ভয়ংকর সুন্দর (কাব্যগ্রন্থ)
উৎসর্গ –
দেশের প্রখ্যাত অর্থোপেডিক্স সার্জন
ডাঃ কে এম সিরাজুল ইসলাম।
যিনি আমার পরম আত্মীয়
যিনি আমার ও আমার স্ত্রীর দ্বিতীয় পিতা।
১. খিলান
কোথায় তোমার রূপ খুঁজি, কোথায় খুঁজি চিম্বুক পাহাড়ের মতো তোমার বুকের ঢাল —
কত অপরূপ রূপ দেখি, তোমার গ্রীবায়, তোমার চিবুকে – বুকের ভিতর থেকে রডোডেনডন গুচ্ছের মৌ-মৌ গন্ধ ভাসে, শঙ্খ নদীর শীতল বাতাসে যেন
রাঙামাটির ধূলো উড়ে..
বলো, কোথায় তোমার লাবণ্যসুধা, কোথায় লুকিয়ে রাখো চিত্রা নদীর বাঁকের মতো দেহবল্লরী!
পূর্ণিমা নিশীথে একবার সুন্দরবনের হিরণ্য পয়েন্টের নির্জনতার ন্যায় পরিভ্রমণ করেছিলাম তোমাকে আবিস্কার করতে … কত নুড়ি পাথর সরিয়ে কত জলজ উদ্ভিদ উপড়ে ফেলে, কত প্রবল স্রোতের বিপরীতে মাস্তুল টেনে মসৃণ পথটি আমাকে তৈরি করতে হয়েছিল…
আর একবার তোমাকে খুঁজে পেয়েছিলাম চলনবিলের কাদায় লুকিয়ে থাকা মুক্তার মতো, পলিকাদা ছানতে হয়েছিল সকাল দুপুর! মুক্তা খুঁজতে যেয়ে দেখি– বিলের পাড়ে ঐপাশটায় পলাশ ফুটে আছে, আমি একবার মুক্তা ধরি, আর একবার পলাশ…
কোন্ কাদায় মুক্তা থাকে তাও জেনেছিলাম ঐসময়ে, কোথায় ফুটে থাকে রক্তিম পলাশ তাও জেনে নিয়েছিলাম–
এইসবের ভিতর আমাকে চিনে নিতে হয়েছিল দীপ্ত এক দিগাঙ্গনাকে– কী যে উন্মুখ করত তোমার চুল, ভ্রু, পরনের শাড়ি, কানের দুল — তোমার ঘর, ঘরের দরজা ও খিলান।
২. মিথ্যা নয়
বসন্তে পাতা ঝরে, বসন্তেই আবার নতুন করে পল্লবিত হয় বৃক্ষ — ভালোবাসা চলে গেলে ভালোবাসা আসে,
রাজা থাকলে যেমন রানী আসে —
আসলে কথাটা কেমন হলো! কথাটা হবে — সব ভালোবাসাই মিথ্যা হয়না।
এক কমলিত ঊষা প্রহরে কেউ একজন বিগলিত প্রেমকণ্ঠে বলেছিল — ‘জীবন জীবনকাল আমি তোমার হয়ে থাকব।’ এরপর রুপালি জলের ঢেউ তুলে কত ভালোবাসা সে ঢেলে দিল।
তারপর সে একদিন চলে গেল সব স্রোতধারা থামিয়ে দিয়ে। কিন্তু তার রেখে যাওয়া ভালোবাসা কী সে নিয়ে যেতে পেরেছে?
আসলেই পারে নাই —
ভালোবাসার চুম্বন, আলিঙ্গন, নিমগ্ন প্রেমময় মুহূর্তগুলি কেউ কখনও ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে না, এই ভালোবাসাগুলি কখনও মিথ্যা হয় না।
৩. চলে যাব একদিন
নীল আকাশের ছায়াতল দিয়ে,
বেতস ঝাড়ের পাশ দিয়ে,
মেঠো পথে হেঁটে যেতে যেতে আবারও গন্ধ নিতে মন চায় ভাঁটফুল আর আমলকির।
যদি সেই পথ এখন হয়ে থাকে
লাল ইটের সুড়কি বিছানো কংক্রিটের ,
যদি দেখতে না পাই কোথাও ফুটে নেই ভাঁটফুল, যদি আর গন্ধ না বিলায় আমলকি।
তাতে কী!
হয়তো দেখতে পাব সেখানে —
বেতস বনে জ্বলছে আজও সন্ধ্যা রাতে অসংখ্য জোনাকি।
৪. তুমি ঋদ্ধ হও
তুমি কপালে আঁকো মহাস্থান গড়ের
লাল মাটির টিপ
অভ্রকুচির সৌরভ ছড়াও সারা শরীরে-
আমি সবকিছু গ্রহণ করব
যা কিছু আছে তোমার।
আমিও সব জল, সব শীতল হাওয়া,
সব কদম ফুল, সব বাঁশি, সব বালুকাবেলা–
তোমাকে দিয়ে যাব।
তুমি গ্রহণ করো, তুমি আনন্দ করো,
তুমি ঋদ্ধ হও।
৫. সম্পর্ক নেই
আমাদের আর কোনও সম্পর্ক নেই,
মায়া মমতা, শ্লেশ, আশ্লেশ, ঘৃণা–
শ্রাবণ দুপুরে নিষ্পলক চেয়ে থাকা,
রাতের খুনসুটি কোনও কিছুই নেই।
সহস্র আলোক-বর্ষের ওপার হতে যে আলো এসে
একদিন সরিয়ে দিয়েছিল যাবতীয় অন্ধকার
সে তীর্যক আলোর প্রতিধ্বনিও নেই–
নিঃশেষিত হয়েছে সব বোধ– ফুলের ঘ্রাণ,
সন্ধ্যা ধুপের সুবাস
ভালোবাসার অভিজ্ঞান, সব স্মৃতিচিহ্ন লুপ্ত হয়ে গেছে–
বিমুগ্ধ প্রগাঢ় চুম্বন, উষ্ণতার সব আলিঙ্গন কোনও কিছুই নেই।
৬. রাত্রি নিশীথের সঙ্গীত
পাথরও কোমল ফুল হয়ে ফুটে ওঠে তোমার ভালোবাসায়। আমি সে ফুল সাজিয়ে রাখি পরমানন্দে হৃদয় কুঠিরে।
তুমি গন্ধ ঝরিয়ে যাও,
কী যতনে বুকে তুলে নাও সন্ধ্যা মালতি।
রাতের তারা ঝিলমিল আকাশকে সাক্ষী রেখে,
কী সহজেই তুমি বলতে পারো —
‘আমি তোমাকে ভালবাসি!’
তুমি পূর্ণিমা নিশীথিনী,
তুমি হয়ে ওঠো রাত্রি নিশীথের সঙ্গীত —
যা জীবনব্যাপী শুনি আমি কান পেতে।
৭. ঘুম নেই
সারারাত ঝরেছিল বৃষ্টি-
ঝুমবৃষ্টির শব্দে শুনতে পারিনি কোনও ফুল ফোটার গান
সারারাত তোমার পায়ের শব্দ বাজেনি
জানালায় লাগেনি এসে দমকা হাওয়া–
সারারাত ছিল তোমার পুরনো চিঠির।
স্বপ্ন দেখব বলে যখন ঘুম এসেছিল চোখে
স্বপ্নহীন ছিল সব ঘুম–
কাল সারারাত কোনও ফুলও ফোটেনি,
স্বপ্নও আসেনি।
৮. সেই চোখ
ছোট কাঠের জানালার মধ্য দিয়ে একটি অচিন মুখ দেখতে পাই
মনে হয় তারই মুখ যাকে দেখেছিলাম দেবদারু গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এক বিকালে,
রোদপড়া লজ্জা মাখা এক শিহরণ লাগা ক্ষণ ছিল তখন।
তার মুখ মাঝে মাঝে সত্যি দেখতে পাই
আসলে সেই মুখ কী আমি দেখি?
নাকি কোনও দিন তাকে দেখি নাই,
অন্য কোনও মুখের সাথে না হয় মিলিয়ে নেব সেই মুখ এই জীবনে।
কত মলয় বাতাস বহিতেছে, কত মানুষ আসে এই শহরে, কত ট্রেন, বাস, লঞ্চ এসে ভেড়ে,
কত চিঠি নিয়ে আসে ডাক পিয়ন রঙিন খামে।
সময় পুরনো হয়ে স্নান হয়ে আসে
ঝাপসা হয়ে আসে চোখ, মনে হয় সেই চোখ কোথাও কাঁদছে।
৯. করোনাকালীন কবিতা
আমার ছিল বৃষ্টি নামানোর দায়,
তুমি মেঘ হয়েছ যত
এই শ্রাবণে তোমার আকাশ ভার,
বৃষ্টি কী হবে অবিরত?
এই শহর থেকে তুমি আজ
থাকো অনেক দূরে —
বদ্ধ ঘরে বন্দী আমি মন যে
কেমন কেমন করে।
পায়ের পাতায় লেগে আছে
যাযাবরের বালি
উদাস চোখে মেঘরাগে তোমায়
মনে পড়ে খালি।
১০. নষ্ট হতে চাই না
নষ্ট হতে চাই না প্রিয়তমা
কিছু দহন বুকের তলাতেই পুড়ুক
কিছু মায়া শব্দহীন থাক
কিছু প্রেম জ্বলে ছাই হয়ে উঠুক
ঘৃণা নেই, তবু কিছু অবহেলা থাকুক।
সুদূরের পথে চলে যাব একা
প্রেমহীন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকব নিভৃতে,
ঝরে যাক সকল বসন্ত পাতা
শুধু তার মর্মরধ্বনি বাজুক
তবুও নষ্ট হতে চাই না প্রিয়তমা।
১১. হাজার দিন রাত্রি
হাজার বছর আমরা কেবল গল্প করেছি
হাজার বছর আমরা তাকিয়েছিলাম দুজন দুজনার মুখের দিকে
যদিও আমরা গান শুনতে পারতাম
কবিতা লিখে সময় কাটাতে পারতাম
হাজার বছর আমরা বসে থেকেছি ঘাসের উপর
হাজার বছর নক্ষত্রেরা ঝরে পড়েছে
আমরা ভালবেসে পাথর হতে পারতাম
হতে পারতাম পারিজাত মধুমঞ্জরী
বৃষ্টি হয়েছে কত
তুষার পড়েছে কত
রোদ্দুর লেগেছে কত
জ্যোৎস্না ছুঁয়েছে কত
হাজার বছর আমরা জেগেই ছিলাম
স্বপ্ন দেখিনি কেউই
আমরা গল্প করেই সময় কাটায়েছি
দুজন ছিলাম দুজনের মুখোমুখি
দুজন ছিলাম সমুদ্রমন্থনেও
একবারও কী দুজন আলিঙ্গনে জড়াতে চেয়েছি?
একবারও কী কাছে টানতে চেয়েছি দেহ বৃত্তে?
হাজার বছর কেবলই কী গল্প ছিল?
সে যে আনন্দ বেদনার হাজার দিন রাত্রি ছিল।
১২. জেগে আছি
দুজনেরই জেগে থাকার কথা ছিল —
কথা ছিল দুজনেই একসাথে ঘুমিয়ে পড়ব,
একসাথে স্বপ্ন দেখব বলে প্রতিশ্রুতি ছিল।
আর তুমি কী-না আগেই ঘুমিয়ে গেলে!
অথচ কতো স্বপ্ন দেখার ছিল!
বলেছিলে আমি নাকি বিশাল আকাশ হবো,
সেই আকাশ জুড়ে তুমি পাখি হয়ে উড়বে।
উদ্দাম নদীর মতো জল হবো আমি। সেই জলস্রোতে তুমি ভেসে যাবে।
১৩. দুঃসহবাস
আমার কী যেন হয়েছে
কোথায় একটি অধ্যায় যেন শেষ হয়ে গেছে।
এ কী কোনও মোহঘোর ছিল, যা ভেঙে গেল।
আমি বিপন্নে জেগে উঠি
পরম যত্নে নির্মিত স্বপ্ন গুলো এ ভাবে ভেঙে যায়!
বনের নিবিড়ে কোনও এক কাঠের কুটিরে দুজনের থাকা হলো, একসাথে কত স্বপ্ন দেখা হলো,
কত ছবি আঁকা হলো,
তারপর আচমকা স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল,
দূর প্রান্তরের পথ ধরে, ভিন্ন ভিন্ন দুটো পথ ধরে আমরা ফিরে এলাম।
তোমার ভেজা চোখের পাতা দেখলে মনে হয়,
সেই ছিন্ন সহবাসের স্মৃতি তুমি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে
মন কেমন করে মনে রাখতে চলেছ।
তুমি কি নিপুণহাতে গুছিয়ে নিয়েছ আগামী জীবনের সুখ স্মৃতির সমস্ত বৈভব
তোমার করকোমলে আঁজলা ভরে চেপে রেখেছ
আমাদের অনাস্বাদিত প্রেম, অভিন্ন হৃদয় বাসনা, ক্ষণিক সংসারের আসবাবপত্র, ছবি আঁকবার রঙিন মাটি।
তুমি কী অনুভব করো —
তোমার গর্ভের মধ্যে প্রজন্মের যে স্পন্দন, সে তোমারই প্রিয় পুরুষের বীজ।
১৪. সারারাত ছিল ঝড়বৃষ্টির
গল্প করতে করতে গল্প শেষ হলো
রাত্রির মধ্য প্রহরে
তখন চাঁদ ঢেকে গেছে মেঘে পশ্চিম আকাশের কোলে।
তুমি ভালোবাসতে চেয়েছিলে সব অনুভব দিয়ে
সকল দ্যুতি ছড়িয়ে সব তারার আলো আকাশ থেকে নিয়ে এসে আমার সর্বাঙ্গে।
কিন্তু তখন সারা আকাশ জুড়ে আসন্ন
ঝড়বৃষ্টির মেঘ…
সারারাত বর্ষার ঢল নামল
ভিজল শালবনের বৃক্ষ, পাহাড়ের ঢাল,
রাত্রিচোরা পাখির পালক, জানালার কাঁচ ও কপাট
দীঘি জলে ভরে উপচে উঠল কূলে,
সকালবেলা পড়ে থাকতে দেখি —
অজস্র ছিন্ন পাতা আর ভাঙা ডালপালা।
সেদিন সারারাত ছিল ঝড়ের,
সেদিন সারারাত ছিল বৃষ্টির…., আমরা সারারাত প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম।
১৫. জোড়া কবিতা
শুভাশিস —
তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকাও না, আকুলও হও না, ভালবাসো না, অন্তর গৃহ তখন তোমার মৌনব্রত থাকে।
তুমি আমাকে মনে রাখতে পারো আবার সহজে ভুলে যেতে পারো যেভাবে সন্ধ্যার তারা মেঘে ঢেকে রাখে।
এত নিবিড় করে কেন এত প্রেম দাও, আবার কেন
তুমি দিতে চাও জীবনের যত অজস্র ঘৃণার লেশ?
অহং উল্লাসে কি এত সুখ পাও? হৃদয় দিয়ে হৃদয় পোড়াও, আমাকেও শেষ করো, নিজেও হও শেষ।
শুভকামনা —
কে আর আমায় দেবে অমৃত সুধা,
কে আর আমায় বলবে ভালো থেকো, কে আর আমায় দেবে অভিশাপ।
কে আর আমায় নেবে স্বর্গবাসে, কে আর আমায় দেবে শান্তি, কে আর আমায় দেবে মুক্তি নরকের যত পাপ।
১৬. সুপ্রভাত
কোনো একদিন ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে যাবে
মেলতে পারব না আর সে চোখ
শরীরের সব চেনা গন্ধ ঢেকে যাবে আতরে
কর্পূরের সুবাস ছড়িয়ে দেয়া হবে কফিনে-
কবরে মাটি ঢাকা পড়লেই দেখতে পাবো না সূর্যাস্ত
দেখতে পাবো না চাঁদ নক্ষত্র জোনাকীদের আলো।
উঠবে আবার সূর্য, শুরু হবে নতুন জীবনের–
তখনও কি তুমি এসে বলবে, ‘সুপ্রভাত’।
১৭. হারিয়ে যাব একদিন
একদিন আমিও হারিয়ে যাব
যেমন করে হারিয়ে যায় চাঁদ কৃষ্ণ গহ্বরে।
একদিন আমিও ঝরে যাব
যেমন করে শিউলি ঝরে যায়
দিনের রোদ্রকরোজ্জ্বলে।
চাঁদের অলক্ষ্যেই তারা হারিয়ে যায়
আবার তারার অলক্ষ্যে চাঁদ,
একদিন ওদের মতো আমিও হারিয়ে যাব
অন্ধকার মৃত্তিকা তলে।
১৮. সূর্য ওঠার আগে
২৫ শে মার্চ,১৯৭১, আমাদের স্বাধীনতার ঠিক আগের দিন
পরাধীনতার শেষ দিন, কিংবা শেষ কালো রাত-
কি হয়েছিল সেদিন, সেই রাতে ?
সারি সারি জলপাই রঙ্গের ট্যাংক নামল রাজপথে
বুটের খট খট শব্দ, ট্যাংকের চাকার শব্দ
তারপর গোলার শব্দ, রাইফেলের গুলির শব্দ
এলোমেলো লাশ পড়তে থাকে পথের দু’ধারে, নর্দমায়-
এমন শব্দ এমন আর্তনাদ শোনেনি এর আগে এই শহরের মানুষ।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনে তাক করে চালানো হয়েছে গুলি
আক্রমন হয়েছে পিলখানায় ইপিআর ব্যারাকে
আক্রমন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ হল, মধুর রেস্তোরা,
আক্রমন হয়েছে নিলক্ষেত পুলিশ ক্যাম্প, মোহসীন হলে
জ্বলছে শহর, হঠাৎ এ কেমন আলোকিত হয়ে উঠেছে নগরী !
দুগ্ধপানরত শিশু ত্রস্ত হয়ে মুখ খুলে ফেলে মায়ের স্তন থেকে
মসজিদে সিজদারত মুসুল্লীরা ভীত হয়ে ওঠে– এ কোন কিয়ামতের আলামত !
মন্দিরে উলুধ্বনি দেওয়া রমণীদের কন্ঠ রোধ হয়ে আসে
গির্জায় যিশুর সামনে প্রার্থনারত মানুষগুলোর প্রার্থনা থেমে যায়
ওয়াইজঘাটের বারবনিতাদের কুঠুরীর আলোগুলো একে একে নিভে যায়
বন্ধ হয়ে যায় সিনেমা হলের রাতের সব প্রদর্শনী।
রক্তে ভাসছে রাজপথ, মুহূর্তেই বুড়িগঙ্গার জল লাল হয়ে গেল
এত লাশ আগে দেখেনি কখনো এই শহরের মানুষ
এত বিধ্বংসী আলো দেখেনি কখনো এই শহরের মানুষ
এত আর্তনাদের কান্না শোনেনি এই শহরের মানুষ।
ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে বিমর্ষ হয়ে পায়চারী করছেন এক নেতা
মুখে তার কালো রঙ্গের তামাক পাইপ, পরনে পায়জামা পাঞ্জাবী–
শতাব্দীর স্তব্ধতা ভেদ করে তিনি ঘোষণা করলেন স্বাধীনতার অমর বানী–
“এটিই সম্ভবত আমার শেষ বার্তা: আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের নিকট আমার আহবান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করুন। যতদিন পাক হানাদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত না হয় এবং যতদিন আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হয় ততদিন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।”
তখন সময় কালো রাতের মধ্য প্রহর, ঠিক নতুন একটি সূর্য ওঠার আগে।
১৯. কবুলনামা
যে গান রাতের সেই গানই শোনাব আজ কলাবতি রাগে, যে খঞ্জনা পাখি হয়ে তুমি ঘরে ফিরে এসেছ সন্ধ্যার অস্তরাগে, সেই পাখিটারই আজ চন্দ্রস্নান হবে কেতকী সুবাস ফাগে।
চিত্রা অরুন্ধতী স্বাতী’রা নেমে এসে আজ রাত্রিকে করবে জ্যোতির্ময়, মেঘে’রা জল হয়ে ঝরে পড়ে পুণ্য করবে আমাদের প্রণয়।
তোমার নাকে পরাব আজ রক্তকুঁচের নাকফুল,
যদি অন্ধকার এসে জড়িয়ে ধরে, তারপরও বলব — এসো, ভালোবাসা করো কবুল।
২০. ফিরে আসি
কত পথ খুঁজে খুঁজে তোমার কাছে চলে আসলাম
কত অন্ধকার সরিয়ে
তুমিই আমার সকল মায়া সকল আশা
সকল তৃষ্ণা,
কত প্রেম তোমার মাঝেই হারালাম
কত বন্দর ঘুরে ঘুরে তোমার কাছেই ফিরে আসলাম
তুমিই দুঃখ আমার
তুমিই ধ্বংস আমার, তোমাতেই সর্বনাশ
কত প্রান্তর হেঁটে হেঁটে এসে
কত তারার আলোয় তোমাকেই ভালোবাসলাম।
২১. পূর্ণতায় তুমি
আঙিনায় নতুন অতিথি রক্ত কুচের ছোট্ট চারাটি দুপুরের রোদে পুড়ে যায়, পানি ঢেলে তা সতেজ রাখতে পেরেছি কখনও?
যে নদী বাঁক খেয়ে চলে গেছে নিরুদ্দেশের পথে
তাকে কী আমি অনুসরণ করতে পেরেছি কখনও?
কতো ধূলির পথ বৃষ্টিতে ভিজে কাদা হলো —
পথের সেই ধুলোয় আর কাঁদায় হেঁটে চলে যেতে পেরেছি কী কখনও?
ভালোবাসাহীন ভাবে এ জীবন মৃত্যুর দিকে ধেয়ে যাক দিগ্বিদিক, তা কী কেউ চায় কখনও?
এই ঘর ভালোবাসায় ভরে দিতে হবে তোমাকেই, অপূর্ণ করে রেখনা তুমি কখনও।
২২. এখন বসন্ত
এই শহরে কোনো গায়েন নেই, কোনো কবি নেই
কিছু যুবকের দল কোরাস গান গাইছে পার্কে
ওরা হাসছে ওদের হাসি বলে দেয় এখন বসন্ত।
এই শহরে পলাশ শিমুলের ডালে আগুন লেগেছে
মধুকরের দল- দল বেঁধে ছুটে চলেছে বনে বনে
গুনগুন মৌমাছিদের গান বলে দেয় এখন বসন্ত।
এই শহরে পালা করে কোকিলেরা ডেকে যায়
ওদের কুহুস্বর ছড়িয়ে পড়েছে মহল্লায় পাড়ায়
কুমারীরা তখন সমস্বরে বলে ওঠে এখন বসন্ত।
এই শহরে গায়েন আর কবি থাক বা না থাক
যুবকের দল গান গেয়ে যায় সারাদিন সারারাত্রি
কুমারীরা প্রেমিকা হয়ে বলে ওঠে- এখন বসন্ত।
২৩. শিরোনামহীন
ঘুম নেই তবু ঘুমের মতো করে
জেগে থাকি
যেমন করে জেগে থাকে কোনও
একলা পাখি
দুঃখ আছে তবু পাজরের নীচে
দুঃখ ঢেকে রাখি।
কবে কোনদিন এসেছিল এক মাধবী
এই জীবনে
সে যে কখন চলে গেছে দূরের কোন
মহুয়া বনে
তাকে আর মনে পড়েনা পূর্ণিমার
চন্দ্র কিরণে।
বিমানবন্দর স্টেশনে থেমে আছে
মধ্য রাতের ট্রেন,
ঘুম কী এনে দিতে পারে আঁধারেতে
রঙিন সাম্ফেন?
এই বসন্ত রাতে জেগে নেই কোনো
বনলতা সেন।
২৪. করোনাকালীন কবিতা
‘জীবন যখন শুকায়ে যায়
করুণাধারায় এসো।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,
গীতসুধারসে এসো।’
চোখের ভিতর অনেক জল ছপ ছৃপ করছে। কিন্তু সব জল স্থির করে রেখেছি। কারোর জীবন দীপ নিভে গেছে, এমন কোনো আঁধার হওয়ার করুণ-সুধারসের কথা আজ বলব না।
রাতভোর নাকি বৃষ্টি হয়েছে। অন্য কোনো দিন হলে
জানালা খুলে বৃষ্টির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বৃষ্টির ছাটে ভিজে শীতল হতো বক্ষ। এক অদ্ভুত ভালোলাগার আবেশে ভরে উঠত শরীর মন।
কী যেন ভাবনা এল। খুব চেনা এক দীঘিতে ছোট ছোট সাদা, লাল, নীল কাগজের নৌকা ভাসছে। কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম ফুল সব ঝরে ঝরে পড়ছে । সেই ফুলগুলো শ্যাওলার মতো করে জ্বলে ভাসছে। পানিপোকা ছুটোছুটি করছে। ওরাও নাকি জলের কানে কান লাগিয়ে জলের গান শোনে।
কী যে ইচ্ছে করে বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ নিতে। কতকাল সাদা টগর ফুল স্পর্শ করিনি। উন্মুখ হয়ে আছি রাধাচূড়ার তলে যেয়ে হাঁটতে। মৌ মৌ গন্ধ ভাসবে বাতাসে। অনেকদিন রাধিকার পাপড়ি ছুঁয়ে দেখিনি। ভিতরটা কেমন চঞ্চল হয়ে আছে।
এই পৃথিবী করোনা মুক্ত হলেই আমি পথে পথে হাঁটব। যদি পথে বৃষ্টি নামে, নামুক। আকাশ কালো করে মেঘ হয়, হোক। তুমুল ঝড় উঠুক। উদ্দাম বেগে বৃষ্টি ঝরুক। আমি বেশি কিছু চাইনা। শুধু দুহাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখতে চাই।
হায়! পৃথিবীর এই অসুখ কবে সেরে উঠবে!!
২৫. সেই
কতদিন ধরে কত বিকেল হাঁটতে যাওয়া হয় না
তোমার হাত ধরে……
কেমন আছে শিয়ালডাঙার নির্জন পথের দুপাশের ঘাস? কেমন আছে মনুষ্যহীন রেল স্টেশন?
কাওলার নিবিড় আম বাগানের কস্তরি পুকুর?
নীল সৌরভে ফুল কী ফুটে থাকে জলে?
আহা!
খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে কতদিন ধরে অস্তাচলে ডুবে যাওয়া সূর্যাস্ত দেখি না!
এখন কেবলই,
অন্তিম সন্ধ্যায় জানালা খুলে দুজন চোখ মেলে সময় করছি পার!
নৈঃশব্দের দিগন্তে নিস্ফল চেয়ে থাকি, কত আঁধার নামতে দেখি এই ঘর থেকে এই আঙিনায়!
তবুও,
প্রাপ্তি তো আছে! তুমি স্নানঘর থেকে সদ্য স্নান করে আসো, মেলে ধরো ভেজা চুল, টপটপ করে ঝরে পড়ে জল, যদিও জড়িয়ে ধরতে পারিনা তোমাকে, শুধু গন্ধ নেই দূর থেকে।
এখনও,
আমাদের স্বপ্নগুলি স্বযত্নে রেখে দিয়েছি বুকের ভিতর, আবার একদিন প্রথম ভালোবাসার মতো শুরু করব আমাদের দিনলিপি।
২৬. তা হয়না
যাবার আগে ওগো তুমি একবার শুনে যেও —
চরাচরের ধাঁধানো রোদ্র থেকে
পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘরাশি থেকে
অমাবস্যার নিগুঢ় অন্ধকার থেকে
শরতের নীল আকাশ থেকে —
পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য কুড়িয়ে এনে
আমরা যে জীবন শুরু করেছিলাম
এই ভূবনের বুক চিরে যে ভালোবাসা দুজনের যৌথ হাতের আঁজলায় ভরে তুলে নিয়েছিলাম
অশ্রুতে দীর্ঘশ্বাসে স্বর্ণচ্ছটা যে ভবিষ্যৎ আমরা নির্মাণ করেছিলাম —
সেই সব সুন্দর, সেই সব আলোকিত রোসনাই
তুচ্ছ করে দিয়ে তুমি একাই চলে যাবে
তা হয়না।
২৭. অস্তিত্ব
গতরাতে রাতের মাঝখানে ঘুম ভেঙ্গে যায়
আজও দেখলাম তোমার একটি নিষ্কলুষ হাত আমার বুক ছুঁয়ে আছে
এটাই তোমার বার্তা, এইটাই তোমার অস্তিত্বের জানান– তোমার থেকে যেন দূরে চলে না যাই।
কোনোদিন কোনো বিদায়ের ক্ষণে
ক্ষণতরে যদি তোমার ও দুটি হাত, না ছুঁইতে পারে
আর,
তখন তুমি দারজা লাগিয়ে দিয়ে চলে যেও —
আমার অশ্রুবিন্দুর মাঝে তোমার মুখচ্ছবির কোনও ছায়া যেন ফেলে না যাও।
২৮. গ্লানি কথা
তোমার চোখ ময়ূরাক্ষী বৃষ্টির জলে ভিজে
কী দুঃখ তুমি জাগিয়ে দিলে,
আজন্ম ঋণী হলাম তোমার ঐ সিক্ত চোখের কাছে,
আমার চোখও জলে ভিজল,
চৌচির এই জলাভুমিতে অকাল বন্যা হলো,
তারপরও তোমাকে পাওয়া হলো না।
তোমাকে হারিয়ে খুঁজি অরণ্যানীতে,
ধুলি পথের উপরে, অস্তরাগের রং লুপ্ত হয়ে যাওয়া দিগন্তের প্রান্তরে,
শীর্ণাকান্ত তটিনী তীরে, পর্বত গুহার আঁধারে,
ধাবমান উত্তর মেঘে।
লিখি শ্লোক, লিখি গল্পকথা, লিখি গ্লানিবদ্ধ শব্দ
দিয়ে যত মর্মরিত কবিতা ।
২৯. পথ সঙ্গীত
আমরা আজ এখানে এই পথের উপর এসেছি
আমরা তোমাদের ভালোবাসা দিতে এসেছি
আকাশ ভরা এত নীল, ঐ নীল থেকে নীল এনেছি
তোমাদের আজ নীলাম্বরী করে রাঙাতে এসেছি।
আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি।
দুরের ঐ পাহাড়ের লতা গুল্ম বনফুল এনেছি
মহুয়া বন থেকে ঝাঁপি ভরে ফুল তুলে এনেছি
তোমাদের আজ মালা পরিয়ে দিতে এসেছি
ফুলের সুবাসে আকুল করে দিতে এখানে এসেছি।
আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি।
সাগর বালুকাবেলা থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে এনেছি
তোমাদের ঘরে মণিমুক্তা ভরিয়ে দিতে এসেছি
রূপালি ঢেউয়ের সমুদ্র পাড়ে নিয়ে যেতে এসেছি
সূর্যস্নানে পুণ্য হবে এই আনন্দ বার্তা দিতে এসেছি।
আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি।
পথের উপরে তোমাদের গান শোনাতে এসেছি
তোমাদের জন্য আজ এই আনন্দ গান বেঁধেছি
পথের দিশা পেতে তোমাদের কাছে এসেছি
পথের মাঝে যেন না হারিয়ে যাই এই কথা ভেবেছি।
আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি।
আমরা অনেক দুঃখ যাতনার কথা ভুলেছি
ভালোবাসা হৃদয় কোণে কানায় কানায় ভরেছি
আমরা তোমাদের সেই ভালোবাসা দিতে এসেছি
ভালোবেসে শুন্য করে দিতে এখানে এসেছি।
আমরা তোমাদের গান শোনাতে এসেছি।
৩০. সন্ধ্যামালতী
একদিন খুব ভোরবেলা আপনি ফজরের নামাজ পড়ে কেবল শেষ করেছেন, ঠিক তখন যদি একটি ফোন কল আসে, যদি জানতে পারেন আপনার ভালোবাসার মানুষটি মারা গেছে, তখন কেমন লাগবে আপনার?
পরপর তিনদিন তার খোঁজ নেননি বলে
কাল সন্ধ্যায় সে আপনার সাথে অভিমান করেছিল, ফিরিয়ে দিয়েছিল আপনার দেওয়া সন্ধ্যামালতী ফুল।
আজ চলে যাবেন তার বাড়িতে তাকে দেখতে, আপনাকে স্মরণ করে যে কপালে পরত
প্রিয় নীল রঙের টিপ, তার কপালে দেখবেন আজ ধূসর রঙের সুরমা।
কেমন লাগবে আপনার আজ সারাদিন !
যে উপন্যাসটা পড়তে যেয়ে শেষ করা হয়নি,
রেখে দেওয়া সেই পৃষ্ঠা থেকে আবার কী
পড়া শুরু করবেন? নাকি একটি কবিতা লিখতে বসবেন।
আজও সন্ধ্যা নামবে, আজও সন্ধ্যামালতী ফুল ফুটবে ঝাড়ে। আজও কী একটি ফুল ছিড়বেন তাকে দেওয়ার জন্য? আজ আর কেউ অভিমান করবে না আপনার সাথে, ফিরিয়ে দেবেনা সন্ধ্যামালতী ফুল।
৩১. যারা এসেছিল
সব বুকেই মুখ লুকালে দুচোখ মুদে ঘুম আসে না।
সব বুকেই শীতল পাটি বিছিয়ে বসে বসে কান্না করা যায় না। কেউ কেউ আসে জীবনে যার শাড়ির আঁচলে শৈশবের মায়ের আদর ছুঁয়ে থাকে।
কারো কারোর গায়ে নিরবতার মতো শান্তি লেগে থাকে। কেউ কেউ আসে জীবনে স্বার্থহীন ভালোবাসা অকাতরে বিলিয়ে দিতে। বিনিময়ে নেয় না কিছুই। বুকে জড়িয়ে ছোট্ট একটি আলিঙ্গনও…
কেউ কেউ চলে গেলে তাদের মনে পড়ে দীপ জ্বালা সন্ধ্যায় কিংবা রাত্রির মধ্য প্রহরে। যখন বাইরে জোছনার প্লাবন বয়। দূরাগত তার মৌন পদধ্বনি শোনা যায়। মনে হয় তার জন্য ঘরের একটি দরজা খুলে রাখি।
কিছু কিছু মানুষকে মনে পড়ে দুঃখের দিনে। যারা দুঃখগুলো মুছে দিত ভোরের মিষ্টি রোদ্র দিয়ে। যারা এসেছিল জীবন প্রাতে। তাদের হাত ধরতে ইচ্ছে করে আবার কাঙ্গালের মতো…
যারা আর কোনোদিন আসবে না, বলবে না আর কখনও — ‘মুখখানি কেমন মলিন হয়ে আছে, এসো আঁচলে মুছে দেই।’ যারা নিঝুম রাতের স্বপ্ন হয়ে চলে গেছে। যারা আমার গল্প হয়ে আছে।
৩২. মধ্যাহ্নে
দুপুরে দক্ষিণের জানালা খুলতেই অকস্মাৎ মলয় বাতাস এসে গায়ে লাগল। কাঁঠাল পাতায় ঝিলিমিলি করছিল রোদ। পাশে ডুমুরের ডালে বসে নাচ্ছিল টুনটুনি। কেমন যেন রৌদ্রের শব্দ চৌচির করছিল চারদিক। তখনই মনে হয়েছিল, মধ্যাহ্নের রূপ বুঝি এই রকমই হয়।
হঠাৎ নীরব হয়ে গেল সব। সকল শব্দ শুষে নিল কেউ। সূর্য পশ্চিমে হেলে যাবার সময় অদ্ভুত নির্জনতা নেমে আসে। এমনই স্তব্ধ সময়ে —
যদি তুমি আসো নির্জন ঐ ছায়াপথ ধরে
হাঁটব রৌদ্রের ধাঁচ গায়ে মেখে
চলে যাব মেঘে সূর্য বধ করে
জল হয়ে ফিরে আসব আবার, ভিজবে ধানক্ষেত,
ভরে উঠবে নদী,
সোনালী আভার সাঁজ বেলায় উৎফুল্ল জোনাকিরা জ্বেলে ধরবে আলো।
৩৩. ধ্যানে তুমি মগ্নতায় তুমি
যদি একদিন হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের কাছে চলে যাই
যদি বলি পাহাড় তোমার চূড়া আমি ছুঁইতে এসেছি
যদি একদিন হাঁটতে হাঁটতে নদীর কাছে চলে যাই
যদি বলি নদী তোমার জলে আমার ঠাঁই মিলবে না?
যদি চলে যাই অরণ্যের কাছে
যদি বনের বিহঙ্গেরা কেনো গান শোনাতে না চায়
যদি আঁধারে একাকী হাঁটতে হাঁটতে পথ হারিয়ে ফেলি একদিন —
খুব ভয় হয় এখন
এসো আমার হাত ধরো —
আজ বাইরে সেই সিদ্ধার্থের পাগল করা পূর্ণিমার রাত
চলো দূরে কোথাও বোধিবৃক্ষ তলে আসন পাতি
যেথায় আমরা ধ্যান মগ্ন হবো, আমাদের প্রেম হবে কস্তুরী শোভাময়।
৩৪. ভালো থেকো
আমি যখন থাকব না, তখনও তুমি ভালো থেকো।
তখন,
একাকী ভোরের পাখিদের গান শুনবে
বন্ধ ঘরে বিছানায় শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনবে
বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিঝুম দুপুরে ঝরা পাতার মর্মরধ্বনি শুনবে
বিকেলে পশ্চিম দিগন্তে চেয়ে দেখবে আবীর মাখা
লাল মেঘ,
সন্ধ্যায় বাড়ির উঠোনে পায়চারি করে খুঁজবে আমার পায়ের চিহ্ন।
রাত্রিতে জানালা খুলে দেখ তারাভরা আকাশ
দেখ পঞ্চমীর চাঁদ, স্নাত হবে জোছনায়।
যদি ঘুমিয়ে যাও তবে স্বপ্ন দেখ না —
আমাকে দেখতে পাবে না কোথাও,
না জাগরণে, না ঘুমে, না স্বপ্নে। উত্তরের হাওয়া থেকে নিঃশ্বাস নিতেও যেওনা , সেথা থেকে আমার শরীরের গন্ধ আসবে না ।
আর…
আমার দেখা যদি তুমি পেতেই চাও
তবে দূর কক্ষপথ ধরে চুপিচুপি চলে এস পরিযায়ী পাখির মতো, দেখা পেয়ে যাবে হয়ত আমায় অপার্থিব কোনো এক ভুবনে।
৩৫. পদ্মকুসুম
কিছুদিন ধরে কোনো গল্প লেখা হয় না। একদিন
রাত্রির নিরিবিলিতে তাই লিখতে বসি গল্প। মনে মনে কাহিনি সাজাচ্ছিলাম কিন্তু কিছুতেই মিলছিল না পরম্পরা। ভাবলাম গল্প থাক — তারচেয়ে কবিতা লিখি। আমার প্রথম যৌবনের থরথর কম্পনের মতো লিখে ফেললাম একটি কবিতা —
তুমি শুধু একবার খুলে দাও হৃদয়ের কপাট
এই উচ্ছ্বল যুবকের সামনে বন্ধ করো না দরজা
একবার খুলে ফেলো লজ্জার অবগুন্ঠণ।
তোমাকে শেখাবো কীভাবে ভালোবাসতে হয়
সব তছনছ করে, সব ভেঙ্গেচুরে কীভাবে গড়তে হয় শরীর শিল্প, হৃদয় ভাঙ্গতে হয় হৃদয়ের গহীনে
যেয়ে।
আমি হাঁটু মুড়ে দু’হাতে স্পর্শ করতে চাই স্বর্ণরেণু
ভুলে যাওয়া ঢের ভাল স্মৃতি কাতর যন্ত্রণা
তুমি এই উন্মূল যুবকের বুকে মাথা রাখো
তোমার সব মণিকাঞ্চন বিলিয়ে দাও অকাতরে।
আমরা মিলব নদীর মতো, অন্তঃশীল স্রোত ধারার মতো — ভেসে ভেসে তুলে আনব অলক্তমাখা পদ্ম-কুসুম।
৩৬. ভয়ংকর সুন্দর
যখন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তখন আমি নিজেকে মলিন করে ফেলি —
কী হবে নিজের সৌকর্যময় সৌন্দর্যের,
কেমন যেন সুখ নেই
বেদনা নেই
বিষণ্ণতা নেই
আনন্দ নেই,
জীবন নেই, জীবনের কোলাহল নেই
প্রাণ নেই —
ঐ অদূরে বয়ে যাওয়া নদীর মতো শীর্ণ, স্রোত নেই,
স্থীর জলতল, কোনো প্রবাহ নেই,
কূলে বৃক্ষ নেই, সবুজ পাতা নেই, চৌচির করছে জীর্ণ পাতা, মর্মর হয়ে ঝরে পড়ছে করুণ সুরের মতো —
ছিন্ন ভূষণ আরক্তহীন অবয়ব,
রুক্ষ কেশ, মৃন্ময় চোখ,
ভাবনা লেশহীন ভাবে পথ চলতে চলতে মনে হয়
আমি সব সুন্দরকে বিসর্জন দিয়ে হাঁটছি একাকী, নিসঙ্গ নিভৃতচারী ভবঘুরের মতো
অরূপে আমার পথ চলা কোনো অসীমে —
মনে হয়,
সুন্দর নেই ছিটেফোঁটাও, তবুও
সৌন্দর্যহীন এই আমার সৌন্দর্য দেখছে কেউ দূর থেকে পলকহীন উদ্বীগ্ন চোখে।
৩৭. উতল পংক্তিমালা
আজ এমনই এক চাঁদ উঠুক আকাশে এমনই তার জোছনা, শুধু গানেরই সেই রাত হবে।
আজ এমনই মেঘ গুরুগম্ভীর দিন হোক, শুধু ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরবে, কাক ভেজা ভিজব দুজনে।
আজ নাহয় রুপালি রঙের রোদ্দুর হোক, সারা গায়ে উত্তাপ ছড়াক তার রূপশুভ্র আভা।
ঐ পরগনা থেকে সেই সাওতাল মেয়েটি নাকি আজ আসবে, যাকে দেখেছিলাম জগতি স্টেশনে –
ও নাকি ঠুমরী শোনাবে,
ওকে আজ ছুঁয়ে দিক এই জোছনা, এই বৃষ্টি, এই রোদ্দুর।
এত ক্ষুধার্ত ঐ বুভুক্ষু চাঁদ, এত ঝুমুর ঝুুমুর মাদল বাজে ঐ বৃষ্টি ধারায়, এত উত্তপ্ত এই রোদ্দুর….
৩৮. গ্লানি কথা
তোমার চোখ ময়ূরাক্ষী বৃষ্টির জলে ভিজে
কী দুঃখ আমায় জাগিয়ে দিলে,
আজন্ম ঋণী হলাম তোমার ঐ সিক্ত চোখের কাছে,
আমার চোখও জলে ভিজল,
চৌচির এই জলাভুমিতে অকাল বন্যা হলো,
তারপরও তোমাকে পাওয়া হলো না।
তোমাকে হারিয়ে খুঁজি অরণ্যানীতে,
ধুলি পথের উপরে, অস্তরাগের রং লুপ্ত হয়ে যাওয়া দিগন্তের প্রান্তরে,
শীর্ণাকান্ত তটিনী তীরে, পর্বত গুহার আঁধারে,
ধাবমান উত্তর মেঘে।
লিখি শ্লোক, লিখি গল্পকথা, লিখি গ্লানিবদ্ধ শব্দ
দিয়ে যত মর্মরিত কবিতা ।
৩৯. করোনাকালীন কবিতা
উত্তরের জানালাটা সহজে খোলা হয়না। পিছনে সরু গলিপথ। পথিকদের পদশব্দ শোনা যায়। কথার কলরব আছে। কিন্তু ভালো লাগেনা। এই অলিন্দ দিয়ে কোনো দিন আমি উত্তরের আকাশের তারা দেখতে পাইনি। চাঁদ ও না। বাতাসও বহেনা।
পূবের জানালাও খুলি না। বিশাল প্রাচীর। প্রাচীরের ওপাশে অট্টালিকা। অট্টালিকার ইট ফুঁড়ে কোনো গান ভেসে আসেনা ওপাশ থেকে। আমার কাছে তাই এই জানালা পরিত্যক্ত।
পশ্চিমে বাঁশঝাড়। ভালোই লাগে। দিনের বেলায় মরা পাতা ঝরতে দেখি। সন্ধ্যা রাতে জোনাকিদের আলো দেখি। শীতে অতিথি পাখিরা এসে এখানে রাত্রি যাপন করে। বসন্ত এলে তারা চলে যায়।
দখিনে আছে বারান্দা। দাঁড়িয়েছিলাম যেয়ে সেখানে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। জামরুল পাতা ছুঁয়ে সেই বাতাস লাগল এসে আমার গায়ে। তারার আকাশ আজ গল্প শোনাতে চাইল। শতবছর আগে এখানে নাকি একটি মাটির ঘর ছিল। এক কলাবতী বধু নাকি এক বাউণ্ডুলে তরুণের হাতের উপরের তালুতে গভীর একটি চুমু দিয়েছিল। আর কিছু না। ভালোবাসা যা ঐ পর্যন্তই…
তারপর সেই বধুটি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তরুণটি অপেক্ষা করতে থাকে মেয়েটির জন্য। নাহ্ ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা না। সেই গভীর চুম্বনটি মেয়েটিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। কিংবদন্তি আছে যে– ছেলেটি অপেক্ষা করতে করতে একসময় নাকি পাগল হয়ে যায়।
এমন গল্প শোনার পর ভালো লাগল না আর জামরুল পাতা ছুঁয়ে আসা স্নিগ্ধ বাতাস! আকাশ ভরা তারা। ভালো লাগল না আকন্দ গাছের নীচে ঘন ঝাড়টাতে জোনাকিদের নীল নীল আলো। কেউ এমন গল্প না বলুক আর কোথাও !
ঘরে চলে আসি।
পৃথিবী জুড়ে করোনার আতঙ্ক! এই প্রলয় বন্ধ হয়ে যাক। ব্যথা সব সেরে যাক। আমাদের গল্পের শেষটা সুন্দর হোক। রাতের আকাশের সব তারাদের আলো এসে পড়ুক….
”তোমরা নাকি এখনও স্বপ্ন দেখ,
এখনও গল্প লেখ গান গাও প্রাণ ভরে।
মানুষের বাঁচা মরা এখনও ভাবিয়ে তোলে
তোমাদের ভালোবাসা এখনও গোলাপে ফোটে ।”
৪০. জোছনার অলীক আলোয়
এক ফাগুনে আগুন জোছনার অলীক আলোয় পথ চিনে চিনে তুমি এসো,
কৃষ্ণচূড়ার পরাগরেণু অঙ্গে মেখে চঞ্চল বাতাসে
তুমি এসো,
রুপালি নদীর ঢেউ তরঙ্গের মতো উদ্দাম বেগে তুমি এসো।
আমি জানালা খুলে রাখব
তুমি এসো,
ঘরের দুয়ার খুলে রাখব
তুমি এসো,
উঠোনের উপর ঝরা পাতা ঝরে থাকবে,
তুমি সেই পাতা মাড়িয়ে এসো।
আকন্দ গাছের ডালে বসে ডাকবে খঞ্জনা পাখি
দুপুরের রোদ ঝরে পড়বে পথে পথে —
তুমি রোদ্রতাপে নীল শাড়ি পরে দেহখানি নীলাদ্রি
করে নীলাম্বরী হয়ে এসো।
তুমি এলে আমরা কথা বলব নিঝুম বারান্দায়
বসে মুখোমুখি,
দুচোখ মেলে দেখব ভালবাসাময় পৃথিবী,
আমরা গল্প করব রাজপুত্র রাজকুমারীর মতো
স্মিত হেসে ,
আমরা প্রতিশ্রুতি করব ভালোবাসার,
ভুলব না কেউ কাউকে, আমরা একই ভুবনে দুজন
বসবাস করব।
আমাদের প্রতিশ্রুতির সাথে জোছনার আলোয় পুণ্যতা মিশানো থাকবে,
আমাদের প্রেম ফাগুন বাতাসে ধুলির মতো
উড়ে যাবে না,
আমরা সব অবিশ্বাস, সব অপ্রেম ধূলো বাতাসে উড়িয়ে দেবো। তুমি এসো।
৪১. আক্ষেপগুলি মোর
জীবনটা এত বেশি ক্ষনস্থায়ী যে, সোনালী মুহুর্তগুলো কখন উড়ে গেল বুঝতেই পারিনি। কথা ছিল সুন্দরের পথ হেঁটে হেঁটে আমরা এই পৃথিবী ছাড়ব। আমাদের চার চোখ মিলে কতোই যে স্বপ্ন ছিল।
আজ এত পথ এসে পিছনে ফিরে দেখছি — আমাদের পাওয়া হয়নি কিছুই। কতো দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে এখনও পৃথিবীর পথে পথে ঘুরছি আরও অনেক
স্বপ্ন দেখব বলে। অথচ পিতামহের রেখে যাওয়া
পুরনো দেয়াল ঘড়িটাতে শেষ ঘন্টাটি বাজছে যেন
ঢং ঢং করে।
৪২. সেও এক মৃত্যু
কালরাতে ঝাউঝোপের অন্ধকার থেকে আসা
উন্মুখ বাতাসে তোমার বাজুবন্ধ বাজছিল ঝুমঝুম করে
কটিতে রূপার বিছায় এসে পড়েছিল চন্দ্রশুভ্র আলো,
হঠাৎ তোমার কালো কেশের খোঁপায় ফুটে উঠল
কুন্দন ফুল
কণ্ঠে দেখলাম পদ্ম-কুসুম খচিত মণিহার
চুল উড়ছিল বসন্ত বাতাস লেগে উর্বশীদের মতো
চোখের কোণে এসে পড়ছিল শত নক্ষত্রের আলো
তুমি কাঁপছিলে জ্যোৎস্নার দ্যুতিতে
নাভির উপরে জ্বলছিল বিষনাগমণি,
তুমি তখন বললে স্পর্শ করো —
আমি সেই মণিখণ্ড ধরতেই দহনে পুড়ে জ্বলতে থাকি
অস্থিচর্ম ভেদ করে নীল আগুন দাউদাউ করে লেলিহান ছড়ায় চতুর্দিক,
আমি আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠি, এবং বলি —
কীসের এ দহন? আমাকে তুমি এ কী করলে?
তুমি নিরুত্তর স্তব্ধ হেম —
আমি অদ্ভূত এক নীল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকি তখন।
৪৩. এখন বসন্ত
এবারও শিমুলের রক্তগন্ধ নেওয়া হলো না
এবারও রোদ্রগন্ধী দেহখানি অপুলকিত হয়ে থাকল,
এবারও মধুমাসে মধুক্ষণ হয়ে থাকল অবীর্যবান।
তুমি এই শহরেই হেমবতীর শাড়ি পরলে
বসন্তের ঝরে পড়া পলাশের গন্ধ মাখলে শরীরে,
মখমল ওড়না উড়ালে চৈত্রের বাতাসে
শিমুলের মধু কুসুম করলে পান
তুমি হয়ে উঠলে বীর্যাবতী।
শিমুল ফুটবে এখানেই, কুসুম মধু পান করব মধুবনে
আমরা উড়ব দিগাঙ্গনার মতো পাগল হাওয়ার প্লাবনে।
৪৪. ডাক
অপেক্ষা করছে মাটি, অপেক্ষা করছে ঘর
অপেক্ষা করছে শূন্য পালঙ্ক, হে প্রিয়তমা —
নির্জন পদচিহ্ন এঁকে তুমি এসো !
অপেক্ষা করছে শুকপাখি, অপেক্ষা করছে নিশি বিহঙ্গ
অপেক্ষা করছে তৃষ্ণার্ত ময়ুর, হে প্রিয়তমা —
রিনঝিন পাখা মেলে পালক ঝরে তুমি এসো।
অপেক্ষা করছে বসন্ত বাতাস, অপেক্ষা করছে
জীর্ণ পাতা, অপেক্ষা করছে বাউলের একতারা,
হে প্রিয়তমা — লালনের গান হয়ে তুমি এসো।
অপেক্ষা করছে পূবের হাওয়া, অপেক্ষা করছে
শুকিয়ে যাওয়া নদী, চরাচরের উপকথা, হে প্রিয়তমা —
বিশ্বলোকের স্বপ্নক্ষরা রমণী হয়ে তুমি এসো।
অপেক্ষা করছে মেঘমল্লার আকাশ, অপেক্ষা করছে সন্ধ্যা তারা, অপেক্ষা করছে তোমার মুখ পানে চেয়ে কয়েকটা শতাব্দী! হে প্রিয়তমা — তুমি এসো।
৪৫. যা হারিয়ে যায়
যেখানে যাবার চলে যাব যখন ইচ্ছে হয়
যদি তুমি দেখাও পথ লণ্ঠন জ্বেলে
তোমার শরীর ছুঁয়ে কসম খেয়ে বলছি
তোমার আলো আমি শরীরে মেখে নেব ।
হয়ত আমি আসব না আর,
হয়ত তুমি জ্বালাবে না আলো সন্ধ্যাববেলায়,
কোনও গল্প থাকবে না তখন, কোনও কথাও।
আমি হারিয়েই যাব,
শূন্য আকাশে চাতকের মতো চেয়ে থাকব
যেখানে অশ্রু নদীর জল শুকিয়ে যায়
তপ্ত দীর্ঘশ্বাসে।
৪৬. অভিযাত্রিনী
তুমি পূর্ণিমার চন্দ্র কিরণের মতো
ব্রহ্মকমলের আকুল করা গন্ধের মতো
ঝুমকা লতার আবেশ ছড়ানো মুগ্ধতার মতো
সন্ধ্যার শেষ অস্তরাগের মায়ার মতো
সুপ্তসুন্দর রাত্রির শান্তির মতো…
তুমি ডানা মেলে উড়ে বেড়াও প্রজাপতির মতো
আকাশের নীলে মিশে থাকো নীলাঞ্জনার মতো
তোমাকে নিয়ে শ্রাবণ বৃষ্টির মেঘে ভেসে যাই
রাতের তারার আলোর বিচ্ছুরণে হেঁটে যাই
নিখিলের দুয়ার খুলে স্বর্গলোকে চলে যাই।
৪৭. তুমি জলপ্রপাত হও
ভুলতে চাইলেই কি ভুলতে পারি
বাহুডোরের উষ্ণতা ?
ভুলতে কি পারি মুখ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির গন্ধের মতো আশ্লেশ ?
পর্বতারোহী হয়ে ভ্রমণ করেছি উপত্যকার বাঁকে বাঁকে
ভুলতে কি পারি শরীরের খাঁজে খাঁজে সেইসব পরিভ্রমণ?
লতাগুল্ম বৃক্ষ ঝোপঝাড় নুড়িপাথর মাড়িয়ে পৌঁছে গেছি যে প্রোতাশ্রয়ে
ভুলতে কি পারি সেই সব রোমাঞ্চকর পথ ?
তুমি চাইলেই সেই পথের পরিব্রাজক হতে পারি, দিতে পারি আবারও আশ্লেশ,
দিতে পারি ঈষাণের পুঞ্জিভূত যত মেঘ
বঙ্গোপসাগর থেকে জল নিয়ে
মেঘে মেঘে ভেসে এসে জলপ্রপাত হতে পারি।
৪৮. তুমি এসেছিলে
হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় তাকে —
চেয়ে দেখি সে যে নান্দীমুখ আবার ভৈরবীর
ঠুমরির সুরও যেন ভেসে আসে
মেঘদূতম্ শ্লোকও শোনা যায়
যেন যমুনা তীরে অকালে বান এসেছে।
‘বর্ষন মন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি তোমারি এ দ্বারে,
পথিকেরে লহ ডাকি তব মন্দিরের এক ধারে।’
এই গান গেয়েছিল কে প্রথম —
এখন সে কোথায়?
এখনও আছ তুমি, এখনও সে আহ্বানও দাও তুমি।
সেই কোন্ জনমে শিউলী ফুটেছিল বাগানে
আগে মাতাল হতাম এর গন্ধে , এখনও হই —
এখনও হাত বাড়ালেই তোমাকে ছুঁই
যেন সায়গল এসে থামে ‘পিয়া নাহি আয়ে’।
নাহ্! তুমি এসেছিলে আমারই গানে।
৪৯. অনাত্মা
তুমিও আগে মরতে পারো, আমিও আগে মরতে পারি
যারই দেহ আগে দেহান্তর হোক,
যিনি পড়ে রইবেন সে যেন বেদনাহত না হয়
তাকে যে বেঁচে থাকতে হবে আরও কিছু কাল।
ঝিরঝির বাতাসে ঝরে পড়ে কত শুকনো পাতা
সেই ঝরা পাতার মর্মরে কান্না খুঁজবে না কেউ
নীল আসমানে লুকিয়ে থাকে কত শুচিশুভ্র মেঘ,
মঞ্জুল সেই মেঘলোকে উড়িয়ে নেবে বেঘোর বাতাস
আমরা মিলিত হবো সেখানে উন্মত্ত ভালবাসায়।
এই পৃথিবীতে প্রেমসৌধ গড়ে তুলেছিলাম
ফোঁটা ফোঁটা অযুত অশ্রুকণা মিশে আছে এর ইটে, বালিতে, ধূলিতে, পাথরের কুঁচিতে —
যেথায় অদূরে বয়ে গেছে পুণ্যতোয়া নদী,
আজলা ভরে জল নিয়েছি, হৃদয় ভরে প্রেম নিয়েছি অপার।
আমাদের কারোর মৃত্যু নেই, এখানে থাকবে অভিজ্ঞান,
থাকবে নদীর দুর্মর কালস্রোত
অসীমের পানে বেগে চলবে তা ধাবমান।
পার্থিব আমরা থাকব না কেউ, থাকবে অন্য কেউ,
অন্য দুটো বুকের গভীর আলিঙ্গন।
৫০. সেই
কতদিন ধরে কত বিকেল হাঁটতে যাওয়া হয় না
তোমার হাত ধরে……
কেমন আছে শিয়ালডাঙার নির্জন পথের দুপাশের ঘাস? কেমন আছে মনুষ্যহীন রেল স্টেশন?
কাওলার নিবিড় আম বাগানের কস্তরি পুকুর?
নীল সৌরভে ফুল কী ফুটে থাকে জলে?
আহা!
খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে কতদিন ধরে অস্তাচলে ডুবে যাওয়া সূর্যাস্ত দেখি না!
এখন কেবলই,
অন্তিম সন্ধ্যায় জানালা খুলে দুজন চোখ মেলে সময় করছি পার!
নৈঃশব্দের দিগন্তে নিস্ফল চেয়ে থাকি, কত আঁধার নামতে দেখি এই ঘর থেকে এই আঙিনায়!
তবুও,
প্রাপ্তি তো আছে! তুমি স্নানঘর থেকে সদ্য স্নান করে আসো, মেলে ধরো ভেজা চুল, টপটপ করে ঝরে পড়ে জল, যদিও জড়িয়ে ধরতে পারিনা তোমাকে, শুধু গন্ধ নেই দূর থেকে।
এখনও,
আমাদের স্বপ্নগুলি স্বযত্নে রেখে দিয়েছি বুকের ভিতর, আবার একদিন প্রথম ভালোবাসার মতো শুরু করব আমাদের দিনলিপি।
৫১. এখনও তুমি
এখনও স্বপ্নে দেখি তোমার ঐ মায়াবী চোখ
এখনও মর্মে শুনি ভোরের পাখীিদের গান
এখনও সুর তোলে চর্যাগীতিকার পদাবলী
এখনও শরীরে পাই তোমার বুঁনো মাটির ঘ্রাণ।
এখনও বকুলের সুবাস ঝরে উত্তরের বাতাসে
এখনও শিউলি ফুল ঝরে থাকে বনছায়া তলে
এখনও মূর্ছণা জাগায় শত বাঁশির তান
এখনও অক্লেশে বুঝতে পারি অনুভবের টান।
এখনও তুমি ফোটাও ফুল বসন্ত ফাল্গুনে
এখনও পাঁপড়ি মেলো কুসুমিত ডানায়
এখনও আনন্দধ্বনি বাজে রাত্রির কানে কানে
এখনও তোমায় কাছে পাই মধুময় যত গানে।
৫২. পরিপূর্ণা
কী নেবে তুমি? কী নেবার আছে?
কী দেবার আছে তোমার?
দেহ মাংস করোটি পোড়ে প্রাগৈতিহাসিক অনলে।
তোমার নখ দাঁত চুল শাড়ি পোড়ে
তুমি ক্রমাগত শুচি হও, শুদ্ধ হও
তুমি তৈরি করো অনাগত শিশু, নাড়িতে, ভ্রুণে।
আর কী কুশিলবতা আছে বলো?
তোমার আঁচল উড়ে ঢেকে দেয় কুন্দফুল
চারিদিকে কীর্ণ মৌমাছি গুণগুণ করে।
আমিই ছিলাম তোমার গর্ভধারণের কুশিলব
এই যে প্রেম, এই যে প্রজন্ম অভিজ্ঞান,
তা সবকিছু নিয়েছ আমার থেকে, আর তুমি হয়ে উঠেছ তাই পরিপূর্ণ রমণী।
৫৩. মধুকর
ভোরের আলোয় পথ চিনে বেরিয়ে পড়েছি পথে
কোথা’ থেকে ভেসে আসছে এমন অচেনা সুবাস
এমন অস্পর্শ ফুল ফুটে আছে কোন্ কুসুম কাননে।
আমি তার আরক্ত পরাগ রেণূতে ছুঁয়েছি ঠোঁট
যেন প্রজাপতি প্রথম পালক রেখে গেল পত্রপল্লবে।
এমন লাজুক প্রস্ফুটিত পাঁপড়িতে বসেনি এর আগে
কোনও উড়ন্ত মৌমাছি থামিয়ে দিয়ে ডানা,
শুষে নিতে পারেনি এর মধুরিমা।
৫৪. নির্জন পরশমণি
ধূসর মেঘের সাথে হাওয়ার রাত
অলৌকিক জলে ভিজে মেদুর হয়েছ
আজ তোমার অগণন চুম্বন গুলো দাও।
এই রাতে কোনো বিষাদ রেখ না
রেখ না খেদ
আজ শ্রাবণ মেঘের অফুরান নেশা
রাত্রি কখনোই ভোর হবে না।
প্রস্ফুটিত শরীর খুলে খুলে দাও
একান্ত ঐশ্বর্যগুলি উৎসর্গ করো
নির্জন পরশমণি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দাও
আমাদের কোনো অপূর্ণকাল নেই।
৫৫. চলে যাবে
তুমি চলে যেতে চাইলে চলে যাবে
সাথে নিয়ে যেও আমার শূন্যতাও
একটি মুখর জীবন ছিল আমার, সেই মুখরিত সময়ে
তোমাকে বেঁধেছিলাম,
তুমি ফিরিয়ে নিয়ে যেও আমার আনন্দও।
তুমি থাকবে না তাই রাস্তা ধরে হাঁটব উড়নচণ্ডীর মতো
পথের ধারে ফুটে থাকবে বুনোফুল আর ঈষৎ শিশির ভেজা রাস্তা এই…
আকাশমুখী মহাদ্রুম অনন্ত ছায়া মেলে রাখবে সেই রাস্তার ওপর। তেরছা হয়ে সূর্যের দু’একটি আলো এসে পড়বে সেখানে।
ফিরে যাব আমি হয়ত কুসুমপুরেই
যখন হেঁটে যাব অস্তমিত সূর্যের আলো পড়বে যমুনার স্বচ্ছ জলে, আমার ঝুলানো ব্যাগ থেকে শোনা যাবে তখন তোমার শূন্যতার চুড়ির টুং টুং আওয়াজ …
৫৬. নীলাভ অধ্যায়
সুন্দরে তুমি নির্জন শান্ত রাত
দূরের নক্ষত্র বীথির মতোন নীলাভ তোমার গোপন রূপ।
নগ্নতায় তুমি পিকাসোর ছবির মতোন বিপথু রমণী
ঢাকাই মসলিনের মতোন তন্বী তুমি, কাঁচা মাটির মতোন আঁকাবাঁকা পটপ্রতিমা।
তোমার শরীর জুড়ে জ্বলে পূর্ণিমা চাঁদের বাঁক খাওয়া গোলাপী রোশনাই,
বিচ্ছূরিত জোৎস্নার মতোন ঝরে পড়ো তুমি সারারাত্রি।
৫৭. আমার সর্বত্রে তুমি
কতকাল ধরে তোমাকে দেখতে পাইনা
কত ঘুমহীন রাত্রি নিশীথে
কত অনন্ত নক্ষত্রবীথির ভিতর চেয়ে থাকি
সেথায় কালকূটের পাশে অরুন্ধতি সর্বগ্রাসী একা।
কত চেয়ে থাকায় আকাশ বিদীর্ণ হলো না
কত অন্ধকার এসে দুচোখ ঢেকে দিল।
যেথায় তুমি চলে যাও নাকো
আমার সকল আলোয় তুমি ঢেকে থাকো
কত অসীম বেদনায় তোমাকে খুঁজে ফিরি
উটের চাহনির মত সর্বত্র দিগ দিগন্তে।
কত হাসনাহেনা ফুটল হেমন্ত রাত্রি প্রহরে
কত মঞ্জুরিকা ঝরে গেল শান্ত ভোরে
আমার সকল নিঃসঙ্গে তুমি যাপিত থাকো।
যেথায় যত দূরেই যাও যত আঁধার সীমান্তে
তুমি রয়ে যাবে সর্বত্রে আমার অন্তর প্রান্তে।
৫৮. সমুদ্র বিষয়ক কবিতা
সীগাল পাখির মত তুমি অবগাহন কর
সমুদ্র জলে,
পথহারা নাবিকের মত ভাসতে ভাসতে
কূলে এনে তোমাকে করি নোঙর।
তোমার মুখ তোমার বাহু তোমার উরু তোমার পা অতলে ডুবুক,
আমি উন্মত্ত ডুবুরির মত খুঁজে নেব সমুদ্রের
অতল তল থেকে।
কত হাঙ্গর এল, কত কুমিড়, কত জলদ হস্তি —
তোমাকে নিয়েই যত কাড়াকাড়ি,
ওদের যত কামজ লালসা তোমার তনুজে,
আমাকেই লড়তে হয় দূরন্ত নাবিকের মত
নির্ভীক একা।
ভাসতে ভাসতে ডুবতে ডুবতে তুমি বলো–
মন্থন কর।
ঝিনুকমুক্তার খোঁজে ভাসি রুপালি জলে আমিও,
কত যে সাঁতরাতে হয়, ক্লান্তিহীন।
৫৯. কত দিনের কত কথা
মেঘ ঝরঝর বৃষ্টি , বৃষ্টি ভেজা রোদ্দুর, রংধনু
আছে কী নেই, এইসব কোনো মনখারাপ করেনা, মনখারাপ করে দাও তুমি।
তুমি আসো বা না আসো, তোমাকে পাই বা না পাই
ভালোবাসো আর না বাসো, এই সবের আক্ষেপ না আক্ষেপের যত কারণ হচ্ছ তুমি।
শিউলি ফুলের রেণুর গন্ধের জন্য না
স্নানের পর ভেজা চুলের সুবাসের জন্য না
রুপালি কোনও জলের জন্য না
শরীরের কোনও গোপন ঝিনুকের জন্য না,
আমার সকল মনখারাপের কারণ হচ্ছ তুমি।
রাতবিরেতে জ্যোৎস্না তলায় একাকী হাঁটি
নির্জন সেই পথ, ঘুম আসেনা
ঘুমের বাইরে, স্বপ্নের বাইরে কাউকে খুঁজি না।
অন্য কাউকে চাইও না,পাইও না, জীবনের মর্মমূলে তুমি, তোমার জন্যই আমার যত মনখারাপ।
৬০. নিশীথের পদাবলী
কী এক বিস্ময়কর ঝাঁকুনিতে দুলে উঠেছিল রাতের প্রথম প্রহর
নক্ষত্রেরা ছিন্নভিন্ন হলে দূর থেকে শুধু বিষাদ ভেসে আসে।
প্রগাঢ় চুম্বনে তুমি বিষণ্নতা মুছে নাও
রাত্রির আঁধার গভীর হলেই ক্রমশ চঞ্চল হয়ে ওঠো
নিশীথের সুররাগ কী আমরা জানি না, মূর্ছনাও —
শুধু নিশাচর পাখিরা ম্লান মেঘ ভেদ করে
ঘুমন্ত চরাচরের দিকে উড়ে উড়ে চলে গিয়েছিল।
****
Leave a Reply