বিধাতা – ১ – ওয়েস্টার্ন সিরিজ – রওশন জামিল – সেবা প্রকাশনী / প্রথম প্রকাশ ১৯৮৯
১.১ ড্যানিয়েল ওহারা
আমি ড্যানিয়েল ও’হারা, সংক্ষেপে ড্যান। এই কাহিনির শুরু আমার বয়েস যখন ছ’বছর। ওই বয়েসেই মাকে হারিয়েছিলাম, হারাতে চলেছিলাম বাবাকে।
আমার মায়ের জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ায়। আমৃত্যু সাগরপাড়ের সুন্দর ওই দেশটির প্রশংসায় তিনি ছিলেন পঞ্চমুখ। এ-ব্যাপারে তাঁর উৎসাহে কখনও ভাটা পড়তে দেখিনি আমি। তাঁর জন্মস্থান তাঁকে হাতছানি দিত সবসময়।
ক্যালিফোর্নিয়ার কথা উঠলে সবাই বলে, জায়গাটা নাকি উষ্ণ আর রোদেলা। কিন্তু আমার জানায়, ওটি ছিল ভয়ের দেশ। আমরা তখন সেখানেই যাচ্ছিলাম। মরুভূমি পেরিয়ে সেই ভয়ের মুখোমুখি হতে। বলতে লজ্জা নেই, আমার বুক কাঁপছিল শঙ্কায়।
রাতের কালো বুক চিরে, ঘর্ঘর শব্দে, এগিয়ে চলেছে আমাদের ছয় ঘোড়ার ওয়াগন। দুঃসাহসিক এক অভিযানে বেরিয়েছি আমরা। একটামাত্র ওয়াগন নিয়ে সান্তা ফে থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছি, মোটে দুজন ঘোড়াসওয়ারের পাহারায়।
আমার চারপাশে আঁধার আর অচেনা মানুষ। যা কিছু আলো তা ওয়াগনের ফাঁক ফোকর দিয়ে চুঁইয়ে-আসা চাঁদের। আমি অনড় বসে, অজানা পৃথিবীর পানে চেয়ে আছি বিস্ফারিত চোখে।
বাবা শুয়ে আমার পাশে। একসময় তাগড়া জোয়ান ছিলেন মানুষটি কিন্তু এখন অসুস্থ। ফুসফুসের অসুখে ফ্যাকাসে আর ক্লান্ত। স্ত্রীর মৃত্যুশোক ভুলতে পারেননি আজও। একমাত্র ছেলের ভালমন্দের চিন্তায় তিনি উদ্বিগ্ন।
ঘুমোতে চেষ্টা করছেন বাবা, কিন্তু থেকে থেকে প্রচণ্ড কাশির দমকে জেগে উঠছেন। আমাদের সহযাত্রীরা এসময়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখছিল তাঁকে। কেউ করুণার দৃষ্টিতে। কেউ-বা বিরক্তির।
আমার মনে পড়ছে, আমরা রওনা হওয়ার আগে স্যান্তা ফে-র লোকজন কী বলেছিল আমাদের এই অভিযান সম্পর্কে। নিছক পাগলামি। অ্যাপাচিদের ফাঁকি যদি বা দিতে পারি, কলোর্যাডো ক্রসিংয়ে আমরা নির্ঘাত ইউমাদের খপ্পরে গিয়ে পড়ব।
বাবাকে এসব কথা জানিয়েছি আমি। নীরবে মাথা ঝাঁকিয়েছেন তিনি। তারপর বিষণ্ণ সুরে বলেছেন, তবু যেতে হবে আমাদের। ডাক্তার পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, তার সময় শেষ হয়ে আসছে। ব্যথিত সুরে বাবা বলেছেন, কথাটা আমাকে বলতে কষ্ট হচ্ছে তার, কিন্তু তিনি নিরুপায়। তাঁর সাহায্য ছাড়াই বড় হতে হবে আমাকে। প্রতিকূল পৃথিবীর সঙ্গে সংগ্রাম করে।
এরপর, এই ওয়াগনটা আমরা দেখতে গিয়েছিলাম একসঙ্গে। পথের কথা ভেবেই এটা বানিয়েছে কিম হিউজ, মানে আমাদের স্কিপার। তক্তাগুলোকে কেবল পরস্পর জুড়ে দিয়ে, ক্ষান্ত হয়নি সে, প্রয়োজনের সময় যেন পানিতে ভেসে থাকতে পারে সেজন্যে মাঝখানের সমস্ত ফাঁক দড়ি আর পুটিং মেরে বুজিয়ে দিয়েছে। বুলেটের আক্রমণ ঠেকাতে দুপাশের দেয়ালে রয়েছে পুরু মোষের চামড়ার দুপ্রস্থ আচ্ছাদন।
অনায়াসে আটজন মানুষ ধরবে এতে। তবে এই অভিযানে রয়েছে ছজন, আমাকে ধরে। নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই রাইফেল নিয়েছে সঙ্গে, আর কমপক্ষে দুশো রাউন্ড করে অ্যামুনিশন। এবং এগুলোর ব্যবহার যে তারা জানে এরও প্রমাণ দিতে হয়েছে সবাইকে।
হিউজ সাফ জানিয়ে দিয়েছে অধিকাংশ সময় আমরা রাতে পথ চলব। হট্টগোল, গোলাগুলি সব বারণ। নইলে অহেতুক ইন্ডিয়ানদের নজরে পড়ে যাব আমরা।
কালো সুট-পরা বলিষ্ঠ গড়নের এক লোক রয়েছে আমাদের মাঝে। নাম ভ্যালেটা। ক্রূর চেহারা, চৌকো চোয়াল, দুপাশের হনু ঠেলে বেরিয়ে এসেছে সামনের দিকে। চোখজোড়া কুঁতকুঁতে। কেন-যেন লোকটাকে পছন্দ হয়নি আমার।
তা হলে শিকার করব কীভাবে? গোলাগুলি নিষেধ শুনে ব্যাজার মুখে প্রশ্ন করেছিল ভ্যালেটা।
করবে না, চাঁছাছোলা জবাব দিয়েছে হিউজ। খাবারদাবারের অভাব নেই আমাদের।
অ। তা ভাড়া কত পড়বে?
জনপ্রতি তিনশো ডলার। ক্যাশ।
বেশি হাঁকছ।
তোমার না পোষালে যেয়ো না। বসন্তকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলে হয়তো এর অর্ধেকেই যেতে পারবে। কিন্তু আমি তাদেরকেই নেব যারা এখন যেতে চায়। দম নিতে থামল স্কিপার। আমরা-কাক-ভোরে রওনা হচ্ছি।
আমার ছেলের জন্যে কত দিতে হবে? বারা জানতে চেয়েছিলেন।
হিউজ একনজর তাকাল আমার দিকে। একটুক্ষণ স্থির হয়ে রইল ওর চোখ। বাচ্চা তো, একশোই দিয়ো।
এটা কিন্তু অন্যায়! বিরক্তি প্রকাশ করে ভ্যালেটা। তুমি বলেছিলে যারা বন্দুক ধরতে জানে, কেবলমাত্র তারাই যেতে পারবে। আমি নিশ্চিত, ওই ছোকরা তা পারে না।
এ কথায় লোকটার দিকে ঠাণ্ডা চাহনি ছুড়ে দিলেন বাবা। সময় হলে তার প্রমাণ পাবে, বন্ধু। আপাতত, আমার বিশ্বাস, আমাদের দুজনের জন্যে আমি একাই যথেষ্ট।
তার মানে?
হিউজের উদ্দেশে নজর ফেরালেন বাবা। মিস্টার হিউজ? আমি ডগলাস ও’হারা।
সিগার ধরাল কিম হিউজ, জ্বলন্ত কাঠিখানা নিক্ষেপ করল আগুনে। আমি সন্তুষ্ট।
কিন্তু–
ভ্যালেটাকে উপেক্ষা করল স্কিপার, ছেলেটা যাচ্ছে, বলে অন্যদিকে চলে গেল সে।
আমার কাঁধে হাত রাখলেন বাবা। চল, বাছা, আমরা এইবেলা আমাদের মালপত্র নিয়ে আসি গিয়ে।
চলে আসার সময়ে আমি শুনতে পেয়েছিলাম, পেছনে গজগজ করছে ভ্যালেটা। বলি, এর মানেটা কী? লোকটা নিজের নাম বলল আর অমনি ওকে নিতে রাজি হয়ে গেল হিউজ! যেভাবে কাশছে, ব্যাটা পথেই টেঁসে যাবে।
বাসার সামনে আমাকে রেখে বাবা ভেতরে গিয়েছিলেন আমাদের মালপত্রগুলো নিয়ে আসতে। বাইরের বেঞ্চিতে বসে তখন কাঁপছিলাম আমি, লস এঞ্জেলসে যার কাছে যাচ্ছি সেই ভয়ঙ্কর বুড়োর কথা ভাবছিলাম। ভয় হচ্ছে আমার, অথচ বাবাকে সেটা বলতে লজ্জা পাচ্ছি।
ওই বুড়ো আমার দাদু হন। বাবাকে উনি ঘৃণা করেন। বহু রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে, এ-ব্যাপারে বাবা আর মায়ের আলাপ শুনে ফেলেছি আমি। আমার বাবা-মায়ের বিয়েতে তার মত ছিল না। এমনকী চেষ্টা করেছিলেন লোক লাগিয়ে দুজনকেই গুম করে দিতে। আমার মা ছিলেন সম্ভ্রান্ত স্প্যানিশ পরিবারের মেয়ে। তাদের সমাজে খ্যাতি আর বংশগৌরবটাই আসল, ভদ্রলোক মাত্রেই সেখানে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকে, চাবুকহাতে।
আর বাবা ছিলেন সামান্য একজন নাবিক, খেটে-খাওয়া মানুষ। সুতরাং, দাদু এ বিয়েতে অমত করবেন এতে আর আশ্চর্য কী!
তবে অন্য আরেকটা ব্যাপারে আমার খটকা লেগেছে। মা-বাবার কথাবার্তা থেকে আমার মনে হয়েছে দাদুর জীবনে সাংঘাতিক কোন রহস্য আছে, এবং সেটা তিনি সযত্নে লুকিয়ে রাখতে চান।
প্রায় রাতেই আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে মা আর বাবাতে আলোচনা হত। তারপর এক রাতে, মা মারা যাওয়ার অল্প কিছুদিন আগে, হঠাৎ বাবার রাগ দেখলাম আমি।
আমি একটা বুদ্ধু, মারিয়া! বাবা বললেন। আমার উচিত ছিল মুখ বুজে থাকা। তা হলেই কক্ষনো উনি জানতে পেতেন না কিছু।
তুমি তখন রেগে গিয়েছিলে। তোমার মাথার ঠিক ছিল না।
রেগে গিয়েছিলাম সত্যি, কিন্তু ওটা কোন অজুহাত হলো না। আমার রাগ হয়েছিল বুড়ো যে ফেলিপির জন্যে। ও কারোকে কিছু বলত না, তবু খুন হতে হলো বেচারাকে।
পাহাড় থেকে খামোকা একটা লোক পড়ে গেলেই হলো? বিশেষ করে ওই পাহাড়টা যার চেনা, জীবনে বহুবার গেছে! তা ছাড়া আবহাওয়া ভাল ছিল সেদিন, চাঁদনি রাত ছিল। না, মারিয়া, ওকে খুন করা হয়েছে।
আমি জানি বাবা একটু কঠোর মানুষ, কিন্তু–
অহঙ্কারী মানুষ, মারিয়া। এরপর হঠাৎ খাদে নেমে যায় বাবার গলা। মারিয়া? ফেলিপি কি জানত?
আ… আমার বিশ্বাস। এ ছাড়া আর কী কারণ…? মানে অমন ভাল একটা বুড়ো মানুষ। মনে হত ও যেন কতকাল ধরে আছে আমাদের সাথে।
কিন্তু আমার প্রশ্ন, হঠাৎ সে-রাতেই কেন? কী এমন ঘটেছিল?
কোন জবাব এল না। আমি জানতাম আসবেও না। ছোট হলে কী হবে, ওই বয়েসেই আমি দিব্যি বুঝতে শিখেছিলাম মা চান না এ-ব্যাপারে কোন আলোচনা করতে। ফেলিপির প্রসঙ্গ উঠলেই কেমন-যেন আনমনা হয়ে যেতেন তিনি।
আমার জানতে ইচ্ছে হয়, কী এমন গোপন রহস্য আছে দাদুর জীবনে যা তিনি লুকিয়ে রাখতে চান। এমনকী এজন্যে মানুষ খুন করতে পর্যন্ত দ্বিধা করেননি?
.
এক নাগাড়ে পশ্চিমে এগিয়ে চলেছি আমরা। রাতে ক্যাম্পফায়ার একরকম হচ্ছে না বললেই চলে। আর দিনে যাও-বা হয়, তা কেবল রান্না আর কফি তৈরির জন্যে। দিনে ঘেসো জমিতে ছাড়া থাকে ঘোড়াগুলো, আমরা আড়াল খুঁজে নিয়ে সেখানে ঘুমোই। তবে আমাদের সঙ্গে যে-দুই পাহারাদার রয়েছে, তাদের অন্তত একজন সজাগ থাকে সবসময়। ওদের সাথে চমৎকার ভাব হয়ে গেছে আমার।
জর্জ বুশ মাঝারি গড়নের মানুষ কখনও হাসেনা, যদিও বেশ রসিক, লেক। অপরজন, কেলসো, একটু বয়স্ক। কালচে-লাল চুলে ঈষৎ পাক ধরেছে। কম কথা বলে। উভয়ই নিজেদের কাজ বোঝে, ইন্ডিয়ানদের সাথে লড়াই করার অভিজ্ঞতা আছে।
ট্রেইলে যতক্ষণ থাকি, ওয়াগনের ভেতর কথাবার্তা হয় না কোন। বাবা পারতপক্ষে কিছুই বলেন না। আমরা যতই এগিয়ে যাচ্ছি ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে, ওই আলাপী মানুষটি কেমন-যেন গুটিয়ে যাচ্ছেন নিজের মাঝে। হয়তো অসুস্থতাই এর কারণ, তবে আমার ধারণা ক্রমশ শঙ্কিত হয়ে উঠছেন তিনি।
একদিন, ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দিতে ট্রেইলে হাঁটছি আমরা, হঠাৎ জর্জ বুশ এগিয়ে এল আমার কাছে। তখন সবে চাঁদ উঠেছে, অন্ধকার ঘনায়নি পুরোপুরি।
ঘোড়ায় চড়বে, বাছা? বুশ প্রস্তাব দিল আমাকে। ইন্ডিয়ানরা আছে কিনা দেখার ব্যাপারে তুমি কিন্তু সাহায্য করতে পার আমাকে।
ছেলেটাকে তুমি ভয় পাইয়ে দিতে চাও? বিরক্তি প্রকাশ করল এক যাত্রী।
না, সার, জবাব দিলাম আমি, আমি ভয় পাব না। যদিও একটু-আধটু পাচ্ছিলাম বৈকি।
আমাকে স্যাডলে তুলে নিল বুশ, সামনে বসাল। কথা বলবে না, উপদেশ দিল ও। কেবল শুনবে। ইন্ডিয়ানরা সাধারণত রাতে ঘুমিয়েই থাকে, তবু সাবধানীর মার নেই।
আমরা লড়ব।
হ্যাঁ, বাছা, তা লড়ব। কিন্তু আগে চেষ্টা করব শান্তিতে কাজ সারতে। লড়াই করবে তখন, দেয়ালে যখন তোমার পিঠ ঠেকে যাবে।
.
০২.
আমাদের ওয়াগনই আমাদের পৃথিবী। ছজন মানুষ আমরা, যতক্ষণ ট্রেইলে থাকি চারপাশের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। ঘুমোই নয়তো বই পড়ে সময় কাটাই, ওয়াগনের ছাতের দিকে চেয়ে থাকি কান খাড়া করে। হ্যাঁ, কান আমাদের সর্বক্ষণ খাড়াই থাকে।
কলোর্যাডো রিভার কাছে এসে পড়ায় আমরা এখন কম সময় ট্রেইলে থাকছি। ভোরের আলো ফোঁটার বহু আগেই গা ঢাকা দিচ্ছি কোথাও গিয়ে।
এখনও পর্যন্ত ইন্ডিয়ানদের ছায়াও দেখতে পাইনি আমরা। কেবল একবার গুটিকতক ট্র্যাক চোখে পড়েছিল জর্জ বুশের, তাও সেগুলো ছিল বেশ কদিনের পুরনো।
বাবা আজকাল নীরব হয়ে গেছেন, চেষ্টা করছেন তাঁর কাশিটাকে দমাতে, কিন্তু সমস্যাটা রয়েই গেছে।
ওয়াগনে, লিকলিকে গড়নের এক লোক বসেছে আমাদের উল্টো দিকে। ওর নাম টমাস গ্রে। ঝুঁকে পড়ে ছোট্ট একটা নোটবুকে সারাক্ষণ কী যেন লেখে সে। এসময় ওর, রোগা কাঁধ দুটো এভাবে ছড়িয়ে যায়, মনে হয় ওগুলো বাজপাখির ডানা, ভজ খুলছে। আমার কাছে একটু অবাকই লাগে ব্যাপারটা, এত ঝাঁকুনিতে কীভাবে ওর পক্ষে সম্ভব হয় লেখা ভেবে পাই না!
যে-রাতে নদীতে পৌঁছুলাম আমরা সেইদিন সকালে, ঘোড়াগুলোকে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে একটা ওঅটর হোলের ধারে নিয়ে গেল কিম হিউজ। বেশি করে পানি খাওয়াতে হবে, ব্যাখ্যা করল সে। নইলে পরে পানির গন্ধে এমন ছুটবে, হুড়মুড় করে ওয়াগনসুদ্ধ নেমে যাবে নদীতে। আর সেই আওয়াজে কাছেপিঠে যত ইন্ডিয়ান আছে সব এসে পড়বে।
ওরা আছে এদিকে? প্রশ্ন করলাম আমি।
নিশ্চয় করে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে ওরা যখন আসে আচমকাই আসে।
জর্জ বুশ এগিয়ে এল আমাদের উদ্দেশে, ওর হাতে রাইফেল। উত্তরপশ্চিমে ধোঁয়া উড়ছে। ফিতের মত।
কত দূরে?
মাইল আটেক। কিছু কমবেশি হতে পারে। তবে নদীর এপাশে। থামল বুশ। আমি কি একবার গিয়ে দেখে আসব ট্রেইলটা।
একমুহূর্ত ভাবুল হিউজ, তারপর বলল, থাক। রাত গভীর হোক, আমরা চুপিসারে কেটে পড়ব।
ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল সে। বুঝলে, বাছা, বলল, সূর্য যখন ডুবে যায়, ইন্ডিয়ানরা ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে এসে চারদিক জরিপ করে। এসময় পাখিদের কিচির-মিচির থেমে যায় বলে, বহুদূর থেকে শোনা যায় আওয়াজ। চোখেও কড়া আলো লাগে না, ফলে নড়াচড়াও দেখা যায় সহজে। থুতু ফেলল সে। না, জর্জ, আমরা চুপচাপ অপেক্ষা করব।
গরম পড়েছে আজ, বাতাস নেই-একটুও। আমরা একটা সিডার বনের ভেতর ক্যাম্প করেছি। সামনের ঘেসো জমিতে চরছে ঘোড়াগুলো। অসংখ্য বোল্ডার রয়েছে এখানে, আর তার ওপাশে শৈলশিরা।
বাবা বসে আছেন চুপ করে। মাঝে মাঝে তাকে আমার হেঁয়ালির মত লাগে। যাত্রার শুরু থেকেই দেখছি বাবাকে যথেষ্ট সমীহ করে চলে হিউজ কেলসো আর বুশ। তাঁকে ওরা নিজেদের একজন বলে মেনে নিয়েছে। কিন্তু অন্যদের বেলায় ব্যাপারটা তেমন নয়।
এরমাঝে বুশ আমাকে একদিন বলেছে পশ্চিমের বহু দেশ বাবার ঘোরা। সাহসী লোক হিসেবে তার সুনাম আছে। ব্রাবাকে আমি ফেলিপির কথা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম। আমার জানতে ইচ্ছে হয়, কেন মরতে হয়েছে ওই বুড়োকে। কিন্তু জিজ্ঞেস করিনি, বাবা তা হলে জেনে যাবেন গোপনে আমি তাদের কথাবার্তা শুনে ফেলেছি। যদিও সেসব কথার অধিকাংশই ছিল আমার ভবিষ্যৎ নয়তো আমার দাদুকে ঘিরে।
নির্জনে বসে ঝিমোচ্ছি আমরা। অনেকক্ষণ হয় পায়চারি করছে ভ্যালেটা। লোকটা ভীষণ অস্থিরপ্রকৃতির, একধরনের হামবড়াই ভাব আছে। আমি জানি বাবাকে পছন্দ করে না ও। আমাকেও নয়।
শেষমেশ ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল সে, একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। আমি দেখছি ওকে, আর ভাবছি ক্যালিফোর্নিয়া যাবার জন্যে লোকটার এত তাড়া কীসের। অবশ্যি এও ঠিক, একমাত্র নিজেদের কারণটি ছাড়া, আর সবাই কেন এই অসময়ে বিপদ ঘাড়ে করে যাচ্ছে ওখানেতাও জানা নেই আমার।
দুজন মহিলা যাত্রী রয়েছেন আমাদের সাথে। এদের কেউ এ..পর্যন্ত আলাপ জমাবার চেষ্টা করেননি আমার সঙ্গে। এটাও একটু অদ্ভুত ঠেকেছে আমার কাছে, কারণ আমি বরাবর দেখে আসছি বাচ্চাদের সঙ্গ মেয়েরা ভালবাসে।
মিস ডায়ানা সুন্দরী মহিলা। একহারা শরীর। বয়েস ত্রিশ বা তার সামান্য কিছু কম হবে। হাজার ধুলোবালি থাকলেও, মহিলা সর্বদা লেস-দেয়া কাপড়চোপড় পরেন। তার জামাকাপড়গুলো বেশ পুরনো হয়ে গেছে, রিপুর চিহ্ন রয়েছে কয়েক জায়গায়। গোড়ায় চঞ্চল দেখালেও, আমি লক্ষ করছি, দিন যত গড়াচ্ছে ক্রমশ গম্ভীর হয়ে উঠছেন তিনি। ইদানীং তাঁর পলক পর্যন্ত কঁপে না। ভদ্রমহিলার যদি অার কোন নাম থেকেও গাকৈ, আমার সেটা জানা নেই।
মিসেস ওয়েবার হৃষ্টপুষ্ট গড়নের মহিলা। তিনি পরেন কালো সাটিনের গাউন। এই ধুলোবালি আর গরমের ভেতর ওই মোটা কাপড় পরে যেরকম হাঁসফাস করেন ভদ্রমহিলা তাতে ওঁর জন্যে ভীষণ মায়া হয় আমার। বেশির ভাগ সময় নাকে রুমাল চেপে রাখেন তিনি, আর সর্দি ঝাড়েন অনবরত।
মাঝে মাঝে আমি আন্দাজ করতে চেষ্টা করি ওরা সবাই কেন যাচ্ছে পশ্চিমে, কিন্তু, বলাই বাহুল্য, প্রতিবারই ব্যর্থ হই।
চারদিক নীরব-নিথর। গাছের পাতাটি পর্যন্ত কাঁপছে না। একটা ঘোড়া মাটিতে পা ঠুকে মাছি তাড়াতে চেষ্টা করল। ওয়াগনের ছায়ায় শুয়েছিল জর্জ বুশ, উঠে রাইফেল হাতেও বেরিয়ে গেল কেলসোর জায়গা নিতে।
হিউজ ধীর পায়ে হেঁটে এসে বসে পড়ল আমার বাবার পাশে। ও’হারা? তুমি এরকম উঁচুতে এর আগে কখনও এসেছ?
মোহাভে এলাকায় গিয়েছিলাম একবার, তবে এদিকে আসিনি।
নদীর পশ্চিম পাশটা চেন?
অল্পস্বল্প। সবসময় সাবধান থাকতে হবে। ইন্ডিয়ান তো আছেই, ঘোড়াচোরদের উৎপাতও কম নয়।
আমরা হুঁশিয়ার।
কেবল ইন্ডিয়ানদের ওপর নজর রাখলে চলবে না–সতর্ক থাকতে হবে শ্বেতাঙ্গদের ব্যাপারে।
.
০৩.
অপেক্ষার প্রহর যেন আর কাটতে চাইছে না। ইন্ডিয়ান হামলার ভয়ে তটস্থ হয়ে আছি আমরা। তবে আমার ভয় সবথেকে বেশি ক্যালিফোর্নিয়ার ভয়ঙ্কর সেই বুড়োকে যিনি আমার দাদু হন।
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি, জেগে উঠলাম আশপাশে নড়াচড়ার শব্দে। সূর্য ইতিমধ্যে নেমে গেছে দিগন্তের নীচে, কিম হিউজ ওয়াগনে ঘোড়া বাঁধছে। এই কাজটা সবসময় নিজে করে ও, কারও সাহায্য নেয় না। আসলে ও নিশ্চিত হতে চায়, প্রয়োজনের সময় সবকিছু যেন ওর চাহিদামাফিক থাকে।
শোন, তোমাদের অস্ত্রশস্ত্রগুলো পরখ করে নাও এখুনি, বলল স্কিপার। লড়াই একটা হবেই। কাজেই আমাদের তৈরি থাকা দরকার।
বাবার দিকে ফিরল হিউজ। ও’হারা? তোমার কী মনে হয়, আমাদের কি উচিত এখন রওনা হওয়া? তিন মাইল লম্বা একটা ক্যানিয়ন পেরোতে হবে আমাদের, পথে প্রচুর পাথর আছে। প্রায় এক ঘণ্টা লাগবে ওটা অতিক্রম করতে। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে যাবে।
এখুনি রওনা দাও।
বুশ? কেলসো?
উভয়েই মাথা ঝাঁকাল। ওয়াগনের সামনে চলে গেল কেলসো, ক্যানিয়নের বাঁ দেয়াল ঘেঁষে এগোচ্ছে। স্যাডল বুট থেকে নিজের রাইফেল বের করে নিয়েছে ও। পঞ্চাশ গজ পেছনে, এর উল্টো দিকে রয়েছে জর্জ বুশ। আর এদের মাঝে আমরা। সবাই সতর্ক। তৈরি।
বাবা আগেই বের করেছিলেন তাঁর রাইফেলটা। এবার কম্বলের ভেতর থেকে বাড়তি একটা শটগানও বের করলেন। আমার কাঁধে হাত রাখলেন তিনি। ড্যান, তোকে আমি শিখিয়েছি কীভাবে গুলি ভরতে হয়। আমি এগুলো নামিয়ে রাখলেই তুই গুলি ভরে ফেলবি। আর এই পিস্তলটা রাখ, কোন ইন্ডিয়ান যদি ওয়াগনের পেছনে চলে আসে, খতম করে দিবি। তবে তার আগে দেখে নিস ওটা একজন ইন্ডিয়ান কিনা, কারণ বুশ বা কেলসোকেও ঘোড়া হারিয়ে ওয়াগনে ফিরে আসতে হতে পারে।
ঠিক আছে, বাবা।
মুগুরের ঘা পড়ছে আমার বুকের ভেতর। বাবা ভরসা করছেন আমার ওপর। আমাকে এর মর্যাদা রাখতে হবে। রিলোডিংয়ের নিয়মকানুনগুলো মনে মনে ঝালাই করে নিলাম আমি। হয়তো অনেক ইন্ডিয়ান দলবেঁধে হামলা চালাবে, সুতরাং দ্রুত এবং নিশ্চিতভাবে কাজ করতে হবে আমাকে।
হ্যাঁ, নিশ্চিতভাবে। বাবা তাড়াহুড়ো করতে নিষেধ করেন সবসময়। ঠাণ্ডা মাথায় কাজ সারতে বলেন।
ধীর গতিতে এগোচ্ছি আমরা, বালু আর নুড়িপাথরের ট্রেইলে চাকার ঘর্ঘর শব্দ উঠছে। আমার গলা শুকিয়ে গেছে। বুকভরে শ্বাস টানলাম। বাবা আমাকে শিখিয়েছেন, ভয়ের সময়ে কীভাবে বড় বড় শ্বাস নিয়ে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে মনকে স্বাধতে হয়।
আমার উদ্দেশে ঘাড় ফেরালেন মিসেস ওয়েবার। তাঁর হাতে এখন একটা রাইফেল শোভা পাচ্ছে। আমাকে অবাক করে দিয়ে অভয়বাণী শোনালেন তিনি। ভয় পেয়ো না, থোকা। সব ঠিক হয়ে যাবে।
নিজের জন্যে নয়, ম্যাম, বললাম, আমি ভয় পাচ্ছি মিস্টার কেলসো আর মিস্টার বুশের কথা ভেবে।
তাই, বাছা। ওরা খুব ভাল লোক। মহিলা এবার মিস ডায়ানার দিকে তাকালেন। বুঝলে, মা, আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম-জর্জ বুশকে বিয়ে করতাম। সৎ চরিত্রবান লোক। তোমার মত একটা মেয়ের আদর্শ স্বামী হওয়ার উপযুক্ত।
মর্মাহত হওয়ার ভান করলেন মিস ডায়ানা, কিন্তু অভিনয়টা জুতসই হলো না। আমারও তাই ধারণা, অস্ফুট স্বরে বললেন তিনি, তবে ক্যালিফোর্নিয়ায় আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি না।
ঝট করে ওঁর দিকে তাকাল গ্রে, তারপর যখন পরস্পর মিলিত হলো ওদের, চোখ, গ্রে মুখ ঘুরিয়ে নিল। নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে বিরক্তিসূচক আওয়াজ করল ভ্যালেটা। মিস ডায়ানা লজ্জায় লাল হলেন।
মহিলার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন বাবা। কোন সন্দেহ নেই, ম্যাম, ক্যালিফোর্নিয়ার যুবকরা খুবই হতাশ হবে এতে।
বিয়েটাই জীবনের সব নয়, গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন মিস ডায়ানা।
ওয়াগনের গতি কমে এসেছে, কাঁধের ওপর দিয়ে মুখ খুলল কিম হিউজ। সামনেই ক্যানিয়নের মুখ। সাবধান।
ওয়াগনের ভেতরে অন্ধকার। বাইরে আলো আছে এখনও, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবে না। স্কিপার হাত বুলিয়ে দেখে নিল তার সিক্স-শুটারটা যথাস্থানে আছে কিনা। জর্জকে দেখতে পাচ্ছি আমি, সহজ ভঙ্গিতে বসে আছে স্যাডলে, আর কেলসো অদৃশ্য হয়েছে একটা বাঁকের ওপাশে।
ঘোড়াগুলো এবার দুলকি চালে ছুটছে, হিউজ যথাসাধ্য চেষ্টা করছে ওদের শান্ত রাখতে। ক্যানিয়নের বাঁক ঘুরতেই অদূরে পানির রুপোলি ছটা চোখে পড়ল আমাদের। আমার মুখ শুকিয়ে কাঠ, ঢোক গিলতে চেষ্টা করলাম।
বাবা আলতো চাপ দিলেন আমার কাঁধে। ভয় করিস না, বাছা, এরা সবাই দক্ষ লোক।
হিউজ নিচু স্বরে আলাপ করছে বাবার সাথে। ও’হারা, তুমি কটনউড আইল্যান্ডটা চেন?
চিনি। একটু থামলেন বাবা, তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন, আমাদেরকে যদি দেখতে না পেয়ে থাকে, মোহাভেরা এসময় ওখানে না থাকারই কথা।
হিউজ টেনে ধরল ঘোড়ার লাগাম, এখন খসখস শব্দে নরম বালুর ওপর দিয়ে এগোচ্ছে ওয়াগন।
হঠাৎ কোত্থেকে যেন কেলো হাজির হলো এসে। শান্তই মনে হচ্ছে, কিম। দ্বীপের এপাশে পানির গভীরতা বিশ ইঞ্চি বেশি হবে না।
এখন উজানে ঢল নামলেই হয়, বিড়বিড় করে বলল হিউজ।
ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলাম আমরা। চারদিক অন্ধকার, নিস্তব্ধ। আকাশে তারার মেলা, নদী থেকে ভেসে আসছে ভেজা গন্ধ। হিউজ একটা পাথরটাই এড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে আরেকটার সাথে ধাক্কা লাগাল ওয়াগনের। মৃদু সুরে নিজেকে গাল বকল সে।
সবাই নীরব। ওয়াগনের অন্ধকারে অন্যদের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি। বাবা এক ঢোক সুরা পান করলেন বোতল থেকে। এমনিতে তিনি মদ্যপ নন, তবে মাঝে মাঝে কাশির বেগ থামাতে পান করেন।
সুমসাম পরিবেশ। কেউ কোন কথা বলছে না, সকলেই স্নায়ুর চাপে ভুগছে। এমনকী ভ্যালেটীও চুপ করে আছে। আমি শুনতে পেলাম একটা পাথরের সাথে পেছনের চাকা ঠোক্কর খেতে মৃদু সুরে বিরক্তি প্রকাশ করল সে। এরপর পাথরের ওপর ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পেলাম আমরা। হিউজ রাশ টেনে ওয়াগন থামাল। পরক্ষণে অন্ধকারের ভেতর দেখা দিল এক ছায়ামূর্তি-কেলসো।
লক্ষণ আমার ভাল ঠেকছে না, কিম। একটা ব্যাঙও ডাকছে না।
বোধহয় নদীর অতটা কাছে এখনও আসিনি।
আমি একেবারে শেষমাথা অবধি গিয়েছিলাম। তা ছাড়া গেল আধঘণ্টায় একটা কয়ৌটের ডাক পর্যন্ত শুনতে পাইনি।
এখন আর কোন উপায় নেই, হিউজ বলল। এরকম খোলা জায়গায় ধরা পড়ার চেয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করা ঢের ভাল।
কিন্তু দলে ওরাই ভারি হবে।
কেউ বলেনি আমরা পিকনিকে বেরিয়েছি। তেমন বেগতিক দেখলে, ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দিয়ে আমরা চেষ্টা করব ভাটিতে ভেসে যেতে।
একমত হলো কেলসো। এটার নীচেই পিরামিড ক্যানিয়ন, পানিঃ ওখানে গভীর। তবে সেক্ষেত্রে আমরা একেবারে মোহাভে এলাকার মাঝখানে চলে যাব।
জজর্থ কোথায়?
অনেকক্ষণ হলো দেখছি না ওকে।
বাবা বললেন, হিউজ, তোমার আপত্তি না থাকলে, আমি তোমার পাশে চলে আসতে পারি। মনে হচ্ছে গোলাগুলি হবে খুব কাছ থেকে, আমার হাত পিস্তলেই চালু বেশি।
তোমাকে পেলে তো সুবিধেই হয়। লাগাম ঝাঁকিয়ে ঘোড়াগুলোকে এগ্লোবার নির্দেশ দিল স্কিপার। ঠিক আছে, কেলসো। তুমি এখন কাছাকাছি থাক। আমরা যাচ্ছি।
ঘোড়ার খুর আর চাকার ঘর্ঘর ছাড়া অন্য কোন আওয়াজ নেই। আমাদের আগে, ঈষৎবায়ে কেটে এগোচ্ছে কেলসো, ওর ডান হাতে উদ্যত পিস্তল।
সামনের পাড়টা ভাঙা। আবার আমাদের পাশে ফিরে এসেছে কেলসো। চাপা গলায় কথা বলছে। সোজা এগিয়ে যাও, দ্বীপের ওপাশে যেতে পারবে। পথের ওপর কোন মরা গাছপালা বা পাথরটাথর পাবে না।
আচমকা ঘোড়াগুলো নেমে গেল নীচে, বার কয়েক লাফিয়ে উঠল ওয়াগন, তারপর ঝপাৎ করে পানিতে গিয়ে পড়ল। তলায় পাথর আছে এখানে, জানাল হিউজ। এর আগে আমি ঘোড়ায় চড়ে পার হয়েছি।
নদীটা রীতিমত খরস্রোতা। ওয়াগনের গায়ে এর ধাক্কা দিব্যি টের পাচ্ছি আমি। একবার স্রোতের টানে প্রায় আধপাক ঘুরে গেল ওয়াগটা, কিন্তু হিউজ ঘোড়াগুলোকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওদের সাহায্যে আবার এগোল সোজা।
পানি থেকে ঠাণ্ডা উঠছে পাটাতনে। নিচু অথচ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে ঘোড়ার সাথে কথা বলছে স্কিপার। পার হতে কতক্ষণ লাগল জানি না, তবে হঠাৎ করেই হাঁচড়ে পাঁচড়ে আমাদেরকে নিয়ে ডাঙায় উঠে পড়ল জানোয়ারগুলো।
ডানে, গাছপালার অন্ধকার, সারি চোখে পড়ল আমাদের, সামনেও ছড়ানো ছিটানো রয়েছে কয়েকটা। এখান থেকে দ্বীপের আরেক মাথা আধমাইলটাক হবে। এগোলাম আমরা; কোথাও কোন শব্দ নেই।
তিক্ত সুরে অনবরত গাল বকছিল ভ্যালেটা। শান্ত অথচ দৃঢ় সুরে মিস, ডায়ানা বললেন, দয়া করে আপনি একটু চুপ করুন, সার।
চকিতে একদম বোবা হয়ে গেল ভ্যালেটা। মন্থর গতিতে এগিয়ে চলল ওয়াগন। কেলসো ঝোপঝাড় আর ঝড়ে উপড়ে-পড়া গাছ-পালার মাঝ দিয়ে পথ দেখাচ্ছে। বাতাসে মৃদু কাঁপন উঠেছে গাছের পাতায়, ডালপালায়।
ফাঁদ, বলল ভ্যালেটা। এটা একটা ফাঁদ।
সবে শেষ হয়েছে ওর কথা, এমন সময় গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ওরা, কালো একটা তরঙ্গ, আচমকা একযোগে তারস্বরে চিৎকার জুড়ল রাতের স্তব্ধতা ভেঙে। সপাং করে ঝলসে উঠল হিউজের চাবুক, লাফিয়ে আগে বাড়ল মাস্ট্যাংগুলো। ঝড়ের গতিতে এগোতে শুরু করলাম আমরা বাবা অবিরাম গুলি ছুড়ছেন।
হঠাৎ সাদা রঙ-করা একটা জংলী মুখ উঁকি দিল ওয়াগনের পেছনে, পর্দা সরিয়ে ওপরে ওঠার প্রয়াস পেল।
ওর কপালের সাথে রাইফেল ঠেসে ধরলেন মিস ডায়ানা, ট্রিগারটা টিপে দিলেন। নিমেষে সেই মুখ, আর মাথা, অদৃশ্য হয়ে গেল।
.
০৪.
খালি হয়ে গেছে বাবার পিস্তল, আমাকে ওটা দিয়ে আরেকটা তুলে নিলেন তিনি। দ্রুত গুলি ছুড়ছেন, অথচ কোনরকম তাড়াহুড়োর ছাপ নেই তার মাঝে। এবং প্রতিটা গুলি লক্ষ্যভেদ করছে। অল্পক্ষণের ভেতর চম্পট দিল ইন্ডিয়ানরা। অ্যামবুশ ব্যর্থ হওয়ায়, এবার ওরা অন্য কোন কৌশল খাটাবে।
ছুটে চলল ওয়াগন, হঠাৎ একটা চিৎকার শুনতে পেলাম আমি, বুশ চোট পেয়েছে! গুলি লেগেছে ওর ঘোড়ার!
ঝট করে রাশ টানল হিউজ, এবং ও কিছু বলতে পারার আগেই বাবা নেমে গেলেন সিট থেকে। আমি দেখলাম পেছন দিকে ছুটে যাচ্ছেন তিনি, কুঠারহাতে এক ইন্ডিয়ান তেড়ে এল তার উদ্দেশে, বাবা গুলি করলেন। লুটিয়ে পড়ল লোকটা।
ক্ষীণ আলোয় দেখা যাচ্ছে বুশকে, চাপা পড়েছে ওর ঘোড়ার নীচে, হাঁসফাস করছে বেরিয়ে আসার জন্যে। দৌড়ে ওর কাছে গেলেন বাবা, পলায়নপর ইন্ডিয়ানদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন আবার, তারপর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন বুশের দিকে।
অতিকষ্টে ওকে যাঁতাকল থেকে মুক্ত করলেন তিনি, এবং দুজনে মিলে পিছিয়ে এলেন ওয়াগনের কাছে। এখন শুধু বুশ গুলি করছে, কারণ বাব্বর দ্বিতীয় পিস্তলটাও খালি হয়ে গেছে। কেলসো ফিরে এল অকুস্থলে, গুলি ছুড়ছে অবিরাম।
কষ্টেসৃষ্টে ওয়াগনে উঠে পড়ল ওরা। গুলিভরা পিস্তলটা বাবাকে দিয়ে অন্যটা রিলোড করার জন্যে নিয়ে নিলামআমি। এগোতে শুরু করল ওয়াগন, একটা গাছের গুড়ির ওপর চাকা উঠে যাওয়ায় ঝাঁকি খেল একবার।–মিস ডায়ানা তার ভারি রাইফেলটা নিয়ে ওত পেতে বসে আছেন ওয়গনের পেছনে, পাশেই রয়েছেন মিসেস ওয়েবার। গুলি ছোড়ার জন্যে সবে রাইফেল উঁচু করছেন মিস ডায়ানা এই সময়ে আচমকা থেমে গেল ওয়াগন, সিট থেকে উল্টে পড়তে পড়তে কোনমতে টাল সামলালেন মহিলা।
বাবার ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি দিলাম আমি, দেখলাম নদীর কালো পানি ছুটে চলেছে খলখল শব্দে। বুঝতে অসুবিধে হলো না স্রোত এবং গভীরতা দুই-ই এখানে বেশি।
পশ্চিম তীর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, দূরত্ব ত্রিশ গজও হবে না, কিন্তু নদীর কারণে এই স্বল্প ব্যবধানকেই দুস্তর মনে হচ্ছে।
কোন উপায় নেই, শান্ত কণ্ঠে বললেন বাবা। দেরি করলে ওরা আমাদের ঘিরে ফেলবে।
হিউজ ঘোড়াগুলোকে নির্দেশ দিল এগোতে, মৃদু সুরে কথা বলছে ওদের সাথে। একটু দোনোমনো করল ওরা, তারপর নেমে গেল পানিতে। স্রোতের টানে ওয়াগনটা ঘুরে গেল ভাটির দিকে, কিন্তু ঘোড়াগুলো দাড়িয়ে রইল অনড় হয়ে। প্রথমে নিজেদের ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে হিমশিম খেল ওরা, তারপর আগে বাড়ল ধীরে ধীরে। নদীর উল্টো দিকে কোনাকুনিভাবে ওদেরকে পরিচালিত করল হিউজ, নিবিড় ঝোপঝাড়ের মাঝে একটা ফাটল বরাবর এগোল।
ক্রমশ কমে আসতে লাগল ব্যবধান। মুহূর্তের জন্যে মনে হলো বুকপানিষ্টে নেমে গেছে ঘোড়াগুলো, ক্ষণে ডাঙায় উঠে এল ওরা।
ইন্ডিয়ানরা ধাওয়া করবে আমাদের, মন্তব্য করল হিউজ। লাগাম টেনে, ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল সে। কেউ কোন চোট পেয়েছে?
ও’হারা আহত হয়েছে, বলল বুশ।
ও কিছু না। এখুনি সেরে যাবে।
আবার এগোলাম আমরা, ঢালু পাড় বেয়ে উঠে এলাম উঁচু জমিতে।
দক্ষিণপশ্চিম দিকে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিল হিউজ, হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। অল্পক্ষণের ভেতর ওয়াগনের পাশাপাশি হলো কেলো। যতটুকু দেখলাম ফাঁকাই মনে হলো, হিউজকে জানাল সে। শক্ত সমতল মরুভূমি, আর কিছু পাথর আছে। অসুবিধে হবে না।
সার? বাবাকে বললেন মিস ডায়ানা, আপনি একটু আসবেন এদিকে, আমি আপনার ক্ষতস্থানে পট্টি বেঁধে দিচ্ছি। এতে করে রক্তপাত আপাতত বন্ধ হয়ে যাবে।
বেশ। অন্ধকার ওয়াগনের পেছনের অংশে সরে গেলেন বাবা।
সারাটা রাত দক্ষিণপশ্চিমে এগোল ওয়াগন। কখনও ঘুমোলাম আমি, কখনও জেগে রইলাম। সকাল নাগাদ দশ-বারো মাইলের বেশি যেতে পারব না আমরা, ভ্যালেটা বলল। তা ছাড়া ঘোড়াগুলোকেও বিশ্রাম দিতে হবে।
যখন ঘুম ভাঙল আমার, ধূসর আলো ঢুকছে ওয়াগনে। ভ্যালেটা ঘুমোচ্ছে, বাবাও। ওয়াগনের ভেতর গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে হিউজ, আর বুশ চালকের আসনে গিয়ে বসেছে। হামা দিয়ে চলে গেলাম ওর পাশে, আসন্ন ভোরের ম্লান আলোয় মরুভূমির অন্তহীন রিক্ততার দিকে তাকালাম। শুধুই বালু আর বালু, এবং পাথর।
যখন পেছনে তাকালাম, দূরে আবছায়া চোখে পড়ল নদীটা। যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক পথ চলে এসেছি আমরা, ক্রমশ উঠে যাচ্ছি আরও উঁচু অঞ্চলে।
ইতিমধ্যে হিউজ উঠে পড়েছিল, গুটিকতক পাথরের মাঝে ফাঁকা একটা জায়গায় ওয়াগনটা নিয়ে গেল সে। অল্পকিছু ঘাস আছে এখানে আর পানি যা আছে তাতে কেবলমাত্র ঘোড়াগুলোর তেষ্টা মিটবে।
তক্ষুণি রাইফেলহাতে নেমে গেল বুশ, আমাদের ট্রেইলের ওপর নজর রাখতে উঁচু একটা পাথরের মাথায় গিয়ে উঠল।
দিনের আলোয় বাবাকে দেখে চমকে উঠলাম আমি, দৌড়ে গেলাম তাঁর কাছে। ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে তাঁকে, জামা রক্তে ভেজা।
একটু সর তো, বাছা, বললেন মিস ডায়ানা। আমি পট্টি বেঁধে দিচ্ছি। জামা খুলতে বাবাকে সাহায্য করলেন তিনি, আমরা দেখলাম বাবার কাঁধের একটা ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। পালকসুদ্ধ একটা তীরের গোড়া বেরিয়ে আছে পিঠের দিকে।
মাথাটা কেটে ফেলেছি আমি, বাবা বললেন। ভেবেছিলাম বাকিটুকু আপনি বের করতে পারবেন টেনে।
রক্ত সরে গেছে মিস ডায়ানার মুখ থেকে। আরেকবার দেখছি চেষ্টা করে।
হিউজ এগিয়ে এল। দাঁড়ান, ম্যাম, আমি দেখছি কী করা যায়। এর আগেও বহুবার বের করেছি এমন।
বাবার কাঁধ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, ধীরে ধীরে তীরটা টেনে বের করল ও, সবসময় হুঁশিয়ার রইল যেন জখমটা:আরও বড় হয়ে না যায়। আমি দেখলাম বাবার কপাল আর মুখে ঘাম ফুটেছে, বড় হয়ে গেছে চোখ, তবু টুঁ শব্দ করলেন না তিনি। তাঁর জন্যে দুঃখ হলো আমার। ভীষণ রুগ্ন দেখাচ্ছে বাবার কাঁধ দুটো, অথচ একসময় দারুণ সবল ছিল ওগুলো, আমি কত খেলা করেছি সেখানে চড়ে।
জানেন, আপনার জন্যেই বেঁচে গেছেন মিস্টার বুশ, বললেন মিস ডায়ানা।
আমরা সবাই নিজেদের সাধ্যমত কাজ করেছি, বাবা জবাব দিলেন।
কিন্তু কালকের নায়ক ছিলেন-আপনি! দৃঢ়কণ্ঠে নিজের অভিমত ব্যক্ত করলেন মিস ডায়ানা।
স্মিত হাসলেন বাবা। এই পরিবেশে ওটা একটা ফাঁকা বুলি, ম্যাম। ওসব কথা গল্প-উপন্যাসে মানায়। এখানে মানুষকে মানিয়ে চলতে হয় পরিস্থিতির সঙ্গে।
একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে কেলসো, টুপি খুলে ফেলেছে, চোখ বোজা। আমার মনে হলো সীমান্তের ডাকাবুকো কেউ নয়, বরং কবি হলেই ওকে মানাত বেশ।
বালুর ওপর জোড়াসন হয়ে বসে আছে গ্রে। হিউজ ওর কাছে যেতে চোখ তুলল সে। আমি পারিনি। আমি কোন কাজের না।
থমকে দাঁড়াল হিউজ, মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে জিজ্ঞেস করল, পারনি? কী পারনি?
গুলি ছুড়তে।
নিভে-যাওয়া পাইপটা আবার ধরিয়ে নিল স্কিপার, তারপর বলল, প্রথম-প্রথম সবারই হয় এরকম। ও কিছু না। মন খারাপ কর না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
গোমড়া মুখে বসে রয়েছে ভ্যালেটা। কবার গুলি ছুড়েছে ও? আমি দেখিনি। জানিওনা। হয়তো অনেকবার।
মাথার ওপর উঠে গেছে সূর্য। তবে আমরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছি সেখানে ছায়া রয়েছে। বাবাকে পরিষ্কার একটা শার্ট পরতে সাহায্য করলেন মিস ডায়ানা। এটাই তার শেষ জামা। গোসল আর ধোঁয়া কাপড়চোপড় এ-দুটো জিনিসই বাবার সবচেয়ে প্রিয়। মুখে হাত দিয়ে একবার কাশলেন তিনি। মিস ডায়ানা বললেন, আপনি অসুস্থ, মিস্টার ও’হারা।
তাই। ম্লান হাসলেন বাবা। আপনার সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ, ম্যাম।
আপনার ছেলেকে দেখলাম পিস্তল লোড করতে পাবে। কীভাবে শিখল?
আমি শিখিয়েছি। আমি চাই না আমার ছেলে দুর্বল হোক।
আবার হাসলেন বাবা। আপনি কিন্তু বেশ কাজের, ম্যাম।
পলকে আরক্তিম হলেন ডায়ানা। কাজ-ফাজ বুঝি না, যেটা করা প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে তাই করেছি।
সেটাই তো সবসময় করা উচিত, তাই না?
আপনি কি লস এঞ্জেলেসেই থাকবেন?
ক্ষীণ হাসি ফুটল বাবার মুখে। বোধহয়..দিন কয়েকের জন্যে। আমার বিশ্বাস হয় না কোথাও আমি দীর্ঘদিন থাকতে পারব। মানুষ আর সভ্যতা, এদের মধ্যে মিল আছে, ম্যাম। এরা জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে দিনে-দিনে, যৌবনপ্রাপ্ত হয়, তারপর একদিন বুড়ো হয়ে মরে যায়। আসলে সব জিনিসই তাই।
অন্তত আমি, যোগ করলেন তিনি, যেখান থেকে এসেছি সেই সমুদ্রেই ফিরে যাচ্ছি আবার। ছেলেবেলায় ভেবেছিলাম বড় হয়ে বাবার মত জাহাজের ক্যাপ্টেন হব। কিন্তু তারপর ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে এলাম।
বদলে গেলেন?
প্রেমে পড়েছিলাম, ম্যাম। অপূর্ব সুন্দরী এক স্প্যানিশ রমণীর প্রেমে পড়েছিলাম। ওই ব্যাপারটাই আমার জীবন পাল্টে দিল, এবং ওরও।
উনিই কি ছেলেটির মা?
ছিল। ওকে আমরা হারিয়েছি, ম্যাম। ছেলেটাকে আমি এখন ওর দাদুর কাছে নিয়ে যাচ্ছি।
এরূপর দীর্ঘ নীরবতা। বিরাট একটা পাথরের ছায়ায় আমি বসে, চোখ মিস্টার কেলসোর মত বোজা।চরাচর শান্ত।
বুশ নেমে এল ওপর থেকে, ক্যান্টিনের ছিপি খুলে এক ঢোক পানি খেল। কিস্য নেই, হিউজকে বলল ও। আশপাশের অনেকটা দেখা যায় ওখান থেকে।
আমি যাব?
আরাম কর। আরও ঘণ্টা দুয়েক আমিই চালিয়ে নিতে পারব। ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল বুশ। খাওয়া হলে আমার কাছে চলে এস। তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে।
আচ্ছা।
…মরুভূমিতে পালিয়ে গিয়েছিলেন আপনি? মিস ডায়ানা কথা বলছেন আমার বাবার সাথে। ওরা আপনাকে তাড়া করেছিল?
হ্যাঁ, ম্যাম। সংখ্যায় ওরা অনেক ছিল। পাহারা বসিয়েছিল সবখানে।
তা হলে পালালেন কীভাবে?
ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন বাবা। তাঁর গলার স্বরে সেটা স্পষ্ট। আমরা কখনোই পালাতে পারিনি, ম্যাম। যদিও বিশ্বাস করেছিলাম পেরেছি। এখন আবার তার কাছেই ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি ছেলেটাকে। কারণ উনি ছাড়া ওর আর কেউ নেই।
আবার দীর্ঘ নীরবতা, তারপর মহিলা বললেন, আমি ওকে মানুষ করতে পারি।
বাবার চোখ খুলে গেল, তাকালেন মিস ডায়ানার দিকে, ম্লান স্বরে বললেন, জানি, আপনি পারবেন। কিন্তু আগে…আগে ওর আত্মীয়স্বজনের কাছে চেষ্টা করতে হবে আমাদের।
ওরা আপনাকে ঘৃণা করা সত্ত্বেও?
বাবা শ্রাগ করলেন। করলই-বা। আমার সম্পর্কে ওদের কী ধারণা তাতে কি আসে যায় না। আমার ছেলের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই এখানে সব। মাথা গোঁজার একটা ঠাই দরকার ওর।
মন্থর লয়ে গড়িয়ে চলেছে সময়। খাওয়াদাওয়ার পর, আমি উঠে গেলাম বুশ যেখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে সেখানে।
সঙ্গে ওর জন্যে রুটি আর মাংস নিয়েছিলাম, সেগুলো নিয়ে খেতে বসল ও। পাথরপের মাথায়, একটা গাছের গোড়ায় বসে আছি আমরা। যতদূর চোখ চলে ধু-ধু প্রান্তর। অগুনতি ক্যানিয়ন, ভাঙাচোরা এবড়োখেবড়ো। দূরে নীলাভ দেখাচ্ছে শৈলশ্রেণী, নীচে মরুভূমির বুকে মেঘের ছায়া।
খেতে খেতে নানান বিষয়ে আমার সাথে আলোচনা করল বুশ। শেখাল মভূমিতে কীভাবে টিকে থাকতে হয়, আর পাহারা দেয়ার নিয়মকানুন। ও-ই আমাকে জানাল মরুভূমিতে পর্যবেক্ষণ চালানোর সময়ে একপাশ থেকে নজর বোলাতে হয়, কাছ থেকে দূরে। হুশিয়ার থাকতে হয় প্রতিটি নড়াচড়া, অথবা অস্বাভাবিক কোন ছায়া কিংবা অন্যকিছুর জন্যে।
একদিনে হবে না, করতে করতে শিখে যাবে, রুটি আর মাংস চিবুতে চিবুতে লেল বুশ তোমার বাবার কাছ থেকে শিখতে পারবে। এসব ব্যাপারে উনি ঝানু লোক। ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে শিখবে। আর অমিরা, মানে আমি কেলসো আর হিউজও কিছু কিছু শেখাতে পারব তোমাকে।
আমার দিকে তাকাল ও। আচ্ছা, মিস ডায়ানা কি তোমার বাবাকে বিয়ে করতে চাইছেন?
নাহ। আমার তা মনে হয় না। আসলে উনি আমাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করছেন। তারপর বললাম, আমার বাবা অসুস্থ। আর মহিলা সেটা জানেন।
আমারও তাই বিশ্বাস। একটুক্ষণ চুপ করে রইল ও, তারপর বলল, আমি হয়তো চলে যাব, বাছা, তবে একটা কথা মনে রেখ এই জর্জ বুশ আজীবন তোমার বন্ধু থাকবে। যদি কখনও প্রয়োজন মনে কর, খর পাঠিয়ে, আমি চলে আসব।
.
পাথরস্তূপ থেকে যখন আমি নামলাম, বাবা তখন ঘুমিয়ে। চারদিক ভরে উঠেছে আঁঝাল রোদ্দুরে, ভয়ঙ্কর গরম পড়েছে। ওয়াগনের ছায়ায় বসে আছেন মিস ডায়ানা, মাঝে মাঝে তার টুপি দিয়ে হাওয়া করছেন নিজেকে।
পাথরের গোড়ায় যেখানে বসে রয়েছে সেখান থেকে আমার দিকে তাকাল কিম হিউজ। দেখতে পেলে কিছু?
না।
এই সময় না দেখাই স্বাভাবিক, তবে তারমানে এই নয়, ওরা কাছেপিঠে নেই।
জ্বি।
জর্জের কথা তুমি মন দিয়ে শুনো, বাছা। ও চালু লোক। বিপদ হবে কিনা ঠিক টের পেয়ে যায়।
হাঁটু মুড়ে একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে গ্রে। নোটবুকখানা হাঁটুর ওপর রেখে ছাইপাশ কী যেন লিখছে। মাঝেসাঝে পলক তুলছে, যেন ভাবছে কিছু।
কাছেই হাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে একটা গিরগিটি। আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে ওটা যেন মাপছে আমাকে। দূরে লাল-খয়েরি একটা শৈলশিরা আকাশ ছুঁয়েছে। কিন্তু আমি ক্লান্ত, প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মত অবস্থায় নেই, বিশ্রামের উপযুক্ত জায়গা জহি। ভাল ভাল সব জায়গা দখল হয়ে গেছে। তেরপলের নীচে গরম, তবু হামাগুড়ি দিয়ে ওয়াগনের ভেতর গিয়ে আশ্রয় নিলাম।
ধারেকাছেই রয়েছে সবাই, কিন্তু আমার ভয় কাটছে না, ভীষণ একলা লাগছে নিজেকে। ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু পাছে অন্যরা গুনে ফেলে তাই পারছি না। গুগুলী পাকিয়ে শুয়ে রইলাম আমি, ইন্ডিয়ানদের বুনো চিৎকার আর গোলাগুলির কথা ভুলে যেতে চেষ্টা করলাম। এসময়ে মাকে আমার দরকার ছিল পাশে, পরক্ষণে ভাবলাম না থাকায়, ভালই হয়েছে কেননা তা হলে তিনিও ভয় পেতেন। আমার হতভাগ্য বাবার কথা ভাবলাম আমি, রুগ্ন আহত মানুষটি শুয়ে আছেন ওয়াগনের নীচে।
এরপর ক্ষীণ নড়াচড়ার শব্দে চোখ মেলে তাকালাম একসময়, বুঝলাম আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ওয়াগনের ভেতরটা অন্ধকার, নীরব। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম ওখানেও অন্ধকার।
ঘোড়াগুলোকে নিয়ে এসে বাধা হচ্ছে হার্নেসে। মিস ডায়ানা উঠে এলেন ওয়াগনের ভেতরে, আমার নিশ্বাসের আওয়াজ পেয়ে আঁতকে উঠলেন।
কে?
আমি, বললাম।
ওহ ড্যান! তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। আমি জানতাম না কেউ আছে এখানে। তোমার কোন অসুখ করেনি তো?
না, ম্যাম। এমনি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
তোমাকে আমার হিংসে হচ্ছে। আমিও চেষ্টা করেছি, কিন্তু গরমে পারিনি।
মিসেস ওয়েবার ওয়াগনে ঢুকলেন। তারপর, একেএকে, অন্যরা। বাবাকে উঠতে সাহায্য করল গ্রে। আমার পাশে এসে বসলেন তিনি। বাছা, তুই কেমন, আছিস? জিজ্ঞেস করলেন বাবা।
ভাল, বাবা।
চালকের আসনে হিউজের পাশে বসল জর্জ বুশ। আমরা রওনা হালাম, কেলসো পথ দেখাচ্ছে।
ওয়াগনের পেছনের অংশে সরে গেলেন বাবা, ট্রেইলের ওপর নজর রাখবেন। ব্যাপারটা লক্ষ করে ভ্যালেটা নাক সিটকে বলল, তোমার যে-হাল, তাতে লড়তে পারবে বলে তো মনে হয় না।
শীতল জবাব দিলেন বাবা। যতক্ষণ শ্বাস আছে, আমি আমার দায়িত্বটুকু পালন করে যাব।
তারমানে আমি তা করিনি, এটাই তো বোঝাচ্ছ?
তুমি খামোকা চটছ, বন্ধু। ওরকম কিছুই আমি বোঝাইনি। নিজের ঝামেলা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম, তুমি কী করেছ বা করনি-অতসব দেখার সময় ছিল না। আমার বিশ্বাস, তোমার পক্ষে যতটা সম্ভব তুমি তা করেছ। একটু থামলেন বাবা। শত হলেও, আমরা কেউই মরতে চাই…।
তবে একটা কথা মানতে হবে, খানিক বাদে ঈর্ষার সুরে বলল ভ্যালেটা, পিস্তলে:তোমার হাত চালু।
অস্ত্রের ব্যবহার কখনও কখনও জরুরি হয়ে ওঠে, বন্ধু, শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন বাবা।
এরপর নীরব হয়ে গেল ওয়াগনের পরিবেশ, ছড়ানো-ছিটানো পাথরের ওপর দিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে চললাম আমরা।
ক্যানিয়নের ওপাশটা কি অনেক দূরে? বহুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলাম আমি।
পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত কাবার হয়ে যাবে, বাবা বললেন। কাহিল হয়ে পড়বে। ঘোড়াগুলো, আমাদের হয়তো তখন হাঁটতে হবে।
বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। বাবা বলেছেন এ-ই হয় মরুভূমিতে, উত্তাপ ধরে রাখার মত কিছু না থাকায় খুব তাড়াতাড়ি গরম কেটে যায়।
তবে উনি যা অনুমান করেছিলেন, তার চেয়ে দ্রুত এগোলাম আমরা। যখন ভোর হলো, খোলামেলা বিশাল এক মরুপ্রান্তরে বেরিয়ে এসেছি, দিগন্তে নীলগিরি চোখে পড়ছে। এখানে অদ্ভুত এক গাছ দেখতে পেলাম আমি, মানুষের মতই হাত-পা রয়েছে এর, তবে আকারে অন্তত তিন-চার গুণ বড় হবে, আর পাতার বদলে রয়েছে দুচোল ফলা।
জশুয়া গাছ, বারা জানালেন আমায়। তারপর তর্জনী উঁচিয়ে দূরের একট জায়গা দেখিয়ে বললেন, এই যে, ওখানে! একদিনের মত লাগবে পৌঁছুতে, একট ঝরনা আছে এই পাহাড়গুলোর মাঝে। পথে আর কোথাও পানি পাব না আমরা, এক যদি পাইউট ওপাশে থাকে। সেটাও নেহাত কম দূরে নয়। তাও আবার বেশির ভাগ সময় শুকনো থাকে।
চোখ কুঁচকে ওদিকে তাকাল কিম হিউজ, বারো মাইল?
প্রায়।
হুম, ঘোড়াগুলো তরতাজাই আছে। পেছনে তাকাল স্কিপার। ওরা মনে হচ্ছে পিছু নেয়নি।
ইন্ডিয়ানদের কোন বিশ্বাস নেই, জবাব দিল কেলসো। হতে পারে আমরা দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছি বলে আর চেষ্টা করতে চাইছে না-তবে মোহাভেরা সাধারণত এরকম করে না।
আমরা বড়জোর আর মাইল দুই যেতে পারব। হিউজ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল আমাদের পানে। কী, রাজি সবাই?
আগে বাড়, বলল ভ্যালেটা। গরম সবখানেই সমান।
দক্ষিণপশ্চিম অভিমুখে হাঁটতে লাগলাম আমরা। কখনও ওয়াগনের পাশাপাশি, কখনও পেছনে। ঘোড়াগুলোকে খানিক জিরোবার সুযোগ দিচ্ছি, জানি দুর্বল, তবু আমার পাশেই রয়েছেন রাবা। সাবধান থাকতে হবে আমাদের, বললেন তিনি, ওই ঝরনার কাছে যাওয়ার সময়ে।
ইন্ডিয়ানরা থাকবে?
মনে হয়। মরুভূমিতে চলাফেরার সময় প্রত্যেকেরই পানি দরকার হয়। ইন্ডিয়ানরা জানে একথা। পানি কোথায় আছে তাও ওদের জানা। কাজেই, আগেভাগে ওখানে গিয়ে ওত পেতে থাকতে পারে।
একটু পিছিয়ে পড়েছি আমরা, এবার তিনি পঁড়িয়ে গেলেন। ড্যান, আন্তরিক গলায় বাবা বললেন, মরার সময় আমি তোর জন্যে কিছু রেখে যেতে পারব না, শুধু সামান্য কিছু জ্ঞান ছাড়া। মন দিয়ে শোন। এটুকুই আমার সম্বল।
আমরা হাঁটতে শুরু করলাম আবার। বাবা বললেন, মানুষের শেখার শেষ নেই। যে শিখতে চায় না সে নিজেই নিজের কবর খোঁড়ে। সুদিনের প্রত্যাশায় ঝিনুকের মত সাগরতলে বসে থাকলে চলবে না-নিজের কর্ম দিয়ে একে অর্জন করে নিতে হবে।
…আর সবসময় একটা কথা মনে রাখবি: পানি যেখানে আছে মানুষকে সেখানে যেতেই হবে। তাই মরুভূমি যতই বড় হোক না কেন, বাস্তবে জায়গাটা নেহাত ছোট।
বাবা, জিজ্ঞেস করলাম। আমি শুনেছি তোমাকে আর মাকে খুঁজে পায়নি ওরা।
পায়নি। কিংবা যেসব ইন্ডিয়ানকে ওরা গাইড হিসেবে নিয়েছিল তারা হয়তো তেমন জোরাল চেষ্টা চালায়নি। কারণ আমাকে ওরা বন্ধু বলে জানত। তা ছাড়া আরও কিছু ব্যাপার আছে, ড্যান।
আমি জানতাম কোথায় গেলে পানি মিলবে। ছোট ছোট ওঅটর হোল, বড়জোর কয়েক হপ্তা রা থাকে। বৃষ্টি নয়তো বরফগলা পানি। আমি গিয়ে খালি করে দিয়েছিলাম ওগুলো। ইন্ডিয়ানরা সেটা বুঝতে পেরেছিল। কেউ কেউ ওদের নিষেধ শোনেনি। যারা শোনেনি, তারা মারা পড়েছিল বোকার মত।
বিশাল মরুভূমির ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে এগিয়ে চলেছে কাফেলা, ওয়াগন আর এর ক্লান্ত ঘোড়াগুলোর পেছন পেছন। তবে শেষমেশ থামলাম একসময়। আমরা পাইউট ওঅশে এসে গেছি।
সবাই ক্লান্ত, তবু ওয়াগনসহ আমাদেরকে অপর তীরে নিয়ে গেল হিউজ। ঝরনা বা কোন শুকনো খাঁড়ির কাছে যখনই আসবে তুমি, হার্নেস খুলতে খুলতে উপদেশ দিল স্কিপার, সঙ্গে সঙ্গে পার হবে। নইলে সকালে হয়তো দেখবে বান ডেকেছে।
বাবা আমাকে এসব কথা শুনতে বলেছেন। তবে বলার কোন দরকার ছিল না, কারণ ছেলেপুলেরা এভাবেই দুনিয়ার হালচাল শেখে।
খাওয়ার সময় মিস ডায়ানা আমার পাশে বসলেন। আমি কখনও স্কুলে গিয়েছি কিনা জানতে চাইলেন তিনি। এখনি কী, আমার বয়স মাত্র ছয়, বললাম তাকে।
দেখে কিন্তু আরও বড় মনে হয়। অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন আমার দিকে। সমবয়সী বন্ধুবান্ধব ছিল না তোমার?
না, ম্যাম। কোথাও বেশিদিন থাকিনি কিনা।
পড়তে জানো?
লিখতেও পারি। মা আর বাবা দুজনই বেশ যত্ন করে শিখিয়েছেন।
রাতে, একদল কয়ৌট হানা দিল আমাদের ক্যাম্পে। ঘোড়াগুলো যেন ভয় না। পায় সেজন্যে হিউজ পাহারা দিতে গেল ওদের। ওয়াগনের নীচে বাবা শুয়ে আছেন আমার পাশে, পাশ ফিরতে গিয়ে যখনই চোট পাচ্ছেন তার আহত কাঁধে, ঘুমের ভেতর ককিয়ে উঠছেন।
আকাশে জ্বলজ্বল করছে তারা, মেঘ নেই। একবার কম্বলের তলা থেকে বেরিয়ে ওয়াগনের সামনে এসে বসলাম আমি। রাতের নীরব-নিথর এই পরিবেশ কেন-যেন ভাল লাগছে আমার।
এসময় পাহারায় ছিল মিস্টার বুশ, আমার পাশে এসে দাঁড়াল সে। ঘুম আসছে না?
ভেঙে গেছে। এত আলো, চুপচাপ বসে থাকতে ভাল লাগছে।
বুঝতে পারছি। আমারও অনেকসময় হয় এরকম। তবু ঘুমিয়ে পড়। সামনে ধকল আছে।
আমরা থামব পাইউট স্প্রিংয়ে?
বড়জোর এক রাতের জন্যে। কিম হিউজ মনস্থির করে ফেলেছে। কোন কারণে খুব চিন্তার মধ্যে আছে ও। আমি বুঝতে পারছি।
ভোর নাগাদ ফের ট্রেইল ধরলাম আমরা, সোজা এগোলাম পশ্চিমের নিচু পাহাড়ি এলাকার দিকে, এবং মাঝ-সকালে পৌঁছে গেলাম ঝরনায়। ওখানে ভরে নিলাম আমাদের পানির ব্যারেলগুলো। হিউজ কেলসোকে নির্দেশ দিল, প্রচুর কফি সহযোগে বেশি করে নাস্তা বানাতে।
জায়গাটা অত্যন্ত পাথুরে, তবে মনোহর। ঝরনা থেকে একটা সেঁতা পাথরের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে খানিকদূর গিয়ে বালুর ভেতর হারিয়ে গেছে। দেখলাম কোন কোন পাথরে ইন্ডিয়ান ভাষায় লেখা আছে কিছু।
হাতে ধূমায়িত কফি কাপ নিয়ে, বাবার কাছে গেল হিউজ। তুমি এই ট্রেইল চেন?
মোটামুটি। গোটা কয়েক ঝরনা পড়বে পথে। মোহাভে আর পাইউট দুগোত্রই ব্যবহার করে। আমার ধারণা ওই ঝরনাগুলো প্রাচীনকাল থেকেই আছে। একসময় পুয়েরো ইন্ডিয়ানরা এখানে নীলকান্তমণির খোঁজে আসত।
আমার মন কেমন-যেন খুঁত খুঁত করছে।
নিজের ওপর আস্থা রাখ। তুমি এই দেশ চেন। যদি অস্বস্তি বোধ করেই থাক, নিশ্চয় তার পেছনে কারণ আছে। কিছু একটা ধরা পড়েছে তোমার অনুভূতিতে, কিন্তু বুদ্ধি দিয়ে তার স্বরূপ চিনতে পারছি না।
হিউজ তাকাল বাবার দিকে। আচ্ছা, তুমিও তা হলে বিশ্বাস কর এসব। আসলে আমরা সবাই বোধ হয় করি-কম আর বেশি। কফিতে চুমুক দিল ও। কেসো বলছে ওরও নাকি ছমছম করছে গা।
একটু ইতস্তত করল স্কিপার, তারপর জিজ্ঞেস করল, এখন তুমি কেমন বোধ করছ, ওঁহারা? এমনিতেই অসুস্থ, তার ওপর প্রচুর রক্ত হারিয়েছ।
চিন্তা কর না, অভয় দিলেন বাবা। আমি ঠিক হয়ে যাব। ছেলেটার খাতিরে সুস্থ আমাকে হতেই হবে।
ওরা দেখতে পাচ্ছে না আমাকে। খানিক তফাতে পানির ধারে পাথরের ওপর বসে রয়েছি আমি; কিন্তু প্রকৃতি শান্ত থাকায় পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি ওদের কথাবার্তা। পানির ভেতর তাকালাম, প্রার্থনা করলাম বাবা যেন চিরকাল বেঁচে থাকেন।
রাতে, স্বপ্নে, বার কয়েক সেই ভয়ঙ্কর বুড়োকে দেখলাম যার কাছে আমি যাচ্ছি। আচ্ছা, আমাকে যখন দেখবেন তিনি, কী করবেন তখন? রৌদ্রালোকিত একটা র্যাঞ্চ হাউসের স্বপ্ন দেখলাম। যেখানে ওই বুড়ো থাকবেন, কিন্তু আমার বাবার কোন স্থান নেই। ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার শরীর। কী ঘটবে বা আমার এখন কী করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছি না, শুধু এটুকু জানি আমি ওই বুড়োর কাছে যেতে চাই না-এমনকী মুখও দেখতে চাই না তার।
সেইদিনই পাইউট স্প্রিং ত্যাগ করলাম আমরা। পথে হঠাৎ আমার পাশে চলে এলেন মিস ডায়ানা। আমরা তখন অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়েছি সামান্য, একলা রয়েছি। তোমাকে অসুখী মনে হচ্ছে,স্পষ্ট সুরে বললেন মহিলা। কেন-তোমার বাবা অসুস্থ বলে? নাকি আর কোন কারণ আছে?
একমুহূর্ত চুপ করে রইলাম, ব্যাপারটা নিতান্তই আমাদের পারিবারিক, মনে হলো বাইরের কারোকে বলা উচিত হবে না। কিন্তু শেষমেশ কবুল করলাম, বাবা আমাকে দাদুর কাছে নিয়ে যাচ্ছেন।
বুঝেছি। একটুক্ষণ বাদে মিস ডায়ানা বললেন, ড্যান, ওখানে যদি তোমার ভাল না লাগে, তুমি আমার কাছে চলে এস!আমি লস এঞ্জেলেসে থাকব। কি, মনে থাকবে তো, ড্যান?
মনে থাকবে আমার, পরক্ষণে নতুন আরেকটা ভয় আমাকে হেঁকে ধরল। যদি আমার জন্যে ডায়ানার কোন ক্ষতি হয়ে যায়?
মিস ডায়ানা সম্ভবত টের পেলেন আমার মনের কথা, তাই দৃঢ় সুরে বললেন, আমার নিরাপত্তার জনন্য তুমি ভেব না, ড্যান্। আমার কাছে তুমি আরামেই থাকবে।
পলকে পলক তুললাম আমি, তাকালাম ওঁর চোখের দিকে। মহিলাকে বিশ্বাস করলাম।
.
০৫.
সুযোগ ঘটতেই, কথায় কথায় বাবাকে আমি জানালাম মিস ডায়ানা আমাকে কী প্রস্তাব দিয়েছেন। হাঁটছিলাম আমরা, বাবা আচমকা থমকে দাঁড়ালেন। একদৃষ্টে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইলেন তিনি, তারপর গাঢ় স্বরে বললেন, তেমন অবস্থা হলে আমি স্বচ্ছন্দে মিস ডায়ানার কাছে গিয়ে থাকতে পারি।
দেখলাম, ওই মহিলা সম্পর্কে তার ধারণা, বেশ উঁচু। বাবা বললেন মিস ডায়ানা যথেষ্ট রূপসী না হতে পারেন, কিন্তু নিঃসন্দেহে বিদুষী। এখনও যে বিয়ে করেননি তিনি তার কারণ, এ-যাবৎ যত পুরুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে তারা কেউই সম্ভবত গুণের বিচারে তার সমকক্ষ ছিলেন না। মিস ডায়ানা সেই জাতের মহিলা, বাবা বললেন, যারা চান তাদের স্বামী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ হোক।
আমার কাঁধে হাত রাখলেন বাবা। আর কিছু না হোক, তুই একজন ভাল বন্ধু পেয়েছিস, ড্যান। এটাই সবচেয়ে বড় কথা। এবং আমার সাহায্য ছাড়াই ওর বন্ধুত্ব অর্জন করতে পেরেছিস তুই।
ওইদিনই কোন এক সময়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, আমরা মূল রাস্তা থেকে সরে ভিন্ন পথে এগোব। সিদ্ধান্তটা কিম হিউজের, রাতে খেতে বসে আমাদেরকে সেটা জানাল ও।
মরুভূমিতে আর থাকব না আমরা। নতুন আরেকটা রাস্তা ধরে লস এঞ্জেলেসে যাব। এতে করে বেশকিছু পাহাড়পর্বতের বাধা আর আউট-লদের উৎপাত এড়ানো সম্ভব হবে আমাদের পক্ষে।
সঙ্গে সঙ্গে স্কিপারের সাথে একমত প্রকাশ করল ভ্যালেটা আর টমাস গ্রে। মিস ডায়ানা প্রথমে মনোযোগ দিয়ে শুনলেন সবকিছু, তারপর তার সায় জানালেন। আপনি যা ভাল বোঝেন, বললেন মহিলা, কিন্তু পরক্ষণে বাবার অভিমত জানতে চাইলেন। মরুভূমিতে চলাফেরার অভিজ্ঞতা আপনার আছে। আপনার কি মনে হয়, বুদ্ধিমানের কাজ হবে এটা?
হবে, বললেন বাবা, যদিও রাস্তাটা একটু ঘোরা।
রাতের অধিকাংশ সময় ঘুমিয়ে কাটালাম আমি। পরদিন সকালে সবাই যখন নাস্তার আয়োজনে ব্যস্ত, আমাকে একা পেয়ে বাবা বললেন, তোর মিস ডায়ানা, দেখলাম, বেশ বুদ্ধিমতি মহিলা। আমার জানতে ইচ্ছে হয় ওর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
এ-ব্যাপারে শুধু বাবাই যে কৌতূহলী অ নয়। আমি লক্ষ করেছি দলের সবারই একটু-আধটু কৌতূহল আছে মিস ডায়ানা সম্পর্কে। মোটেও অস্বাভাবিক নয় এটা। কোন যুবতী এরকম একা-একা দূরদেশে পাড়ি জমাচ্ছে দেখলে কমবেশি সবারই কপালে ভাঁজ পড়বে। কেউ কেউ ধারণা করল নিশ্চয় তার বিস্তর টাকাকড়ি আছে, লস এঞ্জেলেসে গিয়ে বিয়ে-থা করে সংসারী হবেন। কেলসো বলল, মহিলা যেহেতু অনেক ভাষা জানেন, হয়তো বিদেশী ভাষা শেখানোর স্কুল খুলবেন ওখানে। আবার, কারও কারও মত, বিশেষ করে ভ্যালেটার, মিস ডায়ানা আসলে সুযোগসন্ধানী। লস এঞ্জেলেসে গিয়ে কোন স্প্যানিশ ডনকে লটঘট করে ভজিয়ে তার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবেন নিজের।
কালো মোচাকৃতির লাভা পাহাড় আর শুকনো বালিয়াড়ির মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। এখন আমাদের গাইড বাবা। হামেশা মিস্টার কেলসোর ঘোড়ায় চেপে তিনি আগে বেড়ে দেখে আসছেন ট্রেইল।
তৃতীয় দিনের মাথায়, ওয়াগনের পেছন পেছন হাঁটছি আমি আর মিস ডায়ানা, হঠাৎ থেমে তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, মিস ডায়ানা, ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে আপনি কী করবেন?
তার চোখ দুটো যেন পি করল আমাকে। শেষ পর্যন্ত তুমিও মাথা ঘামাতে শুরু করেছ? রিস্কার করলেন তিনি। তারপর স্মিত হেসে বললেন, ড্যান, ওরা তোমাকে জিজ্ঞেস করলে বল, আমি এখনও কিছু ঠিক করিনি।
মিস্টার কেলসোর ধারণা আপনি স্কুল খুলবেন।
একবার তাই ভেবেছিলাম, ড্যান। কিন্তু কী জানো, আমি আসলে একটু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। তা ছাড়া যে-কারণে এখানে আমার আসা, স্কুল খুললে সেটা সফল, হবে না।
আর মিস্টার ভ্যালেটা বলছেন, আপনি আসলে টাকার কাঙাল। কোন স্প্যানিশ ডনকে বিয়ে করবেন।
যে যেমন সে তাই ভাবে। কয়েক পা এগোলেন মহিলা, তারপর জানতে চাইলেন, তোমার বাবার কী ধারণা?
বাবা মনে করেন আপনি বুদ্ধিমতি মহিলা।
আবার স্মিত হাসলেন তিনি। কখটা পছন্দ হয়েছে আমার। বেশির ভাগ পুরুষই মেয়েদের বুদ্ধি আছে একথা স্বীকার করতে চায় না। এরপর যোগ করলেন মিস ডায়ানা, অবশ্যি এতে সুবিধেও আছে একটা।
বাবা আজকাল অত্যন্ত সতর্ক হয়ে উঠেছেন। প্রায়ই আগে বেড়ে ট্রেইল জরিপ করতে যান, কোথাও কোন সন্দেহজনক ট্র্যাক আছে কিনা দেখেন। ব্যাপারটা কিম হিউজের নজর কাড়ল। জর্জ, চোখ ভোলা রেখ, বুশকে বলল সে। ও’হারা বিপদের আশঙ্কা করছে।
ইন্ডিয়ান?
বোধহয় না। আরও সাংঘাতিক কিছু হবে।
.
দিন কয়েক পর, মাঝরাত নাগাদ ইন্ডিয়ান ওয়েলস-এ থামলাম আমরা। বাবা নেমে এলেন ওয়াগনের পেছন থেকে, ঈষৎ টলছেন।
মিস্টার? কেলসো জিজ্ঞেস করল। তুমি ঠিক আছ তো?
হ্যাঁ হ্যাঁ। একটু দুর্বল, এই যা। তা এখানে কতক্ষণ থাকব আমরা?
বেশিক্ষণ না। আমাদের ঘোড়াগুলো কাহিল হয়ে পড়েছে, তাই হিউজ চাইছে ওগুলোকে বদলে নিতে।
মাথা থেকে টুপি খুলে কপালের ঘাম মুছল কেলসো। খানিক বাদে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, তোমার কি হয়েছে, বুকের দোষ?
মনে হয়। যদিও মরুভূমিতে এসে কাশিটা অনেক কমে গেছে।
তা হলে অ্যগুয়া ক্যালিয়েতে কিছুদিন থেকে যাও না কেন? শুনেছি, ওখানকার শুকনো গরম বাতাস নাকি এই রোগের জন্যে উপকারী।
আমার হাতে অত সময় নেই, কেলসো। ছেলেটাকে আগে লস এঞ্জেলেসে ওর দাদুর কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
অন্ধকারে মিলিয়ে গেল কেলসো। বাবা কাছে টেনে নিলেন আমাকে, অদূরে ছোট্ট একটা কাঠের দালান দেখিয়ে বললেন, তুই এখানে থাক, বাছা। আমি ওখানে যাব আর আসব।
আর কেউ নামেনি ওয়াগন থেকে। সবাই ঘুমিয়ে আছে নয়তো ঘুমোনার চেষ্টা করছে। যারা ঘোড়া বদলাতে গেছে তারা ফিরে আসেনি এখনও। এদিকে ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে আমার।
আস্তে আস্তে কুয়োর কিনারে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি, উঁকি দিলাম ভেতরে। চাঁদের আলোয় দূর-নীচে পানির ছটা চোখে পড়ল।
সাবধানে নামতে শুরু করলাম নীচে, এক-এক করে অনেক ধাপ পেরিয়ে পানির কিনারে পৌঁছুলাম। এবার তাকালাম ওপর পানে। চৌকো আকাশ আর গুটিকতক তারা ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। এবার আশপাশে নজর বোলাতেই অন্ধকারের ভেতর বিশাল একটা পিপে চোখে পড়ল আমার, আর এর পাশেই একটা কাঠের মগ।
মগটা ভরে নিয়ে ঠাণ্ডা পানি পান করলাম আমি। প্রাণটা জুড়িয়ে গেল, মনে হলো। জীবনে কোনদিন জিভে এত সুস্বাদু আর কিছু ঠেকেনি। আবার ডোবালাম মগটা, পরক্ষণে টের পেলাম কে যেন আমাকে লক্ষ করছে।
থুত্থুড়ে এক ইন্ডিয়ান, পরনে তার সুতির ঢোল, জামা। মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে, সাদা, বেণী করে একটা ফিতে জড়িয়ে বেঁধে রেখেছে কপালের সাথে। দেখলাম লোকটার গলায় সুতো দিয়ে নীল তেকোনা একটা পাথর বাঁধা রয়েছে, তাতে কী-সব আঁকিবুঁকি কাটা।
দুঃখিত, সার, আমি আপনাকে দেখতে পাইনি আগে। পানি ভরে মগটা আমি এগিয়ে দিলাম ইন্ডিয়ান বুড়োর দিকে। অদ্ভুত চোখে লোকটা চেয়ে রইল আমার পানে। হঠাৎ বাবার ডাক শুনতে পেলাম, মগটা নামিয়ে রেখে তড়িঘড়ি উঠতে শুরু করলাম ওপরে। দুঃখিত, সার। আমাকে ক্ষমা করবেন। ঘাড় ফিরিয়ে বললাম।
ওয়াগনের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাবা, আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুরলেন। তুই আমায় চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলি, বাছা। ভয় হচ্ছিল বোধহয় পথ হারিয়ে ফেলেছি।
পানি খেতে গিয়েছিলাম।
আবার যখন চলতে শুরু করল ওয়াগন, বাবাকে বললাম, একজন ইন্ডিয়ানকে দেখলাম ওখানে।
শুয়েছিল ভ্যালেটা, উঠে বসল। নিশ্চয়, ভুল দেখেছ। ওরা আমাকে বলেছে ইন্ডিয়ানরা এখন আর কুয়োয় আসে না। বিশেষ করে রাতে।
লোকটা খুউব বুড়ো, বললাম আমি, গলায় নীল একটা পাথর ঝুলছিল।
টারকুইজ, ভ্যালেটা জানাল। ইন্ডিয়ানদের কাছে এর কদর সোনার চেয়েও বেশি।
তাজা ঘোড়া পেয়ে, এখন বেশ জোরে ছুটছে ওয়াগন, বুশ চালাচ্ছে। হিউজ ওয়াগনের পেছনে শুয়ে আছে গুটিসুটি হয়। পরের স্টপই অ্যগুয়া ক্যালিয়েন্তে, বলল স্কিপার। ওখানে তুমি আগে কখনও গেছ, ও’হারা?
হ্যাঁ, বেশ কয়েকবার। একেবারে স্যান হাকিন্টোসের মুখে। অ্যাংলোরা পাম ম্প্রিং নামে ডাকে। তিন-চার ঘর শ্বেতাঙ্গ আর কিছু কাউইয়া ইন্ডিয়ান থাকে।
একটু থামলেন বাবা। ওখানে আমি একটা জরুরি চিঠি পাব বলে আশা করছি।
মালপত্রের গায়ে শরীর এলিয়ে দিলেন তিনি, এবং এর খানিক বাদে আমিও। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, ঘুমোতে ইচ্ছে হচ্ছে, ওয়াগনের ভেতরে মন টিকছে না একটুও কোথাও নেমে পড়ে বিশ্রাম নিতে চাইছি আমি, এরকম একঘেয়ে বিরামহীন যাত্রা আর সহ্য হচ্ছে না আমার।
চুপচাপ শুয়ে আছি, চোখ ভোলা অন্ধকারে। নানান চিন্তা ভিড় জমাচ্ছে মাথায়। এ ঘোড়াগুলো এখন জোরকদমে ছুটছে। শিগগিরই অ্যাণ্ডয়া ক্যালিয়েন্তে পৌঁছে যাব আমরা, এবং তারপর লস এঞ্জেলেসে। আর কয় স্টপ পরে? পাঁচ, ছয়, বারো। জানি না আমি। রাতের বুক চিরে ছুটে চলল ওয়াগন। একসময় উঠে বসলেন বাবা, কোমরে-বাধা হোলস্টারটা সোজা করবেন টেনে। হাত বাড়িয়ে তার রাইফেলটা টেনে নিলেনু কাছে, নাগালের মধ্যে রাখলেন।
বিপদ ঘটতে যাচেছ? মনে মনে প্রমাদ গুনলাম আমি।
নিজের অজান্তেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ ধড়মড় করে জেগে উঠে দেখলাম আমাদের ওয়াগন স্থির। মিস্টার বুশের কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি মারলাম বাইরে, আলোকিত একটা জানালা চোখে পড়ল। তারপর দরোজা খুলে গেল, ঘরের খানিকটা আলো ছিটকে এসে লুটিয়ে পড়ল বাইরে, একজন লোককে দেখতে পেলাম, দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে আসছে ওয়াগনের দিকে।
ওয়াগনের পেছন দিকে সরে গেলেন বাবা, মাটিতে নামলেন। সবে সোজা ইয়েছেন তিনি এই সময় ওয়াগনের কোনা ঘুরে তার কাছে এসে দাঁড়াল লোকটা।
ও’হারা?
কেমন আছ, বিল? অনেককাল পর দেখা, তাই না?
চল, ভেতরে গিয়ে কফি খাবে। লোকটা লম্বায় প্রায় বাবার সমান, গোঁফ আছে। আমার দিকে তাকাল সে। তোমার ছেলে?
ড্যানিয়েল? এ হচ্ছে উইলিয়ম লারকিন। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে, ড্যগ। চল, ভেতরে গিয়ে বসবে।
সম্ভব হলে পরে আসবখন। এখন তাড়া আছে।
আমার কথা না শুনলে তুমি ভুল করবে, ড্যগ। লস এঞ্জেলেসে গেলে ওরা খুন করবে তোমাকে। এবং ছেলেটাকেও।
কী?
হ্যাঁ, ড্যগ, ওরা ওত পেতে আছে তোমার জন্যে।
১.২ ভেতরে গেল ওরা
ভেতরে গেল ওরা, আমি পিছু নিলাম। ছোট্ট একটা স্টোর, একপাশে রার আর গোটা তিনেক টেবিল-চেয়ার। বারের পেছনে কিছু বোতল সাজানো; অন্য আরেকটা কাউন্টারের পেছনে নানা ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন বাবা। তার মুখ ফ্যাকাসে, চোখ গর্তে। এখন আরও কাহিল দেখাচ্ছে তাকে।
বিল, যেভাবেই হোক, ওদের সাথে আমাকে দেখা করতেই হবে। বোঝাতে হবে ওদেরকে। আমার ছেলের একটা আশ্রয় দরকার, ওরা ছাড়া ওর আর কেউ নেই।
আমি মরতে ভয় পাই না। বরং এতে আমার যন্ত্রণা অনেকটা কমে যাবে। আমার একমাত্র চিন্তা, ড্যানকে নিয়ে।
তুমি বুঝতে পারছ না, ড্যগ। ওদের দৃষ্টিতে, তুমি ওদের মেয়েকে বিয়ে করে ওদের বংশকে অপমান করেছ। আর ছেলেটা সেই লজ্জার জ্বলন্ত প্রমাণ। তাই ওকেও মেরে ফেলতে চাইছে ওরা।
কাউন্টারের পেছনে গিয়ে দুটো কাপ আর কফিপট নিয়ে এল বিল, লারকিন। দেয়ালের ধারে একটা বেঞ্চিতে বসে রয়েছি আমি, বাবার মুখের খানিকটা অংশ দেখতে পাচ্ছি।
তার চেহারা ভয় ধরিয়ে দিল আমার মনে, এত ক্লান্ত আর মুমূর্ষ দেখাচ্ছে। যখন ঘাড় ফেরালেন, আমি লক্ষ করলাম তার চোখ নিষ্প্রাণ, দৃষ্টি ফাঁকা।
হায় খোদা, এখন আমি কী করব, বিল? আমি জানতাম ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষ তাদের ছেলেপুলেদের ভালবাসে, ভেবেছিলাম…।
ড্যগ, আমি বরং তোমার মালপত্রগুলো নামিয়ে ফেলি ওয়াগন থেকে। ওরা জানে তুমি আসছ, পাহারা বসিয়েছে রাস্তায়। বেলা ইউনিয়ন অফিসে চার-পাঁচজন ঘাঁটি গেড়েছে।
পিস্তলে তোমার হাত চালু, কিন্তু একা এত লোকের বিরুদ্ধে পেরে উঠবে না। কেউই তা পারবে না।
উঠে দাঁড়াল বিল। তুমি চুপটি করে এখানে বসে থাক, ড্যগ। আমি তোমার মালপত্র নিয়ে আসছি। টেবিলের ওপর লারকিন তার বিরাট হাত দুটো রাখল। শোন, ড্যগ। এখানে চমৎকার একটা বাড়ি রয়েছে। প্রচুর আলো-বাতাস খেলে, যাদের ফুসফুসের দোষ আছে জায়গাটা তাদের জন্যে স্বাস্থ্যকর। দু-চারদিন থাক সেখানে, আরাম কর, তারপর ভেবেচিন্তে দেখা যাবে ছেলেটার জন্যে কী করা যায়। তুমি মরে গিয়ে ওর ক্ষতি ছাড়া কোন উপকার করতে পারবে না।
দরজায় গিয়ে একটু থামল সে। মরুভূমিকে তুমি একসময় ভালবাসতে, ড্যগ। এখন একেও সুযোগ দাও তোমার জন্যে কিছু করার।
বেরিয়ে গেল লারকিন। বাবা ফ্যালফ্যাল করে একটুক্ষণ চেয়ে রইলেন তাঁর কফির দিকে, তারপর চুমুক দিলেন। খানিক পর আরেক চুমুক। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ভুলেই গেছেন আমার অস্তিত্ব।
আমার পেছনের জানালাটা খোল, কোরালের কাছে কয়েকজনের গলা শুনতে পেলাম।
..ওর মালপত্রগুলো নিয়ে যাচ্ছি। হ্যাঁ, ওরা অপেক্ষা করে আছে। বেলা ইউনিয়ন অফিসে ওদের দেখা পাবে তোমরা। একটা উপকার করবে, আচ্ছা-ওদেরকে কিছু বলবে না।
হিউজ কী বলল শুনতে পেলাম না আমি, তারপর আবার ভেসে এল লারকিনের গলা। পথে কেমন ছিল ওর অবস্থা?
খারাপ, খুব খারাপ। তবে কলোর্যাডো নদীর এপারে আসার পর থেকে কাশিটা একটু কমেছে।
ওয়াগন থেকে মালপত্র নামাতে নামাতে লারকিন বলল, কারোকে কিছু বলবে না, আচ্ছা?
অন্যদের ব্যাপারে কথা দিতে পারব না আমি। কানাঘুষা কিছু হবেই।
কফিপান সেরে বাইরে গেলেন বাবা, আমি অনুসরণ করলাম। সিঁড়ির গোড়ায় অপেক্ষা করছিল লারকিন।
ড্যগ, তোমার জন্যে চমৎকার একটা বাড়ি ঠিক করে রেখেছি আমি। পুরনো আমলের এডৌব; এখন তুমি ঘোড়ায় চড়তে পারলেই, কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে সেখানে।
আমরা যখন স্যাডলে চাপলাম, আকাশছোঁয়া একটা পর্বত অভিমুখে আমাদের নিয়ে চর্মল সে। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার, গা-ছমছমে পরিবেশ। বিল লক্ষ করল আমি ঘন ঘন তাকাচ্ছি পাহাড়টার দিকে। বাছা, টাস্কুইস্ ওখানেই থাকে। অন্তত ইন্ডিয়ানদের তাই বিশ্বাস।
ইন্ডিয়ান মেয়েদের ধরে ধরে খেয়ে ফেলত ও। তারপর একদিন কয়েকজন ইন্ডিয়ান যুবক তাড়া করল ওকে, যেখানে ও থাকে সেই গুহাটা আবিষ্কার করল। শোনা যায়, ওরা নাকি অসংখ্য হাড়গোড় দেখতে পেয়েছিল ওই গুহায়। ওদের বিশ্বাস, পরে এক ইন্ডিয়ান যুবক দেয়াল তুলে ওখানেই আটকে রেখেছে ওকে। তোমার বাবা জানেন গল্পটা।
শুনেছি আমি। আচ্ছা, আপনি বিশ্বাস করেন এসব?
বাছা, এরকম নির্জন পরিবেশে কিছুদিন থাকলে তুমিও বিশ্বাস করতে শুরু করবে।
রাতের আকাশের পটভূমিতে নিরেট কালোলা দেখাচ্ছে পাহাড়টাকে, মাথার ওপর ঝুলে রয়েছে অগুনতি তারা। টাহকুইৎসয়ের কথা ভাবলাম আমি, শিউরে উঠলাম ভয়ে। এখনও কি ওই পাহাড়ে আছে সে? ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্যানিয়নে ক্যানিয়নে? নাকি গুহাতেই আটকা রয়েছে, আপ্রাণ চেষ্টা করছে পালানোর?
.
০৭.
গুটিকতক নিচু বালিয়াড়ির মাঝ দিয়ে আমাদেরকে ছোট্ট একটা বাড়িতে নিয়ে এল বিল লারকিন। এর সীমানা লম্বা লম্বা ক্যাকটাস গাছে ঘেরা।
অকটিয়ো, ব্যাখ্যা করল লারকিন, খুব ভাল বেড়া হয়।
ওর পেছনে বসেছি আমি, কোমর জড়িয়ে ধরে। বাবা গজ কয়েক তাতে আরেকটা ঘোড়ায় চেপে আসছেন। বাছা, বলল, বিল, তোমার বাবাকে যেভাবেই হোক ধরে রাখতে হবে এখানে। উনি অসুস্থ। একমাত্র এখানকার জলবায়ুই যা একটু উপকার করতে পারবে ওঁর।
উঠনে রাশ টানল ও, নিজে নেমে আমাকেও নামাল পাঁজাকোলা করে।
খানিক বাদেই এসে পড়লেন বাবা, একটুক্ষণ বসে রইলেন ঘোড়ার পিঠে যেন শক্তি সঞ্চয় করছেন, তারপর নামলেন সাবধানে।
ঘোড়া আমি তুলে রাখছি, ড্যগ। দরজার ঠিক ভেতরেই টেবিল। মোম আছে ওখানে। ডান দিকে।
মোট তিনটে কামরা বাড়িটায়। অত্যন্ত ছোট ছোট দুটো বেডরুম, আর একটা বিরাট লিভিংরুম-কাম-কিচেন। বড়সড় একটা ফায়ারপ্লেস, টেবিল আর খান দুই চেয়ার আর বেঞ্চি রয়েছে এ-ঘরে। একটা চেয়ার রীতিমত ঢাউস, আজ পর্যন্ত আমি যেগুলো দেখেছি নিঃসন্দেহে সেগুলোর দ্বিগুণ হবে।
জ্বলন্ত মোমহাতে থমকে দাঁড়ালেন বাবা, অপলকে তাকিয়ে রইলেন সেই চেয়ারটার দিকে।
কামরার মেঝে মার্বেলপাথরের, কোনরকম আস্তর করা হয়নি, অথচ কেমন সুন্দর জোড়া লেগে রয়েছে পরস্পর।
অ্যগুয়া ক্যালিয়েন্তে বিশেষ কিছু নেই, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল বিল লারকিন। গোটা কয়েক ঝরনা, ইন্ডিয়ানরা আসে, একটা স্টেজ স্টেশন, যদিও কোন স্টেজ আসেনি আজতক, মূলত স্টোর, আর পোস্ট অফিস হিসেবেই ব্যবহৃত হয় ওটা। কালেভদ্রে দু-চারটে চিঠিপত্র আসে।
আশপাশের মাইনিং ক্যাম্পগুলোতে কিছু শ্বেতাঙ্গ রয়েছে। আর আছে ইন্ডিয়ান, অধিকাংশই কাউইয়া। ওদের বেশির ভাগ পাহাড়ে থাকে, স্যান্তা রোসায়।
ওরা তোমাকে চেনে, ড্যগ। কাজেই কোন ক্ষতি করবে না তোমার। তা ছাড়া যদিন এ-বাসায় আছ ইন্ডিয়ানরা তোমার ধারে কাছেও ঘেঁষবে না।
কেন, বাড়িটা আবার কী দোষ করল? এত মজবুত করে বানানো!
এই তল্লাটে এরকম আর একটাও পারে না। তবু কেউ এখানে থাকে–ভৌতিক বলে দুর্নাম আছে।
বাইরে গেল লারকিন, ফিরে এল দুটো ব্ল্যাংকেট রোল নিয়ে। বিল, বাবা বললেন, তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না।
থাক, আর লজ্জা দিয়ো না। যেদিন তুমি আমাকে গ্রিজলির কবল থেকে বাঁচিয়েছিলে, সেদিনই তোমার কাছে ঋণী হয়ে গেছি আমি।
খানিক বাদে বিদায় নিল ও, আমি দেখলাম ধূসর আকাশ আর সাদা বালিয়াড়ির পটভূমিতে ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে ওর গটু কালো অবয়ব।
বাবা শুয়ে পড়েছেন, নিশ্বাসের আওয়াজে বুঝলাম ঘুমোচ্ছেন। রাতের বেশি সময় জেগে কাটিয়েছি আমি, তবু ক্লান্তি লাগছে না একটুও।
আচ্ছা, কী এমন রহস্য আছে এ-বাড়ির? কেউ থাকে না কেন? আবার তাকালাম আমি ঢাউস চেয়ারখানার দিকে? ওটাই কি না থাকার কারণ? ওই চেয়ারের বেঢপ আকৃতি দেখে ভয় পায় লোকে?
এ-বাড়ির সবকিছুতেই চাতুর্যের ছাপ রয়েছে। আলমারিগুলো এমনভাবে বসানো হয়েছে দেয়াল কেটে, প্রথম দেখায় আলাদা করে বোঝাই যায় না ওগুলোর অস্তিত্ব। বাড়ির একটা অংশ অত্যন্ত পুরনো। এখানে-সেখানে মেরামতের চিহ্ন চোখে পড়ল আমার।
বাইরে, পেছন দিকে, শুধু স্ট্যাবল নয় কোরালও আছে। দুটো ঘোড়া রয়েছে ওখানে, আমাদের ব্যবহারের জন্যে রাখা হয়েছে।
বাবা তার গানবেল্ট খুলে কাছেই একটা চেয়ারের পিঠে ঝুলিয়ে রেছেন। তাঁর রাইফেল আর শটগানটাও আছে ওখানে। দরজার মাথায় গোটানো পর্দা দেখতে পেলাম আমি, সন্তর্পণে গিয়ে নামিয়ে দিলাম ওটা।
এটাই এখন আমার বাসা। কতদিনের জন্যে জানি না, কেবল এটুকু বুঝতে পারছি ভয়ঙ্কর সেই বুড়োর কাছে যাওয়া চলবে না আমার।
টেবিলের ওপর পাউরুটি রয়েছে, পাশে ছুরি। পুরু একখানা স্লাইস কেটে নিয়ে ফের সদর দরজায় ফিরে এলাম আমি, উঠনের দিকে তাকালাম।
এর চারপাশে অকটিয়োর বেড়া; ছুঁচোল কাঁটাগুলো মুখ বের করে আছে। হালে বৃষ্টি হয়েছে এদিকে, কচি পাতা বেরিয়েছে গাছের, উজ্জ্বল লাল ও দেখলাম কিছু। ঠীয় ওখানে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, মাঝে মাঝে কামড় বসাচ্ছি রুটিতে, আর চেয়ে আছি সামনের সাদা মেঠো উঠনের দিকে।
অকটিয়োর বেড়াটা যেখানে ভাঙা, তার পাশেই গ্রীজউড ঝোপ। তাকালাম ওটার দিকে, চোখ সরাতে গিয়েই ঝট করে থেমে গেলাম।
কী যেন আছে ওখানে। ঝোপের পেছনে একটা নগ্ন পা দেখতে পেলাম আমি, বালুর রঙ যেমন, প্রায় তেমনি সাদা। আর এক প্যান্টের নীচের অংশ।
পলক তুলতেই দেখলাম আরেক জোড়া চোখের পানে চেয়ে আছি আমি। মিশকালো এক জোড়া চোখ।
ওগুলোর মালিক একটি ছেলে। বয়েসে আমার চেয়ে বড় হবে না।
.
০৮.
ভয় আর কৌতূহলে ঢিপঢিপ করছে আমার বুক, জায়গায় জমে গেছি। উঁচু হয়ে বসে আছে অচেনা ছেলেটা, পাতার ফাঁক দিয়ে দেখছে আমাকে। আর আমি ভয় পাচ্ছি।
না ভয় পাচ্ছি না আমি। আমি ড্যান ও’হারা, মনে মনে বললাম নিজেকে, আমি কোনকিছুকে ভয় করি না।
গায়েগতরেও ছেলেটা বড় হবে না আমার চেয়ে। অনায়াসে বসিয়ে দিতে পারব কয়েক ঘা। তারপর ও যখন ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল ঝোপের পেছন থেকে, আমি ভাল করে তাকালাম ওর দিকে। শ্যামলা রঙ, বেশ শক্তপোক্ত। দেখে বোঝা যায় চালু মাল। নাহ, ওর সাথে বোধহয় এঁটে উঠতে পারব না আমি।
হ্যালো বললাম।
বুয়েনোস ডায়াস।
এক কদম আগে বাড়ল ছোকরা। আমি বুঝতে পারছি না কী করব। শেষমেশ চোখেমুখে ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব ফুটিয়ে তুলে বসে পড়লাম হাঁটুর ওপর, গাছের পলকা ডাল ছিঁড়ে নিলাম একটা। ওটা দিয়ে বালুতে লম্বা চুলওয়ালা মাথা আঁকরলাম আমি, তারপর টুপি বসিয়ে দিলাম সেই মাথায়। এসব ক্ষেত্রে কী বলা বা করা উচিত কিছুই জানা নেই আমার। এ-বয়েসের আর ছেলেরা কী করে তাও জানিনা। এবার, একেএকে চোখ আর ভুরু আঁকরলাম, তারপর দুটো কান জুড়ে দিলাম ছবিতে।
কী করছ তুমি? ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল ছেলেটা।
ছবি আঁকছি।
ঝুঁকল সে, একনজর দেখল ছবিটা। আমার?
হ্যাঁ।
মুখ কই? এটার তো মুখ নেই কোন। আমার আছে।
ডালটা বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে। নাও তুমিই আঁক।
ও নিল ডালটা, দ্বিতীয়ার চাঁদের মত মুখ আঁকল, কোণ দুটো ওপর দিকে উঠানো। আমি দেখলাম মুখখানা হাসছে।
চমৎকার! প্রশংসা করলাম।
পাশাপাশি বসে রইলাম আমরা দুজন, সন্তোষের সঙ্গে দেখছি আমাদের আঁকা, ছবিটাকে।
তোমার বাড়ি এখানে?
আমি যখন যেখানে থাকি সেটাই আমার বাড়ি।
কেন, বাঁধা-ধরা কোন বাসা নেই?
বাতাসে হাত খেলাল ছেলেটা। আছে, ওদিকে। তারপর গর্বের সুরে যোগ করল, আমি ফ্রান্সিসকো।
আমি ড্যানিয়েল। সংক্ষেপে ড্যান।
কাঁধ ঝাঁকাল ছেলেটা। আর কিছু?
ওকে একটু অদ্ভুত মনে হলো আমার। স্বভাব-চরিত্র তেমন কিছুই আঁচ করতে পারছি না। কোথাও যাচ্ছিলে?
না। এখানেই আছি। থামল ছেলেটা। আর তুমি? এখানেই থাকবে তো?
জানি না। লস এঞ্জেলেসে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সেখানে গেলে বিপদ হবে আমাদের।
এখানে থাক, যদি ভয় না পাও।
আমি ড্যান, আমি ভয় পাই না। তারপর, একটু বিরতি দিয়ে, কাকে ভয় পাব?
কেন, এই বাড়িটাকে। কেউ থাকে না এ-বাসায়। এটা টাহকুইৎসয়ের বাড়ি।
কী? অবাক হালাম আমি। ইশারায় পাহাড়পর্বতগুলো দেখালাম। টাহকুইৎসয়ের বাড়ি ওখানে। প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাড়ি কোথায়, এখানে?
শ্রাগ করল ফ্রান্সিসকো। বললাম, না, সব জায়গায়ই আমার বাড়ি, একখানে থাকলেই হলো। কখনও পাহাড়ে থাকি…কখনও মরুভূমিতে।
ইন্ডিয়ানদের ভয় পাও না?
ও তাকাল আমার দিকে। কেন, আমি নিজেও তো ইন্ডিয়ান। কাউইয়া।
কাল রাতে আমি ইন্ডিয়ান ওয়েলসয়ে পানি খেতে নেমেছিলাম। একজন ইন্ডিয়ান বুড়োকে দেখলাম। কথা বলেনি।
উঠে দাঁড়াল ফ্র্যান্সিসকো। আমি এখন যাই।
আবার আসবে তো?
আমি যাচ্ছি।
চলে গেল ও, প্রথমে ধীর পায়ে, তারপর হনহন করে। এবং একটিবারও তাকাল না পেছন ফিরে।
আমি যখন ফিরে এলাম ভেতরে, আলোয় ঘর ভরে গেছে। এবারই প্রথম মেঝেটা দেখলাম ভাল করে। সাদামাঠা, অথচ তাতেই কী সুন্দর! মাঝখানে কালো। একটা পাখির ছবি, ভানা মেলে রয়েছে, আর এর চারপাশে সূক্ষ্ম কারুকাজ। পাখিটা দেখতে অনেকটা কাকের মত।
বেঞ্চিতে বসে, কারুকাজগুলোর দিকে তাকালাম আমি। ডানার খুঁটিনাটি সমস্ত বৈশিষ্ট্যই ধরা পড়েছে এতে। পাখির চোখের জায়গায় রয়েছে ছোট্ট দুটে! লাল পাথর।
শোবার ঘর থেকে ডাকলেন বাবা। কে…ড্যান? ভাল আছিস তো, বাছা?
হ্যাঁ, বাবা। মেঝের পাখিটা দেখছি।
কার যেন গলা পেলাম মনে হলো।
ফ্র্যান্সিসকো। ইন্ডিয়ান। আমার বন্ধু হয়েছে।
এ-ঘরে এলেন বাবা, সদর দরজার কাছাকাছি গেলেন। রোদ উঠলে, দরজা বন্ধ করে দিস। ভেতরটা ঠাণ্ডা থাকবে। হামেশা যা করেন, আমার কাঁধে হাত রাখলেন তিনি। বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সবাই পায় না। এরপর মেঝের দিকে চোখ পড়ল তাঁর। অপূর্ব! অস্ফুট স্বরে বললেন।
গোড়ালির ওপর বসে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেঝেটা পরীক্ষা করলেন তিনি। আঙুল বোলালেন মার্বেলপাথরের গায়ে। সত্যিই অপূর্ব!।
ওটা টাহকুইৎস্। এই বাড়িটা ওর।
ঝট করে চোখ তুললেন বাবা। মানে?
হ্যাঁ। ফ্রান্সিসকোই বলল। টাহকুইৎসয়ের বাড়ি এটা, তাই কেউ থাকে না। যদিও বহুকাল আগে চলে গেছে সে, এবং আর ফিরে আসেনি।
নকশাটা আরেক নজর দেখলেন বাবা। টাহকুইৎস কিনা জানি না, আনমনে। বললেন, তবে এই কারুকাজগুলো যে একজন মানুষের করা তাকে সন্দেহ নেই। এবং লোকটা শিল্প বোঝে।
.
আস্তে আস্তে গড়িয়ে যাচ্ছে, দিন। টাহকুইৎসয়ের বাসায় আমাদের আসা তা প্রায় কয়েক হপ্তা হয়ে গেছে। মাঝেসাঝে উঠনে গিয়ে খেলা করি আমি, ছোট্ট নীল একটা টিকটিকির সাথে মিতালি হয়েছে, আবার কখনও-সখনও বেড়াতে যাই বালিয়াড়িতে। সকালের রোদে বাইরে বসে আরাম করেন বাবা, বিকেলে বইপত্তর পড়ে সময় কাটান। মাঝে-মধ্যে, বেলা ডোবার পর, বেড়াতে বেরোন আমাকে নিয়ে। যখনই ইন্ডিয়ানদের সাথে দেখা হয় আমাদের, বাবাকে সমীহ করে কথা বলে ওরা, তবে আমাদের বাসায় কখনও আসে না।
সাথে পিস্তল ছাড়া বাবা বাড়ির বাইরে যান না কখনও। আমাকে বলে রেখেছেন, অচেনা কারোকে দেখলেই যেন তক্ষুণি তাকে জানাই খবরটা।
এরমাঝে আমাকে একবার ফায়ারপ্লেসের ধারে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা। এর একটা ইট আলগা করে ফেলেছেন তিনি। তার পেছনে লোহার বাক্স রয়েছে একটা i
এটার কথা কারোকে বলবি না। তোর প্রাণের বন্ধুকেও না। এতে কিছু টাকা আছে। ভবিষ্যতে তোর দরকার পড়বে।
.
০৯.
ঠিক এক মাসের মাথায় বিল লারকিন ফিরে এল। সাবধান, ঘরে ঢুকেই বলল সে, ওরা আসছে।
বস, বিল। একটু বিশ্রাম নাও; কফি খাবে?
সময় নেই, ড্যগ। ওরা খুব বেশি হলে মাইল দুয়েক পেছনে রয়েছে।
তবু আছে সময়। যাও, তোমার ঘোড়াটা কোরালে রেখে এ গিয়ে। নিষ্কম্প হাতে নিজের কাপটা তুলে নিলেন বাবা। কজন?
পাঁচ, কমপক্ষে। বেশিও থাকতে পারে।
দ্রুত বাইরে বেরিয়ে গেল লারকিন, আমি টের পায় কোরালে ঘোড়া তুলে রাখছে। আবার যখন ফিরে এল সে, ঘামছে দরদর করে।
বিল, বাসার ভেতরে পানির ব্যবস্থা আছে, খাবারও আছে। এই বাড়িটা প্রায় দুৰ্গের মত। কাজেই ভয়ের কিছু নেই।
ধপ করে বসে পড়ল বিল, বারবার তাকাচ্ছে দরজার দিকে। পানির ব্যাপারটা আমিও জানি। সাধারণত এরকম দেখা যায় না। এই বাড়িটা যারই হোক, নিজের সুবিধার জন্যে সবরকম ব্যবস্থাই সে নিয়েছিল।
আমার পানে ফিরলেন বাবা। ড্যান তুই খাটের পেছনে গিয়ে চুপটি করে মেঝেতে বসে থাক।
আমি তোমার কাছে থাকব।
না বাছা, যা বললাম আমি; তাই কর।
আমি তোমাকে গোলাবারুদ এগিয়ে দিতে পারব।
তা হয়তো পারবি। সেটা পরে দেখা যাবেখন।
লারকিন তাকাল, আমার দিকে। ছেলেটার ভয়-ডর বলে কিছু নেই মনে হচ্ছে?
দেখতে হবে না কার ছেলে বললেন বাবা। সহসা গর্বে ফুলে উঠল আমার বুক, যদিও ঠিক সেই মুহূর্তে একটু ভয়-ভয় করছিল।
বাইরের উঠনে ওদের ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পেলাম আমরা। আমি প্রার্থনা করলাম, আমার নীল টিকটিকিটা যেন লুকিয়ে পড়ে কোথাও গিয়ে।
কে আছে বাসায়!
জানালা দিয়ে একবার উঁকি মেরে, দরজার উদ্দেশে এগিয়ে গেলেন বাবা। ওরা আসলে জানে না আমিই থাকি এখানে, বিলকে বললেন তিনি। খামোকা সন্দেহের ভেতর রেখে লাভ কী?
কবাট খুললেন তিনি। বাইরে গেলেন না, দোরগোড়ায় একটু ভেতরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
এই যে, তুমি! বক্তা একজন অ্যাংলো, বিশাল শরীর, পরনে ডোরাকাটা শার্ট। আমরা ডগলাস ও’হারাকে খুঁজছি। তুমি দেখেছ ওকে?
দেখেছি একথা বলতে পারব না, নরম সুরে জবাব দিলেন বাবা, অন্তত আমি ঘুম থেকে ওঠার পর।
অ, তারমানে সে এখানেই আছে, না? এখানেই আছে?
হ্যাঁ, আছে। বাবা হাসছেন মিটিমিটি। তবে কয়েক হপ্তার জন্যে বোধহয় বাইরে যাবে।
কাঁধের ওপর দিয়ে চাপা গলায় তিনি বললেন, বিল, বাসার পেছনটা তুমি আগলাও।
তা শেষ কখন দেখেছ?
আজ ভোরে, যখন আয়নার দিকে তাকিয়েছিলাম। আমি শেভ করছিলাম।
কৌতুকটা বুঝতে একটু সময় লাগল ওঁদের। তারপর অ্যাংলোর পেছন থেকে এক মেক্সিক্যান বলল, ওই তো! ওই লোকই!
তুমি? তুমিই তা হলে ডগলাস ও’হারা?
শান্ত-ভঙ্গিতে ওখানে দাঁড়িয়ে রইলেন বাবা, হাসলে মুখ টিপে, তারপর আচমকা প্রশ্ন করলেন, কেন এসেছ?
তোমাকে খু–! আমি তখন নেহাত ছোট, তবু বুঝতে পারলাম লোকটা একেবারেই আনাড়ি। স্যাডলের ওপর আড়াআড়িভাবে নিজের রাইফেলটা ফেলে রেখেছিল সে, তুলতে যাবে ওটা এই সময় বাবা গুলি করলেন ওকে। পরক্ষণে তৃতীয় লোকটাকে খতম করলেন তিনি; কারণ দ্বিতীয়জন, যে তাকে চিনতে পেরেছিল সবার আগে, ততক্ষণে বাড়ির কোনা ঘুরে পেছনে চলে এসেছে।
বিলের রাইফেল গর্জে উঠল। ওটা রিলোড করতে নিল সে, আমি ইশারায় শটগানটা দেখিয়ে দিলাম।
সাবধানে, মাটিতে একটুও বারুদ না ফেলে, লারকিনের রাইফেলটা রিলোড করলাম আমি, তারপর মেঝে অতিক্রম করে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু হানাদাররা ইতিমধ্যে চম্পট দিয়েছে। যেখানে ফ্রান্সিসকোর ছবি এঁকেছিলাম আমি সেখানে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে অ্যাংলোটা, পাশেই আরেকজন। আর দুটো ঘোড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে উঠনে, ওদের স্যাডল শূন্য।
হঠাৎ উর্ধ্বশ্বাসে আমাদের সামনে দিয়ে ছুটে পালাল একজন ঘোড়াসওয়ার। বাবা অবাধে যেতে দিলেন, ওকে। লাভ নেই গুলি করে বললেন তিনি। ও এমনিতেই পালাবার জন্যে অস্থির হয়ে আছে। আর ফিরবে বলে মনে হয় না।
কয়েকটা আঙুল হারিয়েছে ব্যাটা, একগাল হাসল বিল লারকিন। স্যাডলের পেছনে গা ঢাকা দিয়েছিল আমি গুলি করে পমেলটা উড়িয়ে দিয়েছি আর সেই সাথে ওর কয়েকটা আঙুল।
থ্যাংকস, বিল আমার দিকে ঘুরলেন বাবা। তোকেও ধন্যবাদ, বাছা। তুই খুব ঠাণ্ডা। বিপদে যারা বুদ্ধি হারায় না, আমি তাদের পছন্দ করি।
আচমকা বসে পড়লেন তিনি, যেন কত ক্লান্ত। বিলের দিকে তাকালেন, মাথা, নাড়ালেন আপনমনে। আমার শক্তি শেষ হয়ে গেছে, বিল। দম পাই না।
তবু আগের চেয়ে তোমাকে অনেক ভাল দেখাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে সদর দরজাটা বন্ধ করে দিল লারকিন। তুমি যা-ই ভাব, এখানকার আবহাওয়াটা কিন্তু তোমার জন্যে উপকারী।
বোধহয়।
বেরিয়ে গেল বিল,আবার যখন বাইরে তাকালাম আমি, লাশ দুটো নেই, রক্তের দাগ মুছে ফেলা হয়েছে।
এরপর যখন ফের একা হলাম আমরা; বাবা বললেন, কারণ যা-ই হোক, মানুষ খুন করাটা খুব সুখের ব্যাপার নয়, বাছা। কিন্তু এ ছাড়া উপায়ও ছিল না কোন।
লোকটা কে বাবা? ডন?
না, তার ভাড়াটে গুণ্ডা।
ডন কি ভয় পান, তাই নিজে আসেননি।
না, বাছা। ভয় কী জিনিস উনি বোধহয় তা জানেনও না। সম্ভবত জানার সুযোগ ঘটেনি। এসব কাজ সারতে লোক ভাড়া করেন তিনি, যেমন করেন বুনো ঘোড়া কিংবা গরুবাছুর ধরতে।
এই ঘটনার প্রায় এক মাস পর আবার বিল লারকিনের দেখা পেলাম আমরা। বাদামি রঙের চমঙ্কার একটা গেল্ডিংয়ে চেপে এল সে। সাথে কিছু খাবারদাবার আর তিনটে বই এনেছে।
বাবা কেমন? জিজ্ঞেস করল ও।
একটু ভাল। কাশিটা কমেছে।
হুম। সবসময় তাজা বাতাসে তাকে নিয়ে ঘুরবে, বাছ। আর শোন, যত পার ওঁর কাছ থেকে দুনিয়ার হাল-হকিকত সম্পর্কে জেনে নাও। অনেক জানেন তোমার বাবা। ওঁর সঙ্গে কথা বললে তোমারই লাভ হবে।
তাই করছি আমি। রোজ বেড়াতে যাই বাবার সাথে। নানান বিষয়ে আলাপ হয় আমাদের। বেশির ভাগই ইন্ডিয়ানদের সম্পর্কে, কীভাবে ওদের বন্ধুত্ব অর্জন করতে হয়। আর মরুভূমির কথা, এখানে বেঁচে থাকার কলা-কৌশল।
দিন-দিন উন্নতি হচ্ছে বাবার শরীর। আজকাল আর অল্পতে হাঁপ ধরছে না। তার মাঝে সুস্থতার এই লক্ষণ দেখে আমিও আশান্বিত হয়ে উঠছি ক্রমশ। জানি বাবা কারও চিরকাল থাকে না, তবু যত বেশি কাছে পাব তাকে ততই আমার লাভ। মানুষের মত মানুষ হওয়ার জন্যে সত্যিকারের একজন শিক্ষক পাব আমি।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক।
সেদিন বিকেলে বেড়াচ্ছি আমরা, হঠাৎ বাবা বললেন, বাড়ি চল, ড্যান। আমার বোধহয় আবার জ্বর এল।
উঠনে ঢুকতেই দেখি ওরা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। মোট চারজন। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক নেতৃত্ব দিচ্ছেন ওদের। তাঁর মাথার সমস্ত চুল সাদা, মুখখানা কঠোর। আর চোখ দুটো নিষ্ঠুর। তিনি বললেন, ওই যে, এসেছে! খুন কর ওকে!
সার? শান্ত কণ্ঠে মিনতি করলেন বাবা, ছেলেটাকে ছেড়ে দিন। ও এখনও শিশু।
মেরে ফেল নেড়িকুত্তাটাকে, বললেন বৃদ্ধ; তারপর ওর ছানাটাকেও! এক্ষুণি!
কথা শেষ করেই ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। ধাক্কা দিয়ে আমাকে মাটিতে ফেলে দিলেন বাবা, ড্র করলেন। তার ডান হাতটা আমাকে বিপদ থেকে ঠেলে সরাতে ব্যস্ত ছিল, ফলে তিনি ড্র করলেন অপেক্ষাকৃত আস্তে। নিজে কোন গুলি ছুড়তে পারার আগেই-আমি দেখলাম-দুবার আঘাত পেলেন বাবা। তারপর গুলি করলেন, একবার, একটা লোক ধরাশায়ী হলো। তাঁর দ্বিতীয় বুলেটটা আমাদের দরজার চৌকাঠের চলটা খসাল, এরপর মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি।
ভাল করে দেখ মরেছে কিনা! শান্ত গলায় দলের লোকদের নির্দেশ দিলেন বৃদ্ধ। এসব ছুঁচোর প্রাণ সাপের চেয়েও শক্ত হয়।
আমার বাবাকে ঘিরে ফেলল ওরা, খুউব কাছ থেকে কয়েকবার গুলি করল তাঁর শরীরে। তারপর একজন পিস্তলটা তাক করল আমার দিকে।
এখানে না, বললেন বৃদ্ধ। ওকে আমরা মরুভূমিতে নিয়ে যাব। ওখানেই ভাল হবে।
আমাকে পাকড়াও করল এক লোক, আমি লাথি মারলাম তাকে। গোঁফের ফাঁক দিয়ে ভেংচি কাটল সে, সজোরে চড় মারল আমার গালে। আবার চেষ্টা করেই দ্যাখ, আমি তোর কান ছিড়ে নেব।
লোকটার নাকের বাঁশিতে গভীর একটা কাটা দাগ রয়েছে। আমার বাবাকে যারা গুলি করেছে ও-ও ছিল তাদের মধ্যে।
নিয়ে চল ওকে, অধৈর্য সুরে আদেশ করলেন বৃদ্ধ। এক্ষুণি চলে যেতে হবে আমাদের। ইন্ডিয়ানরা যে কোন সময়ে এসে পড়তে পারে।
আমরা ওদেরকেও খুন করব, বলল কাটা-নাক।
তুমি একটা গর্দভ! ওরা অনেক, আমরা কম। তা ছাড়া, একটু থেমে যোগ করলেন তিনি, ওরা ওকে ভালবাসত।
শক্ত করে ধরে আমার হাত মুচড়ে দিল কাটা-নাক, আমাকে ব্যথায় কোকাতে দেখে হাসল। তোকে হয়তো আমার হাতে ছেড়ে দেবেন উনি, বলল সে। তখন আমি তোকে চিংড়ি নাচ নাচাব।
প্রায় অন্ধকার এখন। জোরকদমে ছুটছে ওরা, ট্রেইল এড়িয়ে যাচ্ছে। সুদর্শন এক যুবক রয়েছে এই দলে। শীতল চেহারা। মাঝে মাঝে আমার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল সে। এবার বৃদ্ধকে বলল, যাক, কাজটা তা হলে হলো শেষপর্যন্ত। এখন এটাকে খতম করলেই ল্যাঠা চুকে যায়।
ও আমার, বলল কাটা-নাক।
ঝট করে স্যাডলের ওপর শরীর বাঁকা করলেন বৃদ্ধ। চুপ কর! ছোঁড়া এমনিতেই মরবে। আমরা ওকে মরুভূমিতে ফেলে রেখে যাব।
আমরা পুবে যাচ্ছি! আচমকা বলে উঠল সুদর্শন যুবকটি। এটা ভুল রাস্তা!
এটাই ঠিক রাস্তা, অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন বৃদ্ধ। ইন্ডিয়ানরা ভাববে আমরা গিরিপথ দিয়ে ফিরে যাচ্ছি। ওরা পিছু নেবে। কিন্তু অন্ধকারে আমাদের ট্র্যাক দেখতে পাবে না। কাজেই এটাই ঠিক রাস্তা।
ওরা যখন থামল তখন ক্ষীণ আলো রয়েছে, আকাশে। পরিবেশ নীরব-নিথর, আমাদের চারপাশে বালু ভাঙাচোরা পাথর আর কাটাঝোপ।
এখানে, বললেন বৃদ্ধ, ছেড়ে দাও ওকে। শত হলেও, ও আমারই রক্তের। যদি মরতেই হয়
খুন করুন ওকে, বলল যুবক। এখুনি!
না, জেদের সুর ফুটল বৃদ্ধের কণ্ঠে। যা করার মরুভূমিই করুক। আমি আমার নিজের রক্তকে শেষ করতে পারব না–সেটা দূষিত হলেও।
কাটা-নাক আমাকে ছুড়ে ফেলে দিল স্যাডল থেকে, তারপর এমনভাবে ঘুরিয়ে নিল ওর ঘোড়াটাকে যেন খুরের ঘায়ে আমি ভর্তা হয়ে যাই। কিন্তু চট করে গড়িয়ে, সরে গেলাম আমি, আত্মগোপন করলাম পাথরের আড়ালে।
ছেড়ে দাও ওকে! কুদ্ধ স্বরে আদেশ করলেন বৃদ্ধ।
রওনা হলো ওরা, আর আমি, রাগে অন্ধ, উঠে দাঁড়ালাম পাথরের মাঝ থেকে। বিদায় দাদু! বললাম চেঁচিয়ে।
কেমন-যেন কুঁকড়ে গেলেন মানুষটা, যেন কেউ তাকে চাবুক মেরেছে, কাঁধ ঝুলে পড়ল : ফিরতে নিয়েছিলেন দাদু। কিন্ত সেই যুবকটি বলল; ছোঁড়াটা বেয়াদপ! ওর বাপের মতই।
এরপর চলে গেল ওরা। আমি একা হয়ে গেলাম।
.
১০.
মরুভূমিতে পুড়ে রয়েছি আমি। একা। ফিসফিস করে অনবরত বলছি নিজেকে, আমি ড্যান ও’হারা। আমি কখনও ভয় পাই না।
আমার বাবা মারা গেছেন! ওরা খুন করেছে তাঁকে, আর আমাকে এখানে ফেলে রেখে গেছে মরার জন্যে।
কিন্তু আমি মরব না। বেঁচে থাকব। বেঁচে থাকব আমি, এরং তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মারব ওদের যারা আমার বাবাকে শেষ করেছে। আকাশের স্লান আলো এখন জোরাল হয়েছে আরেকটু। যেখানে লুকিয়েছিলাম খানিক আগে এখন সেই পাথরগুলোর মাঝে দাড়িয়ে আছি আমি। কৌতূহলভরে তাকাচ্ছি ইতিউতি।
শুধুই মরুভূমি, বালু আর ন্যাড়া পাথর। এখানে-সেখানে ক্যাকটাস। আমাকে যারা ধরে এনেছে সারা রাত পথ চলেছিল তারা, বলেছিল পুবে যাচ্ছে। কিন্তু আমি জানি, সরাসরি পুবে এগোয়নি অবশ্যি তাতে আসে যায় না কিছু। আমি ওদের ট্র্যাক অনুসরণ করব।
কতটা দূরে এসেছি আমরা? বেশ দ্রুত এগোচ্ছিল ওরা, ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দিতে হাঁটার পর্যায়েও চলার রেগ নামিয়ে এনেছিল কয়েকবার, তবে অধিকাংশ সময় এগিয়েছে বাবা যাকে বলতেন জোরকদমে।
দূরত্ব ব্যাপারটা আমি কিছু কিছু বুঝি। স্যান্তা-ফে থেকে পশ্চিমে এগোনোর সময়ে আমরা পথের হিসেব রেখেছিলাম। আমাদের স্কিপার, কিম হিউজ, প্রায়ই বলত দিনে কতটা পথ চলতে হবে তাকে, কিংবা ক-মাইল পাড়ি দেয়া হয়েছে। আমার অনুমান আমাকে ওরা মরুভূমির চল্লিশ মাইল ভেতরে নিয়ে এসেছে। ঘোড়াসওয়াররা ভেবেছিল হাঁটার পক্ষে পথটা দুস্তর, বিশেষ করে একজন বাচ্চাছেলের জন্যে। কিন্তু ওয়াগনের পেছন পেছন বহুবার হেঁটেছি আমি, তাই দূরত্বটা বেশি মনে হচ্ছে না।
গরম পড়বে। সুতরাং হাঁটতে হলে এখুনি, আবহাওয়া ঠাণ্ডা থাকতে থাকতে। দিনের যে-সময়টা সবচেয়ে গরম, হিউজ তার ঘোড়াগুলোকে বিশ্রামে রাখত তখন। যাত্রা শুরু করত সে বেলা ডোবার পর। যখন শীতল থাকবে আবহাওয়া, আমি হাঁটব; অন্য সময় জিরোব।
কোথায়? তা আমি জানি না এ-মুহূর্তে।
ফ্রান্সিসকো হলে কী করত? আমি যা করছি তাই। হাঁটত। এ ছাড়া আর কী?
বালুতে ট্রাক রয়েছে ওদের ঘোড়ার। ওগুলো অনুসরণ করে আমি ফিরে যাব টাহকুইৎসয়ের বাসায়।
আস্তে আস্তে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিলাম কোথায় আছি আমি। এখান থেকেই শুরু করতে হবে যাত্রা, আমার নতুন জীবন আর কদিনের মধ্যে সাতে পা দেব আমি। এবং কয়েক বছরের মধ্যেই বড় হয়ে যাব, প্রতিশোধ নেয়ার মত যথেষ্ট বড়। তিনজন লোককে দেখা দেব আমি। বৃদ্ধ ডন, সুদর্শন যুবক আর সেই কাটানাককে।
আমার মায়ের শিক্ষা কখনও কারোকে ঘৃণা করতে নেই। ঘৃণা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। তবু ঘৃণা করব আমি। মা আমার মারা গেছেন, বাবাকে খুন করা হয়েছে। জগতে এখন আপন বলতে আমার আর কেউ নেই।
পা দুটো আমার বেজায় ছোট। মনে হলো ওগুলো যদি আরেকটু লম্বা হত ভাল হত তাহলে। লম্বা লম্বা পা ফেলতে চেষ্টা করলাম আমি। পেছনে সূর্য উঠি-উঠি করছে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ট্র্যাক, কোথাও জ্বলজ্বল করছে, কোথাও বা সামান্য ঝাপসা। বাবা আমাকে একটু-আধটু ট্র্যাক করা শিখিয়েছেন, তবে এক্ষেত্রে তার প্রয়োজন পড়বে না।
পানি নেই আমার কাছে। এখানে আসার পথে কোন ঝরনায় থামিনি আমরা। এদিকে আমি এর আগে আসিওনি কোনদিন। তাই জানি না কোথায় মিলবে পানি। তেষ্টা পেয়েছে আমার, তবে ভয় পাওয়ার মত কিছু নয়। ধৈর্য ধরব আমি; এবং হাঁটব।
আমি ডালাস ও’হারা; বললাম জোরে জোরে। আমি ভয় পাইনি।
পরমুহূর্তে অদ্ভুত এক অনুভূতি গ্রাস করল আমাকে। চকিতে থমকে দাঁড়িয়ে তাকালাম আশপাশে। প্রায় সাদা হয়ে গেছে বালু, খানিক আগেও যেসব পাথরকে কালো দেখাচ্ছিল এখন সেগুলো খয়েরি। আকাশ গাঢ় নীল; একচিলতে মেঘও নেই। এসময় ভয় পাওয়াই উচিত আমার, কিন্তু তা পাচ্ছি না। চারধারের সবই যেন পরিচিত ঠেকছে, যদিও আগে কখনও এগুলোর কিছুই আমি দেখিনি, এবং এখানে এসেছি রাতের আঁধারে।
চ্যাপটা একটা পাথরের ওপর বসে পড়লাম। এটাই আমার বাড়ি, আমার দেশ। মা ভালবাসতেন মরুভূমি, বাবা থেকেছেন, একে আর এর অধিবাসীদের ভালবেসেছিলেন তিনি। হয়তো এজন্যেই, তবে আমার বিশ্বাস আরও কিছু আছে এর পেছনে। আমি অনুভব করলাম আমার জন্মই হয়েছে এই কারণে, মরুভূমিতে বাস করতে, এর অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ হতে।
আবার যখন শুরু করলাম হাঁটা; তাড়াহুড়ো করলাম না। একটা আশ্রয় খুঁজে বের করতে হবে আমাকে, এবং রাত নামার আগেই পানি। সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা এখনও আছে আমার মাঝে, মনে হচ্ছে আমি একা নই, এই মরুভূমিই আমার সহায়–আমার বন্ধু!
আশ্রয় খুঁজতে শুরু করলাম। নেই। ভাবলাম গাছের ডালপালা টেনে নিয়ে ছাউনিমত বানিয়ে ঢুকে পড়ব তার নীচে, কিন্তু সবকিছুই এখানে শক্ত এবং কাঁটা আছে।
জশুয়া গাছের ছায়াগুলো ছোট। দুপুর প্রায়, অথচ এখনও কোন আশ্রয়ের হদিস পাইনি আমি। এদিকে গলা শুকিয়ে খটখট করছে। অগত্যা ছোট্ট একটা নুড়ি কুড়িয়ে নিয়ে হাতে রাখলাম, যখন ঠাণ্ডা হলো কিছুটা মুখে পুরলাম ওটা। এতে তেষ্টা মিটবে খানিকক্ষণের জন্যে। হোঁচট খেলাম আমি।
ছোট জাতের কোন পাখি এই পথে দৌড়ে গেছে আমার আগে। দূরে, দক্ষিণপশ্চিম দিকে, পাহাড়পর্বত দেখতে পাচ্ছি। আচ্ছা, ওগুলোই কি আমাদের পাহাড়? নিশ্চয় তাই হবে। কতদূর হেঁটেছি, জানি না। আমি বসে পড়লাম আবার।
ছায়া দেখে বুঝতে পারলাম এখন দুপুর, আমি হাঁটছি সেই ভোর থেকে। আর অল্পক্ষণের ভেতর, যেভাবেই হোক, বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে আমাকে। পানি ছাড়া মানুষ বেশি সময় বাঁচতে পারে না।
যে-ট্র্যাকগুলোর ট্রেইল অনুসরণ করছিলাম, শুকনো, একটা খাঁড়িতে নেমে গেল সেটা। খাঁড়ির ওপাশটা খাড়া। ওখান থেকে যখন উঠে এলাম, ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমি। আর ঠিক তখুনি চোখে পড়ল পাথরস্তূপটা। খুব বেশি উঁচু নয়, তবে একটার মুখ সামান্য বেরিয়ে থাকায় ছায়ামত সৃষ্টি হয়েছে। কাছে যেতে, পাথরটার পেছনে গর্ত দেখতে পেলাম একটা। পাছে সাপখোপ থাকে, তাই সাবধানে পরখ করলাম ওটা। একটা ডাল কুড়িয়ে নিয়ে খোঁচা দিলাম গর্তের ভেতরে।
নেই কিছু…।
গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়লাম ভেতরে গিয়ে। পেছনের ফাটল দিয়ে মৃদু হাওয়া আসছে, আরাম লাগছে শরীরে।
একসময় নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি, কারণ যখন চোখ মেললাম আবার, বেশ ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে প্রকৃতি, সূর্য ডুবে গেছে। বাইরে এসে নজর বোলালাম চারপাশে। শুধুই মরুভূমি, অন্তহীন। সাপখোপ আছে কিনা যে-ডালটা দিয়ে দেখেছিলাম সেটা তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
বাতাসে বালু উড়ে এসেছে ট্র্যাকের ওপর। এখন আর তত স্পষ্ট দেখাচ্ছে না ওগুলো। সহসা ভয়ে কেঁপে উঠল আমার বুক। যদি পথ হারিয়ে ফেলি?
থমকে দাঁড়ালাম আমি, মনে পড়ল কী বলেছিল জর্জ বুশ। সবসময় পথের হদিস রাখবে। বুঝতে চেষ্টা করবে কোথায় আছ তুমি।
আমি জানি কোথায় অস্ত গেছে সূর্য, তারমানে ওটাই পশ্চিম। এর অর্থ আমি দক্ষিণ দিকে মুখ করে রয়েছি। দূরে উঁচু নিচু একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে, সরাসরি দক্ষিণে রয়েছে ওটা। এগোলাম সেদিকে, রাত নামল, যে-পাহাড়টা লক্ষ্য করে এগোচ্ছি তার মাথার ওপর একটা তারাকে বেছে নিলাম পথের দিশা হিসেবে।
রাতে ঠাণ্ডা হয়ে যায় মরুভূমি, শিগগিরই শীত করতে লাগল আমার, তবু হাঁটতে লাগলাম। কাছেপিঠে কোথাও কয়ৌট ডাকল, গাছের ডালটা শক্ত মুঠিতে আঁকড়ে ধরলাম আমি।
মুখ শুকিয়ে গেছে আমার। ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। বুকভরে ঠাণ্ডা নির্মল বাতাস টানলাম, পানির স্বাদ পেলাম যেন, এতই তাজা। হাঁটতে হাঁটতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল আমার, চ্যাপ্টা একটা পাথর পেয়ে বসে পড়লাম তার ওপর। কয়ৌটগুলো ধারেকাছে ঘুরঘুর করছে, বোধহয় পিছু নিয়েছে আমার।
.
আমার ঘুম ভাঙল যখন ভোরের প্রথম আলো ফুটেছে পুবাকাশে। উঠে দাঁড়ালাম আমি, ভয়ানক আড়ষ্ট আর ক্লান্তি বোধ করছি। এবং খিদেও পেয়েছে, তবে মনেপ্রাণে যে-বস্তুটি পেতে চাইছি সেটা পানি।
বাবা বলেছিলেন ব্যারেল ক্যাকটাসে পানি মেলে, কিন্তু এদিকে দেখতে পাচ্ছি না। সেরকম কিছু। কেবল শক্ত শুকনো ডালপালা আর মাঝেসাঝে রোদজ্বলা ঘাস।
কোন পাহাড়টার দিকে হাঁটছিলাম রাতে এখন আর তা বোঝার জো নেই। দিনের আলোয় আমার দিশারি নক্ষত্রটিও বিদায় নিয়েছে। ট্রাকগুলো খুঁজে পেলাম না। আর, তবে আমি দেখতে পাচ্ছি কোথায় উঠছে সূর্য, তাই ফের রওনা হালাম দক্ষিণে। সবে কয়েক কদম গেছি, হঠাৎ বালুতে কয়ৌটের ট্র্যাক চোখে পড়ল আমার। তাজা ট্র্যাক, অল্প কিছুক্ষণ আগের।
ছোট একটা চড়াইয়ের মাথায় উঠে বসে পড়লাম আমি। পা ব্যথা করছে, শরীর চলতে চাইছে না আর। আবার একটা নুড়ি পুরলাম মুখে, কিন্তু বিশেষ কাজ হলো না। সূর্য এখন মাথার ওপর, গনগন করছে।
তাপতরঙ্গ নাচছে মরুভূমিতে। দূরে নীল পানির মরীচিকা দেখতে পাচ্ছি। সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অজস্র পাথর, আর ঝোপঝাড়। এবং এর পেছনেই, স্যান হ্যাকিন্টোস, কিন্তু আমার কাছে ওটাকে মনে হচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
খানিক বাদে হাঁটতে শুরু করলাম আবার, ট্র্যাকগুলোর দেখা পেলাম। আমি এগোলাম ওগুলো ধরে, একবার পড়ে গেলাম হোঁচট খেয়ে, যখন উঠলাম বালু থেকে, আমার হাত ছুড়ে গেছে কাকরের ঘষায়।
বেশকিছু পুরনো ট্র্যাক রয়েছে এখানে। প্রাচীন কোন একটা ট্রেইলে রয়েছি আমি, সোজা চলে গেছে আরও তপ্ত মরুভূমির দিকে, তবে এর শেষমাথায় রয়েছে পাহাড়। জিভ শক্ত হয়ে গেছে আমার, ঢোক গিলতে পারছি না। চোখ ব্যথা করছে, জ্বর-জ্বর লাগছে গা। শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু বালু তেতে আছে আগুনের মত।
অনেকক্ষণ থেকে শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম একটা, ঢাক পেটার মত,,এবার সেটা ঘোড়ার আওয়াজে পরিণত হলো। আমি ঘুরে দাঁড়ালাম।
জনাছয়েক ঘোড়াসওয়ার এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? বার কয়েক চোখ পিটপিট করলাম, ভুরু কুঁচকে দেখতে চেষ্টা করলাম ভাল করে! তাপতরঙ্গের পটভূমিতে ঝাপসা দেখাচ্ছে, অসম্ভব লম্বা মনে হচ্ছে ঘোড়াগুলোর পা। তবে এসবই তাপতরঙ্গের কারসাজি।
এগিয়ে এল ওরা, তাপতরঙ্গ আর ধুলো ভেদ করে, সবচেয়ে সামনের ঘোড়াসওয়ারের একটা পা কাঠের।
লোকটাকে চিনি আমি, পেগ-লেগ স্মিথ, বাবার বন্ধু। স্যান্তা ফে থেকে আমরা যখন ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে আসছিলাম পথে ওর সাথে দেখা হয়েছিল আমাদের।
আমার সামনে এসে রাশ টানল ওরা, পেগ-লেগ স্মিথ বলল, হোলি জেসাস! এ দেখছি ও’হারার ছেলে!
স্যাডল থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল ও, নিজের ক্যান্টিনটা ধরল আমার ঠোঁট। এক ঢোক ঢেলে দিয়েই ওটা সরিয়ে নিল সে।
এবার শুধু মুখটা ধুয়ে ফেল, বলল স্মিথ। চুইয়ে ঢুকতে দাও ভেতরে। তারপর জিজ্ঞেস করল, বাছা, তুমি কোত্থেকে আসছ? তোমার বাবা কোথায়?
ওরা খুন করেছে তাকে, বললাম।
উনি কারোকে শেষ করতে পারেননি? জানতে চাইল আরেকজন।
একটাকে বোধহয়। আমাকে আরেক ঢোক পানি খাওয়াল পেগ-লেগ, তারপর স্যাডলে ফিরে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে।
ওঠ, বাছা বলল সে। তোমাকে নিয়ে যাব আমরা। একটু দ্বিধা করল সে। তোমার বাবা নেই। তা তুমি ঠিক করেছ কিছু কি করবে?
আমাদের বাসায় ফিরে যাব। বিল লারকিন আসবে ওখানে।
নিশ্চয় আসবে। বিল বন্ধুত্বের মর্যাদা বোঝে। সবাইকে নিয়ে সামনে এগোল স্মিথ। বাছা, বাড়িতে খাবারদাবার আছে তো?
আছে।
খানিকদূর যাওয়ার পর, থেমে আমাকে আবার পানি খেতে দিল সে; বেশি খেয়ে ফেলার আগেই সরিয়ে নিল ক্যান্টিনটা।
বহু পরে; যখন ঘোড়ার খুরের একঘেয়ে আওয়াজ আর আমার ক্লান্তি প্রায় ঘুম পাড়িয়ে দিল আমাকে, ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে আমাদের বাসার উঠনে এসে থামলাম আমরা। চারদিক অন্ধকার, নীরব।
টম? বলল পেগ-লেগ। ভেতরে গিয়ে দেখ কেউ আছে কিনা। আমরা তোমাকে কাভার দিচ্ছি।
দোল খেয়ে মাটিতে নামল টম, পিস্তলহাতে হেঁটে গেল দরজার কাছে, শেকল নামাল। ভেতরে পা রাখল সে। একটু বাদে আমরা টের পেলাম মোম খুঁজছে ও, তারপর একচিলতে আলো ছুটে এল দরজার বাইরে।
বাড়ির ভেতর খটখট আওয়াজ তুলল ওর বুট; তারপর আবার দরজায় ফিরে এল টম। একদম ধোয়ামোছা, পেগ!
পাঁজাকোলা করে আমাকে মাটিতে নামিয়ে দিল স্মিথ। একলা থাকতে পারবে তো, বাছা? ইন্ডিয়ানদের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন?
ভাল।
তাহলে তো আর কথাই নেই। আজ মাঝে-মধ্যে এক-আধ চুমুক পানি খেয়ো, তবে পেট বোঝাই করে না। ভরপেট খাবে কাল থেকে।
আর হ্যাঁ, খুউব সাবধান থাকবে, বাছা। ওই স্প্যানিশ বুড়ো যদি জানতে পায় তুমি বেঁচে আছ, এসে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে তোমাকে।
বিদায় নেয়ার আগে আমার উদ্দেশে হাত নাড়াল পেগ-লেগ। চলি, বাছা। দেখা হবে। তোমার বাবার জন্যে দুঃখ হচ্ছে আমার। বড় ভাল মানুষ ছিলেন।
বাবা যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন, উঠনের সেই জায়গায় বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, কান পেতে শুনলাম ওদের ঘোড়ার আওয়াজ, আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। তারপর ভেতরে গিয়ে তাকালাম চারপাশে।
টাহকুইৎয়ের বাসায় এখন একলা রয়েছি আমি। ও কি রাগ করবে আমি এখানে থাকায়? আমাকে তাড়িয়ে দিতে আসবে না তো?
আচ্ছা, এই টাহকুইৎসটা আসলে কে? কোন মানুষ…নাকি অন্যকিছু?
খিদে পেয়েছিল আমার, তবু খেতে ইচ্ছে হলো না। বিছানা ঝেড়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম এল না সঙ্গে সঙ্গে, অনেক রাত অবধি চোখ মেলে তাকিয়ে রইলাম অন্ধকারের ভেতর।
দূরে কোথায় যেন মেঘ ডাকছে, আমার আশপাশের পৃথিবীটা দুলে উঠল। টাহকুইৎস না তো?
ক্রুদ্ধ হয়েছে?
কেন হবে। এটাই তো আমার বাড়ি। নিজের বলতে একমাত্র এই একটি জিনিসই এখন আমার আছে। এবার কী করব আমি? কী করা উচিত? বিল কি সত্যিই আর আসবেনা কোনদিন? আমাকে নিয়ে সে মাথা ঘামাবেই বা কেন? আমি তো ওর ছেলে নই। মাথা ঘামাবার জন্যে ওর নিজেরই অনেক সমস্যা রয়েছে।
মৃদু হাওয়া গুমরে কেঁদে ফিরছে-গাছের পাতায়, জানালা আর ছাদে ঝাপটা মারছে বালু।
মিস ডায়ানা বলেছিলেন আমি তাঁর কাছে গিয়ে থাকতে পারি। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমি আমার শক্রর অনেক কাছাকাছি চলে যাব, এবং ওরা জানতে পাবে আমি বেঁচে আছি। অথচ সেটা ওদের কিছুতেই জানতে দেয়া চলবে না। লস এঞ্জেলেস এখান থেকে পাঁচ-ছয়, বড়জোর-সাতদিনের পথ। ঠিক কত দূরে; তা আমি জানি না।
এ-অবস্থায় কী করতে পারি আমি? থাকতে পারি এখানে-টাহকুইৎসয়ের বাসায়।
অন্তত, যদ্দিন সে না ফিরছে।
১.৩ কাবার্ড খুললাম আমি
যখন সকাল হলো কাবার্ড খুললাম আমি। রুটির বাক্সে রুটি আছে, এ ছাড়া দুই বয়েম জ্যাম, ভুট্টার ছাতু আর দুবোতল মদ আর কফি। প্রথম জিনিসটা আমি খাই না, দ্বিতীয়টা কদাচিৎ।
আলমারির নীচের তাকে পেলাম পনির। এক টুকরো কেটে নিয়ে বাকিটুকু জড়িয়ে রাখলাম কাপড়ে। তারপর রুটিতে পুরু করে জ্যাম আর পনির লাগিয়ে খেতে বসলাম টেবিলে। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম আমি, কী রকম খিদে আমার পেয়েছিল। এর আগে, আমি শুধু পানি খেয়ে ছিলাম।
খাওয়ার পর, দরজায় গেলাম আমি, দেখলাম ফ্রান্সিসকো দাঁড়িয়ে।
টাহকুইৎসকে দেখনি?
না, বললাম আমি।
কাল এসেছিল। রক্ত মুছে দিয়েছে। আমার বাবা যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেই জায়গাটা দেখাল ও। তারপর চলে গেছে।
কেমন দেখতে এই টাহকুইৎস?
আমি দেখিনি। কেউই দেখতে পায় না। ও রাতে আসে, রাতেই চলে যায়। আমরা ওর শব্দ পেয়েছিলাম। আমার পানে তাকাল ফ্র্যান্সিসকো। ও কেবিনে ছিল।
সভয়ে, কেবিনটার দিকে কালাম আমি। ওখানে ছিল? ভেতরে?
এখন কী করবে তুমি?
মানে?
আমাদের সাথে চলে আসছ না কেন? ইন্ডিয়ান হয়ে যাবে।
কিন্তু আমি তো ইন্ডিয়ান নই।
ইন্ডিয়ানদের মত থাকতে পারবে তুমি। কালো চোখের কোণ দিয়ে আমাকে মাপল ও। ইন্ডিয়ানদের মত খেতে পারবে। অন্তত, যোগ করল ফ্রান্সিসকো, খাওয়াটা তো পাবে এতে।
তা পাব। যখন রুটি শেষ হয়ে যাবে, জ্যাম আর পনির থাকবে না, তখন কী করব আমি?
বাবার কাছে শুনেছি, ওক গাছের ফল খায় কাউইয়ারা, ওদের খাবারের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ জুড়ে থাকে এই জিনিস। এ ছাড়া যব আর ভুট্টাও সংগ্রহ করে।
আমাকে থাকতে হবে এখানে। বিল লারকিন আসবে। তারপর না হয় আমি যাবখন তোমার সাথে, তুমি আমাকে শেখাবে সবকিছু।
উঠে দাঁড়াল ফ্র্যান্সিসকো, এতক্ষণে ওর বাকস্কিনের থলেটা চোখে পড়ল আমার। ওটা বাড়িয়ে দিল সে। তোমার জন্যে। আমার দিকে তাকাল ও। জার্কিঃ বুলল ফ্রান্সিসকো, এমনভাবে যেন শব্দটা নেহাত অপরিচিত।
ব্যাগের ভেতর উঁকি দিতে, শুকনো মাংসের টুকরোগুলো দেখতে পেলাম আমি।
প্রেসিয়াস, বললাম। হাসল ও, মুক্তোর মত সাদা একসারি দাঁত বের করে।
আমি এখন যাই, বলল ফ্র্যান্সিসকো।
চলে গেল ও। খানিক বাদে আমি ফিরে এলাম ভেতরে। টাক্কুইস্ এসেছিল এখানে!
দরজার ঠিক ভেতরে দাঁড়িয়ে নজর বোলালাম চারপাশে। টাহকুইৎস যদি এসেইছিল, কী করছিল তবে? ভাবলাম। কেনই-বা আসবে সে? তার বাড়ি দেখতে, সত্যিই যদি এটা তার বাড়ি হয়ে থাকে? নাকি আমরা কী করছিলাম এখানে সেটা জানতে?
কোন পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। আগের মতই আছে সব। মরুকগে, ভাবলাম, আমি ওসব রূপকথায় বিশ্বাস করি না। া, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, টাহকুইৎস আসলে রূপকথার কোন চরিত্র। যেমন অঙ্গরিক বা সিন্ডারেলা। যদি সত্যিই থাকত টাহকুইৎস, কেউ-না-কেউ দেখতে পেত তাকে। অথচ কাউইয়ারাও নাকি দেখেনি। কেবল শব্দ শুনেছে। সেটা বাতাস কিংবা কয়োটের হতে পারে। নয়তো অন্যকিছু।
দেয়ালের এককোণে ঠেস দিয়ে রাখা ছিল বাবার রাইফেলটা। আমি কাছে গিয়ে দেখলাম গুলি ভরা আছে কিনা। আছে। শোবার ঘরের একটা পেরেকে ঝুলছিল তার গানবেল্ট, আমি নামালাম ওটা। লোড করা। নিশ্চয় কেউ করছে কাজটা, কারণ বাবা দুটো গুলি ছুড়েছিলেন। আমার অনুপস্থিতিতে কেউ গুলি ভরে রেখেছে এতে।
গানবেল্টটা এবার খাটের বাজুতে ঝুলিয়ে রাখলাম আমি। এখন থেকে রাতে আমার নাগালের মধ্যে থাকবে ওটা, কী জানি যদি দরকার পড়ে। এর আগে পিস্তল ছুড়েছি আমি, তবে বাবার সাহায্য পেয়েছিলাম। রাইফেল চালনাও তিনি শিখিয়েছেন আমায়।
ওইদিন বিকেলেই বিল দেখা করতে এল আমার সঙ্গে। তখন ঘুমোচ্ছিলাম আমি, হঠাৎ কানে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ আসতে জেগে গেলাম। উঠে, পিস্তলহাতে দাঁড়ালাম দরজার পাশে গিয়ে, বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে। তারপর ঘোড়াসওয়ার যখন দৃষ্টিসীমায় এল, পিস্তল নামিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে।
হাউডি, বয়। যা শুনেছি, তা হলে সত্যি?
হ্যাঁ।
স্যাডল থেকে নামল লারকিন, ঘোড়া তুলে রাখতে কোরালে গিয়ে ঢুকল। আমি পিছু নিলাম। ঘোড়াকে পানি খাওয়াল ও, তারপর খুঁটিতে বেঁধে রেখে, স্ক্যাবার্ড থেকে বের করে নিল ওর রাইফেলটা। হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরে এলাম আমরা।
ভেতরে, কেতলি নিয়ে নিজের জন্যে কফি বানাল বিল, সেই ফাঁকে সব ঘটনা আমি খুলে বললাম ওকে, পেগ-লেগ স্মিথ কীভাবে উদ্ধার করেছে আমাকে সেটাও
বাদ দিলাম না।
ব্যাটা একটা ধেড়ে শয়তান, পেগ-লেগ সম্পর্কে মন্তব্য করল লারকিন, তবে দুঃসময়ে দারুণ উপকারী বন্ধু। আমার পানে তাকাল ও। একা-একা সবকিছু করতে কেমন লাগছে তোমার?
ভালই। ভাবছি কাউইয়াদের কাছে গিয়ে থাকব। ওরা প্রস্তাবও দিয়েছে।
জানি, তোমার আর কোন আত্মীয়স্বজন নেই। তবে তোমার বাবা মিস ডায়ানা নামে এক মহিলা সম্পর্কে কী যেন বলেছিলেন।
মিস ডায়ানার সাথে কীভাবে আমাদের পরিচয় জানালাম বিলকে, তারপর বললাম আমি এখানেই থাকতে চাই।
এখানে? একা? প্রথমে আঁতকে উঠল লারকিন, তারপর বলল, অবশ্যি আমিও খুব ছোটতেই একা হয়ে গিয়েছিলাম। যাক, তোমার জন্যে কিছু খাবার এনেছি। আমার স্যাডলের পেছনে যে-ব্যাগ আছে তাতে পারে। খুব বেশিকিছু না, হাতের কাছে সামান্য যা পেয়েছি তাই নিয়ে এসেছি। আর, বাছা, আমি বোধহয় হরদম এভাবে আর আসতে পারব না।
জানি, পথ অনেক লম্বা।
বোঝই তো, বাছা, আমারও কাজকাম আছে। ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল ও। আমি যেখানে থাকি সেখানে নিয়ে যেতে পারছি না তোমাকে। বাজে জায়গা।
এখানে ভালই থাকব আমি। আর তা ছাড়া, এখানেই আমি থাকতে চাই।
আজ রাতে আমি এখানে থাকলে তোমার কি অসুবিধে হবে, বাছা? খুব ক্লান্ত লাগছে। আবার আমার দিকে তাকাল ও। তোমার ভয় করছে না, ওরা যদি ফিরে আসে?
ওরা ধরে নিয়েছে আমি মরে গেছি।
পা থেকে টেনে নিজের বুট খসাল, লারকিন, বাবার বিছানার কিনারে বসে তাকাল বইগুলোর দিকে। পড়েছ? অবশ্যি তোমার বয়েস কম।
আমি পারি পড়তে। তিন বছর বয়েসে আমার হাতেখড়ি হয়েছে।
মাথা ঝোকাল বিল। হ্যাঁ, বাছা, পড়াশোনাটা চালিয়ে যেয়ো। এতে তোমার উপকারই হবে। তোমার বাবাও বিদ্বান মানুষ ছিলেন। ঠিক আছে, পরের বার যখন আসব:আরও বই এনে দেবখন তোমাকে।
সেবার প্রায় হপ্তাখানেক আমার সাথে কাটাল সে। কেক বিস্কুট এবং আরও কিছু সাধারণ খাবার বানাতে শেখাল আমাকে। সোনা খোঁজার কলাকৌশল, কীভাবে কী করতে হয় ঐগুলোও বুঝিয়ে দিল ভাল করে?
যেদিন বিদায় নিল সে, আমি জানতাম না বহুকালের ভেতর আর দেখা পাওয়া যাবে না বিলের।
.
১২.
পরবর্তী দিনগুলোতে প্রায়ই ফ্রান্সিসকোর সঙ্গে পাহাড়ে যেতাম আমি, মাঝে মাঝে ওর বাবা এবং অন্যান্য কাউইয়াদেরকেও সাথে নিতাম। রোজই নতুন কিছু শিখছিলাম আমি, আর যখন মরুভূমিতে যেতাম তখন লক্ষ করতাম কোন কোন ফল বা বীজ খাওয়ার জন্যে সংগ্রহ করা হয়েছে, আর বাদ পড়েছে কোন্গুলো।
এই ভাবে দিন গড়িয়ে মাস, বছর ঘুরে গেল। বাসায় নিয়মিত পড়াশোনা করছি আমি, শব্দ শিখছি নিত্যনতুন, বাক্যে ওদের অবস্থান দেখে অর্থ বোঝার চেষ্টা করছি। একদিন হঠাৎ, অপরিচিত এক ইন্ডিয়ান যুবক এসে আমাকে জানাল বেশকিছু ঘোড়সওয়ার আসছে এদিকে। আমি চট করে লুকিয়ে পড়লাম বালিয়াড়ির ভেতর, পথের ওপর নজর রাখলাম।
সন্দেহ নেই এতদিনে সবাই ধরে নিয়েছে আমি মারা গেছি। কিন্তু আমার দাদু সন্দেহপ্রবণ মানুষ, নিশ্চয় তার কানে উড়োখবর পৌঁছেছে, কেউ একজন থাকে এই বাসায়। খানিক বাদে ঘোড়াসওয়াররা যখম ঢুকল উঠনে; চারদিক থেকে এদের ঘিরে ফেলল কাউইয়ারা, প্রত্যেকেই সশস্ত্র, হাতে তীরধনুক, নয়তে রাইফেল। নিমেষে, বিনা বাক্যব্যয়ে, ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে অন্য পথ ধরল রাইডাররা, জানে যে কোন সময় বেধে যেতে পারে খণ্ডযুদ্ধ। কাউইয়ারা বহুদূর অবধি ধাওয়া করল ওদের, পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল, এখানে বাইরের কেউ আসে ইন্ডিয়ানদের সেটা কাম্য নয়।
মৃত্যুর সময় বাবা আমার জন্যে ছশো ডলার রেখে গিয়েছিলেন। সবই স্বর্ণমুদ্রায়। আমার খাবারদাবার যখন ফুরিয়ে এল,এবং বিল আর এল না, ছোট্ট বাক্সটা থেকে একটা মুদ্রা বের করে নিয়ে জিনিসপত্র কিনতে ইন্ডিয়ান পল্লীর একমাত্র দোকানটিতে গেলাম আমি।
দোকানি মুদ্রাটা নিল আমার কাছ থেকে, তারপর আশপাশে আর কেউ আছে কিনা চট করে একবার দেখে নিয়ে, গলা খাদে নামিয়ে আমাকে বলল বাছা, তোমার কাছে যদি এরকম পয়সা আরও থেকে থাকে, ভুল করেও কারোকে জানতে দিয়ো না। বেশি জানাজানি হলে বিপদে পড়বে তুমি।
মুদ্রাটা ওজন করল ও। তোমার সমস্ত জিনিস কিনেও কিছু টাকা বেঁচে যাবে এ থেকে। এটা বরং আমার কাছেই থাক; তোমার যখন যা প্রয়োজন এসে নিয়ে যেয়ো। ফের যখন টাকা লাগবে, আমিই বলব তোমাকে।
ওকে আমার দয়ালু লোক বলে মনে হলো। আবার এটাও ঠিক, আমি কারোকে বিশ্বাস করি না। তবে এক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত কথাই বলেছিল দোকানি, তাই আমি মেনে নিলাম ওর প্রস্তাব।
প্রায়শ একা, কখনও কখনও ফ্রান্সিসকোর সাথে, মরুভূমি নয়তো স্যান হ্যাকিন্টোস অর স্যান্তা রোসা পাহাড়ের গভীরে ঘুরতে যাই আমি। মাঝেসাঝে কোন ক্যানিয়নে ঢুকে সেখানে কাটিয়ে দিই দিনকতক।
একদিন একা রয়েছি বাসায়, হঠাৎ টের পেলাম একজন ঘোড়াসওয়ার আসছে। সন্ধ্যার হাওয়া খেতে দরজা খুলে রেখেছিলাম আমি, তাই তড়িঘড়ি বাবার পিস্তলটা তুলে নিয়ে চলে গেলাম দোরগোড়ায়, দেয়ালের সাথে মিশে গিয়ে এক চোখে উঁকি দিলাম বাইরে।
ছেলেবেলা থেকেই ছোট-বড় নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র আমি চিনি। আমাকে শেখানো হয়েছে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় এসব জিনিস, সবসময় ধরে নিতে হয় গুলি ভরাই আছে। এরকম অসময়ে একজন ঘোড়াসওয়ার আসা মানে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা, তবু অশ্বারোহীকে যখন চিনতে পারলাম আনন্দে আরেকটু হলেই হাত থেকে পিস্তলটা ফেলে দিচ্ছিলাম আমি।
লোকটা আর কেউ নয়-জর্জ বুশ।
বেল্টের পেছনে পিস্তল খুঁজে, বাইরে পা রাখলাম আমি। আমাকে দেখামাত্র হাসি ফুটল ওর মুখে। বেশ বড় হয়ে গেছ দেখছি। আমি-নামলে আপত্তি আছে?
কেন থাকবে? চলুন, ভেতরে চলুন।
একটা গাছের ডালে ঘোড়া বেঁধে রেখে, ঘরে এল বুশ, কোলের ওপর টুপি নিয়ে বসল চেয়ারে। পিস্তলটা নজরে পড়ল ওর।
বিপদের আশঙ্কা করছিলে?
হ্যাঁ। ওরা আমার বাবাকে খুন করেছে।
শুনেছি। উনিও সাথে নিয়ে গেছেন একটাকে।
আরও নিতেন, কিন্তু আমাকে বাঁচাতে গিয়ে পারেননি।
স্বাভাবিক।
মিস্টার কেলসো কেমন আছেন?
শেষ যে-বার ওর খবর পাই, মাদার লোড অঞ্চলে একটা ক্লেইমে কাজ করছিল। হিউজ স্যান ডিয়েগোর দিকে র্যাঞ্চ খুলেছে।
আবার আমাকে মাপল বুশ। তোমার রঙ একটু ময়লা হয়ে গেছে। বয়েস কত হলো এখন?
দশ।
আচ্ছা! দেখে কিন্তু পনেরো মনে হয়। তারপর, কেমন আছ…অসুবিধে হচ্ছে না একা থাকতে?
নাহ। তা ছাড়া কাউইয়াদের সাহায্য পাচ্ছি।
এরপর ঘোড়া কোরালে তুলে রাখতে বাইরে গেল বুশ, আমি কফি বানালাম, বহুকাল পর চেনাজানা মানুষের দেখা পেয়ে আমার আনন্দ হচ্ছে। ও যখন ফিরে এল—আবার, মিস ডায়ানার খবর জানতে চাইলাম আমি।
স্মিত হাসল বুশ, জানাল মহিলা ভালই আছেন লস এঞ্জেলেসে। আমদানি রফতানির কারবার খুলেছেন, জাহাজে করে বিদেশের মাল এনে নিজের দোকানে বিক্রি করেন, আবার দেশ থেকে পাঠান কাপড়চোপড়, ফার, চামড়া বা এই জাতীয় জিনিস। বুশ আর কেলসোর সঙ্গে যোগাযোগ আছে মহিলার, ওরা তাঁর ব্যবসা দেখাশোনা করে। এক কথায়, হাসতে হাসতে বলল জর্জ, লস এঞ্জেলেসের অভিজাত সমাজে মিস ডায়ানার এখন যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি। পুরুষরা তাকে কাছে পাবার জন্যে ব্যাকুল, কিন্তু উনি কারোকে পাত্তা দেন না।
বাবা ঠিকই বলেছিলেন, আমি বললাম, মহিলা বুদ্ধিমতি। আমারও বেশ পছন্দ তাঁকে।
সেজন্যেই তো এখানে আমার আসা, কফিতে চুমুক দিয়ে বলল বুশ, মিস ডায়ানার ইচ্ছা তুমি লস এঞ্জেলেসে চলে এস। আমি তোমাকে নিতে এসেছি।
লস এঞ্জেলেস?
কিন্তু দাদু আছেন না?
বুট খসাতে নিয়েছিল বুশ, থেমে গেল। কথাটা আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ডায়ানাকে। তা উনি বললেন, তোমার দাদুর বিশ্বাস তুমি মারা গেছ।
শহরে একটা বাড়ি আছে তাঁর, তবে বেশির ভাগ সময়ে তিনি নিজের জমিদারিতেই থাকেন। যদি কখনও আসেন, রাজার মত চালচলন হয় তার, সাত আটজন ভ্যাকুয়েরো থাকে সঙ্গে।
পা থেকে বুট খসিয়ে মেঝেয় রাখল জর্জ। কেউ জানতে চাইলে মিস ডায়ানা বলবেন, তুমি ওঁর আত্মীয়, পুবে থাকতে। জাহাজের মালিক, ক্যাপ্টেনদের সাথে তার ওঠাবসা। সহজেই বলতে পারবেন, ওদেরই কারও সঙ্গে তুমি এসেছ।
হঠাৎ করেই, মিস ডায়ানাকে দেখতে দারুণ ইচ্ছে হলো আমার। মহিলা দয়ালু, দুদিনের পরিচয় হলেও বাবাকে উনি বুঝতে পেরেছিলেন। আমি জানি, বাবারও উঁচু ধারণা ছিল তাঁর সম্পর্কে।
তা ছাড়া, ডায়ানা বোকা নন। আমার মনে পড়ল পথে আমাদের ওপর ইন্ডিয়ানরা যখন চড়াও হয়, উনিও বন্দুক ধরেছিলেন। তারপর, সহসা উপলব্ধি করলাম, আমি একা-ভয়ঙ্কর একা।
তোমার লেখাপড়ার ব্যাপারে ডায়ানা খুব চিন্তিত। বললেন, তোমার বাবাকে কথা দিয়েছিলেন তাঁর যদি কিছু হয়ে যায়, তোমাকে দেখবেন উনি।
এখানেই ভাল আছি আমি।
ইচ্ছে করলেই ফিরে আসতে পারবে যখন খুশি। শোন, ড্যান, তুমি ইন্ডিয়ান নও। এখন না হয় ভালই আছ, কিন্তু ভেবে দেখ বড় হয়ে কী করবে? তোমার বাবা শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। তাই সবখানেই যেতে পারতেন।
তুমি ইন্ডিয়ান নও, আর এখানে সারাজীবন থাকলেও তা হতে পারবে না। তার চেয়ে লস এঞ্জেলেসে চল, মিস ডায়ানার সাথে কথা বল একবার। তারপর যদি ফিরে আসতে চাও, কেউ তোমাকে আটকাবে না।
এই বাড়িটা আমার পছন্দ। এখানকার কিছু কিছু জিনিস আমার বাবার ছিল।
এখানেই থাকবে ওগুলো। বুড়ো দোকানিকে বলে রাখব আমি, আর তোমার ইন্ডিয়ান বন্ধুরা তো আছেই।
ওরা আসে না এখানে। ভয় পায়।
ভয়? কীসের ভয়?
ওদের ধারণা এটা টাহকুৎইসয়ের বাড়ি। এবং নিশ্চয় অলৌকিক কোন ক্ষমতা আছে আমার, সেজন্যেই এখনও পর্যন্ত কোনরকম বিপদে পড়িনি।
টাহকুইৎসয়ের কাহিনি জানত না বুশ, তাই আমি সামান্য যেটুকু জানি সেটাই বললাম..ওকে। মন দিয়ে শুনল ও, তারপর বলল, আমি কিন্তু, বাছা, কুসংস্কার বলে হেলাফেলা করি না এসব জিনিসকে। আমার যেন মনে হয়, যা রটে তা কিছু বটে। একটু থামল জর্জ। যাক, ভালই হলো তা হলে, তোমার মালপত্র নিরাপদেই থাকবে এখানে। একেবারে না নিলে নয়, কেবলমাত্র সেই জিনিসগুলোই সঙ্গে নেবে তুমি।
বিছানায় শুয়ে, পাশের কামরায় জর্জ বুশের নাক ডাকার আওয়াজ শুনছি আমি, আর ভাবছি লস এঞ্জেলেসের কথা। বহুঁকার্লের ভেতর কোন শহরে যাইনি, এত দীর্ঘ সময় যে আবছাভাবে শুধু স্যান্তা ফের কথাই মনে আছে। সেও ওখানে ছিলাম আমি প্রায় চার বছর আগে।
যখন সকাল হবে, একশোটা ডলার নিয়ে বাকি স্বর্ণমুদ্রাগুলো এখানেই লুকিয়ে রেখে যাব আমি। নিজের ঘোড়াটা সঙ্গে নেব, আর আমার পিস্তল আর রাইফেল। যখন ফেরার ইচ্ছে হবে, স্যাডলে চড়ে চলে এলেই হলো। দুর্গম অঞ্চল পাড়ি দেয়া এখন আর নতুন কোন ঘটনা নয়।
.
রাইফেলটা স্ক্যাবার্ডে তুলে রাখছি আমি এমন সময় ফ্রান্সিসকো হাজির হলো। চলে যাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল সে।
লস এঞ্জেলেসে, বললাম, ঈষৎ গর্বের সুরে।
অনেক দূর, বলল ও।
পাঁচ…ছয় দিনও লাগতে পারে। ঠিক জানি না।
আমার বাবা একবার গিয়েছিলেন। অনেক বড় বড় বাড়ি আছে।
স্বাভাবিক।
তুমি আর ফিরে আসবে না।
এটাই আমার বাড়ি, এই বাসা। আমার বাবার কবর এখানে। আমি আসব ফিরে।
আসবে না, আমি জানি। ওর মুখ গম্ভীর।
ফ্রান্সিসকো, তুমি আমার বন্ধু। চিরকাল তাই থাকবে। আমি ঠিকই ফিরে আসব, বাবার জিনিসগুলো রেখে যাচ্ছি। বইপত্তরও।
তাই! ফ্রান্সিসকো জানে বইয়ের কদর আমার কাছে কত। তা হলে বোধহয়। তুমি আসবে ফিরে।
স্যান হ্যাকিন্টো আর স্যান গরগনিয়ো গিরিশৃঙ্গে চুমু খাচ্ছে সূর্য এই সময়ে রওন হালাম আমরা। যে-গিরিপথ ধরে এগোচ্ছি সেটা এই দুই চূড়ার মাঝ দিয়ে চলে গেছে, এখনও অন্ধকার।
প্রথম চড়াইটার মাথায় উঠে পেছনে তাকালাম আমি, ছড়ানো-ছিটানো পাম অর মেসকিট ঝোপ, গুটিকতক কুঁড়ে আর দোকানের ছাতটা চোখে পড়ল। আমার বাড়িটা ঢাকা পড়েছে বালিয়াড়ির আড়ালে।
চাইনো ক্যানিয়নের মুখে লিনিং রককেও দেখতে পেলাম। কে যেন এর নাম দিয়েছে কলিং রক। ইন্ডিয়ান প্রবাদ, কেউ যদি বাইরে থাকে কলিং রক তাকে ডাকে ফিরে আসতে। আবার এও শোনা যায়, চলে যাওয়ার সময় পেছন ফিরলে কেউ যদি দেখতে পায় এই পাহাড়টাকে, ফিরে সে আসবেই। আমি ওদিকে চেয়ে রইলাম দীর্ঘক্ষণ, কারণ আমি ফিরতেই চাই। ফ্র্যান্সিসকো আছে ওখানে, ও আমার বন্ধু।
জর্জ সাবধান করল আমাকে শোন, কারোকে বলবে না তুমি মরুভূমি থেকে এসেছ। এমনকী এর উল্লেখ পর্যন্ত করবে না। কেউ যদি তোমার আসল পরিচয় জানতে পায়, তুমি বিপদে পড়বে। বুঝেছ?
মনে থাকবে। কয়েক কদম এগোনোর পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, লস এঞ্জেলেসে তো আমার কোন বন্ধু নেই…কথা বলব কার সাথে?
নতুন নতুন বন্ধু করে নেবে। তা ছাড়া মিস ডায়ানা আছে। আমি আছি…আমিও তোমার বন্ধু।
নীরবে এগিয়ে চললাম আমরা। আমি ভাবনার সাগরে ডুব দিয়েছি। বাবা আমাকে গ্রীক মহাকাব্য ইলিয়াড আর ওডিসি-র গল্প শুনিয়েছেন। তিনি বলতেন, মানুষকে সৃষ্টির প্রেরণা জোগাতে এসব কাহিনির দরকার হয়, এগুলো থাকলে বহু আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত মানবসভ্যতা। মানুষ শান্তি খোঁজে, কিন্তু তা প্রতিষ্ঠার জন্যে তাকে শক্তি জোগায় তার শত্রু। নিরলস সংগ্রামের মাঝ দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে সে, শত্রুকে বাধ্য করে শান্তি প্রতিষ্ঠায়।
বাবা আরও বলতেন, আমার ছেলের জন্যে একটা জিনিসই রেখে যাব আমি-ভাষা আর সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা। সেইসব, কবি আর মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা যারা আমাদের মনের কথা বলেছেন। বাবা আমাদের মনের কথা বলতে মানবসভ্যতার কথা বোঝাতেন। তিনি মনে করতেন মানুষকে বড় হতে হলে ঐতিহ্যের সহায়তা প্রয়োজন হয়, আর মানুষ তার এই ঐতিহ্যকে খুঁজে পারে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মাঝে। কারণ মানুষ মাত্রেই যাযাবর, ন! সময়ে নানা দেশে পাড়ি জমিয়েছে সে-মেলামেশা করে অন্য জাতির লোকেদের সঙ্গে। আর এই মেলামেশার ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা।
তা হল, ভাবলাম আমি, লস এঞ্জেলসের উদ্দেশে আমার এই যাত্রাও কি গ্রীক বীরদের সমুদ্র অভিযানের মতই মহান? এটাও কি কোন মহাকাব্যের অংশ হবে? যদি হয়, ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে ধুলো খাওয়ার শামিল। আমি মনেপ্রাণে চাইছি জর্জ এখন বিশ্রাম দিক ঘোড়াগুলোকে, কারণ আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। তবু, বাঁ কাঁধের ওপর দিয়ে পেছন ফিরে যখন একসার পর্বতমালা আর পাইন বন দেখতে পেলাম, আমার চোখ জুড়িয়ে গেল।
আর কিছু না হোক, ভাবলাম, বাবা এসব জিনিস দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন আমাকে, এতেই আমি ধন্য।
সেই রাতে, ক্যাম্পফায়ারের ধারে আমাকে সাবধান করল বুশ। বেশিকিছু আশা কর না। জায়গাটা মোটামুটি স্যান্তা ফের মতই। তবে মিস ডায়ানার বিশ্বাস, খুব শিগগিরই লস এঞ্জেলেস এ-দেশের সবচেয়ে বড় শহরগুলোর একটা হতে যাচ্ছে। আর ওই মহিলাও দারুণ বুদ্ধি ধরেন। তুমি সবসময় দেখবে কীভাবে কাজ কনে উনি। কোন সমস্যায় পড়লে পরামর্শ নেবে তার। দেখবে, আর কোন অসুবিধে থাকছে না তোমার।
কিন্তু আমি তখন মিস ডায়ানার কথা ভাবছিলাম না, বাবার কথাও নয়; আমি ভাবছিলাম পশ্চিমের অজানা দেশে যাওয়ায় যে-আনন্দ তার কথা।
তারপর হঠাৎ করেই শিউরে উঠলাম। লস এঞ্জেলেস নামের উষ্ণ রোদেলা শহরটার কথা ভুলে গেলাম। আমার চোখে তখন ভাসছে দাদুর মুখ, যিনি খুন করিয়েছেন আমার বাবাকে, আর সৃষ্টি করছেন প্রচণ্ড একটা ভীতির যার ভেতর ঘাস করছি আমি।
.
১৩.
লস এঞ্জেলেসে পৌঁছে সরাসরি শহরে ঢুকরলাম না আমরা, জাহাজ-ঘাটায় চলে গেলাম। জর্জ বলল এখানে রাত কাটিয়ে তারপর মিস ডায়ানার বাসায় যাব আমরা। এক জাহাজের ক্যাপ্টেনের সাথে আমার আলাপ করিয়ে দিল সে, কেউ জানতে চাইলে বা হবে এঁর জাহাজে চড়েই বেডফোর্ড থেকে আমি আসছি। কথা প্রসঙ্গে জানলাম ক্যাপ্টেন আমার পিতামহকে চিনতেন, একসময় এই জাহাজে কাজ করেছেন দুজন। সমুদ্র আর দেশ-বিদেশ সম্পর্কে আমার কৌতূহল দেখে ক্যাপ্টেন আমাকে তার জাহাজে কাজ দিতে চাইলেন। কিন্তু আমি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করলাম। বললাম, আপাতত আমি মিস ডায়ানার কাছেই থাকব। তবে ক্যাপ্টেনের প্রস্তাবের কখা আমার মনে থাকবে, যদি কখনও অবস্থা তেমন বুঝি, আর সেসময় কাছেপিঠে থাকেন তিনি, আমি চলে আসব তার কাছে।
মিস ডায়ানারও প্রশংসা করলেন ক্যাপ্টেন। বললেন, মহিলা কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষের বাড়া। এই যে বিদেশের সাথে কারবার করছেন, খুব কম পুরুষই তা করতে পারবে এভাবে।
পরদিন সকালে তীর থেকে একটা খাড়া ট্রেইল ধরে রওনা হালাম আমরা। যখন চড়াইয়ের মাথায় পৌঁছুলাম, তখন দেখলাম আরেকটা জাহাজ ঢুকছে উপকূলে।
শোন, বলল বুশ, তোমাকে আগেভাগে বলে রাখছি, মিস ডায়ানা কী ধরনের ব্যবসা করেন এসব যদি কেউ তোমার কাছে জানতে চায় কখনও, তুমি কিছু বলবে না। লস এঞ্জেলেসের মানুষরা একটু সেকেলে। মেয়েদের ব্যবসা করাটা তেমন ভাল নজরে দেখে না।
কেন, কেউ জানে না?
জানে। দু-চারজন। ডন আবেল স্টার্নস জানেন। সম্ভবত এখানকার সবচেয়ে ধনী লোক উনি। প্রচুর জায়গা-জমি আছে। আরও কয়েকজন জানে…সবাই পুরুষ।
সামনেই গাছপালা রয়েছে কিছু, আর এর বাঁয়ে নিবিড় জঙ্গল। স্ক্রাব ওক আর সাইকামোর গাছ মিলেমিশে আছে। ট্রেইলটা,এই জঙ্গলের পাশ দিয়ে ঘুরে এগিয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রচুর ভালুক আছে, বলল জর্জ, ভীষণ হিংস্র হয়, ভয়-ডর কাকে বলে জানে না।
বাদামি ঘাস আর ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। অদূরে নিচু একটা দালান চোখে পড়ল, রোদে-পোড়া ইটের তৈরি, কোরাল আর লম্বা একচালাও আছে। দালানের ছাদটা লাল টালির।
ওই টালিগুলো দেখেছ? ইন্ডিয়ানদের তৈরি। মিশনারিদের কাছ থেকে শিখেছিল। সেসব মিশনও এখন আর নেই, ইন্ডিয়ানরাও অধিকাংশই ফিরে গেছে পাহাড়ে। ফলে এসব টালি আজকাল আর পাওয়া যায় না।
লস এঞ্জেলেস শহরটা কত বড়?
তা পনেরোশো থেকে দুহাজার বর্গমাইলের মত হবে। বছর কয়েক আগে, আঠারোশো ছত্রিশ-এ, আদমশুমারি হয়েছিল একটা। প্রায় হাজার আড়াই লোক বাস করত তখন। তার মধ্যে পাঁচশোর বেশি ছিল ইন্ডিয়ান।
ফটকের ভেতর ঘোড়া ঢুকিয়ে হিচ রেইলের সামনে রাশ টানল বুশ। আমি এসব ব্যাপারে তেমন মাথা ঘামাই না, কিন্তু মিস ডায়ানা, উনি খুঁটিনাটি সবকিছু জানতে চনি।
ঘোড়া থেকে নামল জর্জ। এস, ড্যান। এখানকার লোকেরা নাস্তা করে বেলা দশটায়, সাধারণত, আর ডিনার তিনটায়। মাঝে-সাঝে সাপার করে ওরা, তবে বেশির ভাগ সময়ই খায় না।
এ-বাসার সবাইকে চিনি আমি। পাবলো সম্ভবত নেই এখন। যানজায় কাজ করে ও। মানে শহরের মাঝ দিয়েয-সেচখালটা চলে গেছে সেখানে। ইসাবেল…ওর বউ…মেক্সিকান মেয়ে। পাবলো ক্যালিফোনিয়।
চল, ভেতরে যাওয়া যাক। বাইরের কেউ এলে ইসাবেল তাদের খাওয়ায়। রোজগারপাতি, তা প্রায় পাবলোর সমানই হবে। বেশিও হতে পারে।
ওপরে টালি, নীচে পাথরের মেঝে, ফলে ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা। তিনটে টেবিল আর বেঞ্চ রয়েছে। আমরা ভেতরে ঢুকতেই একজন তরুণী এগিয়ে এল। সুন্দরী, চোখজোড়া ডাগর কালো।
সিনর! তুমি তো এদিকে আসা ছেড়েই দিয়েছ প্রায়। একটু বস। বিশেষ কিছু নেই, তবে…
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ও, অল্পক্ষণের ভেতর ফিরে এল গরম চকোলেট আর কিছু টিয়া নিয়ে। দাঁড়াও! তুমি কোয়েসাডিয়া পছন্দ করতে, সির,..আছে…এনে দিচ্ছি। থামল মেয়েটা, আমার দিকে তাকাল। আর তুমি? তুমি কী নেবে?
একটা কিছু দিলেই হলো, বললাম আমি, অস্বস্তি বোধ করছি। মেয়েদের সাথে কথা বলার অভ্যেস নেই বলে।
গরম চকোলেটটা আসলেই বেশ গরম, খেতেও স্বাদু। এর আগেও একবার চকোলেট খেয়েছি আমি, তবে এর কাছে সেটা লাগে না।
ইসাবেল যখন ফিরে এল কোয়েসাডিয়া হাতে তখন জিজ্ঞেস করল, তুমি কালাপানি থেকে আসছ?
ও আসছে–হাত ইশারায় আমাকে দেখাল বুশ। আমার সাথে জাহাজঘাটায় দেখা হয়েছে। এখন থেকে লস এঞ্জেলেসেই থাকবে, পড়াশুনো করবে স্কুলে।
তাই? তোমার বাবা-মা আছেন এখানে?
মাথা নাড়লাম আমি।
মিস ডায়ানা ওদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। উনিই আমাকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর কাছে ওকে নিয়ে যেতে।
মিস ডায়ানা দয়ালু মহিলা, ইসাবেল বলল। তবে এখনও যে বিয়ে করেননি এটাই আশ্চর্য।
চোদ্দতেই একরকম বিয়ে-থা কুরে ফেলে ক্যালিফোর্নিয়রা, তাদের কাছে ত্রিশ বছরের অবিবাহিত একজন মহিলাকে হেঁয়ালি মনে করে বৈকি! শুধু শুধু অঢেল প্রেমের বই পড়িনি আমি। কোয়েসাডিয়ায় কমড় বসাতে নাতে বললাম, ওর মনের মানুষ মারা গেছেন…খুনও হয়ে থাকতে পারেন। আমি ঠিক জানি না।
নিমেষে দরদে উথলে উঠল ইসাবেল। ভাঙা হৃদয়ের বেদনা স্প্যানিশদের চেয়ে ভাল আর কে বুঝবে? ওহ! বুঝেছি! তখন নিশ্চয় ওর বয়েস অনেক কম ছিল?
প্রেম করতেন, গম্ভীর গলায় বললাম আমি। দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন ভদ্রলোক। এখনও তার কথাই ভাবেন উনি।
ইসাবেল যখন রান্নাঘরে গেল, জর্জ চোখের কোণে তাকাল আমার দিকে, মৃদু সুরে বলল, আমি কি জানতাম না এটা।
আমিও না, বললাম। তবে এই কাহিনিটাই চালু হয়ে যাবে এখন। আর মিস ডায়ানাও বাঁচবেন ওদের অহেতুক কৌতূহল থেকে।
মুচকি হাসল বুশ। মানতেই হবে, এ-বয়সেই তুমি বেশ চালু। তোমার হবে, বাছা।
শহরে পৌঁছুলাম আমরা সন্ধ্যে নাগাদ। প্রশস্ত সমতল একটা প্রান্তরে অবস্থিত লস এঞ্জেলেস শহর, এর উত্তরে নিচু এক সারি পাহাড় আর পুবে আকাশছোয়া পর্বতমালা। শহরের গা ঘেঁষেই নদী, এ ছাড়া আঙুর বাগান আর হরেক রকমের গাছপালা। খোদ শহরে, রাস্তাঘাটগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। অধিকাংশ ঘরবাড়ি রোদে-পোড়া ইটের তৈরি, সমান নিচু ছাত। অবশ্যি এখানে-সেখানে বড় বাড়িও আছে দু-চারটে, দোতলা। সরকারি ভবন রয়েছে একটা, আর আছে গির্জা।
পেছনের রাস্তা হয়ে উইলো-ঘেরা চমৎকার একটা বাসায় আমাকে নিয়ে এল জর্জ বুশ! এর কাছ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে যানজা বা সেচখাল। এ-বাড়িটাও এডৌব, ছাত লাল টালির। দেখে মনে হলো অন্যগুলোর তুলনায় এটার গাঁথুনি মজবুত। বাসার পেছনে কোরাল, সেখানে ঘোড়া রয়েছে কিছু।
ড্যান, তুমি গিয়ে দরজায় নক কর। মিস ডায়ানা এতক্ষণে নিশ্চয় উতলা হয়ে উঠেছেন তোমাকে দেখার জন্যে। আমি তুলে রাখছি ঘোড়া।
দ্বিধায় পড়লাম আমি, দাঁড়িয়ে রইলাম উঠনে, হাত দিয়ে ঝেড়ে কাপড়চোপড় পরিপাটি করার চেষ্টা করছি। পোর্চের ওপরে নিচু ছাদ রয়েছে। একটা বেঞ্চি আর দোলনা চেয়ার রাখা আছে ওখানে। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম আমি, নক করতে হাত তুলছি এই সময়ে খুলে গেল দরজা, সামনেই একটি মেক্সিক্যান মেয়ে দাড়িয়ে।
ইশারায় আমাকে ভেতরে আসতে বলে পিছু হঠল সে, মিস ডায়ানা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। ড্যান! কদ্দিন পর দেখা! এস, ভেতরে এস!
লজ্জায় লাল হালাম আমি, দেহের ভর বদল করলাম এক পা থেকে অন্য পায়ে। আপনি কেমন আছেন, ম্যাম? জিজ্ঞেস করলাম।
দাড়িয়ে কেন…বস, ড্যান। তোমার সব ঘটনা খুলে বল আমাকে।
বসলাম আমি, একেএকে খুলে বললাম সবকিছু। এর মাঝে মেক্সিকান মেয়েটি গরম চকোলেট দিয়ে গেল, আমি পান করলাম।
আমার কথা যখন শেষ হলো, মিস ডায়ানা বললেন, তোমাকে খুব সাবধান থাকতে হবে, ড্যান। তোমার দাদু অত্যন্ত প্রভাবশালী মানুষ। ধনীও বটে। এখানকার লোকজনের সাথে বড় একটা মেশেন না, বিশেষ করে অ্যাংলোদের সঙ্গে। তবে যদি কিছু জানতে চান, সব খবরই তার কানে পৌঁছয়। আমাদের সুবিধে একটাই সাধারণত কিছু জানতে চান না তিনি।
আচমকা উঠে দাঁড়ালেন মিস ডায়ানা। অনেক রাত হলো, তোমার বিশ্রাম দরকার। কাল তোমার জন্যে একজনু শিক্ষকের ব্যবস্থা করব আমি। আমার কপালে চুমু খেলেন তিনি। বললেন, আজ তা হলে এ-পর্যন্তই…আসি…শুভরাত্রি।
চলে যেতে উদ্যত হয়েছেন ডায়ানা এমন সময়ে এস্ত পায়ে মেক্সিক্যান পরিচারিকাটি ঢুকল ঘরে। সিনরিটা?
বল?
একটা লোক, রাস্তার ওপাশের উইলো ঝোপের ভেতর লুকিয়ে আছে। নজর রাখছে এ-বাসার ওপর।
আচ্ছা। তুমি এখন যাও, ধন্যবাদ। আমার দিকে ফিরলেন তিনি। তুমি নিশ্চয় ভয় পাচ্ছ না, ড্যান?
না ম্যাম।
স্মিত হাসলেন ডায়ানা। বেশ। আমিও পাচ্ছি না।
.
১৪.
মিস ডায়ানার আভিজাত্যই ছিল আলাদা। কখনও চড়া স্বরে তাঁকে কথা বলতে দেখিনি আমি, অশালীন কোন অঙ্গভঙ্গি করতেও নয়। তার পোশাক-আশাক ছিল সাদামাঠা, ধূসর অথবা বাদামি, হালকা শেডের। যখন বাইরে যেতেন কোথাও, সর্বদা ছোট্ট একটা ছাতা থাকত তার হাতে। প্রায়শ হাসতেন তিনি, তবে এর রকমফের ছিল, আমি সেগুলো বুঝতে শিখেছিলাম।
তিনি কে বা কী ছিলেন বলেননি কখনও, কিংবা জীবনের কাছে তার কী প্রত্যাশা বা নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী ভাবেন সে-ব্যাপারেও নিশ্ৰুপ থাকতেন বরাবর। যখন ক্যালিফোর্নিয়ায় এসেছিলেন, টাকাপয়সা সামান্যই ছিল তার কাছে। লোকে যা ভাবে তার চেয়ে অনেক কম, যদিও এর পরিমাণ ঠিক কত ছিল আমি জানি না, তবে আমার বিশ্বাস অন্যদের চেয়ে বেশি জানি আমি। অনেক, অনেক কম টাকা।
মানুষের সাথে সহজে মিশতে পারতেন মহিলা, আর ওরাও পছন্দ করত তাকে। অন্যের বিপদে, সর্বদা হাসিমুখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন তিনি; আর কখন কী করতে হবে তাও বুঝে যেতেন কীভাবে যেন। ফলে পরিস্থিতির হাল সবসময় তার হাতেই থাকত, অথচ হাবভাবে বোঝা যেত না সেটা, এতই দক্ষ ছিলেন নিজের কাজে।
তাঁর, বাবা যাকে বলতেন সুশৃঙ্খল মুন সেটি ছিল। অর্থাৎ, ধীরস্থির। প্রত্যেকটা সমস্যাকে বিচার করতে পারতেন আলাদা আলাদাভারে, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটি, সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন চট করে। একজন উঁচুদরের সফল জুয়াড়ি হতে গেলে যেসব গুণ থাকা দরকার, মিস ডায়ানার মাঝে আর সবই ছিল। বলতে কী, একসময় তাই ছিলেন মহিলা।
বেশ লম্বা ছিলেন তিনি। এমনকী আমি যখন গায়েগতরে পুরোপুরি বেড়ে উঠলাম তখনও লম্বা দেখাত তাঁকে। পুরুষ মাত্রেই আগ্রহ বোধ করত তার প্রতি, এবং ওরা সবাই তাঁকে সমীহ করত। আমার বিশ্বাস শুরুতে অনেকেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল তাকে, এদের ভেতর বিত্তশালী ক্ষমতাবান লোকজনও ছিল। তবে এসব কথা আমি ঘরোয়া আড্ডায় শুনেছিলাম, মিস ডায়ানার কাছে যেসব মেয়ে কাজ করত তাদের কাছে।
ক্যালিফোর্নিয়ায় বেতন খুব কম ছিল সেকালে, তবু একেকবারে কখনোই একজনের বেশি মেয়েকে চাকরি দেননি তিনি। এবং তাও অনেক বাজিয়ে নিয়ে। আমাদের জর্জ বুশও মিস ডায়ানার একজন কর্মচারী ছিল, মাসে বেতন পঁচিশ ডলার।
কী করতে হবে আমাকে? চাকরি নেয়ার সময় বুশ শুধিয়েছিল।
আপনার যা খুশি করতে পারেন, তবে আমি ডাকলেই যেন পাই, এবং প্রায়ই আপনার ডাক পড়বে। সবচেয়ে বড় কথা, নানা কথার পর যোগ করেছিলেন মিস ডায়ানা, আমি এমন মানুষ চাইছি যে বেশি কথা বলে না। আমি চাই আমাদের ব্যবসা সম্পর্কে আপনি কারোকে কিছু বলবেন না, আবার এমন ব্যবহারও করবেন না যাতে, লোকের মনে সন্দেহ জাগে।
এই বুশই আমাকে জানায় লস এঞ্জেলেসের সমস্ত ঘটনা মিস ডায়ানার নখদর্পণে। চামড়ার ব্যবসায় লাভ হওয়াতে তিনি এখন পুরোপুরি ঝুঁকে পড়েছেন এদিকে। তবে প্রকাশ্যে নয়, জর্জ এই ব্যবসাটা দেখাশোনা করে, তার হয়ে।
আমি যখন আসি মরুভূমি থেকে ততদিনে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে পুরনো একটা বাড়িও কিনে ফেলেছিলেন মিস ডায়ানা। এ ছাড়া শহরের উপকণ্ঠে কয়েক একর জমি ছিল তার। এসব জায়গায় তিনি কমলা আর আঙুর গাছ লাগিয়েছিলেন।
মিস ডায়ানার কাছে যেদিন এলাম আমি তার পরদিন সকালে আমাকে একটা খবরকাগজ দিয়ে পড়ে শোনাতে বললেন তিনি। যখন অনেকটা পড়া হয়ে গেল, আমরা নানান বিষয়ে গল্প করলাম। একগাদা প্রশ্ন করলেন মহিলা, বেশির ভাগই মজার, মানুষজন, তাদের পোশাক-আশাক, ঘোড়া এগুলো সম্পর্কে। এর পরের কয়েকটা দিন অনেক আলাপ করলাম আমরা, আইভানহে, রবিনসন ক্রুসো, রবিনহুড এদের নিয়ে। এসব গল্প আমার জানা, নিজে পড়েছি আবার বাবাও বলেছেন কিছু কিছু।
আজ বুঝতে পারছি, সেদিন তিনি আসলে আমার জ্ঞানের পরিধি বিচার করছিলেন। যদি সত্যিই জ্ঞান বলা যায় একে।
টমাস গ্রে-কে মনে পড়ে তোমার কথায় কথায় একদিন জিজ্ঞেস করলেন ডায়ানা।
পড়ে, ম্যাম। আমরা যখন পশ্চিমে আসছিলাম, ওই ভদ্রলোক নোটলকে কী-সব লিখছিলেন।
ঠিক। উনি এখন এ-শহরেই আছেন। ছোটখাট স্কুল খুলেছেন একটা। আমি ভাবছি ওঁর কাছেই পাঠাব তোমাকে। জানি ঝুঁকি আছে এতে, উনি তোমার আসল পরিচয় জানেন, তবু ঝুঁকিটা আমাদের নিতে হবে। কারণ, আমার বিশ্বাস, উনি একজন ভাল শিক্ষক হতে পারবেন তোমার জন্যে।
হ্যাঁ, ম্যাম। চকিতে আরেকটা কথা মনে পড়ল আমার। আচ্ছা, মিস্টার ভ্যালেটা এখন কোথায়?
ঈষৎ ভাবান্তর হলো মিস ডায়ানার চেহারায়। এখানেই আছে। মাঝেসাঝে দেখি রাস্তায়। তবে প্রায়ই স্যান ফ্রান্সিসকোয় চলে যায়।
ওকে আমার পছন্দ হয়নি।
আমারও না। এখনও পছন্দ করি না। পাঁড় জুয়াড়ি। ওকে এড়িয়ে চলবে, ড্যান।
পরে, যখন একা হালাম আমরা, ভ্যালেটার কথা জিজ্ঞেস করলাম বুশকে। সেও মিস ডায়ানার বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করল।
একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না, আমাদের বাসার ওপর কেউ একজন নজর রাখছিল কেন? এর সাথে কি আমার কোন সম্পর্ক রয়েছে? নাকি মিস ডায়ানার সাথে আছে? যদি দ্বিতীয়টাই ঠিক হয়ে থাকে, তা হলে কে এই মিস ডায়ানা? কেন আমাকে মানুষ করতে চাইছেন তিনি?
দয়ালু বলে? আমার বাবাকে শ্রদ্ধা করতেন তাই? নাকি একজন সঙ্গী চান বলে? কিংবা অন্যকিছু যা আমি জানি না?
গল্পের বই পড়লে মানুষ কৌতূহলী হয়ে ওঠে, প্রতিটি ঘটনার পেছনে যেসব কারণ লুকিয়ে থাকে সেগুলো জানতে চায়। কিন্তু বহু চেষ্টা সত্ত্বেও আমি বুঝতে পারলাম না আমার মত একটা বাচ্চা ছেলে কীভাবে কাজে আসতে পারে তাঁর, বরং আমার জন্যে তিনি বিপদে পড়তে পারেন এ-সম্ভাবনাই বেশি।
.
আজ স্কুলে ভর্তি হয়ে যাচ্ছি আমি। আমাদের স্কুলঘরটা লম্বা আর নিচু। একদিকে দুটো জানালা, দাঁড়ালে যানজার ওপাশে ফলমূলের বাগান দেখা যায়। আরেক দিকে একটা জানালা, ওখান থেকে চোখে পড়ে পরিত্যক্ত একটা কোরাল। কামরার ভেতরে আছে দুটো টেবিল আর চারটে বেঞ্চি।
শেষপ্রান্তে ছোট্ট একটা টেবিল আর চেয়ার, মিস্টার টমাস গ্রে বসেন ওখানে। আমরা ক্লাসরুমে ঢুকতেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
মিস ডায়ানা? কী সৌভাগ্য! আর এ হচ্ছে ড্যানিয়েল-?
ডিফো, রবিনসন ক্রুসো লেখকের নামটা বললেন ডায়ানা। ড্যানিয়েল ডিফো। আমার বিশ্বাস ওকে পড়িয়ে আপনি আনন্দ পাবেন।
নিশ্চয়। রোজ চারঘণ্টা করে ক্লাস হয় আমাদের এখানে। বোঝেনই তো, ম্যাম, আমাকে আরও কিছু করতে হয়।
বেশ তো। তা এ-মুহূর্তে কজন ছাত্র-ছাত্রী আছে আপনার?
মোটে পাঁচ। তিনটে মেয়ে আর দুটো ছেলে। ড্যান হবে ষষ্ঠ।
আচ্ছা। তা হলে কাল থেকেই?
সকাল আটটায়…এই ঘরে।
এরপর বেরিয়ে এলাম আমরা। মিস্টার গ্রে স্কুলের গেট অবধি আমাদের এগিয়ে দিলেন। রাস্তার এক কিনার ধরে হাঁটতে লাগলাম আমি আর মিস ডায়ানা। কোথাও কোথাও ফুটপাত আছে, কাঠের, তবে অধিকাংশ জায়গায় নেই। যেসব জায়গায় কাদা বা পানি জমে আছে, হাঁটার সুবিধের জন্যে সেখানে পাথর বিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
মিস ডায়ানার বইয়ের দোকানটা ছোট, একটা জেনারেল স্টোর আর স্যাডল শপের মাঝখানে অবস্থিত। শেলফে বইপত্তর বিশেষ নেই। কিছু খবরকাগজ আর ম্যাগাজিন রয়েছে।
শিগগিরই এসে পড়বে নতুন বই, বললেন তিনি। অর্ডার দেয়া আছে। টুপি খুলে ছাতার পাশে তিনি রাখলেন ওটা। তুমি কিন্তু আমাকে এখানে সাহায্য করতে পার, ড্যান। ঘুরেফিরে দেখবে কী কী আছে আমাদের কী লাগবে।
আপনি বই বিক্রি করেন?
নিশ্চয়ই। আবার রিডিংরুম হিসেবেও ব্যবহার হয় এটা। খবরকাগজ পড়তে আসে লোকজন; ব্যবসা, রাজনীতি এগুলোর আলাপ করে। কান খোলা রাখলে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু শিখতে পারে মানুষ।
তা ছাড়া যারা আমার সাথে দেখা করতে চায় তারাও আসে এখানে। অবশ্যি মূলত মিস্টার বুশই আমার ব্যবসা খাশোনা করেন। চকিতে দুষ্ট হাসির ঝিলিক খেলে গেল তার চোখে। হাজার হলেও, আমি মেয়েমানুষ, ব্যবসা-রাজনীতির কী বুঝি?
থাক, আমার কাছে আর লুকোতে হবে না আপনার, একগাল হেসে, প্রতিবাদ করলাম আমি। একদিন আমি ঠিকই বড় হব, তখন জানব কী করেন আপনি।
ততদিনে যেটি করার তা হয়ে যাবে, ড্যান। তবে আপাতত চোখকান খোলা রাখবে সবসময়, শিখবে, আর কথা বলবে না বেশি। একটা জিনিস মনে রেখ, বড় হয়ে তুমি যা-ই হও না কেন, বেঁচে থাকার জন্যে কাজ তোমাকে করতেই হবে। এটাই দুনিয়ার রীতি, ড্যান। তাই যা পার এইবেলা শিখে নাও।
আচ্ছা, আমার দাদু আসেন না আপনার দোকানে?
উনি পড়াশুনো করেন না। ইচ্ছে করলেই পারেন, কিন্তু করেন না। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের স্বভাবই এরকম, ভাবে একবার বড় হয়ে গেলে বই থেকে আর কিছু শেখার থাকে না।
দরজায় দাড়ালেই, রাস্তায় লোক চলাচল দেখতে পাচিহালাম আমি। এখানে সেখানে খুচরা বিক্রেতাদের হাট বসেছে। সূর্যাস্তের পর দোকান বন্ধ করলাম আম, বাসার দিকে এগোলাম। পথঘাট প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে তখন, অধিকাংশ লোকজন নিজেদের বাড়ি ফিরে গেছে।
এক লোক এসে দাঁড়াল আমাদের সামনে, টুপি খুলে অভিবাদন জানাল মিস ডায়ানাকে, বলল তারা একটা ফ্যানডাংগোর আয়োজন করছে, মিস ডায়ানার সময় হবে কিনা, যোগ দেয়ার। লোকটা যখন চলে গেল, ডায়ানা বললেন, উনি সিনর লিউগো। এখানকার এক বনেদি পরিবারের মানুষ, অনেক জমিজমা আছে। তোমার দাদুকে চেনেন ভদ্রলোক।
বন্ধু?
না। আমার তা মনে হয় না। তোমার দাদু কারও সাথে বন্ধুত্ব করেন না, করার আগ্রহও নেই। সবাই তাকে চেনে, সমীহ করে, ভয় পায়-ব্যস, এই পর্যন্ত।
মায়ের কাছে শুনেছি দাদু অনেকদিন আগে স্পেন থেকে এসেছেন এখানে। তখন খুব ছোট ছিলেন। রাজা জমি দিয়েছিলেন তাকে। শুনেছি, স্পেনে দাদুর বেশ ক্ষমতা ছিল, টাকাপয়সাও।
কিন্তু আমার কী মনে হয় জান, উনি ক্যালিফোর্নিয়ায় এসেছেন কেন? তাকে দেখে মনে হয় না তিনি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ, আর স্পেনে যদি মজবুত অবস্থানই ছিল, তা হলে সাত-সমুদ্র পেরিয়ে এই অখ্যাত জায়গায় এসে পড়ে আছেন কোন দুঃখে?
মা আর বাবাও আলাপ করতেন, এ-ব্যাপারে, তাঁদের কাছেও একটা ধাঁধার মত ছিল বিষয়টা।
তোমার মা-ই কি একমাত্র সন্তান ছিলেন?
জানি না। তবে মনে হয়..নাহ, ঠিক মনে নেই আমার।
তবু কী-যেন আবছায়া মনে পড়ছে আমার…কিছু একটা…কী?
প্রশ্ন যখন উঠেইছে, আমাকে জানতে হবে, অর্থ-সম্মান আছে এরকম একজন মানুষ কেন সবকিছু ছেড়েছুড়ে পড়ে আছেন এখানে এসে। ক্যালিফোর্নিয়া ভাল জায়গা, কিন্তু ক্ষমতা থেকে বহুদূরে। আচ্ছা, কথাটা কোথায় যেন শুনেছি আমি? বাবার কাছে বোধহয়।
নিজের বংশ সম্পর্কে অনেক কথাই বলতেন মা, এবং তার মাঝে আমি আভিজাত্য আর বংশগৌরবের অহঙ্কার পুরোমাত্রায়ই লক্ষ করেছি। তবে আমার মনে হয়, এসব অহঙ্কারের ভিত্তি একটা পরিবারের বহু প্রাচীন কোন ঘটনার ওপর গড়ে ওঠে, কিংবা বংশ-পরম্পরায় অব্যাহত সাফল্যের মাঝ দিয়ে।
বাবাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম কথাটা, তিনি সায় দিয়েছিলেন আমার মতে। বলেছিলেন, আজ যারা বংশমর্যাদায় কৌলীন্যের দাবিদার, খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে তাদের বংশের প্রতিষ্ঠাতা কোন গরীব চাষী ছিলেন। ভাগ্যের চাকা ফৈরাতে হয়তো বেরিয়ে পড়েছিলেন একদিন, তারপর নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে মোটামুটি সম্মানজনক একটা অবস্থানে পৌঁছেছিলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এধরনের সাফল্য এসেছে তরবারির জোরে। প্রাচীনকালে সাহসী সবল মানুষ রাজার সেনাদলে। নাম লেখাত, তাদের বীরত্বে খুশি হয়ে রাজা তাদের জমিদারি, সোনাদানা এগুলো উপহার দিতেন। এবং এভাবেই শুরু হত নতুন একটা অভিজাত বংশের যাত্রা। অত, বাবা বলেছিলেন, ইউরোপে তাই ঘটেছিল।
.
সেরাতে বিছানায় শুয়ে ঘুম এল না। কাল থেকে শুরু হচ্ছে আমার স্কুলজীবন, আর এ-ব্যাপারটাই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। একধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা ছিল আমার মাঝে, সমবয়েসী ছেলেদের সঙ্গে কখনোই মিশতে পারতাম না। বেশির ভাগ সময়ে আমার বন্ধুত্ব, ওঠাবসা হয়েছে বড় মানুষদের সাথে। ফলে অনেক ব্যাপারেই অন্য ছেলেমেয়েদের চেয়ে আমি একটু বেশি জানতাম। আর এটাই সহ্য করতে পারত না। ওরা, ভাবত আমি বুঝি গুলতানি মারছি। এজন্যে অনেক সময় ওদের ধমক-ধামক খেতে হয়েছে আমায়। বার দুয়েক লাগতেও এসেছিল কেউ কেউ পারেনি। খালিহাতে কীভাবে আত্মরক্ষা করতে হয় বাবা আমাকে একটু-আধটু শিখিয়েছিলেন।
স্কুলে যেতে ভয় হচ্ছিল আমার, কারণ আরও দুটো ছেলে ছিল ওখানে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, ওদের কেউ একজন সর্দারি ফলাতে চাইবে আমার ওপর। এবং লড়াই বেধে যাবে আমাদের মধ্যে। অবশ্যি লড়াইকে আমার ভয় তা নয়; মুশকিল হচ্ছে, মিস ডায়ানা পছন্দ করবেন না ব্যাপারটা।
তখনকার দিনে লস এঞ্জেলেসে সবকিছুই ছিল একে অন্যের কাছাকাছি। মিস ডায়ানার বাসা থেকে স্কুল মিনিট তিনেকের পথ, আমি সকাল আটটার একটু আগেই হাজির হালাম, সেখানে।
বাইরের বেঞ্চিতে দুটো ছেলে আর দুটো মেয়ে বসেছিল, তবে একসঙ্গে নয়। আমি যখন উঠনে ঢুকরলাম, সবাই তাকাল চোখ তুলে কিন্তু কেউই কিছু বলল না। একটা ছেলের স্বাস্থ্য আমার চেয়ে ভাল, অনুমান করলাম বয়েসেও বড় হবে।
কী চাস এখানে? রুক্ষ স্বরে জানতে চাইল সে।
আমি ক্লাসে যাচ্ছি।
যদি ঢুকতে না দিই?
আমি চাইনি, তবু বেধে গেল গোলমাল। কিন্তু কী করব, এড়াতে চাইলেই কি আর ঝামেলার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় সর্বদা। ওর দিকে এগোলাম আমি।
এটা মোটেও আশা করেনি ও, ফলে একটু ঘাবড়ে গেল।
মিস্টার গ্রে আমাকে চেনেন। উনি জানেন আজ সকালে আমি আসব।
বাইরের বুড়ো গ্রে-র কোন খবরদারি চলে না। তার যত হম্বিতম্বি ক্লাসে। আর এই উঠনটা–আমার এলাকা।
আমি বললাম না কিছু, স্রেফ ধৈর্য ধরলাম। আমার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। লম্বা-তাগাড়া হতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস হলো না আমি যেসব ইন্ডিয়ান ছেলের সাথে কুস্তি লড়েছি ও তাদের চেয়ে শক্তিশালী হবে।
কে তুই? আমি আগে কখনও দেখিনি তোকে।
এই তো দিনকতক আগে এসেছি সাগর থেকে। বস্টনের একটা জাহাজে চড়ে।
অপর ছেলেটা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। সাগর থেকে? আচ্ছা!
আমার নাম, বললাম আমি, ড্যানিয়েল ডিফো।
এ আর এমন কী, ঠোঁট ওলটাল হামবাগ ছেলেটা, যে-কেউ আসতে পারে সাগর থেকে।
নিশ্চয়ই পারে। তবে আমি তাই এসেছি।
মিছে কথা বলেছিলাম আমি। আসলে তো আমি আসিনি সাগর থেকে, কিন্তু আমার কাহিনিটা প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজন ছিল। মিস ডায়ানা এভাবেই শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন আমায়।
ঠিক ওই মুহূর্তে রাস্তা থেকে উঠনে এসে ঢুকলেন টমাস গ্রে। সুপ্রভাত, ড্যান। র্যাড হিউবারের সাথে ইতিমধ্যেই তোমার পরিচয় হয়ে গেছে দেখছি। আর এ হচ্ছে-অপেক্ষাকৃত ছোট ছেলেটার দিকে ইশারা করলেন তিনি-মাইলো বার্নস।
আর ওই মেয়ে দুটি, বললেন গ্রে, ডেলা কোর্ট আর কেল্ড ওব্রায়েন। ডানে বাঁয়ে তাকালেন শিক্ষক। অ্যানাবেলকে দেখছি না। ও কোথায়?
পরে আসবে। ডেলা নামের মেয়েটা জানাল। ওর বাবা আসছেন আজ, তাই ও রয়ে গেছে বাসায়।
গ্রে তাকালে আমার পানে। ওর বাবা কুইন বেস জাহাজের ক্যাপ্টেন, নাম জন লরেল।
ভেতরে গিয়ে বেঞ্চিতে বসলাম আমরা। অন্যরা আমি আসার আগেই নিজেদের সিট দখল করেছিল, তাই ওরা বসা অবধি আমি অপেক্ষা করলাম, তারপর নিজেও বসে পড়লাম।
ওখানে অ্যানাবেল বসে, কুদ্ধ স্বরে বলল র্যাড।
দুঃখিত, বলে একটু সরে বসলাম আমি।
তুই অন্য টেবিলে গিয়ে বস, আদেশ করল র্যাড।
ও যেখানে বসেছে ঠিকই আছে, বললেন গে। রাগে একটু নড়েচড়ে উঠল র্যাড, বলতে নিল কিছু, তারপর কী ভেবে চুপ করে গেল।
আজ আমরা, শিক্ষক বললেন, কথ্যভাষায় প্রত্যয়-বিভক্তির ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করব।
আর এভাবেই শুরু হলো আমার স্কুলজীবন।
.
১৫.
পরপর তিনদিন স্কুলে হাজিরা দিলাম আমি, প্রত্যেক দিনই আমার পাশের আসনটা ফাঁকা ছিল।
চতুর্থ দিন, স্কুলে ঢুকছি এই সময়ে র্যাড উঠনে থামাল আমাকে। পা ফাঁক করে দাঁড়াল ও। মাইলো বার্নস দাঁড়িয়ে ছিল একপাশে, তবে মেয়েরা তখনও আসেনি স্কুলে। কিংবা এলেও আমি দেখতে পাইনি ওদের।
অ্যানাবেল আজ স্কুলে আসছে, বলল র্যাড। তুই অন্য টেবিলে বসবি।
মিস্টার গ্রে আমাকে বলে দিয়েছেন কোথায় বসতে হবে। আমি সেখানেই বসব।
অ্যানাবেল আমার প্রেমিকা! হয় তুই সরবি নয়তো আমিই সরাব তোকে।
অ্যানাবেলকে আমি চিনি না, বললাম, তবে আমি যেখানে আছি সেখানেই থাকব।
আমাকে ঘুসি মারল ও। ব্যাপারটা নিতান্তই অপ্রত্যাশিত ছিল আমার কাছে, পড়ে গেলাম মাটিতে। হতভম্ব হয়ে উঠে বসলাম আমি, মুখে হাত রাখতেই দেখলাম রক্ত পড়ছে। ঝাঁ করে খুন চড়ে গেল মাথায়, দাড়াতে চেষ্টা করলাম, পাঁজরে লাথি মেরে আবার আমাকে ফেলে দিল র্যাড।
গড়িয়ে সরে গিয়ে প্রয়াস পেলাম ওঠার, ফের মার খেলাম। একই ব্যাপার ঘটছিল বারবার, আমি ওঠার চেষ্টা করছি, আর ব্ল্যাড মাটিতে শুইয়ে দিচ্ছে আমাকে। মাথা ঘুরছে আমার, রক্ত পড়ছে, ব্যথা করছে, তবু হাল ছাড়লাম না আমি। কেন, তা জানি না, তবে তাগিদটা আসছিল আমার ভেতর থেকে।
একটা মেয়ে চেঁচিয়ে উঠল। র্যাড! তুমি ছেড়ে দাও ওকে!
চলে এস, র্যাড। ওকে ছেড়ে দাও, আবেদন জানাল মাইলো।
চুপ কর! অভদ্র সুরে বলল র্যাড। নিজেকে খুব চালু মনে করে ও। আজ একটা উচিত শিক্ষা দিয়ে দেব!
ফের উঠতে নিলাম আমি, হাত আর হাঁটুতে ভর দিয়ে উঁচু হালাম একটু, আর অমনি আমার পাজরে লাথি মারল ও। ব্যথায় খাবি খেলাম আমি, তবু চেষ্টা করলাম উঠে দাঁড়াতে।
দেখেছ? নাক সিটকাল র্যাড। আমার কাছে ও এখনও শিশু।
পিছিয়ে গেল ও, ঘুরে দাঁড়াল। হাঁচড়েপাঁচড়ে সোজা হালাম আমি, ধেয়ে গেলাম ওর দিকে, সমানে ছুড়ছি দুহাত। চেঁচাল কে যেন, র্যাড ঘাড় ফেরাল। আমার একটা ঘুসি আঘাত করল ওর মুখে, ঠোঁট কেটে রক্ত বেরোল, কিন্তু পরক্ষণে একধাক্কায় আমাকে সরিয়ে দিল সে, র্যাড আমার চেয়ে লম্বা, হাত দুটোও বড়, ফলে অনায়াসে তুলোধুনো করল আমাকে। তারপর হঠাৎই মিস্টার গ্রে হাজির হলেন ওখানে।
থাম, থাম! কী হচ্ছে এসব? র্যাড, থাম তুমি! ছেড়ে দাও ওকে!
হাহ দোষ ওরই!
সরে গেল ও। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম আমি, সারা গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, কাপড়চোপড় থেকে ধুলো ঝাড়ার প্রয়াস পেলাম।
টমাস গ্রে এগিয়ে এলেন আমার কাছে। ব্যথা পেয়েছ তুমি? জিজ্ঞেস করলেন।
না, মিথ্যে বললাম।
মুখ ধুয়ে, ক্লাসে এস।
ক্লাসরুমের দরজার পাশেই ওঅশ বেসিন, রক্ত আর ধুলো ভাল করে ধুয়ে ফেলে তোয়ালেতে মুখ মুছলাম আমি। তারপর খোঁড়াতে খোড়াতে ক্লাসে ঢুকরলাম।
ঘাড় ফেরাল র্যাড, ভেংচি কাটল। আমি এগিয়ে গিয়ে আমার রোজকার জায়গায় বসে পড়লাম। র্যাড তাড়াতে নিল, কিন্তু মিস্টার গ্রে ধমক লাগালেন, র্যাড! তুমি বসে থাক!
ওকে আপনি অন্য টেবিলে সরিয়ে দিন, নইলে আমিই সরাব!
না। ফের যদি তুমি এসব কথা বল, তোমাকে আমি বের করে দেব স্কুল থেকে।
হাহ! র্যাড ভেংচি কাটল। আপনি তা পারবেন না। বাবা এক টার্মের পুরো টাকাটাই দিয়ে দিয়েছেন। এখন যদি আমাকে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন, উনি ছাড়বেন না আপনাকে।
ইতিমধ্যে, আমি আমার বই খুলেছি, শ্লেট বের করেছি ব্যাগ থেকে। মিস্টার গে তাকালেন আমার দিকে, কিন্তু কিছু বললেন, না। তার মুখ ফ্যাকাসে, থমথমে। মনে হলো ভয়ও পাচ্ছেন একটু। এই স্কুলের ওপর নির্ভর করছে তার খাওয়া-পরা, আমার ধারণা হলো র্যাডকে যদি শেষপর্যন্ত বিতাড়িত করতেই হয় ওর বেতনের টাকা ফেরত দিতে পারবেন না টমাস গ্রে।
আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল র্যাড, তবে কথা বাড়াল আর। নিজের বই খুলল সে, মলাটের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফিসফিস করে বলল, দাঁড়া! স্কুল ছুটি হোক, তারপর দেখাচ্ছি মজা।
আমার মুখ থেকে টপ করে কী যেন পড়ল শ্লেটে। এক ফোঁটা রক্ত। ওটা মুছে ফেললাম আমি, যেখানে পড়েছিল রক্ত বিতৃষ্ণ চোখে চেয়ে রইলাম সেদিকে।
কী করব আমি? স্কুল ছুটির পর আবার আমাকে ধোলাই করবে ও। কেউ থামাবে না ওকে। তখনও ঝিমঝিম করছে আমার মাথা, চিবুক ঝুলে পড়েছে স্লেটের ওপর, কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু কাঁদলাম না। ওই পুলক ওকে আমি পেতে দেব না! যেভাবেই হোক, এর একটা বিহিত…
বেশ জোরে মারতে পারে র্যাড। আবার আমাকে আঘাত করবে, জোরে। লাথি মারবে। ওদের পেটে আঘাত করবে তুমি, বাবা উপদেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু র্যাডের হাত লম্বা। ঘুসাঘুসি ব্যাপারটা আমি কম জানতাম; তবে ইন্ডিয়ানদের সাষে কুস্তি লড়ার অভিজ্ঞতা ছিল। ওদের সবাইকে হারিয়েছিলাম, কেবল ফ্রান্সিসকোই ব্যতিক্রম। আমরা কেউই কারোকে হারাতে পারিনি কখনও।
মিস্টার গ্রে যখন আইভান হো-র গল্প থেকে পড়তে ললেন আমাকে, তার কথা প্রথমে আমি শুনতে পেলাম না। তারপর উঠে পড়তে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে, কারণ আমার ঠোঁট ফুলে গিয়েছিল, তবু মোটামুটি ভালই পড়লাম।
ভেরি গুড, ড্যান, বললেন মিস্টার গ্রে।
হাহ্! মুখ বাঁকাল র্যাড।
এরপর ক্লাসের কোন কথাই আর দুকল না আমার কানে বসে বসে কেবলই ভাবতে লাগলাম কী করা যায়। আর মার খেতে চাই না আমি! সবার সামনে আমি ধুলোয় লুটাব, আর মুখ টিপে হাসবে ওরা, এ কিছুতেই বরদাশত হবে না আমার। তাই, কিছু একটা আমাকে করতেই হবে।
একটা ব্যাপার আমি জানি। আমি সরছি না। অ্যানাবেলকে আমি চিনি না। মাথাব্যথাও নেই চেনার, তবু আমি সরর না! পারলে ও আমাকে খুন করুক, আমি যেখানে আছি সেখানেই থাকব।
আচ্ছা, এ-অবস্থায় কী করা যায়? কিছু একটা…বাবা বলতেন মাথা খাটালে উপায় যা হোক বের হয়ই। প্রতিটা সমস্যারই জবাব আছে। এখন আমি যদি….
বোধহয়….
শিগগিরই ভাঙবে ক্লাস, আবার বাইরে যেতে হবে আমাকে। এখানে হয়তো-বা, আমাকে রক্ষা করতে পারবেন টমাস গ্রে, কিন্তু ক্লাসের বাইরে তার কর্তৃত্ব চলবে না।
দরজায় নড়াচড়ার আভাস পেলাম একটা, আমি পলক তুললাম। চৌকাঠের ঠিক ওপাশে দাঁড়িয়েছিল মেয়েটি, ওর চুল স্পর্শ করছিল রোদ! লাল-সোনালি আভা দেখা যাচ্ছিল।
একহারা গড়ন, শরীরের প্রতিটি চড়াই-উতরাই স্পষ্ট–এবং রূপসী।
ওর-ই নাম অ্যানাবেল…প্রথম দেখায়ই আমি প্রেমে পড়লাম।
১.৪ দোরগোড়ায় একমুহূর্ত স্থির
দোরগোড়ায় একমুহূর্ত স্থির রইল ও, লাল-সোনালি চুলে সূর্যকিরণ, তারপর এগিয়ে এসে বসে পড়ল আমার পাশে। আপনা থেকেই উঠে দাঁড়ালাম, আমি, পিছিয়ে গিয়ে ভালমত বসার সুযোগ করে দিলাম ওকে। অ্যানাবেল হাসল আমার উদ্দেশে, আমি কেঁপে উঠলাম। তারপর নিজেও বসলাম মেয়েটির পাশে। ওর গাউনে কানা আমার প্যান্ট ছুঁয়ে গেল।
মিস লরেল, বললেন শিক্ষক, আমাদের নতুন ছাত্র, মাস্টার ডিফো, এইমাত্র আইভান হো-র একটা অংশ পড়ে শুনিয়েছেন আমাদের। তুমি শেষটুকু পড়।
গড়গড় করে পড়ে গেল ও, নিচু অথচ সুরেলা কণ্ঠে। আমি চোখ তুললাম না, ঠায় চেয়ে রইলাম বইয়ের দিকে, যদিও ঝাপসা দেখছিলাম সব। আতরের সুবাস আসছিল আমার নাকে, তাজা, ফুলের মত।
শেষমেশ যখন পলক তুললাম, দেখলাম র্যাড আগুন চোখে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে, আর আমি হঠাৎ অসুস্থ বোধ করলাম। আবার আমাকে আক্রমণ করবে ও, যেমনটা শাসিয়েছে। পরাস্ত করবে আমাকে এবং আমি আবার লুটিয়ে পড়ব ধুলোয়। তবে এবারের পরিস্থিতিটা হবে অন্যরকম।
অ্যানাবেল থাকবে সেখানে। দেখতে পাবে ঘটনাটা। এবং করুণা করবে আমাকে।
ভয় আর মানসিক যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত আমি, অপেক্ষা করছি কখন শেষ হবে ক্লাস। জর্জ বুশ আমার ঘোড়া নিয়ে আসবে। প্রাচীন ইন্ডিয়ান ট্রেইল ধরে আলকাতরার খনিতে যাওয়ার কথা আছে আমাদের।
ক্লাস থেকে বেরোনোর সময় আমার দিকে চোখ পড়ল অ্যানাবেলের, ভয়ে আঁতকে উঠল সে। তোমার মুখ! কীভাবে হলো?
মারামারি। বোধহয় এখন আবার হবে।
র্যাড। র্যাডের কাজ, তাই না?
হ্যাঁ। ওর লজ্জা হওয়া উচিত। দুর্বলের গায়ে হাত তোলে।
তুমি যা ভাবছ, র্যাড ততটা বিরাট কিছু নয়।
দরজার উদ্দেশে হাঁটা দিয়েছিলাম আমরা, কিন্তু আমি যখন অ্যানাবেলকে আগে বেরোতে দেয়ার জন্যে পিছিয়ে গেলাম এক কদম, একটা হাত খামচে ধরল আমার কাঁধ, এবং আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। র্যাড আমার জায়গায় এসে দাঁড়াল, অ্যানাবেলের পাশাপাশি হলো।
এবার রেগে গেলাম আমি, শীতল ক্রোধ জেগে উঠল। মেয়েটির সাথে বেরিয়ে যাচ্ছিল ও, ডাকরলাম পেছন থেকে।
কী ব্যাপার, চলে যাচ্ছ বড়? ভয় পেলে নাকি?
ঝট করে থমকে গেল র্যাড, ঘুরে দাঁড়াল। অন্যরাও দাড়িয়ে পড়ল, ক্লাসের দরজায় আমাদের শিক্ষক পর্যন্ত।
ভয় পাব? তোকে? বইখাতা নামিয়ে রাখল ও, তেড়ে এল আমার দিকে।
এইবার, মনে মনে বললাম আমি। আঘাত করার সুযোগ দিয়ো না ওকে, কুস্তি, লড়।
লম্বায়-চওড়ায় সবদিক থেকেই র্যাড আমার দ্বিগুণ, কিন্তু ও কতটা জানে এসবের? ঘুসি মারার জন্যে হাত তুলে রেখেছিল ছোকরা, আমিও। তারপর আচমকা লাফিয়ে পড়লাম ওর পায়ের ওপর, গোড়ালি ধরে মারলাম এক হ্যাচকা টান। সজোরে আছাড় খেল ও।
সঙ্গে সঙ্গে, আমার ডান বগলের নীচে চেপে ধরলাম ওর গোড়ালি, মোচড় দিয়ে প্রায় উপুড় করে ফেললাম ওকে। তারপর ধপ করে আমি বসে পড়লাম র্যাডের নিতম্বের ওপর, উল্টো দিকে মুখ করে। ইন্ডিয়ানরা এই কৌশলটি শিখিয়েছিল আমাকে, জানতাম এখন গোড়ালিতে আরেকটু চাপ বাড়ালেই ওর হিপ-জয়েন্ট ভেঙে যাবে।
পেছনে সামান্য ঝুঁকরলাম আমি, ব্যথায় ককিয়ে উঠল র্যাড। মিস্টার গ্রে হাঁ-হাঁ করে ছুটে এলেন আমাদের দিকে। বাইরে, রাস্তায়, ইতিমধ্যে এসে পড়েছিল জর্জ, স্যাডলের ওপর বসে দেখছিল মারামারি।
বান্ধবীদের সাথে একটু তফাতে দাঁড়িয়েছিল অ্যানাবেল, ওদের চেহারায় উত্তেজনা আর বিস্ময়।
ছেড়ে দাও ওকে! মিস্টার গ্রে আদেশ করলেন।
দেব, কিন্তু তার আগে ও বলুক, আর কখনও ঘাটাবে না আমাকে। আমি কোন ঝামেলা চাই না।
র্যাড, ওর কথার জবাব দাও? গ্রে বললেন।
আমি খুন করব ওকে!
আবার পেছনে সরলাম আমি, এবার আর্তনাদ করে উঠল র্যাড। তারপর বলল, না! না! ছেড়ে দাও আমাকে! আর কক্ষনো লাগব না আমি!
ছেড়ে দিয়ে, উঠে পড়লাম আমি। র্যাড পড়ে রইল একটুক্ষণ, তারপর উঠে দাড়াল ব্যথায় কোকাতে কোকাতে। আমি সতর্ক, পিছু হঠলাম এক পা।
ঢের হয়েছে, আর নয়! তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন মিস্টার গ্রে। ফের যদি গোলমাল কর তোমরা, তোমাদের দুজনকেই বিতাড়িত করব আমি। বোঝা গেছে?
আমি কখনোই গোলমাল করতে চাইনি, বললাম আমি।
র্যাড চোখ পাকাল, কিন্তু বলল না কিছু। অ্যানাবেল একঝলক তাকাল আমার দিকে, তারপর ঘুরে চলে গেল ওর দুই বান্ধবী, ডেলা আর কেল্ডার সাথে।
মিস্টার গ্রে-র উদ্দেশে ঘুরে, আমি বললাম, সার, আমি দুঃখিত। আমি চাইনি মারামারি করতে।
যখন পৌঁছুলাম আমার ঘোড়ার কাছে, জর্জ আমার চেহারা দেখে বলল, তুমিও, মনে হচ্ছে, খেয়েছ দু-চার ঘা।
আগের বার। ওর হাত বেজায় লম্বা।
উচিত সাজা পেয়েছে ছোঁড়া। তা ওই কায়দা শিখলে কোত্থেকে?
কাউইয়া। ওরা হামেশা কুস্তি লড়ে।
দাঁড়াও, একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব তোমার। বক্সিং শিখবে। নইলে এরপর যদি কখনও আবার মারামারি হয় তোমাদের, ওই ছোকরা হয়তো, আর তার কাছে ঘেঁষতে দেবে না তোমাকে।
নীরবে খানিকক্ষণ এগোলাম আমরা, তারপর বুশ বলল, শোন, মিস ডায়ানা চান, লস এঞ্জেলেস আর এর আশপাশের এলাকা তুমি চিনে নাও ভাল করে। কেন, তা জানি না, তবে মনে হয় নিশ্চয় এর পেছনে কোন উদ্দেশ্য আছে ওর।
মিস ডায়ানাকে আমার ভাল লাগে।
উনিও ভালবাসেন তোমাকে। আরেকটা কথা, এদিককার সবকটা ভাষা শিখতে হবে তোমাকে। ইন্ডিয়ানগুলোও।
একটু কঠিন হবে।
হোক, মিস ডায়ানা কথাটা তোমাকে বলার জন্যে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন।
সেদিন আলকাতরার খনি এবং আরও কয়েক জায়গায় ঘুরে আমরা যখন বাড়ির পথ ধরলাম তখন প্রায় সন্ধ্যে। বাসায় ফিরে দেখলাম মিস ডায়ানা দরজায় দাঁড়িয়ে, অপেক্ষা করছেন আমার জন্যে। তার চেহারা দেখেই বুঝতে পারলাম আমি, কিছু একটা ঘটেছে। খারাপ কিছু।
.
১৭.
আমার কাঁধে হাত রাখলেন মিস ডায়ানা, কিন্তু মুখ খুললেন জর্জের উদ্দেশে। একটু ভেতরে আসবেন, মিস্টার বুশ? আপনার এখানে উপস্থিত থাকা দরকার।
আমার চুলে বিলি কাটলেন তিনি। ড্যান? তোমার সাথে দেখা করতে এসেছেন একজন অতিথি।
সন্ধে হয়ে গেছে তখন, মোম জ্বলে উঠছে। ডায়ানার কণ্ঠে উদ্বেগের সুর আমার কান এড়াল না। ডান হাতে রাইফেল আর পিস্তল বেল্ট ধরেছিলাম আমি, এগুলো ছাড়া কখনও বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল আমাকে।
না, ড্যান, ওসবের দরকার পড়বে না তোমার। এস, ভেতরে এস।
আমাকে রাস্তা দেয়ার জন্যে সরে দাড়ালেন তিনি, তারপর আমাদের পেছনে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
এই একটা মুহূর্ত সারাজীবনেও ভোলার নয়। নীরব কামরা, মৃদু আভা ফুটেছে দুটো মোমদানি থেকে দেয়ালের ধারে নকশাখচিত সিন্দুক, টেবিল, চেয়ার, মেঝেতে শতরঞ্চি, আর দীর্ঘদেহী ঋজু এক মহিলা, সোজা চেয়ে আছেন আমার পানে।
ওঁর চুল কালো, তবে কপালের কাছটায় সাদা। কাঁধের ওপর দামী একখানা শাল। মহিলার অবয়ব কৃশকায়; তবে লোকে যাকে বলে আভিজাত্য তা আছে।
মহিলা যথেষ্ট সুন্দরী, রাশভারী; যৌবন ছিল না তখন আর, কিন্তু ব্যক্তিত্ব ছিল, বয়েস আরেক ধরনের সৌন্দর্য দান করেছিল তাকে। এই আভিজাত্য এর আগে কারও মাঝে দেখিনি আমি, মনে হয় না ভবিষ্যতেও কখনও পাব দেখতে।
ঠিক-মহিলার কণ্ঠ নিচু, অত্যন্ত মিষ্টি-আলবত। একেবারে ওদেরই মত দেখতে তুমি!
এগিয়ে এলেন তিনি, একটা হাত সামনে বাড়ানো। ড্যান, আমি তোমার গ্রেট আন্ট…এলেনা এই মুহূর্তটির জন্যেই এতকাল অপেক্ষা করছিলাম আমি।
গ্রেট-আন্ট? বুশের কাছে আমি শুনেছি আমার নানী মারা যাওয়ার পর থেকে, দাদুর এই ছোট বোনটিই তাঁর সংসার আগলাচ্ছেন। মায়ের কাছেও তার এই ফুফুর প্রশংসা শুনেছি। কিন্তু উনি যদি আমার দাদুর বোন হয়ে থাকেন, তা হলে নিশ্চয় আমার শত্রু হবেন। অথচ তাকে দেখে শত্রু বলে মনে হলো না। তার হাসি আমাকে সস্নেহে কাছে টেনে নিল।
–আমি ড্যান… একটু দ্বিধা করলাম আমি, তারপর যোগ করলাম, ড্যানিয়েল ও’হারা।
আমি জানি। বসলেন গ্রেট-আন্ট, আর অতি তুচ্ছ এই নড়াচড়াতেই রাজকীয় একটা ভঙ্গি ফুটে উঠল। আমরা কি একটু কথা বলতে পারি, ড্যান? মিস ডায়ানার দিকে ফিরলেন তিনি। আপনি খুব ভাল। আমার হাতে সময় বেশি নেই। ভাই যদি খোঁজ করে…রাতে আমি আবার কখনোই বের হই না কিনা।
ঠিক আছে।
নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করল জর্জ, কামরার শেষপ্রান্তের একটা চেয়ার দখল করল।
প্লিজ, ড্যান, তুমি আমাকে তোমার মায়ের কথা বল।
আমার মায়ের কথা? কী বলব? কী বলতে পারব তাকে? কেন বলব?
আমি ওকে ভীষণ ভালবাসতাম, ড্যান। ও আমার নিজের মেয়ের মত ছিল। তোমার বাবাকেও পছন্দ করতাম আমি। সবকিছু যদি আমার ইচ্ছায় হত…।
মা খুব সুন্দরী ছিলেন, বললাম, অবিকল আপনার মত। এমনিতে সুখীই ছিলেন, কিন্তু বাড়ির জন্য তাঁর মন কাঁদত। বাবা তাকে ক্যালিফোর্নিয়ায় নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, মা দাদুর ভয়ে রাজি হননি।
তোমার বাবা সরসময়ই ওরকম-সাহসী মানুষ ছিল। ভয় কাকে বলে জানত না। বল আমাকে, বাছা, কোথায় ছিলি তোরা? কী অবস্থায় ছিলি? সব খুলে বল আমাকে।
তো, আমি সংক্ষেপে সবই বললাম গ্রেট-আন্টকে। যখন শুনলেন কী কষ্টের মধ্যে মায়ের আমার মৃত্যু হয়েছে, বাবাকে খুন করেছে দাদুর লোকজন, জলে ভরে গেল তার চোখ।
আমি নিজেই টের পাইনি কখন শেষ হয়ে গেছে আমার কথা। পিনপতন নীরবতা নেমে এসেছে ঘরে, আন্ট-এলেনা পাথর! খানিক বাদে রুমালে চোখ মুছলেন তিনি। তোকে ধন্যবাদ, বাছা, আমাকে সব বলার জন্যে।
উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এবার আমাকে যেতে হবে। কখনও যদি আমাকে তোর প্রয়োজন পড়ে, বাছা, সিনর বুশ নয়তো ডায়ানাকে দিয়ে একটা খবর দিস। আর তুই সাবধানে থাকিস একটু! তোর দাদুর ব্যাপারে আমি কিছুই করতে পারব না। এ নিয়ে বহুবার আমাদের তর্ক হয়েছে।
এখনও সে জানে না কিছু। জানলে আমি ঠিকই খবর পাব। ওর বিশ্বাস তুই মারা গেছিস। এখন তো প্রায়ই বলছে স্পেনেই ফিরে যাবে আবার।
তবে তুই, বাবা, গোলমাল থেকে দূরে থাকিস। স্কুলে কী এক মারামারির কথা বলছিল মেয়েরা, তখনই ড্যান নামটা কানে এল আমার, শুনলাম সে মিস ডায়ানার বাসায় থাকে। আমি জানতাম ডায়ানা তোর বাবার সাথে একই ওয়াগনে চেপে এসেছেন, এবং সিনর বুশ তখন কাজ করতেন সিনর হিউজের অধীনে।
দরজার উদ্দেশে এগোলেন গ্রেট-আন্ট, কিন্তু তাকে বাধা দিয়ে আচমকা উঠে দাঁড়াল জর্জ। এক মিনিট, ম্যাম। আমি আগে বাইরেটা দেখে আসি একবার।
একটু বাদেই ফিরে এল ও। ঠিক আছে, ম্যাম। বুঝলেন না, সাবধান থাকা ভাল।
দরজায় হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন এলেনা, চুমু খেলেন আমার কপালে। তারপর থতমত খেয়ে বেরিয়ে গেলেন বাইরে, অন্ধকারে অদৃশ্য হলেন।
পেছন থেকে আমার কাঁধে আলতো একটা হাত রাখলেন মিস ডায়ানা। ড্যান, আমার বিশ্বাস উনি তোমাকে ভালবাসেন, যেমন বাসতেন তোমার মাকে।
কিন্তু উনি তো জানেন না আমাকে।
তোমার মাঝে তোমার মাকে দেখতে পেয়েছেন উনি। টিয়া এলেনার কোন ছেলেপুলে নেই, তাই তোমার মাকে নিজের মেয়ে মনে করতেন। আর এখন তোমার কথা ভাবছেন।
ভদ্রমহিলা বেশ ভাল।
হ্যাঁ। এখানে এসে বিরাট ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন। তোমার দাদু জানতে পেলে অনর্থ করবেন, হয়তো আটকে রাখবেন ওকে।
করতে পারবেন এরকম?
পারবেনএবং করবেনও।
.
সেরাতে ঘুমোলাম না আমি, কেবলই ভাবলাম টিয়া এলেনার কথা। কিছু কিছু ব্যাপারে মিস ডায়ানার সাথে মিল আছে তার, তবু আলাদা, চমৎকার ইংরেজি বলেন, যদিও আঞ্চলিক টান রয়েছে। দেখলাম ওঁর কথা ভাবতে ভাল লাগছে আমার, কারণ তিনি আমার আত্মীয়, আমার নিজের রক্তের, তিনি ছাড়া দুটো সুখদুঃখের কথা বলার মত আর কোন আত্মীয়কে আমি চিনি না।
পাশাপাশি একধরনের অস্থিরতাও পেয়ে বসেছে আমাকে, বারবার মরুভূমি আর পাহাড়ে ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ফ্র্যান্সিসকো এখন কোথায়? ও কি ভুলে গেছে আমাকে?
বুনো জায়গার প্রতি টান আমার রক্তে, এবং আরও কিছু আছে, অদ্ভুত সব হাতছানি, বাতাসে কারা যেন ফিসফিস করে ডাকে আমাকে ফিরে যেতে বলে সেখানে চাঁদের কাছে যেখানে কাতর ফরিয়াদ জানায় নিঃসঙ্গ কয়ৌট, আর দৈত্যকায় ফণিমনসা হাত বাড়িয়ে থাকে আকাশের দিকে।
কিন্তু ফিরতে পারব না আমি। এখনও নয়। বাবা চাইতেন আমি যেন স্কুলে যাই, মিস ডায়ানা জানতে চেয়েছেন বড় হয়ে কী হওয়ার ইচ্ছে আমার। সম্ভবত উনি যে শুধু এটুকু জানতে চান তা নয়, আসলে তিনি চাইছেন আমি যেন এখন থেকেই ভাবতে শুরু করি ভবিষ্যতের ভাবনা।
যখন সকাল হলো, মিস ডায়ানার সাথে বইয়ের দোকানে গেলাম আমি, সাহায্য করব তাকে। পথে দুজন সুদর্শন ক্যালিফোর্নিয় যুবক পাশ কাটিয়ে গেল আমাদের। ঘোড়া দুটোও চমৎকার, স্যাডলগুলো রুপোর পাতে মোড়ানো। সমব্রেরোর কারনিস ছুয়ে মিস ডায়ানাকে অভিবাদন জানাল, আর আমি ঈর্ষাতুর চোখে চেয়ে রইলাম।
বড় বড় দাঁতওয়ালা স্পারের ঝুনঝুন তুলে চলে গেল দুই অশ্বারোহী, রোদ পড়ে ঝকমক করে উঠল ওদের ঘোড়ার গা। সত্যিই, ঘোড়ায় চড়ায় এই ক্যালিফোর্নিয়দের জুড়ি হয় না আর।
ওদের জন্যে আমার দুঃখ হয়, বললেন মিস ডায়ানা।
কেন? চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
দেখতে পাচ্ছ না, ড্যান, ওদের পৃথিবী কত দ্রুত শেষ হয়ে আসছে, অথচ ওরা বুঝতে পারছে না সেটা। এখনও আরাম-আয়েসে গা ভাসিয়ে রয়েছে, ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবছে না। কিন্তু পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। হ্যাঁ, ড্যান, ওরা বুঝতে পারছে না, ওদের দিন শেষ হয়ে গেছে।
শেষ হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। শিগগিরই পরিবর্তনের ধাক্কা লাগবে এখানে। বস্টনের মানুষজন এসে পড়েছে।
.
১৮.
ঠিক বুঝলাম না, বললাম আমি।
আগেই বলেছি ক্যালিফোর্নিয়রা বিলাসী, অতিথিপরায়ণ জাত। ঋণ করে হলেও বড়লোকি করা চাই ওদের। অন্যদিকে, বস্টনের লোকেরা পরিশ্রমী, ব্যবসা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। ওই যে দুজন ক্যালিফোর্নিয় যুবককে দেখলে ওরা কয়েক হাজার একর জমির মালিক ছিল একসময়…
ছিল?
হ্যাঁ। জমি বন্ধক রেখে আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিল ওরা। এখন সুদে-আসলে যা দাঁড়িয়েছে সেটা শোধ দেয়ার ক্ষমতা ওদের নেই। ফলে ওই জমি এখন আমার।
দোকানে এসে দরজার তালা খুললাম আমি। ভেতরে ঢুকে মিস ডায়ানা তার টুপি আর ছাতা ঝুলিয়ে রাখলেন স্ট্যান্ডে।
আগের দিন সন্ধ্যেয় নতুন বইয়ের চালান এসেছিল আমাদের। বড় বড় দুটো বায় প্যাক করা ছিল ওগুলো। আজ সকালে আমার প্রথম দায়িত্ব হলো বইগুলো বের করে একটা তালিকা প্রস্তুত করা, তারপর শেলফের এমন জায়গায় রাখা যাতে সহজেই চোখে পড়ে।
কাজটা আমার পছন্দ, তাই সোৎসাহে লেগে পড়লাম। কিন্তু একই সঙ্গে ভাবতে লাগলাম মিস ডায়ানার কথা। কে এই মহিলা? কোত্থেকে এসেছেন? পশ্চিমে আসার পথে অন্যরা যখন নিজেদের কথা বলছিল মিস ডায়ানা তখন চুপচাপ শুনে গেছেন সেগুলো। কেউ কেউ ধারণা করেছিল তিনি একসময় স্কুলটিচার ছিলেন, তবে সেটা ছিল নিছক অনুমান। আসল সত্যটা কেউই জানতে পারেনি, শেষমেশ সবাই ধরে নিয়েছিল তিনি পশ্চিমে আসছেন বিয়ে করতে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না এটা। পুরুষদের সঙ্গ পছন্দ করেন ডায়ানা, ওদের কথাবার্তা উপভোগ করেন, কিন্তু আমি লক্ষ করেছি কেউ বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলেই সযত্নে তাকে এড়িয়ে যান তিনি। প্রায়ই দেখি জানালা দিয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন বাইরে, ঠোঁট দুটো শক্ত হয়ে চেপে বসেছে পরস্পর মুখ খড়িমাটি। আমি বুঝেছি, কিছু একটা চিন্তা করছেন মহিলা, তবে সেটা কী তা আন্দাজ করতে পারিনি।
তবে তার ভেতর একটা দৃঢ়সংকল্প, প্রাণশক্তিকে উপলব্ধি করতে পেরেছি আমি। এবং মনে হয়েছে আমার মাঝেও আছে এর ছিটেফোঁটা। একদিন স্কুল ছুটির পর দোকানের কাজে সাহায্য করতে এসেছি আমি, কথাটা নিজে থেকেই তুললেন ডায়ানা।
টমাস, গ্রে-র সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। বললেন, স্কুলে তুমি ভাল করছ, ড্যান। শুনে আনন্দ লাগল। একটু থামলেন তিনি, এবং পরক্ষণে কঠোর, প্রায় ক্রুদ্ধ শোনাল তার কণ্ঠস্বর। আমি চাই তুমি ওদের দেখিয়ে দাও, ড্যান। ওরা তোমার বাবা-মাকে একঘরে করেছিল, এখন তোমাকেও করেছে তুমি ওঁদের ছেলে বলে।
ওদেরকে তুমি দেখিয়ে দাও, ড্যান। নামকরা কেউ একজন হও! গর্ব-করার মত কর কিছু একটা!
এখানে যারা আসেন, মন দিয়ে শুনবে তাঁদের কথা। শিক্ষা শুধু স্কুলের চারদেয়ালে বন্দী হয়ে থাকে না। মানুষের সাথে মিশলেও অনেক কিছু শেখা যায়।
এভাবে তুমি তোমার শত্রুদের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে পারবে। ক্ষমতার দৌড়ে হারাতে পারবে ওদের।
মানুষের জীবনটাই নির্ভর করে সিদ্ধান্তের ওপর। এখনই সিদ্ধান্ত নাও কী হতে চাও তুমি এবং কী করবে ভবিষ্যতে। দুটো জিনিসকে যে একই হতে হবে তার কোন মানে নেই, তবে কখনও কখনও এক হতেও পারে।
.
ওদিকে, স্কুলে বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে আমার। র্যাড আমাকে এড়িয়ে চলে সবসময়, যদিও আমি জানি আমাদের বিবাদ মেটেনি এখনও। অ্যানাবেল লরেল। আমার পাশেই বসছে নিয়মিত, তবু আমার আড়ষ্টতা দূর হয়নি। মেয়েদের সাথে ভাব জমানোর অভিজ্ঞতা আমার বিশেষ নেই।
আর সবার চেয়ে পড়াশুনোয় আমরা এগিয়ে, তবে অ্যানাবেল অঙ্কে আমার চাইতে ভাল।
র্যাড বেশ চটপটে, কিন্তু লেখাপড়া জিনিসটা ওর মোটেও পছন্দ নয়। আর মিটার গ্রে-র চেয়ে ওর শক্তি, ক্ষমতা বেশি হলেই হয়তো তাকেও অপছন্দ করে সে, তবে স্কুলে টিকে থাকার জন্যে ক্লাসের পড়াটা নিয়মমাফিক চালিয়ে যায়। আমি এড়িয়ে চলি ওকে। নতুন করে ঝামেলা সৃষ্টি করার কোন ইচ্ছে আমার আদৌ নেই। তা ছাড়া একবার ওকে আমি হারিয়েছি সত্যি, কিন্তু এরপর হয়তো ব্যাপারটা তত সহজ হবে না, কারণ ও হুঁশিয়ার থাকবে।
মিস ডায়ানা, অথবা জর্জ বুশও হতে পারে, নিশ্চয় আড়ালে বলে রেখেছে তাকে, কারণ টমাস গ্রে কখনও এমন কোন আচরণ করেন না যা থেকে বোঝা যেতে পারে তিনি আগে থেকেই আমাকে বা আমার বাবাকে চিনতেন। এমনকী স্যান্তা ফে থেকে পাহাড়পর্বত আর মরুভূমির মাঝ দিয়ে আমাদের সেই অভিযানের কথাও তাকে বলতে শুনি না।
হামেশাই, যখন আমরা নিজেদের সিটে বসে যাই, এমন কোন সাধারণ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন তিনি যেটা ওই মুহূর্তে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।
আসলে, এক সকালে বললেন গ্রে, সুশিক্ষিত মাত্রেই স্বশিক্ষিত। শিক্ষকের ভূমিকা এখানে গাইডের মত, কোন্ পথে কীভাবে এগোতে হবে সেইটে দেখিয়ে দেয়া। স্কুল, তা যত উঁচুমানেরই হোক না কেন, তোমাদেরকে শিক্ষিত করে তুলতে পারবে না।
তোমরা যা পাও তা মূলত সাধারণ একটা ধারণা, বাচ্চাদের ছবি আঁকার বইয়ে যেমন রেখা টানা থাকে তেমনি। রঙ দিয়ে এগুলো ভরবার দায়িত্ব তোমাদের নিজেদের।
ছুটির পর ক্লাস থেকে বেরোচ্ছি আমরা, হঠাৎ খেয়াল করলাম অ্যানাবেল আমার পাশে। ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল ও, বলল, ওঁকে তোমার কেন মনে হয়? মানে মিস্টার গ্রে-কে?
ভাল। আমার বিশ্বাস উনি লেখক হতে চান।
আচ্ছা, উনি লেখাপড়া করেছেন কোথায় জান?
স্কটল্যান্ডে। আমার বিশ্বাস উনি একজন স্কটিশ। পরক্ষণে ভয় হলো আমার বেশি বলে ফেলেছি মিস্টার গ্রে সম্পর্কে, তাড়াতাড়ি যোগ করলাম, মানে ওঁর নামটা স্কটিশ কিনা।
সেদিনই প্রথম কোন ব্যাপারে অ্যানাবেল আলাপ করল আমার সাথে, তবু শঙ্কিত হলাম আমি। মিস্টার গ্রে সম্পর্কে আমি কোন আলোচনায় যেতে চাইতাম না কারণ তার সম্বন্ধে আমি বেশি জানি এটা প্রকাশ হয়ে পড়লে সন্দেহ জাগতে পারে মানুষের মৃনে, এবং খোঁজখবর নিতে পারে কীভাবে এসব জানলাম আমি।
তোমার বাবা তো একটা জাহাজের ক্যাপ্টেন, তাই না? বললাম।
হ্যাঁ, তবে উনি বলেন,পরিচালক, ক্যাপ্টেন শব্দটা তার পছন্দ নয়। চীনে যান। বাবা, বার কয়েক কেপ অভ হর্ন-এর দিকেও গেছেন।
একথার জবাবে আমি বললাম না কিছু। অ্যানাবেল আড়চোখে তাকাল আমার দিকে। তুমি তো পুব থেকে এসেছ?
আমাদের অধিকাংশই তাই। মানে, আমরা যারা স্প্যানিশ নই আরকী।
বাবার ধারণা অন্যের নজর কাড়ার ক্ষমতা আছে তোমার মাঝে।
সবিস্ময়ে, আমি বললাম, তোমার বাবার? কিন্তু তিনি তো আমাকে চেনেন না!
দেখেছেন। আমি তাকে বলেছি তুমি পড়াশুনায় কত ভাল। উনি বললেন তোমাকে দেখে তার আর একজনের কথা মনে পড়ছে।
এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম আমি। ওর সাথে আরও গল্প করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ভয় পেলাম যদি এমন কোন প্রশ্ন করে বসে অ্যানাবেল যার উত্তর দেয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
আমাকে একটু বেশি পড়তে হয়, ব্যাখ্যা করলাম। মিস ডায়ানার বইয়ের দোকানে কাজ করি আমি।
বাবা আলাপ করতে চেয়েছেন তোমার সাথে। বলেছেন আমি যেন তোমাকে একদিন আমাদের বাসায় নিয়ে যাই।
বেশ তো, যাব না হয় একদিন, বললাম আমি।
একটা মোড়ে এসে গিয়েছিলাম আমরা। আমাকে এবার দোকানে যেতে হবে, বললাম।
ওখানেই ছাড়াছাড়ি হলো আমাদের, কিন্তু আমি যখন ফিরতি পথ ধরার জন্যে ঘুরছি তখন হঠাৎ লক্ষ্য করলাম রাস্তার ওপাশে ব্লাড দাঁড়িয়ে, ক্রুদ্ধ চোখে মাপছে আমাকে। একটু বাদে, আবার যখন পেছনে তাকালাম আমি, তখনও দাড়িয়ে আছে সে; তবে অ্যানাবেল বাসায় চলে গেছে।
মিস ডায়ানা তার টুপিটা মাথায় দিচ্ছেন এই সময়ে দোকানে পৌঁছুলাম আমি। ড্যান, মিনিট কয়েকের জন্যে একটু বাইরে যেতে হচ্ছে আমাকে। এদিকটা তুমি সামলে নিয়ো, কেমন?
বেরিয়ে গেলেন উনি, আর আমি মেঝে থেকে এলোমেলো কিছু খবরকাগজ তুলে নিয়ে সাজিয়ে রাখলাম সেগুলো। তারপর নজর দিলাম বুক-শেলফের দিকে। সবে নামিয়েছি একটা বই; হঠাৎ খুলে গেল দরোজা।
মাইক ভ্যালেটা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে।
ওয়াগনে যেমন দেখেছিলাম এখন তার চেয়ে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে ওর পোশাক আশাকের! দাড়ি সুন্দর করে ছাঁটা, হাবভাবে আত্মবিশ্বাসের ছাপ। আগের সেই রুক্ষভাবটাও নেই।
কেমন আছ, বাছা? অনেকদিন পর দেখলাম তোমাকে।
কিছু চাই আপনার?
হাসল ও, তবে সেটা মোটেও মধুর নয়। তোমার বাবা মারা পড়েছে, বলল ও। আসলে ততটা চালু ছিল না সে।
ওরা দলে ভারি ছিল, বললাম আমি।
হতে পারে…হতে পারে। আমাকে ভেংচি কাটল ভ্যালেটা। তবে তোমার সাহস আছে মানতে হবে, বাছা, একেবারে তোমার শত্রুর নাকের ডগায় এসে বসে আছ।
হাতুড়ির ঘা পড়তে শুরু করল আমার বুকে। ভয় পাচ্ছিলাম আমি, কিন্তু চেষ্টা করলাম ও যেন সেটা টের না পায়।
আমি,তক্কেতক্কেই ছিলাম, বাছা। ভেব না সব ভুলে গেছি। ডেস্কের ওপর হাত রেখে সামনে ঝুকল ভ্যালেটা। তোমাকে আমার কখনোই পছন্দ হয়নি, তোমার বাবাকেও না। নিজেকে খুব বড় ভাবত সে।
যাক, বুড়োটা তো গেছে, কিন্তু তুমি আছ। ঠিক যেখানে আমি পেতে চাই সেখানে। যখন সময় হবে আমার, একহাত দেখে নেব তোমাকে।
আর ওই ডায়ানা মেয়েটা, ওর মতলবখানা কী? আমি ভেবেছিলাম ও পশ্চিমে আসছে বিয়ে করতে। কিন্তু এখন আর ততটা নিশ্চিত হতে পারছি না।
চুপ করে রইলাম আমি, কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি মিস ডায়ানা যেন ফিরে না আসেন, অন্তত এখুনি। ডেস্কের ড্রয়ারে পিস্তল রয়েছে একটা, আমি জানি, ভাবছিলাম চটজলদি কীভাবে ওটার নাগাল পাওয়া যায়।
শুনেছি, ও নাকি ভালই মাল কামাচ্ছে। তাই ভাবছি তোমার ব্যাপারে মুখ বুজে থাকার জন্যে কত হকা য়ায়।
আমার ব্যাপারে? ন্যাকা সাজলাম আমি। কেন, আমার জন্যে কোন দুঃখে টাকা দিতে যাবেন উনি। আমি এতিম, তাই দয়া করে আমার খাওয়া-পরার একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমি তাকালাম ভ্যালেটার দিকে। ওঁর দোকানে আমি কাজ করি।
কয়েকটা বই নিয়ে, শেলফে তুলে রাখলাম ওগুলো। নিশ্চয় মাথা খারাপ হয়েছে আপনার, বললাম। আমার জন্যে আপনি যদি টাকা দাবি করেন, উনি তা দেবেন তো না-ই, উপরন্তু হয়তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন আমায়। ভাববেন, আমি একটা উটকো বোঝা হয়ে গেছি তার জন্যে।
শেলফ থেকে যখন ফিরে এলাম আমি, সোজা ডেস্কে এসে দাঁড়ালাম। আমার খুব কাছেই রয়েছে ভ্যালেটা, তবে আমিও পিস্তলটার কাছাকাছি রয়েছি। এবার ভ্রুকুটি করল সে, ভাবলাম নিশ্চয় আমার কথায় দ্বিধায় পড়ে গেছে সে। কেউ আমার কথা ভাবে না। কণ্ঠে তিক্ততার সুর ফোটানোর প্রয়াস পেলাম আমি। শুধু উনিই যা একটু ভাল ব্যবহার করেন।
কী জানি। সিগার বের করে ধরাল ভ্যালেটা। আচ্ছা, ওই বাড়িটা…মরুভূমির…ওটা তোমার বাবার?
আমরা ওখানে ছিলাম। এই পর্যন্ত।
এবার, হঠাৎ করেই বদলে গেল ওর ব্যবহার। হেসে উঠল হা-হা করে। ধেৎ! তোমার সাথে আমি এমনি মস্করা করছিলাম, বাছা! আসলে আমার ধারণা, তোমার বাবা একজন উঁচুদরের মানুষ ছিলেন। উঁচুদরের মানুষ।
চারপাশে নজর বোলাল ভ্যালেটা। তবে এটাও ঠিক, তুমি বেশ ভাল জায়গায়ই আছ, বাছা। চেষ্টা করলেই টু-পাইস কামাতে পারবে।
ঠোঁট থেকে সিগার নামিয়ে, আরেকটু সামনে ঝুঁকল ও। তুমি আর আমি, আমরা একসাথে এসেছি পঠিমে। আমরা বন্ধু। তাই কোন খবরটবর যদি পাও..মানে ব্যবসাপাতি, টাকাপয়সা এসবের আরকী…আমাকে জানাবে। বুঝেছ?।
অ্যাশট্রেতে ছাই ঝেড়ে সিগারটা আবার দাঁতের ফাঁকে গুজল সে। তা ছাড়া, বিদ্রোহের খবর আছে। আমেরিকানরা আসছে এখানে সে-খবর আছে। উইলসনকে চেন…ওই লোক সব জানে। বোধহয়স্টার্নসও…যাই হোক, যদি কিছু শুনতে পাও, সোজা চলে আসবে আমার কাছে। আমি তোমাকে মোটা বখশিস দেব।
সিগারের পাশ দিয়ে আমার উদ্দেশে দাঁত কেলাল ও, তারপর চোখ মটকাল।
পার্টনার, বুঝলে! তুমি আর আমি!
মিস ডায়ানা এসে পড়বেন যে কোন মুহূর্তে, বললাম আমি।
দরজায় গিয়ে দাঁড়াল ভ্যালেটা। ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। তবে তুমি কিন্তু মনে রেখ কথাটা!
বেরিয়ে গেল ও, পেছনে আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
.
১৯.
প্রায় রাতে গুলির শব্দ শুনতে পেতাম আমরা। সাধারণত সনোরা টাউন থেকে ভেসে আসত ওগুলো, কিন্তু তাই বলে দাঙ্গাহাঙ্গামাকারীরা সবাই যে মেক্সিক্যান বা ক্যালিফোর্নিয় ছিল তা নয়। দলে ভারি থাকলে, অ্যাংলোরাও শরিক হত এতে। খুনখারাপি লেগেই থাকত; চাকুবাজি আর ছিনতাই ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার।
মাঝেসাঝে কাছেপিঠের কোন র্যাঞ্চ থেকে দলবেঁধে ভ্যাকুয়েরোরা আসত শহরে, সবচেয়ে কাছের কোন ক্যান্টিনায় ঢুকে পড়ত গলা ভেজাতে।
কোথাও নাচের দাওয়াত না থাকলে মেয়েরা সন্ধ্যার পর বেরোত না রাস্তায়, আর যদিও-বা বেরোত কখনও, সঙ্গে ব্যাটাছেলে কেউ থাকত। তবু একদিন মাঝরাতের দিকে যখন হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল, বাইরের ঘরে নারীকণ্ঠ শুনতে পেলাম।
রীতিমত চমকে গেলাম আমি, এবং উদ্বিগ্নও হালাম খানিকটা। কান খাড়া করলাম। আপনার কাছে সাহায্যের আশায় ছুটে এসেছি আমি। আর কেউ নেই। গলাটা চেনা-চেনা ঠেকল আমার।
নিশ্চয়, ডোনা এলেনা। বলুন, আমি কী করতে পারি আপনার জন্যে?
আমি ব্যবসা বুঝি না। টাকাপয়সার সাথে সম্পর্ক আছে এরকম কিছুই বুঝি না। আমার স্বজাতির লোকেরা টাকা জিনিসটার মূল্য দেয় না। আমরা…আমরা পণ্যবিনিময় করি। একটা জিনিস দিয়ে অন্য আরেকটা নেই। আপনার দোকান আছে। বই রাখেন সেখানে।
আমি ঠিক জানি না, তবে শুনেছি মাঝে মাঝে ব্যবসাও করেন আপনি।
আপনার প্রয়োজনটা কী সেটাই বলুন?
টাকা খাটাতে চাই। ব্যবসা করতে চাই। ধনী হতে চাই আমার টাকা খাটিয়ে।
দোনোমনো করছিলেন মিস ডায়ানা, কিন্তু শেষপর্যন্ত বললেন, ঝুঁকি আছে এতে। লাভ পেতে চাইলে, লোকসানের জন্যেও তৈরি থাকতে হবে।
জানি। এটা অনেকটা জুয়ার মত, আমার ধারণা। কখনও আমার হাতে ভাল তাস উঠবে, কখনও আরেকজনের। আমি ব্যবসার কিছুই বুঝি না, কিন্তু আমার বিশ্বাস আপনি বোঝেন।
আপনার ভাইয়ের কী ইচ্ছে?
ও জানে না। জানলে বিরক্ত হবে আমার ওপর। করতে দেবে না। ও টাকা ধার করে, কিন্তু যারা ঋণ দেয় তাদেরকে ঘৃণা করে। ও হলো জমিদার। যখন খুশি তখন শোধ দেবে। কেউ ফেরত চাইবে না ওর কাছে।
ইয়াংকিরা চাইবে। চাপ দেবে এজন্যে।
আমিও তাই শুনেছি।
একটুক্ষণ চুপ রইলেন মিস ডায়ানা, যেন ভাবছেন কিছু। নিজের টাকা আছে আপনার? ভাই জানবেন না?
আছে, তবে ও জানে না। আমার মায়ের দেয়া টাকা। ডোনা এলেনা অধোবদন হলেন। মা জানতেন আমার স্বামী নেই, বাবা আর ভাইয়ের ছেলে পছন্দ হত না, ফলে আমারও বিয়ে হয়নি। কিন্তু মা বুঝতেন এর জ্বালা, তাই গোপনে কিছু সোনাদানা দিয়ে গেছেন।
আমাকে একজন বলেছে টাকায় টাকা টানে। তাই ভাবলাম, আপনি আমাকে পথ দেখাতে পারবেন। বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটা ফাঁস হওয়া চলবে না। কারণ আমি হচ্ছিডোনা এলেনা।
বুঝেছি। তাই আপনি আমার সাহায্য চাইছেন। কিন্তু কীভাবে, বলুন?
আমাকে কোথাও টাকা খাটাবার ব্যবস্থা করে দিন। আমি লাভ দেব আপনাকে।
প্রসঙ্গ পালটালেন মিস ডায়ানা। আপনাদের র্যাঞ্চটা…খুব বড়?
বিরাট।
আপনার ভাই যে টাকা ধার করেছেন তার পরিমাণ কত…অনেক?
আমার মনে হয়। ওর খাই বেশি, কিন্তু গরুর চামড়া বেচে আয় হয় না তত। কিছু বলতে গেলে, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়, বলে সব ঠিক হয়ে যাবে, আর কেবল ধার করে।
উনি কার কাছ থেকে ধার করেন আপনি জানেন?
এর-তার কাছ থেকে। এখানে কিছু, ওখানে কিছু।
এই যে আপনি টাকা খাটাতে চাইছেন…এখনই লাভ দরকার।
প্রশ্নই ওঠে না! এসব আমি করছি ভবিষ্যতের জন্যে। আমি দেখলাম মিস ডায়ানার চোখে চোখ রাখলেন আন্ট এলেনা। মৃত্যুর পর আমার লাশ সত্ত্বারে যেন কোন অসুবিধে না হয়।
আপনি যদি লোকসানের ঝুঁকি নিতে রাজি থাকেন, আমি সাহায্য করব আপনাকে। একটু থামলেন ডায়ানা। এ-ব্যাপারে আপনার কোন বিশেষ ইচ্ছে টিচ্ছে?
একটা। শুরুতে এমন কিছু ধরতে চাই যাতে তাড়াতাড়ি কিছু হাতে আসে। ভাই যেসব ঋণ করেছে সেগুলো আমি শোধ করে দিতে চাই।
বুঝেছি।
তবে ওর জানা চলবে না। কিছুতেই নয়। তা হলে ভয়ানক খেপে যাবে। শেষ করে ফেলবে আমাকে। যে ধার দিয়েছিল তাকে শেষ করবে-আপনাকেও করবে।
মৃদু হাসলেন মিস ডায়ানা। আমি এত সহজে শেষ হব না, ডোনা এলেনা।
ও যদি জানতে পায় আমার টাকা আছে, চাইবে, এবং দিতে বাধ্য হব আমি।
জানবেন না। আপনি টাকা নিয়ে আসতে পারবেন এখানে?
মেঝে থেকে একটা কাপড়ের থলে তুলে নিলেন ডোনা এলেনা। এতে আছে কিছু। টেবিলের ওপর থলেটা রেখে ভেতরে হাত ঢোকালেন তিনি, কিছু স্বর্ণমুদ্রা বের করলেন। তারপর থলে থেকে ছোট্ট আরেকটা ব্যাগ বের করলেন আন্ট, ফিতে খুলে উজ্জ্বলমত কী যেন ঢেলে দিলেন টেবিলে। এগুলোও আছে।
এ তো অনেক। এগুলো দিয়ে আপনি বিশ্বাস পাচ্ছেন আমাকে?
সমাজে আপনার সুনাম আছে। তা ছাড়া আমার ধারণা, আপনি আমাকে ঠকাবেন না।
এরপর যদি আরও কথা হয়েও থাকে, আমি শুনতে পাইনি, তার কারণ আমি ঢলে পড়েছিলাম, গভীর ঘুমে, এবং আবার যখন সজাগ হালাম তখন ঘর অন্ধকার, বাইরে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই।
চুপ করে শুয়ে রইলাম আমি, টিয়া এলেনার কথা ভাবতে লাগলাম। তাঁর মত সম্রান্ত মহিলারা সচরাচর পর্দার আড়ালেই থাকেন, স্বামী বা বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পান না কিছু।
একটা প্রশ্ন জাগল আমার মনে, হঠাৎ এ-পদক্ষেপ নিচ্ছেন কেন আন্ট এলেনা? নিশ্চয়ই স্বাবলম্বী হতে চাইছেন খানিকটা, ভবিষ্যৎ জীবনের নিরাপত্তা চাইছেন, এ ছাড়া আর কী হবে? কিন্তু মিস ডায়ানার কাছে এলে কাজ হবে এটা টিয়া এলেনা বুঝলেন কেমন করে? আগে থেকেই জানতেন, নাকি তাঁর নিজস্ব গণ্ডির বাইরে একমাত্র ডায়ানাকেই বিশ্বাস পেয়েছেন?
এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফের ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। যখন জাগলাম, সকাল হয়েছে, বসার ঘরে গলা পেলাম জর্জ বুশের। ঝটপট পোশাক বদলে, ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম আমি। সামনে কফি নিয়ে মিস ডায়ানার সাথে আলাপ করছিল ও।
পরিশ্রমের কাজ, তবে লাভ আছে, বলছিল বুশ। স্যান হোয়াকিন-এ হাজার হাজার বুনো ঘোড়া আছে, এবং এগুলোর মধ্যে ভাল জাতেরও পাওয়া যায়।
কজন লোক লাগবে ধরতে?
চার-পাঁচজন।
আমার দিকে ফিরলেন ডায়ানা। ড্যান, তোমার ইন্ডিয়ান বন্ধুরা সাহায্য করবে? আমি উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেব।
করতে পারে। আমি দেখব আলাপ করে।
কেলসো শহরে আসছে। আমার ধারণা এসময় একটা কাজ পেলে ও খুশিই। হবে, আর তা ছাড়া এসব কাজ ও বোঝে।
বেশ। আপনি আর ড্যান মিলে সব ঠিক করে ফেলুন তা হলে। আমার বিশ্বাস মিস্টার গ্রে-র পক্ষে যতটা শেখানো সম্ভব, শিগগিরই ড্যান শিখে ফেলবে তার সব। তারপর এরকম একটা অ্যাডভেঞ্চারে যেতে পারলে উপকারই হবে ওর।
কত ঘোড়া ধরার ইচ্ছে আপনার? ডজন দুয়েক
হাসলেন মিস ডায়ানা। আমি ভেবেছিলাম চার-পাঁচশোর কথা বলবেন আপনি। নয়তো সহজে যতগুলো সামলাতে পারেন।
চার-পাঁচশো? ম্যাম, নিশ্চয় আপনি
না, ঠাট্টা করছি না, মিস্টার বুশ। কয়েকশো ঘোড়া দরকার আমার, পোষ মানান। যদি খচ্চর দেখতে পান, সেগুলোও ধরবেন।
অত ঘোড়া পোষ মানাতে বছরখানেক লেগে যেতে পারে।
লাগুক। কেন, আপনার কোথাও যাওয়ার তাড়া আছে নাকি, মিস্টার বুশ? সময়ের অভাব নেই আমাদের ঘাসও আছে প্রচুর, এবং আমার বিশ্বাস শিগগিরই বাজারও পাব। যেগুলো সব থেকে ভাল, রেখে দেবেন আলাদা করে-শহরের কাছেই কোথাও। আমরা ওদেরকে বংশবৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করব।
ঠিক আছে, ম্যাম।
টেবিলের ওপর একগাদা ব্যবসার কাগজপত্র পড়েছিল, মিস ডায়ানা সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়ে ফিতে দিয়ে বাঁধলেন সেগুলো। আমি চাই মিস্টার কেলসো, আমার এদিককার কাজকর্ম দেখাশোনা করুন, মানে আপনার জায়গায়, মিস্টার বুশ। মানুষ টের পেতে শুরু করেছে আমরা একসাথে কাজ করি। তাই নতুন কারোকে এখন দরকার আমার। আপনি আর ড্যান ঘোড়ার ব্যাপারটা সামলাবেন।
কাগজপত্র নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, তাকালেন আমার দিকে। ড্যান, বয়স…স্বাস্থ্য…কোনটাই মানুষের আসল জিনিস নয়। মানুষ বড় হয় দায়িত্ববান হয়ে ওঠার মাঝ দিয়ে। তা ছাড়া, আমি চাইছি, আপাতত কিছুদিন শহরের বাইরে গিয়ে থাক তুমি।
বুশের উদ্দেশে ফিরলেন ডায়ানা। মিস্টার বুশ? মেক্সিকোর সাথে যুদ্ধের ব্যাপারে কিছু শুনেছেন আপনি?
যুদ্ধ? না, ম্যাম। নিশ্চয় গুজব হবে।
না, মিস্টার বুশ, গুজব নয়। যুদ্ধ একটা বাধতে যাচ্ছে। তবে আমরা আমেরিকানরা যদি একটু বুদ্ধি খাটাই, এর প্রয়োজন পড়বে না।
মানে?
মিস্টার বুশ, ক্যালিফোর্নিয়দের যারা নেতা তাদের বেশির ভাগই বুদ্ধিমান লোক। ক্যালিফোর্নিয়া মেক্সিকো সিটি থেকে বহুদূরে, অথচ মেক্সিকো ছাড়া আর কারও সাথে ব্যবসা করা নিষেধ। ফলে এখানকার লোকজন অনেক সুবিধে থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করলে যে-মুনাফা পেত সেটা পাচ্ছে না।
এখন মার্কিন সরকার যদি বুদ্ধিমান হয়, কূটনৈতিক মহলে দেন-দরবার করে মিটিয়ে ফেলা যায় সমস্যাটা। নইলে ক্যালিফোর্নিয়রা লড়বে-মেক্সিকোর বিরুদ্ধে। এটা, ওদের বাঁচামরার প্রশ্ন।
আবেল স্টার্নসের সাথে এ-ব্যাপারে আলাপ করেছেন আপনি?
ঠিক এভাবে নয়। মিস্টার স্টার্ন মেক্সিকান নাগরিক, কোনরকম ঝামেলায় জড়াবেন না নিজেকে। আমার বিশ্বাস উনি বোঝেন ব্যাপারটা, কিন্তু নিজের সরকারের প্রতি অনুগত থাকতে চান, শত অসুবিধে হলেও। আমিও জড়াব না, যদিও আমি এখানকার নাগরিক নই। বলতে কী, এখানে আমার ব্যবসা করার আইনসঙ্গত কোন অধিকারই নেই। কেউ কিছু বলে না কারণ আমি মেয়ে, তা ছাড়া স্থানীয় যেসব কর্মকর্তা আছে তাদের সায় আছে আমার কাজকর্মের পেছনে।
তা হলে আপনার ধারণা লড়াই হবে?
হবে। ক্যালিফোর্নিয়দের একটা দলের নেতা-ফ্রিমন্ট। শোনা যায়, লোকটা নাকি ভীষণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী।
চতুর হাসি হাসল বুশ। আমরা সবাই কি তা-ই নই?
কৌতুকে নেচে উঠল মিস ডায়ানার চোখের তারা। নিশ্চয়, মিস্টার বুশ। তবে উচ্চাকাচ্চাকে ব্যবহার করার অনেক রাস্তা আছে।বেপরোয়া হওয়াটা ঠিক নয়।
খানিক বাদে জর্জ যখন বিদায় নিল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, মিস ডায়ানা, এই যে এতসব ঘটছে, এর কারণটা কী…আমাকে বুঝিয়ে বলবেন একটু?
কিছুক্ষণ ব্যবসার কাগজপত্রে ডুবে রইলেন তিনি, তারপর যখন শেষ হলো কাজ তখন বললেন, বছর কয়েক আগে টেক্সাস যুদ্ধ করে নিজের স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। মার্কিন সরকার স্বীকৃতি দিয়েছিল ওদের স্বাধীনতাকে, আর মেক্সিকো ভীষণ নাখোশ হয়েছিল এতে।
এখন, প্রায় দশ বছর পর, টেক্সাস ইউনিয়নের সদস্যপদ চেয়ে আবেদন করেছে, এবং আমরা তাকে অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা দিয়েছি। তাই মেক্সিকো এবার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, আবার যদি কখনও এরকম করি আমরা, এটাকে তারা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে ধরে নেবে।
তবে যা-ই ঘটুক শেষ পর্যন্ত, ক্যালিফোর্নিয়া মেক্সিকোর সাথে থাকুক কিংবা চলে আসুক আমাদের সঙ্গে, আমি চাইছি আমাদের আখের গুছিয়ে নিতে। এখানে সমুদ্রবন্দর আছে, বাইরের দুনিয়ার সাথে কারবার করা সহজ হবে।
দম নিতে একটু থামলেন ডায়ানা। আমরা একা, ড্যান, তুমি আর আমি। তাই সবসময় তৈরি থাকতে হবে আমাদের যেন জোয়ারে গা ভাসাতে পারি। এবং তৈরি আমরা থাকবই।
.
২০.
তোমরাই ইতিহাস, টমাস গ্রে বলেছিলেন আমাদের। কক্ষনো ভেব না ইতিহাস। দূরের কোন বস্তু যার সাথে কেবলমাত্র রাজরাজড়াদেরই যোগ আছে।
আসলে তোমাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ইতিহাস আছে একটা, যেটা আবার লস এঞ্জেলেসের ইতিহাসের অংশ, এবং এইভাবে সারা দুনিয়ার।
বলতে কী, এভাবেই, ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছিল আমাদের লেখাপড়া, রোজ শক্ত-শক্ত জিনিস বুঝতে হচ্ছিল। স্কুলে যাওয়ার এবং ফেরার পথে সনোরা টাউনকে এড়িয়ে চলি আমরা, যদিও ওখানে যারা থাকে তাদের অনেকেই চমৎকার মানুষ। আবার জায়গাটা কঠিন লোকদের ডেরাও বটে।
মিস ডায়ানার সেই কথাটা প্রায়ই মনে পড়ে আমার: আমরা দুজনই এ-পৃথিবীতে একা। আমি ভাবি, তা হলে কি এজন্যেই আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন উনি? আমার ভেতর তার অতীতকে দেখতে পেয়েছিলেন বলে? নাকি আর কোন কারণ ছিল?
আরেকবার আমাকে বলেছিলেন ডায়ানা, কক্ষনো ভয় পেয়ো না। সামান্য এক আধটু ভয় মানুষকে সাবধান থাকতে সাহায্য করে ঠিক, কিন্তু বেশি ভয় তার কাজের উদ্যমকেই দেয় নষ্ট করে। ভয়কে শ্রদ্ধা কর, কিন্তু একে ব্যবহার করবে তোমার প্রেরণা হিসেবে, বাঁধা পড়বে না এর হাতে।
স্কুলে যাওয়া-আসার পথে নিয়মিত রাস্তা বদল করতাম আমি। একই পথ কক্ষনো ব্যবহার করতাম না দুদিনের বেশি। রাস্তাঘাট বিশেষ ছিল না, কিন্তু আমি ব্যবহার করতাম মেঠোপথ, যেখানে ঘোড়া যেতে পারবে না। তখনকার আমলে ক্যালিফোর্নিয়রা সবাই ঘোড়ায় চেপে চলাফেরা করত। পায়ে হাটা ওদের একদম না পছন্দ ছিল।
আমি যখন আবার আমার দাদুর দেখা পেলাম তার আগে কেটে গেল, বহু সময়। মিস ডায়ানা আমাকে আগেই জানিয়েছিলেন তিনি শহরে বিশেষ আসেন না, তার র্যাঞ্চ-হাউসে থাকেন মাসের পর মাস। তারপর একদিন, স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটা বাগানের ভেতর দিয়ে আসছি আমি, হঠাৎ কয়েকটা ঘোড়ার আওয়াজ পেলাম রাস্তায়। চকিতে থমকে দাঁড়ালাম, গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখলাম, দাদু যাচ্ছেন।
চিনতে ভুল হয়নি আমার। ওই বুড়ো বয়েসেও যথেষ্ট সুদর্শন ছিলেন তিনি, চুল আর গোঁফ সাদা, অপূর্ব সুন্দর একটা ঘোড়ার পিঠে বসেছিলেন, স্যাডলটা রুপোর। দুজন লোক ছিল তার সাথে, একজনকে চিনতে পারলাম আমি। কাটা-নাক, আমাকে যে খুন করতে চেয়েছিল।
দ্রুত চলে গেল ওরা, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত ধুলো থিতিয়ে না এল পুরোপুরি, আমি লুকিয়ে রইলাম।
সেদিন আর দোকানে গেলাম না, পড়াশুনো করলাম বাসায় বসে।
পড়ছি আমি, কিন্তু বারবার মন ছুটে যাচ্ছে দাদুর দিকে। মানুষটার প্রতি আক্রোশ রয়েছে আমার, আবার করুণাও বোধ করছিলাম তার জন্যে। হয়তো আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্কই এর কারণ, কিংবা অন্যকিছু হতে পারে। ঠিক জানি না আমি।
দাদুর অহঙ্কার তার বংশমর্যাদা, আর নিজের নাম। বাবা-মা এবং অন্যদের কাছে আমি যতটুকু শুনেছি, এ-অহঙ্কারই ছিল দাদুর একমাত্র সম্বল। তার চোখে মামুলি এক নাবিকের সাথে তার মেয়ের বিয়ে অপমানকর ঠেকতেই পারে। সার ওয়াল্টার স্কট এবং এজাতীয় আরও কিছু প্রণয়কাহিনি পড়া আছে আমার, তাই বুঝতে পেরেছিলাম একজন অহঙ্কারী মানুষকে কতটা বিচলিত করে তুলতে পারে এধরনের ঘটনা।
কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের জগত্সা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের দৃষ্টিতে কর্মই মানুষের একমাত্র পরিচয়; কিন্তু দাদুর জগৎ গড়ে উঠেছিল বংশমর্যাদার ওপর ভিত্তি করে।
এই কৌলীন্যটুকুই যার সম্বল, মনে হলো, কোণঠাসা হয়ে পড়লে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলাই তার পক্ষে স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে এ-ব্যাপারে দাদুর দিকটাও দেখতে শুরু করলাম আমি, যদিও এ-মতের প্রতি আমার সহানুভূতি ছিল সামান্যই।
পরে, মিস ডায়ানাকে যখন খুলে বললাম আমার ধারণার কথা, তিনি চুপ করে শুনলেন প্রথমে, তারপর বললেন, ড্যান, তুমি বড় হতে শুরু করেছ। বুদ্ধির পরিপকৃতা আসছে।
কত কিছুই না তখন ঘটছিল নিত্যদিন। ক্রমশ বাড়ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। ক্লাসে টমাস গ্রে এর কিছু কিছু বুঝিয়ে দিতেন ব্যাখ্যা করে, তবে অত্যন্ত সাবধানে, যেন কোনরকম পক্ষপাত প্রকাশ না পায়।
এরমাঝে জর্জ বুশ একদিন জানাল এসে, দাদু তার র্যাঞ্চে ফিরে গেছেন, আপাতত কিছুদিন তাকে নিয়ে আমার ভয় না পেলেও চলবে।..
মিস্টার ভ্যালেটাকে দেখেছেন? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
বুশ তাকাল আমার পানে। শহরেই আছে। কেন, তুমি দেখেছ?
দোকানে এসেছিল। লোকটাকে আমার পছন্দ নয়।
আমারও না।
আমাকে হুমকি দিয়েছে, বলে আমি সবিস্তারে জর্জকে জানালাম সেদিনকার ঘটনা। মন দিয়ে আমার কথা শুনল বুশ, তারপর বলল, ফের যদি আসে, আমার সাথে দেখা করতে বলবে ওকে।
জানালায় গিয়ে দাঁড়াল বুশ। কেলসোর আসার কথা আজ রাতে।
কোন কারণে জর্জকে আমার উতলা মনে হলো। বাইরে গেল ও, কোরালটা জরিপ করে এল একবার। তোমার সেই রাইফেল আর পিস্তলটা কি আছে এখনও? জিজ্ঞেস করল সে।
আছে।
হাতের কাছে রাখ ওগুলো। ক্যালিফোর্নিয় বা আমেরিকানদের ভয় পাচ্ছি না। আমি…আমার যত ভয় সনোরা টাউনের লোকদের। বেশকিছু গুণ্ডাপাণ্ডা থাকে ওখানে, দিন-দিন যেভাবে,অবনতি ঘটছে আইন-শৃঙ্খলার, যে কোন সময়ে শহরে হামলা দিয়ে লুটতরাজ শুরু করতে পারে ওরা।
সদর দরজার কাছে একটা বিছানা পাতল জর্জ, পাশেই রাখল ওর পিস্তলটা।
প্রায় মাঝরাত নাগাদ দরজায় করাঘাত শুনতে পেলাম আমি, তারপর পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর। কেলসো।
জর্জ! কতদিন পর দেখা! তারপর, কী করছ এখন?
চাকরি। দেখতেই পাবে সব। তোমার জন্যেও ঠিক করে রেখেছি একটা।
অনেকদিন হতে চলল লস এঞ্জেলেসে এসেছি আমি। আজকাল একা হলেই আমার মন চলে যায় মরুভূমিতে, আমার বাসায়, টাহকুইৎসয়ের বাড়িতে। বন্ধু ফ্রান্সিসকোর কথা মনে পড়ে। আচ্ছা, ও কি এখনও আছে ওখানে?
আমাদের মেক্সিক্যান হাউসকিপারটির নাম ছিল রোসা। একদিন সকালে রান্নাঘরে টটিয়া প্রস্তুত করছে ও, আমি নাস্তার খোঁজে ঢুকতেই বলল, একজনকে সে বাসার পেছনের উইলো ঝোপ থেকে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখেছে।
দরজায় গিয়ে জায়গাটা আমায় দেখিয়ে দিল সে। ওই যে, ওখানে! বলল রোসা। ডালপালার আড়ালে লুকিয়েছিল, চেহারাটা আমি ভালমত দেখতে পাইনি।
উইলো ঝোপের ভেতর গিয়ে আশপাশে তাকালাম আমি, ট্র্যাক খুঁজলাম। এবং হঠাৎ করেই পেয়ে গেলাম, শুধু ট্র্যাক নয়-অসংখ্য পোড়া সিগারেটের টুকরোও। কোন কোনটা পুরনো, কোনটা নতুন। ওগুলোর কয়েকটা গেল বৃষ্টির আগে থেকেই আছে ওখানে, বাকিগুলো তাজা।
এর অর্থ, কেউ একজন নজর রাখছিল আমাদের বাসার ওপর।
কৌতূহলী হয়ে উঠলাম আমি, আবিষ্কার করলাম ঠিক কোথায় উইলো ঝোপের ভেতর ঢুকেছে ট্রাকগুলো। এরপর ট্রেইল করলাম, বড় রাস্তায় এসে পড়লাম সরু একটা মেঠোপথ ধরে কয়েকটা ফার্মহাউসের পেছনের উঠনের পাশ দিয়ে।
আর কোন সন্দেহ রইল না আমার, দীর্ঘদিন থেকে কেউ নজর রাখছে আমাদের বাসার ওপর, এবং ওই মেঠোপথ ধরে বহুবার রাস্তা থেকে উইলো ঝোপের ভেতর এসেছে সে।
লোকটা কি আন্ট এলেনাকে দেখতে পেয়েছে?
কে ও, কেন নজর রাখছিল আমাদের বাসার ওপর? আমাকে লক্ষ করছিল? নাকি মিস ডায়ানাকে?
সেদিন স্কুল ছুটির পর বইয়ের দোকানে গেলাম আমি, জর্জ আর মিস ডায়ানাকে একা পেয়ে আমার আবিষ্কারের কথা জানালাম তাদের।
আপনি একটু তদন্ত করে দেখুন তো, মিস্টার বুশ, ব্যাপারটা কী? নির্দেশ দিলেন ডায়ানা।
আপনি যখন বলছেন, দেখব, ম্যাম। তবে আমার ধারণা, ড্যান যখন কিছু বুঝতে পারেনি, আমিও পারব না। ও এসব ব্যাপারে দক্ষ, ওর বাবার গুণটা পেয়েছে।
আমার মনে হয়, বললেন ডায়ানা, আপনাদের এবার ইন্ডিয়ানদের সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় হয়েছে। আচমকা উঠে দাড়ালেন তিনি, কাল ভোরেই, মিস্টার, বুশ। আপনি আর ড্যান রওনা দেবেন।
কিন্তু সেক্ষেত্রে আমরা তো বেশ কিছুদিনের জন্যে বাইরে থাকব, ম্যাম। আপনি একা
মিস্টার কেলসো, থাকবেন এখানে। আমি ভ্যানকে এখন দূরে সরিয়ে দিতে চাই। আর খেয়াল রাখবেন কেউ যেন আপনাদের যেতে না দেখে। প্রয়োজনে যত খুশি ঘোড়া বদলান, কিন্তু এই এলাকা থেকে ঝটপট সরে যাওয়া চাই।
আমার উদ্দেশে ফিরলেন ডায়ানা। তুমি সঙ্গে বই নিতে চাও কিছু? যদি নাও, পছন্দমত পাঁচ-ছয়টা বেছে নিয়ে নামগুলো লিখে আমার ডেস্কে দিয়ে যেয়ো।
জর্জ তার টুপি তুলে নিল। ঠিক আছে, ম্যাম। কালই তা হলে রওনা হচ্ছি আমরা। এখন আপনি নিরাপদে থাকলেই হলো।
আমি পারব সামলে নিতে। মৃদু হাসলেন মহিলা। আপনার নিশ্চয় মনে আছে, যখন দরকার হয়, গুলি ছুড়তে একটুও দ্বিধা করি না আমি।
জর্জ হাসল। আলবত মনে আছে, ম্যাম।
আমার দিকে তাকালেন ডায়ানা। তোমার যা-যা দরকার নিয়ে যাও, ড্যান। কেবল লক্ষ রাখবে বোঝা যেন বেশি ভারি না হয়ে যায়, তা হলে অসুবিধে হবে পথ চলতে। তুমি কাছে না থাকায় ভীষণ খারাপ লাগবে আমার, কিন্তু আমি নিশ্চিত, তুমি একটা অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাবে।
হ্যাঁ, ম্যাম। আচ্ছা, ম্যাম, আন্ট এলেনার সাথে কি দেখা হবে আপনার?
ব্যাপারটা নিয়ে একটুক্ষণ ভাবলেন ডায়ানা, তার আঙুলের ডগা টেবিল ছুঁয়ে আছে। চেষ্টা করব।
.
বেলা ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়লাম আমরা, তখনও শেষ কয়েকটা তারা ঝুলছিল আকাশে, সূর্যের কাছে নতিস্বীকার করতে চাইছিল না। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললাম, বরাবরের মতই ব্যাক ট্রেইল ধরে।
চলার পথে, জর্জ ইশারায় কয়েকটা জায়গা দেখাল আমাকে, যেসব জায়গায় সে নিজে গেছে আর নয়তো তাদের সম্পর্কে শুনেছে অন্য কারও কাছে। মোটামুটি জোরকদমে ছুটছি আমরা, কেবল খাড়া কোন চড়াইয়ের মাথায় ওঠার সময়ে ছাড়। যেখানে সম্ভব, ট্রেইলের সমান্তরালে পাহাড়পর্বতের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি যাতে কেউ আমাদের দেখতে না পায়।
স্কুলে কেমন লাগছে তোমার? হঠাৎ জিজ্ঞেস করল বুশ। র্যাড ছোঁড়াটার সঙ্গে আর কোন,গোলমাল হয়েছে?
না। স্কুলটা ভাল। মিস্টার গ্রে একজন দক্ষ শিক্ষক।
এত কম ছাত্র নিয়ে ওর চলছে কীভাবে কে জানে, তবে স্কুলটা যদি ধরে রাখতে পারে, নিশ্চয় বড় হবে আস্তে আস্তে।
এখন ছজন আছে, আমি বললাম।
ক্যাপন লরেলের মেয়েও তো পড়ে ওখানে, তাই না? সোনালি চুলের সুন্দর মুখ?
লাল-সোনালি, শুধরে দিলাম আমি। হ্যাঁ, আমার পাশেই বসে।
আচ্ছা? তবে তো র্যাডের সাথে তোমার ঝগড়া হওয়াই স্বাভাবিক। আড়চোখে আমাকে মাপল জর্জ, দৃষ্টিতে কৌতুক। ওর বাবার সাথে মোলাকাত না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধর। ক্যাপন লরেল, মজার একখানা মানুষ বটে।
এ-ব্যাপারে কিছুই বলতে পারলাম না আমি, যদিও ভদ্রলোক সম্পর্কে ভাসা ভাসা অনেক কাহিনিই কানে এসেছিল, আর অ্যানাবেল তো বলেইছিল উনি দেখা করতে চেয়েছেন আমার সাথে।..
অত্যন্ত হুঁশিয়ার আর বিচক্ষণ মানুষ এই লরেল। কোন কোন ক্ষেত্রে একটু অদ্ভুতও বটে। ওঁর নাবিকরা বলে, কীভাবে যেন আগাম বিপদ টের পেয়ে যান ক্যাপন, হঠাৎ করেই দিপরিবর্তন করেন জাহাজের। এভাবে, নাকি বহুবার বড় রকমের দুর্ঘটনা থেকে নিজের জাহাজকে বাঁচিয়েছেন তিনি।
তারপর কার্গোর কথাই ধর। যে-বন্দরে কিছুই পাওয়ার নয়, হুট করে সেখানে জাহাজ ভেড়ান তিনি, এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, দেখা যায় অনেক মালপত্র চালানোর জন্যে পড়ে আছে তার অপেক্ষায়। জাপান থেকেও বার কয়েক কার্গো এনেছেন লরেল।
কিন্তু আমি জানতাম, জাপান তার বন্দরে বিদেশি কোন জাহাজ ভিড়তে দেয় না।
তবু লরেল ভিড়ছেন, নিশ্চয় হোমরাচোমরা কারোকে চেনেন ও-দেশের। যাক, তোর সাথে যদি পরিচয় হয় দ্রলোকের, আমরা আরও অনেককিছু জানতে পারব ওঁর সম্বন্ধে।
হামেশা যা করতাম আমরা, নীরবে এগিয়ে চললাম নাগাড়ে, আর এর ফলে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পেলাম আমি। আর বলতে কী, ভাববার মত বিষয়ও ছিল প্রচুর। বহু ধাঁধার জট ছাড়ানো বাকি ছিল তখনও। মা বলতেন আমার বাবার নাকি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ ছিল, আগেভাগে বুঝতে পারতেন সামনে কী ঘটবে। ক্যাপ্টেন লরেলেরও কি তা-ই আছে? নাকি এটা সেই জিনিস যাকে সবাই বলে অনুমান। কিংবা তিনি জ্ঞানী বলেই টের পেয়ে যান সবকিছু।
বাবা আমাকে আমার দাদা আর তার সমুদ্রযাত্রার অনেক কাহিনি শুনিয়েছিলেন। আমি জানি জাহাজের ক্যাপ্টেনরা অনেকসময় বহু বন্দরের হদিস ইচ্ছে করেই গোপন রাখেন, কারণ তারা চান না ওইসব বন্দরে যে মাঝে-মধ্যে অত্যন্ত মূল্যবান সব পণ্যের চালান থাকে সেটা আর কেউ জানুক।
সূর্যাস্তের আগেই এখন ট্রেইল থেকে সরে যাই আমরা, নিরালা একটা স্থান বেছে নিয়ে ক্যাম্প করি সেখানে, আলো থাকতে থাকতে শুকনো ডালপালা ধরিয়ে রান্না সেরে নিই। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ি আগুন মেরে, জানি কোনরকম বিপদ এলে আমাদের ঘোড়াগুলো জানান দেবে।
কিছু রসদ কিনতে এল ক্যাম্পোতে থামলাম আমরা। একটা দোকান আর গুটিকতক বাড়িঘর ছিল ওখানে।
তুমি ঘোড়ার কাছে থাক, জর্জ বলল আমাকে। একটু আড়ালে। মানুষজন যেখানে কম সেখানে নতুন মুখ দেখলে মনে রাখে সবাই।
গরম পড়েছে বেশ, হাওয়া নেই। ঝোপঝাড়ের ভেতর ছায়ায় দাঁড়িয়ে রইল ঘোড়া দুটো, আমি মোটা একটা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। একঘেয়ে সুরে গুনগুন করছে মাছি। গর্তে নাক ডুবিয়ে মাঝেসাঝে পানি খাচ্ছে, ঘোড়াগুলো; মৌমাছিরাও আসছে পানির জন্যে। কয়েকশো গজ দূরে, দোকান ঘরটার দিকে তাকালাম আমি, কামনা করলাম জর্জ যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে।
উষ্ণ রোদ নিদ্রালু করে তুলল আমাকে। টুপিখানা টেনে দিলাম চোখের ওপর মাছি তাড়ানোর জন্যে লেজ ঝাপটাল ছোড়াগুলো। আমি ঝিমুতে লাগলাম।
ধুলোয় পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বুটের চাপে গুড়িয়ে গেল একটা মাটির ঢেলা। কোটের তলায় পিস্তলের বাঁটে হাত রাখলাম আমি, বুঝতে পারছি লোকটা আর যে-ই হোক বুশ নয়।
বুট আর পা। মাথা না তুলেই, হ্যাট-ব্রিমের কিনার দিয়ে ওগুলো দেখতে পাচ্ছি আমি। সরু স্প্যানিশ বুট, বড় দাঁতের ক্যালিফোর্নিয় স্পার আর প্যান্ট, হাঁটুর নীচ থেকে চেরা।
অধিকাংশ লোকই, বলল একটা কণ্ঠ, ভাববে তুমি ঘুমোচ্ছ। কিন্তু মন্টে ম্যাক কায়া সেই দলে নেই। এসব লুকোচুরি আমিও খেলেছি অনেক।
ঘাড় কাত করে ওর দিকে তাকালাম আমি। একহারা পেশীবহুল শরীর, তেমন লম্বা নয়, তবে কাঁধ দুটো চওড়া আর কোমর সরু, ঘোড়াসওয়ারদের যেমন হয়।
কেমন আছ? বললাম।
বাছা, ওই পিস্তল থেকে তুমি হাতটা সরিয়ে নিতে পার। আমি তোমার বন্ধু।
যতক্ষণ আমার হাত এই পিস্তলের ওপর আছে, তা থাকলেই ভাল করবে তুমি, বললাম আমি।
শব্দ করে হাসল লোকটা। চমকার কথা বল তো তুমি। একদম লাগসই জবাব দিয়েছ। গোড়ালির ওপর বসে পড়ল ও, চওড়া কারনিসের মেক্সিক্যান সমব্রেরোটা ঠেলে দিল মাথার পেছনে। লোকটা দেখতে মোটামুটি, এক গালে পোড়া দাগ রয়েছে, থুতনি অবধি কালো গোঁফ, আর চোখজোড়া সদাহাস্যময়।
সামান্য কৌতূহল আরকী, বলল ম্যাক-কায়া। দোকানের সামনে হিচরেইল থাকতে কেউ দূরে ঘোড়া রেখে আসে না।
এখানে ছায়া আছে।
ঠিক। কিন্তু তুমি কী করছ? তোমার বয়েসী একটা ছেলের দোকানে ঢুকে এটা ওটা দেখতে চাওয়াই স্বাভাবিক। আমি যখন ছোট ছিলাম
আমার ঘুম পাচ্ছিল, বললাম।
হতে পারে, একমত হলো লোকটা, আবার এও হতে পারে, তুমি আসলে কারোকে তোমার চেহারা দেখাতে চাও না। কিন্তু কেন এরকম ইচ্ছে হবে তোমার? তুমি ঘোড়াচোর নও, অন্তত এ-বয়েসে কেউ তা হতে পারে না। তারমানে এর পেছনে অন্য কোন রহস্য আছে। এবার বল দেখি, বাপধন, তোমার পরিচয়টা কী?
আমার ঘুম পাচ্ছে, হাই তুললাম আমি।
১.৫ ওক গাছের ছায়া
প্রকাণ্ড সব ওক গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে দোতলা একটা এডৌব। গাছের ভারি ডালপালা নুয়ে পড়েছে দোতলার বারান্দায়। সামনের উঠনে রয়েছে কৃত্রিম ফোয়ারা। শান্ত সুশীতল রাত। একতলার লিভিং রুমে বসে রয়েছেন ডন রোমেরো, তাঁর ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগার, সামনে তেপায়ার ওপর গ্লাসভর্তি ওয়াইন।
ডন রোমেরো কৃশকায় মানুষ, চোয়াল ভাঙা, হনু দুটো উঁচু। তাঁর চুল পাকা, গোঁফ আর দাড়িতেও ছোঁয়া লেগেছে এর। পরনে দামী শৌখিন কাপড়চোপড়। শান বাঁধানো উঠনে যখন এক জোড়া বুটের আওয়াজ রোমেরোর কানে পৌঁছল, ঈষৎ জকুটি করলেন তিনি।
কে এল? এমন অসময়ে?
খোলা দরজায় দেখা দিল এক লোক, হাতে টুপি। ওর নাক থ্যাবড়া, বাঁশিতে কাটা দাগ রয়েছে। লোকটার পরনে সাদা শার্ট, গলায় লাল রুমাল, আঁটসাট প্যান্ট। কোমরের হোলস্টারে বিরাট এক পিস্তল, আর ছুরি।
আমার সাথে দেখা করতে এসেছ?
নবাগত তার টুপিটা নাড়াচাড়া করল একটু, তারপর বলল, অত্যন্ত নিচু স্বরে, ও বেচে আছে।
ডন রোমেরোর শিরদাঁড়ায় হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল যেন। সামনে ঝুঁকলেন তিনি, সিগারের ছাই ঝাড়লেন।
অসম্ভব। একই সঙ্গে অবজ্ঞা আর বিরক্তির সুর ফুটল তার কণ্ঠে।
আমি দেখেছি ওকে। বেঁচে আছে।
ভুল করছ। নিশ্চয় আর কারোকে দেখেছ। ও বাঁচতেই পারে না।
বাপটা বেঁচে গিয়েছিল।
ডন রোমেরোর ভুরুতে নীলচে শিরা জেগে উঠল। ননসেন্স! তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় দেখেছ এই…এই ছেলেটাকে?
পুয়েরোতে। রাস্তায়। ও-ই। আমি জানি।
নিঃশব্দে, প্রায় অশরীরীর মত, লোকটার পেছনে এসে হাজির হলেন ডোনা এলেনা। হতেই পারে না। এ অসম্ভব।
এক মহিলার বাসায় থাকে ও। মিস ডায়ানা-অ্যাংলো।
ঘাড় না ফিরিয়েই, এলেনার উদ্দেশে বললেন ডন, তুমি কি জান এ-ব্যাপারে?
ভদ্রমহিলাকে চিনি। অনেক বন্ধুবান্ধব আছে। তারপর মৃদু সুরে যোগ করলেন টিয়া এলেনা, ডন আবেল স্টার্নস আর ডন বেনিটো উইলসনও ওঁর বন্ধু।
ফুঃ! কে ওরা? অ্যাংলো!
একটা কথা তুমি ভুলে গেছ, ব্রাদার। এখন ক্ষমতায় আমরা না, অ্যাংলোরাই আছে। একটু থেমে ডোনা এলেনা বললেন, ওঁর বন্ধুদের মধ্যে পিয়ো পিকোও আছেন, এবং জেনারেল ভায়েজো।
ওকে জান তুমি?
সিনোরিটা ডায়ানা সবাইকেই জানেন। আগেই তো বললাম, ওঁর বন্ধু অনেক।
হ্যাঁ, বলেছ। এবং আমাদের তা নেই, এটাই তো বোঝাতে চাইছ?
বন্ধু থাকা ভাল।
তাও বলেছ তুমি। প্রায়ই বলে থাক। এই মেয়েটা? ডায়ানা-ওর বাসায় যেতে চাই আমি। এখুনি…আজ রাতেই!
আজ রাতে? কিন্তু সে তো অনেকদূরে। মাঝরাত পেরিয়ে যাবে।
রাত যত গভীর হয় ততই ভাল। আমি আচমকা হাজির হতে চাই, কোনরকম জানান না দিয়ে। উঠে দাঁড়ালেন ডন রোমেরো। এই যে, তুমি! ঝটপট পাঁচজন লোক নিয়ে, চল আমার সঙ্গে। পাঁচজন সশস্ত্র লোক, বোঝা গেছে?
না, তুমি পারবে না যেতে! এভাবে মাঝরাতে একজন মহিলার বাড়ি যায় কেউ?
আমার যা খুশি, আমি তা-ই করব। ছেলেটা যদি থাকে ওখানে, কেড়ে নেব। এই মেয়ের কী অধিকার আছে আমার নাতিকে তার কাছে রাখার?
কেন কেড়ে নেবে, যাতে খুন করতে পার ওকে? যেমনটা আগেও চেষ্টা করেছিলে একবার? একদমে কথাগুলো বলে হাঁপাতে লাগলেন এলেনা। অ্যাংলোদের তুমি চেন না, ব্রাদার। ওরা তোমার ওই বংশমর্যাদা হোড়াই পরোয়া করে। নির্ঘাত ফাঁসিতে ঝোলাবে তোমাকে।
ফাঁসি? বোকার মত কথা বল না!
পাই করে ঘুরে দাঁড়ালেন ডন, আগুন চোখে তাকালেন এক পরিচারিকার দিকে। তুমি! আমার বুট! জলদি!
বুটের ভেতর পা গলালেন তিনি, মেঝেতে ঠুকে বসিয়ে নিলেন জায়গামত। তারপর বোনের উদ্দেশে ফিরলেন। তুমি মেয়েমানুষ, কাজেই কত আর বুদ্ধি হবে! এই ছেলের বেঁচে থাকাটাই আমার জন্যে অপমানকর। আমার মেয়ের সাথে কিনা ওই…ওই খালাসিটার বিয়ে!
অত্যন্ত সৎ লোক ছিল সে, অল্পদিনের ভেতর জাহাজের ক্যাপ্টেন হয়ে যেত।
ফুঃ! জাহাজের ক্যাপ্টেন! নিশ্চয় কোন ছোট লঞ্চ-টথের? সে হবে আমার জামাই?
গটগট করে দরজার দিকে এগোলেন ডন, দোরগোড়া থেকে ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, খামোকা চিন্তা করে নিজেকে কষ্ট দিয়ো না তুমি। ওই ছোঁড়া এবার মরবে। আমি সেটা পাকাঁপোক্ত করতেই যাচ্ছি।
ডোনা এলেনা শুনতে পেলেন তার ভাইয়ের পদশব্দ উঠনের ওপাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে একাবর ভাবলেন তিনি, নিজের ঘোড়ায় চেপে পেছনের পথে রোমেরোর আগেই পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন শহরে। পরক্ষণে বুঝলেন, কোন লাভ হবে না এতে। পথঘাট ভাল চেনেন না তিনি, হারিয়ে যেতে পারেন।
মিস ডায়ানার শীতল সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ল তাঁর। মহিলা নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমতি, সহজে পরাস্ত হবেন না।
তবু, ভয় পাচ্ছিলেন ডোনা এলেনা। ছেলেটার কী দশা হবে? রোমেরো দেখামাত্র চিনে ফেলবে ওকে, এবং হত্যা করবে।
একটি জায়গায় কোনমতেই সুবিধে করতে পারবেন না সিনোরিটা ডায়ানা, আইন তাকে বাধ্য করবে দাদুর হাতে নাতিকে তুলে দিতে।
.
অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসলেন মিস ডায়ানা, এইমাত্র একজন ঘোড়াসওয়ার চলে গেছে তাঁর জানালার পাশ দিয়ে ব্যাপার কী? ভাবলেন তিনি। ড্যান আর জর্জ কি ফিরে এল?
না, অসম্ভব। তার কর্মচারীদের কেউ বাসার ওই পাশ দিয়ে চলাফেরা করবে না।
তবে কি আউট-ল? চোর? ঝটিতি বিছানা ছাড়লেন ডায়ানা, গায়ে রোব চাপালেন।
কেলসো কোথায়?
বালিশের নীচ থেকে আলগোছে নিজের পিস্তলটা বের করে নিলেন তিনি, গাউনের ভাঁজে লুকিয়ে নিয়ে এগোলেন লিভিং রুমের দিকে। আর ঠিক তক্ষুণি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সদর দরজা, জনাকয়েক লোক ঢুকল ভেতরে-একেবারে সামনে ডন রোমেরো।
তোমার এখানে একটা ছেলে থাকে। আমি তাকে দেখতে চাই।
আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, সিনর। কিন্তু আপনি দরজা ভেঙে আমার বাসায় ঢুকেছেন-এটা বেআইনি। এবং আইনত দণ্ডনীয়। এখন দয়া করে আপনি চলে গেলে আমি খুশি হব।
বাড়ি সার্চ কর! নির্দেশ দিলেন ডন রোমেরো।
মিস ডায়ানা তার পিস্তল তাক করলেন। সিনর! আমি কখনও মিস করি না! আপনি বা আপনার কোন লোক যদি আগে বাড়ে, আমি গুলি করে আপনার কান ফুটো করে দেব। এবং কাল সকালেই খবরটা সবাই জেনে যাবে।
ডায়ানার ডান দিক থেকে শান্ত গলায় কথা বলে উঠল একটা কণ্ঠস্বর, ওরা কোথাও যাচ্ছে না, ম্যাম। আমার এই বন্দুকটা একটা স্ক্যাটার-গান।
কেলসো ল্যাম্পের সলতে উস্কে দিতে, উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে, দেখা গেল উদ্যত শটগানহাতে দাঁড়িয়ে আছে ও।
তুমি? পেছনে-দাঁড়ানো অপেক্ষাকৃত তরুণ এক ভ্যাকুয়েরোকে আচমকা ডাকলেন ডায়ানা, দয়া করে ওই ঘরগুলোয় তুমি একটু উঁকি মেরে দেখবে? যদি কোন ছেলেকে চোখে পড়ে, হাঁক দিয়ো।
একটু ইতস্তত করল সে, তারপর এগিয়ে এল। সব দরজা খোলা থাকায়, মাত্র মিনিটখানেক লাগল কাজটা সারতে। সবশেষে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল লোকটা। সিনর? কোন ছেলে-টেলে নেই। এই দুজন, আর রাঁধুনি। ব্যস।
ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে এবার থ্যাবড়া-নাকের উদ্দেশে ফিরলেন ডন রোমেরো। গর্দভ! মিস ডায়ানার দিকে তাকালেন তিনি। সিনোরিটা, আমি সত্যি
সার, আপনি একটা বোকা এবং কাপুরুষ। আপনার বংশের কলঙ্ক। যে বংশগৌরব নিয়ে আপনার অহঙ্কার, প্রতিদিন তাকেই অপমান করছেন আপনি, ঘৃণায় মুখ বাঁকালেন ডায়ানা।
আপনার কাহিনি সবাই জানে। নিজের মেয়েকে দেশছাড়া করেছেন, খুন করিয়েছেন তার স্বামীকে, তারপর আপনার নাতিকেও খুন করার চেষ্টা করেছিলেন আপনি।
সিনর, আপনি ভেবেছেন কেউ জানে না একথা? ভুল করবেন, তা হলে। আপনার আড়ালে আপনাকে টিটকারি দেয় সবাই, কখনও কখনও ভয়ে শিউরে ওঠে।
যে-জামাইকে আপনি হত্যা করেছেন, হাজার গুণে সে আপনার চেয়ে ভাল লোক ছিল। কী আছে আপনার, সার? কিচ্ছু না!
ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ডন রোমেরোর চেহারা, চোয়াল, ঝুলে পড়েছে, কুৎসিত দেখাচ্ছে। তুমি যদি পুরুষ হতে, আমি খুন করতাম তোমাকে! আবেগে ফ্যাঁসফ্যাঁসে শোনাল তার কণ্ঠ। আমি
না, ডন রোমেরো, সেরকম কিছুই আপনি করতেন না। সামনাসামনি কারও সাথে লড়ার সাহস আপনার নেই। আপনি আমাকে খুন করাতেন–ওদের কারোকে দিয়ে হাত ইশারায় ডনের পেছনে-দাঁড়ানো লোকগুলোকে দেখালেন ডায়ানা। জীবনে কখনও কোন মানুষকে নিজে হাতে মেরেছেন আপনি? আত্মরক্ষার খাতিরে হলেও? আপনার হম্বিতম্বি সবই বাপ-দাদাদের টাকায়…নিজে কিছু করেছেন?
আপনার পূর্বপুরুষরা, সিনর, আপনার দেশের লোকেরা সবাই সাহসী মানুষ ছিল, লড়াকু মানুষ ছিল। কিন্তু আপনি কী? স্রেফ খালি একটা কলসি!
যে-তরুণটি খানাতল্লাশি করেছিল, সে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল বাইরে। অন্যরা, লজ্জায় অধোবদন, পিছোতে শুরু করল দরজার দিকে।
মুখ খোলার চেষ্টা করলেন ডন রোরো, কিন্তু উপযুক্ত ভাষা খুঁজে পাওয়ার আগেই, ডায়ানা গর্জে উঠলেন, বেরিয়ে যান আপনি! বেরিয়ে যান এক্ষুণি! ফের কখনও যদি আমার দরজায় দেখি, আমি নিজ হাতে খুন করব আপনাকে!
ঘুরে দাঁড়ালেন ডন, তার লোকজন সবাই চলে গেছে। অন্ধের মত দরজার দিকে এগোলেন তিনি, পা রাখলেন বাইরের অন্ধকারে।
কেলসো তার শটগানটা নিচু করল। খোদার কসম, ম্যাম! আমি এরকম দেখিনি। আপনি ওঁকে চাবুকপেটা করেছেন?
আমি দুঃখিত, মিস্টার কেলসো। রাগতে চাইনি, কিন্তু ওই ছেলেটার জন্যে…
আমি বুঝেছি, ম্যাম। একটু দ্বিধা করল কেলসো। ম্যাম, কিন্তু আপনি জানেন, কী করেছেন আজ? ওঁকে শেষ করে দিয়েছেন। দশটা বন্দুকও যা করতে পারত না।
ওই যে লোকগুলো এসেছিল? ওরা চলে গেছে, ম্যাম। আর কখনও থাকবে না ওর সাথে। ওরা খেটে-খাওয়া মানুষ, ধনী না হতে পারে, কিন্তু আত্মসম্মানবোধ আছে।আর ওদের সেই অহঙ্কার গড়ে ওঠে নেতাকে ঘিরে, যার নুন খায় ওরা। তাই, আজ চোখের সামনে যখন সেই অহঙ্কারকে ধুলোয় মিশতে দেখল, ওরা আর ওঁর পেছনে থাকবে না। হাজার ডাকলেও, ডন রোমেরো এখন আর কাছে পাবেন না কারোকে।
.
মুহূর্তের জন্যে, যখন পৌঁছুলেন নিজের ঘোড়ার কাছে, ডন রোমেরো হেলান দিলেন স্ট্যালিয়নের গায়ে। বিস্ময়ে তার সারা মন অসাড় হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত কেউ তার সঙ্গে কথা বলেনি ওভাবে। সাহস পায়নি কেউ।
এসব কথা বলার দুঃসাহস ও পেল কোথায়? নিশ্চয় মেয়েমানুষ বলেই গ্রহণ করেছে সুযোগটা, জানে তাকে চ্যালেঞ্জ করবে না কেউ।
পমেলে ভর দিয়ে স্যাডলে উঠে বসলেন ডন, আশপাশে তাকিয়ে দলের লোকদের খুঁজলেন।
নেই। তিনি একা।
গর্দভের দল! কী ভেবেছে ওরা, এধরনের বেয়াদপি তিনি সহ্য করবেন?
গলা চড়িয়ে দলের লোকদের নাম ধরে ডাকলেন রোমেরো। আন্দ্রে! পেদ্রো! এস, আমরা যাচ্ছি।
সাড়া মিলল না কোন।
আবার ডানে-বাঁয়ে তাকালেন ডন, অবাক হয়েছেন। চলে গেছে ওরা। গলা ভেজাতে গেছে শহরে, সম্ভবত। তবু, কেমন-যেন অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন রোমেরো, মনে হলো তার পেটের ভেতর কিছু একটা চাপ বেঁধেছে। বাড়ির উদ্দেশে ঘোড়া ছোটালেন তিনি।
হতচ্ছাড়ি! জোরে জোরে বললেন রোমেরো। কী দুঃসাহস! মিস ডায়ানার কথাগুলো মনে পড়তেই, তিনি শিউরে উঠলেন আরেকবার। ডাইনী, সাক্ষাৎ ডাইনী।
কী ব্যবহারটাই না করল!
চারদিকে নজর বোলালেন ডন। অন্ধকার রাস্তায় তিনি একা। কোন অনুচর নেই, আওয়াজ নেই তার রাইডারদের খুরের।
বাসায় পৌঁছে রোমেরো দেখলেন সামনের উঠন অন্ধকার, নীরব-নিথর। মাটিতে নামলেন তিনি, আশপাশে তাকিয়ে সহিসকে খুঁজলেন ঘোড়া বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে।
কেউ নেই।
ঘুরে দাঁড়ালেন ডন, ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন চারদিকে। কেবলমাত্র র্যাঞ্চ হাউসেই একটা বাতি জ্বলছে; আর সবকিছু অন্ধকার, নিস্তব্ধ।
হোয়াকিম! চেঁচিয়ে ডাকলেন তিনি।
লোহার আংটার সাথে স্ট্যালিয়নটাকে বেঁধে রাখলেন রোমেরো। শিগগিরই কেউ নিয়ে যাবে এসে। উঠনের ওপাশে হাঁটা দিলেন তিনি, অখণ্ড স্তব্ধতার মাঝে প্রতিধ্বনি তুলল তার বুটের খটখট।
অনেক রাত হয়েছে তখন। স্বাভাবিকভাবেই কাছেপিঠে ছিল না কেউ। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি সেটা। যখন মিস ডায়ানার বাসার উদ্দেশে রওনা হন, তখনই প্রচুর রতি হয়ে গিয়েছিল।
নিজের ভেতরটা ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকল ভঁর। এতক্ষণ এসব আবল-তাবল কী ভাবছিলেন তিনি? সিনোরিটা ডায়ানা একজন সম্রান্ত মহিলা, সবাই সমীহ করে তাকে, শুধু অ্যাংলোরাই নয়, তার স্বজাতির লোকেরাও ওই মহিলাকে পছন্দ করে।
তার স্বজাতি? কবে থেকে ওদের সম্পর্কে এভাবে ভাবতে শুরু করেছেন তিনি? ওরা হয় ক্যালিফোর্নিয়, নয়তো মেক্সিক্যান। আর তিনি এসেছেন ক্যাস্টাইল থেকে।
এবার সত্যি সত্যি নিজেকে ভীষণ অসুস্থ মনে হলো ডন রোমেরোর। তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? লোকের বিদ্রূপ থেকে বাঁচতেই ক্যাস্টাইল ত্যাগ করেছিলেন তিনি। দুর্বিষহ এক অপমান থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছিলেন এখানে। আর তারপর মারিয়া…
সেই আমেরিকান লোকটা। তুচ্ছ একটা নাবিক, সে কিনা প্রেমনিবেদন করল ওকে! তার মেয়েকে!
স্ট্যালিয়নটাকে রেখে, বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন ডন। টেবিলের ওপর মোম জুলছিল একটা। ঘরের দেয়াল আলমারির ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন রোমেরো, পরপর দুটেক উষ্ণ সুরাপান করলেন। তারপর তৃতীয় দফা গ্লাস ভরে নিয়ে, চলে গেলেন ঘোড়ার চামড়ার বড়সড় একটা চেয়ারের সামনে বসে পড়লেন ধপ করে।
তিনি ক্লান্ত। অবসন্ন। অনেক রাত হয়েছে এখন, আর তিনিও আগের সেই যুবকটি নন। ডায়ানাকে মন থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করলেন রোমেরো, কিন্তু ওই ঝলসানো চোখ, কণ্ঠস্বর, এত, তীক্ষ্ণ…
মৃদু নড়াচড়ার শব্দ হলো তার পেছনে, সস্নেহ একটা হাত এসে পড়ল ডনের কাঁধে। রোমেরো? রাত অনেক হলো। তুমি এবার বিছানায় যাও।
আমার ঘোড়া–
আমি দেখব। তুমি শুতে যাও।
তুমি জান? শুনেছ কিছু?
শুনেছি। ওরা যখন ওদের জিনিসপত্র নিতে ফিরে–
ওদের কী?
ওরা নেই, রোমেরো? আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছে। একটু থামলেন এলেনা। ওরা গর্ব করত আমাদের নিয়ে। কিন্তু আমরা হতাশ করেছি ওদের।
মুখ বিস্বাদ ঠেকল ডন রোমেরোর। ডানে-বাঁয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি উঠতে নিয়েও, পরক্ষণে বসে পড়লেন আবার।
সব গর্দভের দল! জাহান্নামে যাক ব্যাটারা! আরও ভাল লোক জোগাড় করবেন তিনি। তার অর্থ আছে। মোটা টাকা দিতে পারবেন।
বিছানা..হ্যাঁ, তার এখন খানিকটা ঘুম দরকার। আর অল্পক্ষণের ভেতর আরেকটা নতুন দিনের সূচনা হবে। তার মনে পড়ে না শেষ কবে তিনি ক্লান্ত বোধ করেছিলেন!
তবে একটা কথা ঠিক, তাঁকে চলে যেতে হবে এখান থেকে। স্পেনেই ফিরে যেতে হবে।
তাঁর লোকেরা তাঁকে পরিত্যাগ করেছে। সবাই।
.
২২.
আমরা যখন এল ক্যাম্পে থেকে বেরিয়ে আগুয়া ক্যালিয়েন্তের দিকে এগোলাম, মন্টে ম্যাক-কায়াও সঙ্গ নিল আমাদের। জর্জ মোটামুটি সাদরে গ্রহণ করল ওকে, কিন্তু আমার সন্দেহ ঘুচল না। কারণ তখনও পর্যন্ত লোকটার পরিচয় বা তার চাহিদা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না আমি।
যখন প্রায় পাম স্প্রিংয়ের কাছাকাছি এসে পড়েছি, রেকাবের ওপর দাঁড়িয়ে আমি চোখ মেলে দিলাম সামনে। ওই যে, হাত ইশারায় দেখিয়ে, আচমকা চেঁচিয়ে উঠলাম খুশিতে, কলিং রক।
ম্যাক-কায়া দেখতে পেল ওটা, জরিপ করল। কী আছে ওখানে?
ওকে আমি জানালাম কেন ওই পাহাড়ের নাম হয়েছে কলিং রক, তারপর বললাম কেউ কেউ একে লিনিং রকও বলে।
প্রথম নামটাই শ্রুতিমধুর, বলল মন্টে। আর তোমার ওই কাহিনিটাও সুন্দর। তা, তুমিও কি পেছনে তাকিয়েছিলে?
অবশ্যই। আমি ফিরে আসতে চেয়েছিলাম।
যখন আরও কাছাকাছি হালাম আমরা, ইশারায় আমি চাইনো ক্যানিয়নটা দেখালাম। ওখানে গুহা আছে একটা, ভেতরে পানি মিলবে। শিকারে যাওয়ার আগে কাউইয়ারা ওই গুহায় ঢুকে পানি খেয়ে নেয় আগে। ওদের ধারণা এতে নাকি বহুগুণ বেড়ে যায় ওদের শক্তি।
পলক তুলে ক্যানিয়নটা দেখল ম্যাক-কায়া। আমাকে একবার ঢুকে দেখতে হবে জায়গাটা কেমন।
ওর নজরে পড়েছিল আমি আর জর্জ ঘনঘন পেছন ফিরে আমাদের ব্যাক ট্রেইল জরিপ করছি। ব্যাপার কী, তোমাদেরকে কেমন-যেন অস্থির মনে হচ্ছে, শেষমেশ বলেই ফেলল ও। কেন, বিপদের আশঙ্কা করছ নাকি?
তোমার যদি ভয় করে, চলেযেতে পার, বলল জর্জ। সম্ভবত বিপদ এড়াতে পেরেছি আমরা, তবু ঝুঁকি নিতে চাইছি না।
যেহেতু একসঙ্গে চলছি আমরা, জবাব দিল ম্যাক-কায়া, তোমাদের বিপদ মানেই আমার বিপদ। যদি দেখ ওরা আসছে, আমাকে জানাতে দেরি কর না। একবার দেখব, ব্যাটাদের হজম ক্ষমতা কত।
এটা তোমার লড়াই নয়, বলল জর্জ।
তবু আমি থাকছি। যে-মুহূর্তে এসেছি তোমাদের ক্যাম্পে, তখন থেকেই আমি তোমাদের লোক।
অদ্ভুত মানুষ ছিল এই মন্টে ম্যাক-কায়া। গান করত সারাক্ষণ। বেসুরো গলা, তবু গানই যেন ছিল ওর জীবন।
বুনো ঘোড়া ধরার ব্যাপারে আমাদের পরিকল্পনার কথা যখন জানল সে, সঙ্গী হতে চাইল আমাদের।ল্যারিয়েট ছুড়তে জানি আমি, বলল।ঘোড়াও পোষ মানাতে পারি।
পরে, যখন একা হালাম আমরা, আগুনের ওপর দিয়ে জর্জ তাকাল আমার দিকে। ড্যান, তুমি কী বল? নেব ওকে?
আমার ধারণা লোকটা ভালই, বললাম, আর তা ছাড়া সাহায্যও লাগবে আমাদের।
পাম স্প্রিংয়ে যে-দোকানটা ছিল পরদিন সকালে বেলেপাহাড়ের মাঝ দিয়ে সেখানে গেলাম আমরা।
দোকানি দেখামাত্র চিনতে পারল আমাকে। স্মিত হেসে বলল, কেমন আছ, বাছা? বেশ কয়েক ইঞ্চি লম্বা হয়েছ দেখছি।
জ্বি। আচ্ছা, আমার বাসাটা কি খালিই পড়ে আছে এখনও?
খানিক আমতা-আমতা করল দোকানি, তারপর বলল, তুমি যখন ফিরে এসেছ তখন নিশ্চয়ই খালি হয়ে যাবে।
আর ফ্রান্সিসকো…আছে?
মাঝেসাঝে দেখি। ও যদি তোমার সাথে দেখা করতে চায়, ঠিকই খুঁজে নেবে তোমাকে। জানই তো, বাছা, ইন্ডিয়া একটু খেয়ালি হয়।
ওই দোকান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র কেনাকাটা করল জর্জ। ময়দা, লবণ, কফি, হ্যাম আর দুচাকা বেকন।
দরজার কাছে গিয়ে, আমি তাকালাম বাড়িটা যেখানে অবস্থিত। সেই বেলেপাহাড়গুলোর দিকে। মুহূর্তের জন্যে মনে হলো ক্ষীণ একটা ধোঁয়ার রেখা দেখতে পেলাম যেন? অজানা আশঙ্কায় ধড়াস করে উঠল আমার বুক।
একটু ইতস্তত করলাম আমি, তারপর জর্জের উদ্দেশে ঘুরে, যেন কিছুই হয়নি এভাবে বললাম, তোমরা মালপত্র গুছিয়ে নাও, আমি এগোচ্ছি। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
ঝট করে আমার দিকে তাকাল ও, মন্টে ম্যাক-কায়া ঘাড় ফেরাল। আমি আসব?
দরকার নেই। আমি একাই যাব। তারপর বিতর্কের অবসান করতে যোগ করলাম, ওখানেই খুন হয়েছিলেন আমার বাবা। আমি একাই যেতে চাই ওখানে।
তাই? ঠিক আছে, বলল মন্টে। আমরা না হয় পরেই আসছি।
তবে আমি জানি, জর্জকে বোকা বানাতে পারিনি। আমার ওই বাড়িটা যে ভুতুড়ে ও তা জানে। বাবার মৃত্যুর পর মরুভূমি থেকে ফিরে আশ্চর্যজনকভাবে তার অস্ত্রপাতিগুলো যেমন গুলি-ভরা অবস্থায় আবিষ্কার করেছিলাম আমি, তেমনি প্রায়ই একটা-দুটো করে আমার বই চুরি যেত বাসা থেকে, তারপর আবার দিনকতক পর দেখতাম যথাস্থানেই রাখা আছে ওগুলো কিন্তু গায়েব হয়েছে অন্য বই। তারপর এবার কেলসোর সাথে যখন দেখা হলো, জানলাম হালে সে নাকি একবার এসেছিল এদিকে এবং তখন টাহকুইৎসয়ের বাসায় বাতি দেখতে পেয়েছিল। সুতরাং জর্জও যে আমার মতই কৌতূহল বোধ করছিল আসল ব্যাপারটা কী তা জানার জন্যে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
প্রথমে বইয়ের থলেটা খুলে নিয়ে স্যাডলের ওপর আমার সামনে রাখলাম আমি, তারপর ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে ধীর কদমে এগোলাম ট্রেইল বরাবর। যখন বালিয়াড়ির মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে-যাওয়া মেঠোপথে ঢুকরলাম, গলা ছেড়ে গান ধরলাম একটা!
উঠনে পৌঁছে ঘোড়া থেকে নামলাম আমি, বইয়ের থলেটা তুলে নিলাম কাঁধে। সিঁড়ির গোড়ায় এসে থলেটা নামিয়ে খুলে ফেললাম ওটার মুখ, একেবারে ওপরের বইটা বের করলাম। প্রথম কয়েকটা পাতা দেখলাম উল্টে-পাল্টে, তারপর বইখানা আবার রেখে দিলাম যথাস্থানে। শেকল নামিয়ে দরজা খুললাম।
যেমনটি রেখে গিয়েছিলাম তেমনি আছে ঘর। হলে ঝট দেয়া হয়েছে মেঝে, কোনা-কাঞ্চি কোথাও কোন স্কুল নেই। বইগুলো আগের মতই সাজানো-গোছানো রয়েছে শেলফে, তবু দীর্ঘদিন বদ্ধ থাকলে যেমন হয়, ঘরের পরিবেশ ততখানি গুমোট ঠেকল না আমার কাছে।
খাট দুটোও বেশ পরিপাটি, কেবল কম্বলের সঙ্গে চাদরও যোগ হয়েছে এখন। কাবার্ডগুলো খুললাম আমি। রসদপত্র মজুত আছে। জর্জের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই।
ফায়ারপ্লেসে কফিপট চাপানো ছিল। কাপ নামিয়ে আমি ভরে নিলাম ওটা, দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বসলাম চেয়ারে।
আবার বাড়ি ফিরে এসেছি আমি। এই সেই মরুভূমি, আমার মরুভূমি। আমার বাবা-মা, পারস্পরিক ভালবাসার বন্ধনে বাঁধা পড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন এই মরুভূমির ওপারে, সাময়িকভাবে গা ঢাকা দিয়েছিলেন এখানে, এর ওপর নির্ভর করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করেছিলেন। এবং আমিও রক্ষা পেয়েছি। এবং এখন আবার ফিরে এসেছি মরুভূমিতে, ফিরে এসেছি আমার বাসার পেছনের আকাশছোঁয়া পাহাড়পর্বতের কাছে, এর সেই নিঃসঙ্গতার কাছে যা কখনোই নিঃসঙ্গ নয়, এর অখণ্ড স্তব্ধতার কাছে যা নীরব কণ্ঠে কেবলমাত্র আমার সঙ্গেই কথা বলে।
আস্তে আস্তে, রয়ে-সয়ে, কফি পান করতে লাগলাম আমি, আর তাকিয়ে রইলাম জানালার বাইরে, পাহাড়পর্বতের দিগন্ত-বিস্তৃত কাল তরঙ্গের দিকে।
যখন শেষ হলো কফি, উঠে দাঁড়ালাম, দুটো ঘোড়া থামার শব্দ পেলাম বাইরে, তারপর মানুষের গলা, মন্টে আর জর্জের।
বইয়ের থলেটা তুলে নিতে বাইরে পা রাখলাম আমি, দেখলাম সবচেয়ে ওপরেরটা উধাও হয়েছে।
ইচ্ছে করেই আমি আর মাথা ঘামালাম না এ-ব্যাপারে। গোপনীয়তা জিনিসটা কারও যদি এতই পছন্দ হয়ে থাকে, ভাবলাম, আমি তাতে ব্যাঘাত ঘটাব না।
জর্জ বুশ আর মন্টে ম্যাক-কায়া ওদের ঘোড়া দুটো তুলে রাখতে কোরালের দিকে এগোল। আমি পিছু নেব, হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মন্টে, তর্জনী ইশারায় ওর পায়ের কাছে মাটিটা দেখাল।
ধুলোর বুকে একটা পায়ের ছাপ জ্বলজ্বল করছিল ওখানে, অতিকায় একটা মোকাসিনের ছাপ!
মাশাল্লা! সভয়ে ফিসফিস করে বলল জর্জ। মাপটা দেখেছ?
আমার দ্বিগুণ,মন্টে বলল ছাপটার পাশে তার বুট রেখে। না, তিন গুণ!
আমি অকালাম ওদিকে, পরক্ষণে সরিয়ে নিলাম চোখ। ওই পায়ের ছাপ, মনে মনে বললাম নিজেকে খামোকা আসেনি এখানে। এর অর্থ, শিগগিরই অবসান হবে সমস্ত রহস্যের, আমি জানতে পাব আমার অবর্তমানে কে আসা-যাওয়া করে টাহকুইৎসয়ের বাসায়।
এর আগে এখানে কোন পায়ের ছাপ চোখে পড়েনি আমার, শুধু বই চুরি যাওয়া থেকে বুঝতে পারতাম আমি ছাড়াও আরও কেউ একজন আছে কাছেপিঠে।
আর এখন, পায়ের ছাপ থেকে একটা তথ্য জানতে পেলাম। এর মালিক যেন প্রকারান্তরে আমাকে বলে দিল, দেখ, আমি এই মাপের মানুষ। তুমি যদি আর এগোতে ভয় পাও-এগিয়ো না।
সহসা বেদনায় টনটন করে উঠল আমার বুক। এরকম একজন মানুষ কোথায় পাবে তার সঙ্গী? কে পারবে অসম আকৃতির এই বাধাকে ডিঙিয়ে ওর সাথে দেখা করতে? আমি-ই কি পারব?
নিশ্চয় ভীষণ একা ও। কিম্ভুত গঠনের কারণে অন্য সবার থেকে আলাদা-বিচ্ছিন্ন।
হ্যাঁ, আমার বিশ্বাস, ইচ্ছে করেই রেখে যাওয়া হয়েছিল ওই পায়ের ছাপ।
এদিকে আমিও, নিজের মুদ্রাদোষে, আর আমার বাবা-মায়ের অবস্থানগত কারণে, আমার সমবয়সী আর সবার চেয়ে একদম আলাদা। যেখানেই যাই, লোকে আমাকে পর ভাবে, ব্যতিক্রম শুধু এই মরুভূমি আর আমার জানামতে, এর অধিবাসী ইন্ডিয়ানরা।
অবশ্যি এতেও কোন সন্দেহ নেই, সব শ্বেতাঙ্গকেই বিদেশী ভাবে ইন্ডিয়ানরা, কারণ আমাদের রীতিনীতি ওদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা; আর তা ছাড়া প্রত্যেক সমাজের লোকই মনে করে তাদের নিয়মটাই বুঝি মানুষের সহি স্বভাব। কিন্তু তার এটা বোঝে না, আসলে এগুলো পরিবেশের সৃষ্টি, তাদের পারিবারিক অবস্থান, লেখাপড়া, পারস্পরিক আচার-ব্যবহার এসবের মাঝ দিয়ে গড়ে-ওঠা।
চমৎকার জায়গা, অর্থপূর্ণ গলায় মন্তব্য করল মন্টে। কষ্ট করে সাফ-সুতরোও করে রেখেছে কে যেন।
জর্জের দিকে তাকাল ও। এই ইন্ডিয়ানদের তুমি চেন?
জর্জ ইশারায় আমাকে দেখাল। ও চেনে। ইন্ডিয়ানদেরকে সামলাবার দায়িত্ব ওর। ইন্ডিয়ানরা চেনে ওকে। ওর বাবাকেও সম্মান করত। তুমি দেখতেই পাবে।
অন্ধকার ঘনাতে, ল্যাম্প ধরালাম আমরা, থলে থেকে অরশিষ্ট বইগুলো বের করে আমি শেলফে সাজিয়ে রাখলাম। পুরোনো বইপত্তর থেকে কয়েকটা বেছে আলাদা করলাম আমি, মনে হলো দোকানে নিয়ে রাখলে যারা পড়েনি হয়তো তাদের উপকারে আসবে। সে-আমলে পড়ার সামগ্রী পাওয়া যেত না বিশেষ, আর গেলেও তার দাম হত চড়া, কেউ কারোকে দিতে চাইত না।
তোমার বাবা খুন হয়েছিলেন এখানে? জিজ্ঞেস করল মন্টে।
দোরগোড়ায়, জবাব দিলাম আমি।
কী নাম তোমার বাবার-ডগলাস ও’হারা? আমাকে ওপর-নীচ মাথা ঝাঁকাতে দেখে ও বলল, চিনতাম। কিন্তু, বাছা, তোমার মত যার এত শক্ত, তার তো পিস্তলে চালু হওয়া লাগে।
কাজ চালিয়ে নিতে পারি।
আমি বোধহয় এ-ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারব। তোমাকে ক্ষিপ্র হতে হবে, অসম্ভব, তা হলে ভয় থাকবে না আর কোন।
ঠিক আছে।
ফায়ারপ্লেসের ধারে মেঝেতে নিজেদের বিছানা পাতল ওরা। আর আমি আমার পুরনো শোবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। যখন শুলাম বিছানায়, অন্ধকার ছাতের দিকে তাকালাম আমি, অ্যানাবেলকে মনে করলাম।
ঘোড়ার পাল নিয়ে যখন ফিরে যাব আমরা, তখন হয়তো ওর দেখা পাব আমি, এবং মিলিত হব ওর বাবার সাথে।
রাতে বাতাস উঠল, মৃদুমন্দ গতিতে ছুটে এল পুবের মরুভূমি থেকে। শিগগিরই ওখানে যাব আমি, ঘুরে বেড়াব।
পাশাপাশি আরও একজনের কথা মনে পড়ল আমার। ভাবলাম টাক্কুইস্ এখন কোথায়, কী করছে।
ফ্রান্সিসকোকে স্মরণ করলাম আমি। হাস্যোজ্জ্বল একটা মুখের ছবি এঁকেছিল সে। আবার যখন দেখা হবে আমাদের, ভাবলাম, তখনও কি হাসবে সেই মুখ?
এখনও কি আমার বন্ধু থাকবে ও? আমরা বড় হয়ে গেছি এখন, তায় দেখা সাক্ষাৎ নেই অনেকদিন।
ইন্ডিয়ান সমাজের রীতি অনুযায়ী এতদিনে সাবালক হয়ে গেছে ও। কিন্তু আমিও কি তা-ই হইনি?
কত দ্রুত কেটে গৈছে সময়। এরমাঝে কোনরকম যোগাযোগ হয়নি আমাদের।
তবু আশা করলাম, ওর স্মৃতিকে সামান্য হলেও আমি পারব নাড়া দিতে।
আশা করলাম, কাল আমি দেখা পাব ফ্রান্সিসকোর।
সহসা টুটে, গেল আমার তন্দ্রা। ইন্ডিয়ান ওয়েলসয়ে বহুকাল আগে এক বুড়োকে দেখতে পেয়েছিলাম আমি, গলায় তার নীলকান্তমণির মালা ছিল। আজও জানি না, সত্যিই আমি দেখেছিলাম বুড়োকে, নাকি ওটা ছিল আমার নিছক কল্পনা।
আচ্ছা, ভাবলাম আমি, ওই একবারই সে কেন এসেছিল আমার কাছে? আমি যদি দেরি করতাম, সে কি বলত কথা?
আবার কি আসবে কখনও?
.
২৩.
অবিশ্বাস্য ঘটনা যাতে মেনে নিতে পারি সেজন্যে বাবা ছেলেবেলায়ই গড়েপিঠে দিয়েছিলেন আমার মন। এমনিতে, তিনি যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন, কিন্তু সমুদ্র আর মরুভূমিতে জীবন কাটিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন জানার কোন শেষ নেই, এবং মানুষ আজ পর্যন্ত যা জানতে পেরেছে তা আসলে অন্তহীন জ্ঞানসমুদ্রের একটা কণা মাত্র।
মনের জানালা খোলা রাখবে সবসময়, বাবা বলতেন। কারণ কোটা সম্ভব আর কোনটা নয়, এ-ব্যাপারে কেউই নিশ্চয় করে বলতে পারে না কিছু।
তাই পরদিন সকালে আমি যখন শয্যাত্যাগ করলাম, তখন বাবার সেই উপদেশই বাজছিল আমার কানে।
লিভিং রুমে এসে দেখলাম জর্জ নাস্তা তৈরি করছে, আর মন্টে কী কাজে যেন বাইরে গেছে।
অল্পক্ষণের ভেতর ফিরে এল সে, বলল, ওই লোকটা তার অপর পা-খানা কোথায় রেখেছিল দেখলাম।
আরেকটা ট্র্যাক? জর্জ জানতে চাইল।
ঠিক তা নয়। মাটি নরম এরকম এক জায়গায় পাথরের ও পা রেখেছিল সে। ফলে পাথরটা দেবে গিয়েছিল। একটা কদম থেকে আরেকটার যা দূরত্ব, তাতে মনে হয় লোকটা আট ফুট লম্বা হবে!
লাফ দেয়নি তো?
মনে হয় না, জবাব দিল মন্টে। সেক্ষেত্রে পাথরটা একটু হলেও চিড় খেত।
যাক, এ-নিয়ে আমাদের চিন্তা করে লাভ নেই, বললাম আমি। লোকটা যে-ই হোক, আমাদের কোন ক্ষতি করেনি।
মন্টে বলতে নিয়েছিল কিছু, কিন্তু জর্জ বাদ সাধল। আমার বিশ্বাস, ড্যানের কথাই ঠিক। স্রেফ ভুলে যাও ব্যাপারটা, কেমন? ঘাড় ফিরিয়ে ম্যাক-কায়ার দিকে তাকাল ও। এমনকী কারোকে কোন প্রশ্ন করবে না এ-ব্যাপারে।
শ্রাগ করল মন্টে। বেশ তো।
এরপর আমরা বুনো ঘোড়া এবং কীভাবে ওদের ধরা যায় সে-ব্যাপারে আলাপ শুরু করলাম।
যদি বেশি বুড়ো হয়, মন্টে পরামর্শ দিল, ভাল জাতের হলেও ধরা ঠিক হবে। পোষ মানে না সহজে।
কোন র্যাঞ্চ থেকে পালিয়েছে এরকম ঘোড়াও মিলতে পারে কিছু মত প্রকাশ করল জর্জ।
পারে। তবে বুনো ঘোড়াও প্রচুর আছে, বললাম আমি। বাবা একবার কিছু ধরে দিয়েছিলেন ইন্ডিয়ানদের।
আচ্ছা, আমরা কোথায় যাব এই ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে দেখা করতে? প্রশ্ন করল মন্টে।
যাব না, বললাম আমি, ওরাই আমাদের খুঁজে নেবে।
তা হলে স্রেফ বসে থাকব চুপচাপ? মন্টের জিজ্ঞাসা।
কখন কোথায় দেখা করবে ওরাই ঠিক করে নেবে সেটা বললাম। ওরা নিজেদের মর্জিতে চলে।
জর্জের স্বভাব ছিল অনেকটা ক্যালিফোর্নিয়দের মত, র-হাইডের ল্যারিয়েট বানাতে পছন্দ করত বড়সড় একটা র-হাইড নিয়ে সেটা পাকাতে বসে পড়ল সে। শিগগিরই বুনো ঘোড়া ধরতে বেরোব আমরা, তারই আয়োজন আরকী! তবে ইন্ডিয়ানদের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ফ্রান্সিসকো নয়তো অন্য কেউ ওই স্টোরে দেখা করবে আমাদের সাথে।
ঠিক সেই মুহূর্তে অদ্ভুত কিছু একটা কাজ করছিল আমার মাঝে, যার স্বরূপ আজও বুঝে উঠতে পারিনি আমি। মানসিক স্থৈর্য পুরোমাত্রায়ই বজায় ছিল আমার, বলতে কী মরুভূমি থেকে বিদায় নেয়ার পর এতটা শান্তি আমি আর কখনোই বোধ করিনি, আবার এর পাশাপাশি, দুর্গম প্রান্তরে বেরিয়ে পড়ার জন্যে অসম্ভব ছটফটও করছিলাম। আমি জানি না মরুভূমির সাথে আমার আত্মিক কোন সম্পর্ক রয়েছে। কিনা। অনেকে পূর্বজন্মে বিশ্বাস করে। যদি সত্যি হয়ে থাকে সেটা, তবে কি আগের জন্মে মরুভূমিতেই ছিলাম আমি? নাকি এমন কিছু খুইয়েছি এখানে যা ফিরে পাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছি এখন?
এইসব প্রশ্ন তখন কুরে খাচ্ছিল আমাকে, তবে এসব কথা আমার সঙ্গীদের জানালাম না।
বাইরে বেরিয়ে পাহাড়পর্বতের দিকে তাকালাম আমি। ওখানে, ওই দূরে কোথাও টাহকুই থাকে। কল্পিত এই জীবটির কথাই বলে কাউইয়ারা, এবং সেই একই জীব মাঝে মাঝে হানা দেয় এ-বাসায় এখন যেখানে রয়েছি আমি। যখন সময় হবে, আপনা থেকেই আত্মপ্রকাশ করবে সে।
সাত ফুট লম্বা? একটু অসম্ভব মনে হলো। কিন্তু আমিও প্রায় ছফুট এখন, এবং ক্রমশ লম্বা হচ্ছি আরও।
ট্র্যাকটা যেখানে ছিল, সেখানে গেলাম আমি, জরিপ করলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। পরে কাজে আসতে পারে ভেবে ওটার ছবি গেঁথে নিলাম মনে। আমার সুবিধার জন্যে ইচ্ছে করেই রেখে যাওয়া হয়েছে ওই ছাপ, যাতে ভবিষ্যতে চিনতে কোন অসুবিধে না হয়।
সেইদিন রাতে দোকান থেকে ঘুরে এসে মন্টে বলল, আমার চেনাজানা আরও কজন লোক থাকে এখানে।
ওর দিকে তাকালাম আমরা, দৃষ্টিতে কৌতূহল। যেমন প্যলিশে ওয়েভার।
পাহাড়ি লোক, জর্জ বলল। চিনি। ভাল মানুষ।
ওর সাথে সেক্সটন নামে আরেকজন রয়েছে। বুড়ো হুয়ান অ্যান্টনিয়োর সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে ওরা। মন্টে ঘাড় ফেরাল আমার পানে। প্যলিশে তোমার বাবাকে চিনত।
প্রত্যেকেই ভাল লোক ওরা, তবু আমি খুশি হতে পারলাম না। এই মরুভূমি আমি ছাড়া আর কারও হবে এ যেন কিছুতেই সহ্য হলো না আমার। উঠে বাইরের অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারা ফুটেছে আকাশে, পাহাড় থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে।
যদি আরও মানুষ আসে মরুভূমিতে, ভাবলাম আমি, তা হলে এখানে যেসব নিঃসঙ্গ উপাস্য, যেসব কিংবদন্তী রয়েছে কী পরিণতি হবে তাদের কোথায় আশ্রয় নেবে প্রাচীন মানুষদের বিশ্বাস? তারা কি আত্মগোপন করবে বৃদ্ধ কোন গাছে নয়তো গুহায়? নাকি, আর কেউ শ্রদ্ধা করবে না তাদের-ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যাবে আমাদের এসব ঐতিহ্য আর কৃষ্টি?
যখন ভেতরে ফিরে গেলাম, আমি বললাম, জানি উপায় নেই, কিন্তু আমি চাই এখানে লোকের ভিড় বাড়ক। আমার যেন মনে হয় এতে বহুকিছু হারাচ্ছি। আমরা।
জর্জ মাথা ঝাঁকাল। তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝি। ট্রেইলে যখন আর কারোকে দেখি, আমারও ঈর্ষা হয়। কিন্তু কিছু করার নেই, সবাই আসবে এখানে-এটাই স্বাভাবিক।
ওখানে কিছু একটা রহস্য আছে, জর্জ। বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই তার সমাধান জানতে হবে আমাকে। কে যেন প্রতিনিয়ত আমাকে ডাকে হাতছানি দিয়ে।
একটুক্ষণ চুপ করে রইল ও, তারপর বলল, তোমার বাবা আমাকে বলেছেন। তোমার মাকে নিয়ে তিনি যখন ছিলেন এখানে, তারা দুজনেই সুখ পেয়েছিলেন খুব। হয়তো বেশিদিন টেকসই হয়নি, তবু পেয়েছিলেন। আমার উপদেশ, এই একটা কথা কোনদিন ভুলে যেয়ো না তুমি।
বাবা-মায়ের কথা মনে পড়তেই আরেকটা মুখ ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। সে-মুখ অ্যানাবেলের। এখন কোথায় ও? আমার কথা কি ভাবে কখনও? অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে হাসলাম আমি, বোকার মত আবোলতাবোল চিন্তা করছি বলে। আমার কথা কোন্ দুঃখে ভাবতে যাবে ও? আমি স্রেফ ওর সহপাঠী, এর বেশি কিছু নয়। বরং যখনই চোখ পড়ত ওর ওপর, লজ্জায় লাল হতাম।
আচ্ছা, আমার বাবা আর মায়ের মধ্যে প্রথম দেখা হয়েছিল কীভাবে? বাবাও কি লজ্জা বোধ করেছিলেন? আমার সন্দেহ আছে। তার মাঝে আত্মবিশ্বাস ছিল। দীর্ঘ কয়েকটা মাস পাশাপাশি বসেছি আমরা…তবু অ্যানাবেলকে আমি বলতে পারিনি কিছু। অবশ্যি একধরনের যোগাযোগ ছিল আমাদের মাঝে। ক্লাসে পড়াশুনোয় আর সবার চেয়ে ভাল ছিলাম আমরা। শিক্ষক এ-কারণে প্রায়ই পালা করে আমাদের পড়া শুনতে চাইতেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস হলো না এতে ইতরভেদ ঘটবে কিছু।
.
ফ্র্যান্সিসকোর দেখা না পেয়ে অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম আমি, তাই পরদিন সকালে স্যাডলে চেপে স্টোরে গেলাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠছি, এই সময় এক লোক বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। মাইক ভ্যালেটা।
ওর মুচকি হাসি দেখে রাগে আমার পিত্তি জ্বলে গেল। তোমার ওপর নজর রেখেছিলাম, বলল ভ্যালেটা, তাই যখন দেখলাম মরুভূমিতে যাচ্ছ; কৌতূহল হলো।
এতে আপনার আসে যায় কিছু?
ওর হাসি বজায় রইল, কিন্তু মিলিয়ে গেল কৌতুকের ভাবটা। বোধহয় যায়, বলল ভ্যালেটা। তোমার বাবা অনেকদিন ছিল এই মরুভূমিতে। ইন্ডিয়ানদের সাথে খাতির ছিল তার। আমার বিশ্বাস, এখানেই কোথাও টাকার হদিস পেয়েছিল সে।
টাকা? আমি হতভম্ব। কীসের টাকা?
তোমার বাবা খুব বেশিদিন ছিল না পুবে। অথচ তোমাকে পশ্চিমে নিয়ে আসার জন্যে এককাড়ি টাকা খরচ করেছে। কোথায় পেল?
আমার ধারণা, তোমার মাকে নিয়ে যখন এই মরুর্ভুমিতে ছিল, তখনই টাকার কোন খনি আবিষ্কার করেছিল সে।
ফ্যালফ্যাল করে আমি চেয়ে রইলাম ওর দিকে। পুবে নিদারুণ কষ্টে কেটেছে বাবার জীবন, আমাদের মুখে দুবেলার আহার জোটাতেই হিমশিম খেয়েছেন অনেকসময়। পশ্চিমে আসার ভাড়া জোগাড় করতে গিয়ে, যা কিছু সহায়-সম্বল ছিল আমাদের তার প্রায় সবই বিক্রি করে দিতে হয়েছিল তাকে।
আপনার ধারণা ভুল, সার, বললাম আমি। বাবা যখন পুবে যান, টাকাপয়সা খুর সামান্যই ছিল তার কাছে। এবং সেগুলোও রোজগার করেছিলেন গরুবাছুর আর ফার বিক্রি করে।
পকেট থেকে একটা সিগার বের করল ভ্যালেটা, দাঁত দিয়ে গোড়া কাটল। হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমাদের আর সবার সাথে সোজাসুজি লস এঞ্জেলেসে না গিয়ে ও এখানে নেমে পড়ল কেন? বাতাসে হাত খেলাল ও। এরকম অজপাড়াগাঁয়ে? আমার বিশ্বাস, নিশ্চয় কোন কারণ ছিল এর পেছনে। আর সেটা সোনা না হয়েই যায় না।
আমার ধারণা, তোমার ওই মিস ডায়ানাও জানে এই সোনার খবর। তা না হলে আর কোন্ কারণে সে খাওয়া-পরা দিচ্ছে তোমাকে? আর তুমিই-বা কেন ওই বুশটাকে সঙ্গে নিয়ে মরুভূমিতে যাচ্ছ?
সিগারটা মুখে গুঁজে ম্যাচের কাঠি জ্বালল ও, দুহাত জড়ো করে বাতাস থেকে আড়াল করল আগুন। তুমি এগোও। আমি আছি পেছনে। হয়তো আমাদের সবার জন্যেই প্রচুর আছে।
ভ্যালেটা, বললাম আমি, তুমি একটা বোকা।
মুহূর্তের জন্যে মনে হলো ও বুঝি মারবে আমাকে, সারা শরীর টানটান করে বললাম, সাবধান, ভ্যালেটা।
আমার কণ্ঠস্বরে নিশ্চয় ছিল কিছু, সাবধান হয়ে গেল ও, পলক তুলল ঝট করে। পরক্ষণে ক্রুর হেসে বলল, বাহু তুমি দেখছি অনেক সেয়ানা হয়ে গেছ এখন। এবার তোমাকে খুন করতে পারব আমি।
কী ঘটে গেল আমার মাঝে জানি না, তবে সহসাই সাহসী হয়ে উঠলাম আমি। মৃদু হাসলাম ওর উদ্দেশে। যখন তোমার খুশি, ভ্যালেটা! যখন তোমার খুশি!
Leave a Reply