বিশুদ্ধ শহরের নিষিদ্ধ গল্প – শহিদুল শাহ
প্রকাশক – বুনন
প্রথম প্রকাশ – জুলাই ২০২৩
প্রচ্ছদ : শ. ই. মামুন
.
[এই উপন্যাসটি লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত চিন্তাপ্রসূত। কাহিনি, চরিত্র, স্থান ও ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কোনও ব্যক্তি বা কোনও স্থান, অঞ্চল, জাতি, ভাষাগোষ্ঠী বা ধর্মীয় আচরণের সঙ্গে যদি মিলে যায়, তবে তা সম্পূর্ণ কাকতালীয় এবং উপন্যাসের চরিত্র বা সংলাপ কোনও ব্যক্তিআবেগ বা কোনও প্রতিষ্ঠান, জাতি, সামাজিক শ্রেণি বা ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করার জন্য নয়। উপন্যাস সম্পর্কিত যে কোনও প্রশ্ন বা ব্যাখার দায় লেখকের। এক্ষেত্রে প্রকাশকের কোনও দায় নেই।]
.
উৎসর্গ
কবি মানিক শিমুল
ও
অনুবাদক রুদ্র মুহাম্মদ মনজুকে
.
গুরুগৃহ
জয়গুরু। আজকের এই মারফতি জলসায় যারা অংশগ্রহণ করেছেন, সকলের রাঙা চরণে আমার হৃদয় নিংড়ানো প্রেম-ভক্তি রইল; আপনারা আমার ভক্তি গ্রহণ করুন।
সম্মানিত সুধীমণ্ডলী,
মারফত জিনিসটা কী মারফত অর্থ গোপন বিষয়, যা প্রকাশ করা যায় না। ইসলামে পথ মূলত চারটি—শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারফত। এ চারটি পথ সম্পর্কে বিশ্বনবি বলেছেন—শরিয়ত আমার মুখের কথা, তরিকত আমার কাজ, হকিকত আমার প্রেরণা এবং মারফত আমার গোপন রহস্য। নবিজির প্রিয় সাহাবি আবু হুরাইরা (রা.) বলেছেন—আমি রসুলুল্লাহ থেকে জ্ঞানের দুইটা পাত্র সংরক্ষণ করেছি। একটি পাত্র প্রচার করেছি, অন্যটি যদি প্রচার করি, তাহলে আমার গলাকাটা যাবে। সূক্ষ¥ভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় হজরত আবু হুরাইরা এইখানে মারফতি জ্ঞানের কথাই বলেছেন।
প্রিয় সুধীবৃন্দ,
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা-মক্তবে জাহিরি জ্ঞান তথা আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জন করা যায়; মারফতি জ্ঞান অর্জন করা যায় না। মারফতি জ্ঞান অর্জন করতে হইলে একজন কামেল গুরু, আল্লাহর বন্ধু, ভাবুক ও প্রেমিকপুরুষের সঙ্গ লাভ করতে হয়। আত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন ঘটলেই কেবল তার কাছে মারফত প্রকাশ করা যায়, তাঁকে মারফতি বিদ্যা শেখানো যায়। এজন্যই নবিজি তাঁর সাহাবিদের মারফতি ইলম দান করেন নাই। তিনি হাতেগোনা কয়েকজন সাহাবিকে গুপ্ত ইলম দান করেছেন। দুই আত্মা মিলে এক আত্মা না-হওয়ার আগ পর্যন্ত যদি কোনও গুরু তার ভক্তকে মারফতি জ্ঞান শিক্ষা
দেন, তাইলে ওই ভক্ত গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই জনসম্মুখে মন্তব্য কইরা বসবে, আর এতে সমাজে ভুল বার্তা পৌঁছে যাবে এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। তাই তো সাধকেরা বলেন—আপন সাধন কথা, না কইও যথা তথা, আপনারে আপনি তুমি হইও সাবধান।
প্রিয় আত্মাগণ,
আপনারা আজ এইখানে যে-কয়জন মানুষ উপস্থিত হইছেন, আমি আপনাদের প্রত্যেককেই আমার হৃদয়ের আসনে ঠাঁই দিয়েছি, আশা করি আপনারাও আপনাদের নিজের জীবনের চেয়ে আমাকে বেশি ভালো বাসেন। আর এজন্যই আজকে আপনাদের সঙ্গে মারফতি কিছু কথা বলার চেষ্টা করব। শুরুতেই বলেছি মারফত অর্থ গোপন বিষয়, যা প্রকাশ করা যায় না। মারফত কেন প্রকাশ করা যায় না? এর গোপনীয়তাই বা কতদূর?
একটা ঘটনা বলি, শোনেন—
মুসা নবি আল্লাহর সঙ্গে কথা কইতে মাঝেমধ্যেই তুর পাহাড়ে যাইতেন। রাস্তার পাশেই এক বয়স্ক মহিলা বাস করতেন। একদিন মুসা যাইতেছেন তুর পাহাড়ের দিকে। বয়স্ক মহিলাটির সঙ্গে দেখা হইল। মহিলাটি বলল—মুসা, তুমি তো আল্লাহর সঙ্গে কথা কইতে যাইতেছ, তাই না? আল্লাহরে জিগাইও তো, মরার পরে আল্লাহ আমার জন্য কী রাখছে। বেহেশত? নাকি দোজখ? মুসা চইলা গেলেন পাহাড়ে। আল্লাহর সঙ্গে কথাবার্তা হইল। শেষে মুসা জানতে চাইলেন—হে আল্লাহ, মরার পরে ওই মহিলাটির জন্য কী রেখেছেন? বেহেশত রাখছেন? নাকি দোজখ? আল্লাহ বললেন—হে মুসা, মরার পরে ওই মহিলার জন্য বেহেশতের মধ্যে যে সর্বশ্রেষ্ঠ বেহেশত আছে, আমি তাঁর জন্য সেটাই রেখেছি! কথা শেষে মুসা বাড়ি ফিরছিলেন। মহিলাটি মুসারে দেইখা জিজ্ঞেস করলেন—মুসা, আমার ব্যাপারে আল্লাহ কী কইছে? মুসা বলল—আপনার জন্য খুশির সংবাদ আছে। বেহেশতের মইধ্যে যে সর্বশ্রেষ্ঠ বেহেশত আছে, আল্লাহ আপনার জন্য সেইটাই রাখছেন! কী সৌভাগ্য আপনার! মহিলাটি অবাক হইয়া কইলেন—কও কী! আমার জন্যে বেহেশত? না, আমার বিশ্বাস হয় না! নিশ্চয়ই তোমার আল্লাহ শয়তান-টয়তান হবে! নইলে আমি যে পাপ করছি, এতে সত্যিই যদি তোমার আল্লাহ সত্যি আল্লাহ হইতো, তাইলে আমারে কোনওভাবেই বেহেশত দিতেন না। মুসা রেগে গিয়ে বললেন—আপনে ফালতু কথা কইতেছেন কেন? কী হইছে? কী পাপ করছেন আপনি? মহিলাটি কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল—শোনো; আমার স্বামী যখন মারা যায়, তখন আমার সন্তানের বয়স মাত্র ছয়মাস। তখনও আমি যুবতী। আমার বিয়া হইছিল অল্প বয়সে। আমি আমার ছেলের কথা চিন্তা কইরা স্বামীর বাড়ি ছাড়ি নাই, আর কারও সঙ্গে বিয়াও বসি নাই। কষ্ট কইরা ছেলেরে মানুষ করতে থাকি। ছেলে বড়ো হইতে থাকে…। সে একসময় যৌবনে পৌঁছায়। আমি আমার ছেলেরে নিয়া এক ঘরেই থাকতাম। একসময় মনের অজান্তেই ছেলের রূপ-যৌবনে আমি বিমোহিত হই, কামনা জাগে! খুব কইরা চাই সে আমার ভেতরে প্রবেশ করুক। আমার মনের কথা ছেলেরে শরমে কইতে পারি না। ছেলের সঙ্গে কীভাবে মিলিত হইতে পারি সেই পথ খুঁজতে থাকি…। ছেলেটা পাশের গ্রামের এক নারীর কাছে যাইতো। ওই নারীর স্বামী দূরদেশে বাণিজ্যে যাইতো। আর সেই সুযোগে রাতের-পর-রাত নারীটি আমার ছেলেরে বিছানায় নিতো। বুদ্ধি কইরা আমি সেই নারীর কাছে যাই। তাঁরে গিয়া কই—তোমার পোশাক-আশাক আর বিছানা আমারে একরাইতের জন্যে ভাড়া দেও, তুমি যত টাকা চাও, পাইবা।
সে রাজি হয়। আমি ওই মোহিনী নারীর পোশাক-আশাক পরি এবং সুন্দর কইরা সাইজাগুইজা তার বিছানায় বইসা থাকি। ওই দিন এমন কইরা সাজছিলাম যে, আমিই আমারে চিনতে পারছিলাম না। অতঃপর ছেলে আসে। গলার স্বর শুইনা যদি চিনা ফালায় সেই-ভয়ে আদি রসের কোনও কথাবার্তা না-কইয়া ইশারা- ইঙ্গিতে তারে বিছানায় নিলাম। আলিঙ্গনে, চুমায়-চুমায় তার শরীরে কামনার আগুন জ্বালাইলাম। সেই আগুনে নিজেরে পোড়াইলাম। জ্বইলাপুইড়া খাক হইলাম। আমার ইচ্ছারে পূরণ করলাম। কিন্তু; পর মুহূর্তেই আমি অনুশোচনার আগুনে পুড়তে থাকলাম! আমার ভেতরের আরেকটা আমি আমাকেই ছিছিছি করে উঠল। বিবেকের কাঠগড়ায় নিজেরে দাঁড় করাইয়া আমি কোনওভাবেই মুক্তি পাইলাম না! সেই থেকে এই ঘৃণ্যতম অপরাধবোধ আমারে প্রতিদিন তাড়াইয়া বেড়ায়! এখন অনুভবের দুনিয়ায় আমি ফেরারি আসামি। অতএব, আমি কীভাবে মরার পরে বেহেশত যাইতে পারি? মহিলাটির কথা শুইনা মুসা হতভম্ব হইয়া গেল! রাগে-ক্ষোভে মুসা তাড়াতাড়ি চইলা গেল তুর পাহাড়ে। আল্লাহরে ডাইকা বলল—হে আল্লাহ, আপনার কোনও আক্কেল জ্ঞান নাই? আপনি কী নির্বোধ? ওই পাপী মহিলাটির জন্যেও আপনি বেহেশত রেখেছেন?… ছিঃ! আল্লাহ মুসারে বললেন— মুসা, এইবার যাও, ওই মহিলারে কও, মৃত্যুপরবর্তী জীবনে দোজখের মইধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর যে দোজখটি আছে, সেইটা আমি তার জন্যে রাখছি!
প্রিয় ভক্ত-অনুরাগী,
তো, এই ঘটনা থেকে কী বুঝলেন? এর মানে এই যে, গোপন বিষয় কখনও প্রকাশ করতে নেই। হাদিসেও আছে—যে মুসলমান আরেক মুসলমানের দোষ গোপন রাখে, রোজ হাশরে আল্লাহ তার দোষ গোপন রাখবেন। আল্লাহ বলেছেন—আমি মানুষের রহস্য, মানুষ আমার রহস্য। রহস্য মানেই গোপন। আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার পথও গোপন। মক্কা, মদিনা, মসজিদ, মন্দির, গয়া, কাশী, গির্জা, প্যাগোডা কিংবা হেরাগুহায় গেলে আল্লাহরে পাওয়া যায় না; তারে পাইতে হইলে আগে নিজেরে চিনতে হয়। আল্লাহ বলেছেন—আমি মানুষের মোটা শিরা হতেও আরও নিকটবর্তী। আবার বলেছেন—আল্লাহ তোমাদের মধ্যেই অবস্থিত; কিন্তু, তোমরা তা দেখতে পাও না। রাসুলাল্লাহ্ বলেছেন—বিশ্বাসীদের কালব আল্লাহর আরশ। অলি-আউলিয়া বলেছেন—যা আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে মানবভাণ্ডে।
প্রিয় আশেকান,
খেয়াল করুন, নবিজি বলেছেন মুমিনের কালব আল্লাহর আরশ। তো; কালব জিনিসটা কী? কালব শব্দের অর্থ কী? ইনকিলাব শব্দ থেকে কালব শব্দের উৎপত্তি। ইনকিলাব অর্থ উল্টামুখি। তাইলে মানবদেহে উল্টামুখি অঙ্গ কোনটি? এইটা দেহের কোথায় অবস্থিত? এইটা আসলে মাতৃজঠর বা জরায়ু। মানবদেহে জরায়ুই একমাত্র অঙ্গ যার মুখ উল্টা দিকে বা নিচের দিকে। জরায়ুরেই রূপকে কালব বলে। এইখানেই আল্লাহর বসবাস। এইখানে বসেই তিনি মানুষ সৃষ্টি করেন। আপনারা হয়তো কইতে পারেন, জরায়ুতেই যদি আল্লাহ থাকেন, তাইলে তো তিনি শুধু নারীদেহেই বিরাজমান; তো, পুরুষরা তাইলে কীভাবে নিজের দেহে আল্লাহরে খুঁইজা পাইবো? শোনেন—দেহধাহমই দেবালয়, নরনারী মিলেই পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়। এজন্যই আধ্যাত্মিক বিদ্যায় পুরুষরে অর্ধাঙ্গ এবং নারীরে অর্ধাঙ্গিনী বলা হইছে। আল্লাহর দেখা পাইতে একজন পুরুষের যেমন একজন নারী লাগে, তেমনই একজন নারীরও একজন পুরুষ লাগে। এজন্যই প্রতিটা মহাপুরুষ সাধনসঙ্গিনী বাইছা নিতেন। যেমন যিশুখ্রিস্ট বাইছা নিছিলেন মেরি ম্যাগদানেলরে, গে․তম বুদ্ধ নিছিলেন সুজাতারে, আর শ্রীকৃষ্ণ নিছিলেন মামি রাধিকারে। আমাগো নবিজি আল্লাহর সঙ্গে যেইদিন দেখা করছিলেন, সেইদিন তিনি উম্মে হানীরে বাইছা নিছিলেন। তাই তো সাধকরা বলেন—মেরাজের ভেদ জানে উম্মে হানী, আর জানে দিব্যজ্ঞানী।
প্রিয় সুধী,
এই ধরনের কথাবার্তা শুনতে অ-নে-ক ধৈর্যের প্রয়োজন। এতক্ষণ ধৈর্য ধরে আমার কথাগুলো শোনার জন্য আপনাদের প্রতি আবারও আমার হৃদয় নিংড়ানো প্রেম-ভক্তি রইল, আপনারা আমার ভক্তি গ্রহণ করুন। পরবর্তীকালে আবারও এধরনের আলোচনায় বসতে আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন, আমিন।
মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও সাঁইজি তার গুরুগৃহে ভক্ত-আশেকদের উদ্দেশে কথাগুলো অনর্গল বলতেছিলেন। বাড়িতে আলাদা একটা ঘর, ঘরের দরজায় বড়ো করে লেখা—গুরুগৃহ; এই গৃহেই তিনি সাধুসঙ্গ করেন। পরিবারের কোনও সদস্যকে এই গৃহে প্রবেশ করতে দেন না। এবং কি নিজের স্ত্রীকেও না। তিনি প্রতি রাতে সাধুসঙ্গ করেন। ভক্ত অনুরাগীদের মারফতি বিদ্যা শেখান। আদম তত্ত্ব, নবি তত্ত্ব, মেরাজ-তত্ত্ব, হাশর, কেয়ামত, পুলসিরাত ও জান্নাত-জাহান্নাম- তত্ত্বের আলোচনা করেন। কামসাধন, লালসাধন, প্রেমভাজা, ত্রিবেণীর ঘাট ও সাঁই কি জিনিস তা খুলে বলেন। তার সাধুসঙ্গে সবাই যে বসতে পারে, তা নয়। তার পছন্দমতো কিছু নারীপুরুষ এই সাধুসঙ্গে বসার সৌভাগ্য লাভ করে থাকে। দীর্ঘদিন তার দরবারে যারা যাতায়াত করে, যাদেরকে তার পছন্দ হয়, তাদের মধ্য থেকে দু’একজনকে বেছে নেন। বিশ্বস্ত লোক ব্যতিত কাউকে তিনি মারফতি বিদ্যা শেখান না। দিনের আলো নিভে রাতের অন্ধকারে ছেয়ে যায় পুরো শহর, দিনের ক্লান্তিতে বিছানায় নুয়ে পড়ে খেটে-খাওয়া মানুষ, রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরেরা ঘুমে নাক-ডাকে, চুপ হয়ে যায় রাতজাগা পাখি ও ঝিঁঝিঁ পোকারা, বিশ্বপ্রকৃতি করে নীরবতা পালন, তখনও পির মাহবুব জেগে থাকেন, সাধুসঙ্গ করেন, অনুরাগীদের বাতলে দেন আল্লাহকে দেখার পথ…। কোনও কোনও দিন সাধনায় সিদ্ধিলাভকারী ভক্ত-অনুরাগীদের আল্লাহকে স্বচক্ষেও দেখিয়ে দেন! গভীর রাত পর্যন্ত তার সাধনযজ্ঞ চলে। চলে গুরুকথা। সাধুসঙ্গ ভেঙে দিয়ে তিনি গুরুগৃহেই ঘুমিয়ে পড়েন। আমিও গুরুজির সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ি। বাকিরা মাজারে রাত কাটায়। কেউ কেউ গেস্ট হাউসে চলে যান। অবসরপ্রাপ্ত এক ক্সসনিক এই বাড়ির দারোয়ান। তিনি অতন্দ্র প্রহরী। গভীর রাতেও তিনি গেইট খুলে দেন, পুনরায় বন্ধ করেন। ভক্তরা সকাল হলে যে-যার মতো চলে যান। গুরুজি বেশিক্ষণ ঘুমান না। ফজরের আজান ভেসে আসার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি ঘুম থেকে মোচড় দিয়ে উঠে পড়েন। এরপর ফরজ গোসল করেন, অজু করেন। অতঃপর শাদা আলখাল্লা পরে বের হয়ে বংশপরম্পরায় চলে আসা মাজারে যান, মাজার জিয়ারত করেন। বাড়িতে এসে হালকাপাতলা নাশতা করেন, তারপর ঘুমাতে যান। বিকেল হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি বেঘোরে ঘুমান। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে গোগ্রাসে খাবার খান। অতঃপর রাজকীয় পোশাক পরিধান করে খানকায় বসেন। আগত অতিথিদের উদ্দেশে বয়ান করেন, বায়াত দেন। কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে যান; বিশেষ কোনও কারণ ছাড়া তিনি বাড়ির বের হোন না। পুনরায় রাতে বসেন সাধুসঙ্গে।
আজ কী হলো? সাঁইজি কেন ঘুম থেকে উঠছেন না? তিনি কি প্রতিদিনের মতো মাজার জিয়ারত করবেন না? ফজরের আজান শেষ। পাখিরা জেগে গেছে, সূর্য উঠে গেছে, তবু সাঁইজি ঘুম থেকে কেন উঠছেন না? তিনি কী মরে গেছেন?
স্ত্রী-সন্তানরা চিন্তিত। বাড়ির কাজের মেয়েরা চিন্তায় অস্থির। আমি তখনও ঘুমে। প্রতিদিন আমি ঘুম থেকে দেরি করে উঠি। সাঁইজি শয্যা ত্যাগ করার সময় আমাকে ডাকেন না। গুরুমা ফাতিমার ডাকে আমার ঘুম ভাঙে। গুরুমা ডাকেন— এই শিমুল, সাঁইজির কি হইছে? তিনি ঘুম থেকে কেন উঠছেন না? আমি ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠি। ঘরের দরজা খুলে দেই। মাতৃজঠরে সর্বজীবের ভ্রূণ সৃষ্টিকারী শ্বেতবর্ণের মানবজলকে সাঁই বলে। যে সাঁই পান করলে দেহ পরিশুদ্ধ হয়, অমরত্ব লাভ করা যায়। যিনি কাম সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে নারীদেহ থেকে সাঁই বের করতে পারেন, তিনিই সাঁইজি। সাঁইজিকে প্রণাম করার সময়ে বলতে হয় আলেক সাঁই। আমার দীক্ষাগুরু নারীদেহ থেকে সাঁই বের করতে পারেন, এজন্য আমি আমার গুরুজিকে সাঁইজি সম্বোধন করে ডাকি, প্রনাম করার সময় বলি—আলেক সাঁই। তার বিশেষ ভক্তরাও তাকে সাঁইজি বলেন। যদিও দূরের মানুষ তাকে পির মাহবুব হিসেবেই চিনেন। গুরুমাও তার স্বামীকে সাঁইজি সম্বোধন করে কথা বলেন। ঘরের দরজা খুলে সাঁইজির কাছে এসে বলি—আলেক সাঁই। …সাঁইজি…ও সাঁইজি, সকাল হয়েছে, ঘুম থেকে উঠুন। সাঁইজিকে ধাক্কা দিই। নড়েচড়ে না। শরীর ঠান্ডা এবং শক্ত। জোরেশোরে ধাক্কা দিই। এ-কি! রক্ত! সাঁইজির নাকমুখ দিয়ে রক্তের ধারা বইছে! কে হত্যা করল সাঁইজিকে? সাঁইজির স্ত্রী- সন্তানেরা হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কাজের মেয়েরাও বাদ গেল না। নারীরা বিকট শব্দে কান্নাকাটি আরম্ভ করল। কান্নার শব্দ ছড়িয়ে গেল চারদিক। দেখতে-দেখতে বাড়ির আশেপাশের লোকজন চলে এলো। একজন দুজন করে লোকে ভরে গেল পুরো বাড়ি। লোকে লোকারণ্য। কোথাও পা ফেলার জায়গা নাই। এতক্ষণে সাঁইজির মৃত্যুসংবাদ নিশ্চয়ই দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেছে! সাঁইজির আত্মীয়-স্বজনরা এলো। সবাই আমার দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায়। তাদের চোখে চোখ পড়লে অস্বস্তি লাগে, ভয় হয়। সাঁইজির মৃত্যুতে সবাই কাঁদে; শুধু আমি কাঁদতে পারছি না। কি থেকে কি হয়ে গেল! কিচ্ছু মাথায় ধরছে না। মিথ্যে কান্নার অভিনয় করি; চোখে জল আসে না। সাঁইজির মৃত্যুতে আমার কোনও শোক নাই; তবে, ভয়ে আমার হাতপা কাপছে! আমার শরীর ঘেমে যাচ্ছে। সবার দৃষ্টি বলে দেয় সাঁইজিকে নিশ্চয়ই আমি খুন করছি। সবার সন্দেহ হবারই কথা। সাঁইজির সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক আমি। সাধুসঙ্গ ভেঙে গেলে সাঁইজি আর আমি একই বিছানায় ঘুমাই। সাঁইজি যে-রাতে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হোন, সে-রাতে শুধু আমি তার বিছানায় থাকি না। এমন দু’একটা রাতও গেছে সাঁইজি, সাঁইজির স্ত্রী ও আমি একসঙ্গে ঘুমাইছি। দেহসাধন করতে একজন পুরুষের একজন সাধিকা লাগে। আমি প্রথম যেদিন দেহসাধন করতে যাই, সেদিন সাধিকার ভূমিকায় ছিলেন স্বয়ং গুরুমা! আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেছিলাম। সাঁইজিকে বলেছিলাম— না, আমি পাড়বো না। সাঁইজি বললেন—দ্যাখো বাজান, নদীতে গোরুছাগল, ঘোড়াগাধা, কুকুর আর নোংরা মানুষেরা গোসল করলেই যেমন নদীর পানি অপবিত্র হয়ে যায় না, ঠিক তেমনই তুমি তোমার গুরুমার কাছে গেলেও সে আমার জন্য হারাম হয়ে যাবে না। এরপর গুরুমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন—অধরা, শুরু কর। গুরুমার নাম ফাতিমা, সাঁইজি ডাকেন—অধরা। অধরা মা শুরু করলেন। সাঁইজি বসেবসে দেখতে ছিলেন আর বলতেছিলেন আমার কখন কোন কে․শল অবলম্বন করতে হবে। অধিকাংশ রাত আমি আর সাঁইজি একসঙ্গে ঘুমাই। সাধুসঙ্গ শেষে গুরুগৃহেই ঘুমিয়ে পড়ি। সেই আমার বর্তমানে সাঁইজি খুন হয়ে গেলেন অথচ আমি জানি না, এটা কেউ মানতে চাইছে না! অধরা মাও আমাকে অবিশ্বাসের চোখে দেখছে…! আমারও বুঝতে বাকি রইল না এই খুনের দায়ে আমার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে, অথবা ফাঁসি! খাটের নিচে লুকিয়ে রাখা মদের বোতল চুপিচুপি বের করি। ঘরভরতি মানুষ। মানুষের ভিড় ঠেলে রান্নাঘরের পাশে এসে দাঁড়াই। ঢকঢক করে পুরো বোতল গিলে ফেলি। সিগারেট ধরাই, জোরেশোরে টানি। নেশায় বেহুঁশ হতে চাই। সিগারেটের প্যাকেটে গাঁজার বিড়ি। গাঁজার বিড়ি টানি। নেশায় হাতপা নেতিয়ে আসে। আমি মরে পড়ে থাকতে চাই। আমার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাক। আমি কিচ্ছু টের পেতে চাই না। আমি বুঝে গেছি, আমার পরিণাম ভয়াবহ! আমাকে টেনেহিঁচড়ে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করা হবে। অথবা পুলিশ এসে আমাকে গ্রেফতার করবে, রিমান্ডে নিয়ে বেদম পেটাবে। আমার মুক্তির কোনও পথ নাই। কিন্তু; আমাকে অবাক করে দিয়ে সাঁইজির মেজো ছেলে কুদরত কানেকানে বলে—শিমুল দাদা, ভয় পাইও না আমি আছি। কুদরত গিজগিজ করা মানুষের ভিঢ় ঠেলে গুরুগৃহে ঢুকল। বেরিয়ে আসার সময় চিৎকার করে বলল—ওই-শুয়োরের বাচ্চারা, তোরা যারা কইবি পির মাহবুব মইরা গ্যাছে, তাগোরে আমি গুলি কইরা মাইরা হালামু। বাজান মরে নাই। বাজান মরতে পারে না। তোরা শুনিস নাই অলি-আউলিয়ার কোনও মৃত্যু নাই? যা, তোরা সব এই বাড়ি থেকে বাড়াইয়া যা।
কুদরতের অনুগত লোকের অভাব নাই। এলাকার লোক তাদেরকে কুদরত বাহিনী বলে। কুদরত অনেক রাগী মানুষ। কেউ তার বিরুদ্ধে গেলে কুদরত তাদের উপর খ্যাপে যায়, মারধর করে। কুদরতকে যারা চেনে তারা তাকে ভয় পায়। কুদরতের হুকুমে কুদরত বাহিনী সাঁইজির লাশ দেখতে আসা লোকজনকে তাড়িয়ে দিলো। বাড়ির গেইট বন্ধ করে দেওয়া হলো। কুদরত তার মা, বোন ও ভাইদের বলল—মাইনষে জানে অলি-আউলিয়া গায়েব জানেন। বাজানের ভক্ত-আশেকরাও জানে বাজান গায়েব জানতেন। এখন যদি সমাজে প্রচার হয় যে বাজানরে হত্যা করা হইছে, তাইলে শত্রুরা কইবো—পির মাহবুব যদি সত্যিই গায়েবের খবর জানতেন, তাইলে তাকে হত্যা করা হবে এইটা কেন তিনি জানলেন না? তখন বাজানের জনপ্রিয়তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াইবো তোমরা চিন্তা কইরা দেখছো? যে মরার সে মইরা গ্যাছে, তারে নিয়া টানাহেঁচড়া করার দরকার নাই। তারচে মরার পরে-ও যেন তার খ্যাতি অটুট থাকে, সেই ব্যবস্থা আমাগো করতে হইবো।
কুদরত একজনকে হুকুম করল—এই যাও, মসজিদের মাইকে ঘোষণা করে দাও পির মাহবুব পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। বড়োভাই মনিরকে ফিসফিস করে বলল—তুই ফেসবুকে পোস্ট দে, বাজান মরার তিনদিন আগেই আমাদের পরিবারের সবাইরে ডাইকা কইছিলেন, আমি আর পৃথিবীতে থাকব না। তোমরা আমার ভক্ত-আশেকদের দেইখা রাইখো। মুহাম্মদী ইসলামরে জিন্দা রাইখো। তোমরা পথভ্রষ্ট হইও না।
মাজারের সামনে, মসজিদের সামনে, বাড়ির সামনে, রাস্তায়, লোকজনে থইথই করছে! সারাদেশে খবর ছড়িয়ে গেছে পির মাহবুব আর নেই। মাইকে ঘোষণা করা হলো—খুব তাড়াতাড়ি হুজুর কেবলার দাফনকাজ সম্পন্ন করা হবে, আপনারা যারা এক নজর তাকে দেখতে চান, যারা তার জানাজার নামাজে শরিক হতে চান, তারা বেলা দশটার মইধ্যে দরবারের মাঠে উপস্থিত হোন।
যে মানুষটাকে কেউ কোনওদিন স্পর্শ করার সাহস পেত না, যার সম্মানার্থে অতিথিরা ঘর থেকে বেরোনোর সময় উলটো দিকে মাথানিচু করে হেঁটে যেত, তাকে টেনেহিঁচড়ে ঘরের বাহির করা হলো! উঠানে একটা ভাঙাচোরা খাটের ওপর শোয়ানো হলো। হালকাপাতলা গুঁতোগুঁতি করে পানি ছিটিয়ে সাবান মাখিয়ে লাশটা ধুয়ে ফেলা হলো। যে মানুষটা অনেক দামি আর রাজকীয় পোশাকআশাক পরিধান করতেন, তাকে কমদামের শাদা কাফনের কাপড়ে মোড়ানো হলো। এমনভাবে মোড়ানো হলো যেন মরে পঁচে যাওয়া কোনও কুকুরকে আবর্জনার স্তূপে ফেলে দেওয়া হবে। খাটের পাশে আগরবাতি জ্বালানো হলো। লাশের উপর গোলাপজল ছিটিয়ে দেওয়া হলো। আতর লাগানো হলো। তখনও পির মাহবুবের নাকমুখে রক্তের ধারা বইছে…। যে মানুষটার সামনে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্র ও বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জড়সড়ো হয়ে বসে থাকতেন, যার সঙ্গে এমপি- মন্ত্রীরা আড্ডা দিতেন, প্রধানমন্ত্রী যাকে সম্মান করতেন, যিনি কোথাও যাওয়ার জন্য বের হলে গোটা তিরিশটা দামি গাড়ি প্রস্তুত থাকতো, যার পায়ের ধুলো মাথায় নেওয়ার জন্য অনুরাগীরা অপেক্ষায় থাকতো, যিনি পথ দিয়ে হাঁটলে তার পা ফেলার স্থানে ভক্তরা চুমু খেতো, যার খাবারের উচ্ছিষ্ট খাওয়ার জন্য কুকুরের মতো আশায় বসে থাকতো ভক্তরা, সেই তাকে, আমার সাঁইজি পির মাহবুবকে ভাঙাচোরা খাটে উঠিয়ে কলেমা পড়তে-পড়তে মাজারের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো!
মাজারে পূর্বপুরুষদের কবরের পাশেই কবর খোঁড়া হয়েছে। উপস্থিত লোকজনকে এক নজর দেখানো হলো। সাংবাদিকদের কাছে ঘেষতে দেওয়া হলো না। কাউকে ছবি তুলতে দেওয়া হলো না। সাঁইজির আত্মীয়স্বজনদের কাউকে কিচ্ছু বলতে দেওয়া হলোনা। অপরিচিত কাউকে লাশ ছুঁতে দেওয়া হলো না। কুদরত বাহিনী লাশ ধরাধরি করে কবরে নামালো। দ্রুত মাটিচাপা দিলো। ভক্ত- আশেকানদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে আসছে। কেউ মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমি নীরব দর্শকের মতো দেখতে থাকলাম…।
নিষিদ্ধপল্লি
মিথ্যে বলব না; সেই ছেলেবেলায় মায়ের সঙ্গে একবার জেলখানায় গিয়েছিলাম, মামাকে দেখতে। মামা একটা খুনের মামলার আসামি ছিলেন। আমার মায়ের ছোটো চাচা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি যে ওয়ার্ড থেকে মেম্বার নির্বাচিত হয়েছিলেন সে ওয়ার্ড ছিল চোর-ডাকাতে ভরা। তিনি চোর-ডাকাত দমনে কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। চোরেরা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে তাদের কঠিন বিচার করতেন। এতে নিরীহ এবং ভালো মানুষের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। কিন্তু, খারাপ মানুষগুলো তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়। একসময়ে মেম্বার থেকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দিলে খ্যাপে যান সাবেক চেয়ারম্যান। সাবেক চেয়ারম্যান চোর-ডাকাতদের দিয়ে আমার মায়ের ছোটো চাচাকে, অর্থাৎ, আমার ছোটো নানাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
পৌষ মাস। নানাবাড়িতে ভাপা পিঠার আয়োজন করা হয়েছে। আমার ছোটো নানা, আমরা দু-ভাই যাকে মেম্বার নানা বলতাম, তিনি আমাদের নিতে এসেছেন, বিকেলবেলা। মেম্বার নানার সওয়ারি ঘোড়া ছিল। ঘোড়ায় চড়ে তিনি চলাফেরা করতেন। সেই ঘোড়ায় আমাদের দুই ভাইকে উঠিয়ে নানা ঘোড়ার লাগাম টেনে আগে-আগে হেঁটে যাচ্ছিলেন, আর মা-বাবা পিছে-পিছে। নানা আমাদের দুই ভাইকে খুব ভালো বাসতেন। তাদের বংশে আমরা দুই ভাই প্রথম নাতি হওয়াতে আমাদের সমাদর ছিল বেশি। সন্ধ্যার দিকে নানাবাড়িতে পৌঁছালাম। আমাদের বাড়ি থেকে নানাবাড়ি যেতে মাঝখানে একটা গ্রাম পাড়ি দিতে হয়। বাড়িতে আরও অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছে। সে রাতে মুরুব্বিদের ক্সবঠকি গানের আসর বসেছিল। রাত এগারোটার দিকে মেম্বার নানার দোস্ত এলেন। তিনি নানাকে বললেন—দোস্ত, বাড়িতে যাইতে হইবো, একটা সালিশ আছে। নানার মা, মানে আমার মায়ের দাদি নানারে বাঁধা দিয়ে বললেন—রাইত কইরা যাওনের দরকার নাই, দিনে যাইস। নানা মানলেন না। যতদূর মনে পড়ে, সেদিন রাতে মেম্বার নানার পোষা কুকুরটা নানার পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিল। বারবার নানার লুঙ্গি কামড়ে ধরছিল। নানা কুকুরটাকে ধমকিয়ে বন্ধুর সঙ্গে বের হয়ে গেলেন।
ফজরের আজান দেওয়ার আগে মেজো নানার বড়ো মেয়ে ফরিদা খালা আমার মায়ের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে ছিল—ওই আপা, মেম্বারের গলা কাইটা হালাইছে তোরা তাড়াতাড়ি আয়। মা ঘুমের মানুষ উইঠা দৌঁড় মারলেন। আমিও ছোটো মানুষ কান্না করতে-করতে মায়ের পিছনে দৌড়াতে থাকি। পিছনে ভাই এবং বাবা। আমার অন্যান্য নানা ও মামারা ডেগার, ছুরি ও লাঠিসোঁটা নিয়ে দৌঁড়াতে লাগল। দৌড়ে নানার বন্ধুর বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি ঘরে রক্তের বন্যা! নানার ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহ মাটিতে পড়ে আছে। সকাল আটটা-নয়টার দিকে অনেক পুলিশ এলো। পুলিশ এসে নানার লাশ নিয়ে গেল।
বন্ধুর বাড়িতে নানা ঘুমিয়ে ছিলেন। খুনিরা পরিকল্পনা করে নানাকে তার বন্ধুর বাড়িতে এনেছে। নানার বন্ধুও টাকার লোভে এই খুনের সঙ্গে জড়িত। নানারে বলেকয়ে বাড়িতে এনে অনেক রাতভর গালগল্প করে নানারে নানার বন্ধু তার নিজের বিছানায় নিজের পাশেই শুইয়ে রেখেছিলেন। নানা যখন গভীর ঘুমে, তখন নানার বন্ধু ঘরের দরজা খুলে দেন এবং খুনিরা আরামে ঘরে ঢুকে নানারে খুন করেন। খুনিদের নামে মামলা হলো। খুনিরা প্রভাবশালী হলেও আমার নানা- মামারাও কম নন। তাদের দাপটে খুনিরা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন। আমার নানা-মামারা খুনিদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলেন। খুনিরা কয়েকবছর পালিয়ে বেড়ানোর পর তাদের জায়গাজমি বিক্রি করে এবং ক্ষমতাবান লোকেদের ধরে মামলাটা গায়েব করে দিলেন। একসময়ে খুনিরা বাড়িতে এসে সংসার করতে লাগলেন। এতে আমার নানা-মামারা খ্যাপে গেলেন এবং খুনিদের মধ্যে ভয়ংকর খুনিকে টার্গেট করলেন। একদিন বৃষ্টির রাত, ওই রাতে নানা-মামারা মিলে সেই ভয়ংকর খুনিকে জবাই করলেন! এইবার আমার নানা-মামাদের নামে মামলা হলো। সেই মামলায় আমার বড়ো মামা ধরা পড়লেন। এরপর মা-বাবা মাঝেমধ্যে মামাকে দেখতে জেলখানায় যেতেন। একদিন আমিও মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম।
আমাদের বাড়ি থেকে জেলখানা খুব একটা দূরে না। রিকশায় গেলে তিরিশ- পঁইত্রিশ মিনিটে যাওয়া যায়। জেলখানায় যেতে যে-রাস্তা দিয়ে যেতে হতো, সে- রাস্তার পাশেই ছিল একটি পতিতালয়। কেউ কেউ বলে—নটীবাড়ি, খানকিবাড়ি, বেশ্যালয়। শিক্ষিত মানুষ বলে—পতিতাপল্লি বা নিষিদ্ধপল্লি। আমাদের এলাকার মানুষ বলে—বেশ্যাপাড়া। এই পাড়ার সামনে দিয়েই আমাদের থানায় যেতে হতো; কোর্টে, মার্কেটে, হসপিটালে ও লাইব্রেরিতে যেতে হলেও এই পাড়ার সামনে দিয়েই যেতে হতো। তখন উত্তরপাড়া, দক্ষিণপাড়া, পশ্চিমপাড়া, পূর্বপাড়া বুঝি; বেশ্যাপাড়া বলতে কী বোঝায়, বুঝি না। এখানে কাদের বসবাস, এখানে কারা যাওয়া-আসা করে, এসে কী করে, তাদের ধর্ম কী, তাদের সমাজব্যবস্থা কেমন, এর কিচ্ছু জানতাম না। জানার কথাও না। তখন আমি অনেক ছোটো। মা আর আমি রিকশায় বসে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়লো অনেক মহিলা সেজেগুজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। কেউ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে। কেউ দেয়াল ঘেঁষে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। কেউ গান গাইছে। কেউ রাস্তার পুরুষ মানুষকে ইশারায় ডাকছে, চোখ মারছে। আমি ভেবেছিলাম এটা একটা বিয়েবাড়ি হয়তো। কয়েকটি মহিলাকে দেখলাম তারা প্রকাশ্যে সিগারেট টানছে! আমি অবাক হই। মহিলা মানুষ বিড়ি-সিগারেট টানে এটা এই প্রথম দেখলাম। মাকে বললাম—মা, এই মহিলারা বিড়ি টানতেছে কেন? উনাদের মাইনষে খারাপ কইবো না? মা বলে—চুপ থাক কথা কইস না। এরা আসলেই খারাপ মানুষ। এই জায়গাটাও খারাপ। মায়ের কথায় আমার কে․তূহল জাগে। আমার জানতে ইচ্ছে করে, এরা কারা? জায়গাটাই-বা খারাপ কেন? ততক্ষণে রিকশা পৌঁছে গেছে জেলগেটে। রিকশা থেকে নেমে মা টিকিট কাটল। মামার সঙ্গে দেখা হলো। মামা চোদ্দো শিকের ভেতরে, আমরা বাইরে থেকে কথা বললাম। লোকজনের হইচইয়ে কথা ভালো করে শোনা যায় না। কোনওকোনও আসামির আত্মীয়স্বজনের কান্নাকাটি চিৎকার চেঁচামেচিতে বিরক্তিকর একটা অবস্থা। কথাবার্তা শেষে বাড়ি ফেরার সময় রিকশায় উঠতে গিয়ে মা আর টাকা খুঁজে পায় না। বাড়ি থেকে মা খরচের টাকা যা নিয়ে এসেছে সব টাকা শাড়ির আঁচলে বেঁধে রেখেছিল। অনেক লোকের ভিড়ে আঁচলের বাঁধন খুলে চোরে টাকা কখন নিয়ে গেছে মা বুঝতেই পারেনি। বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হলো। পতিতালয়ের সামনে দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলাম। এই সুযোগে আমিও পতিতাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মা ধমক দিয়ে বলল— কি দ্যাখস? মায়ের কথার উপরে কোনও কথা বলতে না পারলেও আমার শিশুমন বলে উঠল—কেন, এদের দেখলে সমস্যা কী?
আরেকবার, এক ইদে আমি বায়না ধরলাম আমাকে চামড়ার জুতা কিনে দিতে হবে। মা বলল—ট্যাকাপয়সা নাই, এই ইদে জুতা কিনা দিতে পারুম না। আমার মনখারাপ দেখে বাবা আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল—চিন্তা করিস না, তরে আমি জুতা কিনা দিমু। পরদিন বাবা আমারে গ্রামের হাটে নিয়ে গেল। কোনও জুতা পছন্দ হলো না। বাবা বলল—ঠিক আছে, আগামীকাল তরে নিউমার্কেট নিয়া যামু। নিউমার্কেটে জুতার দাম অনেক বেশি; বেশি দামের জুতা ধরবি না? আমি বললাম—ঠিক আছে বাবা, তুমি যেই জুতা কিনা দিবা, আমি সেইটাই নিমু।
পরেরদিন বাবা আর আমি নিউমার্কেটে যাচ্ছি, রিকশায়। সেই পতিতালয়ের সামনে দিয়ে। রাস্তায় অনেক জ্যাম। রাস্তায় গাড়িঘোড়া আর অতিরিক্ত লোকজনে গিজগিজ করছে। রাস্তার একপাশে পতিতালয়, আরেক পাশে দোকানের সারি। দোকানগুলো থেকে ধুমধড়ক্কা গানের আওয়াজ আসছে। আমার কান জ্বালাপোড়া করছে। বিরক্ত হচ্ছি। তবু তাকিয়ে আছি পতিতালয়ের দিকে, দেখছি পতিতাদের গতিপ্রকৃতি। বাবা চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ এক মহিলা বাবাকে ডাক দিলো—ওই আয়, মাত্র পঞ্চাশ টাকা। পোলারে নিয়া আয়, সমস্যা নাই।
বাবা মহিলাটার দিকে তাকিয়েও দেখলো না; লজ্জায় মাথানিচু করে রইল। রিকশা আস্তেধীরে সামনে এগুচ্ছে। বাবাকে বললাম—আইচ্ছা বাবা, এই মহিলারা এইখানে কী করে? আমার প্রশ্ন শুনে রিকশাওয়ালা চাচা হাহাহা করে হেসে ওঠে। আমি বুঝতে পারি না এই হাসির মানে কী। বাবা বলে—এইখানে সব খারাপ মাইনষের আড্ডা। এই জায়গাতে কুনুদিন আইবি না। আমার শিশুমন প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে গেল। কেন খারাপ? কীসের খারাপ? এই জায়গায় কী আছে?
এরপর যখন বড়ো হলাম, যৌবন এলো, দাড়িগোঁফ গজালো, উচ্চমাধ্যমিক পাস করে পড়ালেখায় ইতি টেনে কর্মে যোগ দিলাম, মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজনদের মাঝে গুঞ্জন শুনলাম আমাকে তারা বিয়ে করাবে, তখন একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম ওই খারাপ জায়গার ভিতরে যাবো, অবশ্যই যাবো। এতদিনে বুঝে গেছি ওই খারাপ জায়গায় দেহ বিক্রি হয়। ওখানে টাকা দিয়ে কিছু সময়ের জন্য ভালোবাসা কিনে পাওয়া যায়। ইচ্ছেমতো পছন্দ করে যে-কাউকে ভালোবাসা যায়, আদর করা যায়, আদর পাওয়া যায়, এবং ছুঁয়ে দেখা যায়। আমার সমবয়সী বন্ধুরা গল্প করে। ওরা ওখানে গিয়ে কত টাকা দিয়েছে, কেমন মহিলা নিয়েছে, কয়জনের কাছে গেছে, কীভাবে কী করেছে এইসব গল্প করে। এইসব গল্প শুনে আমারও শিহরন জাগে, যেতে ইচ্ছে হয়। বন্ধু বাবুলকে একদিন বলেই ফেলি—দোস্ত, আমারে ওই পাড়ায় নিয়া যাইবি? বাবুল রাজি হয়।
অপেক্ষার পালা শেষ করে একদিন ঢুকে পড়ি পতিতালয়ে। অনেক মহিলাই টানাটানি করে; তাদের টানে যাই না। এক মহিলা জোর করে তার রুমে ঢুকাতে চায়, বন্ধু বাবুল ধমক দিয়ে বলে—ওই চুতমারানি মাগি, ওরে ছাইড়া দে, নয়লে কিন্তু পিটামু। বন্ধু বাবুল যতটা চালাক, ততটা ঝানু। ও এখানে অনেকবার এসেছে। এখানকার দালালরা ওরে চেনে। বুঝতে পারলাম ও নিজেও দালাল। আমাদের স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে—মাগির দালাল। এই পাড়ার দোকানদাররাও বাবুলকে চেনে। এখানকার নাসরিন সর্দারনির সঙ্গে ওর ভালো সম্পর্ক। মহিলাটি আমাকে ছেড়ে দেয়। বাবুল বলে—
দোস্ত দ্যাখ, দেইখা যেইটা পছন্দ অয় সেইটার কাছে যা। তরে কেউ কিছু কইবার সাহস পাইবো না, আমি আছি। আমার চেনা একটা ভালো মাল আছে, ওর কাছে যাইবি? আমি এদিক-ওদিক দেখতে থাকি। মনের মানুষ খুঁজি; একজনকেও পাই না। বাবুলকে বলি—চল দোস্ত তোর পরিচিত মালটারে দেখি। বাবুল মেয়েটির কাছে নিয়ে আসে। মেয়েটি সত্যিই সুন্দর। এ যেন খাঁটি পল্লিবধূ। হাজার ফুলের মাঝে একটি গোলাপ। নারীদের বাজারে তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে বিক্রি হবার জন্যে নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে। সাদামাটা পোশাকআশাক। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মেয়েটি আমার হাত ধরে মুচকি হেসে বলে- আসো। বাবুল মেয়েটিকে বলে—ওই শোন, এইটা আমার লোক, নতুন আইছে, উলটাপালটা করবি না। মেয়েটির সঙ্গে রুমে ঢুকে পড়ি। বন্ধু বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে। রুমে ঢুকেই মেয়েটি দরজা বন্ধ করে। কাপড়চোপড় খোলে। আমার বুকের ভেতর কেমন যেন ভয় কাজ করতে থাকে। মেয়েটি আমাকে উলঙ্গ হতে বলে। আমার হাতপা কাঁপে। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখি মক্কার পবিত্র কাবাঘরের একটি ছবি ঝোলানো। পাশেই মসজিদ-এ নববির ছবি। আরেকপ্রান্তে ঝুলে আছে একটি অদ্ভুত প্রাণীর ছবি; মাথাটা সুন্দরী নারীর, বাকি অংশটা প্রায় ঘোড়ার মতো দেখতে। লোকমুখে শুনেছি এটা বোরাক; এই বোরাকের পিঠে সওয়ার হয়ে আমাদের দিনের নবি মেরাজে গিয়েছিলেন তথা আল্লাহর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। টেবিলের উপর পড়ে আছে জায়নামাজ, তসবি ও পবিত্র কোরআন শরিফ। আমি নিবিড়ভাবে দেখতে থাকি। মেয়েটি আমাকে খোঁচা মারে এবং বলে—এই, তুমি কী এইসব দেখার জন্যে আইছও? আমি মেয়েটির দিকে তাকাই। জীবনের প্রথম কোনও উলঙ্গ নারীকে দেখলাম। রেশমি কালো চুল আমাকে মুগ্ধ করে। মায়াবী হরিণীর মতো চোখ দুটো আমাকে আকর্ষণ করে। কমলালেবুর মতো গাল দুটো ছুঁয়ে দিতে মন চায়। দুধে-আলতা মেশানো গায়ের রং। উন্নত বুক, নাভিমূল ও নিতম্বের দিকে তাকিয়ে থাকি, মুগ্ধ হই। মানবজাতির আগমনের পবিত্র রাস্তার দিকে অপলক চেয়ে থাকি। রাস্তার চারপাশে খয়েরি রঙের ঘাস; ইচ্ছে হয় ঘাসগুলোর ডগা আলতো করে ছুঁয়ে দেই। মেয়েটির কাছে যাই, খুব কাছে। তার মাথায় হাত বুলাই। মাথায় মসৃণ কালো চুল; চুলগুলো আলতো করে ধরে নাকের সামনে নিয়ে বুক ভরে চুলের ঘ্রাণ নিই। শ্বেতশুভ্র কপালে একটা চুমু দিয়ে ওর মাথাটা বুকে টেনে নিই। আদর করার প্রবল ইচ্ছা জাগে। ইচ্ছেরা বলে— জন্মজন্মান্তর ধরে এভাবেই আগলে রাখো; ছেড়ে দিও না। মেয়েটির শ্বাসপ্রশ্বাস ঘনঘন ওঠানামা করছে। মৃদুভাবে মাথাটা বুকে নিয়ে কিছুক্ষণ চেপে ধরে রাখি। আচমকা মেয়েটি খ্যাপে গিয়ে বলে—অই চোদানির পোলা, কাম করলে কর না- করলে যাহ। ধোনে জোর নাই মনের জোরে আইছও খানকি বাড়ি?
আমি হতভম্ব হয়ে যাই। কারণ, আমি গালি খাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কোনওদিন এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি। মেয়েটির আচরণ আমার বুকের বাম পাঁজরে লাগে, হৃদয়টা ক্ষত-বিক্ষত হয়। আহত পাখির মতো ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। এতো সুন্দর নিস্পাপ শিশুর মতো মেয়েটির মুখের ভাষা এতটা খারাপ? আমি তো ওকে আদর করতেছি, ও আমাকে গালিগালাজ করছে কেন? ওর প্রতি আমার আর কামনা জাগে না। আমি দ্রুত মানিব্যাগ থেকে একশো টাকার দুইটা নোট হাতে গুঁজে দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসি। পেছন থেকে ডেকে বলে— অই, তোর ট্যাকা নিয়া যা। বন্ধু বাবুল তখনও বাহিরে দাঁড়ানো। মেয়েটির কথা শুনে বাবুল বলে—কী অইছে রে শিমুল? ও তোর লগে খারাপ ব্যবহার করছে? আমি বলি—না, কিছু না, চল বাড়ি যাই।
বাড়িতে এসেও কোনওভাবে মেয়েটিকে ভুলতে পারছিলাম না। সে আমার অনুভ‚তির রাজ্যকে দখল করে নিয়েছে। যতই ওকে ভুলে থাকার চেষ্টা করছি, ততই ওর মুখের ছবি আমার হৃদয়ের আয়নায় ভেসে উঠছে! উঠতে, বসতে, খাইতে, চলতে, ফিরতে ওর নগ্ন নারীমূর্তি আমার চোখে ভাসছে। কাজে গিয়েও ওকে ভুলতে পারছি না। যখনই ওর গালির শব্দগুলো আমার মনে হয়, তখনই আহত হই। বুকের বাম পাঁজরে চিনচিন করে ব্যথা ওঠে! ও আমারে গালি দিলো কেন? কী করেছি আমি? নিশ্চয়ই এর কোনও মানে আছে। আমি তো খারাপ ব্যবহার করিনি, তবু গালি দিয়েছে, অথচ আমার জানা হলো না কেন সে গালি দিলো। খুব ইচ্ছে করে আরেকটা বার বুকে নিয়ে বলি—তুমি আমারে গালি দিলা কেন? আমার উপরে তোমার এতো রাগ কীসের? কী করছি আমি? মনেমনে সিদ্ধান্ত নিই- আবারও যাব মেয়েটির কাছে। কিন্তু গালির শব্দগুলো যখন তিরের মতো বুকে এসে লাগে, তখন আর ওর কাছে যাওয়ার সাধ জাগে না।
একদিন বিকেলবেলা। বন্ধু বাবুলকে বললাম—
আমার একটা কাম কইরা দিবি দোস্ত? আমি তো ওই মেয়েটারে ভুলতে পারতেছি না। আমি ওরে কিছু উপহার দিমু, তুই ওর কাছে পৌঁছে দিবি? ক, দিবি? বাবুল বিস্ময়ের হাসি হেসে বলে— কি রে, তুই ওর প্রেমে পইড়া গেছ? আমি বলি— প্রেমে পড়া কি দোষের?
বাবুল রাজি হয়। আমার উপহার মেয়েটির কাছে পৌঁছে দিবে শুনে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। পরদিন মার্কেটে গিয়ে শাড়ি চুড়ি আর কানের দুল কিনি। তারপর সুন্দর করে প্যাকেট করে বাবুলের হাতে তুলে দিই।
এরপর বাবুলের সঙ্গে কয়েকদিন আর দেখাসাক্ষাৎ হয় না। বাবুল মাঝেমধ্যেই শহরে গিয়ে তিন-চারদিন করে থাকে। শুনেছি সারাদিন মদ-গাঁজা সেবন করে, দালালি করে, গুন্ডাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। পতিতালয়ের পাশেই একটা গেস্টহাউস আছে, রাতে ওখানেই থাকে। ইনকাম বেশি হলে কোনও পতিতার গৃহে রাত কাটায়। পাঁচদিন পর সন্ধ্যার দিকে বাবুল ফিরে আসে। হাতে একটা ভাজ করা কাগজ। কাগজটা দিয়ে বলে—তুই একটা জিনিস রে দোস্ত! মালটা তোরে পছন্দ করছে। এই মালের কাছে অনেকেই পাত্তা পায় না; অথচ তোর লাইগা তার চোখটা দেখলাম জলে ভইরা গ্যাছে! এই কাগজটা লেখার সময়ও কানছে! দ্যাখ পইড়া দ্যাখ কী লেখছে।
কাগজটা দ্রুত খুলে ফেলি। ভাঙা-ভাঙা অক্ষরে লেখা—
শিমুল,
আমি আয়শা; বাবার নাম—রাম, রহিম, ঈসা, মুসা অথবা বুদ্ধ, কৃষ্ণ, নানক কোনও একটা হবে হয়তো। সব পতির যে আলয় সেটাই তো পতিতালয়। এ আলয়ে বিভিন্ন রঙের মানুষ আসে। হিন্দু, বে․দ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান আসে, মুসলমানও আসে। সেইদিক থেকে জন্মসূত্রে আমি কোন ধর্মের অনুসারী এবং আমার জন্মদাতা পিতার নামপরিচয় কী, এর কিচ্ছু জানি না। এইখানে পির- ফকির, মোল্লা-মৌলবী, ঠাকুর-পুরোহিত, গুন্ডা-বদমাশ ও ভালোমন্দ সবধরনের পুরুষ আসে। এদিক থেকেও আমার বাবা ভালো মানুষ নাকি খারাপ মানুষ ছিলেন, তা-ও জানি না।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছ আমার মা একজন পতিতা, তাই না? —হ্যাঁ, আমার মা একজন পতিতা, আমি পতিতার মেয়ে পতিতা। অনেকে হয়তো খানকি, মাগি, নটী কিংবা বেশ্যা বলে থাকে। আর ভদ্র মানুষেরা বলে-যৌনকর্মী। আমার জন্মদায়িনী মা খাদিজা নামে পরিচিতা। কেউ খাদিজা খালা বলে, কেউ খাদিজা সর্দারনি বলে। মা জন্মসূত্রে মুসলিম। তিনি মুসলিম হিসেবে গর্বিতা। আমি আমার মায়ের নামে পরিচিতা, তাই আমিও নিজেরে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকি। আমার মা কীভাবে যৌন পেশায় আইছিলেন, জানি না। জানতেও চাইনি কোনওদিন। কিন্তু, আমি কীভাবে এই পেশায় আইছি তা তোমারে বলতেছি, শোন—
আমি তখন ছোটো। ছোটো মামির কাছে সবেমাত্র কোরআন পড়া শিখেছি। চার কলেমা শিখেছি। এবং দুই-একটা সুরাও মুখস্থ করছি। আমার নানি আমারে একটা সরকারি স্কুলে ভর্তি করাইয়া দিছিল। ভর্তি কইরা দেওয়ার সময় কইছিল- পিতা মৃত মোহাম্মদ আবদুল আজিজ। নানির কাছে শুনেছি আমার বাবা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গ্যাছে। তাই মা শহরে চাকুরি করে। আমি মায়ের কাছে থাকলে সমস্যা, তাই মা আমারে নানির কাছে রাইখা গ্যাছে। নানি যা কইছে আমি তাই বিশ্বাস করছিলাম। পড়ে বুঝতে পারছিলাম নানি মিথ্যা কইছিল।
যাই হোক, নানি মিথ্যা কথা কইয়া আমারে স্কুলে ভর্তি করাইয়া দিল। আমি নিয়মিত স্কুলে যাই। মনোযোগ দিয়া পড়াশোনা করি। যেহেতু ছাত্রী হিসেবে ভালো আছিলাম, তাই অনেক মেয়েই আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইত। আমার ভালো লেগেছিল শেফালিকে। শেফালি খুব সরল ও নরম মনের। ওর সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে। ক্লাসে একসঙ্গে বসি, একসঙ্গে স্কুলে আসি-যাই। স্কুল ছুটি শেষে শেফালি একদিন আমারে ওদের বাড়ি যাইতে বলে। আমি ওর নিমন্ত্রণ ফেলে দিতে পারি নাই। শেফালির সঙ্গে ওদের বাড়িতে গেলাম। ঘরে গিয়া বসলাম। শেফালি জোরে-জোরে ডাক দিয়ে বলল—মা ভাত দেও। দ্যাখো আমার বান্ধবীরে নিয়া আইছি, ওরেও ভাত দেও। শেফালির মা এলেন। তিনি আমারে দেইখা বিব্রত হইলেন। শেফালিরে একটু দূরে ডাক দিয়া নিয়া গিয়া বললেন—একজন বেশ্যার মেয়ের সঙ্গে তোর এতো খাতির কিসের? সাবধান কইরা দিতেছি, ওর সঙ্গে আর চলবি না। আমি কথাগুলো স্পষ্ট শুনলাম। খুব কষ্ট পাইলাম। সেদিন চোখের জলে আমার বুক ভাইসা গেছিল। আমি তাড়াতাড়ি উঠে চোখ মুছে শেফালিরে কইলাম, যাইগা শেফালি। শেফালি আমার পেছনে ফ্যাল-ফ্যাল কইরা তাকাইয়া রইল। ওর চোখে জল টলমল করছিল। বাড়িতে আইসা টেবিলে বইখাতা রাইখা বুক ভইরা কিছুক্ষণ কাঁদলাম। নানি আইসা জিজ্ঞেস করে—কি রে কি অইছে? নানিরে বলি—আইচ্ছা নানি, সত্যি কইরা কও তো, আমার মা কোথায় থাকে? আমার মায় কি বেশ্যা? বেশ্যারা কি খারাপ? আমার নানি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে—ভাত খা, কে কইছে তোর মা বেশ্যা?
মায়েরে খুব দেখতে চাইতাম। তখনও জানি না আমার মা কে। আমার মায়েরে কেমন দেখা যায় তাও জানি না। নানি একদিন আমারে মায়ের কাছে নিয়া গেল, শহরে। একটা হোটেলে পরির মতো সুন্দরী একটা নারী বইসা রইছে, বোরখা পইরা। আমারে দেইখা জড়াইয়া ধরলো। জানতে পারলাম সুন্দরী এই নারীটাই আমার মা। আমারে অনেক চুমু খাইলো। হোটেল থেকে আমারে নিয়া মার্কেটে গেল। সুন্দর-সুন্দর অনেক জামা আর চুড়ি মালা কিনে দিল। ব্যাগ ভরতি ফলমূল কিনে দিল আর নানির হাতে বেশকিছু টাকা দিয়া বলল—
মা, ওর দিকে খেয়াল রাইখো। পড়ালেখা যেন ঠিকমতো করে।
আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। একদিন রাইতে চার-পাঁচজন পুরুষ আমার ওপর হামলে পড়ে। তখন আমি ঘুমে ছিলাম। একজন মুখ চেপে ধরে। বাকিরা হাতপা শক্ত কইরা ধইরা আমারে পুকুরপাড়ে নিয়া যায়। আমি চিৎকার করতে পারি না। ওদের হাত থেকে ছুটতেও পারি না। আমার পরনের কাপড়চোপড় খুলে ফেলে। তারপর ওরা আমার সঙ্গে কী করেছিল নিশ্চয়ই বুঝে গেছ। এরপরের ঘটনা আমি জানি না। পরদিন নিজেকে আবি®‥ার করি একটা হসপিটালে। আমার সারা শরীরে ব্যথা। নিম্নাঙ্গ দিয়ে তখনও রক্ত ঝরছে। চোখ মেইলা তাকাইয়া দেখি পাশে বইসা আছে পরির মতো সুন্দরী সেই নারী, নানি যারে আমার মা বইলা পরিচয় করাইয়া দিছিল। মায়ের চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে। কয়েকদিনের মাথায় সুস্থ হইলাম। মা আমারে নিয়া আইলো তার আবাস্থল পতিতালয়ে। মায়ের অধীনে কাজ করতেন শান্তা খালা, হিন্দু। উনি বেশ শিক্ষিত ছিলেন। উনার কাছে মা আমারে পড়াতেন। আজকে যে-লেখাটা তোমার কাছে লিখছি, এটা শান্তা খালার অবদান।
প্রথমেই তোমারে কইছি—সব পতির যে আলয়, সেটাই পতিতালয়। এইখানে মায়ের যে পতি হইয়া আসে, সে মেয়েরও পতি হইতে পারে। আমার মায়ের কাছে এই শহরের এক নেতা আসতেন। তিনি জনদরদি ও খেটে-খাওয়া মেহনতি মানুষের নেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি আমার মায়ের বান্ধা কাস্টমার ছিলেন। তার চোখ একদিন আমার উপরে পড়ল। মায়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে আমারে ছিঁড়েখুঁড়ে খাইলো। সেইদিন থেকেই শুরু, আমার দেহব্যবসা।
এই পতিতালয়কে খেলাঘরও বলতে পারো। এইখানে একমুহূর্ত কিংবা কয়েক মুহূর্তে খেলা জমে এবং ভাঙে। কত রঙের মানুষ আসে এখানে। ভদ্র মানুষেরা আসে রাতে। ওরা টাকা দিয়ে সাময়িক সংসার গড়ে। যাবার আগে টাকা সুদে আসলে তুইলা নিয়া যায়। একেকজনের সুদ একেকরকম। কেউ পায়ুপথ থেকে নেয়, কেউ মুখে, কেউ বা নেয় সামনে থেকে। উঠে, বসে, দাঁড়িয়ে, শুয়ে ওরা ওদের হিসাব কষে নেয়। পিষে, খামচে ও কামড়ে ওরা ক্লান্ত হয়, ওরা আরও ক্লান্ত হতে চায়। কেউকেউ আদর কইরা ঠোঁটে চুমু খায়; কিন্তু, ওদের চুমু থেকে ভাইসা আসে মদ গাঁজা ও পান বিড়ির গন্ধ। ঘৃণায় আমার বমি আসে। এইসব পতি চলে যাবার সঙ্গে-সঙ্গে আমি হাতমুখ ধুই, গোসল করি, কাপড় পালটাই। বেশিরভাগ রাতেই আমি কাস্টমার ঘরে তুলি না। নামাজ পইড়া, কোরআন পইড়া কিংবা বই পইড়া সময় কাটাই, এবং ঘুমাইয়া যাই। এইখানে আমার মা সর্দারনি হওয়ার কারণে আমি বিশেষ একটা সুযোগ পাইয়া থাকি। যখনতখন ঘরে কাস্টমার না তুললেও আমার সমস্যা নাই। অন্যান্য মেয়েদের ক্ষেত্রে বিপরীত। ওরা কাস্টমার ফিরিয়ে দিলে সর্দারনি ওদের বকাবকি করে, মারে।
আমি স্বপনচারিণী। আমি অবিরাম স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি স্বামী, সংসার ও সন্তানাদির। আমিও আর দশটা নারীদের মতো সামাজিকভাবে বাঁচতে চাই। শ্বশুর-শাশুড়ীর সেবা করার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু মা বলে—এইসব স্বপ্ন দেখা বাদ দে; মনে রাখবি পতিতাদের কপালে আল্লাহ তিনটে জিনিস ল্যাখে নাই—১. স্বামীর সংসার, ২. সম্মান, ৩. জানাজা। আমি মায়ের কথায় প্রতিবাদ করতে পারি না। কারণ, বাস্তবতা এটাই দেইখা আসতেছি।
আমি পরিপাটি থাকতে পছন্দ করি। একা এক ঘরে থাকতে ভাল্লাগে। আমার ঘরে আমি একাই থাকি। জঘন্য কাস্টমার আসলে ওদের তাড়াতাড়ি বিদায় করার চেষ্টা করি। যেদিন আমার পছন্দের পুরুষেরা আসে, সেদিন ওদের অনেক সময় দেই, বুকে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমাই, কারও-কারও কাছ থেকে টাকাও নেই না। সেদিন আমি আমার আচরণেও পরিবর্তন লক্ষ করি। আমি পল্লিবধূর মতো মাথায় ঘোমটা দিয়ে থাকি। কথা বলি নরম সুরে। আমার মেজাজ থাকে ফুরফুরে। আমি স্বপ্ন দেখি এমন পুরুষের, যে আমার উপর হায়েনার মতো হামলে পড়বে না; যে আমাকে আদর করবে, যার স্পর্শে থাকবে প্রেম। এমন প্রেমিক পুরুষেরা আসে, মাঝেমধ্যেই আসে। ওরা আইসা ক্ষণিকের জন্য স্বপ্ন দেখায়, আবার স্বপ্ন ভাইঙ্গা চইলা যায়। ইদানীং এইসব প্রেমিকের প্রতিও আমার মনের আকাশে ঘৃণা জমে গ্যাছে। ওরা কেন আসে কেন যায়? ক্ষণিকের জন্যই যদি আইবি, তো প্রেম চোদানোর দরকার কী? আইছা চোদার জন্য চুইদা যাবি, এতো ভাব দেখানোর দরকার কী?
সেদিন তুমি আইছিলা। তোমার স্পর্শেও পাইছিলাম প্রেমের ছোঁয়া। তোমার স্পর্শ আমার কাছে এতটা পবিত্র আর মধুর ছিল যে, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি নাই; মনে হইছিল, তুই তো শালা একটু পরেই কাইটা পড়বি, তাইলে মায়ায় জড়ানোর দরকার কী? তাই গালাগালি করেছিলাম। সবার ভিড়ে আমি তোমারে চিনতে ভুল করছিলাম। আমারে ক্ষমা কইরা দিও। তোমার উপহার আমি গ্রহণ করেছি। এ-জীবনে এটা আমার পরম পাওয়া। পরম যতেœ উপহারটা রাইখা দিলাম। তোমার দেওয়া শাড়ি পইরা আমি কোনও কাস্টমারের সামনে দাঁড়াইতে পারমু না। তোমার উপহার আমারে বলে দিয়েছে, তুমি আমারে ভালোবেসে ফেলেছ। শাড়িটা পইরা ভালোবাসার মানুষটার সামনেই দাঁড়াতে চাই। তুমি আরেকটাবার আসো, অবশ্যই আইবা তুমি। আর হ্যাঁ, কবে কখন আইবা, আসার আগেই বাবুলরে দিয়া একটা খবর দিও। আমি তোমার জন্য সাজবো। ভয় পেও না, আর গালি দিবো না, কোনওদিনও না। ভালো থেকো, শুভকামনা।
ইতি—
আয়শা।
শুনেছি; নীলকর ডেবিট সাহেব ব্রিটিশ শাসনের প্রারম্ভে আমাদের সদর উপজেলার আলীগঞ্জ ও কালীগঞ্জ মৌজার মধ্যবর্তী এলাকা সোনাপুরে নীল চাষ করতেন এবং নীলের কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। নীলকর ডেবিট সাহেব সোনাপুরে আসার পরপরই গড়ে ওঠে পতিতাপল্লিটি।
মোগল আমলে বাঁশখালী ও তৎসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় মগ ও পুর্তুগিজ জলদস্যুরা দস্যুবৃত্তি, খুন ও অপহরণের মাধ্যমে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। দস্যুরা এই অঞ্চলের নারীপুরুষ ও শিশুদের ধরে হাতের তালু ফুটো করে সেই ফুটোর ভেতর দিয়ে পাতলা বেত ঢুকিয়ে বেঁধে নৌকার পাটাতনের নিচে ফেলে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যেতো ইউরোপে। ভয়ংকর এই জলদস্যুদের দমনে বাংলার সুবেদার দক্ষিণ ভারতের মালাবার অঞ্চলের সাহসী মোপলা যোদ্ধাদের নিয়ে আসেন। মোপলাদের দুঃসাহসিক প্রতিরোধের মুখে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের উৎপাত যখন বন্ধ হয়, তখন মোপলাদের বসতি স্থাপনের জন্য আমাদের সদর উপজেলার সোনাপুরকে নির্ধারণ করা হয়। সোনাপুরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে ত্রিবেণি নদী। এই নদীর পার ঘেঁষে মোপলারা উপনিবেশ গড়ে তোলে। মোপলাদের মূল জীবিকা ছিল মাছ ধরা এবং স্থানীয় জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনে মাছ বিক্রি করা। মোপলা স¤প্রদায় নিজেদের মাহিফরাস বলেও পরিচয় দিয়ে থাকেন। মাছ বিক্রেতাদের বলা হয় নিকারি। মোপলা বা মাহিফরাসদের যেহেতু মাছ বিক্রি করাই ছিল মূল পেশা, সেহেতু স্থানীয়দের কাছে তারা নিকারি হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেন। এখনও আমাদের সোনাপুর শহরে এই নিকারিরা টিকে আছেন।
নিকারিদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকতো। নিকারিরা মুসলমান হওয়ার কারণে তৎকালীন হিন্দু জমিদারেরা তাদের নিষ্পেষণ করতেন। সোনাপুর থেকে একটু দূরেই উত্তর-পূর্ব পাশে ছিল মদের ঘর, এখন যে জায়গার নাম হয়েছে মদের মোড়। একসময়ে এখানে বসে হিন্দু জমিদারেরা মদ পান করতেন এবং বাইজি নাচাতেন। নীলকর ডেবিট সাহেব এখানে আসার পরে এই মদের ঘরে তিনি এবং তার লোকজন আড্ডা দিতেন। স্থানীয় কতিপয় দালাল শ্রেণির মানুষ তাদের প্রশ্রয় দিতেন, মদ ও নারী সংগ্রহ করে দিতেন।
একদিন মদ্যপ অবস্থায় ডেবিট সাহেবের এক কর্মচারি যৌনসুখ নিতে সোনাপুরে নারী খুঁজতে থাকেন। মফিজের বউ আমেনা বেগম বাড়ির উঠান ঝাড়ু দিতেছিলেন। বাড়িতে আর কেউ ছিল না। মফিজ গিয়েছিল নদীতে মাছ ধরতে। ডেবিটের সাদা চামড়ার লম্বা মোটাসোটা কর্মচারী মফিজের বউ আমেনার সঙ্গে জোর করে সংগমে লিপ্ত হয়। ধর্ষিতা হয় আমেনা বেগম। এই ঘটনা যখন জানাজানি হয়, তখন মফিজের বউ আমেনা বিচার পাবে তো দূরের কথা বরং সমাজ থেকে নিষিদ্ধ হয়! সমাজের মানুষ আমেনাকে একঘরে করে দেয়। এতে আমেনা বেগম খ্যাপে গেল। লোকসমাজে মানসম্মান যেহেতু আর রইল না, তাই তিনি মানইজ্জতের ভয় না করে জমিদার ও ডেবিটের লোকজনের কাছে দেদারসে দেহ বিক্রি করতে লাগলেন। জমিদার ও ডেবিটের লোকজন আমেনার বাড়িতে আসা-যাওয়ার কারণে সমাজের লোকজন ভয়ে কিছু বলতে সাহস পেত না। সংসারের অভাবের তাড়নায় বাড়ির আশেপাশের দুয়েকজন মহিলা রাতের আঁধারে আমেনা বেগমের বাড়িতে এসে দেহ বিক্রি করে যেতেন। আমেনার স্বামী এতে উচ্চবাচ্য করেননি। আমেনার স্বামী মূলত সরল-সোজা ও রোগা-সোগা মানুষ ছিলেন। আমেনার সংসার এতে খুব ভালো চলতে লাগল। বুদ্ধি করে আমেনা বেগম চর এলাকার গরিব মেয়েদের শহরে কাজ দেওয়ার নাম করে নিজের বাড়িতে এনে দেহ ব্যবসায় জড়িত করতে লাগলেন। সব জায়গায় ছড়িয়ে গেল সোনাপুরে টাকার বিনিময়ে মহিলা পাওয়া যায়। ধীরেধীরে প্রায় পুরো সোনাপুর ছড়িয়ে গেল দেহ ব্যবসা। লজ্জায় অনেক নিকারি সোনাপুর ছেড়ে আশেপাশের এলাকায় বাড়ি করলেন। এরপর সোনাপুর নাম হলো সোনাপুর পতিতাপল্লি। একসময়ে আমেনা বেগম আর নিজে দেহ বিক্রি করতেন না; দালালদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে অসহায় নারীদের কিনে নিতেন এবং তাদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করতেন। যারা স্বেচ্ছায় এই পেশায় আসতে চাইতেন তাদের তিনি সহযোগিতা করতেন। ফলে তিনি পতিতাদের সর্দারনি হয়ে উঠেছিলেন। তার অবর্তমানে বহু সর্দারনি এই সোনাপুরে এসেছে এবং গেছে। এখন আর সর্দারনির অভাব নেই, যৌনকর্মীরও অভাব নেই। এই পতিতালয়ে বহু নারী বহু পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যৌন পেশায় নিয়োজিত হয়। দীর্ঘদিন পতিতাবৃত্তি করতে-করতে একসময়ে নিজেই সর্দারনি হয়ে উঠেন এখানকার পতিতারা। তেমনই আয়শার মা খাদিজা খালা এই সোনাপুর পতিতাপল্লির একজন সর্দারনি।
একদিন হয়তো আয়শা নিজেও তার মায়ের স্থান দখল করবে। আচ্ছা, আয়শারে আমি কী এই জীবন থেকে মুক্তি দিতে পারি না? আয়শারে বিয়ে করলে কেমন হয়? মানুষ কত খারাপ স্ত্রী নিয়ে সংসার করে খাইতেছে, আর আমি আয়শারে অন্ধকার জগৎ থেকে বের করে এনে আলোর পথ দেখালে সমস্যা কি? আয়শা তো মেয়ে খারাপ না। ভাগ্যের উত্থান-পতনে আজ আয়শার এই দশা। ও তো ইচ্ছে করে পতিতাবৃত্তি বেছে নেয়নি।
গারমেন্টস
এ…এ…এ হালার ঘরের হালা, চোইখে দ্যাখস না? সুইং থিকা ছেঁড়াখোঁড়া মাল ফিনিশিংয়ে ক্যামনে যায়? চোইখ বন্ধ কইরা কাম চোদাও? নাকি ছেরি গো মুখের দিগে চাইয়া থাকো?
জিউস টেক্সটপ্রিন্ট অ্যান্ড ফ্যাশন লিমিটেড। এই গারমেন্টসে চাকুরি করা প্রতিটা শ্রমিককে দিনের-পর-দিন মানসিকভাবে আক্রান্ত হতে হয়। এখানকার সুপারভাইজার থেকে শুরু করে লাইন চিফ, ফ্লোর ইনচার্জ, কোয়ালিটি কন্ট্রোলার, কোয়ালিটি ম্যানেজার, এপিএম, পিএম, এজিএম ও জিএম, এদের একজনেরও মুখের ভাষা ভালো না, একদম ভালো না! এদের মুখে হাসি নেই; আছে শুধু চোখ রাঙানি। একটু এদিক-সেদিক হলেই গালাগালি। মাঝেমধ্যে শ্রমিকদেরকে মারতেও আসে! কাটিং সেকশন থেকে টুকরো-টুকরো কাপড় আসে সুইং সেকশনে। অপারেটর ও হেলপারেরা টুকরো কাপড়গুলো প্লেন মেশিন, টু নিডেল, ফ্লাট লক, ওভার লক ও আরও কয়েক ধরনের মেশিনে সেলাই করে পূর্ণাঙ্গ পোশাকে রূপান্তরিত করে। আর কোয়ালিটি ইনস্পেকটররা পোশাকগুলো ঠিকঠাক আছে কি-না চেক দিয়ে ফিনিশিং সেকশনে পাঠায়। ফিনিশিং সেকশন বায়ারের অর্ডার অনুযায়ী ফিনিশিং ম্যাটারিয়ালস প্রয়োগ, ফোল্ডিং, প্যাকিং ও কার্টুন করে শিপমেন্ট দেয়। আমি এখানকার সুইং সেকশনের একজন কোয়ালিটি ইনস্পেকটর। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ক্সতরি পোশাকে রিজেক্ট, ওয়াল্টার, ¯ি‥প ও ড্রপ আছে কি-না চেক করি। মেইন লেবেল, সাইট লেবেল ও বারকোড জায়গামতো আছে কি-না সেটা দেখি। ক্সতরি পোশাকের সব প্রসেস মেজারমেন্ট করে খাতায় রিপোর্ট লিখতে হয়। সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে পা অবশ হয়ে আসে। সেলাইয়ের জয়েন্ট-এ থাকা অতিরিক্ত সুতা কার্টার দিয়ে কাটতে- কাটতে হাত ব্যথা করে। দুয়েকটা খারাপ মাল কীভাবে ফিনিশিং সেকশনে চলে যায় বুঝতে পারি না। খারাপ মাল শুধু আমার একার যায় তা না; অন্যদেরও যায়, ধরা খায় ফিনিশিং সেকশনে। অতঃপর চলে অকথ্য ভাষায় মানসিক নির্যাতন। সিনিয়রদের মানসিক নির্যাতনে ডুকরে কাঁদি। চোখে জল চলে আসে; দ্রুত টয়লেটে গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিই, যাতে কেউ বুঝতে না-পারে আমি কাঁদতেছি। মনে পড়ে আয়শার কথা। আয়শার সঙ্গেও কী এভাবে গালাগালি করে?
আয়শা আর আমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময়ে আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। বন্ধু বাবুলের খালা এই ঢাকেশ্বরী শহরে স্বামী নিয়ে থাকেন। খালা নিজেও একজন গারমেন্টস কর্মী। আয়শার আর আমার বাড়িতে যখন ঠাঁই হলো না, তখন বন্ধু বাবুল ওর খালার ফোন নাম্বার আর ঠিকানা দিয়ে বলল—দোস্ত, তোরা দুইজন খালার ওইখানে চইলা যা। ওইখানে যাইয়া খালারে কইয়া দুইজনেই চাকরি নিবি। ট্যাকাপয়সা কামাই কইরা মানুষের মতো মানুষ অইয়া দ্যাশে আইয়া জাগা-জমি কিইনা বাড়ি করবি। তারপর বাড়ির মাইনষেরে দেখাইয়া দিবি।
কোনও উপায়ন্তর না-দেখে এক পোশাকে আয়শা আর আমি চলে আসি ঢাকেশ্বরী শহরে। বাবুল আগেই ওর খালারে ফোন করে সবকিছু বলেছিল। খালা একটা বস্তিতে থাকেন। খালার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল। আগের স্বামীটা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে পাবলিকের গণধোলাই খেয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে কিছুদিন ঘরে পড়ে থাকে, তারপর একদিন ভিক্ষা করতে বেরোয়। ভিক্ষুক ও পঙ্গু স্বামীর সংসারে টিকে থাকা খালার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই তিনি চলে আসেন শহরে, নেন চাকুরি। খালারে যে মহিলা এই শহর চিনিয়েছে তার স্বামীর সঙ্গে আড্ডা দিতে এই বস্তিতে কিশোরগঞ্জের একটা লোক আসতেন। যাতায়াত করতে-করতে লোকটার সঙ্গে খালার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, বিয়ে হয়। বিয়ের পড়ে খালা জানতে পারেন লোকটার আরও দুইটা বউ আছে। খালা এ নিয়ে মাথা ঘামাননি। কারণ, লোকটার উপর খালা নির্ভরশীল নন। নিজের সংসার নিজে চালান। বস্তিতে যে রুমে থাকেন, তার ভাড়াটাও খালার মেটাতে হয়। এই বস্তির প্রতিটা ঘর টিন, বাঁশ আর হালকাপাতলা কাঠের ক্সতরি। বাঁশের খুঁটি, টিনের ছাউনি টিনের বেড়া, কাঠের পাটাতন, এমন একটা ঘরেই আমাদের আশ্রয় হলো। নিচ থেকে প্রস্রাব- পায়খানার গন্ধ আসে। ইঁদুরের উপদ্রপ, মশার প্রকোপ আর অতিরিক্ত বস্তিবাসীর গুঞ্জনে এখানে টেকা দায়! ভেজা কাপড়চোপড় শুকানোর জায়গা নেই। টয়লেটে যেতে লাইন ধরে দাঁড়াতে হয়। গোসল করতে গেলেও একই দশা। রান্নাঘরের অবস্থা ভয়াবহ। জঘন্য ভাপসা গন্ধ। নোংরা জলের উপর নির্মিত বাঁশের এ বাড়িটি বিভিন্ন জেলার প্রান্তিক মানুষের অভয়ারণ্য। কারও সঙ্গে কারও ভাষার মিল নেই। এক রুমে-না-এক রুমে ঝগড়া লেগেই আছে। পাশের রুমে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার শব্দ শোনা যায়। স্বামী তার স্ত্রীকে বলছে—শুঁটকি মাছের পুটকি মারি তোর মার শাওয়া মারি চোদানির ঝি এইডা কী রানছা? দোহানে আণ্ডা আছিল না? স্ত্রী প্রতিবাদ করে বলে—গোলামের ঘরের গোলাম তুই আমারে ট্যাকা দিছস? দোহানদার কি তোর মায়ের ভাতার লাগে যে হেতি ট্যাকা ছাড়া আমারে ডিম দিবো? আয়শা অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখের ভাষা বলে দেয়—এইটা আবার কোন জায়গায় এলাম? আমি কোনও উত্তর দিই না; শুধু মনের ভাষায় বলি—এই কষ্টটুকু মেনে নাও আয়শা, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আয়শা আমার মনের ভাষা বোঝে।
পরদিন সকালে খালা আমার হাতে বেশকিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললেন— এই ট্যাকা দিয়া থালাবাটি, মগ-বালতি, হাঁড়ি-পাতিল, কাপড়চোপড় আর কিছু বাজার-সদাই কইরো। আপাতত আমাগো চুলাতেই রান্ধো, খাও। পরে চুলা কিইনা নিও। আইজক্যা অফিসে যাইয়া স্যারে গো কইয়া আমু নি। কাইলক্যা দুইজনেই অফিসে ঢুইকা পড়বা। খালারে কী বলে ধন্যবাদ দেবো তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারিনি; মনে মনে তাঁর পায়ে কদমবুসি করলাম। খালা অফিসে চলে যাবার পড় আয়শারে সঙ্গে নিয়ে বাজারে গেলাম। টুকটাক প্রয়োজনীয় যাকিছু লাগে কিনলাম। আয়শার জন্য আর আমার জন্য কাপড়চোপড় কিনলাম। বাসায় দুজন একসঙ্গে রান্নাবান্না করলাম। খালা ও খালুর জন্যেও রান্না করে রাখলাম। ডিউটি শেষে খালা রাতে বাসায় এসে বলেন—শোন, আমাগো অফিসে পোলা মানুষ নিবো না। তয়, আয়শারে আমাগো অফিসে হেলপারে ঢুকান যাইবো। তুমি চিন্তা কইরো না; নোয়াখাইল্যা শাহিনরে কইয়া রাখছি, শাহিন কইছে ওগো অফিসে তোমারে কুয়ালিটিতে ঢুকান যাইবো। কুয়ালিটিতে চাকরি করতে হইলে লেখাপড়া লাগে। তুমি তো লেখাপড়া করছ। কুয়ালিটির কাম করতে পারবা না? খালি মাল চেক দিবা। ক্যামনে চেক দিতে হয় বসে দেখাইয়া দিবো। কাইলক্যা সকাল- সকাল দুইজনেই রেডি অইয়া থাইকো।
দুজনের দুই অফিসে চাকুরি করতে হবে শুনে আমার মনটা খারাপ হয়, দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরে। আয়শা পরপুরুষদের সঙ্গে অন্য কোথাও কাজ করবে এটা কোনওভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। শেষে আমার সিদ্ধান্তের কথা আয়শারে বলি—আমি চাকরি করমু তুমি বাসায় থাকবা। আয়শা আশ্বস্ত করে বলে—চিন্তা কইরো না। আপাতত দুইজনে দুই জায়গাতেই করতে থাকি। তারপর যখন তুমি তোমার অফিসে আমারে নিতে পারবা, অথবা আমি তোমারে আমার অফিসে নিতে পারুম, তখন দুইজনে একসঙ্গে কাজ করমু। এইখানে এখন আগে আমাগো টিকে থাকা দরকার। অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম আয়শা ঠিকই বলেছে। এই শহরে প্রথমে আমাদের টিকে থাকা দরকার। দুজনে আপাতত এক রুমে থাকতে পারবো এটাই অনেককিছু।
দুইজনের দুই অফিসে চাকুরি হলো। সকালে যাই, রাতে আসি। কোনওদিন রাত আটটায় ছুটি হয়, কোনওদিন দশটা, আবার কোনওদিন বারোটা। মাঝেমধ্যে নাইট ডিউটি-ও হয়, রাত তিনটা পর্যন্ত। আয়শার ছুটি দশটায় হলে আমার হয় বারোটায়। আবার আমার দশটায় হলে আয়শার হয় বারোটায়। ভাগ্যক্রমে একসঙ্গে বাসায় ফিরতে পারি। বন্ধের দিন আমার ছুটি থাকে তো আয়শার থাকে না, আয়শার থাকে তো আমার থাকে না। ভাগ্য বেশি ভালো হলে দুজনের একসঙ্গে ছুটি থাকে। ছুটি শেষে আয়শা আগে বাসায় ফিরলে রান্নাবান্না করে আমার জন্য অপেক্ষা করে। বাসায় আমি আগে ফিরলে রান্নাবান্না করি। আয়শার জন্য বসে থাকি। দুইজন একসঙ্গে খেতে বসলে আয়শা অভিযোগ করে বলে—তুমি রান্নার কাছে যাও কেন? রান্নাবান্না কি পুরুষ মাইনষের কাম? তোমারে রান্না করতে কইছি? রান্না আমি করমু, তুমি বইসা থাকবা। আয়শার মুখে খাবার তুলে দিয়ে বলি—যুদ্ধ তো দুইজনে মিলেই করতেছি, তাই না? তাইলে আমি কেন রাজা-বাদশা গো মতে বইসা থাকমু? প্রয়োজন পড়লে তোমার কাপড়চোপড়ও ধুইয়া দিমু। আমরা দুইজন শুধু স্বামী-স্ত্রী না, প্রেমিক-প্রেমিকা। আমরা একে অন্যের। আমাগোরে দুই দেহে এক প্রাণ। তোমারে দিয়া পড়ের কাম করাই এইটাই আমার অপরাধ। নিজের কাছে নিজেরেই ঘিন্না লাগে আমার বউ দিয়া মাইনষের কাম করাই। আল্লায় আমার মুখের দিকে একটু তাকাইলে তোমারে আর আর পরের কাম করতে দিমু না। আয়শার চোখে আনন্দের অশ্রু টলটল করে।
শত কষ্টের মাঝেও নিয়মিত ডিউটি করি। মাঝেমধ্যে খুব খারাপ লাগে সিনিয়রদের গালাগালি শুনে। আমার চিন্তা হয় আয়শার জন্য। ওরে সঙ্গেও কি গালাগালি করে? আয়শার শরীরেও কী সিনিয়ররা হাত দেয়? আমার অফিসে নব্বই ভাগ মহিলাকর্মী। সিনিয়ররা সবাই পুরুষ। বিভিন্ন অজুহাতে সিনিয়ররা মহিলাদের শরীরে হাত দেয়, অশ্লীল কথা বলে। কেউ প্রতিবাদ করে না চাকুরি হারানোর ভয়ে। এই অফিসের পুরুষকর্মীরা অধিকাংশ প্রতারক। তারা একসঙ্গে একই অফিসে তিন-চারজনের সঙ্গে প্রেম করে, প্রেমের অভিনয় করে। ছলেবলে কলেকে․শলে ছুটির দিন বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে প্রেমিকার শরীর ভোগ করে। আমার যেদিন নাইট ডিউটি হয় সেদিন বাসায় আসি না। বাসায় গেলে সকালে ডিউটিতে আসতে খুব কষ্ট হয়। তাই অফিসেই ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে ঘুম থেকে উঠে টয়লেটে ফ্রেশ হয়ে হোটেল থেকে কিছু খেয়ে আবার ডিউটি আরম্ভ করি। রাস্তায় খারাপ লোকের অভাব নাই, ভয়ে মেয়েরাও বাসায় যায় না; অফিসে ঘুমায়। একদিন নাইট ডিউটি করে অফিসে ঘুমিয়ে গেছি। মেয়েরাও যে-যার মেশিনের নিচে কার্টুন বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ একটা মেয়ের চিৎকারের আওয়াজ পেলাম। লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়লাম। দেখি, পিএম স্যার মেয়েটির মুখ চেপে ধরেছে! আর ফিসফিসিয়ে বলতেছে—চুপ থাক। যদি চেঁচামেচি করিস, তাইলে সকালে অফিস থেকে বাইর কইরা দিমু। মেয়েটি চুপ হয়ে গেল। পিএম স্যার ওখানেই মেয়েটির সঙ্গে সংগমে লিপ্ত হলো! আমি কিচ্ছু বলতে পারলাম না, ভয়ে। এই দৃশ্য দেখার পর আয়শাকে নিয়ে আমার আরও দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল। আয়শার সঙ্গেও যদি এমন হয়? না, এটা আমি মানতে পারবো না। ছুটি শেষে রাতে আয়শাকে বলি—তোমার এই চাকরি করা যাইবো না। আমি করলেও তোমারে এই চাকরি করতে দিমু না। আমার ভাল্লাগে না। আয়শারে ঘটনা খুলে বলি। আয়শা বলে—তুমি আমারে নিয়া চিন্তা কইরো না। আমি আমারে হেফাজতে রাখতে পারমু। আমার জন্য দোয়া কইরো। বাইচা থাকতে এই শরীরে তুমি ছাড়া আর কেউ হাত দিতে পারবো না।
দেখতে-দেখতে কয়েক মাস চলে গেল। মা-বাবা, ভাই-ভাবির কথা খুব মনে পড়ে। তাদের দেখতে মন চায়। কিন্তু না; যে বাড়িতে আয়শার জায়গা হয়নি, সে বাড়িতে আর যাবো না। ওটা পবিত্র বাড়ি, ওই বাড়িতে কোনও পতিতালয়ের মেয়ের জায়গা হবে না। ওই বাড়িতে যদি কোনও হিন্দু, বে․দ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা কোনও উপজাতিকে নিয়ে যেতাম আর বলতাম সে মুসলিম হবে, তাহলে তার জায়গা হতো। যদি কোনও চোর, ডাকাত, খুনি, সন্ত্রাসী ও লুচ্চা-বদমাশকে নিয়ে গিয়ে বলতাম সে তওবা করে দিনের পথে আসতে চায়, তাহলে তারও জায়গা হতো। কিন্তু আমি নিয়ে গেছি একজন পতিতালয়ের মেয়েকে। পতিতাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার কোনও অধিকার নাই। আমার দাদা ছিলেন মসজিদের ইমাম, দাদার বাপ ছিলেন ইমাম, এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে তারা মোল্লাগিরি করে আসতেছেন। এলাকার মানুষও আমাদের বাড়িটিকে বলেন- মুনশি বাড়ি। বাবা-মা নিয়মিত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন। তাদের শেষ ইচ্ছে জীবনে একবার পবিত্র মক্কায় হজে যাবেন। সেই বাড়িতে আমি একজন পতিতালয়ের মেয়ে নিয়ে গেছি, তা-ও আবার তাদের বাড়ির বউ করে! তারা কোনওভাবেই আমাদের মেনে নিতে পারলেন না। তারা তাদের বাড়ির সম্মান ধূলিসাৎ হতে দেবেন না। বাবার এককথা, আমি যদি আয়শারে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে না আসি, তাহলে সে আত্মহত্যা করবে! মা চুপচাপ। ভাই-ভাবি রাগে-ক্ষোভে ফোঁসফোঁস করে। আমি নিরুপায় হয়ে বন্ধু বাবুলের কাছে যাই। অতঃপর বাবুল আমার আর আয়শার জন্য যা করল, ওর ঋণ কোনওদিন শোধ করতে পারবো না। বাবুলের খালা আমাদের দুজনের জন্য যতটুকু করেছে, তার ঋণও শোধ করার নয়। বাবুল মদখোর, গাঁজাখোর, পতিতার দালাল। বাবুল খুব খারাপ। বাবুল এই পৃথিবীর ময়লা-আবর্জনা। বাবুল এই সমাজের বোজা। তবু বাবুলের জন্য দোয়া করি, মৃত্যুপরবর্তী জীবনে বেহেশত-দোজখ বলে যদি কিছু থেকে থাকে, হে আল্লাহ, তুমি বাবুলরে বেহেশতে নিও। আয়শাও নামাজ পড়ে বাবুলের জন্য দোয়া করে।
আয়শা যেদিন চিঠি দিয়েছিল, চিঠি পড়ে বুকটা হাহাকার করে ওঠে, এবং সেদিনই সিদ্ধান্ত নিই আয়শারে বিয়ে করবো। আয়শা প্রথম-প্রথম রাজি হয় না। বিশ্বাস করতে পারে না আমি সত্যিই আয়শারে বিয়ে করবো। অনেক ঘোরাঘুরি করে আর বলেকয়ে আয়শারে রাজি করি। একজন পতিতালয়ের মেয়েকে আমি বিয়ে করে সংসার করবো এটা আয়শার মা খাদিজা খালা, মানে আমার শাশুড়ি আম্মাও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। যেদিন সত্যি-সত্যিই আয়শারে আমি বিয়ে করলাম, সেদিন আমার শাশুড়ি দুচোখের জল ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন—বাবা, যদি তোমাদের দুজনের মইধ্যে বনিবনা না হয়, যদি কখনও আয়শারে তোমার ভালো না লাগে, তাইলে ওরে তুমি কোথাও ফেইলা দিও না; আমার বুকে ফিরাইয়া দিও।
পতিতা হোক, আমি একজন মাকে সেদিন কথা দিয়েছিলাম—মা, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আয়শারে আমি দেইখা রাখব। ওর চোখে একটুও জল ঝরতে দেবো না। কষ্ট দেবো না। আপনি এই বিশ্বাসটা রাইখেন।
আয়শা ওর মায়ের কথা মনে করে মাঝেমধ্যে অন্যমনস্ক থাকে, কাঁদে। আমি বলি—আয়শা, আমি একটু ভালো পজিশনে আগে যাই, তুমিও ভালো অপারেটর হও, আমাদের বেতন বেশি হবে, তখন ভালো দেইখা একটা বাসা ভাড়া নিমু। আম্মারে আমাদের বাসায় আনুম। আমাদের ফুটফুটে একটা মেয়ে হবে। আম্মা তার নাতনিকে নিয়ে বাসায় থাকবে, খেলবে, আনন্দ করবে। আয়শা আমার কথায় মাথা নাড়ে, কান্না থামায়। মাঝেমধ্যে আমার যখন মনমরা থাকে, তখন আয়শা বলে, ছুটির দিনে কোথাও ঘুরতে যাওয়া যায় না? ঘুরতে যাইও। কোথাও ঘুরতে গেলে মন ভালো হইবো। আমিও মনে মনে ভাবি, আসলেই কোথাও ঘুরতে যাওয়া দরকার। অফিসের চারদেয়াল আর এই বস্তির চিল্লাচিল্লি একদম ভাল্লাগে না।
মাজার
বামে মসজিদ, ডানে মাজার। নিরাপত্তাজনিত কারণে মাজার ও মাজারসংশ্লিষ্টদের সঠিক নাম বলব না; তবে, বোঝার সুবিধার্থে কিছু কাল্পনিক নাম দেবো। মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক বটগাছ। বটগাছের ডালে-ডালে ঝুলছে লাল রঙের সুতা এবং লালসালুর ছেঁড়া টুকরো। গাছটির একেবারে উঁচু ডালে লম্বা একটা বাঁশে লাল রঙের নিশান পতপত করে উড়ছে। গাছের নিচে বড়োসড়ো একটা পাথর চিকচিক করছে। পাথরে লেগে আছে পোড়া মোমের সর্বশেষ অংশ, আগরবাতির ছাঁই, আর সিঁদুরের প্রলেপ। পাথরের উপরে বসানো পিতলের কলসি। কলসিতে নারী দর্শনার্থীরা তাদের নাক ফুল, কানের দুল, গলার মালা, হাতের বালা ও আংটি ফেলে রেখে যাচ্ছেন মনের বাসনা পূরণের আশায়। কলসির গায়ে লেখা—বাবা রহমত শাহ ইয়ামেনি (রহ.)। পাশেই আছে ইটের ক্সতরি বাক্স, বাক্সের গায়ে লেখা—বাবা রহমত শাহ দানবাক্স। দানবাক্সেও একের-পর-এক টাকা ফেলে যাচ্ছে আগত লোকজন। আশেপাশে অনেক সাধু বসে আছেন, তাদের কারও পাশে ত্রিশূল, কারও কাছে ক্সবচিত্র্যময় লাঠি, কারও সামনে শিঙা, তাবিজ-কবচ, বই, লালসুতা আর গাঁজার পুঁটলি তো আছেই। সাধুদের কাছে যেসব দর্শনার্থীর আশীর্বাদ নিতে যাচ্ছেন তাদের হাতে সাধুরা লালসুতা বেঁধে দিয়ে হাদিয়াস্বরূপ দাম নিচ্ছেন, যে-যা দিচ্ছেন তাই নিচ্ছেন। একটু দূরেই কয়েকজন সাধু গোল হয়ে বসে আছে। তাদের সামনে হারমোনিয়াম, ঢোল, মন্দিরা, দোতারা ও একতারা পড়ে আছে। একজনের হাতে গাঁজার কলকি। কলকি হাতে লোকটা ভক্তিভরে কলকিটা কপালে ঠেকিয়ে একনিশ্বাসে বলল—
হে রাসুল
খাই গাছের ফুল,
যে কয়, খা—
তাঁর হাড়ের মাংস বাইড়া যা।
বাবা শাহজালাল,
যা খাই সব হালাল।
বাবা গোলাপ শাহ,
খিচুড়ি আর বাতাসা।
বাবা মতিঝিল,
দিয়া দে টাকার বাণ্ডিল।
হক মওলানা ভাসানী,
খাইবার না-থাকলে দেয় না কোনও চোদানি।
বাবা শাহ আলী,
চাই তোর চরণধূলি।
বাবা সুলাইমান শাহ,
পূর্ণ কর মনের আশা।
বাবা ফাইলা,
লাগাইয়া দে আইলাঝাইলা।
বাবা ফতেহ আলী,
করিস না তালি-বালি।
বাবা আজমিরি হক খাজা,
আমরা খাই সিদ্ধি, মাইনষে কয়—গাঁজা।
বাবা ওয়ায়েস আল-পাগল,
আমরা দেখি হরিণ, মৌলবিরা কয় ছাগল।
বাবা ধূপবাগী,
আমার পাঁঠা তোমার ছাগি।
বাবা ওসমান গণি,
কপালে আছে শনি।
বাবা জিলানী,
খালি বইড়া বাঁশের গোড়ানি।
জয় মা তাঁরা,
জীবনের কাম সাড়া।
শেষে ‘ইল বাবা ভোলানাথ’ বলে কলকির নিম্নদেশে ঠোঁট লাগিয়ে লোকটা একটানে একগাদা ধোঁয়া ছেড়ে আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল…। লোকটাকে চেনা-চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে এই লোকটার সঙ্গে নিশ্চয়ই পূর্বজন্মে আমার কোনও ভালো সম্পর্ক ছিল। চোখে-চোখ পড়তেই চিল্লিয়ে উঠলাম—আরে বাদল না? বাদলও লাফিয়ে উঠে বলে—আরে তুই শিমুল না?
বাদল আমার বাল্যবন্ধু। ছোটোবেলায় ওরে ওর বাবা-মা একটা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। বাদল মাদ্রাসায় পড়তে চাইতো না। মাঝেমধ্যেই মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে বাড়িতে আসতো। এজন্য ওকে ওর বাবা-মার হাতে বেদম পিটানি খেতে হতো। ওর বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছেলে একজন আলেম হবে। বংশে একজন আলেম থাকা মানে সে বংশের চোদ্দো পুরুষ জান্নাতি। হঠাৎ একদিন খবর এলো বাদল নাই। মাদ্রাসায় নাই, বাড়িতে আসে নাই, কোনও আত্মীয়ের বাড়িতেও যায় নাই, তাহলে গেল কোথায়? অনেক খোঁজাখুঁজি হলো। বেশকিছু দিন খোঁজাখুঁজি করে যখন পাওয়া গেল না, তখন মাদ্রাসার হুজুররা বললেন—বাদলরে জিনে নিয়া গ্যাছে। তারপর খোঁজাখুঁজি বাদ। ওর বাবা-মা কিছুদিন কান্নাকাটি করল, এরপর ভুলে গেল। অতঃপর আমরাও ভুলে গেলাম বাদলরে।
জীবনচলার পথে সেই বাদলকে এই মাজারে পেয়ে যাবো কল্পনাও করতে পারিনি। বাদলরে জড়িয়ে ধরে বললাম—ক দোস্ত তুই এইখানে কেন? তুই বাড়িতে যাস না কেন? গাঁজা খাইয়া চেহারার কী অবস্থা বানাইছা! দাড়িগোঁফ আর চুলের একি হাল! আমরা তো জানি তোরে জিনে নিয়া গ্যাছে; কিন্তু, তুই জিনদের কাছ থেকে এইখানে কেমনে আইলি?
বাদল আমার হাত ধরে মাজারের পিছনের দিকে নিয়ে যায়। মাজারের পিছনে অনেক ঘর; প্রতিটা ঘরের দরজার সামনে সাইনবোর্ডে লেখা—রন্ধনশালা, মুরগিশালা, ছাগলশালা, গোরুশালা ইত্যাদি। সম্ভবত ভক্তদের দেওয়া গোরুছাগল, হাঁসমুরগি ও অন্যান্য জিনিসপত্র এই ঘরগুলোতে সংরক্ষণ করা হয়। একটা রুমে নিয়ে খাটে বসিয়ে বাদল আমারে বলে—আগে ক শিমুল, তুই এই শহরে কেন? কী জন্যে আইছো? আমি বলি—আর কইস না দোস্ত, বাবা-মারে না জানাইয়া বিয়া করছি, এখন তারা আমাগো বিয়া মাইনা নিবো না। তাই তোর ভাবিরে নিয়া বাড়ি ছাইড়া এই ঢাকেশ্বরী শহরে চইলা আইছি। আদমপুর থেকে ঠাকুরতলা হইয়া সোজা উত্তর দিকে একটা বস্তি আছে, বাবুলের খালা যে বস্তিতে থাকে সেই বস্তিতেই আইয়া উঠছি। দুইজনেই গারমেন্টসে চাকরি নিছি। গারমেন্টসের হাউকাউ আর বস্তির চিল্লাচিল্লিতে মনটা বিষিয়ে উঠছে, তাই একটু ঘুরতে আইছি। ঘুরতে-ঘুরতে মাজারে ঢুইকা গেলাম, আর আইয়া তোরে পাইলাম। এইবার ক, তুই বাড়িতে যাস না কেন? বাড়ি থেকে কী তুই পালাইয়া আইছিলি? নাকি তোরে জিনে এইখানে রাইখা গ্যাছে?
বাদল বলে—আরে শুয়োরের বাচ্চা আব্বাসী হুজুরের জন্যই তো পালাইয়া বাড় ছাড়ছি। আমি বলি—হুজুরের জন্যে তুই পালাইলি কেন? বাদল বলে— পালামু না তো কি করমু? প্রথম দিনই হুজুরে ডাইকা কয়—কি রে তোর নাম কী? আমি কই—বাদল। হুজুরে মুখ বাঁকা কইরা কয়—তুই কী হিন্দুর পোলা? মুসলমানের পোলার নাম কি বাদল হয়? আমার ওই দিনই হুজুরের উপর রাগ হয়। আরবি পড়া আমার মাথার মইধ্যে ধরে না। হুজুরে পড়া ধরে পারি না, ইচ্ছামতো মারে। খেলতে গেলে ধইরা মারে। সকালে ঘুমে চোইখে দেখি না, ঘুমের মইধ্যে ধমক মারে, আমার আত্মা দরফর কইরা ওঠে। বাড়িতে যাই, মা-বাবা ধইরা মারে। তাইলে আমি যামু কই? মাদ্রাসায় যা-ও পড়মু, কিন্তু; লুচ্চা হুজুরের জন্যে পড়লাম না, পালাইলাম। একদিন দুপুরবেলায় হুজুরে ডাইকা কয়, আমার রুমে আয়, পড়া কইয়া দিমু। গেলাম। হুজুর আমারে সিপারা থেকে পড়াইলো—আলিপ দুই যবর আন, আলিপ দুই যের এন, আলিপ দুই পেশ উন, আন-এন-উন; বা দুই যবর বান, বা দুই যের বেন, বা দুই পেশ বুন, বান-বেন-বুন। আমি মাথা নাচাইয়া পড়তে নিছিলাম। হঠাৎ হুজুর কয়, পড়া রাখ, সিপারা রাইখা আমার কাছে আয়। আমি ডরাই। ডরে আমার বুকটা ধুকপুক করে। মনে করলাম পড়া ভুল অইসে এইজন্য পেটানোর জন্যে কাছে যাইতে কয়। ডরাইতে-ডরাইতে হুজুরের কাছে গেলাম। হুজুরে মিষ্টি-মিষ্টি হাইসা কয়—মারুম না, কাছে আয়। আমার হাতটা একটু টিপা দে। আমি হাত টিপতে ছিলাম। এরপর আমারে পা টিপতে কইয়া কয়—শোন, ওস্তাদদের সেবাযত্ন করবি, তাইলে পড়া পাড়বি। আমি যখন তোরে ডাকমু, আইবি। আমি যা কমু তাই শুনবি। যদি না শুনছিস তো তোর উপরে জিন চালান কইরা দিমু। আমি জিনের কথা শুইনা আতঁকে উঠি। দাদা আমারে যেদিন জিনের গল্প শুনাইছিল, সেইদিন থাইকা আমি জিনেরে ডরাই। লম্বা পাগড়ি, সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পইরা এক ঠ্যাং মাটিতে ঠেকাইয়া আরেক ঠ্যাং গাছে রাইখা রাস্তার মইধ্যে দাঁড়াইয়া থাইকা এক জিনে দাদারে ডর দেখাইছিল! জিনে মুখে লম্বা চাপদাড়ি। হাতে বিশাল বড়ো তসবি। জিনে তসবি টানছিল আর কোরআনের সুরা পড়ছিল। তসবি দিয়া আগুন বাইর হইতেছিল। দাদাও কম না। দাদা দোয়াদরুদ পাঠ কইরা লুঙ্গি খুইলা মাথায় বাইন্ধা দৌড় মারছিল। দৌড়াইতে- দৌড়াইতে অনেকদূর আসার পরে দ্যাখে হুজুর জিনটা সামনে খাড়া! তারপর দাদা একদমে সুরা জিন পইড়া মাটিতে একটা কোড দেয়, যাতে কোডের ভেতরে জিন না ঢুকতে পারে। জিন আর দাদার কাছে আইতে পারে নাই। কোডের বাইরে থেকেই বাঘ, সিংহ, বিলাই আর ঘোড়ার রূপ ধইরা জিনে ডর দেখাইছে। তারপর মসজিদে যখন আজান দিছে, তখন জিনে চইলা গ্যাছে। যাওয়ার সময় না-না কইরা কইয়া গ্যাছে, তোরে আরেকদিন ধরমু। দাদার এই গল্প শোনার পড় থেকেই আমার মনের ভিতরে একটা ভয় হান্দাইছে। একা কোথাও গেলেই মনে হয় আমার আশেপাশে বোধহয় জিন আছে। দাদার কাছে আরও শুনছি যারা আলেম মানুষ তারা জিন-ভ‚ত তাড়াইতে পারে। তারা ইচ্ছা করলে যে কোনও মাইনষের মইধ্যে জিন চালান কইরা দিতে পারে। আমার উপরে জিন চালান কইরা দিবো শুইনা হুজুররে আমি শক্ত কইরা ধরি। হুজুররে আমি কই—হ হুজুর, যা কইবেন তাই করুম। এরপর হুজুর আমারে তেলের বোতল দেখাইয়া কইলো— এইবার পিঠে একটু তেল দিয়া ডইলা দে। হুজুর উপুড় হইয়া শুইয়া পড়ল, আমি তেল মালিশ করতেছিলাম। এইবার চিৎ হইয়া শুইয়া কয়—লুঙ্গির নিচে একটু তেল দে। লুঙ্গির নিচে তেল দিতে যাইয়া ঘিন্নায় আমার শরীরটা শিউরে ওঠে। লুঙ্গির নিচে বিশাল একটা সাপ ফণা ধইরা রইছে! আমার হাত লুঙ্গির নিচে যাইতে চায় না। হুজুর চোখ বড়োবড়ো কইরা কয়, জিনেরে ডাক দিমু? সাপের চেয়েও আমি জিনেরে বেশি ডরাই। হাতে তেল নিয়ে তাড়াতাড়ি কইরা সাপটারে ধইরা ফেলি। সাপের মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত তেল দিয়া ভয়ে-ভয়ে আদর করি। হুজুর মোচড় দিয়া উইঠা আমারে ধইরা ফেলে। তারপর সাপটা আমার পায়খানার রাস্তায় ছোবল মারে, আমি ব্যথায় মারে-বাবারে কইয়া চিৎকার দেই, হুজুর আমার মুখ চাইপা ধরে। এভাবেই দিনের-পর-দিন সাপটা আমারে ছোবল মারতে থাকে…। আমি মা-বাবারে কই মাদ্রাসায় যামু না, হুজুর ভালো না, তারা আমারে ধইরা আরও মারে। ভাত খাইতে গেলে ঘৃণায় বমি আসে। হুজুরের সাপ বমি করে, সেই বমির দৃশ্য আমার চোইখে ভাসে। তারপর একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম মাদ্রাসা থেকে পালামু, দুইচোখ যেইদিকে যায় সেইদিকে যামু। মাদ্রাসার দেয়াল ডিঙিয়ে মারলাম দৌড়। দৌড়াইতে-দৌড়াইতে বাসস্ট্যান্ডে আইলাম। বাসের পিছনের মই বাইয়া ছাঁদে উঠলাম। তারপর এই শহরে, এই মাজারে। এই মাজারের খাদেম শামসু চাচা আমারে সন্তানের মতো কইরা মানুষ করছে। ডেইলি খাইবার দিছে। এই মাজারের পির ক্সসয়দ মাহবুব শাহ বাবার কাছে মুরিদ হইছি। এখন এই মাজারের দেখাশোনা করি। কোনও কাজকাম করি না। গাঁজা খাইয়া আল্লাহ রাসুল আর বাবা মাহবুবের ধ্যানে পইড়া থাকি।
জিনের আর সাপের গল্প শুনে আমার শরীরটাও শিউরে ওঠে! ঘৃণায় আমারও বমি আসে হুজুরের সাপের গল্প শুনে। এ কেমন সাপ যে শিশু বাচ্চা কিংবা পুরুষ মানে না? বাদলের জীবনের গল্প শুনে যতটা না অবাক হই, তারচে বেশি অবাক হই সে নেশা করে আল্লাহর ধ্যান করে, রাসুলের ধ্যান করে, আবার পিরের ধ্যানও করে! বাদলরে বলি—গাঁজা খাইয়া আল্লাহ রাসুল আর পিরের ধ্যানে পইড়া থাকতে হইবো কেন? বাদল বলে—মাইনষে তো দুধভাত খাইয়া চুরি-ডাকাতি আর লুচ্চামি করে, আমি গাঁজা খাইয়া আল্লাহর ধ্যানে পইড়া থাকি, তাইলে ক কোনটা ভালো? আমি বাদলের যুক্তির সামনে যুক্তি দিয়ে কোনও কথা বলতে পারলাম না। বাদল অবিরাম বলে যাচ্ছে, আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছি। এরপর দুজনে মাজারের চারপাশে হাঁটছিলাম আর কথা বলছিলাম। হাঁটতে-হাঁটতে পির মাহবুব শাহর খানকা, বাসভবন, গোরুর খামার, গেস্ট হাউজ, হসপিটাল ও রেস্তোরাঁ দেখলাম। ঘুরেফিরে বাদল এসব দেখাচ্ছিল আর পির মাহবুব নামের প্রশংসা করছিল। একটা মানুষের মুখে যখন আরেকটা মানুষের প্রশংসা শোনা যায়, তখন প্রশংসিত লোকটাকে দেখার আকাক্সক্ষা জাগে। আমারও মনের ভেতর তীব্র বাসনা জন্ম নিলো পির মাহবুবকে একনজর দেখার। বাদলের কথা বলার ভঙ্গি কত মার্জিত আর শ্রæতিমধুর! কথায় বলে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। সৎ মানুষের সংস্পর্শে এসে বাদলও কতটা বদলে গেছে।
বাদলের সঙ্গে আরও অনেক কথা বলার দরকার ছিল। ওর কাছে আরও প্রশ্ন করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সময় নেই। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে আসছে। বাসায় যেতে হবে। বাদলরে বলি—আইজকা যাইগা, আরেকদিন আমু। সেদিন আইসা অনেকক্ষণ থাকমু। তুই একদিন আমার বাসায় যাইস, তোর ভাবিরে দেইখা আসিস। বাদল বলে—আইজকা থাইকা যা। আমি রাজি হই না। বাদল বলে— ঠিক আছে যা। আরেকদিন আসিস। সময় নিয়া আইবি। আমার কাছে এক রাইত থাইকা যাইবি। আমিও তোর বাসায় একদিন যামুনি। তয় শোন, হাত জোর কইরা কই, আমি বাঁইচা আছি এই খবর বাড়িতে জানাইস না। আমি আর বাড়িতে ফিরা যামু না। জন্ম দিছে বইলাই আমি আমার বাবা-মায়রে মা-বাবা মনে করি না। জন্ম তো কুত্তা বিলাইয়েও দেয়। তাদের ঘরে জন্ম নেওয়াটাই আমার আজন্ম পাপ। তো ঠিক আছে যা। এই শহরে রাতবিরেত চলাফেরা করিস না। আবার যেইদিন আইবি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে আইবি। প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে এইখানে বাউলগানের আসর বসে। রাইত থাইকা দিনে চইলা যাইস। মন চাইলে ভাবিরে সঙ্গে কইরা নিয়া আসিস। সমস্যা নাই, এখানে থাকার ব্যবস্থা কইরা দিতে পারুম। এই মাজারে আমি যা কমু সেইটাই হইবো। সবই বাবা মাহবুব শাহর দয়া।
আমি সেদিনের মতো চলে আসি।
আসর
বাউলগান আমাদের এলাকাতেও হতো; কিন্তু, এখানকার মতো না। আমাদের এলাকায় বাউলগান হলে সুন্দর করে মঞ্চ সাজিয়ে মঞ্চে শিল্পী ও এলাকার মুরুব্বিরা গোল হয়ে বসেন, সভাপতি নির্বাচিত করেন, এবং শিল্পীদের পালা নির্ধারণ করে দিলে শিল্পীরা দাঁড়িয়ে বন্দনা গান গেয়ে পালাগান শুরু করেন। চারপাশে দর্শকরা চুপচাপ বসে থাকেন, গান উপভোগ করেন, শিল্পীদের গানে সন্তুষ্ট হয়ে কেউ কেউ বকশিস দেন। রাতের শেষ প্রহরে শিল্পীরা করুণ সুরে বিচ্ছেদ গান গেয়ে থাকেন। বিচ্ছেদ গান শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে উপস্থিত লোকজন একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করেন, কান্নাকাটি করেন। কিন্তু এখানে সম্পূর্ণ উলটো। বাদলের কথা অনুযায়ী বাবা রহমত শাহ’র মাজারে দ্বিতীয়বার আসা। এসে দেখি একই আস্তানায় পাঁচসাতটা বাউল গানের আসর বসেছে। আসরে গাঁজার কলকি চলছে। শিল্পীরা গানের সঙ্গে যেমন ড্যান্স দিচ্ছে, দর্শক-শ্রোতারাও ঠিক তেমনই ড্যান্স দিচ্ছে! মেয়ে শিল্পীদের বুকের মাঝখানে বকশিসের টাকা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন উৎসুক শ্রোতারা। পুরোই উচ্ছৃঙ্খল একটা অবস্থা। আমি যে আসরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি সে আসরের শিল্পী গান ধরেছে—
টাকা গোল পয়সা গোল, গোল আলু আরও গোল,
মানুষের মনে গন্ডগোল।
ঘড়ি গোল চশমা গোল পায়জামা পরে গোল,
খোঁপা বান্ধিয়া গোল মন করে পাগল…
পৃথিবী বড়ো গোল ভাই তার নিচে মাথা গোল
গোল-গোল সবই গোল ভাই চোখের মণি গোল।
আজব ওই শহরে গেলে লুঙ্গি পরে
গেইট আউট ডোন্ট কেয়ার বলে তারে…
টেডি পরে গেলে কাম হেয়ার বলে
মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড বলে আদর করে….
কিয়ামতের নিশানা জানি কিন্তু কমুনা
মানুষ কত রঙের টেডি পরে রে।
ধরে গোল করে গোল আচমকা দেয় দোল,
বুদ্ধি পাকাইয়া গোল জোরে তোলে রোল…
জগৎ-টা বড়ো গোল ভাই তার নিচে নালা গোল
গোল-গোল সবই গোল ভাই বিচি দুইটা গোল।
এধরনের আধ্যাত্মিক গান আমি বুঝি না, ভালোও লাগে না। তাই আরেক আসরের দিকে যাই। কোথাও ভাল্লাগে না। অতঃপর বাদলরে খুঁজি। খুঁজতে- খুঁজতে পেয়ে যাই প্রথমদিন যে ঘরে বসে কথা বলি, সে ঘরে। ওর সঙ্গে বসে আছে আরও তিনজন লোক। একজনের পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি টুপি; লোকটার মুখে চাপদাড়ি, দেখে মনে হয় বিশাল মাপের হুজুর! কিন্তু; উনার হাতে মদের গ্লাস! হঠাৎ আমার আগমনে সে চমকে গেল এবং মদের গ্লাস আড়াল করার চেষ্টা করল। বাদল লোকটাকে অভয় দিয়ে বলল—শামসু চাচা সমস্যা নাই, ও আমার বন্ধু। এরপর আমারে খাটে বসতে বলে বলল—তুই আইবি আমারে কল দিয়া আইবি না? রাতে খাইছা? বাদল আমারে প্রথম দিনই ফোন নাম্বার দিয়েছিল, আমিও আমারটা দিয়েছিলাম। বাদলরে বললাম—তোরে খুইজা না পাইলে ফোন দিতাম। আর হ, রাতের খাবার খাইয়া আইছি। তোর ভাবিরে কইয়া আইছি আইজকা বাসায় যামু না। বাদল বলে—ঠিক আছে। এরপর বাদল সেই হুজুর গোছের লোকটাকে দেখিয়ে বলল—তোরে কইছিলাম না মাজারের খাদেমের কথা? যে আমারে সন্তানের মতো কইরা মানুষ করছে এই সেই শামসু চাচা। লোকে জানে তিনি নেশা-টেশা করেন না, তাই তোরে দেইখা ঘাবড়ে গেছিল। পাশের দুইজনের সঙ্গেও পরিচয় হলো। একজন মাজার কমিটির সভাপতি, আরেকজন বাজার কমিটির সভাপতি। মাজার ঘিরে যে দোকানপাট গড়ে উঠেছে, সেটাই বাজার। এরপর মদের বোতল এক গ্লাস থেকে আরেক গ্লাসে চালান হতে লাগল। অনেক জোরাজোরি করে বাদল আমারেও একটু মদ দিলো। মদটুকু পান করতে কষ্ট হলেও পরমুহূর্তে নিজেকে একটু হালকা লাগল, শরীর-মনে ভাব এলো। বাদল খাদেম সাহেবকে বলল—শামসু চাচা একটা গান ধরো। শামসু চাচা ডুগডুগি বাজিয়ে গান ধরলো—
তুমি রাম তুমি রহিম তুমি মওলা আলেক সাঁই
তুমি আলী তুমি কালী তুমি শ্যাম তুমি রাই।
তুমি বাপ ছাড়া পুত্র ঈসা
আমরা খুঁজে পাই না দিশা
তাই তো বাইবেল-কোরান-পুরাণে তোমায় খুঁজি সর্বক্ষণ,
তুমি নারায়ণ ওহে খোদা প্রভু নিরঞ্জন।
কত ধর্মের সৃষ্টি হইছে গাইতে তোমার গুণগান,
ভেদ বুঝে কেউ কইলো না কে-বা আল্লাহ কে শয়তান।
তুমি শুরু তুমি শেষ
তুমি গোপন তুমি নিরুদ্দেশ
তবু সাধন-ভোজন যত পাইতে তোমার চরণ,
তুমি নারায়ণ ওহে খোদা প্রভু নিরঞ্জন।
খাইয়া তোমার নামের নেশা পইড়া থাকি গাছতলা,
চোখে দেখি সবই সমান কিই বা দোতলা আর পাঁচতলা।
বাঁচাও কিংবা মারো
ছাড়ো কিংবা ধরো
তবু তোমার নামের মালা গলে রাখবো অনুক্ষণ,
তুমি নারায়ণ ওহে খোদা প্রভু নিরঞ্জন।
… কী সব আবোলতাবোল গান! না-কি আমিই গান বুঝি না? আধ্যাত্মিক গানে রহস্য থাকে, আমি হয়তো রহস্য জানি না, তাই শামসু চাচার গানের মানে বুঝলাম না। মনের মধ্যে প্রশ্ন খোঁচা দিয়ে উঠল—আইচ্ছা, আমাদের নবিজিও কী মদ পান করতেন আর গান গাইতেন? নবিজির সাহাবিগণও কি গানবাজনা করতেন? যদি না করে থাকেন, তাহলে এই লোকগুলো ধর্মকেন্দ্রিক গানবাজনা করছে কেন? মনের কথা মনে রাখতে পারলাম না। শামসু চাচাকে বললাম- আইচ্ছা চাচা, ইসলামে কী গানবাজনা জায়েজ আছে? নবিজিও কি আপনাদের মতো গানবাজনা করতেন? শামসু চাচা খ্যাপে গিয়ে বললেন—রাসুল গানবাজনা করেন নাই ঠিক আছে, কিন্তু, উনি কি গানবাজনা নিষেধ করেছেন? দলিল দেখাইতে পারবা? বাদল শামসু চাচাকে বলল—আরে মিয়া রাইগা যাও কেন? ও এই জগতে নতুন, ওরে ভালো কইরা বোঝাও। গানবাজনা হালাল-না-হারাম সেইটা বোঝাও। পাশে থেকে একজন বলল—হ, উনি আধ্যাত্মিক জগতে মনে হয় নতুন। শামসু চাচা একটা সিগারেট জ্বালিয়ে সুখটান দিয়ে আমার উদ্দেশে বললেন—শোনো ভাতিজা, তোমারে একটা ঘটনা বলি—
নবিজি যখন তাঁর সাহাবিদের নিয়ে নামাজ পড়তেন, তখন মসজিদের বাইরে বইসা শ্রীকৃষ্ণ বাঁশি বাজাইতেন। বাঁশির শব্দে সাহাবিদের নামাজ পড়তে কষ্ট হইতো। তো, সাহাবিরা নবিজিকে একদিন বিচার দিয়ে বললেন—হুজুর আমরা নামাজ পড়ি আর কৃষ্ণ বাঁশি বাজায়, এতে আমাদের সমস্যা হয়, আপনি এর কিছু একটা করেন; কিন্তু, নবিজি কিচ্ছু বললেন না। আরেকদিন নবিজি তাঁর সাহাবিদের নিয়ে নামাজ পড়তেছেন, এমন সময় বাইরে শ্রীকৃষ্ণ বাঁশি বাজাইতে লাগল। হজরত আলী নামাজ থুইয়া রাগের চোটে মসজিদের বাইরে বাড়াইয়া এলেন। এবং কৃষ্ণরে খপ কইরা ধইরা ফালাইলেন। আল্লাহ পৃথিবীর অর্ধেক শক্তি যে আলীরে দিছিলেন, সেই আলীর কাছ থেকে কৃষ্ণ ছুইট্টা দৌড় মারলেন! কিন্তু; কৃষ্ণের পিছনের জামা ছিঁড়ে আলীর হাতে রয়ে গেল। এতক্ষণে নবিজি নামাজ শেষ কইরা মসজিদেই চিৎ হইয়া শুইয়া একটু বিশ্রাম করতেছিলেন। আলী মসজিদের ভিতরে ঢুইকা রাসুলরে কইলেন—আইজকা কৃষ্ণরে ধইরা হালাইছিলাম, কিন্তু ছুইট্টা দৌড় মারছে। যদি ধইরা রাখতে পারতাম, তাইলে কৃষ্ণর আইজকা খবর আছিল। এই দ্যাখেন কৃষ্ণের পিছনের জামা ছিঁড়া আমার হাতে রইয়া গ্যাছে। নবিজি চিৎ হইয়া শোয়া থেকে উপুড় হয়ে শুয়ে বললেন— দ্যাখো তো তুমি কার জামা ছিঁড়েছো? উপস্থিত সব সাহাবা দেখল আলীর হাতে যতটুকু ছেঁড়া জামা, ঠিক ততটুকুই জামা ছেঁড়া নবিজির! তো, এই থেকে কী বোঝা যায়? বোঝা যায়, যিনি কৃষ্ণ তিনিই রাসুল! গানবাজনা যদি হারাম হইতো, তাইলে ওই দিন নবিজি কৃষ্ণরে বাঁশি বাজাইতে নিষেধ করতেন।
গল্পটা শুনে আমি অবাক হই। ঘটনা যদি সত্যিই এটা ঘটে থাকে, তাহলে তো বাউল-ফকিররা সঠিক পথেই আছে। কিন্তু; বুঝতে পারি না হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও শ্রীকৃষ্ণ সমসাময়িক ছিলেন কি-না। অথবা তাদের দুজনের জন্মস্থান একই অঞ্চলে ছিল কি-না তা-ও জানি না। এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করার অবকাশও পেলাম না। বাদল বলে উঠল—শোন, তোরে আরেকটা ঘটনা কই—
আমাগো এই উপমহাদেশে যিনি প্রথম ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন তিনি হইলেন গিয়া খাজেগানে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (আ.)। তিনি কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ হিন্দুরে মুসলমান বানাইছিলেন। তিনি নিজেও গান পছন্দ করতেন, গান
গাইতেন। তিনি বলতেন, গান আমার রূহের খোরাক। তয়, তাঁর মামা ছিলেন আরেকজন মহান অলি বড়োপির আবদুল কাদের জেলানি। বড়োপির গানবাজনা পছন্দ করতেন না। বড়োপির একদিন খাজা মঈনুদ্দিনরে বললেন—এইসব ছাইড়া দেও। খাজা রাগ হইয়া যাইয়া গান ধরলেন। খাজা এমন এক গানে টান দিলেন, সঙ্গে-সঙ্গে পৃথিবী থরথর কইরা কাঁপতে লাগল! আকাশটা নাচতে লাগল! পৃথিবী কাঁপতে-কাঁপতে আর আকাশ নাচতে-নাচতে যখন এক সঙ্গে মিশা যাইতেছিল, তখন বড়োপির দেখলেন যে পৃথিবীর মানুষ তো ধ্বংস হইয়া যাইবো! সঙ্গে-সঙ্গে বড়োপির তাঁর বাম হাত মাটিতে ঠেকাইয়া ডান হাতের লাঠি দিয়া আকাশ ঠেকাইয়া ধরলেন! এইবার চিন্তা করছো ব্যাপারটা? গানবাজনা অতো সোজা না!
বাদল এতোকিছু কিভাবে জানে? আমি ভেবে অবাক হই। গান কি জিনিস! অলি-আউলিয়ার কি ক্ষমতা! এইখানে না এলে এতোকিছু জানতামই না। আমার জানার আগ্রহ জন্মে। বাদলরে বলি—তুই এতোকিছু ক্যামনে জানোস? বাদল বলে—সবই বাবা মাহবুব শাহর দয়া। মাহবুব শাহ নামটি উচ্চারণ করার সঙ্গে- সঙ্গে বাদল দুইহাত কপালে ঠেকিয়ে মাটিতে একটা ভক্তি দেয়। মাহবুব শাহ সম্পর্কে জানতে আমার ইচ্ছে জাগে। তার আগে জানতে চাই এই মাজার যার নামে সেই রহমত শাহ ইয়ামেনি (রহ.) কে? বাদলরে বলি—আইচ্ছা, রহমত শাহ ইয়ামেনি কী বড়োমাপের হুজুর আছিলেন? তিনি কি নামাজ পড়তেন? রোজা রাখতেন? তিনি কি কেরামতি দেখাইতে পারতেন? বাদল শামসু চাচাকে বলে— চাচা, তুমিই কও বাবা রহমত শাহকে। শামসু চাচা মদ আরেক ঢোক গিলে সিগারেট টানতে-টানতে বললেন—এইটা বিশাল বড়ো ঘটনা, তোমারে সংক্ষেপে কই শোনো—
বাবা রহমত শাহ ইয়ামেনি (রহ.) ছিলেন ইয়ামেন দেশের বাসিন্দা। একদিন রাস্তা দিয়া হাইটা কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক মহিলার চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পাইলেন। চইলা গেলেন মহিলার কাছে। মহিলারে জিজ্ঞেস করলেন—কী অইছে তোমার? মহিলা বললেন—আমার স্বামী মারা গ্যাছে অনেক আগে। একমাত্র ছেলে সেও মারা গেল। দুনিয়াতে আমার আর কেউ রইল না। বাবা রহমত শাহ মহিলাটির কথা শুইনা কষ্ট পাইলেন। তারপর মৃত ছেলেটাকে বললেন—এই ছেলে, জীবিত হও। মৃত ছেলেটি সঙ্গে-সঙ্গে দাঁড়াইয়া গেল! এই ঘটনার সংবাদ এক-দুই করে পুরো এলাকা ছড়াইয়া গেল। ওই এলাকায় এক কাঠমোল্লা ছিল, তিনি এলেন। কাঠমোল্লা এসে বাবা রহমত শাহকে বলল— আপনি মৃত মানুষকে কীভাবে জীবিত করলেন? বাবা রহমত শাহ বললেন—আমি বলেছি, এই ছেলে, আমার আদেশে জীবিত হও। কাঠমোল্লা চোইখ বড়ো বড়ো কইরা কইলো—আপনার বলা উচিত ছিল, এই ছেলে, তুমি আল্লাহর হুকুমে জীবিত হও। বাবা রহমত শাহ বললেন—কেন আল্লাহর হুকুমে জীবিত হতে বলবো? যার দুনিয়াতে কেউ নাই, একমাত্র ছেলে ছিল তাকেও যে আল্লাহ তুলে নিয়ে যায়, সেই আল্লাহর হুকুমে জীবিত হতে কেন বলবো? আল্লাহর কি আক্কেল জ্ঞান নাই? এজন্যই আল্লাহর দরবার থেকে এই ছেলের আত্মা ছিনতাই কইরা নিয়া আইছি। কাঠমোল্লা বলল—আপনি শরিয়ত মানেন? মানেন না। আপনি শিরক করেছেন, বিচারে আপনার চামড়া তুলে ফেলা হবে। এই কথা শুইনা সঙ্গে-সঙ্গে নিজের চামড়া নিজেই তুইলা কাঠমোল্লার হাতে ধরাইয়া দিয়া বাবা রহমত শাহ লোকচক্ষুর আড়াল হইয়া গেলেন। ভোরবেলা যখন সূর্য উদয় হইল তখন সূর্যের তাপে বাবার শরীর পুইড়া যাইতেছিল। তখন বাবা সূর্যরে কইলেন, এই সূর্য, আমি শরিয়ত মানছি, আমারে কষ্ট দিও না। সঙ্গে-সঙ্গে সূর্য ডুবে গেল, চারদিকে অন্ধকার নেমে আসলো। দেশের মানুষের মইধ্যে হইচই পইড়া গেল। তখন কাঠমোল্লা বিপদ দেইখা বাবা রহমত শাহকে খুঁইজ্যা বাইর কইরা তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলল—বাজান, আমার ভুল অইসে, ক্ষমা কইরা দ্যান। তখন বাবা রহমত শাহ সূর্যকে বলল—এই সূর্য, তুমি আমার জন্য মাইনষেরে কষ্ট দেও কেন? সঙ্গে-সঙ্গে সূর্য তাপ ছাড়া আলো ছড়াইয়া দিল। এরপর বাবা রহমত শাহ একটা জায়নামাজ বিছাইয়া সাগর পাড়ি দিয়া আমাদের দ্যাশে আইলেন। আমাদের দ্যাশে আইয়া এই মাজারের এইখানে বইসা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এইখানকার সব মানুষ তখন হিন্দু আছিল। এক হিন্দু জমিদার এইখান দিয়া যাইবার সময় বাবা রহমত শাহকে দেখলেন। অপরিচিত লোক দেইখা হিন্দু জমিদার কইলেন—এই তুমি কে? এইখানে কেন? তোমারে তো কোনওদিন দেখি নাই। তখন বাবা রহমত শাহ বললেন—সারা পৃথিবীর যিনি মালিক, আমি তাঁর বন্ধু। বাবার কথা শুইনা জমিদার বাবু বাবার পাশে বইসা পড়লেন। একজন দুজন কইরা আরও লোকজন জড়ো হইল, এবং বাবার পাশে বসলো। লোকজন বাবার সঙ্গে কথা বইলা মনে করছিল এই লোকটা একটা পাগল। তারপর তারা যখন বাবার কাছ থেকে উইঠা যাইতে নিলো, তখন আর তারা কেউ উইঠা দাঁড়াইতে পারলো না! লোকজনের মইধ্যে আতঙ্ক ছড়াইয়া গেল। তারপর বাবা বললেন—তোমাদের ছাইড়া দিতে পারি, যদি তোমরা মুসলমান হও। এই কথা শুইনা সবাই বাবার পায়ে লুটাইয়া পড়লো। এরপর জমিদার বাবু বাবারে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। একমাত্র মেয়ে শতরুপাকে বাবার কাছে বিয়া দিয়া তারা সবাই মুসলমান হইয়া গেল। বাবার সন্তানাদি হইল। বাবার মৃত্যুর পরে এইখানে তাকে কবর দেওয়া হইল। এলাকার লোকজন স্বপ্নে দেখলো, যারা বাবার কবরে ভক্তি দিয়া বাবারে উছিলা কইরা আল্লাহর কাছে কিছু চাইবো, তারা তা পাইবো। এরপর বাবার কবর হইয়া গেল মাজার। এই মাজারে যারা যে নিয়ত কইরা আসে, বাবার দোয়ায় তাদের নিয়ত পূরণ হয়। বাবা রহমত শাহ ও তার বংশধরেরা দো-জাহানের বাদশাহ। এইকালেও তাঁদের সুখ, পরকালেও তাঁদের সুখ। এই যে মাজারের এতো শানশওকত, মাহবুব শাহ হুজুরের এতো জমিজমা, বাড়ি-গাড়ি, টাকাপয়সা, আর ভোগবিলাস, সবই আসে মাজারে আসা লোকদের দানের টাকা থেকে। কেউ টাকাপয়সা দেয়, কেউ সোনাদানা, কেউ হাঁসমুরগি গোরুছাগল দেয়, গাড়ি কোম্পানির মালিকরা সরাসরি গাড়িও উপহার দেয়! চাকরিবাকরি ও উপর লেভেলে তদবিরের জন্য মানুষ টাকার বস্তা নিয়া আসে পির মাহবুব হুজুরের কাছে। বাৎসরিক ওরসে দুই তিনশ গোরু জবাই হয়। হাঁসমুরগি ছাগল ভেড়া যে কত জবাই হয় তারও কোনও হিসেব নাই। লক্ষ-লক্ষ মানুষ আইসা খায়। সারা শহরে ব্যানার পোস্টারে ছাইয়া যায়। এই সবের খরচের টাকাও আসে ভক্ত অনুরাগীদের পকেট থেকে। বাবা রহমত শাহর ভান্ডারে কেউ খালি হাতে আসে না। তাই তো বাবার নামের উপরে এই মাজারে পইড়া থাকি। এইকালেও যেমন কোনও চিন্তা নাই, পরকালেও তেমন চিন্তা নাই। নিশ্চয়ই পরকালের পুলসিরাত বাবা আমাদের হাত ধইরা পার কইরা নিবেন।
রহমত শাহ ইয়ামেনির নাম মুখে নিতেও এখন ভয় হচ্ছে আমার! অপবিত্র মুখে বাবার নাম নিলে পাপ হয়ে যায় যদি! কত বড়োমাপের আল্লাহর অলি ছিলেন তিনি! সত্যিই তো, উনি যদি আল্লাহর কুতুব না হইতেন, তাহলে এতো মানুষ এই মাজারে কেন আসে? কোনও উপকার না পাইলে কি কেউ আসে? মনেমনে বাবা রহমত শাহকে হৃদয়ের মণিকোঠায় বসাই, তার কুদরতি পায়ে ভক্তি দিই। আর ভাবি, বাবার একমাত্র বংশধর পির মাহবুবকে অবশ্যই একনজর দেখব, তাকে ভক্তি চুম্বন দেবো।
বাদলের কাছে হুজুর কেবলা মাহবুবকে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করি। বাদল বলে—আরেকদিন সময় কইরা দিনে আইবি। বাবার সঙ্গে সরাসরি পরিচয় করাইয়া দিমু। বাবারে দেইখা যদি তোর ভাল্লাগে, তাইলে বাবার মুরিদ হইয়া যাইস। বাবা তার খানকাতে প্রতিদিন বিকালে বসেন, বয়ান করেন, মুরিদ করেন। বাবার যারে ভাল্লাগে তারে তার বাড়িতে নিয়া যান। বাবার বাড়িতে যাইয়া তার ঘরে তার পাশে বইসা যারা সাধুসঙ্গ করতে পারে, তাদের শত জন্মের ভাইগ্যের ফ্যার! আইজও পর্যন্ত আমি বাবার ঘরে যাইতে পারি নাই। বাবার আরেকটু দয়া হলে বাবার সঙ্গে সাধুসঙ্গ করবো এইটা মনের আশা।
গভীর রাতে আমাদের আসর ভেঙে গেল। যে যার মতো চলে গেল। বাউলশিল্পীরা চলে গেছে। গাঁজার আসর থেমে গেছে। পাগলেরা শুইয়ে পড়েছে। দূরদূরান্ত থেকে আগত অতিথিরা কেউ হয়তো মাজারের নামে যে গেস্ট হাউস আছে, সেখানে রুম ভাড়া করে ঘুমিয়ে পড়েছে। যাদের টাকাপয়সা তেমন নাই, তারা পাটি ভাড়া করে মাজারেই কোনওরকম কাত হয়ে আরাম করছে। গরিবের মধ্যে যে একটু উন্নত, সে হয়তো বালিশ ভাড়া নিয়েছে। বাদলের কাছ থেকে যা বুঝলাম, তা হলো এখানে একদল মহিলা পাটি আর বালিশ ভাড়া দেয়। পাটি বিশ টাকা, বালিশ চল্লিশ টাকা। সকাল হলেই তারা তাদের পাটি-বালিশ ফেরত নিয়ে যাবে। এখানে এমন মহিলাও আছে, যারা টাকার বিনিময়ে অতিথি পুরুষদের সেবা করে থাকে। বাদল আমারে একটা কথা সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে—বুঝলি, এইটা হইল গিয়া ফুলের বাগান। ফুলবাগানে কত রঙের ফুল ফোটে: গোলাপ, জুঁই, চামেলি, শিউলি, বেলি আরও কত কি! এইখানেও ঠিক তেমনই। ভালোমন্দ, লুচ্চাবদমাশ ও পাপীতাপী সব পাইবি এইখানে। সৃষ্টি জগতের ভালমন্দ সবকিছুরেই আল্লাহ যেমন রক্ষা কইরা চলছে, তেমনই বাবা রহমত শাহ ও তার নুরানি বীর্যের প্রবহমান ধারা বাবা মাহবুব শাহ নিজেও এইখানের সব ভালোমন্দকে রক্ষা কইরা চলেছেন…।
খানকা
দেখতে-দেখতে একটি বছর বিগত হল।
ঋতুর অমোঘ চক্রে ফিরে এলো বসন্ত। শীতের পাতাঝরা বৃক্ষের উলঙ্গ ডালগুলোয় ফুলপাতার ছড়াছড়ি, এ যেন বিগতযৌবনা বৃদ্ধার জরাজীর্ণ দেহে যৌবনের আবির্ভাব! দেহের আবৃত-অনাবৃত অঙ্গে গজিয়ে ওঠা লোমের মতো শু®‥ মাটির শরীরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মসৃণ ঘাস। মাধবীলতার কলি, আমের মুকুল, গোলাপ, পলাশ, অশোক, শিমুল ও কৃষ্ণচূড়া প্রকৃতি-প্রেমিকদের উপহার দিয়েছে ফুলশয্যা। কোকিল, পাপিয়া, বসন্ত বাউরি আর ভ্রমর ক্ষণেক্ষণে গেয়ে উঠছে মিলনের গান। প্রজাপতিরা ছড়িয়ে দিয়েছে প্রাণে পূর্ণিমার রং। গোধূলির আলোমাখা আকাশপটে অন্ধকার নেমে আসতে-না-আসতেই মিটিমিটি জ্বলে ওঠে সন্ধ্যাতারা। সন্ধ্যায় ঝোপঝাড়ে জোনাকিরাও নামিয়ে আনে দূর আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জ। সাদা জুঁইফুলের মতো রাতের আকাশে টিপটিপ খেলা করে নক্ষত্রের দল। পৃথিবীর শরীরে শিহরন জাগায় সপ্তমীর চাঁদ। আমার মনপাখি হারিয়ে যেতে চায় প্রিয়তমার হাতটি ধরে দক্ষিণা বাতাসে উড়ে-উড়ে ভোরের নিস্তব্ধতায় মোড়া শুকতারার দেশে। সেই ছেলেবেলা থেকেই আমি প্রকৃতিপ্রেমী; প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ আমাকে মাতাল করে তোলে। আয়শাকে নিয়ে অচেনা-অজানা এই যান্ত্রিক শহরে আসার পরে আমাদের ঠিকানা হয়েছিল একটা বস্তিতে, যে বস্তির পরিবেশ আমাকে অসুস্থ করে তোলে। আশা ছিল আয়শা সিনিয়র অপারেটর হবে, আমার পদন্নোতি হবে, বেতন বাড়বে, তারপর ভালো দেখে একটা বাসা ভাড়া নেবো। হ্যাঁ, আমাদের আশা পূরণ হয়েছে। প্রথমে আয়শা যে ফ্যাক্টরিতে চাকুরি নিয়েছিল, এখন আমি সেই ফ্যাক্টরির কোয়ালিটি সুপারভাইজার, আয়শা সিনিয়র অপারেটর। ফ্যাক্টরি থেকে বাসা একটু দূরে হলেও যাতায়াতে আমাদের সমস্যা হয় না। এই ফ্যাক্টরির নিয়মকানুন ভালো, যে বাসাটা নিয়েছি সেটাও আমাদের জন্য মানানসই। দুজনের আগে-পরে ছুটি হলেও আমরা একসঙ্গে বাসায় ফিরি। ঘরের কাজ মিলেমিশে করি। ঘরের পিছনেই আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু আর পেয়ারা বাগান। বারান্দার সামনে জুঁই চামেলি, আর আছে ছোট্ট একটি গোলাপের চারা। শহর থেকে একটু দূরে হওয়াতে বাসাটার ভাড়াও অনেক কম। সবকিছু মিলিয়ে আমরা বেশ ভালো আছি।
রোজ রবিবার, ছুটির দিন। খাটে হেলান দিয়ে আরজ আলী মাতুব্বরের সত্যের সন্ধান বইটা পড়তে ছিলাম। হঠাৎ আয়শা ডেকে বলল—একটা খুশির খবর আছে, শুনবা? আমি বইটা রেখে দ্রুত আয়শারে জড়িয়ে ধরে বলি—কও কী খবর। আয়শা আমার মাথাটা ওর পেটের মাঝে চেপে ধরে বলে—শুনছো এইখানে কে কথা কয়? আমার আর বুঝতে বাকি রইল না—আয়শা গর্ভবতী! আয়শার কপালে ছোট্ট একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে বললাম—অভিনন্দন। এরপর আয়শারে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে চুড়ি, মালা, কানের দুল, কপালের টিপ, তাঁতের শাড়ি আর একগুচ্ছ ফুল কিনে দিয়ে বলি—নিজের যত্ন নিও।
আয়শার জন্য আমার ভয় হয়। পোয়াতি মানুষ, এখন সে বাড়িতে থাকলে আমার মা ওর যত্ন নিতো। এখানে আমি ছাড়া ওর যত্ন কে নিবে? একজন পোয়াতি নারীর যত্ন নেওয়া কতটাই-বা আমি বুঝি? কখন কী করতে হবে কে করে দিবে, বলেই-বা দিবে কে? আয়শা বলে—এতো চিন্তা কইরো না, আল্লাহ ভরসা। আমি মনেমনে সিদ্ধান্ত নিই—আর কয়েকটা মাস গেলেই শাশুড়ি আম্মাকে বলেকয়ে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবো।
দুইমাস চলে গেল। আমার মনে হলো আয়শারে নিয়ে বাবা রহমত শাহ ইয়ামেনি (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করে আসা দরকার। যিনি মৃত মানুষকে জীবিত করতে পারতেন তাঁর মাজার জিয়ারতে নিশ্চয়ই মঙ্গল হবে। আয়শারে কথাটা বললাম, আয়শা রাজি হলো। পবিত্র জুমাবারে নামাজ শেষে মাজারে গেলাম। আমাদের সন্তান যেন সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসে সেজন্য মানত করলাম। পিতলের কলসিতে আয়শা তার স্বর্ণের নাকফুলটা ফেলে দিলো। দানবাক্সে আমি পাঁচশো টাকার একটা নোট ফেললাম। এরপর বাবা রহমত শাহর কবরের পাশে আগরবাতি মোমবাতি জ্বালিয়ে দোয়াদরুদ পাঠ করলাম। মাজারের খাদেম মিলাদ পড়িয়ে আমাদের দুজনকে সন্দেশ আর বাতাসা দিলেন। খাদেমকে তিনশো টাকা হাদিয়া দিলাম। খাদেম সেই শামসু চাচা। শামসু চাচা বললেন—ভাতিজা তুমি সেই শিমুল না? ওই দিন রাতে… বাদলের সঙ্গে…। আমি বললাম—হ চাচা, আমি সেই শিমুল। তা, বাদল কোথায়? ওর রুমে আছে? শামসু চাচা বললেন—বাদল তো বাবা মাহবুব হুজুরের খানকাতে গ্যাছে। হুজুর একটু পরেই খানকাতে বসবেন, তারপর ভক্ত আশেকানদের উদ্দেশে তরিকতের বয়ান করবেন। নতুনে যারা তার হাতে বায়াত হতে চায় তাদের বায়াত দিবেন।
সঙ্গে-সঙ্গে মাহবুব হুজুরকে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। এবং চলে গেলাম খানকা শরিফে।
পির মাহবুব রাজসিংহাসনে রাজাদের মতো করে কারুকার্য শোভিত চেয়ারে বসে আছেন। মাথায় লম্বা সবুজ রঙের টুপি। চোখে কালো চশমা। নবাব সিরাজুদ্দে․লা যেমন জুতো ব্যবহার করতেন, তেমন জুতো পরে আছেন পির মাহবুব শাহ। লোকজন একজন-একজন করে পিরের পদস্পর্শ করে ভক্তি দিয়ে আসছেন। পির মাহবুব কারও মাথায়, কারও পিঠে, কারও কপালে, কারও গালে হাত দিয়ে আদর করে আশীর্বাদ করছেন। কাউকে শুধু হাতটা উঁচু করে ইশারায় আশীর্বাদ করছেন। আশীর্বাদ নিয়ে ফিরে আসার সময় লোকেরা পিরের পায়ের কাছে রাখা ঝুড়িতে টাকা গুঁজে দিচ্ছেন। পির সাহেব আরেকটু পরেই উপস্থিত লোকজনকে উপদেশ দিবেন। পিরের পাশেই, একটু দূরে বাদল বসে আছে। লেবাস দেখে মনে হচ্ছে বাদল বিশাল মাপের দরবেশ! লালসালু পরিহিত এক সাধু। হাতে বাঁকা লাঠি। গলায় একগোছা তসবি মালা। হাতে লোহার বালা। একটা করে আঙুলে কয়েকটা করে আংটি। চোখে মাদকতা। বাদলের চোখের দৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক নুর খেলা করে। চেহারায় মায়াবি ছাপ। ভাবখানা এমন যেন সে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলতেছে। বাদল আমাকে দেখে হাত উঁচু করে, আমিও হাত নাড়িয়ে বলি—তোর ভাবিরে নিয়া আইছি। এরপর লোকের ভিড় ঠেলে আয়শাকে নিয়ে মাহবুব হুজুরের কাছে যাই। আমি প্রথমে ভক্তি দিয়ে আয়শাকে বলি—হুজুরকে সালাম করো। আয়শা মাহবুব হুজুরের পায়ে সালাম করে। হুজুর আয়শার পিঠে, মাথায় ও গালে হাত বুলিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে আশীর্বাদ করে। আয়শার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ! বাদল বলে—আইছা যেহেতু আইজকা বাবার বায়াত নিয়া যা। বয়ান শেষে আইজকা বাবা নতুন ভক্তদের বায়াত দিবো। পির মাহবুব বয়ান আরম্ভ করলেন—
প্রিয় আত্মাগণ,
এই দুনিয়ার মইধ্যে যদি কোনওকিছু জানতে চান, বুঝতে চান বা শিখতে চান, তাইলে আপনাদের সেই ব্যক্তির কাছে যাইতে হবে, যিনি সেই বিষয় সম্পর্কে চেনেন, জানেন এবং বোঝেন; আর তিনি হলেন শিক্ষক বা গুরু। আরবিতে মুর্শিদ, ফারসিতে পির, বাংলায় যারে বলে—গুরু। গুরু, গু-শব্দের অর্থ অন্ধকার, আর রু-শব্দের অর্থ আলো। যে ব্যক্তি মানুষের মনের অন্ধকারকে দূর কইরা তার ভেতরে জ্ঞানের আলো জ্বালাইয়া দিতে পারেন, তিনিই গুরু। গুরুর গোলামি কইরা ইলমে মারিফতের জ্ঞান অর্জন কইরা নিজেকে নিজে চেনার পর প্রভু মুহাম্মদের তরিকা মোতাবেক যে ব্যক্তি মাওলায়ত প্রাপ্ত হতে পেরেছেন যাকে দেখলেই গুরুভাবের উদয় হয়, সেই ব্যক্তিই কামেল গুরু। কামেল গুরুর সঙ্গ কইরা যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং মানুষের গোপন রহস্য জাইনা দুনিয়ায় ভালোমন্দ যাচাই- বাছাই কইরা ভালোকে গ্রহণ এবং মন্দকে বর্জন করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারেন, তিনিই আল্লাহর প্রিয় বান্দা; রোজ হাশরে তাঁর ভয় নাই। কিন্তু; আমি একজন মানুষ আবার যারে গুরু ধরমু সেও আমার মতোই একজন মানুষ, তাইলে কেন তার গোলামি করমু? গোলামি করার একটাই কারণ, সেইটা হলো—আমি সত্যের সন্ধান জানি না গুরু জানেন, এজন্য। পথপ্রদর্শক ছাড়া পথের সন্ধান পাওয়া যায় না।
প্রিয় সুধীমণ্ডলী,
অহাবি, খারেজি, ইয়াজিদি, উগ্রবাদী, চরমপন্থি ও সাম্প্রদায়িক কাঠমোল্লারা বইলা থাকে, গুরু ধরার দরকার নাই; গুরু ধরা বেদাত, শেরেক এবং এইগুলা কাফেরদের কর্ম। এরা মূলত সেইসব মোল্লা-মুনশির উত্তরসূরি, যারা নবির বংশকে কারবালার ময়দানে ধ্বংস করেছিল। এদের পূর্বপুরুষরাই ক্ষমতার লোভে মাওলা আলীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল এবং মসজিদের ভেতরে আলী (আ.)-কে হত্যা করেছিল। এরাই রাসুলের মৃত্যুর পর লাশ দাফন না কইরা ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়া ব্যস্ত হইয়া পড়েছিল। এরাই মা ফাতিমার বুকে লাথি মারছিল। এরাই ইমাম হাসান-হোসাইনকে শহিদ করেছে। এইসব চরমপন্থি মোল্লা-মুনশির জাত-বংশরা কোরানের ভুল ব্যাখ্যা কইরা বানোয়াট হাদিস দিয়া সাধারণ মুসলমানরে ধোঁকা দিয়া যুগের-পর-যুগ ধইরা ধর্মব্যবসা কইরা আইতেছে। এরা ধর্ম ব্যবসায়ী। এরা মুনাফেক। এরা ইসলামের শত্রু। নবিজি মরার আগে লিখে দিয়ে যাইতে চাইছিলেন তার অবর্তমানে কে হবেন মুসলিম জাহানের শাসক, কিন্তু এরা লিখতে দেয় নাই। গুরুবাদী ইসলামের রূপরেখাকে তথাকথিত মোল্লা মুন্সির দলেরা ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সফল হয় নাই। ইসলামকে হেফাজত করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। ইসলাম এখনও জিন্দা আছে। আমরা গুরুবাদীরাই একমাত্র মুহাম্মদী জিন্দা ইসলামকে আঁকড়ে ধরে আছি। আল্লাহ বলেছেন— তোমরা পরস্পর বিছিন্ন হইও না; তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো। ইনশাআল্লাহ আমরা গুরুবাদীরা পরস্পর বিছিন্ন হই নাই। গুরুর হাতে বায়াত হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সুরা মায়েদার পঁয়ত্রিশ নাম্বার আয়াতে স্পষ্টভাবে বলেছেন, হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং একজন কামেল গুরুর অছিলা সন্ধান করো, যদি মুক্তি পাইতে চাও। সুরা নিসার উনষাট নাম্বার আয়াতে বলেছেন, হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য কর, এবং আনুগত্য কর নায়েবে রাসুলের। অতএব; কোরান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় ইসলামের পথে নিজেকে অবিচল রাখতে হলে অবশ্যই প্রত্যেককে গুরুর হাতে বায়াত হতে হবে। বায়াত হওয়া ছাড়া ইসলামে কেউ দাখিল হইতে পারবে না। বায়াতহীন ব্যক্তি কখনও মুসলিম হতে পারে না। আর বায়াত না হওয়া অবস্থায় যদি কেউ মইরা যায়, তাইলে তার স্থান জাহান্নামে। সহিহ মুসলিম শরিফে আছে, নবিজি বলেছেন—যে ব্যক্তি গুরুর আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিবে, সে যখন কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াইবে, তখন সে আল্লাহর কাছ থেকে বাঁচার জন্য কোনও পথ খুঁইজা পাবে না।
প্রিয় অনুরাগীগণ,
আপনাদের একটা ঘটনা বলি আপনারা মনোযোগ দিয়ে শোনেন—নবিজি আল্লাহর সঙ্গে দেখা করতে মেরাজে গিয়েছিলেন এটা তো সবাই জানেন। কিন্তু; এইটা কী জানেন নবিজি আল্লাহরে কোন সুরতে দেখেছিলেন? নবিজি যখন সমস্ত আসমান ভেদ কইরা লা-মোকামে তথা সৃষ্টিরাজ্য ত্যাগ কইরা আল্লাহর রাজ্যে
গেলেন, তখন আল্লাহ বললেন—হে দোস্ত, আপনি আর এক পা আগাবেন না। আপনি বায়াত হইয়া আসেন। তখন নবিজি বললেন—হে আল্লাহ, এইখানে আমি কার হাতে হাত রাইখা বায়াত হবো? তখন আল্লাহ বললেন—আপনি দুই চোখ বন্ধ কইরা সামনে হাত বাড়ান। নবিজি দুই চোখ বন্ধ কইরা হাত বাড়ালেন, অনুভব করলেন একটা হাত আইসা নবিজির হাতকে চেপে ধরেছে। নবিজি সেই হাতে হাত রাইখা বায়াত হইলেন। এরপর আল্লাহ বললেন—হে দোস্ত, চোখ খুলুন। নবিজি চোখ খুইলা দেখতে পাইলেন নিজেই নিজের এক হাত আরেক হাতে রাইখা বায়াত হয়েছেন! এরপর নবিজি চইলা গেলেন আল্লাহর কাছে। সত্তর হাজার পর্দা ভেদ কইরা নবিজি দেখতে পাইলেন আল্লাহ সিজদায় পড়ে আছেন। নবিজি আল্লাহরে বললেন—হে আল্লাহ, সমগ্র সৃষ্টিজগৎ যারে সিজদা দেয়, সে আবার কারে সিজদা দেয়? আপনি কার উপাসনা করতেছেন? আল্লাহ বললেন— সমগ্র সৃষ্টিজগৎ আমি যার জন্যে সৃষ্টি করেছি, আমি তারেই সিজদা দেই। এই কথা বলতে-বলতে আল্লাহ যখন রাসুলের দিকে তাকাইলেন, তখন রাসুল দেখতে পাইলেন রাসুলের রূপেই আল্লাহ, আল্লাহর রূপেই রাসুল! তো; এই ঘটনা থেকে বায়াতের হকিকত সম্পর্কে বুঝলেন কিছু?
প্রিয় আশেকান,
যিনি গুরু তিনিই রাসুল, আবার তিনিই আল্লাহ। গুরুর হাতে বায়াত হওয়ার মানে হলো আল্লাহর হাতে বায়াত হওয়া। এ সম্পর্কে আল্লাহ সুরা ফাতাহ্-এর দশ নাম্বার আয়াতে বলেছেন—নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আপনার হাতে বায়াত গ্রহণ করল, সে মূলত আল্লাহর হাতেই বায়াত গ্রহণ করল। কারণ, আপনার হাতের উপরই ছিল আল্লাহর হাত। সহি বোখারি শরিফে রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন—আর যে নিজের গুরুর আনুগত্য করে, সে মূলত আমারই আনুগত্য করে, আর যে নিজের গুরুকে অমান্য করে, সে মূলত আমাকেই অমান্য করে! রোজহাসরের দিনেও আল্লাহ যার যার গুরুকে সহ ডাকবেন। সুরা বনি ইসরাইলের একাত্তর নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলে দিয়েছেন—তোমরা সেইদিনকে ভয় করো, যেইদিন প্রত্যেক মানুষকে তার নিজের গুরুকে সহ ডাকা হবে। হজরত জুনায়েদ বোগদাদি (রহ.) বলেছেন—যার গুরু নাই তার গুরু—শয়তান। পৃথিবীর সব নামকরা আলেম ও ইমামগণ গুরু ধরেছিলেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর গুরু ছিলেন ইমাম বাকের (রহ.)। হজরত ওয়ায়েস আল-করনির গুরু ছিলেন হজরত আলী (আ.)। হজরত আলী (আ.), বকর, ওমর ও ওসমান (রা.)-এর গুরু ছিলেন হজরত মুহম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ.)-এর গুরু ছিলেন হজরত শামস তাবরিজ (রহ.), তাফসিরে কবিরের লেখক ইমাম ফখরুউদ্দিন রাজি (রহ.)-এর গুরু ছিলেন হজরত জালালউদ্দিন কোবরা (রহ.) এবং ইমাম গাজ্জালী (রহ.)-এর গুরু ছিলেন হজরত আবু আলী ফারমাদির (রহ.)। গুরুর হাতে বায়াত হওয়ার অসংখ্য দলিল আছে। যারা হেদায়েত পাওয়ার, তারা অল্পতেই হেদায়েত প্রাপ্ত হয়। কারণ, হেদায়েতের মালিক একমাত্র আল্লাহ। হেদায়েত-প্রাপ্ত মানুষদের ব্যাপারে আল্লাহ সুরা কাহাফ-এর সতেরো নাম্বার আয়াতে বলেছেন—আল্লাহ যারে হেদায়েত করেন, শুধু সেই হেদায়েত প্রাপ্ত হয়। আর যাকে পথ ভ্রষ্ট করেন, সে কখনও কোনও কামেল অলিকে নিজের পথপ্রদর্শক বা গুরু রূপে পায় না। মূলকথা হলো; মানুষের অছিলাতে আমরা দুনিয়াতে আইছি, আবার জায়গামতো যাইতে হলেও একজন পথপ্রদর্শক বা গুরুর সাহায্য লাগবে। পরম করুণাময় আল্লাহ্ আমাদের জন্য একজন কামেল গুরু বা মুর্শিদ নির্ধারণ করুন, আমীন।
বয়ান শেষ হতে-না-হতেই বাদল সকলের উদ্দেশে বলে উঠল—সম্মানিত সুধীমণ্ডলী, আপনারা আজকের মতো আসতে পারেন। আর যারা হুজুর কেবলার হাতে বায়াত হবেন, তারা একজন-একজন করে বাবার সামনে আসেন। আমি এতোক্ষণ মনোযোগ সহকারে হুজুরের বক্তব্য শুনতেছিলাম। মনে মনে চিন্তা করলাম—আমাদের মসজিদের ইমাম, এলাকার মুরুব্বি, আত্মীয়স্বজন, মা-বাবা, কেউ তো কোনওদিন বলল না পিরের হাতে বায়াত হতে হয়; তারাও তো মুসলমান, তারা কেন বায়াত হননি? তারা কী কোরআন পড়েন না? পির মাহবুব তো হাদিস-কোরআন থেকেই এতোক্ষণ কথা বললেন। কোরআন তো পৃথিবীর একমাত্র সত্য গ্রন্থ, সে গ্রন্থেই আছে পির ধরতে হবে। পির মাহবুব তো মিথ্যে বললেন না; তিনি কোরআনের আয়াত নাম্বার দিয়েই কথা বললেন! পির মাহবুব অবশ্যই একজন কামেল গুরু। তার হাতে অবশ্যই বায়াত হওয়া দরকার।
সিদ্ধান্ত নিলাম বায়াত হবো।
লোকজন একজন-একজন করে বায়াত হচ্ছেন। আমিও সিরিয়ালে। আয়শা আমার পিছনে। পিছন থেকে আয়শা বলে—আমি বায়াত হবো না। আমি বলি— কেন? আয়শা বলে—বাসায় গিয়ে বলবো। আয়শার উপর রেগে গেলাম। উপস্থিত লোকজন আমাদের বিষয়টি কিছুটা টের পেল। অনেক মানুষের সামনে ঘটনা বড়ো করলাম না; ভাবলাম, বাসায় গিয়ে যা বলার বলবো। আমার সামনের জন বায়াত হয়ে চলে গেল, এইবার আমার পালা। বসলাম গিয়ে হুজুরের সামনে। হাতে হাত রাখলাম। হুজুর আমার হাত ধরে চোখে চোখ রেখে বললেন—বলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বাবা মাহবুব রাসুলুল্লাহ। আমি চমকে উঠি! আরে এটাতো আমাদের মুসলমানদের প্রধান চার কলেমার এক কলেমা! এই কলেমা তো হবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। কলেমার মধ্যে পির মাহবুব তার নিজের নাম ঢুকিয়ে দিয়েছেন কেন? ভাববার জন্য বেশিক্ষণ সময় পেলাম না। পির মাহবুব হালকা চড়া সুরে বললেন—বলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বাবা মাহবুব রাসুলুল্লাহ। আমি মাহবুব হুজুরের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে কলেমা পড়লাম, আমার বায়াত সম্পন্ন হলো।
বাসায় এসে আয়শাকে বললাম—তুমি এতোগুলা মানুষের সামনে আমারে অপমান করলা কেন? কী হইত বায়াত হলে? কেন বায়াত হইলা না? আয়শা বলে—লোকটারে আমার ভালো লাগে নাই। তার আশীর্বাদের ছোঁয়ায় কামনার আগুন ছিল। আমি চোখ রাঙিয়ে বলি—হ, চুন খাইয়া মুখ পুড়ছে এখন দই দেইখা ডর করে, তাই না? সারাজীবন খারাপ মাইনষেরে দেখছো, এখন ভালো মাইনষেরেও খারাপ মনে হয়। এই লোক একজন আল্লাহর অলি। তার বাপদাদার কেরামতি সম্পর্কে তুমি কিছু জানো? সে নিজেও তো কত সুন্দর কইরা কোরআন হাদিসের কথা কইলো। সে কত মাইনষেরে স্পর্শ কইরা আশীর্বাদ দিলো। তুমি তো তার মেয়ের বয়সী। তোমারে হাত বুলাইয়া আশীর্বাদ দিছে, আর তুমি সেই স্পর্শে কামনার আগুন খুঁইজ্যা পাইছো! সরল সোজা হও, সবকিছুরে সহজভাবে নিতে শেখো। জল টলমল চোখে আয়শা বলে—আমার পূর্বের কৃতকর্মের প্রসঙ্গ তুইলা ওই লোকটার জন্য তুমি আমারে অপমান করলা? তোমারে একটা কথা কই শোনো, পির মাহবুব লোকটার এখনও মোহমুক্তি ঘটেনি। সে বিষয়সমূহের বন্ধনে আটকে গেছেন। বিভিন্ন প্রকার বন্ধন থেকে মাইনষের মুক্তির জন্য কথার দোকান দিছেন। তিনি উপদেশ বাণী, লেবাস, আর প্রার্থনার জালে বন্দি। তার সেই শক্তি নাই, যে-শক্তি একটি অশান্ত এবং অস্থির আত্মাকে শান্তি ও স্বস্তি দিতে পারে। তোমার ভালো লাগলে তুমি তার কাছে যাও, বাঁধা দেবো না।
আয়শার সঙ্গে আর কথা বাড়ালাম না। মোহমুক্তি, বিষয়সমূহ ও কথার দোকান শব্দগুলো সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নাই। আয়শার পূর্বের কৃতকর্মের প্রসঙ্গ তোলার জন্য আমি লজ্জিত হই। আয়শার হাত চেপে ধরে বলি—দুঃখিত, এইভাবে আর কোনওদিন কথা বলমু না। রাগ কইরো না। তোমার উপরে জোর কইরা আমার ভালো লাগা চাপাইয়া দিতে চাইছিলাম, এইটা আসলে অন্যায়।
অনুসন্ধিৎসা
কিন্তু; চলতে-ফিরতে, উঠতে-বসতে, সময়ে-অসময়ে একটি কথাই বারংবার মস্তি®ে‥র স্নায়ুতন্ত্রে ভেসে উঠছে, সেটি হলো—পির মাহবুব বায়াত দেওয়ার সময় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ না বলে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বাবা মাহবুব রাসুলুল্লাহ বললেন কেন?
পরিচিত এমন কোনও লোকও নাই যে তার সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলব। কর্মস্থলে সহকর্মীদের সঙ্গেও এই প্রসঙ্গে কথা বলার সময় কিংবা সুযোগ কোনওটাই নাই। একা-একা বোঝার চেষ্টা করি; হিসাবে মেলাতে পারি না। প্রায় পনেরো দিন পর, বৃহস্পতিবার, রাত দশটার দিকে ফোনে বাদলের কল আসে। হ্যালো বলতে-না-বলতেই বাদল বলে—কি রে, কতদিন হইল দেখাসাক্ষাৎ নাই, একটা কল-ও তো দেস না। কী হইছে? ভুইলা গেছো? শোন, খুশির খবর আছে। ভাবিরে আর তোরে বাবা মাহবুব চান দেখা করতে কইছে। সেই যে বায়াত নিয়া চইলা গেলি, বাবার সঙ্গে আর একবারও দেখা করলি না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আইয়া পড়। বাবা নিজে তোর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করছে! এইটা তো শত- জনমের ভাইগ্যের ফ্যার! কত বড়োবড়ো নামিদামি মাইনষে বাবার দর্শনের জন্যে সিরিয়াল দিয়া দাঁড়াইয়া থাকে, অথচ বাবা তাদের দর্শন দেন না; আর তোরে বাজানে নিজে ডাকছে! আয়, আইয়া পড়। কবে আইবি?
পির মাহবুব আমাকে ডেকেছেন! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! যে মানুষটার সেবাযত্ন করার যোগ্যতা আমার নাই, সেই মানুষটা আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন? বাদলরে দ্রুত উত্তর দিই—আইচ্ছা ঠিক আছে, দুই-একদিনের মধ্যেই আমি আইতেছি। তোর ভাবি যদি যাইতে চায় নিয়া যামু, না যাইতে চাইলে আমি একাই যামু। তোর কি সময় আছে? একটা কথা কইতাম…।
বাদল বলে—ভাবিরে অবশ্যই নিয়া আইবি। বাজান ভাবিরে সঙ্গে কইরা নিয়া আইতে কইছে। আর কী কইবি ক, সময় আছে।
আমি বলি—আইচ্ছা বাদল ক তো, অই দিন বায়াত নেওয়ার সময় হুজুরে কইলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বাবা মাহবুব রাসুলুল্লাহ, এইখানে তো উনি নিজের রাসুল দাবি করল, তাই না? আমাগো নবিজির পরে আর কোনও নবি আইবো না এইটাই তো জাইনা আইতেছি। কিন্তু উনি এইটা ক্যামনে কি কইলো?
বাদল বলে—দ্যাখ শিমুল, তোরে বাজানের সঙ্গে ঘইটা যাওয়া একটা ঘটনা কই, শোন—একদিন বাজানের কাছে একজন শিক্ষিত পণ্ডিত আইলেন দেখা করতে। পণ্ডিত ব্যক্তিটা অনেক প্রশ্ন আর তর্ক করল বাজানের সঙ্গে। আলাপ চলাকালীনই বাজান নিজে ওই পণ্ডিত ব্যক্তিটার জন্য একটা কাপ, আর চায়ের কেটলি আনলেন। টেবিলে কাপটা রাইখা কেটলি থেকে চা ঢালতে লাগলেন। কাপে চা ভইরা গ্যাছে, বাজান তবু চা ঢালতেই আছেন… ঢালতেই আছেন…। কাপ থেকে চা পইড়া যাইতেছিল। এ-দৃশ্য দেইখা একসময় পণ্ডিত লোকটা রাগে কইলেন—এইটা আপনে কী করতেছেন? চা তো পইড়া যাইতেছে। বাজান বললেন—দেখুন, কাপটা পরিপূর্ণ হওয়ার পরে যতটুকু চা ঢালছি তার সবটুকুই পইড়া গেছে। ঠিক এই কাপটার মতোই একটা মানুষ যখন বিভিন্ন জ্ঞানে পরিপূর্ণ থাকে, তখন আর তার মাথায় যত জ্ঞানের কথাই দেওয়া হোক না কেন, তা আর তার মাথায় ধরবে না। অতএব, আমার কাছে আসতে হলে সব বিদ্যাবুদ্ধি মাথা থেকে নামিয়ে আসুন, তবেই আমার কথা বুঝতে পারবেন। আমার সঙ্গে যদি পণ্ডিতি করেন, তাইলে আমার কথা আপনার মাথায় ঢুকবে না। পণ্ডিতি ছাইড়া আমি কী বলি তা যদি ধারণ করতে পারেন, তাইলে আশা করি একটা আলোকিত মানুষ হইতে পারবেন। পণ্ডিত লোকটা বাজানের এই ঘটনা দেইখা আর কথা শুইনা সঙ্গে-সঙ্গে বাজানের পায়ে লুটাইয়া পইড়া বাজানের কাছে বায়াত নিয়া চইলা গেলেন। এরপর শুনছি ওই লোকটা বাজানের সুরত ধ্যান কইরা বিশাল বড়ো অলি হইয়া গেছিল! তো, কেউ যদি পিরের কাছে বায়াত হইতে যায়, তাইলে ওই ব্যক্তির উচিত তার মাথা থেকে আগের জ্ঞানবুদ্ধির ভান্ডার আর তথ্যকথা মুইছা ফেলা। তুই জানিস যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ এইটা হইল নবিজির কালেমা। কালেমা মানে সাক্ষী দেওয়া। এই কালেমার বাংলা অর্থ—নাই কোনও উপাস্য আল্লাহ ছাড়া, মুহাম্মদ আল্লাহর বন্ধু। আইচ্ছা ক তো, তুই কি নবি মুহাম্মদরে দেখছ? দেখিস নাই। তাইলে কেমনে সাক্ষী দিলি যে নবি মুহাম্মদ আল্লাহর বন্ধু? না দেইখা সাক্ষী দেওয়া তো অপরাধ। নবিজি মইরা গ্যাছে সাড়ে চোদ্দোশ বছর আগে, এখন তোরে যদি কই নবিজিরে দেখতে কেমন দেখা যায়? তুই কি উত্তর দিতে পারবি? পারবি না। পিরেরা হইল নায়েবে রাসুল। নবি মরার পরপরই নবুওতের দরজা বন্ধ হইয়া গ্যাছে, এবং চালু হইছে বেলায়ত। বেলায়ত মানে নায়েবে রাসুলদের যুগ। আরেকটা কথা মনে রাখবি, প্রত্যেক নবিই রাসুল; কিন্তু, প্রত্যেক রাসুলই নবি না। কোরআনে নবুওতের খতমের কথা বলা হইছে। তুই কি মনে করছ আল্লাহ কোরানে যা বলার বইলা চুপচাপ বইসা রইছেন, তিনি আর বান্দার সঙ্গে কথা কইবেন না? তিনি কি বোবা হয়ে গেছেন? না। তিনি বান্দার সঙ্গে এখনও কথা কন। নবিদের উপর ওহী নাজিল কইরা তিনি কথা কইতেন, এখন অলি-আউলিয়া বা নায়েবে রাসুলগণের সঙ্গে ইলহামের মাধ্যমে কথা কন। আল্লাহর কথা বলা থাইমা নাই। বাবা মাহবুব শাহ আল্লাহর একজন নায়েবে রাসুল, তাই তোরে তার কালেমাই পড়াইছেন। আমরা যখন মইরা যামু, মরার পড় আমাগো মৃত লাশকে কবরে জীবিত কইরা মনকির-নাকির দুই ফেরেশতা জিগাইবো, ক, তোর আল্লাহ কে? নবি কে? তোর ধর্ম কী? তখন দুইটা প্রশ্নের উত্তর মোটামুটি আমরা দিতে পারমু; কিন্তু, একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারমু না, সেইটা হইল—ক, তোর নবি কে? আমরা যখন ফেরেশতাদের করা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারমু না, তখন নবিজিরে কবরে আইনা জিগাইবো—ক, এই লোকটা কে? কবরে সেদিন আমরা যারা গুরুভক্ত, গুরুভাই, তরিকার লোক, তারাই উত্তর দিতে পারমু, অন্য কেউ পারবো না। কবরে সেদিন যার যার গুরুর রূপে নবিজি হাজির হইবেন! এইজন্যই যারযার গুরুই তার-তার কাছে রাসুল। কোরআনে আছে, যে আল্লাহ এবং রাসুলের মইধ্যে পার্থক্য করে, সে কাফের। তার মানে, যিনি গুরু তিনিই রাসুল, আবার খোদাও তিনি! এইসব অনেক গভীরের কথা। গুরুকর্ম কর, তাইলে জানতে পারবি। আস্তেধীরে সব বুঝবি। গুরুর সঙ্গে ওঠাবসা না করলে কেমনে জানবি এইসব? পৃথিবীতে বাঁইচা থাকতে যদি আল্লারে না দেখতে পারছ, তাইলে তুই পরকালেও অন্ধ থাকবি। আল্লারে দেখতে চাইলে অবশ্যই গুরুর গোলামি করতে অইবো। যাই হোক, অনেক কথা হইল, এখন রাইখা দেই। আর অবশ্যই বাবার সঙ্গে আইসা দেখা কইরা যাইস।
‘আইচ্ছা ঠিক আছে’ বলে ফোনটা রেখে দিলাম।
সত্যিই অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী। না বুঝতে পেরে বাবা মাহবুব হুজুর কেবলাকে আমি সন্দেহ করেছি! বাবার সংস্পর্শে থেকে বাদল আজ কতটা জ্ঞানী হয়ে গেছে! কত সুন্দর করে কথা বলে। কতকিছু জানে। এজন্যই লোকে বলে, সৎসঙ্গে স্বর্গবাস। ধর্মের কাজ তো কিছু করতে পারি না, বাবা মাহবুব চাঁনের দয়ায় যদি কিছুটা পাপমোচন হয়, তাহলে তার গোলামি করলে ক্ষতি কী? বাবাজির সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখা করতেই হবে। রবিবার অফিস বন্ধ থাকবে, তাই সিদ্ধান্ত নিই আগামী রবিবার বাবার দরবারে যাবো।
আমি কে? আমি কোথায় থেকে এলাম? আবার যাবো কোথায়? এই রক্তমাংসে আর অস্থিমজ্জায় গঠিত দেহটাই কি আমি? মৃত্যুর পর আমার দেহ তো পচেগলে যাবে, তাহলে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে আমার বিচার হবে কিভাবে? আসলেই কি মৃত্যুর পর আরেকটা জীবন আছে? আমাকে কী কেউ সৃষ্টি করেছেন? আমাকে যদি কেউ সৃষ্টি করে থাকেন, তিনি কেন সৃষ্টি করেছেন? কি দরকার ছিল আমাকে সৃষ্টি করার? এই বিশ্ববহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা কে? তাকে কেমন দেখা যায়? আচ্ছা, সবকিছুর পেছনে যদি একজন সৃষ্টিকর্তা থেকে থাকেন, তাহলে ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছেন কে? যখন কোনওকিছুই ছিল না, তখন ঈশ্বর ছিলেন কোথায়? ঈশ্বর কি স্থান সৃষ্টি করেছেন? স্থান যদি ঈশ্বরের সৃষ্টি হয়, তাহলে ঈশ্বর স্থান সৃষ্টি করেছিলেন কোন স্থানে দাঁড়িয়ে? সময় এবং শক্তিও কি ঈশ্বরের সৃষ্টি? সময় এবং শক্তি যদি ঈশ্বরের সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে ঈশ্বর সময় সৃষ্টি করেছিলেন কোন সময়ে? তিনি শক্তি সৃষ্টি করেছিলেন কোন শক্তি দিয়ে? সত্যিই কি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান? তিনি কি সবকিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন? ঈশ্বর কি এমন কিছু সৃষ্টি করতে পারবেন যা সৃষ্টি করে নিজেই সেটা নড়াচড়া করতে পারবেন না? প্রশ্নগুলো মাথায় ভাসে। আরজ আলী মাতুব্বরের সত্যের সন্ধান বইটা পড়ার পর থেকে এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার ধারণা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর একমাত্র বাবা মাহবুব শাহ দিতে পারবেন। মনেমনে চিন্তা করি, প্রশ্নগুলো বাবাকে করবো। অপেক্ষায় থাকি রবিবারের, রবিবার আসে। আয়শারে বলি—বাবা মাহবুব শাহ তোমারে আর আমারে দেখা করতে কইছে, চলো দেইখা আসি। আজকে তো অফিস এমনিতেই বন্ধ, বাসায় থাইকা কী করবা? আয়শা সোজা উত্তর দেয়—না, আমি যামু না। তোমার মন চাইলে তুমি যাও।
আয়শার না উত্তর শুনে আমার খুব রাগ হয়। পারি না মারতে, পারি না গালাগালি করতে। ওরে বোঝাতে পারি না যেখানে তোমার স্বামী এই আমি আছি, সেখানে তোমার যেতে সমস্যা কী? তুমি কি আমার উপর ভরসা পাও না? যে আমি তোমার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম, সেই তুমি এখন আমি যেখানে যেতে চাই সেখানে তোমার যেতে আপত্তি কেন? আমারে কি তোমার ভাল্লাগে না? সমস্যা কী? রাগে-ক্ষোভে আমার দুচোখ লাল হয়ে গেছে! ভেতরটা কাঁপছে। আয়শা আমার অবস্থা বুঝতে পারে। আমার হাত ধরে খাটে বসিয়ে ওর মাথা আমার বুকে রেখে বলে—আমি কোথাও যাব না শিমুল। আমার সবচেয়ে বড়ো গুরু তুমি। তুমি আমার ত্রাণকর্তা, জগৎ স্বামী। তুমিই আমারে জাহান্নাম থেকে জান্নাতে নিয়ে এসেছ। তোমারে থুইয়া আমার আর কোথাও যাওয়ার দরকার নাই। তুমি যেইখানে যাইবা সেইখানে আমি কেন যাইবো না এইটা তুমি ভাবতে পারো; কিন্তু, আমার মনে হয় পির মাহবুব নামের ওই লোকটার সংস্পর্শে গেলে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিণতি ভালো হবে না, আমার বুক থেকে সে তোমারে কাইড়া নিবে! আমার ধারণা ভুল হতে পারে, হোক, তবু আমি যাবো না। তুমি যদি অধিকার দেও, তাইলে তোমারেও আমি ওইখানে ওই পিরের কাছে যাইতে দিমু না। আর যদি কও, তোমার যাইতে মন চাইছে যাইবা, তাইলে যাও, আমি তোমার ব্যক্তিস্বাধীনতায় বাধা দিমু না।
আয়শারে না-নিয়ে বাবা মাহবুব শাহর উদ্দেশ্যে বের হই।
চৈত্রের দুপুর, চারদিকে কেমন যেন রুক্ষ-রুক্ষ গুমোট ভাব। প্রকৃতির শরীরে হৃদয় পোড়া গরম; তার নিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসছে ভাপসা ও নোনতা গন্ধ। খাঁ খাঁ রোদ্দুরে ঝকমক করছে রাস্তার ধূলিকণা। ফেটে চে․চির হয়ে গেছে ফসলের মাঠ। পাখিরা নিস্তব্ধ, ভুলে গেছে তাদের গান। রোদের প্রখরতা মাথায় নিয়েই ঢুকে পড়লাম বাবা রহমত শাহ ইয়ামেনি (রহ.)-এর মাজারে। সাধুরা গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে, কেউকেউ হাতপা মেলে বিশ্রাম নিচ্ছেন। লোকজনের আনাগোনা কম। আমি ট্যাপের পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। গলাটা শুকিয়ে গেছে, তৃষ্ণায়। ছুটে গেলাম বাদলের ঘরে। বাদল সিলিং ফ্যানের বাতাসে হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। ডাক দিলাম। বাদল ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে—ভাবিরে নিয়া আইছো? আমি বলি—না, তোর ভাবি আইতে চাইলো না। তার মন টানে না এইখানে আসতে, তাই আসি নাই। তয়, চল বাবার কাছে যাই।
বাদল আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। মনটা ভাড়। তারপর মৃদু হেসে বলে—দোস্ত, আমার তো এক জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল, ওইখানে যাইতেই হইবো। তুই এক কাজ কর, রুমে কিছুক্ষণ আরাম কর, আমি ওইখানে যামু আর আমু, ওইখান থেকে আইসা তারপর দুইজনে বাবার কাছে যামু নি। মনখারাপ করিস না, আমি তাড়াতাড়ি আইতেছি। আমি বললাম—ঠিক আছে, যা। তাড়াতাড়ি কইরা আসার চেষ্টা করিস।
প্রায় চল্লিশমিনিট পর একটা মধ্যবয়সী মহিলা এলো রুমে, হাতে ব্যাগ, বোরখা পরা। বলল—বাদল দাদা আছেন? আমি মহিলাটাকে বললাম—বাদল তো একজায়গায় গ্যাছে, আসতে দেরি অইবো। বাদলের কাছে আপনার কী দরকার? মহিলাটা বলে—দরকার আছে। আমি রুমে একটু বসতে পারি? মহিলাটাকে বসার অনুমতি দিলাম। ভাবলাম নিশ্চয়ই বাদলের সঙ্গে তার ভালো কোনও সম্পর্ক আছে। মহিলাটা রুমে ঢুকলো। ঢুকেই বোরখা খুলতে-খুলতে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো! আমি ভয় পেয়ে চিল্লিয়ে উঠলাম—এই ঘরের দরজা বন্ধ করেন কেন? আপনার উদ্দেশ্য কী? মহিলাটা খপ করে আমার মুখ চেপে ধরে! আমার গালে, কপালে, বুকে চুমু খেতে থাকে। তার ঠোঁটের লিপস্টিক আমার শার্টে লেপটে যায়। আমি তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করি। ধাক্কা দিয়ে মহিলাকে ফেলে দিই। সে দরজার সামনে দাঁড়ায়। শাড়ি-ব্লাউজ খুলতে-খুলতে আমাকে সংগমে আহ্বান করে। আমি তাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে ফেলি। দরজা খুলে বেরিয়ে পড়তে চাই। মহিলাটা আমাকে টেনে ধরে অভয় দিয়ে বলে—কোনও সমস্যা নাই। বাদল দাদার আসতে অনেক দেরি হইবো। মিথ্যে বলব না, মহিলাটির স্পর্শে আমার শিহরন জেগেছিল। ইচ্ছে হয়েছিল তার সঙ্গে আদিম খেলায় মেতে উঠি। কিন্তু, বাদল এসে দেখলে তারপর কী হবে? বাদলরে কী জবাব দেবো? মানইজ্জতের ভয়ে হেঁচকা টানে মহিলার কাছ থেকে ছুটে ঘরের দরজা খুলে ফেলি। একি পুলিশ! দরজার সামনে প্রায় চার- পাঁচজন পুলিশ! পুলিশ আমাকে ধরে ফেলে। হাতে হ্যান্ডকাপ লাগায়। এক পুলিশ বাকি পুলিশদের হুকুম করে—এই ঘর সার্চ করো। তারা ঘর সার্চ করে কয়েকটা মদের বোতল, কিছু গাঁজা, আর একটা পিস্তল পায়। আমার শার্টের কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে উঠাতে-উঠাতে এক পুলিশ বলে—শালা অস্ত্র ব্যবসা করো? দিনেদুপুরে ঘরে মহিলা আইনা ধর্ষণ করা হচ্ছিল? চল, থানায় চল। আমি পুলিশদের বোঝাতে চাই—স্যার আমি এসবের কিচ্ছু জানি না। ওই মহিলা…। আমারে কোনও কথাই বলার সুযোগ দিলো না পুলিশ। আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বাদলরে খুঁজি, বাদল নাই। পুলিশে কালো কাপড় দিয়ে আমার চোখ বেঁধে ফেলল। পুলিশ ওই মহিলাকে কোনও জিজ্ঞাসাবাদ করল না। কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে রাখা অবস্থায় আমাকে গাড়িতে উঠানো হলো। এরপর গাড়ি কোনদিকে ছুটলো বুঝতে পারলাম না।
জেলখানা
চোখের বাঁধন খুলে দেবার পর নিজেকে ছোট্ট একটা আলো-আঁধারি ঘরে আবি®‥ার করলাম। দেয়ালের পলেস্তারা খসে গেছে। তারহীন একটা ফ্যান ঝুলে আছে মাথার উপরে। ভাপসা গরম। প্রস্রাবের তীব্র বেগ পেয়েছে। ঘরের ভেতরেই দরজা খোলা টয়লেট। প্রস্রাব-পায়খানায় টয়লেট ভরতি! ঘৃণায় শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। পানির ট্যাপে পানি নাই। ঘরের চারপাশে নিবিড়ভাবে তাকিয়ে দেখি একটা লোক ঘরের পশ্চিম কোণে দেয়ালে হেলান দিয়ে অথর্বের মতো বসে আছে। তার নিশ্বাস ওঠানামার শব্দ শোনা যায়। কাছে গিয়ে দেখি তার কপাল বেয়ে রক্ত ঝরছে…। কোনও কথা বলার সাহস পাই না। আমি হিসাব মেলাতে পারছি না পুলিশ আমাকে কেন ধরে আনলেন? কেন ওই মহিলাটা আমার সঙ্গে এমন করল? ওই মহিলাটা আমার সঙ্গে জোর করে সংগম করতে চেয়েছিল ঠিক আছে, কিন্তু, পুলিশ এই খবর পেল কীভাবে? বাদলের ঘরে মদ গাঁজা থাকলে থাকতে পারে; কিন্তু, পিস্তল এলো কি করে? এখন আমার কী হবে? বাদল কি সংবাদ পেয়ে এসে এখান থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে? বাদল কী আয়শারে খবরটা জানাবে? আয়শা এই খবর পেলে কিভাবে নিবে ঘটনাটাকে? এখান থেকে মুক্তি না পেলে আয়শার কী অবস্থা হবে? চিন্তায় বুক ফেটে কান্না আসে। অথর্বের মতো বসে থাকা লোকটা চিল্লিয়ে ওঠে—ওই চোদানির পোলারা, আমারে ছাইড়া দে; নইলে কুত্তার মতো কইরা যখন পেটামু তখন আব্বা-আব্বা কইরা কাইন্ধাও মুক্তি পাইবি না। দৌড়ে দুইজন পুলিশ আসে। লোহার দরজা খুলে পুলিশ দুজন ভেতরে প্রবেশ করে অথর্বের মতো বসে থাকা লোকটার তলপেটে লাথি মেরে বলে—ওই শুয়োরের বাচ্চা, ক তুই কে? লোকটা বলে—শোন, তোর এই থানার দারোগা জাকিররে জিগা আমি কে। দুইজন পুলিশের মধ্য থেকে একজন আরেকজনকে বলে—এই জাকির ভাইরে ডাক দ্যান তো। জাকির নামের দারোগা আসে। ভেতরে এসে রক্তাক্ত লোকটাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বলে—আরে তুলা ভাই! আপনে এইখানে কেন? আপনার শরীরে রক্ত কেন? লোকটা কোনও কথা বলে না; রাগে ফোঁসফোঁস করে। জাকির দারোগা পুলিশ দুইজনকে উদ্দেশ্য করে বলে—এইবার ঠেলা সামলাইয়েন। কারে ধইরা আনছেন, চেনেন এরে? উনারে ধইরা আনছেন জায়গামতো খবরটা গেলে আপনাগো ভয়াবহ পরিস্থিতি কইরা ছাইড়া দিবো, বুঝলেন? পুলিশ দুইজনসহ জাকির দারোগা চলে গেল। তাদের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম তুলা অনেক ক্ষমতাবান মানুষ। জাকির দারোগার এলাকার লোক। এখানে কোনও কাজে এসে থানার সামনে ক্লাবে বসে মদ পান করতে ছিলেন। অতিরিক্ত মদ্যপানে বেহুঁশ হয়ে আশেপাশের লোকদের গালাগালি করছিলেন আর ভাঙচুর করছিলেন। পুলিশ সেখানে উপস্থিত হলে তুলা পুলিশদের সঙ্গেও মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন। এতে পুলিশ ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে মারতে-মারতে থানায় ধরে এনেছে। একটু পরেই আবারও জাকির দারোগা এলেন। পানির বোতল, অনেক খাবার আর সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে বললেন—তুলা ভাই, চিন্তা কইরেন না, ওসি স্যাররে কইয়া আপনেরে ছাইড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করতেছি। স্যার এখন থানায় নাই। দারোগা চলে গেলেন। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা, তুলা নামের লোকটা আমাকে ডেকে বলে—ভাই, আপনার সমস্যা কী? আপনেরে কেন ধইরা আনছে? আমি ঘটনা খুলে বলি। আমার কথা শুনে লোকটা চুপচাপ থাকে। কিছুক্ষণ পর খাবারের প্যাকেট আমাকে দিয়ে বলেন—এইগুলা আপনে খান। আমি অসম্মতি জানাই। আমার কোনও ক্ষুধা নাই। এই পরিবেশে দম বন্ধ হয়ে আসছে। লোকটা একটার-পর-একটা সিগারেট টেনেই যাচ্ছে…। তার কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নিয়ে ক্রমাগত টানতে থাকি। এখন আমার কী হবে এই ভাবনার শেষ নাই। রাত প্রায় একটার দিকে জাকির দারোগা তুলা নামের লোকটাকে বের করে নিয়ে গেল। আমি একা বসে রইলাম বন্ধ করে।
সকাল দশটার দিকে দড়ি দিয়ে দুইহাত পিছুমোড়া করে বেঁধে থানা থেকে বের করে গাড়িতে উঠিয়ে আমাকে পুলিশকোর্টে আনা হলো। এখানেও নোংরা পচা গন্ধ। অনেক লোকের ছড়াছড়ি। কেউ বিড়ি টানছে, কেউ বিড়িতে গাঁজা ভরে টানছে, তিন-চারজন একসঙ্গে বসে ইয়াবা টানছে! কারও আত্মীয়স্বজনরা এসে খাবারদাবার দিয়ে যাচ্ছে। কেউকেউ জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলছে। বাহির থেকে যাদের আত্মীয় বা পরিবারের লোকজন এসেছে পুলিশকে টাকা দিয়ে বন্দি ব্যক্তির সঙ্গে তারা কথা বলতেছে। পুলিশকে টাকা দিলেই কথা বলা যায়। কিন্তু, আমার কোনও আপনজন আসে না। দূর থেকে দুপায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে ভর করে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, দেখি আমার আপনজন কেউ আসে কি-না, কেউ আসে না। জানালার কাছে গেলে পুলিশ ধমক দিয়ে ওঠে। ঘরটার ভিতরে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ আর নিকৃষ্ট মানুষ বলে মনে হয়। আমার গন্তব্য কোথায় জানা নাই। ঈশ্বরের কাছে মনে মনে বলি—প্রভু গো, একটিবারের জন্য হলেও আমাকে আয়শার কাছে নিয়ে যাও। এই বিপদ থেকে আমাকে মুক্তি দাও মাবুদ।
সন্ধ্যার দিকে গাড়ি ভরতি করে আসামিদের সঙ্গে আমাকে জেলখানায় নিয়ে এলো। জেলখানার ভেতরে লাইন ধরিয়ে আমাদের বসানো হলো। গণনা করে আমাদের আমদানি নামক একটা ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। গোরুছাগল যেভাবে থাকে, সেভাবেই রাত পার করলাম। সকালে আবার লাইন ধরে বসানো হলো। গণনা শেষে আমাদের আমদানি ওয়ার্ড থেকে বের করল। অনেক নাপিত আসামিদের চুল কেটে দিচ্ছে। একজন নাপিত আমাকে হেঁচকা টান দিয়ে তার সামনে বসিয়ে পাঁচমিনিটে মাথার চুল কেটে দিলো! জেলখানার নিয়মনীতি আমার জানা নেই, যে-যা বলে আর যে-যেভাবে চলে, আমি সেভাবেই তাদেরকে অনুসরণ অনুকরণ করি। দুপুরের আগেই আমাকে তিনতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় পাঠানো হলো। এই জেলখানায় তিনতলা বিশিষ্ট কয়েকটা বিল্ডিং; বিল্ডিং-গুলোর নাম পদ্মা মেঘনা যমুনা সুরমা। প্রতিটা বিল্ডিংয়ের একেক তলায় একেকটা ওয়ার্ড। প্রত্যেকটা ওয়ার্ডের দরজার সামনে কয়েকটি করে বাংলা অক্ষর লেখা। যার নামের প্রথম অক্ষর যে ওয়ার্ডে লেখা থাকবে, তাকে সেই ওয়ার্ডে থাকতে হবে। আমার নামের প্রথম অক্ষর শ, আমার জায়গা হলো পদ্মা ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডে ঢোকার সঙ্গে- সঙ্গে ডোরাকাটা সাদা পোশাক পরিহিত একজন লোক এসে বলল—ভাইজান, এই ফ্লোরের দায়িত্বে আমি আছি। অনেক টাকা দিয়া ডাইকা নিছি। তো, এইখানে যদি ভালোভাবে থাকতে চান, তাইলে খরচাপাতি দিতে হইবো। ভালো দেইখা একটা বেড দিতেছি, বাড়িতে থেকে লোকজন এলে টাকা নিয়া আমারে দিয়েন। বুঝতে পারলাম হাটবাজার সরকারের কাছ থেকে টাকা দিয়ে ইজারা নিয়ে দোকানদারদের কাছ থেকে যেভাবে চাঁদা তোলে, এখানেও সেই ব্যবসা চলছে। আমি কোনও টাকা দিতে পারবো না। আমার কোনও লোকজন নাই। আমার অবস্থার কথা লোকটাকে খুলে বলি। লোকটা সোজা টয়লেটের কাছে আমাকে তিনটা কম্বল দিয়ে বলে—টাকা দিতে না পারলে এইখানেই থাকতে হবে। আমি বাড়তি কথা বলি না। একটা কম্বল বিছিয়ে আরেকটা দিয়ে বালিশ বানাই, আরেকটা রাখি রাতে গায়ে দেওয়ার জন্য। কম্বলগুলোর সঙ্গে ছোঁয়া লাগলেই গা হাতপা চুলকায়। ধুলোবালিতে কম্বলের অবস্থা ভয়াবহ।
এখানে প্রতিদিন সকালে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে লাইন ধরে বসে থাকতে হয়। এখানকার পুলিশদের বলা হয় মিয়া সাহেব। মিয়া সাহেবরা আসেন, গণনা করেন, তারপর গেইট খুলে দেন। তারপর যার যার মতো হাতমুখ ধুয়ে নেয়, ব্রাশ করে, গোসল করে এবং টয়লেটে যায়। অতঃপর লাইনে দাঁড়িয়ে রুটি নিতে হয়। সকালবিকাল গণনা হয়। প্রতিবার সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করতে হয়। বাকি সময় গল্পগুজব, ইবাদত-বন্দেগি আর এইসেই করে কেটে যায়। নেতা পর্যায়ের দামী আসামিরা সকালবিকাল ব্যায়াম করেন, পেপার-টেপার পড়েন, টেলিভিশন দেখেন, কেউকেউ তাস খেলতে বসেন। যাদের টাকাপয়সার অভাব নাই তারা টাকা দিয়ে জেলারকে ম্যানেজ করে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেন। কেউকেউ ল্যাপটপও ব্যবহার করেন। টাকাওয়ালাদের কাছে জেলখানা আর বাসা একই কথা। এরা টাকা দিয়ে বাহির থেকে নারী এনে জেলখানাতেই নারী সম্ভোগে লিপ্ত হতে পারেন। টাকাওয়ালারা এখানে নিজেরাই রান্না করে খেতে পারেন। রাইস কুকার, কারি কুকার, হটপট ও ফ্ল্যাক্স ব্যবহার করেন। চা বানিয়ে খেতে পারেন। জেলখানাতে যারা টাকার দাপট দেখাতে পারেন, তারা গণনার সময়ে লাইন ধরে বসেন না। গরিবের জন্য লাইব্রেরি আছে, বই পড়া যায়। অফলাইনে কম্পিউটার শেখা যায়। সিপারা পড়া শেখা যায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির আসামিরা ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দেয়। কে কোন মামলায় জেলখানায় এসেছে তা নিয়ে গল্প হয়। রাজনীতির আলোচনা হয়। কেউ কেউ চুপচাপ কান্নাকাটি করে। আমিও চুপচাপ কান্নাকাটি করাদের দলে। আমার একটাই চিন্তা—আয়শা কোন হালে আছে? আমার চিন্তায় আয়শা নিশ্চয়ই খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিছে। আল্লাহরে তো কোনওদিন দেখিনি, তবু আল্লাহরে মহান মনে করে তার কুদরতি পায়ে সিজদাহ দিয়ে বলি—মাওলা গো, জীবনে তো কোনও পাপ করি নাই, তুমি আমারে মুক্তি দাও খোদা। এই জাহান্নাম আর সহ্য হয় না মাবুদ। কোন পাপের শাস্তি তুমি আমাকে দিচ্ছ? আল্লাহ গো, তুমি যদি সত্যিই থেকে থাকো, তাহলে আমারে রক্ষা করো।
আমার রক্ষা হয় না।
দিন যায় দিন আসে। কান্নাকাটি করতে-করতে এখন আর চোখে জল আসে না। জেলখানায় বসে ইসলামি বিশ্বকোষ বই পড়ি। একজনের কাছ থেকে সহি নুরানি নামাজ শিক্ষার বই নিয়ে আসি। নামাজ পড়া শিখি। বোমা হামলা মামলার আসামি আমাদের ওয়ার্ডে ইমামতি করেন। তিনি আমাকে কোরআন তেলায়ত শেখান। জেলখানা আমার মতে শ্রেষ্ঠ উপাসনালয়। এখানে চোর-ডাকাত, খুনি- সন্ত্রাসী ও লুচ্চা-বদমাশ সবাই পরহেজগার! বেশিরভাগ সময় আমি একাকী থাকার চেষ্টা করি। ইমাম সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। এককথা দুইকথা করে তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয়। তিনি আমার সম্পর্কে জানতে চান, আমিও তার সম্পর্কে জানতে চাই। আমার জীবনের ঘটনা তাকে খুলে বলি। ইমাম সাহেবের নাম মেহেদি। তিনি আল্লাহর দল সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি সমগ্র বিশ্বে ইসলাম কায়েমের স্বপ্ন দেখেন। তার মতে—হাদিস শরিফে জাল হাদিসে ভইরা গ্যাছে, সুতরাং আমাগো পরিপূর্ণভাবে কোরানরে অনুসরণ করতে হবে। কোরান নিজের ভাষায় পড়তে হবে। নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত নয়, তিন ওয়াক্ত। তিনি পৃথিবীতে কীভাবে ইসলাম কায়েম করতে চান সে ব্যপারে কথা বলেন। তার দলের সদস্য সংখ্যা অনেক। তার অবর্তমানে সংগঠনের কাজ থেমে নাই। বড়ো বড়ো মামলার আসামি হলেও তিনি বেরিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তার লোক দিয়ে আমাকে জেলখানা থেকে বের করবেন সে আশ্বাসও দেন।
একমাস আঠারো দিন পর বাদল আমারে দেখতে আসে। বাদল আমারে দেখতে এসেছে খবর শুনে লাফিয়ে উঠি। দৌড়ে জেলগেট যাই। হ্যা, বাদল এসেছে। বাদলরে বলি—তুই এতদিন পরে দেখতে আইলি? তোর ভাবির খবর কী? তোর ভাবি এখন কোথায় আছে? তোর ভাবি জানে না আমি জেলখানায়?
বাদল বলে—তুই চিন্তা করিস না। তুই ধরা পড়ার পরের দিনই ভাবিরে আমি নিয়া আইছি। ভাবিরে সব ঘটনা খুইলা কইছি। ভাবি এখন বাবা মাহবুব শাহর বাড়িতে আছে। বাবা তারে মেয়ের মতো কইরা বাড়িতে থাকতে দিছে। ভাবি তোরে দেখতে আইতে চাইছিল; বাবায় আইতে দেয় নাই। বাবা বলল সমস্যা আছে। আমাগো দরবার আর বাবা মাহবুব শাহর মানইজ্জত ধূলিসাৎ করতে ওই মহিলা সেদিন মদ গাঁজা আর পিস্তল নিয়া আমার রুমে আইছিল। আইয়া আমারে পায় নাই, তুই ফাঁইসা গেছো। চিন্তা করিস না। বাবা ভালো দেইখা একটা উকিল ধরছে, তোরে জামিনে বাইর করবো। অস্ত্র মামলা, মাদক মামলা, নারী নির্যাতন মামলা, একসঙ্গে তিনটা বড়ো মামলা হইছে; এজন্য জামিনে বাইর করতে দেরি হইতেছে। টাকা যতো লাগে বাবা দিবো, তুই ঘাবড়ে যাইস না। এখন থেকে তোরে মাঝেমইধ্যে দেখতে আসমু, তোর কি লাগবো ক, আমি বাইরে থেকে পাঠাইয়া দিতেছি।
বাদলরে বলি—আমার কিচ্ছু লাগবো না। তুই আমারে এইখান থেকে বাইর কইরা নিয়া যা ভাই। আমি এইখানে মইরা যাইতেছি। তোর ভাবিরে ছাড়া বাঁচুম না।
বাদল চলে গেল। বাহির থেকে মুড়ি, চানাচুর, কাচা মরিচ, পেঁয়াজ, সরিষার তেল, সাবান আর সিগারেট পাঠিয়েছে। আশেপাশের কয়েদিরা আমারে ঘিরে ধরে। সবাইরে সবকিছু বিলিয়ে দিতে হয়। আমার ওয়ার্ডের রাইটার এসে খপ করে হাত থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে যায়। এ যেন জোর যার মুলুক তার। আমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমার মাথায় একটাই চিন্তা—কবে বের হব এখান থেকে?
আমার পাশের বেডের একজনের সঙ্গে কথা হয়। সে বলে—ভাই, আমার কয়েকদিনের মধ্যেই জামিন হইবো, আপনার বাড়ির ফোন নাম্বার দেন, আমি বাইর হইয়া কল কইরা আপনার বাবা-মায়েরে জানামুনি আপনে এইখানে আছেন। লোকটারে বাড়ির ফোন নাম্বার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি।
প্রায় তিনমাস পর; ‘আয়শা অসুস্থ, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, স্বামী শিমুল ছাড়া তার আর কেউ নাই’ হসপিটালের এমন একটা সার্টিফিকেট কোর্টে দাখিল করে বাবা মাহবুব শাহ আমাকে জামিনে বের করেন। জামিনে বের হয়ে দ্রুত আয়শার কাছে যাই। হসপিটালের বেডে অচেতন অবস্থায় আয়শা পড়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে আয়শারে জড়িয়ে ধরি, চিৎকার করে ডাকাডাকি করি, আয়শা ওঠো; আয়শা ওঠে না। নার্সকে জিজ্ঞেস করি—আয়শার কী হইছে? নার্স বলে—পেটের বাচ্চা পড়ে গেছে, অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণে তার এই দশা। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি, আপনি শান্ত হোন। নার্স চলে গেল। আয়শা নিথর। নিশ্বাস ওঠানামা করছে। আয়শারে জাগানোর চেষ্টা করি। অনেকক্ষণ পর আয়শা চোখ মেলে তাকায়। আমার চোখে চোখ রেখে ফ্যালফ্যাল করে আহত পাখির মতো তাকিয়ে থাকে। চোখের কোণে একবিন্দু জল চিকচিক করে। অনেক কষ্টে আমার হাতটা ধরে বলে—নিজের প্রতি খেয়াল রাইখো। আর একসঙ্গে চলা হইল না। আমার লাশ নিয়া তুমি কোনও বিপদে পইড়ো না। কবর দিও না। বাঁইচা থাকতে তো মানুষের উপকারে আসতে পারলাম না, মরার পরে যেন উপকারে আসতে পারি সেই ব্যবস্থা কইরো। আমার লাশটারে কোনও মেডিক্যাল কলেজে দান কইরা দিও। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্ররা আমার লাশ কাটাছেঁড়া কইরা ডাক্তারি জ্ঞান অর্জন করতে পারবো। আমার দেহের অনেক কিছু মানুষের কাজে লাগবো। মরার পরে আপাতত এই চাওয়াটুকু পূরণ কইরো। আর মাহবুব শাহ লোকটা…। আয়শা আর কোনও কথা বলে না! দুচোখের পাতা বন্ধ করে দেয়। আমি আয়শারে আবার ডাকি—আয়শা, কথা কও। মাহবুব শাহ লোকটার কথা কী বলতে চাইছিলা? তুমি মরবা না আয়শা। আমি তোমারে বাঁচাইয়া রাখমু। কথা কও আয়শা। আয়শা নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ! ডাক্তারকে ডাকি—ডাক্তার…। ডাক্তার আসে। ডাক্তার আয়শার শরীরে হাত দিয়ে বলে—মাফ করবেন, তাকে বাঁচানো গেল না। অর্ধেক গলাকাটা মুরগির মতো আমি লাফিয়ে উঠি। আমার পৃথিবীর আকাশ ভেঙেচুরে খানখান হয়ে যাচ্ছে। চতুর্দিকে অন্ধকার! আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমার চিৎকারে চারপাশ প্রকম্পিত হচ্ছে। আমি সন্তানহারা মায়ের মতো দাপাদাপি করি।
কাঁদতে-কাঁদতে একসময় বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পর মাহবুব শাহ পেছন থেকে আমার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন—বাপ, এভাবে ভেঙে পইড়ো না। হায়াত-মউতের মালিক আল্লাহ। মালিকের ডাক যখন আসে, তখন চলে যেতে হয়। একদিন আমাদেরও যেতে হবে। বিপদে ধৈর্য ধরো, শান্ত হও। তোমার ভালোবাসার টানেই হয়তো এই কয়টা দিন মেয়েটা বাঁইচা আছিল। পেটের বাচ্চা পইড়া যাওয়ার সময়ই ওর মইরা যাওয়ার কথা। বেচারি সারাক্ষণ তোমার নাম ধইরা ডাকতো। এখন আর দেরি কইরা লাভ নাই। মরার আগে বেচারি তোমারে যা কইছে, আমি সব শুনছি। তুমি ওর মৃতদেহ মেডিক্যালে দান কইরা দেও, আমি ব্যবস্থা কইরা দিতেছি। ইসলামে মৃত ব্যক্তির দেহ দান করা হারাম। আমি ইসলামের একজন খলিফা হইয়াও এই হারাম কাজ করার সহযোগিতা করতেছি। এতে আমার পাপ যতো হয় হোক, তবু তোমার ভালোবাসার মানুষটার শেষ ইচ্ছাপূরণ হোক। আমি মাহবুব শাহর সঙ্গে কোনও কথা বললাম না।
এক দেড় ঘণ্টা পর একজন লোক এলেন, তার হাতে একটা কাগজ। আমি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে সুস্থভাবে আয়শার মৃত দেহ দান করতেছি এরকম কিছু একটা লেখা কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন—স্বাক্ষর করুন। আমি স্বাক্ষর করলাম। সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করলেন মাহবুব শাহ। আয়শার লাশ হস্তান্তর শেষে মাহবুব শাহ বললেন—বাপ, এখন তুমি কোথায় যাইতে চাও? আমি কোনও উত্তর দিই না। এতিমের মতো মাহবুব শাহর দিকে চেয়ে থাকি। মাহবুব শাহ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন—চলো, আমার সঙ্গে চলো।
পির মাহবুব আমাকে তার গাড়িতে উঠাইলেন। গাড়িটা তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো…।
গেস্ট হাউজ
এখন আমি বাবা মাহবুব শাহর বাড়িতেই থাকি। তার অন্যান্য বাসাবাড়ি ও প্রতিষ্ঠানের গ্যাস বিল, কারেন্ট বিল ও পানি বিল আমিই দিয়ে আসি। বাসার বাজারটাজার করি। বাবার টুকটাক ফয়-ফরমাইশ শুনি। বলা চলে আমি বাবা মাহবুব চাঁনের একজন বিশ্বস্ত বডিগার্ড, ম্যানেজার ও কর্মচারী। আমাকে যে সব সময়ে কাজের ভেতরেই ডুবে থাকতে হয়, তা নয়। অনেকটা সময় পাই চুপচাপ বসে থাকার। আয়শার স্মৃতি মনে করলে চোখে জল আসে। হৃদয়টা কেঁপে ওঠে। ওর স্মৃতি ভুলে থাকার জন্য মাঝেমধ্যে বাদলের সঙ্গে আড্ডা দিই। মদ-গাঁজা সেবন করে নেশায় ঝিম মেরে বসে থাকি। বাবা মাহবুব শাহ প্রতিদিন বিকেলে খানকাতে বসেন, সেখানে চুপচাপ সহযোগিতা করি। আমার চুপচাপ থাকাকে বাবা মাহবুব শাহ খুব পছন্দ করেন। তার যেকোনও কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাই। এটাকে বাবা মাহবুব শাহ ভক্তি শ্রদ্ধা হিসেবে নেন। আমার শ্রদ্ধা ও ভক্তি দেখে বাবা বললেন—এখন থেকে তুই সব সময়ে আমার পাশে থাকবি। রাতে গুরুগৃহে যখন সাধুসঙ্গ হয়, তখনও আমার পাশে থাকবি। আমার ভালোমন্দ দেখাশোনা করবি, পারবি না? আমি মাথা নেড়ে বলি—জি বাজান, আপনার দয়া।
একদিন ফেসবুকে নিলয় কুমার নামক আইডি থেকে একটা পোস্ট আসে। পোস্ট-টা ভাইরাল হয়। পোস্টে লেখা—
নবি মুহাম্মদ কী সত্যিই সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ছিলেন? পঁচিশ বছর বয়সী নবি মুহাম্মদ পাঁচচল্লিশ বছরের খাদিজাকে বিয়ে করেছিলেন, কথা ঠিক কি-না? যে লোক মায়ের বয়সী বুড়ি মহিলাকে বিয়ে করতে পারেন, তিনি ভালো লোক হোন কীভাবে? আপনারা কী কেউ আপনার নয়-দশ বছরের মেয়েকে ষাট বছরের বুইড়ার সঙ্গে বিয়ে দিবেন? দিবেন না। যে বুইড়া এমন বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করবে, তাকে নিশ্চয়ই খারাপ বলবেন, তাই না? তাহলে নবি মুহাম্মদ বাচ্চা আয়শারে বিয়ে করার পরেও কীভাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব হতে পারেন? বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে কেউ সেক্স করলে অবশ্য আমরা তাকে খারাপ মানুষ বলবো। অথচ, নবি মুহাম্মদ দাসী মারিয়া কিবতিয়ার সঙ্গে সেক্স করেছিলেন! তিনি যুদ্ধবন্দিনী নারীদের গনিমতের মাল হিসেবে ভোগ করতেন! পালকপুত্র নিজের পুত্রের চেয়ে কম না। পালকপুত্রের বউকে অবশ্যই নিজের পুত্রবধূ হিসেবে দেখতে হবে। অথচ, নবি মুহাম্মদ পুত্রবধূ জয়নবকে বিয়ে করেছিলেন! যে নারী তাকে বাবা ডেকে ছিলেন, সেই নারীকে নবি মুহাম্মদের বিয়ে করতে হবে কেন? কী দরকার ছিল? একজন ভালো মানুষের এতগুলো বউ থাকবে কেন? কোনও ব্যক্তির ঘরে কয়েকটা বউ থাকার পরেও কী তার কাছে আপনার মেয়ে অথবা বোনকে বিয়ে দিবেন? দিবেন না। লোকটা খারাপ এজন্যই দিবেন না। তো, নবি মুহাম্মদ এতোগুলা বিয়ে করার পরেও তাকে আপনি কেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব মনে করেন? কথায় আছে সঙ্গদোষে লোহা ভাসে, সৎসঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ; অর্থাৎ, যে যে-পরিবেশে থাকে, সে সে-পরিবেশেই বেড়ে ওঠে। নবি মুহাম্মদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সময় দিয়েছিলেন হজরত আলী। আলীর সঙ্গে মুহাম্মদের কী সম্পর্ক ছিল আসুন জেনে নিই—
আলী ছিলেন মুহাম্মদের চাচাতো ভাই। নবি মুহাম্মদ আলীর সঙ্গে নিজের মেয়ে ফাতিমাকে বিয়ে দেন। ফাতিমা মারা যাওয়ার পরে মুহাম্মদের বড়ো বউ খাদিজার ঘরের আরেক মেয়ে জইনবের কন্যা উমামাকে, অর্থাৎ নবি মুহাম্মদের নাতনিকে বিয়ে করেন আলী। সুতরাং; আলী একদিকে নবিজির চাচাতো ভাই, আরেকদিকে মেয়ের জামাই এবং অন্যদিকে নাতিন জামাই। একইসঙ্গে চাচাতো ভাই, মেয়ের জামাই, নাতনি জামাই, সম্পর্কটা কেমন জঘন্য হয়ে গেল না? আবার নবি মুহাম্মদ বিয়ে করেছিলেন ওমরের মেয়ে হাফসাকে। ওমর বিয়ে করেছিলেন হজরত আলীর মেয়ে উম্মে কুলসুমকে। সেইদিক থেকে ওমর হলেন নবি মুহাম্মদের শ্বশুর এবং নাতিন জামাই। ওইদিকে একাধারে চাচাতো ভাই, মেয়ের জামাই ও নাতিন জামাই আলী হলেন নবি মুহাম্মদের শ্বশুরের শ্বশুর! কেমনে কী? সম্পর্ক এতো ত্যানাপ্যাঁচানো কেন? ঘটনা এখানেই শেষ না। নবি মুহাম্মদের মৃত্যুর পর আবু বকরের স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইসকে বিয়ে করেন আলী। আবু বকর ছিলেন নবি মুহাম্মদের শ্বশুর; অর্থাৎ, নবি মুহাম্মদের শাশুড়িকে বিয়ে করেন নবি মুহাম্মদের একাধারে চাচাতো ভাই, মেয়ের জামাই, নাতিন জামাই এবং শ্বশুরের শ্বশুর হজরত আলী। চাচাতো ভাই নিজের শাশুড়িকে বিয়ে করলে সে সম্পর্কের নাম দেবো কী? অথবা আমার মেয়ের জামাই আমার শ্বাশুড়িকে বিয়ে করলে তাকে কি সম্বোধন করে কথা বলবো? যাদের জীবনদর্শনে বিয়ে নামক প্রথায় কোনও বাছবিচার নেই, তারা আমাদের আদর্শ হবেন কীভাবে?
পোস্ট-টা বাবা মাহবুব চান পড়ে রেগে আগুন হয়ে গেলেন। হজরত মুহাম্মদ (স.)-কে নিয়ে লেখার কারণে তিনি যতটা না কষ্ট পেয়েছেন, তারচে বেশি কষ্ট পেয়েছেন হজরত আলী (রা.)-কে নিয়ে লেখার কারণে। হজরত আলী (রা.)-কে তিনি হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর চেয়েও বেশি ভালো বাসেন। নবিজির মৃত্যুর পর ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে হজরত আবু বকর, ওমর, ওসমান, তালহা, জুবায়ের, সাদ বিন আবি আক্কাস ও মাবিয়া হজরত আলীর সঙ্গে বেইমানি করেছিলেন এজন্য আলী বাদে ওইসব সাহাবিদের বাবা মাহবুব শাহ চরমভাবে ঘৃণা করেন। ওই সাহাবিদের নিয়ে কেউ কিছু বললে বাবা মাহবুব শাহর কোনওকিছু যায়-আসে না। কিন্তু মাওলা আলী (আ.)-কে নিয়ে কিচ্ছু বলা যাবে না। কারণ; মাওলা আলী ও নবিজি হলেন একই নূরের দুই টুকরা। পৃথিবীতে আলী-ই একমাত্র ব্যক্তি যিনি পবিত্র কাবাঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। আলী হলেন জীবন্ত কাবা। আলী শব্দের অর্থই হচ্ছে সর্বোচ্চ। আলী মহান। আলী আল্লাহর জাহেরি সুরত!
মহান আলীর অবমাননা সইতে না পেরে বাবা মাহবুব শাহ ফেসবুকে পোস্ট করলেন—এই নাস্তিকের বাচ্চাটাকে (জীবিত অথবা মৃত) কেউ ধরে দিতে পারলে তাকে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। এরপর তিনি দেশের সকল ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমাবেশের ডাক দিলেন। রোজ শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে শহরে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। নাস্তিক্যবাদ বিরোধী মিছিল বেরুলো। মিছিল থেকে ভেসে এলো—নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর, আল কোরআনের আলো ঘরে-ঘরে জ্বালো, ইসলামের শত্রুরা হুঁশিয়ার সাবধান। নারায়ে রিসালাত, ইয়া রাসুলুল্লাহ। পথসভায় বাবা মাহবুব শাহ বাঘের মতো গর্জন দিয়ে মাইকে ঘোষণা করলেন—এই দেশে যারা ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলবে, তাদের জিব্বা টান দিয়া ধইরা কাইটা ফালানো হবে। এই দেশে ইসলামের শত্রুদের কোনও জায়গা নাই। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন—ধর্ম অবমাননাকারীদের জন্য ফাঁসির আইন করতে হবে। যদি না করা হয়, তাহলে আগামী নির্বাচনে আপনারা সংসদে যাইতে পারবেন না। গদি থেকে আপনাদের টেনেহিঁচড়ে নামানো হবে।
এই সমাবেশের পরেই বুঝতে পারলাম বাবা মাহবুব শাহর ক্ষমতা কতদূর! সমাবেশের পরেরদিন অনেক উপহার সামগ্রী নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য বাবা মাহবুবের বাড়িতে হাজির! সংসদ সদস্য বাবার সঙ্গে এমনভাবে কথা বললেন যেন বাবা মাহবুব শাহর জুতা বহন করার যোগ্যতাও ওই সাংসদের নাই!
এরপর দেখতাম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনও আসতেন। দেশের বিভিন্ন নেতা পর্যায়ের লোকজন আসতেন। তারা টাকার বস্তা নিয়ে আসতেন। বিভিন্ন তদবিরের জন্য আসতেন। বাবা ইচ্ছে করলে ফোন করে যে-কারও পদমর্যাদা বাড়িয়ে দিতে পারেন। দেশের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বাবাকে সম্মান করেন। নির্বাচনের সময় গুরুবাদী সংগঠনগুলোর নেতাদের নিয়ে আলোচনা করে বাবা সিদ্ধান্ত নেন কোন দলকে তারা এবার নির্বাচিত করবেন। মসজিদ মাদ্রাসা কেন্দ্রিক হুজুর শ্রেণিদের বাবা তেমন ভালো চোখে দেখেন না। কারণ, এরা গুরুবাদ মানে না। তাই এই হুজুরদের যে সরকার ভালো চোখে দেখেন, সে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন বাবা মাহবুব শাহ। অবশ্য হুজুরদের মধ্যেও একদল আছেন যারা বায়াত হওয়াকে সাপোর্ট করেন। এই হুজুররা শরিয়তকে বেশি প্রাধান্য দেন বলে বাবা মাহবুব তাদেরকে পছন্দ না করলেও গুরুবাদকে সাপোর্ট করার জন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। বাবা মাহবুব যা-ই করুক, কোনও হুজুর তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না। কেউ যদি দুঃসাহস করে বাবার বিরুদ্ধে কিছু বলেন, তাহলে দেখা যায় কোনও-না-কোনো ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে সেই হুজুর জেলে চলে গেছেন!
বাবা মাহবুব কোনও বিড়ি-সিগারেট টানেন না। তিনি জর্দা দিয়ে সব সময়ে পান চিবান। ঘরের ভেতরে চুপিচুপি মদ পান করেন। মদের দুর্গন্ধ দূর করতে তিনি জর্দা দিয়ে পান চিবিয়ে খান। বাবার ঘরে মাজারের খাদেম শামসু চাচা আগে মদ সরবরাহ করতেন, এখন আমি করি। গুরুগৃহে সাধুসঙ্গ করার আগে ইচ্ছেমতো মদ পান করেন। এতে তার শরীরে চোখেমুখে একটা ভাব আসে। সেই ভাব দেখে বাবার কাছে আসা সাধারণ লোকজন মনে করেন বাবাজি সব সময়ে আল্লাহর ধ্যানে নিবিষ্ট থাকেন। তিনি যে মদপান করেন এটা সাধারণ মানুষ কোনওভাবেই বুঝতে পারেন না। তিনি সবসময় একা মদ পান করেন তা-ও না। তার সমতূল্য গুরু পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে বসে মদ পান করেন। তার বাড়িতে যদি অন্য কোনও দরবারের পির আসেন, তাহলে লাল গালিচায় মোড়ানো হয় বাড়িতে ঢোকার রাস্তা। মিউজিক বাতিতে ভরে যায় ঘরবাড়ি। খাসি বকরি মুরগি যে কত জবাই করা হয় তার হিসাব নাই। মন্ত্রীরা এসেও মাঝেমধ্যে বাবার সঙ্গে আড্ডা দেন।
বেশকিছু দিন আগে জাতীয় ক্সদনিক পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল-গুলোতে বেশ ফলাও করে একটা খবর প্রচার হলো—পির মাহবুব শাহ অ‣বধভাবে সরকারি জমি বেদখল করে খানকা নির্মাণ করেছেন। সাধারণ মানুষ মনে করেছিল এইবার পির মাহবুবের খানকা ভেঙে ফেলা হবে। বাবা মাহবুব শাহ এই সংবাদে একটুও বিচলিত হননি। খানকার জায়গায় খানকা ঠিকই রয়ে গেল। বরং, বাবা মাহবুব শাহ আইনের আওতায় আনার হুমকি দিলেন যারা এই খবর প্রচার করেছে, তাদেরকে। কথায়-কথায় সেদিন জানতে পারলাম খানকার সামনে যে খোলা মাঠ রয়েছে, ওটা বাবার এক ভক্তের। ভক্তকে উচ্চমূল্যে জমি বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলে জমিটা নিজের নামেই দলিল করে নিয়েছেন; অথচ, ওই ভক্তকে জমি বাবদ একটি টাকাও দেন নাই। ওই ভুক্তভোগী ভক্ত থানায় বাবার নামে মামলা করেছিলেন। থানায় মামলা করে এতে ওই লোকটার হিতে বিপরীত হয়েছিল। মানি লোকের মান মারার জন্য মানহানি মামলায় লোকটাকে জেল খাটতে হয়েছিল! একের পর এক অদৃশ্য মামলায় জেল খাটতে-খাটতে লোকটা একসময় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। এরকম আরও অনেক অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। কারও জমি পছন্দ হলে বা দরকার হলে জমির মালিককে প্রথমে বিক্রি করার কথা বলেন। জমির মালিক তার জমি বিক্রি করতে রাজি হলে ভালো কথা। তার কাছ থেকে কমমূল্যে অথবা বিনামূল্যে জমিটা নিয়ে নিবেন। আর যদি জমি বিক্রি করতে রাজি না হোন, তাহলে তাকে ভে․তিক বা আজগুবি মামলায় থানা, কোর্ট ও জেলখানায় দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। মামলার ঘানি টানতে-টানতে লোকটা নিঃস্ব হয়ে একসময়ে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। হজরত মুহাম্মদ (স.) ও সাহাবিদের নিয়ে একটা ফেসবুক পোস্ট-কে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন হলো, এই আন্দোলনের আগাগোড়া স্বয়ং মাহবুব শাহ! ওই ফেসবুক আইডি তার নিজের ফেইক আইডি। ওই আইডি থেকে পোস্ট মাহবুব শাহ নিজেই করেছিলেন! এর উদ্দেশ্য হলো নিলয় কুমারের বাপদাদার ভিটেমাটি কিনে নেওয়া। মাজারের পাশেই কয়েকটা হিন্দু পরিবারের বসবাস। একসময়ে পুরো এলাকাটা হিন্দুদের ছিল। হিন্দুরা তাদের জায়গাজমি বিক্রি করে ভারতে চলে গেছে। এখনও কয়েকঘর হিন্দু মাটির টানে এদেশে রয়ে গেছে। হিন্দুদের সর্বশেষ জায়গাটুকুতে মাহবুব হুজুরের চোখ পড়েছে। যেভাবেই হোক জায়গাটা চাই। তাই ধর্ম অবমাননা নামক ফাঁদে ফেলার চেষ্টা। আন্দোলনের মুখে নিলয় কুমার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলো। কিছুদিন পরেই জামিনে বাইর হলো নিলয়। প্রথম চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মাহবুব শাহ দ্বিতীয় বুদ্ধি বের করলেন। গভীর রাতে আমাকে চুপিচুপি বললেন—তুই মসজিদের ভিতরে গণেশের মূর্তি রাইখা আইবি আর আসার সময় পায়খানা কইরা আইবি। সকালে এইটা জানাজানি হইলে তওহিদি জনতাকে সঙ্গে কইরা নিয়া যাইয়া হিন্দুগো বাড়িঘর জ্বালাইয়া দিমু। তারপর দেখি ওরা এইখানে কেমনে থাকে। এই কথা শোনার সঙ্গে-সঙ্গে ভয়ে আমার হাতপা কাঁপতে থাকে! আমার কণ্ঠ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোয় না। আমার অবস্থা দেখে মাহবুব শাহ বলেন—থাক, তোর এই কাজ করতে হইবো না। দেখি কী করা যায়।
বাবা মাহবুব শাহ যে ভণ্ড, এটা নিশ্চিত হলাম। ভণ্ড হয় হোক, এই লোকটার সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে, এটাও একটা কপাল। যার জুতা বহন করার যোগ্যতা আমার নাই, সেই লোকের পাশে বসে কথা বলি, একসঙ্গে ঘুমাই, এরচেয়ে সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? এই লোকটার সঙ্গ পরিত্যাগ করা যাবে না। লোকটার শেষ দেখা দরকার। আরও গভীরে প্রবেশ করা দরকার। তাছাড়া আমার নামে একসঙ্গে তিনটা বড়ো বড়ো মামলা। বাবা মাহবুব চাঁনকে ছেড়ে চলে গেলে আমার মামলার ঘানি টানবে কে? মামলাগুলো আগে শেষ হওয়া দরকার। বাড়িতেই-বা যাবো কোন মুখ নিয়ে? বন্ধু বাবুলের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে আয়শার মা, মানে আমার শাশুড়ি আম্মার কথা। আমার শাশুড়ি আম্মা যদি খোঁজ নিয়ে এসে আমার কাছে আয়শার কথা জানতে চান, তাহলে আমি তাকে কী উত্তর দেবো? বাবুলের খালার সঙ্গেও দেখা করা যাবে না। দেখা হলে তিনি জানতে চাইবেন আমি কোথায় কেমন আছি। খালা বাড়িতে সব বলে দিতে পারে। তারচে বরং এখানেই থেকে যাওয়া ভালো। এখানেই আমার মৃত্যু হয় হোক।
আজ রোজ বৃহস্পতিবার। প্রতি বৃহস্পতিবারের মতো আজকেও মাজারে বাউল গানের আসর জমেছে। মাজার ও খানকা ঘিরে আজকে অন্যরকম আয়োজন। রংবেরঙের লাইট জ্বলছে। মাজার থেকে একটু দূরে অবস্থিত গেস্ট হাউজটাকে সাজানো হয়েছে। গেস্ট হাউজে কোনও অতিথিকে আজ রুম ভাড়া দেওয়া হয়নি। কারণ, আজকে বাবা মাহবুব চানের বেশকিছু মেহমান আসবেন, তারা এখানে আড্ডা দিবেন। রাত এগারোটার দিকে বাবা মাহবুব শাহ গেস্ট হাউজে ঢুকলেন, সঙ্গে আমি। কিছুক্ষণ পরেই গেস্ট হাউজের সামনে দামি-দামি কিছু গাড়ি হাজির হলো। গাড়ি থেকে নেমে ভদ্রলোকেরা সোজা গেস্ট হাউজে ঢুকলেন। একজন জাতীয় ক্সদনিক পত্রিকার সম্পাদক, একজন গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, একজন শিল্পপতি, আরেকজন মাজার কমিটির সভাপতি, মোট চারজন। বাবা মাহবুব শাহ তাদেরকে স্বাগতম জানালেন। তাদেরকে যে রুমে বসানো হলো, সে রুমে বিভিন্ন প্রকার ফলমূল আর মদের বোতলের অভাব নাই। মনে হচ্ছে আমাকে দেখে আগত অতিথিরা বিরক্ত হচ্ছেন। বাবাজি বিষয়টি বুঝতে পেরে তাদেরকে বললেন—সমস্যা নাই। একটু পরেই বাবাজি কাউকে ফোন করে বললেন—তুমি কী এসেছ? অপরপ্রান্ত থেকে একটা নারীকণ্ঠে ভেসে আসে—হ, আমি মাজারের সামনে দাঁড়াইয়া রইছি। বাবাজি বললেন—ঠিক আছে, আমি শিমুলরে পাঠাইয়া দিতেছি, ওর সঙ্গে আইসা পড়। বাবাজি আমাকে বললেন—যা, মাজারের সামনে যা। একজন মহিলা দাঁড়াইয়া রইছে, সোজা এইখানে নিয়া আইবি। আমি মাজারের সামনে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি বোরখা-হিজাবে ঢাকা একটা নারী। তার চোখ দুটো শুধু দেখা যায়। তার চোখে চোখ পড়তেই মনে হলো তাকে কোথাও দেখেছি হয়তো। তার চোখের ভাষা বলে—হ, এই বোরখা হিজাব খুললেই তুমি আমারে চিনতে পারবা। মহিলাটার সঙ্গে কোনও কথা বললাম না। তার শরীর থেকে সুঘ্রাণ বেরিয়ে আসছে। তার হাতের তালু, আঙুল আর পায়ের নখগুলো বলে দেয় তিনি আজ অপূর্ব সাজে সেজেছেন। মহিলাটা আমার পিছনে-পিছনে আসছে। গেস্ট হাউজে ঢুকলাম। রুমে ঢুকতে-না-ঢুকতেই সম্পাদক সাহেব মহিলাটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন। বাবা মাহবুব মুচকি হেসে আমাকে বললেন—শিমুল, গেলাসে মদ ঢাইলা দে। আর ফলমূলগুলা সামনে আইনা দে। আমি মদ পরিবেশন করতে লাগলাম। রুমে হালকা মিউজিক চলছে। অতিথিরা মদ কয়েক ঢোক গিলতে-না-গিলতেই মিউজিকের সঙ্গে মাথা দুলাতে লাগলেন। মদের গ্লাস মহিলাটার হাতে দিয়ে শিল্পপতি সাহেব বললেন—তুমি একটু পান করো সুন্দরী, খাও, পান করো, আমাদের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠো। এসো, তোমার বোরখা-হিজাব খুলতে-খুলতে করি প্রেমের তর্জমা। মহিলাটা বাবা মাহবুব চাঁনের কাছে গেলেন। কানে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বললেন। অতঃপর বাবা মাহবুব শাহ আমাকে বললেন—শিমুল, তুই বাইরে একটু অপেক্ষা কর, কোথাও যাইস না। আমি বাইরে চলে আসলাম। বুঝতে আর বাকি রইল না রুমে এখন কী হবে। কিন্তু; আমার সন্দেহ, এই মহিলাটাকে কি আমি চিনি? আমার সামনে মহিলাটার উলঙ্গ হতে সমস্যাটা কী? মহিলাটা ফিসফিসিয়ে কী বলল?
প্রায় তিনঘণ্টা পরে দরজা খুলল। মহিলাটি বেরিয়ে এলেন। বাবাজি নারীটিকে দেখিয়ে বললেন—উনাকে সোজা মাজারের সামনে রাইখা আইবি। কোথাও দেরি করিস না। মহিলাটি ক্লান্ত। এলোমেলো। তাকে মাজারের সামনে রেখে দ্রুত চলে আসি, গেস্ট হাউজে। আমি আসার পর ভদ্রলোকেরা চলে গেলেন। অতঃপর বাবা মাহবুব শাহ আর আমি বাসায় চলে আসি। দারোয়ান গেইট খুলে দেন। গুরুমা তার ঘরে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেছেন। বাবা মাহবুব শাহ গুরুমাকে ডাকাডাকি করলেন না। সোজা চলে গেলেন গুরুগৃহে। অতঃপর আমরা দুজন একই বিছানায় ঘুমিয়ে গেলাম।
কামতত্ত্ব
বাবা মাহবুব শাহ সর্ব রোগের চিকিৎসক। টাইফয়েড, কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়, হুপিং কাশি, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ক্যানসার, ফুসকুড়ি, হাম, জলবসন্ত, অ্যালার্জি, একজিমা বা চুলকানিসহ যেকোনো রোগের তিনি চিকিৎসা করেন। তার চিকিৎসায় কোনও ওষুধপত্র লাগে না। তিনি রোগীর কী সমস্যা শোনার পর দুচোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে শ্লোক পড়েন এবং রোগীর শরীরে ফুঁ দিয়ে দেন। যেমন কারও হাতপা ভেঙে গেলে ভাঙা স্থানে থুতু দিয়ে ঢলতে-ঢলতে বলেন—
ভাঙা হুয়া হাড় ঝাড়ি কোষ ঝাড়ি
কোষ বনের বাঘ পানির কুম্ভির
জিয়া-রে-জিয়া,
যেখানকার হাড় সেখানে লাগ গিয়া।
এধরনের মন্ত্র উচ্চারণ করে বাবা মাহবুব শাহ রোগীদের চিকিৎসা করেন। কখনও কোরআনের আয়াত পড়ে ফুঁ মারেন। এতে অনেক রোগীর উপশম হয়। যেসব রোগী ভালো হয় না তারা বারবার আসেন। বারবার আসার পরেও ভালো না হলে বাবা বলেন—আল্লাহ তোমারে এই রোগ দিয়ে ইমানের পরীক্ষা নিচ্ছেন। নিশ্চয়ই এর বিনিময়ে আল্লাহ তোমার জন্য উত্তম কিছু রেখেছেন। অবশ্য বাবা মাহবুব শাহর পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে এইসব ঝাড়ফুঁক দিয়ে চিকিৎসা করেন না; সোজা নিয়ে যান হসপিটালে। বাবা মাহবুব শাহর নিজেরও হসপিটালের ব্যবসা আছে। আমার মাথায় ধরে না এই লোক এতোকিছু কেমনে সামলান? প্রায় প্রতিদিন খানকাতে বসে ওয়াজ নসিহত করেন, বায়াত করেন, বায়াত শেষে রোগীদের চিকিৎসা করেন। রোগীরা এবং বায়াত হওয়ার জন্যে আসা লোকজনেরা বাবার পায়ের কাছে রাখা ঝুড়িতে টাকা ফেলে যান, টাকাগুলোর হিসেব রাখেন। হসপিটালের ব্যবসা, গেস্ট হাউজের ব্যবসা, গোরুর খামার, মাজারের দানবাক্সের টাকা, মাজারের পিতলের কলসিতে জমানো সোনাদানা, এর সবকিছুর হিসাব তার মাথায় আছে। মাজার কমিটি ও বাজার কমিটির সভাপতি, হসপিটালের দায়িত্বে থাকা বাবা মাহবুবের মেজো ছেলে কুদরত এবং গোরুর খামারের দায়িত্বে থাকা বড়ো ছেলে মনিরের কাছ থেকে হিসাব বুঝে নেন। বিভিন্ন তদবিরের জন্যে বিভিন্ন লোক টাকার বস্তা নিয়ে আসেন। সে তদবির কোরআনের আয়াত পড়ে করেন না; ফোনের মাধ্যমে করেন। ফোনের মাধ্যমে অনেকের সরকারি চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন, এ থেকেও মোটা অংকের টাকা পান। তার টাকার শেষ নাই। তার কাছে টাকা আসার অনেক পথ। সমগ্র দেশে তার তরিকার অনেক শাখা প্রশাখা আছে। তিনি অনেক ভক্তকে খেলাফত দিয়েছেন। খেলাফত প্রাপ্ত ভক্তরাও খানকা খুলে বসেছেন। সেখান থেকেও আসে চাঁদা। বাবা ইয়ামেনি শাহ (রহ.)-এর মাজার কেন্দ্রিক প্রতি বছর বাৎসরিক উরস শরিফ পালন করা হয়। বাৎসরিক উরশে কোটি কোটি টাকা ওঠে! আমি চিন্তা করি—এই লোক এতো টাকা দিয়ে কী করবে? তার এতো টাকার নেশা কেন? যতদূর জানতে পেরেছি—তিনি একটা এরিয়ার মধ্যে কয়েকশো বিঘা জমি কিনতে চান। সেখানে নিজের নামে একটা উপশহর গড়ে তুলতে চান। সেই শহরে শুধু তার অনুসারীরাই বাস করতে পারবে। অনুসারীদের জন্য তিনি রচনা করবেন নতুন ঐশী বিধান। মৃত্যুর আগে তিনি তার এই স্বপ্ন পূরণ করতে চান। তার স্বপ্নের শহরটা হবে দেশের মধ্যে আরেকটা দেশ, পৃথিবীর মাঝে আরেকটা পৃথিবী। এই শহরের অধিবাসীরা শুধু বাবা মাহবুবের বাতলে দেওয়া পথ অনুসরণ করবে। তার শহরে নিজস্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকবে, থাকবে গোয়েন্দা সংস্থার লোকও! বাবা মাহবুবের বুদ্ধির শেষ নাই। তিনি তার মাজার পরিচালনা করেন গুন্ডা বাহিনী দিয়ে, অথচ কেউ বুঝতে পারেন না। তার বেশকিছু গোয়েন্দাও আছেন। তার ভণ্ডামি আর অপকর্মের ধরন দেখে আমার মনে হয় নিশ্চয়ই এই লোকটা আল্লাহর আশীর্বাদ প্রাপ্ত। আল্লাহর নামে কেউ যদি ভণ্ডামি করে, তাহলে তাকে ঠেকাবে কে? বাবা মাহবুব শাহ সব আল্লাহর নামেই করেন। আল্লাহর রহমত বাবা মাহবুব চাঁনের উপরে না-থাকলে তার কাছে মানুষেরা টাকাপয়সা নিয়ে শুধু-শুধু কেন আসবে? তাকে কেন পূজা করবে?
বৈশাখের প্রথম দিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে ঘোষণা এলো আগামী দুই- এক দিনের ভেতরেই ঘুর্ণিঝড় হবে। ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। বাবার কয়েকজন ভক্তবৃন্দ বললেন—বাজান, এই ঘূর্ণিঝড়টা থামাইয়া দেওয়া যায় না? বাবা বললেন—এই ব্যাপারে আমি আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছি। আল্লাহ চান এই ঘূর্ণিঝড়টা হোক। বিষয়টা নিয়ে আমি আল্লাহর সঙ্গে বাড়াবাড়ি করি নাই। শুধু এইটুকু বলেছি আমার কোনও ভক্তের যেন ক্ষতি না হয়। তোমরা যারা আমার ভক্ত, তারা বিপদের সময়ে শুধু আমার নামটা জপে যাবে। আমার চেহারাটা মনে রাখবে। কোনও ভক্ত গহিন সাগরের মাঝেও ডুবে গিয়ে যদি আমাকে স্মরণ করে বলে—বাবা মাহবুব চান আমারে রক্ষা করো, তাহলে আমি নিজে তাকে হাত ধরে রক্ষা করবো। ভক্তরা সমস্বরে চিল্লিয়ে বললেন—জয়গুরু, মাওলা মাহবুব (আ.)- এর জয়।
দূরদূরান্তের মানুষ বাবা মাহবুবকে পির মাহবুব হিসেবে চিনেন। তার অনুসারীদের মধ্যে শ্রেণি বিভাগ আছে। কেউ বলেন বাবা মাহবুব শাহ, কেউ বাবা মাহবুব চান, কেউ দয়াল মাহবুব, গুরুজি, কেউ বাবাজি এবং কেউ সাঁইজি সম্বোধন করে কথা বলেন। বাবা মাহবুব একেক ভক্তের কাছে একেক রূপে নিজেকে উপস্থাপন করেন। তার ভক্তদের মধ্যে যারা সাঁইজি সম্বোধন করে কথা বলেন, তারা মারফতের একদম চ‚ড়ান্ত পর্যায়ের লোক। প্রথম পর্যায়ের ভক্তদের তিনি সরল-সোজা উপদেশ দিয়ে থাকেন। তাদের বলেন—নামাজ পড়বা, রোজা রাখবা, সাধ্যমতো জাকাত-ফেতরা দিবা, হজ করার সাধ্য থাকলে হজ করবা; প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, স্ত্রীসন্তান ও বাবামায়ের হক আদায় করবা। হালাল-হারাম বাইছা খাইবা, হালাল উপার্জন করবা, মিথ্যা বলবা না, চুরি করবা না, কোনও প্রকার নেশা করবা না, এবং অন্যের নারীদের দিকে কুদৃষ্টি দিবা না। বাবা মাহবুব তার প্রথম পর্যায়ের ভক্তদের শরিয়তের বিধান মেনে চলতে বলেন। শরিয়তের বিধান ধর্মজগতে সাধারণ পাবলিকের জন্য। মারফত সবার জন্য না। মারফতের শিক্ষা একদম গোপনে হয়। এই বিদ্যা কোনওভাবেই প্রকাশ করা যাবে না। এজন্য বাবা মাহবুব খুব সতর্কতার সঙ্গে ভক্ত বাছাই করে তারপর তাদের মারফতি ইলম দান করেন। বিশ্বস্ত হয়ে না-ওঠার আগে বাবা কাউকে মারফতি জলসায় আমন্ত্রণ করেন না।
প্রায় প্রতিদিন দিবাগত রাতের ন্যায় আজকেও গুরুগৃহে মারফতি আলোচনা হবে, সাধুসঙ্গ হবে। আজকে রাতে আমন্ত্রিত অতিথিদের সংখ্যা নারীপুরুষ মিলে প্রায় দশজন। সাধুসঙ্গে এর আগে এতো মানুষ হয়নি। সাধুসঙ্গে আজ আমিও আছি। বাবা মাহবুবের পাশেই বসেছি। আলোচনার শুরতেই একজন বাবা মাহবুবকে প্রশ্ন করলেন—আচ্ছা সাঁইজি, সাধনায় নারী লাগে কেন? সাঁইজি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রেখে তারপর একটা গানের কলি বললেন—
নারী আদ্যশক্তি মহামায়া
সাধন-ভজনের মূল,
যত সাধুগুরু নবি-রাসুল
নারী ছাড়া পায়নি খুঁজে কূল।
গানের কলি শেষ হতে-না-হতেই আরেকজন প্রশ্ন করলেন—সাঁইজি, বীর্য বা রতি সাধন কি? সাঁইজি বলতে লাগলেন—আমরা যেকোনও কাজের শুরুতেই তো বিসমিল্লাহ কই, কই না? এই বিসমিল্লাহর হকিকতটাই তো বীজমে আল্লাহ, অর্থাৎ, বীর্যতেই আল্লাহ! আল্লাহ বলেছেন—তোমরা মানুষ হত্যা কইরো না; মানুষ হত্যা মহাপাপ। যে একটা মানুষ হত্যা করল, সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকেই হত্যা করল। তো; একটা মানুষের জন্ম কোথা থেকে? পুরুষের বীর্যের মধ্যে থাকা লক্ষ-লক্ষ শুক্রাণুর মধ্য থেকে একটা শুক্রাণু থেকে। এই বীর্য কমবেশি আমরা সবাই নষ্ট করেছি, ঠিক কি-না? অতএব, আমরা কত মানুষ যে হত্যা করেছি, তার কি কোনও হিসাব আছে? নাই। এই মহাপাপ থেকে রক্ষা পেতেই আমাদের বীর্য বা রতি সাধন করতে হবে। এই সাধনকেই দেহ সাধন, নুর সাধন, কাম সাধন বা নারী সাধন বলে।
কামকে দমন নয় নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কাম নিয়ন্ত্রণ মানে তুমি নদীতে সাঁতার কাটবা কিন্তু কাপড়চোপড় ভিজবে না। তোমাকে পানি ছাড়া ধান চাষ করতে হবে, তবেই তুমি সাধক। সহজ কথায়, তুমি নারীর সঙ্গে সংগম করবা, কিন্তু রতিপাত হবে না। এজন্যই গুরু-গোসাঁইরা বলেন—টলে জীব অটলে শিব। যার টলে না সেই অটল। অটল থাকার সাধনা করতে হয়।
তৃতীয়জন প্রশ্ন করলেন—আমাদের ইসলাম ধর্মে আল্লাহরে পাওয়ার রাস্তা কি তাহলে যৌনতা কেন্দ্রিক?
সাঁইজি বললেন—
শুধু আমাগো ইসলাম ধর্মেই আল্লাহরে পাওয়ার রাস্তা যৌনতা কেন্দ্রিক হইব কেন? পৃথিবীর প্রতিটা ধর্মেই তাদের ঈশ্বররে পাওয়ার রাস্তা যৌনতা কেন্দ্রিক। গ্রীকপুরাণ অনুযায়ী সীমানা ও বিনিময়ের দেবতা হার্মিস এর প্রতীক লিঙ্গ এবং উর্বরতার দেবতা প্রিয়াপাসের প্রতীক লিঙ্গ। রোমানীয়রা দেবতা মুতুনাস তুতুনাসের লিঙ্গমূর্তি পুজো করতো এবং লিঙ্গের আদলে মাদুলি বানিয়ে গলায় ঝুলাইয়া রাখতো। ভারতে শিবের লিঙ্গমূর্তি, উলঙ্গ দেবী কালীকে এবং কামাখ্যা দেবীর যোনিমূর্তিকে পুজো করা হয়। ভারতের খাজুরাহো মন্দিরে সংগমরত মূর্তিতে ভরপুর। মিশরীয়পুরাণের জীবন-মৃত্যু ও উর্বরতার দেবতা ওসাইরিসের প্রতীক লিঙ্গ। স্কান্ডিনেভিয়ার নর্সপুরাণের প্রেমের দেবতা ফ্রেয়ারের প্রতীক লিঙ্গ। আধুনিক জাপানে লিঙ্গপূজা হয় এবং প্রতি বছর জাপানিরা লিঙ্গের মেলা বসায়। বুলগেরিয়া
ও সার্বিয়ার কুকারী জাতির স্প্রিং অনুষ্ঠানে কাঠের লিঙ্গ প্রদর্শিত হয়। আমেরিকার প্রাক কলম্বিয় কোকাপল্লি ও ইতজাম্না দেবতার প্রতীক লিঙ্গ। কানাডার সমকামী পুরুষেরা কুইবেক মন্ট্রিয়েলে ডি. এফ. ক্যাসিডির প্রতিষ্ঠিত সেন্ট প্রিয়াপাস ধর্মের অনুসারীরা মনে করে বীর্য পবিত্র এবং এতে ঈশ্বরের ক্ষমতা আছে; তাই তারা বীর্য পান করে। এই যে হিন্দুদের ভগবান, এই ভগবান শব্দটাই মূলত যৌনতা কেন্দ্রিক। ভগ অর্থ যোনি, আর বান অর্থ লিঙ্গ। সীতারাম চরিত্র দুইটাও যৌনতা কেন্দ্রিক। সীতা অর্থ লাঙ্গলের ফলার দাগ, আর রাম অর্থ কর্ষণ করা; যা রূপকে যৌনতাকে বোঝায়। সুতরাং, কোথায় যৌনতা নাই? ইহুদিপুরাণের লিলিথের কাহিনিটাও যৌনতা কেন্দ্রিক।
আমি হুটহাট করে বলে ফেললাম—
কিন্তু; আমাগো ইসলাম ধর্মে তো আর লিঙ্গ কিংবা যোনির পূজা করা হয় না, তাইলে আমাগো ধর্মে আল্লাহরে পাইতে যৌনতা কেন্দ্রিক সাধনা কেন করতে হইবো? সাঁইজি মুচকি হেসে বললেন—
আরে গাধা, আমাগো ইসলাম ধর্ম পুরাটাই তো যৌনতা কেন্দ্রিক। এই যে বেহেশত থেকে আদম-হাওয়ারে পৃথিবীতে ফেলে দেওয়ার কাহিনি, এইটা পুরাটাই যৌনতার গল্প। আদম-হাওয়ারে বেহেশত থেকে কেন বাইর কইরা দিছিল? গন্ধম খাওয়ার জন্য। আদম-হাওয়ারে সৃষ্টি কইরা বেহেশতের মইধ্যে রাইখা আল্লাহ কইছিল—তোমরা যা ইচ্ছা তাই করো, শুধু গন্ধম খাইও না। কিন্তু, শয়তানে ধোঁকা দিয়া গন্ধম খাওয়াইলো। এরপর আল্লাহ রাগ হইয়া আদমরে শ্রীলঙ্কায় আর হাওয়ারে সৌদি আরবে পাঠাইলো। তাইলে, গন্ধমটা কী? গন্ধম অর্থ গম, যব বা পায়রা। কোরানে আছে গন্ধম খাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আদম হাওয়া উলঙ্গ হইয়া যায়। হাদিসে আছে গন্ধমে কামড় দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে গন্ধম থেকে রক্ত বাইর হয় এবং সেই থেকে নারী জাতির ঋতুস্রাব শুরু হইছে। তাইলে ক, গন্ধম খাইলে কাপড় খুইলা যাইবো কেন? খাওয়ার সময় গন্ধম থেকে রক্তই বা বাইর হইবো কেন? গন্ধম খাওয়ার সঙ্গে ঋতুস্রাবের সম্পর্ক কী? এই যে আমরা কত গম ভাজা খাই, গমের আটার রুটি খাই, আটা দিয়ে আরও কত কী বানাইয়া খাই, আমাগো কি এইসব খাওয়ার সময় কাপড়চোপড় খুইলা গ্যাছে কোনওদিন? এইসব খাইতে গিয়া কী খাওন থেকে কোনওদিন রক্ত বাইর হইতে দেখছো? দেখ নাই। এইটা আসলে কিছুই না; এইটা যৌনতার গল্প। শরিয়তের দৃষ্টিতে এইটা রূপকে বোঝানো হইছে। এই রূপক বুঝতে চাইলেই তো মারফতের শিক্ষা অর্জন করতে হয়। তাছাড়া খেয়াল কইরা দেখবি এই গন্ধম বা গম দেখতেও নারী জাতির লজ্জাস্থানের মতো!
সাঁইজির কথাগুলো সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। আমরা তাকে আর কোনও প্রশ্ন করছিলাম না। তিনি আবারও বলতে লাগলেন—
এই যে কাবাঘরে কোটি-কোটি মানুষ হজ করবার যায়, এরা কী জানে কাবা জিনিসটা কী? কাবা শব্দের উৎপত্তি কিউব শব্দ থেকে। কিউব শব্দের উৎস কাআব শব্দ থেকে। কাআব অর্থ কুমারী। সেমিটিক শব্দ ছনধ এর সঙ্গে কাবা শব্দের মিল আছে। ছনধ অর্থ নারী-অঙ্গ। হজ করা মানে নারীদেহ পরিভ্রমণ করা। ভালো কইরা খেয়াল কইরা দেখবি কাবার আসওয়াদ নামক পাথরটাও নারীগো যোনীর মতো। মসজিদের মিনার, গম্বুজ আর মেহরাব কিসের প্রতীক জানিস? মিনার লিঙ্গের প্রতীক, গম্বুজ স্তনের প্রতীক, মেহরাব জরায়ুর প্রতীক আর দরজা যোনির প্রতীক। ইমাম সাব মসজিদের ভেতর মেহরাবের সামনে যে সিজদাহ দেয়, এইটা আসলে আধ্যাত্মিকভাবে নারীর জরায়ুতে দেয়। এই জরায়ুতেই জলবৎ আল্লাহর বসবাস। শিয়া মুসলিমরা মক্কার পাথরের কাবাঘরকে কেন্দ্র কইরা যে হজ হয় সেইটা তারা মানে না, এইটা জানিস? শিয়াদের হজ হইল গিয়া তাওয়াফ আল নিসা, অর্থাৎ নারীদেহ পরিভ্রমণ।
নীরবতা ভেঙে আমি বললাম—
জলবৎ আল্লাহ আবার কেমন আল্লাহ?
কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সাঁইজি মাঝেমধ্যে দুচোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকেন। মনে হয় তার কাছে তখন কোনও ইলহাম বা ওহি আসতেছে। দুচোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে সাঁইজি বললেন—
অমাবস্যায় চান্দের বাজার
শুকনো গাঙে আসে জোয়ার
বাসনা হয় দেখিতে যার
সুযোগ বুঝে দাও সাঁতার
ঠিক রাখিও গতি…
পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য সেই মতি।
সাঁইজির ছন্দের মানে বুঝলাম না। অমাবস্যায় চান্দের বাজার আবার শুকনো গাঙে জোয়ার আসা কি কীসের ইঙ্গিত কিচ্ছু বুঝলাম না। বাকিরাও বুঝলো কি-না সন্দেহ। ছন্দের মানে যে আমি বুঝিনি সাঁইজিকে বলেই ফেললাম। সাঁইজি বললেন—
এইটার মানে হইল নারীদের প্রতি মাসে একবার কইরা ঋতুস্রাব হয়। এই ঋতুস্রাবকেই আধ্যাত্মিক বিদ্যায় অমাবস্যা বলে। নারীদেহে ঋতুস্রাব হইয়া আবার যেদিন বন্ধ হয়, সেইদিন নারীদেহে চরম কামোত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এইসময়টাকে বলে চান্দের বাজার এবং মরা গাঙে জোয়ার আসা। এইসময় সাধকপুরুষ ওই নারীর সঙ্গে সংগমে লিপ্ত হলে, প্রায় চল্লিশ মিনিট একটানা সংগম করার পর নারীটির জরায়ু থেকে কামনদী তথা যোনিপথ দিয়ে নারিকেলের পানির মতো প্রায় এক পোয়া জল বাইর হয়, এই জলকেই সাঁই, সুধা বা অমৃত বলে। এই জল পান করলে দেহে কোনও রোগব্যাধি হয় না, দেহ থাকে সতেজ এবং চেহারায় নুর ভাসে। এই জলকে কাওসারের পানি বলে। আধ্যাত্মিক বিদ্যায় এটাই জমজম কূপের পানি। সন্তান জন্ম দেওয়ার উদ্দেশ্যে কোনও পুরুষ যখন নারীর যোনিপথে বীর্যপাত করে, তখন সেই বীর্য থেকে একটা শুক্রাণু নারীর জরায়ু মুখে থাকা ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হয়ে একটা রক্তপিণ্ড ধারণ করে এবং সেই রক্তপিণ্ড থেকে পুরো একটা মানুষে রূপ দেয় নারিকেলের পানির মতো সাদা এই পানি। এইজন্য এই পানিরে বলা হয় জলবৎ আল্লাহ, সাঁই বা সৃষ্টিকর্তা। এই পানি বাইর করতে হলে কাম সাধন জানতে হয়, সাধক হতে হয়। সাধক এমনি-এমনিতেই হওয়া যায় না; সাধক হতে একজন গুরু লাগে। গুরু তার ভক্তরে আবে-হায়াতের পানি পান করিয়ে দিবেন এবং কামের কলাকে․শল শিখিয়ে দিবেন, তবেই ভক্ত সাধক হয়ে উঠবে ও এই পানি আহরণ করার ক্ষমতা অর্জন করবে।
আমি বললাম—সাঁইজি, আমি সাধক হতে চাই।
কামসাধন
শ্রাবণের মাঝামাঝি। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। শহরজুড়ে রিমঝিম বৃষ্টির কান্না। কখন যে সকাল থেকে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে, বুঝতে পারিনি। বিদঘুটে অন্ধকার, সম্ভবত আজ অমাবস্যা। রাস্তাঘাট স্যাঁতস্যাঁতে। আজ কোথাও কেউ বেরোয়নি। রাতের খাবার খাওয়ার সময় হয়েছে। গুরুমা ডাকলেন—এই তোমরা আসো রাতের সেবা নিয়ে যাও। সেবা নেওয়া মানে খাবার খাওয়া। এটা গুরুবাদী ভাষা। সাঁইজি আর আমি গেলাম সেবা নিতে। গুরুমা নিজহাতে আমাদের সেবা দিলেন। বৃষ্টির কারণে সাধুরা আজ আসতে পারেনি। তাই আজকে সাধুসঙ্গ হবে না। ভাবলাম, সাঁইজি আজ রাতে হয়তো গুরুমার কাছেই থাকবেন। সেবা গ্রহণ করে আমি গুরুগৃহে আসতে ছিলাম। সাঁইজি বললেন—যাইতে হইবো না, এখানেই ঘুমা। কোনওকিছু চিন্তা না-করে রাজি হয়ে গেলাম।
ঘণ্টাখানেক গালগল্প করে বিছানায় শুতে গেলাম। গুরুমা বামপাশে, সাঁইজি মাঝখানে এবং আমি ডানপাশে খাটে শুয়ে আছি। কেউ ঘুমাইনি। সাঁইজিকে বললাম—আচ্ছা সাঁইজি, প্রেমভাজা আর লালসাধন কি জিনিস? সাঁইজি সোজা উত্তর দিলেন—খাইলেই বুঝতে পারবি। গুরুমা হিহিহিহি করে হেসে দিয়ে বললেন—সাঁইজির সঙ্গে এতদিন ধইরা থাকিস এখনও প্রেমভাজা আর লালসাধন কী জানিস না? আমি কই শোন, প্রেমভাজা হইল পানির সঙ্গে নিজের গুরুর রতি আটা-ময়দায় মাখাইয়া রুটি ভাইজা খাওয়া; আর লালসাধন হইল নারীর ঋতুস্রাব অনেক প্রকার সবজি, লবণমরিচ ও চাল ডালের সঙ্গে মিশাইয়া খিচুড়ি রাইন্ধা শিন্নি কইরা খাওয়া। এইবার বুঝলি? এইসব সাধনে কী উপকার ভাববার আগেই এগুলো মানুষ খেতে পারে না-কি ভেবেই ঘৃণায় শরীরটা রিরি করে উঠল! আমি গুরুমার কথায় কোনও প্রতিক্রিয়া জানালাম না। সাঁইজি মুচকি হেসে বললেন—তুই না সাধক হইতে চাস? সাধনা করবি? আমি সাধনা করবো এজন্য একজন নারীর দরকার। সাঁইজি বলেছিলেন সাধনায় নারী লাগে। কিন্তু আমি যে সাধনা করবো সাধনসঙ্গিনী পাবো কই? নিজের স্ত্রী ছাড়া এই সাধনে কেউ রাজি হবে? আয়শা বেঁচে থাকলে আয়শাকে আমার সাধনায় সহযোগিতা করতে বলতে পারতাম। আয়শা সম্ভবত রাজি হতো না। তবু বলেকয়ে রাজি করতাম। সাঁইজির কথার উত্তর দিলাম না। নীরবতা ভেঙে সাঁইজি বললেন—আজকে রাইতেই তোর সাধনা শুরু। আজকেই শিখিয়ে দেবো কীভাবে রতিরক্ষা করতে হয়। সাধনসঙ্গিনীর ভূমিকা পালন করতে প্রস্তাব দিলেন গুরুমাকে। আমি লজ্জা-শরমে কিচ্ছু বলছিলাম না। সাঁইজির নির্দেশে গুরুমা শুরু করলেন। তিনি স্পর্শন, চুম্বন ও আলিঙ্গনে আমাকে জাগিয়ে তুললেন। লজ্জার পাশাপাশি আমার ভয়ও হচ্ছিল। এটা কিভাবে সম্ভব? স্বামীর সামনে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হবো, আর স্বামী সেটা বসে থেকে দেখবেন, এইটা কেমন স্বামী? স্ত্রীই বা কেমন? সে কেমন করে স্বামীর সামনেই নিজেকে মেলে দিচ্ছেন? আর আমিই বা কেমন যে স্বামীর সামনেই অন্যের স্ত্রীকে তর্জমা করব? সাঁইজি আমার সংকোচ বুঝতে পেরে অভয় দিলেন। তার নির্দেশ মতোই গুরুমায়ের চুলে, কপালে, গালে, বাহুমূলে, নাভিমূলে ও যোনিমূলে চুম্বন, লেহন ও আলিঙ্গনে ভরিয়ে দিলাম; বাদ রইল না ঠোঁট, নাক, কান, গলা, চিবুক, স্তনযুগল, পেট, পিঠ, নিতম্ব, গুহাপ্রাচীর, ঊরু, জঙ্ঘা ও পায়ের তালু। গুরু মায়ের কনিষ্ঠা, অনামিকা, মধ্যমা, তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলি ভিজে গেল আমার জিহ্বা-রসে। শরীরের প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে আমি বিচরণ করলাম। সাঁইজি বললেন—এইগুলা হইল কামনদীতে বাঁধ দেওয়া। কামনদীতে বাঁধ দিতে হলে প্রেমিকপুরুষ হতে হয়। এই নদীতে কোনও কামুকপুরুষ বাঁধ দিতে পারে না। কামনদীতে নৌকা বাইতে হলে রসিক নাইয়া হতে হয়। নইলে ডুইবা মরতে হয়। যেমন একটা গানে আছে—
এক নদীতে তিন রঙের পানি লাল সাদা আর কালা
নদীর গতি বুঝিয়া মাঝি তোর নৌকা চালা।
দেখতে দেখা যায় মরানদী
সে নদীতে জোয়ার আসে যদি
নদী রূপ ধরে উতলা,
কামুক মাঝি ডুইবা মরে
ভাবুক মাঝি যায় পারে
অবুঝ মাঝির ওঠে মরণ জ্বালা।
নদীর গতি বুঝিয়া মাঝি তোর নৌকা চালা।
জোয়ারভাটা বোঝে যারা
বুইঝা নৌকা চালায় তারা
জানে তারা নদীর পানি কোথায় লাল সাদা আর কালা,
নদীটির তিন ঘাটে তিন রমণী
নৌকারে তিনভাবে দেয় ঢুলানি
রসিক মাঝি সামাল দিয়ে খেলে রঙের খেলা।
নদীর গতি বুঝিয়া মাঝি তোর নৌকা চালা।
রমণীদের দেহ রসে ভরা
সে রস পান করে যারা
তারাই হয় রাম রহিম কৃষ্ণ করিম কালা,
তারা রতি-মতির ঊর্ধ্বে চলে
অকালে নাহি টলে
পার পেয়ে যায় অকাল সন্ধ্যাবেলা।
নদীর গতি বুঝিয়া মাঝি তোর নৌকা চালা।
গানটার মানে বুঝলি? ল, প্রেমের খেলা আর ভাবের খেলা বহুত হইছে, এইবার নদীতে নৌকা চালা। আমি বিসমিল্লাহ বলে সজোরে বইঠা বাইতে লাগলাম। আমার বইঠার প্রতিটা আঘাতে গুরুমা সাড়া দিলেন। বইঠা বাইতে- বাইতে আমি হাঁপিয়ে উঠছি। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এখন আর পারছি না। ছেড়ে দেবো-দেবো ভাব। এমন সময় সাঁইজি আমাকে টান দিয়ে সরিয়ে নিলেন। বললেন—এইবার একটু বিরতি দে। এই মূহুর্তে বিরতি দেওয়া কত যে অ‣ধর্যের, তা হাড়েহাড়ে টের পেলাম। গুরুমাও দম নিচ্ছিলেন। সাঁইজি বললেন—অস্থির হওয়া যাইবো না। আস্তেধীরে নদীর তীরঘেঁষে নৌকা চালাইতে হবে। বইঠা ছাইড়া দেওয়া যাইবো না। যখন ধৈর্যের বাঁধ ভাইঙা যাওয়ার উপক্রম হইবো, তখন গুরুর রূপ ধ্যানে আনবি। একটা প্লাস্টিকের পাইপ মুখে নিয়া পানিতে চুবাইয়া চোষণ দিয়া দেখবি; দেখবি, পানি উপরের দিকে উঠতেই থাকবে…। চোষণ দিয়া দম ছাইড়া না দিয়া পাইপটা পানি থেকে উপরে তুলবি; দেখবি, তবু পাইপের ভেতরে থাকা পানি পড়তেছে না। যেইমাত্র দম ছাইড়া দিবি, দেখবি পানি পইড়া গ্যাছে। ঠিক কামসাধনেও তাই। যখনই দেখবি রতি পইড়া যাইতেছে, তখনই দম আটকাইয়া দিবি, স্থিরতা আনার জন্য আমার ছবি তোর দিব্যচক্ষু দিয়া দেখতে থাকবি; তবেই দেখবি রতি ঊধ্বমুখী হচ্ছে। দিব্যচক্ষু হইল তুই যখন তোর দুই চোখ বন্ধ করবি, তখন দেখবি দুই চক্ষুর মাঝ বরাবর দুই ইঞ্চি উপরে কপালের কাছে একটা অদৃশ্য চক্ষু আছে। এই চক্ষু দিয়া এই পৃথিবীতে থাইকাই খোদার আরশ পর্যন্ত দেখা যায়! এই চক্ষুরে কেউকেউ বলে ত্রিনয়ণ। ত্রিনয়ণে গুরুর চেহারা ধ্যানে আইনা কামযুদ্ধে যারা নিজের রতি উর্দ্ধমুখী করতে পারে, তারাই সাধক; এইটুকুই তাদের সাধনা। এই সাধনাটুকু কইরা যদি কেউ রতি রক্ষা করতে পারে, তবেই তার নিজদেহ উৎপন্ন হবে আবে হায়াতের পানি।
আবে হায়াতের পানি কী জিনিস প্রশ্ন করলাম সাঁইজিকে। সাঁইজি বললেন— এই পানি যেইদিন তোরে পান করামু, আর যেইদিন তোর নিজদেহেই এই পানির নহর বইবে, সেইদিন বুঝবি এই পানি কী জিনিস। কথা বাড়াইস না, এইবার আবার শুরু কর, বইঠা চালা। বইঠা চালানো অবস্থায় বক্ষযুগল পিষতে থাক…। এই সিস্টেম-টা হইল নেগেটিভ-পজিটিভ এক কইরা ফেলা। নেগেটিভ-পজিটিভ এক না হইলে সংযোগ ঘটে না। আর চোখে চোখ রাখ। তার চোখের আয়নায় নিজের ছবি দেখার চেষ্টা কর। তার চোখে চোখ রেখে খেয়াল কইরা দ্যাখ; তোর ছবি দ্যাখ তার চোখে ভাসতেছে। এটাও একধরনের রূপের ধ্যান। রূপের ধ্যানকেই বলা হয় স্বরূপ দর্শন। এই ধ্যানে নিবিষ্ট থাকলে নুর শুধু বিজলির মতো চমকাবে; ঝরবে না।
সাঁইজির দেখানো পথে হাঁটতে থাকলাম। গুরুমার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ আমাকে উন্মাদ করে তুললো। একসময় গুরুমা অ‣ধর্য হয়ে বললেন—ছাইড়া দে বাপ! এই সাধনার জগতে তুই পাস। আমি থামছি না। আমি ক্রমাগত বইঠা বাইতেছি। স্বরূপ দর্শন করতেছি। নুর যাতে ঝরে না পড়ে সেজন্য দুচোখ বন্ধ করে মাঝেমধ্যে গুরুর চেহারা ধ্যান করতেছি। গুরুমা আমার কপালে ও ঠোঁটে বারকয়েক চুমু দিয়ে আবারও বললেন—অনেক হইছে আব্বা, এইবার ছাইড়া দে। যে আমি আমার জীবনে দশমিনিটের বেশি টিকতে পারিনি, সেই আমি গুরুর দেখানো পথে হেঁটে প্রায় পঁইত্রিশ মিনিট টিকে গেলাম! আমি বইঠা ছেড়ে দিলাম। শরীরটা নেতিয়ে গেল। সাঁইজি বললেন—এইবার বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। গুরুমা এবং আমি দুইজনে ফ্রেশ হয়ে আসলাম। অতঃপর গুরুমা আমার জন্যে একগ্লাস শরবত আনলেন। শরবতটা পান করে ঘুমিয়ে গেলাম। গভীর একটা ঘুম হলো।
এই ঘটনার পড়ে নিজেকে নিজের কাছে নোংরা ইতর বদমাশ মনে হলো। একটা অপরাধ বোধ আমার ভেতরে কাজ করতে লাগল। মায়ের বয়সী মহিলার সঙ্গে এটা আমি কী করলাম? আমি এতোটা জঘন্য হয়ে গেলাম? পির মাহবুব নামের এই লোকটা তো আগাগোড়াই ভণ্ড! কীভাবে সম্ভব নিজের স্ত্রীকে ভক্তের কাছে তুলে দেওয়া? সাধনার নামে এই যে যৌনকর্ম, এতে কি সিদ্ধি লুকিয়ে আছে? এই সাধনা করে কী সত্যিই দেহরক্ষা হয়? এই সাধনা করলে কী অমরত্ব লাভ করা যায়? এই সাধনা করে যদি দেহরক্ষা করা যাইতো বা অমরত্ব লাভ করা যাইতো, তাহলে তো চিকিৎসাবিজ্ঞান নারী-পুরুষের যৌনকর্মের মাঝেই সব রোগব্যাধির নিরাময় খুঁজতো। এটা আসলে কিছুই না; এটা পির মাহবুবের যৌনাকাক্সক্ষা মেটাবার পথ। তিনি আল্লাহর নামে আকাক্সক্ষা পূরণ করে চলেছেন। আল্লাহও তার সহায় হয়েছেন। তিনি এই যে অপকর্ম করেই যাচ্ছেন, তাতে তিনি কোনও প্রকার বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন না। তিনি অনায়াসেই যা চাচ্ছেন তাই পাচ্ছেন। তিনি বহুরূপী। বিভিন্ন ভক্তের কাছে তিনি বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হোন। অনেকসময় মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্ররাও তাকে মুফতি মাওলানা ভেবে ভুল করে বসেন। একবার মাদ্রাসা লাইনে ফাজিল পাস করা এক লোক এলেন সাঁইজির কাছে। লোকটা সাঁইজির হাতে বায়াত হতে চান। সাঁইজি বললেন—আপনি বায়াত হতে চান কেন? লোকটা বললেন—পাপ থেকে মুক্তি পাইতে এবং সৎকর্ম করার উদ্দেশ্যে বায়াত হইতে চাই। সাঁইজি বললেন—দেখুন, আপনি একজন শরিয়তের লোক। এতো সুন্দর শরিয়ত নামক একটা পথ, এই পথ কেন ছাইড়া আসতে চান বুঝি না। শরিয়তে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে গিয়ে দিনে পাঁচবার ওজু করতে হয়। আপনি ওজুর হকিকত জানেন? ওজুর হকিকত হলো যখন আপনি দুইহাতে পানি নেন, তখন আল্লাহরে বলেন, হে আল্লাহ, এই হাত দিয়ে আমি যেন আর খারাপ কাজ না করি। তারপর মুখে যখন পানি নিয়ে গড়গড় করেন, তখন আল্লাহরে বলেন, হে আল্লাহ, এই মুখ দিয়ে যেন মিথ্যা না বলি এবং হারাম খাবার না খাই। যখন চোখমুখ ধুয়ে কানে পানি দেন, তখন বলেন, হে আল্লাহ, আমি যেন আমার এই দু-চোখ দিয়ে পরনারীর প্রতি কুদৃষ্টি না দিই এবং এই কান দিয়ে মানুষের কানকথা যেন না শুনি। অতঃপর যখন দুই পায়ে পানি দেন, তখন বলেন, হে আল্লাহ, আমি যেন খারাপ পথে পা না বাড়াই। তাইলে বুঝতে পারছেন তো শরিয়ত জিনিসটা কত সুন্দর? নামাজ রোজা তো দূরের কথা, এক ওজুর বিধানটাই কত চমৎকার! জীবনে যদি কেউ একবার খাঁটি ওজু করতে পারে, তাহলেই পরকালে তার আর কোনও চিন্তা নাই।
ওজুর হকিকত শুনে ফাজিল পাস লোকটা সাঁইজির প্রতি আরও আকৃষ্ট হলেন। তিনি বললেন—আমাকে আপনার চরণে আশ্রয় দিন। পির-ফকির সম্পর্কে আমার একটা ভুল ধারণা ছিল, কিন্তু আপনার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম পির-ফকিরি বিষয়টি অনেক উচ্চ মার্গের বিশেষায়িত জ্ঞান। এই জ্ঞান থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না। ফাজিল পাস লোকটাকে মনেমনে বললাম—শালা ফাজিল, তুই গোপন খবর জানিস না। মারফত মানে গোপন বিষয়, একবার এই জগতে ঢুইকা দ্যাখ, তারপর বুঝবি এইখানে কী চলে। যাই হোক, ফাজিল লোকটা সাঁইজিকে সালাম দিয়ে চলে গেলেন। সাঁইজি সম্ভবত খুব দ্রুত মানুষকে চিনতে পারেন। তিনি কাকে কোন জ্ঞান দিয়ে বিদায় করতে হবে তা তিনি সুক্ষ¥ভাবে জানেন। তিনি শুধু আমাকে বুঝতে পারতেছেন না। তিনি আমাকে আপন করে নিয়েছেন। তার প্রতিটা রূপ আমার কাছে খোলাসা করে চলেছেন। আমিও তার রূপের শেষ দেখতে চাই। তার মারফতের চূড়ান্ত জ্ঞান জানতে চাই। এই ভণ্ডটাকে ছেড়ে যাবো, তবে, তার আগে তাকে দিয়ে আমার মামলামোকদ্দমা ডিসমিস করে নিতে হবে। এখান থেকে চলে গেলেই আমাকে আবার গ্রেফতার হতে হবে। আমার বুঝতে বাকি নাই আমার মামলাগুলো সাঁইজি যখন-তখন শেষ করে দিতে পারেন; কিন্তু, তিনি তা দিচ্ছেন না। আমার ধারণা, এই মামলার জালে বন্দি করেই আমাকে তার কাছে রেখে দিতে চান। আমার সন্দেহ হয় এই মামলাগুলো তার সাজানো নাটক। সত্যিই নাটক কি-না সেটাও আমাকে দেখতে হবে। তার ওপর থেকে আমার বিশ্বাস উঠে গেছে বা যাচ্ছে তা তাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। আমাকে আরও গভীরে প্রবেশ করতে হবে। প্রায় প্রতিদিন সাধুসঙ্গ হয়। সাধুসঙ্গে বেশিরভাগই যৌনতার গল্প হয়। আত্মতাত্তি¡ক গান হয়। আমার এতো কিছু জানার দরকার নাই। আমি জানতে চাই কীভাবে নিজদেহে আবে হায়াতের পানি উৎপন্ন হয়? তিনি তার ভক্তদের কিভাবে খেলাফত দিয়ে থাকেন? এইসব আমার জানতে হবে। আমার জানতে হবে আমার মামলাগুলো এই লোকটারই সাজানো নাটক কি-না। সেদিন যে নারীকে নিয়ে গেস্ট হাউজে আনন্দ ফুর্তি করেছেন, আমার মনে হয় ওই নারীটিই সেই নারী, যে নারীটি বাদলের ঘরে আমার সঙ্গে জোর করে সংগমে লিপ্ত হতে চেয়েছিলেন। তার চোখের ভাষা বলে দিয়েছে ঐটাই সেই নারী। আমার সন্দেহ যদি সত্যি হয়, তাহলে আল্লাহর কসম সাঁইজিকে তথা পির মাহবুবকে আমি নিজ হাতে হত্যা করবো। আয়শা মৃত্যুর সময় মাহবুব শাহ সম্পর্কে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল, বলতে পারেনি। হতে পারে আয়শার সঙ্গেও এই ভণ্ড পির খারাপ আচরণ করেছিল। যে লোক নিজের স্ত্রীকে তার ভক্তের সঙ্গে যৌনকর্মে উৎসাহিত করে, সে মেয়ের সমতূল্য কাউকে কুপ্রস্তাব দিবে না তার কি গ্যারান্টি আছে?
গুরুমাকে নিয়ে দেহসাধন করার প্রায় কয়েকমাস পরে সাঁইজিকে জোরকরে অনুরোধ করলাম—আমার তো কামসাধনা শ্যাষ, এইবার আমারে আবে হায়াতের পানি কী জিনিস বুঝাইয়া দেন। সাঁইজি বললেন—আগামী পূর্ণিমা রাতে একজনরে খেলাফত দিমু। খেলাফত দেওয়ার সময় আবে হায়াতের পানি পান করামু, তোরে সঙ্গেই রাখমু। তারপর নিজের চোখেই দেখবি আবে হায়াতের পানি কী জিনিস।
আমি আগামী পূর্ণিমা রাতের অপেক্ষায় রইলাম।
খেলাফত
চাঁদনি রাত। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে একজন লোক এলেন তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে। আমি গেইটের সামনে দারোয়ানের পাশে বসে সিগারেট টানছিলাম। দারোয়ান সাবেক এক সেনাসদস্য। তিনি শুদ্ধভাবে কথা বলেন। তার সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভালোই লাগে। গুরুগৃহে মাজারের খাদেম শামসু চাচা ও সাঁইজি বসে আছেন। তিনজন একত্রেই ছিলাম। কিছুক্ষণ আগেই তিনজনে ঢকঢক করে দুই বোতল মদ শেষ করেছি। মদ পান করলে আমার সিগারেটের নেশা ধরে। কিন্তু, গুরুগৃহে সিগারেট টানা নিষেধ। সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘরে দুর্গন্ধ বেরোয়। সাঁইজি নিজেও সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। মদ পান করার পর সাঁইজি বেশি করে জর্দ্দা দিয়ে পান চিবান, যাতে মুখ দিয়ে মদের গন্ধ না-বেরোয়। আমি সিগারেট টানার জন্যেই গেইটের সামনে এসেছি। লোকটা তার স্ত্রীকে নিয়ে সোজা গুরুগৃহে প্রবেশ করলেন। দুইমিনিট পর শামসু চাচা ডাকলেন—শিমুল ঘরে আয়, সাঁইজি ডাকছেন। চলে গেলাম।
লোকটার সঙ্গে যে মহিলাটি এসেছেন উনি একজন বাউলশিল্পী। বহুদিন ধরে উনারা এই গুরুগৃহে সাধুসঙ্গ করেন। আজকে তারা সাঁইজির কাছ থেকে খেলাফত নিবেন। এই প্রথম শামসু চাচাকে গুরুগৃহে দেখলাম। সাঁইজি বলেছিলেন খেলাফত দেওয়ার সময় আবে-হায়াতের পানি পান করাবেন। আমার অপেক্ষার সময় কাটে না। আমি দেখতে চাই আবেহ-হায়াতের পানি কী জিনিস। আমি জানতে চাই খেলাফত কিভাবে দেওয়া হয়। খেলাফত তো তাকেই দেওয়া হয় যিনি জ্ঞানের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠতে পেরেছেন। আমি সর্বোচ্চ জ্ঞানী ব্যক্তিটির কর্মকাণ্ডের সাক্ষী হতে চাই। পির মাহবুব নামের ভণ্ড সাঁইজিরও শেষ দেখতে চাই। আমরা মোট পাঁচজন গুরুগৃহে বসে আছি। নীরবতা ভেঙে শামসু চাচা সাঁইজিকে বললেন— সাঁইজি, গন্দম খাওয়ার অপরাধেই তো আল্লাহ আদম-হাওয়ারে বেহেশত থেকে বের করে দুনিয়াতে পাঠাইলেন। গন্দম জিনিসটা তো যৌনমিলনেরই রূপক গল্প। তো, যে অপরাধে বেহেশত থেকে আল্লাহ আদম-হাওয়ারে দুনিয়াতে পাঠাইলেন, আমরা আদম সন্তান তো সেই অপরাধ করেই চলছি! হাশরের ময়দানে আমরা আল্লাহর সামনে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবো? এই যে আমরা লেংটা হই, সংগম করি, কত আসন গ্রহণ করি, এর সবই তো আল্লাহ দ্যাখেন। সত্তুর হাত পানির নিচে কী আছে আল্লাহ তা-ও দেখতে পান। আমরা যে লেংটা হই, এই লেংটা হওয়ার দৃশ্য দেইখা আল্লাহ শরম পান না? নাকি তিনি চুপচাপ বইসা থাইকা এইসব উপভোগ করেন?
সাঁইজি বললেন—শামসু মিয়া, তোমারে একটা ঘটনা কই শোনো— বেহেশতচ্যুত হয়ে আদম (আ.) আছড়ে পড়লেন ভারত উপমহাদেশের সিংহলে এবং হাওয়া (আ.) পড়লেন আরব দেশে। অতঃপর অনেক তপস্যার পরে তাঁদের মিলন হয় সৌদির আরাফাতে। তাঁরা সন্তান উৎপাদন করতে লাগলেন। ক্রমেই আদমের বংশবৃদ্ধি হইতে লাগল। আদম সন্তানেরা ছড়িয়ে পড়লেন পৃথিবীর দিগ্বিদিক। আদম সন্তানেরা আল্লাহর ইবাদতের চেয়ে যৌন চাহিদা পূরণে বেশি মনোযোগ দিলেন। ফেরেশতারা বলাবলি শুরু করলেন—দ্যাখো, এরা কতো দুষ্ট প্রজাতি! কত অবাধ্য! আমরা এদের জায়গায় থাকলে কখনওই অবাধ্য হতাম না। ফেরেশতাদের ভুল ভাঙাতে আল্লাহ বললেন—তোমরা তোমাদের মাঝখান থেকে দুজন ফেরেশতা বাছাই করো; আমি তাঁদের মধ্যে মানবীয় ক্সবশিষ্ট্য সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিচ্ছি, দেখা যাক এরপর তাঁরা কী করে। ফেরেশতারা তাঁদের মধ্য থেকে হারুত-মারুত নামক দুইজন ফেরেশতারে বাছাই করলেন। আল্লাহ্ ফেরেশতাদ্বয়কে বললেন—দ্যাখো, মানুষকে তো আমি নবিদের মাধ্যমে উপদেশ দিই; কিন্তু, তোমাদের সরাসরিই বলে দিচ্ছি—তোমরা শিরক করবে না, জে না করবে না এবং মদপান করবে না।
আল্লাহর প্রত্যাদেশ নিয়ে ফেরেশতারা পৃথিবীতে চলে এলেন। তাঁদের কাজ ছিল মানুষের সকল সমস্যা সমাধান করা। ফেরেশতারা সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় ফেরত যেতেন আকাশে। সকাল হওয়ার আগেই আবার চলে আসতেন পৃথিবীতে। একদিন জোহরা নামে যৌন-আবেদনময়ী এক নারী এলেন তাঁদের কাছে স্বামীর বিরুদ্ধে বিচার চাইতে। অসম্ভব সুন্দরী নারীকে দেখে ফেরেশতারা বিমোহিত হইলেন এবং সেই নারীকে যৌনসংগমে আমন্ত্রণ জানাইলেন। জোহরা রাজি হলেন না। জোহরা ছিল পৌত্তলিক। সে দেবদেবীর পূজা করত। জোহরা জানালেন—তোমরা যদি আমার মতো দেবদেবীর পূজা করো, তাহলে তোমাদের খেলায় মেতে উঠবো, নয়তো না। হারুত-মারুত দেবদেবীর পূজার শর্ত প্রত্যাখান করলেন। কারণ, দেবদেবীর পূজা করা শিরক। এরপর জোহরা একটা শিশুকে নিয়ে এসে হত্যা করতে বললেন। এ শর্তও ফেরেশতারা ফিরিয়ে দিলেন। কারণ, হত্যা করা মহাপাপ। তৃতীয়বার জোহরা মদ নিয়ে এলেন এবং বললেন— আপাতত একটু মদ তো পান করো? তাঁরা মনে করলেন অল্প একটু মদ পান করা যেতে পারে। অল্প খেলে অল্প পাপ। তাঁরা মদপান করলেন। নেশায় বেহুঁশ হলেন। নেশারঝোঁকে ফেরেশতারা দেবদেবীর পূজা করলেন, শিশুটিকে হত্যা করলেন এবং জোহরার উলঙ্গ শরীর থেকে জান্নাতি সুবাস নিলেন। গন্দমের স্বাদ আস্বাদন করলেন। নেশা কেটে যাওয়ার পর ফেরেশতারা জানতে পারলেন তাঁরা আল্লাহর অবাধ্য হয়েছেন! অতঃপর আল্লাহ তাঁদেরকে বললেন—তোমরা অবাধ্য হয়েছ। তোমরা কি দুনিয়াতেই তার শাস্তি নিবে? না-কি পরকালে? তাঁরা দুনিয়ার শাস্তি বাছাই করে নিলেন। আল্লাহ তাঁদের দুজনকে ইরাকের ব্যবিলনে এক কুয়ায় উলটোমুখ করে ঝুলিয়ে রাখলেন। তাঁরা কেয়ামত পর্যন্ত সেভাবেই ঝুলে থাকবে।
সুতরাং; এই ঘটনা থেকে কী বুঝলা? আল্লাহ নিজেও জানেন আদম ও আদম সন্তানেরা কী করবে আর করবে না। পাকের চেয়ে নাপাক বড়ো ভেদ জাইনা লও আগে। একটা আধ্যাত্মিক কবিতায় আছে—
কিতাবে খবর এসেছে—
মানুষ নাপাক বীর্যে পয়দা হয়েছে।
নাপাকে পয়দা হয়ে
সেই মানুষ অজু দিয়ে
পাক হয় কেমনে?
বস্তুটাই নাপাক যেখানে।
পক্ষীকূল আর পশুকূল
সবারই জন্মমূল
নাপাক এই পানি।
এই পানিতেই জন্ম নিছে জ্ঞানী-অজ্ঞানী।
জ্ঞানী যদি পাক হয়
অজ্ঞানী তো নাপাক নয়
একই জন্মবীজ যেখানে,
সেখানে একেরে দুই করি কেমনে?
কর্মে যা পাপ গণ্য
ধর্মে তা দেখি পুণ্য
পাপ করলে দোজখে গমন
পুণ্য করলে হুর রমণ
বেশ্যা যদি পাপী হয়
হুর কিভাবে সতী রয়?
কিতাব অনুসারে
মুমিন কয়েকটা বিয়া করতে পারে
এই দেশেতে হলে পরে
লুচ্চা বদমাশ বলে তারে!
শামসু মিয়া, আরও গভীরে ঢুকে দ্যাখো। আরও অনেককিছু জানার বাকি আছে। আমরা আল্লাহর অবাধ্য হইলে বলি শয়তান আমাদের কুমন্ত্রণা দিছে। আদম-হাওয়া বেহেশতে গন্দম খাইছিল তথা সংগম করেছিল এইটাকেও আমরা বলি শয়তান কুমন্ত্রণা দিয়ে ওই কাজ করতে বাধ্য করেছিল। আমাদের ধারণা শয়তানই সকল পাপকাজে লিপ্ত হওয়ার জন্য আমাদের কুমন্ত্রণা দেয়। শয়তান একজন ফেরেশতা ছিল। আমরা জানি আল্লাহ আদমরে বানাইয়া ফেরেশতাদের বললেন, তোমরা আদমরে সেজদা দেও। ফেরেশতারা বাধ্য হয়ে সেজদা করল। শুধু অবাধ্য হইল শয়তান। আইচ্ছা কও তো; শয়তানের আগে তো আর শয়তান ছিল না, তাইলে আদমরে সেজদা না দেওয়ার জন্য কোন শয়তানে এই শয়তানরে কুমন্ত্রণা দিছিল? গভীরে ডুব দিয়া যদি দ্যাখো, তাইলে দেখতে পাইবা সবই আল্লাহর লীলাখেলা। আদম-হাওয়া যদি এই কাজ না করতো তথা সংগম না করতো, তাইলে এই মানব-বাগান কোথা থেকে আসতো? আদম সন্তানেরা যদি এই কাজ না করে, তাইলে কিভাবে মানবজাতি রক্ষা হবে?
সাঁইজির কথা বলা শেষ হতে-না-হতেই মহিলাটি সাঁইজির নাভির নিচে ভক্তি দিলেন, সঙ্গে পুরুষটিও। এইবার সাঁইজি খেলাফত নিতে আসা লোকটিকে বললেন—বাজান, গুরুর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছ, দায়িত্ব নেওয়ার আগে নিজেকে কীভাবে রক্ষা করতে হয় তার ফাইনাল পরীক্ষাটা আজ তোমাকে দিতে হবে। নারীটীকে উদ্দেশ্য করে বললেন—মা, এইখানে লজ্জাশরমের কিছু নাই। এইখানে আমি তোমার বাবা, তোমার দুইজন গুরুভাই, আর আছে সাধকরূপে তোমার পতিদেব। তুমি তোমার পতিদেবকে সহযোগিতা কর। মনে রাখবা, স্ত্রী যদি আউলিয়া না হয়, স্বামী কখনও আউলিয়া হতে পারেন না। নবিজি যেদিন হেরাগুহায় প্রথম ওহি পেলেন, সেদিন নবিজি ভয় পাইছিলেন। ভয়ে থরথর কইরা কাঁপতে-কাঁপতে নবিজি চইলা গেলেন মা খাদিজার ঘরে। মা খাদিজা ঘটনা শুনে নবিজিকে বললেন—আপনার কাছে নিশ্চয়ই আল্লাহর ফেরেশতা এসেছিলেন। আসেন, আমি উলঙ্গ হয়ে বসি, আপনি আমার উরুতে বসেন। আমি উলঙ্গ হওয়ার পরেও যদি আপনার কাঁপুনি না থামে, তাইলে বুঝে নিবেন আপনার কাছে শয়তান এসেছিল। কারণ, নবির স্ত্রী উলঙ্গ হলে ফেরেশতা লজ্জায় এখানে থাকতে পারবেন না। মা খাদিজা নগ্ন হইয়া নবিজিকে ঊরুতে বসালেন। সঙ্গে-সঙ্গে নবিজির ভয় কেটে গেল, কাঁপুনি থেমে গেল। এরপর মা খাদিজা নিশ্চিত হলেন যে, নবিজির কাছে ফেরেশতা এসেছিলেন। তাইলে বুঝতে পারছো তো নবিজি নবি হওয়ার আগেই মা খাদিজা কত বড়ো আউলিয়া হয়েছিলেন? স্ত্রী যদি আউলিয়া না হয়, স্বামী কখনও আউলিয়া হতে পারেন না। ওই স্বামীর সাধনপথে স্ত্রী হয়ে উঠবে বড়ো বাধা। যৌনচেতনা পুরুষদেহে ঝড়ের মতো আসে, ঝড়ের বেগে চলে যায়। এক্ষেত্রে নারী ভিন্ন। নারীর সহজে শেষ হয় না। এই শেষটা করতেই নারীর সাহায্য লাগে। তাইলে শুরু করো মা।
তারা শুরু করলেন। পুরুষটি প্রথমে নারীটিকে ভক্তি দিলেন। আমরা নামাজ পড়তে গিয়ে সেভাবে সেজদা দিই, ঠিক সেভাবে ভক্তি দিলেন। ভক্তিশেষে পুরুষটি তার দুহাত দিয়ে নারীটির শরীরের বিভিন্ন অংশে সুড়সুড়ি দিলেন। দুহাত ভরে স্তনে আদর করলেন। পা দিয়ে পায়ে ঘর্ষণ করলেন। দুই ঠোঁট দিয়ে স্পর্শকাতর স্থানে চুম্বন করলেন। অতঃপর জিহ্বা দিয়ে যোনিপথ লেহন করলেন। যোনিপ্রাচীরে দাঁত দিয়ে আলতো করে দংশন করলেন। নারীটি যৌনসুখানুভ‚তিতে কেঁপে উঠলেন। নারীটির ভগাঙ্কুর উত্তেজিত ও উত্থিত হলো। এইবার সাধক পুরুষটি তার কামদণ্ড সাধনসঙ্গিনীর ভগাঙ্কুরে সংযুক্ত করলেন। নারীটির যোনিপ্রাচীরের রসগ্রন্থি থেকে রসক্ষরণ হতে লাগল। স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেল যোনি ও নিতম্ব। সাঁইজি টিস্যু এগিয়ে দিলেন। পুরুষটি টিস্যু দিয়ে সিক্ত অঞ্চল মুছে চূড়ান্ত পর্বে চলে গেলেন। সাধকের কামদণ্ড নারীটিকে ক্রমাগত আক্রমণ করতে লাগল। পুরুষটি আক্রমণের গতি কখনও কমালেন, কখনও বাড়ালেন। যুদ্ধ চলছে তো চলছেই…। একটা সময় নারীটি আহত ক্সসনিকের মতো ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠলেন। এইবার সাঁইজি পুরুষটিকে থামিয়ে বললেন—যথেষ্ট হয়েছে, এইবার তুমি থামো।
এরপর সাঁইজি নারীটিকে বললেন—আমার চোখের দিকে তাকাও। চোখ থেকে চোখ যেন না সরে। বাচ্চাদের সুন্নতে খৎনা করানোর সময় পেছন থেকে একজন শক্তিশালী মানুষ যেভাবে বাচ্চাটিকে অক্টোপাসের মতো করে ধরে রাখে, ঠিক সেভাবে পুরুষটি তার সাধনসঙ্গিনীকে আঁকড়ে ধরলেন। পুরুষটিকেও সাঁইজি বললেন—তুমিও আমার চোখে চোখ রাখো। এবার সাঁইজি উলঙ্গ হইলেন। চোখের সামনে এইসব ঘটনা দেখে নিজেকে সামাল দেওয়াটা খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। তবু অবাক বিস্ময়ে আমি দৃশ্যগুলো দেখতেছিলাম। শামসু চাচাও মোচড়ামুচড়ি করছিলেন। সাঁইজি উলঙ্গ হওয়ার পরে নতুন করে আবার অবাক হলাম। একি! সাঁইজির যন্ত্র মাত্র আড়াই ইঞ্চি! এইটুকু দিয়ে তিনি কেমনে কী করেন? পেটটা ঝুলে গেছে। যতটুকু মানুষ তারচে তিনগুণ পেট! ওইটুকু অস্ত্র দিয়েই তিনি যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। দুয়েক খোঁচা দিতে-না-দিতেই সাঁইজি বললেন—শিমুল, তাড়াতাড়ি কাচের গ্লাসে করে এক গ্লাস জল নিয়ে আয়। আমি দ্রুত জল নিয়ে এলাম। সাঁইজি জলের গ্লাসটা হাতে নিয়ে গ্লাসে রতিপাত করলেন। সাঁইজি দুই মিনিটেই হাঁপিয়ে উঠেছেন। হাঁপাতে-হাঁপাতে গ্লাসটা টেবিলে রেখে সাঁইজি সাধক-সাধিকা দুজনকেই বাথরুম থেকে গোসল সেরে আসতে বললেন। তারা গোসল করে এলেন। এরপর দুজনকে সাদা পোশাক পরতে বললেন। তারা সাদা পোশাক পরে সাঁইজির সামনে বসলেন। মহিলাটি লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরিধান করেছিলেন। ভেজা চুলে তাকে অসাধারণ সুন্দর লাগছিল। কপালে লাল সিঁদুরে টিপ। সাঁইজি নিজহাতে সাধক সাধিকার গলায় তুলসীর মালা পরালেন। এরপর রতিপাতকৃত গ্লাসের জল দুজনকে পান করতে বলে বললেন—খাও, পান করো; অপচয় করিও না। নিশ্চয়ই গুরুর রতিই ভক্তের জন্য আবে-হায়াতের পানি। এরপর মন্ত্র উচ্চারণ করতে-করতে সাধক-সাধিকার চারপাশে সাতটা পাক দিয়ে সাঁইজি নিজেই তার ভক্তকে ভক্তি দিলেন এবং নিজের মাথার পাগড়ি খুলে ভক্তের মাথায় পরিয়ে দিলেন, খেলাফত সম্পন্ন হলো।
আমি স্বচক্ষে দেখলাম আবে-হায়াতের পানি।
খেলাফত শেষে সাধক-সাধিকা চলে গেলেন। শামসু চাচাও বিদায় নিলেন। আমি আর সাঁইজি গুরুগৃহেই রয়ে গেলাম। এখন ঘুমানোর পালা। বিছানায় শুয়ে সাঁইজিকে বললাম—সাঁইজি, আপনি তো মানুষকে দীর্ঘক্ষণ সংগমের কলাকে․শলের দীক্ষা দিয়ে থাকেন; কিন্তু, আপনি নিজেই তো দুই মিনিটে টলে গেলেন! ঘটনা কী? সাঁইজি বললেন—আরে পাগল, আমার উদ্দেশ্য তো সংগম করা না। আমার উদ্দেশ্য হইল ওদেরকে আবে হায়াতের পানি পান করানো। আমি ইচ্ছা কইরাই তাড়াতাড়ি পানিটা বাইর করলাম। সাঁইজিকে আবারও প্রশ্ন করলাম—আমার পানি আর আপনার পানি তো দেখলাম একই রঙের, তাইলে আপনারটা আবে হায়াতের পানি হইল কেমনে? সাঁইজি বললেন—আমার পানি উলটোপথে ফিরিয়ে দিতে-দিতে সেই পানির নির্যাস থেকে আবে হায়াতের পানি উৎপন্ন হইছে। তুইও আমার মতো উলটোপথে পানি চালান কইরা দেওয়ার শিক্ষা অর্জন কর, তোর মাঝেও এই পানির নহর বইবে। সাঁইজিকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম—এই পানি দিয়া কী হইবো? এই পানি পান করলে কী অমরত্ব লাভ করা যাইবো? এই পানি পান করলে কী রোগবালাই হইবো না? আপনারও তো দেখি মাঝেমধ্যে রোগব্যাধি পেয়ে বসে। তাইলে কেমনে কি? সাঁইজি ধমক দিয়ে বললেন—ঘুমা, এখন আর কথা কওয়ার সময় নাই।
খেলাফত দৃশ্য অনুভব করতে-করতে ঘুমিয়ে গেলাম।
স্বীকারোক্তি
আমার ধারণা ইদানীং বাদল আমারে হিংসা করে। আমার সঙ্গে আগের মতো কথাবার্তা বলে না। দেখা হলে মুখটা গোমড়া করে রাখে। কী কারণে এমন পরিবর্তন? সাঁইজির সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, এজন্য? শামসু চাচার চোখের ভাষাও সন্দেহজনক। আমার একটা গুণ আছে: আমি মানুষের চোখের ভাষা পড়তে পারি। সাঁইজি এতো বড়ো ধূর্তবাজ জ্ঞানী হওয়ার পরেও তার ভেতরে একটা গুণ তেমন নাই, তিনি সব মানুষের চোখের ভাষা বোঝেন না। যদি বুঝতেন, তাহলে আমাকে এতো আপন করে নিতেন না। হতে পারে তার জীবনে সবচেয়ে বড়ো ভুল এই আমাকে আপন করে নেওয়া। আমি তার সব গোপন বিষয় জেনে গেছি। তিনি মুখোশধারী ভণ্ড ধর্মগুরু। তিনি খোদার খাসি। খোদার নামে তিনি দেদারসে অন্যের খেতের ফসলে মুখ লাগাতে পারেন, এতে খেতের মালিক বেজার হোন না। কিš; খোদার এই বেয়াদব খাসিটাকে আমি চরম শিক্ষা দিতে চাই। জনসম্মুখে তার মুখোশ খুলে দিতে চাই। ধর্মের সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে তিনি যে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন, তা আমি গুঁড়িয়ে দিতে চাই। জীবনে কোনও অন্যায় কাজ করিনি; কিন্তু, এই ভণ্ডের পাল্লায় পড়ে যে পাপ আমি করেছি, তার অপকর্মের পথ বন্ধ করে দিয়ে আমি আমার সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। কীভাবে মুখোশ খুলে দেবো সেই পথ আমাকে বের করতে হবে। আমি একটা কিছু বললেই আমার কথা পাবলিক বিশ্বাস করবে না। তথ্যপ্রমাণসহ ভণ্ডটার মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম তার অপকর্মের ভিডিও ধারণ করব এবং সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে দেবো। এই কাজটা করার আগে আমার নিরাপত্তার বিষয়টি প্রথমে ভাবতে হবে। গোপন ভিডিও প্রকাশ করার সঙ্গে-সঙ্গে আমার জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে পারে। ভণ্ডপির মাহবুবের ভণ্ডামি সম্পর্কে বাদল সবকিছু জানে কি-না এ প্রসঙ্গে বাদলের সঙ্গে আলাপ করা দরকার।
প্রতিদিনের মতো গুরুগৃহে আজকেও সাধুসঙ্গ হবে। সাধুসঙ্গে প্রতিদিন যে সাঁইজি সংগমে লিপ্ত হোন, তা নয়। অধিকাংশ রাতে মারফতি আলোচনা হয়। মাসের বিশেষ কিছু দিবাগত রাতে তিনি যৌনকর্মে মেতে উঠেন। আয়শার মৃত্যুর পর আমার ঠাঁই হয়েছে সাঁইজির কাছে। সেই থেকে সর্বদা আমি তার কাছাকাছি থাকি। মাত্র কয়েকটা রাত তার সঙ্গে থাকতে পারিনি। যেদিন তিনি গেস্ট হাউজে তার বন্ধুদের সঙ্গে নারী নিয়ে আড্ডা দিলেন, সেদিন রাতে সেই আড্ডায় আমি শরিক হতে পারিনি। সম্ভবত বোরখা পরা ওই নারীটি আমার সামনে উলঙ্গ হতে চায়নি। আজকে সাধুসঙ্গে বসার আগেই সাঁইজি বললেন—তুই আজকে বাদলের কাছে চলে যা। আজকে আমার একজন ভক্ত-মেয়ে আসবে, সে তোর সামনে কথাবার্তা বলতে লজ্জাবোধ করে। আমি জানতে চাইলাম—মেয়েটি কে? সাঁইজি তার পরিচয় দিলেন না। আমি কথা না বাড়িয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে বাদলের কাছে যাচ্ছিলাম। গেইট দিয়ে বাসার ভেতরে সেই নারীকে ঢুকতে দেখলাম, যে নারীটি সেদিন রাতে গেস্ট হাউজে সাঁইজির বন্ধুদের ভোগের পাত্রী হয়েছিলেন। গেইট দিয়ে ঢুকতে-ঢুকতে নারীটি আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। বোরখা হিজাবে সর্বাঙ্গ ঢাকা থাকলেও তার চোখ দেখে আমি চিনতে পেরেছি। তার সঙ্গে কথা বলার কোনও সুযোগ পেলাম না। তার পেছনেই তিন-চারজন বয়স্ক মানুষ। তারা গুরুগৃহে ঢুকে পড়লেন।
আমি সোজা চলে গেলাম বাদলের কাছে।
বাদল ঘরে শুয়ে ফোন টিপতে ছিল। আমার উপস্থিতিতে বিরক্তবোধ করল। গোমড়া মুখে বলল—কী জন্যে আইছা? কিছু কইবি? বাদলের কথার কোনও উত্তর দিলাম না। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইলাম। বাদল আবারও বলল—কি রে, কথা কস না কেন? নীরবতা ভেঙে বললাম—তোর কাছে গাঁজা আছে? থাকলে বানা। বাদল মোচড় দিয়ে উঠে গাঁজার কলকি প্রস্তুত করল। পরান ভরে গাঁজা টানলাম। বাদলও টানলো। পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে বললাম—আইজকা একটু ভালো কইরা নেশা করা আমারে। মনটা ভালো নাই। বাদল টাকা পেয়ে খুশি হলো। আমাকে ঘরে রেখে ও বাহিরে চলে গেল। আধাঘণ্টা পরেই চলে এলো। সঙ্গে দুইটা মদের বোতল, সফট ড্রিংকস, আর গোরর মাংস ভুনা। মদ পান করতে-করতে নেশা যখন চরমে উঠেছে, ঠিক তখনই বাদলের হাত ধরে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললাম—আইচ্ছা বাদল ক তো, সেইদিন যে মহিলার কারণে আমারে জেলে যাইতে হইছিল, সেই মহিলারে তুই চিনিস? ক, আমার কাছে কিছু লুকাইবি না। আমি তোর বন্ধু না? বাদল কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে—হ, আমি ওই মহিলারে চিনি। সেইদিনের ঘটনা সব সাজানো নাটক ছিল। এই নাটকের পরিচালক বাবা মাহবুব শাহ। তোরে তোর বউসহ বাবা দেখা করতে কইছিলেন, তুই ওই দিন ভাবিরে সঙ্গে কইরা নিয়া আইছিলি না। বাবা তো তোর বউকে দেখতে চাইছিলেন। তাই বাবার সঙ্গে তোরে দেখা করানোর আগে তার পারমিশন নেওয়ার জন্যে গেছিলাম। তুই ভাবিরে নিয়া আসিস নাই শুইনা বাবা এই নাটক সাজাইলো। সে একান্ত কইরা তোর বউরে পাওয়ার জন্যে এই কাজ করল। যে মহিলাটা তোর সঙ্গে অভিনয় করেছে তিনিও বাবার হাতে বন্দি। ওই মহিলার বাবা ছিল মাহবুবের ভক্ত। ভক্তের জমি বেদখল কইরা নিয়া লোকটারে শেষ কইরা দিছেন। ওই ভক্তের একমাত্র মেয়ে এই মহিলা। মহিলাটার স্বামীকে বাবা মাহবুব মানসিক প্রতিবন্ধী কইরা রাখছেন। দিনের-পর-দিন তিনি এই মহিলারে দিয়া দেহব্যবসা করতেছেন। শুধু এই মহিলাই না, এইরকম মহিলা আরও আছে। বাবা মাহবুব এই বিশুদ্ধ শহরে নিজের আখড়াটারে নিষিদ্ধপল্লি হিসেবে গইড়া তুলছেন। বলতে পারিস তার আবাসিক হোটেল রেস্টুরেন্ট, হসপিটাল, গেস্ট হাউজ, মাজার, খানকা ও বাসা একপ্রকার ভাসমান পতিতালয় ও নেশার আখড়া। তিনি পতিতার দালাল। তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে মাগির দালালি করতেছেন। আপন শালির সঙ্গে তার মেজো ছেলে কুদরতের অ‣বধ সম্পর্ক। খালার সঙ্গে অ‣বধ সম্পর্ক জানার পরেও তিনি কোনও বিচার করেন না। বড়ো ছেলে মনির আপন বোন তাকমিনারে দিনের-পর-দিন ধর্ষণ কইরা আসতেছে, এটা জানার পড়েও তিনি বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন। তার জঘন্য কুকর্মের সামনে শয়তানও হার মানবে। তার স্ত্রী ভয়ে কিছু বলতে পারেন না। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু কইলেই মারতে-মারতে আধমরা কইরা ফালাইবেন। তিনি তার একমাত্র কন্যা তাকমিনার বুকে হাত দিছিলেন। এই ঘটনা গুরুমা দেখার পর প্রতিবাদ করছিলেন। প্রতিবাদ করার পরিণামে গুরুমার হাতপা বাইন্ধা বেদম পিটানি পিটাই ছিলেন। মাথা ন্যাড়া কইরা দিছিলেন। মাইনষে এই শহররে মসজিদের শহর কয়; অথচ, এই শহরটারে পির মাহবুব গোপনে পতিতালয় বানাইয়া ফালাইছেন!
বাদলের কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করে বাদলরে বোঝাতে চাইলাম আমি সবকিছু জানি। আমি জেলে যাবার পরে আয়শারে নিয়ে কী ঘটেছিল সেটা জানার চেষ্টা করলাম। বাদল বলতে লাগল—তুই জেলে যাবার পরে ভাবিরে বাসায় গিয়ে খবর দিই। তোর সঙ্গে দেখা করানোর কথা বইলা ভাবিরে এইখানে নিয়া আসি। তারপর বাবা মাহবুব শাহ ভাবিরে কী জানি কী বুঝাইয়া নিজের বাসায় রাখলেন। আমি প্রথম যেইদিন তোর সঙ্গে জেলখানায় দেখা করতে যাই, সেইদিনই ভাবি অসুস্থ হইয়া পড়ে। বাবা মাহবুব শাহ আমারে তোর সঙ্গে দেখা করতে কয়। নিষেধ করে দেয় আমি যেন ভাবির অসুস্থতার কথা তোরে না কই। ভাবিরে আমি হসপিটালে নিয়া যাইতে চাইছিলাম; কিন্তু, মাহবুব শাহ আমারে নিয়া যাইতে দেয় নাই। চিকিৎসা যা কিছু করার ওই মহিলা করেছে, যে মহিলাটা তোর সঙ্গে জোরকরে সংগম করতে চাইছিল। মহিলাটার দোষ নাই। মহিলাটা বাবার কৃতদাসী। কী কারণে ভাবি অসুস্থ হইছিল আর কেন পেটের বাচ্চা পইড়া গেল সেটা ওই মহিলাই ভালো জানে। আমার ধারণা মাহবুব শাহ ইচ্ছা কইরাই ভাবির পেটের বাচ্চা ফালাইয়া দিছে।
ওই মহিলার সঙ্গে দেখা করার কোনও সুযোগ আছে? বাদলরে বললাম। বাদল বলে—সাবধান, ওই মহিলার সঙ্গে দেখা করতে যাইস না। তুই এতো সোজা মনে করিস না। এইখানে যা কিছু হয় তার সব খবর বাবার কানে যায়। তার নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী আছে। তার ক্ষমতা সম্পর্কে তুই এখনও কিছুই জানিস না। আমি তোর কাছে এতো কথা বলেছি কোনওভাবে যদি সে জানতে পারেন, তাইলে তোরও খবর আছে, আমারও খবর আছে। তোরে এতোকিছু বলতাম না। যে মানুষটার কারণে তোর জীবন ধ্বংস হইয়া গেল, আর তুই তারই গোলামি করছিস, এইজন্য বললাম। গোলামি করতে ভালো লাগলে কর, ভুলেও অতীত নিয়া ঘাঁটাঘাঁটি করিস না। তাইলে জীবনে বাঁচতে পারবি না। আমার আশঙ্কা হয় তুই এইখান থেকে পালিয়েও বাঁচতে পারবি না। দেশের যেকোনও প্রান্তে থাকলেও তোরে ধইরা আনবো। এইখানে যতদিন থাকবি ততদিন মামলার ভয় নাই। এইখান থেকে তুই পালিয়ে গেলে পুলিশ তোরে খুঁইজ্যা বাইর করবো।
আমি বাদলরে বললাম—তাইলে তুই এই দোজখের মইধ্যে পইড়া রইছস কেন? বাদল বলে—কেন কী করমু? এইখানে তো আমি বেশ ভালোই আছি। আমার তো কোনও সমস্যা নাই। কামকাজ কইরা খাইতে হয় না। আরও সবাই আমারে সম্মান করে। এইখানে থাইকা পরকালেরও চিন্তা করি না। কারণ, বাবা মাহবুব শাহ কোরান ছুঁইয়া আমারে কথা দিছে আমি তার কথামতো যা কিছু করি না কেন, এতে যদি পাপ হয়, তাইলে রোজ হাশরে সেই পাপের দায়ভার তিনি নিবেন।
শালা বাইঞ্চত তোরে লেংটা করে পেটানো দরকার বলে বাদলের কাছ থেকে উঠে বাইরে চলে এলাম।
আমি জানি রাত তিনটা-চারটার আগে সাঁইজির সাধুসঙ্গ ভাঙবে না। আমি দ্রুত বাসার কাছে যাই। আমি দেখতে চাই মহিলাটা কখন বের হয়, বের হয়ে কোথায় যায়। তার বাসাটা আমার চেনা দরকার। সাড়ে তিনটার দিকে মহিলাটা বের হলো। আমি মহিলাটাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। চাঁদ ডুবে গেছে। চারদিকে হালকা অন্ধকার, ল্যাম্পপোস্টের আলোতে তিনি পথ হাটছেন। মাজার থেকে সোজা উত্তর দিকে একটা গলি পেরিয়ে দ্বিতীয় গলির ভাঙাচোরা একটা বাসায় ঢুকলেন। আমিও তার পিছু পিছু যাচ্ছি। সে ঘরে ঢোকা পর্যন্ত আমি গেইটের কাছে অপেক্ষা করলাম। এতো রাতে তার বাসায় ঢোকা ঠিক হবে না ভেবে চলে এলাম এবং বাসাটা চিনে এলাম।
পরদিন দুপুরে আমি সরাসরি মহিলাটির বাসায় ঢুকি। হ্যাঁ, এই সেই মহিলা। মহিলাটি দুপুরের খাবার খাচ্ছিলো। আমাকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলল—আপনি এইখানে কেন? আমি সোজা উত্তর দিলাম—আপনার সঙ্গে কথা আছে। সে পুরো খাবার শেষ না করেই হাত ধুয়ে আমাকে বললেন—ঘরে ঢোকেন। বলেন কেন এসেছেন? জানতে এসেছেন সেইদিন আপনার সঙ্গে ওই আচরণ করেছিলাম কেন? বেশি কথা বলার সময় নাই। পির মাহবুব যদি জানতে পারেন আপনি এইখানে চইলা আইছেন, তাইলে আপনার কপালে দুর্দশা আছে। সেইদিনের ঘটনা সব পির মাহবুবের সাজানো নাটক। আপনার স্ত্রীকে একান্ত কইরা পাওয়ার জন্য এই নাটক সাজিয়েছিল। আমার কিছু করার ছিল না। বাধ্য হয়ে আমি তার নাটকে অভিনয় করেছি। আপনি জেলে যাবার পরে আপনার স্ত্রীকে বাদল দাদা পির মাহবুবের বাড়িতে নিয়া আসে। পির মাহবুব আপনার স্ত্রীকে দিনের-পর-দিন জোর করে ভোগ করতে থাকে। আপনার স্ত্রী গর্ভবতী ছিল। উঁচু পেট পির মাহবুবের কাছে ভালো লাগে নাই। তাই জন্মনিরোধক বড়ি খাইয়ে আপনার স্ত্রীর গর্ভপাত করানো হইছে। বড়ি আমিই খাওয়াইছি। খাওয়াইতে বাধ্য হইছি। এরপর আপনার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাসায় রেখেই চিকিৎসা চলছিল। অবস্থা যখন বেগতিক, তখন হসপিটালে নেওয়া হয়। তারপরের ঘটনা তো আপনি নিজেই জানেন। যাই হোক, আপনি এইখান থেকে তাড়াতাড়ি চইলা যান। যা জানতে চান তা তো বললাম। আর এইসব জাইনা লাভ নাই। আপনি কোনও ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। উলটাপালটা চিন্তা করলে আপনার অবস্থাও ভয়াবহ হবে। পির মাহবুবের খুব কাছে থাকেন বলেই মনে কইরেন না আপনি তার সম্পর্কে সবকিছু জেনে গেছেন। যেকোনও একজন মন্ত্রীকেও থাপড়ানোর ক্ষমতা তার আছে। এই শহরটা তার হাতের মুঠোয়। আপনি দ্বিতীয়বার এইখানে আর আইসেন না।
কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম।
নিজামউদ্দিন খুনি একশোটা খুন করার পর আরেকটা খুন করে আউলিয়া হইয়া গেছিলেন। আমি কখনও খুন করিনি; কিন্তু, এই লেবাসধারীর পাল্লায় পড়ে অনেক পাপ করেছি, একে খুন করে পৃথিবীতে আপাতত একটা ভালো কাজ করতে চাই। এই শুয়োরের বাচ্চাটাকে খুন করলে অনেক মানুষ বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবে। এই ভণ্ডের অপকর্ম লুকিয়ে ভিডিও করে কোনও লাভ হবে না। ওর বিচার কেউ করবে না। ওকে অবশ্যই-অবশ্যই হত্যা করতে হবে। কীভাবে হত্যা করব? ওকে হত্যা করে এই শহর থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনও রাস্তা নাই। তবু ওকে হত্যা করতেই হবে। ওকে হত্যা করার রাস্তা একটা বের করতেই হবে। অনেক ভেবেচিন্তে বুদ্ধি বের করলাম—ওকে মদের সঙ্গে বিষ খাইয়ে মারবো। প্রতিদিন একটু-একটু করে বিষ খাওয়াবো, প্রতিদিন একটু-একটু করে মারবো। যেই চিন্তা সেই কাজ। দূরের একটা দোকান থেকে কীটনাশক কিনে আনলাম। এরপর প্রায় প্রতিদিন খুব কে․শলে একটু-আধটু করে বিষ দিতে থাকলাম। ভণ্ডটা মদ পান করলে যেহেতু আমাকেও করতে হতো, সেহেতু ওরে বিষ খাওয়ানোটা আমার জন্য খ্বু কঠিন হয়ে পড়ে।
খোদার খাসিটা একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি তার স্ত্রীকে ডেকে বললেন—আজকাল আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। হাতপা অবশ হয়ে আসে। পেটের ভেতর সমস্যা করে। বুঝতেছি না আমার কেন এমন হচ্ছে। কুদরতকে বাড়িতে আসতে বলো। আমার চিকিৎসার দরকার। গুরুমা তার মেজো ছেলে কুদরতকে ফোন দিলেন। কুদরত বিস্তারিত শুনে বাড়িতে ডাক্তার পাঠিয়ে দিলো। ডাক্তার এসে অনেককিছু জিজ্ঞেস করল এবং বলল—আপনার খাওয়াদাওয়া খুব হিসাব করে করতে হবে। অ্যালকোহল জাতীয় কোনওকিছু পান করবেন না। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর সাঁইজি আমাকে বললেন—কি রে, মদ তো দুই-একদিন ধইরা খাই না। আগে তো সমস্যা হইতো না। এখন কী আমারে ডেট ফেইল মদ খাওয়াস? এরপর দেইখা শুইনা ভালো মদ আনবি। আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম— জি সাঁইজি, আজকে থেকে অন্য ব্র্যান্ডের মদ আনবো।
আমি খুব ভয়ে ছিলাম সাঁইজি আমাকে সন্দেহ করে বসে কি-না। আমি হাল ছেড়ে দিলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম বিষের পুরো বোতল খাইয়ে দেবো। ওকে বিষ দিয়ে হত্যা করাটাই একমাত্র সহজ পথ। আপাতত দুই-একদিন বিষ দেওয়া যাবে না। যদি সন্দেহ করে আমাকে নজরদারিতে রাখে, তাহলে সমস্যা। তারচেয়ে নতুন ব্র্যান্ডের মদ দিয়ে তাকে কিছুদিন সময় দিই। বিশ্বস্ততার বন্ধন একবার ছিঁড়ে গেলে তাকে হত্যা করার সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এরপর থেকে কয়েকদিন তাকে নতুন মদ দিলাম। সে আবার পূর্ণরূপে ফিরে এলো।
আমার দিন যায় না রাত যায় না। কবে কখন হারামিটাকে মেরে ফেলবো, তবে তো আমি শান্তি পাবো, আমার আয়শার আত্মা শান্তি পাবে। অপেক্ষার প্রহর কাটে না। কিন্তু, এই হারামজাদাটা বেঁচে থাকতেই আমার মামলাগুলো ডিসমিস করতে হবে। নয়তো মামলার ঘানি টেনে আমার জীবন যাবে। জানোয়ারটাকে বললাম—সাঁইজি, আমার মামলাগুলো শেষ করে দেওয়া যায় না? জানোয়ারটা বলল—আমি বাঁইচা থাকতে তোরে আর পুলিশে ধরবো না। তুই চিন্তা করিস না। আমি মনে মনে বলি—আরে শুয়োরের বাচ্চা, তুই তো আর বেশিদিন বাঁচবি না। তুই তাড়াতাড়ি আমার মামলা শেষ কর। আমি তোর কাঁধে আজরাইলকে বসা দেখতেছি। আজরাইল তোর জানটা খুব তাড়াতাড়ি টাইনা বাইর করবেন।
আমার টেনশন হয়, হারামজাদাটার মৃত্যুর পর আমি কোথায় যাবো? সোজা বাড়িতে চলে যাবো? বাড়িতে গিয়ে আয়শার কথা কী বলবো? আবার ভাবি, যা- হয়-হবে, আগে আমার মিশনটা সাকসেস করি। এই পশুটাকে আগে দুনিয়া থেকে বিদায় করে নিই।
ফেরারি
বিষের বোতল পুরোটা কোনওভাবেই খাওয়ানো হয়ে উঠছে না। নতুন ব্র্যান্ডের মদ খেয়ে আমি বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পরেই ভণ্ডটা সাধুসঙ্গ আরম্ভ করল। কে কী বলছিল আমি শুনতে এবং বুঝতে পারছিলাম। শুধু বসে থাকার শক্তি নাই। কয়েক ঘণ্টা আলোচনা শেষে সাধুসঙ্গ ভেঙে গেল। পানির পিপাসায় গলা শুকিয়ে গেছে। কোনওভাবে মোচড় দিয়ে উঠে পানি পান করতে গেলাম। জগে কে পানি ভরে রেখেছে জানি না। আমিই ভরে রেখেছিলাম কি-না মনে পড়ছে না। জগ থেকে এক গ্লাস পানি পান করলাম। গ্লাস রেখে দেওয়ার শব্দ শুনে সাঁইজি বললেন—শিমুল, আমারে এক গ্লাস জল দে। ওই জগ থেকেই এক গ্লাস জল এনে দিলাম। ঢকঢক করে জলটা পান করে চার হাতপা চারদিকে ছড়িয়ে সাঁইজি শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরেই নাক ডাকার শব্দ পেলাম। সাঁইজি বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। আমিও দুচোখের পাতা ধরে রাখতে পারছি না। আজকে কেন এতো ঘুম চলে আসছে বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে এটা মরণের ঘুম। হাতপায়ের রগগুলোতে টানটান ব্যথা অনুভব করলাম। ভেতর থেকে উত্তপ্ত বায়ু¯্রােত বেরিয়ে আসছে।
ঘুমের ঘোরে দেখলাম কালো পোশাক পরিহিত একজন লোক আমাকে ডাকছেন—শিমুল দাদা, ও শিমুল দাদা, ঘরের দরজাটা লাগিয়ে ঘুমাও। ভাবলাম সাধুসঙ্গ চলার সময় লোকটা হয়তো বাথরুমে গিয়েছিল, বের হতে দেরি হইছে, আর উনাকে ভেতরে রেখেই দরজা লাগিয়ে দিয়েছি। দরজা খুলে দিলাম। দেখলাম সাঁইজির নাকডাকা বন্ধ হয়েছে। তিনি শান্তির ঘুম দিচ্ছেন। লোকটা চলে যাবার পরে দরজা লাগিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম।
ভোরবেলা গুরুমার ডাকে আমার ঘুম ভাঙে। অতঃপর দরজা খুলে দিয়ে দেখলাম সাঁইজি বিছানায় মরে পড়ে আছে! মৃত লাশটা দেখে মনে হলো—এইটা তো স্বাভাবিক মৃত্যু না। তাকে হত্যা করা হয়েছে। শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। কে হত্যা করল? কালো পোশাক পরিহিত সেই লোকটা কি হত্যা করেছে? আমি তো পাশেই ছিলাম, কই কোনওকিছু তো টের পেলাম না।
অনেকটা ভয় ও সন্দেহের ভেতর দিয়ে সাঁইজির সমাধি রচনা হলো। এই মৃত্যুতে শান্তি ও স্বস্তি পেলেও মনের ভেতর অশান্ত একটা ঝড় শুরু হলো। কে করল সাঁইজিকে হত্যা? সাঁইজির মেজো ছেলে কুদরতের আশ্বাসে আশ্বস্ত হলাম এই হত্যার দায়ভার আমার উপরে পড়বে না। কিন্তু, দুশ্চিন্তা আমাকে ঘিরে ধরলো। এইখানে থাকা কি আমার জন্য ঠিক হবে? এখন আমার মামলাগুলোর কী হবে? বাদলের ফোন পেলাম। ফোন পেয়ে বাদলের কাছে চলে গেলাম। বাদল সরাসরি বলল—তুই হত্যা করছস সাঁইজিরে? বাদলরে সোজা উত্তর দিলাম—না, আমি করিনি। বাদল কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল—তুই মেজো হুজুর কুদরতকে বলে এইখান থেকে চইলা যা। একটা সময় বিপদে পড়তে পারিস।
আমি মেজো হুজুর কুদরতের কাছে গেলাম। কুদরত বলল—আচ্ছা শিমুল দাদা, ওই দিন রাতের সব ঘটনা তোমার মনে আছে? কী ঘটেছিল সে রাতে? কুদরতকে সব খুলে বললাম। কুদরত বলল—জগে কে পানি ভরে রেখেছিল বলতে পারো? কালো পোশাক পরিহিত লোকটাকে তুমি চিনতে পারছো? আমি বললাম—না, জগে কে পানি ভরে রেখেছিল মনে করতে পারতেছি না। কালো পোশাক পরিহিত লোকটা কে তাও স্মরণ করতে পারতেছি না। লোকটা ঠিক আপনার মতোই মোটাসোটা ও লম্বা। কুদরত ওর মুখটা আমার কানের কাছে এনে বলল—জগে আমিই পানি ভরে রেখেছিলাম। ওটাতে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। সাধুসঙ্গ শুরু হওয়ার অনেক আগেই গুরুগৃহে আমি লুকিয়ে ছিলাম। হত্যা আমিই করেছি। নিজ হাতে আমি আমার জন্মদাতা পিতাকে হত্যা করেছি। ইচ্ছে করলে আমি তোমাকে এই হত্যাকাণ্ডে ফাঁসিয়ে দিতে পারি, কিন্তু দেবো না। আমি এতোটা জঘন্য নই। আমি জানি তুমিও আমার পিতাকে হত্যা করতে চেয়েছিলে। তোমার কাজটা আমি সহজ করে দিলাম। এইবার তুমি এই এলাকা ছাড়ো। কিন্তু, কিছুদিন পরে ছাড়ো। বাজানের একদল মুরিদ সন্দেহ করতেছে বাজানকে হত্যা করা হইছে। এই অন্ধ মুরিদদের একটু শান্ত হইতে দেও, তারপর দুচোখ যেইদিকে যায় সেইদিকে চইলা যাইও। কুদরতকে বললাম—আমি কোথায় যাবো? আপনার বাপের সাজানো নাটকে আমি বন্দি। আপনার বাপের কারণে আমার স্ত্রীকে হারাতে হইছে। আমি বাড়িতে গেলে আমার স্ত্রীর কথা জানতে চাইলে আমি কী উত্তর দেবো? আমার শ্বাশুড়ি যদি জানতে পারেন আয়শা মারা গেছে, তিনিও যদি আমার নামে মামলা করেন, তাহলে আমি কী করব? আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনও উপায় নাই। অথবা, আমার যদি জেল খাটতে হয়, তাইলে আমি সব ঘটনা ফাঁস করে দেবো।
কুদরত আমার মুখ চেপে ধরে বলে—সাবধান! এইখানে কি চলে ফাঁস করার কথা ভুলেও চিন্তা কইরো না। তোমাকে কেটে টুকরোটুকরো করা হবে, একটা কাকপক্ষীও জানবে না! তারচে বরং তোমাকে একটা পথ দেখিয়ে দিতে পারি, তুমি বিদেশ চলে যাও। তোমাকে বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থা আমিই করে দেবো। বিদেশ যাও, কামাই রুজি করো, বাবা-মায়ের সেবা করো। বাবা কাবার মতো, মা মদিনার মতো। তাদেরকে মক্কা-মদিনার মতো সম্মান করো। নবিজি তো বাবা- মায়ের সেবা করতে পারেন নাই। তাই তিনি বলে গেছেন—আমি যা করতে পারি নাই, তোমরা তা কইরো। আমি আমার বাবার যথেষ্ট সেবা করে দিলাম। তিনি পৃথিবীতে যতোদিন বেঁচে থাকতেন, ততোদিনে তাঁর পাপের বোজা আরও ভারী হইতো। তাই তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়ে পাপের বোজা হালকা করে দিলাম। এখন থেকে এই পাপের বোজা আমি মাথায় নিলাম। এই গুরুগৃহ, খানকা, মাজার, হোটেল রেস্টুরেন্ট, গেস্ট হাউজ ও হসপিটাল আমার নিয়ন্ত্রণে। এই সাম্রাজ্যের রাজা এখন আমি। এই সাম্রাজ্যের প্রজা হিসেবে আমি তোমাকে দেখতে চাই না। এইখান থেকে তুমি পালিয়ে যাও। আমি তোমাকে পালাতে সাহায্য করবো। টাকাপয়সা লাগলে আমি দেবো। বিদেশ চলে যাও। রাজি আছো?
অনেকটা ভেবেচিন্তে কুদরতকে বললাম—ঠিক আছে দাদা, আমি বিদেশ চলে যাবো। তার আগে আমি আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। আর আমার তো পাসপোর্ট নাই, আমাকে কীভাবে বিদেশ পাঠাবে? কুদরত বলল—পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে চিন্তা কইরো না। সবকিছুর প্রসেসিং আমি কইরা দিমু। তুমি তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা কইরা আসো।
সেদিন সন্ধ্যার দিকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রাত এগারোটায় আমি আমার গ্রামে প্রবেশ করলাম। কাউকে কোনও পরিচয় না দিয়ে পথ হাটলাম। সোজা বাড়িতে না গিয়ে বাবুলদের বাড়িতে গেলাম। বাবুল আমার গ্রামের সেই পুরোনো বন্ধু। আয়শারে বিয়ে করতে ও শহর যাইতে যে আমারে সহযোগিতা করেছিল। বাবুল বাড়িতে নাই। এতো দিনে বাবুলের ফোন নাম্বার ভুলে গেছি। বাবুলের বোনের কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে কল দিলাম। বাবুল বিশ মিনিটের মধ্যে চলে এলো। ওরে নিয়ে দূরে রাতের অন্ধকারে জনশূন্য খোলা মাঠে গেলাম। সবকিছু খুলে বললাম। বাবুলের কাছে জানতে পারলাম আয়শার মা ছয়মাস আগে মারা গেছে! মানুষের মৃত্যুতে মানুষ কাঁদে। কিন্তু, আয়শার মায়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম। আমার আর কারও কাছে ক্সকফিয়ত দিতে হবে না। বাবুল আমার কথাগুলো চুপচাপ শুনছিল। রাতের আঁধারেই অনুভব করলাম ওর চোখ দিয়ে অবিরত জল গড়িয়ে পড়ছে। কথার ফাঁকে-ফাঁকে আমারও দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বাবুল আমার পীঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিল।
বাবুলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাড়িতে গেলাম। গভীর রাতে আমার কণ্ঠ শুনে মা তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলো। এতো দিনেও আমার কণ্ঠস্বর মা ভুলে যায়নি। অভিমান ভুলে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বলল—তুই এতো রাতে আসলি কেন? আয়শারে নিয়ে আসিস নাই কেন? আয়শা কোথায় আছে? একবার ভুল করছি দেইখা কী দ্বিতীয়বারও ভুল করমু? আয়শারে নিয়া এলে কি আমি রাগ কইরা থাকতে পারতাম? যার জন্যে তুই বাবা-মায়েরে ভুইলা যাইতে পারস, বাবা- মা হইয়া কি আমরা তারে বুকে ঠাঁইনা নিতে পারুম না? আয়শা কোথায়? বাবারে জড়িয়ে ধরে চিৎকার দিয়ে বলি—বাবা, সব শ্যাষ! আয়শা নাই। তোমার ছেলেও বাইচা থাকতেও মইরা গেছে।
বাবা-মাকে সব ঘটনা খুলে বললাম।
সকাল হলে আমি বাড়িতে ফিরে এসেছি খবর পেয়ে প্রতিবেশীরা জড়ো হতে পারে। নানান জনে নানান প্রশ্ন করতে পারে। ভোরের আলো ফোটার আগেই আমাকে গ্রাম ত্যাগ করতে হবে। বাবা-মাকে বললাম—আমি বিদেশে যাওয়ার পর কামাই রুজি কইরা টাকাপয়সা পাঠাইলে ভালো দেইখা একটা উকিল ধইরা আমার মামলাগুলো শেষ কইরো।
ভাই-ভাবির সঙ্গেও দেখা করলাম না। ভাইর ফোন নাম্বার আর বাবার ফোন নাম্বার নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ফজরের আজান দেওয়ার আগেই বাবুল আমারে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়ে গেল। সোজা চলে এলাম কুদরতের কাছে। আসার আগে বাবুলরে বলে এলাম—মাদ্রাসা থেকে হারিয়ে যাওয়া আমাদের বন্ধু বাদল বাবা ইয়ামেনি শাহ (রহ)-এর মাজারেই আছে, তুই কয়েকটা দিন পর ওর বাপ-মায়ের কাছে খবর দিস, আমি আগে বিদেশ যাই তারপর।
আসার সময় বাবুল বলল—ভবিষ্যৎ নিয়া অতো চিন্তা করিস না। বিদেশ চইলা যা। কামাই রুজি কইরা টাকাপয়সা দিয়া মামলাগুলো শেষ কইরা কয়েকবছর পরে বাড়িতে আইবি। তুই যে বিদেশ গেছস এইটা দুনিয়ার আর কাউরে কইবি না। শুধু আমি জানলাম, আর তোর বাপ-মা জানলো। বাড়িতে আসার পরে কেউ কোনওদিন আয়শার কথা জিগাইলে কইবি আয়শা তোরে ছাইড়া অনেক আগেই আরেক বেডার লগে ভাইগা গেছে। বলবি, কোথায় গেছে জানি না।
পবিত্র আত্মার নামে এমন অপবাদ দেবো ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠল। তবু জীবনচলার পথে টিকে থাকতে হলে কিছু লুকাতে হবে, একটু অভিনয় করতে হবে, বাবুলের কথায় যুক্তি পেলাম।
অভিযাত্রা
কুদরত একটা ফোন নাম্বার আর কিছু টাকা দিয়ে বলল—আগামীকাল সন্ধ্যায় রামপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে উইঠা সোজা মোহাম্মদপুর যাইবা। মোহাম্মদ অলংকার মোড়ে নাইমা এই নাম্বারে কল দিবা। তোমার কল পাইয়া একজন লোক আইবো। সে তোমারে যেইখানে নিয়া যাইবো, তুমি তার পিছে-পিছে যাইবা। লোকটা তোমারে সম্ভবত কলাতলি নিঁদমহল গেস্ট হাউজে নিয়া যাইবো। যাইতে- যাইতে তোমার রাত হইবো। রাতেই তোমারে সাগরপারে নিয়া যাইবো। সাগরপারে একটা জাহাজ আইবো। জাহাজে আরও যাত্রী থাকবো। সেই জাহাজে কইরা বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়া থাইল্যান্ডে যাইবা। থাইল্যান্ড থেকে গাড়িতে কইরা তোমাগো মালয়েশিয়া পৌঁছাইয়া দিবো। মালয়েশিয়ার পেনাং রাজ্যে আমার লোক আছে, সে তোমারে কাজে লাগাইয়া দিবো। কাজ করবা আর টাকাপয়সা জমাইবা। কামাই রুজি কইরা মানুষের মতো মানুষ হও, শুভ কামনা।
রাতে গেস্ট হাউজে ঘুমিয়ে রইলাম। সকালে চলে গেলাম বাদলের কাছে। বিদেশের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই বাদল বলল—হ, কুদরত আমারে কইছে তোরে বিদেশ পাঠাইবো। কিন্তু, সাগর পাড়ি দিয়া মালয়েশিয়া যাইবি এইটা ভাবতেই ভয় লাগতেছে। জানি না কপালে কী আছে। আমি বললাম—আল্লাহ ভরসা, যা হয় হইবো। তবু এই জাহান্নাম থেকে আগে আমার মুক্তি পাওয়া দরকার। বাদল বলে—জানি না কেন তোরে বিদেশে পাঠাইতেছে। জানি না কুদরতের মনের মইধ্যে কী। যে মানুষ নিজের বাপেরে মাইরা ফালাইতে পারে, সে যে মানুষের কত ভালো চাইবো সেইটা নিয়া সন্দেহ হয়। আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম—সে তার নিজের বাপরে মাইরা ফালাইছে, এইটা তুই কেমনে জানোস? বাদল বলে—আমারে ডাইকা নিয়া কুদরত সবকিছু কইছে। আর সাবধান কইরা দিছে এইখানে যা কিছু ঘটুক, আমি যেন চুপচাপ থাকি। তার বাপের সঙ্গে যাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছিল সে তাদের একজনকেও এই মাজার, খানকা, গুরুগৃহ, হসপিটাল, রেস্টুরেন্ট ও গেস্ট হাউজে দেখতে চায় না। কুদরত এইসব তার নিজের বাহিনী দিয়া নতুন নিয়মে চালাইবো। আমরা ওর কথা না- শুনলে যেকোনও উপায়ে আমাগো শুনাইবো। কুতরদ ওর বাপের চেয়েও ভয়ংকর। ওর কথা না-শুনলে চরম মূল্য দিতে হইবো। আমি বললাম—এজন্যই বিদেশে যাইতে রাজি হইছি। এইখানে থাইকা কী করমু ক? সারাজীবন মদ-গাঁজা খাইয়া কুকুরের মতো মাজারে পইড়া থাকা ছাড়া আর কি কিছু করার আছে এইখানে? তারচে বিদেশে যাওয়াটাই ভালো।
পির মাহবুবের এই আখড়াটা জাহান্নাম হলেও এই জাহান্নামের প্রতি এতোদিনে একটা মায়া জন্মেছিল। ঘুরে-ফিরে সেই বটগাছ, বটগাছের ডালে- ডালে ঝুলে থাকা টুকরো-টুকরো লাল রঙের কাপড়, গাছটার উঁচু ডালে বাঁশে বাঁধা লাল রঙের নিশান, গাছের নিচে বড়োসড়ো পাথরখÐ ও পাথরের উপর পিতলের কলসিটা দুচোখ ভরে দেখলাম। দেখলাম এখনও দর্শনার্থীরা দানবাক্স ও পিতলের কলসিতে সোনা গহনা এবং টাকাপয়সা ফেলছে। কেউ কেউ মাজার জিয়ারত করছে। একদল লোক জাগায়-জাগায় বসে গাঁজা টানছে। আরেকদল লোক ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো শুয়ে-বসে আছে। মাজারে কে কখন তোবারক নিয়ে আসবে, কুকুরগুলো তা চকাস-চকাস করে খেয়ে তৃপ্তির ঘুম দিবে। চলে গেলাম খানকা শরিফে। সাঁইজির বসার রাজসিংহাসনটা এখনও জায়গামতো আছে। সিংহাসনটা স্পর্শ করে দুচোখ বন্ধ করে অনুভব করলাম সাঁইজি এইখানে বসতেন। এইখানে, এই চেয়ারে খোদার একটা খাসি বসে খেলা করতো, যে ছিল শয়তানের চেয়েও ভয়ংকর! খানকা ও মাজারের চারপাশ ঘুরে দেখলাম, সঙ্গে বাদল। বাদল কোনও কথা বলছে না। বাদল কী আমার মতোই স্মৃতির রাজ্যে বিচরণ করছে? ওরও কি খারাপ লাগছে? হয়তো তাই।
এরপর মাজারের ভেতর ঢুকলাম। সাঁইজির কবরটা এখনও তরতাজা, মাটি শুকায়নি। রাজমিস্ত্রিরা কাজ করছে। কবরটা পাকা হবে। টাইলস লাগানো হবে। তারপর তুর্কি চাদরে ঢেকে দেওয়া হবে। কবরের পাশে আগরবাতি মোমবাতি জ্বলবে। কৃত্রিম ফুলদানি থাকবে। কবরের উপরের আলোকোজ্জ্বল লাইট লাগানো হবে। এরপর এটা কবর থেকে মাজারে রূপান্তরিত হবে। মানুষেরা আসবে, কবর জিয়ারত করবে। এখানে আসা সরল বিশ্বাসের মানুষেরা আল্লাহর অলি মনে করে কবরের ভেতরে শুয়ে থাকা মানুষটাকে উছিলা করে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করবে, কতকিছু চাইবে। কেউ জানবে না এইখানে শুয়ে আছে আস্ত একটা শয়তান। যুগের-পর-যুগ, শতাব্দীর-পর-শতাব্দী ধরে কিংবা হাজার-হাজার বছর ধরে হয়তো চলবে এই পূজা-অর্চনা। আবার নতুন কবর রচিত হবে, কবরটা মাজারে রূপান্তরিত হবে। কবর আর মাজারের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে—কবরে থাকে পাপীতাপী, মূর্খ ও সাধারণ মানুষ; মাজারে থাকে আল্লাহর বন্ধু অলি-আউলিয়া। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে মাজারের কর্মযজ্ঞ দেখলাম। মাজার নির্মাণের তদারকি করছেন শামসু চাচা।
শামসু চাচা বাদলরে বললেন—চলো ভাতিজা তোমার রুমে যাই। বাদলের রুমে গেলাম। শামসু চাচা পাঞ্জাবির পকেট থেকে বেশকিছু ইয়াবা ট্যাবলেট বের করে দিলেন। তিনজনে বসে ইয়াবা টানলাম। আমি যে আজ সন্ধ্যায় মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে এই আখড়া ত্যাগ করব, এটা কি শামসু চাচা জানে? কথার ফাঁকে একসময় বাদল জানতে চাইলো—শামসু চাচা, শিমুল এইখান থেকে চইলা যাইতেছে তুমি কি জানো? শামসু চাচা বললেন—কই, কিছু জানি না তো। বিদেশে পাঠিয়ে দিলে তো ভালোই। আমার মতে বিদেশ চইলা যাওয়াই ভালো। এই সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হইবো না। শিমুলরে ছাড়া আমাগো খুব খারাপ লাগবো। আফসোস কইরা লাভ নাই, দোয়া করি শিমুল স্বাভাবিক জীবনে ফিরা আসুক। এইখানে গোলামি কইরা কোনও লাভ আছে? আমি আমার জীবনটা এইখানে শেষ কইরা দিছি। এখন আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই।
শামসু চাচাকেও বুঝতে পারি না। এ লোকটাও সুবিধাজনক না। আমাকে বিদেশ পাঠানোতে তার সম্মতির মতি-মতলব কী জানি না। যাই হোক, আমি চিন্তা করে যতটুকু স্থির করেছি, এতে আমার বিদেশ চইলা যাওয়াই ভালো। ইয়াবা টানা শেষে শামসু চাচা চলে গেল। বাদলের কাছ থেকে আমি উঠলাম। বিকেলেই আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতে হবে। সন্ধ্যায় বাসে উঠতে হবে। আমার কাপড়চোপড় গুরুগৃহে আছে। বাদলরে রেখে গুরুগৃহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
সাঁইজির বাসায় অধরা মায়ের অনুমতি ছাড়া যে-কারও প্রবেশকে নিষেধ করা হয়েছে। দারোয়ানকে হুকুম করে গেছে কুদরত। আমাকে চেনার পরেও দারোয়ান আমাকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দিলো। বলল—এইখানে আপনে দাঁড়ান, গুরুমা যদি ঢুকতে দেয় তো ঢুকতে পারবেন। দারোয়ান ফিরে এসে গেইট খুলে দিয়ে বলল— যান, গুরুমা যাইতে কইছে। বাসার ভেতরে গিয়ে দেখি গুরুমা চোখেমুখে লজ্জার ছাপ নিয়ে তার রুমে চেয়ারে বসে আছেন। আমাকে দেখে মাথাটা নিচু করে খাটে বসার ইঙ্গিত দিলেন। আমি তার পায়ে ভক্তি দিয়ে খাটে গিয়ে বসলাম। তারপর গুরুমা বললেন—শিমুল, আমারে ক্ষমা কইরা দিও বাপ। তুমি আমার ছেলের মতো। সেদিন যা হইছিল তা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হইছিল। পির মাহবুব হাসতে- হাসতে যে আদেশ আমাকে করতেন, তা হাসতে-হাসতেই আমাকে মেনে নিতে হইতো। প্রথম-প্রথম তার অনেক আদেশকে অমান্য করতাম। অনেক নির্যাতন সহ্য করার পর একসময় তার অনুগত হই। তার অনুগত হওয়া ছাড়া আমার কোনও উপায় ছিল না। এই লোকটার জঘন্য কৃতকর্মের সাক্ষী আমি। তার মৃত্যুতে আমি দুঃখী নই। আমি এখন মুক্ত। প্রথমে সন্দেহ করেছিলাম এই হত্যাকাণ্ড তুমি ঘটিয়েছ। এখন জানতে পেরেছি কে করেছে এই কাজ। যে এই কাজ করেছে তার প্রতি আমি সন্তুষ্ট থাকবো না-কি তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করবো বুঝতেছি না। কারণ, সে নিজেও তার বাবার ফটোকপি। সে আমার আপন মায়ের পেটের বোন তার খালার সঙ্গে অ‣নতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এমনও হতে পারে আমার বোনকে পুত্রবধূ করে ঘরে তোলা লাগতে পারে। তবে এইটুকু নিশ্চিত, এখন আর আমার যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হবে না। ছেলে কখনও তার মাকে অন্যের সাধনসঙ্গিনী হিসেবে চাইবে না। তুমি আমার শয্যাসঙ্গী হয়েছিলে এটা কুদরত জানে। যতদূর জানি এই আখড়া থেকে তোমাকে চলে যেতে হবে। যেখানেই যাও, ভালো থেকো। তোমার স্ত্রী আয়শার মৃত আত্মার প্রতি দোয়া রইল, সে যেন জান্নাতবাসী হয়। তোমার স্ত্রী পির মাহবুবের নির্যাতনে পৃথিবী ত্যাগ করেছে। তোমার স্ত্রী তোমাকে যথেষ্ট ভালো বাসতো। সে যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন তার মুখ দিয়ে শুধু তোমার নামটাই উচ্চারিত হচ্ছিল। যাও দেরি করো না। তোমার যাকিছু আছে নিয়ে বেরিয়ে যাও। এই বাসায় তোমার আসা নিষেধ করে গেছে।
অধরা মায়ের পায়ে দ্বিতীয়বার সালাম করে গুরুগৃহ থেকে কাপড়চোপড় গুছিয়ে বেরিয়ে এলাম।
সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। সন্ধ্যার আগেই আমাকে রামপুর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতে হবে। অটোরিকশায় রামপুর বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা দিলাম।
ধর্মখালী
সন্ধ্যায় টিকিট কাটলাম, রাত নয়টায় বাস ছেড়ে দিল। অন্ধকারের বুক চিরে কয়েকটা জেলা পেরিয়ে আমাদের বাস ভোরের আজানের আগেই মোহাম্মদপুর অলংকার মোড়ে থামলো। চারদিক পরি®‥ার হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাকে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। আস্তে-আস্তে চারদিক পরি®‥ার হলো, লোকজন আর ছোটো-ছোটো গাড়িঘোড়ায় ভরে গেল পুরো শহর। দোকানপাট খুলল। একটা হোটেল থেকে ডিম পরোটা খেয়ে নিলাম। তারপর কুদরতের দেওয়া সেই ফোন নাম্বারে কল করলাম। কলটা রিসিভ করে লোকটা আমাকে অলংকার মোড়েই অপেক্ষা করতে বলল। প্রায় ত্রিশমিনিট পর লোকটা এসে আমাকে সিএনজিতে করে একটা ওভারব্রিজের কাছে নিয়ে গেল। ওভারব্রিজের নিচেই স্টেশন। সেখানে কুকি-চিনের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে লোকটা একটা ফোন নাম্বার দিয়ে বলল—ওইখানে আমাগো লোক আছে, ওইখানে নাইমা কল করবেন, আপনারে রিসিভ কইরা নিয়া যাইবো। গাড়িতে করে কুকি-চিন পৌঁছলাম। কুকি-চিন পৌঁছে কল দিলাম লোকটার দেওয়া ফোন নাম্বারে। কল রিসিভ করার পাঁচমিনিটের মধ্যে একটা লোক এলো। স্টেশনের কাছে একটা চায়ের দোকানে আমাকে এক কাপ চা পান করালো। সে আরেকটা ফোন নাম্বার দিয়ে বলল—আপনি কলাতলি পৌঁছানোর পরে এই নাম্বারে কল দিবেন। আর রাস্তায় কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কইবেন ঘুরতে আইছি। কুকি-চিনের মানুষটার ভাষা শুনে মনে হলো আমি বোধহয় বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে পা রেখেছি। অথবা, কুকি-চিন বাংলাদেশের মধ্যে আরেকটা দেশ। এদের মুখের কথা অনুমানে বুঝে নিতে হয়। তারা যে-ভাষায় কথা বলে সে-ভাষায় লিখতে পারছি না, এজন্য দুঃখিত। তাদের সঙ্গে আমার যে কথাবার্তা হয়েছিল এখানে আমি তা আমার ভাষায় বলার চেষ্টা করবো। কুকি-চিন থেকে একটা মাইক্রোবাসে কলাতলি পৌঁছলাম। কুকি-চিনের লোকটার দেওয়া ফোন নাম্বারে কল দিতে-না-দিতেই একজন যুবককে পেয়ে গেলাম। সে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। দুইজনে মিলে একটা রিকশায় উঠলাম। রিকশাটা নিঁদমহল নামক একটা গেস্ট হাউজের সামনে থামলো। তারপর আমাকে একটা রুমে ঢোকানো হলো। রুমে ঢুকে দেখি আরও তিনজন লোক আছে। আমাকে রুমে ঢুকিয়ে লোকটা বলল—আপনারা অপেক্ষা করুন। রাত আটটার দিকে আমাদের জাহাজ ঘাটে এসে ভিড়বে। তারপর আপনাদের এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হবে। লোকটা যাওয়ার সময় বাহির থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে গেল।
প্রায় বিশ-একুশ মিনিট পরে গুন্ডার মতো দেখতে একটা লোক এলো। সে বলল—আপনারা শোনেন, আপনাদের কাছে যা কিছু আছে সবকিছু এইখানে রাইখা যাইতে হইবো। আপনারা কেউ কিছু এইখান থেকে নিয়া যাইতে পারবেন না। আপনারা জাহাজে ওঠার পরে আপনাদের নতুন পোশাক দিবো। আপনাদের যা কিছু দরকার জাহাজে পাইবেন। লোকটা আমাদের এক-এক করে সার্চ করলেন। টাকাপয়সা মোবাইল আংটি ঘড়ি যা কিছু ছিল সব নিয়ে নিলো। সঙ্গে আনা কাপড়চোপড়ের ব্যাগ নিয়ে নিলো। তখন শীতের মৌসুম। আমাদের পরনে যে জ্যাকেট ছিল, সেগুলোও খুলে নিলো। পরনের জ্যাকেট খুলতে-খুলতে বলল—আপনারা যেইখানে যাইতেছেন, ওইখানকার আবহাওয়া না-গরম, না- ঠান্ডা। ওইখানে মোটা কাপড়চোপড় লাগে না। আর শোনেন, জায়গামতো যাওয়ার আগে রাস্তায় আপনারা চিল্লাচিল্লি করবেন না। মোটরসাইকেলে করে আমাদের লোক আপনাদের জাহাজঘাটে পৌঁছাইয়া দিবো। টহল পুলিশ যদি বুঝতে পারে, তাইলে আপনাগো মালয়েশিয়া যাওয়া হইবো না। নিজেগো ভালো চাইলে, আমরা যেইভাবে কই ঠিক সেইভাবেই চলবেন। তখন আমার প্রচুর ক্ষুধা পেয়েছে। লোকটাকে বললাম—আমাকে খাইতে দিন, ক্ষুধায় টিকতে পারতেছি না। সে বলল—জাহাজে আপনাদের জন্য বিরিয়ানি রান্না হইছে, ওইখানে গেলেই খাইতে পারবেন। এই লোকটাও যাওয়ার সময় বাহির থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে গেল।
রাত সাড়ে আটটার দিকে দুইজন লোক এলেন। একজনে আমাদের বলল— আপনারা আমাদের সঙ্গে আসেন। আমরা গেলাম। গেইটের সামনে রাখা মোটরসাইকেলে আমাদের ওঠানো হলো। তখনও প্রচুর শীত। কুয়াশা আর রাতের অন্ধকারে নিজের শরীরটাও দেখা যাচ্ছে না। ঠান্ডায় জবুথবু অবস্থা। নিদ মহল গেস্ট হাউজ থেকে আমাদের একটা গ্রামের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কাচা রাস্তা। পনেরো মিনিট পরে মোটরসাইকেল একটা ফাঁকা বাড়ির সামনে পৌঁছালো। সেই বাড়ির একজন লোক এসে আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন—আমি যেইদিকে যাই আপনারা সেইদিকে চুপচাপ যাইবেন। চিল্লাচিল্লি করলে সমস্যা হইতে পারে। এরপর মোটরসাইকেল দুটো চলে গেল। আমরা ফাঁকা বাড়ির লোকটাকে অনুসরণ করলাম।
পিচ্ছিল ঠান্ডা কাদা আর ঘাসে ছেয়ে যাওয়া পথ মাড়িয়ে আমরা সাগরপারে পৌঁছালাম। লোকটার কাছে জানতে পারলাম এখানে সাগরের ফেনা থেকে লবণ তৈরি করা হয়। ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর, সম্ভবত লবণ পাহারা দেবার জন্যে ঘরটা তোলা হয়েছে। ঘরটার ভেতরে আমাদের ঢুকিয়ে লোকটা বললেন—জাহাজ আসার আগপর্যন্ত আপনারা এইখানে বিশ্রাম করেন। একথা বলে লোকটা চলে গেলেন। এতক্ষণে ক্ষুধায় আমাদের অবস্থা কাহিল। ঘুম, ক্ষুধা আর ঠান্ডা আমাদের নিস্তেজ করে দিলো। আমরা অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলাম। বিরক্ত হয়ে আমাদের মধ্য থেকে একজন বলল—চলেন, আমরা ঘুইরা যাইগা। এইভাবে অপেক্ষা করলে তো আমরা মইরা যামু। কিন্তু, এই রাতের অন্ধকারে আমরা কোনদিকে যাবো? আমরা তো পথ চিনি না। বাধ্য হয়ে রয়ে গেলাম। খুব ভোরে ঘাটে মাছ ধরার একটা ট্রলার ভিড়ল। ট্রলারে চার-পাঁচজন লোক, দুইজন লোক নেমে এসে বলল—আপনারা তাড়াতাড়ি ট্রলারে ওঠেন। আমরা বললাম—ট্রলার কেন? জাহাজ কই? আর আমরা তো ক্ষুধায় মইরা যাইতেছি। তারা বললেন—এই ঘাটে জাহাজ ভিড়তে সমস্যা। আপনারা ট্রলারে ওঠেন, এখনই জাহাজে উঠিয়ে দিয়ে আসবো। আমরা সবাই ট্রলারে উঠলাম।
ঘণ্টাখানেক পরে আমাদের ট্রলারটা একটা দ্বীপ অঞ্চলে নোঙর করল। একজন মাঝি লাফ দিয়ে ডাঙায় নেমে বলল—আপনারা নেমে আসেন। এইখান থেকে পায়ে হাইটা জাহাজঘাটে যাইতে হইবো। আমরা নামলাম এবং তাকে অনুসরণ করলাম। সে আগে-আগে হাঁটলেন, আমরা পিছে-পিছে। দ্বীপটা ছোটো-ছোটো টিলা ও জঙ্গলে ভরা। টিলার কোল ঘেঁষে মাটি কেটে সমতল ভূমি বানিয়ে স্থানীয়রা ধান চাষ করেছে। কোথাও-কোথাও পানের বরজ। ঘুম ও ক্ষুধার অভাবে আমাদের শরীরটা নেতিয়ে গেছে। আমরা হাঁটতে পারছিলাম না। এক কৃষককে জিজ্ঞেস করলাম—ভাই, এই জায়গার নাম কী? সে বলল—ধর্মখালী।
হাঁটতে-হাঁটতে আমরা গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। সেখানে তাঁবু টানিয়ে একটা ক্যাম্প ক্সতরি করা হয়েছে। ক্যাম্পের ভেতর আরও চল্লিশজন লোক আছে! পাঁচ-ছয়জন দস্যু চে․কিতে বসা। তাদের সামনে বন্দুক, ধারালো ছুরি আর লাঠি। দস্যুরা বসে ইয়াবা টানছে। একজনকে বললাম—ভাই আমাদেরকে জাহাজে কখন উঠাইব? লোকটা ফিসফিস করে বললেন—ভাই, আমরা তো আইজ নয়দিন ধইরা বইসা আছি। কোনওকিছু কইলেই মারতে আসে। আমরা যে-কয়জন নতুন গিয়েছি, আমাদের খাবার খেতে দিলো, ভাত আর আলু ভর্তা। ভাত নরম হয়ে গেছে আর আলুভর্তা দিয়ে গন্ধ বেরিয়েছে। তবু ক্ষুধার যন্ত্রণা মেটাতে খেয়ে নিলাম। ক্যাম্পের মেঝেতে প্লাস্টিক বিছানো হয়েছে। কারও পায়ে জুতা না থাকার কারণে সাদা প্লাস্টিক নোংরা হয়ে গেছে। চার-পাঁচজন করে গোল হয়ে যার যার মতো গল্প করতেছে। আমিও তাদের গল্পে যোগ দিলাম। লোকেরা বলাবলি করল—আমরা মনে হয় ফান্দে পইড়া গেছি। কপালে যে কী আছে আল্লাহই ভালো জানে।
ক্যাম্পে রসুলপুরের এক মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র ছিল। সে বলল—আমরা এইখান থেকে কবে মুক্তি পামু জানি না। তো, এইখানে শুধু-শুধু শুইয়া-বইসা না থাইকা আসেন আমরা নামাজ পড়ি। জোহরের ওয়াক্ত। ছেলেটা ইমামতি করার জন্য প্রস্তুত হলো। আমরা তার পেছনে লাইন ধরে দাঁড়ালাম। একজন আজান দিলো। আজান দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে একজন দস্যু মুয়াজ্জিনের পাছায় জোরেশোরে একটা লাথি মারলো। মুয়াজ্জিন মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। ইমামের তলপেটে বন্দুকের নল দিয়ে কয়েকটা খোঁচা দিয়ে বলল—এই নডির পুতেরা, তগো আল্লাহর গুষ্টিরে চুদি, এই জাগাত নমাজ নো পড়িস। লোকটা বোঝাতে চাইলো এখানে আমরা লুকিয়ে আছি। এখানে যদি আজান দিয়ে নামাজ পড়ি, তাহলে আজানের শব্দ শুনে পুলিশ এসে আমাদের ধরে ফেলবে। আমরা মুসুল্লিরা নামাজ ছেড়ে দিলাম।
রাতে একলোক আমার কানেকানে বলল—ভাই, এইখান থেকে পালাইতে হইবো। আমরা পাচারকারী চক্রের হাতে পড়েছি। আমি বললাম—কীভাবে পালাবো? লোকটা বলে—কেন? আমরা কতগুলো লোক, এই চার-পাঁচজন ডাকাতরে হঠাৎ কইরা আক্রমণ করুম। পিটাইয়া অস্ত্র কাইড়া নিয়া ওদের হাতপা বাইন্ধা ফালাইয়া রাইখা চইলা যামু। আমি বললাম—তাহলে তো এই বিষয়টা নিয়া সবার সঙ্গে কথা কইতে হইবো। সবাই যদি একমত থাকে তাইলে চেষ্টা কইরা দেখা যাইতে পারে। লোকটা বলে—ঠিক আছে, আমি দেখতেছি। বিষয়টি নিয়ে লোকটা খুব সাবধানে সবার সঙ্গে কথা বলল। আমাদের কথা পাকাপোক্ত হলো আগামীকাল সকালে ওদের উপর হামলা করবো। কিন্তু; সকাল হওয়ার সঙ্গে- সঙ্গেই দস্যুরা সেই লোকটাকে ডাকলো। তাকে ডেকে নিয়ে বেদম পেটাতে লাগল। কয়েকজন আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে ধরে রইলো। লোকটাকে মারতে-মারতে আধমরা করে ফেলল। আমরা আতঙ্কে কুঁকড়ে গেলাম। এরপর ডাকাত সর্দার বলল—এই তোদের মা বইনে গো চুদি, তোরা পালানোর চিন্তা নো করিস। এইখান থাইকা পালাইয়া বাঁচতে পারবি না। চারদিকে সাগর, কোনদিকে যাইবি? শোন, দুই-একদিনের মইধ্যেই জাহাজ আইবো, জাহাজ আসার আগপর্যন্ত চুপচাপ থাকবি। আর এহন থেকে তোদের খাওন বন্ধ। তোরা এইখান থেকে পালিয়ে বাড়িতে যাইতে পারবি না। প্রয়োজনে তোদের লাশ যাইবো মালয়েশিয়া। আমার ধারণা আমাদের ভেতরেই ওদের গোয়েন্দা আছে। নইলে আমরা যে ওদের উপর হামলা করবো এই খবর ওরা পেল কীভাবে?
তেরো দিনের মাথায় রাত দশটার দিকে দস্যু সর্দার বলল—ভাই আপনারা শোনেন, এই কয়দিন আপনাদের সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেছি, এজন্য দুঃখিত। খারাপ আচরণ করেছি আপনাদের ভালোর জন্যই। যাই হোক, এখনই আপনাদের ট্রলারে করে নিয়ে বড়ো জাহাজে তোলা হবে। জাহাজে আপনারা নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা কইরা চলবেন। আপনারা ভালোভাবে মালয়েশিয়া যান, এই কামনা করি। আপনারা সবাই প্রস্তুত হোন। আমি আগে-আগে যাবো, আপনারা আমার পিছনে লাইন ধরে আসবেন। আপনাদের কারও পায়ে জুতা থাকলে খুলে ফেলুন। লোকটা আগে-আগে চলল, আমরা তাকে অনুসরণ করে হাঁটতে থাকলাম। জঙ্গলের ভেতরে জোয়ারের পানি এসেছে, ট্রলারটাও জঙ্গলের ভেতর নিয়ে আসা হয়েছে। ট্রলারে উঠতে আমাদের কাপড়চোপড় ভিজে গেল। কেউকেউ সাঁতরে ট্রলারে উঠল। ট্রলারের পাটাতন থেকে তলি পর্যন্ত দুইটা বাক্সের মতো। সম্ভবত সেখানে বরফ ও মাছ রাখা হয়। ঢাকনা খুলে আমাদের ভেতরে ঢোকানো হলো। এরপর ইঞ্জিন স্টার্ট হলো। পাটাতনের নিচ থেকে নৌকার গতি অনুভব করলাম। পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। অক্সিজেনের অভাবে আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ঢাকনাতে বারবার আঘাত করলাম। উপর থেকে একজন এসে বলল—ভাই, আশেপাশে নৌবাহিনীর নৌকা আছে;
নৌবাহিনী যদি বুইঝা যায় যে এই ট্রলারে আপনারা আছেন, তাইলে সর্বনাশ! বাংলাদেশের সীমানা পার হওয়ার পরেই ঢাকনা খুইলা দিমু, আপনারা আরেকটু ধৈর্য ধইরা থাকেন। আমাদের মধ্যে থেকে একজন বলল—ভাই আমরা তো দম বন্ধ হইয়া মইরা যাইতেছি। লোকটা ঢাকনাটা একটু ফাঁক করে দিলো।
ভেতর থেকে আমরা নৌকায় আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ, ইঞ্জিনের শব্দ ও নৌকার কাঁপুনি টের পাচ্ছিলাম। নৌকা চলছে-তো-চলছেই…। ঢাকনা যখন খুলে দেওয়া হলো, তখন উপরে বেরিয়ে এসে দেখলাম সকাল হয়েছে। মাঝিরা বলল—জাহাজের কাছে যাইতে আমাদের আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হইবো। আপনাদের যদি প্রস্রাব-পায়খানার প্রয়োজন পড়ে, তাইলে একজন-একজন কইরা বাইর হইয়া নৌকার পিছনে টয়লেটে কাজ সাইরা আবার ভেতরে চইলা যান। আমরা এক-এক করে প্রাকৃতিক কাজ সেরে আবার পাটাতনের নিচে ঢুকে গেলাম।
আমাদের নৌকা চলতেই লাগল…।
মগের মুল্লুক
আমাদের যে জাহাজে ওঠানো হলো এটাকে আসলে জাহাজ বললে ভুল হবে। এটা মূলত বড়োসড়ো মাছ ধরার একটা নৌকা। নৌকাটা এতটাই বড়ো যে পাটাতন থেকে তলি পর্যন্ত দুইতলা বিশিষ্ট দুইটা রুম ছিল। দুই রুমে লোক ঢোকানো হয়েছে প্রায় তিনশো জন। নৌকাটা মিয়ানমার সীমান্তে নোঙর করেছিল। আমরা ছোট্ট নৌকায় মোট চুয়াল্লিশ জন যাত্রী এসেছি। আমাদের মতোই ছোটো-ছোটো নৌকায় করে আরও কয়েক দফা যাত্রী এসেছে এই বড়ো নৌকায়। সংখ্যায় আমরা বাংলাদেশিদের চেয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা যাত্রী বেশি। পনেরো জন নারীও আছে এই নৌকায়। এসব নারীও মালয়েশিয়া যাবে। এই নারীদের স্বামীরা সম্ভবত আগেই নৌকাযোগে মালয়েশিয়া গিয়ে রিফিউজি কার্ড পেয়েছে। এই নৌকার মাঝিরা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মগ উপজাতি। মগদের ভাষা কিচ্ছু বোঝা যায় না। রোহিঙ্গাদের ভাষাও আমরা তেমনটা বুঝি না। ওদের সঙ্গে আমরা ইশারায় কথা বলি। ওরা ইশারায় যা বলে আমরা সেটা বুঝতে পারি। ওদের সঙ্গে ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলতে-বলতে আমার মনে হচ্ছিল আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে বোবা ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
তখন সূর্য মাথার উপরে। অনুমান করলাম বেলা দুপুর। আমাদের খেতে দিলো। তিনবার মুখে দেওয়া যাবে এতটুকু ভাত এবং একটা শুকনো মরিচ। প্লাস্টিকের ঠোঙায় ভাত দিলো। খাওয়া শেষে এক ঢোক করে পানি। প্লাস্টিকের বোতল কেটে এমনভাবে ছোটো গ্লাসের মতো বানিয়েছে যে, ওতে এক ঢোকের বেশি পানি ধরবে না। সাগরের পানি পান করা নিষেধ করে দিয়েছে। কারণ; সাগরের পানি বিষাক্ত এবং লবণাক্ত, এই পানি পান করলে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
এতগুলো মানুষ একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকায় গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম। পাটাতনের নিচে দুইতলা রুম। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না। পা মেলে বসা যায় না। কারও যদি খুব অস্বস্তি লাগে, তাহলে পাশের সহযাত্রীদের বলেকয়ে তাদের শরীরের উপরে হাতপা মেলে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নেওয়া যায়। প্রস্রাব- পায়খানা করার প্রয়োজন পড়লে পাটাতনের উপরে লাগানো ঢাকনায় ঠোকা দিলে প্লাস্টিকের ঠোঙ্গা দেয় নৌকার মাঝিরা তথা জলদস্যুরা। সকাল-সন্ধ্যা দিনে দুইবার খেতে দেয়। প্রতিবার দুই মুঠো ভাত, একটা শুকনো মরিচ, আর এক ঢোক পানি। এভাবে মিয়ানমার সীমান্তেই কেটে গেল সাতদিন। রফিক নামে অল্পবয়স্ক একজন রোহিঙ্গা যাত্রী ছিল আমাদের নৌকায়। ছেলেটা মগ জলদস্যুদের ভাষা বুঝতে পারতো। রফিক ইচ্ছে করলে যখন-তখন পাটাতনের উপরে এবং নিচে যাতায়াত করতে পারতো। ওর কাছ থেকে আমরা খবর নিতে পারতাম আমাদের নৌকা কোথায় আছে, মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে নৌকা কখন ছেড়ে দিবে এবং কোনও সমস্যা হচ্ছে কি-না। মিয়ানমার সীমান্তেই সাতদিন কেটে গেল। এই সাতদিনে আমাদের অবস্থা আরও কাহিল হয়ে গেল। কেউকেউ কান্নাকাটি আরম্ভ করে দিলো। ধনবাড়ির এক ছেলে বুদ্ধি করল—এইভাবে চলতে থাকলে তো আমরা বাঁচতে পারব না। মরতেই যখন হবে, তাহলে একটা ঝুঁকি নিয়ে দেখি। আমরা তো সংখ্যায় অনেক মানুষ, মাঝিরা মাত্র সাতজন। আমরা ওদের মারধর করে হাতপা বেঁধে নৌকা নিয়ে দেশে চলে যাবো। পুলিশে ধরলে ধরবে, তবু জানে বাঁচতে পারবো। মগদের ভাষা বুঝতে পারা ছেলেটা বলল—সাবধান, এই কাজ করা যাইবো না। ওদের কাছে বোমা, বন্দুক আর ছুরি আছে। আর এই নৌকায় কোনও অঘটন ঘটলে আশেপাশের নৌকা থেকে আমাদের গুলি করবো। আর এই নৌকার ইঞ্জিন কীভাবে চালাইতে হয় তাও তো আমরা জানি না। আপনারা ধৈর্য ধরেন। আমাদের তো ওরা মাইরা ফালাইবো না। আমাগো জীবিত অবস্থায় মালয়েশিয়া পৌঁছাইয়া দিতে পারলে ওদেরই লাভ। ছেলেটার কথা শুনে আমাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম। তাছাড়া, এই কয়েকদিনে ঘুম, গোসল ও খাওয়ার অভাবে আমাদের শরীরের জীবনীশক্তিও কমে গিয়েছে। কেউ ঠিকমতো নড়াচড়া করতে পারছি না।
সাতদিনের মাথায় আমাদের নৌকা ছেড়ে দিলো। সাগরের বুক চিরে আমাদের নৌকা অবিরাম গতিতে চলতে লাগল…। ঢেউয়ের আঘাত নৌকায় আছড়ে পড়ে, আমরা ভেতর থেকে অনুভব করি। নৌকার ইঞ্জিন বিশাল বড়ো। ইঞ্জিনের শব্দে আমরা আমাদের কথা ভালো করে বুঝি না। নৌকা চলছে তো চলছেই…।দিন যায় রাত আসে। দিনে একবার, রাতে একবার, দিনেরাতে মোট দুইবার প্লাস্টিকের ঠোঙায় খাবার আসে। কিছু ভাত, একটা শুকনো মরিচ। প্রতিবার একই খাবার। কেউ কেউ খাবারদাবার ছেড়ে দিলো। কারও বমিবমি ভাব, কেউ বমি করেই দিচ্ছে। গোসল না করতে-করতে সবার শরীর দিয়ে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। এদিকে মাত্রাতিরিক্ত লোকের কারণে প্রচণ্ড গরম। সবার মাথার চুল আলুথালু। কারও মুখের দিকে তাকানো যায় না, মায়া হয়। প্রতিটা সময় কেউ-না-কেউ কাঁদতেই থাকে। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কাঁদে। কেউ বাড়ির কথা মনে করে কাঁদে। ক্ষুধা কী জিনিস আমরা অনুভব করলাম। আমার মনে হলো ভয়ংকর ক্ষুধার্ত ব্যক্তির কাছে খাদ্য ছাড়া তার আর কোনও উপাস্য নাই; খাদ্যই তার ভগবানেশ্বরাল্লাহ্ বা উপাস্য। আমরা প্রার্থনা করি কখন আমাদের সামনে খাবার আসবে। একজন সুস্থ মানুষ একদিনে যে খাবার খায়, তা খেয়ে আমাদের দশদিন পার করতে হচ্ছে। পানির তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে চে․চির হয়ে যাচ্ছে। চব্বিশ ঘণ্টায় দুইবার দুই ঢোক পানি পাই, তাও আবার খাবার খাওয়ার সময়। এই এক ঢোক পানিকে মনে হয় বেহেশতের অমৃত পান করছি।
সম্ভবত কেউ কাপড়চোপড় ভরে পায়খানা করে দিয়েছে। পায়খানার গন্ধে থাকা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় কয়েকজনের পাতলা পায়খানা আরম্ভ হলো। কোনও ওষুধপত্র নাই। মগদের ভাষা বুঝতে পারা রফিক নামের ছেলেটাকে বললাম—তুই মগদের বুঝাইয়া ক আমাদের অবস্থা ভালো না। অনেকের পাতলা পায়খানা শুরু হইছে। ওরা যদি এইখানেই পায়খানা কইরা দেয়, তাইলে আমরা সবাই অসুস্থ হইয়া যামু। ছেলেটা গিয়ে নৌকার ক্যাপটেনকে বলে। ক্যাপটেন এসে আমাদের পরিস্থিতি দেখে গেল। তারপর আমাদের সুযোগ দেওয়া হলো—আমাদের প্রস্রাব- পায়খানার প্রয়োজন পড়লে হাত তুলে ইশারা করলেই উপরে যেতে দিবে। নৌকার একদম পেছনে টয়লেট আছে। ততক্ষণে আমাদের অবস্থা ভয়াবহ, উপরে ওঠার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। দুই-তিনজনের পেট ফুলে গেল। খাবার খেতে পারে না। বমি আসে। পাতলা পায়খানা। ওদের অবস্থা এমন হলো যে দ্রুত হসপিটালে নেওয়া ছাড়া বাঁচানো যাবে না এবং ওদের আশেপাশে থাকার কারণে আমরা যে- কজন একটু সুস্থ আছি, তারাও মরণ রোগে আক্রান্ত হবো। পরিস্থিতি ভয়াবহ দেখে ক্যাপ্টেন তার দুইজন সহকর্মীকে নিয়ে ঢাকনা খুলে পাটাতনের নিচে নেমে এলেন। ইশারায় বললেন—যারা অসুস্থ হয়েছে তাদের ধরাধরি করে উপরে উঠিয়ে দে। আমরা মোট ছয়জনকে উপরে উঠিয়ে দিলাম। আমি ঢাকনার ফাঁক দিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখতে ছিলাম রোগীদের কী করে। দেখলাম, মুত্যু পদযাত্রী রোগীদের পেটে চাকু ঢুকিয়ে দিয়ে পেটটা ফেড়ে সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছে! বুঝতে বাকি রইল না এই অবস্থা যাদেরই হবে, তাদেরই সাগরে ফেলে দেওয়া হবে। আমি খবরটা সহযাত্রীদের বলতে-না-বলতেই সবাই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ওদের সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম না।
পরেরদিন আরও একজনের একই অবস্থা হলো।
পরিস্থিতি খুবই খারাপ দেখে নৌকার মাঝিরা সিদ্ধান্ত নিলো আমাদের পঞ্চাশজন করে ভেতর থেকে বের করে পাটাতনের উপরে একঘণ্টা করে রাখবে। নৌকা চলছে তো চলছেই…। এক-এক করে একঘণ্টা পরপর পঞ্চাশজন করে উপরে ওঠানো হলো। পঞ্চাশজন করে একদল উপরে ওঠায়, উপর থেকে আরেকদল নিচে নামায়। উপরে উঠে দুচোখ মেলে তাকালাম। দুচোখ যে-দিকে যায়, শুধু পানি আর পানি। কোথাও কোনও দেশের আকার দেখা যায় না। সবুজ গাছগাছালি, পাহাড় কিংবা বাড়িঘর অনুভবের দৃষ্টিতেও দেখতে পেলাম না। শুধুই নীল জলরাশি। নীলজলে খেলা করে ডলফিন। ঢেউয়ের ফাঁকে ওড়াউড়ি করে উড়ন্ত মাছ। মাছ যে উড়তে পারে তা কোনওদিন দেখিনি এবং শুনিনি। প্রতিদিন একঘণ্টা করে উপরে উঠানোর কারণে আমরা একটু স্বস্তিবোধ করতে লাগলাম।
একদিন রাতে সাগরে ঝড় উঠল। আমরা ভেতর থেকে অনুভব করলাম আমাদের নৌকা জলের গভীর ঢুকে যাচ্ছে, আবার উপরে উঠছে। রফিক, যে ছেলেটা মগ ভাষা বোঝে, ও উপর থেকে দেখে এলো অবস্থা খুবই ভয়াবহ। মাঝিদের মুখেও চিন্তার ভাঁজ। রফিক বলল—আপনারা সবাই আল্লাহ বিল্লাহ করেন। নৌকার গড়াগড়ি দেখে অনুমান করলাম আজকে আমাদের সলিলসমাধি হবে। আজকেই জীবনের শেষ দিন। মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের এক সহযাত্রী বলে উঠল—ভাইজানেরা, আমরা আইজকা শ্যাষ। মরার আগে আসেন আমরা আল্লাহর জিকির করি। আমরা আল্লাহু-আল্লাহু জিকির আরম্ভ করলাম। তড়িৎগতিতে একজন মগ জলদস্যু তথা নৌকার মাঝি প্লাস্টিকের একটা পাইপ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। পাইপ দিয়ে আমাদের ক্রমাগত পেটাতে লাগল। প্লাস্টিকের পাইপের আঘাতে কারও মাথা, কারও পিঠ, কারও মুখ, কারও হাত ফেটে গিয়ে রক্ত বেরুতে লাগল। আমরা বুঝলাম না আমাদের কেন পেটানো হলো। আমরা তো আল্লাহর জিকির করতেছি। এই বিপদ থেকে একমাত্র আল্লাহই বাঁচাতে পারেন। দস্যুটা পেটাতে-পেটাতে রোহিঙ্গা ছেলেটাকে কী যেন বলে গেল। ছেলেটা আমাদের বলল—আপনারা আল্লাহর নাম নিয়েন না। ওরা আল্লাহ-টাল্লাহ বিশ্বাস করে না। পার্বতীপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ঠাকুরবাড়ি থেকে আসা মধ্যবয়সী এক সহযাত্রী আমার কাঁধে হাত রেখে বলে—আইচ্ছা ভাইজান, আল্লাহ কী এইসব চোইখে দ্যাখে না?
লোকটার প্রশ্নের কোনও উত্তর দিলাম না।
এভাবেই নয়দিন নয়রাত আমাদের নৌকা চলল। নয়দিন পর থাইল্যান্ডের সীমান্তে আমাদের নৌকা নোঙর করল। আমাদের নৌকার কাছে একটা খালি নৌকা এলো। সেই নৌকাতে পঞ্চাশজন লোক উঠিয়ে দিলো। প্রায় পাঁচঘণ্টা পরে আমাদের নৌকা আবার গভীর সুমুদ্দুরের দিকে রওনা দিলো। রোহিঙ্গা যুবক রফিক বলল—যে পঞ্চাশজন চলে গেছে তাদেরকে থাইল্যান্ড বর্ডারগার্ড ধইরা ফেলছে। থাইল্যান্ড দিয়ে আমরা ঢুকতে পারবো না। ছেলেটার কথা শুনে আশাহত হলাম। জানি না আর কতদিন এই জলে ভাসতে হবে। আমাদের নৌকা শুধু এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগল। শুনলাম এদিকে আমাদের খাদ্য পানীয় ফুরিয়ে এসেছে। প্রস্রাবের ছুতোয় উপরে উঠে দেখলাম নৌকার ক্যাপ্টেন দুরবিন দিয়ে এদিক- ওদিক কী যেন দেখছে। সম্ভবত আশেপাশে নৌবাহিনীর কোনও নৌকা আছে কিনা সেটা দেখার চেষ্টা করছে। সন্ধ্যায় যখন খাবার খাচ্ছিলাম তখন রোহিঙ্গা ছেলেটা বলল—আমাদের এখন ইন্দোনেশিয়া নিয়ে যাবে। ইন্দোনেশিয়া থেকে মালয়েশিয়া ঢোকাবে। তখন জানি না ইন্দোনেশিয়া থেকে মালয়েশিয়া কতদূর। রোহিঙ্গা ছেলেটার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে এতদিনে। যে কোনও খবর আমার কাছে এসে বলে। দুইরাত দুইদিন পরে আবার আমাদের নৌকা থাইল্যান্ড সীমান্তের দিকে রওনা দিলো।
বিকেলের দিকে আমাদের নৌকা থাইল্যান্ড সীমান্তের খুব কাছাকাছি নোঙর করল। একটা খালি নৌকা এসে আমাদের খাবার দিয়ে গেল। সন্ধ্যায় আমাদের মাছভাত খেতে দিলো! আমরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। খুব মজা করে খাবার খেলাম। আস্তে-আস্তে রাত গভীর হতে লাগল। এরপর একটা স্পিডবোট এলো। এই স্পিডবোটে ত্রিশজন লোক ওঠানো হলো। রোহিঙ্গা ছেলেটা বলল— এই স্পিডবোটে ত্রিশজন করে লোক সরাসরি মালয়েশিয়া নামিয়ে দিবে। প্রথম চালানেই ত্রিশজনের মধ্যে আমি আছি। রাতের অন্ধকারে পানির উপর দিয়ে সাঁইসাঁই করে আমাদের স্পিডবোট ছুটে চলল। পনেরো মিনিট চলতে-না-চলতেই স্পিডবোট থেমে গেল। একটু দূরেই বড়োসড়ো একটা স্পিডবোট। ওই স্পিডবোট থেকে সম্ভবত বলা হলো তোমরা মালয়েশিয়ার? নাকি থাইল্যান্ডের? ওদের ভাষা বুঝি নাই। অনুমানে বুঝলাম আমাদের স্পিডবোট থেকে বলা হলো—আমরা থাইল্যান্ডের। এরপর আবার আমাদের স্পিডবোট ছুটলো। প্রায় ত্রিশমিনিটের মধ্যে জঙ্গলে ঘেরা একটা ঘাটে আমাদের স্পিডবোট থামলো।
পঁইত্রিশ দিন পর মালয়েশিয়ার মাটিতে পা ফেললাম। মাটিতে পা ফেলার সঙ্গে-সঙ্গে অনুভব করলাম আমি যেন আকাশে উড়ছি। ছোট্ট শিশু বাচ্চা হাঁটা শেখার সময় মাটিতে যেভাবে পা ফেলে হাঁটে, ঠিক সেভাবে হাঁটতে লাগলাম। একবার আছাড় খেলাম। হামাগুড়ি দিয়ে উঁচু জায়গায় পাম ওয়েল গাছের নিচে বসলাম।
আরেকটি কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। আমাদের নৌকায় যে পনেরো জন নারী যাত্রী ছিলেন, তাদের অভিযাত্রা আমাদের পুরুষদের মতো ভয়াবহ ছিল না। পুরুষদের জন্য সাগরপথে এই অভিযাত্রা যতটা ভয়ংকর ছিল, নারীদের জন্য ঠিক ততটাই ছিল রোমাঞ্চকর। নারীরা পুরুষদের মতো পাটাতনের নিচে ছিলেন না। তাদের থাকার জায়গা হয়েছিল ইঞ্জিন রুমের সামনেই। নারীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে আলোবাতাস পেতেন। দুচোখ যেদিকে যায় সেদিকে চোখ মেলে তাকাতে পারতেন। উঠতে-বসতে পারতেন। হাতপা মেলে শুয়ে থাকতে পারতেন। মন চাইলে গোসল করতে পারতেন। বাথরুমের প্রয়োজন পড়লে দস্যুরা যে-বাথরুম ব্যবহার করতেন, তারাও সেটা ব্যবহার করতেন। তাদের খাওয়াদাওয়ায় কোনও কষ্ট হয়নি। জলদস্যুরা যে খাবার খাইতেন, নারীরাও একই খাবার খাইতেন। নারীদের প্রতি মগ জলদস্যুরা সহানুভ‚তির হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিনিময়ে মগ জলদস্যুরা এইসব নারীর সঙ্গে সংগমে লিপ্ত হতেন। প্রায় প্রতি রাতে নিচ থেকে পাটাতনের উপরে নারীদের গোঙানির আওয়াজ পেতাম। জলদস্যুদের কোনও সদস্য পনেরো জন নারীর মধ্য থেকে যে কোনও একজনকে বেছে নিয়ে সংগমে লিপ্ত হলে বাকি চোদ্দো জন নারীকে সে দৃশ্য দেখতে হতো। প্রশ্রাব-পায়খানার উদ্দেশ্যে উপরে উঠলে আমরা দেখতে পেতাম মগরা আমাদের নারীদের সঙ্গে আদিম খেলায় মেতে উঠেছে। এই নারীরা আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো। আমরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে যেতে পারছি না এবং আমাদের পুরুষদের কী করুণ দশা তারা তা উপলব্ধি করতেন। নারীরা স্বেচ্ছায় নয় হয়তো ভয়ে এই খেলায় অংশগ্রহণ করতেন।
শুনেছি একসময় মগদের ভয়ে চট্টগ্রাম থেকে ফেনী হয়ে ঢাকার শাঁখারি বাজার পর্যন্ত জনশূন্য স্থানে পরিনত হয়েছিল। মগদের খুন, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের অভয়ারণ্য ছিল দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশ। মগদের নির্যাতনকে কেন্দ্র করেই বাংলা ভাষায় ‘মগের মুল্লুক’ প্রবাদ প্রচলিত হয়েছিল। এখন আমরা মগের মুল্লুক বলতে বুঝি অরাজকতার দেশ। নৌকার ভেতরে তারা যে অরাজকতা করছে, এতে ইতিহাসের সেই বন্য মগদেরই নৃশংসতা উপলব্ধি করলাম। মগদের ইঁদুরের মতো ছোটো-ছোটো হিংস্র চোখের চাহনি এখনও ভুলতে পারিনি। যাই হোক, আমরা যখন জলে থেকে স্থলে উঠলাম, তখন আল্লাহর কাছে মগদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।
স্পিডবোটে একেক করে আমাদের যাত্রীরা ডাঙায় এসে নামলো। মালয়েশিয়ার পাচার চক্রের সদস্য না-কি সীমান্ত রক্ষীদের সদস্য যা-ই হোক হবে, আমরা কতজন মানুষ আছি তারা তা গুনতে লাগলেন এবং দশজন করে ভাগ করলেন।
অরণ্যে রোদন
গণনা শেষে আমাদের দশজন করে গাড়িতে ওঠানো হলো। অনেক গাড়ি আগেই পার্কিং করা ছিল। গাড়িতে আমাদের এমনভাবে ওঠানো হলো যেন ট্রাকে কাচামাল লোড করা হচ্ছিল। আমার সুযোগ হয়েছিল ড্রাইভারের পাশের সিটে বসার। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করলেন। সাঁইসাঁই করে গাড়ি চলতে লাগল। প্রায় পঁচিশ মিনিট পরে গাড়ি থামলো এবং সেখানে আমাদের নামানো হলো। গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে তাকালাম। দেখলাম একতলা-বিশিষ্ট মাঝারি সাইজের একটা বিল্ডিং। চারপাশে জঙ্গলে ভরা। উঁচু-উঁচু পাহাড়। বিল্ডিংটা সম্ভবত মালয়েশিয়ার সীমান্ত রক্ষীদের ক্যাম্প। আমাদের যে গাড়িতে করে আনা হয়েছে সে গাড়ির ড্রাইভারগুলোও সম্ভবত সীমান্ত রক্ষীদের সদস্য। বিল্ডিংয়ের পেছন দিয়ে গভীর জঙ্গলের দিকে পায়ে হাঁটার রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে আমাদের এক-এক করে হাঁটার নির্দেশ দিলো। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। রাত তখন আনুমানিক বারোটা। আমাদের আগেপিছে বন্দুক হাতে বেশকিছু লোক পাহারা দিতে-দিতে পথ হাটছিলেন। আমরা ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলাম না। কখনও গাছের সঙ্গে, কখনও পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। কেউকেউ হামাগুড়ি দিয়ে পথ চলল। এক দেড় ঘণ্টা হাঁটার পর কয়েকজন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। টেনেহিঁচড়ে যাদের উঠাতে পারলাম না তারা রাস্তাতেই পড়ে রইল। পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে যতোটা কষ্ট, তারচে পাহাড় বেয়ে নিচে নামতে কষ্ট আরও বেশি। সাপ-বিচ্ছু আর হিংস্র জন্তুজানোয়ারের ভয় তো আছেই। পাহাড় বেয়ে নিচে নামার সময় পিছলে আছাড় পড়ে বাম হাতের কনুই ছিঁড়ে রক্ত বেরুলো। ব্যথায় চিৎকার দিতে পারলাম না; কারণ, আমাদের চুপচাপ পথ চলতে হবে। এভাবে হাঁটতে-হাঁটতে একসময় খেয়াল করলাম ভোর হয়েছে। জঙ্গলের পাখিরা কিচিরমিচির করছে। একটু দূরেই বনমোরগের ডাক শুনতে পেলাম। সামনেই একটা ঝরনা। স্বচ্ছ পানি। আমরা সবাই আত্মা ভরে ঝরনার পানি পান করলাম, হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। পাহারাদার লোকগুলো ইশারায় আমাদের বসে বিশ্রাম নিতে বলল। আমরা ঝরনার পাশে বসে পড়লাম।
কিছুক্ষণ পড়েই আরেকদল লোক এলেন। এদের কোমরে বাঁধা ধারালো ছুরি। দুয়েকজনের হাতে পিস্তল। এরা যখন আমাদের সঙ্গে কথা বলল, তখন বুঝতে পারলাম এরা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গাদের টানাটানা ভাষা মোটামুটি বুঝতে পারি, ওরাও আমাদের ভাষা বোঝে। এইসব রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া এসে দস্যুবৃত্তি বেছে নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে একজন বলল—আপনারা সবাই সিরিয়াল ধরে আমাদের পিছনে-পিছনে আসেন। আর একটু হাটলেই আমাদের ক্যাম্প। ক্যাম্পে গিয়ে গোসল করে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমাবেন। তারপর ঘুম থেকে উঠে আপনারা আপনাদের বাড়ির ফোন নাম্বার দিবেন, আমরা আমাদের ফোন দিয়ে আপনাদের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবো। লোকটার কথা শুনে আমরা সবাই খুশি হলাম। মনে হলো আমাদের দেহে শক্তি ফিরে এসেছে। আমরা রোহিঙ্গাদের পিছনে-পিছনে হাঁটতে থাকলাম। কয়েকঘণ্টা হাটার পর ক্যাম্পে পৌছালাম। গভীর জঙ্গলে পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল বড়ো ক্যাম্প। ক্যাম্পে আগের চালানের কিছু মানুষ রয়ে গেছে। আমাদের গোসল করার জায়গা দেখিয়ে দিলো। গোসল সেরে আসতে-না-আসতেই দেখি শুঁটকি মাছের ভুনা এবং সাদা ভাত! শুঁটকি মাছের ভুনা দিয়ে এক প্লেট ভাত সামনে পেয়ে মনে হলো পৃথিবীর সকল শান্তি এই প্লেটে জমানো আছে! খপ করে খাবারের প্লেট নিয়ে গাপুসগুপুস খেতে লাগলাম। আমাদের সবাইকে এক প্লেট করে ভাত দেওয়া হয়েছে। আমরা পরম তৃপ্তির সঙ্গে খাবার খেলাম। পানির অভাব নেই, যতটুকু মন চায় ততটুকু পানি পান করলাম। এরপর একটা ঝিমঝিম ভাব এলো, আমরা ঘুমিয়ে গেলাম।
বিকেলবেলা রোহিঙ্গা সর্দারের ডাকে আমাদের ঘুম ভাঙলো। সর্দারের পাশে আরও চারজন রোহিঙ্গা যুবক দাঁড়ানো। ওদের প্রত্যেকের হাতে মোবাইল ফোন। এক রোহিঙ্গা আমার বাড়ির ফোন নাম্বার চাইলে আমি তাকে নাম্বারটা দিলাম। কাগজে লেখা একটা ব্যাংকের একাউন্ট নাম্বার হাতে ধরিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গা যুবক আমাকে বলল—বাড়িতে ফোন দিয়া এই নাম্বারে তিন লাখ টাকা পাঠাইতে কইবি। বলবি টাকা না দিলে আমারে মাইরা জঙ্গলে ফালাইয়া রাখবো। টাকা পাঠাইতে ক, সমস্যা নাই। টাকা দিলে কুয়ালামাপুর শহরে নিয়া কাজে লাগাইয়া দিমু, ইনকাম করবি আর দেশে টাকা পাঠাইবি। আমি রোহিঙ্গা যুবককে বললাম—কেন, কুদরত তো আমারে কইছে আমার কোনও টাকাপয়সা লাগবো না। বিদেশে আসার সব প্রসেসিং সেই-ই কইরা দিবো। রোহিঙ্গা বলল—আরে বেটা কুদরতের মা বইনেরে চোদ, কুদরত কে? কুদরতরে আমরা চিনি? দে, কুদরতের ফোন নাম্বার দে, কুদরতের সঙ্গে কথা ক। আমি কুদরতের ফোন নাম্বার দিলাম। কুদরত কল রিসিভ করার সঙ্গে-সঙ্গে বললাম—আমি শিমুল। আমি তো দাদা মালয়েশিয়ার জঙ্গলে আছি। আমার কাছে ওরা টাকাপয়সা চাইতেছে। টাকাপয়সা দিলে না-কি আমারে শহরে নিয়া কাজ লাগাইয়া দিবো। তো আপনে ওদের সঙ্গে কথা বলেন। কুদরত বলল—কোন শিমুল? কোথাকার শিমুল? শিমুল নামের কাউরে তো আমি চিনি না। কথা শেষ হতে-না-হতেই ফোনের লাইন কেটে দিলো। ফোনে লাউডস্পিকার ছিল। রোহিঙ্গা যুবক সব শুনছিল। কুদরত ফোন কেটে দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে রোহিঙ্গা ছেলেটা বলল—এই চোদানির পোয়া শোন, বাড়ির নাম্বার দে, বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা ক। আগামীকাল দিনের ভেতরে এই একাউন্টে টাকা না ঢুকলে তোরে মেরে ফেলবো। কুদরতের নাম্বারে আবার কল দিতে বললাম। কুদরত রোহিঙ্গার নাম্বার ব্ল্যাকলিস্টে ফেলেছে। রোহিঙ্গা খ্যাপে আমার তলপেটে পিস্তল ঠেকিয়ে বলল—তোর সঙ্গে এতো কথা বলার তো সময় নাই। তাড়াতাড়ি বাড়িতে কল দিবি? আমি ভয়ে বাড়ির ফোন নাম্বার দিলাম। কয়েকবার কল দেওয়ার পরেও কল রিসিভ হলো না। রোহিঙ্গা যুবক আমাকে ক্যাম্পের ভেতরে বসতে বলল। ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে দেখি কান্নাকাটি আরম্ভ হয়ে গেছে। কেউকেউ অলরেডি এলাকার দালালকে টাকা দিয়ে দিয়েছে। এখন এখানকার লোকজন বলতেছে তাদের একাউন্ট নাম্বারে টাকা না দিলে মেরে ফেলবে! কয়েকজনের শরীরে অলরেডি আঘাত করেই ফেলেছে।
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। কুদরত বলল কী আর করল কী? কুদরত এখন আমাকে কেন চিনতে পারছে না? আমার কল কেটে দিলো কেন? অ‣বধভাবে মালয়েশিয়া আসার এই পথ সম্পর্কে কুদরত এতোকিছু জানলো কেমনে? পাচারকারীদের সঙ্গে কুদরতের ভালো সম্পর্ক না থাকলে আমি তো এখানে আসতে পারতাম না। পাচারকারীরা এখন কুদরতকে চিনতে পারছে না কেন? কুদরতের কুদরতি কিচ্ছু বুঝলাম না। এখন আমার কী হবে? বাড়ি থেকে এতো টাকা কেমনে দিবে? রোহিঙ্গা সর্দার ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে সবার উদ্দেশে বলে গেল—দ্যাখো, তোমরা এসেছ, তোমাদের আনতে আমাদের অনেক ঘাট পার করে আনতে হয়েছে। এতে অনেক খরচ হয়েছে। এখন তোমরা যদি টাকা না দেও, তাইলে তোমাদের দিয়ে আমরা কী করমু? এই জঙ্গল থেকে তোমাদের শহরে পার করতেও টাকা লাগবে, কে দিবে এই টাকা? তোমরা চিন্তা কইরো না, বাড়ি থেকে টাকা পাঠাইতে কও, আমরা একাউন্টে টাকা পাইলেই তোমাদের কুয়ালালামপুর পৌঁছাইয়া দিমু। যার টাকা আগে আইবো, তারে আগে শহরে ঢুকাইয়া দিমু।
বুঝতে পারলাম টাকা ছাড়া আমার উপায় নাই।
সন্ধ্যার দিকে সেই রোহিঙ্গা যুবক আমাকে ডাকলো। যার কাছে বাড়ির ফোন নাম্বার দিয়েছিলাম। রোহিঙ্গা ছেলেটা বলল—ল, কল ঢুকছে কথা ক। ফোন ভাই রিসিভ করেছে। ভাইকে সব খুলে বললাম। ভাই আমাকে বলল—টাকার সন্ধানে বাইর হইতেছি, চিন্তা করিস না। রোহিঙ্গা আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে ভাইকে বলল—আগামীকালের মধ্যে টাকা না দিলে আপনার ভাইয়ের লাশ মালয়েশিয়ার জঙ্গলে পইড়া থাকবো।
এক-এক করে কমবেশি সবার টাকা আসতে লাগল। পরদিন সকালে রোহিঙ্গার নাম্বারে ভাই কল দিয়েছে। রোহিঙ্গা বলল—টাকা কোথা থেকে পাঠাইছেন? ভাই বলল—টাঙ্গাইল থেকে। রোহিঙ্গা বলল—দাঁড়ান আমি চেক দিয়া লই। রোহিঙ্গার কাছে থাকা আরেক ফোন দিয়ে কাউকে কল দিয়ে বলল— টাঙ্গাইল থেকে টাকা ঢুকছে? লোকটা বলল—হ। এরপর রোহিঙ্গা আমাকে বলল—আজকে সন্ধ্যায় তোকে শহরে দিয়ে আসবো, চিন্তা করিস না।
বাড়ি থেকে যাদের টাকা এসেছে, তাদেরকে আলাদা করা হলো। সন্ধ্যার দিকে কালো পোশাক পরিহিত কয়েকজন লোক এলো। এদের চেহারা বনমানুষদের মতো। প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র। রোহিঙ্গা সর্দার আমাদের বলল—তোমরা এদের পিছনে-পিছনে লাইন ধইরা যাইবা। চুপচাপ যাইবা। যাইতে- যাইতে সন্ধ্যা হইবো। জঙ্গলের ভেতরেই সামনে একটা পাকা রাস্তা পাইবা। রাস্তার পাশে গাছের আড়ালে তোমরা দাঁড়াইয়া থাকবা। দুইটা গাড়ি আইসা তোমাগো কাছে থামবো, তোমরা একমিনিটের মইধ্যে গাড়িতে উইঠা পড়বা। তাড়াতাড়ি কইরা উঠতে না পারলে কিন্তু তোমাদের রাইখা যাইবো। আমরা সর্দারের কথামতো ডাকাতদের পিছুপিছু হাঁটতে লাগলাম। আবারও সেই জঙ্গলে ভরা উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ। খুব কষ্ট করে হাঁটতে-হাঁটতে সতিসত্যিই একটা পাকা রাস্তা পেয়ে গেলাম। গাছের আড়ালে দাঁড়ালাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার। পাঁচমিনিটের মধ্যে গাড়ি এসে থামলো। আমরা ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে গাড়িতে চাপাচাপি করে উঠলাম। প্রায় দু-ঘণ্টা পর রিসিভ ঘরের সামনে আমাদের গাড়ি থামলো। গাদাগাদি করে আমাদের ঘরের ভেতরে ঢোকানো হলো। এখানে তিনজন বাঙালি আর দুইজন রোহিঙ্গা আছে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি। এক বাঙালি বলল— ভাইজানেরা, এতো রাইতে তো হোটেল বন্ধ। রাতটুকু কষ্ট কইরা থাকেন, সকালেই খাওয়ার ব্যবস্থা করমুনি। আর মালয়েশিয়ায় যদি আপনাদের কারও পরিচিত লোক থাকে, তাইলে তাদের নাম্বার দেন, তাদের কল দিই, তারা আইসা আপনাদের নিয়া যাক। আর যদি পরিচিত কেউ না থাকে, তাইলে আপনাগো বাড়ির ফোন নাম্বার দেন, আমরা একটা একাউন্ট নাম্বার দিতেছি, ওই নাম্বারে বিশ হাজার টাকা দিলে আমরা আপনাগো সরাসরি প্রজেক্টে নিয়া দিয়া আসমু। বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের কাজ, প্রতিদিন সত্তুর রিঙ্গিত করে কামাইতে পারবেন।
সকালে প্যাকেট করা খাবার এলো। মালয়েশিয়া যাদের পরিচিত লোক আছে তারা তাদের পরিচিতদের ফোন নাম্বার দিলো। কয়েকঘণ্টার মধ্যেই তারা এসে আপনজনদের নিয়ে গেল। পড়ে রইলাম আমি। আমার সঙ্গে আরও আট-নয়জন আছে। ওদেরও মালয়েশিয়া পরিচিত কোনও লোক নাই। ফোন দিলাম বাড়িতে। ভাইকে আরও বিশ হাজার টাকার কথা বললাম। ভাই বলল—বাড়ির দলিল বন্ধক রাইখা সুদের উপরে টাকা আনছি। চিন্তা করিস না, আরও বিশ হাজার আইনা দিতেছি। বাঁইচা থাকলে কামাই রুজি কইরা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারবি।
টাকা পাইয়া একজন বাঙালি ভাই আমাকে সঙ্গে নিয়ে কুয়ালালামপুর এলেন। আমাদের রিসিভ ঘরটা সম্ভবত পেনাং রাজ্যে ছিল। পেনাংয়ের বাসস্ট্যান্ডে এসে বাসে উঠতে-উঠতে বাঙালি ভাই বলেছিলেন, আপনি আলাদা সিটে বসবেন। গাড়ি থেকে নামার পর আমি যেদিকে যাই সেদিকে আমার পিছনে-পিছনে যাবেন। মানুষ যাতে বুঝতে না পারে আপনি আমার সঙ্গে যাইতেছেন। লোকটার কথামতো রাজধানী শহর কুয়ালালামপুরে এসে পৌঁছালাম। একটা হোটেলে বসিয়ে বলল— আপনার মন যা চায় খান। আমি গোরুর মাংস দিয়ে পেটভরে ভাত খেলাম। হোটেলটা বাঙালিদের হোটেল। এখানে বাঙালির কোনও অভাব নেই। প্রথম যে-কেউ এসে মনে করবে এটা বাংলাদেশের কোনও একটা শহর। বাঙালি ভাই আরেকজন লোককে ফোন দিলেন। লোকটা পনেরো মিনিটের মধ্যে চলে এলেন। দ্রুত এসে আমাকে সালাম দিয়ে বললেন—আপনি আমার পিছনে-পিছনে আসেন। বাঙালি ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরেক বাঙালির পিছনে হাঁটতে লাগলাম। তিনি একটা কম্পিউটার ঘরে নিয়ে গেলেন। আমার ছবি উঠালেন। দশমিনিটের মধ্যে আমাকে ভিসা পাসপোর্টের ফটোকপি হাতে ধরিয়ে দিলেন। কিন্তু, ভিসা পাসপোর্টে আমার নাম সাদ্দাম। কম্পিউটার ঘরের লোকটা বলল— পুলিশ-টুলিশে ধরলে এই কাগজ দেখাইবেন। আর পাসপোর্ট নাম্বারটা মুখস্থ করে নেন। পুলিশে ধরলে পাসপোর্ট নাম্বার জিগাইতে পারে। নাম জিজ্ঞেস করলে বলবেন আপনার নাম সাদ্দাম।
এরপর লোকটা আমাকে একটা মার্কেটের ভেতরে নিয়ে গিয়ে টিশার্ট আর জুতো কিনে দিলেন। সেলুন ঘরে নিয়ে গিয়ে নাপিতকে চুল কাটতে বললেন। চুল কাটা শেষে একটা বাসে করে আমাকে পুচং নামে একটা জায়গায় নিয়ে এলেন। বিশাল বড়ো একটা প্রজেক্ট। চল্লিশ তলা বিল্ডিং হবে। প্রজেক্টের ভেতরে ঢুকলাম। প্রজেক্টের ভেতরে টিনের ঘর, ছোটো-ছোটো রুম। একটা রুমে ঢুকিয়ে বাঙালি ভাই বললেন—এই রুমে থাকবেন। নতুন আইছেন, দুই একদিন রেস্ট নেন। তারপর কামে লাইগা যাইবেন। বিছির কাম। বিছি মালাই ভাষা, মানে রডের কাম। আর কোথায় গোসল করতে হয়, কোথায় টয়লেট, রুমে যারা আছে তাদের কাছ থেকে জাইনা নিয়েন। রুমে দেখি আমার মতো আরও চারজন অ‣বধ বাঙালি ভাই আছেন, তারাও নৌপথে মালয়েশিয়া এসেছেন।
দুইদিন পর কাজে যোগদান করলাম। প্রচণ্ড গরম। রে․দ্রের তাপে রড আগুনের মতো গরম হয়ে আছে। হাতে মোজা লাগিয়ে কাজ করতে হয়। প্রথম দিনেই আমার পায়ে একটা জংধরা লোহা ঢুকে গেল। কাঠের সঙ্গে লোহাটা লাগানো ছিল। আমি বুঝতে পারিনি এতে লোহা লাগানো আছে। রক্তে সেফটি বুট ভিজে গেল। কুমিল্লার একজন লোক এসে আমার পায়ে যেখানে লোহা ঢুকেছে, সেখানে গ্যাসলাইটের আগুন দিয়ে ছ্যাকা দিয়ে বললেন—আগুন দিয়ে এইখানে পুড়লে ব্যথা কম করবে। এভাবেই সারাদিন কাজ করলাম। রাতে কী ব্যথা! শরীরে জ্বর এলো। নিজেদের রান্না করে খেতে হয়। আমি না খেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। রাত বারোটার সময় শুধু ধপাস-ধপাস আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমার রুমের লোকেরা দরজা খুলে দৌড় মারলেন। ভয়ে আমিও পায়ে ব্যথা নিয়ে তাদের পেছনে দৌড়াতে থাকলাম। দৌড়াতে-দৌড়াতে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলাম। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম—ভাই আমরা এইভাবে দৌড়াইয়া জঙ্গলে ঢুকলাম কেন? কী হইছে? লোকটা বলল—কিছুক্ষণ পরেই রেড পড়বো। প্রজেক্টের বস ফোন কইরা কইছে আমাগো সাবধানে থাকতে। আমি বললাম—রেড কী? লোকটা বললেন—আরে পাগল, পুলিশ আইসা ঘেরাও কইরা আমাগো ধইরা নিয়া যাইবো। আমাগো কাছে পাসপোর্ট ভিসা চাইবো। আমাগো কী পাসপোর্ট ভিসা আছে? নাই। যা আছে এইগুলা ডুপ্লিকেট। রাস্তার পুলিশে ধরলে এইগুলা দিয়া ছাইড়া আসা যায়। ইমিগ্রেশন পুলিশে ধরলে আর মাফ নাই। ইমিগ্রেশন পুলিশরে এইসব ভুয়া কাগজপত্র দেখাইলে তারা সরাসরি অনলাইনে চেক করবো। চেক কইরা যদি দ্যাখে আমাগো এইসব ভুয়া, তাইলে সোজা জেলে ভইরা দিবো। এই দেশের জেল খুব খারাপ। এদেশের জেলে আসামি গো লেংটা কইরা রাখে, খাইতে দেয় না, আবার একটু এদিকসেদিক হইলেই মাইরধইর করে।
বাকিটা রাত জঙ্গলে কাটিয়ে দিলাম। মশার কামড়ে বসে থাকা যায় না। সকালে প্রজেক্টে এলাম। অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজে ঢুকলাম। রেস্ট টাইমে যে লোকটা আমাকে কুয়ালালামপুর থেকে এই প্রজেক্টে এনেছেন তিনি বললেন— ভাই, ঘরে শোয়া যাইবো না। কাজকর্ম শেষে রান্নাবান্না কইরা খাওয়াদাওয়া শেষে জঙ্গলে যাইয়া ঘুমাইতে হইবো। আর বিদেশ করতে চাইলে চোখকান খোলা রাইখা কাজ করতে হইবো। দিনে কাজ করার সময়ও খেয়াল করতে হইবো পুলিশ আসে না-কি। একবার ধরা পড়লেই জীবন শ্যাষ। প্রজেক্ট থেকে প্লাস্টিক নিয়া যাইবেন। জঙ্গলে প্লাস্টিক বিছাইয়া ঘুমাইবেন। মশার কামড় থেকে বাঁচতে চাদর নিয়া যাইবেন। চাদর মুড়ি দিয়া ঘুমাইলে মশায় কামড়াইতে পারবো না। বৃষ্টি এলে প্লাস্টিক মুড়ি দিয়া থাকবেন। কামকাজ করেন, বেতন পাইলে একটা মশারি কিনে নিয়েন।
সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে রে․দ্রে পুড়ে কাজ করি। কাজ শেষে তাড়াতাড়ি করে রান্নাবান্না, গোসল ও খাওয়াদাওয়া করে জঙ্গলে ঘুমাতে যাই। জঙ্গলের শ্বাপদসংকুল পথ মাড়িয়ে এতটা গভীরে ঢুকে পড়ি যে, এইখানে যেন পুলিশ না আসতে পারে। পুলিশের ভয়ে এতটাই দূরে চলে আসি, এইখানে বিপদে পড়লে কাউকে সাহায্য করতেও বলতে পারবো না। প্রাচীন ভারতে গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে সাধকেরা গুরুগৃহ থেকে ঘরে ফিরতেন না; সোজা চলে যেতেন গভীর জঙ্গলে। চিরকুমার-ব্রহ্মচারী হয়ে সংসার ও নারীসঙ্গ বর্জন করে আধ্যাত্মিকবিদ্যার অনুশীলন করতে এবং ঈশ্বরের দর্শন পেতে তারা গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নিতেন। সাধারণ মানুষের কাছে এরা অরণ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অরণরা গভীর জঙ্গলে বাস করতেন বলে একসময় গভীর জঙ্গলকে মানুষ গভীর অরণ্য বলতে লাগল। গভীর অরণ্য মানে দুর্গম এবং বিপদসংকুল স্থান। গভীর অরণ্যে কোনও মানুষজন থাকে না, তাই এখানে বিপদে পড়লে শত কান্নাকাটি করলেও কারও সাহায্য- সহযোগিতা পাওয়া যায় না। এখানে সব আবেদন নিষ্ফল। এজন্যই বিপদে পড়লে সাহায্য পাবার সম্ভাবনা যেখানে নাই, সেখানে মানুষ প্রবাদ বলে—অরণ্যে রোদন। ঈশ্বরের কী লীলাখেলা! আগেকার দিনে মানুষ ঈশ্বরের দর্শন পেতে ও সাধনা করতে যেখানে গভীর অরণ্যে যেতেন, সেখানে আমাকে পালিয়ে থাকার জন্য আসতে হয়! কতটা ভাগ্য বঞ্চিত আমি! এ যেন আরেকটা জাহান্নামের জীবন। মনে হয় জন্মই আমার আজন্ম পাপ। ইচ্ছে করে আত্মহত্যা করি। কিন্তু; বাড়ি বন্ধক রেখে মা-বাবা ও ভাই আমাকে টাকা দিয়েছেন। কামাই রুজি করে ঋণপরিশোধ করতে হবে। যেদিন কাজ থাকে না সেদিনও জঙ্গলে থাকতে হয়। জঙ্গলে থাকতে-থাকতে নিজেকে আজকাল মনে হয় নিশ্চয়ই আমি জঙ্গল মানব। এখানে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে আমাকে কেউ দেখার নাই। না খেয়ে মারা গেলেও মুখে একফোঁটা পানি কেউ দিতে আসবে না। চেহারা সুরতের বেহাল দশা। মাঝেমধ্যে চুপচাপ কান্না করি। কাজে যাবার সময় হলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসি। কাজ শেষে আবার জঙ্গলে যাই। বাড়িতে এখন নিয়মিত যোগাযোগ করা দরকার। বিদেশে এসেছি একমাসের বেশি হয়ে গেছে। একটা বেতন পেলাম। প্রথম মাসের বেতন দিয়ে কিছু কাপড়চোপড় কিনলাম, একটা মশারি কিনলাম, সত্তুর রিঙ্গিত দিয়ে একটা বাটন ফোন কিনলাম। হাতে রইল মাত্র তিনশো রিঙ্গিত। তিনশো টাকা বাড়িতে পাঠালাম। টাকা পেয়ে বাবা বললেন—প্রথম মাসের বেতন দিয়া একটা সভা দিমু। ভালো দেইখা একটা হুজুর আনুম। আল্লাহ যেন তোরে বালামুসিবতে না ফালায় এইজন্য দোয়া করা দরকার। আমি বললাম—হ, দেও সভা। যে আল্লাহ এতো দুঃখ-কষ্ট দিলো, যে আল্লাহর দয়ায় সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম কইরা রাইতে জঙ্গলে ঘুমাইতে হয়, সেই আল্লাহর জন্য একটা সভা দেওয়া দরকার। যে হুজুররে দাওয়াত দিয়া আনবা, তারে ভালো কইরা খাওয়াইয়া তার কাছে আমার দুঃখের কথা কইও, সে যেন আল্লাহরে কইয়া আমার ভাগ্যটারে ভালো কইরা দেয়।
দেশি মুরগি
আমি মানুষটাই যেন প্রবঞ্চনার পুতুল। চাইলে যে কেউ আমাকে নিয়ে খেলতে পারে। যে মানুষটা কুয়ালালামপুর থেকে রিসিভ করে এনে আমাকে কাজ দিলেন, প্রবাসে কীভাবে টিকে থাকতে হবে শেখালেন, এতো ভালোবাসা দেখালেন, সে মানুষটাও আমার সঙ্গে প্রতারণা করলেন। অথচ আমি তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। প্রবাসে আসার তিনমাস পর বুঝতে পারলাম আমি যে বেতনে কাজ করি, তার পুরোটা পাই না। আমার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া লোকটা আমার বেতনের প্রায় অর্ধেকটা নিয়ে নেন। এটা যখন বুঝতে পারলাম, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম এখানে এই লোকের সাহচর্যে আর থাকা যাবে না। এই কয়দিনে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ঈশ্বরদীর বেল্লাল ভাই বেশ পুরোনো। মালয়েশিয়ায় তার দশ বছর চলছে। মালয় ভাষা জানেন। মালয়েশিয়ার অনেক শহর তার চেনাজানা। এই লোকটার কাছেই জানতে পারলাম আমার পরিশ্রমের প্রাপ্য মজুরি আমি পাই না। বেল্লাল ভাই রাওয়াং শহরে নতুন একটা প্রজেক্টে চলে যাবেন। তাকে বললাম—ভাই, আমারে আপনার সঙ্গে নিয়া যাইবেন? বেল্লাল ভাই সোজা উত্তর দিলেন—আপনার এইখান থেকে পালিয়ে যাইতে হইবো। নয়তো আপনেরে যে আনছে সে ঝামেলা করতে পারে। আপনার তো কাগজপত্র নাই, পুলিশ দিয়া ধরাইয়া দিতে পারে। কারণ, যে লোকটা আপনারে আনছে সে আপনেরে দিয়া কামাই কইরা খাইতেছে। বেল্লাল ভাইকে বললাম—ভাই, কীভাবে কী করতে হবে আপনে করেন। আমারে সাহায্য করেন। এইখানে যে টাকা কামাই করতেছি এই টাকা দিয়া বাড়ির ঋণ পরিশোধ করমু তো দূরের কথা সুদের টাকাও পরিশোধ করতে পারতেছি না।
বেল্লাল ভাইয়ের বুদ্ধি মতো পরদিন কাজে গেলাম না। সবাই যখন কাজে গেছে, তখন প্রজেক্ট থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে বেল্লাল ভাই। পায়ে হেঁটে কিছুদূর গিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠলাম। সোজা চলে গেলাম নতুন প্রজেক্টে। প্রজেক্ট ঘুরে দেখে বেল্লাল ভাই বললেন—এই প্রজেক্টে থাকা যাইবো না। এইখানে কাজ করলে রাতে প্রজেক্টেই ঘুমাইতে হইবো। প্রজেক্টে ঘুমাইলে তো সমস্যা। আমাগো তো কাগজপাতি নাই, রেড পড়লে পালামু কোথায়? যে প্রজেক্টের চারদিকে বনজঙ্গল আছে, সেই প্রজেক্টে কাজ করতে হইবো। আমি চিন্তা করে দেখলাম বেল্লাল ভাইয়ের কথাই ঠিক। বেল্লাল ভাইয়ের অনেক বন্ধুবান্ধব। মালয়েশিয়ায় তার বংশেরও অনেক লোক আছে। তিনি ফোনে যোগাযোগ করলেন। একজনের সঙ্গে কথা বলে কাজ ঠিক করলেন। আমরা চলে গেলাম সাইবার জায়া নামক একটা জায়গায়। প্রজেক্ট নতুন শুরু হইছে। একতলা করে প্রায় চল্লিশটা বিল্ডিং ক্সতরি হবে। এখানে অনেকদিন কাজ করা যাবে। চারপাশে জঙ্গলে ভরা। এখানে থাকাটাও নিরাপদ। পরদিন থেকে কাজে যোগদান করলাম। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে রাতে গোসলের পানি পাওয়া যায় না। চিকন একটা পাইপ দিয়ে অনেক দূর থেকে পানি আসে। এই পানি দিয়েই রান্নাবান্না করতে হয়। কাপড়চোপড় ধোয়াও সমস্যা। তাড়াহুড়া করে রান্নাবান্না করি। তরকারিতে কখনও লবণ বেশি, নয়তো ঝাল কম হয়, কখনও ঝাল বেশি, নয়তো লবণ কম হয়। অনেক সময় তরকারি সিদ্ধ হয় না। ভাত রান্না করলেও দেখা যায় একবার নরম হয়েছে তো আরেকবার চাল ফোটেনি। তবু ক্ষুধা মেটাতে খেতে হয়। এখানে বিদ্যুৎ নেই, জেনারেটর চলে। রাতে কয়েকঘণ্টার জন্য জেনারেটর চালু করা হয়। এই সময়টা ফোন চার্জ করার সময়। রান্না, গোসল, খাওয়া, ফোন চার্জ ও কাজ, প্রতিটা সময় এদিক-ওদিক চোরের মতো তাকাতে হয়। লক্ষ রাখতে হয় পুলিশ আসে কি-না। আত্মা সব সময়ে ধুকপুক করে। এই বুঝি পুলিশ এলো! প্রজেক্টের বস একটা দোকান ঠিক করে দিয়েছেন। দোকানদার প্রতিদিন গাড়িতে করে আমাদের চালডাল লবণমরিচ তেল সাবান যা লাগবে দিয়ে যান। বাজার করার জন্য বাহিরে যেতে হয় না আপাতত এই ঝামেলা থেকে বেঁচে গেছি। রাতে জঙ্গলে ঘুমাতে যাই। সঙ্গে নিয়ে যাই প্লাস্টিক, মশারি, আর চাদর। প্লাস্টিক বিছিয়ে মশারি গাছের সঙ্গে বেঁধে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে হয়। মশার উৎপাতে থাকা যায় না। জঙ্গলে ভাপসা পোড়া গরম, তবু মশার প্রকোপ থেকে বাঁচতে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাই। জঙ্গলেও নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি না। ভয় হয়। শুনেছি, ইমিগ্রেশন পুলিশ হেলিকপটার দিয়ে জঙ্গলেও রেড দেয়! হেলিকপটারের লাইটে জঙ্গলে কে কোথায় আছে পুলিশ না-কি সব দেখতে পারে। এমনও রাত যায়, দুচোখের পাতা মেলতে পারি না। বাড়িতে ফোন দিয়ে প্রতিটা দিন মিথ্যে বলতে হয়। মিথ্যে অভিনয় করে বলতে হয়—আমি ভালো আছি। এভাবে তিন-চারমাস কেটে গেল। মাস শেষে বেতন পাই, নিজের জন্য সীমিত খরচের টাকা রেখে বাকিটা বাড়িতে পাঠাই। আমার পাঠানো টাকা দিয়ে বাবা-মা সুদের ঋণ পরিশোধ করতে থাকেন, কিছু হয়তো সংসারে খরচ করেন। আমার নামে পির মাহবুবের সাজানো নাটকের মামলার কী অবস্থা জানার জন্য ভাইকে একদিন খোঁজ নিতে বললাম। ভালো একটা উকিল ধরতে বললাম। ভাই একসপ্তাহ পরে বলল—শিমুল, অনেক ভালো একটা উকিল ধরছি। উকিলে বলছে তারে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিলে মামলা ডিসমিস কইরা দিতে পারবো। আমি বললাম—ঠিক আছে, টাকা জমাইয়া পাঠামু নি। মামলা যেভাবেই হোক শেষ করতে হইবো। নইলে দ্যাশে গেলে জেল খাটা ছাড়া উপায় থাকবো না। ঝড় বৃষ্টি যাই হোক প্রতিদিন কাজে যাই। শরীরে জ্বর এলেও বিশ্রাম করি না। অনেক টাকার দরকার। টাকা দিয়ে মামলা শেষ করতে হবে, বাড়ির জমির দলিল বন্ধক রেখে আনা সুদের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এরমধ্যে খবর পেলাম মালয়েশিয়া সরকার অ‣বধদের ক্সবধ করার ঘোষণা দিয়েছেন। বেল্লাল ভাই বললেন—এইভাবে পালিয়ে চোরের মতো আর কয়দিন বিদেশ করমু? সরকার ক্সবধ করার ঘোষণা দিছে, যতো টাকাই লাগুক, ভিসা কইরা হালামু। শিমুল ভাই আপনে ভিসা করবেন নাকি? সরকার সুযোগ দিছে কইরা হালান। ভিসা যদি পাইয়া যান, তাইলে ছুটিতে দেশে যাইতে পারবেন, আবার আসতে পারবেন। আমি বললাম— ভাই কত টাকা লাগবো? বেল্লাল ভাই বললেন—আমি আগে দালালের সঙ্গে আলাপ কইরা নিই, তারপর কমুনি কত টাকা লাগবো। তিনদিন পরে বেল্লাল ভাই বললেন—শিমুল ভাই, ভিসা করতে সাত হাজার রিঙ্গিত লাগবো। আমি চমকে উঠলাম! সাত হাজার রিঙ্গিত? এতো প্রায় নিজের খরচ বাদে এক বছরের ইনকামের টাকা! মনেমনে চিন্তা করলাম—এতো টাকা দিয়া ভিসা করলে বাড়িতে দিমু কী? বাড়ি কেমনে চলবো? বাড়িতে ফোন দিলাম। ভাইকে বললাম—ভাই, এদেশের সরকার তো অ‣বধদের ক্সবধ করার ঘোষণা দিছে। আমি এহন কি করমু? আমি না হয় এইখানে কামাই কইরা ভিসা করলাম, তোমরা বাড়িতে কেমনে চলবা? ঋণের টাকা দিবা কেমনে? আর মামলাই-বা শেষ করবা কেমন কইরা। ভাই বলল—তুই নিজে আগে বাইচা থাকার চেষ্টা কর। এইখানের ঋণ পরেও শোধ করা যাইবো। যদি ক্সবধ হইতে পারোস তাইলে তো আর চিন্তা নাই। কামাই কইরা ঋণ শোধ করতেই পারবি।
ভাইয়ের কথায় আশ্বস্ত হলাম এবং ভিসা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঈশ্বরদীর বেল্লাল ভাইকে বললাম—ভাই, ভিসা করতে যে টাকা লাগবো, এই টাকাগুলা প্রতি মাসে—মাসে দিলে হবে? বেল্লাল ভাই বললেন—চলেন আগামীকাল সরাসরি দালালের সঙ্গে কথা বইলা আসি। পরদিন কুয়ালালামপুর গেলাম। দালালের অফিস কুয়ালালামপুর। তার নিজস্ব দোকান আছে। তিনি বিমানের টিকিট বিক্রি করেন, কাগজপত্র ফটোকপি করেন, হাইকমিশন থেকে পাসপোর্ট করে দেন, আবার দেশে থেকে লোকও আনেন। পাশাপাশি কাপড়চোপড়ও বিক্রি করেন। তার দোকানে তিনজন কর্মচারীও রেখেছেন। ভাবলাম এই লোককে টাকা দিলে টাকা মেরে পালিয়ে যেতে পারবে না। দালালকে প্রতি মাসে-মাসে টাকা দেওয়ার কথা বললাম, দালাল রাজি হলো। দালাল প্রথমে মালয়েশিয়ার পনেরোশ টাকা, জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি, আর ভোটার আইডি কার্ডের ছবি চাইলেন। কিন্তু, আমার কাছে তো এসব নাই। দালাল বললেন—আপনার বাড়িতে থেকে ইউনিয়ন পরিষদে লোক পাঠাইয়া জন্ম নিবন্ধন উঠাইতে বলেন। তারপর আমার ইমেইল ঠিকানা দিতেছি, একটা কম্পিউটার ঘরে যাইয়া জন্ম নিবন্ধনটা ইমেইল করতে বলেন। বাড়িতে ফোন করে বললাম। ভাই বলল—আগামীকালের মধ্যেই আমি পাঠাইতেছি। এরপর দালালকে টাকা দিয়ে প্রজেক্টে এলাম।
দুইদিন পর দালালকে ফোন করে বললাম—ভাই, বাড়ি থেকে জন্ম নিবন্ধন পাঠাইছে? দালাল বললেন—হ, জন্ম নিবন্ধন পাইছি। অলরেডি পাসপোর্টের জন্য হাইকমিশনে আবেদন করছি। বিশ-একুশ দিনের মধ্যেই পাসপোর্ট বেরিয়ে যাবে। তারপর ভিসার জন্য ইমিগ্রেশনে আবেদন করবো। আপনি চিন্তা কইরেন না। ভিসা হবে ইনশাআল্লাহ। আর আগামী মাসে বেতন পাইয়া বেশি কইরা টাকা দিয়া যাইয়েন। সব টাকা যত তাড়াতাড়ি দিতে পারবেন তত আপনার জন্য ভালো।
পরের মাসে বেতন পাইয়া দালালের কাছে গেলাম। দালালকে আরও পনেরো’শ রিঙ্গিত দিয়ে বললাম—কাজ চলতেছে? দালাল বললেন—আপনার পাসপোর্ট অলরেডি বের হয়েছে। ইমিগ্রেশনে আবেদনও করেছি। সামনের মাসে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে হবে। বেতন পাইয়া সঙ্গে কইরা টাকা নিয়া আইসেন। ফিঙ্গার দেওয়ার এক মাসের মধ্যেই ভিসা পাইয়া যাইবেন।
ভিসার জন্য এখন আমাকে মাঝেমধ্যেই কুয়ালালামপুর আসতে হয়। সঙ্গে যেহেতু ক্সবধ কাগজপত্র নাই, সেহেতু পুলিশের ভয়ে আমাকে খুব সাবধানে রাস্তা হাঁটতে হয়। সেদিন দালালের অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছিলাম। সামনে দেখি পুলিশ গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে একটা চিপা গলিতে ঢুকে হাঁটতে লাগলাম। একজন বাঙালি ভাই গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন— ভাই, দেশি মুরগি, লাগবো নাকি? আমি ভাবলাম অনেকদিন ধরে তো দেশি মুরগি খাওয়া হয় না, একটা নিয়া যাই। উনারা হয়তো বাংলাদেশ থেকে দেশি মুরগি এদেশে এনে বিক্রি করেন। দেশি মুরগি নিয়ে প্রজেক্টে গেলে বেল্লাল ভাইও খুশি হবেন। লোকটাকে বললাম—হ ভাই, আমার একটা লাগবো। লোকটা বললেন— আসেন, আমার সঙ্গে আসেন।
আসলে আমার জীবনটা নাটকের চেয়েও নাটকীয়। নাটকে যেমন কাকতালীয়ভাবে অনেককিছু মিলে যায়, ঠিক আমার ক্ষেত্রেও তাই। এখন যে ঘটনাটা ঘটলো এটা গল্প উপন্যাস কিংবা নাটক সিনেমায় সম্ভব। লোকটা আমাকে একটা বিল্ডিংয়ের দোতলায় নিয়ে গেলেন। ভাবলাম এই দোতলায় হয়তো মুরগি বিক্রি করেন। আমি তার পিছনে-পিছনে দোতলায় উঠলাম। প্রথমেই দেখলাম একজন বৃদ্ধ চাইনিজ টেবিলে রাখা একটা মূর্তিকে আগরবাতি জ্বালিয়ে ফুলফল দিয়ে পূজা করতেছেন। তারপর দেখি দোতলার প্রতিটা রুমে-রুমে শুধু মহিলা আর মহিলা! চাইনিজ, নেপালি, বার্মিজ, ইন্ডিয়ান, ইন্দোনেশিয়ান, ফিলিপাইনি, থাই আর বাঙালি মহিলার অভাব নাই। আমি লোকটাকে বললাম—ভাই, এইখানে মুরগি কই? লোকটা বাঙালি মহিলাদের দেখিয়ে বলল—এই যে দেশি মুরগি, এইগুলা পছন্দ হয় না? আসেন ছয় নাম্বার রুমে, কয়দিন আগে নতুন একটা মুরগি আইছে। সেইরকম জিনিস ভাই। লোকটাকে বললাম—ফাইজলামি করেন? আপনি বললেন মুরগির কথা, এইখানে তো দেখি দেহব্যবসা চলছে। লোকটা বললেন—আপনি বলদ নাকি? মালয়েশিয়া থাকেন দেশি মুরগি কারে বলে জানেন না? লোকটার কথা শুনে রাগ হবো নাকি হাসবো বুঝতে পারলাম না। তাকে জিজ্ঞেস করলাম—আইচ্ছা ভাই, যৌনকর্মীদের মুরগি বলেন কেন? লোকটা আমাকে বুঝাইলেন—এরা তো মুরগির মতোই। মুরগির যেমন নির্দিষ্ট কোনও মোরগ নাই, এদেরও নির্দিষ্ট কোনও জামাই নাই। মুরগিরে যে কোনও মোরগ লাগাইতে পারে, এদেরকেও যে কোনও পুরুষ লাগাইতে পারে। বুঝলেন এইবার? লোকটার কথা শুনে চিন্তা করলাম—বাহ্, আমরা পুরুষজাতি নারীদের কত সুন্দর- সুন্দর অভিধায় সম্মানিত করেছি, কত সুন্দর আর কুৎসিত নাম দিয়েছি! সত্যিই আমরা পুরুষ জাতি বিস্ময়কর এক প্রজাতি। লোকটাকে আবার বললাম—আইচ্ছা ভাইজান, এইখানে তো দেহব্যবসা চলছে, তাইলে ওই চাইনিজ এইখানে কি জন্যে পূজা করতেছে? পতিতালয় কি পূজা করার জায়গা? এইটা তো আর মন্দির না। লোকটা হেসে বললেন—এই চাইনিজ এইখানকার বস। উনি প্রতিদিনই এসে তার দেবতারে পূজা করেন, যাতে করে তার ব্যবসা ভালো চলে। ব্যবসা যদি ভালো না চলে তাইলে টেবিলে রাখা যে মূর্তিটা দেখতেছেন, ওইটারে তিনি আছাড় দিয়া ভাইঙ্গা নতুন মূর্তি নিয়া আসবেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনেমনে বললাম—সত্যিই ধার্মিকের ধর্ম বিশ্বাস এ এক জটিল সমীকরণ। লোকটা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন—ভাই আপনার কী মুরগি লাগবে? না লাগলে বলেন, আমার অন্য কাস্টমার ধরতে হইবো। আমি বললাম—আপনার ছয় নাম্বার রুমের মুরগি দেখান।
ছয় নাম্বার রুমের মুরগিটা দেখে আমি চমকে উঠলাম! আরে এতো আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসন ৯নং ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার রেহেনা বেগম! রেহেনা আমাদের গ্রামেরই মেয়ে। তার বিয়েও হয়েছিল আমাদের গ্রামে। বিয়ের একবছর পরে স্বামী জালালউদ্দিন সৌদি চলে যান। স্বামী বিদেশ থাকার সুবাদে রেহেনা যার তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেত। ঘুসখোর, সুদখোর, চাঁদাবাজ, পাতি নেতা ও নেশাখোর যুবকদের সঙ্গে রেহেনার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এলাকার সাধারণ লোকজন যাদের ভয় পেত তারা রেহেনার বাসায় যাতায়াত করতো। এতে করে গ্রামের সাধারণ মানুষজন রেহেনাকে ভয় করতো এবং সম্মান দেখাতো। এলাকায় ঝগড়া বিবাদ হাতাহাতি হলে রেহেনা সেখানে উপস্থিত হতো এবং বিচার করতো। বিপদে পড়ে কেউ সুদের টাকা খুঁজলে রেহেনা তাকে নিজেই সুদের উপরে টাকা দিতো। জমিজমা, পারিবারিক ও বংশগত আধিপত্য সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমা হলে রেহেনা সে বিষয়টাও দেখতো। গ্রামে পুলিশ ঢুকলেই আগে রেহেনার বাড়িতে যেতো। দারোগা পুলিশের সঙ্গে রেহেনার খাতির ভালো ছিল। গ্রামের কিছু লোকজন রেহেনাকে সন্দেহ করতো। ক্ষমতাবান লোকেদের সঙ্গে রাতবিরেত চলাফেরাকে স্বামীর পরিবারের লোকজনও পছন্দ করতেন না। এই বিষয়গুলো স্বামী জালালউদ্দিনের পছন্দ না হলেও করার কিছু ছিল না। প্রায় পাঁচবছর পর জালালউদ্দিন দেশে ফিরেছিলেন। শরীরে নানাপ্রকার রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে। মালিক জালালউদ্দিনরে চিকিৎসার জন্য দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বেচারার দুর্ভাগ্য, তিনমাসের মাথায় হসপিটালে মারা যায়।
স্বামী মারা যাওয়াতে রেহেনার নতুন করে ভাগ্যের দুয়ার খুলে যায়। জালালউদ্দিন মারা যাওয়ার ছয়মাস পরেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলে আসে। হঠাৎ একদিন দেখলাম রাস্তার মোড়ে-মোড়ে, বাজারঘাটে ও বাড়িতে-বাড়িতে রেহেনার ছবি-সংবলিত পোস্টারে ভরে গেছে। শুনলাম রেহেনা ওয়ার্ড মেম্বার পদে নির্বাচন করবে। রেহেনা বাড়িতে-বাড়িতে গিয়ে দুঃখের কাহিনি শোনাতে লাগলেন। স্বামী ছাড়া স্ত্রী এতিমের মতো। এলাকার মানুষ তার সহায়ক হলো। তাকে ভোট দিয়ে মহিলা মেম্বার নির্বাচিত করল। রেহেনা বেগমের নির্বাচনি প্রচারণা মিছিলে আমিও গিয়েছিলাম। আমাদের পরিবারের লোকজন তার কাছ থেকে কোনও টাকাপয়সা না খেয়েই নির্বাচন করে দিয়েছিল। সে নির্বাচিত হওয়ার পরপরই আমার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। আয়শারে বিয়ে করে বাড়ি ছাড়ি। তারপর কতকিছু ঘটে গেল জীবনে। বাড়ি ছাড়ার ছয় বছর পর রেহেনার সঙ্গে দেখা হলো। তাও আবার দেশের বাহিরে সুদূর মালয়েশিয়ায়, পতিতালয়ে! কিন্তু কেন? রেহেনা এই পতিতালয়ে কেন? রেহেনার মুখের দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। রেহেনা নিজেও আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বলে ওঠার আগেই রেহেনা বলল—তুমি এইখানেই কেন? আমারও প্রশ্ন— আপনি এইখানে কেন? রেহেনা তাড়াতাড়ি রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে আমার দুইহাত ধরে বলে—প্লিজ, আমি যে এইখানে পতিতাবৃত্তি করি এইটা তুমি দেশের কাউরে কইও না।
আমি বিপদে পইড়া এই পেশায় আইছি। আমার সঙ্গে কুদ্দুছ নেতা প্রতারণা করেছে। আমি বললাম—কেন, কীভাবে প্রতারণা করেছে? আপনি এইখানে কেমনে আইছেন? রেহেনা বলতে লাগল—তুমি তো জানোই আমি প্রথমে নির্বাচন কইরা পাস করছিলাম। ওই ট্রামে টাকাপয়সা তো কামাইতে পারি নাই। দ্বিতীয়বার নির্বাচন করতে গিয়া আমি ফতুর হইয়া গেছি। টাকাপয়সা যা আছিল সব শেষ করছি কিন্তু নির্বাচনে পাস করতে পারি নাই। আমার অবস্থা খারাপ দেইখা কুদ্দুস নেতা কইলো, রেহেনা তুমি বিদেশ চইলা যাও। মালয়েশিয়া যাইবা। মালয়েশিয়া একটা দোকানে কাজ করবা। দুইতিন বছর থাইকা টাকাপয়সা কামাইয়া দেশে আইবা, আবার নির্বাচন করবা। প্রতিমাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতন পাইবা। যাইবা? তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা আমিই কইরা দিমু। অনেক ভাইবা চিন্তা কুদ্দুস নেতার কথায় রাজি হইলাম। পাসপোর্ট করলাম। পাসপোর্ট কুদ্দুস নেতার কাছে দিলাম। কয়েকমাস পরেই কুদ্দুস নেতা কইলো তোমার ভিসা আইয়া গেছে, আগামী জুম্মাবার তোমার ফ্লাইট। কুদ্দুস নেতা আমারে ঢাকায় নিয়া আইলো। ঢাকার একটা অফিসে আইসা দেখি কয়েকজন সংগীত শিল্পী আর একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা বইসা আছে। এরপর দেখলাম আমার মতো দশ-পনেরোজন যাত্রী। এখানে আসার আগেই আমার চালানপাতি যাকিছু আছিল সব বেইচা কুদ্দুস নেতারে দিয়া দিছি। যাই হোক, আমরা যারা বিদেশে আসার জন্য ঢাকার অফিসে আইছি, আমাগো বোঝানো হইল আমরা অভিনেতা ও শিল্পীদের সহযোগী হিসেবে মালয়েশিয়া যাইতেছি। মালয়েশিয়া প্রবাসীরা এইসব শিল্পী অভিনেতা ভাড়া করেছে। তাদের সঙ্গে আমরা মালয়েশিয়া যাওয়ার পর তারা প্রোগ্রাম শেষ কইরা দেশে আইসা পড়বেন, আমরা থাইকা যামু, কোনও সমস্যা নাই। গানবাজনা ছবি দেখার অভ্যাস যেহেতু কম তাই ওই অভিনেতা শিল্পীদের চিনতে পারি নাই। যাই হোক, নায়ক-নায়িকা ও শিল্পীদের সঙ্গে মালয়েশিয়া আইলাম। কোথাও কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কখন কী বলতে হইবো আমারে আগেই শেখানো হয়েছিল। আমারে যে মিথ্যা শেখানো হচ্ছিল তা নিয়ে কোনও সংকোচ করি নাই। আমার ভালোই লাগছিল। নায়ক-নায়িকাদের সহযোগী হিসেবে বিদেশ যাত্রায় আমি বেশ আনন্দ পাইতেছিলাম। বিদেশে আসার পরে একটা ফ্লাট বাড়িতে উঠলাম। এসে দেখি এই অভিনেতা শিল্পীদের কোনও প্রোগ্রাম নাই। তারা দুইদিন পর চইলা গেলেন। রইয়া গেলাম আমরা। আমাদের সঙ্গে যেসব পুরুষ যাত্রী ছিল তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো। পুরুষদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে জানি না। আমরা পাঁচ- ছয়জন মহিলা ওই ফ্লাটে রয়ে গেলাম। ফ্লাটের ছেলেরা বাহির থেকে আমাদের জন্য খাবার কিনে আনতো। এরপর তারা আমাদের কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করল। বিরক্ত হয়ে বললাম—আপনারা আমাদের কোথায় কাজ দিবেন সেখানে নিয়ে যান। একজন এসে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বলল, তোমাদের কোনও কাজ নেই। তোমাদের কাজ হচ্ছে আমাদের খুশি করা। লোকটার উপর আমি রেগে যাই। এরপর দেখলাম আমাদের উপর নির্যাতন শুরু হইল। আমাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সব নিয়ে গেল। আমাদের চিৎকারের আওয়াজ ওই ফ্লাটের বাইরে গেল না। এরপর আমরা বুঝতে পারলাম এখানে দেহব্যবসা করা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় নাই। শুরু করলাম দেহব্যবসা। সেই ফ্লাট থেকে তারপর এইখানে। এইখানে চারমাস ধরে এই কাজ করতেছি। বাড়ির মানুষ জানে এইখানে চাকরি করতেছি। যাই হোক; অনেক হিসাব কইরা সিদ্ধান্ত নিছি এইখানে আরও কয়েকমাস থাকমু। টাকাপয়সা কামাই কইরা তারপর পুলিশের কাছে ধরা দিমু। দেশে যাইয়া যমুনা নদীতে গোসল কইরা তওবা পড়ুম। নামাজ রোজা করুম। আল্লারে সব সময়ে ডাকুম। আল্লায় জানি আর কোনও খারাপ পথে আমারে না নেয়।
রেহেনা বেগম মাথা নিচু করে কথাগুলো অবিরাম বলেই যাচ্ছিল। এরপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল— যাইহোক, তা তুমি এইখানে কেমনে আইলা? তুমি তো ভালো পোলা আছিলা। তোমার বাপ-মা কত ভালো মানুষ। তোমাগোরে বংশে কোনও কেলেঙ্কারি নাই। তোমার এই অবস্থা কেন? আমি বললাম—আপা, আমি তো মুরগি কিনতে আইছিলাম। আইয়া পাইলাম আপনারে। আপনার কথাগুলো শুইনা খুব খারাপ লাগল। আমার এইখানে আসার কাহিনি বিশাল বড়ো, পুরো তিনঘণ্টার একটা নাটকের সমান। এতো কথা বলার সময় নাই। এখন চইলা যাইতে হইবো। এমনিতেই ক্সবধ কাগজপত্র নাই। তারমধ্যে প্রজেক্টে যাইতে যদি রাইত করি, তাইলে সমস্যা হইতে পারে। আমার ফোন নাম্বার রাখেন, দরকার পড়লে ফোন দিয়েন।
দরজার বাহির থেকে একটা পুরুষের কণ্ঠ ভেসে এলো—আপা, তাড়াতাড়ি করেন। বাইরে কাস্টমারে ভইরা গেছে। আমি বের হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। ফোন নাম্বার দিয়ে বললাম—টাকাপয়সা লাগবো? বরং রেহেনা আপা বুকের কাছ থেকে মোচড়ানো পঞ্চাশ টাকার তিনটা নোট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল— এই টাকাটা রাখো, ভালো দেইখা কাপড়চোপড় কিনে নিও, আর ফোন দিলে আইও। আমি টাকাটা ফেরত দিলাম। রেহেনা আপার চোখে জল। বলল—বোন কি তার ভাইয়েরে দিতে পারে না? আপাতত সান্ত্বনা দেবার জন্যে টাকাটা নিলাম।
বাহির থেকে আবারও ঝাঁঝালো কণ্ঠে ভেসে এলো—
আপা তাড়াতাড়ি করেন।
ইলুমিনাতি
যার কপাল ভালো তারে হাত পা বাইন্ধাও যদি সাগরে ফালাইয়া দেও, তাইলে দেখবা ভাইসা ওঠার সময় মুখে মাছ একটা কামড় দিয়া ধইরা নিয়া আইছে। কথাটা বলেছিলেন আমার দাদা। ছোটোবেলায় দাদার মুখে শোনা কথাটা আমার এখনও মনে আছে। যার কপাল ভালো সে যে কোনও কাজে সফলতা অর্জন করতে পারে। কপাল যার খারাপ, তার জন্মই যেন আজন্ম পাপ। তার প্রতিটা পদেপদে বিপদ। আমিও সেই কপাল পোড়াদের দলে। নয়লে আমি কেন প্রতিটা পদেপদে প্রতারণার শিকার হই? আমার উপরে কেন এতো বিপদ আসে? এই যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে না-খেয়ে না-পরে এতোগুলা টাকা দিলাম ভিসার জন্য, এখন দালাল বলছে আমার ভিসা হবে না, টাকাও ফেরত পাবো না। আমার প্রতি দালালের এই প্রতারণার বিচার আমি কার কাছে দেবো? থানা-পুলিশ পর্যন্ত গেলে ঘুরেফিরে আমারই বিপদ হবে। লোকটার সঙ্গে চড়া গলায় কথা বললে হেনেস্তা হতে হবে। অবশেষে হতাশ হয়ে ফিরে এলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম মালয়েশিয়া যতদিন থাকবো অ‣বধভাবেই থাকবো। কামাই রুজি করে আগে বাড়ির ঋণ পরিশোধ করব, তারপর না হয় জেল খেটে কিংবা বাড়তি টাকাপয়সা দিয়ে দেশে চলে যাবো।
প্রহর-দিন-মাস-বছর, এমনি করে সময় আজ বহতা নদীর মতো বহুদূর। প্রতীক্ষার আকাশে আমি যেন আজ ডানাভাঙা এক পাখি; অথবা, দূরত্ব না-জানা উড়ন্ত এক বিহঙ্গ। আমার অতীত বিগত, বর্তমান দুঃসময় এবং ভবিষ্যৎ হতাশার। তবে কী মৃত্যুই আমার জীবনের সমাধান? আমার কি আত্মহত্যা করা উচিত? এই জীবনের কী কোনও মানে আছে? এতো জ্বালা যন্ত্রণা নিয়ে মানুষ কিভাবে বাঁচে? এই যে সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে রাতজাগা পাখির মতো জীবনের লেনদেন সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যখন দেখি ফলাফল শূন্য, তখন এ জীবনকে আর জিইয়ে রেখে লাভ কী? লিখতে-লিখতে যে খাতার পাতা শেষ হয়ে গেছে, সে খাতায় বারবার ঘষামাজা করার কী দরকার? তারচে নিজেকে শেষ করে দেওয়াই উত্তম। আবার ভাবি: আমি তো আমার এই জীবনকে সৃষ্টি করিনি, তাহলে এই জীবনকে ধ্বংস করে দেওয়ার আমি কে? যা হবার তা তো হয়েই গেছে, যা হবার হচ্ছে, যা হবার হবে, তাহলে নিজেকে শেষ করে দেবো কেন? আমাকে ঘুরে দাঁড়ানো উচিত। নির্লিপ্তভাবে এই জীবনটাকে উপভোগ করা প্রয়োজন। যেখানে যেমন আছি, সেখানেই আমার জীবনের স্বাদ ও শান্তি খুঁজে নেওয়া উচিত।
কপালের লিখন না যায় খÐন বলে একট কথা শুনতাম মুরুব্বিদের মুখে। তকদির বা ভাগ্যলিপি কারে বলে আগে বুঝতাম না। শুনেছি, প্রতিটা মানুষের জীবনে কি ঘটবে-আর-ঘটবে না ঈশ্বর আগেই তা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। কারে কোন জীবন দান করতে হবে ঈশ্বর তা ভালো জানেন। আচ্ছা, ঈশ্বর কি ন্যায়বিচারক? ঈশ্বর যদি সত্যিই ন্যায়বিচারক হবেন; তো, কেউ মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্মায়, কেউ দারিদ্র্যকে সঙ্গে নিয়ে জন্মায় কেন? কেউ মাছমাংস, ডিম-দুধ ও আপেল-আঙ্গুর খেতে চায় না, কেউ পায় না। কেউ থাকে গাছতলায়, কেউ পাঁচতলায়। কেউ গাড়িঘোড়ায় চড়ে, বিমানে উড়ে; কেউ ধূলি কাঁদা গায়ে লেপটে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হালচাষ করে, লোহালক্কড় টানাটানি করে, মাছ ধরে, নৌকা চালায়, গাড়ি ঠেলে। অসুখবিসুখ এইটা-সেইটা হলে কেউ চিকিৎসার জন্য উন্নত হাসপাতালে যায়, কেউ অর্থের অভাবে ধুঁকে-ধুঁকে মরে! কিন্তু কেন? কেন ঈশ্বরের এই পক্ষপাতিত্ব? তিনি কেন পক্ষপাতিত্ব করে মানুষের ভাগ্যলিপি লিখেছেন?
কেউ জন্ম নিয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাস ও রূপ-সুধা উপভোগ করে, কেউ মাতৃগর্ভে কিংবা ভূমিষ্ঠ হবার কালেই মারা যায়। কেউ জন্মেই কালো, কেউ জন্মেই ধলা। কেউ জন্মেই সুস্থসবল বুদ্ধিমান, কেউ জন্মেই রোগী এবং বোকা। কেউ ভোগী, কেউ যোগী। কেউ পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখতে পায়, কেউ (অন্ধ) আজন্ম দেখে অন্ধকার…। কারও কানে ঈশ্বরের অমৃত বাণী পৌঁছায়, কেউ (বধির) ঈশ্বরের নামটি পর্যন্ত শুনতে পায় না। কেউ মনের মাধুরী মিশিয়ে বাকশক্তির সাহায্যে ভাব প্রকাশ করে; কেউ (বোবা) ঈশ্বরের নামটা মুখে নিতে পারে না, মাকে মা বলতে পারে না, বাবাকে বাবা ডাকতে পারে না! ঈশ্বরের এমন দ্বিচারিতা কেন? কেন সে একচোখে লবণ আর অন্যচোখে চিনি বিক্রি করেন? না-কি তিনি একরোখা? অর্থের বিনিময়ে কেউ রক্ষিতা রাখে, ধর্মালয় গড়ে, তীর্থভ‚মিতে বিচরণ করে, ধর্মানুষ্ঠানের আয়োজন করে, দান-খয়রাত করে এবং লেবাস ধরে; কেউ অর্থের অভাবে নিজের সঙ্গিনীকে দুমুঠো ভাত ঠিকমতো দিতে পারে না, বাবা-মায়ের সেবা করতে পারে না এবং সারাটা জনম যায় দুঃখের গান গেয়ে…। কেন ঈশ্বরের এই সামঞ্জস্যহীন আচরণ? যার কর্মে পক্ষপাতিত্ব, দ্বিচারিতা আর সামঞ্জস্যহীনতা, সে কিভাবে ন্যায়বিচারক হন?
ধরে নিলাম রোগশোক, দুঃখদুর্দশা, স্ত্রী-সন্তান বিয়োগআর জানমালের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে ঈশ্বর তার বান্দাকে পরীক্ষা করেন। কথা হলো—ক্ষমতা আছে বলেই কী যাচ্ছেতাই করার নামে বান্দার পরীক্ষা নিতে হবে? এটা ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে গেল না? অথবা ধরে নিলাম অনাথ, অসহায়, এতিম, গরিব, দুঃখী, রোগশোকে জরাজীর্ণ আর প্রতিবন্ধীরা যাবে জান্নাতে, আর ধনী মানুষেরা যাবে দোজখে; এজন্যই এই তারতম্য। তাহলে তো প্রশ্ন এসে যায়—যে শিশুটি জন্ম নিলেন ধনীর ঘরে, যৌবনে অঢেল সম্পত্তির মালিক হলেন, ঈশ্বরের উপাসনা করলেন, মসজিদ গড়লেন, মানুষকে সাহায্য করলেন, পৃথিবীর আনাচকানাচে দাপিয়ে বেড়ালেন, জীবনের প্রকৃত স্বাদ নিলেন, সংগমসুখ নিতে গ্রহণ করলেন কয়েকটা নারী, তিনি মৃত্যুর পরে দোজখে যাবেন কেন? এসবে কী ঈশ্বরের বিধিনিষেধ আছে? নেই তো। তাহলে?
আজকাল আমার সন্দেহ হয় ঈশ্বর বলে আসলে কিছু নেই; যা আছে তা মানুষের মনগড়া ক্সতরি কিছু মতভেদ। মানুষই ঈশ্বরের রূপরেখা ক্সতরি করেছে। এজন্যই প্রবাদ রচিত হয়েছে—যত কল্লা তত আল্লাহ, কৃষ্ণ কেমন যার মন যেমন। ধর্মমতে মৃত্যুর পড় কেয়ামত পর্যন্ত কবরে থাকতে হবে; হাশরের মাঠে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হয়ে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব কর্মকাণ্ডের হিসাব দিতে হবে; পুলসিরাত পাড়ি দিতে হবে; তারপর জান্নাত অথবা জাহান্নাম। কিন্তু; কবর, কেয়ামত, হাশর, পুলসিরাত ও জান্নাত-জাহান্নামের পূর্বে আমার সমগ্র জীবনটাতেই যে নারকীয় ঘটনা ঘটে গেল, এর দায়ভার নেবে কে? আমি কি চেয়েছিলাম এই জীবন? আমি কি ঈশ্বরকে বলেছিলাম আমাকে দুঃখকষ্ট দিয়ে আমার ইমানের পরীক্ষা নাও? মাঝেমধ্যে যখন একাকিত্ব বোধ করি, নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ এবং অসহায় মনে হয়, তখন অচেনা-অজানা কোনও একজনকে মনের অজান্তেই খুব ভালোবাসি; যাঁরে সামনে থেকে দুই চক্ষু মেলে কোনওদিন দেখি নাই। অনুভবের চক্ষু দিয়ে দেখতে পাই সেও আমাকে অনেকবেশি ভালোবাসে, ভালোবেসে অদৃশ্য বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে, কপালে চুমু খায়, অনুরাগের গান শুনিয়ে আমাকে ঘুম পাড়ায়; কাছে আসে ধরা দেয় না। সে যে আমার অন্তরের ধন হৃদয়ের উপলব্ধি। সে যে আমার মনচোর। জন্মজন্মান্তর ধরে মরুভ‚মির বুকে সে আমারে জলের গান শোনায়, জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাওয়া মনের বনে বৃষ্টি নামায়। কোনও এক জন্মের স্মৃতির আয়নায় তাঁর মনকাড়া রূপের মোহন ছবি ভেসে ওঠে, অসম্ভব ভয়ংকর সুন্দরী সে! তাঁর বাঁকা চাহনি আর স্নিগ্ধ হাসি আমাকে পাগল করে তোলে। তাঁকে ছুঁয়ে দেখতে মন চায়। ইচ্ছে হয় তাঁর বুকে মাথা রেখে বলি—আচ্ছা প্রিয়, আমার প্রিয়তমা স্ত্রী আয়শাকে তুমি কেড়ে নিলে কেন? উত্তরে সে বলে—আমি আমার প্রেমিকদের বাড়ি-ঘর পুইড়া দিই, তার কাছের মানুষরে পর করে দিই, তারে দেশ ছাড়া করি, তার সর্বস্ব হরণ করি; এরপরেও যখন সে আমাকে ভুলতে পারে না, আমি তখন তার দিব্যচক্ষু খুলে দিই।
আজকাল আর কোনওপ্রকার ইবাদত-বন্দেগি করি না, ভাল্লাগে না। গতমাসে হাতের বাটন ফোনটা ফেলে দিতে বাধ্য হই। বয়সের বাড়ে ফোনটা আর কাজ করছিল না। নতুন একটা ফোন নিতে হবে, সহকর্মীদের বুদ্ধিতে একটা স্মার্ট ফোন কিনলাম। ফেসবুক আইডি কীভাবে খুলতে হয় জানতাম না। বেল্লাল ভাই আমাকে একটা ফেসবুক আইডি খুলে দিলেন। ফেসবুকে কীভাবে লাইক, কমেন্ট,
শেয়ার ও পোস্ট করতে হয় তা শেখালেন। ফেসবুক যোগাযোগের অসাধারণ এক মাধ্যম। চাইলেই নিজের আইডিতে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। একে অপরের মতবিনিময় করা যায়। সারাদিন পরিশ্রম করে অবসরে ফেসবুক ব্যবহার করে ভালোই সময় কাটে। মাঝেমধ্যে নিজের কষ্টগুলোকে ফেসবুকে বন্দি করি, এতে হালকা হই। কতজন কতভাবে কতকিছু লিখে পোস্ট করে, আর সেই পোস্টের কমেন্ট বক্সে পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য প্রকাশ করি। অতিরিক্ত ভালো লাগলে শেয়ার করি। মোবাইল ফোনটা আমার সবসময়ের জন্য সঙ্গী হয়ে উঠল, শুধু ফেসবুকের কারণে। নতুন-নতুন আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আসে, পরিচিত হলে একসেপ্ট করি। আমার আইডিতে কখনও যদি পরিচিত মানুষের আইডি ভেসে ওঠে, তাহলে সঙ্গে-সঙ্গে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাই। এভাবেই একদিন পির মাহবুব নামের সেই খোদার খাসির মেজো ছেলে কুদরতের আইডি ভেসে ওঠে। আমার ফ্রেন্ড লিস্টের একজন কুদরতের ফেসবুক আইডির একটা পোস্ট শেয়ার করেছে। আইডির নাম—শাহ সুফি ক্সসয়দ কুদরত শাহ। প্রোফাইল পিকচার দেখার সঙ্গে-সঙ্গে চিনতে পারি এটা সেই পিরের পোলা পির, যে তার জন্মদাতা পিতাকে হত্যা করেছে! মনোযোগ দিয়ে কুদরতের লেখা পোস্ট পড়লাম। অসিয়তনামা শিরোনামের সেই স্টাটাসে লেখা—
মহান সংস্কারক, চেরাগে বেলায়েত, মুহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, যুগের ইমাম, আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া মানবজাতির জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার, সমস্ত নবি-রাসুলের চেয়েও যাঁর মর্যাদা বেশি, যাঁর জীবন্ত ছবি পূর্ণিমার চাঁদে দেখা গেছে, তিনি হলেন হজরত ক্সসয়দ মাহবুব শাহ (আ.)। তিনি এই মাটির পৃথিবী ত্যাগ করে মহান রবের কাছে চলে যাবার সময় পরিবার ও খাদেমদের সম্মুখে কতিপয় নির্দেশনামূলক অসিয়ত করে গেছেন, নিন্মে অসিয়তসমূহ উল্লেখ করা হলো—
১. আমি মেজো হুজুর কুদরতকে মুহাম্মদী ইসলামকে পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে গেলাম, তোমরা সবাই তাঁকে সহযোগিতা করবে।
২. গুরুগৃহ, খানকা, মাজার, বাজার, হোটেল, হসপিটাল ও খামার কুদরত
দেখাশোনা করবে, তোমরা তার হুকুমমতো কাজ করবে।
৩. জমিজমা ও মাজার-সংক্রান্ত যতো মামলামকদ্দমা আছে, তা নিয়ে বড়ো হুজুর মনির লড়বে, তোমরা তাঁর পাশে থাকবে এবং রক্ষা করবে।
৪. তোমরা ইমানহারা হইও না। মুহাম্মদী ইসলাম থেকে বিচ্যুত হইও না। আমার দেখানো পথে হাঁটবে।
৫. তোমাদের নামে মানুষ অনেক কুৎসা রটাবে, তোমরা আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে তা ধৈর্যের সঙ্গে প্রতিহত করবে।
লেখাটা পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে মনেমনে বললাম—শুয়োরের বাচ্চা, তুই তো তোর বাপরে নিজে মারছস, তোর ভণ্ড বাপে কবে অসিয়ত করে গেল রে? ভাবলাম— কমেন্ট বক্সে সত্য প্রকাশ করে দিই। পরে কী যেন কী ভেবে কমেন্ট করলাম না। মেসেঞ্জারে কল দিলাম; কল রিসিভ করে না। ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালাম; সাতদিন ঝুলে থাকার পরেও ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে না। এতোদিনে ওর ফোন নাম্বারটাও ভুলে গেছি। একটা সময় মনে হলো এখনই মনের জ্বালা মেটানোর সময়। ফেসবুকে ওদের কুকীর্তি প্রকাশ করে দেবো। ওরা আর এখন আমার নাগাল পাবে না। আমি এখন অনেকদূরে। বাড়িতে গেলেও চলবে, না গেলেও চলবে। আমার নামে সাজানো মামলাগুলোও শেষ হয়েছে। ফেসবুকের কল্যাণে ওদের ভণ্ডামি প্রকাশ করে দিতে হবে।
সময়-সুযোগ পেলেই ফেসবুকে ঢুকি। ভণ্ডদের কমেন্ট বক্সে গিয়ে তর্ক-বিতর্ক করি। নিজের টাইম লাইনে ভণ্ডদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করি। কুদরতের পোস্টে গিয়ে যেদিন কমেন্ট করলাম তুই তোর বাপের হত্যাকারী, সঙ্গে-সঙ্গে আমার আইডিকে ব্লক মারলো। আমি থেমে গেলাম না। টুকটাক ধর্মের বিরুদ্ধে লেখতে থাকলাম। পির মাহবুব নামের ভণ্ড সাঁইজির আকাম-কুকামের কথা দেদারসে লেখতে থাকলাম। এতে হালকা নাস্তিক, আধা নাস্তিক, ভিতু নাস্তিক, গোঁড়া নাস্তিক, প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তার অনেক বন্ধু জুটে গেল। কোরআন ও হাদিসের অসংগতি নিয়ে পোস্ট করি, রাসুলগণের অজ্ঞানতা নিয়ে পোস্ট করি, আল্লাহর অস্তিত্বের বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে লেখি, তাতে অনেকের সহমত পাই। আমার মতাবলম্বী বন্ধুরা আমার প্রশংসা করে, আমাকে প্রেরণা জোগায়, আমি দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আরও যুক্তিযুক্ত ও তথ্যমূলক লেখা লিখি। মেসেঞ্জারে মুক্তমনা বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট হয়, কখনও অডিও কলে কথা বলি। একটা পোস্ট করলে যদি কেউ বিরোধিতা করে, তাহলে দলবেঁধে তাকে শায়েস্তা করি। কুদরতের অনুসারীরা মাঝেমধ্যে এসে গালি দিয়ে যায়। কুদরত নিজেও তাঁর ফেইক আইডি দিয়ে গালাগালি করে। আমি থেমে যাই না, বরং ইটের বদলে পাটকেল মারি।
সেদিন মাথাটা বিগড়ে যায় কুদরতের আরেকটা ফেইক আইডির পোস্ট পড়ে। পোস্টে লিখেছে—একবিংশ শতাব্দীর এই ক্রান্তিলগ্নে পাপসংকুল পৃথিবীতে সৃষ্টির কুল কায়েনাতের মূল উৎস, সিরাজাম মুনিরার ধারক ও বাহক হিসেবে পৃথিবীতে আগমন করেছেন আরেফে কামেল, মুর্শিদে মোকাম্মেল, যুগের শ্রেষ্ঠতম সাধক, হেদায়েতের হাদি, পাপীতাপীর পথপ্রদর্শক বাবা কুদরত শাহ কেবলাজান হুজুর! পোস্ট পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলামনা। কমেন্ট বক্সে লিখলাম—কি রে মাদারচোদের বাচ্চা, তুই কীভাবে কুল কায়েনাতের মূল উৎস? চোদানির পোলা ক, তোরে কে কইছে তুই সিরাজাম মুনিরার ধারক বাহক? বাইঞ্চদের বাচ্চা, তুই যুগের শ্রেষ্ঠ সাধক না, তুই যুগের শ্রেষ্ঠ কুলাঙ্গার। তুই চার ঠ্যাংওয়ালা ঘেউঘেউ করা জীব। তুই মস্তি®‥ প্রতিবন্ধী। তুই তোর বাপের হত্যাকারী। কমেন্ট করার দুইমিনিট পর আইডিটাকে আর খুঁজে পেলাম না। গালাগালি করে মনের ক্রোধ দমন হলো না। নতুন করে আইডি খুলে সেই আইডি দিয়ে আবারও গালাগালি করলাম। এখন অবসরে ফেসবুকে ঢুকে আমার কাজই গালাগালি করা। মাঝেমধ্যে খুব খারাপ লাগে এই ভেবে যে, এই যে আমি পাবলিক প্লেসে গালাগালি করি, এতে তো মানুষ আমারেই খারাপ বলবে। কী দরকার আছে গালাগালি করার? কিন্তু; আমার অশান্ত আত্মা বিদ্রোহ করে বলে ওঠে—অবশ্যই গালি দিতে হবে। ওদেরকে তো আর অন্য কোনওভাবে শাস্তি দিতে পারবো না; আপাতত গালি দিয়ে হলেও মনের জ্বালা মেটাতে হবে, সত্য প্রকাশ করতে হবে। এতে লোকে কী বলবে বলুক। চুপ মেরে থাকলে লোকেরাও জানতে পারবে না মুখোশের আড়ালে ওরা কতটা ভয়ংকর। কলঙ্কের বোজা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে হলেও কিছু-না-কিছু আমাকে বলতেই হবে।
ভার্চুয়াল জগতেই পরিচিত এক প্রগতিশীল বড়োভাই রাতে কল দিলেন। তাঁর সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথাবার্তা হয়। তিনি একাধারে মুক্তমনা, প্রগতিশীল, সংশয়বাদী, যুক্তিবাদী, নারীবাদী, সাহিত্যিক, দার্শনিক এবং আন্তর্জাতিক নাস্তিক্যবাদী সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। তার কথায় মুক্তা ঝরে। তিনি কখনও উত্তেজিত হয়ে কথা বলেন না। তিনি ধর্মবিরোধী মানুষ, তবু ধার্মিকরা তাকে সম্মান করে। তার সঙ্গে পরিচয় হয়ে নিজেকে ধন্য মনে হয়েছিল। তার হাতে পর্যাপ্ত সময় ছিল। যখন তখন কল দিতেন, বা আমিও কল দিলে কথা বলার সুযোগ পেতাম। একটা বিষয় ভেবে খারাপ লাগে লোকটাকে দেখতে কেমন দেখা যায় তা দেখতে পারলাম না। তার ফেসবুক আইডির প্রোফাইল পিকচার ও কভার ফটোতে তার কোনও ছবি নাই; শুধু ফুল পাখির ছবি দিয়ে রেখেছেন। উনি ভিডিও কলেও কথা বলেন না। উনি কাউকে দেখা দিতে চান না। হয়তো নিজের নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি এমনটা করেন। তিনি সব সময়ে আমাকে উপদেশ দিয়ে কথা বলেন। তিনি আজকে যে উপদেশ দিলেন, তাতে অবাক না হয়ে পারলাম না। তিনি কল দিতেই আমি রিসিভ করে বললাম—
হ্যাঁ ভাইজান, কেমন আছেন?
আছি ভালো। ফেসবুকে তোমার পোস্ট এবং কমেন্ট পড়লাম। ভাবলাম তোমার সঙ্গে কথা বলা দরকার। তুমি যা শুরু করেছ, এতে তোমার কোনও ফায়দা নাই, বরং এসব অশালীন বাক্য-বিনিময়ের কারণে মানুষ তোমাকে ব্যক্তিত্বহীন বলবে। এসবের তো দরকার নাই।তুমি যাদের বিরুদ্ধে অকথ্য ভাষায় কথা বলতেছ, তাদেরকে তো তুমি পথে আনতে পারবা না। তুমি তাদের শাস্তিও দিতে পারবা না। তারচে বরং ভিন্ন পথে হাঁটো।
ভাই, গালাগালি করে মনের জ্বালা মেটাই। এতে শান্তি পাই। ওরা কতটা খারাপ, সেটা আপনি জানেন না। যাই হোক, ভিন্ন পথে হাঁটতে বললেন, এইটা আবার কোন পথ? আর কেনই-বা ভিন্ন পথে হাঁটবো?
দ্যাখো, মানুষ যেখানে আছাড় পড়ে, আবার সেখান থেকেই উঠে দাঁড়ায়। তুমিও যেখানে শেষ হয়েছ, সেখান থেকেই শুরু করো।
বুঝলাম না ভাই, একটু খোলাসা কইরা কইবেন? আমি কোথায় শেষ হয়েছি, আর কোথা থেকে শুরু করব?
পিরগিরি সম্পর্কে তোমার ভালো অভিজ্ঞতা আছে। তুমি পিরগিরি শুরু করো। জাস্ট; একটু লেবাস ধরবা, কথাবার্তা সাবধানে বলবা, আর কিছু টাকা ইনভেস্ট করবা। এই ব্যবসা সম্পর্কে জানোই তো, লস নাই। মানুষ তোমার হাতপা টিপে দিবে, ভক্তি করবে, সালাম দিবে, সম্মানের চোখে দেখবে; আব্বা, বাজান, হুজুর, সাঁইজি ও গুরুজি বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলবে। তোমার বাড়ি গাড়ি ও নারীর কোনও অভাব হবে না। এই যে তুমি হাড়ভাংগা খাটুনি খাটো, এতে কয় টাকা কামাও? প্রবাসে গাধার খাটুনি খেটে যা ইনকাম করতেছ, পিরগিরি যদি জমাইতে পারো তারচে হাজারগুণ বেশি কামাইতে পারবা বইসা থাইকা।
ভাই, আপনি কী আমারে ধর্ম নিয়া ভণ্ডামি করতে কইতেছেন? জাইনা-বুইঝা ভণ্ডামি করলে নিজের সঙ্গে নিজের প্রতারণা করা হয়ে যায় না?
শিমুল, তুমি জানো যে ধর্মগ্রন্থগুলো মানুষের লেখা, জান্নাত-জাহান্নাম বলে কিছু নাই, আল্লাহ বলে কেউ মহাবিশ্বটাকে পরিচালনা করতেছে না বরং এগুলো সবই প্রাকৃতিক। তুমি এসব জানো বেশ ভালো কথা। কিন্তু জাইনা করবাটা কী? নিজে আলোকিত হইছো এবং অন্যরে আলোকিত করতে চাও, এই তো? রাস্তা যদি বাঁকা হয়, তাইলে সোজা পথচলা কঠিন। তোমাকেও বাঁকাপথে হাঁটতে হবে। তুমি যে পথে মানুষকে সচেতন করতে চাও, সে পথে বড়োজোর দুয়েকজনকে হয়তো আনতে পারবা। আর তুমি যাদের পথে আনতে চাও, তাদের ভেতরে ঢুইকা তাদের দিয়ে যদি তুমি সুযোগসুবিধা পাও, তবে সেটাই কি ভালো না? তোমার আদর্শ যদি হয় অন্যায়ের প্রবর্তকদের অবসান ঘটানো, তাইলে তাদের ওপর কর্তৃত্ব না করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করো। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার পথটা হলো তাদের ভেতরে ঢুইকা যাও, সুযোগসুবিধা নাও এবং ওদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো।
ভাই, ধর্মগ্রন্থগুলো মানুষের লেখা নাকি ঐশ্বরিক এইটার পার্থক্য নির্ণয় করার জ্ঞান আমার ভেতরে এখনও আসে নাই। ঈশ্বর আছেন নাকি নাই তা-ও আমি নিশ্চিত না। জান্নাত-জাহান্নাম বলে কিছু আছে কি-না মরার পরে বুঝতে পারবো। কিন্তু, আপনে তো ইলুমিনাতিদের মতো কইরা কথা কইতেছেন। ইলুমিনাতির কোনও সদস্যরে জীবনে দেখি নাই। তাদের সম্পর্কে লোকে যা বলে আপনি সেভাবেই কথা বলতেছেন। তারাও তো একই কথা বলে—অন্যায়ের প্রবর্তকদের অবসান ঘটাতে হলে তাদের ওপর কর্তৃত্ব না করে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আপনি কী ইলুমিনাতির সদস্য?
পৃথিবীর সকল মানুষই ইলুমিনাতির সদস্য। আমরা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ইলুমিনাতির হুকুম মেনে চলছি। পৃথিবীর যাবতীয় রাজ‣নতিক দল, বিচারালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পররাষ্ট্রনীতি, মিডিয়া, অর্থনীতি, কাল্ট ও জঙ্গি সংগঠন ইলুমিনাতির আঙুলের ইশারায় চলে। যে কোনও দেশের সরকারের ক্ষমতায় আসা থেকে শুরু করে জাতিসংঘের নীতিনির্ধারণ সবই ইলুমিনাতির নিয়ন্ত্রণে। অতএব, তুমি কোন দিকে যাইবা? তোমার গুরু পির মাহবুব নিজেও তো ইলুমিনাতির সদস্য ছিলেন। মাত্রাতিরিক্ত নেশা, অর্থ ও নারীর লোভের কারণে তাকে নিহত হতে হলো।
ভাই, আপনার কথাবার্তায় বোঝা যায় পির মাহবুবের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ছিল, অথবা আপনি তাকে খুব ভালো করে চিনতেন। যাই হোক, আপনি যা বলেছেন, যদি ভণ্ডামি করার ইচ্ছা হয় কখনও, তাহলে আপনার কথা ভেবে দেখবো। কিন্তু; একটা কথা বুঝাইয়া বলবেন? পৃথিবীর সব দেশের মানুষই তো ইলুমিনাতির সদস্য না। তাইলে তারা যে কোনও একটা দেশের সরকার পতন, সরকার গঠন, সে দেশের বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে?
ইলুমিনাতিরা একটা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে নিজেরা সেইখানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন না। এইটা তারা ওই রাষ্ট্রের জনগণ দিয়াই করান। প্রথমে তারা দুয়েকজন লোকের মাধ্যমে ধর্মীয় বিরোধ বা বিভাজনের সৃষ্টি করেন। ধর্মীয় বিভাজন বা বিরোধ থেকে সৃষ্টি হয় সাম্প্রদায়িক ক্ষোভ। তখন ধর্মে সৃষ্টি হয় দল- উপদল। সাম্প্রদায়িক ক্ষোভ থেকে সকল পক্ষ একে অপরকে অবিশ্বাস করতে থাকে। এরপর পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে রাখেন যে, যে কোনও সময়ে ধর্মীয় সংঘাতের মধ্য দিয়া তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারেন। একদল কথা না শুনলে আরেকদল দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। একটা দেশকে পুরোপুরিভাবে অথর্ব বানিয়ে সে দেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে সেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইলুমিনাতিরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক শিক্ষাদীক্ষা বাতিল কইরা সেইখানে শুধু ধর্মীয় শিক্ষা ঢুকাইয়া রাখেন, আর এইটা তারা খুব সহজেই করতে পারেন। আরেকটা কাজ হলো আদর্শিক বিরোধ সৃষ্টি করা। দেশের মইধ্যে দুয়েকজন ব্যক্তিকে একেক রূপে আদর্শবান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যাতে ওই দেশের জনগণ একেকজনের অনুসারী হইয়া যায় এবং সেইখানে সৃষ্টি হয় আদর্শিক বিরোধ। বিরোধ এমন পর্যায়ে চইলা যায় যে, যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের লোকজন আইন নিজের হাতে তুইলা নেয়। এবং অন্যান্য দলের মইধ্যে ক্ষোভ দানাবাঁধে। একসময় নির্যাতিতরাও আইন নিজের হাতে তুইলা নেওয়া শুরু করে। তখন দেশের সাধারণ জনগণের মইধ্যে সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে এবং তারা নতুন একজন নেতা খুঁজতে থাকেন। আর এইসময় ইলুমিনাতির সাহায্য-সহযোগিতা নিয়া একজন নেতার আবির্ভাব হয় এবং সাধারণ জনগণের সমর্থনে সেই নেতা ক্ষমতায় বসেন। ক্ষমতায় বসে এই নেতা কঠোরভাবে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করেন এবং রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান নিজস্ব বাহিনী দিয়ে পরিচালনা করতে থাকেন। এবং ইলুমিনাতিদের ইচ্ছেমতো রাষ্ট্র পরিচালনা করতে থাকেন। এই নেতা কোনও সময় যদি ইলুমিনাতির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চইলা যায়, তখন তাকেও একই কায়দায় ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
ভাই এতকিছু তো জানতাম না। এইটা তো আসলে ভয়ংকর ব্যাপার! এই অবস্থা থেকে তো মানবজাতি কয়েক হাজার বছরেও মনে হয় মুক্তি পাইবো না।
মুক্তি পাইয়া লাভ কী? তারচে বরং তাদের পথেই হাঁটো, এতে চাকচিক্যময় একটা জীবন পাবে। ইউরোপিয়ান, আমেরিকান ও ইজরায়েলিদের মতো শান্তিতে থাকতে পারবে।
ভাই, আমারে সরাসরি ইলুমিনাতির কোনও সদস্যের সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দিবেন? আমিও ইলুমিনাতির সাহায্য নিয়া জীবনে কিছু একটা করতে চাই। এই জীবন আর ভাল্লাগে না।
দ্যাখো, তুমি সরাসরি কোনও ইলুমিনাতির সদস্যের দেখা পাইবা না। তাদের যে দর্শন, সেই দর্শন অনুযায়ী যদি চলতে পারো, জীবনে যদি বড়ো ধরনের সেলিব্রিটি হইতে পারো, তাইলে তাদের দেখা পাইলে পাইতে পারো। তোমারে ভালোবাসি তাই এত কথা কইলাম। তোমার জীবন অভিজ্ঞতা পুরোটাই পরিপক্ব। এইবার তুমি চাইলে আশ্রম খুইলা বিশ্রাম নিতে পারো।
আশ্রম
লোকে বলে পরিশ্রমই সকল সুখের চাবিকাঠি। কিন্তু; আমি আমার এই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানলাম বুদ্ধিই সকল সুখের চাবিকাঠি। পরিশ্রমই সকল সুখের চাবিকাঠি এই কথা যারা বলে, তারা মূলত অবিরাম বিশ্রাম চায় অথবা তারা নিজেরা পরিশ্রম করতে চায় না। পরিশ্রমের মধ্যে যদি সুখ থাকতো, তাহলে চালাক মানুষেরা পরিশ্রম করতেন; সাধারণ মানুষদের অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দিতেন না। গাধা বোজা বহন করতে পারে, পরিশ্রম করতে পারে, এটা দেখে চালাক মানুষেরা গাধার খাটুনি খাটতে যায়নি, বরং গাধার পিঠে কীভাবে বোজা আরও বেশি করে চাপিয়ে দেওয়া যায় সেই বুদ্ধি বের করেছে। এই যে আমি সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করি, মাথায় হেলমেট পরে, পায়ে সেফটি জুতা পরে, গায়ে শ্রমিকের এপ্রোন পরে আর কোমরে সেফটি বেল্ট বেঁধে নিজের জীবনটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে লোহালক্কড় টানাটানি করি, আমার সুখ কই? সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে রাতে যখন একমুঠো ভাত খেয়ে বিশ্রামে যাবো, তখনও অশান্তিরা অক্টোপাসের মতো আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রাখে!
এই তো গতকাল ষাট কেজি ওজনের একটা রড এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত করার সময় পা ফসকে আছাড় খেলাম। হাঁটুর চামড়া উঠে গেছে। তা-ও ভালো হাঁটু ভেঙে যায়নি। ভেঙে না গেলেও ভাঙার ব্যথা কম অনুভব করিনি। চামড়া ফেটে রক্ত ঝরছিল। রক্ত থেমে গেল, তারপর কী যে টানটান ব্যথা! সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। কোমরেও বড়ো ধরনের চোট পেয়েছি। চিনচিনে ব্যথা। সন্ধ্যার দিকে কাঁপুনি দিয়ে শরীরে জ্বর এলো। রাতের খাবার খেতে পারলাম না। খুব করে মায়ের কথা মনে পড়ছিল। এই মুহূর্তে যদি মা-বাবা পাশে থাকতেন, তাহলে মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, বাবা ডাক্তার ডাকতেন। অথবা, আমার প্রিয় মানুষটা আয়শা যদি আমার পাশে থাকতো, আমাকে যন্ত্রণায় কাতরাতে হতো না। পিপাসায় গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ব্যথায় নড়াচড়া করতে পারছি না। মশার কামড়। পুলিশের ভয়। জঙ্গলে প্রচণ্ড গরম। তবু শীতে গা হাতপা কাঁপছে! শরীরের যন্ত্রণা আর মনের যন্ত্রণা এক হয়ে চোখের কোণে অশ্রু হয়ে টলমল করে। চিৎকার করে কাঁদতে পারি না। হাতের কাছেই পড়ে আছে মোবাইল ফোনটা। খুব কষ্টে ফোনটা হাতে নিয়ে ডাটা অন করে ফেসবুকে ঢুকে পির মাহবুবের মেজো পুত্র কুদরতের ছবি দেখে ভাবতে লাগলাম, এইটা কোন জীবন আর আমারটা কোন জীবন? ভাবতে-ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানি না। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখলাম, সে এক আজব স্বপ্ন!
স্বপ্নে দেখলাম—আমাদের শহরের মসজিদ থেকে একটু উত্তরে চিপাগলির অল্প একটু পরিত্যক্ত জমি অল্পমূল্যে ক্রয় করেছি। সেই জমিতে একটা বটগাছ লাগিয়েছি। পাশে আরও ফুল-ফলের গাছ। খুব তাড়াতাড়ি গাছগুলো বেড়ে উঠল। বটগাছের ডালপালায় বেঁধে দিলাম রঙিন সুতো। প্রতিটা গাছের গোড়ায় রং মাখিয়ে দিলাম। বটগাছের গোড়ায় বসালাম বিশাল এক পাথর। পাথরে সিঁদুরের প্রলেপ ঢেলে দিলাম। প্রতিদিন আগরবাতি মোমবাতি জ্বালাতে লাগলাম। উৎসুক জনতা দেখতে এলো এখানে কী হচ্ছে। কেউকেউ বসে এখানে বিশ্রাম নিচ্ছে। কেউকেউ গাঁজার কল্কি টানছে। একদল লোক গানের আসর জমিয়েছে। কিছু পাগল যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে, নাচানাচি করছে। এই এলাকায় ছড়িয়ে গেল এই এখানে বটগাছের নিচে পাথরে ভক্তি দিলে যে কোনও বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। মানুষ মুক্তি পেতে লাগল। বিনিময়ে তারা তাদের ভক্তি বা পূজার অর্ঘ্য হিসেবে টুকটাক অর্থকড়ি ফেলতে লাগল। সেই অর্থ থেকে কংক্রিটের প্রাচীর নির্মাণ করলাম। বিশাল বড়ো গেইট নির্মিত হলো। গেইটে আরবি হরফে লিখে দিলাম আল্লাহ সবচেয়ে বড়ো। তারপর লিখলাম আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নাই, হজরত মুহাম্মদ (স.) রাসুল এবং আল্লাহ। অতঃপর বাংলায় বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখলাম—বাবা শিমুল শাহ আশ্রম।
শ্রমহীন আশ্রমের সংবাদ অনেকদূর ছড়িয়ে গেল। অলস কুকুরে ভরে গেল আশ্রমের চারপাশ। লোকজন আমাকে সম্মান দেখাতে লাগল। কেউ আব্বা, কেউ বাজান, কেউ হুজুর, কেউ গুরুজি, কেউ সাঁইজি বলে সম্বোধন করতে লাগল। আমার অনুসারীর সংখ্যা দিনদিন বাড়তে লাগল। আমার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে গেল। একনজর আমাকে দেখার জন্যে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আমি যে-পথে হেঁটে যাই সে-পথের ধুলো মানুষ গায়ে মাখে। আমার উচ্ছিষ্ট ভোগের জন্য মানুষ আশায় বসে থাকে। দূরদূরান্ত থেকে আমার জন্য উপহার সামগ্রী আসে। কেউ টুপি পায়জামা পাঞ্জাবি উপহার পাঠায়। কেউ জায়নামাজ পাঠায়। আমার পছন্দের জুতো ঘড়ি আংটি সবই উপহার হিসেবে আসে। সুগন্ধি আতর আর পারফিউমের অভাব নাই। আমার বাহিরে বেরুনোর জন্য দামি গাড়ি আছে। ক্ষমতাবান লোকেরা বুদ্ধি পরামর্শ ও দোয়া নেওয়ার জন্য আমার কাছে আসে। আমার সামনে কেউ মাথা তুলে কথা বলে না। ভক্তের স্ত্রীরা আমার হাতপা টিপে দেয়। কখন কোনটা খাবো তা থরে-থরে সাজানো থাকে। আমার মুখের বাণী এতটাই পবিত্র হয়ে গেল যে, যা-তা বলে পানিতে ফুঁ দিয়ে সেই পানি যে কোনও রোগীকে পান করালে রোগ ভালো হয়ে যায়। কারও-কারও ভালো হয় না। আমার পানিপড়া খাওয়ার পরেও যাদের রোগবালাই ভালো হয় না, তাদের রোগের চিকিৎসা এই দুনিয়াতে নাই। আমার ফুঁয়ে যে উপকারিতা, এমন উপকারী ওষুধ চিকিৎসাবিজ্ঞান আজও আবিষ্কার করতে পারেনি। আশ্রমে এতো-এতো লোক আশ্রয় নেওয়া শুরু করল যে, তাদের জন্য প্রতিদিন কয়েক মণ চাল ডাল রান্না করতে হয়। এইসব খাবার-দাবারের খরচ দানবাক্স থেকে আসে। লোকসমাগম বেড়ে যাওয়াতে আশ্রম কমিটি গঠন করতে হলো। আশ্রমের চারপাশে দোকানপাটে ভরে গেল। আশ্রমে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ আসতে লাগল। তাদের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মসজিদ ক্সতরি করে দিলাম।
একসময়ে চিন্তা করে দেখলাম আমার যে এতো-এতো ভক্ত, আমি তো চাইলে এমপি পদে নির্বাচন করতে পারি। স্বপ্নের মাঝেই এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। আশ্রমটাকে আরও বড়ো করতে হবে। আশ্রমের চারপাশের দোকানপাট আর বাড়ির মালিককে জমি বিক্রি করতে বললাম। দুয়েকজন আশ্রমের নামে জমি দান করে দিলো। কেউ কম মূল্যে বিক্রি করে দিলো। দুয়েকজন যারা তাদের জমি বিক্রি করতে চাইলো না, তাদেরকে জমি বিক্রি যাতে করতে হয় সেই পথ খুঁজতে লাগলাম। পথ খুঁজতে-খুঁজতেই ভোর হয়ে গেল।
ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। শুনেছি ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। বিছানায় বসেই স্বপ্নসুখ অনুভব করলাম। অনুভবের চক্ষু দিয়ে দেখলাম বিশুদ্ধ এই শহরে গড়ে উঠল আরেকটা নিষিদ্ধ পল্লি, রচিত হলো বিশুদ্ধ শহরের নিষিদ্ধ গল্প।
——
শহিদুল শাহ
কৃতজ্ঞ❣️