বিশ্বাসঘাতক – নারায়ণ সান্যাল
রচনাকাল : ১৯৭৪
কৈফিয়ৎ
[এই ‘কৈফিয়ৎ’টি আমি গ্রন্থরচনার পরে লিখেছিলাম 13.1.78 তারিখে। ঐতিহাসিক কারণে এটি অপরিবর্তিত আকারে ছাপা গেল। কিন্তু এ-গ্রন্থের প্রথম প্রকাশ আঠারই মে 1978-এর পরে। ফলে এখন এই ‘কৈফিয়তের একটি কৈফিয়ৎ’ অনিবার্য হয়ে পড়েছে।]
বাঙলা সাহিত্যে সাধারণ-বিজ্ঞান বা পপুলার-সায়েন্স’-এর বই ইদানিং বড় একটা নজরে পড়ছে না। তার পিছনে আছে একটা বিষচক্র। লেখক লেখেন না, কারণ প্রকাশক ছাপেন না, কারণ লাইব্রেরী কেনেন না, কারণ পাঠক পড়েন না! তাছাড়া ইংরেজি ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষায় পাঠক-সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য–তাঁদের একটা বিরাট অংশ বিজ্ঞানে উৎসুক নন। ফলে বিজ্ঞানের বই যা লেখা হচ্ছে তা পাঠ্যপুস্তক। না পড়লে পরীক্ষায় পাশ করা যায় না। সাহিত্যের বই অধিকাংশই অবসর বিনোদনের জন্য। যাঁরা এ-দুটি বিষয়কে মেশাতে পারেন তারাও সে চেষ্টা করেন না ঐ বিষচক্রের ভয়ে।
দুটি ব্যতিক্রম বাদে এ-কাহিনির প্রতিটি চরিত্রই বাস্তব। সৌজন্যবোধে যে দুটি নাম আমি পরিবর্তন করেছি তার উল্লেখও ‘পরিশিষ্ট ক’তে দেওয়া হয়েছে, এছাড়া ঘটনার পরিবেশ, কথোপকথন ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রেই আমাকে কল্পনা করে নিতে হয়েছে, কিন্তু বাস্তব তথ্যকে কথাসাহিত্যের খাতিরে কোথাও আমি অতিক্রম করিনি। দশ-বারোটি। স্মৃতিচারণ, জীবনী, বিজ্ঞানগ্রন্থ ও সরকারি রিপোর্ট এ-গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনার মূল উৎস। ঐতিহাসিক উপন্যাস রচয়িতা যতখানি স্বাধীনতা সচরাচর দাবী করে থাকেন আমি বোধহয় ততখানি স্বাধিকারও প্রয়োগ করিনি। তথ্য থেকে যেটুকু বিচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে তার স্পষ্ট নির্দেশও গ্রন্থশেষে দেওয়া হল।
পাঠকের সুবিধার জন্য দুটি তালিকা আমি যুক্ত করেছি। প্রথমত, গ্রন্থের শেষে একটি কালানুক্রমিক সূচি। কথাসাহিত্যের খাতিরে অনেক সময় অনেক ঘটনা আমাকে। আগে-পিছে বলতে হয়েছে। পাঠকের যাতে কালভ্রান্তি না হয় তাই ওই তালিকাটি। দ্বিতীয় তালিকাটিও গ্রন্থের শেষে দেওয়া হল। তার কৈফিয়ৎ দিই : এ-কাহিনির সব চরিত্রই বিদেশি। বিদেশি নাম যে-বানানে দেওয়া হয়েছে হয়তো স্বদেশে তাদের নাম সে-ভাবে উচ্চারিত হয় না। প্রথমত, অনেক বিদেশি নামের উচ্চারণ বাংলা বর্ণমালাতে প্রকাশই করা যায় না, দ্বিতীয়ত, বিদেশি ভাষা জানা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে আমাকে আন্দাজে নামগুলি বাংলা হরফে লিখতে হয়েছে। তাই এই তালিকার নামগুলি সাজিয়েছি ইংরাজি বর্ণমালা অনুসারে এবং যে বানানে তারা এখানে উল্লেখিত হয়েছেন, তাও জানিয়েছি। প্রায় আড়াই ডজন নোবেল প্রাইজ প্রাপ্ত চরিত্র এ কাহিনিতে অংশ নিয়েছেন–তাঁদের নামের পাশে তারকাচিহ্ন দেওয়া আছে।
‘পারমাণবিক শক্তি’ ব্যাপারটার সম্বন্ধে আমাদের ভাসা-ভাসা ধারণা আছে। হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে তার নারকীয় কাণ্ডকারখানার কথাও শুনেছি। কিন্তু মোদ্দা ব্যাপারটা যে কী, তা আমরা জানতাম না। জানার প্রয়োজনও এতদিন বোধ করিনি। যা ছিল একান্ত গোপন তার অনেকটাই আজ জনসাধারণকে জানতে দেওয়া হয়েছে। আমেরিকা-রাশিয়া-ব্রিটেন-ফ্রান্স ও চিন-পৃথিবীর পাঁচ-পাঁচটি দেশ এ তথ্য জেনে ফেলেছে, অ্যাটম বোমা ফাটিয়েছে। বিদেশি ভাষায় পপুলার সায়েন্স-জাতীয় বইয়ে এ আলোচনা দেখেছি। বাংলা ভাষায় সে আলোচনা আমার নজরে পড়েনি। গত পঁচিশ-ত্রিশ বছর এ-বিষয়ে অজ্ঞ ছিলাম–তা দুনিয়ার অনেক বৈজ্ঞানিক-তথ্যের বিষয়েই তো কিছু জানি না, কী ক্ষতি হয়েছে তাতে?–ভাবখানা ছিল এই। এতদিনে মনে হচ্ছে–ক্ষতি হয়।
এই কৈফিয়ৎ লিখছি মোমবাতির আলোয়। বিজলি নেই। লোডশেডিং শুধু কলকাতায় নয়, ভারতবর্ষে নয়। পৃথিবী আজ অন্ধকার হতে বসেছে। কয়লার ভাড়ার ক্রমশ বাড়ন্ত হয়ে উঠছে, পেট্রোলের ভাঁড়ে মা ভবানী’-র পদধ্বনি শোনা যায়! কথায় বলে : বসে খেলে কুবেরের ধনও একদিন ফুরোয়! পৃথিবীর অবস্থাও আজ তাই। দুনিয়ার অগ্রসর দেশগুলি তাই আজ শক্তির সন্ধানে ইতি-উতি চাইছে–সূর্যালোকের শক্তি, জোয়ার-ভাটার শক্তি, পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ শক্তি এবং, বিশেষ করে, পারমাণবিক শক্তি।
যুদ্ধোত্তর ইংল্যান্ডে ‘ক্যালডেন হল’ সাফল্যমণ্ডিত হবার পর গ্রেট ব্রিটেন একসঙ্গে অনেকগুলি পারমাণবিক শক্তি-প্রকল্পে হাত দিয়েছিল। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিকরা আশা করেছিলেন–পরের দশকে গ্রেট ব্রিটেনে ব্যবহৃত বিদ্যুৎশক্তির এক-তৃতীয়াংশ এ-ভাবেই পাওয়া যাবে। সে প্রকল্প কতদূর সাফল্যলাভ করেছে তার খবর আর পাইনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 1972 সালে ছয়শত বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি খরচ করেছে নূতন শক্তি-উৎসের সন্ধানে। সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে 28টি পরমাণু প্রকল্প ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে, 49টিতে কাজ চলছে, আরও 67টি পরিকল্পনার জন্য অর্ডার গিয়েছে। একমাত্র ওক-রিজ প্রকল্পেই পারমাণবিক শক্তির সন্ধানে ব্যয় হবে পঞ্চাশ কোটি ডলার। মার্কিন সরকার আশা রাখেন 1980-র ভেতর যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ব্যবহৃত বিদ্যুৎশক্তির (3.7 লক্ষ মেগাওয়াট) ত্রিশ-শতাংশ ওরা পারমাণবিক শক্তি থেকে পাবে। কয়লাবিদ্যুতের চেয়ে পরমাণু বিদ্যুতের দামও নাকি পড়বে কম।
রাশিয়া বা চিনের কথা জানি না, কিন্তু যে ভারতবর্ষ জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে বলে স্কুলে থাকতে কোরাস গান গাইতুম তার খবর কী? 1947 এ ক্টর হোমি ভাবার সভাপতিত্বে পরমাণু-শক্তি কমিশনের প্রথম সভা হয়েছিল, তারপর রিসার্চ রিয়্যাকটর ‘অপ্সরা’র উদ্বোধন হল, ‘জারলিনার’র জন্ম হল, রাজস্থানে পরমাণুকেন্দ্র স্থাপনের একটি প্রকল্প শুরু হয়েছে, ট্রম্বেতেও কাজ হচ্ছে বলে জানি। আজকের সংবাদপত্রে নারোয়ায় চতুর্থ পরমাণু কেন্দ্রের শিলান্যাস হবার খবরও ছাপা হয়েছে–কিন্তু আসল কাজ কতদূর হয়েছে জানি না। যেটুকু জানি, তা হচ্ছে এই–মোমবাতির আলোয় এই কৈফিয়ৎ লিখছি!
এটুকু বুঝি যে, আজ যদি আমরা চিত্তরঞ্জনে বিদ্যুৎ-বাহিত রেলওয়ে এঞ্জিনের পরিবর্তে আবার বয়লার এঞ্জিন বানাবার চেষ্টা করি, পেট্রোল, কোলগ্যাস, কয়লা, কেরোসিন, রেড়ির তেল, কাঠ থেকে ধাপে ধাপে নামতে নামতে মা ভগবতীর অকৃপণ দানের ভরসায় বসে থাকি তবে আমাদের নাতি-নাতির’ কপালে দুঃখ আছে।
আজ তাই মনে হচ্ছে, গত পঁচিশ বছরে পারমাণবিক শক্তির বিষয়ে কোনো খোঁজ-খবর না নিয়ে কাজটা ভাল করিনি। আর সেইজন্যই আপনাকে বলব–এ বইটি যদি না পড়েন তো না পড়লেন, কিন্তু আদৌ যদি পড়েন তবে পাতা বাদ দিয়ে পড়বেন না।
আপনার ‘প্রনাতির’ দোহাই!
নারায়ণ সান্যাল
13.1.74
.
আশির দশকের কৈফিয়ৎ
গ্রন্থরচনার দশ বছর পরে এই কৈফিয়ৎটি সংযোজন করা প্রয়োজন বোধ করছি। প্রথম প্রকাশকালেই গ্রন্থটি অধ্যাপক হোমি জাহাঙ্গির ভাবার পুণ্যস্মৃতিতে উৎসর্গীকৃত। দ্বিতীয় কথা, এ গ্রন্থের অটো কার্ল কাল্পনিক চরিত্র। কোনো বাস্তব চরিত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নেই।
আর একটি কথা। বিদেশি নাম এবং বৈজ্ঞানিক শব্দ বাংলা-হরফে প্রকাশ করা খুব কঠিন; যদি লেখকের সেই ভাষাজ্ঞান বা বিশেষ-বিজ্ঞান সম্বন্ধে যথেষ্ট পড়াশুনা না থাকে। ফলে, প্রথম প্রকাশকালে অনেক বিদেশি বৈজ্ঞানিকের নাম আমি বাংলা হরফে ঠিকমতো লিখতে পারিনি। সাহা ইন্সটিট্যুটের অধ্যাপক রাজকুমার মৈত্র, (পি. আর. এস.) ও অধ্যাপক অশোক চট্টোপাধ্যায় এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রঞ্জন ভট্টাচার্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এইজাতীয় ত্রুটির দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাকে অসীম কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। অনেকগুলি বৈজ্ঞানিক ভ্রান্তিও তাদের কল্যাণে এবারে সংশোধন করা গেল।
নারায়ণ সান্যাল
14.8.84
booklover1317
Apnader Onek Dhonnobad.
Sonirbondho Onurodh, Jodi Apnara “Netaji Rohoshyo Sandhane” ar “Kaantaye Kaantaye Vol 3” ei du ti Boi ekhane Prokashona Korte Paren, khub e Badhito Hobo.