বাউল ফকির কথা – সুধীর চক্রবর্তী
বাউল ফকির কথা – সুধীর চক্রবর্তী। ২০০২ আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্ত বই।
প্রথম সংস্করণ: আগস্ট ২০০৯
.
শ্ৰীঅমিয়কুমার বাগচী
শ্ৰীমতী যশোধরা বাগচী
সৌমিত্রেষু
.
‘বাউল ফকির কথা’ প্রথম প্রকাশিত হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি সংস্কৃতি কেন্দ্র’ থেকে ২০০১ সালের মার্চে। অচিরে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ পায় ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে। ইতিমধ্যে ২০০২ সালে বইটি অর্জন করে আনন্দ পুরস্কার। পরে ২০০৪ সালে পায় সাহিত্য অকাদেমি সম্মান। এরপরে দীর্ঘদিন বইটি দুষ্প্রাপ্য ছিল। এবারে ২০০৯ সালে বইটি প্রকাশিত হল আনন্দ পাবলিশার্সের পক্ষ থেকে। এ ব্যাপারে লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্রের সচিব প্রদীপ ঘোষ লিখিত অনুমতিদানে আমাকে বাধিত করেছেন। নবমুদ্রণে বইটির আকারপ্রকার ও বিন্যাস অনেকটা বদলে গেছে, কিছুটা বর্জিত হয়েছে, কিছু যোজিত হয়েছে। প্রচ্ছদ ও আলেখ্যশোভন অন্তর মহলের নতুন ভিস্যুয়াল-ঔজ্জ্বল্য নবসংস্করণকে সমৃদ্ধ করেছে। আনন্দ পাবলিশার্সের সকলকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।
বাংলার বাউল-ফকিরদের নিয়ে এতাবৎকাল যে সব লেখালিখি বা বইপুস্তক বেরিয়েছ, অনেকের ধারণা তথা অভিযোগ যে সেগুলি প্রধানত সাহিত্যগন্ধী কিংবা তত্ত্বগর্ভ। এইসব সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন বাস্তব সামাজিক অবস্থান ও অবস্থা, তাঁদের নিজস্ব আচরণ ও বিশ্বাসের জগৎ, তাঁদের গানের সুর ও সংগীতের মূল্য, তাঁদের প্রতিবাদের প্রক্রিয়া ও বিদ্যমান সমাজাদর্শের প্রত্যাঘাত—এ ধরনের পুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে গেলে তাঁদের সম্পর্কে যে বিস্তৃত ব্যক্তি-তথ্য ও নিরপেক্ষ সারণি থাকা একান্ত আবশ্যিক, আগেকার অন্বেষকরা সে বিষয়ে তেমন ভাবেননি। এর জন্য আমরা অভাববোধ করতে পারি, শোচনা করতে পারি, কিন্তু পূর্বজ সন্ধানীদের দোষারোপ করতে পারি না। ইতিহাসতত্ত্বে যেমন গত দু’-তিন দশক ধরে নিম্নবর্গ-চেতনা বা সাব অলটার্ন দৃষ্টিকোণ এসে তল-থেকে-দেখা ইতিহাসকে উন্মোচন করছে, তেমনই নবলব্ধ ভাবনা সূত্রে বাউল-ফকিরদের সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে খুঁজে নেবার নতুন দিশা যদি কেউ প্রয়োগ করেন তবে বিষয়টি সম্পর্কে ভাববাদের ধূসরতা কেটে যেতে পারে—অবতীর্ণ হতে পারে এমন সব নতুন পর্যবেক্ষণ ও দ্বান্দ্বিক বিন্যাসের ছক যা পালটে দিতে পারে আমাদের বহুদিন পোষিত ধারণাকে। তাই বলে আগের জানাটাও মূল্যহীন হয়ে পড়ে না।
আমি নিজে সত্তরের দশকের কিছু আগে থেকে, কোনওরকম মেথোডলজির বাধ্যতা না নিয়ে, একেবারে নিজের মতো করে গ্রামবীক্ষণ এবং গৌণধর্মী নিম্নবর্গের কয়েকটি উপাসক সম্প্রদায় সম্পর্কে সরেজমিন প্রত্যক্ষণে মন দিই তাঁদের অবস্থানে গিয়ে। সেই কাজ আলতোভাবে বা আলগা ঢঙে গ্রাম্য মেলায় যাওয়া, একটা দুটো গান সংগ্রহের আত্মতৃপ্তি নিয়ে শহরের মননজীবিতায় ফিরে আসা নয়—আমি তাঁদের মধ্যে থেকে, রীতিমতো বসবাস করে অর্থাৎ তাঁদের আহার-সংস্কার-ধূলিতল ও বেদনাতুর জীবনপ্রবাহের অচ্ছেদ্য শরিক হয়ে সবকিছু জানতে বুঝতে চেয়েছি, তাঁদের সঙ্গে বসে তাঁদের গান গেয়েছি। তার ফলে হয়তো গানের ভিতর দিয়ে পৌঁছতে পেরেছি তাঁদের ভাবসত্য ও জীবনবীক্ষণের অনন্য সরণিতে। সেই গানের আবার কত না ধরন, কত না গায়নশৈলী! ক্রমে ক্রমে আমি বুঝতে পেরেছি আসল গান তাঁদের অব্যক্ত সংলাপ, তাঁদের সাংকেতিক তত্ত্বনির্দেশ। সে গানের ক্রম আছে, কোন গানের জবাবে কোন গান, গুরুর সন্নিধানে তারও শিক্ষা এবং দীর্ঘ প্রস্তুতি আছে। গানের ভিতরের দ্ব্যর্থ এবং অভিসন্ধিত অর্থ বুঝতেও লাগে গুরূপদেশ। আরও আশ্চর্য যে, বাস্তবে দেখেছি, রাঢ়ের বাউল যে-গানটি গাইছেন ঝুমুর অঙ্গের গায়কীতে, সেই একই গান কুষ্টিয়াতে শুনতে পাচ্ছি ভাঙা কীর্তনের ধাঁচে। সেই একই গান আবার উত্তরবঙ্গের বাউলদের গায়নে কিছুটা ভাওয়াইয়া অঙ্গের কাঠামোকে অঙ্গীকার করে নিচ্ছে। শুধু এখানেই বিচিত্রের মর্মবাঁশির শেষ নয়, একই গায়ক সিলেট অঞ্চলের হাসন রজার গান আমাকে শোনান দু’-রকম করে। প্রথমে শান্ত করুণ অত্বর বিন্যাসে—তারপরে ঝোঁক দিয়ে দিয়ে তালের স্পন্দে ছন্দিত করে, যেন কিছুটা হালকা লীলা বিলাসে।
বাংলার নিজস্ব লোকায়তের এমনতর অন্তর্গোপন স্বভাব কেবল তো সুরে বা ঠাটে নেই, আছে সেই জীবনযাপনের দ্বন্দ্বে-ছন্দে, দার্শনিকতায়, সারল্যে ও স্ফূর্তিতে। গানের বেদনার অভিঘাতে যখন আশি-পেরোনো বলহরি দাস বা সত্তর-পেরোনো সনাতনদাস বাউল স্বতই নাচতে থাকেন তখন গানের রূপ ও রস অন্য এক মাত্রায় আমার সামনে প্রতীত হতে থাকে। নাচে-গানে-মেশা একটা আলাদা নৃত্যনাট্যের বাউল-অন্তঃপুর তখন ঝলকে ওঠে—সেই ঝলক দুর্লভ ও বিরলপ্রাপ্য—যেন পাথর আর লোহার সংঘর্ষে চকমকির মতো চকিত ক্কচিৎ স্ফুরণ। বেশ মনে পড়ে, একবার মুর্শিদাবাদের কুমীরদহ গ্রামে এক ফকিরি গানের আসরে, রজনীর নিস্তব্ধ মধ্যযামে, অন্তত আট-দশ জন ফকির তাঁদের গানের তুরীয় অন্তর্লোকের অবগাহনে কেমন উৎক্ষিপ্ত হয়ে নাচছিলেন—মাঝে মাঝেই তাঁদের শরীর ঊর্ধ্বে উঠে যাচ্ছিল নৃত্যবিক্ষেপে। আত্মমগ্ন কিংবা আত্মহারা সেই নাচের উন্মাদনা দেখে কে বলবে যে এইসব ফকির তাঁদের এমন সংগীত-প্রেমের জন্যই গ্রামের গোঁড়া ধর্মসমাজের নির্দেশে নিন্দিত—নিজ গ্রামেই নির্বাসিত। মৌলবাদী ধর্মগুরুর ফতোয়ায় তাঁদের শীর্ণ একতারাও দণ্ডপ্রাপ্ত, তাঁদের কণ্ঠ গানের অপরাধে বিড়ম্বিত।
এই রকম নানা অভিজ্ঞতায় স্নাত হতে হতে পুরো সত্তর দশকটাই কেটে গেছে। শুধুই শুনে যাওয়া আর দেখে যাওয়া। কেবলই অঞ্জলি ভরে গান সংগ্রহ করা—লোকতাত্ত্বিকদের কাছে বারেবারে গিয়ে বোঝার চেষ্টা সেসব গানের গূঢ় সত্য। এমনভাবে অকাতরে পাওয়া যেসব অনুভব আর দিশা, তারই আলোয় আশির দশকে বছর তিনেক ধরে আমি লিখে ফেলি যে-সন্দর্ভ বা তত্ত্ববিশ্বের আখ্যান, তা নানা খণ্ড-শিরোনামে ‘এক্ষণ’ ও ‘বারোমাস’ পত্রে প্রকাশিত হয়ে এলিটিস্ট বিজ্ঞজনকে নাড়া দেয়। শেষমেষ রচনাগুলি দুই মলাটের বাঁধন মেনে ‘গভীর নির্জন পথে’ নামে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে পুস্তকাকার লাভ করে প্রকাশ পায় ১৯৮৯ সালে। সে বই এখনও এই ২০০৯ সালেও, একই রকম জনাদর পেয়ে চলেছে— পত্রপত্রিকার খুব অনুকূল আলোচনার ভাগ্য অর্জন করেছে। এতদিনকার অনুন্মোচিত যৌন-যোগে রহস্যময় অন্তর্মূঢ় বাউল জীবন সম্পর্কে প্রাঞ্জলভাবে জানতে পেরে পাঠকদের অনেকে যেমন চমৎকৃত ও চমকিত হয়েছেন, তেমনই কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন বইটি রোমান্টিক, অর্থাৎ স্বকল্পিত। সেটা অবশ্য নিন্দাছলে প্রশংসাই, কারণ এমন আলো-আঁধারি দোলাচলের মরমি জীবনকে নিছক কল্পনায় ফুটিয়ে তোলা, সে তো সপ্রতিভ সৃজনশীলতার আরেক উচ্চারণ। যাই হোক, এমনতর সমাদরে-সংশয়ে দিন কাটছিল, কিন্তু বাউল ফকিরদের বিষয়ে আমার অন্বেষণ আর অনুসন্ধিৎসার ক্ষান্তি ঘটেনি। সেই থেকে, কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, নিছক কৌতূহলে কিংবা বলা উচিত গভীর লোকায়তের টানে, বছরের পর বছর ঘুরেই চলেছি। ইত্যবসরে লালন শাহকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বই লেখা এবং পশ্চিমবঙ্গের মেলা ও মহোৎসব নিয়ে ধারাবাহিক রচনার কাজ সাঙ্গ হল। বাউল ফকিরদের নিয়ে নতুন করে কোনও আলাদা বই লেখার পরিকল্পনা বা মশলা ছিল না। ১৯৯৪ সালে এসে গেল কলেজীয় অধ্যাপনার শেষে অবসরের দিন। ভাবলাম, এতদিনে এসেছে সেই প্রত্যাশিত সময়, এবারে নিজের মতো পড়াশুনা করে কাটবে দায়হীন দিনগুলি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যবিভাগে সপ্তাহে দুটি দিন অতিথি-অধ্যাপকের লঘু দায়িত্বের আনন্দে বেশ কাটছিল অনুসন্ধানী তরুণ সহকর্মীদের সান্নিধ্যে। হঠাৎ এসে গেল নতুন আহ্বান। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্রের তৎকালীন সচিব চন্দনকুমার চক্রবর্তী ১৯৯৬ সালে আমাকে ভার নিতে বললেন পশ্চিমবঙ্গের বাউল ফকিরদের নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানের প্রকল্প রূপায়ণের গুরু দায়িত্বের।
প্রথমে মনের মধ্যে একটা প্রতিরোধ এসেছিল সরকারি ছকের কৃত্রিম পদ্ধতি কিংবা পূর্ব নির্দেশিকার বাধ্যবাধকতার কথা ভেবে। সরকারি সমীক্ষাপত্র বিষয়ে, এদেশে, নানা কারণে, একরকম অনীহা ও বিরূপতা আছে। সম্ভবত সেগুলি প্রায়ই হয়ে পড়ে কেঠো বিবরণ কিংবা কেজো প্রতিবেদন। সরেজমিন গবেষণা, যাকে ভদ্রভাষায় বলে ক্ষেত্রসমীক্ষা—(বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত একটি বইতে বলা হয়েছে ‘মাঠ গবেষণা’) যার ভিত্তি হল মৌখিক ঐতিহ্যের সঙ্গে বর্তমানের মেলবন্ধন, তার সিদ্ধি বেশ কঠিন। সারা পশ্চিমবঙ্গ ব্যেপে কাজের বিশাল পরিধি, ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও বহুমুখী, এমন প্রকল্প রূপায়ণ আয়াসসাধ্য। তাই দ্বিধা জেগেছিল।
কিন্তু আগ্রহ ও উত্তেজনাও জাগরূক ছিল, কারণ সচিব মহাশয় প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিলেন প্রকল্পের কাজে কোনও খবরদারি বা পূর্বকল্পিত সরকারি ছক থাকবে না, কাজটা করা যাবে স্বাধীনভাবে। অবশ্য একটা ব্যক্তিগত কৌতূহলও ছিল—সত্তর দশকে নদিয়া-মুর্শিদাবাদ-বর্ধমান ঘিরে যে-জনপদে বাউলফকিরদের ঘনিষ্ঠভাবে একদা পর্যবেক্ষণ করেছিলাম নিজের খেয়ালে, দু’দশক পরে তাদের পরিবর্তন ও নতুন সমাজ কাঠামোয় তাদের ভূমিকা জানবার আগ্রহ জাগল। এই ক’দশকে আমাদের দেশে নিম্নবর্গ, লোকধর্ম ও মরমিয়া সমাজ সম্পর্কে জনসাধারণের উৎসাহ এবং জানবার আগ্রহ ইতিমধ্যে অনেক পরিমাণে বেড়ে গেছে—প্রণিধানযোগ্য বেশ ক’টি বইও বেরিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে। দেশি ও বিদেশি গবেষকরা গ্রামে-গঞ্জে নগরে অনেক সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তেমনই গ্রামীণ সমাজে নানা রূপান্তরের লক্ষণ আর নগরায়ণের ছাপ পড়েছে অনেক প্রগাঢ়ভাবে। এই ধরনের রূপান্তর আর গ্রামিক দৃশ্যপট জানতে এবং সেই পরিপ্রেক্ষণীতে নতুন করে লোকায়ত শিল্পী সমাজকে বুঝতে চাওয়া স্বাভাবিক। সহসা সেই সুযোগ এসে গেল, অবশ্য এসে গেল ব্যাপক প্রসারণে—কারণ এবারে অনুসন্ধানের ক্ষেত্র-পরিসর হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গব্যাপী, যার একটা প্রধান অথচ উপেক্ষিত-অনালোকিত অংশ হল ফরাক্কা পেরিয়ে বিশাল উত্তরবঙ্গ।
এটা নিশ্চিতভাবে নির্ণীত হল যে, বীরভূম-বাঁকুড়া-মুর্শিদাবাদ-নদিয়া পশ্চিমবঙ্গের এই চারটি জেলা বাউলফকির অধ্যুষিত। বর্ধমান-মেদিনীপুর-পুরুলিয়ায় বাউলদের কিছু সন্ধান মিললেও দুই চব্বিশ পরগনা-হাওড়া-হুগলি বাউল সমাবেশের দিক থেকে দীন। উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের বাউলদের বসতি, সমাবেশ ও সংখ্যা নিঃসন্দেহে মালদহ-কোচবিহার-দার্জিলিং-জলপাইগুড়ির চেয়ে বেশি।
এইবারে সমস্যা দেখা দিল বাউল ফকিরদের শনাক্তকরণ নিয়ে। রাঢ়ের বাউল আর উত্তরবঙ্গের বাউল একেবারে আলাদা—গানের বিষয় ও গানের ঠাটে, গায়নে, এমনকী বাউলের অঙ্গবাসে। বীরভূমের ফকিরদের জীবনযাপনের ছকের সঙ্গে নদিয়ার ফকিরদের কোনও মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পূর্ণদাসের গানের অঙ্গ যে বাউলনৃত্যবিভঙ্গ তার সঙ্গে বাঁকুড়ার সনাতনদাসের নৃত্যশৈলী সম্পূর্ণ পৃথক। প্রতিতুলনায় উত্তরবঙ্গের বলহরি দাসের নাচ একেবারে অন্য ধারার। নদিয়ার চাকদা-র ষষ্ঠী খ্যাপা আবার ভিন্নতর কৌশলে নাচেন। বীরভূমের ফকিরদের গানে বেহালা সঙ্গত আর নদিয়ার ফকিরদের গানে দোতারা ও আনন্দলহরী ব্যবহার দু’ধরনের দ্যোতনা আনে। সূক্ষ্মবিচারে আরও নানাবর্গের পার্থক্য চোখে পড়ে। যেমন বাউলের সাধনসঙ্গিনীদের ভূমিকা। রাঢ়ে বা নদিয়ায় যত্রতত্র তাদের সহজেই দেখা যায়, উত্তরবঙ্গে তারা বিরলদৃষ্ট। আরেকটা গুরুতর প্রশ্ন হল, সমাজ এদের কেমন চোখে দেখছে। উত্তরবঙ্গে বাউলরা গৃহীত, রাঢ়ে তারা সমাজজীবনের সম্পৃক্ত, নদিয়ায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অথচ মুর্শিদাবাদে তারা অত্যাচারিত ও বিপন্ন।
এ জাতীয় বহুতর দ্বান্দ্বিকতা ছাড়াও অন্য কয়েকটি সমস্যা ছিল। প্রথমত, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ ঘিরে নিম্নবর্গের উপাসক সম্প্রদায়দের জীবন ও চর্যা বিষয়ে কোনও সামগ্রিক কাজ আগে কখনই হয়নি এবং হয়তো একজন একক ব্যক্তির পক্ষে তা সম্পন্ন করা অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের কাজে কোনও পূর্বকল্পিত মডেল ও মেথডোলজি প্রয়োগ করা অনুচিত। লক্ষ করেছি, ইতিপূর্বে এ জাতীয় প্রয়াসে নানা অসম্পূর্ণতা থেকে গেছে। যেমন ধরা যাক, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সুবৃহৎ গ্রন্থ ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’। উদাহরণীয় এই বইতে একজনের রচনা অন্যের নামে মুদ্রিত হয়েছে, সরেজমিন গান সংগ্রহের প্রমাণ কম, উত্তরবঙ্গের বাউল গীতিকাররা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছেন। তেমনই মানস রায়ের লেখা ‘Bauls of Birbhum’ বইতে সমাজ-নৃতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করতে গিয়ে লেখক মূল প্রতিপাদ্যকে গুলিয়ে ফেলেছেন, বহুক্ষেত্রে বাউলদের শনাক্ত করতেই ব্যর্থ হয়েছেন। বৈষ্ণব রীতি ও আচারকে তিনি বাউল আচরণবাদের থেকে আলাদা করতে পারেননি। শক্তিনাথ ঝা-র বহু শ্রমলব্ধ ‘বস্তুবাদী বাউল’ বইটি মুর্শিদাবাদকেন্দ্রিক। এখানে সংকটের এক নতুন মাত্রা যুক্ত হল। আসলে ‘বীরভূমের বাউল’ কিংবা ‘মুর্শিদাবাদের বাউল-সমাজ’ কথাগুলির দ্যোতনা স্পষ্ট নয়– কারণ বাউলদের সমাজগত বা গোষ্ঠীগত অবস্থিতি যখন জেলার সীমায় বলয়িত করে আমরা ধরতে চাইব তখন মনে রাখা চাই যে আমাদের জেলাগুলির সীমা প্রধানত প্রশাসনিক, যাকে বলে Administrative Boundary। প্রত্যক্ষভাবে গ্রামে গ্রামান্তরে ঘুরতে ঘুরতে বেশ বোঝা যায়, নদিয়া-মুর্শিদাবাদের বাউলফকিরদের নানা বিষয়ে প্রচুর মিল এবং তাদের জেলাগত কোনও সীমায় বিশ্লিষ্ট করা সমীচীন নয়। আবার এটাও দেখার যে নদিয়ার বাউল ফকিরদের একটা অংশ ভাবে ভাষায় চলনে অনেক বেশি সম্পৃক্ত বাংলাদেশের কুষ্টিয়া-যশোহরের সঙ্গে। তেমনই দিনাজপুর বা জলপাইগুড়ির বাউলগায়করা প্রধানত রংপুর-পাবনা-রাজশাহী থেকে বাস্তুহারা হয়ে এসে এক নতুন ধারার পত্তন করেছেন—কারণ দিনাজপুর-জলপাইগুড়ি-কোচবিহার অঞ্চল মূলে বাউল ঐতিহ্যের সঙ্গে কোনওদিন যুক্ত নয়। এখানে গড়ে উঠেছে এক নবসমাজ এবং অন্য ধরনের বাউল গায়ক সম্প্রদায়। গড়ে উঠেছে নতুন উৎসুক শ্রোতৃসমাজও।
সরেজমিন কাজ করতে গিয়ে আরেকটি অভিজ্ঞতা অবশ্যম্ভাবী—তা হল সাধক-বাউলদের সঙ্গে গায়ক-বাউলদের আলাদা করতে না-পারা। যে বাউল গায়, সে বিশ্বাসে ও আচরণে একবারেই বাউল নয়, এমন সংখ্যা এখন পর্যাপ্ত। ফকিরিয়ানার স্বেচ্ছাগৃহীত দরিদ্র জীবন আর ফকিরি গান গাওয়ায় কোনও ভেদ নেই কিন্তু মঞ্চে আমন্ত্রিত হয়ে এমন অনেকে এখন ফকিরি গান গাইছেন যিনি পোশাকে ফকির কিন্তু সামাজিক পরিচয়ে হয়তো সচ্ছল কৃষিজীবী। গত কয়েক দশকে বাউল গান এত পেশাদারি হয়ে গেছে যে ‘বহু বেকার যুবক-যুবতী তার টানে মঞ্চে উঠছেন এবং কণ্ঠলাবণ্যে ও গায়নকৌশলে আসর মাত করছে। তাঁদের প্রত্যক্ষ লক্ষ্য যশ ও অর্থ—বিকল্প জীবিকা। যাঁরা আরেকটু তৎপর আর করিতকর্মা তাঁদের লক্ষ্য বিদেশের মঞ্চ, বিদেশিনী ও ডলার। এর কোনওটিই অলীক স্বপ্ন নয়—বাস্তব। এসব জটিলতা এড়াতে যেটা করা উচিত, আমার পদ্ধতি ছিল সেটাই, সরাসরি নানা জায়গায় বাউল ফকিরদের জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়া।
এটা সত্যি যে বাংলার বাউল ফকিরদের অন্তরঙ্গ জীবন পরিচয় উদ্ঘাটন করতে গেলে এমনভাবে প্রশ্নাবলির বিন্যাস করতে হবে যা প্রশ্নকারীর দীর্ঘ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে প্রণীত। কোনও বাঁধা ছকে (Set Pattern) সেই প্রশ্নাবলি গাঁথলে অভীষ্ট তথ্য না মিলতেও পারে। প্রশ্নের লব্জে সমষ্টিগত জিজ্ঞাসা (Macro) আর ব্যষ্টিগত জিজ্ঞাসা (Micro) নানাভাবে আনতে হবে। প্রশ্ন করতে করতেই বোঝা যাবে বাউল ফকিররা এক অর্থে বিচ্ছিন্ন আবার এক অর্থে খুব সম্প্রদায়গত। সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব এবং সমাজবিজ্ঞানের নানা সূত্র প্রশ্ন-প্রণয়নে কাজে লাগানো যায়। আমার তা ছাড়াও বিশেষ ঝোঁক ছিল সাংগীতিক কিছু তথ্য উন্মোচনের।
আমরা পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গের কয়েকশো লোকশিল্পী এবং আচরণবাদী বাউল ফকিরদের মধ্যে চার বছর পরিক্রমা করেছি। এখানে ‘আমরা’ বলতে আমি নিজে এবং তার সঙ্গে বেশ ক’জন প্রকল্প-সহকারী। এই পদ্ধতিতে যেসব উত্তর তথা জৈবনিক তথ্য উঠে এসেছে তা যেমন চমকপ্রদ তেমনই বৈচিত্রবহুল।
দেখা যাবে, একক ব্যক্তির মধ্যে দিয়ে উন্মোচিত গৌণধর্মীদের অনুবিশ্ব যেমন চমৎকৃতিতে ভরা তেমনই দ্বন্দে-ছন্দে স্ববিরোধে স্পন্দিত। হয়তো দেখা যাবে যিনি শিষ্যদের কাছে মান্য ও প্রবীণ বাউলতাত্ত্বিক তিনি পেশাগতভাবে পাগলের চিকিৎসক। বীরভূমের পটুয়ার সন্তান জাতিবিদ্যা চর্চার ফাঁকে গাইছেন বাউল গান। ব্রাহ্মণতনয়া নিছক গানের সম্মোহনে বরণ করেছেন ইসলাম ধর্ম, একজন ফকিরকে তাঁর জীবনসঙ্গীরূপে পেতে। আবার অন্য এক নারী শুধু গানের প্রতি অনুরক্তির কারণে পতিপরিত্যক্তা। দ্ব্যণুক (Binary opposites) সম্পর্কের বেশ কিছু নমুনা পাওয়া যাচ্ছে। যেমন একজন মারতপন্থী ফকির বিশুদ্ধ ইসলামি নামাজ রোজাতেও বিশ্বাস করেন। রোজা-নামাজ-বিরোধী একজন ফকির প্রতিবছর রমজান মাসে রাতটহলিয়ার কাজে কিছু কিছু উপার্জন করেন। বাউলরা স্বভাবত নিরুপাধি এবং খ্যাতিবিত্তের বিপরীত পথের পদাতিক অথচ প্রশ্নাবলির শেষে নিজের নামসই করতে গিয়ে একজন নিজের বিশেষণ দিয়েছেন ‘বাউলরাজা’ ও ‘ভাবরত্ন। একজন বাউল-গায়ক আচরণে ও বিশ্বাসে তান্ত্রিক—বেতার ও দূরদর্শনের শিল্পী কিন্তু জীবিকায় দেবাংশী। বাউলদের সাধনা প্রধানত জন্মরোধের অথচ প্রচুর বাউল অতিপ্রজ। কেউ কেউ নির্মমভাবে স্ত্রী ও সন্তান ত্যাগ করে বিদেশিনী নিয়ে সাধনা করছেন। কেউ আবার একের পর এক সাধনসঙ্গিনী নিয়ে পর্যায়ক্রমে কায়াবাদী। এর বিপরীত উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন গরিব ঘরের কুমারী মেয়ে বাউল গেয়ে বাবার সংসার চালাচ্ছেন। এমন বাউল বা ফকির আছেন যাঁরা নির্বাস—একেবারে চালচুলো নেই। কৃষিকাজ করেন বা মৎস্যজীবী এমন বাউল গায়ক আছেন বেশ ক’জন। হাড়ি বা ডোমবংশ-সদ্ভূত বাউল খুঁজে পাওয়া গেছে। সাঁওতাল বাউলও দুষ্প্রাপ্য নন যিনি নিজে গান রচনা করতে পারেন না কিন্তু জনপ্রিয় বাউল গান সাঁওতালি ভাষায় অনুবাদ করে গান করেন।
এই পথে কাজ করতে গিয়ে প্রত্যক্ষ ব্যক্তির মধ্যে দিয়ে প্রচ্ছন্ন সমাজকে কীভাবে যেন ছুঁয়ে ফেলি। যে বাউলদের কোনও জাতি বা গোত্র থাকা উচিত নয়, আশ্চর্য যে, তাঁদের অনেকে নিজের গোত্রপরিচয় দিয়েছেন ‘আলম্বায়ন’ এবং ‘অচ্যুতানন্দ’ বলে। পূর্ব বা পুনর্জন্মে যাঁদের বিশ্বাস থাকার কথা নয়, বাস্তবে কিন্তু অনেকে তাতে রীতিমতো বিশ্বাসী। অনেকে একজনের কাছে মন্ত্র দীক্ষা নিয়েছেন আর সংগীতশিক্ষা নিয়েছেন আরেকজনের কাছে। বাউল ফকিরদের গরিষ্ঠসংখ্যার কাছে প্রিয় গীতিকার লালন শাহ। অনেক বাউল আবার সক্রিয়ভাবে গণসংগঠনের সঙ্গে জড়িত। ব্যক্তিগত জীবনে অমর্যাদা ও অপমানের কথা অনেকে বলেছেন, সেই সঙ্গে সাধারণ শ্রোতাদের কাছে প্রসার প্রতিষ্ঠার কথাও জানিয়েছেন। প্রশ্ন-সারণি থেকে বেশ বোঝা যায় ডুগি-একতারা বাজিয়ে নিরাভরণ কণ্ঠবাদনে এখনকার শিল্পীরা সাদামাটা গান গাইতে আর রাজি নন, নানা যন্ত্রানুষঙ্গে বেশবাসে ও চমকে তাঁরা গান পরিবেশনে তৎপর। অনেক বাউল বা ফকির অনুমিত কারণে তাঁদের মাসিক আয় কত তা জানাননি। বেশির ভাগই তাঁদের মাসিক আয়, তিনশো থেকে সাতশো টাকা বলে জানিয়েছেন৷ তা সত্যি হলে বলতে হবে আমাদের লোকশিল্পীরা দরিদ্রতম।চার ছেলে চার মেয়ে স্ত্রী ও নিজে এমন দশজনের পরিবারে গান গেয়ে উপার্জন পাঁচশো টাকা— কেমন করে তাঁরা বেঁচে আছেন?
এত নৈরাশ্যের মধ্যে আর অতলগর্ভ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করেও তবু পশ্চিমবঙ্গের বাউল ফকির সমাজ দুর্মর জীবনপ্রত্যয়ে বলিষ্ঠ। তাই তাঁদের কণ্ঠের গান কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। দেখা গেছে মুর্শিদাবাদের কোনও কোনও গ্রামাঞ্চলে মৌলবাদীদের অত্যাচারে নিপীড়নে তাঁরা অতিষ্ঠ এবং জর্জরিত। একতারা ভেঙে, আখড়া পুড়িয়ে, দাড়িগোঁফ মুণ্ডন করে, একঘরে বানিয়েও তাঁদের মতাদর্শ আর গানের সরণি থেকে ভ্রষ্ট করা যায়নি। এখনও গান রচনা করছেন তাঁরা। আলাদাভাবে বেশ ক’জন প্রতিবন্ধী বাউলকে আমরা পেয়েছি— শরীরের প্রতিবন্ধ পেরিয়ে যাঁরা গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তেমনই আত্মবিশ্বাসী নানা বয়সের গ্রাম ও মফস্সলের নারীদের সাহচর্য আমাদের চমকে দিয়েছে যাঁরা সমাজপরিত্যক্ত কিংবা বিধবা কিন্তু বাউল গান তাঁদের জীবিকা ও জীবনের রসদ জুগিয়ে চলেছে। এমন প্রবীণ বাউল সাধক তথা গায়ককে তাঁর আশ্রমে গিয়ে আবিষ্কার করেছি, বেশ ক’বার বিদেশ ভ্রমণ করেও যিনি শান্ত ও অচঞ্চল। সরকারি স্বীকৃতি, রাষ্ট্রীয় সম্মান ও আর্থিক পুরস্কার পেয়েও অবিচলিত। অমল মাধুকরী ব্রতধারীকে দেখেছি। এমন তাত্ত্বিক সাধক খুঁজে পেয়েছি যিনি আপন মনে এঁকে চলেছেন বাউল তত্ত্বের মূল দর্শন ও সত্য তাঁর বর্ণময় চিত্রধারায়।
পাঠক ও অন্বেষীদের একথা জানাও দরকার যে, বাউল ফকিরদের ঐতিহ্য এখনও নতুন পদাতিকে সমাচ্ছন্ন। অনেক ছেলেমেয়ে এ পথে আসছেন। হয়তো প্রাচীনদের মতো মগ্নতা বা আত্মদীক্ষার শমতা নেই তাঁদের, হয়তো কিছুটা প্রদর্শনকামী তাঁরা, গান পরিবেশনে উদ্গ্রীব ও চঞ্চল কিন্তু তবু সচেষ্ট ও প্রতিভাবান। এমন অনেকের গান আমি ক্যাসেটে ধরে রেখেছি। ভবিষ্যতে তাঁদের অনেকে নামী শিল্পী হবেন সন্দেহ নেই।
এতদিন বাঙালি গবেষকদের অন্বেষণ ও সমীক্ষা ছিল অনেকটা একমুখী—প্রবন্ধে আখ্যানে চিত্রকলায় চলচ্চিত্রে ও কাব্যে বাংলার বাউলদেরই শুধু তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। আমার লক্ষ্য তাই প্রথম থেকেই ছিল ফকিরদের স্বতন্ত্র উন্মোচনের দিকে। সেইজন্য প্রস্তুত বইতে, জেলাওয়ারি বাউলদের তালিকার সঙ্গে বাংলার ফকিরদের একটি পঞ্জি যোগ করেছি। সেই সঙ্গে আছে দুজন ফকিরের আত্মবিবৃতি এবং একজনের আত্মকাহিনি। বীরভূম অঞ্চলে কর্মরত আমার প্রকল্প-সহকারী লিয়াকত আলি বহুদিন ফকিরদের মধ্যে রয়েছেন, এক ফকির বংশের কন্যাকে জীবনসঙ্গিনী করেছেন, তাই তাঁর সংগৃহীত ও বিশ্লেষিত তথ্যগুলি খুব কাজে লেগেছে। দায়েম শাহ এবং মহম্মদ শাহ-র রচিত ফকির গানের সম্ভার তাঁর সংগৃহীত এবং এ বইতে সংযোজিত। বীরভূমের বাউলদের মধ্যে বহুদিন সঞ্চরণকারী আদিত্য মুখোপাধ্যায় অশেষ পরিশ্রমে কাজ করেছেন প্রকল্প-সহকারীরূপে। মুর্শিদাবাদে কাজ করেছেন তরুণ লোকশিল্পী ও উৎসাহী যুবা নাজমুল হক। নদিয়া, বর্ধমান ও অন্যান্য বহু জায়গায় প্রকল্প-সহকারী ছিলেন জয়ন্ত সাহা। বাউল ফকিরদের অগণিত আলোকচিত্র ও ডকুমেনটেনশনের কাজে তাঁর উদ্যম স্মরণীয়। এই সূত্রে স্বতন্ত্র উল্লেখের দাবি রাখেন উত্তর দিনাজপুরের সুভাষগঞ্জের তরণীসেন মহান্ত। সমগ্র উত্তরবঙ্গের বহু অজানা বাউল গানের শিল্পী ও গীতিকার বাউলের জীবনতথ্য ও আলোকচিত্র তাঁর আন্তরিক সংগ্রহ। তিনি নিজে একজন আচরণবাদী ও বাউলশিল্পী বলেই তাঁর কাজে বাড়তি দরদ ও নিষ্ঠা লক্ষ করা গেছে। উত্তরবঙ্গ থেকে সংগৃহীত অজস্র গানের পাণ্ডুলিপি থাকবে ভবিষ্যতের সমীক্ষার জন্য।
এই অনুসন্ধান নতুনভাবে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে সারা পশ্চিমবঙ্গের বাউল ফকির সমাজকে জানতে আর বুঝতে। সেই অনুভব থেকে বই লেখার সময় খেয়াল রেখেছি যাতে এটি নীরস বস্তুপুঞ্জ বা কেঠো বিবরণে ভারাক্রান্ত না হয়। এ বইয়ের প্রতিটি তথ্য বাস্তব ও জীবনস্পর্শী। ডকুমেনটেশনের প্রয়োজনে অজস্র বাউল ফকিরদের প্রত্যয় ও জীবিকা যেমন কাজে লেগেছে তেমনই সরাসরি তাঁদের জীবন পরিবেশ ও যাপনের উষ্ণতা আমাকে পদে পদে সমৃদ্ধ করেছে। এইসব অনুসন্ধান ও ভ্রমণে কেউ কেউ সঙ্গী হয়েছেন কখনও কখনও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অবশ্য ছিলাম নিঃসঙ্গ। আলোকচিত্রকররূপে সঙ্গে গিয়ে মূল্যবান সহযোগিতা করেছেন রংগন চক্রবর্তী, দীপঙ্কর কুমার, সত্যেন মণ্ডল, জয়ন্ত সাহা, সঞ্জয় সাহা, ও অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। আগেকার দুটি সংস্করণে ব্যবহৃত অনেক ছবি বর্জিত হয়েছে এবং প্রাসঙ্গিকভাবে এবারকার নব সংস্করণে অনেক নতুন আলোকচিত্র যাঁরা দিয়েছেন তাঁদের নাম অজয় কোনার, অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়, জয়ন্ত সাহা, তরণীসেন মহান্ত, দীপঙ্কর কুমার, দীপঙ্কর ঘোষ, রংগন চক্রবর্তী, ল্যাডলি মুখোপাধ্যায়, সত্যেন মণ্ডল, সঞ্জয় সাহা, সুগত চট্টোপাধ্যায় ও সুরজিৎ সেন। তাঁদের ধন্যবাদ! বেশ ক’টি জেলার তথ্য-আধিকারিকরা সাহায্য করেছেন বাউলদের জেলাওয়ারি পঞ্জি প্রণয়নে। ব্যক্তিগতভাবে আশ্রয় ও পরামর্শ দিয়ে কৃতজ্ঞ করেছেন বাঁকুড়ার ছান্দার গ্রামনিবাসী বন্ধু উৎপল চক্রবর্তী ও পুরুলিয়ার বন্ধু শ্যামাপ্রসাদ বসু। জিয়াগঞ্জের অধ্যাপক শ্যামল রায়, বড় আন্দুলিয়ার রামকৃষ্ণ দে, কোটাসুরের আদিত্য মুখোপাধ্যায়, মেদিনীপুরের সমীরণ মজুমদার ও দিব্যাংশু মিশ্র, ফকিরডাঙ্গার লিয়াকত আলি, সিউড়ির বাবলি ও প্রভাত সাহা এবং অমর দে, দুবরাজপুরের অনুপম দত্ত-র কাছে নানা সূত্রে ঋণ স্বীকার করি। বাউলফকিরদের নিজেদের ডেরা, পর্ণকুটির, আখড়া ও আশ্রমের চৌহদ্দির বাইরেও তাঁদের অন্যভাবে বারেবারে পেয়েছি নানা মেলা ও মহোৎসবে। সে সব জায়গায় তাঁদের মনের আগল খুলে যায়। ঘোষপাড়া, অগ্রদ্বীপ, শেওড়াতলা, জয়দেব-কেঁদুলি ও পাথরচাপুড়ির বার্ষিক সমাবেশে বহু বছর ধরে বহু তথ্য আহরণ করেছি, যা হয়তো অন্যভাবে পাওয়া যেত না। ১৯৯৬ সালে লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র আয়োজিত বর্ধমানের গুসকরায় সমবেত ৪৮ জন বাউলের ওয়ার্কশপ ও সেমিনারে যোগ দিয়ে তাঁদের সান্নিধ্যে মজার মজার উপকরণ পেয়েছি। সেখানে নানা বর্গের ও নানা জেলার অনেক বাউলের সমাবেশ ঘটেছিল।
কাজটি যখন অর্ধপথে তখন সচিব চন্দনকুমার চক্রবর্তী অন্যত্র বদলি হয়ে যান এবং সচিবের দায়িত্ব নেন লোকসংস্কৃতিমনস্ক মরমি মানুষ প্রদীপ ঘোষ। তাঁর উৎসাহ আর সহযোগিতা আমাকে বিশেষভাবে প্রেরিত করেছে। বাউল ফকিরদের জেলাওয়ারি বর্ণানুক্রমিক তালিকা প্রণয়নের কষ্টসাধ্য অথচ সতর্ক কাজটি করেছেন আমার স্ত্রী নিবেদিতা চক্রবর্তী। আলোকচিত্র বিষয়ে বিশেষ সহায়তা করেছেন প্রদীপ বিশ্বাস।
বইটির বিন্যাস সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা দরকার। এর স্পষ্টত দুটি ভাগ। প্রথম ভাগে আছে বাংলার বাউল ফকিরদের অতীত ও বর্তমানকে মিলিয়ে আমার বক্তব্য—যার তথ্যভিত্তি সরেজমিন সন্ধানজাত বাস্তব মালমশলা। এই অংশ লিখতে অনেক প্রাক্তন সূত্র বা তথ্যেরও সাহায্য নিয়েছি কিন্তু গড়পড়তা গবেষণা বইয়ের মতো পাদটীকা বা উল্লেখপঞ্জিতে কণ্টকিত করিনি। করতে চেয়েছি এক সুখপাঠ্য প্রতিবেদন এবং বিশ্লেষণবহুল উদ্ঘাটন ও অবলোকন। দ্বিতীয় ভাগে আছে একজন ফকিরের আত্মকথা, দুজন ফকিরের আত্মবিবৃতি ও আমার প্রাসঙ্গিক ভাষ্য। তারপরে আছে একজন ফকিরের পদ্যে রচিত তত্ত্বসন্দর্ভ। এগুলি অনুসন্ধানসূত্রে সংগৃহীত। তারপরে আছে তিরিশটি ফকিরি গান আর ষোলোটি বাউল গান এবং অন্ধবাউলের রচিত একটি গান। এগুলি প্রধানত মৌখিক সূত্রে সরাসরি সংগৃহীত। বইয়ের পরবর্তী অংশে আছে দশটি গানের স্বরলিপি, যার কিছু বাউল কিছু ফকিরি—উৎসাহীজনেরা এগুলি চর্চা করলে বাংলার বাউল ও ফকিরিগানের বেশ ক’টি শৈলীর আস্বাদ পাবেন। সবশেষে আছে বর্ণানুক্রমিকভাবে সাজানো ফকিরদের তালিকা এবং জেলাওয়ারি বাউলদের তালিকা এবং সেইসঙ্গে বাউল ফকিরদের আর্থ-সামাজিক পরিচয় সারণি। এইসব তালিকা সম্পর্কে দুটি স্বীকারোক্তি মনে রাখতে হবে। এক, এই তালিকা সম্পূর্ণ ও ত্রুটিমুক্ত নয়—অর্থাৎ এর বাইরে আরও বেশ কিছু বাউল ফকির থাকতে পারেন। দুই, তালিকার অন্তর্ভুক্ত দু’-চারজন ব্যক্তি তালিকা প্রণয়নের পরে প্রয়াত যেমন উত্তরবঙ্গের বলহরি দাস, নবাসনের হরিপদ গোঁসাই এবং নদিয়ার ষষ্ঠী খ্যাপা। আরও কেউ কেউ হয়তো মরলোকে নেই কিন্তু সে তথ্য জানা যায়নি। তিন, এ বইয়ের যাবতীয় ব্যক্তি-তথ্য ও পরিসংখ্যান ২০০২ সালের। তার পরিমার্জন বা পরিবর্ধন এখন আর করা সম্ভব নয়।
সব মিলিয়ে ‘বাউল ফকির কথা’ বইটি পশ্চিমবাংলার বাউল ফকিরদের সাম্প্রতিক অবস্থানের বিশ্বস্ত রূপরেখা উপস্থাপিত করতে প্রয়াসী। নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনায় এবং গৌণধর্মীদের প্রকৃত সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত নির্ণয়ে এই আগ্রহী রচনা কিছু তথ্য, তত্ত্ব ও জিজ্ঞাসা সংযোজন করতে পারলে পরিশ্রম সার্থক হবে। উজ্জ্বল হয়ে উঠবে লৌকিক সাধক ও লোকশিল্পীদের মুখশ্রী। তাঁদের কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য।
সুধীর চক্রবর্তী
৮ রামচন্দ্র মুখার্জি লেন
কৃষ্ণনগর ৭৪১ ১০১
Leave a Reply