ব্যোমকেশ সমগ্র – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম সংস্করণ: মে ১৯৯৫
প্রচ্ছদ: সুনীল শীল
.
প্রকাশকের নিবেদন
শরদিন্দু অম্নিবাস (প্রথম-দ্বাদশ খণ্ড) গ্রন্থে সঙ্কলিত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাসমূহ বিষয় অনুসারে এক একটি পৃথক খণ্ডে বিন্যস্ত করার পরিকল্পনা অনুসারে গোয়েন্দা গল্প ও উপন্যাসগুলি একত্রে ‘ব্যোমকেশ সমগ্র’ নামে প্রকাশিত হয় (মে ১৯৯৫)। শরদিন্দু অম্নিবাস-এর প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকা যথাক্রমে সুকুমার সেনের ‘ব্যোমকেশ-উপন্যাস’ এবং প্রতুলচন্দ্র গুপ্তের ‘ব্যোমকেশ, সত্যবতী, সত্যবতীর গাড়ি’ শীর্ষক রচনা দুটিও ‘ব্যোমকেশ সমগ্র’ গ্রন্থের প্রারম্ভে দেওয়া হয়।
গ্রন্থটির বর্তমান সংস্করণে (অক্টোবর ২০০০) সংযোজিত পরিশিষ্ট অংশে পুনর্মুদ্রিত হল শরদিন্দু অম্নিবাস দ্বাদশ তথা শেষ খণ্ডের প্রতুলচন্দ্র গুপ্তের লেখা ভূমিকা ‘ব্যোমকেশ ও সত্যবতীর প্রস্থান’ এবং দ্বিতীয় খণ্ডের পরিশিষ্টে প্রকাশিত পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের রচনা ‘ব্যোমকেশের সঙ্গে সাক্ষাৎকার’।
বিষয় হিসাবে রচনা বিন্যাসের দ্বিতীয় পর্যায়ে লেখকের সমুদয় ঐতিহাসিক উপন্যাস ও গল্প (পাঁচটি উপন্যাস: কালের মন্দিরা, গৌড়মল্লার, তুমি সন্ধ্যার মেঘ, কুমারসম্ভবের কবি ও তুঙ্গভদ্রার তীরে এবং সতেরোটি গল্প) একত্রে ‘ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র’ নামে প্রকাশিত হয়েছে (জানুয়ারি ১৯৯৮)।
তৃতীয় পর্যায়ে প্রকাশিত হয়েছে লেখকের সমুদর রোমান্টিক উপন্যাস (দাদার কীর্তি, বিষের ধোঁয়া, ঝিন্দের বন্দী, ছায়াপথিক, বহু যুগের ওপার হতে, রিমঝিম, রাজদ্রোহী, মনচোরা, অভিজাতক ও শৈলভবন), একত্রে ‘দশটি উপন্যাস’ নামে (সেপ্টেম্বর ২০০০)।
পরবর্তী পর্যায়ে আরও দুটি সঙ্কলন গ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনা করা হয়েছে। একটি, গোয়েন্দা ও ইতিহাস-আশ্রিত গল্প ছাড়া বাকি সমস্ত ছোট গল্পের সঙ্কলন ‘শরদিন্দু গল্পসংগ্রহ’। এই গল্পগুলি বিভিন্ন ধরনের—অলৌকিক, হাস্যকৌতুক, প্রেম এবং সামাজিক।
দ্বিতীয়টি, কিশোরদের জন্য লেখা রচনাগুলি একত্রে ‘কিশোর রচনা সমগ্র’।
ব্যোমকেশ-উপন্যাস
সাধারণ গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে ডিটেক্টিভ গল্প-উপন্যাসের জাতের তফাত আছে। ডিটেক্টিভ গল্প-উপন্যাসকে বলতে পারি একরকম শিকার-কাহিনী। অজানা কোন পশু মানুষের প্রাণহানি অথবা অন্যরকম ক্ষতি করেছে; খোঁজ করে, তাড়া করে, ফাঁদ পেতে, বেড়াজালে ঘিরে, কোণ-ঠেসা করে জব্দ অথবা হত্যা করা হল শিকারীর পেশা। আর, অজানা মানুষ জানা মানুষের প্রাণহানি অথবা অন্যরকম ক্ষতি করেছে; তার পরিচয় উদ্ধার করে, তাকে খুঁজে বার করে, তার অপরাধ প্রমাণযোগ্য করে তাকে বিচারালয়ে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অথবা তাকে দিয়ে অপরাধ স্বীকার করানো হল ডিটেক্টিভের কাজ। আবার, শিকার-কাহিনীর সঙ্গে ডিটেক্টিভ কাহিনীর তফাতও আছে, সে তফাত গুরুতর। শিকার-কাহিনী পুরোপুরি শিকারীর ব্যাপার, তার এক-তরফা কাহিনী। যে কাহিনীতে অন্বিষ্ট অপরাধী জন্তুর তরফ একেবারেই নেই। ডিটেক্টিভ-কাহিনী এমন এক-তরফা নয়, তা দো-তরফা—যেন দাবাবোড়ে খেলা। ডিটেক্টিভ বুদ্ধি খেলাচ্ছে অপরাধীকে মাত করতে, অপরাধী বুদ্ধি খাটাচ্ছে ডিটেক্টিভের চাল এড়িয়ে চলতে। এই দৃষ্টিতে, ডিটেক্টিভ কাহিনীতে দেখতে পাই দুটি ভিন্নমুখী স্রোত। তার মধ্যে একটি হল ডিটেক্টিভের কর্ম ও চিন্তা, কেন্দ্রস্থানীয় ও ধীরতর; দ্বিতীয়টি হল অপরাধীর কর্ম ও চিন্তা, উৎকেন্দ্রিক ও বিচঞ্চল। ডিটেক্টিভ কাহিনীর নায়ক বলতে গেলে একটি নয়, দুটি—অপরাধী এবং ডিটেক্টিভ। অপরাধী হল মূল কাহিনীর নায়ক, যে ঘটনাসূত্রের জট পাকিয়েছে। ডিটেক্টিভ নায়কের প্রতিপক্ষ নয়, নায়কের শত্রুও নয়, সে নায়কের অভিশাপ, তার কর্মফলের পেয়াদা, যে ঘটনাসূত্রের পাকানো জট খুলছে। অতএব বলা যায়, কাহিনীর পক্ষে ডিটেক্টিভ যেন বিধি, অধিনায়ক, যার মধ্যে রচয়িতাও খানিকটা আত্মগোপন করে থাকেন। ডিটেক্টিভ গল্পের পাত্রপাত্রীর একজন নয়, গোড়া থেকেই তিনি গল্পের আসরে পরিপূর্ণ স্বরূপে আসন গ্রহণ করেন। সুতরাং তাঁর স্বভাবের ও প্রকৃতির কোন আবর্তন-বিবর্তন বা রাখাঢাকা নেই কাহিনীসূত্রের বয়নে। তবে কোন লেখক যদি একই ডিটেক্টিভ নিয়ে কিছুকাল ধরে গল্প রচনা করতে থাকেন তবে কখনো কখনো তাঁর কাহিনীগুলির মধ্যে দিয়ে ডিটেক্টিভের জীবনসূত্রের কিছু কিছু টুকরা গাঁথা পড়ে যায়। এই ভগ্নাংশগুলি থেকে ধারাবাহিক জীবনীকাহিনী না পেলেও ডিটেক্টিভের ব্যক্তি-পরিচয়, তার আচার-ব্যবহার ও গৃহজীবনের ইঙ্গিত ইত্যাদি যা পাওয়া যায় তাতে আমরা ডিটেক্টিভকে যেন আমাদের পরিচিত সাধারণ মানুষের মেলায় কখনো কখনো দেখতে পাই। তার ফলে মূল কাহিনীতে এমন একটু অতিরিক্ত ভালোলাগার সঞ্চার হয় যার নাম দিতে পারি পরিচয়-রস। তাতে পাঠকের আগ্রহ বাড়ে। ইংরেজী ডিটেক্টিভ সাহিত্যে এর উদাহরণ অপ্রচুর নয়। বিশেষ করে দুটি ডিটেক্টিভের নাম করা যায় যাঁদের ব্যক্তিগত পরিচয় কাহিনী-পরম্পরায় গাঁথা হয়ে পাঠকের চিত্তে বাস্তবতা পেয়েছে—শার্লক হোম্স আর লর্ড পিটার উইম্সি। একদা অগণিত পাঠক-পাঠিকা শার্লক হোম্স যে রক্তমাংসের মানুষ নয়, সার আর্থার কোনান্ ডয়েলের কল্পনা-সৃষ্ট, সেকথা মানতে চাইত না। এখনকার ভক্ত পাঠকেরা তা মানলেও হোম্সকে সত্যিকার মানুষ ভাবতে ভালোবাসেন। এ ভালোলাগার ভালো পরিচয় তাঁর লন্ডনের বাসা নিয়ে গবেষণা, তাঁর আচার-আচরণ নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা, তাঁর “জীবনীগ্রন্থ” রচনা। মানি এ সবই ছেলেখেলা, তবে বুড়ো মানুষের ছেলেখেলা—এ একরকম “পরীর দেশের বন্ধ দুয়ারে হানা” দেওয়া। এ ছেলেখেলা প্রবীণ সাহিত্য-চিন্তার চেয়ে কম সার্থক নয়।
বাংলায় প্রথম মৌলিক ডিটেক্টিভ গল্প-কাহিনী ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন পাঁচকড়ি দে। এঁর অধিকাংশ রচনাই উপন্যাস এবং সেগুলির কয়েকটি বেশ বৃহৎকায়। ডিটেক্টিভ গল্প ইনি দু’চারটির বেশি লেখেন নি। পাঁচকড়িবাবু প্রধানভাবে অনুকরণ করেছিলেন ইংরেজ ঔপন্যাসিক উইল্কি কলিন্সের রচনা এবং ফরাসী ডিটেক্টিভ-উপন্যাস লেখক এমিল গাবোরিয়োর ইংরেজী অনুবাদ। পরে কোনান্ ডয়েলের কাহিনী বার হলে তিনি ডয়েলের রচনা থেকেও মালমশলা কিছু কিছু নিয়েছিলেন। তবে পাঁচকড়িবাবু শার্লক হোম্সকে ছোঁন নি। এঁর ডিটেক্টিভেরা পুলিস কর্মচারী (কর্মনিরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত) কেননা তখনো ডয়েলের হোম্সের মতো স্বাধীন-কারবারী ডিটেক্টিভের রেওয়াজ হয় নি। তবে, তিনি একটু অগ্রগামীর কাজ করেছিলেন কোন কোন বিষয়ে। তাঁর দুটি প্রধান ডিটেক্টিভের ব্যক্তি-পরিচয় পুরোপুরি নেপথ্যে রাখেন নি, এমন কি তাঁদের দু’জনের মধ্যে একরকম পারিবারিক সম্বন্ধও স্থাপন করে দিয়েছিলেন। যাঁরা পাঁচকড়িবাবুর উপন্যাস ছেলেবেলায় আগ্রহ করে পড়েছেন তাঁদের হয়ত মনে পড়বে যে অরিন্দম বসু ছিলেন দেবেন্দ্রবিজয় মিত্রের দাদাশ্বশুর-স্থানীয়। নাত-জামাই দাদাশ্বশুরের অনুগত শিষ্য ছিল, দাদাশ্বশুর নাত-জামাইয়ের উন্নতিকামী ছিলেন। তার বেশি খবর কিছু নেই।
পাঁচকড়িবাবু আরও এক বিষয়ে অগ্রগামী ছিলেন। তিনি প্রবীণ ডিটেক্টিভকে নবীনের সমভূমিতে রাখেন নি, ঊর্ধ্বভূমিতে তুলেছেন। অরিন্দম যাকে বলে super-sleuth১ তাইই। এই super-sleuth আইডিয়াটি তখনো পাশ্চাত্য ডিটেক্টিভ-কাহিনী লেখকদের মাথায় ভালো করে আসে নি। কোনান্ ডয়েলের এসেছিল কিন্তু একটি ছাড়া তাঁর কোন গল্পে super-sleuth নেই। যে গল্পটিতে আছে সেখানেও তা ইঙ্গিতে প্রদর্শিত। ডয়েলের super-sleuth হল শার্লক হোম্সের দাদা মাইক্রফ্ট হোম্স, গভর্নমেন্ট আপিসের কেরানি। (গল্পটি যে পাঁচকড়িবাবুর পড়া ছিল, তার প্রমাণ আছে ‘নীলবসনা সুন্দরী’তে। সেখানে অরিন্দম ঠিক হোম্সের দাদার মতোই গোয়েন্দাবাজি করেছিলেন)। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, super-sleuth কল্পনার বীজ আমাদের দেশে অনেক কালের। চোর ছাড়া কেউ চোর ধরতে পারে না,—এই ধারণার বশে আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে ঘাগী চোরকে বশ করে পুলিসের কাজ করানো হত। তাই হাজার বছর আগেকার প্রবাদ ছড়ায় বলেছে, “জো সো চৌর সোউ দুষাধী” অর্থাৎ যে সে চোর, সেই শাস্তিদাতা। চুরি সেকালেও অপরাধ বলে গণ্য হত, এমন কি চুরির সাজায় প্রাণদণ্ড হত, তবুও লোকবিশ্বাসে চুরি বাহাদুরির কাজ বলে লোকে মনে মনে তারিফ করত (অন্তত গল্প-কথায়), এবং চৌর্যবৃত্তি দক্ষ শিল্পীর বিদ্যায় পরিণত হয়েছিল। “চুরি বিদ্যে বড় বিদ্যে, যদি না পড়ে ধরা।” ছেলেভুলানো গল্পে যে “বড়” চোরের দেখা পাই তিনিই তখনকার দিনের বড় পুলিস এবং এখনকার দিনের শার্লক হোম্সের বড় ভাই মাইক্রফ্ট হোম্সের ভারতীয় পূর্বপুরুষ।
ছেলেভুলানো গল্পের চোর নায়ক super-criminal২ এবং super-sleuth একাধারে। ঠিক এমনি ভূমিকা সৃষ্টি করেছেন একজন ফরাসী ডিটেক্টিভ-কাহিনী লেখক মরিস ল ব্লাঁ। তাঁর গল্প-উপন্যাসের নায়ক আরস্যান্ লুপ্যাঁ যুগপৎ “চৌর” এবং “দুষাধী”। ল ব্লাঁর কোন কোন কাহিনীতে লুপ্যাঁ হোম্সের প্রতিপক্ষও হয়েছে। আমাদের সাহিত্যে এমন চোর-পুলিস গল্পের সৃষ্টি হলে মন্দ হয় না। (শরদিন্দুবাবু কি বলেন?)।
বাংলাভাষায় নবীন ধারায় ডিটেক্টিভ গল্প-কাহিনীর সৃষ্টিকর্তা শ্রীযুক্ত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় কোনান্ ডয়েলের অনুসরণে একটিমাত্র ডিটেক্টিভ ভূমিকার অবতারণা করেছেন তাঁর দীর্ঘদিনের গল্পমালার নায়করূপে৩। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীর প্রথম আবির্ভাব হয়েছিল ‘সত্যান্বেষী’ গল্পে। ব্যোমকেশ পুলিসের চাকরি করেন না, ডিটেক্টিভগিরি তাঁর জীবিকার্থে নয়, সখের, খেয়ালের। সত্য ও তথ্যের অনুসন্ধানে তাঁর স্বভাবসঙ্গত নিঃস্বার্থ জিজ্ঞাসাবৃত্তি ছিল (লর্ড পিটার উইম্সির মতো), তা-ই তাঁকে হোম্সের মতো দৌঃসাধিক করেছিল। হোম্সের সঙ্গে ব্যোমকেশের মিল-নামের মধ্যে অনুপ্রাসের ঝঙ্কারটুকু কানে না তুললে—ওই পর্যন্তই। ব্যোমকেশ হোম্সের মতো উৎকেন্দ্রিক প্রকৃতির নয়, বিজ্ঞানদক্ষ নয়, গুণী বেহালাদার নয়, নেশাখোরও নয়, সে বর্তমান শতাব্দীর তৃতীয় দশকের বাঙালী যুবক,—শিক্ষিত, মেধাবী, তীক্ষ্ণদৃষ্টি, সংযতবাক্, সহৃদয়। তাঁর চারিত্র্যে মনস্বিতা ও গাম্ভীর্য ছাড়া এমন কিছু নেই যাতে তাঁকে সমান স্তরের সমান বয়সের বাঙালী ছেলের থেকে স্বতন্ত্র মনে করতে হয়। সুতরাং সখের ডিটেক্টিভ বাঙালী ছেলে রূপে ব্যোমকেশ বক্সী সম্পূর্ণ সুসঙ্গত ও সার্থক সৃষ্টি। তাঁর চরিত্রের মতো নামটিও বেশ খাপ খেয়েছে। “ব্যোমকেশ” নামের ধ্বনিগুচ্ছে ধোঁয়া, বুঁদ হয়ে থাকা, ধ্যানমগ্ন মহাদেব, ইত্যাদি প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক শব্দের ইশারা আছে। হয়ত রবীন্দ্রনাথের “পঞ্চভূত”-পঞ্চায়েতের প্রধানেরও চরিত্রাভাস আছে। ডয়েলের ডিটেক্টিভের নামের প্রতিধ্বনির কথা আগে বলেছি। ব্যোমকেশের পদবীও সমান সার্থক। ব্যোমকেশ পুলিসের মতো চাকরি করেন না, উকিলের মতো ফীও নেন না। তবে বক্শিশের—প্রশংসা, যশ, আত্মতৃপ্তি ইত্যাদি ফাঁকা দক্ষিণার—প্রত্যাশা অবশ্যই করেন। তাই ব্যোমকেশের পদবী স-বর্জিত বক্সী।৪
ডিটেক্টিভের সহচর—সহকারী নয়, সুহৃদ্—ভূমিকার সৃষ্টি করেছিলেন কোনান্ ডয়েল। শার্লক হোম্সের বন্ধু ডাক্তার ওয়াটসনও তাঁর সঙ্গে ইংরেজী সাহিত্যে অমরতাপ্রাপ্ত। অজিত কিন্তু ওয়াটসনের বাংলা সংস্করণ নয়। হোম্স ও ওয়াটসনের মধ্যে বয়সের বেশ তফাত ছিল, মানসিক বৃত্তিতেও অসমতা ছিল। অজিত ব্যোমকেশের প্রায় সমান বয়সী এবং তাহাদের মনোবৃত্তি সমান ভূমির। অজিতকে সমসাময়িক ভদ্র বাঙালী যুবকের টাইপ বলা যায়। ব্যোমকেশ-অজিতের সহযোগিতায় শরদিন্দুবাবুর গল্প-কাহিনী তর্তর্ করে বয়ে যায়। হোম্স ওয়াটসনের সহযোগিতা ওদের মতো অত ঘনিষ্ঠ ছিল না। সেই জন্যেই হয়ত তাতে অন্য রসের আমদানি সহজ হয়েছে। পৌরাণিক উপমা টেনে এনে বলা যায় হোম্স আর ওয়াটসন যেন কৃষ্ণ আর উদ্ধব, ব্যোমকেশ আর অজিত যেন কৃষ্ণ আর সুবল।
লব্ধপ্রতিষ্ঠ সখের ডিটেক্টিভরূপে ব্যোমকেশের প্রথম প্রবেশ ছদ্মবেশে ‘সত্যান্বেষী’ গল্পে। কলকাতার চীনাবাজার (?) অঞ্চলে একদা মাসের পর মাস খুন হচ্ছিল, তাতে পুলিসের কর্তৃপক্ষ বেশ বিব্রত হয়ে উঠেছিলেন। একদিকে বেঙ্গল গভর্নমেন্ট, অন্যদিকে খবরের কাগজওয়ালারা পুলিসকে ভিতরে-বাইরে খোঁচা দিয়ে আরও অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। এমন অবস্থায় একদিন ব্যোমকেশ পুলিসের বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করে বললেন, “আমি একজন বে-সরকারী ডিটেক্টিভ, আমার বিশ্বাস আমি এই খুনের কিনারা করতে পারব।” পুলিস কমিশনারের অনুমতি নিয়ে ব্যোমকেশ সেই অঞ্চলে এক মেসে কিছুদিনের জন্যে ঠাঁই নিলেন। মেসের কর্তা ঠাঁই নেই বলাতে একজন মেসবাসী অনুকম্পা পরবশ হয়ে নিজের ঘরে স্থান দিয়েছিলেন। সে মেসবাসীর নাম অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সূত্রে রুম-মেট দু’জনের বন্ধুত্ব-সংযোগ এবং অভেদ্য বন্ধন। সে ১৩৩১ সালের কথা।
অজিতের মেসে ব্যোমকেশ এসেছিল ছদ্মনাম নিয়ে—অতুলচন্দ্র মিত্র। দেখে অজিত অনুমান করেছিল, “তাহার বয়স বোধকরি তেইশ-চব্বিশ হইবে, দেখিলে শিক্ষিত ভদ্রলোক বলিয়া মনে হয়। গায়ের রং ফরসা, বেশ সুশ্রী সুগঠিত চেহারা—মুখে চোখে বুদ্ধির একটা ছাপ আছে।”
অজিতের বয়সও তখন ওই রকম, হয়ত এক আধ বছর কম। সে “বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলি শেষ করিয়া সবেমাত্র বাহির” হয়েছে। সংসারে বন্ধন নেই। বাপ ব্যাঙ্কে টাকা রেখে গেছেন, তার সুদে স্বচ্ছন্দে একলা জীবন কাটানো যাবে। অজিত স্থির করেছে “কৌমার্য ব্রত অবলম্বন করিয়া সাহিত্যচর্চায় জীবন অতিবাহিত” করবে। তবে তখন পর্যন্ত সাহিত্যসাধনায় আদি-পর্বের উদ্যোগই চলছিল। অতঃপর ব্যোমকেশের তাঁবে এসে সে বান্ধবের চরিত-কথার ব্যাসরূপে একেবারে সভাপর্বে অবতীর্ণ হল।
ব্যোমকেশ থাকত হ্যারিসন রোডের উপর—মনে হয় কলেজ স্ট্রীট ও আমহার্স্ট স্ত্রীটের মাঝামাঝি কোন স্থানে, নম্বর বলা নেই—একটা বাড়ির তিন তলাটা ভাড়া নিয়ে। সবসুদ্ধ চার-পাঁচখানা ঘর। সংসারের দ্বিতীয় ব্যক্তি পরিচারক পুঁটিরাম। ব্যোমকেশের নির্বন্ধে অজিত এসে তৃতীয় ব্যক্তিরূপে অধিষ্ঠিত হল। পুঁটিরাম সময়মত চা করে দেয়। জলখাবার জোগায়। রান্নাবান্না করে। চৌকস কাজের লোক।
ব্যোমকেশের ফ্ল্যাটের দরজার পাশে পেতলের ফলকে লেখা ছিল দু’ছত্র—শ্রীব্যোমকেশ বক্সী/ সত্যান্বেষী। সত্যান্বেষী মানে কি জিজ্ঞাসা করায় অজিতকে ব্যোমকেশ বলেছিল, “ওটা আমার পরিচয়। ডিটেক্টিভ কথা শুনতে ভাল নয়,৫ গোয়েন্দা শব্দটা আরও খারাপ। তাই নিজের খেতাব দিয়েছি সত্যান্বেষী।” আর একদিকেও খেতাবটা সার্থক হয়েছিল। ব্যোমকেশ পরে যে মেয়েটিকে বিয়ে করলেন তার নাম সত্যবতী। ডরোথি সেয়ার্সের ডিটেক্টিভ লর্ড পিটার উইম্সির সঙ্গে হ্যারিয়েট ডেনের বিবাহ ঘটনার সূত্র অনেকটা যেন এমনিই। তবে সত্যবতী নিজে কোন হত্যাকাণ্ডের আসামী ছিল না, তা ছিল তার দাদা। হ্যারিয়েট ডেন নিজেই সন্দিগ্ধ আসামী ছিল।
ব্যোমকেশের ধরন-ধারণ সাধারণ বাঙালী ভদ্রলোকের মতোই। তাঁর অসামান্যতার পরিচয় সহজে পাওয়া যেত না। “বাহির হইতে তাহাকে দেখিয়া বা তাহার কথা শুনিয়া একবারও মনে হয় না যে, তাহার মধ্যে অসামান্য কিছু আছে। কিন্তু তাহাকে খোঁচা দিয়া, প্রতিবাদ করিয়া, একটু উত্তেজিত করিয়া দিতে পারিলে ভিতরকার মানুষটি কচ্ছপের মত বাহির হইয়া আসে। সে স্বভাবত স্বল্পভাষী, কিন্তু ব্যঙ্গবিদ্রূপ করিয়া একবার তাহাকে চটাইয়া দিতে পারিলে তাহার ছুরির মত শাণিত ঝকঝকে বুদ্ধি সংকোচ ও সংযমের পর্দা ছিঁড়িয়া বাহির হইয়া পড়ে, তখন তাহার কথাবার্তা সত্যই শুনিবার মত বস্তু হইয়া দাঁড়ায়।”
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-প্রাপ্তির পরেও কিছুকাল ব্যোমকেশরা হ্যারিসন রোডের বাসায় ছিল। তখন ব্যোমকেশের খোকা হয়েছে এবং ব্যোমকেশ রীতিমত সংসারী। কিন্তু আগেকার মতোই সে স্বকর্মনিরত ও নির্বিচল। অজিত ব্যোমকেশের কীর্তিগাথা পরের পর লিখে ও ছাপিয়ে চলেছে। তারা বইয়ের দোকান খুলেছে। তাতে অর্থাগম বেড়েছে। হ্যারিসন রোডের বাড়িতে আর চলছে না। ১৯৬৮ সালের দিকে “অজিত আর ব্যোমকেশ মিলে দক্ষিণ কলিকাতায় জমি কিনেছে, নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে; শিগ্গিরই তারা পুরনো বাসা ছেড়ে কেয়াতলায় চলে যাবে। অজিত একদিকে বইয়ের দোকান চালাচ্ছে অন্যদিকে বাড়ির তদারক করছে”। অজিতের এখন সময়ের টানাটানি যাচ্ছে, ধীরে সুস্থে ব্যোমকেশের কাহিনী লেখবার অবসর পাচ্ছে না। তার লেখার ভঙ্গিও ব্যোমকেশের আর পছন্দ হচ্ছে না; সেকেলে একঘেয়ে বলে মনে হচ্ছে। (সেজন্যে নিশ্চয়ই বইয়ের বিক্রি কমে নি।) হয়ত ব্যোমকেশের সাহিত্যিক হবার বাসনা জেগেছে। যাই হোক, ব্যোমকেশ এখন নিজেই নিজের কীর্তিগাথা লিপিবদ্ধ করবে বলে ঠিক করেছে। তাড়াতাড়ি লিখেও ফেলেছে একটা (‘বেণীসংহার’)। তবে পাঠকেরা অজিতের লেখনীর অনুপস্থিতি এখনো উপলব্ধি করে পারে নি। এই অবস্থা বর্তমানে চলছে। তবে আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে সত্যান্বেষীর দৃষ্টি বুঝি বা অতঃপর কলমের ডগাতেই মাছি হয়ে আটকে যায়। কল্পনাজাল কী সত্যান্বেষীকে সাহিত্যের রসে জারিয়ে দেবে? ব্যোমকেশ চরিতের ব্যাসরূপে অজিতের পুনরাবির্ভাবে আমরা পাঠকেরা খুশি হব। বোধকরি সত্যবতীও হবেন।
শরদিন্দুবাবুর ডিটেক্টিভ কাহিনীর আলোচনায় নেমে তাঁর ডিটেক্টিভ সম্বন্ধেই সাতকাহন করলুম। কেন যে তা, কৈফিয়ৎ অনেকে চাইতে পারেন বলে এখানে দিয়ে রাখি। ডিটেক্টিভ গল্পের প্রধান আকর্ষণ গল্পের কাহিনীতে—তার ঘটনার অভিনবত্বে, তার প্লটের প্যাঁচে, তার ভূমিকাগুলির স্বভাবসঙ্গতিতে, ঘটনা-পরম্পরার অনপেক্ষিততায় এবং সব মিলিয়ে অনন্যতায় অথচ সম্ভাব্যতায়। গৌণ আকর্ষণ থাকে ডিটেক্টিভের ব্যক্তিত্বে—তার আচরণে, বুদ্ধি প্রাখর্যে এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে। কোন এক লেখক যদি অনেক ডিটেক্টিভ কাহিনী লেখেন তবে তিনি সাধারণত ডিটেক্টিভ পাল্টান না। বড় জোর দু’জন (যেমন আগাথা ক্রিষ্টি) অথবা তিনজন (যেমন রেক্স্ স্টাউট)। (প্রত্যেক গল্পের জন্য আলাদা করে ডিটেক্টিভ সৃষ্টি বোধহয় চতুর্মুখেরও অসাধ্য।) সুতরাং পরপর গল্পে ডিটেক্টিভকে নিয়ে পাঠকের ঔৎসুক্য বাড়তে থাকে এবং এমনও হয় যে প্লটের নিপুণতার চেয়ে ডিটেক্টিভের চারিত্র্য গল্প-কাহিনীকে বেশি স্বাদু করে। আমার মতো যাঁরা ডিটেক্টিভ গল্পের মৌতাতী ভক্ত (fans) তাঁরা একথার মর্ম বুঝবেন। শার্লক হোম্স, ডাক্তার থর্নডাইক, ফাদার ব্রাউন, এর্ক্যুল পোয়ারো, মিস পার্পল, লর্ড পিটার উইম্সি, ইন্সপেক্টর ফ্রেঞ্চ, এলবার্ট ক্যাম্পিয়ন, এ্যাপ্লবি, নিরো উল্ফ, টিকাম্সে ফক্স, ডাক্তার গিডিয়ন ফেল, এলেরি কুইন, জজ ডী, ইন্সপেক্টর চাফিক্ ইত্যাদির মেলায় ব্যোমকেশ বক্সীর স্থান। সাহিত্য-লোকের ডিটেক্টিভদের মধ্যে এই বিষয়ে ব্যোমকেশের যোগ্যতা কিছু কম নয়। ব্যোমকেশের গল্পগুলির মধ্যে তাঁর নিজের প্রসঙ্গ যেমন ধারাপতিত হয়ে উপস্থাপিত এমন কোন বিদেশী উদাহরণ মনে আসছে না।
গল্প-লেখক এবং ডিটেক্টিভ-কাহিনী লেখকরূপে শরদিন্দুবাবুর দক্ষতা প্রথম গল্পটিতেই প্রকটিত এবং সে দক্ষতা পরে একটুও খর্ব অথবা ম্লান হয় নি। একঘেয়েমি কাটিয়ে ডিটেক্টিভ গল্প লেখা বেশ দুরূহ ব্যাপার। এবং তার উপর আরও একটা কথা আছে। যাঁর প্রথম গল্প, কবিতা বা উপন্যাস উৎকৃষ্ট হয়েছে। এমন অনেক বাঙালী লেখকের নাম করা যায়। কিন্তু প্রথমবার ভালো লেখার উচ্চমান পরবর্তী রচনা পরম্পরায় অব্যাহত রাখতে পেয়েছেন এমন লেখকের সংখ্যা আমাদের দেশে খুবই কম। শরদিন্দুবাবু সেই খুব কম লেখকদের একজন।
শরদিন্দুবাবুর গল্পের গুণ বহুগুণিত করেছে তাঁর ভাষা। কাহিনীকে ভাসিয়ে তাঁর ভাষা যেন তর্তর্ করে বয়ে গেছে সমাপ্তির সাগরসঙ্গমে। সে ভাষা সাধু না চলিত বলা মুশকিল। বলতে পারি সাধু-চলিত কিংবা চলিত-সাধু। শরদিন্দুবাবুর স্টাইল তাঁর নিজেরই—স্বচ্ছ, পরিমিত, অনায়াসসুন্দর ॥
১৩-৬-৭০
শ্রীসুকুমার সেন
—
১ অতিশায়ী ডিটেক্টিভ।
২ অতিশায়ী অপরাধী।
৩ ‘নায়ক’ শব্দটির এক মানে ছিল মধ্যমণি।
৪ তুলনা করতে ইচ্ছা হয় রেক্স স্টাউটের দ্বিতীয় ডিটেক্টিভের পদবী (Fox)-এর সঙ্গে।
৫ রবীন্দ্রনাথের ‘ডিটেক্টিভ’ গল্প পড়ার ফলে কি?
.
ব্যোমকেশ, সত্যবতী, সত্যবতীর গাড়ি
গত চল্লিশ বছরে ইংলণ্ডে গোয়েন্দা কাহিনীর পরিচিত রীতির পরিবর্তন হয়েছে। জনপ্রিয় কাহিনীতে যে পরিচিত গোয়েন্দাদের মুখ ঘন ঘন চোখে পড়ত এখন তাঁদের চেহারার বদল হয়েছে। এই সাম্রাজ্যের যাঁরা পুরনো অধীশ্বর কিম্বা অধিশ্বরী তাঁরা গোয়েন্দা সম্রাটদের পরিত্যাগ না করলেও রহস্য সমাধান করবার জন্য নতুন মুখের আমদানী করেছেন। তাঁরা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অথবা ডীন, কেউ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, কেউ গ্রামের বৃদ্ধা মহিলা, লর্ড অমুক বা লর্ড অমুকের আত্মীয়। যুদ্ধ ফেরৎ প্রায়-বেকার ও তাঁর প্রণয়িনীও গোয়েন্দাগিরির যৌথ কারবার খুলেছেন। আগে লেখকরা প্রায়ই বেসরকারী গোয়েন্দাই পছন্দ করতেন। প্রসঙ্গক্রমে সরকারী গোয়েন্দাদের অকর্মণ্যতার কথা বলে একহাত নেওয়া যেত। এখন উপন্যাস জগতের যাঁরা নামী গোয়েন্দা তাঁদের মধ্যে সরকারী বেসরকারী দু’ রকমই আছেন। লেখক বা পাঠকদের পক্ষপাত নেই। আমেরিকান ডিটেকটিভ গল্প-উপন্যাসে আরও কিছু রকমফের দেখতে পাওয়া যায়। তবে যাকে নিছক গোয়েন্দা কাহিনী বলে অর্থাৎ রহস্য উন্মোচন যার প্রধান কাজ, সে ধরনের লেখা কমে এসেছে। প্রায়ই বলা হয় গোয়েন্দা কাহিনীর দিন ফুরিয়ে এসেছে। এখন ‘ক্রাইম ফিকশনের’ যুগ।
ষাট সত্তর বছর আগে বাংলাদেশে গোয়েন্দা কাহিনীর শৈশব অবস্থা ছিল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের দারোগার দপ্তরের নাম উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সে তার সাহিত্যগুণের জন্য নয়, প্রাচীনত্বের জন্য। এক সময় পাঁচকড়ি দে এক শ্রেণীর পাঠকের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাঁর বহু গ্রন্থ অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। পাঁচকড়ি দে অনেক কাহিনী বিদেশী লেখকদের রচনা থেকে গ্রহণ করেছেন, কিম্বা অনুবাদ করেছেন। এখন তাঁর উপন্যাসের বিজ্ঞাপনও বিরল হয়ে এসেছে। কিছুদিন পূর্বে তাঁর একজন পাঠক সাময়িক পত্রিকায় পাঁচকড়ি দে’র বইয়ের পুনর্মুদ্রণের অনুরোধ করেছিলেন। এক সময় যে-বইয়ের প্রচুর ভক্ত ছিল পরবর্তীকালে তার অনুরাগী পাঠক পাওয়া যায় না। পাঁচকড়িবাবু বিদেশী গোয়েন্দাকে অনেক সময় বাঙালীর বেশে উপন্যাসে উপস্থিত করেছেন। অন্তত একটি গ্রন্থে শার্লক হোমস বাঙালী পোশাকে অবতীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু যে-লেখক সবচেয়ে বেশি সংখ্যক তরুণ পাঠক আকর্ষণ করেছিলেন, তিনি দীনেন্দ্রকুমার রায়। তিনিও বিদেশী গ্রন্থ কিম্বা পত্রিকা থেকে আখ্যায়িকা গ্রহণ বা প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন। পাঁচকড়িবাবুর সঙ্গে তাঁর তফাৎ এই যে তিনি বিদেশীদের দেশী সাজ কিম্বা নাম পরাননি এবং ঘটনাস্থলও অবিকৃত রেখেছেন। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রবার্ট ব্লেক সিরিজের দোষগুণ যাই থাক ছেলেবয়সে লন্ডনের এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভূগোল শিক্ষার এমন সহজ উপায় আর ছিল না। টেমস নদীর বাঁধ, শহরের দক্ষিণে ফুলহাম পল্লী, ক্রয়ডনের বিমানঘাঁটি, সোহোপাড়া কিম্বা পিকাডেলির সঙ্গে তরুণ বয়সে প্রথম রুদ্ধনিশ্বাস পরিচয় রবার্ট ব্লেকের সৌজন্যে সম্ভব হয়েছিল। তাঁর গোয়েন্দা কাহিনীর জনপ্রিয়তার ফলে দীনেন্দ্রকুমার রায়ের সাহিত্যকীর্তি ‘পল্লীচিত্র’, ‘পল্লীবৈচিত্র্য’ তাঁর জীবদ্দশাতেই দেশবাসী বিস্মৃত হয়েছেন। প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্বে পাঠকেরা খুব সহিষ্ণু ছিলেন, সহজে বিচলিত হতেন না। একটি বহু পঠিত উপন্যাসে আছে একজন গোয়েন্দা হাওড়া স্টেশন ছাড়বার এক ঘন্টা পরেই ট্রেন থেকে পর্বতমালা ও ঝরনার শুভ্র রেখা দেখতে পেলেন। অন্য একজন প্রাচীন লেখকের একটি উপন্যাসে আছে একজন গোয়েন্দা “বৃক্ষকোটরে অনুবীক্ষণ লাগাইয়া” দূরবর্তী বাড়িতে ডাকাতদের দুষ্কৃতি দেখতে পেলেন। আজকালকার পাঠকরা হলে মার্জনা করতেন না।
এখনকার বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত কয়েকটি অদ্ভুত-রসের এবং রহস্যের গল্প লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে সায়েন্স ফিকশন-এর জন্মদাতা বলতে গেলে তিনিই। তাঁর রহস্যসৃষ্টি করতে অরুচি ছিল না। কিন্তু তিনি গোয়েন্দা কাহিনী লেখেননি। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অন্তত একটি, যাকে ক্রাইম স্টোরি বলা হয়, খুব গুছিয়ে লিখেছেন। আর একটি গল্পে একটি রেল স্টেশনের গুদামঘরে একদল বরযাত্রী এবং গোবর্ধন নামে একজন গোয়েন্দা কাহিনীর লেখককে নিয়ে পরিহাস করেছেন; কিন্তু গোয়েন্দা কাহিনী লিখবার ইচ্ছা তাঁর ছিল না। গোয়েন্দা কাহিনী তখনও অপাংক্তেয়। ‘ভারতী’র দল ও ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর কেউ কেউ ছোটদের জন্য অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য ও গোয়েন্দা কাহিনী লিখতেন। সেগুলি খুব জনপ্রিয়ও হয়েছিল। কিন্তু বড়দের কথা তাঁরা ভাবেননি।
রবীন্দ্রনাথ কোনও গল্পে একটি চরিত্রের ডিটেকটিভ বৃত্তির প্রবণতার প্রতি কৌতুক কটাক্ষপাত করেছেন। জানতে ইচ্ছা হয় তিনি ডিটেকটিভ বই কখনও পড়তেন কিনা। কোনান ডয়েলের কোনও কোনও লেখা পড়ে থাকতে পারেন। এডগার এ্যালেন পোর লেখার সঙ্গেও তাঁর নিশ্চয় পরিচয় ছিল। কিন্তু অন্য কিছু? তাঁর চিঠিপত্রেও বোধহয় এর উল্লেখ নেই।
ব্যোমকেশ বক্সীর প্রথমদিকের গল্পগুলি তাঁর বন্ধু অজিতের মুখ থেকে শোনা। সন ১৩৩১ সাল, অর্থাৎ এখন থেকে সাতচল্লিশ বছর আগে ব্যোমকেশের সঙ্গে তার পরিচয়। দু’জনেই হ্যারিসন রোডের একই মেসের বাসিন্দা। পরিচয় অন্তরঙ্গতায় পরিণত হতে দেরি হয়নি। অজিতের সাহিত্যচর্চার অভ্যাস বরাবরই ছিল। ব্যোমকেশের কাহিনী প্রথমদিকে আমরা তার কলমের মারফৎ শুনেছি। কিন্তু অজিত ঠিক ডাক্তার ওয়াটসন কিম্বা ক্যাপ্টেন হেস্টিংস নয়। ওয়াটসনের প্রতি শার্লক হোমসের এবং হেস্টিংসের প্রতি পোয়ারোর কিঞ্চিৎ স্নেহমিশ্রিত করুণার ভাব ছিল। ওয়াটসন এবং হেস্টিংস মনে করি শেষ পর্যন্ত কোনান ডয়েল কিম্বা পোয়ারোর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। অজিতের সঙ্গেও ব্যোমকেশের বন্ধুত্ব ক্ষুন্ন হয়নি। কিন্তু দুটি কথা বলা দরকার। প্রথমত, কয়েক বছর পরে অজিতকে সরিয়ে দিয়ে শরদিন্দুবাবু নিজে কথকের আসন গ্রহণ করেছেন। সম্ভবত অজিতের সাহিত্যচর্চার ফল ব্যোমকেশকে খুশি করতে পারেনি। দ্বিতীয় কথা হচ্চে ব্যোমকেশ বক্সীর জীবনে সহসা একটি মহিলার আবির্ভাব। শার্লক হোমস কোনও মহিলার জন্য উদ্বেলিত-হৃদয় হয়েছেন, কিম্বা পোয়রোর হৃদয় বিচলিত হয়েছে একথা ভাবা যায় না। কিন্তু সবাই একরকম নন। লর্ড পিটার উইম্সিও আছেন। একটি খুনের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে একটি কৃশাঙ্গী কালো মেয়ের সঙ্গে ব্যোমকেশের দেখা হয়। মেয়েটির দাদাকে পুলিস একটি মামলায় ভুল করে জড়িয়েছিল। লর্ড পিটার উইম্সির সঙ্গে হ্যারিয়েট ডেনের পরিচয়ও একটি খুনের মামলাকে উপলক্ষ্য করে।
বিয়ের পরেও ব্যোমকেশ-সত্যবতী হ্যারিসন রোডের মেসের তিনতলার অংশে কয়েক বছর বসবাস করেছিলেন। সঙ্গে অজিতও। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর কলকাতা শহরের চরিত্র বদল গেল। হ্যারিসন রোড অঞ্চল তখন আর সত্যবতীর পছন্দ হবার কথা নয়। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার কয়েক বছর পর ব্যোমকেশ আর অজিত লেকের কাছে কেয়াতলায় এক টুকরো জমি কিনে বাড়ি করেছে। ব্যোমকেশের নামডাক যতই হোক পশার তত সুবিধার হয়নি। তাছাড়া বয়স হচ্চে। অজিত তখন বইয়ের ব্যবসায় মন দিয়েছে। ব্যোমকেশের কাহিনী লিখে তার কি রকম আয় হত জানবার উপায় নেই। শরদিন্দুবাবুর জন্য সে রোজগারের পথও বন্ধ হয়েছে। গল্প বলার ভঙ্গীরও একটু বদল হয়েছে।
১৯৬৪ সালে সেপ্টেম্বর মাসের শরদিন্দুবাবুর একটি চিঠিতে এই কথার উল্লেখ আছে—“ব্যোমকেশকে এবার একটু নতুন বেশে দেখবেন। আপনাদের হুকুমে কেয়াতলায় ব্যোমকেশের বাড়ি তৈরি হচ্চে, গৃহপ্রবেশও অনতিবিলম্বে হবে। অজিতকে বক্তার আসন থেকে সরিয়ে দিয়েছি এবং চলিত ভাষার প্রবর্তন করেছি।” কিছুদিন পরের আর একটি চিঠিতে আছে—“অজিতকে বক্তার গদি থেকে নামিয়ে দেবার জন্যে কেউ কেউ চটেছেন। তবে ভরসা রাখি নতুন পরিবেশ ক্রমে অভ্যাস হয়ে যাবে।” এ আশঙ্কা অমূলক নয়। অজিতের অপসারণে পাঠকরা যে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলেন তা মনে হয় না।
গোয়েন্দা কাহিনীর মধ্যে যা সাহিত্যপদবাচ্য তার কোনও কোনও চরিত্র পাঠকদের কাছে সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠে, তার নজির আছে। সত্যবতী-ব্যোমকেশ নতুন বাড়িতে আসবার পরে তারা কোনও কোনও পাঠকের কাছে কেবল আর গল্পের চরিত্র হয়ে নেই। কেয়াতলা পাড়ার কেউ কেউ তাদের প্রতিবেশী বলে ভাবতে আরম্ভ করেছিলেন।
কলকাতায় তখন ট্যাক্সির খুব দুর্ভিক্ষ। শরদিন্দুবাবুকে লিখলুম ওদের নিশ্চয় খুব অসুবিধা হচ্ছে। আপনি যখন বাড়ি করে দিয়েছেন, এবার সত্যবতীকে একটি গাড়ি কিনে দিন। আমি দেখেছি বিয়ের নিমন্ত্রণে যাবে বলে ওরা দু’জনে গোলপার্কের কাছে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার অবহেলা করে চলে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সত্যবতীর প্রসাধন বাসী হয়ে এসেছে। আর একদিন দেখলুম গড়িয়াহাট থেকে বাজার করে সত্যবতী রিক্সা করে বাড়ি যাচ্চে। গ্রন্থকারের পাষাণ-হৃদয় গলল না। আমাকে লিখলেন—“সত্যবতীর ডিমান্ড ক্রমে বেড়েই যাচ্চে। বাড়ি পেয়েছে তাতেও তৃপ্তি নেই। এখন গাড়ি চাই। বেচারা ব্যোমকেশ কোথা থেকে পায় বলুন দেখি। সত্যবতীকে একটা অটো-রিক্সা কিনে দিলে হয় না? কথাটা বিবেচনা করে দেখবেন।”
কলকাতা পুণা নয়। এখানে অটো-রিক্সার লাইসেন্স পাওয়া যাবে না। তাছাড়া কে শুনেছে বিখ্যাত গোয়েন্দা কিম্বা তাঁদের পত্নী রিক্সা চড়ে ঘুরে বেড়ান? ষাট বছর আগেও গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয় ছ্যাকড়া গাড়ি ছাড়া বের হতেন না। একটা ফর্দও তৈরি করে পাঠিয়েছিলাম বিদেশের নামকরা গোয়েন্দাদের কি ধরনের গাড়ি থাকে। কারুর কারুর এরোপ্লেনও আছে। শরদিন্দুবাবুর হৃদয়ে রেখাপাত হল না। তিনি ফলিত জ্যোতিষের চর্চা করতে ভালবাসতেন। আমাকে লিখলেন—“আমি ব্যোমকেশের হাত দেখেছি। তার বরাতে গাড়ি নেই।”
একটি চিঠিতে শরদিন্দুবাবুকে লিখেছিলাম ব্যোমকেশের আয় ভদ্রমত নয়, ফি বাড়ানো উচিত। তার উত্তরে তিনি লিখেছেন—‘“চিড়িয়াখানায়’ ব্যোমকেশের ফি আপনার কম মনে হয়েছে। মনে রাখতে হবে গল্পের ঘটনাকাল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পরে; টাকার মূল্য হ্রাস হয়েছিল বটে, কিন্তু এমন ‘হাড়ির হাল’ হয়নি। সেই সময়ে একদিনের কাজের জন্য ৫০/৬০ টাকা মন্দ মনে হয় না। এটাও মনে রাখতে হবে যে ব্যোমকেশের অর্থ-ভাগ্য ভাল নয়; এতদিন পরে অজিতের সহযোগিতায় একটা বাড়ি করেছে বটে, কিন্তু সত্যবতীকে একটা অটো-রিক্সা কিনে দেবার সঙ্গতি তার নেই। সত্যবতীর প্রতি আপনার পক্ষপাত আছে জানি, কিন্তু আমি কি করতে পারি? ভাগ্যং ফলতি সর্বত্র।”
বিদেশী ডিটেকটিভদের তুলনায় ব্যোমকেশের আয় নিশ্চয় কিছুই নয়। সত্তর বছর আগে ইয়োরোপের নৃপতিরা গোয়েন্দাদের কাছে কৃতজ্ঞ হৃদয়ে রাজকোষ প্রায় উন্মোচন করে দিতেন। এখন আর সেরকম হবার উপায় নেই। ইয়োরোপে, বিশেষ করে আমেরিকায় নামী গোয়েন্দাদের টাকার খাঁই কিছু কম নয়। আমাদের দেশে পূর্বকালে দেবেন্দ্রবিজয় কখনও টাকার অভাব বোধ করেছেন বলে মনে হয় না। বেশ স্বচ্ছল অবস্থায় থাকতেন। তখন গাড়ির রেওয়াজ ছিল না। থাকলেও দেবেন্দ্রবিজয়ের অসুবিধা হত না। শরদিন্দুবাবু বলেছেন ব্যোমকেশের সঙ্গতির অভাব। এই চিঠি ১৯৬৭ সালে লেখা। তারপরে কলকাতায় লোকের ভিড় আরও বেড়েছে। গাড়ির দামও অনেক বেড়েছে। ব্যোমকেশেরও গাড়ি কেনার টাকা হয়নি। ইতিমধ্যে সত্যবতী ও ব্যোমকেশের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘনিষ্ঠতর হয়েছে, শরদিন্দুবাবুর ভ্রূকুটি সত্ত্বেও। তিনি বলতেন, আমি গাড়ির লোভ দেখিয়ে সত্যবতীর মনের শান্তি নষ্ট করে দিচ্চি এবং ব্যোমকেশের সুখের সংসারে অশান্তি হচ্চে।
কিন্তু শরদিন্দুবাবুর হৃদয় গলতে আরম্ভ করেছিল। আমি জানিয়েছিলাম গাড়ির অভাবে সত্যবতী-ব্যোমকেশ ভাল করে গড়িয়াহাটে বাজার করতে পারছে না, বৌভাতের নিমন্ত্রণে ঠিক সময়ে যেতে পারে না। আমার চিঠিতে সত্যবতীর প্রসাধনের একটু দীর্ঘ বর্ণনা ছিল। শরদিন্দুবাবু এত উৎসাহ পছন্দ করেননি, কিন্তু গাড়ির ব্যাপারে রাজী হয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে ২১শে ডিসেম্বর আমাকে লিখলেন—“অবশ্য আপনি যখন অকলঙ্কচরিত্র মানুষ তখন বিপদের আশঙ্কা বেশি নেই। তবু সাবধানে থাকা ভাল। ব্যোমকেশ যদিও বুড়ো হয়েছে, তবু এখনও সত্যবতীকে ভীষণ ভালবাসে, ‘ওসমান’-এর আবির্ভাব সহ্য করবে না।
“আপনি সত্যবতীর মানসিক অবস্থার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে পাষাণও বিগলিত হয়। আপনি তাকে মোটরকারের লোভ দেখিয়ে তার মানসিক যন্ত্রণা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন।…একটা মতলব ঠাউরেছি, কিন্তু সেকথা এখন থাক।” কি মতলব পরের কয়েকটি পংক্তি থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে। “…অজিত মোটর ড্রাইভিং শিখছে। পুস্তক ব্যবসায়ের যে-রকম দুরবস্থা চলেছে ট্যাক্সি চালানো ছাড়া ভদ্রসন্তানদের আর কোনও পেশা নেই। বুঝ লোক যে জান সন্ধান।”
বুঝতে খুব অসুবিধা হবার কথা নয়। মাসখানেক পরে ১৯৬৯ সালে ২৫শে জানুয়ারি আমাকে আবার লিখছেন—“একটা গোপন খবর দিচ্চি—ওদের বইয়ের দোকান ভাল চলছে না। অজিত লুকিয়ে লুকিয়ে মোটর চালানো শিখছে। সন্দেহ হয় যে সে এবার ট্যাক্সি চালাবে। ভদ্রলোকের ছেলের কি দুরবস্থা বলুন তো। ব্যোমকেশ বোধহয় জানে না। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়। হয়তো এই ফাঁকে সত্যবতীর মোটর লাভ হয়ে যাবে।” শরদিন্দুবাবু কিছুদিন পরে মতলবটি পরিত্যাগ করেছিলেন। অজিত ড্রাইভার, সত্যবতী আরোহিণী—এই চিত্র তাঁর মনে বেশি দিন স্থান পায়নি।
ইতিমধ্যে শরদিন্দুবাবুর জন্মদিনের সময় এসে গেল। এই সময় একটি ঘটনা হয়েছিল শরদিন্দুবাবু জানতেন না। সেটি আমার চিঠি থেকে তুলে দিচ্চি—“দশটার সময় বিশ্ববিদ্যালয় যাবার মুখে যাদবপুর ডাকঘরে গিয়েছি। বক্সী দম্পতির সঙ্গে দেখা। আপনাকে জন্মদিনের টেলিগ্রাম পাঠাতে এসেছে। খসড়াটা আমাকে দেখালেন। আমি তো দেখে স্তম্ভিত। খসড়াটি এই রকম—Byomkesh and Satyabati Send Greetings to Ungrateful Father। বললাম, ছি ছি, এ সব কি কাণ্ড। এ কথা কি কেউ লেখে? কোনান ডয়েলকে কেউ কেউ Ungrateful father বলেছেন। শরদিন্দুবাবু কি সেই রকম? কোনান ডয়েল তো শার্লক হোমসকে মেরেই ফেলেছিলেন। আর শরদিন্দুবাবু তোমাদের বহাল তবিয়তে রেখেছেন। কেয়াতলায় বাড়ি পর্যন্ত করে দিয়েছেন। এই কথা শুনে ব্যোমকেশের মনে কি হল জানি না। কিন্তু সত্যবতীর বড় বড় চোখে জল এলো। মনে হল কাকচক্ষু দীঘি জল, দীঘি ছাপিয়ে পড়ছে। বোধহয় একটু চেঁচিয়ে কথা হচ্ছিল। যাদবপুরের রাস্তায় আপিসের ভিড়। তাছাড়া সুন্দরীর চোখে জল দেখে ভিড় জমে গেল। ব্যোমকেশ এক পা দু পা করে স্ত্রীর হাত ধরে ডাকঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। সে টেলিগ্রাম আপনি পাননি। ওরা বুদ্ধি করে খসড়া বদল করে দিয়েছিল।
“ভাবছি এইবার বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে পড়ি, ঝামেলায় আর কাজ নেই। এমন সময় পেছন থেকে মোটা গলায় কে একজন বললেন, “কি ব্যাপার, মহিলাটি কাঁদছিলেন কেন?” তাকিয়ে দেখি এ রকম চেহারা কখনও দেখিনি। ভদ্রলোকের গায়ে প্লেট দেওয়া শার্ট, শার্টের হাতে শক্ত ‘কফ্’, তার উপরে চায়না সিল্কের বুক খোলা কোট। কালোপাড় শান্তিপুরী কোঁচাননা ধুতি। পায়ে সিল্কের মোজা ও ডার্বি জুতো। এ রকম চেহারা ষাট বছর আগে দেখা যেত। ভদ্রলোক বললেন, “আমাকে চেনেন?” আমার কি রকম চেনাচেনা মনে হতে লাগল। কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে করতে পারলাম না। কি রকম জানেন, খানিকটা সম্রাট সপ্তম এডোয়ার্ড, খানিকটা শেখ ফসিউল্লা কৃত গোলাপ নির্যাসের মোড়কে যেমন ছবি থাকত সেই রকম। ভদ্রলোক বললেন, “আমি কে জানেন? আমি বিখ্যাত ডিটেকটিভ দেবেন্দ্রবিজয়বাবু। ” তৎক্ষণাৎ সব পরিষ্কার হয়ে গেল। ছেলেবেলায় পড়া ‘হরতনের নওলা’, ‘মায়াবিনী’, ‘নীলবসনা সুন্দরী’ আর সেই পরিচিত ছবি—দেবেন্দ্রবিজয় সিল্কের কোট, কফ্ দেওয়া সার্ট, শান্তিপুরী ধুতি আর ডার্বি জুতো পরে জলে ভাসছেন। গাছের শিকড় ধরে তীরে উঠবার চেষ্টা করছেন আর সুন্দরী পাপিষ্ঠা জুমেলিয়া ছুরি দিয়ে শিকড় কেটে দিচ্চে। দেবেন্দ্রবিজয়বাবু অসহায়। আর কিছুক্ষণ জলে থাকলে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে।
“বললাম, “কিছু মনে করবেন না স্যার, অনেকদিন আগের পরিচয় কিনা চিনতে দেরি হচ্ছিল। ” ভদ্রলোক একটু খুশি হলেন মনে হল, কিন্তু সত্যান্বেষীরা কর্তব্য ভোলে না। আমাকে বললেন, “মহিলাটি কাঁদছিলেন কেন বললেন না তো।” বলে ফেললাম, “আর কিছু নয়, শরদিন্দুবাবু মহিলাটিকে গাড়ি কিনে দেবেন বলে গাড়ি কিনে দেননি। তাই উনি কাঁদছিলেন। কথার খেলাপ করেছেন কিনা।” দেবেন্দ্রবিজয়বাবু দাড়িতে হাত দিয়ে বললেন, “শরদিন্দুবাবু মেয়েছেলেটিকে গাড়ি দেবেন কেন?” বললাম, “ঠিক ওঁকে না স্যার, ওঁর স্বামীকে। তিনি ডিটেকটিভ কিনা—বিখ্যাত ব্যক্তি—ব্যোমকেশ বক্সী।” দেবেন্দ্রবিজয়বাবু বললেন, “নাম শুনিনি।” আপনি শুনলে হয়তো ব্যথা পাবেন। কিন্তু সত্য গোপন করা উচিত নয়। দেবেন্দ্রবাবু বললেন, “ডিটেকটিভের আবার মোটর গাড়ির দরকার কি? এই যে আমি এত চোরডাকাত ধরেছি, আমার গাড়ি ছিল? তবে হ্যাঁ, পাঁচকড়িবাবুর দয়ার শরীর, থার্ড ক্লাশ ছ্যাকড়া গাড়ি হলেও চড়তে দিয়েছেন। আমি সেই গাড়িতে চড়ে বেহালা, বরানগর, কলকাতার দক্ষিণে হাজরা রোডে ঠ্যাঙ্গাড়েদের ধরেছি। আমার গাড়ি ছিল?”…এই সব কথা শুনে হকচকিয়ে গেলাম। হঠাৎ দেখি দেবেন্দ্রবিজয়বাবু আর সেখানে নেই। কি করে তিনি অন্তর্ধান করলেন ভাবতে ভাবতে ক্লাশের ঘণ্টা পড়ে গেল।
“সেই রাত্রে ভীষণ বিভীষিকার স্বপ্ন দেখলাম। আমি যেন পুণায় বেড়াতে গিয়েছি। সন্ধ্যাবেলায় লাকড়ি ব্রিজের কাছে পা ফস্কে জলে পড়ে গেলাম। জোরে হাত পা ছুঁড়তে লাগলাম। কিন্তু জলে একটুও শব্দ হল না। একটা ঢেউ উঠল না, একটা বুদ্বুদও নয়। মনে হল একটা বড় কাচের টুকরোর মতন জল আমাকে চারদিক থেকে চেপে রেখেছে। যখন একেবারে ডুবে যাচ্চি, তখন কয়েকটা শিকড়ের সঙ্গে হাত আটকে গেল। কোনও রকমে সেটা ধরে উঠবার চেষ্টা করছি, এমন সময় উপরের দিকে তাকিয়ে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। পরনে কালো শাড়ি পরা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। তার মুখ ভাল করে দেখতে পেলাম না। মনে হল ছেলেবেলায় জুমেলিয়ার যে ছবি দেখেছিলাম তার সঙ্গে কোথায় যেন মিল আছে। আমি যতবার শিকড় ধরে উঠবার চেষ্টা করছি মেয়েটি ছুরি বার করে শিকড় কেটে দিচ্ছে। আমি হঠাৎ চীৎকার করে উঠলাম। ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিন্তু তার আগে তার মুখের কাপড় সরে গিয়েছিল। এক সেকেন্ডর জন্য দেখতে পেলাম সে মুখ জুমেলিয়ার নয়, সে মুখ সত্যবতীর।”
এই চিঠি পেয়ে শরদিন্দুবাবু আমাকে লিখলেন—“ব্যোমকেশ আমাকে Ungrateful father বলে ‘তার’ করতে যাচ্ছিল জেনে ভীষণ রাগ হয়েছিল। ভেবেছিলাম ওকে ত্যাজ্যপুত্র করব, নেহাৎ সত্যবতীর কথা ভেবে নিরস্ত হয়েছি। মেয়েটা বড় ভাল। ভাগ্যদোষে অপাত্রে পড়েছে। ওর কান্না আমিও দেখেছি। কাঁদলে ওকে বড় সুন্দর দেখায়। অজিতের কথা ধরি না। ওটা গোল্লায় গেছে; বুড়ো বয়সে ট্যাক্সি চালাবে বলে মোটর ড্রাইভিং শিখছে। কিন্তু আমিও শপথ করেছি ওকে ট্যাক্সি চালাতে দেব না। বই-এর ব্যবসা ছেড়ে ট্যাক্সি চালাবে। ইয়ার্কি পেয়েছে।” দেবেন্দ্রবিজয় বসু সম্বন্ধে এই চিঠিতেই লিখছেন—“আপনি স্বনামধন্য দেবেন্দ্রবিজয় বসু মহাশয়ের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। আপনি ধন্য। আমার ধারণা ছিল তিনি বহুকাল দেহরক্ষা করেছেন। বোধহয় কায়কল্প করে বেঁচে আছেন। কিন্তু তাঁর অসামান্য প্রতিভা যে এতটুকু ম্লান হয়নি তা তাঁর কথা থেকেই বোঝা যায়। ব্যোমকেশের নাম শোনেননি তিনি এ আর বিচিত্র কি। ঈগল পাখি কি টুনটুনি পাখির নাম জানে। আর গাড়ি কেনা সম্বন্ধে তিনি যা বলেছেন তা তাঁর মতন জ্ঞানগরিষ্ঠ লোকেরই উপযুক্ত। নেহাৎ কথা দিয়ে ফেলেছি, নইলে আমি হাত গুটোতাম।”
বোঝা গেল অজিতের ট্যাক্সির ব্যবসা হবে না। বিনা পয়সায় ট্যাক্সি চড়া সত্যবতীর কপালে নেই। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই দেখছি সত্যবতীর গাড়ি সম্বন্ধে শরদিন্দুবাবুর মত বদলে গিয়েছে। প্রথম অটো-রিক্সায় রাজী হয়েছিলেন, অটো-রিক্সা থেকে অজিতের ট্যাক্সি। পরে আবার একটি সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি দেবার কথাও তাঁর মনে হয়েছিল। ১৯৭০ সালের প্রথমে একটি চিঠিতে তাঁকে লিখেছি—“কি গাড়ি সত্যবতীকে দিচ্ছেন? সেকেন্ডহ্যান্ড দেবেন না। এখন নতুন গাড়িরই যা অবস্থা। এমন গাড়ি দেবেন যাতে সত্যবতীর মন প্রসন্ন হয় এবং স্বনামধন্য পাঁচকড়িবাবুও খুঁত ধরতে না পারেন। সেবার তিনি আপনার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।” শরদিন্দুবাবু তার উত্তরে আমাকে বলেছিলেন সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়িই দেব, কিন্তু এমনভাবে দেব সত্যবতী ঠিক বুঝতে পারবে না। এইভাবে এই সংগ্রহের শেষ গল্প বিশুপাল বধের সূচনা হয়েছিল।
১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে শরদিন্দুবাবু কলকাতায় এসে মাসখানেক ছিলেন। পুণায় ফিরে গিয়ে তিনি বিশুপাল বধ শুরু করেছিলেন। গল্পটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। পড়লে মনে হয় প্রায় অর্ধেক লেখা বাকি আছে। উত্তর কলকাতার একটি থিয়েটারের স্টেজে একজন অভিনেতার খুনের রহস্যভেদ করবার চেষ্টা কেবল আরম্ভ হয়েছে। এই গল্পে আমার নামের সঙ্গে মিল, শরদিন্দুবাবু হয়তো বলতেন স্বভাবের সঙ্গেও মিল, একটি চরিত্র আছে। সে ব্যোমকেশকে থিয়েটার দেখাতে নিয়ে যাচ্চে এবং প্রসন্নচিত্তে গড়িয়াহাট মার্কেট থেকে সত্যবতীর বাজারের ব্যাগ নিজের হাতে বয়ে নিয়ে আসছে। গল্পটির পাণ্ডুলিপি লেখকের জীবদ্দশায় দেখিনি। তবে তাঁর মুখে শুনেছিলাম তিনি আমার নাম ব্যবহার করেছেন। আমার ক্ষীণ আপত্তি টেঁকেনি। এই গল্পের ঘটনা বা দুর্ঘটনার অবশ্যম্ভাবী ফল সত্যবতীর মোটর গাড়ি প্রাপ্তি সে সম্বন্ধেও আভাস পাওয়া গিয়েছিল। শরদিন্দুবাবু আমাকে শাসিয়ে রেখেছিলেন গল্পটিতে প্রতুলবাবু নামের ব্যক্তিটিকে পুলিসের জেরায় নাজেহাল হতে হবে। কিন্তু গল্পটি ততদূর এগোয়নি। থিয়েটারের প্রম্পটার কালীকিঙ্কর দাসের জবানবন্দী আরম্ভ হয়েছে মাত্র। থিয়েটারের লোকের জবানবন্দী শেষ হলে অন্য সবার পালা আসত। বঙ্কিমচন্দ্র একটি অসমাপ্ত ভূতের গল্প রেখে গিয়েছিলেন। তার নাম নিশীথ রাক্ষসীর কাহিনী। গল্পটির সূত্রপাত কেবল আরম্ভ হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর অনেক পরে কোনও মাসিক পত্রিকার সম্পাদক সেটিকে অন্য একজনকে দিয়ে সমাপ্তি ঘটিয়ে প্রকাশ করেছিলেন। শরদিন্দুবাবুর প্রকাশক সে চেষ্টা করেননি। বোধহয় ভালই করেছেন।
একটি বিষয় হয়তো লক্ষ্য করবার আছে। তাঁর পরিচিতরা জানতেন শরদিন্দুবাবুর ফলিত জ্যোতিষে অগাধ বিশ্বাস ছিল। তিনি বারে বারে বলেছেন ব্যোমকেশের কোষ্ঠী দেখেছি, ওর গাড়ি কেনবার সম্ভাবনা নেই। আমাদের উপরোধে অবশেষে গাড়ি দিতে রাজী হয়েছিলেন। কিন্তু গল্পটি শেষ হয়নি। সত্যবতীর বরাতেও শেষ পর্যন্ত গাড়ি হল না। ফলিত জ্যোতিষে তাঁর গণনা কি রকম অভ্রান্ত হয়, শরদিন্দুবাবু বোধহয় তার প্রমাণ দিয়ে গেলেন।
প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
৩রা আশ্বিন, ১৩৭৮
Suparimal Barua
Byomkesh samagra pdf download