার প্রতিবাদ করেনি। আজও করল না। মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।
রফিকা বেগমও জানেন, আতাহার কখনো তার কথার অবাধ্য হয়নি। তাই আর কিছু না বলে বললেন, আয় নাস্তা খাবি আয়।
পরের দিন মসজিদে মাগরিবের নামায পড়তে গিয়ে নাসির উদ্দিনের সঙ্গে আতাহারের দেখা হতে চিন্তা করল, ব্যাপারটা কতটা গড়িয়েছে জানা দরকার। সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, আজ পড়াতে এলি না যে?
নাসির উদ্দিন বলল, আমি যে কুলসুম ও খাদিজাকে পড়াতে যাই তা আম্মা জানত না। পরশুদিন রাতে তুই আর শবনম যখন গুপ্তগঞ্জ বাজারের কাছে কথা বলছিলি, তখন মুনসুর দেখেছিল। কাল আমাদের বাড়িতে এসে সে কথা ও পড়াবার কথা আম্মাকে বলে গেছে। আর তোর সম্বন্ধে অনেক বদনামও করেছে। তারপর তার আম্মার বকাবকির কথা বলে বলল, আমি আর পড়াতে যাব না। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। যত গণ্ডগোলের মূলে ঐ মুনসুর।
আতাহার বলল, খুন করতে যদি আল্লাহ নিষেধ না করতেন, তাহলে কবেই ওকে খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দিতাম। আত্মীয় হয়ে যে আত্মীয়ের এত বড় দুশমন হয়, তা এই নরপিশাচকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
.
আজ পনের দিন হয়ে গেল আতাহার ঢাকা থেকে এসেছে। কাল চলে যাবে। যাওয়ার আগে শবনমের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার মন খুব ছটফট করছে; কিন্তু মায়ের নিষেধের কথা মনে করে তা পারছে না। মসজিদে নাসির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়, কিন্তু তাকেও কিছু বলতে পারছে না। আজ আসরের নামায পড়ে অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটতে হাঁটতে চৌধুরীদের বাগানে গেল। আলমাসকে কাজ করতে দেখে সালাম দিয়ে বলল, চাচা কেমন আছেন?
আলমাস সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি বাবা, তুমি কেমন আছ? অনেক দিন আসনি কেন?
আতাহার বলল, ঢাকায় ছিলাম। সেখানে অসুখ করেছিল। কয়েকদিন হল এসেছি।
আলমাস বলল, চৌধুরী হুজুর এসেছেন, তিনি তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।
আতাহার বলল, তাই নাকি? চলুন তা হলে ওঁর সঙ্গে দেখা করি।
আলমাস বলল, আমি এখন কাজ করছি যেতে পারব না। তুমি যাও। আমাদের ঘরের পিছনের ঘরটায় চৌধুরী হুজুর থাকেন। উনি বারান্দায় বসে কেতাব পড়ছেন।
আতাহার সেখানে গিয়ে সালাম দিল।
চৌধুরী হুজুর কেতাব বন্ধ করে সালামের উত্তর দিয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি আতাহার না?
আতাহার বলল, জ্বি।
চৌধুরী হুজুর পাটির উপরে বসে ছিলেন। বললেন, আমার কাছে এসে বস।
আতাহার বসে বলল, কেমন আছেন হুজুর?
আল্লাহপাক ভালই রেখেছেন। তা তোমার মন খারাপ কেন? শরীরও খুব ভেঙ্গে গেছে দেখছি।
জ্বি, অনেক দিন অসুখে ভুগেছি।
অসুখ বিসুখ সবারই হয়, তাতে মন খারাপ করার কি আছে?
আতাহার চিন্তা করতে লাগল, হুজুরকে শবনমের ব্যাপারটা বলবে কিনা?
চৌধুরী হুজুর তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বললেন, মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছ। লজ্জায় বলতে পারছ না? লজ্জার কি আছে? কোনো বিপদে পড়লে বল, ইনশাআল্লাহ। তা দূর করার চেষ্টা করব।
আতাহার ওঁর দুপা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
চৌধুরী হুজুর পা থেকে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত রেখে বললেন, আহা কি হয়েছে বলবে তো।
আতাহার নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমার আব্বা মারা গেছেন, আপনি জানেন?
হ্যাঁ জানি।
আব্বা মারা যাওয়ার পর আর্থিক দূরবস্থার কারণে আমি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চাকরি করছি।
তা তো ভালই করেছ, এখন কি বিপদ তাই বল।
আতাহার ছোটবেলা থেকে শবনমের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা এবং আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সবই বলল। তারপর আবার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আপনি এর একটা সুরাহা করে দিন।
চৌধুরী হুজুর আবার পা থেকে তার হাত সরিয়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি সুরাহা করবার কে? তুমি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। আর আমি যা বলব, তা যদি মেনে নাও, তা হলে ইনশাআল্লাহ এটার একটা সুরাহা হতে পারে।
আতাহার বলল, আপনি যা বলবেন, ইনশাআল্লাহ আমি মেনে নেব।
তা হলে শোন, শবনম ও তুমি এখন সাবালক হয়েছ। সাবালক ছেলেমেয়েদের এক সঙ্গে মেলামেশা করা হারাম। তুমি আর শবনমের সঙ্গে মেলামেশা করবে না এবং গোপনে বা প্রকাশ্যে দেখাও করবে না। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কত বেতন পাও।
এক হাজার।
ঠিক আছে। আমি তোমাকে প্রতিমাসে দুহাজার টাকা দেব। তুমি ঢাকায় থেকে আবার পড়াশোনা শুরু কর। ঐ টাকা থেকে প্রতিমাসে তোমার আম্মাকে এক হাজার করে পাঠাবে, বাকী টাকায় তুমি পড়াশোনা করবে। আর শবনমের ভার আমি নিলাম। যখন আল্লাহপাকের মর্জি হবে তখন আমিই তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করব। আর একটা কথা, এই সমস্ত কথা তুমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাউকে বলবে না। এমন কি শবনমকেও চিঠিপত্র দিয়ে জানাবে না। কি করবে না করবে এখনই বলতে হবে না। দুএকদিন চিন্তা করে আমাকে জানাবে। কিন্তু খবরদার, আবার বলছি, এসব কথা কাউকে বলবে না।
এমন সময় আলমাস সেখানে এলে তাকে বললেন, আতাহারকে কিছু নাস্তা খেতে দাও। তারপর আতাহারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওর সঙ্গে যাও।
আতাহার চৌধুরী হুজুরের কথা শুনতে শুনতে এতক্ষণ ভাবছিল, সে কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে? এরকম মানুষও তা হলে দুনিয়াতে আছে? ওঁর শেষ কথা শুনে ওঠে সালাম জানিয়ে আলমাসের সঙ্গে চলে এল।
আলমাস তাকে নিজের ঘরের দাওয়ায় বসিয়ে নাস্তা খেতে দিয়ে বলল, চৌধুরী হুজুর কি বললেন?
আতাহার বলল, সে কথা বলতে পারব না। তারপর নাস্তা খেয়ে চলে এল।
সে রাতে আতাহার ঘুমাল না। চৌধুরী হুজুরের কথা মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সারারাত কোরআন তেলাওয়াত ও নফল নামায পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইল, সে যেন চৌধুরী হুজুরের কথা পালন করতে পারে।
সারারাত জাগার ফলে আতাহার সকালে খুব ক্লান্ত বোধ করল। গোসল করে নাস্তা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
সেদিনের পর থেকে ছেলের মন খুব খারাপ দেখে রফিকা বেগমেরও মন খারাপ। তাকে আশ্বাস দেবার কোন উপায় না দেখে নিজেকে শক্ত করে রেখেছেন। কাল আতাহার ঢাকা চলে যাবে তা জানেন। তাই রাত্রে এক ঘুমের পর তাকে এবাদৎ বন্দেগী করতে দেখে বললেন, কাল তুই ঢাকা যাবি, লঞ্চে ঘুমাতে পারবি না। এবার ঘুমিয়ে পড় বাবা।
আতাহার বলল, তুমি ঘুমাও আম্মা, আজ আমার ঘুম হবে না।
রফিকা বেগম মনে করলেন, মানসিক উত্তেজনায় তার ঘুম আসছে না। তাই এবাদৎ করে সময় কাটাচ্ছে। আর কিছু না বলে ছেলের কোরআন পড়া শুনতে শুনতে এক সময় আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে তাকে নাস্তা খেয়ে ঘুমাতে যেতে দেখে বললেন, সারারাত ঘুমাসনি। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নে; আমি সময় মতো জাগাবো। খেয়ে দেয়ে তারপর রওয়ানা দিবি।
আতাহার বলল, আমাকে জাগিও না। ভাবছি দুএকদিন পর ঢাকা যাব।
রফিকা বেগম আতঙ্কিত হয়ে এগিয়ে এসে কপালে হাত রাখলেন, কেন রে শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
না আম্মা, তা নয়। দুদিন পরে গেলেও কোনো অসুবিধা হবে না। তাই আজ যাব না।
রফিকা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তা হলে দুদিন পরেই যাস।
সেদিন আতাহার বাইরে কোথাও গেল না। সন্ধ্যের পর কুলসুম ও খাদিজাকে পড়াতে বসল। এক সময় কুলসুমকে বলল, নাসির উদ্দিন আর তোদেরকে পড়াবে না। আমি তোদের স্কুলের একজন ম্যাডামের কাছে ছুটির পর পড়ার ব্যবস্থা করে দেব।
কুলসুমের এখন সবকিছু বোঝার বয়স হয়েছে। শবনমের সঙ্গে ভাইয়ার সম্পর্কের কথা জানত না। যেদিন যুবাইদা খানম এসে রফিকা বেগমকে ঐসব কথা বললেন, সেদিন, জেনেছে। আর সেই জন্যে নাসির উদ্দিন যে পড়াতে আসেনি, তাও বুঝেছে। এখন ভাইয়ার কথা শুনে বলল, আমাদের ইংলিশের ম্যাডাম খুব ভালো। তুমি তার কাছে পড়বার ব্যবস্থা করো।
আতাহার বলল, ঠিক আছে, তাকেই আগে বলব, রাজি না হলে অন্য ম্যাডাম ঠিক করব।
পরের দিন আতাহার বোনদের সঙ্গে স্কুলে গিয়ে ইংলিশ ম্যাডামের কাছেই পড়াবার ব্যবস্থা করে এসে মাকে সে কথা জানাল।
রফিকা বেগম বললেন, তোর বেতনের টাকায় এমনিতেই কত কষ্টের সঙ্গে সংসার চালাচ্ছি। ওদের প্রাইভেট মাস্টারের বেতন দেব কি করে?
আতাহার বলল, সামনের মাস থেকে ওদের প্রাইভেট মাস্টারের টাকাও পাঠাব।
রফিকা বেগম বললেন, তা হলে ভালই করেছিস।
বিকেলে আসরের নামায পড়ে আতাহার চৌধুরী হুজুরের কাছে গেল।
চৌধুরী হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, কি সিদ্ধান্ত নিলে?
আতাহার বলল, বেয়াদবি মাফ করবেন। সে কথা বলার আগে দু একটা কথা জানতে চাই।
বেশ তো বল।
আপনি আমার জন্য এতকিছু করবেন কেন? আমি শুধু শবনমের ব্যাপারে সাহায্য চেয়েছি। আমাদের অভাব অনটন থাকলেও আল্লাহ তো না খাইয়ে রাখেন না। বরং অনেকের চেয়ে আল্লাহ আমাদেরকে অনেক সুখে রেখেছেন। আপনার এই অযাচিত দান নেওয়া কি আমাদের জায়েজ হবে?
সুবহানাল্লাহে ওয়া বেহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম বলে চৌধুরী হুজুর বললেন, তুমি খুব মূল্যবান কথা জানতে চেয়েছ। বলছি শোন, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত বিপদগ্রস্থকে সাহায্য করা। কেউ যদি তা করে, তার প্রতি আল্লাহ ও তাঁর রসূল (দঃ) খুশী হন। আর তাঁদেরকে খুশী করাও প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। শবনমকে নিয়ে তুমি যে বিপদে পড়েছ, সেই বিপদে সাহায্য করতে হলে এই পথে করতে হবে। আর অযাচিত দানের কথা যে বললে, তা তোমার জন্য জায়েজ। তবে তুমি যদি পার, তা হলে পরিশোধ করে দিও। তবে তা নগদ টাকায় নয়। আমি যা বলব তাই করতে হবে।
বলুন কি করতে হবে।
আমি কিন্তু কোনো প্রতিদান পাওয়ার আশায় তোমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছি না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) কে খুশী করার জন্য চাচ্ছি। তবু তুমি যখন দ্বিধা করছ তখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর আমার জন্য সব সময় দোয়া করবে। আল্লাহপাক যেন আমাকে ঈমানের সঙ্গে মউত দেন, কবরের আজাব থেকে রেহাই দেন, আর হাশরের মাঠে রাসূল (দঃ) এর শাফায়াত নসীব করেন। আর কেউ যদি বিপদে পড়ে তোমার কাছে সাহায্য চায় অথবা কেউ বিপদে পড়েছে জানতে পার, তা হলে তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করবে।
চৌধুরী হুজুরের কথা শুনে আতাহারের আব্বার কথা মনে পড়ল, খবরদার ওঁর সঙ্গে বেয়াদবি করবি না। উনি যা বলেন শুনবি। উনি খুব বুজুর্গ লোক। আব্বার কথাটা মনে পড়তেই ভাবল, কৈফিয়ৎ চেয়ে খুব বেয়াদবি করে ফেলেছি। তাড়াতাড়ি কদমবুসি করে বলল, আমি এই সব জানতে চেয়ে অন্যায় করেছি, আমাকে মাফ করে দিন। আমি আপনার কথায় রাজি।
চৌধুরী হুজুর আলহামদুলিল্লাহ বলে বললেন, আমি তোমার কাছ থেকে এটাই আশা করেছিলাম। আর তুমি অন্যায় কিছু করনি। বরং মনে কোনো সন্দেহ রাখা উচিত নয়। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ঢাকায় তুমি থাক কোথায়, মেসে না কোনো আত্মীয়ের বাসায়?
চৌধুরী হুজুর সুবহানাল্লাহ বলে তার হাতে তিন হাজার টাকা দিয়ে বললেন, কাল তুমি ঢাকা চলে যাও। কয়েকদিন পর এ থেকে এক হাজার টাকা তোমার আম্মাকে পাঠিয়ে দেবে। তুমি তো খুব ভালো ছাত্র ছিলে। এখন থেকে পড়াশোনা আরম্ভ কর। দরকার মনে করলে একজন মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়ো। আর তোমার মামাকে বলবে, তিনি যেন সামনের বছর পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তুমি প্রতি মাসে সময় মতো দুহাজার টাকা পাবে।
আতাহার বলল, চাকরি ছেড়ে দিয়ে পড়াশোনা করার কথা জানার পর মামা জিজ্ঞেস করলে কি বলব?
চৌধুরী হুজুর একটা মুখবন্ধ খাম তার হাতে দিয়ে বললেন, ঢাকায় গিয়ে এটা তার হাতে দিও। তা হলে তিনি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আর যা-যা তোমাকে বলেছি, সে সবের বরখেলাপ কিছু করবে না। আল্লাহ তোমার সহায় হোক। এবার তুমি যাও।
আতাহার কৃতজ্ঞতায় চোখের পানি রোধ করতে পারল না। আর একবার কদমবুসি করে ভিজে গলায় বলল, আপনি দোয়া করবেন হুজুর, আল্লাহ যেন আপনার কথা মেনে চলার তওফিক আমাকে দেন।
চৌধুরী হুজুর চোখ বন্ধ করে বললেন, ফি আমানিল্লাহ। আতাহার সালাম বিনিময় করে চলে এল।
ঘরে এসে মাকে বলল, আমি কাল ঢাকা যাব।
.
০৯.
মুবিন এখন বিয়ে করবে না বলে চিঠি দেওয়ার তিন মাস পর বাড়িতে এল। বড় ভাবি সুরাইয়া ছোট দেবরকে খুব স্নেহ করেন। সে এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসার পর শ্বশুড়ী মারা গেছেন। সেই জন্য বাড়ির বড় বৌ হিসাবে সবাইর দিকে লক্ষ্য রাখলেও মুবিন সবার ছোট বলে তার দিকে বেশি লক্ষ্য রাখে। শবনমকে মুবিনের সঙ্গে ভালো মানাবে ভেবে নিজেই বিয়ের কথা বলেছিল। মুবিন অমত করে চিঠি দিতে তার উপর রেগেছিল। বাড়িতে এসে সে তার সঙ্গে দেখা করতে এলে বলল, তুমি যদি এখন বিয়েই করবে না, তা হলে গতবার এসে যখন বিয়ের কথা শুনলে তখনই তা জানালে না কেন? ভাবিদের কাছে ও তার মা-বাবার কাছে আমরা যে অপমানিত হলাম, সে কথা চিন্তা করেছ?
মুবিন কি বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে চুপ করে রইল।
কি হল কিছু বলছ না কেন? আমার তো মনে হচ্ছে এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে।
কি রহস্য থাকতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
ভোলাতে কোনো মেয়ের প্রেমে হয়তো পড়েছ।
মুবিন হেসে উঠে বলল, প্রেম কি এতই সস্তা যে, মেয়ে দেখলাম আর প্রেম হয়ে গেল।
একে অপরকে দেখেই তো ছেলে-মেয়েরা প্রেমে পড়ে।
তোমার কথা অবশ্য ঠিক; তবে আমার সেরকম কিছু হয়নি।
তা হলে মনের মতো কোনো মেয়ের সঙ্গে নিশ্চয় পরিচয় হয়েছে?
তুমি আমার উপর রেগে রয়েছ, তাই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছ।
রেগে থাকাটা কি অন্যায় ভাবছ?
না, সেটাই স্বাভাবিক।
তা হলে আসল কথাটা বলছ না কেন?
পরে বলব বলে মুবিন তার কাছ থেকে চলে গেল।
কয়েকদিন পর মুবিন চলে যাওয়ার জন্য যখন বড় ভাবির কাছে বিদায় নিতে গেল তখন সুরাইয়া বলল, আসল কথাটা না বলে চলে যাচ্ছ যে?
মুবিন বলল, মাফ কর ভাবি, সেটা বলতে পারব না। তবে এতটুকু বলতে পারি, ভোলায় একটা মেয়েকে পছন্দ হলেও মেয়েটি আমাকে পছন্দ করে কি না এখনো জানতে পারিনি।
সুরাইয়া বলল, তাই বল, আমিও কিন্তু ঐরকম কিছু ভেবেছি। তা মেয়েটার মনের খবর জানতে চেষ্টা করনি?
না।
কেন?
এসব ব্যাপারে তাড়াহুড়া করা আমি ভালো মনে করি না।
কিন্তু বিয়ের বয়স যে পার হয়ে যাচ্ছে, সে কথা চিন্তা করনি?
মুবিন হেসে উঠে বলল, বিয়ের কোনো নির্দিষ্ট বয়স আছে তাতো জানতাম না। অনেকে তো চল্লিশ পঞ্চাশ এমন কি ষাট-সত্তর বছর বয়সেও বিয়ে করে।
সুরাইয়া বুঝতে পারল, মুবিন ফাজলামী করছে। তাই সেও বলল, তা করে, কিন্তু তারা দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বিয়ে করে।
মুবিন হাসতে হাসতে বলল, আমি না হয়, এক সঙ্গে চারজনকে বিয়ে করব।
দেখ মুবিন ভাই, বেশি ফাজলামী করবে না। এবার গিয়ে মেয়ের মতামত নিয়ে চিঠি দিয়ে জানাবে। আমিও তোমার বড় ভাই গিয়ে বিয়ের কথাবার্তা বলে আসব।
দেখি আল্লাহপাকের যদি মর্জি হয় বলে মুবিন বিদায় নিয়ে রওয়ানা দিল।
.
একদিন বিকেলে মুবিন বেড়াতে বেড়াতে এক ডজন বলপেন কেনার জন্য মার্কেটে গিয়ে একটা দোকানে ঢুকল।
একটু আগে নাসিমাও ঐ দোকানে এক ডজন বলপেন কেনার জন্য এসেছে। মুবিন তাকে লক্ষ্য না করলেও নাসিমা দেখতে পেয়ে সালাম দিয়ে বলল, মুবিন ভাই যে, কেমন আছেন?
নাসিমা বোরখা পরে এসেছে। দোকানে ঢুকে মুখের নেকাব সরিয়ে দিয়েছে। মুবিন সালামের উত্তর দিয়ে বেশ অবাক হয়ে বলল, আপনাকে চেনা চেনা মনে হলেও ঠিক চিনতে পারছি না।
নাসিমা বলল, চিনবেন কি করে, বন্ধু ভালো হয়ে যাবার পরে তো আর তাদের বাড়িতে যাননি। একদিনের পরিচয়ে কি আর চেনা যায়? তা কেমন আছেন বললেন না যে?
মুবিন এবার নাসিমাকে চিনতে পেরে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ যেভাবে রাখেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকা প্রত্যেক মুসলমানের উচিত। আপনি কেমন আছেন?
আমিও আল্লাহর রহমতে এক রকম আছি। একটা প্রশ্ন করব।
করুন।
আমাদের বাড়িতে আর যাননি কেন?
এটার উত্তর এখানে বলা যাবে না। আপনার কেনাকাটা শেষ হলে চলুন, হাঁটতে হাঁটতে বলব।
হ্যাঁ হয়েছে, এক ডজন বলপেন কিনতে এসেছিলাম। আপনি কিছু কিনবেন না কি?
মুবিন মৃদু হেসে বলল, আমিও এক ডজন বলপেন কিনতে এসেছিলাম।
নাসিমাও মৃদু হেসে বলল, তাই।
.
মুবিন বলল, একটু দাঁড়ান। তারপর বলপেন কিনে বলল, চলুন।
রাস্তায় নেমে নাসিমা বলল, এবার বলুন।
দেখুন প্রশ্নটা খুব ব্যক্তিগত। ভাবছি, বলাটা ঠিক হবে কিনা।
নাসিমা মনে করল, তা হলে ভাইয়ার সঙ্গে কি মনোমালিন্য হয়েছে? তাই অনুমানটা যাচাই করার জন্য একটু জোর দিয়ে বলল, যতই ব্যক্তিগত হোক তবু শুনব।
শুনলে আপনি মাইন্ড করতে পারেন।
আমাকে মীন মাইন্ডেড ভাবলে ভুল করবেন।
যদি বলি আপনার জন্যই যাইনি।
নাসিমা দাঁড়িয়ে পড়ে তার মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, আমার জন্য?
হ্যাঁ আপনার জন্য।
কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে তেমন খারাপ কিছু করেছি বলে মনে পড়ছে না।
খারাপ কিছু না করলেও অন্য কিছু করেছেন। যার ফলে আপনার ভাইয়া নিয়ে যেতে চাইলেও যাইনি।
নাসিমা আরো অবাক হয়ে বলল, আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ বলুন না কি করেছি।
শুনে মাইন্ড করবেন না বলুন।
এক্ষুণি বললাম না, আমার মন অত ছোট নয়?
প্রথম যেদিন আপনাদের বাসায় যাই, সেদিন আপনার চোখের দৃষ্টি আমার মন চুরি করে নিয়েছে।
কথাটা শুনে নাসিমা ভীষণ লজ্জা পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ভাইয়ার মুখে মুবিনের গুণাগুণ শুনে মনে মনে তাকে ভালবেসে ফেলে। সেই সাথে ভাইয়াকে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখে তার কাছ থেকে ইসলামকে জেনে সেও ঝুঁকে পড়ে এবং মুবিনকে আরো বেশি ভালবেসে ফেলে। সেই জন্য তাকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য ভাইয়াকে বলে। ভাইয়ার অসুখের সময় মুবিন তাকে দেখতে এলে তার মনের আশা পূরণ হয়। তারপর ভাইয়া সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর অনেক দিন যখন এল না তখন একদিন ভাইয়াকে বলল, তোমার বন্ধু আর আসেনি কেন? তার সঙ্গে কি তোমার মানোমালিন্য হয়েছে?
ওয়াহাব হেসে উঠে বলল, মুবিনের মতো ছেলের সঙ্গে কারো মনোমালিন্য হতেই পারে না।
তা হলে ওঁকে আর আননি কেন?
কয়েকবার আনতে চেয়েছি; প্রত্যেক বারই বলে, একটু ব্যস্ত আছি, পরে যাব। ঠিক আছে, কাল দেখা হলে তোর কথা বলব।
নাসিমা লজ্জা পেয়ে বলল, না না, আমার কথা বলবে কেন? তোমার সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছে কিনা জানার জন্যে জিজ্ঞেস করলাম।
নাসিমার মুখে লজ্জার আভা দেখে ওয়াহাবের মনে হল, তা হলে কি মুবিনকে নাসিমা পছন্দ করে? বলল, কাল ওকে যেমন করে হোক নিয়ে আসব।
বলল আমার কথা বলবে না কিন্তু।
পরের দিন মুবিনের অপিস ছুটির সময় ওয়াহাব তার অফিসে গিয়ে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, সত্যি করে বলুন তো আমাদের বাসায় যেতে চান না কেন?
মুবিন মৃদু হেসে বলল, আমি কি বলেছি যাব না।
তা অবশ্য বলেন নি; কিন্তু যান ওতো না। আপনি যান না বলে নাসিমা মনে করেছে আপনার সঙ্গে আমার মনোমালিন্য হয়েছে।
তাই নাকি? তা হলে তো একদিন যেতেই হয়।
একদিন কেন, আজই চলুন না।
কিছু মনে করবেন না। কাল বাড়ি যাব। আজ কিছু কেনাকাটা করব। বাড়ি থেকে ফিরে এসে একদিন যাব।
কত দিন পরে ফিরবেন?
চারদিনের ছুটি পেয়েছি।
ঠিক আছে, ফিরে আসুন, তারপর দেখা হবে। এই কথা বলে বিদায় নিয়ে ওয়াহাব বাসায় এসে নাসিমাকে কথাটা জানাল।
নাসিমা বলল, আমার কথা বলনি তো?
প্রথমে বলিনি, যখন দেখলাম অজুহাত দেখাচ্ছে তখন তোর কথা বললাম। তোর কথা শুনেই তো ঐ কথা বলল।
নাসিমা লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে মিষ্টি ধমকের সুরে বলল, তোমাকে আমার কথা বলতে নিষেধ করলাম, তবু বললে? ছিঃ ছিঃ ভদ্রলোক কি মনে করলেন?
মুবিন সে রকম ছেলেই নয় যে, কিছু মনে করবে।
কাজটা তুমি ভালো করোনি ভাইয়া বলে নাসিমা তার কাছ থেকে চলে গেল।
ছোট বোনের মুখের অবস্থা দেখে ও তার কথা শুনে অনুমানটা আরো গাঢ় হল। মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, তুই আমার একমাত্র বোন, যেমন করে হোক তোর মনের আশা পূরণ করব।
এবার বাড়ি থেকে আসার পর নাসিমার কথা মুবিনের সব সময় মনে পড়ছে। তাদের বাসায়ও যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু ওয়াহাব আসছে না বলে যেতে পারছে না। দশ বার দিন হল বাড়ি থেকে এসেছে। নাসিমাকে দেখার জন্য তার মন অস্থির হয়ে উঠল। তাই একদিন ওয়াহাবের অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, সে অফিসের কাজে কয়েকদিন আগে ঢাকায় গেছে। ফিরতে আরো দু একদিন দেরি হবে।
আজ হঠাৎ মার্কেটে নাসিমার সঙ্গে দেখা। নাসিমাকে মন চুরি করার কথা বলার পরে তাকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, মাইন্ড করলেন তো? এই জন্যে কথাটা বলতে চাইনি।
নাসিমা মাথা তুলে লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, মাইন্ডের বদলে যদি অন্যকিছু করি তা হলে?
তা হলে সেটা কি বললে খুশি হব।
পরে বলব, তার আগে চলুন কোনো রেস্টুরেন্টে বসে গলা ভেজান যাক।
বেশ তো চলুন ঐ সামনের রেস্টুরেন্টে।
রেস্টুরেন্টে এসে মুবিন বলল, কি খাবেন?
শুধু চা।
তা হতেই পারে না।
কেন?
প্রথম দিন আপনাকে শুধু চা খাওয়াতে পারব না। তারপর বেয়ারাকে ডেকে মিষ্টি ও চায়ের অর্ডার দিয়ে বলল, এবার বলুন।
যার চোখ আপনার মন চুরি করল, তাকে শাস্তি দিতে যাননি কেন?
প্রমাণ করার মত কোন ডকুমেন্ট ছিল না। তাই যাইনি। তবে এবার যাব।
ডকুমেন্ট পেয়েছেন?
এতদিন পাইনি। একটু আগে পেলাম।
তা হলে চোরকে শাস্তি দিতে যাচ্ছেন কবে।
মনে হচ্ছে, না যাওয়ায় চোর শাস্তি পাচ্ছে। ভাবছি, ওয়াহাব সাহেব ঢাকা থেকে আসার পর চোরকে প্রথমে এ্যারেস্ট করার ব্যবস্থা করব। তারপর আরো কঠিন শাস্তি দেব।
চোর যদি ধরা না দেয়।
আর আমি যদি বলি চোর ধরা দেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে?
নাসিমা লজ্জা পেয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর বলল, চোর কোনোদিন স্বেচ্ছায় ধরা দিতে চায় না।
যেভাবে ধরা দেয়, সেই ভাবেই ধরব।
এমন সময় বেয়ারা দুটো প্লেটে মিষ্টি ও দুকাপ চা দিয়ে গেল।
মিষ্টি খাওয়ার পর নাসিমা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আর আমি যদি বলি যিনি চোর ধরতে চাচ্ছেন, তিনি অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে গিয়ে তার বোনের মন চুরি করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন?
তা হলে আমিও বলব, এতদিন তাকে ধরার চেষ্টা করছেন না কেন?
সে যে মেয়ে, আর চোর হল পুরুষ। মেয়েরা কি পুরুষ চোর ধরতে পারে?
নিশ্চয়ই পারে। আজ কাল কত মেয়ে পুলিশ রয়েছে। চোর ধরা তো দূরের কথা তার চেয়ে কঠিন কাজও করছে। তা ছাড়া এখন মেয়েরা সমান অধিকারের দাবী তুলছে। একজন লেখিকা তো সে বিষয়ে অনেক বইয়ে লিখেছেন। ছেলেরা যদি যেখানে সেখানে ছোট বাথরুমের কাজ সারতে পারে, তা হলে মেয়েরা পারবে না কেন? ছেলেরা যদি স্যান্ডো গেঞ্জি পরতে পারে অথবা খালি গায়ে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে পারে, তা হলে মেয়েরা পারবে না কেন? ছেলেরা একসঙ্গে দুটো তিনটে বা চারটে বিয়ে করতে পারলে, মেয়েরা পারবে না কেন? পুরুষরা মেয়ে বেশ্যার কাছে যেতে পারলে মেয়েরা পুরুষ বেশ্যার কাছে যেতে পারবে না কেন? বিদেশের মতো এদেশেও পুরুষ বেশ্যালয় থাকা উচিত বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এমন কি আল্লাহপাক কোরআনের যে অংশগুলোতে নারীদের অধিকার সম্বন্ধে বর্ণনা করেছেন, সেই অংশগুলোর সংশোধন করার কথাও বলেছেন।
নাসিমা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ব্যাস ব্যাস, ঐ লেখিকার কথা আর বলবেন না, আমি তার কয়েকটা বই পড়েছি। পড়ে বুঝেছি ঐ লেখিকা একজন নাস্তিক, বিকৃতমনা, কুরুচীসম্পন্না ও জঘন্য ধরনের মহিলা। তাই দেশের লোক তার উপর ক্ষেপে যেতে তিনি ভয়ে সরকারের ছত্রছায়ায় বিদেশে পালিয়ে গেছেন। পত্র-পত্রিকা পড়ে জেনেছি, বিদেশেও পানি পাচ্ছেন না। তার কথা আলোচনা করতে ঘৃণা হয়। বাদ দেন ওসব কথা; কবে আমাদের বাসায় যাচ্ছেন বলুন।
মুবিন মৃদু হেসে বলল, আপনার ভাইয়া ঢাকা থেকে ফিরলে তারপর যাব।
ভাইয়া যে ঢাকা গেছে, সে কথা জানলেন কেমন করে?
তার অফিসে গিয়ে।
ভাইয়া না থাকলে যাওয়া যায় না বুঝি?
তা যাবে না কেন? ভেবেছি এক ঢিলে দুই পাখি মারব।
মানে?
মানে তার সঙ্গে গেলে আপনাদের বাসায় যাওয়াও হবে, আর সেই সাথে চোরকে এ্যারেষ্ট করার প্ল্যান প্রোগ্রামও করা যাবে।
নাসিমা মৃদু হেসে বলল, তাই?
মুবিনও মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ তাই।
চলুন এবার ওঠা যাক।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে মুবিন বলল, চলুন আপনাকে পৌঁছে দিই।
নাসিমাও তাই চাচ্ছিল; তবু বলল, শুধু শুধু কষ্ট করবেন কেন? আমি একটা রিক্সা নিয়ে চলে যাব।
মুবিন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর একটা খালি রিক্সা যেতে দেখে থামিয়ে বলল, নিন উঠুন।
মুবিনও হয়তো এক রিক্সায় উঠবে ভেবে নাসিমা ইতস্তত করল।
বুঝতে পেরে মুবিন বলল, ইতস্তত করার কোন কারণ নেই, আমি আপনার সঙ্গে যাব না।
নাসিমা লজ্জিত হয়ে বলল, মাফ করবেন, আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম। চলুন হেঁটেই যাই। মাত্র তো আধ ঘন্টার পথ।
মুবিন বলল, তা আর হয় না। আপনি রিক্সা করেই যান।
ক্ষমা চাইলাম, তবুও রাগ করলেন।
ক্ষমা চাওয়ার মত অন্যায় করেছেন কি না জানি না, তবে আমি আমার কথার নড়চড় কোনোদিন করি না। রিক্সায় না গেলে বরং আমিই মনে কষ্ট পাব।
নাসিমা বুঝতে পারল, মুবিন খুব সেন্টিমেন্টাল ও একরোখা। ভিজে গলায় বলল, প্লীজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। কথাটা আমি এমনিই বলেছি। আপনি এভাবে নেবেন জানলে বলতাম না।
জানেন বোধ হয়, প্রত্যেক মানুষের কিছু না কিছু দোষ থাকেই। আমারও আছে। তার মধ্যে আমার একটা বড় দোষ, আমি যা একবার না বলি, তা আর হ্যাঁ হয় না। তাই আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেও আপনার সঙ্গে যেতে পারছি না। সে জন্য ক্ষমা চাইছি। তবে কাল যদি আসেন, তা হলে কথা দিচ্ছি যাব।
নাসিমা আর কোনো কথা না বলে চোখ মুছতে মুছতে রিক্সায় উঠল।
রিক্সা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর মুবিন বাসার পথ ধরল।
সেই দিন রাতে মুবিন বড় ভাবিকে নিজের মতামত জানিয়ে নাসিমার অভিভাবকদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলে চিঠি লিখল।
পরের দিন অফিসে যাওয়ার পথে সেটা পোষ্ট করে দিল। গতকালের ঘটনায় মুবিনের মনে শান্তি নেই। সেই থেকে তার কেবলই মনে হয়েছে নাসিমা মনে কষ্ট পেয়েছে। ভেবেছে, কাল যদি আসে, তা হলে তাকে খুশি করার চেষ্টা করবে। অফিসে কাজ করতে করতে বার বার গতকালের ঘটনা মনে পড়ছে। হঠাৎ খেয়াল হল, তাকে আজ আসতে বললাম, কিন্তু কোথায় আসবে বলিনি। ওতো আমার বাসার ঠিকানা জানে না। যদি আসে, তা হলে কি মার্কেটে ঐ দোকানে আসবে? ভেবে রাখল, ছুটির পর ঐ দোকান হয়ে বাসায় ফিরবে।
মুবিনের ছুটি হয় পাঁচটায়। আজ নাসিমার চিন্তায় পাঁচটা পর্যন্ত থাকতে পারল না। ভাবল, সে হয়তো মার্কেটে এসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। তাই চারটের সময় ম্যানেজারকে বলে অফিস থেকে বেরিয়ে গেটের বাইরে এসেছে এমন সময় নাসিমাকে আসতে দেখে মন আনন্দে ভরে গেল।
নাসিমা গতকাল বাসায় ফেরার সময় চিন্তা করল, মুবিন ভাই যা বলল, তা সত্যি, না ডাঁট দেখাল? যদি ডাঁট দেখায়, তা হলে তো সে অহঙ্কারী। তার এক মন বলল, যা স্বাভাবিক তাই তুই বলেছিস, তাতে মাইন্ড করবে কেন? এটা সে ডাঁটই দেখিয়েছে। তা না হলে তোর মনের খবর জানার পরও ঐ সামান্য কথায় রাগ করতে পারে না। আর এক মন বলল, তা কি করে হয়? যারা ধার্মীক তারা অহঙ্কারী হতে পারে না। তারা ভঁটও দেখাতে পারে না। সত্যি সত্যি হয়তো ছোটবেলা থেকেই ঐরকম। সিদ্ধান্ত নিল, কাল তার সঙ্গে দেখা করে সত্য মিথ্যা যাঁচাই করবে।
পরের দিন বেলা আটটার সময় ওয়াহাব ঢাকা থেকে ফিরে মালপত্র অফিসে বুঝিয়ে দিয়ে একটার দিকে বাসায় এল।
ওয়াহাব খাওয়া দাওয়ার পর যখন রেস্ট নিচ্ছিল তখন নাসিমা তার কাছে এসে বলল, তুমি আজ বিকেলে বাসায় থাকবে।
কেন?
কেন আবার থাকতে বললাম থাকবে।
তা না হয় থাকব; কিন্তু কারণটা বলবি তো।
এখন বলব না, থাকলেই জানতে পারবে।
ঠিক আছে এখন যা একটু ঘুমাব।
নাসিমা মুবিনের বাসার ঠিকানা জানে না। তাই অফিস ছুটির আগে এসে গেটের বাইরে অপেক্ষা করছিল। মুবিনকে বেরোতে দেখে এগিয়ে এসে সালাম দিল।
মুবিন সালামের উত্তর দিয়ে হাসিমুখে বলল, ক্ষমা পেয়েছি তা হলে?
নাসিমা বলল, আপনি একথা বলছেন কেন? বরং অন্যায় তো আমি করেছি। কাল ক্ষমা চেয়ে পাইনি। আজ আবার চাইতে এলাম।
মুবিন লজ্জা পেয়ে বলল, গতকালের ঘটনার জন্য সত্যি খুব দুঃখিত। চলুন কোথাও বসি।
আজ আর কোথাও বসব না বাসায় চলুন।
বেশ তাই চলুন বলে মুবিন হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করল, এখান থেকে ওদের বাসায় হেঁটে যেতে আধ ঘন্টা সময় লাগবে। এতটা পথ নাসিমাকে নিয়ে হেঁটে যাওয়া ঠিক হবে না। তা ছাড়া অফিস ছুটির পর তারও ক্লান্তি লাগছিল। একটা খালি স্কুটার আসতে দেখে থামাল। তারপর নাসিমাকে বলল, উঠুন।
নাসিমাও ঐ একই কথা চিন্তা করে স্কুটারের কথা চিন্তা করছিল। তাই কিছু না বলে উঠে বসে বলল, আপনি স্কুটার না থামালে আমি থামাতাম। বাসার কাছে পৌঁছে স্কুটার থেকে নেমে মুবিন ভাড়া দিতে গেলে নিজের অজান্তে নাসিমা তার হাত ধরে ফেলে বলল, আপনি দিচ্ছেন কেন? আমি আপনাকে নিয়ে এসেছি।
নাসিমা হাত ধরাতে মুবিন সারা শরীরে এক অজানা শিহরণ অনুভব করে কোন কথা বলতে পারল না। এক দৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নাসিমা ভীষণ লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি হাত ছেড়ে দিল। তারপর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে কোন রকমে বলল, আসুন।
এমন সময় আসরের আযান হতে শুনে মুবিন বলল, আপনি যান, আমি নামায পড়ে আসছি। নাসিমাদের বাসার পাশে মসজিদ। ওয়াহাবের অসুখের সময় এসে ঐ মসজিদে একদিন নামায পড়েছিল।
নাসিমা ঘড়ি দেখে বলল, জামাতের সময় এখনও বিশ মিনিট বাকি। ভাইয়ার সঙ্গে যাবেন। আসুন আমার সঙ্গে।
মুবিন অবাক হয়ে যেতে যেতে বলল, আপনার ভাইয়া ফিরেছেন?
জ্বি, আজই ফিরেছে।
ওয়াহাব ঘুম থেকে উঠে নাসিমাকে দেখতে না পেয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল, নাসিমা কোথায়?
সারা বেগম বললেন, কোথায় যেন গেল। যাওয়ার সময় বলল, ভাইয়াকে থাকতে বলো।
ওয়াহাব চিন্তা করতে লাগল, নাসিমা কোথায় গেছে? আর আমাকেই বা থাকতে বলল কেন? বলল, ভেবেছিলাম মুবিনের সঙ্গে আজ দেখা করব।
ওয়াহাব বোনের মনোভাব বুঝতে পারার পর একদিন মা-বাবাকে বলেছিল। আমি নাসিমার জন্য মুবিনকে পছন্দ করেছি। আমার এক কলিকের বাড়ি ওদের পাশের গ্রামে। তার কাছে সব খোঁজ খবরও নিয়েছি। সে বলল, মুবিনের মত ছেলে আজকাল পাওয়া যায় না। ওদের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থা খুব ভালো। কিছুদিন আগে দৌলতখানে বিয়ের কথা হয়েছিল। মুবিন প্রথমে রাজি থাকলেও পরে অমত করেছে। তাই বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। ভাবছি, একবার ওর সঙ্গে গিয়ে সব কিছু দেখে আসব।
ওয়াহাবের আব্বা বখতিয়ার সাহেব ডিস্ট্রিক জজ ছিলেন। গত বছর রিটায়ার্ড করেছেন। ওঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে জাপানে চাকরি করতে গিয়ে সেখানে বিয়ে করে সেটেল্ড। ছোট ওয়াহাব আর মেয়ে নাসিমা।
ছেলের কথা শুনে বললেন, তোমরা দুজনই এখন আমাদের সবকিছু। আমরা মা বাবা হলেও তুমিই নাসিমাকে গাইড দিয়ে মানুষ করেছ। তার ভালো মন্দের দায়িত্বও তোমার। আমার ও তোমার মায়ের ওকে পছন্দ। কেন বিয়ে ভেঙ্গে গেল, গিয়ে ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে এস।
সারা বেগম এখন মুবিনের কথা শুনে বললেন, নাসিমা তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে গেছে। ফিরার পর মুবিনের কাছে না হয় যাবি।
ওয়াহাব আযান শুনে অজু করতে যাবে। এমন সময় জানালা দিয়ে নাসিমা ও মুবিনকে উঠোনের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে খুব খুশি হয়ে তাদের দিকে চেয়ে রইল। তখন তার মনে হল, ঠিক যেন একজোড়া কপোত-কপোতি। তাদেরকে পাশাপাশি আসতে দেখে আরো মনে হল, এই বাড়ির মেয়ে জামাই আসছে। ওরা দেখতে পাওয়ার আগেই জানালার কাছ থেকে সরে গেল।
নাসিমা মুবিনকে ড্রইং রুমে বসিয়ে ভাইয়ার কাছে এসে বলল, তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব।
ওয়াহাব অবাক হবার ভান করে বলল, তা সারপ্রাইজটা কি শুনি?
বলব না, ড্রইং রুমে যাও। আমি আসছি বলে নাসিমা নিজের রুমে চলে গেল।
ওয়াহাব পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে ড্রইংরুমে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
মুবিন সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আলহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন?
ওয়াহাবও আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, বাড়ির সব খবর ভালো?
আল্লাহর রহমতে ভালো। জামাতের সময় হয়ে গেছে, নামায পড়ে আসি চলুন।
হ্যাঁ তাই চলুন।
নামায পড়ে এসে দু বন্ধুতে বসেছে। এমন সময় নাসিমা কাজের মেয়েকে নিয়ে নাস্তা পরিবেশন করতে করতে ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি তো তোমার বন্ধুকে আনতে পারনি। কাল মার্কেটে ওঁর সঙ্গে দেখা। বাসায় আসতে বলাতে বললেন, আজ আমি যদি আনতে যাই, তা হলে আসবেন। তুমি আজ এসে পড়লে। তাই ভাবলাম, তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব।
ওয়াহাব বলল, সারপ্রাইজটা আজ তোকেই আমি দেব বলে ভেবেছিলাম। আল্লাহর মর্জি অন্য রকম। তাই বিপরীত ঘটনা ঘটল। তারপর মুবিনের দিকে চেয়ে বলল, নিন শুরু করুন।
নাস্তা খাওয়া হয়ে যেতে নাসিমা পট থেকে কাপে চা ঢেলে প্রথমে মুবিনকে দিল। তারপর ভাইয়াকে দেওয়ার সময় বলল, তোমার বন্ধুকে বল, উনি আজ রাতের খাবার খেয়ে যাবেন।
ওয়াহাব বলল, আমি বলব কেন? তুই গিয়ে নিয়ে আসতে পারলি, আর এই কথাটা বলতে পারলি না?
নাসিমা বলল, তুমি না থাকলে বলতাম।
ওয়াহাব মুবিনকে বলল, শুনলেন তো, আজ রাতে খেয়ে তারপর যাবেন।
মুবিন বলল, দাওয়াত কবুল করা যখন সুন্নত কখন তো আর না করতে পারি না। তবে আপনার বোন অফিস থেকে আমাকে ধরে এনেছেন। এখন বাসায় যাই। পরে আসব।
ওয়াহাব বলল, ঠিক আছে, তাই আসবেন।
রাতে খাওয়া দাওয়া করে ফেরার সময় মুবিন ওয়াহাবকে বলল, কিছু যদি মনে না করেন, তা হলে একটা কথা বলতে চাই।
ওয়াহাব বলল, মনে করার কি আছে? আপনি বলুন।
কিছুদিন আগে অভিভাবকরা এক জায়গায় আমার বিয়ের কথাবার্তা বলেছিলেন, কোনো কারণে আমি সেখানে বিয়ে করতে রাজি হইনি। এবার বাড়ি যেতে তারা আবার মেয়ে দেখার কথা বললে আমি আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছি। অবশ্য একথাও বলেছি আপনাদের মতামত জেনে তাদেরকে জানাবার পর যেন তারা আসেন।
ওয়াহাব বোনের মনের খবর আগেই বুঝতে পেরেছিল। এখন মুবিনের মনের খবর বুঝতে পেরে খুশিই হল। বলল, কথাটা বলে ভালই করলেন। আপনাকে আমাদের সবাইয়ের পছন্দ। এখন আপনি না বললে, আমি দু একদিনের মধ্যে বলব বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু আল্লাহপাক তার আগেই আপনাকে দিয়ে কথাটা বলালেন। আপনি চিঠি দিয়ে আসতে বলুন।
মুবিন বলল, একটা অনুরোধ করব।
বলুন।
আল্লাহপাকের ইচ্ছায় যদি সব কিছু ঠিক হয়ে যায়: তবু আপনার বোন যেন না জানে আমার সঙ্গে তার বিয়ে হবে।
তা কি করে সম্ভব? আব্বা-আম্মা থাকলেও আমিই ওর অভিভাবক। আমি ওকে খুব। আদরে মানুষ করেছি। আমরা ভাইবোন হলেও খুব ফ্রিভাবে যে কথাবার্তা বলি, তা তো। আপনি নিজের চোখে দেখলেন। ওর বিয়ের ব্যবস্থা করেছি শুনলে আমার উপর ভীষণ রাগ করবে এবং মনে কষ্ট পাবে। নাসিমা বড় অভিমানী। আপনার অনুরোধ রাখতে। গেলে হিতে বিপরীত ঘটিয়ে ফেলব। তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, আপনি যে কারণে ওকে জানাতে নিষেধ করলেন, সে ব্যাপারে কোনো অসুবিধা হবে না। ও বরাবরই খুব ফ্রি। আগে সবার সঙ্গেই ফ্রিভাবে মিশতো। ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ার পর কারো সঙ্গে মিশে না। তবে আমার মনে হয়, বিয়ের কথাবার্তা হওয়ার পরও আপনার। সঙ্গে মেলামেশা করতে কোনো দ্বিধা করবে না।
মুবিন লজ্জা পেয়ে বলল, আপনারা দুই ভাইবোন খুব চালাক।
ওয়াহাব বলল, আমার তো মনে হচ্ছে, আমরা তিনজনেই চালাক।
এই কথায়, দুজনেই হেসে উঠল।
হাসি থামিয়ে ওয়াহাব বলল, এবার আমি কিছু বলব, মাইও করবেন না তো?
মুবিন হাসতে হাসতে বলল, আপনার কথাতেই উত্তর দিচ্ছি, মাইণ্ড করার কি আছে? বলুন।
আপনাকে আমার পছন্দ হওয়ার পর নাসিমার মনের খবর জানার চেষ্টা করি। পজেটিভ জানতে পেরে আপনার ফ্যামিলীর খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম, সবকিছু ভালো; কিন্তু কিছুদিন আগে আপনার বিয়ে ঠিক ঠাক হয়েছিল, মানে যে কথা আপনি একটু আগে নিজেই বললেন। শুনেছি, ঐ বিয়েতে আপনি প্রথমে রাজি ছিলেন, পরে অমত করেছেন। অমতের কারণটা বলবেন?
মুবিন আহত স্বরে বলল, আপনি কি আমাকে অবিশ্বাস করেন?
ছিঃ ছিঃ এ আপনি কি বলছেন? অবিশ্বাস করতে যাব কেন? যদি করতাম, তা হলে সব কিছু জানার পর আপনার সঙ্গে নাসিমার ব্যাপারে কোনো কথাই বলতাম না। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। অভিভাবক হিসেবে আপনার সব কিছু জানা কি আমার উচিত নয়?
মুবিন নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল, আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম, ক্ষমা করে দিন।
ওয়াহাব বলল, মানুষ মাত্রেই ভুল করে। ক্ষমা চাওয়ার মত ভুল আপনি করেননি।
মুবিন বলল, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন, মেয়েটি আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। অপছন্দ করার মত মেয়ে নয়। তাই প্রথমে অমত করিনি, পরে ঐ মেয়ের সম্পর্কে এমন কিছু জানতে পারি, যার কারণে সব কথাবার্তা পাকা হয়ে যাওয়ার পরও আমি অমত করি। এর বেশি কিছু বলতে পারব না। প্লিজ এ ব্যাপারে আমাকে আর কোনো কথা। জিজ্ঞেস করবেন না।
ওয়াহাব বলল, ঠিক আছে, যা জানার জানা হয়ে গেছে।
মুবিন বলল, এবার তা হলে আসি। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
ওয়াহাব যখন মুবিনকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল তখন নাসিমা চুপে চুপে তাদের পিছনে পিছনে এসে গেটের কাছে আড়ালে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ তাদের কথোপকথন শুনছিল। মুবিন চলে যেতে তাড়াতাড়ি করে ফিরে এল। সে রাতে নাসিমা শোকরানার নামায পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে মনের কামনা-বাসনা জানাল। তারপর আনন্দের চোটে অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারল না।
পরের দিন দুটোর সময় কলেজ ছুটির পর তার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এল। বাসায় না গিয়ে রিক্সায় করে মুবিনের ব্যাংকের গেটে এসে যখন নামল তখন মুবিন হোটেল থেকে খেয়ে ফিরছিল। নাসিমাকে দেখে অবাক হলেও আনন্দিত হল। সালাম বিনিময় করে বলল, কি ব্যাপার আজ আবার এলেন যে।
নাসিমা বলল কেন, আসতে নেই বুঝি?
তা কেন, মানে …….।
তাকে থামিয়ে দিয়ে নাসিমা বলল, থাক আর মানে করা লাগবে না। আসুন আমার সঙ্গে।
এক মিনিট বলে মুবিন ভিতরে চলে গেল। একটু পরে ফিরে এসে বলল, চলুন।
নাসিমা হাঁটতে শুরু করে বলল, বসের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন তো?
মুবিন মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ।
মুবিনকে হোটেলের দিকে যেতে দেখে নাসিমা বলল, এদিকে যাচ্ছেন কেন?
মুবিন বলল, আপনি কলেজ থেকে এসেছেন, আগে আপনার কিছু খাওয়া দরকার।
নাসিমা শুকরিয়া জানিয়ে বলল, আপনি দুপুরে কোথায় খান?
হোটেলে।
হোটেলে খেলে তো গ্যাস্টিক হবে।
এছাড়া যখন কোন উপায় নেই তখন হলে কি আর করব। তবে এবার একটা ছেলে ঠিক করেছি। সে সামনের মাস থেকে বাসা থেকে ভাত নিয়ে আসবে। হোটেলে এসে জিজ্ঞেস করল, ভাত খাবেন, না অন্য কিছু?
নাসিমা বলল, আমি হোটেলে কোনোদিন ভাত খাইনি। আজ খেয়ে দেখব, হোটেলের রান্না কেমন?
মুবিন নাসিমার জন্য ভাতের অর্ডার দিয়ে নিজের জন্য একটা চা দিতে বলল।
হোটেল থেকে বেরিয়ে মুবিন বলল, কোথায় যেন যাবেন বলছিলেন?
যদি বলি বাসায়।
আপত্তি নেই, তবে কথাটা ঠিক বলেননি।
আপনার অনুমান ঠিক। কোথায় যাব, সেটাও অনুমান করে বলুন।
মুবিন বুঝতে পারল, নাসিমা তাকে নিয়ে বেড়াবে বলে এসেছে। তাই দুষ্টুমী করে বলল, মনে হচ্ছে, চোর জানতে পেরেছে ধরার ব্যবস্থা হচ্ছে। তাই শাস্তির ভয়ে ধরাপড়ার আগে দোষ স্বীকার করতে এসেছেন।
নাসিমা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, চোরের বয়েই গেছে দোষ স্বীকার করতে। তারপর বলল, চলুন নদীর ধারে বেড়াতে যাই।
দুটো শর্তে যেতে পারি।
আগে শর্ত দুটো বলুন। তারপর ওয়াদা করব।
একটা হল, প্রতিদিন পাঁচটার সময় ব্যাংকের গেটে আসবে, অন্যটা হল, এখন থেকে তুমি করে বলবে।
নাসিমা বলল, বিয়ে না করেই বৌ পেতে চাচ্ছেন?
তা হলে চল এক্ষুনি কাজি অফিসে যাই।
নাসিমা হেসে উঠে বলল, তা সম্ভব নয়, ভাইয়া মনে ভীষণ ব্যাথা পাবে, তারপর বলল, ঠিক আছে, দুটো শর্তই মেনে নিলাম।
.
১০.
গুপ্তগঞ্জের রাস্তায় আতাহারের সঙ্গে শবনমের দেখা হওয়ার পর আজ পনের দিন হতে চলল আর দেখা হয়নি। শবনম মনে করল, দেখা করার কোনো উপায় না পেয়ে আতাহার ঢাকায় চলে গেছে। তবু একদিন মেজ ভাইকে আতাহারের কথা জিজ্ঞেস করল।
নাসির উদ্দিন বলল, আমার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। শুনেছি দশ বার দিন আগে ঢাকায় চলে গেছে।
শুনে শবনমের চোখে পানি এসে গেল। মুখ নিচু করে তার কাছ থেকে সরে গেল।
এর দুদির পর আলমাস চৌধুরী হুজুরের হুকুমে শবনমদের বাড়িতে এসে উঠানের পাশে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন, সাখাওয়াত সাহেব বাড়িতে আছেন?
তখন বাড়িতে কেউ ছিল না। শবনম আর তার মা ছিল। আব্বার নাম ধরে বাড়ির বাইরে কেউ ডাকছে শুনে শবনম মাকে বলল, কেউ যেন আব্বাকে ডাকছে।
যুবাইদা খানম বললেন, গায়ে মাথায় ভালো করে কাপড় দিয়ে গিয়ে দেখে আয়।
শবনম গায়ের ওড়না দিয়ে মাথা ও শরীর ঢেকে বেরিয়ে এসে আলমাসকে চিনতে পারল। খুব অবাক হয়ে সালাম দিয়ে বলল, চাচা আপনি?
হ্যাঁ মা, তুমি তা হলে সাখাওয়াত সাহেবের মেয়ে?
জ্বি।
চৌধুরী হুজুর তোমার আব্বাকে দেখা করতে বলেছেন?
আব্বা তো বাড়িতে নেই। চিটাগাং এ থাকেন।
চৌধুরী হুজুর বলেছেন, উনি বাড়িতে না থাকলে বাড়িতে আসার পর যেন ওনার সঙ্গে দেখা করেন।
ঠিক আছে বলব। তারপর বলল, আপনি বসুন চাচা।
না মা বসতে পারব না। চৌধুরী হুজুর খবরটা দিয়েই চলে যেতে বলেছেন। কথা শেষ করে আলমাস চলে গেল।
শবনম মায়ের কাছে এসে আলমাস যা যা বলে গেল, তা বলল।
যুবাইদা খানম স্বামীর কাছে চৌধুরী হুজুর যে বুজুর্গ লোক, তা শুনেছেন। বললেন, তোর আব্বা হয়তো সামনের সপ্তাহে আসবে। আমার মনে থাকে কি না থাকে, তুই মনে করে বলিস।
সেই দিন বিকেলেই সাখাওয়াত হোসেন বাড়ি এলেন। ছেলের বিয়ের আর মাত্র দশ দিন বাকি। তাই এক মাসের ছুটি নিয়ে এসেছেন। সামসুদ্দিনকেও সঙ্গে আনতে চেয়েছিলেন; কিন্তু এত আগে সে ছুটি পেল না। বিয়ের তিন দিন আগে আসবে।
সন্ধ্যের পর যুবাইদা খানম চৌধুরী হুজুরের ডেকে পাঠাবার কথা স্বামীকে বললেন।
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, উনি তা হলে এখন এখানে আছেন। কাল সকালেই ওঁর কাছে যাব। সামসুদ্দিনের বিয়ের কথা বলে দাওয়াতও দেব।
পরের দিন নাস্তা খেয়ে চট্টগ্রাম থেকে আনা কিছু ফল ও মিষ্টি নিয়ে সাখাওয়াত হোসেন চৌধুরী হুজুরের কাছে গেলেন।
সালাম বিনিময়ের পর চৌধুরী হুজুর তাকে বসতে বলে বললেন, আপনি শবনমের বিয়ের ব্যাপারে কোনো চেষ্টা করবেন না। আল্লাহপাক যখন রাজি হবেন তখন হবে।
সাখাওয়াত হোসেন অবাক হয়ে বললেন, হুজুর আমার মেয়েকে চেনেন দেখছি? তারপর বললেন, তাই হবে হুজুর।
চৌধুরী হুজুর বললেন, আর একটা কথা, এই ব্যাপারটা কাউকে বলবেন না। এমন কি আপনার স্ত্রী বা ছেলে মেয়েদেরকেও না। এবার আপনি আসুন।
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, হুজুর আমার বড় ছেলে সামসুদ্দিনের চৌদ্দ দিন পর বিয়ে। যদি মেহেরবানী করে দাওয়াত কবুল করতেন।
চৌধুরী হুজুর আলহামদুলিল্লাহ বলে বললেন, দাওয়াত কবুল করা সুন্নত। আল্লাহপাক যদি অতদিন আমাকে এখানে রাখেন, তা হলে ইনশাআল্লাহ যাব।
সাখাওয়াত হোসেন সালাম বিনিময় করে চলে এলেন। আসার পথে চিন্তা করলেন, উনি শবনমকে চিনলেন কেমন করে? আবার তার বিয়ে না দিতে এবং ওঁর কথা কাউকে বলতেও নিষেধ করলেন। তা হলে কি ওঁর হাতে কোন পাত্র আছে? যাই হোক হুজুর যখন বলেছেন তখন নিশ্চয় এর ভিতর কোনো ভেদ আছে।
শবনম নাসির উদ্দিনের মুখে আতাহারের ঢাকা চলে যাবার কথা শুনে সেই দিনই চিঠি লিখে তাকে পোস্ট করতে দেওয়ার সময় বলল, তোর নামে চিঠি দিতে বলেছি। চিঠি এলে আমাকে দিবি। কিন্তু এক মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও চিঠির উত্তর এল না। এই ভাবে তিন মাস চিঠি দিয়েও যখন আতাহারের কাছ থেকে কোনো উত্তর পেল না। তখন খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। নাসির উদ্দিনকে প্রায় চিঠির কথা জিজ্ঞেস করে।
নাসির উদ্দিন বলে, আতাহার ভাই চিঠি দেয়নি। দিলে তোকে ঠিক দিতাম।
এদিকে এস, এস, সির রেজাল্ট বেরোল। শবনম ও নাসির উদ্দিন ফাষ্ট ডিভিসনে পাশ করেছে। নাসির উদ্দিন দৌলতখান আবু আব্দুল্লাহ কলেজে আর শবনম দৌলতখান মহিলা কলেজে ভর্তি হল।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর শবনম আতাহারকে চিঠি দিয়ে তার কলেজের ঠিকানায় চিঠি দিতে জানাল। ভেবেছিল, নাসির উদ্দিন হয়তো তার চিঠি মেরে দেয়। এবার নিশ্চয় আমি পাব। কিন্তু মাস গড়িয়ে বছর পার হয়ে যেতেও যখন আতাহারের চিঠি পেল না তখন তার মনে সন্দেহ হল। ভাবল, তা হলে কি সে আমাকে ভুলে গেল। কথাটা ভেবে মনে ভীষণ ব্যথা পেল। চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। তকদিরের কথা চিন্তা করে অনেকক্ষণ কাঁদল। তারপর আল্লাহকে জানাল, আল্লাহ তুমি আমার তকৃদিরে যদি এটাই লিখে রেখেছিলে, তা হলে আতাহারকে ভালবাসার সুযোগ কেন দিলে? একদিন নাসির উদ্দিনকে বলল, আতাহার ভাই বাড়িতে এলে তোর সঙ্গে দেখা হয়?
নাসির উদ্দিন বলল, হয়, তবে আমাকে দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। একদিন তাকে বলেছিলাম, আমি কি তোর দুশমন। আমাকে দেখলে তুই মুখ ঘুরিয়ে চলে যাস কেন? বলল, তোর কোনো কথার উত্তর দিতে পারব না বলে চলে যাচ্ছিল। আমি তার পথ আগলে বললাম, আমার কথার উত্তর না হয় নাই দিতে পারলি; কিন্তু আজ এক বছর হয়ে গেল, শবনমের চিঠির উত্তর দিস না কেন? তোর কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বলল, সে কথাও বলতে পারব না। তারপর হন হন করে চলে গেল। আমার মনে হয়, এমন কিছু একটা হয়েছে, যে জন্যে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
শবনম বলল, খেয়াল রাখবি, এবারে আতাহার ভাই এলে যেমন করে হোক তার সঙ্গে আমার দেখা করতেই হবে। আর সে ব্যাপারে তোকে সাহায্য করতে হবে।
আতাহার নাসির উদ্দিনকে এড়িয়ে চললেও এবং নাসির উদ্দিন তার বোনদের পড়ান বন্ধ করে দিলেও সে স্কুলে কুলসুমের সঙ্গে দেখা করে। একদিন আতাহারের কথা জিজ্ঞেস করতে কুলসুম বলল, বেশ কিছুদিন থেকে ভাইয়া যেন কেমন হয়ে গেছে। বাড়িতে এসে কোথাও যায় না। এমন কি মসজিদেও নামায পড়তে যায় না। দুএকদিন থেকে চলে যায়। সব সময় গম্ভীর হয়ে থাকে। আমাদের সঙ্গেও আগের মত হেসে কথা বলে না। ভাইয়ার পরিবর্তন দেখে আম্মা একদিন জিজ্ঞেস করতে বলল, আমি একটা সাধনা করছি। তুমি দোয়া কর, আল্লাহ যেন আমাকে সফলতা দেন। আম্মা বলল, তা না হয় দোয়া করব; কিন্তু তুই বাড়িতে দুএকদিনের বেশি থাকতে চাস না কেন? ভাইয়া বলল, বেশি দিন ছুটি পাই না তাই। সেদিনের পর থেকে নাসির উদ্দিন কুলসুমকে আর আতাহারের কথা জিজ্ঞেস করেনি। তবে তার ও খদিজার পোষাক পরিচ্ছদ দেখে বুঝতে পারে। আতাহারের আয় বেড়েছে। এখন শবনমের কথা শুনে বলল, ঠিক আছে চেষ্টা করব।
পরের দিন নাসির উদ্দিন স্কুলে গিয়ে কুলসুমকে বলল, আতাহার বাড়িতে এলে আমাকে বলবে, আমি তার সাথে দেখা করব।
কুলসুম বলল, ভাইয়াতো আজ এসেছে। কাল হয়তো চলে যাবে।
নাসির উদ্দিন বলল, তা হলে তো আজকেই তার সঙ্গে দেখা করতে হয়?
কুলসুম বলল, আমি কি তোমার কথা ভাইয়াকে বলব।
না, তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি সন্ধ্যের পর তোমাদের বাড়িতে যাব। এখন আসি বলে নাসির উদ্দিন চলে এল।
বাড়িতে এলেই শবনমকে দেখার জন্য আতাহারের মন পাগল হয়ে উঠে। তাই বেশি দিন থাকে না। মসজিদ শবনমদের ঘরের কাছে। নামায পড়তে গেলে শবনমের ভাই-বোনর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া নাসির উদ্দিন যদি নামায পড়তে আসে, তবে তার সাথে দেখা হবেই। এই সব কারণে মসজিদে না গিয়ে সে ঘরেই নামায পড়ে। আজ মাগরিবের নামায পড়ে কুলসুম ও খাদিজাকে পড়াচ্ছিল। এমন সময় নাসির উদ্দিনের গলা শুনতে পেল, আতাহার ঘরে আছিস? আতাহার চমকে উঠল। ভাবল, নিশ্চয় শবনম পাঠিয়েছে। তার সঙ্গে দেখা করবে কিনা চিন্তা করতে লাগল। নাসির উদ্দিনের গলা আবার শুনতে পেল, আতাহার আমি নাসির উদ্দিন, ঘরে থাকলে একটু বাইরে আয়। আতাহার বেরিয়ে এল।
তাকে দেখে নাসির উদ্দিন সালাম দিল।
আতাহার সালামের জওয়াব দিয়ে বলল, চল বাইরে কোথাও বসি।
ওদের বাড়ির অল্প দূরে ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা। তারপর ধানের মাঠ। রাস্তায় এসে নাসির উদ্দিন বলল, তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে, মাঠে গিয়ে বসি চল।
মাঠে এসে দুবন্ধুতে আজ প্রায় দেড় বছর পর মুখোমুখি বসল। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। আকাশে পঞ্চমীর চাঁদ। তার আলোতে নাসির উদ্দিন দেখল আতাহারের চোখে পানি চিক চিক করছে। বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, উত্তর দিবি?
আতাহার মাথা নেড়ে অস্বীকৃতি জানাল।
বাল্যবন্ধু হয়েও কি তোর ভালো-মন্দের কথা জিজ্ঞেস করতে পারি না? কি হয়েছে যদি বলতিস, তা হলে সাহায্য করতে না পারলেও মনে কিছুটা স্বস্তি পেতাম।
আতাহার চোখ মুছে বলল, বলার মতো হলে নিশ্চয় বলতাম। বাল্য বন্ধুর দাবিতে আমি তোর কাছে দাবি করছি, আমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করবি না। আর …….।
নাসির উদ্দিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কিন্তু শবনম যে তোর চিন্তায় নিজে যেমন পাগল হচ্ছে তেমনি আমাকে তোর কথা জানার জন্য অস্থির করে তুলছে। ভালো হোক আর মন্দ হোক, কলেজে ওকে চিঠি দিয়ে জানা। এই দেড় বছরে তোকে পাগলের মত চিঠি দিয়ে যাচ্ছে, আর তুই কিনা তাকে একটারও উত্তর দিসনি। আমার তো ভয় হয়। শবনম আত্মহত্যা না করে ফেলে। আচ্ছা, তোদের মধ্যে কি কোনো ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে? অথবা কোনো ঝগড়া।
আতাহার তার মুখে হাত চাপা দিয়ে ভিজে গলায় বলল, তুই চুপ কর নাসির তুই চুপ কর। আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি। আর শবনম কিছুতেই আত্মহত্যা করতে পারে না। আমি বলছি বলে বলবি না। তুই তাকে বলবি, ধৈৰ্য্যই সাফল্যের চাবি। কিন্তু সে তোর সঙ্গে অন্ততঃ একবারের জন্য হলেও দেখা করতে চায়।
না-না, তা কখনই সম্ভব নয় বলে আতাহার দ্রুত উঠে হন হন করে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।
নাসির উদ্দিন তার পিছু নিয়ে বলল, আতাহার যাসনে শোন।
আতাহার যেতে যেতেই বলল তুই চলে যা, আমার কাছে আর আসবি না।
নাসির উদ্দিন ঘরে এসে সব কথা শবনমকে বলল।
শবনম শুনে ফুঁপিয়ে উঠল।
নাসির উদ্দিন বলল, কাঁদছিস কেন? সে তোকে শুধু বলতে বলল, ধৈৰ্য্যই সাফল্যের চাবি।
শবনম সামলে গিয়ে বলল, হ্যাঁ কথাটা আতাহার ভাই প্রায় আমাকেও বলত।
সেইদিন রাতে শবনম আতাহারকে শেষ বারের মতো চিঠি লিখতে বসল।
আতাহার ভাই,
প্রথমে তোমার পদপ্রান্তে শত কোটি সালাম ও অন্তর উজাড় করে ভালবাসা জানালাম। এই দেড় বছর ধরে তোমাকে যে কত চিঠি দিয়েছি, তা তুমিও জান। এটাই হয়তো তোমার কাছে আমার শেষ চিঠি। আজ মেজ ভাইয়ের কাছে তোমার সব কথা শুনলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। কেন যে তুমি নীরব হয়ে গেলে আল্লাহ মালুম। আমাকে কোনো কারণে ঘৃণা করে মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছ কিনা অথবা অন্য কোনো কারণে তোমার এই নীরবতা, তা জানার বড় ইচ্ছা হয়। জানি এই চিঠির উত্তরও আমি পাব না। কারণ আমার মন বলে, এই দেড় বছরে যত চিঠি তোমাকে দিয়েছি সেগুলো পড়নি। হয় জ্বালিয়ে ফেলেছ, না হয় ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছ।
যা কিছুই কর না কেন? আমি তোমার কথা আমরণ মনে রাখব। আল্লাহ ছাড়া কোনো মানুষ আমাকে আমার সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পারবে না। যে উদ্দেশ্যে তুমি নীরব হয়ে গেছ, সেই উদ্দেশ্য আল্লাহ তোমার পূরণ করুক, এই দোয়া চেয়ে শেষ করছি-আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
তোমার শুধু তোমারই শবনম।
এতদিন শবনম যত চিঠি দিয়েছে, আতাহার একটাও পড়েনি। সব বাক্স বন্দী করে রেখেছে। কারণ পড়লে শবনমের চিন্তা তাকে পাগল করে দেবে। তাই শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মনকে শক্ত করে বাক্সে তুলে রাখে আর ভাবে, আল্লাহ যে দিন তাদের মিলনের বাধা দূর করে দেবেন, সেদিন শবনমকে দিয়েই তার চিঠি পড়াবে। এবারে ঢাকায় ফিরে শবনমের এই চিঠিটাও বেদনা ভরা মনে আগের গুলোর সঙ্গে রেখে দিল।
.
১১.
চার বছর পরের ঘটনা। নাসির উদ্দিন বি, এ, পাশ করে তার বাবার পোস্টে কাজ করছে। সাখাওয়াত হোসেন রিটায়ার্ড করে দৌলতখান বাজারে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর দিয়েছেন। সামসুদ্দিন তিন বছরের একটা ছেলে ও এক বছরের একটা মেয়ের জনক হয়েছে। কলিম উদ্দিন এ বছর কলেজে ভর্তি হয়েছে। আসমা নাইনে পড়ছে। শবনমের সঙ্গে আতাহারের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। সে কথা তাদের দুই পরিবারের সবাই জেনে। গেছে। স্বামীকে শবনমের বিয়ের ব্যাপারে যুবাইদা খানম বার বার বলেন। সাখাওয়াত হোসেন মিথ্যে করে বলেন, চেষ্টা তো কম করছি না। কিন্তু ভালো ছেলে তো পাওয়া যাচ্ছে না। উনি মাঝে মাঝে কলাকোপায় গিয়ে চৌধুরী হুজুরের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু সাহস করে শবনমের বিয়ের কথা বলতে পারেন না। চৌধুরী হুজুরও কিছু বলেন না। মজিদ শালীর জন্য এবং সামসুদ্দিন বোনের বিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করছে, কিন্তু শবনমের উপযুক্ত কোনো ছেলে পাচ্ছে না।
এতদিনে কুলসুমের সঙ্গে নাসির উদ্দিনের সম্পর্ক আরো গম্ভীর হয়েছে। সে কথা এরা দুজন ছাড়া অন্য কেউ না জানলেও শবনম জানে। শবনম বি, এ, পাশ করার পর আব্বা বড় ভাই ও মেজ ভাইয়ের সাহায্যে উঠোনের একপাশে ঘর উঠিয়ে বয়স্ক মেয়েদের জন্য একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছে। সেখানে গ্রামের মেয়েদেরকে ইসলামিক জীবন পদ্ধতি শিক্ষা দেয়। সেই সঙ্গে কোরআন ও নামায পড়া শেখায়। কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ায় এবং বিভিন্ন মাসালা-মাসায়েলও শিক্ষা দেয়।
আতাহার চৌধুরী হুজুরের কথা মতো চলে বি, এ, পাশ করার পর আগের অফিসেই উঁচু পদে চাকুরী করছে। ঘরের সংস্কার করিয়েছে। কুলসুম কে এস, এস, সি পাশ করার পর কলেজে ভর্তি করে দিয়েছে। খদিজা এইটে পড়ছে। আর তার ছোট ভাই আনোয়ার এ বছর সেভেনে উঠেছে।
এবারে বাড়িতে এসে আতাহার শুনল, নদীতে চর জেগেছে। সরকার থেকে চরের জমি বিলি হচ্ছে। যাদের জমি জায়গা সেখানে ছিল, তারা চরের দখল নেবার জন্য। সরকারী লোকের কাছে কাগজ-পত্র নিয়ে ছুটোছুটি করছে। চৌধুরী হুজুর আতাহারকে জানিয়েছিলেন, আমি না জানান পর্যন্ত তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে না। এই প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরের মধ্যে উনি পাঁচ বার দেখা করতে বলেছিলেন। এখন চরের জমির ব্যাপারে ওঁর সঙ্গে পরামর্শ করবে কিনা দুদিন ধরে চিন্তা করে কাটাল।
তৃতীয় দিন সকালে নাস্তা খেয়ে উঠেছে এমন সময় ছোট ভাই আনোয়ার এসে বলল, আলমাস নামের একজন লোক আপনাকে ডাকছে।
আতাহার বাইরে এসে আলমাস কে দেখে সালাম দিয়ে বলল, কি খবর চাচা।
আলমাস সালামের উত্তর দিয়ে বলল, তোমাকে চৌধুরী হুজুর দেখা করতে বলেছেন। উনি এখন কলাকোপায় আছেন। একজন লোক এসে খবরটা দিয়ে গেল। আমি খবরটা পেয়েই তোমাকে বলতে এলাম।
আতাহার বলল, ঠিক আছে চাচা, এক্ষুণি আমি রওয়ানা দেব। আপনি বসবেন আসুন, এক কাপ চা খেয়ে যাবেন।
আলমাস বলল, না বাবা, এখন চা খাবার সময় নেই। আরো এক জায়গায় যেতে হবে।
আতাহার আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করে ঘরে এসে মাকে চৌধুরী হুজুরের ডেকে পাঠাবার কথা বলে কলাকোপায় রওয়ানা দিল।
আতাহার চৌধুরী হুজুরের বাড়িতে পৌঁছে দেখল, অনেকে বসবার রুমে বসে রয়েছেন। প্রতিদিন যারা ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আসেন, খাদেম তাদেরকে একটা রুমে বসিয়ে চা-নাস্তা খাওয়ায়। তারপর একজন একজন করে সিরিয়াল মত পাশের রুমে হুজুরের সঙ্গে দেখা করে। পাঁচ জনের পর আতাহরের সিরিয়াল এল। আতাহার রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে কদমবুসি করল।
চৌধুরী হুজুর সালামের উত্তর দিয়ে দোয়া করে বললেন, নদীতে চর জেগেছে। এর মধ্যে অনেকে কাগজ পত্র দেখিয়ে দখল পেয়েছে। তুমিও তাই কর। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আল্লাহপাকের ইচ্ছায় এখন তুমি স্বাবলম্বি হয়েছ। দোয়া করি, আল্লাহ আরো ত্বরক্কী দিক। তোমাকে মানুষের মত মানুষ করার জন্য যে সব শর্ত দিয়েছিলাম তা রহিত করা হল। এখন থেকে তুমি স্বাধীন। তবে বিয়ের আগ পর্যন্ত তুমি শবনমের সঙ্গে দেখা করবে না। তবে চিঠি পত্র দিতে পার। আর ইনশাআল্লাহ তোমাদের বিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে হবে। তুমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছ, চাকরি করছে শুনে খুশি হয়েছি। দোয়া করি, ভবিষ্যতে দুনিয়াবী ও আখেরাতের সমস্ত পরীক্ষায় তোমাকে আল্লাহ উত্তীর্ণ করাক। এবার তুমি এস।
কৃতজ্ঞতায় আতাহারের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। চোখ মুছে কদমবুসি করে বলল, আবার কবে আপনার সঙ্গে দেখা করব?
চৌধুরী হুজুর মৃদু হেসে বললেন যখন আল্লাহ পাকের মর্জি হবে। সব সময় মনে রাখবে, আল্লাহ পাকের মর্জি ছাড়া দুনিয়াতে কোনো কিছুই হয় না। এবার তুমি যাও, আরো অনেকে অপেক্ষা করছে।
আতাহার সালাম দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসে বসবার রুমে সাখাওয়াত হোসেনকে দেখতে পেল। উনি তখন হুজুরের রুমে ঢুকতে যাবেন বলে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আতাহার সালাম দিয়ে বলল, চাচা আপনি? কেমন আছেন?
সাখাওয়াত হোসেন সেই ছোট বেলায় আতাহারকে দেখেছিলেন। তারপর এতদিন আর দেখেননি। তাই চিনতে পারলেন না। সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাকে তো আমি চিনতে পারছি না।
আতাহার বলল, আমাকে চিনতে পারলেন না চাচা? আমি আতাহার, মোজাম্মেল খন্দকারের ছেলে।
সাখাওয়াত হোসেন খুব অবাক হয়ে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে লাগলেন। সেই একটু খানি ছেলে আজ কত সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান হয়েছে। বললেন, ঠিক আছে, তুমি একদিন দোকানে আমার সঙ্গে দেখা করো। তারপর হুজুরের রুমে ঢুকে সালাম দিলেন।
চৌধুরী হুজুর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আতাহারের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
এই কথা শুনে সাখাওয়াত হোসেন অবাক হয়ে বললেন, জ্বি হয়েছে।
কেমন দেখলেন?
সাখাওয়াত হোসেন থতমত খেয়ে বললেন, জ্বি? জ্বি ভালো।
এখন তা হলে আর ওর সঙ্গে শবনমের বিয়ে দিতে অমত করবেন না?
আতাহারকে চিনতে পারার পর সাখাওয়াত হোসেন বেশ অবাক হয়েছিলেন। এখন হুজুরের কথা শুনে আরো বেশি অবাক হয়ে হাঁ করে হুজুরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
চৌধুরী হুজুর বললেন, অত অবাক হচ্ছেন কেন? আল্লাহ পাকের ঈশারা মানুষের বোধগম্য নয়। আমি একদিন আপনাকে শবনমের বিয়ে দিতে নিষেধ করেছিলাম। আজ ডেকে পাঠিয়েছি, বিয়ে দেওয়ার জন্য। আর পাত্র হল আতাহার। সে এখন বি, এ, পাশ করে চাকরি করছে। তার মতো ছেলে আর পাবেন না। শবনম সুখী হবে। আর শুনুন, আপনি তো চরের জমি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন, সেই সঙ্গে আতাহার যাতে তার বাবার চরের সম্পত্তি ফিরে পায়, সে জন্য তাকে সাহায্য করবেন। আতাহার ছেলে মানুষ। কাগজপত্র তেমন বুঝবে না। আপনি সাহায্য করলে অনেক উপকার হবে।
সাখাওয়াত হোসেনের বরাবর ইচ্ছে ছিল, আতাহারের সঙ্গে শবনমের বিয়ে দেওয়ার। স্ত্রী ও বড় মেয়ে এবং বড় ছেলের কথার চাপে সে কথা প্রকাশ করতে পারেননি। তার উপর আতাহারের নামে নানা রকম দুর্নাম শুনে মন ভেঙ্গে গিয়েছিল। এখন চৌধুরী হুজুরের কথা শুনে বুঝতে পারলেন, কেন উনি শবনমের বিয়ে দিতে নিষেধ করেছিলেন। হয়তো এটাই আল্লাহ পাকের ঈশারা। বললেন, আপনি যা বলবেন তাই করব হুজুর।
যা বলার আমি বলেছি। এবার আপনি আসুন।
ওদের বিয়ের সময় আপনাকে থাকতে হবে।
খবর দেবেন, আল্লাহপাক রাজি থাকলে নিশ্চয় থাকব।
চৌধুরী হুজুরের কথা শোনার পর থেকে আতাহারের মনে আনন্দের বান বইতে শুরু করেছে। ফেরার সময় সারা পথ শবনমের চিন্তায় ডুবে রইল। বাস থেকে দৌলতখান নেমেই মসজিদে গিয়ে শোকরানার নামায পড়ল। তারপর বাড়িতে এল।
রফিকা বেগম অনেক দিন ছেলের মুখে হাসি দেখেননি। আজ আগের মতো তার মুখে হাসির আভা দেখে খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, চৌধুরী হুজুর ডেকেছিলেন কেন?
আতাহার কি বলবে কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, উনি আমাকে খুব স্নেহ করেন। তোমাকে বলিনি, উনি মাঝে মাঝে আমাকে ডেকে পাঠাতেন এবং আমি গেলে অনেক সৎ উপদেশ দিতেন। আজও সেজন্যে ডেকেছিলেন। বিয়ের কথাটা লজ্জায় বলতে না পেরে মাথা নিচু করে নিল।
তাকে লজ্জা পেতে দেখে ও তার কথা শুনে রফিকা বেগমের মনে সন্দেহ হল। ভাবলেন, শুধু ভালো উপদেশ শুনে আতাহার এত খুশি হতে পারে না এবং মুখেও লজ্জা ফুটে উঠতে পারে না। নিশ্চয় উনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা লজ্জায় বলতে পারছে না। বললেন, তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু তুই এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আমি তোর আম্মা, আমার কাছে বলতে তোর লজ্জা কিসের?
আতাহার বলল, উনি এবার আমাকে বিয়ে করতে বললেন?
রফিকা বেগম হেসে ফেলে বললেন, এই কথায় এত লজ্জা পাবার কি আছে? উনি ভালো কথাই বলেছেন। কয়েকদিন আগে ফজল ঘটক এসেছিল। আমিও এবার তোর বিয়ের কথা চিন্তা করে তাকে ভালো মেয়ে দেখতে বলেছি।
আতাহার বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, চৌধুরী হুজুর বললেন, মেয়ের বাবা নাকি নিজেই প্রস্তাব নিয়ে আসবেন। আমার কি মনে হয় জান আম্মা, উনি হয়তো কোনো মেয়ের বাবাকে পাঠাবেন।
রফিকা বেগম বললেন, তা হলে তো ভালই হল। উনার পছন্দের উপর তো কোনো কথাই নেই।
আজ আলমাস আতাহারকে চৌধুরী হুজুরের ডেকে পাঠানোর কথা বলে সাখাওয়াত হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তাকেও একই কথা বলেছিল। কলাকোপা যাওয়ার সময় তিনি স্ত্রীকে সে কথা বলে গিয়েছিলেন।
স্বামী ফিরে আসার পর যুবাইদা খানম জিজ্ঞেস করলেন, চৌধুরী হুজুর ডেকেছিলেন কেন?
সাখাওয়াত হোসেন কি বলবেন, আসার পথে ভেবে রেখেছিলেন। বললেন, তিনি আমাদের পরিবারের সব খবর জানেন। শবনমের বিয়ে যাতে তাড়াতাড়ি হয় সে জন্যে তদবিরের কথা বলতে বললেন, তদবির লাগবে না। আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় অতি সত্ত্বর ওর বিয়ে হবে। তারপর আতাহারের কথা বলে বললেন, শবনমের উপযুক্ত হল আতাহার। আল্লাহ চাহে তো আপনার মেয়ে সুখী হবে। আমাকে চিন্তিত দেখে আবার বললেন, চিন্তা করছেন কেন? আপনারা হয়তো জানেন না, আতাহার বি, এ, পাশ করে ভালো চাকরি করছে। এই জমানায় ওর মতো ভালো পাত্র আর পাবেন না। আপনি নিজেই প্রস্তাব নিয়ে যাবেন। আরো বললেন, আতাহারের বাবার চরের জমির ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে।
স্বামীর কথা শুনে যুবাইদা খানম এত অবাক হলেন যে, কোনো কথা বলতে পারলেন না। এক দৃষ্টে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সাখাওয়াত হোসেন মৃদু হেসে বললেন, তুমি খুব অবাক হচ্ছ, তাই না? হওয়ারই কথা। চৌধুরী হুজুরের কথা শুনে আমার অবস্থাও তোমার মতো হয়েছিল। আমি চিঠি দিয়ে সামসুদ্দিন, নাসির উদ্দিন, খালেদা ও জামাইকে আসতে বলি। তাদেরকে চৌধুরী হুজুরের কথা বলে তাড়াতাড়ি শবনমের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
শবনমও জানত, আব্বা চৌধুরী হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। তাই ফিরে এসে আম্মার সঙ্গে কথা বলতে দেখে দরজার আড়াল থেকে এতক্ষণ তাদের কথাবার্তা শুনছিল। ঐ পর্যন্ত শুনে সে আর স্থির থাকতে পারল না। নিজের রুমে এসে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বেশ কিছুক্ষণ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করল। তারপর দুরাকায়াত শোকরানার নামায পড়ে চিন্তা করল, আতাহার ভাই তা হলে আমাকে পাওয়ার জন্য এতদিন সাধনা করেছে। কিন্তু আমার দেওয়া কয়েকশ চিঠির উত্তর দিল না কেন? অন্ততঃ একটা চিঠি দিয়ে আমাকে জানাতে পারত। নাসির উদ্দিন তো আমাদের সম্পর্কের কথা জানে, তার কাছেও বলতে পারত।
মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে কয়েকশো চিঠি দিয়ে যখন শবনম একটা চিঠিরও উত্তর পেল না। তখন মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে মনের কামনা-বাসনা জানিয়েছে এবং সবর করার তওফিক চেয়েছে। আজ আব্বার মুখে তার কথা এবং তার সঙ্গে বিয়ের কথা শুনে একদিকে যেমন আনন্দে আত্মহারা হল, অপর দিকে তেমনি চিঠির উত্তর না দেওয়ার জন্য আতাহারের উপর প্রচন্ড অভিমান হল। ভেবে রাখল, আল্লাহপাকের ঈশারায় সময় হলে এর প্রতিশোধ নেবে।
আতাহার এশার নামায পড়ে খাওয়া দাওয়ার পর শবনমকে চিঠি লিখতে বসল।
প্রাণ প্রিয়া শবনম,
প্রথমে আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে প্রেম, প্রীতি ও ভালবাসা গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করো। আজ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর কেন তোমাকে চিঠি লিখছি তা চিঠিটা পড়লেই বুঝতে পারবে। এই পাঁচ বছর ধরে তুমি আমাকে যে কয়েকশ চিঠি দিয়েছ, সেগুলো পড়া তো দূরের কথা একটার মুখও না খুলে রেখে দিয়েছি। আল্লাহপাক রাজি থাকলে, তোমার সামনে খুলে পড়ব। কেন চিঠিগুলো পড়িনি সে কথা বলতে আমি অপারগ। সে জন্য এবং তোমার সঙ্গে এতদিন কোনো যোগাযোগ না রেখে যে অপরাধ করছি, তার জন্যও ক্ষমা চাইছি। আমি জানি তুমি আমার উপর যতই রাগ বা অভিমান করে থাক না কেন? এই চিঠি পাওয়ার পর সে সব কর্পূরের মত বাতাসে উড়ে যাবে। চিঠিতে বিস্তারিত কিছু লিখব না। শুধু এতটুকু লিখছি, ইনশাআল্লাহ আমাদের মনের বাসনা অতি অল্প সময়ের মধ্যে পূরণ হবে। তার আগে শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তোমার সঙ্গে আমার দেখা করা সম্ভব নয়। আল্লাহ চাহে তো, এবার আর লুকিয়ে দেখা সাক্ষাৎ নয়, একেবারে বিয়ে করে আমাদের বাড়িতে এনে বাসর ঘরে সারারাত তোমাকে দেখব। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও আমি জানি, আমার মতো তুমিও ঐ রাতটার জন্য সবর করে অধীর আগ্রহে দিন যাপন করছ। আল্লাহ তাড়াতাড়ি আমাদের মনো বাসনা পূরণ করুক এবং আমাদেরকে সমস্ত বিপদ আপদ থেকে হেফাজত করুক, এই দোয়া করে শেষ করছি-আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
তোমার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক
আতাহার।
চিঠিটা শেষ করে ভেবে রাখল, কাল কুলসুমকে দিয়ে এটা শবনমের কাছে পাঠাবে।
Leave a Reply