বিদেশে
০১.
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে রাতদুপুরেই হোক আর দিনদুপুরেই হোক চট করে বলতে পারবেন না, আপনি যে হোটেলে শুয়ে আছেন সেটা কোন শহরে। টোকিও, ব্যাংকক কলকাতা, কাবুল, রোম, কোপেনহাগেন যে কোনও শহর হতে পারে। আসবাবপত্র, জানালার পর্দা, টেবিলল্যাম্প যাবতীয় বস্তু এমনই এক ছাঁচে ঢালা যে স্বয়ং শার্লক হোমসকে পর্যন্ত তাঁর সব-কটা পুরু পুরু অতসি কাঁচ মায় তার জোরদার মাইক্রোস্কোপটি বের করে, ওয়াটসনকে কার্পেটের উপর ঘোড়া বানিয়ে, নিজে তার পিঠে দাঁড়িয়ে, ছাতের উপর তার স্বহস্তে নির্মিত আ লা হোমস স্প্রে ছড়িয়ে বাকিটা থাক, ব্যোমকেশ ফেলুদার কল্যাণে আজ স্কুলবয়ও সেগুলো জানে– তবে বলবেন, হয় মন্তে কার্লোর রেজিনা হোটেল নয় য়োহানেসবের্গের অল হোয়াইট হোটেল। দূরপাল্লার অ্যারোপ্লেনের বেলাও আজকের দিনে তাই। একবার তার গর্ভে ঢুকলে ঠাহর করতে পারবেন না, এটা সুইস অ্যার, লুফট হানজা, অ্যার ইন্ডিয়া না কে এল এম। তিমির পেটে ঢুকে নোয়া কি আর আমেজ-আন্দেশা করতে পেরেছিলেন এটা কোন জাতের কোন মুল্লুকের তিমি?
ইন্ডিয়ান মানেই নেটিভ, মানে রদ্দি। আস্তে আস্তে এ ধারণা কমছে। নইলে জর্মনি এ দেশের সেলাইয়ের কল, রুশ কলকাতার জুতো কিনবে কেন?
অতএব অ্যার ইন্ডিয়া কোম্পানির অ্যারোপ্লেনকে একটা চানস দিতেই-বা আপত্তিটা কী? অন্য কোম্পানিগুলো তো প্রায় সব চেনা হয়ে গিয়েছে। অবশ্য আরেকটা কথা আছে। ওই কোম্পানির এক ভদ্রলোক বুদ্ধি খাঁটিয়ে, তদ্বির-তদারক করে আমার সুখ-সুবিধার যাবতীয় ব্যবস্থা না করে দিলে হয়তো আমার যাওয়াই হত না। তার নাম বলব না। উপরওলা খবর পেলে হয়তো কৈফিয়ত তলব করে বসবেন, কোনও একজন ভিআইপি-কে সাহায্য না করে একটা থাচ্ছো কেলাস নেটিভ রাইটারের পিছনে তিনি আপিসের মহামূল্যবান সময় নষ্ট করলেন কেন? তবে কি না তাঁর এক ভিআইপি মিত্রও আমাকে প্রচুরতম সাহায্য করেছিলেন। তাকে না হয় শিখণ্ডীরূপে খাড়া করবেন।
ভেবেছিলুম চুঙ্গিঘরের (কাস্টমসের) উৎপাত থেকে এই দুই দোস্তো কতখানি বাঁচাতে পারবেন। ইতোমধ্যে এক কাস্টমিয়া আমার কাগজপত্র পড়ে আমার দিকে মিটমিটিয়ে তাকিয়ে শুধাল, আপনিই তো আপনার বইয়ে চুঙ্গিঘরের কর্মচারীদের একহাত নিয়েছেন, না?
খাইছে। এ যাত্রায় আমি হাজতে বাস না করে মানে মানে কলকাতা ফিরতে পারলে নিতান্তই পঞ্চপিতার আশীর্বাদেই সম্ভবে। কে জানে, এই কাস্টমিয়াই হয়তো হালে কয়েকজন ভাঙর ডাঙর ভিআইপি-কাম-সরকারি কর্মচারীকে বেআইনিতে মাল আনার জন্য নাজেহাল করেছিলেন।… একদিন জলের কল খুললে যেরকম জল না বেরিয়ে শব্দ বেরুত সেই সময় আমার ব্লটিং পেপারের লাইনিংওলা গলা দিয়ে কথা না বেরিয়ে বেরুল ঘস ঘস খস খস চো ধরনের কী যেন একটা।
নাহ্। এ লোকটির রসবোধ আছে কিংবা এর বাড়িতে মাসে একদিন জল আসে বলে ওই ভাষা বোঝাতে তিনি সুনীতি চাটুয্যে মশাইকে তাক লাগিয়ে উত্তম ধ্বনিতত্ত্ববাবদে কেতাব লিখতে পারবেন। বললেন, নিশ্চিন্তমনে ওই আরাম চেয়ারটায় বসুন। আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি। তার পর ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে কী এক অশ্রুত টরেটক্কার সংকেত করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে জনচারেক বাঙালি কাস্টমিয়া আমাকে ঘিরে যা আদর-আপ্যায়ন আরম্ভ করলেন যে, হৃদয়ঙ্গম করলুম, দেবীর প্রসাদে মূক যেরকম বাঁচাল হয়, আমি কেন, হরবোলাও মূক হতে পারে।
প্রতিজ্ঞা করলুম, চুঙ্গিঘর লেখাটা আমি ব্যান করে দেব। কার যেন দু-শো টাকা ফাইন হয়েছে।
কিন্তু এত সব বাখানিয়া বলছি কেন?
শুনুন। জীবনে ওই একদিন উপলব্ধি করলুম, সাহিত্যিক তা সে আমার আটপৌরে সাহিত্যিক হওয়ার মধ্যেও একটা মর্যাদা আছে।
এসব যে বাখানিয়া বলছি তার আরও একটা কারণ আছে।
আমার নিজের বিশ্বাস, প্লেনের পেটের ভিতরকার তুলনায় অ্যারপোর্টে আজব আজব তাজ্জব চিড়িয়া দেখতে পাওয়া যায় ঢের বেশি। পাসপোর্ট, কাস্টমস, হেলথ অফিসে, রেস্তোরাঁয় তাদের আচরণ কেউ-বা সংকোচের বিহ্বলতায় অতীব ম্রিয়মাণ, কেউ-বা গড় ড্যাম্ ডোন্টো কেয়ার ভাব– ওদিকে একটি বিগতযৌবনা মার্কিন মহিলা, অ্যারোপ্লেনে অর্ধন্দ্রিা যামিনী কাটিয়ে আলুথালু-বেশ, হৃত-পাউডার-রুজ, এঞ্জিনের পিস্টন বেগে পলেস্তরা পলেস্তরা ক্রিম-পাউডার-রুজ মাখছেন, এদিকে তাঁর কর্তা প্লেনে সস্তায় কেনা স্কচ স্যাঁট স্যাঁট করছেন; আর ওই সুদূরতম প্রান্তে দেখুন, দেখুন বললুম বটে, কিন্তু দেখার উপায় নেই কালো বোরখাপরা জড়োসড়ো গণ্ডা দুই মক্কাতীর্থে হজযাত্রিনীর গোঠ। এঁরা নিশ্চয়ই চলতি ফ্যাশানের ধার ধারেন না। বেশিরভাগ আঁকড়ে ধরে আছেন পুঁটুলি– হ্যাঁ, বেনের পুটুলি। গরুর গাড়িতে বা গয়নার নৌকোয় ওঠার সময় যে পুঁটুলি সঙ্গে নেন। ওঁরা ভাড়া বাবদ কয়েক হাজার টাকা দিয়েছেন নিশ্চয়ই! অনায়াসে হালকা স্যুটকেস কিনতে পারতেন। দু-একজনের ছিলও বটে। কিন্তু ওদের কাছে গরুর গাড়ি যা, হাওয়াই জাহাজও তা–এদের মক্কা পৌঁছলেই হল। হায়, এরা জানেন না, প্লেনে ভ্রমণ– তা সে যে কোনও কোম্পানিই হোক না কেন– গরুর গাড়িতে মুসাফিরি করার তুলনায় ঢের বেশি তকলিফ দেয়। এমনকি প্লেনে এঁদের পক্ষে হায়া-শরম বাঁচিয়ে চলাও কঠিন। কলকাতার বস্তিতে কী হয় জানিনে, কিন্তু এদের যখন প্লেনে করে যাবার রেস্ত আছে তখন এঁরা সেখানকার নন। আর গ্রামাঞ্চলে কেউ কখনও প্রাতঃকৃত্যের জন্য কিউ দেয় না। অথচ প্লেনে প্রাতঃকৃত্যের জন্য এঁদের কিউয়ে দাঁড়াতে হবে– মেয়েমদ্দে লাইন বেঁধে। সেকথা পরে হবে। তবে হজযাত্রীদের জন্য স্পেশাল প্লেনে যদি স্পেশাল ব্যবস্থা থাকে তবে তার তথ্য জানিনে; কোনও কোম্পানি অপরাধ নেবেন না।
শুভক্ষণে দুর্গা স্মরি প্লেন দিল ছাড়ি
দাঁড়ায়ে রহিল পোর্টে সব বেরাদরি শুষ্ক চোখে।
পূর্বেই নিবেদন করেছি, প্লেনের ভিতরে দেখবার কিচ্ছুটি নেই। থার্ডক্লাস ট্রেনে যা দেখতে পাওয়া যায় তার চেয়েও কম। আর সর্বক্ষণ আপনার চোখের তিন ফুট সামনে, সমুখের দুটো সিটে দুটো লোকের ঘাড়। তারও সামনে সারি সারি ঘাড়। দোস্ত আমার এ প্লেনের মালিক। অতএব আমার জন্য উইন্ডো সিটের ব্যবস্থা করেছেন অর্থাৎ বাঁ দিকে তাকালে বাইরের আকাশ দেখা যায়। বলতে গেলে পৃথিবীর কিছুই না। একে রাত্রি, তদুপরি আল্লায় মালুম, বিশ হাজার না পঁচিশ হাজার ফুট উপর দিয়ে প্লেনে যাচ্ছেন, কিছু দেখতে চাইলে ত্রিনয়নের প্রয়োজন। উপরেরটা হয়তো কিছু-বা দেখতে পায়। তবে ভারতীয় প্লেনে একটা বড় আরাম আছে। যদিও অধিকাংশ যাত্রী ভারতীয় নয়। বিদেশি এবং প্রধানত ইউরোপীয়। তারা জানে, ইন্ডিয়ানরা বেলেল্লাপনা পছন্দ করে না। কাজেই অতিরিক্ত কলরোল, এবং মাঝে মধ্যে তদতিরিক্ত কলহরোল থেকে নিশ্চিন্ত মনে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
এ বাবদে এখানেই থাক। কারণ শ্রদ্ধেয় শ্ৰীযুত তারাশঙ্কর, সম্মানীয় শ্ৰীযুত বুদ্ধদেব, ভদ্র প্রবোধ ও অন্যান্য অনেকেই প্লেনের ভিতরকার হাল সবিস্তর লিখেছেন।
জাগরণ, তন্দ্রা, ঘুম সবই ভালো। কিন্তু তিনটেতে যখন গুবলেট পাকিয়ে যায় তখনই চিত্তির। এ যেন জ্বরের ঘোরে দু দিন না তিন দিন কেটে গেল বোঝবার কোনও উপায় নেই।
চিৎকার চেঁচামেচি। রোম! রোম!! রোম!!!
ক্যাথলিকদের তো কথাই নেই। প্রটেস্টানদের ঈষৎ সংযত কৌতূহল। বিশেষ করে মার্কিনদের। দেশে ফিরে বড়ফাট্টাই করতে হবে, া, তেমন কিছু না, তবে কি না, হ্যাঁ, দেয়ালের আর গম্বুজের ছবিগুলো ভালো। কী যেন নাম (ভামিনীর দিকে তাকিয়ে) মাইকেল রাফাএল, না, হল না। লেওনার্দো দা বত্তিচেল্লি। ও! সেটা বুঝি মোনালিসার লিনিং টাওয়ার।
বললে পেত্যয় যাবেন না, আমি স্বকর্ণে শুনেছি, তাজমহলের সামনে বসে একই বেঞ্চে বসা এক মার্কিনকে তার মিসিসের উদ্দেশে শুধাতে শুনেছি, কিন্তু আশ্চর্য, এই ইন্ডিয়ানরা এসব তৈরি করল কী করে– ফরেন সাহায্য বিনা, অর্থাৎ, আমাদের সাহায্য না নিয়ে।
রোমে নামতেই হল। সেখানে আমার এক বন্ধু বাস করেন। কিন্তু তার কোনও নম্বর জানা ছিল না বলে যোগসূত্র স্থাপন করা গেল না। একখানা পত্রাঘাত, তদ্দরুন স্ট্যাম্প জোগাড় করতে না করতেই অ্যার কোম্পানির লোক রাখাল ছেলে যেরকম গরু খেদিয়ে খেদিয়ে জড়ো করে গোয়ালে তোলে সেই কায়দায় প্যাসেঞ্জারদের প্লেনের গর্ভে ঢোকাল। প্যাসেঞ্জারদের গরুর সঙ্গে তুলনা করাটা কিছুমাত্র বেয়াদবি নয়। মোটা পালটা ঠিক বয়স্ক গরুরই মতো লাউঞ্জের মধ্যিখানে একজোট হয়ে বসেছে বটে কিন্তু বাছুরের পাল, অর্থাৎ চ্যাংড়া-চিংড়িরা যে কে কোনদিকে ছিটকে পড়েছে তার জন্য হুলিয়া শমন বের করেও রত্তিভর ফায়দা নেই। কেউ গেছেন কিওরিওর দোকানে। কাইরোর মতো এখানেও খাঁটি-ভেজাল দুই বস্তুই সুলভ এন্তের পড়ে আছে কিন্তু দুর্লভ, কলকাতার মাছের বাজারকেও হার মানায় গাহকের কান কাটতে। কেউ-বা গেছেন বিনমালের (ট্যাক্স ফ্রি) দোকানে। হয়তো ইতালির নামকরা একখানা আস্ত ফিয়াৎ (মোটামুটি ফ্রা বিকেশন ইতালিয়ান Automobile Turino- এই আদ্যক্ষর নিয়ে Fiat। টুরিনো সেই শহরের নাম যেখানে এ গাড়ি তৈরি হয়) গাড়ি কিনে নিয়ে আসেন! একটি হাফাহফি, আধা-আধি, অর্থাৎ পাতে দেওয়া চলে মার্কিন চিংড়ি ওই হোথা বহু দূরে বার-এ বসে চুটিয়ে প্রেম করছেন একটি খাবসুরৎ ইতালিয়ান চ্যাংড়ার সঙ্গে। খাবসুরৎ বলতেই হবে এই রোম শহরে ছবি এঁকে, মূর্তি গড়ে যিনি নাম করেছেন সেই মাইকেল এঞ্জেলো যেন এই সদ্য একে গড়ে চরে খাওগে, বাছা বলে ছেড়ে দিয়েছেন। আর ইতালিয়ান যুবক-যুবতীর প্রতি মার্কিনিংরেজের যে পীরিতি সেটা প্রায় বেহায়ামির শামিল। চরে খাবে না কেন? সর্বশেষে বলতে হয়, ইতালির কিয়ান্তি মদ্য দুনিয়ার কুল্লে সুধার সঙ্গে পাল্লা দেয়। সেটাও পাওয়া যাচ্ছে ফ্রি, গ্রেটিস অ্যান্ড ফর নাথিং। মুফৎমে।
প্লেনে ঢুকে দেখি, সত্যি সেটা গোয়ালঘর। মশা খেদাবার তরে গায়ের চাচার বাড়িতে যেরকম সঁতসেঁতে খড়ে আগুন ধরানো হত এখানেও সেই প্রতিষ্ঠান। তবে হ্যাঁ, এটা বিজ্ঞানের যুগ। নানা প্রকারের ডিসিনফেকটেন্ট, ডিঅডরেনট স্প্রে করা হয়েছে প্রেমসে। সায়েবদের যা বি ও বডি ওডার গায়ের বোটকা দুর্গন্ধ।
সকালবেলায় আলো দিব্য ফুটে উঠছে। ইতোমধ্যে প্লেনে পাক্কা সাড়ে পনেরো ঘণ্টা কেটেছে। দমদমা ছেড়েছি রাত নটায়; এখন সকাল আটটা। হওয়ার কথা তো এগারো ঘন্টা! কী করে হল? বাড়ির কাচ্চাবাচ্চাদের শুধোন।
.
০২.
প্লেন যখন ছাড়ল তখন অপ্রশস্ত দিবালোক।
দিবালোকের সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক আছে। যে দেশে যাচ্ছি, সেই জর্মনির বাঘা দার্শনিক কান্ট নাকি বলেছেন কাল এবং স্থান ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে না। (টাইম অ্যান্ড স্পেস আর আ প্রিয়রি কনসেপশন)।
কাজের বেলা কিন্তু দেখলুম, তত্ত্বটা আদৌ সরল সহজ নয়।
বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি, যেন দেশের সকালবেলার সাতটা-আটটা। কিন্তু হঠাৎ হাতঘড়ির দিকে নজর পড়াতে দেখি, সেটি দেখাচ্ছে সাড়ে বারোটা! কী করে হয়? আমার ঘড়িটি তো পয়লা নম্বরি এবং অটোমেটিক। অবশ্য একথা আমার অজানা নয়, অটোমেটিক বেশি সময় কোনও প্রকারের ঝাঁকুনি না খেলে মাঝেমধ্যে থেমে গিয়ে সময় চুরি করে। কিন্তু কাল রাতভর যা এপাশ ওপাশ করেছি তার ফলে ওর তো দম খাওয়া হয়ে গেছে নিদেন দু দিনের তরে। আমার পাশের সিটে একটি চার-পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে। তার পরের সিটে এক বর্ষীয়সী বাচ্চাটার ঠাকুরমা-দিদিমার বয়সী। তাঁর দিকে ঝুঁকে শুধালুম, মাদাম, বেজেছে কটা, প্লিজ? মাদামের এলোমেলো চুল, সকালবেলার ওয়াশ, মুখের চুনকাম, ঠোঁটের উপর ঊষার লালবাতি জ্বালান হয়নি। শুকনো মুখে যতখানি পারেন ম্লান হাসি হেসে বললেন,পারদো মসিয়ো, জ ন পার্ল পা লেদুস্থানি। অর্থাৎ তিনি হিন্দুস্তানি বলতে পারেন না। ইয়াল্লা। সরলা ফরাসিনী ভেবেছেন, প্লেনটা যখন হিন্দুস্তানি, হিন্দুস্তানে প্লেনে উঠেছি, চেহারাও তদ্বৎ। অতএব আমি নিশ্চয়ই হিন্দুস্তানিতে কথা বলেছি। আমি অবশ্য প্রশ্নটি শুধিয়ে ছিলুম আমার সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত অতিশয় নিজস্ব বাঙাল ইংরেজিতে। ওদিকে এ তত্ত্বও আমার সবিশেষ বিদিত যে ফরাসিরা নটোরিয়াস, একভাষী– ফরাসি ভিন্ন অন্য কোনও ভাষা শিখতে চায় না। তাদের উহ্য বক্তব্য বল্লোক যখন হদ্দমুদ্দ হয়ে ফ্রান্সে আসছে, বিশেষ করে কড়ির দেমাক, বন্দুক-কামানের দেমাক, চন্দ্রজয়ের দেমাকে ফাটো ফাটো মার্কিন জাত এস্তেক– ফরাসির মতো লাজুক জবান শেখবার ব্যর্থ চেষ্টায় হরহামেশা খাচ্ছে তখন ওদের আপন দেশে আপসে তারা যে কিচির-মিচির করে সেগুলো শেখার জন্য খামোকা উত্তম ফরাসি ওয়াইনে সুনির্মিত নেশাটি চটাবে কেন? তবু মহিলাটির উক্তি শুনে আমারও ঈষৎ ন্যাজ মোটা হল। দূর-দুনিয়ার ভারতীয় প্লেন সার্ভিস না থাকলে মহিলাটি কি কল্পনা করতে পারতেন যে হিন্দুস্তানিও আন্তর্জাতিক ভাষা হতে চলেছে— মুসাফির যেরকম অ্যার ফ্রান্সে ফরাসি, কে এল এম-এ ডাচ, বি ও এ সি-তে ইংরেজির জন্য তৈরি থাকে।
তখন পুনরপি আপন ঔন অরিজিনাল ফরাসিতে প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করলুম। আ– আ–! বুঝেছি, বুঝেছি। কিন্তু এই সময় সমস্যাটি ভারি কাঁপকে অর্থাৎ কমৃপ্লিকেটেড, জটিল। আমি ওটা নিয়ে মাথা ঘামাইনে।
তবু?
সব দেশ তো আর এক টাইম মেনে চলে না। ভোয়ালা–নয় কি? প্যারিসে যখন বেলা বারোটা তখন রেঙ্গুনে– আমি সেখানে বাস করি বিকেল পাঁচটা-ছটা। কিন্তু আপনাকে ফের বলছি, ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই। আমি টাইম কত জেনে যাই আমার অতিশয় বিশ্বাসী মিনিস্ দ্য লেতেঁরিয়রকে (হোম সেক্রেটারি, অর্থাৎ ভিতরকার ইন্টেরিয়ের এতেরিয়র-কে) শুধিয়ে। সোজা কথায় পেটটিকে। ওখানে লা-মার্সেইয়েজ সঙ্গীত (বাংলায় পেটে যখন হুলুধ্বনি) বেজে ওঠে তখন সেটা লাঞ্চের বা ডিনারের সময়। উপস্থিত আমার এতেরিয়রেতে সে সঙ্গীত ক্রেসেন্ডতে (তার সপ্তকের পঞ্চমে)। তাই এখন রেঙ্গুনে নিশ্চয়ই দেড়টা-দুটো।
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, তা এখখুনি বোধহয় লাঞ্চ দেবে।
মাদাম যদিও বলেছেন তিনি টাইম নিয়ে মাথা ঘামান না কিন্তু দেখলুম, তিনি প্রাকটিক্যাল দিকটা খাসা বোঝেন। আপত্তি জানিয়ে বললেন, রেঙ্গুনে যখন লাঞ্চ তখন এই মিত্রোপাত্রে (মিৎ = মিলা, রোপ; ইউরোপের শেষাংশ অর্থাৎ মধ্য-ইউরোপে) ব্রেকফাস্ট। জাপানে যারা এ প্লেনে উঠেছে, তাদের তো এখন ডিনারের সময় হয় হয়। সুতরাং কোন যাত্রী কোথায় উঠেছে, কার পেট কখন ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ/ডিনারের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে সে হিসেবে তো আর কোম্পানি ঘড়ি ঘড়ি কাউকে লাঞ্চা কাউকে সাপার, কাউকে স্যানউইচসহ বিকেলের চা দিতে পারে না। তবে কি না এরা ব্রেকফাস্টে যে পরিমাণ খেতে দেয় সেটা কলেবরে প্রায় লাঞ্চের সমান।… তাই বলছি, এসব টাইম-ফাইম নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। ট্রেনেও যদি ঘড়ি ঘড়ি ঘড়িটার দিকে তাকান তবে সে জর্নি দীর্ঘতর মনে হয় না? আমি তো প্যারিসে পৌঁছতে পারলে বাঁচি। বদিয়ো (দয়ালু ঈশ্বর) ঘন্টা দেড়েকের ভিতর পৌঁছিয়ে দেবেন। নাতনিটা নেতিয়ে গিয়েছে।
মহিলাটি যেভাবে সবিস্তার গুছিয়ে বললেন, সেটা ধোপে টেকে কি না বলতে পারব না, কারণ আমি যতবার এসেছি-গিয়েছি, আহারাদি পেয়েছি তখন ঘড়ি মিলিয়ে দেখিনি কোনটা লাঞ্চ, কোনটা কী? এবং আজকের দিনে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন টাইমের সালঙ্কার সটীক ফিরিস্তি দেবার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনে। রেডিও, ট্রান্সজিস্টারের কল্যাণে এখন বাড়ির খুকুমণি পর্যন্ত জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দেয়, বুঝিয়ে বলে গ্রিনিচ মিন টাইম, ব্রিটিশ সামার টাইম, সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান টাইম কোনটা কী। তবু যে এতখানি লিখলুম, তার কারণ ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন টাইম যে কীভাবে কসরৎ বিন মেহৎ আয়ত্ত করতে হয় সেটা ফরাসি মহিলাটি আমাকে শিখিয়ে দিলেন অতি প্রাকটিকাল পদ্ধতিতে। সেটা কী? রাজা সলমন যেটা গুরুগম্ভীরভাবে, ধর্মনীতি হিসেবে আপ্তবাক্যরূপে হাজার তিনেক বছর পূর্বে প্রকাশ করে গিয়েছেন নো দাইসেল নিজেকে চেনো (চিনতে শেখ)। শ-বছর আগে লালন ফকিরও বলেছেন আপন চিনলে খুদা চেনা যায়। ফরাসি মহিলাটিও সেই তত্ত্বটিই, অতিশয় সরল ভাষায় প্রকাশ করলেন, আপন পেটটিকে বিশ্বাস কর। তার থেকেই লোকাল টাইম, স্ট্যান্ডার্ড টাইম জানা হয়ে যাবে। ওইটেই মোক্ষমতম ক্রনোমিটার। বরঞ্চ ক্রনোমিটার মাঝে-মধ্যে বিগড়োয়। আলবৎ, পেটও বিগড়োয়। কিন্তু বিগড়ানো অবস্থাতেও সে লাঞ্চ-ডিনারের সময়টায় নিগেটিভ খবর জানিয়ে দেয় তার ক্ষিদে নেই।
ইতোমধ্যে ব্রেকফাস্ট না কী যেন এসে গেছে। মাদাম বলেছিলেন, সেটা কলেবর। আমি মনে মনে বললুম, বপু। অ্যাব্বড়া বড়া ভাজা সসিজ, পর্বতপ্রমাণ ম্যাশট পটাটো, টোস্ট-মাখন, মার্মলেড টমাটো ইত্যাদি কাঁচা জিনিস, আরও যেন কী কী। তখন দেখি, বেশ খাচ্ছি। অতএব পেটের ক্রনোমিটার বলছে, এটা লাঞ্চ, অর্থাৎ বেলা একটা-দুটো। ঘড়ি মিথ্যেবাদী বলছে ন-টা!
.
০৩.
অজগাঁইয়া যেরকম ওয়াকিফ হবার চেষ্টা না দিয়েই ধরে নেয় দিল্লি মেলও তার ধেধধেড়ে গোবিন্দপুর ফ্ল্যাগ ইসটিশানে দাঁড়াবে এবং চেপে বসে নিশ্চিন্দি মনে তামুক টানে, আমার বেলাও হয়েছিল তাই। আমার অপরাধ আরও বেশি। আমি জেনেশুনেই অপকর্মটি করেছিলুম। আমি ভালো করেই জানতুম যে প্লেনে যাচ্ছি সেটা যদিও জর্মনির উপর দিয়ে উড়ে যাবে, তবু সে দেশের কোনও জায়গায় দানাপানির জন্যও নামবে না। অবশ্য অ্যার-ইন্ডিয়ার মুরুব্বি আমার, একগাল হেসে আমায় বলেছিলেন, এ প্লেনটা কিন্তু প্যারিসে নামে। আপনি সেখানে চলে যান। দু-চারদিন ফুর্তিফার্তি করে চলে যাবেন জর্মনি। খর্চা একই। আর প্যারিসে হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ সঙ্গে যে মিত্রটি ছিলেন তিনিও মৃদু হেসে সায় দিলেন। দু জনারই বয়স এই তিরিশ-পঁয়ত্রিশ। মনে মনে বললুম, এখন কলকাতা-দিল্লির রাস্তাঘাটেই যা দেখতে পাওয়া যায় প্যারিসের নাইট ক্লাব-কাবারে তার চেয়ে বেশি আর কী ভেল্কিবাজি দেখাবে? তদুপরি বানপ্রস্থে যাবার বয়সও আমার বহুকাল হল তামাদি হয়ে গিয়েছে। এ বয়সে নির্বাণদীপে কিমু তৈলদানং? তাই আখেরে স্থির হল আমি অ্যার-ইন্ডিয়া প্লেন থেকে সুইটজারল্যান্ডের জুরিচে (স্থানীয় ভাষায় স্যুরষি) নামব। হেথায় চেঞ্জ করে ভিন্ন প্লেনে মৌকামে পৌঁছব অর্থাৎ জর্মনির কলোন শহরে। তাই সই।
ফরাসিনীকে বিস্তর বঁ ভোয়াইয়াজ (গুড জনি, গুড ফ্লাইট) বলে জুরিচের অ্যার পোর্টে নেমে পাসপোের্ট দেখালুম। তার পর গেলুম খবর নিতে কলোনে যাবার প্লেন কখন পাব। উত্তর শুনে আমি স্তব্ধ, জড়। দেশে বলে,
অল্প শোকে কাতর।
অধিক শোকে পাথর ॥
তখন বেজেছে সকাল ন-টা। রামপন্টক বলে কি না, কলোন যাবার প্লেন দ্বি-প্রহরে। বিগলিতাৰ্থ আমাকে নিরেট তিনটি ঘণ্টা এখানে বসে বসে আঙ্গুল চুষতে হবে।
শুনেছি, যে-রোগী দশ বত্সর ধরে পক্ষাঘাতে অসাড় অবশ সে নাকি মৃত্যুর সময় অকস্মাৎ বিকট মুখভঙ্গি করে, তার সর্বাঙ্গ খিচোতে থাকে, হঠাৎ দশ বৎসরের টান-টান-হাঁটু যেন ইলেকট্রিক শক খেয়ে খাড়া হয়ে থুতনির দিকে গোত্তা মারতে চায় এবং মুখ দিয়ে অনর্গল কথা বেরোতে থাকে।
আমার হল তাই। আমি হয়ে গিয়েছিলুম অচল অসাড়। স্তম্ভিত বললুম না, কারণ আজকের দিনের পয়লা নম্বরি অ্যারপোর্টে স্তম্ভ আদৌ থাকে না। যাই হোক যাই থাক, আমার মুখ দিয়ে বেরুতে লাগল আতশবাজির ঝটকা, তুবড়ির পর তুবড়ির হিংস্র হিস্ হিস্ আর পটকা বোমার দুদ্দাড় বোম্-বাম। আর হবেই না কেন? যে জুরিচের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে কর্ণপটহবিদারক তথা নয়নান্ধকারক আতশবাজি ছাড়ছি সেই আতসবাজিকেই আপন জর্মন ভাষায় বলে বেঙ্গালিশে বেলায়েষটুঙ অর্থাৎ বেঙ্গল রোনানি; এবং এ-দেশের ফরাসি অংশে বলে ফ্য দ্য বাঙাল অর্থাৎ ফায়ার অব বেঙ্গল।* তদুপরি বিশেষভাবে লক্ষণীয় ফরাসি ভাষায় বঙ্গদেশকে বাঙ্গাল রূপে উচ্চারণ করে। আমি বাঙাল বঙ্গসন্তান। আমি আমার জন্মনি, জন্মনি অধিকার অর্থাৎ বার্থরাইট ছাড়ব কেন? ফায়ার ওয়ার্কস চালাবার যদি কারও হক্ক থাকে তবে সে আমার। হুহুঙ্কার ছাড়লুম :
কী বললে? ঝাড়া দিনটি ঘণ্টা আমাকে এই অ্যারপোর্টে বসে কলোনের প্লেনের জন্য তাজ্জিম মাজ্জিম করতে হবে? আমার দেশ যে ভারতবর্ষকে তোমরা অন্ডর ডিভালাপড় কন্দ্রি– সাদামাটা ভাষায় অসভ্য দেশ- বল, সেখানেও তো তিন-তিনটি ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় না, কনেকশনের জন্য। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি রেলগাড়ির কথাই বলছি। আমি যদি আজ ভারতের যে-কোনও ডাকগাড়িতে করে যে-কোনও জংশনে পৌঁছই তবে আধ ঘণ্টার ভিতর কনেকশন পেয়ে যাই। না পেলে সেটাও সাতিশয় কালে-কস্মিনে–খবরের কাগজে জোর চেল্লাচেল্লি করি (মনে মনে বললুম অম্মদেশীয় রেলের কর্তারা তার ঘোড়াই কেয়ার করেন!) অ্যারোপ্লেনের তো কথাই নেই। সে তো আরও তড়িঘড়ি কনেকশন দেয়। আমাকে যত তাড়াহুড়ো করে মোকামে পৌঁছে দিতে পারে, ততই তার লাভ। অন্যত্র অন্য প্যাসেঞ্জারের সেবার্থে যেতে পারলে তার আরও দু পয়সা হয় … অ! তোমাদের বিস্তর ধনদৌলৎ হয়ে গিয়েছে বলে তোমরা আর পয়সা কামাতে চাও না? আর শোন ব্রাদার, এ তো হল ট্রেন-প্লেনের কাহিনী, গরুর গাড়ির নাম শুনেছ? বুলক কার্ট? সেই গরুর গাড়িতে করে
[*আমার এক সুপণ্ডিত মিত্র বহু গবেষণার পর স্থির করেছেন; এদেশে গুড় তৈরি হত বলে এর নাম গৌড় (এবং গুড় থেকে রাম মদ তৈরি হত বলে তার নাম গৌড়ী– মহাভারতেও এর উল্লেখ আছে যেমন মধু থেকে মাধ্বী মদ)। এবং এই গুড় সর্বপ্রথম চীন দেশে রিফাইনড হয়েছিল বলে এর নাম চিনি (পরে মিশরে তৈরি চিনির নাম হল মিসরি বা মিশ্রী)। তার মতে বারুদ প্রথম আবিষ্কৃত হয় বাঙলা দেশে আতশবাজির জন্য। চীনদেশে সেটা সর্বপ্রথম আগ্নেয়াস্ত্রে ব্যবহৃত হয় বলে চীনদেশকে বারুদের আবিষ্কারক বলা হয় এবং সেটা ভুল।]
যদি আমি দশ-বিশ মাইল যাই তবে সেখানে পৌঁছেও সঙ্গে সঙ্গে কনেকশন পাই। বোলপুর থেকে ইলামবাজার গিয়ে নদীর ওপারে তদ্দণ্ডে অন্য গরুর গাড়ির কনেকশন হামেহাল তৈরি। বস্তুত তখন ওপারের গাড়োয়ানরা গ্রাহককে পাকড়াও করার জন্য যা হৈ-হুঁল্লোড় লাগায় তার সামনে আন্তর্জাতিক পাণ্ডা প্রতিষ্ঠানের জেরুজালেম-পাণ্ডারা পর্যন্ত নতমস্তক হন। এ নিয়ে আমি অষ্টাদশ পর্ব মহাভারত–থুড়ি, পাঁচখানা ইলিয়াড দশখানা ফাউসট লিখতে পারি। কিন্তু উপস্থিত সেটা স্থগিত থাক। আমার শেষ কথা এইবারে শুনে নাও। এই যে আমি কন্টিনেনটে এসেছি তার রিটার্ন টিকিটের জন্য কত ঝেড়েছি জানো? এক-একটা টাকা যেন নাক ফুটো করে কুরে কুরে বেরিয়েছে- তোমরা যাকে বল, পেইংথ দি নোজ। রোক্কা ছ হাজার পাঁচশোটি টাকা। তার পর ফরেন এক্সচেঞ্জ গয়রহ হিসাবে নিলে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে সাত হাজারের মতো। এ ভূখণ্ডে থাকব মাত্র তিনটি মাস। এইবারে হিসাব কর তো সে বসে বুঝি তোমার পেটে কত এলেম, এই যে কনেকশনের জন্য আমার তিনটি ঘণ্টা বরবাদ করলে তার মূল্যটা কী? সে না হয় গেল। কিন্তু সে সময়টা যে বন্ধুবান্ধবীর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করলে তার জন্য তোমার হৃদয়বনে কোনও সন্তাপানল প্রজ্বলিত হচ্ছে না? তারা—
ইতোমধ্যে আমার চতুর্দিকে একটা মিনি মাক্সির মধ্যিখানের মিডি সাইজের ভিড় জমে গিয়েছে। ফ্রি এন্টারটেনমেন্ট। আমার সোক্রোতেসপারা কিংবা দ্রৌপদী যে রকম রাজসভায় আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিলেন সেই ধরনের যুক্তিজাল বিস্তার এদের হৃদয়বনে যেন মলয়বাতাসের হিল্লোল, দে দোল দোল খেলিয়ে গেল। এদের বেশিরভাগই আমার বেদনাটা সহানুভূতিসহ প্রকাশ করছে। য়া য়া, উই উই, সি সি যাবতীয় ভাষায় আমাকে মিডি-সমর্থন জানাচ্ছে। আমি ফের তেড়ে এগুতে যাচ্ছি এমন সময়
এমন সময় সর্বনাশ! একটি কুড়ি-একুশ বছরের কিশোরী, আমি যাকে কেছে মুছে ইস্ত্রি মেরে ভাঁজ করে পকেটে ঢোকাতে যাচ্ছি, কাউন্টারের পিছনের কুঠরি থেকে বেরিয়ে এসে তাকে বললে, আপনার টেলিফোন। তনুহূর্তেই সেই মহাপ্রভু তেলব্যাজ না করে, যেন সসেমিরে দে ছুট দে ছুট। লোকটা নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথের আমারে ডাক দিলে কে ভিতর পানে গানটি জানে।
কিশোরী একগাল হেসে আমাকে শুধালে, আপনার জন্য কী করতে পারি স্যার?
দুত্তোর ছাই। আধ-ফোঁটা এই চিংড়ির সঙ্গে লড়াই দেব আমি।
নাথিং বাট ইয়োর লভ। বলে দুমদুম করে লাউঞ্জের সুদূরতম প্রান্তে আসন নিলুম।
.
০৪.
সোফাটা মোলায়েম। সামনে ছোট্ট একটি টেবিল।
বেজার মুখে বসে আছি। এমন সময় দেখি একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দু হাতে দুটি ভর্তি ওয়াইনগ্লাস নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঠিক যতখানি নিচু হয়ে অপরিচিতজনকে বাও করাটা কেতাদুরস্ত তাই করে শুধোলেন, ভু পেরমেতে, মসিয়ো–অর্থাৎ আপনার অনুমতি আছে, স্যার? নিশ্চয়, নিশ্চয়। যদিও সোফাটির যা সাইজ তাতে পাঁচজন কিংকং অনায়াসে বসতে পারে তবু দ্ৰতা দেখাবার জন্য ইঞ্চিটাক সরে বসলুম। ভদ্রলোক ফের কায়দামাফিক বললেন, ন ভু দেরাজে পা, জ ভু প্রি। এর বাংলা অনুবাদ ঠিক কী যে হবে, অতখানি ফরাসি জানিনে, বাঙলাও না। মোটামুটি না, না, ব্যস্ত হবেন না। ঠিক আছে, ঠিক আছে। উর্দুতে বরঞ্চ খানিকটে বলা যায়, কফ ন্ কিজিয়ে ওই ধরনের কিছু একটা। তকলুফ কথাটা তকলিফ (বাঙলায় কিছুটা চালু) অর্থাৎ কষ্ট। মোদ্দা : আপনাকে কোনও কষ্ট দিতে চাইনে।
সেই দুটো গ্লাস টেবিলে রেখে একটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আরেকটা নিজে তুলে নিয়ে বললেন, আপনার স্বাস্থ্যের মঙ্গলের জন্য।
চেনাশোনা কিছুই নেই। খোদার খামোখা এ-লোকটা ড্রিংক দিচ্ছে কেন? তবে কি লোকটা কনফিডেনস ট্রিকস্টার? আমাদের হাওড়া-শ্যালদাতে যার অভাব নেই। ভাবসাব (কনফিডেনস) জমিয়ে বলবে, দাদা, তা হলে আপনি টিকিটদুটো কিনে আনুন। এই নিন আমার লিলুয়ার পয়সা, আমি মালগুলো সামলাই। …টিকিট কেটে ফিরে এসে দেখলেন, ভোঁ ভোঁ। আপনার মালপত্র হাওয়া।
কিন্তু এ লোকটা আমার নেবে কী? সুকুমার রায়(?) একদা একটি ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন। বিরাট ভুড়িওলা জমিদার টিঙটিঙে দারোয়ানকে শাসিয়ে শুধোচ্ছেন, চোর ভাগা কিও? দারওয়ান বললে, মেরা এক হাতমে তলওয়ার, দুসরেমে ঢাল। পকড়ে কৈসে? আমার এক হাতে তলওয়ার, অন্য হাতে ঢাল। ধরি কী করে?
আমার একপাশে আমার মিত্রের দেওয়া এটাচি, অন্যদিকে অ্যার ইন্ডিয়ার দেওয়া ছোট্ট একটি বাসো। দুটোই তো বগলদাবা করে বসে আছি। লোকটাকে দেখে তো মনেও হচ্ছে না, ও স্বৰ্গত পি সি সরকার (এস্থলে বলে রাখা ভালো সরকার কখনও এহেন অপকর্ম করতেন না) যে আমার দুটি বাক্স সরিয়ে ফেলবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা, এরকম রুচিসম্মত পোশাক-আশাক আমি একমাত্র ডিউক অব উইনডসরকে (উচ্চারণ নাকি উইনজার) পরতে দেখেছি– জীবনে একবার। ডিউকের জীবনে একবার নয়, আমার জীবনে একবার। সে বেশের বর্ণনা অন্যত্র দেব।
একখানা কার্ড এগিয়ে দিলেন। তাঁর নাম আঁদ্রে দ্যুপোঁ। তার পর একগাল হেসে শুধোলেন, যদি অপরাধ না নেন তবে একটি প্রশ্ন শুধাই, আপনি কি কসটিঙে বিশেষজ্ঞ?
আমি থতমত খেয়ে শুধোলুম, কটিঙ? সে আবার কী?
দ্রলোক আরও থতমত খেয়ে কিন্তু চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, সে কী মশাই! এইমাত্র আপনার অনবদ্য লেকচারটি শুনলুম, আপনি ক হাজার টাকা ঝেড়ে কলকাতা থেকে এদেশে আসার রিটরন টিকিট কেটেছেন, এবং কনেকশন না পেয়ে তিন ঘন্টাতে আপনার কী পরিমাণ অর্থক্ষয় হল তার পুরো-পাক্কা, করেক্ট টু দি লাস্ট সাতিম, ব্যালানস শিট। একেই তো বলে কসটিঙ। আমি ব্যবসাবাণিজ্য করি। ওই নিয়ে নিত্যি নিত্যি আমার ভাবনাচিন্তার অন্ত নেই। কিন্তু সে-কথা থাক। আমি আপনার কাছে এসেছি একটি প্রস্তাব নিয়ে। আপনার যখন তিন ঘন্টা বরবাদ যাচ্ছে তখন এক কাজ করুন না? মিনিট পনেরো পরে এখান থেকে একটা প্লেন যাচ্ছে জিনিভা; আমি সে প্লেনে যাচ্ছি। আপনি চলুন আমার সঙ্গে জিনিভায়। আমার সামান্য একটি বাড়ি আছে সেখানে। আপনার খুব একটা অসুবিধে হবে না। বেড-রুম, বাথরুম, ডাইনিং রুম, স্টাডি সব নিজস্ব পাবেন। (আমি মনে মনে মনকে শুধুলুম একেই কি বলে সামান্য একটি বাড়ি?)–আমাদের সঙ্গে আহারাদি, দু দণ্ড রসালাপ করে জিরিয়ে জুরিয়ে নেবেন। তার পর আপনাকে আপনার মোকাম কলোনগামী প্লেনে তুলে দেব। তার পর একটু ইতি-উতি করে বললেন, কিছু মনে করবেন না। আমি এ প্রস্তাবটা নিজের স্বার্থেই পাড়ছি। আমার একটি ছেলে আর দুটি মেয়ে। ষোল, চোদ্দ, দশ। আপনার সঙ্গে আলাপচারী করে তারা সত্যই উপকৃত হবে। এদেশে চট করে একজন ইন্ডিয়ান পাওয়া যায় না। পেলেও তিনি ফরাসি জানেন না। আর আমার বিবি খাসা রাঁধতে পারেন—
আমি বাধা দিয়ে বললুম, কিন্তু এই দশ মিনিটের ভিতর আপনি আমার জন্য জিনিভার টিকিট পাবেন কী করে?
মসিয়ো দ্যুপোঁ মুচকি হেসে বললেন, সেই ফরমুলা, ন ভু দেরাজে পা –আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। এটা-ওটা ম্যানেজ করার কিঞ্চিৎ এলেম আমার পেটে আছে; নইলে ব্যবসা করি কী করে! কাচ্চাবাচ্চারা বড় আনন্দ পাবে। প্লেনের ভাড়াটার কথা আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না
আমি ফের বাধা দিয়ে বললুম, আপনি ও বাবদে চিন্তা করবেন না। অ্যার-ইন্ডিয়ার আমার টিকিটটি অমনিবাস, অর্থাৎ যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারি; তার জন্য আমাকে ফালতো কড়ি ঢালতে হবে না (পাঠক, এ ধরনের মোটর অমনিবাসকে কবিগুরু নাম দিয়েছেন বিশ্বস্বহ। এবং তদীয় অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ মোটরগাড়ি, অটোমবিলকে, যেটা আপন শক্তিতে চলে, তার নাম দিয়েছিলেন স্বতশ্চলশকট। অতএব এস্থলে আমার যানবাহন প্লেনের টিকিটকে স্বতশ্চল বিশ্বষহ মূল্য পত্রিকা অনায়াসে বলা যেতে পারে)।
একটু থেমে বললুম, আমি এখখুনি আসছি। অর্থাৎ সেস্থলে যাচ্ছি, যেখানে রাজাধিরাজও ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারেন না অর্থাৎ শৌচাগার।
সেদিকে যাইনি। যাচ্ছিলুম অন্য পথে! অ্যাটাচি বাকসো সোফাতেই রেখে এসেছি। এরকম সহৃদয় সজ্জনকে বিশ্বাস করে আমি বরঞ্চ এ দুটো হারাব, অবিশ্বাস করতে ঘেন্না ধরে। গেলুম বার-এ। সেখানে মসিয়ো যে ওয়াইন এনেছিলেন তারই দু গ্লাস কিনে ফিরে এলুম সোফায়! একটা গ্লাস তার দিকে এগিয়ে দিয়ে তার স্বাস্থ্য কামনা করে বললুম, আপনার আন্তরিক আমন্ত্রণের জন্য আমার অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমার একটা বড়ই অসুবিধে আছে। কলোন অ্যারপোর্টে আমার বন্ধুবান্ধবরা অপেক্ষা করছে। তারা খবর নিয়ে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছে, আমি তিন ঘণ্টা পরে কনেকশন পাব। আমি আপনার সঙ্গে জিনিভা গেলে বড্ড দেরি হয়ে যাবে। তারা বড় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে।
আর মনে মনে ভাবছি, ইহসংসারে, এমনকি ইউরোপেও সেই বাগদাদের আবু হোসেনও আছে যারা রাস্তায় অতিথির সন্ধানে দাঁড়িয়ে থাকে। সে একা একা খেতে পারে না।
মসিয়ো বড্ডই দুঃখিত হয়ে প্রথম বললেন, কিন্তু আপনি আবার আমার জন্য ড্রিংক আনলেন কেন? এ কি দেনা-পাওনা!
আমি মাথা নিচু করলুম। দ্যুপো বললেন, তা হলে দেশে ফিরে যাবার সময়ে আমার ওখানে আসবেন?
তাঁর একটি পকেট-বই বের করে বললেন, কিছু একটা লিখে দিন। ছেলেমেয়েরা খুশি হবে। আমি তৎক্ষণাৎ লিখলুম :
কত অজানারে জানাইলে তুমি
কত ঘরে দিলে ঠাঁই
দূরকে করিলে নিকট বন্ধু
পরকে করিলে ভাই।
হায়! ফেরার পথেও দ্যুপোঁর বাড়িতে যেতে পারিনি।
.
০৫.
জুরিকের মতো বিরাট অ্যারপর্টে কী করে মানুষ একে অন্যকে খুঁজে পায় সেটা বোঝবার চেষ্টা করে ফেল মেরেছি। তা হলে নিশ্চয়ই স্বীকার করতে হবে এখানকার কর্মচারীদের পেটেপিঠে এলেম আছে। তাদেরই একজন আমার সামনে এসে বললে, আপনার জন্য একটা মেসেজ আছে, স্যার। আমি সত্যই বিস্মিত হলুম। আমাকে এই সাহারা ভূমিতে চেনে কে? বললুম, ভুল করেননি তো; এজ্ঞে না। আমি জানি–সঙ্গে সঙ্গে ছোকরা আমার পুরো নামটি বলে দিল। যদিও সে এদেশেরই লোক তবু আমার মনে হল সে দেশ পত্রিকার পঞ্চতন্ত্র নিত্য সপ্তাহে পড়ে এবং তারই মারফত আমার ভোলা নামটি পুরো পাক্কা রপ্ত করে নিয়েছে। হয়তো ডাকনামটাও জানে। হয়তো ভোম্বল ক্যাবলা জাতীয় আমার সেই বিদঘুঁটে ডাকনামটা সে পাঞ্চজন্যে শঙ্খধ্বনিতে প্রকাশ করতে চায় না। কিন্তু এসব ভাববার চেয়ে ঢের বেশি জানতে চাই, কে আমাকে স্মরণ করলেন।
অ ৷ ফ্রলাইন ফ্রিডি বাওমান। কিন্তু ইনি জানলেন কী প্রকারে যে আমি আজ সকালে এখানে পৌঁচচ্ছি। তাঁর মেসেজ খুলে জিনিসটে পরিষ্কার হল। কলকাতা ছাড়ার পূর্বে অ্যার ইন্ডিয়ার ইয়াররা শুধিয়েছিলেন, জুরিকে আমার কোনও পরিচিতজন আছেন কি না, কেননা ওখানে আমাকে কনেকশনের জন্য খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। খবর পাঠালে ওঁরা হয়তো অ্যারপোর্টে এসে আমাকে সঙ্গসুখ দেবেন। আমি উত্তরে বলেছিলুম, জুরিকে নেই, তবে সেখানে থেকে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে লুৎসের্ন শহরে একটি পরিচিত মহিলা আছেন এবং তার নামঠিকানা দিয়েছিলুম। এ কথাটা ভুলে গিয়েছিলুম বেবাক। দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি গুড়ের পাটালি; কিছু ঝুনো নারিকেল; দুই ভাণ্ড সরিষার তেল; আমসত্ত্ব আমচুর– এর মাঝখান কবিগুরু যদি তার প্রিয়া-কন্যাকে ভুলে যান তবে সাতান্নটা হাবিজাবির মাঝখানে আমি যে এটা মনে রাখিনি তার জন্য সদয় পাঠক রাগত হবেন না।
কিন্তু এই সুবাদে সেই খাঁটি জাত-সুইস মহিলাটির সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করে দিতে চাই। ফ্রিডি বাওমান। ১৯৪২/৪৩-এ ইনি সেই মহারাজা সয়াজি রাওয়ের বরোদা প্রাসাদে প্রবেশ করেন। আজকের দিনে ক্রিকেট কিংবা এবং পলিটিকসের সঙ্গে যাঁদেরই সামান্যতম পরিচয় আছে তারাই জানেন বরোদার শ্ৰীযুত ফতেহ সিং রাও গায়কোয়াড়কে। এই ফ্রিডির হাতেই তিনি পৃথিবীতে পদার্পণ করেন। অথবা মস্তকাবতীর্ণ করেন। কিন্তু তার ওপর আমি জোর দিচ্ছিনে। রাজা মহারাজা ভিখিরি আতুর পৃথিবীতে সবাই নামেন একই পদ্ধতিতে।
আসল কথা, ফতেহ সিং রাও মানুষ হন ফ্রিডির হাতে। তিনি অসাধারণ শিক্ষিতা রমণী– সেই ছাব্বিশ বছর বয়সেই। জর্মন, ফরাসি, স্প্যানিশ, ইংরেজি সবকটাই বড় সুন্দর জানতেন। এদেশে এসেছিলেন বেকারির জন্য নয়। রোমান্টিক হৃদয়; ইন্ডিয়াটা দেখতে চেয়েছিলেন। গ্যোটে তাঁর প্রিয় কবি। গ্যোটের ভারতপূজা তার মনে গভীর দাগ কেটেছিল। ওদিকে তার উত্তম উত্তম পুস্তক পড়ার অভ্যেস চিরকালের। রাজপ্রাসাদের কাজকর্মও শুরুভার নয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি যে কী করে তার প্রিয়সাধক শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের বাণীর মর্মস্থলে পৌঁছে গেলেন সেটা বুঝলুম যেদিন তিনি আমাকে বললেন যে ছেলেবেলা থেকেই তিনি সেন্ট ফ্রান্সসিস আসিসির ভক্ত। এবং সকলেই জানেন, এই সন্তটির সঙ্গেই ভারতীয় শ্রমণ সন্ন্যাসী, সাধুসন্তের সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য। একদিকে যেমন দরিদ্রনারায়ণের সেবা, অন্যদিকে ঠিক তেমনি পরমাত্মার ধ্যানে মগ্ন হয়ে প্রভু খ্রিস্টের সঙ্গে একাত্মবোধ করাতে তিনি এদেশের মরমীয়া সাধক, ইরান-আরব-ভারতের সুফিদের সঙ্গে এমনই হরিহরাত্মা যে অনেক সময় বোঝা কঠিন কার জীবনবৃত্তান্ত পড়ছি। খ্রিস্টানের, ভক্তের না সুফির?
কিন্তু আমার কী প্রগলভতা যে আমি তার জীবনীর সংক্ষিপ্ততম ইতিহাসও লিখতে পারি। দেশ পত্রিকার প্রিয়তম লেখক শ্রীযুক্ত ফাদার দ্যতিয়েন যদি বাঙলায় তার জীবনী লেখেন তবে গৌড়জন তাহা আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি। কুমারী ফ্রিডির কথা পুনরায় লিখব। কন্টিনেন্ট সেরে, দেশে ফেরার পথে, লুৎর্সেন শ্রীমতীর বাড়িতে সপ্তাহাধিককাল ছিলুম– সেই সুবাদে। উপস্থিত ফ্রিডি লিখেছেন, তিনি আমার (অ্যার ইন্ডিয়া মারফত) টেলে পেলেন কাল রাত্রে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জুরিকের অ্যারপোটে ট্রাঙ্ক-কল করে জানালেন, আমি জুরিতে নেবেই যেন তাকে ট্রাঙ্ক-কল করি। বরাবর তিনি বাড়িতেই থাকবেন।
মনে হয় কত সোজা। কিন্তু যারা দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে চান তাদের উপকারার্থে এস্থলে কিঞ্চিৎ নিবেদন করে রাখি।
প্রথমত আমাকে টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করতে হবে। সে বুথ আবার সদু ব্রাহ্মণ। আপন দেশজ খাদ্য ভিন্ন অন্য খাদ্য খান না। অর্থাৎ তার বাক্সে আপনাকে ছাড়তে হবে এদেশের আপন সুইস মুদ্রা। অতএব গো-খোঁজা করুন, সে সাহারাতে, কোথায় সে পুণ্যভূমি যেখানে আপনার ডলার বা পৌন্ডের বদলে সুইস মুদ্রা দেবে। সবাই তো ইংরেজি বোঝে না। ভুল বুঝে অনেকেই। তারা কেউ বলে ওই তো হোথায়, কেউ বলবে তার জন্য তো শহরে যেতে হবে। শেষটায় পেলেন সেই কাউন্টার পুণ্যভূমি– আমি অতি, অতি সংক্ষেপে সারছি। পেলেন সুইস বস্তু। তখন আবার ভুল করে যেন শুধু কাগজের নোট না নেন। কারণ ফোন বুথ কাগজাৰ্থর্যাশী নন; তিনি চান মুদ্রা। সেই মুদ্রা আবার ওই সাইজের হওয়া চাই। ঠ্যাঙস ঠ্যাঙস করে চলুন ফের ওই পুণ্যভূমিতে। আরও বহুবিধ ফাড়াগৰ্দিশ আছে। বাদ দিচ্ছি।
আহা! কী আনন্দ!! কী আনন্দ!!!
কে বলছেন? আমি ফ্রিডি।
আমি সৈয়দ।
.
০৬.
ওইয-যা! ট্রাঙ্ক লাইন কেটে গেল! পাবলিক বুথ থেকে ট্রাঙ্ক-কল করা এক গব্বযন্তনা, আমি যে দুটি মুদ্রা মেসিনে ফেলে লুৎর্সেন পেয়েছিলুম, তার ম্যাদ ফুরিয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আর দুটো না ফেলার দরুন লাইন কাট অফফ। ফের ঢালো কড়ি।
অতি অবশ্য সত্য, ফোনযন্ত্রের বাকসে সুইটজারল্যান্ডে প্রচলিত তিন-তিনটি ভাষা– ফরাসি, জর্মন এবং ইতালীয়– লেখা আছে কোন গুহ্য সরল পদ্ধতিতে যন্ত্রটি ব্যবহার করতে হয়। লেখা তো অনেক কিছুই থাকে। ধর্মগ্রন্থে তো অনেক কিছুই লেখা থাকে। সেগুলো পড়লেই বুঝি মোক্ষলাভ হয়! জিমনাস্টিকের কেতাব পড়লেই বুঝি কিক্কড় সিঙ-এর মতো মাসল গজায়! প্র্যাকটিস করতে হয়। এবং তার জন্য খেসারতিও দিতে হয়। উপযুক্ত শুরু বিনা যোগাভ্যাস করতে গিয়ে বিস্তর লোক পাগল হয়ে যায়।… আমি ইতোমধ্যে প্রায় দেড় টাকার মতো খেসারতি দিয়ে হ্যালো হ্যালো করছি। আর, এ খেসারতির কোনও আন্তর্জাতিক মূল্য নেই। কারণ জর্মনি, ফ্রান্স, ইংলন্ড প্রায় প্রত্যেক দেশই আপন আপন কায়দায় আপন আপন মেসিন চালায়। আর সেইখানেই কি শেষ? তিন মাস পরে যখন ফের সুইটজারল্যান্ডে আসব, তখন দেখব, বাবুরা এ ব্যবস্থা পালটে দিয়েছেন। নতুন কোনও এক আবিষ্কারের ফলে যন্ত্রটার ব্যবহার নাকি সরলতর করেছেন। সরলতর না কচু! তাই যারা এসব ব্যাপারে ওয়াকিফহাল নন, যারা এই হয়তো পয়লাবারের মতো কন্টিনেন্ট যাচ্ছেন তাদের প্রতি আমার সরলতম উপদেশ, বিগুরু এসব যন্ত্রপাতি ঘাটাতে যাবেন না। অবশ্য শুরু পাওয়া সর্বত্রই কঠিন; এখানে আরও কঠিন। যে যার ধান্দা নিয়ে উধ্বশ্বাসে হন্তদন্ত। কে আপনাকে নিয়ে যাবে সেই বুথ-গুহায়, শিখিয়ে দেবে সে গুহায় নিহিতং ধর্মস্য তত্ত্বং!
যাক! ফের পাওয়া গিয়েছে লাইন।
তুমি লুৎর্সেন কখন আসছ?
অপরাধ নিও না। আমি উপস্থিত যাচ্ছি কলোন। তার পর হামবুর্গ ইত্যাদি। তার পর লন্ডন নটিংহাম। সেখান থেকে ফেরার পথে লুৎর্সেন। তুমি খেদিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তোমার বাড়িতে।
দ্যৎ! কিন্তু তদ্দিনে এখানে যে বড় শীত জমে যাবে। গরম জামা-কাপড় এনেছ তো? মাখট নিষটস (নেভার মাইন্ড- আসে-যায় না)! আমার কাছে আছে।
তুমি এখনও ফ্রানসিস আসিসিরই শিষ্যা রয়ে গিয়েছ– কী করে কাতর জনকে মদৎ করতে হয়, সে-ই তোমার প্রধান চিন্তা। আমি কি তোমার স্কার্ট ব্লাউজ পরে রাস্তায় বেরুব? সেকথা থাক। আমাকে অ্যারপোর্টে আরও তিন ঘন্টাটাক বসে থাকতে হবে। চলে এসো না এখানে। আজ তো রোববার। তোমাকে অফিস দফতর করতে হবে না।
রোববার! সেই তো বিপদ। বাড়ি থেকে যেতে হবে লুৎর্সেন স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে করে জুরিক। পঁয়ত্রিশ মাইল। সেখান থেকে বাস-এ করে তোমার অ্যারপর্টে। রোববার বলে আজ ঢের কম সার্ভিস। সবকটা উঠতি-নাবতিতে টায় টায় কোথায় পাব কনেকশন–আমি মনে মনে বললুম, :। ফের সেই কনেকশন। ইলামবাজার রামপুরহাট। ফ্রিডি বললে, আচ্ছা দেখি।
আমি বললুম, কতকাল তোমাকে দেখিনি।
ফ্রিডি যদি এখানে আসেই তবে তার বাস দাঁড়ায় কোথায়? আমি বসে আছি ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারের খোঁয়াড়ে। এখানে তো ফ্রিডির প্রবেশ নিষেধ। অবশ্য সে এদেশের রীতিমতো সম্মানিতা নাগরিকা (সংস্কৃত অর্থে নয়) সিজেন্। কাজেই সে স্পেশাল পারমিট জোগাড় করতে পারবে। তবে সেটা জোগাড় করতে করতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে? আম আনতে দুধ না ফুরিয়ে যায়। ততক্ষণে হয়তো আমার কলোনগামী প্লেনের সময় হয়ে যাবে।
বাসস্ট্যান্ডে যেতে হলে আমাকে খোয়াড় থেকে বেরোতে হয়। কিন্তু আমাকে বেরুতে দেবে কি? খোয়াড়ের বাইরেই স্বাধীন, মুক্ত সুইটজারল্যান্ড। তার জন্য ভিজার প্রয়োজন। আমার সেটা নেই। তবু চেষ্টা করে দেখাই যাক না, কী হয় না হয়। সুকুমার রায় বলেছেন, উৎসাহে কী না হয়, কী না হয় চেষ্টায় সেইটি পড়ে আমার এক সখা ডাকপিয়নকে বলেছিল, আমার কোনও চিঠি নেই? কী যে বলছ? ফের খুঁজে দেখ। উৎসাহে কী না হয়, কী না হয় চেষ্টায়।
খোয়াড়ের গেটে গিয়ে সেখানকার উর্দিপরা তদারকদারকে অতিশয় সবিনয় নিবেদন করলুম, স্যর! আমি কি একটু বাইরে ওই বাসস্ট্যান্ডে যেতে পারি?
আপনি তো ট্রানজিট। না?
আমি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললুম, বাস-এ করে লুৎর্সেন থেকে আমার একটি বান্ধবী হায় পাঠক, তুমি সেই তদারকদারের প্রতিক্রিয়া যদি তখন দেখতে। বান্ধবী! বান্ধবী!! সেরতেমা (সার্টনলি) চেত্মানতে (ইতালিয়ানে, সার্টনলি) এবং তার পর জর্মনে জিষার জিষার (শিওর, শিওর) এবং সর্বশেষে যদি কূল না পায়, মার্কিন ভাষায় শিয়ের শিয়ে।
আমি জানতুম, আমি যদি বলতুম, আমার বন্ধু আসছেন, সে বলত, নো। যদি বলতাম আমার বিবি, উত্তর হত তদ্বৎ। যদি বলতুম, বৃদ্ধা মাতা, তখনও হত না– হয়তো কিঞ্চিৎ থতমত করে। কিন্তু বান্ধবী! আমার সাতখুন মাপ।
.
০৭.
কলোনের নাম কে না শুনেছে? বিশেষ করে হেন ফ্যাশনেবল মহিলা আছেন কি যিনি কস্মিনকালেও প্রসাধনাৰ্থে ও-দ্য-কলোন– জর্মনের ক্যলনিশ ভাষায়– কলোনের জল ব্যবহার করেননি। বিশ্বজোড়া খ্যাতি এই তরল সুগন্ধটির। ৪৭১১ এবং মারিয়া ফারিনা এই দুটিকেই সবচেয়ে সেরা বলে ধরা হয়। এদেশেও কলোন জল তৈরি হয় কিন্তু ওটা বানাতে হলে যে সাত-আট রকমের সুগন্ধি ফুলের প্রয়োজন, তার কয়েকটি এদেশে পাওয়া যায় না– সর্বোপরি প্রাকপ্রাণালী তো আছেই। বিলেতেও কলোন জলের এতই আদর, যে হিটলারের সঙ্গে দেখা করার জন্য চেম্বারলেন যখন সপরিষদ কলোন থেকে মাইল বিশেক দূরে গডেসবের্গ-এর মুখোমুখি, রাইন নদীর ওপারে যে বাড়িতে ওঠেন, তার প্রতি ঘরে কলোন জল, কলোন জলের সুগন্ধ দিয়ে নির্মিত গায়ে মাখার সাবান, দাড়ি কামাবার সাবান, ক্রিম, পাউডার– বস্তুত প্রসাধনের তাবৎ জিনিস রাখা হয়েছিল। হিটলারের আদেশে। চেম্বারলেন এই সূক্ষ্ম বিদগ্ধ আতিথেয়তা লক্ষ করেছিলেন কি না জানিনে। কারণ তখন তার শিরঃপীড়া, তাঁর এ অভিসার তাঁর দেশবাসী কী চোখে দেখবে। তাঁর আপন ফরেন অফিস যে সেটা নেকনজরে দেখছে না, সেটা তিনি জানতেন, কারণ ইতোমধ্যেই তারা একটা প্যারডি নির্মাণ করে ফেলেছে :
ইফ এট ফার্স্ট ইউ কানট সাকসিড/ ফ্লাই ফ্লাই এগেন।
বলা বাহুল্য চেম্বারলেন ফ্লাই করে গিয়েছিলেন। আর আমি তো সেই গডেসবের্গ-এর উপর দিয়ে কলোন পানে ফ্লাই করে যাচ্ছিই। সেই সুবাদে প্যারডিটি মনে পড়ল।
জুরিচে ফ্রিডির সঙ্গে মাত্র কুড়ি মিনিট কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলুম। মনটা খারাপ হয়ে গেছে।
কলোন শহরের সঙ্গে আমার চল্লিশ বছরের পরিচয়।
এখান থেকে প্রায় চোদ্দ মাইল দূরে বন। সেখানে যৌবনে পড়াশুনা করেছিলুম। ট্রামে, বাস-এ, ট্রেনে, জাহাজে করে এখানে আসা অতি সহজ। আমার একাধিক সতীর্থ কলোন থেকে বন ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করত। তাদের সঙ্গে বিস্তর উইকএন্ড করেছি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শহরটাকে দেখেছি।
সেসব সবিস্তর লিখতে গেলে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি হবে। আর লিখতে যাবই-বা কেন? জর্মন টুরিস্ট ব্যুরো যদি আমাকে কিঞ্চিৎ ব্রাহ্মণ-বিদায় করত তবে না হয়—
যদি নিতান্তই কিছু বলতে হয়, তবে প্রথম নম্বর সম্বন্ধে বলি যে, সেটি আপনি চান কি না চান, কিছুতেই এড়াতে পারবেন না। কলোনের বিরাট গগনস্পর্শী গির্জা। প্যারিসে যেরকম যেখানেই যান না কেন, অ্যাফ্যাল টাওয়ারটা এড়াতে পারবেন না, কলোনের এই কেথিড্রেলটির বেলাও তাই। তবে অ্যাফ্যাল স্তম্ভ বদখদ, কিন্তু কলোনের গির্জাচুড়ো তন্বঙ্গী সুন্দরী। যেন মা-ধরণী উপানে দুবাহু বাড়ায়ে পরমেশ্বরকে তাঁর অনন্ত অবিচ্ছিন্ন নমস্কার জানাচ্ছেন।
এ গির্জা আবার আমাদের কাছে নবীন এক গৌরব নিয়ে ধরা দিয়েছে।
বছর দুত্তিন পূর্বে কলোনবাসী প্রায় শ-দুই তুর্কি ও অন্যান্য মুসলমান ওই গির্জার প্রধান বিশপকে গিয়ে আবেদন জানান, এ বছর ঈদের নামাজ শীতকালে পড়েছে। বাইরে বরফ; সেখানে নামাজ পড়ার উপায় নেই। হুজুর যদি আপনাদের এই গির্জের ভিতরে আমাদের নামাজ পড়তে দেন, তবে আল্লা আপনাকে আশীর্বাদ করবেন। বিশপের হৃদয়কন্দরে কণামাত্র আপত্তি ছিল না কিন্তু…? এ শহরের লোক খ্রিশ্চান। তাদেরই বিত্ত দিয়ে, গরিবের কড়ি দিয়ে এ গির্জা সাতশো বছর আগে গড়া হয়েছে। এখনও ওদেরই পয়সাতে এ মন্দিরের তদারকি দেখভাল চলে। সে-ও কিছু কম নয়। এরা যদি আপত্তি করে? কিন্তু এই বিশপটি ছিলেন বড়ই সন্তপ্রকৃতির সজ্জন। এবং তার চেয়েও বড় কথা : সাহসী। তিনি অনুমতি দিয়ে দিলেন। মা-মেরি মালিক। তিনি সর্বসন্তানের মাতা।
কিমাশ্চর্যমতঃপরম। তাঁর কাছে কোনও প্রতিবাদপত্র এল না। খবরের কাগজের এই অভাবনীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ বেরোল না। অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!! অবিশ্বাস্য!!!
কিন্তু মার্কিন টাইম কাগজে বেরিয়েছে ও বিলেতেও বেরিয়েছে। তার পর সন্দ করে কোন পিচেশ!
কলোন অ্যারপোর্টে নেমে দেখি, দুটো স্যুটকেসের একটা আমার নেই। ছুট ছুট দে ছুট, সেই ঘরের দিকে যেখানে হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ সম্বন্ধে তড়িঘড়ি ফরিয়াদ জানাতে হয়। নইলে চিত্তির। অবশ্য এরা নিজের থেকেই হয়তো দু-পাঁচ দিনের ভিতরেই আমার বেওয়ারিশ জাদুকে খুঁজে পাবেন, কিন্তু আমি কোন মোকামে আস্তানা গাড়ব, তার ঠিকানাটা এদের না দিলে মাল হস্তগত হবে কী করে? সেটা তখন তার মালিককে হারাবে। কোনও এক গ্রিক দার্শনিক নাকি বলেছেন, একই নদীতে তুমি দু বার আঙুল ডোবাতে পারবে না, একই শিখায় দু বার আঙুল পোড়াতে পারবে না। কারণ প্রত্যেকটি বস্তু প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। মানলুম। কিন্তু একই স্যুটকেস নিশ্চয়ই দু বার, দু বার কেন দু-শোবার হারাতে কোনও বাধা নেই। অতি অবশ্য কবিগুরু বলেছেন, তোমায় নতুন করে পাব বলেই হারাই ক্ষণে ক্ষণে ও মোর ভালোবাসার ধন। কিন্তু প্রশ্ন, এটা কি হারানো বাকসের বেলাও খাটে?
আপিসঘরটি প্রমাণ সাইজের চেয়েও বৃহদায়তন। ভিতরে একটি ফুটফুটে মেমসাহেব বসে আছেন। আমার লাগেজ টিকিট দেখাতেই তিনি মুচকি হেসে বললেন, নিশ্চিন্ত থাকুন, ওটা খোওয়া যাবে না। কিন্তু বলুন তো, ওটার ভিতর কী কী আছে?
সর্বনাশ! সে কি আমি জানি? প্যাকিং করেছে আমার এক তালেবর ভাতিজা মুখুয্যে। তার বাপ প্রতি বৎসর নিদেন তিনবার ইউরোপ-আমেরিকা যেতেন। সে নিখুঁত প্যাকিং করে দিত। আমার বেলা এবারে করেছে নিখুঁততর। কোন বাকসে কী মাল রেখেছে কী করে জানব!
কিন্তু মিসি বাবা সদয়া। পীড়াপীড়ি করলেন না। আমার ঠিকানাটি টুকে নিলেন। আর ইতোমধ্যে বার বার বলছেন, অ্যার ইন্ডিয়া বলুন, লুফট-হানজা বলুন, সুইস-অ্যার বলুন কোনও লাইনেই কোনও লাগেজ খোওয়া যায় না। আপনি পেয়ে যাবেনই যাবেন।
আমি মনে মনে বললুম, বটে! বেরোবার সময় তাকে বিস্তর ধন্যবাদ জানিয়ে সবিনয়ে বললুম, গ্লেডিগেস ফ্রলাইন (সদয়া কুমারী)! একটি প্রশ্ন শুধোতে পারি কি?
সুমধুর হাস্যসহ, নিশ্চয়, নিশ্চয়।
আমি বললুম, তাবৎ হারানো মালই যদি ফিরে পাওয়া যায়, তবে এ হেন বিরাট আপিস আপনারা করেছেন কেন? আমি তো শুনেছি, কলোন অ্যারপোর্টের প্রতিটি ইঞ্চির জন্য দশ-বিশ হাজার টাকা ছাড়তে হয়।
প্রত্যুত্তরের প্রতীক্ষা না করেই একলক্ষে দফতর থেকে বেরিয়ে মালসামান নিয়ে উঠলুম বিরাট এক বাস-এ।
বাঁচলুম বাবা, বাঁচলুম। প্লেনের গর্ভ থেকে বেরিয়ে খোলামেলায় এসে বাঁচলুম। বাসটি যদিও পর্বতপ্রমাণ, সাগর করিবে গ্রাস হয় অনুমান তবু চলছে যেন রোলস রইস রইস খানদানি গতিতে, মৃদু মধুরে। কবিগুরু গেয়েছিলেন, কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসার ঘায়ে– আমি গাইলুম, বাঁচালে তুমি মোরে ভালো বাস-এর ছায়ে।
আহা কী মধুর অপরাহ্নের সূর্যরশি! কখনও মেঘমায়ায়, কখনও আলোছায়ায়। দু দিকের গাছপালার উপর সে রশ্মি কভু-বা মেঘের ভিতর দিয়ে আলতো আলতো হাত বুলিয়ে যায়, কভু-বা রুদ্রদীপ্ত হয়ে প্রচণ্ড আলিঙ্গন করে। ওই হোথায় দেখছি, বুড়ো চাষা ঘাসের উপর শুয়ে আছে, চোখের উপর টুপি রেখে। তার সবুজ পাতলুন যেন ঘাসের ঝিলিমিলির সঙ্গে এক তালে যায় মিলি। এদেশের নবান্ন হতে এখনও বেশ কিছুদিন বাকি আছে। চতুর্দিকে অল্পবিস্তর ফসল কাটা হচ্ছে। আজ রোববার। রাইনল্যান্ডের লোক বেশিরভাগই ক্যাথলিক। তাদের অধিকাংশই সেদিন সর্বকর্ম ক্ষান্ত দেয়। তাই ক্ষেতখামারে তেমন ভিড় নেই। আমিও মোকামে পৌঁছেতে পারলে বাঁচি। ইংরেজিতে প্রবাদ : এ সিনার হ্যাঁজ নো সনড়ে। পাপীর রোববার নেই। আমি তো তেমন পাপিষ্ঠ নই।
.
০৮.
বাস মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রামের ভিতর দিয়ে যায়। সেখানে রাস্তা নির্জন। বাচ্চাকাচ্চারা কোথায়? তারা তো ক্লাইপে বা সুধালয়ে যায় না সেখানে অবশ্যই আজ জোর কারবার, বেজায় ভিড়। আমার পাশের সিটে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসেছিলেন। তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে বললুম, স্যর, ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে আমি এসব গ্রামের ভিতর দিয়ে গিয়েছি। তখন তো ছেলেমেয়েরা রাস্তার উপর রোল-স্কেটিং করত, দড়ি নিয়ে নাচত- এমনকি ফুটবলও খেলত। ওরা সব গেল কোথায়?
বৃদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, একাধিক উত্তর হয়তো আছে। চট করে যেটা মনে আসছে সেটা বলতে গেলে বলি, বন্ধ ঘরে টেলিভিশন দেখছে।
আমি একটু ঘাড় চুলকে বললুম, কিছু যদি অপরাধ না নেন, স্যর তবে শুধাব, এটা কি সর্বাংশে ভালো? ফারসিতে একটি দোহা আছে :
হর চে কুনি, ব খুদ কুনি।
খা খুব কুনি, আ ব কুনি ॥
যা করবে স্বয়ং করবে
ভালো করো কিংবা মন্দই করো।
এই যে প্যাসিভভাবে বসে বসে টেলি দেখা, তার চেয়ে রাস্তায় অ্যাকটিভভাবে খেলাধুলো করা কি অনেক বেশি কাম্য নয়?
গুণী এবারে চিন্তা না করেই বললেন, নিশ্চয়ই। অবশ্য ব্যত্যয়ও আছে। যেমন মনে করুন, আমরা যখন মোসার্ট বা শপা শুনি তখন তো আমরা প্যাসিভ। আর তাই-বা বলি কী করে? বেটোফেনকে গ্রহণ করা তো প্যাসিভ নয়। ভেরি ভেরি অ্যাকটিভ কর্ম! কী পরিমাণ কনসানট্রেশন তখন করতে হয়, চিন্তা করুন তো। কিন্তু বাচ্চাদের কথা বাদ দিন কটা বয়স্ক লোকই সে জিনিস করে?
বুঝলুম লোকটি চিন্তাশীল। এঁকে খুঁচিয়ে আরও অনেক তত্ত্বকথা জেনে নিই। বললুম, তা টেলিতে কি ভালো প্রোগ্রাম কিছুই দেয় না?
তা হলে শুনুন, আপনাকে পুরো ফিরিস্তি দিচ্ছি। যদিও আমি ওই যন্ত্রটির পূজারি নই। পুরনো ফিল্ম, নয়া থিয়েটার, গর্ভপাতের সেমিনার-আলোচনা, পাদ্রিদের বক্তৃতা (এ দুটো তিনি ঠিক পরপর বলেছিলেন সেটা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে), রাজনীতিকদের সঙ্গে ইন্টারভু, খেলা, কাবারে, ইতালি ভ্রমণ, চন্দ্রাভিযান, ভিয়েতনাম থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর প্রতিবেদন, পার্লামেন্টে হার ভিলি ব্রান্ট ও হার শেলের বক্তৃতা এবং সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ওই একই কেচ্ছা, একই অন্তহীন খাড়া বড়ি হোড় হোড় বড়ি খাড়া (তিনি জর্মনে বলেছিলেন একই ইতিহাস- ডি জেলবে গেশিষটে)। সর্বস্তৃ কুচি কুচি করে পরিবেশন। পরের দিনই ভুলে যাবেন, আগের দিন কী দেখেছিলেন- মনের ওপর কোনও দানা কাটে না। পক্ষান্তরে দেখুন, বই পড়ার ব্যাপারে আপনি আপনার রুচিমতো বই বেছে নিচ্ছেন।
ইতোমধ্যে আমাদের বাস কতবার যে কত ট্রাফিক জ্যামে কত মিনিট দাঁড়িয়েছে তার হিসাব আমি রাখিনি। অথচ এদেশে রিকশা, ঠ্যালা, গরুর গাড়ি এমন কোনও কিছুই নেই যেসব হ্যবরল আমাদের কলকাতাতে নিত্যি নিত্যি ট্রাফিক জ্যাম জমাতে কখনও স্বেচ্ছায় কখনও অনিচ্ছায় বিশ্ববিজয়ী প্রতিষ্ঠান।
ভদ্রলোক বাইরের দিকে আঙুল তুলে বললেন, এই দেখুন, আরেক উকট নেশা। মোটর, মোটর, মোটর। প্রত্যেক জর্মনের একখানা মোটরগাড়ি চাই। জর্মন মাত্রই মোটরের পূজারি।
আমার কেমন যেন মনে হল, আমরা বোধহয় বন শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে গিয়েছি। কিছুটা চেনা-চেনা ঠেকছে, আবার অচেনাও বটে। অথচ একদা এ শহর আমি আমার হাতের তেলোর চেয়ে বেশি চিনতুম। আমি ভদ্রলোককে আমার সমস্যা সমাধান করতে অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, এটা বনই বটে। তবে এ অঞ্চলটা গত যুদ্ধে এমনই বোমারু-মার খেয়েছিল যে এটাকে নতুন করে গড়া হয়েছে। তবে শহরের মধ্যিখানটা প্রায় পূর্বেরই মতো মেরামত করে বানানো। আসল কথা কী জানেন, বমিঙের ফলে ঘিঞ্জি পাড়াগুলো যে নষ্ট হয়ে গেল সেগুলোকে ভালো করে নতুন করে, প্ল্যান মাফিক বানাবার চান্সটা আমরা মিস করেছি। তবে এই যে বললুম, শহরের মাঝখানটা মোটামুটি আগেরই মতো হার্ট অব দি সিটি– আর জানেন তো, পুরনো হার্টের জায়গায় নতুন হার্ট বসানো মুশকিল। এই ধরুন লুটভি ফান বেটোফেন–।
আমি বললুম, ওই নামটার ঠিক উচ্চারণটা কী আমি আজও জানিনে।
হেসে বললেন, ওই তো ফেললেন বিপদে। মাঝখানের Vanটা যে খাঁটি জর্মন নয় তা তো বুঝতেই পারছেন। ওঁরা প্রাচীন দিনের ফ্ল্যামিশ। তখন তারা ভান না ফান উচ্চারণ করত কে জানে অন্তত আমি জানিনে–
আমি বললুম, থাক, থাক। এবারে যা বলছিলেন তাই বলুন।
সেই বেটোফেনের বাড়ি যদি বোমাতে চুরমার হয়ে যেত তবে সেখানে তো একটা পিরামিড গড়া যেত না।
এমনকি তাজমহলও না।
দুম করে গাড়ি থেমে গেল। এ কী? ও। মোকামে পৌঁছে গিয়েছি। অর্থাৎ বন শহরে। এবং সবচেয়ে প্রাণাভিরাম নয়নানন্দদান দৃশ্য যে পরিবারে উঠব তারই একটি জোয়ান ছেলে ডিটরিষ উলানোফঙ্কি প্রবলবেগে হাত নাড়াচ্ছে। মুখে তিনগাল হাসি। পাশে পঁড়িয়ে তার ফুটফুটে বউ। সে রুমাল দুলাচ্ছে।
.
০৯.
লক্ষ্মী ছেলে ডিটরিষ। তার মাঝারি সাইজের মোটরখানা এনেছে। আমার কোনও আপত্তি না শুনে বললে, আমি মালপত্রগুলো তুলে নিচ্ছি। তুমি ততক্ষণ বউয়ের সঙ্গে দুটি কথা কয়ে নাও। ও তো তোমাকে চেনে না। মেয়েটিকে বাড়ির কুশলাদি শুধোলুম। কিন্তু বড় লাজুক মেয়ে–কয়েকদিন আগে দেশ পত্রিকায় যে সিগারেট-মুখী মডার্ন মেয়ের ছবি বেরিয়েছে তার ঠিক উল্টোটি। কোনও প্রশ্ন শুধোয় না। শুধু উত্তর দেয়। শেষটায় বোধহয় সেটা আবছা আবছা অনুভব করে একটিমাত্র প্রশ্ন শুধালে, বন কি খুব বদলে গেছে। আমি অবশ্য প্রাচীন দিনের বন চিনিনে। আমার বাড়ি ছিল ক্যোনিমবের্গে।
সর্বনাশ! এবং পাঠক সাবধান!
ক্যোনিষবের্গ শহরটি এখন বোধহয় পোলাভের অধীনে। ওইসব অঞ্চল থেকে লক্ষ লক্ষ নরনারী বাস্তুহারা সর্বহারা হয়ে পশ্চিম জর্মনিতে এসেছে। তাদের বেশিরভাগই সেসব দুঃখের কাহিনী ভুলে যেতে চায়। কাজেই সাবধান! ও-সব বাবদে ওদের কিছু জিগ্যেস কর না।
তবে এ তত্ত্বও অতিশয় সত্য যে মোকা-মাফিক দরদ-দিলে যদি আপনি কিছু শুনতে চান তখন অনেক লোকই, বিশেষ করে রমণীরা অনর্গল অবাধ গতিতে সবকিছু বলে ফেলে যেন মনের বোঝা নামাতে চায়। বিশেষ করে বিদেশির সামনে। যে দু দিন বাদেই আপন দেশে চলে যাবে। ও যা বলেছিল সেটা নিয়ে খামোখা কোনও ঘোটালার সৃষ্টি হবে না। আমি তাই বেমালুম চেপে গিয়ে বললুম, ও ক্যোনিষবের্গ! যেখানে এ যুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক কান্ট জন্মেছিলেন! এবং শুনেছি তিনি নাকি ওই শহরের বারো না চোদ্দ মাইলের বাইরে কখনও বেরোননি। শহরটাকে এতই ভালোবাসতেন।… ইতোমধ্যে ডিটরিষ স্টিয়ারিঙে বসে গেছে এবং আমার শেষ মন্তব্যটা শুনেছে। বললে, ভালোবাসতেন না কচু। আসলে সব দার্শনিকই হাড়-আলসে। আমি বললুম, সেকথা থাক। তোর বউ শুধোচ্ছিল, বন শহরটা কি খুব বদলে গেছে? তারই উত্তরটা দিই। বদলেছে, বদলায়ওনি—
তুমি মামা, চিরকালই হেঁয়ালিতে কথা কও।
আমি বললুম, থাক, বাবা, থাক। বাস-এ এক বৃদ্ধ বিষয়টির অবতারণা করতে না করতেই মোকামে পৌঁছে গেলাম। আর এ তাবৎ দেখেছিই-বা কী?
বন শহরের নাম করলেই দেশি-বিদেশি সবাই বেটোফেনের নাম সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করে বটে, কিন্তু এ বৎসরে বিশেষ করে। কারণ তাঁর দ্বিশতজন্মশতবার্ষিকী সম্মুখেই। ডিসেম্বর ১৯৭০-এ। এ শহর তাঁকে এতই সম্মান করে যে তার সুন্দর প্রতিমূর্তিটি তুলেছে তাদের বিরাটতম চত্বরে, তাদের বৃহত্তম এবং প্রাচীনতম না হলেও তারই কাছাকাছি প্রাচীন মনসটার গির্জার পাশে। হয়তো তার অন্যতম কারণ, বেটোফেন ছিলেন সর্বান্তঃকরণে ঈশ্বরবিশ্বাসী। শুধু তাঁর সঙ্গীতে নয়, তাঁর বাক্যালাপে চিঠিপত্রে সর্বত্রই তার ঈশ্বরে পরিপূর্ণ বিশ্বাস, প্রভুর পদপ্রান্তে তার ঐকান্তিক আত্ম-নিবেদন বার বার প্রকাশ।
সেখান থেকে কয়েকটি মিনিটের রাস্তা ছোট্ট গলির ছোট্ট একটি বাড়ির ছোট্ট একটি কামরায় যেখানে তাঁর জন্ম হয়। বাড়ির নিচের তলায় বেটোফেন মিউজিয়াম। সেখানে তার ব্যবহৃত অনেক কিছুই আছে, যেমন ইয়াসনা পলিয়ানাতে তলস্তয়ের–বৃহত্তর, সম্পূর্ণতর, কারণ সেটা দেড়শো বছর পরের কথা এবং অসম্পূর্ণতম রবীন্দ্রনাথের উত্তরায়ণে যদ্যপি সেটা তলস্তয়ের প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে।…
কিন্তু সেখানে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী বেটোফোনের কানের চোঙাগুলো। বত্রিশ বৎসর বয়স থেকেই তিনি ক্রমে ক্রমে কালা হতে আরম্ভ করলেন। বিধাতার এ কী লীলা! বীণাপাণির এই অংশাবতার আর তার বীণা শুনতে পান না। তখন তিনি আরম্ভ করলেন ওইসব কানের চোঙা ব্যবহার করতে। পাঠক, দেখতে পাবে, তার বধিরতা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যেমন যেমন বাড়তে লাগল সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোঙার সাইজও বাড়তে লাগল। তাতে করে তার কোনও লাভ হয়েছিল কি না বলা কঠিন। তবে এটা জানি, তার কিছুকাল পরে, যখন তার সঙ্গীতপ্রেমী কোনও সহচর বলতেন, বাহ্! কী মধুর সুরেলা বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে রাখাল ছেলেটি, আর তিনি কিছুই শুনতে পেতেন না তখন বেটোফেন বলতেন, তিনি তনুহূর্তেই আত্মহত্যা করতেন যদি না তার বিশ্বাস থাকত যে সঙ্গীতে এখনও তার বহু কিছু দেবার আছে। আমাদের শ্রীরাধা যেরকম উদ্ধবকে বলেছিলেন, যদি না আমার বিশ্বাস থাকত, প্রভু একদিন আমার কাছে ফিরে আসবেন, তা হলে বহু পূর্বেই আমার মৃত্যু হয়ে যেত। এবং সকলেই জানেন, বদ্ধ কালা হয়ে যাওয়ার পরও বেটোফেন মনে মনে সঙ্গীতের রূপটি ধারণা করে বহুবিধ স্বর্গীয় রচনা করে গেছেন যেগুলো তিনি স্বকর্ণে শুনে যেতে পাননি। আমি যেন কোথায় পড়েছি, তিনি সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে করুণ আবেদন জানাচ্ছেন, প্রভু যেন তাকে একবারের মতো তাঁর শ্রুতিশক্তি ফিরিয়ে দেন যাতে করে তিনি মাত্র একবারের তরে আপন সৃষ্ট সঙ্গীত শুনে যেতে পান। তার পর তিনি সধন্যান্তকরণে পরলোকে যেতে প্রস্তুত।
চিন্তাস্রোতে বাধা পড়ল। ডিটরিষ শুধাল, মামা, কথা কইছ না যে!
বললুম, আমি ভাবছিলাম বেটোফেনের কানের চোঙাগুলোর কথা। ওগুলো সত্যি কি তার কোনও কাজে লেগেছিল?
ডিটরিষ বললে, বলা শক্ত। কোনও কোনও আধাকালা একখানা কাগজের টুকরো দু পাটি দাঁত দিয়ে চেপে ধরে কাগজের বেশিরভাগটা মুখের বাইরে রাখে। ভাবে, ধ্বনিতরঙ্গ ওই কাগজকে ভাইব্রেট করে দাঁত হয়ে মগজে পৌঁছোয়, কিংবা কান হয়ে। কেউ-বা সামনের দু পাটির চারটে দাঁত দিয়ে লম্বা একটা পেনসিল কামড়ে ধরে থাকে। কী ফল হয় না হয় কে বলবে?… আচ্ছা মামু, তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, কী রকম অদ্ভুত, প্রিমিটিভ মিনি সাইজের যন্ত্র দিয়ে তিনি তাঁর বিচিত্র সঙ্গীত রচনা করেছিলেন? আমার কাছে ভারি আশ্চর্য লাগে!
আমি বললুম, কেন বস, ওই যে তোমার ছোট পিসি, যার সঙ্গে আমার চল্লিশ বছরের বন্ধুত্ব, লিজেল দেখেছ, ঝড়তি পড়তি কয়েক টুকরো লেটিসের পাতা, আড়াই ফোঁটা নেবুর রস আর তিন ফোঁটা তেল দিয়ে কী রকম সরেস স্যালাড তৈরি করতে পারে? মুখে দিলে যেন মাখম!!… আর তোর-আমার যত আনাড়িকে যাবতীয় মশলাসহ একটা মোলায়েম মুরগি দিলেও আমরা যা রাঁধব সেটা তুইও খেতে পারবিনি, আমিও না। পিসি লিজেল কী বলবে, জানিনে। অথচ জানিস, এই অদ্ভুত মুরগিটি তাঁকে তখন দিয়ে দে। তিনি সেটাকে ছোট ছোট টুকরো করে যাকে ফরাসিরা বলে রাও ফাঁ, রা ফ্রিকাস, অর্থাৎ লম্বা লম্বা ফালি-ফালি করে কেটে, মুরগিটাতে আমরা যেসব বদ-রান্নার ব্যামো চাপিয়েছিলুম সেগুলো রাইনের ওপারে পাঠিয়ে অ্যামন একটি রান্না করে দেবেন যে, প্যারিসের শ্যাফতক আ মরি আ মরি বলতে বলতে তারিয়ে তারিয়ে খাবে।… প্রকৃত গুণীজন যা-কিছুর মাধ্যমে যা-কিছু সৃষ্টি করতে পারেন। আমাদের দেশে একরকম বাদ্যযন্ত্র আছে। একতারা তার নাম। তাতে একটি মাত্র তার। তার দু দিকে দুটি ফ্লেকসিবল বাঁশের কৌশল আছে। সে দুটোতে কখনও জোর কখনও হালকা চাপ দিয়ে, আর মাঝখানের তারটাকে প্লাক করে নাকি বিয়াল্লিশ না বাহান্নটা নোট বের করা যায়। তবেই দ্যাখ। বেটোফেনের মতো কটা লোক পৃথিবীতে আসে আমাদের দেশেও গণ্ডায় গণ্ডায় তানসেন জন্মায় না। যদিও আমাদের দেশ তোদের দেশের চেয়ে বিস্তর বিরাটতর, এবং সেখানে কলাচর্চা আরম্ভ হয়েছিল অন্তত চার হাজার বছর পূর্বে। এবং আমাদের কলা-জগতে আমরা এখন সাহারাতে। এবং
ডিটরিষ বললে, তুমি আমাদের পার্লামেন্ট হাউসটা দেখবে না। রাইনের পারে। আমি একটু ঘোরপথে যাচ্ছি। সোজা পথে গেলে দু-পাঁচ মিনিট আগে বাড়ি পৌঁছতুম।
দ্যাখ ডিটরিষ, তোর পিসি নিশ্চয়ই বিস্তর কেক, পেসট্রি আমাদের জন্য বানিয়ে বসে আছে–
ডিটরিষের বউ বললে, মামা, শুধু কেক পেসট্রি বললেন। ওদিকে পিসি কী কী বানিয়ে বসে আছেন, জানেন? ক্যানিঃসবের্গের ক্লপসে (ক্যানিঙসবের্গ শহরের একরকম কোতা), ফ্রাঙ্কফুর্টের সসিজ, হানোফারের ষাঁড়ের ন্যাজের শুরুয়া
আমি বাধা দিয়ে বললুম, সে তো জানি। কিন্তু লিজেল পিসি আমার জন্যে কি ক্যাঙারু ন্যাজের শুরুয়া তৈরি করেছে।
দু জনাই তাজ্জব। আমি বললুম, ষাড়ের ন্যাজের ভিতরে থাকে চর্বি এবং মাংস। তার একটা বিশেষ স্বাদ থাকে। কিন্তু ষাঁড়ের ন্যাজ আর কতটুকু লম্বা? তার চেয়ে ক্যাঙারুর ন্যাজ ঢের ঢের বেশি। ওটা যদি পাঁচজনকে খাওয়ানো যায় তবে বিস্তর কড়ি সাশ্রয় হয়।
ঘ্যাঁচ করে গাড়ি থামল।
এটা কী রে? মনে হয়, গোটা আস্টেক বিরাট বিস্কুটের টিন একটার উপর আরেকটা বসিয়ে দিয়েছে। বললুম আমি।
ডিটরিষ বললে, এটাই আমাদের পার্লামেন্ট।
.
১০.
যাকে বলে মর্ডান আর্ট, পিকাসো উপস্থিত যার পোপস্য পোপ সেই পদ্ধতিটি জর্মনরা কখনও খুব পছন্দ করেনি। কাইজার দ্বিতীয় ভিলহেলম, যাকে এখনও মার্কিনিংরেজ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী করে তিনি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে আর্ট এবং আর্টের আদর্শ সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দেন। তাঁর বক্তব্য ছিল : আর্ট হবে সুন্দর, আর্ট হবে সমাজসেবক, রাষ্ট্রসেবক, আর্ট মানুষের দুঃখদৈন্যের ছবি না এঁকে আঁকবে এমন ছবি, কম্পোজ করবে এমন সঙ্গীত, রচনা করবে এমন সাহিত্য যাতে মানুষ আপন পীড়াদায়ক পরিস্থিতি ভুলে গিয়ে আনন্দসায়রে নিমজ্জিত হবে। আজকের দিনে আমরা এটাকে নাম দিয়েছি এসকেপিজম– পলায়ন মনোবৃত্তি। বলা বাহুল্য জর্মন আটিস্ট-সাহিত্যিক সঙ্গীতস্রষ্টা- কাইজারের এই পথনির্দেশ খবরের কাগজে পড়ে স্তম্ভিত হন। তা হলে আর্টিস্টের কোনও স্বাধীন সত্তা নেই। সে তার আপন সুখ-দুঃখ, আপন বিচিত্র অভিজ্ঞতা আপন হৃদয়ে উপলব্ধ ভবিষ্যতের আশাবাদী চিত্র অঙ্কন করতে পারবে না। সে তা হলে রাষ্ট্রের ভাঁড়, ক্লাউন! তার একমাত্র কর্তব্য হল জনসাধারণকে কাতুকুতু দিয়ে হাসানো।
কিন্তু জর্মন জনসাধারণ কাইজারের কথাই মেনে নিল। এটা আমার ব্যক্তিগত মত নয়। এই পরিস্থিতিটা বোঝাতে গিয়ে প্রখ্যাত জর্মন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, দার্শনিক শ্ৰীযুত রোখিম বেসার বলেছেন, জর্মন মাত্রই উপরের দিকে তাকায়; রাজা কী হুকুম দিলেন সেই অনুযায়ী কাব্যে চিত্রে সঙ্গীতে আপন রুচি নির্মাণ করে।
১৯১৮-এ কাইজার যুদ্ধে হেরে হল্যান্ডে পলায়ন করলেন।
তখন সত্য সত্য আরম্ভ হল মর্ডান আর্টের যুগ। যেন কাইজারকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করার জন্য আর্টিস্টরা আরম্ভ করলেন রঙ নিয়ে নিত্য নব উন্মাদ নৃত্য, ধ্বনি নিয়ে সঙ্গীতে তাণ্ডব একসপেরিমেন্ট, ভাস্কর্যে বিকট বিকট মূর্তি যার প্রত্যেকটাতেই থাকত একটা ফুটো (তার অর্থ বোঝাতে গেলে পুলিশ আমাকে জেলে পুরবে)। আমি ওই সময়ে জর্মনিতে ছিলুম। মর্ডানদের পাল্লায় পড়ে একদিন একটা চারুকলা প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে একলক্ষে পুনরপি বেরিয়ে এসেছিলুম। একদা যেরকম কোনও এক জু-তে বোকা পাঠার আঁচার সামনে থেকে বিদ্যুৎগতিতে পলায়ন করেছিলুম। বোটকা গন্ধে।
তার অর্থ অবশ্য এ নয় যে সেখানে উত্তম দ্রষ্টব্য কিছুই ছিল না। নিশ্চয়ই ছিল। রাস্তার ডাস্টবিন খুঁজলে কি আর খান দুই লুচি, একটা আলুর চপ পাওয়া যায় না? কিন্তু আমার এমন কী দায় পড়েছে।
এর পর ১৯৩৩-এ এলেন হিটলার। তাঁর কাহিনী সবাই জানেন। কিন্তু আর্ট সম্বন্ধে তার অভিমত সবাই হয়তো জানেন না; তাই সংক্ষেপে নিবেদন করছি। হিটলার সর্বক্ষণ কাইজারকে অভিসম্পাৎ দিতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, কাইজার যদি কাপুরুষের মতো হার না মেনে লড়ে যেতেন তবে জর্মনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করতই করত।… অথচ আর্ট সম্বন্ধে দেখা গেল, হিটলার-কাইজার সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেন। তিনি কঠিনতর কণ্ঠে উচ্চৈঃস্বরে বারবার বলে যেতে লাগলেন, আর্ট হবে সমাজের দাস, অর্থাৎ নাৎসিদের দাস। সূর্যনিম্নে এই পৃথ্বীতলে তারা যে ন্যায়সম্মত আসন খুঁজছে, তারই সেবা করবে আর্টিস্টরা।
কাইজারের চরম শত্রুও বলবে না, তিনি অসহিষ্ণু লোক ছিলেন। তাঁর আমলে তাঁর নির্দেশ সত্ত্বেও যারা মর্ডান ছবি আঁকত তাদের বিরুদ্ধে তিনি কোনও প্রকারেরই কোনও কিছু করেননি।
কিন্তু হিটলার চ্যানসেলার হাওয়ার পর আরম্ভ হল এঁদের ওপর নির্যাতন। উত্তম উত্তম ছবি, নব নব সঙ্গীত ব্যান করা হল। সেরা সেরা পুস্তক পোড়ানো হল– কারণ এগুলো নাৎসি সঙ্গীতের সঙ্গে এক সুরে এক গান গায় না। আমি দূর থেকে এরকম একটা অগ্নিযজ্ঞ দেখেছিলাম। কাছে যাইনি। পাছে প্রভুরা আমার রঙ দেখে, আমাকে ইহুদি ঠাউরে আমার নাকটা না কেটে দেন। যদিও আমার নাকটি খাঁটি মঙ্গোলিয়ান। খাটো, বেঁটে, হ্রস্ব। কিন্তু বলা তো যায় না।
হিটলার তার সাধনোচিত ধামে গেছেন। এখন জর্মনরা উঠেপড়ে লেগেছেন মর্ডান হতে। চোদ্দতলা বাড়ি ভিন্ন অন্য কথা কয় না।
তাই এই বিস্কুটটিনপারা পার্লিমেন্ট।
ডিটরিষকে বললুম, জানো, ভাগিনা, আমাদের দেশেও এ ধরনের স্থাপত্য হুশ হুশ করে আকাশপানে উঠছে। তারই এক আর্কিটেকট এসেছেন আমাদের সঙ্গে তাস খেলতে। ভদ্রলোক সিগার খান। বর্ষাকাল। সিগার গেছে মিইয়ে। ঘন ঘন নিভে যায়। ভদ্রলোক দেশলাই খোঁজেন।… খেলা শেষ হল। তখন কেন জানিনে তিনি তার দেশলাই আর খুঁজে পান না। আমাদের এক রসিক বন্ধ বসে বসে খেলা দেখছিল। সে দরদি কন্ঠে বলল, দাদাদের কাছে আমার অনুরোধ, আর্কিটেকট মশয়ের মডেলটি তোমরা কেউ গাপ মেরো না। ওই দেশলাইটির মডেল থেকেই তো তিনি হেথাহোথা সর্বত্র বিয়াল্লিশতলার বিলডিং হাঁকাচ্ছেন? ওটা গায়েব হলে ওঁয়ার রুটি মারা যাবে যে।
ডিটরিষ বললে, জানো মাম, আমাদের বিশ্বাস প্রাচ্যদেশীয়রা বড্ডই সিরিয়স। সর্বক্ষণ গুমড়ো মুখ করে, লর্ড বুদ্ধের মতো আসন নিয়ে শুধু আত্মচিন্তা মোক্ষানুসন্ধান করে। তারাও যে রসিকতা করে একথা ৯৯.৯% জর্মন কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। অথচ তোমার এই বন্ধুটির রসিকতাটি শুধু যে রসিকতা তাই নয়, এতে গভীর দর্শনও রয়েছে। মর্ডান আর্কিটেকচর সম্বন্ধে মাত্র ওই একটি দেশলাই দিয়ে তিনি তাঁর তাচ্ছিল্য সিনিসিজমসহ প্রকাশ করলেন কী সাতিশয় সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে। ভদ্রলোক কি তোমার মতো লেখেন-টেখেন- লিতেরাত্যোর?
আমি বললুম, তওবা, তওবা! ভদ্রলোক ছিলেন আমাদের ফরেন অফিসের ডেপুটি মিনিস্টার; পণ্ডিত নেহরুর সহকর্মী। খুব বেশিদিন কাজ করেননি। ওইসব দার্শনিক সিনিক রসিকতা তিনি সর্বজনসমক্ষে প্রকাশ করতেন তার ভিন্ন ভিন্ন সহকর্মী মন্ত্রীদের সম্বন্ধে। ঠিক পপুলার হওয়ার পন্থা এটা নয়– কী বল? কাজেই তিনি যখন ফরেন অফিস থেকে বিদায় নিলেন তখন আমি বলেছিলাম, তিনি মন্ত্রিমণ্ডলী থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বিদায় নেবার সময় উল্লাসে নৃত্য করলেন এবং মন্ত্রিমণ্ডলীও তার থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে উল্লাসে নৃত্য করলেন।
ডিটরিষ চুপ। আমি একটু অবাক হলুম। সে তো সবসময়ই জুত্মাফিক উত্তর দিতে পারে।
সে বললে, আমার অবস্থাও তাই। যে অফিসে আমি কাজ করি সেটা থেকে বেরুতে পারলে আমিও খুশি হই; ওরাও খুশি হয়।
.
১১.
ওই তো সামনে গোডেসবের্গ। ডিটরিষ শুধালে, মামু, পিসি বলছিল তুমি নাকি এই টাউনটাকে জর্মনির সর্ব জায়গার চেয়ে বেশি ভালোবাসা কেন বল তো?
আমি মুচকি হেসে কইলুম, যদি বলি তোর পিসির সঙ্গে হেথায় আমার প্রথম প্রণয় হয়েছিল বলে?
ডি। ধ্যত! আমি ছেলেবেলা থেকেই লক্ষ করেছি, লিজেল পিসির ধ্যানধর্ম শুধু কাজ আর কাজ। ফাঁকে ফাঁকে বই পড়া। এবং সে বইগুলোও দারুণ সিরিয়স। বড় পিসি বরঞ্চ মাঝে মাঝে হালকা জিনিস পড়ত। কিন্তু ছোট পিসি ওসবের ধার ধারত না। সে যেত প্রতি প্রভাতে ট্রামে চড়ে বন শহরে সেখানে সে চাকরি করত–
আমি। সেই সূত্রেই তো আমাদের পরিচয়। আমো ওই সকাল আটটা পনেরোর ট্রামে বন যেতুম। আমরা আর সবাই দু-তিনটে সিঁড়ি বেয়ে ট্রামে উঠতুম। আর লিজেল পিসি ডান হাতে একখানা বই আর বাঁ হাতে ট্রামের গায়ে সামান্যতম ভর করে সিঁড়িগুলোকে তাচ্ছিলি করে এক লাফে উঠত ট্রামের পাটাতনে। উঠেই এক গাল হেসে ডাইনে-বাঁয়ে-সমুখ পানে তাকিয়ে বলত, শুটেন মরগেন সুপ্রভাত। ওর লক্ষ মেরে ওঠার কৌশল দেখে আমি মনে মনে বলতুম, একদম ট বয়! ওর উচিত ছিল, মার্কিন মুল্লুকে কাউ বয় হয়ে জন্ম নেবার। অথবা ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুঈন–গুরুদেবের ভাষায়।
গোডেসবের্গ তখন অতি ক্ষুদে শহর। সবাই সবাইকে চেনে। কিন্তু আসল কথা, ওই আটটা পনেরোর ট্রামে থাকত পনেরো আনা কাচ্চাবাচ্চা। স্কুলে যাচ্ছে বন শহরে। এরা সবাই জানত যে লিজেল পিসির, অবশ্য তখনও তিনি পিসি খেতাব পাননি, কাছে আছে লেবেনচুস, দু-একটা আপেল, হয়তো নবাগত মার্কিন চুইংগাম, মাঝেমধ্যে চকলেট। কাজেই বাচ্চারা সমস্বরে, কোরাস কণ্ঠে বলত অন্তত বার তিনেক সুপ্রভাত, সুপ্রভাত—। তার পর সবাই তার চারপাশ ঘিরে দাঁড়াত। সবাই বলত– প্লিজ প্লিজ, এজ্ঞে এজ্ঞে, এই এখানে বসুন।
আমি বললুম, বুঝলি ডিটরিষ, তোর পিসি লিজেল ছিল আমাদের হিরোইন অব দ্য প্লে। তবে তুই ঠিকই বলেছিস, ও কখনও প্রেম-ফ্রেমের ধার ধারত না। আমি দু-একবার তার সঙ্গে হাফাহাফি ফ্লার্ট করতে গিয়ে চড় খেয়েছি। অথচ আমাদের মধ্যে প্রীতিবন্ধুত্ব ছিল গভীর। আমাকে কত কী না খাইয়েছে ওই অল্প বয়সেই বেশ দু পয়সা কামাত বলে। তখনকার দিনে ছিল– এখনও নিশ্চয়ই আছে একরকমের বেশ মোটা সাইজের চকলেট– ভিতরে কন্যা। বড় আক্রা। কিন্তু খেতে ওহ! কী বলব–মুখে ফেলে সামান্য একটু চাপ দাও। ব্যস, হয়ে গেল। ভিজে ভিজে চকলেট আর তরল কন্যাকে মিশে গিয়ে, দ্যাখ তো না দ্যাখ, চলে গেল একদম পেটের পাতালে। কিন্তু যাবার সময় ওই যে কন্যাক– তোরা যাকে বলিস ব্র্যানটভাইন, ইংরেজিতে ব্রান্ডি, নাড়িভূঁড়ির প্রতিটি মিলিমিটার মধুর মধুর চুলবুলিয়ে বুঝিয়ে দিত, যাচ্ছেন কোনও মহারাজ।… আর মনের মিলের কথা যদি তুলিস তবে বলব, লিজেল ছিল বড়ই লিবরেল। তাই যদিও নাৎসিরা তখনও ক্ষমতা পায়নি কিন্তু রাস্তাঘাটে দাবড়াতে আরম্ভ করেছে পিসি সেটা আদৌ পছন্দ করত না। আমিও না। কিন্তু সত্যি বলতে কী, ইংরেজ যে ইতোমধ্যেই হিটলার বাবদে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে সেটা আমার চিত্তে পুলক জাগাত। পিসিও সেটা জানত। ভারতবর্ষের পরাধীনতার কথা উঠলেই সে ব্যথা পেত। বলত, ও কথা থাক না। ওরকম দরদি মেয়ে চিনতে পারার সৌভাগ্য আমি ইহসংসারে অতি অল্পই পেয়েছি।
হঠাৎ লক্ষ করলুম, ভাগিনা ডিটরিষ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছে। শুধালুম, কী হল রে? তুই কি পরশুদিনের হাওয়া খেতে চলে গিয়েছিস?
কেমন যেন বিষণ্ণ কণ্ঠে ভেজা-ভেজা গলায় বললে, মামা, তুমি বোধহয় জানো না, আমার বাবা অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে ওপারে চলে গেল কী করে।
ডিটরিষের এখন যৌবনকাল। তার বাপ কেন, ঠাকুন্দাও বেঁচে থাকলে আশ্চর্য হবার মতো কিছু ছিল না। বললুম, আমি তো জানিনে, ভাই। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, আবার হচ্ছেও না। কারণ তোর গলাটা কীরকম যেন ভারী ভারী শোনাচ্ছে–
তুমি এইমাত্র বললে না, তুমি, পিসি দু জনাই নাৎসিদের পছন্দ করতে না। বস্তুত পিসিপরিবারের কেউই নাৎসি ছিল না। যদিও আমি তোমার বান্ধবীকে পিসি বলে পরিচয় দিয়েছি, আসলে তিনি আমার মাসি। তারা তিন বোন। আমার মা সক্কলের ছোট। তিনি বিয়ে করলেন এক নাৎসিকে কট্টর নাৎসিকে। কেন করলেন জানিনে। প্রেমের ব্যাপার। তবে হ্যাঁ, চিন্তাশীল ব্যক্তি ছিল। বাড়ি গিয়ে তোমাকে তার ডাইরিটি দেখাব। আর চেহারাটি ছিল সুন্দর–
বাধা দিয়ে বললুম, সে তো তোর চেহারা থেকেই বোঝা যায়।
থ্যাঙ্কউ। আর বাবা ছিল বড়ই সদয়-হৃদয়–
ভাগিনা, কিছু মনে কর না। আমি মোটেই অবিশ্বাস করি না যে তোর পিতা অতিশয় করুণহৃদয় শান্তস্বভাব ধরতেন– তোর দুই মাসিই সেকথা আমাকে বারবার বলেছে। কিন্তু, আবার বলছি, কিছু মনে কর না, তা হলে তিনি নাৎসিদের কনসানট্রেশন ক্যাম্প সয়ে নিলেন কী করে?
ডিটরিষ চুপ মেরে গেল। কোনও উত্তর দেয় না। আমি এবার, বহুবারের পর আবার বুঝলুম যে আমি একটা আস্ত গাড়োল। এরকম একটা প্রশ্ন করাটা আমার মোটেই উচিত হয়নি। বললুম, ভাগিনা, আমি মাফ চাইছি। আমি আমার প্রশ্নটার কোনও জবাব চাইনে। ওটা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি।
ডিটরিষ বললে, না, মামু। তুমি যা ভেবেছ তা নয়। আমি ভাবছিলুম, সত্যই তো, বাবা এগুলো বরদাস্ত করত কী করে? এবং আরও লক্ষ লক্ষ জর্মন? এই নিয়ে আমি অনেকবার বহু চিন্তা করেছি। তুমি জানো, মার্কিনিংরেজ রুশ-ফরাসি নরেনবের্গ মোকদ্দমায় বার বার নাৎসিদের প্রশ্ন করেছে, তোমরা কি জানতে না যে হিটলারের কনসানট্রেশন ক্যাম্পে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে খুন করেছে? উত্তরে সবাই গাইগুই করেছে। সোজা উত্তর কেউই দেয়নি। জানো তো, যুদ্ধের সময় কত সেনসর কত কড়াকড়ি। কে জানবে, কী হচ্ছে, না হচ্ছে। আমার মনে হয়, আবার বলছি জানিনে, বাবার কানে কিছু কিছু পৌঁছেছিল। কিন্তু বাবা তখন উন্মত্ত। তিনি চান জর্মনির সর্বাধিকার। তাঁর ডাইরিতে বার বার বহুবার লেখা আছে, ইংরেজ কে? সে যে বিরাট বিশ্ব শুষে খেতে চায় তাতে তার হক্কো কী? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই মানি, তারা যদি আমাদের কিংবা ফরাসিদের মতো কলচরড জাত হত তবে আমরা এ নিয়ে কলহ করতুম না। কিন্তু ইংরেজ জাতটাই তো বেনের জাত। তারা কলচরের কী বোঝে! ওদের না আছে। মাইকেল এঞ্জেলো, না আছে বেটোফেন। আছে মাত্র শেক্সপিয়ার। ওদের না আছে স্থাপত্য, না আছে ভাস্কর্য, না আছে–হঠাৎ বললে, ওই তো বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি ॥
.
১২.
ভু, হালুঙ্কে
সোল্লাসে হুহুঙ্কারে রব ছাড়ল শ্রীমতী লিজেল। তুই গুণ্ডা–
আমরা যেরকম কোনও দুরন্ত ছোট বাচ্চাকে আদর করে গুণ্ডা বলে থাকি হালুঙ্কে তাই। শব্দটা চেক ভাষাতে জর্মনে প্রবেশ লাভ করেছে। গত চল্লিশ বছর ধরে দেখা হলেই লিজেল এইভাবেই আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে।
তার পর আমাকে জাবড়ে ধরে দু গালে দুটো চুমো খেল।
ডিটরিষ মারফত পাঠককে পূর্বেই বলেছি, লিজেল ছিল ন-সিকে টম-বয়, এবং দু-একবার তার সঙ্গে হাফাহাফি ফ্লার্ট করতে গিয়ে চড় খেয়েছি। তবে এটা হল কী প্রকারে? শুচিবায়ুগ্রস্ত পদি পিসিরা ক্ষণতরে ধৈর্য ধরুন। বুঝিয়ে বলছি। এই ষাট বছর বয়সে তার কি আর টমবয়ত্ব আছে? এখন আমাকে জাবড়ে ধরে আলিঙ্গন করাতে সে শুধু তার অন্তরতম অভ্যর্থনা জানাল।
আমি মনে মনে বললুম চল্লিশ বছর ল্যাটে, চল্লিশ বছর ল্যাটে। এই আলিঙ্গন-চুম্বন চল্লিশ বছর পূর্বে দিলেই পারতে, সুন্দরী। পরে তাকে খুলেও বলেছিলুম।
ইতোমধ্যে ডিটরিষ আমতা আমতা করে বললে, আমরা তা হলে আসি। রাত্রের পার্টিতে দেখা হবে। ওরা পাশেই থাকে। তিন মিনিটের রাস্তা। ওদের ভাব থেকে বুঝলুম, ওরা মনে করছে বিদ্যা ও সুন্দর যখন বহু বৎসর পর সম্মিলিত হয়ে গেছেন তখন ওদের কেটে পড়াই ভালো। আমাদের প্রেমটি যে চিরকালই নির্জলা জল ছিল সেটি হয়তো তার গলা দিয়ে নাবাতে পারেনি– হজম করা তো দূরের কথা।
লিজেল আমাকে হাতে ধরে ড্রইংরুমের দিকে নিয়ে চলল। আমি বললুম, এ কী আদিখ্যেতা! চল্লিশ বছর ধরে যখনই এ বাড়িতে এসেছি তখনই আমরা বসেছি বাবা, মা, বড়দি, তুমি, ছোড়দি রান্নাঘরে। অবিশ্যি মা রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আজ কেন এ ব্যত্যয়? তদুপরি ওই বিরাট ড্রইংরুম! বাপস! তুই যদি এক কোণে বসিস আর আমি অন্য কোণে, তা হলে একে অন্যকে দেখবার তরে জোরদার প্রাশান মিলিটারি দুরবিনের দরকার হবে; কথা কইতে হলে আমাদের দেশের ডাক-হরকরা, নিদেন একটি ট্রাঙ্ক-কল-ফোন ব্যবস্থা, আর–
লিজেল সেই প্রাচীন দিনের মতো বললে, চোকোর চোকোর। তুই চিরকালই বড় বেশি বকর বকর করিস।
গতি পরিবর্তন হল। আমরা শেষ পর্যন্ত রান্নাঘরেই গেলুম।
কিচেনের এক প্রান্তে টেবিল, চতুর্দিকে খান ছয় চেয়ার। অন্য প্রান্তে দুটো গ্যাস উনুন, তৃতীয়টা কয়লার (সেটা খুব সম্ভব প্রাচীন দিনের ঐতিহ্য রক্ষার্থে)। দুই প্রান্তের মাঝখানে অন্তত দশ কদম ফাঁকা। অর্থাৎ কিচেনটি তৈরি করা হয়েছে দরাজ হাতে। বস্তুত লিজেলের মা যখন রাঁধতেন তখন এ প্রান্ত থেকে আমাকে কিছু বলতে হলে বেশ গলা উঁচিয়ে কথা কইতে হত।
লিজেল একটা চেয়ার দেখিয়ে বললে, এটায় বস।
সত্যি বলছি, আমার চোখে জল এল। কী করে লিজেল মনে রেখেছে যে, চল্লিশ বৎসর পূর্বে (তিনি গত হয়েছে, বছর আটত্রিশেক হবে) তার পিতা আমাকে ওই চেয়ারটায় বসতে বলতেন। আমি জানতুম, কেন। জানালা দিয়ে, ওই চেয়ারটার থেকে দূর-দূরান্তরের দৃশ্য সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। পরে জানতে পেরেছিলুম, তিনি স্বয়ং ওই চেয়ারটিতে বসে আপন ক্ষেত-খামারের দিকে এবং বিশেষ করে তার বিরাট আপেলবাগানের দিকে নজর রাখতেন (মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে আমাদের যেরকম আমবাগান)। অবশ্যই তিনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে ভালোবাসতেন। নইলে আমাকে তার আপন আসন ত্যাগ করে, আপন অভ্যস্ত আসন ছেড়ে দিয়ে ওখানে বসতে বলবেন কেন? আমি তো সেখান থেকে তার ক্ষেতখামার, আপেলবাগান তদারকি করতে পারব না– যারা ঘোরাঘুরি করছে, তারা তাঁর আপন মুনিষ না ভিন-জন আমি ঠাহর করব কী প্রকারে? আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ? সে দিকে আমার কোনও চিত্তাকর্ষণ নেই। একদিন ওই শেষ কথাটি তাকে আস্তে আস্তে ক্ষীণ কণ্ঠে বলতে–যাতে অন্যেরা শুনতে না পায় তিনি বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে অতিশয় সুন্দর স্মিতহাস্যে বললেন, তোমরা ইন্ডিয়ান। তোমাদের দেশে এখনও কলকারখানা হয়নি। তোমরা এখনও আছে প্রকৃতির শিশু। শিশু কি মায়ের সৌন্দর্য বোঝে না। সে শুধু তার মায়ের স্তনরস চায়– সেই স্তনদ্বয়ের সৌন্দর্য কি সে বোঝে? যেমন তার বাপ বোঝে? ঠিক ওইরকম তোমরা তোমাদের মা-জননী জন্মভূমিতে ক্ষেত-খামার করে খাদ্যরস আহারাদি সংগ্রহ কর। তোমরা এখন কী করে বুঝবে, নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বলতে কী বোঝায়? সেটা শুরু হয় যখন মানুষ কলকারখানার গোলাম হয়ে যায়। অর্থাৎ মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর, বড় হয়ে সে মাতৃদুগ্ধের মূল্য বুঝতে শেখে।
আমি বললুম, মানছি, কিন্তু দেখুন, গ্রিস, রোম এবং আমার দেশ ভারতবর্ষেও তো কলকারখানা নির্মিত হওয়ার বহু পূর্বে উত্তমোত্তম কাব্য রচিত হয়েছিল এবং সেগুলোতে বিস্তর প্রাকৃতিক নৈসর্গিক বর্ণনা আছে। তবে কেন?
ওইসব কথাবার্তা যেন ওই চেয়ারে বসে কানে শুনতে পাচ্ছি। কত বৎসর হয়ে গেছে। এমন সময় লিজেল আমার মাথায় মারল একটা গাট্টা। আমার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। বিশেষ করে তার ঠাকুরমার ছবিটি।
কী খাবে বলছিলে?
আমি আশ্চর্য হয়ে উত্তর দিলুম, আমি তো কিছুই বলিনি।
তবে চল, তুমি যে সুপ পছন্দ করতে সেই সুপই করেছি– অর্থাৎ পি সুপ (কলাইটির সুপ)- এবারে বল তুমি কী খাবে? তুমি যা খেতে চাও তার জন্য মাছ, মাংস, ক্রিম আছে।
আমি বললুম, দিদি, সুপ ছাড়া আমার অন্য কোনও জিনিসের প্রয়োজন নেই। আর এই জর্নিতে আমার সর্বাঙ্গ অসাড়।… তবে কি না আমি বঙ্গসন্তান। হেথায় ডান পাশে রাইন নদী। সে নদীর উত্তম উত্তম মাছ খেয়েছি কত বৎসর ধরে। তারই যদি একটা কিছু
বেচারি লিজেল।
শুকনো মুখে বললে, রাইনে তো আজকাল আর সে-মাছ নেই।
আমি শুধালাম, কেন?
বললে, রাইন নদে জাহাজের সংখ্যা বড্ড বেশি বেড়ে গিয়েছে। তাদের পোড়ানো তেল তারা ওই নদীতে ছাড়ে। ফলে নদীর জল এমনই বিষে মেশা হয়ে গিয়েছে যে, মাছগুলো প্রায় আর নেই। আমার কাছে যেসব মাছ আছে সেগুলো টিনের মাছ।
আমি বললুম, তা হলে থাক।
.
১৩.
বিনু যখন সোয়ামির সঙ্গে ট্রেনে করে যাচ্ছিল তখন বললে, আহা, ওরা কেমন সুখে আছে। আমরাও ভাবি ইংরেজ ফরাসি জর্মন জাত কীরকম সুখে আছে। কিন্তু ওদেরও দুঃখ আছে। তবে আমাদের মতো ওদের দুঃখ ঠিক একই প্রকারের নয়। ওরা খেতে পায়, আশ্রয় আছে। তৎসত্ত্বেও ওদের দুঃখ আছে।
লিজেলদের বাড়ি প্রায় দুশো বছরের পুরনো। সে আমলে স্টিল-সিমেন্টের ব্যাপার ছিল না। বাড়িটা মোটামুটি কাঠের তৈরি। দুশো বছর পরে ছাদটা নেমে আসছে। এটাকে খাড়া রাখা যায় কী প্রকারে।
আমি জিগ্যেস করলুম, লিজেল, এটাকে কি মেরামত করা যায় না?
লিজেল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, শুধু ছাদ নয়, দেয়ালগুলো ঝুরঝুরে হয়ে এসেছে। এ বাড়ি মেরামত করতে হলে কুড়ি হাজার মার্ক (আমাদের হিসাবে চল্লিশ হাজার টাকারও বেশি) লাগবে। বাবা গেছেন, আমার কোনও ভাইও নেই। ক্ষেত-খামার দেখবে কে? আপেলবাগানটা পর্যন্ত বেচে দিয়েছি। তাই স্থির করেছি বাড়িটা সরকারকে দিয়ে দেব। ওরা সব পুরনো বাড়ির কিছু কিছু বাঁচিয়ে রাখতে চায়। কারণ এ বাড়িটির স্টাইল এক্কেবারে খাঁটি রাইনল্যান্ডের।
আমি বললুম, এটা মর্টগেজ করে টাকাটা তোল না কেন?
লিজেল বললে, যে টাকাটা কখনও শোধ করতে পারব না সে-টাকা ধার করব কী করে!
আমার মনে গভীর দুঃখ হল। বাড়িটা সত্যিই ভারি সুন্দর। শুধু বাড়িটি নয়, তার পেছনে রয়েছে ফল-ফুলের বাগান, তরিতরকারির ব্যবস্থা, কুয়ো, হ্যান্ডপাম্প দিয়ে জল তোলার ব্যবস্থা গ্রামাঞ্চলে উত্তম ব্যবস্থা। ক্ষেত-খামার গেছে যাক। ওদের আপেলবাগান এই অঞ্চলে বৃহত্তম ও শ্রেষ্ঠতমও ছিল। সে-ও গেছে যাক। কিন্তু এই সুন্দর বাড়িটা সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে, এটা আমার মন কিছুতেই মেনে নিতে চাইল না।
ইতোমধ্যে লিজেলের ছোট বোন মারিয়ানা এল। তিন বোনের ও-ই একমাত্র যার বিয়ে হয়েছিল। যে ডিটরিষ আমাকে নিয়ে যাবার জন্য বন-এ এসেছিল তার মা। ছেলের বাড়ি দু-মিনিটের রাস্তা। সেখানে বউ নিয়ে থাকে।
মারিয়ানা বিধবা। প্রায় সাতাশ বছর পূর্বে তার বিয়ে হয়। বরটি ছিল খাসা ছোকরা–কিন্তু…
এ বাড়ির তিন বোনের কেউই নাৎসি ছিল না। এরা সবাই ধর্মভীরু ক্যাথলিক। ইহুদিরা প্রভু খ্রিস্টকে হয়তো ক্রুশবিদ্ধ করেছিল, হয়তো করেনি। যাই হোক, যাই থাক– তাই বলে দীর্ঘ সুদীর্ঘ সেই ঘটনার দু-হাজার বছর পর এদের দোকানপাট, ভজনালয়, ওদের লেখা বইপত্র পুড়িয়ে দেবে (মহাকবি হাইনরিষ হাইনের কবিতাও বাদ যায়নি), ইহুদি ডাক্তার, উকিল প্র্যাকটিস করতে পারবে না– এটা ওরা গ্রহণ করতে পারেনি। এটা ১৯৩৪ সালের কথা। তখনও কনসানট্রেশন ক্যাম্প আরম্ভ হয়নি। যখন আরম্ভ হল তখন আমি দেশে। যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। চিঠি-চাপাটির গমনাগমন সম্পূর্ণ রুদ্ধ। কিন্তু আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ ছিল না যে, লিজেলদের পরিবার এ প্রকারের নিষ্ঠুর নরহত্যা শুধু যে ঘৃণার চোখে দেখবে তাই নয়, এরা যে এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছে না সেটা তাদের মনকে বিকল করে দেবে।… এসব শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি যখন জর্মনি যাই, তখন লিজেল আমাকে বলেছিল, ডু হালুঙ্কে, তুই তো ভালো করেই চিনিস, আমাদের এই মুফেনডার্ফ গ্রাম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের না হোক, জর্মনির ক্ষুদ্রতম গ্রাম। সেই হিসেবে আমার প্রখ্যাততম গ্রাম। এখানে মাত্র একটা-দুটো ইহুদি পরিবার ছিল। দিদি সময়মতো ওদেরকে সুইটজারল্যান্ডে পাচার করে দিয়েছিল।
এবারে আরম্ভ হবে ট্রাজেডি।
মারিয়ানা বড় সরলা। এসব ব্যাপার নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাত না। অবশ্য সে-ও ছিল আর দুই দিদির মতো পরদুঃখ-কাতর।
বিয়ে করে বসল এক প্রচণ্ড পাঁড় নাৎসকে। কেন করল, এ মূর্খকে শুধোবেন না। মেয়েরা কেন কার প্রেমে পড়ে, কেন কাকে বিয়ে করে এ নিগূঢ় তত্ত্ব দেবতারাও আবিষ্কার করতে পারেননি।
তার পর যুদ্ধ লাগল। সেটা শেষ হল।
এইবারে মার্কিন-ইংরেজদের কৃপায় দেশের শাসনভার পেলেন নাৎসি-বৈরীরা। এরা খুঁজে খুঁজে বের করলেন নাসিদের। তখন আরম্ভ হল তাদের ওপর নির্যাতন। আজ ধরে নিয়ে যায়। তিন দিন তিন রাত্তির গারদে নির্জন কারাবাসের পর আপনাকে ছেড়ে দিল। আপনি ভাবলেন, যাক বাঁচা গেল। দশ দিন যেতে না যেতে আবার ভোর চারটেয় আপনাকে গ্রেফতার করে ঠাসল গারদে। (এই যে আপনাকে ছেড়ে দিয়েছিল সেটা শুধু আপনার পিছনে গোয়েন্দা রেখে ধরবার জন্য কারা কারা আপনার সহকর্মী ছিল; কারণ স্বভাবতই আপনি তাদেরই সন্ধানে বেরুবেন। দ্বিতীয়ত এরা আপনার দরদি বন্ধু। আপনার দৈন্য-দুর্দিনে একমাত্র তারাই আপনাকে সাহায্য করবে– অবশ্য যদি তাদের দু-পয়সা থাকে।… এটা কিছু নবীন ইতিহাস নয়। আমাদের এই স্বদেশী আন্দোলনের সময়, পরবর্তী যুগে মহামান্য টেগার্ট সাহেবের আমলে–
বারে বারে সহস্র বার হয়েছে এই খেলা।
দারুণ রাহু ভাবে তবু হবে না মোর বেলা ॥)
সর্বশেষে মারিয়ানার স্বামীর তিন বছরের জেল হল। সেখানে যক্ষ্মা। বেরিয়ে এসে ছ-মাসের পরই ওপারে চলে গেল।
পাঠক ভাববেন না, আমি নাৎসি-বৈরীদের দোষ দিচ্ছি।
বার বার শুধু আমার মনে আসছে :–
এদেশের লোক সবাই কৃশ্চান।
এদেশের প্রভু, প্রভু খ্রিস্ট আদেশ দিয়েছেন, ক্ষমা, ক্ষমা, ক্ষমা।
জানি, মানুষ এত উঁচুতে উঠতে পারে না।
কিন্তু সেই চেষ্টাতেই তো তার খ্রিষ্টত্ব, তার মনুষ্যত্ব।
.
১৪.
হুররে, হুররে, হুররে।
কৈশোরে অবশ্য আমরা বলতুম, হিপ হিপ হুরে।
পুরোপাক্কা ক্রেডিট নিশ্চয়ই অ্যারইন্ডিয়া কোম্পানির।… দীর্ঘ হাওয়াই মুসাফিরির পর অঘোরে ঘুমিয়েছিলুম সকাল আটটা অবধি। নিচে নামতেই লিজেল চেঁচিয়ে বললে, ডু হালুঙ্কে! তোর হারানো সুটকেস ফিরে পাওয়া গিয়েছে।
কী করে জানলি?
আমাদের তো টেলিফোন নেই। চল্লিশ বছর আগে এই গডেসবের্গের যে বাড়িতে তুই বাস করতিস তার টেলিফোন নম্বরটি তুই কলোনের হারানো প্রাপ্তির দফতরে সুবুদ্ধিমানের মতো দিয়ে এসেছিলি। আশ্চর্য! সে নম্বর তুই পুত-পুত করে এত বৎসর ধরে পুষে রেখেছিলি কী করে আর সেটা যে কলোনের সেই হারানো প্রাপ্তি দফতরে আপন স্মরণে এনে ওদের দিয়েছিলি সেটা আরও বিস্ময়জনক। তোর পেটে যে এত এলেম তা তো জানতুম না। আমি তো জানতুম তোর পশ্চাৎদেশে টাইম বম রাখতে হয় (আমরা বাঙলায় বলি পেটে বোমা না মারলে কথা বেরোয় না), ফিউজের হিসহিস শুনে তবে তোর বুদ্ধি খোলে। সে-কথা থাক। কলোনের দফতর সেই নম্বরে ফোন করে, আব তোর সেই প্রাচীন দিনের ল্যান্ডলেডির মেয়ে আনা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল তুই আমাদের বাড়িতে উঠেছিস। তাছাড়া যাবি আর কোন চুলোয়। আনা-র বিয়ে হয়েছে এক যুগ আগে। ভাতার আর বাচ্চা দুটো রয়েছে। তাই সেখানে না উঠে আমাকে আপ্যায়িত করতে এসেছিস। ফের বলছি সেকথা থাক। আনা কিন্তু বুদ্ধিমতী মেয়ে–
আমি বাধা দিয়ে বললুম, হবে না কেন? আমি ওদের বাড়িতে ঝাড়া একটি বচ্ছর ছিলাম। আমার সঙ্গ পেয়েছে বিস্তর।
লিজেল আমার দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে কোনও মন্তব্য না করে বললে, সে জানে আমাদের টেলিফোন নেই। কিন্তু আমাদের পাশের বাড়ির মহিলার আছে। তাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে যে, তোর সুটকেসটি পাওয়া গিয়েছে এবং কলোন দফতরে জমা পড়েছে।
আমি বললুম, সর্বনাশ। আমাকে এখন ঠ্যাঙস ঠ্যাঙস করে যেতে হবে সেই ধেড়ধেড়ে গোবিন্দপুর কলোনে? আধ-খানা দিন তাতেই কেটে যাবে। হেথায় এসেছি ক দিনের তরে। তারও নিরেট চারটি ঘণ্টা মেরে দিয়েছে জুরিক। কনেকশন ছিল না বলে। আমি
লিজেল বাধা দিয়ে বললে, চল্লিশ বৎসর পূর্বে প্রাথমিক পরিচয়ে তোকে যে একটা আকাট মূর্খ ঠাউরেছিলুম সেটা কিছু ভুল নয়; কলোনের দফতরে তোর প্র্যাকটিকাল বুদ্ধি ব্যত্যয়। অবশ্য আমি কখনও বলিনে, একসেপশন প্রভজ দি রুল। আমি বলি, রুল ভজ দি একসেপশন। তোর সুটকেস তারাই এখানে পৌঁছে দেবে।
.
ওহ! কী আনন্দ, কী আনন্দ। কাল রাত্রে ভয়ে ভয়ে আমি আমার হারিয়ে না-যাওয়া সুটকেসটি খুলিনি। যদি দেখি, এদের এবং আমার অন্যান্য বন্ধুবান্ধবের জন্য ছোটখাটো যেসব সওগাত এনেছি সেগুলো ওই বড় সুটকেসটিতে নেই! এটাকেই নাকি বিদেশি ভাষায় বলে অসট্রিচ মনোবৃত্তি।
ইতোমধ্যে বাড়ির সদর দরজাতে ঘা পড়ল। লিজেল সেথায় গিয়ে কী যেন কথাবার্তা কইল। মিনিট দুই পরে সেই হারিয়ে-যাওয়া-ফিরে-পাওয়া সুটকেসটি নিয়ে এসে আমার সামনে রেখে বললে, তোদের অ্যার-কোম্পানি তো বেশ স্মার্ট : কম্পিটেন্ট। এত তড়িঘড়ি হুলিয়া ছেড়ে, বাক্সটাকে ঠিক ঠিক পকড় করে তোর কাছে পৌঁছে দিল! আমার ছাতি সুশীল পাঠক, ইঞ্চি ছয়–মাফ করবেন আজকাল নাকি তাবৎ মাপ সেন্টিমিটার মিলিমিটারে বলতে হয় অর্থাৎ ১৫ মিলিমিটার (কিংবা সেন্টিমিটারও হতে পারে আমার প্রিন্স অব, ওয়েলস অর্থাৎ বড় বাবাজি যে ইসকেলখানা রেখে দিয়ে ঢাকা চলে গিয়েছেন সেটাতে তার হদিস মেলে না) ফুলে উঠল।
বাকসোটা খুলে দেখি, আমার মিত্র যেসব বস্তু খাদি প্রতিষ্ঠান থেকে কিনে দিয়েছিল তার সবই রয়েছে। (১) বারোখানা মুর্শিদাবাদি রেশমের স্কার্ফ, (২) উড়িষ্যায় মোষের শিঙে তৈরি ছটি হাতি, (৩) পূর্ববৎ ওই দেশেরই তৈরি পিঠ চুলকানোর জন্য ইয়া লম্বা হাতল, (৪) দশ বান্ডিল বিড়ি (এগুলো অবশ্য লিজেল পরিবারের জন্য নয়; এগুলো আমার অন্য বন্ধুর জন্য), (৫) ভিন্ন ভিন্ন গরম মশলা এবং আচার, (৬) বর্ধমানের রাজপরিবারের আমার একটি প্রিয় বান্ধবীর দেওয়া একখানি মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম স্কার্ফ (তার শর্ত ছিল সেটি যেন আমি আমার সর্বশ্রেষ্ঠা বান্ধবীকে দিই), (৭) তিনটি ফার্স্টক্লাস বেনারসি রেশমের টাই, কাশ্মিরের ম্যাংগো ডিজাইনের শালের মতো এগুলো বর্ধমানেরই দেওয়া, (৮) দুই-পৌন্ড দক্ষিণ ভারতের কফি ও পূর্ববৎ ওজনে দার্জিলিঙের চা।… এবং একখানা বই ঠাকুর রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে তার এক বিশেষ পূজারিণীর জন্য, তিনি বাস করেন সুইটজারল্যান্ডে। আর কী কী ছিল ঠিক ঠিক মনে পড়ছে না। বেশ কিছু কাসুলোও ছিল। এই ইউরোপীয়ানদের বড্ডই দেমাক, তাদের মাস্টার্ড নিয়ে। দম্ভজনিত আমার উদ্দেশ্য ছিল, এদেরকে দেখানো যে আমাদের বাঙলা দেশের কাসুন্দো এ-লাইনে অনির্বচনীয়, অতুলনীয়। পাউডার দিয়ে তৈরি ওদের মাস্টার্ড দু দিন যেতে না যেতেই মনে ধরে সবুজ হয়ে অখাদ্যে পরিবর্তিত হয়। আর আমাদের কান্দো? মাসের পর মাস নির্বিকার ব্রহ্মের মতো অপরিবর্তনশীল।
লিজেলকে বললুম, দিদি, এসব জিনিস ওই বড় টেবিলটার উপর সাজিয়ে রাখ। আর খবর দে ডিটরিষ ও তার বউকে। মারিয়ানা আর তুই তো আছিসই। যার যা পছন্দ তুলে নেবে।
লিজেল বললে, এটা কি ঠিক হচ্ছে এখান থেকে তুই যাবি ডুসলডর্কে– সেখানে তোর বন্ধু পাউল আর তার বউ রয়েছে। তার পর যাবি হামবুর্গে; সেখানে তোর বান্ধবীর (তিনি গত হয়েছেন) তিনটি মেয়ে রয়েছেন। তার পর যাবি স্টুটগার্ট-এ। সেখানে রয়েছেন তোর ফার্স্ট লভ। এখানেই যদি ভালো ভালো সওগাত বিলিয়ে দিস তবে ওরা পাবে কী?
একেই বঙ্গভাষায় বলে, পাকা গৃহিণী। কোন গয়না কে পাবে জানে ॥
.
১৫.
গডেসবের্গ সত্যই বড় সুন্দর। এ শহরের সৌন্দর্য আমাকে বার বার আহ্বান করেছে। রাস্তাগুলো খুবই নির্জন। এতই নির্জন যে পথে কারও সঙ্গে দেখা হলে, সে সম্পূর্ণ অচেনা হলেও, আপনাকে অভিবাদন জানিয়ে বলবে, গুটেন টাহু। আপনিও তাই বলবেন। রাস্তার দু পাশে ছোট ছোট গেরস্ত-বাড়ি। সবাই বাড়ির সামনে যেটুকু ফাঁকা জায়গা আছে তাতে ফুল ফুটিয়েছে। যদি কোনও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আপনি ফুলগুলোর দিকে মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে থাকেন তবে প্রায়ই বাড়ির কর্তা কিংবা গিন্নি কিংবা তাদের ছেলেমেয়েদের একজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপনার সঙ্গে কথা জুড়ে বসবে। শেষটায় বলবে, আপনিও আমাদেরই একজন; কিছু ফুলটুল চাই বলুন না, কোনগুলো পছন্দ হয়েছে। তার পর একগাল হেসে হয়তো বলবে, প্রেমে পড়েছেন নাকি? তা হলে লাল ফুল। হাসপাতালে রুগী দেখতে যাচ্ছেন নাকি? তা হলে সাদা ফুল। আমি একবার শুধিয়েছিলুম, আর যদি আমার প্রিয়ায় সঙ্গে ঝগড়া হয়ে থাকে, তা হলে কী ফুল পাঠাব? যাকে শুধিয়েছিলুম তিনি দু গাল হেসে বলেছিলেন, সবুজ ফুল। সবুজ ঈর্ষার রঙ। আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, সবুজ ফুল তো এদেশে দেখিনি কখনও। আমাদের দেশেও সবুজ ফুল একেবারেই বিরল। ভদ্রলোক বললেন, আমাদের দেশেও। কিন্তু আমাদের এক প্রতিবেশীর বাড়িতে সবুজ ফুল আছে। আমি এখুনি এনে দিচ্ছি। ও মশাই, দাঁড়ান দাঁড়ান, আমার সবুজ ফুলের তেমন কোনও প্রয়োজন নেই– ও মশাই–
কিন্তু কে বা শোনে কার কথা!
মিনিট দুই যেতে না যেতেই সেই মহাত্মার পুনরাবির্ভাব। হাতে একটি সবুজ গোলাপ। চোখে মুখে যে আনন্দ তার থেকে মনে হল তিনি যেন বাকিংহাম প্রাসাদ কিংবা কুতুবমিনার কিংবা উভয়ই কুড়িয়ে এনেছেন। আমি বিস্তর ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, ডাঙ্কে শ্যোন, ডাঙ্কে রেষট শ্যোন’ বলে অজস্র ধন্যবাদ জানালুম।
ইতোমধ্যে বাড়ির দরজা খুলে গেল। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের একটি মহিলা ডেকে বললেন, ওগো, তোমার কফি
হঠাৎ আমাকে দেখে কেমন যেন চুপসে গেলেন।
ভদ্রলোক বললেন, চলুন না। এক পাত্র কফি– হেঁ হেঁ-
আমি বললুম, কিন্তু আপনার গৃহিণী–?
না, না, না, আপনি চিন্তা করবেন না। আমার গৃহিণী খাণ্ডারিণী নয়। অবশ্য সে আপনাকে কখনও দেখেনি। চলুন চলুন।
বসার ঘরে ঢুকে ভদ্রলোক আমাকে কফি টেবিলের পাশে সযত্নে বসিয়ে বললেন, আপনাকে চল্লিশ বৎসর পূর্বে কত না দেখেছি। আমার বয়স তখন চৌদ্দ-পনেরো। কিন্তু ভয়ে আপনার সঙ্গে পরিচয় করতে পারিনি।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, সে কী?
এজ্ঞে আমি জানতুম, আপনি ইন্ডিয়ান। আর ইন্ডিয়ানরা সব ফিলসফার। তারা যত্রতত্র যার-তার সঙ্গে কথা কয় না। তাই। আপনি ধীরে ধীরে পা ফেলে ফেলে যেতেন রাইন নদের পারে। আমি কত না দিন আপনার পিছন পিছন গিয়েছি। আপনি একটি বেঞ্চিতে বসে রাইনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেন ভাবতেন। তখন কি আর বিরক্ত করা যায়?
আমি বললুম, ব্রাদার, এটা বড় ভুল করেছ। তখন আমার সঙ্গে কথা কইলে বড়ই। খুশি হতুম।
ইতোমধ্যে বাড়ির গৃহিণী কেক ইত্যাদি নিয়ে এসে আমাদের টেবিলে রাখলেন। তাঁর গালদুটো আরও লাল হয়ে গিয়েছে, ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরছে এবং তিনি হাঁপাচ্ছেন। অর্থাৎ এ পাড়ায় কোনও কেকের দোকান নেই বলে তিনি কুড়ি মিনিটের রাস্তা ঠেঙিয়ে কেক টার্ট নিয়ে এসেছেন।
এস্থলে যে কোনও ভদ্রসন্তান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মাফ চাইত। বলত, এ সবের কী প্রয়োজন ছিল? কিন্তু আমি চাইনি। আমাকে বেয়াদব, মূর্খ, যা খুশি বলতে পারেন।
আমি শুধু আমার পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে তাঁর কপালটি মুছে দিলুম।
.
১৬.
হুমবলট স্টিফটুঙ
ভ্রমণকাহিনী লিখতে লিখতে মানুষ আশকথা পাশকথার উত্থাপন করে। গুণীরা বলেন এটা কিছু দুষ্কর্ম নয়। সদর রাস্তা ছেড়ে পথিক যদি পথের ভুলে আশপথ পাশপথে না যায় তবে অচেনা ফুলের, নয়া নয়া পাখির সঙ্গে তার পরিচয় হবে কী প্রকারে? কবিগুরুও বলেছেন,
যে পথিক পথের ভুলে
এল মোর প্রাণের কূলে—
অর্থাৎ প্রণয় পর্যন্ত হতে পারে। তাই আমি যদি মাঝে-মধ্যে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ি তবে সহৃদয় পাঠক অপরাধ নেবেন না।
আলেকজান্ডার ফন্ হুমূবটের নাম কে না শুনেছে? নেপোলিয়ন গ্যোটে শিলারের সমসাময়িক। দুই কবির সঙ্গে তার ভাবের আদান-প্রদান হত। এবং অনেকেই বলেন, ওই সময়ে পাশ্চাত্য মহাদেশগুলোতে নেপোলিয়নের পরেই ছিল হুম্বটের সুখ্যাতি। আসলে তিনি ছিলেন বৈজ্ঞানিক এবং পর্যটক ওদিকে কাব্য, দর্শন, অলঙ্কারশাস্ত্রের সঙ্গেও সুপরিচিত।
কিন্তু তার পরিপূর্ণ পরিচয় দেওয়া আমার শক্তির বাইরে এবং সে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এ লেখাটি আরম্ভও করিনি।
হুমবলট গত হন ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। যেহেতু তিনি ভিন্ন ভিন্ন দেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক যোগাযোগের জন্য (দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ককেশাস সাইবেরিয়া পর্যন্ত) অতিশয় সযত্নবান ছিলেন তাই ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বার্লিনের জর্মন পররাষ্ট্র দফতরের উৎসাহে ওই দেশের জনসাধারণ একটি প্রতিষ্ঠান এন্ডাওমেন্ট দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর, ওয়াকফ, যা খুশি বলতে পারেন নির্মাণ করল : নাম আলেকজান্ডার ফন্ হুমবলট স্টিটু। তাদের একমাত্র কর্ম তখন ছিল বিদেশি ছাত্রদের বৃত্তি দিয়ে জর্মনিতে পড়াশুনো করার ব্যবস্থা করে দেওয়া। আমার বড়ই বিস্ময় বোধ হয়, জর্মনির ওই দুর্দিনে (ইনফ্লেশন সবে শেষ হয়েছে; তার খেয়ারি তখনও কাটেনি) সে কী করে এ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করল? আমরা বলি আপনি পায় না খেতে–। অনেক চিন্তা করে বুঝেছিলুম, দয়াদাক্ষিণ্য আর্থিক সচ্ছলতার ওপর নির্ভর করে না। লক্ষপতি ভিখিরিকে একটা কানাকড়ি দেয় না, অথচ আমি আপন চোখে দেখেছি এক চক্ষুষ্মন ভিখিরি এক অন্ধ ভিখিরিকে আপন ভিক্ষালব্ধ দু-চার আনা থেকে দু-পয়সা দিতে। আমার এক চেলা এদানীং আমাকে জানাল গঙ্গাস্বরূপা ইন্দিরাজিও নাকি বলছেন, গরিবই গরিবকে মদত দেয়।
সে আমলে ইন্ডিয়া পেত মাত্র একটি স্কলারশিপ আজ অনেক বেশি পায়।*[* দয়া করে আমাকে প্রশ্ন শুধিয়ে চিঠি লিখবেন না, কী কৌশলে এ স্কলারশিপ পাওয়া যায়।] সেটি পেলেন আমার বন্ধু সতীর্থ বাসুদেব বিশ্বনাথ গোখলে।**[** দয়া করে গোখেল উচ্চারণ করবেন না।] ইনি সর্বজনপূজ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রাতঃস্মরণীয় ঈশ্বর গোখলের ভ্রাতুস্পুত্র। তার চার বত্সর পর পেলুম আমি। সেকথা থাক। মাঝে মাঝে গাধাও রাজমুকুট পেয়ে যায়।..
গোডেসবের্গ শহরের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দেখি, একটি বাড়ির সম্মুখে মোটা মোটা হরফে লেখা,
আলেকজান্ডার ফন
হুমবলট স্টিফটুঙ
আমারে তখন আর পায় কে? লম্বা লম্বা পা ফেলে তদ্দণ্ডেই সে বাড়িতে উঠলুম।
আমি অবশ্যই আশা করিনি যে সেই চল্লিশ বৎসর পূর্বেকার লোক এ আপিস চালাবেন।
কিন্তু এনারাও ভদ্রলোক। অতিশয় ভদ্রভাবে শুধোলেন,
আপনি কোন সালে হুমবলট বৃত্তি পেয়েছিলেন?
১৯২৯।
ভদ্রলোক যেন সাপের ছোবল খেয়ে লম্ফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
আমিও তাজ্জব বনে গিয়ে বললুম, কী হল?
কী! চল্লিশ বছর পূর্বে।
এজ্ঞে হ্যাঁ।
মাইন গট (মাই গড), এত প্রাচীন দিনের কোনও স্কলারশিপ-হোল্ডারকে আমি তো কখনও দেখিনি!
আমি একটুখানি সাহস পেয়ে বললুম, ব্রাদার, ইহ-সংসারে তুমিও অনেক কিছু দেখনি, আঘো দেখিনি। তুমি কি আপন পিঠ কখনও দেখেছ? তাই কি সেটা নেই?
.
যেহেতু আমি এ বাড়িতে ঢোকার সময় আমার ভিজিটিং কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, তাই তারা ইতোমধ্যে চেক-আপ করে নিয়েছে, আমি সত্য সত্যই ১৯২৯-এ স্কলারশিপ পেয়ে এ দেশে এসেছিলুম।
হঠাৎ ভদ্রলোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
অ– অ- অ। জানেন, আপনি আমাদের প্রাচীনতম স্কলারশিপ-হোল্ডার?
আমি সবিনয় বললুম, তা হলে আমাকে আপনাদের প্রাচ্যদেশীয় জাদুঘরে পাঠিয়ে দিন। টুটেনখামের মমির পাশে কিংবা রানি নফ্রেটাট্রর পাশে আমাকে শুইয়ে দাও।
.
১৭.
সুইটজারল্যান্ড, জর্মনি, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেনে টাকাকড়ির এমনই ছড়াছড়ি, সে কড়ি কী করে খরচ করবে যেন সেটা ভেবেই পায় না। বিশ্বময় সঠিক বলতে পারব না, তবে বোধ হয় চীন এবং লৌহ-যবনিকার অন্তরালের দেশগুলো এখনও অপাঙক্তেয়। গণ্ডায় গণ্ডায় স্কলারশিপ ছড়ানোর পরও হুম্ব ওয়াফের হাতে বেশকিছু টাকা বেঁচে যায়।
তাই তারা প্রতি বৎসর একটা জব্বর পরব করে। তিন দিন ধরে। জর্মনিতে যে শত শত হুমবলট স্কলার ছড়িয়ে আছে এবং যারা একদা স্কলার ছিল, উপস্থিত জৰ্মনিতেই কাজকর্ম করে পয়সা কামাচ্ছে, তাদের সব্বাইকে তিন দিনের তরে বাড় গডেসবের্গে নেমন্তন্ন জানায়। যারা বিবাহিত, তাদের বউ কাচ্চাবাচ্চাসহ;- বলা বাহুল্য ওই উপরোক্ত সম্প্রদায়, যারা কাজকর্ম করে পয়সা কামায়। আসা-যাওয়ার ট্রেনভাড়া, হোটেলের খাইখর্চা, তিন দিন ধরে নানাবিধ মিটিং পরব নৃত্যগীত অনুষ্ঠানে যাবার জন্য মোটরগাড়ি– এক কথায় সব– সব। প্রাচীন দিনে আমাদের দেশে যেরকম জমিদারবাড়িতে বিয়ের সময় দশখানা গায়ের বাড়িতে তিন দিন ধরে উনুন জ্বালানো হত না।
হার পাপেনফুস্ স্টিফটুঙের অন্যতম কর্তাব্যক্তি। আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে বললেন, আপনার তুলনায় জর্মনিতে উপস্থিত যেসব প্রাক্তন স্কলার আছেন তাঁরা নিতান্তই শিশু।
আমি বললুম, আমার হেঁটোর বয়স।
পাপেনফুস ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। অর্থাৎ বুঝতে পারেননি। সব দেশের ইডিয়ম, প্রবাদ তো একই ছাঁচে তৈরি হয় না। আমি বুঝিয়ে দেওয়ার পর বললুম, আমাকে যে আপনাদের পরবে নিমন্ত্রণ করেছেন তার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আপনাদের পরব আসছে সপ্তাহ তিনেক পরে। ওদিকে আমাকে যেতে হবে কলোন, ডর্ফ, হামবুর্গ, স্টুটগার্ট এবং সর্বশেষে স্টুটগার্ট থেকে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে পাড়াগাঁয়ে আমার প্রাচীন দিনের এক বিধবা বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে। আমরা একসঙ্গে পড়াশুনো করেছি। তার অর্থ আমার স্কলারশিপের মতো তিনিও চল্লিশ বছরের পুরনো- প্লাস তার বয়স।
লক্ষ করলুম, যে তৃতীয় ব্যক্তি সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন তার চোখে ঠোঁটে কেমন যেন একটুখানি মৃদু হাসি খেলে গেল। এর অর্থ হতে পারে :
(১) এ তো বড় আশ্চর্য। ষাট বছর বয়সের প্রাচীনা প্রিয়ার অভিসারে যাচ্ছে এই নাগর।
কিংবা
(২) এর এক-প্রিয়া-নিষ্ঠতাকে তো ধন্যি মানতে হয়।
(রামচন্দ্রকে বলা হয় একদারনিষ্ঠ)।
ইতোমধ্যে কর্তা বললেন, সে কী কথা। আপনি আসবেন না, সে তো হতেই পারে না। আপনার ভাষায়ই বলি, আপনার মতো মিউজিয়ম পিস আমাদের কর্তাব্যক্তিদের গুণীজ্ঞানীদের দেখাতে পারব না, সে কি একটা কাজের কথা হল? ওনাদের অনেকেই ভাবেন, আমাদের আলেকজান্ডার ফন্ হুমবট স্টিফটুঙ বুঝি পরশু দিনের বাচ্চা। অথচ আমাদের প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করে সেই ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে অবশ্য যুদ্ধের ফলস্বরূপ জর্মনি যখন তছনছ হয়ে গেল তখন কয়েক বৎসর প্রতিষ্ঠান দেউলে হয়ে রইল। এদের আমি দোষ দিইনে–সব জর্মনই তো ঐতিহাসিক মসজেন হয় না। অতএব চল্লিশ বছরের পূর্বেকার জলজ্যান্ত একজন বৃত্তিধারীকে যদি ওদের সামনে তুলে ধরতে পারি, তখন হুজুরদের পেত্যয় যাবে।
আমি মনে মনে বললুম, ঈশ্বর রক্ষতু। যাদুঘরে যেরকম পেডেস্টালের উপর গ্রিক মূর্তি খাড়া করে রাখে, সেরকম নয় তো! তা করুক, কিন্তু জামাকাপড় কেড়ে নিয়ে লজ্জা নিবারণার্থে কুল্লে একখানা ডুমুরপাতা পরিয়ে দিলেই তো চিত্তির—
কর্তা বলে যেতে লাগলেন, আপনি পরবের সময় কন্টিনেন্টে যেখানেই থাকুন না কেন, আমরা সানন্দে আপনাকে একখানা রিটার্ন টিকিট পাঠিয়ে দেব। এখানে হোটেলের ব্যবস্থা, যানবাহন সবই তো আমরা করে থাকি। তার পর আপনি ফিরে যাবেন আপন মোকামে। বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন, আপনি কি মাত্র তিনটি দিনও স্পেয়ার করতে পারবেন না… আচ্ছা, তবে এখন চলুন আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে।
বড়ই নেমকহারামি হয়। তদুপরি এরা আমাকে দুই যুগ পরে আবার নেমক দিতে চায়। একদা যে প্রতিষ্ঠান, যে জর্মন জাত এই তরুণকে স্কলারশিপ-নেমক দিয়েছিলেন, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে, তাদেরকে নিরাশ করি কী প্রকারে?
আমি সকৃতজ্ঞ পরিপূর্ণ সম্মতি জানালুম।
.
রেস্তোরাঁটি সাদামাঠা, নিরিবিলি ছোটখাটো ঘরোয়া। ব্যান্ডবাদ্যি, জ্যাজু মুজিক, খাপসুরৎ তরুণীদের ঝামেলা কোনও উৎপাতই নেই। বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না যে এ রেস্তোরাঁতে আসেন নিকটস্থ আপিস-দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা। তার অন্যতম প্রধান কারণ মেনু (খাদ্যনির্ঘণ্ট) দেখেই আমার চক্ষুস্থির। ত্বরিতেই হিসাব করে দেখলুম এখানে অতি সাধারণ লাঞ্চ খেতে হলেও নিদেন পনেরো মার্ক লাগবার কথা। আমাদের হিসাবে তিনখানা করকরে দশ টাকার নোট! অবশ্য গচ্চাটা আমাকে দিতে হবে না। কারণ ওঁরা আমাকে নিমন্ত্রণ করে এনেছেন। এবং এ দেশের রেস্তোরাঁতে যে ব্যক্তি অর্ডার দিল সে-ই পেমেন্ট করবে– যে খেল তার কোনও দায় নেই।
কিন্তু এস্থলে সেটা তো কোনও কাজের কথা নয়।
যারা আমাকে নিমন্ত্রণ করে এনেছেন তাঁরা আমাকে মেনু এগিয়ে দিয়ে বলেছেন, কী খাবেন, বলুন। আমি কি তখন তাদের ঘাড় মটকাব!
আমি শুধোলম, আপনারা কি এই রেস্তোরাঁতেই প্রতিদিন লাঞ্চ খেতে আসেন?
এজ্ঞে হ্যাঁ।
কী খান; মানে, কোন কোন পদ।
সুপ, মাংস আর পুডিং। কখনও-বা আইসক্রিম- তবে সেটা বেশিরভাগ গ্রীষ্মকালে। মাঝেমধ্যে শীতকালেও!
আমি অবাক হয়ে শুধোলুম, শীতকালে আইসক্রিম!
তখন আমার মনে পড়ল, আমরাও তো দারুণ গরমের দিনে গরমোতর চা খাই। তবে এরাই-বা শীতকালে আইসক্রিম খাবে না কেন?
আমি অতিশয় সাদামাঠা লাঞ্চ অর্ডার দিলাম। যে হাঁস সোনার ডিম পাড়ে তার গলা মটকাতে নেই।
.
১৮.
আহারাদির কেচ্ছা শুরু হলেই আমি যে বে-এক্তেয়ার হয়ে যাই আমার সম্বন্ধে সে বদনাম এতই দীর্ঘকালের যে, তার সাফাই এখন বেবাক তামাদি– ইংরেজি আইনের ভাষায় টাইম-বার না কী যেন বলে–হয়ে গিয়েছে। তাই পাঠক ধর্মাবতারের সমুখে করজোড়ে স্বীকার করে নিচ্ছি আমি দোষী, অপরাধ করেছি।
কিন্তু আমি জাত-ক্রিমিনাল। আমার মিত্র এবং পৃষ্ঠপোষক জনৈক জেল-সুপারিনটেনডেন্ট তার একাধিক প্রামাণিক পুস্তকে লিখেছেন, এই বঙ্গদেশে জাত-ক্রিমিনাল হয় না। হু! আমি যে জাত-ক্রিমিনাল সেটা জানার পূর্বেই তিনি এসব দায়িত্বহীন বাক্যবিন্যাস করেছেন। তাই আমি আবার সেই লাঞ্চের বর্ণনা পুনরায় দেব।
সুপ আমি বড় বেশি একটা ভালোবাসিনে।
এ বাবদে কিন্তু আমি সমুদ্রের বেলাভূমিতে সম্পূর্ণ একাকী নুড়ি নই। ডাচেস অব উইন্ডসর (উচ্চারণ নাকি উইনজার) অতি উত্তম রান্নাবান্না করতে পারেন। তা সে অনেকেই পারেন। কিন্তু তিনি আরেকটি ব্যাপারে অসাধারণ হুনুরি। ভোজনটি কী প্রকারে কমপোজ করতে হবে– এ তত্ত্বটি তিনি খুব ভালো করে জানেন।
অপরাধ নেবেন না। আমরা বাঙালি মাত্রই ভাবি, ভোজনে যত বেশি পদ দেওয়া হয়। ততই তার খানদানিত্ব বেড়ে যায়। তিন রকমের ডাল, পাঁচ রকমের চচ্চড়ি, তিন রকমের মাছ, দু-তিন রকমের মাংস, চিনি-পাতা দই আর কত হরেক রকমের মিষ্টি তার হিসাব না-ই বা দিলুম।
আর প্রায় সবকটাই অখাদ্য! কারণ, এতগুলো পদের জন্য তো এতগুলো উনুন করা যায়, গোটা দশেক পাঁচক ডাকা যায় না। অতএব বেগুনভাজা মেগনোলিয়ার আইসক্রিমের মতো হিম, চিনি-পাতা দই পাঞ্জাব মেলের এনজিনের মতো, গরম লুচি কুকুরের জিভের মতো চ্যাপটা, লম্বা–খেতে গেলে রবারের মতো। আজকাল আবার ফ্যাশন হয়েছে ঘি-ভাত বা পোলাউয়ের বদলে চীনা ফ্রাইড রাইস। চীনারা র উচ্চারণ করতে পারে না। অতএব বলে ফ্রাইড লাইস- অর্থাৎ ভাজা উকুন! তা সে যে উচ্চারণই করুক আমার তাতে কানাকড়ি মাত্র আপত্তি নেই। শুনেছি, মহাকবি শেক্সপিয়ার বলেছেন, গোলাপে যে নামে ডাকো গন্ধ বিতরে। তাই ফ্রাইড রাইস বলুন বা ফ্রাইড লাইসই বলুন–সোওয়াদটি উত্তম হলেই হল। কিন্তু আজকালকার কেটারাররা (হে ভগবান, এই সম্প্রদায়কে বিনষ্ট করার জন্য আমি চেঙ্গিস হতে রাজি আছি) নেটিভ পাঁচক দিয়ে ফ্রাইড লাইস নির্মাণ করেন। সত্য সত্য তিন সত্য বলছি, যে মহামূল্য সম্পদ জিহ্বাগ্র স্পর্শ করার পূর্বেই আপনি বুঝে যাবেন এই অভূতপূর্ব বস্তু উকুন ভাজা। আলবৎ আমি নতমস্তকে স্বীকার করছি, উকুন ভাজা আমি এই কেটারার-সম্প্রদায়ের অবদান মেহেরবানির পূর্বে কখনও খাইনি। তাই গোড়াতেই বলেছি, আমরা মেনু কম্পোজ করতে জানিনে।
তা সে থাক, তা সে যাক। পরনিন্দা মহাপাপ। এখানেই ক্ষান্ত দিই। বয়স যত বাড়ে মানুষ ততই খিটখিটে হয়ে যায়।
পুরনো কথায় ফিরে যাই। ডাচেস অব উইনজার নাকি তার লাঞ্চ-ডিনারে নিমন্ত্রিতজনকে কখনও সুপ পরিবেশন করেন না। অতিশয় অভিজ্ঞতালব্ধ তার বক্তব্য: এই যে বাবুরা এখন ডিনার খেতে যাবেন তার আগে তেনারা গিলেছে গ্যালন গ্যালন ককটেল, হুইস্কি। জালা জালা শেরি, পোর্ট। সক্কলেরই পেট তরল বস্তুতে টইটম্বুর– ছয়লাপও বলতে পারেন। ডাচেসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাপ্রসূত সুচিন্তিত অভিমত : এর পরও যদি হুজুররা তরল দ্রব্য সুপ পেটে ঢোকান তবে, তার পর আর রোস্ট ইত্যাদি নিরেট সলিড দ্রব্য খাবেন কী প্রকারে? তাই তার ডিনারে নো সুপ? অবশ্য ডাচেস সহৃদয়া মহিলা। কাজেই যারা নিতান্তই সুপাসক্ত তাদের জন্য সুপ আসে। ওদেরকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য তিনিও মাঝে মাঝে দু-চার চামচ সুপ গলাতে ঢালেন।
অতএব আমাকেও নিতান্ত সঙ্গ দেওয়ার জন্য হুমবলট স্টিফটুঙ প্রদত্ত লাঞ্চে কিঞ্চিৎ সুপ সেবন করতে হল।
বাহ্! উত্তম সুপ! ব্যাপারটা তা হলে ভালো করে বুঝিয়ে বলি।
যেসব দেশের কলোনি নেই–বিশেষ ভারত, সিংহল কিংবা ইন্দোনেশিয়ার–তারা গরম মশলা পাবে কোত্থেকে? কেনার জন্য অত রেস্ত কোথায়? শত শত বৎসর ধরে তাদের ছোঁকছোঁকানি শুধু গোলমরিচের জন্য। শুনেছি, ভাস্কো দা গামা ওই গোলমরিচের জন্য অশেষ ক্লেশ করে দক্ষিণ ভারতে এসেছিলেন। কোনও কোনও পণ্ডিত বলেন, কলমবসও নাকি ওই একই মতলব নিয়ে সাপ খুঁজতে গিয়ে কেঁচো পেয়ে গেলেন– অর্থাৎ ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে গিয়ে আমেরিকায় পৌঁছে গেলেন। এর পর ইউরোপীয়রা দক্ষিণ আমেরিকায় ঝাল লাল লঙ্কা আবিষ্কার করল, কিন্তু ওটা ওদের ঠিক পছন্দ না। যদ্যপি আমরা ভারতীয়রা সেটি পরামানন্দে আলিঙ্গন করে গ্রহণ করলুম।
ইতিহাস দীর্ঘতর করব না।
ইতোমধ্যে জর্মনির এতই ধনদৌলত বেড়ে গিয়েছে যে, এখন সে শুধু কালা মরিচ কিনেই পরিতৃপ্ত নয়– এখন সে কেনে দুনিয়ার যত মশলা। বিশেষ করে কারি পাউডার আর লবঙ্গ, এলাচি, ধনে ইত্যাদির তো কথাই নেই। তবে কি না আমি কন্টিনেন্টের কুত্রাপি কাঁচা সবুজ ধনেপাতা দেখিনি। কিন্তু ভয় নেই, কিংবা ভয় হয়তো সেখানেই। যেদিন কন্টিনেন্টের কুবের সন্তানরা ধনে-পাতা-লঙ্কা-তেঁতুল-তেলের চাটনির সোয়াদটা বুঝে যাবেন, সেদিন হবে আমাদের সর্বনাশ। হাওয়াই জাহাজের কল্যাণে কুল্লে ধনে-পাতা হিল্লি-দিল্লি হয়ে চলে যাবেন কাঁহা কাহা মুল্লুকে। এটা তো এমন কিছু নয়া অভিজ্ঞতা নয়। ভারত বাংলাদেশের বহু জায়গাতেই আজ আপনি আর চিংড়িমাছ পাবেন না। টিনে ভর্তি হয়ে তারা আপনার উদরে না এসে সাধনোচিত ধামে (অর্থাৎ কন্টিনেন্টে– সেখানে চিংড়িমাছ কেন, সর্ব ভারতীয় যুবকই যেতে চায়) প্রস্থান করেন। একমাত্র কোলাব্যাঙ সম্বন্ধেই আমাদের কোনও দুঃখ নেই। যাক, যত খুশি যাক। এটা ফরাসিদের বড়ই প্রিয় খাদ্য। তবে কি না বাঙালোর থেকে তারস্বরে এক ভদ্রলোক প্রতিবাদ করেছেন, পাইকিরি হিসেবে এভাবে কোলাব্যাঙ বিদেশে রফতানি করার ফলে ওই অঞ্চলে মশার উৎপাত দুর্দান্তরূপে বৃদ্ধি পেয়েছে; কারণ ওই কোলাব্যাঙরাই মশার ডিম খেয়ে তাদের বংশবৃদ্ধিতে বিঘ্নসৃষ্টি করত।
এটা অবশ্যই সমস্যা দুশ্চিন্তার বিষয়। কিন্তু আমার ভাবনা কী? আমার তো একটা মশারি আছে।
.
১৯.
গুরুমে ভোজনরসিকরা বলেন, সুইটজারল্যান্ডের জর্মনভাষী অঞ্চলের খাদ্যই সবচেয়ে ভেঁতা। অথচ নেপোলিয়ন না কে যেন বলেছেন– ইংরেজ এ নেশন অব শপকিপারজ (অবশ্য ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে সাকি নামক ছদ্মনামের এক অতিশয় সুরসিক ইংরেজ লেখক বলেন, আমরা এখন এ নেশন অব শপলিটার অর্থাৎ আমরা এখন দোকানের ভিড়ে চটসে এটা-ওটা-সেটা চুরি করাতে ওস্তাদ) এবং সুইসরা এ নেশন অব হোটেলকিপারস। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে তাবৎ ইউরোপে সুইসরাই পরিচ্ছন্নতম হোটেল রাখে কিন্তু প্রশ্ন : তোমার হোটেল-রেস্তোরাঁ যতই সাফসুরো রাখো না কেন তোমার রেস্তরার সুপে ব্লন্ড, ব্রুনেট, কালো চুল না পাওয়া গেলেও (দিনের পর দিন তিন রঙের চুল আবিষ্কার করতে করতে আমার এক মিত্র– সুইটজারল্যান্ডে নয়, অন্য এক নোংরা দেশের হোটেলে–একদিন ম্যানেজারকে শুধোলেন, আপনার রান্নাঘরে তিনটি পাচিকা আছেন, না? একজনের চুল ব্লভ, অন্যজনের ব্রুনেট এবং তেসরা জনের কালো। নয় কী? ম্যানেজার তো থ। এই ভদ্রলোকই কি তবে শার্লস হোমসের বড় ভাই মাইক্রফট হোমস। সবিনয়ে তথ্যটা স্বীকার করে শুধাল, স্যার, আপনি জানলেন কী করে? আপনি তো আমাদের রসুইখানায় কখনও পদার্পণ করেননি! বন্ধু বললেন, সুপে কোনও দিন ব্লন্ড, কখনও-বা ব্রুনেট এবং প্রায়ই কালো চুল পাই– কালোটাই পাতলা সুপে চোখে পড়ে বেশি। এ তত্ত্বে পৌঁছবার জন্য তো দেকার্ত-কান্ট-এর দর্শন প্রয়োজন হয় না। আমি বলছি ওই কালো চুলউলীকে যদি দয়া করে বলে দেন, সে যেন আর পাঁচটা হোটেলের পাঁচজন পাঁচকের মাথায় যেরকম টাইট সাদা টুপি পরা থাকে ওইরকম কোনও একটা ব্যবহার করে। আমার মনে হয় ওর মাথায় দুর্দান্ত খুসকি–পাঠক অপরাধ নেবেন না, এ কেচ্ছাটা বলার প্রলোভন কিছুতেই সম্বরণ করতে পারলুম না। সুন্দুমাত্র সুইস হোটেলের সুপমধ্যে হরেকরকম্বা চুল নেই বলেই যে দুনিয়ার লোক হমুদ্দ হয়ে সে দেশে আসবে এ-ও কি কখনও সম্ভবে? আমার সোনার দেশ পূর্বপচ্ছিমওতর বাঙলায় সুপ তৈরি হয় না। অতএব প্লাটিনাম ব্লন্ড, সাদামাটা ব্লন্ড, চেসনাট ব্রাউন, মোলায়েম ব্রাউন, কালো মিশকালো কোনও রঙের কোনও চুলের কথাই ওঠে না। মোটেই মা রাধে না, তার তপ্ত আর পান্তা। কিংবা বলতে পারেন, হাওয়ার গোড়ায় রশি বাঁধার মতো।) তাই বলে কি মার্কিন-সুইস টুরিস্ট এদেশে আসে না?
বিজনেস ইজ বিজনেস–তাই সুইস এ পর্যন্ত তাদের রান্নাতে প্রাচ্যদেশীয় মশলা ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে।
আমার কাছে একখানা সুইস সাপ্তাহিক আসে। তার কলেবর প্রায় ষাট পৃষ্ঠা। একদা কেউ ল্যাটে এলে আমরা ঠাট্টা করে বলতুম, কী বেরাদর, কেপ অব গুড হোপ হয়ে এলে নাকি?– সুয়েজ কানাল যখন রয়েছে। এখন কিন্তু এটা আর মস্করা নয়। অ্যার মেলের কথা অবশ্য ভিন্ন। কিন্তু ষাটপৃষ্ঠা বপুধারী পত্রিকা তো আর অ্যার মেলে পাঠানো যায় না। খর্চা যা পড়বে সেটা সাপ্তাহিকের দাম ছাড়িয়ে যাবে। হিন্দিতে বলে– লড়কে সে লড়কার শু ভারী-বাচ্চাটার ওজনের চাইতে তার মলের ওজন বেশি।
সেই পত্রিকার একটি প্রশ্নোত্তর বিভাগ আছে। কেউ শুধাল, মাংস আলু তরকারিসহ নির্মিত ভোজনের মেন ডিশ (পিয়েস দ্য রেজিসাস) খাওয়ার পর যেটুকু তলানি সস (শুকনো শুকনো ঝোল, কলকাত্তাইয়ারা কাইও বলে থাকে) পড়ে থাকে তার উপর পাউরুটি টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়ে, কাঁটা দিয়ে সেগুলো নাড়িয়ে চাড়িয়ে চেটেপুটে খাওয়াটা কি প্ৰতোকোলসম্মত– এটিকেট মাফিক, বেয়াদবি অভদ্রস্থতা নয় তো?
উত্তর : পৃথিবীতে এখন এমনই নিদারুণ খাদ্যাভাব যে, ওই সসটুকু ফেলে দেওয়ার কোনও যুক্তি নেই (অবশ্য তার সঙ্গে রুটির টুকরোগুলোও যে গেল সে বাবদে বিচক্ষণ উত্তরদাতা কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। কারণ রুটিটি পরের ভোজনেও কাজে লাগত, কিংবা গরিব-দুঃখীকেও বিলিয়ে দেওয়া যেত– এটো প্লেটের তলানি সস্ তো পরবর্তী ভোজনের জন্য বাঁচিয়ে রাখা যায় না, কিংবা গরিব-দুঃখীকেও বিলোনো যায় না– লেখক)। তার পর তিনি বলেছেন, কিন্তু আপনি যদি নিমন্ত্রিত হয়ে কোথাও যান তবে এই কার্পণ্যটি করবেন না। তার মানে আপনার বাড়ির বাইরের এটিকেট যেন বাড়ির ভিতরের চেয়ে ভালো হয়। আমি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্নমত ধরি। আমার মতে বাড়ির এটিকেট, আদব-কায়দা যেন বাইরের চাইতে ঢের ঢের ভালো হয়।
প্রশ্ন : কোহিনূর প্রস্তর কোন ভাষার শব্দ?
উত্তর : ফারসি।
(সম্পূর্ণ ভুল নয়। কোহ্ = পাহাড়–ফারসিতে। যেমন কাবুলের উত্তর দিকে কোহিস্তান রয়েছে (আমার সখা আব্দুর রহমান ওই কোহিস্তানের লোক)। কিন্তু কোহ-ই-নূরের নূর শব্দটি ন সিকে আরবি। খাঁটি ফারসিতে যদি বলতেই হয় তবে নূর-এর বদলে রওশন বা রোশনি বািঙলায় রোশনাই) ব্যবহার করে বলতে হয় কোহ-ই-রওশ। শুদ্ধ আরবিতে বলতে হলে জবলুন (পাহাড়) নূর।… কিন্তু এ রকম বর্ণসঙ্কর সমাস সর্বত্রই হয়ে থাকে। দিল্লীশ্বর ইত্যাদি।)
প্রশ্ন : আমার বয়স বত্রিশ; আমি বিধবা। আমার ষোলো বছরের ছেলের একটি সতেরো বছরের ভেরি ডিয়ার ক্লাসফ্রেন্ড প্রায়ই আমাদের এখানে আসে। কিন্তু কিছুদিন ধরে সে আমার সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা জমাবার চেষ্টা করছে। আমি করি কী?
উত্তর : আপনি ওকে সঙ্গোপনে নিয়ে গিয়ে বলুন, তুমি তোমার অল্পবয়সী মেয়েদের সঙ্গে প্রেমট্রেম কর। আমি তোমার মায়ের বয়সী। তোমার বয়সী মেয়ের তো কোনও অভাব নেই। কিন্তু আমার মনে হয়, ছেলেটার বোধহয় মাদার কমপ্লে আছে– অতি অল্প বয়সেই তার মা গত হন। কাজেই সে একটি মায়ের সন্ধানে আছে। তার পর আরও নানা প্রকারের হাবিজাবি ছিল।
এ উত্তর যে কোনও গোগর্দভ দিতে পারত।
কিন্তু এই প্রশ্নোত্তরমালা নিতান্তই অবতরণিকা মাত্র।
কয়েক মাস পূর্বে–মনে হল– একটি প্রাচীনপন্থি মহিলা–প্রশ্ন শুধালেন : আজকালকার ছেলে-ছোকরারা এমনকি মেয়েরাও বড় বেশি মশলাদার খানা খাচ্ছে। আমি গ্রামাঞ্চলে থাকি। সেদিন বাধ্য হয়ে আমাকে শহরে যেতে হয়। যদি জানতুম, শহরের মাই লর্ড রেস্তোরাঁওয়ালারা কী জঘন্য ঝাল, মাস্টার্ড (আমাদের কাসুন্দো– লেখক), আর মা মেরিই জানেন কী সব বিদকুটে বিকুটে বিজাতীয় মশলা দিয়ে যাবতীয় রান্না করেন, তবে কি আমি সে রেস্তোরাঁয় যেতুম। এক চামচ সুপ মুখে ঢালা মাত্রই আমার সর্বাঙ্গ শিহরিত হতে লাগল। আমার কপালে, সেই শীতকালে, ঘাম জমতে লাগল। মনে হল, আমার জিভে যেন কেউ আগুন ঢেলে দিয়েছে। আমার চোখ থেকে যা জল বেরুতে আরম্ভ করল সেটা দেখে আমার কাছেরই একটি সহৃদয় প্রাইভিট শুধাল– মাদাম, আমি বহু দেশ-বিদেশ দেখেছি- যেখানে টিয়ার গ্যাস ছাড়া হয়; কিন্তু আমাদের এই সুইটজারল্যান্ডে তো কখনও দেখিনি। শোকাতুরা হয়ে কান্না করলে রমণীর চোখে যে অশ্রুজল বেরোয় এটা তো তা নয়।
.
২০.
একদা সুইস কাগজে প্রশ্ন বেরুল : এই যে আমরা প্রতিদিন আমাদের রান্নাতে মশলার পর মশলা বাড়িয়েই চলেছি এটা কি আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো?
সেই সবজান্তা উত্তরিলা :
মাত্রা মেনে খেলে কোনও আপত্তি নেই, কোনও বস্তুরই বাড়াবাড়ি করতে নেই। (মরে যাই! এই ধরনের মহামূল্যবান উপদেশ পাড়ার পদি পিসি, স্কুলবয় সবাই দিতে পারে! লেখক) তার পর সবজান্তা বলছেন– ডাক্তারদেরও আধুনিক অভিমত, মেকদার-মাফিক মশলাদার খাদ্য ভোজনস্পৃহা আহার-রুচি বৃদ্ধি করে। তদুপরি আরেকটা গুরুত্বব্যঞ্জক তত্ত্ব আছে। আপনি যদি আপনার ভোজন ব্যাপারে সর্বক্ষণ এটা খাব না ওটা ছোঁব না এরকম পুতুপুতু করে আপনার ভোজনযন্ত্রটিকে নসিকে মোলায়েম করে তোলেন, (ইংরেজিতে একেই বলে মলিকড়ল করেন। তবে কী হবে? আপনি যতই চেষ্টা দিন না কেন, আপন বাড়িতে তৈরি মশলা বিবর্জিত রান্নামাত্রই খাব তথাপি ইহসংসারে বহুবিধ ফাড়া গর্দিশ আছে যার কারণে আপনাকে হয়তো কোনও রেস্তোরাঁতে একবেলা খেতে হল। কিংবা মনে করুন, আপনি নিমন্ত্রিত হলেন। শক্তসমত্ত জোয়ান আপনি। কী করে বলবেন আপনি ডায়েটে আছেন? ওদিকে রেস্তোরাঁ বলুন, ইয়ার-বখশির বাড়িই বলুন সর্বত্রই সর্বজন শনৈঃ শনৈঃ গরমমশলার মাত্রা বাড়িয়ে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই। পরের দিন আপনি কাত। অতএব–আমাদের সবজান্তা বলছেন, কিছু কিছু মশলা খেয়ে নেওয়ার অভ্যাসটা করে ফেলাই ভালো।
কিন্তু মশলা পুরাণ এখানেই সমাপ্ত নয়। সেটা পরে হবে। ইতোমধ্যে আমি দুম করে প্রেমে পড়ে গেলুম।
কবিগুরু গেয়েছেন :
যদি পুরাতন প্রেম
ঢাকা পড়ে যায় নব প্রেম জালে
তবু মনে রেখ।
কিন্তু এ আশা রাখেননি, সেই প্রথম প্রিয়াই পুনরায় তাঁর কাছে ফিরে আসবে। আমার কপাল ভালো।
লাঞ্চ সেরে মৃদুমন্থনে যখন বাড়ি ফিরছি তখন বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চিতে বসেই দেখি বেঞ্চির অন্য প্রান্তে যে মেয়েটি বসেছিল সে জ্বল জ্বল করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমার দুশমনরা তো জানেনই, এস্তেক দোস্তরাও জানেন, আমি কন্দর্পকিউপিডের সৌন্দর্য নিয়ে জন্মাইনি। তদুপরি বয়স যা হয়েছে তার হিসাব নিতে গেলে কাঠাকালি বিঘেকালি বিস্তর আঁক কষাকষি করতে হয়। সর্বশেষে সেটা ভগ্নাংশে না ত্রৈরাশিকে দিতে হবে তার জন্য প্লাশেত মারফত ঈশ্বর সুকুমার রায়কে নন্দনকানন থেকে এই যবনভূমিতে নামাতে হবে।
অবশ্য লক্ষ করেছিলুম, আমি ওর দিকে তাকালেই সে ঝটিতি ঘাড় ফিরিয়ে নেয়।
রোমান্টিক হবার চেষ্টাতে বলেছিলুম, মেয়েটি। কিন্তু তার বয়স হবে নিদেন চল্লিশ, পঁয়তাল্লিশ এমনকি পঞ্চাশও হতে পারে। কিন্তু তাতে কী যায়-আসে! বিদগ্ধ পাঠকের অতি অবশ্যই স্মরণে আসবে, বৃদ্ধ চাটুয্যেমশাই যখন প্রেমের গল্প অবতারণা করতে যাচ্ছেন তখন এক চ্যাংড়া বক্রোক্তি করে বলেছিল চাটুয্যেমশাই প্রেমের কীই-বা জানেন। মুখে আর যে কটা দাঁত যাব-যাচ্ছি যাব-যাচ্ছি করছে তাই নিয়ে প্রেম।
চাটুয্যে মশাই দারুণ চটিতং হয়ে যা বলেছিলেন তার মোদ্দা : ওরে মূৰ্থ, প্রেম কি চিবিয়ে খাবার বস্তু যে দাঁতের খবর নিচ্ছিস!
প্রেম হয় হৃদয়ে।… একদম খাঁটি কথা। ভলতের, গ্যোটে, আনাতোল ফ্রাস, হাইনে আমৃত্যু বিস্তরে বিস্তর যারা ফট ফট করে নয়া নয়া হুরী পরীর সঙ্গে প্রেমে পড়েছেন। এই সোনার বাঙলাতেও দু-একটি উত্তম দৃষ্টান্ত আছে। তা হলে আমিই-বা এমনকি ব্রহ্মহত্যা করেছি যে হুট করে প্রেমে পড়ব না।
বললে পেত্যয় যাবেন না, অকস্মাৎ একই মুহূর্তে একে অন্যকে চিনে গেলুম। যেন আকাশে বিদ্যুৎ বহ্নিপরিচয় গেল লেখি।
সে চেঁচাল হ্যার সায়েড!
একসঙ্গে আমি চেঁচালুম লটে।
তার পর চরম নির্লজ্জার মতো সেই প্রশস্ত দিবালোকে সর্বজন সমক্ষে আমাকে জাবড়ে ধরে দুই গালে ঝপাঝপ এক হর বা দুই টন চুমো খেল।
সুশীল পাঠক, সচ্চরিত্রা পাঠিকা, আমার দেশের মরালিটি-রক্ষিণী বিধবা পদিপিসি এতক্ষণে এক বাক্যে নিশ্চয়ই নাসিকা কুঞ্চিত করে ছ্যা ছ্যা বলতে আরম্ভ করেছেন। আমি দোষ দিচ্ছিনে। এস্থলে আম্বো তাই করতুম– যদি না নাটকের হেরোইন আমার প্রিয়া লটে (তোলা নাম সাল) হত। বাকিটা খুলে কই। ওর বয়স যখন নয়-দশ, আমার বয়স ছাব্বিশ, আমি বাস করতুম ছোট গোডেসবের্গ টাউনের উত্তরতম প্রান্তে লটেদের বাড়ির ঠিক মুখোমুখি। ওদের পাশে থাকত দুই বোন ঘেটে ক্যাটে। আরও গোটা পাঁচেক মেয়ে–তাদের বাড়ির পরে। কারওরই বয়স বারো-তেরোর বেশি নয়।
লটে ছিল সবচেয়ে ছোট,
আমার জীবনের প্রথমা প্রিয়া।
আর সবকটা মেয়ে এ তথ্যটা জানত এবং হয়তো অতি সামান্য কিছুটা হিংসে-হিংসে ভাব পোষণ করত। ওদের আশ্চর্য বোধ হত, যে লটে তো ওদের তুলনায় এমন কিছু গুলে-বাকাওলি নয় যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এসে আমি এরই প্রেমে মজে যাব। এটা অবশ্য আমি বাড়িয়ে বলছি। প্রেমে মজার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমার বয়স ছাব্বিশ ওর নয় কি দশ।
আসলে ব্যাপারটি কী জানেন? জর্মনদের ভিতর যে-চুল অতিশয় বিরল, লটের ছিল সেই চুল। দাঁড়কাকের মতো মিশমিশে কালো একমাথা চুল। ঠিক আমার মা-বোনদের চুলের মতো। ওর চুলের দিকে তাকালেই আমার মা-বোনদের কথা, দেশের কথা মনে পড়ত। আর লটে ছিল আমার বোনদের মতো সত্যই বড় লাজুক। সকলের সামনে নিজের থেকে আমার সঙ্গে কখনও কথা বলত না।
আমাদের বাড়ির সামনে ছিল একচিলতে গলি। সেখানে রোজ দুপুর একটা-দুটোয় আমরা ফুটবল খেলতুম। আমার বিশ্বাস তুমি পাঠক, আমাদের সে টিমের নাম জান না। আমিও অপরাধ নেব না। আমরা যে আইএফএ শিলডে লড়াই দেবার জন্য সে-আমলে ভারতবর্ষে আসিনি তার মাত্র দুটি কারণ ছিল। পয়লা : অতখানি জাহাজ ভাড়ার রেস্ত আমাদের ছিল না এবং দোসরা : আমাদের কাইজার টিমে পুরো এগারো জন মেম্বার ছিলেন না। আমরা ছিলুম মাত্র আষ্টো জন। তৃতীয়ত যেটা অবশ্য আমাদের ফেভারেই যায়, আমাদের ফুটবলটি ছিল অনেকটা বাতাবি নেবুর মতো। ওরকম ফুটবল দিয়ে কি সমদ, কি জুম্মা খান কখনও প্যাটার্ন-উইভিং ড্রিবলিং ডজিং, ডাকিঙের সুযোগ পাননি।
হায়, হায়। এ জীবনটা শুধু সুযোগের অবহেলা করে করেই কেটে যায়।
এসব আত্মচিন্তা যে তখন করেছিলুম তা নয়।
চল্লিশ বছর পর পুনরায়, এই প্রথম আমাদের পুনর্মিলন। লটে হঠাৎ শুধুলো, হার সায়েড! তুমি বিয়ে করেছ?
শুনেছি, ইহুদিরা নিতান্ত গঙ্গাযাত্রার জ্যান্ত মড়া না হলে কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন শুধিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা দেয়। আমি শুধলুম, তুই?
খল খল করে হেসে উঠল।
কেন? আমার আঙ্গুলে এনগেজমেন্ট রিং, বিয়ের আংটি দুটোই এখনও তোমার চোখে পড়েনি। আমি তো দিদিমা হয়ে গিয়েছি। চল আমাদের বাড়ি।
আমি সাক্ষাৎ যমদর্শনের ন্যায় ভীতচকিত সন্ত্রাসগত হয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলুম, সে যদি আমায় ঠ্যাঙায়।
দুটি মিষ্টি মধুর ঠোঁটের উপর অতিশয় নির্মল মৃদু হাসি একে নিয়ে বললে, বটে! আমার জীবনের প্রথম প্রিয়কে সে প্যাদাবে! তা হলে সেই হালুঙ্কেটাকে আমি ডিভোর্স করব না।
তওবা, তওবা!
.
২১.
লটে ছেলেবেলায় কথা কইত কমই। এখন দেখি মুখে খই ফুটছে, তবে সেই বাল্য বয়সের শান্ত ভাবটি যায়নি। আমি বললুম, চল না কাফে স্নাইডারে। এক পট কফি আর আপফেল টার্ট (এপল টার্ট)- পঞ্চাশ বছরের কোনও মহিলা যদি বাসস্ট্যান্ডের পেভমেন্টে বসে হঠাৎ হাততালি দেয় তবে সবাই একটু বাঁকা নয়নে তাকায়। লটে বেপরোয়া। হাততালি দিয়ে উল্লাসভরে বললে, তুমি ডিয়ার, সেই প্রাচীন দিনের ডিয়ারই রয়ে গেছ। কাফে স্নাইডার অতি উস্কৃষ্ট আপফেল টার্ট বানাতো সে তোমার এখনও মনে আছে।
আমি বললুম, সোওয়াদটি এখনও জিতে লেগে আছে… অবশ্য তোমাকে যদি নিতান্তই ট্রাম ধরতে হয় তবে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে মুফেনডর্ক
মুফ্রিকা বল। ওই অজ পাড়াগাটা এমনই প্রোহিস্টরিষ (প্রাগৈতিহাসিক) যে আমরা ওটাকে আফ্রিকার সঙ্গে এক কাতারে ফেলে মুফ্রিকা নাম দিয়েছিলুম ভুলে গেছ?
আমি তীব্র প্রতিবাদ করে বললুম, আমি এখনও লিজেন্সকে মুফ্রিকানরিন (মুফ্রিকাবাসিনী) ডাকি। সে আমায় ডাকে হালুঙ্কে (গুণ্ডা) তুমি যেরকম এইমাত্র ওই নামে তোমার বেটার-না-ওয়ার্স ৫০%-কে রেফার করলে। তুমিও আমার মতো অপরিবর্তনশীল।
লটে বিষণ্ণ কণ্ঠে বললে, উপায় কী বল। এই ধর না, কাফে স্নাইডারের আপফেল টার্ট। ওটা কেন এত মধুর হত জানো। ওটা বানানো সম্পর্কে আমার এক মাসি। আর তোমার মনে আছে কি আমার ঠাকুদ্দার বাবা যখন একশো বছর বয়সে পা দিলেন তখন মা পরবের দিন আপফেল টার্ট বানিয়েছিল, মাসির চেয়েও ভালো। কার বুদ্ধিতে জান? থাক! আমি বড় লাজুক ছিলুম; তাই তোমাকে কিছু বলিনি। তুমি তো খাও চড়ুইপাখির হাফ রেশন। তাই তুমি যখন পুরো দু পিস খেলে তখন আমার ভারি আনন্দ হয়েছিল। ওমা! তার পর সবাই চলে যাওয়ার পর বাড়ির লোক আমাকে যা খ্যাপাল। এস্তেক ঠাকুন্দার বাবা। ওঁর কথা তখন জড়িয়ে যেত। জন্মদিনের বিশেষ সিগারে দম দিয়ে তার খাস প্যারা ছেলেকে বয়স তখন তাঁর সত্তর– বললেন, আমাদের লটে বাঁচলে হয়। তবে হ্যাঁ, আমার ঠাকুমা লটের চেয়েও মর্ডান ছিলেন। ন বছর বয়সে প্রথম প্রেম করেন। সে হল গে ১৭৫০ কিংবা তারই কাছে-পিঠে। এবং জানো, সেই দজ্জাল হুঁড়ি আখেরে সেই ছোকরাকেই বিয়ে করে।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, দ্যৎ! ন-দশ বছরে আবার প্রেম! তবে কি না, দেবতা শ্রীকৃষ্ণ নাকি ওই বয়সেই ভাব-ভালোবাসা করেছিলেন।
আখেরে ঠাকুরমার ঠাকুরমার মতো ওই মেয়েটিকে বিয়ে করেছিলেন?
আমি বললুম, না। উনি বিবাহিত ছিলেন।
তার বয়স কত ছিল?
ঠিক বলতে পারব না। তবে বেশ কিছুটা সিনিয়র ছিলেন। আমাদের কাব্যে আছে :–
নিশাকাল, এ যে ভীরু, তুমি রাধে
লয়ে যাও ঘরে
হেন নন্দাদেশ পেয়ে চলে পথে
যমুনার কূলে
শ্রীরাধামাধব কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে
রস কেলি করে।
অপিচ শ্রীরাধার নানা বর্ণনার মধ্যে একটি বর্ণনা আমার মনের গভীরে উজ্জ্বল হীরকের মতো চতুর্দিক উদ্ভাসিত করে রেখেছে। আমাদের দেশের কাব্য নাট্যাদি আরম্ভ করার পূর্বে লেখক-নাট্যকার সরস্বতী বা ঈশ্বরের কোনও অবতারের বন্দনা তথা এবং পাঠক-দর্শক মণ্ডলীর মঙ্গল কামনা করেন। এখন হয়েছে কী, শ্রীকৃষ্ণ বাল্যে বড় দামাল ছেলে ছিলেন। প্রায়ই মায়ের তৈরি ননী–
সে আবার কী? আমার মস্তকে অনুপ্রেরণা এল। প্রিয়াকে প্রীত করার জন্য আমার মতো গণ্ডমূর্থের প্রতিও কন্দর্প সদয় হন। অবশ্য হৃদয়ে ওই অত্যাবশ্যকীয় প্রেমরসটি থাকা চাই-ই। তাই হাফিজ গেয়েছেন,
নেত্র নাই বাঞ্ছা হেরি বিধুর বদন
কর্ণ নাই চাই শুনি ভ্রমর গুঞ্জন ॥
প্রেম নাই প্রিয় লাভ আশা করি মনে।
হাফিজের মতো ভ্রান্ত কে ভব-ভবনে ॥
বললুম, এই যে তোকে কাফে মাইডারে নিয়ে যাবার জন্য এতক্ষণ ধরে ঝুলোঝুলি করছি, সেখানে আপফেল টার্টের উপর যে হুইপট ক্রিম বিছিয়ে দেয় অনেকটা সেই বস্তু।
সঙ্গে সঙ্গে লটে উঠে দাঁড়াল। চল।
আমি বললুম, তুমি না কোথায় যেন যাচ্ছিলে?
উত্তরে লটে যা বললে হিন্দিতে সেটা ভালো, মারো গোলি (গুলি)। গোল কর যাও। চুলোয় যাকগে বড্ড রূঢ়।
লটে বললে, রাধার বয়ঃসন্ধিক্ষণ না কী যেন বলছিলে?
আমার বাধো বাধো ঠেকছিল। যদিও তার বয়স এখন পঞ্চাশ তবু ক্ষণে ক্ষণে তার ঠোঁটের কোণের লাজুক হাসি, কথা বলতে বলতে হঠাৎ মাথা নিচু করে পায়ের দিকে তাকানো এসব যেন তাকে চল্লিশ বছরে উজিয়ে নিয়ে দশ বছরের ছোট্ট পরিবর্তিত মেয়েটিকে করে তুলছিল। তবু দুগগা বলে ঝুলে পড়লুম। বললুম, সেই শ্রীকৃষ্ণ পাঠক দর্শককে আশীর্বাদ করুন যিনি ছিলেন ননীচোরা। ধরা পড়ার পর নন্দপত্নী মাতা যশোদা যখন তাকে শুধালেন, তুমি কতখানি ননী চুরি করেছ? তখন তিনি শ্রীরাধার স্তনযুগল দেখিয়ে বললেন, ওই অতটুকু–সেই শ্রীকৃষ্ণ সর্বজনকে আশীর্বাদ করুন।
বলা শেষ হতে না হতেই কেমন যেন লজ্জা পেলুম। অবশ্য মোদ্দা কথাটি এই ওইটুকু আট বছরের বাচ্চা আর কতখানি ননী খেতে পারে। অর্থাৎ ব্রজসুন্দরীর তখন উঠতি বয়স মাত্র।
লটে আমার লজ্জারক্ত ভাব দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল। বললে, হায়, হায়, হায়; হাস আমাদের হার ডক্টর। চল্লিশ বৎসর পূর্বে তুমি মেয়েছেলের মতো যেরকম লাজুক ছিলে এখনও তাই আছ। ইতোমধ্যে কত কী হয়ে গেল, মায় একটা বিশ্বযুদ্ধ। এখনও তোমার। চোখে পড়েনি, ছেলেমেয়ে পাশাপাশি ভিড়ে ভর্তি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একজন অন্যজনের কোমরে হাত দিয়ে মেয়েটা ছেলেটার কাঁধে হাত দিয়ে নাচের সময় আমরা যে পজিশন নিই– ঘাড় বাঁকিয়ে একে অন্যকে চুমো খেতে খেতে এগিয়ে যাচ্ছে ধীর পদে। তৎসত্ত্বেও মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছে। রাস্তার লোক নির্বিকার, পুলিশও তুরীয় ভাব অবলম্বন করেছে। আমার কুড়ি বছর বয়সে নির্জন বনের ভেতরও হেরমান যখন আমাকে আদর করত আমার আড়ষ্টতা তখনও কাটত না। রাস্তায় চলতে চলতে চুম্বন– এ টেকনিক আমি আর কখনওই রপ্ত করতে পারব না।… চল্লিশ বছর! কত পরিবর্তন হয়েছে– বাইরে ভিতরে এবং তোমার-আমার লিজেল আনার পক্ষে সে পরিবর্তন যে কী নিদারুণ ট্র্যাজেডি সেটা বুঝতে তোমার বেশ কিছুদিন কেটে যাবে। তুমি কাফে স্নাইডার স্নাইডার করছিলে। আমি তোমাকে নিরাশ করতে চাইনি, ও কাফে কতকাল উঠে গিয়েছে। ওখানে এখন পঁচিশ গজি লম্বা একটা মার্কিন বার। বারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে হলে ট্যাক্সি ভাড়া নেয় মার্কিনরা। সেই শান্ত সুন্দর বাড়িটি; ভিতরে বসে শোনা যেত মাসি যে ঘরে টার্ট বানাত সেখান থেকে আসছে আধমুঠো পরিমাণ ক্ষুদে ক্যানারিপাখির কাঁপা কাঁপা হুইসল, আর আসছে বেকিং-এর কেকের মৃদু গন্ধ, আরও সর্বোপরি, ভেসে আসে, মাসির রুমালের ল্যাভেন্ডার গন্ধ।
সেকথা থাক। অন্য একটা মধুর চিন্তা আমার মাথায় হৃদয়েও বলতে পার ভিনাস্ টিলার প্রজাপতির মতো– সর্বক্ষণ ঘুর ঘুর করছে যদিও আমি কথা বলছি, তোমার কথাও শুনছি। সেটা বলি; এতদিন ধরে যে সবাই আমাকে ক্ষেপাত যে তুমি আমাকে ভালোবাসো, তার সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানত, ছাব্বিশ বছরের ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট (জর্মনিতে যে যুগে স্টুডেন্টরা উচ্চ সম্মান পেত– ধরে নেওয়া হত এরা সব এরিস্টোক্রেট) দশ বছরের বাচ্চার প্রেমে পড়ে না। সে পীরিত করে মেয়ে-স্টুডেন্টদের সঙ্গে কিংবা বেকার কিন্তু ধনী ঝিয়ারীদের সঙ্গে। কিন্তু ওরা একটা কথা জানত না, আমি তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসতুম যাকে জর্মন বলে লিবে ইংরেজিতে বোধহয় লাভ।
আমি তো অবাক। কিন্তু যেরকম গম্ভীর কণ্ঠে সিরিয়াসলি শব্দ কটি উচ্চারণ করল তাতে ওই নিয়ে পাগলামি করার মতো রুচি বা সাহস আমার ছিল না। সেই চল্লিশ বৎসর পূর্বে আমার বয়স ছিল লটের আড়াই গুণ। এখন তো আর আড়াই গুণ নয়– তা হলে আমার বয়স হত ১২৫ বৎসর। আমাদের বয়স এখন অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। ওর যদি আশি বৎসর হয় আর হবেই না কেন, ওর ঠাকুদ্দার বাপ তো একশো এক বছর অবধি বেঁচে ছিলেন তখন আমার ছিয়ানব্বই আর ওর আশিতে তো কোনও পার্থক্যই থাকবে না।
তুমি ভাবছ, দশ বছরের মেয়ে কি প্রেমে পড়তে পারে? পারে, পারে, পারে! অবশ্য সিচুয়েশনটা খুবই অসাধারণ হওয়া চাই।
আর তোমার যে পাকা একটি বান্ধবী ছিল– বন-এ তোমার সঙ্গে পড়ত, নাম আনামারি–
সর্বনাশ! নামটা পর্যন্ত জানত। এখনও স্মরণে রেখেছে।
.
২২.
গডেসবের্গের সবচেয়ে বড় রাস্তা দিয়ে চলেছি। এ রাস্তা দিয়ে যাবার সময় আগের প্রায় দোকানিকে চিনতুম বলে তারা রোদ পোওয়াবার তরে চৌকাঠে দাঁড়ালে শুট মর্গেন গুট টাখ কিংবা দিনের শেষে ক্লান্ত কণ্ঠে শুট অকেনট বলতুম। সুন্ধুমাত্র ফুলওলার দোকানটির কাছে আসামাত্র পা চালিয়ে দ্রুতবেগে ওটাকে পেরিয়ে যেতুম। কেন? শো-উইন্ডোর বিরাট কাঠের জানালা দিয়ে দেখা যেত কত না সুন্দর তাজা ফুল– এক্কেবারে সাক্ষাৎ শুলস্তান। অনেক কিশোর-কিশোরীই এই শো-উইন্ডোর সামনে ব্লদেভু করত। দ্বিতীয় পক্ষ সময়মতো না এলে প্রথম পক্ষ ফুল দেখতে দেখতে হেসে-খেলে দশ-বিশ মিনিট কাটিয়ে দিতে পারত। তবে কি আমি ফুল ভালোবাসিনে? খুবই ভালোবাসি। বিশেষ করে শীতকালে যখন সবকিছু বরফে ঢাকা পড়ে যায়, গাছের পাতাগুলো পর্যন্ত ঝরে গিয়ে উঁচু উঁচু শাখা ন্যাড়া সঙিনের মতে ভয় দেখায়। শুনেছি, তখন এ দোকানের বেবাক ফুল আসত দক্ষিণ ইতালি, মন্তে কার্লো, কোদাজুর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল চার্লস ল্যামের রুদ্র রসিকতা। এক শৌখিন ধনী ব্যক্তি তাঁকে শুধিয়েছিল, আপনার ঘরে ফুল নেই যে। আপনি কি ফুল ভালোবাসেন না? তিনি জানতেন যে ওই মব তার অর্থকতা বাবদে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল হয়েও এই বেতমিজ প্রশ্ন শুধিয়েছে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, স্যার! আমি ছোট্ট বাচ্চাদের খুবই ভালোবাসি কিন্তু তাই বলে তাদের মুণ্ডুগুলো কেটে নিয়ে ফুলদানিতে সাজাই না। আমি দাঁড়াতুম না অন্য কারণে। সেই প্রাচীন যুগে আমি এখানে আসার দু-তিন দিন পর যখন মুগ্ধ নয়নে ফুলগুলো দেখছি, এমন সময় দরজা খুলে দোকানি একগুচ্ছ ফুল হাতে দিয়ে মৃদু হেসে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললে, শুটন্ টাখ ঝুঙার হার (ইয়াং জেন্টলম্যান)! এই সামান্য কটি ফুল গ্রহণ করে আমাকে। আপ্যায়িত করবেন কি? আমার ভাইঝি লিসবেতের কাছে শুনলুম আপনি আমাদের এই ক্ষুদে গোডেসবের্গে ডেরা পেতেছেন। আমাদের এখানে যে কজন বিদেশি আছেন, তাঁদের সংখ্যা গোনবার জন্য হাতের একটা আঙুলই যথেষ্ট। কিন্তু জানেন, এর চেয়ে ক্ষুদ্রতর পরিবেশে–সে শতাধিক বত্সরের কথা এখানে বাস করতেন রাজদরবারের এক সম্মানিত আমির*[* অধুনা বাঙলায় একাধিক লেখক একবচনে ওমরাহ লিখে থাকেন। বস্তুত ওমরাহ শব্দটি বহুবচন। একবচন আমির শব্দের বহুবচন ওমরাহ। এবং আমির-ওমরাহ সমাস কলেক্টিভ নাউন রূপে ফারসি, উর্দু, বাঙলাতে ব্যবহার হয়।]তারাই জলসাঘরে বন শহরের বেটোফেন তখনকার দিনের গ্রামেত্র (গ্রান্ড মাস্টার) ওস্তাদস্য ওস্তাদ হ্যান্ডেলকে বাজনা বাজিয়ে শোনান–
বলা বাহুল্য আমি দাম দেবার চেষ্টা করে নাস্তানাবুদ হয়েছিলুম।
ফুস করে একটি ক্ষুদ্রতম দীর্ঘশ্বাস বেরুল কিন্তু লটের কান যেন বন্দুক। শুধাল, কী হল? এরই মধ্যে আমার সঙ্গসুখ তোমার কাছে একঘেয়ে হয়ে উঠল? আমি সজোরে মাথা নেড়ে বললুম, না, না, না। তার পর ওমর খৈয়াম থেকে আবৃত্তি করলুম–
তব সাথী হয়ে দগ্ধ মরুতে
পথ ভুলে তবু মরি,
তোমাদের ছাড়িয়া মসজিদে গিয়ে
কী হবে মন্ত্র স্মরি!
তার পর সেই ফুলওলার কাহিনী বয়ান করে বললুম, ডার্লিং লটে! আমি এসব দোকানপাট তো বিলকুল চিনতে পারছিনে। কিন্তু সেই ফুলের দোকান নিশ্চয়ই সামনে এবং নিশ্চয়ই ফের চেষ্টা দেবে আমাকে মুফতে ফুল দেবার। চল অন্য পেভমেন্টে।
লটে পুনরায় ডুকরে কেঁদে বললে, হায়, হায়, হায়! কোন ভবে আছ তুমি! সে দোকান আর নেই। তার মালিক ওটাকে বেচে দিয়ে মাইল সাতেক দূরে আলু–আলু গো, আলু ফলাচ্ছেন। প্রাচীন দিনের আর কজন দোকানি আপন আপন দোকান বাঁচাতে পেরেছে। এই ছোট্ট জায়গাটিতে যারা বংশপরম্পরায় বাস করেছে তারা হয় পালিয়েছে, নয় আপন আপন বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। রাস্তায় পর্যন্ত বেরুতে চায় না। এই তোমার লিজেল– অন্তত চার মাইল না হাঁটলে অর্থাৎ মুফেনডর্ফ-গোডেসবের্গ দুবার না চষলে যার পেটের চকলেট হজম হত না (মনে পড়ল অত্যুকৃষ্ট ব্রান্ডি ভর্তি মোটা মোটা লাল আঙুরের চকলেট খেত লিজেল) সে তো এখন আর একদম বাড়ি থেকে বেরোয় না। তোমার ল্যান্ডলেডির মেয়ে আনা বেরোয় না, আমাদের যে একটি ক্ষুদ্র বিউটি সেলুন ছিল তার মালিক কাটেরিনা সৌন্দর্য আর যৌবন বাঁচিয়ে রাখবার জন্য বিস্তর সন্ধিসুড়ক জানত বলে এবং বাঁচিয়ে রেখেছেও এখনও তাকে দেখলে মার্কিন চ্যাংড়াদের মুণ্ডগুলো বাই বাই করে ঘুরতে থাকে, সে পর্যন্ত বাড়ি থেকে বেরোয় না।
তাই তো তোমাকে পেয়ে আমার এত আনন্দ। তোমার আজকের দিনের চেহারাতে আর সেদিনকার চেহারাতে আর কতখানি মিল? বার বার মনে হয়, যেন তোমাকে ঘন কুয়াশার ভিতর দিয়ে দেখছি। কী রকম জানো? তুমি যে বাড়িতে থাকতে সেটা প্রায় তিনশো বছরের পুরনো। সে-যুগে আস্তানার ভালো ব্যবস্থা ছিল না বলে আমার বাপ-মার বেডরুম সবকটা ঘর ছিল খুদে খুদে যেন বেদেদের কারাভানের গাড়িতে ক্ষুদে ক্ষুদে বেড-রুম, ডাইনিংরুম, কিংবা হা হা, মনে পড়েছে, ওয়ালট ডিজনির ম্যাজিকল্যান্ডের রাজকন্যা বনের ভিতর কাঠুরের অতি ছোট্ট ঘরে আশ্রয় নিয়ে জানালার পাশে বসে আপন মায়ের কথা ভাবছে।
হুবহু ঠিক ওই রকম একটি ছোট্ট জানালা ছিল তোমার ঘরে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে একহাত হয় কি না হয়। তুমি আসবার আগে ওটাতে একটা সাদা মোটা পর্দা ঝুলত। কিন্তু তোমার এখানে আসা স্থির হয়ে যাওয়ার পরই আনার মা আপন হাতে ক্রুশের কাঁটা দিয়ে একটুকরো নেট বুনল। তার যা বাহার। আর তার মিহিন কাজ ডাচ লেসকেও টিঙ দেয়। আমি যখন মাখম কিনতে গেলুম আনাদের দোকানে তখন আনাকে শুধালুম, অতিথি আসছে নাকি? উত্তর শুনে আমি ভয়ে ভিরমি যাই আর কি! আমাকে একদিন ভয় দেখাবার জন্য বাবা বলছিল, তবে ডাকি একটা ইন্ডারকে! তার মাথায় পাগড়ি, ইয়াব্বড়া দাড়ি আর হাতে বাঁকা ছোরা। (আমি বুঝলুম শিখ আর গুখাতে লটের বাবা ককটেল বানিয়ে ফেলেছিল– লেখক) নাভিকুণ্ডলীর উপর সেঁধিয়ে দিয়ে এক হ্যাঁচকায় পাঁজর অবধি ফাঁসিয়ে দেয়। ওমা! তার পর কোথায় কী? সেই রাত্রে তোমার ছোট্ট জানালার বাহারে লেসের পর্দার ভিতর দিয়ে দেখি, ঠিক তাই, তোমাকে এইমাত্র যা বললুম, তোমাকে যেন তখন ঘন কুয়াশার ভিতর দিয়ে দেখছি, তুমি টেল ল্যাম্পের সামনে বসে কিছু একটা লিখছিলে।
আমি বললুম, কত যুগের কথা! কিন্তু জাস্ট বাই চান্স্ তোমার মনে আছে কি, সেটা কী বার ছিল?
দিব্য মনে আছে। শুক্রবার সন্ধ্যাবেলা।
অ। তাই বল। শুক্রবার রাতদুপুরে ইন্ডিয়ার জন্য লাস্ট মেল ছাড়ে। প্রতি মাসে চিঠি না। পেলে সব বড্ড চিন্তিত হয়। তোমার রাজকন্যা যেরকম বনের ভিতর কাঠুরের কুটিরে ছোট্ট জানালার পাশে বসে তার মায়ের কথা ভাবত, আমার মায়ের মনও তেমনি আমার দিকে উধাও হয়ে চলে আসে।
লটে বললে, আহা! সেই অল্প বয়সে লটে লাজুক ছিল বটে কিন্তু তার দরদি হিয়াটি সে কখনও লুকিয়ে রাখতে পারত না। বললে, একদা যেখানে কাফে স্নাইডার ছিল সেখানে পৌঁছে গিয়েছি।
আমি বললুম, না। টাকার জোরে মার্কিনরা যে প্রতিষ্ঠান আত্মসাৎ করেছে সে পাপালয় তো ব্রথেল। আমি ওখানে যাব না।
লটে যেন খুশি হল। বললে, ওই যে ব্রথেল বললে, সেটা একদম খাঁটি কথা। হয়তো না ভেবে বলেছ, কিন্তু পেরেকের ঠিক মাঝখানে মোক্ষম ঘা-টি মেরেছ। সেদিন একটা বইয়ে পড়ছিলুম, ইহুদিরা ঠিক এমনি ধারা কড়া কড়া টাকা নিয়ে প্যালেস্টাইন গিয়ে সেখানকার গরিব আরব দোকানদারদের দোকানপাট কিনে তো নিলই তার পর কিনল ওদের জমিজমা। আরবরা এখন নাকি ভিটেছাড়া হয়ে সর্বত্র ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরেকটা বইয়ে পড়ছিলুম, কোনও জায়গায় যদি একটা নতুন বন্দর তৈরি করা হয় তবে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে এন্তের বার আর বিস্তর ব্রথেল হুশ হুশ করে ব্যাঙের ছাতার মতো গজাতে থাকে।
আমি চিরকালই অ্যাডেনাওয়ারকে ভক্তি করেছি। তারই কল্যাণে যুদ্ধে-বন্দি বিস্তর জর্মন মুক্তি পায় রুশ কারাগার থেকে, সাইবেরিয়া থেকে। ওদের মধ্যে ছিল আমার এক মাসতুতো ভাই আমার মা তাকে ভালোবাসত আপন ছেলের মতো। তা হলেই বুঝতে পারছ, আডেনাওয়ারের প্রতি আমাদের কতখানি শ্রদ্ধা। এবং সকলেই জানে এই বন্দিদের মুক্ত করার জন্য তাঁকে তাঁর মাথা অনেকখানি নিচু করতে হয় সে লোক হিটলারের সামনেও কখনও নিজেকে খাটো করেননি।
কিন্তু এই যে তিনি ফুটফুটে সুন্দর ছোট্ট শহর বন-কে জর্মনির রাজধানীরূপে মনোনীত করলেন তাতেই হল বন-এর সর্বনাশ এবং আমাদের গোডেসবের্গের সর্বস্ব নাশ। বন-এর আশপাশে ফাঁকা জায়গা নেই। বিদেশি রাজদূত বাবুরা গোডেনবের্গের চতুর্দিকে গমক্ষেত বরবাদ করে হাঁকলেন বিরাট বিরাট এমারত, তৈরি করলেন আপন আপন কলোনি। অফ কোর্স মার্কিনরাই হলেন পয়লা নম্বরি কলোনাইজারস। তারা চান ঝাঁকে ঝাঁকে বার। রাতারাতি গোডেসবের্গের চেহারা বদলে গেল। এদেশে স্লেভারি নেই। নইলে আমরা সব্বাই ওদের নিগ্রো স্লেভ বনে যেতুম।
তার পর ঝপ করে আমাকে একটা চুমো খেয়ে বললে, একটু দাঁড়াও-না, তুমিও সঙ্গে চল। হেরমানকে ফোন করব, আমার ফিরতে দেরি হবে।
.
২৩.
ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন কায়দা-কেতার পাবলিক টেলিফোন বস্, ফোন কিয়ো থাকে। তার কোনও কোনওটাতে আপনি যদি প্রার্থিত নম্বর না পান, বা এনগেজড থাকে তবে B বোতাম টিপলে আপনার প্রদত্ত কড়ি একটা ফুটো দিয়ে ফেরত পাবেন। এখন হয়েছে কী, বেশিরভাগ লোকই আপন বাড়ি থেকে ফোন করে। নম্বর না পেলে বা এনগেজড পেলে বোতাম টেপার কোনও কথাই ওঠে না। তাই পাবলিক ফোন থেকে ওই দুই অবস্থায় B বোতাম টিপতে ভুলে যান। অতএব আপনার মতো শেয়ানা লোকের কর্তব্য, পাবলিক ফোনে ঢুকেই প্রথম B বোতাম টেপা। যদি আপনার পূর্ববর্তী ভোলামন জনের কড়ি সেখানে থাকে তবে ফোকটে সেটি আপনি পেয়ে যাবেন এবং তাই দিয়ে আপনার কলটি মাছের তেলে মাছ ভাজার প্রক্রিয়া অবলম্বনে সেরে নেবেন। এমনকি আপনি কোনও ফোন করবেন না; পথে যেতে যেতে দেখলেন একটি ফোন বাসো। ঢুকে B টিপবেন। কড়ি পেয়ে গেলে ভালো। না পেলে কীই-বা ক্ষতি। কড়িটি পকেটস্থ করে শিস দিতে দিতে এগিয়ে চলবেন যতক্ষণ না আরেকটা ফোন বস্ পান। মার্কিন প্রসাদাৎ গোডেসবের্গের নানাবিধ অধঃপতন হওয়া সত্ত্বেও ঘড়ি ঘড়ি পথপ্রান্তে অর্থোপার্জনের এ ধরনের চিত্তহারিণী প্রতিষ্ঠান ফোন বস্ খুবই কম, কিন্তু হামবুর্গ, বার্লিন, কলোন– মরি! মরি! তিনশো কদম যেতে না যেতেই সেই নয়নাভিরাম প্রতিষ্ঠান। আবার ঢুকবেন আবার টিপবেন। কীই-বা সময় যায় তাতে! এতে আপনার বিবেকদংশন হওয়ার কথা নয়। কারণ কড়িটা তো সরকারের নয়। ওটা আপনার মতোই কোনও নাগরিকের। ওতে আপনার হই বেশি।
লটেকে এ কৌশলটি শেখাবার মোকা পূর্ববর্তী যুগে আমি কখনও পাইনি। ইতোমধ্যে আমার মতো জউরি প্রেমিকও সে বোধহয় পায়নি। ফোন বসে ঢুকে যেই না পয়সা ঢালতে যাচ্ছে আমি অমনি লম্ফ দিয়ে তাকে ঠেকালুম কর কী? কর কী? বলে B-তে দিলেম চাপ।
ঈশ্বর পরম দয়ালু
তাহার কৃপায় দাড়ি গজায়
শীতকালে খাই শাঁকালু।
দু-কান ভরে যেন কেষ্টঠাকুরের মুরলিধ্বনি শুনতে পেলুম। যদ্যপি খটাং করে– কাসার থালার পর টাকাটি ফেললে যে রকম কর্কশ ধ্বনি বেরোয়। তিনটি গ্রশেন, আমাদের দিশি হিসাবে সাড়ে ন গণ্ডা পয়সা সুরসুর করে বেরিয়ে এল।
লটে তাজ্জব মেনে শুধাল, এ আবার কী?
ভারতের জন্য প্রথম এটম বানাতে পারলে আমার একাননে সীতালাভে দশাননে যে আত্মপ্রসাদ অহংশ্লাঘা উদ্ভাসিত হয়েছিল তারই আড়াই পেঁচ মেখে নিয়ে হিটলারি কণ্ঠে আদেশ দিলুম, এই কড়ি দিয়ে উপস্থিত সাত পাকের সোয়ামিকে ফোন তো কর; পরে সবিস্তর হবে।
লটে : হেরমান?
অন্য প্রান্ত থেকে কৃচিত জাগরিত বিহঙ্গ কাকলীর মতো শব্দ হল। হায়, কেন যে সেই ফরাসি কৌশল বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ল না– আফসোস করি প্যারিসে একদা পাবলিক কল বক্সে ফোনযন্ত্র থেকে একটি সরু রবারের নল– তার মাথায় ক্ষুদে একটি লাউডস্পিকার, এমপ্লিফায়ার– বোম লাগানো–ঝুলতে থাকে। এখানে সেটা থাকলে আমি সেই বোতামটি কানে লাগিয়ে দিব্য শুনতে পেতুম ওই প্রান্ত থেকে হেরমান কী বলছে।
লটে : আমি লটে বলছি। লিকসটে (ইংরেজিতে এস্থলে হানি = মধু!) আমার ফিরতে দেরি হবে।… আঁ না না! আমার প্রাচীন দিনের এক লাভারের সঙ্গে হঠাৎ দেখা। এখন তার সঙ্গে কফি টার্ট খাব। তার পর সিনেমা। তার পর ছ-পদী ডিনার। সর্বশেষে পার্কের বেঞ্চিতে বসে দু দণ্ড রসালাপ (মৃদু মর্মরগানের মর্মের কথার মধুময় মাখামাখি)। ওদিকে আমি প্রাণপণ হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে সর্বাঙ্গে মৃগী রোগীর কাঁপন তুলে তুলে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করছি–কাট আউট, কাট আউট– মা-মেরির দিব্যি, সান্তা মাগদালেনের দিব্যি, সান্তা আনার, সান্তা তেরেসর দিব্যি…।
হেরমান বেশ একটানা কিছুক্ষণ কীসব যেন বললে। লটে বললে, দেখি চেষ্টা করে। কিন্তু তোমার সর্বনাশের জন্য প্রস্তুত থেকো।
আমার বহু বৎসরের নিপীড়িত অভিজ্ঞতা বলে মেয়েছেলে একবার ফোন ধরলে আপনি নিশ্চিন্ত মনে মর্নিং ওয়াক (রবীন্দ্রসরোবর প্রদক্ষিণ তদ অন্তর্ভুক্ত) সেরে ফোন বসে ফিরে দেখবেন তখনও তিনি বলছেন, তা হলে ছাড়ি, ভাই। বাইরে জনা তিনেক ফোন করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কেন বাপু, আর ফোন বক্স নেই কাছে পিঠে। এই তো মাত্র দু-মাইল দূরের গোরস্তানে (বাপস্ সেই রাতের ভুতুড়ে অন্ধকারে গোরস্তানের শর্টকাট প্রাশান আর্মি অফিসার পর্যন্ত এড়িয়ে চলে) আরেকটা কল বক্স রয়েছে। তা হলে ছাড়ি ভাই এই ছাড়ি ভাই, ভাই- তার পরও নিদেন দশটি মিনিট ধরে চলবে।
কিন্তু লটে বড় লক্ষ্মী মেয়ে। যেই না দেখেছে একটি মহিলা কিয়োস্কের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন অমনি লটে বললে, আউফ ভিডার হ্যোরেন যতক্ষণ না পুনরায় একে অন্যের কণ্ঠস্বর শুনি (ততক্ষণের জন্য বিদায়- এটা উহ্য থাকে।)*
[*১. সাক্ষাৎ দেখাদেখির পর বিদায় নেবার সময় জর্মন বলে আউফ ভিডার জেন (দেখা) হয়। ফোনে বলে আউফ ভিডার হ্যো রে (শোনা যায়)। ভিয়েনাতে বলে আ দিয়ো (ভগবানের হাতে দিলুম)। নানা দেশে নানা রকমের বিদায়বাণী বলা হয়। জানিনে, এই লক্ষ্মীছাড়া মুল্লুকে এখন পনেরো আনা লোক– এমনকি মেয়েরা পর্যন্ত ঘোর অপয়া এখন তবে যাই বলে। যেন অগস্ত্য যাত্রা করছে! এখন তবে আমি প্রায় উঠে গেছে। আমরা তখন উত্তরে বলতুম এসো। এখন কী উত্তর দেয়।
এই আধুনিক আধুনিকারা যখন কেউ বলে, এখন তবে যাই? তারা কি হ্যাঁ, যাও বলে? সর্বনাশ! এর চেয়ে মারাত্মক বর্বর অপয়া উত্তর কী হতে পারে। যাই শুধু তখনই বলা চলে যখন কেউ আসছে। ডাকলুম, রামা, রামা, এদিকে আয় তো, বাবা। সে উত্তরে বলে, যাই বাবু।]
রাস্তায় নেমে লটে বললে, ফোন বক্স থেকে যে কৌশলে পয়সা বের করলে সেটা বুঝিয়ে বল।
আমি বললুম, হেরমান কী বললে? এবং তার কটা পিস্তল?
খিল খিল করে হেসে বললে, দুটো। হেরমানের রেজিমেন্ট যখন রাশা থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে জর্মনি ফিরল তখন কোনও দফতর পর্যন্ত নেই যে পিস্তলটা জমা দেয়। অন্যটা তার দাদার আপন নিজস্ব ছিল। সে রয়ে গেছে। আমি অন্যদিকে ঘাড় ফেরালুম। সুশিক্ষিত জর্মন জাত পর্যন্ত পয়া-অপয়া মানে। সে রয়ে গেছে অর্থাৎ সে যুদ্ধ থেকে ফেরেনি। খুব সম্ভব মারা গেছে। হয়তো আত্মীয়স্বজন সৈন্যবিভাগ থেকে চিঠি পেয়েছে, অমুক অমুক দিন অমুক স্থলে বীরের মৃত্যু বরণ করেছে। কিন্তু তারা ভাবে, মৃত সৈন্য সনাক্ত করাটা সব সময় নির্ভুল হয় না। হয়তো-বা সে সাইবেরিয়ার কারাগারে বা লেবার ক্যাম্পে আছে। কিংবা হয়তো শেল শক খেয়ে তার স্মৃতিশক্তি সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে (এমনেসিয়া)। নিজের নামধাম পর্যন্ত স্মরণে আনতে পারছে না। হয়তো কোনও হাসপাতালে পড়ে আছে, নয় ইডিয়টের মতো রাশার গ্রামে গ্রামে ভিখারির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত কী হতে পারে। হয়তো একদিন ফিরে আসবে। মারা গেছে এই অপয়া কথা বলি কী করে? সত্যি তো, আমিও তাই বলি।
কিন্তু সুশীলা লটে-চরিত্রের কোনও কোনও অংশ বেশ টনটনে। বললে, কিন্তু ফোন থেকে যে কড়ি দুইয়ে বের করলে সেটা বুঝিয়ে বল।
আমি বললুম, সেটা পরে হবে। তুমি বরঞ্চ বল, হেরমান কী বললে?
হঠাৎ থেমে গিয়ে বললে, দেখো হের ডক্টর হের প্রফেসর, প্রাচীন দিনের কথা স্মরণে আনন। তোমার কোনও আদেশ, কোনও নির্দেশ আমি কস্মিনকালেও অমান্য করেছি? এখনও কি আমার পালা আসেনি আদেশ করার–গলায়, অল্প অত্যল্প ভেজা ভেজা অভিমানের সুর।
আমি হন্তদন্ত হয়ে বললুম, এ কী বলছ তুমি। তুমি যা বলবে, তাই হবে। সে আমলে। বললেও হত। ওই যে ফোনের বাক্স
তার বাঁ হাত দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে পাঁজরে দিলে কাতুকুতু।
আমি কোঁক বলে সামনের দিকে দু ভাঁজ হই আর কি।
লটে ভারি পরিতৃপ্ত হয়ে বললে, একদিন তোমার বাড়িতে রান্নাঘরে ঢুকে দেখি সেই গুণ্ডা অসকার তোমাকে সোফায় চিৎ করে ফেলে তার লোহার আঙুল দিয়ে তোমার পাঁজরে যেন পিয়ানো বাজাচ্ছে। আর তুমি পরিত্রাহি চিৎকার ছাড়ছ। আমারও বড় শখ হয়েছিল, আমিও মজাটা চেখে দেখি। এবারে ভাবলুম, এত দিনে বোধহয় পাঁজরে তোমার আর সে সেনসিটিভনেস নেই। আছে, আছে, আছে। তুমি এখনও আমাদের সনাতন ফুটবল টিমের ক্যাপটেন। থাক ফোনের কেচ্ছা। হেরমান বলছিল, কাফেতে যাচ্ছি, উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু ডিনার বাইরে কেন? তার শিকারের উত্তম হরিণের মাংস যখন বাড়িতে রয়েছে।
আমি বললুম, আহ্!
মানে?
আমি জিভ চ্যাটাং চ্যাটাং করে বললুম, হরিণ আমি বড্ড ভালোবাসি। কিন্তু তার জন্যে হরিণের মতো আমিও কি তার হাতে শিকার হব?
আর বললে, সিনেমাটা বাদ দাও। ওখানে তো রসালাপ করতে পারবে না। বরঞ্চ বাড়িতে ডিনার খেয়ে পার্কে যাবে। আমি বললুম, চেষ্টা দেব বন্ধুকে নিয়ে আসতে। এখন চল কাফেতে।
আমি পুনরায় মেরির ভেড়ার মতো লটের পিছনে পিছনে কাফেতে ঢুকলুম।
.
২৪.
ভোজনান্তে দীর্ঘ জীহ্বা প্রকাশিয়া ইন্দ্রধনু বিনিন্দিত হনুদ্বয় বিস্তারিয়া
আপনি যদি উদরস্থ বায়ু পাঠান-মুল্লুকের গিরিদরি প্রকম্পিত করে সশব্দে আস্যদেশ থেকে উছুসিত না করেন, সোজা বাঙলায় একটা বিরাট রামবোম্বাই ঢেঁকুর না তোলেন (নাবালেও পাঠান বিচলিত হয়ে স্বীয় উষ্ণীষপুচ্ছ নাসিকারন্ধ্রে স্থাপন করবে না) তবে পাঠান অতিথিসেবক বড়ই মিয়মাণ হয়ে আন্দেশা করে, তার ধর্মপত্নী স্বহস্তে ১২৮ ডিগ্রির উষ্ণতম বাতাবরণে অশেষ ক্লেশ ভুঞ্জিয়া যে খাদ্যাদি প্রস্তুত করলেন সেটি আপনার রসনাপূত হয়নি। পক্ষান্তরে আপনি যদি এই ভদ্ৰস্ততা কোনও ডিউক ডিউক কেন, ডিউকেতরের– বাড়িতেও করেন তবে অনায়াসে ধরে নিতে পারেন যে ও-বাড়িতে প্রভু খ্রিস্টের ন্যায় ওইটেই আপনার লাস্ট সাপার (Suffers) এবং সেইটে অজরামর করে রাখবার জন্য লেওনার্দো দা ভিঞ্চির সন্ধান নিতে পারেন।
ইংল্যান্ডের কায়দা-কেতার সঙ্গে কন্টিনেন্টের কায়দা-কেতার বেশ খানিকটে তফাৎ আছে। ইংল্যান্ডে সবসময়ই লেডিজ ফার্স্ট। এই সুবাদে একটি অতি মনোরম সত্য ঘটনা মনে পড়ল। সেটা বলছি।
ইতোমধ্যে সদর রাস্তা থেকে গলিতে ঢুকে লটে ছোট একটা কাফেতে ঢুকল। আমি পিছন পিছন। সঙ্গে সঙ্গে অন্তত তিনটি কণ্ঠ যেন গির্জের হাল্লেলুইয়া, হে প্রভু! তোমার স্বর্গরাজ্য এই খর-তাপদগ্ধ মরুতে নেবে আসুক, ডমিনুস্ ভবিসকুম শেষ পর্যন্ত শেষ পর্যন্ত, অবশেষে অবশেষে, আখের আখের এলি। দর্শন পেলুম। দিবারাত্তির মিনষেকে জাবড়ে ধরে শুয়ে থাকিস নাকি? না–
লটে রেসেপশন কমিটির গণ্যমান্য সদস্যদের হুলুধ্বনি উপেক্ষা করল মদ্দেশীয় কংগ্রেসি মাইলৰ্ডরা যেরকম সর্বপ্রকারের প্রশস্তি নবমীনিন্দিত আবাহন তাচ্ছিল্য ভরে উপেক্ষা করেন কিন্তু শুনে যাওয়ার ভান করেন। লটে অবশ্য কোনও প্রকারের ছলাকলা কস্মিনকালেও জানত না। তাই শুধাল, হের প্রফেসর ডক্টর সৈয়দকে যে একটা মামুলি গুড মর্নিংও বললিনে! মেয়েগুলো লটের মেয়ের বয়সী; আমাকে চিনবে কী করে? একজন বললে, মাকে ডেকে আনি।
লটে : হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই কর। ওর সঙ্গে হয়তো আমাদের কালামানিকের গোপন প্রেম ঘুপসি ভাব-ভালোবাসা ছিল। আমাদের লটবরটি তোদের মায়ের যৌবনে ছিলেন একটি আস্ত পেটিকোট-শিকারি ব্রা-বিজয়ী। আমি বললুম, ছিঃ! পফুই।
লটে বললে, মডার্ন হতে শেখো। নইলে আমার সঙ্গে নাগরালি চতুরালি করবে কী করে? নিরামিষ প্রেমে আমার অরুচি।
আমি কথাটা চাপা দেবার জন্য বললুম, তোমাকে একটা মর্মস্পর্শী সত্য ঘটনা বলছি– এটিকেটের সুবাদে এইমাত্র মনে পড়ল। তোমদের দেশে তো প্রায় কুল্লে মোকা-বেমোকাতে লেডিজ ফার্স্ট। এখন হয়েছে কী, ফরাসি বিদ্রোহের সময় উন্মত্ত জনতা কোনওপ্রকারের বাছবিচার না করে কচুকাটা করছিল ফ্রান্সের ডুক, ব্যারন জমিদার তাবৎ খানদানি অভিজাতদের। প্রথম তাদের জেলে পুরে, পরদিন ভোরবেলা একজনের পিছনে অন্যজনের দীর্ঘ লাইন করে মেয়ে-মন্দ সবাইকে মন্থর গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেত গিলোটিনের দিকে কারাগারের বিরাট চত্বর ক্রস করে। সর্বপ্রথম জন এগিয়ে গিয়ে মুণ্ডুটা ঢুকিয়ে দিত গিলোটিনের ফ্রেমের ফুটোটাতে। হুশ করে নেবে আসত দারুণ ভারি সুতীক্ষ্ণ ট্যারচা তিনডবল খড়গের চেয়ে সাইজে বড় একটা কাটার। বিদ্যুৎবেগে মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ত মাপ-মাফিক অদূরে রক্ষিত একটা বাস্কেটের ভিতর (ফরাসি স্ল্যাঞ্জে তাই এখানে বলে বাস্কেটে থুথু ফেলা অর্থাৎ গিলোটিন প্রসাদাৎ পরলোকগমন)। জল্লাদ সেটা সরিয়ে দিয়ে সেখানে নতুন বাস্কেট রাখার পর কিউয়ের দ্বিতীয় উমেদারের দিকে তাকাবার পূর্বেই তিনি এগিয়ে আসতেন। পূর্ববৎ প্রক্রিয়া।
এখন হয়েছে কী, সে প্রভাতে কিউয়ের পঞ্চম ব্যক্তি ছিলেন এক সাতিশয় খানদানি মনিষ্যি, ফ্রান্সধিরাজ সম্রাটের ভাগ্নে না কী যেন। তিনি বন্দি হওয়ার সময়ই জানতেন তাঁর অদৃষ্টে কী আছে। তাই তার সর্বোত্তম রাজদরবারি বেশ পরেই তিনি কারাগারে এসেছিলেন। সকালে বধ্যভূমিতে নির্গত হওয়ার পূর্বে ঘণ্টাখানেক ধরে প্রসাধন করেছেন। জুতোর খাঁটি রুপোর বগলস ঘষে ঘষে ঝা চকচকে করেছেন। পা থেকে আরম্ভ করে সর্বশেষে মাথার পরচুলার উপর সযত্নে পাউডার ছড়িয়েছেন। আহা যেন নব বর– গিলোটিন-বধূকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছেন।
তিনি লক্ষ করেছিলেন, কিউয়ে ঠিক তারই সামনে একটি মহিলা।
আমাদের নব বর কিউ থেকে একপাশে সরে গিয়ে ডান হাত দিয়ে মাথার হ্যাট তুলে, বা হাত বুকের উপর রেখে কোমরে দুভাজ হয়ে বাও করে মহিলাটিকে বললেন, আমাকে স্মরণাতীতকাল থেকে আমার মা-জননী আদেশ করেছেন, লেডিজ ফার্স্ট। সে আইন আমি কস্মিনকালেও অমান্য করিনি। আজ বড়ই প্রলোভন হচ্ছে মাত্র একবারের তরে সে আইন খেলাফ করি। একবারের বেশি যে করব না সে-শপথ আমি মা মেরির পা ছুঁয়ে গ্রহণ করতে প্রস্তুত। প্রমাণস্বরূপ আরও নিবেদন করতে পারি মাতৃলব্ধ সেই অনুশাসন ভঙ্গ করার পর ধন্য হে জননী মেরি, তুমি মা করুণাময়ীর অশেষ করুণায়– যার পদপ্রান্তে আমরা ত্রিসন্ধ্যা অশ্রুজলসিক্ত প্রার্থনা জানাই, দেবতাত্মা মা মেরি দেবজননী। পাপী-তাপী আমাদের ওপর এক্ষণে তোমার আশীর্বাদ বর্ষণ কর এবং যখন মরণের ছায়া আমাদের চতুর্দিকে ঘনিয়ে আসবে। আমেন– তাঁরই অশেষ করুণায় আমার মাতৃদত্ত সেই অনুশাসন ভঙ্গ করার পর আমি মাত্র মিনিট তিনেক ইহসংসারে মাতৃআজ্ঞা লঙ্ন করার বিবেকদংশনে কাতর হব, তিন মিনিট হয় কি না হয় মরণের ছায়া ঘনিয়ে আসবে, মা মেরি আশীর্বাদ করবেন, তাঁরই পদপ্রান্তে অনন্ত শান্তি অশেষ আনন্দ পাব।
আমার একান্ত অনুরোধ কিউয়ে আপনি আমার স্থানটি গ্রহণ করুন। আমি আপনার স্থানটি গ্রহণ করার ফলে গিলোটিনে যাব আপনার পূর্বে লেডিস ফার্স্ট আইন সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় ভঙ্গ করব এ জীবনে প্রথমবার এবং এ জীবনে শেষবারের মতো। এই আমার সকরুণ ভিক্ষা আপনার কাছে।* যে বংশে জন্মেছি তার প্রসাদে এবং প্রাসাদে আমাকে কখনও ভিক্ষা করতে হয়নি। এ জীবনে এই আমার সর্বপ্রথম ভিক্ষা গ্রহণ এবং দ্বিতীয়বার এ দীনাচার করার পূর্বে সেটা চূর্ণবিচূর্ণ করে অনন্তলোকের প্রতি অভিযান। মা মেরির জয় হোক।
[*১. আত্মহত্যা করার পূর্বে হিটলার তাঁর উইলে অনুশাসন করেন এবং তাঁকে বাচনিক আদেশ দেন গোবেলস যেন তার মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী (চ্যান্সেলর) রূপে কর্মভার গ্রহণ করেন। কিন্তু গোবেলস আত্মহত্যা করেন হিটলারের মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা পর। তার উইলে লেখেন, আমার জীবনে এই প্রথম আমি ফুরারের আদেশ অমান্য করলুম। কিন্তু এটা লিখতে ভুলে গেলেই এবং এইটেই শেষ অবাধ্যতা। আফটার অল গোবেলস তো খানদানি ভদ্রলোক নন। ফরাসি অভিজাতদের মতো তার পেটে এত এলেম, বুকে অত দরদ হবে কোথায়?]
লটের চোখ দেখি ছলছল করছে। মেয়েটা চিরকালই স্পর্শকাতর আর অভিমানী।
কাফের রেসেপশন কমিটির মেয়েরাও তখন গুঁড়ি গুঁড়ি এসে আমার কাহিনী শুনছে।
আমি বললুম, তুমি তো সাতিশয় খানদানি–
কী যে বল!
আমি বললাম, তোমরা লিমেরা রেগরা, গ্রেটে-কেটেরা, তোমরাই তো এখানকার প্রাচীনতম বাসিন্দা। এবং আপস্টার্ট মার্কিনদের সঙ্গে দু-পয়সার মোহে ধেই ধেই নৃত্য না করে উপায়ান্তর না দেখে আপন আপন বাস্তুবাড়িতে নিজেদের জ্যান্ত গোর দিয়েছ–
থাক, থাক। আমি হলে কী করতুম? বলতুম, না, সম্মানিত মহাশয়। আমি তিন মিনিট বেশি বাঁচলুম কি না বাঁচলুম সেটা অবান্তর। কিন্তু আপনি আপনার মাতৃ আজ্ঞা– তা সে মৃত্যুর তিন মিনিট পূর্বেই হোক আর তিন বছর পূর্বেই হোক– লজ্জন করতে যাবেন কেন? ফল যাই হোক না কেন। অবশ্য আমি নিশ্চয় জানি, আপনার পুণ্যশীলা মাতা মা মেরির পদ-প্রান্ত থেকে সস্নেহ দৃষ্টিতে আপনার দিকে তাকিয়ে আপনাকে আশীর্বাদ করবেন, আপনাকে গর্ভে ধরে নিজেকে ধন্য মনে করবেন।
লটে হঠাৎ বলে উঠল, এই হুঁড়িরা, তোরা ভাগ দেখি এখান থেকে। আমি হেরমানকে ফাঁকি দিয়ে ছোঁড়াটাকে (আমি মনে মনে বললুম, আমি সিটি সিস্ ইয়ার ওল্ড নই, আমি সিক্সটি সি ইয়ার ইয়ং) নির্জনে নিয়ে এলুম পীরিত করব বলে। তোরা আবার বাগড়া দিচ্ছিস কেন? যাঃ! মেয়েগুলো হুড়মুড়িয়ে একে অন্যের ঘাড়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্ধান। শুধু একজন বললে, কোজনেফ মা! লটে মাসি যে অ্যাদ্দিন ডুবে ডুবে শ্যামপেন খাচ্ছিলেন সে তো এ মুল্লুকের কোনও চিড়িয়াও জানত না।
লটে আমার পায়ের উপর জুতো বসিয়ে সম্পূর্ণ মোলায়েমসে চাপ দিল।
আমি সোৎসাহে বললুম, গো… ল।
লটে : মানে?
তোমার পা দিয়ে কী করছ? ফুটবল খেলছ না?
বললে, ধ্যৎ। আমার পাশেই ছিল একটা হ্যাট-স্ট্যান্ড। হঠাৎ লটের নজর গেল। সেদিকে। সবচেয়ে ধূলিমাখা হ্যাটটি নামিয়ে এনে বললে, এইটেই তো তোমার? দাঁড়াও আসছি। বলে কাউন্টারে গিয়ে সেখান থেকে নিয়ে এল একটা ব্রাশ। টুপিটাকে অতি সযত্নে ব্রাশ করতে করতে বললে, তোমাকে দেখভাল করার জন্য ইহসংসারে কেউ নেই। টুপিটার গণ্ডি নিচের দিক থেকে যে ধুলো বেরুল সে-রঙের ধুলো এ দেশে নেই। আর এদেশে দেখভাল করার তরে কেউ যে নেই সেটা তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
আমি বললুম, কী যে বল। তুমি তো রয়েছ।
লটের চোখে ফের জলের রেখা। হতাশ কণ্ঠে বললে, কদিনই-বা এদেশে থাকবে। আর কবারই তোমার দেখা পাব। কিন্তু ভেবে দেখ দিকি, এটা কি একটা আশ্চর্য ঘটনা নয়। বল। দেখি এ পৃথিবীতে কটা মেয়ে দশ বছর বয়সে যাকে ভালোবেসেছে তাকেই ফিরে পেল চল্লিশ বছর পরে। তা-ও নিতান্তই দৈবাৎ। তুমি যদি দশ মিনিট পর ট্রাম-স্ট্যান্ডে আসতে তো তোমার সঙ্গে দেখাই হত না; আমার ট্রাম এসে যেত আর আমি চলে যেতুম কোথায় কোন পোড়ারমুখো বন শহরে। তার পর ফের দেখা হত পঞ্চাশ বছর পরে।
আমি বললুম, মোটেই বিচিত্র নয়। তোমার ঠাকুদ্দার বাবা তো বেঁচেছিলেন একশো এক বছর! তুমিই-বা কী দোষ করলে।
রাগের ভান না রাগ, হতে পারে দুটো মিশিয়ে, বললে, তোমার শুধু হাসাহাসি আর ঠাট্টা মজা। কোনও জিনিস সিরিয়াসলি নিতে পার না।
আমি শঙ্কা আর দুর্ভাবনার ছল করে শুধালুম, আমাদের প্রেমটা কি বড়ই সিরিয়াস?
আকাশ পানে হানি যুগল ভুরু বললে, দারুণ ডেঞ্জারাস, কখন যে ফট করে আমার হার্টটা টুক করে ফেটে যাবে তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। আর শোনো, আমি একশো বছর বাঁচতে চাইনে।
কেন?
হেরমানের পরিবারের সবাই স্বল্পায়ু… বাপের দিক থেকে, মায়ের দিক থেকেও। সে আমার আগে চলে গেলে আমি সইতে পারব না। বেশিদিন বাঁচব না। আমি মনে মনে সমস্ত হৃদয় দিয়ে প্রার্থনা করলুম। তোমার সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় থাকুক। তোমার জীবন যেন খণ্ডিত না হয়। তুমি অখণ্ড সৌভাগ্যবতী হও।
.
২৫.
আমি শুধালুম, লটে, এদেশে তো নিয়ম কাফে-রেস্তোরাঁ-পাব-এ ঢোকার সময়ে ব্যত্যয় হিসেবে লেডিজ ফার্স্ট নয়, পুরুষ আগে ঢোকে। তবে তুমি হুট করে এ-রকম পয়লা ঢুকলে কেন?
উত্তর শুনে বুঝলুম লটে রীতিমতো তালেবর মেয়ে হয়ে উঠেছে। বললে, এটিকেট যারা অন্ধভাবে মেনে চলে তারা হয় মূর্থ নয় সব। স্নব-রা সর্বক্ষণ ভয়ে মরে, ওই বুঝি এটিকেটের পান থেকে চুন খসে গেল, এবং সঙ্গে সঙ্গে সবাই বুঝে গেল যে সে আসলে নিম্ন পরিবারের লোক কিন্তু এখন দু-পয়সার রেস্ত হয়েছে বলে উঠেপড়ে লেগেছে কী করে খানদানি সমাজে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়। তা হলেই তো সর্বনাশ। স্নেক অ্যান্ড ল্যাডার খেলায় সাপের মুখে পড়লে যেরকম এক ধাক্কায় স–স-র করে পিছলে পড়ে ফের আপন কোটে ফিরে যেতে হয় তারও হবে সেই হাল। আবার, ফের, ফিনসে। আসলে এ এটিকেটের কারণটা কী? রেস্তোরাঁ-পাব-এতে আকছারই কোনও কোনও পেঁচি মাতাল এমনকি অতিশয় খানদানি মনিষ্যিও (শোনোনি ড্রাঙ্ক লাইক এ লর্ড) বানচাল হয়ে হইহুল্লোড় লাগায় আকছার। ওই অবস্থায় কোনও লেডি যদি হুট করে হঠাৎ ঢুকে পড়েন তবেই তো চিত্তির। তিনি হবেন বিব্রত অপ্রতিভ। তাই সঙ্গের পুরুষ তার আগে ঢুকে পাব-এর বাতাবরণটা জরিপ করে নিয়ে হয় তদণ্ডেই বেরিয়ে যায় নয় তাকে গ্রিন সিগনেল দেয়। বেরুবার সময় কিন্তু লেডিজ ফাস্ট। লেডির উপস্থিতিতে সে হয়তো বিল বাবদে স্লো সার্ভিস নিয়ে কথা কাটাকাটি করতে চায়নি। লেডি বেরিয়ে গেলে কাউন্টারে গিয়ে প্রেমসে লড়াই লাগাবে। হয়তো-বা বড় বেশি বিয়ার খাওয়ার ফলে পেট টনটন করছে– সে স্থলে স্বয়ং কাইজারও ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারেন না– অর্থাৎ বাথরুম– সে স্থলে একটা চুঁ মেরে আসতে চায়।
এ কাফেটি আমি চিনি আমার হাতের চেটোর মতো– দশ বছর বয়স থেকে। কাফের অধিষ্ঠাত্রী মালিক আমাকে চেনেন সেই আদ্যিকাল থেকে। এখানে আমি হুট করে ঢুকলে বিব্রত হব কেন? তদুপরি সবচেয়ে মোক্ষম তত্ত্ব যেটা অবতরণিকাতেই বলা উচিত ছিল যে, এ কাফেতে মাদকদ্রব্য আদৌ বিক্রি হয় না। এখানে বানচাল হবে কী গিলে? আইসক্রিম, চা, কোকো, নেবুর রস, ইওগুর্ত (দই), কফি?–আর কালো কফি খেলে তো নেশা কেটে যায়।
আমি শুধালুম, লটে, তুমি কখনও নেশা করে বানচাল হয়েছ?
লটে বললে, বা রে। সেই যে দশ বৎসর বয়সে তোমাকে ভালোবেসেছিলুম সে নেশার খোয়াড়ি তো এখনও কাটেনি। অবশ্য একথা ঠিক, তোমার সঙ্গে যদি ফের দেখা না হত তবে সে প্রেম এরকম মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠত না। শুনেছি, চীন দেশে নাকি একরকম মোক্ষম দারুণ কড়া মদ আছে। রুশদের ভোদকা, ফরাসিদের আবাৎ তার কাছে নাকি একদম নিম্বুপানি। সে-মদ রাত দশটা অবধি দু-তিন পাত্তর খেতে না যেতেই পুরো পাক্কা নেশা। তার পরও যদি খাও তবে হয় বমি করবে, নয় অঘোরে ঘুমিয়ে পড়বে। পরের দিন ঘুম ভাঙতে দেখবে নেশা বিলকুল কেটে গিয়ে মাথা একদম সাফ। তখন সামান্য একটুখানি প্রাতরাশ সেরে খাবে দু-পেয়ালা গরম জল। আর যাবে কোথা? চড়চড় করে ফের নেশা চড়বে হুবহু আগের রাত্তিরের মতো। চীনারা বলে, আগের রাত্তিরের নেশার একটা তলানি পেটে জমে থাকে আর পাঁচটা মদের মতো শরীর থেকে বেরিয়ে যায় না। সেটাতে গরম জল পড়লেই সে মাথাচাড়া দিয়ে জেগে ওঠে, আবার সেই অরিজিনেল মদের কাজ করে। পরের দিন আবার দ্বিতীয় দিনের মতো স্রেফ দু-পেয়ালা গরম জল ঢাললেই ফের উত্তম নেশা, করে করে একবার মদ খেয়ে তিন দিন ধরে তিন বার নেশা করা যায় একই খর্চায়।
আমি শুধালুম, মদ্যাদি ব্যাপারে যে তুমি এত গবেষণা করেছ সে তো আমি জানতুম না।
চোখ পাকিয়ে বললে, তুমি একটা আস্ত বুদ্ধ (জর্মনে বলে ডো তার পর সেই ডোফ শব্দের তর তম করে বললে ডোফ–ডোভার– কালো)। রূপকটা একদম ধরতে পারনি। আমার দশ বৎসর বয়সে তুমি যে প্রেমমদিরা খাইয়েছিলে, চল্লিশ বৎসর পরে এসে তার তলানিতে ঢাললে দু পেয়ালা গরম জল। সে প্রেম ফের চাড়া দিয়ে উঠল। বুঝলে? না টীকার জন্য প্রফেসর কিফেলের সন্ধানে বেরুতে হবে।*[*প্রফেসর কিফেল গডেনবের্গে বাস করতেন বলে লটে তাকে চিনত। বন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত পড়াতেন। পুরাণ সম্বন্ধে তিনি একখানা বিরাট গ্রন্থ রচনা করেন। নাম ইন্তিশে কসমোগনি। বহু জর্মন-অজর্মনকে উত্তম সংস্কৃত শিখিয়েছিলেন আমাকে শটকে শেখাতে পারেননি। সেনসাস রিপোর্টে ধর্মস্থলে তিনি লেখেন, বৌদ্ধ।]
খানিকক্ষণ মুচকি হেসে শুধালে, আচ্ছা বল তো, আমার বয়স যখন কুড়ি আর তোমার ছত্রিশ তখন আমাদের দেখা হলে কী হত?
আমি সতর্কতার সঙ্গে শুধালুম, হেরমান তখন বাজারে ছিল কি?
বললে, জোঃ। শুধু হেরমান! আমি কি অতই ফ্যালনা! আমার রসের হাটে অন্তত হাফ ডজন নাগর ছিলেন। সপ্তাহের ছটা দিন ছটা উইক-ডে ওদের ভাগ করে দিয়েছিলুম রীতিমতো টাইম-টেবল বানিয়ে। আর রোববারটা রেখেছিলুম ফ্রি চয়েসের জন্য। সপ্তাহের ছ দিনের আটপৌরে কাপড় পরার মতো আটপৌরে লাভার নিয়ে তো রোববার বেরুনো যায় না। পরতে হয় সানডে বেসটু। কিন্তু কই আমার কথার তো উত্তর দিলে না।
কোন কথা?
ঠোঁট বেঁকিয়ে বললে, লাও! কোন কথা? হায়রে আমার লাভার! আমার বয়স যখন কুড়ি আর তোমার
অ! বুঝেছি বুঝেছি, কিন্তু জুলিয়েটের বয়স তো ছিল চোদ্দ।
সে তো ইতালির মেয়ে, প্রেমের ফুল ফুটে যায় কলিটা ভালো করে শেপ নেবার পূর্বেই। ওরা তো দক্ষিণ দেশের।
মনে মনে বললুম খাস কলকাত্তাই বজবজের লোককে বলে দোনো। ওরা নাকি বড়ই অকালপক্বতা রোগ ধরে দোহাই ধর্মের আমাকে দোষ দেবেন না– শুনেছি, কলকাতায় ফুর্তি করতে এসে চারটি পয়সা বেঁচে গেলে কাগজ কিনে খুড়োর নামে একটা ভুয়ো মোকদ্দমা লাগিয়ে গ্রামে ঢোকার সময় খুড়োকে শুধিয়ে যায় মোকদ্দমা লাগিয়ে এসেছি, খুড়ো! এইবারে শিকের ঝুলনো হাঁড়ি থেকে ধুতি শার্ট বের কর। সদরে কবার ছুটোছুটি করতে হবে রাসবিহারী ঘোষও বলতে পারবে না। আর ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরে যেও। নইলে খবরটা আমার কানে পৌঁছলে আমি তোমার ভাইপো হিসেবে বড় লজ্জা পাব যে।
ওদিকে লটে অতিষ্ঠ।
আমি গম্ভীর কণ্ঠে বললুম, ওই সময়ে দেখা হলে, হুঁ, একটা আতশবাজি, একটা বিশ্বযুদ্ধ, একটা ভূমিকম্প, একটা দাবানল, একটা প্রলয়ঙ্করী মন্বন্তর, একটা– মুখে আর কথা জোগাল না। ঈষৎ ভয় পেয়ে বললুম, কিন্তু নাৎসিরা তখন সর্বশক্তিমান। তারা কি আমাকে ছেড়ে কথা কইত! আমাকে ইহুদি ভেবে—
যাহ্। তোমাকে ইহুদি ভাবতে যাবে এমনতরো দু চোখ কানা নাৎসিদের ভিতরও হয় না। ইহুদিদের মতো শকুনিপারা বাঁকা নাক তোমার কোথায়? কোথায় মোটা মোটা ঠোঁট যার নিচেরটা ঝুলে পড়েছে বিঘৎ খানেক? কোথায় দুটো বিরাট বিরাট কান যেগুলো মাথার সঙ্গে চেপ্টে না গিয়ে পার্পেনডিকুলার হয়ে যেন আকাশের দু-প্রান্ত ছুঁয়ে উঠে আছে দুনিয়ার কে কী বলছে সেসব সাকুল্যে শোনার জন্য যেন ফাঁদ পেতেছে। আর বলতে নেই কিন্তু কোথায় তোমার সেই হাফ-মেয়েলি নাদুসনুদুস যুগ নিতম্ব ইহুদিদের পেটেন্ট করা মাল? বরঞ্চ আমাকে ইহুদিনী বলে ভাবতে পারে।
আমি ভয় পেয়ে বললুম, করেছিল নাকি?
তাচ্ছিল্লির সঙ্গে বললে, এক লক্ষ্মীছাড়া কালো কুর্তিপরা নাৎসি আমার সঙ্গে আলাপচারী করার জন্য কোনও অরিজিনাল পন্থা না পেয়ে শেষটায় ক্যাবলাকান্তের মতো বত্রিশটা পোকায় খাওয়া মুলোর মতো হলদে দাঁত বের করে শুধল, আমি ইহুদিনী কি না?
আমি বললুম, সর্বনাশ! আমসটার্ডমের আন ফ্রাঙ্কের কথা মনে পড়াতে শরীরটা শিউরে উঠল। কনসানট্রেশন ক্যাম্পে অসহ্য যন্ত্রণা ভুলে যে গেল, তার দিদি মৃত্যুশয্যায় ছটফট করতে করতে উপরের বাঙ্ক থেকে সিমেন্টের মেঝেতে পড়ে শিরদাঁড়া ভেঙে মারা গেল। তাদের বুড়ি মা গেল অন্য ক্যাম্পে অনাহারে, কিন্তু শান্তসমাহিত-চিত্তে। পরিবারের মাত্র একজন বেঁচে গেলেন অবলীলাক্রমে। হুকুম এসেছিল যে কটা ইহুদি, বেদে, বামন বাঁটকুল আছে (এই বাটকুলেরা সার্কাসের ক্লাউন প্রভৃতি সেজে নাৎসি কসাইদের মনোরঞ্জন করত বলে এদের গ্যাস-চেম্বারে পাঠানোটা ক্রমেই পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। তাদের সবাইকে খতম করে কনসানট্রেশন ক্যাম্প নিশ্চিহ্ন করা হোক। কিন্তু সে আদেশ পালন করার পূর্বেই রাশানরা ক্যাম্প জয় করে সবাইকে মুক্তি দিল। এরই মধ্যে ছিলেন আন ফ্রাঙ্কের পিতা। ইনি যখন কৃষ্ণ সমুদ্র থেকে বাড়ি আমসটার্ডম পাড়ি দিলেন তখন তারই মতো অবলীলাক্রমে নিষ্কৃতিপ্রাপ্ত ইহুদিদের কাছ থেকে শুনতে পেলেন তাঁর পরিবারের সম্পূর্ণ বিলুপ্তির কথা।*
[*হিমলার সম্প্রদায় যে কী মারাত্মক আহামুকিবশত কত লোক মেরেছে তার হিসাব নেই। একবার ধরা পড়ে কয়েকশো বা হাজার এক অজানা জাতের লোক। বিস্তর এনসাইক্লোপিডিয়া ঘেঁটেও হিমলারের জাতি নিরূপণ বিভাগের উঁইফোড় পণ্ডিতরা স্থির করতে পারলেন না, এরা আর্য না অনার্য, সাবধানের মার নেই এই তত্ত্বের স্মরণে শেষটায়– বোধহয়, একটা মুদ্রা টস করে– ওদের গ্যাস-চেম্বারেই পাঠানো হল। যুদ্ধের পর সন্দেহাতীতরূপে আন্তর্জাতিক গবেষকরা মীমাংসা করলেন এরা আর্য। এ জাতের কটা লোক এখনও বেঁচে আছে কেউ জানে না।]
লটে বললে, আমি তেড়ে বললুম, আমার চতুর্দশ পুরুষ ইহুদি। তার পর হ্যান্ডব্যাগ থেকে বের করে আমাদের ছাপানো কুলজি দিলুম বাছাধনের হাতে। ওটা ছাপা হয়েছিল কাইজারের আদেশে। তিনি অবশ্য তখন নির্বাসনে। কিন্তু কাইজার থাকাকালীন তিনি এরকম কেউ শতায়ু হলে তাকে অভিনন্দন জানাতেন, ঠাকুদ্দার বাবাকেও সেই রীতি অনুযায়ী শুভেচ্ছা। জানান এবং অনুরোধ করেন আমাদের কুলজি যেন নির্মাণ করা হয়।
আমাদের অধ্যাপক কিফেল, গেরেমভারি বিস্তর বাঘা বাঘা প্রফেসর মায় পাদ্রি সাহেবরা, যাদের গির্জেতে আমরা বাপ্তিস্ট হয়েছি এবং চার্চের কেতাবে আমাদের নাম রয়েছে– এন্তের গবেষণা করে প্রমাণ করলেন আমাদের পরিবার সাতশো বছরের পুরনো ক্যাথলিক। এর চেয়ে প্রাচীনতর কোনও পরিবার আছে বলে তারা জানেন না। এটা যখন তৈরি হয় নাৎসিরা তখনও দাবড়ে বেড়াতে আরম্ভ করেননি। কাজেই ওতে কোনও ফাঁকি-ফক্কিকারি ছিল না। আর গোটা ফতোয়াটাতে ক্যা অ্যাব্বড়াবড়া শিলমোহর– সুপ প্লেটের সাইজ।
কথা থামিয়ে হঠাৎ বললে, বেচারি হেরমানকে কতক্ষণ বসিয়ে রাখবে? না বাইরে খাবে।
আমি বললুম, না হয় হেরমানের হাতে গুলি খেয়েই মরব। কিন্তু হরিণের মাংসটা খেয়ে নিয়ে।
বললুম, এই আসছি, কাউন্টারে গিয়ে কিনলুম একটা ঢাউস কেক।
ফিরতেই লটে বললে, এ আবার কী আদিখেত্তা।
আমি বললুম, হেরমানের জন্য ঘুষ।
বললে, আ! ঘুষ দেবার প্রাচ্যদেশিক পদ্ধতি এদেশে আবার আমদানি করছ কেন?
.
২৬.
বন-গডেসবের্গে একদা প্রবাদ ছিল, হাতে যদি মেলা সময় থাকে তবে ট্রামে চাপো, নইলে হন্টনই প্রশস্ততর, অর্থাৎ সংকীর্ণতর অর্থাৎ কম সময় লাগবে। কারণ এসব প্রাচীন শহরে এত গলিখুঁজির শট-কাট রয়েছে যে ট্রামকে অনায়াসে ঢিড দিতে পারেন–কারণ তাকে যেতে হয় চওড়া রাস্তা দিয়ে এবং তাকে অনেকখানি ঘুরে-ফিরে কখনও-বা ট্রায়েঙ্গেলের দুই সাইড কাভার করে, কখনও-বা চতুর্ভুজের তিন ভুজ দিয়ে তিন হদ্দি (ঈশ্বর রক্ষতু। চৌহদ্দি হয়) কেটে মোকামে পৌঁছতে হয়। বস্তুত আপনি ঘলিযুঁজি দিয়ে যাবার সময় ওই ট্রামকে অন্তত বার দু তিন অনেক দূর থেকে দেখতে পাবেন আপনার অনেক পিছনে। বস্তুত সে আমলে তিন শ্রেণির লোক ট্রামে চাপত: প্রথম-বিশ্বযুদ্ধে আহত খঞ্জ, বাচ্চা-কোলে মা এবং থুতুরে বুড়ি। বস্তৃত কোনও সুস্থ-সমর্থ যুবক ট্রামে উঠলে সবাই ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকাত : ভাবত নিশ্চয়ই অগা টুরিস্ট কিংবা মুক্ত পাগল (বদ্ধ পাগল নয়): পাগল গারদকে ফাঁকি দিয়ে পালাচ্ছে।
শুনেছি, কাশীর ঠিক মধ্যিখানে ওই একই হাল। হাতে এন্তের সময় থাকলে টাঙ্গাগাড়ি নেবে, না থাকলে চরণশকট। দিল্লিতে তো রীতিমতো এর আঙ্গিনা দিয়ে, ওর রান্নাঘরের দাওয়া থেকে লক্ষ মেরে তেসরা আদমির চৌবাচ্চায় উঠে, এমনকি সুড়ুৎ করে কোনও রমণীর প্রসাধনকক্ষের এক দরজা দিয়ে ঢুকে অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে মোকাম পৌঁছানই রেওয়াজ। কেউ কিছুটি বলবে না।
রাস্তায় নেমে লটে শুধাল, ট্রাম না হন্টন?
আমি গুনগুন করে গান ধরলুম,
–তোমারি অভিসারে
যাব অগম পারে—
লটে খুশি হয়ে বললে, বাহ্ তোমার তো বাস ডুঙ্কেলে (অন্ধকার) গলা।
আমি শুধালুম, ডুঙ্কেলে স্টিমে, সে আবার কী?
ও হরি, তা-ও জানো না। হেলে স্টিমে– সে হল পরিষ্কার গলা–
আমি অভিমানভরে বললুম, বদখদ গলা? সেকথা সোজা কইলেই পার, অত ধানাইপানাই কেন? আর তোমার হেরমানের গলা বুঝি কোকিলের মতো, সুজ কুকুক না (চুলোয় যাকগে)–*
[*জর্মন শিক্ষার্থীদের উপকারার্থে : কোকিলকে জৰ্মনে কুকুক বলে। তবে দু টাতে বোধহয় কিঞ্চিৎ পার্থক্য আছে– যদুর আমার জ্ঞান। সুজ কুকু নমাল, অনেকটা আমাদের কছু, ঘন্টা, হাতি-র মতো। এস্থলে কোকিলকেই কেন বেছে নেওয়া হল সে প্রশ্ন যদি আপনি শুধোন তবে উত্তর, কচু, ঘণ্টা, হাতিই বা আমরা বেছে নিলুম কেন? ছাই জানেনা কেন? আর জমনে বলা হয়, যে কোকিললোকে (কুকুকসৃল্যান্ড) বাস করেছে সে মহাশূন্যে বাসা বেঁধেছে; বাস্তবের সঙ্গে তার কোনও যোগ নেই। হিটলারের তাবৎ সৈন্যদল যখন পরাস্ত, রুশরা বার্লিন উপকণ্ঠে হানা দিয়েছে তখনও হিটলার ম্যাপের উপর লাল-নীল নানা রঙের বোম সাজিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কাল্পনিক সেনাবাহিনীর (কারণ তারা তখন হেরে গিয়ে উধাও) প্রতীক দিয়ে কোথায় তিনি পুনরায় আক্রমণ করে রুশদের মরণকামড় দেবেন, তারই স্ট্র্যাটেজি-পরিকল্পনা করছেন। যেসব জেনারেল তখনও তাঁকে ত্যাগ করেননি তারা বাস্তবের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন বলে যুদ্ধশেষে লিখেছেন, হিটলার তখন কোকিললোকে বাসা বেঁধেছেন। বিশেষ করে কোকিলকেই কেন বাছা হল– সে তো খুব উর্ধ্বাকাশে যায় না তার কারণ বোধহয় সেই অবাস্তবলোকে কোকিলই তাঁকে মধুর আশার বাণী শোনায়।]
বাধা দিয়ে লটে বলে, তোর বুদ্ধি বাড়তি না কমতি? সুকুমার রায় যেরকম হযবরল নামক তুলনাহীনা পুস্তিকায় কার যেন বয়স কত জানার পর বিকুটে প্রশ্ন শুধান বাড়তি না কমতি? অর্থাৎ বয়স বাড়ছে, না কমছে?
আমি তাড়া দিয়ে বললুম, আমি ছেলেবেলাতেই ছিলুম অলৌকিক বালক। যে রকম বেটোফেন আট না দশ বছর বয়সে ওস্তাদস্য হেন্ডেল একবার এই গোডেসবের্গে এলে পর তার সামনে কী যেন এক যন্ত্র বাজান, মেন্ডেলজন ওই বয়সেই গ্যোটের সামনে পিয়ানো বাজান। তোমরা যাকে বল ভুভার কিট (ওয়ান্ডার চাইলড়) ইংরেজিতে বলে চাইলড প্রডিজি।
লটে আমাকে জড়িয়ে ধরে জায়গাটায় ঈষৎ আলোছায়ার লুকোচুরি চলছিল– বললে, হ্যাঁ আলবৎ! তুমি সেই ছাব্বিশ বছরেই ছেষট্টি বছরের বুদ্ধি ধরতে।
আমি খুশি হয়ে বললুম, হেঁ হেঁ। তখন হঠাৎ খেয়াল গেল, লটে মিন করেছে, ছাব্বিশের পর আমার বুদ্ধি বাড়েনি। বললুম, কী বললে?
লটে একটা বাড়ি দেখিয়ে বললে, এই তো তোমার আরেক প্রিয়া, লিসবেটের বাড়ি।
আমি চিন্তান্বিত হয়ে বললুম, লিসবেট? লিসবেট?– আ এলিজাবেৎ।
অবহেলার চরমে পৌঁছে লটে যা বললে সেটা আমরা বাঙলায় বলি, পাড়ার মেধো ও-পাড়ার মধুসূদন।
আমি বললুম, ওর সঙ্গে আমার আবার কবে ভাব-ভালোবাসা হল? আমাদের মেলার সময় সবাই সকলের সঙ্গে কথা কয়। সেখানে প্রথম আলাপ। তার পর তো মাত্র দু-তিন বার ট্রামে—
হ্যাঁ হ্যাঁ। তুমি আর ও তোমরাই তো ছিলে দু জন যারা এখান থেকে বন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যেতে।
.
ট্রামে সামান্য আলাপ হয়।
তার পর সেটা যে দানা বাঁধল না তার একমাত্র কারণ, মেলার তিন-চারদিন পরই তো তোমার ল্যাভলেডি গোডেসবের্গের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে বন-এ ফ্ল্যাট নিল। তুমিও সুশীল ছেলের মতো তার সঙ্গে সঙ্গে বন চলে গেলে। কেন? গোডেসবের্গে কি অন্য ঘর আর ছিল না?
আমি চুপ।
বললে, আমি কেঁদেছিলুম।
আমি তো অবাক।
আমরা তখন তোমার প্ল্যাৎসে পৌঁছে গিয়েছি। লটে বললে, ওই দ্যাখো একটা ট্রাম আসছে। ওটা ধরলে পাঁচ মিনিটে বাড়ি পৌঁছে যাব।
আমি সেই প্রাচীন প্রবাদ সময় হাতে থাকলে ট্রাম, নইলে হন্টন উদ্ধৃত করলুম।
ছোঃ, এখন তো ট্রামটা একদম ফাঁকা রাস্তা দিয়ে নাক বরাবর মেলেম যাবে! একদম আমাদের বাড়ির সামনে ট্রামের টার্মিনাল।
আমি উৎসাহিত হয়ে বললুম, পায়ে চলার পথ দিয়ে কিছুটা ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে একদম রাইনের পাড়ের উপর একটা ফুটফুটে কটেজ আছে বলে মনে পড়ছে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমার কী করে এতসব মনে আছে?
য়োহানেস সে তো যুদ্ধে রয়ে গেল, আংনেস আর আমি এখানে প্রায়ই আসতুম– রাইনে সাঁতার কাটতে। একদিন হয়েছে কী– সে ভারি মজার গল্প– আংনেস একটা ঝোঁপের আড়ালে ফ্রক-ট্রক ছেড়ে সেগুলো একটা উঁচু ঝোঁপের নিচের ডালে ঝুলিয়ে রেখে সুইমিং কসটুম পরে বেরিয়ে এল। সাঁতার কাটতে কাটতে সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে এল। ফেরার মুখে আংনেস কিছুতেই সে ঝোঁপ খুঁজে পায় না। বেঝো ঠেলা। য়োহানেস, জানো তো, সবসময়ই ঠাট্টামস্করা করতে ভালোবাসত। সে বিজ্ঞভাবে বললে, নিশ্চয়ই আংনেসের কোনও এডমায়ারার চুরি করেছে। যেন চাপানের ওতর দিলুম, যেন বৃন্দাবনের বস্ত্রহরণ। য়োহানেস শুধাল, সে আবার কী? ওদিকে আংনেস কাঁদো কাঁদো। সুদুমাত্র সুইমিং কসটুম পরে এখান থেকে বাড়ি পর্যন্ত সদর রাস্তা দিয়ে সে যাবে কী করে। চোখের জলে প্রায় ভেসে গিয়ে বললে, তোমরা দু জনার কেউ কি লক্ষ করনি আমি কোন ঝোঁপটার আড়ালে কাপড় ছেড়েছিলুম?
য়োহানেস, বা রে? আমরা বুঝি আড়ি পেতে দেখব একটি তরুণী কী প্রকারে বিবস্ত্র হচ্ছে?
কোরাস :
আমি, বিলক্ষণ! বিলক্ষণ! ভদ্রতায় বাধে নইলে—
আংনেস : অশ্রুবর্ষণ তথা রোদন।
শেষটায় আমি বললুম, ওই যে রাইনের পাড়ে বাড়িটি সেখান থেকে না হয় তোমার জন্য একটা ফ্রক ধার নেওয়া যাবে। অবশ্য ও-বাড়ির বাসিন্দাদের আমরা আদৌ চিনতুম না।
লটে বললে, তখন সে বাড়িতে থাকতেন আমার শ্বশুরশাশুড়ি আর হেরমান। তাঁরা গত। হলে পর– সে অনেক দিনের কথা– হেরমান আমাকে বিয়ে করে ওই বাড়িতে তোলে। নইলে তো অন্য বাড়ি খুঁজতে হত। কিন্তু
ট্রামগাড়ি তখন প্রায় ফাঁকা। টার্মিনাসে পৌঁছেছে কি না। ঠাঠা করে অট্টহাস্যে কন্ডাক্টরকে সচকিত করে লটে শুধু হাসে আর হাসে।
আমি শুধালুম, কী হল?
হাসতে হাসতে বললে, সে বাড়িতে তখন তো আমার শাশুড়ি ভিন্ন অন্য কোনও মেয়েছেলে নেই। তার ওজন ছিল নিদেন একশো কিলো। ইয়া দশাসই গাড়ম লাশ। আংনেসের চেয়ে দেড় মাথা উঁচু। তাঁর ফ্রক পরে আংনেস রাস্তায় নামলে তোমাদের দু জনাকে মাটিতে লুটনো সেই ফ্রকের শেষপ্রান্ত তুলে ধরে চলতে হত– বিয়ের সময় গির্জেতে দুটি মেয়ে যে রকম কনের অ্যাললম্বা ফ্রকের শেষপ্রান্ত তুলে ধরে পিছন পিছন যায়। তা সে যাকগে। শেষটায় হল কী তাই কও।
পর্বতের মূষিকপ্রসব। ব্যাপারটা কী জানো, আমাকে তোমরা যতখানি ভালো ছেলে বলে মনে করতে
কে বললে?
আমি ততখানি মোটেই ছিলুম না। আড়ি পেতে বেশ কিছুটা—
চোপ!
অবশ্য আমি চালাকও বটি। যখন ঝোঁপটা খুঁজে পেলুম তখন তার থেকে বেশ খানিকটে দূরে গিয়ে য়োহানেসকে ডেকে বললুম, ওহে সোনার চাঁদ য়োহানেস, ওই হোথা ঝোঁপটায় তদন্ত কর তো? আমি এদিকটা সামলাই।
মূর্খ য়োহানেস যখন আবিষ্কারের বজ্রধ্বনি ছাড়ল তখন কোথায় লাগে প্রাচীন যুগের ইউরেকা–সে তো ঝিঁঝি পোকার মর্মরধ্বনির মৃদু গুঞ্জরণ।
আংনেস তখন যোহানেসের দিকে যেভাবে তাকাল তার তুলনা তুমি যদি আমার দিকে পিস্তল উঁচিয়ে খুনের শাসানি দিয়ে শুনতে চাও তবে বলব, য়োহানেস যদি কোনও গ্রামের দয়ানিধি নিরীহ পাদ্রিসাহেবকে সপরিবার হত্যা করে তাদের লাশ ওই গ্রামের একটিমাত্র কুয়োতে ফেলে দিয়ে তার জল বিষিয়ে দিত তবুও বোধ হয় গ্রামের কনস্টেবল তার দিকে ওভাবে তাকাত না।
মনে মনে বললুম, খেলেন দই রামকান্ত, বিকারের বেলা গোবদ্দন।
সেই ঝোঁপঝাড়ের ভিতর দিয়ে বনের পথে আঁধার-আলোর আলিম্পনের উপর দিয়ে আমি লটের কোমরে হাত রেখে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছি। লটে যেন আরও ধীরে ধীরে যাচ্ছে। সে বনে যেন আবেশ লেগেছে। রাইন থেকে বয়ে আসা বাতাসের পরশে পাতায় পাতায় যেন নূপুরধ্বনির মৃদু গুঞ্জরণ। হায় যদুপতি, কোথায় গেল মথুরাপুরী–না, না, কোথায় গেল সেই কদম্ব বনঘন বৃন্দাবন। কলিযুগে দেবতাদের স্মরণ করা মাত্রই সম্বল।
–চলি পথে যমুনার কূলে
শ্রীরাধামাধব কিবা
কুঞ্জে কুঞ্জে রসকেলি করে।
বল লটে, কেবা যায় ঘরে!!
হায়, আমার কপাল যে বড়ই মন্দ।
লটে তার দীর্ঘতম উষ্ণ প্রশ্বাস ফেলে বললে, তুমি বড় দেরিতে এলে।
আমি মনে মনে বললুম, তবু তো এসেছি। কদম্ববনবিহারিণী বিরহিণীর শোক তো লটে জানে না। শ্যামসুন্দর যখন মথুরা চলে গেলেন তখন তারই স্মরণে আমারই গ্রামের কবি গেয়েছিলেন :
দেখা হইল না রে, শ্যাম, আমার এই
নতুন বয়সের কালে।
লটে বাড়ির দোরে ল্যাচকি লাগাবার পূর্বেই হুস করে দরজা খুলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে– কে আর হবে– হেরমান।
আমি মূৰ্ছাহতের ন্যায় দরজা চেপে ধরে ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলুম, কটা পিস্তল?
.
২৭.
এই হেরমান লোকটির সঙ্গে পরিচয় না হলে আমার জীবনে একটা দুঃখ থেকে যেত। খবরের কাগজে তাই কোনও কোনও বেসাতির চতুর বেসাতি বিজ্ঞাপনে বলেন, আপনি জানেন না, আপনি কী হারাইতেছেন অর্থাৎ আপনি যে সানসা কিংবা অমূল্য রমা-দালদা ব্যবহার করছেন না– তাতে করে আপনার যে কী মারাত্মক সর্বনাশ হচ্ছে সেকথা আপনি জানেন না। উত্তরে গুণীরা বলেন, হু! যার সম্বন্ধে আমি কিছুই জানিনে, সেটা আমার আর কী ক্ষতি করতে পারে। যতক্ষণ আপনার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হওয়ার ফলস্বরূপ আপনি জানতে পারেননি আপনার একচেটে প্রিয়া বিশ্বপ্রেমে বিশ্বাস করেন, ভূমাতে আনন্দ পান, কাউকে কোনও ব্যাপারে বঞ্চিত করে তাকে মনোবেদনা দিতে অতিশয় বিমুখ, ততক্ষণ আপনার কিসের দুঃখ, কিসের দৈন্য, কিসের লজ্জা, কিসের ভয়। কিন্তু হায়, এ তত্ত্বও সর্বাবস্থায় কার্যকরী হয় না। আপনার সেই প্রিয়াই আপনার অজানাতে খাদ্যে সেঁকো মিশিয়ে দিল। আপনি সেঁকোর উপস্থিতি সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না বলে সেঁকো কি আপন ধর্মানুযায়ী কর্ম করে আপনাকে নিমতলায় পাঠাবে না? সেকথা থাক।
ইতোমধ্যে লটে টাট্টু ঘোড়ার মতো ছুট দিয়েছে, রান্নাঘরের দিকে।
হেরমান দেখলুম তৈরি। কোনও গুরুর কৃপায় জানতে পেরেছে যে আমি মোজেল খেতে ভালোবাসি। অত্যুকৃষ্ট মোজেল নিয়ে এল ফ্রিজ থেকে। একটা গেলাসে নিজের জন্য ঢেলে নিয়ে আমার গেলাসে ঢালল। পাঠক হয়তো আশ্চর্য হয়ে ভাবছেন, এটিকেট পর্যায়ে যেরকম প্রথম আপ্তবাক্য, লেডিজ ফাস্ট, ঠিক তেমনি মেহমানদারির মামেলায় প্রথম অনুশাসন, গেস্ট ফার্স্ট। কিন্তু লটে নির্দেশিত প্রথম আপ্তবাক্যের যে রকম ব্যত্যয় আছে, এই অনুশাসনের বেলাও হুবহু তাই। আপনি যদি মেহমান (অতিথি সঙ্কারক)* হন, তবে আপনি সরবত, হুইস্কি ইত্যাদি দেবার সময় প্রথম মেহমানের জন্য ঢালবেন। কিন্তু যদি যে বোতল থেকে ঢালছেন সেটা কর্ক দিয়ে ছিপি আঁটা থাকে তবে নিজের জন্য ঢালবেন, পয়লা। কারণ অনেক সময় কর্কের অতি ছোট ছোট টুকরো বা গুঁড়ো পানীয়ের উপরে ভাসে। হোস্ট নিজের গেলাসে প্রথম ঢালতে সে রাবিশ তিনি গ্রহণ করবেন। বিবেচনা করি বিদ্যেসাগরমশাই এই নীতিটি ঈষৎ সম্প্রসারণ করেই দুধ ঢালবার সময় আরশোলাটা আপন গেলাসে গ্রহণ করেছিলেন।**
[*মেহমান শব্দ আমরা জানি, কিন্তু মেজমান (host) শব্দটিও যদি বাঙলায় চালু হয় তবে একটা জুৎসই শব্দ পাওয়া যায়। অতিথি-সকার ইত্যাদি শব্দে আমি ঈষৎ ভীত। এক মারওয়াড়ি বিদ্যাসাগর নাকি তার বাঙালি অভ্যাগতকে সবিনয় বলেন, আপনি এই এখানে দেহরক্ষা করুন। আমি আপনার সকার (আপ্যায়ন করি।]
[**বঙ্গের রত্নমালা না কী যেন এক পুস্তকে আমি এটা পড়ি। সেখানে গেলাস শব্দই ছিল, কিন্তু আমার বিশ্বাস সে-যুগে তখনও ফিরিঙ্গির গেলাস গৌড়ীয় পরিবারে প্রবেশাধিকার পায়নি। আর পাঠান-মোগল ব্যবহার করত জাম–যার থেকে জামবাটি। ইদানীং ইন্দ্রমিত্র মহাশয় নাকি বিস্তর বিদ্যাসাগরীয় লেজেন্ড ফুটো করে দিয়েছেন (আফটার অল, ঘটির দেশ তো!), এটা করেছেন কি না জানিনে। কারণ তাঁর পুস্তকখানি প্রাপ্তির ঘণ্টাখানেকের ভিতর সেটি কর্পূর হয়ে যায়। চোর মহাশয় যদি সেটা ফেরত দেন তবে আমি রাবণের মতো দশ হাত তুলে তাঁকে আশীর্বাদ করব। হায়রে দুরাশা–]
হেরমান সিগারেট এগিয়ে দিয়ে অনুরোধ করলেন, ইচ্ছে হোক।
আমি সঙ্গে আনা কেকটা করিডরের একটি ছোট্ট টেবিলে রেখে এসেছিলুম। চিন্তা করতে লাগলুম, লটের অসাক্ষাতে কেকটি এই বেলা দরগায় ভেট দেব কি না। এমন সময় লটেই ছুটে গিয়ে কেকটা নিয়ে এসে বললে, এই নাও তোমার ঘুষ। তোমার কাছে দুটো পিস্তল আছে শুনে সেই ভয়ে এনেছে।
হেরমান বললে, তা হলে শেমপেন অনুপানরূপে ব্যবহার করতে হয়। তাবৎ ইউরোপে বিশেষ করে বিলেতে কেক অ্যান্ড শেমপেন, শেমপেন অ্যান্ড কেক। (মদ্দেশীয় মুড়ির সঙ্গে পাঁপড়ভাজা কিংবা মেঘের কোলে ইন্দ্রধনু মরণকালে হরির নাম)। তুমি একটু বসো লটে, আমি সেলার থেকে নিয়ে আসছি। কে বা শোনে কার কথা। হেরমানের অনুরোধ শেষ হওয়ার পূর্বেই সেলারের কাঠের সিঁড়িতে শোনা গেল লটের জুতোর খটখট শব্দ।
বোতল ঘিরে মাকড়ের জাল এবং দেড় পলস্তরা ধুলো। জর্মন, ডাচ, অস্ট্রিয়ান, সুইসরা ঘরদোর মাত্রাধিক ছিমছাম রাখে, কিন্তু ভূগর্ভস্থ কুঠুরির মদের বোতল কখনও ঝাড়ামোছা করা হয় না। এবং মেহমানের সামনেও সেটা পেশ করা হয় ওই অবস্থাতেই। তিনি স্বচক্ষে দেখতে পাবেন, ইটি প্রাচীন দিনের খানদানি বস্তু।* ইতোমধ্যে লটে এনেছে একটা রুপোর কিংবা ওই জাতীয় কোনও ধাতু সংমিশ্রণে তৈরি, বরফে ভর্তি একটা বালতি। হেরমান বতরিবৎ বোতলটি ন্যাপকিন দিয়ে সাফসুরো করে বালতিতে ঢুকিয়ে বললে, বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। আমাদের সেলারটিই আধা ফ্রিজ। এই হল বলে। ততক্ষণ মোজেল চলুক।
[*এটিকেট, যার বাড়াবাড়িকে চালিয়াতি বলা যেতে পারে, বিলেতে নগণ্য জন কাড়ি কাড়ি টাকা কামিয়ে হঠাৎ নবাব (আপস্টার্ট) বনে যাওয়ার পর সে যখন সমাজের উচ্চতম স্তরের ডিউক-আর্লদের সঙ্গে দহরম মহরম করে কঙ্কে পেতে চায় (বারি) তখন তাকে সাহায্য করার জন্য একখানি প্রামাণিক পুস্তিকা লেখেন এক ডিউক স্বয়ং– বিলেতের প্রাচীনতম ডিউকদের অন্যতম। ডিউক অব বেডফর্ড লিখিত পুস্তিকার নাম বুক অব মবস। ইনি তাঁর প্রাসাদ দর্শকের জন্য অবারিতদ্বার করে দেন দেড় শিলিঙের দক্ষিণার পরিবর্তে।]
আমি রহস্যভরা কণ্ঠে বললুম, যতক্ষণ বেত না আসে কানমলা চলুক।
এরকম বেরসিক আছে যারা কোনওকিছু না বুঝতে পারলে হাসে। ভাবে, যখন বুঝতে পারিনি তখন নিশ্চয়ই কোনও রসিকতা। আশস্ত হলুম, হেরমান সে গোত্রের নয়।
এস্থলে এটা রসিকতা। এবং এতই উত্তম যে যদিও এটি আমি ভিন্ন প্রসঙ্গে অন্যত্র উল্লেখ করেছি তবু অক্লেশে এটার পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে।
বললুম, আমাদের দেশের গ্রামঞ্চলে কোনও মর্কট বড় বেশি বাঁদরামি করলে পণ্ডিতমশাই সর্দার পড়ুয়াকে আদেশ করেন একখানা লিকলিকে বেত নিয়ে আয় তো এবং ছেলেটার কান মলতে মলতে বলেন, যতক্ষণ বেত না আসে কানমলা চলুক
অসম্পূর্ণ বাক্যাংশ না শুনেই হেরমান হো হো করে হেসে বললে, বুঝেছি, বুঝেছি। যতক্ষণ শেমপেন না আসে মোজেল চলুক। উত্তম রসিকতা।
বিলকুল এবং শুধুমাত্র তাই নয়, এটা নিত্য ব্যবহার্য না হলেও পালপরবে অবশ্যই। এমনকি আপন গৃহেও। এই মনে করুন লটে আপনাকে কী একটা হাবিজাবি মাছ খেতে দিল। আপনি নিমন্ত্রিত বন্ধুসহ দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে রান্নাঘর থেকে মুরগি রোস্ট করার খুশবাই পেয়েছিলেন। তাই সেই হাবিজাবি খেতে খেতে ইয়ারকে বলবেন, যতক্ষণ বেত (রোস্ট) না আসে ইত্যাদি এবং তার পর সেটি রসিয়ে রসিয়ে বুঝিয়ে বলবেন। এবং
ইতোমধ্যে আমার কোচের পশ্চাৎ থেকে হুঙ্কার শুনতে পেলুম, কী! আমি বুঝি হাবিজাবি মাছ রাধি! জানো, রাইনের জন্ম হওয়ার বহু বহু যুগ আগের থেকেই আমরা পুরুষানুক্রমে রাইনের পারে বাস করছি (আমি মনে মনে বললুম, রামের পূর্বেই রামায়ণ!), রাইনের মাছ আমি রাঁধতে জানিনে– মুরমুরে ভাজা, আঙুর পাতায় জড়ানো স্যাকা খেয়েছ কখনও?
আমি বললুম, রাইনের মাছ যে অপূর্ব সে বিষয়ে সন্দেহ করে আমি কি তৃতীয় পিস্তলকে আমন্ত্রণ জানাব? আমাদের গঙ্গার ইলিশও কিছু ফ্যালনা নয়। সংস্কৃতে শ্লোক আছে, আমার ঠিক ঠিক মনে নেই, কিসের উপরে যেন কী, তার উপরে যেন আরও কী, তার উপর বোধ হয় জল, তার উপর কচ্ছপ, কচ্ছপের উপর পৃথিবী, তার উপর হিমালয়– তোমাদের আলপস তো তার হেঁটোর বয়সী– তার সর্বোচ্চ চুড়ো এভারেস্টের উপরে শিব
ও! শিবের কাহিনী আমি জানি। কিন্তু বলে যাও।
শিবের উপর তার জটার ভিতর গাঙ্গেস (গঙ্গা) তার জলের উপর কেলি করেন ইলিশ। সেই সর্বোচ্চ স্থানাসীন ইলিশ যে খায় না, তার চেয়ে বৃহত্তর মূর্খ ত্রি-সংসারে আর কেউ আছে কি? কিন্তু ভদ্রে, আমি তো শুনেছি, অগুনতি জাহাজের পোড়া তেল ইত্যাদি (বিজ) প্রক্ষিপ্ত হওয়ার ফলে এখন নাকি রাইনের মাছে আর সে সোয়াদ নেই।
লটে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল। দশ সেকেন্ড যেতে না যেতে বলল, এখুনি আসছি।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, তুমি ঠিক আমার বোনেদের মতো। যখনই ওদের বাড়িতে গিয়ে উঠি এবং সেটা ঝাড়া চলিশ বছরের ব্যবধানে নয়– তখনই তারা ঠিক তোমারই মতো ডার্বি ঘোড়ার স্পিডে ঘড়ি ঘড়ি রান্নাঘরের দিকে ছুট দেয়। ভালোমন্দ এটা-সেটা নয়, রাজ্যের তাবৎ পদ খাওয়াবে বলে। আমি বলি, বোস, তোর সঙ্গে দুটি কথা কই, কতদিন পরে দেখা। আমি তো খেতে আসিনি। কিন্তু ওরা শোনে না, ওরা জানে, যবে থেকে মা গেছে, অন্য কারওরই রান্না আমার পছন্দ হয় না। ওরাই কিছুটা পারে, কিছুটা নয়, বেশ বিস্তর।
লটে তার ঠোঁটের উপর করুণ মুচকি হাসির সঙ্গে মধুরিমা মিশিয়ে বললে, সে আমি জানি। তুমি একদিন বিষ্ণুত্বারে রাত নটার সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলেছিলে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে। আমি তখনও ছোটদের মধ্যে। টায়-টায় আটটায় শুয়ে পড়তে হত। সে রাত্রে পূর্ণিমার চাঁদ পড়লেন তাঁর কড়া আলো নিয়ে আমার চোখের উপর। পর্দাটা টানবার জন্য জানালার কাছে যেতেই দেখি তুমি। ফিস ফিস করে ডাকলুম তোমাকে। তুমি থমকে দাঁড়িয়ে বললে, এক লহমার তরেও সময় নেই। চিঠি ফেলতে ডাকঘরে যাচ্ছি। তার পর ঠিক জানালার নিচে দাঁড়িয়ে।
হেরমান বিগলিত কণ্ঠে মুদিত নয়নে কাব্যিক কাব্যিক সুরে বললে– যেটা বাঙলায় দাঁড়ায়– মরি গো মরি! সখী তোরা আমায় ধর, ধর। এ যে সাক্ষাৎ রুমিয়ো-জুলিয়েট। আর বলতে হবে না। রুমিয়ো তখন পূর্ণচন্দ্রকে সাক্ষী মেনে লটে থুড়ি শারলটে-কে, ফের থুড়ি, জুলিয়েটকে তার অজরামর প্রেম নিবেদন করলেন– তোমাদের কপাল ভালো, মাইরি। সে সন্ধ্যাটা পূর্ণিমা না হয়ে অমাবস্যাও হতে পারত, পূর্ণিমা হয়েও গভীর ঘনমেঘের ঘোমটা পরে আত্মগোপন করে থাকতে পারত
লটে বললে, কী জ্বালা! হার সায়েডের বুকপকেটে তখন তার প্রিয়া আমারি, জরিমানা, মার্লেনে– জানিনে কোন প্রিয়ার নামে লেখা প্রেমপত্র। আর সে তখন শপথ করবে আমাকে প্রেম নিবেদন করে! অতখানি ডন জুয়ান আমার বন্ধু কস্মিনকালেও ছিল না। শোনোই না বাকিটা। আমি তো সেই সন্দ করে ঠোঁট বাঁকিয়েছি আমার দিকে তাকিয়ে বললে–এখখুনি ছুটতে হবে। ইন্ডিয়ান সাপ্তাহিক মেল-এর শেষ ক্লিয়ারেনস গোডেসবের্গে হয় প্রতি বিষবারে—
রহস্য উদ্ঘাটিত হল। বললুম, তাই বল– নইলে সেটা যে বিষত্বার ছিল সেকথাটা এত যুগ পরেও তোমার মনে রইল কী করে, আমিও তাই ভাবছিলুম।
লটে অসহিষ্ণু হয়ে বললে, শোনোই না! তুমি আর হেরমান যেন যমজ দুই ভাই জেমিনাই (অশ্বিনী ভ্রাতৃদ্বয়) একজন যদি থামলেন তো অন্যজন পে ধরলেন।
আমি মুদিত নয়নে উধ্বমুখে প্রার্থনা করলুম, আমেন, আমেন।
লটে : মানে?
অতি সরল। জেমিনাই জমজ… অন্তত আমাদের দেশে একই সময়ে একই রমণীর প্রেমে পড়েন।
হেরমান লম্বা এক দমে শেমপেন গেলাস শেষ করে বললে, লাও! অ্যাদ্দিন বাদে এসে জুটলেন আমার, সাতিশয় মাই ডিয়ার, টুইন ব্রাদার তার, খবর নিতে। তখন কোথায় ছিলে, বৎস, হার ডক্টর, যখন লটের প্রেমে আমি চোখের জলে নাকের জলে হাবুডুবু খাচ্ছি, বিষ্টিতে ভিজে ঢোল হয়ে রাঁদেভূতে পৌঁছে মাদমোয়াজেলকে না পেয়ে তিক্ততম সত্য অনুভব করলুম, সেই জলঝড়ে তিনি তার সাত বছরের পুরনো ফ্রকটি- যেটা এ আমলের ফ্যাশানের নিদর্শনস্বরূপ লুভর যাদুঘরে হেসে-খেলে উচ্চ সিংহাসন পায়– সেটাকেও বরবাদ করতে নারাজ, এবং
হেরমানের খেদোক্তি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে লটে যেন শুধু আমাকে বললে– দু গালে দুটি টোল জাগিয়ে তখন তুমি বললে, সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে সেই সুদূর ইন্ডিয়ায় মা বসে আছে এই চিঠির প্রতীক্ষায়। শেষ ক্লিয়ারেন্স মিস করলে ইন্ডিয়ান মেলও মিস। মাকে নেট চিঠির জন্যে প্রহর গুনতে হবে আরও পুরো সাতটি দিন। আর আমার মা স্বপ্নেও কাউকে কখনও অভিসম্পাত করেনি– নইলে তার অভিশাপে গোটা জর্মন দেশটা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। মনে পড়ছে?
আমি ভেজা গলায় বললুম, খুব মনে পড়ছে। কিন্তু তোমার মনে আছে কি, তুমি প্রায়ই আমাকে তার পর শুধাতে, মায়ের চিঠি লিখেছেন? কেন বাপু, বিষবারের শেষ মুহূর্তে চিঠি লিখতে বসা? দু দিন আগে ধীরেসুস্থে চিঠিটা লিখে পোস্ট করতে আপনাকে ঠেকিয়ে রাখে কোন হিন্ডেনবুর্গ? তুমি বড় পাকা মেয়ে ছিলে, ডার্লিং লটে!
.
২৮.
যোগাযোগ, যোগাযোগ! সবই যোগাযোগ। দার্শনিকার মতো বললে লটে।
আমি শুধালুম, কী রকম?
বললে, এই যে আকস্মিকভাবে আমাদের দেখা হল।
হেরমান জর্মনে যে শব্দটি ব্যবহার করল সে যদি বাঙাল হত তবে বলত খাইছে! ঘটিগো ভাষায় খেয়েছে! এই মরেছে-তে ঠিক যেন সেরকম খোলতাই হয় না। আবার ওরা যখন বলে মাইরি তখন আমাগো ভাষায় তার ইয়ার পাওয়া যায় না।… তার পর বললে, বা– রে! এত বড় অত্যাচার! অদ্য রজনীর টাইমটেবল তো পাকাঁপোক্ত করা হয়ে গিয়েছে। আহারাদির পর তোমরা যাবে সিনেমায়, তার পর শাস্ত্রানুযায়ী যাবে পার্কে–অশাস্ত্রীয় রসালাপ করতে। তবে কেন, আমার প্রাণের লটে, আমার হক্কের ওপর ট্রেসপাস করছ? আমাকে দুটি কথা কইতে দাও না, সায়েডের সঙ্গে।
লটে বললে, কোথায় হল ট্রেসপাস আর কোথায়ই-বা রসালাপ! ট্রামে আসার সময় সায়েড আমাকে বলছিল, ১৯৩০-এ তুমি-আমি হিটলারের থোড়াই তোয়াক্কা রাখতুম। তার পর ওই তিরিশেই আখেরে সে পেল মেলাই ভোট। আমরা তবু নিশ্চিন্ত মনে আমাদের ফুটবল চালিয়ে গেলুম।* তিন বৎসর যেতে না যেতে ভিয়েনার সেই ভ্যাগাবন্ড, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আটপৌরে নিতান্ত সাধারণ একটা করপোরাল– তার পর কী জানি কোন এক ভাষায় কী একটা কবিতা আউড়ে বললে আমি আবৃত্তি করেছিলুম, বণিকের মানদণ্ড পোহালে শর্বরী দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে। লক্ষ্মীছাড়া ভবঘুরে পোহালে শর্বরী বসে গেল রাজসিংহাসনে জর্মনির মতো অত্যুচ্চ শিক্ষিত দারুণ ঐতিহ্যপন্থি দেশের হয়ে গেল চ্যান্সেলার।
[*১. এই ফুটবল খেলা নিয়ে আমি বহু বৎসর পূর্বে ৮/১০/১২ বছর হতে পারে একটি গল্প লিখি। তার প্লট : আমাদের ফুটবল গ্রাউন্ডের (অর্থাৎ সরু একচিলতে গলির) শেষ প্রান্তে বাস করতেন ফ্রাউ উলরিষ, খাণ্ডারিনী, ইয়া লাশ বুড়ি। একবার যদি তিনি কারণে-অকারণে চটে গিয়ে বকা আরম্ভ করতেন তবে যতক্ষণ না তার পরবর্তী ভোজনের সময় আসে তিনি নায়গ্রা প্রপাতের মতো নাগাড়ে বকে যেতে পারতেন। আমাদের পুরোপাক্কা খবরদারি হুশিয়ারি সত্ত্বেও একদিন ফুটবলটা দড়াম করে গিয়ে পড়ল তার জানালার উপর শার্সিখানা খান খান। এহেন অন্যায় আচরণ ফুটবলের নয়, আমাদের যে তাঁকে সেদিন বকাবকির রেকর্ড নির্মাণের তরে টুইয়ে দেবে সে তত্ত্ব বাৎলে দেবার জন্য হেমলেটের পিতৃপ্রেতাত্মা কেন, আমি টেশে গেলে যে মামদো জন্মাবে তারও প্রয়োজন নেই। সে পেল্লায় কটু বক্তিমের মূল বক্তব্য ছিল– সরকার কি রাস্তা বানিয়েছে ফুটবলের তরে? বহু বৎসর পরে জানতে পাই, বুড়ি উলরিষ তার বেবাক সঞ্চিত ধন উইল করে দিয়ে যায়, আমাদের পাড়ার ছেলেমেয়েদের জন্য একটা ক্ষুদে প্লেগ্রাউন্ড নির্মাণ করার জন্য। কাহিনীটি আমি হারিয়ে ফেলার ফলে সেটি পুস্তকাকারে কখনও প্রকাশিত হয়নি। কোনও সহৃদয় পাঠক যদি দয়া করে আমাকে জানান (C/o সম্পাদক দেশ ৬নং প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলিকাতা-১) কোন বসর, কোন মাস, কোন পত্রিকায় এটি বেরোয়, তবে আমি তার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকব।]
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর লটে ফের বললে, যোগাযোগ যোগাযোগ, সবই যোগাযোগ! এই যে আমরা খানিকক্ষণ আগে হোটেল ড্রেজেনের গা ঘেঁষে এলুম না, সেখানে এসে উঠেছিলেন হিটলার। সমস্ত জৰ্মনির সব হোটেলের চাইতে তিনি বেশি ভালোবাসতেন এই হোটেল ড্রেজেন। আর রাইনের ওপারে পেটেরসবের্গ পাহাড়ের উপরকার হোটেলে উঠেছিলেন ইংলন্ডের প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীযুত চেম্বারলেন। সমঝাওতা হল না। শুভক্ষণে শুভলগ্নে কোন্ যোগাযোগ হল না বলে সবকিছু ভেস্তে গেল, সে তত্ত্ব আমরা কখনও জানতে পারব না।
কিন্তু আরেকটা বিবরণ জানা আমার আছে।
গেল বছর আমি গিয়েছিলুম মনিক। তুমি হয়তো জানেন না, সয়েড, জর্মনদের এখন এমনই বস্তা বস্তা ধনদৌলত হয়েছে যে কী করে খরচ করবে ভেবে পায় না। তাই নিত্যি নিত্যি লেগে আছে সেমিনার কনভেরজাৎসিয়োনে, কনফারেন্স আরও কত কী। আমার আজ আর মনে নেই যেটাতে গিয়েছিলুম সেটা বিশাল জর্মন ট্যারাদের কনফারেন্স না–
আমি বাধা দিয়ে বললুম, ট্যারাদের কনফারেন্সে তুমি যাবে কী করে? তুমি তো ট্যারা নও। এস্তেক লক্ষ্মীট্যারাও নও।
বললে, কে বলল আমি ট্যারা নই। ওই তো সেদিন আমার এক আত্মীয় কোত্থেকে জানি নিয়ে এল এক নয়া যন্তর। আমার হাতে সেটা দিয়ে বললে, ওই ফুটাটার ভিতর দিয়ে তাকাও তো একটিবার। দেখতে পাবে একটা খাঁচা আর অন্য প্রান্তে একটা পাখি। এইবারে এই হান্ডিলটা নাড়িয়ে পাখিটাকে খাঁচার মধ্যে পোরো দিকিনি!
দম নিয়ে বললে, হেরমানের মতো সদাই উড়ু উড়ুকু চিড়িয়াকে পুরেছি চোখে-না-যায়-দেখা, হাতে না-যায় ছোঁওয়া খাঁচায়। আমারে ঠ্যাকায় কেডা?
হেরমানের দিকে চোখ মেরে বললে, কই, কিছু বলছ না যে?
কে কাকে পুরছে তার খবর রাখে কোন গেস্তা, কোন ওগৃপু? চিড়িয়াখানায় খাটাশটার খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা চিত্তবিনোদন করি। ওদিকে খাটাশটা ভাবে, নিছক তার চিত্তবিনোদনের জন্যই আমাদের ডেকে আনা হয়েছে। আমাকে জু-র বড়কর্তা অতিশয় সঙ্গোপনে বলেছেন, যেদিন জলঝড় ভেঙে দু চারটি মুক্ত-পাগল ভিন্ন অন্য কেউ জু-তে আসে না সেদিন খাটাশটা তার নিত্যদিনের চিত্তবিনোদন বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে রীতিমতো মনমরা হয়ে যায়।
লটে বললে, কই তোমাকে তো কখনও মনমরা হতে দেখিনি।
আমি মনে মনে বললুম, লাগ, লাগ, লাগ। বাইরে বললুম, কে কাকে খাঁচায় পুরেছে সে তার উপস্থিত থাক। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, দু জনাতে একই খাঁচাতে তো দিব্য উঁহু উঁহু। কুঁহু কুহু করছ। রীতিমতো হিংসে হয়। তা সে যাকগে। তুমি তো খাঁচায় পুরলে সেই চিড়িয়াটাকে। ডাক্তারের আলুক্ষেতে তাতে করে ক গণ্ডা পুলি পিটে গজালো, শুনি।
লটে : সায়েডষেন, সেইখানে তো রগড়। ডাক্তার বলে কি না, আমি নির্ভেজাল চোদ্দ ডিগ্রি ট্যারা।
সেন্টিগ্রেড না ফারেনহাইট?
লটে ঘন ঘন মাথা নাড়িয়ে বললে, কোনওটাই না। তুমি কিছু বোঝ না। চোদ্দ ডিগ্রি বলেছিল, না চোদ্দ কেজি বলেছিল সে কি আর আমি কান পেতে শুনেছিলুম। চোদ্দ– কোনও কিছু একটা। তার পর ডাক্তার কী বলল, জানো? বললে, এই ট্যারাইসিন সারাতে হলে হয় কামচাটকা, নয় লুলুম্বা হুলা হুলা থেকে আনাতে হবে এক অতি বিশেষ রকমের চশমার পরকলা হঠাৎ থেমে গিয়ে আমাকে শুধাল, তোমার কী হল সায়েড ডিয়ার? হঠাৎ অভিনিবেশ সহকারে এরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করছ কেন? বিস্তর পুরুষমানুষ দেখেছি যারা ডিনার শেষে ওয়েটার বিল নিয়ে আসছে দেখলে হঠাৎ অতি অকস্মাৎ জানালা দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করতে লেগে যায়। ও প্রকৃতির কী মাহাত্ম্য! পাঁচো ইয়ার তখন আর কীই-বা করেন। হাঁড়িপানা মুখ করে সেই জিরাফকণ্ঠী বিলটা শোধ করে দেন। কই, আমরা তো এখনও তোমাকে কোনও বিল দিইনি, মাইরি।
আমি চিন্তাকুল কণ্ঠে বললুম, যত দুর্ভাবনায় ফেললে, লটে সুন্দরী।
যথা?
ওহে হেরমান, এমন মোকাটি হেলায় অবহেলা কর না ভাই। টাপেটোপে কই। তোমারই মতো এক নিরীহ, গোবেচারীর বউয়ের জিভে কী যেন কী একটা বিকুটে ব্যামো দেখা দিল। বউ একদম একটি কথাও বলতে পারছে না। এমনকি গা গা ইডিয়টের মতো গাঁ-আঁ আঁ, গাঁ আঁ আঁও করতে পারছে না। বেচারি সেই সাত পাকের সোয়ামি নিয়ে গেল বউকে ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার মাত্র একটিবারের তরে বউয়ের জিভের উপর চামচের চ্যাপটা হাতলটা বুলিয়েছে কি বুলোয়নি– দ্যাখ তো না দ্যাখ– সাত পাকের হাত পাকড়ে ধরে দে ছুট। বৃহৎ হাসপাতালের নিভৃততম কোণে তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, হিপোক্রাতেসের শপথে এ বিধান নেই। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, আমার ধর্মবুদ্ধি বলে কারও কোনও ব্যামো যদি অন্য কারওর উপকার সাধন করে তবে উপকৃতজনকে এ বিষয়ে কনসাল্ট করে নিতে। আপনাকে অতিশয় সঙ্গোপনে একটি তথ্য নিবেদন করি : আপনি সত্যই বড় লাকি পুরুষ; কথায় বলে স্ত্রী ভাগ্যে ধন। এই যে আপনার স্ত্রীর জিভ আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছে, কোনও প্রকারের শব্দটি মাত্র উচ্চারণ করতে পারছেন না, টু ফ্যা দূরে থাক, অষ্টপ্রহর বকর বকর করে আপনার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে পারছেন না, এরকম ক দৈবাৎ কখনও কোনও স্বামীর কপালে নৃত্য করে। বললে পেত্যয় যাবেন না, শতেকে গোটেক নয়, লাখে এক হয় কি না হয়। ডাক্তার দম নিয়ে স্বামীকে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ভেবে দেখুন, ভালো করে চিন্তা করে নিন আপনি কি সত্য সত্য, তিন সত্য চান, যে আমি আপনার স্ত্রীর জিভটা সারিয়ে দিই। বলুন, আবার বলছি চিন্তা করে বলুন।
হেরমানের হাসির পরিমাণ থেকে অনুমান করলুম, সে লটেকে কতখানি ডরায়।
বললে, কিন্তু গল্পটি আমারই উদ্দেশে বিশেষ করে বললে কেন?
আমি বললুম, বলছি, বলছি। অত তাড়াহুড়ো করছ কেন, হের গট– সদাপ্রভু তো এক মুহূর্তেই বিশ্বসংসার নির্মাণ করতে পারতেন; তবে পূর্ণ ছয়টি দিন ওই কর্মে ব্যয় করলেন কেন? কিন্তু তার পূর্বে লটে-কে একটা প্রশ্ন শুধান দরকার। আচ্ছা লটে, তুমি যে চৌদ্দ ডিগ্রি না চৌদ্দ গজ ট্যারা সে তো বুঝলুম, কিন্তু তোমার ট্যারাতর ট্যারাতম মার্জিন আর কতখানি? মোলা, আঠারো? আমাদের ছেলেবেলায় চশমার পাওয়ার মাইনাস কুড়ির চেয় বেশি হত না।*
[*সুকুমার রায় যজ্ঞির ভোজে পরিবেশকদের বর্ণনা করেছেন, কোনও চাচা অন্ধপ্রায় মাইনাস কুড়ি। ছড়ায় ছোলার ডাল পথঘাট জুড়ি।]
লটে বললে, আমি ঠিক ঠিক শুধাইনি। যদূর মনে পড়ছে চোদ্দই শেষ সীমা। তবে মেরেকেটে আরও দু-এক মাত্রা, দু-এক পেগ সেবন করতে পারি বোধহয়।
তাই সই। ওহে হেরমান, তুমি এই বেলা সময় থাকতে থাকতে লটের বিরুদ্ধে একটা ডিভোর্স কেস ঠুকে দাও। আদালতকে বলবে, এই রমণী আমাকে ধাপ্পা মেরে বিয়ে করেছে। বিয়ের পূর্বে একবারও সেই গুহ্য তথ্যটি প্রকাশ করেনি যে, সে ট্যারা। আর যা তা ট্যারা নয় হুজুর, একদম চৌদ্দ ডিগ্রি ট্যারা। এর বেশি ট্যারা মি লাট–মাই লর্ড–বিবাদিনী গেল বছর যে বিশাল– জর্মন ট্যারা কনফারেন্স-এর নিমন্ত্রিত হয়ে মুনিক গিয়েছিলেন—
এস্থলে আদালত বাধা দিয়ে তোমার উকিলকে শুধোবেন, বিবাদিনী কেন নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন?
তোমার উকিল সোল্লাসে : ঠিক ওই বক্তব্যেই আমরা আসছিলাম, হুজুর। আমরা জনৈক প্রসিদ্ধ চক্ষু চিকিৎসককে সাক্ষীরূপে এই মহামান্য আদালতে হাজির করব, এবং তিনি কিছু হেজিপেজি যেদোমেধো–
আদালত ঈষৎ শুষ্ক তথা দৃঢ়কণ্ঠে : বিজ্ঞ আইনজ্ঞের শেষোক্ত জনপদসুলভ গ্রাম্য সমাসদ্বয়ের প্রয়োগ মহামান্য আদালতের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করবার অবকাশ ধারণ করে।
উকিল : আমি খুশমেজাজে বহাল তবিয়তে (মহামান্য আদালত ঈষৎ কুঞ্চন করলেন কিন্তু স্পষ্ট বোঝা গেল তিনি ভাষার জগাখিচুড়িকে আর ঘটাতে চান না।) ওই দুটো লক্ষ্মীছাড়া সমাসকে আদালত থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিলুম। কিন্তু হুজুর, ইংরেজও বেকায়দায় পড়লে এ জায়গায় টম ডিক অ্যান্ড হ্যারি এস্তেমাল করে থাকে।
আদালত : অত্র আদালত স্বাধিকার-অপ্রমত্ত। কিন্তু অত্র আদালত অর্বাচীন আলবিয়নের রসনাসহযোগে অস্মদ্দেশীয় রাইন-মোজেল-মদিরা আস্বাদন করে না।
উকিল : তথাস্তু মি লট। পুরনো কথার খেই ধরে নিয়ে উপস্থিত জটটা ছাড়াই : সেই চোখের ডাক্তারের সুনাম দেশ-বিদেশের কহাঁ কহাঁ মুল্লুকে ছড়িয়ে পড়েছে। গত বৎসর তিনি প্যারিস যান। সারা জাহাঁ আঁখ মজলিসের দাওয়াত পেয়ে। তিনিই হরেক রকম হাতিয়ার চিড়িয়া পিঁজরা হুনর দিয়ে মহামান্য আদালতকে বাৎলে দেবেন, বিবাদিনী চোদ্দ পেগ-এর ট্যারা।
বিবাদিনীর উকিল পেরি মেসন কায়দায় হাইজাম্প মেরে : আমি আমার সুবিজ্ঞ সহকর্মী বাদিপক্ষের উকিল যে মন্তব্য করেছেন তার তীব্রতম প্রতিবাদ জানাই। তিনি অশোভন ইঙ্গিত করছেন, আমার সম্মানিতা মক্কেল চৌদ্দ পেগ হুইস্কির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
হেরমান বাধা দিয়ে বললে, তোমাদের সিনেমা গমনের কী হল? আচ্ছা, তুমি বলছ, আমার কেস একদম ওয়াটার টাইট? মোকদ্দমা জিতবই জিতব?
আমি সোৎসাহে : আলবৎ, একশো বার।
আর তুমি তখন লটেকে বগলদাবা করে ড্যাং ড্যাং করে নাপাতে নাপাতে এন্ডিয়া বাগে সটকে পড়! না? অফ কোর্স নট। আমাদের ফরেন মিনিস্টারের নাম হের শেল (Scheel), অর্থাৎ ট্যারা, লক্ষ্মীট্যারা নয়, সমুচা ট্যারা। তার বউ তো তাকে তালাক দেয়নি।
লটে এক লাফে হেরমানের কোলে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে খেতে বললে, ডার্লিং, তুমি সত্যই আমার মূল্য বোঝে।
আমি বললাম, কচু বোঝে। ওয়াইলড বলেছেন, আমাদের প্রত্যেকেরই এমন সব রদ্দিমাল আছে যা আমরা সানন্দে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিতুম। শুধু ভয়, পাছে অন্য কেউ না কুড়িয়ে নেয়। এস্থলে আমি শর্মা রয়েছি যে।
কী! আমি রদ্দি মাল! তোমার সঙ্গে সিনেমা যাব না, না, না!!
.
২৯.
আমি বললুম, সুন্দরী লটে, তুমি যাত্রারম্ভে বার বার মন্ত্রোচারণ করেছিলে যোগাযোগ, যোগাযোগ, সবই যোগাযোগ, এবং সঙ্গে সঙ্গে হিটলারেরও উল্লেখ করেছিলে সেটা তো সঠিক প্রকাশ করলে না। আমি জানি, ভালো করেই জানি জর্মন মাত্রই হিটলার-যুগটাকে যেন একটা দুঃস্বপ্নের মতো ভুলে যেতে চায়। আমি তাদের খুব একটা দোষ দিইনে; আমি দেশে বসেই হিটলারের বিজয়ের পর বিজয়, পতনের পর পতন, প্রায় সবকিছুই স্বকর্ণে শুনেছি–
মানে?
অতি সরল। বেতার আমাদের দেশে ত্রিশ শতকেই বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে ইউরোপীয় বেতারকেন্দ্রগুলো আমাদের বড় একটা পরোয়া করত না– একমাত্র বিবিসি আমাদের জোর তোয়াজ করত। বোঝাবার চেষ্টা করত, আখেরে ইংরেজ জিতবেই জিতবে। ওদের ভয় ছিল আমরা যদি ইংরেজ পরাজয়ের মোকাটি হেলায় অবহেলা না করে ভারত থেকে তাদের তাড়াবার বন্দোবস্ত শুরু করি তা হলেই তো চিত্তির। তাই তারা সুবো-শাম জোর প্রপাগান্ডা চালাত– বিশেষ করে ডানকার্কের অতুলনীয় পরাজয়ের পর–যে ইংরেজকে হারানো চারটিখানি কথা নয়। জর্মনি তখন বিজয়মদে মত্ত। বিজয় মাত্রই কড় কড়া মদ। সে মদে যদি আবার পঞ্চরঙ মিশিয়ে দাও তা হলে তো আর কথাই নেই–
পঞ্চরঙ আবার কী মদ?
আমি সবিনয় নিবেদন করলুম, ওই বস্তুটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি বলে আমি সত্যই লজ্জা বোধ করি। শুনেছি পাঁচটা ভিন্ন ভিন্ন পাইপে (ছিলিম তো এরা বুঝবে না) পাঁচটা ভিন্ন ভিন্ন জাতের নেশা, যেমন গাঁজা, চরস, ভাঙ–
এসব আবার কী?
বোঝানো শক্ত, কারণ নিজেই জানিনে। তবে ইউরোপোমেরিকায় প্রচলিত হশিশ, হেরোইন, মরফিন এগুলোর প্রায় সবকটাই হয় গাঁজা নয় আফিম থেকে তৈরি হয়। এই যে তোমাদের হিপিরা–
লটে ভুরু কুঁচকে বললে, আমাদের!
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললুম, সরি সরি! এই যে ইউরো-আমেরিকা থেকে হিপিরা ভারতে যায়, তারা তো সক্কলের পয়লা ধরে গাঁজা।* ওটার একটা লাতিন নামও আছে– কানাবিস ইন্ডিকা না কী যেন তা সে যাকগে!… যা বলছিলুম, গাঁজা, চরস, ভাঙ, আপিঙ, আরেকটার নাম হিপিদের উচিত এটা তাদেরই কোনও একেলে বেটোফেনকে দিয়ে সুরে বসিয়ে ইন্টারনেশনাল রূপে গাওয়া।
[*পশ্চিম বাংলায় প্রচলিত আছে কি না জানিনে বলে একটি গঞ্জিকাপ্রশস্তি নিবেদন করি :
জীবন গাঞ্জা, তোরে আমি ছাড়তাম না (ধু)
এক ছিলিমে যেমন তেমন
দুই ছিলিমে মজা
তিন ছিলিমে উজির নাজির
চার ছিলিমে রাজা।
পাঁচ ছিলিমে হুকুর হুকুর
ছয় ছিলিমে কাশ
সাত ছিলিমে রক্ত– গা
(মডার্ন মেয়েরা যাকে বাথরুম পাওয়া বলে।)।
আট ছিলিমে নাশ।]
ভুলে গিয়েছি– পাঁচটা পাইপে সাজিয়ে সে পাইপগুলো ঢুকিয়ে দেয় আরেকটা মোটা পাইপে। দেখে নাকি মনে হয় যেন একটা গাছের গুঁড়ি থেকে পাঁচটা শাখা ট্যারা হয়ে উপর বাগে উঠেছে। আবার সেই বড় পাইপটা ঢুকেছে একটা খোলে। সে খোলে থাকে কড়া ধান্যেশ্বরী। সেই খোলের একটা ফুটোর ভিতর ছোট্ট একটি পাইপ হুবহু সিগ্রেট হোল্ডারের মতো দেখতে, দেবে ঢুকিয়ে। ওদিকে পঞ্চ পাইপের মুণ্ডতে ধরাবে মোলায়েম আগুন। আর হোল্ডারে মুখ লাগিয়ে দেবে ব্রহ্মটান। ওহ! তাতে নাকি কৈবল্যানন্দ লাভ হয়। তা সে যাকগে। হিটলার আর তাঁর জাদরেলরা তো জর্মন জাতটাকে খাইয়ে দিলেন বিজয় মদ। তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন নাৎসি পার্টির হের ডক্টর অর্থাৎ গ্যোবেলস পঞ্চঙ্গ প্রোপাগান্ডা। কিন্তু তিনি নিজে মাতাল হলেন না। একে তোমার মতো রাইন নদের পারে তার জন্ম–
লটে থাক, থাক কিন্তু মোলায়েম গলায়। আমি ও মনোভাবটা বুঝি! গ্যোবেলস মার্কা-মারা পাজির পা-ঝাড়া হতে পারে কিংবা সৎ ব্রাহ্মণের পদধূলিও হতে পারে, কিন্তু যাই বল যাই কও সে তো তার জন্মভূমি রাইনল্যান্ডকে বিশ্বের সুদূরতম কোণে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
বললুম, তার শত্রুরা পর্যন্ত স্বীকার করে, নাৎসি পার্টির করাতের খুঁড়ো ভর্তি মাথাওলাদের ভিতর ওরকম পরিষ্কার মগজওলা দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল না। মায় হিটলার।* ইংরেজ জাত ফরাসি জাতটার ওপর অত্যধিক সুপ্রসন্ন নয়, তারা পর্যন্ত স্বীকার করে লাতিন জাতের ফরাসিরাই এ জাতের অগ্রণী, ইতালীয়রা যতই চেল্লাচেল্লি করুক না কেন– এতে পরিষ্কার মাথা স্যাকসন টিউটনদের হয় না, এবং গ্যোবেলসের ধড়ের উপর যে ব্রেন-বক্সটি হামেশাই সজাগ থাকত সেটা ছিল লাতিন মগজে টইটম্বুর। আশ্চর্য নয়, এই রাইনল্যান্ডেই যে জর্মন রক্তের সঙ্গে ফরাসি রক্তের সবচেয়ে বেশি সংমিশ্রণ হয়েছে সে তত্ত্বটি বর্ণসঙ্কর বিভীষিকায় নিত্য নিত্য ঘামের ফোঁটায় কুমির দেখনেওলা হিমলার পর্যন্ত অস্বীকার করতে পারেননি। কেন লটে, তোমার যে চোদ্দ ডিগ্রি ট্যারার মতো চোদ্দ কেন, চোদ্দশো পুছ কালো চুল তার জুড়ির সন্ধানে বেরুতে হলে তো যেতে হয় ইতালি বা স্পেন মুল্লুকে। কী বল, আমার কৃষ্ণা কেশিনী?
[*স্বয়ং গ্যোবেলস তাঁর ডাইরিতে লিখেছেন, ফুরারের পশ্চাদ্দেশে তিনি এস্থলে যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেটি জর্মনির গ্রাম্যতম আটপৌরে শব্দ এবং ইংরেজিতেও একই অর্থ এবং প্রায় একই ধ্বনি ধরে) আস্ত একটা জ্যান্ত টাইম বম না রাখা পর্যন্ত তার চৈতন্যোদয় হয় না।]
তাচ্ছিল্যভরে বললে, রেখে দাও তোমার ওই রক্ত নিয়ে ধানাইপানাই। হিটলার চেল্লালেন, জর্মনরা সব নর্ডিক। এখন রব উঠেছে, আমরা রাইনলেভার নই, প্রাশান নই, এমনকি আমরা জর্মনও নই(!), আমরা সব্বাই এখন ইউরোপীয়ান! ছোর। কিন্তু এই সুবাদে শুধোই, লোকে বলে বিপরীত বিপরীতকে টানে। তোমার চুল তো কালো। তবে তুমি প্লাটিনাম ব্লন্ড রুপোলি ব্লন্ডের এফাঁকে উল্লাসে নৃত্য করতে করতে তোমার টিমের গোলি না করে আমাকে করতে কেন?
হেরমান এতক্ষণ অবহিত চিত্তে আমাদের চাপান-ওভোর শুনছিল। মৌনভঙ্গ করে বললে, শাবাশ! হে অশ্বিনীপ্রধান! (আশা করি শ্রুতিধর পাঠককে অযথা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না, অশ্বিনী ভ্রাতৃদ্বয় নিরবচ্ছিন্ন অভিন্নমনা ছিলেন বলে উভয়ে একই কামিনীকে কামনা করতেন। তোমার জয় হোক। তৎপূর্বে প্রিয়াকে সদুত্তর দাও। অনুজ শিক্ষালাভ করুক।
আমি বললুম, প্রিয়ে কৃষ্ণকুন্ডলে! তোমার চুল আমাকে আমার দেশের খেলার সাথীদের কথা স্মরণ করিয়ে দিত। তাদের চুল ছিল তোমারই মতো কালো।
(লটের চোখে কেমন যেন সন্দ সন্দ ভাব)
আমার প্রথম খেলার সাথী জোটে সাত-আট বছর বয়সে।
(লটের ঠোঁটে ক্ষীণতর মধুর স্মিতহাস্য)
করে করে আমার পাঁচটি সঙ্গিনী জুটল। আমি আমার ছোট বোনেদের কথা বলছি।
লটে আমার দিকে রহস্যভরা নয়নে তাকিয়ে বললে, খুশি হব, না ব্যাজার হব ঠিক অনুমান করতে পারছিনে। তুমি যদি বলতে, আমার চুল দেখে তোমার আপন দেশের প্রিয়ার কথা স্মরণে আসে তবে আমার বুক নিশ্চয়ই হিংসায় কিছুটা খচ খচ করত। তা-ও না হয় সয়ে নিতুম, কিন্তু আমার চুল তোমাকে তোমার বোনেদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় সে যে বড় পানসে।
হেরমান বললে, মানুষের মতিগতি এমনিতেই বোঝা ভার, তার ওপর যে মানুষ দূর বিদেশ থেকে এসেছে তার হৃদয়, তার রুচি বোঝা আরও কঠিন। লটে ঠিকই শুধিয়েছে, কালো চুলের প্রতি তোমার, বিশেষ করে তোমার এহেন অহেতুক আনুগত্য কেন? কালোর কীই-বা এমন ভূলোক দ্যুলোক জোড়া বাহার?
মুচকি হেসে এবং বেশ গর্বসহকারে বললুম, এর উত্তর তোমাদের কান্টও দেননি, আমাদের শঙ্করাচার্যও দেননি। দিয়েছে বাঙলা দেশের এক গাঁইয়া কবি। গেয়েছে,
কালো যদি মন্দ তবে।
কেশ পাকিলে কান্দো কেনে?
ব্লন্ডের সন্ধান সে কবি জানতেন না। কেশ পাকলে সাদা হয়, আর বল কেশ মানেই তো বার্ধক্য। তা সে কেশকে যে নামেই ডাকো না কেন– ব্লন্ড, প্ল্যাটিনাম ব্লন্ড, সিলভার ব্লন্ড, পরান যা চায় সে নাম দাও। হ্যাঁ, স্বীকার করি, সত্যিকার ব্লন্ড চুল অদ্ভুত চিকচিক করে, ঠিক যে রকম লটের কালো চুল চিকচিক করে (লটের একটা ক্ষীণ আপত্তি শোনা গেল তার চুলে নাকি পাক ধরতে শুরু করেছে। কিন্তু যবে থেকে না জানি কোন নাৎসি লক্ষ্মীছাড়া ছাতের চিমনির উপর থেকে চাঁচাতে আরম্ভ করল, খাঁটি নর্ডিক জাতের চুল হয় ব্লন্ড, অমনি আর যাবে কোথা– বইতে লাগল গ্যালন গ্যালন হাইড্রোজেন পারক্সাইড না কী যেন এক রাসায়নিক দ্রব্য। রাতারাতি সবাই হয়ে গেল ব্লন্ড। কিন্তু সে দ্রব্যের প্রসাদাৎ যে ব্লন্ড নির্মিত হন, তিনি না করেন চিকচিক, না আছে তেনাতে কোনও জৌলুস।
লটে বললে, থামো না। তুমি কি ওয়ার্লড ফেডারেশন ফর দি প্রিভেনশন অব হাইড্রোজেন পারক্সাইডের প্রেসিডেন্ট?
আমি বললুম। আর একটুখানি সময় দাও। কিন্তু আমি জানি, হেরমান কেন তোমাতে মজেছে। চুল কালো হলে এদেশে চোখ হয় কটা। বিকুটে কটাও আমি দেখেছি–ঠিক যেন বেড়ালের চোখের মতো। কিন্তু কালো চুল আর নীল চোখের সমন্বয় বড়ই বিরল। লটের বেলা সেই সমন্বয় ঘটেছে। আর জানো সুনীল-নয়না লটে, নীল চোখ আমি বড় ভালোবাসি। তোমাদের দেশে খাঁটি নীল রঙের আকাশ বড় একটা দেখা যায় না। যেটা আমাদের দেশে দিনের পর দিন দেখা যায় বিশেষ করে শরৎকালে। নীল চোখ এন্তের না হলেও বিরল নয় এদেশে। লটের কালো চুল আমার স্মরণে আনত বোনেদের কথা, আর তার নীল চোখের দিকে তাকালেই আমি যেন দেশের নীলাকাশ দেখতে পেতাম; মনটা বিকল হবে না তো কী? বিশ্বাস করবে না, ওই নিয়ে একটা কবিতাও লিখে ফেলেছিলুম।
কাতরে শুধাই, একি
তোমার নয়নে দেখি,
আমার দেশের নীলাভ আকাশ
মায়া রচিছে কি?
জর্মন অনুবাদটা আমার পছন্দসই হল না। কিন্তু লটেকে পায় কে? সে কবিতার বাকিটা শুনতে চায়।
আমি কিন্তু-কিন্তু করে গোটা দুই টোক গিলে বললুম, কিছু মনে কর না লটে, আর ব্রাদার হেরমান, কবিতার বাকিটা একটু স্কেটিং অন থিন আইস, আমাদের দেশের ভাষায় সদ্য নতুন ভেসে-ওঠা চরের চোরাবালির উপর হাঁটা। যে যুগে কবিতাটি লেখা হয় তখন সেটা রীতিমতো দুঃসাহসিক কর্ম ছিল।
হেরমান বললে, বাইরের দিকে দেখতে গেলে কবিতা গদ্যের তুলনায় অনেকখানি শৃঙ্খলাবদ্ধ। তাকে ছন্দের বন্ধন, মিলের কড়া শাসন মেনে চলতে হয়; আর সনেট রচনা করতে গেলে তো কথাই নেই। সেখানে এসবের বন্ধন তো আছেই তদুপরি ক ছত্রে সে কবিতাটিকে সুষ্ঠু সমাপ্তিতে আনতে হবে সেটা যেন রাজদণ্ডাদেশ। কোনও কোনও দেশে যাবজ্জীবন কারাবাসের অর্থ চোদ্দ বছরের শ্রীঘর। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় এই চোদ্দর অনুশাসনটি আইন-কর্তারা ধার নিয়েছেন কবিদের কাছ থেকে, তাদের সনেট হবে চতুর্দশপদী। এবং তারও ওপর আরেকটা মোক্ষম বন্ধন বিষয়বস্তু কোন কায়দাকেতায় পরিবেশন করবে সেটাও আইনকানুনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। প্রথম চার ছত্রে প্রস্তাবনা, দ্বিতীয় চার ছত্রে আমার মনে নেই আরও যেন কী কী। কিন্তু ঠিক এই কারণেই সে অনেক-কিছু বলার স্বাধীনতা পেয়ে যায়, যেটা গদ্যের নেই, গদ্যে সেটা কর্কশ এমনকি ভালগার শোনায়। এই যে আমি লটেকে বিয়ে করে পরাধীনতা স্বীকার করে নিয়েছি।
লটে : অর্থাৎ বিয়ের সদর রাস্তা ছেড়ে আইবুড়ো বয়সের সাইড জাম্প আর মারতে পার না।
ইগজেকলি! কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নীলাকাশে উড্ডীয়মান হওয়ার মতো, কিংবা বলতে পারো লটের নীল চোখের গভীরে ডুবে যাওয়ার মতো এমন একটা স্বাধিকার লাভ করেছি যেটা অতুলনীয়, যেটা না পাওয়া পর্যন্ত বাউণ্ডুলে আইবুড়ো সেটার বিন্দু পরিমাণ কল্পনাও করতে পারে না। লটেকে আমি সবকিছু বলতে পারি। এস্তেক আমার মারাত্মকতম দুর্বলতা। কবিতার বেলাও তাই। দেখোনি–প্রিয় অপ্রিয় গোপন কথা বাদ দাও–বহু কবি তার হীনতা নীচতা পর্যন্ত অম্লান বদনে স্বীকার করেছেন আপন আপন কবিতায় এবং সেটাও কোনও বিশেষ ব্যক্তির সম্মুখে নয়, বিশ্বজনকে সাক্ষী মেনে। তুমি নির্ভয়ে বলে যাও।
আমি তবু আমতা আমতা করে বললুম, পূর্বেই বলেছি তোমাদের দেশে নীলাকাশ হয় না, কিন্তু নীল নয়ন হয়। ঠিক তেমনি না হলেও বলা যায়, তোমাদের দেশে পদ্মফুল ফোটে না বটে, অর্থাৎ সরোবরে ফোটে না, কিন্তু ফোটে অন্যত্র! আমাদের দেশে মেয়েরা শ্যাম, উজ্জ্বল শ্যাম, এমনকি ফর্সাও হয় বটে, কিন্তু ধরো আমাদের লটের মতো ধবলশুভ্র কস্মিনকালেও হয় না। তাই, যার নীল নয়ন দেখে দেশের নীলাকাশ মনে পড়েছিল তাকে বললুম,
তোমার বক্ষতলে
আমার দেশের শ্বেত পদ্ম কি
ফুটিল লক্ষ দলে?
.
৩০.
হেরমান দুষ্ট হাসির মিটমিটি লাগিয়ে বললে, লোভ হচ্ছে না?
আমি বললুম, সে আর কও কেন, ব্রাদার?
লটে বুঝতে পারেনি। চটে বললে, কী সব হেঁয়ালিতে কথা বলছ তোমরা? কবি বলেছেন
মধু তার নিজ মূল্য নাহি জানে,
মধুকর তারে না বাখানে।
আসলে লটে কী করে জানবে, সামান্য কয়েক গ্লাস ওয়াইন খেতে না খেতে তার গাল দুটি আরও টুকটুকে হয়ে গিয়েছে। দেখতে পাচ্ছে হেরমান, লক্ষ করছি আমি। লটে জানবে কী করে? আমাদের দেশের সাধারণ জনের বিশ্বাস, ইউরোপের মেমসায়েবরা সায়েবদেরই মতো জালা জালা মদ গিলে ধেই ধেই নৃত্য করে। দ্বিতীয়টা সত্য। পুরুষের তুলনায় মেয়েরা নাচতে ভালোবাসে বেশি (কাষ্ঠরসিকরা তার সঙ্গে আবার যোগ দেন, বাচ্চা বয়সে তারা আপন খেয়াল-খুশিতে নাচে; একটু বয়স হওয়ার পর বেকুব পুরুষগুলোকে নাচায়) কিন্তু মদ তারা খায় পুরুষের তুলনায় ঢের ঢের কম। কেন কম খায়, সে এক দীর্ঘ কাহিনী। তবু একটা ইঙ্গিত দিতে পারি; কাচ্চাবাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা লোপ পাওয়ার পর অনেক মেয়েছেলেই পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মদ খেতে শুরু করে এবং বিস্তর পয়সাওলী বৃদ্ধা খাটে শুয়ে শুয়ে রাত বারোটা অবধি খাসা টুকুস ঢুকুস করে। লটের এখনও বাচ্চা হতে পারে কি না বলা কঠিন অসম্ভব নয়। তবে একথা ঠিক, লটের ওয়াইন চুকুস চুকুস করার কায়দাকেতা থেকে পষ্ট মালুম হয়, ও রসে এ গোবিন্দদাসী বঞ্চিত না হলেও আসক্তা তিনি নন। তাই কুল্লে আড়াই গ্লাস চুষতে না চুষতেই তার গোলাপি গাল দুটি হয়ে গিয়েছে টুকটুকে লাল– বুড়িদের নাক হয়ে যায় বিচ্ছিরি কোণী ঘেঁষা লাল।
হেরমান নির্ভয়ে বললে, হের সায়েড তার দেশের কী এক মাছের বিরাট বয়ান দিয়ে বলেছিল না, সে মাছ যে খায় না সে মূর্খ। তোমার গাল দুটি যা টুকটুকে লাল হয়েছে– মনে হয় ঠোনা দিলেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটবে– সে গালে একটুখানি হাত বুলিয়ে দিতে যে লোকের ইচ্ছে হয় না সে মূর্যের চেয়েও মূর্খ, গবেট, গাড়ল এবং বর্বর।
লটে আমার দিকে তাকিয়ে শুধাল, আর তুমি সায় দিচ্ছিলে?
আমি ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে এ পোড়ার দেশে আবার টাইট কলারের চাপে আপন অপ্রতিভ ভাবটা যথারীতি পাকা ওজনে চুলকোনোও যায় না– নানা প্রকারের অস্কুট আনুনাসিক মার্জার সুলভ আঁও এ্যাও করতে করতে বললুম, তা, –সে– এটাতে– সত্যি বলতে কী, এহেন দুরাকাঙ্ক্ষা যদি আমার হৃৎকন্দরে অঙ্কুরিত হয় তবে সেটা এমনকি অন্যায় হল বল তো। তোমাদের দেশেই তো, বাপু, প্রবাদ আছে, বেড়ালটা পর্যন্ত খুদ কাইজারের দিকে তাকাবার হক্ক ধরে।
আমি মনে মনে ভাবছিলাম, লটে বোধহয় বিরক্ত হয়েছে।
ওমা, কোথায় কী! লটে চটেনি।
বললে, আমার বয়স পঞ্চাশ বুড়ি হতে আর ক বছর বাকি?
আমি গম্ভীর কণ্ঠে বললুম, জর্মনিতে বুড়ি নেই। এ দেশে কেউ বুড়ি হয় না।
মানে?
এ তত্ত্বটা আমি শিখি এই গোডেসবের্গ শহরেই। তোমার মনে আছে, আমাদের সেই ফুলওলা? সবে এখানে এসেছি, তার সঙ্গে আলাপ হয়নি। ইতোমধ্যে মার পেটে কী যেন একটা হল। জব্বর অপারেশন করলেন কলোন থেকে এসে ডাকসাইটে এক সার্জন।
লটে বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার পষ্ট মনে আছে। আমাদের পাড়ার হাসি-খুশি তখন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
একদম খাঁটি কথা। আমার মা যখন সেরে উঠছেন তখন ভাবলুম, কিছু ফুল নিয়ে যাই। ঢুকলুম সেই ফুলের দোকানে। সেই ছোকরা প্রায় আমার বয়সী তো উল্লাসে প্রায় নৃত্যমান। বার তিনেক জপ-মন্ত্রের মতো গুটন্ মর্গন বলতে বলতে শুধালে, আপনার ইচ্ছে? আদেশ করুন। এবং পূর্ববৎ অদৃশ্য সাবানে হাত কচলাতে লাগল।
জর্মন ফুলের তত্ত্ব তখনও কিছু জানিনে। কোন ফুল নিলে ভদ্রদুরস্ত হয় সে বাবদে আরও অজ্ঞ। তাই কিন্তু কিন্তু করছি দেখে অতিশয় লাজুক খুশিভরা মুখে বলল, স্যর, কিছু মনে করবেন না। কে, কার জন্য, কোন ফুল নেবেন কি নেবেন না, সে সম্বন্ধে কোনও প্রকারের কৌতূহল দেখানো আমার পক্ষে, সর্ব ফুলবেচনেওলার পক্ষে অমার্জনীয় অপরাধ। তাই, হেঁ হেঁ, কিছু মনে করবেন না, যদি সামান্যতম ইঙ্গিত দেন–
আমার বয়স তখন আর এমন কী। লজ্জা পেয়ে থতমত হয়ে তোতলালুম, না, না, সেরকম কিছু নয়। আমি ফুল কিনব একজন অসুস্থ বৃদ্ধা
সঙ্গে সঙ্গে যেন কেউ তার উদোম পিঠে সপাং করে বেত মেরেছে– কোঁৎ করে ককিয়ে বললে, এমন কথাটি বলবেন না, স্যর।
আমি তো রীতিমতো ভীতসন্ত্রস্ত। নাচতে গিয়ে আবার কোনও এটিকেট নামী মহিলার পা মাড়িয়ে দিয়েছি।
কোমরে দু ভাঁজ হয়ে বাও করে বিনয় কণ্ঠে বললে– আপনি বিদেশি; তাই জানেন না, আমাদের এই ডয়েশনট ঝুবার আলেসের দেশে, বিশেষ করে এই সুর-কানন সুন্দর রাইনল্যান্ডে কোনও বৃদ্ধা, এমনকি প্রৌঢ়া মহিলাও নেই। কস্মিনকালে হয়নি, হবেও না। বলতে হয় বর্ষীয়সী এবং সর্বোত্তম পন্থা, কিঞ্চিৎ হেঁ হেঁ করে যেন বড়ুই অনিচ্ছায়। বলছেন, এই একটুখানি বয়স হয়েছে আর কি। সেই আমার প্রথম শিক্ষা। তাই বলি, পঞ্চাশ! ছছাঃ! সে আর এমন কী বয়স!
লটে বললে, পিরামিডের তুলনায় তেমন আর কী?… সেই যে বলছিলুম, আর বচ্ছর যখন আমি মনিক গিয়েছিলুম।
আমি উৎসাহিত হয়ে বললুম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হিটলার, যোগাযোগ, ড্রেজেন হোটেল এসব দিয়ে কেমন যেন একটা ক্রসওয়ার্ড পাজল বানাচ্ছিলে?
ম্যুনিকে পরিচয় হল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে, পরবের শেষ পার্টিতে। কথায় কথায় বেরিয়ে পড়ল, তিনি হিটলারের যে অ্যারোপ্লেন পাইলট ছিলেন বাওর, তার নিকট-আত্মীয়। আমাদের মধ্যে কে যেন আশকথা-পাশকথার মাঝখানে যোগাযোগের মাহাত্মের প্রতি ইঙ্গিত করেছিল। আত্মীয়টি তখন বললেন, এই যে পাঁচ বছর ধরে পৃথিবীর বীভৎসতম যুদ্ধ হয়ে গেল, কত নিরপরাধ ইহুদি কনসানট্রেশন ক্যাম্পে মারা গেল, বমিঙের ফলে হাজার হাজার নারী-শিশু মারা গেল এর কিছুই হয়তো শেষ পর্যন্ত ঘটত না, যদি না সামান্য একটা যোগাযোগে একটুখানি গোলমাল হয়ে যেত। তার পর বিশেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি গডেসবের্গের বাসিন্দা বললেন না, সেই গডেসবের্গের ড্রোজেন হোটেলে গিয়ে উঠেছেন হিটলার। তারিখটা ২৯-এ জুন ১৯৩৪। আমার আত্মীয় বাওর বলেন, হিটলারের আশু প্রোগ্রাম সম্বন্ধে কেউই বিশেষ কিছু জানত না। তবে হিটলার তাঁকে বলে রেখেছিলেন, তাঁর প্লেন যেন হামেহাল তৈরি থাকে। বাওর খানিকক্ষণ পরে এসে বললেন, সে প্লেনে নাকি কী একটা গলদ দেখা গিয়েছে তবে তিনি অন্য প্লেনে বার্লিন গিয়ে সেখান থেকে রাতারাতি স্পেয়ার নিয়ে আসতে পারবেন। হিটলার অসম্মতি জানালেন। রাতের খানাদানা শেষ হলে পর হিটলার কেমন যেন চুপ মেরে গেলেন। যথারীতি তাঁর প্রিয় ভাগনারের রেকর্ড বাজতে শুরু করল। হিটলারের সেদিকে যেন কান নেই, অভ্যাসমাফিক সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে উরুতে ঠেকাও দিচ্ছেন না আর সর্বক্ষণ উসখুস করছেন। বাওর তখন সেই একঘেঁয়েমি থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য হিটলারের কাছ থেকে ঘণ্টা দুত্তিনের ছুটি চাইলেন। ইচ্ছে, পাশের বন শহরে একটা রোদ মেরে আসেন। এটা কিছু নতুন নয়। হিটলার হামেশাই এ ধরনের ছুটি সবাইকে মঞ্জুর করতেন। আজ কিন্তু বললেন, না, তোমাকে যে কোনও সময় আমার প্রয়োজন হতে পারে। দুপুররাতে বাওরকে বললেন, খবর নাও তো, মুনিক ফ্লাই করার মতো আবহাওয়া স্বাভাবিক কি না। বাওর পাশের বড় অ্যারপোর্ট কলোন শহরে ট্রাঙ্ককল করে খবর পেলেন, আবহাওয়া খারাপ। হিটলার কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বাওরকে আদেশ দিলেন, খানিকক্ষণ বাদে বাদে যেন তিনি ট্রাঙ্ককল করে আবহাওয়ার খবর নেন। বাওর তাই করে যেতে লাগলেন। শেষটায় রাত তিনটের সময় বাওর সুসংবাদ দিলেন, এখন ফ্লাই করা সম্ভব। হিটলার সঙ্গে সঙ্গে মোটরে উঠলেন, প্লেনে চেপে ভোরের আলো ফুটি ফুটি করছে এমন সময় মুনিক পৌঁছলেন। এস্থলে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, হিটলারের আপন প্লেন মেরামত হয়নি বলে তিনি মনিক পৌঁছলেন অন্য প্লেনে। অ্যারপোর্টে পৌঁছেই হিটলার জোর পা চালিয়ে গিয়ে উঠলেন মোটরে। সে গাড়িতে তার কয়েকজন অতিশয় বিশ্বাসী সশস্ত্র সহচর তার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। মোটর সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতগতিতে উধাও হল। বাওর প্লেন হ্যাঁঙারে তোলার ব্যবস্থা করে দিয়ে অ্যারপোর্টে পায়চারি করছেন এমন সময় তার পরিচিত এক অফিসার তাঁকে দেখে শুধোলেন, আপনি এখানে? কেন, ফুরারকে খানিকক্ষণ আগে প্লেনে করে এখানে নিয়ে এলুম যে।
অফিসার আরও আশ্চর্য হয়ে শুধোলেন, সে কী? তাঁর প্লেন তো দেখতে পেলুম না।
আমরা অন্য প্লেনে এসেছি। কিন্তু ব্যাপার কী?
অফিসার অত্যন্ত চিন্তান্বিত হয়ে বললেন, কেপটেন র্যোম আমাকে খাড়া হুকুম দিয়েছিলেন, আমি যেন এখানে কড়া চোখ রাখি, ফুরারের প্লেন দেখা গেলেই যেন তাকে ফোন করে খবর দিই। এখন করি কী?
বাওর বললেন, করার তো কিছুই নেই আর। ফুরার তো এতক্ষণে কেপটেন রোমের ওখানে নিশ্চয়ই পৌঁছে গিয়েছেন।
এস্থলে বলা প্রয়োজন, হিটলার সম্বন্ধে বিশেষ কোনও বই পড়া না থাকলেও একাধিক ফিলমের মারফত অনেক পাঠকই জানেন, এই কেপটেন রোমই হিটলারের সর্বপ্রধান অন্তরঙ্গ সখা যিনি হিটলারকে জর্মনির চ্যানসেলর রূপে গদিনশিন করার জন্য সর্বাধিক কৃতিত্ব দেখান। তাঁর অধীনে প্রায় পাঁচ লক্ষ নাৎসি যুবক আধা-মিলিটারি ট্রেনিং পেয়েছিল। হিটলার নাকি হঠাৎ খবর পান– কখন পান বলা কঠিন– যে র্যোম নাকি তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, তাঁকে হটিয়ে স্বয়ং গদিতে বসবেন। তবেতে আছে, বিশেষ করে তাঁরই (র্যোমেরই) অনুগত পাঁচ লক্ষ নাৎসি– এদেরই নাম ব্রাউন শার্ট।
হিটলার তাই কাউকে কোনও খবর না দিয়ে, গোপন ব্যবস্থা করে হঠাৎ গোডেসবের্গ থেকে (সেখানে গিয়েছিলেন যেন পূর্বাভ্যাসমতো বিশ্রাম নিতে– আসলে র্যোমের চোখে ধুলো দেবার জন্য; অবশ্য র্যোমও কিছুটা সন্দেহ করেছিলেন বলে পূর্বোল্লিখিত অফিসারকে অ্যারপোর্টে মোতায়েন করেছিলেন) মনিকে পৌঁছে সোজা র্যোম যে হোটেলে স্বাস্থ্যোদ্ধার করছিলেন, সেখানে অতি ভোরে পৌঁছে তাঁকে অতর্কিতভাবে হামলা করে বন্দি করেন।
র্যোম এবং তাঁর নিতান্ত অন্তরঙ্গ ষড়যন্ত্রকারীদের গুলি করে মারা হয়।
লটে বললে, আবহাওয়ার যোগাযোগ তো আছেই কিন্তু আসল কথা এই, হিটলার যদি আপন প্লেনে আসতেন তবে সেই পাহারাদার অফিসার তৎক্ষণাৎ রোমকে জানাতেন। রোমও তৈরি থাকতেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গকে জড়ো করতেন। কে জানে, আখেরে কী হত। হয়তো রোমই জিততেন। তা হলে কী হত? কে জানে? হিটলারের মতো র্যোম তো ফ্রানসের প্রতি বিরূপ ছিলেন না ভালোবাসতেন বললেও অত্যুক্তি হয় না।
আর জানো, সবকিছু ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার পর বাওর এই প্লেনের গুবলেট-কাহিনী হিটলারকে বলেন।
হিটলার নাকি প্রত্যুত্তরে বলেন, নিয়তি!
লটে বললে, আমি বলি, যোগাযোগ।
.
৩১.
আচ্ছা লটে, আর পাঁচজন জর্মনের মতো তুমি তো হিটলার-যুগটা একটা বিভীষিকা ভরা দুঃস্বপ্নের মতো ভুলে যেতে চাও না। তবে একটি কাহিনী আমি শুনতে চাই- বরঞ্চ বলা উচিত, আমি শুনতে চাই আর না-ই চাই, আমার দেশের ছেলেছোকরা মোকা পেলেই আমাকে শুধোয়, হিটলার বিয়েশাদি করলেন না কেন? তা সে করুন আর না-ই করুন ইউরোপে যখন দুধ সস্তা তখন গাই কিনে সেটার হেপাজতির বয়নাক্কা– ঝামেলা পোয়ানো মহা আহাম্মুকি– প্রেম-ট্রেমের দিকে তার কি কোনও প্রকারেরই ঝোঁক ছিল না?
লক্ষ করেছি, এ প্রশ্নে অনেক জর্মনই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। কিন্তু লটে মেয়েটির সমঝ-বুঝ আছে। একদিকে যেমন খানিকটে ধরিটানিজম আছে, অন্যদিকে কথাপ্রসঙ্গে যদি প্রেম এমনকি আলোচনা দৈহিক কামনার দিকে মোড় নেয় তবে সে সবসময় নাসিকা কুঞ্চিত করে না। এমনকি মাঝে মাঝে হাজার ভলটের প্রাণঘাতী শকও দিতে জানে। যেমন আমাদের তিনজনাতে বেশ যখন জমে উঠেছে তখন লটে বেশ রসিয়ে রসিয়ে য়োহানেস-আঙনেস-আমার মান-বিহারের বিপর্যয় কাহিনী হেরমানকে শোনাল। হেরমান কৌতুকভরে আমাকে শুধাল, আচ্ছা সায়েড, সবই তো হল কিন্তু ঝোঁপের আড়াল থেকে অষ্টাদশী আঙনেসের বার্থডে ফ্ৰকপরা যে অনাবিল সৌন্দর্য
ঝোঁপের ভিতর দিয়ে আসার সময় কাহিনী বলতে বলতে যখন এই অঙ্কে পৌঁছই তখন যে রকম রসভঙ্গ করে লটে ধমক দিয়ে বলেছিল চোপ, এস্থলে সেটা তদ্বৎ।
আমি হেরমানের দিকে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে ফরিয়াদ জানালুম, ভায়া হেরমান, আড়াল থেকে মাত্র দুটিবার এ জীবনে নগ্ন সৌন্দর্য দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল–
ঠোঁটকাটা হেরমান শুধলে, আর মুখোমুখী?
লটে ফের ধমকাল, চোপ! এ- চোপেতে আমার সর্বান্তঃকরণের সম্মতি।
রূঢ়বাক্য প্রয়োগের বেলায় লটের শব্দভাণ্ডার বড়ই বাড়ন্ত। অনুমান করলুম, প্রাচীনদিনের সেই নবীনা লটে নানা অনাবশ্যকীয় কিন্তু অনিবার্য পরিবর্তন সত্ত্বেও সেই লটে এখনও শান্তা নাম নিতে পারে। কাউকে ধমক-টমক দিতে দিতে কড়া কথার স্টক বড় একটা বাড়াতে পারেনি।
আমি হেরমানকে করুণতর কণ্ঠে বললুম, শুনলে ভাইয়া, শুনলে? দেখলে, কী মারাত্মক পুরিটান, ঝুরঝুরে সেকেলে পদি পিসি!
লটে স্থির নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে বললে, আমার সঙ্গে যুগ অভিসারে বেরিয়েছ আমারই বাড়ির সামনেকার কুঞ্জবনে–।
আমি মনে মনে খানিকটে আমেজ করে গুনগুনালুম,
আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়
আমারি আঙ্গিনা দিয়া।
লটে বাক্যের শেষাংশ পুনরাবৃত্তি করে বললে আমারই বাড়ির সামনেকার কুঞ্জবনে, আর আমাকে শুনতে হবে, কান ভরে শুনতে হবে, প্রাণভরে আ মরি-আ মরি বলতে হবে আংনেসের নগ্ন সৌন্দর্যবর্ণনার প্রতিটি শব্দ যখন আমার কানের পর্দাতে কটাং কটাং করে হাতড়ি ঠুকবে। ভেবো না আমি হিংসুটে। নগ্ন সৌন্দর্যের বর্ণনা যে কোনও পুরুষ যে কোনও রমণীর এবং ভাইস-ভার্সা দিক। আমার তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই– তা সে বিন্দু সরেসতম নেপলিউন ব্রান্ডিরই হোক আর নিরেসতম জাপানি বিয়ারেরই হোক; কিন্তু তুমি যদি দিতে চাও– তা সে তোমার জীবনে প্রথমবারের মতোই হোক, আর শেষবারের মতোই হোক-তুমি দেবে আমায় রইল কথা।
হেরমান বললে, ব্রাভো, ব্রাভো, ন-বউ বাঁচলে হয়।
এবার আমার চোপ বলার পালা। হেরমান যেন রণাঙ্গনে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়ে বলল, কেন? শুনতে পাবার মতো অধিকার আমার কাছে কি, বর্ণনাটা গেলবার মতো প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি কি, সে সিনেমাটা এ মার্কা না বি-মার্কা, জানতে পারি কি? কেন আর্টিস্টরা কি ন্যুড মডেল সামনে দাঁড় করিয়ে ছবি আঁকে না? আর দাঁড় করিয়েই বা বলছি কেন? আর্টিস্ট পিটলারের স্টুডিয়োতে যখনই গিয়েছি, তখনই দেখেছি, নিদেন গোটা তিনেক মডেল বার্থডে ফ্রক পরে কেউ বা কফি বানাচ্ছে, এখান থেকে দেশলাই আনছে, ওখান থেকে চিনিটা আনছে, সেখানে আতিপাতি খুঁজছে, কফির কৌটোটা গেল কোথায় শুধোচ্ছে, জানো তো আর্টিস্ট মাত্রই কী রকম মারাত্মক গোছ-গোছানোর নিট অ্যান্ড ক্লিন বেড়ালটির স্বভাব ধরেন– অন্যজন মুলারের আসন্ন প্রদর্শনীর জন্য ছবি খুঁজতে গিয়ে কখনও কাত হয়ে গড়াতে গড়াতে সোফার নিচে ঢুকছেন, কখনও-বা অর্ধ লফে জানালার চৌকাঠের উপর উঠে একটি বাহু সম্প্রসারিত করেছেন সর্বোচ্চ শেলফের দিকে, আমি তো ভয়ে মরি, হাতখানির প্রলম্বিত ওই টান-টান টানের ফলে দেহশ্রীর উচ্চার্ধ না বক্ষচ্যুত হয়।
হেরমান সবিনয় বললে, তাই সই। বাকিটা সংক্ষেপে সারছি। কারণ তৃতীয়া মডেলটি সবাকার সেরা। সেই বিরাট স্টুডিয়োর মাঝখানে তিনি মেদ বৃদ্ধি নিবারণার্থে জিমনাস্টিক জুড়েছেন। আর সে যা তা জিমনাস্টিক নয়– ভারতীয় সাপুড়ে নাচ থেকে শুরু করে মিশরি বেলিডানস– নাভিকুণ্ডলীটি কেন্দ্র করে।
আর ওইসব হুরীপরীদের কর্মকলাপের মধ্যিখানা যেন তুর্কির পাশা জর্মন পিটলার তার খাস-প্যারা ডিভানটির উপর অঘোরে ঘুমঘোরে নাক ডাকাচ্ছেন। একদিন পিটুকে শুধিয়েছিলুম, মঞ্চের উপর মডেল ছিল… দাঁড়িয়ে আছেন সে না হয় বুঝি। কিন্তু কাজকর্ম করার সময় ওনারা জামা-কাপড় পরলে কী দোষটা হয়। পিন্টু বললে, আমি নাকি একটা আস্ত বুন্ধু। দুনিয়ার তাবৎ মেয়েই তো এমন কিছু আর্টিস্টের মডেলের মতো যাবজ্জীবেৎ ততকাল মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে সুখং জীবেৎ বরাত নিয়ে আসে না। ওরা হাঁটে, কাজ করে, উপ হয়ে এটা-সেটা কুড়োয়, পায়ের আট আঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে নাগালের প্রায় বাইরের তাকটা থেকে আচারের বোয়াম নামায়। এগুলোও তো আঁকতে হয়– অবশ্য ফ্রক ব্লাউস তখন তাদের পরনে থাকে, আমিও তাই আঁকি। কিন্তু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্থান পরিবর্তন এবং তজ্জনিত নানাবিধ আন্দোলন নুডে না দেখা থাকলে ছবি ডাইনামিক হয় না। উদাহরণ দিয়ে পিট বলেছিল, গাছের যে ডালপালা– তার গতিবিধি হুবহু জানতে হলে গাছটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হয়, যখন শীতকালে সে সর্ব পত্রবিবর্জিত নগ্ন।
আমি বললুম, তা হতে পারে। কিন্তু আর্টিস্টরা সবকিছু দেখে নিরাসক্ত নয়নে। নুড গাছ, নুড রমণীকে একই নিরাসক্ত নয়নে। কিন্তু আর পাঁচজন তো প্রভু খ্রিস্টের মতো নয়। তিনি বলেছেন, পাপনয়ন উপড়ে ফেল। আর বললে বিশ্বাস করবে না, আমাদের দেশের এক বেশ্যাসক্ত পাপী ওই উপদেশ না জেনেও জ্ঞানচক্ষু খুলে যাওয়াতে চর্মচক্ষু উপড়ে ফেলে। আশ্চর্য, প্রভু খ্রিস্ট উদ্ধার করলেন ভ্ৰষ্টা নর্তকী মারি মাগদেলেনকে আর ভ্রষ্টা নর্তকী চিন্তামণির উপদেশে উদ্ধার পেল পাপী বিল্বমঙ্গল। কিন্তু সেকথা থাক। আমি বলছি, তোমার বউ তো বিরাট ওকগাছ–
লটে : কী বললে! আমি ধুমসী মুটকী ওকগাছ?
আহা চটো কেনে? অন্য হাতটা আনতে দাও—
সে আবার কী জ্বালা?
পরে হবে, –কিংবা তুমি তন্বঙ্গী চিনার গাছও নও, তা হলে, বল বত্স, হেরমান, করি কী?
হেরমান : কে বললে তোমাকে, আর্টিস্টরা নিরাসক্ত নয়নে কুল্লে দুনিয়ার দিকে তাকায়? তা হলে কোনও নুডকে সরলা, কোনওটিকে চিন্তাশীলা, কোনওটিকে কামুকা, কোনওটিকে চিত্তপ্রদাহিণী, কোনওটিকে শান্তিদায়িনী আঁকে গড়ে কী প্রকারে? নিশ্চয়ই তাদের হৃদয়মনে ভিন্ন ভিন্ন ভাবোদয় হয়। অবশ্য পূর্ণ সিদ্ধা মডেল তার থোড়াই পরোয়া করে। সঙ অব সঙ- সঙ অব সলমন নামেও পরিচিত– ফিলিম দেখেছ? আমাদের ওই পাশের শহরে। কলোনের মেয়ে হিটলার-বৈরী রমণী মার্লেন ডিটরিষ সে ফিলিমের প্রধান নায়িকা। গাঁইয়া মেয়ে এসেছে শহরে পিসির দোকানে কাজ করতে। সেখানে এক ছোকরা ভাস্করের সঙ্গে মাত্র কয়েক মিনিটের আলাপ। ছোকরা পিসির ভয়ে বেরুবার সময় শুধু আঙ্গুল দিয়ে দেখাল– সামনের পাঁচতলার বাড়ির চিলেকোঠায় তার স্টুডিও। মেয়েটা মজেছে। সে রাত্রেই গেল আর্টিস্টের কাছে। আর্টিস্ট সত্যই মেয়েটিকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছে যেন সন্ধান পেয়েছে তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি, মাস্টারপিস সঙ অব সঙস সর্বগীতির সেরা গীতি ওরই ব্লড দিয়ে নির্মাণ করবে। অনুপ্রাণিত ভাষায় মেয়েটিকে তার আদর্শ, তার সর্বকীর্তির শ্রেষ্ঠতম কীর্তির কথা বলে বলে সেই সরলা বালার হৃদয়ে তার ভাবাবেগ সঞ্চারিত করল। অবশেষে অনুরোধ করা মাত্র সর্ব আবরণ খুলে ফেলে দাঁড়াল মঞ্চের উপর সে মেয়ে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য আর্টিস্ট ঊর্ধ্বশ্বাসে দ্রুততম গতিতে এঁকে যেতে লাগল প্রথম স্কেচ। সম্বিতে ফিরে এল স্কেচ শেষ হওয়ার পর। তখন এই সর্বপ্রথম, সে লক্ষ করল মেয়েটির দেহের সৌন্দর্য। তার চোখের উপর ফুটে উঠল সে ভাব-পরিবর্তন, মেয়েটি এক পলকেই সে আবেশ লক্ষ করল। সঙ্গে সঙ্গে পেল নিদারুণ লজ্জা। ছুটে গিয়ে সর্বাঙ্গ জড়াল, হাতের কাছে যা পেল তাই দিয়ে।
এতক্ষণ অবধি দু জনার কারওরই কোনও আচরণে কোনও প্রকারের আড়ষ্টতা ছিল না। দু জনা একই সৃষ্টিকর্মের ভাবাবেশে নিমজ্জিত, একই আদর্শে অনুপ্রাণিত– একজন ডাইনামিক অন্যজন স্টাটিক। একজনের সে ভাব পরিবর্তন হওয়া মাত্রই সে পরিবর্তন ওর মনে সঞ্চারিত হল। মৃন্ময় দেহ সম্বন্ধে সে এই প্রথম সচেতন হল। সঙ্গে সঙ্গে তার চিত্তে উদয় হল, সঙ্কোচ ব্রীড়া লজ্জা। সঞ্চারিত হল দেহে।
অনুরোধের সঙ্গে সঙ্গে এ মেয়েটির বিবস্ত্র হওয়া, আর্টিস্ট যতক্ষণ স্কেচ করছিল আপন নগ্নদেহ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন থাকা, স্কেচ শেষে হঠাৎ আর্টিস্টের চোখের ভাবান্তর লক্ষ করে চিন্ময়ভুবন থেকে মৃন্ময়লোকে পতন– এ সবই সম্ভব হয়েছিল, তার একটিমাত্র কারণ সে ছিল জনপদবালা সরলা কুমারী।
হেরমান ঠিক সমে এসেই থামল। আমার দিকে তাকিয়ে বললে, বে-আদবি মাফ হয়। আমি একটু আসি।
আমি লটের দিকে তাকালুম। তার নয়ন মুদ্রিত। হেরমানের ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার শব্দ শুনে চোখ মেলে আমার দিকে গভীর স্নেহভরা চোখে তাকিয়ে বললে, হেরমান অনায়াসে চিন্ময়-মৃন্ময়ে আনাগোনা করতে পারে। আমার অতখানি বুদ্ধি নেই, অতখানি স্পর্শকাতরও আমি নই। আমি অত্যন্ত সাদামাটা রাইনের কাদায় গড়া মানুষ। তবু বলব, হেরমান যেভাবে সমস্যাটা বুঝিয়ে বলল, এর পর হিটলারের প্রেম নিয়ে আলোচনা করা যায় না। লোকে বলে হিটলারের প্রেম, কিন্তু সে পঙ্কিল বস্তুটাকে প্রেম নাম দিতে হলে অনেকখানি কল্পনাশক্তির প্রয়োজন, ওটা আজ থাক।
খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে শুধাল, আজ চাঁদের আলোটা ঠিক তেমন উজ্জ্বল নয়, সেই সে-রাত্রে তুমি যখন রাইন গলট এক্সপ্রেসের তুফান বেগে চিঠি ডাকে ফেলতে যাচ্ছিলে। তবু নেই নেই করে কিছুটা তো আছে। আচ্ছা তুমি কখনও চাঁদের আলোতে ক্যানভাসের ফোলডিং বোট-এ রাইনের উপর ঘোরাঘুরি করেছ?
আমি বললুম, কেন?
আমাদের একটা আছে! যাবে?
আমি শুধালুম, সে তো বেশ কথা। হেরমান নিশ্চয়ই ভালো নৌকো বাইতে জানে– রাইনের পারে জন্মাবধি এতটা কাল কাটাল।
লটে খিল খিল করে হেসে বললে, তুমি কি ভেবেছ আমাদের ফোলডিং বোট স্বর্গীয় মানওয়ারি জাহাজ বিসমার্ক বা কুইন মেরি সাইজের জাহাজ। ওটাতে মাত্র দু জনার জায়গা হয়।
আমি বললুম, সর্বনাশ।
.
৩২.
কথায় বলে কানু ছাড়া গীত নেই। অবশ্য সে গীত শ্রীকৃষ্ণের শৌর্যবীর্য, তার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা এমনকি তিনি যে মথুরায় একাধিক বিবাহ করেছিলেন এবং হয়তো-বা এঁদের কোনও একজন বা একাধিক জনকে ভালোও বেসেছিলেন– এসব বিষয় নিয়ে নয়। সত্রাজিত দুহিতা সত্যভামার প্রতি তিনি যে বিলক্ষণ অনুরক্ত ছিলেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মহাভারতে আছে, সত্যভামা কোপাবিষ্ট চিত্তে রোদন করিতে করিতে বাসুদেবের ক্রোড়ে উপবিষ্ট হইয়া তাহার কোপানল উদ্দীপিত করিলেন। এবং ফলস্বরূপ পরে যে হানাহানি আরম্ভ হয় সেটাতে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বিস্তর ভোজ এবং অন্ধক বংশের বীরদের বিনষ্ট করেন। কিন্তু প্রশ্ন, সত্যভামার প্রতি বাসুদেবের অনুরাগ নিয়ে কোনও কবি উচ্চাঙ্গের কাব্যসৃষ্টি করেছেন বা গীত গেয়েছেন একথা তো কখনও শুনিনি। কানুর গীত মানেই শ্রীরাধার উদ্দেশে কৃষ্ণের প্রেমনিবেদনের গীত এবং তার চেয়েও মধুরতর এবং বেদনায় নিবিড়তর–বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয়–কানুর বিরহে রাজার ঝিয়ারীর আর্তগীতি।
গোডেসবের্গ-মেলমের অতি কাছেই রাইনের দুটি অপরূপ সুন্দর দ্বীপ। অর্থাৎ লটেদের বাড়ি থেকে দূরে নয়। কিন্তু উজানবাগে।
হেরমান নৌকাটি ফিটফাট করে সেটাকে এক ধাক্কায় ভাটির দিকে ঢালু করে দিয়ে বেশ উঁচু গলায় বললে, বলি লটে, বেশি বাড়াবাড়ি কর না। রিভার-পুলিশ কাছেই। আমাদের স্টেশনে স্টেশনে যেরকম একদা সাইনবোর্ড সাবধানবাণী শোনাত পকেটমার নজদিকে হৈ। আমি বললুম, তবেই হয়েছে। বলেই ফিক করে আধগাল হেসে নিলুম।
তোমার কথায় আর আচরণে কোনও মিল নেই। এদিকে বলছ, তবেই হয়েছে, অর্থাৎ কাছেপিঠে রিভার-পুলিশ থাকলে আমাদের সর্বনাশ হবে। ওদিকে ঠোঁটের আলোতে খেলে গেল মোলায়েম হাসি। মানে খুশি। কোনটা ঠিক? হেঁয়ালি ছেড়ে কথা কও। তুমি চিরকালই বেখেয়ালি। অভদ্র ভাষায় বলতে হলে নির্ভয়ে বলব, তুমি আমার মনে আমার বুকে কী চলছে সে সম্বন্ধে উদাসীন। আচ্ছা, তুমি কি একবারের তরেও নিজের মনকে শুধিয়েছ, আমি তোমাকে সর্বক্ষণ কোন প্রশ্নটি, মাত্র একটি প্রশ্ন শুধোতে চাই? বল।
এর চেয়ে পকেট-বুক সাইজের ভেলা, মোচার খোলও অক্লেশে বলা যেতে পারে ত্রিসংসারে হয় না। জর্মন জাতটাই দুই একসট্রিম নিয়ে গেণ্ডেরি খেলতে ভালোবাসে, ক্ষণে আসমান ক্ষণে জমিন, ক্ষণে মোচার খোলা নৌকো ক্ষণে জেপেলিন। এ ভেলাটি সাইজে দেশের মাদ্রাজি মেসবাড়ির মাদ্রাজি উচ্চারণে হিন্দিতে চোট সে চোটা– তক্তপোশের যমজভাই দৈর্ঘ্যেপ্রস্থে। অবশ্য নৌকাটির হাল আর গলুইয়ের দিক দুটো উঁচল বলে সে দু-প্রান্তে তক্তপোশকে অবশ্যই হার মানায়। লটে হাল ধরে বসেছে একপ্রান্তে, আমি অন্যদিকে। দেশের কেঁদা নৌকোর সঙ্গে এ ভেলার আর একটা সর্বনাশা প্রাণঘাতী মিল আছে। কোঁদা নৌকোতে ওঠার সময় নৌকোর ঠিক মধ্যিখানে না বসলে, বসার পরও ডাইনে-বাঁয়ে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রির বেশি, হঠাৎ কাত হয়েছ কি অমনি নৌকো কুপোকাত। হাটবারে কচ্ছপকে চিৎ করে রাখে, আর ইনি হয়ে যান উপুড়। হ্যাঁ, হেরমান অতি নিশ্চিত তালেবর মাল। এ ভেলায় আর যা হয় করতে চাও কর কিন্তু ঢলাঢলিটি–উভয়ার্থে করতে যেয়ো না, বাপধন! আচ্ছা এক নয়া সেফটিবেল্ট আবিষ্কার করেছে রাম ঘুঘু হেরমান। ওদিকে আমি তো ঘুঘু দেখেই নাচতে শুরু। ফাঁদ তো, বাবা দেখিনি ॥–হেরমান যখন পার্কের বেঞ্চিতে বসার প্রোগ্রাম বাতিল করে দিয়ে কত না সোহাগভরে তরণীবিহারের প্রস্তাবটা পাড়লে তখন সে কত ধুরন্ধর বুঝতে পারিনি– পরে লটে বলেছিল।
সংস্কৃতের ডাকসাইটে অধ্যাপক প্রফেসর কিফেল বহু বৎসর রাইনের পারে বাস করেছেন। একদিন আমি যখন রাইনের পাড়ে বসে আত্মচিন্তায় মগ্ন তখন তিনি আমার পাশে এসে বসাতে আমার ধ্যান ভঙ্গ হল। তিনি শুধালেন, রাইন আজ কী রকম? আমি বললুম, নদীর এপার ও-পার দু-পারই তো বেশ পরিষ্কার কিন্তু ঠিক জলের উপরটা কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা দেখায়। প্রফেসর বললেন, সে প্রায় গোটা বছর ধরেই চলে। তাই যেসব আর্টিস্ট রাইনের ছবি এঁকেছেন তাঁরাই রাইনের ঠিক উপরটা যেন সামান্য কুয়াশাঢাকা ঝাপসা ঝাপসা এঁকেছেন। এ বাক্যালাপের পর আমি রাইনের বহু ছবি দেখেছি। প্রফেসরের কথা ন-সিকে খাঁটি।
আজও তাই লটেকে দেখতে পাচ্ছি ঠিকই। কিন্তু মাঝে মাঝে কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলো আজ রাতে তেমন উজ্জ্বল নয়। কিন্তু সে আরও কুহেলির গ্লানি ছিন্ন করে মাঝে মাঝে তার মুখের রেখা স্পষ্ট করে দিচ্ছে। কপালের উপরকার অতি সামান্য ঘাম তখন চিকচিক করে ওঠে। আর চিকচিক করে ওঠে তার অতি কৃষ্ণ কুন্তলের মাঝখানে তুষারশুভ্র সীমান্তরেখা। এরকম শুভ্র সিতের সমন্বয় তো আমাদের দেশে চোখে পড়ে না। মাঝে মাঝে আমার দিকে এক ঝলক তাকায় আর একটুখানি মুচকি হাসে।
শুধাল, কই? আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না!
মুশকিল! বললুম, তুমি কী প্রশ্ন শুধাতে চাও সেটা আমি এতক্ষণ চিন্তা করতে করতে হঠাৎ আমার একটি কবিতা মনে পড়ে গেল। তাই সমস্যাটার কোনও শেষ সমাধানে পৌঁছতে পারিনি। কখনও পারব বলে মনেও হয় না।
আমি বলব?
বল।
তুমি বাকি জীবন এই গোডেসবের্গ-মেলেমে কাটাবে না, সে আমি জানি। কিন্তু কদিন এখানে থাকবে সেটা আমি বার বার জিগ্যেস করতে গিয়ে থেমে গিয়েছি। যদি হঠাৎ বলে বসো, কালই চলে যাচ্ছ, তখন কী? এটা বলতে তোমার তো এতটুকু বাধবে না সে আমি ভালো করেই জানি। তোমার হৃদয়ে যে রত্তিভর মায়ামহব্বৎ নেই সে আমি ভালো করেই জানি। আর সত্যি বলতে কী, তোমার-আমার অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন যে চাঁদের আলোতে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় একদা জানালার পাশে এসে আমি দেখি, তুমি ছুটে চলেছ মায়ের চিঠি ডাকে ফেলতে। তুমি যদি সেদিন রহস্য করে যা লোকে আকছারই করে থাকে, বলতে হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ, এই– এই প্রিয়ার চিঠি ডাকে ফেলতে যাচ্ছি
আমি বাধা দিয়ে বললুম, ছিঃ! দশ বছরের বাচ্চা মেয়েকে কেউ কখনও এরকম কথা বলে?
লটে অবাক হয়ে বলল, কেন? সবাই তো বলে, সক্কলের সামনে!
আমাদের দেশে বলে না।
সেকথা থাক! আসল কথা তুমি যে তোমার মাকে খুব ভালোবাস সেটা আমাকে বড় আনন্দ দিয়েছিল সেদিন। ওইটুকু ছিল বলে–
কাকে-চিলে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে উধাও হয়ে যায়নি।
মানে?
অতি সরল, অর্থাৎ এমনই পচা জিনিস যে কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাবে না। পচা জিনিসের প্রতি লোভ কার? কাকের-চিলের। কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলি, লটে, যদি প্রতিজ্ঞা কর, আমি যা বলতে যাচ্ছি, সেটা নিয়ে তার পর তুমি আমার সঙ্গে কোনও আলোচনা জুড়বে না, কোনও প্রশ্ন শুধোবে না।
প্রতিজ্ঞা করছি।
গলায় দরদ ঢেলে বললুম, তুমি বড় লক্ষ্মী মেয়ে লটে। তা হলে বলি। আমি আমার মাকে জানা-অজানায় যতখানি কষ্ট দিয়েছি অন্য কেউ সেরকম দিয়েছে কি না বলতে পারব না। আর আমি আমার জীবনে যা-কিছু দুঃখকষ্ট পেয়েছি সে শুধু মাকে কষ্ট দিয়েছিলুম বলে তার শাস্তিস্বরূপ, সেকথা জানি। ব্যস, এ বিষয়ে আর কোনও কথা না। এবারে তোমার কথার উত্তর দিই। আমি গোডেসবের্গ ছেড়ে কাল যাচ্ছিনে, পরশু যাচ্ছিনে, তরশুও না।
খুশিতে গলা ভরে বললে, বাঁচালে। তার পর মনমরা হয়ে শুধাল, তরশুর পর?
আমি গম্ভীর হয়ে বললুম, লটে, তোমার কথা শুনলে যে কোনও লোক ভাববে যেন কোনও বাচ্চা মেয়ে জীবনে এই প্রথম প্রেমে পড়েছে।
নিশ্চিন্ত মনে লটে বললে, তা ভাবুক না। আমার তাতে কী? যে জিনিসের মূল্য না বুঝে কিংবা নিজেদের এঞ্জেলের মতো মনে করে দম্ভভরে কতকগুলি পাড় ইডিয়ট হাসি-ঠাট্টা করে তার গায়ে তাতে করে কোনও ক্ষত হয় না।
আমি উৎসাহভরে বললুম, দাঁড়াও, দাঁড়াও, তোমার কথাতে আমার গুরুর একটি আপ্তবাক্য মনে হল। শোনো, শোনো।
বাহুর দম্ভ, রাহুর মতো, একটু সময় পেলে
নিত্য কালের সূর্যকে সে এক-গরাসে গেলে,
নিমেষ পরেই উগরে দিয়ে মেলায় ছায়ার মতো,
সূর্যদেবের গায়ে কোথাও রয় না কোনও ক্ষত।
হায়, অনুবাদে কি আর সে রস আসে, সাধে কি বিবেকানন্দ বলেছেন, অনুবাদ– সে তো কাশ্মিরি ডিজাইনের উল্টো দিকটা দেখার মতো।
লটে বললে, মূর্খ মূর্খ মূর্খ, কী ভাববে সবাই? বুড়ি লটের ভীমরতি ধরেছে, এইবারে দেখে নিও। কী কেলেঙ্কারিটাই না হয়। ড্যাং ড্যাং করে লাফাতে লাফাতে হের সায়েডকে বগলে চেপে চলল লটে মন্তে কালো কিংবা হাওয়াই দ্বীপে। জব্বর অপারেশন করিয়ে মুখের চামড়া টান-টান করাবে। পাকি-পাকছি পাকি-পাকছি চুলের উপর লাগাবে তিন পলস্তরা কলপ
তা হলে?
তা হলে? এই যে তুমি তিন দিন থাকবে আমি কি তোমার পিছন পিছন ছোঁক ছোঁক করব নাকি? তোমার গায়ে পোস্টেজ স্ট্যাম্পের মতো সেঁটে রইব নাকি।
গেল গেল চিৎকার করে উঠলুম আমি। কী যেন কী একটা ভাসন্ত জিনিসের সঙ্গে ভেলা খেয়েছে জব্বর এক ধাক্কা ॥
.
৩৩.
জর্মন কবি গ্যোটেকে নিয়ে যত গবেষণা আলোচনা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তার শতাংশের একাংশ হয়েছে কি না সন্দেহ। অথচ জর্মন সাহিত্যে গ্যোটে ছাড়াও এমন সব কবি রয়েছেন যাঁদের দু-চারজনকে পেলে আমাদের সাহিত্য বর্তে যেত। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তাই অল্প বয়সেই জর্মন কবি হাইনের গুটিকয়েক কবিতার বাঙলা অনুবাদ করেন। লোকে বলে গ্যোটের সম্বন্ধে জর্মনে তথা পৃথিবীর অন্যান্য ভাষাতে এত বেশি আলোচনা টীকা-টিপ্পনী করা হয়ে গিয়েছে যে আজ নয়, প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্বে এক ছোকরা গবেষক তার ডকটরেটের জন্য অন্য কোনও সবজে না পেয়ে থিসিস লেখে গ্যোটে ও দম্ভশূল বিষয়ের ওপর। তার বক্তব্য ছিল গ্যোটের কাব্যে যেসব বিষাদময় নৈরাশ্যব্যঞ্জক অনুভূতি আমরা পাই, তার অধিকাংশই কবি রচনা করেছেন যখন তিনি দাঁতের কনকনানিতে কাতর, কিংবা কাতর না হলেও সেটা তাঁকে স্বস্তিতে আপন রুচি অনুযায়ী (কলকাত্তা-ই হিন্দিতে যে রকম বলে আপন রুচি খানা) কবিতা রচনা করতে দিত না। দন্তরুচি অনুযায়ী অর্থাৎ দাঁতের যা রুচি, সেই অনুযায়ী লিখতে বাধ্য হতেন, অর্থাৎ পর রুচি খেতেন। এখানে আমি অবশ্য দন্তরুচি প্রচলিত দাঁতের সৌন্দর্য অর্থে ব্যবহার করিনি। এবং দাঁতের রুচি যে কী হতে পারে সেটা ভুক্তভোগী পাঠক নিশ্চয়ই আমার নিবেদন শেষ হওয়ার বহু পূর্বেই দন্তরুচি বিকশিত করে সহাস্য আস্যে অনুমান করে নিয়েছেন।
এসব অবশ্য বাড়াবাড়ি। কিন্তু আমরা সকলেই জানি, নদী এবং প্রধানত পদ্মই রবীন্দ্রনাথের জীবনের কতখানি বৃহৎ অংশ অধিকার করে তাঁকে সুখে-দুঃখে সঙ্গ দিয়েছে। এমনকি শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন করার পর থেকে পদ্মার সঙ্গে তার যোগসূত্র ক্ষীণতর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কাব্যজগতে সে বিরাট নদী চলে নিরবধি। ক্ষীণস্রোতা তো হয়ইনি, বরঞ্চ সে মৃন্ময়ী নদী তখন চিন্ময় রূপ ধারণ করে তাঁর জীবনদর্শনে প্রধানতম স্থান অধিকার করে নিয়েছে। তাই বৈতরণীর সম্মুখীন হওয়ার বহু পূর্বেই তিনি গেয়েছেন :
ওরে দেখ, সেই স্রোত হয়েছে মধুর,
তরুণী কাঁপিছে থর থর।…
তিনি চলবেন,
মহাস্রোতে
পশ্চাতের কোলাহল হতে
অতল আঁধারে– অকূল আলোতে।
নদী তরণীর দেশ বাঙলা দেশ। সে শুভদিন প্রত্যাসন্ন সেদিন ওই বাঙলা দেশের ভাবী পদ্মা-সন্তান রবীন্দ্রনাথ-পদ্মাতরণী রচনা করে বাঙলা দেশের চিন্ময়রূপ আলোকিত করবেন।
.
পদ্মার জলে স্নান করেছি, সাঁতার কেটেছি বিস্তর। কিন্তু নৌকো কুপোকাত হওয়ার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ কখনও নাকানিচোবানি খাইনি। একদা মিস মেয়ে যখন তার ড্রেন-ইনিপেক্টর রিপোর্টে ভারতবাসীর নোংরা স্বভাবের চুটিয়ে নিন্দা করেন তখন তদুত্তরে প্রাতঃস্মরণীয় লালা হরকিষণ লালের সুযোগ্য পুত্র শ্রীযুক্ত কানহাইয়া লাল গাওবা তার আংকল শ্যাম (Uncle Sham = ঝুট চাচা বা ঠক চাচাও বলতে পারেন) পুস্তকে প্রসঙ্গক্রমে মার্কিনদের স্বপ্নলোক ফ্রানসভূমি– মার্কিন প্রবাদে আছে অশেষ পুণ্যবান আমেরিকান পরজন্মে ফ্রান্সভূমিতে জন্মলাভ করে–তথা তথাকার জনসাধারণের বদখদ নোংরা স্বভাব সম্বন্ধে বক্রোক্তি করেন, সেই ফরাসি দেশ– যেখানকার আপামর জনসাধারণ নিতান্ত জাহাজডুবি ভিন্ন অন্য কোনও অবস্থাতেই স্নান করে না। কিন্তু আমি এমন কী পাপ করেছি যে এই রাতদুপুরে নৌকাডুবির ব্যবস্থা করে বরুণদেব আমাকে স্নান করাবেন– আমি তো হে, প্রভো, নিত্য প্রভাতে দিব্য স্নান করি। তদুপরি যে দুর্ভাবনা আমার মনের ভিতর চড়াৎ করে নেচে গেল সেটি শুনলে লেডি-কিলার মাত্রই আমাকে বর্বরস্য বর্বর ভিন্ন অন্য কোনও উপাধি দেবেন না– লটে সাঁতার জানে তো, আমি তো ব্রিটেনের প্রাক্তন মন্ত্রী নটবর মি. প্রফুমো নই যে মাঝরাতে রাইন নদীতে লটের সঙ্গে জলকেলি করব। হুঃ–
নদী জলে স্নান করাটা
বলেন গুণী, স্বাস্থ্যকর।
প্রাণটা আগে বাঁচাই দাদা,
জলকেলিটা তাহার পর ॥
কিন্তু উলটো বুঝলি রাম; লটে চেঁচিয়ে শুধাল, সায়েড, তুমি সাঁতার জানো তো?
বাঁচাল। কারণ যে সুরে প্রশ্নটা শুধাল, তার থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, লটে সাঁতার জানে, তার দুশ্চিন্তা আমকে নিয়ে। বদরপীর সোনাগাছির জন্মদাতা সোনা গাজি দু জনই পানির পীর, এবং মাঝি-মাল্লার ত্রাণকর্তা। এতক্ষণ মনে মনে উভয়কে স্মরণ করছিলুম; এখন বিস্তর শুকরিয়া জানালুম।
কিন্তু কোনও পীর, কোনও বরুণদেবের শরণ না নিলেও চলত। লটে দেখি খোলামকুচিখানা খাসা সামলে নিয়েছে। কিন্তু ধাক্কা লেগেছিল কিসে? কোনও বয়াতে নাকি? কিন্তু লটে আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা বিলকুল বেকার মনে করে শুধাল, ভয় পেয়েছিলে নাকি?
না।
লটে তাচ্ছিল্যভরে বললে, এরকম তো আখছারই হয়। আর ছোট নৌকো তো বড় জাহাজের চেয়ে ঢের বেশি নিরাপদ। নইলে বিরাট জাহাজ ডুবে গেলে মানুষ ক্ষুদে লাইফবোটে ওঠে কেন? তা হলে আগেভাগে ছোট নৌকো চড়লেই হয়। কিন্তু এ যুক্তিটা আমার আবিষ্কার নয়। কে যেন এক মিনি-নৌকো-পাগল দুদে আটলান্টিক শিকারি, বলতে গেলে ডিমের খোলায় চড়ে স্পেন থেকে পানামা না কোথায় যেন পৌঁছায়। সেখানে কেউ ওকে না থামালে হয়তো তার পর লেগে যেত প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিতে। তাকে নাকি হিটলার প্রশ্নটা শুধিয়েছিল। হয়তো লোকটার কথাই ঠিক। আমি কিন্তু ওরকম সাগর পাড়ি দিতে একা একা পারব না।
কেন, মেয়েরা একা কোনও কাজ করতে ভয় পায়, তাই?
কিছু জানো না তুমি সায়েড। একা একা বিস্তর কাজ করে থাকে মেয়েরা। কিন্তু ভয় পায় একা থাকতে। শারীরিক-মানসিক দুই অবস্থাতেই ভয় পায় একা থাকতে। এই যে ছোঁড়াছুঁড়িরা ধেই ধেই করে নৃত্য করছে, তাদের তিন কোয়ার্টার শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে চায়। কিন্তু আরেকটা একা থাকা সত্যই রীতিমতো বিপজ্জনক। আমাদের বাড়িটা দেখেছ তো– চতুর্দিক নির্জন। যে কোনও রাত্রে এমনকি দিনের বেলাও যে কোনও মহাপ্রভু মার্কিন স্টাইলে বাড়ি হানা দিতে পারেন হাতে পিস্তল চোখের উপর দুটো ফুটোওলা পট্টি। এবং মেয়েরাও কম যান না। পিস্তল ব্যবহার করতে মোটেই বাধে না। ব্যাঙ, ব্যাঙ, ব্যাঙ। ব্যস হয়ে গেল। তুমি দু-ভাঁজ হয়ে সামনের দিকে না, দড়াম করে নয়, চুবশে-যাওয়া বেলুনটার মতো ধীরে ধীরে কার্পেটের উপর গুটিয়ে পড়বে। তার পর রক্তগঙ্গা–
আমি বাধা দিয়ে বললুম, লটে, তুমি বড় বেশি মার্কিন ক্রিমি পড়েছ (ক্রাইম-নভেল, ক্রাইম-টেলিভিশনের মার্কিনি এই শব্দটি জর্মনরা গোগ্রাসে গ্রহণ করেছে। আমাদের দেশের লোক একটুখানি অলঙ্কার চাপিয়ে এস্থলে বলে, ঘামের ফোঁটায় কুমির দেখছ।
কথাটা তো চমৎকার। মনের খাতায় টুকে রাখলুম। কিন্তু তোমাকে যা বলছি সেটা একদম সত্যি। আচ্ছা, সবকিছু বাদ দিয়ে তোমাকে শুধোই, তুমি কখনও বাড়ারমাইনহ-গ্রুপ-এর নাম শুনেছ?
না। পলিটিক্যাল পার্টি নাকি?
না। তাই এখনও নিজেদের গ্রুপ বলে। এই তো তোমাদের এলেম। কথায় কথায় তুমি যে আমাকে মার্কিনি মার্কিনি খেতাবটা দাও, যে আমি মার্কিন বেড়ালের জর্মন ন্যাজ, তুমি বরঞ্চ মার্কিন রিপ ভান উইনকে হার মানাতে পার। সে ঘুমিয়েছিল কুল্লে কুড়িটা বছর, তুমি ঝাড়া চল্লিশটি বছর। এরকম–।
আহা! চল্লিশটি বছরে আমার কোনও অভিজ্ঞতা হয়নি, আর পাঁচটা দেশের তুলনায় জর্মনি যে অনেকখানি বদলে গেছে তার কোনও খবর রাখিনে– এই তো?
উ—
সে-ই তো ভালো। তাই তোমাকে দেখামাত্রই চিনে ফেললুম,
তোর পানে চেয়ে চেয়ে
হৃদয় উঠিল গেয়ে,
চিনি, চিনি, সখী।
কত প্রাতে জানায়েছে
চিরপরিচিত তোর হাসি,
আমি ভালোবাসি।
এইবারে বল, চল্লিশ বছরে আর পাঁচজন যেরকম বদলে গেছে আমার বেলা তাই হলে কি ভালো হত।
খুশি মুখে লটে বললে, শুনতে মন্দ লাগছে না। কিন্তু এই ভালোবাসার ব্যাপারেই যে তুমি কী দারুণ অগা সেটা আমি তোমাকে না শুধিয়ে বুঝতে পেরেছি। এবং যৌন সম্পর্ক ব্যাপারে আজ জর্মনি কোন জায়গায় এসে পৌচেছে তার কোনও খবরই রাখ না। আচ্ছা বল তো, তোমার কি মনে হয়, এদেশের স্কুলের ছেলেমেয়েদের শতকরা ক জনের স্কুলে থাকতে। থাকতেই যৌন অভিজ্ঞতা হয়ে যায়।
কী করে বলব, বল। খুবই অল্পই। ধর্তব্যের মধ্যে নয় নিশ্চয়ই।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে লটে বললে, তা হলে শোন, এবং ভিরমি খেয়ো না। ষোল-সতেরো বছর বয়স হতে না হতেই শতকরা পঁয়ত্রিশটি ছেলের ত্রিশটি মেয়ের পরিপূর্ণ যৌন অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। পনেরো বছর বয়সেই যথাক্রমে শতকরা চৌদ্দ পনেরো ও দশ। এবং চৌদ্দ বছর বয়সেই একশোটার ভিতর জনা পাঁচেক!
আমি স্তম্ভিত হয়ে শুধোলুম, এসব কি সত্যি? আর তুমি জানলেই-বা কী করে?
জানতে হয় তাই জেনেছি। আমি যে একটা স্কুলে আমার বান্ধবীর হয়ে মাঝে মাঝে পড়াতে যাই। হালেরই তো একখানা প্রামাণিক বই বেরিয়েছে। আমি তোমাকে শুধোচ্ছিলুম, তোমাদের দেশে পরিস্থিতিটা কী রকম, তার খবর নিয়ে তুলনা করে দেখতে। জানো, আমার নিজের বিশ্বাস যে দেশের লোক অল্প বয়সেই যৌন অভিজ্ঞতা পেয়ে যায় তারা উন্নতিশীল প্রোগ্রেসিভ হয় না। এসব কথা এখন থাক। তোমাকে সেই স্ট্যাটিসটিকস্ ভর্তি বইখানা দেব। তুমি সেটা পড়ে নিলে আলোচনার সুবিধে হবে। কিন্তু হাতের কাছে ভিরমি ভাঙবার জন্য স্পেলিং সলটস্ রেখ।… এই দেখ, আমরা জর্মন রাইষের প্রেসিডেন্টের বাড়ির কাছে এসে গিয়েছি।
.
৩৪.
এদেশে, এদেশে কেন পৃথিবীর সর্বত্রই এ যুগে স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে এত বেশি আলোচনা, নাটক, ফিল্ম, সাহিত্য, সঙ্গীত তৈরি হচ্ছে যে, আমরা এই হট্টগোলের মাঝখানে প্রায়ই ভুলে যাই যে, এই ভারতেই রতি বা কাম সম্বন্ধীয় প্রথম পুস্তক রচিত হয়। এই সর্বপ্রথম পুস্তক বহু যুগ ধরে সম্মানিত হয়েছে নিশ্চয়ই, কিন্তু এ যুগে পৃথিবীর সর্বত্র এ বই এমনই সিংহাসনে আসন পাচ্ছে, শুধু তাই নয়, এমনই জনপ্রিয় হয়েছে যে, একে এখন অক্লেশেই ওরো-আমেরিকার অন্যতম বেস্ট-সেলার বলা যেতে পারে। ঠিক মনে পড়ছে না, কোথায় যেন পড়েছি, এক নাতিবৃদ্ধ জ্যাঠামশাইকে তার ভাইঝি একখানা অতি মনোরম দ্য-লুকস বই উপহার দেয় তার জন্মদিনে। এই ভদ্রজন পুস্তক সঞ্চয়নে অতিশয় অনুরক্ত ছিলেন এবং এরকম মরক্কো চামড়ার বাধাই সোনালি, চারুকার্যে ঝলমলিয়া কেতাব যে তিনি একটু মনোযোগ সহকারে দেখবেন, মেয়েটি সে আশা নিশ্চয়ই করেছিল! জ্যাঠামশাই সেরকম কিছু করলেন না বটে, কিন্তু দেখা গেল, তিনি অতিশয় সযত্নে তার আপন ডেসকে আর পাঁচটা দামি জিনিসের সঙ্গে সেটি তালাবদ্ধ করলেন। তার পর বহু বৎসর কেটে গেল, সামান্য এই ঘটনাটি কে-ই বা মনে রাখে। তার মৃত্যুর পর (যতদূর মনে পড়ছে তার অন্য এক ভাইঝি) তাঁর ঘরদোর গোছগাছ করতে গিয়ে ডেসকের ভিতর আবিষ্কার করল সেই প্রাচীন দিনের বইখানি। ততদিনে ইউরোপ নানা বিষয়ে মুক্তমনা হয়ে গিয়েছে কিন্তু ভাইঝি বইখানা দেখে স্তম্ভিত। সেই সে আমলে কোনও ভদ্র পরিবারের মেয়ে তাঁর শান্তশিষ্ট বয়স্ক জ্যাঠামশাইকে কামসূত্র উপহার দেবে, এ তো একেবারেই অবিশ্বাস্য। আসলে মেয়েটি দোকানে গিয়ে নিশ্চয়ই চেয়েছিল, কোনও একখানা বেস্ট-সেলার এবং তার চেয়েও বড় কথা, সেটার বাঁধাই যেন অসাধারণ চাকচিক্য ধরে। জ্যাঠামশাই সব জাতের বইয়ের খবর রাখতেন। রঙিন মোড়ক খুলে এক নজর তাকাতেই বুঝে ফেলেছিলেন, ব্যাপারটা কী, কিন্তু মেয়েটি যাতে লজ্জা না পায় তাই তিনি ওই পন্থা অবলম্বন করেন।
এর থেকেই পাঠক অনায়াসে বুঝে যাবেন যে, ঘটনাটি ঘটেছিল মান্ধাতার আমলে; নিদেন মহারানি ভিক্টোরিয়ার সুবর্ণযুগে এবং খুব সম্ভব তাঁর পূতপবিত্র আপন দেশে। কারণ বহু বহু কন্টিনেন্টাল গুণীজ্ঞানীর দৃঢ় প্রত্যয়, কুল্লে ইউরোপের একমাত্র বিলেত দেশেই যৌনজীবন নামক কোনও প্রতিষ্ঠান নেই, কস্মিনকালেও ছিল না– অন্তত ফরাসিদের গলা কেটে ফেললেও তারা এ বিশ্বাস কিছুতেই ত্যাগ করবে না। অবশ্য দেশকালপাত্র হিসেবে নিয়ে ইংরেজ জীবনযাপন পদ্ধতি সম্বন্ধে সে তার মতবাদের অতি সামান্য কিছুটা অতি অবরে-সবরে সামান্য রদবদল করতে পারে। যেমন, একদা ইংরেজ সম্বন্ধে ফরাসিদের মধ্যে সুপ্রচলিত প্রবাদ ছিল, কন্টিনেন্টের আর-সর্বত্র নরনারীর মধ্যে যৌনসম্পর্ক থাকে, ইংরেজের থাকে, গরম জলের বোতল।* কিন্তু ইতোমধ্যে এই পৃথিবীতে, তার সর্বোত্তম গৌরবময় যুগে, মানুষ কলকজা যন্ত্রপাতি, এক কথায় টেকনিকাল সর্ববাবদে এমনই উন্নতি করেছে যে, এস্তেক ফরাসিও সেটাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। বংশবৃদ্ধি বংশ-নিরোধ আরও মেলা আশকথা পাশকথা তার কানে এসেছে। তাই বিস্তর ঘাড় চুলকে অনেক ভেবেচিন্তে তার পূর্বেকার প্রবাদটি বছর দশেক পরে পরিবর্তিত করে সর্বাধুনিক পরিমার্জিত সংস্করণ ছাড়ল, এখন তারা ইলেকট্রিক কারেন্টে গরম করা লেপ ব্যবহার করে।
[*এদেশেও বলে, শীত কাটাতে হলে হয় দুই, নয় রুই (তুলার লেপ)। ইংলন্ডের কাঠফাটা শীতে তুলোতে কিছু হয় না বলে হট-ওয়াটার-বটকে সে শয্যাসঙ্গিনী করে। ইংরেজের চাচাতো ভাই ডাচদের সম্বন্ধে বলা হয় যদিও বিলেতের মতো ও দেশেও যৌন-জীবন নেই– এ কথা কেউ কখনও বলেনি অন্য দেশের পুরুষ যৌবনে বিয়ে করে, হল্যান্ডের লোক পাশবালিশ কেনে, এটা চালু হয় ডাচদের কিপটেমি বোঝাবার জন্যে।]
এসব বিষয়ে অধুনা এক অতিশয় খানদানি ডিউক একখানি প্রামাণিক পুস্তিকা রচনা করেছেন। এ পুস্তিকা রচনা করার হক্ক তাঁর ন-সিকে, রাস শরণার্থী সহায়তা কি লিয়ে পাঁচ নয়ে পয়সে। বললুম বটে কিন্তু বক্ষ্যমাণ জান (কোম্পানি আমলের বানান) সায়েব যখন রাজসিক চাকচিক্যময় ডিউকত্ব লাভ করলেন তখন সঙ্গে সঙ্গে লাভ করলেন মহারানির রাজত্ব বাঁচাবার জন্য, সহায়তা কি লিয়ে চার মিলিয়ন পৌভের চেয়েও বেশি মৃত্যু-কর, বা ডেথ ডিউটি। ফরেন এক্সচেনজ নিয়ে কালোবাজার করার মতো কিস্মাৎ কপালে লেখা ছিল না বলে সেই পাঁচ পয়সী ডাকঘর যিনি নিরিখ বেঁধে মৃন্ময় টাকাকে হিরন্ময় পৌন্ডে পরিণত করেন সে আর্যা নির্দেশ দিয়ে বলে মোটামুটি ১০০,০০০,০০০ (দশ কোটি) টাকা–যদি খেসারতি চার মিলিয়নের উপরে ধরা হয়; নইলে কত আর?– এই ধরুন কোটি সাত-আষ্টেক।
এ ভদ্রলোক বলছেন, যৌনসম্পর্ক ব্যাপারটা নিছক কন্টিনেন্টের একচেটে আবিষ্কার নয়। কন্টিনেন্টের বাসিন্দারা তাঁদের কমন মার্কেটে আমাদের পাত পাড়তে না দিয়ে সে সুখ থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে পারেন কিন্তু প্রেম করার সুখ থেকে বঞ্চিত করতে পারবেন না। তফাৎটা তবে কোথায়? ওনারা তাদের যৌনজীবন নিয়ে বিস্তর ঢাকঢোল বাজিয়ে বেহদ্দ চেল্লাচেল্লি করেন, এন্তের বড়ফাট্টাই মারেন, ওই নিয়ে অষ্টপ্রহর ভ্যাচর ভ্যাচর করেন। আমরা করিনে। আমাদের বিবেচনা-বোধ আছে, আমরা পিছিয়ে থাকতে ভালোবাসি। এর থেকে কি স্পষ্টই ধরা পড়ে না যে, নিজেদের ওপর ওদের প্রত্যয় নেই, আমরা ওদের চেয়ে সরেস? (ডুক বোধহয় বলতে চেয়েছেন, ইংরেজ জাতটা নীরব কর্মী! –লেখক) আর এইটেই হল সব কথার নির্যাস। পৃথিবীর আর সর্বত্র যা ঘটে থাকে এ দেশেও তাই ঘটে। শুধু আমরা আমাদের যৌনজীবন নিয়ে বড় একটা কথা বলিনে। হয়তো-বা প্রকৃতিদেবীই এই প্রবৃত্তিটি দিয়ে আমাদের গড়েছেন। পুরুষানুক্রমে হয়তোবা আমরা নীতিবাগীশ– ওইটে পেয়েছি উত্তরাধিকারে। কিংবা হয়তো এ-ও হতে পারে যে, এ খেলাটার আইনকানুন আমাদের দেশে অন্য এক ভিন্নভাবে গড়ে উঠেছে; আর সবাই জানে স্পোর্টসের আইনকানুন মেনে চলাতে আমরা পয়লা নম্বরি এবং তার চেয়েও ঢের ঢের বেশি কেরানি আছে আমাদের ভণ্ডামিতে।
এই এতক্ষণে আমাদের মাই লর্ড ডিউকপ্রবর হাটের মধ্যিখানে হাঁড়িটি ফাটালেন– ইংরেজিতে বলা হয় কার্পেটের হ্যান্ডব্যাগ থেকে লুকননা বেড়ালটা বের হবার মোকা পেয়ে এক লক্ষে কেলেঙ্কারিটা ফাস করে দিল। কিন্তু এস্থলে শ্রীযুক্ত জন-এর প্রতি সুবিচারের খাতিরে অবশ্যই বলতে হয়, তিনি সজ্জন এবং সঙ্গে সঙ্গে এককাড়া দুষ্টুবুদ্ধিও ধরেন। ইংরেজের নষ্টামি ভণ্ডামি চিচিং ফাঁক করে দিতে পারলে তিনি সর্বদাই নির্বিষ বিমলানন্দ উপভোগ করেন। তার একটা কারণ হয়তো এই যে, সাতপুরুষের (আসলে ইনি গোষ্ঠীর এয়োদশ পুরুষ) ভিটের উপর খাড়া প্রাচীন কালটি বাঁচাতে হলে তাকে সরকারের প্রাপ্য অষ্ট কোটি টাকার ট্যাক্সটি দিতে হয় রোক্কা নন্দানন্দি, এবং সে রেস্তটা কাছারিবাড়ির হেঁদো তহবিলে বাড়ন্ত। তাই বহু পূর্বেই নিবেদন করেছি, এস্থলে আমাদের উল্টো উপীন যেন তেন প্রকারেণ কাসূলটি খুলে দিলেন পাবলিকের তরে। ফ্যালো দর্শনীর কড়ি মাখো ত্যাল। বলে কী! বিলেতের খানদানি পরিবারের কেউ কস্মিনকালেও এ হেন অনাছিষ্টি কম্বো করেননি। নবাব সায়েরা যে কী পরিমাণ চটেছিলেন তার জরিপ এ স্থলে অবান্তর। বরঞ্চ জন মিঞার দাদ নেবার কায়দাটি বড়ই মুখরোচক– তিনি ওনাদের যাবতীয় ধূর্তামি নষ্টামি বের করে দিলেন দু-খানি বইয়ে– এবং ইহসংসারে ভিলেজ ইডিয়টটা পর্যন্ত বিলক্ষণ অবগত আছে ভণ্ডামির গণ্ডা গণ্ডা ভাণ্ড চিরকালই যৌবনরসে টৈটম্বুর।
এই বৃদ্ধ বয়সে আমি যে ইউরোপের কাম-কাণ্ড নিয়ে অল্পবিস্তর গবেষণা করছি তার জন্য কোনও প্রকারের কৈফিয়ত দেবার বা সাফাই গাইবার প্রয়োজন আমার পাপ-বিবেক রত্তিভর অনুভব করছে না। আমার অকরুণতম পাঠক এমনকি এদানির যেসব রুচিবাগীশ মার্কামারা পদি পিসির পাল এসব ঢলাঢলি না করে খট্টাঙ্গপুরাণ বা এরশুমৌলার নবনির্ঘন্ট নির্মাণ করতে মাণ্ডামাস ঝাড়েন তাঁদের স্মরণে আনছি যে, ঝাড়া বিয়াল্লিশ বছর ধরে আমি ভারত-ইউরোপ-আফ্রিকায় মাকু মারছি, ক্রনিক মেলিগনেন্ট বেকারি ব্যামো থেকে ভুগছি বলে গত বাইশ বছর ধরে মাঝেসাঝে সেই মাকু মারার বয়ান লিখে পথ্যির হাঁড়ি চড়িয়েছি, তার পূর্বেকার অর্থাৎ ভ্রমণারম্ভের প্রথম কুড়ি বছরের কাহিনী কাবলিওয়ালার বোয়াল মাছের মতো চোখ-রাঙানি সত্ত্বেও মা সরস্বতীর কাছ থেকে ভিক্ষে চাইনি। সেসব কথা এখন থাক। আমি শুধু শুধোচ্ছি, অর্ধসিদ্ধ অর্ধপ যা-সব লিখেছি তাতে কি পাঠকের মনে কখনও সন্দেহ জেগেছে যে, আমি যৌন কেচ্ছার সন্ধান পাওয়ামাত্রই তার পিঠের উপর ডাকটিকিটের মতো সেঁটে গিয়েছি? বরঞ্চ বলব ও বাবদে আমার উৎসাহ ছিল অত্যল্প। তার প্রধান কারণ, আমার ধারণা জন্মেছিল, যদিও ইউরোপের যৌনজীবন, প্রেমের ছড়াছড়ি প্রাচ্যভূমির তুলনায় অনেকখানি বে-আবরু তবু তাদের ঐতিহ্য বৈদগ্ধ্যের সঙ্গে তাদের আচরণের খতেন মেলালে সামঞ্জস্যটাই চোখে পড়ে বেশি। (বরঞ্চ মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, কামসূত্র, কুট্টনীমতম, চৌরপঞ্চাশিকা, এমনকি অর্বাচীনকালে বিদ্যাসুন্দর লেখার পর আমরা কেমন যেন ঈষৎ বেরসিক হয়ে গিয়েছি। সেকথা থাক।) মাত্র দশ বছর পূর্বেই ইউরোপে যে বাড়াবাড়ি দেখেছি তাতেও মনে হয়নি যে, ওই নিয়ে কাউকে অত্যধিক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হবে। তবে খুব সম্ভব দু-এক জায়গায় আধা-সাদা অপ্রসন্নতা প্রকাশ করেছি। এবারে যা দেখলুম, শুনলুম, পড়লুম, বিশেষ করে লটে যেসব কথা বলল তার থেকে মনে প্রশ্ন জাগল, প্রতীচ্যের বহু দেশে অত্যধিক মদ্যপান যেমন এই শতাব্দীর গোড়ার থেকে একটা কঠিন সমস্যায় দাঁড়িয়েছে, ঠিক তেমনি এদের যৌন আচরণ যে-স্রোতে গা ঢেলে দিয়েছে, যে গতিতে এগিয়ে চলেছে, বিশেষ করে স্কুলের পনেরো-ষোল-সতেরো বছরের ছেলেমেয়েদের ওপর এটা যেভাবে প্রভাব বিস্তার করছে তার পরিণতি কোথায়? ব্যক্তিগতভাবে আমার মাত্র একটি বিষয়ে কৌতূহল আছে : ব্রহ্মচর্য, সেক্স স্টার্ভেশন কি মহত্তর কর্মে সাহায্য দেয়, উচ্চতর আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে? দু-হাজার বছর ধরে ক্যাথলিক পাদ্রিরা ব্রহ্মচারী জীবনযাপন করার পর আজ বহুতর ব্রহ্মচারী এবং গৃহীর মনে ওই নিয়ে সন্দেহ জেগেছে বৌদ্ধদের ভিতর এ সমস্যা নিয়ে কোনও আলোচনা এখনও আমার কানে এসে পৌঁছয়নি।…
পাঠকদের মধ্যে যাদের বয়স কম তাদের মনে নিশ্চয়ই আরেকটা চিন্তার উদয় হবে : আজ ইউরোপে যা হচ্ছে কাল সেটা এদেশে দেখা দেবে না তো? এবং দিলে দু-দিনের মধ্যে যে তার ভেজাল রূপ দেখা দেবেই সে বিষয়ে আমি সুনিশ্চিত।
সবুরদার পাঠক! এ কচকচানিতে তুমি যদি কিঞ্চিৎ চঞ্চলিত হয়ে থাক, তবে আমি মাফ চাইছি। ভবিষ্যতে আর কখনও এমন গুনা করব না– এ-ওয়াদা করলে অধর্ম হবে, তবে চেষ্টা দেব, পরশুরামি ভাষায় তোমার মন যেন হিল্লোলিত হয় চিত্তে চুলবুল লাগে।
তার জন্য ওই জন সাহেবটির সরেস মন্তব্য যেন মন্তব্যমণ্ডলীর সায়েব।
পাঠক, ফরাসি দেশে তুমি যদি কোনও ফিলম-স্টার বা অভিনেত্রীর সঙ্গে প্রেম জমাতে পারো তবে আর পাঁচজনের চোখে ফুটে উঠবে সম; মুখে ফুটবে সপ্রশংস ও! লা লা! বুকে ফুটবে কাঁটাকিন্তু সেটি অতিশয় বেবি সাইজের, দুশ্চিন্তার কারণ নেই, কারণ ফরাসি জাতটা মোটেই হিংসুটে নয়। কিন্তু, জন্ বলছেন, এমন কম্মটি লন্ডনে করতে যেয়ো না। এতে করে তোমার খ্যাতি-প্রতিপত্তি বাড়বে তো না-ই বরঞ্চ তোমার পক্ষে রীতিমতো খতরনা হতে পারে বিশেষ করে তুমি যদি এ লাইনে এমেচার হও। এমনকি মেয়ে আর্টিস্টের প্যার পেলেও ওই একই হাল। আর্টের সঙ্গে প্রেমে মোটেই ম্যাচ করে না। ও দুটোর মধ্যে কোনও সম্পর্কই নেই। ফরাসিরা অবশ্য প্রেমটাকে আর্টের উচ্চাসনে বসায় (গুরুচণ্ডালী!–বলব আমরা) এবং ওটাকে একটা অত্যন্ত প্রকৃষ্ট আপন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আর্ট বলে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু আমরা ইংরেজ জাতি স্পোর্টসের নেশন; এ দেশে প্রেম এক বিশেষ ধরনের ডনকসরত (জিমনাস্টিক) বলে স্বীকৃত হয়।
.
৩৫.
স্বখাত সলিলে আমি ডুবিনি, তোমাকে ডোবাইনি। পাঠক নিশ্চিন্ত থাকতে পার। আর ডুবলেই-বা কী? কবিগুরু বাউলের গীত উদ্ধৃত করে বলেছেন, যে জন ডুবল, সখী, তার কী আছে বাকি গো অবশ্য পাতকোতে নয়, রসের সাগরে অমিয় সায়রে। কিন্তু আশ্চর্য, ইংরেজের আপন দেশে চতুর্দিকে গভীর জলের সন্দ্র থাকা সত্ত্বেও সে ভোবাডুবির প্রস্তাব বড় একটা পাড়ে না। তাই ডুক জন সেটা লক্ষ করে বলেছেন, অন্য দেশের লোক প্রেমকে আর্টের পর্যায়ে ফেলুক (কিংবা ঈশ্বরোপলব্ধির প্রথম সোপান বলে গণনা করুক– লেখক), ইংরেজের কাছে প্রেম এক প্রকারের জিমনাস্টিক। কৌতূহলী মন জানতে চাইল, সেটা কোন প্রকারের জিমনাস্টিক? তখন, ও হরি, আবিষ্কার করলুম ইংরেজের আরেকপ্রস্ত ভণ্ডামি। মার্কিন জাতের পুণ্যভূমি যে রকম প্যারিস, বিলেতের ভণ্ড এবং স্নব– দু জনার মধ্যে খুব যে একটা ফারাক আছে তা নয়– দু জনারই মোক্ষক্ষেত্র অক্সফোর্ড। সেই অক্সফোর্ডে আছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজ মোকা-বে-মোকায় হামেশাই কভু-বা কনে বউয়ের মতো ফিসফিসিয়ে কভু-বা বাঘা জমিদারের মতো গলা ফাটিয়ে মহারানির যে রাজত্বে সূর্য কখনও অস্তমিত হন না সে রাজত্বের এবং তারই কাছেপিঠে উপীনদের যে দু বিঘে জমি আছে সেসব জায়গাকেও জানিয়ে দেয় অক্সফোর্ডের মতো বিদ্যায়তন ত্রিসংসারে আর কোথাও নেই, এবং এসব ব্যাপারে ইংরেজের ন্যাজ মার্কিন মুব সাধারণ সর্বাঙ্গ ঘন ঘন আন্দোলিত করে সম্মতিসূচক মুদ্রা মারে। সেই বিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় একখানা রাজভাষার অভিধান।* অভিধানটি উত্তম, কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সবারিতে ভর্তি। সেই কোষ খুলে দেখতে গেলুম, টু মেক লাভ বলতে কী বোঝায়? প্রেমে পড়া সে তো খুব সম্ভব বিলেতে টু ফল ইন লাভ থেকে কবে, কোনকালে পালতোলা জাহাজে করে সরাসরি এদেশে চলে এসেছে। দেখি টু পে অ্যামরাস অ্যাটেনশনস্ টু–। তবেই তো ফেলল মুশকিলে। ইংরেজ কী ধুরন্ধর জাত। যেখানে টাকাকড়ির ব্যাপার নয় সেখানে চট করে ঋণ স্বীকার করতে ভারি চটপটে। তদুপরি দায়টা ফরাসির ঘাড়ে ফেলে দিয়ে নিজে চটসে সরে পড়ল– প্রেমট্রেম তো বাধা, জানে ওরাই। কথাটা এসেছে ফরাসি ভাষা থেকে; আমূর শব্দের অর্থ প্রেম (মূলত অবশ্য এসেছে লাতিন আমরসুস্ থেকে। কিন্তু ফরাসিরা আমূর বলতে প্রেম, কাম সবই বোঝে। ওদিকে ইংরেজ অ্যামরাস বলতে বোঝে নিছক প্রেম– সে প্রায় আমাদের রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম/ কামগন্ধ নাহি তায়… তা হলে আমাদের মহাখানদানি অক্সফোর্ড অভিধানের মতানুযায়ী টু মেক লাভ কথাটার অর্থ বল্লভার প্রতি সপ্রেম মনোযোগ দেওয়া, তাঁর যত্ন আত্যিকর। এস্থলে বলে রাখা ভালো লাভ শব্দে সে জাতীয় কোনও প্রকারের ভেজাল নেই এ কথাটা পষ্টাপষ্টি বলবার মতো দুঃসাহস অক্সফোর্ডের নেই। তাই অতি অনিচ্ছায় (আমার মনে হয়) স্বীকার করেছেন, সেকসুয়াল অ্যাফেকশন, ডিজায়ার ইত্যাদি। পুনরপি বলেছেন, রিলেশন বিটউইন সুইট হার্টস- এবারে পাঠক নিশ্চয়ই ঠাহর করে নিয়েছ শ্রাদ্ধটা কোন দিকে গড়াচ্ছে সুইট হার্টস– একে অন্যের প্রতি অনুরক্ত জনের সম্পর্ক তো হাজারো রকমের হতে পারে। এখানে যদি অক্সফোর্ড সত্যের খাতিরে সাতিশয় কায়ক্লেশে লিখতেন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তা হলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত।
[*ইংরেজ জাতটার প্রাণপুরুষ যে বেনে সেটা বোঝাবার জন্য বহু জ্ঞানী বহুতর যুক্তিতর্ক উদাহরণ-হদিশ পেশ করেন। সেগুলো নিতান্তই কাঁচা পড়ুয়ার সেই যুক্তির মতো ডাস্টবিন মার্কা : গুরুমশাই, আমি ঘুমুচ্ছিলুম, কে যেন আমার হাত দিয়ে তামাক খেয়ে গেছে। আসল মোক্ষম যুক্তি, কামারের এক ঘা-র মতে, এই বিপুল বসুন্ধরায় লক্ষ্মী এবং সরস্বতাঁকে একই গোয়ালে নাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে কে কোথায়? ইংরেজ– অক্সফোর্ডে। পেত্যয় না হয় তো যান সেই বিগ্রহ-পাণ্ডার যুগল-মিলন দেখতে সেখানে। এই বিদ্যায়তন এন্তেক কেতাবাদি ছাপে, প্রকাশ করে। এবং সবচেয়ে বড় কথা লাভ করে। কন্টিনেন্ট বা ভারতের বিদ্যায়তনদের লাভ করা মাথায় থাকুন গচ্চা দিতে দিতে কণ্ঠশ্বাস। অর্থশাস্ত্রের মহাজনরা বলেন, ১৯৩০-৩২ যখন বিশ্বময় ব্যবসা-বাণিজ্য জীবনূত তখন যে প্রতিষ্ঠান রেকর্ড মুনাফা করেন তিনি অক্সফোর্ড। অম্মদেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্টমন্ত্র Advancement of Learning এই কারসিকতা শুনে এক ইংরেজ বলেছিল, সে কী! একশো বছর হয়ে গেল, তোমরা এখনও ফালতো L অক্ষরটি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আমাদের মতো Advancement of Earning করতে পারোনি!]
এইবারে আইস, নিন্ননাসিক পাঠক, অন্য একখানা অভিধানের শরণাপন্ন হই। যে কনসাইস অক্সফোর্ড ডিকশনারি নিয়ে এতক্ষণ নাড়াচাড়া করছিলুম, যার নাম শ্রবণেই শ্রীরাধার ন্যায় উন্নাসিকজনের কপোল ভাসিয়া যায় নয়নের জলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে; পক্ষান্তরে আমি যে অন্য কোষের শরণাপন্ন হচ্ছি সে কোষ প্রথম যে রূপ নিয়ে প্রকাশিত হয় সেটি ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ অক্সফোর্ডের প্রায় একশো বছর পূর্বে। তার অর্থ, গত একশো বছর ধরে এ অভিধানের ঐতিহ্য। একে সচরাচর ওয়েবস্টার বলা হয় এবং উপস্থিত Websters Seventh New Collegiate Dictionary নাম দিয়ে কলকাতায় রাস্তাঘাটে জলের দরে বিক্রি হচ্ছে আমার হিসাবে যার দাম হওয়া উচিত ৬০/৭০ টাকা, বিক্রি হচ্ছে সেটি দশ টাকায়– চেষ্টা-চরিত্র করলে পাবেন আট টাকায়। এ অভিধান অবহেলা করার মতো কেতাব নয়। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলেন, অভিধানের ইতিহাস লিখতে গিয়ে এ অভিধানের উল্লেখ না করলে সে বিবরণী অসম্পূর্ণ থেকে যায় এবং কনসাইস অক্সফোর্ড যে পাঁচখানি বেস মডার্ন ডিকশনারির কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন তার মধ্যে ওয়েবস্টার রচিত কোষ অন্যতম। এইবারে দেখি ইনি কী বলেন। প্রথমেই দেখা যাচ্ছে, ইনি ঈষৎ ধর্মভীরু, কারণ লাভ শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, পিতার ন্যায় ঈশ্বর মানবসন্তানের জন্য যে মঙ্গল চিন্তা করেন (উদ্বেগ ধরেনও বলা যায়, কারণ ইংরেজিতে আছে ফাদারলি কনসার্ন)। অক্সফোর্ডে ভগবান নেই– না, না– আমি বলতে চাই, অক্সফোর্ড অভিধানে লাভ শব্দ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংকলনকারী মানুষের প্রতি ঈশ্বরের, কিংবা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের ভালোবাসার উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি কিংবা এই কুসংস্কারে বিশ্বাস করেননি। তা সে যাই হোক, সেই ধর্মভীরু, ওয়েবস্টার লাভ শব্দের নানা অর্থ দিতে গিয়ে (কেউ কেউ যে ঈশ্বরের প্রতিশব্দরূপে লাভ ব্যবহার করেন সেটাও বলেছেন) লিখছেন যৌন আলিঙ্গন এবং সেটা বোঝাতে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপিটাল অক্ষরে লিখেছেন, COPULATION অর্থাৎ মৈথুন যৌন সঙ্গম এবং যে টু মেক লাভ নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করেছিলুম তার বেলা ইংরেজের মতো বিস্তর ধানাই-পানাই না করে, আশকথা পাশকথা (বিট অ্যাবাউট দি বুশ) না ঝেড়ে, এর ঘাড়ে ওর কাঁধে আপন বোঝা না চাপিয়ে একদম এক ঘায়ে সোজাসুজি উত্তর দিচ্ছেন : টু এনগেজ ইন সেক্সায়েল ইন্টারকোর্স।
অবশ্য বলতে পারেন, ওয়েবস্টার অভিধান মূলত মার্কিন অভিধান। এর উত্তরে নিবেদন : (১) এ অভিধান আমেরিকায় প্রকাশিত হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই এর বিলিতি সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং এখনও যেসব ইংরেজ উন্নাসিকতা অপছন্দ করেন (আমি নেটিব ঘৃণা করি) তারা এ অভিধানই ব্যবহার করে থাকেন; (২) কনসাইজ অক্সফোর্ড বহুস্থলে বিশেষ বিশেষ ইংরেজি শব্দ মার্কিন মুল্লুকে যে অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয় তার উল্লেখ করেন; এ স্থলেও করলে পারতেন; (৩) আমি ভূরি ভূরি ইংরেজ-লিখিত গল্প-উপন্যাসে এর ব্যবহার পেয়েছি। কিন্তু স্কু পাইনি, এবং ওয়েবস্টারেও শব্দটা নেই কারণ শব্দটা এখনও গ্রাম্য; (৪) এবং সর্বশেষ বক্তব্য, ওয়েবস্টার মার্কিন দেশগত বলে যদি তাকে অস্পৃশ্য বিবেচনা করতে হয় তবে এ অভিধানখানি এদেশের গুণীজনের আশীর্বাদ লাভ করল কী প্রকারে? কারণ গ্রন্থ পরিচিতিতে স্পষ্ট ছাপা আছে।
Published with the assistance of Joint Indian-American Text Book Programme
এ বিষয়ে এতখানি লেখবার কারণ কী? গত সপ্তাহে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, কচর কচর আর করব না, কিন্তু আমার কপাল মন্দ, তার দু-দিন পরেই এক সদ্য বিলেতফেরতা তরুণের সঙ্গে মোলাকাত। ছেলেটি ভালো, কিন্তু বিলিতি মোহ ঝেড়ে ফেলতে এখনও তার ঢের সময় লাগবে। তখন হঠাৎ আমাকে স্ট্রাইক করল, কে যেন বলেছিল, বিলিতি মবারি স্বরাজ লাভের পর আদৌ কমেনি, বরঞ্চ বেড়েছে। যেসব ছেলেছোকরারা আমার লেখা পড়ে আমাকে সম্মানিত করে অন্তত তারা যেন অক্সফোর্ড বলতে ভিরমি না যায়, রকবাজি গুলমারার সময় খোদার-খামোখা বিলিতি মবারির চিত্রিত গর্দভ না হয় তাই এতসব বলতে হল, অন্যান্য যথা বিদেশের বর্তমান অনুচ্ছেদ প্রধানত সেক্স নিয়ে সেগুলো পূর্বেই নিবেদন করেছি। অভিধান নিয়ে আলোচনা করে স্পষ্ট বোঝা গেল, ইংরেজ ভাজে ঝিঙে, বলে পটল।
ড্যুক অব বেডফোর্ড জন ভণ্ডামি সম্বন্ধে যা বলেছেন তার অনেকখানি সর্বদেশে সর্বকালেই থাকে তবে কোনও কোনও দেশে চক্ষুলজ্জাটার বাড়াবাড়ি কোনও কোনও দেশে কম। কোনও ফরাসি যখন সমাজের সম্মানিতা কোনও মহিলাকে প্রণয়িনীরূপে গ্রহণ করে তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে সেটা গোপন রাখার কোনও প্রয়োজন বোধ করে না, কিন্তু বিলেতে ঠিক তার উল্টো অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বর্জনীয়। এবং অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজ তার ভাব-ভালোবাসাটা এমনই নিরন্ধ্র গোপন রাখতে সক্ষম হয় যে মহিলাটিও তার ডবল সুযোগ নেবার পথটা নিজের থেকেই দেখতে পান। জন সাহেব একটি সত্য ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন, একটি প্রখ্যতা মহিলা (এই গোপনীয়তার সুযোগ নিয়ে) সমাজের অতি উচ্চস্থানে প্রতিষ্ঠিত দু জন অভিজাত জনের সঙ্গে একই সময়ে প্রণয়লীলা চালালেন। কথায় বলে ডান হাতের কারবার বাঁ হাত জানে না– নটবরদ্বয়ের একজনও জানতেন না, মহিলাটি দু জনার এজমালি রক্ষিতা। মহিলাটি যেসব কেনাকাটা করতেন, তাঁর খরচাপাতি যা হত তার প্রত্যেকটি বিল তিনি দোকানির কাছ থেকে ডুপ্লিকেটে চেয়ে নিতেন এবং আমাদের চৌকস শেয়ালের একই কুমিরছানা দু-দুবার দেখাবার কায়দায় দুই মহাশয়ের সামনে পেশ করতেন। মাগ্যি-ভাড়ায় ছিমছাম যে বাড়িটিতে বাস করতেন তার ভাড়াও গুনতেন দুই হুজুরই। বলা বাহুল্য, হাফাহাফি নয়, পুরোপুরিই কারণ প্রেমের বখরাদার আছে সে তথ্যটি না জানলে ভাড়ার বখরাদার জুটবে কোত্থেকে? কিন্তু তাবৎ কেচ্ছার মধ্যে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ব্যাপার : বেশ অনেক বৎসর ধরে উভয়েই কাচ্চাবাচ্চাগুলোর জনকরূপে গণ্য হতেন।
এখানে আমি পড়েছি বিপদে। কার কাছে গণ্য হতেন? ধরে নিচ্ছি তালেবর মহিলাটি সযতে দুই প্রস্থ বন্ধুবান্ধব বেছে নিয়েছিলেন যাদের এক প্রস্থ অন্য প্রহকে চিনতেন না। দুই প্রস্থকে দুই নাগরের নাম দিতেন। কিংবা হয়তো স্যুকের চিন্তাধারা আদৌ সেদিকে যায়নি। তিনি বলতে চেয়েছেন, দুইজনাই ভাবতেন, বাচ্চাগুলো তারই। কিন্তু তবু শেষ প্রশ্ন থেকে যায়, বাচ্চাগুলো ভাবত কী? তারা ঠিক যে রকম জানে, একজোড়া জুতোতে দুটো জুতো থাকে ঠিক সেইরকম মেনে নিয়েছে একই বাড়িতে দুটো বাপ আনাগোনা করে! পাঠক জানেন, আমার কল্পনাশক্তি বড়ই অনুর্বরা। আপনারাই না হয় এ সমস্যাটি সমাধান করে নিলেন।
এবং সর্বশেষ জন বলেছেন, দু-দুজন নাগরের কাছ থেকে প্রেম, আত্মনিবেদন, প্রশস্তি-গীতি, আসঙ্গসুখ লাভ করে, সমাজের দু-দুটো হোমরাও সিং চোমরাও খানকে আস্ত দুটো বোকা ম্যাড়ার মতো আঙ্গিনার খুঁটিতে বেঁধে রেখে তিনি যে তার আত্মশ্লাঘা বাড়াতে চেয়েছিলেন তা নয়, তিনি সবকিছু করেছিলেন সুন্ধুমাত্র পৌন্ড শিলিং পেন্সের জন্য।
ফ্রান্সে তো এসব নিত্যদিনের ডাল-ভাত। রীতিমতো একটা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না, জনও আমাদের বলছেন, পৃথিবীর আর সর্বত্র যা ঘটে থাকে, বিলেতে তাই ঘটে, তবে, সায়েবরা এসব বাবদে উচ্চবাচ্য করেন না।
কিন্তু জন যে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিলেত তথা তাবৎ কন্টিনেন্টের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করেন আপন মতামত প্রকাশ করেন, কিংবা যখন নীরব থাকেন, অথবা কোনও প্রকারের উপদেশ দেওয়া থেকে নিরস্ত থাকেন, সবক্ষেত্রেই তাঁর বৈশিষ্ট্য আছে। তারই একটা পরিস্থিতির উল্লেখ তিনি করেছেন বড় বে-আব্রু ভাষায়। আমি সেটা মামুলি ঢঙে পেশ করি। বলছেন, কোনও হাউস পার্টিতে (অর্থাৎ যেখানে উইক এন্ড কাটাতে হয়) যদি তুমি সুযোগ পেয়ে গৃহকত্রীর সঙ্গে কিংবা কোনও বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে মাত্রাধিক প্রেম করে ফেল তবে সে-গেরো থেকে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা কর– অবশ্য যতখানি পার ভদ্রতা বজায় রেখে। বলা বাহুল্য, অতিশয় চতুরতাসহ। কারণ কোনও মহিলারই হৃদয়ানুভূতিতে আঘাত হানা অনুচিত। কিন্তু হায়, ইহসংসারে সব গেরো তো আর এড়াতে পারা যায় না।
এস্থলে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, পরিস্থিতিটা জন-এর মনঃপূত নয়। কিন্তু তিনি তার দেশবাসীর তথা বিশ্বজনের মনোবৃত্তি ভালো করেই জানেন বলে লম্বা লেকচার ঝেড়ে সদুপদেশ দেননি। তার নীরবতা বহু ক্ষেত্রেই হিরন্ময়।
.
৩৬.
যুদ্ধ ব্যাপারটা কী তার সঙ্গে আমাদের সামান্য কিছু কিছু পরিচয় হচ্ছে। ভালোই। না হলে অবশ্য আরও ভালো হত। ভবিষ্যতে, কখনও, কস্মিনকালেও হবে না সে ভরসা যদি কার্তিকেয় দিতেন তবে হত সবচেয়ে ভালো। কিন্তু চতুর্দিকে যে হালচাল দেখছি তাতে তো মনে হয়, বর্তমান যুদ্ধটা ঝটপট শেষ হোক বা রয়ে-সয়েই শেষ হোক, এটাই শেষ যুদ্ধ নয়। আরেকটা মোক্ষমতর লাগবে। কবে লাগবে? সঠিক কেউ বলতে পারবেন না, তবে কোনও মস্তান যদি আমার কানের উপর পিস্তল বসিয়ে না বললে নিষ্কৃতি নেই রবে হুঙ্কার ছাড়ে তবে বলব, বছর পঁচিশেকের ভিতর। কেন, কাতে কাতে, এসব প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দেব না। আমি শুধু ভবিষ্যদ্বাণীটি করে রাখলুম এবং আজ দিনের যেসব নাবালক নিতান্ত আর কিছু না পেয়ে আমার এ লেখাটি পড়েছে তারা যেন সেদিন আমাকে স্মরণে আনে অবশ্যই প্রাণভরে অভিসম্পাত দিতে দিতে। কারণ, ততদিনে। আমি ইহলোকের ডাঙাকে এক লাথি মেরে পরলোকের নৌকোয় বসে ভরা পাল তুলে বৈতরণীর হেপারে।
যুদ্ধ প্রতিষ্ঠানটি উত্তম একথা কোনও সুস্থ ব্যক্তি বলেছেন বলে শুনিনি, বরঞ্চ বহু বহু বিজয়ী বীর যুদ্ধের অজস্র নিন্দা করে গেছেন। তবে একটা বিষয়ে যুদ্ধের কি শত্ৰু কি মিত্র সকলেই অকুণ্ঠ প্রশংসা করে গেছেন। যুদ্ধের সময় অতি সাধারণ মানুষও প্রায়ই এমন সর্বোচ্চ পর্যায়ের স্বার্থত্যাগ, দেবদুলভ পরোপকার করে থাকে, পরের জন্য অশেষ ক্লেশ সহ্য করে মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করে নেয় যে তার সামনে বহু রণের বিজয়ী বীর নেপোলিয়ন-সম্প্রদায় পর্যন্ত অবনত মস্তকে স্বীকার করেন যে, ওই সাধারণ জনের অসাধারণ কীর্তির কাছে তাদের লক্ষ রণজয় তুচ্ছ।
তারই একটা উদাহরণ লটে আমার সামনে পেশ করেছিল : তার উল্লেখ প্রকাশিত প্রবন্ধ বা পুস্তকে কোথাও আমি পাইনি, লটেও পায়নি।* কাহিনীটি পড়া সমাপ্ত করে পাঠক হয়তো কিছুটা নিরাশ হবেন। ইংরেজ এ স্থলেই বলে থাকে : নাথিং টু রাইট হোম অ্যাবাউট–চিঠি লিখে বাড়িতে জানাবার মতো এমন কিছু অসাধারণ ব্যাপার নয়। আমি কিন্তু তবু জানাচ্ছি, তার কারণ প্রথম দুশমন ইংরেজ যা করে না করে তার উল্টোটা করতে পারলে আমার জানটা বড় খুশ হয়। দ্বিতীয়ত ঘটনাটির নায়ক আমার পরিচিত। নাতিদীর্ঘ আট বছরের পরিচয় সেটা দীর্ঘতম হবার সুযোগ কেন পেল না সেইটেই আমি রাইটিং হোম অ্যাবাউট।
[*অসংখ্য রতনরাজি বিমল উজ্জ্বল
খনির তিমির গর্ভে রয়েছে গভীরে
বিজনে ফুটিয়া কত কুসুমের দল
বিফলে সৌরভ ডালে মধুর সমীরে।
গ্রে-র কবিতা থেকে এই অংশানুবাদ বছর চল্লিশ পূর্বে এতই মুখে মুখে প্রচারিত ছিল যে কেউ সেটা ছাপালে পাঠক সম্প্রদায় বিরক্তিভাবে অবজ্ঞাও প্রকাশ করত না। আজ সে যুগের পাঠক, বৃদ্ধরা পুরনো দিনের স্মরণে দু চোখের জল ফেলছেন, তরুণরা হয়তো পড়বেনই না– আদৌ মডার্ন নয়।]
লটে বললে, উইলিকে তো চিনতে নিশ্চয়ই ভালো করে –তোমাদের সেমিনারের হাউসমাস্টার?
আমি বললুম, বন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন পীরমুরশিদ চিনতেন না তাকে? এস্তেক সেমিনারের বড়কর্তা প্রফেসর ডকটর পাউল কালে পর্যন্ত উইলির বাক্যস্রোত চট করে থামাবার চেষ্টা করতেন না।
এস্থলে কাহিনীর প্রথম অংশটা আমাকেই বলতে হবে। উইলির সঙ্গে লটের পরিচয় বরঞ্চ বলা উচিত ফ্রাউ উইলির সঙ্গে লটের পরিচয় হয় অনেক পরে। বিশেষত, অন্তত দুটি বছর তার সঙ্গে আমাকে মুখোমুখি হতে হত প্রতিদিন পাঁচ-দশবার। তার পদবি ছিল হাউস মাইস্টার। মাইস্টার শব্দের অর্থ জৰ্মনে যদিও মাস্টার তবু হাউস-মাইস্টার বলতে হাউস মাস্টার বা বোর্ডিং স্কুলের শিক্ষক বোঝায় না। হাউস-মাইস্টার কোনও বাড়ি বা অফিসের দেখ-ভাল করে। একে দরওয়ান বলা চলে না। বরঞ্চ ইংরেজিতে হাউস-কিপার বলা চলে, ফরাসিতে ইনিই কাসিয়েৰ্জ নামে পরিচিত।
উইলি, তোলা নাম ভিলহেলম, সেমিনার বাড়িটা ফিটফাট ছিমছাম রাখত সে-কথাটার বিশেষ উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। সেন্ট্রাল হিটিঙে উনিশ-বিশ, মূল্যবান পাণ্ডুলিপি ফটোস্টাট করার জন্য ডার্করুমের পর্দা থেকে আরম্ভ করে সূক্ষ্মতম যন্ত্রপাতিতে এককণা ধুলো পড়ে থাকতে কেউ কখনও দেখেনি। কোনও একটা ট্যাপের ওয়াশার বিগড়ে যাওয়াতে সেটার থেকে পিটির পিটির জলের ফোঁটা ঝরছে, এহেন গাফিলতি কেটে কখনও দেখাতে পারলে, হাউস-মাইস্টার উইলি যে তনুহূর্তেই এক ছুটে রাইন ব্রিজের উপর পৌঁছে সেখান থেকে জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করত সে সত্য সম্বন্ধে আমাদের কারও মনে ধূলিপরিমাণ সন্দেহ ছিল না।
সেমিনার বাড়ির পাশে ছোট একটি দোতলা বাড়ির উপরের তলায় ছিল মাইস্টার উইলির কোয়ার্টার। সেখানে সর্বাধিকারিণী ছিলেন তাঁর বিবি। গাব্দাগোব্দা শরীর, হাসিভরা মুখ– ন-সিকে টিপিকাল জর্মন হাউস-ফ্রাউ। বয়স চল্লিশের মতো হবে, কিন্তু উইলিকে দেখে ঠাহর করা যেত না তার বয়স কত হতে পারে। সেমিনারের সবচেয়ে পুরনো কর্মী বলতেন, পনেরো বছর ধরে তাকে ওই একই চেহারায় দেখছেন। সর্বাঙ্গে সর্বত্র অনেকগুলি ছোট ঘোট সাইজের মাসল ছড়ানো; ছোট ছোট সাইজের কারণ আর পাঁচটা জমনের তুলনায় উইলি ছিল রীতিমতো বেঁটে।
সেমিনার পূর্ণসিদ্ধ অর্ধসিদ্ধ পণ্ডিতে পণ্ডিতে ভর্তি, আর জনা পাঁচেক সুপ্রাচীন অর্ধপ্রাচীন অধ্যাপক। সর্বশেষে ডক্টরেটের থিসিস লেখাতে ব্যস্ত আমরা কয়েকজন তো ছিলুমই। আমার মনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগত, এতসব পণ্ডিত আর এঁদের দিনের পর দিন একটানা বিদ্যাচর্চা দিনে দশ ঘণ্টা খাটা সেমিনারের ডাল-ভাত– এসব দেখে দেখে পাণ্ডিত্যের প্রতি উইলির মনোভাবটা ছিল কী? কাউকে যে বড্ড বেশি একটা সমীহ করে চলত, উইলির ধরনধারণ দেখে সেটা তো মনে হত না। তাকে কোনওদিন খবরের কাগজ পর্যন্ত পড়তে দেখিনি। আমি তার কোয়ার্টারে বহুবার গিয়েছি, কারণ আশপাশের কাফের তুলনায় উইলির বউ আমাদের জন্য কফি বানিয়ে দিত ঢের সস্তায়। আমাদের সময়াভাব তাই তার ব্লিৎস সার্ভিস উপেক্ষা করে খুদ কাফেতে যাওয়াটা আমরা নিছক থার্ডক্লাস স্মবারি চালিয়াতি বলে মনে করতুম। সেমিনারের জানালা দিয়ে ফ্রাউ উইলিকে শুধু আঙ্গুল তুলে দেখাতে হত ক-কাপ ক-পট কফি চাই। রেকর্ড টাইমের ভিতর ফ্রাউ উইলি ডাইনে-বাঁয়ে দুলতে দুলতে ট্রেতে করে কফি নিয়ে উপস্থিত। আমি কিন্তু সোজা ওদের ঘরে গিয়ে কফি খেতুম–কী হবে ওই ফুল স্লিম (গাব্দাগোব্দার দ্ৰ ইংরেজি প্রতিবাক্য) ফাউকে সিঁড়ি ভাঙতে দিয়ে। সেখানে একদিন লক্ষ করলুম, ঘরে মাত্র একখানা বই– বাইবেল। বহু ব্যবহৃত। আমি জানতুম, ক্যাথলিক জনসাধারণ সচরাচর বাইবেল বড় একটা পড়ে না– তারা তাদের উপাসনা পুস্তিকা নিয়েই সন্তুষ্ট, গিঞ্জেয় যাবার সময় ওই বই-ই সঙ্গে নিয়ে যায়। কথায় কথায় শুধালুম বাইবেলখানা পড়ে কে? উইলি। এবং একখানা বই ছাড়া অন্য কোনও কেতাব ছোঁয় না। তাই তো। সমস্যাটা একটু তলিয়ে দেখতে হয়।
সেমিনার খোলা থাকত সকাল আটটা থেকে রাত দশটা অবধি। জবরদস্ত গবেষকরাও রাত আটটার সময় বাড়ি গিয়ে আর বড় একটা ফিরতেন না। কিন্তু আমার তখন গৃহিতৃৈব কেশেমু মৃত্যুনা ধর্মমাচরেৎ মৃত্যু যেন তোমার চুল পাকড়ে ধরে আছেন এইভাবে ধর্মের আচরণ করবে। ধর্ম মাথায় থাকুন, মাথার উপরকার কেশ পাকড়ে ধরে আছেন আমার ট্যাক। সোজা বাঙলায় কইতে গেলে, ইংরেজ যে সত্যি বেনের জাত সেটা সপ্রমাণ করল আমার শেষ কল্পনখানা কেড়ে নিয়ে একদিন বিলকুল মিন নোটিশে– গোলড স্ট্যান্ডার্ড বর্জন করে। আদাজল খেয়ে যে কড়ি ক-টা জমিয়েছিলুম– আরও ছটি মাস জর্মনিতে বাস করে রয়েসয়ে আমার গব্বযন্তনা থিসিসখানা নামাব বলে, তাদের উপর বমিং হয়ে গেছে। গোলড স্ট্যান্ডার্ড নাকচ হওয়ার ফলস্বরূপ হঠাৎ একদিন দেখি আমার ট্র্যাকের তিনকড়ি চট্টোপাধ্যায় চটসে দু-কড়ি চাটুয্যেতে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলেন। অতএব আর মাত্র দুটি মাসের ভিতর যদি সেই লক্ষ্মীছাড়া থিসিসটা শেষ করে, তিন-তিনটি ভাইভা পরীক্ষা পাস না করতে পারি তবে শয়নং যত্রতত্র ভোজনং হট্টমন্দিরে তাই-বা কী করে হয়, এই পাথরফাটা শীতের দেশে যত্রতত্র শয়ন করলে মৃত্যু অনিবার্য এবং বন শহরের হাটবাজারের ভিখিরিকে দিনান্তে খয়রাতি এক পেলেট সুপ দেবার ব্যবস্থাও নেই- ফুরার হিটলার ভিয়েতন তেষার বরাতে একদিন যমরাজকে ফাঁকি দিতে পেরে অন্য পুণ্যভূমিতে পরজন্ম লাভ করলেন। তাই তখন প্রাণপণ রেস দিচ্ছি টাইমের সঙ্গে। সকাল, বিকেল পাঁচ-পাঁচ দশ ঘণ্টা কাজ করার পরও মাঝে মাঝে আলুসেদ্ধ মাখম রুটি দিয়ে ব্যানকুয়েট সেরে রাত সাড়ে আটটায় আরেক প্রস্ত সেমিনার যেতুম। কিন্তু আমার ওয়াটারলু ছিল অন্যত্র। সেটা এতক্ষণ পেশ করিনি, কারণ অধিকাংশ শ্যানা পাঠকই সেটা আমার লেখকজীবনের প্রথম প্রভাতেই জেনে গিয়েছেন; নিতান্ত যারা জানেন না তাদের বলি লেখাপড়ায় আমি চিরকালই ছিলুম বিংশ শতাব্দীর এক নবকালিদাস যিনি মা সরস্বতীর কৃপালাভ কস্মিনকালেও কামনা করেননি এবং দেবীও অহেতুক তাঁকে দর্শন দেননি। সাদামাটা ভাষায় বলতে গেলে কেতাবপত্র দেখলেই আমার গায়ে জ্বর আসত, স্কুলবাড়িটা আমার কাছে শুশানমশানের লাগোয়া ওয়েটিংরুমের মতো মনে হত এবং কুয়েশচন পেপারের ওপর চোখ বুলুতে না বুলুতেই পরীক্ষার হলে কতবার যে ভিরমি গিয়েছি। সেটা আমাদের শহরের এমবুলেনস তাদের রেকর্ডরূপে সযত্নে লোহার সিন্দুকে পুরে রেখেছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও কী করে, কোন দুষ্টগ্রহের তাড়নায় যে আমি বন শহরে ডক্টরেট নেবার জন্য এসেছিলাম সেটা গোপন রাখতে চাই– পাঠক অযথা খোঁচাবেন না।
কাঁটায় কাঁটায় রাত দশটায় উইলি এসে আমাকে হুনো লাগিয়ে একখানা লেকচার ঝাড়ত। রাইনল্যান্ডের গাঁইয়া ডাএলেক্টে। সে ভাষা বোঝে কার সাধ্যি? সেমিনারের নমস্য পণ্ডিতগণ তো কানে ডবল আঙ্গুল পুরতেন। আমি যে অক্লেশে বুঝতে পারতুম তার একমাত্র কারণ আমার দিনযামিনী কাটত এই শেষের ক মাস ছাড়া শহরের বেকার, ফোকটে পয়সা মারায় তালেবর, ঘাঘরা-পল্টনের তাবেদার মস্তানদের সঙ্গে। তারা গ্যোটে-শিলারের ভাষায় কথা কয় না। কিন্তু থাক সে পুরনো কাসুন্দো।
সে লেকচারের সারাংশ : কী হবে হে, ছোকরা অত নেকাপড়া করে? দুটো প্যাখনা গজাবে বুঝি? ঢের ঢের বাঘা বাঘা পণ্ডিতদের তো এই হাতের চেটোতে চটকালুম, বাওয়া, অ্যাদ্দিন ধরে! কী পেলুম ক দিকিনি, তবে বুঝি তোর পেটে কত এলেম। বলি– কান পেতে শোন, আখেরে ফয়দা হবে, তাই ভাঙিয়ে খাবি। এই যে হেথায় কেতাবে কেতাবে চতুর্দিক ছয়লাপ, ওদেরই মতো ওরা খসখসে শুকনো বুঝলি, শুকনো। রসকষের নামগন্দো নেই। বাড়ি যা, বাওয়া বাপের সুপুর– দু-গেলাস বিয়ার স্যাঁটস্যাঁট করে মেরে দে। গায়ে-গত্তি লাগবে। জানটা ত-র-র-র হয়ে যাবে, চোখের সামনে গুল-ই-বাকওয়ালির পাল ফটফট করে ফুটে উঠবে।
আমি পকেট থেকে একটা সস্তার চেয়েও সস্তা সিগার বের করলুম। এদেশে সেটাকে র্যাট কিলার মূষিক নিরোধ খেতাব দেওয়া হয়। কিছু না, রান্নাঘরে ওরই এক টুকরো রেখে দিন। আর দেখতে হবে না পরের দিন গণ্ডাখানেক মড়া ইঁদুর ঘরে-বাইরে পেয়ে যাবেন। ওই সিগারে বার দুই ঠোক্কর মেরেই অক্কা লাভ করেছেন। এই সোনার শহর কলকাতাতেও বিড়িওলার কুঠুরিতে ব্লেক-আউটের মধ্যিখানেও সে দিব্য মূর্তমান। আমার এক মিত্র আকছার ওই মাল আমাকে রুপোর কেস থেকে বের করে সাড়ম্বর প্রেজেন্ট করে জানিনে কোন্ দুরাশায়।
উইলির দিকে এগিয়ে দিয়ে সিরিয়াস গলায় বলতুম, পাক্কা বাকিংহাম পেলেসের সিগার। বহু কষ্টে তোমার জন্য পাচার করেছি। লাও, হল তো?
উইলি পুনরায় সেই ধুয়ো ধরে, কী যে হয় নেকাপড়া করে–বিড়বিড় করতে করতে চলে যেত এক পণ্ডিতের কামরায়। সেখানে লেকচার না ঝেড়ে চাবির গোচ্ছাটা শুধু ঝমঝমাত।
উইলি আর ঘণ্টা দেড়টাক তাড়া দিতে আসত না।
কে বলে শুধু জর্মন মুল্লুকে ঘুষের মতো লুবরিকেনট ভাদ্রবধু?
তবে হ্যাঁ, বলে রাখা ভালো, উইলি সিগারটার সওগাৎ প্রতিবারে নিত না। না নিলে ও আমার ম্যাদ বাড়াত, নিত্যি নিত্যিই।
.
৩৭.
অর্ধশিক্ষিত বহু মার্কিন যে একটিমাত্র জর্মন বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতির কথা শুনেছে সেটি বন শহরে প্রতিষ্ঠিত। এবং সে-খ্যাতির জন্য চোদ্দ আনা শিরোপা পায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিভাগ তরো-বেতেরো ভাষা শেখায় প্রাচীন মিশরীয় বাবিলনীয়, বৈদিক সংস্কৃত থেকে আরম্ভ করে অন্যদিনের মডার্ন জাপানি পর্যন্ত তার নাম ওরিয়েন্টাল সেমিনার। এখানে দুনিয়ার কুলে রকমের ঝোঁপ থেকে নানান রঙের চিড়িয়া আসে হরেক রকমের বুলি শেখার তরে এবং মাঝেমধ্যে অধ্যাপকরা যখন সেমিনারে অনুপস্থিত, তখন যা কিচিরমিচির লাগায় তাতে ধ্বনিশাস্ত্রের জানা-অজানা কোনও আওয়াজই বাদ যায় না। ওদিকে মার্কিনদেশের বাসিন্দাদের জাত আগাপাশতলা সাতান্ন জাতের জগাখিচুড়ি দিয়ে তৈরি। তাই তারা আসে বন শহরে, আর অনেকেই জর্মন দেশের সেরা সেই সেমিনারে বসে পড়ে আপন আপন মাতৃভাষায় খবরের কাগজ। অনেকটা সেই কারণে সেমিনারের কাছেই ছিল একটি খবরের কাগজের হরবোলা কিয়োস। আমরা উইলিমাস্টারকে কাছে পেলে তার হাতে পয়সা গুঁজে দিয়ে বলতুম, ফেরার সময় আমার জন্য সেই খবরের কাগজটা এনে দেবে তো? সেই বলার কারণ ওস্তাদ উইলি পৃথিবীর তাবৎ ভাষা উচ্চারণ করত তার আপন নিজস্ব মৌলিক গাঁইয়া রাইন উচ্চারণে। আমি স্বকর্ণে শুনেছি, সেমিনারের সর্বাধিকারী খুদ ডিরেকটর সায়েব উইলিকে বললেন একখানা টাইমস নিয়ে আসতে। উইলি এক সেকেন্ড চিন্তা করে বললে, ও! টে টিমেস? The Times-এর The জর্মন ভাষায় আইনানুযায়ী উচ্চারিত হয় টে এবং Times উচ্চারিত হবে টিমেস। ধ্বনিতন্ত্রে বাঘা পণ্ডিত অধ্যাপক মেনজেরাটের গুরুরও সাধ্য নেই যে লাতিন অক্ষরে লেখা শব্দ তা সে জর্মন হোক, ইংরেজি হোক বা সাঁওতালিই হোক, জর্মন উচ্চারণে যদি পড়তে হয় তবে মাস্টার উইলির উচ্চারণে খুঁং ধরেন। ভূরি ভূরি উদাহরণ দিয়ে ভাষা বাবদে আমার মতো মূর্খও সপ্রমাণ করতে পারবে যে মাস্টার উইলি আমাদের সেমিনারের লেকচারার হারসিগেনশৃপেকের (নামটা শুনুন স্যর! শব্দার্থ ছাগলের চর্বি) যখন অতিশয় ধোপ-দুরস্ত সুমধুর উচ্চারণসহ রাজসিক জর্মন বলতেন তখন উইলি উপস্থিত থাকলে তার মুখে স্পষ্ট দেখা যেত সে যেন প্রচ্ছন্ন কৌতুক অনুভব করছে। এমনকি যখন প্যারিস, ভিয়েনা, অক্সফোর্ড, হারভার্ডের ইয়া বড়াব্বড়া দাড়িওলা বাঘা বাঘা প্রফেসর পণ্ডিতরা আমাদের সেমিনারে এসে এ দেশের সিঙিমার্কা বিদ্যেবাগীশদের সঙ্গে একটি একটি কথা যেন সদ্য-দাগা কামান ঝেড়ে যে তুমুল বাক-বিতণ্ডার সৃষ্টি করতেন আর উইলি মেস্টার একপ্রান্তে ভুরভুরে খুশবাইয়ের ম-ম-মারা কফি সাজাত তখন তার চেহারা দেখে দিবান্ধ-জনও সম্যক হৃদয়ঙ্গম করত, উইলি একটি সাক্ষাৎ পরমহংস : মিঞা মৌলানাদের বাক্যবর্ষণের ঝরঝর বারিধারা তার রাজহাঁসের পালকের উপর পড়ামাত্রই সঙ্গে সঙ্গে ঝরে যেত। পাঠকমাত্রই অবশ্য এসব শুনে বলবেন, বড় বড় পণ্ডিতদের যুক্তিতর্কে রা আলাপ-আলোচনা উইলি বুঝবে কী করে? কাজেই তার পক্ষে ওই প্রতিক্রিয়াই তো স্বাভাবিক। উত্তরে বলি, প্রবাদ আছে, কাজীর বাড়ির বাদীও দু-কলম জানে। তা জানুক আর না-ই জানুক, এসব ক্ষেত্রে বহুলোক দু-পাঁচটা লবজো কুড়িয়ে নিয়ে বের ন্যায় বিদ্যে জাহির করে। কিন্তু এহ বাহ্য : স্বৰ্গত দ্বিজেন্দ্রলাল ঠাকুরকে স্মরণে এনে তারই আপ্তবাক্যের। পুনরাবৃত্তি করি : প্রকৃত সভ্যতার উপলব্ধির জন্য বিস্তর লেখাপড়া করতে হয় না, কেতাবপত্র ঘাঁটতে হয় না।.. এই যে সেদিন কুষ্টিয়া অঞ্চল রাহুমুক্ত হল, সেই অঞ্চলের গাইয়া লালন ফকিরের গীত নিয়ে কবিগুরু থেকে আরম্ভ করে যেসব তত্ত্বান্বেষী সজ্জন আলোচনা করেছেন তারা সকলেই দ্বিজেন্দ্রনাথের আপ্তবাক্যটিকে বার বার নমস্কার জানিয়েছেন।
সেকথা যাক। আমার মনে কিন্তু একটা ধোকা ছিল। উইলি যদি সত্যই পাণ্ডিত্য বাবদে এতই উদাসীন হয় তবে সে আমাদের জন্য বই জোগাড় করার বেলা এত তুলকালাম কাণ্ড করে কেন? প্রয়োজনমতো আমরা তাকে সকালবেলা যেসব পুস্তক ধার চাই তার একটা ফর্দ দিতুম। সেইটেই নিয়ে সে যেত বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে। এবং ফিরে এসে করিডরে ঢুকতে না ঢুকতে প্রায়ই শোনা যেত তার উচ্চ কণ্ঠস্বর;-অর্থ, কয়েকখানা বই সে পায়নি। আমাদের কেউ কেউ তাকে কখনও-সখনও বোঝাবার চেষ্টা করেছি, সবসময় সব বই পাওয়া যায় হেন লাইব্রেরি ইহসংসারে নেই। আমি স্বয়ং একদিন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলুম, ও-বই না পেলেও আমার কাজ আটকাবে না। উইলি মাস্টার গরগর করে বলেছিল, আটকাবে কেন? বই না হলে কি সংসার চলে না? বই লেখা না হওয়ার আগে কি সংসার চলেনি? ইত্যাদি ইত্যাদি!
১৯৩২-এ পরীক্ষা পাস করে দেশে ফিরলাম। ১৯৩৪-এ ফের বন শহরের সেমিনারে উইলির সঙ্গে দেখা। এবারে আমাকে সেখানে তিনবেলা খেটে মরতে হত না। কিন্তু উইলিকে প্রাচীন দিনের কায়দা অনুযায়ী মাঝে মাঝে একটা সিগার দিতুম। হিটলার তখন দেশের কর্ণধার। তার চেলাচামুণ্ডারা গরম গরম বুলি কপচাচ্ছে। প্রধান বুলি যুদ্ধং দেহি। কিন্তু আজ এই বঙ্গদেশে এখনও বারুদের গন্ধ যায়নি। ও-কথা থাক!
১৯৩৮-এর গরমের ছুটিতে বন শহরে পৌঁছেই গেলুম সেমিনারে পথমধ্যে উইলির সঙ্গে দেখা। ততদিনে নাৎসি আদেশে প্রায় সবাই একে অন্যকে হাইল হিটলার বলে নমস্কার জানায়। গুটেন মর্গেন গুটেন আবেনট উঠে যাওয়ার উপক্রম। অনেকটা যেমন অভ্যাসবশত উইলিকে হাইল হিটলার বলে প্রীতি-অভিবাদন জানালুম। চার বছর পরে দেখা। উইলি সানন্দে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে কাছে এসে কেমন যেন বিষাদভরা গম্ভীর কণ্ঠে বললে, তুমি তো, বাপু, বিদেশি। তুমি আবার হাইল হিটলার করছ কেন? কথাটা সত্য। বিদেশির পক্ষে এ-আইন প্রযোজ্য ছিল না।
বুঝলুম অবশ্য আগেই অনুমান করেছিলুম– উইলি প্রচ্ছন্ন হিটলারবৈরী।
এইবারে লটে যেন আমার কাহিনীর খেই ধরে নিয়ে বললে, উইলি রাজনীতির বড় একটা ধার ধারত না। কিন্তু যুদ্ধ লেগে যাবার পর তখন আর কোথায় রাজনীতি কোথায় কী? গোড়ার দিকে জয়ের পর জয়। চতুর্দিকে হর্ষধ্বনি। বৃদ্ধেরা হিসাব করে দেখালেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তুলনায় এ যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা নগণ্য। তাই সই। কিন্তু তখন কজন জানত জঙ্গল থেকে। পুরোপুরি বেরুবার পূর্বেই আনন্দধ্বনি ছাড়তে নেই : আরম্ভ হল জর্মনির উপর বোমাবর্ষণ। প্রথমটায় বড় বড় শহরের উপর। ওই সময় একদিন ব্ল্যাক-আউটের ঠেলায় আশ্রয় নিতে হল উইলি-পরিবারে। স্বয়ং উইলির তখন দম ফেলার ফুরসত নেই। হেথা-হেথা ট্রেঞ্চ খুঁড়ছে, বুংকার বানাচ্ছে এবং তার সবচেয়ে বড় কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেমিনার বাড়িটাকে যেন হিটলারের আবাসভূমি কিংবা বাকিংহাম প্রাসাদের চেয়েও সুরক্ষিত জিব্রটর-দুর্গে পরিণত করে ফেলতে পারে– সে একা, তার দু-খানা হাত দিয়ে। স্বয়ং লর্ড মেয়ার থেকে আরম্ভ করে ভায়া রেকটর হয়ে, সেমিনারে এই একটিমাত্র নাৎসি, লেকচারার শোডার এস্তেক সে সকলের সঙ্গে ঝগড়াকাজিয়া কান্নাকাটি করে জোগাড় করেছে সেমিনারের বরাদ্দানুযায়ী প্রাপ্যের চেয়ে তিন ডবল মালমশলা; অষ্টপ্রহর বয়ে বেড়াচ্ছে বালির বস্তা, ইট-সিমেন্টের ডাঁই।
লটে বললে, হ্যার উইলি ঘরে ঢুকল মজুরদের এপ্রন গায়ে। সর্বাঙ্গ স্বেদসিক্ত কর্দমাক্ত। কথায় কথায় আমি বললুম, মার্কিনরা যত বুদ্ধ হোক, ওরা তো জানে, বন ইউনিভার্সিটি টাউন, এখানে বন্দুক-কামানের কারবার নেই বললেও চলে। এখানে বোমা ফেলে ওদের কী লাভ?
উইলি একটু শুকনো হাসি হেসে বললে, মার্কিনরা বন শহরটাকে ভালো করেই চেনে। এই সেমিনারেই কত মার্কিন এল-গেল। ডকটরেট পাস করল বাইবেল নিয়ে কাজ করে। আমিও তো অন্তত জনাতিরিশকে চিনি। ওরাই আমাকে বলেছে, তাবৎ মার্কিন মুল্লুকে সবচেয়ে বেশি করে নামকরা এই বন-এর ইউনিভার্সিটি। কিন্তু লড়াইয়ের ব্যাপারে ওরা আকাট। আকাশ থেকে বন শহরটাকে সনাক্ত করবে প্যারিস বলে, ভিয়েনাকে ভাববে ইস্তাম্বুল। আর হাতের তাগ তো জানো। দুনিয়ার সবকিছু এক্কেবারে চাঁদমারীর মধ্যিখানের বুলস-আইয়ের মতো বেধড়ক হিট করতে পারে–সব হিট করতে পারে, শুধু যেটাকে হিট করতে চায়, যেটাকে ভাগ করেছে সেইটে ছাড়া! তাগ করবে বার্লিনের রাইষটগ, বোমা পড়বে বন-এর সেমিনারের উপর।
লটে বললে, আমি জানতুম না উইলি দুরবস্থা দুদৈর্ব নিয়েও পুটকারি করতে পারে। কিন্তু তার কথাই ফলল। ভগবান যে কখন কার মুখ দিয়ে কোন ভবিষ্যদ্বাণী করিয়ে নেন কে জানে। এবং এখনও জানিনে কোন নিশানা তাগ করতে গিয়ে তারা লাগিয়ে দেয় সেমিনারের পাশের বাড়িতে আগুন।
উইলি তো প্রথম আপ্রাণ চেষ্টা দিল আগুনটা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে। যুদ্ধের শেষের দিক-শক্ত জোয়ানসোমথ মদমানুষ কোথায় যে তাকে সাহায্য করবে; আগুন পোঁছে গেল সেমিনার বাড়িতে।
তখনকার দিনের সেই ঘেঁড়াখোঁড়া সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্যে অনেক আগেই উইলি বিস্তর মূল্যবান পুঁথিপত্র পাণ্ডুলিপি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সেমিনারের নিত্যদিনের গবেষণাকর্ম পঠন-পাঠন সিলমোহর সেঁটে তো একেবারে বন্ধ করে দেওয়া যায় না– বিশেষ করে ছাত্রদের অসম্পূর্ণ ডক্টরেটের থিসিস, অধ্যাপকদের পুস্তক। উইলি পাগলের মতো দোতলা-তেতলা উঠছে-নামছে আর দু-হাতে জড়িয়ে ধরে সেসব সেমিনারের দোরের গোড়ায় নামাচ্ছে। তার বউ সেগুলো দূরের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।
সেমিনার বাড়ি তখন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। সবকিছু পুঁথিপত্র কেতাব কাগজের ব্যাপার। পুরনো কেতাবে আবার আর্দ্রতা এক্কেবারেই থাকে না। বারুদ-পেট্রলের পরেই বোধ হয় তারা পুড়ে মরতে জানে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে।
উইলি তখনও ওঠানামা করছে।
উইলির বউ প্রতিবার স্বামীকে উপরে যেতে বারণ করছে। সে-ও প্রতিবার বলে, এই শেষবার, বউ। আর যাব না।
কী আর বলব।
উইলির বউ বলেছিল, হঠাৎ বাড়িটা যেন একসঙ্গে হুড়মড়িয়ে ভেঙে পড়ল। লটে রুমাল বের করে চোখের জল মুছল।
বললে, জানো সায়েড, উইলির বউ আমাকে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিল, শেষবারের মতো উইলি যখন তার বউকে বলে, এই তার শেষ ক্ষেপ, আর উপরে যাবে না, তখন তার গলায় এমন কিছু ছিল যার থেকে বউ বিশ্বাস করেছিল, এর পর আর সে উপরে যাবে না। সে তার কথা রেখেছিল–না? উপরে সে যায়নি–নাবেইনি যখন।
আরেকটা কথা আমার মনে বড় দাগ কেটেছে। উইলির বউ যেসব পাণ্ডুলিপি নিরাপদ জায়গায় এক উঁইয়ের উপর আরেক উঁই ডাম্প করেছিল সেগুলো পরে সরাবার সময় ব্রা পড়ল উইলি ফাস্ট প্রেফরেন্স দিয়ে সক্কলের পয়লা উদ্ধার করেছিল ছাত্রদের অসমাপ্ত অসম্পূর্ণ থিসিস– তার পর অধ্যাপকদের পাণ্ডুলিপি। … তোমাদের, আই মিন, ছাত্রদের সে খুব ভালোবাসত। না! বোধহয় জানত, প্রথম বাচ্চা প্রসব করার মতো স্টুডেন্টদের প্রথম বই– ডক্টরেট থিসিস বিয়োনোটা শক্ত ব্যাপার। আবার সেই বাচ্চা, আই মিন, ওই অর্ধসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিও যদি পুড়ে গিয়ে বিনষ্ট হয়ে যায়। সে তো মারাত্মক গর্ভপাত। প্রফেসরদের তো সে ভাবনা নেই। তাদের কেউ কেউ তো শুনেছি, বছরবিয়েনি– বছরের এ মোড়ে একখানা কেতাব, ওই মোড়ে আরেকখানা।
জ্বলন্ত কেতাব-পুঁথির আগুনে পুড়ে মারা গেল উইলি।
আমার মনে পড়ে গেল আরব পণ্ডিত বহুর উল জাহিজের কথা।*
[*যারা এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার নামে অজ্ঞান, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিবেদন, সে কেতাবে তাঁর মৃত্যুর সন দেওয়া হয়েছে ১৮৬৯। আসলে তার মৃত্যু ৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে।]
মৃত্যুর তিন-চার দিন পূর্বে তার স্বাস্থ্যের একটুখানি উন্নতি দেখা দেওয়াতে তিনি তার স্ত্রীকে অনুরোধ করেন, তাঁকে যেন ধরে তাঁর কাজ করার তক্তপোশে নিয়ে যান। স্ত্রী আপত্তি জানালে তিনি অনুনয় করে বললেন যে, তার বইখানার আর মাত্র কয়েকখানি পাতা লিখলেই বইটি সমাপ্ত হয়।
জাহিজ যে জায়গায় বসে কাজ করতেন তার চতুর্দিকে থাকত দু-চার গজ উঁচু বইয়ের মিনার।* তারই নিচের একখানা টেনে বের করার চেষ্টাতে সে মিনার তো ভেঙে পড়লই, তার ধাক্কাতে আর কটা মিনারের বিস্তর বইয়ের তলায় চাপা পড়লেন জাহিজ। বই সরানো হলে দেখা গেল, বইখানা সমাপ্ত করতে গিয়ে তিনি জানটি খতম করে দিয়েছেন।
[*বঙ্গীয় শব্দকোষের লেখক ঈশ্বর হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই পদ্ধতিতে কাজ করতেন। তার পাণ্ডুলিপির এক ক্ষুদ্র অংশ তিনি তাঁর কঁচা ঘরে রেখে বিদ্যালয়ে পড়াতে যান। ঘরে আগুন লাগাতে তিনি অর্ধোন্মাদ উইলির মতো জ্বলন্ত গৃহে প্রবেশ করতে গিয়ে বাধা পান। হরিচরণের প্রতি নিয়তি– অন্তত উপরের দুই বিষয়ে সদয় ছিলেন। তার পরলোকগতি জাহিজ বা উইলির মতো হয়নি। তিনি অন্ধ হয়ে যান।]
তাঁর জীবনীকার বলেছেন, পণ্ডিতের পক্ষে পুস্তক্যুপের নিচে গোর পাওয়ার চেয়ে শ্লাঘনীয় সমাধি আর কী হতে পারে!
উইলি পণ্ডিত ছিল না। কিন্তু পণ্ডিতদের সেবক, পুস্তক সংরক্ষণের একনিষ্ঠ সাধক। পুস্তক সহমরণে সমাধি লাভ করল– এর চেয়ে শ্লাঘনীয় শেষকৃত্য আর কী হতে পারে।
Leave a Reply