বিলের জীবন : নমশূদ্রদের বারো মাসে তেরো পার্বণ – সুধাংশু শেখর বিশ্বাস
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৮
উৎসর্গ
এই রচনায় ব্যবহৃত তথ্যের সিংহভাগ সংগৃহীত হয়েছে যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, অন্ত্যজ গোষ্ঠী নিয়ে কাজ করা সেই শক্তিমান লেখক অসিত বিশ্বাস এবং কোন সুদূর অতীতে বিল এলাকায় এসে বসতি গেড়েছিল যারা পরম শ্রদ্ধাভাজন আমাদের সেই পূর্বপুরুষ ও নতুন প্রজন্ম যাদের হাতে তুলে দিতে চাই তাদের জন্ম ইতিহাস, সমৃদ্ধ অতীত ও সংস্কৃতি।
লেখকের প্রকাশিত অন্যান্য বই
গবেষণা উপন্যাস
১. বিলের জীবন : নমশূদ্রদের বারো মাসে তের পার্বণ (নালন্দা)
২. শরণার্থী (নালন্দা) ভ্রমণ
৩. নমসপুত্র
উপন্যাস
১. ম্যাকেলিনা
২. সাগিনো ভ্যালি
৩. হোটেল সিয়াম (নালন্দা)
গল্প সংকলন
১.স্ট্যাটাস (নালন্দা)
লেখকের পরবর্তী বই
১. অদ্ভুত আঁধার এক ( উপন্যাস )
২. হোয়াইট চ্যাপেল ( ভ্রমণ উপন্যাস)
৩. সুরুজ দ্য গ্রেট ( কিশোর কাহিনি) ( নালন্দা)
৪. সোনালি ডানার চিল (স্মৃতি গল্প) (নালন্দা)
প্রারম্ভ কথা
কালের প্রবাহে সময়ের সাথে সাথে বদলায় সমাজ, সভ্যতা। বদলে যায়। অর্থনীতি। তার সাথে বদলে যায় গ্রামীণ জীবন, সংস্কৃতি।
বিল এলাকার জনজীবনও আমূল বদলে গেছে মাত্র ষাট-সত্তর বছরেই। একসময় বিল থাকত কানায় কানায় ভরা। থৈ থৈ জলে ঢেউ খেলে বয়ে যেত বাতাস। বাড়ির ঘাটে ঘাটে থাকত নৌকা। ভরা বর্ষায় গ্রামগুলো ভাসততা দ্বীপের মতো। সেই বিল এলাকায় গ্রামের পর গ্রাম ছিল শুধুই নমশূদ্রদের বাস। লেখাপড়ার কোনো বালাই ছিল না। অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর কুসংস্কারের গহিন অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল তারা।
অভাব-অনটন ছিল তাদের নিত্য সঙ্গী। কিন্তু সেসব খুব একটা স্পর্শ করত না। অফুরন্ত আমোদ-ফুর্তির মধ্যেই দিন কাটাত তারা। তারা কৃষিকাজ করত, ফসল ফলাত, জাল বুনতো, বিলে মাছ ধরত। ভরা বর্ষায় নৌকা বাইত, গলায় তুলত ভাটিয়ালির সুর। সন্ধ্যায় তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলত। খোল-করতালের সাথে রাতভর চলত কীর্তন, দেহতত্ত্ব, কবিগান, যাত্রা, রামায়ণ। এত সব বৈপরীত্য নিয়েই তখন কাটত নমশূদ্রদের জীবন।
আমার এই রচনা সেই সময়ের নমশূদ্রদের জীবনধারাকেন্দ্রিক। তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-স্বপ্ন, তাদের সংস্কৃতি, পূজা-পার্বণ, উৎসব ইত্যাদি তুলে ধরা আমার উদ্দেশ্য। সাথে যুক্ত হয়েছে তাদের ইতিবৃত্ত, অতীত ইতিহাস, এই বঙ্গে তাদের আগমন, নম-এর সাথে শূদ্র কীভাবে যুক্ত হয়েছে সেসব বিষয়।
বন্যা-খরায় নমশূদ্র কৃষকদের অবস্থা কঠিন হয়ে যেত। কিন্তু কাহিল হয়ে পড়ত না।
বর্ষার সাথে সাথে বিলে জল আসতে শুরু করত। নতুন জলে খলবল করে ছুটে বেড়াত চ্যালা, পুঁটি, ট্যাংরা, রয়না, খয়রা, টাকি, সরপুঁটি আরও কত রকমের ছোট মাছ। জলের আর একটু গভীরে দাপাদাপি করে বেড়াত শোল, গজার, নওলা, কাতল, মৃগেল, বোয়াল। এরকম সময়েই কাটা হয়ে যেত আউশ ধান। থেকে যেত আমন। একটু একটু করে বাড়ত বিলের জল। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠত আমন ধানের গাছ। যেন জলের উপরে নাক উঁচু করে গাছগুলো সাঁতার কাটত অবিরত। এক একটা ধানগাছ হতো পনেরো বিশ হাত পর্যন্ত লম্বা। ভালোয় ভালোয় এই ধান ঘরে তুলতে পারলে এলাকার নমশূদ্রদের মুখে আর হাসি ধরত না।
তাদের জীবন ছিল তখন পুরোপুরি প্রকৃতিনির্ভর। বন্যা-খরা ছিল বিলের মানুষের নিত্যসঙ্গী। রাতের মধ্যেই কোনো বছর বানের জল ভাসিয়ে নিয়ে যেত সবকিছু। ডুবে যেত বাড়িঘর, ডুবে যেত ফসল। শেষ হয়ে যেত এলাকার মানুষের সংবৎসরের আহারের সংস্থান। বানভাসি মানুষগুলোর কপালে নেমে আসত অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট। অনাহারে-অর্ধাহারে কাটত তাদের দিন। আবার কোনো বছর খরার প্রচণ্ড দাবদাহে চৈতালি ফসলও পুড়ে খাক হয়ে যেত।
আজ বদলে গেছে নমশূদ্রদের জীবন। বদলে গেছে বিল এলাকার সেই গ্রামীণ চিত্র। নদীগুলোর পাড়জুড়ে উঁচু উঁচু বাঁধ এখন। বিলে এখন আর জল হয় না তেমন। আউশ-আমনের আবাদ হয় না আর। গোটা মাঠজুড়ে এখন ইরি ধানের চাষ। ভটভট শব্দে চলে পাওয়ার টিলার, ডিপ টিউবওয়েল, শ্যালো মেশিন।
তারা এখন শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পদে কর্মরত। তারা এখন শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, উকিল, বিচারক, ব্যবসায়ী। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে উচ্চপদে যারা আসীন, তাদের নব্বই ভাগই নমশূদ্র। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে বা পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে এই চিত্র ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।
নমশূদ্ররা এখন আর হতদরিদ্র নয়। খেটে খাওয়া এই মানুষগুলোর আর্থিক অবস্থা এখন অনেক ভালো। গ্রামে গ্রামে, বাড়িতে বাড়িতে এখন শিক্ষিত ছেলেমেয়ে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। বিলের ভিতর দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। সেই রাস্তায় চলে ভ্যান, রিকশা, টেম্পু, বাস, ট্রাক। কেরোসিনের টিমটিমে বাতির জায়গায় বাড়িতে বাড়িতে জ্বলে এখন উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাল।
একসময় বৈশাখ থেকে শুরু করে চৈত্র মাস পর্যন্ত সারা বছর ধরে নমশূদ্ররা পালন করত হরেক রকম উৎসব। শত অভাব-অনটনেও জীবন তাদের বয়ে চলত অপার আনন্দধারায়। সময়ের সাথে সাথে ভৌগোলিক আর অর্থনৈতিক পরিবর্তনে বদলে যাচ্ছে সেই জীবনধারা। বদলে যাচ্ছে সংস্কৃতি, উৎসব পালনের ধারা। হারিয়ে যাচ্ছে সেসব বিস্মৃতির অতলে।
এখন আনন্দ-উৎসবে থাকে সাউন্ডবক্স, বাজে কড়া বিটের হিন্দি গান। তার সাথে চলে ছেলেমেয়েদের উদ্দাম নাচ। উঠোনজুড়ে বসে পদ্মপাতা, কলাপাতায় খাওয়া-দাওয়া হয় না আর। সেই স্থান দখল করেছে ডেকোরেটরের টেবিল-চেয়ার, ম্যালামাইনের থালা। এখন আর ব্রতকথা, রামায়ণ, কবিগানের আসর বসে না। রাজধানী থেকে আসে ব্যান্ড শিল্পী। কনসার্টের সাথে তালে তালে কোমর দোলায় তারা।
বিস্মৃতির অতলে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে সারা বছর ধরে পালিত নমশূদ্রদের সেই সব উৎসব, আনন্দ, পার্বণ তথা সামগ্রিক জীবনধারা নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার প্রয়াসে এই রচনা–
‘বিলের জীবন
নমশূদ্রদের বারো মাসের তেরো পার্বণ’
Leave a Reply