ব্লু ফ্লাওয়ার – ৩
পর্ব ৩
ভূমিকা
.
দোকান থেকে রিয়াজ যখন লাখমা কিনে বাড়ির পথে রওনা দিল তখন সময়টা গোধূলি । আলো আধারির খেলায় তাদের বোমাবিধ্বস্ত শহরটা চেষ্টা করছে উঠে দাঁড়াতে। মাস খানেক আগেও রাস্তায় বেরনো যাচ্ছিল না। এখন দেশের সেনা অনেকটাই দখল নিয়েছে রাজপথের। সন্ত্রাসীরা পিছু হটেছে। গ্রামের বাড়িতে সব কিছু ছেড়ে পালাতে হয়েছিল রিয়াজকে। গতকালই বাড়ির সবাইকে নিয়ে শহরে ফিরেছে সে।
আজ তৈল শোধনাগারে জয়েন করেছে। কারখানায় খুশির আমেজ। প্রথমদিনেই মালিকপক্ষ তাদের পাওনাগন্ডা বুঝিয়ে দিয়েছে। পরের মাস থেকে আমেরিকা সরকার তাদের কারখানা অধিগ্রহণ করছে। সুখের কথা হল তাদের চাকরি যাচ্ছে না। দেশের অর্থনীতি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে আশা করা হচ্ছে। জেহাদের নামে খুনখারাপি নতুন সরকার মানবে না কথা দিয়েছে। ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়েছে। বর্ডার সিল করে দেওয়া হয়েছে। আমেরিকা থেকে ব্যাপক হারে সেনা পাঠানো হয়েছে। রাজপথে ঘুরছে ট্যাঙ্কার।
বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস ধরে তাদের বাড়ির কাছের স্টপে নামল রিয়াজ।
সোহানের মুখটা ভেসে উঠল। ছেলেটা লাখমা খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিল গ্রাম থেকেই। এইটুকু বয়সেই কথার চাষ করা শিখে গেছে ছেলেটা। বাড়ি এলেই তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমিনার কথা ভেবে খুশি হল রিয়াজ।
আমিনার খুব ইচ্ছা ছিল শহরের স্কুলে পড়াবে ছেলেকে। সব কিছু যখন ঠিক হয়ে গেছে, এবারে নিশ্চয়ই স্কুলও শুরু হবে। সোহানকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে গেছিল রিয়াজ। তাদের ব্যালকনিতে সোহানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমিনা। তার ফেরার সময়টা। আগে যেরকম দাঁড়াত।
সোহান তাকে দেখামাত্র হাত নাড়াল। রিয়াজ হাটায় জোর দিল।
আরেকটু দূরেই অ্যাপার্টমেন্ট।
আমিনা তাকে দেখে হাসছে।
রিয়াজ দাঁত বের করল।
তার বউটা এত সুন্দর কেন? এই হাসি দেখলেই সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যেতে ইচ্ছা করে।
রিয়াজ প্রতিদিনের মত চোখ বন্ধ করে সর্বশক্তিমান প্রভুকে ধন্যবাদ দিল আমিনার মত একজন বউ দেবার জন্য।
চোখ খুলে আমিনার দিকে হাত বাড়াল।
ঠিক এই মুহূর্তে চারপাশ কাঁপিয়ে প্রবল শব্দে কিছু একটা তাদের অ্যাপার্টমেন্টের ওপর পড়ল। রিয়াজ গত ক’দিনের অভ্যাস মত রাস্তায় শুয়ে পড়েছিল। পরক্ষণেই মাথায় এল আমিনা আর সোহানের কথা। লাফ দিয়ে উঠতেই আবার প্রবল শব্দে তাদের অ্যাপার্টমেন্টে আরেকটা বিস্ফোরণ হল। এবারে আর রিয়াজ শুল না।
প্রবল ধুলো, আর ইটে ধোঁয়াশার মধ্যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
আরেকটু এগোতেই দেখা গেল যে ব্যালকনিতে আমিনা সোহানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেই ব্যালকনিটাই এখন আর দেখা যাচ্ছে না।
কংক্রিটের কংকাল তার দিকে তাকিয়ে বিশ্রী হাসি হাসছে।
রিয়াজ আর্তনাদ করে উঠল প্রবল যন্ত্রণায়।
এই দুঃস্বপ্নটাই তো সে দেখে এসেছে এতদিন ধরে।
সত্যি হয়ে গেল শেষ মেষ?
.
১
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গম্ভীর মুখে বললেন “কাশ্মীর ইজ ডিটোরিয়েটিং এভ্রি ডে তুষার”।
তুষার বললেন “নট অনলি ইন ইন্ডিয়া স্যার। ইন বোথ রিজিয়ন দ্য সিচুয়েশন ইজ গেটিং টেরিবল”।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তুষারের দিকে তাকিয়ে অবাক গলায় বললেন “বোথ রিজিয়ন মিনস? ও পারেও? কেন, কী হয়েছে ওদিকে?”
তুষার বললেন “কিছু বাইরের দেশ থেকে আর্মস ইমপোর্ট করছে টেররিস্ট অরগানাইজেশনগুলো। পাকিস্তান গভর্নমেন্ট পর্যন্ত এদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। ওরা প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র শস্ত্র মজুত করেছে। পাকিস্তানি আর্মির একাংশের মদত আছে”।
মন্ত্রী বললেন “সে তো থাকবেই। আমাদের এই মুহূর্তে কী করা উচিত বলে আপনি সাজেস্ট করেন?”
তুষার বললেন “উই হ্যাভ টু ক্রিয়েট প্রেশার। আমাদের কাছে কিছু ফটোগ্রাফস এসেছে, সেগুলো আমরা ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ার কাছে তুলে ধরতে পারি। আই এস আই চিফ সরফরাজের সঙ্গে কাশেম সোলেমানির মিটিং এর কিছু সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে। আমাদের সেটা নিয়েও প্রেশার ক্রিয়েট করা প্রয়োজন”।
মন্ত্রী একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন “ওকে, লেটস ডু দ্যাট। ওয়ান মোর থিং তুষার, আপনার অফিসাররা উইদাউট আওয়ার পারমিশন এফ বি আইকে পেশোয়ার সম্পর্কে ডেটা সাপ্লাই করেছে বলে একটা অভিযোগ উঠছে, এটা নিয়ে একটা ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারি করতে হবে আপনাকে। সায়ককে শো কজ করতে হবে”।
তুষার হাসলেন “ওকে স্যার। কিন্তু আমার একটাই প্রশ্ন আছে। পেশোয়ারে কাশেম সোলেমানি আছে, এটা আমরা জানলে কী করতে পারতাম? আদৌ কি কিছু করতে পারতাম? আর আমাদের সিচুয়েশন ডিটোরিয়েট করলে ডিসিশন নিজেদেরই নিতে হয়। সে দিন আর্মি আমাদের ঘাটি খুঁজে পেলে কী হত আশা করি আপনাকে এক্সপ্লেইন করতে হবে না”।
মন্ত্রীও হাসলেন “আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আমি তো জাস্ট একটা রুটিন এনকোয়ারি করতে বললাম। তারা একটা রিপোর্ট দিয়ে দেবে সায়ক এটা করে নি। ব্যস। মিটে যাবে ঝামেলা”।
তুষার বললেন “সরি স্যার, কিন্তু আমার মনে হয়, এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি না ঘাঁটানোই ভাল। যে মুহূর্তে আমরা এটা নিয়ে নাড়াচাড়া করব, সরকারি নথি তৈরী হবে, সে মুহূর্তে ব্যাপারটা অফিশিয়াল হয়ে যাবে। আমরা এই নিয়ে বেশি না এগোলেই ব্যাপারটা সবার জন্য ভাল হবে বোধ হয়”।
মন্ত্রী তুষারের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বললেন “ওকে। আপনার কথা আমি মেনে নিচ্ছি। সায়ক কোথায় এই মুহূর্তে?”
তুষার বললেন “আমি জানি না স্যার, কোন যোগাযোগ নেই”।
মন্ত্রী বললেন “আপনি জানেন না, নাকি বলতে চাইছেন না?”
তুষার মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। কিছু বললেন না।
মন্ত্রী বললেন “ওকে, আমি আপনাকে এই নিয়ে বেশি বিব্রত করব না। আমাকে শুধু আপনি কাশ্মীরটা নিয়ে হেল্প করুন। গত সাতদিনে তেরো জন সরকারি কর্মচারী খুন হয়েছেন, তাদের মধ্যে পাঁচ জন পুলিশ। কাশ্মীর সরকারের লোক পর্যন্ত অনন্তনাগ যাওয়ার আগে দুবার ভাবছে। শ্রীনগরে আর্মি ক্যাম্প হামলা হতে পারে যে কোন মুহূর্তে। এভাবে ক’দিন চলবে বলুন তো?”
তুষার বললেন “যেখানে পলিটিশিয়ানরা অবধি যেতে ভয় পায় সেখানে আমাদের আর্মি আছে তো স্যার। চিন্তা করছেন কেন? এভাবে আমি অন্তত বেশিদিন চালাতে দেব না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন”।
মন্ত্রী কাঁধ ঝাঁকালেন “ওকে। দেখা যাক, কী করেন আপনারা। আশা করি জানেন কাশ্মীরে একটা বিদ্রোহ দমন করতে গেলে কী পরিমাণ আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়”।
তুষার বললেন “সে তো নিশ্চয়ই। চাপটা তো শুধু… ঠিক আছে স্যার। আমি আসছি”।
মন্ত্রী গম্ভীর মুখে তুষারের দিকে তাকিয়ে বললেন “কী হল জানাবেন”।
তুষার বললেন “সারটেনলি স্যার”।
মন্ত্রীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে তুষার নিজের গাড়িতে বসলেন।
গোটা দিল্লি কুয়াশার চাদরে ঢাকা এই দিনের বেলাতেও।
গাড়ি অত্যন্ত ধীর গতিতে এগোচ্ছিল।
তুষার নোটপ্যাড বের করে জরুরি কিছু তথ্য নোট করছিলেন, এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল।
তুষার ধরলেন “হ্যালো”।
ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল “সন্দেশে আতে হ্যায়, হামে তড়পাতে হ্যায়, কে ঘর কব আওগে”।
সায়ক।
তুষার হেসে ফেললেন।
.
২
“শেষ কবে এসিতে ছিলাম ভুলে গেছি মিয়াঁ। কী বিচ্ছিরি গরম বলত?”
গরমে ছটফট করতে করতে বলল আব্বাস।
সায়ক চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। বলল “বাড়িতে গিয়ে এসি চালিয়ে শুয়ে থেকো। হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির কথা মনে করে ভাল থাকার চেষ্টা কর”।
আব্বাস বলল “আর ক’দিন এভাবে লাহোরে পড়ে থাকতে হবে?”
সায়ক বলল “যতক্ষণ না সিগন্যাল আসছে। কিচ্ছু করার নেই”।
আব্বাস হতাশ গলায় বলল “ধুস মিয়াঁ। তোমার ওপর কত আশা ছিল আমার। ভেবেছিলাম তুমিই সব ব্যবস্থা করে ঠিক দেশে নিয়ে যাবে। এখন দেখছি তোমার ক্ষমতা আমার চেয়েও কম”।
সায়ক হেসে ফেলল। বলল “বাড়ি যাবার জন্য যদি এত ছটফটই করতে হয় তাহলে এই চাকরি বাছলে কেন?”
আব্বাস বিরক্ত গলায় বলল “সে অনেক গল্প। আমার কি আজকে এখানে থাকার কথা নাকি? আমার বন্ধুরা সবাই বাইরে আছে”।
সায়ক বলল “তুমিও তো বাইরে আছো”।
আব্বাস বলল “ও মিয়াঁ, কার সঙ্গে কার তুলনা হয়? আমি যে আছি, এখানে কাউকে আমার পরিচয় দিতে পারব? এই একটা বাড়িতে কতদিন ধরে আটকে বসে আছি। কবে যাব, কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার বন্ধুরা কেউ থাকে ইউ এস এ, কেউ থাকে দুবাই, কেউ থাকে আবু ধাবি… আর আমি?”
সায়ক বলল “তুমি গোটা দেশকে রিপ্রেসেন্ট করছ। তোমার যে বন্ধু সব থেকে বেশি মাইনেও পায়, তার থেকেও বেশি উপকার তুমি নিজের দেশের জন্য করছ। নিজের ওপর গর্ব কর, নিজেকে ঘেন্না করে কারো কোনদিন উপকার হয় নি আব্বাস”।
আব্বাস কিছুক্ষণ গোঁজ হয়ে বসে থেকে বলল “দেখো মিয়াঁ, আমি সত্যিই ক্লান্ত। আর পারছি না। ইসলামাবাদে কী করি নি বলত? লোকের জুতো পালিশ অবধি করেছি। আমাদের দিকটাও তো আমাদের লোকেদের দেখা উচিত। আর কতদিন এভাবে লাহোরে পড়ে থাকব?”
“পাঞ্জাবের কিন্তু একেবারেই কাছে বুঝলে লাহোর? এখানকার লোকের কথা বার্তা সবই পাঞ্জাবের মতই। পাকিস্তানের পাঞ্জাবেই আছি আমরা আপাতত”। কথা ঘোরাতে চেষ্টা করল সায়ক।
আব্বাস বলল “এর থেকে আমরা কিন্তু ইসলামাবাদ গিয়ে অন্য কিছু একটা চেষ্টা করতে পারতাম”।
সায়ক বলল “কী চেষ্টা?”
আব্বাস বলল “নকল পাসপোর্টের ব্যবস্থা করতাম। তারপর দুবাই গিয়ে সেখান থেকে ইন্ডিয়ান এমব্যাসিতে কন্ট্যাক্ট করে দেশে ফেরা। ইজি”।
সায়ক বলল “যদি নকল পাসপোর্ট এরা চিনে নিত? তাহলে কী করতে?”
আব্বাস মরিয়া হয়ে বলল “কেউ ধরতে পারবে না। অত সোজা নাকি? প্লিজ মিয়াঁ, ইসলামাবাদ যাই আমরা”।
সায়ক কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে বলল “তৈরী হয়ে নাও। আমরা ওয়াঘা যাচ্ছি”।
আব্বাস তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বলল “বর্ডার পার করবে?”
সায়ক বলল “না, বর্ডারে ফ্ল্যাগ মার্চ দেখতে যাব। আবার চলে আসব”।
আব্বাস উঠল। বলল “উফ, কতদিন পর নিজের দেশ দেখতে পাব”।
সায়ক বলল “উৎসাহের আতিশয্যে আবার জয় হিন্দ বলে দিও না। ওরা কিন্তু একটু বেচাল দেখলেই…”
আব্বাস বলল “বুঝেছি বুঝেছি। সব সময় এক ভয় দেখিয়ে যাচ্ছ”।
দুজনে তৈরী হয়ে নিল। ডেরা থেকে বেরিয়ে খানিকটা পথ হেঁটে বাস স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছল তারা। সায়ক চোখে সুরমা লাগিয়েছে। আব্বাসকেও দিয়েছে।
বাস এলে দুজনে উঠে বসল।
ভর্তি বাস। ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতে পাকিস্তানের পতাকা। একজন বাচ্চা এসে তাদের হাতেও ছোট দুটো পতাকা দিয়ে গেল।
সায়ক বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
আব্বাস ফিসফিস করে বলল “নাও, এবার এদের পতাকা নিয়েও নাচানাচি কর”।
সায়ক বলল “উগ্র জাতীয়তাবাদ থাকলে স্পাইগিরি করে এজন্মে পেট চালাতে হবে না হে। জাস্ট চেপে যাও। সবার সঙ্গে মিশে থাকো”।
আব্বাস গোমড়া মুখে বসে থাকল।
ঘন্টাখানেক লাগল ওয়াঘা বর্ডার পৌঁছতে।
ভারতের গ্যালারিতে প্রচুর লোক সমাগম হয়েছে। দেশাত্মবোধক গান বাজছে। বাচ্চারা সে তালে তালে নাচছে।
পাকিস্তানের বাচ্চারাও বাস থেকে নেমে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে লাগল।
উৎসবের পরিবেশ।
সায়ক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভারতবর্ষের গ্যালারির দিকে তাকিয়ে থাকল।
.
৩
গ্রামের নাম ওয়াজুরা।
অনন্তনাগ জেলার মধ্যে গ্রামটি।
লিডার নদী বয়ে চলেছে গ্রামের পাশ দিয়ে।
এ গ্রামের লোকসংখ্যা অত্যন্ত কম। সেনা ছাউনি আছে গ্রামের বাইরে৷ মাঝে মাঝে অবশ্য সেনারা টহল দিয়ে যায়।
গ্রামের ভেতরে একটা ছোট বস্তি আছে। সেখানেই একটা বাড়িতে ইসমাইল আব্বাস আস্তানা গেড়েছে। বাড়িটা মাটির। এক বুড়ো বুড়ি থাকেন। ইসমাইল তাদের ভয় দেখিয়ে রেখেছে। বুড়ো বুড়িকে বলে দিয়েছে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে যেন শ্রীনগর থেকে ভাইপো এসেছে। দুদিন পরেই চলে যাবে।
একটা ঘর নিয়ে রয়েছে সে। গাল ভর্তি দাড়ি। সারাদিন শুয়ে থাকে আর মাঝে মাঝেই খাটের তলায় একটা ট্রাংক খুলে অস্ত্র শস্ত্রগুলো ঠিক আছে নাকি দেখে নেয়।
সন্ধ্যে নেমেছে।
ইসমাইল নামাজ শেষে করে চুপ করে বসেছিল। এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল। ইসমাইল ফোন তুলল, ওপাশ থেকে ভেসে এল “কী খবর?”
ইসমাইল বলল “কোন খবর নেই। আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষাতে আছি”।
ওপাশের গলা একটু চুপ করে থেকে বলল ” আল্লাহ তোমাদের মত বান্দাদের জন্য আলাদা জায়গা রেখেছেন তার জন্নতে৷ তোমরা তার খাস বান্দা”।
ইসমাইল বলল “শুক্রিয়া”।
“সময় নষ্ট হচ্ছে”৷
“সে তো ঠিকই। কতদিন আর এভাবে বসে থাকব?”
“আগামীকাল শ্রীনগরে সেন্ট্রালের মিনিস্টার আসছে। তার জন্য আজ কোন সুখবরের ইন্তেজাম করা যাবে?”
ইসমাইল নড়ে চড়ে বসে অবাক গলায় বলল “এখন বলছেন? আরেকটু আগে বললে ভাল হত”।
“আগে পরে তো কিছু হয় না৷ তার ইচ্ছাতেই সব হয়। তিনি যদি মনে করেন তবে আজকেই হবে। এখনই হবে”।
ইসমাইল বলল “রাখছি এখন। এসে কথা হবে ইনশাআল্লাহ”।
“আবার যদি ধরা পড়…”
“ধরা এবার একবারই পড়ব। আল্লাহর কাছে”।
দৃঢ়প্রতিজ্ঞ গলায় কথাটা বলে ফোনটা কেটে দিল ইসমাইল। মিনিট তিনেকের মধ্যে তৈরী হয়ে নিয়ে বাড়ির বাইরে এল। বুড়ো বসেছিল। তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। ইসমাইল কড়া গলায় বলল, “জলদি আসছি। দরজা খোলা রাখবি”।
ইসমাইল বাড়ি থেকে বেরিয়ে জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। খানিকক্ষণ পরে একটা বাড়ির দরজায় তিনবার টোকা মারল। একজন যুবক দরজা খুলল। তাকে দেখে গলা নামিয়ে বলল “কোথাও যাবার আছে?”
ইসমাইল বলল “বাইক বের কর”।
ছেলেটা ইসমাইলের নির্দেশ শোনামাত্র বাড়ির ভিতরে গিয়ে মিনিট দুয়েকের মধ্যে বাইক নিয়ে হাজির হল। ইসমাইল বাইকের পিছনে বসে পড়ল। ঠান্ডা পড়েছে তবে ইসমাইলকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল না সেটা৷ সে চোয়াল শক্ত করে বসে ছেলেটাকে রাস্তার দিকনির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল।
একটু পরেই তারা পেট্রোল পাম্পের সামনে এসে গেল। দেখা গেল পাম্পের একটু দূরের শাটার দেওয়া দোকানটায় আর্মির দুজন জওয়ান দাঁড়িয়ে আছে।
বাইকটা একটু দূরে দাঁড় করাল ছেলেটা। ইসমাইলকে বলল “আর্মি আছে”।
ইসমাইল জওয়ান দুজনের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছেলেটাকে বলল “সে তো আমিও দেখেছি। বাইক নজদিক কর”।
ছেলেটা চমকে বলল ” জওয়ান তো”।
ইসমাইল হেসে বলল “এইগুলোকে মেরেই বেশি মজা। চালা বাইক”।
ছেলেটা গাইগুই করছিল ইসমাইল ছেলেটার মাথায় একটা চাপড় মারল। ছেলেটা আর দ্বিরুক্তি না করে বাইক স্টার্ট দিল। হাত কাঁপছিল ছেলেটার।
জওয়ান দুজনের একজন ছেলেটার দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল। নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলে চেচাল৷
“ওখানেই দাঁড়া”।
ইসমাইল চাপা গলায় বলল “নজদিক লে, নজদিক লে”।
ছেলেটা ভয় পেয়ে বাইকের গতি বাড়িয়ে দিল।
জওয়ান দুজন কিছু একটা আন্দাজ করে বন্দুক বের করতে যাবে ঠিক সেই সময় কোমর থেকে রিভলভার বের করে নিখুঁত নিশানায় দুজন জওয়ানেরই কপালে গুলি চালাল ইসমাইল। দুজনে পড়ে গেল। রিভলভারে সাইলেন্সার ছিল। কোন শব্দ হল না। ভয়ে ছেলেটার হাত কাঁপছিল। ইসমাইল বলল “চল, চল, গাঁও চল, জলদি”।
ছেলেটা বাইক ঘোরাতে গেল৷ কিন্তু ঠিক করে ঘোরাতে পারল না খানিকটা স্নায়ুর চাপেই। গাড়ি নিয়ে পড়ে গেল। ইসমাইলও পড়ে গেছিল, তবে তার ফিটনেসের জোরে সে উঠে দাঁড়াল। ছেলেটাকে একটা চড় মেরে বলল “শালে বাইক চালানে কা আউকাত নেহী, নিকলে জিহাদ করনে মাদারচোদ”।
ছেলেটা কাতরাচ্ছিল। ইসমাইল বাইকটা ডাবল স্ট্যান্ড করে ছেলেটাকে বাইকের পেছনে বসিয়ে বাইক স্টার্ট দিল। খানিকটা দূর থেকে গাড়ির আওয়াজ আসছিল। ইসমাইল বাইকটা নিয়ে পেট্রোলপাম্পের ভিতরে ঢুকল। শুনশান পেট্রোলপাম্প। কর্মীরা ভেতরে বসে আছে শীতের মধ্যে। বাইক দেখে একজন বেরিয়ে এল। ইসমাইল ঠান্ডা গলায় তাকে বলল “ফার্স্ট এইডের কিছু আছে? বাইক থেকে পড়ে গেছে আমার ভাই”।
লোকটা আবার পাম্পের ভেতরে ঢুকল। একটা বড় আর্মির ট্রাক পাম্পের বাইরের দোকানটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। টহলে বেরিয়েছিল।
জওয়ান দুজনকে পড়ে থাকতে দেখেছে। ইসমাইল ব্যাপারটা আঁচ করে আর অপেক্ষা করার ঝুঁকি নিল না। বাইক স্টার্ট দিয়ে পাম্পের উলটোদিকের রাস্তায় ঢুকে গেল। পেট্রোলপাম্পের যে লোকটা অফিসে ঢুকেছিল ফার্স্ট এইড বক্স আনতে সে দৌড়তে দৌড়তে এল। চলে যাওয়া বাইকটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।
.
৪
রাত সাড়ে দশটা।
প্রেসিডেন্ট নিয়াজি খানিকক্ষণ আগে ডিনার করেছেন।
ড্রয়িং রুমে বসে নিউজ চ্যানেল দেখছিলেন।
তার খাস খানসামা জাকির খান তার সোফার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।
নিয়াজি জাকিরকে বললেন “দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। বসুন আপনি”।
জাকির হেসে বলল “কী যে বলেন জনাব। এ তো অসম্ভব কথা”।
নিয়াজি বললেন “শুনুন, অসম্ভব কোন কিছুই নয়। প্রেসিডেন্ট হাইজের প্রটোকল আমিও জানি। কিন্তু আপনি ভুলবেন না আমি একজন আর্মি ম্যানও বটে। আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে আমার নিজেরই খারাপ লাগছে। প্লিজ হ্যাভ এ সিট”।
জাকির খানিকটা ইতস্তত করে অত্যন্ত কুন্ঠার সঙ্গে সোফার ওপরে বসল।
নিয়াজি বললেন “আপনি এই হাউজে কতদিন ধরে আছেন?”
জাকির বলল “তা জনাব আমার চাকরি জীবনের অধিকাংশ সময় এখানেই কেটে গেল। পঁচিশ বছর তো আছিই”।
নিয়াজি বললেন “আপনার কী মনে হয়, পাকিস্তানের জন্য আমি কেমন প্রেসিডেন্ট হব?”
জাকির বলল “খুবই ভাল প্রেসিডেন্ট হবেন আপনি জনাব। এ নিয়ে আমি একটুও দ্বিধাগ্রস্থ নই”।
নিয়াজি বললেন “আপনি সৎভাবে বলুন। ভয় নেই, আমি আপনার কোর্টমার্শাল করব না”।
জাকির বলল “আমি অত্যন্ত সততার সঙ্গেই আমার কথা বললাম জনাব। পাকিস্তানের জন্য আপনাকেই দরকার ছিল। আমার সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা ব্যক্তি একেবারেই পছন্দ না”।
নিয়াজি বললেন “আগের আর্মি প্রেসিডেন্ট আসগর খান সম্পর্কে আপনার কেমন মতামত ছিল জাকির?”
জাকির বলল “যথেষ্ট ভদ্রলোক ছিলেন। তবে প্রেসিডেন্ট হাউজের একটা সম্মান আছে। সব ধরণের লোক এখানে না আনাই ভাল। আসগর খানের…”
জাকির চুপ করে গেল।
নিয়াজি বললেন “উনি প্রেসিডেন্ট হাউজে প্রস্টিটিউট নিয়ে আসতেন, তাই তো?”
জাকির পায়ের নখের দিকে একভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকল।
নিয়াজি বললেন “এটা হয়। দীর্ঘদিন বর্ডারে নারীহীন অবস্থায় থাকার পর হঠাৎ যখন কেউ ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যায় তখন সে কী করবে নিজেই ঠিক করে উঠতে পারে না। আপনি বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের নাম শুনেছেন আশা করি। ভদ্রলোক নিজের হাতে তৈরী টুপি বিক্রি করে নিজের খরচ চালাতেন। রাজ কোষাগারে হাত পর্যন্ত দিতেন না। একজন শাসককে চরিত্রহীন হলে চলে না। তাহলে রাষ্ট্রের চরিত্রও নষ্ট হয়ে যায়। আপনি হয়ত জানেন, দ্বিতীয়বার সেনা অভ্যুত্থানের সময় আসগর খানের বুকে আমিই প্রথম গুলি চালিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য এই ধরণের লোক একেবারেই ঠিক নন। সেই সময় আমাদের গণতন্ত্রের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, যে গণতন্ত্রকে আমরা এত কষ্ট করে আনলাম, রাজনীতিবিদরা তার দাম দিতে পারলেন না। দুর্নীতি করে করে দেশের অর্থনীতিকে ছিবড়ে করে দিলেন”।
অনেকটা কথা বলে নিয়াজি থামলেন।
জাকির মুগ্ধ গলায় বলল “জনাবের অগাধ জ্ঞান”।
নিয়াজি বললেন “পাকিস্তানের এই মুহূর্তে জ্ঞানী ব্যক্তির প্রয়োজন নেই জাকির। পাকিস্তানের প্রয়োজন একজন কড়া লোকের”।
ড্রয়িং রুমের ফোন বাজছিল।
জাকির নিয়াজির থেকে অনুমতি নিয়ে ফোন ধরল। একটু কথা বলে নিয়াজিকে বলল “মুস্তাক ইব্রাহিম ফোন করছেন জনাব করাচি থেকে”।
নিয়াজি জাকিরের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বললেন “ওঁকে বলুন, এই সময়টা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার জন্য অনেক রাত। কাল সকালে ফোন করতে বলুন”।
জাকির ও প্রান্তকে কথাটা রিলে করে শোনাল। ও প্রান্তের কথা শুনে জাকির নিয়াজিকে বলল “জনাব, অত্যন্ত জরুরি কথা বলার আছে বলছেন”।
নিয়াজি বিরক্ত মুখে বললেন “ওকে। যেটা বললাম সেটাই আবার বলুন”।
জাকির কথাগুলো বলে ফোনটা রেখে দিল।
নিয়াজির দিকে তাকিয়ে বলল “মুস্তাক একটু রেগে গেছেন মনে হল”।
নিয়াজি বললেন “গেলে যাবে। ও আমাদের আতিথেয়তায় আছে। আমরা ওর আতিথেয়তায় নেই। ওকে অত পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই তো”।
জাকির কিছু না বলে মেঝের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
নিয়াজি কয়েক সেকেন্ড গুম হয়ে বসে থেকে বললেন “আগামী কাল আমি করাচী যাব। ইন্তেজাম করতে বলে দিন”।
.
৫
শালামার গার্ডেন/শালিমার গার্ডেন, লাহোর।
বিকেল পাঁচটা।
একটা কাঠের বেঞ্চে বসে আইসক্রিম খাচ্ছিল সায়ক।
আব্বাস বিরক্ত গলায় বলল “মিয়াঁ,তোমার চাল চলন আমি সত্যি বুঝতে পারছি না। পেশোয়ার থেকে লাহোর নিয়ে এলে বাড়ি নিয়ে যাবে বলে, এখন শুধু এখানে ওখানে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছো। তুমি সত্যি সত্যি কী চাও একটু বলবে?”
সায়ক আব্বাসের কথার উত্তর না দিয়ে বলল “এই যে শালিমার গার্ডেনটা তুমি দেখছ, এটা বানিয়েছিলেন বাদশাহ শাহজাহান। শাহজাহান ছিলেন প্রকৃত শিল্পের সমজদার। এই ধরণের বাগিচা তুমি শ্রীনগরেও দেখতে পাবে। অথচ দেখো, এই ভদ্রলোক, মানে শাহজাহান যখন কোথাও বাগিচা, কোথাও বা তাজমহল বানিয়ে রাজকোষের অর্থ শেষ করছেন, ঔরঙ্গজেব কিন্তু ঠিক তার উল্টো। তুমি ঔরঙ্গজেবের বানানো দুর্গ কিংবা মসজিদ যদি দেখো, দেখবে ভদ্রলোক এক টাকাও ফালতু কাজে ব্যয় করেন নি। ওঁর কাজগুলো ছিল কমপ্যাক্ট…”
আব্বাস সায়ককে থামিয়ে দিয়ে বলল “তুমি কি আমার ইতিহাস ক্লাস নিতে চাইছ? মানে বিশ্বাস কর, এসব ব্যাপারে আমার সত্যি কোন দিলচস্তি নেই”।
সায়ক বলল “মুঘল যুগে হিন্দুস্তান পাকিস্তান ছিল না। সবটাই একটা দেশ ছিল। তুমি তো দেশেই আছো আব্বাস। মনে কর গ্রেটার হিন্দুস্তানে। টাইম মেশিনে করে চাইলে ফেরত চলে যেতে পারো সেই সময়টায়। জাস্ট ভাবো, ওই যে বেদীর কাছটায় একজন লক্ষ্ণৌয়ের বাঈজি একটা ঠুমরি ধরেছেন। বাদশাহ শাহজাহান চোখ বন্ধ করে সে ঠুমরি শুনতে শুনতে মাঝে মাঝেই মোহর ছুঁড়ে দিচ্ছেন বাঈজির দিকে। চারদিকে ঘিরে আছে তার পারিষদেরা। তারা মনে মনে হিংসে করছে। নিজেদের গা টেপাটেপি করে আলোচনা করছে এই লোকটা তো রাজকোষ পুরো ফাঁকা করে দিল। এর ছেলেদের জন্য আদৌ কি কিছু রেখে যেতে পারবে?”
আব্বাস বলল “গ্রেটার হিন্দুস্তান? এখানে কাউকে বললে পেটে কুড়িটা গুলি করে দিয়ে চলে যাবে”।
সায়ক বলল “সে তো স্বাভাবিক। মানুষ তো যত দিন যাচ্ছে তত অসভ্য হচ্ছে। গ্রেটার হিন্দুস্তান কেন, শুধু হিন্দুস্তানটাই এখন ইন্ডিয়াতে নেই। প্রতিটা রাজ্যে রাজ্যে ঝামেলা। কোথাও বাঙালীকে মারছে, কোথাও বিহারীকে তাড়াচ্ছে, ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি ছিল আমাদের দেশের গর্ব। জানিনা কতদিন এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারব”।
আব্বাস রেগে গিয়ে বলল “আচ্ছা মিয়াঁ, তুমি কি লেকচার দিতে আমাকে নিয়ে ঘুরছ? তোমার কাজ কর্ম আমার ঠিক সুবিধার লাগছে না কিন্তু। ঠিক কী চাইছ বল তো তুমি?”
সায়ক আব্বাসের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল “গোলাপ বাগিচার দিকে তাকাও আব্বাস। দেখো একজন আর্মির পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে”।
আব্বাস বলল “সে তো থাকবেই। আর্মি এখন দেশ দখলে রেখেছে, সব খানে তো ওদেরই লোক থাকবে”।
সায়ক বলল “হ্যাঁ। তা ঠিক। এবার নজর দাও ওর কাছাকাছি বেঞ্চটাতে। দেখো একজন ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা বসে রয়েছেন। ভদ্রমহিলা হিজাব পরিহিত। দুজনের চাল চলন এবং পোশাক দেখলে পরিষ্কার বুঝতে পারবে এরা পাকিস্তানি নন। খুব সম্ভবত মিডল ইস্টের লোক। আরেকটু ভাল করে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবে এই ভদ্রলোক লেবাননের সেই কুখ্যাত ফারমান আলী। এফ বি আই, সি আই এ এই লোকটাকে পেলে পাতি ছুরি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে নেবে পারলে। হি ইজ ওয়ান অফ দ্য মোস্ট ওয়ান্টেড পারসন অফ এফ বি আই”।
আব্বাস চমকে উঠে বলল “ফারমান আলী লাহোরে কী করছে?”
সায়ক বলল “আর্মস এক্সপোর্টার তো। নিশ্চয়ই কোন ডিল করতে এসেছে”।
আব্বাস বলল “পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে? নাকি এর মধ্যে আবার পাকিস্তানি আর্মির মধ্যে কোন এগেইন্সট গোষ্ঠী তৈরী হয়ে গেছে”?
সায়ক মাথা নেড়ে বলল “এ সম্পর্কে আমার কোন আইডিয়া নেই”।
আব্বাস একটা শিস দিয়ে বলল “এ শালা পাকিস্তানেই সম্ভব। খুলে আম ঘুরে বেড়াচ্ছে বউ নিয়ে। সত্যি সত্যি দেশটা টেরোরিস্টদের কান্ট্রি হয়ে গেছে”।
সায়ক বলল “ওটা ওর বউ নাও হতে পারে। লোকের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য ট্যুরিস্ট সেজে আছে। এদের অনেক বউ। রাতের পার্টনারও অনেক। এরাও এক একটা শাহজাহান”।
ফারমান উঠল। চারদিক তাকিয়ে আর্মি পোশাক পরিহিত লোকটার সঙ্গে একটা কথা বলেই মহিলাকে নিয়ে হাঁটা দিল।
সায়ক চাপা গলায় বলল “লেটস ফলো দেম”।
সায়ক হাঁটতে শুরু করল।
আব্বাস তার পিছনে ছুটতে ছুটতে এসে বলল “সত্যি করে বল তো মিত্রো, তুমি লাহোরে এদের লিড পেয়েই এসেছ না? বাড়ি যাওয়া টাওয়া আমাকে উল্লু বানাবার জন্য?”
সায়ক আব্বাসের পিঠে হাত দিয়ে বলল “বাড়ি তোমাকে আমি নিয়ে যাবই। কথা দিলাম তোমায়”।
.
৬
বীরেন কলকাতার আর্মি হাসপাতালে পৌঁছল বিকেল নাগাদ।
মিনির কেবিনের বাইরে সোমেন দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তাকে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।
বীরেন বলল “স্যার আমাকে এখানেই থাকতে বলেছেন আপাতত। কালকে রিলিজ করা হবে শুনলাম”।
সোমেন বললেন “হ্যাঁ। কিন্তু মেন্টাল শকটা কাটতে কত দিন লাগবে সেটা ডাক্তারবাবু বলতে পারেন নি। রেগুলার কাউন্সেলিং দরকার। এখনও ঘুমের ফাঁকে চেচিয়ে উঠছে”।
বীরেন দেখল মিনির মা অনিন্দিতা কেবিনের থেকে বেরিয়ে এলেন।
সোমেন বললেন “আপনি কি যাবেন দেখতে?”
বীরেন মাথা নাড়ল “না, আমি এখানেই ঠিক আছি। আমাদের বেশ কয়েকজন লোক এখানে রাখা আছে, এটা হাইসিকিউরিটি জোনও বটে, তবু কোন রকম বেচাল দেখলে আমাকে ফোন করবেন। আমার নাম্বারটা এখানে আছে”।
বীরেন একটা কার্ড এগিয়ে দিল সোমেনের দিকে।
সোমেন কার্ডটা নিয়ে মাথা নেড়ে বললেন “আমি জানি না, ঠিক কী বলব আমি। এ ক’দিন কী প্রবল উৎকণ্ঠায় দিন কেটেছে আমাদের! আমার তো এখনও বিশ্বাস হয় না, আমার নিজের দাদা এরকম একটা সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। আমরা গোটা পরিবারটা একটা শকে আছি”।
বীরেন চুপ করে থাকল।
অনিন্দিতা চোখের জল মুছছিলেন। বীরেনকে দেখে একটু সামলে বললেন “ওই স্কাউন্ড্রেলটার কী খবর?”
বীরেন বলল “ইন্টারোগেশন চলবে”।
অনিন্দিতা বললেন “আদৌ কিছু হবে? এসব লোককে তো জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা উচিত”।
সোমেন বললেন “আহ, কী যে বল না”।
অনিন্দিতা বললেন “তা ছাড়া আর কী বলব বল? আমার মেয়েটার কী দশা করেছে দেখেছ? এদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত?”
সোমেন বীরেনের দিকে তাকিয়ে বললেন “প্লিজ কিছু মনে করবেন না। মা তো…”
বীরেন বলল “ওঁর রাগ করা স্বাভাবিক। উচিত ছিল সেদিনই নাজিবকে মেরে ফেলা। কিন্তু সমস্যা হল…” বীরেন চুপ করে গিয়ে বলল “সব কথা তো বলা যায় না”।
সোমেন বলল “তা ঠিক। আমাদের কপাল ভাল মিনিকে ওরা উদ্ধার করতে পেরেছেন। তার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব তুষার রঙ্গনাথনের কাছে। উনি না থাকলে হয়ত এত বড় রেসকিউ অপারেশনটা হতই না”।
অনিন্দিতা বললেন “দাদার সঙ্গে দেখা করেছেন আপনি?”
বীরেন মাথা নাড়ল “না, ওখানে আমি যাই নি এখনও”।
অনিন্দিতা বললেন “কোনদিন দেখা হলে বলবেন, ওঁকে আমরা কোনদিন ক্ষমা করতে পারব না”।
সোমেন বললেন “তুমি প্লিজ একটু নিজেকে সামলাও। বুঝতে পারছ না এসব সংগঠন কী সাংঘাতিক। নিজের মায়ের পেটের দাদা পর্যন্ত আমাদের এভাবে আঘাত দিল, বুঝতে পারো না?”
অনিন্দিতা বললেন “আমি সংগঠন, হিন্দু, মুসলমান কিচ্ছু বুঝি না। শুধু বুঝি যে লোকটা আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে, আমাদের বাড়ির দোতলায় থেকে, আমাদের মেয়েকে ছোটবেলা থেকে বড় হতে দেখে, আমাদের এত বড় সর্বনাশ করল, তার ফাঁসি দেখতে পারলে আমি খুশি হব। আর কোন শাস্তি না। আমি মৃত্যুদন্ড দেখতে চাই”।
সোমেন মাথা নিচু করলেন।
বীরেন বলল “আপনারা চাইলে মেন্টাল কাউন্সেলিংটা এখানেও শুরু করা যায়। সেক্ষেত্রে সিকিউরিটি দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সুবিধা হবে”।
অনিন্দিতা চোয়াল শক্ত করলেন “না, আমার মনে হয় মিনি আমাদের বাড়িতে গিয়েই ঠিক থাকবে। কিংবা কোন জায়গায় হাওয়া বদল করলে। ওর বাবা চেষ্টা করছে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে যদি ওকে পুরী নিয়ে যাওয়া যায়”।
বীরেন বলল “সেক্ষেত্রে আমাদের কয়েকজনকেও যেতে হবে। আমি তুষার স্যারের সঙ্গে কথা বলে জানাচ্ছি আপনাদের”।
অনিন্দিতা বললেন “মিনিকে কি সারাজীবন এরকম সিকিউরিটি নিয়েই ঘুরে বেড়াতে হবে?”
বীরেন বলল “সেটা আমি বলতে পারব না ম্যাম, তবে এই মুহূর্তে তো সিকিউরিটি খুবই প্রয়োজন সেটা আপনারাও বুঝতে পারছেন। যেভাবে শহরের মাঝখান থেকে ওঁকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় ওরা কাউকে ভয় পায় না। এবারে আর কোন রকম ঝুঁকি নেওয়া যাবে না”।
অনিন্দিতা থমথমে, গম্ভীর মুখে বসে রইলেন।
.
৭
নাজিবের সামনে বসে আছেন আশরফ খান।
নাজিব আশরফের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে।
আশরফ বললেন “তা এই নিরীহ অসহায় মেয়েদের ওপর অত্যাচার করা কোন জেহাদে শিখিয়েছে ভাই?”
নাজিব বলল “তার জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমি কী ব্যবহার করব সেটার জবাবদিহি ভারতের পুলিশকে আমি দেব না”।
আশরফ জোরে হেসে বললেন “তাই নাকি? জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে করা ইসলাম স্বীকৃত কে বলল?”
নাজিব আশরফের দিকে লাল চোখে তাকাল, “কাফেরদের সাথে আমি এই নিয়ে কোন কথা বলতে রাজি নই”।
আশরফ উঠে গিয়ে নাজিবের কানটা জোরে মুচড়ে দিয়ে বললেন “তোর থেকে অনেক বেশি মুসলমান আমি। তুই মুসলমান কেন, মানুষও নোস”।
নাজিব আশরফের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গাত্মক হেসে বলল “ওহ, আপনি মুসলমান? তা এই রেন্ডিয়াতে আবার মুসলমানদের মানুষ বলে মনে করে নাকি? গরু খেলে তো কেটে রেখে দেয়। নিজের ধর্মের ভাইদের বিরুদ্ধে গেছেন আর বলছেন আপনি মুসলমান?”
আশরফ মুখে চুক চুক শব্দ করে বললেন “লাভ নেই, লাভ নেই। এসব সুড়সুড়ি আমায় দিয়ে লাভ নেই। অশিক্ষিত, গোঁয়ার গোবিন্দদের দিবি”।
নাজিব ফুঁসে উঠে বলল “অশিক্ষিত, গোঁয়ার গোবিন্দ? তাই নাকি? নিজের ধর্মের কথা বললে, নিজের মানুষদের কথা বললে সেটা অশিক্ষিতদের কথা হয় বুঝি? কোথায় ছিলিস তুই আফগানিস্তানে যখন আমেরিকা বোমা মেরেছিল? কোথায় ছিলিস তুই যখন ইরাকে অ্যাটম বোম আছে বলে একের পর এক মিসাইল হামলা হয়েছিল? বিশ্বের সর্বত্র এখন আমাদের এক হওয়ার সময়। আমাদের এক হতে হবে। উড়িয়ে দিতে হবে সব বিধর্মীদের। হয় আমাদের কথা শুনবে নয় মরবে। তুই মুসলমান? তোর নিজের দেশে কাশ্মীরিদের কীভাবে রেখেছে দেখিস নি? লজ্জা হায়া বলে কিছু রাখে নি কাশ্মীরি মেয়েদের। তুই আবার বড় বড় কথা বলিস”?
আশরফ নাজিবের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললেন “তা একটা শহরের রাস্তা থেকে একটা নিরীহ মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ের নামে রেপ করাটা কোন ধর্মে আছে?”
নাজিব বলল “অবশ্যই আছে। সমস্ত বিধর্মীদের গর্ভে আমাদের সন্তান থাকবে। এভাবেই আমাদের লোকেরা বাড়বে”।
আশরফ মাথা নেড়ে বললেন “ইউ সিক বাসটার্ড! তোর ক্লাস আমি পরে নিচ্ছি”।
নাজিব রাগী চোখে আশরফের দিকে তাকিয়ে রইল।
আশরফ গলা বাড়িয়ে একজনকে ডাকলেন।
তিনি এলে আশরফ বললেন “এখন সকাল এগারোটা বাজে। এই মালটাকে দুপুর দুটো পর্যন্ত থার্ড ডিগ্রি দিয়ে যাবেন। আধমরা হলে খবর দেবেন”।
নাজিবের মুখ শুকিয়ে গেল।
আশরফ বললেন “দেখি, তোর জিহাদ তোকে কতটা কষ্ট সহ্য করতে শিখিয়েছে”।
ইন্টারোগেশন রুম থেকে বেরিয়ে আশরফ পীযুষের ঘরে গেলেন।
পীযূষ নাজিবের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক চেক করছিলেন।
আশরফকে দেখে বললেন “কী বলল শুয়োরটা?”
আশরফ হাসলেন “যা করে, লাইক মাকসুদ, লাইক হিস চ্যালা। রিলিজিয়াস সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। তোমার খবর বল। কী কী উদ্ধার হল?”
পীযুষ বললেন “প্রচুর কোডেড মেসেজ আছে। ডিকোড করতে টাইম লাগছে। তবে যা বোঝা যাচ্ছে হাসান মাকসুদ যশোরের এ বাড়িতে হল্ট দিত প্রায়ই। ওখানে বেশ কয়েকটা অরগানাইজেশনের লোকজনও আসত। চট্টগ্রামের তিন থেকে চারটে জায়গার নাম পাওয়া যাচ্ছে যেখানে এরা বেশ ভাল পরিমাণ আর্মস মজুত করেছিল”।
আশরফ বললেন “তুষার স্যারকে জানিয়েছ?”
পীযূষ বললেন “হ্যাঁ। তবে পুরোটা নয়। আমি আরও ডিকোড করছি। ঢাকা ব্লাস্টে এদের হাত থাকলে অবাক হব না। সিলেট, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা মাদ্রাসাতে এদের যোগাযোগ আছে। ধর্মশিক্ষার নামে অস্ত্রশিক্ষা চলে। ইমিডিয়েটলি আমাদের বাংলাদেশ গভর্নমেন্টকে সতর্ক করা প্রয়োজন”।
আশরফ বললেন “হ্যাঁ, স্বস্তির ব্যাপার হল জঙ্গি দমনে ঢাকার ভূমিকা যথেষ্ট সদর্থক। তবে আমাদের যেটা আরও বেশি করে জানা প্রয়োজন, এদের সাপ্লাই লাইনটা কারা? কোত্থেকে আসছে সব কিছু? ইন্ডিয়াতেই বা এদের আর্মস ইম্পোর্টের স্পটগুলো কোথায়?”
পীযূষ মাথা নাড়লেন, “অত কিছু এখানে পাওয়া যাবে না। তার জন্য মাকসুদ আর আর এই নাজিবকে আরও বেশি করে জেরা করতে হবে”।
আশরফ গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন।
.
৮
ইরাবতী টিভি দেখছিলেন।
তুষার যখন বেল বাজালেন তখন রাত সাড়ে ন’টা বাজে।
ইরাবতী উঠে দরজা খুললেন।
তুষার বললেন “সেম সিরিয়াল দেখছ নিশ্চয়ই?”
ইরাবতী বললেন “মুভি দেখছিলাম। কমেডি”।
তুষার জুতো খুলে সোফায় বসে বললেন “কমেডি? কেন থ্রিলার ফেভারিট ছিল যে তোমার”?
ইরাবতী হাসলেন “বয়স বাড়ছে তো। আর থ্রিলার ভাল লাগে? তাছাড়া তুমি এমনিতেই যা থ্রিলের মধ্যে রেখে দাও, আর নতুন করে থ্রিলার দেখতে ইচ্ছে করে না”।
তুষারও হাসলেন, “তা বটে। এ নিয়ে কোন ডাউট নেই। কাল যেমন কলকাতা যাব আবার”।
ইরাবতী অবাক হয়ে বললেন “কালই যেতে হবে”?
তুষার বললেন “হ্যাঁ, হাসানকে এবার দিল্লি নিয়ে আসব। সঙ্গে ওই বাস্টার্ডটাকেও”।
ইরাবতী বললেন “কী যেন নাম? নাজিব?”
তুষার ক্লান্ত গলায় বললেন “হ্যাঁ। ব্রেইনওয়াসড পাবলিকে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে সব দিকে। এদেশে একরকম, মুসলিম কান্ট্রিগুলোতে আরেকরকম। সারাক্ষণ ধর্ম ধর্ম ধর্ম করে যাচ্ছে, অ্যাস ইফ এই মুহূর্তে এ জিনিসটা বাদ দিয়ে অন্য কিছু নেই। প্রায়োরিটি চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে মানুষের”।
ইরাবতী চিন্তিত মুখে তুষারের দিকে তাকালেন। বললেন “তুমি ভীষণভাবে জড়িয়ে পড়ছ আজকাল। আগে কিন্তু এতটা পড়তে না”।
তুষার বললেন “জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। এছাড়া তো আর কিছু উপায় নেই। আজকাল তো আমার মনে হচ্ছে আমরা যত উন্নত হচ্ছি, ততটাই পিছিয়ে পড়ছি। মিডল ইস্টের দিকেই দেখো, দে আর বিকামিং থ্রেট ফর দ্য হোল ওয়ার্ল্ড। আই এস আই এস এমনভাবে এগোচ্ছে, যে কোন দিন ওদের হাতে নিউক্লিয়ার ওয়েপন চলে আসবে। তার পর কী হতে পারে ভাবতে পারছ?”
ইরাবতী বললেন “ভাবতে চাইছি না। তুমি কফি খাবে”।
তুষার মাথা নাড়লেন, “নাহ। ডিনার করে নেব। কাল ভোরের ফ্লাইট”।
ইরাবতী বললেন “আশরফের শরীর কেমন আছে?”
তুষার বললেন “অনেকটা ইমপ্রুভ করেছে”।
ইরাবতী বললেন “বেঁচে গেল বলতে হবে”।
তুষার বললেন “আমাদের চাকরিতে বেঁচে থাকাটাই একটা প্রাইজ বলতে পারো”।
ইরাবতী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তুষারের ফোন বেজে উঠল, তুষার অন্য ঘরে গেলেন।
তুষার দেখলেন শ্রীনগর থেকে ফোন এসেছে। ধরলেন “হ্যালো”।
“স্যার, হামিদ বলছি”।
রেহানের মৃত্যুর পরে হামিদ কাশ্মীরের চার্জে আছেন এখন।
তুষার বললেন “হ্যাঁ, বল হামিদ”।
“স্যার আজ পহেলগাওয়ের কাছে হাইওয়েতে আমাদের দুজন জওয়ানের ওপর হামলা হয়েছে শুনেছেন তো?”
“হ্যাঁ, সে তো শুনেছি। গ্রামগুলো তল্লাশি করতে বলেছিলাম তো, সেটা চলছে তো?”
“হ্যাঁ স্যার, সে ব্যাপারেই ফোন করেছি। ওই ঘটনার পরে ওয়াজুরা বলে একটা গ্রামে গিয়ে জানা যায় দুটো বাড়িতে দুই মক্কেল ছিল বেশ কয়েক দিন ধরে। আজকের পর গা ঢাকা দিয়েছে”।
“শিট। কারা ছিল কিছু জানা গেছে?”
“না স্যার। তবে যা ডেসক্রিপশন পাওয়া গেছে তাতে একজন যে ইসমাইল, তা ক্লিয়ার”।
তুষার মাথায় হাত দিলেন। ঠিক এই সময়গুলোতে তিনি রেহানের অভাব ভীষণ বোধ করেন। বললেন “সব ক’টা চেকপোস্ট অ্যালার্ট করে দিয়েছ?”
“হ্যাঁ স্যার, ওদের সঙ্গে বাইক ছিল। কতদূর গেছে সেটা তো বোঝা যাচ্ছে না। যদি অনন্তনাগ পৌঁছে গিয়ে থাকে তার আগে তাহলে তো…”
তুষার বললেন “আমি অবস্তীর সঙ্গে কথা বলছি। অনন্তনাগে যত বাজে সিচুয়েশনই হোক, চিরুণি তল্লাশি জারি রাখতে হবে। তাতে যা হয় হোক। ইসমাইলকে খোলা ময়দানে ছেড়ে রাখার মত বিলাসিতা আমি করতে পারি না”।
হামিদ বললেন “ওকে স্যার। আমিও খবর রাখছি। কোন আপডেট হলে আপনাকে জানাচ্ছি”।
তুষার ফোন রাখলেন। অবস্তীকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন। একবার রিং হতেই অবস্তী ধরলেন “আমি তোমাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। নিশ্চয়ই ওয়াজুরা ইনসিডেন্টটা নিয়ে কথা বলবে?”
তুষার বললেন “অবভিয়াসলি। তোমার কি মনে হয়, ইসমাইল অনন্তনাগে পৌঁছে গেছে?”
অবস্তী বললেন “হাই চান্স আছে। আরেকটা চান্স আছে, পহেলগাও গিয়ে বসে থাকতে পারে”।
তুষার বললেন “অমরনাথ যাত্রা এখন নেই তো?”
অবস্তী বললেন “না, তবে নেক্সট মান্থ থেকে শুরু হবার কথা”।
তুষার বললেন “চাপটা বুঝতে পারছ অবস্তী?”
অবস্তী বললেন “সে তো বুঝতেই পারছি। তুমি কী সাজেস্ট কর সেটা বল আগে”।
তুষার বললেন “আমি কী করি বলত? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কোন স্টেটের লোক যদি আমাদের তাদের শত্রু বলে মনে করে তাহলে আমরা কী করতে পারি”?
অবস্তী বললেন “খুব অস্বস্তিকর কথা। এর উত্তর আমি না দিলেই খুশি হব”।
তুষার বললেন “সে তো ঠিকই। এসব কথা না বলাই ভাল আমাদের। কিন্তু মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে পড়ি”।
অবস্তী বললেন “হামিদ ভরসাযোগ্য তুষার?”
তুষার বললেন “হ্যাঁ। যথেষ্ট। ওর সমস্যা অন্য, রেহানকে যেমন সব কথা বলার প্রয়োজন হত না, হামিদ ঠিক তার উল্টোটা। আমি যা যা বলব, তার বাইরে একটা কাজও করবে না। ইন্টেলিজেন্সের লোকেদের এভাবে কাজ করলে চলে?”
অবস্তী বললেন “দেন সেন্ড ইওর বেস্ট অফিসার হিয়ার। অ্যাটলিস্ট ইসমাইলকে তো ধরতেই হবে অ্যাট এনি কস্ট?”
তুষার বললেন “ওকে, তাই হবে, অ্যাজ ইউ উইশ”।
.
৯
রাত সাড়ে এগারোটা।
লাহোরের কাবাব গলিতে এক ছোট দোকানে বসে মন দিয়ে মুরগীর ঠ্যাং চিবোচ্ছিল সায়ক।
আব্বাস এক প্লেট তন্দুরি চিকেন নিয়েছে কিন্তু খাচ্ছে না।
সায়ককে বলল “ফারমান আলীর হোটেলে রুম নিলেই তো ভাল করতাম আমরা”।
সায়ক আড়চোখে চারদিকে তাকিয়ে বলল “তারপর? ট্র্যাক করে ফেললে কী করতে?”
আব্বাস অধৈর্য মুখে বলল “তাহলে কী করতে চাও তুমিই বল। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না”।
সায়ক বলল “তুমি কী করতে চাও শুনি”।
আব্বাস বলল “আমি তো পারলে মেরেই দিতাম জানোয়ারটাকে”।
সায়ক বলল “হু”।
আব্বাস উত্ত্যক্ত হয়ে বলল “কী হু? তুমি এত নিশ্চিন্ত থাকো কী করে বল তো?”
সায়ক বলল “চুপচাপ খেয়ে নাও। এখানে এসব আলোচনা করার জায়গা না”।
আব্বাস ব্যাজার মুখে মাংসে কামড় দিল।
সায়ক বলল “তোমাকে কিন্তু পাঠান ড্রেসে পাঠানের মতই লাগছে”।
আব্বাস বলল “না লাগার কী আছে? আমি তো পাঠানই”।
সায়ক বলল “তোমার হাবভাবে তো সেরকম লাগে না। কেমন বাঙালি বাঙালি ব্যাপার আছে তোমার মধ্যে একটা। বাড়ি যাব, বাড়ি যাব ভাব সারাক্ষণ। পাঠান হলে এরকম তো হত না”।
কাবাব গলিতে ভিড় আছে বেশ। অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকেরা দল বেঁধে কাবাব খেতে এসেছে। চারদিক ঝলমল করছে।
আব্বাস বলল “সবাই বাড়ি যেতে চায় মিয়াঁ। তুমি ছাড়া। তুমি যে কী দিয়ে তৈরি আল্লাহই জানেন”।
সায়কের খাওয়া হয়ে গেছিল। হাত ধুয়ে নিয়ে বলল “এইরকম কাবাব পেলে কে বাড়ি যাবে বল তো?”
আব্বাস বলল “তুমি আমাদের বাড়ি চল। আমার আম্মি যা কাবাব বানায়, তার পাশে এ সব কাবাব ফেল”।
সায়ক বলল “তা ঠিক। মায়েদের হাতের সব রান্না পৃথিবীর যে কোন রান্নার থেকে ভাল। এটা আমিও মানি”।
গলিতে আর্মির একটা গাড়ি ঢুকে দাঁড়াল। গাড়িতে ভর্তি সেনা। দুজন নেমে এক দোকান থেকে কাবাব অর্ডার করল। তার মধ্যে বিকেলে শালিমার গার্ডেনে দেখা জওয়ানও ছিল।
আব্বাস একটু হলেই চেচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। সায়ক আব্বাসের পায়ে একটা চিমটি কাটল। বলল “চুপচাপ খেয়ে যাও”।
আব্বাস সায়কের চিমটি খেয়ে চুপসে গেল। ফিসফিস করে বলল “আস্তে কাটো মিয়াঁ। কাল সকালেই নখ কেটো। উফ, কী ধার রে বাবা নখে”।
প্যাকেট নিতে বেশিক্ষণ লাগল না। গাড়িটা বেরিয়ে যেতেই সায়ক বলল “তুমি খাও। আমি আসছি। খাওয়া হয়ে গেলে তারপরেই আসবে”।
আব্বাস প্রতিবাদ করার আগেই সায়ক বেরিয়ে গেল। আব্বাস দেখল যে দোকান থেকে সেনারা কাবাব নিয়েছিল সে দোকানে ঢুকে পড়ল সায়ক।
আব্বাস তাড়াতাড়ি নিজের খাওয়া শেষ করে টাকা মিটিয়ে সেদিকে দৌড়ল।
দোকানের ভিতর বেশ ভিড়। অপরিসর জায়গা কিন্তু প্রচুর লোক খাচ্ছে। সায়ক একটা টিক্কাকাবাব নিয়ে বসেছে।
আব্বাস অবাক গলায় সায়কের সামনে বসে বলল “এই তো খেয়ে উঠলে হে”।
সায়ক বলল “অসাধারন টেস্ট মনসুর মিয়াঁর কাবাবের। তাই তো ভাবি এই টুকু দোকানে এত ভিড় কেন?”
আব্বাস বলল “এত খেলে সকালে চাপ হয়ে যাবে যে”।
সায়ক উত্তর দিল না। মন দিয়ে খেতে লাগল।
খাওয়া হয়ে গেলে উঠে পড়ল। বিল মিটিয়ে ক্যাশে বসা লোকটার সঙ্গে গুজগুজ করে কী সব কথা বলে বলল “চল। আলম রোডে যেতে হবে। ফারমানের হোটেলের নাম তাজ”।
আব্বাস সায়কের সায়কের পাশে জোরে জোরে হাঁটতে হাঁটতে বলল “এই যে বললে ফারমানের হোটেলে থাকলে ট্র্যাক করে ফেলবে”?
সায়ক উত্তর না দিয়ে অটোস্ট্যান্ডে পৌঁছে অটোতে বসে আলম রোডের ঠিকানা দিল।
আব্বাস বিড় বিড় করে বলল “কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না”।
সায়ক আব্বাসের কথার উত্তর না দিয়ে মোবাইল বের করল।
মোবাইলে লাহোরের ম্যাপ বের করে স্থির চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল।
.
১০
লিফলেট ছাড়া হয়েছে গোটা কাশ্মীর জুড়ে। যার বয়ান হল
“প্রিয় কাশ্মীরবাসী,
এই অত্যাচারী ভারত সরকার আমাদের সব দিক থেকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এই মুহূর্তে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনা/সি আর পি এফের সংখ্যা সাত লাখেরও বেশি। আম কাশ্মীরিরা বারে বারে আবেদন জানিয়েছেন আফস্পা তুলে নিতে। কিন্তু এ দেশের অত্যাচারী শাসকেরা তাতে কর্ণপাত পর্যন্ত করেন নি। উপরন্তু প্রতি কাশ্মীরিকে প্রতিদিন চূড়ান্ত হেনস্থা হতে হচ্ছে। মা বোনেদের লজ্জা হায়া বলে কিছু আর নেই। আমাদের ধর্ম প্রতিমুহূর্তে কলুষিত হচ্ছে। আমরা চাই আজাদ কাশ্মীর। আমরা চাই, এই অত্যাচারী ভারতীয় শাসকরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের এই পবিত্র ভূমি ছেরে পিছু হটুক।
আমরা চূড়ান্ত সতর্কবার্তা দিতে চাই ভারতীয় সেনার কাছে। হয় তারা এই ভূমি পরিত্যাগ করুক, নয়ত তাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব করে দেব আমরা”।
মাথুর লিফলেটটা মন দিয়ে পড়ছিলেন। খানিকক্ষণ আগে এসেছেন শ্রীনগরে।
হামিদ গম্ভীর মুখে বসে আছেন তার সামনে।
মাথুর বললেন “সর্বত্র ছড়িয়েছে এই পোস্টার?”
হামিদ মাথা নাড়লেন।
মাথুর বললেন “অবস্তীস্যারকে জানিয়েছেন?”
হামিদ বললেন “হ্যাঁ স্যার, উনি বিশেষ আমল দিলেন না”।
মাথুর বললেন “তুষার স্যারের অফিসে এই কপি স্ক্যান করে ইমেল করে দিন”।
হামিদ বললেন “ওকে স্যার”।
মাথুর বললেন “রেহান খানের ফ্যামিলির কী অবস্থা এই মুহূর্তে?”
হামিদ বললেন “ওর মা আছেন ওর বাড়িতে। যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে”।
মাথুর বললেন “কোন পোস্টার বা কালি লেপা ইত্যাদি কিছু হয় নি তো?”
হামিদ মাথা নাড়লেন, “না”।
মাথুর বললেন “বাকি খবর কী? ইসমাইলের কোন খবর আছে?”
হামিদ বললেন “অনন্তনাগের কোথাও একটা লুকিয়ে আছে। কোন গ্রামেও হতে পারে। স্থানীয় কাশ্মীরিদের থেকে কোন খবর আদায় করা যাচ্ছে না। যারা আমাদের ইনফরমার ছিল তারা হয় খুন হয়েছে নয়ত তাদের গুম করা হয়েছে। এই মুহূর্তে কাশ্মীর অগ্নিগর্ভ জনাব”।
মাথুর চিন্তিত মুখে হামিদের দিকে তাকিয়ে বললেন “আশরফের ওপর কারা অ্যাটাক করেছিল সে সম্পর্কে কোন ক্লু পাওয়া গেছে?”
হামিদ দুদিকে মাথা নাড়লেন।
মাথুরের মুখে গালাগাল চলে আসছিল। তিনি উঠে বললেন “আমি অনন্তনাগ যেতে চাই”।
হামিদ অবাক গলায় বললেন “এখন?”
মাথুর বললেন “হ্যাঁ। এখনই। কেন? কোন সমস্যা?”
হামিদ বললেন “এই মুহূর্তে না যাওয়াই ভাল। একটা ডেমনস্ট্রেশন চলছে আজকে। প্রচুর র্যাফ মোতায়েন আছে। ব্যাপারটা পিসফুলি হবার কথা তবে যে কোন সময় আগুন ছড়াতে পারে”।
মাথুর বললেন “ছড়ালে ছড়াবে। আমরা কি ঘরে বসে থাকার জন্যই মাইনে পাই হামিদ সাহেব?”
হামিদ নিরুত্তর থাকলেন।
মাথুর বললেন “রেহানের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? আপনার ইচ্ছা করে না রেহানের খুনের প্রতিশোধ নিতে?”
হামিদ বললেন “আমরা একসঙ্গে কাজ করতাম। রেহান খান আমাদের ডিপার্টমেন্টের শান”।
মাথুর বললেন “শান বলে চুপ করে বসে থাকলে হবে? এই মুহূর্তে আমাদের দেশ ঠিক কী ধরনের বিপদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা আছে?”
হামিদ মাথা নিচু করলেন “জি জনাব”।
মাথুর বললেন “আমি বেরোচ্ছি। একটা গাড়ির ব্যবস্থা করুন”।
হামিদ বললেন “স্যার একটু সময় লাগবে। সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে হবে”।
মাথুর বললেন “কোন সিকিউরিটির দরকার নেই আমার। অনেক হয়েছে। একটা ভাল ড্রাইভার দিন আমায়। আশা করি আপনার অফিস থেকে খবর লিক হবে না আমি অনন্তনাগ যাচ্ছি”।
হামিদ বললেন “না জনাব। এতো অসম্ভব”।
মাথুর বললেন “সবই অসম্ভব হামিদসাহেব। এর আগে আশরফের ওপর যে হামলা হয়েছিল সেটাও আমরা অসম্ভবই ভেবেছিলাম। যাই হোক, আপনি ছেড়ে দিন। আমি অবস্তীস্যারের সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করছি”।
হামিদ বললেন “তার কোন দরকার হবে না স্যার। আমিই নিয়ে যাব আপনাকে অনন্তনাগ। প্রয়োজন হলে আমি নিজেই ড্রাইভ করব”।
মাথুর বললেন “আপনি শিওর?”
হামিদ বললেন “হান্ড্রেড পারসেন্ট স্যার”।
মাথুরের মুখে হাসি ফুটে উঠল।
.
১১
সকাল এগারোটা। আশরফ খান পীযূষের ঘরে বসে কাজ করছিলেন।
পিওন এসে খবর দিল এক অ্যাডভোকেট এসে দেখা করতে চাইছেন।
আশরফ বললেন “পাঠিয়ে দিন”।
মিনিট পাঁচেক পরে কালো কোট পরিহিত এক ভদ্রলোক এসে হাত জোর করলেন “আমি অ্যাডভোকেট সুলতান আলী”।
আশরফ বললেন “বসুন। ঠিক কী ব্যাপারে এসেছেন বলুন”।
সুলতান ব্যাগ থেকে একগাদা কাগজ বের করে আশরফকে দিলেন।
আশরফ বললেন “আমার পড়ার অত সময় নেই। আপনি একটা ব্রিফ করে দিন আমায়”।
সুলতান বললেন “ওকে। আমাদের কাছে খবর আছে আপনি আমার মক্কেল শ্রী জ্যোতির্ময় ওরফে হাসান মাকসুদকে বিনা গ্রেফতারি পরোয়ানায় আপনাদের হেফাজতে রেখে দিয়েছেন। এটা একটা লিগাল নোটিস দেওয়া হল। এই দেশের আইন অনুযায়ী হাসান সাহেব আইনি সহায়তা পাবেন। যতক্ষণ না ওঁর দোষ কোর্টে প্রমাণ না হয়, ততদিন ওঁকে আপনারা আটকে রাখতে পারেন না”।
আশরফ সুলতানের দিকে তাকিয়ে হেসে আবার কম্পিউটারে মন দিলেন।
সুলতান খানিকটা অধৈর্য হয়ে বললেন “আপনি শুনতে পেরেছেন আমি কী বলতে চাইছি?”
আশরফ বললেন “তার আগে বলুন আপনি বুঝতে পেরেছেন আপনি কোথায় এসেছেন?”
সুলতান বললেন “আপনারা আমার মক্কেলকে আটক করে রেখেছেন সেটা ঠিক তো?”
আশরফ বললেন “একেবারেই মিথ্যা কথা। আমাদের অফিসটা দেখে মনে হচ্ছে আপনার মক্কেলকে এখানে কোথাও আটকে রাখা হয়েছে”?
সুলতান বললেন “দেখুন স্যার, আমরা কিন্তু ওঁর বাড়িতেও গেছিলাম। উনি বাড়িতে নেই। ওঁর বাড়ির লোকও আপনার অফিসের কথাই বলেছে”।
আশরফ বললেন “ওরা জানেন না অত কথা। আপনার কথা বলুন সুলতান সাহেব। আপনার কার্ডটা একটু দেখতে পারি?”
সুলতান গম্ভীর মুখে বললেন “আমার কোন কার্ড নেই”।
আশরফ বললেন “আপনাকে কে অ্যাপয়েন্ট করেছে?”
সুলতান বললেন “সেটা জানাতে আমি বাধ্য নই”।
আশরফের ফোন বাজছিল। আশরফ দেখলেন তুষার ফোন করছেন। ধরলেন “হ্যালো স্যার”।
তুষার বললেন “সব রেডি তো?”
আশরফ বললেন “আপনি কোথায় স্যার?”
তুষার বললেন “এই তো, এসে গেছি। আর দশ মিনিট ম্যাক্স। কেন কী হয়েছে? কোন প্রবলেম?”
আশরফ বললেন “এক অ্যাডভোকেট সাহেব এসেছেন। হাসান মাকসুদের সম্পর্কে জানতে”।
তুষার বললেন “কথা বলতে থাকো। আমি আসছি”।
আশরফ ফোন রেখে দেখলেন সুলতান ঘরটা মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছেন।
বললেন “আপনার বাড়ি কোথায়?”
সুলতান বললেন “বলা যাবে না”।
আশরফ বললেন “এই দেশে তো? নাকি অন্য কোন দেশে যার জন্য আপনার বাড়ির কথা বলতে এত সমস্যা?”
সুলতান বললেন “আমি আমার ব্যক্তিগত কথা আপনার সঙ্গে শেয়ার করতে বাধ্য না”।
আশরফ বললেন “এই যে আপনি যার জন্য এখানে এসেছেন, তিনি ঠিক কতজনের মৃত্যুর কারণ, সেটা জানেন আশা করি?”
সুলতানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল।
তুষার ঢুকলেন পাঁচ মিনিট পরেই। সুলতান তুষারকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন।
তুষার বললেন “বলুন, আপনার কী দাবী?”
সুলতান বললেন “আমার কোন দাবী নেই স্যার। আমি কেবল আমার ক্লায়েন্টকে দেখতে চাই। তিনি কেন নিখোঁজ হয়ে আছেন সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানতে চাই তথ্য জানার অধিকার আইনে। বুঝেছেন?”
তুষার সুলতানের দিকে ঝুকে পড়ে বললেন “আপনার কোন আইডিয়া আছে আপনি কোথায় এসেছেন? নাকি ভাবছেন পাড়া গাঁয় যেমন গরু চুরির কেসের ইনভেস্টিগেশন করার জন্য শালিশি সভা বসে, এখানেও সেরকম কিছু একটা হয়েছে?”
সুলতান কঠিন গলায় বললেন “আমি অন্য কোন কথা বলতে চাই না। আমি আমার ক্লায়েন্ট জনাব হাসান মাকসুদ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য চাই”।
তুষার সুলতানের সামনের টেবিলে বসে পড়ে বললেন “ঠিক কে পাঠিয়েছে আপনাকে সুলতান সাহেব?”
সুলতান একবার তুষার, আরেকবার আশরফের দিকে তাকিয়ে বললেন “আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এসেছি। আমাকে আমার ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হোক”।
তুষার মাথা নাড়লেন “আপানাকে কে পাঠিয়েছে না বললে আপনাকে কোন রকম তথ্য দিতে আমরা অপারগ”।
সুলতান ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তুষার হঠাৎ করে সুলতানকে জোরে কষিয়ে একটা চড় মারলেন। সুলতান মেঝেতে পড়ে গেলেন।
আশরফ উঠে দারিয়েছিলেন।
তুষার বললেন “সবার আগে এটাকে ইন্টারোগেট করা শুরু কর। আই নিড এভ্রি ইনফো ফ্রম হিম। থার্ড ডিগ্রি,ফিফথ ডিগ্রি, যা লাগে দাও। কিন্তু আমি এদের নেটওয়ার্ক ঠিক কতটা ছড়িয়েছে, সে সম্পর্কে সব জানতে চাই”।
সুলতান ধুকতে ধুকতে বললেন “কাজটা ভাল করলেন না আপনারা। এর ফল ভুগতে হবে আমাদের”।
তুষার হাসতে হাসতে বললেন “ঠিক। হাসানের মত ইনিও আজ থেকে লা পতা”।
.
১২
তাজে রুম পেতে সমস্যা হল না।
দুজনের কাছেই করাচীর আইডি ছিল। রিসেপশনে কোন প্রশ্নও করল না।
অ্যাডভান্স নিয়ে রুমের চাবি দিয়ে দিল রিসেপশনিস্ট।
ঘরে ঢুকে আব্বাস বলল “এই হোটেলেই ফারমান আলী আছে তো মিয়াঁ? কোন আলাদা সিকিউরিটি দেখলাম না কিন্তু”।
সায়ক জুতো পরেই খাটে শুয়ে পড়ে বলল “রেজিস্টারে অ্যাটলিস্ট কোন ফারমান নেই”।
আব্বাস অবাক গলায় বলল “ওহ তোমার রেজিস্টার পড়া হয়ে গেল? ফারমান আলী নেই? তাহলে কী হবে?”
সায়ক ঠান্ডা গলায় বলল “ফারমান নিজের নামে থাকলেই বরং বেশি অবাক হতাম। যাই হোক, আপাতত তুমি ঘুমিয়ে পড়। কালকে দৌড় করতে হতে পারে সে হিসেবে যতটা পারো রেস্ট নিয়ে নাও”।
আব্বাস বলল “আর তুমি?”
সায়ক বলল “আমিও ঘুমাব”।
আব্বাস বলল “কাল কোথায় যাব? লাহোর ছাড়ব?”
সায়ক বলল “দেখা যাক”।
আব্বাস রেগে বলল “তোমার সঙ্গে না মিয়াঁ এগুলোই সমস্যা! অর্ধেক কথা পেটে রাখো, অর্ধেক কথা মুখে বল। অর্ধেক কেন, প্রায় সব কথাই পেটে রাখো। এত চেপে থাকলে কী করে হবে বল তো?”
সায়ক বলল “কেন? কোন কথা পেটে রাখলাম?”
আব্বাস বলল “এই যে মিয়াঁ, প্রথমে বললে বাড়ি নিয়ে যাবে। তারপর দেখা গেল বাড়ি নিয়ে গেলে না, এখানে ফারমান আলীকে ফলো করা শুরু করালে। এখন বলছ কাল দৌড় করতে হতে পারে, কিন্তু কোথায় যাব, কী বলছ কিছুই বলছ না। এভাবে চললে কী করে হবে বল তো?”
সায়ক হাসল “বুঝতে পারছি দেশে যেতে না পেরে তোমার মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও এখন। কাল সকালে সব বলছি তোমায়…”
সায়কের কথা শেষ হল না দরজায় জোরে জোরে নক করল কেউ।
আব্বাস ভীতু চোখে সায়কের দিকে তাকাল।
সায়ক উঠে দরজার কাছে গেল। কী হোল দিয়ে দেখল বাইরে দুজন সেনা দাঁড়িয়ে আছে।
আব্বাস ফিসফিস করে বলল “কে?”
সায়ক বলল “করাচীতে মোবাইলের ব্যবসা করি। এখানে ডিলারশিপের কাজে এসছি। তুমি আমার চাচাতো ভাই। মনে আছে তো?”
আব্বাস ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল।
সায়ক দরজা খুলল।
বাইরে দাঁড়ানো একজন সেনা তার দিকে তাকিয়ে বলল “আপনার নাম?”
সায়ক বলল “সেলিম রিজভি স্যার। ও আব্বাস রিজভি”।
সেনা সায়কের আপাদমস্তক মেপে বলল “মে আই কাম ইন?”
সায়ক দরজা ছেড়ে দাঁড়াল।
দুজন ঘরে ঢুকে রুমের চারদিকে তাকাল। একজন খাটের তলা দেখল। বলল “লাহোরে কী করতে এসেছেন করাচী থেকে? লাগেজ নেই কেন?”
আব্বাসের মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেছিল। সায়ক দৃঢ় গলায় বলল “ও স্যারজী, মোবাইল সেটের ব্যবসা। লাহোরে হেড কোয়ার্টার আমাদের। টাকা দিতে এসেছিলাম। রাত হয়ে গেল, আব্বু বলল থেকে যেতে”।
“আই ডি দেখি”।
সায়ক আইডি দেখাল।
সেনা বলল “শহরে এত হোটেল থাকতে এখানে উঠেছেন কেন?”
সায়ক বলল “কোন কারণ নেই স্যারজী। অটোওয়ালা নিয়ে এল এখানে। আমরা তো কোন হোটেলই চিনি না”।
দ্বিতীয়জন প্রথমজনকে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল “চল মুস্তাক। এরা সাধারন লোক”।
প্রথমজন সায়কের দিকে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ঘর থেকে বেরোল।
সায়ক দরজা বন্ধ করল।
আব্বাস জোরে একটা শ্বাস ফেলে বলল “এরকম হল কেন?”
সায়ক বলল “ফারমান আলী আছে যে হোটেলে সে হোটেলে একটু ছান বিন হবেই। তার ওপরে যে দেশে সেনা অভ্যুত্থান ঘটেছে, সেখানে তো এসব কোন ব্যাপারই না। কপাল ভাল কোন ঘুষ চেয়ে বসে নি। এদেশের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ভীষণ দুর্নীতিগ্রস্থ। আরও কপাল ভাল এরা আমাকে চিনতে পারে নি”।
আব্বাস মাথায় হাত দিয়ে বলল “আমাদের উচিত ছিল এ হোটেলে না থেকে অন্য কোন হোটেলে থাকা। আমায় যদি কিছু জিজ্ঞেস করত আমি নির্ঘাত কিছু চেপে রাখতে না পেরে সব বলে দিতাম”।
সায়ক উঠল। দরজা খুলল।
আব্বাস বলল “কোথায় যাচ্ছ?”
সায়ক আব্বাসকে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে দেখাল।
গলা বের করে চারদিক দেখল। খানিকক্ষণ বাইরে থেকে ঘুরে এসে আবার ঘরে ঢুকে গেল।
আব্বাস বলল “কী হল? কেন বেরোতে গেলে?”
সায়ক হেসে বলল “ব্যাটা এই ফ্লোরেই আছে। সে জন্যই এরা উকি দিয়ে গেল”।
.
১৩
চুয়াল্লিশ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে গাড়ি চলছে। হামিদ গাড়ি চালাচ্ছেন।
পাশে বসে আছেন মাথুর। রাস্তার প্রতিটা ইঞ্চি দখল নিয়েছে ভারতীয় সেনা। তবু কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। আম কাশ্মীরিরা রাস্তায় বাইকে বা হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন বটে তবে তাদের মধ্যে একটা নিস্প্রাণ, নিস্তেজ ভাব।
মাঝে মাঝেই টহলদারি ভ্যান কিংবা জিপের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
মাথুর বললেন “আপনার বাড়ি কোথায়?”
হামিদ বললেন “মুজফফরাবাদে জন্মেছিলাম। আমার বাবা মা এদেশে চলে এসেছিলেন আমার ছোটবেলাতেই। ওপারে খুব সমস্যা হচ্ছিল”।
মাথুর বললেন “এখন শ্রীনগরেই বাড়ি?”
হামিদ বললেন “হ্যাঁ। বাবা এখানে এসে লোকাল ট্যুরিস্ট গাইড হলেন। আজন্ম ভারতীয় হিসেবে গর্ব করতেন। বলতেন আমাদের লোকেরা বোকা, এদের কোন ধারণা নেই, পাকিস্তানি আর্মি আর জঙ্গিরা কত খারাপ। ছোট ছোট ছেলেদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় মানববোমা বানাবার জন্য, ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হয়”।
মাথুর বললেন “আপনার জন্মের সময় কাশ্মীর নিয়ে টেনশন ছিল?”
হামিদ বললেন “না। অ্যাকচুয়ালি সে সময়টা বিভিন্ন জঙ্গী ঘাঁটি তৈরী হচ্ছিল ও প্রান্তে। প্রতিটা বাড়ি থেকে জোর করে নিয়ে যেত ট্রেনিং দেওয়ার নাম করে। আমার বাবা সে সময়েই আমার মাকে নিয়ে এদেশে পালিয়ে আসেন”।
মাথুর বললেন “ইন্টারেস্টিং”।
হামিদ বললেন “চা খাবেন?”
মাথুর বললেন “কেশর দেওয়া?”
হামিদ হাসলেন “হ্যাঁ”।
গাড়িটা রাস্তার ধারে একটা দোকানে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নামতেই প্রবল ঠান্ডা হাওয়া ভেসে এল।
মাথুর বললেন “উইন্টার ইজ কামিং”।
হামিদ বললেন “হ্যাঁ স্যার। এই সময়টা ওদের ঘর গোছানোর সময়”।
হামিদ দুজনের জন্য চা নিলেন। মাথুর চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন “ঘর থাকলে ঘর তো গোছাবেই হামিদ সাহেব। প্রশ্নটা হল ঘর রাখার সাহস পাচ্ছে কী করে?”
হামিদ বললেন “কাশ্মীরকে আসলে অতটা সহজে বোঝা সম্ভব না। সব কাশ্মীরিই যে মিলিট্যান্টদের সমর্থন করেন তা নয়। কিন্তু খোদ রাষ্ট্র যদি একজন আম কাশ্মীরির সঙ্গে একজন আম ভারতীয়র তফাৎ করে দেয়, সমস্যাটা সেখান থেকে শুরু হয়। আপনিই বলুন না, কিছুদিন আগে একটা সিনেমা রিলিজ নিয়ে হরিয়াণায় বেশ কয়েকটা স্কুল বাসে পাথর চার্জ করল বিক্ষোভকারীরা। পুলিশ কিচ্ছু করল না। ঠিক এই জিনিসটা যদি শ্রীনগরে হত তাহলে কী হত? স্বয়ং রাষ্ট্রই যদি তার নাগরিকদের সন্ত্রাসবাদী ভেবে নেয়, তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাঁধা দেয় অনবরত, তখন মানুষ কোথায় যাবে?”
মাথুর হামিদের দিকে তাকিয়ে বললেন “আপনি তবে আফস্পা সমর্থন করেন না? প্রত্যাহার হোক সেটা আপনিও চান?”
হামিদ বললেন “নিশ্চয়ই। আপনাকে আপনার দেশের মানুষকে তাদের মত করে থাকতে দিতে হবে। যখনই আপনি সেটাকে আটকাতে যাবেন, মানুষ দেশের বিরুদ্ধে চলে যাবে। যেটা দিনের পর দিন কাশ্মীরে ঘটে চলেছে”।
মাথুর বললেন “একজন ভারতীয় নাগরিক হয়ে আপনি আপনার চাকরিদাতার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন? জানেন উপরমহল যদি আপনি এটা বলেছেন জানতে পারে, তাহলে কী হতে পারে?”
হামিদ হাসলেন “উপরমহল আর কীই বা করতে পারে জনাব? আমাকে সরিয়ে দেবে, কিংবা সাসপেন্ড করবে। কিন্তু তাতে কি কাশ্মীরের অবস্থার কিছু উন্নতি হবে?”
মাথুরের চা শেষ হয়ে গেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি একটা সিগারেট বের করে ধরালেন।
ভারতীয় সেনার একটা টহলদার জিপ এসে দাঁড়াল।
হামিদকে দেখে প্রশ্ন করা শুরু করল।
হামিদ শুরুতেই নিজের আই কার্ড দেখিয়ে দিলেন। সেনারা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
হামিদ বললেন “জাতীয় সড়কে এরকম জিজ্ঞাসাবাদ সাধারণত হয় না। ইসমাইলের জন্য সবাই খুব অ্যালার্ট হয়ে আছে”।
মাথুর বললেন “হামিদ সাহেব”।
হামিদ বললেন “জি”।
মাথুর বললেন “আমাকে হয়ত অনন্তনাগে দু তিন দিন থাকতে হতে পারে। আমি এই মুহূর্তে শ্রীনগরে ফিরব না। কোন সরকারী আবাসনে থাকতে চাই না। কাছাকাছি কোন গ্রামে কারো বাড়িতে আমার থাকার জায়গা করতে পারবেন?”
হামিদ বললেন “এখানে বিশ্বাস করার মত তেমন কেউ নেই জনাব। নিরাপত্তার স্বার্থে আপনাকে সেনাদের আশ্রয়েই থাকতে হবে”।
মাথুর একটু হেসেই গম্ভীর হয়ে বললেন “আমাকে নামিয়ে দিয়ে আপনি শ্রীনগর ফিরে যান। বাকিটা আমি বুঝে নিচ্ছি।
.
১৪
করাচীর আইয়ান এ সদর রোডে সিন্ধের গভর্নর হাউজে এসেছেন প্রেসিডেন্ট নিয়াজি।
সিন্ধ প্রদেশের গভর্নর ইসমাইল জুবের ভীত মুখে বসে আছেন তার সামনে।
প্রেসিডেন্ট নিয়াজি কফিতে চুমুক দিয়ে গম্ভীর মুখে জুবেরের দিকে তাকিয়ে বললেন “আপনার গভর্নর হিসেবে ক বছর হল?”
জুবের বললেন “দু বছর জনাব”।
প্রেসিডেন্ট নিয়াজি বললেন “এই দুবছর মুস্তাক ইব্রাহিমের সঙ্গে কত বার দেখা করেছেন?”
জুবের গলা খাকড়ানি দিয়ে চারদিকে তাকালেন। চতুর্দিকে ব্যুরোক্র্যাটেরা দাঁড়িয়ে আছে।
নিয়াজি বললেন “আপনি সবার সামনে বলতে পারেন। এরা সবাই আমাদের গভর্নমেন্টের বিশ্বস্ত লোক”।
জুবের বললেন “জনাব মুস্তাক ইব্রাহিম আমাদের সব রকম সাহায্য করেন ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। আপনি জানেন সে কথা”।
নিয়াজি চোখ ছোট ছোট করে বললেন “সব ধরণের সাহায্য করেন? তা কী কী ধরণের সাহায্য করেন শুনি”।
জুবের আবার অস্বস্তির সঙ্গে চারদিকে তাকালেন।
নিয়াজি বাকিদের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন। ঘর ফাঁকা হয়ে গেলে আধ মিনিটের মধ্যে।
নিয়াজি বললেন “বলুন”।
জুবের বললেন “জনাব আরব সাগরে করাচী থেকে মুম্বই যাবার যে করিডর রয়েছে, সেখানে অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে পাকিস্তানি সেনা ঢুকতে না পারলেও মুস্তাকের লোক ড্রাগ পাচার করতে অনায়াসে ঢুকে পড়তে পারে। ইন্ডিয়ান টেরিটরিতেও ওদের বেরাদারি আছে। আপনি ভুলে গেছেন কী না জানি না, কিন্তু ছাব্বিশ এগারোর মত সফল অপারেশন মুস্তাককে ছাড়া কি সম্ভব হত?”
নিয়াজি ভ্রু কুঁচকে বললেন “পাকিস্তানি জলসেনা ঢুকতে পারে না, মুস্তাক ইব্রাহিমের লোক অনায়াসে ঢুকে যায়? রিয়েলি? ডু ইউ হ্যাভ স্পেসিফিক ইনফরমেশন”?
জুবের মাথা নিচু করে বললেন “স্পেসিফিক ইনফরমেশন না থাকলেও আমাদের বিশ্বাস সেরকম। বলিউডের বহু বড় বড় নামের সঙ্গে মুস্তাক এখনও জড়িত। করাচী থেকে মুস্তাক যেভাবে অপারেশন চালান, সেটা আমাদের দেশের পক্ষে একটা অত্যন্ত সদর্থক ব্যাপার”।
নিয়াজি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থেকে বললেন “আপনি জানেন মুস্তাকের ব্যাপারে আমাদের ওপর ইন্টারন্যাশনাল প্রেশার আছে? ইন্টারপোল পর্যন্ত আমাদের বার বার বলছে মুস্তাককে ওদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য?”
জুবের বললেন “পাকিস্তানের ওপরে কোন ব্যাপারে ইন্টারপোলের প্রেশার নেই জনাব? কিন্তু পাকিস্তানকে তো টিকে থাকতে হবে সব রকম প্রতিকূলতা মাথায় রেখে। কাশ্মীরে যে অর্গানাইজেশনগুলো আছে, তারা না থাকলে কাশ্মীরে আমরা ঠিক ঠাক অপারেশন চালাতে পারতাম?”
নিয়াজি জুবেরের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন “দেশের সব ব্যাপারে আপনার ভালই জানকারি আছে জুবের সাহেব। আই অ্যাম ইমপ্রেসড”।
জুবের প্রত্যুত্তরে কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। চুপ করে বসে রইলেন।
নিয়াজি বললেন “মুস্তাক ইব্রাহিমকে গভর্নর হাউজে আনার ব্যবস্থা করা যাবে?”
জুবের উশখুশ করে বললেন “জনাব, মিডিয়া আছে, ব্রিটিশ মিডিয়া, আমেরিকান মিডিয়াও এসেছে আপনার সঙ্গে। হাউজের বাইরেই তারা আছে”।
নিয়াজি বললেন “আমি তো মুস্তাককে আনতে বলেছি শুধু। কীভাবে আনবেন সেটা আপনার ব্যাপার”।
জুবের চিন্তিত মুখে ফোন বের করে নিচুস্বরে কারো সঙ্গে কথা বললেন।
পরক্ষণে বললেন “আসবেন। তবে বোরখা পরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমার মিসেসের বন্ধুরা আসেন। তাদের সঙ্গে আসবেন”।
নিয়াজি অবাক হয়ে বললেন “আপনার মিসেসের বন্ধুদের সঙ্গে আসবেন? তার মানে এ হাউজের সঙ্গে মুস্তাকের ভালই যোগাযোগ আছে, তাই তো?”
জুবের মাথা নিচু করলেন “মুস্তাকের ছোট ছেলে আমার ছেলের বন্ধু জনাব। করাচীর সফল ব্যবসায়ী ইজাজ ইব্রাহিম”।
নিয়াজি মাথা নাড়লেন, “হু। একজন মুম্বইবাসী এখন করাচীতে গভর্নর হাউজ অবধি ঢুকে পড়েছে। জেনানা মহল, ব্যবসায়ী মহলে তার অবাধ যাতায়াত। খানিকক্ষণ পরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও তার মুলাকাত হবে। উত্থানের পরিধিটা বুঝতে পারছেন আপনি?”
জুবের বললেন “জি হুজুর, পাকিস্তানের স্বার্থে আমরা এটা করতেই পারি। তাই না?”
নিয়াজি বললেন “পাকিস্তানের স্বার্থে আমরা আর কী কী করতে পারি সেটাই জানতে চাই আমি। আসুক ইব্রাহিম”।
ঘরে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল।
.
১৫
“এই মুহূর্তে কাশ্মীর যে পরিস্থিতিতে আছে, সেখানে কাশ্মীরিদের কোন দোষ নেই। তারা পরিস্থিতির শিকার। যে পরিস্থিতি মানুষকে দিনের পর দিন গোলাম করে রেখে দিয়েছে এই দেশের সরকারের কাছে।
কাশ্মীরের মানুষ চেয়েছে স্বাধীনতা। সব রকম গোলামির থেকে। এই স্বাধীনতা কাশ্মীরের মানুষকে অর্জন করতে হবে। শুধু নিয়ম মাফিক পড়াশুনা নয়। পড়াশুনা তখন হয়, যখন দেশে স্থিতাবস্থা থাকে। আপনাদের কি মনে হয় আমরা এখন স্থিতাবস্থার মধ্যে আছি?”
ছাত্রছাত্রীদের দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন মহম্মদ কাদরী।
ছাত্রছাত্রীরা একে অপরের দিকে তাকাল।
কাদরী উত্তেজিতভাবে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় ইউনিভারসিটির ক্লার্ক হুসেন দরজায় নক করল।
কাদরী শব্দ শুনে সেদিকে তাকালেন “কী হল?”
হুসেন বলল “আপনাকে প্রিন্সিপাল স্যার এখনই ওঁর অফিসে ডেকেছেন”।
কাদরী বললেন “যাচ্ছি, ক্লাস শেষ করে”।
হুসেন বলল “ক্লাস শেষ করে না, উনি বলেছেন এখনই যেতে। জরুরি তলব”।
কাদরী হুসেনের দিকে তাকিয়ে স্থির চোখে বললেন “যাও, আসছি”।
হুসেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে গেল।
কাদরী হেসে ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন “মনে হয় প্রভুরা জানতে পেরে গেছেন তাদের পোষা কুকুরগুলো কেউ কেউ বিদ্রোহী হয়ে গেছে। আর মনে হয় আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে না। অলভিদা”।
একটা ঝড়ের হাওয়া যেন ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।
ছাত্রছাত্রীরা যন্ত্রবৎ বসে রইল। কী করবে কিছুই বুঝতে পারল না।
প্রিন্সিপাল ঘরে ছিলেন।
কাদরী নক করলেন। প্রিন্সিপাল গম্ভীর গলায় কাদরীর দিকে তাকিয়ে বললেন “আসুন”।
কাদরী ঘরে ঢুকে বললেন “কী ব্যাপার জনাব? আমি কি আমার শেষ ক্লাসটা নিয়ে ফেলেছি”?
প্রিন্সিপাল খানিকটা থতমত খেয়ে পরমুহূর্তেই সামলে নিয়ে একটা চিঠি কাদরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন “আপনার নামে স্পেসিফিক অভিযোগ আছে কাদরী, আপনি ক্লাসে পড়াবার পরিবর্তে দেশ বিরোধী কথা বলছেন। ছাত্র ছাত্রীদের এই দেশের বিরুদ্ধে উস্কাচ্ছেন। আমি অনেক রকম ভাবেই চেষ্টা করেছিলাম ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দিতে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আই ফেইলড। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি। আপনাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শ্রীনগর পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যেতেও বলা হয়েছে আপনার সময়মত”।
কাদরী বাঁকা হাসি হেসে বললেন “ওহ, তাই বুঝি? হেডকোয়ার্টারে আমার সময়মত ডেকে পাঠিয়েছে? কী সৌভাগ্য বলুন তো আমার? আমি তো ভেবেছিলাম কোমরে দড়ি পরিয়ে নিয়ে যাবে আপনার সরকার। তাও ভাল, আল্লাহর অসীম রহমত, একজন শিক্ষকের প্রতি এটুকু সৌজন্যবোধ দেখানো হয়েছে”।
প্রিন্সিপাল বললেন “দেখুন কাদরীসাহেব, আমাদের সবাইকেই একটা স্পেসিফিক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। রুলস এন্ড রেগুলেশনস সব খানেই আছে। আপনি যদি সেগুলো না মেনে দেশবিরোধী কথা বার্তা বলে চলেন সেক্ষেত্রে…”
কাদরী প্রিন্সিপালকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললেন “আপনি কি আশা করেন জনাব, পলিটিক্যাল সায়েন্স ক্লাসে আমি সার্নের কোলাইডার নিয়ে বক্তৃতা দেব? আমার ক্লাসের ছাত্র ছাত্রীরা দেশের হালহকিকত সম্পর্কে কিছুই জানবে না? তারা একেবারে অজ্ঞ থাকবে? যেখানে ইউনিভারসিটিতে যেতে আসতে পর্যন্ত হাজারগন্ডা কারফিউ পেরিয়ে আসতে হবে, যেখানে নিজের দেশেই নিজের বাড়িতে থাকতে পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হবে, সেখানে কীভাবে আশা করেন শুধুমাত্র কতগুলো পুথিগত বিদ্যাতেই আটকে থাকবে আমার ক্লাস?”
প্রিন্সিপাল চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে কাদরীকে বললেন “আপনি যা বলছেন, তা অনেকাংশেই আমি মানি কাদরীসাহেব। কিন্তু আমি মনে করি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ রয়েছে। এই মুহূর্তে কাশ্মীর যে পরিস্থিতিতে আছে, সেখানে আমাদের কারো কিছু করার নেই। স্বাধীন কাশ্মীরের কথা ভাবা একান্তই বাতুলতা। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে থাকতে হবে আমাদের”।
কাদরী হাসলেন “তা বটে। কাঁচের ঘরে বসে এ সব কথা বলতে আমাদের কারো কোন সমস্যা নেই, এ কথা আমরা সবাই খুব ভাল করে জানি। শুধু মনে রাখবেন জনাব, গান্ধীর যুগ এখন নেই, এ দেশের মানুষও কাশ্মীরিদের এখন আর ভারতীয় বলে মনে করে না। তারা আমাদের আদৌ মানুষ বলেই মনে করে না। নিজের অধিকার ছিনিয়ে নিতে গেলে যে আওয়াজের প্রয়োজন হয়, তা আমাদের দরকার। এবং তা দরকার এখনই। আর আপনি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা বলছেন? এ দেশের কোন রাজ্যে এভাবে আফস্পা চলে? কোন রাজ্যে ঘরে ঘরে যখন তখন সেনা ঢুকে ঘরে ঘরে মা বোনেদের পোশাক তল্লাশি করে। জঙ্গিদমনের নাম করে শিশু কিশোরদের অবলীলায় খুন করে? বলতে পারবেন কোন রাজ্যে? যাই হোক, আপনি ভাল থাকুন। আমার বেস্ট উইশেস থাকল আপনার জন্য”।
কাদরী চেয়ার ছেড়ে উঠে আর প্রিন্সিপালের কথা শোনার কোন প্রয়োজন বোধ করলেন না।
সটান বেরিয়ে গেলেন প্রিন্সিপালের চেম্বার ছেড়ে।
প্রিন্সিপাল একমুখ অস্বস্তি নিয়ে বসে রইলেন।
.
১৬
ভোর চারটেয় উঠে বসল সায়ক। খোঁচা দিয়ে আব্বাসকে ডাকল।
আব্বাস ধড়মড় করে উঠে বসে চেঁচাতে যাচ্ছিল সায়ক আব্বাসের মুখে হাত দিয়ে বলল “আসতে কথা বল”।
আব্বাস হতাশ গলায় বলল “কী ব্যাপার মিয়াঁ,এখনও তো সকালই হয় নি। ডাকলে কেন হঠাৎ করে”?
সায়ক ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল “শব্দ পাচ্ছ?”
আব্বাস একটু শোনার চেষ্টা করে বলল “হ্যাঁ। কিছু একটা টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা চলছে মনে হচ্ছে”।
সায়ক লাফ দিয়ে উঠে খুব ধীরে ব্যালকনির দরজা খুলে ব্যালকনিতে গেল। নিচে একটা ট্রাক এসে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানি সেনারা এক গাদা কফিন তুলছে ট্রাকে।
সে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
আব্বাস গলা নামিয়ে বলল “কী হল?”
সায়ক বলল “ঘরের দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখো তো বাইরে আর্মি আছে নাকি?”
আব্বাস ভয়ার্ত গলায় বলল “ওরে বাবা রে, ওসব আমি পারব না”।
সায়ক বলল “কেন? না পারার কী আছে? যাও”।
আব্বাস মাথা নাড়ল, “না না মিয়াঁ, তুমি ক্ষেপেছ? ধরা পড়লে একদম হালাল মাংস বানিয়ে দেবে আমার”।
সায়ক চিন্তিত মুখে আব্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল “তা ঠিক। চল রেডি হয়ে নি”।
আব্বাস আঁতকে উঠে বলল “ওদের সামনে গিয়ে পড়বে এক্কেবারে?”
সায়ক নির্লিপ্ত গলায় বলল “করাচীর বাস ছাড়ে ভোর ছ’টায়। আমাদের তো করাচী পৌছতে হবে না মিয়াঁ তার আগে? তাছাড়া ফজরের আজানের আগে উঠে গেছো। সমস্যা কোথায়?”
আব্বাস ব্যাজার মুখে উঠে বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে বলল “রাতে ঘুমাতে দেবে না, দিনে দু দন্ড সুস্থির হয়ে বসতে দেবে না। তুমি মিয়াঁ বড্ড জ্বালাতন করছ কিন্তু”।
সায়ক পোশাক পরতে পরতে বলল “কথা কম বল। তৈরী হও জলদি”।
আব্বাস তবু গজগজ করতে করতে তৈরী হয়ে গেল।
দুজনে ঘর লক করে ফ্লোরে এসে দেখল ফ্লোর আর্মিতে ছয়লাপ হয়ে গেছে। তাদের দেখে একজন গলা তুলে বলল “কোথায় যাবেন?”
সায়ক মিঠে গলায় বলল “জনাব, কালকে তো আপনাদের বললাম করাচী থেকে এসেছি আমরা। ভোরের বাসে সেখানেই ফিরে যাব”।
তাদের ছেড়ে দিল সেনার লোকজন। সায়ক এক মুহূর্তও কোন দিকে না তাকিয়ে রিসেপশনে পৌঁছে বকেয়া মিটিয়ে দিল।
হোটেলের বাইরে চার পাঁচটা অটোওয়ালা অটো দাঁড় করিয়ে ঘুমাচ্ছিল।
সায়ক হেঁটে গিয়ে একজনকে তুলে বলল “বাসস্ট্যান্ড যাবে মিয়াঁ?”
অটোওয়ালা কোন কথা না বলে উঠে বসল।
সায়ক আব্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল “উঠে পড়”।
অটোওয়ালা একটু পরে অটো স্টার্ট দিল।
সায়ক বলল “কভি কভি মেরে দিল মে খায়াল আতা হে… আমি তো ভেবেছিলাম এত তাড়াতাড়ি তুমি আসতে পারবে না বিলাল”।
অটোওয়ালা হাসল “কাল রাতে মেসেজ পেয়ে কালই চলে এসেছিলাম”।
আব্বাস অবাক গলায় বলল “হ্যাঁ? চেনো একে?”
সায়ক আব্বাসকে পাত্তা না দিয়ে বলল “কফিন নিয়ে কী করছে এঁরা? তাও এই লোক ভর্তি জায়গায়?”
বিলাল বলল “জনমানবহীন জায়গাতে সন্দেহ বেশি হয় মিয়াঁ। এদের টার্গেট দিনের আলো ফোটার আগে সব মুজফফরাবাদে পাঠানো। কফিন তো মানুষের চোখে ধুলো দেবার জন্য। ভেতরে ভর্তি আর্মস”।
সায়ক বলল “হু, সে তো হবেই। নইলে ফারমান বাস্টার্ড এখানে কী করতে আছে। কী করে মাল চলে আসছে কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না”!
বিলাল বলল “তোমাদের বাস স্ট্যান্ডেই নামাতে হবে। পাক সেনার ওপর আমার ভরসা নেই। আমরা সত্যিই বাস স্ট্যান্ডে যাচ্ছি নাকি সেটা দেখার জন্য আমার পেছনে তাড়া করতেই পারে। ওখান থেকে তোমরা যেখানে ইচ্ছা যাও কোন অসুবিধা নেই”।
সায়ক বলল “ঠিক আছে”। তারপরই সায়কের গলায় ঠাট্টার সুর শোনা গেল, “আচ্ছা শোন বিলাল, আব্বাস খুব জ্বালাচ্ছে আমায়। অমৃতসর যাওয়ার কোন ব্যবস্থা করা যাবে আজকে? ওকে পৌঁছে দিয়ে আসতাম। বাড়ি যেতে চায় বেচারা।”
বিলাল বলল “মাথাতেও আনবে না এখন এসব কথা। আপাতত বাস স্ট্যান্ড পৌঁছে ডিসিশন নাও আজকে কী করবে”।
আব্বাস রাগী মুখে সায়কের দিকে তাকাল।
.
১৭
রাত এগারোটা।
প্রেসিডেন্ট নিয়াজী ইসলামাবাদে ফিরে প্রেসিডেন্ট হাউজে ডেকেছেন আর্মি চিফদের। চারজন এসেছেন। আমরা নাম না বলে চিফ ১, চিফ ২ বলে অভিহিত করছি। নিয়াজি স্কচের গ্লাস নিয়ে চারজনের প্রত্যেকের মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে বললেন “অপারেশন ব্লু ফ্লাওয়ার ফার্স্ট ফেজ ওয়াজ আ বিগ ফেইলিওর, যদিও ব্লু ফ্লাওয়ার সম্পর্কে কোন কিছুই আমার কাছে পুরোপুরি ক্লিয়ার নয় এখনও। এটা নিয়ে কোন রকম আপডেট কিন্তু আমার কাছে আসে নি। আপনাদের কাছে কোন আপডেট আছে?”
চিফ ১ বললেন “ইসমাইল আব্বাস শ্রীনগর জেল থেকে পালিয়েছে। অনন্তনাগের কাছে দুজন ইন্ডিয়ান আর্মির জওয়ানকে খুন করে গা ঢাকা দিয়েছে”।
নিয়াজী বললেন “ইসমাইল? ও কি ব্লু ফ্লাওয়ারে ইনক্লুডেড ছিল”?
চিফ ১ বললেন “জি জনাব। এয়ারপোর্ট এক্সিট প্ল্যানে ওই ক’জনের মধ্যে ও ছিল”।
নিয়াজি বললেন “ওকে কে কন্ট্রোল করে এখন? লস্কর?”
চিফ ১ বললেন “জি”।
নিয়াজি বললেন “ঠিক আছে। আই নিড টু নো হিজ একজ্যাক্ট পজিশন। কালকের মধ্যে। যেভাবে পারেন আমাকে দেওয়ার চেষ্টা করুন”।
চিফ ১ বললেন “জি জনাব”।
নিয়াজি বললেন “ইন্ডিয়া থেকে আর কী কী ইনপুটস পাওয়া যাচ্ছে?”
চিফ ৪ বললেন “ইন্ডিয়ান মুসলিমস আর নট ইন আ গুড স্টেট স্যার। বিফ ইটিং নিয়ে তাদের মনে একটা ভয় ঢোকানো হয়েছে। মন্দির মসজিদ ইস্যুসও আছে। একটা অংশ ফুঁসছে”।
নিয়াজি স্কচে চুমুক দিয়ে বললেন “গুড নিউজ। থোড়া আউর জেহের ডাল দো”।
চিফ ৪ বললেন “সেম সিচুয়েশন ইন সিন্ধ প্রদেশ স্যার। বেশ কয়েকজন হিন্দু অত্যাচারের জন্য ইন্ডিয়ায় পালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে তাদের শেল্টার দেওয়া হচ্ছে”।
নিয়াজি নড়ে চড়ে বসলেন “কোন করিডর দিয়ে”?
চিফ ৪ বললেন “রাজস্থান”।
নিয়াজি বললেন “ডু উই হ্যাভ হিন্দু স্পাই?”
চিফ ৪ বললেন “ডেফিনিটলি স্যার”।
নিয়াজি বললেন “নেক্সট মান্থ দিল্লিতে সার্ক মিট আছে। তার আগে আমার এ সমস্ত স্পাইয়ের অপারেশন ডিটেলস চাই”।
চিফ ৪ বললেন “আমি পরশুর মধ্যে আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি ডিটেলস”।
নিয়াজি বললেন “পাকিস্তানের মত দেশে প্রেসিডেন্ট হবার সমস্যা কী জানেন? এক্সটারনাল প্রব্লেমের থেকে ইন্টারনাল প্রবলেম নিয়ে বেশি জেরবার থাকতে হয়”।
চিফ ৪ বললেন “আর্মি যতদিন দেশের চার্জে আছে জনাব, ততদিন আমাদের ইন্টারনাল প্রবলেম নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না”।
নিয়াজি লাল চোখে চিফ ৪ এর দিকে তাকিয়ে বললেন “তাই নাকি? তো আপনিই বলুন তো, আমার ওপর অ্যাটাকটা কারা করেছিল সেটা বের করা গেছে”?
চিফ ৪ আমতা আমতা করে চুপ করে গেলেন।
নিয়াজি বললেন “আই এস আই নিয়ে আমাদের চিন্তা করার সময় এসেছে। আর্মির সঙ্গে ইন্টেলিজেন্সের সিনক্রোনাইজেশন প্রবলেম হচ্ছে। কমিউনিকেশন গ্যাপও আছে। নইলে কাশেম সোলেমানীর সঙ্গে সরফরাজ নিয়মিত মিট করত আমরা জানতামই না? এটা মেনে নেওয়া যায়?”
সবাই চুপ করে বসে রইলেন উত্তর দিতে না পেরে।
নিয়াজি বললেন “ইন্ডিয়া পাকিস্তান মৈত্রী ক্রিকেট টুর্নামেন্ট করছি। বিসিসিআই মেনেও নিয়েছে”।
চিফ ১ বললেন “ওই সময়টা আমরা ইন্ডিয়ান প্রাইম মিনিস্টারকেও ইনভাইট করতে পারি স্যার”।
নিয়াজি বললেন “গুড। কালকেই ফোন করছি। দুশমন যত কাছে থাকে, তার ওপরে নজর রাখা তত সুবিধা”।
চিফ ২ বললেন “ওই সময়টা একটা ব্লাস্ট করবেন নাকি কোন একটা শহরে?”
নিয়াজি চিফ ২ এর দিকে তাকিয়ে বললেন “পাকিস্তানের সিটিতে? আর ইউ ক্রেজি?”
চিফ ২ মাথা নাড়িয়ে বললেন “না না, ইন্ডিয়ান সিটিতে। ইন্ডিয়াতে অ্যাটাক হলেই খেলাটা জমবে। প্রাইম মিনিস্টার আর ক্রিকেট টিম এখানে আর ইন্ডিয়ান সিটিতে অ্যাটাক। দ্যাট উইল বি আ গ্রেট জোক”।
নিয়াজি বললেন “কে করবে অ্যাটাক?”
চিফ ২ হাসলেন “আপনি বলুন জনাব, বাকিটা আমরা দেখে নেব”।
নিয়াজির গ্লাস খালি হয়ে গেছিল। নিজের পেগ নিজেই বানাতে বানাতে বললেন “খেলার মাঝে হলে টিম নিয়ে চলে যেতে পারে ওরা। সেটা হলে পিসিবির লস হবে। আফটার সিরিজ করলেই ভাল হয়”।
চিফ ২ বললেন “সেক্ষেত্রে আমরা ইন্ডিয়ান প্রাইম মিনিস্টারকে শেষের দিকে আমন্ত্রণ করি”।
নিয়াজি চিন্তিত মুখে বসে বসে গ্লাস শেষ করতে লাগলেন।
.
১৮
সকাল ছ’টা।
অনন্তনাগ, কাশ্মীর। আর্মি ক্যাম্প।
তীব্র শীত। হিমাংকের নিচে নেমে গেছে তাপমাত্রা।
মাথুর জমে যাচ্ছিলেন শীতে। নিজের তাবুতে কোনমতে খাট থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে দেখলেন জওয়ানরা ফুটবল খেলছে। বেশ কয়েকজনের পরনে শুধু স্যান্ডো গেঞ্জি আর শর্টস। মাথুর অবাক হয়ে সেদিকে তাকালেন।
অবস্তী কফি খাচ্ছিলেন মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে।
মাথুর কাঁপতে কাঁপতে অবস্তীর পাশে গিয়ে বললেন “এই ঠান্ডায় ফুটবল খেলছে কী করে বলুন তো এরা? তাও এই ড্রেসে?”
অবস্তী হাসলেন “আমিও খেলেছি তো এককালে। আপনি খেলবেন নাকি?”
মাথুর আঁতকে উঠে বললেন “ক্ষেপেছেন? আমি এই শীতেই মরে যাচ্ছি”।
অবস্তী বললেন “এখানকার নিয়ম হচ্ছে শীত আপনাকে দখল করার আগে আপনার কাজ হল শীতের দখল নেওয়া”।
মাথুর বললেন “যা বলেছেন। আমরা টাকা দিয়ে হলে সুপারহিরো দেখতে যাই কিন্তু সত্যিকারের সুপারহিরোরা খুব কাছেই আছে। বুঝতে পারি না”।
অবস্তী মাথুরকে একটা কফি মাগ দিলেন। মাথুর বললেন “আব্বাসের কোন খবর পাওয়া গেল?”
অবস্তী বললেন “নাহ। এই মুহূর্তে কিছু পাওয়া যায় নি। একবারে গা ঢাকা দিয়ে দিয়েছে আবার”।
মাথুর চিন্তিত গলায় বললেন “ওকে যে করেই হোক ধরতে হবে অফিসার। হি ইজ দ্য টাফেস্ট গাই”।
অবস্তী বললেন “সে তো আমিও বুঝি, কিন্তু কাশ্মীরের এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি তাতে যদি এখানকার লোকজনই ওকে লুকিয়ে রাখে তখন আমাদের আর কী করার থাকতে পারে?”
মাথুর বললেন “হয়ত তুষার স্যার কিছু বুদ্ধি দিতে পারবেন”।
তুষারের নাম শুনে অবস্তীর মুখে চওড়া হাসি খেলল “তা ঠিক। তুষার কাশ্মীরে এলে ভালও লাগত। বহুদিন দেখা হয় না ওর সঙ্গে”।
মাথুর কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন “আসবেন হয়ত স্যার। আমাকে ওই জন্যই পাঠিয়েছেন অবস্থা দেখে রিপোর্ট পাঠাবার জন্য। আসলে রেহানের মার্ডার হওয়াটা আমাদের জন্য একটা বিরাট সমস্যা হয়ে গেছে। হি ওয়াজ ওয়ান ম্যান আর্মি। দ্যাট বাস্টার্ড ইসমাইল!”
অবস্তীর চোয়াল শক্ত হল “চিন্তার কিছু নেই মাথুর, এই মুহূর্তে সড়ক পথ দিয়ে যাতে ইসমাইল ফস্কে না যেতে পারে তার ব্যবস্থা করছি”।
মাথুর বললেন “আমি কিন্তু বিশ্বাস করি না ইসমাইল এরকম ছুটকো ছাটকা সমস্যা তৈরী করতে এ পারে এসেছে। ওর আরও বড় কোন প্ল্যান আছে”।
একজন জওয়ান ফুটবলে জোরে শট করেছিলেন। বলটা গড়াতে গড়াতে মাথুরের কাছে চলে এসেছিল। মাথুর এক শটে সেটা মাঠে ফেরত পাঠালেন।
অবস্তী বললেন “বাহ, আপনি তো ভালই শট মারতে পারেন”।
মাথুর বললেন “সে খেলতাম এককালে কলেজ লাইফে”।
অবস্তী বললেন “খেলা চালিয়ে যেতে পারতেন। বাই দ্য ওয়ে, আপনি ঠিকই বলেছেন, ইসমাইল এসব ছুটকো ছাটকা সমস্যা তৈরী করতে এ পারে আসে নি। আমি শুনেছি ও একটা মারাত্মক লেভেলের সাইকো। ওর লক্ষ্য আরও ভয়াবহ কিছু”।
মাথুর বললেন “সাইকো না হলে কেউ অন্য দেশের লোকেদের মারার জন্য এত রিস্ক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়? আপনি ভাবুন না, কেউ কেউ এখন চেষ্টা করছে কী করে মানব সভ্যতার জন্য ভাল ভাল ওষুধ বের করা যাবে, কেউ চেষ্টা করছে জানার জন্য বাইরের কোন গ্রহে প্রাণ আছে কী না, আর এই ইসমাইলের মত লোকগুলো চেষ্টা করছে ভায়োলেন্স ক্রিয়েট করতে। কোথাকার শিক্ষা বলুন তো এসব?”
অবস্তী বললেন “দু বছরের বাচ্চাকে মানব বোমা হিসেবে ব্যবহার করে। এদের নিয়ে আর কী বলব!”
হঠাৎ বাইরে থেকে ফায়ারিং এর শব্দ ভেসে এল।
জওয়ানরা সঙ্গে সঙ্গে খেলা থামিয়ে দিলেন।
মাথুর অবাক হয়ে বললেন “কী হল?”
অবস্তী কফি মাগ রেখে বললেন “বুঝতে পারছি না। দেখতে হবে। চেক পোস্ট থেকে শব্দটা আসছে। আপনি এখানেই থাকুন। দেখছি”।
অবস্তী দৌড়লেন চেক পোস্টের দিকে। ক্যাম্পগুলো থেকে মুহূর্তের মধ্যে জওয়ানেরা বেরিয়ে চেক পোস্টের দিকে দৌড়ে গেলেন।
মাথুর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
.
.
১৯
মিনিকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে।
মিনি অদ্ভুত রকম শান্ত হয়ে গেছে। কারো সঙ্গে কোন কথা বলছে না।
ডাক্তারবাবু নার্ভের ওষুধ দিয়ে রেখেছেন।
বীরেন সকাল থেকেই ড্রয়িং রুমে বসে ছিল।
ফোন বেজে ওঠায় চমকে উঠে দেখল তুষার ফোন করছেন।
বীরেন ধরল “হ্যাঁ স্যার”।
তুষার বললেন “কী খবর ওদিকে?”
বীরেন বলল “বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে স্যার”।
তুষার বললেন “আমি আধঘন্টার মধ্যে পৌছচ্ছি। তুমি ওখানেই থেকো”।
বীরেন বলল “শিওর স্যার”।
ফোন রেখে বীরেন কাগজে মন দিল। এ বাড়িতে সকালে আসে, রাতে অফিস কোয়ার্টারসে চলে যাবে আপাতত ঠিক ছিল। তুষার আসায় কী হবে ঠিক নেই। ভেতরের ঘর থেকে মিনির মা এবং কাকীমার গলা ভেসে আসছে। মিনি খাচ্ছে না। চুপ করে বসে আছে। মিনির মা অনিন্দিতা বাইরে এলেন কিছুক্ষণ পরে। তাকে দেখে বললেন “ওহ, আপনাকে কিছু দেওয়া হয় নি। একটু বসুন প্লিজ আমি ব্রেকফাস্ট দিয়ে যাচ্ছি”।
বীরেন শশব্যস্ত হয়ে বলল “না না, প্লিজ আমার জন্য ব্যস্ত হবেন না। আমি খেয়েই এসেছি”।
অনিন্দিতা কুন্ঠিত মুখে বললেন “এরকম তো আমাদের বাড়িতে কোন দিন হয় নি। কেউ না খেয়ে বসে থাকবে আমাদের বাড়িতে এসে, আমরা ভাবতেও পারি না। কিন্তু কী করি বলুন, কেমন একটা ঝড় এসে সব কিছু তছনছ করে দিয়ে চলে গেল আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই”।
বীরেন বলল “আমি বুঝতে পারছি। আমার জীবনটাও তো এ ক’দিনে পুরো পালটে গেল। আমি তো নিজে স্বপ্নেও কোন দিন ভাবতে পারি নি এরকম কিছু হতে পারে”!
অনিন্দিতা বললেন “মেয়েটা কিছুতেই খাচ্ছে না। এরকম চললে বাঁচাতে পারব না। মানুষ কী করে এত ভয়ংকর হতে পারে আমি বুঝে উঠতে পারি না”।
বীরেন উত্তর খুঁজে না পেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
অনিন্দিতা বললেন “আমি চা করছি”।
ভেতরের ঘরে চলে গেলেন অনিন্দিতা।
কিছুক্ষণ পরেই তুষার এলেন একটা সাদামাটা গাড়িতে। বীরেনই দরজা খুলল। তাকে দেখে তুষার বললেন “কোন সিকিউরিটি কনসার্ন আছে?”
বীরেন বলল “এখন অবধি সেরকম কিছু দেখতে পারি নি স্যার”।
তুষার বললেন “নজর রেখো, আমরাও সতর্ক আছি। ওদের আক্রোশ মনে হয় না এত সহজে যাবে। আচ্ছা মেয়েটি কোথায়?”
বীরেন বলল “ভেতরে আছে”।
তুষার ভেতরের ঘরের দরজায় নক করলেন।
অনিন্দিতা তুষারকে দেখে অবাক হয়ে বললেন “আপনি কি এখনই এলেন?”
তুষার বললেন “হ্যাঁ। মেয়ে কেমন আছে?”
অনিন্দিতা বললেন “সেই একই। খাচ্ছেই না। এরকম হলে কী করি বলুন তো?”
তুষার বললেন “কোথায় আপনার মেয়ে? আমি দেখতে চাই”।
অনিন্দিতা তুষারকে মিনির ঘরে নিয়ে এলেন।
তুষারের সঙ্গে বীরেনও ধীর পায়ে মিনির ঘরে ঢুকল।
মিনি তুষারকে দেখে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল।
তুষার হেসে একটা চেয়ারের ওপর বসে বললেন “বুঝলে মিনি, তোমাকে একটা গল্প বলি। গল্প না, সত্যি কথা। এই কিছুদিন আগের কথা। একটা স্লিপিং সেল এ দেশের বিভিন্ন জায়গায় একটার পর একটা সিরিয়াল ব্লাস্ট করছিল। আমাদের ইন্টেলিজেন্স মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। কী হবে! কে করছে এসব! প্রতিটা ব্লাস্টের টেকনিক অভূতপূর্ব। এত সূক্ষ্ম বোম আমরা কেউ আগেও দেখি নি। এয়ারপোর্ট স্ক্রিনিংএও ধরা সম্ভব নয় সেসব জিনিস। সেই কঠিন সময়টা আমাদের… শুধু আমাদের কেন, আমাদের গোটা দেশকে একটা মেয়ে বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। শুধু সেই ভয়াবহ বিপদটা থেকে রক্ষা করে নি মেয়েটা, আমাদের সাহায্য করেছিল সব কিছু থেকে বেরোতে। মেয়েটা কে জানো নিশ্চয়ই তুমি?”
মিনি মাথা নিচু করল। দু চোখ দিয়ে তার জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। প্রতিমা বললেন “ওর ওপর বেশি চাপ দেবেন না অফিসার”।
তুষার মিনির দিকে তাকিয়ে বললেন “বিজয়ীদের ওপরে কখনও চাপ থাকে না ম্যাডাম। যারা যেতে, যারা দেওয়ালে পিঠ ঠেকতে ঠেকতে ফিরে আসতে পারে, যারা তাদের বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে একটা গোটা দেশকে বাঁচিয়ে দেয়, তারা কখনও হেরে যায় না। মিনি…”
মিনি কেঁপে উঠল।
অনিন্দিতা বললেন “ভয়ে শিউরে উঠছে এখনও”।
তুষার বললেন “ওকে নিয়ে চলুন”।
অনিন্দিতা অবাক হয়ে তাকালেন “কোথায়?”
তুষারের চোয়াল শক্ত হল “ওর আংকেলের কাছে”।
.
.
.
২০
আর্মি ক্যাম্পে বাইরে থেকে এসে উদ্দেশ্যহীনভাবে গুলি চালিয়ে পালাচ্ছিল দুজন যুবক। সেনারা তাদের ধাওয়া করেছিল। যুবক দুজন গুলি থামায় নি। অগত্যা তাদের পায়ে গুলি করতে হয়েছে। একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
দুজনকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
অবস্তী মাথুরকে বললেন “লোকাল আইডি আছে। এরা দুজনই কাশ্মীরি। বয়স দেখুন, খুব বেশি হলে একুশ। কিংবা তাও না”।
মাথুর বললেন “কী করবেন এদের নিয়ে?”
অবস্তী বললেন “জেলে পাঠাতে হবে। শ্রীনগরে। আর্মস কোত্থেকে পাচ্ছে বুঝতে পারছেন আশা করি”।
মাথুর বললেন “ওরা শুধু একটা কেওস তৈরী করতে এসেছিল। পাকিস্তান চাইছে এই মুহূর্তে কাশ্মীর অশান্ত হয়ে উঠকু যাতে ওরা ঘোলা জলে মাছ ধরতে পারে। এরা সুস্থ হলে আমি এদের জেরা করতে চাই”।
অবস্তী বললেন “কত জেরা করবেন? জেরা করে করে ক্লান্ত হয়ে যাবেন। এরা সব ব্রেইনলেস ক্রিচার”।
মাথুর বললেন “করিডরগুলো তো জানতে হবে? কোথা থেকে এত আর্মস আসছে”!
অবস্তী বললেন “কাশ্মীর ছেয়ে গেছে এই ধরণের আর্মসে। আমরা প্রচুর তল্লাশি করি। প্রচুর আর্মস উদ্ধার করা হয়। তবু এরা হাল ছাড়ে না। পঙ্গপালের মত বাড়ছে সব কিছু”।
মাথুর চিন্তিত গলায় বললেন “সবাই তো আর বিরোধী হয়ে যায় নি। পাকিস্তানপন্থীও সকলে নয়। সব মানুষ কি খেতে পান? রোজগার আসে কোত্থেকে?”
অবস্তী বললেন “মূলত উলের ব্যবসা, কাঠের কাজ, আর পর্যটন শিল্পে চলে কাশ্মীর। উলের ব্যবসার সেই রমরমা আর নেই। আর এই ভায়োলেন্সের মরসুমে ক’টা পর্যটক আসবে বলতে পারেন?”
মাথুর বললেন “হু। সুতরাং অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে”।
অবস্তী বললেন “নেভার এন্ডিং হেট স্টোরি ইন্ডিয়া পাকিস্তানের। যার ফলাফল একটা গোটা রাজ্যের মানুষের জীবন বরবাদ হয়ে গেল”।
অবস্তীর ফোন বাজছিল। অবস্তী কয়েক সেকেন্ড কথা বলে ফোন রেখে মাথুরের দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বললেন “ক্যাম্পের গেটের বাইরে লোকাল গ্যাদারিং হয়েছে। ছেলেদুটোকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য”।
মাথুর বললেন “আপনারা কী করতে চাইছেন?”
অবস্তী ম্লান হেসে বললেন “যা আফস্পা চালু থাকা অবস্থায় করতে হয় তাই করব। বাইরে গিয়ে দেখে আসুন, মেয়ে বাচ্চা পুরুষ এসে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছে। সবার আমাদের ওপর প্রবল ক্ষোভ”।
মাথুর বললেন “আর্মি ক্যাম্পে গুলি গালাজ করে চলে গেছে। এদের এত কথা শোনার কী দরকার? আমরা তো কাঁদানে গ্যাস ছেড়ে এদের শান্ত করতে পারি”।
অবস্তী বললেন “তাই করা হবে। এছাড়া আর কী করব? আমরা নিরূপায়”।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কড়া হাতে বিক্ষোভ দমন করা গেল। আর্মি রাস্তার দখল নিতে জনতা ছত্র ভঙ্গ হয়ে গেল।
মাথুর তুষারকে ফোন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। উদ্দেশ্যহীনের মত হাঁটাহাঁটি করতে শুরু করলেন।
অবস্তী বললেন “আমার সামান্য হলেও সন্দেহ হচ্ছে ইসমাইলের ওপর। ও নিশ্চয়ই কোন প্ল্যান করে এটা করিয়েছে, আমরা সবাই এদের নিয়ে ব্যস্ত থাকব আর ইসমাইল ওর প্ল্যানে আমাদের ওপরে আরও বড় কোন অ্যাটাক করবে”।
মাথুর বললেন “সব ক’টা ক্যাম্পে খবর পাঠিয়ে দিন। সবাই যেন অ্যালার্ট থাকে। ছেলেদুটো সুস্থ হলেই ওদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করতে হবে। থার্ড ডিগ্রি হোক ফোর্থ ডিগ্রি হোক, ওদের ওপর সব প্রয়োগ করে পেট থেকে কথা বের করতে হবে।”।
অবস্তী বললেন “আমি মোবাইল টাওয়ারে জ্যামার বসিয়ে দিতে বলেছি সর্বত্র, যাতে এখান থেকে কোন রকম ফোন বাইরে না যায়। ওপার থেকেও কিছু আসতে পারে”।
মাথুর বললেন “ইসমাইল মোবাইল ইউজ করবে না। ওর কাছে নিশ্চয়ই আরও কোন ডিভাইস আছে যেগুলোর মাধ্যমে ও বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যেমন রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ট্রাই করতে পারে, জাস্ট এক্সাম্পেল দিলাম, আরও অনেক কিছুই হতে পারে”।
অবস্তী বিষণ্ণমুখে মাথা নেড়ে বললেন “শত্রুপক্ষ যথেষ্ট শক্তিশালী। অত্যাধুনিকও বটে। এদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য এদের লেভেলে নামতে হবে। নইলে কিচ্ছু হবে না”।
.
.
২১
জ্যোতির্ময়কে বসিয়ে রাখা হয়েছিল অন্ধকার ঘরে।
তুষার বললেন “আলো জ্বালাও”।
আলো জ্বলল।
তুষার ঘরের বাইরে থেকে দেখলেন আলো জ্বলার ফলে জ্যোতির্ময় খানিকটা চমকে চারদিকে দেখছেন। তুষার আশরফকে বললেন “আমি ভেতরে যাচ্ছি। মিনি এখানেই বসুক”।
মিনিকে একটা চেয়ারে বসানো হল।
অনিন্দিতাও এসেছেন। মেয়ের পাশে বসলেন।
তুষার ঘরের ভেতর গিয়ে বললেন “কেমন আছেন হাসান মাকসুদ?”
জ্যোতির্ময় তুষারের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালেন।
তুষার চেয়ার টেনে বসে বললেন “আপনার সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছে”।
জ্যোতির্ময় তুষারের দিকে তাকিয়েই রইলেন। কোন কথা বললেন না।
তুষার বললেন “বেনাপোল পেরিয়ে যশোর থেকে একটা নেটওয়ার্ক বানানো হয়েছে। নোয়াখালী, চট্টগ্রামে একটার পর একটা অস্ত্র কারখানা, যার ইনচার্জ আপনি। আপনার অবর্তমানে এই জায়গাগুলো কে চালাচ্ছে মিস্টার মাকসুদ?”
জ্যোতির্ময় বাঁকা হাসি হেসে বললেন “কারখানা আছে যখন জানেন, তখন কে চালাচ্ছে সেটাও আপনার জানা উচিত”।
তুষার পায়ের ওপর পা তুলে বললেন “আপনি আমাকে বিস্মিত করেছেন। একটা দেশের প্রতি ঠিক কতটা ঘেন্না থাকলে এই কাজগুলো করা যায় সেটাই ভাবছিলাম। আচ্ছা আপনি কখনও ভাবেন না নিরীহ মানুষদের মারলে আসলে কোন লাভ হয় না?”
জ্যোতির্ময় বললেন “আমি আপনার সঙ্গে এই ব্যাপারে কোন কথা বলতে চাই না”।
তুষার বললেন “বেশ তো বলবেন না। আপনাকে বলতেও হবে না। আমার কাছে আপনি জবাব দিতে বাধ্যও নন। কিন্তু কারো কারো কাছে আপনাকে জবাব দিতেই হবে হাসান মাকসুদ”।
জ্যোতির্ময় রাগী গলায় বললেন “একমাত্র আমার উপরওয়ালার কাছে আমি জবাব দিতে বাধ্য। আর কারো কাছে নয়”।
তুষার কাঁচের জানলার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন।
অনিন্দিতা মিনিকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
জ্যোতির্ময় মিনিকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল।
বললেন “ওকে কেন এখানে নিয়ে এসেছেন? ও ছোট মেয়ে”।
তুষার হাসলেন “ছোট মেয়ে? এই ছোট মেয়েটাকেই আপনার লোকজন তুলে নিয়ে গেছে। অকথ্য অত্যাচার করেছে, ধর্ষণ করেছে। এখন আপনার মনে পড়ছে মিনি ছোট মেয়ে?”
মিনি আচ্ছন্নের মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। তুষারের কথাগুলো শুনে শিউরে উঠে জ্যোতির্ময়ের দিকে তাকাল। তুষার দেখলেন জ্যোতির্ময় মিনির চোখের দিকে তাকাতে পারছেন না। তুষার বললেন “তাকান হাসান মাকসুদ, এই ছোট মেয়েটার দিকে তাকান। আপনাকে তাকাতেই হবে। এই মেয়েটাকেই আপনি কোলে পিঠে করে বড় করেছেন, একই বাড়িতে থেকেছেন, একই সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করেছেন। আর নিজের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে আপনি এই মেয়েটাকে নিজের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন,আপনি নিজেই বলুন তো কোনদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ দেখার ইচ্ছা হবে আপনার?”
তুষারের কথা শেষ হবার আগেই সবাইকে চমকে দিয়ে মিনি জোরে একটা চিৎকার করে এগিয়ে গিয়ে জ্যোতির্ময়ের গালে সজোরে একটা চড় মারল। অনিন্দিতা দৌড়ে গিয়ে মিনিকে ধরলেন কিন্তু মিনিকে আটকানো যাচ্ছিল না। জ্যেঠুর দু গালে ক্রমাগত মারতে মারতে অবসন্ন হয়ে মাটিতে বসে পড়ল।
তুষার ইঙ্গিত করলেন, একজন মহিলা কর্মী ঘরে এলেন। তুষার বললেন “ওর মাকে সাহায্য করুন মেয়েটিকে বাইরে নিয়ে যেতে”।
মিনিকে ধরে নিয়ে দুজনে বাইরে গেলেন।
জ্যোতির্ময় বিধ্বস্ত হয়ে বসে ছিলেন। তুষার বললেন “কেমন লাগল হাসান মাকসুদ? খুশি হলেন?”
জ্যোতির্ময় তুষারের দিকে তাকিয়ে বললেন “কাজটা আপনি ভাল করলেন না অফিসার। এর ফল ভুগতে হবে আপনাকে”।
তুষার ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন “আমরা তো চিরকাল ফল ভোগার জন্যই আছি। আপনারা আছেন আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য। আপনি নিজেকেই প্রশ্ন করুন না হাসান মাকসুদ, ঠিক কী পেলেন আপনি এত কিছু করে? আপনার নিজের ছেলে গুলি খেয়ে মরেছে, আপনার স্ত্রীকে জেলে রাখা হয়েছে। আপনার ভাইয়ের মেয়েকে আপনারই লোকেরা অকথ্য অত্যাচার করে স্থবির বানিয়ে রেখে দিয়েছে। আপনার নিজের পরিবার বিধ্বস্ত। আর আপনি এখানে। আমার সামনে। কী পেয়েছেন আপনি? বলুন হাসান মাকসুদ, কী পেয়েছেন আপনি?”
জ্যোতির্ময় গম্ভীর গলায় বললেন “পার্থিব কিছু চাওয়া পাওয়া হারানোর জন্য আমরা তার কাজ করি না। আগেও বলেছি, আবারও বলছি, আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে বা মেরে ফেললে কিচ্ছু হবে না অফিসার। আমার কাজ আমি করে দিয়েছি। এবার আপনারা কী করবেন ভেবে দেখুন”।
তুষার মাথা নাড়লেন “ঠিক। আপনি ঠিক বলেছেন। বেস্ট অফ লাক”।
ইন্টারোগেশন রুম থেকে বেরলেন তুষার। মিনিকে জলের ছিটে দিয়ে জ্ঞান ফেরানো হয়েছে। চুপচাপ বসে আছে মিনি। তুষার খানের দিকে তাকিয়ে বললেন “মাকসুদকে দিল্লি নিয়ে যাব। রেডি হও”।
.
.
২২
বীরেন অফিসের রিসেপশনে বসে ছিল। মিনিদের বাড়ি থেকে সে তুষারের সঙ্গে এসেছিল কিন্তু তুষার তাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে মিনিদের নিয়ে ইন্টারোগেশন চেম্বারে গেছেন।
ফোনটা নিয়ে খেলছিল সে এমন সময় দেখল ফোনটা রিং হচ্ছে। আননোন নাম্বার। বীরেন ধরল “হ্যালো”।
“ভাল আছেন?”
“কে বলছেন?” অবাক হল বীরেন।
“বাংলাতেই তো জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর দিতে অসুবিধা হচ্ছে?”
বীরেন খানিকটা রাগল “কে বলছেন বলবেন তো?”
“আমাকে আপনি চিনবেন না। শুধু জেনে রাখুন, আপনাকে আমাদের দলে নেওয়ার জন্য হাসান সাহেবকে সুপারিশটা আমিই করেছিলাম”।
বীরেন বলল “মানে?”
ওপাশ থেকে একটা হাসির শব্দ ভেসে এল। বীরেন বলল “কী ইয়ার্কি মারছেন? ফোনটা রাখুন”।
“ইয়ার্কি মারব কেন বীরেনবাবু? আপনি তো আমাদের দলেরই লোক। আপনি যদি আমাদের সঙ্গে এখন কো অপারেট না করেন তবে আপনার পরিবারের দায়িত্ব তো আর আমরা নিতে পারব না, কী হবে বলুন তো সেক্ষেত্রে?”
বীরেন ফোনের দিকে তাকাল। আননোন নাম্বার লেখা। কোন নম্বর দেখাচ্ছে না ফোনে। সে ফোনটা কেটে দিল।
রাখার সঙ্গে সঙ্গেই মেসেজ এল “মিনির সঙ্গে যে ব্যাপারটা হয়েছে যদি আপনার বোনের সঙ্গে আমরা করি, সামলাতে পারবেন তো?”
বীরেনের একটা হার্টবিট মিস হল।
সে উঠতে যাচ্ছিল এমন সময় পরের এস এম এসটা এল “ভুলেও কাউকে বলার চেষ্টা করবেন না। অফিসের বাইরে গিয়ে ফোনটা ধরুন”।
বীরেন ঘামছিল।
অফিস থেকে বেরোল। ফোনটা রিং হতে শুরু করল তার।
ধরল সে, “কে বলছেন আপনি?”
“কে বলছি আমি সেটা ইম্পরট্যান্ট নয়। ইম্পরট্যান্ট হল কেন ফোন করেছি”।
বীরেন বলল “বলুন… কী বলবেন?”
“আপনাকে আজ দিল্লি নিয়ে যাওয়া হবে। সঙ্গে আশরফ খান এবং তুষার রঙ্গনাথন যাবেন। জানেন আপনি?”
বীরেন অবাক গলায় বলল “না, জানি না”।
ওপাশে কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পরে ভেসে এল “আপনার কাজ বেশি না, আপনাদের অফিসের বাইরে দেখুন একটা ফাঁকা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে, নাম্বার হল ডব্লু বি জিরো টু নাইন টু থ্রি সিক্স, দেখতে পাচ্ছেন?”
বীরেন ট্যাক্সিটাকে দেখতে পেল, বলল “হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি”।
“ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারের পাশে বসুন। ড্রাইভার আপনাকে একটা ছোট মোবাইল দেবে। আপনার কাজ হল সেটা হাসান মাকসুদের কাছে পৌছনো”।
বীরেন বলল “আমি কী করে পৌঁছবো?”
“সেটা তো আমি আপনাকে বলে দেব না। আপনাকেই বের করতে হবে। মিনির এখন অবস্থা দেখেছেন তো? তার চেয়েও খারাপ অবস্থা আপনার বোনের হতে পারে। আরবের শেখেদের কাছে একবার বিক্রি হয়ে গেলে বুঝতেই পারছেন কী দশা হতে পারে। বেস্ট অফ লাক”।
ফোনটা কেটে গেল।
রাস্তার মাঝখানে বীরেন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। এপাশ ওপাশ তাকিয়ে সোজা ট্যাক্সিটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখা মাত্রই ট্যাক্সিটা স্টার্ট দিল। বীরেন জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে ডাকল “ও দাদা কিছু দেওয়ার আছে?”
ট্যাক্সিচালক জানলা দিয়ে একটা ফোন তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বেশ স্পিডে গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।
বীরেন চারদিকে তাকাল। কেউ তাকে দেখছে না দেখে মোবাইলটা হাতে নিল।
সাধারন একটা কিপ্যাডওয়ালা কম দামী ফোন। আবার চারদিকে দেখে বীরেন ফোনটা নিয়ে অফিসে ঢুকল।
হৃদস্পন্দন বাড়ছিল তার। পীযুষ বেরোচ্ছিলেন অফিস থেকে। বীরেনকে দেখে হাসলেন “কী ব্যাপার বীরেন? কেমন আছো?”
বীরেন হাসল কোন মতে। পীযূষ বললেন “তোমাকে মনে হয় দিল্লি যেতে হবে আজকে। স্যার বলছিলেন। সাবধানে থেকো। কলকাতা এলে দেখা হবে আবার”।
বীরেন বলল “শিওর স্যার”।
পীযূষ বেরিয়ে গেলেন। বীরেন সোফায় বসে চোখ বন্ধ করল।
কিছুক্ষণ পরে অনিন্দিতা মিনিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মিনিকে দেখা মাত্রই মিনির মুখের পাশাপাশি বোনের মুখটাও মনে পড়ে গেল বীরেনের। চোয়াল শক্ত হল তার। সোফা থেকে উঠে তুষারের চেম্বারের দিকে রওনা দিল। চেম্বারের দরজা বন্ধ ছিল।
বীরেন দরজায় টোকা দিল। তুষার দরজা খুলে তাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন “তোমার তো অপেক্ষা করার কথা ছিল”।
বীরেন বলল “একটু কথা ছিল স্যার”।
তুষার বললেন “ভেতরে এসো”।
বীরেন ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখল জ্যোতির্ময়কে তুষারের ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। জ্যোতির্ময় তার দিকে তাকালেন।
তুষার বললেন “তুমি আমাদের সঙ্গে দিল্লি যাচ্ছ”।
বীরেন বলল “আপনার সঙ্গে কথা ছিল স্যার”।
জ্যোতির্ময় বীরেনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে জোরে হেসে উঠলেন।
.
.
২৩
ভোরবেলা। লাহোর বাস স্ট্যাণ্ডে সার দেওয়া অটো আর বাস দাঁড়িয়ে আছে।
বিলাল করাচীগামী বাসের পাশে অটো দাঁড় করিয়ে বলল “কী করবে বল”।
সায়ক চারদিকে তাকাল। এখনও ভাল করে আলো ফোটে নি। লোকজনের ব্যস্ততা অবশ্য শুরু হয়ে গেছে।
আব্বাস বলল “কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে নিয়ে এলে মিয়াঁ, এবার কী করবে ঠিক কর তাড়াতাড়ি। বাসে একটা জায়গা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। যেখানে নিয়ে যাবে, যাব, আর কী করব”।
বিলাল বলল “এসি বাস আছে করাচীর। ওতে চলে যাও”।
সায়ক বিলালের দিকে কিছুক্ষণ চিন্তিত মুখে তাকিয়ে বলল “কিন্তু ওঁরা আর্মসগুলো কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বল তো?”
বিলাল হাসল। বলল “আমি জানি তুমি এত সহজে এখান থেকে যাবে না। চল তবে”।
বিলাল অটো স্টার্ট দিল। আব্বাস অবাক গলায় বলল “কোথায় যাচ্ছি? এই যে বলছিলে পাকিস্তানী আর্মি আমাদের ফলো করতে পারে”?
বিলাল কোন কথা বলল না। সায়ক আব্বাসের দিকে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করল চুপ করে যেতে।
বেশ খানিকক্ষণ অটো চালিয়ে বিলাল একটা বস্তির মুখে এসে অটো থামাল। বিলাল নামতে সায়কও অটো থেকে নেমে বিলালকে অনুসরণ করতে করতে আব্বাসকে বলল “এসো জলদি”।
ঘুপচি ঘুপচি ঘর, প্রবল দুর্গন্ধের মধ্যে দিয়ে মিনিট খানেক হাঁটার পর বস্তির অপরপ্রান্তে একটা গ্যারেজের সামনে এসে হাজির হল তারা। বিলাল পকেট থেকে চাবি বের করে গ্যারেজটা খুলে একটা গাড়ি বের করল।
আব্বাস বলল “এ আবার কী?”
সায়ক বলল “কথা না বলে গাড়িতে উঠে বস”।
আব্বাস প্যাঁচা মুখ করে গাড়িতে উঠল।
বিলাল গাড়ি গ্যারেজ থেকে বের করে গ্যারেজের দরজা বন্ধ করে অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিল।
আব্বাস বলল “নিশ্চয়ই আমরা তাজের কাছে যাচ্ছি?”
সায়ক হাসল “এই তো তুমি বুদ্ধিমান হয়ে গেছ”।
আব্বাস রাগী গলায় বলল “মারওয়াগে ক্যা? পাকিস্তান আর্মি দেখে নেয় যদি?”
সায়ক বলল “দেখলে দেখবে। কী হবে খুব বেশি হলে? মরে যাবে। তার থেকে আর খারাপ কী হবে?”
আব্বাস বলল “হুহ, সত্যিই তো, সিয়াচেনের উদাহরণ দাও নি আমার আব্বুর ভাগ্য ভাল”।
ভোরের রাস্তা ফাঁকাই ছিল। হোটেল তাজ থেকে বেশ খানিকটা দূরে গাড়িটা পার্ক করল বিলাল।
দুটো আছে হোটেলের নীচে। একটা ট্রাকে আর্মস লোড করা হয়ে গেছে। দ্বিতীয়টায় আর্মির লোকেরা নিঃশব্দে গাড়ির মধ্যে আর্মস তুলছিল। সায়ক ফিসফিসিয়ে বলল “ফারমান আলী নিজে এসে তদারকি করছে দেখছি”।
বিলাল বলল “হ্যাঁ, পাক-কাশ্মীরে যাবে ট্রাকগুলো সম্ভবত”।
সায়ক বলল “লস্কর ক্যাম্পে?”
বিলাল বলল “হ্যাঁ”।
সায়ক বলল “লস্করকে এভাবে আর্মস পৌঁছে দিয়ে এদের লাভ কী হচ্ছে?”
বিলাল কাঁধ ঝাঁকাল “আল্লাহ জানে”।
তাদের নজর সামনের দিকে ছিল। হঠাৎ তাদের চমকে দিয়ে একটা মিলিটারি জিপ গাড়ির পাশে দাঁড়াল। আব্বাস ভয়ার্ত গলায় বলল “মর গয়ে”।
বিলাল বলল “একটাও কথা বোল না,আমি দেখছি”।
একজন সেনা এসে গাড়ির কাঁচে নক করল। বিলাল কাঁচ নামিয়ে বলল “জি জনাব?”
সন্দিগ্ধ চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে জওয়ান বলল “কী হচ্ছে এখানে?”
বিলাল বলল “হোটেলে বন্ধুকে নিতে এসেছি জনাব, স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে আসব”।
“কোন হোটেলে?”
বিলাল পাশের হোটেলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল “কোয়ালিটি হোটেলে জনাব”।
জওয়ান বলল “কাহা হে তেরা দোস্ত?”
বিলাল বলল “হোটেলে আছে। ওয়েট করছি। আসবে এখনই”।
জওয়ান কিছুক্ষণ তার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে নিজেদের জিপের দিকে ঘুরল।
সায়ক গলা নামিয়ে বলল “গাড়ি স্টার্ট দাও। এখনই”।
বিলাল ঘাবড়ে গেছিল খানিকটা। সায়ক বিলালের হাত ধরে নাড়া দিল। জওয়ান গাড়িতে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কিছু কথা একটা মনে হল তার। বিলাল গাড়ি স্টার্ট দিতেই হই হই করে উঠল।
বিলাল কোন দিকে না তাকিয়ে প্রবল বেগে গাড়ি ছোটাল। জিপের লোকজন কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেকটা এগিয়ে গেছিল তাদের গাড়ি, কিন্তু একটু সামলে নিয়ে জিপটা তাদের ধাওয়া করল। আব্বাস ভয় পেয়ে বলল “এবার কী হবে?”
সায়ক বলল “চুপ করে বসে থাকো”।
বিলাল গাড়ির গতিবেগ বাড়াল।
বলল “গাড়িটার মায়া ত্যাগ করতে হবে মিয়াঁ। চল তাই সই”।
কিছুক্ষণ পরে বিলাল একটা গলির মধ্যে গাড়ি ঢুকিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল “চল”।
তিনজনে বেশ খানিকক্ষণ দৌড়নোর পর একটা বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল।
.
.
২৪
দরজা খোলা ছিল। তিনজন দরজা ঠেলে ঢুকলে বিলাল দরজা ভেজিয়ে বলল “এসো”।
একটা সংকীর্ণ ঘোরানো সিড়ি। বেশ খানিকটা উঠে একটা করিডর এল।
করিডর বরাবর বেশ খানিকটা যাওয়ার পর একটা দরজার সামনে এসে বিলাল পকেট থেকে চাবি বের করে দরজাটা খুলল।
বোঝা যাচ্ছে ঘরটা পরিত্যক্ত। প্রচুর ধুলো। বিলাল দরজা খুলে রাখল কিছুক্ষণ। আব্বাস হতভম্ব গলায় বলল “এখানে থাকব কী করে?”
সায়ক নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বলল “তোমার জন্য ফাইভ স্টার হোটেলের ব্যবস্থা করছি। আপাতত এখানেই সেঁধিয়ে যাও”।
মিনিট পাঁচেক পরে বিলাল দরজা বন্ধ করল। মেঝেতে পুরু ধুলো। সায়ক বলল “কার ঘর এটা?”
বিলাল বলল “এক বুড়ির ছিল। তার গাড়ি চালাতাম। বুড়ির তিন কূলে কেউ নেই। মরে যাবার আগে চাবি দিয়ে গেছিল। আসা হয়ে ওঠে না”।
আব্বাস বলল “বুড়ি ওই সিড়ি বেয়ে উঠত কী করে?”
বিলাল বলল “উঠত কোথায় আর? শেষ জীবনে বহুদিন নামে নি। আমিই খাইয়ে দিয়ে যেতাম”।
আব্বাস বলল “বোঝ! ভারতীয় এজেন্ট এসে পাকিস্তানি বুড়িকে খাইয়ে দিয়ে যেত”।
বিলাল হাসল “মায়ের আবার ভারত পাকিস্তানি কি মিয়াঁ? তাছাড়া বুড়ি না থাকলে আজ কোথায় লুকোতে বল দেখি?”
সায়ক বলল “আমার পুনর্জন্ম পাকিস্তানি বাবা মায়ের হাতেই আব্বাস। দেশ তো মানুষেরই সৃষ্টি। কিন্তু কখনও কখনও সত্যিকারের মানুষ হওয়ারও দরকার পড়ে”।
আব্বাস অধৈর্য হয়ে বলল “সব বুঝলাম কিন্তু এবার কী করব আমরা সেটা তো বল”।
সায়ক বলল “আমার অনুমান যদি ভুল না হয় তবে পাকিস্তানি সেনা এতক্ষণে বুঝে গেছে আমি লাহোরেই আছি। আমাদের এখানে কিছু দিন চুপ করে বসে থাকতে হবে”।
আব্বাস বলল “তখন গাড়ি চালাবার দরকারটা কী ছিল হে? গাড়ি না চালালে জীবনেও বুঝতে পারত ওরা আমরা ওখানে আছি?”
সায়ক একটা টাওয়েল জোগাড় করে সোফা ঝেড়ে তার ওপর শুয়ে পড়ে বলল “আমার সিক্সথ সেন্স বলছিল ব্যাটা ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাদের গাড়ি থেকে নামাত। আর আমার সিক্সথ সেন্স খুব একটা ভুল করে না”।
বিলাল বলল “তোমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সকাল হোক, আমি দেখছি কী করা যায়”।
সায়ক বলল “কিচ্ছু করতে হবে না। অন্তত আজ সকালটা তো কোন প্রশ্নই নেই। ওরা এই চত্বরে কড়া নজর রাখবে”।
বিলাল বলল “কিচ্ছু হবে না। বুড়ির বোরখা আছে, আমি সেটা পরে খাওয়ার নিয়ে আসব”।
সায়ক আগ্রহী গলায় বলল “বোরখা আছে? তাহলে এখানে থাকার কী দরকার? আমরা আমাদের ঘাটিতে পৌঁছে যেতে পারি তো আরামসে”।
আব্বাস রেগে গিয়ে বলল “তোমার সাহস আছে বটে মিয়াঁ। এই কিছুক্ষণ আগে ব্যাটাদের গুলি থেকে কোন মতে বাঁচলে, আবার এখনই বলছ নতুন অ্যাডভেঞ্চারে নেমে পড়বে”।
সায়ক মাথা নেড়ে বলল “অ্যাডভেঞ্চারের কিছু নেই। আমাদের এখানে শুধু নিজেদের বাঁচিয়ে রাখলে চলবে না, অস্ত্রগুলো কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটাও জানতে হবে। বিলাল, তুমি বুড়ির বোরখা বের কর”।
বিলাল বুড়ির আলমারি ঘেটে বেশ কয়েকটা বোরখা বের করল।
সায়ক বোরখার দৈর্ঘ্য দেখে বলল “বিলাল তোমার লাহোরী মা ইনশাল্লাহ ভালই লম্বা ছিলেন। এক্কেবারে আসল জিনিস পেয়ে গেছি। চল তৈরী হওয়া যাক”।
আব্বাস গাই গুই করতে করতে বোরখা পরল।
ঘন্টাখানেক পরে তারা রাস্তায় নামল। রাস্তার মোড়ে সেনার গাড়ি টহল দিচ্ছিল। সৌভাগ্যবশতঃ তাদের কেউ সন্দেহ করল না। একটা অটো নিয়ে বিলালের বস্তিতে পৌঁছল। বস্তির ভেতর বেশ কয়েকটা ঘর পেরিয়ে বিলাল তাদের একটা ঘরে ঢুকিয়ে হাঁফ ছেড়ে বলল “এবার বোরখা ছাড়তে পারো”।
আব্বাস বোরখা ছেড়ে মেঝেতে লম্বা হয়ে বলল “আল্লাহ!!! জীবন বের করে দিয়েছিল! অটোওয়ালা কেমন কেমন করে তাকাচ্ছিল! সন্দেহ করছিল নির্ঘাত”।
সায়ক বোরখা খুলে হাসতে হাসতে বলল “সেটাই স্বাভাবিক। যে বেশি ভয় পায়, তার প্রতিই সন্দেহটা বেশি হয়। এত ওভার অ্যাক্টিং করার কী দরকার ছিল?”
বিলাল বলল “আধঘন্টা সময় নিচ্ছি। একটা গাড়ির জোগাড় করছি। আমাদের মুজফফরাবাদ বেরোতে হবে”।
সায়ক বিলালের দিকে তাকিয়ে হাসল, “তার আগেই রেডি হয়ে যাচ্ছি”।
.
.
২৫
পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান ইকবাল আখতারকে ডেকে পাঠানো হয়েছে প্রেসিডেন্ট হাউজে। ইকবাল আখতার এককালে বাঁ হাতি স্পিনার ছিলেন। তবে তার ক্রিকেট কেরিয়ার বেশি দিন দীর্ঘায়িত হয় নি। ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্টের সময় বাঁ হাতের আঙুলে চোট পেয়ে খেলা ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ক্রিকেট প্রশাসনে এসে দ্রুত উন্নতি করেন।
প্রেসিডেন্ট নিয়াজিকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন ইকবাল।
নিয়াজি নিজে বসে ইশারায় ইকবালকে বসতে বললেন। ইকবাল সালাম জানালেন। নিয়াজি বললেন “দেশের ক্রিকেটের কী হাল মিস্টার আখতার?”
ইকবাল বললেন “সমস্যায় আছে জনাব। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড কেউই পাকিস্তানে আসতে চায় না। আবুধাবি কিংবা দুবাইতে খেলা তো হয় কিন্তু তাতে আমাদের বোর্ডের তো কোন লাভ হচ্ছে না”।
নিয়াজি হাসলেন “সে কারণেই তো আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি। আমি চাইছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইন্ডিয়ার সঙ্গে একটা টেস্ট আর ওয়ান ডে সিরিজ শুরু করতে”।
ইকবাল অবাক হয়ে নিয়াজির দিকে তাকিয়ে বললেন “ইন্ডিয়া? ওরা কোন দিন রাজি হবে না জনাব”।
নিয়াজি বললেন “ঠিক রাজি হবে। আমরা তো ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্টকে এই সিরিজটা করার প্রস্তাব পাঠাব না। আপনি পাঠাবেন ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ডকে। টিভি স্বত্ব, অ্যাড, হাইপ এই সব কিছু থেকে দুটো বোর্ড অর্থনৈতিকভাবে কত লাভবান হবে সে সম্পর্কে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ড কনভিন্স হলে ওরাই সব ব্যবস্থা করে নেবে। আমাদের চিন্তা করতে হবে না”।
ইকবাল একটু ভেবে বললেন “সেটা আপনি ঠিকই বলেছেন জনাব কিন্তু এই সফর চলাকালীন এদের সিকিউরিটির পুরো দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। একটা কিছু হলে গোটা দুনিয়া আমাদের ছেড়ে কথা বলবে না”।
নিয়াজি মাথা নাড়লেন “কিচ্ছু হবে না। অন্তত পাকিস্তান সেনাবাহিনী যতক্ষণ দেশের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে ততক্ষণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোন রকম সমস্যা তৈরী হলে সেসব আমি দেখে নেব”।
ইকবাল বললেন “ক্রিকেট ক্যালেন্ডার দেখতে হবে জনাব। ইন্ডিয়ার কার কার সঙ্গে খেলা আছে সেসব দেখতে হবে। আমাদের সামনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুর আছে, তারপরেই নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে আবুধাবিতে টেস্ট সিরিজ। অন্তত এক বছরের আগে কি সব কিছু অ্যারেঞ্জ করা সম্ভব হবে?”
নিয়াজি বললেন “আপনি প্রপোজাল রেডি করুন। স্পন্সরদের সঙ্গে বসুন, তাদের সঙ্গে কথা বলে এই সিরিজের ফলে দুটো বোর্ড কতটা আর্থিক সুবিধা পাবে সে সব ডেটা ওদের জানান। ইন্ডিয়ান বোর্ড এত বোকা না যে এই ব্যাপারটা এত সহজে উড়িয়ে দেবে। আমিও ইন্ডিয়ান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি মিট করব। আমাদের তরফ থেকে এল ও সিতে এখন যেন কোন রকম কোন উত্তেজনা তৈরী না হয় সেটাও দেখব। সব মিলিয়ে ইন্ডিয়াকে যে করেই হোক এই সিরিজটা খেলার ব্যাপারে রাজি করাতে হবে”।
ইকবাল গলা খাকরিয়ে বললেন “জনাব আপনার বিচার বিবেচনার ওপরে আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে কিন্তু আপনার কি মনে হয় না বর্তমান পরিস্থিতিতে এত বড় ইভেন্ট হোস্ট করা আমাদের পক্ষে সমস্যা হতে পারে?”
নিয়াজি বললেন “একেবারেই না। আমি তো কোন কোন শহরে খেলা হবে সেটাও ভেবে রেখেছি। পেশোয়ার, লাহোর আর করাচিতে তিনটে টেস্ট হবে। পাঁচটা ওয়ান ডে আর দুটো টি টুয়েন্টি। প্রত্যেকটা পিচে পুরু ঘাস থাকবে, ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানদের তো যাবতীয় জারিজুরি ফ্ল্যাট ট্র্যাকে হয়। দেখব বাউন্সি ট্র্যাকে কেমন দম তাদের”।
ইকবাল এবার একটু হেসেই গম্ভীর হয়ে বললেন “জনাব যে ক্রিকেট খুব পছন্দ করে সেটা শুনেছিলাম, এবারে বুঝতে পারলাম”।
নিয়াজি বললেন “আমি খেলতেও পছন্দ করতাম। ক্রিকেট না থাকলে আজ আমি বেঁচেও থাকতাম না মিস্টার আখতার। সেদিন যদি পার্কে আমি গাড়ি থেকে নেমে খেলতে না যেতাম তাহলে হয়ত…” নিয়াজি অন্যমনস্ক হলেন।
ইকবাল বললেন “ঠিক আছে জনাব, আগামী সপ্তাহেই জোহানেসবারগে আইসিসির সভা আছে, সেখানে ইন্ডিয়ান বোর্ড প্রেসিডেন্টকে আমি প্রস্তাবটা দিচ্ছি”।
“আগামী সপ্তাহে জোহানেসবারগে না, আগামী কাল ফোনেই বলবেন”। নিয়াজি ঠান্ডা গলায় বললেন।
ইকবাল চমকে তাকালেন।
নিয়াজি বললেন “আপনি কালকেই প্রস্তাব পাঠিয়ে আমাকে জানাবেন”।
ইকবাল মাথা নাড়লেন “জি জনাব। যা বলবেন”।
.
২৬
রুটি নিয়ে এসেছে বিলাল। প্লেটে সব্জির সঙ্গে সেগুলো তিনভাগ করে বলল “খেয়ে নাও। আমি দেখছি কী করা যায়। আর্মি টহল আছে শহরে আজকে বেশি মাত্রায়। এখন বেরোলে ধরা পড়ে যাব”।
সায়ক বলল “সে তো বুঝতেই পারছি। সমস্যা হল অন্তত এটুকু যদি জানতে পারতাম এরা ঠিক কী প্ল্যান করে রেখেছে, তাহলেও শান্তি পেতাম”।
আব্বাস রুটি খেতে খেতে বলল “শোন মিয়াঁ, একটা খুব সিম্পল কথা শোন। পাকিস্তান একটা টেরোরিস্ট কান্ট্রি। এরা এসব পাক কাশ্মীরে পাঠাবে কাশ্মীরে আরও সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর উদ্দেশ্যে। ব্যস। এটা নিয়ে তো এত চিন্তার কোন কারণ নেই”।
সায়ক বলল “সেটা হলে তাও একটা পয়েন্ট এস্টাব্লিশ হয়। কিন্তু সেটা যদি না হয়? এদের প্ল্যান অন্যকিছুও তো থাকতে পারে?”
আব্বাস বিরক্ত হয়ে বলল “কী থাকতে পারে আবার?”
সায়ক বলল “এরা যদি এই আর্মসগুলো কোনভাবে ইন্ডিয়ার বিভিন্ন শহরে পাঠাতে পারে তাহলে কী ধরণের নাশকতা বাড়তে পারে সে সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা আছে?”
বিলাল বলল “হতেই পারে। লাহোর থেকে অনেকগুলো করিডর ইউজ করা যেতে পারে। শুধু কাশ্মীরেই যাবে, এরকম কোন ব্যাপার নেই”।
সায়ক নড়ে চড়ে বসল “যেমন?”
বিলাল বলল “পাকিস্তান থেকে ইন্ডিয়াতে ফুটবল, খেলা ধুলোর সরঞ্জাম, চামড়ার জিনিস সহ বেশ কিছু জিনিস এক্সপোর্ট হয় ওয়াঘা সীমান্ত থেকে”।
সায়ক বলল “সে তো সব রকম সিকিউরিটি চেকিং পেরিয়ে তারপরেই ইন্ডিয়ায় ঢোকে”।
বিলাল বলল “জিনিস শুধু মাত্র আইনী পথেই যায় তা তো নয়। বে আইনী পথেও পাঠানো সম্ভব”।
সায়ক বলল “এরকম কোন করিডরের সন্ধান আছে তোমার কাছে?”
বিলাল হাসল “থাকলে কি আর চুপচাপ বসে থাকতাম? সেসব সন্ধান করব বলেই তো ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা করি এখানে”।
খাওয়া হয়ে গেছিল। বিলাল টিভি চালাল। টিভিতে দেখাচ্ছে পেশোয়ারে আফগান শরণার্থীদের বিদ্রোহে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে। সেনাবাহিনী সম্পূর্ণভাবে পেশোয়ারের দখল নিয়েছে। দেশের গণতন্ত্র ফেরানোর সর্বতভাবে চেষ্টা চালাবে সেনাবাহিনী, জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট নিয়াজি।
আব্বাস বলল “বোঝ অবস্থা, নিয়াজি নাকি গণতন্ত্র ফেরাবে। এর থেকে ছোটদের জোকসের বই পড়া ভাল”।
বিলাল বলল “পরিস্থিতি ঘোরালো হচ্ছে। পাকিস্তানি সেনা দেশের দখল নিচ্ছে বুঝতেই পারছ। আমরা এখন দুটো কাজ করতে পারি। এক, এখান থেকে যেভাবেই হোক দেশে ফেরার ব্যবস্থা করতে পারি। দুই, এখানে থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যতটা খবর দেশে পাঠানো সম্ভব, সেটা পাঠাতে পারি”।
সায়ক বলল “দুটো একসঙ্গেও করা যায়”।
আব্বাস বলল “মানে? পালাবেও আবার খবরও পাঠাবে?”
সায়ক বলল “একজ্যাক্টলি। আমাদের এখানে এত কষ্ট করে থাকার তো লক্ষ্য একটাই। সেটা ঠিক ঠাক হচ্ছে নাকি আমাদের সেটাই দেখতে হবে”।
দরজায় কেউ তিনটে টোকা দিল।
বিলাল দরজা খুলল। একজন উত্তেজিতভাবে বিলালকে কিছু বলল।
বিলাল তাদের দিকে তাকাল “উঠে পড়। আমার সঙ্গে চল । বস্তিতে আর্মি ঢুকে পড়েছে”।
সায়ক আর আব্বাস বিলালের কথা শুনে উঠে পড়ল।
বিলাল জোর পায়ে হাঁটতে লাগল।
সায়ক বলল “বস্তিতে আর্মি এল কী করতে?”
বিলাল বলল “এই তো চলছে ক’দিন ধরে। যখন তখন যেখানে সেখানে তল্লাশি শুরু করে দিচ্ছে। এদিকে এসো”।
একটা অপরিসর গলির মধ্যে খানিকটা নিয়ে গিয়ে বিলাল একটা কোঠাবাড়িতে নিয়ে গেল। মেয়েদের হাসির আওয়াজ আসছে। বিলাল বলল “মুজরো শুনি চল”।
আব্বাস বলল “তোবা তোবা। পাগল নাকি মিয়াঁ?”
বিলাল বলল “পেছনে আর্মি লেগেছে এখন তোবা করে লাভ নেই। চল শিগগির”।
কোঠাবাড়ির একটা ঘরে মুজরো দেখতে বসে গেল তিনজনে। চটুল বলিউডি সঙ্গীতে দুজন নাচছিল। বেশ কয়েকজন মধ্য বয়স্ক লোক টাকা উড়াচ্ছিল মেয়েদুটির গায়ে।
তারা তিনজন সে ঘরে ঢুকে বসে পড়ল।
আব্বাস ব্যাজার মুখে সায়ককে বলল “তোমার সঙ্গে বেরোলেই শুধু এসব জায়গায় আসতে হয়, কী পাপ যে করেছিলাম আমি যে আমার তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল”।
সায়ক আব্বাসের কথা শুনে হেসে ফেলল।
.
২৭
লাহোরের হীরা মান্ডি এলাকা। বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত পতিতাপল্লী।
দিনের বেলাতেও গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। এই পল্লী তৈরী হয়েছিল ব্রিটিশ সেনাদের মনোরঞ্জনের স্বার্থে। কালে কালে ব্রিটিশরা গেছে, কিন্তু লাহোরের মানুষদের মনোরঞ্জন তো আর বন্ধ হয় নি। থেকে গেছে এই অঞ্চল। উপমহাদেশের অন্যান্য শহরের নিষিদ্ধ পল্লীর মতই হীরা মান্ডির ঘর বাড়িও অপরিসর, ছোট ছোট ঘরে ভর্তি। গলিতে ঢুকতেই দেখা গেল মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে।
আব্বাস মাথা নিচু করে যেতে যেতে বলল “মিয়াঁ, আবার তুমি আমাকে এইরকম জায়গায় নিয়ে এলে? আমার জাহান্নাম আর ঠ্যাকায় কে?”
সায়ক বলল “চুপচাপ বিলালকে ফলো করে যাও। আর শোন, আগে তো বেঁচে থাকো কোন রকমে, তারপরে না হয় জাহান্নামের কথা ভাববে”।
আব্বাস বলল “আর বেঁচে থাকা, এই পাকিস্তানিদের হাতেই মরতে হবে যা বুঝতে পারছি”।
একটা তিনতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বিলাল তাদের ইশারা করল।
সায়ক কোন দিকে না তাকিয়ে বিলালের পেছনে হাঁটতে শুরু করল।
বিলাল ফিসফিস করে বলল “কোন দিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকো”।
তিনজনে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল। বিলালকে দেখা গেল অনেকেই চেনে তাই কেউ কোন প্রশ্ন করল না।
বাড়িটার ছাদে নিয়ে এল বিলাল। চারজন মহিলা বসে তাস খেলছিল। বিলাল সায়কের দিকে ইশারা করল। সায়ক এগিয়ে গিয়ে এক মহিলাকে কিছু বলল। তিনি সায়কের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে উঠে পড়ে বললেন “আসুন”।
মহিলার পিছন পিছন হাঁটতে থাকল সায়ক। আব্বাস অবাক গলায় বলল “কী বললে মিয়াঁ? চেনো নাকি?”
সায়ক হাসল “আমাকে না। কাজল বেগমকে চেনেন”।
আব্বাস মাথায় হাত দিল “উফ, কন্ট্যাক্ট রাখতেও পারো তুমি। তোমাকে সেলাম মিয়াঁ”।
সায়ক উত্তর দিল না।
তিনতলার একটা বদ্ধ ঘরের তালা খুলে তাদের বসতে বলে দরজাটা বন্ধ করে চলে গেলেন মহিলা। একেবারেই ছোট একটা অপরিচ্ছন্ন ঘর। আব্বাস হাঁচতে হাঁচতে বলল “এ কোথায় নিয়ে এলে মিয়াঁ?”
সায়ক বলল “দুঃখিত, তোমার জন্য ফাইভ স্টার হোটেল পাওয়া গেল না। আপাতত পৈতৃক প্রাণটা এখানে থেকেই বাঁচিয়ে রাখো, আর কী বলি”।
আব্বাস মুখ চুন করে বলল “তোমার সঙ্গে বেরনোই আমার ভুল হয়ে গেছে। এর থেকে পাকিস্তানের জেলে পচে মরা ভাল। অন্তত সারাক্ষণ পেছনে আর্মির গুলি খাওয়ার ভয় থাকে না”।
বিলাল মুখ খুলল এবার, সায়কের দিকে তাকিয়ে বলল “আজ সন্ধ্যেয় একটা ট্রাক যাবে ইসলামাবাদে। কুড়ি থেকে পঁচিশজন মেয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। সব চেক পোস্টে এদের টাকা খাওয়ানো থাকে। কেউ কিছু বলবে না। তোমাদের বোরখা পরে উঠে পড়তে হবে ট্রাকে। কষ্ট হবে, কিন্তু কিছু করার নেই”।
সায়ক কিছু বলার আগেই আব্বাস ঝাঝিয়ে উঠল “না না মিয়াঁ, আর জেনানা সাজতে পারব না। বোরখা পরে থাকা যায় নাকি?”
সায়ক আব্বাসকে থামিয়ে দিয়ে বিলালকে বলল “নো প্রবলেম। এত মেয়ে কেন যাবে?”
বিলাল বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল “হিউম্যান ট্রাফিকিং। এসব তো সব দেশেই হয়। ইন্ডিয়াতেও হয়। লাহোর এদেশের এই সব মেয়েদের বেস ক্যাম্প বলতে পারো। এখান থেকে ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিন্ডির বিভিন্ন কোঠায় মেয়ে সাপ্লাই হয়। এদের গড় বয়স দশ থেকে সাড়ে দশ। এখন থেকেই ওদের বিভিন্ন ভাবে তৈরী করা হয়। আরেকটু বয়স হলে…”
সায়ক মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড বসে থেকে বলল “এত ছোট মেয়েদের সঙ্গে আমরা যাব? সন্দেহ করবে না?”
বিলাল বলল “বোরখা পরে বসে থাকবে। তোমরা ছাড়াও এদের এখান থেকে দুজন যাবে। ওরা তোমাদের ইসলামাবাদ পৌঁছে দেবে। কিন্তু ইসলামাবাদ পৌছে কী করবে কিছু ভেবেছ?”
সায়ক মাথা নাড়ল “আমি ব্ল্যাংক হয়ে গেছি। সম্ভবত আবার মুজফফরাবাদে যাব”।
আব্বাস চমকে উঠে বলল “ক্ষেপেছ? লস্করের ডেরায়? আমি নেই, আমাকে ছাড়া প্ল্যান কর তুমি”।
সায়ক বলল “বেশ তো, তোমাকে রাঘবস্যারের কাছে রেখে যাব, কিন্তু মনে রেখো, ইসলামাবাদে থাকলে কিন্তু দেশে ফেরার চান্স কমে যাবে। হ্যাঁ হতে পারে, মুজফফরাবাদ থেকে আমরা নাও ফিরতে পারি, তবু… খানিকটা হলেও চান্স থাকবে দেশে ফেরার, তুমি যা ঠিক করবে”।
আব্বাস ব্যাজার মুখে সায়কের দিকে তাকিয়ে বলল “তুমি মানুষ খুন করে দেবে মিয়াঁ। সত্যি বলছি বিশ্বাস কর”।
সায়ক হাসল “সে তো করতেই হবে, হয় আমি বাঁচব, নয় আমি মরব। আমাদের কাজে কি মাঝামাঝি কোন রাস্তা আছে আব্বাস মিয়াঁ?”
.
.
২৮
.
দুপুর দুটো।
তাদের গাড়ি কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছল। একটা ছোট কনভয়। দ্রুত গতিতে পৌঁছে দিল তাদের।
আলাদা একটা গাড়িতে কম্যান্ডোবেষ্টিত করে জ্যোতির্ময়কে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বীরেন তুষারকে সব কথা বলবে ভেবেও চুপ করে গেছে। যখনই বোনের মুখটা মনে পড়ছে, তার সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
আরেকটা ব্যাপারও আছে। ফোনটা পাওয়ার পর থেকে তার মনে হচ্ছে তাদের মধ্যেই কেউ আছে যে অনবরত শত্রুপক্ষকে খবর দিয়ে যাচ্ছে।
কম শীতেও ঘেমে যাচ্ছিল বীরেন।
ড্রাইভার চুপ করে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভারের পাশে বসেছে বীরেন। পিছনে খান এবং তুষার বসলেন।
এয়ারপোর্টে পৌঁছে একটা আলাদা ঘরে তাদের নিয়ে যাওয়া হল। বীরেন, খান এবং তুষারের সঙ্গে বসল।
তুষার ট্যাব দেখতে দেখতে খানকে বললেন “দে আর প্ল্যানিং সামথিং বিগ খান। কাশ্মীর ইজ নট সেফ”।
খান বললেন “শুধু কাশ্মীর? আমার বারবার অপারেশন ব্লু ফ্লাওয়ারের কথা মনে পড়ছে”।
বীরেনের পকেটের ফোনটা বাজছিল। বীরেন ফোনটা ধরে উঠে একটু আলাদা হয়ে ফোনটা ধরল “হ্যালো”।
“বলছি অ্যাসিড অ্যাটাক হলে একটা মেয়ের কী হতে পারে জানা আছে?”
বীরেন শিউরে উঠল। একটু ভেবে বলল “আমাকে একটু সময় দিন প্লিজ। আমি দেখছি”।
“দেখো দেখো। তোমার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে আছে বীরেন। তোমার বাবা আবার সকালে সাইকেল চালিয়ে বাজার যান। জাস্ট ভাবো একটা লরি এসে…”
বীরেন বাধা দিয়ে বলল “আমি দেখছি। প্লিজ এরকম কিছু করবেন না। ওঁর কাছে ফোনটা আমি ঠিক পৌঁছে দেব। একটু সময় দিন আমায়”।
“গুড। আমরা জানি তুমি পারবে। তুমি তো আমাদেরই দলের লোক। ইনাম পাবে। চিন্তা কোর না”।
ফোনটা কেটে গেল।
বীরেনের দরদর করে ঘাম হচ্ছিল। সে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না।
সে আবার তুষারের পাশে গিয়ে বসল।
তুষার বললেন “কী হল বীরেন, তোমাকে একটু টেন্সড লাগছে। সব ঠিক আছে তো?”
বীরেন মাথা নাড়ল “হ্যাঁ স্যার। নো প্রবলেম”।
তুষার বললেন “তোমাকে কাশ্মীরে স্পেশাল ট্রেনিং এ পাঠাব ভাবছি। ওখানে এখন মাথুর আছে। তোমার সঙ্গে মাথুরের পরিচয় আছে তো?”
বীরেন বলল “হ্যাঁ স্যার”।
খান বললেন “মাথুরকে বেশিদিন কাশ্মীরে রাখা যাবে না বীরেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে কাশ্মীরের সমস্তটা বুঝে নিতে হবে”।
তুষার বললেন “না, বীরেনকে এখনই গোটা কাশ্মীর বুঝে নিতে বললে সেটা একটু বেশিই হয়ে যাবে তবে বীরেনকে নিয়ে আমার অন্য প্ল্যান আছে”।
বীরেন জিজ্ঞাসু চোখে তুষারের দিকে তাকাল।
তুষার হাসলেন “সময় হলেই বলব”।
বিমানবন্দর অথোরিটি থেকে কয়েকজন অফিসার এসে তুষারের সঙ্গে দেখা করলেন। তুষার তাদের বললেন “আধ ঘন্টার মধ্যে আমরা রওনা দিচ্ছি। তোমাদের কি খিদে পেয়েছে?”
বীরেন মাথা নাড়ল।
তুষার বললেন “হাসান মাকসুদের ইন্টারোগেশন পার্ট খুব ইন্টারেস্টিং হতে চলেছে। লোকটা যে সব জিনিস দিয়ে এবং যেভাবে ছোট সাইজের শক্তিশালী বোম বানিয়েছে, তা আমাদের ডিফেন্স অ্যাকাডেমীকে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে হাসান মাকসুদকে পেতে ওরা সচেষ্ট হবে। আর কোন ভাবেই যেন কোন কম হাইজ্যাকিং এর…”
তুষারের ফোন বেজে উঠল। তুষার ধরলেন না।
কয়েক সেকেন্ড পরে খানের ফোন বেজে উঠল। খান ফোনটা ধরেই তুষারকে বললেন “স্যার আপনার ফোন”।
তুষার বিরক্ত হয়ে বললেন “কে?”
খান বললেন “বুঝতে পারছি না স্যার, আপনাকে চাইছে”।
তুষার ফোনটা ধরলেন। কয়েক সেকেন্ড পরে তার হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল।
খান বললেন “কি হল স্যার?”
তুষার ফ্যাকাসে মুখে বললেন “ইরাবতীকে কলেজের মধ্যে কেউ গুলি মেরেছে এইমাত্র। দে হ্যাভ স্টারটেড দ্য গেম, খান”।
খান এবং বীরেন দুজনেই চমকে উঠল।
খান বললেন “শিওর স্যার আপনি? এটা কোন প্র্যাংক কল নয় তো?”
তুষার ফোন বের করে পাগলের মত দিল্লিতে ফোন করতে শুরু করলেন।
খান অবাক হয়ে বীরেনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
.
২৯
ডাল লেক বরাবর বেশ খানিকটা গিয়ে বাজার এলাকায় গাড়ি দাঁড় করালেন মহম্মদ কাদরী। ডাল লেক বরফের চাদরে মুড়ছে অল্প অল্প করে। দিনের বেশির ভাগ সময় তুষারপাত হচ্ছে। গাড়ি পার্ক করে বাজারের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে বোঝার চেষ্টা করলেন তাকে কেউ লক্ষ্য করছে নাকি। কয়েক মিনিট পরে নিঃসন্দেহ হবার পরে হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট শোপিসের দোকানের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
দোকানী একাই ছিল দোকানে। কাদরীকে দেখে হাসল। সালাম দিল।
কাদরী প্রত্যুত্তরে সালাম দিয়ে বললেন “এসেছে?”
দোকানী কাদরীকে একটা ছোট কৌটো দিল।
কাদরী সেটা নিয়ে জ্যাকেটের পকেটে ভরে দোকান থেকে বেরিয়ে কোন দিকে না তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের গাড়িতে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।
মিনিট কুড়ি গাড়ি চালাবার পর নিজের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করালেন। বাড়ির অনতিদূরে সশস্ত্র আর্মিরা পাহারা দিচ্ছে। তাকে চেনে অনেকেই। কাদরী জওয়ানদের দেখে হাসলেন। একজন জওয়ান হাত নাড়ল।
গাড়ি পার্ক করে কাদরী চাবি বের করে দরজার তালা খুললেন।
ঠান্ডা পড়ছে জাঁকিয়ে। কাদরী আলো জ্বালাতে সুইচ দিলেন। আলো জ্বলল না।
কাদরী হতাশ হয়ে মোম জ্বালিয়ে বেডরুমে গেলেন।
খাটে একজন ঘুমাচ্ছে। কাদরী টেবিলের ওপর মোম রেখে বললেন “সারাদিন ঘুমোলে জেহাদ হবে কী করে?”
খাট থেকেই ঘুম জড়ানো গলায় ইসমাইল আব্বাস বলল “অনেকদিন পর এরকম নরম বিছানায় ঘুমাচ্ছি প্রফেসর। ভাল লাগছে খুব”।
কাদরী বললেন “সে তো বুঝতেই পারছি তোমার খুব ভাল লাগছে। কিন্তু আমাদের খুব শিগগিরি এই বাড়ি ছাড়তে হবে। ওরা কিছু একটা আন্দাজ করছে”।
ইসমাইল আব্বাস উঠে বসল। বলল “তুমি জিনিয়াস প্রফেসর। তুমি ঠিকই জানো তোমাকে কী করতে হবে। আমার জন্য কী বার্তা আছে?”
মহম্মদ কাদরী পকেট থেকে ছোট কৌটোটা বের করে ইসমাইলকে দিল। ইসমাইল বলল “লাইট প্লিজ”।
কাদরী মোবাইলের টর্চ জ্বালালেন। ইসমাইল বাক্সটা খুললে একটা চিরকুট বেরোল।
কাদরী বললেন “পেয়েছ বার্তা?”
ইসমাইল হাসতে লাগল।
কাদরী বললেন “কী হল?”
ইসমাইল বলল “এতে তো তোমাকে মেরে ফেলার কথা বলা আছে”।
কাদরী হাসলেন “নো প্রবলেম। যদি তাই লেখা থাকে, মেরে ফেলো। আমি প্রস্তুত”।
ইসমাইল হাসতে হাসতে কাদরীর কাঁধে হাত রেখে বলল “আমি জানি প্রফেসর তুমি এক কথার মানুষ। কিন্তু এত সহজে তোমার জন্নত যাওয়া হবে না। তার আগে অনেক কাজ করতে হবে। আচ্ছা আমাকে এবার বল, তুমি এখান থেকে পালাবার কথা ভাবছ কেন? তোমাকে ওরা সন্দেহ করছে?”
কাদরী বললেন “আজ কলেজ থেকে তাড়িয়েছে। নজর রাখছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। এখানে থাকা আমার জন্য সেফ না। তোমার জন্য তো নয়ই”।
ইসমাইল এবার গম্ভীর হল। বলল “আমাদের ওপর অমৃতসর যাওয়ার নির্দেশ এসেছে। আজকেই”।
কাদরী বললেন “যাব কী করে? রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ চেকিং আছে, আর্মি চেকিং আছে…”
ইসমাইল হো হো করে হেসে বলল “বেওকুফ ইন্ডিয়ান আর্মি আমাকে বনে বাদারে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওরা কখনও ভাবতেই পারবে না ওদের বুকের ওপর দিয়ে রাস্তা দিয়ে আমি যেতে পারি। তুমি চিন্তা কোর না প্রফেসর। আজ রাতের খাবার খেয়ে আমরা শ্রীনগর ছাড়ব”।
কাদরী চিন্তিত মুখে ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে বললেন “তুমি আমাদের একমাত্র ভরসা ইসমাইল। এত বড় ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে?”
ইসমাইল বলল “যে বান্দা রেহান খানের মত অফিসারকে মেরে শ্রীনগর জেল থেকে পালাতে পারে, সে সব করতে পারে প্রফেসর। তুমি আমার ওপর ভরসা রাখো। আমিও জানি, তুমিও জানো, কাশ্মীরে যেভাবে তল্লাশি চলছে, তাতে বেশিদিন এখানে থাকলে আমাদের ধরা পড়বার চান্স অনেক বেশি। ওখান থেকে যখন নির্দেশ এসেছে, তখন নিশ্চয়ই কোন কাজ সম্পূর্ণ করার কথা ভেবেই করা হয়েছে। তুমি গোছগাছ শুরু করে দাও। যা হবে দেখা যাবে”।
কাদরী কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে গোছগাছ শুরু করলেন।
ইসমাইল আব্বাস আবার শুয়ে পড়ল।
.
৩০
সন্ধ্যে সাতটা।
একটা বড় ট্রাক এসে দাঁড়িয়েছে গলির মুখে। ট্রাকের ভেতরে টানা বেঞ্চ রাখা। তার মধ্যে দশ বারো বছরের একগাদা মেয়েকে গাদা করে বসানো হয়েছে।
আব্বাস আর সায়ককে সে ট্রাকের মধ্যে তুলে দিল বিলাল।
বোরখার ভেতর থেকে আব্বাস বলল “কী একটা বোরখা দিয়েছে বুঝতে পারছি না মিয়াঁ, জঘন্য গন্ধ, কেউ মনে হয়ে এর ভেতরেই ওসব করেছে”।
সায়ক বলল “যেভাবে আছো, সেভাবেই থাকো। বেশি বকবক কোর না”।
মেয়েগুলো ভয়ে সিটিয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে কথা পর্যন্ত বলছে না। যে বয়সে নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টা, ইয়ার্কি করবে, সে বয়সে যেন ওদের মধ্যে কোন আতঙ্ক ভর করে আছে।
একটা মেয়ে “আব্বু আব্বু” বলে কাঁদছিল। একজন মহিলা এসে চড় দিয়ে চুপ করিয়ে দিল।
আব্বাস সায়ককে বলল “মেয়েটার বাবা মেয়েটাকে বিক্রি করে দিয়ে গেছে?”
সায়ক বলল “হু। থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির সমস্যা। নিজেরা গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা পয়দা করবে, তারপর কন্যাসন্তানকে বেচে দেবে”।
আব্বাস বলল “এই টুকু টুকু মেয়েদের ইসলামাবাদে নিয়ে যাচ্ছে কেন?”
সায়ক বলল “এখন থেকে তৈরী করবে। এদের রেটই সব থেকে বেশি। যেদিন থেকে মেন্সট্রুরাল সাইকেল শুরু হবে, সেদিন থেকে সব থেকে বেশি দামে বিকোবে এরা”।
আব্বাস হতাশ গলায় বলল “এরা তো শিশু”।
সায়ক বলল “যারা হিউম্যান ট্রাফিকিং করে তাদের কাছে শিশুর দামই সব থেকে বেশি। কলকাতা বল কী করাচি, মুম্বই বল কী ইসলামাবাদ, মেয়েদের যোনির দাম সর্বত্র সমান”।
আব্বাস বলল “ঈশ, কী হবে মিয়াঁ এই যুদ্ধ যুদ্ধ করে! মানুষ আর পশুর মধ্যে পার্থক্য কোথায়?”
সায়ক বলল “কোথাও নেই। আই এস আই এস কিংবা লস্কর আরও এক কাঠি ওপরে। তালিবানেরা তো মেয়েদের মানুষ বলেই মনে করে না। তুমি শোন নি, কোন এক মেয়ে পর্দা করে নি বলে স্টেডিয়ামসুদ্ধ লোক মেয়েটাকে পাথর মেরেই মেরে ফেলেছিল?”
আব্বাস মাথায় হাত দিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইল।
কিছুক্ষণ পরে ট্রাকের পেছনের দরজা বন্ধ করে দিল। ট্রাক নড়ে উঠে চলতে শুরু করল।
সায়ক বলল “তবে আজকাল মানুষ অনেক সভ্য হয়েছে। এককালে রাজা যুদ্ধে জিতলে পরাজিত রাজ্যের মেয়েদের ধর্ষণ করা হত, তাদের ক্রীতদাসী বানিয়ে রাখা হত। নিউক্লিয়ার ওয়েপুনের ভয়াবহতা সম্পর্কে লোক সম্যক ওয়াকিবহাল বলেই হয়ত মানুষ তার জন্যই অনেক সংযত হতে পেরেছে। এসব অস্ত্র এসে একদিকে ভালই হয়েছে। বলতে পারো হিরোশিমা, নাগাসাকি নিজে মরে আমাদের বাঁচিয়ে দিয়ে গেছিল। নইলে এতদিনে মানবসভ্যতা বলে কিছু থাকত না”।
একটা মেয়ে বমি করতে শুরু করল। আব্বাস বলল “আহা রে, জার্নিতে বমি করে। আমার ভাইঝিও করে। এদের দেখে আমার ভাইঝির সঙ্গে পার্থক্য করতে পারছি না মিয়াঁ”।
একজন মহিলা ছিলেন। তিনি মেয়েটাকে জল দিলেন। মেয়েটা ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেই চড় মারলেন। তাতে মেয়েটার কান্না বেড়ে গেল।
আব্বাস ফিসফিস করে বলল “আমরা কি কিছুই করতে পারব না মিয়াঁ? এতগুলো শিশুর জীবন বরবাদ হয়ে যাবে, চোখের সামনে দেখব?”
সায়ক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘কতজন শিশুকে বাঁচাব মিয়াঁ? আমাদের প্রথম প্রায়োরিটিগুলোই তো চেঞ্জ হয়ে গেছে বুঝতে পারছ না? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান না। যুদ্ধ, যুদ্ধ, যুদ্ধ”।
আব্বাস কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ট্রাকটা দাঁড়িয়ে পড়ল।
আব্বাস বলল “কী হল?”
সায়ক বলল “চুপচাপ বসে থাকো। মাথা নিচু করে থাকবে’।
মিনিট দুয়েক শ্বাসরোধ করে বসে থাকার পর ট্রাকের পেছনের ডালা খোলা হল। টর্চের আলো এসে পড়ল মেয়েগুলোর ওপর।
দুজনে বোরখা পরেছিল।
ট্রাকে কেউ উঠল না। নিজেদের মধ্যেই সেনারা হাসি মশকরা করতে করতে ডালা বন্ধ করে দিতে বলল।
মিনিট পাঁচেক পরে ট্রাক আবার চলতে শুরু করল।
আব্বাস বলল “উফ! আমার টয়লেট পেয়ে গেল মিয়াঁ। এদের কিচ্ছু বলল না?”
সায়ক হাসল “তোমাকে বললাম না, আমাদের দেশগুলোর প্রায়োরিটিগুলোই চেঞ্জ হয়ে গেছে”।
.
৩১
বসন্ত নেমেছিল উপত্যকায় সেদিন। টিউলিপ ফোটার মরসুম। বরফ গলতে শুরু করেছে কাছের পাহাড়গুলোতে। সবুজের ভরসায় দিন গুনছে সবাই।
এর মধ্যে গ্রামে সেদিন তীব্র চাঞ্চল্য। জঙ্গী ঢুকেছে শুনে গ্রামে আর্মি তল্লাশি শুরু হয়েছে। প্রতিটা ঘরে সেনারা তল্লাশি করছে।
ছোট কাদরী বাড়ির সামনে খেলছিল।
চাচা এসেছে বলে তার খুব মজা। কিছু বোঝার আগেই বাড়ির বাইরে আর্মির গাড়ি এসে দাঁড়াল।
কাদরী অবাক হয়ে দেখল একগাদা লোক হাতে বন্দুক নিয়ে তাদের বাড়ির ভিতর ঢুকল। আলমারিতে লুকিয়ে ছিল তার চাচা। তাকে টানতে টানতে নিয়ে এল আর্মি। বাড়ির লোক, গ্রামের লোক ভিড় করে এসেছে দেখার জন্য। তার চাচা ভীত চোখে চার দিকে তাকাচ্ছে। পকেট থেকে কিছু একটা বের করতে গেল আর সেই মুহূর্তে গর্জে উঠল সেনার গুলি।
চোখের সামনে ছোটচাচাকে লুটিয়ে পড়তে দেখেছিল মহম্মদ কাদরী।
ঈদে তারা জম্মু এসেছিল ফুপার বাড়িতে। ঝামেলার সময় ফুপাকে আগুনে পুড়িয়ে মারল অচেনা লোকেরা। আব্বু ফুপাকে বাঁচাতে গেল। আব্বুকেও মেরে দিল।
সে রাতটা দুঃস্বপ্নে এল আবার। শিউরে উঠে গাড়িতে উঠে বসলেন কাদরী। রাত দেড়টা। জওহর টানেল আটকে রাখা হয়েছে। গাড়ির দীর্ঘ লাইন। রাস্তার পাশেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
সারে সারে আর্মি ট্রাক জম্মু থেকে কাশ্মীরে আসছে। অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।
ইসমাইল পেছনের সিটে ঘুমিয়ে আছে। কাদরী দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে সিগারেট ধরালেন। দুজন ভারতীয় সেনা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে। ইসমাইল সরাসরি তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন “স্যার গাড়ি কখন ছাড়বে?”
একজন ঘড়ি দেখে বললেন “আরও দু ঘন্টা। কোথায় যাবেন আপনি?”
কাদরী বললেন “ফুপার বাড়ি। জম্মু। কাল ফুপাতো বোনের বিয়ে। খুব দেরী হয়ে যাবে স্যার”।
জওয়ানটি বললেন “কিছু করার নেই। অপেক্ষা করুন”।
কাদরী বললেন “আপনার বাড়ি কোথায়?”
জওয়ান বললেন “ওয়েস্ট বেঙ্গল। আপনি প্লিজ গাড়িতে গিয়ে বসুন। এভাবে কথা বলবেন না”।
কাদরী হেসে বাংলায় বললেন “জানি, সিভিলিয়ানদের সঙ্গে আপনাদের কথা বলা বারণ, চিন্তা করবেন না, আমিও ভারতীয়। ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। আর বেঙ্গলে আমি অনেকবার গেছি। টেগোরের দেশ। আমরা কাশ্মীরিরা অনেকেই কিন্তু সুন্দর বাংলা বলতে পারি”।
জওয়ান বললেন “জানি প্রফেসর সাহেব। কিন্তু আপনি প্লিজ গাড়িতে গিয়ে বসুন। এখানে হাই অ্যালার্ট আছে বুঝতেই পারছেন”।
কাদরী বললেন “জানি তো। কাশ্মীর মানেই তো তাই। আপনারাও বুঝতে পারছেন আমরা কীসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি”।
অপর জওয়ান জিজ্ঞাসু চোখে এগিয়ে এল। বাঙালি জওয়ান কাদরীকে বললেন “জানি স্যার। কিন্তু কিছু করার নেই”।
অপর জওয়ান বাঙালি জওয়ানটিকে জিজ্ঞেস করলেন “কী হচ্ছে?”
বাঙালি জওয়ান বললেন “কিছু না। উনি শ্রীনগরের কলেজে পড়ান”।
কাদরী সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন দুজনের দিকে। দুজনেই মাথা নাড়লেন। বাঙালি অপর জওয়ানকে বললেন “তুমি যাও। আমি দেখছি”।
অপরজন চলে গেলেন।
কাদরী বললেন “আপনাদের সারাদিন সারারাত এভাবে পাহারা দিতে কষ্ট হয় না?”
জওয়ান হেসে বললেন “সেটাই আমার কাজ”।
কাদরী সিগারেটে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন “তা বটে। টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশনগুলোর যেমন কাজ বর্ডারে আর ইন্ডিয়ার ভেতরে সমস্যা তৈরী করা”।
জওয়ান উত্তর দিলেন না। একের পর এক গাড়ি যাচ্ছে। ঠান্ডা পড়ছে জাঁকিয়ে। কাদরী বললেন “আপনি সিগারেট নেবেন না?”
জওয়ান বললেন “না। আপনি গাড়িতে চলে যান। বুঝতেই পারছেন এসব জায়গায় আপনার সঙ্গে কথা বলাটা সমস্যা আছে”।
কাদরী হাসি মুখে “থ্যাঙ্কিউ” বলে গাড়িতে গিয়ে বসলেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোতে বেশিরভাগ মানুষ ঘুমাচ্ছে। জম্মু কাশ্মীর পুলিশের ভ্যান টহল দিচ্ছে।
ইসমাইল শুয়ে থাকা অবস্থাতে ফিসফিস করে বলল “কয়েক কেজি জিনিস থাকলে এই কমবখত দেশটাকে এখানেই কিছু শিক্ষা দিয়ে যাওয়া যেত প্রফেসর”।
কাদরী গম্ভীর গলায় বললেন “এসব মাথাতেও এনো না এখন। মিশন ভুলে যেও না”।
ইসমাইল হাই তুলে বলল “হ্যাঁ প্রফেসর। রক্ত গরম। বুঝতেই পারছেন”।
কাদরী বললেন “তোমার গরম রক্ত ঠান্ডা কর প্রয়োজনমত। এখানে সুইসাইডাল অ্যাটেম্পটের কোন মানে নেই। কাশ্মীরে রোজ এরকম গণ্ডায় গণ্ডায় অ্যাটেম্পট হয়। লোকের গা সওয়া হয়ে গেছে। ইন্টেলিজেন্স তোমাকে গ্রামে গ্রামে পাগলের মত খুঁজছে। তোমার কোন রকম বোকামি এখন আমি অ্যালাউ করব না বুঝতে পারছ আশা করি”।
ইসমাইল বলল “হ্যাঁ হ্যাঁ প্রফেসর। আল্লাহ সময় বলবেন জানি আমিও। তবু তর সয় না”।
কাদরী চোখ বুজলেন “তর সওয়াও। কোন জলদি নেই”।
ইসমাইল ফিক ফিক করে হাসতে লাগল।
.
.
৩২
গোটা রাস্তা তুষার একটা কথাও বললেন না। থমথমে মুখে বসে রইলেন।
দিল্লি পৌঁছে জ্যোতির্ময়কে নিয়ে কনভয়ে বেরিয়ে গেলেন খান। তুষারের সঙ্গে বীরেন থাকল। গাড়িতে তুষারকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারছিল না বীরেন। একই সঙ্গে ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছিল। কতটা শক্তিশালী নেটওয়ার্ক হলে এরা ইরাবতীর মত মহিলাকে টার্গেট করতে পারে তা অচিন্তনীয়।
নার্সিং হোমে পৌঁছে আই সি ইউর দিকে দৌড়লেন তুষার। পিছন পিছন বীরেন। ডাক্তার জানালেন গুলি বুকের ডান দিক ছুঁয়ে গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। পেশেন্টের জ্ঞান নেই। এই মুহূর্তে কিছু বলা যাচ্ছে না। তুষার সবটা শুনে বেরিয়ে ভিজিটরস রুমে গিয়ে বসলেন। বীরেন দাঁড়িয়ে ছিল, তুষার বীরেনকে বললেন “বোস। এখন আমাদের হাতে কিছু নেই”।
বীরেন কোন কথা না বলে বসল।
তুষার একটু চুপ করে থেকে বললেন “বুঝতে পারছ আমরা ঠিক কোন ডিপার্টমেন্টে কাজ করছি?”
বীরেন বলল “হ্যাঁ স্যার”।
তুষার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন “সব থেকে ভাল হত হয়ত কোন পিছুটান না থাকলে। কিন্তু মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সেটা তো সম্ভব নয়। কী আর করা যায়”।
বীরেন নিজেও বুঝল কথাটা। তুষার অবশ্য চুপ করে বসে থাকলেন না। আশরফ খানকে ফোন করে তারা ঠিক ঠাক পৌঁছেছেন কিনা হাসান মাকসুদকে নিয়ে, তার খবর নিলেন। মিনিস্ট্রি থেকেও ফোন আসতে শুরু করল কিছুক্ষণ পরে।
তুষার ঠান্ডা মাথায় সবাইকে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। বীরেন চমৎকৃত হল তুষারকে দেখে। এই মারাত্মক ব্যক্তিগত বিপর্যয়েও কী অস্বাভাবিক শান্ত হয়ে আছেন তুষার! অথচ বাবা মা কিংবা বোনকে নিয়ে একটা হুমকিতেই সে কীভাবে ভেঙে পড়ছে। সেও তো একটা টেনশনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। প্যান্টের পকেটে ফোনটা আছে। কী আছে এই ফোনে যেটা জ্যোতির্ময়ের কাছে পাঠাবার জন্য ওরা এত ব্যাকুল হয়ে আছে?
বীরেন ফোনটা বের করে দেখে আবার পকেটে রেখে দিল।
তুষার বললেন “চল ক্যান্টিনে চল কিছু খেয়ে নেওয়া যাক”।
বীরেন একটু অবাক হয়েই তুষারের দিকে তাকাল।
তুষার বললেন “নিজেদেরকে ঠিক রাখতে হবে। কী করব? কিছু করার আছে? চল”।
দুজনে নার্সিং হোমের ক্যান্টিনে গেল। তুষার ধোসা নিলেন দুজনের জন্য। চুপচাপ খেয়ে যেতে থাকলেন।
তুষার খেতে খেতে বললেন “এটাও ইন্টেলিজেন্স ফেইলিওর। আমি ওর ওপর নজর রাখার জন্য দুজনকে রেখেছিলাম। তারাও কিছু করতে পারল না। আমার সিক্সথ সেন্স বলছিল ওরা কিছু একটা করতে পারে। এতটা মরিয়া হয়ে উঠবে বুঝতে পারিনি”।
বীরেন বলল “ওদের দুজনের সামনেই গুলি করেছে?”
তুষার বললেন “ওরা সবটাই ট্র্যাক করেছিল। যে মুহূর্তে সুযোগ পেয়েছে গুলি চালিয়ে পালিয়েছে”।
বীরেনের ফোন বাজতে শুরু করল। বীরেন দেখল বাবা ফোন করছে। ধরল সে “হ্যালো”।
“কী রে তোর খবর কী? কোথায় আছিস এখন?”
বীরেন তুষারের দিকে তাকাল। তুষার খেয়ে যাচ্ছেন। সে বলল “দিল্লিতে এসেছি। আমি রাতের দিকে ফোন করছি বাবা, ব্যস্ত আছি এখন”।
ফোন রাখল বীরেন।
তুষার বললেন “বাড়ি থেকে ফোন এলে কথা বলা উচিত। দে মিস ইউ”।
বীরেন বলল “হ্যাঁ স্যার। বলব”।
তুষার বললেন “ফিল ফ্রি টু টক। খেয়ে নিয়ে ফোন কর”।
বীরেন বলল “ওকে স্যার”।
তুষার খেয়ে বললেন “আমি আই সি ইউর দিকে যাচ্ছি, অপারেট করার কোন প্ল্যান আছে নাকি দেখি ওদের। তুমি কথা বলে নিও”।
বীরেন মাথা নাড়ল।
তুষার বেরিয়ে গেলেন। বীরেন খেয়ে ফোন বের করে বাবাকে ফোন করবে ভেবে ফোন বের করতে দেখল আননোন নাম্বার থেকে আবার ফোন আসা শুরু করেছে।
সে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল “কাজ হয়েছে?”
বীরেন বলল “না। আমি জ্যোতির্ময়বাবুর সঙ্গে নেই”।
“ওকে। ওয়েটিং। তোমাকে খুব বেশি হলে আর বারো ঘন্টা দিতে পারি আমরা”।
ফোনটা কেটে গেল।
বীরেন চুপ করে বসে থাকল কিছুক্ষণ।
তুষারের মুখটা মনে পড়ল অকারণেই। শান্ত সমাহিত ফোকাসড একজন মানুষের মুখ।
বাবাকে ফোন করল সে। বাবা ফোন ধরেই বলল “কী রে, বললি যে রাতে ফোন করবি?”
বীরেন বলল “না বল। কী বলছিলে”?
বাবা উদ্বিগ্ন গলায় বলল “সব ঠিক আছে তো রে?”
এই সাধারন একটা কথা বীরেনের সব কিছু এলোমেলো করে দিল। চোখের কোণা জলে ভিজে উঠল তার।
.
৩৩
দিল্লিতে ইন্টেলিজেন্সের গোপন ডেরায় নিয়ে আসা হয়েছে জ্যোতির্ময়কে।
সারারাস্তা জ্যোতির্ময় একটা কথাও বলেন নি।
আশরফ খানের নির্দেশে একটা চেয়ারে হাত পা বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
রাত দশটা।
আশরফ নিজের চেম্বারে বসেছিলেন।
তুষার ফোন করলেন।
আশরফ ধরলেন “হ্যাঁ স্যার”।
তুষার বললেন “কী আপডেট খান?”
আশরফ বললেন “বসিয়ে দিয়েছি। রেস্ট দিই নি কোন”।
তুষার বললেন “গুড। তুমি নিজে নজর রেখো”।
খান বললেন “সে তো নিশ্চয়ই। ডাক্তাররা কী বলছেন স্যার?”
তুষার ঠান্ডা গলায় বললেন “যা বলে। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। অবজারভেশনে রাখা হচ্ছে। সারভাইভালের চান্স আছে”।
খান বললেন “ম্যাডাম নিশ্চয়ই সারভাইভ করবেন স্যার। একদম চিন্তা করবেন না”।
তুষার বললেন “আমিও জানি ও সারভাইভ করবে। ব্যাপারটা হল ওরা ইচ্ছা করে এটা করেছে। ওদের লক্ষ্য আমাদের ভয় দেখানো। তোমার ফ্যামিলিকেও সাবধানে রেখো খান। মাথুরকেও আমি অ্যালার্ট করে দিয়েছি। দে হ্যাভ এভ্রি ফাকিং ডিটেইলস অ্যাবাউট আস”।
খান বললেন “আমাদের ভেতরের খবর ওরা পাচ্ছে কী করে?”
তুষার বললেন “অনেকগুলো পথ আছে। হানি ট্র্যাপ হতে পারে কিংবা ফ্যামিলির লাইফ থ্রেট। সিসিটিভি মনিটরিং চাই মাকসুদের ইন্টারোগেশন চেম্বারে। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে যারা আমাদের ইনফরমেশন লিক করছে, তাদের কেউ ওর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবে”।
খান বললেন “সিসিটিভি অলরেডি ইনস্টলড স্যার”।
তুষার বললেন “মিনিস্টার মাকসুদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। আমি ডিরেক্ট না করে দিয়েছি। আই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি ইনভলভমেন্ট”।
খান হাসলেন, “আপনাকে মিনিস্ট্রি থেকে সরিয়ে দেবে এরপরে। ওদের কোন কথাই শুনছেন না আপনি”।
তুষার বললেন “সরিয়ে দিলে দেবে। যতক্ষণ আমি আছি আমার পোস্টে, ততক্ষণ কারো কথা শুনব না”।
খান বললেন “রাইট স্যার”।
তুষার বললেন “গুড নাইট খান। কোন রকম সমস্যা হলে ফোন করবে”।
খান বললেন “গুড নাইট স্যার”।
ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ করিডরে হাঁটাহাঁটি করলেন খান। পরক্ষণেই নিজের চেম্বারে এসে কম্পিউটার খুললেন। মাথুর ফোন করছেন। ধরলেন “বল মাথুর, কাশ্মীরের কী হাল”?
মাথুর বললেন “কাশ্মীরের হাল কখনও ভাল হবে না খান। কী করবে বল? তার ওপর যা ঠান্ডা এখানে, মরেই যাব মনে হচ্ছে”।
আশরফ বললেন “একা একা বেরিও না কিন্তু। কাশ্মীর ইজ নট সেফ অ্যাট অল”।
মাথুর বললেন “তা আর বলতে। কিন্তু এই ইসমাইলটাকে না পেলে যে সমস্যা বেড়েই যাবে। ওয়াজুরায় যেভাবে দুজন জওয়ানকে মেরেছে ইমাজিন করতে পারবে না। কে জানে ব্যাটা কোন গ্রামে এখন লুকিয়ে আছে”।
আশরফ বললেন “অবস্তীসাহেবের হেল্প নাও”।
মাথুর বললেন “নিচ্ছি তো। চিরুণিতল্লাশি হচ্ছে রীতিমত। ওদের কমিউনিকেটিং ডিভাইসগুলোরও কোন রকম নাগাল পেলাম না। তুমি কি একবার কাশ্মীরে আসবে?”
আশরফ একটু থমকে গিয়ে বললেন “ডেফিনিটলি। তুষার স্যার আমাকে ছাড়লেই আমি যাব। অবশ্য আমি শুনছিলাম বীরেনকে তোমার কাছে পাঠানো হতে পারে”।
মাথুর বললেন “বীরেন ইজ আ ব্রেভ বয়। কিন্তু আমার মনে হয় ইসমাইলকে ধরার জন্য কোন পাকা মাথার দরকার আছে যে কাশ্মীরকে ভাল করে চেনে”।
আশরফ বললেন “ডেফিনিটলি। আমি যাব। তুমি চিন্তা কোর না। ভাল থেকো”।
ফোন রেখে আশরফ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। মাথুর আর তিনি এক সঙ্গেই জয়েন করেছিলেন। আশরফ থাকলে মাথুর আলাদা বল পান।
আশরফ মোবাইলের ইনবক্স দেখলেন। প্রতিদিন দশ বারোটা করে হুমকি মেসেজ আসে। ধর্মের নাম করে ভয় দেখানো হয়। এই মেসেজগুলো তার ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি। গালি গালাজ দেওয়া মেসেজগুলো এলেই তিনি বুঝতে পারেন, ঠিক পথেই এগোচ্ছেন। কোন ভুল কাজ করছেন না।
ইন্টারোগেশন চেম্বারের সিসিটিভির সারভারে লগ ইন করলেন তার কম্পিউটার থেকে। জ্যোতির্ময় চুপচাপ চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। এত অত্যাচারের পরও স্নায়ু শান্ত করে এভাবে চুপ করে বসার জন্য কতটা ট্রেনিং দরকার সেটা ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছিলেন আশরফ। শুনেছেন এদের ট্রেনিং ভারতীয় সেনাবাহিনীর কম্যান্ডো ট্রেনিংএর মতই হয়। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে কিংবা মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে এরা ট্রেনিং নিয়ে আসে।
আশরফ তীক্ষ্ণ চোখে জ্যোতির্ময়ের দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে ইন্টারোগেশন চেম্বারের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।
চেম্বারের বাইরে একজন নিরাপত্তারক্ষী বসে ছিলেন। আশরফ তাকে চেম্বারের আলো জ্বালাতে বলে ঘরের ভিতরে গেলেন।
চেয়ার নিয়ে জ্যোতির্ময়ের সামনে বসলেন।
জ্যোতির্ময় হেসে বললেন “কেমন আছেন অফিসার? পরিবারের সবাই ভাল তো?”
আশরফ বললেন “তা জেনে আপনি কী করবেন হাসান মাকসুদ?”
জ্যোতির্ময় বললেন “দিল্লি খুব ড্রাই এলাকা বুঝলেন খানসাহেব। বেশি করে জল খাবেন”।
আশরফ বললেন “আপনার মত কোন শুভানুধ্যায়ী আমার দরকার নেই হাসান মাকসুদ”।
জ্যোতির্ময় বললেন ‘হজে যান? নিজের মানুষদের সঙ্গে দেখা করেন? নাকি এই সব না পাক নাস্তিকদের সঙ্গে থেকে থেকে আপনিও নাস্তিক হয়ে গেছেন”?
আশরফ হাসলেন “দ্যাটস নান অফ ইওর বিজনেস। আপনি ভাবলেন কী করে এত কিছু আপনাকে বলব?”
জ্যোতির্ময় মাথা নাড়লেন “তা বটে। আপনি সৎ মানুষ। আপনার জন্নতই নসীব হবে”।
আশরফ বললেন “আপনাদের দৌলতে তো এখনই পৃথিবীটা জাহান্নাম হয়ে গেছে। মৃত্যুর পর কী হবে ভেবে কী হবে? তার আগেই তো সব কিছু শেষ করে দিচ্ছেন আপনারা”।
জ্যোতির্ময় বললেন “সব কিছু আপেক্ষিক খানসাহেব। আমরা আমাদের দুনিয়াটা আমাদের মত করে নেব। তৃতীয় কোন ব্যক্তি কী বলল তা নিয়ে আমরা কখনই চিন্তিত নই। বাই দ্য ওয়ে, তুষার স্যারের ওয়াইফ কেমন আছেন?”
আশরফ চমকে উঠতে গিয়ে সামলে নিয়ে বললেন “ভাল আছেন”।
জ্যোতির্ময় বললেন “সাবধানে থাকতে বলবেন। দিনকাল ভাল নয়”।
আশরফ স্থির চোখে জ্যোতির্ময়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
.
৩৪
রাত সাড়ে বারোটা।
আব্বাসের চোখ লেগে এসেছিল।
সায়ক চুপচাপ বসেছিল।
ট্রাক দাঁড়াতে আব্বাসের ঘুম ভেঙে গেল। সে বিরক্ত গলায় বলল “উফ, একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দেয় না”।
সায়ক বলল “ইসলামাবাদ এসে গেছে”।
আব্বাস বলল “এত তাড়াতাড়ি? সারারাত পরে এলেই ভাল হত? এখন কোথায় ঘুমাব?”
ট্রাকের পেছনের দরজা খুলে গেল। বেশ কয়েকজন মহিলা এসে গাড়ি থেকে মেয়েদের নামাতে শুরু করল।
আব্বাস বলল “চল নামি”।
সায়ক বলল “চুপ করে বসে থাকো”।
বাচ্চা মেয়েগুলো সব নেমে গেলে একজন বোরখা পরিহিত মহিলা ট্রাকে উঠে এসে তাদের সামনে বসলেন।
আব্বাস সভয়ে সায়কের দিকে তাকাল।
সায়ক হেসে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল “অনেকদিন পর দেখা হল”।
বোরখা সরিয়ে রাঘব বললেন “হ্যাঁ’।
আব্বাস চমকে উঠে বলল “উফ, আপনি পুরো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। ভাবছিলাম হয়ে গেল বোধ হয়”।
রাঘব বললেন “গাড়ি এনেছি। নামো তাড়াতাড়ি”।
তিনজনে তাড়াতাড়ি নেমে হাঁটতে শুরু করল।
খানিকটা দূরে রাঘবের গাড়ি পার্ক করা ছিল।
তিনজনে গাড়িতে উঠে বসল।
আব্বাস বলল “ভাগ্যিস এসেছিলেন। নইলে আমি ভাবলাম আজকেও এই মিয়াঁ আমাকে এখানেই রেখে দেবে”।
রাঘব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললেন “সে থ্যাঙ্কস টু সায়ক। লাহোরে থাকলে এতক্ষণে উপরওয়ালার কাছে পৌঁছে যেতে। ওখানে তোমাদের খোঁজে রীতিমত তল্লাশি শুরু হয়েছে”।
সায়ক হেসে বলল “স্বাভাবিক। দে হ্যাভ মেনি সিক্রেটস টু কিপ”।
রাঘব বললেন “প্ল্যান কী তোমার?”
সায়ক বলল “আজকের রাতে বিছানা চাই। ঘুমাব। আর কোন প্ল্যান নেই”।
রাঘব হাসতে থাকলেন, বললেন “ওকে ওকে”।
আব্বাস আবার গাড়ির মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের ডেরায় পৌঁছে গেল তারা।
আব্বাসকে ঠেলে তুলতে হল।
হাই তুলতে তুলতে আব্বাস বিরক্ত গলায় বলল “আবার সেই জায়গা। আর ভাল লাগে না মিয়াঁ”।
সায়ক হাসতে হাসতে বলল “চল ঘুমাও”।
রাঘব গাড়ি থেকে দুটো প্যাকেট বের করে বললেন “খেয়ে নিও”।
রাঘব বেরিয়ে গেলেন।
সায়ক আব্বাসকে নিয়ে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালল।
আব্বাস বলল “তুমি খেয়ে নাও মিয়াঁ। আমার খিদে নেই”।
সায়ক বলল “নাহ। সেই লাহোরে খেয়েছিলে। এখন খেয়ে শক্তি সঞ্চয় কর। কাল কী আছে কে জানে?”
আব্বাস মুখ কালো করে বলল “এই জন্য না মিয়াঁ তোমাকে আমি নফরত করি। যেই একটু স্বাভাবিক কথা ভাবব, তুমি ঠিক বাগড়া দিয়ে ভয় দেখিয়ে দেবে”।
সায়ক প্যাকেটটা খুলল। বাখরখানি আর কাজু কিসমিস আছে। সে শুকনো বাখরখানি চিবোতে চিবোতে বলল “বাড়িতে এত রাতে ফিরলেও মা ভাত গরম করে দিত। যতক্ষণ না খাওয়া শেষ হবে, বসে থাকত”।
আব্বাস বলল “মাকে ফোন করতে পারো তো মিয়াঁ”।
সায়ক বলল “কী দরকার? উই অল হ্যাভ সিক্রেটস টু কিপ”।
আব্বাস মুখ শুকনো করে বলল “এসব কথা কেন বলতে গেলে? আমারও এবার বাড়ির জন্য মন খারাপ করতে শুরু করল”।
সায়ক বলল “খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। মন খারাপ আমাদের জন্য না”।
আব্বাস গজগজ করতে করতে খেতে শুরু করল।
#
সকাল ন’টা।
আব্বাসের ঘুম ভাঙল। সে উঠে সায়ককে ঠেলে তুলল।
বলল “আমি মার্কেট যাচ্ছি মিয়াঁ”।
সায়ক বলল “কেন?”
আব্বাস বলল “আরে কিছুই তো নেই। রান্না করে খাই আজ। বাইরে খেয়ে খেয়ে পেটের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে”।
সায়ক বলল “এখন বেরোবে?”
আব্বাস বলল “হ্যাঁ। বেশিক্ষণ লাগবে না। দেখি তুমি কাল মাছ মাছ করছিলে, কোন মাছ পাওয়া যায় নাকি”।
সায়ক হেসে বলল “ওকে। তাড়াতাড়ি আসবে। বেশি দেরী করবে না”।
আব্বাস তৈরী হয়ে বেরোল। সায়ক উঠে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে দরজা খুলে বাইরের দিকে উঁকি মারল। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে।
রাস্তার পাশেই বাড়িটা। প্রচুর লোকের আনাগোনা। এই ধরণের ডেরা জনবহুল এলাকাতেই রাখা হয় যাতে কেউ সন্দেহ না করতে পারে।
সায়ক রুমে এসে আবার শুল। গত দুদিন ধরে প্রচুর দৌড়াদৌড়ি হয়েছে। শরীর অবসন্ন লাগছিল।
ক্লান্তিতে আবার চোখ বুজে এল তার।
ঘুম ভাঙল দরজার নকের শব্দে। সায়ক সচেতন ছিল। উঠে দরজার কাছে গিয়ে বলল “কে?”
ওপাশ থেকে রাঘবের গলা ভেসে এল “আমি। খোল শিগগির”।
সায়ক দরজা খুলতেই রাঘব ঘরে ঢুকে বললেন “এখনই এ ডেরা ছাড়তে হবে”।
সায়ক অবাক গলায় বলল “কেন? আব্বাস ফেরেনি তো এখনও”।
রাঘব সায়কের দিকে তাকিয়ে বললেন “আব্বাস অ্যারেস্টেড। জাস্ট লিভ উইথ মি। নাও”।
.
৩৫
বীরেন রাতে তুষারের সঙ্গেই ছিল। তুষার বাড়ি যান নি।
শেষ রাতের দিকে নার্সিং হোমের ভিজিটরস রুমের বেঞ্চে বীরেন ঘুমিয়ে পড়েছিল।
সকাল ন’টা নাগাদ ঘুম ভাঙতে দেখল তুষার চুপ করে বসে আছেন।
বীরেন তাড়াতাড়ি উঠে বলল “গুড মর্নিং স্যার”।
তুষার বললেন “গুড মর্নিং বীরেন। তবে এই মর্নিংটা অত ভাল না আমাদের কাছে”।
বীরেন বলল “ম্যাডাম ঠিক আছেন তো?”
তুষার বললেন “হ্যাঁ, ও ঠিক আছে, হয়ত আজকে জ্ঞানও ফিরে আসবে”।
বীরেন অবাক হয়ে বলল “তবে?”
তুষার অস্বস্তির সঙ্গে বললেন “সমস্যা একটা হয়েছে। এখন সেটা তোমাকে বলতে পারছি না। তুমি আমাদের গেস্ট হাউজে চলে যাও। এখানে থেকো না”।
বীরেন মাথা নাড়ল “না না স্যার, তা হয় না। আমি থাকছি। আমার কোন প্রবলেম নেই”।
তুষার বললেন “প্রবলেম নেই তো?”
বীরেন বলল “না স্যার”।
তুষার বললেন “মিনিস্ট্রি থেকে প্রচুর ফোন আসছে। আমাকে হয়ত ডিফেন্স মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। তুমি তবে এখানেই থেকো। কোন রকম খবর এলে আমাকে ফোন করে দিও”।
বীরেন ঘাড় নাড়ল “ওকে স্যার”।
তুষার বীরেনের কাঁধে হাত রেখে বললেন “থ্যাংকিউ”।
বীরেন চুপ করে থাকল। তার ভেতরে যে ঝড়টা যাচ্ছে সেটা তুষারকে বলতে গিয়েও চুপ করে গেল।
তুষার বেরোলেন। ড্রাইভারকে বলা ছিল, তাকে সরাসরি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বাংলোতে নিয়ে গেল।
মন্ত্রীর বাড়ির গেটে তুষারের আইডেন্টিটি কার্ড দেখা মাত্র নিরাপত্তারক্ষীরা ছেড়ে দিল। দলীয় কর্মীরা বাইরের ঘরে দল বেঁধে বসে ছিল। তুষার ফোন করলেন। তাকে মন্ত্রীর আপ্তসহায়ক এসে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেলেন।
মন্ত্রী বেডরুমেই ছিলেন। খানিকক্ষণ আগে ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজ পড়ছিলেন।
তাকে দেখে উঠে বসে বললেন “আসুন তুষার, আপনার ওয়াইফ ভাল আছেন তো?”
তুষার চেয়ারে বসলেন। ঘরে যারা ছিলেন মন্ত্রী তাদের বেরিয়ে যেতে বললেন। ঘর ফাঁকা হতে তুষার বললেন “হ্যাঁ স্যার। শি ইজ ইমপ্রুভিং”।
মন্ত্রী চিন্তিত গলায় বললেন “এটা একটা গেল। এবার সেকেন্ডটায় আসি। খবরটা সত্যি?”
তুষার বললেন “কোন খবরটা স্যার?”
মন্ত্রী বললেন “আপনার লোক ইসলামাবাদে অ্যারেস্ট হয়েছে?”
তুষার মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন “আপনাকে কে বলল স্যার?”
মন্ত্রী বললেন “কাম অন তুষার, আমি জানব না তো কে জানবে? আমার তো ঘুমই ভাঙল এই খবরে”।
তুষার বললেন “হ্যাঁ স্যার, এই খবরটা দিতেই আমি এখানে এসেছিলাম”।
মন্ত্রী বললেন “এবার কী প্ল্যান আপনার?”
তুষার বললেন “চিন্তার কিছু নেই স্যার। ও কিছুই বলবে না”।
মন্ত্রী বললেন “কাগজপত্র? পাসপোর্ট?”
তুষার বললেন “কিছু নেই”।
মন্ত্রী বললেন “তবু… পাকিস্তান মিডিয়া দেখাতে শুরু করে দিয়েছে। বুঝতে পারছেন এর কনসিকোয়েন্সেস কী হতে পারে। আমরা কি কিছুই করতে পারি না?”
তুষার হাসলেন “না স্যার”।
মন্ত্রী বললেন “আর ছেলেটার ফ্যামিলি? তাকে কি জবাব দেবেন?”
তুষার বললেন “যেভাবে আর পাঁচটা জওয়ানের পরিবারকে আমরা কিছু জবাব দিতে পারি না স্যার”।
চা দিয়ে গেল। মন্ত্রী চায়ের কাপ হাতে তুলে বললেন “কিছু একটা তো করুন তুষার। পি এম ফোন করেছেন অলরেডি”।
তুষার বললেন “চিন্তা করবেন না স্যার। আব্বাসের সম্পর্কে কোন অফিসিয়াল নথি নেই। আব্বাস নিজেও স্বীকার করবে না কিছু, ওকে যত অত্যাচার করাই হোক। আমরা আমাদের ছেলেদের সেভাবেই ট্রেইন করি। মরে যাবে, কিন্তু মুখ খুলবে না”।
মন্ত্রী তুষারের দিকে তাকিয়ে বললেন “আপনি জানেন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড থেকে আমাদের কাছে ক্রিকেট খেলার প্রস্তাব এসেছে গতকাল?”
তুষার বললেন “না স্যার। জানা উচিত ছিল। কাল স্বাভাবিক দিন গেলে নিশ্চয়ই জেনে যেতাম”।
মন্ত্রী বললেন “তা বটে। সত্যিই আপনার কাছে কালকের দিনটা নাইটমেয়ার ছিল। যাই হোক, দে ওয়ান্ট টু প্লে আ ফুল সিরিজ উইথ আস, ইন পাকিস্তান। পিসিবির অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল নয়, সেটা ইমপ্রুভ করার জন্য ওরা বিসিসিআই এর হেল্প চাইছে”।
তুষার হেসে ফেললেন।
মন্ত্রীও হেসে বললেন “ওরা চায় সিরিজের শেষে আমাদের পি এম ইসলামাবাদে যান। শান্তি আলোচনা এটসেট্রা”।
তুষার বললেন “পি এম কী চাইছেন?”
মন্ত্রী বললেন “আপনার মতামত”।
তুষার মুখের হাসি বজায় রেখে মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
.
৩৬
ভারতের হাইকমিশনারকে প্রেসিডেন্ট হাউজে ডেকে পাঠানো হয়েছে। ড্রয়িং রুমে বসিয়ে প্রেসিডেন্ট নিয়াজিকে খবর দেওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট নিয়াজি ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করা মাত্র হাইকমিশনার নমন সিব্বাল উঠে দাঁড়ালেন।
প্রেসিডেন্ট নিয়াজি এগিয়ে এসে নমন সিব্বালের হাত ধরে বললেন “আপনাকে তড়িঘড়ি প্রেসিডেন্ট হাউজে ডেকে পাঠানোর জন্য আমি খুবই দুঃখিত নমন সাহাব”।
নমন প্রত্যুত্তরে হেসে বললেন “কোন সমস্যা নেই। নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হয়েছে, আমি দেরীও করি নি আপনার হাউজ থেকে ফোন আসার পরে”।
নিয়াজি বসে বললেন “প্লিজ বসুন”।
নমন বসলেন।
নিয়াজি বললেন “ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ডকে পিসিবি আমন্ত্রন জানিয়েছে ক্রিকেট খেলার জন্য। এই খবরটা কি আপনাকে কেউ জানিয়েছে?”
নমন বললেন “হ্যাঁ। আমি আজ সকালে নিউজ পেপার পড়ে জানলাম”।
নিয়াজি মাথা নেড়ে বললেন “দিস রিপোরটারস! সব সময় ওত পেতেই আছে। যাক গে, এতে অবশ্য কোন সমস্যা নেই। আমি আপনাকে এই জন্যই ডেকে পাঠিয়েছিলাম”।
নমন বললেন “বলুন, এই বিষয়ে আমি কী করতে পারি”।
নিয়াজি বললেন “দেখুন জনাব, আপনি আশা করি জানেন, এই মুহূর্তে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড একটা মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তারাই আমার কাছে এই আর্জিটা নিয়ে এসেছিল। পিসিবির খেলা বেশিরভাগই এখন দুবাই বা আবুধাবিতে করতে হচ্ছে। এর ফলে সে মাঠে লোকও হচ্ছে না। পাকিস্তান বোর্ডে সেভাবে কোন টাকাও আসছে না। এই মুহূর্তে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান সিরিজ হলে বুঝতেই পারছেন আমাদের দেশের পক্ষে সেটা কতটা লাভজনক হতে পারে। সব থেকে বড় কথা, আমরা তো কখনই ক্রিকেট আর রাজনীতিকে মেলাতে চাই নি। ক্রিকেটই পারে দু দেশের মধ্যে টেনশন কমাতে। এবার নিশ্চয়ই ইন্ডিয়া থেকে আপনার কাছেও একটা মতামত চাওয়া হবে এই বিষয়ে। আমি চাইব আপনি একটা পজিটিভ ফিডব্যাক দেবেন পাকিস্তান সম্পর্কে। আপনার কি মনে হয় না পাকিস্তান এই মুহূর্তে নিরাপদ হাতে রয়েছে?”
নমন বললেন “অবশ্যই নিরাপদ হাতে আছে। এও জানি ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিম পাকিস্তানে এলে নিরাপত্তার অভাব কোনভাবেই বোঝা যাবে না। তবে…”
নিয়াজি বললেন “আপনি বুঝি আমার ওপর হওয়া হামলাটা নিয়ে কিছু বলতে চাইছিলেন?”
নমন হেসে বললেন “পাকিস্তানি মিডিয়া আসলে ব্যাপারটাকে এমনভাবে রিপ্রেসেন্ট করেছিল…”
নিয়াজি বললেন “ঠিকভাবেই করেছিল। আমি নিজেও ভাবতে পারি নি কোন দিন এভাবে হামলা হতে পারে। কিন্তু ভেবে দেখুন, ইন্ডিয়ান প্রাইম মিনিস্টারদের ওপরেও তো হামলা হয়েছিল তাই না? ইন্দিরা গান্ধী কিংবা রাজীব গান্ধীকে তো ইন্ডিয়ানরাই খুন করেছিল। তা বলে কি ইন্ডিয়াতে কোন টিম খেলতে যাবে না? দেখুন জনাব, এই মুহূর্তে পাকিস্তানের নিরাপত্তা আমরা অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে সবার নিরাপত্তার দায় নিতে রাজি আছি। আমি চাইব, এই সিরিজটা যেন অবশ্যই সংঘটিত হয়”।
নমন বললেন “আমি আপনার বার্তা ইন্ডিয়াতে এখনই পাঠানোর ব্যবস্থা করছি”।
নিয়াজি বললেন “থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। প্লিজ হ্যাভ ব্রেকফাস্ট উইথ মি জনাব”।
নমন বললেন “আমার সৌভাগ্য। কিন্তু আমি অলরেডি ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি স্যার”।
নিয়াজি দুঃখিত হবার মুখ করে বললেন “আমার দুর্ভাগ্য”।
পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়েছে এরকম মুখ করে বললেন “ওহ, আপনাকে একটা কথা জানাই। আজ সকালে একজনকে ইন্ডিয়ান স্পাই সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরকম কোন খবর আপনি শুনেছেন?”
নমন আকাশ থেকে পড়ার মুখ করে বললেন “ইন্ডিয়ান স্পাই? সেকী? এরকম কিছু আছে সে সম্পর্কে তো আমার কোন ধারণাই ছিল না মিস্টার নিয়াজি”।
নিয়াজি মাথা নেড়ে বললেন “আমারও তাই। আমরা তো বরাবরই দুদেশের সু সম্পর্ক বজায় থাকুক সেটাই চেয়েছি। তবে কী জানেন জনাব, এই স্পাইটিকে পেশোয়ারে এবং লাহোরে আমাদের ইন্টেলিজেন্স স্পট করেছিল। বেচারির ভাগ্য খারাপ যে সে ভেবেছিল হয়ত আমরা তাকে ধরতে পারব না। আরেকজনও আছে… কী নাম যেন তার…”
নমন চুপ করে রইলেন।
নিয়াজি বললেন “আহ, ছাড়ুন। তার নামটা আমি মনে করতে পারছি না। তবে পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া কোন দুর্ঘটনার সঙ্গে যদি এদের কোন লিংক প্রমাণিত হয় তবে কিন্তু সমস্যা হতে পারে জনাব”।
নমন বললেন “আমি এই ব্যাপারে একেবারেই অন্ধকারে জনাব। সেরকম কিছু হলে আমি অবশ্যই সমর্থন করব না। আপনার মত আমিও চাইব দু দেশের সম্পর্কের যেন কখনোই পতন না হয়”।
নিয়াজি বললেন “মাশাল্লাহ। আপনার কাছে আমি এটাই শুনতে চেয়েছিলাম জনাব”।
নমন উঠে বললেন “আমি এবার অফিসের পথে রওনা হব স্যার। আমাকে অনুমতি দিন”।
নিয়াজি উঠে দাঁড়িয়ে নমনকে বিদায় দিলেন। নমন চলে গেলে নিয়াজি মনে মনে বললেন “কূটনীতি হল দাবা খেলার মত। সবাই দেখতে পাবে তুমি রাণী বাঁচাতে নিজের সৈন্যকে কুরবান করছ কিন্তু কেউ স্বীকার করবে না। কেয়া বাত। কেয়া বাত”।
.
৩৭
সকাল এগারোটা। ইসলামাবাদ ছাড়িয়ে গাড়িটা এগিয়ে চলেছে হাইওয়ে ধরে।
সায়ক গম্ভীর হয়ে বসে আছে।
রাঘব বললেন “প্ল্যান কী?”
সায়ক বলল “কোন প্ল্যান নেই। মাথায় শুধু ঘুরছে আব্বাসকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলাম”।
রাঘব মাথা নেড়ে বললেন “আব্বাসকে ভুলে যেতে হবে সায়ক। এছাড়া আর কোন উপায় নেই”।
সায়ক বলল “স্বাভাবিক। আমি যেদিন ধরা পড়ব, সেদিনও ভারত সরকার সেটাই বলবে”।
রাঘব বললেন “আমার ক্ষেত্রেও। আমাদের কাজটাই তাই”।
সায়ক চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল “আব্বাসকে ওরা ধরেছে মানে আমাকেও ট্রেস করেছে”।
রাঘব বললেন “কী করে বুঝছ?”
সায়ক বলল “আমরা কোথায় যাচ্ছি এখন?”
রাঘব বললেন “মুজফফরাবাদ”।
সায়ক মাথা নাড়ল “হু। আমারও সেটাই ধারণা ছিল”।
রাঘব বললেন “মানে?”
সায়ক বলল “কত টাকা দিয়েছে আপনাকে? নাকি ফ্যামিলির কাউকে কিডন্যাপ করা হয়েছে?”
রাঘব চমকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন “এসব তুমি কী বলছ সায়ক?”
সায়ক তড়িৎ গতিতে পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে রাঘবের গলায় তাক করে বলল “আমাদের বাংলা ভাষায় একটা কথা আছে, মামদোবাজি। এখন সেটাই বলছি। মামদোবাজি হচ্ছে? আব্বাস ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি বুঝে গেলেন আর আমাকে নিয়ে মুজফফরাবাদ চললেন?”
শীতল আবহাওয়া সত্ত্বেও রাঘবের ঘাম হওয়া শুরু করল। বললেন “ওদের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না সায়ক। ওরা ডেঞ্জারাস। তুমি বুঝতে পারছ না ওরা…”
সায়ক বলল “ওরা আমাদের ফলো করছে?”
রাঘব চুপ করে থাকলেন।
সায়ক রাঘবের মুখে জোরে একটা ঘুষি মেরে বলল “চুপ করে থাকবেন না। দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে কোন রকম কম্প্রোমাইজ আমি সহ্য করব না রাঘব ভাটিয়া। যা হয়েছে বলুন”।
রাঘব কেঁদে ফেলে বললেন “দে হ্যাভ মাই ডটার সায়ক। আমি কী করব বল”।
সায়ক বলল “বুঝেছি। এরকমই কিছু একটা সন্দেহ করেছিলাম। কী ইন্সট্রাকশন আছে আপনার ওপর”?
রাঘব বললেন “তোমাকে নিয়ে মুজফফরাবাদে যেতে হবে। ওখানে ওরা তোমাকে হ্যান্ড ওভার নেবে”।
সায়ক বলল “তারপর ওরা আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে তার কোন নিশ্চয়তা আছে?”
রাঘব বললেন “যতক্ষণ না ওরা জানবে তুমি কিছু জানো না আছে নিশ্চয়ই। আমার মেয়েটা…”
রাঘবের গলা ধরে এল।
সায়ক মাথায় হাত দিয়ে বসে বলল “আপনি আমাকে আগে হিন্ট দিতে পারতেন”।
রাঘব ধরা গলায় বললেন “আমার কিছু করার ছিল না সায়ক। অ্যাজ ইউজুয়াল আমি আমার ডেরায় ছিলাম। ওরা এসে বেধড়ক মারল আমায়। আমার মেয়ের ছবি দেখিয়ে বলল দে হ্যাভ মাই ডটার। বউয়ের সঙ্গে কথা বলাল। আমি কী করব বল? আমাদের দেশের ভেতর থেকেই ইনফরমেশন লিক হচ্ছে। নইলে ওরা কী করে জানবে আমার সম্পর্কে?”
সায়ক বলল “আমার হাতে এখন দুটো অপশন খোলা আছে ভাটিয়া সাহেব। আপনি চুজ করুন একটা”।
রাঘব বললেন “আমি আমাকে নিয়ে ভয় পাই না সায়ক, কিন্তু আমার মেয়েকে নিয়ে তো পাই। এক্সট্রিমিস্টরা কী ভয়ানক হতে পারে তুমি জানো। এবার তুমিই বল বাবা হিসেবে কী করার আছে আমার”।
সায়ক চুপ করে কিছুক্ষণ ভেবে বলল “ওকে। ড্রাইভ দেন”।
রাঘব অবাক গলায় বললেন “মানে?”
সায়ক বলল “মুজফফরাবাদে নিয়ে যান আমায়। কী আর হবে? মেরে ফেলবে। এর বেশি তো কিছু হবে না। দেখুন এর পুরস্কারস্বরূপ আপনার মেয়েকে ফেরত পান কিনা”।
রাঘব মাথা নাড়িয়ে বললেন “এটা সলিউশন হয় না”।
সায়ক বলল “আপনার সেটা আগে ভাবা উচিত ছিল”।
রাঘব বললেন “আমার ভাবার ক্ষমতা তখনই চলে গেছিল যখন ওরা আমার মেয়েকে নিয়ে ব্ল্যাকমেল করল। তুমি গাড়িটা নিয়ে চলে যাও সায়ক। আমাকে আধমড়া করে রেখে যাও। আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলব না হয় তুমি জেনে গেছিলে। যা হয় দেখা যাবে”।
সায়ক বলল “আপনি গাড়ি থেকে নেমে যান। যা করার আপনি করুন”।
রাঘব কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থেকে বললেন “বেস্ট অফ লাক সায়ক”।
.
৩৮
বীরেন নার্সিংহোমের ভিজিটরস রুমে বসে ছিল। বার কয়েক অজানা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। ধরে নি। কিন্তু প্রতিবারই বাড়িতে ফোন করে খবর নিয়েছে সব ঠিক আছে কী না।
আশরফ নার্সিং হোম এলেন দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ।
বীরেনকে দেখে বললেন “কোন আপডেট আছে?”
বীরেন মাথা নাড়ল।
আশরফ বললেন “তোমার ফোনে দেখা যাচ্ছে একটা ব্ল্যাঙ্ক নাম্বার থেকে ফোন আসছে। কী বলছে ওরা?”
বীরেন চমকে আশরফের দিকে তাকাল।
আশরফ বললেন “ভয় পাওয়ার কিছু নেই বীরেন, আমাদের টিমের সবার নাম্বারই আমাদের আইটি ডিপার্টমেন্টকে বলে ট্রেস করানো হয়। কে কোথায় ফোন করছে না করছে আমাদের কাছে ইনফরমেশন থাকে। এখানে আসার আগেই দেখলাম তোমার ফোনে এরকম একটা ফোন এসেছে কাল থেকে। আমাকে কি বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করবে?”
বীরেন চারদিকে তাকাল।
আশরফ বললেন “এসো, তুমি আমার সঙ্গে এসো”।
আশরফ সিট থেকে উঠে হাঁটতে শুরু করলেন। বীরেন আশরফকে অনুসরণ করল।
কয়েক মিনিট পরে আশরফ একটা ছোট ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে বলল “কী চাইছে ওরা?”
বীরেন গড় গড় করে সব কথা আশরফকে বলল।
আশরফ তার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বললেন “ওরা বার বার তোমাকে টার্গেট করছে। কেন করছে তোমার কাছে কোন হিন্ট আছে?”
বীরেন বলল “না স্যার। বুঝতে পারছি না”।
আশরফ বললেন “তোমার ডিফেন্স একজামে সব বিভাগে ভাল রেজাল্ট করার পরেও ফেল হওয়া থেকে ওরা তোমাকে টার্গেট করেছে। তোমায় সায়ক বড়ালের আইডেন্টিটি দিয়ে কাশ্মীর পাঠিয়েছে, ইনডাইরেক্টলি দিল্লি ব্লাস্ট করিয়েছে, মুম্বইতে উড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছে, ওখানে বেঁচে যাওয়ার পরে আবার পাকিস্তান নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছে, এবং এখন আবার তোমাকে দিয়ে জ্যোতির্ময়ের কাছে ডিভাইস পাঠানোর প্ল্যান করছে। কিন্তু ওদের এত নেটওয়ার্ক স্ট্রং হওয়া সত্ত্বেও ওরা তোমায় এই ফোনেই ফোন করে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে। সামথিং ইজ নট রাইট বীরেন। তুমি নিজে ভাবো, ঠিক কী কারণে ওরা তোমায় টার্গেট করছে। এভাবে সফট টার্গেট করা সহজ কারণ তুমি নতুন, ফ্যামিলির ওপর অ্যাটাকের কথা বলে তোমাকে ভয় পাওয়ানোও সহজ। কিন্তু হোয়াই ইউ?”
বীরেন বলল “স্যার আমিও তো এটাই ভেবে যাচ্ছি। ইন ফ্যাক্ট ওই নাম্বার থেকে ফোন করে আমাকে বলা হয়েছে আমি নাকি ওদেরই দলের লোক”।
আশরফ থমথমে মুখে বীরেনের দিকে তাকিয়ে বললেন “আই অ্যাম অ্যাফরেড বীরেন, তোমাকে ছুটিতে পাঠাতে হবে”।
বীরেন বলল “চাকরিটা চলে যাবে স্যার?”
আশরফ মাথা নাড়লেন “না, চাকরি যাবে না। কিন্তু তোমাকে আমরা আমাদের সঙ্গে এই মুহূর্তে রাখতে পারব না। থাকলে রিস্কটা তোমারও বাড়বে, আমাদেরও বাড়বে। তুমি আজই বাড়ি যাও। আমি অফিসে কথা বলে তোমার কলকাতার ফ্লাইটের টিকিট করিয়ে দিচ্ছি। তুষার স্যারের সঙ্গেও তোমার ব্যাপারে কথা বলছি। তুমি তোমার ফ্যামিলির কাছে যাও, ওদের সঙ্গে সময় কাটাও”।
বীরেন বলল “কতদিন স্যার?”
আশরফ বললেন “টিল ফারদার ইন্সট্রাকশন। তুমি এখানে থেকো না”।
বীরেন মাথা নিচু করে বসে বলল “ইরাবতী ম্যাডামের এই অবস্থা, আমি চলে গেলে সেটা কি ভাল হবে?”
আশরফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বীরেনের কাঁধে হাত রেখে বললেন “এই মুহূর্তে তুমি এখানে থাকলে আরও কী কী হতে পারে সেটা আমিও জানি না। তুমি আমার জীবন দিয়েছ বীরেন, তুমি না থাকলে সেদিনই কাশ্মীরে আমার শেষ দিন হত, তোমাকে কোন রকম বিপদে ফেলতে আমি পারব না। কিন্তু আমার সিক্সথ সেন্স বলছে, ব্লু ফ্লাওয়ার মিশনে তোমায় ওরা একটা তাস হিসেবে ইউজ করছে। সেটার সিগনিফিক্যান্স কী, আমি এখনও ক্র্যাক করতে পারি নি”।
বীরেনের ফোন বেজে উঠল। বীরেন দেখল আননোন নাম্বার।
বীরেন ধরল না ফোনটা। আশরফ বীরেনের কাঁধে হাত দিলেন।
বললেন “চিন্তা কোর না, সব ঠিক হয়ে যাবে”।
.
৩৯
অমৃতসরের আগে একটা গ্রামে কাদরীর গাড়িটা যখন থামল তখন দুপুর গড়িয়েছে। গাড়ির পেছনের সিটে ইসমাইল ঘুমাচ্ছিল।
কাদরী ইসমাইলকে তুললেন।
ইসমাইল বলল “পৌঁছে গেলাম প্রোফেসর সাহাব?”
কাদরী বললেন “এসো”।
এ গ্রামের বাড়ি অধিকাংশই বর্ধিষ্ণু কৃষকের। এ বাড়িটাও অনেক জায়গা নিয়ে। বড় গেট পেরিয়ে ঢুকতে হয়েছে।
ইসমাইল বলল “গা হাত পা ব্যথা হয়ে গেছে প্রফেসর সাহাব। খিদেও পেয়েছে। গোস্তের ব্যবস্থা হবে তো?”
কাদরী হেসে বললেন “দেখা যাক”।
দুজনে বাড়িতে প্রবেশ করলেন।
বাড়ি ভর্তি লোক। হৈ হৈ ব্যাপার। ইসমাইল কাদরীকে বলল “ভুল বাড়িতে এলাম না তো?”
কাদরী হেসে বললেন “চলে এসো দোতলায়”।
সিঁড়ি ভেঙে তারা দোতলায় পৌঁছল। একটা মাত্র বড় ঘর দোতলায়। বাকিটা ছাদ। ঘরের দরজায় গিয়ে কাদরী নক করতে লাগলেন।
এক যুবক দরজা খুলল।
কাদরী বিরক্ত গলায় বললেন “কী করছিলে এতক্ষণ ধরে আসলাম?”
আসলাম বলল “মেইল চেক করছিলাম স্যার। আসুন”।
কাদরী ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে বললেন “এসো”।
দুজনে ঘরে প্রবেশ করল।
নোংরা ঘর। কাদরী আসলামকে বকতে শুরু করলেন ঘরের পরিস্থিতি দেখে। আসলাম চুপ করে শুনল।
অনেকক্ষণ বকা ঝকার পর কাদরী বললেন “খাওয়ার কী ব্যবস্থা আছে?”
আসলাম একটা মাদুর পেতে দিল। কাদরী ইসমাইলকে বললেন “বস”।
ইসমাইল বসল। আসলাম মাংস রুটি বেড়ে দিল থালায়। দুজনে ক্ষুধার্তের মত সেগুলো খেল।
খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে উঠে কাদরী আসলামকে বললেন “কী ইমেল এসেছে?”
আসলাম ইসমাইলকে দেখিয়ে বলল “সবাই ওর খোঁজ করছিলেন”।
কাদরী হেসে ইসমাইলকে বললেন “তুমি তো বিখ্যাত লোক হে”।
ইসমাইল বলল “বিখ্যাত তো বটেই জনাব। এখান থেকে ফোন করা কি নিরাপদ হবে?”
কাদরী বললেন “মেইল কর। কোড ইউজ কর। ফোন করার দরকার নেই”।
ইসমাইল কম্পিউটারে বসল। দরজায় নকের শব্দ হল।
কাদরী পকেট থেকে বন্দুক বের করতে যাচ্ছিলেন। আসলাম হাত দেখিয়ে তাকে নিরস্ত করে বলল “আমি দেখছি”।
আসলাম দরজা খুলল। এক মেয়ে ট্রেতে তিনটে লস্যির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আসলামের ট্রে হাতে দিয়ে চলে গেল।
কাদরী রাগী গলায় বললেন “কে?”
আসলাম সংকুচিত হল খানিকটা “বাড়িওয়ালার মেয়ে। খোঁজখবর নেয় আর কী”।
কাদরী বললেন “তোমাকে কতবার বলেছি মেয়েলি কেসে জড়াবে না?”
আসলাম ঘামছিল। ইসমাইল আসলামের হাতের থেকে গ্লাস নিয়ে গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল “আহ। লা জবাব। অত চিন্তা করবেন না প্রফেসর সাহাব। যদি মেহমাননওয়াজীর জন্য আসলাম আমাদের জন্য কোন ব্যবস্থা করেন তাহলে আমি দুঃখিত হব না”।
আসলামের চোখটা এক সেকেন্ড জ্বলে উঠেই স্বাভাবিক হয়ে গেল।
ইসমাইল সেটা দেখে বলল “ইশক বহুদূর এগিয়েছে বুঝি আসলাম মিয়াঁ?”
আসলাম আমতা আমতা করে বলল “না মানে জনাব, তেমন কিছু না”।
ইসমাইল গ্লাস রেখে মুহূর্তের মধ্যে আসলামের গলা টিপে ধরল, আসলামের চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছিল, কাদরী গলা নিচু করে ধমকালেন “কী হচ্ছে?”
ইসমাইল আসলামকে ঠেলে ফেলে দিল। মাটিতে গড়িয়ে পড়ল আসলাম। আসলামের পিঠে জোরে একটা লাথি মেরে ইসমাইল বলল “আমাকে চোখ গরম দেখাচ্ছে মাদারচোদ। সাহস কত বড়। জানিস আমি কে? জানিস?”
আসলাম মাথা নিচু করে বসে রইল।
কাদরী চেয়ার টেনে বসে ঠান্ডা গলায় আসলামকে বললেন “তোমাকে যা যা বলা হয়েছিল তার কোনটাই মেনে চল নি বোঝা যাচ্ছে। আমার ইচ্ছা করছে তোমায় এখনই কুরবানী দিয়ে দি। সময় এলে তাই দেব বটে। ভুলে যেও না কত ঝামেলা করে এখানে তোমায় নিয়ে আসা হয়েছে। মেয়েদের দেখে জিভ বের করার জন্য আনা হয় নি”।
ইসমাইল আরেকটা লাথি কষাল আসলামের পিঠে। আসলাম যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করল কিন্তু কোন শব্দ করল না।
ইসমাইল কাদরীর দিকে তাকিয়ে বলল “এ বিশ্বাসযোগ্য তো?”
কাদরী থমথমে মুখে আসলামের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
৪০
রাঘব ভাটিয়াকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে সায়ক গাড়ি ঘুরাল ইসলামাবাদের দিকে।
ঘন্টাখানেক পরে সে মারগালায় ইসলামাবাদ রেলস্টেশনে পৌঁছে গাড়িটা রেখে দেখল প্ল্যাটফর্মে করাচী ক্যান্টনমেন্ট যাওয়ার ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। কোন কিছু চিন্তা না করে সে করাচীর টিকেট কেটে ট্রেনে উঠে পড়ল।
গাড়ির ড্যাশ বোর্ড বক্সে চেক করে বেশ কিছু পাকিস্তানী টাকা পাওয়া গেছিল। সেখান থেকে টিকেটের টাকা হয়ে গেল। ট্রেনের জেনারেল কামরায় ভিড় গিজগিজ করছে। সায়কের ভিড়ে মিশে যেতে অসুবিধা হল না।
সায়কের পাশে একটা পরিবার বসেছে। চার পাঁচটা বাচ্চা খিল খিল করে হাসছে। সবক’টা বাচ্চা বসার জায়গা পায় নি। সায়ক একটা বাচ্চাকে কোলে বসাল। বাচ্চার বাবা হাসিমুখে তাকে জিজ্ঞেস করল “আপনি কি করাচী যাবেন ভাইসাব?”
সায়ক বলল “না, রাওয়ালপিন্ডি নেমে যাব”।
বাচ্চার বাবা মুষড়ে পড়ল “ওহ, আপনি থাকলে ভাল হত। দেখছেন না বাচ্চাগুলোকে সামলানো কত কঠিন। আমার বেগম তো অস্থির হয়ে যাচ্ছে”।
সায়ক হাসল। বাচ্চাগুলো কিচির মিচির করে চলেছে।
সায়ক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মানবজন্মের এই সময়টাই সব থেকে ভাল। এরপরেই তারা দেশ, ধর্ম, বর্ণ সহ বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে যায়।
কথোপকথনে জানা গেল বাচ্চার বাবার করাচীতে রেস্তোরাঁ আছে। ছেলে মেয়ে নিয়ে তারা কাশ্মীরে বেড়াতে এসেছিল। তাদের গোটা কাশ্মীর দেখারই ইচ্ছা ছিল কিন্তু পাকিস্তানি আর্মি মুজফফরাবাদের পর রাস্তা আটকে দিয়েছে। সাধারন মানুষের জন্য প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছে। বাচ্চার বাবাকে বেশ বিমর্ষ দেখাল।
বাচ্চাদের মা সবার জন্য খাবার দিলেন। সায়ককেও দিলেন।
সায়ক না করল না। প্রচন্ড খিদে পেয়েছিল বুঝতে পারল খাওয়ার সময়। ভদ্রলোকের স্ত্রীও কী করে যেন বুঝলেন সেটা। তাকে আরও দুটো বেশি রুটি দিলেন।
সায়ক আশ্চর্য হল না। মায়েরা সব দেশেই একই হন। ক্ষুধার্তের কষ্ট তারা ঠিক বুঝতে পারেন।
অতি অল্প সময়েই এই পরিবার তাকে আপন করে নিয়েছিল। ট্রেন থেকে নামার সময় যে বাচ্চা তার কোলে বসেছিল সে চাচু চাচু করে কান্না আরম্ভ করল। ভদ্রলোক তার কার্ড দিলেন সায়ককে।
ট্রেন থেকে নেমে সায়ক বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে হাঁটল। জমি খন্ডের জন্য এই মানুষই পিশাচ হয়ে যায়। কী অদ্ভুত এই রাজনীতি। অথচ এক সময় গোটাটাই ভারতবর্ষ ছিল। এক দেশভাগ সব কিছু তছনছ করে দিল।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে অটো নিয়ে সায়ক গরডন কলেজ রোড পৌঁছল। রাওয়ালপিন্ডির সবচেয়ে প্রাচীন এলাকা এই রাস্তায়। পুরনো সব বাড়ি, কম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোন কোন বাড়ি ভেঙে পড়ছে। রাস্তার পাশ দিয়ে উত্তর কলকাতার মত সরু সরু গলি।
সায়ক অনেকটা রাস্তা গলি দিয়ে হেঁটে একটা চারতলা বিল্ডিঙে পৌঁছল। বিল্ডিঙে লিফট নেই।
সায়ক সিঁড়ি ভেঙে দোতলা পৌঁছে একটা ঘরের সামনে নক করল।
এক যুবতী দরজা খুলল।
সায়ককে দেখে বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।
সায়ক বলল “ওভাবে তাকাচ্ছ কেন? আমি বেঁচে আছি, দেখতে পাচ্ছো তো”!
যুবতী দরজা ছেড়ে দিল।
সায়ক ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বলল “তোমার বাবা কোথায় মেহের? তুমি চিন্তা কোর না, নিতান্ত নিরূপায় হয়ে আমি এখানে এসেছি। আজকের দিনটা থেকেই চলে যাব”।
মেহের তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল “পানি দেব?”
সায়ক বলল “দাও”।
মেহের রান্নাঘর থেকে তার জন্য গ্লাসে জল এনে দিল।
সায়ক গোটা গ্লাসটা এক চুমুকে খেয়ে বলল “তোমার বাবা কোথায় বললে না তো?”
মেহের বলল “লাহোর গেছেন। তিন দিন পর ফিরবেন”।
সায়ক বলল “শিট। তাহলে তো আমার থাকাটা সমস্যা হয়ে গেল”।
মেহের বলল “কেন? আমি মানুষ নোই?”
সায়ক বলল “তা নয়, কিন্তু এখানে থাকাটা…”
মেহের বলল “থাকুন। আমি পাশে ফুপার বাড়ি গিয়ে থাকব”।
সায়ক বলল “আর কেউ জিজ্ঞেস করলে?”
মেহের বলল “আপনাকে সবাই চেনে। জানে আপনার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা চলছে। অসুবিধা হবে না”।
সায়ক সোফায় হেলান দিয়ে বলল “যাক। তাহলে নিশ্চিন্ত”।
মেহের বলল “আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? আপনি সত্যি বলবেন? আপনি কোথায় ছিলেন এতদিন?”
সায়ক হেসে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বললেন “ব্যবসা বাড়াচ্ছি মেহের। বিয়ে করতে হবে তো তোমাকে, এত কম রোজগারে আজকাল সংসার চলে? তুমিই বল। পেশোয়ারে গেছিলাম আম্মির এক বন্ধুর কাছে। ভাল খবর আছে। হয়ে যাবে হয়ত ব্যবসাটা, তাহলেই তো নিশ্চিন্ত, কী বল?”
মেহের অবিশ্বাসী চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
.
৪১
বীরেন বাড়ি ফিরল রাত দশটা নাগাদ। বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও আশরফ খান তাকে দিল্লিতে থাকতে দিলেন না। বললেন পরিবারের কাছে যাও। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা তিনিই করে দেবেন।
দরজা খোলা মাত্র বাবা তাকে দেখে চমকে উঠে বললেন “আরে! তুই?”
বীরেন মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল “হ্যাঁ, চলে এলাম ছুটি নিয়ে”।
বাবা বললেন “ভাল করেছিস। আয় আয়”।
বীরেন ঘরে ঢুকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে ঘিরে বাড়িতে হৈ হৈ শুরু হল।
মা বললেন “একটু খবর দিয়ে আসতে কী হয়েছিল তোর? ডিম দিয়ে ভাত খাবি। কিচ্ছু নেই আর”।
বীরেন মাকে জড়িয়ে ধরে বলল “ও যা আছে তাই দাও। কোন অসুবিধা নেই”।
মা শুনলেন না। বললেন “দাঁড়া দেখছি কী আছে। অন্তত একটা তরকারি তো করি”।
বুল্টি মার সঙ্গে রান্নাঘরে রওনা দিল।
বীরেন ঘরে এসে হাঁফ ছাড়ল। ব্যাগ রেখে চেঞ্জ করে মোবাইল অন করল। আশরফ মেসেজ পাঠিয়েছেন। তাদের বাড়ির আশে পাশে বেশ কয়েকজন ইন্টেলিজেন্সের লোক নজর রাখবেন বলে জানিয়েছেন।
বীরেনের ভয় লাগছিল না। খারাপ লাগছিল। ইরাবতীর জ্ঞান ফেরাটা দেখে আসতে পারল না। হঠাৎ করে ছুটি হয়ে যাওয়াটাও মন খারাপ করে দিচ্ছিল। এরকম ছুটি তো সে চায় নি। তার মধ্যে কী এমন আছে যার জন্য তাকে এভাবে বারবার টার্গেট করা হচ্ছে?
সে খাটে চোখ বন্ধ করে শুল। ডিফেন্স অ্যাকাডেমির পরীক্ষার দিনের কথা মনে করার চেষ্টা করল। অ্যাডমিট কার্ড দেওয়া হয়েছিল, দৌড় সহ বিভিন্ন পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল।
বীরেন বাড়ি ফিরে সযত্নে সে অ্যাডমিট কার্ড আলমারিতে তুলে রেখেছিল।
কী মনে হতে বীরেন উঠে আলমারি খুলল। ফাইল থেকে অ্যাডমিট কার্ড বের করল।
নাহ, ঠিকই আছে। তার নামই লেখা আছে। সেদিন এমন কিছুই ঘটে নি যাতে বিন্দুমাত্র অন্য কিছু মনে হতে পারে।
বেশ কয়েক মিনিট অস্থির হয়ে বসে থেকে বীরেন ঘর থেকে বেরোল। বাবা তাকে দেখামাত্র বললেন “কোথায় যাচ্ছিস?”
বীরেন বলল “এই পাড়াটা একটু চক্কর মেরে আসি”।
বাবা অবাক গলায় বললেন “এত রাতে? কাল সকালে যাস”।
বীরেন বলল “একটু হেঁটে আসি। চলে আসছি এখনই”।
বাবা যাতে আর কোন প্রশ্ন করতে না পারেন, বীরেন তড়িঘড়ি বাড়ি থেকে বেরোল। পাড়ার প্রায় সব বাড়ি থেকেই টিভি সিরিয়ালের আওয়াজ আসছে। বীরেন হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড় অবধি গেল।
আশরফ চারটে নাম্বার তাকে মেসেজ করে পাঠিয়েছিলেন। বীরেন একটা নাম্বার ডায়াল করল।
ফোনটা রিং হয়ে গেল। কেউ ধরল না। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বীরেন দেখল একটা বাইক এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। তাকে বলল “আপনি এখন বাড়ি যান। চিন্তা নেই। আমরা আছি”।
বীরেন অবাক হল। তাদের প্রত্যন্ত মফস্বলেও আশরফ খান এত তাড়াতাড়ি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে ফেললেন? একটু একটু করে আত্মবিশ্বাস ফিরছিল তার।
বাইকটা চলে গেলে বীরেন আশরফকেই ফোন করল।
রিং হতেই ধরলেন আশরফ “পৌঁছেছ?”
বীরেন বলল “হ্যাঁ স্যার। আপনি যাদের পাঠিয়েছেন, তাদের একজনের সঙ্গে দেখাও হয়েছে”।
আশরফ বললেন “চিন্তার কিছু নেই। এই চারজন চল্লিশ জনের সমান। তোমার কোন রকম অসুবিধা হলে আমাকে ফোন করবে”।
বীরেন বলল “শিওর স্যার। ইরাবতী ম্যাডামের জ্ঞান ফিরেছে”?
আশরফ চিন্তিত গলায় বললেন “নাহ। তুষার স্যার এখানেই আছেন। তোমার কথা বললাম। উনিও আমার সিদ্ধান্তকেই সঠিক বললেন। তুমি চিন্তা কোর না বীরেন, আই হ্যাভ ফুল ফেইথ অন ইউ। শুধু তুমি ডিফেন্সের একজ্যামের দিন বা তার আগের দিন তোমার সঙ্গে কী কী হয়েছে, কে দেখা করেছে, এর একটা লিস্ট তৈরী করে যত তাড়াতাড়ি পারো আমাকে পাঠিয়ে দাও। সর্ষের ভেতরের ভূত যত তাড়াতাড়ি বের করতে পারি, আমাদের তত মঙ্গল। গুড নাইট। সেফ থেকো। ভাল থেকো”।
বীরেন ফোনটা রেখে রাস্তার চারপাশে তাকাল। স্বাভাবিক সব কিছুই। ভয়ের কিছু নেই।
তবে কি ওরা তাকে অকারণ ভয় দেখাচ্ছে? বীরেনের অবচেতন মন কিছুতেই মানতে চাইল না। তার মনে হচ্ছিল, আবার কোন ভয়ংকর কিছু ঘনিয়ে আসতে চলেছে তাকে ঘিরে।
৪২
রাত আটটা। সায়ক দুপুর থেকে ঘুমোচ্ছিল।
উঠে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখল মেহের টিভি দেখছে। সায়ককে দেখে সহজ গলায় বলল “চা খাবেন?”
সায়ক বলল “ভাল হয় করলে। কেউ জানতে পারে নি তো আমি এখানে এসেছি?”।
মেহের বলল “নাহ। আপনি বসুন। আমি চা এনে দিচ্ছি”।
মেহের উঠে চায়ের জল বসিয়ে এসে বসল। বলল “আপনি নিউজ চ্যানেল দেখতে পারেন”।
সায়ক বলল “না থাক। তুমি দেখো। তোমার কি কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?”
মেহের বলল “অনেক কিছুই আছে। তবে সবার আগে একটাই প্রশ্ন, বিয়েটা কি আদৌ আপনার করার ইচ্ছে আছে?”
সায়ক বলল “অবশ্যই। তুমি এসব নিয়ে কেন ভাবো?”
মেহের তার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল “তাহলে এভাবে মাঝে মাঝে লা পাতা হয়ে যান কেন?”
সায়ক হাসার চেষ্টা করল “তোমাকে তো বললাম মেহের, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমার আব্বু আম্মি নেই। যা করেছি সবটাই তো নিজের চেষ্টায়”।
মেহের মাথা নিচু করে বলল “আপনার ওপর আমার অনেক অভিযোগ আছে”।
সায়কের ইচ্ছা করছিল মেহেরের পাশে গিয়ে বসে ওর হাত ধরতে। কিন্তু এর কিছুই করল না সে। বলল “জানি মেহের। আমাকে আরও কিছু সময় দাও”।
মেহের কোন কথা না বলে রান্না ঘরে গিয়ে চা নিয়ে এসে চায়ের কাপ সায়কের হাতে দিল। বলল “ফুপুরা কেউ বাড়িতে নেই। আমাকে এখানেই থাকতে হবে”।
সায়ক বলল “অসুবিধা নেই। তুমি ভিতরের ঘরে শুয়ো। আমি সোফায় শুয়ে যাব”।
মেহের বলল “মেহেমানদের সঙ্গে এরকম করে নাকি?”
সায়ক বলল “আমি মেহেমান কেন হব মেহের? আমি তো ঘরের লোক”।
মেহের বলল “নাহ। আপনি মেহেমানই। ঘরের লোক কখনও না বলে নিখোঁজ হয়ে যায় না”।
সায়ক এ কথার কী উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে রিমোট নিয়ে টিভির চ্যানেল চেঞ্জ করে নিউজ চ্যানেলে দিল। আব্বাসের খবর দেখাচ্ছে। পাকিস্তানি সরকার আব্বাসকে ভারতীয় গুপ্তচর হিসেবে ধরেছে।
ভারত সরকার জানিয়েছে আব্বাস পাকিস্তানে কী করছিল সে সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। সায়ক চুপ করে দেখে যাচ্ছিল।
মেহের বলল “আব্বুও আপনার ওপর রেগে আছে। মাঝে খুব ক্ষেপে উঠেছিল আমার জন্য ছেলে দেখবে বলে”।
সায়ক বলল “ভাল তো। বিয়ে দিয়ে দিলে ভাল। আমার মত পাগলের সঙ্গে তোমার বিয়ে না হওয়াই ভাল। সারাজীবন অশান্তিতে থাকবে”।
মেহের রাগী চোখে সায়কের দিকে তাকিয়ে বলল “এরকম কথা বলবেন না দয়া করে। আপনার জন্য অনেকের অনেকরকম কথা শুনতে হয় আমাকে। আমি কোন কিছুই মনে করি না তাতে। কিন্তু স্বয়ং আপনি যদি এই কথা বলেন তবে সেটা মেনে নিতে পারি না কিছুতেই”।
সায়ক অপ্রস্তুত হল খানিকটা। মেহের এভাবে রেগে যাবে সে বোঝে নি।
মেহের বলল “আপনি নিখোঁজ হয়ে যান ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে তো ফোন করতে পারেন। আমাকে না হোক, আব্বুকে অন্তত। আমরা নিশ্চিন্ত থাকি আপনি ভাল আছেন”।
সায়ক হাসার চেষ্টা করল “ঠিক আছে, এর পর থেকে আমি ফোন করব। খুশি? আচ্ছা তোমার আব্বু তোমাকে এভাবে একা রেখে লাহোর চলে গেলেন কেন? তোমার ভয় করে না?”
মেহের বলল “না ভয় করবে কেন? ভয় করার কিছু তো নেই। তাছাড়া এখানে অত ঝামেলা নেই। সেসব ঝামেলা অন্যদিকে হয়। আব্বু গেছেন ব্যবসার কাজেই। হঠাৎ জরুরি দরকার পড়ে গেল। আমি কি আব্বুকে ফোন করে আপনার কথা বলব?”
সায়ক বলল “না না, থাক। উনি একটা কাজে গেছেন। ওকে ব্যস্ত করে লাভ নেই। তাছাড়া আমি এখানে থাকছি এটাও ভাল দেখায় না”।
মেহের বলল “সব ভাল দেখায়। আপনাকে এত বুঝতে হবে না। আপনি খেয়ে বিশ্রাম নিন। কাল সকালে ভাবা যাবে কী করবেন”।
সায়ক চুপ করে বসে থাকল। এই মেয়ে তার আসল পরিচয় জানলে কি এভাবেই তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে?
৪৩
রাত সাড়ে বারোটা। কাশ্মীর। অনন্তনাগ আর্মি ক্যাম্প।
তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমেছে। মাথুর তার ক্যাম্পের বাইরে চেয়ারে বসে কফি খাচ্ছিলেন।
অবস্তী জিপে বেরিয়েছিলেন, মাথুরকে দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে বললেন “কী ব্যাপার মাথুর, এখানে বসে আছেন এত রাতে?”
মাথুর বললেন “বসুন। কফি খেয়ে যান”।
অবস্তী বসে বললেন “সে না হয় বসলাম। কিন্তু আপনি কি কোন কারণে অতিরিক্ত চিন্তিত?”
মাথুর বললেন “যেভাবে আমাদের লোকেদের ফ্যামিলিতে এরা অ্যাটাক করে চলেছে তাতে চিন্তিত না হবার কোন কারণ আছে কি? ইরাবতী ম্যাম কী দোষ করেছিল বলুন? তাকেও তো ছাড়ল না”।
অবস্তী বললেন “এখানে তো আর বলা যাবে না অল ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার। তাহলে তো মেনে নিতে হয় যুদ্ধবন্দীদের ওপর আমরা যা ইচ্ছা তাই অত্যাচার করতে পারি। সময় পাল্টাচ্ছে মাথুর। এখন নারী, শিশুদের ছেড়ে দেওয়াটাই দস্তুর। কিন্তু এই জানোয়ারগুলো সেগুলো মানে না। ইনফ্যাক্ট এরা কিছুই মানে না। নইলে নিরীহ মানুষ যেখানে আছে, সেখানে বম্ব ব্লাস্ট করে কী আনন্দ পায় এরা? বাই দ্য ওয়ে, আপনি কি আপনার ফ্যামিলি নিয়ে চিন্তিত?”
মাথুর বললেন “না, আমি আমার ফ্যামিলি নিয়ে চিন্তিত নই। আমি সবার ফ্যামিলি নিয়েই চিন্তিত। এভাবে যদি ওরা ডিফেন্স পারসোনেলদের ফ্যামিলি টার্গেট করে তবে আমাদের শুধু সেটাকে ডিফেন্সিভ ট্যাক্টিক্স হিসেবে না রেখে অ্যাটাকিং মেন্টালিটি নিয়ে এগোনোটাই বেশি দরকার বলে মনে হয়”।
অবস্তী বললেন “পাবেন কোথায় তাদের? সব থেকে বড় সমস্যা তো সেটাই, তাই না?”
মাথুর বললেন “ইসমাইলের কোন খবরই কি পাওয়া যাচ্ছে না?”
অবস্তী মাথা নাড়লেন “না। যেন ভোজবাজির মত উবে গেছে। ওকে পাওয়া গেলে খানিকটা নিশ্চিন্ত হতে পারতাম”।
মাথুর বললেন “রেহান খানকে খুন করেছে। ওকে আমি কোন দিন ক্ষমা করতে পারব না”।
অবস্তী কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললেন “আমিও না। আমাদের ফুল ফোর্স প্রয়োজন হলে তাই সই। কিন্তু ইসমাইলকে আমাদের চাই”।
মাথুর বললেন “ইসমাইল পাকিস্তানে চলে যায় নি তো?”
অবস্তী মাথা নাড়লেন “নাহ। ইসমাইল এই দেশে এসেছে কোন মিশন নিয়ে। মিশন কমপ্লিট না করে ফিরে ও যাব না। ফিদায়ে জঙ্গী তো এরা। মরতে ভয় পায় না। কিন্তু মরার আগে যাতে সব থেকে কম ড্যামেজ করতে পারে, আমাদের সেদিকেই মন দিতে হবে। এর আগে লস্করের একটা গোটা ফিদায়ে টিমকে আমরা লালচক থেকে ধরেছিলাম। একটাকেও বাঁচাতে পারি নি। ওরা সায়ানাইড নিয়েই আসে। ধরা পড়ে গেলে নিজেরাই মরে যাবে”।
মাথুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন “মানবজন্মের কী অপচয় বলুন?”
অবস্তী মাথা নাড়লেন “ওসব ওরা ভাবে না। ওরা হল টয়ের মত। চাবি দিয়ে দিলেন, সেভাবে চলতে থাকবে। অত বুদ্ধি কারো থাকলে তারা নিজেদের মারত, আপনিই বলুন? কতটা মাত্রায় ব্রেইনওয়াশড ক্রিচার হলেই এটা করা সম্ভব হয়”।
মাথুর মাথা নাড়লেন “আপনার সঙ্গে একমত। এরা ব্রেইনওয়াশড। এরা মানুষই নয়। অমানুষ”।
অবস্তীর ওয়াকিটকি বেজে উঠল। অবস্তী কিছুক্ষণ কথা বলে উঠে পড়লেন “আমাকে বেরোতে হবে মাথুর। বাজারের কাছে একটা দোকানে উটকো কিছু লোক উঠেছে বলে নিউজ আছে। কাল কথা হবে”।
মাথুর মাথা নাড়লেন।
অবস্তী বেরিয়ে যেতে মাথুর টেন্টে এসে শুলেন।
এ ক’দিনে শীত সহ্য হয়ে গেছে।
মাথুরের ফোন বাজছিল। দেখল তুষার ফোন করছেন। অবাক হয়ে ফোনটা ধরল “হ্যাঁ স্যার”।
তুষার বললেন “তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ?”
মাথুর বললেন “না স্যার। কোইন্সিডেন্স। ঘুমাই নি, আর আপনিও ফোন করছেন”।
তুষার হাসলেন “ইন্টেলিজেন্সের সিক্সথ সেন্স আর কী! যাই হোক, ইসমাইলের কোন খবর হল?”
মাথুর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন “না স্যার। চিরুণি তল্লাশি জারি আছে কিন্তু কোন ট্রেস নেই এখনও অবধি”।
তুষার বললেন “টাফ জব ইন এ প্লেস লাইক কাশ্মীর। সব রকম প্রোবাবিলিটি চেক করতে হবে। শুধু অনন্তনাগ না, শ্রীনগরেও অ্যালার্ট থাকতে বলে দাও অবস্তীকে”।
মাথুর বললেন “শিওর স্যার। ম্যাডামের জ্ঞান ফিরেছে?”
তুষার বললেন “নাহ, তবে চান্স পজিটিভ এখন। বেঁচে যাবে হয়ত”।
তুষার যেন রোবটের মত কথাটা বললেন।
মাথুর বললেন “হয়ত কেন? নিশ্চয়ই বাঁচবেন স্যার। এভাবে বলছেন কেন?”
তুষার বললেন “ইসমাইলকে ধর মাথুর। ও বড় কিছু করার আগে ধর। আমি…”
তুষার আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন মাথুরের তাবুর বাইরে এক জওয়ান মাথুরকে ডাকলেন।
মাথুর বললেন “এক মিনিট স্যার। কেউ একজন ডাকছে”।
তুষার বললেন “শিওর”।
মাথুর তাবুর বাইরে গিয়ে যা শুনলেন তাতে তার গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল।
বাজারে যে দোকানে অবস্তীরা রেইড করতে গেছিলেন, সেখানে তাদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে।
দোকানের ভিতর থেকে অতর্কিতে বেশ কয়েকজন তাদের ওপর বম্ব ব্লাস্ট করে সবাইকে মেরে ফেলেছে।
মাথুরের বিশ্বাস হচ্ছিল না। লোকটার সঙ্গে একটু আগেও কথা হল!
.
৪৪
রাত দেড়টা।
রাস্তাজুড়ে লাশ পড়ে আছে। কারো হাত উড়ে গেছে, কারো পা। চতুর্দিক রক্তাক্ত।
সেনারা কঠিন মুখে লাশগুলোকে এক জায়গায় করে জায়গাটা পরিষ্কার করছে।
সাদা সাদা গুড়ো পাউডারের মত বরফ পড়ছে। গোটা এলাকায় কারফিউ জারি হয়েছে। ইতিউতি কাছাকাছি বাড়ি থেকে মুখ উঁকিঝুঁকি মেরে ঘরের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। প্রতিটা বাড়ি, দোকান তল্লাশি শুরু হয়েছে।
মাথুর অবস্তীর মৃতদেহের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে রাস্তায় হাঁটতে লাগলেন। কর্নেল সিং দৌড়তে দৌড়তে তার কাছে এসে বললেন “স্যার একা একা কোথাও যাবেন না প্লিজ। ওরা কাছে পিঠেও লুকিয়ে থাকতে পারে”।
মাথুর বললেন “কী করবে আর বলুন? মেরে ফেলবে? এই তো। এভাবে আর ক’দিন?”
সিং বললেন “স্যার প্লিজ। আপনি তাহলে ক্যাম্পে ফিরে যান”।
মাথুর বললেন “ঠিক আছে। আমি এখানেই আছি। আপনারা আপনাদের কাজ করুন”।
তুষারকে জানানো হয়েছে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। সেনাবাহিনীর বিশেষ টিম শ্রীনগর থেকে অনন্তনাগের দিকে রওনা দিয়েছে। বেশ কয়েকজন কাশ্মীরী যুবককে এনে দাঁড় করানো হয়েছে। দোকানের কাছে পিঠের বাড়িগুলো থেকে। দু চারজনকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে।
প্রত্যেকের তল্লাশি চলছে। মাথুর তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। লম্বা সুন্দর মুখশ্রী।
মাথুর বললেন “আপনারা কাউকে দেখেছেন? কোন রকম সন্দেহজনক লোককে? বা এলাকার বাইরের কাউকে আজ দেখেছিলেন?”
প্রত্যেকে প্রায় একযোগে মাথা নাড়ল।
সিং বললেন “লাভ নেই স্যার। এরা কেউ কিছু বলবে না”।
মাথুর সিং এর দিকে তাকিয়ে বললেন “আমি ওদের সঙ্গে কথা বলছি। আপনি ওদিকটা দেখুন বরং। অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে”।
সিং খানিকটা বিরক্তি নিয়েই চলে গেলেন। মাথুর ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন “ভাল লাগে আপনাদের? রোজ রোজ এরকম অশান্তি?”
একজন বলল “না স্যার। কেন ভাল লাগবে বলুন?”
মাথুর বললেন “এভাবে আমাদের জওয়ানদের মেরে চলে যাবে, আর আমরা চুপ করে থাকব। আপনারা চুপ করে থাকবেন? এটা আপনাদের দেশ না?”
একজন এগিয়ে এসে বলল “এটা আমাদের দেশ স্যার? জওয়ানদের এই দমন নীতি ইন্ডিয়ার কোন স্টেটে আছে বলুন?”
মাথুর বললেন “আপনার নাম কী?”
ছেলেটা বলল “ইস্তিয়াক স্যার”।
মাথুর চারদিকে দেখে নিলেন। আশে পাশে কেউ নেই। ইস্তিয়াকের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন “জানি। আমি আপনাদের জন্য ফিল করতে পারি। আপনারা ইয়ং জেনারেশন। আপনারা ভাল জানবেন, আমাদের কারো জন্যই এই সিচুয়েশন ভাল নয়। আমার বন্ধু অবস্তী সাহেব মারা গেলেন। ভদ্রলোকের ছেলে ক্লাস টেন দেবে এবছর। কী করবে? বাবার কথা তার মনে হবে না? পারবে ছেলেটা নিজের লাইফে ঠিক থাকতে?”
ইস্তিয়াক মাথা নিচু করে বললেন “এখানে অনেকেই আছে স্যার, যারা ক্লাস সেভেন এইটে পড়ে। সামান্য প্রতিবাদ করতে গিয়ে ওদের চোখে পেলেট গান মারা হয়েছে। কারো কারো চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ার কোন স্টেটে নিজেদের হকের জন্য প্রতিবাদ করতে গিয়ে চোখ নষ্ট করে দেওয়া হয় স্যার? আমাদের কাশ্মিরীদের যদি আমাদের কথাই বলতে না দেওয়া হয়, নিজেদের প্রতিবাদ করতে না দেওয়া হয়…”
একটা ছেলে চেঁচিয়ে উঠল “আহ, ইস্তিয়াক, চুপ কর। কী বলে যাচ্ছিস?”
মাথুর হাত তুলে ছেলেটাকে থামিয়ে ইস্তিয়াককে বললেন “আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু ইস্তিয়াক, আমরা সবাই যদি হিংসার পথেই থাকি, দিন দিন কি পরিস্থিতি ভাল হবে? আপনিই বলুন। আপনি কত অবধি পড়াশুনা করেছেন?”
ইস্তিয়াক বলল “আমি বি এস সি পড়ছি। কেমিস্ট্রি অনার্স”।
মাথুর বললেন “তবে? আপনি শিক্ষিত। আপনার শিক্ষা কোন কাজে লাগবে ইস্তিয়াক যদি দিনের পর দিন এভাবেই কোন দিন এ পক্ষ, কোন দিন ও পক্ষের মানুষ মরতে থাকে। আছে কোন সলিউশন?”
ইস্তিয়াক বলল “আছে স্যার। কাশ্মীর আজাদ করে দিন। সৈন্য সরিয়ে নিন। সব সমস্যা মিটে যাবে”।
মাথুর হাসলেন “মিটে যাবে? পাকিস্তানে সব সমস্যা মিটে গেছে? ওদেশে টেরোরিস্ট নেই? ওরা যদি কাশ্মীরে এসে আবার আপনাদের ওপর দমন পীড়ন শুরু করে, তখন সেটা সামলাবেন কী করে ইস্তিয়াক? বাংলাদেশের কথা ভুলে গেলেন এত সহজে? ওরাও তো ধর্মের ভিত্তিতে পার্টিশন করেছিল। কী লাভ হয়েছিল ওদের?”
ইস্তিয়াক মাথা নিচু করল। মাথুর বুঝলেন ছেলেটা দ্বিধায় পড়েছে। একজন বলল “স্যার, আপনার মত তো কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলে না। সবাই শুধু ভয় দেখায়, আর হ্যারাস করে। আমরা যে মানুষ, তাই তো মাঝে মাঝে ভুলে যাই”।
মাথুর বললেন “আমি কথা বলব আমাদের উপরের অফিসারের সঙ্গে। আমাদের আপনারা হেল্প করুন। একটু ভাবুন, বাইরে থেকে কোন দল এসেছিল কি?”
সবাই চুপ করে গেল। মাথুর ইস্তিয়াকের দিকে তাকিয়ে বললেন “রক্তের বদলে রক্ত আমরা কেউ চাই না। কিন্তু সদ্য হওয়া এই ব্লাস্টে আমাদের সেনাবাহিনী যেভাবে রেগে থাকবে, আপনারা বুঝতে পারছেন এর আঘাত গিয়ে সেই নিরীহ কাশ্মীরি পরিবারের উপরেই পড়বে। যারা অন্তত কিছু জানে না, তাদেরও হ্যারাস হতে হবে। আপনারা বলুন, হেল্প করুন। আমি আছি আপনাদের জন্য, যে কোন সমস্যায়। প্লিজ বলুন”।
আবার সবাই চুপ করে গেল। মাথুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওদের ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলেন। অ্যাম্বুলেন্সে বডিগুলোকে তোলা হচ্ছে। হঠাৎ পিছনে হৈ হৈ শব্দ। পিছন ফিরে দেখলেন ইস্তিয়াক তার দিকে আসতে যাচ্ছিল, একজন আটকেছে। মাথুর চেঁচালেন “ওকে আসতে দিন”।
ইস্তিয়াককে ছেড়ে দেওয়া হল। ইস্তিয়াক দৌড়ে তার কাছে এসে বলল “চকবাজারে আব্দুল স্টোরসের ওপরে একটা দল এসেছিল। এখনও আছে ওরা মনে হয়”।
মাথুর ইস্তিয়াকের কাঁধ চাপড়ে বললেন “সাবাশ। আমার কার্ড রাখুন। যখন যা দরকার হবে, আমি আছি আপনাদের সঙ্গে। গোটা দেশ আছে কাশ্মীরের সঙ্গে”।
মাথুর সিং এর দিকে এগিয়ে গেলেন।
#
রাত সাড়ে তিনটের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী পাঁচজন জঙ্গিকে কুকুরের মত গুলি করে মারল।
.
৪৫
মেহেরের বারণ সত্ত্বেও সায়ক ড্রয়িং রুমের সোফাতেই শুয়েছিল।
মেহের ভেতরের ঘরে।
রাত দুটোর দিকে সায়ক জেগে উঠল। সন্তর্পণে উঠে দরজা খুলতে গিয়ে দেখল দরজা ভেতর থেকে তালা দেওয়া।
চাবি খুঁজতে শুরু করল সায়ক। সারা ঘরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও চাবি পাওয়া গেল না। সায়কের অস্থির লাগছিল। প্ল্যান ছিল রাতে বেরিয়ে যাবে।
সে সোফায় ক্লান্ত হয়ে বসল।
“আপনি এত রাতে কোথায় যেতেন?”
মেহের যে কখন ঘরে চলে এসেছে বুঝতে পারে নি সে। চমকে উঠল।
মেহের আলো জ্বালাল।
সায়ক বলল “তুমি ঘুমাও নি?”
মেহের বলল “না, আমার মনে হচ্ছিল আপনি আগের মতই না বলে চলে যাবেন”।
সায়ক থমকে বলল “হ্যাঁ, আমার করাচী যাওয়ার দরকার ছিল আসলে”।
মেহের বলল “এত রাতে?”
সায়ক বলল “হঠাৎ করেই মনে হল আর কী”।
মেহের কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে বলল “ইন্ডিয়ার কোথায় বাড়ি আপনার?”
সায়ক চমকাল না। ঠান্ডা মাথায় মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল “কেন বলতো? ইন্ডিয়ায় আমার বাড়ি হতে যাবে কেন?”
মেহের তার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল “এই বিলটা আগের বার আপনার প্যান্টের পকেটে পেয়েছিলাম। আপনাকে জিজ্ঞেস করার আগেই আপনি পালিয়েছিলেন। আমি আব্বুকেও কিছু বলি নি। আপনি কে?”
সায়ক দেখল ওষুধের দোকানের ছোট একটা রসিদ। মানিব্যাগে ছিল। সে বলল “ওহ, এটা আমাকে একবার কলকাতা যেতে হয়েছিল তো, সেবার ওষুধ কিনেছিলাম, তার বিল”।
মেহের বলল “আপনি কলকাতা গেছিলেন আমাকে বলেন নি তো কখনও”।
সায়ক বলল “ওহ, বলি নি? ভেবেছিলাম তুমি জানো”।
মেহের বলল “আপনি যাবার দুদিন পর আব্বুর কাছে দুজন এসেছিল। ওরা আপনার ব্যাপারেই আলোচনা করছিল”।
সায়ক কী বলবে বুঝতে পারল না।
মেহের বলল “রাস্তায় মিলিটারি টহল চলছে এখন। ভোর চারটে থেকে পাঁচটা কোন গাড়ি থাকে না। আপনি সে সময় যান”।
সায়ক বলল “তুমি কী করে জানলে সে সময় টহল থাকে না?”
মেহের বলল “উপরের ঘরের আসিফচাচা মিলিটারিতে আছেন। ওর কাছে শুনেছিলাম”।
সায়ক বলল “তোমার আব্বু আমার ব্যাপারে জানেন তার মানে?”
মেহের বলল “জানি না। আপনি বসুন। এখন যাবেন না”।
সায়ক বসল সোফায়।
মেহের বলল “আমায় কি আপনি বলবেন আপনি কে?”
সায়ক বলল “বলতে পারব না মেহের। শুধু বলতে পারি তোমার বা তোমার আব্বুর কোন ক্ষতি করার মানুষ আমি নই”।
মেহের বলল “সেটা জানি আমি। কারো ক্ষতি করার লোক আপনি নন। সে কারণেই জানতে চাই, আপনি কে? আমার সঙ্গে বিয়ের কথাই বা বলেছিলেন কেন? এতটা মিথ্যা বলার দরকার ছিল কি?”
সায়ক শ্বাস ফেলে বলল “কোরাণে আছে এই পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষ কিছু না কিছু কাজের জন্য এসেছে। তুমিও ভেবে নাও, আমি আল্লাহর নির্দেশে সেরকমই কোন কাজের জন্য এই পৃথিবীতে আমি এসেছিলাম। এই মুহূর্তে এর বেশি কিছু বলার ক্ষমতা আমার নেই”।
মেহের সোফায় তার পাশে এসে বসল। বলল “যেদিন থেকে আপনার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হয়েছে, আমি সেদিন থেকে শুধু আপনার কথাই ভেবেছি। আপনার প্রতিটা চলাফেরা, কথা বার্তা, খাওয়া দাওয়া আমি চুপ করে দেখে যাই। আর আপনি যখন থাকেন না, তখনও সেই আপনার অপেক্ষাতেই বসে থাকি। বেল বাজলে দৌড়ে গিয়ে দেখি আপনি এসেছেন নাকি। আমি এই বিলটা দেখার পরেও কাউকে বলিনি। কেন জানেন?”
সায়ক জিজ্ঞাসু চোখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল “কেন?”
মেহের হাসল, বলল “আপনি বোঝেন না? আপনার আল্লাহ আপনাকে সেটুকু বোঝার ক্ষমতা দেন নি?”
সায়ক বলল “আমি ফিরে আসব মেহের। তুমি অপেক্ষায় থেকো”।
মেহের বলল “নাহ। আপনাকে একটাই অনুরোধ। আপনি আর আসবেন না”।
মেহের উঠে দাঁড়াল। আলমারি খুলে একটা ব্যাগ বের করে সায়কের হাতে দিয়ে বলল “এখানে বেশ কিছু টাকা আছে। আপনি নিয়ে যান। কাজে লাগতে পারে”।
সায়ক কিছু বলতে পারল না। চুপ করে বসে থাকল।
৪৬
মেঝেতে একটা আর্ট পেপার পাতা হয়েছে। আসলামের মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল কিন্তু কোন রকম ফার্স্ট এইড না করেই সে চুপ করে ঘরের এক কোণে বসে আছে। কাদরী মার্কার পেন দিয়ে আর্ট পেপারের ওপর ম্যাপ এঁকে ইসমাইলকে বললেন “এই হল স্বর্ণমন্দিরের চারপাশ। এবার তুমি বল তুমি কোন পথ দিয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করবে।
ইসমাইল ক্রুর চোখে বেশ কিছুক্ষণ ম্যাপের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল “আপনি যে পথ দিয়ে বলবেন, আমার কোন চয়েস নেই। আপনিই বলুন, আপনি এসেছেন এখানে বেশ কয়েকবার”।
কাদরী আসলামের দিকে তাকিয়ে বললেন “কতবার স্বর্ণমন্দির গেছো তুমি?”
আসলামের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবটা কমে এসেছিল। ইসমাইলের মারগুলো তার বেশ লেগেছে। সে বলল “দশ বারোবার”।
কাদরী বললেন “এবং কোন সময়টা তোমার মনে হয়েছে বেস্ট ফর অ্যাটাক”?
আসলাম বলল “ওখানে সশস্ত্র বাহিনী থাকে, শিখদের নিজস্ব সেনা। ওখানে কিছু করা সমস্যা আছে”।
ইসমাইল আসলামকে ধমক দিয়ে বলল “এই ইবলিশের বাচ্চা, তোর কাছে আমি সাজেশন চেয়েছি? তোর কাছ থেকে শিখতে হবে আমাকে ওখানে সেনা আছে কি নেই?”
আসলাম চুপ করে গেল।
কাদরী বললেন “আসলাম ঠিকই বলেছে। অসংখ্য সিসিটিভি, আর তার সঙ্গে ওখানে অতন্দ্র প্রহরায় থাকে ওদের নিজস্ব বাহিনী। কাজটা কঠিন আছে”।
ইসমাইল হো হো করে হেসে উঠে বলল “প্রফেসর সাহাব, কাজ সোজা হলে কি বর্ডার পেরিয়ে এত ঝক্কি সামলে এতদূর আসতাম? আল্লাহ আমাকে একটা নির্দিষ্ট কাজের হুকুম দিয়েছেন। আমি সেই কাজ করতে প্রস্তুত”।
কাদরী আসলামের কম্পিউটারে বসলেন। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পরে স্যাটেলাইট কল করা গেল, ওপ্রান্ত থেকে গলা ভেসে এল “কোড প্লিজ”।
কাদরী কোড বললেন। সঙ্গে সঙ্গে ও প্রান্ত থেকে স্বাভাবিক গলায় কেউ বলল “সালাম ওয়ালাইকুম জনাব। শের জঙ্গলে পৌঁছেছে তো?”
কাদরী হেসে বললেন “হ্যাঁ। শের জঙ্গলে পৌছেছে। এখন শিকারের মাপজোক চলছে আর কী”।
“মাশাল্লাহ। কোহিনুর হে হামারা শের”।
কাদরী বললেন “তা ঠিক। কিন্তু কোহিনুরকে বড্ড তাড়াতাড়ি জন্নতে পাঠানোটা ভুল পদক্ষেপ হয়ে যাচ্ছে না কি?”
“আল্লাহর মর্জিমাফিক হচ্ছে জনাব। আমরা তো নিমিত্তমাত্র। তিনি চেয়েছেন বলেই তো এত কিছু হচ্ছে। আমরা তার বার্তা পাই, তিনি যেভাবে বলেন, আমরা সেভাবেই চলি”।
কাদরী বললেন “শেরকে তো খালি হাতে শিকারে পাঠানো যায় না জনাব। শেরের জন্য প্রয়োজনীয় আনাজ কোথায় পাব সে সম্পর্কে কোন ইন্সট্রাকশন এখনও আসে নি”।
ওপাশ একটু থেমে উত্তর দিল “আজ রাত আটটায়। ক্যানাল রোড। কোড তকদীর”।
কাদরী বললেন “শুক্রিয়া জনাব”।
ফোনটা কেটে গেল ওপাশ থেকে। কাদরী আসলামের দিকে তাকালেন, বললেন “ক্যানাল রোড চেনো?”
আসলাম মাথা নাড়ল।
কাদরী বললেন “সন্ধ্যের দিকে গাড়ি জোগাড় কর। ক্যানাল রোড যেতে হবে”।
আসলাম বলল “জি জনাব”।
কাদরী ইসমাইলের দিকে তাকালেন। ইসমাইল মাটিতে বসে চোখ বন্ধ করল। শরীর আবেগে থর থর করে কাঁপছে তার, দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা।
আসলাম অবাক চোখে ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে আছে।
কাদরী ইসমাইলের পাশে গিয়ে বসলেন। ইসমাইল বিড়বিড় করে একভাবে নিজের মনে কথা বলে যেতে লাগল।
মিনিট পাঁচেক পরে ইসমাইল চোখ খুলে বলল “আমি স্নান করব”।
আসলাম দৌড়ে গিয়ে টাওয়েল নিয়ে এল ইসমাইলের জন্য। ইসমাইল বাথরুমে ঢুকে গেল।
দরজায় আবার নক হল। কাদরী সতর্ক গলায় আসলামকে বললেন “দেখো কে”?
আসলাম উঠল। দরজা খুলে দেখল বাড়িওয়ালার মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মেয়েটি বলল “আর কিছু লাগবে?”
আসলাম ভেতরের দিকে তাকিয়ে সতর্ক গলায় বলল “না। চাচাজান ঘুমাবে এখন। পরে এসো”।
মেয়েটি কৌতূহলী গলায় ঘরের ভিতরের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল। আসলাম খানিকটা রাগী গলায় বলল “পরে এসো বললাম না?”
মেয়েটি আসলামের দিকে তাকাল এতক্ষণে। অবাক হয়ে বলল “তোমার কী হয়েছে? পড়ে গেছো নাকি?”
কাদরী উঠলেন। দরজার কাছে গিয়ে বললেন “চাচাজানের হাতে মার খেয়েছে। এখনও বড় হয় নি তো! তুমি এসো, নইলে তোমাদের বাড়ির লোক তোমার ওপর রাগ করবেন”।
মেয়েটি অবাক চোখে আসলামের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল।
কাদরী আসলামকে বললেন “শুয়েছ এটার সঙ্গে?”
আসলাম ঘাবড়ে গিয়ে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল “না না। সেসব কিছু না”।
কাদরী আসলামকে থাপ্পড় মারলেন। আসলাম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
.
৪৭
ভোর হয়েছে।
অনন্তনাগের আর্মি হাসপাতালের সামনে প্রচুর মিডিয়ার প্রতিনিধি এসে হাজির হয়েছে।
দিল্লি থেকে আর্মির স্পেশাল টিম এসেছে। মাথুর চোখ বন্ধ করে হাসপাতালের বেঞ্চে বসে ছিলেন। তার পাশে ইস্তিয়াক চুপ করে বসে আছে। মাথুরই বসিয়ে রেখেছেন।
ব্রিগেডিয়ার শাহ এসে মাথুরকে ডাকলেন “মাথুর, আপনি কি ক্যাম্পে যাবেন?”
মাথুর চোখ খুলে বললেন “নাহ। দেশের মানুষের বরবাদি দেখছি চোখের সামনে। এছাড়া তো কিছু করার নেই”।
শাহ বললেন “অ্যানাদার ইন্টেলিজেন্স ফেইলিওর?”
মাথুর বললেন “হ্যাঁ। আমরা হেরে যাচ্ছি যুদ্ধটা। প্রতিমুহূর্তে। শুধু মাঝে মাঝে এই ইস্তিয়াকের মত ছেলেরা আমাদের খানিকটা হেল্প করে বলে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নটা এখনও দেখি ব্রিগেডিয়ার”।
ব্রিগেডিয়ার শাহ বললেন “আই অ্যাম অ্যাফ্রেইড মাথুর, ছেলেটিকে আমাদের কাস্টোডিতে নিতে হবে। ও যদি আরও কিছু জানে, তাহলে সেটা আমাদের কাজে দেবে, বিশেষ করে ইসমাইলের ব্যাপারে”।
মাথুর ইস্তিয়াকের দিকে তাকালেন। ইস্তিয়াকের মুখে কোন বিকৃতি হল না। যেন এটাই হবে সে জানত।
মাথুর ব্রিগেডিয়ার শাহকে বললেন “সরি স্যার। ইস্তিয়াককে আমি আপনাকে দিতে পারব না। আমি তুষার স্যারের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। ওকে দেওয়া সম্ভব না”।
ব্রিগেডিয়ার বললেন “আর ইউ সিওর অফিসার? আর্মি কিন্তু সেক্ষেত্রে কোন দায় নেবে না ফিউচারে যদি কোন প্রবলেম হয়”।
মাথুর বললেন “হ্যাঁ স্যার। আমি সিওর”।
ব্রিগেডিয়ার কাঁধ ঝাঁকালেন, “ওকে, ফাইন দেন। আমাদের দিক থেকে কোন হেল্প লাগলে বলবেন। আমি জওয়ানদের ফ্যামিলিদের খবর দেওয়ার কঠিন কাজটা করতে যাই এবার। মিসেস অবস্তীকে কী করে বলব সেটাই ভাবছি”।
মাথুর ভাবতে চাইছিলেন না। তবু ব্রিগেডিয়ারের কথায় অবস্তী সাহেবের মুখটা মনে পড়ে গেল তার। নিজের মনেই বলে উঠলেন “আই হেট দিস জব”।
ব্রিগেডিয়ার চলে গেলেন কন্ট্রোল রুমে।
ইস্তিয়াক মাথুরকে বলল “শুক্রিয়া স্যার”।
মাথুর বললেন “কী কারণে?”
ইস্তিয়াক বলল “আপনি আর্মির হাত থেকে আমাকে বাঁচালেন”।
মাথুর বললেন “তোমরা আর্মিকে এত ভয় পাও কেন ইস্তিয়াক? ওরা না থাকলে কী হত বলতো? তুমি তো শিক্ষিত ছেলে, তুমি জানো না, টেরোরিস্টরা আসলে কাদের সুবিধা করে দিচ্ছে? নিরীহ কাশ্মীরিরা বুঝতে পারছে না এখনও”?
ইস্তিয়াক বলল “কী করে বুঝব স্যার? দেশের আর পাঁচটা স্টেটের মত তো আমরা থাকি না। রাস্তায় বেরোলে সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় কী হয় কী হয়। একদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা, একদিকে পাকিস্তানপন্থী, একদিকে ইন্ডিয়ান আর্মি… আমাদের সাধারন কাশ্মীরীদের কথা ক’জন ভাবে স্যার? আমরা কি মানুষ নই”?
মাথুর ইস্তিয়াকের কাঁধে হাত রেখে বললেন “অবশ্যই মানুষ। তুমি না থাকলে আজ ওদের মারতে পারতাম না আমরা। কিন্তু এই মুহূর্তে ওরা পিপড়ের মত কাশ্মীরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে আম কাশ্মীরীদের কানে মন্ত্র দিচ্ছে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে। একমাত্র তোমরাই কিন্তু পারো কাশ্মীরকে রক্তপাতহীন করতে। আমি কথা দিচ্ছি, যত রকম সহায়তা লাগে আমরা করব। আমি করব”।
ইস্তিয়াক কয়েক সেকেন্ড মাথা নিচু করে বসে বলল “ওদের ধরতে গেলে সেনাছাউনির নিরাপদ ক্যাম্পে বসে থাকলে হবে না। কনভয়ে করে ঘুরলেও হবে না স্যার। ওদের ধরতে গেলে ওদের পদ্ধতিতেই চলতে হবে। প্রতিটা পথ অবরোধে পেলেট গান চালালে হবে না। বরং আমাদের কথা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। আমরা কোন পাপ করিনি স্যার কাশ্মীরে জন্ম নিয়ে। আপনাদের সরকার, আপনাদের আর্মি যদি সেটা বুঝতে না পারে তবে সব থেকে ক্ষতি আপনাদেরই হবে”।
মাথুর বললেন “আপনাদের কেন বলছ। আমাদের বল”।
ইস্তিয়াক ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল “সে ফেসিলিটি আমাদের জন্য আন অ্যাভেইলেবল স্যার”।
মাথুর বললেন “কিচ্ছু আনঅ্যাভেইলেবল না। তুমি আমাদের হেল্প কর, তুমি বল তোমার কী চাই। আমি থাকব তোমার পাশে। ইসমাইলের সম্পর্কে কোন লিড দিতে পারবে তুমি?”
ইস্তিয়াক বলল “ওয়াজুরা গ্রামে আমার ফুপু থাকেন। ইসমাইলরা ওখানে নিরীহ মানুষদের ভয় দেখিয়ে থাকত। আমার মনে হয় আপনি ওয়াজুরা গেলে ওদের সম্পর্কে কিছু তথ্য পেতে পারেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করে যেভাবে জোর করে তথ্য বের করার চেষ্টা আর্মি করেছে, ওরা তো ভয়েই বলে নি। ওদের সঙ্গে থেকে দেখুন। ওদেরও অনেক কথা বলার আছে”।
মাথুরের চোখ উজ্জ্বল হল, “তুমি আমাকে নিয়ে যাবে ওয়াজুরা?”
ইস্তিয়াক বলল “একটাই শর্তে স্যার। কোন সরকারি গাড়িতে, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে যেতে পারবেন না। আমার সঙ্গে যেতে হবে”।
মাথুর একটু চুপ করে থেকে বললেন “রেহান শ্রীনগর জেলে একা গিয়ে খুন হয়েছিলেন। আশরফকে ওরা গুলি করে চলে গেছিল কোন মতে বেঁচেছে। এরপরেও আমি তোমার কথা বিশ্বাস করব ইস্তিয়াক। আমি বিশ্বাস করি তোমরাই কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ। তোমার শর্ত মঞ্জুর। চল, আর দেরী করা ঠিক হবে না। ব্রিগেডিয়ার শাহ জানলে কিছুতেই আমাকে যেতে দেবেন না”।
.
৪৮
নার্সিং হোমের বেঞ্চে তুষার চুপ করে বসে ছিলেন। একজন নার্স এসে তাকে ডাকল, “স্যার, পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। আপনাকে খুঁজছেন”।
তুষার কথাটা শুনে কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে বসে থেকে আইসিইউর দিকে রওনা দিলেন।
ইরাবতী তাকে দেখে হাসলেন। তুষারকে ডাক্তার বললেন “পাঁচ মিনিট স্যার, খুব বেশি হলে”।
তুষার মাথা নাড়লেন “রাইট ডক্টর”।
ইরাবতীর বেডের পাশে রাখা চেয়ারে বসলেন তুষার।
বললেন “কেমন আছো?”
ইরাবতী হাসলেন “ভাল। বেঁচে গেলাম বলতে পারো”।
তুষার বললেন “দে আর ডেঞ্জারাস”।
ইরাবতী বললেন “আই নো। বাট ডোন্ট ওরি, ওরা জিততে পারবে না। আমি মন থেকে বিশ্বাস করি”।
তুষার মাথা নিচু করে বসে বললেন “এখনও আশা রাখছো?”
ইরাবতী বললেন “ডেফিনিটলি। কোনবারেই তো তুমি হারো নি। এবারে এত সহজে হেরে যাবে নাকি?”
তুষার ইরাবতীর হাতে আলতো করে নিজের ডান হাত রেখে বললেন “এবার ওরা তোমাকে মেরেছে। আমাদের ছেলেদের ফ্যামিলিকে টার্গেট করছে। ভয় পাওয়ার কারণ আছে, একবারে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে পারছি না”।
ইরাবতী বললেন “তুমি এ কথা বললে কী করে হবে তুষার? এ যুদ্ধ প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে লড়ছো তোমরা। তুমি সে টিমের ক্যাপ্টেন হয়ে এই কথা বলছ? রেহান যদি শহীদ হতে পারে, আমি কেন নই? পিছুটান রেখো না”।
একজন নার্স এসে তুষারকে বলল “স্যার, ম্যাডাম যত কম কথা বলবেন তত ভাল হয়”।
তুষার মাথা নাড়লেন “ওকে”। ইরাবতীর দিকে তাকিয়ে বললেন “তুমি শোও। চিন্তা কোর না। আমরা এত সহজে হাল ছাড়ব না”।
ইরাবতী কিছু বললেন না। হাসলেন শুধু।
তুষার ঘর থেকে বেরলেন। ভারাক্রান্ত মন খানিকটা হলেও শান্ত লাগছিল।
ফোনটা সাইলেন্ট করা ছিল। পকেট থেকে বের করে দেখলেন একই নাম্বার থেকে তিনবার মিসড কল এসেছে।
তুষার তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করলেন।
ওপাশ থেকে ভেসে এল “গুড মর্নিং তুষার, আমি ব্রিগেডিয়ার শাহ বলছি”।
তুষার বললেন “গুড মর্নিং। বলুন।”
শাহ ক্ষোভে ফেটে পড়লেন “কী হচ্ছে তুষার? মাথুর কী শুরু করেছে?”
তুষার অবাক হলেন “কেন? কী হয়েছে বলুন?”
শাহ বললেন “মাথুর একজন লোকাল কাশ্মীরি ছেলের সঙ্গে কোথাও একটা চলে গেছে। আমাদের কোন রকম ইনফরমেশন দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে নি। এবং সব থেকে বড় কথা, ওর সঙ্গে কোন সিকিউরিটিও ছিল না। এই ছেলেটাই টেরোরিস্টদের ব্যাপারে ইনফরমেশন দিয়েছিল। এবার কী করব আপনিই বলুন”।
তুষার বললেন “চলে গেছে? মাথুরের মোবাইল ট্রাই করেছেন?”
শাহ বললেন “ইয়েস। অনেকবার। কিছুতেই পাচ্ছি না। সুইচড অফ বলছে”।
তুষার ফোন কেটে চুপচাপ রিসেপশনের সামনের চেয়ারে বসলেন। মাথুরের ফোনে দুবার চেষ্টা করলেন। পাওয়া গেল না।
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থেকে তুষার অন্য একটা নাম্বারে ফোন করলেন।
ভেসে এল “হ্যালো স্যার, হাউ মে আই অ্যাসিস্ট ইউ?”
তুষার বললেন “মাথুরের ফোন ট্রেস কর। এক্ষুণি। বেশিক্ষণ সময় দিতে পারব না”।
“ওকে স্যার”।
ফোনটা রেখে তুষার পায়চারি শুরু করলেন।
বেশ কয়েক মিনিট পরে আশরফকে ফোন করলেন। আশরফ খান একবারেই ধরলেন “গুড মর্নিং স্যার”।
তুষার বললেন “সিকিওর লাইন?”
আশরফ বললেন “হ্যাঁ স্যার”।
তুষার হাঁফ ছাড়লেন “মাথুরকে পাওয়া যাচ্ছে না। লোকাল কাশ্মীরি ছেলের সঙ্গে লাপাতা হয়ে গেছে”।
আশরফ চমকে উঠলেন “সেকী!”
তুষার বললেন “ট্র্যাপ হতে পারে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না এখন কী করব এখানে বসে”।
আশরফ বললেন “হামিদ কিছু করতে পারবে?”
তুষার মাথা নাড়লেন “কোন আশা করছি না। মাথুর একবার পারমিশন নিতে পারত খান”।
আশরফ ইতস্তত করে বললেন “কাশ্মীরের মোবাইল নেটওয়ার্ক কেমন জানেনই তো স্যার। নিশ্চয়ই টাওয়ার পায় নি”।
তুষার চিন্তিত মুখে খানকে বললেন “এভাবে এখানে বসে থাকলে হবে না। কিন্তু সমস্যা হল, বিপদ যে কোন পথ দিয়ে আসছে, সেটাই তো বুঝতে পারছি না এখনও। কী বল?”
খান বললেন “আমরা আপাতত অপেক্ষা করি স্যার। এ ছাড়া কোন উপায় নেই আমাদের”।
তুষার ফোন রেখে চুপ করে বসে রইলেন।
৪৯
দুপুর সাড়ে বারোটা। ওয়াজুরা গ্রামে ইস্তিয়াকের বাইকে করে পৌঁছেছেন মাথুর।
উপত্যকার মাঝে একটা ছোট্ট গ্রাম ওয়াজুরা। রাস্তায় আর্মি প্রহরা ছিল, দু বার চেকিংও হয়েছে। তবে কেউ সন্দেহ করে নি। মাথুর একটু টেনশনে ছিলেন সেনারা যদি তাকে চিনে ফেলে, কিন্তু সৌভাগ্যবশত তাকে কোন প্রশ্ন করা হয় নি।
ইস্তিয়াক তাকে নিয়ে একটা মাটির বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল “আমার ফুপুর বাড়ি। আসুন”।
মাথুর ইস্তিয়াকের সঙ্গে বাড়িটায় ঢুকল। ইস্তিয়াকের ফুপু বেরিয়ে এলেন। ইস্তিয়াক তাকে দেখিয়ে পুস্তু ভাষায় কিছু বলল। ফুপুর উত্তর শুনে ইস্তিয়াক তার দিকে তাকিয়ে বলল “আসুন স্যার, একটু বিশ্রাম করুন। আমরা গরীব, কিন্তু বাড়িতে মেহেমান এলে আমরা তাদের সহজে ছাড়ি না”।
মাথুর হাসলেন “আমার কোন সমস্যা নেই, কিন্তু কাজের ক্ষতি হবে না তো?”
ইস্তিয়াক বলল “না স্যার। একটু বসুন আগে। আসুন”।
ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন মাথুর। দরিদ্র কাশ্মীরি পরিবার তবু ঘরের মধ্যে রুচির ছাপ স্পষ্ট। মাটির মেঝের মধ্যে কম্বল পেতে দিলেন ইস্তিয়াকের ফুপু। ইস্তিয়াক বলল “বসুন স্যার”।
মাথুর বসলেন।
ইস্তিয়াকও বসল। ফুপু ব্যস্ত সমস্ত হয়ে একটা প্লেটে একগাদা বিস্কুট দিলেন মাথুরকে। মাথুর দুটো বিস্কুট তুলে নিলেন। ইস্তিয়াক বলল “স্যার, আমি আগের সপ্তাহে এই গ্রামে এসেছিলাম। ফুপুর থেকে শুনেছিলাম এই গ্রামে বেশ কড়া মিলিটারি ছানবিন হয়েছিল”।
মাথুর বললেন “হ্যাঁ, ইসমাইল এই গ্রামেই তো লুকিয়ে ছিল”।
ইস্তিয়াক ফুপুর সঙ্গে পুস্তু ভাষায় কথা বলে তার দিকে তাকাল “ইব্রাহিমচাচার বাড়িতে ছিল ইসমাইল। আমরা ওদিকেই যাব”।
মাথুর বিস্কুটে কামড় দিয়ে বললেন “ওকে। এখনই যাই”।
ইস্তিয়াক বলল “একটু বসুন স্যার, চা খেয়ে যাওয়া যাক”।
মাথুর বললেন “বেশ”।
ফোনটা অফ করে রেখেছিলেন মাথুর। একবার ভাবলেন অন করবেন, পরক্ষণেই সেই প্ল্যান বাতিল করলেন। ফোন অন করলেই একের পর এক ফোন আসা শুরু করবে। এত প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছা করছিল না তার। ইস্তিয়াক একটা কাগজ আর পেন জোগাড় করে তার সামনে গ্রামের ম্যাপ এঁকে বলল “এই দেখুন স্যার, গ্রামে সব মিলিয়ে পয়ত্রিশ থেকে ছত্রিশটা বাড়ি আছে। তার মধ্যে এই দুটো বাড়িতে ওরা ছিল”।
মাথুর বললেন “এই গ্রামে এর আগে ওরা কেউ এসেছিল?”
ইস্তিয়াক বলল “না স্যার। আসে নি। ওরা যে কোন একটা আস্তানায় বেশি থাকে না তো। তবে এখানে ওদের শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা তো কম নেই, বুঝতেই পারছেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর লোকাল কাশ্মীরীদের প্রচুর রাগ আছে”।
মাথুর মাথা নাড়লেন “কোন কোন গ্রামে ওরা বেশি থাকে বলতে পারবে?”
ইস্তিয়াক বলল “ওরা গ্রামে কম থাকে। গ্রামের পপুলেশন কম। অচেনা অজানা লোক থাকলে ঠিক খবর হয়ে যায়। ওদের বেশিরভাগ শ্রীনগরেই থাকে। ওল্ড শ্রীনগরের বহু বস্তি আছে, ডাল লেকের বিভিন্ন হাউজবোট আছে যেখানে ওরা লুকিয়ে থাকে”।
মাথুর অবাক হলেন “তুমি এত জানলে কী করে?”
ইস্তিয়াক হাসল “এসব তো কাশ্মীরের ঘরে ঘরে সবাই জানে। এ আর এমন কী ইনফরমেশন স্যার”।
মাথুর বললেন “হু, হাউজবোটে রেইড করা অত সহজ কাজ নয়। অতগুলো হাউজবোট, আর অত বড় ডাল লেক। কীসের মধ্যে লুকিয়ে আছে, ইজ ভেরি টাফ টু ফাইন্ড”।
চা এল। তার সঙ্গে লোকাল বেকারির কেক। মাথুর লজ্জিত হয়ে ইস্তিয়াককে বললেন “ওরা গরীব মানুষ। আমাকে এখানে না আনলেই ভাল করতে তুমি”।
ইস্তিয়াক বলল “স্যার এরকম বলবেন না। আপনি যে এখানে এসেছেন, সেটা যে কত ভাল ব্যাপার সেটা বলে বোঝানো যাবে না। আমরা তো এটাই চেয়ে এসেছি সব সময়, দেশের মেইন স্ট্রিমে মিশতে চেয়েছি। পারি নি। সে রাগে দেশের বিরুদ্ধেই চলে গেছি কখনও কখনও”।
মাথুর বললেন “রেহানও তোমার মত কথাই বলত। কাশ্মীরের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত ছেলেটা। আমাদের দেশকে তো আমাদেরই ভাল রাখতে হবে”।
ইস্তিয়াক হাসল “রাইট স্যার, সমস্যাটা হল এ কথাটা সবাই বুঝল না”।
চা খেয়ে দুজনে বেরোল। গ্রামটা ছোট হলেও অত্যন্ত সুন্দর।
গ্রামের পাশ দিয়ে লিডার নদী বয়ে চলেছে। নদীর ওপারে উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় রোদের আলোয় ঝকঝক করছে বরফ।
গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে কৌতূহলী চোখ তাদের দেখছিল।
ইস্তিয়াক ফিসফিস করে বলল “চুপচাপ চলে আসুন স্যার”।
ইব্রাহিম বুড়োর বাড়ি পৌঁছে ইস্তিয়াক চারদিকে তাকিয়ে বলল “আসুন স্যার”।
দরজা বন্ধ ছিল।
ইস্তিয়াক দরজা ঠকঠকালো।
এক বৃদ্ধ দরজা খুললেন। ইস্তিয়াক বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বললেন “চাচা, ইনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ইসমাইল কোন ঘরে ছিল একটু দেখাবেন?”
বৃদ্ধ কোন কথা না বলে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন।
ইস্তিয়াক মাথুরের দিকে তাকিয়ে বলল “আসুন স্যার”।
মাথুর ইস্তিয়াককে বললেন “যাও ভেতরে যাও”।
অন্ধকার ঘর। এ বাড়িতেও দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট।
ইস্তিয়াক মোবাইলের টর্চ জ্বালাল। ঘরের মধ্যে একটা বড় খাট। বুড়ো ইস্তিয়াককে কিছু একটা বলল।
ইস্তিয়াক মাথুরের দিকে তাকিয়ে বলল “স্যার এই খাটে শুত ইসমাইল”।
মাথুর ঘরের চারদিকে তাকালেন। কিছুই সেরকম লক্ষ্য করার মত নেই।
ইস্তিয়াককে বললেন “ফোনটা দাও”।
ইস্তিয়াক মাথুরের হাতে ফোনটা দিল।
মাথুর ফোনের টর্চ নিয়ে খাটের তলায় নজর দিলেন, বেশ কিছু খবরের কাগজ বের হল।
মাথুর কাগজগুলো ভাল করে ঘাটলেন। পাকিস্তানের কয়েকটা কাগজ। কাগজের মধ্যে কোথাও কোন রকম দাগ দেওয়া নেই।
মাথুর তবু ভাল করে কাগজগুলো দেখলেন। সেরকম কিছু পেলেন না। ইস্তিয়াক বলল “কিছু পেলেন স্যার?”
মাথুর মাথা নাড়লেন।
ইস্তিয়াক, ইব্রাহিম বুড়োকে চেঁচিয়ে কিছু প্রশ্ন করল। বুড়ো কিছু একটা বলল। সেটা শুনে ইস্তিয়াক বলল “সব নিয়েই পালিয়েছে ওরা। তেমন কিছু নেই এখানে। তাছাড়া আর্মির তল্লাশিও হয়েছিল। কিছু না পাওয়ার চান্সই বেশি”।
মাথুর হতাশ মুখে কাগজগুলো ছুঁড়ে মারলেন।
চুপ চাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলেন।
মাথুর তীক্ষ্ণ চোখে চার দিকে নজর দিলেন। কেউ তাকে দেখছে না এখন। নেইও কেউ আশে পাশে।
একটা সিগারেট ধরালেন। ইস্তিয়াক বলল “স্যার আর কিছু দেখবেন না”?
মাথুর চারদিকে তাকালেন। বাড়িটার ভৌগোলিক অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলেন।
এ বাড়িটায় পিছনদিকে অনেকগুলো গাছ আছে। অগোছালো বাগান আছে।
মাথুর বাগানে ঢুকলেন। একগাদা আগাছা। বেশ কিছুক্ষণ ভাল ভাবে সে দিকে লক্ষ্য করে দেখা গেল আগাছার ঝোপের মধ্যে একটা ছোট্ট জায়গায় মাটি দেখা যাচ্ছে। মাথুর এগোলেন। তার মুখে হাসি ফুটল।
পরিষ্কার জায়গার মাটির দিকে ভাল করে তাকিয়ে মাথুর হাঁটু গেড়ে বসলেন। হাত দিয়েই মাটি সরাতে শুরু করলেন। ইস্তিয়াক বলল “স্যার আমার হেল্প লাগবে”?
মাথুর ইস্তিয়াককে বললেন “মাটি খোড়া যায়, এরকম কিছু আছে?”
ইস্তিয়াক বলল “দেখছি”। ঘরের ভেতর ঢুকে কয়েক মিনিট পরে বেরিয়ে এল একটা শাবল নিয়ে। মাথুরের মুখে হাসি ফুটল, “গুড। এবার মাটিটা সরাও তাড়াতাড়ি”।
ইস্তিয়াক শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করল। কিছুটা খোঁড়ার পরে ছোট্ট একটা চৌকনো প্যাকেট বেরোল। মাথুরের হাতে সেটা দিল ইস্তিয়াক। চারদিকে কোন লোক আছে কিনা তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হবার পরে মাথুর প্যাকেটটা খুললেন। একগাদা কাগজ বেরোল।
মাথুর কাগজগুলো একের পর এক দেখে যেতে থাকলেন। কাশ্মীর আর পাঞ্জাবের দুটো ম্যাপ আঁকা। তার ওপর উর্দু আর ইংরেজিতে লেখা বিভিন্ন শব্দ। মাথুর একটা কাগজ ইস্তিয়াককে দিয়ে বললেন “কী লেখা দেখো তো উর্দুতে?”
ইস্তিয়াক পড়ে বলল “কিছু বুঝতে পারছি না স্যার। সম্ভবত কোন কোড ল্যাংগুয়েজ হবে”।
মাথুর ইস্তিয়াকের দিকে তাকিয়ে বললেন “রাইট। সব কাগজের ছবি তুলে আমাকে পাঠাও”।
ইস্তিয়াক ছবি তুলতে শুরু করল।
.
৫০
ভোর চারটে বেজেছে। মেহের সায়ককে বলল “আপনি বসুন। আমি দেখছি”।
দরজা খুলে মেহের বাইরে গেল। কয়েক মিনিট পরে ফিরে এসে বলল “আপনি এবারে যেতে পারেন। পিছনের দরজা দিয়ে বেরোবেন। চকের কাছে অটো পেয়ে যাবেন। স্টেশন চলে যান”।
সায়ক উঠে দাঁড়াল। বলল “শুক্রিয়া”।
মেহের বলল “আপনি যান। শুক্রিয়া বলার দরকার নেই”।
সায়ক কয়েক সেকেন্ড মেহেরের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরোল। যতক্ষণ না সায়ক চোখের আড়াল হল মেহের দাঁড়িয়ে রইল। সায়ক মনে মনে বলল “ভাল থেকো মেহের, আর পারলে আমাকে ক্ষমা কোর”।
বিল্ডিং এর বাইরে টিমটিমে আলো জ্বলছে। সায়ক সন্তর্পণে চারদিকে তাকাল। মেহের ঠিকই বলেছিল। এই সময়ে কোন টহল হচ্ছে না। সায়ক হেঁটে অটোস্ট্যান্ডে পৌঁছল। অটোর মধ্যেই ঘুমাচ্ছিল সবাই। সায়ক একটা অটোতে মুখ ঢুকিয়ে ডাকল “ভাইজান, স্টেশন যাবেন?”
অটোওয়ালা উঠে বসে বলল “কেন যাব না ভাইজান, এমনি এমনি সারারাত অটোতে ঘুমাই? উঠে বসুন”।
সায়ক উঠল।
অটোওয়ালা দেশের হাল আলোচনা করতে করতে গাড়ি চালাতে লাগল। নিয়াজি খুব বাজে লোক, তেলের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে, জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য হয়ে গেছে। তাদের মত গরীব মানুষরা কী করে বেঁচে থাকবে ইত্যাদি। সায়ক হু হাঁ করে গেল। শহর পুরোপুরি ঘুমায় নি। বাজারের অনেক জায়গাতেই আলো জ্বলছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে সারারাত ধরে মালপত্র আসে। কেউ কেউ দোকানেই ঘুমিয়ে পড়ে। পুরনো চক পেরোতে ঝকঝকে রাওয়ালপিন্ডি শহরটা দেখা গেল। সায়ক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আব্বাসের কথা মনে পড়ছে হঠাৎ করে। আব্বাসকে সে কথা দিয়েছিল দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। পাকিস্তানিরা অকথ্য অত্যাচারের জন্য কুখ্যাত। কথা বের করার জন্য ওরা শেষ পর্যন্ত যেতে পারে।
স্টেশনে পৌঁছে সায়ক চারদিকে তাকাল। সেনা আছে তবে সংখ্যায় কম। সে পাঠান স্যুট পরেছিল। টিকেট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দ্বিধায় পড়ল। এই মুহূর্তে তার আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া উচিত। অন্তত দু তিন মাস কেউ তাকে খুঁজে না পায় এরকম ব্যবস্থা করা উচিত। সায়কের ক্লান্ত লাগছিল। টিকেট না কেটে সে কাউন্টারের উল্টোদিকের বেঞ্চিতে বসল। ভোরবেলাতেই একগাদা ফুলের সারি নিয়ে এক দোকানদার কোথাও যাচ্ছে। সায়ক তীক্ষ্ণ চোখে সে দিকে তাকিয়ে রইল। সে মনে মনে বলে উঠল “ইয়েস। ইয়েস। মনে পড়েছে”।
পূবের আকাশ একটু একটু করে আলোকিত হচ্ছে।
সায়ক লাফিয়ে উঠে টিকেট কাউন্টারে গিয়ে বলল “করাচীর ট্রেন কখন ছাড়বে মিয়াঁ?”
টিকেট কাউন্টারের লোকটা বলল “দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনে। এখনই ছাড়বে”।
সায়ক বলল “একটা টিকিট দিন”।
টিকিটটা নিয়ে সায়ক দৌড় লাগাল। ট্রেন হুইসল দিচ্ছে। কোনমতে দৌড়ে গিয়ে একটা জেনারেল কামরায় উঠতেই ট্রেন ছেড়ে দিল।
বসার সিট ছিল। বসে সায়ক জোরে জোরে শ্বাস ছাড়তে লাগল।
“কী মিয়াঁ, খুব জলদি মনে হচ্ছে?”
পাশের পাঠান ভদ্রলোক উচ্চস্বরে প্রায় কামরার সবাইকে শুনিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল।
সায়ক বলল “হ্যাঁ মিয়াঁ, অটোওয়ালার দৌলতে ট্রেন আরেকটু হলেই মিস হয়ে যাচ্ছিল আর কী”।
পাঠান বলল “তা ঠিক। রাওয়ালপিন্ডির অটোওয়ালাগুলোই এরকম। আমারও কতবার হয়েছে”।
সায়ক বুঝল এ লোকের বকবক করা স্বভাব আছে। সে চোখ বুজে ঘুমনোর ভান করল।
পাঠান অবশ্য বকবক থামাল না। বকে যেতে লাগল।
টিকেট চেকার এসে চেক করে গেল। সূর্য উঠেছে। শীত আছে। সায়কের শীত লাগছিল।
পাঠান বলল “মিয়াঁ, আপনি কোথায় যাবেন?”
সায়ক বলল “করাচী”।
পাঠান আঁতকে উঠে বলল “ওরে বাবা, একটা গোটা দিন আপনি বসে বসে যেতে পারবেন?”
সায়ক মাথা নাড়ল। পাঠান বকবক করে যেতে লাগল, কীভাবে লোকে এতটা রাস্তা বসে যেতে পারে তা নিয়ে তার বড় চিন্তা। সায়কের তন্দ্রা মত এসেছিল। ট্রেনের দুলুনিতে সে ঘুমিয়েই পড়ল।
ঘুম ভাঙল সকাল দশটা নাগাদ। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে মাঠের মধ্যে। পাথুরে মালভূমি অঞ্চল। ধু ধু প্রান্তর। পাঠান নেই। নেমে গেছে। চড়া রোদ উঠেছে।
সায়ক পাশের জনকে জিজ্ঞেস করল “কোন স্টেশন পেরিয়েছে?”
পাশের জন বলল “মালুম নেই”।
সায়ক জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল।
খিদে পাচ্ছে। সায়ক উঠল। ফেরিওয়ালার খোঁজে বেরোল।
.
.
৫১
“স্যার মে আই কাম ইন”?
প্রতিরক্ষামন্ত্রীর চেম্বারে নক করে বললেন তুষার।
মন্ত্রী হাসলেন “আরে আসুন, প্লিজ। গুডমর্নিং। প্লিজ সিট”।
তুষার বসলেন। বললেন “গুড মর্নিং স্যার”।
মন্ত্রী বললেন “পি এম আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন”।
তুষার বললেন “এখন?”
মন্ত্রী বললেন “হ্যাঁ। এক মিনিট”।
মন্ত্রী ইন্টারকমে ফোন করে জেনে নিলেন পি এম ফাঁকা আছেন নাকি। নিশ্চিত হয়ে উঠে পড়ে বললেন “চলুন”।
তুষার উঠলেন। দুজনে বেরোলেন চেম্বার থেকে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বললেন “একসঙ্গে অনেকগুলো ইস্যু এসে গেছে তুষার। উই নিড টু ডিসকাস দিস টুগেদার। আপনার ওয়াইফের খবর শুনলাম। এখন ঠিক আছেন তো?”
তুষার বললেন “হ্যাঁ। শি ইজ রিকভারিং”।
মন্ত্রী খুশি হলেন “গুড”।
প্রধানমন্ত্রীর চেম্বারে প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে আসতে দেখেই দরজা খুলে দিয়েছিল নিরাপত্তারক্ষীরা। তারা প্রবেশ করলেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন “গুড মর্নিং। প্লিজ সিট”।
দুজনে বসলেন। প্রধানমন্ত্রী তুষারের দিকে তাকিয়ে বললেন “মিস্টার রঙ্গনাথন, সায়ক বড়ালের আপডেট কী?”
তুষার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দিকে তাকালেন। মন্ত্রী কিছু বললেন না। তুষার প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন “আপডেট এখনও অবধি কিছু আসেনি স্যার। এলেই আপনাকে জানিয়ে দেব”।
প্রধানমন্ত্রী বললেন “আপনার পাকিস্তান টিমের অবস্থা করুণ মিস্টার রঙ্গনাথন। তাদের আমরা ডিজওন করেছি ঠিকই, কিন্তু পাকিস্তান ওদের সবাইকে ধরতে পারলে আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের মুখ দেখানোর জায়গা থাকবে না”।
তুষার বললেন “দে আর ডুইং দ্য টাফেস্ট জব স্যার। আব্বাসকে ওরা দুমড়ে মুচড়েও কিছুই বের করতে পারে নি। এই মুহূর্তে পাকিস্তান যে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে বিদেশী অস্ত্র জড়ো করছে, সে খবর ওরা না দিলে আমরা জানতেও পারতাম না। আমার মনে হয় সায়কের ওপর আমাদের ভরসা রাখা উচিত, এছাড়া তো উপায়ও নেই কোন”।
প্রধানমন্ত্রী চিন্তিত মুখে বললেন “আর কাশ্মীর? কাশ্মীরের কী অবস্থা? অবস্তীকে মেরে দিল, শুনলাম আপনার টিমের একজন সদস্য নিখোঁজ হয়ে গেছে, এরকম ছন্নছাড়া অবস্থা তো রিসেন্ট পাস্টে হয়েছে বলে মনে পড়ছে না”।
তুষার বললেন “আমি কিন্তু নেগেটিভ কিছু ভাবছি না স্যার। আমাদের অফিসারেরা যথেষ্ট এফিসিয়েন্ট। গত কয়েক বছরে আমাদের ফেইলিওর রেটও যথেষ্ট কম। এই মুহূর্তে কাশ্মীর সমস্যা শুধু তো আর্মিদের জন্য হয় নি। পলিটিক্যাল ডিসিশনসও তার জন্য দায়ী”।
প্রধানমন্ত্রী ঈষৎ ক্ষুব্ধ হলেন “আপনি কী বলতে চাইছেন মিস্টার রঙ্গনাথন? আমরা দায়ী কাশ্মীর সমস্যার জন্য?”
তুষার হাসলেন “ব্যাপারটা তো আমরা-ওরার না স্যার। আমাদের তো একটা ইউনিট হিসেবেই কাজ করতে হবে। পাকিস্তান ইজ এ থ্রেট টু দ্য সিভিলাইজেশন। যে দেশের গভর্নমেন্ট সরাসরি টেররিজমকে স্পন্সর করে সে দেশের থেকে আর কী এক্সপেক্ট করা যায়? কিন্তু যে সব দেশ পাকিস্তানকে আর্মস বিক্রি করছে, তারা তো জেনে বুঝেই করছে? আমাদের বার বার বলা সত্ত্বেও কি তারা পাকিস্তানকে আর্মস বিক্রি করা বন্ধ রেখেছে? এদিকে আমরা কি সেভাবে কূটনৈতিক চাপ দিতে সক্ষম হয়েছি? একই ভাবে, আমরা যদি কাশ্মীরে আরও বেশি করে নজর দিতে পারি, আমার মনে হয় কাশ্মীর বিদ্রোহী হবার আগে একটু হলেও চিন্তায় পড়বে”।
প্রধানমন্ত্রী বললেন “আমরা কাশ্মীরের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। এ কথা আপনার থেকে ভাল কেউ জানে না। কিন্তু ওরা যদি টেরোরিস্টদের শেল্টার দেয়, তখন ন্যাশনাল সিকিউরিটির প্রশ্নে আপনাকে তো কড়া হতেই হবে। কী করবেন তখন আপনি?”
তুষার বললেন “শিওর স্যার। আমি আপনার সঙ্গে একমত। আমাকে অন্তত সাতদিন সময় দিন। আশা করছি আমি আপনাকে একটা ব্রিফ করে দিতে পারব প্রেজেন্ট সিচুয়েশনের”।
প্রধানমন্ত্রী বললেন “আর একটা কথা”।
তুষার প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকালেন, “ইয়েস স্যার”।
প্রধানমন্ত্রী বললেন “টিম রেডি করুন। নিয়াজি বার বার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। আমি ঠিক করেছি ওর আমন্ত্রণ গ্রহণ করব। ক্রিকেট সিরিজেও রাজি হব। আপনি টিম পাঠিয়ে সিকিউরিটি ইস্যুজগুলো দেখে আমায় রিপোর্ট করুন, সাতদিনই সময় দিতে পারি আপনাকে। এক সঙ্গে সবটা দেবেন না হয়, ক্লিয়ার?”
তুষার প্রধানমন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে বললেন “ক্লিয়ার স্যার”।
.
৫২
ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেল বীরেনের। সারারাত এপাশ ওপাশ করেছে। একবার বাবা মার কথা মনে হচ্ছে। পরক্ষণেই অপরাধবোধ আসছে, মনে হচ্ছে ছুটিতে না এসে আশরফ খানের পাশে থাকলেই ভাল হত।
কোনদিন স্বপ্নেও সে ভাবে নি এরকম চাকরি হতে পারে তার। দেশের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চাকরি যা দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত।
উঠে পড়ল সে। মুখ হাত ধুয়ে ট্রাইজার আর টি শার্ট পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।
পূব আকাশে সবে সূর্য উঁকি মারছে। আকাশ মেঘলা। বাড়ি থেকে পাড়ার মাঠটা হাঁটা পথে মিনিট পাঁচেকের। বেশ বড় মাঠ। অনেকেই দৌড়তে আসে সকালে। বীরেন মাঠে পৌঁছে আগের অভ্যাসমত দৌড়তে শুরু করল। দৌড়নোর সময় সে দেখেছে মাথায় কোন দুশ্চিন্তা থাকে না। নিজের সঙ্গে অদ্ভুত একটা আত্মিক যোগ তৈরী হয় এ সময়টায়।
মাঠের চারদিকে সাত পাক দৌড়ে বীরেন মাঠের পাশের সিমেন্ট বাঁধানো জায়গায় হালকা এক্সারসাইজ শুরু করল। হরেনকাকা প্রতিদিনের মত প্রাণায়াম করছিলেন। তাকে দেখে বললেন “কী বীরেন, আজকাল তো তোকে আর দেখা যায় না। কোথায় পোস্টিং তোর?”
বীরেন সতর্ক হল। কিছুই বলা উচিত না তার। বলল “আপাতত কলকাতাতেই”।
হরেনকাকা বললেন “বিয়ে থা করবি তো, নাকি?”
বীরেন বলল “সবে তো চাকরিতে ঢুকলাম কাকা। ওসব পরে দেখা যাবে”।
হরেনকাকা বললেন “দেখিস, আমার এক ভাইয়ের মেয়ে আছে। দেখতে শুনতে ভাল। তুই চাইলে তোর বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারি”।
বীরেন হতাশ হল। টেনশনের মধ্যে এসব কথা শুনতে ভাল লাগছিল না।
সে বলল “আচ্ছা কাকা সেসব দেখা যাবে, আমি মাঠের চারপাশে আরেকপাক দিয়ে আসি”।
হরেনকাকা হাঁ হাঁ করে ওঠার আগেই বীরেন দৌড়তে শুরু করল।
মাঠে বাচ্চারা এসেছে উইকেট ব্যাট নিয়ে। মাঠের মাঝখানে উইকেট পুতে খেলা শুরু করেছে। বীরেন দৌড়তে দৌড়তে সেদিকে তাকাচ্ছিল। খেলতে ইচ্ছা করছিল। কয়েকটা পুশ আপ মেরে আবার দৌড়ে নিল খানিকটা। মাঠটা ঘোরা হয়ে গিয়ে বাঁধানো জায়গাটায় এসে তার একটা হার্টবিট মিস করল।
হরেনকাকা উল্টো হয়ে পড়ে আছেন। বীরেন এগিয়ে গিয়ে দেখল দুচোখের মাঝখানের জায়গাটায় কেউ গুলি করেছে। বীরেন চারদিকে তাকাল। কাউকে দেখতে পেল না। সে মোবাইল নিয়ে বেরোয় নি। হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড। একটা বাইকের জোরে বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল।
বীরেন চেঁচিয়ে বাচ্চাগুলোকেই ডাকল। সবাই ছুটে এল। বীরেন তাদের বলল “সবাইকে ডাক শিগগির”। বাচ্চাগুলো সভয়ে হরেন কাকার দিকে তাকাল। এরকম দৃশ্য তারা এর আগে কেউ দেখে নি।
মিনিট দশেকের মধ্যে পাড়ার প্রায় সবাই চলে এল।
শান্ত মফস্বলে এরকম ঘটনা হতে পারে কেউ ভাবতেই পারে না।
পুলিশ এল। থানার ওসি তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন “আপনিই দেখেছিলেন?”
বীরেন মাথা নাড়ল।
ওসি বললেন “আচ্ছা, আমার সঙ্গে একটু থানায় যেতে পারবেন? বডি আপাতত ফরেন্সিক যাবে, আপনাকে যেতে হবে আমাদের সঙ্গে”।
বীরেন বলল “নিশ্চয়ই”।
পুলিশের গাড়িতে থানায় নিয়ে যাওয়া হল তাকে। ওসি তাকে বসতে বলে বললেন “ঠিক কী হয়েছিল বলুন”।
বীরেন বলল।
ওসি বললেন “কেউ ছিল না, আর আপনি এসে দেখলেন ভদ্রলোক মরে পড়ে আছেন? কথাটা বিশ্বাসযোগ্য”?
বীরেন খানিকটা ঘাবড়েই গেছিল। সে এর উত্তর দিতে যাচ্ছিল এমন সময় দুজন থানায় ঢুকে সরাসরি ওসির সামনে এসে দাঁড়ালেন “ওকে ছেড়ে দিন”।
ওসি অবাক হয়ে বললেন “মানে? আপনারা কারা?”
একজন পকেট থেকে আই কার্ড বের করে ওসিকে দেখালেন।
ওসি সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন “এক্সট্রিমলি সরি”, বীরেনের দিকে তাকালেন ওসি, “আপনি যেতে পারেন”।
দুজন বীরেনের দিকে তাকিয়ে বললেন “চলুন”।
বীরেন বেরোল। থানার বাইরে এসে একজন বললেন “আপনি বাড়ি চলে যান। এভাবে একা বেরোবেন না এখন”।
বীরেন বলল “ওরা কি আমাকেই … ?”
ভদ্রলোক বললেন “নাও হতে পারে। আপনাকে ভয় দেখিয়ে বাঁকাতে চাইছে”।
বীরেন আতঙ্কিত হল। তার মনে হচ্ছিল এবার আতঙ্কিত হবার যথেষ্ট কারণ আছে।
.
৫৩
ট্রেন লেট করল। সায়ক কখনও ঘুমিয়ে ছিল, কখনও জেগে বসেছিল। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে খাবার কিনে খেল।
করাচী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে যখন ট্রেন পৌঁছল তখন সকাল সাড়ে আটটা বাজে। ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে সে ট্রেন থেকে নামল। স্টেশনে সেনা ভর্তি। সায়ক কোন রকম তাড়াহুড়ো করল না। ধীরে সুস্থে হাঁটতে লাগল। চেকারের কাছে টিকেট জমা দিল এবং স্টেশনের বাইরে এল। স্টেশনের বাইরে বাস স্ট্যান্ড।
সায়ক দেখল নর্থ নাজিমাবাদের বাস দাঁড়িয়ে আছে। সে বাসে উঠে বসল। আরব সাগরের তীরে অবস্থিত করাচী শহর। আধুনিকতার ছোঁয়া এসে লাগলেও উপমহাদেশের শহরগুলোর মতই জনবিস্ফোরণে ধুঁকছে। বাস ছাড়তেই জ্যামের মুখে পড়ল। সায়ক অস্থির হল না, চুপ করে বসে রইল।
মিনিট পঁয়তাল্লিশ বাদে সায়কের বাসস্ট্যান্ড এল। সে বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল। নর্থ নাজিমাবাদ করাচীর অন্যতম পশ এলাকার মধ্যে পড়ে। পাকিস্তানের জন্মের পরে ইতালীয়দের দিয়ে এই অঞ্চলটির প্ল্যানিং করা হয়েছিল। সুদৃশ্য বাড়ি, সুপ্রশস্থ রাস্তা। একেকজনের বাড়ি অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরী।
সায়ক নিজের মনে বিড় বিড় করতে করতে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিনিট পনেরো বাদে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। এ বাড়িটাও অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরী, কিন্তু বর্তমানে কেউ থাকে না সেটা বাড়িটার বাগানে আগাছা আর গেটে তালা দেখলেই বোঝা যায়।
বাড়ির সামনের নেমপ্লেটে উর্দুতে লেখা “ওমর শেখ”।
সায়ক চারদিক দেখে নিল। শান্ত জায়গা। রাস্তা দিয়ে গাড়ি গেলেও এলাকার বাড়িগুলো থেকে তেমন সাড়াশব্দ নেই। পাশাপাশি বাড়িগুলোর মধ্যেও দূরত্ব অনেকটাই। দু তিন বার চার পাশে তাকিয়ে পাঁচিল টপকাল সে। সন্তর্পণে বাড়ির দরজার কাছে এসে তালাটা পরীক্ষা করল।
শক্ত তালা। সায়ক হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ির পিছনে গেল। পিছনের দিকে একটা ঘেরা মত জায়গা। দরজাটা ভেতর থেকে তালা দেওয়া। সায়ক চুপ করে দাঁড়াল কয়েক সেকেন্ড। তারপর দরজায় জোরে ধাক্কা মারল। দরজাটা একটুও নড়ল না।
সায়কের ঘাম দিচ্ছিল। তার চোখ পড়ল দেওয়াল সংলগ্ন একটা শাল গাছে। একটুও না ভেবে অতি দ্রুততার সঙ্গে শালগাছে উঠে দেওয়ালের ওপরে দাঁড়াতে পারল। নিচে কংক্রিট। প্রায় দু মানুষ উঁচু জায়গাটা। সায়ক কিছু না ভেবে নিচের দিকে ঝাঁপ মারল। মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে গেল খানিকটা। কাঁধে ব্যথা হল কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সে ব্যথা সহ্য করে নিল। একটা বড় কুয়ো আছে ঘেরা জায়গাটার মধ্যে। সায়ক কুয়ো থেকে জল নিয়ে গায়ে মাথায় দিল। চুপ করে কয়েক মিনিট মেঝেতে বসে বাড়ির ভিতরের দরজার দিকে চোখ গেল তার। পাগলের মত চারদিকে তাকাল সে। যদি কিছু পাওয়া যায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অবশ্য তার মুখে হাসি ফুটল। কুয়োর পাশে একটা কুড়ুল রাখা।
জোরে শ্বাস ছেড়ে কুড়ুলটা নিয়ে দরজায় মারতে লাগল। শাল কাঠের দরজা। অত সহজে ভাঙার বস্তু নয়। দু তিন বার করে বাড়ি মেরে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। আধঘন্টার চেষ্টায় দরজার নিচের দিকটা ভাঙা গেল।
সায়ক অস্ফূটে উল্লাস করে উঠে নিচের ফাঁক দিয়ে বাড়িটার ভেতর প্রবেশ করল।
অত্যন্ত অভিজাত আসবাবপত্র দিয়ে ঘর সাজানো। কিন্তু বাড়িটায় কেউ থাকে না বলে নোংরা জমেছে। মাকড়সার ঝুল হয়েছে। সায়ক তীক্ষ্ণ চোখে চারদিকে তাকাতে তাকাতে ড্রয়িং রুমে এল। আফসানা সাঈদ এবং ওমর শেখের একত্রে একটা ফটো রাখা সোফার পাশে। সায়কের মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে ফটোটা খানিকক্ষণ দেখে বাড়িটা তল্লাশি করতে শুরু করল।
দোতলা বাড়ি। নিচের তলায় বড় বড় দুটো বেডরুম, একটা ড্রয়িং রুম, আর ডাইনিং রুম। দোতলায় যাবার সিঁড়ি হিন্দি সিনেমার বাড়িগুলোর মত, নিচ থেকেই। প্রতিটা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়ল।
একগাদা বই ছাড়া তেমন কিছুই আর পাওয়া গেল না।
সায়কের হতাশ লাগছিল। অন্ধকার হলে আলো জ্বালানো সম্ভব নয়। তাহলে বাইরের লোকের সন্দেহ হতে পারে।
সায়ক দোতলায় একটা বেডরুমে ঢুকল। ওয়ার্ডরোবগুলো তন্ন তন্ন করে খোঁজা শুরু করল। কিছুই পাওয়া গেল না। হতাশায় সায়ক দেওয়ালে জোরে ঘুষি মারল।
আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাকে চমকে দিয়ে দেওয়ালের একটা অংশ পাশে সরে গিয়ে একটা ছোট্ট তাক বেরিয়ে এল ।
সায়ক অবাক হয়ে দেখল সেখানে একটা ছোট ল্যাপটপ রাখা।
সায়ক আনন্দে “ইউরেকা” বলে উঠল।
৫৪
কাঁটায় কাঁটায় ঠিক রাত আটটার সময় অমৃতসরের ক্যানাল রোডের একটা বাড়ির সামনে একটা অল্টো গাড়ি এসে দাঁড়াল। আসলাম গাড়ি চালাচ্ছিল। কাদরী বাড়ির নাম্বার মিলিয়ে নিয়ে আসলামকে বললেন “তুমি এখানেই দাঁড়াও। গাড়ি থেকে নামবে না। কোথাও যাবে না, কোথাও কোন ফোন করবে না। বুঝেছ?”
আসলাম মাথা নাড়ল “বুঝেছি জনাব”।
কাদরী ইসমাইলকে ইশারা করলেন। দুজনে গাড়ি থেকে নামল।
কাছাকাছি কোথাও ডিজে চালানো হয়েছে। খুব জোরে গান বাজনা হচ্ছে।
কাদরী বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে কলিং বেল দিলেন। কয়েক সেকেন্ড পর একটা ছোট জানলা খুলে একটা মুখ বেরিয়ে এল “কে?”
কাদরী শুধু বললেন “বলুন প্রফেসর এসছে”।
জানলাটা বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর বাড়ির গেটটা খুলে গেল। কাদরী ইসমাইলকে নিয়ে বাড়ির বাউন্ডারিতে প্রবেশ করলে গেটটা আবার বন্ধ করে দেওয়া হল। বিরাট বড় বাড়ি। কাদরী কোন দিকে না তাকিয়ে বাড়ির মূল দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই দরজা খুলে গেল। একজন লম্বা চওড়া পাঠান কাদরীকে দেখে হেসে জড়িয়ে ধরল। বলল “আমার সঙ্গে আসুন”।
বাড়িটার ভিতরে অনেক লোক। কাদরী এবং ইসমাইল কোনদিকে না তাকিয়ে লোকটাকে ফলো করে যেতে লাগল। এ ঘর সে ঘর করে লোকটা একটা ছোট ঘরে এসে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করল। তারপর মেঝের একটা প্লেট সরাতে একটা সিঁড়ি দেখা গেল। লোকটা বলল “আমার পিছন পিছন আসুন”।
লোকটা নেমে গেল।
তার সঙ্গে দুজনে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আরেকটা ছোট ঘরে পৌঁছল তিনজনে। লোকটা ঘরের আলো জ্বেলে দিল। ঘর আলোকিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ইসমাইল বলল “মাশাল্লাহ”।
কাদরী হাসি হাসি মুখে ইসমাইলের দিকে তাকালেন। ঘর ভর্তি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র সহ অসংখ্য বিস্ফোরকে।
কাদরী পাঠানের দিকে তাকিয়ে বললেন “শুক্রিয়া”।
পাঠান বলল “আপনাদের জন্য ফারমান আলীর খাস জিনিস পাকিস্তান থেকে পাঠিয়েছেন মেজর সাহাব”।
ইসমাইল একটা মেশিনগান তুলে পরীক্ষা করতে করতে বলল “মেজর সাহাবকে বলে দেবেন ইসমাইল তার জীবনের সঞ্চিত সমস্ত ভালোবাসা তাকে উজাড় করে দিয়েছে। মজা এসে যাবে প্রফেসর সাহাব”।
কাদরী পাঠানের দিকে তাকিয়ে বললেন “এগুলো কবে পাওয়া যাবে?”
পাঠান বলল “এখনই পাবেন। কোন অসুবিধা নেই”।
কাদরী বললেন “এখান থেকে নিয়ে যাব কী করে?”
পাঠান বলল “অপারেশন কবে?”
কাদরী ইসমাইলের দিকে তাকালেন।
ইসমাইল বলল “আজ রাতেই হোক ইনশাল্লাহ। দেরী কেন?”
কাদরী অবাক হয়ে ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে বলল “আজ রাতে”?
ইসমাইল হো হো করে হেসে উঠে বলল “মজা করছিলাম। প্রফেসর সাহাব, এই বারুদের গন্ধ আমার রক্তকে উত্তেজিত করে তুলছে। আমি এখানেই থেকে যাই। কাল ভোরে কাজ করে আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দেব”।
কাদরী ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে বললেন “সেরকম তো নির্দেশ ছিল না”।
ইসমাইল জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল “আসল নির্দেশ তো উপরওয়ালা দেন প্রফেসর সাহাব। আমি ছাড়া আর কেউ তো তার কাছে যাবে না। তাহলে এই সিদ্ধান্তটা আমি নিলেই ভাল হয় না?”
কাদরী কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে পাঠানের দিকে তাকিয়ে বললেন “ইসমাইল এখানে থাকলে কোন সমস্যা?”
পাঠান মাথা নাড়ল “না। আপনি থাকলেও কোন সমস্যা নেই”।
কাদরী চিন্তিত গলায় বললেন “আমার এখানে থাকলে হবে না। রিপোর্টিং এর ব্যাপার আছে। তবে ইসমাইলকে আমার এখনই ছাড়তে ইচ্ছা করছে না”।
ইসমাইল হেসে বলল “প্রফেসর সাহাবের কি আমার সঙ্গে ইশক হয়ে গেছে? আরে মিয়াঁ, আপনি চিন্তা করবেন না, ইসমাইল কখনও ফেল করে না। জীবনের শেষ যুদ্ধেও করবে না”।
মেঝেতে টুল রাখা ছিল। কাদরী টুলের ওপর বসে বললেন “বেশ। তবে কাল ভোর পাঁচটায় গাড়ি নিয়ে আমি এখানে চলে আসব। বাকিটা তোমার ওপর”।
ইসমাইল কাদরীর দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুকিয়ে বলল “জ্যায়সে আপ কহে”।
কাদরী আরও কয়েক মিনিট চুপ করে বসে পাঠানকে বললেন “আমি তবে বেরিয়ে যাই। আমাকে নিয়ে চলুন”।
ইসমাইল এগিয়ে এসে কাদরীকে জড়িয়ে ধরল। কাদরী ইসমাইলের পিঠ চাপড়ে বললেন “সাবধানে। চোখ কান খোলা থাকে যেন”।
ইসমাইল বলল “একদম”।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে পাঠানের দেখানো পথে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলেন কাদরী। আসলাম গাড়ির মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
কাদরী আসলামের পাশে বসে বললেন “চল”।
আসলাম বলল “উনি?”
কাদরী কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে শ্বাস ফেলে বললেন “আসবে না”।
.
৫৫
বীরেন নিজের ঘরে এসে হাঁফাচ্ছিল। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না, খোদ তাদের এলাকায় এসে এরা এত বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে দিয়ে চলে যেতে পারে।
সে বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আশরফ খানকে ফোন করল। একবারেই ধরলেন আশরফ, “গুড মর্নিং বীরেন, কী হল?”
বীরেন বলল পুরো ব্যাপারটা।
আশরফ বললেন “মাই গড। তুমি কোন সাউন্ড পাও নি? বা লোকটাকে পড়ে যেতেও দেখো নি?”
বীরেন বলল “না স্যার। আমি কিচ্ছু দেখি নি। আমি যখন হরেনকাকার কাছে গেলাম, উনি অলরেডি মরে পড়ে ছিলেন”।
আশরফ বললেন “বুঝেছি। দে হ্যাভ গ্রোন স্ট্রঙ্গার। তুমি চোখ কান খোলা রেখে চল। ফ্যামিলির ওপরে নজর রাখো। আমি তোমাকে পরে ফোন করছি”।
বীরেন বলল “আচ্ছা স্যার”।
ফোন রাখল বীরেন। মা এল ঘরের ভিতরে, উদ্বিগ্ন গলায় বলল “কীরে, কী শুনছি! কী সাংঘাতিক ব্যাপার! আমাদের এলাকায় তো কোনদিন এসব কিছু হয় নি!”
বীরেন মাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল “তুমি চিন্তা কোর না, দেখো হরেনকাকার কোন শত্রু ছিল হয়ত”।
মা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল “তুই সকালে আর হাঁটতে যাবি না। ঠিক আছে?”
বীরেন মাকে জড়িয়ে ধরে বলল “আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। আর যাব না। খুশি?”
বাবা ঢুকল ঘরের ভেতরে। বলল “তোর মার সব কিছুতেই চিন্তা। নকশাল আমল যেন দেখে নি। এই খুন হচ্ছে, এই কাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, সে সব ভয়ানক দিন ছিল। এসব ছুটকো ছাটকা মার্ডার নিয়ে চিন্তা করছে”।
মা বলল “তুমি থামো। একটা মার্ডারও ভাল না। কেন এভাবে মারবে? এগুলো ঠিক?”
বাবা বলল “আচ্ছা, তুমি যাও। চা কর একটু। এসব নিয়ে যত চিন্তা করবে তত চিন্তা বাড়বে”।
মা গজগজ করতে করতে ঘরের বাইরে গেল।
বাবা বীরেনের পাশে বসে ঠান্ডা গলায় বলল “ওদের কথাটা শুনতে পারতিস। দেখ তো ওরা কী শুরু করল!”
বীরেন চমকে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল “মানে? তুমি জানো?”
বাবা হেসে বলল “তোকে এখন আর বলতে তো কোন প্রবলেম নেই। ওরা কি তোকে এমনি এমনি সিলেক্ট করেছিল? তুই আমার ছেলে বলে করেছিল”।
বীরেন বিস্ফারিত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল “মানে?”
বাবা বলল “মুদসসর নওয়াজ খান, রাজাকার ছিলাম। রাজাকার মানে জানিস? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের সাহায্য করেছিল যারা। কেনই বা করবে না? আসল ধর্ম তো ওরাই পালন করে। বাঙালিরা কি সত্যিকারের মুসলমান নাকি? থুঃ। এরা কোনদিন হতেও পারবে না। যাই হোক, মুক্তিবাহিনীর তাড়া খেয়ে একাত্তরে ভারতে ঢুকি। কোথায় যাব? তখন তো এপারেও খুব একটা ভাল পরিস্থিতি ছিল না। হরদম খুন দাঙ্গা লেগে আছে। আমি জয়েন করলাম একটা নকশাল গ্রুপে। কিছুদিন অপারেশন চালাবার পর বুঝলাম নকশালরা মরবে। সব মরবে। চলে গেলাম বম্বে। বছর পাঁচেক গা ঢাকা দিয়ে এখানে চলে এলাম। তখন এত সমস্যা ছিল না। রেশন কার্ড ভোটার কার্ড সব হয়ে গেল। নাম পাল্টালাম। হিন্দু নাম রাখলাম। সদাগরী অফিসে চাকরি করলাম। কারও বাপের সাধ্যি নেই সন্দেহ করে। বিয়ে করলাম অফিসের এক সিনিয়র কলিগের মেয়ের সঙ্গে। তুই হলি, বুল্টি হল। যোগাযোগটা কিন্তু ঠিকই ছিল। নির্দেশ একটাই ছিল, চুপ করে থাকো। কিছু করতে হবে না। যেরকম চলছে সেরকমই চলুক। একদিন কুরবানী দিতে হবে। তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। একজন সাচ্চা মুসলমান তো আল্লাহর কাছে তার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটাকেই কুরবানী দেয়। আমার সব থেকে প্রিয় তুই। মনে আছে তোকে ছোটবেলায় রুমান মিয়াঁ বলে ডাকতাম? ওটাই তোর নাম। এবার বল, তোর বাবার জন্য তুই নিজেকে কুরবান করতে রাজি নোস?”
বীরেন হাঁ করে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না তার অফিস করা বাবা, দৈনন্দিন জীবনে সাধারনের থেকেও সাধারনতর বাবা এই কথাগুলো বলছে। সে কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না, কোনমতে বলল “বোম্বেতে ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারত বাবা। হাইজ্যাকিং এর সময়ও”।
বাবা ঠান্ডা গলায় বলল “পারত। এই মিশনে ওরা তোকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। ওদের হাতে আমি তোকে কুরবান করেছি। তোকে অনেকবার অনেকভাবে ওরা বলেছে, যোগাযোগ করেছে। আমি চাইনি তোর সামনে আসতে। কিন্তু কী করব বল, তুই কিছুতেই বুঝছিস না। অগত্যা…”
বাবা তার দিকে তাকাল।
বীরেন বলল “মা জানে?”
বাবা হাসিমুখে বলল “খেপেছিস? এসব কেউ বলে?”
মা চা নিয়ে ঢুকল। তাদের দেখে বলল “কী কথা হচ্ছে বাপ ছেলেতে?”
বীরেন উত্তর দিতে পারল না। তার মনে হচ্ছিল সে মাটিতে মিশে যাচ্ছে।
.
৫৬
রাত এগারোটা।
প্রেসিডেন্ট হাউজ। ইসলামাবাদ।
আই এস আইয়ের নবনিযুক্ত চিফ মুস্তাকিন শাহরিয়র গোপনে এসেছেন প্রেসিডেন্ট নিয়াজির সঙ্গে দেখা করতে। বসার ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। কিছুক্ষণ পরে নিয়াজির খাস খানসামা জাকির এসে শাহরিয়রকে বলল “আপনি আমার সঙ্গে আসুন জনাব”।
শাহরিয়র উঠলেন। খানিকটা হেঁটে একটা ছোট ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন জাকির। শাহরিয়রের আরেকপ্রস্থ তল্লাশির পর দরজা খুলে দেওয়া হল। শাহরিয়র দেখলেন প্রেসিডেন্ট টিভিতে ক্রিকেট দেখছেন এক মনে। তাকে দেখে বললেন “আসুন”।
শাহরিয়র ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলে জাকির দরজা বন্ধ করে দিল।
নিয়াজি বললেন “বসুন, নিজেকে স্বাভাবিক করুন”।
শাহরিয়র উসখুস করে বসলেন।
নিয়াজি টিভির দিক থেকে মুখ না ঘুরিয়ে শাহরিয়রকে বললেন “আপনি ঠিক কোন পদে আছেন, সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনার সম্যক ধারণা আছে মিস্টার শাহরিয়র?”
শাহরিয়র গলা পরিষ্কার করে বললেন “জি জনাব”।
নিয়াজি বললেন “দেখুন মিস্টার শাহরিয়র, আমি চাইলে অনেক ব্যক্তিত্বযুক্ত কাউকে আই এস আই চিফ করতেই পারতাম, কিন্তু ভেবে দেখলাম তাতে আমার পারপাস সলভ হবে না। ইসলামাবাদকে অনেক ক্ষেত্রে কিছু না জানিয়ে আই এস আই নিজের মত করে কাজ কর্ম করে চলে। সরফরাজের কথাই ধরুন। ও যে কাশেম সোলেমানীর কাছে যাবে, আমার থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতিটুকুর পর্যন্ত প্রয়োজন বোধ করে নি। তাছাড়া যত দিন যাচ্ছে, আমার এ বিশ্বাস তত বেড়ে চলেছে যে, সেদিন আমার গাড়িতে ব্লাস্টের পিছনেও আই এস আইয়ের যথেষ্ট হাত আছে। আমি কি ভুল বলছি মিস্টার শাহরিয়র?”
শাহরিয়র এসির প্রবল ঠান্ডা সত্ত্বেও ঘামছিলেন। কোন মতে বললেন “জি জনাব, সরফরাজের কাজ কর্ম সম্পর্কে আমি খুব বেশি ওয়াকিবহাল ছিলাম না। উনি বহু ক্ষেত্রেই আমাদের অন্ধকারে রেখে অনেক সিদ্ধান্ত নিতেন। তবে আপনার গাড়িতে ব্লাস্টের পেছনে যেই থাকুক, আমরা তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধরতে সক্ষম হব, আমি এই আশা অবশ্যই করি”।
নিয়াজি টিভি থেকে মুখ সরিয়ে কয়েক সেকেন্ড শাহরিয়রের দিকে তাকিয়ে বললেন “ইন্টারেস্টিং। ইউ আর এ গুড ম্যান মিস্টার শাহরিয়র। লাইক আ পোয়েট। আপনি আই এস আইতে কী করছেন?”
শাহরিয়র হাসলেন না। চুপ করে বসে রইলেন।
নিয়াজি বললেন “এই মুহূর্তে পাকিস্তানের হাল সম্পর্কে আমাকে কি কোন ব্যাপারে আপনি অবগত করতে চান মিস্টার শাহরিয়র?”
শাহরিয়র বললেন “বিভিন্ন মিডিয়া হাউজ থেকে পাকিস্তানে ডেমোক্রেসি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সওয়াল করা হচ্ছে। এই নিয়ে বিরূপ জনমতও তৈরী হচ্ছে জনাব”।
নিয়াজি ঠান্ডা গলায় বললেন “সেক্ষেত্রে সেই মিডিয়া হাউজের এডিটরগুলোকে বেঁধে এনে ইন্ডিয়া বর্ডারে ট্যাঙ্কের সামনে ছেড়ে দিন। এত ডেমোক্রাসি দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক। আপনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। মিডিয়া যা চাই, তা দেখাতে পারে না। পৃথিবীর সর্বত্র মিডিয়াকে কন্ট্রোল করা হয়। পাকিস্তান ডাজ নট ডিজারভ ডেমোক্রেসী। এই সাবকন্টিনেন্টের কোন দেশই ডেমোক্রেসী ডিজারভ করে না”।
শাহরিয়র বললেন “ওকে জনাব। আমি ওদের কন্ট্রোল করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি”।
নিয়াজি সামনে রাখা টেবিলে স্কচের গ্লাস তুলে চুমুক দিয়ে বললেন “ফারমান আলী পাকিস্তানে কী করছে জনাব? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া?”
শাহরিয়র চমকে নিয়াজির দিকে তাকালেন। নিয়াজি বললেন “জানি জানি, আমি জানব না তো কে জানবে? এই মুহূর্তে পাকিস্তানের ভাল মন্দ দেখার সব দায়িত্ব যখন আমার তখন তো আমিই দেখব, তাই না? ফারমান আলী পাকিস্তানে কী করছে মিস্টার শাহরিয়র?”
শাহরিয়র বললেন “দে আর প্ল্যানিং সামথিং ভেরি বিগ। সো দে আর প্রিপেয়ারিং”।
নিয়াজি বললেন “প্রিপেয়ারিং? অ্যান্ড হাউ বিগ? এতটাই বিগ যে আমাকে জানাবার প্রয়োজনটুকু মনে পড়ে নি কারো?”
শাহরিয়র মাথা নিচু করে বললেন “সরি জনাব। আমিও সম্প্রতিই জেনেছি। আগে জানলে নিশ্চয়ই জানাতাম আপনাকে। তবে কর্নেল খান হয়ত এই ব্যাপারে আমার থেকে অনেক বেশি জানবেন”।
নিয়াজি চোখ ছোট ছোট করে শাহরিয়রের দিকে তাকিয়ে বললেন “কল হিম। নাও”।
শাহরিয়র বললেন “এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছেন হয়ত”।
নিয়াজি বললেন “ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসুন। আমি ডেকেছি যখন তখন তিনি যে জাহান্নামেই থাকুন, তাকে তো আসতেই হবে মিস্টার শাহরিয়র”।
শাহরিয়র পকেট থেকে ফোন বের করলেন।
৫৭
নথিগুলোর ফটো তোলা হয়ে গেছিল।
মাথুর ইস্তিয়াককে বললেন “এবার আমাদের অনন্তনাগে ফিরে যেতে হবে”।
ইস্তিয়াক বলল “স্যার, আমার ফুপু অনেক কষ্ট করে কিছু খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। না খেয়ে গেলে যে খুব খারাপ হবে”।
মাথুর ইস্তিয়াকের দিকে তাকিয়ে বললেন “কিন্তু আমায় যে এই ডকুমেন্টগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠাতে হবে”।
ইস্তিয়াক বলল “কোন অসুবিধা নেই স্যার। আপনি খেয়ে নিন। আমি যত জোরে সম্ভব বাইক চালিয়ে আপনাকে ক্যাম্পে নিয়ে যাব”।
মাথুর আর না বলতে পারলেন না।
ইস্তিয়াকের ফুপু অনেক কিছু আয়োজন করে ফেলেছিলেন এইটুকু সময়েই। মাথুর খেতে ভালোবাসেন। তবু খাওয়ায় মন বসাতে পারছিলেন না। মোবাইল দেখছিলেন মাঝে মাঝেই। পাঞ্জাবের ম্যাপের মধ্যে অনেকগুলো দাগ দেওয়া আছে। এই দাগের মানে কী?
ফোনে নেটওয়ার্ক ধরছে না। ইসমাইল এ গ্রামে ছিল জানার পরে নেটওয়ার্কে জ্যামার বসানো হয়েছে। নেটওয়ার্ক কখনও থাকে, কখনও থাকে না। মাথুরের অস্থির লাগছিল।
কোনমতে খেয়ে বেরলেন। ইস্তিয়াক বলল “ফুপু খুব খুশি হয়েছে আপনি এসেছেন। এ তল্লাটে তো চিরুণি তল্লাশি করতে আসা ছাড়া ভারতীয় কোন অফিসার কোন দিন আসে নি”।
মাথুর হাসলেন ইস্তিয়াকের ফুপুর দিকে তাকিয়ে।
ইস্তিয়াক বাইক স্টার্ট দিল।
মাথুর বললেন “যে মুহূর্তে নেটওয়ার্ক অ্যাভেলেবল হবে গাড়ি দাঁড় করাবে। আমার মনে হচ্ছে বড় কোন লিড পেয়েছি আমরা”।
ইস্তিয়াক হাসল “আপনি ধরে বসুন স্যার। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাবার চেষ্টা করছি”।
ইস্তিয়াক অ্যাক্সিলেটর জোরে করল। আশে পাশের পাহাড়ি রাস্তা, লিডার নদী, সব মিলিয়ে একটা মায়াবী পরিবেশের মধ্যে দিয়ে বাইকটা যাচ্ছিল। মাথুরের হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল।
খানিকটা যাবার পরেই পাঁচ জন যুবক বাইক আটকাল। ইস্তিয়াক ফিসফিস করে বলল “স্যার, লোকাল ছেলে, কিছু বলবেন না। আমি কথা বলব”।
মাথুর বললেন “ঠিক আছে”।
ছেলেগুলো মাথুরকে পুস্তু ভাষায় একগাদা কথা বলে গেল। প্রত্যুত্তরে ইস্তিয়াকও বলল। মাথুর বসে বসে দেখছিলেন। এদের ভাষা তিনি কিছুই বুঝতে পারছিলেন না।
হঠাৎ একটা ছেলে এগিয়ে এসে ইস্তিয়াককে জোরে একটা ধাক্কা মারল।
মাথুর হৈ হৈ করে উঠলেন, ইস্তিয়াক চেঁচিয়ে উঠল, “স্যার একদম কিছু বলবেন না। ওরা এরকম করেই থাকে। আমি সামলে …”
ইস্তিয়াক কথা শেষ করার আগেই একটা ছেলে ইস্তিয়াককে চোয়ালে জোরে একটা ঘুষি মারল। ইস্তিয়াক হাত তুলে কিছু একটা বলল। মাথুর বুঝলেন পরিস্থিতি হাতের বাইকে যাচ্ছে। তিনি হিন্দিতে বলতে চেষ্টা করলেন “কী করছ তোমরা, ওকে ছেড়ে দাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব”।
ছেলেটা ইস্তিয়াককে ছেড়ে মাথুরের দিকে এগিয়ে এল। ইস্তিয়াক হতাশ গলায় বলল “কী দরকার ছিল স্যার, আমি বুঝছিলাম তো”।
মাথুর পাঁচজনকেই মেপে নিলেন। একজনের হাতে আবার ছুরি আছে।
প্রথমে একটা ছেলে মাথুরকে মারতে এলে মাথুর হালকা একটা রদ্দা মারলেন ছেলেটাকে। ছেলেটা কচি কলাপাতার মত পড়ে গেল।
ইস্তিয়াক সাবাশ দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু এর পরের তিরিশ সেকেন্ড কী হল সেটা সে নিজে না দেখলে কোন দিন বিশ্বাসও করত না। মোটাসোটা চেহারার মাথুর প্রায় চোখের নিমেষে বাকি চারজনকে মাটিতে ফেলে দিলেন। ছেলেগুলো কাতরাচ্ছিল।
ইস্তিয়াক অবাক গলায় বলল “ক্যা বাত স্যার, আমি তো ভাবতেই পারি নি আপনি এত তাড়াতাড়ি…”
মাথুর হালকা গলায় বললেন “অত আনন্দের কিছু নেই। যে চাকরি করি তাতে বরং এগুলো না জানাটাই অস্বাভাবিক। চল এবার আর দেরী করা যাবে না”।
ইস্তিয়াক বাইকের স্পিড তুলল। বলল “চাকরি নেই, কিছু নেই, যত দিন যাচ্ছে, এরকম গ্যাঙের সংখ্যা বাড়ছে স্যার”।
মাথুর কিছু বললেন না। চোয়াল শক্ত করে বসে রইলেন।
অনন্তনাগে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। মাথুর ইস্তিয়াকের কাঁধে হাত রেখে বললেন “থ্যাঙ্কিউ ভেরি মাচ। তুমি না থাকলে…”
ইস্তিয়াক ম্লান হাসল “মনে রাখবেন স্যার, তাহলেই হবে। আমাদের তো কেউ মনে রাখে না, যেন আমরা পথের জঞ্জাল। আপনি মনে রাখবেন শুধু। আর কিছু চাই না”।
.
৫৮
রাত দশটা।
অমৃতসর শহর পেরিয়ে গাড়িটা যাচ্ছে। রাস্তায় বড় বড় ট্রাক যাচ্ছে। আসলাম ধীরে ধীরে ড্রাইভ করছে।
কাদরী বললেন “তোমার সমস্যাটা কী আসলাম?”
আসলাম ঘাবড়ে গিয়ে বলল “জি, কিছু না জনাব”।
কাদরী বললেন “তোমাকে দেখে তো মনে হয় না কোন মিশনে আছো তুমি। দেখে মনে হয় পিকনিক করতে এসেছো। ক্যানাল রোডে ঘুমিয়ে পড়লে দিব্যি। বাড়িওয়ালার মেয়ের সঙ্গে ভাব জমিয়েছো। কী চাও তুমি?”
আসলাম গাড়ির স্পিড বাড়াল। দ্রুত গতিতে একটা ট্রাককে ওভারটেক করে এগিয়ে গেল।
কাদরী ধমকালেন “সাবধানে চালাও। পাকিস্তান থেকে এখানে তোমাকে একগাদা ডলার খরচ করে এমনি এমনি নিয়ে আসা হয় নি”।
আসলাম বলল “সরি জনাব”।
কাদরী কয়েক সেকেন্ড আসলামের দিকে তাকিয়ে বললেন “রাস্তায় সিগারেটের দোকান দেখলে দাঁড়াবে”।
আসলাম মাথা নাড়ল।
কিছুক্ষণ পরে একটা পেট্রোল পাম্পের সামনে গাড়িটা দাঁড়াল। পেট্রোল পাম্প লাগোয়া দোকান আছে। কাদরী আসলামকে বললেন “যাও এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসো”।
আসলাম গাড়ি থেকে নেমে গেল।
কাদরী গাড়ি থেকে নেমে পায়চারি করছিলেন এমন সময় একটা পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল। কাদরী ঘাবড়ালেন না। যেভাবে পায়চারি করছিলেন, সেভাবেই করতে লাগলেন।
পুলিশের টহলদারি জিপ। একজন অফিসার গাড়ি থেকে নেমে দোকানে ঢুকে গেল।
আসলাম সিগারেট নিয়ে পুলিশ দেখে ঘাবড়ে গিয়ে তার দিকে দৌড়তে শুরু করল।
আসলামকে দৌড়তে দেখা মাত্র ভ্যানের বাকি পুলিশরা আসলামকে তাড়া করল। আসলাম সম্পূর্ণ উল্টোদিকে দৌড় মারল।
কাদরী দেরী করলেন না। গাড়িতে চাবি রাখাই ছিল। গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। আসলামের পিছনে দৌড়ে যাওয়া পুলিশেরা হৈ হৈ করে উঠল কিন্তু কাদরী গাড়ি দাঁড় করালেন না। দ্রুত গতিতে গাড়ি চালালেন। খানিকটা গিয়ে গাড়িটা রাস্তার বাঁ দিকে দাঁড় করিয়ে রাস্তা পেরোলেন। একটা ট্রাক আসছিল। হাত দিয়ে দাঁড় করিয়ে বললেন গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। লিফট পেলে ভাল লাগবে।
ট্রাকওয়ালা ভাল লোক। তাকে তুলে নিল।
কাদরী ট্রাকে ড্রাইভারের পাশে বসলেন। খানিকটা যাবার পর দেখা গেল পুলিশের গাড়িটা জোরে বেরিয়ে গেল।
ড্রাইভার বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ল “নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে পাঁজি”।
কাদরী বোকা সাজলেন “কী হয়েছে?”
ড্রাইভার বলল “আরে এটা হাইওয়ে না, বেশিরভাগ ড্রাইভারই তো নেশা করে গাড়ি চালায়। দেখুন কে কাকে ঠুকে দিয়েছে। পুলিশ এখন ধাওয়া করেছে। এই তো চলে এই রাস্তায়”।
ড্রাইভার জোরে হেসে উঠল।
কাদরী বললেন “আপনার কোন হেল্পার নেই”?
ড্রাইভার বলল “আছে তো। পাঠানকোটে ওর বাড়িতে গেছে। কাল সকালেই চলে আসবে। বিকেলে সেই মুম্বই যাব”।
কাদরী অবাক হবার ভান করলেন “মুম্বই?”
ড্রাইভার মাথা নাড়াল “হ্যাঁ সাহেব, কী করব, আমাদের তো এটাই কাজ। এখান ওখান করে বেড়ানো, দিওয়ালির সময়, বৈশাখীর সময়েও যদি ফিরতে না পারি তাহলে এভাবেই কেটে যায়”।
কাদরী বললেন “হ্যাঁ, আপনাদের তো তাও উৎসব আছে, কাশ্মীরিদের তো তাও নেই”।
ড্রাইভার বলল “কেন নেই সাহেব?”
কাদরী বললেন “কিছু না। আমাকে সামনে নামিয়ে দিন। আমার বাড়ি এসে গেছে”।
ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করাল। কাদরী পকেট থেকে একশো টাকা বের করলেন, ড্রাইভার হাঁ হাঁ করে উঠল “কী যে করছেন। কেন লজ্জা দিচ্ছেন। রাস্তায় যাচ্ছিলাম, আপনি এলেন, আপনার থেকে কীভাবে টাকা নিতে পারি। যান যান”।
কাদরী কয়েক সেকেন্ড ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে ট্রাক থেকে নামলেন। ট্রাক বেরিয়ে গেলে পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নাম্বার ডায়াল করলেন। ওপাশ থেকে ভেসে এল “সালাম ওয়ালাইকুম”।
“আসসালাম ওয়ালাইকুম। একটা সমস্যা হয়েছে”।
“কী সমস্যা? ইসমাইলকে নিয়ে কিছু?”
“না, আসলামকে নিয়ে? এই ধরণের লোককে মিশনে ইনভলভ করেছিল কে? এক্কেবারে আকাট”!
“কী হয়েছে বলুন”।
“আসলাম সম্ভবত পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে”।
“ওহ। প্রবলেম নেই। ইন্ডিয়ান জেলে মেহেমানের মত থাকবে। কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে? আমি এখন ডেরায় ফিরে যেতে পারব? কোথায় যাব? আর আসলাম যদি মুখ খোলে?”
“খুলুক না। তার আগে ইসমাইল যা করার করে দেবে”। ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এল।
কাদরী বললেন “আই নিড শেল্টার ফর টুনাইট”।
“অমৃতসর ফিরে যান। ইসমাইলের সঙ্গে থাকুন। বাই। গুডনাইট”।
কাদরী কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে গেল।
কাদরী রেগে মেগে শূন্যে লাথি ছুড়লেন।
কেউ দেখল না। কেবল রাস্তার ধারে একটা কুকুর শুয়েছিল। তাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
.
.
৫৯
.
দুপুরবেলা। করাচীর কুখ্যাত জ্যামের মধ্যে দিয়ে বাসটা শম্বুক গতিতে এগোচ্ছে।
শহরের এক প্রাচীন শিয়া মসজিদে খানিকক্ষণ আগে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে।
বাসে প্রচুর ভিড়। মানুষের চোখে মুখে ভীতির লেশমাত্র দেখল না সায়ক। তারা যেন এসব ব্যাপার নিজেদের ভবিতব্য হিসেবেই ধরে নিয়েছে।
জানলার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল শহরে সেনা গিজগিজ করছে। একটা ছোট ব্যাগের মধ্যে ল্যাপটপটা ভরেছে সে।
ওরাঙ্গি টাউন, মুম্বইয়ের ধারাভি বস্তির মতই এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম বস্তি এলাকা।
সায়ক যখন বাস থেকে নামল দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে।
সন্তর্পণে চারদিক দেখে নিয়ে বস্তির ভেতর হাঁটতে শুরু করল সায়ক। মানুষের দারিদ্র চোখে দেখা যায় না। ছোট ছোট বাচ্চাদের পরণের পোশাকটুকু নেই।
সায়ক মনে মনে হাসল। দু দেশের চিত্র একেবারে এক। তবু মানুষ নয়, অস্ত্রই দু দেশের ফার্স্ট প্রায়োরিটি। দুদেশকে লড়িয়ে দিয়ে প্রথম বিশ্বের দেশগুলো আর ধনী হচ্ছে। আর ধনী হচ্ছে দু দেশের রাজনৈতিক নেতারা। ধর্মের নামে, হিংসার নামে, দ্বেষের নামে নিজেদের মধ্যে হানাহানিটাই যেন মোক্ষ। খানিকটা আনমনা হয়েই হাঁটছিল সায়ক, যার ফলে গন্তব্য ছাড়িয়ে চলে গেছিল।
মনে পড়তে পিছু ফিরল। ছোট একটা ঘুপচি ঘর। ভেতর থেকে আটকানো।
সায়ক দরজা ধাক্কাল।
“কৌণ হে?”
চিৎকার শোনা গেল ঘরের ভিতর থেকে।
সায়ক উত্তর না দিয়ে আবার ধাক্কা দিল।
“আবে কৌন হে বে” বলে দরজা খুলল এক বছর পঞ্চাশের ভদ্রলোক। চুল দাড়িতে মেহেন্দি করা। সায়ককে দেখে হাঁ করে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে চারদিকে তাকাল। সায়ক ঘরের ভিতর ঢুকে ব্যাগটা রেখে মেঝেতে বসে পড়ে বলল “কেমন আছো দিলওয়ার? সব ঠিক তো?”
দিলওয়ার চারদিক তাকিয়ে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে বলল “আপনি করাচীতে? আই এস আই থেকে শুরু করে সবাই আপনাকে পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে আর আপনি করাচীতে বসে কী করছেন?”
সায়ক বলল “বলছি বলছি। আগে পানি তো পিলাও”।
দিলওয়ার ঘরের ভেতর গিয়ে একটা জলের বোতল এনে সায়কের হাতে দিল। সায়ক এক চুমুকে বোতলটা প্রায় অর্ধেক খালি করে দিয়ে বলল “উফ, বাঁচালে। আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করবেন”।
দিলওয়ার ব্যাজার মুখে বলল “সে যে কী রক্ষা করবে তা তো বুঝতেই পারছি। আপনার দেশ আপনাকে অস্বীকার করছে, পাকিস্তানের সর্বত্র আপনাকে দেখা মাত্র গুলির অর্ডার দিয়েছে, আর সে আপনি আমার কাছে চলে এলেন। আমার আর রক্ষা পাওয়া হল না বুঝলেন জনাব?”
সায়ক দিলওয়ারের দিকে তাকিয়ে ফিক ফিক করে হেসে বলল “তোমার বেগম কোথায়?”
দিলওয়ার বলল “পেশোয়ার গেছে। ফুপার ছেলের বিয়ে। আর আমি এখানে পচে মরছি। এখন মনে হচ্ছে চলে গেলেই ভাল হত। প্রাণটা তো বাঁচত!”
সায়ক বলল “ফালতু কথা বোল না। অনেক কাজ। দাঁড়াও”।
সায়ক ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করল।
দিলওয়ার বলল “এটা কার?”
সায়ক হাসল, বলল “আমার এক দোস্তের। ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করতে পারবে?”
দিলওয়ার বলল “আমি কী করে করব? এখানে সম্ভব না”।
সায়ক বলল “র কি তোমাকে এখানে সি বিচে বাদাম বেচার জন্য টাকা দেয় দিলওয়ার? জলদি ব্যবস্থা কর। আর্জেন্ট”।
দিলওয়ার মাথায় হাত দিল “উফ, আমি জানি, আপনি এসেছেন মানে আমার মাথা খারাপ করবেনই। আমার কপালেই আছে। আপনার হাতে পড়লেই আমার হয়ে গেল”।
সায়ক ল্যাপটপ অন করল। পাসওয়ার্ড চাইছে। সায়ক কয়েক সেকেন্ড ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলল “শিট”।
দিলওয়ার বলল “কী হয়েছে?”
সায়ক চোখ বন্ধ করে বলল “দিলওয়ার, টিউলিপ কেমন লাগে তোমার?”
দিলওয়ার বলল “ভাল লাগে। ফুল, খারাপ লাগবে কেন?”
সায়ক বলল “ব্লু টিউলিপ দেখেছ?”
দিলওয়ার বলল “এখানে কী করে দেখব? সে তো পাহাড়ি জায়গার ফুল। চাষ করে অবশ্য এখানে একটা নার্সারি আছে সি বিচের ধারে”।
সায়ক সচকিত হয়ে বলল “কোথায়? কী নাম?”
দিলওয়ার বলল “শুজামল নার্সারি হাউজ। সব রকমের ফুল পাওয়া যায়। অদ্ভুত ব্যাপার, কীভাবে যে এই ওয়েদারে ওরা এই ফুল ফোটায় খোদায় মালুম”।
সায়ক পাসওয়ার্ড দিল “শুজামল”।
নিল না।
হিন্টসে ক্লিক করল। লেখা মিশন। সায়ক চোখ ছোট ছোট করে কয়েক সেকেন্ড ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে টাইপ করল “আফসানা”।
নিল না।
গম্ভীর হয়ে সায়ক ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে রইল। দিলওয়ারকে বলল “আমার মনে একটা পাসওয়ার্ড আছে দিলওয়ার। প্রথম দুবারেই দিতে পারতাম। ভয়ে দি নি। যদি না নেয়, তাহলে আমার হাতে আর কোন তাস থাকবে না। আমি শেষ হয়ে যাব। আল্লাহর কাছে দুয়া কর যেন এটা নেয়। তাহলে আমি তোমায় কাবাব খাওয়াব। ভাল করে দোয়া কর”।
দিলওয়ার বলল “হু হু। করছি। এক পা মাটিতে, এক পা কাফনে আপনার। কী যে বলি”।
সায়ক দিলওয়ারের দিকে তাকিয়ে হেসে কি বোর্ডে ধীরে ধীরে টাইপ করল “ব্লুফ্লাওয়ার।”
তারপর চোখ বন্ধ করে এন্টার মারল।
চোখ খুলে দেখল পাসওয়ার্ড নিয়ে নিয়েছে।
.
৬০
বীরেন নিজের মধ্যেই ছিল না। তার কিছুই বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল সে স্বপ্ন দেখছে।
মা ঘর থেকে বেরোতে বাবা ঠান্ডা গলায় বলল “ফোনটা কর”।
বীরেন বাবার দিকে তাকিয়ে খানিকটা চমকে ফোনটা বের করল, কাঁপা কাঁপা হাতে তুষারের নাম্বার ডায়াল করল। একবার রিং হতেই ধরলেন তুষার “বল বীরেন, কী খবর?”
বীরেন বলল “স্যার, আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। পারলে আজই দিল্লি যেতে চাই”।
তুষার বললেন “তোমাকে তো বাড়ি পাঠানো হয়েছে। তুমি এর মধ্যে আবার দিল্লি আসবে কেন? কী প্রবলেম হল?”
বীরেন বলল “স্যার, ফোনে বলা যাবে না, ফোন ট্যাপ হতে পারে। আমি আজ বিকেলের মধ্যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। সম্ভব স্যার?”
তুষার বললেন “ফাইন, তুমি দিল্লি চলে এসো। আমাদের অফিসেই চলে এসো সরাসরি। তুমি কিন্তু আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলে বীরেন। খুব সিরিয়াস কিছু?”
বীরেন বলল “হ্যাঁ স্যার”।
তুষার বললেন “ওকে। চলে এসো। রাখছি এখন, ইরাবতীর সঙ্গে দেখা করে আসি”।
বীরেন বলল “ওকে স্যার”।
ফোনটা রেখে বীরেন বাবার দিকে তাকাল। বাবা বলল “তোকে হাসান মাকসুদের সঙ্গে আজকে রাতের মধ্যে দেখা করতে হবে। না করলে সবার সমস্যা। বুঝতে পারছিস আমি কী বলছি?”
বীরেন কয়েক সেকেন্ড বাবার দিকে তাকিয়ে থাকল। এতদিনের একটা চেনা লোক এভাবে অচেনা হয়ে গেল? কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না সে।
মা ডাক দিল “খেতে আসবে? আর তো পারি না তোমাদের জ্বালায়, তাড়াতাড়ি এসো”।
বাবা বলল “খেয়ে স্নান করে বেরিয়ে যা। এয়ারপোর্ট পৌঁছে দু নাম্বার গেটের কাছে দাঁড়াবি। টিকিট পেয়ে যাবি। যা ইন্সট্রাকশন ওখানেই কাগজে লেখা থাকবে। বুঝেছিস?”
বীরেন মাথা নাড়ল।
কোন মতে সে ডাইনিং রুমে এল।
মা খাবার বাড়ছে। বীরেন মাকে বলল “আমাকে আজকেই জয়েন করতে যেতে হবে মা”।
মা অবাক গলায় বলল “সেকী! এই তো বললি ছুটিতে এসেছিস?”
বীরেন মাথা নাড়ল “ডাক এসে গেছে”।
মা ক্ষুব্ধ গলায় বলল “এ কেমন চাকরি? এটা কোন চাকরি হল? আমাদেরও কি আমাদের ছেলেকে কাছে পেতে ইচ্ছা করে না?”
বাবা এসে খাবার টেবিলে বসে বলল “চাকরির ব্যাপারে কিছু বলতে নেই। আজকালকার বাজারে অনেক কষ্টে চাকরি জোটে। সেটা নিয়ে বাজে কথা বলতে নেই”।
মা গজগজ করতে লাগল।
বীরেন রোবটের মত খেয়ে যাচ্ছিল। বুল্টি এসে বসল। তাকে দেখে বলল “কীরে দাদা, তুই দিল্লিতে আছিস না এখন? শোন না, আমার জন্য ভাল কুর্তা এনে দিবি চার পাঁচটা?”
স্বাভাবিক কথাবার্তা। বাবাও কেমন স্বাভাবিক ভাবে বসে আছে।
বীরেনের মাথার ভিতরটা শূন্য হয়ে যাচ্ছিল। সব মিথ্যা? সব মিথ্যা? এরকম হতে পারে? কীভাবে হতে পারে? সে আসলে কী? মানুষ না? অমানুষ? কুরবানি করা একটা পশু? তার বাবা তাকে বলি দিতে পারল? বাবা কাকে বলছে আবার সে, বায়োলজিকাল বাবা হলেই কি কেউ বাবা হয়? আসলে সব কিছুর আড়ালে উনি একজন ভয়ানক আততায়ী!
খেতে পারল না বীরেন। উঠে পড়ল।
মা হাঁ হাঁ করে উঠল। বীরেন শুনল না। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে স্নানে ঢুকে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরী হয়ে গেল সে। বাবা ঘরে এসে তার মাথায় হাত দিয়ে বলল “তুই জিতবি। আমি জানি তুই জিতবি। আমার এত বছরের এত পরিশ্রম, দাঁতে দাঁত চিপে শত্রু দেশে পড়ে থাকার মর্ম তুই বুঝবি আমি জানি বীরেন”।
বীরেন বাবার দিকে তাকাল। আর পাঁচটা ভিড়ে মিশে থাকা সাধারন মানুষের মত একটা মানুষ। সে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
টোটো যাচ্ছিল একটা, হাত বাড়িয়ে দাঁড় করাল। টোটোটা খানিকটা এগোতে মুখ ফিরিয়ে দেখল বাবা, মা, বুল্টি তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। একটা সাধারন পরিবারের মত।
.
৬১
রাত আটটা।
ইসলামাবাদ ক্যাপিটাল টেরিটরি।
পিন্সটেক (পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি)
প্রেসিডেন্টের কনভয় সুরক্ষিত জায়গাটার গেটে এসে দাঁড়াল। প্রেসিডেন্টের গাড়ি বাদ দিয়ে বাকি গাড়িগুলো গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে গেল।
গেট থেকে গাড়িটা বেশ খানিকটা রাস্তা গিয়ে একটা বড় বাগানের মত জায়গায় এসে দাঁড়াল। চারদিকে কিছুই নেই, শুধু একটা ছোট ঘর।
প্রেসিডেন্ট নিয়াজি গাড়ি থেকে নেমে খানিকটা হেঁটে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। পিন্সটেক চিফ আহমেদ আলি প্রেসিডেন্টের জন্য অপেক্ষা করছিলেন দরজার সামনেই।
প্রেসিডেন্ট নিয়াজিকে অভিবাদন করে আহমেদ আলি দরজার পাশের বায়োমেট্রিক যন্ত্রে নিজের বুড়ো আঙুল ছোঁয়ালেন। দরজাটা খুলে গেল। একটা লিফট অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দুজন নিরাপত্তারক্ষী লিফটে উঠতে গেলে নিয়াজি তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন “আমি একাই যাব। আপনারা অপেক্ষা করুন”।
লিফটে আহমেদ আলি এবং নিয়াজি প্রবেশ করা মাত্র বাইরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল নিজে থেকে। আহমেদ আলী লিফটের সুইচ টিপলেন। লিফট নিচে নামতে শুরু করল।
লিফটটা একটা বিরাট ল্যাবরেটরির সামনে এসে দাঁড়াল। আহমেদ আলী হাত বাড়িয়ে বললেন “আসুন জনাব”।
প্রেসিডেন্ট নিয়াজি ল্যাবরেটরির ভেতরে প্রবেশ করলেন। যারা কাজ করছিল, তারা সবাই প্রেসিডেন্টকে দেখা মাত্র সতর্ক হল।
নিয়াজি হাত তুলে বললেন “আপনারা আপনাদের কাজ করুন। আমি আলীসাবের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি”।
সবাই তবু তটস্থ হয়ে রইল।
নিয়াজি আলীকে বললেন “আপনার অফিসে চলুন”।
আলী নিয়াজিকে নিজের চেম্বারে নিয়ে গেলেন। ছোট একটা সাধারন ঘর। দেওয়ালে জিন্নাহর ছবি আর পাকিস্তানের পতাকা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।
টেবিল চেয়ার ছাড়াও ঘরের মধ্যে একটা ছোট সোফা আছে। নিয়াজি সেই সোফাতেই বসে পড়লেন।
আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন “কোয়াইট ইম্প্রেসিভ আলীসাহাব। আপনার চেম্বারে বাহুল্যের চিহ্নমাত্র নেই”।
আলী হাসলেন “জনাব, সময় কোথায়?”
নিয়াজী মাথা নাড়লেন, “তা বটে। জিনিয়াসদের কাছে সময় কোথায়? আর আপনি পাকিস্তানের সম্পদ আলীসাহেব। গোটা দেশ আপনার ওপরে নির্ভর করে আছে”।
আলী বললেন “আই অ্যাম ট্রাইং মাই লেভেল বেস্ট স্যার”।
নিয়াজী বললেন “জানি। আমি এই প্রথম পিন্সটেকে এলাম আলীসাহাব। এর আগে একবার ভেবেছিলাম আসব, কিন্তু আসা হয় নি। সেনাবাহিনীর সঙ্গে রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনের সব মানুষের যোগাযোগ থাকে না, যেমন আমার ছিল না”।
আলী হাসলেন “এখন তো আর আপনি শুধু সেনাবাহিনীর নন জনাব। আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট মানে আমাদের সবার প্রেসিডেন্ট। বলুন জনাব, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি”।
নিয়াজী আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন “আলীসাহাব, আমার সঙ্গে আপনার যা কথা হবে তা এই ঘরের বাইরে যাবে না। যদিও আমি জানি, আপনি যে কাজ করেন, তাতে সিক্রেট কিপিংই আসল, তবু আপনাকে একবার নিয়মরক্ষার জন্য বলে রাখলাম”।
আলী মাথা নাড়িয়ে বললেন “জরুর জনাব। বলুন’।
নিয়াজী বললেন “সরফরাজ খান আই এস আই চিফ থাকাকালীন কতবার এখানে এসেছিল জনাব?”
আলী একটু ভেবে নিয়ে বললেন “উনি তো প্রায়ই আসতেন জনাব। আমাদের কাজকর্ম নাকি ওর খুব ভাল লাগত। আমাদের উৎসাহ দিতে প্রায়ই আসতেন তিনি”।
নিয়াজি চোখ ছোট ছোট করে বললেন “একা আসতেন উনি?”
আলী বললেন “অবশ্যই স্যার। পিন্সটেকে আমি অন্য কাউকে ঢুকতে দেবই বা কেন?”
নিয়াজি হাসলেন “রাইট জনাব। আমি জানি আপনি এখানে কাউকে অনধিকার প্রবেশ করতে দেবেন না। আচ্ছা, এই ইন্সটিটিউটে সম্প্রতি কেউ নতুন রিক্রুট হয়েছে?”
আলী বললেন “না জনাব। এখানে রিসেন্টলি আমি কাউকে অ্যালাউ করি নি’।
নিয়াজি চারদিকে তাকিয়ে বললেন “আলীসাহাব, আপনি জানেন পাকিস্তান একটা অদ্ভুত দেশ। একই সঙ্গে আমরা ইন্ডিয়ার এগেইন্সটে লড়ি, আবার ভয়ে থাকি, যাদের সহায়তায় আমরা লড়ছি, তারা যেন আমাদের ওপর সওয়ার না হয়ে পড়ে। বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাইছি?”
আলী মাথা নাড়লেন “শিওর জনাব”।
নিয়াজি বললেন “এই কথাগুলো আমি আপনাকে ডেকেও বলতে পারলাম কিন্তু বললাম না। একজন বিজ্ঞানীকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া আমি কর্তব্য বলে মনে করি। আমি চাই, আপনার ল্যাবের প্রত্যেকের ওপর নজরদারি চালাতে। আপনি আমাদের তাদের ডিটেলস কালকের মধ্যে দিতে পারবেন?”
আলী নিয়াজির দিকে কয়েকসেকেন্ড তাকিয়ে বললেন “আপনি হুকুম করলে আমি দিতে বাধ্য জনাব। আপনি কালকেই সব পেয়ে যাবেন”।
নিয়াজি খুশি হলেন। তবুও উঠলেন না। চুপ করে বসে কী যেন ভাবতে লাগলেন।
৬২
তুষার ইরাবতীকে দেখে হাসপাতাল থেকে ফিরে অফিসে এসে বসেছিলেন। জানলার বাইরে দিল্লির কুখ্যাত কুয়াশা সব কিছু কালো করে রেখেছে। তুষার চিন্তিত মুখে আকাশ দেখছিলেন।
আশরফ দরজা নক করলেন।
তুষার বললেন “কাম ইন”।
আশরফ ভিতরে এলে তুষার ইশারা করলেন আশরফকে বসার জন্য।
আশরফ বসে বললেন “বীরেন ফোন করেছিল আপনাকে? কী বলার আছে বুঝতে পারছি না”।
তুষার হাসলেন “বাচ্চা ছেলে। এভ্রি অ্যাকশন ইজ হ্যাপেনিং হিয়ার, ছেলেটা বাড়িতে বোর হচ্ছে। আসতে চাইছে। আসতে দাও”।
আশরফও হাসলেন “ইয়েস স্যার। হি ইজ অ্যা হার্ড ওয়ার্কিং বয়, কিন্তু ওরা ওকেই কেন টার্গেট করছে বার বার বুঝতে পারছি না”।
তুষার বললেন “নতুন ছেলেদেরই তো ভয় দেখানো সহজ। যাই হোক, পাকিস্তান যেতে হবে আশরফ। নিয়াজি ক্রিকেট সিরিজের জন্য বার বার ইনসিস্ট করছেন। পি এম সিকিউরিটি ইস্যুজ সম্পর্কে রিপোর্ট চাইছেন। উই হ্যাভ টু সেন্ড আ টিম। আমাদের দুজনকেই যেতে হবে”।
আশরফ চিন্তিত মুখে বললেন “কিন্তু স্যার, ইসমাইল দেশে ঢুকে বসে আছে, মাথুর এখনও কন্ট্যাক্ট করে নি। আমরা দুজনে পাকিস্তানে গেলে…”
তুষার দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশরফের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে বললেন “মাথুর কোথায় আছে?”
আশরফ বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় তুষারের ফোন বেজে উঠল। তুষার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বললেন “কোইন্সিডেন্স দেখো খান। মাথুর ইজ কলিং”।
ফোন ধরলেন তুষার। আশরফ আগ্রহী চোখে তুষারের দিকে তাকালেন। তুষার বললেন “হ্যালো মাথুর। তোমার খবর তো পি এম অবধি চলে গেছিল। কোথায় হাওয়া হয়ে গেছিলে?”
মাথুর বললেন “স্যার ওয়াজুরা গেছিলাম। এক লোকাল কাশ্মীরি ছেলের সঙ্গে। ওই গ্রামেই ইসমাইল লুকিয়ে ছিল”।
তুষার সোজা হয়ে বসলেন “গুড গড! দেন?”
মাথুর বললেন “বেশ কিছু কাগজ উদ্ধার করা গেছে। অমৃতসর আর কাশ্মীরের ম্যাপ পেয়েছি। আপনাকে মেইল করেছি এখনই। চেক করুন প্লিজ”।
তুষার আশরফকে বললেন “আমার মেইল চেক কর খান”।
খান উঠে তুষারের ল্যাপটপ নিজের দিকে নিয়ে মেইলবক্স খুললেন।
তুষার বললেন “তোমার ফাইন্ডিংস নিশ্চয়ই কাজে লাগবে মাথুর। কিন্তু তুমি উইদাউট সিকিউরিটি ওয়াজুরা গিয়ে রিস্ক নিয়ে নিয়েছিলে। তুমি কিংবা আশরফ আমাদের ওয়েল নোন মুখ। যাবার আগে অ্যাটলিস্ট আমাকে জানিয়ে যেতে পারতে। ব্যাক আপ রাখা যেত”।
মাথুর বললেন “কিছু করার ছিল না স্যার। এখানে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। এদিকে আর্মি আমার যাতায়াত এমনভাবে কন্ট্রোল করছিল যে আমি ইন্ডিপেন্ডেন্টলি কিছুই করতে পারছিলাম না। মিস্টার অবস্তীও এতটা ওভারকনফিডেন্ট না হলেই ভাল করতেন”।
তুষার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন “ইয়েস। উই হ্যাভ লস্ট আ গুড ফ্রেন্ড। তুমি এখন আর্মি ক্যাম্পে ফিরে গেছ?”
মাথুর বললেন “আমি শ্রীনগর যাব স্যার। আমার একটা ডাউট আছে। ফোনে বলতে পারব না। কিন্তু শ্রীনগর না গিয়ে আমি আপনাকে কিছুই বলতে পারব না”।
তুষার বললেন “ওয়েল! যাও। কিন্তু কীভাবে যাবে? আবার একা?”
মাথুর বললেন “না। আর্মি কনভয় যাবে একটা। ওদের সঙ্গে যাব”।
তুষার বললেন “যাও। হামিদের হেল্প নিও। ওকে ইনভলভ কোর। আর্মি চিফের সঙ্গেও আমি কথা বলে নিচ্ছি। উনি তোমাকে যতটা পারবেন হেল্প করবেন”।
মাথুর বললেন “বাই স্যার। বেঁচে থাকলে দেখা হবে”।
তুষার ধমক দিলেন “আমাদের কাজে এইসব নেগেটিভ কথার কোন জায়গা নেই মাথুর। সব সময় পজিটিভ থাকো। জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী”।
মাথুর হাসলেন “রাইট স্যার। আমরাই জিতব”।
তুষার খুশি হলেন “শিওর। আমরাই জিতব। বাই নাও। শ্রীনগরে পৌঁছে ফোন করবে”।
মাথুর বললেন “বাই স্যার”।
ফোন রেখে তুষার খানের দিকে তাকিয়ে বললেন “কী আছে মেইলে?”
খান প্রিন্ট আউট নিচ্ছিলেন অ্যাটাচমেন্টগুলো। সব কাগজ তুষারের সামনে দিয়ে বললেন “আমার মনে হচ্ছে অমৃতসরে ওদের কোন অ্যাসাইনমেন্ট আছে স্যার। নইলে অমৃতসরের ম্যাপ নিয়ে কী করবে ইসমাইল”?
তুষার চিন্তিত মুখে প্রিন্টআউটগুলো দেখতে দেখতে বললেন “এগুলো দেখে তো কিছু বোঝা সম্ভব না। আচ্ছা আশরফ, অমৃতসর বললে সবার আগে তোমার মনে কী আসে?”
আশরফ বললেন “অপারেশন ব্লু স্টার স্যার”।
কথাটা বলেই আশরফ চমকালেন।
তুষারও।
৬৩
ল্যাপটপে খুলতেই একগাদা এনক্রিপ্টেড ফাইল বেরোল। সায়ক কয়েক সেকেন্ড ঠোঁট কামড়ে সে দিকে তাকিয়ে বলল “দিলওয়ার মিয়াঁ”।
দিলওয়ার ব্যাজার মুখে বসে ছিল। বলল “কী হল?”
সায়ক বলল “কিছু খাওয়াও মিয়াঁ। খালি পেটে মাথা কাজ করে কখনও? কী রান্না করেছ দুপুরে?”
দিলওয়ার উঠল, “বাখরখানি আছে। চলবে?”
সায়ক বলল “দৌড়বে। দাও। পানিও দিও। পানি ছাড়া তোমার ওই শুকনো বাখরখানি আমার বাঙালি গলা দিয়ে নামবে না”।
দিলওয়ার ঘরের ভিতর থেকে একটা বোতলে জল আর দুটো বড় বড় বাখরখানি এনে দিল।
সায়ক ক্ষুধার্তের মত খেল। দিলওয়ার সায়কের খাওয়া দেখে লজ্জিত হয়ে বলল “হায় আল্লা, আপনার তো অনেক খিদে পেয়েছিল। আগে বলবেন তো”।
সায়ক খাওয়া শেষে অনেকটা জল খেয়ে বলল “আমার নিজেরই খাওয়ার কথা মনে ছিল না। ল্যাপটপ খুলে মনে পড়ল। কিন্তু এ তো কঠিন চিজ দিলওয়ার মিয়াঁ। এর ভেতরে কী আছে কিছুই তো বুঝতে পারছি না। এ জিনিস দিল্লি পাঠাতে পারলে ভাল হত”।
দিলওয়ার চমকে উঠল। তারপর ক্যাবলা হেসে বলল “মজাক করছেন মিয়াঁ?”
সায়ক মাথা নাড়ল, “না মিয়াঁ। মজাক করব কেন? সিকিওর লাইনের কী অবস্থা করাচীতে? ফোন করা যাবে?”
দিলওয়ার মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বলল “না না। ক্ষেপেছেন? সব জায়গায় পাকিস্তানি আর্মির কড়া নজর এখন। আমি কোন রিস্ক নিতে পারব না”।
সায়ক ঠান্ডা গলায় বলল “কোথায় যেতে হবে বল না। বাকিটা আমি দেখছি”।
দিলওয়ার কয়েক সেকেন্ড সায়কের দিকে তাকিয়ে বলল “আপনি কিছুতেই কিছু বুঝবেন না, তাই না?”
সায়ক বলল “বুঝব না। কোথায় যেতে হবে বল”।
দিলওয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “নাপিয়ের রোড। কিন্তু সে বাড়িতে পাক আর্মির সন্দেহ আছে। সর্বদা নজর রাখে ওরা। দু বার রেইড হয়েছে, কিছু পায় নি। কোন রকম বেচাল দেখলে কপালে দুঃখ আছে”।
সায়ক বলল “মেক আপ কিট দাও তোমার। আয়নার সামনে বসি। দেখি কতটা চেঞ্জ করতে পারি নিজেকে”।
দিলওয়ার মাথা নেড়ে বলল “আপনি শোধরাবেন না। পাক আর্মির বুলেট না খাওয়া অবধি আপনার শান্তি নেই”।
সায়ক বলল “শান্তি কোথায় আছে দিলওয়ার? সেটার খোঁজেই তো সবাই পাগলের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাক গে, তোমার মেক আপ কিট দাও”।
দিলওয়ার আলমারি খুলে গোপনে লুকিয়ে রাখা একটা বাক্স বের করে সায়কের হাতে দিল। সায়ক বাক্সটা খুলে খুশিতে শিস দিয়ে বলল “জিওহ। এবার আধঘন্টা সময় লাগবে কেবল”।
গুণে গুণে ঠিক তিরিশ মিনিট সময়ই নিল সায়ক। আয়নায় নিজেকে বেশ কয়েকবার দেখে দিলওয়ারকে দেখে বলল “কী হে মিয়াঁ, আমাকে চেনা যাচ্ছে?”
দিলওয়ার সায়কের দিকে তাকিয়ে বলল “আমি কী করে বলব? পাক আর্মি আপনাকে চিনতে না পারলেই হল”।
সায়ক হাসল। কুর্তা পাজামা পড়ল। ল্যাপটপটা ব্যাগে পুরে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দিলওয়ারকে বলল “চলি এখন। রাতে আসব ইনশাল্লাহ”।
দিলওয়ার বলল “সেই আশাই করি। সাবধানে যান”।
সায়ক হেসে দিলওয়ারের ঘর থেকে বেরোল। বাইরে কতগুলো ছেলে ক্রিকেট খেলছিল। সায়ককে দেখে অবাক হয়ে তাকাল। সায়ক সোজা হাঁটতে শুরু করল। বেশ কিছুক্ষণ পরে সে বড় রাস্তায় এসে একটা ট্যাক্সিতে উঠে বলল “নেপিয়ার রোড চল মিয়াঁ”।
ট্যাক্সিওয়ালা কোন কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট করল।
ট্যাক্সি খানিকটা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেনা রাস্তা আটকে রেখেছে। মসজিদে হামলার ঘটনায় শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ মিছিল বেরিয়েছে।
ট্যাক্সিচালক বিরক্ত গলায় বলল “আপনি কি নেমে যাবেন জনাব?”
সায়ক বলল “নাহ, আমি অপেক্ষা করতে রাজি আছি। মিছিল শেষ হোক”।
ট্যাক্সিচালক গান চালাল গাড়ির মিউজিক প্লেয়ারে। বলিউডের গান।
রাস্তায় গাড়ির মিছিল হয়ে গেছে। প্রচন্ড জ্যাম।
সায়ক অপেক্ষা করতে লাগল গাড়ির ভেতরে বসে।
৬৪
রাত ১২টা।
একটা মেশিনগান নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল ইসমাইল। পাঠান দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করছিল।
ইসমাইল বলল “ধর্মস্থানের মত ভাল টার্গেট আর কিছু হতে পারে না জনাব। পেশোয়ারে একটা মসজিদে একবার ব্লাস্ট করেছিলাম। আহ, দারুণ লেগেছিল। আল্লাহর ঘর থেকেই আল্লাহর খাস বান্দা হবার দিকে সব রওনা হল”।
পাঠান হেসে বলল “শিখরা খুব ধর্মপ্রাণ হয়। একজন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ওরা মেরে দিয়েছিল শুধু মাত্র হরমন্দির সাহিবে সেনা পাঠানোর অপরাধে। এখানে ওরা নিজেদের দেশ বানিয়ে রয়েছে। নিজেদের সেনা, নিজেদের সব কিছু। একটা ভাল অ্যাটাক ইন্ডিয়া কাঁপিয়ে দেবে মিয়াঁ”।
ইসমাইল মাথা নাড়তে নাড়তে বলল “জানি। নীল ফুলের প্রথম পাপড়ি নীল তারাই হবে। এই মিশনে আল্লাহর পায়ের কাছে বসে খাস সেবা প্রথমে আমিই করব”।
পাঠান সেলাম দিয়ে বলল “ইনশাল্লাহ। নিশ্চয়ই হবে। পার্টিশান মিউজিয়াম বানিয়েছে ইন্ডিয়া”।
ইসমাইলের চোখ জ্বলে উঠল, “তাই নাকি? তা কী কী আছে সেখানে?”
পাঠান বলল “দেশভাগের সময়ের ছবি আছে। আগে ছিল না। এলাকাটাও আগে খুব একটা ভাল ছিল না। ঘিঞ্জি ছিল। আমি যখন আগে এসেছিলাম অনেক নোংরা ছিল। এখানকার গভর্নমেন্ট ঢেলে সাজিয়েছে। মজা আজায়েগা আপকো। তবে সারভাইভ করার চেষ্টা করবেন যতক্ষণ পারেন। যত বেশি বাঁচবেন, দুশমন তত বেশি মরবে”।
ইসমাইল হাসল না। কঠিন মুখে বলল “অমৃতসরে আমাদের পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল। পার্টিশনের সময় আমার দাদিজানকে এই শিখরা গলা কেটে খুন করেছিল। এই মিশনে আমার এক সঙ্গে দুটো কাজ হবে। এদেরই কোন পূর্বপুরুষেরা আমার দাদিকে মেরেছিল। প্রতিশোধ নেওয়া হবে, একই সঙ্গে আল্লাহর কাজও করা হবে”।
পাঠান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার ফোন বেজে উঠল। পাঠান ফোন ধরল। কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর ফোন রাখল।
ইসমাইল উৎসুক হয়ে বলল “কী ব্যাপার মিয়াঁ? কী হয়েছে? এত উত্তেজিত হয়ে গেলে কেন?”
পাঠান হতাশ গলায় বলল “মিশন পোস্টপন করতে বলা হয়েছে। রাত দশটা থেকে অমৃতসর সিটি ঘিরে ফেলেছে ইন্ডিয়ান আর্মি। ওদের ইন্টেলিজেন্সের কাছে সম্ভবত আমাদের মিশনের খবর পৌঁছে গেছে”।
ইসমাইল কয়েক সেকেন্ড পাঠানের দিকে তাকিয়ে রইল। হাতের মেশিনগানটা ছুঁড়ে মারল দেওয়ালে। দু হাতে চোখ ঢেকে কয়েক সেকেন্ড বসে থেকে বলল “এই দেশের প্রত্যেকটা কাফেরকে একদিন আমি নিজের হাতে কুকুরের মত গুলি করে মারব, যেমন করে রেহান খানকে মেরেছিলাম। একটা কুত্তাকেও ছাড়ব না। সব ক’টাকে মারব। কুকুরের মত গুলি করে। কথা দিলাম”।
পাঠান বলল “সে তো ঠিক আছে মিয়াঁ, কিন্তু সমস্যা হল এবার আপনাকে কয়েক দিন এখানেই গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। শহর ছেড়ে বেরনোর সব রাস্তাতেই ওরা নাকাবন্দী করে তল্লাশি করবে। আমাদের এখন অপেক্ষা করা ছাড়া কোন রাস্তাও তো নেই”।
ইসমাইল ক্রুর চোখে পাঠানের দিকে তাকিয়ে বলল “সমস্যা তো শহর ছাড়তে হলে হবে। শহরের ভেতরে ঢুকে কিছু করলে তো হবে না মিয়াঁ। ভাল হয়েছে তো ইন্ডিয়ান আর্মি শহর ঘিরে রেখেছে। আমার তো ভালই হল। এবার আমি ওদের মেরে মরব। মজা তো অব আয়েগা”!
পাঠান মাথা নাড়ল “না জনাব। মৌলবী সাব কড়া ভাষায় আপনাকে কোন রকম নাড়া চাড়া করতে বারণ করেছেন। পরিষ্কার বলে দিয়েছেন আপনি যেন চুপ করে থাকেন এখন। আপনি চাইলে আপনাকে ফোনে কথা বলিয়ে দিতে পারি”।
ইসমাইল গুম হয়ে রইল কিছুক্ষণ। পায়ের কাছে একটা ছোট টুল ছিল। সেটাকে লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিয়ে অপ্রশস্ত জায়গার মধ্যে দিয়ে পায়চারি করতে করতে বলল “ইন্ডিয়ান আর্মির ভয়ে ইসমাইল চুপ করে বসে থাকবে। আমাকে কি ডরপোক বলে মনে হয় মিয়াঁ?”
পাঠান বলল “একেবারেই না মিয়াঁ। কিন্তু আপনি আল্লাহর খাস বান্দা। আল্লাহপাক যদি আপনার কুরবানীর সময়কে নিজে থেকেই পরিবর্তন করতে চান, তাহলে তো আপনাকে মেনে নিতে হবে। ওর কথার ওপরে কি আর কোন কথা হয়?”
ইসমাইল হতাশ হয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। বলল “ফোন করে আমাকে দাও। আমি কথা বলি”।
পাঠান বলল “এখান থেকে বার বার পাকিস্তানে ফোন করা ঝুঁকির কাজ। ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্সের কাছে খবর বেরিয়ে গেছে মানে ওরা ফোনে নজর রাখবে”।
ইসমাইল অবিশ্বাসী চোখে পাঠানের দিকে তাকিয়ে বলল “সত্যিই ফোন এসেছিল তো? নাকি আমাকে বুদ্ধু বানাচ্ছ?”
পাঠান বলল “আপনাকে বুদ্ধু বানাব কেন মিয়াঁ? আমার কী স্বার্থ? আপনার মত আমিও তো ইন্ডিয়ার বরবাদি দেখতে চাই। কিন্তু যদি মৌলবী সাহেব বললে সত্যিই কি কিছু করার থাকে?”
ইসমাইল গম্ভীর গলায় বলল “আমার ডাক এসে গেছে। মৌলবির হুকুমে তার আর পরিবর্তন হবে না। যথেষ্ট আর ডি এক্স আছে। যথেষ্ট আর্মস, বারুদ, সব আছে। আমি আর কারো কথা শুনব না। কালকে ভোরেই বেরোব আগের প্ল্যান মত। গাড়ির ব্যবস্থা করুন মিয়াঁ”।
.
৬৫
বীরেনের ফ্লাইট দিল্লি এয়ারপোর্টের মাটি ছুঁল যখন, তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। প্লেন থামল, সবাই নেমে গেল, বীরেন অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিল। এক এয়ারহোস্টেস এসে তাকে ডাকলে সে চমকে উঠে দাঁড়াল।
প্লেন থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোল সে। দিল্লিতে গরম পড়ছে। বীরেন রুমাল বের করে ঘাম মুছল। ট্যাক্সিতে উঠে তার মনে পড়ে গেল ইতিহাসের স্যার পড়াতেন দিল্লির মসনদের জন্য কত লড়াইই না হয়েছে। কত মানুষ খুনোখুনি করেছে, ভাই ভাইকে মেরেছে, ছেলে বাবাকে অন্ধকূপে পাঠিয়েছে, মানুষ নিমেষের মধ্যে পশুতে পরিণত হয়েছে।
এই দেশ স্বাধীন হবার জন্যও কি কম সংগ্রাম করতে হয়েছে? ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, রাসবিহারী বসু, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ভগত সিং সহ কত মানুষ নিজেদের জীবনের সর্বস্বটুকু দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করার জন্য লড়াই করেছিলেন। স্যার বলতেন সূর্য সেনকে ফাঁসি দেওয়ার আগে এত মারা হয়েছিল যে তার মুখ কেউ দেখলে চিনতে পারত না। অকথ্য অত্যাচার করে খুন করে মাস্টারদার দেহ সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
কত ভাল বাড়ি, কত ভাল চাকরি ছেড়ে একেকজন মানুষ দেশের জন্য নিজের সব দিয়ে দিয়েছিলেন।
তার বাবা…
একজন দেশদ্রোহী? সন্ত্রাসবাদী? আর সে কিনা একজন বলিপ্রদত্ত সৈনিক?
বীরেন ট্যাক্সির মধ্যে দুহাতে মুখ ঢেকে বসল।
তার মিনির কথা মনে পড়ে গেল। বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে ওর ওপর কী অত্যাচারটাই না করা হয়েছিল? তার বাবা, তার সব থেকে প্রিয় মানুষ, সে দলের একজন, সন্ত্রাসবাদী? জ্যোতির্ময়ের মতই স্লিপিং সেলের মেম্বার?
ভাবতে পারছিল না সে। মাথা কাজ করছিল না তার। কী প্ল্যান করছে ওঁরা? জ্যোতির্ময়কে ফোনটা দিতে চাইছে কেন? কী আছে ফোনের মধ্যে?
তাকে খানিকটা চমকে দিয়েই ফোনটা বেজে উঠল। সে দেখল তুষার ফোন করছেন। ধরল সে “হ্যাঁ স্যার”।
“তুমি পৌঁছে গেছো বীরেন?” তুষারের গলা ভেসে এল।
বীরেন বলল “হ্যাঁ স্যার”।
তুষার বললেন “তোমার সঙ্গে আমার দেখা হওয়াটা একটু পিছোবে বীরেন”।
বীরেন অবাক হয়ে বলল “কেন স্যার?”
তুষার বললেন “তুমি যেখানে আছো, সেখানেই থাকো। আশরফের সঙ্গে তোমার লোকেশন শেয়ার কর। ও একটা জরুরি মিশনে অমৃতসর যাচ্ছে। আমি চাই তুমি যখন এসেই পড়েছো তখন ওকে অ্যাসিস্ট কর। ওর সঙ্গে অমৃতসর যাও। একবার তো ওঁকে কাশ্মীরে বাঁচিয়েছো তুমি, তুমি হলে খানের লাকি ম্যাসকট, বুঝলে?”
তুষার হাসলেন ফোনের ওপ্রান্তে।
বীরেন বলল “কিন্তু স্যার…”
তুষার বললেন “কিছু কিন্তু না। ঘুরে এসো, তারপর না হয় কথা হবে। ডোন্ট ফরগেট টু শেয়ার ইওর লোকেশন। খান আসছে তোমায় পিক করতে”।
বীরেন হতভম্ব হয়ে ফোনটা রেখে দিল। খানিকটা অবাক হল, একই সঙ্গে ভয়ও পেল।
বাবা তো তাকে হাসানের সঙ্গে দেখা করতে বলেছিল।
সে বেশি কিছু না ভেবে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে বাবাকে ফোন করল।
ও প্রান্তে একবার রিং হতেই বাবা ধরল “বল। পৌছেছিস?”
বীরেন বলল “পৌঁছতে পারি নি, আমাকে অমৃতসর পাঠানো হচ্ছে। স্যার বললেন ফিরে এসে কথা বলবেন”।
ও প্রান্তে খানিকটা নীরবতা। বীরেন নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছিল।
কয়েক সেকেন্ড পর বাবা বলল “অমৃতসরে কী করতে পাঠাচ্ছে?”
বীরেন বলল “জানি না, আমাকে বলল যেতে হবে। কী করব, কাজটাই এরকম”।
বাবা বলল “তুই কোন রকম চালাকির চেষ্টা করছিস না তো?”
বীরেন অবাক হল। বাবা তাকে অবিশ্বাস করছে। তার নিজের বাবা!
সে কোন মতে বলল “না। আমি তো আমাদের অফিসের দিকেই যাচ্ছিলাম। চাইলে আমার লোকেশন পাঠাচ্ছি, দেখে নাও”।
বাবা আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল “ঠিক আছে। যাই হবে, সব ইনপুট আমার কাছে পৌঁছনো চাই। হাসানকে দেওয়ার জন্য যে ফোনটা নিয়ে গেছিস সেটা রাস্তার কোন ডাস্টবিনে ফেলে দে। তুই ফিরে এলে আবার একটা ফোন তোকে দেওয়া হবে”।
বীরেন অবাক গলায় বলল “ফেলে দেব?”
বাবা বলল “ফেলে দে। রাখলাম। ওরা যা বলছে তাই কর। শুধু রিপোর্টটা করে যাবি”।
ফোন কেটে দিল বাবা।
বীরেন ফ্যাল ফ্যাল চোখে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে রইল।
.
৬৬
ইসলামাবাদে আই এস আই হেড কোয়ার্টারের সামনে প্রেসিডেন্টের গাড়ি দাঁড়াল।
আগে থেকে খবর দেওয়া ছিল না। পিন্সটেক থেকে বেরিয়ে নিয়াজি সরাসরি চলে গেছেন।
প্রেসিডেন্টের সিকিউরিটি সার্ভিসকে দেখা মাত্র দরজা খুলে গেল। প্রেসিডেন্ট নিয়াজি গাড়ি থেকে বেরিয়ে হেড কোয়ার্টারসে প্রবেশ করলেন। বেশ কয়েকজন উচ্চ পদস্থ অফিসার ছিলেন। নিয়াজিকে দেখামাত্র স্যালুট করলেন সবাই।
নিয়াজি তাদের বললেন “চিফ রুমে আছেন?” তারা সমস্বরে হ্যাঁ বললেন। নিয়াজি আর কোন দিকে না তাকিয়ে আই এস আই চিফের রুমের দিকে এগোলেন। নিয়াজি এসেছেন, মুস্তাকিনের কাছে খবর চলে গেছিল। ব্যস্তসমস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। নিয়াজি তাকে বললেন “আপনার চেম্বারে চলুন। বাকিরা বাইরে থাক”।
মুস্তাকিন তটস্থ হয়ে নিয়াজিকে নিয়ে নিজের চেম্বারে প্রবেশ করলেন।
বেশ বড় চেম্বার। দুজন মহিলা কম্পিউটারে কাজ করছিলেন। মুস্তাকিন তাদের ঘরের বাইরে যেতে বললে তারা বেরিয়ে গেলেন।
নিয়াজি সোফায় বসে বললেন “মিস্টার শাহরিয়র”।
মুস্তাকিন বললেন “জি জনাব”।
নিয়াজি বললেন “আপনি বালোচ রেজিমেন্টে ছিলেন?”
মুস্তাকিন মাথা নাড়লেন “জি জনাব”।
নিয়াজি বললেন “ক্যানাডিয়ান ফোরসেস এন্ড স্টাফ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করে ইসলামাবাদে জয়েন করেছিলেন ১৯৮০ সালে। ঠিক বলছি?”
মুস্তাকিন হেসে বললেন “জনাব সব খবর রাখেন আমার”।
নিয়াজি বললেন “রাখতেই হবে। দেশের যা অবস্থা। যাই হোক, ইন্ডিয়ান চরটির কী খবর? কিছু উগরেছে?”
মুস্তাকিন হতাশ গলায় মাথা দুপাশে নাড়িয়ে বললেন “না জনাব”।
নিয়াজি বললেন “স্বাভাবিক। এদের থেকে কিছু বের করা যায় না। নেক্সট জুম্মায় কুরবানী করব ভাবলাম, কিন্তু এখন ইন্ডিয়ান রিপ্রেজেন্টেটিভস আসবে। সিরিজটা শুরু হোক, সিরিজ চলাকালীন কুরবানীটা হবে। ওদের পলিটিক্যালি কোণঠাসা করা যাবে”।
মুস্তাকিন মাথা নাড়লেন, “জি জনাব”।
নিয়াজি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন “অপারেশন ব্লু ফ্লাওয়ার সম্পর্কে আপনি কী জানেন মিস্টার শাহরিয়র?”
মুস্তাকিন বললেন “জনাব, আপনি তো দেখলেন সেদিন কর্নেল খানও ব্লু ফ্লাওয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলতে পারল না। তবে আমাদের এক মেজর আজকেই আমাকে ব্লু ফ্লাওয়ার সম্পর্কে কিছু তথ্য দিলেন”।
নিয়াজি বললেন “কে সে? ডাকুন তাকে”।
মুস্তাকিন উঠে গিয়ে চেম্বারের বাইরে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে এক যুবককে নিয়ে ভিতরে এলেন।
যুবক নিয়াজিকে সেলাম করে বলল “আফতাব খান জনাব”।
নিয়াজি বললেন “অপারেশন ব্লু ফ্লাওয়ার সম্পর্কে আপনি মিস্টার শাহরিয়রকে কী বলছিলেন আফতাব?”
আফতাব বলল “জনাব সরফরাজ খান মাঝে মাঝেই শহরের বাইরে যেতেন জনাব। আপনি তখনও প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। তার কাছে আমি এক আধবার এই টার্মসটা শুনেছিলাম”।
নিয়াজি সোজা হয়ে বসে বললেন “আমার সিক্সথ সেন্স বলছে মিডল ইস্ট থেকে আই এস আই এস আফগানিস্থান হয়ে পাকিস্তানে ঢুকতে চাইছে এবং তাদের হেল্প করত সরফরাজ। অ্যাম আই রাইট”?
আফতাব খানিকটা সংকুচিত হয়ে বলল “সে ব্যাপারে আমার কাছে ডিটেলস কোন প্রমাণ নেই জনাব”।
নিয়াজি বললেন “আমার গাড়িতে কারা বোম রেখেছিল সে সম্পর্কে আপনার কোন আইডিয়া আছে?”
আফতাব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
নিয়াজি বললেন “আপনি যেতে পারেন”।
আফতাব যেন পালিয়ে বাঁচল।
নিয়াজি বললেন “আফসানা সাইদের জিনিসপত্র কাদের কাস্টোডিতে আছে”?
মুস্তাকিন বললেন “আমাদের। ওমর শেখেরও আছে”।
নিয়াজি বললেন “ইসমাইল এই মুহূর্তে কোথায় আছে জানেন?”
মুস্তাকিন মাথা নাড়লেন।
নিয়াজি বললেন “লস্কর চিফের সঙ্গে গত তিন দিন ধরে কোন রকম যোগাযোগ করতে পারছি না। মুজফফরাবাদের গভর্নর লন্ডন গিয়ে বসে আছেন। ফারমান আলীকে দিয়ে পাকিস্তান আর্মির একাংশ আর্মস ইমপোর্ট করছে এবং তার কোন রকম সুলুক সন্ধান আমাদের হাইয়ার অফিশিয়ালদের কাছে নেই। আপনার কাছে নেই। আজকেও করাচীতে মসজিদে ব্লাস্ট হয়েছে। এরকম চললে তো দেশ চালানো কঠিন হয়ে যাবে মিস্টার শাহরিয়র। আপনি বলুন আপনি পারছেন না, আমি যোগ্যতর কাউকে আপনার পোস্টে আনব। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু লুজ এনি ফারদার ব্যাটল এগেইন্সট এনি অফ আওয়ার রাইভালস। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?”
মুস্তাকিন বললেন “জি জনাব”।
নিয়াজি উঠলেন “ফারমান আলী আর লস্করের কাশ্মীর অপারেশন সম্পর্কে কাল সকাল দশটার মধ্যে আপনি আমাকে রিপোর্ট করছেন মিস্টার শাহরিয়র। আমি আর কিছু শুনতে চাই না”।
মুস্তাকিন ঘাবড়ে গিয়ে বললেন “এত তাড়াতাড়ি জনাব”?
নিয়াজি বললেন “হ্যাঁ, এত তাড়াতাড়িই। দরকার হলে আপনার ডিপার্টমেন্ট সারারাত জাগবে। এনি প্রবলেম?”
মুস্তাকিন জোরে জোরে মাথা নাড়লেন “নো জনাব”।
নিয়াজি কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মুস্তাকিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাম মুছলেন কপালের।
.
৬৭
আশরফ খানের আসতে বেশিক্ষণ লাগল না। বীরেন লোকেশন শেয়ার করে দিয়েছিল। খান তাকে দেখে খুশিতে হাত নাড়লেন।
বীরেন গাড়িতে উঠলে বললেন “তুষার স্যার তোমায় খুব পছন্দ করছেন দেখছি। ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসতেই অ্যাসাইনমেন্টে পাঠিয়ে দিলেন। অবশ্য ছুটি টার্মটা ইউজ করা ঠিক হবে না। তোমার ওপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে এখন। পাড়ায় যে খুনটা হয়েছিল কোন কিনারা হয়েছে?”
বীরেন মাথা নাড়ল।
খান চিন্তিত মুখে বললেন “ওরা খুবই অরগানাইজড। ওদের ধরতে যাওয়া এখন অনেকটা ডিফেন্স খালি রেখে গোল করতে যাওয়ার মত হচ্ছে। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই”।
বীরেন বলল “আমরা এখন অমৃতসর যাচ্ছি?”
খান বললেন “হ্যাঁ। খুব ভয়ংকর একজনের মুখোমুখি হতে। জানি না মুখোমুখি হবার সুযোগ পাব নাকি”।
বীরেন বলল “মানে?”
খান বললেন “রেহানকে খুন করেছিল ইসমাইল। কাশ্মীর দিয়ে ঢুকে এখন খুব সম্ভবত অমৃতসরে বড় কিছু করার প্ল্যান করছে”।
বীরেন চমকে উঠল “বড় কিছু?”
খান হাসলেন “হ্যাঁ, যদি মানুষ মারাকে বড় কিছু বল তো অবশ্যই বড় কিছু। জানি না, কোন স্কেলে ওরা এগোচ্ছে, কিন্তু মাথুরের দেওয়া সোর্স থেকে যা বোঝা গেছে তা হল ও অমৃতসরে আছে। আর অমৃতসর মানে একটাই জায়গা হয়। স্বর্ণমন্দির। লাখ লাখ লোক আসে প্রতিদিন। সেখানে কোন রকম টেনশন তৈরী হলে গোটা দেশে আগুন জ্বলবে। মুজফফরাবাদে মাথাটা আছে, আর প্ল্যান এক্সিকিউট হচ্ছে এখানে। ঠিক কোন চুলোয় ইসমাইল আছে আর এত বড় ঘিঞ্জি শহরে কোথায় কী করছে সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের বের করতে হবে”।
বীরেনের ঠান্ডা লাগছিল হঠাৎ করে। সে আসলে ইসমাইলদের মত খুনীদের দলের লোক?
এরা কী করতে চাইছে? একটার পর একটা ব্লাস্ট? জ্যোতির্ময়ের সঙ্গে দেখা হবার পরের দিনগুলো মনে পড়ে গেল বীরেনের। দিল্লি পৌঁছে টিভিতে কাশ্মীরে ব্লাস্ট দেখার কথাটা এখনও দুঃস্বপ্নে আসে তার। একগাদা নিরস্ত্র নিরীহ লোককে মেরে ঠিক কোন উদ্দেশ্য সফল হয় এই লোকগুলোর?
সে একজন রাজাকারের ছেলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধর সময়ে যারা পাকিস্তানকে সাহায্য করেছিল, নিজের দেশের মহিলাদের ধর্ষণ, পুরুষ, শিশুদের খুন করতে সাহায্য করেছিল, তাদের রাজাকার বলা হয়। গোটা দেশের মানুষ এদের ঘেন্না করে। এরা ভেবেছিল পাকিস্তান ঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের হারিয়ে দেবে। ধর্মের ভিত্তিতে তৈরী হওয়া দেশে ধর্মের ভিতই মজবুত হবে। লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষদের মারতে সাহায্য করেছিল এই লোকগুলো। কিন্তু ধর্মের নামে অধর্মের পরিবেশে ধর্মের কলই শেষমেশ নড়েছিল। ভারতীয় সেনার সাহায্যে পাকিস্তানকে গোহারান হারিয়ে দেশ ছাড়া করে স্বাধীনতা পেয়েছিল বাংলাদেশ। রাজাকারেরা কেউ মুক্তিবাহিনীর হাতে খুন হয়েছিল, কেউ পাকিস্তানে পালিয়ে গেছিল, কেউ বা দেশেই অন্য প্রান্তে গিয়ে নাম ভাড়িয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছিল। ভাষার অধিকারে দেশ তৈরীতে বাংলাদেশের নাম পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তার বাবা বাংলাদেশ বিরোধী, সভ্যতা বিরোধী, মানবতা বিরোধী একজন মানুষ। সে এমন বাবার ছেলে। বীরেন চোখ বুজল। কী অপরাধ করেছিল সে? ভালই তো চলছিল সব কিছু। এত বড় দুঃস্বপ্ন অপেক্ষা করছিল তার জন্য?
এয়ারপোর্ট এসে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই।
তাকে নিয়ে সেনার হেলিকপ্টারে উঠলেন আশরফ। আকাশ থেকে রাতের দিল্লি শহর মায়াবী লাগছিল।
খান বীরেনকে বললেন “মাঝে মাঝে মনে হয়, চাকরি বাকরি ছেড়ে বাড়ি গিয়ে পানের দোকান দি বীরেন। এত টেনশন, এত চাপ, নিজের পরিবারের ওপরেও সব সময় শত্রুদের নজর। যখন তখন যা খুশি হয়ে যেতে পারে। তারপর যখন এই মিশনগুলোতে যাই, তখন কেন জানি না, অদ্ভুত একটা গর্ব হয়। আমাদের জব প্রোফাইলটা সব থেকে প্রেস্টিজিয়াস বীরেন। প্রাউড টু বি আ পার্ট অফ দিস জব”।
বীরেন ম্লান হাসল। খানের কথাটা অনেকটা নাড়া দিল তাকে।
কিছুক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে খান ট্যাব বের করে মাথুরের পাঠানো নথিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল।
বীরেন চোখ বন্ধ করল। স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। আশরফ খানের প্রাণ বাঁচিয়েছিল সে। সেই ঘটনার পর থেকে তার গুরুত্ব বেড়েছে। আশরফ খান, তুষার রঙ্গনাথন, প্রত্যেকেই তাকে আলাদা চোখে দেখেন। স্নেহ করেন।
এটাও কি প্ল্যান করেই করা হয়েছিল? আশরফ খানকে ওরা খুন না করে ইচ্ছা করে আহত করেছিল যাতে সে খানকে বাঁচিয়ে সবার বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠে?
বীরেনের মাথা ঘুরে উঠল হঠাৎ করে। ঠিক কতটা গোড়া থেকে প্ল্যানটা করা হয়েছিল?
.
৬৮
পাকিস্তানি সময় রাত সাড়ে এগারোটা (ভারতীয় সময় রাত বারোটা)।
প্রেসিডেন্ট হাউজের টিভি রুমে বসে স্কচের গ্লাস হাতে বসে আছেন প্রেসিডেন্ট নিয়াজি।
তার পাশে খাস খানসামা জাকির দাঁড়িয়ে আছে ত্রস্ত ভঙ্গিতে।
নিয়াজি টিভিতে খেলা দেখতে দেখতে জাকিরকে বললেন “ক্রিকেট দেখো জাকির?”
জাকির বলল “হ্যাঁ জনাব। সময় পেলে দেখি’।
নিয়াজি বললেন “কাকে ভাল লাগে?”
জাকির বলল “জি জনাব, আমি রাওয়ালপিন্ডির মানুষ, আমার শোয়েব আখতারকে ভাল লাগত। এছাড়াও ইজাজ আহমেদ, ইনজি ভাইজান, আমির সোহেলের খেলাও ভাল লাগত”।
নিয়াজি বললেন “জাভেদ মিয়াদাদের খেলা ভালো লাগত না? সেই লাস্ট বলে ছয় মেরে জেতানো, ভুলে গেলে?”
জাকিরের মুখে হাসি ফুটল, “জি জনাব। কী করে ভুলি?” নিয়াজি মাথা নাড়লেন “সব দেশের সঙ্গে জেতায় এক আনন্দ, ইন্ডিয়ার সঙ্গে জিততে পারলে আরেক রকম আনন্দ, কী বল জাকির?”
জাকির বলল “জরুর জনাব। ইন্ডিয়াকে হারানোর মজাই আলাদা। তবে ইন্ডিয়াতেও ভাল ভাল প্লেয়ার ছিল। শচীন টেন্ডুলকারের ব্যাটিং দেখেছিলাম জনাব রাওয়ালপিন্ডিতে”।
জাকির উৎসাহিত হয়ে বলতে গিয়ে চুপ করে গেল।
নিয়াজি মাথা নাড়লেন “বল বল। আমি রাগব না। গ্রেটের সম্মান দিতে জানতে হয়। তা সে যে দেশেরই হোক না কেন! তবে আমাদের সাইদ আনোয়ারকে ইন্ডিয়া কিছুতেই আউট করতে পারত না সেটা ভুললেও চলবে না। হি ওয়াজ অলসো এ গ্রেট ব্যাটসম্যান। ইন্ডিয়ার সামনে পড়লেই আনোয়ার বাঘের বাচ্চা হয়ে যেত”।
নিয়াজির গ্লাস খালি হয়ে গিয়েছিল। জাকির বলল “জনাব, আর দেব?”
নিয়াজি বললেন “হ্যাঁ। দাও। আমার ঘুম আসছে না আজকে। সিক্সথ সেন্স কাকে বলে বোঝ জাকির?”
জাকির নিয়াজির পেগ তৈরী করতে করতে বলল “জি জনাব”।
নিয়াজি গ্লাস হাতে নিয়ে চিন্তিত মুখে চুমুক দিতে লাগলেন।
জাকির কোন কথা বলল না। তার প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছিল সাহেব কেন সিক্সথ সেন্সের কথা বললেন কিন্তু সে প্রশ্নটা করল না। সে তার সীমানা জানে। ঠিক কোন জায়গাটায় গিয়ে থেমে যেতে হয় সেটা এত বছর এই হাউজে থেকে তার থেকে ভাল কেউ জানে না।
প্রেসিডেন্ট নিয়াজি অস্থির হাতে রিমোট কন্ট্রোলে চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে বললেন “বর্ডারে থাকাকালীন শত্রুপক্ষ যখন অতর্কিতে আমাদের চার্জ করত, তখন অতটা ভয় কখনই লাগে নি। ইউ নো দেম, দে নো ইউ। কোথাও কোন অসুবিধা নেই। সমস্যা নেই। তোমরা জানো কী হতে পারে, কী হতে চলেছে। বি অলওয়েজ প্রিপেয়ারড। পাকিস্তানী আর্মি কেন, পৃথিবীতে যুযুধান সমস্ত দেশের আর্মির মূল মন্ত্র এটাই। কিন্তু সমস্যাটা কোথায় জানো জাকির?”
জাকির জিজ্ঞাসু চোখে প্রেসিডেন্টের দিকে তাকাল। কিন্তু এবারেও কোন প্রশ্ন করল না।
প্রেসিডেন্ট বললেন “সমস্যাটা হল যখন শত্রু বন্ধুবেশে সাপ সেজে তোমার আস্তিনেই লুকিয়ে বসে থাকবে। তখন তোমার কিছু করার থাকবে না। নিজের লোকেরাই যখন… পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের গাড়িতে বোমা রেখে দিচ্ছে আই এস আই…ভাবা যায়?”
জাকির এবার না বলে থাকতে পারল না “জনাব আপনি কি প্রাক্তন আই আস আই চিফ সরফরাজ খানের কথা বলছেন?”
প্রেসিডেন্ট জাকিরের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন “ইউ আর ভেরি ইন্টেলিজেন্ট জাকির মিয়াঁ। সহি পাকড়ে হো আপ। ইয়েস। অ্যান্ড দে প্ল্যান্ড সামথিং বিগ… ভেরি বিগ…”
ড্রয়িং রুমের ফোন বেজে উঠল। নিয়াজি ভ্রু কুঁচকে জাকিরের দিকে তাকালেন।
জাকির তড়িঘড়ি ফোন তুলল। কয়েক সেকেন্ড কথা বলে ফোন হাতে রেখে প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে বলল “জনাব আই এস আই চিফ মুস্তাকিন শাহরিয়র এসেছেন, দেখা করতে চান”।
প্রেসিডেন্ট বললেন “লেট হিম কাম”।
জাকির ফোন তুলে বেরিয়ে গেল। নিয়াজি গ্লাসে চুমুক দিয়ে ফিসফিস করে বললেন “সিক্সথ সেন্স… সিক্সথ সেন্স”।
মুস্তাকিন শাহরিয়র প্রায় ঝড়ের গতিতে ঢুকলেন।
জাকির দরজাটা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল।
নিয়াজি হাসিমুখে বললেন “বলুন শাহরিয়র সাহেব, নিশ্চয়ই কোন সমস্যার কথা বলতে এসেছেন?”
শাহরিয়র হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন “জনাব, আপনার কথা মতো, আফসানা সাইদ আর ওমর শেখের করাচীর বাড়িতে আমাদের লোক গিয়েছিল। কেউ ট্রেসপাসিং করেছিল জনাব ও বাড়িতে। জিনিসপত্র ওলোট পালোট করে রাখা”।
নিয়াজি বললেন “চমৎকার, আপনাদের কোন পাহারাদারই ছিল না ওখানে? সব ঘটে যাওয়ার পর জানতে পারলেন বুঝি? বাহ বাহ। নিন স্কচ খান”।
শাহরিয়র থমথমে মুখে বসে রইলেন।
.
৬৯
রাত এগারোটা। আর্মির কপ্টার একটু দেরী করে অমৃতসর বিমানবন্দরে নেমেছে।
অমৃতসর এয়ারপোর্টে তারা নেমে বেরোতে যেতেই ভারতীয় সেনার মেজর গুরবীর সিং আশরফকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। আশরফ তাকে জড়িয়ে ধরলেন। মেজর বীরেনকে দেখিয়ে আশরফকে বললেন “নতুন শের?”
আশরফ হাসলেন “একদম। একদম তাজা শের। আমাকে দেখতে পেতেন না এই ছেলেটা না থাকলে”।
মেজর বীরেনের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বললেন “সাবাশ বেটা। তোমাদের মত নওজওয়ানদেরই তো আমাদের দরকার”।
আশরফ বললেন “আপডেট দিন মেজর। কী হাল?”
মেজর বললেন “সেনা নেমে গেছে শহরে। নাকা চেকিং শুরু হয়েছে। দুশমন যেই থাকুক, কিছুই করতে পারবে না, ইন্ডিয়ান আর্মি আপনাকে এই আশ্বাস দিচ্ছে”।
আশরফ বললেন “দুশমনকে এত হালকাভাবে নিলে হবে না মেজর। দুশমন অত্যন্ত ধূর্ত। শুধু কোল্যাটেরাল ড্যামেজ করে পালাবে এটা তো হতে দেওয়া চলবেই না, আমাদের তাকে ধরতেও হবে। এরাই ইরাবতী ম্যাডামের ওপর হামলা করেছে। আমাদের কারো জীবন নিরাপদ নয় এদের দৌরাত্ম্যে। কেন এরকম হবে বলুন তো? নিজের দেশে কেন আমাদের এত ভয়ে কাটাতে হবে? হয় আমাদের এই ভয়কে জয় করে দুশমনকে একদম শেষ করে দিতে হবে গোঁড়া থেকে, নইলে এভাবেই ভয়ে ভয়ে একদিন ঘরে বসে খুন হয়ে যেতে হবে। আর সবার উপরে, রেহান খানের খুনীকে আমি ফ্রি স্পেস দিতে পারব না, কী প্ল্যান করেছে এরা খানিকটা আঁচ করছি। যদি সেটা হয় তাহলে ভয়াবহ কান্ড হবে একটা”।
মেজর আশরফ খানের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন “আপনি ভাববেন না খান, শেয়াল যতই ধূর্ত হোক, বাঘের কাছে তাকে মাথা নত করতেই হবে। ইসমাইলকে ছাড়ব না। আপনি শুধু হুকুম করুন আমাদের কী করতে হবে”।
আশরফ খান বললেন “আপাতত আমরা গোল্ডেন টেম্পল যাই। ওখানের সিচুয়েশন দেখে আপনাকে এর পরে কোথায় যেতে হবে জানাচ্ছি”।
মেজর বললেন “ফাইন, আসুন”।
তারা বিমানবন্দর থেকে বেরোতে বীরেন দেখল সেনার কনভয় দাঁড়িয়ে আছে। একটা গাড়িতে তারা উঠতেই কনভয় চলতে শুরু করল।
আশরফ খান বললেন “আমাদের ধর্মটা জানো তো বীরেন, দিনে দিনে কিছু লোকের জন্য এভাবে কলুষিত হয়ে যাচ্ছে। যে ছেলেটা বড় হয়ে ভাবছে একজন ভাল নাগরিক হবে, এসব লোকের জন্য তারা বিপথে চলে যাচ্ছে। শিক্ষা শুধু না, আরও অনেক কিছু দরকার রিফর্মের জন্য। তুমি তো বুঝবে না, তুমি হিন্দু ঘরে জন্মেছ, একজন মুসলমান হয়ে জন্মানোর পর যে কীভাবে আমাদের দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে সেটা আমরাই জানি”।
অমৃতসর ঘিঞ্জি শহর। রাত বলে গাড়ির গতিতে কোন রকম সমস্যা হচ্ছিল না। আশরফ খানের কথাগুলো শুনে বীরেন খানিকটা গুটিয়ে গেল। সে হিন্দু ঘরে জন্মেছে তো জন্ম থেকে জানত। আদতে তার বাবার পরিচয় জানার পর তো তার মাথা আর কাজ করছে না। হিন্দু, মুসলিম বা খ্রীষ্টান পরিচয় নিয়ে এই এখনও ভাবতে হবে? কেন? কাশ্মীর নামের একটা ছোট ভূখণ্ড নিয়েই বা দু দেশের মধ্যে এত ঝামেলা কেন হবে, যে দেশের বেশিরভাগ মানুষই এখনও পেট ভরে দু বেলা খেতে পারে না?
বীরেনের প্রতি মুহূর্তে ইচ্ছা হচ্ছিল খানকে সব খুলে বলে কিন্তু অদৃশ্য একটা হাত যেন তার গলা জড়িয়ে ধরেছিল। বাবার মুখটা মনে পড়ছিল। জন্মদাতা বাবা। নিজের বাবা। কী করে নিজের পিতৃপরিচয় অবলীলায় ভুলে যাবে সে?
আশরফের মোবাইলে ফোন আসছিল। আশরফ ফোন ধরলেন। খানিকক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে বললেন “মাথুর ফোন করেছিল। ইসমাইলের সঙ্গে শ্রীনগর ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসরও আছে। সিমস লাইক দে হ্যাভ এ ভেরি বিগ প্ল্যান”।
বীরেন চোখ বন্ধ করল। বিগ প্ল্যান? কী হতে পারে বিগ প্ল্যান?
কনভয় একটা খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গায় এসে দাঁড়াল। খান গাড়ি থেকে নামতে আর্মির বেশ কয়েকজন দৌড়ে এলেন।
খান বীরেনকে বললেন “এসো”।
আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে আছে। খান বীরেনকে নিয়ে এগোতে এগোতে বললেন “গোল্ডেন টেম্পলে এসেছো কোনদিন? ওয়ান্ডারফুল প্লেস। এখানকার হালুয়া লা জবাব”।
বীরেন মাথা নেড়ে বলল “আসি নি”।
বেশ খানিকটা পথ হেঁটে তারা মন্দিরের প্রবেশ পথের থেকে একশো ফুট দূরে দাঁড়াল। একজন আর্মির জওয়ান বললেন “স্যার মন্দিরের ভেতর তো আর্মি ঢুকবে না। তবে খালসাবাহিনীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায় কারো এত সাহস হবে না”।
আশরফ বললেন “তবু, কোন রকম রিস্ক নেওয়া যাবে না। সিসিটিভি মণিটরিংএ যেন কোন ফাঁক থেকে না যায়”।
বীরেন হাঁটতে হাঁটতে স্বর্ণ মন্দিরের বাইরে জুতো রেখে জলে পা ধুয়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেতরের দিকে সিঁড়ি বেয়ে উঠল। এখনও কত মানুষ আছেন। বিশ্বাসে চলে এসেছেন ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। মানুষই ঈশ্বর তৈরী করে আবার তারাই ঈশ্বরের ঘরে আসার অপরাধে মানুষকে মেরে ফেলে।
বীরেন ক্লান্ত ভঙ্গিতে সিঁড়িতে বসে পড়ল।
এক বৃদ্ধ শিখ ভদ্রলোক বেরোচ্ছিলেন, তার বসে পড়া দেখে কিছু একটা আঁচ করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
বীরেনের খুব কান্না পেল।
অনেক কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে সে কান্না চাপল।
এ কী রকম অভিশপ্ত জীবন পেল সে?
.
৭০
.
পাকিস্তানি সময় রাত একটা। আই আস আই চিফ মুস্তাকিন শাহরিয়র অপরাধীর মত মুখ করে নিয়াজির সামনে বসে আছেন। নিয়াজি চুপ চাপ একটার পর একটা পেগ শেষ করছেন। ভরছেন, আবার খাচ্ছেন। খানসামা জাকির একবার এসে দেখে চলে গেছে। কোন কথা বলে নি।
অনেকক্ষণ পরে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে নিয়াজি ঠান্ডা গলায় বললেন “আপনার চার্জ হ্যান্ড ওভার পাওয়ার সময় খুবই কম। খুব রিসেন্টলি আপনি আই এস আই চিফ হয়েছেন মিস্টার শাহরিয়র। কিন্তু এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি, তাতে আপনাদের আরও ট্যাক্টফুলি কাজ করতে হবে আশা করি সেটা আপনি বুঝতে পারছেন”।
শাহরিয়র ঘাড় নাড়লেন “জি জনাব”।
নিয়াজি টিভির দিকে তাকিয়ে বললেন “ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমটাকে দেখেছেন? ওদের বিধ্বংসী সব ব্যাটসম্যান আছে, দুর্দান্ত অলরাউন্ডার বোলার আছে, তবু ওরা হেরে যায় কেন ম্যাচগুলোতে বলুন তো?”
শাহরিয়র বললেন “দে হ্যাভ ল্যাক অফ কনসিসটেন্সি জনাব”। নিয়াজি মাথা নাড়লেন “ইয়েস, সেটা একটা কারণ তো বটেই, কিন্তু আরও কারণ আছে। দে হ্যাভ ল্যাক অফ সিরিয়াসনেস। ওরা খেলাটাকে এনজয় করতে মাঠে যায়। আর বিভিন্ন দেশের লোকেদের এক সঙ্গে খেলার সমস্যাটা আলাদাভাবে ধরলে আছেই। আপনি জিনিসটাকে এনজয় করুন, খুব ভাল কথা। কিন্তু তার সঙ্গে যদি আপনার প্রপার সিরিয়াসনেসটা না থাকে সেটাও চিন্তার ব্যাপার। ওমর শেখ আর আফসানা সাইদ দুটো পাকা ঘুটি ছিল আই এস আই এর। তাদের বাড়িতে মিনিমাম সিকিউরিটি থাকবে না, এটা কেন হবে?”
শাহরিয়র মাথা নাড়লেন “ঠিকই জনাব”।
নিয়াজি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় জাকির ঘরের ভেতর এসে নিয়াজির দিকে তাকিয়ে বলল “জনাব একজন ফোন করেছেন। নাম বলছেন না। শুধু বলছেন ফোনটা আপনার জন্য খুব জরুরি”।
নিয়াজি অবাক চোখে জাকিরের দিকে তাকিয়ে বললেন “প্রেসিডেন্ট হাউজের নাম্বার আছে তার কাছে? তাহলে জরুরিই হবে। দাও ফোনটা”।
জাকির নিয়াজির কাছে ফোনটা এনে দিল।
নিয়াজি ফোনটা কানে দিয়ে বললেন “হু ইজ দেয়ার”?
ওপাশ থেকে ভেসে এল “জনাব, বেঁচে থাকতে কেমন লাগছে?”
নিয়াজি জাকিরকে বললেন “খোঁজ নাও কোত্থেকে ফোনটা এসেছে। এখনই”। তারপর কয়েক সেকেন্ড ফোনটা কানে ধরে থেকে ঠান্ডা গলায় বললেন “কে বলছেন? পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এইভাবে কথা বললে কী হতে পারে কোন ধারণা আছে আপনার?”
ওপাশে হালকা হাসির আওয়াজের সঙ্গে ভেসে এল “জনাব, মুস্তাক জিমরির সঙ্গে মুজফফরাবাদে দেখা করে আসার পর ফতিমা জিন্না পার্কে আপনার গাড়িটা ব্লাস্ট করল। গোটা দুনিয়াকে আপনি বলে দিলেন ব্লাস্টটা ইন্ডিয়া করেছে। আপনার একবারও জানতে ইচ্ছা করে নি, ব্লাস্টটা সত্যিই কে করেছে?”
নিয়াজি বললেন “আপনি জানেন? বলুন তবে?”
“অবশ্যই জানি জনাব। আপনি আমাকে চিনবেন না হয়ত। তবে পাকিস্তান আর্মি আর আই এস আই আমাকে খুব ভাল ভাবেই চেনে। আমার নাম সায়ক বড়াল। নামটা কি শোনা শোনা লাগছে জনাব?”
নিয়াজির চোখ বড় বড় হয়ে গেল, পরক্ষণেই শান্ত হয়ে বললেন “চিনি আপনাকে। না চেনার তো কিছু নেই। আপনি আমাকে ফোন করেছেন কেন?”
“আপনার দেশের ইন্টেলিজেন্স ফেইল করেছে জনাব। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদেরও তো কিছু কর্তব্য আছে, তাই না?”
নিয়াজি মুস্তাকিনের দিকে তাকালেন। মুস্তাকিন বিমর্ষ মুখে বসে আছেন।
জাকির ঘরে এসে জানাল ফোন ট্রেস করা যাচ্ছে না। স্যাটেলাইট কল।
নিয়াজি বললেন “মিস্টার বড়াল, আপনি আমাকে ফোন করেছেন যখন তখন নিশ্চয়ই আমার হাল হকিকত জানার জন্য ফোন করেন নি। দ্বিতীয়ত দিল্লি থেকে এই ফোন এলে সেটা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হত”।
সায়ক বলল “অবশ্যই জনাব। কিন্তু দিল্লিতে ফোন করার আগে আমি আপনাকেই ফোন করেছি। কারণ ব্লু ফ্লাওয়ার কোড আমি এই মাত্র ক্র্যাক করেছি জনাব”।
নিয়াজি চমকালেন খানিকটা। পরক্ষণে সামলে নিয়ে বললেন, “কী বলবেন? আই এস আই চিফ সরফরাজ খান আর আই এস আই এস চিফ কাশেম সোলেমানির ব্রেইন চাইল্ড ব্লু ফ্লাওয়ার?”
সায়ক বলল “অবশ্যই জনাব। কিন্তু সেটাই সব নয়। মুস্তাক জিমরি আপনাকে প্রস্তাব দিয়েছিল পাক অধিকৃত মুজফফরাবাদে আর্মস ইমপোর্ট করার। সেটা আপনি মানেন নি। এর ফলেই আপনার ওপর হামলা হয়েছিল। জনাব, কাশেম সোলেমানি পাকিস্তানকে ইসলামিক স্টেট করতে চেয়েছিল। তার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে দ্রুত গতিতে। ফারমান আলীর নেতৃত্বে পাকিস্তানে একের পর এক আর্মস ঢুকছে লেবানন থেকে। পেশোয়ার, করাচী, লাহোরে প্যারালাল ফোরস তৈরী হচ্ছে। এবার আপনিই ঠিক করুন, মিডল ইস্টের সিরিয়া, ইরাকের মত পাকিস্তানেরও সেই হাল হবে, নাকি ওদের আটকাবেন। সবটাই এখন আপনার হাতে জনাব”।
নিয়াজি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন “এত কথা আমাকে বললেন কেন আপনি?”
সায়ক বলল “আমার তরফ থেকে গুডউইল জেসচার ভাবতে পারেন। আমার দেশকে আমি বলব না আপনাকে ফোন করেছিলাম। গোটা ব্যাপারটাই আনঅফিশিয়াল থাকবে। এত বছর আপনাদের মেহমান হয়ে আছি, হতে পারে, দেখলেই গুলি করবেন, কিন্তু সুস্থ স্বাভাবিক একটা দেশকে চোখের সামনে শ্মশান হয়ে যেতে দেখব কী করে জনাব? এরাই তো এর পরে আমাদের দেশের দিকে এগোবে। অলরেডি এগিয়েছেও অবশ্য, তবে ওদের মেইন প্ল্যান কিন্তু পাকিস্তানই”।
নিয়াজি চোয়াল শক্ত করে বললেন “আপনি কী চান?”
সায়ক বলল “ইসমাইলকে আটকান, লস্করকে বলুন ওকে যেন পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।”
নিয়াজি হতাশ গলায় বললেন “ওর কন্ট্রোল আমাদের কাছে নেই”।
সায়ক কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল “বেশ। তবে আব্বাসকে ছেড়ে দিন। ওকে ইন্ডিয়া যেতে দিন। এটুকু আশা করি করবেন আপনি আমাদের জন্য”।
নিয়াজি কয়েক সেকেন্ড ফোনটা ধরে থেকে বললেন “করব। থ্যাঙ্কস ফর দ্য ইনফরমেশন”।
ফোনটা রেখে নিয়াজি মুস্তাকিন শাহরিয়রকে বললেন “কনভয় রেডি করতে বলুন। আমি বেরব”।
মুস্তাকিন বললেন “এত রাতে?”
নিয়াজি মুস্তাকিনের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন “দেশ চালাচ্ছি। নউটঙ্কি করছি না। চলুন”।
.
.
৭১
তুষার রঙ্গনাথন কম্পিউটার খুলে বসেছিলেন। কাশ্মীরের ম্যাপের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে ছিলেন। ফোন বেজে উঠল তার। তুষার ফোন ধরলেন।
ওপাশ থেকে ভেসে এল “এক লডকি কো দেখা তো এয়সা লাগা”।
তুষার উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন “তুমি বেঁচে আছো?”
সায়ক হাসল “মরে গিয়ে যাই কোথায় স্যার? গোটা পৃথিবী ঘুরলেও আমি আমার দেশেই মরব স্যার”।
তুষার বললেন “বল কী বলবে”।
সায়ক বলল “স্যার ব্লু ফ্লাওয়ারের কোড ব্রেক করেছি। ভেবেছিলাম পীযূষকে লাগবে কিন্তু নিজেই পেরেছি। আমি করাচীতে আছি এই মুহূর্তে। আমার হাতে বেশি সময় নেই। পালাতে হবে এখান থেকে। পাকিস্তানি আর্মি কড়া টহলদারি রেখেছে এই চত্বরে”।
তুষার বললেন “ওকে, ওকে, তুমি কী বলতে চাও সেটা বল”।
সায়ক বলল “আব্বাসকে কাল ছাড়ছে ওরা”।
তুষার বললেন “কী করলে তুমি? কেন ছাড়বে?”
সায়ক বলল “এত এক্সপ্লেইন করার সময় নেই স্যার। সেকেন্ড হল, ওরা আগেরবারে হাসান মাকসুদের সাহায্যে যে সিরিয়াল ব্লাস্ট করেছিল, তারই কন্টিনিউশনে ওদের প্ল্যান এবার আরেকটু প্যাচালো। ওরা গোল্ডেন টেম্পল, বাবরি মসজিদ বা রাম মন্দির, সিদ্ধি বিনায়ক টার্গেট করেছিল। কিন্তু প্রথম বারেই ওমর মারা যাওয়ায় ওরা এখন একটা একটা করে এগোবে। কোড অনুযায়ী গোল্ডেন টেম্পলই ওদের ফার্স্ট টার্গেট”।
তুষার বললেন “হ্যাঁ, তুমি ঠিক। মাথুর ওয়াজুরা থেকে যা ডকুমেন্ট পেয়েছে তাতে জানা গেছে গোল্ডেন টেম্পলেই ওরা আছে”।
সায়ক বলল “স্যার, আমাদের সেনাবাহিনীর মধ্যে, এমনকী ইন্টেলিজেন্সের মধ্যেও ওদের লোক আছে। একদিন হঠাৎ করে নেই, বহুদিন ধরে আছে। ওদের বেশ কয়েকজন স্পাই ইন্ডিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বছরের পর বছর ধরে আছে”।
তুষার বললেন “স্বাভাবিক। তাদের ডিটেলস কি পাওয়া গেছে?”
সায়ক বলল “না স্যার। আফসানার ল্যাপটপে অসংখ্য এনক্রিপ্টেড ফাইল আছে। আমার কাছে এখন এত সময় নেই। আমি এই সেফ হাউস ছাড়ছি এখন। করাচী ছাড়ব আজ রাতেই”।
তুষার বললেন “কোন রিস্ক নেই তো? এত রাতে বেরোবে?”
সায়ক বলল “থাকাটাই রিস্ক। আমার ছবি দেওয়া সর্বত্র। ভয় নেই স্যার। মরব না”।
সায়ক হাসল। ফোনটা কেটে গেল।
তুষার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে আশরফ খানকে ফোন করলেন।
আশরফ ধরলেন একটা রিং এই “হ্যাঁ স্যার”।
“ইটস কনফার্মড। গোল্ডেন টেম্পল আশরফ”।
“ইয়েস স্যার। আমরা তৈরী”।
“তুমি কোথায় এখন?”
“এখানেই স্যার। রাতেও লোকজন থাকে তো। আপনি এসেছেন অনেকবার ভুলে গেছেন?”
.
“আরে আমি রেনোভেশনের আগে গেছিলাম। ব্লু স্টারের পরে ওখানেই ডিউটি ছিল আমার। তারপর তো অনেক কিছু ঘটেছে। এখন কমপ্লিট মডারনাইজেশন ঘটেছে। সেটা দেখা হয় নি”।
“ইসমাইল অত্যন্ত ধূর্ত স্যার। ও যদি গোল্ডেন টেম্পল ছেড়ে অমৃতসরের অন্য কোন জায়গায় কিছু করে? এ প্রাচীন শহরের অসংখ্য গলিঘুঁজি, অসংখ্য মানুষ থাকে এখানে”।
তুষার ফোনটা ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললেন “আমরা হেল্পলেস। করলে করবে। দেখো পালিয়ে না যেতে পারে। আর কি বলব? নাকা চেকিং চলছে ঠিক ঠাক?”
আশরফ বললেন “হ্যাঁ স্যার। সন্দেহজনক বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে”।
তুষারের চোখ তীক্ষ্ণ হল “তাদের মধ্যে কাশ্মীরি ক’জন? শিক্ষিত?”
আশরফ বললেন “ওদের এখানে আনা হয় নি। বেশিরভাগই ড্রিংক এন্ড ড্রাইভিং এর কেস ছিল। আপনার ডিটেলস লাগবে?”
তুষার বললেন “সারটেনলি। যে ক’জন কাশ্মীরি আছে করতে বল। তুমি যেখানে আছো সেখানে এনে আমার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সিং করে মুখ দেখাও। ইমিডিয়েটলি”।
আশরফ বললেন “রাইট স্যার”।
ফোন কাটলেন আশরফ।
তুষার প্রবল উত্তেজনায় পায়চারি করতে শুরু করলেন।
ফোনটা এল আধঘন্টা বাদে। তুষার ফোন ধরে বললেন “বল আশরফ”।
“স্যার, এরা বেশিরভাগই গরীব মানুষ। সেরকম কিছু নেই। ট্রাক চালাচ্ছিল, কেউ বা রাস্তার ধারে ফুটপাথে শুয়ে ছিল”।
তুষার বললেন “ঠিক আছে। ভিডিও কল কর”।
আশরফ ফোন কেটে ভিডিও কল করলেন। পাঁচজন কাশ্মীরি ছিল। তুষার প্রত্যেকের মুখ দেখলেন। শেষ জন মদের নেশায় টলছিল। তুষার তাকে একবার দেখেই আশরফকে চেঁচিয়ে উঠে বললেন “একে আলাদা কর। ইউ হ্যাভ গট ইওর ম্যান। কাদরী। এই কাদরী। এ অভিনয় করছে”।
কাদরী তুষারের গলাটা শুনে চমকে আশরফের ফোনের দিকে তাকালেন। তিনি ভাবতেও পারেন নি তুষার তাকে চিনে ফেলবেন। ইসমাইলের কাছে অমৃতসর ফিরছিলেন ক্যানাল রোডে। শহরে ঢোকার মুখে রাস্তায় তল্লাশি হচ্ছে দেখে একটা দোকান থেকে মদ কিনে খেয়ে এক ট্রাকওয়ালাকে ম্যানেজ করে ট্রাকে উঠেছিলেন। তবুও আর্মির লোক তাকে সন্দেহ করে আটক করেছিল। তুষার যে একবার দেখেই তাকে চিনবেন কাদরী কল্পনা করতে পারেন নি। আশরফ চিনতে পারলেন না সামনে দেখে, শুধু ফোনে দেখেই তুষার চিনে ফেললেন? কাদরী কোন কিছু না ভেবে দৌড়তে গেলেন।
আশরফ এগিয়ে গিয়ে সপাটে চাপড় মারলেন কাদরীর পিঠে। কাদরী মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
.
৭২
প্রফেসর কাদরীকে সেনারা ঘিরে রয়েছে। আশরফ খান এগিয়ে গিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বললেন “তো প্রফেসর সাব, একজন প্রকৃত মুসলমান হয়ে নিরীহ মানুষদের মারার শিক্ষা আপনাকে কোন ইসলাম দিয়েছে জানতে পারি?”
কাদরী একটা রামের বোতল পুরোটাই খেয়ে ফেলেছিলেন। তার নেশা প্রবল হয়েছিল। তবু লাল চোখে আশরফ খানের দিকে তাকিয়ে বললেন “যে ইসলাম তোকে শিক্ষা দিয়েছে অসহায় কাশ্মীরিদের খুন করার, ছোট ছোট মেয়েদের বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে রেপ করার, সেই একই ইসলাম আমাকে শিক্ষা দিয়েছে তার প্রতিশোধ নেবার। বুঝেছিস?”
আশরফ খান কয়েক সেকেন্ড কাদরীর দিকে তাকিয়ে কাদরীর মুখে জোরাল একটা ঘুষি মারলেন। কাদরীর নাক থেকে রক্ত বেরোতে শুরু করল।
খান বললেন “পাকিস্তান কত ভাল রেখেছে তোদের ওপাশের কাশ্মীরকে? কত ভাল রেখেছে? প্রতিটা সাধারন মানুষের বাড়িতে জঙ্গীদের পুষে রেখেছিস তোরা। সেখানে মেয়েদের হায়াত শরমের খেয়াল কে রাখে?”
কাদরী জোর গলায় বললেন “ওরা আমাদের যোদ্ধা, যোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া প্রতিটা মুসলমানের পবিত্র কর্তব্য। তোরা কী করে বুঝবি কাশ্মীরিদের কষ্ট! রাস্ট্রের টাকায় পালিত হওয়া কুকুরের দল”!
খান আবার সজোরে ঘুষি চালালেন কাদরীর মুখে। পর পর ঘুষি মারতে থাকলেন। আর্মির এক জওয়ান খানকে আটকাতে গেছিল খান লাল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন “দূরে থাকুন। আমাকে বুঝতে দিন। এই ধরণের মানসিকতার লোকেদের জন্য ভারতের প্রতিটি নিরীহ মুসলমানকে প্রতিদিন শুনতে হয় তারা সন্ত্রাসবাদী। প্রতিদিন তাদের পরীক্ষা দিতে হয় তারা দেশকে ভালোবাসে না পাকিস্তানকে। এদের কোন রকম ক্ষমা করা যাবে না। কোনভাবেই না”।
কাদরীর মুখ থেকে রক্ত পড়ছিল। বীরেন শিউরে খানিকটা দূরে সরে গেল। তাকে ধরতে পারলে এভাবেই মারবেন আশরফ? বীরেন বুঝতে পারছিল না কী করবে। তার জল পিপাসা পেল হঠাৎ। আবার জুতো খুলে হেঁটে হেঁটে স্বর্ণ মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করল সে। জল খেল আজলা ভরে। জলাশয়ের জলে পা চুবিয়ে বসল। জলের ওপর সোনার মন্দিরটা কী অপূর্ব দেখতে লাগছে। মায়ের কোলে এক বাচ্চা পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। কোথাও গরীব মানুষেরা মেঝেতেই শুয়ে পড়েছে।
ফোন বেজে উঠল তার। বীরেন চমকে উঠে ফোন হাতে নিয়ে দেখল বাবা ফোন করছে।
ধরতে ইচ্ছা করল না তার। ফোনটা পুরো বেজে বন্ধ হয়ে গিয়ে আবার বাজতে শুরু করল।
এবার বীরেন ধরল “হ্যালো”।
“কী করছিলি?”
অধৈর্য গলায় বাবা বলল।
বীরেন সতর্ক হল। বলল “গাড়িতে যাচ্ছিলাম, শুনতে পাচ্ছিলাম না কিছু”।
“তুই এখন কোথায়?”
“অমৃতসরে পৌছেছি তো। হোটেলে আছি। কাল কী সব কাজ আছে বলল”।
মিথ্যে করে বলল বীরেন।
“ও। তুই সত্যি বলছিস তো?”
বীরেনের মনে পড়ে গেল মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষার পর সে বলেছিল সে একশোতে একশোই উত্তর করেছে তখন বাবা ঠিক এভাবেই তাকে জিজ্ঞেস করেছিল। তার দু চোখের কোণা জলে ভিজে উঠল। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হল সব দুঃস্বপ্ন ঘটছে তার সঙ্গে। সে কোন রকমে বলল “হ্যাঁ বাবা, আমি সত্যি বলছি”।
“ঠিক আছে। কী হল বলবি”।
“তুমি ভাল আছো বাবা?” বীরেন কথাটা বলতে চায় নি। বলে ফেলল।
বাবা ওপাশে খানিকটা থমকে গিয়ে বলল “হ্যাঁ। ভাল আছি। কেন, কী হয়েছে?”
বীরেন “কিছু না” বলে ফোনটা কেটে দিল। আশরফ ফোন করছেন। বীরেন তড়িঘড়ি ধরল “হ্যাঁ স্যার”।
“তুমি কোথায় বীরেন?” আশরফ খানের গলা উত্তেজিত শোনাল।
বীরেন বলল “টেম্পলের ভেতরে স্যার। জল খেতে এসেছিলাম”।
“চলে এসো। উই হ্যাভ গট দ্য পাসওয়ার্ড”।
“মানে?”
“এসো জলদি। রেহান তোমাকেও খুব ভালবাসত। ভুলে গেছো?”
বীরেন উঠল। দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে জুতো নিয়ে খানের কাছে পৌঁছল।
কাদরীকে আধমরা করে ফেলে রাখা হয়েছে।
আশরফ বীরেনের কাঁধে হাত রেখে হেসে বললেন “চল বীরেন। শহরটা ঘুরে দেখি”।
.
.
৭৩
রাত আড়াইটা। ইসমাইল প্রার্থনা করছিল। প্রার্থনার শব্দ কখনও খাদে চলে যাচ্ছিল, কখনও উচ্চস্বরে ইসমাইল চিৎকার করছিল। তার চোখ জ্বলছে, শরীর কাঁপছে উত্তেজনায়, দু চোখ দিয়ে নামছে জলের ধারা। পাঠান ইসমাইলকে দেখছিল।
.
পাঠান গাড়ির ব্যবস্থা করেছে ভোরবেলায়। ঠিক হয়েছে ইসমাইল শিখের ছদ্মবেশে বেরোবে।
সে ইসমাইলকে সাজিয়ে দেবে। ছদ্মবেশের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনা হয়েছে। পাগড়ি বেঁধে পাক্কা শিখ সেজে ইসমাইল মন্দির চত্বরে ঢুকবে। ভেতরে কড়া নিরাপত্তার বলয় থাকবে বলে মন্দিরের বাইরের ভিড়েই ইসমাইল তার অপারেশন শেষ করবে। যতজন মানুষকে পারবে এলোপাথাড়ি গুলি করে মারবে।
পাকিস্তান থেকে বেশ কয়েকবার মিশন অ্যাবর্ট করার বার্তা এসেছিল কিন্তু ইসমাইল একটা বার্তাও রিসিভ করে নি।
ঘন্টা খানেক পরে ইসমাইল প্রার্থনা সেরে উঠলে পাঠান এসে ইসমাইলকে জড়িয়ে ধরল “আপনার এই পবিত্র আওয়াজ গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ুক মিয়াঁ। আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনাই করি। কালকে যেন একজন মানুষও আপনার গুলিতে বেঁচে থাকতে না পারে। প্রতিটা মানুষ, যার দিকে আপনি চোখ দেবেন, সেই যেন ঝাঁঝরা হয়ে যায় আপনার গুলিতে। কাফেরদের অপবিত্র ভূমি তাদের রক্তেই পবিত্র হোক। ইনশাল্লাহ”।
ইসমাইল একটা জ্যাকেট বের করল। মন দিয়ে তার ওপরে একটা সার্কিট বসাতে শুরু করল। পাঠান অবাক গলায় বলল “আপনি বাঁচার চেষ্টা করবেন না?”
ইসমাইল আবেগঘন গলায় বলল “বাঁচার চেষ্টা করে ডরপোকরা। আমি ডরপোক নই। আল্লাহর খাস বান্দা। গোটা দুনিয়া আমার নাম জানবে, আর তার আওয়াজ সূর্য চাঁদ অবধি পৌঁছে যাবে”।
পাঠান দু হাত তুলে উপরের দিকে নির্দেশ করে বলল “আমার এদেশে আসা সার্থক হয়েছে। এত দিন থাকাও। মৌলবী সাহেব ঠিকই বলেছিলেন, আমার কাছে শের আসবে। শের আপনি। আপনি পারবেন, আমি জানি”।
ইসমাইল জ্যাকেটের সার্কিট ঠিক করার চেষ্টা করতে শুরু করল।
স্যাটেলাইট ফোন আবার বাজতে শুরু করেছে।
ইসমাইল বিরক্ত গলায় পাঠানকে বলল “ফোনটা ধরুন। নইলে এরা শান্তিতে কাজ করতে দেবে না”।
পাঠান ফোন রিসিভ করল। “সালাম ওয়ালাইকুম”।
ওপাশ থেকে উত্তেজিত গলা ভেসে এল “ওয়ালাইকুম আসসালাম। ইসমাইল কোথায়?”
পাঠান ইসমাইলের দিকে তাকাল। ইসমাইল আঙুল দিয়ে পাঠানকে মিথ্যা বলতে বলল।
পাঠান বলল “উনি বেরিয়েছেন”।
“বেরিয়েছে মানে কী? কোথায় বেরিয়েছে?” ওপাশের গলার উত্তেজনা একটুও কমল না।
পাঠান বলল “এই বাউন্ডারিতেই আছে। কোন কিছু বলতে হবে?”
“হবে। ওকে বল সব জায়গা থেকে নির্দেশ এসেছে। কিছুতেই যেন কালকের মিশনে ও না যায়। কিছুদিন তোমার সঙ্গেই থেকে কাশ্মীরে ফিরে যায়। আমরা নতুন তারিখ বলব খুব তাড়াতাড়ি। আই রিপিট, ইসমাইল যেন কিছুতেই এই মিশনে না এগোয়। শুনতে পাচ্ছ?”
পাঠান ফোনটা কেটে দিয়ে ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে বলল “মিশন অ্যাবর্ট করতে বলছে”।
ইসমাইল শিষ দিতে দিতে জ্যাকেটে বোমা পরাতে লাগল। পাঠানকে বলল “পানির ব্যবস্থা কর মিয়াঁ। অনেকটা পানি খেতে হবে। বুকটা কাফেরদের রক্তের জন্য পিপাসার্ত হয়ে উঠছে”।
পাঠান মাথা নাড়ল “জরুর। আমি এখনই নিয়ে আসছি”।
সিঁড়ি বেয়ে পাঠান উপরে উঠল।
কয়েক মিনিট পরে সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল আশরফ খান আর বীরেন। ইসমাইল বুঝতেও পারে নি প্রথমে, ভাবতেও পারে নি সুদূর কল্পনাতেও। তড়িঘড়িতে নামতে গিয়ে বীরেনের পা সিঁড়িতে জোরে শব্দ করা মাত্র ইসমাইল সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে রিভলভার তুলতে যাচ্ছিল। খান তৈরী ছিলেন, সিঁড়ি থেকেই নিখুঁত নিশানায় ইসমাইলের ডান হাতে গুলি করলেন। ইসমাইল ছিটকে পড়ে গেল।
খান সিঁড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়ে নেমে ইসমাইলের কলার জোরে চেপে ধরে মুখে সজোরে একটা ঘুষি মারলেন।
ইসমাইল যন্ত্রণায় কাতরে উঠল। খান হাসিমুখে বীরেনের দিকে তাকিয়ে বলল “ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স। এনি ডে এদের আমাদের থেকে এগিয়ে রাখে। তাই না বীরেন? দেখে নাও, এই জানোয়ারটাই রেহানকে খুন করেছিল। এই আমাদের জওয়ানদের খুন করেছে। ধর্মের নামে এরা লজ্জা। ইসলাম এদের বর্জন করে, এই মানবতার শত্রুদের ঘেন্না করে।”
ইসমাইল যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে জোরে হেসে উঠল। খান রিভলভারের বাট দিয়ে ইসমাইলকে মারতে যাবেন, এমন সময় বীরেন খানের মাথায় রিভলভার তাক করে বলল “ওকে যেতে দিন স্যার”।
.
৭৪
বাইরে জোরে হাওয়া দিচ্ছে। তুষার জানলা খুলে দিলেন। আশরফ একটু আগেই জানিয়েছেন কাদরী সব উগড়ে দিয়েছেন। ক্যানাল রোডে ইসমাইলের গোপন আস্তানার লোকেশনও পাওয়া গেছে।
তুষারের অস্থির লাগছিল। হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিল। ইরাবতীর অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তুষার অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন। বাইরের রাস্তায় দুয়েকটা গাড়ি যাচ্ছে কেবল। পথের কুকুরেরা তাকে দেখে দৌড়ে এল। তুষার ভয় পেলেন না। তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেন। দেখা গেল কুকুরগুলো তাকে আর তেড়ে এল না। তুষার রাস্তায় হাঁটতে লাগলেন। কুকুরগুলো তার পিছন পিছন হাঁটতে লাগল।
নিজের অজান্তেই তার হাত ফোনের দিকে চলে যাচ্ছিল। খানের ফোনের অপেক্ষা করছেন তিনি। খানিকটা তাকে চমকে দিয়েই ফোনটা বেজে উঠল। তুষার তড়িঘড়ি ফোন বের করে দেখলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফোন করছেন। বিরক্ত হলেন, তবু ধরলেন “বলুন স্যার। ঘুমান নি?”
মন্ত্রী হাসলেন “ঘুম কি শুধু আপনার উড়বে তুষার? আমরাও তো মানুষ, না কি? গোল্ডেন টেম্পলে এত সেনা নামিয়েছেন আপনারা। আমার তো প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। শুধু সেখানে সেনা ঢোকানোর অপরাধে একজন প্রাইম মিনিস্টার খুন হয়ে গেলেন। আপনারা যা করছেন, ভেবে করছেন তো? পি এম কিন্তু সব খবর রাখছেন”।
তুষার সবটা মন দিয়ে শুনে বললেন “স্যার, আপনার কাছে হয়ত ঠিক ঠাক বার্তা পৌছয় নি, আর্মি মন্দিরে কোথাও ঢোকে নি, শুধু অমৃতসরের ওপর থ্রেট আছে বলে ওই চত্বরটা ঘিরে রেখেছে। আপনি বুঝতেই পারছেন, যদি টেম্পলে কোন রকম আঘাত আসে তাহলে সমস্যাটা আরও অনেকটাই বেড়ে যাবে”।
মন্ত্রী কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন “উই আর ওয়ারিড তুষার। প্লিজ কিপ আস আপডেটেড। বেস্ট অফ লাক”।
ফোনটা কেটে গেল। তুষার ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলেন আর কোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল নাকি। হাঁটতে হাঁটতে আবার অফিসের গেটের কাছে এলেন। কুকুরগুলো তাকে লক্ষ্য করে আসছিল। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। তুষার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তারক্ষীদের বললেন “বিস্কিট আছে আমার চেম্বারে। নিয়ে যাও কেউ। এদের দাও”।
একজন নিরাপত্তারক্ষী তার পেছন পেছন এল। তুষার খালি পেটে থাকতে পারেন না বলে বিস্কুটের কৌটো রাখেন। যে এসেছিল তার হাতে দিয়ে দিলেন কৌটোটা। জানলা দিয়ে দেখলেন কুকুরগুলোকে বিস্কুট দেওয়া হচ্ছে। তারা ল্যাজ নাড়তে নাড়তে সে বিস্কুট খাচ্ছে।
তুষার খানিকক্ষণ সে দিকে তাকিয়ে দুটো চেয়ার সামনা সামনি রেখে একটা চেয়ারে বসে আরেকটা চেয়ারে পা রাখলেন। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন, তার ফোন বেজে উঠল। তুষার চমকে উঠে ফোনটা ধরলেন “হ্যালো”।
“স্যার, সায়ক বলছি”।
সায়কের গলা উত্তেজিত। তুষার হাসলেন “কোন কোড বললে না সায়ক? কী ব্যাপার?”
“স্যার, আমি লাহোরের ট্রেনে আছি। আপনি আমাকে শুধু বলুন আমাদের ডিপার্টমেন্টে ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে নতুন রিক্রুট কে হয়েছে?”
তুষার সোজা হয়ে বসে বললেন “বীরেন। হি ইজ এ গ্রেট ফাইটার। ওই তো গেছে আশরফের সঙ্গে”।
“স্যার, বীরেন রাজাকারের ছেলে। পাকিস্তানি স্পাই। আশরফের সঙ্গে গেছে মানে? কোথায় গেছে?”
তুষার চেঁচিয়ে উঠলেন “কী সব বলছ তুমি? নরম্যাল মিডল ক্লাস ফ্যামিলির ছেলে। আশরফকে তো ওই বাঁচিয়েছিল। ও কেন স্পাই হতে যাবে? তোমার কোড ভাঙতে কোন প্রবলেম হয়েছে সায়ক”।
সায়ক বলল “আমার কোন ভুল হয় নি স্যার। অপারেশন ব্লু ফ্লাওয়ারে আফসানা সাইদের কম্পিউটারে সবার আগে এই ছেলেটির নামই লেখা আছে। এর বাবার নাম মুদসসর নওয়াজ খান। রাজাকার ছিল। ইন্ডিয়াতে ঘাপটি মেরে ছিল। নিজের ছেলেকে কুরবান করেছে মুদসসর। হাসান মাকসুদ ঠিক সময়ে একে মিশনে পাঠিয়েছিল। প্ল্যান ছিল একে দিয়েই একটার পর একটা সিরিয়াল ব্লাস্ট করানো হবে”।
সায়ক গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল। তুষার ফোনটা পাশে নামিয়ে রেখে অস্ফুটে বললেন “হোয়াট আ শেম”!
.
.
৭৫
পাকিস্তানি সময় রাত তিনটে।
ইসলামাবাদের শাহ ইমামের মসজিদের সামনে প্রেসিডেন্টের গাড়ি যখন দাঁড়াল। নিয়াজি গাড়ি থেকে নামলেন। সঙ্গে মুস্তাকিন শাহরিয়র।
নিয়াজির নিরাপত্তারক্ষীরা তাড়াতাড়ি এসে তার পাশে দাঁড়াল। নিয়াজি বললেন “মসজিদের দরজা কখনও বন্ধ করতে নেই এরা জানে না? মসজিদের দরজা খোলাও”।
নিরাপত্তারক্ষীরা চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। নিয়াজি জোরে চেঁচালেন “যা বলছি কর, মসজিদের দরজা খুলতে বল। নইলে ভেঙে দাও”।
দুজন এগিয়ে দরজা ধাক্কা দিল। সুনসান রাস্তাঘাট। শীতল হাওয়া ভেসে আসছে কোথা থেকে। শাহরিয়র বললেন “এখানে কী আছে জনাব?”
নিয়াজি তীব্র দৃষ্টিতে শাহরিয়রের দিকে তাকিয়ে বললেন “আপনার বিদেশী ডিগ্রি নিয়ে কোন লাভ হয় নি মিস্টার শাহরিয়র। লজ্জা করুন নিজের ওপর। আপনি আই এস আই চিফ?”
শাহরিয়র ঘাবড়ে গিয়ে চুপ করে গেলেন। মসজিদের দরজা একটু ফাঁক হল।
একটা মাথা বেরিয়ে এসে বলল “জি”।
নিয়াজি এগিয়ে গিয়ে বললেন “প্রেসিডেন্ট সাহাব এসেছেন। দরজা খোল”।
ও প্রান্তে খানিকক্ষণ নিশ্চুপ। পরক্ষণেই দরজা খুলে গেল। নিয়াজি শাহরিয়রের দিকে তাকিয়ে বললেন “আসুন”।
দরজা খোলার পর দেখা গেল মূল মসজিদের পাশে একটা ছোট করিডর মত আছে। নিয়াজি সরাসরি সে করিডর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। বাকিরা তার পিছন পিছন।
খানিকটা গিয়ে একটা সিঁড়ি পড়ল নিচে নামার। অদৃশ্য কেউ যেন সিঁড়ির আলো জ্বালিয়ে দিল। নিয়াজি নেমে গেলেন। পিছন পিছন সবাই।
একটা দরজা পড়ল। সার দিয়ে লোক শুয়ে ছিল।
নিয়াজিকে দেখা মাত্র সবাই উঠে পড়ল।
নিয়াজি শাহরিয়রের দিকে তাকিয়ে বললেন “জনাব আই এস আই চিফ, চিনে রাখুন, লস্করের ইসলামাবাদ ব্রাঞ্চ”।
শাহরিয়র খানিকটা চমকে উঠে বললেন “আমি শুনেছিলাম এই ব্যাপারে জনাব। ডিটেলস নিতাম শিগগিরি”।
নিয়াজি শাহরিয়রের কথা যেন শুনলেনই না এমন ভঙ্গি করে একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন “মৌলবী সাহেব কোথায়?”
ছেলেটির বয়স আঠেরোও হয় নি। নিয়াজির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে মৌলবি সাহেবের ঘর দেখিয়ে দিল।
নিয়াজি মৌলবির ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় নক করলেন। দরজা খুলে গেল।
মৌলবি নিয়াজীকে দেখে নতজানু হয়ে বললেন “আসুন জনাব, আসুন”।
নিয়াজি মৌলবির দিকে তাকিয়ে বললেন “ইসলামাবাদে আপনাদের কেন আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল সে সম্পর্কে আপনার সম্যক ধারণা আছে আশা করি”।
মৌলবি চিন্তিত মুখে বললেন “জরুর জনাব। আপনি এ কথা কেন বলছেন জনাব?”
নিয়াজি বললেন “ফারমান আলী সম্পর্কে আমাকে কেন জানানো হয় নি?”
মৌলবি হাত নাড়িয়ে বললেন “প্রেসিডেন্ট সাহেব এইসব ছোটখাটো ব্যাপারে জানবেন না, আমি ভাবতেই পারি নি জনাব। যদি কোন রকম গুস্তাখি করে থাকি, মাফ করে দেবেন জনাব”।
নিয়াজি কয়েক সেকেন্ড মৌলবির দিকে তাকিয়ে বললেন “আপনারা কাল সকালের মধ্যে ইসলামাবাদ ছাড়বেন। যদি না ছাড়েন, কুকুরের মত গুলি করে মারা হবে আপনাদের প্রত্যেককে”।
মৌলবির দু চোখ একবার জ্বলেই নরম হয়ে গেল “জনাব, আমাদের ওপর এত রেগে আছেন কেন যদি একবার জানতে পারতাম”।
নিয়াজি বললেন “ইসমাইলের ওপর আমরা কন্ট্রোল চেয়েছিলাম, আপনারা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন”।
মৌলবি বললেন “জনাব, ইসমাইলের ওপর আমাদেরই কন্ট্রোল নেই। আমরা ওকে মিশন ক্যান্সেল করে কাশ্মীরে ফিরতে বলছি, কোন উত্তরই দিচ্ছে না। ওর জন্য আমাদের কেন শাস্তি দেবেন জনাব?”
নিয়াজি মৌলবির চোখে চোখ রেখে বললেন “অপারেশনের ব্লু ফ্লাওয়ারের সম্পর্কে আমরা কেন কিছু জানতে পারি নি? কেন জানান নি? আপনি জানতেন না আমার গাড়িতে বম্ব ব্লাস্ট হতে পারে?”
মৌলবি কান ছুঁয়ে তওবা তওবা করে বলল “জনাব, আমি যদি এত কিছু জানতাম তাহলে কি আর আমাদের আপনার শরণাপন্ন হতে হত? আমরা তো আপনার আশ্রয়েই আছি। আপনি তাড়িয়ে দিলে চলে যেতে হবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, নেমকহারামি আমি অন্তত করি নি”।
নিয়াজি ক্রুদ্ধ গলায় বললেন “তাহলে কে করেছে?”
মৌলবি বললেন “জনাব লস্কর বরাবর আপনার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। আমরা আপনাদের থেকে উপকৃত। কেন খামোখা আপনাকে…”
কথা শেষ না করেই মৌলবি রিভলভার বের করলেন জ্যাকেটের পকেট থেকে। নিয়াজি তৈরী ছিলেন। পকেট থেকে রিভলভার বের করে মৌলভীর বুকে পর পর চারটে বুলেট ছুড়লেন। সশব্দে প্রতিধ্বনিত হল আওয়াজ। নিয়াজির নিরাপত্তারক্ষীরা আগেই পজিশন নিয়ে নিয়েছিল। মৌলবীর লোকেরা উঠতেও সাহস পেল না।
নিয়াজি রিভলভার পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন “শেয়ালকে কুকুর ভেবে কখনও পুষতে নেই মিস্টার শাহরিয়র। এই সব ক’টাকে আটক করে জেলে ঢোকানোর ব্যবস্থা করুন। ফারমান আলীর খোঁজ লাগান, যেখানে পাবেন, যেন কুকুরের মত গুলি করে মারা হয়। নো মার্সি। দেশে এই মুহূর্ত থেকে এক্সট্রিম এমারজেন্সি লাগু করুন। যে কজন জেনারেল প্রেসিডেন্টের এগেইন্সটে অভ্যুত্থানের প্ল্যান করেছিল, তার লিস্ট পেয়ে যাবেন কিছুক্ষণের মধ্যে। প্রত্যেকের কোর্ট মার্শাল হবে আজ রাতেই। কেউ যেন কাল ভোরের আলো দেখতে না পায়”।
ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে প্রেসিডেন্ট নিয়াজি মৌলবীর শরীরে একটা লাথি মেরে বাইরের দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।
.
৭৬
খান অবাক হয়ে বীরেনের দিকে তাকিয়ে বললেন “মানে?”
বীরেনের হাত কাঁপছিল। তার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না সে কী করছিল।
সে কোন মতে বলল “ছেড়ে দিন স্যার। ও চলে যাক। সেফ প্যাসেজ দিন। রিভলভারটা ফেলুন নইলে আমাকেই আপনাকে শ্যুট করতে হবে”।
আশরফ খান বীরেনের দিকে অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে বললেন “তুমি…”
ইসমাইল শুয়ে থাকা অবস্থাতেই চেঁচিয়ে উঠে বলল “পাকিস্তানি। শাবাস জুনিয়র মুদসসর নওয়াজ খান। ইউ হ্যাভ ডান ইট। নাও হিট হিম। হিট হিম হার্ড”।
বীরেন আশরফের দিকে তাকাল “রিভলভারটা ফেলুন স্যার। ছুঁড়ে ফেলুন, প্লিজ”।
আশরফের অবিশ্বাস যাচ্ছিল না। সে রিভলভারটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে বলল “তাহলে সেদিন তুমি আমায় বাঁচালে কেন? ওদিন তো আমায় মেরে দেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ ছিল”।
বীরেন বলল “প্লিজ স্যার। এত কথা শোনার সময় নেই আমার। আপনি ওকে সেফ প্যাসেজ দেওয়ার ব্যবস্থা করুন”।
ইসমাইল খানিকটা গড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল “তিনজন আছি আশরফ খান। তিনজনের শরীরেই বইছে এমন রক্ত যারা গোটা দুনিয়াকে পায়ের তলায় ফেলে রাখতে চায়। এই যে ছেলেটিকে নিয়ে আপনি আমাকে মারতে এসেছেন, ও জানত না যে, শুরু থেকেই ও আমাদের সঙ্গে আছে। ফসল হবার জন্য যখন বীজ বোনা হয়, তখন কি জানা যায় সব ফসল থেকেই ফল পাওয়া যাবে নাকি? আমরা কিন্তু জানতাম মুদসসর নওয়াজের ছেলে বেইমান হতে পারে না। রক্ত কথা বলে অফিসার। এই ছেলেটির রক্ত যেমন বলেছে। কোকিলের বাচ্চা যেমন কাকের বাসায় বাড়ে, জুনিয়র মুদসসরও তেমনই আপনাদের বাসায় বেড়েছে। এবার আপনাকে অফিসিয়াল অফারটা দি। চলে আসুন আমাদের সঙ্গে। কেউ জানবে না। আমাকে সেফ প্যাসেজ দিন। আপনি শুধু আমাদের ইনফরমেশন দিয়ে যাবেন। যা চাইবেন, তাই দেব আপনাকে আমরা। জন্নত যেতে চাইলে মরতে হবে না, এই দুনিয়াতেই নামিয়ে আনব জন্নত আপনার জন্য। কাল সকালের মধ্যে আমাকে এল ও সি পৌঁছে দিন”।
আশরফ গর্জে উঠে বললেন “কোন দিন না। তোরা শুধু ভারতের শত্রু না, তোরা গোটা মানবতার শত্রু। সেফ প্যাসেজ তো দূরের কথা, যারা নিরীহ মানুষদের মেরে ভাবে জন্নত যাবে, তাদের আমি জাহান্নামে নিয়ে যাব। আমি বেঁচে থাকতে কিছুতেই তোকে এ দেশ ছেড়ে পালাতে দেব না”।
ইসমাইল জোরে হেসে উঠে বলল “কে পালাতে চেয়েছে? আমি তো চাইনি। আমি চেয়েছি আপনার দেশ থেকেই আমার অভীষ্ঠ উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে। আপনাকে অফার দিয়েছিলাম, আপনি নিলেন না। আমার আর কিছু করার নেই। সরি আশরফ মিয়াঁ। জানি না জন্নতের ভারত পাকিস্তান আছে কি না, যদি থেকে থাকে, তবে সেখানেই দেখা হবে। আলভিদা। বীরেন, শ্যুট হিম”।
বীরেন আশরফ খানের দিকে বন্দুক তুলল।
ইসমাইল জোরে প্রার্থনা করা শুরু করল। আশরফ খান হাসিমুখে বীরেনের দিকে তাকিয়ে বললেন “শ্যুট বীরেন। ভাল থেকো”।
বীরেনের বন্দুকের নিশানার সামান্য পরিবর্তন হল। ইসমাইলের মাথায় পরপর তিনটে গুলি করল বীরেন। প্রার্থনা করতে করতেই কাটা কলাগাছের মত পড়ে গেল ইসমাইল।
বীরেন হাঁটুগেড়ে বসে পড়ে কেঁদে ফেলল।
আশরফ খান বীরেনের দিকে তাকিয়ে বললেন “বন্দুকটা দাও”।
বীরেন আশরফ খানের দিকে রিভলভারটা এগিয়ে দিল। আশরফ ইসমাইলের শরীরে বাকি বুলেটগুলোও বসিয়ে দিয়ে বললেন “রেহান তোমাকে তার জন্নত থেকে চকলেট পাঠিয়েছে বীরেন। আর এই জানোয়ারটার জাহান্নামেও জায়গা হবে না। জাহান্নামে মানুষের বাচ্চারা যায়। এই টেরোরিস্টের বাচ্চা, নিরীহ মানুষদের খুন করতে যাদের হাত কাঁপে না, তারা যায় না”।
বীরেন ধরা গলায় বলল “আমার বাবা…”
আশরফ বীরেনকে জড়িয়ে ধরে তুলে ধরে বললেন “আমরা বুঝে নেব। ভেবো না। ইউ আর এ হিরো বীরেন। আমাদের দেশ, সরি তোমার দেশ তোমাকে স্যালুট জানায়”।
বীরেন কিছু বলার আগেই সিঁড়ি বেয়ে একদল সেনা নেমে এসে বীরেনের দিকে রাইফেল তুলে বলল “ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট”।
আশরফ হো হো করে হেসে উঠে বললেন “নিশ্চয়ই তুষার স্যার পাঠিয়েছে। হায় হায়। এবারে স্যার লেট করে ফেললেন। বাই দ্য ওয়ে, সবাই বাইরে যাও। চা বানাও। মালাই চা খাব। ভোর হয়েছে। এখন এসব নাটক আর ভাল্লাগে না”।
.
.
৭৭
জ্যোতির্ময়কে অন্ধকার ঘরে একলা বসিয়ে রাখা হয়েছিল।
তুষার ঘরের আলো জ্বেলে জ্যোতির্ময়ের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে বললেন “এই জীবনটা কেমন লাগছে মিস্টার মাকসুদ? ভাল লাগছে? অন্ধকার ঘরে বসে আছেন একা একা! স্ত্রীকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এক ছেলে, সেও মৃত। গোটা পরিবার আপনার অস্তিত্বটাকেই ঘেন্না করে। কেমন লাগছে এই জীবনটা?”
জ্যোতির্ময় তুষারের চোখের দিকে না তাকিয়ে বললেন “আমার হাজার হাজার সহকর্মী এভাবেই বেঁচে আছে। তাদের কষ্টের তুলনায় আমার কষ্ট কিছুই নয়”।
তুষার পায়ের ওপর পা তুলে বসে বললেন “আপনার সহকর্মীরা আমার স্ত্রীর ওপরে গুলি চালিয়েছিল, যার সঙ্গে আপনাদের দূর দূরান্তের কারো কোন সম্পর্ক নেই। একটার পর একটা সিরিয়াল ব্লাস্টে অসংখ্য গরীব মানুষ আপনারা মেরেছেন যার মধ্যে মুসলিমরাও আছে। এ দেশের অসংখ্য মুসলিম সর্বক্ষণ সিটিয়ে থাকেন, কখন আপনারা কোথাও একটা বিস্ফোরণ করবেন, আর তাদের শুনতে হবে তারা সন্ত্রাসবাদী…”
জ্যোতির্ময় বললেন “আমার স্ত্রীর ওপরেও আপনারা অত্যাচার করেছেন যার সঙ্গে দূর দূরান্তেও আমাদের কাজের কোন সম্পর্ক ছিল না”।
তুষার বললেন “হ্যাঁ এবং তার পরে তাকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সব থেকে ভাল চিকিৎসা দেওয়ার পর নিরাপদ জায়গায় রাখা হয়েছে। আপনার প্রভুদের মত কোন স্টেডিয়ামে রেখে চারদিক থেকে পাথর ছুঁড়ে মারা হয় নি”।
জ্যোতির্ময় উত্তেজিত হয়ে বললেন “বার বার আমার প্রভুদের মত কথাটা বলবেন না। আমার কোন প্রভু নেই। আমি স্বাধীন। আমি যে পথ বেছে নিয়েছি, তা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়”।
তুষার হাসতে হাসতে বললেন “আপনার প্রয়োজন ওদের কাছে ফুরিয়েছিল মিস্টার মাকসুদ। ওরা ভয়ে পেয়েছিল, যদি আপনি ওদের সম্পর্কে সব উগড়ে দেন। আপনাকে মারতে আপনারই তৈরী অত্যাধুনিক মোবাইল বম্ব দিয়ে পাঠানো হচ্ছিল। কত শুভাকাঙ্খী আপনার ওরা”।
জ্যোতির্ময় স্থির চোখে তুষারের দিকে তাকিয়ে বললেন “আমি ওদের আর কোন ভাবে সাহায্য করতে পারতাম না। ওরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আমার তাতে পূর্ণ সমর্থন আছে”।
তুষার পকেট থেকে একটা আপেল বের করে চিবোতে চিবোতে বললেন “সেটা ঠিক। একটা শেয়াল ডাকলে সব শেয়ালই ডাকে। জেহাদী মানেই তাই”।
জ্যোতির্ময় হো হো করে হেসে উঠে বললেন “সিরিয়াল ব্লাস্টের মত। একজায়গায় হলে সব জায়গায় পর পর হতে থাকে। ঠিক না?”
তুষার শব্দ করে আপেল খেতে খেতে বললেন “একদম তাই। তবে কী জানেন তো, যে পথ আপনারা নিয়েছেন তাতে অন্যের ঘর পোড়াতে গিয়ে নিজের ঘরও পুড়ে যায়। কেউ যখন মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করে তখন প্রথমে ধর্মে করে, তারপর ধর্মের ভেতরে করে। ভেদাভেদটাই তখন রাজনীতি, সেটা না থাকলে সব কিছু মিথ্যা হয়ে যায়। এদেশে হিন্দু মুসলমান, হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ দলিত, ইসলামী দেশগুলোতে তেমনই শিয়া সুন্নী। এভাবে মানুষে মানুষে ভাগ করতে করতে একদিন মানুষেরাই সব শেষ হয়ে যাবে। অবশ্য সেটাই মঙ্গল। কী হবে বলুন দেখি মানুষের বেঁচে থেকে। পৃথিবীটাকে নোংরা করে, বাকি প্রাণীদের বসবাস অযোগ্য করা ছাড়া মানুষ তো আর কিছু করে নি। আপনি শিক্ষিত মানুষ, কাশ্মীরীদের জন্য আপনার প্রাণ কেঁদে আকুল হয়ে যাচ্ছে, অথচ এই কাশ্মীরীদেরই হিউম্যান শিল্ড হিসেবে সব থেকে বেশি ব্যবহার করেন আপনারা”।
জ্যোতির্ময় বললেন “স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান জরুরি”।
তুষার হাসতে হাসতে বললেন “তাই বুঝি? তা আত্মবলিদান যে জরুরি সেটা ওদেরই ঠিক করতে দিতে পারতেন তো। তা তো করছেন না। নিজেরাই পরিস্থিতিটা আরও জটিল করে তুলছেন”।
জ্যোতির্ময় বললেন “যাই বলুন, কাশ্মীর একদিন আজাদ হবেই”।
তুষার হাসি থামিয়ে বললেন “দারিদ্র থেকে আজাদ হবে? সন্ত্রাসবাদ থেকে? হিংসা থেকে? জঙ্গি সংগঠনগুলোর আরোপিত বাধা নিষেধ থেকে আজাদ হবে? যদি হয়, সেদিন আপনার সঙ্গে আমিও কাশ্মীরের আজাদি চাইব। কথা দিলাম’।
জ্যোতির্ময় বললেন “আমাকে একা থাকতে দিন। আর বকতে ভাল লাগছে না”।
তুষার দাঁড়িয়ে বললেন “আপনাকে আর বকতে হবেও না বেশিদিন। কাল ভোরটা আপনার আর দেখা হবে না মিস্টার মাকসুদ। আপনি যার কাছে যেতে চান, আমরা আপনাকে তার কাছেই পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। তৈরী হন। আমাদের কাছে আপনার প্রয়োজন ফুরিয়েছে”।
জ্যোতির্ময় চমকে উঠে বললেন “এটা আপনারা করতে পারেন না। মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে। এই দেশের নাগরিক হিসেবে আমার পূর্ণ অধিকার আছে একজন উকিলের সঙ্গে কথা বলার”।
তুষার আপেলটা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে বললেন “যারা নিরীহ মানুষদের মারার জন্য প্ল্যান করে, আমরা তাদের মানবাধিকার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি মিস্টার মাকসুদ। এ দেশ আপনার মত নাগরিকদের ডিজওন করে। তৈরী হোন। ডোন্ট ওরি। ইট উইল বি আ সাইলেন্ট ডেথ”।
জ্যোতির্ময় কয়েক সেকেন্ড তুষারের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন “গো টু হেল”।
তুষার হেসে বললেন “ক্ষতি নেই। জন্নত যাবার জন্যই এসব করছিলেন তো। দেখুনই না, কীভাবে আপনাকে অভ্যর্থনা করা হয়। গুড বাই হাসান মাকসুদ। এ শেম টু হিউম্যানিটি”।
.
৭৮
শ্রীনগরের অফিসে বসে কাজ করছিলেন মাথুর। হামিদ বললেন “স্যার আসব?”
মাথুর হাসিমুখে বললেন “নিশ্চয়ই। আবার পারমিশন নেওয়ার কী হয়েছে? আপনারই তো অফিস। আপনিই থাকবেন। আমাকে তো আবার দিল্লি ফিরতে হবে। বসুন, বসুন”।
হামিদ মাথুরের সামনের চেয়ারে বসে বলল “ইসমাইল নিকেশ হয়েছে খবরটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছি স্যার। এই ধরণের লোকেরা শুধু ভারতের জন্য না, কাশ্মীরের জন্যও ক্ষতিকারক। কিন্তু প্রফেসর কাদরীর জন্য খারাপ লাগছে। শিক্ষিত মানুষেরাও কীভাবে ভুল আদর্শে চালিত হয়ে যাচ্ছে…”
হামিদ দুঃখিত ভাবে মাথা নাড়লেন।
মাথুর একটু চুপ করে থেকে বললেন “সবটা দোষ কাশ্মীরীদের উপর দিয়ে আমরা নিশ্চিন্তভাবে বসে থাকতে পারি না বোধ হয়। আমার রিপোর্টেও তাই থাকছে। উই শুড বি মাচ মোর সিমপ্যাথেটিক টু দ্য কাশ্মীরি পিপল। এই দেশটা তাদেরও। ইস্তিয়াক…”
মাথুর কথাটা শেষ করতে পারলেন না একজন পিওন এসে খবর দিল মাথুরের সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছে। মাথুর তাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিতে বললেন। মিনিট খানেক পরে ইস্তিয়াক এসে দাঁড়াল। মাথুর হাসিমুখে বললেন “আরে কী সারপ্রাইজ ইস্তিয়াক, আমি হামিদসাহেবকে তোমার কথাই বলছিলাম। এসো এসো”।
ইস্তিয়াক মাথুরের চেম্বারে প্রবেশ করল। হামিদকে মাথুর বললেন “হামিদ সাহেব, ইস্তিয়াক না থাকলে হয়ত আজ গোটা দেশে আগুন জ্বলত। ও যদি আমাকে ওয়াজুরা গ্রামে নিয়ে না যেত তাহলে ইসমাইলের মিশন সফল হত, সেটা যে কী হত, ভাবাও যাচ্ছে না”।
ইস্তিয়াক বলল “স্যার দুঃখজনক হলেও সত্যি, বেশিরভাগ কাশ্মীরীই এখন ইসমাইলের মৃত্যুর খবরে দুঃখিত। তারা খুশি হয় নি। ইসমাইলদের এরা সমর্থন করে”।
মাথুর হামিদের দিকে তাকিয়ে বললেন “হামিদ, গাড়ি বের করুন। একজনের বাড়ি ঘুরে আসা যাক। এসো ইস্তিয়াক”।
তিনজনে বেরোলেন।
মাথুর ড্রাইভারকে গন্তব্যের কথা বললেন। গাড়ি স্টার্ট নিল। ডাল লেকের পাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। উপদ্রুত হবার জন্য শ্রীনগরে পর্যটক খুবই কম। দোকানীদের মুখ শুকনো।
মাথুর বললেন “পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে সবার আগে”।
ইস্তিয়াক বলল “আফস্পা প্রত্যাহার করুন। স্বাভাবিক হয়ে যাবে”।
মাথুর ইস্তিয়াকের দিকে তাকিয়ে বললেন “ইশক মোহাব্বত সম্পর্কে ধারণা আছে তো ইস্তিয়াক? কখনও কারো সঙ্গে ইশক করেছো?”
ইস্তিয়াক ঘাবড়ে গিয়ে বলল “না মানে করি নি, তবে ধারণা আছে”।
মাথুর বললেন “তোমার আর তোমার মাশুকার মধ্যে ঝামেলা হচ্ছে। এই সময় যদি তৃতীয় কোন ব্যক্তি এসে ক্রমাগত তোমার মাশুকাকে উস্কিয়ে যায় তাহলে তোমাদের সম্পর্কটা কোনদিন স্বাভাবিক হবে না। ঝামেলা লেগেই থাকবে। কাশ্মীর আর ভারতের সম্পর্কটা এখন ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে। পরিস্থিতি যতবার স্বাভাবিক হবে, আফস্পা প্রত্যাহারের পরিস্থিতি আসবে, পাকিস্তান ঠিক সেটাকে বিগড়ে দেওয়ার জন্য উস্কানি দেবে। আমি মানছি আমাদের সরকারের আরও সংবেদনশীল হওয়া উচিত, অবশ্যই হওয়া উচিত, কিন্তু পাকিস্তানের ইন্ধনকে তুমি অস্বীকার করতে পারো না। কাদরীর মত শিক্ষিত লোকেরা ইসমাইলদের মত জানোয়ারদের কেন সাহায্য করবে বল তো? এত রাগ আমাদের ওপরে?”
গাড়ি গন্তব্যে এসে পৌঁছল। রেহান খানের বাড়ি। মাথুর বললেন “আমি ভেতরে যাচ্ছি। হামিদ সাহেব আর ইস্তিয়াক চাইলে আসতে পারেন”।
দরজায় বেল বাজালেন মাথুর। রেহানের মা দরজা খুললেন। মাথুর রেহানের মায়ের পা ছুঁয়ে বললেন “চিনতে পারছেন মা জী?”
রেহানের মা বললেন “ভেতরে এসো”।
সবাই ভেতরে গেলেন। ড্রয়িং রুমের দেওয়ালে রেহান খানের ছবি রাখা। মাথুর কয়েক সেকেন্ড সে ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বললেন “ইসমাইলকে তোমার কাছেই পাঠিয়েছি রেহান। ছেড়ো না ওখানেও”।
রেহানের মা চায়ের ব্যবস্থা করতে ভেতরে গেছিলেন। বেরিয়ে এসে বললেন “আপনারা কি কোন কাজে এসেছেন?”
মাথুর হেসে বললেন “হ্যাঁ, আপনার খোঁজ নিতে এসেছিলাম। আপনি ভাল আছেন তো?”
রেহানের মা কেঁদে ফেললেন। সবাই চুপচাপ বসে রইল তাকে ঘিরে।
.
৭৯
ওয়াঘা সীমান্তে তীব্র রেষারেষি চলছে নিউজ চ্যানেলগুলোর। বি এস এফের আধিকারিক প্রমোদ ভাট প্রবল রেগে রয়েছেন। তাদের দেওয়া বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করেই চ্যানেলগুলোর প্রতিনিধিরা মনের সুখে যত্র তত্র বিচরণ করছে। প্রমোদ ঠিক করেছেন একটা সময় অবধি দেখবেন, তার পরে লাঠি চার্জের অর্ডার দেবেন। তাতে নিউজ চ্যানলগুলো তাকে ভিলেন বানাবে ঠিকই কিন্তু এই মুহূর্তে আইন শৃঙ্খলা সামলাতে লাঠি চার্জ ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
বসন্তের দুপুর। মাঝে মাঝে হাওয়া দিচ্ছে বটে, কিন্তু গরম আছে। ট্যুরিস্টরা কাতারে কাতারে ভিড় জমাচ্ছে। এত ট্যুরিস্টকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না দর্শক গ্যালারিতে। দর্শক গ্যালারি পূর্ণ হয়ে গেলে বাকিরা বাইরের বড় স্ক্রিণে দেখবে।
এক চ্যানেলের প্রতিনিধি ক্যামেরার সামনে লাফাতে শুরু করল “আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, ভারত সরকারের তীব্র চেষ্টা এবং চাপের কাছে নতি স্বীকার করে পাকিস্তান শেষ অবধি ভারতীয় নাগরিক আব্বাসকে সসম্মানে রিলিজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপনারা সকলেই জানেন আব্বাসের ওপর ভারতীয় স্পাই হবার আরোপ ছিল, আদতে তিনি ব্যবসার কাজে পাকিস্তানে গেছিলেন”।
আব্বাসের পরিবার এসেছে। তাদের সযত্নে ভি আই পি গ্যালারিতে বসানো হয়েছে। বক্সে দেশপ্রেমের গান বাজানো হচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভারতীয় পতাকা নিয়ে মনের আনন্দে খেলছে।
পাকিস্তানী গ্যালারিতেও আজ প্রচুর মানুষ। বেশিরভাগ মানুষই আব্বাসকে ফিরিয়ে দেওয়ার তীব্র বিরোধী। মাঝে মাঝেই তারা ভারত বিরোধী স্লোগান দিচ্ছে। এদের মধ্যেই একজন পাঠান পোশাক পরিহিত মানুষ চুপ করে বসে আছে। তার মনের ভেতরে কী চলছে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না।
লাহোর থেকে আব্বাসকে নিয়ে কনভয় ওয়াঘা সীমান্তে পৌঁছেছে। বিভিন্ন রকম সরকারী কাগজপত্রে আব্বাসকে সই করানো হচ্ছে। আব্বাসের হাত ভাঙা হয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন। হাতের চিকিৎসা করা হয়েছে। সামনের দুটো দাঁত সাড়াশি দিয়ে তোলা হয়েছে। প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। এত কিছু সত্ত্বেও আব্বাসের মুখ থেকে আই এস আই এবং পাকিস্তানী আর্মি কিছুই বের করতে পারে নি।
পাকিস্তানের বিভিন্ন টিভিতে প্রেসিডেন্ট নিয়াজীর বক্তব্য দেখানো হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট নিয়াজী দেশের সর্বত্র শান্তি আরোপের কথা বলেছেন। ভারতের প্রতি গুডউইল জেসচার হিসেবে আব্বাসকে ছাড়া হয়েছে। আব্বাসকে শারীরিক নিগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট।
পাকিস্তানের কোণায় কোণায় সেনা নেমেছে। আই এস আই এর বেশ কয়েকজন অফিসারের কোর্টমার্শাল অর্ডার বেরনোয় গোটা দেশে সাড়া পড়ে গেছে। ফারমান আলীকে আটক করা হয়েছে। তাকে তার দেশে পত্রপাঠ ফেরত পাঠানো হচ্ছে। পাকিস্তানী আর্মির একাংশের থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র আটক করা হয়েছে। আমেরিকা সহ বিভিন্ন পশ্চিমী দেশ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রেসিডেন্ট নিয়াজীকে সব রকম সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছে।
আব্বাসকে পাকিস্তানী গেটে আনা মাত্র মিডিয়ার হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। পাকিস্তানী আর্মি জেনারেল ভারতীয় সেনার হাতে আব্বাসকে হস্তান্তর করলেন।
আব্বাস গোটা প্রক্রিয়ায় পাথরের মত শক্ত ছিল।
ভারতের মাটিতে পা রাখামাত্র আব্বাস শব্দ করে কেঁদে উঠল। মিডিয়ায় আব্বাসের কান্নার ছবি দেখানো হচ্ছে। পাকিস্তানী গ্যালারিতে অবশ্য ভারত বিরোধী স্লোগান বিন্দুমাত্র কমেনি।
আব্বাস ভারতে প্রবেশ করা মাত্র ভারতীয় পোশাক পরিহিত মানুষটি উঠে দাঁড়ালেন। পাশ থেকে একজন বলল “ও মিয়াঁ, কোথায় যাচ্ছ? এই নৌটঙ্কি রোজ রোজ দেখা যায়? ভারতের কাছে আমাদের প্রেসিডেন্ট এভাবে মাথা নোয়ালো দেখে লজ্জা পাচ্ছ বুঝি?”
সায়ক লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল “হ্যাঁ মিয়াঁ। এ লজ্জা চোখে দেখা যায় না। চলেই যাই”।
লোকটা বিরক্ত গলায় উঠে পড়ে বলল “ঠিকই বলেছো। এ আর চোখে দেখা যায় না। চল মিয়াঁ, আমিও ফিরি। লাহোরেই থাকো তো?”
সায়ক গ্যালারি থেকে নামতে নামতে বলল “হ্যাঁ, লাহোরেই থাকি। তুমি কোথায় থাকো?”
লোকটা বকবক করতে শুরু করল। সায়ক বেরোতে বেরোতে একবার পিছন ফিরে তাকাল। তার দেওয়া কথা সে রাখতে পেরেছে মনে পড়তে তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।
৮০
দিল্লি অফিস।
তুষারের সামনে আশরফ খান আর বীরেন বসে আছে।
একটু আগেই তারা এসেছে।
তুষার বীরেনের দিকে তাকিয়ে বললেন “চা খাবে? দার্জিলিং টি আছে। নিজের হাতে বানাবো”।
বীরেন মাথা নাড়ল।
তুষার উঠে বীরেনের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বললেন “বীরেন, আবেগবর্জিত হতে শেখো। আমাদের কাজে আবেগ থাকলে চলবে না”।
আশরফ হাসতে হাসতে বললেন “স্যার আপনি এখান থেকে বলছেন, আমার কথাটা ভাবুন, আমাদের বাচ্চা আমাদের মাথায় রিভলভার রেখে বলছে ইসমাইলকে যেতে দিন”।
বীরেন মাথা নিচু করল।
তুষার বীরেনের সামনের টেবিলে উঠে বসলেন। বললেন “জানো তো বীরেন, কিছু মানুষ ভুল আদর্শের জন্য সারাজীবন বেঁচে থাকেন। তারা সে আদর্শকে এতটাই আঁকড়ে ধরে থাকেন, যে তারা কোনদিন ভাবতেও পারেন না, তাদের আদর্শটা কত ভুল। তুমি ভাবতে পারো বীরেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি আর্মি যখন বুঝতে পারল যে তারা যুদ্ধটা হেরে যাচ্ছে, তখন তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দশজন শিক্ষক এবং অসংখ্য ছাত্রকে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মেরেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যেন দেশটা স্বাধীন হবার পর কোন দিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। দেশ চালাতে তো বুদ্ধিজীবিদের দরকার হয়, যদি তারাই না থাকেন, তাহলে আর দেশ চালাবার দরকার কী করে হবে। তোমার বাবার ভেতরে এই ভুল আদর্শটাই ছিল। ভাল মন্দের ভাবনা তার মধ্যে ছিল না। আমাদের লড়াইটা হিন্দু মুসলিমের বিরুদ্ধে নয় বীরেন, আমাদের লড়াইটা এই সমস্ত রকম অশুভ চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে। যারা মানুষের ভাবনার জায়গাগুলোকে বন্ধ করে দিয়ে শুধু মাত্র হিন্দু এবং মুসলমানে সব কিছুকে ভাগ করে দিতে চায়। আমাদের লড়াইটা শুধুমাত্র দেশের বাইরের শত্রুর সঙ্গে নয়, আমাদের লড়াইটা আমাদের ভেতরের মানুষটার দ্বিধা দ্বন্দ্বের সঙ্গেও। এই লড়াইটা নিরন্তর ভাল মন্দের সঙ্গে চলতে থাকে, ঠিক যেমনটা তোমার চলেছিল তোমার পিতৃপরিচয় এবং দেশের স্বার্থের মধ্যে। আসলে লড়াইটা কিন্তু তা ছিল না। লড়াইটা ছিল তোমার সঠিক শিক্ষার সঙ্গে সমস্ত রকম ধ্বংসাত্মক চিন্তার মধ্যে। লড়াইটা তুমি জিতে গেছো বীরেন। আর কোন দিন পিছন ফিরে তাকিও না”।
বীরেন বলল “আমায় কি এবার ক্লোজ করা হবে স্যার? আমার সম্পর্কে এত কিছু জানার পরে আপনারা আমাকে কি আর কোন মিশনে পাঠানোর ঝুঁকি নেবেন?”
তুষার বললেন “নাহ। তোমাকে আরও কঠিন দায়িত্বে পাঠানো হবে। তোমার ওপর আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা আছে, সে কাজে তুমি আমাদের নিরাশ করবে না”।
বীরেন তুষারের দিকে তাকাল।
তুষার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন “পাকিস্তান ইন্ডিয়াকে যে ক্রিকেট সিরিজ করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল, তা পাকিস্তানে চলা বর্তমান টানাপোড়েনের জন্য ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট নাকচ করে দিয়েছেন। আমাদের পাকিস্তানে যাবার কথা ছিল, কিন্তু সে ট্যুর ক্যান্সেল হয়েছে। এই মুহূর্তে পাকিস্তানে আমাদের এজেন্ট সায়ক বড়াল আছে। উই হ্যাভ ডিসাইডেড টু সেন্ড ইউ দেয়ার। সায়কের সঙ্গে কাজ কর। অনেক কিছু শিখতে পারবে। তখন আর তোমার মধ্যে কোন রকম টানাপোড়েন থাকবে না। বুঝতে শিখবে, দেশের ওপরে কেন কিছু নেই”।
বীরেনের মুখ হাসিতে ভরে উঠল “থ্যাংক ইউ স্যার”।
তুষারও হাসলেন, “ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। আমার স্ত্রী অনেকটা রিকভার করেছেন। তিনি তোমাকে দেখতে চান বীরেন। একবার দেখা করে এসো”।
আশরফ বললেন “স্যার, ম্যাডাম আমাকে দেখতে চান না?”
তুষার জোরে হেসে উঠলেন “অবশ্যই, কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের হিরো কে, তা তো বুঝতেই পারছো”।
আশরফ হাসতে হাসতে বললেন “রাইট স্যার। আচ্ছা আমি তবে বীরেনের সঙ্গেই ম্যাডামকে দেখে আসব”।
বীরেনের ফোন বেজে উঠল। বীরেন দেখল বোন ফোন করছে। তুষার বললেন “ধর”।
বীরেন ফোন তুলল “বল”।
ওপাশ থেকে বোনের কান্নার শব্দ ভেসে এল, “দাদা, কাল রাতে বাবাকে কয়েকজন ডেকে নিয়ে গেল, বাবা সেই যে বেরিয়েছে,এখনও ফেরে নি। মা খুব চিন্তা করছে। দেখ না, থানায় একটু ফোন করে”।
বীরেন কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল “দেখছি রে। রাখ আমি দেখছি”।
ফোনটা কাটল বীরেন।
তুষারকে বলল “স্যার আমার একটাই আর্জি আছে, মুদসসর নওয়াজ খানকে যেন খুব বেশি কষ্ট দেওয়া না হয়, একটা বুলেটেই যেন…” বীরেনের গলা কান্নায় ভিজে এল।
তুষার বীরেনের কাঁধে হাত রেখে বললেন “তোমার কথা রাখা হবে। তুমি বাড়ি যাও। ছেলের যা যা কাজ আছে, সব শেষ করে জয়েন কর। হ্যাঁ, ভদ্রলোককে কবর দিও না, পুড়িও। যে পরিচয়ে বেঁচে ছিলেন, সে পরিচয়েই থাকুন উনি। তোমার মা আর বোন যেন কোন দিন জানতে পারে তিনি কে ছিলেন। উই আর প্রাউড অফ ইউ বীরেন। তোমার দেশ তোমার জন্য গর্বিত। জয় হিন্দ”।
বীরেন মাথা নিচু করে অস্ফূটে বলল “জয় হিন্দ স্যার”।
.
৮১
মধ্যপ্রাচ্য। এই সময়।
রিয়াজ মানসিক হাসপাতালে আছে এখন।
মাঝে মাঝেই চেঁচিয়ে ওঠে। বার বার দুঃস্বপ্নে আসে ছেলে সোহান আর স্ত্রী আমিনা। তারা হাত নাড়ছে তাকে বাড়ি ফিরতে দেখে। বোমার আঘাতে ব্যালকনিটা ভেঙে পড়ছে। তলিয়ে যাচ্ছে তার পরিবার। তলিয়ে যাচ্ছে সর্বস্ব।
একই অ্যাসাইলামে তার সঙ্গেই আছে আরও অসংখ্য রিয়াজ।
ধর্ম ব্যবসায়ীরা এগিয়ে চলেছে পৃথিবীতে তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার অভিপ্রায়ে।
মানবিকতা, মনুষ্যত্ব ধ্বংস হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে।
আমেরিকা সেনা পাঠিয়েছে তাদের শহরে।
বিদ্রোহীরাও বিন্দুমাত্র বসে নেই।
তারাও দ্বিগুণ উৎসাহে এলাকা দখলের লড়াইতে নেমেছে।
কেউ কাউকে রেয়াত করছে না। আজ এর বাড়ি ধ্বসে যাচ্ছে, কাল তার বাড়ি।
এই বিশ্বাসহীনতার পৃথিবীতে আমরা ফিরে যাই পাকিস্তানের এক শহরে।
এক যুবক ধীর পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে এক দরজার সামনে।
ঠক ঠক করে করছে দরজায় কড়া নাড়ছে।
এক যুবতী দরজা খুলল।
যুবক হেসে বলল “ভাল আছো?”
যুবতী যুবককে দেখা মাত্র চমকে ভিতরের ঘরের দিকে তাকাল সভয়ে।
বলল “বাবা আছে তো”।
যুবক হাত ধরে যুবতীকে বাইরে নিয়ে এসে বলল “আমাকে বিয়ে করবে মেহের? কথা দিচ্ছি আমি, তোমাকে কোন দিন কষ্ট দেব না, ছেড়ে যাব হয়ত, কিন্তু ঠিক ফিরে আসব। বারে বারে ফিরে আসব তোমার কাছে। তোমার চোখের দিব্যি মেহের। আমি আসবই।”
মেহের যুবকের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল। বলল “তোমাকে বিশ্বাস করি না”।
যুবক মেহেরের হাত ধরে বলল “বিশ্বাস কর না? সত্যি? তাহলে তুমি দরজা খুললে কেন?”
মেহের যুবকের হাত ছাড়িয়ে নিল “ও তো এমনিই খুলি। যাও। তোমাকে চাই না আমার”।
যুবক বলল “তাই? আচ্ছা, তবে চলে যাই বরং”।
মেহের এবার যুবকের হাত শক্ত করে ধরে বলল “না, তুমি কোথাও যাবে না। একদম যাবে না। পুলিশকে দিয়ে ধরিয়ে দেব তখন বুঝবে”।
মেহেরের দু চোখ দিয়ে জলের ধারা নামল। সায়ক মেহেরের দুচোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল “সংসার পাতবে আমার সঙ্গে? বিশ্বাস করবে আমায়?”
মেহের সায়কের হাত ধরে বলল “করব। কথা দাও, আর কোন দিন ছেড়ে যাবে না”।
সায়ক হাসল। বলল “যাব না। খুশি?”
মেহের বলল “আব্বাজান এসেছে। ওর সামনে আবার বেশি কথা বলতে যেও না। ভালোবাসা দেখাতে হবে না অত”।
সায়ক বলল “আচ্ছা দেখাব না। আব্বাজানের সঙ্গে কথা না বললে বিয়েটা হবে কী করে?”
মেহের দুষ্টু হাসি হেসে বলল “পালিয়ে যেও আমাকে নিয়ে। তোমার মুলুকে। আচ্ছা, কী আছে ওখানে?”
সায়ক বলল “মা আছে আমার। দেখা করবে আমার মায়ের সঙ্গে?”
মেহেরের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “হ্যাঁ। করব। তোমার মা আমাকে ভালবাসবেন?”
সায়ক বলল “খুব। কেন বাসবেন না?”
মেহের বলল “আমার দেশ আলাদা যে? ধর্মও আলাদা তো!”
সায়ক বলল “মায়ের কাছে মেয়ের কোন ধর্ম হয় না মেহের। এ পৃথিবীতে একটাই ধর্ম থাকা উচিত, ভালোবাসা, আর সব কিছুর অস্তিত্ব বিপন্ন হোক”।
মেহের সায়কের হাত শক্ত করে ধরল।
বাইরের রাস্তায় প্রতিদিনের মত টহল দিচ্ছে পাকিস্তানী সেনা।
তারাও ক্লান্ত। বাড়ি ফিরতে চায় তারাও।
এ পৃথিবীর প্রতিটা পাখিই একদিন ঘরে ফিরতে চায়।
শত সহস্র যুদ্ধের পরেও…
Leave a Reply