বাঙালির যৌনচর্চা : বটতলা থেকে হলুদ বই – অর্ণব সাহা
বাঙালির যৌনচর্চা : বটতলা থেকে হলুদ বই – অর্ণব সাহা
সপ্তর্ষি প্রকাশন
প্রথম সংস্করণ – জানুয়ারি ২০১৯
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো
.
মুখবন্ধ
‘যৌনতা’ কোনও স্বতঃস্ফূর্ত, ‘স্বাভাবিক’ ও ‘প্রাকৃত’ বিষয় নয়। ‘আধুনিক’ সময়ের সামাজিক উপাদান হিসেবে যৌনতা এক জটিল ‘সাংস্কৃতিক’/ ‘রাজনৈতিক’ নির্মাণ। এই বইয়ের আলোচ্য বিষয়বস্তু হল, সমগ্র উনিশ শতক, বিশ শতকের প্রথমভাগ হয়ে প্রায় আশির দশক পর্যন্ত, বাংলায়, শরীর-কেন্দ্রিকতা, শরীর-বিষয়ক জ্ঞানতত্ত্ব, যৌনবোধ, যৌন আচরণ-অভ্যাস এবং যৌনতা-বিষয়ক সন্দর্ভের একটি সংক্ষিপ্ত চেহারা খুঁজে বের করা। আমাদের প্রাক-ঔপনিবেশিক সমাজে প্রচলিত শরীর-যৌনতা সংক্রান্ত ধারণা ও আচরণগুলো ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে পৌঁছে কীভাবে পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়েছে— তা যেমন এই বইয়ের একটা বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে, তেমনই, বিশ শতকের প্রথম তিন দশক ও পঞ্চাশ-ষাট দশকের যৌনবইয়ের বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা কীভাবে নব্বইয়ের বিশ্বায়ন-পরবর্তী সময়ে এসে বদলে গেল, তারও এক ক্ষীণ ছবি আঁকা হয়েছে এখানে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে জোর দেওয়া হয়েছে ঐতিহাসিক ‘ধারাবাহিকতা’ ও ‘ছেদ’-এর ধারণাটিকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে, অর্থাৎ প্রাক-ঔপনিবেশিক শরীর-যৌনতা-যৌনবোধ সংক্রান্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার কীভাবে ইউরোপীয় জ্ঞান-যুক্তির সংস্পর্শে এসে নতুন চেহারা নিয়েছিল, বা আদৌ নিয়েছিল কিনা— সেই ইতিহাসই বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে এখানে। এক্ষেত্রে, ইউরোপ ‘অনুঘটকের’ কাজ করলেও,পাশ্চাত্যের সঙ্গে ‘সাদৃশ্য’ নয়, বরং ‘পার্থক্য’-ই দেশীয় সাংস্কৃতিক কাঠামোয় ইউরোপীয় প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য এখানে কোনো প্রত্যক্ষ দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে গ্রথিত নয়, বরং ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় তা এক মিশ্র বা বর্ণসংকর জ্ঞানকাঠামোর জগৎ, যেখানে ‘ডায়ালেকটিক’-এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ‘বৌদ্ধিক সম্প্রসারণ’ বা ‘ডিসেমিনেশন’। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, ইংরেজি সাহিত্য-পাশ্চাত্য দর্শনের প্রভাব বিস্তৃত হবার মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য জ্ঞানকাঠামোই আধিপত্যমূলক অবস্থানে চলে আসতে চাইলেও উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই প্রত্যক্ষভাবে ‘জাতীয়তাবাদী’ ভাবধারার বিকাশ, সেই পাশ্চাত্য জ্ঞানকাঠামোয় নিজস্ব সংযোজন ঘটাতে শুরু করে সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় সংহত করার তাগিদে। ফলত, পাশ্চাত্য ‘যুক্তি’/আলোকায়ন’ প্রক্রিয়াকে আত্মস্থ করেও ‘জাতীয়তাবাদী আধিপত্যমূলক বাচন’ বা ‘ন্যাশনালিস্ট হেজিমনিক ডিসকোর্স’ গড়ে তোলে এক সমান্তরাল জ্ঞানকাঠামো এবং আচরণ-অভ্যাস, যা ব্যক্তি-পরিবার-দাম্পত্যভাবনার পুনর্বিন্যাস ঘটায়। যদিও দেশজ বাস্তবতায় এই নব্য ডিসকোর্সের ভিতর ঢুকে পড়ে অসংখ্য ‘নন-ডিসকার্সিভ’ উপাদান। শুধু তাই নয়, যৌনতা-সংক্রান্ত ‘উপস্থাপনা’-কে বহুক্ষেত্রেই প্রতিস্থাপিত করে প্রকৃত সামাজিক ‘বাস্তবতা’। এবং যেহেতু ‘ঔপনিবেশিক ক্ষমতা’ এবং ‘জাতীয়তাবাদী ক্ষমতা’ কখনোই সমগ্র সমাজদেহকে পুরোপুরি অধিকৃত করতে পারেনি, সেহেতু আধিপত্যবাচক সন্দর্ভের সার্বিক নজরদারি ও আওতার বাইরে রয়ে যায় অসংখ্য বিপরীতধর্মী আচার-আচরণ ও প্রতিস্পর্ধী জ্ঞানকাঠামো। সেই জটিল, বহুমাত্রিক ‘যৌনতা-নির্মাণে’র এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশকেই ধরতে চাওয়া হয়েছে এই বইতে। গবেষণার মুখ্য উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে উনিশ শতকীয় বাংলা নাটক-প্রহসন, গদ্যগ্রন্থ, উপন্যাসধর্মী রচনা, কাব্য-পুস্তিকা, যৌন-নির্দেশিকা, বাংলা কামশাস্ত্র, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত লেখালেখি, বিশ শতকের গোড়ায় প্রকাশিত বেশ কিছু জনপ্রিয় বই, যেগুলো আজ সামাজিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তুলনায় ‘এলিট’ সাহিত্যিক উপাদান এখানে কমই ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যবহৃত হয়েছে বিংশ শতকের একাধিক সেক্স-ম্যানুয়াল। ষাট-সত্তর থেকে সাম্প্রতিক সময়ের বাংলা পর্নোগ্রাফিক বইও আলোচনায় এসেছে। এগুলো সবই আজকের জ্ঞানচর্চায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরে শরীর-যৌনতা সংক্রান্ত ধারণাগুলো কীভাবে বিধিবদ্ধ প্রকরণ হিসেবে গড়ে ওঠে ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে, সেই আলোচনায় ‘এথিকস’ ও ‘মর্যালিটি’-র ভিতরের সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলোকেও আলোচনায় নিয়ে আসা দরকার। বিশ্লেষণ করা দরকার সামাজিক ‘ক্ষমতা’ কীভাবে এই ধারণাগুলোকে প্রভাবিত ও পরিচালিত করে এবং সর্বজনীন ‘সত্য’ হিসেবে এগুলোর ‘স্বাভাবিকীকরণ’ ঘটায়। ‘আধুনিকতা’-র প্রধানতম উপকরণ ‘নৈতিকতা’ নামক ‘ধারণা’-র সম্ভাব্যতা ও অসম্ভাবতাও ব্যাখ্যা করা দরকার। এই বিষয়টির ‘জিনিওলজি’ খুঁজতেই গ্রিকো-রোমান যুগ থেকে প্রাক-রেনেসাঁস যুগ পর্যন্ত ইউরোপীয় প্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। একদিকে আলোচিত হয়েছে ‘জ্ঞান-যুক্তি-আলোকপর্বে’র যুগ থেকে উনিশ শতকীয় ‘আধুনিকতা’-য় মান্য ‘যৌননৈতিকতা’-র লক্ষণগুলো। অন্যদিকে ব্যাখ্যাত হয়েছে ইউরোপীয় ইতিহাসভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের নিরিখে শরীর-যৌনতা সংক্রান্ত বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার। খোঁজা হয়েছে সার্বিক জীবনসাধনার চতুর্বর্গ উদ্দেশ্যের অন্যতম হিসেবে ‘কাম’-এর অবস্থান ও আমাদের ঐতিহ্যে ‘শরীর’-বিষয়ক দার্শনিক ধারণা। ব্যবহৃত হয়েছে প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় ভারতীয় কামশাস্ত্রসমূহ, মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যে উপস্থাপিত ‘কাম’, বিভিন্ন ধরনের ‘দেহবাদী’ ধর্মসাধনায় ‘শরীর’ ও ‘কাম’-এর গুরুত্ব এবং বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক যুগসূচনায় মান্য স্ত্রী/পুরুষ লিঙ্গপরিচয়ের বাইরে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ সংক্রান্ত আলোচনা।
উনিশ শতকে ‘মুদ্রণপুঁজি’-র সংস্পর্শে প্রাক-ঔপনিবেশিক কামসাহিত্য বাজারোপযোগী এক নতুন চেহারা লাভ করে। নতুন ‘মুদ্রণসংস্কৃতি’ উনিশ শতকের গোড়া থেকেই জনসমাজের ভিতর এযাবৎ প্রচলিত কামসাহিত্য ও কামসংস্কৃতির এক নতুন উপভোগের পরিসর তৈরি করল। এক্ষেত্রে মহিলা পাঠক ও মুসলিম পাঠকের উপভোক্তা হিসেবে পৃথক ভূমিকাও বিবেচ্য। বটতলার প্রকাশনার মধ্য দিয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল আঠারো শতকের বিখ্যাত টেক্সট বিদ্যাসুন্দর। অসংখ্য নতুন সংস্করণের মধ্য দিয়ে বিদ্যাসুন্দর কাব্যের নানামাত্রিক প্রতিসরণ ঘটছিল। ১৮৫০-এর দশক থেকে শুরু হওয়া ‘বিদ্যাসুন্দর-বিতর্ক’ উনিশ শতকীয় ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালির মননে শ্লীলতা-অশ্লীলতা সংক্রান্ত নতুন ‘ডিসকার্সিভ প্র্যাকটিস’ ও আলোচনার সাক্ষ্য বহন করে। এমনকী, ‘বিদ্যাসুন্দরে’র অনুকরণে যেমন একদিকে প্রচুর টেক্সট লেখা হতে লাগল, তেমনই, লেখা হচ্ছিল অজস্র কামগ্রন্থ, যেমন— দূতীবিলাস, আদিরস, স্ত্রীজাতির দুরাচরণের কথা, কামিনী গোপন ও যামিনী যাপন, গোপন বিহার, অনঙ্গবিলাস ইত্যাদি। এছাড়াও ছিল যৌনকেচ্ছা-মূলক লেখালেখির এক বিপুল ভাণ্ডার, যার কিছুটা আমরা এখানে আলোচনা করেছি সম্বাদ রসরাজ পত্রিকার লেখাগুলির বিস্তারিত ব্যাখ্যায়। বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে এইসব পাঠ্যবস্তু ও সাংস্কৃতিক উপাদান প্রাক-ঔপনিবেশিক জনরুচি, অভ্যাস ও দৃষ্টিকোণকে আদৌ পরিবর্তিত করতে পেরেছিল কিনা, বা, পারলেও কতটা পেরেছিল। এক্ষেত্রে আমাদের মত হল, সামাজিক রুচির ক্ষেত্রে কোনও সর্বাত্মক ‘ছেদ’ ঘটেনি, বরং প্রাক-ঔপনিবেশিক কামসংস্কৃতির ‘ধারাবাহিকতা’-ই ভিন্ন ভিন্ন নতুন চেহারায় প্রচলিত থেকেছে।
‘সন্দর্ভ’ ও যৌনতার আন্তঃসম্পর্কও আলোচিত হয়েছে এখানে। আধুনিক যুগে ‘ক্ষমতা’ যৌনতা-বিষয়ক ‘সন্দর্ভ’কে গড়ে তোলে ও নিয়ন্ত্রণ করে। আধুনিক ইউরোপে ‘সেক্স’ নামক ‘সম্বন্ধের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার’ (ডিপ্লয়মেন্ট অফ অ্যালায়েন্স), জ্ঞান-যুক্তি-আলোকায়নের প্রভাবে ‘সেক্সুয়ালিটি’ নামক এক পুরোদস্তুর ‘ডিসকার্সিভ’ জ্ঞানচর্চায় পরিণত হয়। ইউরোপীয় জ্ঞানকাঠামোর অঙ্গ হিসেবে আমাদের উনিশ শতকীয় ‘বাঙালি ভিক্টোরিয়ান’ সমাজেও, মিশেল ফুকো-কথিত ‘স্ট্র্যাটেজিক ইউনিটি’-গুলোর মাধ্যমে যৌনতার ‘আধুনিক’ ডিসকোর্স মান্যতা পেতে থাকে। একের পর এক সেক্স ম্যানুয়াল লেখা হয়, যেখানে, যৌনতাকেন্দ্রিক জ্ঞানপ্রকরণের সঙ্গে পাশ্চাত্য মেডিক্যালাইজেশন পদ্ধতি মিলেমিশে এক নতুন ‘বর্ণসংকর’ জ্ঞানকাঠামোর জন্ম হয়। এর পাশাপাশি লেখা হতে থাকে একেবারে দেশীয় ‘কামশাস্ত্র’ তথা ‘যৌনবিজ্ঞান’-এর বই, যেখানে পাশ্চাত্য ডিসকোর্স আদৌ প্রভাব ফেলেনি।
ইউরোপিয় এনলাইটেনমেন্টের ধাঁচে আমাদের নিজস্ব ব্যক্তি-পরিবার -দাম্পত্যভাবনার ক্ষেত্রে এক নতুন যৌননৈতিকতার সূচনা হয়। উনিশ শতকীয় আত্মচরিত, উপন্যাস, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখালেখির মধ্য দিয়ে এই বিশেষ নৈতিকতার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। এক্ষেত্রে বাইরে থেকে প্রযুক্ত ‘ক্ষমতা’র অবদমন প্রক্রিয়ার তুলনায় ‘আত্মশৃঙ্খলা’র ধারণাটি কার্যকর হয়ে ওঠে। বাঙালি শিক্ষিত পরিবারে এই ভিক্টোরিয়ান যৌনশৃঙ্খলার আরোপ ও তা থেকে বিচ্যুত হবার ফলে ‘ব্যক্তি’র তীব্র উৎকণ্ঠাও এক চালু নিদর্শন হয়ে দাঁড়ায়। পাশ্চাত্য-প্রভাবিত দাম্পত্যভাবনায় স্ত্রীকে স্বামীর সর্বাঙ্গীন সঙ্গী হিসেবে ভাবা হতে থাকে। ঐতিহ্যাগত বাঙালি দাম্পত্যের ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা ও আদর্শ দাম্পত্যের রীতিনীতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার মধ্য দিয়ে ‘দাম্পত্য’ সেদিন হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন ‘সন্দর্ভক্ষেত্র’। এবং বলাই বাহুল্য, এই নতুন ‘দাম্পত্যভাবনা’ও ছিল রীতিমতো পুরুষতান্ত্রিক ও লিঙ্গাত্মক। একদিকে দাম্পত্য-বিষয়ক নতুন ভাবনার বিস্তার, উলটোদিকে, গোটা উনিশ শতক ও বিংশ শতকের প্রথম দিকটা জুড়ে খোলাখুলি গণিকাবিলাসের বৈপরীত্য— দুটোই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছবি। বাল্যবিবাহ-বহুবিবাহ-বালবৈধব্য-নারীপুরুষের অসম দাম্পত্যসম্পর্ক-দাম্পত্যবহির্ভূত সম্পর্ক ও গণিকাগমন সেদিনের অসংখ্য নাটক-প্রহসনের চালু বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
বিংশ শতকের প্রথম দুই/তিন দশকের ভিতর বাঙালি চৈতন্যে শরীর-যৌনতা সংক্রান্ত উনিশ শতকীয় ভাবনায় লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে যায়। অন্ত্য-উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ এক ‘কাল্পনিক জাতিরাষ্ট্রে’র কেন্দ্রীয় প্রকল্পের আধারে ব্যক্তি-পরিবার-দাম্পত্যসম্পর্কের ভিতর যৌনতার স্থানাঙ্ক নির্ণয় করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তথাকথিত ‘হিন্দু আধ্যাত্মিক’ ভাবকাঠামোর অংশ হিসেবে শরীর/যৌনতার তাৎপর্য অস্বীকৃত হয় এবং পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যবাচক ডিসকোর্সের বাইরে ‘ব্যক্তি’-র স্বাধীন, ইনডিভিজুয়াল সত্তার গুরুত্ব মান্যতা পেতে শুরু করে। মনস্তত্ত্ব বা মনোসমীক্ষণ-সংক্রান্ত বিপুল লেখালেখির সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে শিক্ষিত বাঙালি। ফ্রয়েড-হ্যাভলক এলিসদের প্রভাবে উনিশ শতকের ‘জৈব শরীর’ (অরগ্যানিক বডি) এবার বদলে যেতে থাকে ‘মনস্তাত্ত্বিক শরীর’-এ (সাইকোলজিক্যাল বডি)। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত উনিশ শতকীয় যৌন-দৃষ্টিকোণ যে খুব একটা বদলায়নি, কোনও সার্বিক ‘ছেদ’-এর জন্ম দেয়নি, তারও প্রমাণ পাওয়া যায় অসংখ্য উপাদানের ভিতর।
গবেষক জেফরি উইকস তাঁর বিখ্যাত গবেষণায় বলেছিলেন, যৌনতা হল ঐতিহাসিকভাবে অনিশ্চিত এবং খাপছাড়া একটি বিশেষ ধরনের নির্মিত ‘সামাজিক উপাদান’, যা একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে কয়েকটি নির্দিষ্ট কৌশলের মধ্য দিয়ে বিশ্লেষণযোগ্য, ব্যাপক জ্ঞানভাণ্ডারের জন্ম দিয়েছে। ‘সেক্স’ এবং ‘সেক্সুয়ালিটি’ যেমন আলাদা, তেমনই যৌনক্রিয়া এবং যৌন অস্তিত্ব—এই দুয়ের ভিতরেও বড়ো ধরনের পার্থক্য গড়ে উঠতে থাকে বিশ শতকের গোড়া থেকেই। তাই ডেভিড হ্যালপেরিন বলেছিলেন, আধুনিক যুগে ব্যক্তির যৌনপ্রাতিস্বিকতার পৃথক পৃথক ধারণাগুলো (যেমন, হোমোসেক্সুয়ালিটি, হেটেরোসেক্সুয়ালিটি, বাইসেক্সুয়ালিটি ইত্যাদি) দিয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ের যৌন আচরণ/অভ্যাস/নৈতিকতার পুরোদস্তর ব্যাখ্যা করা যাবে না। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর মতে, খ্রিস্টপূর্ব গ্রিক সমকামকে আধুনিক ‘হোমোসেক্সুয়ালিটি’ নামক বর্গ দিয়ে ব্যাখ্যা করা অনুচিত। আরও এগিয়ে মিশেল ফুকো যেমন দেখিয়েছেন, ‘সেক্সুয়ালিটি’ আসলে আধুনিক যুগে ‘সামাজিক ক্ষমতা’ আর ‘টেকনোলজি অফ সেলফ’-এর সমন্বয়ে গড়ে-ওঠা ‘বিষয়’। আধুনিক বাঙালির মননেও ‘যৌনতা’ নামক বিশেষ উপাদানটি গড়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক জ্ঞান-যুক্তি-আলোকায়ন উদ্ভূত ‘ক্ষমতা’-র অভিব্যক্তি হিসেবে। যদিও এই ঐতিহাসিক নির্মাণ-প্রক্রিয়াটি ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ‘সম্পূর্ণ অনুরূপ’ নয়, ‘প্রায়-অনুরূপ’ পদ্ধতিতে গড়ে উঠেছে। এই বইটি সেই ‘প্রায়-অনুরূপ’ ঐতিহাসিক নির্মাণ-কৌশলকে বুঝতে চাওয়ার একটি খণ্ডিত চেষ্টা মাত্র। ‘সাদৃশ্য’গুলোর পাশাপাশি তাই এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ‘পার্থক্য’-গুলোকেও চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে।
এই বইয়ের প্রবন্ধগুলো বেরিয়েছিল অনুষ্টুপ, অবভাস, একালের রক্তকরবী, কারুবাসনা, ব্রাত্যজন নাট্যপত্র, একদিন এবং এই সময়-এ। কয়েকটি লেখা পরিমার্জিত হয়েছে। সম্পাদক এবং যে শিক্ষক-বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীরা বিভিন্ন সময়ে সাহায্য করেছেন, তাঁদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। কৃতজ্ঞতা জানাই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, চৈতন্য লাইব্রেরি ও উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি কর্ত,পক্ষকে, যারা নানাভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
অর্ণব সাহা
কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯
Amit
I want this book in pdf
Sajjadul
Plz send