বিক্রয় ও জনসংযোগ প্রতিনিধি হবেন কীভাবে
“সঠিক জনসংযোগের কাজে আমাদের সামাজিক মেলামেশায় কিছু উদ্দেশ্যের স্পর্শ থাকা নেহাতই জরুরি। মানুষকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করতেই হবে।”–হাবার্ট ক্যাসন
“যে বিশেষ ক্ষমতায় কোনো বিশেষ একজন অন্যকে প্রভাবিত করতে পারেন, ঠিক সেই ক্ষমতাকেই আমরা সংক্ষেপে ব্যক্তিত্ব বলে থাকি।”-রয় শেরউড
.
ভূমিকা
আমাদের জাতীয় জীবনে বয়স্ক শিক্ষা আন্দোলন বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, আর এই কাজে সবচেয়ে সক্রিয় ব্যক্তি নিঃসন্দেহে ডেল কার্নেগি। কার্নেগিই বোধহয় আজকের দুনিয়ায় একমাত্র মানুষ যিনি সবচেয়ে বেশি বয়স্কদের লেখার আর বক্তৃতার সমালোচনা করেছেন। রিপ্লের ‘অবিশ্বাস্য’ নামের কার্টুনে প্রকাশ পেয়েছে কার্নেগী প্রায় দেড়লক্ষ বক্তৃতা সমালোচনা করেছেন। সংখ্যাটা শুনে যদি তেমন ধারণা না জন্মায় তাহলে বলি, এর অর্থ হলো কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করার পর যতদিন কেটেছে তারপর জন্মায় তাহলে একটি করে বক্তৃতা।
ডেল কার্নেগির জীবন সত্যিই বিচিত্র মানুষ কোনো মৌলিক ধারণা পোষণ করলে আর তার আগ্রহ থাকলে কি করা সম্ভব এ জীবন তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।
মিসৌরীর এক খামারে, রেললাইন থেকে দশ মাইল দূরে জন্মানোর পর তিনি বারো বছর বয়সের আগে কোন গাড়ি দেখেন নি। অথচ প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পৌঁছনোর পর পৃথিবীর সর্বত্রই তাঁর পরিচিতি।
এই মানুষটি প্রথম জীবনে প্রায় আধ ডজন বার জনগণের সামনে কথা বলতে গিয়ে ব্যর্থ হন, অথচ তিনিই হন আমার ব্যক্তিগত ম্যানেজার। আমার সাফল্যের অনেকখানিই ডেল কার্নেগির শিক্ষার ফলেই হয়েছে।
তরুণ কার্নেগি শিক্ষার জন্য প্রচণ্ড সংগ্রাম করেছিলেন। গোড়ার তাকে পড়ে থাকতে হয় উত্তর পশ্চিম মিসৌরীর ভাঙাচোরা সেই খামারে। হতাশায় মরীয়া হয়ে কার্নেগিপরিবার মিসৌরীর কাছে। ওয়ারেনসবুর্গের স্টেট টিচার্স কলেজের কাছে আর একটা খামার কেনেন।
ওই কলেজে প্রায় ছ’শ ছাত্র ছিলো। কার্নেগির এমন টাকা ছিলো না যাতে শহরে থাকা সম্ভব। তিনি দেখলেন কলেজে সেই ছাত্রদেরই রমরমা, যারা ফুটবল আর বেসবল খেলে বা যারা বিতর্ক আর লোকজনের সামনে বক্তৃতা দিয়ে বিজয়ী হয়।
খেলাধুলোয় কোন দক্ষতা নেই বুঝেই কার্নেগি বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় জয়ী হবেন ভাবলেন। মাসের পর মাস তিনি বক্তৃতা তৈরি করে চললেন।
কিন্তু এতো প্রাণপণ চেষ্টা, হারের পর হারের ফলে বৃথাই গেল। তারপর আচমকা তিনি জয়ী হতে আরম্ভ করলেন। কলেজের সব প্রতিযোগিতাতেই তার জয় হল। অন্য সব ছাত্ররাও এরপর তাকে শিক্ষা দিতে অনুরোধ জানাতে আরম্ভ করল আর তারাও জয়ী হল।
গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর পশ্চিম নেব্রাসকা আর পূর্ব উইণ্ডমিঙে তিনি ডাকযোগে শিক্ষার পাঠক্রম বিক্রি শুরু করেন। প্রচুর পরিশ্রম করেও তেমন সাফল্য এলোনা। জীবন ধারণের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে নানা জীবিকা গ্রহণ করতে হল কার্নেগীকে। বিক্রয় প্রতিনিধি হয়ে প্যাকার্ড কোম্পানির ট্রাক বিক্রি তার মধ্যে অন্যতম।
সেই সময় কার্নেগির মতো অসুখী মানুষ বোধহয় আর ছিল না। প্রতিদিনের জীবন তার কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠল। তাঁর জীবনের আকাঙক্ষা ছিল বই লিখবেন, যে বই লেখার স্বপ্ন তিনি কলেজে পড়ার দিনগুলোয় দেখতেন। শেষপর্যন্ত তাই তিনি কাজে ইস্তফা দিয়ে দিলেন। মনে মনে কার্নেগি ঠিক করলেন গল্প, উপন্যাস লিখতে সুরু করবেন আর রাতের স্কুলে শিক্ষাদান করে জীবিকা নির্বাহ করবেন।
কিন্তু কী শিক্ষা দেবেন? কলেজ জীবনের দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করে কার্নেগীর মনের পটে জেগে উঠলো বক্তৃতা দেবার শিক্ষাই তাঁকে একমাত্র আত্মবিশ্বাস দিতে পেরেছিলো। এরই মধ্যে তিনি লাভ করেছিলেন সাহস, গতিশীলতা আর ব্যবসা জগতের অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষমতা। এই কথা স্মরণ করেই কার্নেগি নিউ ইয়র্কের সমস্ত ওয়াই.এম.সি. এ. স্কুলে বাণিজ্য জগতে মানুষের বক্তৃতাদান শেখানোর ক্লাসে শিক্ষকের কাজের জন্য আবেদন জানালেন।
ব্যাপার কী? ব্যবসায়ীদের বক্তা হিসেবে গড়ে তোলা? অসম্ভব! এটা তারা ভালোই জানেন যে এরকম হতে পারে না। আগে এ চেষ্টা চালিয়ে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।
স্কুল কর্তৃপক্ষ যখন তাকে প্রতিরাতে মাত্র দু ডলার মাইনেও দিতে রাজি হলেন না, কার্নেগি তখন মোট লাভের উপর কমিশনে কাজ নিতে রাজি হলেন–অবশ্য লাভ আদৌ হলে। আশ্চর্য ঘটনা হল, মাত্র তিনবছরে কর্তৃপক্ষ তাকে প্রতিরাতে দু ডলারের বদলে তিন ডরার দিতে থাকেন।
পাঠক্রম বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ক্রমে অন্য শহরের স্কুলও এ কাহিনী শুনল। ডেল কার্নেগি নিউ ইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, বাল্টিমোর, লন্ডন, প্যারী–সর্বত্রই খ্যাতিমান হয়ে উঠলেন। যারা তাঁর পাঠক্রমের প্রতি আগ্রহী ছিলেন তাঁদের জন্য ভালো কোন পাঠ্য পুস্তক ছিল না। কিন্তু তাতে উদ্যম হারান নি কার্নেগী–তিনি নিজেই একখানা বই লিখে ফেললেন ‘জনগণের সামনে বক্তৃতা ও বাণিজ্য জগতে প্রভাব বিস্তার।‘ আজ সেই বই সমস্ত ওয়াই এম. সি. এ., আমেরিকান ব্যাঙ্কার্স অ্যাসোসিয়েশন অব ন্যাশনাল ক্রেডিট মেনস্ অ্যাসোসিয়েশনের সরকারী পাঠ্যপুস্তক।
আজ ডেল কার্নেগীর পাঠক্রমের ছাত্র সংখ্যা অন্য যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতা পাঠক্রমের ছাত্র সংখ্যার চেয়ে বেশি।
ডেল কার্নেগির দাবি যে কোন মানুষই ক্ষেপে গেলে কথা বলতে পারে। তার মত হল আপনি যদি শহরের সবচেয়ে অজ্ঞ লোককেও মুখে ঘুসি মারেন, সে উঠে দাঁড়িয়ে উন্মত্তের মতই চিৎকার করে মনোভাব প্রকাশ করবে। তিনি আরো বলেন, যে-কোনো মানুষই আত্মবিশ্বাস থাকলে জনগণের সামনে সংলাপে সক্ষম। শুধু তার মনের অভ্যন্তরে আকাঙক্ষা যদি টগবগ থাকে।
আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার পথ তার মতে হল, যে কাজে আপনার ভীতি আছে সেই কাজই করা। এই জন্যই তিনি তাঁর পাঠক্রমের ক্লাসে প্রত্যেককে অল্পবিস্তর বক্তৃতা দিতে বলে থাকেন। শ্রোতারাও সহানুভূতিশীল-কারণ তাঁরা সবাই একই নৌকার যাত্রী। একমাত্র ধারাবাহিক অনুশীলনই সাহস, আত্মবিশ্বাস আর আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে পারে।
ডেল কার্নেগী আপনাদের বলবেন যে তিনি আজ পর্যন্ত এই বক্তৃতা দান শিক্ষা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কিন্তু তিনি অন্য একটা দাবীও করবেন, আর তাহল তার প্রধানতম কাজ মানুষের ভয় দূর করে সাহস জাগিয়ে তোলা।
কার্নেগীর সব ছাত্রই হলেন ব্যবসা জগতের মানুষ। এই জন্যই তারা চাইতেন দ্রুত কোন ফলাফল। যাতে তাদের শিক্ষাকে তারা কাজে লাগতে পারেন। কার্নেগি সে কাজে যে সম্পূর্ণ সফল আজ তাঁর পাঠক্রমের অভাবিত জনপ্রিয়তাই সেকথা প্রমাণ করে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম জেম্স বলেছিলেন, সাধারণ মানুষের সুপ্ত মানসিক ক্ষমতার মাত্র শতকরা দশভাগই জাগিয়ে তোলা সম্ভব। ডেল কার্নেগি বয়স্কদের সুপ্ত ক্ষমতা জাগিয়ে তুলে অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়েছেন।
লাওয়েল টমাস
Leave a Reply