বাংলার নবজাগৃতি – বিনয় ঘোষ
প্রথম প্রকাশ ১৯৪৮
.
তিরিশ বছর আগে যখন ‘বাংলার নবজাগৃতি’ লিখেছিলাম তখন মনপ্রাণ, যাকে thirtees leftism বলে, তারই ঝনৎকারে সর্বদা অনুরণিত হত। ইংরেজি চারের দশকের শেষদিক। সে এক আশ্চর্য যুগ মনে হয়, যদিও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখন শেষ হয়েছে। বিপ্লব সমাজতন্ত্র সাম্যবাদ এসব তখন হাতের মুঠোয় এবং মুঠোগুলো স্বভাবতই নবীন তরুণদের। Caudwell—ইজম Auden-ইজম Isherwood-ইজম Strachey-ইজম Palme Dutta-ইজম ইত্যাদি ইজম—এর ভিতর দিয়ে Marx-ইজম—এর বৈচিত্র্য, তৎসহ Victor Gollancz, Left Book Club ইত্যাদির সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া, সুদূর বাংলা দেশের কলকাতা শহরে আমাদের মতো যুবকদের মনে যে রামধনু রঙের স্বপ্নের সৃষ্টি করেছিল তা আজ রূপকথার মতো শোনায়। মাত্র তিরিশ বছরের ব্যবধান যা একপুরুষের ব্যবধান হওয়ার কথা তা ১৯৭৮—৭৯ সালে মনে হয় যেন বহুপুরুষের ব্যবধান। তাই এই একপুরুষকালের দূরত্বের মধ্যেই ‘বাংলার নবজাগৃতি’—যা একদিন ঐতিহাসিক সত্য বলে মনে হয়েছিল—আজ তা মনে হয় ‘একটি অতিকথা’ (সংযোজন দ্রষ্টব্য)।
‘বাংলার নবজাগৃতি’ সম্বন্ধে আগে যা ভাবতাম যা ভেবেছিলাম তার কোনও পরিবর্তন করিনি, পুনর্মুদ্রিতই করা হয়েছে, যাতে আমার চিন্তাধারার পরিবর্তন, যা নতুন সংযোজিত রচনায় প্রতিফলিত, তা পাঠকরা বুঝতে পারেন। চিন্তাধারার কেন পরিবর্তন হয়েছে, এই প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হল, যেহেতু সমাজের রূপ ও প্রকৃতির পরিবর্তন হয়েছে এবং সমাজতত্ত্বের বিভিন্ন আলোকরশ্মির সাহায্যে আমরা এই পরিবর্তনের স্বরূপ আগের চেয়ে অনেক বেশি বুঝতে পেরেছি, এবং পারছি।
বিনয় ঘোষ
বৈশাখ ১৩৮৬। এপ্রিল ১৯৭৯
কলকাতা—৭০০০৩২
.
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
‘বাংলার নবজাগৃতি’ প্রকাশিত হল। ইংরেজদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার পর পাশ্চাত্য অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ঘাতপ্রতিঘাতে চারিদিকের পুঞ্জীভূত সংকট ও পর্বতপ্রমাণ ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও আমাদের দেশে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে যে নবজাগৃতির সূচনা হয়েছিল, এবং যে নবজাগৃতিধারা তরঙ্গায়িত হয়ে বিচিত্র পথে আজও এক বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে, ‘বাংলার নবজাগৃতি’ গ্রন্থে তারই ইতিহাস রচনা করার চেষ্টা করেছি। আমার একার পক্ষে এ চেষ্টা সার্থক করা যে সাধনাতীত ব্যাপার তা আমি জানি। এই অসমসাহসের একমাত্র অনুপ্রেরণা হল বাংলার বর্তমান ব্যাধিগ্রস্ত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ। রামমোহন দ্বারকানাথ রামগোপাল দেবেন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর কেশবচন্দ্র বিবেকানন্দ মাইকেল বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই শার্দূলশ্রেণি আজ বাংলায় কোথায়? বাংলা আজ বনগাঁ। বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে যাঁরা আজ ‘অগ্রগণ্য’, কোথায় তাঁদের চরিত্রে সেই পৌরুষ বলিষ্ঠতা ও উদারতা, কোথায় তাঁদের প্রতিভায় সেই মুক্ত বুদ্ধি সুস্থ যুক্তি ও স্বাধীন চিন্তার প্রদীপ্তি? আজ তাই বারংবার মনে হয়, বাঙালির ঐতিহাসিক স্মৃতি কই? বঙ্কিমচন্দ্রের কথা মনে পড়ে : ”বাঙলার ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙালী কখন মানুষ হইবে না। …বাঙলার ইতিহাস নাই, যাহা আছে, তাহা ইতিহাস নয়, তাহা কতক উপন্যাস, কতক বাঙলার বিদেশি বিধর্ম্মী অসার পরপীড়কদের জীবনচরিত মাত্র। বাঙলার ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙলার ভরসা নাই।” কিন্তু কে লিখবে সেই ইতিহাস, যে ইতিহাস উপন্যাস হবে না, জীবনচরিত হবে না, নিছক ঘটনাপঞ্জিও হবে না, একটা জাতির উত্থান—পতনমুখর জীবনেতিহাস হবে। তার উত্তরে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন : ”তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙালী, তাহাকেই লিখিতে হইবে। মা যদি মরিয়া যান, তবে মার গল্প করিতে আনন্দ। আর এই আমাদিগের সর্ব্ব—সাধারণের মা জন্মভূমি বাঙলাদেশ, ইহার গল্প করিতে কি আমাদের আনন্দ নাই? আইস, আমরা সকলে মিলিয়া বাঙলার ইতিহাসের অনুসন্ধান করি। যাহার যতদূর সাধ্য, সে ততদূর করুক, ক্ষুদ্র কীট যোজনব্যাপী দ্বীপ নির্মাণ করে। একের কাজ নয়, সকলে মিলিয়া করিতে হইবে।”
বাংলার নবজাগৃতির ইতিহাস লেখার এই হল, একমাত্র কৈফিয়ত। এই ইতিহাস আজ সকলকেই লিখতে হবে। যে বাঙালি, বাংলাদেশ যার জন্মভূমি, তাকেই লিখতে হবে। বাংলার জাতীয় ঐতিহ্য চরিত্র শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি যখন ভিন্ন, যখন ক্ষমতালোভী মুনাফাখোর চোরাকারবারি পেশাদার হত্যাকারী ও চরিত্রহীন চাটুকারদের তর্জন—গর্জনে বাংলার জনজীবন সশঙ্ক, যখন শক্তের প্রসাদজীবী উচ্ছিষ্টলোভী অমেরুদণ্ডী ভক্তবৃন্দ বাংলার সমাজের ও সংস্কৃতির কর্ণধার, যখন বিবেক বুদ্ধি বিচার যুক্তিনীতি রুচি সৎসাহস ও সত্যবাদিতা বাংলার মাটি থেকে নির্বাসিতপ্রায়, যখন ক্লীবের ধর্ম বাংলার যুগধর্ম, তখন বাংলার নবযুগের নবজাগৃতির ইতিহাস রচনার গুরুদায়িত্ব প্রত্যেক বাঙালিরই গ্রহণ করা উচিত। সকলে মিলে বাংলার প্রবহমান পরিবর্তনশীল ইতিহাসের ধারাটি অনুসন্ধান করা উচিত। যার যত দূর সাধ্য সে তত দূর করবে। তাতে যাঁরা এই ধারার অনুসন্ধান করেছেন এবং ভবিষ্যতে আরও অনেকে যাঁরা করবেন তাঁদের মধ্যে আমি একজন। ”ক্ষুদ্র কীট যোজনব্যাপী দ্বীপ নির্মাণ করে”—বঙ্কিমচন্দ্রের এই ভরসাতেই আমি এ কাজে গত কয়েক বছর ধরে আমার সমস্ত শক্তি ও উদ্যম নিয়োগ করেছি। যে কাজ একের কাজ নয়, সকলে মিলে করতে হবে, তার অপূর্ণতা ও ত্রুটিবিচ্যুতি সম্পর্কে আমি সচেতন।
ইতিহাসের ধারা অনুসন্ধান করতে হলে অনুসন্ধানকারীর একটা নিজস্ব ‘দৃষ্টি’ থাকা চাই। এই দৃষ্টিকোণটাই আসল। এই দৃষ্টিকোণের পার্থক্যের জন্য ইতিহাস উপন্যাস হয়, ঘটনাপঞ্জি হয়, জীবনচরিত হয়, আবার দ্বন্দ্বমুখর বিরোধবন্ধুর বাস্তব জীবনেতিহাসও হয়। বাংলার নবজাগৃতির ইতিহাসের ধারার অনুসন্ধান আমি একটা বিশেষ ‘দৃষ্টি’ দিয়ে করেছি। এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন।
মানুষের সমাজ সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসের ধারা সরলরেখায় প্রবাহিত হয়নি, হয় না। সর্পিল রেখার উত্থান—পতনের বিরোধবন্ধুর পথে যুগ থেকে যুগান্তরের দিকে ইতিহাস এগিয়ে চলে। এই ইতিহাসের মূলধারাটি হল মানুষের জীবন—সংগ্রামের ধারা। মানবসমাজের ইতিহাসবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে অনুশীলন করলে দেখা যায় যে, এই জীবনসংগ্রামের একটা সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, এবং সেই সংগ্রাম—পদ্ধতি যুগে যুগে বদলায়। প্রধানত সংগ্রামের আয়ত্ত হাতিয়ার দ্বারাই এই পদ্ধতি নিরূপিত হয়। আদি প্রস্তরযুগের স্থূল পাথুরে হাতিয়ার তিরধনুক ইত্যাদি বন্যপশু শিকারের উপযোগী ছিল, নব্যপ্রস্তর যুগের সূক্ষ্ম পাথুরে হাতিয়ার পশুপালক ও কৃষিজীবীর গ্রাম্য সমাজ গড়ে তুলেছিল, ব্রোঞ্জ ও লৌহযুগের উন্নত ধাতুনির্মিত হাতিয়ার নগরসভ্যতা রাজতন্ত্র ও দাসপ্রথার প্রবর্তন করেছিল, কুটিরশিল্প কৃষিকাজ বিনিময় বাণিজ্য সংঘধর্ম ও ভূস্বামিত্ব সামন্তপ্রথার স্তম্ভ ছিল, বিজ্ঞান ও যন্ত্রশিল্পের ভিত্তির উপর ধনিকতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে এবং তারই ব্যাপক প্রসার প্রয়োগ ও সর্বাঙ্গীণ উন্নতির ফলে সমাজতন্ত্রের বিপুল সম্ভাবনা ঐতিহাসিক সত্যরূপে প্রকাশ পেয়েছে। যুগ থেকে যুগান্তরে যাত্রার এই যে পরিবর্তনশীল ইতিহাস এর চালিকাশক্তি হল সমাজমূলের এই উৎপাদনপদ্ধতি। উৎপাদন হাতিয়ার বা উৎপাদনযন্ত্র উৎপাদন—পদ্ধতি নিরূপণ করে। এই উৎপাদন—পদ্ধতি জীবনধারণের তাগিদে মানুষ গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং তার ফলে সমাজের মধ্যে মানুষের সঙ্গে মানুষের একটা বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই সম্পর্কস্থাপন কেবল মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। এই সামাজিক শ্রেণিসম্পর্কের ভিতর দিয়েই মানুষের জীবনদর্শন গড়ে ওঠে, রাষ্ট্রিক নৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদর্শ নির্ধারিত হয়। এই সমাজবিশ্লেষণেরই আর—এক নাম হল ইতিহাসের বাস্তব ব্যাখ্যা এবং এর প্রবর্তক যেহেতু কার্ল মার্কস সেইজন্য ইতিহাসব্যাখ্যার এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিকে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বলা হয়। কার্ল মার্কস ও মার্কসবাদী নাম শুনে একশ্রেণির পণ্ডিত ও পাঠক হয়তো স্নায়বিক প্রতিক্রিয়ায় বিহ্বল হবেন। কিন্তু বিহ্বলতা ও পক্ষপাতিত্বের কোনও যুক্তিসংগত কারণ নেই। আজ নৃবিজ্ঞানী প্রত্নতাত্ত্বিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা সকলেই প্রায় ইতিহাসের এই বাস্তব ব্যাখ্যাকে একমাত্র বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। যাঁরা করেননি তাঁদের মতামতের যৌক্তিকতা ও স্বাতন্ত্র্যের চেয়ে পূর্বসংস্কারপ্রিয়তাই বেশি উল্লেখযোগ্য। মার্কসবাদকে আজ আদর্শ সমাজবিজ্ঞান হিসাবে গ্রহণ করতে কোনও কুণ্ঠা বা পূর্বসংস্কার না—থাকাই উচিত এবং রাজনীতিক্ষেত্রের দৈনন্দিন সংঘাতের ভীতিপ্রদ স্মৃতি যদি সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাস বিশ্লেষণে অন্তরায় না হয় তাহলেই ভাল।
ইতিহাসের এই বিজ্ঞানসম্মত বাস্তব ব্যাখ্যা সম্বন্ধে আরও একটু বলা দরকার। সাধারণভাবে বিচার করলে দেখা যায়, সমাজমূলের অর্থনৈতিক উৎপাদন—পদ্ধতি ও শ্রেণিসম্পর্কই রাষ্ট্র রীতিনীতি রুচি এবং সংস্কৃতির রূপ নির্ধারণ করে। অর্থনৈতিক ভিত্তির রূপান্তরের ফলে এইসব আদর্শেরও রূপান্তর ঘটে। কিন্তু বাস্তব জগতের অর্থনৈতিক রূপান্তর যেমন সুনির্দিষ্টভাবে ঘটে, আদর্শলোক বা মনোজগতের রূপান্তর তেমনভাব ঘটে না, ধীরেসুস্থে নতুন—পুরাতনের ঘাতপ্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে মানসলোকের পরিবর্তন হয়। বাস্তব—জগতের সঙ্গে মনোজগতের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক নয়, পরোক্ষ সম্পর্ক। বাস্তব—জগতের অর্থনৈতিক জীবনসংগ্রামও যেমন মনোজগতের আদর্শ সংগ্রামকে প্রভাবিত করে, তেমনি আদর্শ সংগ্রামও জীবনসংগ্রামের রূপ বদলায়। এই ঘাতপ্রতিঘাতের ভিতর দিয়েই সমাজ—সংস্কৃতি সব এগিয়ে চলে এবং ধীরে ধীরে যুগপ্রকৃতির স্বরূপ উদঘাটিত হয়। (ক) মার্কসবাদীর দৃষ্টি অর্থনীতিসর্বস্ব অনুদার দৃষ্টি বলে যাঁরা মার্কসবাদের অপব্যাখ্যা করেন তাঁদের এ কথা মনে করিয়ে দেওয়া এখানে প্রয়োজন। মার্কসীয় সমাজতত্ত্ববিদ যাঁরা, অর্থাৎ যাঁরা আদর্শ সমাজবিজ্ঞানী তাঁরা সমাজের ঐতিহাসিক ধারাবিশ্লেষণের সময় আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসেন না, মাটি থেকে আকাশপথে যাত্রা করেন। মানুষ কী কল্পনা করে, চিন্তা করে, অর্থাৎ চিন্তাশীল কল্পনাপ্রবণ মানুষ থেকে শুরু করে রক্তমাংসের মানুষের ইতিহাস তাঁরা অনুসন্ধান করেন না। খাঁটি রক্তমাংসের মানুষ, সক্রিয় সামাজিক মানুষ থেকে তাঁদের ইতিহাসব্যাখ্যা শুরু হয় এবং তাঁদেরই বাস্তব জীবনধারার উৎস থেকে কলোচ্ছ্বসিত ভাবাদর্শের স্বরূপবিশ্লেষণ করে তাঁরা সেই ইতিহাসব্যাখ্যা শেষ করেন। নীতি ধর্ম অধ্যাত্মবাদ আদর্শবাদ, এককথায় মনোজগতের বাহ্যরূপের কোনও সমাজবিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্র ইতিহাস নেই। সমস্ত ইতিহাসই সামাজিক মানুষের বাস্তব জীবনের ইতিহাস এবং তারই ঘাতপ্রতিঘাতে মানুষের নিজের প্রকৃতি মানসপ্রতিমা ও ভাবাদর্শ পরিবর্তনের ইতিহাস। (খ) ইতিহাসের এই বাস্তব ব্যাখ্যাই আমি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা বলে গ্রহণ করেছি এবং সমাজবিজ্ঞানীর এই দৃষ্টি দিয়েই বাংলার নবজাগৃতিধারার বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করেছি। সার্থক হয়েছি কি না সে বিচারের ভার পণ্ডিতমণ্ডলীর উপর নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিয়ে আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি যে এ চেষ্টার প্রেরণা পেয়েছি বাংলার বর্তমান সামাজিক পরিবেশ থেকে এবং আমার সাধ্যমতন তাকে সার্থক করে তুলতে একনিষ্ঠার সঙ্গে মেহনত করতে পশ্চাৎপদ হইনি।
বাংলার নবজাগৃতির ইতিহাস পূর্বে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের অধিকাংশ লেখাই আংশিক অথবা প্রাসঙ্গিক। রাজনারায়ণ বসুর ‘সেকাল আর একাল’, শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’, ড.সুশীলকুমার দে—র ‘Bengali Literature in the Nineteenth Century’’, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার সমাজ সাহিত্য ও সংস্কৃতির আংশিক চিত্র মাত্র। সজনীকান্ত দাসের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ (১ম খণ্ড) এবং সুকুমার সেনের ‘বাঙলা সাহিত্যে গদ্য’ ও ‘বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস’ সাহিত্যের ও গদ্যভাষার উল্লেখযোগ্য তথ্যসমৃদ্ধ ইতিহাস, কিন্তু এগুলিকে বাংলার নবজাগৃতির ইতিহাস বলা যায় না। ‘জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য’ গ্রন্থে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের প্রাসঙ্গিক আলোচনা, মোহিতলাল মজুমদারের ‘বাংলার নবযুগ’ ঠিক বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবেতিহাস নয়, বাঙলার নবজাগৃতির ইতিহাসের একটা সমগ্র অখণ্ডচিত্রও তাঁদের লেখার মধ্যে ফুটে ওঠেনি। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ”সংবাদপত্রে সেকালের কথা”, ডঃ নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের “Selections from writings of Harish Chandra Mookherji”, যোগেশচন্দ্র বাগলের ”ভারতবর্ষের স্বাধীনতা” ঐতিহাসিক উপাদানের সংকলনগ্রন্থ হিসাবে মূল্যবান, ইতিহাস নয়। এই ধরনের আরও অনেক গ্রন্থে প্রবন্ধে ও জীবনচরিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙলার ইতিহাসের নানাদিক ও নানাবিষয় নিয়ে আংশিক আলোচনা করা হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টি নিয়ে আলোচনা এর মধ্যে অনেকেই করেননি। গোপাল হালদারের দু’একটি প্রবন্ধ এবং অমিত সেনের খসড়া ‘Notes on Bengali Renaissance’ এ বিষয়ে প্রথম দিগদর্শন বলা যায়, কিন্তু তাঁরা কেউ নবজাগৃতির সম্পূর্ণ ইতিহাস রচনা করেননি।
যাঁদের কথা এখানে বলা হল এবং আরও অনেক যাঁদের কথা এখানে বলা হল না তাঁরা সকলেই বাংলার নবজাগৃতির আংশিক ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা করলেও পরোক্ষভাবে আমার এই ইতিহাসের রচনায় তাঁরাই উৎসাহদাতা ও পথপ্রদর্শক। তাঁদের কাছে আমার ঋণস্বীকার করছি। তা ছাড়া ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে ‘সাহিত্য সাধক চরিতমালা’ যদি প্রকাশিত না হত তাহলে এ কাজ যে অনেক বেশি দুরূহ হত তা বলাই বাহুল্য।
‘বাংলার নবজাগৃতির’ বিষয়বিন্যাস সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন। বাংলার নবজাগৃতির এই ইতিহাস আমি তিন খণ্ডে ভাগ করেছি। প্রথম খণ্ডে নবজাগৃতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক পশ্চাদভূমি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। কলিকাতার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ থেকে এই আলোচনা শুরু, কারণ নবযুগের অর্থনীতি ও শিক্ষা সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র আধুনিক মহানগর। কলকাতা মহানগরের ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে এ যুগের অর্থনৈতিক রূপের বিশ্লেষণ করা হয়েছে, এবং কেনই বা তা এ দেশের সমাজব্যবস্থায় বৈপ্লবিক যুগান্তর এনেছে তারও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ফলে সমাজের মধ্যে যে নতুন শ্রেণিবিন্যাস হল, যে নতুন জমিদারশ্রেণি বুর্জোয়াশ্রেণি মধ্যবিত্ত শ্রেণি বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ও মজুরশ্রেণির উদ্ভব হল, তাদের স্বরূপ বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং সেই শ্রেণিবিন্যাস কীভাবে বাংলার হিন্দু—মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেছে তারও বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে বাংলার সংস্কৃতিসমন্বয়ের বিশিষ্টতা, বিশেষ করে বাংলার হিন্দু—মুসলমানদের সংস্কৃতিসমন্বয়ের ইতিহাস আলোচনা করে নবযুগে পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতির সংস্পর্শে যে বৃহত্তর সংস্কৃতিসমন্বয়ের সুযোগ ঘটল তার স্বরূপ ও গুরুত্ব উপলব্ধি করার পথ পরিষ্কার করা হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে নবজাগৃতির ভাববিপ্লবের মূল কারণ ও উপাদানগুলি এবং তাদের বৈপ্লবিক ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্বন্ধে আলোচনা করে প্রথম খণ্ড শেষ করেছি।
‘বাংলার নবজাগৃতির’ দ্বিতীয়খণ্ড ‘সমাজখণ্ড’, সামাজিক নবজাগৃতির ইতিহাস। এই খণ্ডে রামমোহন, দ্বারকানাথ, দক্ষিণারঞ্জন, রামগোপাল, তারাচাঁদ, দেবেন্দ্রনাথ, কেশবচন্দ্র, রাধাকান্ত, ভূদেব, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর, ‘ইয়াং বেঙ্গল’, সৈয়দ আহমেদ, সৈয়দ আমীর আলি, সৈয়দ হাসান ইমাম, আব্দুল লতিফ খাঁ, সৈয়দ বলায়েৎ আলি খাঁ প্রভৃতি সম্বন্ধে আলোচনা করে সামাজিক নবজাগরণের ধারা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং মুসলমান সমাজের নবজাগৃতির ইতিহাসও সেই সঙ্গে সযত্নে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে নবযুগের বাংলার নতুন অভিজাত পরিবার ও ধনিকশ্রেণির বিস্তৃত পরিচয়ও দেওয়া হয়েছে। বেরিলি বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ, মুসলিম বিদ্রোহ, মোপলা বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ ও সিপাহিবিদ্রোহের ভিতর দিয়ে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ, জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা, প্রভাববিস্তার ও পরিণতির ইতিহাসও এই দ্বিতীয় খণ্ডের আলোচ্য বিষয়বস্তুর মধ্যে অন্যতম। জাতীয় আন্দোলনের সাম্প্রতিক রূপ ও বিচিত্র ধারা, সমসাময়িক বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা, কলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সংকট, বঙ্গবিভাগজনিত সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা, বৃহত্তর বাংলা ও প্রবাসী বাঙালির সমস্যা, কলকাতার ভবিষ্যৎ ইত্যাদি সম্বন্ধেও আলোচনা দ্বিতীয় খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয় খণ্ড ‘সংস্কৃতিখণ্ড’ বা বাংলার সাংস্কৃতিক নবজাগৃতির ইতিহাস। বাংলা দেশে ঊনবিংশ শতাব্দীতে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের ইতিহাস, ছাপাখানা ও সংবাদপত্রের ইতিহাস, ভাষা সাহিত্য চিত্রকলা ও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস তৃতীয় খণ্ডের আলোচ্য বিষয়বস্তু। এ ছাড়া তৃতীয় খণ্ডের মধ্যে বাংলার আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির স্বরূপ এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা সম্বন্ধেও আলোচনা করা হয়েছে। এই হল ‘বাংলার নবজাগৃতির’ তিন খণ্ডের সংক্ষিপ্ত বিষয়পরিচয়।*
এই ইতিহাসের মালমশলা সংগ্রহ আমি নিজে একা করেছি বললে অন্যায় হবে। আমার সঙ্গে আরও যে কয়েকজন নিঃস্বার্থভাবে পরিশ্রম করেছেন তাঁরা কেউ আমার খ্যাতি—অখ্যাতির অংশীদার হতে চান না বলেই তাঁদের নাম অপ্রকাশিত রাখতে আমি অনুরুদ্ধ হয়েছি। এখানে কেবল কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রীযুক্ত যোগেন্দ্রনারায়ণ রাহা মহাশয়ের নাম উল্লেখ করছি, যাঁর বিরাট গৃহপাঠাগারের দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাবলি আমার প্রয়োজনমতন ব্যবহারের পূর্ণ সুযোগ ও স্বাধীনতা না পেলে, এই বইয়ের উপাদান সংগ্রহের কাজ অত্যন্ত দুরূহ হয়ে উঠত। এঁরা ছাড়াও এ কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে ‘ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশিং হাউস লিমিটেডের’ প্রকাশক—বন্ধুরা যদি এই দুর্দিনে এই সুবৃহৎ গ্রন্থ প্রকাশ করার সৎসাহস (না, দুঃসাহস?) না দেখাতেন তবে আমার উৎসাহ অনেক আগেই নিভে যেত। আমার প্রকাশক বন্ধুদের সেজন্য আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
প্রত্যেক অধ্যায়ের ‘প্রসঙ্গনির্ঘণ্ট’ (Reference Notes) পাদটীকা হিসাবে না দিয়ে গ্রন্থের শেষে একত্রে দেওয়া হয়েছে এবং সেই সঙ্গে অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের সুবিধার জন্য একটি ‘গ্রন্থপঞ্জি’ও যোগ করা হয়েছে।
বিনয় ঘোষ
শ্রাবণ, ১৩৫৫
১৫ ল্যান্সডাউন প্লেস
কলকাতা—২৯
(ক) Karl Marx : ‘A contribution to the Critique of Political Economy’, Selected Works, Vol I
(খ) Karl Marx & Frederich Engels : The German Ideology
* এই পরিকল্পনা পরে লেখকের বিভিন্ন গ্রন্থে রূপায়িত হয়েছে। —বি. ঘোঃ
.
পরিমার্জিত সংস্করণ প্রসঙ্গে প্রকাশকের কথা
সমাজতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিক শ্রদ্ধেয় বিনয় ঘোষের জন্মশতবর্ষের তিন বৎসর পর দীপ প্রকাশন থেকে ‘বাংলার নবজাগৃতি’ নবরূপে প্রকাশিত হল।
পাঠ্যবিষয়ে কিছু কিছু সংশোধনও করা হয়েছে। ‘মুদ্রণটি’ হয় লেখকের প্রয়াণের পর।
নতুন করে প্রকাশ করার সময় আমাদের অবলম্বন করতে হয়েছে পূর্ব প্রকাশের মুদ্রণ। কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ লক্ষ করা যায়। সে-সব সাধ্যমতো সংশোধন করা হয়েছে। এবং লেখক ও তাঁর লেখাকে যথাযথ মর্যাদা দিতে আমরা যত্ন নিয়েছি ছাপা ও সামগ্রিক প্রকাশনার বিষয়ে। নির্ঘণ্ট প্রস্তুত করেছেন শ্রী সত্যব্রত ঘোষাল। আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
Leave a Reply