বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা – বদরুদ্দীন উমর
(প্রথম প্রকাশ জানুয়ারী ১৯৭৬)
উৎসর্গ
বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে
যাঁরা দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে
সংগ্রাম করেছেন
তাঁদেরই উদ্দেশে
প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধ
বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের কতকগুলি মৌলিক সমস্যা এই বইয়ে সংকলিত প্রবন্ধগুলিতে আলোচিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে প্রথম চারটি ইতিপূর্বে ১৯৭৪ সালে মাসিক সংস্কৃতিতে দ্বিতীয় থেকে অষ্টম (শেষ) সংখ্যা পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯২১ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের কোন একটি দেশেও জনগণতান্ত্রিক অথবা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয়নি। শুধু তাই নয়। এই সমগ্র অঞ্চলের কোন একটি দেশেও এখন বিপ্লবের নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা সম্পন্ন একটি কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই। এই পরিস্থিতি যে নিদারুণ সংকটজনক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
এই সংকট থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রয়োজন ১৯২১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস এবং তার পটভূমির বিস্তৃত পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যাগুলিকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করা এবং সেগুলির সমাধানের উপযুক্ত পথ নির্ধারণ করা। এই কাজে যারা আত্মনিয়োগ করেছেন অথবা করতে চান তাঁদেরকে সহায়তার উদ্দেশ্যেই এই বইয়ে সংকলিত প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হলো। এখানে যে আলোচনার সূত্রপাত করা হলো আশা করি অন্যান্যরা তাকে আরও গভীর ও ব্যাপক করে পূর্ণতা দান করতে এগিয়ে আসবেন।
বদরুদ্দীন উমর
ঢাকা
২১ শে ডিসেম্বর ১৯৭৫
.
দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ
বাঙলাদেশ কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে প্রায় আট বৎসর গত হয়েছে। এই আট বৎসরে এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে সব পরিবর্তন দেখা দিয়েছে এবং বিলোপবাদী চিন্তাধারা ও কর্মতৎপরতা কমিউনিস্ট নামে আখ্যায়িত পার্টিগুলিকে যেভাবে কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করেছে সে বিষয়টি বেশ কতকগুলি প্রবন্ধে আমি
আলোচনা করেছি। সেগুলির মধ্যে কয়েকটি বাঙলাদেশে মার্কসবাদ ও বাঙলাদেশে বুর্জোয়া রাজনীতির চালচিত্র নামক বই দু’টিতে সংঙ্কলিত হয়েছে।
সংশোধনবাদী ও বিলোপবাদী নীতি অনুসরণ করে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি বহুধাবিভক্ত হয়ে আজ প্রকাশ্যে বুর্জোয়া সংগঠনে পরিণত হয়েছে। যে দুই একটি সে ধরনের সংগঠন প্রকাশ্যে আসে না তারা টিকে আছে পেটি বুর্জোয়া সন্ত্রাসবাদী দল হিসেবে। এ বিষয়টি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, পুরাতন পার্টি ও তার অবশেষ বলতে যা বোঝায় তার সবটাই আজ কমিউনিস্ট শক্তি হিসেবে বিলুপ্ত এবং বুর্জোয়া রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে একাকার ও তারই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এই পরিস্থিতি বাঙলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্টি হলেও তার থেকে একথা মনে করার কোন কারণ নেই যে, পুরাতনের পতন নোতুন সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ করেছে অথবা তাকে অসম্ভব করেছে। মোটেই তা নয়। উপরন্তু সংশোধনবাদী ও বিলোপবাদী চিন্তাধারার এই পরিণতি এদেশে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী চিন্তাধারার এক নোতুন উন্মেষ সাধন করছে এবং এক নোতুন উত্থানের প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত হিসেবে দেখা দিয়েছে।
১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর বেশ কিছুদিন পূর্বে এই বইয়ের প্রথম সংস্করণ শেষ হলেও নানা কারণে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হতে কিছুটা দেরি হলো। এই সংস্করণটি প্রকাশের জন্য আমি মুক্তধারা ও শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহার কাছে কৃতজ্ঞ।
বদরুদ্দীন উমর
ঢাকা
১১ই অক্টোবর, ১৯৮৩
.
তৃতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ
বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা লিখিত হয়েছিলো ১৯৭৪ সালে। সে সময়টা এমন ছিলো যখন এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংগঠিত কোন অস্তিত্ব প্রকৃতপক্ষে আর থাকে নি। কয়েকভাগে বিভক্ত পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি ১৯৭১ সালে একদিকে চরম দক্ষিণপন্থী এবং অন্যদিকে চরম বামপন্থী বিচ্যুতির কারণে আরও অনেকভাগে বিভক্ত ও প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়েছিলো। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত যে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব পূর্ব বাঙলা নামক এই ভূখণ্ডে কমিউনিস্ট আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন তাঁদের অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা সত্ত্বেও বাস্তব বুদ্ধির ঘাটতি ও তত্ত্বগত দেউলিয়াপনা, নীতি ও কৌশল নির্ধারণে অপারগতা, আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী ও আচরণ, সুবিধাবাদ ও আপোষকামিতা ইত্যাদি ১৯৭১ সালের শেষ দিকে দেশের জনগণ ও নানা উপদল ও গ্রুপে বিভক্ত কর্মীদের মনে এ ধারণার সৃষ্টি করেছিলো যে. তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতৃত্বের কোন অংশই, সে হোক দক্ষিণ অথবা বামপন্থী, কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বের জন্য যথেষ্ট নয়। যথেষ্টতার এই অভাব থেকেই তখন কর্মীদের মধ্যে চিন্তা শুরু হয়েছিলো বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা, অতীতের কার্যকলাপের পর্যালোচনা এবং ভুলভ্রান্তির বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যমে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নোতুনভাবে দাঁড় করানোর এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত কমিউনিস্টদের মধ্যে একটি ঐক্য গড়ে তোলা।
বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপের কর্মীদের সাথে এবং কিছু কিছু স্থানীয় ব্যক্তির সাথে আলাপ আলোচনা করে আমার নিজের মধ্যেও এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছিলো যে, আমাদের দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি, বিপ্লবের স্তর, আমাদের আশু ও দূরবর্তী কর্তব্য সব কিছু বিষয়ে ধারণা সৃষ্টি করা দরকার। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথাযথ মার্কসবাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে, কঠিন কঠোর বিশ্লেষণের মাধ্যমে, আমাদের করণীয় কর্তব্যগুলি নির্ধারণ করা দরকার, এ উদ্দেশ্যে সকল গ্রুপভুক্ত কর্মীদের ও নেতাদের মধ্যে আলাপ আলোচনা ব্যাপকভাবে হওয়া দরকার।
১৯৭১ এর যুদ্ধকালীন অবস্থায় পার্টি লাইনের সাথে নীতি ও কৌশলের ক্ষেত্রে ঘোরতর মত পার্থক্য ও মত বিরোধের পরিণামে আমি নিজে ১৯৭১ এর ডিসেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) থেকে পদত্যাগ করি। তার পর থেকে আমি সকল পার্টি ও গ্রুপের সাথেই যোগাযোগের যথাসাধ্য চেষ্টা করি এবং নোতুনভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলন গঠন সম্পর্কিত আলাপ আলোচনার সূত্রপাত নিজের উদ্যোগেই গ্রহণ করি। সেই অনুযায়ী ১৯৭২ সাল থেকেই বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে কিছু কিছু আলাপ আলোচনা প্রায় নিয়মিতভাবে চলতে থাকে। এই আলোচনার অভিজ্ঞতা এবং ১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার আলোকে আমার নিজের মধ্যে চিন্তার যে তাগিদ সৃষ্টি হয় তারই বশবর্তী হয়ে আমি বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যায় অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলি মাসিক সংস্কৃতিতে ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করি।
এই আলাপ আলোচনা যাতে তাত্ত্বিকভাবে বিভিন্ন গ্রুপভুক্ত কমিউনিস্ট কর্মী ও নেতাদের মধ্যে হতে পারে সেই উদ্দেশ্যেই আমি মাসিকপত্র হিসেবে সংস্কৃতি প্রকাশের উদ্যোগ নিই। কিন্তু আমার অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও এ দেশের কমিউনিস্টরা সে সুযোগ গ্রহণ তো করেনই নি, উপরন্তু তৎকালীন কোন কোন কমিউনিস্ট নামধারী পার্টির নেতারা সংস্কৃতিকে “প্রতিবিপ্লবী” পত্রিকা হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন। যে “বিপ্লবীরা” সে সময় সংস্কৃতিকে প্রতিবিপ্লবী বলেছিলেন তাঁরা এখন প্রতিবিপ্লবের নর্দমায় গড়াগড়ি দিচ্ছেন। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কোন বোধ বুদ্ধি এবং বিদ্যা ছাড়া অতি বিপ্লবী হওয়ার চেষ্টার পরিণাম এরকমই হয়ে থাকে।
যাই হোক, তৎকালে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা আলোচনা আমি করেছিলাম সেটাকে আমার গুরুতর কর্তব্য বিবেচনা করে। সেই কর্তব্য সম্পাদন করতে গিয়ে আমি বাঙলাদেশে বিপ্লবের স্তর, বিপ্লবী শক্তিসমূহের বিন্যাস, বিপ্লবের শত্রুমিত্র ইত্যাদি সম্পর্কে যে বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছিলাম আজকের দিনেও সেটা প্রায় আগের মতোই প্রাসঙ্গিক মনে হয়। এ কারণে বইটির এই নোতুন সংস্করণের প্রয়োজন এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে এখনো যথেষ্ট বলেই আমি নিজে মনে করি।
বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা নামে এই বইটিতে যে সব বিষয় আলোচিত হয়েছে তার মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো এ দেশে বিপ্লবের স্তর, বিশেষতঃ ১৯৭১ এর পরবর্তী পর্যায়ে বিপ্লবের স্তর। ঘোরতর সমাজতন্ত্র বিরোধী আওয়ামী লীগ হঠাৎ ভোল পাল্টে নিতান্তই সুবিধাবাদী কারণে ঘোরতর সমাজতন্ত্রী একটি পার্টি হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করে, এদেশের শিল্প কারখানা জাতীয়করণকে সমাজতন্ত্র আখ্যা দিয়ে লুটপাটের ক্ষেত্র অবাধ করে, এদেশে সমাজতন্ত্রের নামে এক ফ্যাসিস্ট সরকার কায়েম করে। অর্ধ শিক্ষিত এবং প্রায় অশিক্ষিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে এ ব্যাপারে তাত্ত্বিক শক্তির যোগান দিতে বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সি. পি. বি.) ১৯৭১ সালের পর এ দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব “সম্পন্ন” হয়েছে বলে এক তত্ত্ব হাজির করে ১৯৭১ পরবর্তী স্তরকে সমাজতন্ত্রের স্তর হিসেবে আখ্যায়িত করে। আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আসা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও (জাসদ) “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র” এর আওয়াজ তুলে বিপ্লবের স্তরকে সমাজতান্ত্রিক হিসেবে ঘোষণা করে এমন এক “বিপ্লবী” আন্দোলন শুরু করে যার সাথে বাস্তব পরিস্থিতির কোন সম্পর্ক ছিলো না।
এই সব তাত্ত্বিক বিভ্রান্তির অবশেষ ও রেশ এখনো আছে যা তৎকালীন আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যবাহী জাসদের একাধিক ভগ্ন অংশ এবং তাদের থেকে বের হয়ে আসা বাঙলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এর একাধিক গ্রুপ এর মধ্যে এখনো দেখা যায়। এই ধরনের “বামপন্থী” রাজনৈতিক দলগুলি বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের নামে যে সব কাজ করছে তার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে এদেশের সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তি, বিশেষতঃ মার্কসবাদী- লেনিনবাদীদের উপলব্ধিতে সাধারণভাবে কোন অস্পষ্টতা নেই। কিন্তু সেটা না থাকলেও বৃহত্তর রাজনীতির ক্ষেত্রে এই চিন্তার ক্ষতিকর প্রভাব এখনো যথেষ্ট। এ কারণেই এ বইটিতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কিত যে আলোচনা করা হয়েছে সেটা আজকের দিনেও খুব প্রাসঙ্গিক।
এক এক ঐতিহাসিক পর্যায়ে সমাজের স্তর এবং বিপ্লবী পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট স্তর ও চরিত্র অনুধাবনের গুরুত্ব যে কত বেশি সেটা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় এ দেশের কমিউনিস্টদের দ্বারা সংগ্রামের স্তর ও চরিত্র নির্ণয়ের ব্যর্থতার মধ্যে যেভাবে দেখা গেছে সেভাবে তার পূর্ববর্তী কোন সময়ে দেখা যায় নি। সেই ব্যর্থতার মূল কারণগুলি বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে আমি যে দলিলটি তৈরি করেছিলাম সেটি একটি দীর্ঘ ভূমিকা সহ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙলাদেশে কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক ভূমিকা নামে গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়েছে। (জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ১৯৯৬)। এই উল্লিখিত দলিলটিতে যে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা আছে মূলতঃ সেটাই আমি ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে যুদ্ধকালীন অবস্থায় আমাদের তৎকালীন পার্টি (অধুনালুপ্ত) ‘পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)’র কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে একটি ৬৩ পৃষ্টার লিখিত রিপোর্টে উপস্থিত করেছিলাম। সেই রিপোর্ট তৎকালীন আমলাতান্ত্রিক পার্টি নেতৃত্বের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়ে তাঁদের কাছেই বাক্সবন্দী থেকে পরবর্তী সময়ে “অদৃশ্য” হয়েছিলো। এক ঘোরতর চক্রান্তমূলক আন্তঃপার্টি দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে সেই দ্বন্দ্বের বাইরে অবস্থিত আমার মতো একজন পার্টি কর্মীর দেওয়া তৎকালীন পরিস্থিতি, আমাদের পার্টি লাইনের ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি এবং জরুরী করণীয় সম্পর্কিত সেই রিপোর্ট পার্টি নেতৃত্ব কর্তৃক আমল দেওয়ার মতো গণতান্ত্রিক কোন প্রক্রিয়া পার্টি সংগঠনের মধ্যে ছিল না।
যাই হোক, আমার সেই দলিলে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের এবং আমাদের তৎকালীন পার্টির পরিণতি সম্পর্কে যা বলা হয়েছিলো সেটাই বাস্তবত ঘটেছিলো। ১৯৭৬ সালে লিখিত পরবর্তী দলিলটিতে ১৯৭১ সালে প্রাপ্ত পরিস্থিতিতে কমিউনিস্টদের অনুসৃত লাইন সম্পর্কে যে আলোচনা করা হয়েছে তার মধ্যেই দেখা যাবে এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রকৃত সঙ্কটের কতকগুলি চিহ্নিত এলাকা।
কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা লেখার দুই বৎসর পর সেই দলিলটি লেখা হলেও তাতে যে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ উপস্থিত করা হয়েছে সেভাবেই আমি ১৯৭১ সালের পরিস্থিতি অনুধাবন ও উপলব্ধি করেছিলাম। সেই উপলব্ধির আলোকেই ধারাবাহিকভাবে লেখা হয়েছিল এ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলি। কাজেই এদুটি বইয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ট। এদুই বইয়ের অন্তবর্তীকালে ও পরবর্তীকালে লিখিত কিছু প্রবন্ধ ছাড়া এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো সম্প্রতি প্রকাশিত বাঙলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি নামে একটি বই (আফসার ব্রাদার্স, বাংলাবাজার ঢাকা ১৯৯৭)। এই বইয়ে প্রকাশিত রচনাগুলিও ধারাবাহিকভাবে ১৯৯৬ জানুয়ারি থেকে ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সংস্কৃতিতে প্রকাশিত হয়েছে। বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রকৃত সমস্যা, তার ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূলসমূহ সম্পর্কে একটা সুষ্ঠু ধারণার জন্য এ তিনটি বই একত্রে ও সম্পর্কিতভাবে পড়া দরকার বলেই মনে করি
বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া যেমন বিপ্লবী আন্দোলন হয় না, তেমনি কোন বিপ্লবী আন্দোলনে সচেতন অংশগ্রহণ ছাড়া সে বিপ্লবের তত্ত্ব নির্মাণ সম্ভব নয়। এ বিষয়ে লেনিনের সুবিখ্যাত বক্তব্য যে কত সঠিক সেটা অন্য অনেক দেশের অভিজ্ঞতা বাদ দিলেও আমাদের দেশের ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে তত্ত্বচর্চা ও তাত্ত্বিক বিতর্কের নামে যা হয়েছে তার মধ্যে প্রকৃত তত্ত্বের দেখা কদাচিৎ পাওয়া যায়। অধিকাংশই মুখস্ত বিদ্যা, তোতাপাখির বুলি অথবা নিতান্তই আত্মমুখী চিন্তা। সেগুলির সাথে মার্কসীয় বিপ্লব তত্ত্বের কোন সম্পর্ক নেই, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বাস্তবতারও নেই কোন সম্পর্ক। অন্যদিকে আমাদের দেশের জনগণ এবং একক কমিউনিস্ট পার্টি ও পরবর্তীকালে কয়েকভাবে বিভক্ত পার্টিগুলি অনেক আন্দোলন করেছেন। অনেক ত্যাগ স্বীকার ও তিতিক্ষার পরিচয় তাঁরা দিয়েছেন। কিন্তু বিপ্লব না হয়ে প্রতিবিপ্লবই বারবার জয়যুক্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে কোন মৌলিক পরিবর্তন এখনো ঘটেনি।
সে পরিবর্তন ঘটাতে হলে সব রকম সংস্কার, দলীয় ও ব্যক্তিগত আহমিকা, আত্মমুখিতা ইত্যাদির ঊর্ধ্বে থেকে বিদ্যমান পরিস্থিতির সামগ্রিক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ আমাদের করতে হবে; সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কসমূহ যথাযথভাবে অনুধাবন করতে হবে; নিজেদের বাস্তব কাজের ধারা, অভ্যাস আচরণ ইত্যাদির ত্রুটি বিচ্যুতিগুলি চিহ্নিত করে নিজেরা সংশোধিত হতে হবে, জনগণের চিন্তাভাবনার সাথে পরিচিত হয়ে তার প্রতিটি স্তর সম্পর্কে অবহিত হতে হবে কোন জায়গায় নাড়া দিলে জনগণ স্পন্দিত, উদ্বেলিত এবং আন্দোলিত হবেন সেটা কাণ্ডজ্ঞানের সাহায্যে উপলব্ধি করতে হবে। বইপত্র থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান ও সেই সাথে কাণ্ডজ্ঞান এবং আন্দোলনের বাস্তব অভিজ্ঞতা যথাযথভাবে যুক্ত হলেই একদিকে যেমন সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব নির্মাণ সম্ভব হয়, তেমনি সম্ভব হয় বিপ্লবী আন্দোলনের সঠিক সূত্রপাত, গঠন এবং অগ্রগতি।
এই লক্ষ্য অর্জন সহজ কাজ নয়। এ কাজ সহজ মনে করে কতকগুলি বিক্ষিপ্ত আন্দোলনের সূচনা করে অথবা তার মধ্যে থেকে আত্মপ্রসাদ লাভের কোন সুযোগ এ ক্ষেত্রে নেই। বিশেষতঃ এ কারণে নেই যে, আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তোলার সব নিয়মকানুনের ব্যাপারে অজ্ঞতা, নিয়ম কানুনের জ্ঞান অর্জনে অনীহা এবং কোনভাবে সে সব নিয়ম সম্পর্কে কিছু ঢালাও ধারণা থাকলেও সেগুলি উপযুক্ত গুরুত্ব সহকারে মেনে চলার ক্ষেত্রে বড় রকম ব্যর্থতাই এ দেশের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসের একটা বিশেষ নেতিবাচক দিক, যা আবার পরিণত হয়েছে এক অনড় ঐতিহ্যে। সামগ্রিকভাবে দেশীয় পরিস্থিতি ও সেই সাথে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ, উভয়ের মধ্যে যোগসূত্র অনুধাবন, সামাজিক শক্তিগুলির মধ্যে বাস্তব রাজনৈতিক কাজের ধারা নির্ধারণ ও ক্রমাগত সেই অনুযায়ী কাজ করে যাওয়া, কাজের যৌথ পর্যালোচনাকে একটা সঙ্গতিপূর্ণভাবে সুশৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা ছাড়া বিপ্লবী প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া ও বিপ্লব সাধন কোনক্রমেই সম্ভব নয়।
এই কর্তব্য ক্ষেত্রে যতটুকু সম্ভব সহায়তার উদ্দেশ্যেই আমি বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যার অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলি রচনা করেছিলাম। এগুলি এখনো পর্যন্ত যথেষ্ট, এমনকি পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক, মূলত এই ধারণার অনুবর্তী হয়েই আমি এই বইটি পুনর্মুদ্রণে আগ্রহী হয়েছি। এটি প্রকাশের জন্য ‘জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন’ এর কমল কান্তি দাস ও মোরশেদ আলমকে ধন্যবাদ।
বদরুদ্দীন উমর
ঢাকা
০৭.০৮.১৯৯৭
Leave a Reply