বিধাতা – ২ – রওশন জামিল
প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৯
২.১ বুনো ঘোড়ার সন্ধানে
০১.
এক বুনো ঘোড়ার সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। আমরা মানে, আমি বুশ আর মন্টে এবং ফ্রান্সিসকোর নেতৃত্বে একদল ইন্ডিয়ান। ভ্যালেটা চলে যাওয়ার পরপরই ওই দোকানে ফ্রান্সিসকোর সঙ্গে দেখা হয় আমার, এবং ও আমাকে চিনতে পারে।
নীরবে আমরা অনুসরণ করছি ইন্ডিয়ানদের। দোকানের দিকে আড়চোখে যখন তাকালাম, ওঅটর ট্রাফের সামনে চারটে স্যাডল হর্স চোখে পড়ল আমার।
কাদের ঘোড়া ওগুলো? ভাবলাম। কেন রয়েছে ওখানে? দিনের এ-সময়ে ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক, তাই এই খটকা আমার। সবাই যখন ট্রেইলের বাটিতে আরেকটা মেসকিট ঝোপের ভেতর হারিয়ে গেল, আবার পেছনে তাকালাম আমি।
দোকান থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসেছে বাইরে, চোখের ওপর হাত তুলে চেয়ে আছে আমাদের গমনপথের দিকে। দূর থেকে যতটুকু বোঝা গেল তাতে মনে হলো লোকটা মাইক ভালেটা।
লস এঞ্জেলেসে ফিরে গেল আমার চিন্তা, আন্দাজ করতে চেষ্টা করলাম মিস ডায়ানা আর আন্ট এলেনা কী করছেন এখন।
সেই আন্ট এলেনা; চিরকুমারী নিঃসঙ্গ রহস্যময়ী এক মহিলা। তবু আচারে ব্যবহারে মধুর, ব্যক্তিত্বে এ্যানিট পাথরের মত নিরেট। আচ্ছা, যখন একা থাকেন তখন নিজের সম্পর্কে কী ভাবেন তিনি? কিংবা তার ওই ভাইটি সম্পর্কে, যার কারণে তার এই দশা? মিস ডায়ানার কথা ভাবলাম আমি। কে এই মহিলা? কখনও কি বিয়ে করেছিলেন? পুবের জৌলুস ছেড়ে কেন এই নির্বান্ধব দেশে এসে পড়ে ছেন তিনি? নিজের নিঃসঙ্গতাকে ঢাকতেই কি মহিলা বুকে টেনে নিয়েছেন আমায়।
কারণটা যা-ই হোক, তার কাছে আমি ঋণী। নিরাশার মাঝে আমাকে আশার আলো দেখিয়েছেন তিনি। বাইরে ডায়ানা দেখতে শান্তু বিনয়ী, বোঝার জো নেই প্রয়োজনে ওই মানুষটাই কী রকম শীতল আর কঠোর হয়ে উঠতে পারে। সবসময় হিসেবি একটা মন কাজ করে তার ভেতর।
মরুপথে একাকী চলতে গিয়ে চিন্তাভাবনা করার অবকাশ পায় মানুষ। কথা বলা দুষ্কর হয়ে পড়ে এ-সময়ে, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগোতে হয় সারবেঁধে, আর তা ছাড়া কথা বললে পিপাসাও পায় বেশি। তাই এখানে নীরবে পথ চলে মানুষ, স্বপ্ন দেখে, ধূসর অতীত কিংবা সোনালি ভবিষ্যতের, আর নয়তো স্রেফ ঝিমোয়।
মাথার ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে আশাবাদী শকুন। অদুরে কৌতূহলী এক কয়ৌট দাঁড়িয়ে, আর দূর-পেছনে, রোদজ্বলা আকাশের পটভূমিতে ধুলোর অস্পষ্ট ট্রেইল।
অত্যন্ত ক্ষীণ একটা ট্রেইল, প্রশ্নবোধক চিহ্নের মত ঝুলে রয়েছে শূন্যে।
ফ্রান্সিসকো পথ দেখাচ্ছে এখন, জর্জ পিছিয়ে পড়ল আমার সঙ্গে মিলিত হওয়ার। ইচ্ছায়। স্যাডলের ওপর ঘুরে, মাথা ঝাঁকিয়ে ব্যাক ট্রেইলের দিকে ইশারা করলাম আমি। আজকাল মনে হয় মানুষের আনাগোনা খুব বেশি এদিকে, মন্তব্য করলাম।
শিকারী, ফোড়ন কাটল জর্জ।
ক্রমশ তেতে উঠছে সূর্য, মরুভূমির সর্বত্র-তাপতরঙ্গের উদ্বাহু নৃত্য, দূরে নীল পানির হাতছানি, কিন্তু আমরা কাছে যেতেই মিলিয়ে যায় আপনাআপনি।
ঘাম গড়াচ্ছিল আমার মুখে। ব্যান্ডানা দিয়ে মুছে ফেললাম।
সামনে, বহুদূরে, নীল মরীচিৎকার মাঝে অবিশ্বাস্যরকমের লম্বা, দেখাচ্ছিল এক ঘোড়াসওয়ারকে ফ্রান্সিসকো আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সেদিকে।
তাকালাম আমি, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে কালো অবয়বটি।
র্যামন, বলল ফ্রান্সিসকো। তুমি দেখতেই পাবে। র্যামন? আমি হতভম্ব। কে? কী করে?
ওই যে বললাম-রামন। কেবল এটুকু বলেই চুপ করে গেল ফ্রান্সিসকো; তারপর, খানিক বাদে যোগ করল, ভূতুড়ে মানুষ। ঘোড়া চেনে।
আরেকটু কাছাকাছি হালাম আমরা। র্যাম অনড়, চুপচাপ বসে আছে স্যাডলে। লোকটা জোয়ান না বুড়ো, দূর থেকে ঠিকমত ঠাহর করতে পারলাম না আমি। তবে ঘোড়ায় বসার ঢংটি ঋজু, আর সমব্রেরোটা ঝুলছে স্যাডল হর্নে।
ও জানে কোথায় গেলে মিলবে ঘোড়া, ফ্রান্সিসকো বলল।
আমরা আরও কাছে এগিয়ে যেতে, পিছু হটল মরীচিকা, কিন্তু র্যামন যেখানে ছিল সেখানেই রইল।
ও চেনে তোমাকে, আবার মুখ খুলল ফ্রান্সিসকো।
র্যামন? কই, আমি এ-নামে কারোকে চিনি বলে তো মনে পড়ছে না।
একহারা শরীর, দূর থেকে দীর্ঘদেহী মনে হয়েছিল ওকে। কিন্তু যখন ঘোড়া থেকে নামল, আমি দেখলাম র্যামন মোটেও লম্বা নয়, মাঝারি উচ্চতা। পরনে বুক খোলা, পিঠের সাথে কী-যেন বাঁধা রয়েছে র-হাউডের দড়ি দিয়ে। ব্রিচেসটা বাকস্কিনের কোমরে চওড়া বাকলসের চামড়ার বেল্ট। খাপে-ভরা ছুরি রয়েছে সঙ্গে, কিন্তু কোন পিস্তল নেই। স্যাডল স্ক্যাবার্ডে শোভা পাচ্ছে রাইফেল।
আমি র্যামন, বলল সে।
আমি ড্যান ও’হারা, জবাব দিলাম। আর ওরা-সঙ্গীদের পরিচয় দেয়ার জন্যে ঘাড় ফেরালাম আমি-জর্জ বুশ আর মন্টে ম্যাক-কায়া। বাকিদের তো তুমি চেনই।
না, চিনি না। ভেতরে ভেতরে অবাক হলেও, মুখে আমি বললাম, এ হলো ফ্রান্সিসকো। আর অন্যরা-আলেয়ান্দ্রো, মার্টিন, দিয়েগো, জেইমি, আর সেলমো।
পালা করে সবার ওপরে চোখ বোলাল র্যামন। ওর চুল প্রায় সাদা, চোখ দুটো গভীর কালো। আর গায়ের রঙ কালচে, বাবা যাকে বলতেন-ইস্ট ইন্ডিয়ানদের মত, আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের থেকে আলাদা।
স্প্যানিশ নাম গ্রহণ করাটা একরকম রেওয়াজে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সেসময়, যদিও নিজস্ব একটা নাম প্রত্যেকেরই ছিল ওদের, কিন্তু আত্মীয়স্বজনের বাইরে সেটা জানত না কেউ। সন্দেহ নেই, এই রেওয়াজের শুরু মিশনে, পাদ্রিরা নিজেদের সুবিধের জন্যে একটা করে স্প্যানিশ নাম দিতেন ইন্ডিয়ানদের।
র্যামন উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নিল তার ঘোড়া, আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
ফ্রান্সিসকো পাশাপাশি হলো আমার। ওর চেহারা কাউইয়াদের মত নয়, বললাম আমি।
ও কাউইয়া নয়। ও হলো র্যামন। ব্যস, আর কিছু না।
আমি চিনি না ওকে।
স্যাডলে নড়েচড়ে বসল ফ্রান্সিসকো। আমি তো বলিনি তুমি চেন। তবে ও চেনে তোমাকে।
ব্যাপারটা হেঁয়ালি মনে হলো আমার। স্মৃতির পাতা অনেক হাতড়েও ওই নামের কারোকে মনে করতে পারলাম না আমি। শেষমেশ ভাবলাম, কী জানি হবেও-বা আমাকে চেনে ও, প্রায় চার বছর ছিলাম মরুভূমিতে, তখন হয়তো কোথাও দেখেছে।
র্যামনের সঙ্গে দেখা হওয়ার দ্বিতীয় দিনের মাথায় ঘোড়ার আবাসে আমাদেরকে, নিয়ে এল সে। তৃণভূমিতে চরছিল হাজার হাজার, পাহাড়ের কিনারে গাছপালার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমরা কিছুক্ষণ জরিপ করলাম ওদের, তারপর সামনে একটা পাইন বনের ভেতরে গিয়ে ক্যাম্প করলাম।
ঘেসো জমিতে ঘোড়া বেঁধে রেখে সবাই লেগে পড়ল রান্নার আয়োজনে। র্যামন আর ফ্রান্সিসকোকে সঙ্গে নিয়ে আমি বেরোলাম চারপাশটা একটু ঘুরে দেখতে।
খানিক বাদে, জর্জ যোগ দিল আমাদের সাথে। ওখানে পানি খেতে আসে ওরা, ঝরনার ধারে কতকগুলো গর্ত দেখিয়ে বলল র্যামন।
জর্জ নজর বোলাল উপত্যকার চারদিকে, গাছপালা আর ঝোপঝাড়গুলো দেখল। দুপাশে বেড়া দিয়ে কোরাল তৈরি করব আমরা, মত প্রকাশ করল ও, যাতে পানি খেতে এসে আটকা পড়ে ঘোড়া।
আমরা ঘুরেফিরে দেখলাম চারপাশের এলাকা, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে স্থির করলাম, কোরালে ঢোকার রাস্তাটা হবে চওড়া, ক্রমশ সরু হয়ে এগোবে ঝরনা বরাবর, আর দরজা থাকবে মাঝামাঝি জায়গায় যেন পর্যাপ্ত সংখ্যক ঘোড়া ধরা পড়লেই বন্ধ করে দিতে পারি বেরোবার রাস্তা।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ, পরদিন সকাল থেকে কোরাল তৈরিতে হাত লাগালাম আমরা সবাই। ঝোপঝাড় কেটে গাছপালার মাঝের ফাঁকা জায়গাগুলো ভরাট করলাম প্রথমে, তারপর যেখানে প্রয়োজন সেখানে খুঁটি বাঁধলাম। যখন সন্ধ্যে হলো, আবার ফিরে এলাম ক্যাম্পে, বনচরেরা নির্ভয়ে যেন ঝরনায় যেতে পারে।
এইভাবে গড়িয়ে চলল দিন, এবং মাত্র দশদিনের ভেতর প্রায় শ-তিনেক বুনো ঘোড়া জড়ো করে ফেললাম আমরা।
.
০২.
আগামীতে কিন্তু এত সহজ হবে না কাজটা, মন্তব্য করল মন্টে। এর আগে কখনও ওদেরকে ধরার চেষ্টা করেনি কেউ। তাই তোমাদের মতলব বুঝতে পারেনি।
ঠিক, একমত হলো জর্জ।
স্যাডলে বসে ঘোড়াগুলোকে জরিপ করছিলাম আমরা। এবার শুরু হবে বাছাই। যেগুলো বাদ পড়বে তাদের মুক্তি দেয়ার পর পোষ মানাব বাকিগুলোকে।
ওটা, কালো একটা স্ট্যালিয়ন দেখিয়ে বলল জর্জ, বেয়াড়া জীব। আমার মতে ওকে তাড়িয়ে দেয়াই উচিত।
ওকে আমার চা-ই বললাম আমি।
শোন, সাবধান করল জর্জ, ওই স্ট্যালিয়নের বয়েস কমপক্ষে ছবছর হবে। একেবারে বুনো। নাজেহাল করে ছাড়বে তোমাকে।
ও ঠিক কথাই বলছে, ড্যান, সায় জানাল মন্টে।
তবু ওকে আমার চাই, জেদ ধরলাম আমি। ওর ভার ছেড়ে দাও আমার ওপর।
বুঝেছি, হতাশ কণ্ঠে বলল জর্জ, তোমার মরণ ঘনিয়েছে।
আরম্ভ হলো বাছাই আর পোষ মানানোর পালা। ভালই যাচেছ আবহাওয়া। উদয়াস্ত পরিশ্রম করি। তাড়াহুড়ো নেই কোনরকম, যখন শেষ হয় কাজ, খাওয়াদাওয়া সেরে কোরালের ধারে চলে যাই আমি। এ-কদিনে আমি বুঝতে শিখেছি ঘোড়া শান্ত করতে গানের জুড়ি হয় না। কারণ এতে ওরা বুঝতে পারে, কেউ লুকোচুরি খেলছে না ওদের সাথে।
কোরালের খুঁটিতে হেলান দিয়ে ওদের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলি আমি, চাই ওরা যেন দ্রুত চিনে যায় আমায়, বিশেষ করে ব্ল্যাক স্ট্যালিয়ন।
কোরালের ভেতরে ছোট ছোট কয়েকটা দলে জোট বেঁধেছে ঘোড়াগুলো, ব্ল্যাক স্ট্যালিয়ন তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে সবসময় তফাতে সরে থাকে, তবে কখনোই গেট থেকে বেশিদূরে নয়।
দেখে বোকা মনে হলেও, জর্জ বলল একদিন, পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলতে ঘোড়া খুব ওস্তাদ। যত্ন নিলে ওদেরকে অনেককিছু শেখাতে পারবে তুমি। আর বুনো ঘোড়ারা এমনিতেই একটু চালু হয়, কাজেই সাবধানে।
চতুর্থ দিনের মাথায়, বাছাই পর্ব একরকম শেষ হয়ে এল আমাদের। ক্যাম্পফায়ারের পাশে বসে আমরা আলাপ করছি এরপর কী করব, এই সময়ে র্যামন হাজির হলো ওখানে। এক কাপ কফি নিল ও, আলতো চুমুক দিল, তারপর বলল, কারা যেন নজর রাখছে আমাদের ওপর।
জর্জ তাকাল ওর দিকে। ইন্ডিয়ান?
শ্বেতাঙ্গ। ছ-সাতজন।
ভ্যালেটা হতে পারে, বললাম আমি।
সম্ভবত, একমত হলো জর্জ।
কফিপটের দিকে হাত বাড়াল মন্টে। আমরা পাহারা বসাচ্ছি না কেন? প্রতিবারে দুজন করে?
বোধহয় ভ্যালেটাই ভাবলাম আমি, আবার আমার দাদুও হতে পারেন। তাঁর ক্ষমতার বিস্তার ব্যাপক, লোকবলও বেশি। তা ছাড়া ইন্ডিয়ান আক্রমণের ভয় আছে, মোহাভেরা হিংস্র জাত, প্রায়ই হামলা চালায় কাছেপিঠের লোকালয়ে।
কিংবা বুড়ো পেগ-লেগ স্মিথও এসে থাকতে পারে। ওকে যতটা বুঝেছি আমি, ঘোড়াগুলোকে আমরা বশ মানানো অবধি অপেক্ষা করবে সে, তারপর কেড়ে নেবে, আচমকা হানা দিয়ে।
আমি ওদেরকে বললাম সেকথা, কিন্তু জর্জ মানতে পারল না। আমি শুনেছি ও ফ্রিসকোয় আছে।
সেদিনই আমাদের ক্যাম্প কোরালের কাছাকাছি একটা জায়গায় সরিয়ে আনলাম আমরা। কেবল পাহরা দেওয়া নয়, আরও একটা উদ্দেশ্য আছে এর: যাতে খুব দ্রুত ওদের সাথে আমাদের একটা জানাশোনাও গড়ে ওঠে।
পরের তিনটে সপ্তাহ কাটল হাড়ভাঙা খাটুনির ভেতর দিয়ে। ঘোড়া বশ করতে গিয়ে আমরা অনেকেই চোট পেলাম এক-আধটু। কাউইয়ারা সবাই দক্ষ ঘোড়াসওয়ার, তবে ফ্রান্সিসকো নিঃসন্দেহে সেরা।
কিন্তু সেও এড়িয়ে চলে ব্ল্যাক স্ট্যালিয়নকে। ওটা সাক্ষাৎ শয়তান, আমাকে হুঁশিয়ার করল ফ্রান্সিসকো।
আমার কথা হয় ওকে ছেড়ে দাও নয়তো মেরে ফেল, পরামর্শ দিল মন্টে। ওর দাঁত আর খুরের জখমগুলো দেখেছ-ব্যাটা জাত লড়য়ে।
কথাটা যে ঠিক তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে দেখতে বুনো হলেও, আমার কেন-যেন সন্দেহ হয় কোন একসময় ওই ঘোড়া কারও পোষা জীব ছিল, সম্ভবত খুব ছোট বয়েসে। এমনটি আমি কিন্তু একেবারে খামোকা ভাবিনি। আগেই বলেছি সারাক্ষণ গেটের আশপাশে ঘুরঘুর করে ব্ল্যাক স্ট্যালিয়ন, তক্কেতক্কে থাকে কখন পালাবে সুযোগ বুঝে। কিন্তু যদি অন্যগুলোর মত পুরোপুরি বুনো হত, ওরা যা করেছে এও তাই করত-কোরালের খুঁটি ভেঙে পালাবার চেষ্টা। অথচ তা করেনি। আর সেজন্যেই আমার মনে হয়েছে কোরাল বস্তুটি কী সে-ব্যাপারে নিশ্চয় কোন পূর্বধারণা আছে ওর।
তখনও আমরা ক্যাম্প তুলিনি, ঘোড়া পোষ মানানো চলছে পুরোদমে, হঠাৎ এক সন্ধ্যেয় এক ঘোড়াসওয়ার হাজির হলো আমাদের ক্যাম্পে। সবে খেতে বসেছি, অকস্মাৎ একটা ঘোড়া এগিয়ে আসার শব্দে সতর্ক হয়ে গেলাম সবাই মন্টে আর আমি গা ঢাকা দিলাম অন্ধকারে।
অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। খানিক বাদে, গলা শুনতে পেলাম একটা, কে আছ! একটু কফি হবে?–
ভেতরে এসো,বলল জর্জ বুশ, তবে দুহাত সামনে রেখে।
লোকটা কুঁজোই, হালকা-পাতলা গড়ন, লম্বা। চোখ দুটো বেজায় চঞ্চল। ছাই রঙের চমৎকার একটা গেল্ডিংয়ে চেপে আমাদের ক্যাম্পে ঢুকল সে। আমি দেখলাম ওর স্যাডলের পেছনে কোন ব্ল্যাংকেট রোল নেই।
নেমে, এখানে এসো, আগুনের ধার থেকে কল জর্জ। কফি আর খাবার দুই-ই আছে।
থ্যাংকস, মেনি মেনি থ্যাংকস! হেঃ হেঃ! অনেকদূর থেকে আসছি আমি, খিদেও পেয়েছে ভীষণ!
মন্টে রাইফেল হাতে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে, আগন্তুকের ডানে চলে গেল। এরপর দেখা দি ফ্রান্সিসকো আর আলেয়ান্দ্রো। অন্যরা দূরে সরে রইল আগুন থেকে। দিয়েগো ঘোড়া পাহারা দিচ্ছে, এবং সম্ভবত জেইমিও।
সোজা ক্যাম্পফায়ারের সামনে চলে এল লোকটা, নজর বোলাল আশেপাশে। হঠাৎ একসঙ্গে এত মানুষ দেখতে পেয়ে রীতিমত ঘাবড়ে গেল ও, আমার মনে হলো চোখ দিয়ে গুনছে মোট কজন রয়েছে।
লস এঞ্জেলেস থেকে আসছি, গায়ে পড়ে বলল নবাগত। যাব কলোর্যায়ে।
এতে আর অবাক কী? মন্তব্য করল মন্টে। সবাই আজকাল উত্তরে যাচ্ছে, সোনার খোঁজে।
খুঁজতে জানলে সোনা সবখানেই পাওয়া যায়, সহজ কণ্ঠে বলল আগন্তুক। আমি যাচ্ছি ক্যাটল র্যাঞ্চ করতে। সোনা পাক না পাক, খেতে তো সবারই হবে।
নিরুত্তর রইলাম আমরা। কফিতে চুমুক দিল ও, মনে হলো কিছু বলতে যাচ্ছে, পরক্ষণে কী ভেবে চুপ করে গেল। তারপর বলেই ফেলল শেষপর্যন্ত, ওদিকে একটা কোরাল দেখলাম? বুনো জীবজন্ত ধরছ তোমরা?
অল্পস্বল্প, জানাল বুশ। পোষও মানাচ্ছি।
নিশ্চয়ই সোনাও আছে এখানে, মানুষ জানে কোথায় খুঁজতে হয়।
সে তো তুমি আগেই বলেছ, মৃদু সুরে ফোড়ন কাটল জর্জ, খুঁজতে জানলে সবখানেই পাওয়া যায়। আমরা ভাবলাম, চলাফেরা করতে হলে মানুষের বাহন দরকার, তাই বিক্রির জন্যে পোষ মানাচ্ছি।
কোন ইন্ডিয়ান দেখেছ কাছেপিঠে? নিরীহ সুরে জানতে চাইলাম আমি। মোহাভে, বা পাইউট? এই জায়গাটা খুব খারাপ, যদিও, খাদে নামালাম গলা, ওরা বড় একটা আসে না এদিকে। মানে…টেহাচাপি গিরিপথের এপাশে আরকী।
এমনভাবে তাকাল ও যেন এই প্রথম দেখতে পেয়েছে আমাকে। আসে না? কেন?
কুসংস্কার, বলে ইশারায় গিরিপথটা দেখালাম আমি। এই জায়গা নাকি অভিশপ্ত।
কই, তোমাদের তো ভীত মনে হচ্ছে না, মুখ বাঁকাল নবাগত।
কারণ আমরা ভীত নই, সমান তালে জবাব দিলাম আমি। নিজস্ব ওঝা আছে আমাদের, কেউ শত্রুতা করতে এলে তার বিষ ঝেড়ে দূর করবে।
আমি বিশ্বাস করি না এসব, বলল ও।
আমিও করতাম না, জবাব দিলাম। ওই লোক যে গুপ্তচর তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আমার। একেবারে ঝাড়া হাত-পা, বিছানাপাটি নেই সঙ্গে, অথচ দাবি করছে বহুদূর থেকে আসছে। এমনকী একফেঁটা ঘাম পর্যন্ত নেই ওর ঘোড়ার গায়ে।
আমিও করতাম না, কথাটা বললাম আবার, কিন্তু-এবার অনর্গল মিথ্যে বলতে লাগলাম-ওই লোকটা যখন আমাদের ওঝার ঘোড়া চুরি করল তখন বাধ্য হালাম বিশ্বাস করতে।
ক্ষমতায় আমাদের ওঝাও কম যায় না। ও ইশারা করতেই ঘোড়াটা দিল এক লাফ, আর অমনি মাটিতে পড়ে গিয়ে চোর বাবাজির কোমর গেল ভেঙে।
তারপর কী হলো?
কাঁধ ঝাঁকালাম আমি। আবার কী? সেটা ছিল অগাস্ট মাস, তায় মরুভূমির নাম মোহাভে। ওর কপাল যদি ভাল হয়ে থাকে, পয়লা রাতেই পটল তুলেছে।
পালা করে আমাদের ওপর চোখ বোলাল লোকটা, হাসি দেখতে পেল না কারও মুখে। মন্টে বলল, তবে এমনিতে ওঝা মানুষটা ভাল, কেউ ওর সাথে দুশমনি না করলে।
আগন্তুকের পিস্তলের দিকে চোখ পড়ল আমার। হোলস্টারের ফিতে খোলা। অথচ একজন নিরীহ ঘোড়াসওয়ার ফিতে আটকে রাখবে এটাই স্বাভাবিক, নইলে পথচলার সময়ে ঝাঁকুনিতে অস্ত্র পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে।
আলেয়ান্দ্রো ইতিমধ্যে সরে এসেছে আরেকটু এখন আগন্তুকের ঠিক পেছনেই বসে আছে। মৃদু সুরে কথা বলে উঠল ও, তুমি কিন্তু তোমার নাম বলনি আমাদের।
যাহোক একটা নাম হলেই চলবে, বললাম আমি। ফলকে লেখার জন্যে আমাদের দরকার হবে।
কী? উঠতে নিল লোকটা, পরক্ষণে বসে পড়ল ধপ করে। কীসের ফলক?
ধর, ঘোড়া চোররা এখন হামলা করল আমাদের, শুরু করলাম আমি। তোমাকে আমাদের সন্দেহ হতে পারে, কিংবা চোররাই ভাবল তুমি আমাদের লোক। সেক্ষেত্রে তোমার কবরে স্মৃতিফলক বসানোর জন্যে আমাদের একটা নামের দরকার পড়বে। কবরে মৃতব্যক্তির পরিচয় না থাকাটা খুবই লজ্জার ব্যাপার।
কফির কাপ নামিয়ে রাখল ও। আমার বোধহয় এবার যাওয়া দরকার। কী বল…আবহাওয়া এরকম ঠাণ্ডা থাকতে থাকতে?
সাবধানে উঠে দাঁড়াল লোকটা। প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে নিয়েও সামলে নিল শেষমুহূর্তে। বোধহয় উপলব্ধি করেছে এর ফলে ওর হাত পিস্তলের কাছাকাছি চলে যাবে এবং আমরা তাতে স্পর্শকাতর হয়ে উঠতে পারি।
যাও, বললাম আমি। ভ্যালেটার সঙ্গে যখন দেখা হবে, তাকে বলবে তার যখন খুশি আসতে পারে।
.
০৩.
সকালে নাস্তার পর, একখণ্ড রুটি হাতে কোরালের ধারে গেলাম আমি, রুটিখানা বাড়িয়ে ধরলাম ব্ল্যাক স্ট্যালিয়নের দিকে। ঝট করে পিছিয়ে গেল ও, কিন্তু আমি হতাশ হালাম না, শান্ত কণ্ঠে কাছে ডাকরলাম ওকে।
একটা মেয়ার এগিয়ে এসে ভেঙে লি রুটির একটা কোনা। স্ট্যালিয়নটাকেও ইচ্ছুক মনে হলো আমার, তবু দূরে সরে রইল সে। শেষমেশ রুটিটা রেইলের ওপর রেখে দিয়ে আমি চলে এলাম।
কফিতে চুমুক দিয়ে আগুনের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল জর্জ। আমাদের এবার রওনা দেয়া উচিত, বলল সে। ওই লোকগুলোকে আমার মোটেও পছন্দ না।
আমারও না, মন্টে সায় জানাল।
ডোরাকাটা একটা ডান ঘোড়া হাঁটিয়ে নিয়ে আগুনের ধারে এল র্যামন। লাগামটা ছেড়ে দিয়ে, কাপ তুলে নিল ও, কফি ঢালল পট থেকে। ইতিমধ্যে অন্যরা চলে গেছে নিজেদের ঘোড়ায় জিন চাপাতে, অধিকাংশ বিছানা গোটানো হয়ে গেছে।
আমরা কি আজই যাব?
জর্জের পছন্দ হচ্ছেনা জায়গাটা।
তোমার?
আমি পছন্দ করি। পাহাড়তগুলো দেখিয়ে বললাম, ওখানে কী যেন অপেক্ষা করে আছে আমার জন্যে। মরুভূমিতেও।
ফিরে আসবে?
যখন সুযোগ পাব। কফির তলানিটুকু মাটিতে ঢেলে ফেললাম আমি। কাপ ধুয়ে রেখে দিলাম ব্লাংকেট রোলের ভেতরে।
তোমার চলাফেরা আমাদের মতই, বলল র্যামন।
আমি ড্যান ও’হারা। এ-মুহূর্তে এটাই আমার একমাত্র পরিচয়। তবে এটুকু জানি, অনেক বড় হতে হবে আমাকে কিছু একটা হতে না পারলে জীবনের কোন মূল্য থাকে না।
ঠিক।
জানি না শেষপর্যন্ত কী হব, তবে একটা কিছু হওয়ার ইচ্ছা রাখি!
দুনিয়ার চোখে? অন্য মানুষের চোখে?
বোধহয়। ওটাও একটা কারণ বটে, তবে আমার আসল লক্ষ্য নিজের পায়ে দাঁড়ানো।
র্যামন ওর স্যাডলটা তুলে নিল। বেশি স্বাবলম্বী হওয়া ভাল নয়। এতে করে মানুষ অনেকসময় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। একটা কথা জেন, পুরুষের জীবনে যেমন নারী দরকার আছে, তেমনি নারীরও একজন পুরুষের সান্নিধ্য প্রয়োজন হয়।
কোরালে গিয়ে আমাদের ঘোড়া বের করলাম আমরা। ফ্রান্সিসকো পাশাপাশি হলো আমার। স্ট্যালিয়নটাকে সঙ্গে নেবে তুমি? ঝামেলা বাধাবে কিন্তু।
বাধালে আমি সামলাবখন।
মন্টে এগিয়ে এল আমার কাছে। জর্জ ইতিমধ্যে স্যাডলে চেপেছে। যেগুলো বেশি শান্ত, প্রথমে তাদের বের করব আমরা। অন্যরা, আমার বিশ্বাস, নিজের থেকেই পালের সঙ্গে থাকতে চাইবে। আমরা ওদের টেয়োন গিরিপথের দিকে নিয়ে যাব।
ভ্যালেটারা নজর রাখবে, বললাম আমি। হামলা চালাতে পারে।
তা পারে, তবে আমার ধারণা ওরা রাতের অন্ধকারে চুরি করতে আসবে। ঘোড়াগুলো ট্রেইলে চলতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার পর। এতবড় পাল সামলাতে হলে যত লোক দরকার, ওদের তা নেই।
ঘোড়া নিয়ে রওনা হালাম আমরা। সাদাকালো বুটিদার একটা মেয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছে পালের। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ঘোড়া ওটা, ঘাড়ে অদ্ভুত এক মার্কা রয়েছে যার মাথামুণ্ডু আমরা কেউই বুঝতে পারিনি।
ওই স্ট্যালিয়নে চড়বে তুমি? মন্টে প্রশ্ন করল।
দুদিন আগে বা পরে, স্বীকার করলাম, যখন সময় বুঝব।
হুট করে কিছু করতে যেয়ো না, বিপদে পড়বে, হুঁশিয়ার করল ও।
আমরা যে-ট্রেইল ধরেছি সেটা প্রাচীন, নিচু টিলাটকর আর ছড়ানো-ছিটানো পাথরের মাঝ দিয়ে এগিয়েছে। অল্পকিছু ওকগাছ রয়েছে, তবে ঘাস প্রচুর।
দলের একদম পেছনে রয়েছে সেলমো, লক্ষ রাখছে ওদিকের ঘোড়াগুলো যেন পালাবার চেষ্টা না করে। আমি আর মন্টে পিছিয়ে পড়লাম।
বাছা, তুমি কখনও লড়াইতে অংশ নিয়েছ? জানতে চাইল ও।
পশ্চিমে আসার পথে ইন্ডিয়ান হামলার ঘটনাটা ওকে বললাম আমি, মিস ডায়ানাও তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন, শুনে অবাক হলো মন্টে। বলল, ওর ধারণা ছিল মেয়েরা খুনোখুনিতে ভয় পায়, রক্ত দেখলে ওদের হাত-পা কাপে। আমি বললাম, আর কারও কথা জানি না, তবে মিস ডায়ানা অন্য ধাতুতে গড়া, বিপদকে উরান না।
বিকেলের দিকে মন্থর হয়ে এল আমাদের চলার গতি, দানাপানি খাওয়ার সুযোগ দিলাম ঘোড়াগুলোকে। সন্ধ্যে নাগাদ যখন ক্যাম্প করার প্রস্তুতি নিচ্ছি, আলেয়ান্দ্রো মিলিত হলো আমাদের সঙ্গে। জায়গাটা মোটামুটি সুরক্ষিত, ঘোড়া রাখার জন্যে প্রকৃতিদত্ত সুযোগ-সুবিধা আছে। আরেক দফা ঘাস খাইয়ে নিয়ে, জানোয়ারগুলোকে আমরা গাছপালা আর বোন্ডারের মাঝখানে একফালি ফাঁকা জমিতে এনে রাখলাম, বাড়তি সাবধানতা হিসেবে প্রত্যেকেই অতিরিক্ত ঘোড়া বেছে নিলাম একটা করে, স্যাডল হর্সের সাথে একদড়িতে বেঁধে নাগালের মধ্যে এনে রাখলাম।
মার্টিন আগুন জ্বালল ছোট করে, কাছেই গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে বসল ফ্রান্সিসকো।
ওরা আসছে, ফ্রান্সিসকো বলল।
তুমি দেখেছ?
আসছে। আজ বা কাল রাতেই।
সদলবলে ভ্যালেটা যে আসবে আমরা তা জানি; আর তাই তৈরিই আছি সবাই। যখন অন্ধকার ঘনাল আমার রাইফেলটা তুলে নিলাম আমি, গোটা দুয়েক টর্টিয়াসহ এগোলাম কোরালের উদ্দেশে। একটার অর্ধেক অন্য এক মেয়রকে খাওয়ালাম, আড়চেখে সেটা লক্ষ করল ব্ল্যাক স্ট্যালিয়ন। ওর দিকে আস্ত একটা বাড়িয়ে ধরলাম আমি, আগে বাড়তে নিয়েও শেষমুহূর্তে পিছু হটল স্ট্যালিয়ন। মেয়ারটা খেতে চাইছিল ওটা, কিন্তু আমি দিলাম না।
ফ্রান্সিসকো আমার পাশে এসে দাঁড়াল। মোহাভেরা আসছে।
সবিস্ময়ে, আমি বললাম, মোহাভে? ইন্ডিয়ান?
সি। দশ…বারোজনও হতে পারে।
শেষপর্যন্ত মোহাভেরাও? ভাবলাম আমি। ওরা ভ্যালেটার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, নাকি নিজেরাই চাইছে আমাদের ঘোড়া লুটে নিতে? হয়তো দ্বিতীয়টাই ঠিক, কিন্তু ভ্যালেটা কি জানে ওদের উপস্থিতির কথা?
যখন পুরো এলাকা চক্কর দেয়া হয়ে গেল, ক্যাম্পফায়ারে ফিরে গেলাম আমি, কফি সহযোগে টটিয়া আর জার্কি খেতে বসলাম।
খানিক বাদে জর্জ এল খাওয়াদাওয়া করতে। আমি ওকে জানালাম ফ্রান্সিসকো কী বলেছে। আমার পাশে আসনপিড়ি হয়ে বসলেন সে, একটুক্ষণ পর মন্টেও যোগ দিল।
তুমি কী বল? মন্টে জানতে চাইল।
ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিয়ে ফের যাত্রা। আলেয়ান্দ্রো বলছে, মাইল কয়েক সামনে, চমৎকার একটা জায়গা রয়েছে, ঘাস আর পানি মিলবে। আগুন জ্বালিয়ে রেখেই সরে পড়ব আমরা। সোজা হলে জর্জ। যাই, আমি বরং কথাটা বলে আসি গিয়ে সবাইকে।
আমার পানে তাকাল ও। তোমার কোন আপত্তি নেই তো?
না। মুখের কাছে হাত তুলে হাই চাপলাম আমি, তারা দেখলাম আকাশের। আলোর অভাব হবে না।
অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল র্যামন। কালি-পড়া কফিপটটা চাপানোই ছিল আগুনে, ও কাপ ভরে নিয়ে বসল আমার কাছে এসে। নীরবে কফিপান করতে লাগল।
আবার যখন পথে নামলাম আমরা তখন রাত। বুটিদার মেয়ারের পিঠে জিন চাপানোর সময় আমি লক্ষ করলাম স্ট্যালিয়নটা মাপছে আমাকে। একদিন, ওকে বললাম আমি, এই স্যাডলটা তোর হবে।
ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করল ও, এমনভাবে মাথা ঝাঁকাল যেন বুঝতে পেরেছে আমার কথা।
আবছা ট্রেইল ধরে আমরা এগোলাম ঘোড়ার পালসমেত, মন্টে আর আমি আগের মতই পেছনে রয়েছি। ফ্রান্সিসকো, রাইফেল হাতে, আমাদের পাশাপাশি হলো।
তারপর হঠাৎ দূর-পেছন থেকে একপশলা গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে এল। স্যাডলের ওপর পেছন ফিরল ফ্রান্সিসকো, কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকার বলে কিছুই দেখা গেল না।
আবারও গুলির আওয়াজ হলো, তবে এবার অপেক্ষাকৃত কম, তারপর, সামান্য বিরতি দিয়ে, আর একটা।
মন্টে তাকাল আমার দিকে। মনে হচ্ছে শেষপর্যন্ত কোনও ঝামেলায় পড়বনা আমরা।
অন্তত এ-যাত্রা নয়, একমত হালাম আমি।
সন্দেহ নেই খানিক আগে যে-গোলাগুলি হয়েছে সেটা ছিল ভ্যালেটার দলবল আর মোহাভেদের মধ্যে। তবে কেন-যেন আমার মনে হলো, আর যে-ই মরে থাকুক, ভ্যালেটার কিছু হয়নি।
আমি জানি, আমার হাতেই ঘটবে ওর মরণ, কিংবা ওর হাতে আমার।
চল, তাড়া দিলাম আমি, এবার লস এঞ্জেলেসে।
তোমার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে ওখানে তুমি কোন প্রেমিকা ফেলে এসেছ, হাসতে হাসতে বুলল মন্টে।
এসেছি, স্বীকার করলাম আমি, তারপর হেসে যোগ করলাম, তবে মেয়েটি জানে না সেকথা।
মেয়েদের ব্যাপারে কিছুই বলা যায় না, বাছা, মন্টে বলল। কিছুই না।
.
এখন লস এঞ্জেলেসের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছি আমরা। পথে আজকাল ব্ল্যাক স্ট্যালিয়নটার পাশেই থাকি আমি, যাতে আমার সাথে ওর চেনাজানাটা প্রগাঢ় হয়।
বুনো ঘোড়া সম্পর্কে মন্টের অভিজ্ঞতা বেশি, তাই ওর উপদেশমত এখনও স্ট্যালিয়নের পিঠে ওঠার চেষ্টা করিনি, কেবল মাঝেসাঝে দূর থেকে খেতে দিয়েছি এটা-ওটা। এসব খাবার কখনও-সখনও গ্রহণ করেছে ও। একবার মনে হয় একটু বেশি কাছে চলে গিয়েছিলাম, পেছনের পায়ে সোজা হওয়ার পাঁয়তারা করেছিল ঘোড়াটা যাতে সামনের দু-পা দিয়ে আঘাত করতে পারে আমাকে। কিন্তু আমি আলগোছে পাশ কাটিয়েছি যেন দেখতেই পাইনি ওকে।
কাহুয়েঙ্গী, গিরিপথের পশ্চিমে পাথরে-ঘেরা একটা জায়গায় আমাদের ঘোড়াগুলোকে কোরাল করলাম আমরা। তারপর মন্টে আর ইন্ডিয়ানদের পাহারায় রেখে, আমি আর জর্জ শহরের উদ্দেশে রওনা হালাম।
বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে এরমাঝে, আমি লক্ষ করলাম জর্জ আড়চোখে মাপছে আমাকে।
তোমার গায়ে বেশ মাংস লেগেছে, মন্তব্য করল ও। মিস ডায়ানা চিনতেই পারবেন না হয়তো।
ফ্রান্সিসকো এগিয়ে এল আমাদের কাছে। আমরা শিগগিরই বাড়ি যাব, বলল।
তোমাদের জন্যে টাকা আনতে যাচ্ছি, জানাল জর্জ। আমরা বসের সাথে কথা বলে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।
আমরা গরুবাছুর নেব, ফ্রান্সিসকো বলল।
পাবে, বললাম আমি।
শহরে ঢোকার সময়ে রেকাবের ওপর উঠে দাঁড়ালাম আমি, চোখ মেলে দিলাম দৃষ্টির শেষসীমানা অবধি।
এখান থেকে অ্যানাবেলের বাসা দেখতে পাবে না, টিপ্পনী কাটল জর্জ।
আরক্ত মুখে, আমি তাকালাম ওর পানে। না…এমনি….শহরটা দেখছিলাম আরকী। বহুদিন হলো বাইরে কিনা!
আগের মতই আছে সবকিছু। ডন রোমেরোও আছেন ওখানে। কাজেই সাবধানে চল, বাছা। আমার উদ্দেশে ঘাড় ফেরাল বুশ। মন্টে বলছিল, পিস্তলে তোমার হাত বেশ চালু।
সবই ওর অবদান।
না, মন্টে যেভাবে বলল তাতে মনে হয় তুমি আগে থেকেই পাকা। কি, বাবা, শিখিয়েছেন?
একটু-আধটু।
তবু সাবধান থেক। গেল বছর, লস এঞ্জেলেসে রোজ গড়ে একজন করে খুন হয়েছে। আমি চাই না এবার তুমি ওদেরই একজন হও।
অথবা তুমি, জর্জের উদ্দেশে একগাল হেসে বললাম আমি।
.
০৪.
আমি দরজা দিয়ে ঢুকতেই চোখ তুললেন মিস ডায়ানা, তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে অপলকে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। ড্যান! প্রায় এক বছর পর!
উঠে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। আমি করমর্দন করলাম। দেখলাম এখন তার চুলে পাক ধরেছে খানিকটা।
বস। সব খুলে বল আমাকে, কেমন কাটল তোমাদের দিন।
এই তো সবে এলাম ঘোড়া তুলে রেখে, প্রতিবাদ করলাম আমি।
বোকার মত কথা বল না। আমি যা বলছি শোন।
আশ্চর্যের ব্যাপার, কোত্থেকে যেন রাজ্যের জড়তা এসে ঘেঁকে ধরল আমাকে। সংক্ষেপে তাঁকে জানালাম আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি।
পরিশ্রমের কাজ আমার পছন্দ শুনে খুশি হলেন তিনি, জানতে চাইলেন নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি কিছু ভেবেছি কিনা।
জবাবে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়িয়ে, আমি প্রসঙ্গ পাল্টালাম। আন্ট এলেনার সাথে দেখা হয়েছে আপনার?
হ্যাঁ, প্রায়ই হয়। উনি তোমাকে ভীষণ ভালবাসেন, ড্যান। একটু থামলেন মিস ডায়ানা, খানিক ইতস্তত করে বললেন, মনে হয় কোন কারণে বেশ দুঃখ আছে তোমার আন্টের। কোন এক আত্মীয়ের ব্যাপারে? তুমি কিছু জান?
না। মা টিয়া এলেনার গল্প করতেন মাঝে-মধ্যে…ব্যস, এই পর্যন্তই।
ঠিক আছে, আজ তা হলে তুমি শুয়ে পড় তাড়াতাড়ি, প্রচুর ধকল গেছে শরীরের ওপর দিয়ে।
টুপি তুলে নিয়ে আমার কামরার দিকে পা বাড়িয়েছি এমন সময়ে ডায়ানা বললেন, ওঃ, ড্যান, আরেকটা কথা। ক্যাপ্টেন লরেল নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে ইদানীং কারবার করছি আমি। ওঁর জাহাজ আছে, উইলমিংটন আর স্যান পেদ্রোয় হামেশাই ভেড়ে।
মুখ খুলতে নিয়েও সামলে নিলাম আমি। ধীরে-সুস্থে, অনেকটা দায়সারা ভঙ্গিতে বললাম, তাই? ভদ্রলোকের নাম শুনেছি মনে হয়।
কৌতুকে নেচে উঠল ডায়ানার চোখ। আমারও তাই বিশ্বাস…শুনেছ। ওঁর মেয়ে, অ্যানাবেল, তোমার সাথেই পড়ত, ড্যান। তোমার ব্যাপারে মেয়েটাকে বেশ কৌতূহলী মনে হলো।
আমার ব্যাপারে?
হ্যাঁ। আমরা স্কুলে পাশাপাশি বসতাম; বোধহয় সেজন্যেই।
ওর ওপর দখল নিয়ে একবার মারামারিও করেছ শুনলাম।
লজ্জায় রাঙা হালাম আমি, ঘাড় চুলকালাম মাথা নিচু করে।
র্যাড এখনও আছে, কাজেই সাবধান, ড্যান। হপ্তা কয়েক আগে সনোরা টাউনে একজনকে খুন করেছে ছোকরা। পারলে এড়িয়ে চল ওকে।
ওর সাথে গোলামালে জড়িয়ে পড়ার কোন ইচ্ছে নেই আমার, বিছানায় গিয়ে র্যাড আর অ্যানাবেলের কথা ভাবলাম আমি! নিশ্চয় এতদিনে সাবালিকা হয়েছে ও! ওর বয়েসের বহু মেয়েই বিয়ে করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।
অ্যানাবেলও কি করেছে? মিস ডায়ানা ওর বিয়ের ব্যাপারে কিছুই বলেননি। আচমকা উঠে বসলাম আমি। অসম্ভব, করতেই পারে না। তা হলে মিস ডায়ানা জানাতেন আমায়। সত্যিই কি জানাতেন? কেনই-বা জানাবেন?
জিজ্ঞেস করতে যাওয়ার জন্যে শয্যাত্যাগ করতে যাচ্ছিলাম আমি, পরক্ষণে উপলব্ধি করলাম ব্যাপারটা নিছক বোকামির শামিল হবে। তা ছাড়া, মিস ডায়ানা এখন ঘুমোচ্ছেন।
সকালে নাস্তার টেবিলে আমি দেখা পেলাম কেলোর। গরম পানিতে গোসল করার ফলে এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে আমার শরীর। আমি ঢুকতেই কাপ নামিয়ে তাকাল ও।
বাহ! অনেক বড় হয়ে গেছ দেখছি!
ঘোড়া পোষ মানানোর ব্যাপারে ওর সাথে আলোচনা করলাম আমি, ব্ল্যাক স্ট্যালিয়নটার কথাও জানালাম।
শুনেছি, বলল কেলসো। ওটা খুনে ঘোড়া, বাছা।
চুপ করে কী যেন ভাবল ও, তারপর বলল, রাস্তাঘাটে সাবধানে বেরিয়ো। মোটামুটি শান্তই ছিল গেল কয়েকটা দিন, মাত্র চারজন খুন হয়েছে। তোমরা যাওয়ার পর থেকে, এ-যাবৎ বাইশজনকে ফাঁসি দিয়েছি আমরা। এদের কারও কারও বিচার হয়েছিল-তবে বেশির ভাগই বিনাবিচারে সাজা পেয়েছে। লিঞ্চ মব ছিনিয়ে নেয় ওদের।
আর সনোরা টাউনটা তো হয়ে উঠেছে খুনে-কদমাশদের আখড়া। শুধু যে মেক্যান তা নয়, বেশকিছু অ্যাংলোও আছে ওদের মধ্যে। বস্টন ডেইউড তাদেরই একজন।
নাম শুনেছি।
আরও অনেকরই নাম শুনবে। ভাসকোয়েযের দলবল প্রায়ই জ্বালাচ্ছে ইদানীং। আইন টিকিটিও ধরতে পারছে না ওদের।
এরপর কেলসো আমাকে জানাল বিভিন্ন জায়গা থেকে নিত্যনতুন লোক আসছে শহরে, নতুন নতুন ব্যবসা খুলছে।
শহরে ঘুরতে বেরিয়ে আমি লক্ষ করলাম। এ কদিনে বহুকিছু যেমন বদলে গেছে। আবার আগের মতই আছে অনেক জিনিস। বেআইনি, তবু মেয়েরা এখনও তাদের কাপড় কাছে যানজায়। খাবার পানি নেয়া হয় যেসব পুকুর থেকে, উদোম গায়ে ইন্ডিয়ান ছেলেপুলেরা ঝাঁপাঝাঁপি করে সেখানে।
টমাস গ্রে-র ছোট্ট স্কুলটা উঠে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে ঢিলে তালে, দেখলাম অনেক দোকানিই সাঙ্গপাঙ্গ জুটিয়ে নিয়ে তাস খেলছে জানালার চৌকাঠে বসে।
রাস্তার আরেকটু সামনে পথের দুধারে জুয়াখানা চালু হয়েছে কয়েকটা, সেগুলোর মধ্যে এল ডোরাডো আর মন্টোগোমারিতে ভিড় সবচেয়ে বেশি।
ফিরে আসার জন্যে ঘুরছি, হঠাৎ সেই কাটা-নাক মেক্সিক্যানকে দেখতে পেলাম চোখের কোণে। মাত্র একঝলক, পরমুহূর্তে অদৃশ্য হলো সে। আমাকে কি অনুসরণ করা হচ্ছে? ভাবলাম।
এগিয়ে গিয়ে রাস্তার মোড় ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। অচিরেই দেখা মিলল সেই মেক্সিক্যানের। বাঁক ঘুরতে নিয়েছিল সে, কিন্তু আমাকে দেখেই থমকে গেল ঝট করে।
কারোকে খুঁজছ? আমি হয়তো সাহায্য করতে পারব। ওর দিকে এক কদম এগোলাম।
নিজের জায়গায় অনড় দাঁড়িয়ে রইল লোকটা, ডান হাত লাল ব্যান্ডানার পেছনে, ছুরির বাঁটে।
আমি এখন আর কচি খোকাটি নই, বললাম। একদিন আমাকে খুন করতে চেয়েছিলে তুমি। এখন সে-সুযোগ পেয়েছ।
ঠিকই করব..যখন সময় হবে আমার, বলল কাটা-নাক।
এখুনি, নয় কেন? আমি তৈরি।
পরে। বাতাসে হাত খেলাল ও। এখানে তোমার বন্ধুবান্ধব প্রচুর। সবুর করতে আমার, আপত্তি নেই।
বেশ, বললাম আমি।
ঘুরে দাঁড়াল ও, চলে যেতে নিয়েও থেমে গেল আচমকা। ঘাড় ফিরিয়ে হিংস্র চোখে তাকাল আমার পানে। ভেবেছিস তুই বড় হয়ে গেছিস, হিসহিস করে উঠল ওর গলা। তুই একটা ফালতু! স্রেফ ফালতু! পাখা গজিয়েছে, না? জীবনে লড়েছিস কারও সাথে? তোকে খুন করা আর একটা ভেড়াকে মারা আমার কাছে সমান!
চলে গেল ও, আর আমি স্থাণু, রাগে অন্ধ। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন ঠাণ্ডা হয়ে এল মাথা, ফিরে এল যুক্তিবোধ, তখন ভাবলাম, সত্যিই তো, কার সাথে লড়েছি তুমি? ওই কাটা-নাক ভ্যাকুয়েরো নিশ্চয় এ-ব্যাপারে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। ছুরি অথবা পিস্তল দুটোতেই দক্ষতা আছে। কেবলমাত্র ওর বাড়তি সাবধানতাই এ-যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছে আমায়।
.
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে মিস ডায়ানা যখন দেখলেন আমি গুম মেরে রয়েছি তখন জানতে চাইলেন আমার অসুখ করেছে কিনা।
নিজেকে বোকা মনে হলে কাই-বা ভাল লাগে বলুন! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম আমি।
তুমি যদি বোকার মত কোন কাজ করে থাক এবং পরে নিজে থেকেই বুঝতে পার সেটা, তা হলে ধরে নিতে হবে আসলে তুমি খুব একটা বোকা নও, সস্নেহে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সান্ত্বনা দিলেন তিনি। যাকগে, কী হয়েছে বলবে না আমাকে?
সকালের ঘটনাটা খুলে বললাম ডায়ানাকে।
তোমার ওই কাটা-নাক একটা আস্ত শয়তান। ওর নাম চ্যাতো ভ্যালডে। সনোরা টাউনের সবাই ওকে ভয় করে। তুমি ভালই করেছ ওর সাথে গোলমাল না করে।
বুদ্ধিটা কিন্তু আমার মাথায় খেলেনি, তিক্ত স্বরে বললাম।
এখন কী করবে ভাবছ তাই বল?
লড়াইয়ের কলাকৌশল শেখার ইচ্ছে। পিস্তলে ভয় পাই না; কিন্তু অন্য সব ব্যাপারে আমি:আর্নাড়ি। অথচ এখানে সম্ভবত ওগুলো জানাই বেশি জরুরি। তার ওপর র্যাড হুবার আছে। ওর ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে আমাকে।
এরপর মিস ডায়ানা আমাকে ডন রোমেরোর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের কথা জানালেন।
দাদু তা হলে ভোলেননি কিছুই?
না, জবাব দিলেন ডায়ানা। তরে এখন আর হুট করে কিছু করতে সাহস পাবেন বলে মনে হয় না। ওর মনটা খুউব ছোট, বিরূপ সমালোচনা মোটেই সইতে পারেন না। ভীষণ ঘৃণা করেন তোমাকে, আর এখন নিশ্চয় আমাকেও। হ্যাঁ, আমার বিশ্বাস আমাদেরকে ভোলেননি উনি।
আপনার ওই চ্যাতো ভ্যালডেযের বেলায়ও একথা খাটে। এবং ভ্যালেটার।
স্মিত হাসলেন ডায়ানা। আমাদের শত্রু প্রচুর, ড্যান। তবে শুক্র থাকা একপক্ষে ভাল, মানুষকে সাহায্য করে শক্তিশালী হতে। আমরা তাই হব-শক্তিশালী।
একমুহূর্ত চুপ করে রইলেন তিনি। তোমার আন্ট এলেনার কথাই ধর? নিজস্ব ধরনের তিনিও বেশ শক্তিশালী। তবু, আমার ধারণা তার জীবনে গোপন রহস্য আছে একটা কোন। হয়তো সেটা ওঁর ভাইয়ের জীবনেরও রহস্য, তবে একটা কিছু না থেকেই যায় না…।
মাঝপথে থেমে গেলেন ডায়ানা, তারপর বললেন, ও, হ্যাঁ, তোমার সেই স্ট্যালিয়নের পিঠে এ-পর্যন্ত সওয়ার হয়েছ একবারও?
না, জবাব দিলাম আমি, তবে শিগগিরই হব। আমার বিশ্বাস ও আমাকে পছন্দ করে। পিঠে উঠতে চাইলে খুব একটা নারাজ হবে না।
বাইরে গাছের পাতায় মর্মর তুলল দমকা হাওয়া। উঠে দাঁড়ালেন মিস না, তারপর আচমকা বললেন, আরে, ভুলেই গিয়েছিলাম। দুপুরে ক্যাপ্টেন লরেল এসেছিলেন দোকানে। উনি তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান।
অ্যানারেলের বাবা আলাপ করতে চান আমার সাথে? কী ব্যাপারে? যা-ই হোক, আমি দেখা করব তার সাথে।
এবং হয়তো অ্যালাবেলের সঙ্গেও।
.
০৫.
স্যান হোয়াকিন থেকে সম্প্রতি বেশকিছু বুনো ঘোড়া ধরে এনেছি আমি, এ-খবর জানাজানি হওয়ার পর থেকে অনেকেই চাইছিল আমাকে প্রশ্ন করে জানতে ওই এলাকাটা কেমন। লস এঞ্জেলেসের লোকজন পাম স্প্রিং মরুভুমি আর এর আশপাশের অঞ্চল সম্পর্কে সে-আমলে জানত না বিশেষ। অবশ্যি বেন উইলসন আর উইলিয়ম উলফস্কিলের কথা আলাদা, একসময় ট্র্যাপার ছিলেন ওঁরা, অন্তত একবার হলেও গিয়েছিলেন ওদিকে।
কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য প্রসঙ্গে। ক্যাপ্টেন লরেল কেন দেখা করতে চান আমার সাথে? এ-ব্যাপারেই কি? উনিও কি, আমার মতই, মরুভুমি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী? নাকি আর কি আছে?
একদিন বিকেলে আমার সাদাকালো মেয়ারে চেপে ওঁর দরজায় হাজির হালাম আমি। এক সুশ্রী ইন্ডিয়ান পরিচারিকা আমাকে লিভিং রুমে নিয়ে গিয়ে বসাল। ঘরটা। আয়তাকার, মেঝেতে পারসিয়ান গালিচা। প্রতিটি চেয়ারের পিঠেও রয়েছে হাতের কাজকরা মখমল। দেয়ালগুলো সাদা, আর ম্যান্টলের ওপর শোভা পাচ্ছে বহু প্রাচীন একটা ঢাল আর দুটো সামুরাই তরবারি। বইয়ে ছবি দেখেছি, তাই চিনতে অসুবিধে হলো না ওগুলো।
কামরার এক দেয়াল ঢাকা পড়েছে বইয়ের আলমারিতে। আমি, দাঁড়ালাম সেখানে গিয়ে। প্রথম দর্শনেই বুঝতে পারলাম এ-বাড়ির গৃহস্বামীর বিস্তর পড়াশোনা। এমন সব বই রয়েছে, পড়া দূরে থাক, আগে কখনও দেখারই সৌভাগ্য হয়নি আমার। বেছে বের করলাম একটা, ম্যাথিউ রিকির চীন ভ্রমণের কাহিনি। বইয়ের পাতায় এতই ডুবে গেলাম যে টের পেলাম না কখন ঘরে প্রবেশ করেছেন ক্যাপ্টেন লরেল। চমক ভাঙল তিনি আমার পাশাপাশি হওয়ার পর।
চীন সম্পর্কে কৌতূহল আছে তোমার?
সব ব্যাপারেই আছে, স্বীকার করলাম আমি। তবে ট্রাভেল অভ মার্কো পলো ছাড়া চীনের ওপর আর কিছু পড়িনি।
তা হলে রিক্কির বইটা তোমার পড়া উচিত। ইচ্ছে হলে, পড়তে পার নিয়ে।
ধন্যবাদ, সার। আমি আমার নিজের বইয়ের মতই যত্নে রাখব।
একটা ভুরু তেরছা করলেন তিনি। তা হলে তো ভয়ের কথা। মনে রেখ, বইটা তোমার নিজের নয়। বেশির ভাগ মানুষই পড়তে নিয়ে ভুলে যায় ফেরত দিতে।
আমি তা—
হাত নেড়ে আমাকে থামিয়ে দিলেন লরেল। ঠাট্টা করছিলাম। আরে, দাঁড়িয়ে কেন, বসবে না?
আমরা যখন বসলাম, গরম চকোলেট পরিবেশন করল সেই ইন্ডিয়ান পরিচারিকাটি। আমার দিকে বার কয়েক তাকালেন ক্যাপ্টেন। তোমার দাদাকে চিনতাম আমি, বললেন আচমকা, এবং তোমার বাবাকেও খানিকটা। অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন।
প্রসঙ্গ পাল্টালেন ভদ্রলোক। তো, বল এবার…তোমার সাম্প্রতিক অভিযানের কথা।
সংক্ষেপে অথচ গুরুত্বপুর্ণ বিষয়গুলো বাদ না দিয়ে, আমি তাকে ওই অঞ্চল, আমাদের বুনো ঘোড়া ধরা আর কাউইয়াদের অবদানের কথা জানালাম। মন দিয়ে শুনলেন তিনি, মাঝে-মধ্যে প্রশ্ন করলেন দুটো-একটা, তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আমার মেয়েকে তুমি চেন…নিশ্চয়ই?
চিনি, সার। আমরা এক স্কুলেই পড়তাম।
ভাল শিক্ষক ছিলেন গ্রে। আবার আমার দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিচ্ছ?
এখানে আর সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমি আর ছোটটি নেই, জীবিকার সন্ধান করতে হবে। তাই ভাবছি, যা কিছু লেখাপড়া এখন থেকে বাড়িতেই করব।
সমুদ্রে যেতে চাও না?
না, সার। ক্যালিফোর্নিয়াই আমার পছন্দ।
কাপ খালি করে নামিয়ে রাখলেন তিনি। একটুক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার পানে, সিগার ধরালেন।তোমার শত্রু অনেক।
আছে, সার। আমি নিজে করিনি। ওরাই শত্রু হিসেবে বেছে নিয়েছে আমাকে।
কিছু আসে যায় না। শক্র আছে এটাই মূল কথা। থামলেন ক্যাপ্টেন, অপলকে জরিপ করলেন আমায়। সম্ভবত তাদের সবাইকে তুমি চেনও না। এটাই মুশকিল। জানা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়। কিন্তু অন্যদের বেলায়…অথচ তারাই হয়, সবচেয়ে ভয়ানক।
আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, সার। আমার দাদু–
জানি। মারাত্মক বোকামি করছেন তিনি। কেবল তোমার সাথে শত্রুতা করে নয়, অন্যদেরকে নিজের কোলে ঠাঁই দিয়েও।
সিগারেটটা নামালেন ক্যাপ্টেন। তুমি ভেবেছ কখনও, তোমার দাদু মারা যাওয়ার পর কী ঘটবে?
মারা যাওয়ার পর? না, সার, ভাবিনি। বলতে কী, মনেও হয়নি কখনও। বড়জোর একজন শত্রু কমবে-এ ছাড়া আর কী হতে পারে?
তার সম্পত্তির কী হবে?
ভাবিনি, সার।
ভাবলে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তোমার দাদুর যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। আমার ধারণা, এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম হবে না, যারা চায় তিনি যেন আর বেশিদিন না বাঁচেন। তিনি যদি মারা যান, তুমি হবে তার উত্তরাধিকারী, অন্তত উত্তরাধিকারীদের একজন।
কেন; আন্ট এলেনা–
হাত নাড়িয়ে আমার যুক্তি খারিজ করে দিলেন লরেল। উনি মেয়েমানুষ। বেশি হলে, একটা ভাতা পেতে পারেন। থেমে, সিগারের ছাই ঝাড়লেন তিনি, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আর কোনও উত্তরাধিকারীকে তুমি চেন?
না, সার। চিনি না, স্বীকার করলাম আমি, তা ছাড়া এ নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথাও নেই। দাদু আমাকে ঘৃণা করেন। সুতরাং কিছুই দিয়ে যাবেন না আমাকে।
হতে পারে। আবার এও সম্ভব, তাঁর আর সব ব্যবসায়িক লেনদেনের মত এ ব্যাপারেও তেমন সতর্কতা অবলম্বন করেননি ভদ্রলোক। হয়তো দেখা যাবে, তার কোন উইলই নেই।
অস্থিরভাবে মেঝের আরেক প্রান্তে চলে গেলেন ক্যাপ্টেন, তারপর হঠাৎ ঘুরে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, স্পেনে তোমার দাদুর যেসব জমিজমা আছে সেগুলোর ব্যাপারে তুমি কতটুকু জান?
জানিই না কখনও কিছু ছিল ওখানে?
আছে। এত যে তুমি ধারণাই করতে পারবে না।
আবার বসলেন অ্যানাবেলের বাবা, হাঁটুতে কনুই রেখে। ক্যাপ্টেন লরেল ছোটখাট বলিষ্ঠ গড়নের মানুষ। রোমশ ভুরুযুগল ধবধবে সাদা, চুল কোঁকড়ানো, কাঁচা-পাকা। ডন ফেডেরিকো ভিয়েগ্রা সম্বন্ধে কিছু জান?
এই নামটা আমার কাছে নতুন।
সিগারে লম্বা টান দিলেন ক্যাপ্টেন, ছাই ঝাড়লেন ফের, তারপর বললেন, তোমার অনেক বন্ধু, তাই বেঁচে গেছ। ওদের ছাড়া একমুহূর্তও টিকতে পারবে না তুমি।
ঈষৎ বিরক্ত হালাম আমি, বললাম, নিজেকে আমি সামলাতে পারব! কথাটা বলেই বুঝলাম ভুল হয়ে গেছে। চ্যাতো ভ্যালডে এর আগে একবার বোকা বানিয়েছে আমাকে। হ্যাঁ, বেশকিছু ভাল বন্ধু আছে আমার, শুধরে নিলাম তড়িঘড়ি।
আসলে তুমি নিজেও জান না তাদের সংখ্যা কত। আচ্ছা, এবার বল দেখি, আমি কেন ডেকেছি তোমাকে?
আমি জানি না। সত্যি, সার। নিজেই ভড়কে গিয়েছিলাম প্রথমে, যদিও আপনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা বরাবরই ছিল।
তাই? এখন তো তা হলে পরিচয় হলোই আমাদের। এর পুরো কৃতিত্ব অবশ্যি অ্যানাবেলের। ওর ধারণা তোমার সাহায্য দরকার।
অ্যানাবেল ভেবেছে আমার সাহায্য দরকার? তারমানে, আমাকে কি এখনও শিশুটি মনে করে ও? নাকি দুর্বল? কিছু বললাম না আমি, লরেলের পরবর্তী কথা শোনার অপেক্ষায় থাকরলাম।
শোন, নওজোয়ান অ্যানাবেল আর আমি এমন সব কথা জানি যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। অবশ্যি দোষটা তোমার নয়, কারণ জানার কোনও উপায়ও তোমার ছিল না।
ডন ফেডেরিকোর সাথে তোমার মায়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তোমার দাদু। যখন তিনি পালালেন তোমার বাবার সঙ্গে, ফেডেরিকো অপমানিত বোধ করলেন। ক্ষিপ্ত হলেন ভয়ঙ্কর, তাড়া করলেন তোমার বাবাকে। সিগার টানলেন ক্যাপ্টেন, নিভে গেছে টের পেয়ে খালি কাপের পাশে নামিয়ে রাখলেন ওটা। কেবল যে তোমার মায়ের জন্যে তা নয়।
এই ফেডেরিকো হচেছন তোমার আত্মীয়। দূর সম্পর্কের। এতটা যে তোমার মাকে নিয়ে করতে পারতেন। আবার এতই কাছের, তুমি মারা গেলে সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারীও হবেন তিনি।
ফ্যালফ্যাল করে একটুক্ষণ চেয়ে রইলাম আমি। তারপর আস্তে আস্তে বোধগম্য হলো সবকিছু। আপনি ঠিক জানেন?
বাছা, স্পেন থেকেই ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রথম আসি আমি। তার আগে বার কয়েক ত্রিপোলি আর স্পেনের মধ্যে যাতায়াত করেছিলাম জাহাজ নিয়ে। তা ছাড়া, আমার কান খোলা থাকে সবসময়, আর রাতাস তখন গুজবে ভারিই ছিল। তোমার দাদু হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেন আমেরিকায় পাড়ি জমানোর। এবং এক রাতের মধ্যে ক্যাডিয ত্যাগ করেন।
আপনার জাহাজে?
না, আমার জাহাজ পরে আসার কথা ছিল। তাঁর কিছু পণ্য নিয়ে আসছিলাম আমি। এবং তার বোনকে!
আন্ট এলেনাকে?
ঠিক। সেবার পাঁচজন যাত্রী ছিল আমার জাহাজে। এক বৃদ্ধ, বছর আঠারোর এক স্প্যানিশ তরুণ, তিজন মহিলা, আর একটা অসুস্থ ছেলে।
তারমানে আপনি আন্ট এলেনাকে চেনেন?
সামান্যই। বেশির ভাগ সময় নিজের কেবিনে থাকতেন তিনি। অসুস্থ ছেলেটার সাথে যে-মহিলা ছিল সেও। মাঝেসাঝে, যখন ভাল থাকত আবহাওয়া, খোলা ডেকে বেরোতেন তোমার আন্ট, কখনও-সখনও অসুস্থ বাচ্চাটির সেবাযত্নও করতেন। যদিও আমি ঠিক জানি না, ওঁ সত্যিই অসুস্থ ছিল কিনা।
আপনার সন্দেহের কারণ?
বাইরে যে-কবার দেখেছিলাম, ওকে আমার চটপটে বলেই মনে হয়েছিল। তা ছাড়া আরও কারণ আছে। আগেই বলেছি, যাত্রীদের মধ্যে আরেকজন স্যানিশ ছোকরা ছিল। একদিন রাতে, অসুস্থ ছেলেটা যখন ডেকে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছিল, পেছন থেকে ওই ছোকরা ছুরি নিয়ে আক্রমণ করে ওকে। কীভাবে যেন টের পেয়ে যায় ছেলেটা ঝট করে ঘুরেই চেপে ধরে হাত, মোচড় দিয়ে ছুরিটা কেড়ে নেয়।
এই ঘটনার সময় একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল আমার মেট। সে ডেকে আনে আমাকে, কিন্তু ওরা দুজনেই বেমালুম অস্বীকার করে ব্যাপারটা। ফলে, আমি আর কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারিনি।
নীরবে ভাবতে লাগলাম আমি। এ-কাহিনির উল্লেখযোগ্য দিক একটাই, আন্ট এলেনার সাগর ভ্রমণ নেহাত সাদামাঠাভাবে শেষ হয়নি।
চকোলেট নেবে আরও? আমি কিন্তু নেব।
প্লিজ। তারপর বললাম, তা হলে নিশ্চয় ওদের মধ্যে ঝগড়া ছিল কোন?
বোধহয়। ইন্ডিয়ান পরিচারিকা আরেক দফা চলোকলেট দিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন ক্যাপ্টেন, তারপর বললেন, ডন ফেডেরিকোই হচ্ছেন সেই স্প্যানিশ ছোকরা।
তবে কী…তবে কী আমাকে সাবধান করতে চাইছেন ক্যাপ্টেন?
অপর ছেলেটা, যে অসুস্থ ছিল, এই ঘটনার পর স্রেফ হারিয়ে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। হয়তো মারাই গেছে। এখানে একবার মহামারি হয়েছিল। আমি পরে খোঁজ করেছিলাম ওর, কেউ কিছু বলতে পারেনি। আর যে-মেয়েটা ওর সেবা করত, সেও অদৃশ্য হয়েছে। অনেক পরে জেনেছি, ও, নাকি বিয়ে করেছে কোন্ এক ভ্যাকুয়েরোকে।
সেসময় বহু লোকই এদিক-ওদিক যাওয়া-আসা করত। এ-কাহিনিতে নতুনত্ব কিছু নেই। তখনকার দিনে আকছার ঘটত এরকম।
ঠিক। উঠলেন ক্যাপ্টেন লরেল। তুমি আমাদের সাথে খাচ্ছ নিশ্চয়? এখুনি এসে পড়বে অ্যানাবেল। তোমাকে দেখলে খুশি হবে…আমি জানি।
আমি নীরবে সম্মতি জানিয়ে চেয়ে রইলাম চকোলেটের দিকে। লরেল কী বলতে চাইছেন আমায়? ডন ফেডেরিকো আমার শত্রু, কাজেই বিপজ্জনক নোক? এতে আমারও কোন সন্দেহ নেই। বাবা আর মাকে যারা মরুভূমি পর্যন্ত তাড়া করেছিল, ক্যাপ্টেন বলেছেন, ফেডেরিকো ছিলেন তাদের মধ্যে।
কিস্যু আসে যায় না, শেষমেশ বললাম। দাদুর কোনকিছু চাই না আমি।
হুট করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বস না। তুমি না চাইতে পার, কিন্তু অন্যদের তো নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
একথার অর্থ কী?
আপনি তো চীন সাগরে গেছেন, জিজ্ঞেস করলাম, ওদের কী এক ধরনের আত্মরক্ষার কৌশল আছে বলে শুনেছি? শেখার ইচ্ছে আছে আমার।
স্মিত হাসলেন ভদ্রলোক। কয়েক বছর লাগে শিখতে। যাইহোক, তোমার যদি আগ্রহ থাকে আমি হয়তো পারর ব্যবস্থা করতে। আমার সর্দার মাল্লা, ও জানে।
আমি এক চীনার কথা শুনেছি। এদিকেই কোন পাহাড়ে যেন থাকে।
লরেল হাসলেন। চিনি, কি সে তো শেখাবে না কারোকে। আর ও চীনাঃ নয়, যদিও ওর দেশটা এখন চীনেরই অংশ.. খোতান।
খোতান?
হ্যাঁ…দুরপশ্চিমে, তুর্কিস্থানে, কুনলান পর্বতমালার কাছাকাছি। ওই পথে ভারতে যাওয়া যায়। একসময় বৌদ্ধ সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল জায়গাটা।
হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। মার্কো পলোর লেখায় পড়েছি; সিল্ক রুট, চীন থেকে ভূমধ্যসাগর অবধি চলে গেছে।
খোতানে একটা শাখা বেরিয়েছে সিল্ক রুটের, সিরিয়া হয়ে পাহাড়পর্বতের মাঝ দিয়ে ভারত পর্যন্ত।
ওই লোকের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে আমাকে।
শেখাবে না। জায়গাটা ভাল লেগে যাওয়ায় এখানেই রয়ে গেছে। যদ্দুর জানি-একাই থাকে।
সাঁঝ এসে পড়েছে, গাঢ় হচ্ছে ছায়ারা। ইন্ডিয়ান পরিচারিকা এসে বাতি জ্বেলে দিল ঘরের আলোটা দারুণ উজ্জ্বল দেখে বিস্ময় প্রকাশ করলাম আমি।
কেরোসিন। চীনারা কয়েকশো বছর ধরে ব্যবহার করছে।
প্রসঙ্গ বদলালেন ক্যাপ্টেন, জাহাজ ব্যবসা, মানুষ, সমুদ্র আর বিভিন্ন বিদেশি বন্দর সম্পর্কে আলোচনা হলো আমাদের।
কামরার শেষপ্রান্তে একটা দরজা খুলে গেল, ভেতরে ঢুকল অ্যানাবেল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাড়ালাম আমি। দেখতে ও আগের চেয়ে এখন আরও সুন্দর হয়েছে।
দুহাত সামনে বাড়িয়ে, আমার কাছে এল ও। ড্যান! ওফ, কদ্দিন পর দেখা!
এখন আর আগেকার সেই কিশোরিটি নেই অ্যানাবেল, পুরোদস্তুর যুবতী। আগেও মেয়েটি হেঁয়ালি ছিল আমার কাছে, এখন আরও হেঁয়ালি মনে হলো।
তুমি আমাদের সাথেই খাচ্ছ তো? কেল্ডাকে মনে আছে? ও আসছে, আর সম্ভবত মাইলো বার্নস।
এবং র্যাড হুবার?
না, র্যাড হুবার আসবে না। ওর দহরম-মহরম অন্য মহলে। মাঝে-মধ্যে ওকে দেখি রাস্তায়। চকিতে আমার পানে তাকাল অ্যানাবেল। জান, ও এখন বড় হয়ে গেছে।শক্তি ধরে যথেষ্ট।
মন্তব্যটা জ্বালা ধরিয়ে দিল আমার গায়ে। আমি নিজেও এখন বলশালী।
সাপারের আগমুহূর্তে এসে পড়ল কেল্ট ওব্রায়েন, আর সঙ্গে মাইলো বানস। ওর নাকে এখনও ঘামাচি রয়েছে কিছু, চোখ দুটি গভীর নীল, চুল কালো। মাইলো বদলায়নি বিশেষ, শুধু হাতে-পায়ে বেড়েছে একটু, আর গলার স্বর পাল্টে গেছে।
আমি অ্যাডলসডর্ফার কোম্পানিতে আছি, আর ওদের মাধ্যমে হ্যামবুর্গ ব্রেমেনে।
অ্যাডলসডর্ফার আমদানির ব্যবসা করে, জানি আমি, আর হ্যামবুর্গ-ব্রেমেন বীমা কোম্পানি।
ভাল চাকরি পেয়েছ, বললাম।
আনন্দ পাচ্ছি কাজ করে, ভবিষ্যৎ আছে। আড়চোখে আমার দিকে তাকাল মাইলো, হঠাৎ হাসল ফিক করে। সারের সাথে দেখা হয়েছে? জান, একটুও বদলাননি। সম্প্রতি বইটা শেষ করেছেন, শিগগিরই বেরোবে বাজারে। এ ছাড়াও তাঁর আরও দু-একটা প্রবন্ধ লন্ডন আর জার্মানিতে প্রকাশিত হয়েছে।
গ্রে তার বই শেষ করেছেন, বার্নস পেয়েছে নিশ্চিত ভবিষ্যতের সন্ধান। কিন্তু আমি? আমার অবস্থান কোথায়? আমি কী হয়েছি?
২.২ ক্ষমাপ্রার্থনা করে
ক্ষমাপ্রার্থনা করে, রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে এলাম আমি। যানজায় নিয়ে গিয়ে পানি খাওয়ালাম আমার ঘোড়াকে, তারপর কোরালে বেধে রেখে খানিকটা খড় ধরলাম ওর মুখের সামনে। মিনিট কয়েক ওখানে দাঁড়িয়ে রইলাম নিশ্চল, হাত বুলিয়ে দিলাম মেয়ারের কেশরে। শান্ত স্নিগ্ধ রাত। আকাশে উজ্জ্বল তারা।
ডন ফেডেরিকো? ভদ্রলোকবকে আমি চিনি না, যদিও তিনি আমাকে চেনেন নিশ্চয়। অচেনা শত্রুকে মোকাবেলায় এই এক মস্ত অসুবিধে, সর্বক্ষণ সন্ত্রস্ত থাকতে হয়।
ক্যাপ্টেন লরেল নিঃসন্দেহে আমাকে সাবধান করতেই ডেকের সেই ঘটনাটা তখন উল্লেখ করেছেন। তিনি চান আমি যেন অতর্কিত আক্রমণের ব্যাপারে সদা হুশিয়ার থাকি।
দাদুর সম্পত্তি পাওয়ার কথা কখনও মাথায়ই আসেনি আমার, আর তেমনটি ঘটবেও না কোনদিন। মনেপ্রাণে ঘৃণা করে যাকে, কেউই চায় না তাকে নিজের সম্পত্তি দিয়ে যেতে।
এ-যাবৎ যা-যা ঘটেছে, সেসবের জন্যে কতটুকু দায়ী ডন রোমেরো? কিংবা ডন ফেডেরিকো? হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমি, মরুভূমিতে আমাকে নির্বাসন দেয়ার সময় সুদর্শন যে-যুবককে আমি দেখেছিলাম দাদুর সঙ্গে সম্ভবত তিনিই ডন ফেডেরিকো।
একটা দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে ঘাড় ফেরালাম, দেখলাম অ্যানাবেল সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। রওনা হব ওর দিকে, এই সময় ও এগিয়ে এল আমার কাছে।
দেরি দেখে আর থাকতে পারলাম না।
ঘোড়াকে পানি খাওয়ানোর পর, নিজেও হাওয়া খাচ্ছিলাম একটু। জান, আমার ভাবতেই অবাক লাগছে, যাদের আমি চিনি না তারাই কিনা খুন করতে চাইছে আমাকে।
স্বাভাবিক। বাবার ধারণা তুমি হয়তো হঠাৎ করে বিপদে পড়তে পার। তোমার জন্যে উনি ভীষণ চিন্তিত। একটু থেমে অ্যানাবেল যোগ করল, শুনেছ নিশ্চয়ই, তোমার দাদার কাছেই জাহাজের ব্যাপারে হাতেখড়ি হয়েছিল বাবার। নাড়ির টান ছিল দুজনের মাঝে। তোমাকে উনি নিজের পরিবারের একজন বলে মনে করেন।
কোনকিছু না ভেবেই, ফস্ করে আমি বলে ফেললাম, হলে বেশ হত কি?
ঠাট্টাচ্ছলে, অ্যানাবেল বলল, ভাইয়ের সাথে কী রকম ব্যবহার করতে হয় আমি কিন্তু জানি না।
আমি ভাই হওয়ার কথা ভাবছিলাম না।
চল, ভেতরে যাওয়া যাক। সম্রান্ত মহিলারা বাইরে দাঁড়িয়ে কোন ভদ্রলোকের সঙ্গে খোশগল্প করে না।
হাঁটতে হাঁটতে পোর্চে ফিরে গেলাম আমরা। ক্যাপ্টেন লরেল বললেন, তোমার যদি আগ্রহ থাকে, কালই নাহয় আমার সর্দার মাল্লাকে তলব দেব। তবে, বাচা, তোমাকে প্রচণ্ড খাটতে হবে। আমার হাতে সময় বিশেষ নেই-শিগগিরই আবার বেরোব জাহাজ নিয়ে।
তো এভাবেই শুরু হলো মার্শাল আর্ট শেখা। পরের ছয়টা সপ্তাহ রোজ গড়ে ছ সাত ঘণ্টা করে লিউ চ্যাংয়ের কাছ থেকে তালিম নিলাম আমি। লিউ চ্যাং বিরাটকায় মানুষ, গায়ে আসুরিক শক্তি, ক্ষিপ্রতায় বাকেও হার মানায়।
খেলা হিসেবে নয়, আমি মার্শাল আর্ট শিখছিলাম আত্মরক্ষার তাগিদে। যাতে কোন আক্রমণ এলে চকিতে সামলে নিয়ে পাল্টা আঘাত হানতে পারি। তাই লড়াইয়ের প্রাথমিক কলা-কৌশলের ওপরেই গুরুত্ব দিলাম বেশি করে, পদ্ধতিগত, জটিলতার ভেতরে আর না গিয়ে।
মাঝেসাঝে, লিউ চ্যাং যখন ব্যস্ত থাকে অন্য কিছুতে, কোরালে চলে যাই আমি, মন্টে ম্যাক-কায়াকে সাহায্য করি ঘোড়া পোষ মানানোর কাজে। জর্জ হামেশাই থাকে ওখানে।
ব্ল্যাক স্ট্যালিয়নটা এখন আমার খোঁজে আসে রেইলের কাছে। আমি হাত বাড়ালে সরে যায়, কিন্তু আমার-দেওয়া রুটি খেতে আপত্তি করে না। বেছে বেছে এ পর্যন্ত দুটো ঘোড়া নিজের জন্যে আলাদা করেছি আমি। একটা ড্যাপল-গ্র, অন্যটা বে-লেজ আর কেশর কালো। কত জোরে ছুটতে পারবে ওরা জানি না, তবে উভয়েরই দম অফুরন্ত; আর বেশ চটপটে।
.
বাতাসে পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে, যত ব্যস্ততাই থাক, ব্যাপারটা বুঝতে কারোরই অসুবিধে হয় না।
মিস ডায়ানা উল বুনছিলেন আমি যখন দোকানে ঢুকরলাম। ড্যান! আজকাল যে তোমার দেখাই মেলে না।
তাকে আমি ঘোড়া পোষ মানানোর কথা বলতে তিনি জানালেন, ওগুলোকে শিগগিরই আমরা বাজারে ছাড়ব, ড্যান। এই শহরেরই এক লোক ওয়াগন বানাচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়রা হয়তো সহজে অভ্যাস পাল্টাবে না, তবে আমার ধারণা পুবের লোকেরা তাদের মালপত্র আনা-নেয়ার জন্যে ওয়াগনের ওপরই নির্ভর করবে বেশি।
নতুন যেসব বই এসেছে সেগুলো একঝলক দেখে নিয়ে রাস্তার দিকে তাকালাম আমি, দেখলাম ওপাশের ফুটপাতে কালো সুট পরনে দীর্ঘদেহী এক লোক দাঁড়িয়ে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় খবরকাগজ পড়ছে লোকটা, কিন্তু আমি দিব্যি ঠিক পেলাম, আসলে আমাদের দোকানের ওপর নজর রাখাই ওর উদ্দেশ্য।
ম্যাম? আপনি চেনেন ওই লোককে?
আমার দিকে তাকালেন ডায়ানা, তারপর আমার দৃষ্টি অনুসরণ করলেন রাস্তা অবধি। এক মুহূর্ত পর বললেন, ঠিক বুঝতে পারছি না, ড্যান। তবে চেনা-চেনা লাগছে।
ঘোড়ায় চেপে জনাকয়েক ভ্যাকুয়েরো চলে গেল; তারপর একটা তিন-চাকার ড্যান বা কারেতাস। আবার যখন তাকালাম আমি, লোকটা তখন নেই। কলম নামিয়ে রেখে, ডেস্কের ওপর হাত রাখলেন মিস ডায়ানা, যেন উঠতে যাচ্ছেন, কিন্তু পরক্ষণে ঢিল দিলেন শরীরে। তাকে আমার বিচলিত মনে হলো।
শিগগিরই, বললেন তিনি, আমাদের বোধহয় একটা আলোচনায় বসতে হবে।
আমি কি কোন দোষ করেছি?
স্মিত হাসলেন ডায়ানা। না, ড্যান। তবে আমার হয়তো পরামর্শের প্রয়োজন হতে পারে।
পরামর্শ? আমার কাছ থেকে? আমার যদি কিছু করার থাকে…?
আমি তোমার মতামতের মূল্য দেই, ড্যান। এ-জন্যে যাওয়ার মত আমার আর কেউ নেই।
খুশিমনে করব আমি, আপনি শুধু হুকুম করবেন একবার।
তবু আমার খটকা গেল না। মহিলাকে বরাবর আত্মবিশ্বাসী, স্বাবলম্বী জেনে এসেছি আমি। ফের তাকালাম রাস্তার দিকে। না, ফিটফাট পোশাক-পরা লোকটা চলেই গেছে।
কে ও? ওই লোকই কি মিস ডায়ানার বিচলিত হওয়ার কারণ? নাকি ব্যাপারটা নিছক কাকতালীয়?
অবশ্যি সে-অর্থে মিস ডায়ানা সম্পর্কে বেশিকিছু জানি না আমি। আর বলতে কী, কে-ইবা তা জানে? আমার জানামতে মিস ডায়ানার জীবনই শুরু হয়েছে আমরা যখন একসঙ্গে হিউজের ওয়াগনে চড়ে পশ্চিমে আসছিলাম।
কে এই ডায়ানা? কোন্ জীবন ফেলে এসেছেন পেছনে? দেখে বোঝা যায় সম্রান্ত মহিলা তিনি, এবং শিক্ষিতা। নইলে এত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারতেন না সব ব্যাপারে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, তার দেশ কোথায়…পশ্চিমে আসার আগে কোথায় ছিলেন?
ভ্যালেটা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল, তবে এও ঠিক, ও সবাইকেই সন্দেহ করে। অসৎ লোকের যা হয়, নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে অন্যের মাঝে।
.
০৭.
লস এঞ্জেলেসে আমাদের প্রাথমিক বছরগুলোতে, জনসংখ্যা যখন ছিল প্রায় হাজার তিনেক, প্রতি বছর গড়ে পঞ্চাশ-ষাটটা খুন হত। তবু মিস ডায়ানার র্যাঞ্চে ঘোড়ার পাল সরিয়ে আনতে গিয়ে এতটুকু বেগ পেলাম না আমরা। এমনকী ব্ল্যাক স্ট্যালিয়নটাও শান্ত ছিল, শুধু একবার, আমি ওর পিঠে নেড়ে দেয়ার সময়ে, পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া।
ডায়ানার র্যাঞ্চটা বেশ নিরিবিলি, প্রকাণ্ড একটা সাইক্যামোরের ছায়ায় সাবেক ফ্যাশনের এডৌব র্যাঞ্চ-হাউস, সামনে খোলামেলা, লস এঞ্জেলেসগামী রাস্তার অনেকটাই দেখা যায়।
যেদিন ঘোড়াগুলো স্থানান্তরিত করা হলো, তার পরদিন সকালে, যেহেতু অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন মিস ডায়ানা, আমি দোকান খুললাম শহরে গিয়ে, ভোরের স্টেজে উইলমিংটন-থেকে-অসা খবরকাগজ সাজিয়ে রাখলাম স্ট্যান্ডে।
রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাঁকাই ছিল তখনও। কেবল কমার্শিয়াল স্ট্রিটের মোড়ে একজন লোককে চোখে পড়ে, অ্যাপ্রন গায়ে ফুটপাত ঝাট দিচ্ছে। সেলফ থেকে একটা বই নামিয়ে পড়তে শুরু করেছি এই সময় দরজায় ছায়া পড়ল কার যেন আমি পলক তুলে সেই লোকটিকে দেখতে পেলাম, সেদিন রাস্তার উল্টো দিক থেকে আমাদের দোকানের ওপর নজর রাখছিল যে।
লোকটা, আমরা যাকে বলি মাঝবয়েসী, পরনে ধূসর রঙের পরিপাটি সুট, আর সরু কারনিসঅলা হ্যাট। আলতো মাথা ঝুঁকিয়ে আমাকে অভিবাদন জানাল সে, জিজ্ঞেস করল বস্টনের কোন খবর-কাগজ হবে কিনা।
দশদিনের বাসি, তবে আমাদের জন্যে এটাই তাজা।
আমার জন্যেও। মৃদু হাসল লোকটা, কিন্তু ওর ধূসর চোখজোড়া তীক্ষ্ণ, অন্তর্ভেদী। বেশ সাজানো-গোছানো দোকান। মালিক কে-তুমি?
ওর কথাবার্তায় দুরভিসন্ধির আভাস পেলাম আমি, সতর্ক হয়ে গেলাম নিমেষে। পাশাপাশি একধরনের খটকা লাগল। যদিও ক্ষীণ, লোকটার উচ্চারণে আঞ্চলিক টান রয়েছে, পরিচিত ঠেকল, কিন্তু ঠিক কোথায় শুনেছি তা মনে করতে পারলাম না।
আমি বসলে আপত্তি আছে? এটা তো রিডিং রুম, নাকি?
জ্বি।
দোকানটা চমৎকার। তোমার আবার জিজ্ঞেস করল সে।
প্রথমবার উত্তর এড়িয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু এবার বাধ্য হালাম বলতে নয়তো ওর অহেতুক সন্দেহ জাগতে পারে। মিস ডায়ানার।
ডায়ানা? সুন্দর নাম। অনেকদিন থেকে চেন?
হ্যাঁ। দারুণ মহিলা।
সন্দেহ নেই, তবে অন্য একটা কারণে আমার একটু কৌতূহল হচ্ছে। বুঝলে, এধরনের নাম বিশেষ দেখা যায় না। ভদ্রমহিলাকে আমি বোধহয় দেখেছি। বেশ লম্বা, আকর্ষণীয়…ঠিক?
জ্বি।
ওঁর বয়েসের অধিকাংশ মহিলাই বিবাহিত। মন্তব্য করল লোকটা।
একথার জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজন আমি বোধ করলাম না। খবরকাগজ পড়তে পড়তে, অলস আড্ডা দেয়ার ভান করছিল লোকটা, কিন্তু ওর আসল মতলব বুঝতে অসুবিধে হলো না আমার। মিস ডায়ানার ব্যাপারেই তার যত কৌতূহল,.. কৌশলে আমাকে জেরা করছে। সহসাই আমার মনে হলো মিস ডায়ানা আর যুবতীটি নেই, তবু যৌবনকে যেন ধরে রেখেছেন। বয়েসের তেমন কোন ছাপ আজও তার মাঝে লক্ষ করিনি আমি।
আমি ভাবছি-হালকা সুরে বলল লোকটা-ওই নাম তিনি পেলেন কোথায়?
আমরা সবাই যেভাবে পেয়ে থাকি, আমার বিশ্বাস। ঈষৎ রুক্ষ স্বরেই দিলাম জবাবটা। সন্দেহ নেই, আপনিও সেভাবেই পেয়েছেন আপনারটা। তারপর হাতের কাজ একপাশে সরিয়ে রেখে বললাম, প্রসঙ্গ যখন উঠেইছে, নিজের পরিচয়টাও বোধহয় আমার দেয়া দরকার। আমি ড্যান ও’হারা।
আমি অ্যালেক্সিস ফুলটন।
অদ্ভুত নাম। ফুলটন নামটি ইংরেজি, নিঃসন্দেহে, কিন্তু অ্যালেক্সিস? রুশ হতে পারে।
খবরকাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরল ফুলটন, যেন পড়বে।
আপনি গরু ব্যবসায়ী নন। আপনার আগ্রহ কিসে…ঘোড়ায়?
আমাদের রাশিয়াতেই প্রচুর ঘোড়া।
অ, আপনি তারমানে রাশিয়া থেকে আসছেন? ইংল্যান্ড নয়? উচ্চারণে ওই টানটাই কি তখন ধরা পড়েছিল আমার কানে? যদিও মনে পড়ল না এর আগে কোথায় শুনেছি ওধরনের কথাবার্তা।
বিরক্ত হলো ফুলটন। তাতে কি কিছু আসে যায়?
মোটেই না। আমাদের ক্যালিফোর্নিয়াতে শুরু থেকেই প্রচুর রাশিয়ান আছে। আমার ধারণা একসময় জায়গাটা ওরা দখল করার কথাও ভেবেছিল!
আর নামের কথা বলছেন, স্রেফ কৌতূহল আরকা, আপনারই মত। ক্যালিফোর্নিয়াতে এখন রোজই নতুন নতুন মানুষ আসছে। কেউ সোনার খোঁজে, আবার কেউ-বা, এরাই বুদ্ধিমান নিঃসন্দেহ, জমি কিনতে। সওদাগরও আছে কিছু।
আমি পর্যটক মানুষ। ডায়ানা নামটায় আশ্চর্য হয়েছি এই যা। তেমন চালু নয় বলে।
আপনি অবশ্যি তাই বলছেন। তবে ছেলেবেলায় আমি যখন পুবে ছিলাম, বেশ কয়েকজন ডায়ানাকে চিনতাম। আপনি চাইলে তাদের ঠিকানাও দিতে পারি। ফিলাডেলফিয়ায় থাকে ওরা।
খবরকাগজটা ভাঁজ করে নামিয়ে রাখল ফুলটন। তার কোন দরকার নেই…ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই এতে, উত্তর দিলাম আমি। আপনার যদি কখনও কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে, সংকোচ করবেন না বলতে।
লোকটা এমনভাবে তাকাল আমার দিকে যেন ভস্ম করে ফেলবে আমাকে, কিন্তু আমি হাসলাম মৃদু। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল ফুলটন, দরজাটা টেনে দিল সশব্দে।
মনে মনে একচোট হেসে নিয়ে, আবার নিজের কাজে ফিরে গেলাম আমি। রাস্তাঘাট ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে, মানুষজন সকলেই নেমে পড়েছে যার যার কাজে।
আবার সেই আঞ্চলিক উচ্চারণের কথা ভাবলাম আমি। রুশ, না? কিন্তু কবে কোন রাশানের সঙ্গে পরিচয় হলো আমার? না, হয়নি।
চকিতে আবার ফিরে এল সেই চিন্তা। মিস ডায়ানা কে? ফুলটনের আগ্রহ কি প্রণয়ঘটিত? ডায়ানার বয়স…মানুষ যাকে যুবতী বলে তিনি আর তা নন এই সত্যটি উপলব্ধি করে আমার বুকের ভেতরটা খচখচ করে উঠল।
হঠাৎ করেই এসে পড়লেন ডায়ানা, তবে খুব একটা আচমকা নয়, কারণ বেশ কিছুক্ষণ হলো ফুটপাতে তাঁর হিলের খটখট স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম আমি।
দরজা বন্ধ করে চারপাশে নজর বোলালেন তিনি, তারপর সচকিত হয়ে তাকালেন আমার দিকে। ড্যান? কী হয়েছে তোমার?
এক লোক এসেছিল…সেদিন রাস্তার ওপাশে আমরা যাকে দেখেছিলাম। আমার ধারণা ভদ্রলোক আপনার সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। হয়তো আমার বুঝতে ভুল হয়েছে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না ব্যাপারটা রোম্যান্টিক।
স্বর্গীয় হাসি হাসলেন জয়ানা। রোম্যান্টিক? নাহ্, তার সময় বহু আগেই পেরিয়ে গেছে।
সত্যিই কি পেরিয়ে যায় কখনও? একটু থেমে আমি যোগ করলাম, ভদ্রলোকের নাম অ্যালেক্সিস ফুলটন।
হাতের দস্তানা খুলছিলেন তিনি, মুহূর্তের জন্যে থেমে গেলেন।
না, আনমনে বললেন ডায়ানা; এ হতে পারে না। এতকাল পর আর সম্ভব নয়। ডেস্কে না বসে সোজা রিডিং রুমে চলে এলেন তিনি। তুমি কী বলেছ ওকে?
কী আর? আপনি সুন্দরী। এই দোকানের মালিক। এ ছাড়া আপনার সম্পর্কে আর কীই-বা জানি আমি?
দুষ্ট-দুষ্ট হাসলেন মিস ডায়ানা। আমি তোমাকে বিশেষ কিছু বলিনি…বলেছি?
লোকটা আসার পর অবশ্যি একটা তথ্য জেনেছি, মন্তব্য করলাম, ওর ইংরেজি উচ্চারণ থেকে। চকিতে ডায়ানার দিকে তাকালাম আমি। আপনি রাশান, তাই না?
একসময় ছিলাম। বহুকাল আগে। এখন আমি আমেরিকান। ক্যালিফোর্নিয়ান।
কিন্তু রাশিয়ান ছিলেন।
এখুন পেছনের কথা ভাবলে মনে হয়, ওটা যেন অন্য এক পৃথিবী, সম্পূর্ণ আলাদা জীবন, আলাদা মানুষ।
ফিরে যাবেন?
সম্ভব নয়, ড্যান। সাইবেরিয়ায় পাঠানো হয়েছিল আমাকে, কিন্তু আমি পালিয়েছি। শুরুতে মোট নজন ছিলাম আমরা, সফল হয়েছিলাম তিনজন। আমরা যখন চীনে পালিয়ে এলাম তখন কতই-বা হবে আমার বয়েস….এই চোদ্দ-পনেরো। আমার এক ভাই সাইবেরিয়ায়ই মারা যায়, আরেকজন কঠোর পরিশ্রমে, আর শেষজন মারা পড়ে মঙ্গোলিয়ায়, ডাকাতদের হাতে। আমিই আমার বংশের শেষ, ফিরে যাব কার কাছে…কেউ নেই। তা ছাড়া, গেলেই আবার আটক করা হবে আমাকে।
ধীরে ধীরে আমি জানলাম, রাশিয়াতে জমিদারি ছিল ডায়ানার বাবার। তার মা ছিলেন ইংরেজ। সেই সুবাদেই ইংরেজি ভাষায় তাঁর দখল। পরে নিজের আগ্রহে ফরাসিও শিখেছেন। বাবা জমিদার হলে কী হবে, ডায়ানাদের বাড়িতে বইত আধুনিক ইউরোপের হাওয়া। ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে তখন, ইংল্যান্ডেও শেষ হয়েছে। রাজতন্ত্রের সুদিন। অথচ রাশিয়াতে জার-শাসনের কঠিন নিগড়ে হাঁসাস করছিল মানুষ। জারতন্ত্র উচ্ছেদের জন্যে একটা গুপ্ত বিপ্লবী সংস্থা গড়ে ওঠে এসময়, নাম ইউনিয়ন অভ ওয়েলফেয়ার। ডায়ানার তিন ভাই এই ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। জার প্রথম আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর একটি বিদ্রোহের পরিকল্পনা নেন তাঁরা। কিন্তু সাংগঠনিক দক্ষতা না থাকলে যা হয়, ভেস্তে যায় তাঁদের প্ল্যান, ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয় সদস্যদের ফাঁসি হয়, আর অন্যরা নির্বাসিত হন সাইবেরিয়ায়।
কিন্তু আপনি তো তখন ছোট ছিলেন!
তাতে কোন ইতরভেদ হয়নি। রাশিয়ার নিয়মই এই বংশের একজন সরকার বিরোধী হলে, সবাইকেই দেখা হয় সেভাবে। আমরা গোপনসূত্রে খবর পেয়েছিলাম, আমাদেরকেও মেরে ফেলা হবে। সেজন্যেই পালানোর সিদ্ধান্ত নিই।
আর এখন?
আমার পক্ষে ফেরা সম্ভব নয়, ড্যান। এখনও শত্রু মনে করা হয় আমাদের, আর পালানোর ফলে অপরাধ আরও বেড়ে গেছে।
চুপ করে রইলাম আমি, বাইরে মধ্যাহ্নের ঝা-ঝাঁ রোদ্দুর, রাস্তা-ঘাট খা-খ। ফুটপাতের ওপর ছায়ামত একটা জায়গায় নিথর শুয়ে একটা কুকুর, কেবল বুকের ওঠানামা বলে দিচ্ছে বেঁচে আছে ও-এবং ঘুমোচ্ছে।
তা হলে তো আপনাকে সাবধান থাকতে হবে, খানিক পর বললাম।
সে আমি সবসময়ই থাকি, বলে আমাকে একটু মাপলেন ডায়ানা। ডন রোমেরোর কথা কখনও মনে হয় তোমার?
তাকে আমি কখনোই ভুলে যাইনি, তবে….আরও বহুকিছু আছে। আচমকা উঠে দাঁড়ালাম আমি। মরুভূমির জন্যে আমার মন আনচান করছে।
ওখানে তুমি কী পাবে, ড্যান? সৌন্দর্য, নিশ্চয়, কিন্তু আর কী?
জানি না। ভ্রূকুটি করলাম। সম্ভবত এই না জানাটাই হয়েছে আমার সমস্যা। জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম আমি, তারপরঘুরে মুখোমুখি হালাম ডায়ানার। ওখানে কী যেন অপেক্ষা করছে, আমার জন্যে, হয়তো কারও অসমাপ্ত কোন কাজ, যেটা শেষ করতে হবে আমাকে।
এই যে ব্যবসা, প্রাণচাঞ্চল্য সবই-বাতাসে হাত খেলাম আমি অনুভব করতে পারি আমি। এখানে চেষ্টা করলেই ধনী হওয়া যায়। কিন্তু একমাত্র সেটাই কি আমার চাহিদা? নাকি আরও কিছু আছে? এমন জিনিস, যার সন্ধান আমার বাবা-মা পেয়েছিলেন?
তুমি ঠিক জান? সত্যিই কি কিছু পেয়েছিলেন তাঁরা? নাকি স্রেফ পালিয়ে গিয়েছিলেন এখান থেকে? পরস্পরের কাছ থেকে সুখ পেয়েছিলেন…আমরা জানি, এ ছাড়াও কি আরও কিছু ছিল?
বহুকাল আগের, বাল্যের, সেই সময়টিকে স্মরণ করলাম, যখন আমি নির্বাসিত হয়েছিলাম মরুভূমিতে, আর পেগ-লেগ আমাকে খুঁজে পেয়েছিল। মনে করতে চেষ্টা করলাম ভয় পেয়েছিলাম কিনা, কিন্তু আমার স্মৃতির কোথাও ভয় নামক অনুভূতিটি ধরা পড়ল না। বিপদে পড়েছিলাম সত্যি, কিন্তু জানতাম কীভাবে উদ্ধার পেতে হবে, এবং সে-চেষ্টাই করছিলাম। হয়তো সফলও হতাম শেষপর্যন্ত।
না…না, সফল হতাম না আমি। পেগ-লেগ আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। নইলে মরে পড়ে থাকতাম ওখানেই। পথ ছিল দুস্তর, আর মরুভুমি সম্বন্ধে আমার জ্ঞান সামান্য।
তবু কেন এই পিছুটান? কে ডাকছে আমায়…টাহকুইৎসয়ের সেই বাড়ি…না মরুভূমি নিজেই?
কে যেন আসছে, হঠাৎ বললেন মিস ডায়ানা। সাবধান।
জানালা থেকে সরে এসে দরজার দিকে ঘুরলাম আমি। আস্তে করে পাল্লা খুলে, ছোট্ট একটি ছেলে উঁকি দিল ভেতরে, ওর চোখ ডাগর কালো, মাথায় ঢাউস এক শোনার টুপি। পালা করে মিস ডায়ানা আর আমার ওপর নজর বোলাল সে, তড়িঘড়ি ছোট্ট একটা চিরকুট আমার হাতে গুঁজে দিয়েই সরে পড়ল।
পরিচিত হাতের লেখা, বক্তব্য সংক্ষিপ্ত অথচ প্রাঞ্জল।
আসতে পারবে? তোমাকে আমার দরকার, ভীষণ!
অ্যানাবেল
চিঠিটা মিস ডায়ানার হাতে দিয়ে, দরজার উদ্দেশে এগোলাম আমি।
অ্যানাবেলের বাসা কাছেই। মিনিট কয়েকের ভেতর পৌঁছে যেতে পারব।
.
০৮.
ভয়ার্ত চেহারার এক পরিচারিকা দরজা খুলে দিল আমাকে। ওহ্, সিনর! আসুন! সাবধান!
পথ দেখাল ও, উঠন পেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে উঠলাম আমি, দোরগোড়ায় থামলাম।
দুজন মানুষ রয়েছে ভেতরে। অ্যানাবেল, মুখ আমার দিকে, আর একজন পুরুষ, পেছন ফিরে আছে। ওকে চিনতে অসুবিধে হলো না আমার। র্যাড হুবার।
দুঃখিত, অ্যানাবেল। দেরি হয়ে গেল আসতে। ঘরে ঢুকরলাম আমি, র্যাড ঘুরে আমার মুখোমুখি হলো। আরে র্যাড যে, বিস্ময়ের ভান করলাম। অনেককাল পর দেখছি তোমাকে।
ওজনে আমার চেয়ে কমপক্ষে চল্লিশ পাউন্ড বেশি হবে র্যাঙ, ইঞ্চিখানেক লম্বাও। সমস্ত অবয়বে নিষ্ঠুর শক্তির সদম্ভ প্রকাশ, কিন্তু এর সঙ্গে আরও কী যেন আছে…দুর্বলতারই আভাস বোধহয়।
বেরিয়ে যাও! ইশারায় দরজাটা দেখিয়ে দিয়ে, নিচু কণ্ঠে আদেশ করল ও। সময় থাকতে।
দুঃখিত, র্যাড। অ্যানাবেলের সঙ্গে আমার জরুরি আলাপ আছে। ক্যাপ্টেন লরেলই আসতে বলেছেন আমাকে। তুমি কিছু মনে করবে না তো?
পা ফাঁক করে দাঁড়াল র্যাড। বরাবরই ওর চিন্তা সরলরেখায় চলে, এখনও বদলায়নি। গোলাগুলির আশঙ্কা করছে ও, এবং তাতে আপত্তি নেই এতটুকু। কিন্তু সমস্যা অ্যানাবেলকে নিয়ে, বুলেট সবসময় তার ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছায় না।
বেশ। যা বলবে, বলেই কেটে পড়।
আমি হাসলাম, আমাদের ব্যাপারটা গোপনীয়, র্যাড। তোমার সাথে এর কোন যোগ নেই। তা ছাড়া আমি এখানে আমন্ত্রিত, র্যাড। কিন্তু তুমি?
তোমার নিশ্চয় মনে আছে, গেল কবছরে বেশকিছু ফাঁসি হয়েছে এখানে, তার মধ্যে অন্তত তিনজন মারা পড়েছে মহিলাদের ওপর জোর খাটাতে গিয়ে। এরপর কিন্তু তোমার পালা আসতে পারে।
আমি প্রেম করছি ওর সাথে।
ওকে চলে যেতে বলা হয়েছিল, এই প্রথম মুখ খুলল অ্যানাবেল। বাবা বাড়ি নেই জেনেই আসতে সাহস পেয়েছে ও।
আজ এখানে আমার আসা,মূলত সেজন্যেই। তোমার বাবা, মিথ্যে বলতে শুরু করলাম, আমাকে বলেছিলেন এল মন্টে থেকে দুজন লোক খুঁজে দিতে। বাড়ি পাহারা দেয়ার জন্যে।
তারপর র্যাডের দিকে ঘুরে যোগ করলাম, শিগগিরই এসে পড়বে। তখন তুমি এখানে না থাকলেই ভাল করবে।
আমার উদ্দেশে চোখ পাকাল র্যাড। তোর সাথে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল ও, একদিন ঠিকই মোকাবেলা হবে আমার। শুধু তোর আর আমার মধ্যে।
নিশ্চয় হবে, র্যাড। আমরা দুজনেই জানি এটা….নাকি? আমাদের লড়াইটা চুকে যাক আগে, তারপর আমি হাত দেব অন্য কাজে।
কাজে হাত দিবি? শখ তো মন্দ নয়! আরে, তুই তো মরবি!
ক্ষমাসুন্দর হাসি হাসলাম আমি। না, র্যাড। পিস্তলে তুমি অত চালু নও। তোমার অবশ্যি কৌশল আছে একটা-মারামারি। তুমি অনেক সময় নষ্ট করেছ, র্যাড। অথচ সময়ই হচ্ছে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
বলতে কী, র্যাড হুবারকে আমি কখনও অ্যাকশনে দেখিনি, কিন্তু ও তো আর তা জানে না, আর আমি চাইছিলাম ওর ভেতরে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সংশয় জাগিয়ে তুলতে। যদি বেশিমাত্রায় আত্মসচেতন হয়ে ওঠে র্যাড, ওর রিফ্লেক্স কমে যেতে বাধ্য। হয়তো শঙ্কাল মন থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করবে, তবে সফল হবে না পুরোপুরি, বরং এটা তাড়া করে ফিরবে ওকে। এতে যে আমি লাভবান হবই তা বলছি না, কিন্তু সুযোগ নিতে দোষ কী!
তুই একটা ফালতু, বলল ও। বরাবরই তাই ছিলি।
স্কুলের কথা এরইমধ্যে ভুলে গেলে, র্যাড? নাহ, তোমার স্মরণশক্তি দেখছি ভীষণ দুর্বল!
দরজায় গেল ও, ঘাড় ফেরাল যেন কিছু বলবে, তারপর বেরিয়ে গেল স্পারের ঝুনঝুন তুলে।
অ্যানাবেল এগিয়ে এল আমার কাছে। ওহ, ড্যান! আমি সত্যিই দুঃখিত! আবার ঝামেলায় ফেলে দিলাম তোমাকে। কিন্তু কী করব বল, বিপদের সময় তুমি ছাড়া আর কারও কথা আমার মনে আসেনি।
আমি ছাড়া আর কে আছে? ওর হাত ধরলাম আমি। অন্য কারোকে ডাকলে বরং অখুশিই হতাম। আমি আশা করব, যেকোন সমস্যায় আমাকেই ডাকবে তুমি।
কিন্তু আমার কারণে র্যাডের সাথে ঝগড়া হলো তোমার। আগের বারও সমস্যার মূল ছিলাম আমিই।
এমনিতেও লাগত আমাদের। আমি তোমার সিটে বসার আগেই পাঁয়তারা শুরু করেছিল ও। তুমি শুধু ওকে ছুতোটা জুগিয়েছিলে।
কফি খাবে?
উঠনের তিন পাশে বারান্দা, খিলানের নীচে টেবিল পেতে বসলাম আমরা, সামনেই কৃত্রিম ফোয়ারা।
বাসায় তোমার কখনোই একা থাকা উচিত নয়, পরামর্শ দিলাম আমি। তখন অবশ্যি র্যাডকে ভয় দেখানোর জন্যেই এল মন্টের লোকদের কথা বলেছিলাম, কিন্তু সত্যি সত্যি ওদের কারোকে নিয়োগ করলে ক্ষতি কী? ওরা মানুষ ভাল, তবে কঠিন, কেউই ওদের সাথে গোলমালে জড়াতে চায় না। এখানে ব্যাটাছেলে কেউ একজন থাকা দরকার।
একজন আসছে। কাল এসে পড়বে।
তোমার বাবার পরিচিত কেউ?
একটু দোনোমনো করল অ্যানাবেল। হ্যাঁ, বাবা চেনেন। তাঁর এক বন্ধু পাঠাচ্ছেন ওকে, কোরালের ধারে যে-কেবিনটা রয়েছে সেখানে থাকবে।
তোমার বাবা যখন ফিরবেন, তার সাথে আবার আমার কথা বলার ইচ্ছে আছে। আমার আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে তিনি মনে হয় আমার চেয়ে বেশি জানেন।
ইতস্তত করল অ্যানাবেল, তারপর বলল, তোমাকে নিয়ে বাবার খুব চিন্তা।
হ্যাঁ, তিনি সেরকম কিছুই বোঝাতে চাইছিলেন সেদিন। তার ধারণা অপ্রত্যাশিত আঘাত আসতে পারে আমার ওপর।
চুপ করে রইল অ্যানাবেল; খানিক পর যোগ করল, বাবার প্রায়ই হয় এরকম: যেখানে হওয়া উচিত নয়, সেখানেই বিপদের আশঙ্কা করেন।
হতে পারে। তবে আমার মনে হয়েছে যেসব কথা আমি জানি না সেগুলোও জানেন তিনি। যেমন জাহাজের ঘটনাটা, ডন ফেডেরিকো অপর ছেলেটাকে খুন করার চেষ্টা করেছিলেন।
বাবা এরকম বহু ঘটনার কথাই জানেন। আমার ধারণা ওদের মধ্যে নিশ্চয় ঝগড়া ছিল কোন ব্যাপারে, তাই রাগের বশে ডন ফেডেরিকো ছুরি বের করেছিলেন।
আমি ভাবছি অপর ছেলেটার কী হলো? ডন ফেডেরিকো তো এখানেই আছেন।
বাবার সন্দেহ ও মারা গেছে। তোমার আন্ট এলেনাকে একবার জিজ্ঞেস করতেও চেয়েছিলেন।
উনি জানেন?
জানলে একমাত্র টিয়া এলেনাই।
আন্ট এলেনার সাথে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা নেই, তবে তাকে আমার ভাল লাগে।
আমারও। প্রায়ই আসেন আমাদের বাসায়। একটুক্ষণ নীরব থাকার পর, অ্যানাবেল যোগ করল, এবং ডন ফেডেরিকোও।
কী? চমকে উঠলাম আমি।
এক ফ্যানডাংগোতে পরিচয় হয়েছে আমাদের। চমৎকার নাচেন।
অযৌক্তিকই, হয়তোবা, নিজেকে আমার প্রবঞ্চিত মনে হলো। গরম কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেললাম আমি। মনে মনে, তিরস্কার করলাম নিজেকে। বাধা দেয়ার আমি কে? যার সঙ্গে খুশি দেখা করতে পারে ও। কিন্তু ভাবলাম আমি, কবে থেকে ফেডেরিকোর যাতায়াত শুরু হয়েছে এ-বাসায়? নিশ্চয় ওর বাবা বিদেশ যাওয়ার পর।
চাইলেই আসর জমাতে পারেন ভদ্রলোক, বলল অ্যানাবেল। তোমার দাদুর ভালমন্দের কথা বেশ ভাবেন দেখলাম।
সেই ছোটবেলায় একবার দেখেছিলাম। তেমন একটা জানি না, ফেডেরিকোকে।
স্বাভাবিক। এখন তার বয়েস হয়েছে, তবু অনেক বিষয়েই মতের মিল আছে আমাদের।
সবিস্ময়ে, প্রতিবাদ করে উঠলাম আমি, তুমি নিশ্চয় কে বিয়ে করার কথা ভাবছ না?
সকৌতুকে হাসল অ্যানাবেল। আমার বিশ্বার্স ফেডেরিকোর তাই ইচ্ছে।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে রইলাম আমি, তারপর বললাম, আমার কণ্ঠস্বর তখন বদলে গেছে, ডন ফেডেরিকো আমার শত্রু। আমি যখন ছোট ছিলাম, আমাকে তিনি খুন করার চেষ্টা করেছিলেন।
তুমি নিশ্চিত, ফেডেরিকোই সেই লোক? বহুকাল আগের ঘটনা ওটা, আর তা ছাড়া তুমিও তখন খুব ছোট ছিলে।
তাকে আমার মনে আছে।
নিশ্চয় ভুল করছ তুমি। একবার তোমার কথা তাঁকে বলেছিলাম আমি, কিন্তু উনি তোমাকে চেনেন বলে মনে হলো না। বললেন, অ্যাংলোদের সাথে তার খুব একটা জানাশোনা নেই।
সহসাই, ওখান থেকে চলে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করলাম আমি। অথচ ওখানেই সর্বক্ষণ, পড়ে থাকে আমার মন। অ্যানাবেলকে ছাড়া আর কারোকে। ভালবাসার চিন্তা কখনও ভুল করেও করিনি আমি। তারপর সখেদে ভাবলাম, ঠিকই তো, এসব ব্যাপারে কতটুকুই-বা আমার অভিজ্ঞতা। নারীর মন সম্পর্কে কী বুঝি আমি?
দারুণ ঘোড়াসওয়ার ভন ফেডেরিকো, বলছিল অ্যানাবেল, এরকম সুদর্শন পুরুষ আমি খুব কম দেখেছি।
আড্ডার আনন্দটাই মাটি হয়ে গেছে। ফোয়ারা থেকে এখনও উৎসারিত হচ্ছে পানি, গাছের পাতায় রয়েছে মর্মর, কিন্তু আমার শত্রু এসেছিল এখানে। হয়তো ঠিক এ-জায়গাই বসেছিল যেখানে এখন আমি বসে আছি।
উঠে পড়লাম। আমাকে এবার যেতে হয়।
গাছে পানি দিচ্ছিল অ্যানাবেল, সচকিত হয়ে ঘাড় ফেরাল। না গেলেই নয়? এই তো এলে।
র্যাঞ্চে ফিরতে হবে। কাজ আছে।
অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে আমার মুখে কী যেন খুঁজল ও, কিন্তু আমি নিলিপ্ত থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম। ও কাকে সঙ্গ দেবে না, দেবে সে-ব্যাপারে আমি আপত্তি করার কে?
তোমার সেই স্ট্যালিয়নের খবর কী? চড়েছ?
এখনও নয়।
পরিবেশ থেকে কী যেন বিদায় নিয়েছে। আমার মত অ্যানাবেলও এখন উপলব্ধি করতে পারছে সেটা। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা, পরস্পরের মুখোমুখি, দুজনেই বলতে চাইছি কিছু কিন্তু উপযুক্ত ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
তবে একটি কথা সত্যি, আমার স্বপ্ন সার্থক হয়েছে–এভাবে অ্যানাবেলকে একাকী কাছে পেয়ে। কিন্তু বাস্তব রূঢ়, আমার মন ভেঙে দিয়েছে। ঝট করে ঘুরে, দরজার দিকে হাঁটা দিলাম আমি।
ড্যানিয়েল? ড্যান?
সদর দরজার কাছে গিয়ে আমি থামলাম, ব্যাপারটা আমার কাছে কতখানি কষ্টের তুমি জান না, বললাম। আমার দাদু আর তোমার ডন ফেডেরিকোই সব নষ্টের মূল। তারাই আমার বাবা-মাকে মরুভূমি পর্যন্ত তাড়া করেছিলেন। শিকারী যেভাবে শিকার খোঁজে তেমনিভাবে খোঁজ করেছিলেন তাদের-খুন করার জন্যে। এবং শেষপর্যন্ত বাবাকে ধরেওছিলেন-আর এর পরের ঘটনা তুমি জানই।
কিন্তু সেজন্যে দায়ী তোমার দাদু!
ডন ফেডেরিকোও ছিলেন সেখানে। আমাকে ওখানেই মেরে ফেলার জন্যে উস্কানি দিয়েছিলেন দাদুকে।
অসম্ভব। আমি বিশ্বাস করি না। তিনি কেমন মানুষ আমি জানি।
জানবেই তো। সুদর্শন, ভাল নাচেন।
তার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।
আমাকে যেতে হয়।
আবার আসবে তো?
আমাকে যদি তোমার প্রয়োজন হয়, আসব। নইলে… দ্বিধা করলাম আমি, তারপর বললাম, নয়। ফেডেরিকোর সঙ্গে এখানে যদি আমার দেখা হয়ে যায় তখন?
তোমার কাছে ভদ্রলোকের মত ব্যবহার আশা করব। আমি জানি তিনিও তাই করবেন।
তা, একজন ভদ্রলোক তার সম্ভাব্য আততায়ীর সাথে কি রকম ব্যবহার করেন জানতে পারি?
বলেইছি তো, আমি বিশ্বাস করি না এই অভিযোগ। তুমি লোক চিনতে ভুল করছ।
তুমি জান, কেমন হয় খুনীর চেহারা? বাইরেরটাই মানুষের আসল রূপ নয়, অ্যানাবেল।
তবু, আমি অন্তত টের পেতাম।
সন্দেহ নেই, তুমি সবজান্তা। কামনা করি এই ক্ষমতাটা যেন সবসময় তোমার উপকারে আসে।
স্যাডলে উঠে অনড় হয়ে রইলাম একমুহূর্ত। অ্যানাবেল দরজায়, দেখছে আমাকে। কিন্তু ফেডেরিকো এসেছিলেন ওখানে। নিশ্চয় আবারও আসবেন। ওর বাবা পছন্দ করবেন না ব্যাপারটা, কিন্তু তিনি এখন সুদূর চীনের পথে। চলে এলাম আমি, একটিবারও তাকালাম না পেছনে।
আমার দিনটাই মাটি হয়ে গেছে, সুন্দর একটা দিন। এ-জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। আরও মারাত্মক কিছুর জন্যে ছিলাম সত্যি, কিন্তু এ-জন্যে নয়। কীভাবে প্রেম করতে হয় আমি জানি না, কিন্তু ভেবেছিলাম, বিশ্বাস করেছিলাম, আমার এই অনুভূতিরই অপর নাম ভালবাসা এই যে অ্যানাবেলকে আমার চাওয়া, আমার স্বপ্ন, অথচ এখন…।
তবু ওর স্বপ্ন দেখে যাব আমি। ফিরে তাকাবার মত আর কারও দেখা পাইনি বলে। আর কারোকে এত আপন করে চাইনি আমি, অথচ…
ডন ফেডেরিকো…
পাহাড়ের দিকে চলে গেল আমার চোখ, লস এঞ্জেলেসের সমভূমিতে থাকলে সবসময়ই যা যায়। ওই পাহাড়ের কাছেই চলে যাব আমি। হারিয়ে যাব ওদের মাঝে। মরুভূমির কাছে ফিরে যাব। অ্যানাবেল থাক তার ডন ফেডেরিকোকে নিয়ে। আর ডন ফেডেরিকো…
তিক্ত সুরে অভিশাপ দিলাম নিজের ভাগ্যকে।
তারপর সহসা উপলব্ধি করলাম বৈজায় জোরে ছুটছি আমি, খাটিয়ে মারছি আমার মেয়ারকে। মহুর করলাম গতি। নিয়তির ওপর রাগ করে ভাল একটা ঘোড়াকে মেরে ফেলার কোন অর্থ হয় না। আচ্ছা, কেমনতর লোক আমি? নিজেকে আমি সরল, সাহসী বলে জানতাম। দৃঢ়চিত্তের মানুষ মনে করেছিলাম, অথচ সেই আমিই কিনা ভেঙে পড়েছি তুচ্ছ এক নারীর কয়েকটি কথায়!
এবার হাঁটার পর্যায়ে নামিয়ে আনলাম চলার বেগ, তাকালাম চারপাশে। প্রাচীন ইন্ডিয়ান ট্রেইলের ওপর আলকাতরার যে-খনি রয়েছে তার কাছাকাছি চলে এসেছি এখন।
দূরে ধুলো দেখা যাচ্ছে, ধুলোর একটা মেঘ এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
আমার রাইফেল স্ক্যাবার্ডে, তবে পিস্তল রয়েছে, কোমরে, তা ছাড়া আজ আমি তৈরি।
অচিরেই মন্টেকে চোখে পড়ল, সাথে আরেকজন, এল মন্টে র্যাথের রাইডার। আমাকে দেখতে পেয়ে রাশ টানল ওরা।
ড্যান! চেঁচিয়ে উঠল মন্টে। তোমার খোঁজেই আসছিলাম। ও নেই, পালিয়েছে।
কী ব্যাপার? কে পালিয়েছে?
র্যাঞ্চে হামলা হয়েছিল। আমরা হটিয়ে দিয়েছি। আর পালিয়েছে, একটু থেমে বলল মন্টে, তোমার স্ট্যালিয়ন। ওকে চুরি করার চেষ্টা করছিল একজন, লোকটাকে খুন করে পাহাড়ে পালিয়ে গেছে ওটা।
.
০৯.
আমার ঘোড়া নেই! অমন সুন্দর একটা ব্ল্যাক স্ট্যালিয়ন হাতছাড়া হয়ে গেছে! অবশ্যি, ও-ও ঠিক এমনি সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিল এতদিন। বুনো দুর্গম দেশই বোধহয় ওর উপযুক্ত। তবু, ঘোড়াটার, অভাব আমি বোধ করলাম। কারণ আমার বিশ্বাস, পরস্পরকে বুঝতে পেরেছিলাম আমরা।
বরাবরই আমার বিশ্বাস, কোন না কোন সময়ে ওই ঘোড়াটা পোষা জীব ছিল কারও। কোন কোন ব্যাপারে ওকে আমি ত্বরিতে সাড়া দিতে দেখেছি।
যাইহোক, প্রথমে আমাকে র্যাঞ্চে ফিরে গিয়ে জানতে হবে ঠিক কী ঘটেছে, তারপর বিহিত-ব্যবস্থা। কতগুলো ঘোড়া পালিয়েছে? কতক্ষণ আগে হয়েছিল হামলা? কজন হানাদার এসেছিল? কেবলমাত্র এসব জানার পরই লোকজন নিয়ে মাঠে নামতে পারব আমরা।
কমপক্ষে চল্লিশটা ঘোড়া খোয়া গেছে। টোমাস ম্যাচাডো, আমাদের র্যাঞ্চের এক কর্মচারী থামাল আমাকে। স্ট্যালিয়ন? না, ও নেই ওগুলোর মধ্যে। স্ট্যালিয়নটা পালিয়েছে। সাথে আরও দু-তিনটে মেয়রকে জুটিয়ে নিয়ে পাহাড়ে ফিরে গেছে।
বুশ আর কেলসো আছে এখানে, বলল মন্টে। তুমি আমার একটু আগে এসেছে ওরা আমরা কি পিছু নেব?
তা নয়তো কী?
অ্যামবুশ করার চেষ্টা করবে, শেরিফ বার্টনকে যেমন করেছিল, আমার মতামত জানার পর নিজে অভিমত প্রকাশ করল বুশ। এরা ভয়ঙ্কর লোক। সম্ভবত পাঞ্চো ড্যানিয়েলের দলের
সাবধান থাকব আমরা। ফের মাথায় টুপি চাপলাম আমি। আমি একাই যেতে পারব। লোক যত কম হয় ততই ভাল। অ্যামবুশ এড়ানো সম্ভব হবে।
আমরা কিন্তু অ্যাকশনের আশায় এল মন্টে থেকে ছুটে এসেছি, বলল ওয়েন হার্ডিন। তুমি বাদ দিতে চাইছ আমাদের?
হার্ডিন বেঁটে গড়নের মানুষ, চওড়া বুকের ছাতি, মোটা ঘাড়। মাত্র বাইশ বছর বয়েসেই টাক পড়তে শুরু করেছে ওর মাথায়। মন্টে বলল আমরা কিছু অ্যাকশন দেখতে পাব। আর তুমি কিনা এখন একাই সব সেরে ফেলতে চাইছ।
ঠিক আছে, এসো তবে। কেলসো, বললাম আমি, আমি চাই তুমি থাক। মিস ডায়ানার প্রয়োজন হবে তোমাকে। তা ছাড়া কদ্দিন বাইরে থাকতে হয় আমাদের তারও কোন নিশ্চয়তা নেই।
তবু কদ্দিন লাগতে পারে বলে তোমার ধারণা?
ঘোড়া উদ্ধার করতে যতদিন লাগে?
সেজন্যে তোমাকে সনোরা অবধি যেতে হতে পারে।
ভালই হবে তা হলে। আজও সনোরা দেখা হয়নি আমার। চিয়াহুয়াহুয়াও নয়।
এখানে কেউ আমার পথ চেয়ে বসে নেই, বলল মায়রন ব্রডি। আর আমিও কখনও যাইনি সনোরায়। তবে, যোগ করল ব্রডি, চিয়াহুয়াহুয়ায় গেছি একবার।
জায়গাটা চেন তুমি? জিজ্ঞেস করল বুশ।
একগাল হাসল ও। খুব ভাল নয়। রাতেই পথ চলেছি বেশি।
তা হলে কাল ভোরেই, বললাম আমি, বেলা ওঠার আগে রওনা হব আমরা।
.
র্যাঞ্চ-হাউসের লিভিং রুমের একখানা চেয়ারে বসে রয়েছি আমি। খানিক আগে কফি দিয়ে গেছে এলফেগো। গোটা দুয়েক চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখলাম কাপ, চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে চোখ বুজলাম।
ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না আমার। সীমান্তবর্তী কোন র্যাঞ্চে হানা দেয়া আজ নতুন কোন ঘটনা নয়। কিন্তু মাত্র অল্প কিছুদিন আগেই, আমাদের ঘোড়াগুলো যখন পাহাড়তলিতে ছিল তখন একবার চেষ্টা হয়েছিল ওগুলো ছিনিয়ে নেয়ার। সেসময় জনাকয়েক হানাদার মারা পড়েছিল আমার গুলিতে। আর আমার খুটকা এখানেই, এত তাড়াতাড়ি সংঘবদ্ধ হয়ে আবার হামলা চালাবে ওরা এটা মোটেও আশা করিনি আমি। ভেবেছিলাম গেল ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেবে দুর্বৃত্তরা। তবু হামলা হয়েছে, এবং খোয়া গেছে বেশকিছু ঘোড়া। এ থেকে কী ধরে নেব আমি?
নিশ্চয় কোন কিন্তু আছে এর ভেতরে। আমার মন খুঁতখুত করছে। আমাদের কাছেপিঠে এমন অন্তত ডজনখানেক ঘোড়ার পাল রয়েছে যেগুলো অতিসহজে ছিনতাই করা যেত। তবু আমাদের র্যাঞ্চেই হামলা হলো কেন…এবং এত স্বল্পসময়ের ব্যবধানে?
লিভিং রুমের পরিবেশ শান্ত, মনোরম। অ্যানাবেলের দিকে ধাবিত হলো আমার চিন্তা, এবং কুঁকড়ে গেলাম আমি। ও প্রবঞ্চনা করেনি আমাকে। নিজের ভালমন্দ বোঝার বয়েস ওর হয়েছে, কাজেই যা ওর খুশি তা-ই করতে পারে। ডন ফেডেরিকো যে সুদর্শন আর আকর্ষণীয় মানুষ তাতে কোন ভুল নেই। তিনি আমার শত্রু বলে যে ওরও শক্র হবেন এমন ভাবাটাই আমার অন্যায়। আসলে আমিই একটা বোকার হদ্দ।
তবু, ভাবনাটা বিচলিত করল আমাকে, চোখ মেলে আমি সিলিং পানে তাকালাম, বর্তমান সমস্যার দিকে ফেরাতে সচেষ্ট হালাম নিজের চিন্তাকে। কফিতে চুমুক দিলাম। আচ্ছা, ধরা যাক…?
না, এমনটি না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। তবু, হিসেবের মধ্যে রাখতে হবে একে…এমনও তো হতে পারে, আমাকে খুন করার মতলবেই চুরি করা হয়েছে। ঘোড়াগুলো? আমাকে ফাঁদে ফেলতে, যেমনটি বার্টনকেও ফেলা হয়েছিল।
গত হামলায় যারা নিহত হয়েছিল তাদের বন্ধুবান্ধব? নাকি ডন রোগেরো? অথবা ডন ফেডেরিকো নিজেই? এমন কী হতে পারে না, অ্যানাবেলের কাছে আমার নাম শুনে ওই মঞ্চটি থেকেও আমাকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি?
আমার ব্যক্তিগত সমস্যা আমার দৃষ্টি আচ্ছন্ন করছে না তো? ব্যাপারটা তো মামুলি একটা ঘোড়া চুরির ঘটনাও হয়ে থাকতে পারে।
যাক, সেভাবেই এগোব আমি, তবে একই সঙ্গে শেরিফ বার্টনকে অ্যামবুশ করার ঘটনাটাও মনে রাখব, এবং হুঁশিয়ার থাকব।
.
ভোরে আমরা যখন রওনা হালাম আকাশে তারা আছে তখনও, উপকূলে ভেড়ানো জাহাজের অ্যাংকর লাইটের মত মিটমিট করে জ্বলছিল।
ওরা ওত পেতে থাকরে, বললাম আমি। নিছক ঘোড়া চুরিই ওদের লক্ষ্য নয়। আশপাশে আরও অনেক র্যাঞ্চ আছে যেখানে গেলে অল্প ঝুঁকিতে আরও বেশি ঘোড়া ছিনতাই করতে পারত। তোমরা বোধহয় আমাকে একা যেতে দিলেই ভাল করতে।
তুমি পাগল নাকি?
ওদের লক্ষ্য-আমি। কিন্তু ওই অঞ্চল ওদের চাইতে আমার বেশি চেনা, আমি কাউইয়াদের মাঝে বড় হয়েছি। আমি ঠিকই ওদেরকে খুঁজে বের করে ঘোড়া ফিরিয়ে আনতে পারব।
আমরা অ্যাকশনের আশায় এসেছি, আবার বলল হার্ডিন, অ্যাকশন না দেখে ফিরছি না।
ধন্যবাদ। আন্তরিক গলায় বললাম, যদিও একা যেতে পারলেই খুশি হতাম আমি। কারণ সেক্ষেত্রে কেবল নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হত আমাকে।
সরু পাহাড়ি একটা ট্রেইল ধরে আমরা যখন স্যান ফার্নান্দো ভ্যালিতে হাজির হালাম তখন বেলা উঠে গেছে। জংলা ঘাসের প্রতাপ বেশি এই উপত্যকায়, অল্পকিছু, প্রিকলি পিয়ারও রয়েছে। এখানে-সেখানে চরছে গুটিকতক গরুবাছুর। একটু তফাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্যান ফার্নান্দো মিশন।
এতক্ষণ পথ চলতে কোনরকম অসুবিধে হয়নি আমাদের। পরিষ্কার ট্র্যাক দেখতে পেয়েছি হানাদারদের। তবে আমরা যা বুঝতে পারিনি, তা হলো, ফাঁদটা ওরা পাতবে কোথায়।
জোরকদমে এগিয়েছে দুবৃত্তরা, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে।
আমার মনে হয় ফাঁদ পাতার জায়গাও ঠিক করে রেখেছে লোকগুলো, বলল জর্জ।
ওরা আমাদের চেয়ে পুরো একদিনের পথ এগিয়ে রয়েছে, যোগ করল মন্টে।
নাগাড়ে এগোলাম আমরা, দুপুরে খানিক বিশ্রাম নিয়ে যাত্রা করলাম ফের এই ট্রেইলটা তেমন ব্যবহৃত হয় না, প্রতিটা চড়াইয়ের মাথা থেকে সামনের ট্র্যাক চোখে পড়ছে।
সন্ধ্যার মুখে ক্যাম্প করার জন্যে আদর্শ একটা জায়গার হদিস পেলাম আমরা। পাহাড় থেকে ওক আর উইলো ঝাড়ের মাঝ দিয়ে ক্ষীণ জলধারা নেমে এসেছে, ঘোড়ার জন্যে ঘাসও রয়েছে যথেষ্ট।
নিজের ঘোড়া বেঁধে রেখে, ক্যাম্পফায়ারের ধারে এসে বসল মায়রন ব্রডি। ওপাশের ওই বড় পাথরাইয়ের পাশে ট্র্যাকগুলো দেখেছ?
সঙ্গী পেয়েছে ওরা।
আরও দুজন বলল ব্রডি। তারমানে আমরা কখন রওনা হচ্ছি তা জানতে শহরের লোক রাখা হয়েছিল। সব মিলিয়ে ওদের দলে এখন জনাবারো হবে।
বোধ হয়।
কিন্তু আমরা পাঁচজন, একটা ভুরু তেরছা করল মন্টে।
প্রায় ফুটে উঠেছে কফি। কেতলির নীচে আরও কিছু কাঠ গুঁজে দিয়ে ওর দিকে তাকালাম আমি। তোমার যে-রকম বড়গলা, তাতে আমার বিশ্বাস কমপক্ষে দুজনকে তুমি একাই সামলাতে পারবে। আর এল মন্টের রাইডাররা
পাঁচজনই কাফি, দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করল হার্ডিন। আমি সবাইকে বলে দিয়েছি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে। এক-এক করে হজম করব ব্যাটাদের।
আমাদের পেছনেই ওক ঝাড়, মাটিতে পড়ে রয়েছে অসংখ্য ডাল-পালা। সুতরাং ওই পথে চুপিসারে আসা সম্ভবপর হবে না কারও পক্ষে। ওক গাছগুলোকে পেছনে রেখে ঝরনার সামনে গুটিকতক বোল্ডারের মাঝে শুয়ে পড়লাম আমি।
অন্যরা ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে, কাজেই রাতে যদি হামলা হয়ও, আমাদেরকে একসঙ্গে কাবু করতে পারবে না তস্কররা। প্রত্যেকেই নিজের পছন্দানুযায়ী শোবার জায়গা বেছে নিয়েছে, আগুন থেকে তফাতে।
আমার ঘুম পায়নি, বলল ব্রডি। কাজেই তোমরা বরং এইবেলা ঘুমিয়ে নাও। আমি ঘণ্টা দুয়েক, চাই কী চার ঘণ্টাও জাগতে পারব।
মন্টে নিজের বিছানা পাততে পাততে বলল, তোমার কথাই ঠিক, ড্যান। ওদের লক্ষ্য ঘোড়া নয়-তুমি। তোমাকে ওরা খুন করতে চায়।
সেজন্যেই ট্র্যাক লুকানোর চেষ্টা করেনি, বললাম আমি, যাতে আমরা ওদের ফাঁদে গিয়ে পা দিই। আমার ধারণা সকাল-সকাল বিছানায় যাবে ওরা, অন্ধকার থাকতেই ক্যাম্প ছেড়ে কাছেপিঠে কোথাও গিয়ে ওত পাতবে আমাদের জন্যে।
আগে থাকতে মনের ভেতর কোন ধারণা, পুষে রাখা ভাল নয়, উপদেশ দিল জর্জ। আমরা সতর্ক থাকব, পরিস্থিতি বুঝে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।
ওর কথা ঠিক, সন্দেহ নেই, কিন্তু আমি চেষ্টা করছিলাম ওদের পরিকল্পনা কী হতে পারে তা আগাম বুঝতে।
এখন থেকে অত্যন্ত সতর্ক হয়ে এগোতে হবে আমাদের। যেকোন জায়গায় অ্যামবুশ হতে পারে। সাধারণত প্রতি রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে, পরদিন কী ঘটতে পারে সে-ব্যাপারে আঁচ-অনুমানের চেষ্ট করে থাকি আমি, কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা অচল। বুশের বক্তব্যই যথার্থ, ছকবাঁধা নয়, আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে অপ্রত্যাশিত আঘাত মোকাবেলার জন্যে।
.
জর্জ পাশাপাশি হলো আমার। কয়েক ঘণ্টা হলো স্যাডলে রয়েছি আমরা, হঠাৎ করেই বায়ে পাহাড়ের ভেতর হারিয়ে গেল ট্র্যাকগুলো বছর কয়েক আগে আমি একবার গেছি এ-পথে। কিছুদূর সামনে ছোট উপত্যকা রয়েছে একটা, চারদিক পাহাড়ে ঘেরা, না জানা থাকলে বোঝারই উপায় নেই কোন উপত্যকা থাকতে পারে ওখানে।
ছোট মানে কতটা ছোট?
এই তিন-চার হাজার একরমত হবে। গোটা দুয়েক ঝরনা আছে। চোরাই গরুরাছুর লুকিয়ে রাখার জন্যে আদর্শ স্থান।
তোমার ধারণা ওখানেই যাচ্ছে ওরা?
ধারণা কী, আমি বাজি রাখতে পারি।
ট্রেইল থেকে সরে ওক বনে ঢুকরলাম আমরা। ভীষণ গরম পড়েছে। ব্যান্ডানার সাহায্যে মুখ আর ঘাড় মুছলাম, প্রখর রৌদ্রকিরণে আমার চোখ সংকুচিত। বুশের সাথে কথা বলার সময়ে পেছন ফিরতে কষ্ট হচ্ছে, গরমে তেতে রয়েছে ক্যাল, ছোঁয়া যাচ্ছে না।
এই ট্রেইল নিয়মিত ব্যবহার হয়, বললাম আমি, তবে ওরা এ-পথে যায়নি।
ওদিকে র্যাঞ্চ আছে একটা। ওই র্যাঞ্চের কাছাকাছি দুর্বৃত্তরা যাবে না। নিজের ঘোড়াকে আরেকটু ছায়ায় সরিয়ে নিয়ে গেল জর্জ। ওরা উপত্যকায়ই যাচ্ছে।
গাঢ় ছায়ামত একটা জায়গা দেখাল ও, যেখানে ঘন হয়ে জন্মেছে বেশ কয়েকটা ওক।চল, ওখানে গিয়ে একটু জিরিয়ে নেয়া যাক। ভয়ঙ্কর গরম।
ঘোড়া হাঁটিয়ে নিয়ে এগোলাম আমরা, মাঝেসাঝে নিচু ডালপালা এড়াতে নিচু করছি মাথা। ইতিউতি ছায়া পড়েছে গাঢ় হয়ে, পাহাড় থেকে হাওয়া বইছে মৃদু। ঘামে ভিজে সপসপ আমাদের শার্ট, বাতাসের ছোঁয়া লাগলে শীত করছে।
স্যাডল থেকে নামলাম আমরা, ওয়েন হার্ডিন রাইফেল হাতে ছায়ার শেষমাথায় চলে গেল, ট্রেইলের ওপর নজর রাখতে উবু হয়ে বসল গাছের নীচে। নিজেদের অবস্থা বোঝার জন্যে প্রত্যেকেই সময় ব্যয় করলাম আমরা। এখন যেখানে রয়েছি। সেখানে আড়াল নেই কোন, শুধু গুটিকতক মরা গাছের গুড়ি ছাড়া
আমরা ধীরেসুস্থে এগোব, প্রস্তাব দিলাম আমি। অযথা ঝুঁকি নেয়ার কোন মানে হয় না। আমার ধারণা, এ-মুহূর্তে ওরাও নিশ্চয় কোথাও না কোথাও বিশ্রাম নিচ্ছে।
পাতলা ঘাসের বিছানায় টানটান হয়ে গেল মন্টে, চোখের ওপর হ্যাট টেনে দিল। ক্যান্টিনের ছিপি খুলে এক ঢোক ঠাণ্ডা পানি খেলাম আমি। জিভে সুস্বাদু ঠেকল।
সূর্যাস্তের পর, বললাম, রওনা দেব আবার। এখন বিশ্রাম। তারপর ব্রডির দিকে ফিরে বললাম, ঘণ্টাখানেক পর তুমি হার্ডিনকে রেহাই দিতে পারবে না?
নিশ্চয়ই পারব।
বিশাল ওক কাণ্ডে মাথা ঠেকিয়ে চোখ মুদলাম আমি, মনেপ্রাণে চাইলাম আমার ভেজা শার্টের ভেতর দিয়ে যেন আরেক দফা বাতাস বয়ে যায়।
কাছেই ছিল বুশ। কী ভাবছ, মরুভূমিতে ফিরে যাবে কিনা? জিজ্ঞেস করল সে।
হ্যাঁ। জায়গাটা আমার পছন্দ, জর্জ। আর তা ছাড়া, আমাকে ধরে রাখতে পারে এরকম কিছু তো নেই লস এঞ্জেলেসে।
কিছুই কী নেই? চকিতে আমার দিকে তাকাল ও।
আবার অ্যানাবেলের কথা ভাবলাম আমি। না, জর্জ, নেই। আমি মরুভূমিতেই ফিরে যাচ্ছি। কী লাভ বল, অনর্থক হানাহানি করে!
.
১০.
যতদূর মনে পড়ে আন্ট এলেনার, বরাবর খুব ভোরে শয্যাত্যাগ করে আসছেন তিনি। তার ধারণা এই অভ্যাসটি তিনি তার বাবার সূত্রে পেয়েছেন। যদিও জমিদার ছিলেন ভদ্রলোক, স্পেন আর মরক্কো দুজায়গাতেই ছিল বিশাল এস্টেট, তবু রোজ ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ঘোড়ায় চেপে হাওয়া খেতে না বেরোলে তার চলত না। ছোটবেলায় এলেনা প্রায়শ এসময়ে সঙ্গী হতেন বাবার।
সকালের নাস্তায় স্বল্পাহার করেন এলেনা। বহুদিনের অভ্যাস, ই এক কাপ চা আর একটা টর্নিয়া আর একখণ্ড ফল মুখে দেন।
এলেনার দায়িত্ব ডন রোমেরোর সংসারের তদারকি, যদিও ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর তেমন বনিবনা কোনকালেই নেই। মিস ডায়ানা যেভাবে বলে দিয়েছেন সেভাবে প্রতি শনিবার সকালে নিজের অ্যাকাউন্ট চেক করেন এলেনা। কোথায় খাচ্ছেন টাকা তার খুঁটিনাটি বিবরণ লিখে রাখেন ছোট্ট একটা খাতায়, এবং এরই অন্য পৃষ্ঠায় থাকে ভবিষ্যতে কোন কোন ব্যবসায় বিনিয়োগ করা চলে তার তালিকা। নিয়মটা মিস ডায়ানার কাছ থেকেই শিখেছেন তিনি, তবে এখন নিজস্ব পদ্ধতিতে চলেন। নিজেই। নিজের পরিকল্পনা তৈরি করেন। ফলে তার সামান্য পুঁজি বিনিয়োগই ক্রমশ ফুলে ফেঁপে উঠছে।
যদিও নিয়মিত গির্জায় যান, তবু নিজেকে ধার্মিক মহিলা বলে মনে করেন না। এলেনা। গির্জার শান্ত-সমাহিত পরিবেশ, পাদ্রির ভরাট কণ্ঠস্বর আর কাপড়চোপড়ে খসখস শব্দ তার ভাল লাগে।
প্রায়ই যানজার পাড় ধরে নয়তো ওকগাছের ছায়ায় হাঁটতে বেরোন তিনি। বলতে কী, ওইসব মুহূর্তের নিঃসঙ্গতাকে উপভোগ করেন এলেনা। এসময়ে কখনও-সখনও একজন তরুণ পাদ্রিকেও দেখা যায় তার সাথে, পাদ্রির নাম ফাদার জেইমি। এলেনার ধারণা তাঁদের দুজনার মানসিকতায় মিল রয়েছে। এই মিল থাকার ব্যাপারটি এতদিন কেবল শুনেই এসেছিলেন তিনি, ফাদার জেইমির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রয়োগ করতে পারেননি কারও বেলায়।
আজ সকালে অবশ্যি একাই হেঁটেছেন এলেন, বাসায় ফিরে ঠিক করলেন আরেক কাপ চা খাবেন। সবে বসেছেন টেবিলে এইসময়ে স্পারের ঝুনঝুন আওয়াজ এল তাঁর কানে। মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল টিপট-ধরা হাত, চোখেমুখে বিরক্তির ছোঁয়া লাগল। ওই পদশব্দ তিনি চেনেন, ওর প্রতিটি পদক্ষেপে ফুটে উঠেছে সীমাহীন ঔদ্ধত্য।
অচিরেই দোরগোড়ায় দেখা গেল ডন ফেডেরিকোকে, পরনে রাইডিং ড্রেস। আঃ, টিয়া! সকাল-সকাল উঠেছ যে?
সবসময়ই উঠি।
আমি জানতাম না।
স্বাভাবিক।
কড়া চোখে তাকালেন ফেডেরিকো, কিন্তু এলেনা তখন চায়ের পট নামিয়ে রাখছেন। অতিথিকে আমন্ত্রণ জানালেন না টেবিলে।
শিগগিরই এবার চুকে যাবে সব,সন্তোষের সুর বাজল ফেডেরিকোর কণ্ঠে।
সত্যিই কি কোনকিছু চুকে যায় কখনও শেষ হয়? কোনই প্রতিক্রিয়া কি থাকে?
কাঁধ ঝাঁকালেন ফেডেরিকো। ড্যান ও’হারা কিছু চোরাই ঘোড়া উদ্ধার করতে মরুভূমিতে গেছে। তার চোখ এলেনার ওপর। ও আর ফিরবে না। মুছে যাবে
চায়ে চুমুক দিলেন এলেনা। তাই?
এবার একেবারে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা।
ডন রোমেরোর সাথে আলাপ করেছ এ-ব্যাপারে তিনিও কি জড়িত?
বাতাসে, হাত ঝাড়া দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলেন ফেডেরিকো। উনি বুড়ো হয়ে গেছেন! বড় ধীর! কিন্তু আমাদের পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব না। আমার তো মনে হয় দুর্বল হয়ে পড়েছেন রোমেরো, কাজের চেয়েতার ভাবনা বেশি। অবশ্যি কিছু আসে যায় না এতে। আমি বাজিমাত করে দিয়েছি।
তুমি বোধহয় একটু বেশি অনুমানের ওপর চল, ফেডেরিকো। ডন রোমেরো: তাকে না জানিয়ে কেউ কিছু করুক এটা চান না।
উনি কেবল টালবাহানা করেন। তা ছাড়া, আমি তো তার ইচ্ছারই বাস্তবায়ন করেছি। কী মনে করেছিলে তুমি, এই…এই…নরকের কীটটা বেঁচে থাকতে আমি চুপচাপ বসে থাকব দর্শকের ভূমিকায়?
এবার আচমকা এলেনাকে আক্রমণ করলেন ফেডেরিকো। তুমি কিন্তু আমাকে কখনোই পছন্দ কর না, টিয়া।
পছন্দ করার মত কী আছে তোমাতে? মৃদু স্বরে জানতে চাইলেন আন্ট এলেনা।
নিমেষে মুখে এসে জমা হলো ফেডেরিকোর সমস্ত রক্ত, দৃষ্টিতে ফুটল ক্রুরতা। দেখতেই পাবে! যখন আমি সম্পত্তির মালিক!
আচ্ছা?
নয়তো আর কে? সব খতম। মারিয়া আর আলফ্রেডো আগেই। এখন শেষটাও গেল! অবশ্যি ও ছোকরা এমনিতেও একআধলাও পেত না। তা হলে বাকি থাকল আর কে?
এলেনার পোড়-খাওয়া চোখ বিদ্রূপ করল ডনকে। আমি থাকছি, শান্ত গলায় বললেন তিনি।
ফুঃ! তুমি তো মেয়ে। তুমি কী করতে পারবে?
উত্তরাধিকার হতে পারব। নাকি আমাকেও খুন করবে তুমি?
দুমদুম করে পা ফেলে ঘরের আরেক প্রান্তে গিয়ে থামলেন ফেডেরিকো। তোমার কোন ভয় নেই। এই বাড়ি তুমিই পাবে। আমি স্পেনে ফিরে যাব।
স্পেনে, বুঝেছ? মাদ্রিদে থাকার সুযোগ পেলে এই পোড়া দেশে কোন বোকা থাকে! সব ভেবে রেখেছি আমি! ঠাটেবাটে থাকব! তোমার এখানে কী হাল হবে তাতে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। এই বাড়িটা ছাড়া সব বেচে দেব আমি।
ডন রোমেরো এখনও বেঁচে। তার কী হবে সেটাও কি ভেবে রেখেছ তুমি?
কাঁধ ঝাঁকালেন ফেডেরিকো। উনি বুড়ো হয়ে গেছেন…বুড়ো।
মাত্র সাতষট্টি। আমাদের বাবা পঁচানব্বই বছর বেঁচেছিলেন, আর দাদু ঊননব্বই। কাজেই, রোমেরো আরও ত্রিশ বছর বেঁচে থাকতে পারেন।
বাতাসে হাত ঝাড়া দিয়ে সম্ভাবনাটা নাকচ করে দিলেন ফেডেরিকো, হনহন করে চলে গেলেন খিলানের দিকে, কিন্তু মুখে বললেন না কিছু।
রোমেরো আরও ত্রিশ বছর বেঁচে থাকতে পারেন ফেডেরিকো। ততদিনে তুমিও বুড়ো হয়ে যাবে…অবশ্যি সে-পর্যন্ত বেঁচে থাক যদি।
বড্ড বেশি কথা বল তুমি।
যদি বলেই থাকি, তবে সেটা তোমার মগজ সাফ করতে। বোঝ না তুমি? বড় যে স্বপ্ন দেখ। তুমি জিততে পারবে না। তাসের প্রাসাদ বানানোই সার হবে তোমার। ড্যানকে তুমি হারাতে পারবে না, ফেডেরিকো, যেমন পারনি ওর বাবাকে।
মারিয়াকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে যাতে তোমার সম্পত্তি পাওয়াটা নিশ্চিত হয়। কিন্তু ও তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। তারপর তো ডগলাস ও’হারাকেই বিয়ে করল।
সাধারণ একটা নাবিককে! খালাসিকে!
একজন পুরুষকে।
পুরুষ! কেন, আমি কি পুরুষ নই?
একটা কাঁধ উঁচুনিচু করলেন এলেনা। কী জানি?
ওঁর দিকে এক কদম এগোলেন ফেডেরিকো, মুখ রাগে বিকৃত। সুযোগ পাই একবার!
সেলাইয়ের ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা পিস্তল বের করে ডনকে দেখালেন এলেনা। সাবধান, ফেডেরিকো। আমি তোমাকে বিশেষ পছন্দ করি না।
তুমি একটা বোকা।
তোমার মা যখন মারা গেলেন, ডন রোমেরোই মানুষ করেছেন তোমাকে, লেখাপড়া শিখিয়েছেন।
কিন্তু আমি তোমাদের ঘৃণা করি! তোমাদের সব্বাইকে। কেন তোমাদের সব থাকবে, আর আমি কিছু পাব না?।
পাওয়ার মত তোমার কী এমন যোগ্যতা আছে;ফেডেরিকো?
তোমারই-বা কী যোগ্যতা আছে শুনি? ক্রোধে ফেটে পড়লেন ফেডেরিকো। কিংবা ডন রোমেরোর?
নিজের কাপে আবার চা ঢেলে নিলেন এলেনা। তেমন কিছু নয়, ফেডেরিকো। তেমন কিছু নয়। স্পেনে অভিজাত সমাজের লোক বলে গণ্য হতাম আমরা, কিন্তু এর অর্থ কি তা জান? এর অর্থ, আমাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে দু-একজন সাহসী পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। এঁদের একজন যুদ্ধ করেছিলেন মুরদের বিরুদ্ধে, আর সেই সূত্রেই আমাদের ধনপ্রাপ্তি।
পরে তাঁরই উত্তরসুরিরা বুদ্ধি খাটিয়ে আরও বাড়িয়ে নেন সেটা।
তো?
কেন, বুঝতে পারছ না এখনও! যার কল্যাণে আমাদের বংশের এত বাড়-বাড়ন্ত, জীবনের শুরুতে তিনি একজন চাষী ছিলেন। তোমার সেরকম কেউ নেই, কাজেই নিজের চেষ্টায় কিছু করছ না কেন? আজ যাদের তুমি সম্মান কর, খোঁজ নিলে জানবে তাদের অনেকেই মামুলি কোন সেপাইয়ের ছেলে বা মেয়ে।
ফেডেরিকো সাড়া দিলেন না একথায়, এলেনাই বললেন আবার, জাহাজে আলফ্রেডোকে তুমি খুন করার চেষ্টা করেছিলে।
সফল হইনি আমার দুঃখ এটাই। কেউ পছন্দ করত না ওকে। এমনকী তুমিও। মারিয়ার আদরও ছিল লোক-দেখানো।
ওকে ভালবাসত ও। আমরা সবাই বাসতাম।
শ্রাগ করলেন ফেডেরিকো। তুমি অবশ্যি তাই বলে থাক। তবে আমরা সবাই ওকে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিলাম, আর আপদটা বিয়েও হয়েছে শেষপর্যন্ত। কই, আজ পর্যন্ত তো কারও চোখে পানি দেখিনি আমি।
এলেনা তখন ফেডেরিকোকে তাড়াতে পারলে বাচেন, কিন্তু ডন রয়ে গেলেন আরেকটুক্ষণ…কেন? ছোট্ট পিস্তলের বাঁটটা আঁকড়ে ধরলেন এলেনা। ওই লোককে মোটেও বিশ্বাস নেই। উদ্ধত লোভী, ভীষণ স্বার্থপর। কিন্তু তাই বলে ভয় পান না তিনি। ফেতৈরিকো তাকে ঘৃণা করে। আর ওর স্বভাবের জন্যে, তিনি ওকে অবজ্ঞা করেন।
আমার পরামর্শ শোনো, বললেন এলেনা, একা থাকতে দাও ড্যানকে। তুমি ওকে চেন না। ওর বাবার চেয়েও ওর ক্ষমতা বেশি, আর তেমনি ভয়ঙ্কর
হাহ।
তুমি বোকামি করছ, ফেডেরিকো। ডন রোমেরো তোমাকে আরও জমি দেবেন। তোমার নিজেরও আছে কিছু। দিনকাল বদলে যাচ্ছে এখন, টাকা বানানোর এটাই সময়।
ওসব প্রতিশোধের চিন্তাভাবনা ছেড়ে দিয়ে, কর কিছু একটা। ব্যবসা—
নাক সিটকালেন ফেডেরিকো। তুমি কী মনে কর আমাকে? বানিয়া?
চেয়ারে হেলান দিয়ে ওর দিকে তাকালেন টিয়া এলেনা, তার কাপড়ের ভঁজে এখনও ধরে রেখেছেন পিস্তলটা। আমার ধারণা তুমি একটা আস্ত গর্দভ। না, তুমি বানিয়া নও। সম্ভবত তা হতেও পারবে না।
দামী কাপড়চোপড় পর। ঘোড়ায় চড়তে জান ভালই। চেষ্টা করলে, বড়জোড় ভ্যাকুয়েরো হতে পারবে। এ ছাড়া তোমার যদি আর কোন গুণ থেকেও থাকে-আমি অন্তত তার সন্ধান পাইনি। ছোটবেলা থেকেই তোমার এক চিন্তা, কীভাবে ডন রোমেরোর সম্পত্তি গ্রাস করা যায়।
এবং তা আমি করবও। সব। ফুটো কড়িও দেব না তোমাকে। কিস্যু না!
মুহূর্তের জন্যে পিস্তলটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরলেন এলেনা। ওকে এখনই খুন করলে কেমন হয়? এতে কি রক্ষা পাবে ড্যান? নাকি সবাইকে দাড়াতে হবে গিয়ে আসামীর কাঠগড়ায়? অপলকে কিছুক্ষণ ফেডেরিকোর পানে চেয়ে রইলেন তিনি, মনে মনে যাচাই করলে সম্ভাবনাগুলো। লোকটাকে খুন করা দরকার, এটাই ওর উচিত পাওনা। তবু ধীরে ধীরে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও, ঢিল পড়ল তার আঙুলে।
তুমি এবার যেতে পার, বললেন এলেনা।
পাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালেন ফেডেরিকো। কী?
তুমি যেতে পার। আমি তোমাকে এখনই খুন করব না।
কী? হতভম্ব দৃষ্টিতে আন্ট এলেনার দিকে তাকালেন ডন। খুন করবে…আমাকে?
পিস্তলটা উঁচু করলেন টিয়া এলেনা। সেটাই ভাবছিলাম এতক্ষণ, কিন্তু মনে হলো বৃথাই একটা বুলেট অপচয় হবে। চলে যাও তুমি…আমি মত বদলাবার আগেই চলে যাও দয়া করে।
হকচকিয়ে গেছেন ডন ফেডেরিকো, তবু তার চোখ পালা করে এলেনা আর পিস্তলটাকে মাপল, তারপর সহসাই বুঝতে পারলেন এতক্ষণ কী ভয়ঙ্কর বিপদের মাঝে তিনি ছিলেন।
কিন্তু এত মানুষ থাকতে কিনা আন্ট এলেনা? তাকে খুন করতে চায়! চকিতে এলেনার দিকে আর একবার তাকালেন ডন, উপলব্ধি করলেন ওই শান্তশিষ্ট বৃদ্ধাটিকে আসলে তিনি মোটেই চেনেন না। সবসময় ডন রোমেরোর কাছেপিঠে ক্ষীণ একটা ছায়ার মত ছিল তার উপস্থিতি; বরাবর নীরব, নিপ। কিন্তু আজ অকস্মাৎ বদলে গেছে সেই মহিলার কণ্ঠস্বর। ইস্পাতকাঠিন্য প্রকাশ পাচ্ছে। হ্যাঁ, ইচ্ছে করলেই, ওই বুড়ি খুন করতে পারত তাঁকে।
ঝটিতি ঘুরে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন ফেডেরিকো, একটিবারও তাকালেন না পেছন ফিরে। উঠনে পৌঁছে থামলেন তিনি। আচমকা শিউরে উঠলেন ভয়ে।
মুখের ভেতরটা খটখটে ঠেকল তাঁর। ওই সুরে এলেনাকে এর আগে কখনও কথা বলতে শোনেননি ফেডেরিকো। আবার শিউরে উঠলেন। বুড়ি চাইলেই খুন করতে পারত তাঁকে এটা মনে হলেই ভয়ে তার কলিজা পর্যন্ত শুকিয়ে যাচ্ছে।
নিজের ঘোড়ার কাছে ফিরে গেলেন ডন। লাগাম গুছিয়ে নিয়ে থমকে দাঁড়ালেন মুহূর্তের জন্যে, স্যাডলে উঠে রওনা হলেন আস্তে আস্তে, সাবধান থাকতে হবে তাকে। সবখানে শত্রু।
তাই বলে আন্ট এলেনা! নাহ, এ অসম্ভব!
.
চা-পান শেষ করে নিজের কামরায় গেলেন টিয়া এলেনা। এখন তিনি নিশ্চিত, যা করছেন ঠিক কাজটিই করছেন। তবু উকিলের সঙ্গে তার বোধহয় পরামর্শ করা দরকার একবার। মিস ডায়ানা খুলে দিয়েছেন তাঁর চোখ, দেখিয়ে দিয়েছেন নারী কী শক্তি।
ঠাণ্ডা মাথায় আন্ট এলেনা খতিয়ে ভাবলেন তার এই কাজের কী পরিণতি হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে ফেডেরিকোকে লক্ষ করছেন তিনি, জানেন লোকটা কেমন। তিনি এও জানেন, তাদের আলাপ নিবৃত্ত করবে না ওকে, বরং ইন্ধন হিসেবে কাজ করা অসম্ভব নয়।
অনুগত লোকজনের বিদায় আর ডন রোমেরোর মানসিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফেডেরিকো পুরোমাত্রায় জাকিয়ে বসেছে আসল, কর্তৃত্ব দখল করেছে। অন্যদিকে তার ভাই ক্রমশ গুটিয়ে গেছেন নিজের ভেতরে, জ্বলেপুড়ে খাক হয়েছেন আক্রোশের আগুনে।
তাই এখন তাঁকে, এলেনাকে আরেকটু দ্রুত চলতে হবে, ধরা পড়ার ঝুঁকি নিয়ে হলেও। স্পেনের সম্পত্তি সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না তিনি, যদিও সময়ে সবই জানতে পাবেন। ওগুলো তার ভাইয়ের মাথাব্যথা তিনি আগলে রাখবেন কেবলমাত্র এখানে যা কিছু আছে সেগুলো।
যেভাবেই হোক, আনমনে বিড়বিড় করলেন এলেনা, ওগুলো আমাকে বাঁচাতে হবে। নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে আগামী বংশধরদের জন্যে।
ফেডেরিকো স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন নিজের কুমতলব ওর এই অসদুদ্দেশ্য সম্পর্কে কখনোই সংশয় ছিল না এলেনার। মারিয়ার জন্যে কিছুই করতে পারেননি তিনি। মারিয়া পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে। কিন্তু…না, চেষ্টা করতেই হবে তাকে।
এবং সেই সাথে, সবদিক সমঝে চলতে হবে। এখন ফেডেরিকো জেনে গেছে তিনি ওর শক্র। নিজের পথ পরিষ্কার করতে প্রয়োজন হলে তাকে খুন করতে কুণ্ঠিত হবে না ও। কেবল এখন থেকে সে একটু রয়ে-সয়ে এগোবে।
আর একটি কাজ বাকি রয়ে গেছে এখনও। ওই মেয়েটিকে খুঁজে বের করা।
কিন্তু চল্লিশ বছর আগে যে চলে গেছে তাকে তিনি খুঁজে বের করবেনই-বা কীভাবে? কোথায় করবেন খোঁজ?
এতদিনে হয়তো মারা গেছে সে, নয়তো মেক্সিকোয় চলে গেছে; ইন্ডিয়ানরাও ধরে নিয়ে গিয়ে থাকতে পারে। এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে, ওর কোন খবর জানেন না তিনি।
একটু অদ্ভুত ছিল মেয়েটা, সংসারে এরকম হাজারে একটা মেলে কিনা সন্দেহ। এমন মেয়ে কোথায় গিয়ে থাকতে পারে? কী কাজ করবে সে? সেই রাতটির কথা স্মরণ করলেন এলেনা, প্রচণ্ড ঝড়-বাদলের রাত। ক্যালিফোর্নিয়ায় ওরকম ঝড় আর দ্বিতীয়টি হয়নি।
দুটো কালো ঘোড়া নিয়ে এসেছিল এক লোক, যার মুখ তিনি দেখতে পাননি। মেয়েটাকে যেতে দেয়ার জন্যে এলেনা নির্জেই খুলে দিয়েছিলেন দরজা, আর ছোট্ট মারিয়া এসময়ে তার পাশে ছিল।
বৃষ্টিতে ঠকঠক করে কাঁপছিল ঘোড়াগুলো, বিজলি চমকাচ্ছিল, আর তারই মাঝে মেয়েটি নিজের পুঁটুলি নিয়ে উঠে বসেছিল স্যাডলে, তারপর ওই দুর্যোগ মাথায় করে চলে যায় ওরা।
চলে গেছে। কিন্তু কোথায়? সেই থেকে আর কোন খোঁজখবর নেই। দেখাসাক্ষাৎ দূরের কথা, একটা চিঠি পর্যন্ত পাননি এলেনা।
বেমালুম লাপাত্তা…
২.৩ সূর্য ওঠার পর
সূর্য ওঠার পরপরই বইয়ের দোকানটা খুললেন মিস ডায়ানা। বাইরে রাস্তাঘাট বিরান। অ্যালিসো স্ট্রিটে নিঃসঙ্গ এক ঘোড়াসওয়ারকে দেখেছেন তিনি, আর মেইন স্ট্রিটে একটা দোকানের সামনে ফুটপাত ঝাঁট দিচ্ছিল একজন।
রাতের অর্ধেকটাই ড্যানের জন্যে দুশ্চিন্তায় জেগেকাটিয়েছেন তিনি; এবংদুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। ড্যান দুর্গম পথে চলতে অভ্যস্ত। ওসব জায়গা তার চেনা, ওখানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে। ইন্ডিয়ানদের মাঝে বাস করেছে; উতরে গেছে পাহাড়ি এলাকার বহু কঠিন পরীক্ষায়, প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলার ব্যাপারে নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে।
সবে ডেস্কে বসেছেন তিনি এই সময়ে দড়াম করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল অ্যানাবেল। ও কোথায়?
কেন, ঝগড়া হয়েছে বুঝি?
আ…আমার মনে হয়। ডন ফেডেরিকো দেখা করতে এসেছিলেন আমার সঙ্গে, ড্যান পছন্দ করেনি এটা।
করবে…এ-আশাই করেছিলে তুমি?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল অ্যানাবেল। কোথায় ও?
পাহাড়ে গেছে…আমাদের কিছু চোরাই ঘোড়া উদ্ধার করতে। কখন ফিরবে আমি জানি না।
ধপ করে বসে পড়ল অ্যানাবেল, চোখ কপালে। চোরাই ঘোড়া? কিন্তু এতে ওর মৃত্যু হতে পারে!
ও জানে সেটা। এও জানে, ঘোড়া চুরি করা হয়েছে ওকে ফাঁদে ফেলার জন্যে। যারা চুরি করেছে তারা আশা করছে ও পিছু নেবে। এবং ওরা ওত পেতে থাকবে।
তারপরও গেল, কেন?
কারণ ও ঘোড়াগুলো ও-ই ধরেছিল, সাহায্য করেছিল ওদের পোপাষ মান্নাতে। শিগগিরই ঘোড়া ব্যবসায় নামতে যাচ্ছিল ডন। আমার বিশ্বাস, ও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে।কথাগুলো বলার সময়ে ডায়ানা প্রার্থনা করলেন তার আশা যেন সত্যি হয়। জর্জ আছে ওর সাথে। অন্যরা রয়েছে।
কিন্তু কে করছে এমন কাজ? ডন রোমেরো?
অন্তত এবারে নয়, শীতল কণ্ঠে জবাব দিল মিস ডায়ানা। ডন ফেডেরিকো, অন্তত আমাদের তাই বিশ্বাস।
অসম্ভব! কেন এ-কাজ করতে যাবেন তিনি? হ্যাঁ, আমি জানি, ড্যান বিশ্বাস করে ডন ফেডেরিকো একবার ওকে খুন করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু
তুমি বিশ্বাস কর না?
অবশ্যই করি না! ফেডেরিকো খাটিভদ্রলোক। আর তা ছাড়া এমন কাজ তিনি করতে যাবেনই-বা কেন?
তোমারই বরং জানার কথা সেটা। ফেডেরিকোর ব্যাপারে তোমার বাবাই সতর্ক করে দিয়েছিলেন ড্যানকে।
বাবা ফেডেরিকোকে চেনেন না! তাকে দেখেনওনি কোনদিন!
বেশ তো, শিগগিরই আমরা জানতে পাব সব। আগের দিন সন্ধ্যার ডাকগুলো ঠেলে একপাশে সরিয়ে রাখলেন মিস ডায়ানা। যাইহোক, তুমি জান ডন ফেডেরিকো এখন কোথায়?
কীঅবে তা জানবে অ্যানাবেল? ডন তো আর বলে যাননি ওকে।
ড্যান কীভাবে পারল এমন করে চলে যেতে? একটা বিদায় পর্যন্ত নিয়ে আসেনি।
খুব তাড়াতাড়ি চলে যেতে হয়েছে ওকে। তা ছাড়া তোমাদের যদি ঝগড়া
না, সেরকম কিছু হয়নি। তবে ফেডেরিকোর আসার কথা যখন বললাম একটু মর্মাহত দেখিয়েছিল ওকে। কিন্তু আমি তেমন গুরুত্ব দিইনি তাতে।
নিজেকে প্রবঞ্চিত ভেবেছে ও। আমি জানি।কাজটা কঠিন, অ্যানাবেল, তবে সিদ্ধান্ত তোমাকে নিতেই হবে, তুমি কার পক্ষে থাকছু। ড্যান জানে ফেডেরিকো ওকে খুন করার চেষ্টা করেছিলেন। একবার না, বেশ কয়েকবার। ডন রোমেরো যখন মরুভূমিতে ফেলে চলে আসছিলেন, ফেডেরিকো তখন ওখানেই ওকে খতম করতে চেয়েছিলেন।
আমি বিশ্বাস করি না। ড্যান তখন খুব ছোট ছিল। এত আগের কথা ওর মনে থাকতেই পারে না।
মনে আছে। তুমি তা হলে জান না, ডন ফেডেরিকো এখন কোথায়? আমি বলছি..মরুভুমিতে..তার ফাঁদ যেন সফল হয় সেটা নিশ্চিত করতে।
ঝট করে উঠে দাঁড়াল অ্যানাবেল। অত্যন্ত অন্যায় কথা বলছেন আপনি! আমি বিশ্বাস করি না।
তোমার বাবা কিন্তু করেন।
যেভাবেই হোক; ড্যানকে আমার খুঁজে বের করতে হবে।
পারবে না, অ্যানাবেল। সম্ভবত মিস্টার কেলসো ছাড়া আর কেউই পারবে না। একে দুর্গম দেশ, তার ওপর চোরদের ধাওয়া করছে, এসময় ওকে খোঁজা বৃথা।
আমি ভাবতেই পারিনি এভাবে চলে যাবে ও। ভেবেছিলাম আবার দেখা পাব। আমি
অ্যানাবেল, তুমি একটু বুঝতে চেষ্টা কর। জীবনে অনেক বিপদ-আপদ এসেছে ড্যানের, ফলে সবসময় একটা সন্ত্রস্ত অবস্থার মধ্যে থাকে সে। তবে আমার ধারণা, তোমাকে ও ভালবেসেছিল, বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু যখন দেখল সেই তুমিই ওর শত্রুকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে, তখন মনে হলো ওই স্বর্গও তার জন্যে নিরাপদ নয়।
তাই এখুন সে মরুভূমিতে ফিরে গেছে। আর তুমি জান নিশ্চয়, মরুভূমির সাথে ওর একটা আত্মিক যোগাযোগ আছে?
হ্যাঁ, বলেছে।
ওর বাবা-মাও দুদণ্ড শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন মরুভূমিতে। ড্যানও পায়। অন্যদের যেখানে ভয়ঙ্কর একা লাগে, ড্যান সেখানে নিজের বাড়ি মনে করে মরুভূমিকে।
আপনি কী বলছেন এসব?
ডেস্কের ওপর হাত রাখলেন মিস ডায়ানা। বলছি, ও যদি বেঁচেও যায়, হয়তো আর ফিরে আসবে না।
কী? তারমানে আপনি বলছেন ড্যান ওখানেই থেকে যাবে।
তাই। ড্যানের যেটা সবচেয়ে বড় গুণ, খুব অল্পতে তুষ্ট হতে পারে। সংসারে কারও সাহায্য ওর প্রয়োজন নেই।
তা হলে ওর জীবনে আমার স্থান কোথায়?
আমি বলেছি কারও সাহায্য ওর প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারমানে এই নয়, কারোকে চায় না। ও একবার আমাকে বলেছে, সুখ জিনিসটা যত ভাগাভাগি করা যায় ততই বাড়ে। আমার মনে হয়, তোমরা সবে পরস্পরকে বুঝতে শুরু করেছিলে। আর ঠিক এই সময়ে এল আঘাতটা। ড্যানের জন্যে এটা মর্মান্তিক। জীবনে কারও সঙ্গে গম্ভীরভাবে মেশেনি ও মেশার সুযোগ হয়নি বলে। আজ পর্যন্ত যা কিছু পেয়েছে নিজের বলে, কঠোর পরিশ্রম করে সেগুলো অর্জন করতে হয়েছে তাকে। ফলে একধরনের নিঃসঙ্গতার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ওর। অ্যানাবেল, তোমার ড্যান একা, ভীষণ একা।
আপনি অনেককাল চেনেন ওকে…না?
বলতে পার।
চুপ করে রইল অ্যানাবেল, আর মিস ডায়ানা তাঁর চিঠিপত্রগুলো গুছিয়ে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন একেএকে।
আসলে আমি বোধহয় ওকে একেবারেই চিনি না, শেষমেশ বলল অ্যানাবেল। আমি ভেবেছিলাম
ড্যান আর সবার মত? তা নয় ও। ড্যান একদিকে যেমন জটিল, আবার তেমনি সরল। যা-ই করে, প্রচুর পড়াশোনা আর চিন্তাভাবনা থাকে তার পেছনে।
এরপর কিছু সময় নীরবে বসে রইল ওরা, মিস ডায়ানা তাঁর প্রাত্যহিক ব্যবসা সংক্রান্ত কাজকর্মে মন দিলেন। জর্জ বুশের অভাব প্রতি মুহূর্তে বোধ করছেন তিনি। কেলসো কাজের, তবে অতখানি দক্ষ নয়। তার নির্দেশ ঠিকমত পালন করে, কিন্তু ব্যবসার ওতঘাত তেমন বোঝে না।
আমিও চিনি না ওকে। হঠাৎ মুখ খুললেন ডায়ানা। আমার মনে হয় এলেনাই। আমাদের মধ্যে সবথেকে বুদ্ধিমান। ড্যানকে বোঝার ভান করেন না, সে-ইচ্ছেও তার নেই। তিনি শুধু ভালবাসেন ওকে। প্রথমে বাসতেন ও মারিয়ার ছেলে বলে, আর এখন ওর গুণের জন্যে। ড্যানের মঙ্গলের জন্যে প্রয়োজনে তিনি মরতেও রাজি। আমি, জানি, বিরাট ঝুঁকি নিয়েছেন মহিলা…বলতে কী, সব হারাবার ঝুঁকি।
এখন লোক চলাচল শুরু হয়েছে রাস্তায়। ঘোড়াসওয়ার, দু-একটা-ওয়াগন আর ড্যানগাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাতাসে ধুলো উড়ল রাস্তার, এক লোক ফুটপাত ধরে এগিয়ে এসে দোকানের সামনে থামল। লোকটা আর কেউ নয়-অ্যালেক্সিস ফুলটন।
ডানে-বাঁয়ে তাকাল সে, তারপর চকিতে দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে। অ্যানাবেলের ওপর দৃষ্টি পড়ল তার, কপালে বিরক্তির ছাপ ফুটল।
ম্যাম? আমরা কি নিভৃতে একটু আলাপ করতে পারি?
আপনার যদি কিছু বলার থাকে, সার, এখানেই বলতে পারেন। এজন্যে একা হওয়ার কোনও প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
আমি রাশিয়া থেকে আসছি।
জানি… তো?
আমরা চাই আপনি দেশে ফিরে আসুন। আপনার মাতৃভূমিতে।
রাশিয়া এখন আর আমার দেশ নয়। জার আমাকে সাইবেরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন।
ওসব এখন ভুলে গেছে সবাই। আমার দায়িত্ব আপনাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া।
স্বাভাবিক। তা এবার কী ঘটবে? আবার সাইবেরিয়া?
প্লিজ! আমি যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারব। আপনি আবার আপনার আত্মীয়স্বজন সবাইকে ফিরে পাবেন।
আমার কেউ নেই। সাইবেরিয়ায় মারা গেছে। এটাই আমার দেশ, আমি এখানেই থাকব।
প্লিজ, ম্যাম, আপনি একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আপনার দেশ আপনাকে ফিরে চায়।
আপনি অযথা সময় নষ্ট করছেন, মিস্টার ফুলটন।
একমুহূর্ত চুপ করে রইল ফুলটন, আড়চোখে দেখল অ্যানাবেলকে। তারপর শান্ত কণ্ঠে, বলল, আমার পরামর্শ, আপনি স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে এলে ভাল করবেন। এখানকার ব্যবসাপত্র গোছাবার জন্যে আমরা আপনাকে দিন কয়েক সময় দেব, তারপর যেতে আপনাকে হবেই। তা না হলে আমি আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হব।
মৃদু হাসলেন ডায়ানা। আপনি কিন্তু বেশ মজার লোক, মিস্টার ফুলটন। আমি বলি কী, আপনি বরং আইনের আশ্রয়ই নিন গিয়ে। যেকোন আমলার সঙ্গে দেনদরবার করতে পারেন। আমার আপত্তি নেই।
আমাকে পাঠনো হয়েছে আপনাকে নিয়ে যেতে। খালি হাতে আমি ফিরতে পারব না।
কৌতুকে নেচে উঠল ডায়নার চোখ। ফেরার দরকারটাই-বা কী? আপনিও থেকে যান না!
শক্ত হয়ে গেল অ্যালেক্সিস ফুলটনের চোয়াল। দেখুন, ম্যাডাম, আমি সরকারি কর্মচারী। আমার দায়িত্ব।
এদেশে আপনি সরকারি কর্মচারী নন, মিস্টার ফুলটন। এখানে আমরা আপনাকে বড়জোর বাউন্টি হান্টারের মর্যাদা দিতে পারি। উঠে দাঁড়ালেন ডায়ানা। আপনি এবার বিদায় হলে আমি খুশি হব, মিস্টার ফুলটন।
অ্যালেক্সিস ফুলটনের চেহারায় ক্রোধের ছাপ ফুটল। একটুক্ষণ কটমট করে চেয়ে রইল সে, তারপর এগোল দরজার দিকে। দোরগোড়ায় গিয়ে থামল লোকটা, ঘাড় ফিরিয়ে বলল, বেশ, যাচ্ছি। তবে শিগগিরই ফিরে আসব। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে।
ফুলটন বেরিয়ে যাওয়ার পর নিজের চেয়ার ছাড়ল অ্যানাবেল,মুখ ফ্যাকাসে। আপনি এত শক্ত হন কীভাবে? আমি হলে মূৰ্ছা যেতাম।
একটা সময় ছিল, অ্যানাবেল, যখন আমিও ভয় পেতাম। কিন্তু আজ আর পাই। এখন আমার প্রচুর বন্ধু।আমার একটা কথা রাখবে, অ্যানাবেল…যত পার বন্ধুত্ব করবে মানুষের সাথে। যেখানেই থাক, সবসময় লক্ষ রাখবে, মানুষ যেন তোমার বন্ধু হয়।
আমার বিশ্বাস, ওই লোক আর আসবে না।
না, আসবে। তবে আগে চেষ্টা করবে আমাদের আমলাদের দলে টানতে। যখন তা পারবে না, তখন বলপ্রয়োগের রাস্তা বেছে নেবে। আমি ওদের হাড়েহাড়ে চিনি। ওটাই ওদের কায়দা।
আমি তা হলে এখন যাই। ড্যানের যদি খোঁজ পান, দয়া করে জানিয়েন আমাকে…জানাবেন তো?
জানাব।
একটু ইতস্তত করলেন মিস ডায়ানা, তারপর বললেন, তোমার বাবার বন্ধু ইয়াকুব খানকে চেন? আমি ভাবছি তোমার বাবা যদ্দিন না ফিরছেন, ওঁকে তোমাদের বাসায় এনে রাখলে কেমন হয়… তোমার আপত্তি আছে?
.
১২.
চাঁদনি আকাশের পটভূমিতে জাফরি-কাটা নকশার মত দেখাচ্ছে বৃক্ষপত্রপল্লবকে। এমন রাতে ভোলা জায়গায় কখনও সহজে ঘুম আসে না আমার। তাই জেগে রয়েছি, বিশ্রাম নিচ্ছি, তবে সতর্ক। পাতায় মর্মর তুলল হাওয়া, তারপর মরে গেল। পা ঠুকল একটা ঘোড়া। অন্ধকারে হাত বাড়ালাম আমি, পিস্তলের বাঁট স্পর্শ করলাম।
খানিক বাদে শুনতে পেলাম শব্দটা-নরম মাটিতে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। কনুইয়ের ওপর উঁচু হয়ে, আমি তাকালাম ক্রীক লাগোয়া ট্রেইলের দিকে।
তিনজন ঘোড়াসওয়ার, ফ্যাকাসে ঘাসের পটভূমিতে গাঢ় কালো।
ঝরনার পাড়ে থামল ওরা, ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়াতে মাটিতে নামল। কাছেপিঠের ক্ষীণ একটা নড়াচড়ার শব্দ আমাকে জানিয়ে দিল, আমাদের দলের অন্তত আরও একজন জেগে আছে। নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে নবাগতরা, কিন্তু ওরাশ খানেক গজ দূরে থাকায় স্পষ্ট করে কিছু বুঝতে পারলাম না আমি। অল্পক্ষণ পর আবার স্যাডলে চাপল লোকগুলো, চলে গেল ঘোড়া হাঁটিয়ে নিয়ে।
আরও তিনজন বাড়ল, বলল মন্টে ম্যাক-কায়া।
এইবেলা একটু ঘুমিয়ে নাও, রামর্শ দিলাম। ভোর হতে বেশি বাকি নেই।
হেসে উঠল কে যেন, কম্বলের খসখস শব্দ হলো, তারপর আবার নীরবতা।
তিনজন মানুষ, গভীর রাতে পথ চলছে এবং দ্রুত গতিতে। এর অর্থ, তস্করদের। সঙ্গে আঁতাত আছে ওদের। নিশ্চয় নির্দিষ্ট কোন এক সময়ে নির্ধারিত কোন এক জায়গায় কারও সাথে ওদের মিলিত হওয়ার কথা আছে, তাই যাওয়ার এত তাড়া। আর নয়তো আশপাশেই কোথাও হবে ওদের গন্তব্য।
চিত হয়ে শুয়ে, জাফরি-কাটা বৃক্ষপত্রপল্লবের দিকে চেয়ে চেয়ে, পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতে লাগলাম আমি। ধারেকাছে কোথাও ঘোড়ার পিঠে বড়জোর ঘণ্টাখানেকের পথ হবে, ফাঁদ পাতা হয়েছে। হ্যাঁ, কোন সন্দেহ নেই, জায়গাটা আশপাশেই হবে। আমার মনে হয় না এখন আর বেশিদূরে যেতে পারবে ওই ঘোড়া তিনটে। এই অন্ধকারেও ওদের চলায় ক্লান্তির আভাস পেতে অসুবিধে হয়নি আমার।
এর অর্থ কী তা হলে? অ্যামবুশের সময় কেউ একজন উপস্থিত থাকতে চাইছে ঘটনাস্থলে? ডন রোমেরো? অসম্ভব নয়, তবে তিনি ঘোড়ার কদর বোঝেন, এরকম অসময়ে অত্যাচার করতে চাইবেন না ওদের ওপর। কিন্তু ডন ফেডেরিকোর কথা আলাদা।
ক্যাপ্টেন লরেল আমাকে হুঁশিয়ার করার আগে পর্যন্ত, আমার ধারণায়ই আসেনি। দাদুর সম্পত্তির আমি একজন সম্ভাব্য উত্তরাধিকার বলে কেউ আমাকে পথের কাঁটা ভাবতে পারে। তবে এখন বুঝতে পারছি, সেটা খুবই সম্ভব।
আমার আফসোস, ডন ফেডেরিকো যদি কেবল একটু উপলব্ধি করতেন সম্পত্তির লোভী আমি কখনোই নই। টাকা আমার জীবনের মোক্ষ নয়, আমি চাই মানুষ হতে, একজন সৎ মানুষ।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, যখন সজাগ হালাম, নাস্তার আয়োজন চলছে। উঠে বসে, পা থেকে মোকাসিনজোড়া খুলে নিয়ে বুট পরলাম। মন্টে কফি জ্বাল দিচ্ছে, মায়রন ব্রডি পানি খাওয়াতে ঘোড়াগুলোক নিয়ে গেছে ঝরনায়।
চারদিক কেমন যেন থমথমে! ঘুম ভেঙে উঠে বসল বুশ।
যা ঘটবার আজই ঘটবে, বললাম আমি।
গানবেল্ট হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল ওয়েন হার্ডিন, আমারও তাই মনে হয়।
আগুনের পাশে বসে, কাপের গায়ে হাত গরম করলাম আমি। মরুভূমির বা এর আশপাশের এলাকায় রাতে সবসময় ঠাণ্ডা পড়ে। সতর্ক চোখে আমাদের সামনের পাহাড়পর্বতের মাথা আর তরাইয়ের ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত ঝোপঝাড়গুলোর ওপর নজর বোলালাম।
আমার ভাল ঠেকছে না, বুশ বলল। এই ট্রেইল যদি ক্যানিয়নের ওপর দিকে চলে গিয়ে থাকে তখন কী হবে?
আমিও ভাবছিলাম কথাটা। কঠিন অবস্থা, বললাম। ওখানে কেউ যদি রাইফেল নিয়ে বসে থাকে, সে একেবারে ফাঁকায় পেয়ে যাবে আমাদের।
আমরা বরং বসে থাকি, মন্টে পরামর্শ দিল। যাতে ওরাই আসতে বাধ্য হয় আমাদের কাছে।
কফিটা বেশ স্বাদু। একখণ্ড জার্কি মুখে পুরলাম আমি। পরিষ্কার উজ্জ্বল সকাল, এখনও সূর্য ওঠেনি, তবে গাছপালার নীচে দ্রুত কেটে যাচ্ছে কুয়াশা। ঝরনার তীরবর্তী ঝোপের ভেতর থেকে ডানা ঝাঁপটে উড়াল দিল একটা লাল বনমোরগ।
কফিপান সেরে উঠে দাঁড়ালাম আমি।তোমরা গল্প করো, বললাম, আমি শেভ করতে যাচ্ছি।
শেভ? ব্রডি তার ঘোড়া থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করল।
মন্টের পরমার্শটা আমার পছন্দ হয়েছে। ওই আসুক আমাদের কাছে। তোমাদের যা খুশি করতে পার, তবে কাছাকাছি থেক। ওরা আশা করছে আমরা ওদের ফাঁদে পা দেব, সুতরাং দেরি দেখলে নিজেরাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে ব্যাপার জানতে।
ক্রীকের পাড়ে একসার উইলো আর কতকগুলো কটনউড় গাছ, রাইফেল হাতে ওখানে গেলাম আমি, সন্ধানী নজর বোলালাম চারপাশে, তারপর একটা গাছের ডালে আয়না লটকে দিয়ে দাড়ি কামালাম।
যেভাবেই হোক ওই ঘোড়াগুলো উদ্ধার করতে হবে আমাদের। প্রচুর মেহনত হয়েছে ওগুলোকে পোষ মানাতে। সুযোগ পেলে ওদের অনেকেই আবার ফিরে যাবে বুনো জীবনে। এটাই ওদের আবাস, সুযোগ পেলে এখানে চলে আসবে আমার স্ট্যালিয়ন।
ক্যানিয়নের ঢালগুলো ভালমত জরিপ করার জন্যে একটা ঝোপের ভেতর গিয়ে বসলাম আমি, ধীরে ধীরে তাকালাম প্রতিটা পাহাড়ের দিকে। হঠাৎ অস্পষ্ট একটা ট্রেইল চোখে পড়ল, শৈলশিরার গা ঘেঁষে চলে গেছে ক্যানিয়নের ওপর পানে। চোখ কচলে নিয়ে ভাল করে তাকালাম সেদিকে। হ্যাঁ ঠিক, ট্রেইলই তো। বুনো জীবজন্তু বা প্রাচীন ইন্ডিয়ানদের পায়েচলা একটা পথ। আচ্ছা, ঘোড়া চোরেরা কি জানে ওটার কথা?
জায়গা চিনে রাখতে, সযত্নে শৈলশিরার ওপর নজর বোলালাম, কারণ আমি জানি একেক অবস্থান থেকে একেক রকম দেখাবে ওটাকে। তারপর যখন ফিরলাম ক্যাম্পে, আবার তাকালাম ওদিকে। না, ট্রেইলটা আর দেখা যাচ্ছে না।
বুশ কফি বানিয়েছিল, এক কাপ নিয়ে একটা গাছের গুড়ির ওপর বসলাম আমি, সঙ্গীসাথীদের কাছে ডেকে বললাম আমার আবিষ্কারের কথা।
আমার মনে হয় ওই পথ দিয়ে যাওয়াই ভাল, প্রস্তাব দিল মন্টে।
যেখান থেকে ট্রেইলটা দেখতে পেয়েছিলাম, মন্টে আর ওয়েন হার্ডিনকে সেখানে নিয়ে গেলাম আমি। ওটা খুঁজে পেতে বেশ কিছুটা সময় লাগল ওদের।
তা হলে আজ আর কিছু ঘটছে না,বললাম। আমরা রাতে রওনা দেয়।
ওয়েন হার্ডিন জরিপ করল ট্রেইলটা। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসছে, বলল সে। আমি বরং একটু ঘুরেফিরে দেখে আসি গিয়ে ওই ট্রেইলের শুরু কোথায়।
ও চলে যাওয়ার পর, ঘুমিয়ে আর গল্প করে সময় কাটালাম আমরা। প্রত্যেকেই জানি সামনে দুঃসময়।
সন্ধ্যা হয়-হয়, এই সময় ফিরে এল হার্ডিন। পেয়েছি। সহস্যে ঘোড়া থেকে নামল ও। ওদিকে আরেকটা শাখা ক্যানিয়ন আছে, ট্রেইলের শুরু ওখানে। দেখে মনে হলো বহুঁকার্লের মধ্যে পা পড়েনি কারও। আমি জানতাম তাই, নইলে বোঝার উপায় নেই ওদিকে কোন ট্রেইল আছে।
নিভুনিভু আগুনের পাশে গোড়ালির ওপর বসল হার্ডিন, পট থেকে কফি ঢেলে নিল কাপে। ওর শার্ট ঘামে ভেজা, কাঁটার খোঁচায় এক জায়গায় ছিড়ে গেছে।
ধন্যবাদ, ওয়েন। আমাদের ঝামেলা বাঁচিয়ে দিয়েছ তুমি।
অন্ধকারে তুমি দেখতেই পাবে না, একমত হলো ও। তবে আমাদেরকে সাবধানে এগোতে হবে। ওরা জানার চেষ্টা করছে আমরা কী করছি।
কফিপান করল হার্ডিন, তারপর গাছের নীচে টানটান শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল মিনিটখানেকের মধ্যে। আগুনের ধারে এসে, বালু আর অবশিষ্ট কফিটুকুর সাহায্যে কয়লাগুলো নিভিয়ে দিলাম আমি, ঠাণ্ডা হওয়ার জন্যে পটটা সরিয়ে রাখলাম ছায়ায়। তারপর ফিরে গেলাম গাছতলায়, আমার পিস্তল আর রাইফেলটা পরখ করলাম।
এখন পাহারায় আছে মায়রন ব্রডি। প্রকাণ্ড এক জুনিপারের তেডালায় বসে রয়েছে ও, ঘন লতাপাতার ভেতর অবধি দেখা যায় ওখান থেকে।
ওয়েন ঢুলছিল, হঠাৎ খুলে গেল চোখ। ওহহহ, আরেকটা কথা জানাতে ভুলে গেছি। ওখানে কিছু ট্র্যাক দেখতে পেয়েছি আমি।
জর্জ চোখ মেলল, কান খাড়া। আমি আমার পিস্তলের সিলিন্ডার ঘোরালাম একপাক, গুলি এলাম।
ট্র্যাক?
…অল্প কয়েকটা…ছড়ানো-ছিটানো।
তারপর?
দেখে মনে হলো তোমার ওই ব্লাক স্ট্যালিয়নের ট্র্যাক।
এখানে..থাকবে, নাই-বা কেন? এটাই ওর দেশ, ওর সাবেক চারণভূমির অংশ এই জায়গা।
বুশ উঠে বসল। স্বাভাবিক। সুযোগ পেলে, যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফিরে যায় ঘোড়া। ওদের রক্তে বাড়ির টান প্রবল।
আমার দিকে তাকাল ও। তোমাকে তো বলা হয়নি, ওই ব্ল্যাক স্ট্যালিয়নটা সম্পর্কে র্যামন কী বলেছে। ওর ধারণা ওটা ভুতুড়ে ঘোড়া। ও না চাইলে, কেউ ওর পিঠে সওয়ার হতে পারবে না।
কুসংস্কার, হার্ডিন বলল, ইন্ডিয়ানরা বিশ্বাস করে এসবে।
আমি চড়তে পারব কিনা সে ব্যাপারে কিছু বলেনি র্যামন? জিজ্ঞেস করলাম।
বুশ তার হ্যাটখানা তুলে নিয়ে স্যোএটব্যান্ডটা মুছল, মাথায় দিয়ে টেনে বসাল জায়গামত।
আলবত বলেছে। ওর ধারণা ঘোড়াটার তোমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
.
তারাখচিত আকাশ মাথায় করে ট্রেইল খুঁজতে রওনা হালাম আমরা। মিগ্ধ আবহাওয়া, মাঝেমধ্যে খুরেরূরাব্দ হচ্ছে পাথরে, ঝোপের গায়ে ঘষা খাচ্ছে আমাদের কাপড়চোপড় আর স্যাডল। ঝরনাতীরবর্তী ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে খাড়া একটা চড়াইয়ের দেখা পেলাম।
আগাছার মাঝ দিয়ে পথ করে, এককাতারে চড়াইয়ের ওপর পানে এগিয়ে চললাম আমরা। কোন ঘোড়া এদিকে এর আগে আসেনি কখনও, অন্য কোনও জীবজন্তুর ট্র্যাকও চোখে পড়ছে না। বিপদের আশঙ্কায় টানটান হয়ে আছে আমাদের, মায়, দেখেশুনে সাবধানে পা ফেলছি।
অগণিত ধূসর পাহাড়পর্বতের মাঝে ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত একঝাড়গুলোকে মনে হচ্ছে যেন জমাট অন্ধকারের দ্বীপ। শেষমেশ সরু একটা শৈলশিরার মাথায় পৌঁছুলাম আমরা, বায়ে আলগা পাথরের একটা তূপ দেখতে পেলাম। ঘোড়া থেকে নেমে চ্যাপটামত একটা পাথর কুড়িয়ে নিলামআমি, নিক্ষেপ করলাম স্তূপে।
ওটা আবার কী জন্যে? জানতে চাইল হার্ডিন।
প্রাচীন ইন্ডিয়ানরাও করত একসময়। এভাবে অর্ঘ্য দিত পথের দেবতাকে।
তুমি বিশ্বাস করো এসব?
কাজটা করতে আমার ভাল লাগে। একটুক্ষণ আমার ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, হাত স্যাডলে, ওদের প্রতি আমার একটা টান আছে। মানে প্রাচীন দেবতাদের প্রতি। ব্যাপারটা ওদের জন্যে নিশ্চয় খুব কষ্টের-আজকাল কেউ আর ভক্তিশ্রদ্ধা করে না।
আমার তরফ থেকেও তা হলে দাও একটা, অনুরোধ করল হার্ডিন। এসময় সম্ভাব্য সবার সাহায্য আমাদের প্রয়োজন হবে।
কমপক্ষে বারোজনের বিরুদ্ধে আমরা মোটে পাঁচজন, তাও শক্ত ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে লড়তে হবে।
খাড়া ঘেসো পাথরসংকুল ঢাল ধরে সরু একটা নালায় নেমে এলাম আমরা, কোনাকুনিভাবে এগোলাম বিপরীত চড়াইয়ের দিকে। মাঝে-মধ্যে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হচ্ছিল ট্রেইল, একবার যখন এভাবে পথ হারিয়ে ফেললাম, মন্টে একটা নালার প্রায় শ-গজ নীচে দুটো পাথর দেখতে পেল, একটার ওপর আরেকটা বসানো। ওই পথ ধরলাম আমরায়বার দেখা পেলাম ট্রেইলের। হঠাৎ কান খাড়া করল আমার ঘোড়া, উত্তরে তাকালৰোকের পাটা ফুলে উঠল। আমি ধমক দিলাম ওকে, ঘোড়াটা সবেগে মাথা নাড়িয়ে বিরক্তি প্রকাশ করল।
ইতিমধ্যে ফরসা হতে শুরু করেছে আকাশ। রাশ টেনে বাতাসে কান পাতলাম সবাই, ক্ষীণ লাকড়ি-পোড়া গন্ধ পেলাম। তারপর দুটো ধাতব বস্তুর পরস্পর ঠোকাঠুকির আওয়াজ।
কাছেই, ফিসফিস করে বলল ব্রডি। শ-দুয়েক গজের বেশি হবে না।
হঠাৎ দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল ট্রেইল, একটা শাখা সটান নেমে গেছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন বড়সড় একটা গর্তের ভেতর, এবং সেখান থেকে চওড়া ক্যানিয়নে গিয়ে ঢুকেছে। ঝরনা রয়েছে ওখানে, পানিতে রোদের ঝিলিমিলি। আমাদের প্রত্যেকের হাতে রাইফেল, পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি।
গাছপালার ফাঁক দিয়ে গর্তের ভেতর তাকালাম আমরা, খাড়া পায়েচলা একটা পথ, আছে, নামা সহজ নয়, পা দিলেই পাথরধস শুরু হবে। টের পেয়ে যাবে শত্রুপক্ষ।
স্যাডল থেকে নেমে কিনারে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি, নীচে তাকালাম। ঘোড়া পারবে, কিন্তু মানুষ নয়। অর্ধেক পথ পেরোনোর আগেই শত্রুর বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে শরীর। ধীরে ধীরে পরে সন্ধান করতে লাগল আমার চোখ।
পায়ে হেঁটে নামতে পারবে একজন, যদি যথেষ্ট হুঁশিয়ার হয় সে। অস্পষ্ট একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। হাসছে কেউ। আমাদের ঠিক নীচেই রয়েছে ওরা। তবু, রাইফেল হাতে যদি নামতে পারি….বোধহয় ওদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারব, আর সেই ফাঁকে গর্তে নেমে যাবে আমার বন্ধুরা।
পাহাড়ের গায়ে ওকগাছ আছে কিছু। নামার সময় আমাকে খেয়াল রাখতে হবে কোনও নুড়ি পাথর যেন আচমকা গড়াতে শুরু না করে। এমনকী একটা পড়লেও শুশিয়ার হয়ে যাবে ওরা, সেক্ষেত্রে আমি সহজ টার্গেটে পরিণত হব।
চারপাশ জরিপ করে আমার পথ খুঁজে পেলাম আমি। তরে অন্যরা যদি সফলকাম হতে না পারে, আমিফঁদে পড়ব। ধীরপায়ে ঘোড়ার কাছে ফিরে এলাম, বুটজোড়া খুলে মোকাসিন পরলাম।
তোমার মতলবটা কী? জানতে চাইল ব্রডি।
একা একজন নামতে পারবে। আমি আটকে রাখছি ওদের, সেই অবসরে তোমরা নেমে যাবে।
কেশে নিজের গলা সাফ করল জর্জ বুশ। বাছা, আমিই বরং যাই। এসব কাজে আমার দক্ষতা আছে।
গাছপালার ফাঁক দিয়ে মুহূর্তের জন্যে একটা সোরেলকে চোখে পড়ল। দুকদম এগোতেই দেখতে পেলাম ঘোড়াগুলোকে, ছোট্ট একটা বক্স ক্যানিয়নের ভেতর আটকে রাখা হয়েছে। ক্যানিয়নের আরেকটু উজানে, কোরালের শেষপ্রান্তে বেড়া রয়েছে, ঝোপঝাড় আর গাছের।
কোন লোক যদি…
জর্জ? হাত ইশারায় জায়গাটা দেখালাম আমি! কেউ যদি ওখানে নেমে গিয়ে গেট খুলে দিতে পারে,
হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসবে ঘোড়াগুলো, এবং ওদের মাঝায়ে চলে যাবে সোজা, আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল ব্রডি।
এবং আমরাও আমাদের ঘোড়া পেয়ে যাব, বুদ্ধিটা সমর্থন করল হার্ডিন।
শৈলশিরার পাশ দিয়ে সামনে কোথায় যেন গিয়েছিল মন্টে ম্যাককায়া। এবার ফিরে এল সে। ওখানে, হাত তুলে জায়গাটা দেখাল, ক্যানিয়নের ওপরের অংশে নামার একটা পথ আছে মনে হলো। সম্ভবত ঘোড়ায় চেপেই নামা যাবে। খাড়া ঢাল, তবে ওদের ক্যাম্প থেকে দূরে, আর এটার মত এতটা দুরারোহ নয়।
আমার ঘোড়াটাকে নিয়ে যাও তোমরা, অনুরোধ করলাম। আমি এ-পথেই যাচ্ছি। একটু থেমে যোগ করলাম, আমরা সবাই জানি কী ঘটতে পারে। সুতরাং কেউ যদি দলছুট হয়ে পড়, সোজা ফিরে যাবে শহরে; আর যদি ঘোড়াগুলোকে উদ্ধার করতে পার, ওদের সঙ্গে থাকবে।
আমার ঘোড়ার লাগামটা হাতে নিল মন্টে। চল, যাওয়া যাক, প্রস্তাব দিল ও, এবং আমাকে একা রেখে ধীরকদমে বিদায় নিল ওরা।
ভোরের কমলা আলোয় একমুহূর্ত ওখানে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। আকাশ ঈষৎ মেঘলা। এখনও প্রকৃতি ঠাণ্ডা, চারদিকে তাকালাম আমি, শ্বাস টানলাম বুকভরে। তারপর আস্তে আস্তে গিয়ে পঁাড়ালাম বুড়ো একটা ওকগাছের পাশে, যে-পথে নামতে হবে তাকালাম সেদিকে। ডান হাতে রাইফেল নিয়ে আগে বাড়লাম আমি, মেপে মেপে পা ফেলছি।
ধূসর ধূলিমলিন মাটি আর পাইন পাতা স্পর্শ করল আমার মোকাসিন। এগুলো ডিগরি পাইনের পাতা, একেকটা আট-দশ ইঞ্চি লম্বা। পায়ে পায়ে প্রায় পঞ্চাশ ফুট নীচে নেমে গেলাম আমি, প্রকাণ্ড এক ওকগুড়ির পেছনে ঘাপটি মেরে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম সামনে।
ছোট্ট ক্যাম্পফায়ারের ধারে আড্ডা মারছে তিন লোক। একটু তফাতে রয়েছে আরও দুজন, তাস পিটছে কম্বল পেতে। প্রত্যেকেই সশস্তু, সবকটা রাইফেল নাগালের ভেতর রয়েছে। আগুনে কফিপট চাপানো আছে একটা, শক্রর চোখে ধুলো। দিয়ে কোনমতেই ওখানে পৌঁছুনো যাবে না। তা হলে এখানে বসে আমি করছিটা কী?
আর সবাই কোথায়? আরও অন্তত শাচজনকে হিসেবে ধরেছি আমি। চাই কী, ডজনখানেকও থাকতে পারে, আবার এমনও হতে পারে আর কেউ নেই।
এসব পরিস্থিতির সমস্যা একটাই; কেবল সামনে এগিয়ে যেতে হয়, ফেরার পথ থাকে না। এখন যেখানে অপেক্ষা করছি আমি সেখান থেকে ওদের ক্যাম্প শ-গজ দূরে হবে, যার পঞ্চাশ গজেরও বেশি ভয়ঙ্কর খাড়া।
যে-পথে যেতে হবে, সেটা জরিপ করলাম এক হাঁটু মাটিতে নামিয়ে, তারপর চট করে সরে গেলাম সুবিধেজনক আরেকটা অবস্থানে। এখানে আড়াল বেশি, গুড়ি ছাড়াও গাছের ভাঙা ডালপালা রয়েছে।
হঠাৎ আমার পাশ দিয়ে একটা পাথর গড়িয়ে পড়ল। সচকিত হয়ে, ওপরে তাকালাম আধপাক ঘুরে, দেখলাম ঢাউস সমব্রেরোমাথায় এক মেক্সিক্যান রাইফেল তাক করছে আমার দিকে।
পেছন ফিরতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়েছিলাম আমি, ধপাস করে পড়ে গেলাম মাটিতে। সশব্দে গর্জে উঠল ওপরের রাইফেল। বাম কনুইয়ের ওপর ঝটিতি কাত হালাম আমি, ট্রিগার টিপলাম আমার রাইফেলের। মাত্র ত্রিশ ফুট দূরে ছিল মেক্সিক্যান, আমার বুলেটটা বুক পেতে নিল।
গড়িয়ে আমার দিকে চলে এল সে, আমি পথ ছেড়ে দিলাম, তারপর ঘুরে মুখোমুখি হালাম ক্যাম্পের।
ক্যানিয়নের দিক থেকে চিৎকার আর একপশলা গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে এল, পরমুহূর্তে ক্যাম্প বরাবর গুলি ছুঁড়তে লাগলাম আমি। আগুনের ধার থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়াচ্ছিল এক লোক, আমার বুলেটের আঘাতে ধূলিশয্যা নিল। জায়গা বদল করে, জুয়াড়িদের একজনকে গুলি করলাম, এবং ও আমাকে। শুরুতে দুজনেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হালাম আমরা, তারপর আমার বুলেটে ওর পা গুঁড়িয়ে গেল।
এবার আমি উঠে দাঁড়ালাম ঝট করে, দু-পা সামনে দিয়ে ঢাল ঘষটে নেমে গেলাম ক্যাম্পের দিকে। একটা বুলেট কাছেই একটা গাছের কাণ্ডে আঘাত হানল, কিছু ছালবাকল ছিটকে এসে পড়ল আমার চোখে, আর মুখে। সমতল জমি স্পর্শ করল আমার পা, অবিরাম গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঢুকে গেলাম ক্যাম্পে।
বুনো একটা চিৎকার ভেসে এল মূল ক্যানিয়ন থেকে, বধভাঙা স্রোতের মত পাশ কাটিয়ে চলে গেল ঘোড়াগুলো। এক লোক বাধা দেয়ার প্রয়াস পাচ্ছিল, আমি গুলি করে ওর খুলি ফুটো করে দিলাম। জনাকয়েক ঘোড়াসওয়ারকে দেখতে পেলাম আমি, ক্যানিয়নের ভেতর থেকে আরেক পশলা গোলাগুলির শব্দ ভেসে এল, আমি চকিতে চারপাশে নজর বোলালাম।
দুজন লোক পড়ে রয়েছে মাটিতে। আরেকজন কাতরাচ্ছে নিজের পা চেপে ধরে। একটা ঘোড়ার নাগাল পাওয়ার লক্ষ্যে আমি ছুট দিলাম ক্যানিয়নের ভাটিতে।
নীচে থেকে লোকজন ছুটে আসছে ওপরে, ঘুরে ফের ক্যানিয়নের উজানে ছুটলাম, যেভাবে হোক একটা ঘোড়ার নাগাল পেতে চাইছি। কিন্তু নেই একটাও।
মোড় ঘুরতেই, এক মেক্সিক্যানের লাশ চোখে পড়ল আমার, এবং এর অদূরে ব্ৰড়ির।
একনজরেই বুঝলাম ব্রডিও মারা গেছে। লোকজনের আসার শব্দ পাচ্ছি আমি, দৌড়তে শুরু করলাম আবার, নরম বালুর ওপর দিয়ে যাচ্ছি যাতে কোনরকম আওয়াজ না হয়। দেয়ালের গায়ে ফাটল দেখতে পেয়ে ঢুকে পড়লাম সেখানে, দম নিতে থামলাম একমুহূর্ত, তারপর ক্যানিয়ন টপকানোর উদ্দেশে ওপরে উঠতে শুরু করলাম ছড়ানো-ছিটানো পাথরের মাঝ দিয়ে পথ করে।
ব্রডি মারা গেছে! বড্ড ভাল মানুষ ছিল ও, সৎ মানুষ।
দম নিতে ফের থামলাম আমি। ওরা কি জানে এখনও কাছেপিঠে রয়েছি আমি, হাঁটছি? যদি জানে, শিগগিরই ঘিরে ফেলবে আমাকে। আমার রাইফেল আর কার্তুজ বেল্টটা পরখ করলাম একবার। তারপর যথাসম্ভব আড়ালে আড়ালে চলে ক্যানিয়নের ওপর, পানে রওনা হালাম। এ-মুহূর্তে আমার একটাই চিন্তা: পালাতে হবে, ঘোড়া ধরতে হবে একটা।
ব্রডি তো মারা গেছে…আর অন্যরা? আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু জর্জ এখন কোথায়? যে-পথে উঠে যাচ্ছি আমি, একসময় সেটা পাহাড়ি নালা ছিল। শিগগিরই আমি পৌঁছে যাব শৈলশিরার চূড়ায়। তখন শত্রুদের কেউ কি ওত পেতে থাকবে ওখানে?
চূড়ার সামান্য নীচে গাছতলায় বসে পরিস্থিতি বিচার করলাম। আমাকে দেখে ফেলেছে ওরা, সন্দেহ নেই, চিনেছে। জখমি পায়ের লোকটা যদি ইতিমধ্যে রক্তক্ষরণে পটল তুলে না থাকে, আমার পরিচয় ফাঁস করে দেবে, এবং শত্রুরা জেনে যাবে আমি এখানেই আছি এবং সাথে ঘোড়া নেই।
আমার খোঁজে ধেয়ে আসবে ওরা। ঘোড়া হারাতে ওদের আপত্তি নেই, কিন্তু আমাকে হাতছাড়া করতে চাইবে না।
ঘাড় ফিরিয়ে ট্রেইলের দিকে তাকালাম, পাথরের মাঝে অদৃশ্য হয়েছে, কিছুদূর সামনে ঘেসো জমিতে বেরিয়েছে আবার নীচের ক্যানিয়নের ফাঁদ থেকে পালানো কঠিন হবে। এখন আমি যেখানে সেই ন্যাড়া পাহাড়ে লুকানোর জায়গা নেই। কমপক্ষে জনাআটেক ঘোড়াসওয়ার খুঁজে ফিরছে আমাকে, অথচ আমি বাহনহারা। এমুহূর্তে আমার যা প্রয়োজন তা হলো অবিলম্বে দূরে কোথাও চলে যাওয়া। আমি দৌড়তে শুরু করলাম প্রাচীন ট্রেইল ধরে, মনে আশা এই পথ আমাকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাবে।
ঘোড়াগুলো জর্জ, মন্টে আর হার্ডিনের তত্ত্বাবধানে রয়েছে, ওরা ওদেরকে লস এঞ্জেলেস: আর নয়তো র্যাঞ্চে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। হয়তো আমার খোঁজে ফিরে আসবে আমার বন্ধুরা, তবে তা না এলেই মঙ্গল করবে নিজেদের।
দম নিতে মুহূর্তের জন্যে থামলাম পথে, তাকালাম পেছনে। এখনও দেখা যাচ্ছে না কারোকে। মিস ডায়ানা, আন্ট এলেনা, অ্যানাবেল…ওদের কথা ভাবলাম। ওরাই আমার পরিবার। হ্যাঁ, অ্যানাবেলও।
ওকে ভালবেসেছিলাম আমি। এখনও বাসি।
ঘুরে, ফটিকস্বচ্ছ ভোরের আলোয় ছুটতে শুরু করলাম। উদিত সূর্যের দিকে মুখ করে।
আমার পেছনে, ধাবমান ঘোড়ার খুরের নিনাদ…
.
১৩.
এখানেই কি তা হলে অবসান হবে সমস্ত আশা-আকাক্ষার? মরুভূমির ওপরের এই পার্বত্য এলাকায়? এ-ই কি আমার নিয়তি, শক্রর হাতে মরণ? আমার মা-বাবার আত্মত্যাগ কি শেষপর্যন্ত এখানে নিয়ে এসেছে আমায়?
তবু আমি পালাতে লাগলাম, ভুয়ে নয়, লড়াই করার জন্যে সুবিধেজনক একটা অবস্থানের সন্ধানে। অতীতে বহুবার দৌড়েছি আমি, আমার বন্ধু মরুবাসী ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে। তাই ফুসফুসে চাপ পড়ছে না, তবে রাইফেলটাকে বোঝা মনে হচ্ছে, কিন্তু আমি নিরুপায়, অন্ত্রটা প্রয়োজন হবে।
এক মাইল, দুই। বড় বড় পাথরাইয়ের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে চললাম আমি। উঁচু এক শৈলশিরার মাথায় উঠে যখন তাকালাম পেছন ফিরে দেখলাম আসছে ওরা, কাতারবেঁধে। ছজনকে শুনলাম আমি, পেছনে আরও রয়েছে।
তোমরা ধরতে চাও আমাকে, বললাম চেঁচিয়ে, বেশ, ধর তা হলে।
সাবলীল গতিতে দৌড়চ্ছি আমি, জানি অনায়াসে এভাবে আরও কয়েক মাইল পাড়ি দিতে পারব। এও জনি, ঘোড়া আরও জোরে ছুটতে পারে, কিন্তু দূরের রাস্তায় বেশি জোরে ছোটাতে গিয়ে সওয়ারি অনেক সময় মেরে ফেলে তার বাহনকে। বিশেষ এক উদ্দেশে, এবার সরে গেলাম প্রাচীন ট্রেইল থেকে, আরও দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরলাম।
এখন যে-পথে যাচ্ছি তার এখানে-সেখানে আকাশ পানে মাথা তুলেছে বন্ধুর সব পাহাড়, গাছপালা বলতে আছে ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত কিছু বুড়ো সিডার আর চোলা ক্যাকটাস। প্রায় মরুভূমির কাছাকাছি এসে পড়েছি আমরা, দক্ষিণে আছে ভয়ঙ্কর সেই মোহাভে, যোজন-বিস্তৃত, তারপর মিলিত হয়েছে কলোর্যাডো মরুভূমির সাথে।
ভোরের প্রশান্ত আমেজ বিদায় নিয়েছে এখন, তাপ বাড়ছে ক্রমশ। চকিতে ডান দিকে ঘুরেই, খাড়া ঢাল বেয়ে ক্যাটি ঝোপের ভেতর নেমে গেলাম আমি, শুষ্ক একটা নালা পেরিয়ে উঠে এলাম পাথরের অরণ্যে। এবং যা খুঁজছিলাম এতক্ষণ, গুটিকতক পাথরচাই আর বুড়ো এক সিডারের আড়ালে পেয়ে গেলাম তা।
আমার প্রত্যাশার চেয়েও বেশিকিছু রয়েছে, মায় ওঅটর হোল পর্যন্ত। প্রথমে ঠোঁট ভেজালাম পানিতে, তারপর চুষলাম জিভ দিয়ে। অপেক্ষা করছি আমি, রাইফেলের নল পাথরের ওপর রেখে।
অচিরেই শুনতে পেলাম ওদের আসার শব্দ, ধীর হয়ে এসেছে খানিকটা, তবে আসছে। সামনের পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এক ঘোড়াসওয়ার, আমি আস্তে করে ট্রিগারটা টেনে দিলাম।..
আমার লক্ষ্য কারোকে খুন করা নয়, আমি চাইছিলাম ওদের দলে যেন আহত কেউ একজন থাকে, যার সেবাশ্রষার জন্যে, সামান্য হলেও, সময় নষ্ট করতে বাধ্য হয় ওরা।
লোকটা যখন পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে তখন প্রায় তিনশো গজ ছিল আমাদের ব্যবধান, আমি গুলি করলাম ওর কাঁধে। বুলেটের ধাক্কায় প্রচণ্ড এক আঁকি খেল সে, কাত হয়ে গেল স্যাডলের ওপর। এলোপাতাড়ি আরেকটা গুলি ছুড়েই ওখান থেকে পিছু হটলাম আমি, পাথর টপকে ঢুকে গেলাম গাছপালার ভেতর।
এবার আর ওরা দৃষ্টিসীমায় পাবে না আমাকে, কারণ ঢাল এখানে খাড়া, পাহাড়ের গা দেখতে হলে ওদেরকে অন্তত আরও শ–সামনে আসতে হবে। হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে একটা ট্রেইলের হদিস পেয়ে গেলাম, এর আগে যেটা অনুসরণ করছিলাম সম্ভবত তারই কোন শাখা হবে।
একটু দোনোমনো করলাম আমি, এ-পথ মরুভূমিতে চলে গেছে, আমার কাছে ক্যান্টিন নেই, ওদের কাছেও, আমি নিশ্চিত। তবে কিনা আমি একা, প্রয়োজন অল্প পানির, আর ও অনেক।
আহত লোকটিকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হবে? নাকি ওদের সঙ্গেই তাল মেলানোর চেষ্টা করবে সে?
পাহাড়ের গা ঘেঁষে অস্পষ্ট যে-ট্রেইল ধরে এগোচ্ছি আমি, ক্রমশ ঢালু হয়ে যাচ্ছে সেটা, আবার মাঝেসাঝে খাড়াও হচ্ছে। আমি মন্থর করলাম চলার গতি। বিশ্রাম নিতে থামলাম বার কয়েক।
দুপুর নাগাদ পৌঁছুলাম মরুভূমির কিনারে। আকাশ নির্মেঘ, নীল। ধরিত্রী উত্তপ্ত।
শক্রদের ধকল কম হবে আমার চেয়ে, আর ঘোড়াগুলোর বেশি, তবু ওরা এখন, বারেকের জন্যে হলেও, ভাববে কী আছে সামনে। আমি যে-পথে এসেছি সেটা বেশ আঁকাবাকা, কয়েক জায়গায় হারিয়ে গেছে ঝোপঝাড় আর পাথরের ভেতর, কিন্তু এর গন্তব্য পরিষ্কার। মরুভূমিতে গেছে, এবং যারা সেখানে যাবে পানির প্রয়োজন পড়বে তাদের।
গুটিকতক পাথরের পেছনে থেমে, ব্যাক ট্রেইল জরিপ করলাম আমি। ব্যবধান কমিয়ে আনছে প্রতিপক্ষ।
এখন আমি ক্লান্ত, শ্রান্ত। বিশ্রাম দরকার, তবে না নিয়েও চলতে পারব। শত্রুরা পরিচালিত হচ্ছে একজন মানুষের আক্রোশের দাপটে; আর আমি বাঁচার তাগিদে।
আবার থেমে পেছনে তাকালাম, প্রতিপক্ষের সাথে আমার দূরত্ব আর ওদের শক্তি বোঝার চেষ্টা করলাম। সহসা হাসি পেল আমার। ওরা মরুভূমিতে আসছে, ওদের বাঁচা-মরা এখন আমার হাতে।
এটাই আমার পৃথিবী-এই ঊষর নির্জন প্রান্তর, এই অনন্ত নৈঃশব্দ্য, এই তাপ তরঙ্গের নাচ আর নিষ্ঠুর পাহাড়ি খাঁজের দেশ। প্রখর সূর্যের তাপে পাথরও কালো হয়ে যায় এখানে, ওরা যদি পিছু নেয় আমার, ওদের হাড়গোড়ের দশাও তাই হবে।
এখান থেকে আরও দক্ষিণে, আরেক মরুভূমিতে আমার বাবা-মাকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল ওরা, কিন্তু তারা রক্ষা পেয়েছিলেন। এবার আমিও পাব।
চোখ কুঁচকালাম রোদের তাপে, দেখলাম শেষ ঢাল বেয়ে নেমে আসছে ওরা। একটা নালায় নেমে গেলাম-আমি, উননের মত তেতে আছে তলদেশ। ইচ্ছেকৃতভাবে। এগোলাম ট্রেইল রেখে। ওদেরকে সুযোগ দিলাম অনুসরণ করার।
বালিয়াড়ির চড়াইতে ওঠার সময়ে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলাম একবার। এটাও ইচ্ছেকৃত, যাতে ওরা ভাবে আমাকে বাগে পাওয়া গেছে। কিন্তু আদপে আমি একা নই, কারণ এই মরুভূমিই নিঃসঙ্গ দেবতাদের আবাস, এবং ওরা আমার বন্ধু। মরুভুমি নিজেও আমার বন্ধু।
আয়! কায়মনোবাক্যে ডাকরলাম। আমাকে অনুসরণ কর!
তবু মেঘের ছায়ায় যখন নালা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম, তখন দেখলাম পাহাড়ের গোড়ায় থেমে ইতস্তত করছে দুবৃত্তরা। তর্ক চলছে নিজেদের মধ্যে, আমি নিশ্চিত। সামান্য হলেও, অনীহা দেখা দিয়েছে। কে জিতবে…সাবধানতা না বিদ্বেষ?
একজন ফিরতি পথ ধরল, অন্যরা এগোল। সম্ভবত আহত লোকটাই হবে। নাকি ওদের মধ্যে যে বেশি বুদ্ধিমান সে?
চারদিক ধু-ধু। মাথার ওপর সূর্য আগুন। প্রতিপক্ষের চেয়ে মাইল কয়েক এগিয়ে রয়েছি আমি, এসময়ে এর প্রতিটি ইঞ্চিই আমার জীবনের জন্যে মহামূল্যবান। আমার শার্ট ঘামে ভেজা, তবে এতে সুবিধাও পাচ্ছি একটা, যখনই হাওয়া বইছে জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর। পাহাড়পর্বতের ভেতর বাঁক নিয়ে, গর্ত খুঁজতে শুরু করলাম আমি। অধিকাংশই শুকনো; শেষমেশ আধা-ছায়াচ্ছন্ন একটা গর্তের দেখা পেলাম, গ্যালন দুয়েক পানি সমেত। ঠোঁট ছোয়ালাম প্রথমে, তারপর চুষলাম। খানিক জিরিয়ে নিয়ে পান করলাম এক ডোক। এরপর মুখ আর ঘাড় ধুলাম আমি, রওনা হালাম ফের।
ইতিমধ্যে আরও কাছে এসে পড়েছে ওরা, কিন্তু ওদের পানির দরকার হবে, অথচ একফোঁটাও নেই। ঘুরে, ছড়ানো-ছিটানো পাথরের পাশ দিয়ে এগোলাম, মরুভূমিতে নামলাম। আমার হিসেব ঠিক হয়ে থাকলে, এখন যেখানে আছি সেখান থেকে বেড়রক স্প্রিং মাইল দশেক হবে। উত্তরপশ্চিম দিকে, আমার পথ থেকে খানিকটা তফাতে, তবে পানি মিলবে ওখানে।
আমি এগোলাম, রেড মাউন্টিনকে ডানে রেখে। সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক যদি আমি হতাম, সূর্যাস্তের আগে কিছুতেই আর নড়তাম না ছায়া ছেড়ে। কিন্তু এক্ষেত্রে পরিস্থিতি আমার প্রতিকূলে।
এগিয়ে চললাম নাগাড়ে। মাঝেসাঝে বিগহন ভেড়া আর কয়ৌটের ট্র্যাক দেখতে পাচ্ছি। একবার পেছনে ঘাড় ফেরাতে চোখে পড়ল অনেক কাছে এসে গেছে শক্ররা। লম্বা পায়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুট দিলাম আমি। গরম বাতাসে অসাড় হয়ে গেল আমার ফুসফুস, অচিরেই হাঁপাতে লাগলাম, হাঁটতে শুরু করলাম অগত্যা।
পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, ওরা থেমে গেছে। জটলা পাকিয়েছে এক জায়গায়, নিশ্চয় তর্ক করছে। এখন যদি ফিরে যায়, হয়তো সন্ধ্যার আগে পানির। কাছে পৌঁছুতে পারবে…যদি সহায় হয় ভাগ্য।
দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চললাম আমি। কোথাও কোথাও বালু বেশ গভীর, তবে যখন সম্ভবপর হচ্ছে ট্রেইলে গিয়ে উঠছি কারণ সুদীর্ঘ ব্যবহারে মাটি ওখানে শক্ত। যাত্রাপথ সামান্য বদল করে, পাহাড়ের ছায়ায় ছায়ায় সোজা বেড রক স্প্রিংয়ের দিকে এগোচ্ছি আমি। যখন রেড মাউন্টিনের ছায়া থেকে বেরোলাম তখন দেখলাম আমার সামনে ডোম পীক। ঝরনাটা এর ঠিক পেছনেই কোথাও হবে।
ফের ব্যাক ট্রেইলের দিকে তাকালাম আমি। দুজন ঘোড়াসওয়ার এখনও অনুসরণ করছে; বাকি সবাই ফিরে গেছে। নিঃসন্দেহে এই দুজন সবসময় চোখে চোখে রাখতে চাইবে আমাকে আর অন্যরা ফিরে গিয়ে তাজা ঘোড়া আর পানি নিয়ে আসবে।
ট্রেইল এখানে বাঁক নিয়ে উত্তরপুবে চলে গেছে। দিনের শেষ আলো বিদায় নিতে আর বেশি বাকি নেই, আমি ক্লান্ত, কিন্তু জানি কী করতে হবে এখন। ডম মাউন্টিনের কাছে এসে অকস্মাৎ লাভা প্রান্তরে ঢুকে গেলাম, এবং তারপর, যাতে কোন ট্র্যাক না থাকে, পাহাড়ের ধার ঘেঁষে পুব দিকে ঝরনা অভিমুখে এগোলাম।
পাথুরে ঢাল থেকে নেমে, ঝরনার আশপাশের এলাকা জরিপ করলাম আমি। প্রতিপক্ষে এমন কেউ থাকা বিচিত্র নয় যে এই মরুভূমিকে বেশি চেনে আমার চেয়ে, এবং তেমন হলে এখানে ওত পেতে থাকবে সেই লোক। মিনিট কয়েক পর যখন তিনটে বিগহন ভেড়া চোখে পড়ল, স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম আমি।
ঝরনায় পৌঁছে তেষ্টা নিবারণ করলাম। পানিটা ঘোলাটে তবে ঠাণ্ডা, আর এসময়ে ভেজা যে কোন জিনিসই আমার কাছে লোভনীয়। রাইফেলখানা নাগালের মধ্যে রেখে, প্রতীক্ষায় বসলাম আমি ওরা যদি ধরতে চায়আমাকে, শুধু এখানে আসার অপেক্ষা।
গেল আধমাইল পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটেছি আমি, কোন ট্র্যাক না রেখে। এর আগের একটা মাইলেও সামান্যই রয়েছে, তবে কিনা ওরা দুজন, একটু ঘুরেফিরে হয়তো অনুমান করে নিতে পারবে আমার গন্তব্য কোথায়। আর তা ছাড়া ঘোড়া দুটো যে পানির গন্ধ পাবে, সেকথা বলাই বাহুল্য।–গুটিকতক পাথরের ওপরে একটা সমব্রেরো জেগে উঠল। আমি বুলেট ঢুকিয়ে দিলাম ওতে, হ্যাটটা অদৃশ্য হলো।
একটু সরে বসলাম আমি, অপেক্ষা করছি, কিন্তু নতুন কিছু ঘটল না। সব নীরব নিথর। পানির কাছে পৌঁছুতে চাইবে ওরা, কিন্তু সেজন্যে অন্ধকার অবধি ধৈর্য ধরতে হবে, এবং সেই সাথে চাই বুকের পাটা।
থমথমে পরিবেশ। পাথরের ওপর ঘোড়া দুটোর নড়াচড়ার আওয়াজ হচ্ছে, এত কাছে এসেও পানি খেতে না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়েছে বেচারারা। আমাদের চারপাশে অন্ধকার তার ছায়া মেলে ধরল। আবার পানি খেলাম আমি, রাইফেলে হাতে সরে গেলাম অন্ধকারের ভেতর।
আমার সামনে নিচু, এবড়োখেবড়ো পাহাড়। আঁধার নামার বহু আগেই পথের নিশানা হিসেবে চোখা একটা পাথর চিনে রেখেছিলাম, জানি এখন আমি সেদিকেই যাচ্ছি। যখন এই নিচু পাথুরে শৈলশিরা অতিক্রম করব, রাতের আকাশের পটভূমিতে আমার চোখে পড়বে পাইলট নব।
আমি কোথায় গেছি না জেনে, অন্ধকারে পানির কাছ থেকে নড়বে না ওরা। এবং বেড রক স্প্রিংয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিলেও ভোরের আগে নয়। বালুর ওপর শুয়ে, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
.
শীত জাগিয়ে দিল আমায়। হাত-পা সব অসাড় হয়ে গেছে। ঘুম আর অবসাদে ঢুলতে ঢুলতে, গড়িয়ে উঠে বসলাম আমি।
আকাশ একদম পরিষ্কার, তারাগুলো দারুণ উজ্জ্বল। কান পেতে কোন শব্দ শুনতে পেলাম না। কষ্টেসৃষ্টে উঠে, রাইফেলে ভর দিয়ে দাড়িয়ে রইলাম একটুক্ষণ। ধবধবে সাদা দেখাচ্ছে বালু, আর গ্রীজউড ঝোপঝাড় নিরেট কালো। অবসন্ন পায়ে আমি হাঁটা দিলাম পাইলট নবের উদ্দেশে।
কাউইয়াদের সঙ্গে আমার আলাপসুত্রে আমি জানি পাইলট নব মাইল দশেকের পথ হবে, তবে ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে সঠিক দূরত্ব কখনোই জানা যায় না। তবু অনুমান করলাম, ভাগ্য ভাল হলে, সূর্য উঠতে উঠতে পৌঁছে যাব ওখানে, আর আমার শক্ররা ভোরের আগে শুরু করবে না তাদের ধাওয়া। সবে দিগন্তের ওপর উঁকি দিয়েছে সূর্য, এই সময় পাইলট নবে পৌঁছলাম আমি, পানি খেলাম ক্ষুদ্র একটা ঝরনা থেকে।
আমার মূল লক্ষ্য যারা আমাকে খুন করতে চাইছে তাদের কবল থেকে পালানো। কিন্তু সেই সাথে নিজের শক্তিও সঞ্চিত রাখতে হবে আমাকে। সামনে কোন বিপদ রয়েছে জানি না, তবু আমি ঝুঁকি নিচ্ছি এই ভরসায়, এই মরুভূমি ওদের চেয়ে আমার বেশি চেনা। একটা ব্যাপার ভাবিয়ে তুলেছে আমাকে যারা ফিরে গেছে তারা কী করছে? ছুটি নিয়েছে একেবারে? তাজা ঘোড়া আর পানি আনতে গেছে? নাকি কোন মতলব আটছে, যাতে আমাকে ফাঁদে ফেলতে পারে?
আমার পরবর্তী গন্তব্য ইন্ডিয়ান স্প্রিং। ওই জায়গা খুঁজে পাওয়া সহজ হবে না। তবে যারা আমায় অনুসরণ করছে, এবার আমি তাদের ধ্বংস করতে শুরু করব।
দুপুর নাগাদ ইন্ডিয়ান স্প্রিংয়ে হাজির হালাম আমি। জায়গাটা অসংখ্য বোল্ডার আর উঁচু ঝোপঝাড়ে ঘেরা। জানা না থাকলে বোঝার উপায় নেই এখানে পানি আছে।
পানির ধারে হাঁটু গেড়ে বসে, ঠোঁট ভেজালাম আমি, চেটে নিলাম জিভ দিয়ে। তারপর ঘাড়, মুখ আর বুক ধুলাম। পানি খেলাম। ঝোপের ছায়ায় বসে আঁজলা ভরে নিয়ে বার কয়েক পানি ঢাললাম গায়ে, মাথায়। পাশাপাশি, মাঝে মাঝে হামাগুড়ি দিয়ে পাথরের কিনারে গিয়ে আমার ব্যাক ট্রেইলও জরিপ করলাম। শেষমেশ একসময় দেখা পেলাম ওদের। এমনকী এতদূর থেকেও স্পষ্ট বুঝলাম হাঁটছে ওরা, ঘোড়াগুলোকে টেনে আনছে লাগামে ধরে। মাথা গুনলাম।
পাঁচ…পাঁচ?
তারমানে যারা চলে গিয়েছিল কাল, তাদের তিনজন আজ ফিরে এসেছে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও, আমার আশ্রয়স্থলটিকে সরীসৃপদের হাতে সঁপে দিয়ে ঝরনা থেকে সরে গেলাম আমি। এই জায়গা ওরা খুঁজে পাবে না বলেই আমার বিশ্বাস। কাউইয়াদের সাহায্য না পেলে আমারই অজানা থাকত এখানে পানি আছে।
আকাশ যেন গলা পেতল, মরুভূমি খা-খা ধূলিধূসর তামা, আর তার বুকে তাপতরঙ্গের নাচ। আমার শতচ্ছিন্ন মোকাসিনজোড়ার দিকে চোখ নামালাম আমি, নিজের পদযুগলকে নিজের কাছেই অচেনা ঠেকল। তবু এগিয়ে চললাম মরুভূমির বুক চিরে, পুবে যাচ্ছি, জানি সামনে পথু দুস্তর, গার্লিক স্প্রিংয়ের আগে আর কোথাও সম্ভবত পানি মিলবে না।
হাতে বেজায় ভারি মনে হচ্ছে রাইফেলটাকে, ভীষণ লোভ জাগছে ফেলে দেয়ার, অতিকষ্টে সেই লোভ আমি সংবরণ করলাম।
আগামী কয়েক ঘণ্টার ভেতর পানি খাওয়ার সুযোগ পাব না আমি, যদি আদৌ পাই শেষপর্যন্ত। কিন্তু তার আগেই রাত নামবে, তার মিগ্ধতা নিয়ে। সুতরাং আবহাওয়ার এই তারতমকেও হিসেবের মধ্যে রাখতে হবে আমাকে। কষ্টসহিষ্ণু হতে হবে। আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।
হ্যাঁ, যদি অপেক্ষা করি, হয়তো ওদের পরাস্ত করতে পারব। সব্বাইকে।
বোকামি কর না? ঝাঁঝাল কণ্ঠে নিজেকে শাসন করলাম আমি। বড়জোর এক দুজন, সবাইকে নয়।
বিশ্রামের চিন্তা আপাতত শিকেয় তুলে, মরুভূমি উত্তাপ আর পিপাসার দরবারে নিজেকে আমি সঁপে দিলাম। দৃঢ় পায়ে ঢুকে গেলাম মরুভূমির গভীরে, চোখ দূর পর্বতমালার দিকে।
অসহনীয় তাপ উঠছে মরুভূমির পিঠ থেকে। একবার তাকালাম পেছনে। আসছে ওরা, আমাকে দেখতে পেয়েছে।
আবার সংকুচিত করলাম চোখ, তিনজনকে দেখতে পেলাম। মোটে তিনজন? অগ্নিপরীক্ষায় আমি জিততে চলেছি, তা হলে।
আমি জিতেছি? শতদুঃখেও, হাসলাম আপনমনে। কেউ যদি জেতে, সে এই মরুভূমি। যা কিছু প্রাণ ঝরবে, তার সবই হরণ করবে মরুভূমি।..
শেষ কখন খেয়েছি আমি? মনে করতে পারলাম না, খাবারের চিন্তায় আমার পেট গুলিয়ে এল। পড়ে গেলাম, কিন্তু উঠলাম তক্ষুণি।
পেছনে তাকাতে দেখলাম, আরও কাছে এসে পড়েছে ওরা। এখন স্যাডলে চেপে ধরতে আসছে আমাকে, তবে ঘোড়াশুলো হাঁটছে। ওরা ছুটতে পারবে, আমার মনে হয় না।
প্রচণ্ড গরমে হাঁটতে গিয়ে টলে উঠল পা, পড়ে যাচ্ছিলাম, শেষমুহূর্তে মাটিতে রাইফেল ঠেকিয়ে টাল সামলে নিলাম। ঘুরে দাঁড়ালাম আমি, রাইফেল উচিয়ে নিশানা করলাম সযতে, টেনে দিলাম ট্রিগার।
স্যাডলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এক লোক। লক্ষ্যভেদ করতে পারব এ-আশা আমার ছিল না, তারপর দেখলাম লোকটা গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে।
টলোমলো পায়ে, কখনও হাঁচড়েচড়ে আমি এগিয়ে চললাম। পড়ে গেলাম আবার, তারপর সহসা বাল্যের সেই কথাটা মনে পড়ে গেল। আমি ড্যান ও’হারা। আমি কখনও ভয় পাই না।
উঠে বসলাম হাঁটুতে ভর দিয়ে, সোজা হয়ে হাঁটতে লাগলাম ফের, আর পড়লাম না। আমি ড্যান ও’হারা। আমি ভয় পাইনি।
অনবরত জপতে লাগলাম আমি, এবং একসময়, আপনাআপনি, আমার মাথার ভেতর অবিরাম ঝংকার তুলল কথাটা, তারপর কোথা থেকে যেন ছুটে এল হিমেল হাওয়া, বিদায় নিল দিন। আমার কাক্ষিত পর্বতমালা এখন আর তত দূরে নেই।
সন্ধ্যার মুখে, যখন একটা-দুটো তারা দেখা যাচ্ছে সবে, ঝরনায় পৌঁছুলাম, আমি। পাশাপাশি দুটো ওঅটর হোল, টাইফোর্ট মাউন্টিনের পাদদেশে, মাঝে ব্যবধান মাত্র কয়েক গজ।
.
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি, ক্ষীণ একটা শব্দে জেগে গেলাম হঠাৎ।
মানু…নড়াচড়া করছে…এগিয়ে আসছে কাছে।
উঠে বসলাম। পূবাকাশে ফিকে আলোর আভাস। পিস্তলটা বাগিয়ে ধরলাম হাতে। অচিরেই মরুভূমির দিক থেকে এগিয়ে এল একলোক, ঝোড়ো কাকের মত চেহারা, টলছে, চোখ ঘোলাটে। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল।
পানি হবে? মিনতি ফুটল ওর কণ্ঠে। পানি?
তোমার গানবেন্ট আর ছরি ফেলে দাও।
হারিয়ে গেছে…ওখানে।
তবে পান কর, যত ইচ্ছে।
চোঁ-চোঁ করে পানি খেতে শুরু করেছিল, চুলের মুঠি ধরে ওকে ঝরনা থেকে সরিয়ে আনলাম আমি। রয়ে-সয়ে খাও, বোকা কোথাকার। এরকম করলে মারা পড়বে।
হলুদ রঙ লাগল আকাশে। আগন্তক একজন অ্যাংলো, মুখ রোদে ঝলসে গেছে, গালে কাটা একটা দাগ, বুটজোড়া ছেঁড়া ন্যাকড়া।
অন্যরা কোথায়?
নেই…মারা গেছে…ওখানে। হাত তুলে মরুভূমি, দেখাল ও। সবাই।
ডন ফেডেরিকো ছিলেন ওদের মধ্যে।
উনি ফিরে গেছেন। তাজা ঘোড়া আনতে। তোমাকে ধরার জন্যে। লোকটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল আমার পানে। একটু বাদে বলল, তুমি মরবে। মরুভূমি থেকে বেরোলেই! সবকটা ওঅটর হোলে পাহারা বসাবেন ফেডেরিকো। ওঁর সাথে একজন আছে যে জানে পানির খোঁজে কোথায় কোথায় যেতে হবে তোমাকে।
ওর দিকে পেছন না ফিরে, আমার বাকস্কিন কোটটা কাছে টেনে নিলাম আমি। আগে এর খানিকটা দিয়ে মোকাসিন বানিয়েছিলাম, এবার ছিড়ে নিলাম হাতাগুলো। একটা দুভাঁজ করে তার মাঝে বসালাম, অন্যা, কোটের সুতো খসিয়ে নিয়ে পরস্পর বেঁধে দিলাম দুটোকে।
আমার কাজ লক্ষ করছিল লোকটা, বলল, ওই ব্যাগে কি লাভ হবে না। লি করবে।
করতে পারে। তবু সামান্য থাকবে।
তুমি একটা বোকা। ওরা তোমাকে ঠিকই ধরে ফেলবে।
মরুভূমির দিকে হাত ইশারা করলাম আমি। ওরাও তাই ভেবেছিল।
পানিতে মুখ ডোবাল লোকটা, আমি বাধা দিলাম না। তুমি বোকা, আবার বলল সে।
ঠিক-তবে জ্যান্ত বোকা, আমি বললাম।
পানির ব্যাগটা ঝরনায় ডোবালাম আমি, যখন তুললাম পানি গড়াতে লাগল।
দেখেছ?
তবু অনেকটা পানি রয়ে গেল ভেতরে। আবার ঝরনায় নামালাম ব্যাগটা।
তুমি…পিস্তল উচিয়ে বললাম, ওঠ।
হতভম্ব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল ও। উঠে দাঁড়াল আস্তে আস্তে।
ওদিকে আরেকটা ওঅটর হোল আছে। ওখানে যাও। কোনরকম পাঁয়তারা কর, আমি তা হলে খুন করব তোমাকে।
টলতে টলতে দ্বিতীয় ওঅটর হোলটার পাশে গিয়ে বসে পড়ল ও। এখান থেকে বেরিয়েই দ্যাখ, তুই মরবি, শাসাল আমাকে।
দুই ওঅটর হোলের মাঝে ব্যবধান প্রায় ফুট চল্লিশেক, কিন্তু ওতেই কিছুটা হাঁপ ছাড়ার সুযোগ পেলাম আমি। খানিক বাদে বালুর ওপর লম্বা হয়ে গেল লোকটা, ঘুমিয়ে পড়ল। আমিও ঝিমোতে লাগলাম পাথরে হেলান দিয়ে।
সারাদিন বিশ্রাম নিলাম এভাবে, পানি খেলাম একটুক্ষণ পরপর, তারপর যখন সন্ধ্যা হলো, পানির ব্যাগটা ফের ভরে নিয়ে পিস্তল ঝোলালাম কোমরে, মরুভূমির দিকে পা বাড়ালাম।
লোকটা উঠে বসে তাকাল আমার গমনপথের দিকে। তুই মরবি! বলল চিৎকার করে। একবার যা ওখানে, মরবি তুই!
বৃথা পেছনে তাকিয়ে আমি সময় নষ্ট করলাম না। আমাকে দূরপথ যেতে হবে।
ও কয়েক কদম দৌড়ে এল আমার পেছন পেছন। উন্মাদের মত চিৎকার করে বলল, মরবি…তুই মরবি!
পানির ব্যাগটা গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে, হাঁটতে লাগলাম আমি।
…মরবি! চিৎকার করল লোকটা।
দূরে দেখা যাচ্ছে শৈলমালা, পাহাড় যেখানে আছে সেখানে পানি থাকাও স্বাভাবিক। আমার ব্যাগের পানি টিকবে না বেশিক্ষণ। এরইমধ্যে ব্যাগ ভিজে গেছে পুরোপুরি, অল্পক্ষণের ভেতর বাকস্কিন শুকিয়ে কুঁকড়ে যাবে। এতে কি লাভ হবে কোন? সব শেষ হয়ে যাওয়ার আগে, বড়জোর কয়েক চুমুক অবশিষ্ট থাকবে।
মোটে কয়েক চুমুক…তারপর?
অ্যানাবেলকে ভাবলাম আমি, কোনদিন যা বলতে সাহস পাইনি আজ চেঁচিয়ে বলে ফেললাম সেই কথা। অ্যানাবেল তোমাকে আমি ভালবাসি।
আবার রক্তপাত শুরু হয়েছে পা থেকে। যন্ত্রণা বাড়ছে প্রতি পদে। দূর-পাহাড়ের মাথায় সুদূরের একটা নক্ষত্রকে বেছে নিলাম আমি।
এগিয়ে চললাম, রাতের মখমলে মোড়া মরুভূমির মাঝ দিয়ে।
.
১৪.
মিস ডায়ানা কফি বানালেন বড় কেতলিতে। আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে বেলা ইউনিয়নে পৌঁছে যাবে স্টেজ, নতুন খবরকাগজ আসবে তার কাছে। তখন নিশ্চয় শহরের গণ্যমান্য লোকদের অনেকেই ভিড় জমাবে এখানে। আজকাল সৌজন্য সাক্ষাতের স্থান হিসেবে, স্যালুনের কলকোলাহল থেকে দূরে, নিরিবিলি এই রিডিং রুমটাই ওদের বেশি পছন্দ।
শহরের সব তাজা খবর আগে এখানে আলোচিত হয়, স্টার-এর পাতায় স্থান পায় পরে। শুরুতে অবশ্যি এমন ছিল না অবস্থা, স্রেফ ছোটখাট একটা বইয়ের দোকান চালাতেন তিনি, কিন্তু এখন তারও ডাক পড়ে আলোচনায়। তবে যখন বেশি লোকজন থাকে, ডায়ানা নিজের ডেস্কে ফিরে যান।
আপন চিন্তায় এতখানি ডুবে গিয়েছিলেন তিনি যে যখন ঘুরে দেখলেন আঁর দরজার ভেতর এক লোক দাঁড়িয়ে তখন রীতিমত চমকে গেলেন। একে আগে কখনও দেখেননি ডায়ানা, কিন্তু পরক্ষণে বুঝতে পারলেন আগন্তুকের পরিচয়-ইয়াকুব খান।
প্রথম দর্শনেই তাঁর মনে হলো এ-লোক শক্তিধর। শুধু যে দৈহিক তা নয়, চেহারায় প্রখর ব্যক্তিত্বের আভাস রয়েছে।
ইয়াকুব খান তার চেয়ে লম্বা হবে না, তবে শরীর আরও চওড়া ও পুরু। পা দুটো ঈষৎ ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে, মুখ সামনে, পরনের ঢোলা শার্টখানা ঝুলছে ট্রাউজারের বাইরে। ইয়াকুব খানের মুখাবয়ব প্রশস্ত, চোয়ারে হাড় মজবুত, মাথা কামানো।
আপনি অ্যানাবেল লরেলের বন্ধু?
হ্যাঁ।
অ্যানাবেল ড্যান ও’হারার খোঁজে বেরিয়েছে।
কী? অ্যানাবেল? সর্বনাশ! কাজটা মোটেই উচিত হয়নি!
চারজন লোক রয়েছে, ওর সাথে। একজনের নাম টোমাস ম্যাচাডো, ভাল মানুষ। তিনটে প্যাকহর্সও নিয়েছে।
মরুভূমিতে ভ্যানের হদিস পাওয়া অ্যানাবেলের পক্ষে অসম্ভব। সাফল্যের সম্ভাবনা হাজারে একও নয়। ড্যান ঘোড়া চোরদের ধাওয়া করছে, পথের শেষ অবধি ও যাবে। অ্যানাবেল কোনদিন যায়নি দুর্গম অঞ্চলে, তাই বুঝতে পারছে না ওখানে যাওয়ার বিপদ কত।
মরুভূমিতে পৌঁছানোর আগেই আটকাতে হবে ওকে।
আমি যাচ্ছি।
আপনি? ইন্ডিয়ান ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়!
কৌতুক নেচে উঠল ইয়াকুব খানের চোখে। আমার জন্ম মরুভূমিতে। টাকলামাকান-এ।
টাকলামাকানের কথা আমি জানি। ছোটবেলায় আমি গোবি অতিক্রম করেছি। কিন্তু এই মরুভূমি একটু অন্যরকম, যদিও আপনাদেরটার চেয়ে কম ভয়ঙ্কর।
আমি পারব ওদের খুঁজে বের করতে।
ইয়াকুব খান যখন চলে গেল, পাথরের মত বসে রইলেন ডায়ানা। কৈশোরে গোবি মরুভূমি পাড়ি দেয়ার কথা মনে পড়ছে তার। টাকলামাকানকে তিনি জানেন এক কুখ্যাতির সুবাদে; কারও কারও মতে পৃথিবীর বুকে ওটাই সব থেকে ভয়ঙ্কর মরুভূমি।
হ্যাঁ, ইয়াকুব খানের মত লোকের পক্ষে, বোধহয়, সম্ভব অ্যানাবেলকে ফিরিয়ে আনা।
কিন্তু ড্যান কোথায়? ও গেছে প্রায় তিন হপ্তা হতে চলল।
একসময় অচেনা কিছু মানুষের সঙ্গে ভ্যানের শক্রতার ব্যাপারে অ্যানাবেল নিজেই চিন্তিত ছিল। এবং মূলত ওর উদযোগেই ক্যাপ্টেন লরেলের কাছ থেকে এই শক্রতার আসল হেতুটি জানতে পায় ড্যান। তবে এ-সবই ঘটেছে ডন ফেডেরিকোর সাথে অ্যানাবেলের দেখা হওয়ার আগে।
ফেডেরিকোর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর, অ্যানাবেলের মনে হয়েছে তার ভয় অমূলক। ডনের মিষ্টিকথায় ভুলেছে ও, ধরে নিয়েছে এরকম নিপাট একজন ভদ্রলোক কিছুতেই কোনরকম গুপ্তহত্যার চক্রান্ত আঁটতে পারেন না।
ড্যান নেই। আচমকাই চলে যেতে হয়েছে ওকে। মিস ডায়ানার মনে পড়ল, ড্যান আর ফিরতে নাও পারে এ-ধারণা তিনি নিজেই দিয়েছেন অ্যানাবেলকে।
রিক্ত মনে বাড়ি ফিরে গেছে মেয়েটি, নিজেকে দায়ী করেছে ড্যানকে দূরে ঠেলে দেয়ার জন্যে। অ্যানাবেল শহুরে যুবকদের সঙ্গে মেলামেশায় অভ্যস্ত, কিন্তু ড্যান হচ্ছে ভিন্ন ধাতুতে গড়া। ওর চরিত্রের তল খুঁজে পায়নি অ্যানাবেল লরেল। ও দেখেছে ওর বাবা ছেলেটিকে সমীন করেন, এটা বিস্ময়কর ঠেকেছে মেয়ের কাছে, কারণ ক্যাপ্টেন সহজে কারও প্রতি আকৃষ্ট হন না।
কিন্তু অ্যানারেলও বাপেরই বেটি। ড্যান আর ফিরবে না আশঙ্কা করে, নিজেই গেছে ওর সন্ধানে। বাড়ির পরিচারিকা ছাড়া অন্য কারোকে কথাটা জানায়নি ও, তবে ডায়ানা অনুমান করলেন টোমাস নিশ্চয় বলবে এলেনাকে।
জানালায় গিয়ে বাইরে তাকালেন মিস ডায়ানা। ড্যানের পিছু নিতে অ্যানাবেল মরুভূমিতে যেতে পারে এ-চিন্তা তার মাথায় আসেনি। আবার অ্যানাবেলেরও জানবার কথা নয়, কোন বিপদে পা বাড়াচ্ছে সে।
ফুটপাতে পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলেন তিনি, এবং আওয়াজটা চিনতে পারলেন তক্ষুণি। সাগ্রহে দরজার দিকে তাকালেন, কবাট ঠেলে ভেতরে ঢুকল জর্জ বুশ।
মিস্টার বুশ…!
ও ওখানে রয়ে গেছে, ম্যাম। আমরা ঘোড়া উদ্ধার করেছি, কিন্তু ওরা ড্যানের পিছু নিয়েছে। ও আমাদের বলেছে ঘোড়া ফিরিয়ে আনার সময় আমরা যদি আলাদা হয়ে যাই, ওর জন্যে যেন চিন্তা না করি। নিজেকে সে সামলাতে পারবে।
মরুভূমিতে ড্যান একা?
মরুভূমিতে যাওয়ার মত প্রতি আমাদের ছিল না, ম্যাম। ওদেরও না। তাজা ঘোড়া আর রসদপত্র: নিতে দুজন লোককে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসেছেন ডন ফেডেরিকো। আমার ধারণা:ওরা এবার ওঅটর হোলগুলোয় পাহারা বসাবে।
ওখানকার অবস্থা কেমন?
গরম…একশো ডিগ্রির ওপরে। তবে ড্যানের অসুবিধে হবে না ওর বাবা আর ওই ইন্ডিয়ানরা বহুকিছু শিখিয়েছেন ওকে।
এদিকে আবার আরেক ফ্যাসাদ হয়েছে। ড্যানের খোঁজে বেরিয়েছে অ্যানাবেল।
সর্বনাশ! কেন…?
মেয়েটার কাঁচা বয়েস, তায় প্রেমে পড়েছে। তাই ভয় পাচ্ছে, ড্যান যদি আর না ফেরে।
মনে মনে খিস্তি করল বুশ। কত দূরে গেছে ও? ঝটপট চোখা কয়েকটা প্রশ্ন করল জর্জ। তোলপাড় শুরু হলো ওর মগজে। নিশ্চয় পুনর্মিলনের আশায় অধৈর্য হয়ে আছে মেয়েটি, নাগাড়ে এগোতে চাইবে। টোমাস দক্ষ লোক, কিন্তু ওর যদি কিছু হয়ে যায় তখন? মরুভূমিতে একা হয়ে যাবে অ্যানাবেল, অচেনা তিন পুরুষের সাথে, খুনে ডাকাতুদের এলাকায়। আশ্চর্য, ও ভাবতে পারল কীভাবে ড্যানকে খুঁজে পাবে?
ভীষণ ক্লান্ত সে। মাত্র এসেছে শহরে, অমানুষিক ধকল গেছে পথে। মন্টে আর ওয়েন হার্ডিনেরও এই হাল। তার ওপর হার্ডিন তার প্রিয় বন্ধু মায়রন ব্রডির মৃত্যুতে শোকে কাতর।
বিশ্রাম দরকার তার। তুমি এখন আর যুবকটি নও, নিজেকে বলল বুশ। তবে; বুড়োও হয়নি, তা ছাড়া ওই মরুভূমি, খানিকটা হলেও, তার চেনা।
সম্ভব হলে, টোমাস দেরি করিয়ে দেবে ওকে। এরমধ্যে জায়গাটার মোটামুটি চেহারা যদি দেখতে পায়, হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পারবে মেয়েটা। থামল বুশ। আমি তৈরি হতে বলছি আমাদের ছেলেপুলেদের, তবে ওরাও সবাই ক্লান্ত। তবু যথাসাধ্য চেষ্টার ত্রুটি করব না আমরা।
ইয়াকুব খান অ্যানাবেলের খোঁজে গেছে।
বুশ অর টুপির স্যোএটব্যান্ড মুছল, চেহারা চিন্তিত। ইয়াকুব খান? প্রাচ্যের লোক, পাহাড়ে থাকে, মোটে একবার লোকটাকে দেখেছে ও।
ইয়াকুব ক্যাপ্টেন লরেলের রন্ধু।
কিন্তু ও তো বিদেশি…এখানে কতটা কী করতে পারবে?
ওঁর জন্ম যে-মরুতে সেটা মোহাভের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
ঘোড়ায় চড়তে পারে? মানে, একমাত্র ইংরেজরা ছাড়া, বেশির ভাগ বিদেশিই পারে না কিনা।
ওরা ঘোড়ার পিঠেই মানুষ, মিস্টার বুশ। আর সেখানে যেসব পাহাড়, আমাদেরগুলো সে-তুলনায় একেকটা মাটির ঢিবি।
বেশ, মানলাম। কিন্তু লড়তে জানে?
জানে। এমনকী খালিহাতেও।
চুপ করে রইল বুশ। শেষমেশ ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে। এ-মুহূর্তে মরুভূমিতে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না ওর, কিন্তু সেটা বোঝাবে কী করে? টানা তিন হপ্তা স্যাডলে কাটাতে হয়েছে তাকে। তুমুল লড়াই হয়েছে। তার ওপর সে জানে ড্যানের হদিস বের করা দুষ্কর। মরুভূমিতে আত্মগোপন করবে ও। এমন সব জায়গায় যাবে, সঙ্গে প্রচুর পানি না থাকলে কোন ঘোড়াসওয়ারের পক্ষে যেখানে যাওয়া অসম্ভব।
অ্যানাবেল লরেলকে বুশ চেনে না, তবে ওর দৃঢ় বিশ্বাস মেয়েটি হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসবে। কোন যুবতীই চাইবে না গরমে দগ্ধ হতে, কিংবা রাতে ঘুমোতে খোলা, আকাশের নীচে…।
আর যদি একান্তই কেউ চায়, তা হলে নিঃসন্দেহে সে উন্মাদ। নিজের অজান্তেই, মিস ডায়ানার হাত থেকে কফি কাপটা গ্রহণ করল বুশ।
আরও মানুষজন আসতে শুরু করেছে। ম্যাট কেলার, ডি লা গুয়েরা, সবশেষে বেন উইলসন।
ক্যাপ্টেন লরেলের মেয়ে? জিজ্ঞেস করলেন উইলসন। কেন…?
প্রেম, জানালেন মিস ডায়ানা।
স্মিত হাসলেন উইলসন। বুঝেছি। কিন্তু কারও গিয়ে ওকে ফিরিয়ে আনা দরকার এক্ষুণি। আমি গেছি ওই মরুভূমিতে, ওখানে বেশিক্ষণ থাকলে মারা পড়বে মেয়েটা।
কফি শেষ করে উঠে দাঁড়াল বুশ। আমি দেখছি কী করা যায়।
ড্যান খুব খুশি হবে তোমার ওপর।
জানি, ম্যাম।
মরুভূমিতে যাওয়ার পথ বহু। সে কি পারবে অ্যানাবেলেরটা চিনতে?
কাপের ওপর দিয়ে বুশের দিকে তাকালেন উইলসন। অনেক বড় জায়গা, বললেন।
তাই, বিরস মুখে জবাব দিল বুশ।
আবার ওর পানে তাকালেন উইলসন। মেয়েটার যদি তাড়া থাকে, বোধহয় আছেও, তাজা ঘোড়া দরকার হবে ওদের।
পরস্পর মিলিত হলো ওদের চোখ। বেন উইলসন অনেকের চেয়ে ভাল চেনেন এই দেশটাকে, জানেন একমাত্র কোন্ র্যাঞ্চে তাজা ঘোড়া পেতে পারে ওরা। জায়গাটী আউট-লদের ডেরা, ভাসকুয়েয আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের, এবং উইলসন জানেন সেটা। তিনি এও জানেন, কথাটা বুশেরও অজানা নয়।
দরজায় গেল জর্জ বুশ। মিস ডায়ানার উদ্দেশে ঘাড় ফিরিয়ে হাত নাড়াল।
যখন বন্ধ হয়ে গেল কবাট, ডায়ানা বললেন, ও যেতে চাইছিল না।
এবং সেজন্য ওকে দোষ দেয়া যায় না, জবাব দিলেন উইলসন।
.
১৫.
পাহাড়ি কারনিসে বসে সাঁঝের মরুপ্রান্তরের দিকে আমি তাকিয়ে। আজ চারদিন হলো শেষ শত্রুকে ফেলে এসেছি পেছনে, এ-পর্যন্ত দেখা পাইনি নতুন কারও।
যারা আমার পিছু নিয়েছিল তারা মারা গেছে, ভবিষ্যতে কেউ হয়তো পথের ধারে সাদাটে হাড়গোড় দেখে আর বুকের শূন্য খাঁচায় মরুবাতাসের বিলাপ শুনে চিনতে পারবে ওদের ট্রেইল।
বহু আগেই খালি হয়ে গেছে আমার বাকস্কিনের ওঅটর ব্যাগ, তবে এতে চিন্তার কিছু নেই। এখন আমি যেখানে বসে তার কয়েক গজের মধ্যে পাথরের ফাঁকে চৌবাচ্চা রয়েছে একটা, বৃষ্টির পানি সমেত।
অন্ধকার হতে বেশি বাকি নেই। আজ রাতে চাঁদ থাকবে, দিগন্তবর্তী পাহাড়পর্বতগুলোর উদ্দেশে এগোব আমি। এখন আমি মরুভূমির দক্ষিণ সীমানার কাছাকাছি রয়েছি, তাই অত্যন্ত সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।
সহজাত অনুভূতি আর সাধারণ বুদ্ধি থেকে বুঝতে পারছি কেউ-না-কেউ এত পেতে থাকবে আমার জন্যে। নতুন করে লোকলস্কুর আনতেই শহরে ফিরে গেছেন ডন ফেডেরিকো। আমাকে মৃত দেখতে চান তিনি। এক্ষেত্রে একটি কাজ করলেই সফল হবে ওদের উদ্দেশ্য: মরুভূমির প্রান্তে যেসব ওঅটর হোল রয়েছে সেগুলোয় পাহারা বসানো।
নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, আমাকে পথের কাঁটা ভাবছেন ফেডেরিকো, অথচ নিজেকে আমি কখনও দাদুর সম্পত্তির উত্তরাধিকার ভাবিনি। ডন রোমেরোর কাছ থেকে কখনও কোনকিছু নেয়ার কথা মনে হয়নি, যদিও এর একটা দিক রীতিমত দোলা দিয়েছে আমাকে, দার সমস্ত অপচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে, শেষপর্যন্ত যদি তার, সম্পত্তির উত্তরাধিকার আমি লাভ করি, তবে সেটাই হবে তার মোক্ষম শাস্তি।
উঁচু জায়গা থেকে মরুভূমির চারপাশে নজর বোলাতে বোলাতে এবার আমি অনুমান করতে সচেষ্ট হালাম আমার শক্রর কোথায় কোথায় থাকতে পারে।
আমার বর্তমান পাহাড়ি বিশ্রামস্থল থেকে ওল্ড উওম্যান স্প্রিং পাঁচ মাইলও হবে,; এর কাছেই রয়েছে কটনউড স্প্রিং। আর তার ওপাশে পাহাড়পর্বত, যেখানে আমি যেতে চাইছি।
র্যাবিট স্প্রিংয়ের দূরত্ব হবে পঁচিশ-ত্রিশ মাইল, তবে আমার উল্টো পথে। ফেডেরিকো ঠিক আঁচ করে নেবেন, পাহাড়ের পাদদেশে, উষ্ণ ঝরনার কাছেপিঠে আমার যেসব ইন্ডিয়ান বন্ধুবান্ধবের বাস, আমি সেখানে পৌঁছুবার চেষ্টা করব। এসব পাহাড়ে নয়, আরও দক্ষিণে স্যান হ্যাকিন্টোসে। মরোঙ্গো ভ্যালির ইন্ডিয়ানদের কথা তিনি জানেন কিনা আমি জানি না। এরা মোটামুটি আমার নাগালের ভেতর রয়েছে, এবং বন্ধুও বটে। এইসব ঝরনায় নির্ঘাত লোক রাখবেন ডন ফেডেরিকো।
পানির জন্যে যে আমি মরিয়া হয়ে উঠব, এটা বুঝতে বেগ পাবে না শক্ররা, তাই লম্বা করে দেবে নিজেদের ধৈর্যের সুতোটাকে। তবু এক্ষেত্রে বিশেষ এক সুবিধে রয়েছে আমার। বাল্যে কাউইয়াদের সঙ্গে এখানেই আমি ঘুরে বেড়িয়েছি।
আর একটা মরুপ্রান্তর পাড়ি, এবং আরও একদল সতর্ক পাহারাদার…ব্যস, এদের ফাঁকি দিতে পারলেই আমি নিরাপদ।
স্যান গরগোনিও মাউন্টিন, সাগরসমতল থেকে প্রায় এগারো হাজার ফুট উঁচু, একরকম, আমার নাক বরাবর দক্ষিণে। একটুক্ষণ ওটার পানে চেয়ে রইলাম আমি, তারপর চূড়ার পুব দিকের একটা তারা লক্ষ্য করে হাঁটতে শুরু করলাম।
পা ভেঙে আসছে, কিন্তু আমি নাছোড়। কখনও কখনও চোখ বুজে আসছে শ্রান্তিতে, তবু হাঁটছি অবিরাম। ওই তো আমার তারা দেখা যায়, আরও সামনে…আর একটু…তারপরই আমার পাহাড়।
হঠাৎ ধোঁয়ার গন্ধ পেলাম।
লাকড়ির ধোঁয়া, ক্যাম্পফায়ারের। আধমাইল দূরেও হবে না, বরং কম হতে পারে, ও উওম্যান স্প্রিং, ঝোপঝাড়ের ফাঁকে ক্ষীণ আলোর আভাস।
আগুন। শক্ররা অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। বিশ্রাম নিচ্ছে ওরা, তারিয়ে তারিয়ে পানি আর কফি পান করছে।
আচ্ছা, আমি আগাম ওদেরকে শত্রু ভাবছি কেন? কোন অঘুরেও তো হতে পারে, স্রেফ ক্যাম্প করেছে ওঅটর হোলের কাছে। তারা আমাকে স্বাগত জানাবে, পানি আর খাবারবে।
ঝুঁকি নেয়া কি উচিত হবে? আশ মিটিয়ে পানি খাই না বহুদিন, খিদেও এখন আমার নিত্যসঙ্গী। দোটানায় পড়লাম, কাছে যেতে মন চাইছে, আবার ভয়ও পাচ্ছি। তবু এগোলাম শেষমেশ, থামছি ঘন ঘন। ঝোপের এপাশে ছায়া ফেলে আগুনের ধারে সরে গেল কেউ একজন, তারপর একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম আমি।
খামোকা সময় নষ্ট। খাওয়া আর পানি ছাড়াশরুভূমিতে অ্যাদ্দিন কেউ বাঁচতে পারে না! তার ওপরে ওর কাছে যখন ঘোড়া নেই।
তবু এখানে থাকতে অসুবিধেটা কোথায়? আমরা জে মজুরি পাচ্ছিই।
মুহূর্তের জন্যে হতাশায় আমার চোখের সামনে পৃথিবী দুলে উঠল; তারপর ঘুরে পাশ কাটালাম ওদের। টলতে টলতে হাঁটতে লাগলাম আধ-ঘুম আধো-জাগরণে। স্যাডলক স্প্রিং দশ মাইল…না, বেশি। অন্ততপক্ষে বারো মাইল।
কাছাকাছি আরেকটা ঝরনা রয়েছে, কিন্তু ওটার ওপরেও সম্ভবত নজর রাখা হবে। এলোমেলো পায়ে, হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে চললাম আমি। পা ক্ষতবিক্ষত, চামড়া ফেটে গেছে।
এখন আমি বেঁচে আছি শুধুমাত্র পানির জন্যে, ভালমন্দ একরকম হলেই হলো, কোন জায়গায়। টু হোল স্প্রিংয়ের নাম শুনেছি আমি…স্যাডলরকের চেয়ে কাছে হবে ওটা। পানি ছাড়া আর একমুহূর্ত বাঁচব না আমি।
অকস্মাৎ আকাশছোঁয়া পর্বতমালা মাথা জাগাল সামনে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম, ধোঁয়ার গন্ধ পেলাম নাকে, থমকে দাঁড়ালাম। ছড়ানো-ছিটানো কয়েকটা ঝোপ আর পাথরের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতেই, আগুনের শিখা চোখে পড়ল। সন্তর্পণে আরেকটু কাছে এগিয়ে গেলাম।
আগুন…আর একজন মানুষ। বিশালদেহী এক অ্যাংলো, মুখে চাপদাড়ি। ঝাঁকড়া চুল। আগুনে লাকড়ি ফেলল ও। কফির সুবাস পেলাম আমি। খিদেয় হুঙ্কার ছাড়ল পেট। কফি খাবার আর পানির কথা ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলাম আরও কাছে।
লোকটা দেখতে পেল আমাকে।
কাপ ভরে নেয়ার জন্যে কফিপটটা তুলে নিয়েছে ও, এই সময়ে তার চোখ পড়ল আমার ওপর। ধীরে ধীরে, সাবধানে, মুহূর্তের তরেও দৃষ্টি অন্যদিকে না সরিয়ে, কফিপটটা নামিয়ে রাখল দুবৃত্ত। হলদেটে দাতে সিগারের গোড়া চেপে ধরল, জিভ দিয়ে ঠেলে নিয়ে এল ঠোঁটের কোণে।
ওর গোঁফ থুতনি-ছোঁয়া। পরনের শার্টখানা নোংরা। আস্তে আস্তে সোজা হলো সে, সিগারের ধোঁয়া টানল।
এরপর ঠোঁটের ফাঁকে হাসল সে, ঠাণ্ডা মাথায় হাত বাড়াল পিস্তলের দিকে। হতভম্বের মত আমি চেয়ে রইলাম ওর দিকে। অবসাদে ঘোলা হয়ে গেছে আমার বুদ্ধি। দেখলাম পিস্তলের বাঁট আঁকড়ে ধরেছে ওর হাত, হোলস্টার মুক্ত হয়ে উঁচু হচ্ছে ক্রমশ, দুবৃত্তের হলদেটে দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছে, মুখে নেকড়ের হাসি, পিস্তল তাক করছে আমার দিকে। এবার আমি গুলি করলাম।
ডান হাতে রাইফেল ধরে রেখেছিলাম, কোমরের কাছ থেকে গুলি করলাম। বুলেটটা আঘাত করল ওকে, এক পা পিছিয়ে গেল সে, চোখে অবিশ্বাস। তারপর গর্জে উঠল ওর পিস্তল, আমার পায়ের কাছে মাটিতে বুলেট বিঁধল। আগে বেড়ে, রাইফেলের ব্যারেল, দিয়ে সপাটে ওর বাহুতে আঘাত করলাম আমি, পিস্তলটা ডানা মেলল শূন্যে।
হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল দুবৃত্ত, আতঙ্কিত দৃষ্টিতে দেখছে আমাকে, জামাকাপড় রক্তে ভিজে যাচ্ছে। ওর কাপ তুলে নিয়ে কফি ঢেলে নিলাম আমি। তারপর বাঁ-হাতে কাপটা উঁচু করে ভান করলাম স্যালুট দেয়ার,গ্রেসিয়াস,বলে চুমুক দিলাম কফিতে।
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শ্রাগ করল ও, যেন বলতে চাইল: খাও তোমার যত খুশি। আবার কফিপান করলাম আমি।
লোকটার এক হাত মাটিতে; অপরটার সাহায্যে তলপেটে যেখানে বুলেট ঢুকেছে। সেই জায়গাটা চেপে ধরেছে।
মাত্র পঞ্চাশ ডলারের জন্যে, নিজের করুণ পরিণতির কারণ ব্যাখ্যা করল ও।
ওটাই অনেক টাকা, প্রয়োজনের সময়, ঐকমত হালাম আমি, একটু থেমে যোগ করলাম, তুমি কিন্তু চমৎকার কফি বানাও।
পোর নাদা, বলল সে।
কফি শেষ করে আবার ভরে নিলাম কাপ। এখনও যন্ত্রণার ছাপ ফোটেনি ওর চেহারায়। ওরা আসবে, বলল লোকটা। গুলির আওয়াজ…।
জানি, সায় দিলাম আমি।
হাত ইশারায় নিজের জিনিসপত্রগুলো দেখাল ও। ওখানে বেকন আছে, বলল। কিন্তু তোমার সময় নেই।
নেব ওগুলো? কফি?
অবশ্যই নেবে, বলল চাপদাড়ি, তারপর থেমে যোগ করল, ওল্ড উওম্যানে অপেক্ষা করছে ওরা। আমার মনে হয় না তুমি পার পাবে।
কী জানি, কাঁধ ঝাঁকালাম আমি। দুটো স্যাডলব্যাগ আছে দেখছি।
ওগুলোতেই পাবে কফি আর বেকন।
নেব…পটটাও।
মাত্র পঞ্চাশ ডলারের জন্যে, আবার বলল সে। এখানে এলে পঞ্চাশ, আর তোমাকে শেষ করতে পারলে আরও একশো।
তাই? তোমার কপাল মন্দ, বললাম। কম্পিত হাতে ধীরে-সুস্থে রিলোড করলাম আমার রাইফেলটা। এ-মুহূর্তে প্রতিটা গুলিই অত্যন্ত মূল্যবান আমার জীবনের জন্যে। স্যাডলব্যাগের পাশে ক্যান্টিন ছিল একটা। ওগুলো কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে, কাপ আর কফিপটখানা তুলে নিলাম।
ঘোড়াও আছে, বলল ও। তুমি নিয়ে যাও।
ধন্যবাদ, আবার বলে পা বাড়ালাম ঘোড়ার দিকে, কাঁধের ওপর দিয়ে লোকটাকে বললাম, অন্য সময় হলে, আমি হয়তো ড্রিংক কিনে দিতাম তোমাকে।
জানি, বলল সে, এবং আমি তোমাকে।
এখন ও রক্তের পুকুরে বসে। হাত তুললাম আমি। অ্যাডিয়োস! বললাম। সেও আমাকে হাত নেড়ে বিদায় জানানোর প্রয়াস পেল-কিন্তু পারল না।
ক্যাম্পফায়ারের আলোর প্রান্তে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার বাঁধন খুললাম আমি। পঞ্চাশ ডলারনা? বললাম। এমন কিছু বেশি নয়।
কী জানি? বলে পাথরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল চাপদাড়ি, চোখ স্থির আগুনের দিকে।
বিদায়, আবার বললাম, কিন্তু লোকটা কোন জবাব দিল না।
ঘোড়াটা ক্লান্ত, তবে আমার মত নয়। ওর পিঠে চেপে আমি র্যাটলম্নেক ক্যানিয়নে ঢুকে গেলাম, টিলাটরের মাঝ দিয়ে এগোলাম সাডলরকের উদ্দেশে। আমার ক্যান্টিনে পানি বেশি নেই। তবে স্যাডলকে ভরে নিতে পারব যদি কোন পাহারা না থাকে ওখানে।
ছিল না। স্যাডল থেকে নেমে, ক্যান্টিনটা, ধুলাম ভালমত, ভরে নিয়ে যাত্রা করলাম ফের।
শিগগিরই এসে পড়বে ওরা। অথচ আমার লড়াই করার শক্তি নেই এখন।
মরোঙ্গো ভ্যালি। কতদূর হবে? দশমাইল…নাকি আরও বেশি?
গুলির আওয়াজ শুনতে পাবে ওরা। এমন নিস্তব্ধ রাতে বহুদূর থেকে শোনা যাবে…দুটো গুলি!
পেটে দানাপানি আর কফি পড়ায় আমার বুদ্ধি এখন খোলতাই হয়েছে আবার।
বার্নস ক্যানিয়ন ট্রেইল ধরে ধেয়ে আসবে দুবৃত্তরা, মরোঙ্গোতে আমার যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেবে। ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার কথা নিশ্চয়ই জানে লোকগুলো, যেমন জানত আমার বাবার বেলায়।
আমার পথ আগলে দাঁড়াবে ওরা,তাড়িয়ে নিয়ে যাবে মরুভূমিতে।
না আর নয়। খোদা…আর যেন না ঘটে অমনটা।
ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে, নিচু শৈলশিরা পার হওয়ার রাস্তা সন্ধান করলাম আমি এবং পেয়েও গেলাম।
সামনে উন্মুক্ত তরাই, এখানে-সেখানে জশুয়াগাছ। এগোলাম ওগুলোর মাঝ দিয়ে, একঝাঁক বোল্ডারের সামনে গিয়ে পড়লাম, পাশ কাটালাম অনেকটা ঘুরে। তারপর শুনতে পেলাম ওদের আওয়াজ।
বানর্স ক্যানিয়ন ট্রেইল ধরে ছুটে আসছে ঝড়ের বেগে, কোলাহল থেকে বুঝলাম বিরাট দল। চ্যাপারোসা স্প্রিংয়ের দিকে ঘোড়া হাঁকালাম আমি, মনে আশা শত্রুদের পাশ কাটিয়ে আগেভাগে পৌঁছুতে পারব, মরোঙ্গো উপত্যকায়।
সহসা বুনো চিৎকার ভেসে এল একটা, তারপর গুলি। চ্যাপারোসায়ও রয়েছে একদল, জনাপাচ-ছয়েক, আটকাতে চাইছে আমাকে। এবার গুলি করলাম আমি; আবার। লাফিয়ে উঠল আমার ঘোড়া, হোঁচট খেল।
কী ব্যাপার? ঝটিতি মরুভূমিতে ঢুকে গেলাম আমি, ঘোড়ার পা বিষম তালে পড়ছে। গুলি লেগেছে ওর গায়ে।
প্লিজ, ফিসফিস করে মিনতি করলাম, আরেকটু সামনে! প্লিজ!
লড়াকু মনোভাব নিয়ে, বেপরোয়া ভঙ্গিতে ছুটে চলল ঘোড়াটা। তারপর অকস্মাৎ পড়ে, গেল হুমড়ি খেয়ে, আর আমি লাফিয়ে নেমে পড়লাম মাটিতে, দৌড়তে লাগলাম।
তাড়াহুড়োয় কখন যেন হাতছাড়া হয়েছে রাইফেল, কেবল ক্যান্টিন আর স্যাডলব্যাগ দুটো আছে সঙ্গে। প্রাণপণে ওগুলোকে জড়িয়ে ধরলাম আমি, কতকগুলো পাথরাই চোখে পড়তে ঢুকে গেলাম সেখানে, দৌড়ে একটা ঢালের নীচে নেমে, আরও বোন্ডার আর জয়া বনের ভেতর দিয়ে এঁকেবেকে ছুটে চললাম।
বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর থেমে কান পাতলাম, টের পেলাম ওরা দক্ষিণে চলে যাচ্ছে। সন্দেহ নেই, অচিরেই মরা ঘোড়াটা চোখে পড়বে ওদের, এবং শুরু হবে তল্লাশি।
আর কয়েক মিনিট…মোটে কয়েকটা মিনিট…
আসছে ওরা।
২.৪ আগুনের পাশে বসে
আগুনের পাশে বসে রয়েছে অ্যানাবেল, হাত কোলের ওপর। আগুনের দিকে অপলকে চেয়ে আছে ও, ভয়ার্ত দৃষ্টি। বোকামি করেছে সে, চরম বোকামি, এখন ফেঁসে গেছে।
ওর উল্টো দিকে রয়েছে টোমাস, রান্না করছে। ওই বৃদ্ধও বেকায়দায় পড়েছে, এবং সেজন্যে দায়ী অ্যানাবেল। ওকে অনেক বুঝিয়েছিল টোমাস, বলেছিল এই বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে একজন মানুষকে খুঁজে বের করা অসম্ভব। কিন্তু বিশ্বাস করেনি ও, আর এখন দেরি হয়ে গেছে প্রচুর।
তৃতীয় দিন থেকে অ্যানাবেল উপলব্ধি করতে শুরু করে, ওর ধারণা কতখানি অসার কিন্তু ওর জেদ ওকে ফিরতে দেয়নি, ড্যানকে খুঁজে পাবে না এটা বিশ্বাস করতে পারেনি ও। কেবলই মনে হয়েছে ওকে তার পেতেই হবে।
আরও দুজন লোক রয়েছে ওদের সঙ্গে। একজন, নাম ইগলেসিয়াস, আগে কখনও কাজ করেনি টোমাসের সাথে, ওদের অভিযানের কথা জানতে পেরে স্বেচ্ছায় সঙ্গী হয়েছে। শুরু থেকেই অ্যানাবেলকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে লোকটা। সবসময় ঘুরঘুর করে ওর আশপাশে, ইঙ্গিতপূর্ণ কটাক্ষ হানে।
একবার, অ্যানাবেলকে সে বলেছে, টোমাস বুড়ো হয়ে গেছে। তোমার কোন উপকারে আসবে না।
তৃতীয় দিন রাতে পাহাড় থেকে আরও দুজন লোক এসে যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে। নিজেদের পরিচয় দেয়নি ওরা, তরে কথাবার্তায় বোঝা গেছে ইগলেসিয়াসকে তারা চেনে।
সন্দেহ নেই, এই সাক্ষাৎ পূর্বপরিকল্পিত। ওর দিকে নির্লজ্জের মত তাকায় ওরা, এবং তখন ওর শরীরের যত্রতত্র ঘোরাফেরা করে ওদের চোখ, মুখ টিপে হাসে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে।
একজন তো বলেইছে, শিগগিরই।
এখন ফিরে যেতে চায় অ্যানাবেল, কিন্তু ভয় পাচ্ছে সেক্ষেত্রে বিপদ আরও তুরান্বিত হবে। বরং ধৈর্য ধরলে, কিছু একটা ঘটতে পারে।
অত্যন্ত ভয়ের মধ্যে রয়েছে সে, কিন্তু অন্যদের তা জানতে দেয়া চলবে না। ছোট্ট একটা পিস্তল আছে তার কাছে, মেয়ের জন্মদিনে বাবার উপহার, তবে সেটা লুকিয়ে রেখেছে সে, ওরা হদিস পায়নি।
এখন আর সে ড্যানের কথা ভাবতে পারছে না। সর্বক্ষণ মনোযোগ রাখতে হচেছ বর্তমান পরিস্থিতির ওপর। টোমাস তাকাল ওর পানে। বুড়ো জানে সবই বোঝে অ্যানাবেল, একটা কিছু বিহিত করার জন্যে সদাপ্রস্তুত রয়েছে।
আদৌ যদি সম্ভবপর হয় কিছু করা।
ড্যান নিশ্চয় কাছেপিঠে আছে কোথাও, অকস্মাৎ নীরবতা ভেঙে বলল অ্যানাবেল। এরচেয়ে বেশিদূরে ও যাবে না।
অ্যানাবেল জানে ওর ধারণা সত্যি নয়, ড্যান আশপাশে কোথাও নেই, তবু আশা করল ওর সঙ্গীসাথীরা বিশ্বাস করবে একথা।
আগুনের ধার থেকে আড়মোড়া ভাঙল টোমাস। ঠিক, বলল, যে কোন মুহূর্তে এসে পড়বে।
অন্যরা আমল দিল না ওদের কথায়। কেবল টোমাসের অধীনে যে-ছেলেটি কাজ করে সে ছাড়া। চুপ করে রইল ও, ভয়ে।
তুমি খুবই ছোট, দলের একজন বলল ওকে, তবু ইচ্ছে করলে মজা লুটতে পার। ওই বুড়ো মিঞাকে ভয় পাবার কিছু নেই, ওর বিষদাত ভাঙা।
বক্তা, যাকে ওরা সবাই বিসক্যাল নামে ডাকে, এবার তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে অ্যানাবেলের উদ্দেশে ফিরল। আমরা জানি ও কোথায়। মরুভূমিতে, পায়ে হেঁটে পালাচ্ছে, প্রতিপক্ষের তাড়া খেয়ে। এতক্ষণে হয়তো শকুনের খোরাক হয়ে গেছে।
ও আসবে না। বিসক্যাল হাসল দাঁত কেলিয়ে। কেউ আসবে না। আমরা একা।
ক্যাপ্টেন লরেল সাহসী মানুষ, টোমাস মুখ খুলল এবার, ভয় কাকে বলে জানেন না। মেক্সিকোতেও তার ক্ষমতা অসীম।
ফুঃ! সে এখন সমুদ্রে। যখন ফিরকে সবাই জানে মেয়েটা পাহাড়ে গেছে, কে বলতে পারে কোন ভালুক খেয়েছে ওকে?
যে-কথাটি প্রচ্ছন্ন ছিল, এ-যাবৎ এখন তা উলঙ্গ হয়ে পড়েছে। আমার বন্ধুবান্ধবদের তোমরা চেন না, অ্যানাবেল বলল। আমার কোন ক্ষতি হলে, নরক পর্যন্ত ধাওয়া করবে তোমাদের, ফাঁসিতে লটকে দেবে।
খিকখিক করে হাসল বিসক্যাল। তুমিই প্রথম নও, তবু ফাঁসি হয়নি আমার। যদিও, আবার বলল সে, তুমিই সবচেয়ে খাসা। ওদের কথা দিয়েছি, নইলে আমি একাই ভোগ করতাম।
এখনও ভয় পাচ্ছিল অ্যানাবেল, তবে এবার কী-যেন একটা জেগে উঠেছে ওর ভেতরে, প্রস্তুত হয়ে আছে। যখন সময় আসবে, লোকটাকে কাছে আসার সুযোগ দেবে সে এবং ওকেই হত্যা করবে আগে।
ছেলেটা সাহায্য করবে ওকে, অ্যানাবেল নিশ্চিত, এবং টোমাসও, কিন্তু শত্রুরা তিনজন। সুতরাং, একজনকে নিকেশ করতে হবে ওর, দ্রুত এবং নিশ্চিতভাবে।
ও আমার আশ্রয়ে আছে, শান্ত কণ্ঠে বলল টোমাস। ওর কোন ক্ষতি করা চলবে না।
বোকামি কর না, বুড়ো মিঞা। এসবের বাইরে থাক, হয়তো বেঁচে যাবে তুমি। অবশ্যি এ-ব্যাপারে এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেইনি আমি, তবু তুমি যদি বুদ্ধিমান হও…হয়তো বাচতেও পার?
আগুনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল টোমাস। কয়লাগুলো নেড়েচেড়ে দিল একটু, কফিপটটাতে নিয়েও শেষমুহূর্তে এক ঝটকায় সরিয়ে নিল হাত, দৃষ্টি বিনিময় করল অ্যানাবেলের সাথে। আভাসে মেয়েটিকে কিছু জানাল সে।
কফি, গরম কফি। ওটাও একটা অস্ত্র। অ্যানাবেলের মনে পড়ল ওর বাবা একদা বলেছিলেন, কৌশল জানলে যে কোন জিনিসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আগ্নেয়াস্ত্র আবিষ্কৃত হওয়ার শত-সস্র বছর আগেও মানুষ মানুষকে হত্যা করেছে। বন্দুক যদি নাও থাকে, কিছু-না-কিছু থাকেই সবসময়।
সতর্ক থাকতে হবে ওকে, সুযোগ বুজতে হবে। এটাই আসল। পালালে চলবে, কারণ ভারি কাপড়চোপড় পরে দৌড়ে ওদেরকে হারাতে পারবে না সে, বরং সে চেষ্টা করলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ব্যাপারটা সম্পর্কে এবার আরেকটু খতিয়ে ভাবুল ও। কফি একটা অন্ত্র, তবে আরও বহুকিছু আছে। আগুনের কাছাকাছি লম্বা লাঠি পড়েছিল একটা। ওটা তুলে নিয়ে আগুনে গুঁজে দিল ও, যেন জ্বালানি ফেলছে। ওই লাঠিখানা রয়েছে..
আমাদের খাবার দাও, টোমাস। ফুর্তি-ফার্তা পরে হবেখুন। ঘাড় ফিরিয়ে অ্যানাবেলের দিকে আড়চোখে কটাক্ষ হানল বিসক্যাল। জানো, তোমাকে প্রথম যেদিন শহরে দেখি, সেদিনই মনে হয়েছিল কীভাবে তোমাকে মুঠোয় পোরা যায়। নীরব বন্ধুদের উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল ও। ব্যাপারটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনাও করেছিলাম আমরা। তারপর তুমি যখন পাহাড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে…তোফা! এর চেয়ে ভাল কোন ফন্দি আমরাও আঁটতে পারতাম না!
এখনই কি গুলি করা উচিত ওকে? আচমকা? নিজের কুমতলব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে লোকটা। এখন সে যদি কোনরকম, আগাম হুঁশিয়ারি না দিয়ে গুলি করে, হয়তো হকচকিয়ে দিতে পারবে ওদের। হয়তো একজনকে মারলেই তার উদ্দেশ্য সফল হবে।
তাই বলে ঠাণ্ডামাথায় খুন? আত্মরক্ষার জন্যে করতে দোষ কী? ওর রাইডিং ড্রেসের পকেটের ভেতর চোরাপথ আছে একটা, ওখান দিয়ে পিস্তলটা বের করা যায়। এই বুদ্ধিটি ওর বাবার, কিন্তু ও স্বপ্নেও ভাবেনি কোনদিন এর প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।
কিন্তু বিনা অজুহাতে পকেটে হাত দেয়া চলবে না, সন্দেহ জাগতে পারে ওদের মনে। হ্যা…পাওয়া গেছে…যখন সময় আসবে, সর্দি ঝাড়ার ভান করবে সে, রুমাল নেয়ার ছলে হাত ঢোকাবে পকেটে, তারপর গুলি করবে লোকটাকে।
পিস্তল বের করার প্রয়োজন নেই, কাপড়ের ভেতর থেকেই গুলি করা যাবে।
ইগলেসিয়াস তাকিয়েছিল ওর দিকে। তুমি ভয় পাওনি মনে হচ্ছে? খানিকটা বিস্মিত দেখাল ওকে।
ভয়? কেন? ঈষৎ সামনে ঝুঁকল অ্যানাবেল। ড্যানকে তোমরা অ্যাকশনে দেখেছ কখনও? ভীষণ, ক্ষিপ্র, ঠিক ওর বাবার মত। জানো না, একবার ঘোড়া ছিনতাই করতে এসে কী রকম বেকায়দায় পড়েছিল ডাকাতরা? ও একাই ঠেকিয়ে দিয়েছিল সবাইকে।
এস! আচমকা ডাকল টোমাস। খাওয়ার সময় হয়েছে। দয়া করে আগুনের পাশে সরে এস সবাই। হাত ইশারায় টুটিয়ার একটা তৃপ দেখাল ও।নিজেরাই বেড়ে নাও।
স্নিগ্ধ নক্ষত্রালোকিত রাত। বাতাসে লাকড়ি-পোড়া গন্ধ। আকাশ পানে তাকাল অ্যানাবেল, তারপর আগুনের দিকে। মনে মনে বলল:
ড্যান তুমি কোথায়?
এত বোকা সে, কি এখন আক্ষেপ করেও আর লাভ নেই কোন।
কোথায় ড্যান? কথাটা কি সত্যি, শত্রুপক্ষ মরুভূমিতে তাড়িয়ে ফিরছে ওকে? হয়তো এখনও ওখানেই আছে ও, ধুকে মরছে-একা।
এ-ব্যাপারে কিছুই করার নেই তার, ড্যানও ওকে সাহায্য করতে পারবে না কোন। যা করবার, তাকেই করতে হবে। আমি অপেক্ষা করব না, নিজেকে বলল অ্যানাবেল। এখুনি গুলি করব বদমাশটাকে।
লোকটা তৈরি হওয়ার আগেই। কোনরকম ব্যবস্থা নিতে পারার আগে। আচমকা গুলি করব ওকে, এবং অন্যরা এতে ভয় পেয়ে যাবে।
অকস্মাৎ মাথা উঁচু করল একটা ঘোড়া, নাক ফোলাল। দেখ! সবিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল অ্যানাকেল। কেউ একজন আছে ওখানে!
সচকিত হয়ে তাকাল ওরা। আগুনের পাশে উবু হয়ে বসেছিল ইগলেসিয়াস, উঠে অন্ধকারের ভেতর উঁকি দিল।
কয়েটি, বলল ও।
তাই কি? জিজ্ঞেস করল অ্যানাবেল।
অস্বস্তিভরে চারদিকে নজর বোলাল বিসক্যাল। নিচু কণ্ঠে স্প্যানিশে ইগলেসিয়াসকে বলল কী-যেন, জবাবে অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল দ্বিতীয়জন। আরেকটা টটিয়া তুলে নিল বিসক্যাল, একমুঠো মটরশুটি আর মাংস পুরল মুখে। পাশাপাশি, সতর্ক।
আরেকটু এগিয়ে বসল অ্যানাবেল, পট থেকে খানিকটা খাবার নিজের প্লেটে বেড়ে নিয়ে খেতে শুরু করল। বেশ মজা হয়েছে, টোমাস, প্রশংসা করল ও। তোমার রান্না ভাল। তা, এবার কি একটু কফি পাব?
আলবত, সিনোরিটা! একটা কাপ ভরে নিয়ে অ্যানাবেলের দিকে এগিয়ে দিল। বুড়ো, অ্যানাবেল নিয়ে কফিপান করল এক চুমুক, তারপর কাপটা কাছেই একটা পাথরের ওপর রেখে দিল। ওরা কি লক্ষ্য করেছে বাঁ-হাতে কাপ ধরেছিল সে? বোধহয় না, তবে ইগলেসিয়াস দেখছিল ওকে, বিচলিত দৃষ্টিতে।
আবার মাথা উঁচু করল ঘোড়াটা, কান খাড়া। অন্যরাও। সংকটাই চেয়ে আছে অন্ধকার পানে; তারপর ঘাড় ফেরাল একটা, আগুনের ওপাশে কীসের দিকে যেন তাকাল।
খিস্তি করে উঠে দাঁড়াল বিসক্যাল, উঁকি দিল অন্ধকারের ভেতর। বস তো, বিরক্তির সুরে বলল ইগলেসিয়াস। তুমি দেখছি মেয়েমানুষের মত ছটফট করছ!
কিছু একটা আছে ওখানে, অস্ফুট স্বরে বলল বিসক্যাল। আমার ভাল ঠেকছে।
তিনজন শক্তসমর্থ বেয়াড়া লোকের বিরুদ্ধে একজন বুড়ো, একটি ছেলে, আর অসহায় এক নারী। একজনকে গুলি করবে সে, ভাবল অ্যানাবেল, কফি ছুড়বে আরেকটার ওপর, যদি সম্ভবপর হয়। তৈরি থাকতে হবে তাকে, সুযোগ কিছুই হারানো চলবে না।
কী ওটা? আচমকা প্রশ্ন করল অ্যানাবেল।
পলক তুলল বিসক্যাল। কী? কী শুনতে পেয়েছ তুমি?
কিছু একটা…ঠিক জানি না। একটা শব্দ। আ—
কিস্যু না! রাগে গজগজ করে উঠল ইগলেসিয়াস। যত্তসব।
অস্বস্তিভরে আবার ডাইনে-বাঁয়ে তাকাল বিসক্যাল। কফিপটের ওপর উবু হলো টোমাস, তারপর আধসোজা হয়ে কান পাতল বাতাসে। বিসক্যাল নিজের ঠোঁট ভেজাল, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।
তৃতীয় লোকটি চুপ করেছিল এতক্ষণ, এবার পালা করে সঙ্গীদের দিকে তাকাল সে। সব গর্দভের দল! অবজ্ঞার স্বরে বলে উঠে দাঁড়াল দুর্বৃত্ত। আমি আর অপেক্ষা করব না। আমি তৈরি।
হঠাৎ সভয়ে পিছু হটল একটা ঘোড়া, ব্যাপার দেখতে ঘুরে তাকাল সবাই।
আর ঠিক এ-সুযোগটিকেই কাজে লাগাল অ্যানাবেল, বা-হাতে কাপ নিয়ে উঠে দাঁড়াল। টোমাসের পানে চকিতে তাকাল সে, ঘাড় কাত করল সামান্য। ওর ডান হাত ঢুকে গেল পকেটে, চোরাপথ হয়ে আঁকড়ে ধরল ছোট্ট পিস্তলটা।
ছেলেটিও, টোমাসের সংকেত পেয়ে, উঠে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যে। ইগলেসিয়াসের ওপর নজর রাখছে।
এবারে শব্দটা সবাই শুনল ওরা, কী-যেন নড়ছে অন্ধকারে। একটা পায়ের আওয়াজ শোনা গেল, আরেকটা, তারপর শুনশান।
কে ওখানে? চ্যালেঞ্জ করল বিসক্যাল!
দমকা হাওয়ায় নড়ে উঠল গাছের পাতা। আর কোন সাড়াশব্দ নেই। তৃতীয়জনের দিকে নিজের মনোযোগ ফেরাল অ্যানাবেল, লোকটা চোখ দিয়ে যেন গিলছে ওকে। এখন, বলল সে, তুমি আমার কাছে এস, সুন্দরী। যদি একটু মিনতি কর, হয়তো বেশি ব্যথা দেব না?
সাবধান! তীক্ষ্ণ স্বরে ধমক লাগাল অ্যানাবেল।
ইগলেসিয়াস তার কফি কাপ ফেলে দিল মার্টিতে। এবার! এবার তাহলে খেলা! দুহাত শূন্যে ছুড়ে বলল সে। আমি আগে…আমি…
.
১৭.
দরজায় আলতো টোকার শব্দে এক মুহূর্ত অনড় বসে রইলেন মিস ডায়ানা। এখন রাত অনেক, অতিথি আসার সময় নয়, তা ছাড়া অ্যালেক্সিস ফুলটন আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে কারও ডাকে দরজা খোলার ব্যাপারে তিনি সতর্কতা অবলম্বন করছেন। উঠে, মেঝে অতিক্রম করলেন ডায়ানা, অপেক্ষা করলেন একটুক্ষণ, তারপর আবার যখন টোকা পড়ল, মৃদু সুরে জিজ্ঞেস করলেন, কে?
আমি, ম্যাম, কেলসো।
কবাট খুললেন ডায়ানা, ঝটিতি ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল কেলসো, টুপি নামাল মাথা থেকে। এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করছি বলে আমি দুঃখিত, ম্যাম। কিন্তু আপনার বাতি জ্বলছে দেখে ভাবলাম, আপনি হয়তো এখুনি জানতে চাইবেন।
অ্যানাবেল লরেলের ব্যাপারে? নাকি ড্যান?
না, ম্যাম। অনেকদিন আগে একজন সম্পর্কে আপনি আমাকে খোঁজখবর নিতে বলেছিলেন। ওই যে…টিয়া এলেনার সাথে একই জাহাজে চড়ে এসেছিল যে ছেলেটি।
ওঃ, হা-হ্যাঁ। ভুলেই গিয়েছিলাম।
অদ্ভুত এক খবর জানলাম। মনে আছে আপনার, একটা মেয়ের কথা আমরা শুনেছিলাম? ছেলেটাকে নিয়ে এক রাতে উধাও হয়েছিল? ও ছিল ফেলিপির বোন।
ফেলিপি?
সেই ভ্যাকুয়েরো, ডন রোমেরোর রেঞ্জের এক পাহাড়চূড়া থেকে পড়ে গিয়েছিল।
এবার মনে পড়ল ডায়ানার কৌতূহল বোধ করেছিলেন তিনি। যদিও কেন, তা মনে করতে পারলেন না। বহুকিছুই ঘটে গেছে ইতিমধ্যে, ড্যান, লাপাত্তা হয়েছে মরুভূমিতে, অ্যানাবেল ও সন্ধানে গেছে।
নিজের ছেলের মত ওকে ভালবাসত মেয়েটি। সবসময় যত্ন নিত ওর। পাইপ বের করল কেলসো। খেলে আপত্তি আছে, ম্যাম? বেশ লম্বা-চওড়া কাহিনি।
এমনিতেই রাত যথেষ্ট এখন, তার ওপর ড্যান আর অ্যানাবেলের কুশল জানার জন্যে উতলা হয়ে আছেন তিনি। ওর খোঁজে দুর্গম প্রান্তরে ফিরে গেছে জর্জ বুশ। উপরন্তু তারও বিশ্রাম দরকার, ঘুম পেয়েছে। তবু, কেলসোর আগ্রহে বাদ সাধতে চাইলেন না ডায়ানা; নোকটা সৎ, পরিশ্রমী, ওর কথা শুনবেন তিনি।
কফি খাবেন? মোটামুটি গরমই আছে; যদিও তেমন টাটকা হবে না।
অভ্যেস আছে। বেল্টে ম্যাচ ঘষে পাইপে অগ্নিসংযোগ করল কেলসো। ওই ছেলের নাম আলফ্রেডো। ওকে সরিয়ে ফেলার জন্যে টাকা দেয়া হয়েছিল মেয়েটাকে। তবে ওর কোন সন্তান ছিল না, তাই ছেলেটার মায়ায় পড়ে যায়। ওকে পাহাড়ে নিয়ে আসে সে…ইন্ডিয়ান অঞ্চলে। ছেলেটিকে মানুষজনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল ও, তাই নিজের কাছেই রাখত সর্বদা।
এরপর এক লোকের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয় ওর। থাকতে-রু করে একসঙ্গে। লোকটা ছিল অ্যাংলো..নানাধরনের কাজ করত। ছেলেটিকেও পুষ্যি নেয় সে। মাঝেসাঝে মিশন থেকে ওকে ছবির বই-টইও এনে দিত।
কেলসোর কাপ আবার ভরে দিলেন মিস ডায়ানা। উঠতে চাইছিলেন তিনি, পরক্ষণে ভাবলেন কেলসো নিশ্চয় বুঝেছে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ, নইলে এমন রাতদুপুরে তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে আসত না।
এইসব বই-ই হয়ে ওঠে ওই ছেলের জগৎ। ও যেখানে থাকত, শ্বেতাঙ্গ মানুষ সেখানে ছিল না বিশেষ, আর ইন্ডিয়ানরাও তেমন লেখাপড়া জানত না। আমার বিশ্বাস দারুণ নিঃসঙ্গ জীবন কেটেছে ওর, বিশেষ করে মেয়েটি মারা যাওয়ার পর।
মারা যাওয়ার পর?
হ্যাঁ, ম্যাম। ও, মারা যাওয়ার পর ছেলেটা উধাও হয়ে যায়। অবশ্যি তখন আর ছোটটি নেই সে। বছর চোদ্দ-পনেরো হবে, চাই কি আরেকটু বেশিও হতে পারে।
যারা ওকে চিনত তাদের কাছে ও ছিল হেঁয়ালি। তারপর একদিন নিজে থেকেই চলে গেল কোথায় যেন।
সত্যিই দুঃখজনক, মিস্টার কেলসো। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না–।
তবে সেই লোকটা…স্প্যানিশ মেয়েটির সাথে থাকত যে, তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ওর। কিন্তু লোকটা ওর হদিস কারোকে দেয়নি…কারোকে না।
ভীষণ ক্লান্ত বোধ করছিলেন ডায়ানা। উঠে বাসনকোসন গোছাতে শুরু করলেন, আশা করছেন কেলসো এবার বিদায় নেবে। কাপহাতে আগুনের দিকে তাকিয়েছিল কেলসো, হঠাৎ পলক তুলল।
বুঝলেন, ম্যাম, ওই লোকটা…স্প্যানিশ মেয়েটির সঙ্গে যার প্রেম ছিল…বিশেষ মিশত না কারও সাথে। তবে একজন ছিল, যাকে সে বন্ধু মনে করত।
দেখুন, মিস্টার কেলসো, রাত অনেক হলো, আমি
উঠে দাঁড়াল কেলসো। দুঃখিত, ম্যাম। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আপনার জানা দরকার। ওই লোক যাকে বন্ধু বলে দাবি করত তার নাম-ডগলাস ও’হারা।
একমুহূর্ত নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলেন ডায়ানা, কিন্তু শেষপর্যন্ত জয় হলো কৌতূহলেরই। আপনি বসুন, মিস্টার কেলসো। কফি নিন আরেকটু।
যা বলছিলাম, ওই লোক মিশত না কারও সাথে, তবে ওর সদ্গুণও ছিল কিছু। আনুগত্য তার একটা। তাই যখন সে শুনল তার বন্ধু ড্যগ ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরে আসছে তখন আগে বেড়ে মরুভূমিতে গিয়ে দেখা করল তার সঙ্গে। আপনি নিশ্চয় চিনবেন, ম্যাম, এই লোকই ডগলাস ও’হারাকে নামিয়ে নিয়েছিল স্টেজ থেকে। ওর নাম বব লারকিন।
আলবত মনে আছে তাঁর। অমার্জিত চেহারা, তবে কথাবার্তায় বোঝা গিয়েছিল বন্ধুর প্রতি তার দরদ অপরিসীম, এবং মানুষটি সে সৎ।
কেলসো বিদায় নেয়ার পরেও, বহুক্ষণ বিনিদ্র কাটালেন ডায়ানা, ছটফট করলেন বিছানায় শুয়ে। আলফ্রেড়ো…ওই ছেলেটিই এলেনার সাথে একই জাহাজে চেপে এসেছিল। ডন ফেডেরিকো, তিনিও তখন ছেলেমানুষ, খুন করার প্রয়াস পেয়েছিলেন আলফ্রেডোকে।
কেন হঠাৎ ভোজবাজির মত লোকচক্ষুর আড়ালে হারিয়ে গেল আলফ্রেডো? এখন কোথায় সে? আদৌ বেঁচে আছে কি?
বব লারকিন জানবে। যেভাবেই হোক, ববের সঙ্গে কথা বলতে হবে তাকে। কিন্তু তিনিই বা কেন মাথা গলাচ্ছেন পরের ব্যাপারে? ডগলাস ও’হারার সঙ্গে লারকিনের জানাশোনা যে নিছক কাকতালীয়, সন্দেহ নেই, তবে আলফ্রেডোকে মানুষ করেছে যে-মেয়েটি সে ছিল ফেলিপির বোন-এবং এই ফেলিপি এক রাতে, ডন রোমেরোর রেঞ্জে রহস্যজনকভাবে নিহত হয়। ডায়ানা অনুমান করলেন গোটা সমস্যাটি একসুতোয় বাঁধা। আর একথা ভাবতে ভাবতেই একসময় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
যখন সকাল হলো, বিচলিত মনে দিনের প্রাত্যহিক কাজকর্ম শুরু করলেন, ডায়ানা। যদিও ঠাহর করতে পারলেন না, কেলসোর তথ্য কেন এত ভাবিয়ে তুলেছে তাঁকে। অবশ্যি এও ঠিক, ড্যানের সাথে সামান্যতম যোগাযোগ থাকতে পারে এমন যে কোন ব্যাপারেই কৌতূহল বোধ করবেন তিনি। স্বজন বলতে যা বোঝায়, তার জীবনে ড্যান তাই। শুরু থেকেই ওকে তিনি আপন সন্তানের মত জেনে আসছেন।
এলেনা! হ্যাঁ, এলেনার সাথে দেখা করতে হবে তাকে। কে এই আলফ্রেডো? বব লারকিন সম্বন্ধে কী জানেন এলেনা?
দরজায় গেলেন ডায়ানা, রাস্তার দিকে একবার নজর বুলিয়ে নিজের ডেস্কে ফিরে এলেন।
ড্যান এখন কোথায়? অ্যানাবেল?
কারও কোন খবর নেই। মন্টে ম্যাক-কায়া ওযেন হার্ডিন এবং আরও দুজনসহ ওদের খোঁজে গেছে জর্জ বুশ, পাছে দীর্ঘ সময় থাকতে হয়, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র আর গোটা কয়েক প্যাক হর্সসাথে নিয়েছে ওরা।
নাহ্, এলেনাকে একটা খবর পাঠাতে হয়। এখুনি।
ড্যান, যদি বেঁচে থাকে এখনও, তার ইন্ডিয়ান বন্ধুদের কাছে পৌঁছুতে চেষ্টা করবে। কিন্তু শক্ররাও জানে একথা, কাজেই প্রস্তুত থাকবে। অথচ তিনি কিছুই করতে পারছেন না। যদি না…
ঠিক, হয়তো এখনও সব আশাভরসা শেষ হয়ে যায়নি।
ডায়ানা জানেন, ডন রোমেরো, আজ শহরে আছেন। তার সঙ্গে দেখা করবেন তিনি। পরিস্থিতি বিচার করতে বসে মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা করলেন ডায়ানা, তারপর লোক দিয়ে ডেকে পাঠালেন কেলসোকে।
আমরা আজ ডন রোমেরোর সাথে দেখা করছি, বললেন তিনি। এই ঝামেলাটা আমি চিরতরে শেষ করে ফেলতে চাই।
উনি আপনার কথা শুনবেন না, ম্যাম।
শুনবেন। ডোনা এলেনাও আছেন ওখানে। আমরা দুজনে মিলে শুনতে বাধ্য করব তাকে।
মাত্র হাতে-গোনা কয়েকটা বাতি জ্বলছে। তবে কোরালে অনেকগুলো ঘোড়া রয়েছে। বাংকহাউস থেকে ভেসে আসছে ভ্যাকুয়েরোদের উচয় কথাবার্তা আর হাসির আওয়াজ। ওদিকে একটুক্ষণ চেয়ে রইল কেলসো, তারপর ঘাড় ফিরিয়ে বলল, ওরা খুব বাজে লোক, ম্যাম্। আপনি না গেলে হয় না? আমি শুনেছি ডন এখন আগের চেয়েও হিংস্র হয়ে উঠেছেন।
ওরা ফুর্তি করছে। টেরও পাবে না আমরা এসেছি। আর তা ছাড়া, আমরা এখানে থাকবও না বেশিক্ষণ।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও, দরজায় গেল কেলসো, করাঘাত করল। বেশ অনেকক্ষণ সাড়াশব্দ মিলল না কোন, আবার হাত তুলছে সে এই সময়ে রুক্ষ চেহারার এক মহিলা কবাট ফাঁক করল একটা।
কে? কী চাই?
ডন রোমেরোর সঙ্গে একটু দেখা করব আমরা।
উনি কারও সাথে দেখা করবেন না। বিশেষ করে গ্রিংগোদের সঙ্গে।
তীক্ষ শোনাল মিস ডায়ানার কণ্ঠস্বর। তা হলে আমরা ডোনা, এলেনার সাথেই দেখা করব। এক্ষুণি!
একটু দোনোমনো করল হাউসকিপার; তারপর ঘুরে রওনা হলো অন্দরমহলের দিকে, ওরা পিছু নিল। একটা খিলানের নীচে ঢুকে গেল পরিচারিকা, নিচু স্বরে। কথাবার্তা হলো কিছু, খানিকবাদে ডোনা এলেনা হাজির হলেন।
সোজা ওদের কাছে চলে এলেন তিনি। আপনারা! করেছেন কী! এখানে আসা উচিত হয়নি! তারপর কী মনে করে?
ডন রোমেরোর সঙ্গে কথা বলতে। ড্যানকে তাড়া করে ডন ফেডেরিকে মরুভূমিতে গেছেন। আমরা খবর পেয়েছি, সব ওঅটর হোলে পাহারা বসিয়েছেন তিনি ড্যানকে দেখামাত্র খুন করবেন। আমি চাই বন্ধ হোক এটা…এখুনি।
কিন্তু আমার ভাই আপনার কথা শুনবেন না, সিনোরা! আপনাদের জন্যে এ বাড়ি বিপজ্জনক। আপনি চলে যান।
দেখা আমাকে করতেই হবে।
খানিক ইতস্তত করলেন এলেনা, তারপর বললেন, বেশ, শুনবেনই না যখন…আসুন তবে আমার সাথে।
রাজকীয় একখানা ইজিচেয়ারে শরীর ডুবিয়ে বসেছিলেন ডন রোমেরো, হাতে জ্বলন্ত সিগার। পলক তুললেন তিনি, মিস ডায়ানাকে চিনতে পেরে টানটান হয়ে গেলেন।
এই মেয়ে কী করছে এখানে? সক্রোধে জানতে চাইলেন রোমেরো। কোন সাহসে আমার বাসায় ওকে ঢুকতে দিয়েছ তুমি! বের করে দাও-এক্ষুণি!
ডন ফেডেরিকো মরুভূমিতে। আপনার নাতিকে তাড়া করছেন, খুন করার জন্যে। আমি চাই এটা বন্ধ করতে।
তুমি চাও বন্ধ করতে? তুমি কে বন্ধ করার? বেরিয়ে যাও এখান থেকে!
আমি চাই উনি থাকবেন, এবং তুমি ওর কথা শুনবে।
এলেনার কথায় সরোষে ঘাড় ফেরালেন ডন রোমেরো। একমুহূর্ত নির্বাক হয়ে রইলেন তিনি, তারপর বললেন, তুমি চাও? তুমি কে চাইবার? তুমি তোমার ঘরে যাও!
না, রোমেরো, আমি থাকছি। কারোকে যদি যেতেই হয়-সে তুমি?
কটমট করে তাকালেন ডন, কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠেছে, মুখ সাদা। এলেনা! বোমার মত ফাটলেন তিনি, তু…তুমি…। কথা জোগাল না তার মুখে।
নীরবতার সুযোগে, ডন যখন উপযুক্ত ভাষা খুঁজতে ব্যস্ত, শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে এলেনা মুখ খুললেন, না, রোমেরো, আমার ঘর, আমারই বাড়িতে থেকে তুমি আমাকে হুকুম দিতে পারবে না।
উঠে দাঁড়ানোর ব্যর্থপ্রয়াস পেলেন ডন রোমেরো। তবে রে, রাক্ষুসি! আমার সাথে এভাবে কথা বলিস!তোর বাড়ি মানে? রাগে ভব্যতা জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন তিনি।
হ্যাঁ, আমার বাড়ি, দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলেন এলেনা। তুমি খাজনা দাওনি, আমি পরিশোধ করেছি। তুমি বন্ধকের টাকা শোধ করনি আমি কিনে নিয়েছি সেগুলো। এই বাড়ি র্যাঞ্চ যা কিছু আছে সব আমার। তুমি থাকতে পারবে, যদি দ্রতা বজায় রাখ নিজের।
চোখ নামালেন রোমেরো, হাত বাড়িয়ে হাঁটার ছড়িটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মারতে উদ্যত হলেন বোনকে, তারপর এলেনার কথাগুলোর অর্থ সম্ভবত ঢুকল তাঁর মগজে।
কী করেছ? এত টাকা পেলে কোথায় তুমি?
এখন আর দুর্বলটি নন ডোনা এলেনা। মারা যাওয়ার সময় মা দিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে, মৃদু সুরে জবাব দিলেন। তুমি যখন তোমার ঘৃণার আগুনে জ্বলেপুড়ে মরছ, আমি তখন আরও অনেক ক্যালিফোর্নিয়র মত ওই টাকা ব্যবসায় খাটিয়েছি, লাভ করেছি।
ডন, ফেডেরিকোর কাছে এবার কারোকে পাঠাবে তুমি। ফিরে আসতে বলবে তাকে। বলবে, ড্যান ও’হারার কোন ক্ষতি যেন সে না করে।
আমি তোকে খুন করব? জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন রোমেরো, ক্রোধে মুখ বিকৃত।
স্মিত হাসলেন এলেনা। ঠিক ওই মুহূর্তে তাঁকে অসাধারণ মনে হলো মিস ডায়ানার। যদি তা কর, ডোনা এলেনার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট, ড্যান ও’হারা মালিক হবে সম্পত্তির। তখন তুমি ওর আশ্রয়ে থাকবে! ওর খাবার খাবে! আমি উইল করে সব লিখে দিয়েছি ওকে। এই দেশের আইন অনুযায়ী আমার উকিলকেও বলা আছে সেইমত।
বিশ্বাস করি না, অস্ফুটে বললেন ডন রোমেরো। সব তোর চালাকি। মাথা খারাপ হয়েছে তার। আমি সবাইকে বলব, তুই উন্মাদ।
কাকে বিশ্বাস করবে ওঁরা…তোমাকে, না আমাকে?
ওদের পেছনে, দোরগোড়ায় নড়াচড়ার শব্দ হলো। মেক্সিকান পরিচারিকা দাড়িয়েছে এসে, সঙ্গে তিনজন পিস্তলধারী।
মিস ডায়ানা মুখ খুলতে নিয়েও, থেমে গেলেন, শেষমুহূর্তে। ম্যাম,শান্ত কণ্ঠে বলল কেলসো, আমি আগেই নিষেধ করেছিলাম, আমাদের আসা ঠিক হবে না। জানি, আপনি ভালর জন্যেই এসেছেন, কিন্তু…
ডন রোমেরো বসে পড়লেন আবার, ছড়িখানা রাখলেন কোলের ওপর। নিভে যাওয়া সিগারটা তুলে নিলেন তিনি, ছাই ঝেড়ে মোমর আগুনে ধরলেন। টান দিলেন ঘন ঘন, সিগার-ধরা হাতটা কাঁপছে থরথর।
কিন্তু এখন আর, অবশেষে মুখ খুললেন রোমেরো, আগের মত নেই অবস্থা। তোমার কথাই যদি সত্যি হয়ে থাকে, ভগিনী, তা হলে ড্যান ও’হারার উত্তরাধিকারী কে হচ্ছে শুনি।
ওর কি ছেলে আছে কোন? হাসলেন বৃদ্ধ। কাজেই, শেষপর্যন্ত, জিত আমারই হচ্ছে।
ডন ফেডোরকো ড্যানকে খুন করবে। তোমাকেও মেরে ফেলব, তখন তো সবই আমার!
হাত ইশারায় দোরগোড়ায় অপেক্ষমাণ তিন বন্দুকবাজ আর পরিচারিকাকে দেখালেন তিনি। আর এদেরকে মোটা বখশিস দিলেই চলবে-মুখ বুজে থাকবে।
এলেনার উদ্দেশে তাকালেন ডন। বুঝলে, ভগিনী, সবই আমার হবে। সরকারি লোকদের কাছে যাব আমি, দুশ্চিন্তার ভান করব। ওদের বলব, তোমরা দুজন ড্যানের খোঁজে মরুভূমিতে গেছ। এবং ওরা আমার কথা বিশ্বাস করবে।
বিশেষ করে তোমাদের লাশ আবিষ্কৃত হওয়ার পর আর কোন সন্দেহ থাকবে না। কারও। আফসোস করে শুধু বলবে, বোকার দল! কেন মরতে গিয়েছিল খামোকা?
আর আমি হাসব মনে মনে, সব ঝামেলা চুকিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে খাব।
.
১৮.
খররৌদ্রের মাঝ দিয়ে হাঁটছি আমি, দক্ষিণে, স্যান হ্যাকিন্টোসের অনতিদূর দিয়ে। ওরা রয়েছে উত্তরে আর পুবে। প্রচণ্ড অবসাদে সারা শরীর ভারি আমার, মাথার ভেতর কেমন যেন ভোতা অনুভূতি। দূরে গুলির শব্দ শুনলাম একটা। ওরা কি তবে আমার ট্রেইল খুঁজে পেয়েছে? অসম্ভব নয়, তবে আমি ট্র্যাক বিশেষ রেখে আসিনি। কাছেই গুটিকতক জশুয়াগাছ চোখে পড়তে, ঘুরে ধীর কদমে আমি এগোলাম সেদিকে, গাছপালা আর ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত পাথরাইয়ের মাঝ দিয়ে ছোটখাট একটা উপত্যকায় বিশ্রাম নিতে বসছিলাম, কিন্তু পাথর ভয়ঙ্কর তেতে থাকায় তা আর সম্ভবপর হলো না, বাধ্য হয়ে এগোলাম আবার। এখন যে-পথে হাঁটছি সেটা প্রাচীন ট্রেইল, পেছনে তাকিয়ে আমার কোন ট্র্যাক দেখতে পেলাম না।
পালানোর মত জায়গা খুঁজছি আমি…একটা কিছু হলেই হলো।
পড়ে গেলাম হোঁচট খেয়ে। আমার দ্বিতীয় জোড়া মোকাসিনও ছিড়ে গেছে। অবসাদে মাথা কাজ করছে না। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম আমি, আবার পড়ে গেলাম, ফের উঠলাম, চোখ ছোট করে তাকালাম ঝলমলে তাপতরঙ্গের ভেতর দিয়ে।
কে ও?
কেউ একজন…কী যেন…তাপতরঙ্গের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে। বার দুয়েক চোখ পিটপিট করে আবার তাকালাম আমি। একজন মানুষ ইন্ডিয়ান?
একজন বৃদ্ধ ইন্ডিয়ান…নাকি স্বপ্ন দেখছি? থমকে দাঁড়ালাম। না, চোখের ভুল নয়, লোকটা ইন্ডিয়ানই, এবং বুড়ো। পরনে তার রঙজ্বলা লাল শার্ট, বুক খোলা। মাথায় ফেট্টি বাঁধা। কে…?
ওর গলায় র-হাইডের সুতোর সাথে চ্যাপটামত নীলকান্তমণি ঝুলছে একটা।
হাত তুলল লোকটা, আমার ডানের পাথরাইগুলোর দিকে ইশারা করল। সেদিকে তাকালাম আমি, যখন ঘুরলাম, ইন্ডিয়ান বুড়ো আর নেই-মিলিয়ে গেছে।
আগে বেড়ে, হাঁক দিলাম আমি, তাকালাম চারপাশে। কেউ নেই…একটা ট্র্যাক পর্যন্ত নয়।
স্বাভাবিক, এরকম প্রাচীন ট্রেইলে কোন ছাপ না ফোটারই কথা।
হঠাৎ দূরে কার যেন চিৎকার শুনতে পেলাম, তারপর গুলির আওয়াজ। ঘুরে, বুড়ো ইন্ডিয়ানের নির্দেশিত পথে ছুট দিলাম এবার, পড়ে গেলাম, উঠলাম হাঁচড়েপাঁচড়ে, বোল্ডারপের মাঝে ফাটল দেখতে পেয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেলাম সেখানে।
ফাটলটা পাথরে-ঘেরা, রীতিমত অন্ধকার। ছোট্ট একটা পাথুরে চৌবাচ্চায় কয়েক গ্যালন পানি রয়েছে, বৃষ্টির। এক জায়গায় পুড়ে অঙ্গার হয়ে আছে কয়েকটা পাথর, বহুকাল আগে কখনও হয়তো রান্নার আগুন ধরিয়েছিল কেউ। বুকে হেঁটে গাঢ় ছায়ায় ঢুকে গেলাম আমি, পিস্তল বের করলাম হোলস্টার থেকে, ওদের আসার অপেক্ষায় রইলাম।
ঝড়ের বেগে ছুটে এল একদল ঘোড়াসওয়ার, ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, সামনে চলে গেল কয়েকজন, অচিরেই ফিরে এল কেউ কেউ।
একজন বলল, আশ্চর্য, হতভাগা গেল কোথায়?
পেছনে কোথাও আছে হয়তো, বলল আরেকজন।
টোনিও, বলল অপর এক লোক, একটা আস্ত গাড়ল। কোন কাজের না-খালি কথা।
ও এ-পর্যন্ত এসেছে বলে আমার মনে হয় না, বলল প্রথম কণ্ঠস্বরটি। গেল মাইলখানেকের মধ্যে আমি কোন ট্র্যাক দেখতে পাইনি।
ওদিকে কিছু ঘোড়ার ট্র্যাক দেখলাম, মন্তব্য করল আরেকজন।
নিশ্চয় বুনো। এরকম আমিও দেখেছি কয়েকবার।
পাঁচ-ছয়টার বেশি হবে না।
আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে এল কণ্ঠস্বরগুলো, মিলিয়ে গেল দূরে, আমি পিস্তল বাগিয়ে বসে রইলাম। আমি যেখানে রয়েছি সেখানে নড়াচড়ার জো নেই, তবে পাথরগুলো যেখানে অঙ্গার সেখানে অনায়াসে দু-তিনজন আঁটবে। এটা কোন হাইড আউট নয়, কোনদিন হয়তো ঝড়ের কবল থেকে বাঁচতে ইন্ডিয়ানরা এসে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রবেশ পথটা সংকীর্ণ, আগেভাগে জানা না থাকলে এত অজস্র পাথরের ভিড়ে ঠাহর পাবে না কেউ।
বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি, চেতন পেলাম:শীতে। হাত অসাড় আমার, ঝিঝি ধরেছে। ঝাঁকিয়ে, ডলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করে নিলাম আবার, উঠে বসে কান পাতলাম বাতাসে।
কোন শব্দ নেই, চরাচর স্তব্ধ। চিত হয়ে শুয়ে ঘুমোলাম ফের, যখন সজাগ হালাম তখন সকাল। এক ঢোক পানি খেয়ে পাথরে হেলান দিয়ে বসলাম আমি, ঝিমোতে লাগলাম।
বাইরের ওই প্রান্তরে আছে ওরা, ওত পেতে। হয়তো আমার মাইল কুয়েকের ভেতর নেই, তবে নজর রাখছে সবখানে। এ-জায়গা, অনুমান করলাম, স্টাবি স্প্রিং থেকে তেমন একটা দূরে হবে না…কিংবা লস্ট হর্স ওয়েলস থেকে। অন্তত কাছেপিঠেই কোথাও হবে ওগুলো। যখন রাত নামবে, এখান থেকে বেরিয়ে সন্তর্পণে পাহাড়ের উদ্দেশে যাত্রা করব আমি।
আমার পশ্চিমে গভীর এক ক্যানিয়ন রয়েছে, ওখানে ঢোকার কোন রাস্তা যদি থাকে-আর সম্ভবত ঝরনার ভাটিতে আছেও তা-ক্যানিয়ন ধরে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে, টিলার অতিক্রম করে ওপাশের পাইন বনে পৌঁছুতে পারব আমি, তারপর সেখান থেকে উপত্যকা পেরিয়ে আমার বন্ধুদের কাছে।
ভাবা যত সহজ, করা ঠিক তার উল্টোটি। নিঃসন্দেহে কঠিন হবে কাজটা, পথ বন্ধুর, আর স্টাবি স্প্রিং যদি ওদের চেনা থাকে, তা হলে সেখানেও হয়তো পাহারা বসাবে। ওই পর্যন্ত পৌঁছুতে পৌঁছুতে তেষ্টা পাবে আমার; এবং আমি তা নিবারণ করবও।
স্টাবি স্প্রিংয়ে যদি জনাদুয়েক লোক থাকে, আমরা সকলেই বিপদে পড়ব। গুলিভরা পিস্তল আছে আমার কাছে, আর কোমরের কার্তুজবেল্টে রয়েছে বাড়তি চব্বিশ রাউন্ড। এবং আমি খোশমেজাজে নেই।
যখন ছায়া ঘনাতে শুরু করল, পার্থরতৃপের কোনা থেকে সরে এলাম, ফাঁকায়, বেরোনোর আগে কান খাড়া করলাম মুহূর্তের জন্যে। যখন বুঝলাম কেউ নেই, বাইরে এসে হাঁটতে শুরু করলাম। স্টাবি স্প্রিং বেশিদূরে নেই।
পেছনে হাত বাড়িয়ে, হোলস্টারের ফিতে খুলে দিলাম আমি, ঢিলে করে রাখলাম পিস্তলটাকে যেন প্রয়োজনের সময়ে তুরিতে ড্র করতে পারি।
আমার ক্যান্টিন ভরা, পানি খেলাম এক ঢোক। মুখ শুকিয়ে খটখট করছে পাকা চামড়ার মত, মেজাজ তিরিক্ষে।
ওরা আমাকে দেখে ফেলার আগেই ওদের ঘোড়াগুলো চোখে পড়ল আমার। দুজন রয়েছে, প্রায় একই সময়ে পরস্পরকে দেখতে পেলাম আমরা, ওদের মধ্যে যে লোকটি রাইফেলধারী আমি গুলি করলাম তাকে।
টলছি আমি, তবু অব্যাহত রাখলাম গুলিবর্ষণ। আমাকে মারার চেষ্টা করছিল যে লোক সে অ্যাংলো হলেও খিস্তি করল স্প্যানিশে, তারপর আবার গুলি করল আমাকে, লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো, কারণ ইতিমধ্যে আমার তিনটে বুলেট হজম করতে হয়েছে ওকে।
বাঁকা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল শত্রু, ওদের ঘোড়াগুলো ছুটে পালাল ক্যানিয়নের ভাটিতে। বালুর ওপর বসে রিলোভ করে নিলাম আমার পিস্তল, তারপর আবার গোলাগুলি শুরু করার জন্যে তৈরি হয়ে যখন তাকালাম আগুনের দিকে, তখন দেখলাম উভয়েই অক্কা পেয়েছে।
উদ্যত পিস্তলহাতে, কষ্টেসৃষ্টে সোজা হালাম আমি, ঢুকরলাম ওদের ক্যাম্পে গিয়ে। কফিপট চাপানো আছে আগুনে, বেকন ভাজা হচ্ছে।
একজন এমন বেকায়দায় পড়েছিল যে তার প্যান্ট পুড়তে শুরু করেছিল, আমি লাথি মেরে আগুন থেকে সরিয়ে দিলাম, ওর পা, একখণ্ড বেকন তুলে নিয়ে মুখে পুরলাম। তারপর কফিপান সেরে, রাইফেলটা যেখানে পড়েছে সেখানে গেলাম। প্রথমে বোল্টের বারোটা বাজিয়েছে আমার বুলেট, তারপর শত্রুর পেটে গিয়ে ঢুকেছে। লোকটার অবস্থা দেখে আমার নিজেরই মায়া হলো।
.
১৯.
স্টাবি স্প্রিং ছেড়ে প্রায় তিন মাইল এসেছি এই সময়ে গুটিকতক শকুন চোখে পড়ল আমার। অদূর আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছে ওরা, বুঝতে অসুবিধে হয় না নিশ্চিত আহারের সন্ধান পেয়েছে। আমার পিস্তলখানা যথাস্থানে আছে কিনা দেখে নিয়ে, কতকগুলো বোল্ডারের পাশ দিয়ে এগোলাম আমি, মরা একটা জশুয়াগাছের কোনা ঘুরে এক চিলতে পাথুরে জমিতে উপস্থিত হালাম।
হঠাৎ সামনে, মাটি থেকে একযোগে ডানা মেলল কয়েকটা শকুন, তবে পালাল। আমি বুঝলাম যা-ই থাক ওখানে, সেটা মরেনি, তবে মরার পথে রয়েছে।
এবার সন্তর্পণে এগোলাম। মাঝেসাঝে শকুনের কর্কশ চিৎকার ছাড়া শুনতে পাচ্ছি না আর কিছু। দুটো শবভুক পাখি ওড়া থামিয়ে কাছেই একটা পাথরের ওপর বসেছিল। আমি দেখলাম কুৎসিত গ্রীরা বাঁকিয়ে নিয়ে কী যেন উৎসুক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে ওগুলো।
এরপর যখন ছোট্ট এক টিলার কোনা ঘুরলাম, তিনটে ঘোড়ার দেখা পেলাম। দুটো ধূলিশয্যা নিয়েছে, ওগুলোর একটা আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওঠার। আর তৃতীয় ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই, তবে হাঁটু কাঁপছে, মাথা ঝুলে পড়েছে। তবু একটা শকুন যখন ছো মারার পায়তারা করল, মাথা উচিয়ে ভেংচি কাটল ও, তাড়াল পাখিটাকে।
পাথর মাড়িয়ে আমার নামার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল ওরা। মাথা জাগাল ঘোড়াটা, তাকিয়ে রইল অপলকে।
সবিস্ময়ে আমি দেখলাম, ওটা আমার ব্ল্যাক স্ট্যালিয়ন।
মুহূর্তের জন্যে পাথর হয়ে গেলাম আমি। এর আগে কোনদিন দেখিনি এরকম কাহিল অবস্থায় নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে কোন ঘোড়া। পড়ে গিয়েছিল ও, আর নয়তো আক্রান্ত হয়েছিল কারও দ্বারা। একটা কাঁধ রক্তাক্ত, নিতম্বের এক জায়গায় ছড়ে গেছে বিচ্ছিরিভাবে।
মাথা উঁচু করে আমার দিকে চেয়ে রইল ও, কিন্তু সেই সাথে ভূপাতিত মেয়ারটাকে আগলানোর জন্যে পিছিয়ে গেল খানিকটা।
ভয় নেই, বেটা, আমি বললাম, আমি আসছি!
ঈষৎ খাড়া হয়ে গেল ওর কান। আমার ধারণা আমার গলা চেনে ব্ল্যাক স্ট্যালিয়ন, আর তা চেনা ওর উচিতও। সুযোগ পেলেই ওর সঙ্গে প্রচুর কথাবার্তা বলতাম আমি।
কাছে গিয়ে দেখলাম একটা ঘোড়া আগেই মারা গেছে; অন্যটাও বাঁচবে না। যন্ত্রণা থেকে রেহাই দেয়ার জন্যে মেরে ফেলা দরকার ওকে, কিন্তু পাছে, ভয় পেয়ে ছুটে পালায় স্ট্যালিয়ন, তাই গুলি করতে সাহস পেলাম না।
মৃদু সুরে কথা বলতে বলতে আমি এগিয়ে গেলাম ওর কাছে। ছোটাছুটি করার অবস্থায় নেই ও, যে-ই তাড়া করে থাকুক ওদের, বেধড়ক ছুটিয়েছে অবলা জীবগুলোকে। আর কিছুক্ষণ এরকম করলে স্ট্যালিয়নটারও তার সঙ্গীদের হাল হত, আর শকুনরা হামলা চালাত তখন।
কাছে গিয়ে, আমার টুপিটা নামালাম আমি, ক্যান্টিনের ছিপি খুলে ওতে প্রায় অর্ধেকটা পানি ঢেলে স্ট্যালিয়নের দিকে বাড়িয়ে ধরলাম। প্রথমে একটু পিছু হটল ও, তারপর যখন গন্ধ পেল পানির, কাছে সরে এল।
টুপিতে নাক ডোবাল স্ট্যালিয়ন, পানি খেল। একনিশ্বাসে সবটুকু শেষ করে আরও চাইল সে, কিন্তু আমি নিরুপায়, সামান্য যেটুকু পানি অবশিষ্ট আছে ভবিষ্যতের জন্যে রাখতে হবে।
স্টাবি স্প্রিংয়ের ক্যাম্পে র-হাইডের রুকস্যাক পেয়েছিলাম আমি, ওটার ফিতে দিয়ে এবার চলনসই লাগাম তৈরি করলাম একটা। গোড়া থেকেই আমার সন্দেহ, এই
স্ট্যালিন অতীতে কারও পোষা জীব ছিল। তাই লাগাম পরানোর সময় একটুও বাধা দিল না ও। খানিক দূরে নিয়ে গিয়ে আমি ওকে একটা গাছের সাথে বেঁধে রেখে আবার ফিরে এলাম আগের জায়গায়, আহত মেয়রকে মুক্তি দিলাম ওর নরকযন্ত্রণা থেকে।
.
এখন প্রায় সন্ধ্যা। পাম স্প্রিংয়ে পৌঁছেছি আমি। আর কিছুদূর গেলেই আমার বাড়ি।
তাড়া দিলাম ব্ল্যাক স্ট্যালিয়নকে। চল, বেটা, বললাম, এবার আমরা বাড়ি যাব।
গোধূলি আলোর রেশ মিলিয়ে যায়নি এরকম সময়ে বালিয়াড়ির মাঝ দিয়ে ইন্ডিয়ান পল্লীর সেই দোকানে এসে হাজির হালাম।
খাঁ-খাঁ করছে ছোট্ট হতদরিদ্র দোকান-ঘরটা, চামড়ার কবজায় ল্যাগব্যাগ করে। ঝুলছে, দরজা; চিমনিসুদ্ধ ছাতের একাংশ ধসে পড়েছে; ভাঙা দেয়ালের মাঝে মাথা কুটছে মরুবাতাস। ভেতরে উঁকি দিলাম আমি। ধুলো, ভাঙা একটা বাক্স, গোটা দুয়েক খালি বোতল, আর একটা জরাজীর্ণ বাকেট। দোকানি লোকটি স্থায়ী বসত করেনি এখানে, আমি জানি, তাই বেগতিক বুঝে উঠে গেছে অন্য কোথাও।
ব্ল্যাক স্ট্যালিয়নের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে, এরপর বাসার পথ ধরলাম। শেষ বালিয়াড়ির কোনা ঘুরতেই চোখে পড়ল অকটিয়োর বেড়া, কিন্তু বাড়িটা গেছে।
দেয়াল ভেঙে পড়েছে; চিমনি কালো একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন; লিভিং রুমের জায়গায় পড়ে রয়েছে কতকগুলো দগ্ধ কড়িরগা। স্ট্যালিয়নের সঙ্গ ছেড়ে ধ্বংসস্তূপের দিকে এগোলাম আমি। একটা বইয়ের পোড়া মলাটের অংশবিশেষ দেখতে পেলাম। আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল কেউ।
পাশ কাটালাম, ঘোড়াকে ডাক দিয়ে, ওঅটর ট্রাফের দিকে এগোলাম। হৃষ্টপুষ্ট চার ঠ্যাংয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা, ভূমিকম্প আর আগুন ক্ষতি করতে পারেনি। মরচে ধরা পাইপ হয়ে টলটলে ঠাণ্ডা পানি এসে জমা হচ্ছে গামলায়। আস্তাবলের ছাত ধসে পড়েছে, তবে কোণগুলো অক্ষত আছে এখনও।
ঘনায়মান সাঁঝের অন্ধকারে নিশ্চল আমি তাকালাম চারপাশে। নেই..সব শেষ, এই সেই জায়গা যেখানে বাবা তার জীবনের শেষ কটি দিন কাটিয়েছিলেন আমার সঙ্গে যেখানে, তার অসুস্থতা সত্ত্বেও, ক্ষণিকের সুখ খুঁজে পেয়েছিলাম আমরা।
স্ট্যালিয়নকে পানি খাওয়ার সুযোগ দিয়ে, ভূপাতিত একটা পাথরের ওপর বসলাম। আচ্ছা, আমার সেই নিঃসঙ্গ অতিকায় মানুষটি এখন কোথায়…পাহাড় থেকে পাইনের সৌরভ নিয়ে আমার বাসায় যে আসত বই চুরি করতে?
খানিক বাদে ওঅটর ট্রাফের পাইপে মুখ লাগিয়ে আমার ক্যান্টিনটা ভরে নিলাম। এখানে আঁর থাকা চলবে না। শক্ররা, পয়লা চোটেই আমার খোঁজ করবে এখানে, আমি জানি, ওরা তেমন পিছিয়ে নেই। এতক্ষণে হয়তো স্টাবি স্প্রিংয়ের লাশগুলো আবিষ্কার করেছে, এবার দুইয়ে-দুইয়ে চার মেলাতে অসুবিধে হবে না বিশেষ। ট্র্যাক করার জন্যে সময় নষ্ট করবে না ওরা, সোজা চলে আসবে আমার এই বাসায়।
আমি ক্লান্ত, তবু আপাতত আশ্রয় নেয়ার জন্যে যত দ্রুত সম্ভব অন্য কোন জায়গা খুঁজে নিতে হবে। এবার আমি লস এঞ্জেলেসে ফিরে যাব, অ্যানাবেলের কাছে।
কিন্তু এখন কোথায় যাব? পাম ক্যানিয়নে? ওদিকে হামেশাই থাকে কিছু ইন্ডিয়ানরা, কিন্তু ওদেরই-বা কেন বিপদে ফেলতে যাওয়া?
তবে সম্ভবত একটা লাগাম আর স্যাডল মিলবে ওখানে গেলে।
চলে আসার জন্যে ঘুরছি, হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তে থমকে দাঁড়ালাম। চিমনির কাছে ফিরে গেলাম আমি, ফায়ারপ্লেসের ইটগুলো গুনে, খসিয়ে আনলাম একটা।
আমার বাবার সোনা, আমার সোনা। ওটার কথা আমি ভুলে বসেছিলাম আরেকটু হলেই। স্বর্ণমুদ্রাগুলো পকেটে পুরে, ইটটা আবার রেখে দিলাম যথাস্থানে।
এ-মুহূর্তে যা প্রয়োজন আমার, তা হলো বিশ্রাম, কোথাও স্থির হয়ে, একদিনের জন্যে হলেও।
একটি জায়গার কথা আমি জানি, ফ্রান্সিসকোর সঙ্গে গেছি বেশ কবার।মেসকিট আর পাম ঝোপে-ঘেরা একটা ঘেসো গর্ত, সন্দেহ নেই মাটি খুঁড়লে পানিও পাওয়া যাবে।
ওখানে গা ঢাকা দেয়া সম্ভব, সহজে শত্রুপক্ষ সন্ধান পাবে না আমার।
জায়গামত পৌঁছে দেখলাম সবকিছু আগের মতই আছে। ব্ল্যাক স্ট্যালিয়নের লাগামের খুঁটা মাটিতে পুঁতে, টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাম আমি, পলক তুলে আকাশের তারা আর পাহাড়ের কালো দেয়ালের দিকে তাকালাম, তারপর চোখ বুজতেই নেমে এল গাঢ় ঘুম।
রাতে অকস্মাৎ নড়ে উঠল পাহাড়, ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ল নীচে। জেগে গেলাম আমি, কান খাড়া, সতর্ক। আরেকটা ভূমিকম্প? বৈরী পরিবেশে, আমার মত বাস যাদের, প্রকৃতির ছোটখাট খামখেয়াল তাদের গা-সওয়া হয়ে যায়। পাহাড়ের অন্ধকার চড়াই থেকে গড়িয়ে পড়ল আরও কিছু পাথর।
টাহকুইৎস…আবার চেষ্টা করছে তার বন্দীগুহা থেকে বেরোতে।
কথাটা ভাবতেই, বন্ধু টাহকুইৎসকে মনে পড়ল আমার, তারপর ডন ফেডেরিকোকে।
ধড়মড় করে উঠে বসলাম, মাথায় খুন। বেশ, লড়তেই যখন চায় ওরা, কাল থেকে আমিই হব শিকারী-আর তাড়া-খাওয়া শিকার নয়।
এরপর ঘুমোলাম আবার, ভোরের দিকে যখন চোখ মেললাম; দেখি গর্তের কিনারে এক লোক বসে, পরনে গোলাপি শার্ট, নীল ব্যান্ডানা, আর, মাথায় চওড়া কারনিসের হ্যাট।
তোমার ঘুম একটু বেশি গাঢ়, তিরস্কার করল সে, তাড়া-খাওয়া শিকার হিসেবে।
ওই লোক ফ্রান্সিসকো, আমার বন্ধু।
অসুবিধে নেই, জবাব দিলাম। আজ থেকে আমিই শিকারী।
আমারও তাই বিশ্বাস। তা হওয়ার সময় হয়েছে।
.
২০.
আগুনের কাছে রয়েছে টোমাস, কালো চোখজোড়া সতর্ক। অন্ধকারের দিকে, ঘোড়াগুলোর কাছাকাছি, সরে গেছে ছেলেটা। ওকে ছেড়ে দাও, বলল টোমাস।
অ্যানাবেলের ওপর থেকে চোখ সরাল না ইগলেসিয়াস। বোকামি করনা! কে জানছে? আসেটা কে এখানে?
ড্যান ও’হারা জানবে। ও অ্যাপাচিদের মত ট্র্যাক পড়তে পারে। ও আসবে। খুঁজে বের করবে তোমাদের।
হাহ! ড্যান এতক্ষণে পটল তুলেছে। মরুভূমিতে ওকে খুন করেছে ওরা। মেয়েটা এখন খাঁচার পাখি। ছোট্ট ঘুঘু-আর আমরা হচ্ছি শিকারী বাজ।
বিসক্যাল দাঁড়িয়ে রয়েছে, তিন নম্বর লোকটিও, কাছে সরে এসেছে আরেকটু। ধীর লয়ে হাতুড়ির ঘা পড়ছে অ্যানাবেলের বুকের ভেতর। ডান হাতে ছোট্ট পিস্তলটা, আঁকড়ে আছে ও, কাপড়ের ভঁজের আড়ালে। দুটো বুলেট রয়েছে ওতে, অর্থাৎ দুটো গুলি করা যাবে। পিস্তলের ব্যারেল হোট, সুতরাং ওদেরকে একেবারে নাগালের মধ্যে পেতে হবে। কোনমতেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া চলবে না।
তবু ভয় পাচ্ছে না ও। আগে পেয়েছিল, কিন্তু এখন নয়। ওর বাবা, চীনা আর মালয় জলদস্যদের সঙ্গে বহু লড়াই করেছেন যিনি, প্রায়ই গল্প করতেন এধরনের ঘটনার কথা। ভেবেচিন্তে, বলেন তিনি, ঠাণ্ডা মাথায় ঠিক কাজটি করবে।
আগুনের ওপাশ থেকে টোমাস তাকাল ওর পানে, হালকা সুরে বলল, ড্যানের সাথে তার কাউইয়া বন্ধুরা থাকবে। ওদের বল, তুমি ড্যানের বন্ধু, তা হলে ওরাও তোমার বন্ধু হয়ে যাবে।
কাউইয়া? তার বন্ধু? তবে কি টোমাস পালানোর পরামর্শ দিচ্ছে ওকে? ইন্ডিয়ানদের কাছে যেতে বলছে। কিন্তু কীভাবে…?
ইঞ্চি ইঞ্চি করে কাছে সরে আসছে ওরা।
থাম! আদেশ করল টোমাস। রাইফেলের দিকে হাত বাড়াল, বিসক্যাল গুলি করল ওকে।
অ্যানাবেল দেখল টোমাস টলছে, পরক্ষণে নামহীন লোকটা লাফ দিল ওর উদ্দেশে। কাপড়ের নীচ থেকে ওর পেটে গুলি করল অ্যানাবেল। চকিত আতঙ্কের ছায়া দেখতে পেল লোকটার চোখে। ওর চার ফুটের ভেতর এসে পড়েছিল দুবৃত্ত, হাত সামনে বাড়িয়ে।
বোবা চিৎকারে হাঁ হয়ে গেল ওর মুখ। পয়েন্ট ফোর ফোর বুলেটের ভারি ভেঁতা আঘাত স্পষ্ট শুনতে পেল অ্যানাবেল।
ঝটিতি পিছিয়ে গেল ও, বিসক্যাল আর ইগলেসিয়াসের দিকে পিস্তল ঘোরাল।
সিনোরিটা! চেঁচিয়ে ডাকল ছেলেটা। সিনোরিটা, প্লিজ!
অ্যানাবেলের ঘোড়া, জিন-চাপানো। আরেকটা গুলি ছুড়ল সে, মিস্ করল, তারপর পোমেল চেপে ধরে দোল খেয়ে উঠে বসল স্যাডলে। ওপাশের রেকাবে পা নামানোর সময়ে ওর স্কার্টের কোন্তা আটকে গেল ক্যান্টলে, কিন্তু ঘোড়াটা ততক্ষণে রওনা দিয়েছে, উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে অন্ধকারের ভেতর।
পেছনে আরেকটা গুলির আওয়াজ পেল সে, একটা আর্তচিৎকার…অখণ্ড স্তব্ধতা।
কে গুলি খেল? ছেলেটা? নাকি টোমাসই আবার?
জীবনে কখনও স্পার ব্যবহার করেছে সে এ-স্মৃতি অ্যানাবেলের নেই, কিন্তু এবার করতে হবে, কারণ ওর ঘোড়া দিশেহারা, অন্ধকারে ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত পাথর আর কাঁটাঝোপের পাশ কাটিয়ে ছুটছে জোরকদমে।
দক্ষিণ। হ্যাঁ, দক্ষিণে যেতে হবে তাকে। ড্যানের প্রিয় দুর্গম দেশে। ওর সন্ধান করতে হবে, সন্ধান করতে হবে ড্যানের ইন্ডিয়ান বন্ধুদেরও। টোমাস তাকে লস এঞ্জেলেসে ফেরার পরামর্শ দেয়নি…কেন? আশঙ্কা করেছে আরও বিপজ্জনক শত্রু থাকতে পারে ওখানে। ঠিক, এসময় মানুষের চেয়ে বিজন বুনো দেশকে দিয়ে ভয় অনেক কম।
রাশ টানল অ্যানাবেল, কান খাড়া। ওকে তাড়া করছে না কেউ। টোমাসের কী হলো? ছেলেটার? জানা দরকার ছিল, কিন্তু ফিরে গেলে বৃথা যাবে ওদের এই আত্মত্যাগ, এবং আরও কঠিন সংকটে পড়বে সে।
নক্ষত্রের দিকে তাকাল ও। বাবার সঙ্গে বহুবার সাগরে গেছে, সব নক্ষত্রই তার পরিচিত। কোন ট্রেইল সে চেনে না; কিন্তু ভয় কী, ধ্রুবতারা রয়েছে। সপ্তর্ষি ধরে সামনে চলে গেল ওর দৃষ্টি, ধ্রুবতারাকে দেখতে পেল। তারপর দক্ষিণে ঘুরে গেল সে।
স্যান গরগোনিয়ো পর্বতমালা এখন ওর ডানে, আকাশের পটভূমিতে নিচু। পাহাড়ের কাছাকাছি থাকলে অনেক নিরাপদে থাকবে সে। ঘোড়ার খাবার মিলরে, চাই কী পানিও।
ওদিকে, দূর-পেছনে, ঝোপের ভেতর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে ছেলেটা, কান্না চাপতে নিজের হাত কামড়াচ্ছে। বুড়ো আহত, হয়তো মরতে চলেছে। বুড়োর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেছে সে। ঘোড়া তৈরি রাখ। সুযোগ পেলেই পালাবে। তোমার মরার কোন কারণ নেই?
তোমার কী হবে? ছেলেটা শুধিয়েছিল।
আমি বুড়ো মানুষ। নিজের কাজ করে যাব, আর খোদাকে ডাকব। এরা শয়তান, আর ওই মেয়েটি ভাল।
শেষপর্যন্ত নিরাশ হতে হয়নি তাকে। পালাতে পেরেছে, চমৎকার একটা ঘোড়ায় চেপে। কিন্তু এখন ওদের যাওয়ার প্রতীক্ষায় আছে সে, যাতে ফিরে গিয়ে টোমাসের শুশ্রূষা করতে পারে।তিনকুলে তার কেউ নেই, টোমাসই তাকে খাওয়া-পরার সুযোগ করে দিয়েছিল।
সেই দয়ালু বুড়ো মানুষটা এখন পড়ে আছে ওখানে, বুলেটের আঘাতে মৃত্যুযন্ত্রণায় ধুকছে, যদি ইতিমধ্যে মারা গিয়ে না থাকে। ছেলেটি প্রার্থনা করল টোমাস যেন মারা না যায়।
মেয়েটি ওদের একজনকে হত্যা করেছে। ওই নিষ্ঠুর লোকটার পরিচয় সে জানে না, তবে শুনেছে ও ভাসকুয়েযের লোক, বিসক্যালের সমস্ত অপকর্মের সঙ্গী।
আগুনের পাশে চোখ বুজে পড়ে আছে টোমাস। মারাত্মক চোট পেয়েছে সে, প্রার্থনা করছেদুবৃত্তরা যেন সত্বর বিদায় হয়। নিথর সে, টু-শব্দ করছে না।
রক্তক্ষরণ হচ্ছে ভীষণ, টের পাচ্ছে ও, যন্ত্রণা বোধ করছে, তবু আশার কথা মেয়েটি পালাতে পেরেছে-ছেলেটাও। এমনটি ঘটাই উচিত হয়েছে। সে বুড়ো মানুষ, দুঃখ-কষ্ট তার জীবনে নতুন নয়। অতএব সইতে পারবে।
টোমাস ভাবল এসময় তার রাইফেলটার নাগাল পেলে হত। হয়তো ওদের একজন কিংবা উভয়কেই খতম করতে পারত সে। আর ছেলেটা ফিরতে পারত তা ইলে, এবং তারা দুজনে মিলে হয়তো সাহায্য করতে পারত সিনোরিটাকে।
হাহ! ছোট্ট পিস্তল! কে ভাবতে পেরেছিল মেয়েটির কাছে অমন কিছু থাকতে পারে কিংবা ও ব্যবহার করবে সেটা?
ইগলেসিয়াস এগিয়ে এল ওর কাছে। পাথরের ওপর দুর্বত্তের বুটের শব্দ শুনতে পেল টোমাস। হঠাৎ প্রচণ্ড এক লাথি খেল সে পাঁজরে। তবু একটুও কাতরাল না। এখন শব্দ করার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু।
ছোট্ট পিস্তল ছিল ওটা, বলল বিস্ক্যাল, দোনলা। ওগুলোর্কেই ডেরিঞ্জার বলে। মেয়েটা দুটো গুলি ছুড়েছে।
তারমানে ও নিরস্ত্র এখন?
আলবত। এই জায়গাটা দুর্গম। ও পথ হারিয়ে ফেলবে। পানি ছাড়া থাকুক কদিন, আপসে ধরা দেবে আমাদের বুকে।
নিজের রাইফেলটা কুড়িয়ে নিল বিসক্যাল, ঝোপের ভেতর অবশিষ্ট,ঘোড়াগুলো যেখানে আছে সেদিকে এগোল। বেশিদূরে যায়নি ও, মন্তব্য করল সে। আমাদের ঘোড়া ওবুটাকে ধরে ফেলবে। চল, যাওয়া যাক।
ডাইনে-বাঁয়ে তাকাল ইগলেসিয়াস। তুমি ঘোড়াগুলো নিয়ে এস, বলল, আমি এদিকটা সামলাচ্ছি।
বিসক্যাল যখন অদৃশ্য হলো ঝোপের ভেতর, এগিয়ে গিয়ে নিহত সঙ্গীর পকেট সার্চ করল ইগলেসিয়াস। পঞ্চাশ পেসো, বিড়বিড় করে বলল সে, মোটে পঞ্চাশটা পেসো ছিল তোর কাছে।
মুদ্রাগুলো পকেটস্থ করে সোজা হলে দুবৃত্ত, টমাসের দিকে এগোল। বাহ, জোরে জোরে বলল ও, তোর কাছে কি নেই। পানিও না। মরে গিয়ে বরং বাচলি।
ওদের ঘোড়ার আওয়াজ যখন মিলিয়ে গেল সম্পূর্ণ, কেবলমাত্র তখনই নিজের জায়গা ছেড়ে নড়ল টোমাস, এবং সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ব্যথা অনুভব করল। বুলেট ওর শরীর এফোঁড়-ওফোড় করেছে, অনুমান করল বুড়ো, এবং প্রচুর রক্ত হারিয়েছে সে।
কফিপটখানা চাপানোই আছে আগুনে। ওই কফিপটটা, তার, বিসক্যাল বা ইগলেসিয়াস কেউই নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। ওদের পানীয় টেকুইলা। যাক, ভালই হয়েছে, এখন তার প্রয়োজনে আসবে ওই কফি।
ঘোড়া হাঁটিয়ে নিয়ে ধীর পায়ে ফিরে এল ছেলেটি। আমি কী করতে পারি? জানতে চাইল ও।
সিনোরিটার জন্যে, কিছুই না। সবই এখন খোদার হাতে। ছেলেটার দিকে তাকাল টোমাস। আমার ভাগ্যও খোদার হাতে, এবং তোমার।
আমি আনাড়ি।
প্রথমে কফি পান করব আমরা, তুমি আর আমি। তারপর তুমি পটে পানি গরম করে আমার ক্ষতস্থান সাফ করবে। এতে কতটা লাভ হবে জানি না, তবে আমি আরাম পাব।
খুব ব্যথা?
খানিকটা। আমি আগেও চোট পেয়েছি অনেক। টোমাসের মুখ পার, ভাষায় প্রকাশ না করলেও ওর চোখ যন্ত্রণার আভাস দিচ্ছে। আমার স্যাডলব্যাগে টেকুইলা আছে; সামান্য। আমি খুব এক ঢোক। তারপর, যখন ক্ষতস্থান সাফ করা হয়ে যাবে, ওখানেও তুমি ঢালবে কিছুটা।
পাথরে হেলান দিয়ে চোখ বুজল বুড়ো, ছেলেটা ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের কাজে।
কিছু গাছগাছড়া আছে যেগুলো লাগালে উপকার হয়। আমার মা চিনতেন। আমি দেখছি চিন্তা করে, মনে পড়ে কিনা।
কম্বল নিয়ে এসে টোমাসের কাঁধ ঢেকে দিল ছেলেটা, তারপর কফিপান করল ওরা।
এবার, বলল টোমাস, কাজ শুরু কর।
লাকড়ি ফেলা হলো আগুনে, সশব্দে স্ফুলিঙ্গ ছুটল। খালি কফিপটে পানি ভরে নিয়ে, ঘুরে বসল ছেলেটা, তারপর হঠাৎ থমকে গেল ও, ভয়ে ধক্ করে উঠল বুক।
আলোর কিনারে দাঁড়িয়ে এক লোক, আগে কখনও অমন মানুষ দেখেনি সে।
ঘোড়া হাঁটিয়ে নিয়ে ক্যাম্পে ঢুকল লোকটা; নজর বোলাল চারপাশে, প্রথমে টোমাস এবং তারপর ছেলেটাকে দেখল, হ্যাঁ, বলল, ভালমত গরম কর। আমি দেখছি ওকে। আর সেই ফাঁকে তুমি আমাকে খুলে বল কী ঘটেছে।
টোমাসের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল ইয়াকুব খান, পরনের কোটখানা খুলে নিল। তারপর ধারাল একখানা ছুরি দিয়ে কেটে ফেলল রক্তাক্ত শার্টটা।
সব বলবে। কিচ্ছু বাদ দেবে না। তোমাদের সঙ্গের মেয়েটা কোথায়?
বলতে শুরু করল ছেলেটা, ইয়াকুব উঠে তার স্যাডলব্যাগ দুটো নিয়ে এল। শোনার পাশাপাশি সমান তালে হাত চলছে ওর, পানিতে বলক এলে পটটা নামাল, ক্ষতের মুখ আর পেছন উভয় দিকই-সাফ করল ধুয়ে।
নড়ে উঠল টোমাসের চোখের পাতা, খুলে গেল। ঘোলাটে দৃষ্টিতে ইয়াকুব খানের দিকে তাকাল সে, জকুটি করল। ভয় পেয়ো না, বলল ইয়াকুব খান। এ-কাজে অভিজ্ঞতা আছে আমার। এরকম চোট অনেক দেখেছি জীবনে। আমার চেষ্টার কোন ত্রুটি হবে না।
ভোরের দিকে টোমাসের যন্ত্রণা প্রশমিত হলো খানিকটা, ও ঘুমোল।
আরাম করুক ও, বলল ইয়াকুব। যখন জাগবে, জার্কির সুপ খেতে দিয়ো। আমি আবার আসব এ-পথে। এক মুহূর্ত চুপ করে রইল সে, তারপর বলল ফের, যদি না আসি, পাঁচ দিন দেখে বাড়ি নিয়ে যেয়ো ওকে।
.
ক্লান্তি সত্ত্বেও, রাতে ভাল ঘুম হয়নি অ্যানাবেলের। এখন ভোর, অপরিচিত পরিবেশ জাগিয়ে দিল ওকে। পাহাড়ের পাদদেশে গাছ-পালার ভেতর ঘুমিয়েছিল সে, এবার বসল উঠে। অদূরের ঘেসো জমিতে মহা আনন্দে চরছে ওর ঘোড়া।
তেষ্টা পেয়েছে ওর, এবং সেই সঙ্গে খিদে, কিন্তু ওসব ভাববার সময় নয় এটা। দক্ষিণে কোথাও আছে ড্যান; ওর সৌভাগ্য, বিপদ শুরু হওয়ার আগে ওদিকেই ওদের নিয়ে যাচ্ছিল টোমাস। ঘোড়ার পিঠে স্যাডল চাপাল অ্যানাবেল, বিশীর্ণ একটা জলধারায় ওকে পানি খাইয়ে নিয়ে রওনা হলো দক্ষিণে।
টোমাস মারা গেছে-এতে কোন সন্দেহ নেই ওর। আর দৈবাৎ যদি বেঁচেও থাকে, এতই আহত হয়েছে যে কোনরকম সাহায্যে আসতে পারবে না। ছেলেটা, আদৌ যদি ফাঁকি দিতে পারে বাকি দুজনকে, বুঝবে না এসময় তার কী করণীয়। সে, সম্ভব হলে, সোজা বাড়ি ফিরে যাবে।
ইগলেসিয়াস আর বিসক্যাল তার পিছু নেবে। নিশ্চয় দক্ষ ট্র্যাকার ওরা, দ্রুত ধরে ফেলবে। ট্রেইল গোপনের কৌশল আছে অনেক, তার ধারণা, কিন্তু সেসব সে জানলেও লাভ হত না, সময় ছিল না হাতে। এখন যা ওর দরকার তা হলো একটা অন্ত্র। পিস্তলটা আছে এখনও, কিন্তু গুলি নেই। সত্যিই কি নেই, স্যাডলব্যাগে বাড়তি দু-একটা কাজ?
মরুভূমিতে নেই ও, এর উপকণ্ঠে, অস্পষ্ট একটা ট্রেইল অনুসরণ করছে, ওর বিশ্বাস ইন্ডিয়ানদের। নীচে হয়তো আরও সহজ ট্রেইল মিলবে, কিন্তু সেটা খোলামেলাও হবে বেশি। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, গাছপালায়-হাওয়া পথ ধরে এগোচ্ছে সে।
অকস্মাৎ এক জায়গায় একফালি ফাঁকা জমিতে বেরিয়ে এসেছে ট্রেইল, তাই জোরে ঘোড়া ছোটাল অ্যানাবেল। একটা চড়াইয়ের মাথায় উঠে, পাইন ঝোপের ভেতর রাশ টানল, তাকাল পেছনে।
কী ওটা…ধুলো?
সামনে নজর ফেরাল অ্যানাবেল, গাছপালার মাঝ দিয়ে নীচে নেমে গেছে ট্রেইল, তারপর ওপাশের চড়াইয়ে গিয়ে উঠেছে, এঁকেবেঁকে, আরও ওপরে। ওঠার সময়ে দেখা যাবে তাকে, কিন্তু উপায়ও নেই এ ছাড়। এগোল সে, মাঝে-মধ্যে পেছনে তাকাচ্ছে। তলদেশে পৌঁছে উল্টো দিকের চড়াইয়ে উঠতে যাবে অ্যানাবেল, এই সময়ে আচমকা পিছিয়ে এল ওর ঘোড়া, বেসামাল করে ফেলল ওকে।
অতিকষ্টে জানোয়ারটাকে বাগে এনে চড়াইয়ের ওপানে রওনা হলো ও। কী দেখে অমন ভয় পাচ্ছিল ঘোড়াটা? পাহাড়ি সিংহ নেকড়ে? নাকি ভালুক?
হঠাৎ বয়ে আরেকটা ট্রেইল চোখে পড়ল ওর, মরুভূমি থেকে এসে এই ট্রেইলে মিশে গেছে। ভুরু কুঁচকে, রেকাবের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল অ্যানাবেল, সামনে তাকাল।
কিছু নেই…যখন পেছনে তাকাল, একজন ঘোড়াসওয়ারকে দেখতে পেল, বেরিয়ে এসেছে বন থেকে…ইগলেসিয়াস।
ঘোড়ার পেটে স্পার দাবিয়ে লাফিয়ে আগে বাড়ল অ্যানাবেল; এবার ঝোপ থেকে সঁই করে দড়ি ছুটে এল একটা, ওর ঘোড়ার গলায় জড়িয়ে গেল ফাস। পেছনের পায়ে সোজা হলো ঘোড়াটা, অ্যানাবেল পড়ে গেল। পোমেল আঁকড়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করল ও, সশব্দে আছাড় খেল মাটিতে। একটা পাথরে ঠুকে গেল মাথা।
আঘাতটা অনুভব করল অ্যানাবেল, সীমাহীন ভয় আর আতঙ্কের একটা ধাক্কা বোধ করল, তারপর সব অন্ধকার।
দড়ি গোটাতে গোটাতে ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বিসক্যাল। অচেতন অ্যানাবেলের দিকে তাকাল ও, তারপর নিজের আর মেয়েটার ঘোড়া বাঁধল।
জলদি এদিকে এস, ইগলেসিয়াস, বলল বিসক্যাল, মেয়েটা মনে হয়…
অ্যানাবেলের পাশে গোড়ালির ওপর বসেছিল সে, হঠাৎ চোখ গেল একটা পায়ের ওপর, মোকাসিন-পরা, কল্পনাতীত বড়।
সভয়ে, মাথা পেছনে হেলাল বিসক্যাল, উঠে দাঁড়াল। ঝুলে পড়ল ওর চোয়াল, মুখ হাঁ; চোখ ক্রমশ উঠে যাচ্ছে ওপরে…আরও ওপরে… চিৎকার করে উঠল দুর্বৃত্ত।
পালাবার প্রয়াস পাচ্ছিল বিসক্যাল, অতিকায় এক হাত দোল খেয়ে নেমে এল নীচে, ধাক্কা মেরে পথ থেকে সরিয়ে দিল ওকে। দশ ফুট নীচের এক পাথরের ওপর গিয়ে পড়ল সে, এবং সেখান থেকে অজস্র পাথরসমেত আরও ফুট পঞ্চাশেক নীচে।
চোখ মেলে খোলা আকাশ দেখতে পেল বিসক্যাল, গুঙিয়ে উঠল, হাঁটু ভাঁজ করে বসতে চেষ্টা করল। পারল না। ওর মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে।
ইগলেসিয়াস…কোথায় গেল ব্যাটা? একটা ছায়া পড়ল ওর মুখে। বিসক্যাল চোখ খুলল।
শকুন…
২.৫ আধো-অন্ধকারে
আধো-অন্ধকারে চোখ মেলল অ্যানাবেল। একদৃষ্টে চেয়ে রইল কাঁপা-কাঁপা অগ্নিশিখার দিকে, নিচু সিলিংয়ের গায়ে নাচছে ভৌতিক আলো, কিন্তু ও যেন সেসব কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। স্রেফ মনে হচ্ছে একটা কিছু আছে ওখানে, অনেকটা মাথার ভেঁাতা যণার মত স্থির। একটু বাদে চোখ বুজল ও, কিন্তু যখন খুলল আবারও, কম্পিত ছায়াগুলো আছে, গুহার ছাতে, অদ্ভুত সব নাচের মুদ্রায়।
হাস্যকর চিন্তা, অবশ্যই, তবে কিনা জায়গাটা দেখতে আসলেও গুহার মত কিন্তু গুহায় কী করতে এসেছিল সে? চোখ মুদল অ্যানাবেল, ভীষণ দপদপ করছে ব্যথায়, পতনের অবশ্যম্ভাবী ফল, নিঃসন্দেহে।
পতন? কীসের পতন? ওহ.., মনে পড়েছে। ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিল সে, কিংবা ফেলে দেয়া হয়েছিল ঝটকা মেরে। কাজটা কার? ওর মন, এখনও ধোঁয়াটে, জবাব হাতড়াতে শুরু করল।
পরমুহূর্তে সব মনে পড়ে গেল। ঝোপ থেকে একজন ল্যাসো ছুড়েছিল, হ্যাচকা টান মেরে ওকে ফেলে দিয়েছিল ঘোড়া থেকে।
বিসক্যাল, ওটাই তো নাম লোকটার। ঝোপ থেকে বেরিয়ে, দড়ি গোটাতে গোটাতে, ওর দিকে এগিয়ে আসছিল সে। শেষ এ-দৃশ্যটিই মনে আছে তার।
আতঙ্কে, বিস্ফারিত হয়ে গেল ওর চোখ। কাঁপা-কাঁপা আঙুলে বিছানাটা পরখ করল অ্যানাবেল। পশুছালের ওপর শুয়ে আছে, কোন এক গুহায়, কম্বল দিয়ে কে যেন ঢেকে দিয়েছে তার শরীর।
বুটজোড়া বাদে, আর সবকিছুই আছে ওর গায়ে। উঠে বসার প্রয়াস পেল অ্যানাবেল, কিন্তু তীব্র ব্যথা অনুভূত হওয়ায় শুয়ে পড়ল আবার। কী যেন নেমে এসেছে চোখের ওপর, হাত দিতে বুঝল ভেজা ন্যাকড়া। জলপট্টি দেয়া হয়েছিল কপালে। এবার ক্রমশ সজাগ হতে লাগল ওর বোধশক্তি।
পরিচিত, বোধগম্য শব্দ শোনার প্রত্যাশায় কান খাড়া করল অ্যানাবেল। আগুনের পটপট ছাড়া অন্য কিছু শুনতে পেল না। গুহার অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশের দিকে, হ্যাঁ, এখন আর সন্দেহ নেই এটা একটা গুহাই, চোখ ফেরাল সে। দেয়ালের গায়ে রাইফেল দেখতে পেল, দুটো রাইফেল, আর এর অনতিদূরে কল্পনাতীত বিশাল একজোড়া স্নো-শু। আরেকটু সামনে, পাথুরে তাকের ওপর, একারি বই।
বই? গুহায়? আগুনের দিকে ঘাড় ফেরাল অ্যানাবেল।
ফায়ারপ্লেসই পাথর কুঁদে বানানো, শিখার কম্পন বলে দেয় পর্যাপ্ত বাতাস পাচ্ছে। কাছেই, অন্যান্য তাকে, সাজানো আছে রান্নার সরঞ্জাম। এগুলোর পাশে একটা কাঠের বাক্স কুঠার আর করাতও রয়েছে। এ-সবের অর্থ, গুহাটা অস্থায়ী কোন আস্তানা নয়, কারও বাসস্থান।
কে ওকে নিয়ে এসেছে এখানে? কেমন মানুষ থাকতে পারে এমন জায়গায়? গুহামুখের দরজাটা ভারি এবং প্রকাণ্ড, আস্তাবল ছাড়া এতবড় দরজা ইতিপূর্বে আর কোথাও দেখেনি সে। চারপাশে আরেক দফা নজর বুলিয়ে অ্যানাবেল এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুল, যে-লোকটির বাস এখানে একাধারে সে গোছাল এবং পড়ুয়া। অতএব, বিসক্যাল রা ইগলেসিয়াস যুগলের কেউ নয়, যারা ভ্যাকুয়েরো থেকে এখন আউট লতে পরিণত হয়েছে।
হঠাৎ বিশাল এক থাবার টানে বাইরের দিকে খুলে গেল দরজা। ধড়মড় করে উঠে বসল অ্যানাবেল যখন দেখল দোরগোড়ায় অতিকায় এক মা দাঁড়িয়ে। চোখ কপালে উঠল তার, এরকম প্রকাণ্ড মানব-সন্তান সে জীবনে কখনও দেখেনি। বিরাট মাথা ওর, রোমশ, হনু দুটো পুরু, চোয়াল অবিশ্বাস্যরকমের চওড়া। ভেতরে ঢুকল লোকট, বন্ধ করে দিল দরজা।
ভয় পেয়ো না। আমি তোমার বন্ধু।
বিছানার কাছেই, অ্যানাবেলের স্যডলব্যাগ দুটো মেঝেয় নামিয়ে রাখল সে। তোমার ঘোড়ার যত্ন নেয়া হয়েছে। সব ভাল। তুমি আরাম কর।
লোকটার কণ্ঠস্বর অসম্ভব রাট, যেন কোন গভীর কুয়ো থেকে উঠে আসছে। ডাকাতরা? ওদের জন্যে ভয় নেই। চলে গেছে।
কী হয়েছিল?
মেঝেতে বসে পড়ল অতিকায় আগন্তক। উপবিষ্ট অবস্থায়ই, লম্বায় প্রায় অ্যানাবেলের মাথা ছাড়িয়ে গেল সে। একজন দড়ি,ছুড়ে তোমাকে ধরে ফেলেছিল। তারপর আমি যখন পাহাড় থেকে নেমে এলাম, আমাকে দেখে ভয় পেয়ে গেল লোকটা, পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল। অপরাধীর ভঙ্গিতে নিজের ঘাড় চুলকাল দৈত্য। আমি চড় মেরে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছি ওকে। অনেক নীচে, পাথরের ওপর।
আর অন্যজন?
ওর ঘোড়াটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কৌতুকে ঈষৎ নেচে উঠল বিশালদেহীর চোখ। আমাকে যেসব ঘোড়া চেনে না তাদের হয় এমন। ঘোড়াটা ওকে নিয়ে ছুটে পালিয়েছে।
আগুনের দিকে ঘুরে বসল লোকটা। কফি খাবে? অবশ্য তোমাকে খাওয়াবার মত তেমন কিছু আমার নেই এখানে। ঘাড় ফিরিয়ে অ্যানাবেলের পানে তাকাল ও, তর্জনী ইশারায় দক্ষিণ দিক নির্দেশ করল। আমার আসল বাড়ি স্যান হ্যাকিন্টোসে।
আপনিই তা হলে টাহকুইৎস?
মিষ্টি হাসল লোকটা। টাহকুইৎস! কুমারী মেয়েদের নিজের গুহায় ধরে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলে। অ্যানাবেলের দিকে আড়চোখে তাকলি ও। তবে আমি ক্ষুধার্ত নই।
নিঃসন্দেহে আমার জন্যে সুখবর এটা, কিন্তু আমি ক্ষুধার্ত। ভয়ঙ্কর।
তাক থেকে তাওয়া আর একখণ্ড বেকন নামাল দৈত্য। ক্ষুরধার একটা ছুরি দিয়ে চাক-চাক করে কাটতে শুরু করল বেলা। আমি কে জান? আলফ্রেডো। আর তুমি-অ্যানাবেল লরেন্স।
ইতিমধ্যে বলক এসেছে কফিতে। কাপে ঢেলে অ্যানাবেলকে এগিয়ে দিল আলফ্রেডো। আর এই আলফ্রেডো কে জান? আলফ্রেডো হলে অপমান। লজ্জা। জন্ম থেকেই আমি বিরাট। আমাকে নিয়ে আমার বাবার লজ্জার অন্ত ছিল না। আমাকে তিনি লুকিয়ে ফেললেন, তারপর ক্যালিফোর্নিয়ায় নিয়ে এলেন, তবে আলাদা জাহাজে। এরপর কিছু টাকাপয়সাসহ আমাকে আমাদের এক আয়ার হাতে তুলে দিলেন। নির্দেশ ছিল দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলতে হবে আমাকে। কিন্তু সেই মহিলা তা করেনি-বরং মায়ের মেয়ে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে আমাকে।
আপনি আমার নাম জানেন কীভাবে? কথাটা হঠাৎ মনে পড়তে প্রশ্ন করল অ্যানাবেল।
ড্যান আমার ভাগ্নে। ওর মা, মারিয়া ছিল আমার বোন।
আমরা দুজনেই আমাদের বাবাকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছি। আমি, এরকম দৈত্যকায় হয়ে জন্মগ্রহণ করে। আর মারিয়া-গরিব এক নাবিককে বিয়ে করে।
একটা প্লেটে কয়েক চাকা বেকন, একমুঠো কাজুবাদাম আর কিছু ঠাণ্ডটর্নিয়া বাড়ল আলফ্রেডো।
খাও। তোমার পেট হয়তো প্রবে না। কিন্তু কী করব বল, যদি জানতাম অতিথি আসবে-নিশ্চয় ব্যবস্থা রাখতাম আরও খাবারের।
ড্যান কোথায়? ওর সাথে আমার দেখা হওয়া দরকার। ও ভাল আছে তো?
বেঁচে আছে, তবে কষ্ট পেয়েছে অনেক। আমার বিশ্বাস, এবার রোধহয় পালটা আঘাত হানবে ড্যান। কারণ সেটাই হবে ওর উপযুক্ত কাজ, ওর বাবাও তাই করেছিলেন।
আলফ্রেডো, আপনি ঠিক জানেন ও সুস্থ আছে? ওকে আমার ভীষণ দরকার! আমি ওকে ভালবাসি, খুউব, এখন ভয় পাচ্ছি ও হয়ত্তে আর লস এঞ্জেলেসে ফিরবে না।
নিশ্চয় ফিরবে।
আপনি জানেন না। ডন ফেডেরিকো এসেছিলেন আমাদের বাসায়। লোক বেশ অমায়িক। আর, আমিও বোধহয় মজে গিয়েছিলাম। ড্যানকে বলেছিলাম কথাটা, কিন্তু বুঝতে পারিনি…
আরেকটু বুদ্ধি খাটানো উচিত ছিল তোমার। অবশ্যি আমরা কে-ইবা তা খাটাই? ওই লোক যেখানে আছে ড্যান তার ধারেকাছে থাকতে চায় না। ফেডেরিকো একটা আস্ত শয়তান। ছেলেবেলায়ও তাই ছিল। ভীষণ স্বার্থপর। অকস্মাৎ হেসে উঠল আলফ্রেডো, চোখে কৌতুক। ওর বিশ্বাস আমি মারা গেছি। মনে হয় এই বিশ্বাসটি এবার ভেঙে দেয়ার সময় হয়েছে।
ড্যানের কাছে আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন আপনি?
পারব। তুমি বললে, নিরাপদে লস এঞ্জেলেসেও তোমার ফেরার ব্যবস্থা করতে পারি।
না, আমাকে ওর কাছে নিয়ে চলুন! প্লিজ!
বেশ। সকাল হোক। আপাতত এখানেই থাক…এখানে, তুমি নিরাপদ। জঙ্গলের দিকে ইশারা করল আলফ্রেডো। আমার থাকার অন্য জায়গা আছে।
আচ্ছা, আপনিও চলুন না আমার সাথে লস এঞ্জেলেসে? এখানে আপনার থাকার কোন প্রয়োজন নেই!
স্মিত হাসল আলফ্রেডো। আমাকে দেখলে ভড়কে যাবে লস এঞ্জেলেসের লোকেরা। ছফুটকেই সবাই অস্বাভাবিক লম্বা মনে করে। আর আমি সেখানে সাত ফুট আট ইঞ্চি। ওজন প্রায় চারশো পাউন্ড।..
থ হয়ে যাবে ওরা। তাকিয়ে থাকবে ফ্যালফ্যাল করে। জিজ্ঞেস করবে আমি কত লম্বা, এবং হতাশ হবে আরও বেশি লম্বা নই বলে। দরজাগুলো হবে খুউব ছোট, হাত নিচু, আর সব চেয়ার বামনদের বসার উপযুক্ত।
এখানে অবস্থা অন্যরকম। পাহাড়পর্বতের তুলনায় আমি শিশু, গাছপালার মাঝে অতিক্ষুদ্র একটা বস্তু। ওখানে আছে ভয় আক্রোশ আর বিদ্বেষ। এখানে নির্মল হাওয়া, সাধারণ খাবার, আর আমার বই।
আচ্ছা, ভ্যানের সঙ্গে আপনি কখনও কথা বলেছেন?
ওঃ, না! আর বোধহয় সে-কারণেই আমরা বন্ধু হতে পেরেছি। বই আদানপ্রদান হয়েছে আমাদের মধ্যে, এবং সম্ভবত চিন্তাধারারও। ও আমাকে জানে, বোঝে। বোধ করি আমার আসল পরিচয়ও জানে। আমি চেয়েছিলাম ও আমাকে জানুক, তাই আমার স্বাক্ষর রেখে এসেছিলাম। বুঝেছিলাম, ভাষায় যা সম্ভব নয়, এতে করে অনেক না-বলা কথা বলা হয়ে যাবে।
আমার ফেরার উপায় নেই, অ্যানাবেল। লস এঞ্জেলেস আমাকে দানব ভাববে। আমার জন্মদাতা, আমার বাবা, তিনিই যখন ওই দৃষ্টিতে দেখেছেন, তখন অন্যদের কাছে আমি আর কী আশা করতে পারি বল?
এখানে কেউ আপনাকে দেখেনি?
দেখেছে। দু-একজন ইন্ডিয়ান। তবে ওরা ভদ্র। আমি ওদের ব্যাপারে নাক গলাই না, আর ওরা আমার।
ওদের বিশ্বাস আপনি টাহকুইৎস।
বাজে কথা। ওই নামে ডাকে আমাকে কারণ আমি একা থাকি টাকুইৎসয়ের পাহাড়ে। কিন্তু আসল ঘটনা জানে সবাই, এবং এ নিয়ে ঠাট্টা-তামাশাও করে নিজেদের মধ্যে।
উঠে দাঁড়াল আলফ্রেডে। নিজের অজান্তেই সেই অতিকায় অবয়বের সামনে কুঁকড়ে গেল অ্যানাবেল। সকৌতুকে হাসল দৈত্য। কী, এবার নিজেই বুঝছ তো? যাক, এখন ঘুমাও তা হলে। আমি ভোরে আসব। তবে দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি উঠ। আমি চাই পাহাড় থেকে তুমি মরুভূমির সূর্যোদয় দেখ। এটা দেখা যদি বাকি থাকে, জীবনে কোন দেখাই তোমার পূর্ণ হবে না।
বাইরে বেরিয়ে গেল আলফ্রেডো, পেছনে আস্তে করে টেনে দিল দরজা।
আর গুহায় অ্যানাবেল একা, ভাবল, রাতের অন্ধকারে টুইলে, যেখানে কালো কালো সৈনিক পাইনদের সারির ভিড়ে নিঃশব্দে ডানা মেলে ওড়ে বাদুড়, হয়তো এখন হাঁটছে ওই মানুষটা, আর তার সঙ্গী শুধুই বাতাস। আপনা থেকেই জলে ভিজে এল অ্যানাবেলের দুচোখ।
.
২২.
ডন রোমেরোর কথা শেষ হতেই, মুহূর্তের জন্যে থমথমে নীরবতা নামল ঘরে। মিস ডায়ানা যদি ভয় পেয়েও থাকেন, বাইরে তা বিন্দুমাত্র প্রকাশ করলেন না।
সিনর, দুঃখের সঙ্গেই বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি মান্ধাতা যুগে বাস করছেন। চল্লিশ, চাই কি বিশ বছর আগেও এসব করে হয়তো পার পেয়ে যেতেন, কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়।
আপনি সমাজ থেকে এমনভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন যে জানেন না, আইনকানুন কত বদলে গেছে।
ডগলাস ও’হারার সাথে আপনার বিবাদের কারণ সবাই জানে। তবে সেটা অনেককাল আগের ঘটনা। কিন্তু এখন যদি আমার, বা আপনার বোন এলেনার, কোন ক্ষতি হয়, সঙ্গে সঙ্গে হৈ-চৈ পড়ে যাবে ব্যাপারটা নিয়ে, তদন্ত হবে। আর আমি এখানে আসার আগে সমস্ত নথিপত্রই নিরাপদ জায়গায় রেখে এসেছি, যাতে প্রয়োজনের সময়আইনের হাতে পড়ে ওগুলো।
ড্যান ও’হারার যদি কিছু হয়ে যায়, আমি আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলাব। আমার বা আপনার বোনের কিছু হয়ে গেলেও ফাঁসিতে ঝুলবেন আপনি। এবং-হাত ইশারায় দোরগোড়ায় অপেক্ষমাণ দলটাকে দেখালেন ডায়ানা-ওরাও। তখন আপনার আত্মগরিমা আর বংশমর্যাদা কোথায় যাবে? চিরকার্লের মত কলঙ্কিত হবে, আর তার কারণ হবেন আপনি।
দোরগোড়ার লোকজনের উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়ালেন ডায়ানা। তোমাদের হাতিয়ার ফেলে দাও। একটা মেয়েমানুষকে তোমাদের এত ভয়, তাই পিস্তল বের করেছ? একবার ভেবে দেখেছ, এ-কাজের জন্যে কে তোমাদের টাকা দেবে? ওঁর কোন টাকা নেই। উনি তোমাদের কি দিতে পারবেন না, কি না। তোমরা সবাই অন্ধ, তাই একজন অন্ধ লোকের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছ!
বেরিয়ে যাও এখান থেকে। এক্ষুণি। সম্রাজ্ঞীর ভঙ্গিতে হাত ইশারা করলেন ডায়ানা। মিস্টার কেলসো, ওরা যদি না যায়, আপনি গুলি করবেন।
নত হলো পিস্তলের নল। বিমূঢ় দৃষ্টিতে, পালা করে একে অন্যের মুখ দেখল লোকগুলো, তারপর তাকাল ভন রোমেরোর দিকে। কেলসো ইতিমধ্যে তার পিস্তল বের করেছে। ও ভাল করেই জানে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভাতা, কিন্তু বাইরের আচরণে সে নির্বিকার রইল।
দলের একজন নিঃশব্দে ঘুরে চলে গেল, তারপর আরেকজন। সবশেষে বিদায় নিল মেক্সিক্যান হাউসকিপার।
ডন রোমেরো। মিস ডায়ানার কণ্ঠস্বর মৃদু অথচ শীতল ও দৃঢ়। আপনার জায়গায় আমি থাকলে, এক্ষুণি লোক পাঠিয়ে তলব করতাম ডন ফেডেরিকোকে। আমার পরামর্শ, আপনি তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিন, তিনি আপনার উত্তরাধিকারী নন, কোনদিন হবেনও না। যতক্ষণ না এটা জানছেন ফেডেরিকো, আপনার নিজের জীবনের নিরাপত্তা নেই কোন উন ফেডেরিকো প্রমাণ করেছেন, তার লোভ অপরিসীম, এবং তিনি থামতে জানেন না।
উনি যা বলছেন সত্যি, ভাই। এমনকী যখন ছোট ছিল, তখনও, একবার আলফ্রেডোকে খুন করার চেষ্টা করেছিল ও। দিন কয়েক আগে আমাকে শাসিয়েছে। ড্যানকে তাড়া করছে কারণ ও বেঁচে থাকলে তোমার জমিদারি পাওয়ার ব্যাপারে ফ্রেডেরিকোর পথে বাধার সৃষ্টি হতে পারে।
জ্বলন্ত চোখে বোনের দিকে তাকালেন ডন রোমেরো। তোমার কথা সত্যি যদি হয়ে থাকে, আমার কোন জমিদারি নেই। কিচ্ছু নেই।
সত্যি,জবাব দিলেন এলেনা, কণ্ঠস্বর নিচু। তুমি কাজে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারনি, ভাই, তাই প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা আমাকেই গ্রহণ করতে হয়েছে, মিস ডায়ানার সহায়তায়। তবে উন ফেডেরিকো একথা জানে না। ওকে তোমার এক্ষুণি ডেকে পাঠানো উচিত, ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটে যাওয়ার আগেই।
আমাদের আইন অনুযায়ী, ডন রোমেরো, যোগসাজশকারী হিসেবে আপনিও অভিযুক্ত হবেন, যোগ করলেন মিস ডায়ানা। কাজেই আপনার নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারটিও আপনাকে ভাবতে হবে।
পাঠানোর মত কেউ নেই আমার। সবাইকে তোমরা তাড়িয়ে দিয়েছ।
আপনি নির্দেশটা লিখে দিন, জবাব দিলেন ডায়ানা, আমি দেখছি ওটা যেন আপনার কাজ করত এমন কারোকে দিয়ে পাঠানো যায়।
ডেস্কে গেলেন এলেনা, কাগজ কলমআর কালি এনে দিলেন ডনকে।
একমুহূর্ত কাগজটার দিকে স্থির চেয়ে রইলেন রোমেরো; তারপর ধীরে ধীরে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও, হুকুমনামাটা লিখে দস্তখত করলেন নীচে।
এলেনার উদ্দেশে পলক তুললেন ডন, চোখে নগ্ন আক্রোশ। তুই আমাকে ধ্বংস করলি।
না, ভাই। আমি তোমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছি। তুমি নিজেই নিজেকে ধ্বংস করেছ। শুরু থেকেই তোমার এই অন্ধ আত্মগরিমা আর বিদ্বেষ তোমার সমস্ত সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দিয়েছে।
রূঢ়, নিষ্ঠুর আচরণ করেছ তুমি, কিন্তু আমার বিশ্বাস এ-জন্যে অনেকটাই দায়ী ডন ফেডেরিকো। ও-ই হচ্ছে তোমার শনি, সর্বদা ছায়ার মত ঘুরেছে তোমার পেছনে, ফুসমন্তর দিয়েছে। আমার ধারণা ফেডেরিকোর ইন্ধন না থাকলে, বহুকাল আগেই নিজেকে তুমি শুধরে নিতে।
নড়েচড়ে বসলেন বৃদ্ধ। ওই পুঁচকেল, অস্ফুট স্বরে বললেন তিনি, আমাকে দাদু বলে ডেকেছিল!
কেলসো তার পিস্তল হোলস্টারে রাখল। ম্যাম, রাত অনেক হলো। আপনার কথা জানি না, তবে আমি ক্লান্ত।
ওঃ, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদেরও যেতে হয় এবার। ঘাড় ফেরালেন ডায়ানা। এলেনা? আপনি আসছেন আমাদের সঙ্গে?
আমি থাকছি। আমাকে এখন ওর প্রয়োজন হবে।
.
পাইন বনের পোল কোরালে ঢুকে বব লারকিন তার ঘোড়ার পিঠ থেকে মালপত্রগুলো নামাল। গাছপালার ফাঁক দিয়ে হিডেন লেক-এর পানি আবছায়া দেখতে পাচ্ছে ও। যা ভেবেছিল, পৌঁছুতে তার চেয়ে দেরি হয়েছে ওর, সুতরাং রাতটা কাটাতেই হবে।
ভারি একটা চটের ব্যাগ কাঁধে তুলে নিল ও, তারপর অন্য ব্যাগটা হাতে করে এগোল ট্রেইল ধরে।
এখন পড়ন্ত বিকেল, আকাশ পরিষ্কার, আবহাওয়া ঠাণ্ডা। পথে দুবার বিশ্রাম নিতে থামল সে। তুমি আর যুবকটি নও, বাছা, নিজেকে শুনিয়ে বলল লারকিন।
বিশাল দুই হাতের থাবায় মাথা রেখে, বাইরে বসেছিল আলফ্রেডো।
বাছা, তোমার শরীর ভাল তো?
চোখ তুলল আলফ্রেডো। মলিন, থমথমে মনে হচ্ছে ওর চেহারা, তবে ওটা সম্ভবত আলোর কারসাজি, ভাবল বব, তির্যকভাবে পতিত হওয়ায় ঈষৎ বিকৃত দেখাচ্ছে মুখাবয়ব।
না, বব। ভাল না। হাঁটতে কষ্ট হয় এখন। আ…আমার বিশ্বাস পেশীগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে।
তোমার জন্যে আরও কিছু খাবার আর বইপত্তর এনেছি। আমিও আর আজকাল এই ট্রেইলে বিশেষ চলতে পারি না। বুড়িয়ে যাচ্ছি, মনে হয়।
চারপাশে নজর বোলাল লারকিন। চমকার একখানা জায়গা পেয়েছ তুমি, বাছা। কেমন একটা পবিত্র-পবিত্র ভাব আছে। আপনা থেকেই মন জুড়িয়ে আসে প্রশান্তিতে।
অ্যানাবেল লরেলকে উদ্ধার করেছি আমি, বলল আলফ্রেডো।
নিরাপদ তো?
ইন্ডিয়ানদের কাছে আছে। ফ্রান্সিসকোর স্ত্রীর কাছে।
কোন ঝামেলা হয়েছিল?
দুজন লোক। একটা পালিয়েছে। অন্যজনকে আমি…থাবড়া মেরেছিলাম।
থাবড়া…তুমি?
নীরব হলো ওরা, অস্তাচলগামী লাল সূর্যটাকে ঢলে পড়তে দেখছে পাহাড়ের পেছনে। বাছা, আমার যদি কিছু করার থাকে, সংকোচকর না বলতে।
আমার জন্যে তুমি অনেক করেছ, বব। তোমার সাহায্য ছাড়া… তোমার সাহায্য ছাড়া আমি কিছুই করতে পারতাম না।
খামোকা মন খারাপ করতে নেই; অ্যাল। একটা ডাল কুড়িয়ে নিয়ে পাইন শাখায় খোঁচা দিল শারকিন। তোমাদের সাথে দেখা হওয়ার আগে, আমার জীবনটাও ছিল ছন্নছাড়া। তোমার মা-ই আমাকে সংসারী করেছে।
উনি আমার মা ছিলেন না, মানে পেটে ধরেননি।
জানি, বাছা। কিন্তু তুমিই ছিলে ওর জীবনের সব। মরার আগে আমার এই হাত দুটো ধরে ও বলেছিল, আমি যেন লক্ষ রাখি তোমার দিকে।
এবং তুমি তা রেখেওছ। তুমিই আমাকে পিতৃস্নেহে ভরিয়ে তুলেছ, বব।
বাছা, আমার বয়স হয়েছে, আর ওই ট্রেইলটাও যেন খাড়া হচ্ছে দিন-দিন। আমার যদি কিছু হয়ে-
শুধু শুধু এসব ভেবে নিজেকে কষ্ট দিয়ো না, বব। আমিও বোধ হয় আর বেশিদিন নেই এখানে। মুখ খুলতে যাচ্ছিল লারকিন, কিন্তু হাত তুলে বাধা দিল আলফ্রেডো। না, বব। আমি বুঝতে পারি। ভীষণ ক্লান্ত লাগে আজকাল, জান? এইসব পাহাড়পর্বতকে ভালবেসেছি আমি। এরাই আমার জীবনের সব। আর ড্যান? ও-ও আমার জন্যে বিরাট কিছু।
ড্যান ভাল ছেলে। এই দেশটার প্রতি ওর অন্যরকম টান আছে।
জান, ওই বাড়িটা যখন ওরা পুড়িয়ে দিল, ভয়ানক দুঃখ পেয়েছিলাম আমি।
বুঝি। মেঝের ওই নকশাটা করতে অনেক কষ্ট হয়েছিল তোমার।
আসলে এমন কিছু তৈরি করতে চেয়েছিলাম, যেটা কার্লের ঘষা খেয়েও অম্লান থাকবে। মিশন থেকে তুমি যেসব পুরনো বইপত্র এনে দিয়েছিলে, তারই একটায় মোজাইকের ছবি ছিল কিছু। আমি ওই জিনিসই করতে চেয়েছিলাম।
রাত বাড়ছে, বাছা। তুমি বরং ভেতরে গিয়ে বিশ্রাম নাও।
আলফ্রেডো ভেতরে যাওয়ার পরেও, অনেকক্ষণ বাইরে বসে রইল বব লারকিন। বন্ধু হও, নিজেকে বলল-সে। এমন নয় যে সে ছেলেটার কোন ক্ষতি চায়, কারণ এখন ও-ই ওর আলো। সমস্যা একটাই, তার বয়েস হয়েছে, দীর্ঘ পথের ধকল ইদানীং আর সহ্য হয় না শরীরে।
তা ছাড়া, মানুষের নজরে পড়তে শুরু করেছে ব্যাপারটা। এ-পথে ওরা তাকে যাতায়াত করতে দেখেছে, কৌতূহল বোধ করেছে নিজের মনে। হয়তো একদিন তাদের কেউ পিছু নেবে।
লারকি যখন ভেতরে গেল, আলফ্রেডো তার প্রকাণ্ড বিছানায় শুয়ে। চোখ গুহার সিলিং পানে স্থির।
আমি বরং তোমার খাবারের জোগাড় করি, বাছা, বলল লারকিন। তুমি আরাম কর। কয়েকটা আলু কুচি করে কেটে একটা তাওয়ায় ফেলল ও, এখানে আসার সময়ে বেকনের যে-চাকাটা এনেছে সঙ্গে সেটা বের করল। তোমার জন্যে আমার আর কিছু করার আছে, বাছা?
স্যান বার্নারডিনোর দিকে যদি যাও কখনও, আমার সেরা জিনিসগুলো নিয়ে এস এখানে। আমি বোধহয় আর ফিরতে পারব না।
চকিতে আলফ্রেডোর পানে তাকাল লারকিন। এত খারাপ?
হ্যাঁ, বব। এখন রীতিমত কষ্ট হয়। অথচ একসময় সবকিছুই কত সহজ ছিল?
কিন্তু তুমি তো এখনও তরুণ!
একবার, আমরা তখনও স্পেন থেকে চলে আসিনি, আমার বোন আমাকে এক মুর হেকিমের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেই ভদ্রলোক ছিলেন মুসলিম, তাই কেউ যেত না ওঁর কাছে, কিন্তু আমার বোন শুনেছিল আর সবার চেয়ে চিকিৎসা জিনিসটি উনি ভাল বোঝেন।
তো, সেই হেকিম ভদ্রলোক আমাকে দেখে বলেছিলেন, এরকম অসুখের কথা তিনি জানেন, যদিও এর হার অত্যন্ত কম। আমার কী কী অসুবিধে হতে পারে তাও বলে দিয়েছিলেন তিনি। তাই আমি তৈরিই আছি বিদায়ের জন্যে।সহসা স্মিত হাসল আলফ্রেডো। জান, বব, আমি শুধু তোমার কাছেই এখনও তরুণ। কিন্তু আসলে সেই সময়টা আমার বহু আগেই পেরিয়ে গেছে।
কিন্তু তাই বলে তুমি আমার মত বুড়োও নও। আমার বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি।
চোখ বুজল আলফ্রেডো, নীরব। আধো-অন্ধকারে এভাবে চুপচাপ শুয়ে থাকলে আরাম বোধ হয়। সত্যি, শত ঝড়ঝঞ্ঝা সত্ত্বে, জীবনকে সে উপভোগ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে এখানকার এই বিস্তৃত পার্বত্য এলাকায় বিচরণ করেছে অবাধে, বাঁচতে শিখেছে, কাউইয়ারা যেভাবে বাঁচে। মাঝেসাঝে যখনই কোনকিছু নিতে ওদের পল্লীতে গেছে, ওদের মালিকানা আর তার অনধিকার প্রবেশের স্বীকৃতি হিসেবে নিজের তরফ থেকে সেখানে কিছু না কিছু রেখে এসেছে সে। প্রায়ই উঁচু নিরাপদ কোন স্থানে বসে ও দেখত কোথায় খাবার জমিয়ে রাখে ওরা, কী কী শাকসবজি ব্যবহার করে। বব লারকিন আর ওর মা-ওই মহিলাকে সে তা-ই জানে-আরও অনেককিছু শিখিয়েছে ওকে।
বব ওকে বলেছিল ছেলেকে নিয়ে ডগলাস ও’হারা ফিরে আসছে, এবং ওরা একমত হয় যেভাবেই হোক তার লস এঞ্জেলেসে যাওয়া ঠেকাতে হবে।
এস, বাছা; খাবার তৈরি। লারকিনের ডাকে সহসা ছিড়ে গেল আলফ্রেডোর চিন্তাজাল। চাপটা একটা গাছের গুড়ি মাঝে রেখে মুখোমুখি খেতে বসল দুজনে।
অ্যানাবেল ফ্রান্সিসকোর বউয়ের সাথে আছে, না? তা হলে ভালই থাকবে ওখানে।
আর তুমি, বব? তুমি কী করবে?
আগুনের দিকে তাকাল লারকিন, তারপর আলফ্রেডোর পানে। জানি না বাছা। হয়তো ঘোড়া সাজিয়ে বেরিয়ে পড়ব আবার। তবে কখনোই তোমার কাছ থেকে বেশি দূরে যাব না
বব? লারকিনের হাতে আলফ্রেডো তার বিশাল মাংসল হাতখানা রাখল। মানে আমি বলছি, পরে? তার পরে?
দীর্ঘ একটা মুহূর্তের নীরবতা। তারপর বব লারকিন যখন মুখ খুলল তখন মনে হলো বহুদূর থেকে যেন কথা বলছে। জানি না, বাছা। তবে মনে হয় পর বলে কিছু থাকবে না। তুমি আর সেই মহিলাই ছিল আমার সব। আমার চিন্তাভাবনার একটা বিরাট সময় জুড়ে আছ তুমি।
বব? ড্যানের কাছে চলে যেয়ো। দেখা কর ওর সাথে। আমি চাই না তুমি একা হয়ে যাও। ড্যান অনেক বড় কাজে নামবে, আমার বিশ্বাস, বিশ্বস্ত লোকের প্রয়োজন হবে ওর। আর তাছাড়া, ও তোমাকে পছন্দ করে।
দূর-পাহাড়ের নীরবতার মাঝে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সেই ভরাট কণ্ঠস্বরটি, আর ওঁরা বসে রইল চুপ করে, আগুনের দিকে চেয়ে।
ভোর হওয়ার আগেই, নিদ্রাবিভোর লারকিনকে একা রেখে, গুহা ত্যাগ করল আলফ্রেডো। বাইরে দাঁড়াল সে, আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সতর্ক নজর বোলাল চারপাশে। এই গুহার সাথে ওর স্যান বার্নারডিনোর অস্থায়ী আবাসের তেমন কোন ফারাক নেই; তফাত শুধু এটুকুই এটা আরও বড়, আর ভেতরে ছোট ছোট কয়েকটা খুপরি রয়েছে। আরও দুটো পথ আছে এখানে ঢোকার, দুটোই বেশ কিছুটা দূরে অবস্থিত। একটি প্রাকৃতিক; অন্যটা, গুহার একপ্রান্ত পাহাড়ের বাইরের দেয়াল অবধি প্রসারিত এটা আবিষ্কার করে, ও নিজেই তৈরি করে নিয়েছে। উভয় প্রবেশমুখই সুরক্ষিত, সহজে কারও চোখে পড়বে না।
পথে নামবার আগে, নিথর দাঁড়িয়ে চারদিক আরেকবার জরিপ করে নিল আলফ্রেডো। এদিকে কারও এসে পড়া বিচিত্র নয়, যদিও আজ পর্যন্ত কোন শ্বেতাঙ্গকে পাহাড়ে উঠতে দেখেনি সে, আর কাউইয়ারা তার এলাকা সর্বদা এড়িয়ে চলে। প্রায়শ অদূরের তৃণভূমিতে হরিণ চরে, এবং একবার একটা ভালুক চোখে পড়েছিল ওঁর।
আজ ভোরে, পাইন বনের মাঝ দিয়ে, অস্পষ্ট ট্রেইল ধরে পাহাড়ের কিনারে চলে গেল আলফ্রেডো, একটা পাথুরে কারনিসে বসল। এই কারনিসের নাম রেখেছে সে চেয়ার। এর পাথরটা অর্ধবৃত্তাকার, পেছনের দিকে সামান্য উঁচু। ফলে বেশ আরামে বসা যায়।
এ-জায়গায় হামেশাই আসে সে, নীচের উপত্যকা থেকে প্রায় আট হাজার ফুট ওপরে, সামনে তাকালে দক্ষিণপুবের অসংখ্য ক্যানিয়ন উষ্ণ ঝরনা আর সবুজ সতেজ প্রাতর চোখে পড়ে।
এখানে বসে উপত্যকার সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করতে পারে ও, দেখতে পায় দূরের গিরিপথ যার ভেতর দিয়ে পূবের মানুষরা এসেছে পশ্চিমে। পুব দিকের মরুভূমিও দেখা যায়, সাদা আর গোলাপির বিস্তীর্ণ এক প্রান্তর, সূর্যের উদয়–অস্তের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রমাগত রঙ বদলায় নিজের। দিনে, মেঘের ছায়ারা রাজকীয় ভঙ্গিতে কুচকাওয়াজ করে ওই অবারিত-প্রসারিত প্রান্তরে।
এই সেই স্থান। যখন শেষ-সময় আসবে, যদি সম্ভবপর হয়, এখানে চলে আসবে সে। বসবে এখানে, যেমন এখন বসে আছে, এবং প্রতীক্ষা করবে অনন্ত নীরবতার।
ওঠার প্রয়াস পেল ও, কিন্তু পেশীগুলোকে মনে হলো নিজীব। আবার চেষ্টা করল, কাত হয়ে পড়ে গেল নিজের আসনে। অনেকক্ষণ অনড় বসে থাকল ও, দৃষ্টি মরুভূমির দিকে। তারপর চেষ্টা করল আবার, কিন্তু শরীরে এখন আর একফোঁটা শক্তিও অবশিষ্ট নেই ওর। মাথাব্যথা করছে..এই ব্যথাটা ইদানীং ভীষণ ভোগাচ্ছে তাকে। নিশ্চল বসে রইল ও, চোখ বন্ধ। তার, ধীরে ধীরে, পাপড়ি মেলল, দেখল মরুভূমি থেকে উত্তপ্ত বাতাসে চেপে উড়ে আসছে একটা ঈগল, আশ্চর্য ডানায় ভর, করে ওপর পানে উঠছে ওটা…ওপরে…আরও ওপরে…তারপর মুহূর্তের জন্যে ঈগলটাকে ও হারিয়ে ফেলল, তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।
চোখের সামনে নিজের বিরাট হাতখানা মেলে ধরল সে, আস্তে আস্তে মুঠি বন্ধ করল। হাতটা ধপ করে পড়ে গেল ওর কোলের ওপর। আবার তাকাল সে, প্রয়াস পেল ঈগলটাকে খোজার। ওই তো, উড়ছে ওখানে, আকাশের পটভূমিতে ওর অপূর্ব ডানা মেলে।
ফের উঠতে চেষ্টা করল ও, কিন্তু এবার সামান্যতম সাড়া অনুভব করল না কোথাও। ধীরে ধীরে শরীর এলিয়ে দিল সে, বসে রইল স্থাণুর মত, বিরাট হাত দুখানি প্রকাণ্ড দুই হাঁটুর ওপর পড়ে।
এখনই? ফিসফিস করে শুধাল আলফ্রেডো। এখনই কী? এবং তারপর, আরও স্বগত স্বরে, কেন নয়?
.
২৩.
বালিয়াড়ির পাড়ে বসে আমাকে দেখছিল ফ্রান্সিসকো। শুনলাম তুমি এসেছ। জানি তোমার বাড়ি পুড়ে গেছে। তাই সহজেই অনুমান করে নিলাম, তুমি এখানে থাকবে, আমাদের পুরনো আড্ডায়। চারপাশে নজর বোলাল ও। কিছুই বদলায়নি।
অন্তত এখানে নয়, একমত হালাম আমি। তারপর হাসলাম ওর পানে চেয়ে। তুমি বেশ মুটিয়ে গেছ, ফ্রান্সিসকো। নিশ্চয় খুব খাও?
শ্রাগ করল ও। আমার বউ…ওর ধারণা আমি মোটেই খাওয়া-দাওয়া করি না। একটু থেমে আবার মুখ খুলল ফ্রান্সিসকো। তুমিও কিন্তু তাগড়া হয়েছ।
না হয়ে উপায় কী, আমার অনেক শত্রু।
বিয়ে করনি? গাছের ডাল দিয়ে বালুতে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে হালকা সুরে জিজ্ঞেস করল ও।
না, জবাব দিলাম, তবে একজনকে করবার ইচ্ছে রাখি।
গাত্রোত্থান করল ও, আড়মোড়া ভাঙল। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে সেই মেয়ে, বলল ফ্রান্সিসকো। আর গল্প করছে আমার বউয়ের সাথে।
সবিস্ময়ে, উঠে দাঁড়ালাম আমি, এগোলাম ব্ল্যাক স্ট্যালিয়নের দিকে। অনাবেল? এখানে।
তোমার খোঁজ করছে। ওর ভয় তুমি আর ফিরে যাবে না ওর কাছে। তারপর আমার পাশাপাশি হয় ফ্রান্সিসকো যোগ করল, মেয়েটা বিপদে পড়েছিল, অ্যামিগো। আমার বউকে বলেছে, আর বউ আমাকে। চকিতে আমার উদ্দেশে তাকাল ও। একজনকে খুন করেছে সে। গুলি করে।
অ্যানাবেল? অসম্ভব!
কাঁধ ঝাঁকাল ফ্রান্সিসকো। শোন, মেয়েছেলের হৃদয়ে কোন পাথর আছে কেউ তা জানে না। ও পালিয়েছিল, আর ওরা পিছু নেয়। থামল ফ্রান্সিসকো, সামনের পাম ঝোপের দিকে তাকাল।
সেই বিশালদেহী…রাতে হাঁটে…মেয়েটাকে রেখে যায় আমাদের গ্রামের ধারে। তারপর ও একাই চলে এসেছে আমাদের কাছে।
বিশালদেহী? টাহকুইৎস?
কাঁধ ঝাঁকাল ফ্র্যান্সিসকো। ওটাও একটা নাম বটে। তবে তোমার বউ বলল ওর আসল নাম আলফ্রেডো।
আলফ্রেডো…চমকে উঠলাম আমি। পরক্ষণে খুলে গেল সমস্ত রহস্যের জট।
.
আমি আগুনের ধারে আসতেই চকিতে উঠে দাঁড়াল অ্যানাবেল। একমুহূর্ত ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ও, তারপর দৌড়ে চলে এল আমার কাছে, আর আমিও, স্বভাবতই, ওকে টেনে নিলাম বুকে।
আমরা এবার বাড়ি ফিরে যাব, প্রিয়া, বলেই বিস্মিত হালাম আমি। এই প্রথম কোন মহিলাকে আমার এই সথোধন, দেখলাম হাসিমুখে তা মেনে নিয়েছে অ্যানাবেল। সত্যি, নারীর মন বোঝা ভার।
গল্প করলাম আমরা, তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে আমি যখন আবার আমার ঘোড়ার কাছে গেলাম তখন দেখলাম ওর পিঠে জিন চাপিয়ে অপেক্ষা করছে ফ্রান্সিসকো। এবার অ্যানাবেলের দুর্ভোগের ইতিহাস সবিস্তারে আমাকে জানাল ও, এবং সবশেষে যোগ করল, ওই একজন যে রয়ে গেছে, সেই লোকই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। ওর নাম ইগলেসিয়াস।
তো?
ইগলেসিয়াস ভাসকুয়েযের লোক। মেয়েটার পিছু নিয়ে এদিকে এসেছে সে। কাজেই তুমি একটু সাবধানে থেক।
অ্যানাবেল এগিয়ে এল, কাপড়চোপড় ঝেড়ে পরিপাটি করে নিয়েছে যথাসম্ভব, চুল বেঁধেছে নতুন করে। এই মেয়েই আমার স্বপ্নসখী, এবং আরও বেশিকিছু।
স্যাডল চাপিয়ে ওর ঘোড়াটাও নিয়ে এল ফ্র্যান্সিসকো। তুমি খুব তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছ,আক্ষেপ করল ও। কথাই হলো না আমাদের।
মনে আছে, স্নো ক্রীক ট্রেইলের এক জায়গায় বুনো কুল কুড়াতাম আমরা? আমি বললাম। ওখানে যাচ্ছি এখন।
ওপর-নীচ মাথা দোলাল ও, হাত কোমরে। তোমরা তাড়াতাড়ি ফিরে এস। তুমি আর তোমার বউ। আমরা ঘর তুলে দেব-তোমরা থাকবে।
রওনা দিলাম আমরা, পাশাপাশি ঘোড়া ছুটিয়ে, আবার প্রস্পর মিলিত হতে পেরে দুজনেই খুশি। তবে ইগলেসিয়াস সম্পর্কে ফ্রান্সিসকোর হুঁশিয়ারি আমার মনে আছে, তাই মাঝে-মধ্যে তাকাচ্ছি পেছনে।
সামনে ইন্ডিয়ান পন্নী আছে একটা, বললাম, আমরা ওখানে থামব। ওদের আমি চিনি। একসময় বব লারকিনও প্রায়ই আসত ওখানে।
বব নিশ্চয় বুড়িয়ে গেছে এখন? প্রশ্ন করল অ্যানাবেল।
মনে হয়। তবে, বয়েস দিয়ে মানুষকে আমি বিচার করি না। মনটাই হচ্ছে আসল।
.
ইগলেসিয়াস এখন একজন ভীত মানুষ। শুধু যে ওর ঘোড়াটা ভয় পেয়েছিল তা নয়। দৈত্যকায় লোকটিকে চোখে পড়েছিল ওর, অতিকায় হাতের আলতো ছোঁয়ায় বিসক্যালকে সে খাদে পড়ে যেতে দেখেছিল। শেষমেশ যখন নিজের ঘোড়া থামাতে সমর্থ হয় ও, তখন বা ক্যানিয়নের উজানে এসে পড়েছে। তাই আরেকটু সামনে এগিয়ে গেল ইগলেসিয়াস, রাতটা কাটাল টিপ টপ মাউন্টিনের ছায়ায়, রাউন্ড ভ্যালিতে।
যখন সকাল হলো, নাস্তার পাট চুকিয়ে পরিস্থিতি বিচার করতে বসল ও। সম্ভবত স্বপ্নই দেখেছে সে। সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ব্যাপার। যা দেখেছে, ওরকম কোন জীব দুনিয়াতে থাকতে পারে বলে বিশ্বাস হলো না ইগলেসিয়াসের।
কিন্তু মেয়েটা! ও তো রক্তমাংসের, খাসা, সুন্দরী। জীবনে কখনও অমন কটা সোনালি চুল কারও মাথায় দেখেনি সে। জিভ নেড়ে ইগলেসিয়াস তার ঠোঁট চাটল, মনে মনে অভিসম্পাত দিল নিজেকে। অমন একখানা ডবকা জিনিস পেয়েও হাতছাড়া করলি, হতভাগা? নাহ্, তোকে দিয়ে কি হবে না।
তবে…মেয়েটির বাড়ি লস এঞ্জেলেসে, ওখানেই ফিরে যাবে সে। আর ফেরার অর্থ, ওকে স্যান গরগোনিয়ো গিরিপথ অতিক্রম করতে হবে। কাজেই এখন সে, ইগলেসিয়াস, যদি সিয়েনাগা সেকা ট্রেইল হয়ে বিগ মিডৌতে যায়, সহজেই সাউথ ফর্কের উজান হয়ে ফলস ক্রীক ট্রেইলে পৌঁছুতে পারবে। একবার সে করেছে এরকম, আরও কজনের সাথে, ব্ল্যাঞ্চারদের কবল থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে।
চেষ্টা করলে হয়তো সে গিরিপথে ঢুকে, কৌশলে প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারবে মেয়েটা চলে গেছে কি-না। কাজটা যে সহজ নয়, ওতা জানে, তবু লস এঞ্জেলেসেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ইগলেসিয়াস।
ঘোড়াকে ঘাস খাওয়ার সুযোগ দিয়ে, এ-ব্যাপারে আরও কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করল ও। সে-রাতে-সিয়েনাগা সেকায় ক্যাম্প করল দুবৃত্ত। পরদিন সকালে, বিগ মিডৌর উদ্দেশে যাওয়ার পথে মুহূর্তের জন্যে একবার পেছনে তাকিয়ে ওর মনে হলো, একটা কিছুর নড়াচড়া দেখতে পেয়েছে সে। বোধহয় হরিণ, ভাবল ইগলেসিয়াস। এদিকে অজস্র আছে ওই জানোয়ার। তবু সাউথ ফর্কের দিকে বাঁক নেয়ার আগমুহূর্তে আরেকবার পেছনে তাকাল ও।
কিচ্ছু নেই,
ক্যানিয়নের মাইলখানেক উজানে গিয়ে ক্যাম্প করল ইগলেসিয়াস। হিমেল হাওয়া নেমে আসছে চূড়া থেকে। কাজটা সম্ভবত বোকামিই হচ্ছে। একটা মেয়ে হাতছাড়া হলে কী এমন আসে যায়? কিন্তু তাই বলে অমন একটি মেয়ে!
গায়ে আলোয়ান জড়িয়ে নিয়ে, আগুনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ওই মেয়েটির কথাই আনমনে ভাবতে লাগল সে। কেউ-না-কেউ থাকবে ওর সঙ্গে। কোন পুরুষ, সন্দেহ নেই। সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে ও, তারপর লোকটার লাশ ফেলে দেবে।
পথে, ডলার লেক-এ পানি খেয়ে যখন আবার স্যাডলে উঠতে যাচ্ছিল সে, হঠাৎ মাথা উঁচু করে ওর ঘোড়া, কান দুটো খাড়া হয়ে যায়। পরের কয়েক মাইলে চকিত বার কয়েক নিজের ব্যাক ট্রেইল জরিপ করেছে ইগলেসিয়াস, কিন্তু কিছুই দেখতে পায়নি।
কাল সে গিরিপথে পৌঁছুবে। সুতরাং আজ রাতে পূর্ণ বিশ্রাম। নিজের রাইফেলখানা চেক করল ও। কার্ল, দুটো গুলি, পুরুষ আর তার ঘোড়ার জন্যে।
ঠিক, মেয়েটির সঙ্গে বেশি লোকও থাকতে পারে, এবং তাতে ঝামেলা বাড়বেই শুধু। তবু…এ-ধরনের কাজ ওর জীবনে আজ নতুন নয়।
.
চোখ খোলার আগেই লাকড়ি পোড়ার পটুপট্র আওয়াজ শুনতে পেল ইগলেসিয়াস, সতর্ক হয়ে গেল নিমেষে। আগুনটা তো এতক্ষণে মরে যাওয়ার কথা, আর তা ছাড়া তাজা জ্বালানি না পেলে কখনোই আগুন থেকে অমন শব্দ উঠবে না। চোখ মেলল ও।
এক লোক, গোড়ালির ওপর বসে মাংস ঝলসাচ্ছে আগুনে।
লোকটি তেমন লম্বা নয়, কিন্তু অসম্ভব চওড়া আর পুরু। ওর কাঁধ আর হাতের পেশীগুলো চোখে পড়ল ইগলেসিয়াসের, প্যান্টের সেলাই ছিড়ে উরুর মাংস বেরিয়ে পড়তে চাইছে।
ধীরে ধীরে, সাবধানে, উঠে বসল সে। লোকটা হাসল ওর দিকে তাকিয়ে। তোমার ঘুম খুব গাঢ়, বলল। উচ্চারণে আঞ্চলিক টান, তবে স্প্যানিশ বা জার্মান নয়..
তোমার পেশায় এত গাঢ় ঘুম ভাল না।
ইগলেসিয়াস সতর্ক, কিন্তু ওর পিস্তলটা রয়েছে একটু তফাতে, তার জ্যাকেটের নীচে। ছুরিখানাও সেখানে। তা আমার পেশাটা কী? জানতে চাইল দুবৃত্ত।
চুরি, জবাব দিল আগন্তুক। মাঝেসাঝে খুনও করে থাক, এবং সুযোগ পেলেই আক্রমণ কর মেয়েদের।
জান, একথার জন্যে আমি খুন করতে পারি তোমাকে, ফুঁসে উঠল ইগলেসিয়াস।
তারমানে আসলে তুমি বলতে চাই, আমাকে খুন করতে পারলে খুশি হতে। ইগলেসিয়াসের চোখে চোখ রাখল লোকটা, হাসল। কি তোমার কপাল মন্দ-আমাকে মারতে পারবে না।
ঝলসানো-মাংসের টুকরোটা হাতে নিল লোকটা, ইগলেসিয়াস জানে ওটা গরম, কিন্তু আগন্তুকের পলক পর্যন্ত পড়ল না। যদি হাত পুড়ে গিয়েও থাকে, যন্ত্রণার সামান্যতম আভাসও ফুটল না তার চেহারায়।
নিরীহ ভঙ্গিতে, আলগোছে ইগলেসিয়াস তার হাতখানা জ্যাকেটের ওপর রাখল। দাঁত দিয়ে ছোট্ট এক টুকরো মাংস ছিড়ে নিতে নিতে, আবার হাসল লোকটা। পিস্তলের খোঁজকরনা। ওটা নেই।
ছুরিটাও। তুমি যখন ঘুমোচ্ছিলে তখনই আমি সরিয়ে ফেলেছি। ফের ভাঁজ পড়ল আগন্তুকের গালে। আমার রাইফেল স্যাডল স্ক্যাবার্ডে, তবে ওটার প্রয়োজন আমার এমনিতেও পড়বে না।
কী বকছ এসব আবলতাবল? কে তুমি?
যেখান থেকে এসেছ সেখানে যদি ফিরে যেতে, হয়তো বাচতে তুমি, বলল আগন্তুক, কিন্তু তা না করে আবার সেই মহিলার পিছু নিলে। আর ঠিক তখনই আমি বুঝলাম, তোমাকে মরতে হবে।
এসব যা-তা কী বলছ তুমি? পাগল নাকি?
প্রথমবারে শিক্ষা হয়নি তোমাদের। মেয়েটা পালাল, আর তোমরা তাড়া করলে। তোমাদের এক বন্ধুকে ফেলে রেখে
আমার কোন বন্ধু নেই!
না থাকাই স্বাভাবিক। তোমাদের একজন সঙ্গী, তা হলে। ওর লাশ কবর না দিয়েই, মেয়েটাকে তাড়া করলে তোমরা। আরেকটু হলেই ধরে ফেলেছিলে, এই সময়
তোমার অপর সঙ্গী অক্কা পেল।
কে তুমি?
কে? নামে কিছু আসে যায় না, তবু বলছি, আমি ইয়াকুব খান। ওই মহিলা আর তার বাবার বন্ধু। এবং সম্ভবত, ড্যান ও’হারারও। আবার হাসল সে। কিন্তু তোমার বন্ধু নই।
ইগলেসিয়াস ভাবছে। দেখে মনে হয় না আগন্তুক সশস্ত্র, তবে নিঃসন্দেহে প্রচণ্ড শক্তিধর। ওর সাথে লড়াই করার চিন্তা বাতুলতা। তবু, একটা লাকড়ি কিংবা পাথর…আচ্ছা, সে যদি এখন ভালমানুষটির মত উঠে তার ঘোড়ার দিকে এগোয়, কী করবে লোকটা?
উঠে দাঁড়াল ইগলেসিয়াস, আর লোকটা খেতে লাগল আয়েস করে। ইগলেসিয়াস তাকাল ওর দিকে, দৃষ্টিতে সংশয়। তুমি বেশি কথা বল! বলল সে। আমি চললাম।
চারপাশটা দেখে নাও একবার। ভাল করে। আমি চাই তুমি দেখ এই জায়গাটা। সত্যি সত্যি দেখ। সুন্দর, তাই না? পানিতে রোদের ঝিলিমিলি? পাতায় কাঁপন-
অকস্মাৎ উবু হয়ে একটা গাছের ডাল কুড়িয়ে নিল ইগলেসিয়াস। লোকটা স্রেফ তাকাল ওর পানে, ধীরে-সুস্থে নিজের খাওয়া সেরে উঠে দাড়াল।
চারপাশ দেখে নাও, আবার বলল সে। সুন্দরের কদর সবাই বোঝে, তোমার মত একটা ইবলিসও। আমি চাই তুমি দেখ, কারণ এটাই হবে তোমার জীবনের শেষ দেখা।
তুমি বদ্ধ উন্মাদ। ইগলেসিয়াস তার ঘোড়ার দিকে পিছাতে শুরু করল।
দেখা নয়, নড়াচড়াটা অনুভব করল ও। ডালটা মাথার ওপর তুলেছে সে এমন সময় আগন্তুকের হাত চেপে ধরল ওর জামার বুক। ডালখানা সপাটে নামিয়ে আনল ইগলেসিয়াস, কিন্তু ওর হাত বেকায়দা অবস্থায় ছিল, ফলে তেমন জুতসই আঘাত হানতে পারল না। ইয়াকুব খান ওর গায়ের সাথে যেন সেঁটে গেছে! ওপর পানে উঠে গেল একটা ঘুসি, প্রচণ্ড ধাক্কা অনুভব করল ইগলেসিয়াস, টের পেল কী যেন ফেটে গেছে তার বুকের ভেতর।
ইয়াকুব খান আলগা করল না তার মুঠি, অপলকে চেয়ে রইল আতঙ্কগ্রস্ত দুই চোখের দিকে। তুমি যদি অন্য পথে যেতে, হয়তো পারতে বাঁচতে, বলে ইগলেনিয়াসকে ছেড়ে দিল সে।
দুর্বৃত্তের ঘোড়ার কাছে গেল ও, পিঠ থেকে জিন খসিয়ে নিয়ে নিতম্বে থাবড়া মেরে ভাগিয়ে দিল জানোয়ারটাকে। তারপর নিজের ঘোড়ার কাছে গিয়ে স্যাডলে চাপল।
পশ্চিমে উপত্যকা দেখা যাচ্ছে একটা, বেশ খোলামেলা; ঝরনাও আছে। ঘোড়া ঘুরিয়ে ওদিকে এগোল সে।
পেছনে, ঘাসের বুকে পড়ে থাকল ইগলেসিয়াস। দম ফেলার প্রয়াস পাচ্ছিল ও কিন্তু পারল না–রক্ত উঠে এল মুখ দিয়ে, ওর গাল আর ঘাড় গড়িয়ে পাইন পাতায় নেমে গেল।
.
২৪.
থমথম করছে বিশাল কামরাটা। ডন রোমেরো তার কাউহাইডের চেয়ারে বসে, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন বাইরের দিকে। সেলাই করছিলেন এলেন, চকিতে পলক তুলে তাকালেন ভাইয়ের পানে। এমনিতেও কথাবার্তা বিশেষ হত না ওদের, কিন্তু ইদানীং রোমেরা কারও সাথেই কথা বলেন না।
আমি স্পেনেই ফিরে যাব, অকস্মাৎ আনমনে বলে উঠলেন তিনি।
বেশ তো।
তুমি?
থাকব। এখানে আমার বন্ধুবান্ধব আছে। ওদের সঙ্গ আমার ভাল লাগে।
এক মহিলা এসে দাঁড়াল দোরগোড়ায়, অপেক্ষা করতে লাগল নীরবে। ওর দিকে তাকালেন এলেনা। বল?
খবর আছে। সিমোরিটা লরেল সিনর ও’হারার সাথে রয়েছেন। বাড়ি ফিরে আসছেন তারা।
খুব ভাল খবর। এলেনা জিজ্ঞেস করলেন না কীভাবে জানল ওরা, কারণ এসব জিনিস চাপা থাকে না কখনও, মানুষের মুখে মুখে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে।
মেয়েটি তবু দাড়িয়ে আছে লক্ষ করে, এলেনা এবার প্রশ্ন করলেন, আর কিছু?
সি, সিনোরা। বিশালদেহী মারা গেছে।
দোরগোড়া থেকে অদৃশ্য হলো মেয়েটি, এবং ঘরে অখণ্ড নিস্তব্ধতা নেমে এল। শেষমেশ ডন রোমেরোই ভাঙলেন নীরবতা। ও কি আলফ্রেডোর কথা বলল তখন?
হ্যাঁ।
আশ্চর্য, ওরা জানল কীভাবে? জানতে পায় কেমন করে? আমি ভেবেছিলাম…বিশ্বাস করেছিলাম অনেকদিন আগেই মারা গেছে ও।
সেই মেয়েটি ভালবাসত ওকে। তারপর ডনের উদ্দেশে ফিরে এলেনা যোগ করলেন, ওরা সব জানে, রোমেরো। সবসময়ই জেনে যায়। বড় বড় বাড়ির কোন খবরই গোপন থাকে না। আমরা উলটোটি বিশ্বাস করে আসলে নিজেদেরই ঠকাই।
বোবা দৃষ্টিতে উঠনের দিকে তাকালেন রোমেরো। এত আয়োজন, সব অর্থহীন! চরম মূর্খতার পরিচয় দিয়েছি আমি। মরুভূমিতে, ছেলেটা যখন অকুতোভয়ে বলেছিল, বিদায় দাদু! আমার উচিত ছিল ওকে বুকে করে বাড়ি নিয়ে আসা। ঝাপসা হয়ে গেল চিন্তাটা, চেয়ারের পিঠে মাথা রেখে চোখ বুজলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর উঠলেন এলেনা, এগিয়ে এসে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেন তার শরীর।
এক্ষুণি একটা খবর পাঠাতে হয় মিস ডায়ানাকে, নইলে মহিলা দুশ্চিন্তায় থাকবেন।
.
জাহাজে করে সদ্যাগত বইয়ের বাক্সগুলো একবার দেখলেন মিস ডায়ানা। মোট তিনখানা বা, দুটো এসেছে নিউ ইয়র্ক থেকে, অপরটা লন্ডন। এসময়ে ড্যানকে তাঁর প্রয়োজন ছিল। ছেলেটি বরাবরই বাক্স খুলে শেলফে বই সাজিয়ে রাখতে ভালবাসে।
কত কিছুই না ঘটছে। বব উইলসন এবং আরও কয়েকজন শহরে গ্যাসবাতির ব্যবস্থা করতে পাওয়ার প্লান্ট বসাচ্ছেন। এর অফিস, তার বিশ্বাস, পিকো হাউস-এর উল্টো দিকে খোলা হবে। নতুন নতুন রাস্তাঘাট হচ্ছে, এবং ইতিমধ্যেই সংস্কার করা হয়েছে শহরমুখী কিছু রাস্তার। সামনে যে-রকম ব্যস্ত জীবন আসছে, এগুলোর প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে।
রিডিং রুমের দরজা খোলার আওয়াজে পলক তুললেন ডায়ানা। দোরগোড়ার ভেতরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছে অ্যালেক্সিস ফুলটন। লোকটা, আনমনে ভাবলেন তিনি, নিঃসন্দেহে সুদর্শন।
আসতে পারি? দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলল ফুলটন।
ঢুকেই তো পড়েছেন। তা আমি কী করতে পারি আপনার জন্যে?
না, ভাবলাম কথাটা আপনাকে বোধহয় আমার জানানো উচিত। আপনার কথামত আমি এ-দেশে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মানে, ক্যালিফোনিয়ায়।
ডায়ানা তাঁর কলমখানা নামিয়ে রাখলেন টেবিলের ওপর। কাজ-কর্ম করবেল ভেবেছেন কিছু?
একটা সওদাগরি অফিসের ম্যানেজারি।
আমার বিশ্বাস আপনি ভালই করবেন এতে। রুশ ভাষা জানেন, সম্ভবত ফ্রেঞ্চও। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তো বটেই, বিদেশি জাহাজিদের সঙ্গেও লেনদেন করতে হবে আপনাকে! স্প্যানিশ জানেন?
অল্পস্বল্প।
ওটা হবে আপনার বাড়তি মূলধন। এখানে মোটামুটি স্প্যানিশেরই চল। কলমটা আবার তুলে নিলেন ডায়ানা। যাই হোক, আপনাকে অভিনন্দন। এরকম চমৎকার একটা সিদ্ধান্ত নেয়ায়।
মিস ডায়ানা? আমি ভাবছিলাম মাঝে মাঝে আপনার কাছে আসব কিনা?
ডায়ানার চোখ শান্ত এবং তীক্ষ্ণ। আসবেন। নিশ্চয়ই আসবেন।
আর একমুহূর্ত দোনোমনো করল ফুলটন, তারপর ঘুরে পেছনে দরজা টেনে দিয়ে বিদায় নিল।
ভ্রূকুটি করে দরজার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ডায়ানা, তারপর আবার শুরু করলেন কাজ। কিন্তু মন বসল না, খানিক বাদে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি, পেছনের একটা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
তোমার এখন নতুন পোশাক দরকার, নিজেকে চোখ রাঙালেন ডায়ানা। বহুদিন হলো তুমি কেনাকাটা কর না। কথাটা মনে হতেই মুহূর্তের জন্যে থমকে গেলেন তিনি। কেনাকাটার সময়ে এলেনাকে সাথে নিতে হবে। খুশি হবেন মহিলা। বাইরে এলেনার একরকম বেরোনোই হয় না।
তবে এ-মুহূর্তে শুধু অ্যালেক্সিস ফুলটনের কথাই ভাবছিলেন না ডায়ানা, যদিও সে-ই, কথাটা অদ্ভুত হলেও সত্যি, তার চিন্তাভাবনাকে এখাতে প্রবাহিত করার মূল কারণ! আরও অনেকে রয়েছেন, তাদের একজন অচিরেই ফিরছেন সাগর থেকে। তা ছাড়া ড্যানের সঙ্গে অ্যানাবেলের বিয়ে আছে। ওরা কী ভাবছে জানেন না ডায়ানা, কিন্তু তিনি এ-ব্যাপারে পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।
.
স্প্যানিশ টাউনের কাছাকাছি, স্যান বার্নারডিনো ট্রেইলের ধারে অবস্থিত ফ্লোরেস ক্যান্টিনায় খদ্দের সমাগম সর্বদা লেগেই থাকে।
এই জায়গাটা বেশ ছায়াচ্ছন্ন, গাছপালায়-ঘেরা, বাইরে একটা হিচিং রেইলও আছে। ভেতরের কামরায় পানীয় পরিবেশন করা হয়, এবং, বাবুর্চি খোশমেজাজে থাকলে, খাবার। বাইরে ছোট্ট উঠন, সেখানে রয়েছে গুটিকতক টেবিল।
সূর্যের অত্যাচার থেকে বাঁচতে, এগুলোরই একটায় এসে বসলেন ডন ফেডেরিকো। এ-মুহূর্তে ডন রোমেরোর একটা চিঠি রয়েছে, তার পকেটে। রোমেরো অবিলম্বে তলব করেছেন তাঁকে, স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর সম্পত্তির এক কানাকড়িও ফেডেরিকো পাবেন না।
চিঠিটা রয়েছে ফেডেরিকোর পকেটে; আর তাঁর মাথায় সীমাহীন ক্রোধ।
ছায়ায় বসে, এক বোতল টেকুইলার ফরমাস দিলেন তিনি। এখানে তার সঙ্গে যোগ দিল চ্যাতো, ঘণ্টাখানেক আগেও যার সাথে একটেবিলে বসার কথা ভাবতে পারতেন না ফেডেরিকো, কিন্তু এখন তার ক্রোধ তাকে সাধারণের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। এবং তারা উভয়েই একই বিদ্বেষের আগুনে জ্বলছেন।
অনতিদূরের আরেকটা টেবিলে, দুজন অ্যাংলো বসেছে। উভয়ের চেহারাই মোটামুটি পরিচিত। ভ্যালেটা বুড়িয়ে গেছে আরেকটু, গায়ে খানিকটা চবিও জমেছে। জুয়াড়ি ব্যবসায়ী হিসেবেই সবাই চেনে তাকে।
পালা করে নবাগত দুজনকে দেখে নিয়ে, সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করল সে, ওদের চেন?
হ্যাঁ। ভোতা-নাকের নাম চ্যাতো। চোর, খুনী। টাকার জন্যে করতে পারে না হেন কাজ নেই।
আর অপরজন?
ডন ফেডেরিকো। ওঁকে তো তোমার চেনা উচিত।
চিনি, তবে অনেককাল পর দেখেছি কিনা, তাই নিশ্চিত হতে চাইছিলাম। কিছু বুঝতে পারছ, ওদের দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে, ওদের হিসেবে বিরাট গোলমাল হয়ে গেছে।
নিজের গ্লাস আবার ভরে নিল ভ্যালেটা। ডন ফেডেরিকো ধনী লোক শুনেই তাঁর সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছিল সে, যাতে সময়ে ওই ধরনের খানিকটা অন্তত হাতিয়ে নিতে পারে। এবং সম্ভব হলে, পুরোটাই।
শেষ খবর শুনেছিলাম, মন্তব্য করল জুয়াড়ি, লোক ভাড়া করছেন উনি, ড্যান ও’হারাকে খুন করার জন্যে। যে সকল হবে সে মোটা বখশিস পাবে।
কথাটা আগে জানলে, আমি নিজেই খুন করতাম হারামিটাকে, সরোষে আফসোস করল র্যাড হুবার।
ওদের টেবিলে খাবার দিয়ে গেল এক মেক্সিক্যান ওয়েট্রেস। মেয়েটি বিদায় নেয়ার পর আড়চোখে পাশের টেবিলের দিকে তাকাল ভ্যালেটা, শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ড্যান ফাঁকি দিয়েছে বুঝি আপনাকে?
চকিতে ঘাড় ফেরালেন ডন ফেডেরিকো, চোখে ক্রোধ। তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না, বললেন তিনি। আমি চিনি না তোমাকে, চেনার ইচ্ছেও নেই।
কৌতুক বোধ করল ভ্যালেটা। আগে না চেনাই ছিল স্বাভাবিক, বলল সে, কিন্তু এখন চেনা উচিত। আমারও চাহিদা ড্যানের মৃত্যু।
কথাটা কিন্তু আদৌ সত্যি নয়। ড্যান বা তার বাবাকে কখনোই সুনজরে দেখেনি ভ্যালেটা; আবার ওদের মধ্যে চরম শত্রুতাও ছিল না কোনকালে। কিন্তু ভ্যালেটা হিসেবি মানুষ, টাকার গন্ধ পায়, যেমন এখন পাচ্ছিল।
এই টেবিলে চলে আসুন, আমন্ত্রণ জানাল সে। আমাদের মধ্যে বোধহয় একটা আলোচনা হওয়া দরকার; যাতে দুপক্ষেরই লাভ হয়…এমন একটা কিছু…আশা করি আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমার কথা।
একটু ইতস্তত করলেন ডন ফেডেরিকো, তারপর তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে উঠে গেলেন অপর টেবিলে। চ্যাতো অনুগামী হলো।
আমি শুনেছি আপনি রোমেরোর উত্তরাধিকারী, ভ্যালেটা বলল।
ছিলাম। কিন্তু এখন আর নই। ডন রোমেরোর চিঠিখানা বের করে ভ্যালেটাকে দিলেন ফেডেরিকো।
চিঠিটা পড়ল ভ্যালেটা, তারপর ঘাড় ফেরাল দ্বারের উদ্দেশে। র্যাড, দেখ তো এখানে একটা কাগজ আর কলম পাওয়া যায় কিনা। আমি এই ভদ্রলোকদের একটু ভেলকি দেখাতে চাই।
যখন কাগজ আর কলম পেল, ডন রোমেরোর চিঠিখানা আরেক নজর জরিপ করল সে, তারপর দ্রুত অথঢ় সাবলীল গতিতে রোমেরোর হাতের লেখা নকল করে আরেকটা চিঠি লিখে ফেলল।
এতদ্বারা আমি, ডন রোমেরো, স্বেচ্ছায় ও সুস্থ মস্তিষ্কে, আমার সমুদয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এবং নগদ টাকাকড়ি আমার প্রিয় উত্তরাধিকারী, ডন ফেডেরিকোকে দান করিলাম।
তারপর উন রোমেরোর স্বাক্ষরটি হুবহু জাল করল ভ্যালেটা।
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন ফেডেরিকো, চোখ তুলে একবার দেখলেন ভ্যালেটাকে, তারপর আবার নজর ফেরালেন। চিঠি আর সই, দুটোই নিখুঁত। এমনকী তার কাছেও, ড রোমেরোর হাতের লেখা যিনি বহুবার দেখেছেন, কোন পার্থক্য ধরা পড়ল না।
এ-জন্যে কী চাও তুমি? জানতে চাইলেন ফেডেরিকো।
অর্ধেক, ভ্যালেটার জবাব।
অর্ধেক! উন্মাদ নাকি!
কিছুই না পাওয়ার চেয়ে অর্ধেক ঢের ভাল। আপনি অর্ধেক, আর্মি অর্ধেক। আমরা দুজনেই ধনী হয়ে যাব। আর নয়তো, আপনি কিছু পাবেন না।
আমার চেয়েও জোরাল দাবি আছে আরও দুজনের।
ক্ষতি নেই, আপনার এই উইলের সামনে কারও দাবি ধোপে টিকবে না। আর তা ছাড়া, ওদেরকে তো আমরা সরিয়েই দিচ্ছি দুনিয়া থেকে।
হাতের কাগজটার দিকে একটুক্ষণ চেয়ে রইলেন ডন ফেডেরিকো। সব এখন তার মুঠোয় এসে গেছে। অথচ তিনি ভেবেছিলেন আর কোন আশা নেই। চকিতে একবার ভাবলেন তিনি। কজন চেনে ভন রোমেরোর সই? তিন-চারের বেশি হবে না। এলেনা অবশ্যই তাদের একজন, তবে তাকেও খতম করা হবে।
শুনুন, শান্ত কণ্ঠে বলল ভ্যালেটা, সবাই জানে ডন রোমেরো তাঁর নাতিকে মেরে ফেলতে চান। তা হলে নাতিই-বা চাইবে না কেন দাদুকে খুন করতে?
গোলাগুলি হবে কিছু, তারপর মানুষজন যখন তদন্ত করতে আসবে তখন দেখবে বুড়ো আর তার বোন অক্কা পেয়েছে, আর ড্যান ও’হারার হাতে পিস্তুল।
ডন ফেডেরিকো আরেকবার পরীক্ষা করলেন জাল উইলখানা, কিন্তু তিনি তখন মাদ্রিদ, প্যারিস, রোম আর লন্ডনের খোয়াব দেখছেন। ঠিক, শূন্যের চেয়ে অর্ধেক ভাল, কিন্তু যদি এমন হয়, উইল লেখার পর..
শত হলেও, ড্যান একসময় র্যাড হুবারের সহপাঠী ছিল, আর ভ্যালেটা ওর সাথেই এসেছে লস এঞ্জেলেসে, তা হলে উন রোমেরোকে আক্রমণের সময় ওরাই-বা কেম,তার সঙ্গে থাকবে না?
.
২৫.
উষ্ণ বিকেল। আর কিছুদূর গেলেই আমাদের রাতের আশ্রয়। আমরা উভয়েই এখন ক্লান্ত।
স্যাডলের ওপর ঘুরে পেছনে তাকালাম আমি…কেউ নেই। তবু, দূর-পেছনে, মনে হলো ধুলোর রেখা ঝুলছে একটা। হোলস্টারের ফিতে আলগা করে দিলাম।
সামনের ওই ক্যান্টিনাটা এক অ্যাংলোর, বললাম অ্যানাবেলকে। ভদ্রমহিলার নাম মিসেস ওয়েবার, আমাদের সঙ্গেই এসেছিলেন পশ্চিমে।
আমি, বাপু, একটু বিশ্রাম আর চারটে খেতে পেলেই খুশি, বলল অ্যানাবেল। বাবা ফেরার আগেই বাড়ি পৌঁছুতে হবে আমাকে। উনি যদি ফিরে দেখেন আমি নেই, ভীষণ চিন্তায় পড়ে যাবেন।
মিসেস ওয়েবারের কাছে তাজা ঘোড়া মিলবে, তখন আরও দ্রুত এগোতে পারব আমরা! আবার পেছনে তাকালাম আমি। হ্যাঁ, ধুলোই, এখন কাছাকাছি হয়েছে আরও। কমপক্ষে জনাচারেক ঘোড়াসওয়ার।
পথ দেখিয়ে নিয়ে, ক্ষুদ্র একটা ঝরনার পাড়ে এলাম আমি, ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়ার সুযোগ দিতে রাশ টানলাম। খাক একটু, বললাম, এটা ওদের পাওনা হয়েছে।
আমাদের সামনেও ধুলো উড়ছিল। অ্যানাবেল, নিমেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, ট্রেইল থেকে সরে যাও। কারা যেন,আসছে!
কিন্তু প্রতিবাদ করল ও।
ওই যে, ওখানে! একটা সরু বাইপাস ট্রেইল চলে গেছে বনের ভেতর। ওই পথে! জলদি!
স্পার দাবিয়ে ঘোড়া ছোটাল অ্যানাবেল, একটা ঝোপের আড়ালে গিয়ে থামল। বাইপাস ট্রেইলটা বনের মাঝ দিয়ে শ-খানেক গজ যাওয়ার পর আবার মূল ট্রেইলে গিয়ে পড়েছে।
এখানে যদি কোন গোলমাল দেখ, ওই ট্রেইল ধরে সোজা ক্যান্টিনায় চলে যেয়ো। মাইল দুয়েকের বেশি হবে না ওটা। আমার জন্যে চিন্তা কর না।
আমার কাছে এখন রাইফেল, আছে।
অ্যানাবেল…প্লিজ! শুধু শুধু তর্ক কর না তো। যদি গোলমাল দেখ, প্রথমে কিছুদূর ঘোড়া হাঁটিয়ে নেবে যাতে ওরা টের না পায় তুমিও আছ। তারপর ছুট লাগাবে!
আই লাভ য়ু, ড্যান!
আমিও তোমাকে ভালবাসি। কিন্তু সেটা উপভোগ করার জন্যে বেঁচে থাকতে হবে আমাদের।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও, বাইপাস ধরে সামনে এগোল ও, আর আমি আবার ফিরে গেলাম ঝরনায়। অ্যানাবেল যদি ক্যান্টিনায় পৌঁছুতে পারে….
এখন আর পঞ্চাশ গজ দূরেও নেই ঘোড়াসওয়াররা। গাছপালার আড়ালে আছি বলে আমাকে ওরা দেখতে পাচ্ছে না এখনও, কিন্তু আমি সবাইকেই চিনতে পারলাম
ডন ফেডেরিকো, চ্যাতো, র্যাড হুবার, আর ভ্যালেন্টা।
চমৎকার! মনে মনে বললাম আমি।
এখন ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলেই ফাঁস হয়ে যাবে আমার উপস্থিতি। তারচেয়ে বরং যথাসম্ভব আত্মগোপন করে থাকাই ভাল। সাবধানে রাইফেল বের করলাম স্ক্যাবার্ড থেকে। আমার বাঁ-পাশ ওদের দিকে ফিরিয়ে, রাইফেলটা আড়াআড়িভাবে স্যাডলের ওপর রাখলাম।
ব্ল্যাক স্ট্যালিয়ন নিশ্চল দাঁড়িয়ে, কান খাড়া, বুনো ঘোড়ার যা হয়, বিপদের গন্ধ পাছে ও।
ভ্যালেটা থামল রাশ টেনে। এখানেই অপেক্ষা করি না কেন? এ-পথেই আসতে হবে বাছাধনদের, একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে না পড়া অবধি আমাদের দেখতে পাবে না।
চ্যাতোই আমাকে দেখতে পেল আগে। চারপাশে তাকাচ্ছিল ও, পরস্পর মিলিত হলো আমাদের চোখ। আমরা দুজনেই উপলব্ধি করলাম চূড়ান্ত মোকাবেলার সময় উপস্থিত। আমি আর এখন ছেলেমানুষ নই, চ্যাতো, বলেই গুলি করলাম আমি।
মাত্র বিশ গজ দূর থেকে পয়েন্ট, ব্ল্যাংক রেঞ্জের গুলি, তবু মিস্ করলাম।
ওই দলে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা চ্যাতোরই ছিল সবচেয়ে বেশি। আমি মুখ খুলতেই, ঘোড়া নিয়ে লাফিয়ে সরে গেল সে, আর ওর জন্যে নির্দিষ্ট বুলেটটা র্যাড হুবারকে আঘাত করল, স্যাভলের ওপর কাত হয়ে পড়ল সে। ভয়ার্ত চিৎকার করে লাফ-ঝাঁপ শুরু করল ওর ঘোড়া, আহত হুবার প্রাণপণ প্রয়াস পেল টাল সামলাবার।
গুলি করল চ্যাতো, প্রায় একই সময়ে মাইক ভ্যালেটা আর ডন ফেডেরিকোও। তপ্ত সীসার ছ্যাঁকা লাগল আমার হাতে, রাইফেলটা ছেড়ে দিলাম আমি।
একঝটকায় বের করলাম আমার সিক্স-শুটারখানা, পরপর দুটো গুলি ঢুকিয়ে দিলাম ফেডেরিকোর বুকে।
তারপর অকস্মাৎ যেন এক ভেঙে পড়ল ওখানে, চারদিক মুখরিত হয়ে উঠল গোলাগুলির কর্কশ আওয়াজ আর ঘোড়ার তীক্ষ্ণ চিৎকারে। আগুনের ফুলঝুরি ছুটল বাতাসে, বারুদের গন্ধে পরিবেশ হলো ভারি। বাউলি কেটে একপাশে সরে গেল স্ট্যালিয়ন, হুবারকে আরেকবার গুলি করলাম আমি।
ভ্যালেটা ধরাশায়ী হয়েছে, কিন্তু আরও অনেক ঘোড়ার পিঠে চরে আসলো গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে। চোখের কোণে মন্টে ম্যাক-কায়াকে দেখতে পাচ্ছিল ভ্যালেন্টা, ওকে খতম করল সে। এবং যেভাবে শুরু হয়েছিল, সেভাবেই আচমকা শেষ হয়ে গেল সবকিছু।
ম্যাক-কায়াকে ছাড়াও জর্জ বুশ, ওয়েন হার্ডিন আর ইয়াকুব খানকে আমি চিনতে পারলাম। অপর দুজন অচেনা; তবে ভাবভঙ্গি থেকে আঁচ করলাম ওরা এল মন্টে র্যাঞ্চের লোক।
পিস্তলটা রিলোড করলাম আমি, রেখে দিলাম হোলস্টারে।
তোমরা কোত্থেকে? শুধোলাম ওদের।
মিস লরেলকে উদ্ধার করার জন্যে, মিস ডায়ানা পাঠিয়েছিলেন আমাদের, জবাব দিল হার্ডিন। পথে, সিল্ক স্প্রিংয়ে ইয়াকুব খানের সাথে দেখা। ওর কাছেই সব জেনেছি।
শহরে ফিরে যাচ্ছিলাম এখন, হঠাৎ দূরে দেখতে পেলাম তোমার ধুলো। তারপর তুমি যখন একটা চড়াইয়ের মাথায় উঠলে, আমরা তোমাকে চিনতে পারলাম। আর ঠিক তখনই চোখে পড়ল আরও চারজন ঘোড়াসওয়ারকে। কাজেই আমরা আর দেরি করিনি।
অ্যানাবেল কোথায়? চারপাশে নজর বোলাল জর্জ।
ক্যান্টিনায় পাঠিয়ে দিয়েছি, বলে, এই প্রথম লাশগুলোর দিকে তাকালাম আমি।
তিনটে রয়েছে: র্যাড হুবার, ভ্যালেটা, আর ডন।
চ্যাতো? পালিয়েছে চ্যাতো!
অ্যানাবেল! চিৎকার করে উঠলাম আমি, স্পার দাবিয়ে ঘোড়া ছোটালাম ক্যান্টিনার উদ্দেশে।
দূর থেকেই দেখতে পেলাম চ্যাতোকে। ক্যান্টিনার সামনে বিরাট এক ওকের ছায়ায় দাঁড়িয়ে, হাতে পিস্তল। ব্ল্যাক স্ট্যালিয়ন পুরোপুরি থামার আগেই লাফিয়ে মাটিতে নেমে পড়লাম আমি, চেঁচিয়ে ডাকরলাম, অ্যানাবেল?
মেয়েদের সাথে আমি লড়ি না, বলল চ্যাতো। আমি লড়াই করি শুধু মরদদের সঙ্গে।
আমি মরদ, বললাম। ইতিমধ্যে আমি বুঝে ফেলেছি অ্যানাবেলের কোন ক্ষতি করেনি ও, তাই এবার পূর্ণ মনোযোগ দিলাম কাটা-নাকের দিকে।
ছায়া পড়েছে চ্যাতোর ক্রূর মুখাবয়বে, ওর ভোঁতা নাক আর সেই পুরনো ক্ষতচিহ্নের ওপর। সেদিনই তোকে আমার খতম করা উচিত ছিল, বুড়ার নিষেধ সত্ত্বেও। তখন তুই ছোট ছিলি, কিন্তু আমি ঠিকই তোর চোখে বিপদ দেখেছিলাম।
এখন আমি বড় হয়েছি, বলেই ওর আগুন-ঝরানো গান মাজলের ওপর দিয়ে গুলি করলাম আমি।
ধীরে এক কদম পিছু হটল চ্যাতো, আবার গুলি করলাম আমি। পিস্তলটা খসে পড়ল ওর হাত থেকে, কুড়িয়ে নেয়ার লক্ষ্যে উবু হলো ও, হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল মাটিতে। ওঠার প্রয়াস পেল না চ্যাতো, মুখ থুবড়ে লুটিয়ে পড়ল।
ছোটবেলায় ভয় পেয়েই মরা উচিত ছিল তোর, বলল সে।
আরেকবার গুলি করে বললাম, আমি কখনও ভয় পাই না।
Leave a Reply