বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র – হুমায়ুন আজাদ
আগামী প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ – ফাল্গুন ১৩৮৯ : ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩
প্রচ্ছদ – সমর মজুমদার
Bangla Bhashar Shatrumitra – Humayun Azad
(The Foes and Friends of Bengali Language)
উৎসর্গ
বাঙলা ভাষার মিত্র
শক্তির প্রতারিত উৎসদের উদ্ধত হাতে
তুমি আর আমি সে-গোত্রের যারা চিরদিন উৎপীড়নের মধ্যে গান গায় –
হাহাকার রূপান্তরিত হয় সঙ্গীতে-শোভায়।
তোমার ‘অ, আ’ চিৎকার সমস্ত আর্যশ্লোকের চেয়েও পবিত্র অজর
তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চণ্ডীদাস
শতাব্দীকাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন
তোমার থরোথরো প্রেমের নাম রবীন্দ্রনাথ
বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম
আমাদের আদিগন্ত আর্তনাদ বিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের একমাত্র গান
ভূমিকা
এ-ছোটো বইটি বা দীর্ঘ রচনাটি লিখেছিলাম আমি ষোলো বছর আগে, যখন দেশে এক সামরিক অন্ধকার ও এক ক্ষুদ্র একনায়ক নিহত হওয়ার পর, আরেক সামরিক অন্ধকার আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, এবং মহাসমারোহে এসে পড়েছিলো লেখাটি পত্রিকায় বেরোনোর এক মাসের মধ্যেই। তারপর ষোলো বছর ও অনেক অন্ধকার কেটে গেছে, বাঙলাদেশ যাপন করেছে বিপর্যয়ের পর বিপর্যয়, এবং শূদ্র বাঙলা ভাষার অবস্থানের কোনোই উন্নতি ঘটে নি। বইটির কথা আমি ভুলতেই বসেছিলাম, কিন্তু কয়েকজন অনুরাগী মাঝেমাঝে বইটিকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন ব’লে এটি আবার বেরোলো।
বইটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে যে বাঙলাদেশের সমাজ-রাষ্ট্রের শক্তিশালী ব্যক্তি, শ্রেণী, প্রতিষ্ঠান, সংঘমাত্রই বাঙলা ভাষার, সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় ও প্ৰত্যক্ষ বা পরোক্ষ, শত্রু; তাঁদের শত্রুতার জন্যেই বায়ান্নোর বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা অর্জনের এতোগুলো দশক পরেও বাঙলা ভাষা সমাজ, রাষ্ট্র ও জীবনে প্রাপ্য প্রতিষ্ঠা পায় নি। জীবনের চারটি এলাকা- দৈনন্দিন জীবন, সাহিত্য, শিক্ষা, ও প্রশাসন-এর মধ্যে শক্তির এলাকা দুটিতেই বাঙলা ভাষা অপ্রতিষ্ঠিত। দৈনন্দিন জীবন ও সাহিত্যের এলাকা দুটি অত্যন্ত ব্যাপক, কিন্তু প্রত্যক্ষ শক্তির এলাকা নয়। শিক্ষা ও প্রশাসন- প্রশাসন বলতে আমি রাষ্ট্রপরিচালনা থেকে ব্যবসাবাণিজ্য, যা কিছু সমাজ-রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, তার সব কিছুকেই বোঝাচ্ছি— শক্তির এলাকা। এর মাঝে প্রথমটি সৃষ্টি করে শক্তিমানদের, এবং দ্বিতীয়টি শক্তিমানদের সাম্রাজ্য : সেখান থেকে সামন্ত প্রভুদের মতো তাঁরা শাসন করেন ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের নষ্টভ্রষ্ট দেশটি। বাঙলা ভাষা বেশ প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় শিক্ষা-এলাকায়; আর প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় প্রশাসন-এলাকায়। আমাদের শক্তিমানগণ ও শক্তিকেন্দ্রগুলো কী প্রক্রিয়ায় প্রতিহত করছে বাঙলা ভাষাকে, ও তার শোষিত মিত্রদের, বইটিতে উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছি তারই সূত্র। আমার অনুসন্ধান একটি ভয়াবহ সত্য উপহার দিয়েছে; সেটি হচ্ছে এভাবে যদি এগোতে থাকে বাঙলাদেশ, তাহলে বিশ ও একুশশতকের অনেক দশকে বাঙলা ভাষা ও তার শোষিত মিত্রদের, সাধারণ মানুষের, প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। বাঙলার শোষিত শ্ৰেণী, প্রগতিশীলতা, ও বাঙলা ভাষা একই সূত্রে গ্রথিত; এ-তিনের প্রতিষ্ঠা ঘটবে একই দিনে। এর আগে শক্তির প্রতারিত উৎসরা শাসকসম্প্রদায়ের কাছ থেকে পাবে শুধু চমৎকার বাক্য, সময়োপযোগী স্তুতি, স্নিগ্ধ প্রতারণা, ও মাঝেমাঝে প্রচণ্ড উৎপীড়ন।
বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র প্রচ্ছদপ্রবন্ধরূপে বেরিয়েছিলো সাপ্তাহিক বিচিত্রার ১৯৮২র একুশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়। প্রবন্ধটিকে বইরূপ দেয়ার জন্যে নানা সংস্কার করেছি, যোগ করেছি কয়েকটি পরিচ্ছেদ, এবং বিয়োগ করেছি আমার অনেক বিক্ষোভ। দুটি পরিশিষ্ট যুক্ত করেছি;- এর প্রথমটি, ‘ভাষা-আন্দোলন : নূরুল আমীনের দৃষ্টিতে’ বেরিয়েছিলো প্রবন্ধপত্রিকা বক্তব্য-এ। নিন্দিত নূরুল আমীনের ভাষণটির ভূমিকা লেখার সময় বায়ান্নোর বৃহস্পতিবারের রক্তধারা ফিনকি দিয়ে উঠেছিলো আমার চোখের সামনে, মিছিল দেখতে পাচ্ছিলাম, বারুদের গন্ধে ভ’রে গিয়েছিলো আমার বাস্তব ও কল্পনা- তখন আমার বয়স কম ছিলো; এবং ভূমিকাটি রচিত হয়ে যাওয়ার পর শিহরিত আনন্দে আমি আবিষ্কার করি যে নূরুল আমীন ও তার গোত্রকে আমি নির্দেশ করেছি ‘সে/তারা’ সর্বনাম দিয়ে, আর ব্যবহার করেছি তার সাথে সংগত ক্রিয়ারূপ। শোভনতার জন্যে ওই সর্বনাম ও ক্রিয়ারূপকে সম্মানাত্মক রূপে বদলাতে, অনেকের পরামর্শ সত্ত্বেও, আমার বিবেকে বাধছে ব’লে গ্রন্থেও ‘সে/তারা’ রেখে দিলাম। শোভনতা খুব দরকার, ঘাতক দানবদের বেলায়ও? আমি এ সম্পর্কে আজো অনিশ্চিত। দ্বিতীয় সংস্করণে কিছুই যোগবিয়োগ করা হলো না; ভুমিকাটিতে শুধু কয়েকটি নতুন বাক্য বসলো।
হুমায়ুন আজাদ
৫ অগ্রহায়ণ ১৪০৫
১৯ নভেম্বর ১৯৯৮
Leave a Reply