বাদশাহী আমল – বিনয় ঘোষ
বাদশাহী আমল – বিনয় ঘোষ
ফরাসী পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত Travels in the Mogul Empire (1656-1668 A.D.) অবলম্বনে
প্রথম প্রকাশ ১৯৫৭
সূচিপত্র
- প্রাক-কথন
- অনুবাদ প্রসঙ্গে
- ভূমিকা
ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের - রাজপুত্রকন্যাদের কথা
দারাশিকোর চরিত্র—সুলতান সুজার চরিত্র—ঔরঙ্গজীবের চরিত্র—মুরাদের চরিত্র—বেগমসাহেবার প্রকৃতি—দেশভেদে প্রেমের কৌশল বর্ণনা—কনিষ্ঠা রৌশনআরার প্রকৃতি। - গৃহযুদ্ধোত্তর ঘটনা
তাতার দূতের কথা—ডাচ দূতের কাহিনি—ঔরঙ্গজীবের চরিত্রের অন্যদিক—খোজার বিচিত্র প্রেমকাহিনি—রাজকুমারীর প্রেম—আরও পাঁচজন দূতের কথা—হাবসি দেশের কথা—সুলতান আকবরের শিক্ষাব্যবস্থা—পারস্যের দূত—ঔরঙ্গজীবের শিক্ষাগুরু মোল্লা শাহের কাহিনি—গণৎকারদের মজার গল্প—হিন্দুস্থানের ব্যক্তিগত সম্পত্তি—সম্রাট সাজাহানের চরিত্র—মগ ও পর্তুগিজ বোম্বেটেদের কথা—ঔরঙ্গজীবের মহত্ত্ব। - হিন্দুস্থান প্রসঙ্গে
মঁশিয়ে কলবার্টের কাছে লেখা বার্নিয়েরের পত্র—হিন্দুস্থানের দেশীয় রাজাদের কথা—রাজপুতদের শৌর্যবীর্য—’মোগল’ কাদের বলা হয়?—মোগল সেনাবাহিনীর কথা—ওমরাহদের কথা—সম্রাটের বিলাসভ্রমণ—মনসবদারের মর্যাদা—রৌজিনদার বা পদাতিক ও বন্দুকচি—গোলন্দাজ—বাহিনী—মোগলদের ধনদৌলত—হিন্দুস্থানের দারিদ্র্যের কারণ—আর্থিক অবনতির কারণ কি?—শিল্পী ও শিল্পকলার অবস্থা—শিক্ষা ও বাণিজ্যের অবস্থা—হিন্দুস্থান ও অন্যান্য দেশ—বিচারের সুযোগ। - দিল্লি ও আগ্রা
মঁশিয়ে ভেয়ারের কাছে লিখিত বার্নিয়ের পত্র—পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য শহর—দিল্লির কাহিনি—দুর্গের অভ্যন্তর—বাজারের গণৎকার—পর্তুগিজ গণৎকার—বাইরের শহর—মধ্যযুগের শহর—দোকানপত্তরের কথা—ভোজনের বিবরণ—কারিগরদের কথা—রাজপ্রাসাদের বর্ণনা—কারখানার বর্ণনা—আমখাসের কথা—সম্রাট সন্দর্শনের প্রথা—মোসাহেবির নমুনা—গোসলখানার বর্ণনা—হারেমের বর্ণনা—আমখাসের উৎসব—হারেমের মেলার বর্ণনা—কাঞ্চনবালার কাহিনি—বার্নার্ড বৃত্তান্ত—হাতির লড়াই—দিল্লির মসজিদ ও সরাই—দিল্লির লোকজন—আগ্রার কথা—আগ্রার পাদরি সাহেব—জাহাঙ্গীরের খ্রিস্টান প্রীতি—খ্রিস্টান ও ইসলামধর্ম—ডাচ বণিকদের কথা—আগ্রার তাজমহল। - হিন্দুস্থানের হিন্দুদের কথা
ফরাসি ও ভারতীয় সূর্যগ্রহণ—পুরীর জগন্নাথ—সতীদাহ ও সহমরণ—সাধুসন্ন্যাসী ফকিরদের কথা—হিন্দুশাস্ত্রের কথা—সংস্কৃত চর্চা ও কাশীধামের কথা—হিন্দুদের চিকিৎসাবিদ্যা—হিন্দুদের জ্যোতির্বিদ্যা—হিন্দুদের ভৌগোলিক ধারণা—হিন্দু দেবদেবীর কথা—হিন্দুদের কালগণনা—সুফিদের ধর্ম ও দর্শন। - সোনার বাংলা
বাংলাদেশের সম্পদপ্রসঙ্গে—বাংলাদেশের আহার্যের প্রাচুর্য—বাংলাদেশের প্রতি বিদেশিদের আকর্ষণের কারণ—বাংলার জলবায়ু—বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য—মগ দস্যুদের অত্যাচারের কাহিনি—পিপলি বন্দর থেকে হুগলির পথে বার্নিয়ের। - পরিশিষ্ট
‘বাদশাহী আমল’ কয়েক বছর পুনর্মুদ্রিত হয়নি। বর্তমানের বোঝার চাপে অতীতের বাদশাহী আমলের কথা মনেই পড়েনি। মনে পড়ল ‘অরুণা প্রকাশনী’র জন্য এবং সেজন্য তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
মুদ্রণকালে আমি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ি, নভেম্বর ১৯৭৭ থেকে জানুয়ারি ১৯৭৮ পর্যন্ত। তাই আমার পক্ষে কপি বা প্রুফ কোনোটাই দেখা বা সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। মোটামুটি আমার নির্দেশে প্রকাশকরাই সেই দায়িত্ব বহন করেছেন। কিন্তু ভুলত্রুটি যদি কিছু থাকে, ঐতিহাসিক তথ্যের বা বিষয়ের তাহলে তার জন্য দায়ী আমি, প্রকাশক নন।
‘বাদশাহী আমল’ প্রায় তিনশো বছর আগেকার কথা। তবু আজকের দিনেও বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্বে, সেই পুরোনো যুগের কথা রূপকথা মনে হবে না। তার কারণ জিনিসপত্রের মূল্য ছাড়া, যাকে ‘লাইফ—স্টাইল’ বলে সেইদিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, আজও আমরা নতুন এক ‘বাদশাহী আমলে’ বাস করছি, যদিও বাদশাহ সাজাহান বা ঔরঙ্গজীব কেউ আজ জীবিত নেই।
বিনয় ঘোষ
বৈশাখ ১৩৮৫
এপ্রিল ১৯৭৮
পরিমার্জিত সংস্করণ প্রসঙ্গে প্রকাশকের কথা
‘বাদশাহী আমল’ প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় চৈত্র ১৮৭৯ শকাব্দে। প্রথম সংস্করণ—এ পরিবেশক ছিলেন সিগনেট বুক সপ। প্রকাশকের নাম পাওয়া যায়নি। পরের দুটি সংস্করণ প্রকাশ করেন অরুণা প্রকাশনী। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশ করেন প্রকাশ ভবন।
নতুন করে প্রকাশ করার সময় আমাদের অবলম্বন করতে হয়েছে পূর্ব প্রকাশের মুদ্রণ। কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ লক্ষ করা যায়। সে-সব সাধ্যমতো সংশোধন করা হয়েছে। এবং লেখক ও তাঁর লেখাকে যথাযথ মর্যাদা দিতে আমরা যত্ন নিয়েছি ছাপা ও সামগ্রিক প্রকাশনার বিষয়ে। নির্ঘণ্ট প্রস্তুত করেছেন শ্রী সত্যব্রত ঘোষাল। আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
“One can read nothing more brilliant, vivid and striking than old Francois Bernier (Nine years’ physician to Aurangzeba)” Karl Marx.
বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তের সম্পূর্ণ অনুবাদ করিনি। সম্পূর্ণ অনুবাদ করার কোনো সার্থকতা আছে বলে আমার মনে হয় না। অনুবাদ না বলে বরং ‘বাদশাহী আমল’ বার্নিয়ের অবলম্বনে রচিত বলা যায়। সেকালের সব ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্যে এমন অনেক বিষয়ের বিবরণ পাওয়া যায়, যার বিশেষ ঐতিহাসিক মূল্য বর্তমানে নেই। যেমন যুদ্ধযাত্রার বিবরণ, কি রাজনৈতিক ঘটনাবর্তের যান্ত্রিক বিবরণ। এ—সবের যে কোনো ঐতিহাসিক মূল্য নেই, এমন কথা বলব না। যেমন, যুদ্ধযাত্রার বিবরণের মধ্যে সেযুগের সামরিক ইতিহাসের অনেক উপাদান আছে। কিন্তু আমার বক্তব্য হল, যেটুকু আছে তা বার্নিয়েরের বৃত্তান্ত থেকে এখানে অনুবাদ করে দেবার কোনো প্রয়োজন নেই। মুসলমানযুগের যে—কোনো প্রামাণ্য ইতিহাসের বইয়ে সে—সব বৃত্তান্ত পাওয়া যাবে। যা নেই, তা হল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উপকরণগুলি। সামাজিক ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণের জন্যই বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্ত ইতিহাস সাহিত্যে স্থায়ী আসন দখল করে রয়েছে। যাঁরা মোগলযুগের ইতিহাস নিয়ে বিশেষভাবে অনুশীলন করেছেন, তাঁরা সকলেই একবাক্যে বার্নিয়ের সম্পর্কে একথা বলেছেন। আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে, ১৮৫৩ সালে, কার্ল মাক্স ও ফ্রিডরীশ এঙ্গেলসের মত সমাজ—বিজ্ঞানীরাও বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে কুণ্ঠিত হননি। কার্ল মার্ক্স একখানি পত্রে এঙ্গেলসকে লিখেছিলেন : “…One can read nothing more brilliant vivid and striking than old Francois Bernier (nine years’ physician to Aurangzeba)” : পত্রের উত্তরে এঙ্গেলস লিখেছিলেন : “Old Bernier’s things really very fine. It is a real delight once more to read something by a sober old clear headed Frenchman, who keeps hitting the nail on the head”… বার্নিয়ের প্রসঙ্গে এই পত্র দু—খানির ঐতিহাসিক বিশ্লেষনমূল্য খুব বেশি বলে, ‘ভূমিকা’র মধ্যে আমি সম্পূর্ণ অনুবাদ করে দিয়েছি।*
মনীষীরা যার জন্য বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তকে মূল্যবান সম্পদ বলে মনে করেন, সামাজিক ইতিহাসের উপকরণের জন্য, তার সমস্ত অংশ সযত্নে সংকলন করে অনুবাদ করেছি। সেইজন্য প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ের—(The History of the late Rebellion in the States of the Great Mogol এবং Remarkable Occurrences after the War)– নির্বাচিত অংশের ভাবানুবাদ করেছি। কেবল সেই অংশগুলির অনুবাদ করেছি যার মধ্যে সামাজিক ইতিহাসের মালমশলা আছে, বাকি অংশ নিছক ঘটনাপ্রধান বলে বাদ দিয়েছি। ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হল বার্নিয়েরের পত্রগুলি। সেই কারণে পত্রগুলি সম্পূর্ণ অনুবাদ করেছি। কেবল কাশ্মীরের যুদ্ধযাত্রার বিবরণ—সম্বলিত পত্রগুলির অনুবাদ করিনি। এই পত্রগুলির মধ্যে যেটুকু সামাজিক ইতিহাসের উপাদান আছে, কার্ল মার্ক্স তাঁর পত্রে তা উল্লেখ করেছেন। ‘ভূমিকা’য় সেই পত্রের অনুবাদ করে দিয়েছি।
সংক্ষেপে বলা যায়, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধের, বাদশাহী আমলের সামাজিক ইতিহাসের যা—কিছু সংকলনযোগ্য মূল্যবান উপাদান বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্যে আছে, তার সবটাই আমি সম্পূর্ণ অনুবাদ করেছি। আমাদের দেশের ইতিহাস—সাহিত্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অভাব খুব বেশি। ঐতিহাসিকরা রাজসিংহাসনের কাড়াকাড়ির দিকে যতটা দৃষ্টি দিয়েছেন, সিংহাসন ও রাজদরবারের বাইরে বৃহত্তম লোকসমাজের দিকে ততটা দৃষ্টি দেননি। যতদিন তা না দেবেন ততদিন ইতিহাস সম্বন্ধে দেশের লোকের বিভীষিকা দূর হবে না এবং ইতিহাসও প্রকৃত ইতিহাস বলে গণ্য হবে না। সেই কথা মনে করেই, মধ্যযুগের ভারতের একখানি প্রামাণ্য মূল ঐতিহাসিক বিবরণের অনুবাদ করেছি। এই ধরনের আরও অনেক মূল ভ্রমণবৃত্তান্তের ও স্মৃতিকথার অনুবাদ করার প্রয়োজন আছে। যোগ্য ব্যক্তিরা যদি সেগুলি একে একে বাংলায় অনুবাদ করেন, তাহলে বাংলা ভাষার ও বাংলা সাহিত্যের উন্নতি ছাড়া অবনতি হবে না। বরং তাতে আমাদের দৈন্য ঘুচবে।
অনুবাদপ্রসঙ্গে দু—একটা কথা বলবার আছে। ইংরেজিতে যাকে literal translation বা আক্ষরিক অনুবাদ বলে, আমার সে—অনুবাদে কোনো আস্থা নেই। অনুবাদ মানে ‘ভাষান্তর’। প্রত্যেক ভাষার নিজস্ব পদবিন্যাস, বাক্যরীতি ও বাচনভঙ্গি আছে। ইংরেজিতে যা এককথায় বলা যায়, বাংলায় হয়ত তা দশকথায় বলতে হয়। আমি সেইভাবে বার্নিয়েরের কথা ভাষান্তরিত করেছি। সবসময় এইটুকু লক্ষ্য রেখেছি যাতে বার্নিয়েরের কোনো বক্তব্য বিকৃত না হয়। যথাযথ অনুবাদ বলতে যদি অবিকৃত ভাষান্তর বোঝায়, তাহলে যথাযথ অনুবাদ করতে আমি কোথাও চেষ্টার ত্রুটি করিনি। এতেও যাঁরা সন্তুষ্ট হবেন না, তাঁরা মূল ফরাসি ভাষায় লিখিত (কারণ ইংরেজিও অনুবাদ) গ্রন্থ পড়তে পারেন। যে—গ্রন্থ অবলম্বন করে আমি অনুবাদ করেছি, তা ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থ—Travels in the Mogul Empire (A.D. 1665-1668) : By Francois Bernier : Second Edition, Revised by Vincent A. Smith (Oxford 1914).
অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে ‘মাসিক বসুমতী’ পত্রিকায় (আশ্বিন ১৩৫৯ থেকে অগ্রহায়ণ ১৩৬১ পর্যন্ত) প্রকাশিত হয়। ‘মাসিক বসুমতী’র সম্পাদকের কাছে সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। অনুবাদ প্রসঙ্গে অন্যান্য বিষয় ‘ভূমিকায়’ বলেছি।
বিনয় ঘোষ
চৈত্র ১৩৬৩
* পরিশিষ্টে মার্কস-এঙ্গেলস্-এর চিঠির ইংরেজি অনুবাদ (মস্কো সংস্করণ) দ্রষ্টব্য।
‘ইতিহাস’ বলতে আমরা আজকাল যা বুঝি, একশো বছর আগেও সেরকম ইতিহাস লেখা হত না। ইতিহাসের লক্ষ্য কি, ইতিহাস রচনার পদ্ধতি কি, এসব সম্বন্ধে সেকালের পণ্ডিতদের কোনো স্পষ্ট ধারণাও ছিল না। সেইজন্য ‘প্রাচীনযুগ’ ও ‘মধ্যযুগে’র কোনো লিখিত ইতিহাস বিশেষ নেই, অন্তত ‘ইতিহাস’ বলতে আমরা এখন যা বুঝি তার কোনো নিদর্শন নেই। সেদিন পর্যন্ত ইতিহাস বলতে ঘটনাপঞ্জি, তারিখের ফিরিস্তি, বংশপরিচয়, রাজা—বাদশাহের রোমাঞ্চকর কাহিনি ইত্যাদি বোঝাত। ঘটনা ও তারিখ কোনোটাই অবশ্য ঐতিহাসিকের কাছে উপেক্ষণীয় নয়। ঘটনার ‘ক্রম’—ই ইতিহাস, এবং কালক্রম ও কালের পটভূমি ছাড়া ঘটনা অর্থহীন সংগতিহীন। সুতরাং ঘটনাও ঐতিহাসিকের কাছে অত্যন্ত মূলবান। কিন্তু তাহলেও ইতিহাস শুধু ঘটনাক্রম বা তারিখের ফিরিস্তি নয়—যুগের কথা, যুগের চলার গতি, রীতিগীতি, আচার—ব্যবহার, বিধিব্যবস্থার কথা, যুগ থেকে যুগান্তরে যাত্রার উত্থান—পতনের কথা—এই হল ইতিহাস। ইতিহাস সম্বন্ধে আগেকার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে এবং এই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাস—রচনা সবেমাত্র শুরু হয়েছে বলা চলে। দৃষ্টিকোণ ও রচনাপদ্ধতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে আজও মতভেদ থাকলেও ইতিহাস যে শুধু ঘটনাক্রম, রাজা—বাদশাহের বংশচরিত ও জীবনচরিত নয়, একথা প্রায় সকলেই স্বীকার করেন। দেশের কথা, দেশের লোকের কথা, সর্বশ্রেণির ও সর্বস্তরের লোকের জীবনযাত্রা ও ধ্যানধারণার কথা নিয়েই ইতিহাস। কিন্তু এ হল ইতিহাস দর্শনের কথা, এখানে এ—বিষয় আলোচ্য নয়।
ইতিহাস—রচনার উপাদান কি এবং কোথায় তার সন্ধান পাওয়া যায়? দেশের মধ্যে আজও যেসব ‘অসভ্য’ আদিমজাতির বাস আছে, তাদের জীবনযাত্রা, সমাজব্যবস্থা, ধর্মকর্ম, ভাষা, ব্যবহার্য হাতিয়ার, জিনিসপত্র ইত্যাদি নিয়ে অনুসন্ধান করে নৃতত্ত্ববিদরা (Anthropologists) আদিমযুগের ইতিহাস রচনা করেছেন। শিলালেখ, প্রাচীন মুদ্রা, আসবাবপত্তর, শিল্পকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি উপাদানের সাহায্যে প্রত্নতত্ত্ববিদরা (Archaeologists) প্রাচীনযুগের ইতিহাসের কাঠামো তৈরি করেছেন। প্রাচীন সাহিত্য, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণকথা, লোককাহিনি ইত্যাদির সাহায্যে ঐতিহাসিকরা তার ওপর চুন—বালি—রঙের প্রলেপ দিয়েছেন। এই একই উপাদান নিয়ে মধ্যযুগের ইতিহাসও রচিত হয়েছে। এছাড়া মধ্যযুগের ঐতিহাসিক উপাদানের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল ‘রাজবংশ পরিচয়’ ‘জীবনচরিত’ ও ‘স্মৃতিকথা’। পর্যটকদের ‘ভ্রমনকাহিনী’ বোধ হয় তার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান। বর্তমান যুগে ইতিহাস রচনার পথও প্রশস্ত, উপাদানও পর্যাপ্ত। বর্তমান যুগ বলতে ছাপাখানার যুগকেই বোঝায়। ছাপাখানার দৌলতে যাবতীয় বিষয় ও ঘটনার বিবরণ মুদ্রিত থাকে—নানাবিধ রিপোর্টে, গ্রন্থে ও পত্রিকাদিতে। সুতরাং ঐতিহাসিক মালমশলার কোনো অভাব নেই, এবং সেইসব মালমশলা সংগ্রহ করারও কোনো অসুবিধা নেই। ছাপাখানার আগের যুগে তা ছিল না, অর্থাৎ আমাদের দেশে দুশো বছর আগে, ইয়োরোপে পাঁচশো বছর আগে। ইতিহাসের উপাদান তখন নানাজায়গা থেকে সংগ্রহ করতে হত, তার মধ্যে পর্যটকদের ‘ভ্রমণকাহিনী’ অন্যতম। তিন—চারশো বছর আগেও সেইসব ‘ভ্রমণকাহিনী’ ছাপা সম্ভব ছিল না, ‘পাণ্ডুলিপি’র আকারেই থাকত, এমন কি ইয়োরোপেও। যেমন বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্ত। ১৬৫৮ সাল থেকে ১৬৬৭ সাল পর্যন্ত বার্নিয়ের ভারতের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন। ফ্রান্সে, অর্থাৎ স্বদেশে ফিরে গিয়ে, ১৬৭০ সালে তিনি ফরাসি সম্রাট ত্রয়োদশ লুইর কাছ থেকে তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত ছেপে প্রকাশ করার অনুমতিপত্র পান।
ভারতীয় ইতিহাসে বিদেশি পর্যটকদের দান
ভারতীয় ইতিহাসে বিদেশি পর্যটকদের দান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বোধহয়, পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত পর্যটক আসেননি, এবং দেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে এত ভ্রমণবৃত্তান্তও লিপিবদ্ধ করে যাননি। ভারতের রাজা—বাদশাহ, ভারতের বৌদ্ধধর্ম, ভারতের ঐশ্বর্য, ভারতের শিল্পকলা, ভারতের শাস্ত্রচর্চা, ভারতের অফুরন্ত প্রাকৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পদ যুগে—যুগে বিদেশিদের আকর্ষণ করে টেনে এনেছে—রাজসিংহাসনের লোভে, অর্থের লোভে, জ্ঞানবিদ্যার লোভে। তাঁদের মধ্যে পর্যটকও এসেছেন অনেক, পূব থেকে পশ্চিম থেকে। গ্রিক চিনা মুসলিম ইয়োরোপীয়—সকল জাতের, সকল দেশের পর্যটক এসেছেন ভারতবর্ষে। কেউ মনে করেছেন এ—দেশকে জ্ঞানবিদ্যা ও ধর্মসাধনার মহাতীর্থ, কেউ বা মনে করেছেন ধনরত্নসম্ভার লুণ্ঠনের স্বর্গরাজ্য। প্রাচীনযুগে চিনা পর্যটকরা এসেছিলেন প্রধানত ভারতের মহান ধর্ম ও সংস্কৃতির মহিমায় মুগ্ধ হয়ে, কিন্তু মধ্যযুগে ইয়োরোপীয় পর্যটকরা এসেছিলেন ধনরত্নের লোভে। তার আগে গ্রিক ও রোমান পর্যটকরা এসেছিলেন ধর্ম ও অর্থ, সংস্কৃতি ও সম্পদ, দুয়েরই লোভে নাবিকের বেশে, বণিকের বেশে, রাজদরবারের দূতের বেশে। তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিবরণ প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ রয়েছে। সকলেই জানেন, গ্রিকদূত মেগাস্থিনিসের (Megasthenes) ভারত—বিবরণ না থাকলে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনা করা কত কঠিন হত। তাও তো মেগাস্থিনিসের ভারত—বিবরণ না থাকলে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনা করা কত কঠিন হত। তাও তো মেগাস্থিনিসের আসল পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গিয়েছিল, পরবর্তী লেখকদের বিস্তৃত উদ্ধৃতি থেকেই তার পরিচয় পেয়েছি আমরা। বিশেষ করে রোমান ভৌগোলিক স্ট্র্যাবোর (Strabo) কাছে এর জন্য আমার ঋণী। মেগাস্থিনিসের আগে আলেকজাণ্ডারের নৌ—সেনাপতি নিয়ার্কাসও (Nearchus) ভারতের কথা কিছু—কিছু লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাও আমরা উদ্ধৃতি—আকারে পেয়েছি। এখন J.W. Mc-Crindle-এর Ancient India as described by Megasthenes and Arrian (১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে) গ্রন্থ থেকে মেগাস্থিনিসের ভারত—বিবরণ পরিস্কার জানতে পারা যায়। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে জনৈক আলেকজেন্ড্রিয়ান নাবিক হিপ্পলাস) ভারতীয় উপকূল ঘুরে (উত্তর—পশ্চিম, দক্ষিণ—পশ্চিম ও দক্ষিণ—পূর্ব উপকূল) ‘Periplus Maris Erythroel’ *নামে যে guide-book লিখে গেছেন, প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের উপাদান হিসাবে তারও মূল্য অনেক (এ বিষয়ে Schoff-এর ‘The Periplus of the Erythrean Sea’ পঠিতব্য)। এইসব গ্রিক ও রোমান নাবিক দূত সেনাপতি ও পর্যটকদের পর চিনা পরিব্রাজকদের ভারতবৃত্তান্তের কথা উল্লেখ করতে হয়। খ্রিস্টীয় চতুর্থ—পঞ্চম শতাব্দী থেকে প্রায় নবম শতাব্দী পর্যন্ত একাধিক চিনা পরিব্রাজক ভারতে এসেছিলেন—
ফা হিয়েন (Fa Hian) : ৩৯৯ খ্রি.-৪১৪ খ্রি.
ইউয়ান চোয়াং (Yuan Chawing) : ৬২৯ খ্রি.-৬৪৫ খ্রি.
আই সিং (I-tsing) : ৬৭১-৬৯৫ খ্রি.
সুঙ উন্ (Sung Yung) : ৬০০ খ্রি-৮০০ খ্রি
হুয়ি সেঙ (Hwi Seng) : ৬০০ খ্রি-৮০০ খ্রি
ও কুঙ (O Kung) প্রভৃতি।
এই চিনা পরিব্রাজকদের ভ্রমণবৃত্তান্ত প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের অপরিহার্য উপাদান। বিশেষ করে ফা হিয়েন ও ইউয়ান চোয়াঙের (হুয়েন সাঙ) ভ্রমণ—বৃত্তান্ত না থাকলে সে যুগের ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাস উদ্ধার করা যে কত কষ্টসাধ্য হত তা কল্পনা করা যায় না। এই ভ্রমণবৃত্তান্ত যাঁরা বিস্তৃতভাবে জানতে চান তাঁরা ফা হিয়েনের ‘Travels’ ও Watter-এর ‘Yuan Chwan’ গ্রন্থ পাঠ করতে পারেন। ভারতীয় ইতিহাসের এই প্রাথমিক উপাদানগ্রন্থের অনুবাদ কোনো ভারতীয় ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে কি না আমি জানি না, তবে বাংলায় ইউয়ান চোয়াঙের একখানি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে ‘বিশ্বভারতী’ থেকে। এ কাজ যদি কেউ ধৈর্য ধরে করেন তাহলে বাংলা সাহিত্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ হতে পারে।
প্রাচীন হিন্দুযুগ পর্যন্ত ভারতীয় ইতিহাসে বিদেশি পর্যটকদের দান সম্বন্ধে মোটামুটি এই হল সংক্ষিপ্ত পরিচয়। মুসলমানযুগে ইয়োরোপীয় ও মুসলিম পর্যটক অনেকে আসেন ভারতবর্ষে। মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য হলেন ইবন বতুতা (Ibn Batuta–‘the traveller of Islam’)। ইবন বতুতা (১৩৪২—১৩৪৭ খ্রি.) ভারতে আসেন মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে। তুঘলক—যুগের ভারত সম্বন্ধে বতুতার বিবরণের মধ্যে অনেক মূল্যবান ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সম্বন্ধেও অনেক কথা বতুতা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। পণ্ডিত হরিনাথ দে মূলগ্রন্থ থেকে তা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন (Description of Bengal : Ibn Batuta : Translated by Harinath De)। ইয়োরোপীয় পর্যটকদের মধ্যে মার্কো পোলোর (Marco Polo) কথা সকলেই জানেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষে (১২৯৩ খ্রি.) মার্কো পোলো চিন থেকে ফেরবার পথে দক্ষিণ ভারতের করমণ্ডল ও মালাবার উপকূল ঘুরে গিয়েছিলেন। দ্বাদশ—ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ইয়োরোপের বাণিজ্য—যুগের সূচনা হয় বলা চলে। বণিকসুলভ মনোবৃত্তি নিয়ে ধনরত্নের লোভে সেই থেকে এশিয়ায় যেসব ইয়োরোপীয় বণিক দুঃসাহসিক অভিযান করেন, তাঁদের মধ্যে ইতালিয় মার্কো পোলো অন্যতম। এশিয়া সম্বন্ধে ইয়োরাপীয় বণিকদের এই ধারণা ও মনোবৃত্তি মার্কো পোলোকে কেন্দ্র করে, বিখ্যাত মার্কিন নাট্যকার Eugene O’ Neill তাঁর ‘Marco Millions’ নাটকে চমৎকারভাবে ব্যক্ত করেছেন। কৌতূহলী পাঠকদের নাটকখানি পড়তে অনুরোধ করছি। মার্কো পোলো ও ইবন বতুতার পর রুশ পর্যটক নিকিটিনের (Athanasius Nikitin) নাম করতে হয়। বহমনী সুলতান তৃতীয় মহম্মদ শাহের রাজত্বকালে (১৪৬৪—১৪৮২) খ্রি. নিকিটিন দক্ষিণাপথে আসেন (১৪৭০ থেকে ১৪৭৪ খ্রি. মধ্যে)। নিকিটিনের ভ্রমণবৃত্তান্ত, ‘India in the Fifteenth Century’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে (H. R. Major সম্পাদিত, Halkyt Society থেকে ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত)। ষোড়শ শতাব্দীর ভারতের ইতিহাসের জন্য আবুল ফজলের বিখ্যাত ‘আকবরনামা’ থাকতে কোনো বিদেশি ভ্রমণকাহিনির শরণাপন্ন হবার প্রয়োজন হয় না। সপ্তদশ শতাব্দীতে জাহাঙ্গীর থেকে ঔরঙ্গজীবের রাজত্বকালের মধ্যে একাধিক ইয়োরোপীয় পর্যটক ও দূত ভারতবর্ষে আসেন। তাঁদের মধ্যে প্রধান হলেন :
উইলিয়াম হকিন্স (William Hawkins) : ১৬০১-১৬১২
টমাস রাে (Sir Thomas Roe) : ১৬১৫-১৬১৯
ফ্রাঁসােয়া বার্নিয়ের (Francois Bemier) : ১৬৫৯-১৬৬৬
তাভার্নিয়ের (Tavernier) : ১৬৪০-১৬৬৭
ডাঃ ফ্রায়ার (Dr. Fryer) : ১৬৭২-১৬৮১
ওভিট (Ovington) : ১৬৮৯-১৬৯২
জেমেলি ক্যাবেরী (Gamelli Careri) : ১৬৯৫
নিকোলাও মনুচ্চি (Niccolao Manucci) : ১৭০৪
ইংরেজ ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হকিন্স নতুন ‘ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি’র প্রতিনিধিরূপে আগ্রায় জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন ১৬০৯ সালে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, সুরাটে ইংরেজদের একটি বাণিজ্যকুঠি প্রতিষ্ঠার অনুমতি আদায় করা। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই তিনি জাহাঙ্গীরের অন্তরঙ্গ দোস্ত হয়ে ওঠেন এবং বাদশাহের সঙ্গে একত্রে মদ্যপানাদিও করতে থাকেন। জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে হকিন্স যে চিত্র এঁকে গেছেন তা এইজন্যই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের মতন অত্যন্ত জীবন্ত হয়েছে। তাঁর এই বিবরণ *ফস্টারের (W. Foster) ‘Early Travellers in India’ গ্রন্থের মধ্যে পাওয়া যাবে। হকিন্সের প্রতি জাহাঙ্গীর ক্রমে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং ১৬১২ সালে স্বদেশে ফিরবার পথে হকিন্সের মৃত্যু হয়। ১৬১৫ সালে ইংলণ্ডের রাজা প্রথম জেমস জাহাঙ্গীরের দরবারে স্যার টমাস রো—কে রাষ্ট্রদূতরূপে পাঠান। রো সাহেব তাঁর দৌত্য জীবনের যে দিনপঞ্জি লিপিবদ্ধ করে গেছেন, ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে তা অমূল্য সম্পদ বলা চলে। চ্যাপলিন এডওয়ার্ড টেরিও (Edward Terry) যেসব মজার কাহিনি লিখে গেছেন তার তুলনা হয় না। টেরির কাহিনি ফস্টারের পূর্বোক্ত গ্রন্থে পাওয়া যাবে এবং রো সাহেবের দিনপঞ্জিও ফস্টারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে (Roe’s ‘Embassy’ : Edited by Sir W. Foster, Hakluyt Society, 1899)।
ফরাসি চিকিৎসক ও পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের ভারতীয় ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে ভারতভ্রমণে আসেন। ১৬৫৮ সালের শেষে তিনি সুরাটে পৌঁছান এবং কিছুদিন দারাশিকোর সঙ্গীরূপে কাটান। সাজাহান তখন মারাত্মক পীড়ায় আক্রান্ত এবং সেই সুযোগে তাঁর পুত্র সুজা, ঔরঙ্গজীব, মুরাদ সিংহাসনলোভে বিদ্রোহী। জ্যেষ্ঠ দারাশিকোর বিরুদ্ধে তাদের চক্রান্ত। গৃহযুদ্ধের আগুনে মোগল সাম্রাজ্য ভস্মস্তূপে পরিণত হবার সম্ভাবনা। এই সময় বার্নিয়ের ভারতবর্ষে আসেন, এবং প্রথমে দারাশিকো ও পরে ঔরঙ্গজীবের সঙ্গে দিল্লি, লাহোর ও কাশ্মীরে যান। এই সময় আরও একজন ফরাসি পর্যটকের সঙ্গে বার্নিয়েরের দেখা হয়, তাঁর নাম তাভার্নিয়ের। বার্নিয়ের ও তাভার্নিয়ের একসঙ্গে বাংলাদেশে আসেন এবং রাজমহল থেকে তাঁরা দুজন দুদিকে চলে যান। বার্নিয়ের যান কাশিমবাজারের পথে এবং পরে বাংলাদেশ ঘুরে মসলিপত্তম ও গোলকুণ্ডায় উপস্থিত হন। গোলকুন্ডায় থাকার সময়, ১৬৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে, তিনি সম্রাট সাজাহানের মৃত্যুসংবাদ পান। ১৬৬৭ সালে তিনি সুরাট থেকে স্বদেশাভিমুখে যাত্রা করেন। এইসময় সুরাটেই তাঁর সঙ্গে বিখ্যাত ফরাসি পর্যটক মঁশিয়ে শাঁর্দার (M. Chardin) সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তাভার্নিয়ের ও শাঁর্দা দুজনেই জহুরি (jeweller) ছিলেন, বার্নিয়ের ছিলেন সুশিক্ষিত চিকিৎসক দার্শনিক।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে যেসব বিদেশি পর্যটক ভারতবর্ষে আসেন তাঁর মধ্যে প্রখ্যাত হলেন ডাঃ ফ্রায়ার, ওভিঙটন, ইতালিয় জেমেল্লি ক্যাবেরি এবং বিখ্যাত ভেনিসিয় পর্যটক নিক্কোলাও মনুচ্চি। ডাঃ ফ্রায়ারের (‘New Account of India’) গ্রন্থের মধ্যে শিবাজীর রাজত্বকালে মারাঠাজাতির ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া যায়, সাধারণভাবে ভারতের কথা বিশেষ কিছু জানা যায় না। তার কারণ ফ্রায়ার সুরাট ছাড়িয়ে বেশিদূর অগ্রসর হননি। ফ্রায়ারের মতন ওভিঙটনও (১৬৮৯—১৬৯২) মোগল দরবারের কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারেননি এবং বোম্বাই ও সুরাটের ইংরেজ বণিকদের মুখে তিনি যা শুনেছেন তাই লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর ‘Voyage to Suratt’ গ্রন্থের মধ্যে। জেমেল্লি ক্যাবেরি ১৬৯৫ সালে সম্রাট ঔরঙ্গজীবের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান এবং এইসময় এই সুযোগ পাওয়ার ফলে তাঁর প্রত্যক্ষ বিবরণ অনেকদিক থেকে মূল্যবান হয়েছে। মনুচ্চিও দারাশিকোর অধীনে কিছুদিন গোলন্দাজের কাজ করেন, তারপর রাজা জয়সিংহের অধীনে কাজে বহাল হন। বোম্বাই ও গোয়ার কাছে কিছুদিন বাস করে তিনি শেষে মাদ্রাজ গিয়ে বসবাস করেন এবং ১৭১৭ সালে মাদ্রাজেই মারা যান। তাঁর বিখ্যাত ‘Storia do Mogar’ আর্ভিন সাহেব (W. Irvine) ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। অনুদিত গ্রন্থ ‘A Pepys of Mogul India’ (London 1908) নামে প্রকাশিত হয়েছে।
এরকম প্রত্যক্ষ ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্যে মনুচ্চির ছাড়া বার্নিয়েরের ও তার্ভানিয়েরের কাহিনির মূল্যই সবচেয়ে বেশি। প্রথমত সময়ের মূল্য, দ্বিতীয়ত অভিজ্ঞতার মূল্য। বার্নিয়ের ও তাভার্নিয়ের যে সময় এসেছিলেন, সেটা ভারতীয় ইতিহাসের সংকটকাল বলা চলে। মোগল সাম্রাজ্যের সূর্য তখন নিশ্চিত অস্তাচলের পথে। মোগলযুগের সমাজ ও সংস্কৃতির যা চূড়ান্ত বিকাশ হবার তা তখন হয়ে গেছে এবং অবনতির সূচনা হয়েছে। এই সময় বার্নিয়ের ও তাভার্নিয়ের এদেশে আসেন। ব্যক্তি হিসেবে বার্নিয়ের ও তাভার্নিয়েরের মধ্যে পার্থক্য ছিল এবং এই পার্থক্যের জন্য তাঁদের পর্যবেক্ষণের মধ্যেও পার্থক্য রয়ে গেছে। ‘মধ্যযুগের ভারত’ সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক স্ট্যানলে লেন—পুল তাঁর ‘ঔরঙ্গজীব’ গ্রন্থের ভূমিকায় এ—সম্বন্ধে বলেছেন :
Bernier writes as a philosopher and man of the world : his comtemporary Tavernier (1640-1667) views India with the professional eye of a jeweller; nevertheless his Travels… contain many valuable pictures of Mughal life and character. (Aurangzib : S. Lane-Poole : Rulers of India Series).
বার্নিয়ের তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখেছেন দার্শনিকের মতন, সত্যদ্রষ্টার মতন। কিন্তু তাঁর সমকালীন তাভার্নিয়েরের ভারতবর্ষকে দেখেছেন জহুরি ব্যবসায়ীর দৃষ্টি দিয়ে। তাহলেও তাভার্নিয়েরের ভ্রমণকাহিনি মূল্যবান, কারণ মোগলযুগের জীবনযাত্রার ছবি তিনি কয়েকদিক দিয়ে ভালোই এঁকেছেন। বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তের এদিক দিয়ে তুলনা হয় না। যেমন তাঁর অসাধারণ পর্যবেক্ষণশক্তি, তেমনি তাঁর যথাযথ বর্ণনার ক্ষমতা। সংস্কার বা স্বার্থের দিক থেকে তিনি কোনো ঘটনার বা কোনো বিষয়ের বিচার করেননি। যা দেখেছেন, উত্তরভারত থেকে দক্ষিণভারত, দক্ষিণভারত থেকে পূর্বভারত পর্যন্ত, তা নিরপেক্ষভাবে বুঝবার চেষ্টা করেছেন, বিচার ও বিশ্লেষণ করেছেন নিজের তীক্ষ্ন বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে। কেবল জহরত বা মণিমাণিক্যের সন্ধানে তিনি আসেননি। মোগল দরবারের ঐশ্বর্য ও সম্পদ দেখে তিনি মোহমুগ্ধ হননি। তাঁর অনুসন্ধানী দৃষ্টি রাজদরবার থেকে বাইরের বাজার—ঘাট পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। সম্রাট, আমির—ওমরাহ থেকে ভারতের সকলশ্রেণির লোকের জীবনযাত্রা তিনি লক্ষ্য করেছেন এবং তাদের কথা সত্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিকের মতন বর্ণনা করে গেছেন। হীরা জহরত মণিমুক্তা ছাড়াও তাই তাঁর দৃষ্টি ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতিতে আকৃষ্ট হয়েছে। এমনকি ‘সতীদাহ’ পর্যন্ত তিনি লক্ষ্য করে বর্ণনা করে গেছেন। মোগলদের রাজস্বব্যবস্থা, দেশের সাধারণ অর্থনৈতিক অবস্থা, জনসাধারণের অবস্থা, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির লোক ও তাদের জীবনযাত্রা, ক্রীড়াকৌতুক, বিলাসব্যসন, আমোদ—প্রমোদ, ধ্যানধারণা, ধর্মকর্ম, চিত্রকর ও শিল্পকলার অবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। কোনোটাই তাঁর পরের মুখে শোনা কথা নয়, নিজের চোখে দেখা, নিজের বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে বোঝা। এইজন্যই বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তকে নিঃসন্দেহে মোগলযুগের বিশেষ করে সপ্তদশ শতাব্দীর অর্থাৎ ঠিক ব্রিটিশ—পূর্বযুগের ভারতের সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিশেষ মূল্যবান প্রাথমিক উপাদানগ্রন্থ বলা যায়।
বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্ত বাংলায় অনুবাদ করার প্রয়োজন এইজন্য অস্বীকার করা যায় না।
ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের
১৬২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বার্নিয়ের ফ্রান্সের আজু গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। চাষবাসই তাঁদের পৈতৃক পেশা ছিল এবং তাই করেই তাঁর পিতামাতা জীবনধারণ করতেন। ছেলেবেলা থেকেই বার্নিয়ের দেশ—বিদেশে ভ্রমণ সম্বন্ধে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন মনে হয়। তখন ইয়োরোপে দুঃসাহসিক অভিযাত্রীরা বহির্জগতের অজানা দেশের সন্ধানে অকূল সমুদ্রে পাড়ি দিচ্ছেন। পৃথিবীর ভূগোল ও মানচিত্র তৈরি হচ্ছে নতুন করে। নতুন নতুন দেশ মানুষের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। নিজের গ্রাম ও নিজের দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ মানুষের মনে বাইরের মানুষকে জানবার, বাইরের দেশ দেখবার প্রবল বাসনা জাগছে। এই সময় এক ফরাসি কৃষক—পরিবারে বার্নিয়েরের জন্ম হলেও তিনিও যুগপ্রেরণায় উদ্বুব্ধ হয়েছিলেন। তাঁর বয়স যখন ২৬—২৭ বছর, তখন তিনি উত্তর—জার্মানি, পোল্যাণ্ড, সুইজারল্যাণ্ড ও ইটালি ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ১৬৪৭ থেকে ১৬৫০ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন—চার বছর ধরে তিনি এইসব দেশে ঘুরে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এসেছিলেন।
সেকালের শিক্ষাদীক্ষার কথা ভাবলে বার্নিয়েরকে রীতিমতো একজন শিক্ষিত লোক বলতে হয়। সাধারণ শিক্ষা নয় শুধু নতুন বিজ্ঞান শিক্ষার দিকে বার্নিয়েরের আগ্রহ ছিল প্রবল। ১৬৫২ সালের মে মাসে তিনি শারীরবিদ্যায় পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন এবং মণ্টিপেলিয়ের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন। বিখ্যাত দার্শনিক গ্যাসেণ্ডি ছিলেন বার্নিয়েরের শিক্ষাগুরু। সেই বছর জুলাই মাসে তিনি চিকিৎসাবিদ্যায় ‘লাইসেনসিয়েট’ পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হন। আগস্ট মাসে চিকিৎসাবিদ্যায় ‘ডক্টর’ উপাধি পান এবং প্যারিস যাত্রা করেন। লেখাপাড়ার মধ্যেও ভ্রমণের নেশা তাঁর বলবতী ছিল। ১৬৫৪ সালে তিনি সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন প্রভৃতি অঞ্চল ঘুরে আসেন।
বার্নিয়ের একজন সাধারণ পর্যটক বা শৌখিন ট্যুরিস্ট ছিলেন না। তিনি ছিলেন দার্শনিক—পর্যটক। যা তিনি চোখে দেখতেন তা নিজের বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে দেখতেন। যা তিনি শুনতেন, তা নিজের যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করে গ্রহণ করতেন। তাঁর সমকালীন অন্যান্য পর্যটকদের দেখার সঙ্গে তাঁর দেখার একটা বিরাট পার্থক্য আছে। বার্নিয়েরের বৃত্তান্তের সঙ্গে অন্যান্য বিদেশি পর্যটকদের বৃত্তান্ত তুলনা করে পড়লে যে—কোনো বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল পাঠক তা সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। বার্নিয়েরের দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্য, বার্নিয়েরের বর্ণনাভঙ্গির ও বিশ্লেষণ রীতির বৈশিষ্ট্য সহজেই তাঁদের দৃষ্টিগোচর হবে। সামাজিক প্রথা, রীতিনীতি, আচার—ব্যবহার ইত্যাদির ব্যাখ্যায় ও বর্ণনায় মানুষের চরিত্র ও প্রকৃতি বিশ্লেষণে, বার্নিয়ের যে অসাধারণ পর্যবেক্ষণশক্তি ও অন্তদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন, তা বিস্ময়কর বললেও ভুল হয় না। শোনা যায়, এই গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণশক্তির জন্য বার্নিয়ের তাঁর শিক্ষাগুরু প্রসিদ্ধ দার্শনিক গ্যাসেণ্ডির কাছে ঋণী।
১৯৫৬ থেকে ১৬৫৮ সাল পর্যন্ত বার্নিয়ের মিশর, জেদ্দা ও মক্কা ভ্রমণ করেন। কায়রোতে তিনি প্রায় একবছরের বেশি ছিলেন। মক্কা থেকে তাঁর হাবসিদের দেশে যাবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু যাননি। একখানি ভারতীয় পোতে তিনি সুরাট (হিন্দুস্থান) যাত্রা করেন এবং বাইশ দিন সমুদ্রপথে কাটিয়ে ১৬৫৮ সালের শেষে বা ১৬৫৯ সালের গোড়ার দিকে সুরাটে উপস্থিত হন।
আজমিরের কাছে দারার সঙ্গে তখন ঔরঙ্গজীবের সেনাদলের যুদ্ধ হচ্ছে। ১৬৫৯ সালের ১২—১৩ মার্চ বার্নিয়ের যখন সুরাট থেকে যাত্রা করে আগ্রার দিকে যাচ্ছিলেন, তখন পথে আমেদাবাদের কাছে দারার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ পরিচয় হয়। তাঁর গুণের পরিচয় পেয়ে দারা তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চান। দারা তখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সিন্ধু প্রদেশের দিকে পলায়ন করছেন। বার্নিয়ের বোধহয় পলাতক দারা ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গের সঙ্গে গোরুর গাড়ি করে যাচ্ছিলেন। পথে তাঁর যানবাহনের ব্যবস্থা করার সময় ছিল না। অতএব বিদেশি বন্ধুটিকে পথের মধ্যে ফেলে রেখেই তিনি পালাতে বাধ্য হন। পথেঘাটে তখন চোর—ডাকাতের উপদ্রব খুব বেশি ছিল। বার্নিয়ের চোর—ডাকাতের হাতে পড়ে নির্যাতিত ও লুণ্ঠিত হন। কোনোরকমে প্রাণটি বাঁচিয়ে তিনি আবার আমেদাবাদ অভিমুখে যাত্রা করেন এবং সেখানে দিল্লিগামী একজন সম্ভ্রান্ত মোগলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তাঁর সঙ্গে তিনি দিল্লি যাত্রা করেন।
সম্রাট ঔরঙ্গজীবের অধীনে গৃহচিকিৎসকের চাকরি নিতে তিনি বাধ্য হন, কারণ তখন তাঁর আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। কিছুদিন পরে তিনি দানেশমন্দ খাঁর অধীনেও চাকরি নেন। এই দানেশমন্দ খাঁ তখন খুব প্রভাব—প্রতিপত্তিশালী ওমরাহ ছিলেন। বার্নিয়েরকে তিনি যথেষ্ট ভালোবাসতেন ও বিশ্বাস করতেন। তাঁর সান্নিধ্য ও অন্তরঙ্গতা লাভ করেই বার্নিয়ের রাজদরবারের অনেক গোপন কথা, আদব—কায়দা ইত্যাদি জানতে পারেন।
সম্রাট ঔরঙ্গজীবের কাশ্মীর—অভিযানেও বার্নিয়ের সঙ্গী ছিলেন। কাশ্মীর থেকে ফিরে এসে তিনি বাংলাদেশ অভিমুখে যাত্রা করেন। এই সময় বিখ্যাত পর্যটক তাভার্নিয়ের তাঁর সঙ্গী হন। রাজমহল পর্যন্ত একসঙ্গে এসে বার্নিয়ের ও তাভার্নিয়ের বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। বার্নিয়ের রাজমহল থেকে কাশিমবাজারের দিকে যাত্রা করেন। বাংলাদেশ ঘুরে বার্নিয়ের মসলিপত্তম ও গোলকুণ্ডা যান এবং সেখানে সাজাহানের মৃত্যু—সংবাদ শুনতে পান (১৬৬৬ সালের ২২ জানুয়ারি)। ১৬৬৬ সালে তিনি সুরাট থেকে যখন স্বদেশাভিমুখে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন প্রসিদ্ধ পর্যটক শাঁর্দার সঙ্গে সেখানে তাঁর দেখা হয়।
১৬৬৯ সালে বার্নিয়ের মার্শাই—এ পৌঁছান। ১৬৭০ সালের ২৫ এপ্রিল তিনি ফরাসি সম্রাটের কাছ থেকে তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত ছেপে প্রকাশ করবার ‘লাইসেন্স’ বা অনুমতিপত্র পান।
১৬৭০—৭২ সালের মধ্যে বার্নিয়েরের জীবদ্দশায়, তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তের ফরাসি, ইংরেজি ও ডাচ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সারা ইয়োরোপে রীতিমতো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ১৬৮৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ৬৮ বছর বয়সে প্যারিসে বার্নিয়েরের মৃত্যু হয়।
ভারতবর্ষে বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তের ইংরেজি অনুবাদ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮২৬ সালে, কলকাতায়। সার্কুলার রোডের ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস থেকে ছাপা হয়। জন স্টুয়ার্ট মুল ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। পরে ১৮৩০ সালে বোম্বাই—এর ‘সমাচার প্রেস’ থেকে বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তের আর একটি ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কলকাতার বঙ্গবাসী কার্যালয় থেকে ১৯০৪ সালে একটি ইংরেজি সংস্করণ, ভূমিকা ও টীকাসহ প্রকাশিত হয়।
বার্নিয়ের প্রসঙ্গে মার্ক্স ও এঙ্গেলস
বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্ক্স ও ফ্রিডরীশ এঙ্গেলস আজ থেকে শতাধিক বছর আগে (১৮৫৩ সালে) বার্নিয়েরের এই ভ্রমণবৃত্তান্তের ঐতিহাসিক মূল্য সম্বন্ধে যে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন, তা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তাঁদের চিঠিপত্র থেকে সেই মন্তব্যের অংশটুকু আমি অনুবাদ করে দিচ্ছি। ১৮৫৩ সালের ২ জুন লণ্ডন থেকে কার্ল মার্ক্স এঙ্গেলসকে লিখেছিলেন :
”প্রাচ্য শহরগুলি উত্থানের ইতিবৃত্ত বৃদ্ধ ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের যেরকম চমৎকার জীবন্ত ও হৃদয়গ্রাহী করে বর্ণনা করেছেন, তেমনভাবে আর কেউ কোথাও করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয় না। নয় বছর তিনি সম্রাট ঔরঙ্গজীবের চিকিৎসক ছিলেন। তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত যেমন মনোরম, তেমনি মূল্যবান ঐতিহাসিক সম্পদ। তখনকার সামরিক ব্যবস্থা সম্বন্ধেও বার্নিয়ের সুন্দর বর্ণনা করেছেন। বিশাল সেনাবাহিনী কিভাবে যুদ্ধযাত্রা করত, কেমন করে তাদের অভিযানকালীন আহারের সংস্থান করা হত, ইত্যাদি বিষয়েরও তিনি অবতারণা করেছেন। এ—সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন : ‘সেনাবাহিনীর মধ্যে অশ্বারোহী দলই হল সর্বপ্রধান। পদাতিক সেনাদল আসলে তত বড়ো নয়, যতটা বাইরে থেকে গুজব শোনা যায়। প্রচুর বাজারের লোক বা চাকরবাকর যারা সেনাদলের সঙ্গে থাকে, তাদের পদাতিক বলে গণ্য করা যায় না এবং তারা যোদ্ধাও নয়। লোকলস্কর দাসদাসী সব একত্রে গণনা করলে, সম্রাটের সঙ্গে প্রায় দুতিন লক্ষ সৈন্য থাকে বললে ভুল হয় না। থাকা স্বাভাবিক, যেহেতু রাজধানী ছেড়ে সম্রাট দীর্ঘকালের জন্য যুদ্ধযাত্রার সময় দূরে চলে যান। মালপত্র কি লাগতে পারে না—পারে, সে—সম্বন্ধেও যাঁদের ধারণা আছে, তাঁরা এই লোকসংখ্যা দেখে আশ্চর্য হবেন না। কতরকমের তাঁবু, কাপড়চোপড়, আসবাবপত্র, আহার্য, কেবল পুরুষদের জন্য নয়, স্ত্রীলোকদের জন্যও যে সঙ্গে যায় এবং তার সঙ্গে কত হাতি ঘোড়া উট বলদ, মাহুত সহিস ভৃত্য, খাদ্যবিক্রেতা, বণিক—ব্যবসায়ী ইত্যাদি যে থাকে, তার ঠিক নেই। হিন্দুস্থানের রাষ্ট্র ও শাসকের যে বিশেষ পদমর্যাদা আছে, তার জন্যই এরকম হয়। একথা মনে রাখা দরকার যে হিন্দুস্থানের সম্রাটই হলেন দেশের ভূসম্পত্তির প্রকৃত স্বত্বাধিকারী। তার ফলে দিল্লি বা আগ্রার মতন শহর গড়ে উঠেছে প্রধানত সম্রাট ও তাঁর সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে। তাই সম্রাট যখন যুদ্ধযাত্রা করেন এবং তাঁর সঙ্গে সেনাবাহিনী যায়, তখন শহরের প্রায় সকলশ্রেণির লোককে তাঁর অনুগামী হতে হয়। হিন্দুস্থানের রাজধানী বা শহরের সঙ্গে ইউরোপের প্যারিসের মতন শহরের ঠিক তুলনা করা যায় না। দিল্লি বা আগ্রার মতন শহরকে ঠিক সামরিক শিবির ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। বৈশিষ্ট্য এই যে, বেশ উন্মুক্ত জায়গায় শহরগুলি গড়ে উঠে।
”প্রায় চারলক্ষ সৈন্য নিয়ে সম্রাট ঔরঙ্গজীব কাশ্মীর অভিযান করেছিলেন। এই বিশাল সেনাবাহিনীর যুদ্ধযাত্রা সম্বন্ধে বার্নিয়ের লিখেছেন : ‘এত বড় সেনাবাহিনী, এত লোকজন ও জীবজন্তুর অভিযানকালীন খাদ্যসংস্থানের কথা চিন্তা করলে অনেকে হয়ত কল্পনা করতে পারবেন না, কি করে এইভাবে যুদ্ধযাত্রা করা সম্ভব? তাঁরা হয়ত জানেন না, খাওয়া—দাওয়া সম্বন্ধে ভারতবাসীরা কত সংযমী ও সরল। অশ্বারোহী সেনাদের মধ্যে দশজন বা বিশজনের মধ্যে একজন অভিযানের সময় মাংস খায় কিনা সন্দেহ। চালডাল মিশ্রিত খিচুড়ি পেলে, তাতে গরম ঘি ঢেলে দিয়ে তৃপ্তি করে তারা খায়, তার বেশি কিছু তাদের দরকার হয় না। উটের সহিষ্ণুতার কথা অনেকেই জানেন, ক্ষুধাতৃষ্ণাও যে বিশেষ তাদের আছে তা মনে হয় না। অভিযানের সময় তাদের আহারের তেমন প্রয়োজনই হয় না। কোনো নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে সেনাবাহিনী যখন হল্ট করে তখন আশপাশের উন্মুক্ত মাঠে প্রান্তরে জীবজন্তুদের ছেড়ে দেওয়া হয় চরে খাবার জন্য। শহরে বা রাজধানীতে (যেমন দিল্লিতে) ছোটোবড়ো বণিকরা যাঁরা বাজারে পণ্যদ্রব্যের কেনাবেচা করেন তাঁরাও সেনাবাহিনীর সঙ্গে থেকে বাইরে সেই কাজ করতে বাধ্য হন।… খাদ্যসংগ্রহ সম্বন্ধেও তাই করা হয়ে থাকে। দরিদ্র লোক যারা, তারা সেনাশিবিরের আশপাশের গ্রামের মধ্যে চলে যায়, যৎকিঞ্চিৎ উপার্জন করে আহারের সংস্থান করে। অনেকে কোদালকুড়ুল দিয়ে কেটে চষে মাঠ থেকে যা কিছু ফলমূল পায়, সৈন্যদের জন্য সংগ্রহ করে নিয়ে আসে।…’
”বার্নিয়ের ঠিকই বলেছেন, সমস্ত প্রাচ্য দেশের বৈশিষ্ট্য হল—ভূসম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অভাব। তিনি এই প্রসঙ্গে তুরস্ক, পারস্য ও হিন্দুস্থানের নাম করেছেন। এই বৈশিষ্ট্যই হল আমার মতে, প্রাচ্যের অমরাবতীর সোপান স্বরূপ।”
কার্ল মার্ক্সের এই পত্রের উত্তরে এঙ্গেলস ম্যাঞ্চেস্টার থেকে ৬ জুন তারিখে (১৮৫৩) লেখেন :
”ভূসম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অভাব সত্যই সমস্ত প্রাচ্যদেশের অন্যতম সামাজিক বিশেষত্ব। এইসব দেশের ইতিহাসের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে হলে, এই কথাটি বিশেষভাবে জানা দরকার। কিন্তু কি করে এরকম ঐতিহাসিক অবস্থার উদ্ভব সম্ভব হল? সামন্তযুগেও ভূসম্পত্তির মালিকানা—স্বত্বের কোনো জটিল বিকাশ সম্ভব হল না কেন? তার প্রধান কারণ, আমার মনে হয়, এসব দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের বিশেষত্ব। এসব দেশের মাটির এমনই গুণ, আবহাওয়ার এমন গুণ যে এরকম না হওয়াই আশ্চর্য। যেমন মনে করুন, বিশাল মরুভূমির বিস্তার দেখা যায়, একেবারে সাহারা থেকে আরম্ভ করে, আরব পারস্য ভারতবর্ষ ও তাতারির ভিতর দিয়ে এশিয়ার উচ্চতম উপত্যকা পর্যন্ত। এরকম প্রাকৃতিক পরিবেশে কৃত্রিম সেচব্যবস্থার প্রবর্তন অপরিহার্য। এই ব্যবস্থা কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে চালু করা সম্ভব নয়, ব্যক্তিগত ব্যাপারই নয় এ—সমস্যা। সংঘবদ্ধভাবে ‘কমিউনের’ তরফ থেকে, অথবা প্রাদেশিক বা কেন্দ্রীয় গবর্নমেন্টের তরফ থেকেই একমাত্র এই ধরনের কৃত্রিম সেচব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভবপর। এইজন্যই দেখা যায়, প্রাচ্যদেশের প্রত্যেক গবর্নমেন্টের প্রায় তিনটি করে সরকারি বিভাগ থাকে : (১) ফিনান্স (ঘরোয়া শোষণ), (২) যুদ্ধ (ঘরোয়া ও বৈদেশিক শোষণ) এবং (৩) সাধারণ পরিকল্পনা বিভাগ (প্রতি—উৎপাদনের জন্য)। ব্রিটিশ শাসকরা, ভারতবর্ষে একনম্বর ও দুনম্বর বিভাগ নিজেদের স্বার্থে ভালভাবেই পরিচালনা করেছেন, কিন্তু তিন নম্বরটি তাঁরা একেবারে ত্যাগ করেছেন। তার ফলে ভারতবর্ষের কৃষিব্যবস্থার শোচনীয় অবনতি হয়েছে। অবাধ প্রতিযোগিতা ভারতীয় পরিবেশে ব্যর্থ হয়েছে। কৃত্রিম সেচব্যবস্থার অবনতির ফলে জমির ফলনশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে এবং তাই দেখা যায়, এককাল যেসব জমিতে আবাদ করলে সোনা ফলত, পরে সেসব জমি পতিত হয়ে রয়েছে। সর্বত্রই তাই দেখা যায়—পামিরায়, পেট্রায়, ইয়েমেনে, মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলে, পারস্যে ও ভারতবর্ষে। এর থেকেই বোঝা যায়, কেন একটি মাত্র সর্বগ্রাসী যুদ্ধের ফলে এক—একটি সমৃদ্ধিশালী সভ্যতার কেন্দ্র কয়েক শতাব্দীর মতন জনশূন্য হয়ে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।…
”প্রবীণ বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্ত সত্যই অপূর্ব, চমৎকার। এরকম বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ একজন ফরাসি পর্যটকের কাহিনি যতবার পড়া যায়, তত ভাল লাগে পড়াতে। এমন অনেক কথাই তিনি লিখেছেন ও বলেছেন, যার গভীর তাৎপর্য বুঝলে হয়ত বলতেন না। অনেক আপাতদুর্বোধ্য বিষয় তিনি আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন।”*
মার্ক্স ও এঙ্গেলসের মতন স্পষ্টবাদী সমাজবিজ্ঞানীর এরকম অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ খুব কম লেখকের বা ঐতিহাসিকের ভাগ্যে জুটেছে। সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত বার্নিয়েরের মতন আরও অনেক বিদেশি পর্যটক নানাকার্য উপলক্ষে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। উইলিয়ম হকিন্স, টমাস রো, তাভার্নিয়ের, ডাঃ ফ্রায়ার প্রভৃতি তাঁদের মধ্যে প্রধান। এদেশের অনেক কথা তাঁরা তাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্যে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের যতটুকু ঐতিহাসিক মূল্য থাকা উচিত, তা তাঁদের বিবরণেও আছে। প্রত্যেকেই দেখেছেন নিজের চোখ দিয়ে, বুঝেছেন নিজের বুদ্ধি ও মন দিয়ে। তাঁদের সকলের মধ্যে, সম্রাট ঔরঙ্গজীবের বিচক্ষণ ফরাসি চিকিৎসক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়েরের দৃষ্টির যেমন স্বাতন্ত্র্য ও গভীরতা আছে, বুদ্ধির যেমন তীক্ষ্নতা আছে, মনের যেমন উদারতা ও দরদ আছে, তেমন আর কারও নেই। অনেকেই দেখেছেন ‘টুরিস্টের’ দৃষ্টিতে ভারতবর্ষকে, বার্নিয়ের দেখেছেন সমাজ—দার্শনিকের দরদি দৃষ্টি দিয়ে। বার্নিয়েরে ভ্রমণবৃত্তান্ত তাই বাদশাহী আমলের ‘সামাজিক ইতিহাস’ হিসেবে অত্যন্ত মূল্যবান এবং যে কোনো উপন্যাসের চেয়ে সুখপাঠ্য।
ভিন্সেন্ট স্মিথ সম্পাদিত বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তের ইংরেজি সংস্করণে যে সব টীকা—টিপ্পনি আছে, সেগুলি ছাড়াও বিভিন্ন প্রামাণ্য, গ্রন্থ থেকে আরও অনেক প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পাদটীকায় আমি সংগ্রহ করে দিয়েছি। বার্নিয়েরের বক্তব্য ভালো করে বুঝতে এগুলি সাহায্য করবে বলে আমার বিশ্বাস।
সামাজিক ইতিহাসের অনুরাগী যাঁরা, তাঁরা এই ‘বাদশাহী আমল’ থেকে মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে অনেক নতুন তথ্য ও চিন্তার খোরাক পাবেন।
…………………
* মূল বই Periplus Maris Erythraci গ্রিক ভাষী মিশরের কোনো এক ব্যবসায়ীর স্মৃতিচারণ ১৯১২ সালে Wilfred Harvey Schoff (1874-1932) অনুবাদ করেন, প্রকাশক লংম্যান, নিউইয়র্ক।
* উইলিয়াম ফস্টার (১৮৬৩—১৯৫১) বইয়ের নাম Early travels in India 1583-1619, London : Oxford, 1921.
* Selected Correspondence : Karl Marx and F. Engels : (Lawrence & Wishart, London : 1943) : Letters Nos. 22 & 23.
Leave a Reply