বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় রচনাবলী ২ (দ্বিতীয় খণ্ড)
মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা: লি:
প্রথম প্রকাশ, আশ্বিন ১৩৮১
প্রধান উপদেষ্টা – শ্রীপ্রমথনাথ বিশী
সম্পাদক – শ্রীগজেন্দ্রকুমার মিত্র ও শ্রীসুমথনাথ ঘোষ
.
ভূমিকা
আমার উপর ভার, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের তিনখানি বই একত্র করে তাঁর রচনাবলীর যে খণ্ডটি প্রকাশিত হচ্ছে তার ভূমিকা লিখতে হবে। বিভূতিবাবুর গল্প-উপন্যাস নিজগুণেই বিখ্যাত এবং বিশেষ জনপ্রিয়। অতএব সে-সব বইয়ের পরিচয় নতুন করে দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। তবে আমি তাঁর এই বইগুলি পড়ে মোটের উপর তাঁর শিল্পীমনের যে পরিচয় পেয়েছি, তার মোটামুটি যদি একটি রূপ গড়ে তুলতে পারি তা হলে ভূমিকা-পাঠকের পক্ষে তা গ্রহণীয় হতে পারে। লেখক ও পাঠকের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন ছাড়া এ আর কিছুই নয়। শিল্পীমনের পরিচয় অবশ্য শিল্পীর সৃষ্টির মধ্যেই প্রকাশ, তবু সাধারণ পাঠকের কাছে কিছু কিছু অপ্রকাশ থেকে যাওয়া সম্ভব, ভূমিকা-লেখকের কাজ সেটি প্রকাশ করার চেষ্টা।
একটি ফুলের ভূমিকা লিখতে গেলে দেখা যাবে তার পাপড়িগুলি কোনোটাই কোনোটার সঙ্গে মেলে না, বিধাতাকে ডেকে বরং জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে, মহাশয়, এ কেমন কথা? বিধাতা বলবেন, তুমি সমগ্রের রূপটি দেখছ না কেন? এর উত্তর, সবটা ভাল লাগছে অবশ্যই; কিন্তু শিল্পীরা একটি পদ্ম আঁকার সময় সব symmetrical করে আঁকে, তেমন মাপজোক দিয়ে ফুলটি গড়লে ক্ষতি ছিল কি? বিধাতা বলবেন, তা ডিজাইন মাত্র হত, সৃষ্টি হত না, যান্ত্রিক হত, জীবন্ত হত না। ক্রিয়েটিভ আর্টের পক্ষে ঐ নিখুঁত হওয়াই মস্ত বড় বাধা। সে সৃষ্টি বিস্ময়ের জন্য নয়, আনন্দের জন্য, ভালবাসার জন্য। একটি জ্যামিতিক ত্রিভুজ বা চতুর্ভুজ কেউ বুকে জড়িয়ে আদর করে না।
এই হল সৃজনধর্মী আর্টের মূলকথা। কিন্তু আর ভূমিকা করব না। আর্টের ত্রুটি নানারকম থাকেই। কিন্তু যা পরিহার্য তা একটা হাতির গায়ে মাছির মত। ল্যাজের ঝাপ্টায় তা দূর হয়ে যায়। বিভূতিবাবুর লেখায় ভাষার দিক থেকে তেমন দু-চারটি লক্ষ্য করেছি। যেমন প্রবেশ করার বদলে সাঁদ করা, লুকানোর স্থলে নুকানো কানে লাগে। অবশ্য যেখানে লেখক নিজের উক্তিতে ঐ ভাষা ব্যবহার করেছেন সেখানে। নুকানো কোনো চরিত্রের মুখের ভাষা হলে বলবার কিছু থাকে না। পূর্ববঙ্গীয় লোকের মুখে ‘শালারে’র স্থলে ‘হালারে’ বদল দরকার। ‘গুলো’ ও ‘গুনো’ দুরকম মেশানো আছে।
এ জাতীয় দু-চারটি কথা কানে লেগেছে। এবং এগুলির কোনটাই সমগ্রের সম্পর্কে অচ্ছেদ্য নয়। অতএব সহজেই ছেদন করা চলে।
আর একটি কথা। স্বর্গাদপি গরীয়সীর সব চেয়ে দুর্বল অংশ আছে উপন্যাসের সীমার বাইরে। সেটি লেখকের ভূমিকা। কাহিনীর যে উদ্দেশ্য এবং ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন, তাতে পাঠক গিরিবালা বা কাত্যায়নীর কথা পড়তে গেলে ক্রমাগত ভাববে এ যেন হিসেব করে চরিত্র সৃষ্টি। ‘চরিত্র কেন সৃষ্টি হল’, যেন তা দুর্বোধ্য; অতএব তার ব্যাখ্যা চাই। কিন্তু এই চরিত্র দুটি সৃষ্টিতে দুর্বোধ্য কিছুই নেই। তাই পাঠক যা পড়ে নিজেই বুঝতে পারত, ভূমিকা পড়ার পরে চরিত্রগুলি ব্যাখ্যার সঙ্গে মেলে কিনা ক্রমাগত পরীক্ষা করে দেখবে। সুতরাং কৈফিয়ত বা ব্যাখ্যা একান্তই অবান্তর। পাঠকের প্রতি এতে অবিচার করা হয়েছে মনে হয়। মাতৃত্ব যে নারীজীবনের সার্থকতা তা শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়। জগতের সমস্ত প্রাণী জুড়ে এই একই জিনিষ লক্ষ্য করা যায়; প্রকৃতির দুর্বোধ্য বিধান এটি। তারই উদ্দেশ্য সাধনে সবাই রত। এটি প্রকৃতির দত্ত urge, সবাই ছন্দে চলেছে। একদল আসছে, তারা তাদের পালা শেষ করে আর একদলকে রেখে যাচ্ছে। মানুষের বেলায় তা আরও সার্থক ও সুন্দর হয়েছে তার ভাষা আর বিচারশক্তির গুণে। তার সমস্ত কাব্য, গান, শিল্প সবই ঐ সৌন্দর্যবোধ বিচারশক্তি ও ভাষার যোগে। এক চোখে আঙুল দিয়ে দেখবার দরকার ছিল না।
এবং রমণী-জীবনে সে সার্থকতা শুধু রমণীর বাৎসল্যেই শেষ নয়, পুরুষের দিক থেকেও নিজেকে ভাগ করে উত্তরপুরুষে প্রকাশিত হওয়ার মধ্যে যে আত্মীয়তাবোধ, তাকেও খুব কম করে দেখার দরকার নেই। সন্তান পালনের দায়িত্ব এবং বাৎসল্য পুরুষের দিকেও অনুপস্থিত নয়। নিম্নশ্রেণীর কীট-পতঙ্গ অথবা পশুদের মধ্যে পিতার দিক থেকে কোনো বাৎসল্যই দেখা যায় না। বেড়াল আপনার শিশুদের ভক্ষণ করে। সুতরাং এই বাৎসল্য মানুষেরই বৈশিষ্ট্য এবং তা জন্মগত। অতএব বাৎসল্য একমাত্র নারীতে সীমাবদ্ধ নয়। লেখক নিজেই তার প্রমাণ। তাঁর ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ পড়তে আরম্ভ করলেই বোঝা যায় তিনি ছোটদের চরিত্রসৃষ্টির সময় মনের সমস্ত স্নেহ-ভালবাসা প্রীতি-মমতা ঢেলে দিয়েছেন তাদের গড়ে তুলতে। এর মধ্যে তাদের প্রত্যেকটি মুহূর্তকে তিনি দেখেছেন এবং প্রাণ ঢেলে নিজের পরমাত্মীয়জ্ঞানে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই তো পুরুষের বাৎসল্য।
শিল্পীর নিস্পৃহতা এতে কতখানি? আর শুধু এ কাহিনীতেই তো নয়, যেখানে শিশুদের মেলা তার বর্ণনা যেন বুকের রক্ত দিয়ে লেখা। অথচ এ সবই শিল্পীর দৃষ্টিতেই দেখা, কোথাও ভুল নেই। এবং কাত্যায়নীর সঙ্গে তিনি নিজের পার্থক্য কিছু পেয়েছেন বলে মনে হয় না।
কিন্তু থাক সে কথা।
ফোটোগ্রাফের ক্ষেত্রে লেনস ও ফিলমের ইমালশন মিলে যে ছবি তৈরি হয়, তার ক্ষেত্রে দুইয়েরই রিজলভিং পাওয়ার কি পরিমাণ তা ঠিক করা হয়। এই দুইয়ে মিলে ছবির ক্ষেত্রে মূলে তথ্য যত বেশি ফুটে উঠবে, তত ও দুইয়ের রিজলভিং পাওয়ার বেশি বুঝতে হবে। এর নাম দেওয়া যেতে পারে বিকলন ক্ষমতা।
অন্যান্য বইয়ের মতো বিভূতিবাবুর স্বর্গাদপি গরীয়সী পড়তে গেলে ঐ উপমাটাই মনে আসে। তাঁর চোখের লেনস ও মনের ইমালশন-এর যে বিকলন ক্ষমতা তা পাঠককে চমককৃত করে। মানুষের সমাজের পরিবেশের পরিবারের সমস্ত তথ্য নিখুঁতভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু আরও বড় কথা—তারা পূর্ণ রূপে ফুটে ওঠে। বয়স যার যতই হোক, শিশু বালক যুবক বৃদ্ধ—এবং তারা যে কোনো বৃত্তিধারী হোন, তাদের কাজের ভিতর দিয়ে, কথার ভিতর দিয়ে ভাষার ভিতর দিয়েই তারা নিজ নিজ পরিচয় চমৎকার প্রকাশ করে।
এখন প্রশ্ন ওঠে, প্রত্যেকটি অংশের বিস্তারিত বিবরণ সমগ্রের পক্ষে অত্যাবশ্যক কিনা, অথবা আদৌ আবশ্যক কিনা।
মস্ত বড় আর্টের প্রশন! অরণ্যকে কিছু দূর থেকে দেখলে তবে তাকে অরণ্য বলে চেনা যায়। কাছে এসে গাছ গুনলে তখন আর তা অরণ্য থাকে না। আর্টের ধর্ম এটি। গাছ যেখনে চাই সেখানে অরণ্য চাই না। কিন্তু এ হল উপমা মাত্র। সকল ক্ষেত্রে একই উপমা না খাটতেও পারে। বিভূতিবাবুর ক্ষেত্রে এর মাঝামাঝি একটা পথ উন্মুক্ত হয়েছে। তিনি তাঁর কাহিনীর প্রত্যেকটা অংশ বিশদভাবে ধৈর্যের সঙ্গে নৈপুণ্যের সঙ্গে দেখেছেন এবং তিনি এমন একটি মধ্যপন্থা ধরেছেন, যাতে এক পা ওদিকে গেলে ভিড়ের চেহারা, এক পা এদিকে এলে প্রত্যেকটি মানুষের পৃথক চেহারা। যে অস্পষ্টতার আবরণ সকল সমগ্র রূপের প্রাণ তাও আছে এবং যে নিকট দৃষ্টির প্রত্যেকটি অংশ স্পষ্ট লক্ষ্যগোচর তাও আছে।
তিনি চাঁদকে দূরের দৃষ্টিতে যেমন দেখেছেন, তেমনি তাকে কাচের দৃষ্টিতেও দেখেছেন এবং দরকার বোধ হলেই চাঁদের মাটিতে নেমে ধুলোবালি সংগ্রহ করেছেন। সমগ্রের বিচারে কোন পরিপ্রেক্ষণ বেশী সফল হয়েছে বা কম সফল হয়েছে সে বিচার করতে সূক্ষ্ম পথ ধরতে হয়। এবং তাহলে তাঁর লেখার সৌন্দর্যবিচারও সেই পরিমাণে ব্যাহত হয়। কলেজপাঠ্য নোটবইতে হয়তো তেমন দরকার হতে পারে।
কিন্তু তিনি যতদূর থেকেই দেখুন, নিকট অথবা দুর—সবই পাঠকের কাছে উপাদেয়।
যে বর্ণনাই হোক, পাঠককে ধরে রাখবার ক্ষমতা এনশেন্ট ম্যারিনারের মতোই। যেমন দুয়ার হতে অদূরে বইতে বহু খণ্ডচিত্র, পরস্পর-বিচ্ছিন্ন, কিন্তু তবু সব মিলে অখণ্ড। এবং চিত্রগুলি কোথায় যে খণ্ডিত হল বোঝাই যায় না। যে সূত্রে বন্ধন সে হচ্ছে লেখকের দার্শনিকতা। কত আত্মচিন্তা, কাব্য, এক থেকে আর একটা মনে পড়া, আবার তখনই চোখ মেলে চেয়ে দেখা।
সেন্টিমেন্টে ডুবে গিয়েও তার বাইরে এসে তাকে আর্টের বিষয়বস্তু করার ক্ষমতা অসাধারণ। তা থেকে মাথা তুলতে না পারলে হয় তিনি উদভ্রান্ত প্রেমের মতো উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়তেন, আর না হয় বসন্ত-প্রয়াণের মতো কেবল উচ্চদার্শনিকতাতেই ডুবে থাকতেন। কিন্তু একটি পরিপক্ক মন এবং বহুমুখী অভিজ্ঞতা তাঁকে তা করতে দেয়নি। সেন্টিমেন্টকে শাসন করার ক্ষমতা তাঁর অসাধারণ। বড় শিল্পীর পরিচয় এটি।
অতি করুণ এবং অতি হাল্কা ছবি পাশাপাশি অনেকে আঁকতে পারেন না। স্বর্গাদপি গরীয়সীর বাঁশের সাঁকো পার হওয়ার মতো একটি দৃশ্য এই কাঠামোতে সাধারণ শিল্পী কল্পনাই করতে পারতেন না।
তেমনি আবার দুয়ার হতে অদূরে বইতে মাতাল জামাইয়ের প্রোসেশন করে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার দৃশ্য, হয়তো কল্পনা, হয়তো সত্য, কিন্তু এমন একটি উদ্দাম হাসির দৃশ্যের অবতারণার কথা বিভূতিবাবু ছাড়া আর কারও পক্ষে কল্পনাই করা যায় না।
বিভূতিবাবুর আর একটি বৈশিষ্ট্য তাঁর বর্ণনায় তাড়াহুড়ো নেই, অধৈর্য নেই, পরিণতির দিকে পাঠককে অহেতুক ছুটিয়ে নেবার গরজ নেই, অথচ পাঠকেরও প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করায় কোনো বাধা উপস্থিত হয় না।
আর একটি উপমার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। তাঁর কাহিনী তাঁর কল্পনার শিখর থেকে নেমে আসছে সমুদ্রে ছুটবে বলে। কিন্তু তিনি কিছু পরে প্রবাহের মাঝখানে ব্যারাজ বেঁধে তার গতিপথ কিছুক্ষণের জন্য রুদ্ধ করলেন। একটা স্থির জলাশয় সৃষ্টি হল। তাকে ঘিরেও অপূর্ব সব দৃশ্য। দর্শক সাময়িকভাবে ভুলেই গেল যে তাকে চলতে হবে। তখন খুলে দেওয়া হল শ্লস গেট। প্রবাহ আবার চলল তার যাত্রাপথে। কিন্তু কিছু পরে আবার পড়ল বাধ। এবং স্থির দৃশ্য যতটুকু উপভোগ্য ততটুকু শেষ হওয়া মাত্র ফ্লাড গেট আবার খুলে দেওয়া হল।
এই রীতি বিভূতিবাবুর উপন্যাসের ক্ষেত্রে আশ্চর্য সফল। এবং আমার মনে হয় তাঁর শিল্পীমন, দৃষ্টিভঙ্গি ও মানুষকে দেখা ও দেখাবার রীতিটি আমি অনেকখানি ধরতে পেরেছি। পাঠক যদি আমার সঙ্গে একমত হন তবে আশা করি উপন্যাসখানিকে আর ব্যবচ্ছেদ করে দেখাবার দরকার নেই। সামগ্রিক রূপটাই আমার কাছে শেষ পর্যন্ত বড়।
১৯৪৫ সনে আমি বিভূতিবাবুর এই জাতীয় উপন্যাসকে গার্হস্থ্য উপন্যাস বা ডোমেস্টিক নভেল নাম দিয়েছিলাম। তাঁর গৃহস্থালীর বর্ণনা দেখে অবাক। গৃহস্থঘরে চোর প্রবেশ করে যেমন যথাসর্বস্ব সাফ করে নিয়ে যায়, তিনিও তেমন গৃহস্থের অন্দরে প্রবেশ করে ঘরকন্নার যাবতীয় সাজসরঞ্জাম অপহরণ করে এনে তাঁর শিল্পের উপকরণ রূপে ব্যবহার করেন। এটি সত্যই বিস্ময়কর। গৃহস্থালীর যাবতীয় খুঁটিনাটি, মেয়েদের মুখের ভাষা (যার প্রতিটি শব্দে চরিত্র উদ্ঘাটিত), সব জীবন্ত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন মেয়েলী ভাষাভঙ্গিও তাঁর আয়ত্ত। আবার যেখানেই বাৎসল্য মনের মধ্যে টগবগ করে ফুটে উঠেছে সেখানে তার প্রকাশ যেন আর এক শিল্পীর, সে প্রকাশ দেবদুর্লভ। ভাঙা পুতুলের উপর সার্জারি, তার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা—এসব একেবারে তুলনারহিত।
আমি বিভূতিবাবুর নিজের ব্যাখ্যা বা কৈফিয়ৎ সেজন্যই মানতে পারিনি। প্রত্যেকটি চরিত্র যদি সমগ্রের সম্পর্কে নিজ নিজ স্বভাব অনুযায়ী পূর্ণতা লাভ করে তবে তার ভেতর থেকেই সমগ্রের একটা ব্যাখ্যা আপনা থেকেই ফুটে উঠতে বাধ্য, এক্ষেত্রেও তা হয়েছে।
স্বর্গাদপি গরীয়সী বিষয়ে এর অপেক্ষা বেশী কিছু বলা বাহুল্য মনে হবে। কাউকে ভুলবে না কেউ। হারাণকেও না।
দুয়ার হতে অদুরে একখানি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বই। স্বর্গাদপি গরীয়সী স্মৃতির কাঠামোয় রচিত, দুয়ার হতে অদূরে চিঠির কাঠামোয় রচিত। এখানে লেখক শুধু দর্শকের ভূমিকায় মাঝেরহাট ফলতা রেল লাইনে, কখনও বা পায়ে হেঁটে, কখনও বা স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে যা দেখেছেন তারই স্ন্যাপশট তুলে বেড়িয়েছেন। এত খণ্ডচিত্র কিন্তু পরমাণু কেন্দ্রের কণিকাগুলি যেমন এক অদৃশ্য শক্তিতে বাঁধা থাকে, এ চিত্রগুলিও তেমনি লেখকের দার্শনিকতা, আত্মচিন্তা, পূর্বস্মৃতি, কল্পনা ও প্রায় সঙ্গীতের সুরের মতো একটি সুরে আচ্ছন্ন হয়ে একত্র বাঁধা পড়ে গেছে। মাত্র একটি দৃশ্যে লেখক দর্শকের ভূমিকা থেকে সরে এসে নিজেই যেন একটি চরিত্র রূপে দেখা দিয়েছেন। সে কোন্ দৃশ্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে সেই মিশন স্কুলের শূন্যপ্রান্তে ক্রীড়ারত শিশুদের জটলা দৃশ্য। এখানে তিনি বাৎসল্য-ক্ষুধা প্রাণভরে মিটিয়ে নিয়েছেন কয়েক মিনিটের জন্য। এ দৃশ্যটিও অপরূপ, তার আরও কারণ এর মধ্যে অনিবার্য একটি বেদনা জড়িয়ে আছে।
অল্পদূরের গ্রাম্যপথের ভ্রমণে তিনি দেখলেন বিচিত্র পল্লীজীবন। চোখের মনের রিজলভিং পাওয়ারে এখানে যেন স্বাদহীন শূন্য পট বিচিত্র স্বাদু জীবনে কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলেছেন। বলেছি এসব স্ন্যাপশট, কিন্তু তাতে অনেকখানি পরিচয়ই বাকি থাকে। এ ফোটোর চেয়ে অনেক বেশি। এ চলন্ত জীবন, এ জীবন থেকে বহু হাসিকান্না কানে এসে বাজে। উপকরণ হয়তো যৎসামান্য, কিন্তু তারই সাহায্যে তিনি যা দেখাতে চেয়েছেন, তা গড়ে নিয়েছেন। প্রকৃতই যা ঘটে তাতে সাহিত্যিক সত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে যে ক্ষমতার প্রয়োজন, তার প্রকাশ এখানে পদে পদে। একটি জিনিস দেখে আর একজন ঠিক এ জিনিস গড়তে পারবেন না।
করুণ দৃশ্যের পাশাপাশি উদ্দাম কৌতুক দৃশ্য, কত সংসার কত দাম্পত্য কত ঘরোয়া আলাপ—সব একত্রে ধরে রেখেছে মনের ঐ বাইন্ডিং কোর্স, যে অমোঘ শক্তি প্রোটোন নিউট্রনকে একত্র বেঁধে রাখে পরমাণুর কেন্দ্রে
রাণুর দ্বিতীয় ভাগ ছোট গল্পের সমষ্টি। বিভূতিবাবুর শিল্পী মানসের মূল পরিচয় দিয়েছি। এ বই পড়লেও সেই একই পরিচয় পাওয়া যাবে সামগ্রিকভাবে। এবং যেখানে তিনি শিশুজগতে প্রবেশ করেছেন সেখানেও তাঁর ক্ষমতার তুলনা মেলা ভার। এমন নিবিড় স্নেহের পরিচয় এমন বিস্তারিত ভাবে, একমাত্র আপন মনের গভীর বাৎসল্য থেকেই উৎসারিত হওয়া সম্ভব। শিশুদের প্রথম দন্তোদগম এবং ঐ দু’একটি দাঁত নিয়ে কাল্পনিক মান-অভিমান অপূর্ব।
এ বইয়ের একটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গল্প তাপস। এর মতো গল্পও বাংলা সাহিত্যে বিরল। গল্পের ঘটনা, চরিত্রসৃষ্টি এবং একটি রোম্যান্টিক দৃশ্যগঠন, যা এ গল্পের প্রাণ—খুবই চমৎকার। এই দৃশ্যটিতেও দেখছি লেখক স্বয়ং তাঁর সকল কাব্যময় সত্তা জড়িয়ে দিয়েছেন। ভাষার কোথাও দ্বিধা নেই, এক বর্ষার স্বপ্নরাজ্যে অ্যালারম ঘড়ির মধুর স্বরের সঙ্গে, নায়িকার ব্যাঞ্জোর ধ্বনির সঙ্গে, যেন আর এক ক্ষুধিত পাষাণের ব্যঞ্জনা।
এ বইতে বরযাত্রী গল্পটি সঙ্গীহারা কেন? বরযাত্রী পর্যায়ের গল্প বিষয়ে আমি আমার পত্রস্মৃতিতে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় অধ্যায়ে যা লিখেছি তার কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি—
“তারপর বিভূতিবাবুর শিবপুরের দলের দেখা পেলাম যেদিন, সে কোন্ দিন মনে নেই, সে দিন এক আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে অভিভূত হয়েছিলাম। কে গুপ্ত, গোরাচাঁদ, ত্রিলোচন, গণশা, ঘোঁত্না প্রভৃতির অংশ জুড়ে জুড়ে যেন একটি অখণ্ড চরিত্র অথচ প্রত্যেকে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে পৃথক। কয়েকজন মিলে ওরা যে সব কাজ করে, যে জাতের কথা বলে, তার ভিতর দিয়ে ওরা শিক্ষা সংস্কৃতি প্রভৃতি এমন একটা বিশেষ স্তরের পরিচয় প্রকাশ করে, যার জন্য আর পৃথক বর্ণনার দরকারই হয় না। কেউ ফুটবল খেলে, কেউ বিবাহ-ব্যাকুল, কেউ গান গায়, কেউ বা কিছু কবিতাও লেখে, কিন্তু সবাই মিলে পরস্পর পরস্পরের পরিপুরক। কেউ কাউকে বাদ দিয়ে দাঁড়াতে পারে না। ওদের একজন আবার তোতলা। ওরা একসঙ্গে ভাসে, একসঙ্গে ডোবে। আনন্দভোগ একসঙ্গে, দুঃখভোগও একসঙ্গে। এক বয়সের, এক জাতের এতগুলো চরিত্রের নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে এমন টীমওয়ার্ক বাংলা গল্পে দুর্লভ।”
এ বইয়ের বরযাত্রী গল্পটি এদেরই কাহিনী। এ ছাড়া কৌতুক রসের দিক থেকে কুইন অ্যানও ব. ড. ম. মার্কা খাঁটি জিনিস।
পরিশেষে একটি কথা। দুয়ার হতে অদুরে বইতে এক অতি ঘুমকাতর এবং অতি ক্ষুধাকাতর লোকের কথায় বিভূতিবাবুর পিকউইক পেপার্সের জো নামক ঘুমকাতর ছেলেটির কথা মনে পড়েছে। এর কথা থেকে মনে আসে বিভূতিবাবু পিকউইক ক্লাবের মতো একটি ক্লাব বাংলাভাষায় রচনা করুন না কেন? এমন বিরাট পরিকল্পনা ও বিচিত্র মানুষের ভিড়সৃষ্টি আমার মনে হয় এখন একমাত্র তাঁর হাতেই সম্ভব।
পরিমল গোস্বামী
.
সূচিপত্র
- স্বর্গাদপি গরীয়সী (১ম খণ্ড) (উপন্যাস)
- রাণুর দ্বিতীয় ভাগ (গল্পগ্রন্থ)
- দুয়ার হ’তে অদূরে (উপন্যাস)
[এই রচনাবলীর রাণুর দ্বিতীয় ভাগ গল্পগ্রন্থটি আলাদা বই হিসেবে দেয়া হয়েছে। বাকি অংশটুকু এখানে দেয়া হলো।]
Leave a Reply