ব্ল্যাকহোল – স্টিফেন হকিং
বিবিসি রিথ লেকচারস
ভাষান্তর – আবুল বাসার
প্রথম প্রকাশ : চৈত্র ১৪২৭, এপ্রিল ২০২১
প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশন
Black Hole by Stephen Hawking
Translated in Bangla by Abul Bashar
উৎসর্গ
কবিকে দিও না দুঃখ, দুঃখ দিলে সে-ও জলে স্থলে
হাওয়ায় হাওয়ায়
নীলিমায় গেঁথে দেবে দুঃখের অক্ষর।
কবি আলতাফ শাহনেওয়াজকে
অনুবাদকের কথা
কিছুদিন আগপর্যন্তও কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে দ্বিধান্বিত ছিলেন বিজ্ঞানীরা। একদা আপেক্ষিক তত্ত্বের জনক খোদ আলবার্ট আইনস্টাইনও কৃষ্ণগহ্বরকে মানতেই চাননি। রীতিমতো অঙ্ক কষে কৃষ্ণগহ্বরের ধারণা বাতিল করার চেষ্টা করেন তিনি। একটা নক্ষত্র তার জীবনকালের শেষ দশায় দুমড়ে-মুচড়ে এমন চরম ঘনবদ্ধ অবস্থায় চলে যেতে পারে, তা আইনস্টাইন বিশ্বাসই করতে পারেননি। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তাঁর আবিষ্কৃত আপেক্ষিক তত্ত্ব ব্যবহার করেই তাত্ত্বিকভাবে কৃষ্ণগহ্বরের ধারণায় এসে পৌঁছেছিলেন বিজ্ঞানীরা। আবার বর্তমানেও কৃষ্ণগহ্বরের গঠনপ্রক্রিয়া কিংবা কৃষ্ণগহ্বর আবিষ্কারের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে তাঁর ওই তত্ত্বটিই। এখন তো চারদিকে কৃষ্ণগহ্বরের জয়জয়কার। কিছুদিন আগে প্রথমবারের মতো ছবি তোলা সম্ভব হয় কৃষ্ণগহ্বরের। তারও কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের লাইগো ডিটেক্টরে শনাক্ত হয় ১.৩ বিলিয়ন বছর আগে বহুদূরের দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষে সৃষ্ট মহাকর্ষ তরঙ্গ। এর পরের বছর, ২০১৭-তে এই মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করার পেছনের কুশীলব হিসেবে কাজ করে নোবেল পুরস্কার পান তিনজন। তাঁরা হলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী কিপ থর্ন, ব্যারি ব্যারিশ ও রেইনার ওয়েস। আবার ২০২০ সালের নোবেল পুরস্কার উঠেছে পদার্থবিদ রজার পেনরোজের হাতে। তার পেছনের কারণও ওই কৃষ্ণগহ্বর। অনেকে বলছেন, স্টিফেন হকিং বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁর ভাগ্যেও জুটতে পারত একখানা নোবেল পুরস্কার। কাজেই কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব এখন কাগজে-কলমে নয়, বরং তার সপক্ষে ভূরি ভূরি প্রত্যক্ষ প্রমাণও আছে।
সত্যি বলতে গেলে, জীবনভর মহাকাশের এই অজানা-উড়ন্ত উদ্ভট বিষয়টি নিয়েই গবেষণা করে গেছেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হকিং। এভাবে তিনি একদিন প্রমাণ করেন, কৃষ্ণগহ্বর আসলে পুরোটা কালো নয়। মহাকাশের এই রহস্যময় বস্তু থেকেও বেরিয়ে আসতে পারে একধরনের বিকিরণ। তাঁর সম্মানে এই বিকিরণকে এখন বলা হয় হকিং বিকিরণ
বর্তমান কালের বহুল আলোচিত বিষয় কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী, গবেষক সবারই তীব্র কৌতূহল। সাধারণের সেই কৌতূহল মেটাতে বই লিখেছেন হকিং, দিয়েছেন বিজ্ঞানবক্তৃতা। জনপ্রিয় রেডিও অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছেন কৃষ্ণগহ্বরকে বিষয়বস্তু করে। তেমনি এক অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নেন বিবিসি রেডিওতে। বিবিসি রেডিওর জনপ্রিয় অনুষ্ঠান রিথ লেকচার। বিবিসির সাবেক ডিরেক্টর জেনারেল লর্ড রিথের নামে ১৯৪৮ সালে চালু হওয়া এ অনুষ্ঠানে বিশ্বের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা অংশ নেন। ২০১৬ সালে এ অনুষ্ঠানে পরপর দুটি আলোচনায় অংশ নেন হকিং। স্বাভাবিকভাবে তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল কৃষ্ণগহ্বর। ওই আলোচনায় সঞ্চালক ছিলেন ‘বিবিসি নিউজ’-এর সায়েন্স এডিটর ডেভিড শুকম্যান। ওই বছরের ২৬ জানুয়ারি এবং ২ ফেব্রুয়ারি লেকচার দুটি সম্প্রচার করা হয়। পরবর্তী সময়ে হকিংয়ের ওই আলোচনা দুটি প্রকাশিত হয় বই আকারে। ব্ল্যাকহোল শিরোনামের সে বইয়ের অনুবাদ আপনার হাতের বইটা।
আক্ষরিক অর্থেই মূল বইটা একেবারে ছোট আকৃতির। তাই প্রাসঙ্গিক হবে ভেবে কৃষ্ণগহ্বরসংক্রান্ত হকিংয়ের আরেকটি দীর্ঘ লেখা এই বইয়ে সংযোজন করা হয়েছে। এ লেখায় কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে আরও বিশদ আলোচনা করেছেন তিনি। পাশাপাশি নামকরা একটা ম্যাগাজিনে হকিংয়ের দেওয়া দীর্ঘ একটা সাক্ষাৎকারও এতে যোগ করা হয়েছে। এ সাক্ষাৎকারে নিজের জীবন, গবেষণা, কৃষ্ণগহ্বরসহ নানা বিষয়ে অকপটে কথা বলেছেন হকিং। এগুলো এ বইয়ের বাড়তি মাত্রা যোগ করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
সবশেষে বইটা পাঠকদের ভালো লাগলেই আমার শ্রম সার্থক বলে মনে করব। সবাইকে ধন্যবাদ।
হ্যাপি রিডিং।
আবুল বাসার
ডিসেম্বর, ২০২০
মোহাম্মদপুর, ঢাকা
[email protected]
ভূমিকা
স্টিফেন হকিং সম্পর্কে সবকিছুই মুগ্ধতার উৎস : আসলে প্রতিশ্রুতিশীল এক জিনিয়াস দুর্ভাগ্যক্রমে অসুস্থ দেহে আটকা পড়েছেন। মুখের একটিমাত্র পেশি নাড়াতে পারেন তিনি। তবু সে মুখে উজ্জ্বল হাসির ইঙ্গিত। মহাবিশ্বে-মহাকাশের অদ্ভুত সব কোণে তাঁর মন ঘুরে বেরিয়ে যেসব আবিষ্কার করেন, তা ভাগাভাগি করে নিতে আমাদের সাদর আমন্ত্রণ জানায় তাঁর অনন্য রোবটিক কণ্ঠস্বর। সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের প্রথাগত গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছেন এই অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব। অবাক ব্যাপার হলো, তাঁর আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম বইটি ১০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। তিনি জনপ্রিয় কমেডি শোতে নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন, হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রিত হয়েছেন এবং নিজের জীবন নিয়ে নির্মিত সমাদৃত চলচ্চিত্রের কারণে তারকা হিসেবেও তাঁর আসন স্থায়ী করেছে। তাঁর অর্জন বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানীর চেয়ে কম অংশে কম নয়।
১৯৬০-এর দশকে মোটর নিউরন রোগ ধরা পড়ে হকিংয়ের। তখন তাঁর আয়ু মাত্র দুই বছর বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অর্ধশতকের বেশি সময় পর এখনো তিনি দিব্যি গবেষণা করছেন, লিখছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর নিয়মিত সংবাদের শিরোনাম হচ্ছেন। তাঁর মেয়ে লুসি এই অসাধারণ প্রেরণাকে বর্ণনা করেছেন ‘অত্যন্ত জেদি’ হিসেবে। [এ ভূমিকাটি লেখার দুই বছর পর, অর্থাৎ ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ মারা যান স্টিফেন হকিং।]
তাঁর ব্যক্তিগত গল্প বেদনাদায়ক হোক কিংবা তাঁর প্ররোচিত করার ক্ষমতা হোক, হকিং কল্পনাটা ধরতে পারেন। একসময় তিনি হুঁশিয়ারি করেছিলেন, মানবজাতি একের পর এক নিজেদের তৈরি করা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। সেই বিপর্যয়গুলোর মধ্যে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা থেকে শুরু করে কৃত্রিমভাবে বানানো ভাইরাস। বিবিসি ওয়েবসাইটে তাঁর এই হুঁশিয়ারি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ছিল ওই সময় সবচেয়ে পঠিত।
ভয়াবহ বিড়ম্বনার ব্যাপার হলো, এমন মহান একজন বক্তা হয়েও তিনি স্বাভাবিক আলাপচারিতা চালিয়ে যেতে সক্ষম নন। তাই সাক্ষাৎকারের জন্য তাঁকে আগে থেকে প্রশ্ন পাঠিয়ে দিতে হয়। কয়েক বছর আগে, আমাকে অপ্রয়োজনীয় আলোচনা না করতে সতর্ক করেন তাঁর সহকর্মী। কারণ, সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত প্রশ্নটির উত্তরের জন্যও তাঁকে অনেকক্ষণ ধরে কষ্ট করে কম্পোজ করতে হয়। তবে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সেই উত্তেজনায় আমি বোকার মতো প্রশ্ন করে বসেছিলাম, ‘কেমন আছেন?’ এরপর তাঁর উত্তরের অপেক্ষা করতে করতে অপরাধবোধে ভুগতে বাধ্য হই। তিনি ভালোই ছিলেন।
তাঁর কেমব্রিজ অফিসে একটি বোর্ডে অনেকগুলো প্রশ্ন দিয়ে ভরা। কসমোলজিতে সবচেয়ে সূক্ষ্ম ধরনের গণিতের চল। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় স্টিফেন হকিংয়ের অনন্য অবদান হলো, দৃশ্যত খুবই আলাদা বিশেষায়িত এসব পন্থায় লাগাম পরানো। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটা হলো, পরমাণুর ভেতরের ক্ষুদ্র কণাগুলোর গবেষণায় ব্যবহৃত বৈজ্ঞানিক কৌশলটি তিনিই প্রথম বিপুল পরিসরের স্থান অনুসন্ধানে ব্যবহার করেছেন।
তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রটি আক্ষরিক অর্থেই জটিল। তাই স্বাভাবিকভাবে এ ক্ষেত্রটিতে জড়িত তাঁর সহকর্মীরা হয়তো আশঙ্কা করতে পারেন যে তাঁদের গবেষণা কখনোই সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য হয়ে উঠবে না। কিন্তু তারপরও ব্যাপক পাঠকসমাজের কাছে পৌছানোর প্রাণপণ চেষ্টাটাই হকিংয়ের ট্রেডমার্ক। চলতি বছর বিবিসি রিথ লেকচারে, দুটি ১৫ মিনিটের আলোচনায় কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে নিজের জীবনব্যাপী অন্তর্দৃষ্টিকে সংক্ষিপ্ত করার চ্যালেঞ্জ হাতে নেন হকিং। যাঁরা এ বিষয়ে আগ্রহী, কিন্তু ধাঁধার মধ্যে আছেন কিংবা এই ধারণায় বিমুগ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বিজ্ঞান সম্পর্কে একটু ভীত, তাঁদের জন্যই এই আলোচনা। তাঁদের সহায়তা হবে ভেবেই মূল বিষয়গুলোর সঙ্গে আমিও কিছু মন্তব্য জুড়ে দিয়েছি।
ডেভিড শুকম্যান
সায়েন্স এডিটর, বিবিসি নিউজ
Sudipta Roy
I want to download books.
Sudipta Roy
I want to download books