বাংলার জাগরণ – কাজী আবদুল ওদুদ
সম্পাদনা : আবুল কাসেম ফজলুল হক
কথাপ্রকাশ মুদ্রণ : একুশে বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ২০১১
উৎসর্গ
বাংলা ভাষার দেশে যে অমর জনগণের মধ্য থেকে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন রামমোহন রায়, রামগোপাল ঘোষ, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন ঘোষ, বিপিনচন্দ্র পাল, জগদীশচন্দ্র বসু, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বেগম রোকেয়া, এস ওয়াজেদ আলি, মোহাম্মদ লুতফর রহমান, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, জসীমউদ্দীন, জয়নুল আবেদীন, শেখ মুহম্মদ সুলতান, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, আবুল কাসেম ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ রেনেসাঁসের ও গণজাগরণের মনীষীরা–যে জনগণের উপর অপরিসীম আস্থা নিয়ে, সম্পূর্ণ আপনত্ত্বে বোধ নিয়ে কাজ করেছিলেন ডিরোজিও, ডেভিড হেয়ার-সেই জনগণের উদ্দেশে।– সম্পাদক
সম্পাদকের নিবেদন
অন্তর্গত চাহিদার তাগিদে আর ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতির অভিঘাতে বাংলার চিন্তানায়ক ও কর্মনায়কদের মধ্যে উনিশ শতকের শুরুতেই এক মহান নবচেতনার প্রকাশ সূচিত হয়। এই নবচেতনা তাদের তাড়িত করে ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার প্রচেষ্টায়, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় ও নতুন সাহিত্যসৃষ্টিতে। এ-উপলক্ষে কলকাতায় পর্যায়ক্রমে দেখা দেয় নতুন নতুন কর্মযজ্ঞ। রামমোহন-দেবেন্দ্রনাথ-কেশবচন্দ্রের চিন্তাধারা ও ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপ্রচেষ্টা, ডিরোজিও-ডেভিড হেয়ার ও ইয়ং বেঙ্গলদের বিচারপ্রবণতা আর উদ্দাম কর্মকাণ্ড, রাধাকান্ত-ভবানীচরণ ও ধর্মসভার প্রতিক্রিয়া, অক্ষয়কুমার-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের কর্মমুখী বলিষ্ঠ চিন্তাধারা, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-অরবিন্দের নতুন ধর্মোপলব্ধি ও প্রচারকার্য, ঈশ্বরগুপ্ত প্যারীচাঁদ-মধুসূদন-দীনবন্ধু-বঙ্কিমচন্দ্র-কালীপ্রসন্ন ঘোষ- গিরীশঘোষ দ্বিজেন্দ্রলাল-রবীন্দ্রনাথ-ত্রিবেদী-শরৎচন্দ্র প্রমুখের সাহিত্যকর্ম, জগদীশবসু প্রশান্তমহলানবিশ-মেঘনাদ সাহা-সত্যেনবসুর বিজ্ঞানসাধনা, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়-আশুতোষ মুখোপাধ্যায়-দীনেশসেনের শিক্ষাব্রত, আবদুল লতিফ-আমির আলির চিন্তা ও কর্ম, বেগম রোকেয়া ও লুতফর রহমানের চিন্তাধারা ও সংস্কারপ্রচেষ্টা, নজরুলের সৃষ্টিপ্রয়াস, এস ওয়াজেদ আলি, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল হুসেন ও মুসলিম সাহিত্য সমাজের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন, ওদুদ-মোতাহার-মোতাহেরের সৃষ্টিসাধনা, প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল ধারার সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র এবং আরো অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে এই নবচেতনা। নবচেতনার অভিব্যক্তি ছিল জীবন-জগতনিষ্ঠ, বৈচিত্র্যময় ও বহুভঙ্গিম। এরই ধারাবাহিকতায় দেখা দেয় গণজাগরণ আধুনিক রাজনীতি।
রামমোহন-ডিরোজিওর কালে এই নবচেতনা ছিল বহুলাংশে স্বগত সত্তায় (an entity in itself), বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের কালে এসে তা উত্তীর্ণ হয় সচেতন সত্তায় (an entity for itself)। নবচেতনার ফলে প্রথমে ঘটে বৌদ্ধিক জাগরণ, তারপর গণজাগরণ। গণজাগরণের ধারায় দেখা দেয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব–আত্মপ্রকাশ করেন সুরেন্দ্রনাথ, বিপিনপাল, চিত্তরঞ্জন, সুভাষবসু, খাজা সলিমুল্লাহ, আকরম খাঁ, নাজিমউদ্দিন, ফজলুল হক, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দি, শেখ মুজিব। গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যে হিন্দু-মুসলমান মিলনের প্রয়াস যেমন ছিল, তেমনি ছিল বিরোধ ও স্বাতন্ত্রেরও বিকাশ।
এই নবচেতনা ও জাগরণই বাংলার জাগরণ বা বাংলার রেনেসাঁস। আসলে তা বাঙালির জাগরণ বা বাঙালির রেনেসাঁস। বাঙালির আত্মশক্তি এবং চিন্তা ও কর্মের পরম্পরার (tradition) উপর ইউরোপীয় সভ্যতা সংস্কৃতির অভিঘাত ও সংশ্লেষণের (thesis-antithesis-syathesis) মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছিল এই নবচেতনা। কার্ল মার্কস ১৮৫৩ সালে ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন, “ব্রিটিশ-শাসিত ভারত তার সমস্ত অতীত ঐতিহ্য, তার সমগ্র অতীত ইতিহাস থেকে পৃথক হয়ে পড়েছে।” কথাটা তিনি বিশেষভাবে বাংলা বা বাঙালি সম্পর্কেই বলেছিলেন। এর আশি বছর পরে ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন : ইংরেজ এল কেবল মানুষ রূপে নয়, ‘নব্য-ইউরোপের চিত্তদূত’ রূপে। “ইউরোপীয় চিত্তের জঙ্গমশক্তি আমাদের স্থাবর মনের উপর আঘাত করল, যেমন দূর আকাশ থেকে আঘাত করে বৃষ্টিধারা মাটির পরে, ভূমিতলের নিশ্চেষ্ট অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করে প্রাণের চেষ্টা সঞ্চার করে দেয়, সেই চেষ্টা বিচিত্র রূপে অঙ্কুরিত বিকশিত হতে থাকে।” দেশি-বিদেশি ভাবুকেরা মুগ্ধবিস্ময়ে ব্রিটিশ শাসিত বাংলার এই নবায়ন ও জাগরণ সম্পর্কে মত ব্যক্ত করে চলেছেন।
নানা ঐতিহাসিক কারণে বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের তুলনায় অগ্রসর ছিল। জাগরণের ধারায় হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক পার্থক্য ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিভেদনীতির (divide and rule) মধ্যে ক্রমেই প্রখর হয়ে ওঠে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ। এর ফলে এক পর্যায়ে রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের (nationalism) স্থলাভিষিক্ত হয় সাম্প্রদায়িকতাবাদ (communalism) উদ্ভাবিত হয় দ্বিজাতিতত্ত্ব (nations theory) তাতে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি ও নিজেদের রাষ্ট্রগঠনের বেলায় ভারতবর্ষ ভাগ হয়, বাংলা ভাগ হয়, পাঞ্জাব ভাগ হয়-। জাগরণের প্রতিটি স্তরেই ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা অনেক লক্ষ করা যায়। ইউরোপের রেনেসাঁসের প্রতিটি স্তরেও ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতাও অনেক আছে। এক এক দেশের এক এক জাতির এক এক অবস্থা–মিল যেমন আছে তেমনি আছে অমিলও। সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ব্রিটিশ-শাসিত বাংলার ইতিহাস উল্লিখিত নবচেতনা ও জাগরণের ধারা ধরেই এগিয়েছে। মানবীয় দুর্বলতার ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়াদি অতিক্রম করে মানবীয় শক্তি আর নবচেতনা দ্বারাই নির্ধারিত হয়েছে ইতিহাসের গতি। অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তিদের এক মহামিছিলের সাক্ষাৎ মেলে ব্রিটিশ-শাসিত বাংলার জাগরণের ধারায়। গণজাগরণের সময়ে সাধারণ মানুষ ঔপনিবেশিক শাসন ও জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অসাধারণ বিক্রমে আত্মশক্তির জানান দিয়েছে।
গত একশো বছরের মধ্যে দেশ-বিদেশের বহু মানবপ্রেমিক, জ্ঞানানুরাগী ও সন্ধিৎসু ব্যক্তি এবং বহু প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিত (academicians) স্বগত সত্তায় কিংবা সচেতন সত্তায় থেকে বাঙালির জাগরণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছেন–লিখেছেন। এ-বিষয়ে গ্রন্থ, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সন্দর্ভ-অভিসন্দর্ভের অন্ত নেই। এইসব লেখায় রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচারপদ্ধতির বিভিন্নতা। আর আন্তরিকতাও সবার সমান নয়।
বাঙালির এই জাগরণ বা রেনেসাস রবীন্দ্রনাথের চেতনায় সৃষ্টির অদম্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে এবং জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এ-নিয়ে তিনি আবেগদীপ্ত ভাষায় মত প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়েই ঘটেছে। এই জাগরণের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি। রবীন্দ্রনাথ একদিকে প্রাচীন ভারত এবং অপরদিকে আধুনিক ইউরোপের দ্বারাও অনুপ্রাণিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মত তার সমকালের ও উত্তরকালের ভাবুকদের ক্রমাগত প্রভাবিত করেছে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধপক্ষের রয়েছে ভিন্ন চিন্তাধারা। কাজী আবদুল ওদুদ রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকে সানন্দে গ্রহণ করেছেন। বাংলার জাগরণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে যখন থেকে বিচার-বিবেচনা আরম্ভ হয়, ওদুদ তখন থেকেই এ-বিষয়ে লিখে আসছেন। ১৯২৭ সালে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে তিনি বাঙলার জাগরণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পড়েছিলেন। তখন সেটি শিখায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই লেখাটি শাশ্বত বঙ্গ গ্রন্থে সঙ্কলিত আছে। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত এমন সুনির্দিষ্টভাবে বাঙালির জাগরণ সম্পর্কে আর কেউ কি লিখেছেন? সুশোভন সরকারের Notes on Bengal Renaissance ১৯৪৬ সালের রচনা। সেটি তিনি। লিখেছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়োজনে–পার্টির নেতা ও কর্মীদের ঐতিহ্যচেতন করার জন্য। বিষয়টি নিয়ে তিনি সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছিলেন। ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ তার সূচনা থেকেই। বাংলার রেনেসাঁস ও ইউরোপের রেনেসাস দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। বাংলার জাগরণ গ্রন্থের গোটা বক্তব্যটি কাজী আবদুল ওদুদ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাভবনে ছয়টি লিখিত বক্তৃতা রূপে ছয় দিনে উপস্থাপন করেছিলেন ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে। ওই বছরই বিশ্বভারতী থেকে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
কাজী আবদুল ওদুদ যখন বাংলার জাগরণ লিখেছিলেন তখনও এ বিষয়ে অনেক তথ্যই সামনে আসেনি। তার ফলে এ গ্রন্থে অনেক কিছুরই অপর্যাপ্ততা উপলব্ধি করা যায়। তা ছাড়া অর্থনৈতিক বিষয় সমূহকে ওদুদ বিবেচনায়ই ধরেননি। কেবল চিন্তা, উপলব্ধি ও বিশ্বাসের বিষয়গুলোকেই তিনি বিবেচনায় নিয়েছেন এবং সমাজে ও জাতীয় জীবনে সেসবের প্রভাব লক্ষ করেছেন। ওদুদ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন রামমোহনে, ব্রাহ্মসমাজের ধারায় এবং রবীন্দ্রনাথে। এটাই তার পছন্দের দিক। তবে অন্য দিকগুলোতেও তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। এই গ্রন্থ বাংলা ভাষায় এ-বিষয়ের একটি ক্লাসিকের মর্যাদা পেতে পারে। মোহিতলাল মজুমদার, সুশোভন সরকার, শশীভূষণ দাশগুপ্ত, যদুনাথ সরকার, এম এন রায়, অচ্যুত গোস্বামী, অরবিন্দ পোদ্দার, গোপাল হালদার, বিনয় ঘোষ, নরহরি কবিরাজ, অন্নদা শঙ্কর রায়, সুপ্রকাশ রায়, শিব নারায়ণ রায়, স্বপন বসু, হুমায়ুন কবির, আবুল মনসুর আহমদ, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল, আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যতীন সরকার ও আরো অনেকের মতের পাশে কাজী আবদুল ওদুদের মত স্বতস্ত্র ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর। ব্রিটিশ-শাসিত বাংলার চিন্তার ও ভাবান্দোলনের ইতিহাস বিবেচনা করতে গেলে কাজী আবদুল ওদুদের বাংলার জাগরণ গ্রন্থেরও প্রয়োজন অনুভূত হবে।
বাংলার জাগরণ বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত হওয়ার পর বছরখানেকের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। তার পর ক্রমেই গ্রন্থটি দুপ্রাপ্য হয়ে ওঠে। এখন এই ঢাকা শহরে দু-একটি কপি কারো কারো ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকতে পারে। কোনো কোনো গ্রন্থাগারে এবং কারো কারো কাছে এর অপরিচ্ছন্ন ফটোকপি আছে, অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখতে পেলাম। এ অবস্থায় কথাপ্রকাশ এই গ্রন্থটি যত্নের সঙ্গে প্রকাশ করছে। এতে আগ্রহী পাঠকদের জন্য গ্রন্থটি পাওয়ার সুযোগ হল। এর দ্বারা কথাপ্রকাশের স্বত্ত্বাধিকারী জনাব জসিম উদ্দিন বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে একটি ভালো কাজ করলেন। নটর ডেম কলেজের প্রভাষক, উদীয়মান লেখক, কর্ষণ পত্রিকার সম্পাদক মিজান রহমান গ্রন্থটি প্রকাশের ব্যাপারে বিশেষ যত্ন নিয়েছেন। বানানের বেলায় প্রুফ-রীডার বাংলা একাডেমীর বর্তমান বানানরীতি অনুসরণ করতে চেষ্টা করেছেন। পরিশিষ্টে হুমায়ুন কবির লিখিত, চতুরঙ্গ পত্রিকায় প্রকাশিত এই গ্রন্থের একটি সমালোচনা এবং ‘রেনেসাঁসের পথ আমাদের পথ’ নামে আমার একটি লেখা সংযোজন করা হয়েছে। বাংলাদেশে নতুন এক রেনেসাঁস আজ একান্ত কাম্য–সেই রেনেসাস সৃষ্টিতে এ-গ্রন্থ সহায়ক হোক–এই কামনা করি।
আবুল কাসেম ফজলুল হক
বাংলা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
২০. ০৮, ২০১০
মুখবন্ধ
গত বছর জুলাই মাসে বিশ্বভারতীর স্বর্গত উপাচার্য ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী বিশ্বভারতীতে কয়েকটি বক্তৃতা দেবার জন্য আমাকে বলেন। ঠিক হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার জাগরণ সম্বন্ধে ছয়টি লিখিত বক্তৃতা দেওয়া হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে বক্তৃতাগুলো তৈরি হবার পূর্বেই ডক্টর বাগচী পরলোকগমন করেন।
বক্তৃতাগুলো দেওয়া হয়েছিল এই বছর জুলাই মাসে। বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য, অধ্যাপক ও ছাত্রছাত্রীরা আর অন্য আশ্রমিকেরা এই ধারাবাহিক বক্তৃতা সম্বন্ধে আগ্রহ দেখিয়ে আমাকে আপ্যায়িত করেন। একটি সচেতন পরিবেশে সেই কটি আনন্দিত দিন যাপন এই বইখানির সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে রইল। আর স্মরণীয় হয়ে রইল স্বর্গত পণ্ডিতবরের কাছে আমার ঋণ–তার তরফ থেকে এমন আমন্ত্রণ না পেলে বইখানি আদৌ লেখা হত কি না কে জানে, যদিও বিষয়টি সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা ও আলাপ-আলোচনা করে আসছি গত ত্রিশ বছর ধরে।
আধুনিক কালে দেশের প্রাণপ্রবাহস্থানীয় এই জাগরণ এক সুবৃহৎ ব্যাপার বিচিত্র ধারা সম্মিলিত হয়েছে এতে। তাই বহুজনের বহু ধরনের অনুসন্ধান ও বিচারের ফলেই এর সম্বন্ধে প্রামাণিক কিছু দাঁড় করানো সম্ভবপর হতে পারে। কিন্তু এই গুরুবিষয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা আজ পর্যন্ত তেমন সচেতনতার পরিচয় দেননি। দেশের নবলব্ধ স্বাধীনতা তাদের নতুন তাগিদ দেবে আশা করা যায়।
The Father of Modern India গ্রন্থ, ডক্টর যতীন্দ্রকুমার মজুমদারের রামমোহন ও তাঁর কাল সম্বন্ধে বইগুলো আর স্বর্গত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংবাদপত্রে সেকালের কথা থেকে যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছি। অন্য যেসব বই থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি আলোচনা প্রসঙ্গে সেসবের উল্লেখ করা হয়েছে। সমস্ত পূর্বসূরির প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
প্রয়োজনীয় বইগুলো সংগ্রহ করেছিলাম ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে। সেখানকার কর্মীদের সৌজন্য আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করছি।
কাজী আবদুল ওদুদ
কলিকাতা
ডিসেম্বর ১৯৫৬
সূচিপত্র
এক
ইউরোপের রেনেসাঁস, বাংলায় রেনেসাঁসের বা নবজাগরণের সূচনা, রামমোহনের প্রথম জীবন, তুহফাতুল মুওহহিদীনের প্রকাশকাল, রামমোহনের কলকাতায় আগমন, সংস্কার-আন্দোলনের সূচনা, রামমোহন-চরিত্র সম্পর্কে উইলিয়ম অ্যাডম, ভট্টাচার্যের সহিত বিচার, নৈতিক উৎকর্ষের দিকে রামমোহনের দৃষ্টি, Precepts of Jesus প্রকাশ, বাদানুবাদ, ধর্মসম্বন্ধে রামমোহনের বিশেষ প্রতিপাদ্য, ইউরোপীয় দর্শন-বিজ্ঞান চর্চার সমর্থন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সমর্থন, ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন, সতীদাহ নিবারণ, নারীর প্রতি সুবিচার সমর্থন, সতীদাহ ও লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক, সমসাময়িকদের উপরে রামমোহনের প্রভাব, আমেরিকায় প্রভাব, রামমোহনের বিলাতগমন, ভারতের শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন সম্পর্কে রামমোহন, রামমোহনের আন্তর্জাতিকতা।
দুই
রামমোহনের পরে ব্রাহ্মসমাজ, ডিরোজিও ও তাঁর শিষ্যদল, ইয়ং বেঙ্গলের বিদ্রোহ, ডিরোজিওর পদত্যাগ, ভারতপ্রেম, ‘ইয়ং বেঙ্গল’ ও রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথের ধর্মজীবন, ব্রাহ্মধর্মের ভিত্তিভূমি নির্ণয়, ম্যাক্সমুলরের প্রশংসা, ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে দেবেন্দ্রনাথ ও রামমোহন, তত্ত্ববোধিনী সভা, বিদ্যাসাগর, বিধবাবিবাহ, বিদ্যাসাগর ও তাঁর যুগ, জনসাধারণের অবস্থা, নীলকরদের দৌরাত্ম, ব্ল্যাক অ্যাক্টস, রামগোপাল ঘোষ, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, হিন্দু-ব্রাহ্ম মিলন।
তিন
সিপাহীবিদ্রোহ ও বাঙালি, নীল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীলদর্পণ নাটক, সংস্কৃত নাটকের রূপান্তর, মধুসূদনের অভ্যুদয়, কেশবচন্দ্র, প্রখর নৈতিক চেতনা, কেশবচন্দ্র ও খ্রিস্টধর্ম, বাণীর শিল্পী কেশবচন্দ্র, আচার্য কেশবচন্দ্র, অক্ষয়কুমার ও দেবেন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথের হিমালয়ে নির্জনবাস, প্রত্যাবর্তন ও ধর্মপ্রচার, ধর্ম ও সমাজকল্যাণ, দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্রের মতভেদ, ব্রাহ্মসমাজ দ্বিধাভিন্ন, মন্থরগতি ব্রাহ্মদল, কেশবচন্দ্রের অনুবর্তীদের ধর্মোন্মত্ততা, দেবেন্দ্রনাথের সমালোচনা, কেশবচন্দ্রের বিলাত গমন, প্রত্যাবর্তন, নতুন কর্মোদ্যম, নতুন বিবাহবিধি, বিরূপ সমালোচনা, বঙ্কিমচন্দ্রের অ্যুদয়, হিন্দুমেলা, বাংলা নাট্যশালা, সুরেন্দ্রনাথ, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, ইংরেজ ও শিক্ষিত বাঙালিতে বিরোধ, কেশবচন্দ্রের শেষজীবন, ব্রহ্মসমাজ ত্রিধাভিন, কেশবচন্দ্রের মরমী সাধনা, নেতৃত্ব, নববিধান।
চার
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার মুসলমান, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, ইংরেজি শিক্ষার প্রতি বিরূপতা, ওহাবি মতের প্রাদুর্ভাব, নবাব আবদুল লতিফের নেতৃত্ব, সৈয়দ আমির হোসেনের শিক্ষাসংস্কার-চেষ্টা, নবজাগরণ ও মুসলমান, দারুল ইসলাম দারুল হরব, মওলানা কেরামত আলির সংস্কারচেষ্টা, আন্জুমান, মুসলিম স্বাতন্ত্র্য।
পাঁচ
হিন্দু জাতীয়তা, শক্তিবৃদ্ধির কারণ, স্যার সৈয়দ, থিওসফি, ইলবার্ট বিল, শশধর তর্কচূড়ামণি, রামকৃষ্ণ পরমহংস, সাধনার বৈশিষ্ট্য, রোমা রোলার মত, আত্মসম্পূর্ণ ভগবৎসাধনা, অবতারত্ব, বিবেকানন্দের প্রথম জীবন, সাধনা, জনগণের উন্নতি সম্বন্ধে মত, আমেরিকায় গমন, আন্তর্জাতিক খ্যাতি, সোহহংবাদ ও প্রেমধর্ম, সংস্কারে আপত্তি, উৎকৃষ্ট চিন্তা ও অসার্থক চিন্তা, বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণের প্রভাব।
ছয়
ঊনবিংশ শতাব্দীর জাগরণের বিংশ শতাব্দীর রূপ, হিন্দু জাতীয়তার শক্তিবৃদ্ধি, শ্রীঅরবিন্দ, সিস্টার নিবেদিতা, রবীন্দ্রনাথ ও হিন্দু জাতীয়তা, বর্ণাশ্রম ধর্ম, বঙ্গবিভাগ, স্বদেশী আন্দোলন, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবোধ ও ধর্মবোধ, বয়কট ও রবীন্দ্রনাথ, হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ও রবীন্দ্রনাথ, বোমা-বিভ্রাট, রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ, হিন্দু জাতীয়তা ও মুসলমান, জাগরণধারায় বিঘ্ন, রবীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্যভঙ্গ, নোবেল প্রাইজ লাভ, ইউরোপ আমেরিকায় প্রচর, মহাত্মা গান্ধি, বাংলার জাগরণের অপ্রধান ধারা, সাহিত্য ও শিল্প, মুসলমান সমাজে উদার-মানবিকতা, সর্বভারতীয় জাগরণ, মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্ব, বাংলার জাগরণের শ্রেষ্ঠ নেতাদের নির্দেশ, জীবন দর্শন হিসাবে তার মূল্য।
সাত
পরিশষ্ট : ১. বাংলার জাগরণ; সমালোচনা–হুমায়ুন কবির
২. রেনেসাঁসের পথ আমাদের পথ–আবুল কাসেম ফজলুল হক
Leave a Reply