বাঙলার সূফী-সাধনা ও সূফী-সাহিত্য – আহমদ শরীফ
প্ৰসঙ্গ কথা
[প্ৰথম সংস্করণ]
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সূফী মতবাদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এ যুগের বাঙালি সূফীরা মুসলিম ভাবধারার সংগে বৈষ্ণব ভাবধারার সংযোগ সাধনের চেষ্টা করেছিলেন। এর ফলে, একদিকে যেমন আল্লাহ্র পথে মানুষ নিজকে উৎসর্গ করেছে অন্য দিকে তেমনি রসূল (সঃ) প্রবর্তিত শরীয়তের বিধানসমূহও তারা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে গ্ৰহণ কবেছে। আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে পরবর্তী পর্যায়ে তারা বিষয়-বুদ্ধি ও সংসার-চিন্তা ত্যাগ করে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ধ্যানে আত্মনিয়োগ করেছে। মধ্যযুগের সূফী সাহিত্যসমূহ এ প্রচেষ্টারই ফলশ্রুতি।
সূফী মতবাদের উদ্ভব সম্বন্ধে পণ্ডিতরা নানা মত পোষণ করেন। তবে অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন দেশেই এ মতবাদের উন্মেষ। পাক-ভারতে এ মতবাদ প্ৰবেশ ও প্রচার লাভ করেছে ইরানীদের সংগে এদেশবাসীর ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে। তবে এ কথা সত্য যে, পাক-ভারতে সূফী মতবাদের ওপরে স্থানীয় প্রভাব পড়েছে এবং এটা স্বাভাবিকও বটে। বাংলা সাহিত্য মুসলিম সাধকের প্রভাবে কতখানি প্রসারিত হয়েছিল, তারই একটা মোটামুটি চিত্র তুলে ধরার উদ্দেশ্যে বাংলা একাডেমী ‘বাঙলার সূফী সাহিত্য’ গ্ৰন্থখানি প্রকাশ করেছেন।
কাজী দীন মুহম্মদ
পবিচালক, বাংলা একাডেমী
৫ই ফেব্রুযারি ১৯৬৯
প্ৰসঙ্গ কথা
বাঙলাদেশের সমােজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগৎ-এ ড. আহমদ শরীফ (১৯২১-১৯৯৯) একজন প্ৰাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, যাকে উপক্ষো করা যায়। তবে কোন অবস্থাতেই তার বিশাল কীর্তি অস্বীকার করা যায় না। নিজস্ব দর্শন, চিন্তা ও বৈশিষ্ট্যের কারণে বোদ্ধা সমাজের কাছে ছিলেন বহুল আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও এ ধারা বহমান। তবে অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, বাঙলাদেশের মতন একটি অনুন্নত দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে এখানে লেখা-পড়া জানা মানুষের মাঝে না-পড়া এবং না-জানার প্রবণতা গড়ে উঠেছে, তাই কেউ নিজে থেকে কোন বইয়ের বা পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে দেখার গরজ অনুভব করে না। আবার যে কোন মানুষকে বা কোন বিষয়কে সমাজে পরিচিত করতে প্রচার হচ্ছে সবচেয়ে বড় মাধ্যম। সরকারী পৃষ্ঠপােষকতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় পর্যায়ের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিতে বা বিভিন্ন জাতীয়-পর্ষদগুলোতে কিংবা জাতীয় প্রচার মাধ্যম আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোতে যারা ঘুরে-ফিরে সবসময় অংশ গ্ৰহণ করার সুযোগ পেয়ে থাকে তারাই কেবল দেশে শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি লাভ করে থাকে। সরকারী বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের রচনাশৈলী যাই হোক না কেন, তার গুণগত মান প্রশ্ন সাপেক্ষ। তবে সঠিক মূল্যায়ণ বিশ্লেষণ শুধুমাত্র বর্তমান ও ভবিষ্যত-এর গবেষকগণই করতে পারবেন।
বাঙলাদেশে ড. আহমদ শরীফ-এর মতন হাতে গোনা চার থেকে পাঁচজন লিখিয়ে পাওয়া যাবে যারা কোন সময়ই সরকারী বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপােষকতার বেড়াজালে নিজেদেরকে জড়াননি। তাই তারা মননশীল লেখক হিসেবে বা তাদের চিন্তা সমৃদ্ধ গ্রন্থগুলো লেখা-পড়া জানা মানুষের কাছে অদ্যাবধি অজ্ঞাত ও অপঠিত থেকে গেছে। দেশ-স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে মৃত্যুর পরবর্তী বছর অবধি প্রতিবছর গড়ে দুটো করে ড. আহমদ শরীফ-এর মৌলিক রচনা সংবলিত গ্ৰন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত সমােজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের উপর শতের অধিক মননশীল গ্ৰন্থ শুধু অপঠিতই নয়, অগোচরেও থেকে গেছে।
পঞ্চাশ দশকের প্রথম থেকে নব্বই দশকের শেষ অবধি সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন ইতিহাসসহ প্রায় সব বিষয়ে তিনি অজস্র লিখেছেন। দ্রোহী সমাজ পরিবর্তনকামীদের কাছে তাঁর পুস্তকরাশির জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়, তাঁর রচিত পুস্তকরাশির মধ্যে বিচিত চিন্তা, স্বদেশ-অন্বেষা, বাঙালির চিন্তা চেতনার বিবর্তন ধারা, বাঙলার বিপ্লবী পটভূমি, নির্বাচিত প্ৰবন্ধ, প্রত্যয় ও প্রত্যাশা এবং বিশেষ করে দুখণ্ডে রচিত বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য তাঁর অসামান্য কীর্তি। তবে এ কথা নিদ্বিধায় বলা যায় যে, পিতৃব্য আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ-এর অনুপ্রেরণায় মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কে পাহাড়সম গবেষণা কর্ম তাকে কিংবদন্তী পণ্ডিত-এ পরিণত করেছে। উভয় বঙ্গে এ বিষয়ে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় এবং অদ্যাবধি স্থানটি শূন্য রয়ে গেছে। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করে তিনি মধ্যযুগের সামাজিক ইতিহাস রচনা করে গেছেন। বিশ্লেষণাত্মক তথ্য-তত্ত্ব ও যুক্তি সমৃদ্ধ দীর্ঘ ভূমিকার মাধ্যমে তিনি মধ্যযুগের সমাজ ও সংস্কৃতির যে ইতিহাস বাঙলা ভাষা-ভাষী মানুষকে দিয়ে গেছেন, তা বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমর গাঁথা হয়ে থাকবে।
ভারত উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিত সূফীতত্ত্ব ও সূফী সাধনা বিষয় ও তত্ত্বগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে ড. আহমদ শরীফ রচিত ও সম্পাদিত শতাধিক গ্রন্থাবলীর মধ্যে “বাঙলার সূফী সাহিত্য” গ্রন্থটি ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আলোচ্য গ্রন্থে ড. আহমদ শরীফ রচিত ভূমিকা থেকে জানা যায় যে, “ইসলামের উদ্ভবের প্রায় ১৫০ বছর পরের থেকে সূফীমত ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হতে থাকে এবং সময়ের বিবর্তনে প্রচলিত বিভিন্ন শাখার সূফীমতগুলো ভিন্ন ধরনের, তাই সূফীমত হচ্ছে একটি মিশ্র দর্শন” (পৃষ্ঠা : ২১)। প্রসঙ্গত যে, কুফার আবু হাশিমই (মৃত্যু ১৬২ হি:) প্রথম সূফী বলে পরিচিত; তিনি হুজুহরীর সংজ্ঞানুগ সূফী। মূলত: ইব্রাহিম আদহম (মৃত্যু: ১৬২হিঃ); ফাজিল আয়াজ (মৃত্যু: ১৮৮হিঃ); হাসান বসোরী প্রমুখের সাধনা ও বাণী থেকেই বিশিষ্ট ও আলোচিত হয়ে উঠে সূফীমত।
ভারত উপমহাদেশ সূফী ধারায় প্রভাবিত হওয়ার পূর্ব থেকেই সূফীমতবাদ ভারতীয় চিন্তাধারায় পরিপূর্ণ হতে থাকে এবং খ্রিষ্টীয় একাদশ শতক থেকেই এই উপমহাদেশে সূফীমত প্ৰবেশ করে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। উল্লেখ্য যে, এ অঞ্চলে সাধারণত: ইসলাম প্রচার করেন। সূফী-দরবেশগণ। যেহেতু অধিকাংশ মুসলমান এদেশী জনগণেরই বংশধর; সেহেতু পূৰ্বপুরুষের ধর্ম, দর্শন, সংস্কার ত্যাগ করা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। সঙ্গত কারণেই অশিক্ষার দরুণ সূফী সাধকের কাছে দীক্ষিত মুসলমানরা শরীয়তের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করতে পাবেনি। এই কারণেই তারা সূফীতত্ত্বের সঙ্গে যেখানেই সাদৃশ্য-সামঞ্জস্য দেখা গেছে, সেখানেই অংশগ্রহণ করেছে। বৌদ্ধ নাথপন্থা, সহজিয়াতান্ত্রিক সাধনা, শক্তিতন্ত্র, যোগ প্রভৃতি এমনি করে তাদের আকৃষ্ট করেছে এবং এভাবেই মিশ্ৰ-দৰ্শনের উদ্ভব ঘটেছে।
পরিশেষে প্রাসঙ্গিকক্রমে বলতে হচ্ছে যে, ‘বাঙলার সূফী সাহিত্য’ প্রথমে ১৯৬৯ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল। ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান ও সাহিত্যের ছাত্র-ছাত্রী ও গবেষকদের কাছে বিষয়ের গুরুত্ব থাকার কারণে দু-তিন দশক পূর্বেই প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায় এবং বিষয়ের গুরুত্ব ও চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলা একাডেমী বিগত ৩৩ বছরেও গ্রন্থটির পুনর্মুদ্রণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। সঙ্গতকারণেই বাঙলাদেশে প্রকাশনা শিল্পের মধ্যে অন্যতম রুচীিশীল প্রকাশনা সংস্থা ‘সময় প্রকাশন” বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে আলোচ্য গ্ৰন্থটি পুনর্মুদ্রণের জন্য আগ্রহ প্ৰকাশ করাতে এর সত্ত্বাধিকারী জনাব ফরিদ আহমেদ-এর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এছাড়া আমার অজ্ঞতা ও ব্যস্ততার কারণে পাণ্ডুলিপির সর্বশেষ প্রািফ কপি দেখে দিয়েছেন আমার সুহৃদ, গবেষক ড. ইসরাইল খান। গ্ৰন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে জনাব মাহমুদ করিম-এর উৎসাহ ও এডভোকেট যাহেদ করিম-এর সহযোগিতা লাভ করেছি। গ্ৰন্থ প্রকাশের শুত-মুহুর্তে তাদের সকলকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।
ড. নেহাল করিম
অধ্যাপক
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভূমিকা –বাঙলার সূফী-সাধনা ও সূফী-সাহিত্য
১
বাঙলাদেশে সূফীতত্ত্ব ও সূফী সাধনা একটি স্থানিক রূপ লাভ করেছিল। বৈদান্তিক সৰ্বেশ্বরবাদ বা অদ্বৈততত্ত্ব ও যোগের প্রত্যক্ষ প্রভাবই এর মুখ্য কারণ। অবশ্য মধ্য এশিয়ার বৌদ্ধমত ও বৌদ্ধ ভিক্ষুর প্রভাবে সিরিয়া, ইরাক ও ইরানে গুরুবাদী, বৈরাগ্য-প্রবণ ও দেহচৰ্যায় উৎসুক কিছু সাধকের আবির্ভাব বারো শতকের আগেই সম্ভব হয়েছিল। ইরান ও বলখ অঞ্চলের ভাবপ্রবণ লোকমনে বৈদান্তিক সৰ্বেশ্বরবাদের প্রভাবও পরোক্ষ মানসক্ষেত্র রচনায় সহায়তা করেছিল বলে মনে করি।
তাই ভারতে যে-সব সূফী সাধক প্রবেশ করেন, ভারতিক অধ্যাত্মতত্ত্ব ও সাধনার প্রভাব এড়ানো তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁদের কাছে দীক্ষিত দেশী জনগণও পূর্ব-ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত অদ্বৈতচেতনা ও যোগগ্ৰীতি ত্যাগ করতে পারেনি। বিশেষ করে বিলুপ্ত বৌদ্ধ সমাজের ‘যৌগিক-কায়-সাধন’ তত্ত্ব তখনো জনচিত্তে অম্লান ছিল। ফলে “সূফীমতের ইসলাম সহজেই এদেশের প্রচলিত যোগমার্গ ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক সাধনমার্গের সঙ্গে একটা আপোষ করে নিতে সমর্থ হয়েছিল।”(১) একই কারণে ও পরিবেশে পরবর্তীকালে সূফীবাদের সামঞ্জস্য হয়ে সহজিয়া ও বাউল সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়।(২)
ব্ৰাহ্মণ্য-শৈব ও বৌদ্ধ তান্ত্রিক সহজিয়ার সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্ৰমত। এর আধুনিক নাম নাথপন্থ। ‘অমৃতকুণ্ড’ সম্ভবত এদেরই শাস্ত্র ও চর্যগ্রন্থ। এটি গোরক্ষ-পন্থীর রচনা বলে অনুমিত হয়।(৩)
বামাচার নয়–কায়সাধন তথা দেহতাত্ত্বিক সাধনই এদের লক্ষ্য। ‘হঠ’ যোগের মাধ্যমেই এ সাধনা চলে। এক সময় এই নাথপন্থ ও সহজিয়া মতের প্রাদুর্ভাব ছিল বাঙলায়, চর্যাগীতি ও নাথসাহিত্য তার প্রমাণ। এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক পরে ইসলামে ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়। কিন্তু পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম আর বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা নিজেদের পুরোনো প্রথায় ধর্মসাধনা করে চলে, এরই ফলে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত বাউল মতের উদ্ভব। অন্যদিকে অদ্বৈতবাদ ও যোগ পদ্ধতিকে সূফীরা নিজদের মতের অসমন্বিত অঙ্গ করে নিয়ে যোগতত্ত্বে গুরুত্ব আরোপ করতে থাকে। এর ফলে মুসলিম সমাজে ও সাহিত্যে যোগের ও যোগসাধনার ব্যাপক প্রভাব ও চর্চা লক্ষ্য করি।
এখানে আমরা এই যোগ-সাহিত্যেরই পরিচয় নেব। এর জন্যে কিছু পূর্বকথার অবতারণা প্রয়োজন।
২
সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্র সুপ্রাচীন দেশী তত্ত্ব ও শাস্ত্ৰ। Pagan যুগের যাদুবিশ্বাস ও টোটেম স্তরের মৈথুন তত্ত্ব থেকে এর উদ্ভব।(৪) সাংখ্য হচ্ছে তত্ত্ব বা দৰ্শন আর যোগ ও তন্ত্র-এর দ্বিবিধ আচার শাস্ত্ৰ।(৫) এসব তত্ত্ব ও আচারের জড় রয়েছে আদিম মানুষের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ব্যবস্থার চিন্তায় ও কর্মে।
অতএব, মূলত এক অভিন্ন তত্ত্ব শাস্ত্ৰই কালে দুই নামে দুই রূপে বিকশিত হয়েছে। প্রভাব হয়েছিল গভীর, ব্যাপক এবং কালজয়ী। বহিরাগত দ্রাবিড়, আৰ্য এবং উত্তর কালের মুসলিম–এদের কেউ অবহেলা করতে পারেনি এসব, বরং গোড়া থেকেই এর প্রভাবে পড়েছিল সবাই এবং নিজেদের ধর্মমত ও আচারের অসমন্বিত অঙ্গ করে নিয়ে যোগ্যতত্ত্বে বিশেষ গুরুত্ব দিতে থাকে।(৬)
বস্তুবাদী এই নাস্তিক্যতত্ত্বের দেশী স্বাধীন বিকাশও লক্ষণীয়। চাৰ্বািক তথা লোকায়ত মতবাদ এই সাংখ্য-যোগ তত্ত্বের আর আচারের বিশেষ বিকাশ, এবং কালিক বিবর্তন আর স্থানিক রূপান্তরও দেখা যায়।(৭)
আবার মুসলমানরাও এই যোগতত্ত্ব এবং সাধন প্রণালী গ্ৰহণ করে সূফী মতের এক বাঙালী তথা ভারতিক রূপান্তর ঘটিয়েছে। কলন্দর ও কবীরই এ ব্যাপারে বিশেষ নেতৃত্ব দিয়েছেন।
৩
ভেলভেলকার ও রানাডে বলেন “যোগ আদিতে অবৈদিক সাধন পদ্ধতি ছিল এবং আদি যাদুবিশ্বাস তথা sympathetic Magic-এর ধারণাও ছিল এর মূলে।”(৮) A. E. Goughও বলেন–“স্থানীয় অনাৰ্য অধিবাসীদের কাছ থেকেই বৈদেশিক আর্যরা কালক্রমে যোগ সাধন পদ্ধতিটা গ্ৰহণ করেছিল।”(৯) H. Zimmer বলেন “সাংখ্য ও যোগের মূল ধারণাগুলি অত্যন্ত প্রাচীন ও বেদ-পূর্ব যুগের। সাংখ্য ও যোগ জৈনদের যান্ত্রিক দর্শনের সঙ্গে সম্বন্ধ যুক্ত”।(১০)
হরপ্ৰসাদ শাস্ত্রী বলেন ‘কৌটিল্য তিনটি মাত্র দর্শনের উল্লেখ করেন–সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত। সাংখ্য মত সকলের চেয়ে পুরান। উহা মানুষের করা এবং পূর্বদেশের মানুষের করা। উহা আৰ্যদের মত নহে; —বঙ্গ বগধ ও চেরজাতির কোন আদি বিদ্বানের মত।… . বৌদ্ধমত সাংখ্যমত হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, এ কথা অশ্বঘোষ এক প্রকার বলিয়াই গিয়াছেন। বুদ্ধদেবের গুরু আড়ার কলম, উদ্রক–দুজনেই সাংখ্যমতাবলম্বী ছিলেন।(১১) সি. কুহিলান রাজার মতেও সাংখ্যমত অবৈদিক।(১২)
৪
সাংখ্য দর্শন সম্মত ত্ৰিগুণ (স্বত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) এবং প্রকৃতির অন্ধ প্রবণতা, যোগদর্শন সম্মত ইন্দ্ৰিয় সংযম এবং চিত্তের অভিনিবেশ-এর উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে বিশেষ করে অথর্ববেদে মেলে। কঠ, শ্বেতাশ্বতর, বৃহদারণ্যক, ছন্দোগ্য ও মৈত্রায়নী উপনিষদে সাংখ্যসম্মত ধারণা লক্ষ্য করা যায়।(১৩) বৃহদারণ্যকে আছে, যে-ব্যক্তি আত্মা ছাড়া অন্য কোন দেবতার আরাধনা করে সে-দেবগণের গৃহপালিত পশু বিশেষ। বৃহদারণ্যকে ও ছান্দোগ্যে চরম কথা ঘোষিত হয়েছে : আত্মাই ব্ৰহ্ম।(১৪)
যোগ ও সাংখ্য মহাভারতে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। মহাভারতের বিভিন্ন ভাবধারায় প্রাথমিক সাংখ্যের স্বভাববাদী দ্বৈতামত ও প্ৰাথমিক যোগদর্শনের সাধনার অঙ্গস্বরূপ ঈশ্বরবাদের প্রভাব লক্ষণীয়। গীতায় সাংখ্য ও যোগকে অভিন্ন বলা হয়েছে। যোগ হচ্ছে সাংখ্যেব ব্যবহারিক প্রয়োগ। যোগ ও সাংখ্যের দার্শনিক ভিত্তি একই। পতঞ্জলি তাঁর যোগসূত্রে ঈশ্ববরূপ যে একটি তত্ত্বের অবতারণা করেছেন, তার জন্যেই এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য।(১৫)
ছান্দোগ্যে বিরোচন বলছেন–‘এই পৃথিবীতে দেহেরই পূজা করিবে। দেহেরই পরিচর্যা করিবে। দেহকে মহীয়ান করিলে এবং দেহের পরিচর্যা করিলেই ইহলোক ও পরলোক এই উভয়লোকই লাভ করা যায়।’ ৮৮।৪।
৫
তান্ত্রিক আচারগুলোর পূর্বাভাসও বেদে বর্তমান। ঐশীশক্তির স্ত্রীরূপকে উচ্চতর মর্যাদা দান এবং বিষ্ণু আর শিবের শক্তি-মহিমা ও ক্রিয়ার ধারণাও অবৈদিক। আগাম শাস্ত্ৰও অবৈদিক।(১৬) সাংখ্য, যোগ, পাশুপত ও পঞ্চরাত্র যথাক্রমে কপিল, হিরণ্যগৰ্ভ, শিব ও নারায়ণপ্রোক্ত বলে বিশ্বাস করা হয়।(১৭) ছন্দোগ্যে রমণক্রিয়াকে যজ্ঞস্বরূপ এবং আয়ু, পশু (ধান), কীর্তি ও সন্তান লাভের উপায় বলে অভিহিত করা হয়েছে।(১৮) মহাভারতে উদালক ঋষির উক্তিতে আছে, “গাভীগণের মত স্ত্রীগণ শত সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও তারা অধৰ্মলিপ্ত হয় না। (বরং এরূপ আসক্ত হওয়াই) নিত্য ধর্ম”।(১৯) পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “তন্ত্র অতি প্ৰাচীন। তন্ত্র ধর্মই বাঙলার আদিম ধর্ম এবং ইহা অবৈদিক ও অনার্য।”(২০) শশিভূষণ দাশগুপ্তের মতেও তন্ত্র ‘আদিম অনাৰ্য গুপ্ত শাস্ত্ৰ’।(২১)
৬
ব্ৰাহ্মণ্যশাস্ত্ৰে গৃহীত হয়ে যেমন সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্রেব মিশ্রীবিকাশ হয়েছিল, তেমনি এদের অবিমিশ্র বিকাশধারাও অব্যাহত ছিল। বরং সে-ধাবাই জৈন-বৌদ্ধযুগে প্ৰবল হয়ে গভীর, ব্যাপক ও স্থায়ী হল।
বৃহস্পতিলৌক্য বা ঋগ্বেদের ব্ৰহ্মণস্পতি সর্বপ্রথম বস্তুকে চরম সত্য বলে ঘোষণা করেন। চার্বাকরা ছিলেন বৃহস্পতির মতানুসারী। এ কারণে তাদেরকে বাৰ্হস্পত্য বা লোকায়তিক বলা হয়। এরা বস্তুবাদী-অধ্যাত্মবাদী হয়, বেদের আমল থেকে অব্যাহত রয়েছে এদের ধারা। তার আগেও যে লোকমনে এর জড় ছিল, তা অনুমান করা যায়, বেদে এ মতের উল্লেখ দেখে। রামায়ণের জাবালিমুনি, হরি বংশের রাজা বেণ, গৌতম বুদ্ধের সমকালীন অজিত কেশ কম্বলী, তাঁর শিষ্য পায়াসি, আর ভাগুরি, পুরন্দর প্রভৃতি বিভিন্ন সময়ে নাস্তিক্যবাদের ধারক ও বাহক ছিলেন।(২২) এ ধারার চিন্তার প্রসূন হচ্ছে ইন্দ্ৰিয়াত্মবাদ, প্ৰাণাত্মবাদ ও মনশ্চৈতন্যবাদ। দেহের বিনাশে চৈতন্য লুপ্ত হয় এবং দেহের উপাদানগুলো নিজ নিজ ভূতে মিশে যায়, কাজেই কর্মফল ভোগ, আত্মার জন্মান্তর গ্রহণ ইত্যাদি অর্থহীন। ‘জড় পদার্থ থেকে চৈতন্যের উৎপত্তি’–এই মত বৃহদারণ্যক উপনিষদেও মেলে এবং দেহাত্মবাদের ইঙ্গিত পাই ছন্দোগ্যের ইন্দ্ৰ-বিরোচন উপাখ্যানে।(২৩)
‘ব্ৰহ্মজাল সূত্ত’ মতে বৈদিক কর্মকাণ্ডে বিরোধী সম্প্রদায় ছিল বহু ও বিবিধ। এ সময়ে বিভিন্নপন্থী তীৰ্থিকগণ (নাস্তিক আচাৰ্য) পুরাণ কস্সপ, মকখলি, গোসাল, অজিতকেশকম্বলী প্রভৃতি পরিব্রাজক সন্ন্যাসী তথা ‘আজিবক’রা ব্ৰাহ্মণ্যমতবাদ বিরোধী প্রচারণা চালাতেন।(২৪)
এসব মতের ধারকরা ব্ৰাহ্মণ্যবাদী জৈন ও বৌদ্ধদের কাছে ‘লোকায়তিক’ বলে ঘৃণ্য ছিল, যদিও বেদাদি সব শাস্ত্রগ্রন্থেই আমরা এসব মতের অপরিমেয় প্রভাব লক্ষ্য করি।
মৈথুন মাধ্যমে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা মানুষকে নারী-পুরুষ, তত্ত্বভাবনায় তথা মৈথুনতত্ত্ব কল্পনায় দিয়েছে প্রেরণা। কিন্তু কালে মৈথুনতত্ত্বের আদি উদ্দেশ্যের বিস্মৃতি ঘটেছে এবং এটি নতুন তাৎপর্য পেয়ে অধ্যাত্ম মাধুর্যে মহৎ এবং তাত্ত্বিক সূক্ষ্মতায় অসামান্য হয়ে উঠেছে। এর বিচিত্র বিকাশ আমরা জৈন-বৌদ্ধ সমাজে এবং শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব-গাণপত্যলিঙ্গায়েতে দেখেছি। আবার এর আদি রূপও নিঃশেষে লোপ পায়নি। তার রেশ রয়েছে। জয়পুর, পাঞ্জাব, নিলগিরি, ছোট নাগপুর, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব বাঙলার আদিবাসীদের মধ্যে।(২৫)
মৈথুন যেমন আদিতে ফসল উৎপাদনের আনুষ্ঠানিক অঙ্গরূপে বিবেচিত হয়েছে, তেমনি আবার রতি বিরোধ সাধনায়ও প্রবর্তনা দিয়েছে। কাজেই বামাচারী ও কামবর্জিত সাধনার উৎস অভিন্ন।(২৬)
বলেছি, সাংখ্য হচ্ছে তত্ত্ব, আর যোগ ও তন্ত্র হচ্ছে সাধনশাস্ত্ৰ। যোগ ও তন্ত্র দুটো ভিন্ন ধারায় যেমন চলেছে, তেমনি আবার যোগ্যতান্ত্রিক মিশ্রধারাও সৃষ্টি করেছে। মুসলমানেরা ধর্মীয় বাধার দরুন তন্ত্রাচার পরিহার করবার চেষ্টায় ছিল। তবু কোন কোন শ্রেণীর সূফী-বাউলে তন্ত্রাচার বিরল ছিল না। দৃষ্টান্তস্বরূপ সৈয়দ মর্তুজা, আউলচাঁদ, মাধব বিবি প্রমুখ সাধক-সাধিকার নামোল্লেখ করা যায়।
৭
তন্ত্ৰমতে পুরুষ ও প্রকৃতির আদি মৈথুন থেকেই বিশ্বের উৎপত্তি।(২৭) সাংখ্যেও তাই।(২৮) তন্ত্রের মতোই সহজিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়ও আদিম কৃষিকেন্দ্রী যাদুবিশ্বাস থেকেই জন্ম লাভ করেছে।(২৯) সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্র মূলত দেহাত্মবাদী ও নাস্তিকমত। যোগে ও তন্ত্রে ঈশ্বর পরবর্তীকালে ঠাঁই করে নিয়েছেন বটে, কিন্তু এসব সাধনায় ঈশ্বররোপাসনার স্থান অপ্রধান। দেহতত্ত্বই মুখ্য। এই দেহাত্মবাদী নাস্তিক্যমতকে ব্ৰাহ্মণ্যবাদীরা গোড়ার দিকে ‘অসুরমত’ বলে আখ্যাত করেছে।(৩০) গীতায় বলা হয়েছে, অসুর মতে ‘অপরস্পর সম্ভূত কিমান্যং কাম হৈতুকম।’ ১৬।৮ অর্থাৎ জগৎ নারীপুরুষের মিলনাজাত এবং কামোদ্ভূত। একে ব্ৰাহ্মণ্যবাদীরা লোকায়ত মত বলে অবজ্ঞা করেছে। নিঃসন্দেহে আদি অবিমিশ্র তান্ত্রিক, যোগী এবং সাংখ্যমতবাদীরাই লোকায়তিক। তাই শীলাঙ্ক রচিত ‘সূত্ৰকৃতাজ্ঞ সূত্রের ভাষ্যে’ সাংখ্য ও লোকায়তিকে বিশেষ পার্থক্য স্বীকৃত হয়নি।(৩১) তিন মতই গীতার আমলেও অভিন্ন ছিল।
৮
যোগতান্ত্রিক সাধনতত্ত্ব : একজন বিদ্ধানের ভাষায় সাধন তত্ত্বটি এই ‘যাহা আছে ভাণ্ডে, তাহাই আছে ব্ৰহ্মাণ্ডে–ব্ৰহ্মাণ্ডে যে গুণা; সন্তি তে তিষ্ঠন্তি কলেবারে।’ ইহাই সকল তন্ত্রের সিদ্ধান্ত। … তন্ত্ৰ বলিতেছেন যে যখন ব্ৰহ্মাণ্ড ও দেহভাণ্ড একই পদ্ধতি অনুসারে একই রকমের উপাদান সাহায্যে নির্মিত, উভয়ের মধ্যে একই পদ্ধতির খেলা হইতেছে, তখন দেহগত শক্তির উন্মেষ ঘটাইতে পারিলে ব্ৰহ্মাণ্ডের শক্তি তোমার অনুকুল হইবে।…এদেশের সিদ্ধগণ বলেন যে মনুষ্যদেহের মতন পূর্ণাবয়ব যন্ত্র আর নাই… অতএব এই যন্ত্রন্থ সকল গুপ্ত এবং সুপ্ত শক্তির উন্মেষ ঘটাইতে পারিলে অন্য কোন স্বতন্ত্র যন্ত্র ব্যতিরেকে তোমার বাসনা পূর্ণ হইতে পারে।(৩২) এখানে বিরোচনের উক্তি স্মর্তব্য : এই পৃথিবীতে দেহের পূজা ও পরিচর্যা করে দেহকে মহীয়ান করলেই দুই লোকে সাফল্য লাভ ঘটে।(৩৩) বাউলের মুখেও পাই এ তত্ত্ব :
সখি গো জন্ম-মৃত্যু যাহার নাই
তাহার সঙ্গে প্ৰেমগো চাই
উপাসনা নাই গো তার
দেহের সাধন সর্ব সার
তীর্থব্ৰত যার জন্য
এই দেহে তার সব মিলে।
কেননা, “এই দেহতেই কৈলাস, এই দেহতেই হিমালয়, এই দেহতেই বৃন্দাবন, এই দেহতেই গোবর্ধন, এই দেহাভ্যন্তরেই হরগৌরী বা কৃষ্ণ-রাধিকা নানা লীলা-নাট্য প্রকাশ করিতেছেন।”(৩৪)
অতএব, আদি যোগ ও মৈথুনতত্ত্বকে বৌদ্ধ ও ব্ৰাহ্মণ্য মনীষা সূক্ষ্মতর বোধ-বুদ্ধির প্রয়োগে নতুন ধর্মে ও শাস্ত্রে রূপায়িত করে। তাই “সহজিয়া, বৈষ্ণব, শৈব, কিশোরীভজা, কর্তাভজা, পরকীয়া সাধনা সবই রিরংসার উপর প্রতিষ্ঠিত।”(৩৫) “বাঙলা দেশে এবং তৎসংলগ্ন পূর্ব-ভারতীয় অঞ্চল সমূহে এই তন্ত্র প্রভাব খ্রীস্টীয় অষ্টম শতক হইতে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করিয়া মহাযান বৌদ্ধ ধর্মকে বজ্রযান, সহজযান প্রভৃতি তান্ত্রিক ধর্মে রূপান্তরিত করিয়া দিয়াছিল। …বাঙলা দেশে যত হিন্দু তন্ত্র প্রচলিত আছে, তাহা মোটামোটি ভাবে খ্রীস্টীয় দ্বাদশ শতক হইতে খ্রীস্টীয় পঞ্চদশ শতকের মধ্যে রচিত।”৩৬) অষ্টাদশ শৈব আগমও গুপ্তযুগে রচিত এবং গুপ্তযুগের শেষের দিকে এবং পালযুগে তান্ত্রিক শক্তির পূজার প্রচলন হয়।(৩৭) “এই তন্ত্ৰ সাধনার একটি বিশেষধারা বৌদ্ধ দোঁহাকোষ এবং চৰ্যাগীতিগুলির ভিতর দিয়া যে সহজিয়ারূপ ধারণ করিয়াছে, তাহারই ঐতিহাসিক ক্ৰম-পরিণতি বাঙলাদেশের বৈষ্ণব সহজিয়া সাধনায় এবং বিশেষ বিশেষ বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে।…(এবং) সপ্তদশ শতক হইতে আরম্ভ করিয়া ইহা এখানে একটা নবরূপ লাভ করিয়াছে এবং এই নবরূপেই বাঙলার সমাজ-সংস্কৃতিকে তাহা গভীর প্রভাবান্বিত করিয়াছে।”।(৩৮) তান্ত্রিক, যোগী, সহজিয়া, বাউল–সবাই দেহচর্চাকেই মূল্যব্রত করেছে। তবে তান্ত্রিক ও সহজিয়ারা রতি-প্রয়োগে এবং নাথাযোগীরা রতিনিরোধে এ সাধনা করে। দুটো যৌগিক প্রক্রিয়া নির্ভর। একটি বামাচারী অপরটি কামবর্জিত। একটি রমণ-ক্রিয়ার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানানুগ সাধনা, অপরটি কেবল বিন্দুধারণ ও উর্ধায়ন প্ৰণালী নির্ভর চর্যা। এর নাম উল্টা সাধনা। হঠযোগ এর অবলম্বন।
“উজান উর্ধ্বগতি রতি চলিবে যাহার
সেইজন বেদবিধি হইবেক পার।”
মুসলমানেরাও এই সাধনায় আস্থা রাখে। দেহস্থ প্রাণ ও অপান বায়ু নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা অর্জনই এর লক্ষ্য। “বৌদ্ধ-যোগাচার মতে যেমন কিছুই থাকে না, বিজ্ঞান মাত্র থাকে, সহজমতে তেমনি কিছু থাকে না আনন্দ মাত্র থাকে। এই আনন্দকে তাঁহারা সুখ বলেন, কখনো বা মহাসুখ বলেন। এ সুখ স্ত্রী-পুরুষ সংযোগ জনিত সুখ”।(৩৯) মানুষের লক্ষ্য হচ্ছে ইহলোকে পরলোকে প্রসারিত জীবনে নিরাপত্তা, সুখ-শাস্তি ও আনন্দ-আরাম। পার্থিব জীবনে রমণ-ক্রিয়াতেই মানুষ চরমসুখের আস্বাদ পায়। এ অভিজ্ঞতার ফলেই ‘সামরস্য’ অধ্যাত্ম তথা স্থায়ী মানস সুখের আদৰ্শরূপে গৃহীত হয়েছে। তাই পুরুষ-প্রকৃতি, শিব-শিবানী, মায়া-ব্ৰহ্ম, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতির মৈথুন প্রসূত স্থায়ী সমরসাবস্থাই দিয়েছে চিরন্তন সুখের ধারণা।
এর আর একটি দিকও আছে। সৃষ্টি সম্ভব হয় দেহস্থ শক্তি ব্যয়ে। এই শক্তিই জীবন। কাজেই সৃষ্টি কর্মে নিয়োজিত না হয়ে যদি সংরক্ষিত থাকে, তবে তা স্বাভাবিক ভাবেই আয়ু বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। ‘মরণং বিন্দুপাতেন জীবনং বিন্দু ধারণং।” (শিব সংহিতা)। আবার সৃষ্টি থাকলেই ধ্বংস থাকবে, সৃষ্টির পথ রোধ করলে ধ্বংসের পথও রুদ্ধ হবে–এ ধারণাও তাদেরকে প্রভাবিত করেছে। প্রজ্ঞা-উপায়, শিব-শক্তি কিংবা রাধা কৃষ্ণের চিরন্তন মৈথুনাবস্থার কল্পনা তথা সহস্রদল পদ্মের উপর পুরুষ-প্রকৃতির সামরস্যের ধারণা এ ভাবেই বিকশিত হয়েছে বলে অনুমান করি। কেননা মোটামুটিভাবে এর ধারাবাহিক ইতিহাস মেলে। সাঁওতাল, হো, পাঞ্চা, কোটার প্রভৃতি সমাজে আজো মৈথুনাচার আদিম আকারেই চালু রয়েছে।(৪০) আবার দার্শনিক তাৎপর্য মণ্ডিত হয়ে উচ্চতর সমাজেও তার কালিক, স্থানিক আর তাত্ত্বিক বিবর্তনও আমরা প্রত্যক্ষ করি। যেমন, শুক্রকে শুভ্ৰ, শুদ্ধ, জ্যোতিষ্মান অমৃত, শিব, চন্দ্র ও ব্ৰহ্ম(৪১) বলে অভিহিত করা হয়েছে। এবং শুক্র আনন্দ স্বরূপ। তাই শুক্ৰ নিৰ্গমকালে আনন্দ অনুভূত হয়। বৈষ্ণবদের মতেও ‘ধাতুরূপে সর্বদেহে বৈসে কৃষ্ণশক্তি’ (বিবর্তবিলাস)। বৌদ্ধ মতেও ‘হেবজ (বাজসত্ত্ব) নারী যোনিতে শুক্ররূপে বাস করেন’! শুক্র বিনা মহাসুখ লাভ সম্ভব নয়। সেজন্যেই কায়াসাধক বলেন :
নিঅ ঘরিনি জাব ন মজ্জই
তাব কি পঞ্চবশ্ন বিহরিজ্জই।
এণো জপ হোমে মঙ্গল কম্মে
অণু দিন আচ্ছসি বাহিউ ধৰ্ম্মে।
তে বিণু তরুণ নিরন্তর নেহেঁ
বোহি কি লম্ভই এণ বিদেহেঁ।
বৈষ্ণব সহজিয়া ও বাউলদের মধ্যে এ মত আজো অপরিবর্তিত এবং এ সাধনা অব্যাহত রয়েছে :
বাহ্য পরকীয়া এবে শুন ওহে মন
অগ্নিকুণ্ড বিনে নহে দুগ্ধ আবর্তন।
প্রকৃতির সঙ্গে সেই অগ্নিকুণ্ড আছে
অতএব গোস্বামীরা তাহা জপিয়াছে।
…বিষকে অমৃত ভাই যে পারে করিতে
কামরতি বিষ জারি হইবে প্রেমেতে। (বিবর্তবিলাস)
লোকায়ত সমাজে তো এটিই স্থূলরূপে বিদ্যমান ছিল। বাৰ্হস্পত্য সূত্ৰমে আছে : সৰ্বথা লোকায়তিকমের শাস্ত্ৰমর্থ সাধনকালে, কাপালিকমের কাম সাধনে।
মাধবাচাৰ্য বলেন লোকায়তিকরা কামাচারী–অর্থ ও কামসাধনাই তাদের লক্ষ্য।
গুণরত্ন বলেছেন–কাপালিক ও লোকায়তিকে কোন তফাৎ নেই। লোকায়তিকেরা গায়ে ভস্ম মাখে, মদ খায়, মাংস খায় এবং তারা মিথুনাসক্ত ও যোগী। বছরের এক নির্দিষ্ট দিনে তারা সবাই একস্থানে মিলিত হয়ে মৈথুনে রত হয়।(৪২) সাঁওতালেরা আজো এমনি উৎসব পালন করে।(৪৩) শৈব-শাক্ত বৈষ্ণব ধর্মেরও ভিত্তি হয়েছে এই শুক্ৰ-রজঃ তত্ত্ব।(৪৪)
৯
ক. বৌদ্ধ দেহতত্ত্ব :
দেহ স্থান | কায়/চক্র | পদ্ম | দল | |
১. | নাভি | নির্মাণ | নাভি | ৬৪ |
২. | হৃদয় | ধর্ম | হৃৎ | ৩২ |
৩. | কণ্ঠ | সম্ভোগ | কণ্ঠ | ১৬ |
৪. | মস্তক | সহজ | উষ্ণীষ | ৪ |
বৌদ্ধমতে গ্রাহ্য-গ্ৰাহকের অস্তিত্বহীনতাই শূন্যতা, এই শূন্যতাই নির্বাণ।
খ, হিন্দু দেহতত্ত্ব :
দেহস্থা | চক্র | পদ্মদল | |
১. | গুহ্য ও জনন-ইন্দ্ৰিয়ের মধ্যস্থ | মূলাধার | ৪ |
২. | জনন-ইন্দ্রিয়ের মূলে সুষুম্নার মধ্যস্থ চিত্ৰণী নাড়ী | স্বাধিষ্ঠান | ৬ |
৩. | নাভি মূল | মণিপুর | ১০ |
৪. | বক্ষ | অনাহত | ১২ |
৫. | কণ্ঠ | বিশুদ্ধ | ১৬ |
৬. | ভ্রূদ্বয়ের মধ্যস্থল | আজ্ঞাচক্র | ২ |
এর উপরে আছে সহস্রদল পদ্ম। নাম সহস্রার। মূলাধারস্থ কুণ্ডলিনী শক্তির সঙ্গে এখানে পরমশিবের মিলন হয়। কুণ্ডলিনী হচ্ছে সাড়ে তিন চক্র করে থাকা মূলাধারস্থ সৰ্প। এটি বজঃবিষ বা কাম বিষেব প্রতীক। বিষকে অমৃতে পরিণত করে স্থায়ী আনন্দ লাভ করাই সাধ্য।
সাধন প্ৰণালী :(৪৫)
দেহের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য নাড়ী।। তার মধ্যে তিনটে প্রধান–ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না বা গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী। এ তিনটেকে মহানদী কল্পনা করলে অন্যসব হবে উপনদী বা স্রোতস্বিনী। এগুলো দিয়ে শুক্র, রজঃ, নীর-ক্ষীর রক্ত প্রবহমান। এ প্রবাহ বায়ু চালিত। অতএব, বায়ু নিয়ন্ত্রণের শক্তি অর্জন করলেই দেহের উপর কর্তৃত্ব জন্মায়।
আবার শুক্র, রজঃ ও রক্ত হচ্ছে মিশ্রিত বিষামৃত, জীবনী শক্তি ও বিনাশ বীজ, সৃষ্টি ও ধ্বংস, কাম ও প্রেম, রস ও রতি। শ্বাস-প্ৰশ্বাস নিয়ন্ত্রণের দ্বারা পবনকে নিয়ন্ত্রিত করলে গোটা দেহের উপরই কর্তৃত্ব জন্মায়। প্রশ্বাস হচ্ছে রেচক, শ্বাস হচ্ছে পূরক এবং দম অবরুদ্ধ করে রাখার নাম কুম্ভক। ইড়া নাভিতে পূরক, পিঙ্গলায় রেচক করতে হয়, দাম ধরে রাখার সময়ে দৈর্ঘ্যই সাধকের শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ। এর নাম প্ৰাণায়াম। এমনি অবস্থায় দেহ হয়। ইচ্ছাধীন। তখন যে শুক্রের স্থলনে নতুন জীবন সৃষ্টি হয়, সেই শুক্রকে নাড়ী মাধ্যমে উর্ধে সঞ্চালিত করে তার পতন-শ্বলন রোধ করলেই শক্তি হয় সংরক্ষিত। সেই সঞ্চিত শুক্র শরীরে জোয়ারের জলের মতো ইচ্ছানুরূপ প্রবহমান রেখে স্থায়ী রমণ-সুখ অনুভব করাও সম্ভব।
যোগে সিদ্ধিলাভ হচ্ছে ইচ্ছাশক্তি অর্জন। ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে তখন মানুষ অসামান্য শক্তির অধিকারী হয়ে অসাধ্য সাধন করে। শুক্র থাকে লিঙ্গের কাছে। সেটাকে প্ৰজনন শক্তির প্রতীক স্বরূপ মনে করা হয়েছে। কুণ্ডলীকৃত সুপ্ত সৰ্পের কল্পনাই নাম পেয়েছে কুণ্ডলিনী। এর মধ্যে রয়েছে কামবিষ। সে কামবিষ সৃষ্টিশীল। শুক্ৰ স্থলনেই সৃষ্টি সম্ভব। শুক্ৰই জীবনী শক্তি। কাজেই সৃষ্টির পথ রোধ করা দরকার। ফলে শক্তি ব্যয় হবে না। আর শক্তি থাকলেই জীবনের ধ্বংস নেই। মূলাধার থেকে তাই শুক্রকে নাড়ীর মাধ্যমে উর্ধে উত্তোলন করে ললাটদেশে সঞ্চিত করে রাখলেই ইচ্ছা শক্তির পূর্ণ প্রয়োগ সম্ভব। এটিই সিদ্ধি। আজকের যুক্তিপ্ৰবণ মনে এর একটি অনুমিত ব্যাখ্যা এ হতে পারে যে এরূপ অস্বাভাবিক জীবনচর্যার ফলে হয়তো এক প্রকার মাদকতা তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে আর তাতেই তারা হয়তো মনে করে যে তারা অতি মানবিক শক্তির অধিকারী হয়েছে এবং আত্মিক অমরত্ব লাভ ঘটেছে।
সাধনার তিনটে স্তর : ১. প্রবর্ত, ২, সাধক ও ৩, সিদ্ধি।
১. প্রবর্তাবস্থায় যোগী সুষুম্নামুখে সঞ্চিত শুক্ররাশি ইড়ামার্গে মস্তিষ্কে চালিত করার চেষ্টা পায়। এতে সাফল্য ঘটলে যোগী প্রেমের করুণারূপ অমৃত ধারায় স্নাত হয়।
২. শৃঙ্গারের রতি স্থির করলে তথা বিন্দু ধারণে সমর্থ হলে যোগী সাধক নামে অভিহিত হয়। তখন মস্তিষ্কে সঞ্চিত শুক্ররাশিকে পিঙ্গলা পথে চালিত করে সুষুম্নমুখে আনে। ফলে বিন্দু আজ্ঞাচক্র থেকে মূলাধার অবধি স্নায়ুপথে জোয়ারের জলের মতো উচ্ছসিত প্রবাহ পায়। এতে প্ৰেমানন্দে দেহ প্লাবিত হয়। এর নাম তারুণ্যামৃতধারায় স্নান।
৩. এর ফলে সাধক ইচ্ছাশক্তি দ্বারা দেহ-মন নিয়ন্ত্রণের অধিকার পায় এবং ইড়া পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ী পথে শুক্র ইচ্ছামত চালু রেখে অজারামরের মতো বোধগত সামরস্যজাত পরমমানন্দ বা সহজানন্দ উপভোগ করতে থাকে। এরই নাম লাবণ্যামৃত পারাবারে স্নান। এতে স্থূল শৃঙ্গারের আনন্দই স্থায়ীভাবে স্বরূপ শৃঙ্গারনন্দ বা সামরস্য লাভ করে। প্রাণায়ামাদি যোগাভ্যাস দ্বারা দেহরূপ দুগ্ধভাণ্ড শৃঙ্গাররূপ মথন দণ্ড সাহায্যে প্রবহমান নবনীতে পরিণত করা হয়। এর ফলে জরা-গ্লানি দূর হয় এবং সজীবতা ও প্ৰফুল্লতা সদা বিরাজ করে।
সূফীমতের উদ্ভব
১
সূফীমতের উদ্ভব সম্বন্ধে বিদ্বানেরা নানামত পোষণ করেন। Von Kremer ও Dozy-এর মতে বেদান্ত প্রভাবেই ইরানে সূফীমতের উন্মেষ হয়। Merix ও Nicholson-এর ধারণা নিউ প্ল্যাটোনিজম থেকেই এর উদ্ভব। E. G, Brown মনে করতেন, বাস্তববাদী শামীয় (Sematic) আরব ধর্ম ইরানের ভাবপ্রবণ আৰ্য মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, তা-ই সূফীতত্ত্বেরূপ লাভ করেছে।
কিন্তু মানবমনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অন্ত ঋজুভাবে ঘটে না। কাজেই কোন এক সরল পথে কিংবা কোনো একক মতবাদের প্রভাবে অথবা প্রতিক্রিয়ায় সূফীমত গড়ে উঠেছে বলা যাবে না।
ভাববাদী কৌতুহলী ইরানী মানসে জোরাস্টার, মানী, মজদক, বাইবেল, কোরআন প্রভৃতির বিচিত্র মতবাদ ও তত্ত্ব যেসব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, তাতে একদিকে আশারীয়, মোতাজেলা প্রভৃতি মত দেখা দিয়েছে, অপরদিকে ইমাম আবু হানিফ্যাদির নেতৃত্বে কোরআনহাদিসানুগ ধর্মানুশীলনে নিষ্ঠার প্রকাশ ঘটেছে। এর পটভূমিকায় ছিল রাজনৈতিক বিপ্লব। ইরানে স্বাধীন তাহেরি (৮২০ খ্ৰীঃ), সফাবী (৮৬৮ খ্ৰীঃ) ও সাসানী (৮৭৪ খ্ৰীঃ) বংশীয়দের প্রতিপত্তিরও কমবেশী প্রভাব রয়েছে। তবু বলতে হবে শ্ৰীক দর্শনের সাথে পরিচয় ইরানে ভাববিপ্লব ত্বরান্বিত করেছে। এবং একত্ব-প্রবণ ইরানী মনের উদারতার ছিদ্র পথে মুসলিম ইরানী মনে সৰ্বেশ্বরবাদও প্রবেশ করেছিল। সূফী ধর্ম হচ্ছে প্ৰেমবাদ। সে-প্ৰেম আল্লাহ প্ৰেম। সাধ্য আল্লাহ বটে, কিন্তু এর মানবিকতাই প্রেমসাধনার প্রথম পাঠ। সৃষ্টি-প্রেমেই স্রষ্টগ্রেমের বিকাশ : মরণ নদীর এপারে ওপারে ব্যাপ্ত জীবনের নির্ঘন্দ্ব উপলব্ধিতেই এ সাধনার সিদ্ধি। তাই সূফী বলেন, “আত্মবিস্মৃত হয়ে সবাইকে গ্ৰীতি দান কর আর পরের কল্যাণ কর্মে আত্মনিয়োগ কর। মানুষের হৃদয় জয় করাই সবচেয়ে বড় হজ। একটি হৃদয় সহস্ৰ কাবার চেয়েও বেশী; কেননা কা’বা আজার-পুত্র ইব্রাহিমের তৈরী একটি ঘর মাত্র। আর মানুষের হৃদয় হচ্ছে আল্লাহর আবাস।’ সূফীদের ভাববাদে বৈদান্তিক সৰ্বেশ্বরবাদের প্রভাব থাকলেও বৌদ্ধ নির্বাণবোদও ফানাতত্ত্বের উন্মেষের সহায়ক হয়েছে, সে সঙ্গে গুরুবাদও।(১)
তাত্ত্বিক ও মরমীয়া হলেও সূফীরা ইসলামকে ভোলেনি, কোরআনের সমর্থনকেই সম্বল করে জীবন ও ধর্মকে সমন্বিত করবার চেষ্টা করেছে। এতে দ্বৈত ও অদ্বৈতবাদের স্বীকৃতিও সম্ভব করে নিয়েছে এবং তাতেও আবার দোহাই কেড়েছে কোরআনের। ভোগ-পরিমিতিবাদের সূত্র ধরে বৈরাগ্যবাদও প্রশ্ৰয় পেয়েছে। সূফীতত্ত্বে।
মুসলমানদেব সাধারণ বিশ্বাস রসুল ব্যক্তিগত জীবনে তাত্ত্বিক তথা মরমীয়াও ছিলেন। এবং তাঁর প্রিয় সহচর আলি ও আবু বকরকে এই তত্ত্বে দীক্ষাও দিয়েছিলেন তিনি। কোরআনের এক আয়াতে আছে, “যেহেতু আমরা তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে রসুল পাঠিয়েছি, যিনি তোমাদের কাছে ওহী পাঠ করেন, তোমাদের দোষ মুক্ত করেন, তোমাদেরকে “কিতাবের শিক্ষা ও প্রজ্ঞা (wisdom) দান করেন এবং যা তোমরা আগে জানতে না, তাই জানিয়ে দেন।”(২)
এই প্রজ্ঞাকে সূফীরা কোরআনোক্ত ব্যবহার-বিধি বহির্ভূত অধ্যাত্মতত্ত্বজ্ঞান” বলে ব্যাখ্যা করেন।
আর একটি আয়াতে আছে, “এবং যারা বিশ্বাস করে তাদের জন্য পৃথিবীতে নিদর্শন রয়েছে এবং তোমার নিজের মধ্যে তুমি কি তা দেখা না!”৩ আবার আমরা তার (মানুষের) ঘাড়ের রাগ বা শিরার চেয়েও নিকটতর।”৪ “আল্লাহ পৃথিবী ও আকাশের জ্যোতিঃ স্বরূপ।”৫ উটের দিকে তাকিয়ে দেখ, কি কৌশলে তা সৃষ্টি হয়েছে। আকাশের মহিমা দেখ, পর্বতগুলো কেমন দৃঢ় করে স্থাপন করেছেন।”৬ “বল তা হচ্ছে আল্লাহর আদেশ বা শক্তি।”৭
কোরআনের এসব আয়াতের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার উপরেই সূফীবাদের ইসলামীরূপ প্রতিষ্ঠিত। আবার জ্যোতিঃতত্ত্বে মানী ও মজদ্দকী দর্শনের এবং আত্মতত্ত্বে সৰ্বেশ্বরবাদের এবং সৃষ্টির মহিমা ও বৈচিত্র্যতত্ত্বে ভাববাদের আশ্রয়ও মিলেছে।
O’ leary’র মতে “Plotinus এর Enneads, St. Paul-এর শিষ্য Dionysius ও Psendo Dionysius মতের ‘on Mystical Theology’ এবং ‘on the name’s of God’ প্রভৃতি খ্রীষ্টীয় মরমীয়াবাদের উৎস ছিল। Stephen Bar sudaılı alıas Hirothens নামে এক সিরীয় Monk-এর (খ্ৰীঃ ৫ম শতক) রচনাও সূফী মতবাদের উদ্ভবে পরোক্ষ সহায়তা করেছে।”
Akhlaq-i-Jalali থেকে Browne(৯) সূফী আবু সায়ীদ বিন আবুল খায়ের (মৃত্যু ৪৪১হিঃ-১০৪৯ খ্ৰীঃ) ও ইবনে সিনার আলাপ সম্বন্ধে যে-বৰ্ণনা দিয়েছেন, তাতে দার্শনিক ও তাত্ত্বিকদের অভিন্ন লক্ষ্যের আভাস মিলে, ইব্নে সিনা বলেছেন “what I know he sees, সায়ীদ মন্তব্য করেছেন “what I see he knows.”
সূফী মতের প্রথম প্রবক্তা হচ্ছেন মিশরীয় কিংবা নুবীয় (Nubian) লেখক জুন নুন (মৃত্যু ২৪৫-৪৬ হিঃ)। তিনি ছিলেন মালিক বিন আনাসের শিষ্য। জুন নুনের রচনাবলী সুসংকলিত ও সুসম্পাদিত করেন জুনাইদ বাগদাদী (মৃত্যু ২৯৭ হিঃ)। এই গ্ৰন্থ সম্বন্ধে O’ leary বলেছেন,
“in it appears essential doctrine of sufism, as of all mysticism, the teaching of Tawhid, the final union of the soul with God, a doctrine which is expressed in a way closely resembling the neo-platonic teaching, save that in Sufism the means whereby this Union is to be attained is not by the exercise of the intuitive faculty of reason but by the piety and devotion.”১০ সূফীমতবাদ সৰ্বেশ্বরবাদের রূপ নেয় ইরানের সূফীদের দ্বারাই।(১১ জুনাইদের পরে তাঁর শিষ্য খোরাসানের আসশিবলীর (মৃত্যু ৩০৯ হিঃ) প্রচারণায় প্রসার লাভ করে এই মত।(১২ সৰ্বেশ্বরবাদী বা অদ্বৈতবাদী সূফীদের মধ্যে হোসেন বিন মনসুর হাল্লাজ (মৃত্যু ৩০৯ হিঃ), বায়জীদ বিস্তামী (ওর্ফে আবু এয়ীদ, মৃত্যু ২৬০ হিঃ) প্রভৃতি ছিলেন অদ্বৈতবাদী। এঁদের মতের সঙ্গে ঐক্য আছে বৈদান্তিক ধারণার। তবে বৌদ্ধ নির্বাণ ও ফানা অভিন্ন নয়। নিৰ্বাণ বিলয় জ্ঞাপক আর ফানা অখণ্ডে মিলন সূচক (বাকা)।
এঁরা জুলুল-এ বিশ্বাসী, অর্থাৎ জীবাত্মা যে পরমাত্মারই অংশ তা এঁদের বিশ্বাসের অঙ্গ। এ বিশ্বাস মূলত বৈদান্তিক। তবু আত্মপরমাত্মা সম্পর্কে ধারণা সৃষ্টির ব্যাপারে নব প্ল্যাটোনিক মতেরই প্রভাব বেশী।(১৩) যিকর সূফীদের অবশ্য আচরণীয় চর্যা। এটিতে কোরআনেরও সমর্থন মিলে–আল্লাহকে ঘন ঘন স্মরণ করা।(১৪)
২
এ সূত্রে “কাশফ-অল-মাহজুব’-এ আলোচিত সূফী তত্ত্ব সম্বন্ধে একটি কথা বলা দরকার। সূফীমতের পরবর্তী বিকাশ ও বৈচিত্র্যর আলোকে বিচার করলে আলহুজুইরীর গ্ৰন্থকে কোরআনিক ইসলামের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা গ্ৰন্থ বলেই অভিহিত করতে হয়।
সূফীমতে বলতে আমাদের যে-ধারণা স্বভাবত আসে, তার সঙ্গে হুজুই্যৱী বৰ্ণিত সূফীমতের রয়েছে মৌলিক পার্থক্য। কাশফ-আল-মাহজুব গুরুত্ব দিয়েছে Plain living and high thinking আদর্শে। ভগবৎপ্রেম ও আনুগত্যের অনুকুল বলে প্রচার করা হয়েছে দারিদ্র্যকে।(১৫) হুজুইরার মতে আত্মার পবিত্রতার (সাফা) সাধনাই সূফী সাধনা, কেননা মানুষ অপবিত্র (কদর)। তিনি মনে করেন, পার্থিব বিষয়ে ও ভোগে অনাসক্তি আর সত্যসন্ধ মনই সূফীর বিশেষ লক্ষণ এবং এসব গুণে হযরত আবু বকর সিদ্দিকী সূফী-প্রধান।(১৬) প্রেম ও পবিত্রতা যোগে যখন পার্থিব বন্ধন মুক্ত হয় সূফী, তখন সে যে দিব্যাবস্থা লাভ করে, তার ফলে ফানাফিল্লাহ স্তর প্রাপ্তি ঘটে তার। তখন সোনা ও মাটি দু-ই তার কাছে সমান।(১৭) অতএব যে আল্লাহ-প্রেমের দ্বারা বিশোধিত এবং আল্লাহতে (Beloved এ) যে বিলীন (absorbed) এবং যে সবকিছু ত্যাগ করেছে সে-ই সূফী।(১৮) এবং সূফীর জুনাইদ-প্রদত্ত সংজ্ঞা সমর্থন পেয়েছে উসমান হুজুইরীর। জুনাইদ বলেছেন, “সূফীর আটটি গুণ–ইব্রাহীমের মতো ত্যাগ, ইসমাইলের মতো আনুগত্য, আয়ুবের মতো ধৈৰ্য, জ্যাকিরিয়ার মতো বাকসংযম, John এর মতো আত্মপীড়ন, ঈসার মতো ভোগবিমুখতা, মুসার মতো পশমী পরিধেয় গ্রহণ এবং হযরত মুহম্মদের মতো দারিদ্র্য বরণ।”(১৯)
অতএব, হুজুইরী ইসলাম সম্মত অধ্যাতন্ত্ৰবাদ তথা মরমীয়াবাদের ভাষ্যকার। আসলে ইসলামেরই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা (spiritual interpretation of Islam) দিয়েছেন তিনি। তাঁর ধারণায় আসহাবে কাহাফ, হযরত মুহম্মদের ভোগবিমুখতা, দারিদ্র্য, আসহাবে সাফফার বৈরাগ্য, আবুবকর সিদিকের ত্যাগশীলতা, হারিসের স্রষ্টা-প্ৰেম, আবু হাশিমের অনাড়ম্বর জীবন, দেহমন-আত্মার পবিত্ৰতা রক্ষার সাধনা প্রভৃতিই সূফীর লক্ষণ। তিনি ‘বাকা-বিল্লাহ’-এ আস্থাবান নন। পক্ষান্তরে ‘ফানায়’ তথা complete surrender to the will of Allahতে–যা ইসলামের দ্বৈতবাদী তথা একেশ্বর তত্ত্বে আস্থাবান। তিনি শরীয়ৎ তথা কোরআন হাদিসোত্ত আচারে নিষ্ঠ।(২০) কাজেই হুজুইরীর সূফীতত্ত্ব আসলে শরীয়তী মুসলমানের আল্লাহু গ্ৰীতিজাত বৈরাগ্য। এক বিদ্বানের ভাষায় “It was an asceticism in the puritanical sense.”(২১)
৩
কিন্তু প্রচলিত বিভিন্ন শাখার সূফী মতগুলো ভিন্ন ধরনের। ইসলামের মৌল অঙ্গীকারের সঙ্গেও পার্থক্য কম নয় এগুলোর। এ না হয়ে পারেনি। কেননা সূফীমত একটি মিশ্রদর্শনের সন্তান। তাও আবার একক মত থাকেনি। তাই আজকেব দিনে সূফীমতে বলতে মত-সমষ্টিই বোঝায়। ইসলামের উদ্ভবের প্রায় দেড়শ বছর পর থেকে সন্তৰ্পণে অঙ্কুরিত হতে থাকে এ মত। কুফার আবু হাশিমই (মৃত্যু : ১৬২ হিঃ) প্রথম সূফী বলে পরিচিত। তিনি হুজুইরীর সংজ্ঞানুগ সূফী। আসলে ইব্রাহীম আদহম (মৃত্যু ১৬২ হিঃ), ফজিল আয়াজ (মৃত্যু ১৮৮হিঃ), মারুফ কখী, দাউদ তায়ী (মৃত্যু : ১৬৫ হিঃ) হাসান বসোরী প্ৰমুখের সাধনা ও বাণী থেকেই বিশিষ্ট হয়ে উঠে সূফী মত।(২২)
খ্রীস্টানদের মধ্যে বৈরাগ্য ছিল, ইহুদীরাও ছিল তত্ত্ব জিজ্ঞাসু। আরবেরা চিরকাল পেয়েছে। এদের সান্নিধ্য। স্বয়ং হযরত মুহম্মদ নবুয়ত লাভের পূর্বে মধ্যে মধ্যে নিভৃত চিন্তায় মগ্ন থাকতেন হেবা পর্বতের গুহায়। ভোগবিমুখতা ও বিষয়ে অনাসক্তি তাঁর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
ইরানে জোরাষ্ট্রীয়রা তত্ত্ববিমুখ হলেও মানী এবং মজদ্দকীদের মধ্যে দুর্লভ ছিল না। মরমীয়াভাব ও তত্ত্বচিন্তা। বৌদ্ধ নির্বাণবাদ ও গুরুবাদের সংস্কারও মিশে ছিল অনেকের মজ্জায়। ২৩ আর স্বেচ্ছাবৃত দারিদ্র্যে অনাড়ম্বর জীবন ছিল রসুল-পার্ষদদের আদর্শ। ২৪ এক সময় এমনি আদর্শ ধাৰ্মিকরা ভোগবিমুখতা ও বিষয় বৈরাগ্যের জন্যে সাধারণ্যে পরিচিত হয় ফকির মানে। একই কারণে কালে ফকির, দরবেশ ও সূফী–শব্দত্রেয় হয়ে উঠে অভিন্নার্থক। ইবনে ইসলাম বিস্তৃতির পরে মানী, মজদ্দকী, যিনদিকী (Zindiqu) ও বৌদ্ধসংস্কারের তথা দেশকালের প্রভাব থেকে পুবো মুক্ত হতে পারেনি মুসলমানেরা। আদর্শ মুসলিমের পার্থিব ব্যাপারে অনাসক্তি, পবিত্রতার সাধনা ও আল্লাহ্র যিকর-এর সঙ্গে যেমন মিশে ছিল এই পূর্ব-সংস্কারের উত্তরাধিকার তেমনি আব্বাসীয়দের আমলে জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলীয় ও নব্য প্ল্যাটোনিক মতের প্রভাবও পড়েছিল সুপ্রচুর। অবশ্য ইসলাম পূৰ্বযুগেও সিরিয়ায় আর ইরানে অনুভূত হত এ্যারিস্টটল ও প্ল্যাটোর দর্শনের প্রভাব।(২৫)
৪
ভারতে বিভিন্ন সূফীমতের উপর স্থানিক প্রভাব পড়েছে প্রচুর। নকশীবন্দিয়া মতবাদে ও সাধনতত্ত্বে ভারতীয় দেহতত্ত্ব ও যোগের প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশী। তারাও স্বীকার করে কুণ্ডলিনী শক্তি। ষড়কেন্দ্রী দেহে ষড়রঙের আলো সন্ধান করা এবং সেই ষড়বর্ণের জ্যোতিকে বর্ণহীন জ্যোতিতে পরিণত করাই সাধনার লক্ষ্য। এটি শিব-শক্তি মিলন জাত আনন্দের কিংবা বৌদ্ধ সহজানন্দের আদলে পরিকল্পিত।
বিভিন্ন সূফীমতবাদে আল্লাহর ধারণা তিন প্রকার : আত্মসচেতন ইচ্ছাশক্তি, সৌন্দর্যস্বরূপ এবং ভাব, আলো কিংবা জ্ঞান স্বরূপ। শকীক বলখী, ইব্রাহীম আদহাম, রাবিয়া বসোয়ী প্রভৃতির ধারণায় আল্লাহ ইচ্ছাশক্তি স্বরূপ। সৃষ্টিলীলায় সেই ইচ্ছাশক্তিরই প্রকাশ। একত্ববাদ এর প্রাণ, তাই এটি আরবীয় বা শামীয় (semitic)। পবিত্রতা, সংসার ধর্মে অনাসক্তি, আল্লাহু প্রেম ও পাপভীতিই এমতের সূফীদের বৈশিষ্ট্য।
আল্লাহকে রূপময়-লীলাময় প্ৰেমকামী রূপে কল্পনা করেছেন যারা, তাদের মতে আল্লাহ নিজের মহিমার মুকুররূপে সৃষ্টি করেছেন জগৎ। তিনি এই সৃষ্টির মুকুরে নিজের রূপ নিজেই প্রত্যক্ষ করেছেন নার্সিসাসের মতো। তুলনীয় : রূপ দেখি আপনার, কৃষ্ণ হয় চমৎকার, আস্বদিতে সাধ উঠে মনে; অথবা, রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি অন্যে অন্যে বিলাসয় রসাস্বাদন করি। এ তত্ত্বের প্রেক্ষিতে এ মতবাদী সূফীরা সৃষ্টিকে মনে করে রূপময়-লীলাময় আল্লাহর manifestation বলে। এবং এর ভিত্তি হয়েছে প্রেম। যেখানে রূপ, সেখানেই প্ৰেম, অথবা প্রেমই দান করে রূপদৃষ্টি। কাজেই এই তত্ত্বে বিশ্বাসী সূফীরা প্রেমবাদী, বিশ্বপ্ৰেম তাদের সাধনার লক্ষ্য ও পাথেয়। জোরাষ্ট্ৰীয় প্রভাব আছে। এরূপ তত্ত্বচিন্তায়। সব রিপু ও বিষয়-চিন্তা পুড়ে ছাই হয়ে উড়ে যায় এই প্ৰেমানলে–হৃদয় জুড়ে থাকে কেবল আল্লাহু। এই বোধের পরিণামে পাই অদ্বৈততত্ত্ব–যার পরিণতি হচ্ছে ‘আনলহক’ বা ‘সোহিম” বোধে। এই মতের সূফীদের মধ্যে বায়জিদ বিস্তামী, মনসুর প্রমুখ প্রখ্যাত। অসীম, অনন্ত ও গুণাতীত অনাদি চিরন্তন সত্তার বোধ জন্মায় এই অভেদতত্ত্ব। এই বোধেও বৈদান্তিক প্রভাব সুস্পষ্ট। জীবাত্মা এখানে পরমাত্মারই খণ্ডাংশ মাত্র। এবং সৃষ্টি মাত্রই ব্ৰহ্মেরই বিকাশ ও প্রকাশ এবং “একোহিম বহুস্যাম’ তত্ত্বভিত্তিক। নাসাফি (Nastafii) পষ্ট করেই বলেছেন “ওহে দরবেশ, তুমি কি মনে করু, তোমার আল্লাহ্বিহীন স্বাধীন সত্তা আছে? তা হলে এ তোমার ভুল।(২৬) আবার শঙ্করের মায়াবাদও অনুপ্রবেশ করেছে এখানে। সৃষ্টি মাত্রই ব্ৰহ্ম থেকে উৎপন্ন এবং ব্ৰহ্মেতে লীন। কাজেই বিচ্ছিন্নতাবোধ বা বিরহানুভূতি অবিদ্যাজাত একটি সাময়িক বোধ-বিকৃতি মাত্র। মায়াজাত বিভ্রান্তি থেকে “অহং এর উৎপত্তি। অহংবোধ তথা নিঃসহায় নিঃসঙ্গ স্বাধীন সত্তাবোধ থেকেই দুঃখের জন্ম। এ বোধ মুখ্যত বৌদ্ধের। বিবর্তনবাদ তথা জন্মান্তরবাদেও আস্থা রেখেছেন রুমী।(২৭) আমরা একদিকে নব প্ল্যাটোনিক তত্ত্বের এবং অপরদিকে বৌদ্ধ জীবনবোধ ও জন্মান্তরিবাদের প্রভাব লক্ষ্য করি এতে।
Neo-Platonism-এ আছে –“As being the cause of all things, it is everywhere, and not also nowhere’, it would be all things.”(২৮)
শেখ শিহাবুদ্দীন সুহরাওয়াদী ওর্ফে শেখুল ইশরাক মকুল (বারো শতকের মধ্যভাগ) মুসলিম জগতে স্বাধীন চিন্তার অন্যতম প্রবর্তক। নতুন তত্ত্ব চিন্তার অপরাধে ইনি ছত্রিশ বছর বয়সে নিহত হন সুলতান সালাহুদীনের আদেশে। তাঁর মতো আল্লাহ হচ্ছেন ‘স্বয়ম্বু জ্যোতি (Nur-l-Qahr) Manifestation তথা মহিমার অভিব্যক্তি দানই এ জ্যোতির স্বভাব। এতেই তাঁর স্বতোপ্ৰকাশ। কাজেই আলো-অন্ধকারের মগনীয় দ্বৈততত্ত্ব এখানে অস্বীকৃত। নিজের মধ্যে ও বিশ্বে পরিব্যাপ্ত এই আলো দেখার আকুলতা মানবে সহজাত। আলোর স্বরূপ উপলব্ধির ও হৃদয়ে প্রতিষ্ঠার সাধনাই সূফী ব্ৰত। এই সিদ্ধির ফলে মানুষ হয় ইনসানুল কামেলা’। অবশ্য এই ইনসানুল কামেল” নীটশের কিংবা বাৰ্নাড শ-এর Superman নয় ; প্রথমটি অধ্যাত্ম সাধনার ক্ষেত্রে আর শেষোক্তটি পার্থিব সমাজের।
মোটামুটিভাবে বলতে গেলে পাক-ভারতে (ক) চিশতিয়া, (খ) কাদেরিয়া, (গ) সোহরাওয়ার্দীয়া ও (ঘ) নকশবন্দিয়া–এর চারটি মতবাদই প্ৰধান। অন্যান্যগুলো এ চারটির উপমাত মাত্র।(২৯)
বাঙলার সূফী সাহিত্য
সুতরাং শাত্তারিয়া, মদারিয়া, কলন্দরিয়া প্রভৃতি প্রত্যেকটি উক্ত চারটির যে কোনো একটির উপমত।(৩০)
১. অদ্বৈতবাদ, ২, সৰ্বেশ্বরবাদ, ৩. দেহতত্ত্ব (কুণ্ডলিনী শক্তি), ৪. বৈরাগ্য, ৫. ফানাতত্ত্ব, ৬. সেবাধর্ম ও মানবগ্ৰীতি, ৭. গুরু বা পীরবাদ, ৮, পরব্ৰহ্ম ও মায়াবাদ, ৯. ইনসানুল কামেল তথা সিদ্ধপুরুষবাদ, ১০. স্রষ্টার লীলাময়ত প্রভৃতি ধারণার বীজ বা প্রকাশ ছিল আরব-ইরানের সূফী তত্ত্বে।
ভারতের মাটিতে অনুকূল আবহে এসব প্রবল হতে থাকে সূফীতত্ত্বে। এখানে সূফীমতে স্থানিক প্রভাব লক্ষণীয়। ইসলাম ও সূফী-মতের প্রভাবে ভাবতেও দেখা দেয় চিন্তা-বিপ্লব। আমরা এদেশে ইসলামী প্রভাবের দু’চারটি নমুনা দিয়ে পরে দেশী প্রভাবের পরিচয় নেব মুসলিম জীবনে ও চিন্তায়।
৫
ভারতে “একেশ্বরবাদ, ভক্তিবাদ, বৈষ্ণব ধর্ম ও শৈবধর্মের জন্ম হল দ্রাবিড়দেশে, নবীন ইসলাম ধর্মের সঙ্গে নব্য হিন্দু ধর্মের ঘাত প্ৰতিঘাতের ফলেই দক্ষিণ ভারতে এই নতুন ধর্মসমন্বয় ও সংস্কৃতি সমন্বয়ের ধারা প্রবর্তিত হয়েছে।.ইসলামের এক দেবতা ও এক ধর্মের বিপুল বন্যর মুখে দাড়িয়ে শঙ্কর আপসহীন অদ্বৈতবাদ প্রচার করেছেন।… শঙ্করাচার্যের আপসহীন অদ্বৈতবাদ মনে হয় যেন নবীন আরবী ইসলামেব একেশ্বরবাদের ভারতীয় রূপ। বেদ-উপনিষদ তার উৎস হলেও ইসলামের প্রভাবেই যে সেই উৎস সন্ধানের প্রেরণা এসেছে এবং ‘অদ্বৈতবাদের’ পুনরুজ্জীবন সম্ভবপর হয়েছে, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। শঙ্করাচার্যের পরে রামানুজ, বিষ্ণুস্বামী, মাধবাচার্য ও নিম্বার্কের দর্শনের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে, দেখা যায়. ইসলামের আত্মনিবেদন, ইসলামের প্রেম, ইসলামের সমান বিচার ও সাম্যের বাণী, ইসলামের গণতন্ত্রের আদর্শ মুসলমান সাধকরা সহজ ভাষায় সোজাসুজি যখন এদেশে প্রচার করেছেন, রামানুজ ও নিম্বার্ক তখন শঙ্করের শুদ্ধজ্ঞানের স্তর থেকে শ্রদ্ধাভক্তি প্রীতির স্তরে নেমে এলেন।(৩১)
এই মতই ব্যক্ত হয়েছে ডক্টর তারাচাঁদের Influence of Islam on Indian Culture গ্রন্থে।(৩২)
উমেশচন্দ্ৰ ভট্টাচাৰ্যও বলেন “একেশ্বরবাদ ভারতেও ছিল, বাহির হইতেও আসিয়াছিল উভয়ে মিলিয়া দশম একাদশ শতাব্দীতে একটা পরিপুষ্ট আকারে দেখা দেয়।…তাহাদের (মুসলমানদের) একেশ্বরবাদের সংস্পর্শে আসিয়া ভারতের একেশ্বরবাদ বিশেষত বৈষ্ণব একেশ্বরবাদ উদ্বুদ্ধ হইয়া উঠে নাই এমন কথা বলিতেও আমাদের সঙ্কোচ বোধ হইতেছে।”৩৩
উত্তর ভারতেও সন্ত ধর্মের উদ্ভব হয় মুসলিম প্রভাবে। রামানন্দ, কবির, নানক, দাদু, একলব্য, রামদাস প্রমুখ কমবেশী মরমীয়াবাদই প্রচার করেছেন।
ভারতে এসে এদেশী ধর্ম, আচার ও দর্শনের প্রভাবে পড়েছিল মুসলমানরা। রাম-সীতা ও রাধা-কৃষ্ণের রূপকে বান্দা-আল্লাহর তথা ভক্ত ও ভগবানের সম্পর্ক, ভক্তি, প্ৰেম, বিরহবোধ কিংবা মিলনাকাজক্ষা প্ৰকাশ করেছেন মধ্য-উত্তর ভারতীয় মুসলমানরা। কবির, এয়ারী, রজব, দরিয়া, কায়েম প্ৰমুখের গান তার প্রমাণ। বাঙলা দেশেও চৈতনোত্তরযুগে মুসলমানরা অধ্যাত্মপ্রেমজ হৃদয়াকুতি প্ৰকাশ করেছেন রাধা-কৃষ্ণ প্রতীকের মাধ্যমে। সৈয়দ মর্তুজার ফারসী গজলে রাধা-কৃষ্ণ নেই, আবার নুর কুতবে আলমের বাঙলা পদে রয়েছে। রাধা-কৃষ্ণের রূপক এতেই বোঝা যায়, অধ্যাত জিজ্ঞাসায় দেশী ভাষানুগ রূপকে অবহেলা করেননি তাঁরা। দেশজ মুসলমানের পূর্ব সংস্কার বশে, চৈতনোত্তরযুগে রেওয়াজের প্রভাবে এবং ভাবসাদৃশ্যবশত সূফীতত্ত্বের রূপক হিসেবে রাধা-কৃষ্ণ-প্রতীক মুসলিম মরমীয়ারা গ্ৰহণ করেছেন বলে অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচাৰ্যও অভিমত প্ৰকাশ করেছেন তাঁর বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবি’ গ্রন্থে।(৩৪) ডক্টর শশিভূষণ দাশগুপ্তও বলেন, “একথা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে যে বাংলার মুসলমান কবিগণ রাধাকৃষ্ণকে লইয়া যে কবিতা রচনা করিয়াছেন, তাহা কোনও বিধিবদ্ধ বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় রচিত নহে।.তাহারা চৈতন্য প্রবর্তিত একটি সাধারণ প্ৰেম ধর্মের প্রভাব সামাজিক উত্তরাধিকার সূত্রেই পাইলেন, কিন্তু পাইলেন না। রাধাকৃষ্ণ লীলা সম্বন্ধে কোন স্থিরবদ্ধ ভাবাদৃষ্টি। সুতরাং বাংলার জনসমাজে যে সাধারণ ভক্তিধর্ম ও যোগধর্ম প্রচলিত ছিল, এই সকল কবিগণ রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে সেই সকলের সঙ্গেই যুক্ত করিয়া লইলেন। বাংলা দেশের প্রেমপন্থী মুসলমান সাধকগণ অল্পবিস্তর সকলেই সূফীপন্থী।… রাধার যে পূর্বরাগ অনুরাগ বিরহের আর্তি তাহা কবিগণের জ্ঞাতে অজ্ঞাতে পরম দায়িতের জন্য নিখিল প্রেম সাধকগণের পূর্বরাগ বিরহের আর্তিতেই পরিণতি লাভ করিয়াছে এবং সেই আর্তির ক্ষেত্রে কবি নিজেকে শুধু দর্শক বা আস্বাদকরূপে খানিকটা দূরে সরাইয়া লন নাই, নিখিল আর্তির সহিত নিজের চিত্তের আর্তিকেও মিলাইয়া দিয়াছেন।…আমরা মুসলমান কবিগণের রচিত রাধাকৃষ্ণ-লীলা সম্বন্ধীয় পদগুলির ভণিতা লক্ষ্য করিলেই এই কবিগণের মূল ভাবাদৃষ্টিরও ইঙ্গিত পাইব।(৩৫)
সূফীমতের আংশিক সাদৃশ্যই রয়েছে। রাধা-কৃষ্ণ লীলায়। তাই একেশ্বরবাদী ও অবতারবাদে আস্থাহীন মুসলমান কবিগণের কল্পনায় সাধারণত রাস, মৈথুন, বস্ত্রহরণ, দান, সম্ভোগ, বিপ্ৰলব্ধা প্রভৃতি প্রশ্ৰয় পায়নি। কেবল রূপানুরাগ, অনুরাগ, বংশী, অভিসার, মিলন, বিরহ প্রভৃতিকে গ্রহণ করেছেন তাঁরা জীবাত্মা-পরমাত্মার সম্পৰ্কসূচক ও ব্যঞ্জক বলে। তাদের রচনায় অনুরাগ, বিরহবোধ এবং জীবন জিজ্ঞাসাই আত্মবোধনী বিশেষরূপে প্রকট।
সৃষ্টিলীলা দেখে স্রষ্টার কথা মনে পড়ে–এটিই রূপ; এ সৃষ্টি বৈচিত্র্য দেখে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কবোধ জন্মে–এটিই অনুরাগ; এবং তাঁর প্রতি কর্তব্য বুদ্ধি জাগে–এটিই বংশী; আর সাধনার আদিস্তরে পাওয়া না-পাওয়ার সংশয়বোধ থাকে–তারই প্ৰতীক নৌক। এর পরে ভাবপ্রবণ মনে উপ্ত হয় আত্মসমৰ্পণ ব্যঞ্জক সাধনার আকাজক্ষা–এটিই অভিসার। এরপর সাধনায় এগিয়ে গেলে আসে অধ্যাত্ম স্বস্তি–তা-ই মিলন। এরও পরে জাগে পরম আকাজক্ষণএকাত্ম হওয়ার বাঞ্ছা–যার নাম বাকাবিল্লাহ–এ-ই বিরহ।
পাক-ভারতে সাধারণত ইসলাম প্রচার করেন। সূফী-দরবেশরাই। অধিকাংশ মুসলমান এদেশী জনগণেরই বংশধর। পূর্বপুরুষের ধর্ম, দর্শন ও সংস্কার মুছে ফেলাও পুরোপুরি সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। সূফী সাধকের কাছে দীক্ষিত মুসলমানেরা শরীয়তের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়নি অশিক্ষার দরুন। কাজেই সূফীতত্ত্বের সঙ্গে যেখানেই সাদৃশ্য-সামঞ্জস্য দেখা গেছে, সেখানেই অংশগ্রহণ করেছে মুসলমানেরা। বৌদ্ধ নাথপন্থ, সহজিয়া তান্ত্রিক সাধনা, শাক্ততন্ত্র, যোগ প্রভৃতি এভাবে করেছে তাদেব আকৃষ্ট। এরূপে তারা খাড়া করেছে। মিশ্ৰ-দৰ্শন। ডক্টর সুনীতি চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘পীর, ফকির, দরবেশ, আউলিয়া প্রভৃতিদের প্রচার এবং কেরামতীর ফলে, মুখ্যতঃ ব্ৰাহ্মণদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ বৌদ্ধ ও অন্যান্য মতের বাঙালী ইসলাম ধর্ম গ্ৰহণ করে। …বাঙ্গালা দেশে ইসলামের সূফীমত বেশী প্রসার লাভ করে। সূফীমতের ইসলামের সহিত বাঙ্গালার সংস্কৃতির মূল সুরটুকুর তেমন বিরোধ নাই। সূফীমতের ইসলাম সহজেই বাঙ্গালার প্রচলিত যোগমার্গ ও অন্যান্য আধ্যাতিমুক সাধনমার্গের সঙ্গে একটা আপোষ করিয়া লইতে সমর্থ হইয়াছিল।”৩৬ সূফীরা গুরুত্ববাদী। শেখ, পীর কিংবা মুর্শীদই তাদের পথপ্রদর্শক। এতে বৌদ্ধগুরুবাদের প্রভাব লক্ষণীয়। ফানা ও বাকাবাদী হোসেন বিন মনসুর হল্লাজ, বায়জিদ বোস্তামী কিংবা ইব্রাহিম আদহাম প্রভৃতি সূফীদের কেউ ছিলেন জোরাষ্ট্ৰীয়ানের, কেউ জিনদিকের কেউবা বৌদ্ধের বংশধর এবং জাতিতে ইরানী।(৩৭) ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে পীরপূজা চালু হয় এ ভাবেই। হিন্দুর গুরুবাদও বৌদ্ধ প্রভাবিত।(৩৮)
‘কুনফায়াকুন’ দ্বৈতবাদের পরিচায়ক। পক্ষান্তরে ‘একোহিম বহুস্যাম’ অদ্বৈতবাদ নির্দেশক। সূফীবা মুসলমান, তাই দ্বৈতবাদী, কিন্তু অদ্বৈতসত্তার অভিলাষী। বৈষ্ণবগণ ব্ৰহ্মবাদের প্রচ্ছায় গড়া। তবু তাদের সাধনা চলে দ্বৈতবোধে এবং পরিণামে (রাগাত্মিক সাধনায়) অদ্বৈতসত্তার প্ৰয়াসে। সূফী ও বৈষ্ণব উভয়েই পরমের কাঙাল। মানবাত্মার সুপ্তবিরহবোধের উদ্বোধনই সূফীবৈষ্ণবের প্রধান কাজ। তাই আমরা সূফী গানে এবং বৈষ্ণবপদে মিলন-পিপাসু বিরহী আত্মার করুণ ক্ৰন্দনধ্বনি শুনতে পাই। মানবাত্মার চিরন্তন Tragedy-র সুর ও বাণী বহন করছে সূফীগজল ও বৈষ্ণবপদ-সাহিত্য।
মুসলমানদের রাধা-কৃষ্ণতত্ত্বে আসক্তির সাধারণ কারণ দুটো ১. সূফীমতবাদের সাথে বৈষ্ণবাদর্শের আত্যন্তিক সাদৃশ্য ও আচারিক মিল এবং ২. জগৎ ও জীবনের চিরাবৃত রহস্য, জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ক নির্ণয়ের কৌতুহল প্রভৃতি মানুষের মনে জিজ্ঞাসা জাগায়, তার সদুত্তর সন্ধান-প্ৰয়াস জাত যে অভিব্যক্তি তাতে দেশে বহুল প্রচলিত রাধাকৃষ্ণরূপকের ব্যবহার। বিশেষ করে বৈষ্ণব চর্যায় ইসলামী প্রভাব তাদের ভেদবুদ্ধি লোপ করেছিল; বৈষ্ণবদের নামকীর্তন, জীবে দয়া, বৰ্ণভেদ প্রথার বিলোপ সাধন তথা সাম্যবোধ, বিনয়, নামেরুচি, দশা, সখীভাব, ঐশ্বর্যপ্রদর্শন, রাগানুগভক্তি, তালাকপ্ৰথা, পুনর্বিবাহ প্রভৃতি সূফীদের যিকর, খিদমত, সামা, হাল, সদাসোহাগ, কেরামতি, তরিকত, হকিকত, মারফত প্রভৃতির অনুকরণ মাত্র। ফানাফিল্লাহ এবং বাকাবিল্লাহও রাধা-কৃষ্ণের অভেদতত্ত্ব আর যুগলরূপে পরিকল্পনার উৎস স্বরূপ। এমনকি অদ্বৈতবাদী হিন্দুর দ্বৈতাদ্বৈতবাদও সূফীর দ্বৈতবাদ থেকে উদ্ভূত। অবশ্য বৈদান্তিক তত্ত্বপ্রভাবে মুসলমান সুফীদের কেউ কেউ আগেই হয়েছিলেন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী। সুতরাং সুফী মতাসক্ত বাঙালী মুসলমানদের বৈষ্ণবসাধনা অনুপ্রাণিত করবে তাতে আশ্চর্যা কি? এ জন্যেই সাধক নুর কুতবে আলম এবং সৈয়দ মর্তুজা ফারসী গজল যেমন লিখেছেন, তেমনি রচনা করেছেন বাঙলায় রাধা-কৃষ্ণপদও। অতএব, দুই তত্ত্বে অভিন্ন রূপ দেখেছেন তাঁরা। রাধাকৃষ্ণ যে জীবাত্মা ও পরমাত্মা, দেহ ও প্রাণ এবং ভক্তভগবানের পরিভাষারূপে গৃহীত হয়েছিল, পাক-ভারতের সর্বত্র এঁদের এবং পাক-ভারতের বিভিন্ন ভাষায় রাধাকৃষ্ণ কিংবা রামসীতার রূপকে মুসলিম রচিত পদ ও দােহাঁই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বিশেষ করে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই জগৎ ও জীবনের রহস্য সম্বন্ধে চিরজিজ্ঞাসু। সেই চিরন্তন জিজ্ঞাসার রূপ মানুষ অবিশেষে একই। কাজেই চিন্তাধারাও কমবেশী একই রূপ। কেননা, সবারই “চিত্তকাড়া কালার বাঁশি লাগিছে অন্তরে।”
ভারতে এসেই ভারতীয় যোগ, দেহতত্ত্ব প্রভৃতির প্রভাবে পড়েছিলেন ইরানী সূফীরা। সুফীসাধনার সঙ্গে যোগ ও দেহতত্ত্বের সমন্বয় সাধন করেই তাঁরা শুরু করেন নতুন সূফীচর্যা। পাকভারতের মুসলিমের অধ্যাত্ম সাধনা যোগ-দেহতত্ত্ব বিহীন নয় এ কারণেই। এ সম্বন্ধে আমরা পরে আলোচনা করব অন্য অধ্যায়ে। অতএব সঙ্গীত, যোগ, রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব প্রভৃতিই রচনা করেছে বাঙালী মুসলমানের অধ্যাত্ম তথা মরমীয়া সাধনার ভিত্তি।
৬
মুসলমানদের বিশ্বাস, হযরত মুহম্মদ হযরত আলীকে তত্ত্ব বা গুপ্ত জ্ঞান দিয়ে যান। হাসান, হোসেন, খাজা কামীল বিন জয়দ ও হাসান বসোরী আলী থেকে প্ৰাপ্ত হন সে জ্ঞান। এই কিংবদন্তীর কথা বাদ দিলে হাসান বসোরী (মৃঃ ৭২৮ খ্ৰীঃ), রাবিয়া (মৃঃ ৭৫৩), ইব্রাহীম আদহাম (মৃঃ ৭৭৭), আবু হাশিম (মৃঃ ৭৭৭), দাউদ তায়ী (মৃঃ ৭৮১) মারুফ কখী (মৃঃ ৮১৫) প্রমুখই সূফীমতের আদি প্রবক্তা।(৩৯)
পরবর্তী সূফী জুননুন মিসরী (মৃঃ৮৬০), শিবলী খোরাসানী (মৃঃ৯৪৬), জুনাইদ বাগদাদী (মৃঃ ৯১০) প্রমুখ সাধকরা সূফীমতকে লিপিবদ্ধ, সুশৃঙ্খলিত ও জনপ্রিয় করে তোলেন।(৪০)
আল্লাহ আকাশ ও মর্তের আলো স্বরূপ।৪১ আমরা তার (মানুষের) ঘাড়ের শিরা থেকেও কাছে রয়েছি।৪২ এই প্রকার ইঙ্গিত থেকেই সূফীমত এগিয়ে যায় বিশ্বব্ৰহ্ম বা সৰ্বেশ্বরবাদের তথা অদ্বৈতবাদের দিকে। যিকর বা জপ করার নির্দেশ মিলেছে কোরআনের অপর এক আয়াতে : অতএব (আল্লাহ্কে) স্মরণ কর, কেননা, তুমি একজন স্মারক মাত্র।৪৩ সৃষ্টি ও স্রষ্টার অদৃশ্য লীলা ও অস্তিত্ব বুঝবার জন্যে বোধি তথা ইরফান কিংবা গুহ্যজ্ঞান লাভ করা প্রয়োজন–এ প্রয়োজনবোধ ও রহস্যচিন্তাই সূফীদের করেছে বিশ্বব্ৰহ্মবাদী বা সৰ্বেশ্বরবাদী। এই চিন্তা বা কল্পনার পরিণতিই হচ্ছে “হমহউস্ত’ (সবই আল্লাহ) বা বিশ্বব্ৰহ্মতত্ত্ব তথা ‘সৰ্বংখল্কিদং ব্ৰহ্ম’ বাদ। এ-ই হল তৌহিদই-ওজুদী তথা আল্লাহ্ সর্বত্র বিরাজমান’–এই অঙ্গীকারে আস্থাস্থাপনের ভিত্তি।
বায়জিদ, জুনাইদ বাগদাদী, আবুল হোসেন ইবনে মনসুর হল্লাজ এবং আবু সৈয়দ বিন আবুল খায়ের খোরাসানী (মৃঃ ১০৪৯ খ্ৰীঃ) প্রমুখ প্রথম যুগের অদ্বৈতবাদী সূফী। শরীয়ৎ-পন্থবিরোধী এসব সূফীদের অনেককেই প্রাণ হারাতে হয় নতুন মত পোষণ ও প্রচারের জন্যে। মনসুর হাল্লাজ, শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়াদী, ফজলুল্লাহ প্রমুখ শহীদ হন। এ ভাবেই।(৪৪
ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক বলেন ‘ভারতে সূফী প্রভাব পড়বার পূর্ব হইতে সূফীমতবাদ ভারতীয় চিন্তাধারায় পরিপূর্ণ হইতে থাকে। খ্ৰীষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতেই ভারতে সূফীমত প্ৰবেশ করে। তৎপূর্ব সূফীমতেও ভারতীয় দর্শন ও চিন্তাধারার স্পষ্ট ছাপ দেখিতে পাই’।(৪৫) তাঁর মতে ভারতীয় পুস্তকের আরবী-ফারসী অনুবাদ, ভ্ৰাম্যমাণ বৌদ্ধভিক্ষুর সান্নিধ্য এবং আল-বিরুনী অনুদিত পাতঞ্জল যোগ আর কপিল সাংখ্য তত্ত্বের সঙ্গে পরিচয়ই এ প্রভাবের মুখ্য কারণ।(৪৬ বায়জিদ বিস্তামীর ভারতীয় (সিন্ধুদেশীয়) গুরু। বুআলীর প্রভাবও এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়। ৪৭
তিনি আরো বলেন, “(বাঙলা) দেশে সূফীমত প্রচার ও বহুল বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে, ভারতীয় সহজিয়া ও যোগসাধন প্রভৃতি পন্থা, বঙ্গের সূফীমতকে অভিভূত করিয়া ফেলিতে থাকে। কালক্রমে বঙ্গের সূফীমতবাদের সহিত, এ দেশীয় সংস্কার, বিশ্বাস প্রভৃতিও সম্মিলিত হইতে থাকে এবং সূফীমতবাদ ও সাধন পদ্ধতি ক্ৰমে ক্ৰমে যোগ সাধন প্রভৃতি হিন্দু পদ্ধতির সঙ্গে একটা আপোষ করিয়া লইতে থাকে। চিশতীয়হ ও সুহরাবদীয়াহ সম্প্রদায়-দ্বয়ের সাধনা ভারতে আগমন করার পূর্ব হইতেই অনেকখানি ভারতীয় ভাবাপন্ন হইয়া পড়িয়াছিল; ভারতে আগমনের পর এদেশীয় সাধনার সহিত তাহাদের সাক্ষাৎ যোগসূত্রের সৃষ্টি হইল; ভারতের প্ৰাণের সহিত আরব ও পারস্যের প্রাণের ত্রিবেণী সঙ্গম ঘটিয়া গেল। ভারত বিখ্যাত সাধক কবীর (১৩৯৮-১৪৪০ খ্ৰীঃ) উক্ত প্ৰাণত্রয়ের পুণ্যতীর্থ প্রয়াগক্ষেত্রে পরিণত হইলেন। তাঁহার মধ্যে ভারতীয় যোগ-সাধনা ও সূফীদের “তস্বব্বফ” বা ব্ৰহ্মবাদ সম্মিলিত হইল। সূফীরা সাক্ষাৎভাবে তাহার ভিতর দিয়া ভারতীয়দের আর ভারতীয়েরাও সূফীদের প্রাণের সন্ধান লাভ করিলেন।”৪৮ চৌদ্দটি সূফী-খান্দান বা মণ্ডলীর উল্লেখ আছে আইন-ই-আকবরীতে।(৪৯)
আবুল ফজল প্ৰধান সম্প্রদায়গুলোরই নাম করেছেন হয়তো। তখন এক এক পীর-কেন্দ্রী এক এক সম্প্রদায় ছিল বলেই আমাদের অনুমান। পরে তাত্ত্বিক ও আচারিক বিধিবদ্ধ শাস্ত্র গড়ে উঠার ফলে সম্পপ্রদায় সংখ্যা কমেছে এবং চারটি প্রধান মতবাদী খান্দান প্রসার লাভ করে, আর অপ্রধানগুলো কালে লোপ পায়, অথবা স্থানিক সীমা অতিক্রম করার যোগ্যতা হারায়। আবুল ফজল কথিত চৌদটি খান্দানের অনেকগুলোই লোপ পেয়েছে একারণেই।
চিশতিয়া ও সুহরাওয়াদীয়া মতই প্ৰথমে ভারতে তথা বাঙলায় প্রসার লাভ করে।৫০ এর পরে নকশবন্দীয়া এবং আরো পরে কাদেরিয়া সম্পপ্ৰদায় হয় জনপ্রিয়। মনে হয় ষোলশতক অবধি চিশতিয়া মাদারিয়া ও কলন্দরিয়া সম্প্রদায়ের প্রভাবই ছিল বেশী। মদারিয়া ও কািলন্দরিয়া মত এক সময় জনপ্ৰিয়তা হারিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
সূফীর সৰ্বেশ্বরবাদ আর বৈদান্তিক অদ্বৈতবাদ অভিন্নরূপ নিল চৌদ-পনেরো শতকের মধ্যেই। আচার ও চর্যার ক্ষেত্রেও ঐক্য স্থাপিত হল যোগ-পদ্ধতির মাধ্যমে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এ অভিন্নতা প্ৰথম আমরা প্ৰত্যক্ষ করি। কবীরের (১৩৯৮-১৪৪৮) মধ্যেই। এই মিলনের বিরোধী আন্দোলনও গড়ে উঠে শতোধৰ্ব্ব বছর পরে “মুজদ্দদই-ই-আলফা-ই-সানী’ আহমদ সরহিন্দীর (১৫৬৩-১৬২৪) নেতৃত্বে। কিন্তু সর্বব্যাপী হতে পারেনি সে-সংস্কার আন্দোলন। নকশবদীয়া এবং কিছুটা কাদেরিয়া সম্প্রদায়েই প্রধানত সীমিত ছিল এ সংস্কার আন্দোলন। আলফা সানী স্বয়ং একজন নকশবদীয়া। দেশী তত্ত্বচিন্তা ও চর্যার সঙ্গে ইসলামের বহিরাবয়বের মিলন ঘটানোর চেষ্টায় তা পরিণতিলাভ করে বাঙলায়। সৈয়দ সুলতান ও তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে এই প্ৰচেষ্টাই লক্ষ্য করি।
ভারতীয় যোগ-চৰ্যা ভিত্তিক তান্ত্রিক সাধনার যা কিছু মুসলিম সূফীরা গ্ৰহণ করলেন তাকে একটা মুসলিম আবরণ দেবার চেষ্টা হল, তা অবশ্য কাৰ্যত নয়, নামত। কেননা, আরবী-ফারসী পরিভাষা গ্রহণের মধ্যেই সীমিত রইল এর ইসলামী রূপায়ণ। যেমন নির্বাণ হল ফানা, কুণ্ডলিনীশক্তি হল নকশবন্দীয়াদের লতিফা। হিন্দুতন্ত্রের ষড়পদ্ম হল এঁদের ষড় লতিফা বা আলোককেন্দ্র। এঁদেরও অবলম্বন হল দেহচর্যা ও দেহস্থ আলোর উর্ধায়ন। পরম আলো বা মৌল আলোর দ্বারা সাধকের সর্ব শরীর হয়ে উঠে আলোকময়–এ হচ্ছে এক আলোকময় অদ্বয়সত্তা। এর সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় “সামরস্য” জাত সহজাবস্থার, সচ্চিদানন্দ বা বোধিচিত্তাবস্থার।(৫১)
ভারতিক প্রভাবে যোগীর ন্যাস, প্ৰাণায়াম ও জপের রূপ নিল সূফীর যিকর। বহির্ভারতিক বৌদ্ধ প্রভাবে (ইরানে, সমরকন্দে, বোখারায়, বলখে) এ ভারতিক বৌদ্ধ প্রভাবে বৌদ্ধগুরুবাদও (যোগ-তান্ত্রিক সাধকদের অনুসৃতি বিশে) অপরিহার্য হয়ে উঠল। সূফী সাধনায়। সূফী মাত্রই তাই পীর-মুশীদি নির্ভর তথা গুরুবাদী। গুরুর আনুগত্যই সাধনায় সিদ্ধির একমাত্র পথ। এটিই কবর পূজারও (দরগাহ বৌদ্ধভিক্ষুর স্তুপ” পূজারই মতো হয়ে উঠল) রূপ পেল পরিণামে। আল্লাহর ধ্যানের প্রাথমিক অনুশীলন হিসাবে পীরের চেহারা ধ্যান করা শুরু করেন। সূফীরা। গুরুতে বিলীন হওয়ার অবস্থায় উন্নীত হলেই শিষ্য যোগ্য হয় আল্লাহতে বিলীন হওয়ার সাধনার। প্রথম অবস্থার নাম “ফানা ফিশশেখ” দ্বিতীয় স্তরের নাম ‘ফানা ফিল্লাহ। প্রথমটি রাবিতা (গুরু সংযোগ) দ্বিতীয়টি মুরাকিবাহ (আল্লাহর ধ্যান) এই ‘মুরাকিবাহাঁয় গৃহীত হয়েছে যৌগিক পদ্ধতি। আসন, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি–এই চতুরঙ্গ যোগপদ্ধতি থেকেই পাওয়া।
পীরের খানকা বা আখড়ায় সামা (গান) হালকা (ভাবাবেগে নর্তন) দা’রা (আল্লাহ্র নাম কীর্তনের আসর) হাল (মূর্ছা) সাকী, ইশক প্রভৃতি চিশতিয়া খান্দানের সূফীদের সাধনায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। খাজা মঈনউদ্দীন চিশতির আমল থেকেই। পরবর্তীকালে নিজামিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়েও গৃহীত হয় এই রীতি। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধনায় রয়েছে এরই অনুসৃতি।(৫২)
সূফীদের দ্বারা দীক্ষিত অজ্ঞজন ভাষার ব্যবধানবশত সাধারণ শরীয়তী ইসলামের সঙ্গে অনেক কাল পরিচিত হতে পারেনি। ফলে “তাহারা ক্রিয়া কলাপে আচারে ব্যবহারে, ভাষায় ও লিখায়, সর্বোপরি সংস্কার ও চিন্তায়, প্রায় পুরোপুরি বাঙ্গালী রহিয়া গেল। হিন্দুত্বকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করিতে পারিল না;…এমনকি দরবেশদের প্রশ্ৰয়ও ছিল–তাহারা (দরবেশরা) কখনও বাহ্যিক আচার বিচারের প্রতি বিশেষ মনোযোগ ত দেনই নাই; এমন কি আভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও অসাধারণ মহৎ ও উদার ছিলেন।…এখনও পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গীয় শায়খ’ শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে অনেক হিন্দুভাব, চিন্তা, আচার ও ব্যবহারের বহুল প্ৰচলন (রহিয়াছে).সাধারণ বঙ্গীয় মুসলমানদের মধ্যে এখনও তাহাদের ভারতীয় পিতৃপুরুষ হইতে লব্ধ বা পরবর্তীকালে গৃহীত (যত) হিন্দু ও বৌদ্ধ আচার-ব্যবহার প্রচলিত আছে। এবং চিন্তা ও বিশ্বাস ক্রিয়া করিতেছে।”৫৩
মোকাম, মঞ্জিল ও হাল
বর্হিভারতিক সূফীতত্ত্বে মোকাম-মঞ্জিল-এর ধারণা এরূপ : মোকাম হচ্ছে আল্লার পথে স্থিতি। প্রথম মঞ্জিলের নাম শরীয়ৎ। এ শরীয়ৎ হচ্ছে আল্লার প্রতি মানুষ অবিশেষের স্বাভাবিক কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার অনুগ চর্যা (তওবা)। এ অঙ্গীকার পালিত হয় নাসৃত মোকাম লক্ষ্যে। নাসুত মোকাম হচ্ছে পরিশ্রুত মানবিক গুণের উজ্জীবিত অবস্থা। এর পরে তরিকত তথা আল্লার প্রসন্নদৃষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে বিষয়বুদ্ধি ও সংসার-চিন্তা ত্যাগ করে একনিষ্ঠভাবে আল্লার ধ্যানে আত্মনিয়োগ করা (ইনাবাত)। এ চর্যা গৃহীত হয় মলকুত মোকাম লক্ষ্যে। মলকুত মোকাম হচ্ছে ভগবৎ সাধনায় সমৰ্পিত চিত্ততা। এর পরের স্তর হকিকত। জাগতিক জ্ঞান লোপ করে আল্লাহর সন্ধানে কায়-বাক-চিৎ নিয়োগ করাই হকিকত (যুহৃদ)। এর মোকাম হচ্ছে জবরুতনিশ্চিন্ত নিঃশ্বতা। এর পরে পাই মারফত মঞ্জিল। আল্লাহর ইচ্ছার উপর দেহ-মন-আত্মা সমর্পণের স্তর (তোয়াক্কল)। এর মোকাম হল লাহুত–তথা অহংবোধ শূন্যতা–লীলাময় আল্লাহ্র লীলা নিজ দেহ-মন প্ৰাণের মধ্যে অনুভব করা। এ ব্যাখ্যাই পাই কাশফ-অল-মাহজুব-এ : “Station (Maqam) denotcs anyone’s standing in the way of God, and his fulfilment of the obligation appertaining to that station and his keeping it until he comprehends its perfection so far as lies in a man’s power. It is not permissible that he should quit his station without fulfilling the obligations there of. Thus the first station is repentance (Tawbat), then comes conversion (Inabat) the renunciation (Zuhd), then trust on God (Tawakkul) and son, it is not permissible that anyone should pretend to conversion without repentance, or to renunciation without conversion or to trust in God without renunciation.(১) এর পরেও রয়েছে সর্বেশ্বরবাদীদের হাগুত তথা অদ্বৈতসিদ্ধি। সংক্ষেপে বলতে গেলে, নাসুত হচ্ছে মানবিক, আর মলকুত হচ্ছে ফিরিস্তা সুলভ পবিত্রতার স্তর, এটি অধ্যাতন্ত্র জগতের দ্বার স্বরূপ। জবরুত মোকামে অধ্যাত্মশক্তি অর্জিত হয়, আর লাহুত মোকামে রহিত হয় ফানাভাব তথা অহং-এর ব্যবধান।(২)
হাল
হাল হচ্ছে সাধনার সিদ্ধিস্বরূপ আল্লাহর দান। মানুষের মোকাম সাধনা যদি অকৃত্রিম ও নিখুঁত হয়, তাহলে আল্লাহ তাকে সাধনানুরূপ ফল দান করেন। অতএব মোকাম হচ্ছে সাধ্যকর্ম আর হাল হল সাধ্যফল। হুজুইরী এ সম্পর্কে বলেন, “State (Hal) on the otherhand, is something that descends from God into man’s heart, without his being able to repcal it when it comes, or to attract it when it goes, by his own effort. Accordingly, while the term “statuion’ denotes the way of the seeker and his progress in the field of exertion, and his rank before God in proportion to his merit, and the term “state’ denotes the favour and grace which are god bestows upon the heart of his servant, and which are not connected with any mortification on the latter’s part. ‘Station’ belongs to the catagory of acts, state to the catagory of gifts. Hence the man that has a station stands by his own self mortification, whereas a man that has a “state’ is dead to ‘self” and stands by a ‘state’ which god creats in him ।(৩)
এই হাল দ্বিবিধ : ধ্যান, আল্লাহর সান্নিধ্যবোধ, গ্ৰীতি, ভয়, আশা, বিরহবোধ বা ব্যাকুলতা (উদ্বিগ্নতা) এবং ঘনিষ্ঠতা, শান্তি, সমাধি ও নিশ্চিতভাব। “The states or ahwal’ are meditation, nearncss to God, love, fear, hope, longing, intimacy, Tranquility, contemplation and certainty.”(৪)
সূফীর দেহতত্ত্ব, মোকাম-মঞ্জিল, হাল ও দর্শনের দেশী অবয়ব
বৌদ্ধতন্ত্র ভিত্তি করেই হিন্দুতন্ত্রের উদ্ভব। আবার হিন্দু-বৌদ্ধ তন্ত্রের প্রভাবে বাঙালী সূফীর যৌগিক কায়াসাধনের উদ্ভব। বাঙালী সূফীরা দুইকূল রক্ষার প্রয়াসে দেহতত্ত্ব ও সাধন চৰ্যার অসমন্বিত মিলন ঘটিয়েছেন। ফলে মোকাম, মঞ্জিল, হাল, সূফীতত্ত্ব প্রভৃতি নতুন তাৎপর্য লাভ করেছে তাদের চিন্তায়। বাঙলাদেশের বাইরে কলন্দির ও কবীরই প্ৰথম সমন্বয়কারী। তাদের শিষ্য-উপশিষ্যের হাতে বাঙলায়ও বৌদ্ধ-হিন্দু প্রভাবিত অধ্যাত্ম সাধনা শুরু হয়। এ প্রভাবের কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
ক. বৌদ্ধ চর্তুকায়ের আদলে তন লতিফু, তন কসিফু, তন ফানি এবং তন বকাউ কল্পিত।
খ. আবার চার ‘দীল’ও পরিকল্পিত হয়েছে ; দীল আম্বরী (বক্ষের দক্ষিণাংশে), দীল সনুকরী (বক্ষের বামাংশে), দীল মুজাওয়ারী (মস্তকে), দীল নিলুফারী (উদর ও উরুর সন্ধিস্থলে)। এটিও বৌদ্ধ চার তত্ত্বের–আত্মতত্ত্ব, মন্ত্রতত্ত্ব, দেবতাতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্বের অনুকৃতি। আবার হারিস, মারিস, মুকিম ও মুসাফির–এই চার রুহও হয়েছে কল্পিত। [তালিবনাম]
গ. হিন্দুর ষটচক্র এবং ষড়পদ্মও স্বীকৃত। বিশেষ করে মূলাধার মণিপুর, অনাহত ও আজ্ঞাচক্রের বহুল প্রয়োগ সর্বত্র সুলভ।
ঘ. কুণ্ডলিনী ও পরশিবশক্তিকে এঁরা অভিহিত করেছেন জ্যোতি (লতিফা) নামে।
ঙ. আবার ষড়পদ্মের আদলে ষড় লতিফ’ও কল্পনা করা হয়েছে ; কলুবি (হৃদয়, রুহ, আত্মা), সির (গুপ্তহৃদয়) খাফি (গুপ্ত আত্মা) কস্ফ (বিবেকী আত্মা) ও নাফীস (দুষ্পপ্রবৃত্তি)। এগুলো বিশেষ করে নকশবন্দীয়া খান্দানের পরিকল্পিত।(৫ রুহও চার প্রকার–ক, নাতকি, খ, সামি, গ, জিসিমি ও ঘ, নাসি। [সির্নামা]
চ. ইড়া (গঙ্গা), পিঙ্গল (যমুনা) ও সুষুম্না (সরস্বতী) নাড়ী এবং প্ৰাণ-অপান বায়ুর (দমের) নিয়ন্ত্রণ ও উল্টা সাধনা এদের লক্ষ্য।
ছ. চক্রের অধিষ্ঠাত্রী বৌদ্ধদেবতা লোচনা, মামকী, পাণ্ডুরা, তারার মতো কিংবা হিন্দুতন্ত্রের চক্রদেবতা ব্রহ্মা-ডাকিনী, মহাবিষ্ণু-রাকিনী, রুদ্র-লাকিনী, ঈশ-কাকিনী প্রভৃতির মতো চর্তুদ্বারের জন্যে জিব্রাইল, মিকাইল, ইস্রাফিল ও আজাইল-এই চার ফিরিস্তা প্রহরীরূপে কল্পিত।
জ. হিন্দুর মন্ত্ৰ-তন্ত্র, সঙ্গীতাদি প্রায় সব শাস্ত্র ও তত্ত্ব যেমন শিবপ্রোক্ত বলে বর্ণিত, তেমনি মুসলমানদের কাছে রসুলের পরেই আলির স্থান এবং সব ইসলামী গৃহ্যতত্ত্বই আলিপ্রোক্ত।
ঝ. শরীয়ৎ-নাসূত, তরিকত-মলকুত, হকিকত-জবরুত, মারফত-লাহুত ও হাহুত প্রভৃতি নাম রক্ষিত হয়েছে বটে, কিন্তু তত্ত্ব ও তাৎপর্যের পরিবর্তন হয়েছে।
ঞ. অদ্বৈততত্ত্ব তথা সৰ্বেশ্বরবাদ সর্বত্রই স্বীকৃত। এবং বাকাবিল্লাহ লক্ষ্যে সাধনাও দুর্লক্ষ্য নয়। ‘হমহ্ উস্ত’ (সবই আল্লাহ) বিশ্বাসে এবং হাহুত (পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ম-অবস্থা) লক্ষ্যের সাধনায় বৌদ্ধ নির্বাণবাদ এবং বৈদান্তিক অদ্বৈতবাদের প্রত্যক্ষ অনুকৃতি লক্ষণীয়।
ট. আসন, ন্যাস, প্রাণায়াম, জপ প্রভৃতিও হয়েছে সূফীদের যিকরের অপরিহার্য অঙ্গ। রেচক, পূরক ও কুম্ভক সূফীদের দম নিয়ন্ত্রণচর্যার অঙ্গ।
ঠ. ‘পীরবাদ’ চালু হয়েছিল বৌদ্ধগুরুবাদের প্রভাবেই। বৌদ্ধ-হিন্দু প্রভাবে সূফী সাধনায় পীরের উপর অপরিমেয় গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ফলে অধ্যাত্ম-সাধনা মাত্ৰই গুরুনির্ভর। গুরুর আনুগত্যই সাধনায় সিদ্ধির একমাত্র পথ।
ড. প্রর্বত, সাধক ও সিদ্ধির অনুকরণেই সম্ভবত রাবিতা (গুরু সংযোগ) মুরাকিবাহ্ (আল্লাহ্র ধ্যান) তথা ‘ফানাফিশশেখ’ ও ফানাফিল্লাহ পরিকল্পিত।
ঢ. আল্লাহ্কে বৌদ্ধ ‘শূন্য’-এর সঙ্গে অভিন্ন করেও ভেবেছেন কোনো কোনো সূফী সম্প্রদায়:
দেখিতে না পারি যারে তারে বলি শূন্য
তাহারে চিন্তিলে দেখি পুরুষ হএ ধন্য।
নাম শূন্য কাম শূন্য শূন্যে যার স্থিতি
সে শূন্যের সঙ্গে করে ফকির পিরীতি।
শূন্যেত পরম হংস শূন্যে ব্ৰহ্মজ্ঞান
যথাতে পরম হংস তথা যোগ ধ্যান।(৬) [জ্ঞান প্ৰদীপ]
ণ. পরকীয়া প্রেমসাধনা তথা বামাচারী যোগ সাধনাও কারো কারো স্বীকৃতি পেয়েছে :
স্বকীয়া সঙ্গে নহে অতি প্ৰেমরস
পরকীয়ার সঙ্গে যোগ্য প্রেমের মানস।(৭) [জ্ঞান সাগর]
ত. ঘৰ্ম থেকেই যে সৃষ্টি পত্তন, তা’ সব বাঙালী সূফীই মেনে নিয়েছেন।
সৃষ্টিতত্ত্ব, যোগ ও দেহচর্যা
১
আগেই বলেছি, জীবচৈতন্যের স্থিতি দেহাধার বিহীন হতে পারে না–এ সাধারণ বোধ থেকেই মানুষ দেহ সম্বন্ধে হয়েছে কৌতুহলী। আধেয় চৈতন্যের স্বরূপ দেহাধার বিশ্লেষণ করেই উপলব্ধি করা সম্ভব। তাই গোড়া থেকেই দেহের অন্ধি-সন্ধি বুঝবার প্রয়াস পেয়েছে মানুষ। জীবের জন্মরহস্য, গৰ্ভে দেহ গঠন ও প্ৰাণের সঞ্চার প্রভৃতি বিষয়ে মানুষের বিচিত্র চিন্তা ও অনুমান বিধৃত রয়েছে শাস্ত্রে, সাহিত্যে ও লোকশ্রুতিতে।
ঋগ্বেদের কথাই ধরা যাক। নৈষধ সূক্তে আছে, “আদিতে সর্বত্র অন্ধকার ও জল বিরাজ করত। তার মধ্য থেকে তপঃ প্রভাবে পরব্রহ্মের উদ্ভব হল। ইনি হিরণ্যগৰ্ভ এবং পৃথিবী ও আকাশের কর্তা ও দেবেন্দ্র।”
শামীয় জগতে ‘চিরন্তন ভাবসত্তা’ স্রষ্টার হুকুমেই গড়ে উঠেছে সৃষ্টি। এই সৃষ্টা জ্যোতিস্বরূপ। চীনাদের প্রাচীন মত এই যে নারী পুরুষের (yin ও yang) সহযোগেই সম্ভব হয়েছে সৃষ্টি। এঁদেরই অদ্বয় রূপ Talikelih, ভারতের অনাৰ্য পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্বও এর অনুরূপ। পুরুষ-প্রকৃতি চিন্তাধারার ক্ৰমবিকাশে শিব-শক্তি, বিষ্ণু-লক্ষ্মী প্রভৃতি তত্ত্ব রূপ নিয়েছে।
বৌদ্ধ সৃষ্টিতত্ত্ব এরূপ : জলময় অন্ধকার অবস্থা থেকেই অনাদি শক্তি গড়ে উঠে, এবং তাঁর ইচ্ছা থেকে কায়াধারী আদিনাথ ও নিরঞ্জনের উদ্ভব। আদি শক্তির ঘর্ম থেকে জল, জল থেকে কূর্ম, তারপর হংস, তারপর উলুক, তারপর হল বাসুকীয় জন্ম এবং আদিনাথের মন থেকে আদ্যাশক্তির উদ্ভব। এই আদ্যাশক্তিই জন্ম দিলেন শিব, বিষ্ণু ও ব্ৰহ্মার। আবার শিব ও শক্তি থেকে দেব-মানবের সৃষ্টি।
অহোমেরা, পলিনেশীয়রা, ধর্মঠাকুরের পূজারীরা ও নাথেরা উক্তরূপ সৃষ্টি পত্তনে বিশ্বাসী। আর্যদের সৃষ্টি তত্ত্বেরও মিশ্রণ ঘটেছে এর সঙ্গে। তাই শূন্য পুরাণ, গোরক্ষাবিজয়, আদ্যপরিচয় প্রভৃতি গ্রন্থে একই তত্ত্ব পাই।
যোগ-তান্ত্রিক সাধনায় সৃষ্টিতত্ত্বের গুরুত্ব কম নয়। বাঙলা দেশের সূফীতত্ত্বেও দেশী প্রভাবে সে ঐতিহ্য অবহেলিত হয়নি। সৃষ্টি রহস্য বিমুগ্ধ মনে জাগিয়েছে বিচিত্র চিন্তা। কেউ ভেবেছে নারী-যোনিই সৃষ্টির উৎস, কেউ জেনেছে। পুরুষের লিঙ্গই সৃষ্টির আকর, আবার কেউ কেউ নারী-পুরুষের মিলনেই সৃষ্টি সম্ভব বলে মেনেছে; পুরুষ-প্রকৃতি yin-yang, প্রজ্ঞা-উপায়, শিব-শক্তি, ব্ৰহ্মা-মায়া, বিষ্ণু-লক্ষ্মী প্রভৃতি তত্ত্বের উন্মেষ এমনি ধারণা থেকেই।
আবার স্রষ্টর হুকুমেই সৃষ্টি–এ তত্ত্বটিও সামীয় গোত্রগুলোর সাধারণ আস্থা অর্জন করেছে। “একোহিম বহুস্যাম’ তত্ত্বও বিকশিত মননে হয়েছে সম্ভব। এর পরও রয়েছে আলো-অন্ধকার তত্ত্ব সত্ত্ব-রজঃ-তম বাদ আর সুন্দর কুৎসিত, ভাল-মন্দ, মিত্ৰ-অরি এবং কল্যাণ অকল্যাণ তত্ত্ব। অনস্তি ত্ব, অসুন্দর ও অকল্যাণই অন্ধকার আর সৃষ্টিশীলতা, আনন্দ, সত্য, শিব ও সুন্দরই আলো। এই জ্যোতিতত্ত্বে বাহ্য অনৈক্য থাকলেও মৌল অর্থে কোথাও কোন অমিল নেই।
জোরাষ্ট্ৰীয় মতে দেহে রয়েছে : চৈতন্য (Conscience), প্ৰাণ-শক্তি (Vitaliforce), আত্মা (Soulemind), বিবেক (spirit>reason), আর ফরাবশী (Farawalshi ভগবদাসক্তি স্বরূপ),–যদি সৎচিন্তা, সৎকথা ও সৎকর্মের মাধ্যমে পরিচর্যা পায়, এগুলোই তাহলে আদি জ্যোতি (Primal Light) তথা পরব্রহ্মের সঙ্গে অদ্বয় এবং অবিনশ্বর হয়।(১) ভারতিক যোগেও পাই— “Plane of physical body, Plane of Ethical Double, Plane of Vitality, Plane of Emotional Nature. Plane of thoutht, Plane of Spiritual soul-Reason, the plane of pure Spirit,(২) যোগের আট-বিভূতি;(৩) অনিমা (অণুবৎ হওয়া), মহিমা (বৃহৎ), লঘিমা (light), গরিমা (Heavy), প্রাপ্তি। প্রকাম্য (obtaining pleasure), ঈশত্ব, বশীত্ব।
সূফীরা ভারতিক যোগের আলোকে একে বিভিন্ন মোকামে ও মঞ্জিলে ভাগ করেছেন! World of body নাসুত (দেহলোক), world of pure intelligence মলকুত (বৌদ্ধলোক); world of power জবরুত (শক্তিলোক), the world of negation লাহুত (ফানা বা আত্মবিলোপের জগৎ), the world of Absolute Silence হাহুত (বাকাবিল্লাহ তথা অদ্বয় অবস্থা)।(৪)
২
তেরো শতকের গোড়া থেকেই ভারতিক যোগ ও বেদান্তদর্শনের প্রভাব ইরানী তথা মুসলিম সূফীদের উপর গভীরভাবে পড়তে থাকে। কামরূপের ভোজর ব্ৰাহ্মণ (ভোজবৰ্মণ?) নামে এক ব্ৰাহ্মণ (বৌদ্ধতান্ত্রিকত্ব) যোগীর প্রদত্ত ‘অমৃতকুণ্ড’ নামে যোগী-তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের এক সংস্কৃত গ্ৰন্থ লখনৌতীর শাসক আলি মরদানে খলজীর (১২১০-১৩) আমলের লখনৌতীর কাজী রুকনুদ্দীন সমরখন্দী (১২১০-১৮; ১২১৯ খ্ৰীষ্টাব্দে বোখারায় মৃত্যু হয়) ফারসী ও আরবীতে অনুবাদ করেন।(৫) পরে কামরূপের অপর ব্ৰাহ্মণ অম্ভব নাথের সাহায্যে আর এক অজ্ঞাত সূফীও আরবীতে তৰ্জমা করেন এ গ্রন্থ। Brocklemann-এর মতে এই অনুবাদক দামস্কের সূফী ইবনুল আরবী।(৬) শাত্তারিয়া খান্দানের সূফী গোয়ালিয়রের শেখ মুহম্মদ গাওসীর (মৃত্যু ১৫৬২) প্রবর্তনায় তাঁর শিষ্য মুহম্মদ খাতিরুদ্দীন ‘বহর-অল-হায়াৎ’(৭) নামে পুনরায় এই গ্ৰন্থ অনুবাদ করেন ফারসীতে। এবার সহযোগী ছিলেন কামরূপ বাসী কনাম (Kanama)। কাজী রুকনুদ্দীন সমর খন্দীর পুরোনাম ছিল কাজী রুকনুদ্দীন আবু হামিদ মুহম্মদ বিন মুহম্মদ আলি সমরখন্দী। ইনি ছিলেন বোখারা বাসী। বাঙলায় ছিলেন ১২১০ থেকে ১২১৮ খ্রীস্টাব্দ অবধি। ১২১৯ সনে বোখারায় তিনি দেহত্যাগ করেন।(৮)
এই আরবী অনুবাদ চৌদ্দ শতকের মিশরেও ছিল সুপরিচিত। চৌদ্দ শতকে মিশরের সূফী মুহম্মদ আল মিসূরী অমৃতকুণ্ডের উল্লেখ করেছেন।(৯) মুসলিম জগতের সর্বত্র জনপ্রিয় হয় এ গ্রন্থ। তাই ভারত থেকে মিশর অবধি সব জায়গায় মিলেছে এ বইয়ের পাণ্ডুলিপি।
অমৃতকুণ্ড কামরূপের গ্ৰন্থ কামরূপবাসী ভোজবৰ্মণ ও অম্ভরানাথের সাহায্যে প্রাপ্ত ও অনুদিত। এতে অনুমান করা চলে যে যোগী ব্ৰাহ্মণ নন–বৌদ্ধ। গ্রন্থটি সম্ভবত প্রাকৃতে কিংবা অবহট্টে রচিত ছিল। হিন্দু যোগ-শাস্ত্রীয় গ্ৰন্থ হলে এটি দেশে অবহেলায় লোপ পেত বলে মনে হয় না। বিশেষ করে অমৃতকুণ্ডে বর্ণিত সৃষ্টিপত্তন ও মানব জন্ম রহস্য যোগ্যতান্ত্রিক বৌদ্ধ ঐতিহ্য ধারার সঙ্গেই মেলে বেশী। তা’ ছাড়া আরবী অনুবাদের উপক্ৰমে ‘কামরূপে বিদ্বান ও দার্শনিকদের বাস’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে : … … Kamrup the extreme territory of Hind where lived its famed men and philosophers and one of them came out to hold discussions with the learned divines of Islam. His name was Bhojar Brahmin etc.(১০) আবার অমৃতকুণ্ড গোরক্ষশিষ্যদের শাস্ত্ৰ গ্ৰন্থ বলে উল্লেখ করেছেন মোহসেন ফানী।(১১) সেকালে ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের তথা সমাজের প্রভাব ছিল না কামরূপে। ওটি ছিল বৌদ্ধ বজ্ৰযান-তান্ত্রিক-সহজিয়া-যোগীর প্রাণকেন্দ্র। আর ব্ৰাহ্মণ সম্ভবত বর্মণের বিকৃতি। কামরূপের বর্মণরাজারা পূর্ববঙ্গেও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।(১২)
অমৃতকুণ্ডের সূচীপত্র দেখলেই এর বিষয়বস্তু জানা যাবে। দশ অধ্যায়ে এবং পঞ্চাশটি শ্লোকে বর্ণিত হয়েছে বিষয়গুলো :
অধ্যায় ১. জীবসৃষ্টি On the Knowledge of Microcosm.
অধ্যায় ২. জীবসৃষ্টির রহস্য On the Knowledge of the secrets of Microcosm.
অধ্যায় ৩. On the Knowledge of mind & its meaning.
অধ্যায় ৪. অনুশীলন ও তার পদ্ধতি of the exercises and how to practise them.
অধ্যায় ৫. শ্বাসক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি of breathing and how it should be done.
অধ্যায় ৬. বিন্দুধারণ On the preservation of semen.
অধ্যায় ৭. চিত্তচাঞ্চল্য On the knowledge of whims
অধ্যায় ৮. মৃত্যুলক্ষণ On the symptoms of death.
অধ্যায় ৯. ইন্দ্রিয় দমন On the subjugation of spirit.
অধ্যায় ১০. ইন্দ্রিয় ও মানস জগতের বর্ণনা On the continution of the physical and Metaphsical world.
তেরো-চৌদ্দ শতকের সূফী সাধক শরফুদ্দীন বু আলি কলন্দর (মৃত্যু : ১৩২৬ খ্ৰীঃ কবর পানিপথে) আরবী-ফারসী পরিভাষা সমন্বিত একটি মুসলিম যোগ-পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। ‘যোগ কলন্দির’ নামে প্ৰখ্যাত হয় তা। বিশেষ করে, বাঙলা দেশে আজো তা বিরল নয়। ‘চণ্ডীমঙ্গলে’ মুকুন্দরাম কলিন্দরিয়া ফকিরের বাহুল্যের আভাস দিয়েছেন। (ঋণ কড়ি নাহি দেও, নহ কলন্দর, কলন্দর হৈয়া কেহ ফিরে দিবারাতি)। আর ‘যোগ কলন্দর’ পুথির বহুল প্ৰাপ্তি ও কলন্দরিয়া সূফীমতের অন্তত যোগ-পদ্ধতির বহুল প্রসার প্রমাণ করে।(১৩)
আমবা পূর্বেই বলেছি, পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্ব ভারতের আদিম তত্ত্ব। এই তত্ত্বের আচারিক দিক হল যোগপদ্ধতি। আর্য ধর্ম এবং সংস্কৃতির চাপেও তা’ বিলুপ্ত হয়নি। মহাভারতে এ স্বীকৃতি রয়েছে :
সাংখ্যঞ্চ যোগঞ্চ সনাতনে দ্বে।
দেবশ্চ সর্বে নিখিলেন রাজন।।(১৪)
ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ও বলেন–Some of the fundamental things in Brahmanical Hinduism, like worship of siva and Uma, Visnu and Sri and Yogo philosophy and practice came from the dravidian speakers.(১৫) তাঁর মতে ব্যাস, কৃষ্ণ বাসুদেব, পূজাপদ্ধতি প্রভৃতিও অনার্য। ১৬ বৌদ্ধ ও জৈন আন্দোলন হচ্ছে আর্য তথা ব্ৰাহ্মণ্য দেব, দ্বিজ ও বেদদ্রোহী অভু্যুথান। যোগ ও তন্ত্র নবজীবন লাভ করে বৌদ্ধ যুগে। বিশেষত তিব্বতীনেওয়ারী প্ৰভাবে তা’ কাশ্মীর থেকে বাঙলা-আসাম অবধি হিমালয় প্ৰাস্তিক দেশে প্রবল হয়ে উঠে। ফলে এসব অঞ্চলে ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুত্থান কালে ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মেরও অঙ্গ হিসেবে স্থিতি লাভ করে তা।
মুসলিম বিজয়ের পরে ভারতিক সূফীমতেরও অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠে এই যোগ। ফলে বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম সমাজে যোগ সামান্য আচারিক পার্থক্য নিয়ে সমভাবে গুরুত্ব পেতে থাকে। এক কথায় অধ্যাতন্ত্ৰ সাধনার তথা মরমীয়া বাদের ভিত্তিই হল যোগ-পদ্ধতি। বৌদ্ধ সিদ্ধা, সহজিয়া, বৈষ্ণব সহজিয়া নাথপন্থী, হিন্দু শৈব, শাক্ত, মুসলিম সূফী ও হিন্দু-মুসলিম বাউলদের মধ্যে আজো তা অবিরল। বাঙলা চর্যাপদে, শ্ৰীকৃষ্ণ কীৰ্তন, গোর্থসংহিতায়, যোগীকাচে, চৈতন্যচরিতে, মাধব ও মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে, সহদেব ও লক্ষ্মণের অনিল পুরাণে, বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলে, গোবিন্দ দাসের কালিকা মঙ্গলে, দ্বিজ শক্ৰয়ের স্বরূপবর্ণনে, আর, যোগাচিন্তামণি, বাউল গান, প্রভৃতি সব গ্রন্থে ও রচনায় যোগ আর যোগীর কথা পাই।
মুসলমান লেখকদের মধ্যে শেখ ফয়জুল্লাহ, সৈয়দ সুলতান, হাজী মুহম্মদ, আলাউল, শেখ জাহিদ, শেখ জোঁৰু, আবদুল হাকিম, শেখচাদ, যোগকলন্দরের অজ্ঞাত লেখক, আলিরাজা, শুকুর মাহমুদ, রমজান আলী, রহিমুদ্দিন মুনসী প্রভৃতিকে যোগ-পদ্ধতির মহিমা কীর্তনে মুখর দেখি। আলি রজার ‘জ্ঞানসাগরে’ আছে :
পিরীতি উলটারীতি না বুঝে চতুরে,
যে না চিনে উল্টা সে না জিয়ে সংসারে।
সমুখ বিমুখ হয়ে বিমুখ সমুখ
পাল্টা নিয়মে সব জগত সংযোগ।
বিমুখে আগম পন্থে রাখিছে গোপতে
চলিলে বিমুখ পন্থে সিদ্ধি সর্বমতে।
সমুখের সব পন্থ বিমুখ করিয়া,
পলটি বিমুখ পন্থে যাইব চলিয়া।(১৭)
গোরক্ষ বিজয়ে পাই ‘ষঠচক্ৰ ভেদ গুরু খেলাউক উজান’।(১৮) এরই নাম উল্টা সাধনা।
৩
শিব ও উমা প্রাচীন অনাৰ্য দেবতা। ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মে ও সমাজে তারা গোড়া থেকেই প্রাধান্য পান। বৌদ্ধ বিলুপ্তির যুগে শিবগৌরী যোগাচারী বৌদ্ধদের আদিনাথ ও তারার স্থান গ্ৰহণ করে। এরূপে নাথপন্থ ব্ৰাহ্মণ্য সমাজের উপশাখা রূপে পরিচিত হতে থাকে। আদিনাথও আদি যোগী। যোগীশিব ও চৌরাশী সিদ্ধার যে ঐতিহ্য রয়েছে(১৯) তাতেই বোঝা যায়, এই যোগী ধর্মের বিস্তৃতি ছিল তিব্বত থেকে আসাম-বাঙলা-বিহার ও উড়িষ্যা অবধি। গুজরাট, পাঞ্জাব, রাজপুতনা থেকে উত্তর বঙ্গ অবধি নিরঞ্জন-পন্থী যে-সব যোগী-সন্ন্যাসী কানফটা, মাচ্ছেন্দ্রী বা মছলন্দী, কানিপা প্রভৃতি নামে পরিচিত(২০), তারাও প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ যোগী। জ্যোতিরীশ্বরের ‘বর্ণরত্নাকরে (১৪শ শতক) চৌরাশী সিদ্ধার(২১) উল্লেখ আছে। বলেছি মহাদেব ও গৌরীকে কেন্দ্র করে নাথন্থ নতুন করে উৎসারিত হয়েছে :
আদ্যে গুরু মহাদেব পিছে আর সব
সাধন্ত সকল সিধা তরিবারে ভব।
শিবের ডাহিনে বামে হাড়িফা মিনাই
পৃষ্ঠ ভাগে গৌরী আছে জগতের মাই।।(২২)
নানা কারণে “বঙ্গ-কামরূপে” নাথ মতের বিশেষ বিকাশ হয়েছিল :
হাড়িফা পূর্বেতে গেল দক্ষিণে কানফাই
পশ্চিমোতে গোৰ্থ গেল উত্তরে মিনাই।(২৩)
হাড়িফা ওরফে জালন্ধরী পা’র আদি নিবাস নাকি সিন্ধু দেশে। তিনি পাটিকের রাজ্যভুক্ত জ্বালন ধারা(২৪) তথা আধুনিক চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাস করতেন বলে জালন্ধরী নামে পরিচিত। এবং সেখানে গোবিন্দ চন্দ্র রাজার আমলে ঝাড়ুদারের কাজ করতেন বলে হাড়িফা নামেও হলেন প্ৰখ্যাত। কাহ্নপাদ বা কানুপা ছিলেন সম্ভবত দক্ষিণ বঙ্গ কিংবা উড়িষ্যায়। তিনিও এসেছিলেন শুরু হাড়িফার উদ্ধারার্থ জ্বালান-ধারায়।(২৫) গোরক্ষনাথের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা ছিল গোটা উত্তর ভারতেই। আজো গোরখানাখী সম্প্রদায়ের প্রভাব অম্লান। মীননাথের প্রভাবও সমভাবে পড়েছিল তিববত থেকে বাঙলা-আসাম অবধি। কামরূপ অঞ্চলে কদলী নগর ও মেলে।
৪
ধর্মমঙ্গল-শূন্যপুরাণের ধর্মঠাকুর আর নাথ-ঐতিহ্যের নিরঞ্জন-আদিনাথ অভিন্ন। এবং ধর্ম ঠাকুরের পুরাণ কথা আর নিরঞ্জনের সৃষ্টি বর্ণনা একই।(২৬) যেমন :
নাথপন্থীদের সাধ্য হচ্ছে ‘মহাজ্ঞান’। এই মহাজ্ঞান লাভ করলে যৌগিক সাধনা বলে মানুষ হয় অমর। বৌদ্ধ চিন্তার জরা-মৃত্যু জয় করে আত্মিক বাঁচার সাধনা করাই তাদের ব্ৰত।
শিবের থেকে দুর্গ মহাজ্ঞান লাভ করলে, দুর্গা স্বয়ং ও দুর্গার প্রভাবে গোটা সৃষ্টি অমর হবে,–দ্বিজলক্ষ্মণের ‘অনিল-পুরাণে” এ তত্ত্ব হেঁয়ালী রূপে বৰ্ণিত হয়েছে। এ হেঁয়ালী আমরা চর্যাপদ ও দোহার কাল থেকে পাচ্ছি :
যতেক জ্ঞান কথা শিব দুর্গাকে কহিব
সকল সংসার দুৰ্গা অমর করিব।
ধর্মের পরামর্শে উলুক দুর্গাকে মায়ানিদ্রায় অভিভূত করল, আর মীননাথ দুর্গার হয়ে ‘হুঁ’ ‘হুঁ’করে সব তত্ত্ব জেনে নিল। মহাজ্ঞান লাভের ফলে :
শুনিয়া পরম সত্য পাকা চুল হৈল কাঁচা
সরুতমা সংকীর্ণ নিলে ধরিছে উজান
অক্ষয় অমর দেখা পদ নির্বাণ।
বলেছি প্রজ্ঞা-উপায় ও আদিনাথ-আদ্যাশক্তি এবং ধর্মঠাকুর, ধর্ম নিরঞ্জন-কেতকার স্থলে বৌদ্ধ বিলুপ্তির কালে ব্ৰাহ্মণ্য প্রভাবে শিব-শক্তিই প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধদের উপাস্য হয়ে উঠেন।(২৮)
শিব-গৌরী ও মহাজ্ঞানতত্ত্ব থেকে একদিকে গোরক্ষনাথ-মীননাথ কাহিনীর বিকাশ অপরদিকে হাড়িফা-কানুকা তথা ময়নামতী-গোবিন্দ চন্দ্র গাথার উৎপত্তি। প্রথমটিতে শিষ্য বিকৃত-বুদ্ধি গুরুকে চৈতন্য দান করেছেন। দ্বিতীয়টিতে মাতা পুত্ৰকে বৈরাগ্য অবলম্বনে প্রবর্তনা দিচ্ছেন। প্রথম কাহিনী পাই গোরক্ষাবিজয়ে ও মীন চেতনে, দ্বিতীয় কাহিনী মিলে ময়নামতীগোপীচাঁদের গাথায়। অপর কাহিনী রূপ পেয়েছে ধর্ম নিরঞ্জন তত্ত্বভিত্তিক হয়ে শূন্যপুরাণে, ধর্মপূজাবিধানে, অনিলপুরাণে ও ধর্মমঙ্গলে। এর একটি শাখার বিকাশ ঘটেছে চর্যাপদে বৈষ্ণব সহজিয়ায় ও বাউল গানে। এ সবগুলোই বৌদ্ধ অবলুপ্তির পরে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সম্পপ্রদায়ের ব্ৰাহ্মণ্য সমাজের প্রচ্ছায় স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রয়াস প্রসূত। আর একটি লক্ষণীয় বিষয় এই গোরক্ষনাথমীননাথ কাহিনীর তত্ত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশুদ্ধ যোগীর নাথপন্থ। আর হাড়িফ-কানুফার তত্ত্ব ভিত্তি করে রূপ নিয়েছে বামাচারী তান্ত্রিক সাধনা যার ফলে গড়ে উঠেছে সহজিয়া মতবাদী গৃহযোগী সম্প্রদায়। নাথ পন্থীরা বহু উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত; এঁরা অবধূত যোগী। আর ফা’–পন্থীরা নানা তান্ত্রিক উপসম্প্রদায়ভুক্ত–এঁরা কাপালিক যোগী। নাথপন্থীদের মূল সাধ্য সংযম, চিত্তস্থৈৰ্য, বিন্দুধারণ ও আত্মজ্ঞান লাভ। কালজয়, ব্ৰহ্মচৰ্য, জ্ঞানযোগ ও ভাণ্ডে ব্ৰহ্মাণ্ড দর্শন তাদের ব্ৰত। শিব তাদের আদিগুরু–তাই শৈব হিসেবে তাদের পরিচয়। সহজাবস্থা বা সহজানন্দ লাভে অদ্বৈত সিদ্ধি ঘটে, ফলে ভাণ্ড-ব্ৰহ্মাণ্ড, মর-অমর, বাস্তব-স্বপ্ন একাকার হয়ে যায়। হঠযোগ (চন্দ্র + সূৰ্য) মাধ্যমে উল্টা সাধনায় বীৰ্য উৰ্ধগ, বায়ুনিরুদ্ধ ও চিত্তনিস্ক্রিয় হলেই শিব-শক্তির সামরস্য ঘটে। কেননা,
মন থির তো বচন থির
পবন থির তো বিন্দু থির
বিন্দু থির তো কন্ধ থির
বলে গোরখদেব সকল থির।(২৯)
ডক্টর সুকুমার সেন ঋথেদের নাসদীয় সূক্তে এবং বৃহদারণ্যকে(৩০) ধৰ্মপন্থী ও নাথপন্থীদের মতবাদের জড় আছে বলে বিশ্বাস করেন।
মহাভারতের শল্য পর্বের যোগীর কাহিনী কিংবা বিদুর, ব্যাসদেব, বিপুল, নারদ, সনৎকুমার প্রমুখের কাহিনীতেও যোগীজীবনের আভাস রয়েছে। চর্যাকার ঢেণ্টন, সরহ প্রভৃতির গানের প্রতিধ্বনি ও আদল মিলে কবীর, কুতবন, মালিক মুহম্মদ জয়সী, দাদু ও গোরখপন্থীদের রচনায়। কৃষ্ণ দাসের ‘ভক্তমালে’ মীননাথ-গোরক্ষনাথও ঠাঁই পেয়েছেন। কাজেই নাথপন্থের প্রসার হয়েছিল ভারতময়। নাথদের অমরত্বের স্বরূপ এই :
‘মূঢ় লোকে দৃষ্ট (বস্তু) নষ্ট হল দেখে কাতর হয়
তরঙ্গ ভঙ্গ কি সাগরে শোষে
মূঢ় অবস্থায় লোকের দৃষ্টি খোলে না।
(যেমন) দুধের মাঝে মাখন থাকে, কিন্তু কেউ দেখে না
এই সংসারে কেউ আসে না, যায়ও না
এই ভাব নিয়ে বিলাস করছেন যোগী কাহ্ন।’(৩১)
এই ধারার রূপান্তর পাই যোগীকাচে। উত্তর বঙ্গের হিন্দু-মুসলমান যোগীকাচের তত্ত্বে লক্ষ্য রেখেই দেহসাধন করে। কেবল যে বৌদ্ধশাস্ত্ৰেই এই কায়াসাধন তথা দেহতত্ত্ব বা যোগসাধনা আছে তা নয়। জৈন শাস্ত্ৰেও পাই। যেমন অবহটঠে দেখি :
প্রশ্ন :
কালহিঁ পবনহিঁ রবিসসিহিঁ
চউ একটঠই বসু
হউঁ তুহিঁ পুচ্ছউঁ জোইয়া
পহিলে কাসুবিনাসু?
উত্তর :
সসি পোষই রবি পজ্জলই
পবন হলোলে লেই
সত্ত রজ্জু তমু পিল্লি করি
কৰ্ম্মহঁ কালু গিলেই।(৩২)
জৈন ধর্মের আদি প্রবর্তন বলে পরিচিতি ‘ঋষভ’ও জৈনশাস্ত্ৰে আদিনাথরুপে অভিহিত। ইনি বৃষধ্বজ এবং নিবাস কৈলাসে। নাথদের আদিনাথ শিব, অতএব জৈনদের আদিনাথও সম্ভবত শিব-ই। মহাবীরও নিগন্থনাথ (>নিগ্রন্থ>বেদবিরোধী)। ইনি জ্ঞাতিগোত্রীয় বলে নাথ পুত্ত (জ্ঞানি>ঞাতি>নাত, পুত্ৰ>পুত্ত) নামেও পরিচিত।
যোগীদের হঠযোগ প্রক্রিয়া আর তান্ত্রিকদের ভূতশক্তি মূলত অভিন্ন। দুটোই যৌগিক প্রক্রিয়া। কাজেই ভারতিক কোনো সাধনাই যোগবিহীন নয়। হঠযোগই কায়াসাধনের প্রকৃষ্ট উপায় : হ = (সূৰ্য>অগ্নি) ও ঠ>(চন্দ্ৰ> সোম) যথাক্রমে শুক্র ও রজঃ-এর প্রতীক। প্রথমটি ভোক্তা, দ্বিতীয়টি উপভোগ্য। দুটোর মিলনেই সৃষ্টি সম্ভব।(৩৩)
এগারো শতকের জৈন প্রাকৃতে সিদ্ধ হেমচন্দ্রের লেখা ‘কুমারপাল চরিত’-এর টীকায় দেহতত্ত্ব সম্পর্কিত পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে।(৩৪) বাঙলা-বিহারের এক শ্রেণীর লোক ‘শবাক’ নামে পরিচিত। ‘শরাক’ ‘শ্রাবক’-এর বিকৃতি হওয়াও অসম্ভব নয।(৩৫)
৫
‘প্ৰাণ সঙ্কলি’ নামে সৃষ্টিপত্তন ও মানব জন্ম রহস্য রয়েছে। শূন্যপুরাণে, ধর্মপূজাবিধানে, যোগীব গানে, যোগীকাচে, ধর্মঠাকুবের পূজা-পদ্ধতিতে (৩৬ মুসলিম রচিত ‘গোরক্ষাবিজয়’ ‘আগম’ ‘মোকামমঞ্জিল’ ‘আদ্য পরিচয়’ প্রভৃতি গ্রন্থেও ‘প্ৰাণ সঙ্কলি’ দেখি। এটি যোগ গ্রন্থের অপরিহার্য অঙ্গ। কায়াসম্ভেদ’-এ আছে :
প্ৰথম মাসেতে গর্ভে বর্ণ যে যব প্ৰমাণ
দ্বিতীয় মাসেতে গর্ভে বিন্দু বর্ণ আন।
তৃতীয় মাসেতে গর্ভে বিন্দু রক্ত গোলা
চতুর্থ মাসেতে বিন্দু স্থানে স্থানে স্থানা।
পঞ্চম মাসেতে গর্ভে বিন্দু অতি বড় সুখ
ষষ্ঠম মাসেতে গর্ভে বিন্দু অতি বড় দুখ।
সপ্তম মাসেতে গর্ভে বিন্দু সপ্ত ঋতু বসন্তি
অষ্টম মাসেতে গর্ভে বিন্দু গতাগতি।
অষ্ট অঙ্গে জোড় নয় মাসে
গর্ভে বিন্দু উপবায়ু পবন আকাশে
নয় মাসে নির্মল মুরতি
দশ মাসে দশদিক মূরতি।(৩৭)
শেখ জাহিদের ‘আদ্য পরিচয়ে’ও বর্ণিত হয়েছে এমনি গর্ভরহস্য। ধর্মঠাকুর পন্থীদের প্রভাবও পড়েছে। এ গ্রন্থে।
এর ‘প্ৰস্তাবনা’ ও ‘সৃষ্টি পত্তন’ অংশ এখানে উদ্ধৃত হল :
গৰ্ভতন্ত্র যোগতন্ত্র সিদ্ধের কাহিনী
বুঝিলে মুকতি হয় শুনিতে মধুর বাণী।
আউটি বিচার যেবা জানিব নিশ্চয়
জ্ঞান কর্মেতে তাকে সন্দেহ নাহি রয়।
জ্ঞান জনিব যেবা করিব ধেয়ান
ধ্যান না কৈলে তার কিবা গেয়ান।
দান ধ্যান যেবা করএ সমরস
যোগতন্ত্র সিদ্ধাতন্ত্র রাখে। সব হএ বশ।
লোহ মোহ কাম ক্ৰোধ কিছু করিতে না পারে
আপনি অনুগ্রহ তারে করেন করতারে।
গর্ভের বিচার জানিলে বাড়িব রঙ্গ
যেমতে সৃষ্ট হয় মনুষ্যের অঙ্গ।
মায়ের যতেক দ্রব্য পিতার যত ধন
অনাদ্য ধর্মের যত বয়স রতন।
স্বৰ্গ মৰ্ত্য পাতাল কহিমু স্থানে স্থানে
বাত, বরুণ, আনল বেশে যে যেইখানে।
চন্দ্ৰ সূৰ্য আকাশে যত তারা সাজে
তুলনা দিমু সব শরীরের মাঝে।
নদ নদী আর গঙ্গা ভাগীরথী
শরীরের মাঝে ঢেউ বহিছে দিবারাতি।
কিঞ্চিৎ কহিমু তাহা শুরুর উপদেশ
তাহার প্রসাদে মুঞি জানিলুঁ বিশেষ।
আদ্য অনাদ্য গুরু কহিল শ্ৰবণে
সেই হইতে মোর জনমিল জ্ঞানে।
কহিল সকল কথা হৃদয়ে উতরি
কিঞ্চিৎ কহিমু সেই কথা অনুসারি।
ব্ৰহ্মার আনন যত রাবণের করে
গুনিলে যত হয় সহস্ৰ উপরে।
এত শাকের মাঝে করিল প্রচার
পয়ার প্রবন্ধে কহি আত্মা বিচার।
জাহিদে কহে চিত্তে করি আছোঁ সার
সুহৃদ চরণ বিনে গতি নাঞি আর।
বাঙলার মুসলমান সূফীদের লক্ষ্য, সাধ্য ও সাধনা এরূপই ছিল। জাহিদ বর্ণিত সৃষ্টি তত্ত্ব :
না ছিল ক্ষিতি জল ই মহি মণ্ডল
শূন্য মধ্যে না ছিল প্ৰকাশ।
স্বৰ্গ মর্ত্য পাতাল সব ছিল অন্ধকার
আউর না ছিল আকাশ।
চন্দ্ৰ সূৰ্য তারা না ছিল অভিপরা(?)
না ছিল নবীন জলধার
বাউ বরুণ আনল পৃথিবী রসাতল
না ছিল পর্বত শিখর।
নদনদী শূন্যাকার না ছিল পাড় ঝঙ্কার
না ছিল সাগর তিখ স্থান
সংসারে না ছিল কিছু সব হৈল তার পিছু
সবেমাত্র ছিল ভগবান।
এক ছিল নিজরূপ কিছু না পাইল সুখ
ভাবিলা প্ৰভু আপন শরীরে
শূন্যাকার ঘুচাই দৃষ্ট রচিলাত নানা সৃষ্ট
এক খেলা খেলাব সংসারে।
আপনার দিরা৷রতি নিজে লয়ে এক মূর্তি
রাখিল গোসাঞি অলঙ্ঘ্য সাগরে।
মিত্ত সঙ্গে অ্যালাপনে কৌতুক বাড়িল মনে
নিৰ্মাইল একটি হুঙ্কারে।
সৃজন করিয়া মিত্ত হরিষ বাড়িল চিত্ত
জলের উৎপত্তি হইল সংসাবে।
শীঘ্র কহিতে বচন তাহাতে জনিল পবন
আনল জন্মিল ক্ৰোধ হৈতে।
মিত্তের অঙ্গে মলি নিজ কবে তাহা তুলি
যোগাইল জলের উপরে
মিত্তিকা বাড়য়ে জলে সমুদ্রের উৎতালে
দিনে দিনে হয় প্রসারে।
জনিল চাবি রত্ন পাইয়া মহা রত্ন
শ্রধাএ সৃজিল গোসাঞি
সংসারেত জন্মে সব হয় ক্রমে ক্রমে
ওহি বহি অন্য কিছু নাঞি।
যত ছিল ভয়ঙ্কর সব হইল প্রচার
ওঙ্কারে করিল নির্মাণ
রচিল তিন জীব তাহাতে দিয়া শিব
সৈন্য মুখ্য কৈল স্থানে স্থান।
জন্মিল দেব অসুর বলে হইল প্রচুর
বাহু বলে না চিনে অন্যথা
নিরবধি করে রণ না জানে মরণ
কাহো সনে নাহিক মমতা।
ঘোড়া হস্তী প্রখর রাক্ষস ভয়ঙ্কর
রাজত্ব করে চিরকাল
ভুঞ্জিল আপন মনে বিধির বিধানে না চিনে
কেবা সৃজিল সয়াল।
প্ৰভু করিল মনে আমা কেহো নাহি চিনে
কি কারণে করিলুঁ প্ৰকাশ
ক্ৰোধ হইয়া দেও সব করিল খও
যে কে কে কৈল বংশ নাশ।
নির্মূল করিয়া দেও সংসারে নাঞি কেও
এমন গেল কত দিবস
পুনর্বার করিল মনে মনুষ্য সৃজোঁ ভুবনে
তাহা হৈতে পাইমু হরিষ।
তাহাক করিমু রাজা জীবেরে করিমু প্ৰজা
পৃথিবী সৃজিয়া দিব মহীতলে।
করিমু প্ৰবীণ পূজে যেন রাত্রিদিন
তেয়াগিয়া সকল জঞ্জালে।
আর কথা সৃজিল কাহাত সুখ না পাইল
মনুষ্য করিমু সৃজন
আপনার অঙ্গ ছিল আর কথা নিৰ্মাইল
কেমন মনুষ্য আকার হয়।
সেবক জাহেদ কএ শুন গুরু মহোশএ
শতে শীতে প্ৰণতি আমার।
ভাবিয়া চরণ তোমার লিখিব আমি পয়ার
যেমতে হএ মনুষ্য আকার।
এরপরে গর্ভে শিশুর গঠন বর্ণিত হয়েছে।
বৌদ্ধ-হিন্দু যোগ্যতান্ত্রিক সাধনার ভিত্তি সম্ভবত এই ধারণায় যে দেহ নিরপেক্ষ চৈতন্য যখন সম্ভব নয়, তখন চৈতন্যের স্বরূপ উপলব্ধি করতে হবে চৈতন্যধার দেহ বিশ্লেষণ করেই। এই চৈতন্যই আত্মা। আর সৃষ্টি আছে বলেই ধ্বংস আছে কিংবা বিনাশ আছে বলেই সৃষ্টি সম্ভব। কাজেই সৃষ্টির পথ রোধ করলেই ধ্বংসের পথও বন্ধ করা সম্ভব হবে। এই সৃষ্টি শক্তি আয়ত্তে এনে সৃষ্টিক্রিয়া বন্ধ করলে সেই সংরক্ষিতশক্তি (Energy) মানুষকে করবে। অজর ও অমর। আবার পরম সুখ আনন্দের ধারণাও লাভ হয়েছে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই। মৈথুন তথা রমণাবস্থা হচ্ছে জীবনে উপলব্ধ চরম সুখাবস্থা। এই সুখই তাদের কাম্য। তাই মানস রমণাবস্থাই সাধ্য। এরই নাম সামরস্য, শিব-শক্তি বা প্রজ্ঞা-উপায়ের মিলন, তথা অদ্বয়াবস্থা। অতএব রতিনিরোধ তথা বিন্দু ধারণ করে এক চিরন্তন রমণাবস্থা লব্ধ সুখ উপভোগ করাই এ সাধনার সাধারণ লক্ষ্য। দেহের স্বাভাবিক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে রতির উর্ধ্যায়ন দ্বারা ললাটস্থ সহস্রায় প্রতিষ্ঠিত করাই যোগ্যতান্ত্রিক সাধনা।
মুসলমান সাধকগণ ইসলামের প্রচ্ছায় গড়ে উঠেছেন বলে এই তত্ত্বে আস্থা রাখতে পারেননি। তবে চৈতন্য তথা আত্মার আগার এই দেহ তাদেরও করেছে কৌতুহলী। ভারতিক যোগাদির প্রভাবে দেহ সম্বন্ধে তাদের আগ্ৰহ বেড়েছে, এবং সে-জন্যই যৌগিক প্রক্রিয়ার বিস্ময়কর প্রভাবকে অবহেলা করতে পারেন নি তাঁরা। কায়া সাধনকে তাঁরা জিকরের অনুকূল করে নেবার প্রয়াসী ছিলেন। এবং ভারতীয় যোগ সাধনার ফারসী-আরবী পরিভাষা সৃষ্টি করে একে ইসলামী রূপ দেবার ব্যর্থ প্ৰয়াসও করেছেন তারা। ফলে ইসলামী নামের আবরণে এই হিন্দুয়ানী সাধনাই প্রাধান্য লাভ করেছে; এমনকি প্রাকৃতজন এবং তাত্ত্বিক প্রভাব থেকেও মুক্ত হতে পারেনি, তাই আমরা আজো দেখতে পাচ্ছি মুসলমান বাউল সম্প্রদায়। অন্য অনেকের মধ্যে আমরা শাহু বুআলী কলিন্দর, কবীর, দাদু, রজব, দারাশিকোহ প্ৰমুখ যোগী সাধকের কথা জানি। কলন্দর প্রবর্তিত যোগপদ্ধতি ’যোগ-কলন্দাব’ নামে বিশেষ জনপ্রিয় হয় বাঙলা দেশে। এই যোগ নির্ভর কায়া সাধনাই শেখ ফয়জুল্লাহকে ‘গোরক্ষাবিজয়’ এবং সুকুর মাহমুদকে ‘গোপীচাঁদের সন্ন্যাস’ রচনায় অনুপ্রাণিত করেছে।
যতই মহৎ আর নিখুঁত হোক, কোন আদর্শ, কোন বিধি বা কোন পদ্ধতিই সব যুগের ও সব দেশের মানুষের জীবনের বিচিত্ৰ চাহিদা মেটাতে পারে না। দেশ-কালের প্রেক্ষিতে পরিবর্তন-পরিবর্ধন কিংবা গ্ৰহণ-বর্জনের প্রয়োজন থাকবেই। জীবন হচ্ছে বহন্তানদীর স্রোতের মতো। নব নব বঁাকের বাধা স্বীকার করেই এবং সুকৌশলে তাকে অতিক্রম করেই সতেজে ও স্ব-ভাবে চলতে হয়। এ জন্যে কোন বৃহৎ সাফল্যই সরলময়–সর্পিল। নতুনকে বরণ করার মতো সুবুদ্ধি এবং স্বাঙ্গীকরণের মতো শক্তি না থাকলে কেউ বা কোন জাতি দেশকালের যোগ্য হযে বাঁচতে পারে না। আত্মবিকাশেব অন্যতম প্রকাশ আত্মবিস্তারে। একদা বিশ্বের মুসলিম জগদ্ব্যাপী আত্মপ্রসারে আত্মনিয়োগ করেছিল, ব্ৰতী হয়েছিল মানুষকে ইসলামের প্রচ্ছায় এনে মহান মানবতায় দীক্ষাদানের সাধনায়। ইসলামের বিকাশের ধারা অনুধাবন করলে আমবা দেখতে পাব, দেশ-কালের মননকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়েই মুসলমানেরা জয় করেছিল মানুষের হৃদয়। প্রাণময়তা ও উদারতা থাকলেই মানুষ হয়। সৃজনশীল ও গ্রহণশীল। উঠতির যুগে মুসলমানেরা এমনি সহনশীল ও গ্রহণশীল ছিল বলেই কল্যাণবুদ্ধি নিয়ে আরব বহির্ভূত দেশের মানুষের মনন ও জীবনচর্যার সঙ্গে আপোষ করে নিতে সমর্থ হয়েছিল, আব্ব তাই ভারতে ইসলাম হযেছিল সহজেই গ্ৰহণীয়। ৭ জনপ্রিয়তাই এদেশে ইসলামেব প্রসারের মুখ্য কারণ। এ আপোষেব নীতি ও পদ্ধতি কিরূপ ছিল, তা-ই আমরা জানিবার-বুঝবার চেষ্টা করেছি। এখানে।
আহমদ শরীফ
[১৯৬৮ সালে লিখিত ভূমিকা]
.
তথ্য কুঞ্জী
১. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য, পৃ. ৪১
২. সুশীল কুমার গুপ্ত, উনবিংশ শতাব্দীর বাঙলার নবজাগরণ, পৃ. ৬
৩. মোহসিন ফানি, দবিরস্তান-অল মজাহিব, বোম্বাই সং, পৃঃ ১৪৪
৪. ক. S. N. Dasgupta : History of Indian Philosophy, PP81, 451-52, Vols. Il & III.
খ. Philosophy of the Upanisads and Ancient Indian Philosophy, P. 18.
গ. Philosophy of India, P. 281.
[দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রণীত লোকায়ত দর্শন গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃঃ ৫১৩-১৪]
ঘ. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী : ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৭৪-৮৩
ঙ. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচাৰ্য : বাংলার বাউল ও বাউল গান, পৃঃ ১৮৬
চ. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন : (ভারত সরকার প্রকাশিত) ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩৬
৫. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন : (ভারত সরকার প্রকাশিত) ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৪৩, ২৪৬
৬. ক. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩৪, ৩৬, ৪২
খ. S. K. Chatterjee : Indo Aryan and Hindi, PP. 31-32
৭. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন : পৃঃ ১৩৩, ১৩৫
৮. History of Indian Philosophy, PP 81, 451-52.
৯. Philosophy of the Upanisads and Ancient Indian Philosophy, P. 18.
১০. Philosophy of India : P. 281.
১১. Bauddha Dharma : P 37
১২. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন, পৃঃ ৩৬
১৩. শ্বেতাশ্বতর : ২/৬-৭, ২/১৫, কঠা : ৬/৩ ইত্যাদি
১৪. বৃহদারণ্যক : স বা ইয়মাত্মা ব্ৰহ্ম।। ৪/৪/৫, ৩/৭/১৪ ছান্দোগ্য : ৬/৮/৭
১৫. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন, পৃঃ ৮৯, ২৫৬
১৬. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন, পৃঃ ৩৬, ৪২
১৭. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন, পৃঃ ৮৯
১৮. ছন্দোগ্য : ২/১৩/২
১৯. মহাভারত, আদি পর্ব, ১২২তম অধ্যায়
২০. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী ১ম খণ্ড, পৃ: ২৭৪-৮৩
২১. Obscure Religious Cults as Back Ground for Bengali Literature : S. B. Dasgupta, P. 27.
২২. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন, পৃ: ১৪৫-৪৬
২৩. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন, পৃঃ ১৪৮
২৪. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন, পৃঃ ১৭১-৭২
২৫. ক. James Frazer: Golden Bough, P. 138
খ. দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : লোকায়ত দর্শন, পৃ: ৪৭৯
২৬.Golden Bough : P. 138
২৭. ক. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী : ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৯৪
খ. গৌড়পাদ সাংখ্যকারিকাভাষ্য, পৃঃ ২১
২৮.উমেশচন্দ্র ভট্টাচাৰ্য : ভারত দর্শন সার, পৃঃ ১৪৯
২৯. লোকায়ত দর্শন, পৃ: ৪৬৭
৩০. বিষ্ণু পুরাণ, ছন্দোগ্য ও মৈত্ৰেয়ী উপনিষদ
৩১. S. N. Dasgupta : History of Indian Philosophy, Vol, III. P. 527.
৩২. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী : ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৮৪, ২৯৪
৩৩. ছান্দ্যোগ্য : ৮/৮/৪
৩৪. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : তদেব, পৃঃ ২৮৫-৮৬, ৩২৫
৩৫. তদেব
৩৬. ক. তদেব
খ. S. B. Dasgupta : Obscure Religious Cult, P P. 115-16, 120.
গ. শশিভূষণ দাশগুপ্ত : শাক্ত সাহিত্য, পৃঃ ১১-১২
৩৭. P. C. Bagchi : Studies in Tantras, P. 102
৩৮. পাদটীকা হবে।
৩৯. বৌদ্ধধর্ম, পৃঃ ৬৯
৪০. ক. S. N. Dasgupta : History of Indıan Philosophy, Vol. II. P. 533
খ. Journal of Asiatic Society (Science) Vol. XIX. 1953
(লোকায়ত দর্শনে উদ্ধৃত, পৃঃ ১১৭-১৮।)
৪১. য এষ সুপ্তেষু জাগর্তি কামং কামং পুরুষো নির্মিমাণঃ। তদেব শুক্রং তদব্ৰহ্ম তাদেবামৃত মুচ্যেতে। তম্মিল্লোকাঃ শ্ৰিতাঃ সর্বে তদুনাতে্যুতি কশ্চন এতদ্বৈতৎ–অর্থাৎ সুপ্তপ্রাণিজগতে যিনি জাগ্রত থেকে অবিদ্যা দ্বারা কামানুরূপ স্ত্র্যাদ্যৰ্থ নিম্পন্ন করেন, তিনিই শুক্র, তিনিই ব্ৰহ্ম ও অমৃত স্বরূপ। তিনি সর্বলোকের আশ্রয় তথা কারণ স্বরূপ। কেউ তদ্বাত্মকতা
অতিক্রম করতে পারে না –কঠোপনিষদ।
৪২. S. N. Dasgupta : History of Indıan Philosophy, Vol, III, P. 533
৪৩. Journal of Asiatic Society (Science) Vol XIX. 1953 (লোকায়ত দর্শনে উদ্ধৃত, পৃ: ১১৭-১৮
৪৪. ক. শাক্ত সাহিত্য, পৃঃ ১১-১২
খ. Obscure Religious Cults: PP 115-16, 120.
গ. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় ; তদেব, পৃঃ ৩২৫
৪৫. হঠযোগ দীপিকা প্রভৃতি নানা গ্রন্থের সাহায্যে লিখিত
১) Sir Muhammad Iqbal : Development of Metaphysics in Persia. P83.
২) সুরাহ : ২, আয়াত : ১৪৬
৩) সুরাহ : ৫১, আয়াত : ২০-২১
৪) সুরাহ : ৫০, আয়াত : ১৫
৫) সুরাহ : ২৪, আয়াত : ৩৫
৬) সুরাহ : ৮৮, আয়াত : ২০
৭) সুরাহ ; ১৭, আয়াত : ৮৭
8) Arabic thought in Hostory. PP 188-89.
৯) (ক) Literary History of Persia: Vol. P. 26
(খ) O’. leary: Arabic thought in History: P. 189.
১০) Arabic thought in History. PP. 192-93.
১১) bid P. 92
১২) bid P. 92
১৩) bid PP. 194-95, 201
১৪) সুরাহ : ৩৩, আয়াত ৪১
১৫) Chapter II on Poverty, PP 19-25
১৬) Chapter III on Sufism, PP 31-32
১৭) bid P. 33
১৮) Ibid P34
১৯) Ibid P. 40
২০) R. A., Nicoolson : Preface : Kashf-al-Mahjub-Translation. P. VIII
২১) O’leary: Arabic thought in History, P 184.
২২) bid PP 84-85
২৩) bid PP 90-9
২৪) bid PP 86-87
২৫) ক. bid PP |87-89 it.
খ. Browne: Literary History of Persia. Chapter XIII it.
গ. R. A. Nicholson: Mystics of Islam.
ঘ. R. R.A.Nicholson : Selected Poems from the Dewan of Shams–Tabriz.
২৬) Dost thou think that thy existence is independent of God? This is a great error”. Maqsadi Aqsa, Folio No 8b quoted by M Iqbal in Development of Metaphysics in Persa : P 90
২৭) মসনবী–চতুর্থ খণ্ড।
২৮) Whittaker : Neo-Platonism. P 58
২৯) a. J. A. Sobhan : Sufism, its saints and shrines, (Luknow 1938). P. 74
b. H. A. R. Gibb: Mohammadanism, (Oxford University Press 1953) Chapter VIII & IX
৩০) Abdul Majid (Azamgarh) : Tasawwuf-I Islam. P. 45
৩১) বিনয়ঘোষ : বাঙলার নবজাগৃতি, পৃ: ১২১-২৪
৩২) Influence of Islam on Indian Culture: PP. –2, 4, 19-20
৩৩) ভারতদর্শনসার, পৃঃ ৬৪-৬৭, ২৯২ ৩৪.
৩৪) বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবি, পৃঃ ৯-৩৩ ৩৫.
৩৫) শশীভূষণ দাশগুপ্ত : শ্ৰীরাধার ক্রমবিকাশ–দর্শনে ও সাহিত্যে, পৃঃ ৩২১-৩০ ৩৬.
৩৬) জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য পৃঃ ২৫-২৬ vol.
৩৭) O’leary: Arabic thoutht in History. PP 190-91, 194.
৩৮) S. K. Chatterji : Origin and Development of Bengali Language.
৩৯) Arahic thought in History: PP 191-93
৪০) Ibid P.192
৪১) কোরআন, সূরাহ ২৪/আয়াত ৩৫
৪২) কোরআন, সূরাহ ৫০/আয়াত ১৬
৪৩) কোরআন, সূরাহ ৮৮/আয়াত ২১
৪৪) মুহম্মদ এনামুল হক : বঙ্গে সূফী প্রভাব, পৃঃ ৩৪
৪৫) ঐ, পৃ. ৭৪
৪৫) ঐ, পৃ. ৭৫-৮০
৪৭) R. A. Nicholoson : The Mystics of Islam, P. 17.
৪৮) তদেব বঙ্গে সূফী প্রভাব, পৃঃ ৩৮, ৪৫
৪৯)Ain-l-Akbar1 : Jarret. Vol, III cdited by J. N. Sarkar PP360 ff.
৫০) তদেব বঙ্গে সূফী প্রভাব, পৃঃ ৫৫
৫১) ক. Dr. M. lqbal: Development of Metaphysics un Persia, PP:40—lI
খ. বঙ্গে সূফী প্রভাব, পৃঃ ৮১ (এই গ্রন্থে উদ্ধৃত : ইরশাদ-ই-খালিকীয়াহ আবদুল করিম, ২য় সং, পৃঃ ১১৫-১৩৩)
৫২) ক. তদেব বঙ্গে সূফী প্রভাব, পৃঃ ১৬৯-৮২
খ. আহমদ শরীফ, মুসলিম কবির পদ সাহিত্য : ভূমিকা
৫৩।) তদেব বঙ্গে সূফী প্রভাব, পৃঃ ১৬৩-৬৪
মোকাম মঞ্জিল ও হাল
১. R. A. Nicholson : Tran. P. 8
২. ক. J. A. Sobhan : Sufism : it sants & Shrines. P. 75
খ. S. Iqbal Ali Shah : islamic Sufism. P. 294
৩. R. A. Nicholson : Tran. P. l8l
৪. R. A. Nicholson : Kilab al-Lumma: Nasr-as-Sarray : Tran. PP. 55-72
৫. J. A. Sobhan : Sufism: its saints & shrines. PP. 61-62. 149
৬. সৈয়দ সুলতান : জ্ঞানপ্ৰদীপ
৭. আলি রাজা জ্ঞানসাগর : আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত, পৃঃ ৮০
সৃষ্টিতত্ত্ব যোগ ও দেহচৰ্যা
১. ক. Geiger: Civilization of Eastern Iranians. Vol I, P 124.
খ. Dr. Hang : Essays. P. 205.
গ. Dr. M. Iqbal : Development of Metaphysics. PP. 9-10.
২. ক. Annie Besant : Re-incarntion. P, 30.
খ. Development of Metaphysics: PP 10-11.
৩. Dr. S. B. Dasgupta: Obscure Religious cult. etc. P. l 13.
৪. Civilization of Eastern Iranians: Vol I, P 105
৫. ক. Journal of the Pakistan Historical Society 1953, Vol I, Pt. I, PP 45, 51-52.
খ. Islamic Culture : 1947, PP 190-91.
৬. Brocklemann: Catalogue.
৭. Catalogue of the Persian Mss. in the Library of the India Office: Ethe: No. 2002.
৮. ক. Dr. A. Karim : Social History of the Muslims in Bengal, down to 1538 A. D. PP. 6-7, 62-65.
খ. Dr. A. Rahim : Social History of Bengal. PP 64-66.
৯. Dr. A. B. M. Habibullah : Journal of the Asiatic Society of Pakistan : 1960, P. 23
১০. Journal of the Pakistan Historical Society 1953, Vol 1, pt. PP. 46 ff.
১১. Mohsen Fani : Dabirstan-al-Mayahih : Bombay edition. P. 144.
১২. History of Bengal, Vol I, D.U.
১৩. আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ : পূথি পরিচিতি
১৪. শান্তিপর্ব : ৩৫১ অধ্যায়
১৫. Kirata Jana Kriti : JASB 1950, P. 151
১৬. Ibid Sections 1, 4, 4, PP. 5-52, 176.
১৭. পূর্বোক্ত জ্ঞানসাগর : আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত, পৃঃ ৩৬-৩৮
১৮. শেখ ফয়জুল্লাহ ; গোরক্ষাবিজয় : আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত, পৃঃ ১৪০
১৯. Medieval Mysticism and Kabir : Visva Bharati Quaterly 1945, PP. 35-52
২০. গোর্খবিজয় ভূমিকা : সুকুমায় সেন পৃঃ ১-ক (পঞ্চানন মণ্ডল সম্পাদিত)
২১. সৈয়দ সুলতানের ‘জ্ঞানপ্ৰদীপ’ সূত্রে জানা যায়, মানুষের দেহ স্ব স্ব আঙুলের পরিমাপে দৈর্ঘ্যে ৮৪ আঙুল পরিমিত। এজন্যে দেহের রূপকার্থক পরিভাষা হচ্ছে চৌরাশী। যিনি এই চৌরাশী আঙুল পরিমিত দেহরতত্ত্বে বা চর্যায় সিদ্ধিলাভ করেছেন, তিনিই চৌরাশী সিদ্ধা কায়া সাধনায় সিদ্ধা। অতএব ‘চৌরাশী সিদ্ধা’ শব্দটি সিদ্ধপুরুষের সংখ্যাবাচক নয়বরং কায়সাধনায় সিদ্ধিজ্ঞাপক। চৌরাশী সিদ্ধাকে সিদ্ধ পুরুষের সংখ্যাবাচক ধরেই গত পাঁচশ’ বছর যাবৎ বিদ্বানেরা চৌরাশীজন সিদ্ধার সন্ধানে ও নামের তালিকা নির্মাণে গোজামিলের আশ্ৰয় নিয়েছেন।
২২. পঞ্চানন মণ্ডল–সম্পাদিত গোর্খবিজয়।
২৩. ঐ
২৪. জ্বালান-ধারা>জুলান্ধর–তপ্তজলের ধাবা রয়েছে যেখানে–সীতা-কুণ্ড ও বাড়বকুণ্ড অঞ্চল=চট্টগ্রাম। আরব ভৌগোলিকদের সামন্দরী’ও এই অৰ্থবোধক। চট্টগ্রামের ইতিকথা [আদিযুগ]–আহমদ শরীফ।
ক. বাংলাদেশে মুসলিম আগমনের প্রাথমিক যুগ : সাহিত্য পত্রিকা, ৭ম বর্ষ, বর্ষা সংখ্যা : ১৩৭০, পৃঃ ৯০-৯২।
খ. Dr. A. Karim: Samandar of the Arab Geographers. JASP. Vol VIII NO. 2, 1963, PP. 13-24
২৫. JASB, 1898, PP20-34 (Saratchandra Das : On Taranath’s History),
২৬. পঞ্চানন মণ্ডল সম্পাদিত গোর্থবিজয় ; ভূমিকা : সুকুমার সেন, পৃঃ ১ক-২
২৭. ঐ, ক ১-৪
২৮. রূপরামের ধর্মমঙ্গল ; ভূমিকা, পৃঃ ১০। গোর্থবিজয় ভূমিকা, পৃ: ৪, ঘ-২
২৯. হঠযোগদীপিকা, ভারতবষীয় উপাসক সম্প্রদায় ; ২য় খণ্ড, ২য় সং, পৃঃ ১১৮। গোর্থবিজয় ভূমিকা : সুকুমার সেন, পৃঃ ১-গ-৩ ৷
৩০. ক. নাসদাসীৎ ন সদাসীতদানিম। তম আসীৎ তমসা গৃঢ়মগ্রে। স্বধা অধস্তাৎ প্ৰব্যতিঃ পরস্তাৎ। তপসস্তন মহিনা জায়তেকম মনসো রেতঃ প্ৰথমং যদাসীৎ। -ঋগ্বেদ।
খ. হিরন্ময়ঃ পুরুষঃ এক হংসঃ।-বৃহদারণ্যক।
৩১. গোর্থবিজয়ের ভূমিকায় উদ্ধৃত
৩২. ডক্টর হীরালাল জৈন সম্পাদিত ও রাম সিংহ রচিত : পাহুড়া দোহা (৮০০ খ্রীস্টাব্দ) : ২১৯, ২২০ ৷
৩৩. Obscure Religious Cults etc. P. 271
৩৪. শঙ্কর পণ্ডুরঙ্গ পণ্ডিত সম্পাদিত : ৮।। ২২।। ২৫।
৩৫. কবীর–ডক্টর হাজারী প্ৰসাদ ত্ৰিবেদী।
৩৬. গোর্খবিজয় ; ভূমিকা, পৃঃ জ-৩।
৩৭. ঐ (উদ্ধৃতি), পৃঃ জ-৪।
Leave a Reply