বাঙালি মুসলমানের মন – আহমদ ছফা
বাঙালি মুসলমানের মন (প্রবন্ধ) – আহমদ ছফা
উৎসর্গ
দুই জন সংস্কৃতিপ্রেমিক হৃদয়বান মানুষ
লুতফর রহমান সরকার
মোস্তফা কামাল
শ্ৰদ্ধাস্পদেষু
.
প্রাক ভাষণ
বর্তমান গ্রন্থে স্থানপ্রাপ্ত রচনাগুলো অনধিক বার বছর সময় সীমার মধ্যে লিখিত। নাম প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। মাসিক সমকালের কোনো একটি সংখ্যায়। ‘রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা’ রচনাটি ড. আনিসুজ্জামান সম্পাদিত গ্রন্থ ‘রবীন্দ্রনাথ’-এ স্থান পেয়েছে এবং সেজন্য ওটি লিখিত হয়েছিল। ভবিষ্যতের জন্য রচনাটি ১৯৬৯ সালের দিকে অধুনালুপ্ত ‘কণ্ঠস্বর’-এর কোনো একটি সংখ্যায় প্রকাশ পেয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র লেখাটি ‘পারাপার’ নামে আরেকটি সংকলনে ১৯৭৩ সালের দিকে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘ফেব্রুয়ারি উনিশশ বাহাত্তর’ রচনাটি উনিশশ বাহাত্তর সালে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানোপলক্ষে লিখতে হয়েছে। পরে সেটি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ‘বই’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষার দর্শন প্রবন্ধটি ১৯৭২ কি ’৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সেমিনারে পঠিত হয়েছিল। পরে কোথায় ছাপা হয়েছিল মনে পড়ছে না। ‘বার্ট্রান্ড রাসেল’ লেখাটি অধুনালুপ্ত ‘মুখপত্র’ পত্রিকায় ১৯৭০ সালের দিকে ছাপা হয়। ‘বাংলার ইতিহাস’ প্রসঙ্গে রচনাটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কলকাতায় সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘অভিযান’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ‘বাংলার চিত্র ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা’ শীর্ষক রচনাটি লেখা হয়েছে মাত্র মাসকয়েক আগে। এটি ‘মূলভূমি’ নামে একটি সংকলনে সবে ছাপা হলো।
এই গ্রন্থের লেখাগুলো সূচি অনুসারে না দেখে লেখার কালানুসারে বিচার করলে লেখকের মানস পরিণতির একটা ছায়া বোধ করি দৃষ্টিগোচর হবে।
রচনাগুলো প্রেসে দেয়া হয়েছিল তিন বছর আগে এবং প্রায় অর্ধেকের বেশি ছাপাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে এতদিন পর। সেই দুঃখের কথা বলে লাভ নেই। তবু ভাবতে ভাল লাগছে ১৯৮১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে লেখাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলো।
বিনীত
আহমদ ছফা
২১ ফেব্রুয়ারি ’৮১
১০৭ আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
.
উত্তর ভূমিকা
এই গ্রন্থের নাম প্রবন্ধটি লেখার পেছনে সামান্য ইতিহাস আছে। তখন জিয়াউর রহমানের রাজত্বকাল। অধ্যাপক আবুল ফজল তার শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা। আবুল ফজল সাহেবের সঙ্গে আমার বিলক্ষণ পরিচয় ছিল এবং তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। আমার গল্প উপন্যাস এবং প্রবন্ধের উপর তিনি তিনটে প্রবন্ধ লিখেছেন। লেখক জীবনে আবুল ফজল সাহেবের কাছে আমি অনেক পরিমাণে ঋণী। তিনি আমার মতো অনেক তরুণেরই প্রেরণার উৎস ছিলেন। তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধির পূজারী এবং ঘঘাষিতভাবে নাস্তিক। যেহেতু ফজল সাহেব নাস্তিকতা প্রচার করতেন, প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ লোকেরা তাকে ভীষণ খারাপ চোখে দেখত এবং প্রায়ই পত্র পত্রিকায় তাকে গালাগাল করা হতো।
একদিন সকালবেলা আমি প্রাতভ্রমণ করতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়েছি। খুব অবাক হয়ে লক্ষ করলাম সকালবেলা আবুল ফজল সাহেব মোটাতাজা উঁচা লম্বা ফর্সা মতোন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসছেন। তার মাথায় একটা গোল টুপি। আবুল ফজল সাহেবের মাথায় টুপি দেখে আমি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সালাম করে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার এত সকালে কোথায় যাচ্ছেন? তিনি জানালেন, সিরাত মাহফিলে যোগ দেবেন বলে বেরিয়েছেন। তার সঙ্গের মানুষটির পরিচয়ও আমি পরে জানতে পেরেছি। তিনি ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমানের আকাশ সেনা প্রধান জনাব এম এ জি তাওয়াব। ধর্ম নিয়ে অত্যধিক বাড়াবাড়ির কারণে এই ভদ্রলোক জিয়াউর রহমানকে অনেকবার বেকায়দায় ফেলেন। শেষ পর্যন্ত জেনারেল জিয়া তাওয়াব সাহেবকে তার শ্বশুরের দেশ জার্মানিতে চলে যেতে বাধ্য করেন।
আমি আবুল ফজল সাহেবকে টুপি পরে সিরাত মাহফিলে যোগ দিতে যাওয়ার ঘোষণা শুনে মনে মনে একটা চোট পেয়ে গেলাম। এই ঘোষিতভাবে নাস্তিক ভদ্রলোকটি আজকে ক্ষমতার স্বাদ পেতে না পেতে নিজেকে প্রচণ্ড ধার্মিক বলে পরিচয় দিতে চাইছেন। এরকম কাণ্ড কি করে ঘটে সেটা আমাকে ভয়ানক রকম চিন্তিত এবং উতলা করে তোলে।
অনেক নাস্তিক শেষ পর্যন্ত আস্তিকে পরিণত হয়েছে এরকম ভুরিভুরি লোকের নাম আমি জানি। কিন্তু আবুল ফজল সাহেবের মতো লোক যিনি সারাজীবন নাস্তিকতার পুরোহিতের ভূমিকা পালন করে গেছেন তিনি ক্ষমতার কাছাকাছি আসতে না আসতেই কোনোরকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ না দিয়েই একটি ভিন্ন পরিচয়ে নিজেকে চিহ্নিত করতে তৎপর হয়ে উঠলেন সেটাই আমাকে সবচাইতে বিস্মিত করেছে।
এই যে হঠাৎ পরিচয় পাল্টে ফেলা তার পেছনে আমার মনে হয়েছিল একগুচ্ছ সামাজিক কারণ বর্তমান। আবুল ফজল সাহেব উপলক্ষ মাত্র, কারণ নন। বাঙালি মুসলমান সমাজের ভেতরে এমন কিছু ব্যাপার-স্যাপার আছে যেগুলো ব্যক্তিকে কোনো বিশ্বাসের বিন্দুতে স্থির থাকতে দেয় না। ডানে কিংবা বাঁয়ে হেলতে বাধ্য করে। মনের এই উত্তেজিত অবস্থাতে আমি এক রাতে একটুও না থেমে বাঙালি মুসলমান রচনাটি লিখে শেষ করি।
লেখাটি যখন প্রথম সমকালে প্রকাশিত হয়, আমাদের দেশের চিন্তাশীল মানুষদের মধ্যে কিছু আলোড়নও আমি লক্ষ্য করি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদ আমার লেখার তীব্র সমালোচনা করে একটি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন। আত্মপক্ষ সমর্থনে আমাকেও ওই একই সমকাল পত্রিকায় জনাব এবনে গোলাম সামাদের অভিযোগের একটা কড়া জবাব দিতে হয়।
বর্তমান গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি জমা দেয়ার প্রায় দুবছর পরে বাংলা একাডেমী ছাপার কাজ শুরু করে। লেখাটি যখন চার ভাগের তিন ভাগ ছাপা শেষ হয়েছে একাডেমী কর্তৃপক্ষকে আমি অনুরোধ করি শেষের দিকে আমি এই গ্রন্থে একটি বড়সড় লেখা সংযোজন করতে চাই এবং সেজন্য তাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমার মনে সামান্য অস্বস্তি ছিল। বাঙালি মুসলমান সমাজকে নানা দিক থেকে আমি অভিযুক্ত করছি অথচ আমার জন্ম এই সমাজে ঘটেছে। এই সত্য কোনোদিন অস্বীকার করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। নিজের সমাজের অবিমিশ্র নিন্দে করে কোনো মানুষ ভাল কিছু করতে পারে না। সেজন্য আমি মনে মনে অনুসন্ধান করছিলাম এমন কিছু খুঁজে পাই কিনা, যা দিয়ে বাঙালি মুসলমানের দিক সামান্য হলেও আমি উল্লেখ করতে পারি।
এই রচনা লেখার প্রায় পাঁচ বছর আগে আমার সঙ্গে প্রয়াত শিল্পী এস এম সুলতানের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং পরিচয় পরে বন্ধুত্বে রূপ নেয়। সুলতানকে আমার বাঙালি মুসলমান সমাজে নয় শুধু গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে একজন অনন্যসাধারণ মানুষ বলে মনে হয়। আমাদের দেশের জ্ঞানী-গুণী মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এই মহান শিল্পীর প্রতি উপেক্ষা এবং তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে যে পাপ করে আসছিল সেই পাপ স্খলনেরও একটা পন্থা উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা আমি তীব্রভাবে অনুভব করে আসছিলাম। যেভাবে সুলতান এবং তার শিল্পকর্ম দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন সেই জিনিসটি তুলে আনতে পারছিলাম না বলে আমাকে ক্রমাগত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এই সময়ে দীর্ঘ পঞ্চাশ পৃষ্ঠা বিস্তৃত রচনাটি আমি শেষ করি এবং তার পরে বাংলা একাডেমী বইটি প্রকাশ করে।
‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থটি বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এই গ্রন্থের পক্ষে বিপক্ষে নানা ব্যক্তি অভিমত প্রকাশ করতে থাকেন। আমার এই রচনার বিরূপ প্রতিক্রিয়াসমূহের মধ্যে থেকে কয়েকটির কথা আমি তুলে ধরতে চাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক (ভূতপূর্ব সভাপতি, প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি) আবুল কালাম আজাদ জনাব অলি আহাদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় অন্যূন ছয় মাস ধরে আমার লেখা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধটির বিরুদ্ধে একটানা লিখে যেতে থাকেন। এই হ্রস্বকায় করিতকর্মা অধ্যাপককে যিনি জানেন, অবশ্যই একমত হবেন, তার প্রতিশোধ গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা কি রকম ভয়ংকর হতে পারে। আজাদ সাহেব ইত্তেহাদ পত্রিকায় নিবন্ধসমূহ লিখে নিবৃত্ত হতেন না, তার নিবন্ধ সংবলিত পত্রিকাটি প্রতি সপ্তাহে আমার দরজার তলা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে যেতেন। আমি তখন থাকতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে এবং তিনি থাকতেন আমার পেছনে শিক্ষকদের কোয়ার্টার্সে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ভালমন্দ যাই লিখুক না কেন আমি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করব না। কারণ আমি আবুল কালাম আজাদ সাহেবের কৌশলটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। তিনি তার লেখাগুলো পাঠ করিয়ে আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চাইছিলেন। আমি ঠিক করেছিলাম তার ফাঁদে কিছুতেই ধরা দেব না। তাই দরজা খুলে যখন দেখতাম একটা ইত্তেহাদ পত্রিকা মেঝের উপর শুয়ে আছে, আমি কালবিলম্ব না করে সেটা জ্বালিয়ে ফেলতাম। তারপর আবুল কালাম আজাদ সাহেব একটা ভিন্নপথ ধরলেন। ইত্তেহাদের প্রকাশিত নিবন্ধগুলো দিয়ে তিনি একটা পুস্তিকা প্রকাশ করলেন এবং সেই পুস্তিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিতরণ করে এলেন। কিন্তু শিক্ষকরা কেউ উচ্চবাচ্য কিছু করলেন না। এই ছোট মানুষটি মোটেই দমে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি এক শুক্রবারে স্বরচিত পুস্তিকাটি হাতে করে কাঁটাবন মসজিদে এলেন। নামাজ শেষে উপস্থিত মুসল্লিদের কাছে নিবেদন করলেন, আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমানদের হিন্দুদের জারজ সন্তান বলেছে। সুতরাং তার একটা বিহিত হওয়া দরকার। আমার ধারণা মুসল্লি সাহেবরা আবুল কালাম সাহেবের চরিত্র জানতেন, তাই তারা চেতে ওঠার বিশেষ প্রয়োজন অনুভব করেননি।
এভাবে তো আবুল কালাম পর্ব ছুটল। এরপর আক্রমণ এল সম্পূর্ণ ভিন্ন দিক থেকে। দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় আমাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে পর পর দু-সংখ্যায় একটি লেখা প্রকাশিত হলো। এক ভদ্রলোক ছদ্মনামে এ রচনাটি প্রকাশ করেছেন। পরে আমি এ ভদ্রলোকটির নাম পরিচয়ও উদ্ধার করতে পেরেছি। তিনি ছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব উপাচার্য এবং পরবর্তীকালে জিয়া সরকারের একজন মন্ত্রী। যতই নিন্দে সমালোচনা হোক তথাপি লেখাটির মধ্যে একটা শক্তি ছিল যা আমাদের দেশে প্রধান এবং খ্যাতনামা গদ্য লেখকদেরও প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিল।
আমি যে যুক্তি শৃঙ্খলা প্রয়োগ করে বাঙালি মুসলমানের মানসজীবন বিশ্লেষণ করার প্রয়াস নিয়েছিলাম আমার সেই চিন্তন পদ্ধতিটি অনেকেই গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু আমার প্রতি সামান্য ঋণের কথা উল্লেখ করলে তাদের সম্মানহানি ঘটে সেজন্য আমার নামটি একেবারেই উল্লেখ করেন নি।
একটা দুঃখের কথা বলি, একবার বাংলা একাডেমী সিদ্ধান্ত নিলেন তারা একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ করবেন। যে সংকলনে বাংলা সাহিত্যের প্রধান গদ্য লেখকদের রচনা স্থান পাবে। একেবারে কনিষ্ঠ লেখক হিসাবে আমারও একটি লেখা গ্রহণ করবেন বলে ঠিক করেছেন। আমাকে যখন একটি লেখা দিতে বলা হলো আমি ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধটি একাডেমীতে জমা দিলাম। কিছুদিন পর একাডেমীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমাকে জানালেন, সম্পাদকমণ্ডলী আমার রচনাটি বিশেষ কারণে গ্রহণ করতে পারছেন না, আমি যেন তাদেরকে অন্য একটি রচনা দিয়ে বাধিত করি। এই সংবাদটি শুনে আমি অত্যন্ত চটে যাই এবং একাডেমীকে চিঠি লিখে জানাই, প্রস্তাবিত প্রবন্ধ সংকলনের যে চারজন সম্পাদক রয়েছেন তাদের মধ্যে তিনজনই এই লেখা থেকে মালমসলা সংগ্রহ করে দেদার লেখা লিখে যাচ্ছেন। সম্পাদকবৃন্দ কি কারণে এই রচনাটি গ্রহণ করতে চাননি আমাকে লিখে জানালে বাধিত হব। একাডেমী আমাকে কোনো কিছু জানাননি এবং সেই গদ্য গ্রন্থটি অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি, যদিও লেখকদের সম্মানী পরিশোধ করা হয়েছিল।
আমাকে এই প্রবন্ধটি সম্বন্ধে আরও কিছু কথা বলতে হবে এবং বলব রচনার শেষ পর্যায়ে। এখানে একটি সংবাদ জানিয়ে রাখতে চাই। কলকাতাতে যখন গ্রন্থটি প্রকাশ হতে যাচ্ছিল সে সময়ে মিরান্দা প্রকাশনীর শ্রীমতি পাপিয়া রায় একটি গ্রন্থ প্রকাশ উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। সদ্য প্রয়াত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ওই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেছিলেন। তারপর থেকে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার একটি সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়। গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের প্রাক্কালে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা একটি কর্তব্য বলে মনে করছি।
এই গ্রন্থে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ ছাড়াও আরও কিছু রচনা স্থান পেয়েছে। তার মধ্যে ‘ভবিষ্যতের ভাবনা’ রচনাটি আমি লিখি ছাত্রজীবনে। রচনাটি জনাব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আইয়ুব খান সাহেবের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন যখন রেডিও টিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করার ঘোষণা দেন, সেই সময়ে আমি আমার এক বন্ধু কাজী সিরাজ মিলে ঠিক করি এই পরিস্থিতিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত পরিচিতিসম্পন্ন তরুণ-প্রবীণ কবি-লেখকদের রচনা সংগ্রহ করে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করলে সবচাইতে ভাল হয়। আমরা প্রখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান স্টুডেন্ট ওয়েজকে এই প্রস্তাবিত গ্রন্থটি প্রকাশ করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি করাই। তারপর আমাদের শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামান সাহেবকে এই গ্রন্থটি সম্পাদনা করতে অনুরোধ করি এবং তিনি রাজিও হন। এই উপলক্ষে আমি ‘রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা’ শীর্ষক লেখাটি লিখি। এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না ওই সংকলনে এটি ছিল একমাত্র ছাত্রলিখিত রচনা। আমার লেখাটির অংশবিশেষ প্রয়াত সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় স্টেটসম্যান পত্রিকায় ইংরেজি অনুবাদ করে প্রকাশ করেন।
‘বাঙালির ইতিহাস প্রসঙ্গে’ লেখাটি লেখা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। তখন প্রয়াত কবি সিকান্দার আবু জাফর কলকাতা থেকে সাপ্তাহিক ‘অভিযান’ পত্রিকাটি প্রকাশ করতেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষা বিষয়ক সেমিনারে পাঠ করার জন্য ‘শিক্ষার দর্শন’ শীর্ষক রচনাটি লিখিত হয়।
একটু ভুল হয়ে গেল। ছাত্র থাকার সময়ে যে সকল প্রবন্ধ লিখেছি ‘বার্ট্রান্ড রাসেল’ও সেই পর্যায়ভুক্ত রচনা। লেখাটি ড. আহমদ শরীফের বাড়িতে পাঠচক্রের একটি সাপ্তাহিক সভায় পঠিত হয়েছিল।
প্রথম সংস্করণে যে সকল রচনা প্রকাশিত হয়েছিল অপ্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় বর্তমান সংস্করণটিতে চারটি প্রবন্ধ বাদ দেওয়া হলো। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থটিতে অন্তত তিনটি রচনা স্থান পেয়েছে; যেগুলোর জন্য আমি সামান্য কৃতিত্ব দাবি করতে পারি। প্রথমত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের একটি চরিত্র প্রবন্ধটির কথা উল্লেখ করব। হোসেন মিয়ার চরিত্রটিকে আমি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছি সেটি একেবারে নতুন। ইতোপূর্বে বাংলা সাহিত্যে কোনো সমালোচনা মানিকের সৃষ্ট ওই অপূর্ব চরিত্রটির এরকম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাননি।
গৌতম ঘোষ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটির যে চিত্ররূপ দিয়েছেন তাতে খুঁটিয়ে বিচার করলে আমার এ প্রবন্ধটির প্রভাব লক্ষ্য করা যাবে। গৌতম যে উৎকৃষ্ট ছবি করতে পারেননি সেই দোষ তো আমার নয়। আমি তো চরিত্রটির সঠিক ব্যাখ্যা করেছিলাম।
দ্বিতীয় যে প্রবন্ধটির কথা উল্লেখ করতে চাই সেটি হলো ‘বাংলার চিত্র ঐতিহ্য : এবং সুলতানের সাধনা’। এই বিশেষ রচনাটি লিখতে পারার কারণে আমি মনে করি একটা বড় সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দায়িত্ব পালন করেছি। পঞ্চাশের দশকের দিকে শিল্পী এস. এম. সুলতান ইউরোপ আমেরিকায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কনটেমপরারি গ্রেট মাস্টার্স পিকাসো, ডালি, মাতিস, পল ক্লি প্রমুখ শিল্পীদের সঙ্গে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন, এ কথা সত্য বটে। কিন্তু দেশে ফিরে আসার পরে তার কথা লোকে একেবারেই ভুলে যায়। তিনি নড়াইলের কৃষিজীবী সমাজের সঙ্গে একেবারে মিলেমিশে জীবন যাপন করতে থাকেন। এখানে ওখানে কিছু ছবি এঁকেছেন। শিশুদের আঁকার তালিম দিয়েছেন। গাঁজা চরস টেনে তার দিন কেটে যাচ্ছিল। ১৯৭৬ সালে দেশে আসার প্রায় ত্রিশ বছর পর শিল্পকলা একাডেমীতে সুলতানের একটি চিত্র প্রদর্শনী হয় এবং এতে পাঁচশর মতো ছবি স্থান পেয়েছিল।
আমাদের দেশের শিল্পী এবং চিত্র অনুরাগী মহল সুলতানের এই অমর চিত্র সমূহের প্রতি কোনো অনুরাগ দেখাতে পারল না- এ ঘটনাটা আমাকে ভয়ংকর রকম ব্যথিত করে। এই শহরবাসী মানুষদের এই নীরব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে সুলতানের প্রতিভা যথাযথভাবে দেশের মানুষদের সামনে তুলে ধরার একটা তীব্র আকাক্ষা আমার মধ্যে জাগ্রত হয়। আমি পেশাদার চিত্রসমালোচক ছিলাম না; শিল্পেও আমার কোনো রকমের অধিকার বোধ ছিল না। প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অভাব সত্ত্বেও সুলতানের উপর দীর্ঘ প্রবন্ধটি আমি রচনা করি। এ লেখায় সুলতানকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রকরদের একজন হিসাবে চিহ্নিত করার কারণে আমাদের দেশের ছবি আঁকিয়েদের কাছ থেকে অনেক খারাপ কথা শুনতে হয়েছে। এটা গেল এক দিক। আরো একটা দিক রয়েছে। এ রচনাটি প্রকাশিত হবার পর শিল্পী সুলতানকে নতুনভাবে বিচার করার একটা প্রক্রিয়াও এখানে শুরু হয়। মূলত আমার রচনার বিশ্লেষণধারা অনুসরণ করে তরুণ চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ সুলতানের জীবন অবলম্বন করে ‘আদম সুরাত’ শিরোনামে একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করেন। দেশের একজন প্রথিতযশা কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই ‘সুলতান’ উপন্যাসটি লিখেন। সুলতানকে ঘিরে এক ব্যাপক কর্মতৎপরতার সূচনা হয় এবং অল্পদিনের মধ্যেই একটি জীবন্ত কিংবদন্তী হিসেবে সুলতানের নাম বাংলাদেশের ঘরে ঘরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাকে রাষ্ট্রীয় শিল্পীর মর্যাদা দেয়া হয় এবং সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মানও তাকে দেখানো হয়। অনেকগুলো দেশ থেকে চিত্র প্রদর্শনী করার আমন্ত্রণ আসে। সুলতানের অসুস্থতার কারণে কোথাও যাওয়া সম্ভব হয়নি। তার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে জার্মানিতে তার নামে একটি মিলনায়তনের নামকরণ করা হয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেছে যে সুলতানের জন্মস্থান নড়াইলে একটি যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং এ উদ্দেশ্যে সরকার দেড় কোটি টাকা অনুদান বরাদ্দ করেছে। আমার ধারণা সুলতান সম্পর্কিত লেখাটি প্রকাশিত না হলে আমাদের দেশ ও পৃথিবীর সামনে সুলতানের এই নতুন পরিচয় তুলে ধরা সম্ভব হতো না। সুলতান একজন মহান শিল্প ব্যক্তিত্ব, তবু আমার একটা বিশ্বাস জন্মেছে, হয়তো এ প্রবন্ধটি না লিখলে সুলতানের পরিচয়টি এমনভাবে ঝালিয়ে তোলা সম্ভব হতো না।
এ লেখার শুরুতে বলেছিলাম নাম প্রবন্ধ বাঙালি মুসলমানের মনের উপর আরো কিছু কথাবার্তা বলব। আমি বাঙালি মুসলমান সমাজের সৃষ্টিকর্ম বিশ্লেষণ করে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম যে, বাঙালি মুসলমান রচিত কোনো শৈল্পিক এবং দার্শনিক সৃষ্টি কোনোরকম তাৎপর্য দাবি করতে পারে না। তার কারণ, এই সমাজ বাইরের দিক দিয়ে পারিপার্শ্বিক পৃথিবীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তাপে চাপে বাধ্য হয়ে অল্পবিস্তর পরিবর্তিত হলেও তার কৌম সমাজের মনের গণ্ডীবদ্ধতার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বাঙালি মুসলমানের সমষ্টিগত মনের প্রসারহীনতার একটি মুখ্য কারণই আমি নির্দেশ করতে চেষ্টা করেছি। শুরু থেকেই বাঙালি মুসলমান সমাজ রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পর্কিত ছিল না বলেই তার মনের ধরনধারণটি অশ্বখুরাকৃতি হ্রদের মতো থেকে গেছে। মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতাই তার জাগতিক অগ্রগতির উৎস। বাঙালি মুসলমান চিন্তাই করতে শেখেনি। তার কারণ, কখনো সে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করার অধিকার পায়নি। একটি রাষ্ট্রগঠনের মাধ্যমে একটি সমাজ বিশ্ব সমাজের অংশে পরিণত হয় এবং বিশ্বসভায় একটি আসন অধিকার করে।
বাঙালি মুসলমানের উল্লেখ করার মতো কোনো কীর্তি ছিল না। কিন্তু বাঙালি মুসলমান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি বাঙালি জাতীয় রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। এটাই তার সবচাইতে বড় এবং অবিস্মরণীয় কীর্তি। এ কীর্তির পাশে অন্যবিধ কীর্তিগুলো ম্লান হয়ে যায়। এখানে একটা কথা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে। আমি বাঙালি মুসলমান বাঙালির জাতি ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছে এই কথাটি। বলে অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দাবি খারিজ করিনি। বাংলাদেশে সংখ্যাধিক মানুষ মুসলমান এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা সবচাইতে প্রণিধানযোগ্য সে কথাটি মনে রেখে বলেছি বাঙালি মুসলমান একটি বাঙালি জাতীয় রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলি এই জাতীয় রাষ্ট্র সৃষ্টিতে কোনো ভূমিকা পালন করেনি সে কথা আদৌ সত্য নয়।
ইতিহাসে বিশ-ত্রিশ বছর কোনো দীর্ঘ সময় নয়। বাঙালি মুসলমান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র যন্ত্রটি প্রতিষ্ঠা করেছে সে রাষ্ট্রের সংকটের অন্ত নেই, কোথাও কোনো দিক-নির্দেশনার চিহ্ন পরিদৃশ্যমান নয়। সামাজিক সভ্যে এবং ধর্মীয় কুসংস্কার সাম্প্রতিককালে এমন প্রচণ্ড আকার নিয়ে দেখা দিয়েছে, অনেক সময় মনে হয় এই জাতি মেরুদণ্ডের উপর থিতু হয়ে কোনোদিন দাঁড়াতে পারবে না। মধ্যযুগীয় ভূত এই জাতিকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে তার নাগপাশ কখন কিভাবে ছাড়াতে পারবে একথা এখন একরকম চিন্তা করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান অস্থিরতা এবং মধ্যযুগীয় ধর্মীয় বদ্ধমতের পুনরুত্থানের একটি কারণ আমি নির্দেশ করতে চাই। শুরু থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে দলটি গিয়েছিল তার আদর্শিক বৃত্তটি বিশ্লেষণ করলেই সেটি ধরা পড়বে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে। অন্যান্য দলও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানী ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিবুর রহমান নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। সুতরাং একথা বলা একটুকুও অযৌক্তিক হবে না যে, মূলত আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগের একটা অংশ। পাকিস্তানের সঙ্গে বাস করে তাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারছিল না বলে আওয়ামী লীগকে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা করতে হয়েছিল।
একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন তাৎপর্যের দিক দিয়ে দুটি এক জিনিস নয়। এই আওয়ামী লীগের আন্দোলন যতই বেগ এবং আবেগ সঞ্চয় করেছে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের নেতৃত্ব কবুল করে নিয়েছিল। কিন্তু সমাজের ভেতর তারা কোনো নতুন মূল্য চিন্তার জন্ম দিতে পারেনি; নতুন সংস্কৃতি নির্মাণ করতে পারেনি। তারা সেকুলারিজমের নীতিকে শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর শেখ মুজিব সপরিবারে যখন নিহত হলেন তখন তার অনেকদিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। মূলত আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যারা আমাদের জনগণের ঐতিহাসিক সংগ্রামের উত্তাপ থেকে জন্ম নিয়েছে এবং তাই তার একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। মুশকিলের কথা হলো আওয়ামী লীগ যখন জেতে তখন মুষ্টিমেয় নেতা বা নেত্রীর বিজয় সূচিত হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন পরাজিত হয় গোটা বাংলাদেশটাই পরাজিত হয়, আওয়ামী লীগের যারা বুদ্ধিজীবী তাদের অনেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলমান সমাজে গ্রহণযোগ্য ভাষায় কথা বলতে জানেন না। তাদের কথা অনেক সময়ে মনে হয় ভারতের তথাকথিত সেকুলার বুদ্ধিজীবীদের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মাত্র। আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরা দেশের ভেতরে সেকুলারিজম আবিষ্কার করতে অক্ষম। বাইরে থেকে সেকুলারিজম আমদানি করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এখানেই আমাদের জাতি এবং সমাজ জীবনের যাবতীয় বিপত্তির উৎস। মুসলিম সমাজ এবং সংস্কৃতির ভেতরে একটা সেকুলারিজম-এর ভিত প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আমাদের জনগণের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। শেষ কথা আমি এই বলতে চাই যে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ধর্মীয় সংস্কারে পীড়িত মুসলিম সমাজের দিকে অত্যন্ত সাহস নিয়ে সহানুভূতির সঙ্গে তাকাতে হবে। মধ্যযুগীয় সমাজকাঠামোর ভেতরে আধুনিক সমাজের বীজ রোপণ করে প্রাচীন সমাজ কাঠমো ফাটিয়ে ফেলতে হবে। এই কাজটি যেদিন হবে বাঙালি এ জাতীয় রাষ্ট্রটি আপন শক্তি এবং শৌর্য নিয়ে পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রটি জন্ম দিয়েছে সেটি ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে সবচাইতে আধুনিক রাষ্ট্র। এই আধুনিক রাষ্ট্রের দাবি এবং প্রয়োজনটি স্বীকার করে নিয়ে সঠিক রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা লাভ করলে বাংলাদেশ বাঙালি জনগোষ্ঠীর সত্যিকারের আশ্রয়স্থল হিসেবে পৃথিবীতে গৌরবের সঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়াবে।
বুক পয়েন্ট গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশে সাহসী হয়েছেন সেজন্য অনেক ধন্যবাদ। অন্য সকলের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা অন্তহীন।
আহমদ ছফা
২৩/ ০৯/ ৯৫
Leave a Reply