বিনুর বই ও নির্বাচিত ছোটোগল্প – অন্নদাশঙ্কর রায়
বিনুর বই ও নির্বাচিত ছোটোগল্প – অন্নদাশঙ্কর রায়
প্রথম পর্বের ভূমিকা
‘আমি প্রবীণদের মহলে নবীন, নবীনদের মহলে প্রবীণ।….নবীন ও প্রবীণ উভয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি পরস্পরকে পরিচিত করাতে পারি। প্রবীণদের বোঝাতে পারি নবীনরা কী ভাবে, যদিও নবীনদের সঙ্গে আমার পরিচয় অপ্রচুর। আর নবীনদের বোঝাতে পারি প্রবীণদের মনোভাব, যদিও প্রবীণদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ স্বল্প। …আধুনিক সাহিত্যিকদের সম্বন্ধে সাধারণের ভ্রান্তি আছে, আমি চেষ্টা করব নিরসনের। আধুনিকদের কাছে অত্যাধুনিকদের নানা জিজ্ঞাসা আছে, আমি উত্তরদানের চেষ্টা করব। এই দুই কর্তব্য একসঙ্গে করা হয় যদি অভিভাষণটিকে কাহিনির আকার দিই। …আমি যার কাহিনি বলতে যাচ্ছি তার নাম দেওয়া যাক বিনু।’
প্রায় চার বছর আগে জামশেদপুর প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে এই ছিল আমার গৌরচন্দ্রিকা। বিনুর সে কাহিনি পরে জীবনশিল্পী-র অন্তর্গত হয়েছে। কাহিনিটিকে একটু বড়ো আকারে লেখবার ইচ্ছা ছিল। এতদিন পরে তার সুযোগ পাওয়া গেল। এটি কিন্তু কাহিনি হল না। কাহিনি যদি হয়ে থাকে তবে জীবনের নয়, মনের। কিন্তু জীবনকে বাদ দিয়ে নয়।
অন্নদাশংকর রায়
২ অক্টোবর ১৯৪৪
.
দ্বিতীয় পর্বের ভূমিকা
বিনুর বই লেখা হয়েছিল ১৯৪৪ সালে। তখন আমার বয়স চল্লিশ বছর। যৌবন তখনও অস্ত যায়নি। শরীর ও মনের যথেষ্ট শক্তি ছিল। দিনের পর দিন এক এক পৃষ্ঠায় এক-একটি অনুচ্ছেদ লিখতুম। লেখা কলমের মুখে আপনি আসত, তাকে সাধতে হত না। ভাবনাও আসত আপনি, তার পিছনে ছুটতে হত না। বই লেখা হয়ে যায় মাস তিনেকের ভিতরে।
তখন থেকেই আমার বাসনা ছিল পরে একসময় অভিজ্ঞতার আলোয় বিনুর বই দ্বিতীয় লিখব। কিন্তু কিছুতেই মনস্থির করতে পারা গেল না। হাতে অনেক কাজ ছিল। এক এক করে সেসব সারতে হল। অবশেষে দ্বিতীয় পর্বে যখন হাত দিলুম তখন আমার বয়স ছিয়াশি বছর। তখন আমি সূর্যাস্তের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। শরীর অপটু। মন অবসন্ন। প্রত্যেকটি পরিচ্ছেদ ভেবেচিন্তে লিখতে হয়েছে, একটানা লিখে যেতে পারিনি। মাঝে মাঝে বিরত থেকেছি। স্মৃতিশক্তি নির্ভরযোগ্য নয় তাই বিভিন্ন পরিচ্ছেদে কোনো কোনো বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, তার জন্যে আমি দুঃখিত। জীবনদর্শন শুরু করতে যাচ্ছি এমন সময় আমার জীবনসঙ্গিনীর প্রয়াণ। চিন্তা ও লেখায় ছেদ পড়ে যায়। যা-ই হোক কোনোরকমে শেষ করা গেল।
উনি আমাকে বলেছিলেন, ‘এবার তুমি একটি Summing Up লেখো। যেমন লিখেছিলে সমরসেট মহম।’ আমারও সেইরূপ অভিপ্রায় ছিল। কিন্তু লিখতে লিখতে দেখা গেল ঠিক সেই জিনিসটি হয়নি। যা হয়েছে তাতেই আমি সন্তুষ্ট। এখন আমি নব্বইতে পড়েছি। এ বয়সে এর চেয়ে ভালো আশা করা যায় না। তবে কিছু কথা বাকি রয়ে গেল। তার জন্যে আমি অপেক্ষা করতে অক্ষম।
অন্নদাশংকর রায়
৩০ জুন ১৯৯৩
Leave a Reply